দ্বিতীয় অধ্যায়
ঈমান
ঈমান ও জ্ঞান
কি কি বিষয়ের উপর ঈমান আনতে হবে
তাওহীদ
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহঃ তাওহীদের মূলযন্ত্র
শিরকের তাৎপর্য
তাওহীদের তাৎপর্য
তাওহীদের বিশ্বাসের সুফল
রেসালাত
নবীর উপর ঈমানঃ দাবী ও তাৎপর্য
অন্যান্য নবী ও মুহাম্মদ (স) এর মর্যাদার মধ্যে পার্থক্য
ফেরেশতাদের উপর ঈমান
কিতাবের উপর ঈমান
আখেরাত
মৃত্যু এক চরম সত্য
মৃত্যুর পর জীবন
পরকাল সম্পর্কে ইসলাম
পরকাল অস্বীকারের পরিণাম
পরকাল বিশ্বাসের গুরুত্ব
পরকাল বিশ্বাসে উপকার
ঈমান
ঈমান ও জ্ঞান
দুনিয়ায়চলতে হলে জানতে হয় অনেক কিছু। জানতে হবে আমরা কারা? আমরা মানুষ, আমাদের জীবনের কি কোন উদ্দেশ্য আছে? না কি, অন্যান্য জীব-জন্তুর মত আমাদের জীবন? কে আমাদের সৃষ্টি করলো? কে সৃষ্টি করলো এত বড় বিশ্বটাকে? কে পাঠালো আমাদের এই পৃথিবীতে? কেন পাঠালো? পাঠালোইযখন তখন আমরা কিভাবে চলবো? কোন পথে চললে পাবো শান্তি এবং মুক্তি? সে পথ কি আমরা নিজেরা আবিস্কার করে নেব? নাকি কেউ আমাদের বাতলিয়ে দেবে? সব মানুষই মরে যায়, কিন্তু মরণের পরে কি সব শেষ হয়ে যায়? এমন হাজারও প্রশ্নের সঠিক উত্তর পেতে হবে আমাদেরকে।
‘সঠিক’ উত্তর কেন? কেননা এসব কিছুর সঠিক উত্তরের উপরই নির্ভর করে মানুষ কিভাবে চলবে এই দুনিয়ায়। মনে করো একজন বিশ্বাস করে মানুষ অন্যান্য জন্তু-জানোয়ারের মত নয়, বরং সে সব সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠ। আর অন্য একজন বিশ্বাস করে মানুষ আদতে অন্যান্য জীব-জানোয়ারের মতই। খাও, দাও –এই তার কাজ। এখন স্বাভাবিকভাবেই এই দু’জনের চাল-চলন, আচার-ব্যবহার, স্বভাব-চরিত্র আলাদা হবে, তাইনা?
এই দু’জনের চলার পথ এক হতে পারেনা। তাই আমরা বলতে পারি জীবন সম্পর্কে আমাদের ধারণা ও বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে মানুষের চলার পথ এবং পন্থা। জীবন সম্পর্কে ধারণা ও বিশ্বাস যার সঠিক হবে সেই পাবে সঠিক পথ। আর যার বিশ্বাস হবে ভুল, তার জীবনের পথও হবে ভুল।
ইসলাম হলো আল্লাহর শেখানো পথ। ইসলাম জীবন সম্পর্কে আমাদের সঠিক জ্ঞান দেয়। আমাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ, আল্লাহর গুণরাজি, আল্লাহর ক্ষমতা সম্পর্কে আমাদের দেয় সঠিক সম্পর্ক। কিভাবে মানুষ পাবে আল্লাহর হুকুম-আহকাম, কিভাবে জানতে হবে সেসব আইন-কানুন। আল্লাহর আইন-কানুন মানলে আমাদের কি কি উপকার হবে, আর না মানলে আমাদের কি অপকার হবে।
আরও একটা জিনিস আমাদের ভাল করে বুঝে নিতে হবে যে, ইসলামের দেওয়া এসজ জ্ঞান শুধু জানলেই হবে না; এর উপর থাকতে হবে পুরোপুরি বিশ্বাস। জেনে বুঝে সেই মতো আমল করতে হবে। জীবন সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি জানা এবং তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করাকে ইসলামের পরিভাষায় বলে ‘ঈমান’। সহজ ভাষায় ঈমানের অর্থ হলো, ‘জানা এবং মেনে নেয়া’। মানুষ, মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য কি, জীবনের সফলতা কিসে, মানুষের করণীয় কাজ কি কি –এসব সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণার জন্য মুসলমানদেরকে দেয় জীবন সম্পর্কে সঠিক, স্বচ্ছ ও সুন্দর ধারণা। তাই ঈমানকে বলতে পারি জীবন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান।
কি কি বিষয়ের উপর ঈমান থাকতে হবে
যে যে বিষয়ের উপর মুসলমানগণ দৃঢ় বিশ্বাস এবং প্রত্যয় ঘোষণা করে তা সুন্দরভাবে নীচে বলা হয়েছে যাকে আমরা বলি “আল-ঈমানুল সুফাসসাল”। যার অর্থ হলোঃ
আমি বিশ্বাস করলাম আল্লাহকে, তাঁর ফেরেশতাদেরকে, তাঁর কিতাবসমূহকে, তাঁর রাসূলকগণকে, কিয়ামতের দিনকে, অদৃষ্টের ভালমন্দের উপর এবং মৃত্যুর পর আবার জীবিত করা হবে সেই পুনরুত্থানের উপর এবং মৃত্যুর পর আবার জীবিত করা হবে সেই পুনরুত্থানের উপর।
এখানে সাতটি জিনিসের উপর বিশ্বাস আনার কথা বলা হয়েছেঃ
১। আল্লাহ
২। ফেরেশতাসমূহ (মালাকাহ)
৩। কিতাবসমূহ (কুতুবুল্লাহ)
৪। রাসূলগণ (রাসূলুল্লাহ)
৫। বিচার দিবস (ইয়াওমুদ্দিন)
৬। অদৃষ্ট (আল কদর)
৭। মৃত্যুর পর জীবন (আখেরাত)
তাওহীদ
তাওহীদ অর্থ আল্লাহর একত্ব। তাওহীদ ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিশ্বাস। এর তাৎপর্য হলো এ বিশ্বের প্রতিটি জিনিস এক এবং একমাত্র সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি। তিনি আল্লাহ। এই বিশ্বের তিনিই রক্ষণাবেক্ষণকারী –প্রতিপালক। তিনিই একমাত্র এই বিশ্বের পরিচালক।
