হযরত মূসা আলাইহিস সালাম
হযরত মূসা আলাইহিস সালাম মিসরে জন্মলাভ করেছিলেন। তিনি ছিলেন আল্লাহর নবী হযরত ইয়াকুবের (আ) বংশধর। তাঁর পিতার নাম ছিল ইমরান। হযরত মূসা (আ) বনী ইসরাঈল বংশের লোক। বনী ইসরাঈলগণ কিনআন থেকে হযরত ইউসুফের (আ) যুগে মিসরে আসেন এবং বসবাস করতে থাকেন। তাঁর সময়েও মিসরের শাসক রাজাদের উপাধি হতো ফিরআউন। হযরত ইউসুফের (আ) সময়ের ফিরআউন ইউসুফের সুমধুর চরিত্র, জ্ঞান-গরিমা ও বুদ্ধিমত্তা ধেখে মুগ্থ হন এবং মিসরের শাসনভার তাঁর ওপর অর্পণ করে নিজে নাম মাত্র শাসক থঅকেন। এ সময়ে বনী ইসরাইলগণ কিনআন থেকে মিসরে আগমন করেন।
হযরত মূসা (আ) যে সময় জন্মলাভ করেন সে সময়ে মিসরের শাসক ছিল ফিরআউন দ্বিতীয় রা’মসীস। এ সময় বিভিন্ন কারণে মিসরে আদিবাসী কিবতিরা বনী ইসরাঈলদের ওপর অত্যাচার শুরু করেছিল। ফিরআউন রা’মসীসের হুকুমে বনী ইসরাঈলদের ঘরে কোন পুত্র সন্তান হলে তাকে সরকারী লোকজন গিয়ে মেরে ফেলতো। আরো বিভিন্ন ভাবে তাদের ওপর অত্যাচার করা হতো। তাদের দিয়ে অমানুষিক পরিশ্র্রমের কাজ করানো হতো। এ যখন অবস্থা তখন বন িইসরাঈলদের মধ্যে মূসা (আ) জন্মলাভ করেন। সরকারী লোকজন খবর পেলেই এস তাঁকে মেরে ফেলবৈ, এ চিন্তায় হযরত মূসার মা অস্থির হয়ে উঠলেন। অবশেষে তিনি একটি ফন্দি করলেন। একটি কাঠের বাক্স তৈরী করে তার মধ্যে মূসাকে শুইয়ে দিয়ে বাক্সটি নীল নদীতে ভাসিয়ে দিলেন। বাক্ ভাস েভাসতে ফিরআউনের মহরে ঘাগেট গিয়ে ভিঁড়লো। লোকজন বাক্সটি তুলে এনে দেখলো তার মধ্যে ফুটফুটে একটি শিশু হাত-পা নেড়ে খেলা করছে। ফিরআউন তাকে কোন বনী ইসরাঈল ঘরের সন্তান মনে করে মেরে ফেলতে চাইলো। কিন্তু ফিরআউনের স্ত্রী তাকে নিজের সন্তান হিসেবে লালন-পালন করতে চাইলেন। ফিরাউন এতে রাজি হলো এবং পরে টাকার বিনিময়ে মূসার মাকেই দাই হিসাবে ডেকে আনা হলো। এভাবে আল্লাহর মহান কুদরতে হযরত মূসা (আ) রক্ষা পেলেন এবং নিজের মায়ের কোলেই লালিত পালিত হতে লাগলেন।
ফিরআউনের মহলেই হযরত মূসা (আ) ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠলেন। বড় হয়ে তিনি দেখলেন মিসরে বনী ইসরাঈলদের ওপর চ লছে নানা প্রকার জুলুম। মাঝে মাঝে তিন িএ সব জুলুমের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেন। একদিন তিনি বাজারের মধ্যে যাওয়ার সময় দেখলেন এক কিবতী বনী ইসরাঈলেল একজন লোরেক ওপর জুলূম করছে। হযরত মূসা (আ) কিবতীকে নিবৃত্ত করতে চাইলেন। কিন্তু সে হযরত মূসা ()আ)-কেই আক্রমণ করে বসলো। তখন তিনি কিবতীতে সজোরে এক ঘুষি লাগালেন। এতে হঠাৎ করে সে মারা গেল। পরে মূসা (আ) জানতে পারলেন ফিরআউন বিষয়টি জানতে পেরেছে এবং তাঁকে হত্যা কারার ষড়যন্ত্র করছে। এ খভর পেয়ে হযরত মূসা (আ) মিসর ছেড়ে বের হলেন এবং কয়েকদিন পর মাদায়েন এলাকায় গিয়ে উপস্থিত হলেন।
বেশ কয়েক বছর তিনি মাদায়েনে কাটালেন এবং সেখানেই বিয়ে করলেন। পরে ক্ষমতাসীন ফিরআউন দ্বিতীয় রামসীসের মৃত্যু হলে এবং তার পুত্র মিনফাতাহ ফিরাউন হলে তিনি মাদায়েন থেকে মিসরে যেতে মনস্থ করলেন। তাই একদিন স্ত্রীকেসাথে নিয়ে মিসরে রওয়ানা হলেন। পথিমধ্যে সিনাই মরুভূমিতে একদিন রাত্রি বেলা আগুনের দরকার হলো। হযরত মূসা (আ) পাহাড়ের উপর আগুন দেখে তা আনতে গেলেন। পাহাড়টির নাম ছিল তূর পাহাড়। আগুন ছিল মহান আল্লাহর নূর। সেখঅনেই আল্লাহ তা’আলা তছাকে নবুওয়াত দান করলেন। আল্লাহ তাছকে আদেশ করলেন: তুমি ফিরআউনের কাছে যাও। সে বাড়াবাড়ি করছে। তাকে আমার আদেশ নিষেধ শুনিয়ে সৎপথে আসতে বলো। এই সাথে আল্লাহ তা’আলা মূসা (আ)-কে কিছু মুজিযাও দান করলেন।
মূসা (আ) মিসরে গিয়ে ফিরআউনের দরবারে উপস্থিত হলেন। সংগে ছিলেন তাঁর ভাই আল্লাহর নবী হযরত হারূন (আ)। দরবারে উপস্থিত হয়ে মূসা (আ) ফির্াউনকে বললেন: আমাদের দু’ভাইকে আল্লাহ তাঁর রসূল করে তোমার কাছে পাঠিয়েছেন। আমরা তোমার কাছে আল্লাহর দেয়া হিদায়েতের বাণী নিয়ে েএসেছি। তুমি আল্লাহকে প্রভু বলে স্বীকার করো। তাঁর আইন-কানুন দেশে চালু করো। তাহলে দেশে সুখ-শান্তি আসবে। আর বনী ইসরাঈলদের ওপর অত্যাচার করা বন্ধ করো। তা না হলে তাদের মিসর থেকে বের করে নিয়ে যেতে দাও।
এসব কথা শুনে ফিরাউন বললো: হে মূসা, তোমার ব বা প্রভু কে? মূসা (আ) বললেন: যিনি আসমান-যমীন, পাহাড়-পর্বত, জীব-জন্তু সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। যিনি সবাইকে খেতে দেন, যিনি মৃত্যু দেন তিনিই আমার রব বা প্রভু। ফিরাউন বললো: তুমি যে আল্লাহর নবী তার প্রমাণ কি? তখন মূসা (আ) তাঁর লাঠিখানা মাটিতে ফেলে দিলেন। সংগে সংগে সেটি সাপ হয়ে গেল। আর হাতখানা বগলের নিচে রেখে তারপর বাইরে বের করলেন, আর সংগে সংগে তা বিদ্যুত চমক সৃষ্টি করলো। এসব দেখে ফিরআউন মনে করলো মূসা খুব যাদুবিদ্যা শিখে এসেছে। সুতরাং তাঁকে বড় বড় যাদুকর দিয়ে জব্দ করতে হবে। তাই ফিরাউন সারা মিসরে সব বড় বড় যাদুকরকে ডেকে মূসা (আ)-কে মোকাবিলা করতে বললো। একদিন একটা মাঠে অসংখ্য লোকের সামনে হযরত মূসা (আ) ও যাদুকরদের মোকাবিলা হলো। যাদুকররা তাদের যাদুর সাহায্যে বড় বড় সাপ তৈরী করলো এতে ভয়ংকর অবস্থার সৃষ্টি হলো। কিন্তু হযরত মূসা (আ) ভয় পেলেন না। তিনি তাঁর লাঠি মাটিতে ফেরা মাত্র তা প্রকান্ড সাপে পরিণত হলো এবং যাদুকরদের বানানো সাপগুলোকে এক এক করে মুহূর্তের মধ্যে গিলে ফেললো। এতে যাদুকররা বুছতে পারলো যে মূসা (আ) যাদুকর নন। তিনি সত্যই আল্লাহর নবী। সুতরাং যাদুকররা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনলো এবং হযরত মূসা (আ)-কে নবী বলে স্বীকার করে নিল। আরো অনেক লোকও ঈমান আনলো। এ দেখে ফিরাউন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলো। শুরু হলো মূসা (আ) ও তাঁর লোকদের ওপর আরো বেশী অত্যাচার। সব দেখে মূসা (আ) তাঁর লোকদের বললেন, সবর করো- ধৈর্য ধরো। তোমরা সত্য পথে আছ। সুতরাং তোমরাই জয়ী হবে।
জুলুম, অত্যাচার খুব বেড়ে গেল। যে সব যাদুকর আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছিল এবং মূসা (আ)-কে নবী বলে স্বীকার করেছিল ফিরআউন তাদের শূলে চড়িয়ে হত্যা করলো। মূসা (আ) দেখলেন এখন আর মিসরে থাকা সম্ভব নয়। তাই আল্লাহর নির্দেশে তিনি মিসর থেকে বনী েইসরাঈলদের নিয়ে অন্য জায়গায় চলে যাওয়ার সিদ্ধঅন্ত নিলেন। এক রাতে যখন মিসরের অধিবাসীরা এবং ফিরআউনের লোকজন এক আনন্দ উৎসবে মত্ত ছিল তখন মূসা (আ) খবর পাঠিয়ে সমস্ত বনী ইসরাইলদের জড়ো করলেন এবং মিসর থেকে বের হয়ে পড়লেন। তিনি চাচ্ছিলেন লোহিত সাগর পার হয়ে সিনাই উপত্যকায় পৌঁছবেন। বনী ইসরাঈলরা বের হয়ে পড়ার পরপরই ফিরআউন তা জানতে পারলো। সুতরাং তৎক্ষণাৎ সে সৈন্য-সান্ত নিয়ে তাদের পিছু ধাওয়া করলো। সকাল বেলায় বনী ইসরাঈলরা যখন লোহিত সাগরের কিনারে পৌঁছলো তার পরপরই ফিরআউনের বিশাল সৈন্যদল অস্ত্র-শসত্র সহ তাদের কাছে পৌঁছে গেল। বনী ইসরাঈলরা ভয়ে শিউরে উঠলো। কিন্তু আল্লাহর নবী মূসা (আ) মোটেই ভয় পেলেন না। তিনি আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইলেন। আল্লাহ তা’আলা তাঁকে আদেশ করলেন: তুমি তোমার লাঠি দিয়ে সাগরের পানির উপর আঘাত কর। মূসা (আ)তাই করলেন। সংগে সংগে সাগরের পানি দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল এবং মাঝখান দিয়ে রাস্তা তৈরী হয়ে গেল। মূসা (আ) সে রাস্তা দিয়ে বনী ইসরাঈলদের নিয়ে পার হয়ে সিনাই উপত্যকায় পৌঁছে গেলেন। ফিরআউন দেখলো সাগরের মধ্য দিয়েসুন্দর রাস্তা। মূসা দিব্যি এ রাস্তা দিয়ে পার হয়ে গেল। সুতরাং সে তার লোকজন সৈন্য-সামন্তকেও সে রাস্তা দিয়ে পার হতে আদেশ দিল। নিজেও অগ্রসর হলো। কিন্তু সাগরের মাঝখানে পৌঁছলে আল্লাহর আদেশে সাগরের পানি আবার মিশে গেল। ফিরআউন ও তার সৈন্য-সামন্ত সাগরের অথৈ পানিতে হাবুডুবু খেতে লাগলো। এভাবে ফিরআউন ও তার লোকজন লোহিত সাগরে ডুবে মারা গেল। জালিমদের পরিণতি কেমন হয় আল্লাহ পাক এভাবে তা দেখিয়ে দিলেন।
হযরত মূসা (আ) বনী ইসরাঈলদের মিসর থেকে উদ্ধার করে নিয়ে সিনাই আপদ্বীপে পৌঁছলেন। তূর পাহাড় এই স্থানে অবস্থিত। এ পাহাড়েই আল্লাহ তা’আলা মূসা (আ) এর সাথে কথা বার্তা বলতেন। মূসা (আ) কে আল্লাহ তা’আলা ‘তাওরাত’ নামক আসমানী কিতাব দান করলেন- যাতে তিনি তাঁর জাতিকে আল্লাহর পথে চালাতে পারেন। এখানেই মূসার (আ) বড় ভাই আল্লাহর নবী হযরত হারূন (আ) মৃত্যুবরণ করেন। হযরত মূসাও (আ) দীর্ঘদিন জীবিত থাকার পর এ স্থানেই একশ’ বিশ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ কনে এবং তূর পাহাড়ের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। একটি হাদীসে নবী (স) বলেছেন: আমি সেখানে গেলে পথের ধারে বালুর লাল ঢিবিগুলো থেকে সামান্য দূরে তাঁর কবর তোমাদের দেখিয়ে দিতে পারতাম।
এভাবেই আল্লাহর সব নবী (আ) মানুষের উপকারের জন্য সারা জীবন কাজ করে গিয়েছেন। তাঁরা আল্লাহ ছাড়া আর কাউকেই ভয় করেননি।
অনুশীলনী
১। হযরত মূসা (আ) কোথায় জন্মলাভ করেছিলেন?
