Bhutbada: ভূততত্ত্ব, প্রকৃতিতত্ত্ব
ভারতীয় দর্শনের পাশ্চাত্য ভাষ্যকারগণের কেহ কেহ প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের লোকায়ত মতকে ভূতবাদ বলে আখ্যায়িত করেন। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতককে এই মতের উৎপত্তিকাল বলে অনুমান করা হয়।
‘ভূতবাদ’ আখ্যা দ্বারা জগৎ ও সৃষ্টি সম্পর্কে প্রাচীন ভারতীয় দর্শনকে সংক্ষেপে চিহ্নিত করা চলে। প্রাচীন গ্রিক দর্শনের ন্যায় প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের বৈশিষ্ট্য ছিল প্রধানত জাগতিক। জীবন ও বস্তু জগতের মূলে কি আছে, এ প্রশ্নের জবাবে প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের লোকায়ত শাখা এরূপ মনে করত যে, জীবন ও জগৎ হচ্ছে ‘পঞ্চ ভূতাত্ত্বক’। প্রাচীন চিন্তাবিদগণ এই পঞ্চভূতকে যথাক্রমে ক্ষিতি (পৃথিবী) অপ (পানি), তেজ (অগ্নি), মরুৎ (বায়ু) এবং ব্যোম (আকাশ) বলে অভিহিত করতেন। পঞ্চভূত বা পঞ্চমূলের আবির্ভাব সম্পর্কে বিভিন্ন প্রকার মত ছিল। বেদান্ত দর্শনের মতে প্রথমে আকাশ থেকে অগ্নি, অগ্নি থেকে পানি এবং পানি থেকে পৃথিবী, এভাবে পঞ্চভূতের আবির্ভাব হয়। এই পঞ্চভূতই হচ্ছে সমস্ত সৃষ্টির মূল উপাদান। সৃষ্টির মধ্যে যত প্রকার বা ভেদ সবই এই মৌলিক উপাদান-সমূহের বিভিন্ন প্রকার সম্মেলনের ফল। এমনকি মন বা চেতনাও সমস্ত উপাদানের একটি বিশেষ ধরনের সম্মেলনের ফলে উদ্ভূত হয়েছে। কিন্তু ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম এই পঞ্চভূতের বিশেষ এবং জটিল সম্মেলনে সৃষ্ট চেতনার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, চেতনা অপর কোনো পদার্থে চেতনা সৃষ্টি করতে না পারলেও মূল পদার্থের মিলন প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে বিভিন্ন নতুন পদার্থ সৃষ্টিতে সে সক্ষম।
ভূততত্ত্বের চেয়ে ভারতীয় দর্শনের বস্তুবাদী ধারা চার্বাক দর্শন নামে অধিকতর পরিচিত। উল্লিখিত পঞ্চভূতের মধ্যে ব্যোম বা আকাশ ছাড়া অপর চারটি পদার্থের স্বীকৃতি প্রচীনতম চার্বাক দর্শনে পাওয়া যায়। সৃষ্টি ব্যতীত জ্ঞানের ক্ষেত্রেও লোকায়ত বা চার্বাক দর্শনের অভিমত ছিল বস্তুবাদী। চার্বাক দর্শন ইন্দ্রিয়-বহির্ভূত জ্ঞানকে অলীক বলে মনে করত। এ কারণে পরোক্ষ বা অনুমানসিদ্ধ জ্ঞান তাদের কাছে যথার্থ বলে স্বীকৃত হয় নি। ধর্মের অলৌকিক শক্তি বা বিধাতার অস্তিত্ব অনুমানের উপর নির্ভরশীল। এ জন্য চার্বাকরা অজ্ঞেয় বিধাতার অস্তিত্ব এবং আত্মার পুনর্জন্মকেও অস্বীকার করেছে।
Binet, Alfred: আলফ্রেড বাইনেট (১৮৫৭-১৯১১ খ্রি.)
ফরাসি পরীক্ষামূলক মনোবিজ্ঞানী। ফরাসি দেশে ১৮৯৫ সনে আলফ্রেড বাইনেট প্রথম ফরাসি মনোবিজ্ঞানের পত্রিকার প্রতিষ্ঠা করেন। মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁর সহকর্মী সাইমনের সঙ্গে যুক্তভাবে বাইনেট শিশুর বুদ্ধি পরিমাপের একটি পদ্ধতি আবিস্কার করেন। এ কারণেই প্রধানত আলফ্রেড বাইনেট খ্যাতি অর্জন করেন। উক্ত পদ্ধতি মনোবিজ্ঞান বাইনেট পরিমাপক বা বাইনেট-সাইমন পরিমাপক নামে পরিচিত। সাধারণ মনোবিদ্যায় এ পর্যন্ত ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বুদ্ধিগত পার্থক্য এবং তার কারণের বিষয় আলোচিত হয় নি। কেবল অন্তর্দৃষ্টি বা ইনট্রোসপেকশানের মারফত এ পার্থক্যের কারণ স্থির করার উপায় ছিল না। আধুনিক শিল্প-বিপ্লবের পূর্বে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে পার্থক্যের বিষয়টি সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে এত তাৎপর্যপূর্ণ হয়েও দেখা দেয় নি। কিন্তু শিল্প-বিপ্লব একদিকে যেমন অসংখ্য মানুষকে অর্থনৈতিক জীবনের এক একটি কেন্দ্রে কেন্দ্রীভূত করতে শুরু করল, তেমনি উৎপাদনের ক্ষেত্রে শ্রমের বিভাগ এক এক ব্যক্তির উপর উৎপাদনের প্রত্যন্ত অংশের দায়িত্ব ন্যস্ত করল। ফলে উৎপাদনের কোনো সমগ্র প্রক্রিয়ার পরিবর্তে এক একটি বিশেষ দিকে দক্ষতা অর্জন ব্যক্তির জন্য অধিকতর প্রয়োজনীয় হয়ে উঠল। সামাজিক এই পরিবশে আলফ্রেড বাইনেটের দৃষ্টি ক্রমান্বয়ে সাধারণ মনোবিদ্যা থেকে পরীক্ষামূলক মনোবিজ্ঞানের বিকাশে নিবদ্ধ হয়। একই পরিবারের পাঁচটি শিশু একই রকম বুদ্ধির পরচয় দেয় না। কি কারণে একই পরিবেশে একটি শিশু যে কাজ যেরূপ দক্ষতার সঙ্গে করতে পারে, অপর শিশু তা পারে না? এই কারণ অনুসদ্ধানেই বাইনেট তাঁর মনোবিজ্ঞানের গবেষণা নিবদ্ধ করেন। নিজের দুটি কন্যার বুদ্ধিগত পার্থক্যই তাঁর প্রথম পরীক্ষার বিষয় হয়। পরে তিনি অপ্রাপ্ত বুদ্ধির শিশুদের শিক্ষায়তনে দল হিসাবে তাঁর তত্ত্বের পরীক্ষা করেন। বাইনেটের প্রধান প্রতিপাদ্য ছিল এই যে, বুদ্ধির কোনো একক আছে। দেহের যেমন বয়স বৃদ্ধি ঘটে, তেমনি জন্ম থেকে শিশুর বুদ্ধিরও বৃদ্ধি ঘটে। কিন্তু দেহে বয়সের বৃদ্ধির সঙ্গে সমতা রেখে শিশুর বয়স বৃদ্ধি না পেতে পারে এবং কোনো স্থানে এসে তার বুদ্ধির বয়স বৃদ্ধির প্রক্রিয়া স্তব্ধ হয়েও যেতে পারে।
এই প্রতিপাদ্য প্রমাণের জন্য বাইনেট বিভিন্ন বয়সের শিশুদের জন্য ত্রিশ রকম পরীক্ষা উদ্ভাবন করেন। মৌখিক বা অ-মৌখিক ক্রিয়াগত এই পরীক্ষাগুলিকে বাইনেট খুব সহজ করার চেষ্টা করেন। তাঁর মতে এই পরীক্ষাগুলির মাধ্যমে আমরা যে-কোনো শিশুর বুদ্ধির পর্যায় স্থির করতে পারি। পরীক্ষাগুলির ফলাফলের গড়ের ভিত্তিতে শিশুর বুদ্ধির একক বার করা সম্ভব। এই একক বা নির্দেশককে ইংরেজিতে ‘ইনটেলিজেন্স কুশেণ্ট’ বলা হয় এবং সংক্ষেপে ‘আই. কিউ’ অক্ষরদ্বয় দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। বাইনেটের পদ্ধতি ক্রমান্বয়ে কেবল শিশু নয়, যে-কোনো বয়সের ব্যক্তির বুদ্ধি পরিমাপের ক্ষেত্রে প্রযুক্তি হতে থাকে। ব্যক্তির বুদ্ধি পরিমাপের জন্য বাইনেট এরূপ স্থির করেন কোনো শিশু বা ব্যক্তির দেহের বয়ঃক্রমের সংখ্যাকে তার বুদ্ধির বয়সের ক্রম সংখ্যা দ্বারা ভাগ করে উক্ত ফলকে ১০০ দ্বারা গুণ করলে ব্যক্তির বুদ্ধির মান বা ‘আই. কিউ’ বার করা সম্ভব হবে। বাইনেট প্রবর্তিত পদ্ধতি হুবহু ব্যবহার করা না হলেও তাঁর পরীক্ষামূলক মনোজ্ঞানের নীতি মনোবিদ্যাকে প্রভূত পরিমাণে উন্নত করেছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন সমস্যার ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি উপযুক্ত হবে এবং কোন ব্যক্তি উপযুক্ত হবে না, তা নির্ধারণের জন্য বাইনেটের পরীক্ষার নীতি ও পদ্ধতি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির বুদ্ধিগত পার্থক্য নিরূপণকে বাইনেট তাঁর মনোবিজ্ঞানের প্রধান লক্ষ্য হিসাবে স্থির করায় তাঁর অভিমতকে ডিফারেনশিয়াল সাইকোলজি বা ভেদাত্মক মনোবিজ্ঞান বলেও আখ্যায়িত করা হয়।
Biology: জীববিদ্যা, জীববিজ্ঞান