তাওহীদ হলো আল্লাহকে তাঁর ক্ষমতা ও সকল গুণসহ বিশ্বাস করা। তিনি মেহেরবান। তিনি সকল অবস্থায় আমাদের সঙ্গে আছেন। তিনি সর্বাবস্থায় আমাদেরকে দেখেন কিন্তু আমরা তাঁকে দেখতে পাইনা। তিনি অতীতে ছিলেন, এখনও আছেন এবং অনন্তকাল ধরে থাকবেন –তিনি শাশ্বত। তিনি আদি, তিনি অন্ত। তাঁর কোন অংশীদার নেই, কোন শরীক নেই, কোন সন্তান-সন্ততি নেই। তিনিই আমাদেরকে জীবন দিয়েছেন এবং মৃত্যুর পর আমাদেরকে তাঁরই কাছে ফিরে যেতে হবে।
আল্লাহর প্রকৃত পরিবয় বা সত্তা (যাত), তাঁর গুণাবলী (সিফাত), তাঁর অধিকার (হুকুম) এবং তাঁর ক্ষমতা (ইখতিয়ার) সহ তাঁকে বিশ্বাস করা এবং এ ব্যাপারে কাউকে অংশীদার না বানানোই হচ্ছে তাওহীদ।
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহঃ তাওহীদের মূলমন্ত্র
তাওহীদ হলো ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। এই শিক্ষা সুন্দরভাবে উচ্চারিত হয়েছে কালেমা শাহাদাতে। কালেমা শাহাদাতে ঘোষণা দিতে হয়ঃ
আশহাদু আল্ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু
ওয়া দাহু লাশারিকা লাহু,
ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহ।
এই কালেমার অর্থ বুঝতে হলে আমাদেরকে প্রথমেই ইলাহ ও আল্লাহ শব্দ দুটোর অর্থ ও তাৎপর্য বুঝতে হবে।
ইলাহ শব্দের অর্থ মাবুদ বা হুকুমকর্তা-মনিব। মোটকথা যিনি এবাদতের যোগ্য। আমাদের ইবাদত ও বন্দেগীর কে যোগ্য হতে পারেন? তিনিইতো আমাদের এবাদতের যোগ্য যিনি শ্রেষ্টত্ব, গৌরব ও মহত্বে সকলের চেয়ে বড়। যিনি অনন্ত শক্তির অধিকারী, যাঁর শক্তি সম্পর্কে মানুষ ধারণা করতে পারেনা।
ইলাহ শব্দের অর্থ এও যে তিনি নিজে কারও মুখাপেক্ষী হবেন না। বরং সকলেই তাঁর কাছে ভিক্ষা চাইবে।
আমরা কার ইবাদত করব? আমরা একমাত্র তাঁরই ইবাদত করব যিনি আমাদেরকে হুকুম দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন।
আল্লাহ হচ্ছে একক সৃষ্টিকর্তার মৌলিক নাম। মূল সত্তার পরিচায়ক নাম। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু এর মাধ্যমে তাই দু’টো ঘোষণা দেওয়া হলো। একটি ‘অস্বীকার’ করার, অন্যটি ‘স্বীকার’ করার ঘোষণা। ‘লা ইলাহা’ হলো অস্বীকার করা, আর ‘ইল্লাল্লাহু’ হলো স্বীকার করা।
একজন মুমিম ব্যক্তিকে প্রথমে অন্তরে সব ধরনের ‘দেবতা’ বা অন্য কিছুর পূজা করা থেকে পরিস্কার করতে হবে। তারপরই সেখানে এক এবং একক আল্লাহর উপর বিশ্বাসের বীজ বপন করা সম্ভব। জমীনে যেমন বপন করার আগে আগাছা দূর করতে হয়। এও ঠিক তেমনি ধরনের। তাহলে বুঝতে হবে, যে হৃদয়ে ‘তাওহীদের’ চাষ হয়নি সে হৃদয়ে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারুর পূজা এবং এবাদতের আগাছা আপনা থেকেই বেড়ে উঠেছে।
শিরকের তাৎপর্য
তাই আমাদের জানতে হবে মানুষের মধ্যে কেন আল্লাহ ছাড়া আর কোন ‘খোদা’, ‘দেবতা’ কে পূজা বা ইবাদত করার ঝোঁক দেখা দেয়।
খুব গভীর ভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় যে, মানুষ জন্ম থেকেই করানো না কারো গোলাম হয়েই জন্মগ্রহণ করে। স্বাভাবিকভাবেই সে দুর্বল, দুঃস্থ এবং পরমুখাপেক্ষী। বেঁচে থাকার জন্য তার এমন সব জিনিসের কখনও তার হাতে সে নিজের শক্তি দিয়ে পেতে পারেনা। এসব জিনিস কখনও তার হাতে আসে আবার কখনও আসেনা। আর এমনও জিনিস আছে যা তার জন্য ক্ষতিকর। তার সারা জীবনের পরিশ্রম নষ্ট করে দেয়। হাজার ইচ্ছা থাকলেও সে সেই ক্ষতি থেকে বাঁচতে পারেনা।
এমনিভাবে মানুষ নিজেকে বড় অসহায় মনে করে। এই অসহায় মানুষ তখন নিজকে অন্য কারোও গোলাম বা অধিনস্ত ভাবতে শুরু করে। সে ভাবতে শুরু করে আমি যা চাই তা আমি পেতে পারিনা। আমাকে অন্য কেউ তা দিবে। অন্য কোন সত্তা আমাকে বিপদ থেকে বাঁচাবে। বাঁচাবে রোগ-শোক, দুঃখ ও ক্ষতি থেকে। অন্যের কাছে চাওয়া, অন্যের মুখাপেক্ষী হওয়া, অন্য সত্তার পূজা এবং ইবাদত করাটা মানুষের একটা স্বভাব ধর্ম। এমনিভাবে মানুষের মনে একজন মালিক কিংবা প্রভুর ধারণা জন্ম নেয়।
মানুষ এই চিন্তার ফলেই পাথর, মেঘ, বৃষ্টি, সূর্য, চন্দ্র ও আগুনকে পূজা করেছে। এদের শক্তি ও ক্ষমতা দেখে মানুষ মনে করলো এরাই খোদা। কিন্তু পরর্বীতে মানুষ দেখলো এই সব কিছু আসলে মানুষের কোনই উপকার করতে পারেনা বরং নিজেরাই কোন না কোন বিশেষ বিধানের আনুগত্য করে চলছে। মনে হয় খালি চোখে দেখা যায়না এমন কোন এক অদৃশ্য রহস্যময় শক্তির নিয়মে সব কিছু চলছে। তখন মানুষ পাথর, আলো, বাতাস, পানি ব্যাধি, স্বাস্থ্য এমন সব কিছুর পেছনে এক একটি অদৃশ্য শক্তির কল্পনা করে নিল এবং তাদের পূজা করা শুরু করলো। জন্ম হলো বহু খোদা-বহু দেবতার ধারণা।