২। বনী ইসরাঈলগণ কখন মিসর গমন করেছিলেন?
৩। একদিন বাজারে মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় মূসা (আ) কি দেখলেন? তিনি তখন কি করলেন?
৪। হযরত মূসা (আ) মিসর ছেড়ে গেলেন কেন? তিনি কোথায় গেলেন?
৫। হযরত মূসা (আ) কোন স্থানে নবুওয়াত লাভ করলেন? আল্লাহ তাঁকে কি বললেন?
৬। যাদুকরদের ডেকে ফিরআউন কি করলো? যাদুকররা ঈমান আনলো কেন?
৭। ফিরআউন কিভাবে ডুবে মরলো?
৮। হযরত মূসা (আ) কোথায় ইনতিকাল করেছিলেন? তাঁর বয়স তখন কত ছিল?
৯। মিসরের শাসকদের উপাধ কি ছিল?
১০। হযরত মূসা (আ) এর সময়ে মিসরের শাসক কেমন ছিল? তার নাম কি ছিল?
১১। মূসা (আ) এর ভাইয়ের নাম কি? তিনি কোথায় ইনতিকাল করেন?
১২। মূসা (আ)-কে আল্লাহ তা’আলা যে মুযিজা দিয়েছিলেন তা কি ছিল উল্লেখ করো।
১৩। হযরত মূসা (আ) এর উপর নাযিলকৃত কিতাবের নাম কি?
হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালাম
হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালাম বনী ইসরাঈল বংশের একজন নবী এবং হযরত দাউদ আলাইহিস সালামের পুত্র ছিলেন। কোরআন মজীদের বিভিন্ন সূরায় ষোলীট জায়গায় হযরত সুলায়মনের (আ) কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ হযরত দাউদ (আ)-কে নবুওয়াত ও বাদশাহী এক সাথে দান করেছিলেন। হযরত সুলায়মান (আ)-কেও তেমনি নবুয়াত ও বাদশাহী এক সাথে দান করেছিলেন। তাঁর রাষ্ট্র ছিল যেমন বিশাল তেমনি তিনি ছিলেন বিস্ময়কর ক্ষমতার অধিকারী েএবং বুদ্ধিমান।
হযরত দাউদের (আ) ইনতিকালের পর বার বছর বয়সে হযরত সুলায়মান (আ) পিতার বিশাল রাজ্যের অধিকারী হলেন। বয়স এতো কম হলে কি হবে? তিনি ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান দুলদৃষ্টি সম্পন্ন। রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে তিনি ছিলেন খুব পারবর্শী। তিনি বাল্যকাল থেকেই যে কোন মামলা মোকদ্দমার সঠিক ফয়সালা করতে পারতেন। একবার হযরত দাউদের (আ) কাছে এসে এক ব্যক্তি একটি মামলা দায়ের করলো যে, এক ব্যক্তি বকরীর পাল তার ফসলের ক্ষেতে ঢুকে তা নষ্ট করে ফেলেছে। হযরত দাুদ (আ) বকরীর মালিকের বকরীগুলো ক্ষেত্রের মালিককে দিয়ে দেয়ার ফয়সালা দিলেন। কিন্তু হযরত সুলায়মান (আ) এ ফয়সালা পছন্দ করলেন না। তিনি ফয়সালা করলেন যে, বকরীর মালিক ক্ষেতের যত্ন নেবে ও দেখাশোনা করবে। ক্ষেতের মালিক বকরীগুলো থেকে উপকৃত হতে পারবে। এ ফয়সালা হযরত দাউদ (আ) ও অন্য সবাই পছন্দ করলেন।
বায়তুল মাকদাসের নির্মাণ]
বাদশাহ হিসেবে ক্ষমতা লাবের পর হযরত সুলায়মান (্িা) পিতার অসিয়াত অনুসারে বায়তুল মাকদাসের নির্মণ শুরু করেন। প্রচুর অর্থ ব্যয় করে সাত বছরে তিনি এ মহৎ কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম হন। তিনি ইয়ারূসালেম (জেরুজালেম) শহরের চারদিকে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করে সুরক্ষিত করেন। বায়তুল মাকদাস নির্মাণ শেষ হওয়ার পর তিনি হাইকালে সুলায়মানী নামক মহল নির্মাণ করেন। এভাবে সংস্কার ও নির্মাণ কাজের প্রতি তিনি খুব গুরুত্ব প্রদান করেন। অনেক লিখেছেন, হযরত সুলায়মানের (আ) েএকটা বৃহৎ নৌ-বহর ছিল্ এ নৌ-বহরের মাধ্যমে তিনি ভার থেকে সোনা, রূপা ও অন্রান্য মুল্যবান সামগ্রী নিয়ে যেতেন। তিনি আল্লাহর ও তাঁর ইসলামী রাষ্ট্রের শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য উত্তম জাতের বহু ঘোড়া পালতেন।
হযরত সুলামানের (আ) প্রতি আল্লাহর নিয়ামত
আল্লাহ তা’আলা হযরত সুলায়মানকে (আ) পশু-পাখীর ভাষা বুঝার ক্ষমতা দিয়েছিলেন। যেমন হুদহুদ নামক পাখী ও পিঁপড়ার কথা বুঝার বিষয় কোরআন মজীদে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা তাঁকে বাল্যকাল থেকেই হিকমত বা বুদ্ধিমত্তা দান করেছিলেন। আল্লাত তা’আলা তাঁকে বাতাসের ওপরও কর্তৃত্ব দান করেছিলেন। আল্লাহর ইচ্ছা পশু-পাখী ও জ্বিন, এমন কি বিদ্রোহী শয়তানদেরও উপর আধ্যিপত্য লাভ করেছিলেন। এরা সবাই ছিল তাঁর প্রজা। তাঁর শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল এদের সবার ওপর। এমন কি তাঁর সৈন্যদল মানুষ ছাড়া জ্বিন এবং পাখীও অন্তর্ভুক্ত ছিল্ তিনি দুষ্ট ও বিদ্রোহী জ্বিনদের ধরে ধরে শাস্তি দিতেন এবং বন্দী করে রাখতেন। তাদের দিয়ে কঠিন কাজও আদায় করতেন। এভাবে তাদের ক্ষতিকর প্রভাব থেকেও মানুষকে রক্ষা করতেন।
সাবার রাণী বিলকিসের ইসলাম গ্রহণ
সুলায়মানের (আ) সময়ে সাবা নামে আরবের সর্বদক্ষিণে িএকটি রাজ্য ছিল। রাণী বিলকিস সে দেশ শাসন করতেন। সে দেশের সব মানুষ সূর্যের পূজা করতো। দেশটি ছিল খুবই সুন্দর। হুদহুদ পাখীর মুখে হযরত সুলায়মান (আ) সে দেশের ও রাণীর খবর জানতে পারলেন। তিনি পাখীর মাধ্যমে রাণীকে ইসলাম গ্রহণ করে তাঁর কাছে হাজির হওয়ার পত্র পাঠালেন। পাখী পত্র খানা রাণীর কাছে পৌঁছে দিলে রাণী তাঁর সব লোকজনকে ডেকে পরামর্শ করলেন এবং নির্দেশ মত সুলায়মানের (আ) কাছে হাজির হওয়ার জন্য রওয়ানা হলেন। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে তিনি হযরত সুলায়মান (আ) দরবারে হাজির হলেন এবং তাঁর চরিত্র, বুদ্ধিমত্তা, শাসন ক্ষমতা ও জাঁক-জমক দেখে অভিভূত হয়ে গেলেন। তিনি সমস্ত দলবলসহ ইসলাম গ্রহণ করলেন। এভাবে হযরত সুলায়মানের (আ) সময়েই সুদূর সাবায় ইসলামের বাণী ছড়িয়ে পড়লো।
হযরত সুলায়মান (আ) শুধু নবী ছিলেন না। তিনি ছিলেন বিশাল এক রাজ্যের বাদশাহও। তাই বলে তিনি বাদশাহীর মোহে পড়ে এক মুহূর্তের জন্যও আল্লাহকে ভুলেননি। আল্লাহর নির্দেশ মতই তিনি রাজকার্য পরিচালনা করতেন, নিজেও সে ভাবে চলতেন। সব ব্যাপারেই তিনি ন্যায় ও ইনসাফ অনুসারে ফয়সালা করতেন। তিনি সামান্য কোন অন্যায় করেছেন একথা বিশ্বাস করা একেবারেই অসম্ভব। তাই বলে ভাল মানুষকেও খারাপ বলার লোকের কিন্তু অভাব হয় না। আল্লাহর লানতপ্রাপ্ত ইয়াহুদীরা তাঁকে নানাভাবে দোষারোপ করেছে। কারণ, তিনি তাদের খারাপ কাজ করতে মানা করতেন।
ইনতিকাল
সাবার রাণী বিলকিসের সাথে হযরত সুলায়মানের বিয়ে হয়ে যায়। রাণী বিলকিসের জন্য তিনি বা’লাবাক শহরে িএকটি প্রকা্ড মহল নির্মাণ করেছিলেন। তিনি নিজেও এটি দেখাশুনা করছিলেন। এ অবস্থায় তিনি একদিন ইনতিকাল করেন। তখন তিনি লাঠির উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। েইনতিকালের পরেও লাঠির উপর ভর দেয়া অবস্থায় তিনি থাকলেন। কেউ বুঝতে পারল না যে তিনি ইনতিকাল করেছেন। অনেকদিন পরে উই পোকা তাঁর লাঠি খেয়ে ফেললৈ লাঠি ভেঙ্গে তাঁর শরীরটা পড়ে গেল। তখন সবাই বুছতে পারলো যে তিনি ইনতিকাল করেছেন। বায়তুল মাকদাসে তাঁকে দাফন করা হয়। ইনতিকালের সময় তাঁর বয়স ছিল বায়ান্ন বছর।
তিনি সারা জীবন মানুষকে আল্লাহর দীনের পথে ডেকেছেন এবং সে অনুযায়ী দেশ শাসন করেছেন।
অনুশীলনী
১। হযরত সুলায়মান (আ) কে ছিলেন? কোরআন মজীদের কত স্থানে তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছে?
