Catholicism: ক্যাথলিকবাদ
খ্রিষ্টান ধর্মের মধ্যে দুটি সম্প্রদায় প্রধানঃ ক্যাথলিক এবং প্রটেষ্টান্ট সম্প্রদায়। মূল খ্রিষ্টান ধর্মের আচার, আচরণ, ব্যাখ্যা প্রভৃতি ক্ষেত্রে মত পার্থক্য থেকে এই দুই সম্প্রদায়ের উদ্ভব। ক্যাথলিক সম্প্রদায়ই গোড়াকার ধারা। প্রটেস্টান্ট সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটেছে পরবর্তীকালে ষোড়শ শতকে জার্মানীর মার্টিন লুথারের নেতৃত্বে। ক্যাথলিকবাদ খ্রিষ্টান ধর্মের গোঁড়া মতবাদ। ক্যাথলিকবাদের বিশ্বাস পবিত্র আত্মার উৎস কেবল ঈশ্বর নয়। তার উৎস যিশুখ্রিষ্ট বা ঈশ্বরের পুত্রও। পরলোকে পারগেটরী বা পাপীদের শোধনাগারও ক্যাথলিকদের বিশ্বাসের একটি অংশ। পোপ দোষত্রুটিশূণ্য। ক্যাথলিকবাদে ধর্মযাজকদের জন্য বিবাহ এবং পারিবারিক জীবন নিষিদ্ধ। রোমের ভ্যাটিকান হচ্ছে পোপের রাজধানী। ইউরোপে মধ্যযুগে পোপতন্ত্র কেবল ধর্শের ক্ষেত্রে নয়, পার্থিব সম্পদ ও শক্তিরও এক বিপুল সাম্রাজ্য হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এখনও পৃথিবীতে খ্রিষ্টান ধর্মের মধ্যে ক্যাথরিকদের প্রভাব এবং সাংগঠনিক শক্তি প্রধান।
Causality: কার্য-কারণবাদ
দর্শন শাস্ত্রের একটি শব্দ। দুটি বস্তু বা ঘটনার মধ্যকার অনিবার্য সম্পর্ককে কার্যকারণ সম্পর্ক বলে অভিহিত করা হয়। দুটি ঘটনার যেটি পূর্বে সংঘটিত হয় তাকে কারণ এবং যেটি তার ফল হিসাবে পরে সংঘটিত হয় তাকে কার্য বলে। কার্য-কারণ সম্পর্ক দুটি ঘটনা বা বস্তুর সম্পর্ক হলেও কার্য ও কারণ হিসাবে দুটি ঘটনা বিশ্বের অপরাপর ঘটনা থেকে বিযুক্তভাবে সংঘটিত হয় না। উপলব্ধির সুবিধার জন্য আমরা দুটি ঘটনাকে অপরাপর ঘটনা থেকে বিযুক্তভাবে ভাবার চেষ্টা করি। কিন্তু আসলে যে ঘটনাকে কার্য বলে অভিহিত করা হচ্ছে সে একই সময়ে অপর ঘটনার কারণ এবং যাকে কারণ বলে অভিহিত করা হচ্ছে সে অপর ঘটনার কার্য বা ফল হিসাবে সংঘটিত হচ্ছে। বস্তুর সমগ্র বিশ্বচরাচর কার্য কারণের সামগ্রিকসূত্রে আবদ্ধ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কারণ হিসাবে হিটলারের কথা উল্লেখ করা যায়। কিন্তু সে হিটলার জার্মানীর তৎকালীন অর্থনৈতিক-সামাজিক রাষ্ট্রীয় অবস্থারই কার্য বা ফল। আবার বিংশ শতকের ধনতন্ত্রবাদী দুনিয়ার অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণেই জার্মানীর সেই সামাজিক অর্থনৈতিক রাষ্ট্রীয় অবস্থার সৃষ্টি। তাই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কারণ কেবল হিটলার নয়। একটি কার্যের সামগ্রিক কারণ তাই একটি নির্দিষ্ট কারণের চেয়ে বৃহত্তর। কোনো ঘটনার নির্দিষ্ট কারণ তার সামগ্রিক কারণের ভিত্তিতেই উপলব্ধি করা সম্ভব। কিন্তু প্রাত্যহিক জীবনে সামগ্রিক কারণ উপলব্ধি করে আমরা জীবন যাপন করি নে। একটি ঘটনার নির্দিষ্ট কারণকেই আমরা স্থির করার চেষ্টা করি।
ঘটনামাত্রেরই কারণ আছে কিংবা কারণমাত্রেরই ফলাফল আছে। কথাটা স্বতঃসিদ্ধ হলেও দর্শনে কার্যকারণের কথা একটি মৌলিক বিষয়। প্রাচীন ভারতের বৈশেষিক দর্শন থেকে শুরু করে আধুনিক ইউরোপের অজ্ঞেয়বাদী হিউমের দর্শনেও কার্যকারণের সমস্যা বিশেষ আলোনার বিষয় বলে বিবেচিত হয়েছে। অন্যান্য সমস্যার ন্যায় কার্যকারণের সমস্যার আলোচনারও দুটি ধারণা দেখা যায়। একটি হচ্ছে ভাববাদী ধারা; অপরটি বস্তুবাদী। ভাববাদী মতে ঘটনায়-ঘটনায় কিংবা বস্তুতে-বস্তুতে কার্যকারণের সম্পর্ক আমাদের মনের কল্পনার বিষয়। কার্যকারণ সম্পর্ক কোনো বস্তু বা ঘটনা নয়। সুতরাং কার্যকারণ সম্পর্ক দৃশ্য নয়। আমরা বস্তুকে দেখি, কিন্তু বস্তুতে বস্তুতে সম্পর্ককে দেখি নে। আমরা আগুণ দেখতে পারি। আমরা ধোঁয়া দেখতে পারি, কিন্তু আগুন ও ধোঁয়ার মধ্যে কার্যকারণ রয়েছে বা আগুন ধোঁয়ার কারণ এবং ধোঁয়া আগুনের কার্য বা ফল এটা আমরা দেখতে পারি নে। হিউমা এই যুক্তিতে কার্যকারণ সম্পর্কের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করতে চেয়েছেন। দার্শনিক কাণ্ট একদিকে কার্য-কারণ সম্পর্কের বাস্তবতাকে অস্বীকার করেছেন, আবার অপরদিকে তাকে আমাদের জ্ঞানের অন্যতম অপরিহার্য সূত্র বা মাধ্যম বলে আখ্যাত করেছেন। তাঁর মতে অন্যান্য মূলসূত্রের ন্যায় কার্য-কারণ সম্পর্কের ধারণা আমাদের একটি অভিজ্ঞতা-পূর্ব জন্মগত ধারণা। বস্তুবাদী দর্শন, বিশেষ আধুনিককালের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী দর্শন, কার্যকারণ সম্পর্কের ভাববাদী ব্যাখ্যাকে অস্বীকার করে। এই মত অনুযায়ী মানুষের জ্ঞানলাভের পদ্ধতি হচ্ছে মানুষের সাথে বস্তুর সাক্ষাৎ সম্পর্কের অভিজ্ঞতার নিয়ত বিকাশমান প্রক্রিয়া। বাস্তব ঘটনাকে মানুষ আদিকাল থেকে প্রত্যক্ষ করেছে। মানুষ হিসাবে এই অভিজ্ঞতার পথেই ঘটনার সম্পর্কের কার্যকারণরূপ সে উপলব্ধি করেছে এবং আবিস্কার করেছে। কার্যকারণ যে, বস্তু জগতের প্রতিটি অণুর সঙ্গে অপর অণুর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া-ঘটনা মানুষের কল্পনার বিষয় নয়। আর এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াই হচ্ছে বস্তুর কার্যকারণ সম্পর্ক। একটি আলপিন আমার আঙুলে বিদ্ধ হয়েছে। এটি প্রত্যক্ষ ঘটনা। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়াতে আঙুল থেকে রক্ত নির্গত হচ্ছে এবং আমি ব্যথা বোধ করছি। বিশ্বচরাচরের বস্তুজগতে বস্তুতে বস্তুতে কোনো ফাঁক বা শূন্যনা নেই। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সতত সম্পর্কে বস্তু-জগৎ আবদ্ধ এবং ক্রিয়াশীল।
Chaitanya: চৈতন্য (১৪৮৫-১৫২৭ অথবা ১৫৩৪ খ্রি.)
বৈষ্ণব ধর্মের চৈতন্য সম্প্রদায়ের প্রবর্তক। বাংলাদেশ শ্রী চৈতন্য বা চৈতন্যদেব বলে সুপরিচিত। বর্তমান পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া জেলার ১৪৮৫খ্রিষ্টাব্দে একটি ব্রাহ্মণ পরিবারে চৈতন্যদেবের জন্ম হয়। কিশোর বয়সেই চৈতন্যদেব সংস্কৃত ভাষায় এবং হিন্দু ধর্মের গীতা এবং ভাবগত পুরানে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। গীতায় কৃষ্ণা বা ঈশ্বরের উপর ভক্তি স্থাপনকে মানুষের মুক্তির প্রকৃষ্টতম উপায় হিসাবে বলা হয়েছে। চৈতন্যদেব গীতার এই ভক্তিতত্ত্বে বিশেষভাবে প্রভাবিত হন।
পঁচিশ বছর বয়সে শ্রী চৈতন্য সংসার ত্যাগ করে সন্নাসব্রত অবলম্বন করেন। এই পর্যায়ে তিনি উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের প্রায় সকল প্রধান ধর্ম-কেন্দ্রগুলি পরিভ্রমণ করেন এবং পরিশেষে উড়িষ্যার জগন্নাথ মন্দিরকে নিজের ধর্ম প্রচারের কেন্দ্র হিসাবে নির্দিষ্ট করেন। চৈতন্যদেবের পরলোকগমন সম্পর্কে মতভেত আছে। চৈতন্য সম্প্রদায় মনে করে, চৈতন্যদেব সমুদ্রের তরঙ্গশীর্ষে তাঁর অরাধ্য কৃষ্ণকে রাধার সঙ্গে নৃত্যরত দেখেন এবং কৃষ্ণের সঙ্গে মিলনের আকর্ষণে তিনি গভীর সমুদ্রে গিয়ে নিমজ্জিত হন। অপর অনেকের মত হচ্ছে শ্রী চৈতন্য ১৫৩৪ খ্রীস্টাব্দে পরলোকগমন করেন।
শ্রী চৈতন্য-প্রচারিত ধর্মের মূল কথা ভক্তিতেই মুক্তি, যুক্তি কিংবা কোনো আচার-আচরণ বা পূজায় নয়। ঈশ্বর করুণার আধার। শিশুতে, প্রেমাস্পদে এবং সর্বজীবে মায়া ও মমতারূপে তার প্রকাশ। মানুষে মানুষে জাতি বা বর্ণের কোনো পার্থক্য নেই। ঈশ্বরকে লাভ করার জন্য প্রেমময়রূপে কল্পনা করতে হবে। তাকে প্রেমাস্পদের ন্যায় ভালবাসতে হবে। রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের উপাখ্যান চৈতন্যদেব তার ধর্মীয়তত্ত্ব আরোপ করেন।
