বড়ো পীর
আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর ইনতিকালের প্রায় চারশ’ বছর পরের কথা। মুসলিম জাহানের জন্য তখন বড়োই দুর্দিন। সেই যুগটি ছিলো প্রায় হাজার বছর আগের। খৃষ্টানদের অধীন ছিলো রোম সাম্রাজ্য। তার চারপাশে রয়েছে মিশর, ইরান, সিরিয়া এবং আরও কতকগুলো মুসলিম দেশ। খৃষ্টানরা মুসলিম দেশগুলো দখল করে নিতে চেয়েছিলেন। মাঝে মাঝে রোমক সৈন্যরা মুসলিম দেশগুলোতে এসে হানা দিতো, লুটপাট করতো।
সেই সময় বাগদাদের শাসক ছিলেন মুসলমান। আব্বাসীয় বংশের বলে তাঁরা পরিচিত ছিলেন। অত্যন্ত শক্তিশালী ছিলেন তাঁরা। অতি অল্প সময়ের মধ্যে তাঁরা অনেক দেশ জয় করে নেন। ফলে বহু দূর পর্যন্ত তাঁদের রাজ্যের সীমা বেড়ে যায়। কিন্তু সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দিক থেকে তাঁরা ছিলেন দুর্বল। সব সময় আরাম-আয়েশ, আমোদ-প্রমোদ, জাঁকজমক ও বোগ বিলাসের মধ্যে তাঁরা পড়ে থাকতেন। তাঁরা ইসলামের আদর্শ থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিলেন।
ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য এ সময়ে এক শ্রেণীর মুনাফিক এক আন্দোলন গড়ে তোলে। তাদের এ আন্দোলন কারামতি আন্দোলন নামে পরিচিত। তাদের কাছে নামায, রোজা, হজ্জ ও যাকাতের কোন মূল্যই ছিলো না। তারা বলে বেড়াতো, আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন। নামায পড়লেই যে আল্লাহ খুশী হবে, তা নয়।তাদের কাছে সুদ, ঘুষ, হালাল-হারামের কোন পার্থক্য ছিলো না। মদ-নেশা, খুন-জখম, লুটতরাজ-সব কিছুই তাদের কাছে জায়েয ছিলো।
মুসলমান সমাজে যখন এমনি দুর্দিন, ঠিক সেই সময় আমাদের মহানবী হযতর মুহাম্মদ (সা)-এর বংশে হযতর আবদুল কাদির (রঃ) জন্মগ্রহণ করেন। পারস্যের জিলান শহর ছিলো তাঁর জন্মস্থান। জিলান শহরে জন্ম হওয়ার জন্য তাঁর নামের শেষে জিলানী বলা হয়।
হযরত আবদুল কাদির জিলানী (রঃ)-এর মায়ের নাম ছিলো হযরত সাইয়েদ উম্মুল খায়ের ফাতিমা (রঃ)। মা ছিলেন খুবই পরহেজগার মহিলা। সব সময় পাক পবিত্র থাকতেন। সময় পেলেই কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করতেন। হযরত আবদুল কাদির (রঃ) মার পাশে বসে তা শুনতেন। অবাক হওয়ার কথা, মায়ের কুরআন তিলাওয়াত শুনেই তিনি পাঁচ বছর বয়সের সময়েই কুরআনের আঠারো পারা মুখস্ত করে ফেললেন।
পাঁচ বছর যখন বয়স তাঁর, তখন তিনি মক্তবে ভর্তি হন। তিনি পড়াশোনায় খুবই মনোযোগী ছিলেন। ফলে অল্প বয়সেই তিনি অনেক কিছু শিখে ফেলেন। অন্য ছাত্ররা সাত দিনে যতোটুকু পড়া আয়ত্ত করতো, তিনি দু’একদিনের মধ্যে তা শিখে ফেলতেন।
সম্পূর্ণ কুরআন মুখস্থ করা ছাড়াও হাদীস শরীফ পাঠেও তিনি অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দেন। তিনি যখন যে বিষয়ে পড়াশোনা করতেন, তা শেষ না করে অবসর নিতেন না। শিক্ষকদের নানা রকম প্রশ্ন করতেন। শিক্ষকগণ তাঁর জ্ঞান পিপাসা ও প্রতিভা দেখে অবাক হয়ে যেতেন। অল্প বয়সেই ভালো ছাত্র হিসেবে তাঁর সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। শুধুমাত্র মক্তবের বই পড়েই তিনি সন্তুষ্ট থাকতেন না, জীবন, জগৎ ও প্রকৃতি সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করতেন।