২। কত বছর বয়সে হযরত সুলায়মান (আ) রাজত্ব লাভ করেছিলেন, তিনি ক্ষেত ও বকরীর মালিকের ব্যাপরটি কিভাবে মীমাংসা করেছিলেন?
৩। বায়তুল মাকদাস ও হায়কালে সুলায়মানীর নির্মাণকারী কে? বায়তুল মাকদাস নির্মাণে কত বছর সময় লেগেছিল?
৪। তিনি ভারত থেকে সোনা, রূপা ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী কিভাবে নিয়ে যেতেন? তিনি ঘোড়া পালতেন কেন?
৫। আল্লাহ তা’আলা হযরত সুলায়মান (আ)-কে কি কি নিয়ামত দান করেছিলেন?
৬। রাণী বিলকিসের ইসলাম গ্রহণের ঘটনা বর্ণনা ক র।
৭। হযরত সুলায়মানের ইনতিকালের ঘটনাটি বর্ণনা কর।
হযরত ইলিয়াস আলাইহিস সালাম
হযরত ইলিয়াস আলাইহিস সালাম বনী ইসরাঈলদের একজন বিখ্যাত নবী। তিনি হযরত মূসার (আ) ভাই হযরত হাুনের (আ) বংশধর। তিনি বর্তমান জর্ডান নদীর উত্তর অঞ্চলের জিল’আদ নামক স্থানের “আবেল মাহুলা” নামক জায়গার অধিবাসী ছিলেন। খৃষ্টান এবং ইয়াহুদদের কাছে তিনি ইলিশা নামে পরিচিত। তিনি খৃষ্টপূর্ব ৮৭৫ থকে ৮৫০ সনের মাঝামাঝি সময়ে জন্মলাভ করেন।
মহান আল্লাহর ইচ্ছায় বনী ইসরাঈলদের মধ্যে বহু নবী আগমন করেন। এর পরও তারা বার বার সত্য পথ থেকে দূরে সরে যায়। যে সময় হযরত েইলিয়াস (আ) জন্ম লাভ বরেন সে সময় বনী িইসরাঈলগণ আবার আল্লাহর পথ ছেড়ে গোনাহর কাজে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল।
হযরত সুলায়মানের (আ) সময় বনী ইসরাঈলদের প্রভাব- প্রতিপত্তি চরম পর্যায়ে উনীত হয়। কিন্তু তাঁর ইনতিকালের পর পরই বনী ইসরাঈলদের রাষ্ট্র দু’ভাগ হয়ে যায়। দক্ষিণ ফিলিস্তিনে একটি ছোট রাষ্ট্র কায়েম হয়। এর রাজধানী হয় বায়তুল মাকদাস। অন্যদিকে উত্তর ফিলিস্তিনে েইসরাঈল নামে একটি রাষ্ট্র কায়েম হয়। এর রাজধাী ছিল সামেরিয়া। উত্তর এলাকার ইসরাঈল নামক রাষ্ট্রে প্রথম থেকেই শিরক, মূর্তি পূজা, জুলুম-অত্যাচার ও লজ্জাহীনতা বেড়ে যেতে থাকে। এ অবস্থায় এ রাষ্ট্রের শাসক ‘আখীআব’ লেবাননের মুশরিক রাজ কন্যা ইযবেলকে বিয়ে করে। তার প্রভাবে পড়ে ‘আখী আব’ ও শুশরিক হয়ে যায়। স্ত্রী ইযবেলের কথামত সে রাজধানী সামেরিয়ায় ‘বা’ল’ দেবতার মন্দির ও বলির বেদী তৈরী করে এবং এক আল্লাহকে বাদ দিয়ে বা’ল দেবতার পূজা প্রচলনের চেষ্টা চালায়।
ঠিক এ সময় হযরত ইলিয়াস (আ) এর আবির্ভাব ঘটে। তিনি এসব পাপ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। লোকজনকে তিনি এ মূর্তি পূজার অপকারিতা বুঝাতে থাকেন। তিনি বাদশাহ ‘আখী আবকে তার অন্যায় কাজকর্মের জন্য সাবধান করে দেন। তিনি বাদশাহকে বললেন: তুমি এসব অন্যায় বন্ধ না করলে তোমার রাষ্ট্রে আর এক বিন্দু বৃষ্টিও হবে না। আল্লাহর নবীর কথাই সত্য প্রমাণিত হলো। সেখানে সাড়ে তিন বছর পর্যন্ত বৃষ্টি হলো না। এমন অবস্থায় বাদশাহ ইলিয়াস (আ)-কে খুঁজে আনলেন এবং বৃষ্টির জন্য আল্লাহর কাছে দো’আ করতে বললেন। এ সময় হযরত ইলিয়াস (আ) বা’ল দেবতা এবং মহান আল্লাহর পার্থক্য মানুষের সামনে প্রকাশ করতে চাইলেন। তিনি বললেন: একটি প্রকাশ্য সভায় বা’ল দেবতার পূজারীরা তাদের দেবতার নামে কুরবানী করবে এবং আমি আল্লাহর নামে কুরবানী পেশ করবো। গায়েবী আগুন এসে কুরবানীকে পুড়িয়ে ফেলবে সেই সত্য পথের অনুসারী। ‘আখী আব’ প্রস্তাবটি মেনে নিল। সুতরাং কারমেল পর্বতে বা’ল দেবতার আটশত পূজারী এবং হযরত ইলিয়াস (আ) হাজার হাজার লোকের সামনে কুরবানী পেশ করলেন। গায়েবী আগুন এসে হযরত ইলিয়াসের (আ) কুরবানী পুড়িয়ে ফেললে সবাই তাঁর প্রভুর সত্যতা মেনে নিল। েইলিয়াস (আ) সেখানেই পূজারীদেরকে হত্যা করালেন। এরপর তিনি দো’আ করলেন। প্রচুর বৃষ্টি হলো। এতে প্রমাণ হলো একমাত্র আল্লাহই সত্যিকার ক্ষমতার অধিকারী। তিনিই সব ইবাদত পাওয়ার যোগ্য। আর হযরত ইলিয়াস (আ) তাঁরই প্রেরিত নবী।
এই ঘটনার পর রাজা ‘আখী আব’ তার স্ত্রী ইযবেলের প্ররোজনায় হযরত ইলয়াসের (আ) শত্রু হয়ে গেল। সে শপথ করল: বা’ল দেবতার পূজারীদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে েইলিয়াসকেও সেভাবে হত্যা করবে। এ অবস্থায় হযরত ইলিয়াস (আ) দেশ ছেড়ে সিনাই মরুভূমির সিনাই পর্বতে গিয়ে আশ্রয় নিলেন এবং কয়েক বছর পর্যন্ত সেখানেই কাটালেন। ঐ সময় তিনি আল্লাহর কাছে দো’আ করে বলতেন: ‘হে আল্লাহ, বনী ইসরাঈলরা তোমার হুকুম-আহকাম পরিত্যাগ করেছে। তোমার নবীদের হত্যা করেছে। তোমার নবীরেদ মধ্যে এখন আমিই শুধু বেঁচে আছি। তারা আমাকেও হত্যা করতে চায়।
এ সময়েই বায়তুল মাকদাসের ইয়াহুদী রাষ্ট্রের শাসক ইয়াহুরাম ইসরাঈলৈর বাদশাহ আখী আবের য়েকে বিয়ে করে। ফলেতারা রাজ্যেও শিরক ও বা’ল দেবতার পূজা শুরু হয়। হযরত েইলিয়াস (আ) ইয়াহুরামের কাছে পত্র লিখে তাকেও সাবধান করে দেন। কিন্তু তারা কেউিই তাঁর কথায় কান দিলো না। অবশেষে তাদের ওপর আল্লাহর গযব নেমে আসে। বিদেশীরা ইয়াহুরামের রাজ্রের উপর হামলঅ করে তাকে হত্যা করে এবং স্ত্রীকে বন্দী করে নিয়ে যায়। কিছুদিন পর সেও কঠিন পেটের পীড়ায় মারা যায়।
এর কয়েক বছর পর হযরত ইলিয়াস (আ) আবার ইসরাঈলে ফিরে গিয়ে ‘আখী আব’কে সাবধান করে দেন। তার মৃত্যুর কিছুদিন পর হযরত ইলিযাস (আ) ইনতিকাল করেন।
হযরত ইলিয়াস(আ) সারা জীবন অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। তিনি মানুষের কল্যাণ কামনা করেছেন। আর একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করেননি।
অনুশীলনী
১। যার সময়ে বন্দী ইসরাঈলদের প্রভাব প্রতিপত্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল?
২। ইসরাঈল রাষ্ট্রে কি বেড়ে গিয়েছিলো?
৩। শাসক ‘আখী আব’ কিভাবে মুশরিক হয়েছিলো?
৪। বাল দেবতা ও মহান আল্লাহর মধ্যেযার পার্থক্য তুলে ধরার জন্য হযরত ইলিয়াস (আ) কি করলেন?
৫। হযরত ইলিয়াস (আ) বা’ল দেবতার পূজারীদের কিভাবে হত্যা করাতে সক্ষম হলেন?
৬। বাদশাহ হযরত ইলিয়াস (আ) কে হত্যা করতে চাইলো কেন?
৭। সিনাই পর্বতে ইলিয়াস (আ) কি বলে আল্লাহর কাছে দো’আ করতেন?
৮। হযরত ইলয়াস (আ) কার কাছে পত্র দিলেন এবং কেন?
৯। ইয়াহুরাম তার ও তার রাজ্যের পরিণতি কি হয়েছিলো লিখ?
হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম
হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম ছিলেন আল্লাহর একজন শ্রেষ্ঠ রসূল। তিনি বনী ইসরাঈল বংশে জন্মলাভ করেছিলেন এং তাদের জন্যই রসূল হিসেবে এসেছিলেন। তাঁর জন্ম আল্লাহ তা’আলার অসীম শক্তির প্রমাণ। আল্লাহ তা’আলা হযরত আদম আলাইহিস সালঅমকে মাতা-পিতা ছাড়াই সৃষ্টি করেছিলেন। আর হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করেছিলেন পিতা ছাড়াই। হযরত মরিয়াম (আ) ছিলেন তাঁর মা। তাই তাঁকে ঈসা ইবনে মরিয়াম বলা হয়।
হযরত ঈসার (আ) মা হযরত মরিয়াম (আ) মায়ের পেটে থাকতেই তাঁর মা হান্না বিবি মানত করেছিলেন যে, তাঁর গর্ভের সন্তানকে েএকনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ঘর বায়তুল মাকদাসের খাদেম বানাবেন। কিন্তু ভূমিষ্ঠ হলে দেখা গেল পুত্র সন্তান জন্মলাভ না করে মেয়ে সন্তান জন্মলাভ করেছে। তিন তাঁর িএ মেয়ের নাম রাখলেন মরিয়াম। একটু বড় হলে মেয়েকেই তিনি বায়তুল মাকদাসেরখেদমতের জন্য নিয়োজিত করলেন। হযরত যাকারিয়া আলাইহিস সালাম ছিলেন বায়তুল মাকদাসেরমোতাওয়াল্লী। তিনি ছিলেন হযরত মরিয়ামের আত্মীয়। তাঁর তত্ত্বাবধানে তিনি বায়তুল মাকদাস সংলগ্ন িএকটি আলাদা কামরায় থাকতেন। অত্যন্ত পবিত্র পরিবেশে তিন লালিত পালিত িএবং বড় হতে থাকলেন। যাকারিয়া (আ) খোঁজ-খবর নেয়ারজন্য মাঝে মাঝে তাঁর কামরায় প্রবেশ করতেন। যখনই তিনি যেতেন তখনই দেখতেন বালিকা মরিয়ামের কামরায় অনেক সুমিষ্ট ফল-মূল। এ দেখে তিনি আশ্চর্য হয়ে যেতেন। ভাবতেন অসময়ে মারিয়াম এসব কোথা থেকে পায়? একদিন তিনি মরিয়ামকে জিজ্ঞেস করলেন: মারিয়াম তুমি এসব ফল-মূল কোথা থেকে পাও? এ সব তো এখন পাওয়ার কথা নয়। মরিয়াম বললেন মহান আল্লাহ আমাকে এ সব ফল-মূল দান করেন। এ সব ঘটনা থেকেই বুঝা যায় যে, হযরত মারিয়াম ছিলেন আল্লাহর অত্যন্ত প্রিয় পাত্রী।
মারিয়াম সেখানেই বড় হলেন এবং যৌবনে পদার্পণ করলেন। এ সময় একদিন আল্লাহর ফেরেশথা হযরত জিব্রাঈল (আ) তাঁর কাছে এসে বললেন: আমি আল্লাহর দূত। আল্লাহ আমাকে তোমার কাছে পাঠিয়েছেন। আমি তোমাকে (আল্লাহর হুকুমে) একটা সন্তান দান করবো। এ বলে হযরত জিব্রাঈল (আ) তাঁর বুকে একটি ফূঁ দিলেন। হযরত মরিয়মা গর্ভবতী হলেন এবং বায়তুল মাকদাসের অদূরে এক স্থানে একটি সন্তান প্রসব করলেন। তিন সন্তানের নাম রাখলেন ঈসা। মায়ের পেট থেকে ভূমিষ্ট হওয়ার পর পরিই ঈসা কথা বলে উঠলেন। হযরত মরিয়াম অত্যন্ত খুশী হলেন। তাঁর সব দুঃখ দূর হয়ে গেল। লজ্জা ভয় কোন কিছুই আর তাঁর থাকলো না। শিশু সন্তান কোলে নিয়ে ফিরে আসতে দেখে দুশ্চরিত্র ইয়াহুদীরা তাঁকে অনেক গাল-মন্দ দিতে লাগলো। কিন্তু তিনি কোন কথা বললেন না, শুধু শিশুর দিকে ইশারা করলেন অর্থাৎ এ শিশুই সব কথা বলবে। সবাই বলে উঠলো, এ দোলনায় শায়িত শিশুর সাথে আমরা কেমন করে কথা বলবো? সে কি কথা বলতে পারবে? তখন শিশু নবী হযরত ঈসা (আ) কথা বলে উঠলেন। তিনি বললেন, “আমি আল্লাহ বান্দা। আলআহ মানুষের হেদায়েতের জন্য আমাকে কিতাব দান করেছেন। তিনি আমাকে নবী হিসেবে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন।” সদ্য প্রসূত শিশুর মুখে এসব কথা শুনে সবাই তাজ্জব বনে গেল। তারা তাঁকে বিশ্বাস করলো এবং কোন কিছু না বলে চলে গেল।
হযরত ঈসা (আ) ধীরে ধীরে বড় হলেন এবং নবুওয়াত লাভ করলেন। এ সময় বনী ইসরাঈলগণ আল্লাহর সব নির্দেশ ভুলে গিয়েছিল। তারা শিরক ও আরো অনেক গোনাহর কাজে লিপ্ত ছিল্ রাজা বাদশারাই আবার বেশী করে আল্লাহ ও তাঁর আদেশ নির্দেশ ভুলে গিয়েছিল। এনটিওকস নামে এক রাজা তার আমলে জোর পূর্বক বায়তুল মাকদাসের মধ্যে মূর্তি স্থাপনেএবং লোকজনকে তার পূজা করতে বাধ্য করেছিল। আল্লাহর নামে কুরবানী করা বন্ধ করে দিয়েছিল। যারা বাড়িতে তাওরাত গ্রন্থ রাখতো সে তাদের মৃত্যুদন্ড দেয়ার ব্যবস্থা করেছিল্ হযরত ঈসা (আ) তাদের এসব অন্যায় কাজ করতে নিষেধ করলেন। তারা যে সব অন্যায় কাজ করতো তিনি সে সব কাজ সম্পর্কেও তাদের সাবধান করে দিলেন।
েইয়াহুদরা তাঁর এসব কথা ভাল মনে করলো না। তারা তাঁর বিরোধিতা শুরু করলো। কেউ যাতে তাঁর কথা না মানে সেজন্যও তারা চেষ্টা করতে লাগলো। ইয়াহুদ আলেমরাও তাঁকে নবী বলে স্বীকার করলো না। হযরত ঈসা (আ) যখন দেখলেন যে, কেউ তা৭র কথা শুনছে না তখন তিনি সবাইকে ডেকে বললেন: আল্লাহর দ্বীনের কাজে আমাকে কে সাহায্য করতে পার? তাঁর এ আহবানে একদল মৎস্যজীবী জেলে তাঁর ওপর ঈমান এনে তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন। এঁদেরকে কোরআন মজীদে হাওয়ারী বলা হয়েছে। হাওয়ারীরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত হযরত ঈসা (আ) কে সাহায্য করেছেন।
হযরত ঈসাকে (আ) আল্লাহ তা’আলা অনেক মু’জিযা দান করেছিলেন। তিনি আল্লাহর হুকুমে মৃত মানুষকে জীবিত করতে পারতেন। কুষ্ঠ ও অন্যান্য কঠিন রোগ ভাল করতে পারতেন। মাটি দিয়ে পাখি তৈর িকরে তাতে ফুঁক দিলে তা জীবিত হয়ে উড়ে যেতো। লোকেরা কি খেতো এবং বাড়িতে কি জমা করে রাখতো আল্লাহর হুকুমে তাও তিনি বলতে পারতেন।
ইয়াহুদদের দোষ-ত্রুটি প্রকাশ এবং অন্যায় কাজ করতে নিষেধ করার কারণে তারা তাঁর শত্রু হয়ে গেল এবং তাঁকে হত্যা কারা ষড়যন্ত্র করলো। তারা দেশের শাসনকর্তার কাছে গিয়ে হযরত ঈসা (আ) সম্পর্কে এ বলে অভিযোগ করলো যে, তিন লোকদের তার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলছেন। শাসনকরাতা েইয়াহুদদের কথা বিশ্বাস করলো। সে হযরত ঈসা (আ)-কে হত্যা করার জন্য লোক পাঠালো। ইয়াহুদরা তাঁকে গ্রেহফতার করার ব্যাপারে সাহায্য করলো। গ্রেফতার করে তাঁকে একটি ঘরে বন্দী করে রাখা হয় এবং পরে শূলে চড়িয়ে হত্যা করার সিদ্ধান্ত হয। তাঁকে ধরে আনার জন্য প্রথমে ঘরের মধ্যে একটি লোক প্রবেশ করে। কিন্তু সে হযরত ঈসা (আ)-কে সেখানে দেখে আশ্চর্ হয়ে যায়। পরে অন্যান্য লোকেরা সেখানে গিয়ে ঐ লোকটিকে হযরত ঈসা (আ)-এর আকৃতিতে দেখতে পায় এবং তাঁকে ঈসা মনে করে শুলে চড়িয়ে হত্যা করে।
এদিতে হয়েছে কি! আল্লাহ তাঁর প্রিয় রসূলের এরূপ বিপদ দেথে কাঁকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করেন। তিনি নিজের অসীম কুদরতে তাঁকে উঠিয়ে নেন। আর যে লোকটি হযরত ঈসা (আ)-কে ধরে আনার জন্য প্রথমে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেছিল তাকে ঈসার আকৃতি দান করেন। লোকেরা মনে করলো সেই বুঝি ঈসা। তাই তাকে শূলে চড়িয়ে হত্যা করলে। মহান আল্লাহ এভাবে তাঁর নবীকে রক্ষা করলেন।
কিয়ামতের পূর্বে দাজ্জালকে হত্যা করার জন্য তিনি আবার দুনিয়াতে আসবেন। তবে তখন তিনি নবী হিসেবে আসবেন না।
অনুশীলনী
১। হযরত ঈসাকে (আ) ঈসা ইবনে মারিয়াম বলা হয় কেন?
২। হযরত মারিয়ামের কামরায় গিয়ে হযরত যাকারিয়া (আ) কি দেখতে পেতেন?
৩। কিভাবে বুঝা যায় যে, হযর মারিয়াম আল্লাহর প্রিয় পাত্রী ছিলেন?
৪। ফেরেশতা হযরত বিজরাঈল এসে মারিয়ামকে কি বললেন?
৫। দুশ্চরিত্র ইয়াহুদরা হযরত মারিয়ামকে গাল –মন্দ দিল কেন? জবাবে তিনি কি বললেন?
৬। বনী ইসরাঈলদের অবস্থা কিরূপ ছিল?
৭। হযরত ঈসার (আ) ডাকে কারা সাড়া দিয়েছিল? তাঁর কি কি মু’জিযা ছিল?
৮। ইয়াহুদরা তাঁর শত্রু হলো কেন? তিনি আবার কি দুনিয়ায় আসবেন?
শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
আল্লাহ তা’আলা দুনিয়াতে যত নবী ও রসূল পাঠিয়েছেন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লম তাদের মধ্যে সর্বশ্রেস্ঠ ও সর্বেশেষ রসূল। তিনি ৫৭০ ঈসায়ী সনে আরব দেশের মক্কা নগরে জন্মলাভ করেছিলেন। তিনি আরবের সর্বশ্রেস্ঠ বংশ কুরাইশ বংশে জন্মলাভ করেন। তাঁর পিতার নাম আবদুল্লাহ আর মায়ের নাম আমিনা। জন্মের কয়েক মাস পূর্বেই পিতা ইনতিকাল করেন। আর জন্মের ছয় বছর পর ইনতিকাল করেন মা।
তোমরা জান মানুষ যখনই আল্লাহকে ভুলে যেতো এবং নানা রকম অন্যায় কাজ-কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়তো তখনই আল্লাহ তাদের সৎ পথে আনার জন্য নবী এবং রসূল পাঠাতেন। হযরত মুহাম্মদ (স)-কেও আল্লাহ তা’আলা একই উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে ছিলেন। তবে তাঁর আগে যত নবী ও রসূল দুনিয়াতে এসেছিলেন তাঁদের একটা জাতি বা এলাকার জন্য পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (স)-কে পাঠানো হয়েছিল সারা দুনিয়ার জন্য। আল্লাহ তা’আলঅ তাঁকে সারা দুনিয়ার মানুষকে হিদায়াত করার জন্য পাঠিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন শেষ নবী ও রসূল। তাঁর পর আর কোন নবী বা রসূল আসবেন না।
তিনি যে সময় আরবে জন্মলাভ করেন সে সময় আরবের মানুষেরা পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তারা পরস্পর মারামারি করতো। গোত্রে-গোত্রে ও এলাকায় এলাকায় সব সময় হিংসা বিদ্বেষ লেকেই থাকতো। মানুষ মানুষকে খুন করতে মোটেই পিছপা হতো না। মেয়েদের সাথে তারা জঘণ্য ব্যবহার করতো। কারো ঘরে মেয়ে জন্ম নিলে তাকে জীবিত পুঁতে ফেলতৈা। ভাল ব ্যবহার তারা জানতো না। লজ্জা-শরম বলতে কিছুই তাদের ছিল না। তারা উলঙ্গ হয়ে কা’বা ঘরে তাওয়াফ করতো। হাটে-বাজারে মানুষ কেনা-বেচা করতো। যে সব মানুষদের তারা কিনে আনতো তাদের বলা হতো দাস।দাসদের তারা নির্দয়ভাবে শাস্তি দিতো। তাদের দিয়ে কঠিন কঠিন কাজ করাতো কিন্তু ঠিকমত খেতে দিতো না। আসরে বসে পাল্লা দিয়েমদ খেতো, জুয়া খেলতো। গর্ব আর অহংকার করা ছিল তাদের স্বভাব। এ ধরনের আরো অনেক খারাপ কাজ তারা করতো।
এরূপ এক অসভ্য সমাজে আমাদের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স) জন্মলাভ করেন। আরবের সম্ভ্রান্ত খানদানের নিয়ম অনুসারে জন্মলাভের পর নবী (স)-কে মক্কার বাইরে এক বেদুইন পরিবারে হালীমা নাম্নী এক ধাত্রীর কাছে প্রতিপালনের জন্য দিয়ে দেয়া হলো। হালীমা তাঁকে নিজের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। এখানকার মুক্ত আলো বাতাসে নবী (স) বড় হয়ে উঠতে লাগলেন। হালীমা তাঁকে আপন সন্তানের মত আদর যত্ন করতেন। হালীমার আদর-স্নেহ ও যত্নে লালিত পালিত হয়ে একটু বড় হলে তিনি তাঁকে নিয়ে মক্কায় এলেন এবং তাঁর মা আমিনার কাছে নিয়ে গেলেন।
বিবি আমিনা শিশু নবী মুহাম্মদ (স)-কে সাথে করে মদীনায় তাঁর বাপের বাড়িতে গেলেন। উদ্দেশ্য ছিল সেখানে গিয়ে স্বামীর কবর যিয়ারত করা। মদীনা থেকে ফেরার সময় পথিমধ্যে আমিনাও িইনতিকাল করলেন। তিনি রেখে গেলেন ছয় বছরের ইয়াতীম মুহাম্মদ (স)-কে দাসী উম্মে আয়মান তাঁকে সাথে করে মক্কায় ফিরে এলেন। তখন থেকে তাঁকে প্রতিপালনের ভার নিলেন দাদা আবদুল মুত্তালিব। দাদা তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। কিন্তু দু’ বছর পর দাদাও মারা গেলেন। এবার মহানবীর লালন –পান ও দেখা শোনার ভার নিলেন চাচা আবু তালেব। চাচা তাঁকে খুবই স্নেহ করতেন। তিনিও বিভিন্ন কাজে চাচাকে সাহায্য করতেন। একবার ব্যবসা উপলক্ষে চাচা তাঁকে সিরিয়ায় নিয়ে গিয়েছিলেন।
নবী (স) কৈশোর থেকে যৌবনে পদার্পণ করলেন। তিনি কাউকে ঠকাতেন না। মিথ্যা কথা বলতেন া। সবাই মদ পান করতো কিন্তু তিন মদ স্পর্শও করতেন না। কারো সাথে ঝগড়া করতেন না। সাধ্যমত গরীব ও অসহায়দের সাহায্য করতেন। তাঁর চরিত্র ছিল অতি পবিত্র। তাই লোকে তাঁকে আল-আমীন বা বিশ্বাসী বলে ডাকতো। লোকেরা তাঁর কাছে মূল্যবান জিনিস-পত্র আমানত রাখতো।
এ সময় মক্কায় একজন ধনী মহিলা ছিলেন। তাঁর নাম ছিল খাদীজা। তিন সম্ভ্রান্ত কুরািইশ বংশের মেয়ে। থাঁর ছিল বিরাট ব্যবসা। অঢেল ছিল তাঁর ধন-সম্পদ। তিনি ছিলেন সৎ। তাঁর ব্যবহার ছিল কোমল। তাঁর সৎ চরিত্র ও কোমল ব্যবহারের কারণে সবাই তাঁকে ‘তাহেরা’ বা পবিত্র মহিলা বলে ডাকতো। তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্য দেখা শোনার জন্য এক সময় একজন সৎ ও বিশ্বাসী লোকের দরকার হয়ে পড়লো। তিনি নবীকে (স) তাঁর এ কাজের জন্য মনোনীত করলেন।
খাদীজার ব্যবসায়ের পণ্য সম্ভার নিয়ে নবী (স) সিরিয়ায় রওয়ানা হলেন। সাথে গেল খাদীজার ক্রীতদাস মায়সারা। এ দীর্ঘ সফরে সে নবী (স) সংগী হলো। নবীর (স) সাচর্যে থেকে সে তাঁর চরিত্র মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে গেল। সিরিয়া থেকে ফিরে েএসে নবী (স) খাদীজাকে অনেক মুনাফা বুঝিয়ে দিলেন। ইতিপূর্বে এতো মুনাফা আর কেউ তাঁকে দেয়নি। ক্রীতদাস মায়সারাও তাঁর চরিত্র, কোমল ব্যবহার, মধুর গুণাবলী ও বুদ্ধিমত্তার কথা- খাদীজাকে জানালো। খাদীজা তাঁর সততা ও পবিত্র চরিত্রে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। চাচা আবু তালিবের সাতে পরামর্শ করে নবী (স) খাদীজাকে বিয়ে করলেন।
নবী (স)-েএর সন্তানদের মধ্যে একমত্র ইবরাহীম ছাড়া আর সবাই খাদীজার (রা) গর্ভে জন্মলাভ করেন। খাদীজার গর্ভজাত পুত্র সন্তানদের নাম ছিল-কাসেম, তাইয়েব ও তাহের। পুত্র সন্তানদের সবাই তাঁর নবুওয়াত লাভের পূর্বেই ইনতিকাল করেন। মেয়ে সন্তানগন ছিলেন: যায়নাব, রুকাইয়া, উম্মে কুলুসুম ও ফাতেমা। এরা সবাই বেঁচে ছিলেন এবং ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। সবাই আবার তাঁর সাথে মক্কা থেকে হিজরতও করেছিলেন। সর্ব কনিষ্ঠা কন্যা ফাতেমা ছাড়া অন্য কোন কন্যার কোন সন্তান ছিল না।
হেরা গুহায় রাত্রি যাপন ও অহী প্রাপ্তি
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বয়স যতই বাড়তে থাকলো ততই তিন তাঁর কওমের লোকদের অজ্ঞতা ও মুর্খতা দেখে ব্যথিত হয়ে উঠলেন। তিনি দেখতেন সৃষ্টির সেরা মানুষগুলো অসহায় মাটির মূর্তির সামনে মাথা নত করে সিজদা করছে, কাকুতি মিনতি করছে। তিনি প্রায়ই চিন্তা করতেন তাঁর জাতিকে এসব থেকে কি করে উদ্ধার করবেন? এরপর তিনি হেরা পর্বতের গুহায় রাত কাটাতে শুরু করলে। দু’তিন দিনের খাবার এবং পানি নিয়ে যেতেন এবং তা শেষ হয়ে গেলে আবার এসে নিয়ে যেতেন। কোন কোন সময় স্ত্রী খাদীজাও তাঁর খাবার দিয়ে আসতেন। এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে গেল। একদিন প্রত্যুষে তিন হেরা গুহায় অবস্থান করছিলেন। িএ সময় আল্লাহর ফেরেশথা হযরত জিবরাঈল (আ) এসে তাঁকে একখন্ড রেশমী কাপড়ে লেখা আল্লাহর বাণী পড়তে বললেন। তিনি বললেন: আমি তো পড়তে জানি না। তখন ফেরেশতা তাঁকে বুকে চেপে ধরলেন। রেপর আবার আল্লাহর বাণী লিীখত কাপড় খন্ড সামনে ধরে পড়তে বললে নবী (সা) তা অনায়াসে পড়লেন। এটি ছিল মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নবীর (স) কাছে প্রথম অহী-সূরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত। আয়াহগুলোর অর্থ হলো:
পড় তোমার রবের নামে। যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি মানুষকে ‘আলাক’ হতে সৃষ্টি করেছেন। পড়, তোমার রব সর্বাপেক্ষা অনুগ্রহশীল ও দয়াবান। যিনি কলমৈর সাহায্যে মানুষকে জ্ঞঅন দান করেছেন। মানুষকে এমন জ্ঞান শিখিয়েছেন যা সে জানতো না।
ভয়ে ভয়ে বাড়ি ফিরলেন
হেরা গুহায় এ ঘটনা ছিল নবীর (স) কাছে অত্যন্ত বিস্ময়কর। ফেরেশতা চলে যাওয়ার পর তিন ভয় ও বিস্ময় নিয়ে দ্রুত বাড়ি ফিরলেন। খাদীজাকে ডেকে বললেন: আমার শরীর কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও। পরে খাদীজাকে সব কথা খুলে বললেন। িএতে তাঁর ভয় ও আশংকাও প্রকাশ করলেন। খাদীজা ছিলেন খুব বুদ্ধিমী মহিলা। তিন তাঁকে অভয় ও সান্তনা দিলেন। তিনি বললেন: আল্লাহ কখনো আপনাকে লাঞ্চিত করবেন না। আপনি তো সব সময় ভাল কাজ করেন। আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করেন। গরীব, দুঃখীদের কষ্ট দূর করেন, আমানদারী রক্ষা করেন, সত্য কথা বলেন, উপার্জন করে অসহায়দের দান করেন, মেহমানদের আপ্যায়ন করেন এবং ভাল কাজে সাহায্য করেন। অতএব আপনার ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই।
