August Movement: আগষ্ট আন্দোলন
১৯৪২ সালের আগষ্ট মাসে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ভারতের স্বাধীনতার জন্য ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন আরম্ভ করে তা আগষ্ট আন্দোলন নামে পরিচিত।
এই শতাব্দীর বিশের দশক থেকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের দাবি প্রবর হতে শুরু করে। বিশের এবং ত্রিশের দশকে বিভিন্ন প্রকার আইন অমান্য আন্দোলনের মধ্যে এবং তার চেয়েও জঙ্গী শ্রমিক-কৃষকদের জীবিকার সংঘবদ্ধ আন্দোলন এবং মধ্যবিত্তের সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমে এই স্বাধীনতার দাবির তীব্রতা প্রকাশ পেতে থাকে। কিন্তু একদিকে ব্রিটিশ সরকারের দমননীতি এবং অপরদিকে ভারতের প্রধান রাজনীতিক দল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের অনৈক্যের কারণে ভারতে স্বাধীনতার আন্দোলন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হওয়া পর্যন্ত সফলতা অর্জন করতে পারে নি। ১৯৩৯ সালে ইউরোপে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ক্রমান্বয়ে এই যুদ্ধ এশিয়াতে বিস্তারিত হয়। জাপান অক্ষশক্তি, অর্থ্যাৎ জার্মানি ও ইতালির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করে। মিত্রপক্ষের প্রধান শক্তি ছিল সোভিয়েত রাশিয়া, ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পরাধীন ভারতও ব্রিটিশ সরকারের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এই যুদ্ধে জড়িত হয়ে পড়ে। ১৯৪২-এ এশিয়াতে যুদ্ধের সীমানা ব্রহ্মদেশে অতিক্রম করে বাংলার নিকটে এসে পড়ে। ব্রহ্মদেশও তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন। ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনী ব্রহ্মদেশ পরিত্যাগ করে পশ্চাদপসরণ করতে থাকে। জাপান কলকাতা নগরী ও চট্রগ্রামের উপর বিমান থেকে বোমা বর্ষণ করে। ব্রিটিশ সরকার তখন একটা সামরিক বিপর্যয়ের সষ্মুখীন। ব্রিটিশ সরকারের এই সঙ্কটকে স্বাধীনতা লাভের উত্তম সময় বিবেচনা করে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারের নিকট ৪২-এর আগস্ট মাসে একটি প্রস্তাব মারফত কতগুলি দাবি উত্থাপন করে। ভারতীয় জাতীয় কমিটির ওয়ার্কিং কংগ্রেসের এই প্রস্তাব আগস্ট প্রস্তাব নামে পরিচিত। প্রস্তাবটির এক অংশে সরকারের নিকট অবিলম্বে ভারতের স্বাধীনতা প্রদানের দাবি করা হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, মিত্রপক্ষের যুদ্ধে জয়লাভের জন্য ভারতের স্বাধীনতা অপরিহার্য। স্বাধীন ভারতের স্বাধীন সরকারই মাত্র মিত্রপক্ষকে যুদ্ধ জয়ে উপযুক্ত রূপে সাহায্য করতে সক্ষম হবে। প্রস্তাবের অপর অংশে গান্ধীর নেতৃত্বে গণআন্দোলন শুরু করার কথাও বলা হয়েছিল। কংগ্রেস নেতৃত্বের আশা ছিল, তাদের স্বাধীনতার দাবি এবং আন্দোলনের হুমকীতে ব্রিটিশ সরকার তাদের সঙ্গে আপস আলোচনাতে সম্মত হবে। কিন্তু ভারতের জনমত তখনো জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতৃত্বে বিভক্ত। এই অনৈক্য ছিল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের দুর্বলতা। ব্রিটিশ সরকার এই দুর্বলতাকে ভিত্তি করে কংগ্রেসের সঙ্গে আলোচনার পরিবর্তে দমননীতি গ্রহণ করে। আগষ্ট প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় ৮ আগষ্ট। তার পরদিনই ৯ আগষ্ট ব্রিটিশ সরকার গান্ধীসহ কংগ্রেস ওয়াকিং কমিটির নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করে।
কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তারে দেশব্যাপী প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বিভিন্নস্থানে আন্দোলন জঙ্গী এবং ধ্বংসাত্মক আকার গ্রহণ করে। রেল লাইন, টেলিগ্রাফ তার এবং শাসনযন্ত্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আন্দোলনকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত করতে থাকে। মেদিনীপুরের একটি অঞ্চলে ব্রিটিশ সরকারের শাসন ব্যবস্থা অস্বীকার করে স্বাধীন সরকার স্থাপন করা হয়। কিন্তু এ সমস্ত কার্যক্রম খুব সংগঠিত ছির না। কোনো কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে এ আন্দোলন পরিচালিত হয় নি। অহিংসার নীতিতে বিশ্বাসী গান্ধী তখন কারাগারে আবদ্ধ। বিচ্ছিন্ন এবং নেতৃত্বহীন এরূপ স্বতস্ফূর্ত বিক্ষোভ ব্রিটিশ সরকারের সামরিক এবং নির্মম দমনের মুখে অধিক দিন স্থায়ী হতে পারে নি। ৪২ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই এ আন্দোলন দমিত হয়ে যায়। আগষ্ট ৯ এবং ডিসেম্বর ৩১-এর মধ্যে ৬০ হাজারের অধিক লোককে গ্রেপ্তার করা হয়; ১৮০০০ রাজনীতিক কর্মীকে ভারত রক্ষা আইনে আটক রাখা হয়; পুলিশ এবং সামরিক বাহিনীর গুলি বর্ষণে প্রায় এক হাজার নিহত হয়। ( দ্রষ্টব্য: রজনী পামে দত্ত: ‘ইন্ডিয়া টু ডে’)
Augustine Saint: সেণ্ট অগাস্টিন (৩৫৪-৪৩০ খ্রি.)
উত্তর আফ্রিকার হিপোতে অগাস্টিনের জন্ম। যৌবনকালে অগাস্টিন ছিলেন ধর্মীয় বিশ্বাসে প্যাগান বা প্রকৃতবাদী। কিন্তু কিশোর বয়স থেকেই তাঁর মধ্যে সত্যানুসন্ধানের প্রবল আগ্রহ প্রকাশ পেতে থাকে। অগাস্টিনের রচনার আগ্রহ এবং ক্ষমতাও ছিল অসাধারণ। তাঁর সমকালীন জীবনের ধর্মীয়, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং ব্যক্তির জীবনের নীতিগত সমস্ত সমস্যাই তাঁর রচনাসমূহে আলোচিত হয়েছে। এই রচনার মধ্যে তাঁর ‘কনফেকশন’ বা ‘স্বীকারোক্তি’ এবং ‘সিটি ব গাড’ বা ‘ঈশ্বরের রাজ্য’ প্রসিদ্ধ। তাঁর স্বীকারোক্তির মধ্যে তাঁর যৌবনকালের আচরণ এবং বিচিত্র ধর্মীয় অভিজ্ঞতার বর্ণনা। বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসরণ এবং বিচার শেষে ৩৩ বৎসর বয়সে অগাস্টিন খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। ৩৯১ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে হিপোর ধর্মযাজক রূপে ঘোষণা করা হয়। খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করার পর তিনি খ্রিষ্টধর্মের একজন শক্তিশালী প্রচারক এবং রহস্যবাদী দার্শনিকরূপে জীবনযাপন করেন। দর্শনের ক্ষেত্রে অগাস্টিনের মূল কথা ছিল: বিশ্বাস ব্যতীত জ্ঞান সম্ভব নয়। তাঁর ‘ঈশ্বরের রাজ্য’ বা ‘সিটি অব গড’ খন্ডাকারে তের বছর ধরে রচিত হয়। সর্বপ্রকার সমস্যাই তিনি তাঁর এই গ্রন্থে আলোচনা করেন। ‘ঈশ্বরের রাজ্য’ এবং ‘পাপের রাজ্য’কে অগাস্টিন পুণ্য এবং পাপ; সৎ এবং অসৎ-এর দ্বন্দ্বমান জগৎরূপে কল্পনা করেন। বিশ্ব সম্পর্কে খ্রিষ্টধর্মের বিশ্বাস অগাস্টিনের ইতিহাস ব্যাখ্যার ভিত্তি হিসাবে কাজ করেছে। ইতিহাসের এ ব্যাখ্যাকে অদৃষ্টবাদ বলা হয়। বিশ্বে যা কিছূ ঘটেছে, ঘটছে বা ঘটবে তা সবই ঈশ্বর কর্তৃক পূর্ব নির্ধারিত।
Auterchy: স্বশাসন, স্বয়ংসম্পূর্ণতা
Autonomy: স্বায়ত্তশাসন
অটারকী এবং অটোনমি উভয়ই গ্রিক শব্দ থেকে উদ্ভূত। গ্রিক ‘অটারকীয়া’র অর্থ স্বয়ংসম্পূর্ণতা। অর্থনীতিকভাবে কোনো রাষ্ট্র যদি এরূপ নীতি গ্রহণ করে যে, জীবনের যা কিছু প্রয়োজন সেসব রাষ্ট্রের অভ্যন্তরেই উৎপাদিত হবে এবং কোনো কিছুর জন্যই সে অপর রাষ্ট্রের উপর বা অপর রাষ্ট্র থেকে আমদানির উপর নির্ভর করবে না তা হলে একে অটারকী বা সয়ংসম্পূর্ণতার নীতি বলা যায়। অপরদিকে স্বায়ত্বশাসন বলতে যেমন কোনো পরাধীন জাতির পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের ইচ্ছা বুঝাতে পারে, তেমনি স্বায়ত্তশাসন দ্বারা একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অন্তর্ভূক্ত বিশেষ কোনো অঞ্চল বা অধিবাসীর নির্দিষ্ট পরিমাণ শাসনাধিকারকেও বুঝাতে পারে। স্বায়ত্তশাসনের বাস্তব এবং সঙ্গত দাবি পূর্ণ না হলে এবং রাষ্ট্রের কোনো প্রভাবশালী জনাংশের মধ্যে নির্যাতিত কিংবা বঞ্চিত থাকার অবিযোগে দীর্ঘদিন প্রবাহিত হতে থাকলে স্বায়ত্তশাসনের দাবি বিচ্ছিন্নতা এবং পূর্ণ স্বাধীনতার রূপ গ্রহণ করতে পারে।
Axis: অক্ষ
Axis Power: অক্ষশক্তি
অক্ষ বলতে গণিত ও জ্যোতিষ শাস্ত্রে সূর্য থেকে কোনো দূরত্বের পরিমাণ ভূগোলে পৃথিবীর গ্রহের কাল্পনিক মেরুকেন্দ্ররেখা এবং প্রাণিবিদ্যায় প্রাণীদেহের মেরুদণ্ডকে বুঝায়। কিন্তু রাজনীতিতে ‘অক্ষশক্তি’ কথাটি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় প্রচারিত হয়। অক্ষশক্তি দ্বারা তখন জার্মানি, ইতালি এবং জাপান এই তিন শক্তির জোটকে বুঝান হত। শক্তির কেন্দ্র হিসাবে অক্ষ কথাটি ব্যবহার করে প্রথমে ১৯৩৬ সালে ফ্যাসিবাদী ইতালির শাসক মুসোলনী। মুসোলিনী নাকি জার্মানির হিটলারের সঙ্গে আঁতাত গঠনের কালে রোম-বার্লিন সম্পর্কের শক্তির অক্ষরেখা বলে অভিহিত করে। এই আঁতাততে তারা ইস্পাতদৃঢ় আঁতাত বলে আখ্যায়িত করে। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রগোষ্ঠীর জঙ্গীনীতির মূল লক্ষ্য সমাজতন্ত্রের ধ্বংস এবং তখনকার একমাত্র সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত রাশিয়াকে আক্রমণ করা। এই মূল লক্ষ্যের জন্য জার্মানি এবং ইতালি জাপানকেও সাম্যবাদবিরুদ্ধতার চুক্তির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। যুদ্ধের প্রথম দিকে দ্বিধা থাকলেও যুদ্ধের সংকটজনক পরিস্থিতিতে ইংল্যাণ্ড এবং মার্কিনযুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে বৃহত্তর ঐক্যজোট গঠনে বাধ্য হয়। এই ঐক্যের ফলে অক্ষশক্তি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ১৯৪৫ সালে পরাজয় বরণে বাধ্য হয়।
B
Babeuf: বাব্যুফে (১৭৬০-১৭৯৭ খ্রি.)