শ্রী চৈতন্যের প্রবর্তিত ধর্মের একটি সামাজিক তাৎপর্য আছে। চৈতন্যদেব হিন্দু ধর্মেরই একজন ব্যাখ্যাতা। হিন্দু ধর্মের বর্ণাশ্রম প্রথা এবং ব্রাহ্মণদের একাধিপত্যের বিরুদ্ধে বৌদ্ধ ধর্ম একদিন বিরাটভাবে প্রসার লাভ করেছিল। বৌদ্ধধর্ম হিন্দুধর্মের বর্ণাশ্রমপ্রথা এবং জন্মান্তরবাদ তত্ত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ ছিল। বৌদ্ধধর্ম হিন্দুধর্মের বর্ণাশ্রমপ্রথা এবং জন্মান্তরবাদ তত্ত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ ছিল। বৌদ্ধধর্মের প্রসারে হিন্দুধর্ম অনেকটা আঘাতপ্রাপ্ত হয়। হিন্দুধর্মের মূল আচার সর্বস্বতাও অনেকের মনে হিন্দুধর্ম সম্পর্কে বিরূপ ধারণার সৃষ্টি করে। শ্রী চৈতন্য হিন্দুধর্মের নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে তাকে এই দ্বিবিধ আক্রমণ থেকে রক্ষা করার প্রয়াস পান। তাঁর মন্দিরে বংশ, বর্ণ বা জাতির কোনো ভেদাভেদ থাকবে না –এ নীতি সমাজের নির্যাতিত মানুষের মনে প্রবল আবেগের সঞ্চার করে। ফলে চৈতন্যদেবের ব্যাখ্যার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত চৈতন্যবাদ ভারতবর্ষে বিভিন্ন অংশে বিশেষ করে বাংলাদেশে নির্যাতিত শ্রেণীর মধ্যে দ্রুত প্রসার লাভ করে। বাংলা সাহিত্যে চৈতন্যদেবের ভক্তিবাদ প্রেমমুলক গীতিকবিতার সৃষ্টি করে। নতুন দৃষ্টিতে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম নিয়ে বাংলার কবিগণ সাহিত্য সৃষ্টি করতে শুরু করেন। চৈতন্য অনুসারীগণ চৈতন্যদেবকেও ঈশ্বররূপে কল্পনা করে তাঁর প্রতি ভক্তি প্রকাশের জন্য তাঁর প্রশংসামূলক জীবনী রচনা করতে শুরু করেন। এর ফলে বাংলা কাব্য সাহিত্যে যে নতুন সৃষ্টির প্রাবল্য দেখা দেয়, তাকে সাহিত্যের ইতিহাসকারগণ চৈতন্যযুগ বলে আখ্যায়িত করেন।
শ্রী চৈতন্যের ধর্মতত্ত্বের দার্শনিক তাৎপর্যটি এই যে, চৈতন্যের মতে ঈশ্বর এবং তার প্রকাশের জন্য তাঁর প্রশংসামূলক জীবনী রচনা করতে শুরু করেন। এর ফলে বাংলা কাব্য সাহিত্যে যে নতুন সৃষ্টির প্রাবল্য দেখা দেয়, তাকে সাহিত্যের ইতিহাসকারগণ চৈতন্যযুগ বলে আখ্যায়িত করেন।
শ্রী চৈতন্যের ধর্মতত্ত্বের দার্শনিক তাৎপর্যটি এই যে, চৈতন্যের মতে ঈশ্বর এবং তার প্রকাশের মধ্যে একদিকে যেমন কোনো দ্বৈত ভাব নেই, তেমনি অপর দিকে ঈশ্বরের প্রকাশ এবং ঈশ্বরওএক কথা নয়। প্রাচীন বৈষ্ণব ধর্ম ঈশ্বর এবং তার প্রকাশকে দ্বৈতরূপে কল্পনা করেছে। এর উপর ভিত্তি করে বৈষ্ণব ধর্মের দ্বৈতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চৈতন্য ঈশ্বর বা চরম সত্তার সঙ্গে তার প্রকাশের দ্বৈতরূপ বা বিরোধকে অস্বীকার করেছেন। কিন্তু অপরদিকে তিনি মানুষ অর্থাৎ চরম সত্তার প্রকাশকে ভক্তির মাধ্যমে পরিণামে পরম সত্তার মধ্যে নিজের অস্তিত্ব লোপ করে দেবার লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হতে বলেছেন। একদিকে দ্বৈতভাবের অস্বীকার, অপরদিকে ভক্তির মাধ্যমে ঈশ্বর প্রাপ্তির কথা বলার জন্য শ্রী চৈতন্যের অভিমতকে অচিন্ত্য বা অভাবনীয় ভেদাভেদ বলে ভারতীয় দর্শনে আখ্যায়িত করা হয়। চৈতন্যদেবের ভক্তিবাদ এবং মুসলিম সুফী চিন্তাবিদদের মতবাদের মধ্যে বিশেষ মিল দেখা যায়।
Chartism: চার্টিস্ট আন্দোলন, চার্টার বা অধিকার আন্দোলন (১৮৩৮-১৮৪৮)
উনিশ শতকের ইংল্যাণ্ডের গণঅধিকার অর্জনের ঐতিহাসিক একটি এন্দোলনের নাম ‘চার্টিস্ট আন্দেলন’ বা চার্টার আন্দোলন। রাজনৈতিক অধিকারসহ ১৮৩৮ এর গণঅধিকার অর্জন এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল। জনসাধারণের দাবির অন্যতম ছিল প্রাপ্তবয়স্কদের সর্বজনীন ভোটাধিকার, পার্লামেন্টের নিয়মিত বার্ষিক অধিবেশন আহবান, ব্যালটের মাধ্যমে ভোটপ্রদান, পার্লামেন্টের সদস্যদের ভাতা দান, নির্বাচনী এলাকাগুলির সম আকার, পার্লামেন্টের সদস্য হওয়র জন্য বিশেষ পরিমাণ আর্থিক সঙ্গতি থাকার শর্ত বিলোপ। এই সমস্ত দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের নেতারা ১৮৩৯ সনে একটি জাতীয় কনভেনশন আহবান করেন। এবং সে কনভেনশনে পার্লামেন্টে গণসহিসহ গণদরখাস্ত পেশকরার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। গণসহি সংগ্রম সরে সেই গণসহির স্তূপ বহন করে পার্লামেন্টে নিয়ে আসার চেষ্টায় পুলিশ বাধা দিলে জনসাধারণের সঙ্গে একাধিক সংঘর্ষ সংঘটিত হয়। বার্মিংহামে এরূপ সংঘর্ষে ২৪ জন চার্টিষ্ট বা চার্টার আন্দোলনের কর্মী নিহত হয়। এই গণ আন্দোলন ১৮৩৮ থেকে ১৮৪৮ পর্যন্ত নানা অবস্থার মধ্য দিয়ে অব্যাহত থাকে। ১৮৩৯, ১৮৪২ এবং ১৮৪৮: তিন দফায় গণসহিসহ গণদরখাস্ত পার্লামেন্টে পেশ করা হয়। প্রতিবারই পূর্বের চেয়ে অধিকতর সংখ্যক সহি সংগৃহীত হতে থাকে। প্রথমে ১২ লক্ষ, দ্বিতীয় বারে ৩৩ লক্ষ এবং তৃতীয়বারে প্রায় ৫০ লক্ষ সহি সংগৃহীত হয়। এ সহির বোঝা এত বিরাট আকার এবং ভারী হয় যে ১৮৪২ সালে এই সহির বোঝা একটা বিরাট পাত্রে স্থাপন করে বিশজন আন্দোলনকারীকে বহন করতে হয়।
বস্তুত এত বিপুল আকারে সহি সংগ্রহ করার ঘটনা ইতিহাসে ইতোপূর্বে আর কখনো ঘটে নি। সহি সংগ্রহ উপলক্ষে আন্দোলনকারীগণ সমাজের সমস্যাসমূহ নিয়ে যে সভা, আলোচনা ইত্যাদি সংগঠিত করে তাতে শ্রমিকসহ সমাজের নিচের তলার ব্যাপকতর মানুষ আলোড়িত হয়ে ওঠে। এই আন্দোলন শ্রমিকদের দ্বারাই পরিচালিত হয় এবং আন্দোলনের ফলে শ্রমিকদের মধ্যে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের শক্তি সম্পর্কে একটি অভূতপূর্ব উপলব্ধির সৃষ্টি হয়। ১৮৪০ সনে চার্টিস্টরা একটি ঐক্যবদ্ধ চার্টিস্ট পার্টি তথা একটি শ্রমিক পার্টি গঠন করার সর্বপ্রকার চেষ্টা করে। চার্টিষ্ট আন্দোলন পুঁজিবাদী শাসনের সে যুগের ক্ষমতা ও অবস্থার পটভূমিতে বাহ্যত ব্যর্থ হলেও শ্রমজীবী মানুষের চেতনা সঞ্চারে এক বিরাট ভূমিকা পালন করেছিল। এ কারণে শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে ইংল্যাণ্ডের চার্টিস্ট আন্দোলন একটি উল্লেখযোগ্য তাৎপর্যপূর্ণ আন্দোলন
Charvake: চার্বাক
ভারতীয় দর্শনের বস্তুবাদী মতবাদ চার্বাকবাদ বলে পরিচিত। বস্তুবাদী দর্শনকে লোকায়ত দর্শনও বলা হয়। ভারতীয় দর্শনকে সাধারণত ভাববাদী বলে মনে করা হয়। কিন্তু গ্রীক দর্শনের ন্যায় ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসেও অতি প্রাচীনকাল থেকে বস্তুবাদী দর্শনের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। ঋগবেদে বৃহস্পতির যে মতের উল্লেখ দেখা যায় সে মতকে ভারতীয় দর্শনের আদি বস্তুবাদী মত বলা যায়। বস্তুই হচ্ছে চরম সত্তা –ঋগবেদে বৃহস্পতি এরূপ অভিমতের উল্লেখ আছে। বৃহস্পতির এই বস্তুবাদী অভিমতের অনুসরণ করে চার্বাকবাদের উৎপত্তি ঘটে। মহাকাব্য রামায়ণে ঋষি জাবালীর উক্তির মধ্যেও বস্তুবাদী ভাব পাওয়া যায়। বার্চাকবাদী দর্শনের ভিত্তি হচ্ছে জ্ঞানতত্ত্ব। তাদের মতে জ্ঞানের ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান বা প্রত্যক্ষ জ্ঞানই হচ্ছে যথার্থ জ্ঞান। প্রত্যক্ষ জ্ঞানের বাইরে কোনো জ্ঞানই সংশয়মুক্ত হতে পারে না। চার্বাক দর্শনে গোড়ার দিকে ইন্দ্রিয়কে জ্ঞানের একমাত্র মাধ্যম মনে করা হত। এ কারণে চার্বাক দর্শনে প্রথমে আনুমানকে জ্ঞানের উপায় হিসাবে স্বীকার করা হয়নি। প্রত্যক্ষভাবে মানুষ কেবল বিশেষকেই জানতে পারে, নির্বিশেষকে নয়। এ জন্য যে জ্ঞান বিশেষের নয়, নির্বিশেষের সে জ্ঞানের কোনো নিশ্চযতা নেই। অনুমান হচ্ছে নির্বিশেষে জ্ঞান। কিন্তু অনুমানকে অস্বীকার করলে আমাদের জ্ঞানের পরিধি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এই উপলব্ধি থেকে পরবর্তীযুগের চার্বাকবাদীগণ ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের সঙ্গে অনুমানকেও জ্ঞানের একটি মাধ্যম বলে স্বীকার করেছেন। অনুমানের অস্বীকৃতির ভিত্তিতে আদি চার্বাকবাদীগণ কার্যকারণের জ্ঞানকেও অগ্রাহ্য করেন। মানুষ ঘটনাকেই শুধু প্রত্যক্ষ করতে পারে। তাদের মধ্যকার সম্বন্ধকে সে প্রত্যক্ষ করতে পারে না। ঘটনায় ঘটনায় কোনো প্রত্যক্ষ যোগ সম্পর্ক নেই। মানুষ বলে, আগুণের কারণে ধোঁয়া সৃষ্টি হয়। চার্বাক দর্শনের মতে আগুন এবং ধোঁয়া দুটি ঘটনা। মানুষ এই ঘটনা দুটিকেই প্রত্যক্ষ করতে পারে। আগুণ ও ধোঁয়ার মধ্যে কোনো সম্পর্ককে সে প্রত্যক্ষ করতে পারে না। কাজেই একটি অপরটির কারণ কিংবা ফল একথা বলার উপায় নেই। চার্বাকবাদীদের এই মতের সঙ্গে ইউরোপীয় অজ্ঞেয়বাদী দার্শনিক হিউমের কার্যকারণতত্ত্বের মিল দেখা যায়। চার্বাকবাদীগণ ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ অর্থাৎ মাটি, পানি ও আগুন এবং বায়ু এই চাররকম বস্তুকে সমস্ত সৃষ্টির মূল বলে স্বীকার করেন। বস্তু থেকেই জীবনের সৃষ্টি। চেতনার কোনো দেহাতীত অস্তিত্ব নেই। মনুষ দেহ এবং তার চেতনা হচ্ছে মূল-সত্তা ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুতের যৌগিক মিশ্রণের ফল। মন বা আত্মারও কোনো দেহাতীত অস্তিত্ব নেই। দেহের মৃত্যুর সঙ্গে চেতনা বা আত্মারও মৃত্যু ঘটে। জীবন্ত দেহ মৃহ হয়ে পরিশেষে তার মূল বস্তুতে পরিণত হয়। এই তত্ত্বের ভিত্তিতে আত্মার পুনর্জন্মকে সর্বকালের চার্বাকবাদীগণই অস্বীকার করেছেন। বিশ্বচরাচরের সৃষ্টি হয়েছে মূল পদার্থের আকষ্মিক সংমিশ্রণে, কোনো অতি প্রাকৃতিক স্রষ্টার কারণে নয়। ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে কোনো প্রত্যক্ষ জ্ঞান মানুষের নেই। ভারতীয় দর্শনের ভাববাদ যেখানে জগৎকে মায়া এবং দুঃখপূর্ণ বলে অভিহিত করেছে চার্বাকবাদীগণ সেখানে জগৎ এবং জীবনকে আশাবাদের দৃষ্টিতে দেখেছেন। চার্বাকবাদীদের মতে জগৎ কেবল দুঃখপূর্ণ নয়। জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে সুখলাভ। সুখই হচ্ছে যথার্থ উত্তম। চার্বাকবাদীদের সুখলাভের তত্ত্বকে ভাববাদীগণ বিকৃত করে তাকে কেবলমাত্র স্থূল এবং অবিমিশ্র সুখের তত্ত্ব বলে ব্যাখ্যা করেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি ‘ঋণং কৃত্য ঘৃতং পিবেৎ’ প্রবচনকে বিকৃতভাবে চার্বাকবাদীদের জীবনদর্শন বলে প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু চার্বাকবাদীগণ অবিমিশ্র সুখের কল্পনাকে অসার বলেছেন। ‘ঋণ করেও ঘৃত’ খাবার নীতি দ্বারা চার্বাকগণ জীবনে দুঃখকে বড় না করে দুঃখের মধ্যেও জীবনকে আনন্দময় ভাবার চেষ্টা করতে বলেছেন। চার্বাকবাদীগণ সামাজিক শ্রেণীভেদকেও অস্বীকার করেছেন। ব্রাহ্মণ কিংবা চণ্ডাল সকলের দেহের রক্তের রঙই লাল, এরূপ দ্বিধাহীন সাম্যমূলক উক্তি চার্বাকবাদীগণ করেছেন। বস্তুত ভারতীয় দর্শনে চার্বাকবাদ কোনো এক বিশেষ ব্যক্তির দর্শন নয়। প্রতি যুগের কুসংস্কার এবং অজ্ঞানতার প্রতিবাদই চার্বাকবাদ। ভারতীয় দর্শনে বিভিন্ন যুগে ভাববাদী চিন্তা ধারাই প্রাধান্য লাভ করেছে। প্রধান সেই ভাবধরারা চার্বাকবাদী বা লোকায়ত চিন্তাধারাকে তার প্রতিপক্ষ মনে করে তাকে বিকৃত এবং নিষিদ্ধ করেছেন। চার্বাকবাদ কোনো প্রখ্যাত দার্শনিকের দর্শন হিসাবে স্বীকৃত না হলেও ভাববাদী ধারার আক্রমণের ভিতরে তার অস্তিত্বের প্রমাণ স্পষ্ট।
Chinese Philosophy: চীনা দর্শন
চীনের দর্শনের ইতিহাস ভারত ও গ্রীক দর্শনের ন্যায় সুপ্রাচীন। খ্রীষ্টাব্দের হাজার বছর পূর্বেও চীনে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্নের দার্শনিক আলোচনার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এই সময়ে চীনে দর্শনের বৈশিষ্ট্য ছিল বস্তুবাদী। কিছু সংখ্যক দার্শনিক সূত্র এই সময়ে প্রচলিত ছিল। এই দার্শনিক সূত্রগুলির বক্তব্য ছিল যে, বিশ্বপ্রকৃতির মূলে রয়েছে পঞ্চশক্তি যথা –পানি, আগুন, কাঠ, ধাতু এবং মাটি। সমস্ত সৃষ্টি এই পঞ্চশক্তির সম্মেরনেরই ফল। পরবর্তীকালে ইকিং বা পরিবর্তনের গ্রন্থে এই সূত্রগুরি গ্রথিত হয়। ইকিং-এ বিশ্বপ্রকৃতির মূল হিসাবে পাঁচটির বদলে আটটি বস্তুর উল্লেখ দেখা যা। ইকিং –এর বাইরে ইন এবং ইয়াং বলে আরও দুটি সূত্রের কথাও জানা যায়। ইন-এর অর্থ হচ্ছে স্থিতি এবং ইয়াং-এর অর্থ গতি। এদেরকে অনেক সময় যথাক্রমে প্রকৃতির অন্ধকার এবং আলো; অস্তি এবং নাস্তি; পুরুষ এবং স্ত্রী হিসাবে উল্লিখিত হতে দেখা যায়। খ্রিষ্টাব্দ শুরু হওয়ার পূর্বে পঞ্চম থেকে তৃতীয় শতাব্দীতে প্রাচীন চীনা দর্শন অধিকতর সুস্পষ্ট রূপ লাভ করে।এই সময়ে চীনা দর্শনের বিভিন্ন প্রাচীন মতবাদ বা শাখা বিকাশ লাভ করে। এদের মধ্যে তাও দর্শণ এবং মোতিদর্শন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। লাওজ এবং চুংজুকে তাও দর্শনের প্রধান ব্যাখ্যাতা বলা হয়। এঁরা বস্তুর অস্তিত্ব এবং চরিত্র ইত্যাকার দার্শনিক সমস্যার আলোচনা করেন। অপরকে দার্শনিক মোতি এবং তাঁর অনুসারীগণ জ্ঞানের সমস্যা মীমাংসা করার চেষ্টা করেছেন। এ আলোচনায় ভাববাদী ব্যাখ্যারও সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। কুংসুঙলুন নামক দার্শনিক ভাবকে বস্তুনিরপেক্ষ ভাবের মিল দেখা যায়। নীতিগত এবং রাষ্ট্রীয় প্রশ্নে কনফুসিয়াস এবং মেঙজুর মতের প্রসার ঘটে। প্রাচীন চীনা দর্শনের এ যুগকে স্বর্ণযুগ বলে অভিহিত করা হয়। এই যুগের দার্শনিক আলোচনার বিষয় ছিল প্রধানত আকাশ ‘মনের ভাব’, ধর্মশক্তি, চরিত্র, বস্তুর মৌলিক গুণ ইত্যাদি। কনফুসিয়াস ও মেঙজুর মতামতের বৈশিষ্ট্য ছিল, একজন যেখানে মানুষকে স্বভাবগতভাবে ভালো মনে করেছেন, অপরজন সেখানে মানুষকে স্বভাবগতভাবে খারাপ মনে করেছেন। খ্রিষ্টাব্দের প্রথম শতকে চীনা দর্শনে ভাববাদ ও বস্তুবাদের দ্বন্দ্ব অধিকতর স্পষ্টরূপে আত্মপ্রকাশ করে। চীন ভূখণ্ডে বৌদ্ধধর্মের প্রসারও এই যুগে ঘটতে থাকে। কনফুসিয়াসবাদ এবং তাওবাদের সঙ্গে বৌদ্ধবাদ একটি তৃতীয় দার্শনিক মত হিসাবে অনুসৃত হতে শুরু করে। বৌদ্ধবাদীগণ জগৎকে মায়া বলে ব্যাখ্যা করেন। কনফুসিয়াস ও তাওবাদ ভাববাদী দর্শনের উদগাতা। কিন্তু কেবল ভাববাদী দর্শনই নয় –এই যুগের বিখ্যাত দার্শনিক হো চেন তিয়েন এবং ফানচেন জগৎ, অস্তিত্ব, আত্মার অমরতা ইত্যাদি প্রশ্নে বস্তুবাদী মত প্রচার করেন। দশম থেকে ত্রয়োদশ শতকে চীনের সমাজ পরিবর্তন তার ভাবাদর্শেও প্রকাশ পেতে শুরু করে। ভাব এবং বস্তুর প্রকৃতি ও সম্পর্কের ক্ষেত্রে কনফুসিয়াস ও বুদ্ধের মতবাদের স্থানে নবকনফুসিয়াসবাদের উদ্ভব ঘটে এই সময়ে। এই যুগের অন্যতম দার্শনিক চুশী ‘লী’ এবং ‘চী’ অর্থাৎ ভাব এবং বস্তুর মধ্যে ভাবকে প্রধান বলে গণ্য করে ভাববাদের পক্ষ অবলম্বন করেন। চীনের আধুনিক পর্বের শুরু হিসাবে আফিং যুদ্ধের বৎসর অর্থাৎ ১৮৪০ সালকে উল্লেখ করা যায়। এই সময় থেকে চীনের সমাজ জীবনে নতুন আলোড়ন ও পরিবর্তনের ধারা বইতে শুরু করে। একদিকে বৈদেশিক শক্তি চীনকে ক্রমান্বয়ে গ্রাস করার চেষ্টা করে। চীনের সঙ্গে আধুনিক জগতের সাক্ষাৎ পরিচয় ঘটতে শুরু করে। আবার অপরদিকে বিদেশীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধাত্মক জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ হতে আরম্ভ করে। চীন ক্রমান্বয়ে আধা উপনিবেশে পরিণত হয়। কিন্তু ভাবাদর্শের ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ নতুন সংগ্রামী বস্তুবাদী চিন্তাধারারও পথ প্রশস্ত করে দেয়। তাণসেতুঙ এবং সানইয়াত সেনের ন্যায় অগ্রসরবাদী চিন্তাবিদ এবং নেতৃবৃন্দ প্রাচীন বস্তুবাদের ঐতিহ্যকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা কজরে সামন্তবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে প্রচার এবং প্রয়োগ করতে শুরু করেন।
Christianity: খ্রিষ্টধর্ম
পৃথিবীর প্রচলিত প্রধান ধর্মসমূহের একটি হচ্ছে খ্রিষ্টধর্ম। যিশু খ্রিষ্টের উপদেশ এবং তাঁর মূল অনুসারীদের নতুন গ্রন্থ বা নিউটেস্টামেন্টে রক্ষিত কাহিনী ও কথামৃত হচ্ছে খ্রিষ্টধর্মের ভিত্তি।
খ্রিষ্টান ধর্মের উদ্ভব ঘটে পূর্ব রোমান-সাম্রাজ্যে নির্যাতিত দাস এবং দরিদ্র মানুষের মধ্যে। রোমান সম্রাটদের দ্বারা দাসদের বিদ্রোহ পর্যুদস্ত হওয়ায় দাস এবং দরিদ্রের মধ্যে হতাশার সঞ্চার হয়। কন্তু হতাশার মধ্যে তারা এই বিশ্বাসও পোষণ করতে থাকে, কোনো এক উদ্ধারকারী মর্তে আগমন করে সকল অত্যাচার থেকে তাদের মুক্ত করবে। এমন পরিস্থিতিতে যিশু অত্যাচারিত মানুষের ত্রাতা হিসাবে আবির্ভূত হন বলে এই ধর্মের অনুসারীগণ বিশ্বাস পোষণ করেন। এরূপ কাহিনী আছে যে, জুযিয়ার রোমান শাসক পন্টিয়াস পাইলেট ক্রুশে বিদ্ধ করে যিশুকে হত্যা করে। কিন্তু যিশু মৃত্যুর পরে পুনরায় সশরীরে পুনরুত্থিত হন এবং স্বর্গে আরোহন করেন। নির্যাতিতের কাছে অপর ধর্মসমূহের ন্যায় খ্রিষ্ট ধর্মেরও এই আশ্বাস যে, যারা সততার সঙ্গে দুঃখ কষ্ট ভোগ করেও জীবনযাপন করবে স্বর্গে তাদের সুখ লাভ হবে। অপরাপর অনেক ধর্মের ন্যায় খ্রিষ্ট ধর্মের মধ্যেও অনুসারীদের জাতি, অঞ্চল এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রভৃতির ভিত্তিতে মতামতের পার্থক্য সৃষ্টি হয়ে থাকে। এর ফলে কালক্রমে খ্রিষ্টান ধর্ম তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ক্যাথলিক ধর্ম, পূর্বাঞ্চলের মৌলবাদী খ্রিষ্টান ধর্ম এবং সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে ষোড়শ শতকে ইউরোপের মার্টিন লুথারের নেতৃত্বে সংগঠিত প্রটেস্ট্যান্ট ধর্ম। (দ্র. প্রটেস্ট্যান্টবাদ ও মার্টিন লুথার)