আবার কেউ ভাবরো এইসব খোদা বুঝি কোন এক বড় খোদার হুকুম মত চলে। তা না হলে সারা বিশ্বজুড়ে সবকিছু একটি নিয়মে চলছে কেন? তাই বড় খোদাকে খুশী করতে হলে এইসব ছোট ছোট খোদাকে খুশী করতে হবে।
কিন্তু মানুষ যখন জ্ঞানের ক্ষেত্রে আরও উন্নতি লাভ করলো –চিন্তা করলো, ভাবলো তখন এক একটা ছোট ছোট খোদার সংখ্যা কমতে থাকলো। শেষ পর্যন্ত এক খোদার ধারণাই অবশিষ্ট থাকলো।
কিন্তু সেই এক খোদার ধারণার মধ্যেও গলদ দেখা দিলো। কেউ মনে করলো, এই খোদা আমাদের মত রক্ত মাংস দেহের অধিকারী। তাঁর স্ত্রী, পুত্র, কন্যা সবই আছে। আবার কেউ মনে করলো, খোদা মানুষের রূপ নিয়ে অবতার হয়ে পৃথিবীতে আসে।
কেউ বলে, এই দুনিয়ার সবকিছু চালু করে দিয়ে খোদা বসে আছেন। আরাম আয়েশে দিন কাটাচ্ছেন। সুতরাং এই দুনিয়ায় আমরা আমাদের মত চলবো। আমাদের ইচ্ছায় আমরা চলবো। এইবাবে নিজের ইচ্ছা, নিজের মনের বাসনাকেউ কেউ আবার খোদা বানিয়ে নিলো।
কেউ ভাবলো, খোদা, সেতো বিরাট ব্যাপার, আমরা তাঁর কাছে কিভাবে পৌঁছাবো? কিভাবে আমাদের মনের কথা পৌঁছাবো? তাই আমাদের মধ্যে কোন এক বুজুর্গ লোক খুঁজে বের করে তাঁরই সুপারিশ নিয়ে খোদার কাছে যেতে হবে। খোদাকে পেতে হলে আরও একজনকে সুপারিশকারী ধরে প্রকৃতপক্ষে আরও একজন খোদার জন্ম দিলো মানুষ। এমনিভাবে মানুষ অজ্ঞতার বশে নিজের মনের মধ্যে আল্লাহ ছাড়া হাজারো খোদার জন্ম দেয়। একেই বলে ‘শিরক’ করা।
তাওহীদের তাৎপর্য
তাওহীদ বিশ্বাসের তাৎপর্য হলো এমনি সব ভ্রান্ত খোদার গোলামী থেকে মুক্ত হয়ে এক ও একক আল্লাহর বিশ্বাসকে মনের মধ্যে দৃঢ়ভাবে গেঁথে রাখতে হবে। বিশ্বাস করতে হবে সেই আল্লাহকে যে আল্লাহর কোন শরীক নেই। যে আল্লাহর কোন অংশীদার নেই। যে আল্লাহর কোন সন্তান নেই। যে খোদা কারও মুখাপেক্ষী নন এবং স্বাধীন, সর্বশক্তিমান। যিনি সব কিছু জানেন, শুনেন এবং দেখেন। যাঁর হুকুম কেউ অমান্য করতে পারেনা। যিনি অনন্ত শক্তির অধিকারী। যিনি সকল অভাব, ভুল এবং দুর্বলতা থেকে মুক্ত। যে আল্লাহ তাঁর বান্দার ডাক শুনেন –সরাসরি তার মনের কথা জানেন।
আল্লাহ সম্পর্কে এই সঠিক ধারণাই যুগে যুগে নবীর পয়গাম্বররা মানুষকে দিয়েছেন। সকল জ্ঞানের সেরা এই জ্ঞান।
তাওহীদের এই শিক্ষা সুন্দরভাবে ‘সূরা ইখলাসে’ বলা হয়েছেঃ
বল, তিনি আল্লাহ এক। আল্লাহ সবকিছু থেকে নিরপেক্ষ, মুখাপেক্ষীহীন, সবাই তাঁরই মুখাপেক্ষী, না তাঁর কোন সন্তান আছে, আর না তিনি কারো সন্তান এবং কেউ তাঁর সমতুল্য নয়।
তাওহীদ বিশ্বাসের সুফল
এক এবং একক আল্লাহর উপর বিশ্বাস মানুষের পুরো জীবনটাকে বদলিয়ে দেয়।
ক. তাওহীদে বিশ্বাসী ব্যক্তি আল্লাহর কাছে সম্পূর্ণরূপে নিজেকে বিলিয়ে দেয়। এইভাবে পুরোপুরিভাবে সে আল্লাহর গোলামে পরিণত হয়। এই জমীন-আসমানের সবকিছু মানুষের জন্যই। মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্যই সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ। আল্লাহর কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিলে তাই আর অন্য সব সৃষ্টির উপর মানুষেল নিয়ন্ত্রণ আসবে।
খ. এক আল্লাহতে বিশ্বাস মানুষকে করে আত্মবিশ্বাসী, আত্মসচেতন। মানুষ নিজকে চিনতে পারে। পৃথিবীর শ্রেষ্ট সৃষ্টি হিসেবে নিজকে জানতে পারে। নিজের অভাব পূরণের জন্য সে আল্লাহ ছাড়া আর কারো মুখাপেক্ষী নয়। এই চেতনা তাকে করে আত্মবিশ্বাসী। একজন গরীব ক্রীতদাস তখন নিজেকে ছোট মনে কেরনা। সে তার নিজের আসল পরিচয় খুঁজে পায়। সে পায় মানুষের মর্যাদা।
গ. সে বিশ্বাস করে তার যা কিছু আছে সব আল্লাহর দেওয়া। তাই তাওহীদে বিশ্বাসী লোক কখনও অহংকারী, দেমাগী হয়না। সে হয় বিনয়ী ও ভদ্র।
ঘ. তাওহীদে বিশ্বাস মানুষকে করে কর্তব্যপরায়ণ। সে জানে তার একমাত্র কাজ হলো আল্লাহর হুকুম মেনে চলা। এই হুকুম মেনে চললে আল্লাহ খুব খুশী হবেন। তাই সে কোন দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেনা। করেনা কোন অন্যায় ও পাপ কাজ।