মক্তবের পাঠ শেষ না করতেই তাঁর পিতা ইনতিকাল করেন। তখন সংসারের সমস্ত ভার এসে পড়ে তাঁর উপর। কিন্তু সংসারের চাপ শিক্ষার আগ্রহকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। সময়মত সংসারের কাজকর্ম শেষ করে আবার লেখাপড়ায় ডুবে যেতেন তিনি।
হযরত আবদুল কাদির জিলানী (রঃ) ছোটবেলা থেকেই একটু ভিন্ন প্রকৃতির ছিলেন। একা এবং নিরিবিলিতে থাকতেই যেনো তাঁর বেশী ভালো লাগতো। মাঝে মধ্যে তিনি চুপচাপ বসে কি যেতো ভাবতেন! ধর্মের প্রতি তাঁর প্রবল ঝোঁক ছিলো। ধর্মের খুঁটিনাটি বিষয় তিনি সযত্নে মেনে চলতেন। তিনি স্বল্পভাষী ছিলেন। ঝগড়া করা, বাজে তর্ক করা তিনি কখনো পছন্দ করতেন না। সব সময় সত্য কথা বলতেন তিনি। তাঁর ভালো ব্যবহার জ্ঞান ও বুদ্ধি দেখে সবাই ছিলো মুগ্ধ। সবাই তাঁকে সম্মান করতো-ভালবাসতো।
হযরত আবদুল কাদির জিলানী (রঃ) যখন গ্রামের মক্তবের পাঠ শেষ করলেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র সতের বছর। এবার তাঁর উচ্চ শিক্ষার পালা। তিনি নিয়্যত করলেন বাগদাদে গিয়ে নিযামিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হবেন। জিলান শহর থেকে বাগদাদ চারশ’ মাইলের পথ। তখণকার দিনে পায়ে হেঁটে পথ চলতে হতো। কারণ বর্তমানের মত গাড়ী ঘোড়া তখন ছিলো না।
মা তাঁকে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য বাগদাদ যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। আল্লাহ মেহেরবান। দেখতে দেখতে সুযোগ এসে গেলো। তিনি এক কাফেলার সন্ধান পেলেন। কাফেলার সবাই সওদাগর। জিলান শহর থেকে বাগদাদে যাচ্ছেন। তিনি তাদের সাথে যাত্রা শুরু করলেন। বিদায় দেওয়ার সময় মা তাঁকে কয়েকটি কথা সম সময় মনে রাখতে বললেনঃ প্রথমত, বিপদে-আপদে সুখে-দুঃখে সব সময় আল্লাহর উপর ভরসা রাখবে। দ্বিতীয়ত, কখনো মিথ্যা কথা বলবে না। সত্যবাদিতা মুক্তি দান করে এবং মিথ্য ধ্বংস করে –এই হাদীসটি সব সময় স্মরণ রাখবে। পরে মা খরচ বাবদ চল্লিশটি মোহর দিয়ে তাঁকে বিদায় দিলেন।
বাগদাদ যাত্রার তৃতীয় দিন। গভীর রাত। কাফেলায় ডাকাত পড়লো। ডাকাতরা যার কাছে যা পেলো সবই কেড়ে নিলো। কিছুক্ষণ পর একজন ডাকাত এসে তাঁকে বললোঃ ওহে! তোমার কাছে কোন কিছু আছে কি? তিনি নির্ভয়ে সত্য কথা বললেনঃ হ্যাঁ, আমার কাছে চল্লিশটি সোনার মোহর আছে। ডাকাতটি অবাক হয়ে বললোঃ সত্যি কথা বলতে গেলে কেনো? তুমি না বললে তো আমরা তোমার মোহরের কথা জানতেই পেতাম না। তিনি বললেনঃ মা’র আদেশ, হাজার বিপদে পড়লেও যেনো মিথ্যে কথা না বলি। তা’ছাড়া আল্লাহ তো সবই জানেন এবং দেখেন। তাঁর তো অজানা কিছুই নেই। আল্লাহকে তো আর ফাঁকি দিতে পারি না!