Cicero: সিসেরো (খ্রি. পৃ. ১০৬-৪৩)
প্রাচীন রোমের বাগ্মী, দার্শনিক এবং রাজনীতিক। প্লেটো যেরূপ সংলাপের আকারে রচিত গ্রন্থে তার দর্শনকে প্রকাশ করেছিলেন, সিসেরাও তেমন পদ্ধতিতে তাঁর দর্শন লিপিবদ্ধ করেন। সিসেরোর দর্শন প্রধানত সমন্বয়বাদী। জ্ঞানের ক্ষেত্রে সিসেরোকে সন্দেহবাদের সমর্থক বলা যায়। তাঁর মতে কোনটি সত্য, কোনটি মিথ্যা, তা নির্ণয় করার কোনো উপায় নেই। রাজনীতিক তত্ত্বের ক্ষেত্রে সিসেরোর এই শাসনব্যবস্থায় রাজতন্ত্রী, অভিজাততন্ত্রী এবং গণতন্ত্রী বৈশিষ্ট্যকে সম্মিলিত করা উত্তর বলে মনে করতেন। প্রাচীন রোমে, সিসেরোর জীবনকালে বিভিন্ন রাজনীতিক ব্যক্তিত্বের বিরোধ, লড়াই এবং পারস্পরিক হত্যা রাজনৈতিক জীবনের বৈশিষ্ট্য ছিল। খ্রি. পূ. ৪৯-এ জুলিয়াস সিজারের হত্যার পরে যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব চলতে থাকে তাতে খ্রি. পূ. ৪৩ সনে সিসেরো ক্ষিপ্ত জনতার হাতে নির্মমভাবে নিহত হন।
Class: শ্রেণী
Class Struggle: শ্রেণী সংগ্রাম
কোনো বৈশিষ্ট্য বা গুণের ভিত্তিতে যে-কোন সমষ্টিকে শ্রেণী বলে অভিহিত করা চলে। ‘শ্রেণী’ শব্দটি তত্ত্ব এবং বিজ্ঞানের বাইরে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের একটি বহুল ব্যবহৃত শব্দ। যুক্তিবিদ্যায় কোনো জাতিবাচক পদকে শ্রেণী বলা হয়। ‘মানুষ’, ‘পশু’, ‘বাঙালী’, ‘হিন্দু’, ‘মুসলমান’ –ইত্যাদি পদ শ্রেণীবাচক পদ। কোনো বিশেষ গুণের ভিত্তিতে একাধিক ব্যক্তি বা উপাদানের উপর প্রযোজ্য নাম। মার্কসীয় তত্ত্বে ‘শ্রেণী’ শব্দের প্রধান ব্যবহার অর্থনৈতিক ব্যবহার। জীবন ধারণের সম্পদের মালিকানা এবং অ-মালিকানার ভিত্তিতে কোনো সমাজের মানুষকে চিহ্নিত করার তত্ত্ব। মার্কসবাদের মতে মনুষ্যসমাজের আদিতে সামাজিক সম্পদের কোনো ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না। সে হিসাবে সেই আদি কালের মনুষ্যসমাজ শ্রেণীহীন ছিল বলে অনুমান করা চলে। জীভন যাপনের হাতিয়ার বা যন্ত্রপাতির বিকাশের একটা বিশেষ পর্যায়ে সম্পদের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা যখন সমাজের কোনো অংশের পক্ষে সম্ভব হয়, তখনই সমাজে এরূপ অর্থনৈতিক শ্রেণীর উদ্ভব হয়। এবং তারপর থেকে সমাজ বিকাশের প্রধান চালিকা শক্তি হিসাবে সম্পদের এরূপ মালিকশ্রেণী এবং সম্পদের মালিকানাবিহনীন সম্পদহীন শ্রেণীর মধ্যকার দ্বন্দ্ব এবং সংগ্রাম কাজ করে আসছে বলে মার্কসবাদ মনে করে। এ হিসাবে কার্ল মার্কস এবং এঙ্গেলস তাঁদের বিখ্যাত ‘কমিউনিষ্ট ইশতেহারে’ উল্লেখ করেন যে, ‘মানবজাতির জ্ঞান ইতিহাস হচ্ছে শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস’। অবশ্য মার্কসবাদের অপর এক তত্ত্ব হচ্ছে এই যে, মানুষের সমাজের বিকাশের পরিণতিতে ভবিষ্যতে সমগ্র সামাজিক সম্পদের উপর মানুষের সামাজিক মালিকানা যখন প্রতিষ্ঠিত হবে তখন এরূপ বৈষম্যমূল অর্থনৈতিক শ্রেণীর আর অস্তিত্ব থাকবে না।
Cognition: জ্ঞান প্রক্রিয়া
‘আমাদের জ্ঞান আছে, আমরা জ্ঞান আহরণ করি’ ইত্যাদি কথা আমরা সব সময়ই ব্যবহার করি। জ্ঞানের দ্বারাই মানুষ আদিকাল থেকে নিজের জীবন রক্ষা করে এসেছে, প্রকৃতিকে সে জয় করে চলেছে এবং মানুষের সভ্যতা সৃষ্টি করেছে। জ্ঞান বাদে মানুষ নাই। কিন্তু মানুষ কি করে জ্ঞানলাভ করে একটি দর্শনের একটি বিশেষ আলোচনার বিষয়। জ্ঞানের সমস্যার ক্ষেত্রে ভাববাদী দার্শনিক জর্জ বার্কলির মত খুব পরিচিত। তিনি এরূপ মত প্রকাশ করেছিলেন যদিচ মানুষ বস্তু জগৎকে জানে বলে স্বতঃসিদ্ধভাবে ধরে নেয়, তবু যুক্তিগতভাবে মানুষ বস্তুকে আদৌ জানতে পারে না। মানুষ কেবল তার মনের ভাবকেই জানে। বস্তু কথাটিও মানুষের মনের ভাব। বস্তুর অস্তিত্ব মানুষের মন জানতে পারে না। মানুষের জ্ঞান কতকগুলি প্রধান এবং অপ্রধান ধারণা দ্বারা গঠিত। প্রধান বা মৌল ধারণাগুলি বিশ্বচরাচরের বিধাতা মানুষের মনে সৃষ্টি করেদেন। সেগুলির ভিত্তিতেই মানুষ তার জ্ঞানের জগৎ তৈরী করে। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ জ্ঞানপ্রক্রিয়ার এই ভাববাদী ব্যাখ্যাকে অগ্রাহ্য করে। এই মতানুযায়ী মানুষের জ্ঞান হচ্ছে বস্তুজগতের সঙ্গে মানুষের ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ামূলক সম্পর্কের ফল। মানুষ তার জন্ম থেকে জৈবিক তাড়নাতেই বাইরের বস্তুকে নিজের জীবনের স্বার্থে আয়ত্ত করার চেষ্টা করে আসছে। বস্তুকে সে নিজের হাতে-পায়ে চোখে-কানে অনুভব করছে। এই প্রক্রিয়ায় বস্তু মানুষের দেহে এবং মস্তিষ্কের কোষে বিভিন্ন সাড়ার সৃষ্টি করেছে। এই মাধ্যমে মানুষের মস্তিষ্ক বিকাশলাভ করেছে। মানুষের মধ্যে বস্তু সম্পর্কে অনুধাবনের, ব্স্তুর উপর গুণ আরোপ করার এবং গুণের সাহায্যে বস্তুকে স্মরণ রাখার শক্তি জন্মেছে। বস্তুজগতের সঙ্গে মানুষের এই জটিল সম্পর্কই যেমন জ্ঞানের প্রক্রিয়া তেমনি এই প্রক্রিয়া থেকেই মানুষের জ্ঞানের সৃষ্টি। জ্ঞান বিধিদত্ত কোনো সম্পদ নয়। জ্ঞানকে মানুষই সৃষ্টি করেছে এবং করছে। বস্তু-বিচ্ছিন্নভাবে জ্ঞান এবং জগৎ বলে কিছু নেই। মানুষের জ্ঞানের লক্ষ্য হচ্ছে বাস্তব জগতের রহস্য উদঘাটন করা। বাস্তবকে জেনে জীবন রক্ষার স্বার্থে তাকে ব্যবহার করা, পরিবর্তন করা। জ্ঞান কোনো স্বয়ংসম্পূর্ণ সীমাবদ্ধ বিষয় নয়। জ্ঞানের প্রশ্নের মানুষের সঙ্গে তার বাস্তব জগতের সক্রিয় সম্পর্ক সর্বদাই জড়িত। মানুষের বাস্তব জগৎ আর্থিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় কাঠামো হিসাবে সংঘটিত। মানুষের জ্ঞানও তাই তার আর্থিক সামাজিক অবস্থার দ্বারা একদিকে যেমন নিয়ন্ত্রিত অপরদিকে তেমনি মানুষের জ্ঞান দ্বারা বিশেষ পর্যায়ের সামাজিক ও আর্থিক কাঠামো নিজেও নিয়ন্ত্রিত। ব্যবহার বাদে জ্ঞান অর্থহীন। মানুষ সতত যেমন তার পরিপার্শ্ব সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করছে তেমনি নিয়ত সেই জ্ঞানের প্রয়োগ দ্বারা তার পরিবেশকে নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য লাভের জন্য পরিবর্তিত করার চেষ্টা করছে।
Coherence: সামঞ্জস্য, সামঞ্জস্যবাদ
দর্শনে সত্যের মাপকাঠি নিয়ে তর্ক আছে। একটা কথা বা বক্তব্য সত্য –এরূপ দাবির অর্থ কি? কেউ যদি বলে, সে ভূত দেখেছে তা হলে তার সে কথাকে মিথ্যা বলে অভিহিত করি। কিন্তু ‘ওখানে একটি চেয়ার আছে’ এ কথাকে আমরা সত্য বলি। কিসের ভিত্তিতে একটি বাক্য বা বক্তব্যকে সত্য বলা হবে? সত্যের মাপকাঠির এই প্রশ্নে দর্শনে দুটি প্রধান তত্ত্বের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। একটি হচ্ছে ‘থিওরি অব করেন্সপণ্ডেন্স’। একে বাংলায় সাদৃশ্যের তত্ত্ব বলা যায়। অপরটি হচ্ছে থিওরি অব কোহারেন্স। একে সামঞ্জস্যের তত্ত্ব বলা যায়। সাদৃশ্যের তত্ত্বের দাবি হচ্ছে যে, কোনো বক্তব্য অনুযায়ী বাস্তব জগতে যদি কোনো অস্তিত্ব থাকে তবে সে বক্তব্যকে সত্য বলা হবে। ‘ওখানে একটি চেয়ার আছে’ এই বক্তব্য অনুযায়ী চেয়ার কথার সদৃশ কোনো বস্তুর যদি অস্তিত্ব বক্তব্যের মুহুর্তে থাকে তবে ওখানে একটি চেয়ার আছে কথাটি সত্য হবে।
সামঞ্জস্যবাদ ভিন্নতরভাবে সত্য নিরূপণ করতে চায়। এই তত্ত্বের ব্যাখ্যাদাতাতের মতে একটি বক্তব্যের বরাবর বাস্তব অস্তিত্ব সত্যের মাপকাঠি হতে পারে না। বিশ্লিষ্ট বা এ্যাবষ্ট্রাক্ট বক্তব্যের বরাবর কোনো বাস্তব অস্তিত্ব আমরা পাইনে। দয়া একটি মহৎ গুণ। কিন্তু দয়ার অস্তিত্ব কোথায়? দয়ালু মানুষ আছে বটে। কিন্তু মানুষ নিরপেক্ষভাবে স্বাধীন অস্তিত্ব সম্পন্ন দয়াকে আমরা দেখতে পাইনে। কাজই সাদৃশ্যের তত্ত্ব সমস্ত সত্যের ব্যাখ্যা করতে পারে না। সামঞ্জস্যবাদ অনুযায়ী সত্যের জগৎ হচ্ছে একটা সামগ্রিক সত্তা। তার অন্তর্ভুক্ত সমস্ত সত্যই পরস্পর যৌক্তিক সম্পর্কে সম্পর্কিত। তাই আমরা যখন কোনো কথা উচ্চারিত করি বা অভিমত পেশকরি তখন তার যথার্থতার বা সত্যের নিরূপণ হবে সত্যের সমগ্র সত্তার সঙ্গে সে সঙ্গতিময় কিংবা সঙ্গতিময় নয় তার বিচারে।
Comte, August: অগাস্ট কোঁতে (১৭৯৮-১৮৫৭ খ্রি.)