ঙ. তার মন হয় প্রশান্ত ও তৃপ্ত। সে কোন দুশ্চিন্তা করেনা। সে জানে তার যা কিছু প্রয়োজন সবই আল্লাহ দিচ্ছেন। সে জানে তার জন্য আল্লাহ যা কিছু করেন সবই তার ভালর জন্য করেন। সাময়িক বিপদ-আপদ সবই আল্লাহর তরফ থেকে আসে। আল্লাহ যাকে সাহায্য করতে চান তাকে কেউ বঞ্চিত করতে পারবেনা। আর আল্লাহ যাকে কিছু দিতে চাননা তাকে কেউ কিছু দিতে পারবেন না। তাই মুমিন মন কখনও হতাশ হয়না। মুমিনের মন কখনও ভাঙ্গেনা। সে আল্লাহতে থাকে তুষ্ট।
চ. তাওহীদ মানুষের মনে সৃষ্টি করে দৃঢ় সংকল্প, উচ্চাকাংখা, অধ্যবসায় ও সবর। সে মৃত্যুকে ভয় পায়না। দুঃখ ও কষ্টে টলেনা। তাই কোনো ভাল কাজ, মহৎ কাজ করতে সে কখনও পিছপা হয়না। মৃত্যুভয়, জুলুম, অত্যাচার তাকে সত্যের পথ থেকে টলাতে পারেনা। ধন-সম্পত্তি, সন্তান-সন্ততির ভালবাসা কোনটাই তার কাছে স্থান পায়না। একমাত্র আল্লহার রাস্তায় সে হয় বিপ্লবী সাহসী পুরুষ।
ছ. সবচেয়ে বড় কথা একজন মুমিন বিশ্বাস করে, আল্লাহ তার অন্তরের সব কিছু জানেন, সব কিছু দেখেন। এই চিন্তা তাকে আল্লাহর আদেশ মান উৎসাহিত করে। তার দ্বারা কোন পাপ কাজ হয়না। কেউ না দেখলেও তার দ্বারা কোন খেয়ানত হয় না। এমনিভাবে সে হয় আল্লাহর একজন অনুগত বান্দা। তার বিশ্বাসের সাথে কথা ও কাজের মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
রেসালাত
এই দুনিয়ায় চলতে হলে মানুষের অনেক কিছু প্রয়োজন। আল্লাহ মানুষকে চলার জন্য এই দুনিয়ায় সব রকমের উপকরণই দিয়ে দিয়েছেন। তার কোন হিসাব নেই। মানুষের চলার জন্য দিয়েছেন পা, কাজ করার জন্য হাত, শুনবার জন্য কান, দেখবার জন্য চোখ এমন অনেক কিছু। এছাড়া বেঁচে থাকার জন্য দিয়েছেন খাদ্য, পানীয়, বাতাস, তাপ ও আলো। সুন্দর জীবন গড়ার জন্য দিয়েছেন মায়ের আদর, পিতার স্নেহ, অন্যের মনে তার জন্য ভালবাসা।
দুনিয়ায় সব কাজ কারবার যেন ঠিকমত চলে সেজন্য আল্লাহর দেওয়া ব্যবস্থা কি চমৎকার! দেখো, তিনি একেক মানুষের মধ্যে দিলেন একেক যোগ্যতা, একেক গুণ। একেক পারদর্শিতা। কারও মধ্যে থাকে নেতৃত্বের গুণাবলী, কেউবা অসাধারণ বক্তৃতা দেওয়ার গুণ লাভ করে। কেউবা আল্লাহর দেওয়া প্রতিভায় মানুষের জন্য আবিস্কার করে নতুন নতুন জিনিস। ফলে দুনিয়ার বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন গুণে পারদর্শী হয়।
কোন সমস্যা হলে তাই আমরা সকলের কাছে না গিয়ে সেইসব বিশেষজ্ঞদের কাছে ছুটে যাই। রোগ হলে যাই ডাক্তারের কাছে। বড় বড় দালান-কোঠা, পুল, রাস্তা তৈরী করতে হলে যাই ইঞ্চিনিয়ারের কাছে। বিজ্ঞানের জটিল সমস্যা দেখা দিলে ছুটে যাই বৈজ্ঞানিকের কাছে মোট কথা, আমাদেরকে কোন এক সমস্যার সমাধান পেতে হলে সেই বিশসে পারদর্শীর কাছে যেতে হবে।
এমনিভাবে দুনিয়ার সব সমস্যারই সমাধানের এক চমৎকার ব্যবস্থাও আল্লাহই করে দিয়েছেন। কিন্তু এরপরও একটা বিরাট সমস্যা থেকে যায়। জীবনে চলার জন্য প্রয়োজন জীবনের উদ্দেশ্য জানা, আমাদের সৃষ্টিকর্তাকে জানা, সৃষ্টিকর্তার আদেশ নিষেধ জানা। এসব জানার উপায় কি? মহান দয়ামতয় আল্লাহ সে উপায়ও আমাদের বাতলিয়ে দিয়েছেন। মানুষকে সঠিক পথ চিনবার জন্য, মানুষকে সঠিক পথে চালানোর জন্য এক চমৎকার ব্যবস্থা করেছেন।
দুনিয়ায় বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন লোককে যেমন বিভিন্ন যোগ্যতা দিয়ে তিনি পারদর্শী বানিয়েছেন তেমনি আল্লাহকে চিনার উচ্চতম যোগ্যতা দিয়ে মানুষের মাঝে কিছু মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। সেইসব মনোনীত মানুষকে আল্লাহ সঠিক পথের জ্ঞান দিয়েছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন খোদার বিধান। আর সে বিধান অনুযায়ী তাঁদের চরিত্রকে গঠন করেছেন এবং অন্যকে আল্লাহর বিধান জানিয়ে দেওয়ার, বুঝিয়ে দেওয়ার এবং বাস্তবে পালন করে দেখিয়ে দেওয়ার দায়িত্বও তাদেরকে দিয়েছেন। এইসব মহান মানুষদেরকে আমরা বলি নবী, রাসূল বা পয়গম্বর।
আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষকে হেদায়াত দানের এটাই একমাত্র ব্যবস্থা। নবী, রাসূলদের এই ধারাকে ইসলামী পরিভাষায় বলে ‘রেসালাত’। আল্লাহ এবং মানুষের মাঝে যোগাযোগের মাধ্যম হলো এই রেসালাত।
নবীর উপর ঈমানঃ দাবী এবং তাৎপর্য
সাধারণ মানুষের কাজ হলো সে সত্যিকারের পয়গাম্বরকে চিনে নেবে। বেছে নেবে জীবনে চলার পথের নেতাকে। আল্লাহর নবীকে চিনে নেবার পর তার কাজ হলো সেই নবীর আদর্শের উপর ঈমান আনা, তাঁর আদেশ নিষেধ মেনে চলা, তাঁর দেখানো পথে চলা। কাউকে পয়গাম্বর হিসেবে মেনে নেবে অথচ তাঁর হুকুম মান হবে না, এটা একেবারেই বুদ্ধিহীনেরকাজ। কেননা নবী পয়গাম্বররা যা কিছু বলেন, যা কিছু করেন সব আল্লাহর পক্ষ থেকে। তাই তাঁদেরকে না মানার অর্থ আল্লাহকে না মানা। তাদের বিরোধিতা করার অর্থ আল্লাহর বিরোধিতা করা।