জীববিদ্যা বা জীববিজ্ঞান বলতে জীবনের বিকাশের নিয়ম এবং জীবনের প্রকারভেদ নিয়ে আলোচনা এবং গবেষণা বুঝায়। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকদের চিন্তাধারায় জীবনের বিকাশগত সমস্যার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এ নিয়ে তাঁরা চিন্তা করেছেন। কিন্তু স্বাধীন, সুসংবদ্ধ এবং পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষাভিত্তিক বিজ্ঞান হিসাবে এর উদ্ভব আধুনিককালেই মাত্র ঘটেছে। ফরাসি প্রকৃতিতত্ত্ববিদ লামার্ক (১৭৪৪-১৮২৯ খ্রি.) তাঁর আলেচনায় প্রথম ‘জীববিদ্যা’ কথা ব্যবহার করেন।
জ্ঞানের ক্ষেত্রে জীববিজ্ঞানের পরিধি বিশেষ ব্যাপক। বস্তুত বর্তমানে জীববিজ্ঞান বলতে পদার্থবিজ্ঞানের ন্যায় একটিমাত্র বিজ্ঞানকে বুঝায় না। জ্ঞানের একটি দিক হিসাবে জীববিদ্যাকে দেখা হয়। যে-কোনো প্রাণীর মধ্যে জীবনের যে বিকাশ ঘটেছে তার বৈজ্ঞানিক আলোচনাই জীববিজ্ঞানের পরিধির অন্তর্ভুক্ত। এজন্য এই বৃহৎ পরিধির মধ্যে একাধিক জীবনবিষয়ক বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটেছে। জীববিজ্ঞানের মধ্যে জুলজি বা প্রাণিবিজ্হান, বোটানি বা উদ্ভিদবিজ্ঞান, এমব্রিওলজি বা ভ্রূণবিজ্ঞান, পেলিওনটলজি বা প্রত্নজীববিজ্ঞান, মাইক্রোবাইওলজি বা জীবাণুবিজ্ঞান, জেনিটিক্স বা বংশতত্ত্ব এবং ফিজিওলজি বা দেহতত্ত্বকে অন্তর্ভুক্ত মনে করা হয়।
জীবনের পর্যবেক্ষণমূলক আলোচনা ঊনবিংশ শতকেই শুরু হয়। এই শতকের মধ্যভাগে জীবন সম্পর্কে চার্লস ডারউইনের পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা জীববিদ্যায় একটি বিপ্লব সাধন করে। ইতোপূর্বে জীবন এবং তার বিকাশ কেবল দার্শনিক তত্ত্বকথার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তখন পর্যন্ত মানুষের সাধারণ এবং ব্যাপক ধারণা ছিল যে, জীবনের শুরু থেকে মানুষ বর্তমান আকারেই ছিল। মানুষজাতি বর্তমান অবয়বে জীবনের শুরুতেই সৃষ্ট হয়েছে। ডারইউনের ক্রমবিবর্তনবাদ এবং সজীবদেহের মূল হিসাব সংখ্যাহীন জীবকোষের আবিস্কার জীবন সম্পর্কে পুরাতন বদ্ধমূল ধারণাকে আমূল পাল্টে দেয়। জীবনের বিকাশের মূল কারণকেও ডারউইন উদঘাটিত করেন। এর ফলে পূর্বকার টেলিওলজিক্যাল বা উদ্দেশ্য প্রণোদিত বিকাশবাদের তত্ত্বও নস্যাৎ হয়ে যায়।
দার্শনিক তত্ত্ব যেমন বহুকাল দর্শনের পরিধির মধ্যে রেখে জীববিদ্যাকে প্রভাবিত করেছে, অপরদিকে জীববিদ্যার আধুনিক বিকাশ দর্শনকেও প্রভূত পরিমাপে প্রভাবান্বিত করেছে। বর্তমান জীবন সম্পর্কে দার্শনিক আলোচনা জীববিজ্ঞানের সিদ্ধান্তের স্বীকৃতির ভিত্তিতেই করা হয়। এ ছাড়া জীববিদ্যার বিকাশ দর্শনের জন্য আলোচনার নতুনতর সমস্যাও সৃষ্টি করেছে। এ সমস্ত সমস্যার মধ্যে জীবদেহের সামগ্রিকতার সঙ্গে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবহারগত সম্পর্কের সমস্যাটি অন্যতম। জীববিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত হচ্ছে যে, একটি জীবনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে যে একটি পূর্ণ সত্তা বা ‘হোল’ তৈরি করে, সেই সত্তার বাইরে এই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অনুরূপ ব্যবহার সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। ইংরেজিতে এই সমস্যাকে ‘Wholism’-এর সমস্যা বলে আখ্যায়িত করা হয়।
Blanqui, Luis: লুই ব্লাঙ্কুই (১৮৫০-১৮৮১ খ্রি.)
ফরাসিদেশের কাল্পনিক সাম্যবাদী। ১৮৩০ এবং ১৮৪৮ এর বিপ্লবী অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেন এবং দু’বার মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। জীবনের প্রায় অর্ধভাগ তাঁর কারাগারে অথিবাহিত হয়। ব্লাঙ্কুইর উপর প্রভাব পড়েছিল অষ্টাদশ শতকের বস্তুবাদ, নিরীশ্বরবাদ, কাল্পনিক সমাজবাদ এবং বিশেষ করে বাব্যুফবাদের। তাঁর মনোভাব ছিল বিপ্লবী। কিন্তু বিপ্লব সাধনের জন্য গণআন্দোলন এবং বিপ্লবী দল গঠনের তাৎপর্য তিনি উপলব্ধি করেন নি। এ কারণে তাঁর বিপ্লবী প্রচেষ্টা অনেক ক্ষেত্রে ষড়যন্ত্রমূলক আঘাতে পর্যবসিত হয়েছিল।
Bodin, Jean: বোদিন বা জাঁবোদা (১৫৩০-১৫৯৬ খ্রি.)
ষোড়শ শতাব্দীর বিখ্যাত ফরাসি রাষ্ট্রচিন্তাবিদ। তাঁর রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের তত্ত্ব বিশেষ আলোচিত তত্ত্ব। ষোড়শ শতাব্দীতে ফরাসিদেশ যখন শক্তিসঞ্চার করতে থাকে, এবং একটি কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা বিকাশলাভ করে, বোদিনের সার্বভৌমিক তত্ত্ব তখন রাজার একচ্ছত্র শাসনের অধিকারকে জোরদার করে। বোদিন রাষ্ট্রের উৎপত্তির প্রশ্নে পরিবারকে মূল বলে গণ্য করেন। আদিতে পরিবারসমূহের গোষ্ঠীবদ্ধতার সমাজ বিভক্ত ছিল। পারিবারিক গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহের মাধ্যমে শক্তিশালী গোষ্ঠীর জয়লাভ এবং দুর্বল গোষ্ঠীসমূহের পরাজয় এবং বশ্যতা স্বীকারের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছে বলে বোদিন অভিমত পোষণ করেন। বোদিনের মতে রাষ্ট্রের শাসকই হচ্ছে সার্বভৌম। ঈশ্বরের বিধান এবং প্রাকৃতিক ও সামাজিক নৈতিক বিধানের বাইরে রাষ্ট্রের গানরিকদের উপর শাসকের শাসনের সার্বভৌমত্বের অপর কোনো সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে না। এই যুক্তিতে বোদিন রাজতন্ত্রকে সরকারের সর্বোত্তম প্রকার বলে বিবেচনা করেন। কারণ সার্বভৌম রাজাই নাগরিকদের জীবনে শান্তি এবং শৃঙ্খলার নিশ্চয়তা দান করতে পারে। তাঁর মতে রাষ্ট্রের তাত্ত্বিক সার্বভৌমত্ব বাস্তবে শাসক রাজার মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়। তা সত্ত্বেও বোদিন আবার রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব এবং শাসক রাজা বা রাষ্ট্রের সরকারকে অভিন্ন বিবেচনা করেন নি। সার্বভৌমত্ব যুক্তিগতভাবে অবশ্যই রাষ্ট্রের। কিন্তু বাস্তবে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রকাশ ও প্রয়োগ ঘটে যে ব্যবস্থার মাধ্যমে তা হচ্ছে সরকার। কাজেই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রাজতান্ত্রিক, অভিজাততান্ত্রিক কিংবা গণতান্ত্রিক বিভিন্ন প্রকার সরকারের মাধ্যমেই প্রকাশিত হতে পারে।
Border-Line Situation: প্রান্তিক পরিস্থিতি
জাসপারস-এর অস্তিত্ববাদী তত্ত্বের একটি নীতি। জাসপারস-এর মতে ভীতি, অপরাধ, দ্বন্দ্ব, অসন্তোষ, মৃত্যু ইত্যাদি হচ্ছে মানুষের জন্য প্রান্তিক পরিস্থিতি। এগুলি মানুষের আত্মিক অভিজ্ঞতার সীমাকে চিহ্নিত করে। এরা হচ্ছে অস্তিত্বের প্রান্ত। এই প্রান্তকে অতিক্রম করে অনস্তিত্বের সূচনা। জাসপারস-এর মতে প্রান্তিক পরিস্থিতি মানুষ মাত্রের জন্য অমোঘ এবং অনিবার্য। পান্তিক পরিস্থিতি অতিক্রম করার অর্থই হচ্ছে, মানুষের অস্তিত্ব থেকে অনস্তিত্বে উৎক্রমণ। মানুষে যথার্থভাবে ন্যায়, অন্যায়, ভালো, মন্দ, সৎ-অসৎ-এর বিসংবাদের মীমাংসা করে নীতিগত সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত কেবলমাত্র এই প্রান্তিক পরিস্থিতির অনিবার্যতা উপলব্ধির মাধ্যমেই গ্রহণ করতে পারে।
Bradley, F.H. : ব্রাডলে (১৮৪৬-১৯২৪ খ্রি)
