Pyrtho : পিরহো (৩৬৫-২৭৫ খ্রি.পূ)
প্রাচীন কালের গ্রিক দার্শনিক পিরহোকে সন্দেহবাদের প্রতিষ্ঠাতা বলে মনে করা হয়। পিরহোর প্রধান বিবেচ্য বিষয় ছিল নীতিশাস্ত্র এবং ব্যক্তির সুখ দুঃখের সমস্যা। তাঁর কাছে সুখ যেমন দুঃখশূণ্যতা, তেমনি তা ব্যক্তির নিস্পৃহতার মধ্যেও নিহিত। জ্ঞানের প্রশ্নে পিরহো সন্দেহবাদী ছিলেন। তাঁর অভিমতে, আমরা বস্তু বা সত্তা সম্পর্কে কিছু যথার্থভাবে জানতে পারি নে। সে কারণে কোনো কিছু সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত আমরা গ্রহণ করতে পারি নে। জীবনের সকল সমস্যার ব্যাপারে নিস্পৃহ এবং নিরুদ্বিগ্ন থাকাই হচ্ছে মনের শান্তির আসল উপায়।
Pythagoras : পাইথাগোরাস (৫৮০-৫০০ খ্রি.পূ)
পাইথাগোরাস ছিলেন একজন প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক। তাঁর অনুসারীগণকে পাইথোগোরিয়ান বলা হতো। অঙ্ক এবং জ্যোতিষশাস্ত্রের বিকাশে পাইথোগোরাস এবং তাঁর অনুসারীদের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পাইথোগোরাস এবং তার অনুসারীদের মতে বিশ্ব অস্তিত্বের মূল হচ্ছে সংখ্যা। তাঁর অনুসারীগণ সংখ্যার উপর অলৌকিক ক্ষমতাও আরোপ করতেন। সংখ্যা ছিল তাঁদের কাছে শক্তির প্রতীক। বস্তুত সংখ্যার এই দর্শন কালক্রমে এই রহস্যময় ধর্মীয় বিশ্বাসের রূপ গ্রহণ করে এবং পাইথোগোরাস দক্ষিণ ইতালিতে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করেন। প্রাচীন গ্রিসে দাসের শোষণভিত্তিক সমাজে পাইথোগোরাসের রহস্যবাদী সংখ্যা দর্শন এবং ধর্ম অভিজাত শাসকশ্রেণীর হাতিয়াররূপে ব্যবহৃত হয়।
Quality and Quantity : গুণ এবং পরিমাণ
বস্তুর দুটি দিক। একটি তার গুণের দিক, অপরটি পরিমাণের। গুণ বলতে কোনো বস্তুর সত্তানির্ণয়ক বৈশিষ্ট্য বা চরিত্র বুঝায়। গুণের বর্ণনার দ্বারা বস্তুকে বুঝার সঙ্গে বস্তুর বিরামহীন পরিবর্তনশীলতা এবং তার আপেক্ষিক স্থিরতার প্রশ্নটি জড়িত। কোনো বস্তুই স্থির নয়। অণুর সংগঠনে বস্তু। কিন্তু অণু গতিময়, তাই বস্তু গতিময়। এই অস্থিরতায় বস্তুকে কোনো নির্দিষ্ট মুহুর্তে ‘এই বস্তু’ কিংবা ‘ঐ বস্তু’-অর্থাৎ এই গুণসম্পন্ন বস্তু বা ঐ গুণসম্পন্ন বস্তু বলা অসম্ভব বলে বোধ হয়। তথাপি আমরা ব্যবহারিক জীবনে বস্তুকে বিশেষণ দ্বারা নির্দিষ্ট করি। বস্তুর বিশেষণের ভিত্তিতে বস্তুকে আমরা পর্যবেক্ষণ করি এবং তার পরিবর্তনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করি। এটা সম্ভব এই কারণে যে, বস্তুর পরিবর্তনশীলতা সত্ত্বেও আপেক্ষিকভাবে নির্দিষ্ট মুহুর্তে একটি সংগঠন অপর বস্তু বা সংগঠনের সঙ্গে তার সহস্র সম্পর্কের ভিত্তিতে একটি নির্দিষ্টতায় স্থির থাকে। বস্তুর পরিবর্তনের সঙ্গে তার পরিমাণের প্রশ্নটিও জড়িত। মূলত বস্তুর পরিবর্তন ঘটে তার অণুর সাংগঠনিকতায়। অণুর সাংগঠনিতায় ক্রম পরিবর্তনে নতুন সাংগঠনিতার উদ্ভব ঘটে আর এই নতুন বিন্যাসই নতুন গুণসম্পন্ন বস্তু বলে দৃষ্ট হয়। প্রকৃতি বিজ্ঞানে এর সহজ দৃষ্টান্ত উত্তাপে কিংবা শৈত্যের পরিমাণ বৃদ্ধিতে পানির বাষ্প কিংবা বরফে রূপান্তরিত হওয়া। বস্তুর এই পরিবর্তনের একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, পরিবর্তনের পরিমাণ একটি বিশেষ আকার কিংবা মুহুর্ত প্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত বস্তুর বাহ্যিক গঠন অপরিবর্তিত বলে বোধ হয় এবং এই বাহ্যিক গঠনকে বিশেষ গুণ দ্বারা চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। পানিতে তাপের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পেতে একটি মুহুর্তে পানি পরিবর্তিত হয়ে বাষ্পে পরিণত হয়। পানিকে তরল পদার্থ বলে আমরা চিহ্নিত করি। অথচ তাপের মাধ্যমে পানি নিরন্তর তরল হতে বাষ্পের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তথাপি যেহেতু উত্তাপের বিশেষ মুহুর্তের পূর্ব পর্যন্ত পানির তরলতা পরিবর্তিত হয়ে যায় না, এ কারণে এই বস্তুটিকে তার নিরন্তর পরিবর্তনশীলতা সত্ত্বেও একটা সময় পর্যন্ত পানি বলে অভিহিত করতে পারি। এবং যতক্ষণ পর্যন্ত সে পানি, ততক্ষণ পর্যন্ত তার চরিত্র অবশ্যই তরল।
Quietism : শান্তিবাদ
শান্তিবাদ বলতে ইউরোপে সপ্তদশ শতকে ক্যাথলিকবাদের একটি ধর্মীয় এবং নৈতিক তত্ত্বকে বুঝানো হয়। শান্তিবাদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ঈশ্বরের নিকট পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ এবং ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ, কষ্টভোগ সবকিছুকে প্রতিরোধহীনভাবে গ্রহণ করা। শান্তিবাদকে এ দিক থেকে যে কোনো ধর্মের নিয়মিতবাদেরই প্রকাশ বলে বিবেচিত করা যায়। নিষ্কিৃয়তা এবং দুঃখ কষ্টের ব্যাপারে নিস্পৃহতার তত্ত্ব শপেনহারের দর্শনেও পাওয়া যায়।
Racialism : জাতিতত্ত্ব
জাতিতত্ত্ব একটি প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্ব। এই তত্ত্ব অনুযায়ী পৃথিবীর সব জাতিরই সমানভাবে উন্নত হওয়ার অধিকার নেই। যে জাতির রক্ত বিশুদ্ধ তারাই উন্নত হতে পারে এবং অপর জাতির উপর তাদের শাসন করার অধিকার আছে। প্রথম মহাযুদ্ধের পরবর্তীকালে জার্মানীতে এডলফ হিটলারের নাজি দল এই তত্ত্বের ভিত্তিতে উগ্র জার্মান জাতীয়তাবাদ প্রচার করেন। হিটলার ‘মাইনকেমফ’ নামক যে আত্মজীবনী লিখেছিলেন তাতে এই স্থূল ও প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্ব তিনি জঙ্গি মনোভাব নিয়ে প্রকাশ করেছিলেন। হিটলার এবং তাঁর অপরাপর তাত্ত্বিকদের মতে জার্মান জাতি হচ্ছ বিশুদ্ধ আর্য জাতি হতে উদ্ভূত। এবং আর্য জাতি হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ এবং ঈশ্বরের নির্বাচিত জাতি। আর সকল জাতিকে শাসন করার অধিকার তাদের আছে। এই বিশুদ্ধ জার্মান জাতির একচ্ছত্র অধিকার বিস্তারের অজুহাতে হিটলার ইউরোপের দুর্বল জাতিগুলিকে গ্রাস করতে আরম্ভ করেন। এবং এর পরিণামে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ সংঘটিত হয়। সংকটগ্রস্ত পুঁজিবাদী অর্থনীতি নিজেকে রক্ষা করার শেষ চেষ্টায় উপজাতিতত্ত্ব এর আশ্রয় গ্রহণ করে। উন্নতির সম্ভাবনার ক্ষেত্রে জাতিতে জাতিতে জন্মগত কোনো পার্থক্য নেই। ঐতিহাসিক কারণে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির শোষণের ফলেই জাতিতে জাতিতে পার্থক্য সৃষ্টি হয়। সাম্রাজ্যবাদ এই পার্থক্যকে চিরস্থায়ী করে রাখার জন্য জাতিতত্ত্বের সৃষ্টি করে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সাফল্য, সমাজতান্ত্রিক সমাজের বিস্তার এবং এর ফলে অঞ্চল এবং জাতি নির্বিশেষে পূর্বকার অনুন্নত জাতিসমূহের বিস্ময়কর সামাজিক, রাজনীতিক এবং অর্থনীতিক উন্নতি জাতিতত্ত্বের অসারতা প্রমাণ করেছেন।
Radhakrishnan, Sarbapalli : সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ঞন (১৮৮৮-১৯৭৫ খ্রি.)
আধুনিক ভারতের অন্যতম ভাববাদী দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ঞন আন্তর্জাতিকভাবেও বিশেষ পরিচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পালন ব্যতীত তিনি অক্সফোর্ড, মস্কো, শিকাগো বিভিন্ন স্থানের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে দর্শনের অধ্যাপনা করেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবনও উল্লেখযোগ্য। স্বাধীন ভারতে প্রথমে ভাইস প্রেসিডেন্ট, পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট হিসেবেও নির্বাচিত হন। সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ঞনের রচিত গ্রন্থের মধ্যে ‘দি রেইন ইন রিলিজিয়ন ইন কনটেমপরারি ফিলসফি’, ‘দি ফিলসফি অব দি উপনিষদ’, ‘দি রিলিজিয়ন উই নিড’, এ্যান আইডিয়ালিস্ট ভিউ অব লাইফ’ প্রভৃতির উল্লেখ করা যায়।
Ramkrishna : রামকৃষ্ঞ (১৮৩৪-১৮৮৬ খ্রি.)
পরমহংস বলে রামকৃষ্ঞ তাঁর ভক্তজনদের দ্বারা আখ্যাত। রামকৃষ্ঞ পরমহংসের প্রকৃত নাম ছিল গদাধর চট্টোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন হিন্দু ধর্মের সংস্কারক। তিনি বেদান্তর ব্যাখ্যার ভিত্তিতে হিন্দু ধর্মের বহু দেবতার জায়গায় এক ঈশ্বর তত্ত্বের প্রচার করেন। রামকৃষ্ঞ ঊনবিংশ শতাব্দীর বিকাশমান বাঙালী মধ্যবিত্তের উপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেন। তাঁর প্রভাবের মূল ছিল একদিকে শাস্ত্রের উদার ব্যাখ্যা। অপরদিকে সমাজ সেবাকে ধর্মের মূল হিসেবে প্রচার করা। সত্তার মূলে নির্গুণ ব্রহ্ম। কিন্তু জগৎ মায়া নয়। মানুষ কলিযুগের মধ্যে এসে প্রবেশ করেছে। স্বার্থপরতা, অর্থগৃধ্নতা, সাম্রাজ্যবাদী শোষণ এই কলিযুগের স্বভাব। মানুষের সেবার মধ্য দিয়েই মানুষ কলিযুগের এই মনুষ্যত্ববিরোধী ও ঈশ্বরবিরোধী স্বভাবকে পরাভূত করতে সক্ষম হবে। রামকৃষ্ঞ সাম্রাজ্যবাদী শোষণের বিরুদ্ধে কোনো সক্রিয় সংগ্রামের কথা প্রচার করেন নি। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের যে জাতীয় ঐক্য অপরিহার্য সে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় তাঁর হিন্দু ধর্মের উদারনীতিক, কুসংস্কারবিরোধী এক ঈশ্বরের তত্ত্ব অবশ্যই একটি সহায়ক শক্তির কাজ করেছে।
Ram Mohon Roy, Raja : রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩ খ্রি.)
অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতকের প্রগতিশীল ভারতীয় চিন্তাবিদ, সমাজ সংস্কারক এবং জাতীয়তাবাদী নেতা।
রামমোহনের জন্ম হয় হুগলী জেলার রাধানগর গ্রামে। তিনি একটি প্রাচীন জমিদার বংশের সন্তান ছিলেন। তখনো ভারতে মুসলমানি শাসন একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায় নি। আরবি এবং ফারসি ভাষা তখনো সমাজের উচ্চতর মহলে বেশ প্রচলিত। রামমোহন আরবি, ফারসি, সংস্কৃত এবং পরবর্তীকালে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। রামমোহন নিজে আন্তরিকভাবে যে খুব ধার্মিক ছিলেন তা নয়। কিন্তু তাঁর নিজস্ব সামাজিক ও দার্শনিক চিন্তাধারাকে প্রকাশের জন্য হিন্দু, মুসলমান এবং খ্রিষ্টধর্মের উদারতামূলক ব্যাখ্যার তিনি আশ্রয় গ্রহণ করেন। হিন্দু ধর্মের পৌত্তলিকতাকে তিনি সমালোচনা করেন এবং বেদ ও উপনিষদের ব্যাখ্যা করে বলেন যে, মূল শিক্ষার ও সভ্যতার প্রসার কামনা করেছিলেন। কারণ তিনি মনে করেছিলেন পাশ্চাত্যের জ্ঞান বিজ্ঞান ব্যতীত ভারতবর্ষের জীবনের বন্ধ্যাত্ব ও কুসংস্কার দূরীভূত হবে না। কিন্তু ইংরেজি সভ্যতার প্রসার কামনা করলেও রামমোহন ইংরেজ শাসনকে ভারতবর্ষের মুক্তিদাতা এবং স্থায়ী শাসক হিসেবে চিন্তা করেন নি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারীদের অধীনে চাকুরী করার মাধ্যমে কিংবা অপরাপর উপায়ে যথেষ্ট পরিমাণে সম্পত্তি অর্জন করলেও রামমোহন নিজের তীক্ষ্ম বুদ্ধি ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টিবোধকে কখনো হারান নি। সমকালীন আন্তর্জাতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে এবং বিশেষ করে গণাতান্ত্রিক শক্তি বিকাশের মাধ্যমে রামমোহন বিশেষ আগ্রহশীল ছিলেন। ধর্মের উদারনীতিক ব্যাখ্যা এবং সমাজের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রামমোহন প্রচুর সংখ্যক পুস্তক পুস্তিকা ফারসি, আরবি, ইংরেজি এবং বাংলা ভাষায় রচনা করেন। তাঁকে আধুনিক গদ্যরীতির জনকও বলা হয়। ১৮৩০ সালে রামমোহন বিলাত যাত্রা করেন। বিলাতে তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্ট নিকট সতীদাহ বা স্বামীর মৃত্যুর পরে স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় বিধবা স্ত্রীকে জীবন্ত দগ্ধ করার কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রথাকে রদ করার আবেদন করেন। ইংল্যান্ডের উদারনীতিক দার্শনিক ও সমাজসেবীগণ রামমোহনের চিন্তাধারাকে সমর্থন করেন এবং তাঁকে সংবর্ধিত করেন। দিল্লীল সম্রাটের পক্ষ হয়ে সম্রাটের ভাতা বৃদ্ধির জন্য তিনি ইংল্যান্ড গমন করেছিলেন। রামমোহন রায়ের রাজা উপাধি ভারতের তৎকালীন মোঘল সম্রাটের প্রদত্ত। ইংল্যান্ডে অবস্থানকালে ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিস্টল শহরে রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যু হয়।
Rationalism : অভিজ্ঞতাউর্ধ্ব জ্ঞানবাদ, যুক্তিবাদ, হেতুবাদ
১. অভিজ্ঞতাউর্ধ্ব জ্ঞানবাদ অনুযায়ী জ্ঞানের সার্বিক এবং অপরিহার্য সূত্রগুলি ব্যক্তি অভিজ্ঞতা থেকে লাভ করতে পারে না। এগুলি মানুষের মনের ব্যাপার। মন থেকেই ব্যক্তি এই সূত্রগুলি লাভ করে। স্থান, কাল, কার্যকারণ সম্পর্ক, ২+২=৪ প্রভৃতি সর্বজন স্বীকৃত সত্যসমূহ মানুষ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে লাভ করে না। কারণ, অভিজ্ঞতার মধ্যে এদের অস্তিত্ব দেখা যায় না। এ সমস্ত সত্য মানুষের মনে অভিজ্ঞতার পূর্বে থেকে জন্মগতভাবেই বিরাজমান। অভিজ্ঞতা মনের এই সূত্রগুলিকে পরিস্ফূটিত করে তুলতে পারে, কিন্তু অভিজ্ঞতা এদের সৃষ্টি করতে পারে না। অভিজ্ঞতাউর্ধ্ব জ্ঞানবাদ তাই অভিজ্ঞতাভিত্তিক জ্ঞানতত্ত্বের বিরোধী। অভিজ্ঞতাউর্ধ্ব জ্ঞানবাদের উদ্ভব ঘটে প্রথমে আঙ্কিক সূত্রগুলির বিশ্লিষ্ট ও বস্তুনিরপেক্ষ সত্যতার সমস্যা আলোচনার ভিত্তিতে। ইউরোপে সপ্তদশ শতকে দেকার্ত, স্পিনাজো এবং লাইবনিজ এবং অষ্টাদশ শতকে কান্ট, ফিকটে, শেলিং এবং হেগেলকে জ্ঞানের ক্ষেত্রে এই তত্ত্বের প্রবক্তা হিসাবে আমরা দেখতে পাই। জ্ঞানের ক্ষেত্রে সাধারণ বা সার্বিক সত্য এবং বিশেষ অভিজ্ঞতার পারস্পরিক সম্পর্ক একটি জটিল সমস্যা; এ সমস্যার আলোচনা এবং সমাধান অভিজ্ঞতার ঊর্ধ্ব জ্ঞানতত্ত্ব একপেশে। অভিজ্ঞতাকে অস্বীকার করে অভিজ্ঞতা উর্ধ্ব জ্ঞানবাদী দার্শনিকগণ সার্বিক সূত্রগুলিকে চরম সত্তায় পরিণত করার চেষ্টা করেছেন। এর পরিণামে সার্বিক সূত্রগুলি একদিকে যেমন কেবলমাত্র মনের ভাবে পর্যবসিত হয় তেমনি তার মাধ্যমে অন্যদিকে ব্যক্তি চিন্তা এবং সত্য মিথ্যার ক্ষেত্রে যে কোনো অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। জ্ঞানের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় অভিজ্ঞতা এবং অভিজ্ঞতার সাধারণীকরণে মানুষের মনের জটিল ক্ষমতা এই উভয় সত্যকে অবশ্যই স্বীকৃতি দিতে হবে।
২. যুক্তিবাদ : জ্ঞানতত্ত্ব, নীতিশাস্ত্র, মনোবিজ্ঞান, বিশ্বসৃষ্টি সর্বক্ষেত্রে যুক্তির ভিত্তিতে অগ্রসর হওয়াকে যুক্তিবাদ বলা হয়। যুক্তি বলতে প্রতিপাদ্য, উদাহরণ, প্রমাণ সিদ্ধান্ত ইত্যাদির পারম্পর্য এবং সঙ্গতি বুঝায়। যুক্তিবাদ অযুক্তিবাদের বিরোধী। অযুক্তিবাদ বলতে প্রধানত সজ্ঞা বা অনুভূতির মাধ্যমে সত্যোপলব্ধিকে বুঝানো হয়।
৩. ধর্মের ক্ষেত্র্রেও একশ্রেণীর ধর্ম ব্যাখ্যাকারীদের মধ্যে যুক্তিবাদ বা হেতুবাদের সাক্ষাৎ মেলে। এরা ধর্মকে বুদ্ধির কাছে গ্রাহ্য করার জন্য ধর্মের যে অভিমতগুলি যুক্তিগ্রাহ্য কেবল তাদেরকেই সত্য কিংবা সঠিক বলে গ্রহণ করার মত প্রকাশ করেন।
Reflexes : প্রতিবর্ত
কোনো উদ্দীপক বা উত্তেজকের সংস্পর্শে জীবন্ত দেহের কোনো স্নায়ু সচেতন ইচ্ছা ব্যতিরেকে যে প্রতিক্রিয়ামূলক আচরণ করে তাকে প্রতিবর্ত বলা হয়। কোনো ব্যক্তির আঙুলের ডগায় জ্বলন্ত দেয়াশলাই এর কাঠি ধরলে ব্যক্তি তার আঙুল অবিলম্বে সরিয়ে নেয়; চোখের উপর তীব্র আলো নিক্ষেপ করলে ব্যক্তি চোখের পাতা বন্ধ করে দেয়। তেঁতুল দেখলে কিংবা তেঁতুলের কথা মনে পড়লে ব্যক্তির জিহ্বায় লালা নিঃসরিত হয়-এগুলি প্রতিবর্তের দৃষ্টান্ত। প্রতিবর্তকে সাধারণত দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যায় : অনিয়ন্ত্রিত প্রতিবর্ত ও নিয়ন্ত্রিত প্রতিবর্ত। উপরের দৃষ্টান্তগুলির মধ্যে আগুন থেকে আঙুলের সরে আসা কিংবা আলোর আঘাতে চোখের বন্ধ হওয়া অনিয়ন্ত্রিত প্রতিবর্তের দৃষ্টান্ত। কিন্তু তেঁতুল দেখলে কিংবা তেঁতুলের কথা মনে হলে জিহবায় লালা নিঃসরিত হওয়া নিয়ন্ত্রিত প্রতিবর্তের দৃষ্টিান্ত। নিয়ন্ত্রিত এই কারণে যে, এই দৃষ্টান্তে ইন্দ্রিয়ের প্রতিক্রিয়া গোড়াতে সহজাত কিংবা অনিয়ন্ত্রিত ছিল না। কারণ গোড়াতে তেঁতুল বা টকজাতীয় দ্রব্য জিহবার সাক্ষাৎ সংস্পর্শে এলেই মাত্র একটি বিশেষ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারত। কিন্তু অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে ক্রমে তেঁতুলের সাক্ষাৎ স্বাদ গ্রহণ ব্যতীত কেবলমাত্র চোখের দেখা কিংবা মনে করার মাধ্যমেও জিহবার সেই বিশেষ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি দ্বারা প্রতিক্রিয়াটিকে নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে। নিয়ন্ত্রিত প্রতিবর্তের সুবিখ্যাত উদাহরণ হচ্ছে রুশ বিজ্ঞানী পাভলভের কুকুর নিয়ে পরীক্ষা। উদ্দীপকের জবাবে স্নায়ুর প্রতিক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করার জন্য পাভলভ কুকুরের ক্ষুধার উপর এই পরীক্ষাটি করেন। তিনি প্রথমে কুকুরের ক্ষুধার সময়ে তার স্নায়ুকে ক্রিয়াশীল করার জন্য তার সম্মুখে এক টুকরা মাংস ধরতেন এবং এই সঙ্গে একটি ঘন্টাধ্বনি করতেন। মাংস দেখামাত্র কুকুরের জিহবায় লালা নিঃসরিত হতো। মাংসের সঙ্গে ঘন্টাধ্বনি উদ্দীপকটিও কিছুদিন যাবৎ সংঘটিত করার পরে পাভলভ নির্দিষ্ট সময়টিতে মাংসের টুকরোটিকে বাদ দিয়ে কেবলমাত্র ঘন্টাধ্বনি করে কুকুরের স্নায়ুর প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করেন। পর্যবেক্ষণে দেখেন যে, মাংসের টুকরো না থাকা সত্ত্বেও ঘন্টাধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে কুকুরের জিহবায় লালা নিঃসরিত হতে শুরু করেছে। এভাবে পাভলভ প্রমাণ করলেন যে, স্নায়ুর বিশেষ প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত করা যায়। উদ্দীপকের পরিবর্তন করা চলে। এক উদ্দীপক থেকে প্রতিক্রিয়া অপর উদ্দীপকে স্থানান্তরিত করা চলে। পাভলভের এই সিদ্ধান্ত মনোবিজ্ঞানের আচরণবাদী এবং বস্তুবাদী বিকাশে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।
Reformation : সংস্কার আন্দোলন
ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইউরোপে সামন্ততন্ত্র এবং খ্রিষ্টধর্মের গোঁড়া ক্যাথলিক মতবাদের বিরুদ্ধে প্রগতিশীল আন্দোলন সংস্কারবাদী আন্দোলন নামে পরিচিত। সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে প্রাথমিক বুর্জোয়া বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটে। এই পর্যায়ে বিকাশমান বুর্জোয়া শ্রেণীর সঙ্গে সামন্তশ্রেণীরও একটি অংশ যোগদান করে। সংস্কার আন্দোলন খ্রিষ্টধর্মকে সাধারণের জন্য সহজগ্রাহ্য করার চেষ্টা করে এবং কুসংস্কার ও আচারের বদলে ব্যক্তির আন্তরিক বিশ্বাসকে মুক্তির উপায় বলে ব্যাখ্যা করে। সংস্কার আন্দোলন রাষ্ট্রের শাসনে গির্জার প্রভাব হ্রাস করে এবং গির্জাকে রাষ্ট্রের অধীনস্থ করে। সংস্কার আন্দোলনের প্রভাবে ইউরোপীয় দেশসমূহে বুর্জোয়া বিপ্লব এবং বিজ্ঞানের বিকাশ সহজতর হয়।
Relations of Production : উৎপাদন সম্পর্ক
‘উৎপাদন সম্পর্ক’ কথাটি মার্কসবাদী তত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র। সমাজের অর্থনীতিক ক্ষেত্রে মানুষে মানুষে যে সম্পর্ক বিদ্যমান সে সম্পর্কের একটি চেতনা নিরপেক্ষ সত্তা আছে। জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির উৎপাদন, বিনিময় ও বন্টনের ক্ষেত্রে গঠিত সামাজিক সম্পর্কই হচ্ছে উৎপাদন সম্পর্ক। উৎপাদন সম্পর্ক যে কোনো উৎপাদন প্রক্রিয়ার একটি অপরিহার্য প্রকাশ। মানুষ যেমন সামাজিক জীব, তার জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় উৎপাদনও একটি সামাজিক অর্থাৎ যৌথপ্রক্রিয়া। মানুষকে আদিকাল থেকেই উৎপাদনী যন্ত্র কমবেশি পরিমাণে যৌথভাবে ব্যবহার করতে হয়েছে। কিন্তু যন্ত্র বা উপায়সমূহের মালিকানা সামাজিক বা যৌথ হয় নি। উৎপাদনের উপায়গুলির মালিকানার চরিত্র অনুযায়ী উৎপাদনের ক্ষেত্রে মানুষের সামাজিক সম্পর্ক নির্দিষ্ট হয়। আদিতে অনিবার্যভাবে উৎপাদনী প্রক্রিয়া যেমন যৌথ ছিল তেমনি উৎপাদনযন্ত্রের মালিকানাও যৌথ ছিল। উৎপাদনযন্ত্রের মালিকানার ভিত্তিতে উৎপাদিত দ্রব্যের অর্থাৎ উৎপাদিত সম্পদের মালিকানাও স্থির হয়। কাজেই উৎপাদনযন্ত্রের মালিকানা যেখানে যৌথ সেখানে উৎপাদিত সম্পদের মালিকানাও সমষ্টিগত এবং উৎপাদকের সামাজিক সম্পর্ক সমানাধিকারের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। যেখানে উৎপাদন যন্ত্রের মালিকানা ব্যক্তিগত সেখানে উৎপাদিত সম্পদ ব্যাষ্টির, সমষ্টির নয় এবং উৎপাদকের মধ্যে যন্ত্রের মালিকানাহীন মানুষ যন্ত্রের মালিকদের উপর নির্ভরশীল। আদি সাম্যবাদী সমাজে উৎপাদন উপায়ের মালিকানা যখন ব্যক্তিগত হয়ে দাঁড়ায় তখন মালিকরা প্রভু এবং মালিকানাহীন উৎপাদকেরা দাসে পরিণত হয়। মূলত সামাজিক সম্পর্কের এই বিন্যাস সামন্ততান্ত্রিক এবং পুঁজিবাদী উভয় সমাজের ক্ষেত্রে সত্য। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণী যেখানে উৎপাদনযন্ত্রের মালিকানা দখল করতে সক্ষম হয়েছে সেখানে উৎপাদনের সম্পর্কও সামাজিক অর্থাৎ সমষ্টিগত রূপ গ্রহণ করেছে। এক উৎপাদন সম্পর্কের স্থানে অপর উৎপাদন সম্পর্কের স্থাপনা একচোটেই চূড়ান্ত রূপ গ্রহণ করে না। এক সম্পর্ক থেকে আর এক উৎপাদন সম্পর্ক স্থাপনের মধ্যবর্তীকালে উভয় প্রকার সম্পর্কের অবস্থান সাময়িকভাবে থাকতে পারে। দাস সমাজের স্থানে সামন্ততান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মধ্যবর্তী সময়ে অর্থাৎ দাস সমাজের ক্ষয় এবং সামন্ততান্ত্রিক সমাজের পূর্ণ প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত দাস সমাজের সম্পর্কের রেশ চলতে থাকে। সামন্ততান্ত্রিক সমাজও আকস্মিকভাবে পুঁজিবাদী সমাজে রূপান্তরিত হয় নি। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং অর্থনীতিতে পুঁজিবাদী সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করলেও সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতি এবং তার সম্পর্ক আংশিকভাবে চলতে থাকে। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উচ্ছেদের পরেও পরিপূর্ণ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত একটা মিশ্র অর্থনীতির অস্তিত্ব থাকতে পারে। অর্থনীতির কম গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সম্পদ এবং শ্রমিকদের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা কার্যকর থাকতে পারে। কালক্রমে অবশ্য পুরাতন উৎপাদন পদ্ধতি এবং উৎপাদন সম্পর্ক পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং নতুন সম্পর্ক একমাত্র সম্পর্কে পরিণত হয়।