ডাকাতের সরদার অবাক। সত্যের জন্য এতো ত্যাগ স্বীকার! সাথে সাথে পাপ কাজ ছেড়ে দিলো ডাকাত সরদার আর সাথীরা। তাঁর সাথে এই ডাকাত সরদার একদিন আল্লাহর ওলী হয়েছিলেন।
হযরত আবদুল কাদির জিলানী (রঃ)-এর বয়স তখন আঠারো বছর। জ্ঞান লাভের জন্য বাগদাদে এসে হাজির হলেন। বাগদাদের নিযামিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হলেন তিনি। মনের সমস্ত দরদ আর ভালোবাসা ঢেলে দিলেন তিনি জ্ঞান সাধনায়। কিন্তু এখানেও বিপদ তাঁর পিছু ছাড়লো না। বাগদাদে আসার পরপরই তিনি অর্থ কষ্টে পড়রেন। এমনি অর্থ কষ্টের মধ্যে থেকেও তিনি তিল তিল করে অনেক জ্ঞান অর্জন করলেন। কুরআন, হাদীস, তফসীর, ফিকাহ, দর্শন, ইতিহাস, ব্যাকরণসহ নানা বিষয়ে তিনি জ্ঞান অর্জন করলেন। সুনাম ও কৃতিত্বের সাথে তেরটি বিষয়ে তিনি সনদ লাভ করলেন।
আরো অনেক বিষয়ে জ্ঞান লাভের ইচ্ছা ছিলো তাঁর। কিন্তু বালক আবদুল কাদির (রঃ)-এর হাতে কোন টাকা পয়সা নেই। এই অবস্থায় কি করবেন বুঝে উঠতে পারলেন না। অর্থের অভাবে যতই দিন যায় তাঁর কষ্টও বেড়ে চলে। এভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কখনো খেয়ে, কখনো না খেয়ে কাটাতে হয়। না খেয়ে তাঁর শরীর ভেংগে পড়তে থাকে। কিন্তু তাঁর সাহস ছিলো অনেক। এতো দুঃখ কষ্টে থেকেও মনোবল হারান নি। এতো অভাব অনটনে থেকেও কখনো কারো কাছে হাত পাতেননি। অভাবের কথা বলে কারো কাছ থেকে সাহায্য নেবেন এটা তিনি পছন্দ করতেন না। ভিক্ষা করাকে তিনি মনে প্রাণে ঘৃণা করতেন।
হযরত আবদুল কাদির (রঃ)-এর পোশাক-আশাক ছিলো খুবই সাধারণ। কিন্তু পোশাক সাধারণ হলে কি হবে? তাঁর মন ছিলো খুবই উদার ও অসাধারণ। দয়া-মায়া, স্নেহত-মততায় তাঁর অন্তর ছিলো ভরা। হাজার দুঃখ কষ্টের মধ্যেও অন্যকে সাহায্য করতেন। নিজের ভবিষ্যতের দিনগুলো কিভাবে কাটবেতা তিনি কখনো ভাবতেন না। তাঁর সব কিছু অন্যের জন্য দান করে আনন্দ পেতেন। এমনিভাবে বালক আবদুল কাদির (রঃ) আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অসীম রহমতে জীবনে হতে পেরেছিলেন গাউসুল আযম বা বড়ো পীর।
বালক আবদুল কাদির (রঃ)-এর জীবনের একটি ঘটনা।
একবার বাগদাদে ভিষণ দুর্ভিক্ষ দেখা দিলো। খাদ্যদ্রব্যের খুবই অভাব। যারা গরীব, নিরাশ্রয় এবং বিদেশী তাদের অবস্থা খারাপ হয়ে উঠলো। কে দেবে তাদের খাবার? কে দেবে একটু আশ্রয়? এ সময় বালক আবদুল কাদির (রঃ)-এর অবস্থাটাও ভালো যাচ্ছিলো না। তিনি কয়েক দিন অনাহারে থাকলেন। খাবারের জন্য হন্যে হয়ে ফিরতে লাগলেন তিনি। কিন্তু শহরের কোথাও খাবার পেলেন না। কোথাও খাবার না পেয়ে নিরুপায় হয়ে তিনি দজলা নদীর দিকে ছুটলেন। সেখানে যদি কোন ফলমূল, শাক-শবজি পাওয়া যায়, এই আশায়। কিন্তু নদী তীরে এসেও তিনি হতাশ হলেন। সেখানে তাঁর মতো আরো অনেক লোক এসেছে। সবাই ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির হয়ে খাবার খুঁজে বেড়াচ্ছে। সবাই ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির হয়ে খাবার খুঁজে বেড়াচ্ছে।