ঊনবিংশ, বিংশ শতকের ব্রিটিশ ভাববাদী দার্শনিক। ব্রাডলের ‘এ্যাপিয়ারেন্স এ্যাণ্ড রিয়ালিটি’ বা ‘প্রকার ও সত্তা’ একখানি বিখ্যাত দার্শনিক গ্রন্থ। রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রেও ব্রাডলে একজন উল্লেখযোগ্য চিন্তাবিদ। উল্লিখিত কালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপক, যেমন কেয়ারড (১৮৩৫-১৯০৮), টমাস হিল গ্রিন (১৮৩৬-১৮৮২), বারনার্ড বোসানকোয়েট (১৮৪৮-১৯২৩) এঁরা ‘অক্সফোর্ড ভাববাদী’ বলে পরিচিত হন। ইতোপূর্বে ইংল্যাণ্ডে শিল্প বিপ্লবের ফলশ্রুতিতে এবং রাজতন্ত্রের একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে ব্যক্তি স্বাধীণতার আন্দোলনের মাধ্যমে যে চরম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বিকাশ ঘটেছিল অক্সফোর্ড ভাববাদীদের মধ্যে তার একটা প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের প্রাধান্যের কালে যেখানে ব্যক্তির জীবনে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপকে মূলতই অবাঞ্ছিত বলে গণ্য করা হয়, সেখানে এই ব্রাডলে এবং উল্লিখিত চিন্তাবিদগণ ব্যক্তির জীবনে রাষ্ট্রের কল্যাণমূলক হস্তক্ষেপের যে প্রয়োজন রয়েছে, তার উল্লেখ করেন। এঁদের মতে মানুষ যেমন একটি নৈতিক প্রাণী এবং তার কার্যের মূল বিচার তার নীতি বা লক্ষ্যের ভিত্তিতে, রাষ্ট্রের বিচারও তার লক্ষ্যের ভিত্তিতে। রাষ্ট্রের লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের নৈতিক উন্নতি সাধন। এ লক্ষ্যে ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রকে পরস্পরবিরোধী শক্তি হিসাবে বিবেচনা করা অযৌক্তিক। ব্যক্তিকে নিয়ে যেমন রাষ্ট্র এবং ব্যক্তির উন্নতিতেই রাষ্ট্রের উন্নতি, তেমনি রাষ্ট্র বা সমাজের বাইরেও ব্যক্তির কোনো অস্তিত্ব থাকতে পারে না। ব্রাডলে এই দৃষ্টিভঙ্গির উপর জোর প্রদান করে তার ‘এথিক্যাল স্টাডিস’ গ্রন্থে বলেন যে, নৈতিক প্রাণী হিসাবে পরিবার এবং সমাজের বাইরে ‘ব্যক্তি’ হিসাবে ব্যক্তির কোনো অস্তিত্ব নাই। পিতামাতার কাছ থেকে প্রাপ্ত দৈহিক এবং মানসিক গুণাবলী যেমন ব্যক্তির অস্তিত্বের মৌল উপাদান তেমনি যে সমাজে সে বর্দ্ধিত হয় এবং জীবন ধারণ করে সেই সমাজের ভাসা, আচার-আচরণ, সংস্কার, বিশ্বাস এবং প্রতিষ্ঠানই তার সামাজিক অস্তিত্বকে তৈরি করে। কাজেই ব্যক্তি বনাম সমাজ বা রাষ্ট্র, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের এমন চরম চিন্তার কোনো বাস্তব ভিত্তি থাকতে পারে না। অক্সফোর্ড ভাববাদী বলে কথিত চিন্তাবিদদের এই সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাচীন গ্রিক চিন্তাবিদ এ্যারিস্টটলের রাজনৈতিক চিন্তার বেশ কিছুটা পুনঃপ্রকাশ লক্ষ্য করা যায়।
Brahe, Tycho: টাইকো ব্রাহে (১৫৪৬-১৬০১ খ্রি.)
জ্যোতির্বিজ্ঞানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ডেনমার্কের একটি অভিজাত পরিবারে জন্ম। কোপেন হেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন অধ্যয়ন শুরু করলে ১৫৬০ সনে ২১ আগস্ট সূর্যের পূর্ণগ্রহণের দৃশ্য টাইকো ব্রাহেকে জ্যোতির্মণ্ডলের পর্যবেক্ষণ ও গবেষণায় আকৃষ্ট করে। এতদিন পর্যন্ত যেখানে অন্তরীক্ষের তারকামণ্ডলীকে এ্যারিস্টটলীয় তত্ত্ব অনুযায়ী অপরিবর্তনীয় মনে করা হত সেখানে টাইকো ব্রাহে তারকামণ্ডলীর পরিবর্তনকে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করে এ্যারিস্টটলীয় তত্ত্বকে ভুল প্রমাণিত করেণ। টাইকো ব্রাহের জ্যাতির্বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণ ও গবেষণায় তাঁর মৃত্যুর কিছুকাল পূর্বে কেপলারের আবিস্কারের মূলে টাইকোর পর্যবেক্ষণ ও পরামর্শের বূমিকা বৈজ্ঞানিকগণ দ্বারা আজ স্বীকৃত।
Bruno, Giordano: গিওর্দানো ব্রুনো (১৫৪৮-১৬০০ খ্রি.)
ইউরোপীয় পুনর্জাগরণ যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ। গিওর্দানো ব্রুনো কেবল দার্শনিক ছিলেন না। তিনি ইতালির বিখ্যাত কবি এবং নাট্যকার বলেও পরিচিত। স্বাধীন প্রবক্তা ব্রুনো খ্রিষ্টধর্মের ডমিনিকান মত পরিত্যাগ করায় গোঁড়া সাধক সম্প্রদায় তাঁকে ইনকুইজিশন বা ধর্মীয় আদালতে বিচার করে প্রথমে কারাগারে নিক্ষেপ করে। দীর্ঘ আট বছর কারাগারে নির্মম নির্যাতনের পরে ব্রুনোকে রোম শহরে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।
গিওর্দানো ব্রুনো মধ্যযুগের ধর্মতত্ত্বের বিরোধী ছিলেন। তিনি রোমান ক্যাথলিক মতকে সমালোচনা করেন। জীবন এবং জগৎ সম্পর্কে তাঁর অভিমত ছিল বিস্ময়কররূপে বস্তুবাদী। এই বস্তুবাদী বিশ্বদৃষ্টি তিনি প্রাচীন গ্রিসের বস্তুবাদী দার্শনিকদের নিকট থেকেই প্রধানত লাভ করেন। তাঁর বস্তুবাদ প্যানথিজম বা সর্বপ্রাণবাদ বলে আখ্যায়িত হয়। ব্রুনো বিশ্বাস করতেন, একটা বিশ্বপ্রাণের অস্তিত্ব আছে। এই প্রাণ সর্ববস্তুতেই প্রকাশমান। ব্রুনোর মতে প্রকৃতি বা জগৎ হচ্ছে অসীম। তিনি পৃথিবী সম্পর্কে কপারনিকাসের তত্ত্বকে স্বীকার করেন। কিন্তু ব্রুনোর অভিমতে আমরা কেবলমাত্র কপারনিকাসের তত্ত্বের স্বীকৃতি পাইনে, তাঁর অভিমতে কপারনিকাসের তত্ত্বের অধিকতর বৈজ্ঞানিক বিকাশও লক্ষ করা যায়। কারণ কপারনিকাস যেখানে সূর্যকে স্থির এবং সৌরমণ্ডলকে একমাত্র মণ্ডল বলে মনে করতেন, সেখানে গিওর্দানো ব্রুনো এরূপ অভিমত প্রকাশ করেন যে, সূর্য স্থির নয় এবং সৌরমণ্ডল একমাত্র সৃষ্টিমণ্ডল নয়। তাঁর মতে মহাজগতে অসংখ্য জগতের অস্তিত্ব রয়েছে এবং সৌরমণ্ডল একমাত্র সৃষ্টিমণ্ডল নয়। তাঁর মতে মহাজগতে অসংখ্য জগতের অস্তিত্ব রয়েছে এবং পৃথিবী ছাড়া অপর জগতেও জীবন থাকা সম্ভব। ব্রুনোর পূর্বে পৃথিবী গ্রহের গঠন সম্পর্কে কোনো সুসমঞ্জস ধারণা ছিল না। ব্রুনোই বলেন যে, পৃথিবরি সর্বাঞ্চলের গঠনের মধ্যেই মাটি, পানি, বাতাস, তেজ এবং ইথারের ক্ষেত্রে সাদৃশ্য আছে। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকের ন্যায় ব্রুনোও বস্তুকে গতিময় মনে করতেন। মানুষের চেতনাও বস্তু বা প্রকৃতিরই ভেদ। এ সমস্ত অভিমত ছাড়া সমগ্র প্রকৃতির গতি, মহাজগতের ঐক্য এবং অস্তিত্বের পারস্পরিক নির্ভরতা প্রভৃতি প্রশ্নেও ব্রুনোর চিন্তা ছিল বৈজ্ঞানিক।
Buddhism: বৌদ্ধবাদ
প্রাচীন ধর্মসমূহের অন্যতম ধর্ম হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্ম। অভিজ্ঞানপ্রাপ্ত সিদ্ধার্থ বা বুদ্ধ এই ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। বুদ্ধের জীবনকাল ছিল ৫৬৩-৪৮৩ খ্রি. পূ.। প্রাচীন ভারতে হিন্দু বা ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রতিপত্তি ছিল। বুদ্ধের অভিমত এই প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহস্বরূপ। এ কারণে হিন্দুধর্ম এবং হিন্দু সম্রাটগণ বুদ্ধের ধর্মের প্রচারকে রুদ্ধ করে দেবার চেষ্টা করেন। বুদ্ধের অনুসারীদের উপর নানাপ্রকার অত্যাচার ও নির্যাতন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ব্রাহ্মণ্যধর্মের গোঁড়ামি, আচার-অনুষ্ঠান, ব্যাপক পশুবলি এবং অনমনীয় বর্ণপ্রথার বিরুদ্ধে জনমতের প্রতিধ্বনিস্বরূপ ছিল বলে বৌদ্ধধর্ম দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। শুধু ভারতে নয় –ভারতের বাইরে সিংহল, নেপাল, বার্মা, চীন এবং জাপানে বৌদ্ধ ধর্ম প্রসারিত হয়। প্রথমে বিরোধাত্মক সম্পর্ক থাকলেও কালক্রমে ব্যাপক হিন্দুধর্ম বুদ্ধকে তার অন্যান্য অবতারের সঙ্গে নবম অবতার বলে স্বীকৃতিদান করে।