Religion : ধর্ম
ধর্ম বলতে জীবন এবং জগতের উপর অতিজাগতিক এক কিংবা একাধিক শক্তির অস্তিত্ব সম্পর্কে মানুষের বিশ্বাসকে বুঝায়। ধর্মীয় বিশ্বাস মানুষের সামাজিক চেতনার বিকাশের একটা পর্যায়ের সূচক। চেতনার একটা পর্যায়ে মানুষ তার প্রাকৃতিক পরিবেশ, পরিবেশের পরিবর্তন, তার কোনো বস্তুর বিরাটত্ব কিংবা ক্ষুদ্রতা, জীবনের জন্য কোনো বস্তু ও প্রাকৃতিক শক্তিকে হিতকর কিংবা অহিতকর ভাবতে সক্ষম হয়। জীবন রক্ষার জন্য সূর্য, ঝড়, ঝঞ্জা, অগ্নি, বিদ্যুৎ পর্বত, বিরাটাকার পশু ইত্যাদিকে বশীভূত করার উপায়ের কথা মানুষ চিন্তা করে। মানুষের এই অসহায় অবস্থায় এবং প্রয়োজনের মধ্য দিয়ে ধর্মের প্রাথমিক রূপ হিসাবে প্রকৃতি এবং প্রতীকের উপর অলৌকিক শক্তি আরোপ এবং তাদের আরাধনা শুরু হয়। পৃথিবীর মানুষের মধ্যে একটিমাত্র ধর্ম বিকাশ লাভ করে নি। একাধিক ধর্মীয় বিশ্বাস এবং তার আনুষঙ্গিক সংস্কার ও অনুষ্ঠানসমূহও বিকাশ লাভ করে আসছে। ধর্মের অতিজাগতিক শক্তির বিশ্বাস থাকলেও তার একটা জাগতিক ইতিহাস আছে। ধর্মের বিকাশের ইতিহাসে মানুষের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বিকাশ প্রতিফলিত হয়েছে। আদিম অসহায় অবস্থা অতিক্রম করে মানুষ অধিকতর সংঘবদ্ধ জীবন যাপন করতে আরম্ভ করলে মানুষের ধর্মীয় কল্পনাও অধিকতর সংবদ্ধ ও সূক্ষ্ম আকার ধারণ করতে শুরু করে। গাছ, পাহাড়, পশু ইত্যাদির স্থানে সুউচ্চ পাহাড়ে কিংবা আকাশে বাসকারী এক দেবরাজ্যের কল্পনা করতে তারা শুরু করে। এই দেবতাদের সঙ্গে মানুষের নিজের চারিত্রিক মিল ছিল। মানুষের সমাজের ন্যায়ই দেবতাদের মধ্যে ছোটবড় ছিল। দেবরাজ্যেও মানুষের ন্যায় ঝগড়া বিবাদ, হিংসাবিদ্বেষ, প্রেম, আকর্ষণ ইত্যাদির অস্তিত্ব ছিল। মানুষের জীবনের ইতিহাসের তুলনায় একেশ্বরবাদী ধর্মসমূহের উদ্ভব খুবই আধুনিক। অর্থনীতিক বিকাশের সাথে শ্রেণীবিভক্ত সমাজের উদ্ভব এবং সেই শ্রেণীবিভক্ত সমাজের অধিকতর বিকাশে সমাজের অধিকতর ঐক্যবদ্ধ সংগঠন এবং তার রাজনীতিক কাঠামোতে একক নেতৃত্বের প্রয়োজনের পরিপূরক হিসেবে মানুষের মনে অতিজাগতিক এক ঈশ্বরের কল্পনা উদ্ভূত হতে থাকে। আধুনিককালের অর্থাৎ একেশ্বরবাদী ধর্মের সঙ্গে ভাববাদী দর্শনের একটি যোগসূত্র আছে। ভাববাদী দর্শন যুক্তি সহকারে ধর্মীয় বিশ্বাসকে অধিকতর গ্রাহ্য করার চেষ্টা করে। জগতের উপর ঈশ্বর আছে এই বিশ্বাসের ন্যায় ভাববাদী দর্শনও বলে , কারণ ব্যতীত যেহেতু কোনো কাজ হয় না তখন জগতেরও এক আদি কারণ বিদ্যমান। ধর্ম ঈশ্বরের কোনো জন্ম, মৃত্যু বা পরিবর্তন স্বীকার করে না। কিন্তু ধর্মের জন্ম, মৃত্যু ও পরিবর্তন ঘটতে পারে। যত ধর্ম একদিন প্রচলিত ছিল তত ধর্ম আজ আর প্রচলিত নেই। ধর্ম অবশ্যই মানুষের বিশেষ প্রয়োজনের পরিপূরক। এ প্রয়োজনের উৎস হচ্ছে শ্রেণীবিভক্ত সমাজে বৃহত্তর সংখ্যক শোষিত মানুষের অসহায় অবস্থা এবং তাদের স্বাভাবিক আশা আকাঙ্খা পরিপূর্ণ হতে না পারা। যে অন্যায় এবং অবিচার শোষিত মানুষ অসহায়ভাবে ইহজগতে ভোগ করে তার পরিপূরক হিসেবে তার কল্পিত স্বর্গলোকে অন্যায় ও অবিচারের পরিবর্তে ন্যায়বিচার ও সুখের চরম লাভ সে আশা করে। সাধারণ মানুষের এই কল্পনা শাসক ও শোষক শ্রেণীর দার্শনিক, ভাবুক, সাহিত্য ও রাষ্ট্রযন্ত্র বিভিন্নভাবে বিশ্বাসযোগ্য ও স্থায়ী করে রাখার প্রয়াস পায়। কেননা এরূপ ধর্মীয় বিশ্বাস প্রচলিত অর্থনীতিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কায়েম রাখার সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করে। সমাজের আমুল পরিবর্তনে, শ্রেণীহীন সমাজের সংঘটনে এবং বিজ্ঞানের বিকাশে ব্যক্তির অসহায়তা যত অধিক দূরীভূত হবে অতিজাগতিক রক্ষাকর্তা হিসেবে ঈশ্বরের অস্তিত্ত্বের প্রয়োজন ব্যক্তি তত কম বোধ করবে এবং কালক্রমে ঈশ্বর হয়তো মানুষের মনকে ব্যাপৃত রাখার বিষয় হিসেবে গণ্য হবে না।
Renaissance : নবজাগরণ
সাধারণভাবে নবজাগরণ বলতে নতুন জাগরণ বুঝায়। কোনো দেশ বা জাতি যখন সৃষ্টির বন্ধ্যাত্বে আক্রান্ত হয় তখন তাকে কাটিয়ে উঠতে যে সমস্ত চিন্তা সহায়তা করে তাকে নব জাগরণ বা নব জাগরণের চিন্তা বলা হয়। কিন্তু ইংরেজি ‘রিনাইসেন্স’ বা নব জাগরণ দ্বারা ইউরোপীয় দেশসমূহে, বিশেষ করে ইতালীতে সামন্ততান্ত্রিক ক্ষয়ের যুগে পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দীতে বিকশিত নতুন পুঁজিবাদী সমাজ সৃষ্টির সহায়ক প্রগতিশীল চিন্তাধারাকে বুঝান হয়। দর্শনের উপর এ সময়ে ধর্মের প্রভাব প্রধান হয়ে থাকলেও আবার জগতের সঙ্গে ইউরোপের সাক্ষাৎ সংযোগের মাধ্যমে প্রাচীন গ্রিক দর্শনের ঐতিহ্যের পরিচয় এবং বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার নতুন উদারনীতিক এবং মানবিক চিন্তাধারার উদ্ভবকে সম্ভব করে তোলে। দর্শনের ক্ষেত্রে নতুন চিন্তার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় কজার নিকোলাস, কামপানেলো প্রভৃতি দার্শনিকের রচনায়। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বিকাশের নীতিতে যে দার্শনিক চিন্তার উদ্ভব ঘটে তা ছিল ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত এবং বস্তুবাদী। এই যুগের দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে (১) পৃথিবীর ব্যাখ্যায় কপারনিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্ব; (২) লিউনার্দো দ্য ভিঞ্চি এবং গ্যালিলিওর অঙ্কশাস্ত্রের উপর গবেষণা এবং প্রকৃতির ব্যাখ্যায় আঙ্কিক গবেষণার প্রয়োগ; (৩) জগৎ ঈশ্বরের উদ্দেশ্য দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে, এই ধর্মীয় ধারণার স্থানে জগতের পরিবর্তনের বৈজ্ঞানিক বিধানসমূহের আবিষ্কার। এই সময়কার সামাজিক অর্থনীতিক পরিবর্তন সমাজতাত্ত্বিক চিন্তাধারায়ও প্রতিফলিত হয়। ধর্মীয় ব্যাখ্যায় ব্যক্তি যেখানে ঈশ্বরের ইচ্ছার ক্রীড়নক ছিল সেখানে নতুন সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় ব্যক্তির মর্যাদা ও ক্ষমতা স্বীকৃত হতে থাকে। ঐক্যবদ্ধ বৃহদাকারের জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটতে থাকে। রাষ্ট্রের উপর ধর্মীয় যাজকতন্ত্রের প্রভাবও হ্রাস পেতে থাকে। ম্যাকিয়াভেলী, বোদিন প্রভৃতি সমাজতাত্ত্বিক এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর চিন্তাধারায় এই বিকাশের প্রতিফলন ঘটে। এই যুগে জার্মানির টমাস মুনজার (১৪৯০-১৫২৫) এর ন্যায় সমাজতন্ত্রের কল্পলোক সৃষ্টিকারী চিন্তাবিদেরও সাক্ষাৎ মিলে। এরা ধর্মীয় গ্রন্থের প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা দ্বারা সমস্ত সম্পদের উপর জনগণের সমষ্টিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠার কথা বলেন।
Revisionism : শোধনবাদ, সংশোধনবাদ
সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে শোধনবাদ একটি বহুল ব্যবহৃত শব্দ। বাস্তব সমাজ জীবনে প্রয়োগের ক্ষেত্রে মার্কসবাদের ব্যাখ্যায় মার্কসবাদ অনুসারীদের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে মত পার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে। ঊনবিংশ শতকের শেষে এবং বিংশ শতকের প্রথম দুই দশক পর্যন্ত মার্কসবাদের নেতৃত্ব দেন লেনিন। তিনি রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন, উহার নেতৃত্ব দেন এবং ১৯১৭ সালের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সাফল্যের সঙ্গে পরিচালিত করেন। মার্কসবাদের প্রয়োগ ও ব্যাখ্যা নিয়ে তার সঙ্গে এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন দলের সঙ্গে বার্নসটইন, বাউয়ার, কাউটসকী, ট্রটসকী প্রমূখ সমাজতান্ত্রিক নেতাদের মত পার্থক্য সৃষ্টি হয়। লেনিন এই সমস্ত নেতাদের মার্কসীয় ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে তাকে সংস্কারবাদ ও সুবিধাবাদ বলে আখ্যায়িত করেন। রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরে এবং লেনিনের মৃত্যুর পরে সোভিয়েত ইউনিয়েনের কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদের সঠিক ব্যাখ্যাতা এবং অনুসরণকারী বলে দাবি করে। কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তীকালে বেশ কিছু দেশের কমিউনিস্ট পার্টি বা উহার অংশবিশেষের সঙ্গে সোভিয়েত কমউনিস্ট পার্টির তত্ত্বগত বিরোধ আত্মপ্রকাশ করে। স্ট্যালিনের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে যুগোশ্লাভিয়ার নেতা টিটোর বিদ্রোহের মধ্যে এ বিরোধের প্রথম প্রকাশ ঘটে ১৯৪৮ সালের দিকে। তখন মার্কসবাদ হতে বিচ্যূতিকে সোভিয়েত নেতৃবৃন্দ ‘টিটোবাদ’ বলে আখ্যায়িত করতেন। স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের সহ অবস্থানের তাৎপর্য এবং সম্ভাব্যতা, শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্যতা, সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক দেশ কি নীতি অনুসরণ করবে এবং করবে না, তৃতীয় মহাযুদ্ধ অনিবার্য কিনা, প্রভৃতিপ্রশ্নে এই মতবিরোধ বেশ তীব্র আকার ধারণ করে এবং চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ও সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি পরস্পরকে মার্কসবাদের সংশোধনবাদী বলতে আখ্যাত করতে শুরু করে। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের এই দুই প্রধান কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশ্য মতপার্থক্য বেশ কিছুসংখ্যক দেশের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে বিরোধ ও বিভেদের সৃষ্টি করে এবং কিছু সংখ্যক দেশে কমিউনিস্ট পার্টি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি সোভিয়েত ইউনিয়েনের কমিউনিস্ট পার্টির পরেই অন্যতম বৃহৎ কমিউনিস্ট পার্টি বলে বিবেচিত হলেও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির অভিমত ছিল চীনের মধ্যে আধুনিক সংশোধনবাদের চরম প্রকাশ ঘটেছে। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে চীনের কমউনিস্ট পার্টিও অনমনীয়ভাবে অনুরূপ অভিমত পোষণ করত।
Revolution, Bourgeois : বুর্জোয়া বিপ্লব, ধনতান্ত্রিক বিপ্লব, পুঁজিবাদী বিপ্লব
সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতি এবং রাজনীতিক ব্যবস্থার পরিবর্তে শ্রমিক ও যন্ত্রশিল্প ভিত্তিক অর্থনীতি এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা ভিত্তিক রাষ্ট্রকাঠামো প্রতিষ্ঠাকে বুর্জোয়া বিপ্লব বলা হয়। বুর্জোয়া বা পুঁজিবাদী বিপ্লব মানুষের সমাজের বিবর্তনে একটা পর্যায়কে সূচিত করে। ঐতিহাসিক এ পর্যায়ের পরিধি বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম হতে পারে। বস্তুত পৃথিবীব্যাপী এ পর্যায়ের শুরু সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতির ক্ষয়ের যুগে ইউরোপে ষোড়শ শতকে জার্মানির কৃষক বিদ্রোহের মধ্যে সূচিত হয়েছিল বলা যায়। অষ্টাদশ শতকে ১৭৮৯ সালে ফরাসি দেশে এই বিপ্লব একটি ঐতিহাসিক সাফল্য অর্জন করে। ১৯১৭ সালের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে রুশ ভূখন্ডে এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তরকালে আরো কয়েকটি দেশে অর্থনীতিক পরিবর্তনে বুর্জোয়া যুগের অবসান ঘটলেও পৃথিবীর অন্যান্য দেশে বুর্জোয়া পর্যায়ের অবসান এখনো ঘটে নি। অনেক দেশে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ এবং সামন্ততান্ত্রিক অবশেষের উচ্ছেদে পূর্ণ পুঁজিবাদী ব্যবস্থাও প্রতিষ্ঠিত হয় নি। পুঁজিবাদী বিপ্লবের মূল ঐতিহাসিক ভূমিকা হচ্ছে, শিল্প কারখানার প্রতিবন্ধক বিকাশের শক্তিসমূহকে উচ্ছেদ করা। সামন্তবাদী অর্থনীতি উচ্ছেদের মাধ্যমে পুঁজিবাদী অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা্ নানা রূপ গ্রহণ করতে থাকে। বিপ্লব সাধনকারী শক্তিতেও তারতম্য ঘটতে পারে। বৃহৎ কয়েকটি দেশে পুঁজিবাদী বিপ্লব সাধিত হওয়ার পরে অন্যান্য দেশে এই বিপ্লব সাধনে নতুনতর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। পুঁজিবাদী দেশ আন্তর্জাতিকভাবে একচেটিয়া পুঁজিসঞ্চয় ও সরবরাহকারী দেশ হিসেবে সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র গ্রহণ করাতে সাম্রাজ্যবাদের অধীন এবং অন্যান্য দুর্বল দেশগুলির বুর্জোয়া বিপ্লব নতুনতর চরিত্র গ্রহণ করেছে। সাম্রাজ্যবাদী যুগের পূর্বে পুঁজিবাদী বিপ্লবের ক্ষেত্রে বিকাশমান ধনিকশ্রেণী বিপ্লবের অগ্রগামী শক্তি ছিল। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী যুগে শ্রমিকশ্রেণী বুর্জোয়া বিপ্লব সম্পূর্ণ করার ক্ষেত্রে একটি প্রধান ভূমিকা পালন করতে শুরু করেছে। ১৯০৫ সালে রাশিয়ায় যে অভ্যুত্থান ঘটে তারও লক্ষ্য ছিল সামন্তবাদী জারতন্ত্রের উচ্ছেদ। কিন্তু এই বিপ্লবে শ্রমিক শ্রেণী নেতৃত্বের ভূমিকা গ্রহণ করে। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারী বিপ্লবেও শ্রমিক এবং কৃষকশ্রেণী সশস্ত্র সংগ্রামের মারফত সামন্তবাদী জারতন্ত্রের পতন ঘটায়। উপনিবেশের বুর্জোয়া বিপ্লব এবং জাতীয় মুক্তি আন্দোলন মিলিত হয়ে এই নতুনতর শ্রেণীবিন্যাসকে স্পষ্টতর করে তোলে। জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে বুর্জোয়া বিপ্লব সাধন করার ক্ষেত্রে জাতীয় বুর্জোয়ার একাংশ সাম্রাজ্যবাদের আশ্রয়ে জাতীয় মুক্তি এবং আর্থনীতিক উত্তরণের পথে প্রতিবিপ্লবী হিসেবে কাজ করে। শ্রমিক ও কৃষকশ্রেণী এই নেতৃত্বমূলক ভূমিকার কারণে বুর্জোয়া বিপ্লব অনেক দেশে নতুন বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে। বুর্জোয়া বিপ্লবের পর্যায়টিকে প্রধানত দুভাগে বিভক্ত করা চলে। ১. অবিমিশ্র বুর্জোয়া বিপ্লব : এ বিপ্লবের প্রধান ভূমিকা ধনিক শ্রেণীর। শ্রমজীবি জনসাধারণের ভূমিকা গৌণ। এরূপ বিপ্লবে আর্থনীতিক রূপান্তর ঘটলেও শ্রমজীবি জনতা বা গরিব কৃষকের অবস্থান কোনো উন্নতি সাধিত হয় না। ২. বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব : এই বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য এই যে, বিপ্লব সাধনে শ্রমিক এবং কৃষক জনতা জাতীয় শিল্পের বিকাশ ছাড়াও শ্রমিকের অবস্থার উন্নতি এবং জমিতে কৃষকের স্বার্থসাধনকারী কৃষি সংস্কারের দাবিসহ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে। বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রযন্ত্র ধনিকশ্রেণীর কবলিত হলেও শ্রমিকশ্রেণী তার রাজনৈতিক চেতনা, ঐক্য এবং সংগঠিত শক্তির প্রভাবে ধনিকশ্রেণীর সরকারকে নিজের স্বার্থে বেশ কিছু পরিমাণে নিয়ন্ত্রিত করতে সক্ষম হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতির অধিকতর শক্তির কারণে এরূপ গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া বিপ্লব একাধিক দেশে সাধিত হয়েছে। শ্রমিকশ্রেণীর সংগঠিত ঐক্যবদ্ধ শক্তি, সমাজতান্ত্রিক দেশের নৈকট্য, জাতীয় বুর্জোয়ার দুর্বলতা প্রভৃতি কারণে এরূপ গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া বিপ্লব জনগণতন্ত্রের রূপ ধারণ করে সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরকে আসন্ন করে তুলতে পারে।
Revolution, October : অক্টোবর বিপ্লব (নভেম্বর বিপ্লব)
পৃথিবীর ইতিহাসে কয়েকটি ঘটনা তাদের বিপুলতার কারণে এবং সমাজের রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কাঠামোর মৌলিক পরিবর্তন সাধনের উৎস হিসাবে বিপ্লব বলে পরিচিত হয়ে আসছে। এদের মধ্যে ১৬৪৯ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডে গৃহযুদ্ধ, ১৬৮৮ খ্রিষ্টাব্দের ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট এর সার্বভৌমত্ব ঘোষণা, ১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণা ও যুদ্ধ, ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসি বিপ্লব এবং ১৯১৭ সনে অক্টোবর বিপ্লব বিশেষভাবে পরিচিত।
১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর (রাশিয়ার পুরাতন বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী ২৫ অক্টোবর) লেনিনের নেতৃত্বে বিপ্লবী বলশেভিক পার্টি রাশিয়ায় ক্ষমতা দখল করে এবং শ্রমিক কৃষক ও সৈনিকদের সোভিয়েত বা সমিতির শাসন প্রতিষ্ঠা করে। রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক এই বিপ্লব অক্টোবর বা নভেম্বর বিপ্লব নামে পরিচিত।
বিশাল রুশদেশে সামন্ততান্ত্রিক শাসনের প্রধান ছিল জার। একদিকে সামন্ততান্ত্রিক জারের শাসন, অপরদিকে অর্থনীতিতে পুঁজিবাদী শিল্পোৎপাটনের বিকাশ ঘটতে শুরু করেছে। ফলে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ক্ষয়িষ্ঞু প্রতিক্রিয়াশীল সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে বিকাশমান পুঁজিবাদী শক্তির সাধারণ দ্বন্ধ তীব্র হতে থাকে। এই বিরোধের প্রকাশ সামন্ততন্ত্র এবং জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে নানা সন্ত্রাসবাদী গুপ্ত সমিতির প্রতিষ্ঠা এবং ঘটনার মধ্যে ঘটতে দেখা যায়। কেবল সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন নয়, মার্কসবাদী সমাজতান্ত্রিক আদর্শে দীক্ষিত বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দলও সংগঠিত হয়। সামন্ততন্ত্র এবং জার শাসনের বিরুদ্ধে ১৯০৫ সালে কৃষক, শ্রমিক জনসাধারণ এবং নৌবাহিনীর নাবিকদের মধ্যে বিপ্লবাত্মক বিক্ষোভ সংগঠিত হয়। যুদ্ধ জাহাজ ‘পটেমকিন’ এর নাবিকগণ নিজেদের জীবনযাত্রা এবং খাদ্যের উন্নয়নের দাবিতে ধর্মঘট ঘোষণা করে। বিদ্রোহী নাবিকদের সঙ্গে বন্দরের শ্রমিকরাও যোগদান করে। কিন্তু জার সরকার সৈন্যবাহিনী নিয়োগ করে এই বিক্ষোভ দমন করে। পর্যুদস্তু হলেও ১৯০৫ সালের এই ঘটনা ১৯০৫ এর বিপ্লব নামে পরিচিত। লেনিন পরবর্তীকালে ১৯০৫ কে ১৯১৭ সালের বিপ্লবের পঞ্চমহড়া বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।
১৯১৪ সালে ইউরোপে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। রাশিয়াও এই যুদ্ধ জার্মানির প্রতিপক্ষ হয়ে লড়াই করে। কিন্তু রুশ বাহিনী যুদ্ধে বিপর্যস্ত হতে থাকে। যুদ্ধে প্রথম আড়াই বছরের মধ্যে রাশিয়ার পঞ্চান্ন লক্ষ সৈন্য নিহত হয়। ক্রমান্বয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যদের সমরাস্ত্র যোগান দেওয়াও সরকারের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। দেশে দুর্ভিক্ষাবস্থা দেখা দেয়। যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ে। সরকারের মধ্যে অনৈক্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। জার তার মন্ত্রিসভাকে ঘন ঘন পরিবর্তন করে। কৃষকদের জমির দাবি এবং সৈনিকদের মধ্যে শান্তির দাবি তীব্র হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে রাশিয়ার রাজধানী পেট্রোগ্রাডে ১৯১৭ সালের ৮ মার্চ(ফেব্রুয়ারী) ব্যাপক ধর্মঘট এবং হাঙ্গামা শুরু হয়। সরকার সৈন্য বাহিনীকে ধর্মঘট দমন করতে পাঠালে সৈনিকেরা ধর্মঘটিদের সঙ্গে যোগদান করে। এই সময়ে রুশ ডুমা বা পার্লামেন্টও সরকার বিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করে। জার ডুমার অধিবেশন বন্ধ করে দেবার হুকুম দিলেও ডুমা সে হুকুম অমান্য করে এক অস্থায়ী সরকার ঘোষণা করে। অবস্থাদৃষ্টে জার দ্বিতীয় নিকোলাস সিংহাসন ত্যাগ করেন। পুরাতন রুশ বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী ফেব্রুয়ারী মাসে সংঘটিত এই ঘটনা ইতিহাসে ‘ফেব্রুয়ারি বিপ্লব’ নামে অভিহিত। চরিত্রগতভাবে এই বিপ্লব ছিল পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক বিপ্লব। কিন্তু অস্থায়ী সরকার জনসাধারণের শান্তি বা জমি এবং রুটির দাবি পূরণ করতে ব্যর্থ হয়। তারা তখনো যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নীতি অনুসরণ করতে থাকে। কিন্তু সৈনিক, কৃষক এবং শ্রমিকদের মধ্যে বিপ্লবী মনোভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। অস্থায়ী সরকারের প্রায় প্রতিদ্বন্ধী সরকার হিসেবে দেশব্যাপী সৈনিক, কৃষক ও শ্রমিকদের নির্বাচিত সমিতি বা সোভিয়েত সংগঠিত হতে থাকে। আসলে ১৯০৫ এর বিপ্লবের মধ্যেই সংগ্রামী জনতার এইরূপ সোভিয়েত প্রথম গঠিত হয়েছিল। লেনিন এতদিনে দেশের বাইরে নির্বাসিত জীবন যাপন করছিলেন। বাইরে থেকে তিনি দেশের বলশেভিক দলের বিপ্লবী কাজ পরিচালনা করছিলেন। ১৬ এপ্রিল(১৯১৭) তিনি দেশে ফিরে এলে বলশেভিকদের নেতৃত্বে শ্রমিক, কৃষক ও শ্রমিকদের সোভিয়েত কার্যত অস্থায়ী সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী সরকার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। যুদ্ধ ও শান্তির ক্ষেত্রে সরকারের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া এবং অন্যান্য সকল প্রশ্নে সোভিয়েতগুলি অস্থায়ী সরকারের আদেশ অমান্য করতে থাকে। শক্তভাবে যুদ্ধ পরিচালনার অজুহাতে এবার অস্থায়ী সরকার সমস্ত বিক্ষোভ এবং দাবিকে দমন করার নীতি গ্রহণ করে। সৈন্য বাহিনীর মধ্যে যে সমস্ত রেজিমেন্ট বিপ্লবী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল তাদের ভেঙে দেওয়া হল। কৃষক আন্দোলন দমনেও কঠোরতর ব্যবস্থা গৃহীত হতে লাগল। এতদিন শ্রমিক কৃষক সৈনিকদের সোভিয়েতগুলিকে বরদাশত করা হলেও এখন থেকে সেগুলিকে সরকার ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। এমন অবস্থায় ১৬ জুলাই তারিখে অস্থায়ী সরকারকে উচ্ছেদের এক চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এ চেষ্টা সফল হয় না। এ চেষ্টা বলশেভিকদের দ্বারা পরিচালিত ছিল না। কেননা বলশেভিকদের মতে অস্থায়ী বুর্জোয়া সরকারকে উচ্ছেদের পরিস্থিতি তখনো পরিপক্কতা লাভ করে নি। এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পরে অস্থায়ী সরকারের দমননীতি তীব্র হয়ে ওঠে। সরকার লেনিনকে গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করে। লেনিন আত্মগোপন করেন। কিন্তু অস্থায়ী সরকারের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী কেরেনসকি এবং সামরিক বাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল কর্ণিলভের মধ্যে বিরোধ বাধে। জেনারেল কর্ণিলভও সেপ্টেম্বর মাসে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেন। জেনারেল কর্নিলভের উদ্দেশ্য ছিল অস্থায়ী সরকারের চরিত্র পুরোপুরি পাল্টে দিয়ে তাকে একেবারে প্রতিক্রিয়াশীল সরকারে পরিণত করা। পেট্রোগ্রাডের বিপ্লবী সৈনিক ও শ্রমিকদের প্রতিরোধে কর্নিলভের এই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। কিন্তু অস্থায়ী সরকারের দুর্বলতা প্রকটতর হয়ে ওঠে। খাদ্য সংকট ও শান্তির কামনা জনসাধারণকে সরকারের যুদ্ধ পরিচালনা নীতির তীব্র বিরোধী করে তোলে। যুদ্ধ প্রচেষ্টায় জনসাধারণ এর পক্ষ হতে কোনো সাড়াই আর সরকার পায় না। এমন অবস্থায় ৬ নভেম্বর তারিখে লেনিন বলশেভিক নেতৃত্বে পরিচালিত লালবাহিনীকে অস্থায়ী সরকারের দপ্তর পেট্রোগ্রাডের শীতপ্রাসাদ দখলের নির্দেশ দেন। ৭ নভেম্বর (নতুন বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী) সোভিয়েতসমূহের নিখিল রুশ কংগ্রেস বলশেভিক পার্টিকে সরকার গঠনের ক্ষমতা প্রদান করে প্রস্তাব গ্রহণ করে। লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি সরকার হিসাবে জনতার কমিসার বা মন্ত্রীপরিষদ গঠন করে। রাজধানীর বাইরে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহরেও বলশেভিকরা ক্ষমতা দখল করে। লেনিন দেশের জন্য শান্তি, জমি এবং রুটি বা রুজির নীতি ঘোষণা করলেন। ব্যক্তিগত মালিকানা নিষিদ্ধ করা হলো। প্রতিবিপ্লবী এবং যাজক প্রতিষ্ঠান গির্জার বিপুল সম্পত্তি সরকারের হাতে বাজেয়াপ্ত হলো। কৃষকদের জমির মালিক ঘোষণা করা হলো। শ্রমিকরা কারখানা দখল করতে শুরু করল। কৃষকদের মধ্যে জমি বিনামূল্যে বিলি করার নীতি গ্রহণ করা হল। ৫ ডিসেম্বর লেনিন যুদ্ধ থেকে রাশিয়ার সম্পর্কহীনতা ঘোষণা করে যুদ্ধ বন্ধ কার্যকর করেন। ১৯১৮ সালের ৩ মার্চ তারিখে জার্মানির সঙ্গে ব্রেস্ট লিটভস্ক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯১৮ সালের জুলাই মাসে বিপ্লবের মাধ্যমে প্রতিষি্ঠত সোভিয়েত রাষ্ট্রের প্রথম সংবিধান ঘোষণা করা হয়।