ফরাসি বিপ্লবী। ১৭৯৬ সালে বাব্যুফের নেতৃত্বে ‘সমানদের ষড়যন্ত্র’ নামে একটা আন্দোলন সংঘটিত হয়। ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটিত হওয়াকে বাব্যুফ এবং তাঁর অন্যতম সাথী ডারথেকে ১৭৯৭ সালে গিলোটিনে হত্যা করা হয়। বাব্যুফে থেকে বাব্যুফবাদের জন্ম হয়। বাব্যুফ এবং তাঁর সঙ্গীরা সমগ্র ফরাসি দেশে একটি কেন্দ্র থেকে শাসনের ভিত্তিতে ‘সমানদের রিপাবলিক’ বা সমানদের একটি জাতীয় কম্যুন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সংগঠিত করতে চেয়েছিলেন। তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক চিন্তার ক্ষেত্রে বাব্যুফবাদ প্রগতিমূলক ছিল। বাব্যুফবাদীগণ ফরাসি দেশে প্রথম সমাজতান্ত্রিক তত্ত্বকে বাস্তবে বিপ্লবী আন্দোলনরূপে প্রকাশ করার চেষ্টা করেন।
Bacon, Francis: ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬ খ্রি.)
দর্শন এবং জ্ঞানের ক্ষেত্রে বস্তুবাদী এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পথপ্রদর্শক।
বেকনের জ্ঞান এবং গবেষণার উৎসাহ কোনো একটি বিষয়ে সীমাবদ্ধ ছিল না। দর্শন, বিজ্ঞান, রাষ্ট্রনীতি, আইন, সর্বক্ষেত্রেই বেকন তাঁর সৃষ্টিশীল মেননের পরিচয় দিয়েছেন। বেকনকে তাই সর্ব-বিষয়ে পারদর্শী বলা যায়। কেবল জ্ঞানের তত্ত্বগত আলোচনায় নয়, ব্যক্তিগত জীবনে ক্শমতা লাভের প্রচেষ্টায়ও তিনি ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। ইংরেজ সম্রাট প্রথম জেমস-এর রাজত্বকালে ‘লর্ড-চ্যান্সেলর’ হিসাবে নিযুক্ত হয়ে বেকন সম্রাটের শাসন ব্যবস্থার সর্বোচ্চ পদমর্যদার অধিকারী হন। একদিকে যেমন জ্ঞানের ক্ষেত্রে বেকন অন্ধবিশ্বাস এবং গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সংগ্রামী অপরদিকে ব্যক্তিগত জীবনে আত্মস্বার্থসাধনে তিনি ছিলেন বিবেকহীন।
‘নোভাম অর্গানাম’, এসেজ, এডভাঞ্চমেণ্ট অব লারনিং, ‘সাইণ্টিয়ারাম’, ‘নিউ এ্যাটলাণ্টিস’ প্রভৃতি গ্রন্থের মধ্যে ‘নোভাম অর্গানাম’ গ্রন্থের জন্যই বেকন খ্যাতি অর্জন করেন সমধিক। এই গ্রন্থের মাধ্যেই বেকনের বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক চিন্তার সুসংবদ্ধ প্রকাশ পাওয়া যায়। বেকন নিজে বৈজ্ঞানিক ছিরেন না সত্য, কিন্তু আধুনিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির তিনি যে উদগাতা ছিলেন এ সত্য অনস্বীকার্য। ষোড়শ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক-সামাজিক জীবনে রূপান্তর সাধিত হচ্ছিল। পুজিঁবাদের তখন প্রথম যুগ। পুজিঁবাদের বাধাহীন বিকাশের জন্য উৎপাদনের নতুনতর উপাদান অর্থ্যাৎ কলকব্জা, যন্ত্রপাতি, অস্ত্র-শস্ত্রের আবিস্কার যেরূপ আবশ্যক ছিল তেমনি আবশ্যক ছিল বস্তুবাদী বৈজ্ঞানিক ভাবাদর্শের। পুঁজিবাদ এবং জ্ঞানের বিকাশকে বেকন এই ভাবদর্শ দ্বারা অবারিত করেছিলেন।
জ্ঞান অর্জনের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বেকন ঘোষণা করেন যে, মানুষ জ্ঞানলাভ করবে প্রকৃতিকে জানার জন্য এবং তাতে বশ করার জন্য। এরূপ জ্ঞানলাভের একমাত্র উপায় হচ্ছে পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষা দ্বারা নিয়ত পরিবর্তিত বিশ্ব-প্রকৃতির পরিবর্তনের সত্যকার কারণ জানা। প্রকৃতির কার্য-কারণকে জ্ঞাত হওয়া প্রচলিত দর্শন ও ধর্মতত্ত্বের অলীক জাল বুননি দ্বারা সম্ভব নয়। প্রচলিত দর্শন আর ধর্মতত্ত্বের প্রবক্তাগণ মাকড়শার মতো নিজেদের কল্পনার জাল বিস্তার করে বিশ্ব-প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করতে চান কিন্তু এ পথ সত্যকার জ্ঞানের পথ নয়। সত্যকার জ্ঞান শুরু হবে সন্দেহ এবং প্রশ্ন দিয়ে। জ্ঞানের ক্ষেত্রে চার রকম দেবতার মূর্তিপূজা অনড় আসন গেড়ে বসে আছে। সেই অনড় মূর্তিদের ধ্বংসকারী হিসাবে নিজেকে ঘোষণা করে বেকন বলেন, মানুষের মনকে এই অপদেবতাদের প্রভাব থেকে মুক্ত করতে হবে। বেকনের মতে এই অপদেবতা বা আইডলগুলোকে চারভাগে ভাগ করা যায়। যথা (১) জাতিগত অপদেবতা মানুষ হিসাবে মানুষের জাতিগত কুসংস্কার ও অবাস্তব ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে সেগুলিকে মানুষের জাতিগত অপদেবতা বলা যায়। মানুষ বিনা প্রশ্নে নিজের জ্ঞানের অসীমতা সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করে তাকে বেকন তাঁর একটি জাতিগত কুসংস্কার বলে আখ্যায়িত করেন। প্রাকৃতিক সমস্যার বিচারের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ না হওয়ার প্রবণতাও মানুষের একটা জন্মগত সংস্কার। মানুষ কেবল তাকেই সত্য বলে স্বীকার করতে চায় যা তার আত্মস্বার্থ সাধন করে। ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকেও মানুষ এই কারণে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই চরম জ্ঞান বলে মনে করে। (২) অন্ধকার বিবরের অপদেবতা হচ্ছে মানুষের মনের দ্বিতীয় অপদেবতা। প্লেটোর গুহায় বন্দি মানুষ যেমন সত্যের ছায়াকেই সত্য বলে মনে করত তেমনি সকল মানুষই ব্যক্তিগতভাবে নিজ জীবনের অন্ধকার গুহায় বন্দি। ব্যক্তিজীবনের গুহার অন্ধকারে বসে মানুষ সত্যের আসল রূপ প্রত্যক্ষ করতে পারে না। তার ছায়াকেই সত্য বলে আঁকড়ে থাকে। এই গুহা থেকে বেরিয়ে আসতেও সে অনিচ্ছা প্রকাশ করে। কিন্তু সত্য সাধককে বিবরের এই বন্ধন ছিন্ন করতে হবে। যে তত্ত্বের প্রতি ব্যক্তির মানসিক আকর্ষণ প্রকট হয়ে ওঠে, সত্য সাধক হিসাবে তাকে সেই তত্ত্বকেই অধিক সন্দেহের চোখে দেখতে হবে। পর্যবেক্ষণ, প্রয়োগ ও পরীক্ষার মারফত তার সত্যাসত্য নির্ধারণ করতে হবে। (৩) বাজারী অপদেবতার বাধাও জ্ঞানলাভের জন্য কম নয়। ভাষার সীমাবদ্ধতাকে বেকন বাজারের অপদেবতা বা ‘আইডলস অব দি মার্কেট প্লেস’ বলে আখ্যায়িত করেন। ভাষার মারফত মানুষ ভাবের বিনিময় করে। কিন্তু ভাষার অর্থ বহনের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার জন্য এক ব্যক্তি যা বলে অপরে তা সঠিকভাবে বুঝে না। নিজের ইচ্ছামতো অপরের কথাকে সে গ্রহণ করে। তাই একই শব্দের একাধিক অর্থ। এ কারণে সঠিক জ্ঞানের জন্য সর্বপ্রথমে আবশ্যক হচ্ছে দর্শন ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত সঠিক অর্থ নির্দিষ্টকরণ। (৪) থিয়েটার বা মঞ্চের অপদেবতার কারণেও আমরা বিশ্বপ্রকৃতির সঠিক জ্ঞান লাভে ব্যর্থ হই। প্রচলিত দার্শনিক তত্ত্বসমূহের বেকন মঞ্চের অপদেবতা বলেছেন। তার কারণ, মঞ্চে যেমন বাস্তবে একটা কল্পলোক তৈরি করা হয় তেমনি দার্শনিকগণ আসল সত্যকে আড়াল করে মিথ্যা জগতের পরিবেশ তৈরি করেন। তত্ত্বদ্বারা দার্শনিক জ্ঞানলাভের প্রচেষ্টায় এই প্রতিষ্ঠিত দার্শনিক মতগুলোকে আমাদের ভূমিসাৎ করতে হবে। দর্শনের সমালোচনার সময়ে বেকন মধ্যযুগের ধর্মতত্ত্ব এবং দর্শনকে আক্রমন করলেও প্রাচীন গ্রিসের দর্শন, বিশেষ করে ডিমোক্রিটাস এবং অন্যান্য বস্তুবাদী গ্রীক দার্শনিকদের তিনি প্রশংসা করেছেন।
এভাবে অজ্ঞানতার প্রতিভূ অপদেবদতাদের ধংধ্ব করে বেতন বৈজ্ঞানিক জ্ঞানলাভের সুত্র প্রতিষ্ঠিত করেন। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের জন্য বেকন আরো তিনটি সূত্র উল্লেখ করেন। যথা: (১) কোনো সমস্যার সমাধান বা কারণের অনুসন্ধানে প্রথমে কারণের উপস্থিতিসূচক ঘটনাসমূহকে সংগ্রহ এবং পর্যবেক্ষণ করতে হবে; (২) দ্বিতীয়ত, উক্ত কারণের অনুপস্থিতিসূচক ঘটনাসমূহকে পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ করতে হবে; (৩) তৃতীয়ত উভয় ধরনের ঘটনাকে তুলনাক্রমে বিচার করে উভয়ের পারস্পারিক সম্পর্ক এবং পরিবর্তনের ক্রম উদ্ঘাটন করতে হবে। বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধানের এই তিনটি সূত্রকে ভিত্তি করে পরবর্তীকালে জন স্টুয়ার্ট মিল তার আরোহী বা ইনডাকটিভ পদ্ধতিতে মিল এ অ-মিলের যুক্ত পদ্ধতি (জয়েন্ট মেথড অব এ্যাগ্রিমেণ্ট এ্যাণ্ড ডিফারেন্স) এবং পরিবর্তনের যুক্তক্রম (মেথড অব কনকোমিট্যাণ্ট ভেরিয়েশন্স) নামক পদ্ধতি প্রবর্তন করেন।
বিখ্যাত ফরাসি লেখক ডিডেরট বেকনের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে বলেছিলেন বেকনের অবিষ্মরণীয় অবদান এই যে, মানুষের জ্ঞানের ইতিহাস রচনাও যখন সম্ভব ছিল না বেকন তখন মানুষের ভবিষ্যৎ পথকে সুনিশ্চিতভাবে নির্দিষ্ট করার ক্ষমতা দেখিয়েছেন।
রাষ্ট্রনৈতিক তত্ত্বে বেকন রাজতন্ত্রের সমর্থনকারী ছিলেন। তিনি সামন্ততন্ত্রের বিরোধিতা করে এককেন্দ্রীক শক্তিশালী রাজতন্ত্রের কথা প্রচার করেন। ‘নিউ এ্যাটলাণ্টিক’ গ্রন্থে তিনি এক কল্পরাজ্যের বর্ণনা করেছেন। বিজ্ঞানের ভিত্তিতে সে রাষ্ট্রের রাজকার্য সাধিত হয়। শোষক এবং শোষিতের অস্তিত্ব সত্ত্বেও বেজ্ঞানিক উপায়ের ব্যবহারে একটা রাষ্ট্র কি বিষ্ময়কর অর্থনৈতিক উন্নতি লাভ করতে পারে তার চিত্র তিনি এই গ্রন্থে তুলে ধরেন।
জ্ঞানলাভের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রতিষ্ঠাকালে বস্তুজগতের যে ব্যাখ্যা বেকন উপস্থিত করেন তার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে: বস্তু এবং প্রকৃতি বিভিন্ন গুণ সমন্বিত অংশসমূহের সম্মেলনের প্রকাশ। বস্তুর প্রধান লক্ষণ হচ্ছে তার গতি, যান্ত্রিক গতিকে বেকন একমাত্র গতি বলে স্বীকার করতেন না। বস্তুর অন্তরেই গতি নিহিত্ যান্ত্রিক গতিতেই কেবল বস্তু গতিবান হয় না। কিন্তু ফ্রান্সিস বেকনের দার্শনিক অভিমত ক্রটিহীন ছিন না। তাঁর দার্শনিক ব্যাখ্যায়বিভিন্ন সময়ে বস্তুবাদকে অতিক্রম করে ধর্মীয় প্রভাব প্রকট হয়েছে। তাঁর প্রবর্তিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আজ হয়তো হুবহু ব্যবহৃত হয় না। কিন্তু আধুনিক ইউরোপীয় দর্শন, বিজ্ঞান এবং সামগ্রিকভাবে জ্ঞানান্বেষণের ক্ষেত্রে বেজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রবর্তনের জন্য বেকন অবিষ্মরনীয় হয়ে রয়েছেন।
Bacon, Roger: রোজার বেকন (১২১৪-১২৯২ খ্রি.)