হযরত আবদুল কাদির (রঃ) উপায় না দেখে ফিরে এলেন। ক্ষুধার জ্বালায় পা আর চলে না। মুখ দিয়ে কোন কথা সরে না। আল্লাহর কুদরতি খেলা কে বুঝতে পারে। হঠাৎ সামনে দেখতে পেলেন একটি মসজিদ। সেই মসজিদে আল্লাহর নাম নিয়ে তিনি ঢুকে পড়লেন। মসজিদের এক কোণে ক্লান্ত শরীরে বসে রইলেন।
কিছুক্ষণ পরে এক অচেনা যুবক এসে ঢুকলো মসজিদে। তার হাতে কিছু রুটি আর গোশত। মসজিদে বসে সে খাবার বের করে খেতে লাগলো।
তার দিকে বালক আবদুল কাদির (রঃ)-এর নজর পড়লো। গোশত রুটি খাওয়ার জন্যে তাঁরও খুব ইচ্ছে হলো। পরক্ষণেই তিনি ভাবলেন, না, পরের খাবার ও পরের জিনিসের প্রতি লোভ করা গোনাহর কাজ। তিনি একথা ভেবে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন অন্য দিকে এবং মনে মনে খুব লজ্জিতও হলেন।
আগন্তুক যুবকটি আবদুল কাদির (রঃ)-কে খাবারে শামিল হওয়ার জন্য আহবান জানালো। বললোঃ আসুন, খাবারে শরীক হোন। যা কিছু আছে, দুজনে ভাগ করে খাই।
তিনি মনে মনে খুব খুশি হলেন যুবকটির উদারতা দেখে। কিন্তু তিনি তাঁর আদর্শ থেকে নড়লেন না। পরের জিনিস তিনি খাবেন না। যুবকটিও নাছোড়বান্দা। বার বার সে হযরত আবদুল কাদির (রঃ)-কে খাবার জন্য অনুরোধ করতে লাগলো। অবশেষে রাজী না হয়ে তিনি পারলেন না। বার বার কেউ যদি অনুরোধ জানায় আর সে অনুরোধ না রাখা হয় তাহলে বেয়াদবী হয়। তিনি সেই কথা ভেবে যুবকটির সঙ্গে খাবার খেতে বসলেন।
দুজনে খেতে অনেক কথা হলো। যুবকটি এক সময় হযরত আবদুল কাদির (রঃ)-কে জিজ্ঞেস করলোঃ আপনি কোথা থেকে এসেছেন ভাই? এখানে কি করেন? হযরত আবদুল কাদির (রঃ) বললেনঃ আমার বাড়ী জিলানে এখানার নিযামিয়া মাদ্রাসায় লেখাপড়া করি। যুবকটি পরম আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করলোঃ আপনি কি আবদুল কাদিরকে চেনেন? সেও নিযামিয়া মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে।
হযরত আবদুল কাদির (রঃ) জবাব দিলেনঃ আমারই নাম আবদুল কাদির। কিন্তু আপনি কেন তাঁকে খুঁজছেন? তাঁর পরিচয় পেয়ে যুবকটি আদবের সাথে বললোঃ জনাব, আমার বাড়ীও জিলানে। বাগদাদে আসার সময় আপনার মা আমার কাছে আটটি দিনার দিয়েছিলেন আপনাকে দেওয়ার জন্য। কিন্তু বাগদাদে এসে বহু খোঁজ করেও আপনাকে পাইনি। ইতিমধ্যে আমার নিজের টাকা পয়সাও শেষ হয়ে যায়, দুই দিন ধরে কিছুই খেতে পারি নি। ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে অবশেষে আপনার জন্য আনা দীনার থেকে কিছু খরচ করে এই খাবার কিনেছি। আমানতের খেয়ানত করে আমি মহাগুণাহর কাজ করেছি। আপনি আমাকে মাফ করে দিন। এই বলে যুবকটি বাকী দীনারগুলো তাঁকে দিয়ে দিলো।
অর্ধাহারে অনাহারে যিনি দিন কাটাচ্ছেন, যাঁর কাছে খাবার কেনার মতো একটি পয়সা নেই, তাঁর কাছে এই ক’টি দীনারের মূল্য অনেক। দীনারগুলো পেয়ে হযরত আবদুল কাদির জিলানী (রঃ) আল্লাহর শোকর আদায় করলেন। যুবকটিকে নানান কথা বল সান্তনা দিলেন। শুধু তাই নয়, যাবার সময় পথ খরচের জন্য যুবকটির হাতে কয়েকটি দীনারও তুলে দিলেন। এমনি উদার এবং স্নেহশীল ছিলেন আবদুল কাদির (রঃ)-এর অন্তর। তাঁর ধৈর্য শক্তি ছিলো অনেক মজবুত। শত অভাব শত বিপদের মধ্যেও তিনি সবর করেছেন। কোনো অবস্থাতেই ভেঙ্গে পড়েন নি।