Revolution, Socialist : সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব
পুঁজিবাদের উচ্ছেদের ভিত্তিতে কারখানা, যন্ত্র, জমি এবং প্রাকৃতিক অপরাপর সম্পদের উপর শ্রমিকশ্রেণীর সমষ্টিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার মধ্যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য নিহিত। মার্কস এবং এঙ্গেল মানুষের সমাজের বিকাশ বিশ্লেষণ করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে পুঁজিবাদের পরবর্তী স্তরে অপরিহার্য বলে ঘোষণা করেছিলেন। তাঁরা পুঁজিবাদকে বিশ্লেষণ করে বলেছিলেন যে, পুঁজিবাদের মূল অসঙ্গতি হচ্ছে –একদিকে উৎপাদনের উপায় এবং উৎপাদিত সম্পদের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা এবং অপরদিকে উৎপাদন প্রক্রিয়ার যৌথ চরিত্র। যৌথভাবে যে সম্পদ শ্রমিকশ্রেণী উৎপাদন করে মালিক শ্রেণী ব্যক্তিগতভাবে তা ভোগ করে। পুঁজিবাদ শ্রমিককে পণ্য এবং শ্রমদাস হিসেবে ব্যবহার করে। শ্রমের বাজারে সর্বহারা বুভুক্ষ অসহায় শ্রমিকের সমস্ত শ্রমশক্তি দিন কিংবা সপ্তাহের চুক্তিতে পুঁজি এবং কারখানার মালিক নামমাত্র মজুরির বিনিময়ে কিনে নয়ে। বিনিময়ের চুক্তি মোতাবেক শ্রমিক তার প্রাপ্য মজুরির সমপরিমাণ সম্পদই মাত্র উৎপন্ন করতে বাধ্য। কিন্তু তার অসহায়তার কারণে শ্রমিক তার প্রাপ্য নির্দিষ্ট মজুরির পরিবর্তে অধিকগুণ বেশি সময় পরিশ্রম করে এবং অধিকগুণ সম্পদ উৎপন্ন করে। মজুরের এই চুক্তি অতিরিক্ত শ্রমের ফল আত্মসাৎ করেই পুঁজিবাদ তার মুনাফা তৈরি করে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্র এই অসঙ্গত অর্থনীতিক বুনিয়াদকে ভাবগত প্রচারে এবং শাসনের যন্ত্র দ্বারা স্থায়ী করে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু উৎপাদনের যৌথ প্রক্রিয়া সর্বহারা একতার শক্তিতে উদ্বুদ্ধ করে তোলে। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে শ্রমিকের সঙ্গে মালিকের শোষণগত বিরোধ ব্যতীত এক পুঁজিবাদীর সঙ্গে অপর পুঁজিবাদীর মুনাফার প্রতিযোগিতা এবং এক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের সঙ্গে উৎপন্ন দ্রব্য অধিকতর লাভে বিক্রি করার জন্য বিশ্ববাজার দখল এবং বন্টনের উপর অপর পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের বিরোধও বিদ্যমান। এই সমস্ত বিরোধের পরিণামে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব অপরিহার্য বলে মার্কস এবং এঙ্গেলস অভিমত প্রকাশ করেন। পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যবাদী স্তরকে বিশ্লেষণ করে লেনিন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অত্যাসন্নতার কথা বলেন। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সূত্রসমূহের উল্লেখ করে লেনিন বলেনঃ ১. পুঁজিবাদের অসমান বিকাশের কারণে শ্রমিকশ্রেণী সাম্রাজ্যবাদের েএবং পুঁজিবাদের দুর্বল অংশ বা এলাকায় আঘাত করে এক কিংবা একাধিক দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত করতে পারে। অর্থাৎ পৃথিবীর সমস্ত স্থানে একই সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হবে এমন কোনো কথা নাই; ২. পৃথিবীর দেশ বা অংশবিশেষে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হলে পৃথিবীতে পুঁজিবাদ এবং সমাজতন্ত্র এই উভয় ব্যবস্থার সহঅবস্থানের প্রশ্নটি জন্মলাভ করবে; ৩. শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বেই মাত্র সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হতে পারে; ৪. বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্র উচ্ছেদ এবং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বহারার একনায়কত্ব অপরিহার্য; ৫. সাম্রাজ্যবাদের সংকটকালে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের সর্বহারা মুক্তিকামী পরাধীন জাতির মুক্তি আন্দোলনের সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করে এবং মুক্তিকামী জনতার সঙ্গে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের শ্রমিক শ্রেণীর এই ঐক্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সাফল্য নিশ্চিত করে তোলে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব যে বিভিন্ন রূপ গ্রহণ করতে পারে লেনিন তারও উল্লেখ করেন। সোভিয়েত রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সাফল্য, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ফ্যাসিস্ট আন্দোলন পর্যদুস্ত করে রাশিয়ার বিজয় লাভ এবং যুদ্ধ পরবর্তীকালে বহু জাতির জাতীয় স্বাধীনতা অর্জন এবং পূর্ব ইউরোপের কয়েকিট দেশে, চীনে ও কিউবায় সমাজতান্ত্রিক পুনর্গঠনের নিশ্চয়তা বিধানকারী জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের সাফল্য পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সুনিশ্চিত করে তুলেছে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সাফল্যমন্ডিত হলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও উৎপাদন উপায়ের মালিকানা শ্রমিকশ্রেণীর হস্তগত হয়। কিন্তু সমাজতন্ত্র জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হওয়া একটি প্রক্রিয়া বিশেষ এবং সম্পূর্ণ হওয়া সময়সাপেক্ষ। সমাজতন্ত্র উৎপাদনের এবং বন্টনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হলে সাম্যবাদী সমাজ বাস্তবায়িত হয়ে ওঠে। সাম্যবাদী সমাজে প্রতিটি মানুষ যেমন তার ক্ষমতা অনুযায়ী সমাজের জন্য শ্রম করবে তেমনি সমাজও তার সমস্ত প্রয়োজনকে পূরণ করবে।
RosenBerg Couple Murder : রোজেনবার্গ দম্পতির মর্মান্তিক হত্যাকান্ড
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকি নামক দুটি নিরস্ত্র নগরের উপর আনবিক বোমা নিক্ষেপের মাধ্যমে। যুদ্ধ ছিল তখন সমাপ্তির পর্যায়ে। জাপান আত্মসমর্পণের পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়িয়েছিল। আণবিক বোমা নিক্ষেপের তখন কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার আনবিক বোমার শক্তির একমাত্র অধিকারী এ কথা বুঝাবার জন্য জাপানের উপর আনবিক বোমা নিক্ষেপ করে এবং মার্কিন কোনো মানবতাবোধ সম্পন্ন বিজ্ঞানী যেন আনবিক বোমা তৈরির কৌশল জানতে না পারে তার জন্য সেই সমস্ত মানবিকতাবোধ সম্পন্ন বৈজ্ঞানিককে গ্রেপ্তার করে হত্যা করার নীতি গ্রহণ করা হয়। মার্কিন যুদ্ধবাদী অধিনায়কদের ধারণা ছিল যে রাজনীতিক দল বা ব্যক্তিদের মধ্যে কমিউনিস্ট তথা সাম্যবাদী ব্যক্তিদের মধ্যে আণবিক বোমার অন্যায় ব্যবহার সম্পর্কে এরূপ ধারণা থাকতে পারে। তাই তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যেকটি দপ্তরে অনুসন্ধান চালাতে শুরু করে, এমন মানবতাবাদী বিজ্ঞানী রাষ্ট্রযন্ত্রের কোথায় থাকতে পারে। এরূপ অনুসন্ধানের মাধ্যমে তারা রোজেনবার্গ দম্পতি নামক এক মানবতাবাদী বিজ্ঞান দম্পতির সন্ধান লাভ করে এবং এই বিষয়ে ভিত্তিহীন অভিযোগে রোজেনবার্গ দম্পতিকে গ্রেপ্তার করে বিনা বিচারে এই দম্পতিকে বৈদ্যুতিক চেয়ারে বসিয়ে হত্যা করে।
Rousseau, Jean Jacques : জাঁ জ্যাক রুশো(১৭১২-১৭৭৮ খ্রি.)
অষ্টাদশ শতকের ফরাসি মুক্তবুদ্ধি পথিকৃতদের অন্যতম ব্যক্তি ছিলেন জ্যাঁ জ্যাক রুশো। দার্শনিক, সমাজতত্ত্ববিদ, সৌন্দর্যতত্ত্ববিদ এবং শিক্ষণের ক্ষেত্রে তাত্ত্বিক হিসেবে রুশো খ্যাতি অর্জন করেন। অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সে একদল বিশ্বকোষিক সংঘবদ্ধভাবে কুসংস্কার এবং প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে মুক্তবুদ্ধির চর্চা করেন। এদের মধ্যে ডিডেরট, ডি এ্যালেম্বার্ট, মন্টেসক্যূ, ভলটেয়ার, হেলভিটিয়াস এবং হলবাকের সঙ্গে রুশোর নামও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এদের রচনাবলী ভাবগতভাবে ফরাসি বিপ্লবের পথ উন্মুক্ত করে দেয়।
রুশো জন্মগ্রহণ করেন সুইজারল্যান্ড এর জেনেভা শহরে। তাঁর পিতা ছিলেন একজন দরিদ্র ঘড়ি নির্মাতা। ১৯৪২ সনে রুশোদ ৩০ বৎসর বয়সে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস গমন করেন। নিজের জীবনধারণের জন্য শৈশবকাল থেকে রুশো বিচিত্র জীবিকা অবলম্বন করেন। এভাবে তিনি জীবনে বিপুল অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হন। প্যারিসে আসার পরে দিজন একাডেমী ঘোষিত একটি রচনা প্রতিযোগিতার প্রতি রুশোর দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় (১৭৪৯)। একাডেমী ঘোষিত প্রতিযোগিতার বিষয় ছিল বিজ্ঞান, সাহিত্য এবং শিল্প কি মানুষের জীবনকে উন্নত করেছে, না তাকে অধিকতার কলুষময় করেছে? রুশো এই প্রতিযোগিতার জন্য একটি প্রবন্ধ পেশ করেন। তাঁর এই প্রবন্ধ একাডেমী কর্তৃক সর্বোত্তম বিবেচিত হয় এবং তিনি প্রথম পুরস্কারে ভূষিত হন। তাঁর এই রচনাতেই রুশোর রাষ্ট্র এবং সমাজদর্শনের মূল দৃষ্টিভঙ্গি প্র্রকাশ পায়। প্রচলিত চিন্তাধারার বিরুদ্ধতা করে রুশো তার এই প্রবন্ধেই দেখাতে চেষ্টা করেন যে, তথাকথিত সভ্যতার পূর্ব যুগেই অধিকতর স্বাভাবিক এবং যথার্থ ছিল। সভ্য মানুষের শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি, তার অন্তরের পরশ্রীকাতরতা, সন্দেহ, ভয়, হৃদয়হীনতা, আত্মম্ভরিতা, ঘৃণা এবং প্রতারণাকে আড়াল করে রাখার আচ্ছাদন বৈ আর কিছু নয়। রুশোর মতে ইতিহাসে সভ্যতা যত অগ্রসর হয়েছে মানুষের জীবন তত কৃত্রিম ও জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সভ্যতার পূর্বেই মানুষ সহজ ও স্বাভাবিক ছিল। রুশোর এই অভিমতের অধিকতর যুক্তিসহ সুবিস্তারিত প্রকাশ ঘটে তাঁর ১৭৬২ সনে প্রকাশিত গ্রন্থ ‘দি সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট’ বা ‘সামাজিক চুক্তি’র মাধ্যমে। লক এবং হবসের ন্যায় রুশোও এই অভিমত পোষণ করেন যে, রাষ্ট্রের সংগঠনের পূর্বে মানুষ একটি প্রাকৃতিক পরিবেশে বাস করত। এই প্রাকৃতিক পরিবেশ বা অবস্থা সম্পর্কে হবস মনে করতেন যে, প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষ সর্বক্ষণ আত্মঘাতী সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল। কারণ মানুষ প্রধানত আত্মকেন্দ্রিক, আত্মসুখান্বেষী এবং পরদ্বেষী। কিন্তু আত্মঘাতী সংঘর্ষের চরম অবস্থা মানুষের মনে এই চেতনার সৃষ্টি করেছিল যে, কোনো শাসক বা শক্তির কাছে নিজেদের ব্যক্তিগত অধিকার সমর্পণ করে শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং শাসকের বিধানমত জীবন যাপন না করলে ব্যক্তির পক্ষে নিরাপদ জীবন যাপন সম্ভব নয়। এই চেতনা থেকে মানুষ একসঙ্গে চুক্তির মারফত শাসক সৃষ্টি করে নিয়মবদ্ধ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে। রুশোও একথা স্বীকার করেন যে, মানুষ চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু প্রাকৃতিক অবস্থার রূপ এবং চুক্তির প্রকার সম্পর্কে রুশো হবস থেকে পৃথক মত পোষণ করেন। রুশোর মতে, মানুষের চরিত্র মূলত স্বার্থপর নয়। প্রাকৃতিক অবস্থাতে মানুষ পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল জীবই ছিল। অপরের প্রতি সহানুভূতি বোধ করা মানুষেরই বৈশিষ্ট্য। কিন্তু সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ তার এই বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে। লকের মতোই একদিকে যেমন রুশো প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষের চরিত্রকে একেবারে আদর্শ কল্পনা করেননি, তেমনি হবস এর ন্যায় তিনি মানুষকে অধমও ভাবেন নি। রুশোর মতে মানুষ প্রাকৃতিক অবস্থায় স্বাভাবিক ও সাধারণ জীবন যাপন করতে চাইত। কিন্তু একটা পর্যায়ে সে দেখতে পেল যে, ব্যক্তির একার পক্ষে অপরের সঙ্গে