‘পজিটিভজম’ বা দৃষ্টবাদের প্রবক্তা ফরাসি দার্শনিক অগাস্ট কোঁতের দর্শন এবং তাঁর রচনাবীল দুটি দিক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি প্রথতে তাঁর যুগ পর্যন্ত জ্ঞানের সমগ্র বিকাশের একটি ইতিহাস তৈরীর চেষ্টা করেন। এই প্রচেষ্টায় ইতিহাসের যে ব্যাখ্যা তিনি উপস্থিত করেন সে ব্যাখ্যাকে পজিটিভজম বা দৃষ্টবাদ বলে তিনি আখ্যাত করেন। অগাস্ট কোঁতে জ্ঞানের বিকাশে তিনটি স্তরকে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর মতে জ্ঞানের বিকাশের আদিযুগ হচ্ছে ধর্মীয় যুগ। এই যুগে রহস্যের ব্যাখ্যায় মানুষ অতি-প্রাকৃতিক শক্তি বা ঈশ্বরের আশ্রয় গ্রহণ করেছে। জ্ঞানের ইতিহাসে দ্বিতীয় যুগ হচ্ছে দার্শনিক যুগ। এ যুগে দার্শনিক চরম কারণ বা চরম সত্তার অস্তিত্বের ভিত্তিতে মানুষ ও জগতের ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে। এটাকে কোঁতে ধর্মীয় যুগেরই প্রকারভেদ বলেছেন। জ্ঞানের তৃতীয় বা শেষ যুগ হচ্ছে পজিটিভিজম বা দৃষ্ট প্রকৃতির যুগ। এ যুগে বিজ্হানের মাধ্যামে দৃষ্ট প্রকৃতিকে মানুষ চরম বলে স্বীকার করেছে। এ যুগে এসে মানুষ উপলব্ধি করেছে যে, প্রকৃতির বাইরে ঈশ্বর বা চরম সত্তার অনুসন্ধান নিরর্থক। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বা দৃষ্ট প্রকৃতিকে অতিক্রম করে যাওয়ার কোনো ক্ষমতা মানুষের নেই। দৃষ্ট প্রকৃতিই হচ্ছে চরমসত্তা। কাজেই বিজ্ঞান বা জ্ঞান প্রক্রিয়ার কর্তব্য হচ্ছে বাস্তব জগতের দৃষ্ট বিষয়ের বর্ণনা দান; অভিজ্ঞতার গভীরে অপর কোনো সত্তার অনুসন্ধান করা নয়। জ্ঞানের বিকাশের ইতিহাস রচনার যে বিরাট চেষ্টা কোঁতে করেছেন সে চেষ্টায় তাঁকে আধুনিক ইতিহাসকারদের পথিকৃৎ বলা চলে। ধর্ম কিংবা দার্শনিক চরমসত্তার স্থানে প্রকৃতির প্রাধান্য স্থাপনের চেষ্টায়ও তিনি বিশেষভাবে স্মরণীয়। কিন্তু মানুষের স্থান কেবল তার দৃষ্ট বস্তুপুঞ্জের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে –দৃষ্টের ভিত্তিতে অ-দৃষ্ট কোনো কিছু সম্পর্কে অনুমানের ক্ষমতা মানুষের নাই, এ মত ধর্মীয় বিশ্বাসের বিপরীত সীমান্তের আর এক চরম মত। এর ফলে অগাষ্ট কোঁতের পজিটিভিজম বা দৃষ্টবাদকে চরম অভিজ্ঞতাবাদ বা ভাববাদের একটি প্রকারবিশেষ ব্যতীত বৈজ্ঞানিক কোনো দর্শণ বলে গ্রহণ করা চলে না।
Communist Manifesto: কমিউনিস্ট ইশতেহার
মার্কস এবং এঙ্গেলস রচিত ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেসটো’ বা ম্যানিফেস্টো অব দি কমিউনিস্ট পার্টি ১৮৪৮ সনে প্রকাশিত হয়। লণ্ডনে নির্বাসিত সাম্যবাদী মতবাদে বিশ্বাসী ‘লীদ অব কমিউনিস্টস’ বা সাম্যবাদী সমিতি মার্কস এবং এঙ্গেলস-এর উপর তাদের মতবাদ ব্যাখ্যা করে একটি ইশতেহার রচনার দায়িত্ব ন্যস্ত করে। এই দায়িত্ব হিসাবে আজীনব পরস্পরের সঙ্গী মার্কষ এবং এঙ্গেলস ক্ষুদ্রাকারের হলেও অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট এবং ব্যাখ্যামূলকভাবে এই ইশতেহারটি রচনা করেন। কালক্রমে এই ইশতেহার শ্রমিকশ্রেণীর সাম্যবাদী বিপ্লবী বিশ্বাসের অন্যতম মৌলিক দলিল হিসাবে পৃথিবীব্যাপী খ্যাতি অর্জন করে। পৃথিবীর প্রায় সমস্ত ভাষায় কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো অনূদিত হয়েছে। মার্কস এবং এঙ্গেলস তাঁদের পূর্বকার কল্পনাবাদী সমাজতন্ত্রী চিন্তাবিদ যথা –সেন্ট সাইমন, ফৌরিয়ার প্রভৃতির ব্যাখ্যা থেকে পার্থক্য নির্দেশ করার জন্য ‘কমিউনিস্ট’ শব্দের ব্যবগহার করেন। ইশতেহারের শীর্ষে তাঁরা ‘দুনিয়ার সকল দেশের শ্রমিক এক হও’ এই আহবার ঘোষণা করেন।
১। বুর্জোয়া এবং প্রলেটরিয়ানস বা সর্বহারা,
২। সর্বহারা এবং কমিউনিস্টগণ,
৩। সমাজতন্ত্রী এবং কমিউনিস্টগণ,
৪। বিদ্যমান বিভিন্ন বিরোধীদলের সঙ্গে কমিউনিস্টদের সম্পর্ক।
এরূপ চারটি প্রধান শিরোনামে মার্কস এবং এঙ্গেলস তাঁদের সাম্যবাদী দর্শন ব্যাখ্যা করেন। শ্রমিকশ্রেণীর সাম্যবাদী দলগুলিকে বিভিন্ন দেশে বেআইনী অবস্থায় গুপ্তভাবে তাদের আন্দোলনকে পরিচালনা করতে হত। ১৮৭২ সনে এর একটি জার্মান সংস্করণ এবং ১৮৮২ সনে প্রকাশিত হয় ইংরেজী সংস্করণ। মার্কস জীবিত থাকাকালে এসব সংস্করণের ব্যাখ্যামূলক ভূমিকা তাঁদের উভয় দ্বারা যুক্তভাবে রচিত হয়। মার্কসের মৃত্যুর পরে ১৮৮৮ সনের ইংরেজী সংস্করণের ভূমিকার একস্থানে এঙ্গেলস লিখেছিলেন “যদিও এই ম্যানিফেস্টো আমাদের যৌথ রচনা, তবুও আমার একথা বলা আবশ্যক যে, এই ইশতেহারের মূল যে বক্তব্য তা মার্কসেরই চিন্তাপ্রসূত। এবং এই মূল বক্তব্য হচ্ছে এই দর্শন যে, ইতিহাসের প্রতিটি যুগে অর্থনৈতিক উৎপাদন এবং বিনিময়ের প্রধান যে ব্যবস্থা তার উপরই প্রতিষ্ঠিত হয় সে যুগের রাজনৈতিক এবং বুদ্ধি বা ভাবগত ইতিহাস। এই মূল ভিত্তি দ্বারাই মাত্র এদের ব্যাখ্যা করা সম্ভব। ফলত মানব জীবনের আদি গোষ্ঠীসমূহের জমির উপর যৌথ মালিকানার পরবর্তী ইতিহাস হচ্ছে শোষক এবং শোষিতের মধ্যকার শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস। এবং এই ইতিহাস এখন বিকাশের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে আজ এমন পর্যায়ে এসে উপস্থিত হয়েছে যেখানে আজকের যুগের শোষিত এবং নির্যাতিত প্রধান শ্রেণী তথা প্রলেটারিয়েট শ্রেণী তার শোষক এবং শাসক বুর্জোয়া শ্রেণীর আধিপত্য থেকে নিজের মুক্তি সমগ্র সমাজের মধ্যে শ্রেণী বৈষম্য এবং শ্রেণী শোষনের বিলোপ সর্বকালের জন্য সাধন করা ব্যতীত অর্জন করতে পারে না”।
কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর ভাষা যেমন সুনির্দিষ্ট তেমনি তার মধ্যে সর্বহারা শ্রেণীর ভবিষ্যৎ অনিবার্য বিজয়ের আবেগময় বিশ্বাসের প্রকাশও সুস্পষ্ট। মানুষের সমাজের ঐতিহাসিক বিকাশের পর্যায়সমূহের উল্লেখ এবং বিশ্লেষণ এবং সাম্যবাদী কর্মীদের করণীয়ের নির্দেশের পরিশেষে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর অন্তিম অনুচ্ছেদটি নিম্নরূপে রচনা করা হয়েছে; ‘কমিউনিস্টরা নিজেদের উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্যকে গোপন করতে ঘৃণা বোধ করে। একথা তারা প্রকাশ্যেই ঘোষণা করছে যে, তাদের লক্ষ্য কেবল বিদ্যমান সকল সামাজিক অবস্থার জোরপূর্বক উৎসাদনের মাধ্যমেই সম্ভব। শাসক শ্রেণীগুলি কমিউনিস্ট বিপ্লবের আতঙ্কে কম্পিত হোক। তাদের নিজেদের শৃঙ্খলকে হারানো ব্যতীতত সর্বহারার হারাবার কিছু নেই। তাদের লাভ করার আছে সমগ্র পৃথিবী। সকল দেশের শ্রমজীবী মানুষ ঐক্যবদ্ধ হও”।
Communism, Primitive:আদিম সাম্যবাদ
সমাজতাত্ত্বিক গবেষক, বিশেষ করে মার্কসবাদীদের মতে মানুষের প্রাথমিক সামাজিক সংগঠনের রূপ ছিল যৌথ এবং সাম্যবাদী। জীবন রক্ষার জন্য উৎপাদনের উপায়গুলো তখনো খুবই অনুন্নত। শ্রমের বিভাগও বিকাশ লাভ করে নি। নারী-পুরুষের কাজের মধ্যেও তেমন পার্থক্য সৃষ্টি হয় নি। এই পর্যায়ে উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে সম্পর্ক ছিল অপরিহার্যরূপে সামাজিক ও সমষ্টিগত। উৎপাদনের উপায় অর্থাৎ সুচালো পাথর, বর্শা, বল্লম ইত্যাকার উৎপাদনী যন্ত্রগুলি ছিল গোত্র বা গোষ্ঠীর যৌথ মালিকানাধীন সম্পত্তি এবং তার ব্যবহার ছিল সমষ্টিগত। উৎপাদিত বা সংগৃহীত খাদ্য সম্পদের ভোগও ছিল সমষ্টিগত। অবশ্য এই সামগ্রিক যৌথ ব্যবস্থার মধ্যেও ব্যক্তিগত মালিকানা যে কিছুই ছিল না, এমন নয়। দেহাবরণ অবশ্যই ব্যক্তিগত ছিল। উৎপাদনী যন্ত্র যে আদৌ ব্যক্তিগত থাকতে পারতো না এমনও নয়। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বাস্তব পরিস্থিতি এমন ছিল যে, গোত্র বা গোষ্ঠীর ঐক্যবদ্ধ এবং যৌথ চেষ্টা ও পরিশ্রম ব্যতীত ব্যক্তির পক্ষেও খাদ্র সংগ্রহ করে এবং বৈরী প্রকৃতি ও বন্যপশুর বা প্রতিদ্বন্দ্বী মানবগোষ্ঠীর আক্রমণ প্রতিরোধ করে জীবন রক্ষা সম্ভব ছিল না। এর পরে সামাজিক পরিশ্রমে বিভাগ শুরু হয়। পশুপালন এবং কৃষিকাজ দুটি আলাদা জীবিকার রূপ গ্রহণ করে। এই বিভাগের ভিত্তিতে সমাজের উৎপাদনী ক্ষমতা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার দ্রব্য-সামগ্রীর পরিমাণের তারতম্যে দ্রব্যবিনিময় শুরু হয় এবং সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানাও সম্ভব হতে শুরু করে। কালক্রমে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে জীবনের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির পরিমাণের পার্থক্যে অসাম্য উদ্ভুত হতে থাকে। গোত্রে গোত্রে লড়াই বা যুদ্ধের পরিণামে পরাজিত গোত্রের মানুষ বিজয়ী গোত্রের দাস বলে গণ্য হয়ে উৎপাদনের এক অভাবিতপূর্ব উপায়রূপে বিজয়ী গোত্রের কাছে কিংবা বিজয়ী গোত্রের শক্তিমান ব্যক্তিদের কাছে দেখা দেয়। এবার সামগ্রিকভাবে সামাজিক কাঠামোতে সাম্যবাদ বজায় রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। দাস এবং উৎপাদনের যন্ত্রাদির ব্যক্তিগত মালিকানায় উৎপাদন বৃদ্ধির যে বিপুল সম্ভাবনা দেখা দেয় পূর্বকার যৌথ ব্যবস্থাপনার অবস্থিতি যে সম্ভাবনার বিকাশের প্রতিশ্রুতি বা শৃঙ্খলের কাজ করতে থাকে। হস্তশিল্প থেকে কৃষিকাজের পৃথকীকরণ শ্রমের বিভাগকে বিস্তৃততর করে উৎপাদন ক্ষমতাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। এই প্রক্রিয়ার পরিণামে আদি সাম্যবাদী সমাজ ভেঙে শ্রেণীবিভক্ত সামজের উদ্ভব ঘটে। শ্রেণী বিভক্ত সমাজ রক্ষার প্রয়োজনে রাষ্ট্রযন্ত্রেরও সৃষ্টি হয়। ইতিহাসে দাস ও প্রভুতে বিভক্ত সমা জন্মলাভ করে।
Copernicus: কপারনিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩ খ্রি.)
আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের জনক কপারনিকাসের জন্ম হয়েছিল পোলাণ্ডে। সৌরজগতের বর্তমান সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কপারনিকাস। এতদিন পর্যন্ত সূর্য, চন্দ্র এবং পৃথিবীর আবর্তনের ব্যাখ্যায় টলেমীর পৃথিবী কেন্দ্রীক তত্ত্বই ছিল স্বীকৃত তত্ত্ব। টলেমীর তত্ত্বানুযায়ী পৃথিবী হচ্ছে বিশ্বের কেন্দ্র। পৃথিবীকে কেন্দ্র করেই সূর্য-চন্দ্র প্রভৃতির আবর্তন। মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস; দার্শনিক এ্যারিস্টটল-এর ব্যাখ্যা কিংবা টলেমীর তত্ত্বের মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না। সকেলই পৃথিবীকেই বিশ্বজগতের কেন্দ্র বলে মনে করেছে। এই প্রতিষ্ঠিত মতের ক্ষেত্রে কপারনিকাসের তত্ত্ব সাধারণ বিশ্বাসের একেবারে বিপরীত ছিল। প্রাচীন গ্রিসের বস্তুবাদী দার্শনিকদের পৃথিবী আবর্তনের তত্ত্বের উপর নির্ভর করে পূর্ণতর গবেষণায় কপারনিকাস দার্শনিকদের পৃথিবী ৩৬৫ দিনে যেমন সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে তেমনি নিজের মেরুদণ্ডের উপরও সে আবর্তিত হচ্ছে। কেবল পৃথিবী নয়, পৃথিবীর মতোই গ্রহ হচ্ছে মারস (মঙ্গল), মার্কারী (বুধ), ভেনাস (শুক্র), জুপিটার (বৃহস্পতি), স্যাটার্ন (শনি)। এরাও সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। সূর্য থেকে দূরত্বের ভিত্তিতে এদের সূর্য প্রদক্ষিণের কালেরও তফাৎ ঘটছে। মার্কারী ৮৮ দিনে, ভেনাস ২২৫ দিনে, মারস ৬৮৬ দিনে, জুপিটার ১২ বছরে এবং স্যাটার্ন ৩০ বছরে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। এভাবে তৈরি হয়েছে সৌরজগৎ। কপারনিসাকের পরবর্তী বৈজ্ঞানিকগণ বিশেষ করে কেপলার, (১৫৭১-১৭২৭ খ্রি.) গ্রহ-উপগ্রহগুলির পরিক্রমণ পথ আরো সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারিত করেন। কিন্তু পৃথিবীকেন্দ্রীক ধারণার উপর প্রথম আঘাত হানার কৃতিত্ব কপারনিকাসের। মানুষ যেখানে এর পূর্বে পৃথিবীকে সর্ববৃহৎ বলে কল্পনা করেছে আর এই পৃথিবীর মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছে, সেখানে কপারনিকাস মানুষের জ্ঞানের সীমাকে পৃথিবীর বাইরে বৃহত্তর বিশ্বে অবারিত করেছেন। ধর্মের অন্ধ এবং অনড় বিশ্বাসের শেকল থেকে বিজ্ঞানের মুক্তিদাতার ভূমিকা তিনি পালন করেছেন। এ কারণে যাজক-সম্প্রদায় থেকে শুরু করে প্রচলিত ধ্যানধারণায় বিশ্বাসী সকল মহলই কপারনিকাসের উপর সেদিন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল।
Corce, Bendetto: বেনেদাতো ক্রোচে (১৮৬৬-১৯৫২ খ্রি.)