পয়গাম্বর আমাদের যা বিশ্বাস করতে বলেছেন আমরা তা বিশ্বাস করবো। যা পালন করতে বলেছেন আমরা তা পালন করব। যা নিষেধ করেছেন আমরা তা করবোনা।
নবীর কোন কাজ, কোন কথা বুঝতে না পারলে কিংবা আমাদের বুদ্ধিতে না কুলালেও তা মেনে নিতে হবে। এটই হলো রেসালাতের উপর ঈমানের দাবী। তাই নবী-রাসূলদের শুধু স্বীকার করলেই হবেনা, তাদের আনুগত্য করতে আল্লাহ মানুষকে নবী –পয়গাম্বরদের মাধ্যমেই হেদায়াত দিয়েছেন। সরল এবং সঠিক সবসময় একটিই হয়। সেই সরল, সঠিক পথের সন্ধান আল্লাহ পয়গাম্বরদের মাধ্যমে আমাদেরকে জানিয়েছেন। দেখিয়ে দিয়েছেন। তাই নবী, পয়গাম্বরদের পথ ছাড়া আর কোন পথইতো আল্লাহর পথ হতে পারেনা। কোন পথই আল্লাহকে জানার ও পাওয়ার জন্য সরল এবং সঠিক পথ হতে পারেনা। নবীর হুকুম মানার মাধ্যমেই আল্লাহর হুকুম মানা সম্ভব।
নবীদের পরিচয়
নবী-রাসূলরা আমাদের মত মানুষ ছিলেন। তাই তাঁদেরকে অতি মানব ভাবা ঠিক নয়। তাঁদের সম্পর্কে এটাও ধারণা করা ঠিক নয় যে, তাঁরা আল্লাহর পুত্র, কিংবা আল্লাহর অংশীদার (নাউযুবিল্লাহ)। নবী-রাসূলদের আনুগত্য করা অর্থ তাঁদের পূজা করা নয়। আনুগত্য তো প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর। নবীদের দেখানো পদ্ধতির আনুগত্য করলেই সেটা হবে প্রকৃত আল্লাহর আনুগত্য। নবী ও রাসূল হলো আল্লাহকে পাওয়ার মাধ্যম।
আল্লাহ সব যুগে, সব জাতির, সব গোত্রের জন্য নবী-পয়গাম্বর পাঠিয়েছেন। পবিত্র কোরআনের ভাষায়ঃ
প্রত্যেক উম্মতের জন্য একজন রাসূল রয়েছে।
সূরা ইউনুছ-৪৭
প্রত্যেক জাতির জন্য একজন পথ প্রদর্শক রয়েছে।
সূরা আর-রা’দ-৭
কোন উম্মতই অতিবাহিত হয়নি যাদের কাছে কোন না কোন সতর্কবাণী আসে নাই।
সূরা ফাতের-২৪
এমনি ভাবে প্রত্যেক যুগেই মানুষকে সরল সঠিক পথ দেখানোর জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে কি সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে দেখো। হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর হাদীস অনুযায়ী নবী-রাসূলদের সংখ্যা একলাখ চব্বিশ হাজার। কিন্তু এদের সকলের নাম জানা যায়নি। পবিত্র কোরআনে ২৫ জন নবীর নাম উল্লেখ আছে।
মুসলমান হিসেবে আমাদেরকে সকল নবী-পয়গাম্বরের উপর ঈমান আনতে হবে। বিশ্বাস করতে হবে, আল্লাহ মানুষকে হযরত আদম (আঃ)-এর মাধ্যমে হেদায়াতের যে ধারা শুরু করেছিলেন হযতর মুহাম্মদ মোস্তফা (সঃ)-এর মাধ্যমে তার পূর্ণতা দিয়েছেন।
অন্যান্য নবী ও হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর মধ্যে মর্যাদার পার্থক্য
আমরা অন্যান্য নবী-পয়গাম্বরকে বিশ্বাস করবো ঠিক। কিন্তু আমাদের কয়েকটি বিষয় জেনে নিতে হবে। তা হলো আমাদের প্রিয় নবী শেষ পয়গাম্বর হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এবং অন্যান্য পয়গাম্বরদের মধ্যে পার্থক্য কি?
১। পূর্ববর্তী নবীরা বিশেষ যুগে বিশেষ কওমের মধ্যে এসেছিলেন কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-কে পাঠানো হয়েছে সারা দুনিয়ার জন্য এবং সর্বকালের জন্য।
২। পূর্ববর্তী নবীদের জীবন কাহিনী সঠিকভাবে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই তাঁদেরকে অনুসরণ করতে চাইলেও তা সম্ভব নয়। অথচ হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর জীবনী, শিক্ষা, মুখের কথা, কাজ সব কিছু মোটকথা পুরো জীবনী সঠিকভাবে আমাদের কাছে আছে। তাই পয়গাম্বর হিসেবে একমাত্র তাঁরই অনুসরণ সম্ভব।
৩। পূর্ববর্তী নবীদের শিক্ষা ছিলো তাঁদের যুগের জন্য। প্রত্যেক নবী এসে তাঁর পূর্ববর্তী নবীর আদেশ, আইন, হেদায়াত সংশোধন ও সংযোজন করেছেন। তাই পূর্বের সকল নবীর শরীয়ত আপনা থেকেই বাতিল হয়ে গেছে। সর্বশেষে হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর মাধ্যমে যে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে তা সবদিক থেকে পূর্ণাঙ্গ। তাই শেষ নবীর অনুসরণ করলে প্রকৃতপক্ষে সকল নবীর শিক্ষার আনুগত্য করা হয়।
ফেরেশতাদের উপর ঈমান
নবী করীম (সঃ) আমাদেরকে ফেরেশতাদের উপর ঈমান আনতে বলেছেন। ফেরেশতারা কারা? কি তাদের কাজ? মানুষ ও ফেরেশতাদের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? কেনই বা আমাদেরকে ফেরেশতাদের উপর ঈমান আনতে হবে?