সংযোগহীনভাবে প্রতিকুল শক্তির বিরুদ্ধে নিরাপদ জীবন যাপন করা এবং নিজের অধিকারসমূহ প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। এই বোধ থেকে মানুষ চুক্তি করে রাষ্ট্র অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় নিয়ম কানুন, বিধি নিষেধের সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু এ চুক্তি সে অপর কোনো শাসক বা অধিনায়কের সঙ্গে করে নি কিংবা চুক্তি মারফত কোনো নিরঙ্কুশ একচ্ছত্র শাসনকর্তা তৈরি করে নি। ব্যক্তি চুক্তি করেছে ব্যক্তির সঙ্গে অর্থাৎ প্রত্যেকে প্রত্যেকের সঙ্গে। চুক্তির মূলকথা হচ্ছে, একে অপরের অধিকারে হস্তক্ষেপ করবে না। এমনিভাবে প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের (নিজের সঙ্গে নিজের) চুক্তিতে সৃষ্ট হয়েছে এক সাধারণ ইচ্ছা ও সাধারণ শক্তি। এই সাধারণ ইচ্ছাই রাষ্ট্রীয় জীবনে মানুষের নিয়ামক। এ ইচ্ছা কোনো ব্যক্তিরই যথার্থ স্বার্থের বৈরী নয়। প্রত্যেকের ইচ্ছা দিয়ে এর সৃষ্টি বলে কোনো ব্যক্তির পক্ষেই যেমন এই সাধারণ ইচ্ছাকে জবরদস্তি মনে করা চলে না-তেমনি এই সাধারণ ইচ্ছা ব্যক্তির যথার্থ স্বার্থের বিরোধী কোনো নিয়ম বা নিষেধ আকারেও প্রকাশিত হতে পারে না। রুশোর মতে, সামাজিক চুক্তির উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজের একটা পর্যায়ে অর্থাৎ প্রাকৃতিক জীবনে মানুষ যে স্বাধিকার ভোগ করত, সভ্যতার পর্যায়েও যৌথ সম্মতির ভিত্তিতে মানুষ যেন নিরাপদভাবে সেই অধিকার ভোগ করতে পারে তার ব্যবস্থা করা। হবস এবং রুশোর চুক্তির মধ্যে একটা সাদৃশ্য এই যে, উভয় ক্ষেত্রে মানুষ তার চুক্তি পূর্ব স্বাধীনতাকে সর্বোতভাবে অপর এক শক্তির কাছে সমর্পণ করে দিচ্ছে। কিন্তু হবস্ এর তত্ত্বে ব্যক্তি যেখানে একচ্ছত্র শাসকের নিকট শর্তহীনভাবে তার স্বাধীনতাকে ত্যাগ করেছে সেখানে রুশোর ব্যাখ্যায় ব্যক্তির আত্মসমর্পণ কোনো শাসকের কাছে নয়; এ আত্মসমর্পণ পরস্পরের কাছে। এখানে শাসকের কাছে অধিকার ত্যাগ করে ব্যক্তি কি লাভ করবে? শান্তি? রুশোর মতে শৃঙ্খলিত বন্দিও তো বন্দীশালায় নিরাপদ শান্তি লাভ করতে পারে কিন্তু তাই বলে সে শান্তি কি মানুষের কাম্য হতে পারে? কাজেই সামাজিক চুক্তি ব্যক্তির অধিকার বিনষ্টির জন্য নয়, তার রক্ষার জন্য। রুশোর মতে, মানুষ পারস্পরিকভাবে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে এই চেতনা হয়েছে যে, এককভাবে তার অধিকার ভোগ করা সম্ভব নয়। এই চেতনা থেকে সকলে সকলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। এ চুক্তির মাধ্যমে ব্যক্তি তার কোনো যথার্থ স্বার্থ থেকে বঞ্চিত হয় নি। কারণ চুক্তিবদ্ধ এক ব্যক্তি এমন কোনো অধিকার অপর ব্যক্তিকে অর্পণ করে দিচ্ছে না যার পরিবর্তে ঠিক সে অধিকারই সে অপরের নিকট থেকেও লাভ করতে পারছে না।
দর্শনের ক্ষেত্রে রুশো ঈশ্বরের অস্তিত্ব এবং আত্মার অমরতা উভয়কেই স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু আবার বস্তুকেও তিনি শ্বাশ্বত বলেছেন। সমাজতাত্ত্বিক হিসেবে রুশো সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার তীব্র সমালোচক ছিলেন। সামন্ততন্ত্রের শোষণ ও শ্রেণীবিন্যাসের উচ্ছেদ করে সকল মানুষের সমান অধিকারের ভিত্তিতে নতুন যে বিপ্লবী চেতনা দেশের ধনিক শ্রেণী ও কৃষক সমাজের মধ্যে বিস্তার লাভ করেছিল বুর্জোয়া বিপ্লবের সে চিন্তাধারাকে রুশো সমর্থন করেছিলেন। সমাজের অসাম্য ও অবিচারের মূল ব্যক্তিগত সম্পত্তির অস্তিত্বকে প্রধান হিসেবে চিহ্নিত করলেও রুশো ব্যক্তির জন্য অল্প পরিমাণ ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষার মতও পোষণ করতেন। শিক্ষার প্রশ্নেও রুশো প্রগতিশীল অভিমত পোষণ করতেন। তাঁর মতে সামন্ততান্ত্রিক শ্রেণীভিত্তিক শিক্ষার পরিবর্তে এমন এক শিক্ষার প্রবর্তন করতে হবে যে শিক্ষা সকল নাগরিককে শ্রমের মর্যাদায় উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হবে।
রুশোর বিপ্লবী চিন্তায় ফরাসি সরকার এবং সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিসমূহ রুষ্ট হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রীয় নিগ্রহের আশঙ্কায় তিনি এক সময় ফ্রান্স পরিত্যাগ করেন। কিন্তু ১৭৬৬ খ্রিষ্টাব্দে বার্ন প্রজাতন্ত্র তাকে আশ্রয় দিতে অস্বীকার করায় তিনি ইংরেজ দার্শনিক হিউমের আমন্ত্রণে ইংল্যান্ড গমন করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে হিউমের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ উপস্থিত হয় এবং তিনি ফ্রান্সেই প্রত্যাবর্তন করেন।
রুশোর রচনাবলীর মধ্যে ‘দি সোস্যাল কন্টাক্ট’ বা ‘সামাজিক চুক্তি’ ব্যতীত তাঁর ‘কনফেশনস’ বা আত্মচরিত এবং ডিডেরটের সম্পাদনায় প্রকাশিত ফরাসি বিশ্বকোষে প্রকাশিত ‘ডিসকোর্স ইন পলিটিক্যাল ইকনমি’ এবং ‘এমিলি’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
Roy, M.N. : মানবেন্দ্রনাথ রায় (১৮৮৭-১৯৫৪ খ্রি)
বিশ শতকের গোড়ার দিকেই মানবেন্দ্রনাথ রায় সেকালের স্বাধীন সংগ্রামী গোপন রাজনৈতিক বিপ্লবী দলে যোগদান করেন। বহু রাজনৈতিক ঘটনার সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে সক্রিয়ভাবে জড়িত মানবেন্দ্রনাথ রায় বহুবার বিভিন্ন সরকার দ্বারা গ্রেফতার হন, কারাবন্দি হন এবং কোনো কোনো বন্দিদশা হতে পলায়ন করে ছদ্মনামে পুনরায় রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯১৭ সনে রুশ বিপ্লবের পরে সমাজতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং কমিউনিস্ট রাজনীতিকের একজন নেতা হিসেবে পরিচিত হন। কিন্তু কালক্রমে কমিউনিস্ট পার্টি এবং আন্তর্জাতিকের মধ্যে মতবিরোধ ঘটলে এম.এন. রায় কমউনিস্ট আন্তর্জাতিক হতে বহিষ্কৃত হন। ইংরেজি ভাষায় প্রাঞ্জল রাজনৈতিক রচনাকার এম.এন. রায় তার নিজস্ব অভিমত ব্যাখ্যা ও প্রচার করার জন্য একাধিক ইংরেজি পত্রিকা ও সাময়িকী প্রকাশ করা ব্যতীত অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে ‘ইন্ডিয়া ইন ট্রানজিশন’, ‘নউ হিউম্যানিজম,’ ‘রিজন, রোমান্টিসিজম এন্ড রিভোল্যূশন’ নামক গ্রন্থ রচনা করেন। এম.এন. রায় প্রচলিত মার্কসবাদী কমিউনিস্ট মতবাদ থেকে ভিন্নভাবে তাঁর দর্শন ও চিন্তাধারা প্রকাশ করার চেষ্টা করেন। তার চিন্তাধারা ‘র্যাডিক্যাল হিউম্যানিজম’ নামে পরিচিত।
Russell, Bertrand: বার্টান্ড রাসেল (১৮৭২-১৯৭০)
বার্টান্ড রাসেল ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইংরেজ দার্শনিক এবং যুদ্ধবিরোধী শান্তি আন্দোলনের সক্রিয় নেতা। রাসেলের জীবন যেমন দীর্ঘ, তেমনি বিচিত্র। তাঁর চরিত্রের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল যে, জীবনের কোনো নীতিকেই তিনি বিনা প্রশ্নে স্বীকার করেন নি এবং কোনো নীতিতে অবিচলও থাকেন নি। তাঁর প্রাঞ্জল রচনারীতি তাঁকে বিপুল মানুষের কাছে জনপ্রিয় করে তুলে। চিন্তা এবং রচনায় তিনি জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। মৃত্যুর কয়েকবছর পূর্বে প্রকাশিত আত্মজীবনীর কয়েকটি খন্ড তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের নিঃসঙ্কোস সত্যকথনের জন্য সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। আত্মজীবনী ব্যতীত তাঁর প্রচুর সংখ্যক গ্রন্থের মধ্যে গণিত দর্শনের উপর লিখিত গ্রন্থসমূহ এবং ‘পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস’ বিশেষভাবে পরিচিতি লাভ করেছে। রাসেল হোয়াইটহেডের সাথে যুক্তভাবে গণিত দর্শনের উপর গবেষণা করেন। আঙ্কিক ন্যায়শাস্ত্রকে তিনি বিশেষভাবে উন্নত করেছেন। ‘লজিক্যাল সিম্বলস’ বা ন্যায়ের প্রতীককে তিনি ত্রুটিহীন করার চেষ্টা করেন। দর্শনের ক্ষেত্রে রাসেরলে নতুন একটি দৃষ্টিভঙ্গি এই ছিল যে, তিনি দর্শনকে কাল্পনিক সমস্যার ততোধিক কাল্পনিক সমাধানের আকর না করে দর্শনকে বিজ্ঞানের ব্যাখ্যাকারীতে পরিণত করার চেষ্টা করেছেন। তিনি মনে করতেন যে, দর্শন বিজ্ঞানের পরিমন্ডল থেকে সমস্যাকে আরোহণ করবে এবং বৈজ্ঞানিক তথ্য ও তত্ত্বকে সামগ্রিক এবং মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার বিশ্লেষণ করাই হবে দর্শনের প্রধান কর্তব্য। দর্শন মানুষকে আকাশচারী কল্পনাবিলাসী নয়, দর্শন মানুষকে বৈজ্ঞানিক ও সামগ্রিক দৃষ্টিসম্পন্ন সমাজতাত্ত্বিকে পরিণত করবে। দর্শনের অপর কাজ হবে মানুষের ভাষাকে বিশ্লেষণ করে তাকে ভাব প্রকাশের সঠিক বাহনে পরিণত করার চেষ্টা করা। জ্ঞানতত্ত্বের ক্ষেত্রে রাসেলকে সন্দেহবাদী বলা চলে। সাধারণ জীবনে তিনি শান্তিপ্রিয় লোক ছিলেন। কিন্তু প্রায় শতাব্দীকালের দীর্ঘ জীবনে তিনি দুটি মহাযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছেন। যে মানবিক আদর্শের তিনি কল্পনা করেছেন ভিয়েতনামের নিরীহ নির্বিবাদী মানুষের উপর অনুষ্ঠিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্বর নিধনযজ্ঞে তা ভস্মীভূত হতে দেখেছেন। এত দীর্ঘজীবনে ঘটনার উত্থান পতনে ব্যক্তির পক্ষে হতাশ হয়ে পড়া স্বাভাবিক। কিন্তু রাসেলের জীবনে বিস্ময়কর দিক এই যে, বৃদ্ধ বয়সেও তিনি হতাশাগ্রস্ত না হয়ে এই ধ্বংসযজ্ঞে প্রতিরোধের সংগ্রামী সৈনিকে পরিণত হন। তাঁর এই সংগ্রামী মনোভাবের কথা প্রকাশ করে ৯০ বছর বয়েসে রাসেল লিখেছিলেন, “সাধারণভাবে যে রকম আশা করা হয়, তার অতিক্রম করে আমি ক্রমান্বয়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছি। অথচ আমি বিদ্রোহী হয়ে জন্মগ্রহণ করি নি। ১৯১৪ সন পর্যন্ত আমি কম বেশি দুনিয়ার সঙ্গে মানিয়ে চলেছি। তখনও অমঙ্গলজনক অবস্থা ছিল। কিন্তু তা হ্রাস পাবে বলে মনে করার যৌক্তিকতা তখনো ছিল। বিদ্রোহীর মন মেজাজ না থাকা সত্ত্বেও ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে আমি ধৈর্য বজায় রেখে ঘটনার সাথে তাল রেখে চলতে পারলাম না। সংখ্যায় সামান্য হলেও এমন একটি দলের আবির্ভাব ঘটেছে যাদের সাথে আমার মতের মিল আছে এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমি তাদের সাথে কাজ করে যাবো।”
Saankhya : সংখ্যা
প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখার নাম ছিল সাংখ্য। পৌরাণিক কাহিনীতে কপিল মুনিকে সাংখ্য শাখার প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। সত্তার ধারণায় সাংখ্য ছিল দ্বৈতবাদী।
পুরুষ এবং প্রকৃতি : উভয়ই মৌলশক্তি। পুরুষ হচ্ছে চেতনা, প্রকৃতি হচ্ছে বস্তু, প্রকৃতিজগৎ। সাংখ্য মতে পুরুষ দ্বারা ঈশ্বর বা স্রষ্টা বুঝায় না। পুরুষ হচ্ছে ব্যক্তির মধ্যে আশ্রয়প্রাপ্ত বা আবদ্ধ নিত্যকালের চেতনা। ব্যক্তি প্রকৃতির অংশ। ব্যক্তির পরিবর্তন আছে, কিন্তু পুরুষের কোনো পরিবর্তন নেই। প্রকৃতি নিয়ত কার্যকারণের বিধান দ্বারা পরিবর্তিত হচ্ছে। প্রকৃতির পরিবর্তনের মূলে আছে সত্ত্ব, তমঃ. রজঃ এই তিন গুণের সমন্বয়। সত্ত্ব হচ্ছে শ্রেষ্ঠ গুণ। স্বচ্ছতা এবং পবিত্রতা হচ্ছে এর বৈশিষ্ট্য। তমঃ হচ্ছে জাড্য বা জড়তা। এবং রজঃ হচ্ছে সক্রিয়তা। বিশ্ব জগৎ এই তিন গুণের সমাহারের সৃষ্টি। প্রকৃতির সঙ্গে পুরুষের সংযোগে বিশ্ব জগতের বিবর্তন শুরু। ব্যক্তির বিবর্তনও এই দুই মৌল শক্তির সংযোগের ফল। দেহের মধ্যে পুরুষ, প্রকৃতি এবং অহং এর স্থিতি। পুরুষের নির্দেশে দেহের ক্রিয়াশীলতা। দেহের বিবর্তনের লক্ষ্য হচ্ছে কর্মের মাধ্যমে এমন বিশুদ্ধ অবস্থা লাভ করা যে অবস্থায় দেহের বন্ধন থেকে পুরুষ নিত্যকালের মুক্তিলাভে সক্ষম হবে।
Santayana, George : জর্জ সান্তায়ানা (১৮৩৬-১৯৫২)
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন বিখ্যাত দার্শনিক এবং লেখক ছিলেন জর্জ সান্তায়ানা। কিন্তু জর্জ সান্তায়ানারা জন্ম হয়েছিল ১৮৬৩ সালে স্পেনের মাদ্রিদ শহরে এবং তিনি মারা যান ইতালির রোম শহরে ১৯৫২ সালে। তাঁর দর্শনকে ক্রিটিক্যাল রিয়ালিজম বা বৈচারিক বাস্তববাদ বলা হয়। জর্জ সান্তায়ানার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্চে : ‘লাইফ অব রিজন’ বা যুক্তির জীবন। তাঁর যুক্তির জীবনকে তিনি পাঁচ খন্ডে বিভক্ত করেন। খন্ডগুলির নাম এরূপ ১. সাধারণ বোধ যুক্তি, ২. সমাজ জীবনে যুক্তি, ৩. ধর্মে যুক্তি, ৪. আর্ট বা শিল্প কর্মে যুক্তি, ৫ বিজ্ঞানে যুক্তি।
Sartree, Jean Paul : জাঁ পল সার্ত্রে (১৯০৫-১৯৮০ খ্রি.)