আধুনিককালের প্রখ্যাত ইতালীয় দার্শনিক। ক্রোচের দর্শন ভাববাদের প্রকার বিশেষ। অনেকে এ দর্শনকে ঐতিহাসিক ভাববাদ বলে আখ্যাত করেন। ক্রোচের রচনাসমূহের বিশ্লিষ্ট চিন্তার দুর্বোধ্য প্রকাশ করেছে। এসথেটিকস বা নন্দনতত্ত্বের ক্ষেত্রে তাঁর মতামত আধুনিককালের, বিশেষ করে ভাববাদী শিল্প আলোচনায় প্রভূত প্রভাব বিস্তার করেছে। ক্রোচের দর্শনের সাধারণ এবং সংক্ষিপ্ত ধারণা দানের চেষ্টায় বলা যায় যে, এ দর্শনের মূল হচ্ছে ইণ্টুইশন বা সজ্ঞা। বস্তু এবং মনের মধ্যে প্রধান শক্তি কে? এ প্রশ্নে ক্রোচ-দর্শনের জবাব হচ্ছে যে, মনই হচ্ছে আসল শক্তি। আর মনের সত্তা বা অস্তিত্ব নিহিত রয়েছে তার ক্রিয়ায়। মনের ক্রিয়ার বাইরে মন বলে কিছু নেই। মানসিক ক্রিয়াই মন। ক্রোচের মতে মনের ক্রিয়া দুরকম তাত্ত্বিক এবং প্রযুক্তিক। তত্ত্বগত ক্রিয়ার মাধ্যমে মন বস্তুর সত্তাকে উপলব্ধি করে আপন সত্তায় তাকে লীন করে নেয় এবং প্রযুক্তিক ক্রিয়ায় মন সৃজনশীল হয়ে নতুন সত্তার সৃষ্টি করে। মনের ক্রিয়া ইণ্টুইশন বা সজ্ঞা, কনসেপশান বা উপলব্ধি, বিশেষের এবং নির্বিশেষের ইচ্ছঅ –এই চার রকমে প্রকাশ পেতে পারে। এই চার রকম ক্রিয়ার মাধ্যমেই মানুষের শিল্প, দর্শন, নীতিশাস্ত্র এবং আর্থিক কর্মপ্রবাহের উদ্ভব। এই চার প্রকার সৃষ্টির একটি অপরটির বিরোধী নয়। এরা পরস্পর পরিপূরক। ক্রোচের মতে শিল্পবোধ বা সৌন্দর্যানুভূতি হচ্ছে সর্বোৎকৃষ্ট জ্ঞান মাধ্যম। সৌন্দর্যবোধই হচ্ছে মানুষের আদিম বোধ। এ বোধ মানুষ বুদ্ধির মারফতে লাভ করতে পারে না। এ বোধ তার সহজাত বা সজ্ঞাজাত। কিস্তু সজ্ঞা কেবল মনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। সৌন্দর্য বা শিল্পসৌকর্য কেবল অনুভূতি নয়। এর অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে প্রকাশে। কোনো সৌন্দর্যানুভূতি অপ্রকাশিত থাকতে পারে না। প্রকাশই হচ্ছে মনের অনুভূতির ভাষা। মানুষের মুখের যে ভাষা তাও সেই সৌন্দর্যানুভূতিরই প্রকাশ। এদিক থেকে ভাষালোচনা এবং সৌন্দর্যালোচনার মধ্যে কোনো পার্থক্য নাই।
Confucianism: কনফুসিয়াসবাদ
চীনের প্রাচীন সামাজিক ও ধর্মীয় নেতা কনফুসিয়াসের উপদেশাবলীকে কনফুসিয়াসবাদ বলা হয়। কনফুসিয়াসের জীবনকাল ৫৫১ থেকে ৪৭৯ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দ বলে ধারণা করা হয়। কনফুসিয়াসের উপদেশাবলী মানুষের জীবনের সর্বক্ষেত্রেই ব্যাপ্ত ছিল। প্রাচীন সমাজে তিনি কোনো বিশেষ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে যত পরিচিত নন তার চেয়ে চীন সমাজের সংরক্ষণকারী হিসাবেই তাঁর ঐতিহাসিক পরিচয়। মানুষ ব্যক্তিগত জীবনে, পারিবারিক ক্ষেত্রে, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় সংস্থায় এবং ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্ক কিরূপ জীবন যাপন করবে এর প্রতিটি বিষয়ে কনফুসিয়াস তাঁর অভিমত প্রকাশ করেছেন। তাঁর সমস্ত উপদেশের লক্ষ্য ছিল প্রচলিত সামাজিক ব্যবস্থায় ভারসাম্য রক্ষা করা।
পৃথিবীর উপরে যদি কাউকে মান্য করতে হয় তা হলে মানুষ মান্য করবে ঈশ্বরকে, ঈশ্বরের বিধানকে। যে মানুষ মহৎ সে ঈশ্বরের বিধানেই মহৎ। যে-মানুষ অধম সে ঈশ্বরের বিধানেই অধম। এর কোনো পরিবর্তনের প্রশ্ন আসে না। প্রশ্ন হচ্ছে সেই বিধানকে সুসঙ্গতভাবে মেনে চলা। যে রাজা, সে ঈশ্বরের বিধানেই রাজা। ছোটর কর্তব্য হচ্ছে বড়কে মানা। রাজা-প্রজা, পতী-পত্নী, পিতা-পুত্র, জ্যেষ্ঠ-কনিষ্ঠ, এই প্রকারের সম্বন্ধের ভিত্তিতেই সমাজ গঠিত। বিধির বিধানে যে স্থানে যে অধিষ্ঠিত সেই স্থান অনুযায়ী দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করা তার কর্তব্য। রাজার আদর্শ হবে উত্তম রাজা হবার এবং প্রজার আদর্শ হবে উত্তম প্রজারূপে তার দায়িত্ব পালন করা। কনফুসিয়াসের অনুসারীগণ বিভিন্নভাবে তাঁর অভিমতকে ব্যাখ্যা করেন। তার ফলে কনফুসিয়াসবাদেও বিভিন্ন উপধারার উদ্ভব হয়। কনফুসিয়াসের অন্যতম শিষ্য মেঙজু মনে করতেন যে, সমাজে যে অসাম্য বিদ্যমান তা বিধাতারই বিধান। বিশ্ব প্রকৃতির ব্যাখ্যায় কনফুসিয়াসের অপর এক অনুসারী সুনজু কিছুটা বস্তুবাদী মত প্রচারের প্রয়াস পান। তাঁর মতে ঈশ্বর প্রকৃতির অংশ, প্রকৃতির ঊর্ধ্বে কোনো সত্তা নয়। খ্রিষ্টাব্দের একাদশ এবং দ্বাদশ শতকে চুশী এবং অন্য অনুসারীগণ নব কনফুসিয়াসবাদের প্রবর্তন করেন। তাঁদের মতে বিশ্বের মূলে রয়েছে ‘লী’ এবং ‘চী’র দ্বন্দ্ব। ‘লী’ হচ্ছে ভাব, আর ‘চী’ হচ্ছে বস্তু। ‘লী’র কারণেই মানুষের মধ্যে মহত্ত্বের সৃষ্টি আর ‘চী’র কারণে মানুষ লোভ, মোহ ইন্দ্রিয় সুখ ইত্যাদির কাছে আত্মসমর্পণ করে। সুর্দীঘকাল স্থায়ী সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় চীনে তিনটি ভাবাদর্শের উদ্ভব দেখা যায়। এই তিনটির একটি হচ্ছে কনফুসিয়াসবাদ এবং অপর দুটি হচ্ছে তাও এবং বৌদ্ধ ধর্ম।
Culture: সংস্কৃতি
মানৃষের সর্বপ্রকার বৈষয়িক এবং আত্মিক সৃজন ও সম্পদের ব্যাপক অর্থবহ শব্দ। অনেক সময় সাহিত্য, শিল্প, দর্শন, সামাজিক আচরণ ও নীতি –অর্থাৎ মানুষের ভাবগত সৃষ্টিকর্মকে কেবল সংস্কৃতি বলে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু মানুষের সৃষ্টির সম্পূর্ণ অর্থে আর্থিক ও কারিগরি সৃজন কর্ম এবং তার ফসল অর্থাৎ উৎপাদনের যন্ত্র, কলকারখানা এবং উৎপাদিত বৈষয়িক সম্পদ ও সৌধকেও একটা মানব সমাজের সংস্কৃতি হিসাবে গণ্য করা উচিত। পার্থক্য হিসাবে ভাবগত সৃষ্টিকে ‘আত্মিক সংস্কৃতি’ এবং দেহগত সৃষ্টিকে ‘বৈষয়িক সংস্কৃতি’ বলে চিহ্নিত করা চলে। কিন্তু এরূপ পৃথকীকরণও কেবলমাত্র আপেক্ষিকভাবে স্বীকার্য। আত্মিক ও বৈষয়িক সংস্কৃতির মধ্যে কোনো চরম পার্থক্য বা বিরোধের অবকাশ নাই। কোনো আত্মিক সংস্কৃতি দেহ এবং বৈষয়িক অবস্থা-নিরপেক্ষভাবে সৃষ্টি হতে পারে না। আবার কোনো বৈষয়িক কর্মই মনের কল্পনা বাদে সাধিত হতে পারে না। সংস্কৃতি হচ্ছে সামাজিক সৃষ্টি। সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তিতে মানুষের ব্যক্তিগত এবং যৌথ ক্রিয়া-কাণ্ডের ফলে এর উদ্ভব। এ কারণে সমাজ-সংগঠনের বিশিষ্ট রূপ দ্বারা সমাজের সংস্কৃতির রূপ প্রধানত নির্দিষ্ট হয়। এক সমাজ থেকে আর এক সমাজের সংস্কৃতি এই ভিত্তিতেই পৃথক হয়। আর্থিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মানুষের সমাজের ইতিহাস শ্রেণীভেদের অবস্থাহীন আদিম সাম্যবাদী সমাজ এবং তারপরে শ্রেণীভেদ সম্পন্ন দাস সমাজ, সামন্ততান্ত্রিক সমাজ এবং পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ হিসাবে এ পর্যন্ত বিভক্ত হয়েছে। এই পর্যায় মানুষের সংস্কৃতির ইতিহাসকেও দাস সমাজের সংস্কৃতি, সামন্ত সমাজের সংস্কৃতি ও পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের সংস্কৃতি বলে চিহ্নিত করা হয়। এক একটা সমাজের সংস্কৃতি ও পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলির ভিত্তিতে সংস্কৃতির এই পরিচয়। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, দাস বা সামন্ততান্ত্রিক বা পুঁজিতান্ত্রিক সংস্কৃতি বলতে তার অভ্যন্তরে বৈচিত্র, বিরোধ এবং বিভিন্নতাশূন্য একটি অখণ্ড সৃষ্টিকে বুঝায়। দাস সমাজে প্রভু এবং দাসের মধ্যে যে বিরোধ, সে বিরোধ প্রভুশ্রেণীর এবং দাসের বৈষয়িক ও মানসিক কর্মকাণ্ডেও প্রতিফলিত। সামন্ততান্ত্রিক সমাজেও অনুরূপ। পুঁজিতান্ত্রিক সমাজেও উৎপাদনের হাতিয়ারের ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত মালিকানা, উৎপাদনের যৌথ প্রক্রিয়া এবং উৎপাদিত সম্পদের ভোগ থেকে অধিকাংশকে বঞ্চিত রাখার ব্যবস্থায় যে শ্রেণীগত বিরোধ, বৈষম্য, সংঘাত এবং ভাবভাবনার সৃষ্টি হয় তার প্রতিরূপ পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের সংস্কৃতি, বিশেষ করে তার আত্মিক সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রকাশ পায়। সমাজতান্ত্রিক সমাজে –অর্থাৎ যে সমাজে উৎপাদনের ক্ষেত্রে মানুষ শোষক এবং শোষিত হিসাবে বিভক্ত নয়, সে সমাজের সংস্কৃতিতে মৌল কোনো আর্থিক সংঘাতের প্রতিফলনের অবকাশ নাই। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক সমাজের সংস্কৃতিও বৈচিত্রহীন নয়। বিরোধাত্মক বৈচিত্রের স্থানে সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতির বৈচিত্র সাধিত হয় সমাজের বিভিন্নমুখী উন্নতি সাধনের বিচিত্র সৃজনকর্মের মাধ্যমে।
Cynic: উদাসীন
Cynicism: ঔদাসীন্য, উদাসীনতাবাদ
ইংরেজী ‘সিনিক’ এবং ‘সিনিসিজম’ শব্দ দ্বারা জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য আরাম আয়েশ সব কিছুর প্রতি একটা কঠোর ঔদাসীন্য বুঝায়। ইংরেজী সিনিক শব্দের উদ্ভব গ্রিক ‘কিওনস’ থেকে। ‘কিওনস’ বলতে কুকুর বুঝায়। আর তাই ‘কিনিকাল’ বা ‘সিনিকাল’ দ্বারা কুকুরের ন্যায় অদমনীয় মনোভাব বুঝাত।