পরে তিনি নবীকে (স) সাথে করে ওয়ারাকা ইবন নওফেলের কাছে নিয়ে গেলেন এবং পুরো ঘটনা তাকে শুনালেন। নওফেল ছিলেন বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে একজন পারদর্শী ব্যক্তি। সব শুনে তিনি বললেন: হেরা গুহায় যিনি এসেছিলেন তিনি হলেন আল্লাহর অহী বহনকারী ফেরেশতা জিব্রাঈল (আ)। তিনিই আগের যুগে সব নবীর কাছে অহী আনতেন। ওয়ারাকা ইবনে নওফেল তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিযে বুঝাতে পারলেন যে, হযরত মুহাম্মদ (স)কে আল্লাহ তা’আলা তার রসূল হিসেবে মনোনীত করেছেন। তাই তিনি তাকে বললেন: আমি যদি সে সময় যুবক হতাম এবং বেঁচে থাকতাম যখন আপনার কওম আপনকে অস্বীকার করবে এবং দেশ থেকে বের করে দেবে তখন আপনাকে যথোপযুক্তভাবে সাহায্য করতে পারতাম। তার একথা শুনে রসূলুল্লাহ (স) জিজ্ঞেস করলেন: তারা কি আমাকে বহিস্কার করবে? তিনি বললেন: হ্যা, যিনিই এ দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন তার সাথেই তার কওম অনুরূপ আচরণ করেছে।
এরপর নবী (স) ও হযরত খাদীজা (রা) বাড়ি ফিরে আসলেন। তিনি বুছতে পারলেন যে, অচিরেই মহা আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর ওপর একটি গুরু দায়িত্ব অর্পিত হতে যাচ্ছে। অর্থাৎ আল্লাহর প্রভুত্ব মেনে নেয়ার জন্য গোটা দুনিয়াবাসীকে আহবান জানাতে হবে এবং তা কায়েম করতে হবে। এর অর্থ হলো মানুষকে আহবান জানাতে হবে যেন তারা তাকেই আল্লাহর নবী বলে স্বীকার করে নেয়।
এরপর অল্প কিছু দিন অহী বন্ধ থাকার পর ধারাবাহিকভাবে অহী নাযিল শুরু হয়। নবী (স)কে তাওহীদ ও ইসলামের মৌলিক বিষয়সমূহ অবহিত করা হয়। সাথে সাথে মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। সে অনুসারে তিনি গোপনে- চুপিসারে বিশ্বস্তজনদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন। তাঁর এ আহবানে দু’ একজন করে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকেন।
প্রথম দিকে বিবি খাদীজা, হযরত আবু বকর, হযর আলী, হযরত যয়েদ, হযরত উসমান (রা) প্রমূখ সাহাবাগণ ইসলাম গহ্রণ করলেন। কিন্তু মক্কার বড় বড় নেতারা নবীর (স) শত্রু হয়ে দাঁড়ালো। তারা দেখলো, মুহাম্মাদের (স) প্রচারিত ইসলাম মানলে তাদের স্বার্থ বিঘ্নিত হবে। তারা আর নেতা থাকতে পারবে না। কারণ, তখন ভাল লোকেরা হবে নেতা। তাই তারা বিরোধিতা শুরু করলো। এসব বেোধীদের মধ্যে আবু জেহেল, আবু লাহাব ও আবু সুফিয়ান ছিলো অন্যতম। তারা নবী (স) ও তাঁর সাহাবাদের হেয় করার জন্য শুরু করলো ঠাট্টা-বিদ্রুপ ও হাসি মশকরা। তারা মনে করতো, এভাবে তাদের সমাজের সামনে হয় ও লজ্জিত করলে তারা হতোদ্যম হয়ে যাবে এবং লোকজনও তাদের কথা শুনবে না। কিন্তু নবী (স) ও ঈমানদারগণ দমলেন না এবং এর পরও লোকজন দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকলো।
শুরু হলো জুলুম
মক্কার নেতারা এবার প্রমাদ গুনলো। তারা দেখলো যত সহজে তারা ইসলামের এ আন্দোলনকে ব্যর্থ করে দিতে চেয়েছিল। তা তত সহজে সম্ভব নয়। নতুন এ আদর্শ ইসলামের নেতা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স) তার এ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সংকল্পবদ্ধ। কোন ভাবেই তাকে এ পথ থেকে বিচ্যুত করা সম্ভব নয়। আবার যারা ইসলাম গহ্রণ করেছে তারাও এর মধ্যে কি যেন একটা মনের পরিতৃপ্তি লাভ করেছে, যা তারা কোনভঅবেই পরিত্যাগ করতে প্রস্তুত নয়। তাই তারা জুলুম-অত্যাচার চালানোর সিদ্ধান্ত নিলো। শুরু হলো অত্যাচার নির্যাতন।
নবী (স) ছিলেন মক্কার তথা আরবের শ্রেষ্ঠ শাখার শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাঁর চাচা আবু তালিব ছিলেন প্রভাবশালী ও সম্মানিত নেতা। তাকে লাঞ্চিত করা ছিল বেশ কঠিন কাজ। তাই কুরাইশরা সুযোগের অপেক্ষায় থাকলো। কিন্তু অন্যান্য মুসলমানদের ওপর তাৎক্ষনিকভাবেই অত্যাচার শুরু হয়ে গেল। কারণ, যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল তাদের বেশির ভাগই ছিল সমাজের দরিদ্র, প্রভাবহীন, ও ক্রীতদাস। ক্রীতদাসদের মালিকরা, তাদের ক্রীতদাসদের ওপর এবং আশেপাশের প্রভাবশালী ও প্রধানরা নিজ নিজ পরিমন্ডলে দরিদ্র ও অসহায়দের ওপর অত্যাচার চালাতে শুরু করলো। কিন্তু তারা বিস্মিত হয়ে দেখলো, অত্যাচার, লাঞ্চনা ও নানা রকম হয়রানি সত্বেও কেউ নতুন দনি ও আদর্শ ইসলাম পরিত্যাগ করতে প্রস্তুত নয়। বরং ইসলামকে আঁকড়ে থাকার ব্যাপারে তাদের সংকল্প যেন আরো কঠো থেকে কঠোরতর হচ্ছে। তাই এবার শুরু হলো নির্দয় ও নির্মম নির্যাতন।
হামশায় হিজরত
মুসলমানদরে ওপর অত্যাচার বেড়ে চললো এবং তা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকলো। যারা এসব িনর্যাতনের শিকার হলেন তাদের মধ্যে ছিলেন বেলাল, আম্মার, সুহায়েব, খুবায়েব, সুমােইয়অ, খাব্বা এবং আরো অনেকে। তখনো পর্যন্ত নবী (স) এর ওপর তেমন কোন আক্রমণ না হলেও তারা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। কারণ তখনো পর্যন্ত প্রকাশ্যে নবী (স) কে কিছু বলার মত পরিস্থিতি তারা তৈরী করতে পারেনি। সাধারণ মুসলমানদের ওপর অত্যাচার প্রচন্ড আকার ধারণ করলে নবী (স) সবাইকে বললেন: তোমরা যদি এ সময় হাবশায় হিজরত করতে তাহলে সেটিই ভাল হতো। সে দেশ এমন কজেন বাদশা শাসন করেন যার শাসনাধীনে কেউ কাউকে জুলূম করতে পারে না। ভাল কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত তোমরা সেখানে গিয়েই অবস্থান করো।
রাসূলুল্লাহ (স) এর এ ঘোষণার পর কিছু কিছু মুসলমান হাবশায় হিজরত করার সিদ্ধান্ত নিল। প্রথম পর্যায়ে এগারজন পুরুষ এবং চারজন মহিলা হিজরত করলেন। তারা একটি জাহাজ ভাড়া করে হাবশার উপকূলে অবতরণ করে পরে দেশটির রাজধানীতে গিয়ে পৌঁছলেন। এরপর একের পর এক দলে দলে মুসলমানরা হাবশায় পৌঁছতে থাকলেন। সর্বসাকুল্যে তাদের সংখ্যঅ দাঁড়ালো একশত একজনে। এর মধ্যে তিরাশি জন ছিলেণ পুরুষ ও আঠারজন মহিলা। ঈমান-আকীদা তথা আদর্শের জন্য এ ছিল এক চরম ত্যাগ ও অনুপম দৃষ্টান্ত।
হাবেশা থেকে মুসলমান প্রত্যাবর্তন
হাবশা পৌঁছে মুসলমানগণ স্বস্তির নিশ্বাস ফেললৈন। বাদশাহ নাজ্জাশির সুশাসনের অধীনে মুসলমানগণও বেশ শান্তিতে বসবাস করতে থাকলেন। কিন্তু কিছদিন পর মুসলমানদরে কাছে এ মর্মে একটা খবর পৌঁছলো যে, মক্কার মুশরিকরা সবাই ইসলাম গ্রহণ করেছে। এখন আর কোন প্রকার জুলূম-নির্যাতন সেখানে নেই। তাই তারা কাল বিলম্ব না করে মক্কায় ফিরে আসার জন্য রওয়ানা হলেন। কিন্তু মক্কা থেকে এক দিনের পথ দূরে থাকতে তারা জানতে পারলেন যে, খবরটি সত্য নয়। মুশরিকদের মুসলমানদের সাথে কোন প্রকার সমঝোতা হয়নি। অনেকেই তাই পথিমধ্যে থেকে পুনরায় ফিরে গেলেন। আর কিছু সংখ্যক মুসলমান চুপিসারে মক্কায় ফিরে আসলেন। তাছাড়া কেউ কেউ কোন মুশরিকের নিরাপত্তাধীনে মক্কায় পৌঁছলেন।
হাবশায় দ্বিতীয় হিজরত
যারা হিজরত করেছিলেন এবার তাদের ওপর পুরোদমে নির্যাতনে শুরু হলো। প্রত্যেক পরিবারের লোক তদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালাতে থাকলো। কারণ, তারা অবগত হয়েছিলো যে, হাবশার বাদশাহ নাজ্জাশি তাদের সাথে খুব ভাল আচরণ করেছেন এবং তারা সেখানে বেশ নিরাপদেই ছিলো। এ অত্যাচার দেখে রাসূলুল্লাহ (স) তাদেরকে আবার হাবশায় হিজরত করার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু কুরাইশরা সতর্ক হয়ে াওয়ায় এবার হিজরত করা ছিলো অত্যন্ত কঠিন। তা সত্ত্বেও আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের সাহায্য করলেন। এবারও তারা কুরাইশদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করে পুনরায় হাবশায় গিয়ে পৌঁছলেন।
মুহাজিরদের বিরুদ্ধে মক্কার কাফেরদের ষড়যন্ত্র
মক্কার মুশরিক নেতারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে আক্রোশে ফেটে পড়লো। কারণ মুসলমানরা নিজেদের দীন ও ঈমান রক্খা করে তাদের নির্যাতনের হাত থেকে বেঁচে একটি নিরাপদ জায়গায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। তারা পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলো, মুসলমানদের দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে এবং নির্যাতনের মাধ্যমে নতুন ধর্ম ত্যাগ করতে বাধ্য করতে হবে। তাই তারা বাদশাহ নাজ্জাশির দরবারে একটা কূটনৈতিক প্রতিনিধি দল প্রেরণ করবে। অতএব তারা অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও ধূরন্ধর দুইজন লোক বাছা করলো। তারা হলো আমর ইবনুল ‘আস ও আবদুল্লাহ ইবনে আবু রাবি‘আ। তারা বাদশা নাজ্জাশি ও তার দরবারের পাদ্রি-পুরোহিতদের জন্র মুল্যবান উপহার সামগ্রী নিয়ে হাবশায় গিয়ে হাজির হলো। পাদ্রি-পুরোহিতগণ বহুমূল্য উপহার সামগ্রী পেয়ে খুশি হয়ে তাদেরকে সহযোগিতা দানের আশ্বাস দিল।