ইউরোপীয় মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ, দার্শনিক এবং আধুনিক পরীক্ষামূলক বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে প্রথম পথিকৃৎ। ষোড়শ শতকে ফ্রান্সিস বেকন দর্শন ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে নবযুগের সূচনা করেন তার বীজ বপন করেছিলেন তিনশত বছরেরও পূর্বে ত্রয়োদশ শতকে তাঁর স্বদেশবাসী রোজার বেকন। রোজার বেকন জ্ঞানের একাধিক বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন। দর্শনের বস্তুবাদী চিন্তা, অন্ধ বিশ্বাসের বিরুদ্ধতা এবং পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষার পদ্ধতিকে বিশ্ব প্রকৃতির জ্ঞানলাভের পথ বলে ঘোষণা করার অপরাধে তাঁকে যাজক সম্প্রদায় ধর্মদ্রোহী ঘোষণা করে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার অধিকার থেকে রোজার বেকনকে বঞ্চিত করা হয়। বেকন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার সাহায্যে বিবর্ধক কাচ বা ম্যাগনিফাইং গ্লাস এবং বন্দুকের জন্য এক প্রকার বারুদও আবিস্কার করেন। গ্রিক দর্শন এবং আবর জগতের দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের চিন্তারাজিকে বেকন অধ্যয়ন করেন। জ্ঞানের প্রশ্নে ধর্মযাজকের বাণীর চেয়ে গ্রিক এবং আরব দার্শনিকদের যুক্তি অধিক মূল্যবান ঘোষণা করায় যাজক সম্প্রদায় তাঁর উপর অধিকতর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তাঁর দার্শনিক চিন্তাধারায় বৈজ্ঞানিক আবিস্কার এবং গ্রিক ও আরব দর্শনের দৃষ্টান্তের উল্লেখ সব কিছুই ধর্মীয় অপরাধ বলে ঘোষিত হয় এবং পোপের আদেশে তাঁকে দীর্ঘ দশ বছর যাবৎ নজরবন্দি করে রাখা হয়। এই বন্দি অবস্থায় বেকন যাতে কোনো প্রকার জ্ঞানের চর্চা করতে না পারেন, সেজন্য দীর্ঘ দশবছরই তাকে সর্বপ্রকার বই এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রাদি থেকে বঞ্চিত রাখা হয়।
রোজার বেকনের ‘ওপাস মাইউস’ নামক গ্রন্থে তাঁর বিষ্ময়কর প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। এই গ্রন্থের আলোচ্য বিষয়কে তিনি সাতভাগে বিভক্ত করেন, যথা: মানুষের ভ্রান্তির কারণ, দর্শন, ভাষার অধ্যয়ন, অঙ্কশাস্ত্র, চক্ষুর চিকিৎসা, পরীক্ষাসিদ্ধ বিজ্ঞান বা এক্সপেরিমেণ্টাল সায়েন্স এবং নীতিশাস্ত্র।
প্রথম ভাগের আলোচনায় রোজার বেকন বলেন যে, জ্ঞানের ক্ষেত্রে মানুষের ভ্রান্তির কারণ চার প্রকার, যেমন: (১) অজ্ঞানীর হুকুম স্বীকার করে তার কাছে আত্মসমর্পণ; (২) প্রচলিত প্রথার মোহ; (৩) জনপ্রিয় কুসংস্কার; এবং (৪) তথাকথিত জ্ঞানের কৌশলের আড়ালে অজ্ঞানতার প্রশ্রয়দান।
জ্ঞানের পথ হচ্ছে অভিজ্ঞতার পথ। অবশ্য অভিজ্ঞতাকে রোজার বহিঃঅভিজ্ঞতা এবং অন্তঃঅভিজ্ঞতা হিসাবে বিভক্ত করণ। ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতা হচ্ছে আমাদের বহিঃঅভিজ্ঞতা। এ হচ্ছে বাস্তব জগতের অভিজ্ঞতা, মানুষের আভ্যন্তরিক অভিজ্ঞতার উৎস হচ্ছে বিধাতা। ইন্দ্রিয়-অভিজ্ঞতার যেমন প্রয়োজন আছে তেমনি জ্ঞানের নিশ্চয়তা কেবল বিধাতার দয়াতেই সম্ভব। অভিজ্ঞতার এই ব্যাখ্যা রোজার বেকনের বস্তবাদকে ক্রটিপূর্ণ করেছে। তা সত্ত্বেও যুগের প্রেক্ষিতে রোজার বেকনের দর্শন ও বিজ্ঞান সম্পর্কীয় অভিমতসমূহ অপরিসীম তাৎপর্যপূর্ণ।
Bakunin, Mikhail Alexandrovich: বাকুনিন (১৮১৪-১৮৭৬ খ্রি.)
অভিজাত পরিবারের সন্তান বাকুনিন ছিলেন একজন পেটিবুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত চরিত্রের রুশ বিপ্লবী। নৈরাষ্ট্রবাদ বা এ্যানার্কিজম মতবাদের প্রচারকারী হিসাবেই বাকুনিন বিখ্যাত হন।
বাকুনিনের মতাদর্শে বিভিন্ন দার্শনিক এবং রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তাধারায় আকৃষ্ট হন। পরবর্তীকালে হেগেলের দর্শনের বস্তুবাদী ব্যাখ্যার পরিবর্তে তার ভাববাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল ব্যাখ্যা গ্রহণ করেন।
সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে বাকুনিনের মতবাদ ছিল এরূপ মানুষ মূলত দুটি যন্ত্র দ্বারা নিষ্পোষিত হচ্ছে একটি রাষ্ট্রযন্ত্র অপরটি ধর্মযন্ত্র বা অলীক বিধাতার দণ্ড। রাষ্ট্রযন্ত্রের অত্যাচার থেকে মুক্তির আশ্বাসে মানুষ ধর্মীয় বিশ্বাসের আশ্রয় নেয়। আসলে ধর্ম এবং রাষ্ট্র যুক্তভাবেই মানুষকে শোষণ করে। মানুষের মুক্তির একমাত্র পথ হচ্ছে এই উভয় যন্ত্রকে ধ্বংস করা। বাকুনিনের ধ্বংসমূলক এ মতের পরিপূরক কোনো গঠনমূলক মত ছিল না। তাঁর মতে রাষ্ট্রযন্ত্র বাদে মানুষ স্বাভাবিকভাবে যূথবদ্ধ হয়ে জীবন যাপন করতে সক্ষম। সে সমাজে কারুর কোনো শাসন বা খবরদারী থাকবে না। বাকুনিনের মতের একটি বিপ্লবাত্মক দিক আছে। কার্ল মার্কসও প্রচলিত রাষ্ট্র-ব্যবস্থার উচ্ছেদের কতা প্রচার করেছেন। কিন্তু প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থার স্থলে সমাজতন্ত্রবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠন মার্কসবাদের অপর অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার সমালোচনার ক্ষেত্রে সাদৃশ্যের কারণে মার্কস বাকুনিনকে প্রথম আন্তর্জাতিকের সদস্য হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে মাকর্সবাদী চিন্তার বিরোধিতার ফলে বাকুনিন প্রথম আন্তর্জাতিক থেকে ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে বহিস্কৃত হন। মাকর্স-এর সঙ্গে বাকুনিনের মতাদর্শের বিরোধের মূল কারণ ছিল মার্কস বাকুনিনকে হঠকারী বিপ্লবী বলে গণ্য করতেন।
বাকুনিন সমাজ বিপ্লবের পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে যেমন কোনো গঠনমূলক মত পোষণ করতেন না, তেমনি সমাজ বিপ্লবের জন্যও কোনো সুসংবদ্ধ সংগঠন ও আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করতেন না। বাকুনিন কৃষক এবং ভবঘুরে সর্বহারাকে বিপ্লবের প্রধান শক্তি বলে বিবেচিত করতেন। কৃষক ও ভবঘুরে সর্বহারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংস করবে, এই ছিল বাকুনিনের বিশ্বাস। সমসাময়িক সমাজবাদী চিন্তাবিদ প্রুধোর মতামতের প্রভাবও বাকুনিনের মধ্যে লক্ষ করা যায়। ‘ফেডারিলিজম, সোস্যালিজম এ্যাণ্ড এ্যাণ্টি থিওলজিজম’ বলে লিখিত বাকুনিনের গ্রন্থে সমাজের যে পরিকল্পনা বাকুনিন প্রথমে উপস্থিত করেন, তা মূলত প্রুধোর নিকট তেকেই গৃহীত।
বাকুনিনের জীবন ঘটনাবহুল। নিজের মতাদর্শ নিয়ে তৎকালীন বিক্ষুদ্ধ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বিপ্লব ও আলোড়নে একাধিকবার অংশগ্রহণ করেন।এর মধ্যে ১৮৪৮-৫০ প্রেগবিপ্লবে তাঁর অংশগ্রহণ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। উক্ত ঘটনার পরে রুশদেশে প্রত্যাবর্তনকালে বাকুনিনকে গ্রেপ্তার করে রুশ সরকার সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত করে। ১৮৬১ সালে সাইবেরিয়ায় নির্বাসন থেকে পালায়ন করে জাপান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়ে বাকুনিন আবার ইউরোপে উপস্থিত হন। রাশিয়ার নারোদনীক পন্থীগণ বাকুনিনের নৈরাষ্ট্রবাদী মতদ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবান্বিত হয়েছিল। কার্ল মার্কস ব্যতীত ফ্রেডারিক এঙ্গেলস এবং লেলিনও বাকুনিনের নৈরাষ্ট্রবাদী মতের তীব্র সমালোচনা করেন।
Balance of Payments: লেনদেনের ভারসাম্য
কোনো দেশ যখন তার আমদানি ও রপ্তানির মধ্যে একটা সমতা বজায় রাখে তখন তাকে লেনদেনের ভারসাম্য বলা হয়। লেনদেনের ভারসাম্যে প্রধান ভূমিকা পালন করে দেশ থেকৈ বিদেশে রপ্তানিকৃত দ্রব্যাদি এবং বিদেশ থেকে আমদানিকৃত দ্রব্যাদির মূল্য। কিন্তু দ্রব্যের আমদানি-রপ্তানি ব্যতীতও একটি দেশের আমদানি খাতে ব্যয় এবং রপ্তানি খাতে আয় হতে পারে। এরূপ আয়ের উৎস হচ্ছে সাধারণত দেশের মধ্যে বিদেশী পর্যটকদের ভ্রমণাদি এবং এই উপলক্ষে পর্যটকদ কর্তৃক বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে দেশীয় মুদ্রা গ্রহণ। আবার ব্যয়ের কারণও ঘটে দেশীয় নাগরিকগণ যখন বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে বিদেশে গমন করেন তখন। এ ছাড়া এক দেশের মধ্যে অপর দেশের ব্যাঙ, বীমা ইত্যাদির ব্যবস্থাপনার খাতেও একটি রাষ্ট্রের বৈদেশিক মুদ্রার আয় কিংবা ব্যয় ঘটতে পারে। এ সমস্ত আয়-ব্যয় উৎপাদিত দ্রব্যাদির আমদানি কিংবা রপ্তানির ভিত্তিতে ঘটে না বলে বৈদেশিক মুদ্রার এরূপ আমদানি রপ্তানিকে অদৃশ্য আমদানি কিংবা অদৃশ্য রপ্তানি বলে অভিহিত করা হয়।
Balance of Power: শক্তির ভারসাম্য