ফেরেশতারা আল্লাহর বিশেষ সৃষ্টি। তাদের বিশেষ কাজ করার জন্য ‘নূর’ দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। যেমন মানুষকে ‘মাটি’ দিয়ে, জ্বীনকে ‘আগুন’ দিয়ে তৈরী করা হয়েছে। ইবলীস শয়তান জ্বীনদের মধ্যের একজন। অনেকের ভুল ধারণা ইবলীস ফেরেশতাদের সর্দার ছিলো।
ফেরেশতারা সব সময় আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী কাজ করছে। আল্লাহর কাজের জন্য হুকুম দিয়েছেন সে সেই কাজই করছে। তাদের কোন ঘুম নেই, নেই আমাদের মত ক্ষুধা ও তৃষ্ণা। আল্লাহ তাঁর অনুগত সুন্দর সৃষ্টি ফেরেশতাদের দ্বারা বিশ্বজাহান পরিচালনা করছেন। আল্লাহর সৃষ্টি জগতে বহু ফেরেশতা আছে। আমরা মাত্র মাত্র কয়েক জন বিখ্যাত ফেরেশতার নাম জানি। আল্লাহর কাছ থেকে হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এবং অন্যান্য নবী-পয়গাম্বরের কাছে আল্লাহর বাণী নিয়ে আসতেন জীবরাঈল (আঃ)। আমাদের মৃত্যুর পয়গাম নিয়ে আসেন আজরাঈল (আঃ)। মানুষের খাদ্য বণ্টন করেন মীকাইল (আঃ) এবং কিয়ামতের দিন শিঙ্গায় ফুঁ দিবেন ইস্রাফিল (আঃ)।
এই ফেরেশতাদের মধ্যে একশ্রেণীর ফেরেশতা সব সময় আমাদের মাঝে থাকেন। আমাদের ভাল মন্দ সব কাজ তারা দেখছেন এবং লিখে রাখছেন। মোট কথা তাদের কাছে সব মানুষের জীবনের সকল রেকর্ড সংরক্ষণ করা হচ্ছে। মৃত্যুর পর আমরা যখন আল্লাহর কাছে হাজির হবো তখন তারা আমাদের সেই রেকর্ড বা আমলনামা আল্লাহর সামনে পেশ করবেন। তখন আমরা দেখতে পাবো জীবনভর আমরা কি কি ভাল কাজ করেছি এবং কি কি খারাপ কাজ করেছি। সবকিছু ঠিক ঠিক মত পেশ করা হবে আল্লাহর কাছে। তারা সব সময় আল্লাহর প্রশংসা করছেন। মানুষ ফেরেশতাদেরকে দেখতে পারেনা যতক্ষণ না তারা আল্লাহর হুকুমে মানুষের রূপ নিয়ে আসেন। আল্লাহর হুকুমে তারা যে কোন রূপ নিতে পারেন। একবার হযরত জীবরাইল (আঃ) মানুষের রূপ নিয়ে নবী এবং তাঁর সাথীদের মাঝে এসেছিলেন।
এখন আমরা দেখব এই অদৃশ্য ফেরেশতাদেরকে আমাদের কেন বিশ্বাস করতে বলা হলো।
আগেই বলা হয়েছে যে মানুষের দুর্বল মন কখনও কখনও এই দুনিয়ার বিভিন্ন কাজের পিছনে বিভিন্ন অদৃশ্য রহস্যময় শক্তি আছে বলে বিশ্বাস করে। সে ধারণা করে কোন শক্তি বাতাসকে নিয়ন্ত্রণ করছে, অন্য কোন এক শক্তির হুকুমে আগুন জ্বলছে। আবার কেউ দান করছে মানুষকে আলো। মানুষ ভাবে এরা আল্লাহর সন্তান-সন্ততি। সে মনে করে এদেরকে খুশী করতে পারলে আল্লাহ খুশী হবেন। তাই তাদের কল্পিত মূর্তি তৈরী করে পূঝা করে অবুঝ মানুষ।
ইসলামের শিক্ষা হলো-না, এসব রহস্যময় শক্তি খোদা নয়। এমনকি খোদার সন্তান-সন্ততিও নয়। তারা ফেরেশতা। আল্লাহর এক বিশেষ সৃষ্টি, এমনিভাবে ফেরেশতার অস্তিত্বের উপর বিশ্বাস মানুষকে অন্ধ শিরক থেকে মুক্তি দেয়।
কিতাবের উপর ঈমান।
মানুষের প্রতি আল্লাহর রহমতের শেষ নেই। আল্লাহ মানুষকে মুক্তির পথের দিশা দিয়ে পাঠালেন নবী ও পয়গাম্বরদের। আল্লাহ তাঁদের কাছে যে বাণী পাঠালেন তাকে অহি বলা হয়। অহির মাধ্যমে অনেক নবীর কাছে কিতাব পাঠিয়েছেন আল্লাহ। এভাবে সৎ, সঠিক, নির্ভুল প্রয়োজনীয় জ্ঞান লিখিত আকারে মানুষের কাছে এলো। এরচেয়ে বড় নেয়ামত আর কি আছে?
কোরআন যে সব কিতাবের কথা উল্লেখ আছে আমরা সে সব কিতাবে বিশ্বাস করি। সেগুলি হলো হযরত মুসা (আঃ)-এর ‘তাওরাত’, হযরত দাউদ (আঃ)-এর ‘জাবুর’, হযরত ঈসা (আঃ)-এর ‘ঈঞ্জিল’, হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর ‘কোরআন’। এছাড়াও বিভিন্ন নবীর কাছে বিভিন্ন কিতাব এসেছে। সে সবের নাম ও পরিচয় আমাদেরকে বলা হয়নি। তাই বর্তমান বিশ্বে আর যেসব ধর্মীয় গ্রন্থ আছে তা যে আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে এ কথা যেমন জোর দিয়ে বলতে পারিনা, তেমনি এ কথাও বলতে পারিনা যে এসব আল্লাহর তরফ থেকে আসেনি। আসল কথা হলো কোরআন ছাড়া আর কোন ধর্মীয় গ্রন্থকে আমরা সঠিকভাবে পাইনা।