পাদ্রিদের সহযোিগিতার আশ্বাস পেয়ে প্রতিনিধি দল বাদশাহর দরবারে হাজির হলো তারা বললো: হে বাদশাহ, আমাদের কতিপয় অবুঝ যুবক আপনার দেশে পালিয়ৈ এসেছে। তারা বাপদাদার ধর্ম পরিত্যাগ করেছে। আপনারও ধর্মও গ্রহণ করেনি। তারা একটি নতুন ধর্ম গ্রহণ করেছে যা আপনার ও আমার সবার অজানা।তাদের বাপ-চাচা ও গোত্রপতিরা আমাদেরকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন। কড়া নজরদারির মাধ্যমেতারা এদের সব রকমের কল্যাণ নিশ্চিত করতে চায়,প্রতিনিধি দল এভাবে চটকদার ভাষায় তাদের আবেদন পেশ করলে পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে দরবারর পাদ্রিরা বলে উঠলো: বাদশাহ নামদার, তারা ঠিকই বলছৈন। আপনি ঐ সব যুবককে তারে হাতে তুলে দিন। তারা ওদের নিয়ে তাদের দেশে আত্মীয়-স্বজনের কাছে পৌঁছিয়ে দেবেন।
বাদশাহ তাদের কথা শুনলেন না কোন দেশে না গিয়ে আমার দেশে আশয় নিয়েছে। সবদিক বিবেচনা না করে তাদেরকে ফেরত পাঠানো ঠিক হবে না। তাই তিনি আশ্রয়প্রার্থী মুসলমানদের পরের দিন দরবারে ডেকে পাঠালেন। খবর পেয়ে মুসলমানগণ নাজ্জাশির রাজ দরবারে হাজির হলেন। তাদের সিদ্ধান্ত হলো, পরিণতি যাই হোক না কেন তারা প্রকৃত ঘটনা বাদশাহর সামনে তুলে ধরবেন। মুসলমানদের পক্ষ থেকে নবী (স) এর চাচাতো ভাই জা’ফর ইবনে আবু তালেব বক্তব্য পেশ করার দায়িত্ব পেলেন। মুসলমাগণ হাজির হলে বাদশাহ তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন: যে দীনের কারণে তোমরা বাপদাদার ধর্ম পরিত্যাগ করেছো আবার আমার ধর্মও গ্রহণ করোনি, সেটা কেমন ধর্ম? মুসলমানদের পক্ষে হযরত জা’ফর ইবনে আবু তালেব (রা) জবাব দিতে গিয়ে বললেন:
হে বাদশাহ, আমরা ছিলাম এমন এক জাতি যারা জাহেলিয়াত তথা অজ্ঞতার গভীর পঙ্কে নিমজ্জিত ছিলাম। আমরা মূর্তিপ পূজা করতাম। মৃত জন্তু খেতাম। ব্যাভিচার করতাম, প্রতিবেশীদের সাথে খারাপ আচরণ করতাম। আমাদের শক্তিশালীরা দুর্বলতের অধিকার নস্যাত করতো। আমরা যখন এ অবস্থার মধ্যে ডুবে ছিলাম। তখন আল্লাহ তা’আলা আমাদের মধ্যে থেকে আমাদের কাছে একজন রাসূল পাঠালেন। তার বংশমর্যাদা ও সততা সম্পর্কে আমরা অবহিত ছিলাম। তিনি আমানতদার ও সম্ব্রমশালী। তিনি আমাদেরকেএক আল্লাহর উপাসনা করতে এবং যেসব দেবদেবীর পূজা আমরা করতাম তা পরিত্যাগ করতে আহবান জানালেন। তিনি আমাদেরকে আহবান জানালেন আমানত আদায় করতে, আত্মীয়তার ন্ধন রক্ষা করতে, প্রতিবেশীল সঙ্গে ভাল আচরণ কর, েহাাম কাজ করা ও রক্তপাত থেকে বিরত থাকতে। তিনি আমাদের নিষেধ করলেন ব্যাভিচার করতে, মিথ্যা বলতে, ইয়াতীমের মাল খেতে, পবিত্র নারীদের অপবাদ দিতে। তিনি আমাদেরকে আদেশ দিলেন একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে এবং তার সাথে কাউকে শরীক না করতে। আদেশ দিলেন নামায পড়তে, যাকাত দিতে, রোযা রাখতে এবং আরো অনেক সুকৃতি করতে ও দুষ্কৃতি বর্জন করতে। আমরা তাকে সত্য বলে মেনে নিলাম এবং তিনি আল্লাহর যে সব নির্দেশ জানালেন তা অনুসরণ করতে থাকলাম এতে আমাদের কওমের লোজন আমাদের প্রতি চরম বৈরী আচরণ শুরু করলো এবং এ বিশ্বাস ত্যাগ করানোর জন্য আমাদের প্রতি নিষ্ঠুর হয়ে উঠলো। অবস্থা যখন আমাদের বরদাশতের বাইরে চলে গেল তখন আমরা অন্য কোথাও না গিয়ে আপনাকে এবং আপনার দেশকে আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিলাম। হে বাদশাহ, আমাদের বিশ্বাস যে, এখানে আমাদের ওপর কোন নির্যাতান করা হবে না।
সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে নাজ্জাশি জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের নবীর কাছে যেসব বাণী এসেছে তার কোন অংশ কি তোমাদের কাছে আছে? হযরত জা’ফর (রা) বললেন, হ্যাঁ। নাজ্জাশী বললেন: আমাকে পড়ে শুনাও। হযরত জা’ফর (রা) সুলা মারিয়াম এর প্রথম দিকের কিছু অংশ তেলাওয়াত করলেন। তা শুনে নাজ্জাশীর চোখ থেকে অম্রু গড়িয়ে পড়তে থাকলো। এমনকি তার দাড়ি ভিজে গেল। দরবারের পাদ্রি-পুরোহিতগণও কাঁদলেন। অশ্রুতে তাদের বই পুস্তকও ভিজে গেল। নাজ্জাশী বললেন, এ বাণী এবং ঈসা (আ) এর ওপর নাযিল হওয়া বাণী একই উৎস থেকে নির্গত। তারপর তিনি কুরাইশ প্রতিনিধি দু’জনকে উদ্দেশ্য করে বললেন: তোমরা চলে যাও। আল্লাহর শপথ! আমি তাদেরকে কখনো তোমাদের হাতে তুলে দেবো না। তারা এবার ব্যর্থতা নিয়ে মক্কায় ফিরে এলো।
হযরত উমর (রা) এর ইসলাম গ্রহণ
আমর ইবরুল ‘আস ও আবদুল্লাহ ইবনে আবু রাবি’আ চরম বল্থতা নিয়ে হাবশা থেকে ফিরে এলে কুরাইশদের ক্রোধের আগুন আরো জ্বলে উঠলো। ঠিক এই সময়েই হযরত উমর (রা) ইসলাম গ্রহণ করেন। তার ইসলাম গহ্রণের ঘটনাটা ঘটে আকস্মিকভাবে। তার বোন ফাতেমা ও ভগ্নিপতি সাঈদ ইবনে যায়েদ গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত খাব্বাব ইবনুল আরাত ফাতেমাকে কুরআন শিক্ষা দিতেন।
আমর ইবনুল ‘আস ও আবদুল্লাহ ইবনে আবু রাবি’আ হাবশা থেকে ব্যল্থ হয়ে ফিরে আসার পর একদিন নবী (স) সাফা পর্বতের পাদদেশে একটি বাড়িতে কিছু সংখ্যক সাহাবার সাথে সমবেত হন। এ খবর পেয়ে উমর ইবনুল খাত্তাব খোলা তরবারি নিয়ে সেদিকে রওয়ানা হন। পথে নাঈম ইবনে আবদুল্লাহর সাথে তার সাক্ষাত হয়। নাঈমও গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। কেউ তা জানতো না। উপরের গতিবিধি তার কাছে ভালমনে না হওয়ায় তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন: উমর কোথায় যাচ্ছ? উমর জবাব দিলেন: ধর্মত্যাগী মুহাম্মদ (স) এর সাথে বুঝাপড়া করতে যাচ্ছি। নাঈম ইবনে আবদুল্লাহ তাকে বললেন: উমর, তুমি কি মনে করো মুহাম্মদকে হত্যা করার পর বনী আবদে ও মানাফ তোমাকে জীবিত ছেড়ে দেবে? এর চেয়ে বরং নিজের পরিবার ও আপনজরদের খবর নাও এবং তাদেরকে সংশোধন করো। উমর জিজ্ঞেস করলেন, আমার পরিবারের কে? নাঈম বললেন: তোমার ভগ্নিপতি সাঈদ ইবনে যায়েত ও বোন ফাতেমা বিনতে খাত্তাব ইসলাম গ্রহণ করেছে।
উমর বোনের বাড়িতে উপস্থিত হলেন
একথা শোনার পর কালবিলম্ব না করে উমর বোনের বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হলেন। সে সময় খাব্বাব ইবনুল আরাতও তাদের বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন। তাদের কাছে একটি সহীফায় সূরা ত্ব-হা লেখা ছিল। তিনি তাদেরকে তা শিক্ষা দিচ্ছিলেন। উপরের উপস্থিতি বুঝতে পেরে তারা খাব্বাকে ঘরের মধ্যেই এক জায়গায় লুকিয়ে রাখলেন। আর ফাতেমা সহীফাখানা নিজের উরুর নীচে লুকিয়ে ফেললেন। বাড়িতে প্রবেশের মুহূর্তেই উমর শুনতে পেলেন খাব্বা কি যেন পড়ে শুনাচ্ছেন। ভিতরে প্রবেশ করে উমর জিজ্ঞেস করলেন: আমি কিসের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম? তারা বললেন: কিছু না।
উমর বললেন: আমি জানতে পেরেছি, তোমরা মুহাম্মদ (স) এর দ্বীন গ্রহণ করেছো। এ কথা বলেই তিনি ভগ্নিপতি সাঈদ ইবনে যায়েদকে ধরলেন। ফাতেমা স্বামীকে রক্ষা করতে অগ্রসর হলে উমর তাকে আঘাত করে আহত কররেন। এতে ফাতেমা ও তার স্বামী দৃঢ় কণ্ঠে বললেন: হ্যাঁ, আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি। েএখন তোমার যা ইচ্ছা করতে পার। এতে উমর লজ্জিত হলেন। তিনি বোনকে বললেন: তোমরা এই মাত্র যা পড়ছিলে তা আমাকে দাও। আমি দেখতে চাই মুহাম্মদ (স) কি নিয়ে েএসেছেন? এতে ফাতেমা তার ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে কিঞ্চিত আশাবাদী হয়ে বললেন: ভািইজান, আপনি মুশরিক, আপনি অপবিত্র। ঐ জিনিস পবিত্রতা ছাড়া কেউ স্পর্শও করতে পারে না। এ কথা শুনে উমর গোসল করে পবিত্র হলেন। অতঃপর সহীফাখানা নিয়ে পড়লেন। কিছুটা পাঠ করার পরই বলে উঠলেণ: কি সুন্দর ও কত উন্নত এই কথাগুলো! উমরের মুখ থেকে একথা উচ্চারিত হতে দেখে খাব্বা (রা) গোপন স্থান থেকে বেরিয়ে উমরের সামনে এসে বললেন: হে উমর, আল্লাহর শপথ! আমার মনে হয় আল্লাহর নবী (স) এর দোয়অ তোমার জন্যই নির্দিষ্ট হয়েছে। গতকালও আমি নবী (স) কে এ বলে দোয়া করতে শুনেছিঃ হে আল্লাহ, আবুল হাকাম ইবনে হিশাম (আবু জেহেল) অথবা উমর ইবনুল খাত্বাবের দ্বারা ইসলামের শক্তি বৃদ্ধি করো। হে উমর আল্লাহকে ভয় করো।’