বাংলাদেশের একজন প্রাচীন বৌদ্ধ কবি রামচন্দ্র বুদ্ধকে লক্ষ্য করে যে উক্তি করেন, তাতে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম এবং বৌদ্ধ ধর্মের বিরোধের ভাবটি সুন্দররূপে প্রকাশ পেয়েছে। উক্ত কবির মতে “ব্রহ্মা অবিদ্যা দ্বারা অভিভূত; বিষ্ণু মহামায়ার আলিঙ্গন বিমুগ্ধ; শঙ্কর আশক্তিবশত পার্বতীকে নিজ দেহে ধারণ করিয়াছিলেন; কিন্তু মুনিপুঙ্গর বুদ্ধ অবিদ্যা, মায়া, আসক্তি এই সমূহ হইতে সম্পূর্ণ বিমুক্ত”।–(বিশ্বকোষ) প্রাচীন ভারতীয় সমাজের একদিকে যখন আদিম গোত্রতান্ত্রিক যৌথ সমাজ-ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছিল এবং অপরদিকে সমাজের একটা অংশ তার অনড় আচার-অনুষ্ঠান এবং বর্ণাশ্রমের মাধ্যমে নিজের স্বার্থকে রক্ষা করার চেষ্টা করছিল, বৌদ্ধধর্মের প্রসার ঘটে সেইকালে। বুদ্ধ ভগবানের অস্তিত্ব, বেদের নির্ভূলতা এবং বর্ণাশ্রম প্রথাকে অস্বীকার করেন।
কিন্তু বুদ্ধ ব্রাহ্মণ্যধর্মের অসার অনুষ্ঠান এবং নির্যাতনমূলক বর্ণ প্রথার শৃঙ্খল থেকে জনসাধারণকে মুক্ত করার জন্য সামাজিক পরিবর্তনের কথা বলেন নি। জনসাধারণকে তিনি আত্মার উন্নতি সাধনের মাধ্যমে কুক্তি অর্জন করতে বলেছেন। হিন্দু ধর্মের জন্মান্তরবাদের তত্ত্বকে বুদ্ধ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করতে পারেন নি। তাঁর মতে আত্মা জন্মান্তর গ্রহণ করে। কিন্তু সে জন্মান্তরের ভালো-মন্দ বর্ণের মধ্যে আবদ্ধ নয়। মানুষ তার কৃতকর্মের কারণে ভালো কিংবা মন্দ জন্মগ্রহণ করে। জীবনের ভোগ বাসনা পরিত্যাগের সাধনা দ্বারাই জীবন জন্মান্তরের বন্ধন থেকে মুক্তি বা নির্বাণ লাভ করতে পারে।
বৌদ্ধধর্মে দুটি ধারা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। একটি হীনযান ধারা, অপরটি মহাযান ধারা। হীনযান ধারাই বৌদ্ধ ধর্মের প্রাচীনতম এবং বুদ্ধের শিক্ষা-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠিত ধারা। হীনযান মতে বিশ্ব এবং জীবকে এক ধারায় গ্রথিত করা হত। সৃষ্টি হচ্ছে বস্তু এবং চেতনার বিবর্তন। বিবর্তিত সৃষ্টিমাত্রেরই বিশেষ বিশেষ স্বভাব আছে। এই স্বভাবই হচ্ছে সৃষ্টির ধর্ম। কোনো অস্তিত্ব বা সত্তার নির্বাণের জন্য আবশ্যক হচ্ছে তার নিজের ধর্মের বর্জন। স্বভাবের বর্জনে সত্তার সমস্ত প্রকার স্বভাব বা ধর্মরূপ শৃঙ্খল থেকে মুক্তি। এই মতের মধ্যে প্রকৃতি ও বস্তু জগতের একটা স্বীকৃতি আছে। পরবর্তীকালে মহাযান মতবাদ বুদ্ধের জীবনের নৈকট্যমূলক অভিমত বর্জন করে। মহাযান পন্থীরা বুদ্ধকে দেবতার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে এবং বিবিধ অনুষ্ঠান মারফত বুদ্ধের দয়া উদ্রেকের মধ্যে মানুষের মুক্তি নিহিত বলে প্রচার করে। মহাযানপন্থীদের মতে বস্তু বা বস্তুর ধর্ম হচ্ছে অলীক বা মায়া। জগৎও মায়া। খ্রিষ্টাব্দ দ্বিতীয় শতকের বিখ্যাত বৌদ্ধ যুক্তিবিদ নাগার্জুন যুক্তির পারম্পর্যে জগৎকে মায়া বা শূন্য বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন।
Bukharin: বুখারিন (১৮৮৮১৯৩৮ খ্রি.)
রুশ বিপ্লবের একজন প্রখ্যাত রাজনৈতিক তাত্ত্বিক। কিন্তু বলশেভিক পার্টির নেতা লেনিনের সঙ্গে যেমন তাঁর ১৯১৮ সনে তত্ত্বগত মতবিরোধ ঘটে, তেমনি বিপ্লবোত্তর রাশিয়াতে স্ট্যালিনের সঙ্গে তার মতান্তর সৃষ্টি হয়। রাশিয়াতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য স্টালিনের সাংগঠনিক ও তাত্ত্বিক নেতৃত্বে যে নীতি সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি গ্রহণ করে, বুখারিত পার্টির অভ্যন্তরে দক্ষিণপন্থী ভিন্ন একটি গ্রুপ গঠনের মাধ্যমে তার বিরোধিতা করেন বলে স্ট্যালিন অভিযোগ করেন। পরবর্তীকালে এই বিরোধ গ্রুপের ধ্বংসাত্মক কাজের অভিযোগে বিচার অনুষ্ঠিত হয় এবং তাঁর অপর সঙ্গীদের সঙ্গে বুখারিনকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
Burke, Edmund: এডমাণ্ড বার্ক (১৭২৯-১৭৯৭ খ্রি.)
অষ্টাদশ শতকের ইংল্যাণ্ডের পার্লামেণ্টের বিখ্যাত বাগ্মী সদস্য এবং রাজনীতিবিদ। বার্কের রাজনৈতিক চিন্তা, বক্তৃতা এবং রচনার মধ্যে উদারনীতি এবং রক্ষণশীলতার মিশ্রণ ঘটে। ইংল্যাণ্ডের সরকার আমেরিকার উপনিবেশের উপর ট্যাক্স আরোপ করলে বার্ক উপনিবেশের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেন। ওয়ারেন হেস্টিংস-এর শাসনে ভারতে ব্রিটিশ শাসনে ব্যাপক দুর্নীতির বিরুদ্ধেও তিনি উচ্চকণ্ঠ হন। সে সময়ে রাজনৈতিক দল হিসাবে হুইগ দল কনজারভেটিভ দলের চাইতে উদারনীতিক ছিল। বার্ক হুইগ দলের সদস্য ছিলেন। কিন্তু বার্ক তার সুপরিচিত পুস্তক ‘রিফ্লেকশানস অন ফ্রেঞ্চ রিভোল্যুশন’ বা ‘ফরাসি বিপ্লবের উপর চিন্তা’ গ্রন্থে ফরাসি বিপ্লবের তীব্র সমালোনার মাধ্যমে নিজের রক্ষণশীল মনোভাবের প্রকাশ ঘটান। বস্তুত ফরাসি বিপ্লবের বিরুদ্ধে বার্কের সমালোচনার মাধ্যমে ইংল্যাণ্ডের প্রতিষ্ঠিত বুর্জোয়া শাসন ব্যবস্থার একটি অংশের ফরাসি বিপ্লবের সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য সম্পর্কে আশঙ্কা এবং ভীতির প্রকাশ ঘটে। ইংল্যাণ্ডে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের বিপ্লবের উদ্যোগী ভূমিকা ইংল্যাণ্ডের পুঁজিবাদী শ্রেণী গ্রহণ করলেও অষ্টাদশ শতকের ফরাসি বিপ্লবের ‘সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার’ আওয়াজ মানুষের চিন্তায় একটা নতুন পর্যায়ের সূচনা ঘটায়। ফরাসি বিপ্লবের এই নতুন তাৎপর্যে কেবল যে ইউরোপের সামন্ততান্ত্রিক শ্রেণী ও রাজতান্ত্রিক শাসকরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে তাই নয়, ইংল্যাণ্ডের বুর্জোয়া শাসকশ্রেণীও ফরাসি বিপ্লবের ‘সাম্যে’র আওয়াজে নিজেদের শ্রেণী শাসনের প্রতি আঘাতের তাৎপর্যকেও উপলব্ধি করে। এডমাণ্ড বার্ক যখন তাঁর ওজস্বিনী ভাষায় ফরাসি বিপ্লবকে আক্রমণ করে বলেন: “ফরাসি বিপ্লবীদের কাছে আমাদের শিক্ষা গ্রহণের কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা ঈশ্বরকে যেমন বয় করি, রাজাকে তেমনি সমীহ করি; আমরা পার্লামেণ্টকে যেমন ভালবাসি, সরকারকে তেমন মান্য করি; আমরা গীর্জার পুরোহিতদের যেমন ভক্তি করি, অভিজাতদের তেমনি সম্মান করি” –তখন কেবল ব্যক্তিগত আবেগ নয়, সমাজের অধিকতর বিপ্লবী বিকাশের প্রশ্নে ইংল্যাণ্ডের শাসকশ্রেণীর শ্রেণীগত উদ্বেগের প্রকাশ ঘটে।
C
Campanella, Thomas: টমাস ক্যাম্পানেলা (১৫৬৮-১৬৩৯ খ্রি.)
ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতকের ইতালির দার্শনিক এবং কল্পনাবাদী চিন্তাবিদ। ১৫২৮ সনে ক্যাম্পানেলা সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেন। ক্যাম্পানেলার চিন্তার মধ্যে অ-খ্রিষ্টীয় অভিমত, ম্যাকিয়াভেলীর বাস্তববাদ এবং খ্রিষ্টীয় ধর্মীয়ভাব –এসবের মিশ্রণ দেখা যায়। স্কলাসটিসিজম বা মধ্যযুগের ধর্মীয় যুক্তিবাদের বদলে ক্যাম্পানেলা প্রকৃতি এবং ইতিহাসের ব্যাখ্যায় শক্তি, যুক্তি এবং প্রেম এই তিন নীতি অধিকতর শ্রেয় বলে বিশ্বাস করতেন। ‘সিভিটাটিস সলিস’ নামে সংলাপের রীতিতে তিনি যে কল্পনা-রাজ্য রচনা করেন সেখানে রাজা হলো একদল নির্বাচকমণ্ডলী দ্বারা নির্বাচিত; রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় কাজের সেখানে সম্মিলন ঘটেছে এবং সর্বজনীন শ্রমের মাধ্যমে যে সম্পদ উৎপাদিত হচ্ছে তার মালিকাতা হচ্ছে যৌথ। কালের বিচারে ক্যাম্পানেলার এরূপ কাল্পনিক সাম্যমূলক চিন্তার সেকালে একটি প্রগতিশীল ভূমিকা ছিল। মুক্তচিন্তার জন্য ক্যাম্পানেলা ধর্মান্ধ গীর্জার কোপানলে পতিত হন। ১৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ক্যাম্পানেলা ইতালিকে স্পেনের দখলকারী শাসন থেকে মুক্ত করার জন্য একটি দেশপ্রেমিক বিদ্রোহ সংগঠিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁর সে চেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং তাঁকে নির্মম নির্যাতনের পরে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। ২৭ বছর ক্যাম্পানেলাকে কারাগারে বন্দি রাখা হয়। কারাগারে তিনি তাঁর ‘সিভিটাটিস সলিস’ বা ‘সূর্য নগরী’ রচনা করেন।
Capital: পুঁজি, মূলধন
১. উৎপাদনের ক্ষেত্রে পুঁজি হচ্ছে প্রয়োজনীয় উপাদানসমূহের মধ্যে একটি উপাদান। সম্পদ বৃদ্ধির জন্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে জমি, যন্ত্র, শ্রম এবং পুঁজি এই চারটি উপাদান প্রধান। ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে ‘পুঁজি’ শব্দ দ্বারা নতুন পণ্য ক্রয়ের আর্থিক সামর্থ্য বুঝায়। এরূপ অর্থ পুঁজি বলতে কেবল টাকা নয়, মালিকের মালিকানাধীন দালানকোঠা, জমি, যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রি বুঝাতে পারে। ‘জাতীয় পুঁজি’ দ্বারা দেশের শিল্পে উৎপাদিত সমগ্র পণ্য এবং অধিকতর পণ্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় মজুর সম্পদকে বুঝায়। মার্কসীয় অর্থনীতির ব্যাখ্যায় ‘পুঁজির আসল কাজ হলো বাড়তি পণ্য অর্থাৎ বাড়তি মূল্য সৃষ্টি করা এবং এই কাজ দিয়েই তার পরিচয়’। কাজেই ‘যে কোনো উৎপাদন যন্ত্র বা উপায় বাড়তি মূল্য তৈরির কাজে নিয়োজিত হলে তাকে আমরা বলতে পারি পুঁজি। পুঁজিকে আবার দুরকম ভাগে ভাগ করা যায় –পরিবর্তনশীল ও অপরিবর্তনশীল পুঁজি। কলমালিক তার পুঁজি দিয়ে দুরকম জিনিস কেনে; এক হচ্ছে শ্রমশক্তি, আর এক হচ্ছে সুতো, কাঁচামাল, কলকব্জা ইত্যাদি। সুতো, কাঁচামাল কলকব্জা ইত্যাদির মূল্য যত ছিল ঠিক ততটাই উৎপাদিত পণ্যের ভেতর চলে যায়, এদের মূল্যের কিছু পরিবর্তন হয় না। এই জন্য এদের বলে অপরিবর্তনশীল পুঁজি বা কনসট্যাণ্ট বা ফিক্সড ক্যাপিটাল। পুঁজির অন্যভাগ যা শ্রমশক্তির জন্য খরচ হয় তা কিন্তু পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয়। এই জন্য একে বলে পরিবর্তনশীল পুঁজি বা ভেরিয়েবল ক্যাপিটাল’। (নীহাররঞ্জন সরকার; ছোটদের অর্থনীতি)।
২. মার্কস-এর বিখ্যাত গ্রন্থের নাম ‘পুঁজি’ বা ক্যাপিটাল। এই গ্রন্থে কার্লমার্কস পুঁজিবাদী উৎপাদনব্যবস্থা বিশ্লেষণ করে তার মৌলিক বিধান উদঘাটন করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের তাত্ত্বিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত করেন। ‘পুঁজি’র প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৮৬৭ সালে। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর আজীবন সাথী ফ্রেডারিক এঙ্গেলস-এর সম্পাদনায় ‘পুঁজি’র দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৮৮৫ সালে এবং তৃতীয় খণ্ড ১৮৯৪ সালে। প্রথম খণ্ডে মার্কস পুঁজির গঠন অর্থাৎ পুঁজি কিভাবে সৃষ্টি হয়; দ্বিতীয় খণ্ডে পুঁজির সঞ্চারণ বা সারকুলেশন এবং তৃতীয় খণ্ডে তিনি সামগ্রিকভাবে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার বিশ্লেষণ করেন। চতুর্থ খণ্ডে স্থান পেয়েছে বাড়তি বা উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব। মানুষের সভ্যতার ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে মার্কস পুঁজিবাদকে একটি বিশেষ পর্যায় বলে চিহ্নিত করে তার সুবিস্তারিত বিশ্লেষণ পেশ করেছেন। এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে তিনি পুঁজিবাদের উৎপত্তি বিকাশ এবং তার পরিণাম বা ধ্বংসের বিধানকে উদঘাটন করেন। মার্কস-এর ‘পুঁজি’ কেবল আর্থনীতিক বিশ্লেষণমূলক গ্রন্থ নয়। মার্কস-এর সামগ্রিক বিশ্বদৃষ্টি অর্থাৎ তাঁর দর্শন এই গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। বস্তুত মার্কসবাদ তথা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মূল গ্রন্থ হচ্ছে ‘পুঁজি’। মার্কস তার দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের প্রয়োগের ভিত্তিতে মানুষের সামাজিক আর্থনীতিক বিকাশকে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, পুঁজিবাদ কোনো অনড় এবং স্থায়ী অস্তিত্ব নয়। পুঁজিবাদ একটি বিকাশমান প্রক্রিয়া। এই আর্থনীতিক প্রক্রিয়া এবং তার উপর প্রতিষ্ঠিত সামাজিক কাঠামো যেমন আদিতে ছির না, তেমনি ভবিষ্যতেও এর পরিবর্তন বা রূপান্তরের মাধ্যমে নতুন অর্থনীতিক উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং সামাজিক-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। পুঁজিবাদের অভ্যন্তরে ক্রম পরিবর্তনের মাধ্যমে সেই গুণগত রূপান্তরের মুহুর্ত যে অনিবার্যবাবে অগ্রসর হয়ে আসছে তা মার্কস সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করেন। অন্যান্য ব্যবস্থায় যেমন, পুঁজিবাদের অভ্যন্তরেও তেমনি পরিবর্তনের মূল কারণ তার আভ্যন্তরিক বিরোধ। এই বিরোধ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার জন্মের পর থেকে উৎপাদনের উপায়ের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা এবং উৎপাদন সম্পর্কের অনিবার্য যৌথ বা সমষ্টিগত রূপের মধ্যে জন্ম নিয়েছে এবং সে বিরোধ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে বিস্ফোরণের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এই পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার একমাত্র পরিণাম হচ্ছে ‘এক্সপ্রোপ্রিয়েটিং দি এক্সপ্রোপ্রিয়েটরস’ বা ‘উচ্ছেদকের উচ্ছেদ’ অর্থাৎ উপাদনের উপায়ের উপর সমষ্টিগত মালিকানার প্রতিষ্ঠা। পরির্তনের এই ক্রম ব্যাখ্যায় মার্কস এই বিরোধের ক্রম বিকাশের প্রতিটি স্তর, সে স্তরের বৈশিষ্ট্য, তার সংকটের বিশেষ সমাধানের ভিত্তিতে নতুনতর স্তরে আগমন বিস্তারিতভাবে দেখিয়েছেন এবং পরিশেষে এই বিকাশের বিধানের উল্লেখ করে বলেছেন ‘একটি বিশেষ উৎপাদন-ব্যবস্থায়ে যে বিরোধ অন্তর্নিহিত থাকে তার ঐতিহাসিক বিকাশের মাধ্যমেই মাত্র সেই উৎপাদন-ব্যবস্থার উচ্ছেদ এবং তার স্থানে নতুন উৎপাদন-ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা সম্ভব’।
Capitalism: ধনতন্ত্র, পুঁজিবাদ
সামাজিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিশেষ। ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপের কয়েকটি দেশে এই সমাজ-ব্যবস্থাতর প্রথম প্রতিষ্ঠা ঘটে। মানুসের সামাজিক অর্থনৈতিক কাঠামো যে বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে বিকাশলাভ করছে এটি আধুনিক চিন্তাধারার একটি স্বীকৃত সত্য। আদিতে মানুষ যেরূপ অসহায় ছিল তেমনি আবার মানুষের গোষ্ঠীবদ্ধ আদি সমাজে কোনো শ্রেণীগত বিভেদ ছিল না। জীবন ধারনের জন্য উন্নত থেকে উন্নততর জীবিকার উপায় আবিস্কারের প্রয়োজন এবং ইচ্ছা মানুষের সহজাত। এই প্রচেষ্টায় শ্রেণীহীন আদিম গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের সমাজ উৎপাদনের হাতিয়ারের মালিক প্রভু এবং উৎপাদনের হাতিয়ারহীন দাসের শ্রেণী সমাজে পরিণত হয়। এই দাস সমাজই আবার কালক্রমে জমির মালিকানার ভিত্তিতে সামন্তপতি এবং ভূমিহীন কৃষকের সামন্তবাদী সমাজে বিকাশ লাভ করে। সামন্তবাদী সমাজের উত্তরকালে বিজ্ঞানের উন্নতি ক্রমান্বয়ে উৎপাদনের আবিস্কার হতে শুরু করে। এ সমস্ত যন্ত্রপাতির যারা মালিক হলো তারা দেখল যে, যন্ত্রপাতি চারাবার জন্য প্রচুর সংখ্যক লোকের আবশ্যক। কিন্তু তখনো অধিকাংশ মানুষ সামন্তবাদী প্রভুর হুকমে জমির সীমানার শিকলে আবদ্ধ। তারা ভূমির মালিক নয়। ভূমির দাস। নতুন শক্তি দেখল সামন্তবাদ কেভল মানুষকেই ভূমির দাস বানিয়ে রাখে নি। তার অস্তিত্ব নতুন উৎপাদনের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভূমির মালিক এবং বূমির দাসের পারস্পরিক সম্পর্ক শোষক এবং শোষিতের। বিজ্ঞানের অগ্রগতি সামন্তবাদের পরিবর্থন অপরিহার্য করে তুলল। কৃষকের বিদ্রোহ এবং উৎপাদনের নতুন পদ্ধতির অজেয় শক্তি সামন্তবাদকে ক্রমান্বয়ে উৎসাহিত করে নতুনতর এক সমাজ-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করলঃ ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। নতুন উৎপাদনী যন্ত্রের মালিক এখানে সমাজের প্রভু। যন্ত্রের মালিক নির্দিষ্ট মজুরিতে যন্ত্রহীন মানুষ দিয়ে তার যন্ত্র চালায় আর অধিক থেকে অধিকতর পরিমাণে উৎপাদন করে দ্রব্য, পণ্য যা সে দেশে-দেশান্তরে বিক্রি করতে পারে এবং বিক্রি করে অর্থ আনতে পারে, অধিক যন্ত্র তৈরি করতে পারে এবং অধিকতর সংখ্যক মজুর নিয়োগ করে অধিকতর পণ্য আবার তৈরি করতে পারে। এ এক নতুন ব্যবস্থা, নতুন সমাজ। এখানে জমির চেয়ে যন্ত্র মূল্যবান। কিন্তু এ যন্ত্র থেকে লাভ অর্জনের মূল সূত্র মজুর এবং বাঁধা মজুরিতে মালিকের জন্য তার অবাধ উৎপাদনের ক্ষমতায়। যন্ত্রের মালিকের মুনাফা আসে মজুরের মজুরির অতিরিক্ত শ্রম থেকে। এ ব্যবস্থায় উৎপাদনের সম্পর্কে হলো একদিকে যন্ত্রের ব্যক্তিগত মালিকানা, অপরদিকে বহু মজুরের যৌথক্রিয়ায় উৎপাদনের যৌথপদ্ধতি। ধনতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ প্রথমে করেন কার্ল মার্কস এবং তাঁর আজীবন সঙ্গী ফ্রেডারিক এঙ্গেলস। তাঁরা সামন্তবাদের সঙ্গে তুলনাক্রমে সমাজ বিকাশে ধনতন্ত্রবাদের অগ্রসর ভূমিকার কথা যেমন উল্লেখ করেন তেমনি এ সমাজেরও অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব এবং বৈষম্যেরও উদঘাটন করেন। যন্ত্রের ব্যক্তিগত মালিকানা এবং তাঁর উৎপাদনের যৌথ পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে এর দ্বন্দ্ব। সামাজিক ক্ষেত্রে এ দ্বন্দ্ব হচ্ছে যন্ত্রের মালিকদের শোষণ এবং যন্ত্রের মালিকদের শোষণ এবং যন্ত্রের শোষিত শ্রমিকদের দ্বন্দ্ব। এই বৈষম্য এবং দ্বন্দ্ব পরিণামে ধনতন্ত্রীদের উৎপাদনের কারণ হয়ে নতুনতম সমানতান্ত্রিক সমাজ বা উৎপাদনের উপায়ের যৌথ মালিকানা এবং যৌথ মালিকদের যৌথ উৎপাদনের নতুন ব্যভস্থা প্রবর্তণ করবে বলে মার্কসবাদীগণ বিশ্লেষণ করে দেখান। সমাজবিকাশের এই প্রক্রিয়ায় একাধিক দেশে ধনতন্ত্রবাদের স্থলে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু অপরাপর দেশের প্রধান আর্থিক ব্যবস্থা এখনো ধনতান্ত্রিক।
ধনতন্ত্রের অগ্রসর ভূমিকা ইউরোপেই প্রধানত কার্যকরী হয়। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দী যখন শেষ হচ্ছে ধণতন্ত্রবাদ তখন নিজ নিজ দেশের সীমা অতিক্রম করে বিদেশকে করায়ত্ত করে নতুন সাম্রাজ্যবাদী বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে শুরু করেছে। ব্যক্তিগত প্রতিযোগিতা এবং পরবর্তীকালে ধনতান্ত্রিক দেশ কিংবা ধনতান্ত্রিক গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে অধিক থেকে অধিকতর উৎপাদন এবং ক্রমাধিক মুনাফা অর্জনের প্রতিযোগিতাই হচ্ছে ধনতন্ত্রের মূল চালিকাশক্তি। এ কারণেই নিজ দেশে মুনাফার বৃদ্ধি সীমিত হয়ে এলে ধনতন্ত্রবাদ অপর দেশ দখল করে মুনাফার ক্রমাধিক বৃদ্ধির প্রাণশক্তিকে জীবিত এবং সক্রিয় রাখতে চায়। ক্রমে আবার এই প্রয়াস ধনতান্ত্রিক ও সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব এবং বিরোধের আকার গ্রহণ করে।
Capitalism, General crisis of: পুঁজিবাদের সাধারণ সংকট
ধনতন্ত্র বা পুঁজিবাদের বর্তমান অবস্থার মার্কসবাদী বিশ্লেষণে ‘পুঁজিবাদের সাধারণ সংকট’ একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা। মার্কসীয় বিশ্লেষণের অনুসারীদের মতে পুঁজিবাদের গোড়াকার প্রগতিশীল ভূমিকা আর বজায় নেই। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা শক্তিহীন হয়ে পড়েছে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্র এবং ব্যবস্থা এখনো শক্তিশালী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বিদ্যমান। কিন্ত এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় তেজী-মন্দার চক্র ক্রমাধিক পরিমাণে তীব্র হয়ে উঠছে। কর্মহীন বা বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্রমাধিক পরিমাণে লাভে পণ্য বিক্রি করতে না পারার সমস্যা বাড়ছে। কিন্তু এই সংকট থেকে মুক্তি পাবার চেষ্টাও পুঁজিবাদী ব্যবস্থা করছে। ব্যবস্থা মাত্রই তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে চায়। অস্তিত্ব রক্ষার এই চেষ্টা নানাভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। উৎপাদনের ব্যয় হ্রাসের মাধ্যমে লাভের হার বজায় রাখার জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে গবেষনা চালানো হচ্ছে। নতুন নতুন যন্ত্র আবিস্কৃত হচ্ছে। পূর্বের অবাধ প্রতিযোগিতার নীতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিত্যক্ত হচ্ছে। উৎপাদন ও লাভকে বহাল এবং বৃদ্ধি করার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর বৃহৎ বা একচেটিয়া পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। জাতীয় সীমা অতিক্রমকারী বহু জাতীয় করপোরেশন বা কারটেল গঠিত হচ্ছে। সামরিক অস্ত্রপাতি উৎপাদন এবং বিভিন্ন দেশে তা বিক্রি করে লাভ অর্জনের চেষ্টা করা হচ্ছে। মানুষের শ্রমের ফসল ধ্বংসকারী সমর শিল্প তাই অতীতের চাইতে অধিক ব্যাপক এবং উন্নত হয়ে উঠছে। সমরশিল্পকে বহাল রাকা এবং বৃদ্ধি করার জন্য প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে যুদ্ধের আবহাওয়া, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহাওয়া তৈরী করার চেষ্টা হচ্ছে। এ সকল বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে বর্তমানের পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য। এবং এর মাধ্যমেই পুঁজিবাদের সাধারণ সংকটের প্রকাশ ঘটছে।
নিম্নের বিবরণটিকে এই বিষয়টির মার্কসবাদী বিশ্লেষণের একটি সংক্ষিপ্ত দৃষ্টান্ত হিসাবে বিবেচনা করা চলে।