একমাত্র কোরআন ঠিক যেভাবে নাযিল হয়েছে সেইভাবে অক্ষত ও অপরিবর্তিত অবস্থায় আছে। তাওরাত, জাবুর ও ইঞ্জিল যেভাবে, সে ভাষায় নাযিল হয়েছিল সেভাবে, সে ভাষায় নেই। তাওরাত ছিল ‘হিব্রু’ ভাষায় এবং ইঞ্জিল ছিল ‘আরামিক’ ভাষায়। বর্তমানে তাদের মূল শব্দাবলীতেও পরিবর্তন এসেছে। সংশ্লিষ্ট নবীদের মৃত্যুর অনেক পরে তাদের অনুসারীরা আবার নতুন করে এসব কিতাব সংকলিত করার দাবী করে। ফলে এ সবের মধ্যে রয়েছে পরিবর্তন, পরিবর্ধন এবং মনগড়া কথা। আল্লাহর মূল কথার সাথে মিশে গেছে মানুষের কথা। শুধু তাই নয়, বাইবেলে আছে অনেক ভুল তথ্য। আছে নবী ও রাসূলদের সম্পর্কে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন গল্প।
তাই এসব কিতাব সম্পর্কে শুধু এটাই বলা যায় যে, এসবের মধ্যে আল্লাহর কালামের সাথে মানুষের কথা মিশে গেছে। কোনটা আল্লাহর কথা আর কোনটা স্বার্থবাদী মানুষের কথা তা বুঝবার কোন উপায় নেই।
তাহলে এসব কিতাবের কথা বলা হলো কোরআনে? সব কিতাবের উল্লেখ করে কোরআন এ কথাই জানিয়ে দিলো –আল্লাহতায়ালা মানুষের হেদায়েতের জন্য প্রত্যেক যুগেই নবী-পয়গাম্বর পাঠিয়েছেন, পাঠিয়েছেন তাঁদের মাধ্যমে কিতাব ও হুকুম-আহকাম। অতীদের নবীর অনুসারীরা সেই কিতাবের শিক্ষাকে ভুলে গেছে। সে শিক্ষাকে নষ্ট করেছে। কোরআন কোন অভিনব জিনিস নয়। মানুষের জন্য আল্লাহর একটা রহমত যা তিনি পাঠিয়েছেন শেষ নবীর কাছে। অতীতের সেই শিক্ষাকে আবার জীবন্ত করার জন্য কোরআন নাযিল করা হয়েছে।
আল্লাহর এও এক অপার রহমত যে সেই কোরআন আজও অপরিবর্তিত, অক্ষত অবস্থায় আমাদের মাঝে আছে। এর মধ্যে কোন পরিবর্তন আনা হয়নি।
আখেরাত
মৃত্যু এক চরম সত্য
দুনিয়াতে আমরা দেখি প্রতিটি প্রাণীর মৃত্যু আছে। দুনিয়ায় এই জীবন চিরস্থায়ী নয়। হাসি ও আনন্দ, সুখ ও দুঃখের এই জীবন একদিন শেষ হয়ে যায়। এই মৃত্যু সকলের জীবনে একদিন না একদিন আসবেই। মৃত্যু কখন আসবে তাও কেউ জানেনা। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছেঃ
অবশেষে প্রত্যেক ব্যক্তিকেই মরতে হবে।
-আল-ইমরান-১৮৫
মৃত্যুর পর জীবন
মৃত্যুর পর জীবনের এক চরম সত্য। তাই স্বাভাবিকভাবেই সকলের মধ্যে প্রশ্ন জাগে, মৃত্যু জিনিসটি কি? মানুষ মৃত্যুর পর যায় কোথায়? এই সঙ্গে আরও একটা প্রশ্ন এসে দেখা দেয়, তা হলো, মৃত্যুর মাধ্যমে আমাদের এই দুনিয়ার জীবনের সব ভাল ও মন্দ কাজের ফলাফল কি শেষ হয়ে যায়? দুনিয়ার জীবনে মানুষ যা কিছু করলো, ভাল কিংবা মন্দ এর ফল কি এই দুনিয়াতেই শেষ? বিষয়টা আরও একটু গভীরভাবে ভাবি।
আমরা দেখি এই দুনিয়ার জীবনে হাজারও কষ্টের মধ্যে, হাজারও প্রতিকূলতার মধ্যে অনেক লোক এমন আছেন যিনি সৎ পথে টিকে থাকার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন সব সময়। তিনি অন্যের উপকার করছেন, অন্যের জন্য জীবন বিলিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু তিনি এই দুনিয়াতে এই সৎ কাজের জন্য পুরোপুরি কোন পুরস্কার পাচ্ছেন না; বরং পাচ্ছেন উল্টোটা-দুর্নাম ও নির্যাতন। কখনওবা তাঁর ভাগ্যে জোটে মৃত্যুদণ্ড। তাহলে কি তিনি যে সৎ কাজ করলেন তা সব বিফলে যাবে? তাঁর মৃত্যুর পর তার সৎ কাজের সুফল এই দুনিয়াবাসী অনন্ত কাল ধরে পাবে আর তিনি নিজে তাঁর ফলাফল পাবেন অসম্পূর্ণ, এটা কিভাবে মেনে নেওয়া যায়?
অন্যদিকে একজন লোক জীবনভর অন্যায় কাজ করলো। আমরা দেখলাম সে হয়তো তার দুষ্কর্মের জন্য দুনিয়ায় কিছুটা শাস্তিও পেলো। কিন্তু তার দুষ্কর্মের শাস্তি সে পুরোপুরি পেলনা। কখনও কখনও এই ধুরন্ধর ব্যক্তি দুনিয়ার সকলকে ফাঁকি দিয়ে দুনিয়ার শাস্তিও এড়িয়ে যায়। লোকের চোখের আড়ালে দুষ্কর্ম চালিয়ে যায়। অথচ তার দুষ্কর্মের ফল অন্যেরা পেতেই থাকে। এই জুলুমের পুরোপুরি শাস্তি কি সে কোন দিনও পাবেনা? দুনিয়ায় যে জুলুম সে করেছেন, যে খারাপ কাজ সে করেছে, তার মৃত্যুর পর তার পরিণাম দুনিয়াবাসী ভোগ করতেই থাকবে। আর মৃত্যু এসে এই জালিমকে একেবারেই বাঁচাবে শাস্তি থেকে, একি কখনও হতে পারে?