জাঁ পল সার্ত্রে ছিলেন একজন বিখ্যাত ফরাসি অস্তিত্ববাদী দার্শনিক, প্রবন্ধকার, নাট্যকার এবং উপন্যাসিক। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সার্ত্রে ফ্যাসিবিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ফ্যাসিবাদের পুনরুজ্জীবনের বিরুদ্ধে সার্ত্রে ছিলেন সোচ্চার এবং সংগ্রামী। সার্ত্রের দর্শনে অস্তিত্ববাদের প্রবক্তা কিয়ার্কেগার্ড এবং মনঃসমীক্ষণের প্রতিষ্ঠাতা ফ্রয়েডের চিন্তাধারার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। সার্ত্রের দর্শনের মূল কথা হচ্ছেঃ সত্তার মূল হচ্ছে মানুষ নিজে। জগতের মধ্যে যুক্তি নেই। মানুষ কোনো বিধিবিধানের দাস নয়। মানুষ নিজের সত্তাকে নিজে তৈরি করে।
Scepticism : সংশয়বাদ
সংশয়বাদ হচ্ছে একটি দার্শনিক তত্ত্ব। বিশেষ করে জ্ঞানের প্রশ্নে প্রাচীন গ্রিসে এই তত্ত্বের উদ্ভব ঘটে। বিষয়ী বা ব্যক্তি নিরপেক্ষ জ্ঞান লাভ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়- এই হচ্ছে সংশয়বাদের মূল কথা। খ্রিষ্টপূর্ব চতূর্থ শতাব্দীতে প্রাচীন গ্রিক সমাজ যখন সামাজিক অস্থিরতায় সংকটগ্রস্ত তখন প্রচলিত ধ্যান ধারণার বিরুদ্ধে সংশয় এবং অস্বীকারমূলক একটা মনোভাব জন্মলাভ করে। প্রাচীন সংশয়বাদের শক্তিশালি প্রকাশ ঘটে পিরহো, আরসেসিলাস, কারনিয়াডিস, ইনিসিডেমাস, সেক্সটাস এমপিরিকাস এবং অপরাপর দার্শনিকের মধ্যে। সফিস্টরা যখন প্রচলিত বিধিবিধান সম্পর্কে জনসাধারণের মনে প্রশ্নে উদ্রেক করেছিল তেমনি সংশয়বাদীগণ বলতে শুরু করে: জ্ঞানের প্রচলিত ধারণারই বা নিশ্চয়তা কি? জগৎ সম্পর্কে, বস্তু সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান আছে বলে পন্ডিতগণ যে দাবি করেন তার কোনো ভিত্তি নেই। ব্যক্তি-নিরপেক্ষ কোনো জ্ঞান আছে বলে প্রমাণ করা যায় না। ব্যক্তির ইন্দ্রিয়সমূহের সুস্থতা, অসুস্থতা, ব্যক্তির অভাব অভিযোগ, সুখ স্বাচ্ছন্দ্য, প্রচলিত বিশ্বাস, অবিশ্বাস, আচার আচরণ দ্বারা ব্যক্তির জ্ঞান প্রভাবান্বিত হয়। অথচ জ্ঞান বলতে পন্ডিতগণ এমন কিছুকে বুঝাতে চান যা ব্যক্তির মন বা পরিপার্শ্ব, তার অবস্থা বা ইতিহাস কোনো কিছুর উপর নির্ভরশীল নয়। কিন্তু ব্যক্তি এবং অবস্থা নিরপেক্ষ যখন সম্ভব নয় তখন বিশ্বের বৃহৎ বৃহৎ সমস্যা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা নিরর্থক। প্রাচীন সংশয়বাদীগণ বলতেন যে, জ্ঞানে অতৃপ্তি এবং অসন্তোষের বৃদ্ধি। তাই মনের শান্তির জন্য শ্রেয় হচ্ছে কোনো কিছু সম্পকে কোনো সিদ্ধান্তমূলক অভিমত আদৌ গ্রহণ না করা। সংশয়বাদ মধ্যযুগেও গোঁড়া ধর্মীয় এবং দার্শনিক অভিমতসমূহের প্রভাব হ্রাসে বিশেষ সাহায্য করেছে। মধ্যযুগে প্রচলিত ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে সংশয়বাদী চিন্তা বস্তুবাদী এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার বিকাশকে সহজতর করেছে। কিন্তু পরবর্তীকালে হিউম এবং কান্ট সংশয়বাদের যে তত্ত্ব প্রচার করেন তাতে জ্ঞান কেবলমাত্র সত্তার বাহ্য প্রকাশে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। কান্টের দর্শনে সত্তার যথার্থ জ্ঞান অতীন্দ্রিয় বোধ বা ধর্মীয় অনুভূতির মাধ্যমেই মাত্র লাভ করা চলে।
Scholasticism : স্কলাসটিসিজম, সাম্প্রদায়িক বিদ্যাভিমান, ধর্মীয় দর্শন
ইউরোপের দর্শনের বিকাশে ‘স্কলাসটিসিজম’ শব্দের একটি বিশেষ অর্থ রয়েছে। ইউরোপীয় দেশসমূহে মধ্যযুগে যখন খ্রিষ্টধর্মের যাজকতন্ত্রের প্রভাব সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রবলভাবে চলছে তখন শিক্ষায়তনগুলি ছিল গোঁড়া যাজক সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রণাধীন। এই সমস্ত স্কুলে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পন্ডিতদের প্রধান কর্তব্য হয় ধর্মের বিশ্বাস ও বিধিনিষেধকে যুক্তির সাহায্যে সত্য বা সঠিক বলে প্রমাণ করা। এই ধারায় ‘স্কলাসিটক’ সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। এই সকল স্কলাসটিক বা পন্ডিতগণ যে ধর্ম যাজক ছিল, তা নয়। কিন্তু এরা ধর্মকে দর্শনের মারফত রক্ষা করাকে নিজেদের প্রধান দায়িত্ব হিসাবে গ্রহণ করেছিল। ধর্মরক্ষাকারী এই পন্ডিতগণ প্রাচীন গ্রিসের বিশেষ করে প্লেটো এবং এ্যারিস্টটলের দার্শনিক মতকে নিজেদের সুবিধামতো ব্যাখ্যা করে খ্রিষ্টধর্মের একটা যুক্তিগত ভিত্তি তৈরি করার চেষ্টা করে। এই ধর্মীয় দর্শনের প্রথমদিকে যে দার্শনিক সমস্যাগুলি আলোচিত হয় তার মধ্যে সাধারণ বা সার্বিকভাবের কোনো বাস্তব অস্তিত্ব আছে কিংবা নেই-প্রশ্নটির উল্লেখ করা যায়। খ্রিষ্টধর্মের সঙ্গে এ্যরিষ্টটলীয় দর্শনের সমন্বয় সাধনের প্রধান চেষ্টা করেন টমাস এক্যুইনাস। টামস এক্যুইনাস পরবর্তীকালে সেইন্ট বা স্বর্গীয় পুরুষ বলে ঘোষিত হন এবং রোমান ক্যাথলিক অর্থাৎ গোঁড়া যাজকতন্ত্রের দর্শনের মুখপাত্র হিসাবে পরিগণিত হন। মধ্যযুগের ধর্মীয় দার্শনিকদের মধ্যে টমাস এক্যুইনাস ব্যতীত এরিজোনা, আনসেলম, আবেলার্দ এবং অকামের উইলিয়ামের নাম উল্লেখযোগ্য। নবম শতাব্দীতে এরিজেনো অব প্লেটোবাদের ব্যাখ্যা করেন; আনসেলম সত্তার প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করেন; দ্বাদশ শতকে আবেলার্স সাধারণ বা সার্বিক ভাবের অস্তিত্বগত প্রশ্নের একটা সমাধানের চেষ্টা করেন এবং চতুর্দশ শতকে অকামের উইলিযাম বলেন, ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিশ্বাসের ব্যাপার, যুক্তি দ্বারা প্রমাণের বিষয় নয়।
Schopenhauer, Arthur : আর্থার শপেনহার (১৭৮৮-১৮৬০ খ্রি.)
শপেনহার ছিলেন ঊনবিংশ শতকের জার্মান ভাববাদী দার্শনিক। তাঁর দর্শনের মূলে ছিল বাস্তব সমাজ এবং জগৎ সম্পর্কে অবিশ্বাস এবং হতাশা। ১৮৪৮ সালের জার্মানি শ্রমিক এবং কৃষক শ্রেণীর বিপ্লবাত্মক অভ্যুত্থানে পূর্ণ ছিল। শোষিত জনসাধারণের এই বিপ্লবী চেতনা এবং চেতনার সংঘটিত প্রকাশে পুঁজিপতিশ্রেণী আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে প্রতিক্রিয়ার পথ অবলম্বন করে। এই পর্যায়ে শাপেনহার তাঁর দর্শনের জন্য খ্যাতি অর্জন করেন। শপেনহার তৎকালীন জার্মানির প্রতিক্রিয়ার মুখপাত্র হিসেবে বিবেচিত হন। পুঁজিবাদ যখন সাম্রাজ্যবাদী যুগে প্রবেশ করে, শপেনহারের ভূমিকা তখন অধিকতর প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। শপেনহার বস্তুবাদের বিরোধিতা করেন। কান্টের দৃশ্যমানতার তত্ত্বকে গ্রহণ করে কান্টের দৃশ্যাতিরিক্ত স্বাধীন সত্তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে সব কিছুর মূলে এক অন্ধ ইচ্ছাশক্তির কল্পনা করেন। এই অন্ধ ইচ্ছাশক্তি কোনো যুক্তির অধীন নয়। অন্ধ ইচ্ছাশক্তি সবকিছুর পরিচালক। কাজেই এই তত্ত্বে প্রকৃতির বিধানের কোনো স্থান নেই এবং কোনো কিছুকে বৈজ্ঞানিকভাবে জ্ঞাত হওয়ারও কোনো প্রশ্ন ওঠে না। শপেনহার ইতিহাসের গতিকে স্বীকার করতেন না। অতীত যদি দুঃখময় হয়ে থাকে, ভবিষ্যতে মহৎ বা সুখময় কিছু আশা করার যুক্তি নেই। ব্যক্তির পক্ষে কামনা বাসনার কোনো অর্থ নেই। ব্যক্তির একমাত্র কাম্য হওয়া উচিত কামনা বাসনা বিমুক্ত নির্বাণ লাভ। এই নির্মাণের তত্ত্ব শপেনহার বৌদ্ধদর্শনের কাছ হতে গ্রহণ করেন। শপেনহারের এই প্রতিক্রিয়াশীল ভাববাদ এবং হতাশাবাদী জীবনবাদ নিৎসের দর্শনের আদর্শগত পটভূমি রচনা করে দিয়েছিল।
Seal, Brojendar Nath : ব্রজেন্দ্রনাথ শীল (১৮৬৪-১৯৩৮ খ্রি.)
ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত বাঙালি পন্ডিত এবং দার্শনিক। ছাত্রাবস্থাতেই ব্রজেন্দ্রনাথ এর তীক্ষ্ম বুদ্ধি এবং জ্ঞানের গভীরতা কথা গল্পের আকারে শিক্ষিত সমাজে ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৮৮৪ সনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্রজেন্দ্রনাথ দর্শনে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। পরবর্তীকালে তিনি কুচবিহার কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ১৮৯৯ সালে ব্রজেন্দ্রনাথ রোমে প্রাচ্যবিদদের আন্তর্জাতিক কংগ্রেসের উদ্বোধন করেন। দীর্ঘদিন যাবত তিনি মহীশুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর এর দায়িত্ব পালন করেন। এক সময়ে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক হিসেবেও নিযুক্ত ছিলেন। ব্রজেন্দ্রনাথ বহু বিষয়ে পন্ডিত ছিলেন। কিন্তু কোনো রচনাতে বিন্দুমাত্র ত্রুটি রাখবেন না- এই কঠিন নীতি অনুসরণ করে চলতেন বলে ব্রজেন্দ্রনাথের রচনার সংখ্যা খুবই অল্প। কোনো রচনাই তিনি লেখামাত্র প্রকাশ করতে দিতেন না। িএজন্য অনেক পান্ডুলিপি পরিণোমে বিনষ্ট হয়ে গেছে।
Secularism : ইহজাগতিকতা
আমাদের ধর্মীয় সামাজিক ও রাজনৈতিক আলোচনার ক্ষেত্রে ‘সেক্যুলারিজম’ কে ধর্মহীন, ধর্মশূণ্য ইতাদি বলে চিন্তা করার ধারণাটিই প্রবল। আসলে কথাটির উদ্ভব ও আলোচনার ক্ষেত্র ছিল ইউরোপের মধ্যযুগ।
একদিকে খ্রিষ্টধর্ম তথা পোপের আধিপত্য, অপরদিকে জাগতিক, রাষ্ট্রীয় অর্থাৎ জাগতিক শাসনের উপর জোর দেওয়াটাই ছিল ‘সেকুলার’ শব্দের দ্বন্ধের ক্ষেত্র।
কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মীয় দাঙ্গা, হাঙ্গামা, গণহত্যার প্রভৃতির ক্ষেত্রে কাউকে সেক্যুলারিস্ট বলে তাকে অধার্মিক এমনকি নাসিত্ক বলে তার বিরুদ্ধে একটি প্রতিকূল ও বৈরী মনোভাব তৈরির প্রবণতা দেখা যায়।
কোনো আবেগের বশবর্তী না হয়ে সেক্যুলারিস্ট ইংরেজি শব্দের বাংলা হিসেবে ‘ইহজাগতিকতা’ ব্যবহার করা সঙ্গত। অনেকে এক্ষেত্রে ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’ শব্দকে ব্যবহার করতে চান। ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটিকে নিরীহ বলে বোধ হলেও তারও শেষ অর্থ দাঁড়ায় ধর্মে ধর্মে নিরপেক্ষতা তথা কোনো বিশেষ শাসক বা শক্তির কোনো ধর্মীয় মতামত বা বিরোধের ক্ষেত্রে বিশেষ পক্ষ অবলম্বন না করার কথা প্রচার করা। কিন্তু এরূপ ব্যাখ্যা অর্থহীন। বাস্তব সমাজ জীবনে নিরপেক্ষতার কোনো অস্তিত্বের কল্পনা করা যায় না। ইউরোপে ম্যাকিয়াভেলির পর থেকে রাজনৈতিক তত্তইবিদ তথা হবস, লক, রুশো এবং পরবর্তীতে মার্কসবাদ সেক্যুলারিজমকে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্মের প্রভাব, প্রতিপত্তিকে অস্বীকার করতে চেয়েছে।
সমাজ, জগৎ ও জীবনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিমাত্রের সবকিছুর উর্ধ্বে এক অলৌকক শক্তির উপর বিশ্বাস থাকতে পারে। এরূপ বিশ্বাস বয়োঃপ্রাপ্ত ব্যক্তির নিজস্ব বিষয়। এজন্যই যুক্তিগতভাবে এরূপ কথা প্রচলিথ আছে : যার ধর্ম তার ধর্ম, কিংবা ‘তোমার ধর্ম তোমার, আমার ধর্ম আমার’।
রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে, কোনো ধর্মেরই কোনো রাষ্ট্রগত ভূমিকা থাকতে পারে না কিংবা থাকা সঙ্গত নয়। রাষ্ট্র পরিচালনা ও শাসন নাগরিকদের যৌথভাবে গৃহীত নীতি ও পদ্ধতির বিষয়। মূলকথা : রাষ্ট্রের পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ ধর্মের ভালো মন্দ বলে কোনো নির্ধারক ভূমিকা নির্দিষ্ট করা সঙ্গত নয়।
Seneca, Lucias Annaeus : সেনেকা (65-4 খ্রি.পূ.)