“ব্যক্তিগত মালিকানা এবং শোষণ যার নীতি সেই বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ঐতিহাসিক বিকাশ সম্ভাবনা আজ নিঃশেষিত। পুঁজিবাদ আজ গভীর এক সাধারণ সংকটে নিপতিত। পুঁজিবাদের মীমাংসাহীন দ্বন্দ্ব এবং তার চরিত্রগত বিধান এই সংকটকে অনিবার্য করে তুলছে। পুঁজিবাদের সাধারণ সংকটের অর্থ হচ্ছে, পুঁজিবাদ বিকাশের বদলে আজ ক্ষয়ের পর্যায়ে প্রবেশ করছে। এ ক্ষয় আজ বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রত্যেক দেশে, এ ক্ষয় উপর থেকে নিচে সর্বত্র বিস্তারিত। এ ক্ষয় গ্রাস করছে তার অর্থনীতি, সামাজিক ব্যবস্থা, এর আদর্শ এবং সংস্কৃতিকে। সাধারণ এই সংকটের ফলে একের পর এক, বিভিন্ন দেশ যারা পুঁজিবাদী-অক্ষ পরিত্যাগ করে সমাজতান্ত্রিক বিকাশের পথ অবলম্বন করছে তাদের নিজের অক্ষের মধ্যে আবদ্ধ রাখতে পুঁজিবাদ ব্যর্থ হচ্ছে।
“পুঁজিবাদের এই সাধারণ সংকটের সূচনা ঘটে রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার মাধ্যমে। এই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ফলে পৃথিবীতে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাই একমাত্র ব্যবস্থা বলে বিদ্যমান থাকার পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। গোড়াতেও পুঁজিবাদী জগৎ সোভিয়েট সমাজবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে সামরিক আক্রমণ, অর্থনৈতিক অবরোধ, সীমাহীন অপপ্রচার, আদর্শগত ধ্বংসাত্মক কাজ প্রভৃতির মাধ্যমে সর্বপ্রকারের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। কিন্তু তার চেষ্টা ব্যর্থ করে সোভিয়েট সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তার অব্যাহত অস্তিত্বের মাধ্যমে নতুন সমাজ ব্যবস্থার প্রাণশক্তির প্রমাণ ঘটায়।
“পুঁজিবাদের সাধারণ সংকটের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ইউরোপ ও এশিয়ার একাধিক দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার মাধ্যমে। বর্তমানে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাই একমাত্র বিশ্বব্যবস্তা নয়। তার প্রতিশক্তি হিসাবে একটি বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাও বিদ্যমান আছে।
“বর্তমানে পুঁজিবাদের সাধারণ সংকটের তৃতীয় পর্যায়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, শান্তির ভারসাম্য আজ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিপরীতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপরীতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে পরিবর্তিত হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক শক্তিসমূহ পৃথিবীব্যাপী বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হচ্চে। সমাজতন্ত্রের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদ অনিবার্যভাবে দুর্বল হচ্ছে।
“বর্তমান যুগে পুঁজিবাদের সাধারণ সংকটের একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, এই সংকট পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অর্থনীতি, রাজনীতি ও নৈতিক চরিত্র –সর্বক্ষেত্রকে গ্রাস করে সার্বিক সংকটের রূপ গ্রহণ করছে। তার বর্তমান অর্থনৈতিক মন্দা ১৯৩০-এর মারাত্মক মন্দার সঙ্গে তুলনীয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিশ্বপুঁজিবাদের প্রধান সকল কেন্দ্রগুলিতেই এই সংকট বিস্তারিত হয়েছে। এই সংকট হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিকশিত রাষ্ট্রীয় একচেটিয়া অর্থনীতির সংকট। উৎপাদনের আকস্মিক পতন ঘটছে, বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পুঁজিবাদের পক্ষে কোনো দেশেরই সক্শ জনসংখ্যাকে কার্যে নিযুক্ত করার ক্ষমতা নেই। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী সত্তর দশকে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে এক কোটি পঞ্চাশ লক্ষ কর্মক্ষম লোক পুরো বেকার। স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র এবং উৎপাদনের উন্নততর যান্তিকীকরণ শ্রমজীবী মানুষের মঙ্গলে আসার বদলে লক্ষ লক্ষ মানুষকে ‘ফজলু’ বা বাহুল্য বলে বাতিল করে দিচ্ছে।
“এই অবস্থা থেকে যুক্তিগত সিদ্ধান্ত হচ্ছে এই যে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে উৎপাদনের শক্তি বা উপায় এবং উৎপাদনের সম্পর্কের দ্বন্দ্ব এরূপ তীব্রতা লাভ করেছে। পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কে উৎপাদনী শক্তির শৃঙ্খল হয়ে থাকে রুদ্ধ করে রাখার চেষ্টা করছে।
“কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, সাম্রাজ্যবাদ তথা পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক শক্তি একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেছে। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে অস্তিত্বের লড়াই, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রসরমান দাবি এবং এক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের সঙ্গে অপর পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের নিমর্ম অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রভৃতি পুঁজিবাদের জন্য উৎপাদনের উন্নতি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বশেষ উদ্ভাবনের প্রয়োগকে অনিবার্য করে তুলছে।
“সাধারণ সংকটের এই নবতম পর্যায়ে পুঁজিবাদের অন্যান্য অন্তর্দ্বন্দ্বও তীব্রতর হয়ে উঠছে। মজুর এবং পুঁজির দ্বন্দ্বের গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে কতিপয় একচেটিয়া বহুজাতিক পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠান ও শক্তির সংঘাত তীব্র হচ্ছে। পুঁজিবাদী দেশসমূহের অসম অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিকাশের ফলে পুঁজিবাদ বিশ্বব্যবস্থার অভ্যন্তরেও শক্তিসমূহের জোটবদ্ধতার ক্ষেত্রে পরিবর্তণ সংঘটিত হচ্ছে। বিভিন্ন পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ও পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের গোষ্ঠীসমূহের পারস্পরিক বৈরিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে”। (ফাণ্ডামেণ্টালস অব সায়েন্টিফিক কম্যুনিজম, মস্কো, ১৯৭৭)
Categories: সূত্র, মাধ্যম
মানুষের জ্ঞান কতকগুলি মৌলিক ধারণা বা সূত্রের উপর নির্ভরশীল। এই ধারণাগুলির মধ্যে প্রধান হচ্ছে স্থান, কাল, সম্পর্ক, গুণ, পরিমাণ ইত্যাদি। এই ধারণাগুলি বাকে আমাদের পক্ষে কোনো কিছুর জ্ঞান লাভ সম্ভব নয়। ‘স্থান’ ধারণার উপর নির্ভর করেই আমরা একটা বস্তুকে স্থানের অন্তর্ভুক্ত করি। আমরা বলি এই বস্তুটি অমুক স্থানে আছে। কালের ধারণা থেকে আমরা বস্তু বা ঘটনার উপর কালানুক্রম আরোপ করি। এরূপ ধারণা ব্যতীত আমাদের জ্ঞানলাভ সম্ভব নয় বলে দর্শনে এদের জ্ঞানের মূলসূথ্র বা মাধ্যম বলা হয়।