শক্তির ভারসাম্য একটি দেশের কূটনীতির ক্ষেত্রে অনুসৃত কৌশলের ব্যাপার। একটি রাষ্ট্র যদি তার বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে এরূপ কৌশল অবলম্বন করে কিংবা করার চেষ্টা করে যাতে তার নিজের রাজনীতিক, অর্থনীতিক এবং সামরিক শক্তিকে আর কোনো রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রগোষ্ঠীয় অনুরূপ শক্তি অতিক্রম করে যেতে না পারে তা হলে এই কৌশলকে শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখার কৌশল বলা হয়। ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধে থেকে প্রথম মহাযুদ্ধ পর্যস্ত ইংরেজ সরকার ইউরোপের ক্ষেত্রে এই কূটনীতিক কৌশল অনুসরণ করে চলছিল। ইউরোপে তখন একদিকে ছিল জার্মানি, অষ্ট্রিয়া এবং ইতালির ত্রয়ী-জোট এবং অপর দিকে ছিল ইংরেজ, ফরাসি এবং রাশিয়ার ত্রয়ী-জোটের শক্তি। এই দুই জোটের পারস্পারিক লক্ষ্য ছিল যেন প্রতিপক্ষ তাকে অতিক্রম করে যেতে না পারে। প্রথম মহাযুদ্ধের পরে ইউরোপে জার্মানি যখন ক্রমান্বয়ে পররাজ্য গ্রাস করে নিজ পক্ষের শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে তখন ইংল্যাণ্ড তার পাল্টা কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে অক্ষম হয়। এই পর্যায়ে ব্রিটিশ সরকার নাজিবাদী জার্মানির প্রতি তোষণনীতি অবলম্বন করে। বস্তুত প্রথম মহাযুদ্ধের পরে ১৯১৭ সালের রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্রমে বিরাট রুশদেশে ধনবাদের প্রতি-ব্যবস্থা হিসাবে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা পুরাতন ভারসাম্যব্যবস্থাকে ধনবাদী যে কোন রাষ্ট্রের নিকট অপ্রয়োজনীয় এবং অকেজো করে তোলে। এখন থেকে ধনবাদী এবং সমাজতন্ত্রী শক্তির মধ্যে ভারসাম্যের প্রশ্নটির সূচনা হয়। কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পর্যন্ত ধনবাদী ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রসমূহের বিশ্বাস ছিল যে, সমাজতন্ত্রী ব্যবস্থা ও শক্তি দীর্ঘজীবি হবে না। তারা সমাজতন্ত্রিক শক্তিকে ধ্বংস করতে পারবে। কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ার বিষ্ময়কর বিজয়, অধিকতর দেশসমূহের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হওয়া এবং জার্মানির মতো দুর্ধর্ষ ধনবাদী রাষ্ট্রের পরাজয় এই বিশ্বাসকে ভিত্তিহীন প্রমাণ করে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে ধনবাদী রাষ্ট্রসমূহের প্রধান শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমাজতন্ত্রকে প্রধান প্রতিপক্ষ বলে গণ্য করে তার সঙ্গে শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখার নীতি অনুসরণ করতে থাকে। বর্তমানে শক্তির ভারসাম্য বলতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত রাশিয়ার পারস্পারিক শক্তির সমতা বুঝায়।
নব্বই-এর দশকের গোড়াতে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পতনের পর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক প্রাধান্য সৃষ্টির পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে।
Basic Democracy: মৌলিক গনতন্ত্র
১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্থানের সামরিক বাহিনীর অধিনায়ক ফিল্ড মার্শাল মুহম্মদ আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করে দেশের পার্লামেণ্টারী শাসন-ব্যবস্থা বাতিল করেন এবং স্থানীয় স্বায়ত্ত্বশাসনের ক্ষেত্রে ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নামে একটি শাসন-ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। এই ব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য ছিল দেশের পার্লামেণ্ট, প্রাদেশিক পরিষদ এবং প্রেসিডেণ্ট নির্বাচনে পরোক্ষ নির্বাচনের পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করা। এই উদ্দেশ্যে সমগ্র দেশকে নির্দিষ্ট সংখ্যক নির্বাচকমণ্ডলীতে ভাগ করা হয় জনসাধারণ এই নির্বাচকমণ্ডলী প্রেসিডেণ্টকে নির্বাচিত করত এবং যথাক্রমে জাতীয় পরিষদ এই অধিকার ব্যতীত পর্যায়ক্রমে ইউনিয়ন, থানা, জেলা ও বিভাগীয় কাউন্সিলে অংশ গ্রহণের কম বেশি অধিকার দেওয়া হয়। এক হাজার অধিবাসীর ভিত্তিতে একজন করে নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ প্রথম পর্যায়ে ইউনিয়ন কাউন্সিল গঠন করত। কিন্তু পরবর্তী থানা পর্যায়ে ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানগরই মাত্র থানা কাউন্সিলের সদস্য এবং থানা কাউন্সিলের সদস্যদের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণই জেলা কাউন্সিলে, আবার জেলা কাউন্সিলের নির্বাচিত সদস্যদের নির্বাচনে বিভাগীয় কাউন্সিলের সদস্যগণ নির্বাচিত হত। ফলে জনসাধারণের প্রত্যক্ষ ভোটদানের ক্ষমতা নির্বাচকমন্ডলীর নির্বাচনেই সীমাবদ্ধ ছিল। জাতীয় পরিষদ, প্রাদেশিক পরিষদ কিংবা প্রেসিডেণ্টের নির্বাচনে জনসাধারণের প্রত্যক্ষ অধিকার ছিল না। স্থানীয় স্বায়ত্ত্বশাসনের ক্ষেত্রেও প্রাথমিক পর্যায়ের ইউনিয়ন কাউন্সিল ব্যতীত অপর স্তরগুলিতে ক্রমাধিক পরোক্ষ নির্বাচন এবং সীমিত অধিকারের ব্যবস্থা করা হয়। প্রেসিডেণ্ট আইয়ুব খান অভিমত পোষণ করতেন যে, দেশের জনসাধারণ পার্লামেণ্টারী গণতন্ত্রের উপযুক্ত নয়। তাঁর প্রবর্তিত ব্যবস্থাকে ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নাম দিয়ে তিনি জনসাধারণকে এই বলে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিলেন যে, জনসাধারণ হচ্ছে মূল এবং সেখানে গণতন্ত্র প্রবর্তন করাই হচ্ছে মৌলিক গণতন্ত্র। এবং মৌলিক গণতন্ত্র হচ্ছে সেরা গণতন্ত্র। কার্যত মৌলিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিল জনসাধারণকে দেশের জাতীয় সমস্যার আলোচনা ও সমাধানের অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখার একটি সুকৌশল স্বৈরতান্ত্রিক প্রচেষ্টা। স্থানীয় শাসনের ক্ষেত্রেও জনসাধারণের কোনো কার্যকর অধিকার ছিল না। প্রতিটি স্তরে আমলাতন্ত্রকে জনসাধারণের প্রতিনিধিদের উপর খবরদারির অধিকার দেওয়া হয়েছিল এবং ১৯৫৮ সালের পূর্ব পর্যন্ত ইউনিয়ন ও জেলা বোর্ডের প্রতিনিধিগণ স্বায়ত্ত্বশাসনের যে অধিকার ভোগ করত সে অধিকারও মৌলিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্তায় বিলুপ্ত করা হয়। ১৯৬৯-৭০-এর গণআন্দোলনে আইয়ুব খান ক্ষমতা থেকে অপসারিত হন এবং কাঁর মৌরিক গণতন্ত্র ব্যবস্থার বিলোপ ঘটে।
ক্ষমতায় আরোহণ করার পর জনসাধারণের রাজনৈতিক অধিকার সঙ্কুচিত করার প্রবণতা উচ্চতর শ্রেণীর শাসকদের একটি সাধঅরণ প্রবণতা। ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ ছিল এই প্রবণতারই প্রকাশ।
Basis and Supersructure: মূল ও উপরিকাঠামো
সমাজের অর্থনৈতিক বুনিয়াদের সঙ্গে তার সাংস্কৃতিক, রাষ্ট্রনৈতিক, ধর্মীয় এবং অন্যান্য অংশের সম্পর্কের ব্যাখ্যায় মার্কসবাদী দর্শন ‘মূল এবং উপরি-কাঠামো’ নামক দুটি শব্দ ব্যবহার করে। মার্কসবাদের মতে যে-কোনো সমাজের অর্থনৈতিক বুনিয়াদই হচ্ছে সমগ্র সমাজের মূল বুনিয়াদ। সমাজ বিকাশের যে-কোনো বিশেষ পর্যায়ে উৎপাদনের উপায় অর্থ্যাৎ জীবিকা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় হাত-পা, মস্তিস্ক এবং যন্ত্রপাতির মালিকানার ভিত্তিতে গঠিত হয় সেই পর্যায়ের অর্থনেতিক বুনিয়াদ। সংক্ষেপে একে বলা হয় ‘উৎপাদনের উপায় এবং উৎপাদনের সম্পর্ক’। উৎপাদনের উপায় এয সম্পর্কের ভিত্তিতে গঠিত মূল বুনিয়াদের উপরই রচিত হয় সে সমাজের আইন-কানুন, নিয়ম-নিষেধ, মতামত, বিশ্বাস, অবিশ্বাস, সাহিত্য এবং সংস্কৃতি। অর্থনৈতিক বুনিয়াদের উপর রচিত এই কাঠামোকে মার্কসবাদ বহির্গঠন, উপরি-কাঠামো বা সুপার স্ট্রাকচার বলে অভিহিত করে।
অর্থনৈতিক বুনিয়াদ বা সমাজের মূল কাঠামো অনুযায়ী তার বহিঃকাঠামো গঠিত হয়। যে সমাজের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ হচ্ছে দাসের দৈহিক শ্রমের মালিকানার ভিত্তিতে প্রভুদের সম্পদ সৃষ্টি সে সমাজের বহিঃকাঠামোর মধ্যে অবশ্যই এই মূল কাঠামোর রাষ্ট্রনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অপরাপর ভাবগত প্রয়োজন প্রতিফলিত হবে। আবার মূল কাঠামোর অন্তর্নিহিত বিরোধও বহিঃকাঠামোর ভাবদর্শের ক্ষেত্রে প্রকাশ পাওয়ার চেষ্টা করবে। এই বিচারে কোনো সমাজের বহিঃকাঠামোর সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ ঘটলে তার সঠিক প্রকৃতি বিচারে সে সমাজের মূল কাঠামোর বিশ্লেষণ আবশ্যক।
সমাজ বিকাশের মূল কাঠামোর পরিবর্তনের পরে উপরি-কাঠামোতে পরিবর্তন আসে। একারণে মূলকাঠামোর পরিবর্তন ব্যতীত ইচ্ছা করলেই কেউ উপরিকাঠামোতে স্থায়ী কোনো পরিবর্তন আনতে পারে না। সমস্ত সমাজের মূল অর্থনৈতিক কাঠামো যখন পরিবর্তিত হয়ে পুঁজির মালিকানা-ভিত্তিক নতুনতর অর্থনৈতিক বুনিয়াদ তৈরি হয়েছে তখনি সামন্ত সমাজের ভাবনা-চিন্তা, আইন-কানুন, বিশ্বাস-অবিশ্বাস বিলুপ্ত হয়ে নতুন বহিঃকাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মার্কসবাদের মতে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক বুনিয়াদের পরিবর্তনের মাধ্যমেই মাত্র তার পুঁজিবাদী বহির্গঠন পরিবর্তিত হয়ে সমাজবাদী বহির্গঠন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
মার্কসবাদের মূল দর্শন দ্বন্দ্বমূলক এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। দ্বন্দ্বমূলক এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মতে সমাজের মূল কাঠামো এবং বহিঃকাঠামোর মধ্যকার সম্পর্ক কেবল একমূখী নয় এ সম্পর্কের চরিত্রও দ্বন্দ্বমূলক এবং দ্বিমূখী। কেবল যে মূল কাঠামো সমাজের বহিঃকাঠামোকে নিয়ন্ত্রিত এবং প্রভাবান্বিত করে, তাই নয়। বহিঃকাঠামো গঠিত হওয়ার পরে তার মধ্যকার বিভিন্ন সামাজিক ব্যবস্থা, আইন-কানুন, অর্থনৈতিক শ্রেণীসমূহের সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় ও দার্শনিক চিন্তাধারাও মূল গঠনকে প্রভাবান্বিত করে। অর্থনৈতিক বুনিয়াদের বিকাশ ও ক্রিয়াশীলতার ক্ষেত্রে তার বহিঃকাঠামোর বিভিন্ন অংশও সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