কিন্তু এই শব্দের দার্শনিক তাৎপর্য গ্রিক দার্শনিক এ্যান্টিসথেনিস (খ্রি. পূ. ৪৩৫-৩৭০) এবং তাঁর অনুসারী ডায়োজেনিস, ক্রেটিস প্রমুখ দার্শনিকদের জীবন দর্শণ এবং জীবনাচার থেকে উদ্ভুত। দাসদের শোষণের ভিত্তিতে গ্রিক গণতন্ত্র এককালে যে শৌর্য এবং বীর্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিল, খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর শেষের দিকে বিভিন্ন গ্রিক নগর রাষ্ট্রের আত্মঘাতী সংঘর্ষে সে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা সমাজে অবিশ্বাস, অন্তর্ঘাত এবং নৈরাজ্যের সৃষ্টি করতে থাকে। সমাজের এই অস্থির অবস্থায় এমন একদল চিন্তাবিদ ও দার্শনিকের উদ্ভব ঘটে যাঁরা মানুষের শান্তি সামাজিক ও রাজনীতিক ক্রিকাকাণ্ডে অংশগ্রহণে নয়, সমস্তরকম সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব এবং জীবনের আরাম আয়েশ বিলাস ব্যসন সব কিছু পরিত্যাগের মধ্যে চিহ্নিত করার প্রয়াস পান। এই মনোভাবের প্রাথমিক লক্ষণ মহৎ ব্যক্তি সক্রেটিসের জীবনাচরণ এবং অভিমতের মধ্যে দেখা যায়। রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব নয়, জ্ঞানের অন্বেষণ এবং সহজ জীবনযাপনের মধ্যেই তিনি ব্যক্তির মহৎ কর্তব্য নির্দিষ্ট করেছিলেন। সহজ জীবন যাপনের সক্রেটিসীয় নীতি সিনিকপন্থীগণ অধিকতর কঠোরভাবে অনুসরণ করার জন্য জীবনের প্রায় সব প্রয়োজনকে বাহুল্য বলে বর্জন করার চেষ্টা করে। ‘অঞ্জলিদে যদি তৃষ্ণার পানি পান করা সম্ভব তা হলে পেয়ালা বাহুল্য। অতএব সে বর্জনীয়’। সিনিক দার্শনিক ডায়োজেনিস (খ্রি. পূ. ৪১২-৩২৩) সম্পর্কে এরূপ কাহিনী প্রচলিত আছে যে, গ্রিক সম্রাট আলেকজাণ্ডার একদিন ডায়োজেনিসের নিকট উপস্থিত হয়েছিলেন। ডায়োজেনিস তখন সূর্যালোকে উপবিষ্ট। সম্রাট আলেকজাণ্ডার সূর্যের রশ্মিকে আড়াল করে ডায়োজেনিসের নিকটবর্তী হয়ে যখন দার্শনিককে বললেন, ‘আমি আপনার কি উপকার করতে পারি?’ তখন দার্শনিক উত্তরে বললেন, ‘আপনি আমার উপর নিপতিত সূর্যের রশ্মিকে আড়াল না করে একটু সরে দাঁড়াতে পারেন।
সিনিক দার্শনিকদের সবকিছু বর্জন করার নীতির একটি রাজনৈতিক তাৎপর্য ছিল। শোষণ এবং অনাচারপূর্ণ তৎকালীন গ্রিক সমাজের সবকিছু বর্জণ করে জ্ঞানের মধ্যে মুক্তি অন্বেষণের নীতিকে সমাজ ব্যবস্থার অসঙ্গতি ও শোষণের সমালোচনা হিসাবে ব্যাখ্যা করা যায়। সিনিকপন্থীগণ সমাজে দাস ও প্রভুর বৈষম্যকে স্বীকার করত না। সকল মানুষ সমান, এই মতাদর্শ তারা অনুসরণ করত। এই আদর্শ তৎকালীন মানুষের দৃষ্টিকে গ্রিক নগর রাষ্ট্রের সংকীর্ণ প্রাচীর অতিক্রম করে বৃহত্তর মনুষ্য সমাজের মধ্যে বিস্তারিত করার সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করেছিল। সিনিক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা এ্যাণ্টিসথেনিস ছিলেন প্লেটোর সমকালীন। তিনি এরূপ অভিমত পোষণ করতেন যে, যিনি জ্ঞানী তাঁর কর্তব্য হচ্ছে ন্যায়পরায়ণতার সর্বজনীন আদর্শকে অনুসরণ করা। তিনি আরো মনে করতেন, জীবন যাপনের ক্ষেত্রে মানুষ সভ্যতার কৃত্রিমতাকে বর্জন করে যত বেশী পশুর প্রাকৃতিক সহজ জীবনে প্রত্যাবর্তন করতে পারবে তত সে স্বাভাবিক এবং উত্তজ জীবনের অধিকারী হবে। এ্যান্টিসথেনিস ‘সাইনো সারজেম’ নামক স্থানে তাঁর দর্শন প্রচার করতেন। এই স্থান থেকেও ‘সিনিক’ শব্দের উৎপত্তি ঘটে থাকতে পারে। বিভিন্ন গ্রিক দর্শনের সঙ্গে দর্শনের প্রচার স্থানের নাম যুক্ত হতে দেখা যায়। একাডেমীয়া স্থান থেকে প্লেটোর একাডেমী। লাইসিউম থেকে এ্যারিস্টটলের লাইসিউম দর্শনপিঠের প্রসিদ্ধি।
D
D’ Alembert: ডি, আলেম্বার্ট (১৭১৭-১৭৮৩ খ্রি.)
ফরাসি বিশ্বকোষিকদের অন্যতম দার্শনিক এবং গণিতশাস্ত্রবিদ ছিলেন ডি’ আলেম্বার্ট। বৈজ্ঞানিক হিসাবে বায়ু প্রবাহের উপর তিনি ১৭৪২ খ্রিষ্টাব্দে একখানি গ্রন্থ রচনা করেন। বিশ্বকোষ রচনার ক্ষেত্রে তিনি ডিডেরটকে বিশেষভাবে সাহায্য করেন। ধর্মের ক্ষেত্রৈ তিনি নিরীশ্বরবাদী না হলেও ঐশ্বরিক প্রত্যাদেশের মাধ্যমে ঈশ্বরের বাণী লাভে তিনি বিশ্বাস করতেন না। এরূপ অভিমত যাঁরা পোষণ করেন তাঁদের ইংরেজীতে ‘ডিস্ট’ বা ঈশ্বরবাদী কিন্তু ঈশ্বরের প্রত্যাদেশবাদী নয় বলে অভিহিত করা হয়। ডি’ আলেম্বার্ট খ্রিষ্ট ধর্মের ‘জেসুইট’ এবং ‘ক্যালভিনিস্ট’ উভয় সম্প্রদায়ের সমালোচনা করেন।
Dadaism: দাদাবাদ, খেয়ালবাদ
প্রথম মহাযুদ্ধকালে ইউরোপ এবং পরবর্তী সময়ে আমেরিকার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কিছুসংখ্যক শিল্পী ও সাহিত্যিকের মধ্যে উদ্ভুত এক প্রকার শিল্প ও সাহিত্য আন্দোলন। মহাযুদ্ধের বিভীষিকায় আকঙ্কগ্রস্ত এবং জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে কিছু সংখ্যক ফরাসী বুদ্ধিজীবী সুইজারল্যাণ্ডের জুরিক শহরে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তাঁদের নিজেদের মতের হতাশা এবং আতঙ্ককে শিল্প ও সাহিত্যে প্রকাশ করার জন্য তাঁরা অ-চিন্তিত এবং অসাধারণ মাধ্যমের আশ্রয় নেন। তাঁরা মনে করতেন সমাজে যুদ্ধ, ধ্বংস, অসাম্য, অত্যাচার –এসবের কারণ মানুষের নিজের চরিত্রে পাশবিক ব্যবহার। এটাকে স্বীকার করা ব্যতীত কোনো উপায়ন্তর নেই। সমাজ কোনো নীতি মেনে চলে না। শিল্পীর পক্ষেও তাই প্রচলিত কোনো নিয়ম-নীতি মেনে চলার প্রয়োজন নেই। মনে যা আসে তাই করো। শিল্পের মাধ্যম হিসাবে যা ইচ্ছা হয় তাই গ্রহণ করো। অক্ষরগুলো এ যাবৎ যেমন লেখা হয়ে আসছে, তেমন করে কেন লিখবো? অক্ষরগুলো উল্টিয়ে লিখলে ক্ষতি কি? এরূপ অরাজক মানসিকতা থেকে জাঁ ককতু, হানস আর্প, মার্সেল দুকাম্প প্রমুখ সাহিত্যিক ও শিল্পী, সাহিত্য ও শিল্পের ক্ষেত্রে প্রচলিত সমস্ত নিয়মনীতিকে লঙ্ঘন করার চেষ্টা করেন। কবি ও ঔপন্যাসিক জাঁ ককতুর মতে যে-কোন শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্মই বিশৃঙ্খলার অভিধানবিশেষ। দাদাবাদকে খেয়ালবাদ বলা হয়। বস্তুত ফরাসি ‘দাদা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘খেয়াল ঘোড়া’। আধুনিক শিল্প ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে সার রিয়ালিজম বা অধিবাস্তববাদ নামক যে আর একটি ধারার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় দাদাবাদ তার উৎস হিসাবে কাজ করেছে। দাদাবাদ বা শিল্পে অরাজকতার এই মনোভাব ১৯২২ সালের দিকে স্তিমিত হয়ে পড়ে।
Dante, Alighieri: দান্তে (১২৬৫-১৩২১ খ্রি.)
মধ্যযুগের ইতালির কবি দান্তে তাঁর ‘ডিভাইন কমেডি’ গ্রন্থের জন্য ইতিহাসের সুবিখ্যাত। কিন্তু কেবল কাব্য ও সাহিত্যকর্মে তিনি নিয়োজিত ছিলেন না। তৎকালীন ইতালির রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে তিনি জড়িত ছিলেন। সেকালে ইতালির রাজনীতি পোপ সমর্থক এবং পোপ বিরোধী, এই দুই প্রধান ধারায় বিভক্ত ছিল। খ্রিষ্ট ধর্মের ধর্মীয় গুরু পোপের সমর্থকরা বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত ইতালিকে ঐক্যবদ্ধ করার বিরোধী শক্তি বলে পরিগণিত হত। পোপের একচ্ছত্র এবং সমগ্র ইউরোপব্যাপী সাম্রাজিক ক্ষমতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশের শাসক তথা রাজাগণও অভিমত পোষণ করতেন। রাষ্ট্রের সুশাসনের জন্য রাজার অধীনে কেন্দ্রীয় জাতীয় শাসনের তখন বাস্তব প্রয়োজন দেখা দিচ্ছিল। কবি দান্তের নিজ নগর ফ্লোরেন্স থেকে পোপ বিরোধী অভিমতের কারণে তাঁকে বহিস্কৃত হতে হয়। তাঁর এই নির্বাসিত জীবনে বিভিন্ন রাষ্ট্রের বিচিত্র রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা তিনি অজর্ন করেন। এই অভিজ্ঞতাপ্রসূত তাঁর রাজনৈতিক অভিমত তিনি তাঁর রাজনৈতিক গ্রন্থ ‘মনারকিয়া’ বা ‘রাজতন্ত্র’ গ্রন্থে প্রকাশ করেন। সেকালের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতিক চিন্তাধারার ক্ষেত্রে মধ্যযুগীয় বিভিন্ন যুক্তির পরিচয় থাকলেও এ গ্রন্থ একটি অগ্রসর চিন্তার বাহক হিসাবে কাজ করে। তখনো ইইরোপে বিগত রোমান সাম্রাজ্যের প্রভাবে একটি সাম্রাজ্যের চিন্তা বিরাজ ককরত। অর্থাৎ সমগ্র ইউরোপে এক সাম্রাজ্য এবং তার এক সম্রাট থাকবে। পোপের পক্ষের যুক্তি ছিল, ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসাবে রোমের পোপ হবেন এই সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র এবং ধর্মীয় ও জাগতিক সকল বিষয়ের শাসক। এক সাম্রাজ্যের প্রয়োজনের কথা কবি দান্তেও তাঁর ‘মনারকিয়া’ গ্রন্থে স্বীকার করেন। কিন্তু জাগতিক ক্ষেত্রে পোপ নয়, রাষ্ট্রের শাসক ততা রাজা হবেন প্রধান –এই ছিল দান্তের অভিমত। মধ্যযুগীয় ধর্মীয় আইন কানুন, বিধিবিধানের প্রভাব সত্ত্বেও ‘মনারকিয়া’র মধ্যে এইরূপ আধুনিক চিন্তারও প্রকাশ ঘটে যে, রাষ্ট্রের অস্তিত্বের মূল হচ্ছে ব্যক্তির মঙ্গল এবং রাষ্ট্রের পরিচালনাতে ব্যক্তিরও ভূমিকা থাকা আবশ্যক।
Darwin, Charles Rbbert: চার্লস রবার্ট ডারউইন (১৮০৯-১৮৮২ খ্রি.)