জ্ঞানের জন্য যে কিছু সংখ্যক মৌল ধারণার আবশ্যক এ সত্য বিভিন্ন দেশের প্রাচীন দার্শনিকগণই জ্ঞানের প্রক্রিয়াকে বিশ্লেষণ করে আবিস্কার করেছেন। ভারতীয় বৈশেষিক দর্শন বস্তু, গুণ এবং ক্রিয়াকে জ্ঞানের মূলসূত্র বিবেচনা করেছে। গ্রিক দার্শনিক এ্যারিস্টটল জ্ঞানের এরূপ সূত্রের বিস্তৃততর বিশ্লেষণ করে এর সংখ্যা দশটি বলে স্থির করেছে। আধুনিক ইউরোপীয় দর্শনে জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কাণ্ট জ্ঞানসূত্র নিয়ে আলোচনা করেছেন। জ্ঞানসূত্রগুলির উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে দার্শনিকদের মধ্যে মতের পার্থক্য আছে। ভাববাদী দার্শনিকদের মতে জ্ঞানসূত্রগুলি মানুষ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার মারফত লাভ করে না। অভিজ্ঞতা-পূর্ব ধারণা হিসাবে মূল জ্ঞানসূত্রগুলি মানুষের মধ্যে জন্মগতভাবেই থাকে। এই ভাববাদী মতের প্রধান আধুনিক ব্যাখ্যাতা হচ্ছেন কাণ্ট। জ্ঞানের সমস্যার কাণ্টীয় বিশ্লেষণ সংক্ষেপত এরূপ মানুষ চরম সত্তাকে জানতে পারে না। মানুষ চরম সত্তার বহিঃপ্রকাশকেই মাত্র জানতে পারে। এই বহিঃপ্রকাশকে মানুষ জানে স্থান, কাল, গুণ, সম্পর্ক এরূপ মৌলসূত্রের মাধ্যমে। জ্ঞানের এই সূত্রগুলি মানুষের মনে অভিজ্ঞতা-পূর্ব ভাব হিসাবে উদ্ভুহত হয়। অভিজ্ঞতার মধ্যে এদের উদ্ভব নয়। বস্তুবাদ জ্ঞানসূত্রগুলিকে নির্বিশেষে ধারণা বলে স্বীকার করলেও অভিজ্ঞতা-পূব উদ্ভবের তত্ত্বকে অস্বীকার করে। বস্তুবাদ, বিশেষ করে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ মানুষের জ্ঞানলাভের প্রক্রিয়াকে একটি সদা বিকাশমান দ্বন্দ্বমূলক জটিল প্রক্রিয়া বলে ব্যাখ্যা করে। বস্তু থেকে যেমন মানুষের বিকাশ, তেমনি মানুষেল সঙ্গে বস্তুর দ্বান্দ্বিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্কের মাধ্যমেই মানুষের চেতনার বিকাশ ঘটেছে। মানুষ বস্তুর সাক্ষাৎ সম্পর্কে আসে। বিভিন্ন বস্তু তার চেতনাকে আঘাত করে করে চেতনাকে বিকশিত করে। বিকশিত সেই চেতনা একাধিক বস্তুকে তুলনা করার ক্ষমতা অর্জন করে। তাদের উপর মিল-অমিলের গুণ আরোপ করে। এমনবাবে যে সূত্রগুলি আজ মানুষের জ্ঞানের মূলসূত্র বা যে সূত্রগুলি মানুষজাতির জন্মগত এবং অভিজ্ঞতা-পূর্ব সম্পদ বলে বিবেচিত হচ্ছে সেগুলি একদিন অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই মানুষ লাভ করেছে। এরূপ মৌলসূত্র নির্দিষ্ট সংখ্যায় একদিনে সৃষ্টি হয়নি কিংবা চিরকালের জন্য এ সংখ্যার সীমাও স্থির হয়ে যায় নি। জ্ঞানের বিকাশমান প্রক্রিয়ায় মানুষ ক্রমান্বয়ে নতুনতর সূত্র অর্জন করে যাচ্ছে।
Categorical Imperative: শর্তহীন বিধান
শর্তহীন বিধান দর্শন, বিশেষ করে দার্শনিক কাণ্টের নীতি-শাস্ত্রে ব্যবহৃত একটি কথা। কাণ্টের মতে নৈতিক জীবনে যে সমস্ত বিধান কার্যকরী সেগুলিকে শর্তসাপেক্ষ এবং শর্তহীন বলে বিভক্ত করা চলে। শর্তসাপেক্ষ বিধানের নিয়ামত হচ্ছে কোনো বিশেষ আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য। আমার সন্তানকে যদি আমি এই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ভালবাসি যে, সেও একদিন আমার বৈষয়িক জীবনে সাহায্যকারী হবে তা হলে সন্তানের প্রতি এই ভালবাসা শর্তসাপেক্ষ ভালবাসা। ভবিষ্যতের প্রতিফলের আকাঙ্ক্ষাই আমার বর্তমানের ভালবাসার নিয়ামক। এখানে সন্তানের প্রতি ভালবাসা শর্তসাপেক্ষ বিধানেরই একটি দৃষ্টান্ত। শর্তসাপেক্ষ বিধান একটি লক্ষ্য অর্জনের উপায় মাত্র। কাণ্টের মত অনুযায়ী মানুষের নৈতিক জীবনের নিয়ামক হবে শর্তহীন বিধান। শর্তহীন বিধান দ্বারা কাণ্ট এমন একটি বিধানকে বুঝাতে চেয়েছেন যে বিধান অপর কোনো লক্ষ্য অর্জনের উপায়মাত্র নয়ে, যে-বিধান নিজেই লক্ষ্য। পিতা যদি সুখশান্তি-সম্পদ অর্থাৎ কোনো প্রকার প্রতিদানের আকাঙ্ক্ষা না করেতার সন্তানকে শুধু ভালবাসার জন্য ভালবাসতে পারে তবেই সে ভালবাসা অপর কোনো লক্ষ্যের উপায়মাত্র না হয়ে নিজেই লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াবে। আর এরূপ ভালবাসাই হচ্ছে সন্তানের প্রতি পিতার আদর্শ ভালবাসা। অনুরূপভাবে ব্যক্তি তার সমাজ জীবনে কেবল শর্তহীন বিধান দ্বারা পরিচালিত হবে, শর্তসাপেক্ষ বিধান দ্বারা নয়। আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের যে-কোন কাজের পেছনেই একটি নীতি বা লক্ষ্য থাকে। সমাজে যে বিরোধ, বৈপরিত্য বা সংঘর্ষের সৃষ্টি হয় তার কারণ ব্যক্তি নিজের স্বার্থসাধনের লক্ষ্যকেই চরম মনে করে। সমাজে যে অধকার সে নিজে ভোগ করতে চায় সে অধিকার অপরের প্রাপ্য একথা সে স্মরণ করে না। কিন্তু যে অধিকার ব্যক্তি নিজে ভোগ করবে সে অধিকার অপরকেও ভোগ করতে না দেওয়ার নীতি অযৌক্তিক। মানুষ যুক্তিবাদী জীবন। তার পক্ষে অযৌক্তিক কাজ করা সম্ভব নয়। ব্যক্তি তার যে-কোন সামাজিক আচরণের ক্ষেত্রে এমন নীতি দ্বারা পরিচালিত হবে, যে নীতি শুধু তার নিজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়; যে নীতি সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যে নীতি সার্বিক। যে ব্যক্তি চুরি করতে যাচ্ছে তাকে বিবেচনা করতে হবে, যে চুরির অধিকার সে ভোগ করতে যাচ্ছে সে চুরির অধিকার অপর সকলেরই আছে; সে মনে করবে যে মুহুর্তে অপরের দ্রব্য সে আত্মসাৎ করছে। এরূপ চিন্তায় ব্যক্তি তার আচরণের অন্তর্নিহিত অসঙ্গতি উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে। যে নীতিকে সে সার্বিক নীতি হতে দিতে চায় না সে নীতিকে নিজেও পরিত্যাগ করবে। এমনিভাবে আদর্শ সঙ্গতিপূর্ণ সমাজ সৃষ্টি হবে। কাণ্ট তাঁর শর্তহীন বিধান দ্বারা এক কল্পলোক বা ইউটোপিয়া তৈরীর চেষ্টা করেছেন। শর্তহীন বিধান দ্বারা প্রত্যেক ব্যক্তি পরিচালিত হলে একটি আদর্শ সমাজের সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে ব্যক্তি কেন স্বার্থপর হয়, কেন সে নিজে যে অধিকার ভোগ করে অপরকে সে অধিকার দিতে চায় না এর কারণের কোনো বিশ্লেষণ কাণ্টের নীতিশাস্ত্রে নেই। ফলে, শর্তহীন বিধান একটি অবাস্তব ইচ্ছায় মাত্র পর্যবসিত হয়েছে। নীতিশাস্ত্র মানুষের সামাজিক আচরণের আলোচনা। বাস্তব অর্থনীতিক ও সামাজিক অবস্থাই ব্যক্তির আচরণের নিয়ামক। কোনো বিশেষ সমাজের বাস্তব অবস্থার বিশ্লেষণ ব্যতিরেকে ব্যক্তির আচরণের সঙ্গতি-অসঙ্গতি নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। বাস্তব অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কহীনভাবে কোনো চরম আদর্শ ব্যক্তির সামনে পেশ করা নিরর্থক। কাণ্ট তাঁর নীতিশাস্ত্রে এই সত্যকে অস্বীকার করেছেন।
Catharsis: বিমোক্ষণ
পুঞ্জিভূত আবেগ বা শক্তির মাধ্যমে শক্তির আধারে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া বা উপায়কে ক্যাথারসিস বা বিমোক্ষণ বলা হয়। ইংরেজী ক্যাথারসিস শব্দের মূল গ্রিক শব্দের অর্থে বিশুদ্ধকরণের ভাব যুক্ত ছিল। গ্রিক গণ তাদের সৌন্দর্যতত্ত্বে এবং সাহিত্যে এই অর্থে শব্দটির ব্যাখ্যা করেছেণ। এ্যারিস্টটল ব্যক্তির উপর সঙ্গীতের প্রভাব আলোচনা করে বলছেন যে, ব্যক্তির উপর সঙ্গীতের একটি বিশুদ্ধকরণে দিক আছে। সঙ্গীতের মাধ্যমে ব্যক্তির আবেগের প্রকাশ ঘটে এবং ব্যক্তি তার ফলে আনন্দ বা স্বস্তি বোধ করে। আধুনিককালে মনোবিজ্ঞানে, বিশেষ করে মানসিক রোগ নিরাময়ের একটি উপায় হিসাবে, বিমোক্ষণের উল্লেখযোগ্য ব্যবহার দেখা যায়। মনোবিকলনের ফ্রয়েডীয় বিশ্লেষণের ভিত্তিতে মনোবিকলনের রোগীকে যদৃচ্ছা আবেগ প্রকাশের সুযোগ দেওয়া হয়। এরূপ ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানী অনুমান করেন যে, রোগীর মনে তার অপূর্ণ কামনা বাসনা, ইচ্ছা অনিচ্ছাসঞ্জাত যে আবেগ জমা হয়ে আছে তা যে কোন প্রকারে প্রকাশের পথ পেলে রোগী আবার রোগপূর্ব স্বাভাবিক ভারসাম্য ফিরে পাবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবেগ বিমোক্ষণের এ পদ্ধতি রোগীর মনকে হালকা করে তার ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে। কিন্তু ব্যক্তির ভারসাম্য বিনষ্টির কারণ ব্যক্তির নিজের মধ্যে তত নয় যত তার পরিবেশ ও সমাজের মধ্যে। রোগীকে সমাজ-নিরপেক্ষ বিবেচনা করে তার মনের কথায় বা সীমাবদ্ধ আচরণে প্রকাশের সুযোগদান কোনো স্থায়ী ফল দিতে পারে না। এ কারণে বিমোক্ষণে আবেগ প্রকাশের একটি পদ্ধতি হলেও তা মনোবিকলনের ক্ষেত্রে নিরাময়ের কোনো নিশ্চিত উপায় হয়ে উঠে নি।