একটি ভাব বস্তু বা বাস্তব অবস্থা থেকে উদ্ভূত হয়। কিন্তু একবার উদ্ভূত হলে সে ভাব বাস্তব অবস্থাকেও পরিবর্তত করতে পারে। মার্কসবাদের এ্ই অভিমতটি এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। মার্কসবাদের মতে ব্যক্তিগত মালিকানা-ভিত্তিক সমাজের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ বা মূল কাঠামোর সঙ্গে তার বহিঃকাঠামোর সম্পর্কের অপর দিকটি হচ্ছে বিরোধাত্মক। অর্থনৈতিক বুনিয়াদের মধ্যকার শ্রেণীগত বিরোধ বহিঃকাঠামোর মধ্যেও প্রতিফলিত হয়। কালক্রমে এই বিরোধ মূল কাঠামো পরিবর্তনের আন্দোলনের রূপ লাভ করে। একটি সমাজের সামগ্রিক কাঠামোর মূল ও বহির্ভাগের বিভাগ ও বেশিষ্ট্য স্বাভাবিক। মার্কসবাদের মত অনুযায়ী এই উভয় দিকের পারস্পারিক সম্পর্কের বিরোধাত্মক চরিত্র সমাজতান্ত্রিক সমাজে আর থাকতে পারে না। কারণ সমাজতন্ত্রের অর্থনৈতিক বুনিয়াদের শ্রেণীতে শ্রেণীতে মারাত্মক বিরোধের অবকাশ নেই। এ কারণে তার উপরি-কাঠামোর মধ্যেও আপসহীন বিরোধের উদ্ভব ঘটে না। তখন সমাজের মূল গঠন এবং বহির্গঠন সংযুক্তভাবে সমগ্র সমাজের অধিতকর অর্থনৈতিক উন্নতি এবং সুসমঞ্জস সভ্যতা বিকাশের মাধ্যম হিসাবে কাজ করে।
Bastille, fall of: বাস্তিলের পতন
১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই বাস্তিলের পতন অত্যাচারী ফরাসি সম্রাটের বিরুদ্ধে জনতার বিপ্লবী অভ্যুত্থানের সূচক বলে ইতিহাসে পরিগণিত হয়। বাস্তিল দুর্গ ছিল প্যারিস শহরে ফান্সের বিখ্যাত কারাগার। স্বৈরতান্ত্রিক সম্রাট এবং সামন্তবাদী শাসন ও অত্যাচারের প্রধান প্রতীক হিসাবে বাস্তিল দুর্গ জনসাধারণের মনে সর্বাধিক ঘৃণা এবং ক্রোধের সৃষ্টি করেছিল। বিপ্লব শুরু হলে প্যারিস শহরের একটি কারখানার শ্রমিকদের নেতৃত্বে বিক্ষুদ্ধ জনতা বাস্তিল দুর্গকে আক্রমণ করে এবং দুর্গের সশস্ত্র বাহিনীকে পর্যদস্ত করে দুর্গের দ্বার ভেঙ্গে ফেলে দুর্গের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। জনতার হাতে দুর্গের শাসক নিহত হয়। সমগ্র ফ্রান্সের নির্যাতনের প্রতীক হিসাবে জনতা এরপরে দুর্গকে একেবারে ভূমিসাৎ করে ফেলার জন্য তার প্রাচীরের পাথর একটি একটি করে খুলে ফেলতে আরম্ভ করে। ১৪ জুলাই বাস্তিলের পতন দিবসকে আজো ফরাসি দেশের জনসাধারণ শক্তির দিবস হিসাবে পালন করেন। বাসিবতল আক্রমণের লক্ষ্য এবং এর পতনের তাৎপর্য নিয়ে ইতিহাসের গবেষকদের মধ্যে মতের পার্থক্য আছে। অনেকে মনে করেন যে, বাস্তিল দুর্গে রাজনীতিক বন্দিদের মুক্তির জন্য জনতা বাস্তিল আক্রমণ করেছিল, একথা ঠিক নয়। আসলে জনতার প্রধঅন লক্ষ্য ছিল দুর্গের অস্ত্র দখল করা। কিন্তু একথা ঠিক যে, বাস্তিলের পতনের মধ্যে দিয়ে বিপ্লবী আক্রমণের উদ্যোগ ব্যপকতম জনসাধারণের হাতে চলে গিয়েছিল। এদিক দিয়ে ফরাসি বিপ্লবের সবচেয়ে নাটকীয় এবং তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ছিল বাস্তিলের পতন। এই ঘটনার পরে জনসাধারণের প্রতিনিধিদের জাতীয় পরিষদই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার উৎস হয়ে দাঁড়ায়।
Behaviourism: আচরণবাদ, ব্যবহারবাদ
আধুনিক মনোবিজ্ঞানে ‘বিহেভিয়রিজম’ একটি নতুন ধারা। বাংলায় একে আচরণবাদ বা ব্যবহারবাদ বলে আখ্যায়িত করা হয়। প্রাগমেটিজম বা প্রয়োগবাদ কিংবা কার্যবাদ নামক আধুনিক দার্শনিক তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রধাণত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মনোবিজ্ঞানের আচরণবাদ তত্ত্বের বিকাশ ঘটে; এ তত্ত্বের প্রথম প্রবক্তা ছিলেন চিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন বি. ওয়াটসন (১৮৭৮-১৯৫৮)। অবশ্য এ ক্ষেত্রে ওয়াটনসনের পূর্বগামী হিসাবে থর্নডাইকের (১৮৭৪-১৯৪৯) উল্লেখ করা যায়। জীব-জন্তুর আচরণের উপর থর্নডাইক যে সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছিলেন ওয়াটসন তাকেই মনোবিজ্ঞানের নতুন তত্ত্বে ব্যবহার করেন।
আচরণবাদ বা ব্যবহারবাদের ক্ষেত্রে ‘আচরণ’ বা ‘ব্যবহার’ শব্দ বিশেষ অর্থ বহন করে। সাধঅরণ জীবনে ‘ব্যবহার’ বা আচরণের সঙ্গে ভালো-মন্দের একটি প্রশ্ন জড়িত থাকে। এবং ব্যবহার বা আচরণ বলতে আমরা কোনো অবস্থায় মানুষের মনের উদ্যোগে গৃহীত কোনো প্রতিক্রিয়ার কথা বুঝাই। সে দিক থেকে অনিচ্ছাকৃত বা বাধ্যতামূলক কোনো প্রতিক্রিয়াকে ব্যবহার বা আচরণ বলঅ হয় না। যেমন একটি আলপিন দিয়ে কারুর আঙুল বিদ্ধ করলে সে হাত টেনে নেয় বা বেদনার্ত চিৎকার করে ওঠে। এ প্রতিক্রিয়া সাধারণ অর্থে ব্যবহার বা আচরণ নয়। কিন্তু আচরণবাদী মনোবিজ্ঞানীর নিকট উল্লিখিত প্রতিক্রিয়াটি ব্যক্তির একটি আচরণ বা ব্যবহার।
আচরণবাদের উদ্ভব ঘটে মনসর্বস্ব কায়েমী মনোবিদ্যার প্রতিবাদ হিসাবে। এতদিন পর্যন্ত এই তত্ত্বই গৃহীত হয়ে আসছিল যে, মানুষের জীবনে মনই হচ্ছে আসল সত্তা। মনের ইচ্ছা-অনিচ্ছা অনুযায়ী মানুষ পরিবেশের সঙ্গে ব্যবহার করে। কিন্তু মন অদৃশ্য এবং অস্পশ্য। এ তত্ত্বের হেরফের কিছু যে না ঘটছে তা নয়। মনের সঙ্গে দেহের সম্পর্ক স্থাপন করারও চেষ্টা হয়েছে। মনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে ভুনড ঘড়ি ধরে মাপার চেষ্টা করেছেন। ডারউইন, মরগান, স্পেন্সার প্রমুখ জীববিজ্ঞানীগণও মনকে পরিবেশ-নির্ভর বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছেন। স্পেন্সার ব্যাক্তি বা সাধারণভাবে মানুষের জীবনকে পরিবেশের সঙ্গে ক্রমাধিকভাবে খাপ খাইয়ে চলার প্রক্রিয়া হিসাবে দেখিয়েছেন।
কিন্তু কায়েমী মনোবিদ্যার বিরুদ্ধে সবচেয়ে জোরালো প্রতিবাদ আসে আচরণবাদী এবং পাভলভ-পন্থীদের পক্ষ থেকে। আচরণবাদের প্রতিষ্ঠাতা ওয়াটসন ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে প্রদত্ত তাঁর বক্তৃতায় কায়েমী মনোবিদ্যার বিরুদ্ধে নিন্মোক্ত যুক্তিগুলি উপস্থিত করেন: (১) অদৃশ্য এবং অস্পশ্য মনকে চরম বলে স্বীকার করলে মনোবিদ্যা কেবল দার্শনিক তত্ত্ব হয়ে থাকবে; মনোবিদ্যা মনোবিজ্ঞানের রূপান্তরিত হতে পারবে না। কারণ মনকে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা চলে না। (২) কায়েমী মনোবিদ্যার অন্তদর্শন বা ইনট্রোসপেকসন পদ্ধতি মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কোনো কার্যকর পদ্ধতি নয়। এ পদ্ধতি দ্বারা শিশু কিংবা পাগল, কারুর মনের খবরই জানা সম্ভব নয়। এ পদ্ধতি ব্যক্তির জীবনকে দুর্জ্ঞেয় করে রাখে। এমনকি ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বা বুদ্ধির পরিমাপও অন্তদৃষ্টির মারফত করা সম্ভব নয়।
এই সমালোচনার ভিত্তিতে আচরণবাদ মনোবিজ্ঞানের নতুন তত্ত্ব উপস্থিত করে। ওয়াটসন বললেন, মানুষের সমস্ত প্রকার ব্যবহারের কার্যকরণ সুত্র উদ্ধার কর মানুষের উন্নততর জীবনের জন্য আবশ্যক। এ উদ্দেশ্য সিদ্ধ হতে পারে যদি মানুষের ব্যবহার নিয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষা পরিচালিত হয়। আলপিন বিদ্ধ হলে জীবন্ত ব্যক্তির দেহ বিশেষ আচরণ করতে বাধ্য। আলপিন এখানে স্টিমুলাস বা উত্তেজক। মনুষ্যেতর জীবও এরূপ ক্ষেত্রে একই ব্যবহার করে। এ উত্তেজক যখনই প্রয়োগ করা হবে, তখনি ব্যক্তি এইরূপ আপরণ করবে। মনের ইচ্ছায় আচরণের কোনো মৌলিক পার্থক্য ঘটবে না। এরূপে ব্যক্তির যে-কোনো ব্যবহারই কোনো একটি উত্তেজকের প্রয়োগে দেহের প্রতিক্রয়া বিশেষ। যে-প্রতিক্রিয়াকে মানসিক বলে বিবেচনা করা হয় বা হত, সে-আচরণকেও উত্তেজক বা উদ্দীপক প্রয়োগের প্রতিক্রিয়া হিসাবে দেখানো চলে। যেমন রুশ জীববিজ্ঞানী পাভলভ তাঁর কুকুরের পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণ করেছেন যে, খাদ্য দেখে কুকুরের জিহ্বায় লালা নিঃসরণ কুকুরের মনের ক্রিয়া বলে মনে করা হলেও খাদ্যের বদলে একটি শব্দ দ্বারাও কুকুরের জিহ্বাকে লালাসিক্ত করা যায়। এজন্য তিনি প্রথম খাদ্যের সঙ্গে শব্দের উদ্দীপকও প্রয়োগ করতেন। পরবর্তীকালে খাদ্য বাদে কেবল শব্দের উত্তেজক কুকুরের জিহ্বা লালাসিক্ত আরম্ভ করেঅ কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, মানুষের যে-কোনো ক্রিয়াই উত্তেজকের প্রতিক্রিয়া এবং যে-কোনো প্রতিক্রিয়াকেই উত্তেজক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করা চলে। অর্থ্যাৎ উত্তেজক বা পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ব্যক্তির প্রতিক্রিয়াও নিয়ন্ত্রণ কার সম্ভব। শিশুর মধ্যে জন্মগত প্রতিক্রিয়ার সংখ্যা সামান্য। শিশু ক্রমান্বয়ে যেরূপ উত্তেজক বা পরিবেশ লাভ করে সেইরূপ প্রতিক্রিয়া দ্বারা সে গঠিত হয়। উত্তেজকের ভিত্তিতে গঠিত প্রতিক্রিয়ার বংশপরাস্পরা হওয়ার কোনো উপায় নেই।
আচরণবাদের এই সংক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে বুঝা যায় যে, আচরণবাদ মন বা চেতনার কোনো স্বাধীন অস্তিত্ব স্বকিার করে না। এবং আচরণবাদকে চরম আকারে গ্রহণ করলে মানুষের ব্যবহার উত্তেজক প্রয়োগমাত্র দেহের যান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া ব্যতীত আর কিছুই নয়। একথা সত্য যে, আচরণবাদ মনোবিদ্যাকে মনোবিজ্ঞানে পরিণত করার ক্ষেত্রে একটি তাৎপর্যপূর্ণ সাহসিক পদক্ষেপ। মনময় হয়ে মনোবিদ্যা এতকাল যে তত্ত্বমার্গে আবদ্ধ ছিল সেখান থেকে আচরণবাদ তাকে বাস্তব পরীক্ষাগারে এনে মানুষের শিক্ষাগত, সমাজগত, জীবিকাগত দিকগুলিকে ক্রমাধিক পরিমাণে সুনির্দিষ্ট এবং ফলপ্রসূ করে তুলেছে। তবে আচরণবাদের চরম ব্যাখ্যা অর্থ্যাৎ মানুষের ব্যবহার ‘উত্তেজক-প্রতিক্রিয়া’ ব্যতীত কিছুই নয় এবং মানুষ্যেতর জীবের সঙ্গে তার ব্যবহারের কোনো পার্থক্য নেই, এরূপ অভিমত দ্বিধাহীনভাবে গৃহীত হয় না। অনেক আচরণবাদী মানুষের জটিল ব্যবহার ব্যাখ্যার জন্য সম্প্রতিকালে ইণ্টারমিডিয়েট ভেরিয়েবলস বা ‘মধ্যবর্তী ব্যত্যয়’-রূপ ধারণাও গ্রহণ করতে শুরু করেছেন।
Bellarmine, Roberd: রবার্ট বেলারমিন (১৫৪২-১৬২১ খ্রি.)