রোমের স্টয়েসিজম বা নিস্পৃহ মতবাদের প্রধান প্রবক্তা ছিলেন সেনেকা। সেনেকা সম্রাট নিরোর শিক্ষক ছিলেন। আবার পরিণামে নিরোই সেনেকাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেন। সেনেকা বহু গ্রন্থ রচনা করেন। এর মধ্যে নীতিশাস্ত্রের উপর রচিত ‘এপিসটলী মরালীস এ্যান্ড লুসিলিয়াম’ নামক গ্রন্থ অবিকৃত আকারে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। সেনেকা সম্রাট নিরোর শিক্ষক এবং উপদেষ্টা হিসাবে তৎকালীন রাষ্ট্র ব্যবস্থার ঘনিষ্ঠ পরিচয় লাভ করেন। এই ঘনিষ্ঠ অভিজ্ঞতায় তিনি একদিকে একচ্ছত্র সম্রাটের স্বেচ্ছাচার, অপরদিকে সাধারণ মানুষের নৈতিক অবনতি দেখে রাষ্ট্র এবং সমাজের উন্নতি সাধনের চেষ্টায় হতাশা বোধ করেন। এই হতাশা থেকে সেনেকা রাষ্ট্র বা সমাজের বিশেষ রূপের ঔচিত্য অনৌচিত্যের বিষয়ে নিস্পৃহ মনোভাব অবলম্বন করেন। সেনেকা ব্যক্তির জন্য নিজের সততা এবং নিস্পৃহতার চর্চা ব্যতীত শান্তির অপর কোনো পথ দেখতে পান নি। সেনেকা তাঁর নিজের দার্শনিক দৃষ্টিকে বিশেষ রাষ্ট্রে সীমা অতিক্রম করে বৃহত্তর মানবসমাজের উপর বিস্তার করেন। কোনো বিশেষ রাষ্ট্রসীমাতেই বিশ্ব যেমন আবদ্ধ নয়, তেমনি কোনো বিশেষ সমাজেই ব্যক্তি বন্দী নয়। ব্যক্তি বৃহত্তর মানব সমাজের অঙ্গীভূত। বিশ্বব্যাপী এক সত্তা এবং প্রজ্ঞা বিরাজমান। বিশেষ রাষ্ট্র বা তার শাসকের স্বেচ্ছাচারিতা সেই বিশ্বপ্রজ্ঞাকে যেমন বিনষ্ট করতে পারে না, তেমনি সম্রাটের অত্যাচার কিংবা নির্বোধ জনতার অনাচারও বিশ্ব মানবতার হানি ঘটাতে পারে না। রাষ্ট্রের উন্নতি কিংবা মানুষের মুক্তি উভয়ই নির্ভর করে মানুষের দৃষ্টিকে ক্ষুদ্র সীমার বাইরে বৃহত্তর এবং অসীমের মধ্যে প্রসারিত করার মধ্য দিয়ে। সেনেকার মধ্যে খ্রিষ্টীয় নৈতিকতার স্পষ্ট আভাস পাওয়া যায়।
Sensation : বেদন, সংবেদন
বস্তুজগতের সঙ্গে ইন্দ্রিয়সমূহের স্পর্শে ব্যক্তির মধ্যে যে চেতনা বা বোধের উদ্রেক হয় তাকে বেদন বা সংবেদন বলে। যে কোনো বস্তুকণাকে আমরা উদ্দীপক বলতে পারি। কোনো উদ্দীপক যখন সজীব মানুষের দেহের স্নায়ুকে উত্তেজিত করে তখন স্নায়ুর অন্তগামী তন্ত্রী উত্তেজনাকে মষ্তিষ্কের চেতনাকেন্দ্রে বহন করে নিয়ে যায়। মস্তিষ্কের চেতনাকেন্দ্রে পৌঁছে উত্তেজনাটি বিশেষ বোধ বা অনুভূতির সৃষ্টি করে। বেদনের মূল তাই উদ্দীপক। উদ্দীপক বাদে বেদনের উদ্ভব ঘটে না। উত্তেজনা বা সংবেদনকে দৃশ্য, শব্দ, স্পর্শ, ঘ্রান প্রভৃতি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়।
Separation of Powers : ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ
রাষ্ট্রযন্ত্রের সমগ্র ক্ষমতাকে আইন, শাসন এবং বিচার প্রধানত এই তিনভাগে বিভক্ত করাকে ক্ষমতার পৃথকীকরণ বা বিভাগকরণ বলা হয়। সামন্তবাদ এবং রাজতন্ত্রের একচ্ছত্র ক্ষমতাকে বিকাশমান ধনিক শ্রেণীর স্বার্থে হ্রাসকরণের প্রয়োজনে রাষ্ট্রের এই ত্রিবিভাগীয় ক্ষমতাকে পরস্পর থেকে স্বতন্ত্রকরণের আন্দোলন শুরু হয়। ইংরেজ দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন লকের রচনায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের প্রয়োজনীয়তার বিস্তারিত আলোচনা সর্বপ্রথম দেখা যায়। পরবর্তীকালে মন্টেসক্যূ এই তত্ত্বকে আরো সুনির্দিষ্ট করেন। ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ আন্দোলনে অভিজাত শ্রেণীও রাজতন্ত্রের একচ্ছত্র ক্ষমতার বিরুদ্ধে ধনিক শ্রেণীকে কিছুটা সমর্থন জুগিয়েছিল। স্বতন্ত্রীকরণ আন্দোলনের প্রধান জোর ছিল ধনিক শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বমূলক আইনসভায় মূল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করে রাজার একচ্ছত্র ক্ষমতাকে সীমিত করার উপর। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ আসলে শাসক শ্রেণীর আভ্যন্তরীণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে সংঘাত হ্রাসের প্রচেষ্টা মাত্র : ক্ষমতার এই বিভাগ বৃহত্তর শ্রমজীবি জনতার স্বার্থরক্ষা বা বিনষ্ট করার ক্ষেত্রে কোনো গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য বহন করে না।
Shintoism : শিন্টোবাদ
প্রাচীন জাপানের ধর্মের নাম ছিল শিন্টো। জাপানের ইতিহাসের বিবর্তনে শিন্টোবাদেরও পরিবর্তন ঘটেছে। পরবর্তীকালে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচলনের ফলে শিন্টো ধর্মে বৌদ্ধ ধর্মের অনেক আচার অনুষ্ঠানের অনুপ্রবেশ ঘটে। বস্তুত বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে পার্থক্য বুঝাবার জন্য অষ্টাদশ শতকের জাপানের প্রাচীন ধর্মকে শিন্টো বলে অভিহিত করা হয়। ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে শিন্টোকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়। শিন্টো ধর্মে প্রাচীনকালে পশু, প্রাকৃতিক বিভিন্ন বস্তু এবং পূর্ব পুরুষের আত্মাকে পূজা করা হতো। এ পূজাকে বলা হতো কামী পূজা। কামী বা দেবতারা বস্তুজগতের এ সমস্ত দ্রব্যাদির মাধ্যমে জগতে আবির্ভুত হতো। জাপানের সম্রাট বা মিকাডো নিজেও একজন দেবতা। তিনি সমস্ত জাপানবাসীর পূর্ব পুরুষ। মিকাডো সূর্যদেব আমেতারাসুর বংশধর। মিকাডোর মাধ্যমেই ইহজগতের মানুষ দেবতাদের সঙ্গে সম্পর্ক সৃষ্টি করতে পারে। ঊনবিংশ শতকের শেষদিক থেকেই শিন্টোবাদের প্রভাব হ্রাস পেতে থাকে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর সম্রাটও আর দেবতা বলে গণ্য হন না।
Simon, Saint : সেইন্ট সাইমন (১৭৬০-১৮২৫ খ্রি.)
ক্লড হেনরী দ্য রুভরয় সেইন্ট সাইমন ছিলেন ফরাসি দেশের একজন কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদী। সেইন্ট সাইমনের জীবন ছিল বিচিত্র ঘটনাপূর্ণ। অভিজাত বংশের সন্তান সেইন্ট সাইমন ফরাসি বিপ্লবের সময় উগ্রপন্থী জ্যাকোবিনদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামেও অংশগ্রহণ করেন। দার্শনিক চিন্তায় সেইন্ট সাইমন ভাববাদ এবং ঈশ্বরবাদের বিরোধিতা করে বস্তুবাদ এবং প্রকৃতিবাদের তত্ত্বকে সমর্থন করেন। মানুষের ইতিহাসকে তিনি সুনির্দিষ্ট বিধান দ্বারা পরিচালিত বলে মনে করতেন। ইতিহাসকে তিনি কেবল অতীতের বিষয় বলে মনে করতেন না। বিজ্ঞান যেমন মানুষের জীবনকে নানা জ্ঞানে ও সম্পদে সমৃদ্ধ করে, জীবনের ক্ষেত্রে তেমনি ইতিহাসেরও অবদান রয়েছে। ইতিহাসের গতি সম্মুখের দিকে। একটি সামাজিক ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়ে ভিন্নতর সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। সামাজিক ব্যবস্থার মূলে থাকে মানুষের নীতি, ধর্ম এবং বিজ্ঞানের উন্নতি। সেইন্ট সাইমন মনে করতেন মানুষের সমাজ তিনটি পর্যায় অতিক্রম করেছেঃ ধর্মীয় পর্যায়। দাস এবং সামন্ততান্ত্রিক সমাজ পর্যন্ত কল্প দার্শনিক। সামন্তবাদ এবং ধর্মীয় ব্যবস্থার পতন এই যুগের বৈশিষ্ট্য। মানুষের সমাজের তৃতীয় পর্যায় হচ্ছে বৈজ্ঞানিক পর্যায়। বৈজ্ঞানিক জ্ঞান এ পর্যায়ের নিয়ন্ত্রক শক্তি। বিজ্ঞানের ভিত্তিতে মানুষের সমাজ এই শেষ পর্যায়ে বিকাশ লাভ করবে। সেইন্ট সাইমন সমাজের বিকাশকে ব্যক্তির ইচ্ছা অনিচ্ছা নিরপেক্ষ বাস্তব সত্য বলে বিবেচনা করতেন এবং এই বিকাশে সম্পদ ও শ্রেণীর যে বিশেষ ভূমিকা আছে তাও তাঁর বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে ধরা পড়েছিল। সেইন্ট সাইমন সমাজতান্ত্রিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বলেছিলেন যে, সমাজের প্রতিটি স্তর তার পূর্ববর্তী স্তরের মধ্যে জন্ম লাভ করে। বৃহদাকারের শিল্প তখনো বিকাশ লাভ করে নি। কিন্তু সেইন্ট সাইমন অভিমত প্রকাশ করেছিলেন, ভবিষ্যতের সমাজ হবে বৃহদাকারের শিল্পভিত্তিক। কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং সমাজের শ্রেণীবিভাগকে তিনি অপরিবর্তনীয় মনে করতেন। সমাজ সম্পর্কে তাঁর ধারণা ছিল সমন্বয়বাদী। তাঁর ধারণা ছিল ভবিষ্যত সমাজ বিকশিত হবে বিজ্ঞানের ভিত্তিতে, সমাজের সকল মানুষের সহযোগিতার মাধ্যমে। শিল্পপতি, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, এবং ব্যাঙ্কপতি এরা সবাই যে সমাজের জন্য যে কেবল অপরিহার্য,তাই নয়। সেইন্ট সাইমনের মতে এদের স্বার্থের মাঝে কোনো দ্বন্ধ বা বিরোধিতা নেই। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সমাজ অগ্রসর হবে। এক কথায় বৃহদাকার শিল্প ভিত্তিক সমাজকে তিনি আদর্শ সমাজ বলে মনে করতেন। এই সমাজের পরিকল্পনা হবে দরিদ্র মানুষের দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য। মানুষ মাত্রেরই তার ক্ষমতানুযায়ী সমাজের অপরিহার্য অংশ হিসেবে কাজ করার অধিকার থাকবে। ভবিষ্যত সমাজের কল্পনায় সেইন্ট সাইমনের একটি অভিমত ছিল যে, ভবিষ্যত সমাজের চরিত্র হবে শাসনমূলকের পরিবর্তে উৎপাদনের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা। সেইন্ট সাইমন মহৎ হৃদয় কল্পনাপ্রবণ দার্শনিক ছিলেন। সমাজের মধ্যে সংঘাতকে তিনি স্বীকার করেন নি। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানা এবং শ্রমিকের উপর অনুষ্ঠিত শোষণের মধ্যকার অসঙ্গতি যে মালিক এবং শ্রমিকের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি করে এবং এই বিরোধাত্মক সম্পর্ক যে কোনো শ্রেণীর কোনো ব্যক্তির ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর নির্ভরশীল নয়, এই সত্য সেইন্ট সাইমন স্বীকার করতে চান নি। তাঁর ধারণা ছিল বিজ্ঞানের মাধ্যমে সঠিক জ্ঞানের প্রসারেই সমাজের সব অসঙ্গতি দূরীভূত হবে এবং বিজ্ঞানভিত্তিক সঙ্গতিপূর্ণ প্রগতিশীল এক সমাজ আপনি সৃষ্টি হয়ে যাবে।