ঊনবিংশ শতকের ইংল্যাণ্ডের অবিস্মরণীয় জীববিজ্ঞানী। জীবনের ঐতিহাসিক বিকাশবাদের প্রতিষ্ঠাতা। প্রাকৃতিক জগতের রহস্যভেদ করার প্রবল আগ্রহ চার্লস ডারউইন কিশোর বয়স থেকেই বোধ করতেন। জীবন সম্পর্কে অধিকতর জ্ঞান লাভ করতে পারবেন মনে করে নিজের পাঠ্যকালে তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞান পাঠ্য হিসাবে নির্বাচন করে। এর পরবর্তীকালে চার্লস ডারউইনের জীবনের যুগান্তকারী ঘটনা হচ্ছে একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রকৃতির বিভিন্ন দিকে পর্যব্কেষণ ও গবেষনার জন্য ‘বিগল’ জাহাজকে বিশ্ব অভিযানে প্রেরণ এবং চার্লস ডারউইনকে উক্ত জাহাজে প্রকৃতি-বিজ্ঞানী হিসাবে নিয়োগ দান। ‘বিগল’-এর অভিযান ডারউইনের জীবনে অকল্পিত এক সুযোগ এনে দেয়। এ অভিযান ১৮৩১ থেকে ১৮৩৬ সাল পর্যণ্ত স্থায়ী হয়। এ অভিযানে ডারউইন পৃথিবীর এক প্রান্ত, দক্ষিণ আমেরিকার উপকূল ভাগের, তার অভ্যন্তরের, মহাসাগরীয় বিভিন্ন দ্বীপের এবং পৃথিবীর অপর প্রান্ত নিউজিল্যাণ্ডের অসংখ্য জীব-জন্তুর সাক্ষাৎ লাভ করেন। প্রাচীনকালের অনেক বৃহদাকার জন্তুর কঙ্কাল বা ফসিলও তাঁর পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ ঘটে। সমস্ত জায়গা থেকে জীব-জন্তুর নানা প্রকার নমুনা তিনি সংগ্রহ করেন। এই সমস্ত জীব-জন্তুর সাদৃশ্য, বৈসাদৃশ্য, তাদের গঠনের সরলতা-জটিলতা ইত্যাদির উপর গবেষণা করে চার্লস ডারউইন অবশেষে ১৮৫৯ সালে জীব-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিপ্লবাত্মক গ্রহ্ণ ‘অরিজিন অব স্পেসিস’ প্রকাশ করেন। তাঁর এই গ্রন্থের প্রতিপাদ্য ছিল যে, পৃথিবীজে জীবনের যে বৈচিত্র্য রয়েছে সে বৈচিত্র্য কোনো একদিন একই সময়ে জগতে কোনো বিধাতা সৃষ্টি করে নি। জগতে জীবনের ক্ষেত্রে সতত পরিবর্তন চলছে। জীবনের গঠন জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে। অতীতকালের অতিকায় জন্তু-জানোয়ারের কঙ্কাল পাওয়া যাচ্ছে, অথচ এসব প্রাণীর আজ অস্তিত্ব নেই কেন? এ প্রশ্নের জবাবে ডারউইন বললেন, জীবনের ক্ষেত্রে আদিকাল থেকে বাঁচার সংগ্রাম চলছে। প্রকৃতি-জগতে নানা পরিবর্তন সংঘটিত হয়। প্রাকৃতিক জগতের পরিবর্তন অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়ে জীবন রক্ষা করার তাগিদ জীবমাত্রের মধ্যে স্বাভাবিক। এই প্রচেষ্টায় যারা বিফল হয়েছে তারা দেহে বিরাট হলেও জীবন রক্ষা করতে পারেনি এবং জাতি হিসাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। এই অভিমতের মূল তত্ত্ব হচ্ছে এই যে, জীব-জগৎ সতত প্রবহমান পরিবর্তনের মাধ্যমে সহজ থেকে জটিল হয়ে বিকাশ লাভ করেছে। এই তত্ত্বের পরিপূরক হিসাবে ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে মানুষের জন্ম এবং বিকাশ সম্পর্কে ডারউইন ‘ডেসেন্ট অব ম্যান’ প্রকাশ করেন। এ গ্রন্থে তিনি দাবি করেন যে, মানুষের গঠনের সঙ্গে মনুষ্যেতর অনেক প্রাণীর সাদৃশ্য আছে। এ সাদৃশ্য থেকে সিদ্ধান্ত হচ্ছে যে, অন্যান্য প্রাণীর ন্যায় মানুষ, মানুষের চেয়ে সহজতর গঠনের জীবন থেকে পরিবর্তনের চরম অবস্থায় বিকাশ লাভ করেছে। মানুষও ‘মানুষ’ হিসাবে কোনো ঊর্ধ্বলোক থেকে নিক্ষিপ্ত হয় নি। চার্লস ডারউইনের বিকাশবাদের এই তত্ত্বের তাৎপর্য বিজ্ঞানের বিকাশের জন্য ছিল অপরিসীম। একটি বিরাট সামাজিক বিপ্লবের ন্যায় ডারউইনের তত্ত্বের বিরুদ্ধে আক্রমণ ও প্রতিবাদের ঝড় বইতে শুরু করে। কিন্তু বাস্তব বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব অন্ধ বিশ্বাসের উপর ক্রমে জয়ী হয়ে আজ প্রায় সর্বজনস্বীকৃত সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডারউইনের তত্ত্বের মধ্যে জগতে যে সতত শক্তিতে শক্তিতে দ্বন্দ্ব চলছে এবং সেই দ্বন্দ্বের ভিত্তিতেই যে জীবন বিকাশ লাভ করে সে বিকাশে পরিবর্তন চরম আকার লাভ করে নতুন অস্তিত্বের সৃষ্টি করতে পারে, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের এই তত্ত্বেরও স্বাভাবিক স্বীকৃতি লক্ষ করা যায়।
Decembrists: ডিসেম্বরপন্থী
১৮২৫ সালের ডিসেম্বর মাসে রাশিয়ার জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে কিছুসংখ্যক সামরিক অফিসারের নেতৃত্বে একটি অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল। এই অভ্যুত্থানকারীদের অনুসারীদের রুশ ইতিহাসে ডিসেম্বরপন্থী আখ্যায়িত করা হয়। রাশিয়ার জারের স্বৈরতন্ত্র এবং সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলনের ইতিহাস সুদীর্ঘ। এই সুদীর্ঘ ইতিহাসে ১৮২৫ সালের ডিসেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থানকে রুশ ইতিহাসকারগণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে বিবেচনা করেন। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ভি.আই. লেলিনের মতে রাজতন্ত্রের যুগে রাশিয়ার গণতান্ত্রিক মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাসে ডিসেম্বরপন্থীদের স্থান অনন্য। ডিসেম্বরের অভ্যুত্থান সংঘটিত হয় ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ান কর্তৃক রাশিয়া আক্রমণের পরে। রুশ-ফরাসি যুদ্ধকালে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী পশ্চিম ইউরোপের সামাজিক অবস্থার সাক্ষাৎ পরিচয় লাভের সুযোগ পায়। ফলে উক্ত যুদ্ধের পরে রাশিয়ার অভ্যন্তরে জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন অধিকতর অনিবার্য রূপ লাভ করতে থাকে। সমাজের অভিজাত এবং শিক্ষিত সম্প্রদায়ের অধিবাসীগণই সামরিক বাহিনীর অফিসার সম্প্রদায়ের বৃহত্তম অংশ ছিল। কিন্তু তাদের মধ্যেও যুদ্ধ-পরবর্তীকালে গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তাবোধ বৃদ্ধি পেতে থাকে। সামরিক বাহিনীর এই সমস্ত অফিসার গুপ্ত সমিতিতে সংঘবদ্ধ হয়ে দেশের শাসনতান্ত্রিক রাজতন্ত্র কিংবা প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করতে শুরু করে। প্রথম আলেকজাণ্ডর তখন রাশিয়ার সম্রাট। সামরিক বাহিনীর অফিসারগণ তাঁর মৃত্যুকালে একটি অভ্যুত্থান মারফত দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংকল্প করে। ১৮২৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর প্রথম আলেকজান্ডার মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পরে সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে বেশ পরিমাণ অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়। এই অনিশ্চয়তার সুযোগ গ্রহণ করে সামরিক বাহিনীর শাসনতন্ত্রবাদী অফিসারগণ ২৬ ডিসেম্বর বিদ্রোহ ঘোষণা করে দেশে শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এবং নিকোলাসের পরিবর্তে তাঁর জ্যেষ্ঠভ্রাতা কনস্টান্টাইনকে সম্রাট হিসাবে অধিষ্ঠিত করার দাবি জানায়। প্রথম আলেকজাণ্ডারের মৃত্যুর পরে নিকোলাস সম্রাট হিসাবে অধিষ্টিত হন। সম্রাট নিকোলাস তাঁর অনুগত সাঁজোয়া বাহিনীর মারফত বিদ্রোহ দমন করে। সাঁজোয়া বাহিনীর আক্রমণে বহু অভ্যুত্থানকারী এবং সাধারণ মানুষ নিহত হয়। জার সরকার ৫৭৯ জনকে গ্রেপ্তার করে বিদ্রোহ হিসাবে বিচার করে। এদের মধ্যে ৫ জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়, ৩১ জনকে যাবজ্জীবনের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। এভাবে ডিসেম্বরের অভ্যুত্থান পর্যুদস্ত হয়। ডিসেম্বর অভ্যুত্থান কেবল সামরিক বাহিনীর একটি অংশের আন্দোলন ছিল না। গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের প্রয়োজন বোধ তখন সমাজের বিভিন্ন অংশে প্রসারিত হয়ে পড়েছিল। তখনকার রুশ সমাজের শিক্ষিত এবং অভিজাত সম্প্রদায়ের ব্যাপকতম অংশ এই আন্দোলনে সমর্থন যোগাচ্ছিল। হারজেনের ন্যায় ইতিহাস-বিখ্যাত বিজ্ঞানীরও সমর্থন ছিল এই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উপর। ডিসেম্বরপন্থী বলে তাই রুশ ইতিহাসে কেবল কিছু সংখ্যক সামরিক অফিসারই পরিচিত নয়। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রথম যুগের সমস্ত প্রগতিশীল অংশই এই নামে পরিচিত। একটি সামাজিক আন্দোলন হিসাবে এই যুগের কবি-সাহিত্যিক-বৈজ্ঞানিক ও সমাজ-কর্মীদের মতামত রুশ ইতিহাসে আলোচিত হয়ে থাকে। ডিসেম্বর আন্দোলনের অনেক সাহিত্যিক ও বৈজ্ঞানিকই সমাজ ও জীবনের ব্যাখ্যায় বস্তুবাদী প্রগতিশীল মত পোষণ করতেন। হারজেন এবং তাঁর সাথীরা বস্তুকে প্রধান বলে বিবেচনা করতেন। চিন্তা মানুষের মস্তিষ্কেরই বিশেষ শক্তি, মন নামক অপর কোনো সত্তার নয়, এরূপ অভিমতও তাঁরা পোশষ করতেন। এঁদের অনেকে ধর্মকে শোষকের হাতে শোষণের অস্ত্র এবং শোষিতের সান্ত্বনার আশ্রয় বলে বিশ্লেষণ করেছেন। কিন্তু সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ডিসেম্বরবাদীগণ বিপ্লবী ছিল না। তাদের অভ্যুত্থানের পেছনে ব্যাপক কোনো গণ-সংগঠন এবং গণ-ভিত্তি ছিল না। এ কারণে সামরিক বাহিনীর একটি অংশের অভ্যুত্থান গণ-বিপ্লবে প্রসারিত না হয়ে সরকারের নিষ্পেষণযন্ত্রে সহজেই পর্যুদস্ত হয়ে যায়। কিন্তু পরাজিত হলেও ডিসেম্বরের অভ্যুত্থান রাশিয়ার পরবর্তীকালের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে প্রভূতভাবে প্রভাবান্বিত করেছে।