মধ্যযুগের একজন বিখ্যাত ক্যাথলিক লেখক। ফরাসিদেশের জেসুইটপন্থী ধর্মযাজক। খ্রিষ্ট ধর্মের গির্জার শাসনে পোপের ঐশ্বরিক অধিকারের বিষয় নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে বেলারমিন সরকারের প্রকার ভেদ নিয়েও আলোচনা করেন। শাসনের প্রশ্নে বেলারমিন অভিজাততন্ত্রকে নাকচ করেন। তাঁর মতে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র হচ্ছে সর্বোত্তম সরকার। কিন্তু একজন আদর্শ চরিত্রবান রাজা পাওয়া মানুষের ভাগ্যে কদাচিৎই ঘটে। সে কারণে জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান দ্বরা রাজার যদৃচ্ছা শাসনকে নিয়ন্ত্রিত করার ব্যবস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়। কারণ রাষ্ট্র শাসনের মূল অধিকার জনগনের। রাজার হস্তে জনসাধারণই শাসনের অধিকার ন্যস্ত করে। অর্থ্যাৎ জনগণকে শাসন করার রাজার ঐশ্বরিক অধিকারের কথা বেলারমিন অস্বীকার করেন। গীর্জা এবং রাষ্ট্রের সম্পর্কের প্রশ্নে বেলারমিন এরূপ অভিমত প্রকাশ করেন যে, গীর্জার শাসন এবং রাষ্ট্রের শাসন পরস্পর পৃথক। মানুষের লৌকিক ব্যাপারে পোপের কোনো প্রত্যক্ষ অধিকার থাকতে পারে না। পোপের অধিকার ধর্মীয় বিষয়ে সীমাবদ্ধ। তবে রাষ্ট্রের শাসক ধর্মের বিরোধী কোনো আইন প্রবর্তন করার চেষ্টা করলে পোপের অধিকার থাকবে সেরূপ আইনকে নিবৃত করার জন্য হস্তোক্ষেপ করার এবং গীর্জার অলঙ্ঘনীয়তাকে শাসক আক্রমণ করলে শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করার অধিকার গীর্জার থাকবে। ফরাসি আইনবিদরা বেলারমিন এরূপ হস্তক্ষেপমূলক অভিমতের তীব্র সমালোচনা করেন।
Bentham, Jeremy: জেরেমী বেনথাম (১৭৪৮-১৮৩২ খ্রি.)
অষ্টাদশ শতকের ইংল্যাণ্ডের প্রখ্যাত নীতিশাস্ত্রবিদ এবং আইনের ব্যাখ্যাতা। নীতিশাস্ত্রের ক্ষেত্রে জেরেমী বেনথামকে ইউটিলিটারিয়ানিজম বা উপযোগবাদের প্রতিষ্ঠাতা মনে করা হয়। নীতিশাস্ত্রের ন্যায়-অন্যায় এবং ভালো-মন্দ প্রশ্নের আলোচনা করে বেনথাম বলেন যে, নীতি বা ন্যায়ের মূলে রয়েছে কার্যের প্রয়োগ বা সার্থকতার প্রশ্ন। একটা কার্য ভালো বা ন্যায্য বলে বিবেচিত হবে তার প্রয়োগ বা সার্থকতার ভিত্তিতে। সার্থকতা কি? কোনো কাজের ফলে সৃষ্ট সুখই হচ্ছে সে কাজের সার্থকতা। ব্যক্তি যখন কোনো কাজ করে তখন সে সুখ লাভ করার জন্যই ইহার সম্পাদন করে। আকাঙ্ক্ষিত সুখ লব্ধ হলেই কাজটি সার্থক এবং ন্যায্য। সুখের পরিবর্তে দুঃখের লাভ ঘটলে ব্যক্তির কাছে সে কাজ অসার্থক। সুখের এ ব্যাখ্যা একেবারেই ব্যক্তিক। সুখের এই ব্যক্তিক ব্যাখ্যাকে হিডোনিজম বা আত্মসুখবাদ বলে প্রচার করতে চান নি। সে জন্য উপযোগ বা সুখের ব্যাখ্যাকে ব্যাপক করে তিনি সুখ বলতে সামাজিক সুখকেও বুঝাতে চেয়েছেন। রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে উপযোগবাদের এই তত্ত্বকে সম্প্রসারিত করে বেনথাম বলেছেন যে, রাষ্ট্রের যে-কোনো আইন বা কার্যের সার্থকতার পরিমাপ হবে অধিকতম সুখের বিধান দ্বারা। সুখকেই কাজের সার্থকতার মাপকাঠি করা, আবার অধিক সংখ্যকের সুখ বিধানের সুপারিশের মধ্যে বেনথাম-তত্ত্বের স্ববিরোধিতা প্রকট হয়েছে। এর কারণ, বেনথাম একদিকে যেমন তৎকালীন ইংল্যাণ্ডের পুঁজিবাদী সমাজের ব্যক্তিকেন্দ্রীকতার পরিপোষক ছিলেন তেমনি অপরদিকে মানবিকতার বোধ থেকে তিনি সে সমাজের বৈষম্য এবং সুখের সামাজিক বণ্টনে ভারসাম্যহীনতাকেও অস্বীকার করতে পারেন নি। এ বিরোধিতার সমঝোতা করার জন্য বেনথাম বলেছেন যে, ব্যক্তিগত সুখ এবং সামাজিক সুখের মধ্যে আসলে বিরোধ নেই। একের সুখেই বহুর সুখ। আবার বহুর সুখেই একের সুখ। আত্মসুখ সাধনের মাধ্যমে মানুষ অপরের সুখও সাধন করতে পারে। কারণ সুখ মানে কেবল দেহের আরাম নয়। বিপন্নকে উদ্ধার করার জন্য জীবদানের মধ্যেও সুখ নিহিত আছে। আর সে সুখই উত্তম সুখ।
নিজের মানবতা বোধ থেকে বেনথাম ইংল্যাণ্ডের আইনের সংস্কারের চেষ্টা করেন। ফরাসি বিপ্লবের বৎসর ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে বেনথামের ‘ফ্রাগমেণ্ট অন গভার্নমেণ্ট’ বা সরকার সংক্রান্ত মতামত উপস্থিত করেন। বেনথাম বলেন, রাষ্ট্রের যে-কোনো বিধান বা কাজের লক্ষ্য হবে সর্বাধিক সংখ্যক অধিবাসীর সর্বাধিক পরিমাণ সুখের বিধান করা। ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের কোনো কাজ ন্যায় কিংবা অন্যায় তা নির্ধারিত হবে সে কাজের ফলে সে সুখ লব্ধ হবে কিংবা বিনষ্ট হবে, তার তুলনামূলক পরিমাণ দ্বারা। রাষ্ট্রের কোনো শাস্তিমূলক বিধানের সার্থকতার মাপকাঠিও এইরূপ হবে। এ বিধান যাদের উপর প্রযুক্ত হবে তাদের সুখের পরিমাণ এর প্রয়োগে যদি বৃদ্ধি পায় তবেই এ বিধান ন্যায্য। অন্যথায় এ বিধান অন্যায্য।
তৎকালীন ইংল্যাণ্ডের রাষ্ট্রীয় বিধানের অধিকাংশই ছিল অলিখিত। আইনের বিশ্লেষণ করে বেনথাম বলেন, রাষ্ট্রের যে কোনো বিধানেরই একটি খারাপ দিক আছে। এর দ্বারা আহত ব্যক্তির সুখ বিনষ্ট হয়। কিন্তু বিনষ্ট পরিমাণের চেয়ে লব্ধ সুখের পরিমাণ অধিক হওয়া মধ্যেই এ বিধানের ন্যায্যতা নিহিত। প্রত্যেক বিধানের আরো দুটি দিক আছে। একটি তার অধিকারের দিক, অপরটি তার দায়িত্বের দিক। যেমন রাষ্ট্র, তেমনি ব্যক্তি উভয়রে ক্ষেত্রে এ সত্য। এ কারণে প্রত্যেক রাষ্ট্রীয় আইনের অধিকারও দায়িত্ব উভয় দিক সম্পর্কে নাগরিকমাত্রেরই ওয়াকিবহাল থাকতে হবে। সে জন্য আইনকে বিধিবদ্ধ, প্রকাশিত এবং প্রচারিত হতে হবে।
বেনথামের নীতিশাস্ত্রীয় তত্ত্বে স্ববিরোধিতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তা ছাড়া তিনি সুখের পরিমাণকে আঙ্কিক হিসাবে পরিমাপ করা যায় বলেও মনে করতেন। কিন্তু সুখের পরিমাণের এরূপ আঙ্কিক পরিমাপ সম্ভব বলে তাঁর পরবর্তী অনুসারীগণ মনে করতেন না। কন্তু স্ববিরোধিতা সত্ত্বেও তাঁর নীতিতত্ত্বে একটি মানবতাবোধের পরিচয় আছে। এই বোধ থেকে তাঁর আইনের বিশ্লেষণ এবং আইন বিধিবদ্ধ করার প্রয়াস ইংল্যাণ্ডের সামাজিক অর্থনৈতিক জীবনে বহু সংস্কারের সূচনা করে।
Bergson, Henri: হেনরী বার্গসঁ (১৮৫৯-১৯৪১ খ্রি.)