মোট কথা, আমরা দেখি দুনিয়ার এই সংক্ষিপ্ত জীবনে মানুষ কখনও তার ভাল এবং মন্দ কাজের সঠিক পুরস্কার কিংবা শাস্তি পেতে পারেনা। বিবেকের কথা হলো, মৃত্যুর পরও তার ভাল ও মন্দ কজের জন্য পুরস্কার কিংবা শাস্তির ব্যবস্থা থাকা উচিত।
পরকাল সম্পর্কে ইসলাম
ইসলাম বল মৃত্যুর পর আরও একটি জীবন আছে। যাকে আমরা বলি ‘পরকাল’। ‘মৃত্যু’ দেখা যায় কিন্তু মৃত্যুর পর কি আছে তা দেখা যায়না। আর দেখা যায়না বলেই অনেকে মৃত্যুর পর কিছু আছে বলে বিশ্বাস কতে চায়না। আমরা নিজেরা দেখতে পারিনা, নিজেরা অনুভব করতে পারিনা বলেই মৃত্যুর পর কিছু আছে কিনা তা বিশ্বাস করবো না এটা কি যুক্তিসঙ্গত হলো? আমরা দেখবো, বিবেক কি বলে। আমরা দেখবো এই পরকাল বিশ্বাস করা কিংবা তা না করার ফলে মানুষের জীবনে কি প্রভাব পড়ে। আমরা দেখবো, পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে সৎ-মহৎ ও পবিত্র বলে প্রমাণিত আল্লাহর মনোনীত নবী-রাসূলগণ আমাদেরকে আল্লাহর পক্ষ থেকে কি শিখালেন।
পরকাল অস্বীকারের পরিণাম
১। যে ব্যক্তি পরকালে বিশ্বাস করেনা তার জন্য তো দুনিয়ার এই জীবনটাই সব। তাই খাও, ফুর্তি করো এটাই তার জীবনের লক্ষ্য। সব কাজ সে এই দৃষ্টিতে দেখবে। যে কাজে তার স্বার্থ নেই সেই কাজে সে উৎসাহ পাবেনা। যে ভাল কাজের ফল সে এ দুনিয়ায় পাবেনা, সেটা তার কাছে ভাল কাজ বলে মনে হবেনা। আর যে অন্যায় কাজের জন্য দুনিয়ায় সে শাস্তি এড়াতে পারবে, তার কাছে সেটা অন্যায় বলে মনে হবেনা।
২। কোন ব্যক্তি যদি পরকালে বিশ্বাস না করে তবে সে কোন সৎকাজে উৎসাহ পেতে পারেনা। কেননা দুনিয়ায় সব সৎকাজের ফল পাওয়া যায়না। ফলে তার চোখের সামনে অন্যায় হবে, জুলুম হবে আর সে তা তাকিয়ে দেখবে। অন্যায় ও জুলুমের প্রতিকারের কোন উপায় না দেখে তার মনোবল ভেঙ্গে যাবে।
৩। এইভাবে সমাজ থেকৈ দিন দিন ভাল কাজ লোপ পায়। আর স্বার্থপরতা, লোভ লালসা বাড়তে থাকে। একে অন্যের জন্য কষ্ট করবে, একে অন্যকে সাহায্য করবে, অন্যের দুঃখে শরিক হবে, এসব ভাল গুণের কদর কমতে থাকে। কে কিবাবে কাকে ঠকাবে, অন্যের সম্পদ কিভাবে লুটবে এটাই হয় মানুষের সব সময়ের চিন্তা। সমাজ তখন মানুষের বসবাসের যোগ্য থাকেনা।
তুমি কি দেখেছ সে লোককে যে পরকালের শুভ প্রতিফল ও শাস্তিকে অস্বীকার করে।
সূরা মাউন-১
তাই পরকালে বিশ্বাস একটা মামুলী বিষয় নয়। পরকালের প্রতি অবিশ্বাস মানুষকে প্রকৃত পক্ষে পশুতে পরিণত করে। মানবতাকে ধ্বংস করে। মানুষ পরিণত হয় খোদাদ্রোহী জালেমে।
পরকাল বিশ্বাসের গুরুত্ব
পরকালের প্রতি বিশ্বাসকে ইসলাম তাই এত বেশী গুরুত্ব দিয়েছে। ইসলামী পরিভাষায় পরকালকে ভলা হয় ‘আখেরাত’। নবী রাসূলগণ আমাদের বিশ্বাস করতে বলেছেনঃ
১। আল্লাহ একদিন এই বিশ্বজগৎ চূর্ণবিচূর্ণ করে ধ্বংস করে দেবেন। সে দিনের নাম ‘কিয়ামত’।
২। এই বিশ্বজগৎ চূর্ণবিচূর্ণ হবার পর আবার সবাইকে দেওয়া হবে নতুন জীবন। মানুষ আবার নতুন দেহ পাবে। সবাইকে আল্লাহর সামনে হাজির করা হবে, আল্লাহ সকলের বিচার করবেন। একে বলা হয় ‘হাশর’।
৩। বিচারের জন্য মানুষ দুনিয়ায় যা কিছু করেছে সেই আমলনামা মানুষের সামনে পেশ করা হবে। মানুষের ভাল কাজ মন্দ কাজ, সব কিছু তার সামনে তুলে ধরা হবে। সত্য ও ইনসাফের সাথে তার বিচার করা হবে। আল্লাহর মানদণ্ডে যার ভাল কাজ মন্দ কাজের চেয়ে বেশী হবে তাকে আল্লাহ পুরস্কার দেবেন। ভাল কাজের পুরস্কার হিসাবে তাকে দেবেন জান্নাত আর খারাপ কাজের জন্য শাস্তি হিসাবে সে পাবে জাহান্নাম।
এভাবেই ইসলাম জানিয়ে দেয় দুনিয়ার এই জীবনই মানুষের শেষ নয়। এই জীবন ক্ষণস্থায়ী। এখানে মানুষের সকল কাজের পুরোপুরি ফলাফল প্রকাশ পায়না। দুনিয়ায় ভাল ও মন্দ কাজের পুরোপুরি ফলাফল পাওয়া যায় আখেরাতে। তাই আখেরাতের জীবনের সফলতা কিংবা ব্যর্থতাই হচ্ছে আসল। দুনিয়া এবং আখেরাতে শান্তিই মানুষের জীবনের চরম ও পরম আকাংখা হওয়া উচিত।
পরকালে বিশ্বাসের উপকার
ইসলাম আখেরাত বিশ্বাসকে সকল বিধি-বিধান ও আইন-কানুনের বুনিয়াদ হিসেবে নিয়েছে।
১। আখেরাতে বিশ্বাস মানুসের মধ্যে এক শক্তিশালী বিবেকের জন্ম দেয়। যা সত্য তাকে সে সত্য বলেই মনে করে। মিথ্যাকে সে মিথ্যা বলতে ভয় পায়না। দুনিয়ার কোন লাভ বা ভয়-ভীতির কারণে সে ভাল কাজ করেনা। নিজের বিবেকের তাড়নাতেই সে সত্যের পথে চলে নির্ভীকভাবে। আখেরাতে আল্লাহর সামনে তাকে হাজির হতে হবে সে চিন্তা তাকে পর্বত প্রমাণ জুলুম সাহসিকতার সাথে মোকাবিলার সাহস জোগায়।
২। আখেরাতের উপর বিশ্বাস মানুষের মাঝে সৃষ্টি করে দুর্লভ গুণ। পরকালে আল্লাহর কাছে পুরস্কারের আশায় সে দুনিয়ায় নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে আসে পরের উপকারে, অন্যের সাহায্যে। তার দ্বারা কারও হক নষ্ট হয়না। এতিম, মিসকিন, পথচারী, প্রতিবেশী সকলের প্রতি সে হয় সদয়।
৩। আখেরাতে বিশ্বাস মানুষকে দায়িত্বশীল করে। সে বিশ্বাস করে দুনিয়ার জীবনই শেষ নয়। দুনিয়ার প্রতিটি কাজ সে তাই দায়িত্ববোধের সাথেই পালন করে। কোনপ্রকার তদারকি ছাড়াই সে নিজের দায়িত্ব পালন করে যায়।
৪। এমনিভাবে আখেরাত বিশ্বাসের উপর যে সমাজ গড়ে উঠে সে সমাজে বিরাজ করে ভ্রাতৃত্ব, মমতা, সহানুভূতি, দয়া ও ভালবাসা। সে সমাজে হক ও ইনসাফের ভিত্তিতে সকল কাজ পরিচালিত হয়। আর তখনই মানুষ পায় মানুষের প্রকৃত মর্যাদা।