উমর বললেন: হে খাব্বা, মুহাম্মদ (স) কোথায় আছেন আমাকে সেখানে নিয়ে চলো। আমি ইসলাম গ্রহণ করবো। খাব্বাব তাকে বললেন যে, তিনি এখন সাফা পর্বতের পাদদেশে একটি বাড়িতে আছেন। ‘উমর উন্মুক্ত তরবারি হাতে রাসূলুল্লাহ (স) ও তাঁর সাহাবাগণ যেখানে আছেন সেদিকে রওয়ানা হলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে গিয়ে পৌঁছলেন। তিনি বাড়ির দরজায় করাঘাত করলেন। রাসূলুল্লাহ (স) এর সাহাবাদের একজন উঠে গিয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলেন উমর দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। তার হাতে খোলা তরবারি। তিনি ভীত হয়ে ফিরে এসে আল্লাহর রাসূল (স) কে তা বলবেন। হযরত হামযা বললেন: সে যদি ভাল উদ্দেশ্যে এসে থাকে তা হলে আমরাও ভাল আচরণ করবো। আর যদি কোন খারাপ মতলবে এসে থাকে তাহলে তার তরবারি দিয়েই তাকে হত্যা করবো। রাসূলুল্লাহ (স) বললেণ, তাকে আসতে দাও। এরপর উমর রাসূলুল্লাহ (স) এর সামনে উপস্থিত হলে তিনি তার কোমরের পার্শ্বদেশ ধরে সজোরে আকর্ষণ করে বললেন: হে খাত্বাবের পুত্র, কি উদ্দেশ্যে তোমার আগমন বলতো।’ উমর বললেন: হে আল্লাহর রাসূল, আমি আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল (স) এবং তিনি যা এনেছেন তার প্রতি ঈমান ঘোষণার জন্য এসেছি।’
মুসলমানগণ উৎসাহিত হয়ে উঠলেন
হযরত উমর (রা)-এর ইসলাম গ্রহণে মুসলমানগণ আরো উৎসাহিত হলেন। হযরত উমর বায়তুল্লায় গিয়ে প্রকাশ্যে নামায আদায় করলেন এবং পরদিনই অতি প্রত্যুষে রাসূলুল্লাহ (স)এর প্রধান শত্রু আবু জেহেলের বাড়ি গিয়ে তাকে জানিয়ে আসলেন যে, তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন।
এভাবে ইসলামের শক্তি ও প্রভাব ক্রমেই বেড়ে চললো। কাফেররাও সাধারণ মুসলমানদের ওপর তাদের আক্রমন ও নির্যাতন ক্রমশঃ তীব্র থেকে তীব্রতর করে তুললো। নবী (স) এর আপন চাচা আবু লাহাবও কাফেরদের দলে ভিরে তাঁকে অনেক কষ্ট দিলো। আবু লাহাব ও রাসূলুল্লাহ (স) বাড়ি ছিল একই সাথে লাগোয়া। মাঝে ছিল শুধু একটি প্রাচীর। উম্মুল মু’মিনীন হযরত খাদীজাতুল কুবরা (রা) যখন বাড়ির আঙ্গিনায় প্রাচীরের পাশে খাবার পাকাতেন তখন প্রাচীরের ওপাশ থেকে খাবারের ওপর ময়লা-আবর্জনা নিক্ষেপ করে তা নষ্ট করে দেয়া হতো। এ ছাড়া মারওয়ানের পিতা হাকাম ইবনুল আ, উকবা ইবনে আবু মু’আই, আদি ইবনে হামরা বেং উবনুল আসদা আল হুযুলীও আবু লাহাবের মত রাসূলুল্লাহ (স) এর নিকটতম প্রতিবেশী ছিল। তারাও নবী (স) এর সাথে একই আচরণ করতো। আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামীল (আবু সুফিয়ানের বোন) রাতের অন্ধকারে কাঁটাযুক্ত ডালপালা ও আবর্জনা এনে নবী (স) এর ঘরের দরজায় ও বের হওয়ার পথে ফেলে রাখতো যাতে সকালে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গিয়ে তিনি ও তার ছোট ছোট সন্তানেরা কষ্ট পান। এ ছাড়া আরো অনেকভাবে তারা নবী (স) কে কষ্ট দিতো।
হযরত খাদীজা (রা) ও আবু তালেবের ইনতিকালা
কুরাইশদের নানাবিধ বিরোধিতা, শত্রুতা ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির পাশাপাশি নবী (স) ও মুসলমানদের চরম ধৈর্য, সাহস ও আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে ইসলামের প্রচার ও প্রসার চলতে থাকে। এভাবে নবুওয়াতের ১০ম বছর এসে যায়। এটি ছিল নবী (স) এর জন্য সবচেয়ে দুঃখবহ বছর। এ বছরই নবী (স) এর প্রিয়তমা স্ত্রী ও পরামর্শদাতা হযরত খাদীজা (রা) এবং পৃষ্ঠপোষক ও পরম হিতৈষী চাচা আবু তালিব ইনতিকাল করেন। আবু তালিবের ইনতিকালে কুরাইশরা নবী (স) এর ওপর জুলুম নির্যাতনের এক মহাসুযোগ লাভ করে। এর সাথে চলতে থাকতো চরম বিরোধিতা। কুরাইশরা ইসলামী দাওয়াতকে ধ্বংস করতে এ সময় থেকে মারমুখী হয়ে ওঠে।
তায়েফ গমন
নবী (স) বুঝতে পারলেন যে, মক্কার লোকেরা তার আহবানে সাড়া দিতে প্রস্তুত নয়। তাই তিনি এবার তায়েফে গিয়ে সেখানকার লোকদের সামনে ইসলা পেশ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। হযরত যায়েদ ইবনে হারেসাকে (রা) সাথে নিয়ে তিন তায়েফে গিয়ে উপস্থিত হলেন। বনী সাকীফ গোত্রের নেতাদের সামনে ইসলামের দাওয়াত পেশ করলেন। কিন্তু তারা নবী (স) এর সাথে অত্যন্ত নিষ্ঠুর আচরণ করলো। তিনি সেখান থেকে ফিরে মুত’য়েম ইবনে আদীর নিরাপত্তায় মক্কায় প্রবেশ করলেন। এবং পুনরায় ঘরে ঘরে প্রত্যেক মানুষেরকাছে গিয়ে ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকলেন।
হজ্জের মওসূমে প্রত্যেক গোত্রের লোকদের কাছে দাওয়াত
হজ্জের মওসুমে সমগ্র আরব উপদ্বীপের আনাচে কানাচে থেকে বিভিন্ন গোত্রের লোকজন হজ্জের জন্য মক্কায় আগমন করলে তিন প্রত্যেক গোত্রের তাঁবুতে গিয়ে ইসলামের দাওয়াত পেশ করতে থাকলেন। একদিন তি িইয়াসরিব (মদীনা পূর্ব নাম) থেকে আগত কিছু লোকের তাঁবুতে গেলেন এবং তাদের নিকট থেকে অনুকূল সাড়া পেলেন। তারা হজ্জ শেষে ইয়অসরিবে ফিরে গেলেন এবং রাসূলুল্লাহ (স) এর নির্দেশ মোতাবেক ইসলাম প্রচার করতে থাকলেন। পরের বছর হজ্জের মওসূমে তারা আরো কিছু লোককে সাথে করে আনলেন। আকাবা নামক স্থানে রাতের বেলা নবী (স) এর সাথে তারা একত্রিত হলেন এবং ইসলাম গ্রহণ করে নবী (স) এর হাতে বাইয়াত হলেন। তাদের সংখ্যা ছিল মোট বারজন। একেই আকাবার প্রথম বাইয়াত বলা হয়। নবী (স) মদীনায় তাদের গোত্রের মধ্যে কুরআন মজীদ ও ইসলাম শিক্ষা দেয়ার জন্য হযরত মুস’আব ইবনে উমায়ের (রা) কে পাঠালেন। তিনি মদীনায় আস’য়াদ ইবনে যুরারা’র বাড়িতে থেকে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে কাজ করে চললেন। পরের বছর হজ্জের মওসূমে আকাবায় মদীনার তিয়াত্তর জন লোকের সাথে নবী (স) এর কথা হলো। তারা সবাই ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং তাকে মদীনায় যাওয়ার আহবান জানালেন। সিদ্ধঅন্ত হলো, সুবিধাজন সময়ে অদূর ভবিষ্যতে নবী (স) মদীনায় চলে যাবেন।
মদীনার লোকেরা ছিল সৎ। তারা প্রায় সকলেই ইসলাম গ্রহণ করলে নবী (স) সেখানে একটি ছোট ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করলেন। এ রাষ্ট্রের প্রধান হলেন নবী (স) নিজে। এসব দেখে মক্কার কাফেরা সহ্য করতে পারলো না। তারা মদীনা আক্রমণ করলো। বদর, ওহুদ, খন্দক ও হুনায়েনে এরূপ অনেকগুলো যুদ্ধ হলো। একমাত্র ওহুদের যুদ্ধ ছাড়া সব যুদ্ধে মুসলমানরা জয় লাভ করলো। কাফেররা ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়লো। বিভিন্ন যুদ্ধে তাদের অনেক বড় বড় নেতা মারা গেল।
হিজরী আট সনে নবী (স) দশ হাজার সৈন্যের এক বিরাট বাহিনী নিয়ে মক্কা জয় করলেন। কাবা ঘরের মধ্যে যে তিন শথ ষাটটি মূর্তি রাখা ছিল তা বের করে ফেললৈন। িএ সময় মক্কার সব লোক ইসলাম গ্রহণ করলো। তিনি তাদের সবেইক েমাফ করে দিলেন। এরপর সারা আরবের লোক দ্রুত ইসলাম গ্রহণ করলো এবং সমগ্র আরবে একটা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো।
হিজরী দশ সনে নবী (স) সারা আরবের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় সোয়া লক্ষ সাহাবা সাথে করে হজ্জ করলেন। আরফাতের মাঠে দাঁড়িয়ে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ। নবীর (স) এ হজ্জকে বলা হয় বিদায় হজ্জ। এ হজ্জের পর তিনি আর হজ্জ করার সুযোগ পাননি।
হজ্জ শেসে মদীনায় ফিরে যাওয়ার পর নবী (স) অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং হিজরী ১১ সনের রবিউল আউয়ংাল মাসের বার তারিখে এ দুনিয়া ছেড়ে মহান আল্লাহর কাছে ফিরে গেলেন। ইনতিকালের সময় তাঁর বয়স ছিল ৬৩ বছর। পবিত্র মদীনা শরীফে মসজিদে ননবীর মধ্যে তাঁর রওযা মোবারক অবস্থিত।
অনুশীলনী
১। সর্বশেষ রসূল কে? তিনি কত সনে কোথায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন? তাঁর বংশ কেমন ছিল?
২। হযরত মুহাম্মদের (স) জন্মের সময় আরবের লোকেরা কেমন ছিল?
৩। তাঁকে লালন-পালনের জন্য মক্কার বাইরে কোথায় পাঠানো হয়েছিল?
৪। রসূলুল্লাহ (স) এর মা আমিনা মদীনায় গিয়েছিলেন কেন? মদীনা থেকে ফিরে আসার সময় কি ঘটেছিল?
৫। যৌবন লাভ করার পর নবী (স)-এর চরিত্র কেমন ছিল?
৬। মক্কার ধনী মহিলাটির নাম কি ছিল?তাঁকে সবাই ‘তাহেরা’ বলে ডাকতো কেন?
৭। নবী (স) কি দেখে বিচলিত হয়ে উঠতেন?তিনি হেরা পর্বতের গুহায় কিভাবে রাত কাটাতেন?
৮। তিনি কবে এবং কিভাবে আল্লাহর অহী পেলেন? অহী পাওয়ার পর তিনি কি করতেন?
৯। প্রথমে কে কে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন? ইসলঅমের মূল কথা কি?
১০। মক্কার বড় বড় নেতারা বিরোধিতা করলো কেন? তারা কিভাবে বিরোধিতা করলো?
১১। মদীনায় হিজরতের পর মক্কার কাফেররা কি করলো?
১২। নবী (স) কবে মক্কা জয় করলেন? তাঁর সাতে কত সৈন্য ছিল?