আধুনিক ভাববাদের প্রখ্যাত ফরাসি প্রবক্তা। বার্গসঁ বহু গ্রন্থের রচয়িতা। এই সমস্ত গ্রন্থের মধ্যে ‘সময় এবং স্বাধীন ইচ্ছা’ এবং সৃজনশীল অভিব্যক্তি বিশ্বব্যাপী পরিচিত। উক্ত গ্রন্থ দুখানার ইংরেজী অনূদিত নাম হচ্ছে টাইম এ্যান্ড ফ্রি উইল এবং ক্রিয়েটিভ ইভোল্যুশন।
বার্গসঁর ভাবধারা জটিল এবং দুর্বোধ্য। তবে তাঁর অভিমনের মূল বলে যা স্বীকৃত সে হচ্ছে এই যে, বার্গসঁ জ্ঞানের ক্ষেত্রে যুক্তির পদ্ধতি এবং সত্যের ক্ষেত্রে বস্তুর অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। সাধারণভাবে বার্গসঁকে জীবনকাল বিস্তৃত ছিল। ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধ এবং বিংশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত ফরাসি দেশ এবং ইউরোপের বিবর্তমান সমাজের তিনি অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন। ধনতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থার স্বর্ণযুগ অস্তমিত। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রনৈতিক সঙ্কট, সংঘাত, বিদ্রোহ, বিপ্লব, মহাসমর, অরাজকতা সভ্যতার শিখরে উন্নীত মানুষের জীবনে দুরারোগ্য ব্যাধি বলে বার্গসঁর মনে হয়েছে। মানুষ আত্মবিনাশকারী সংঘর্ষের নিরসন করে সুস্থ স্বাভাবিক নতুন মানব সমাজ তৈরি করতে পারে, এ জীবনবাদের উপর তাঁর আস্থা ছিল না। আধুনিক বুদ্ধিজীবীদের জন্য এ এক সঙ্কটময় পরিস্থিতি। এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তির দুটি পথ। এক, মানুষের সৃজনশীল ক্ষমতার উপর আস্থা রেখে বাস্তব সঙ্কট ও অরাজকতার কারণ দূর করে নতুন সমাজ তৈরির কার্যে এবং ভাবধারায় অংশগ্রহণ করা; দ্বিতীয় পথ হচ্ছে জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা এবং বস্তুর সত্যাসত্যতার প্রশ্ন তুলে চিন্তার জাল বুনে চলা। এ পথ যাঁরা আধুনিক যুগে গ্রহণ করেছেন, বার্গসঁ তাঁদের অন্যতম। অবশ্য এ পথ কেভল যে ব্যক্তিগত স্বার্থ সাধন করে, তা নয়। ক্ষয়িষ্ণু সঙ্কটগ্রস্ত ধনতান্ত্রিক সমাজের এটাই হচ্ছে অপরিহার্য দর্শন। অবাস্তব চিন্তার জালে বাস্তব সঙ্কট ও তার কারণকে আড়াল করে সে সঙ্কটের মূল রক্ষা করার প্রয়াস হচ্ছে এ দর্শনের লক্ষ্য। এ বিচারে বার্গসঁ অসাধারণ লেখনীর ক্ষমতা প্রয়োগে এক জটিল মায়ারাজ্য রচনা দ্বারা আধুনিক ধনতন্ত্রের শ্রেষ্ঠ দার্শনিকের মর্যাদা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন।
‘টাইম এ্যাণ্ড ফ্রি উইল’ পুস্তকের মধ্যে বার্গসঁ তাঁর মতামতকে অত্যন্ত জোরের সঙ্গে উপস্থিত করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতে আমাদের ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান আদৌ কোনো জ্ঞান নয়। মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয় মানুষকে যে জ্ঞান দেয়, সে জ্ঞান হচ্ছে পরিমাপযোগ্য বিভাজ্য বস্তুনিচয়ের জ্ঞান। কিন্তু সত্য হচ্ছে অবিভাজ্য এবং পরিমাপের অযোগ্য। সেই অখণ্ড এবং অপরিমেয় সত্যের জ্ঞান কেবলমাত্র ইনট্যুশন অর্থাৎ উপলব্ধি বা স্বজ্ঞার মারফতই মানুষ লাভ করতে পারে, বুদ্ধি, যুক্তি এবং বাহ্যিক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আমরা আমাদের সাধারণ জ্ঞান লাভ করি। কিন্তু এ জ্ঞান অলীক। বার্গসঁর তত্ত্বকে অ-যুক্তিবাদের দর্শন বলেও অভিহিত করা হয়। বার্গসঁ তাঁর স্বজ্ঞার দৃষ্টান্ত এবং ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের অলীকতা বুঝাবার জন্য একটি ঘটনার উল্লেখ করেন। কোনো ব্যক্তি তার একটি হাত রাখা অবস্থা থেকে তুলল। এই ঘটনার দুটি দিক আছে। একটি হচ্ছে হাতের মালিকের অনুভূতির দিক। এ ব্যাপারে তার অনুভূতি একটি অখণ্ড অনুভূতি। কিন্তু এই ঘটনাটিকে একজন পর্যবেক্ষক যখন দেখে তখন তার কাছ এ ঘটনা হাতের সঞ্চালন প্রক্রিয়ার কতকগুলি মুহুর্ত বা অবস্থা ব্যতীত কিছু নয়। হাত তোলার এটাই ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান। কিন্তু এ জ্ঞান এবং হাত তোলার মুহুর্তে হাতের মালিকের অখণ্ড উপলব্ধি বা স্বজ্ঞার মধ্যে আদৌ কোনো মিল বা সাদৃশ্য নেই। পদ্ধতির দিক থেকে এরা পরস্পর-বিরোধী। কেবল পদ্ধতি নয়। উভয়ের প্রদত্ত ফল বা সত্যও পরস্পর-বিরোধী। স্বজ্ঞা ব্যক্তিকে এ ক্ষেত্রে যে সত্য সম্পর্কে জ্ঞান করে, সাধারণ জ্ঞানের সত্য তার বিরোধী। একটি ঘটনার ক্ষেত্রে যা সত্য, সমগ্র বিশ্ব চরাচর অর্থাৎ জগৎ সম্পর্কে তাই সত্য। বুদ্ধি ও যুক্তি আমাদের সত্যের অলীক ধারণা দেয়। স্বজ্ঞাই কেবল অখণ্ড সত্তা হচ্চে ‘ড্যুরেশন বা স্থিতিকাল’। ‘স্থিতিকাল’ বস্তু নয়, কিন্তু স্থিতিকালই হচ্ছে সমস্ত বস্তুর মূল। স্থান, কাল, পাত্র বলে যে সমস্ত অস্তিত্বের কথা আমরা বলি, বার্গসঁর মতে সেগুলি এই স্থিতির প্রকার-ভেদ।
কেবল বস্তু নয়, বস্তুর বিকাশের প্রশ্নেও বার্গসঁ বস্তুবাদী বিকাশবাদের বিরোধিতা করেন। বিকাশের বস্তুবাদী তত্ত্ব হচ্ছে যে, বস্তু অন্তর্নিহিত বিরোধের মাদ্যমে নিয়ত পরিবর্তমান। কিন্তু ‘স্থিতিকালের’ তত্ত্ব প্রয়োগ করে বার্গসঁ বলেন যে, সমস্ত সত্তার মূলে যেমন স্থিতিকাল, তেমনি সেই স্থিতিকাল একটা প্রাণবেগে অভিব্যক্ত হচ্ছে। খণ্ডিত সত্তার ক্ষেত্রে যেমন একথা সত্য; চরম বা সমগ্র সত্তা সম্পর্কেও একথা সত্য। চরম সত্তা অভিব্যক্ত হয়ে চলেছে এবং এ অভিব্যক্তির মূলে রয়েছে একটা প্রাণাবেগ বা ‘ভাইটাল ইমপালস’। লতা, বৃক্ষ, জীব-জন্তু, সবকিছু প্রাণাবেগে অভিব্যক্ত হয়ে চলেছে। কেবল প্রাণের প্রশ্ন নয়। সপ্রাণ, অপ্রাণ, বস্তুমাত্রের ক্ষেত্রেই প্রাণাবেগ হচ্ছে অভিব্যক্তির কারণ। ‘প্রানাবেগের’ তত্ত্বের ভিত্তিতে বার্গসঁর বিকাশের অভিমত ক্রিয়েটিভ ইভোল্যুশন বা সৃজনশীল অভিব্যক্তিবাদ বলে পরিচিত।
সামাজিক প্রশ্নে বার্গসঁ ছিলেন রক্ষণশীল। সমাজের আর্থিক বৈষম্য, শ্রেণীগত শোষণ ইত্যাদি অন্যায় নয়। এগুলিও স্থিতিকালের অভিব্যক্তি এবং স্বাভাবিক ব্যাপার।
Berkeley George: জর্জ বার্কলে (১৬৮৫-১৭৫৩ খ্রি.)
খ্রিষ্টান ধর্মযাজক এবং অন্যতম ইংরেজ ভাববাদী। প্রাচীন গ্রিসের শ্রেষ্ঠ ভাববাদী দার্শনিক প্লেটো এবং আধুনিক ভাববাদী দার্শনিক কাণ্টের মধ্যবর্তী দীর্ঘ সময়ে জর্জ বার্কলের ন্যায় শক্তিশালী ভাববাদী দার্শনিক আর দ্বিতীয় কেউ ছিলেন না। ধর্মযাজকদের জেহাদী মনোভাব নিয়ে জর্জ বার্কলে চিন্তার জগতে বস্তুবাদী দর্শনকে নস্যাৎ করার পণ গ্রহণ করেন। মধ্যযুগের ধর্মান্ধতা ছিন্ন করে আধুনিক বিজ্ঞান, দর্শন ও সমাজতত্ত্ব ইংল্যাণ্ডে দৃঢ় পদক্ষেপে অগ্রসর হচ্ছিল। ফান্সিস বেকনের পর্যবেক্ষণমূলক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব এবং জন লকের ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সমর্থনমূলক ভাবধারা ইংল্যাণ্ডের নতুন সমাজ-ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা দুরারোগ্য করে তুলছিল। প্রচলিত ধর্মীয় ভাবধারা বিজ্ঞান, দর্শন এবং সমাজতত্ত্বের এই অগ্রগতিতে অতিশয় বিপন্ন বোধ করেন। ধর্মীয় ভাবধারার এই সঙ্কটকালে যাজক পরিবারের সন্তান জর্জ বার্কলে ধর্মকে রক্ষা করা নিজের কর্তব্য হিসাবে গ্রহণ করেন। জর্জ বার্কলের গ্রন্থসমূহের মধ্যে ‘প্রিন্সিপলস অব হিউম্যান নলেজ’ বা ‘মানবজ্ঞানের সূত্রসমূহ’ নামক গ্রন্থ অতিশয় বিখ্যাত। এই গ্রন্থের মধ্যেই বার্কলের দর্শনের মূলকথা লিপিবদ্ধ। অথচ এ গ্রন্থ ১৭১০ অর্থাৎ বার্কলের মাত্র পঁচিশ বৎসর বয়সে প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থ তাই দার্শনিক কূটতর্কে অংশগ্রহণে এবং নিজের অভিমত উপস্থাপনে তাঁর বিস্ময়কর ক্ষমতার সাক্ষ্য।
জর্জ বার্কলে তাঁর দার্শনিক অভিমত তাঁর পূর্ববর্তী দার্শনিক জন লকের দার্শনিক মতামতের সমালোচনা এবং জবাব হিসাবে উপস্থিত করেন। তাঁর উল্লিখিত গ্রন্থ ১৬৯০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত জন লকের ‘এসে কনসারনিং হিউম্যান আণ্ডারস্ট্যাণ্ডিং’ বা মানববিজ্ঞান সম্পর্কিত নিবন্ধের সরাসরি সমালোচনা।
বস্তুজগৎ এবং বস্তুজগতের জ্ঞান সম্পর্কে জন লকের অভিমত ছিল এরূপঃ বস্তু সম্পর্কে পদার্থবিজ্ঞানের সাক্ষ্য যথার্থ। অণুর সম্মেলনেই বস্তু গঠিত। একটা যান্ত্রিক গতিতে বস্তু গতিময় হয়ে আছে। সেই যান্ত্রিক গতিতে ব্সতু গঠিত। একটা যান্ত্রিক গতিতে বস্তু গতিময় হয়ে আছে। সেই যান্ত্রিক গতিতে বস্তু যখন আমাদের ইন্দ্রিয়কে আঘাত করে তখন সে ইন্দ্রিয় সেই আঘাতজনিত অনুভূতিকে মনের মধ্যে বহন করে। এভঅবেই মনের মদ্যে বিশেষ বিশেষ বস্তু সম্পর্কে ভাবের সৃষ্টি হয়। এভাবেই সমন্বয়েই বস্তুজগৎ সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানভাণ্ডার তৈরি হয়। সুতরাং জ্ঞানের মাধ্যম ভাব এবং ভাবের উৎস অভিজ্ঞতা বা বস্তু। লক অবশ্য অবিমিশ্র বস্তুবাদী অভিমত পোষন করতে পারেন নি। তিনি বস্তু সম্পর্কিত ভাবের শ্রেণীভেদ করে এক প্রকার ভাবকে মৌলিক বা বস্তুসঞ্জাত এবং অপর প্রকার ভাবকে অমৌলিক বা মনসঞ্জাত বলে অভিহিত করেছিলেন। এটা জন লকের দর্শনের দুর্বলতা।
পক্ষান্তরে জর্জ বার্কলে মনে করেন যে, বস্তুকে জ্ঞানের মূল উৎস হিসাবে গ্রহণ করলে ধর্মীয় বিধাতার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়। বস্তুই তা হলে চরম সত্তা হয়ে দাঁড়ায়। তাই তিনি জন লকের উপরোক্ত তত্ত্বকে ধর্মের দিক দিয়ে বিপজ্জনক ঘোষণা করে যুক্তির ক্ষেত্রে গ্রহণের অযোগ্য বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। বার্কলে বললেন লকের তত্ত্ব অনুযায়ী মানুষ জ্ঞানের ক্ষেত্রে মনের ভঅবকে জানে। এ কথা স্বীকার্য; কিন্তু এর অধিক যখন লক বলেন যে, মনের সে ভাব মনের বাইরে মননিরপেক্ষ বস্তুর অস্তিত্বের পরিচায়ক ও প্রতিভূ, তখনি লক হাস্যকর যুক্তির অবতারণা করেন। মন আসলে ভাবের বাইরে আদৌ যেতে পারে না। মন কেবল মনের ভাবকেই জানতে পারে। আমরা যখন টেবিল, চেয়ার, কলম ইত্যাকার কথাগুলি বলি তখন এগুলি দ্বারা আমাদের এক একটি ভাবকে নির্দেশিত করি। ‘টেবিল’ কথাটি একটি টেবিল নামক ‘বস্তু’ নয়। লকের মত অনুযায়ী ‘টেবিল’ কথাটি যদি ‘টেবিল’ বস্তুর প্রতিভূ হয়, তা হলে টেবিলরূপ ভাব এবং টেবিলরূপ বস্তুর মধ্যে একটা ব্যবধান এবং পার্থক্য রয়েছে, তাকে স্বীকার করতে হয়। টেবিল কথা বা ভাব-ই যদি টেবিলরূপ বস্তু না হয়, তাহলে এ ভঅব যে টেবিলরূপ ব্সুতর যথার্থ প্রতিভূ, তার নিশ্চয়তা কোথায়? মনের ভাব ব্যতীত জ্ঞানের কোনো মাধ্যম নেই। আবার মনেরও কোনো ক্ষমতা নেই নিজের ভাবকে অতিক্রম করে বস্তু বা অমনীয় কোনো সত্তাকে স্পর্শ করার। এমন অবস্থায় যাকে আমরা বস্তু বলি যে মনের ভাব ব্যতীত কিছুই নয়। লক যদি একপ্রকার ভাবকে মন নির্ভর বলে থাকেন, তা হলে তাঁর অপর প্রকার ভাবই বা মন নির্ভর হবে না কেন? টেবিল, চেয়ার, কলমের ন্যায় প্রত্যেকটি ভাবই মন-নির্ভর। মন যখন তাদের সম্পর্কে সচেতন হয় তখনি মনের নিকট তারা অস্তিত্বশীল হয় ‘এসসি এট পারসিপি’ –‘আমি তাকে দেখি বা প্রত্যক্ষ করি, আর তাই তার অস্তিত্ব’।
বস্তুবাদের এই খণ্ডন বিজ্ঞান ও বস্তুবাদের বিকাশের সেই যুগে বুদ্ধিজীবী এবং জনসাধারণের নিকট বিশেষ জোরালো বলে মনে হয়েছিল। জন লকের দর্শনের দুর্বলতাই ছিল বার্কলের অভিমতের শক্তির মূল। বার্কলের দর্শনের উপরোক্ত সংক্ষিপ্ত বর্ণনা থেকেই বোঝা যায়, এ দর্শন মনময় দর্শন। শুধু মনময় নয়, এ দর্শন ব্যক্তির মনের মধ্যে আবদ্ধ দর্শন। বার্কলে যখন বলেন, ‘আমি দেখি, তবেই সে থাকে’ তখন ভাবমাত্রই ব্যক্তির চেতনার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। বার্কলে নিজেও তাঁর অভিমতনের এই সঙ্কট সম্পর্কে সচেতন হয়েছিলেন। এ পর্যন্ত তাঁর অভিমত ছিল ‘সলিপসিস্ট’ বা ব্যক্তির মনের ভাবময় দর্শন। বস্তুকে নাকচ করে মনকে চরম বলে স্বীকার করার ফরে বার্কলের দর্শন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, যেখানে মানুষের সমাজ ব্যক্তির মনের বিচ্ছিন্ন স্বাধীন চিন্তার পরস্পর সংযোগহীন একটা অরাজক অবস্থা ছাড়া আর কিছু নয়। এখানে ধর্মীয় বিধাতার কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না এবং যেটাকে আমি টেবিল বলে ভাবছি সেটাকে আর দশটি মনও যে কেন টেবিল বলে ভাবছে তারও হদিস মেলে না। তাঁর দর্শনকে এই সঙ্কট থেকে মনও যে কেন টেবিল বলে ভাবছে তারও হদিস মেলে না। তাঁর দর্শনকে এই সঙ্কট থেকে বাঁচাবার জন্য বার্কলে আর দুটি সূত্রের অবতারণা করেন। ১. ব্যক্তিক মনের বাইরে এক স্বাধীণ চরম মনের অস্তিত্ব আছে। সেই চরম মন হচ্ছে ধর্মীয় বিধাতা; ২. বিধাতার মনে সমস্ত ভাবই সুপ্ত অবস্থায় বিদ্যমান রয়েছে। বিধাতার ইচ্ছায় তাঁর সুপ্ত ভাব ব্যক্তিমনের সক্রিয় ভাবরূপে প্রকাশিত হয়। বিধাতার মধ্যে সব ভান বিদ্যমান বলে আমরা যখন টেবিল বা চেয়ার বা কলম সম্পর্কে অচেতন থাকি, তখনও টেবিল, চেয়ার কলম অস্তিত্বহীন হয়ে যায় না। বিধাতার মনে তাদের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকে; আবার বিধাতার কারণেই এক টেবিলরূপ ভাব সকলের মনেই জাগ্রত হয়; এক ভাব ভিন্নরূপে ভিন্ন ভিন্ন মনে জাগ্রত হতে পারে না। বার্কলে এরূপে তার অভিমতের ব্যাখ্যা করে মনে করেন যে, লকের বস্তুকে তিনি অস্তিত্বহীন প্রমাণ করে ভাব এবং বিধাতার অস্তিত্বকে অখণ্ডনীয় করতে সক্ষম হয়েছেন।
এই দর্শনের অনুসিদ্ধান্ত হিসাবে বার্কলে তাঁর যুগের বৈজ্ঞানিক আবিস্কারাদির সত্যকে অস্বীকার করেন এবং বিজ্ঞানের বিকাশে বাধাদানের চেষ্টা করেন। তিনি বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বলেন যে, বিজ্ঞানের কাজ হবে জগতের মূলে যে স্রষ্টা রয়েছে তার প্রকাশ বোঝার চেষ্টা করা; জাগতিক কার্যকারণ সম্পর্ক দ্বারা প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করা নয়। নিউটনের মহাশূন্য এবং মাধ্যাকর্ষণের তত্ত্বকে তিনি ভিত্তিহীন বলে মনে করেন।
সহজবোধ্য উদাহরণ দ্বারা বার্কলে তাঁর ভাববাদকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করেছিলেন। ঊনবিংশ শতকের ‘ইমানেন্স’, ‘প্রাগমেটিজম’, ‘এমপিরিও ক্রিটিসিজম’ প্রভৃতি বিভিন্ন ভাববাদী উপধারার মধ্যে জর্জ বার্কলের মনময় দর্শনের প্রভাব লক্ষ করা যায়। মার্কসবাদী দার্শনিক ভি. আই. লেনিন তাঁর ‘এমপিরিও ক্রিটিসিজম’ গ্রন্থে বার্কলে দর্শন এবং তার আধুনিক পুনঃপ্রকাশের বিশ্লেষণ ও সমালোচনা করেন।
Berlin wall: বার্লিন প্রাচীর
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে প্রাচ্য তথা রাশিয়া এবং পাশ্চাত্য বা ইংল্যাণ্ড এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইংল্যাণ্ডের উদ্যোগে বার্লিন শহরকে দুই ভাগে বিভক্ত করে পূর্বকে পূর্ব বার্লিন আর পশ্চিম অংশকে পশ্চিম বার্লিন বলা হয়। দুই বার্লিনের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে ১৯৮৯ সনে পাশ্চাত্য শক্তির আঘাতে বার্লিন দেয়ালের পতন ঘটে।
Bernstein, Eduard: এডওয়ার্ড বার্নস্টাইন (১৮৫০-১৯৩২ খ্রি.)
জার্মান সোস্যালডিমোক্রাট। মার্কসবাদীগণ বার্নস্টাইনকে বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলনের বিরোধী ব্যক্তি এবং সংশোধনবাদের প্রতিষ্ঠাতা বলে গণ্য করেন। বার্নস্টাইন মার্কসবাদের মূল দর্শন, অর্থনীতি এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রকে নিজস্ব ব্যাখ্যা দ্বারা সংশোধন করার চেষ্টা করেন। বিপ্লবী সমাজতন্ত্রের বদলে বার্নস্টাইন বিবর্তনবাদী সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব উপস্থিত করেন। তাঁর ‘ইভোল্যুশনারী সোস্যালিজম’ বা ‘বিবর্তনবাদী সমাজতন্ত্র’ নামক গ্রন্থে বার্নস্টাইন এরূপ অভিমত প্রকাশ করেন যে ১. মার্কস পুঁজিবাদের আসন্ন পতনের যে কথা বলেছিলেন তা বাস্তবে সত্য বলে প্রমাণিত হয় নি; ২. মার্কস শ্রেণীবিরোধকে যেভাবে আপসহীন বিবেচনা করেছেন এবং পুঁজিপতি এবং সর্বহারার দুই প্রান্তে সমাজকে বিভক্ত করেছেন, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অব্যাহত অস্তিত্ব তাকে ভুল প্রমাণিত করেছে; ৩. পুঁজিবাদের চরিত্রে পরিবর্তন সংঘটিত হচ্ছে। সমাজসংস্কারের আন্দোলনের ফলে পুঁজিবাদের শোষণমূলক চরিত্রের অনেক পরির্তন সংঘটিত হচ্ছে; ৪. চরম সংঘর্ষের বদলে ধীরে এবং ক্রমান্বয়ে সামাজিক সংস্কারের লক্ষ্য দ্বারা শ্রমিকশ্রেণী অধিকতর স্থায়ী ফল লাভ করতে পারে। বার্নস্টাইনের কাছে হেগেলের দ্বন্দ্ব এবং মার্কসের দ্বন্দ্বের মধ্যে কোনো পার্থক্য নাই। মার্কসবাদের ‘সর্বহারার একনায়কত্বে’র তত্ত্বকে তিনি অস্বীকার করেন। তাঁর মতে শ্রেণীসংগ্রাম ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে একটি সমন্বিত সমাজব্যবস্থা রূপ লাভ করবে। সমাজতন্ত্রের কোনো চরম লক্ষ্য থাকার প্রয়োজনকেও বার্নস্টাইন অস্বীকার করেন। শ্রমিকশ্রেণীর লক্ষ্য হবে সমাজের সংস্কারসাধন, বিপ্লব সংঘটিত করা নয়। “চরম লক্ষ্যের কোনো মূল্য নাই। সংস্কারের চেষ্টা বা আন্দোলনই আসল বিষয়”। রাশিয়ার শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে মেনশেভিক এবং অর্থনীতিবাদী বা ইকনমিস্টদের বার্নস্টাইনের অনুসারী মনে করা হয়। প্লেখানভ এবং লেনিন তীব্রভাবে বার্নস্টাইনের সমালোচনা করেন।