হযরত আবদুল কাদির জিলানী (রঃ) ছিলেন খুবই উদার। সুন্দর ছিলো তাঁর আচার ব্যবহার, নির্মল ছিলো তাঁর চরিত্র। কুরআন ও হাদীসের নিয়মনীতি তিনি নিষ্ঠার সংগে মেনে চলতেন। জীবনকে গড়ে তুলেছিলেন রসূল (সঃ)-এর মহান আদর্শের অনুকরণে। একজন খাঁটি মুসলমানের সকল গুণই ছিলো তাঁর মধ্যে। এজন্য সবাই তাঁকে সমমআন করতো, ভালবাসতো। তাঁর কথা-বার্তা ছিল খুবই মিষ্টি। আপনজনের মতো সকলের সাথে তিনি কথা বলতেন। সবাইকে তিনি ভালবাসতেন। কারোও মনে কষ্ট দিতেন না।
বাড়ীতে মেহমান এলে কখনো তিনি মেহমানকে রেখে একা খাবার খেতেন না। তিনি গরবি দুঃখীদের সাথে অন্তরঙ্গভাবে মিশতেন। মুরুব্বীদের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করা ও অল্প কিছুতেই শোকর আদায় করা ইসলামের নিয়ম।
একবার তিনি কোন এক কাজে কোথাও যাচ্ছিলেন। কতগুলো শিশু তখন রাস্তার উপর খেলা করছিলো। হঠাৎ একটি শিশু দৌড়ে এসে তাঁকে বললোঃ আমাকে কিছু মিঠাই কিনে দাও। তিনি হাসি মুখে শিশুটির আবদার রক্ষা করলেন এবং তখনই তাঁকে এক পয়সার মিষ্টি কিনে দিলেন। তাই দেখে অন্য শিশুরাও তাঁর কাছে মিষ্টির আব্দার করলো। তিনি বিন্দুমাত্র রাগ না করে হাসি মুখে এক এক করে সবাইকে মিষ্টি কিনে দিলেন। আমাদের প্রিয়নবী (সঃ)-এর কথা –যে ব্যক্তি বড়োদের সম্মান করে না এবং ছোটদের স্নেহ করে না, সে রসূল (সঃ)-এর উম্মত নয়। হযরত আবদুল কাদির জিলানী (রঃ) রসূল (স)-এর এই শিক্ষা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন।
তিনি গরীব দুঃখীদেরকে মুক্ত হস্তে দান করতেন। তাঁর কাছে কেউ কিছু চাইলে তাকে কখনো খালি হাতে ফেরাতেন না। তিনি নিজের চেয়ে পরের দুঃখ কষ্টের কথা ভাবতেন বেশী। হযরত আবদুল কাদির জিলানী (রঃ) খুব কম কথা বলতেন। বেশী কথা বলা তিনি মোটেই পছন্দ করতেন না। তাঁর বিশ্বাস ছিলো প্রতিটি কথা ও কাজের জন্যই আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। কারো উপর তিনি রাগ করতেন না। কারো মনে কষ্ট হয় এমন কথা বলতেন না। তিনি সব সময় সত্য কথা বলতেন।হাজার মসিবতে পড়লেও মিথ্যে কথা বলতেন না। আবার উচিত কথা বলতে কাউকে ছাড়তেন না, সে রাজা-বাদশাহ, উযির-নাযির যিনিই হোন না কেন, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে কখনো ভয় পেতেন না।
হযরত আবদুল কাদির জিলানী (রঃ) অহংকারী ছিলেন না। তিনি জানতেন অহংকারীকে আল্লাহ পছন্দ করেন না। বড়ো ভেবে অহংকার করা গুনাহর কাজ।তাঁর নিজের কাজ অন্য কেউ করে দিক –এটাও তিনি পছন্দ করতেন না। নিজের কাজ তিনি নিজ হাতেই করতেন।
এমনিভাবে সহজ ও সরল জীবন যাপন করতেন আর জ্ঞান সাধনার দ্বারা মুসলমান সমাজের অনেক উপকার করেছেন। তাঁর বাণী ও উপদেশ অনুসরণ করে অনেক মানুষ মুসলমান হয়েছেন। তোমরা যদি বড়ো হয়ে তাঁর উপদেশ ও আদর্শ নিজের জীবনে প্রতিফলিত কর, তাহলে তোমরাও সকলের নিকট সমাদ্রিত হবে।
তাঁরকয়েকটি বাণী এখন থেকে মনে রাখার চেষ্টা করোঃ
তিনি বলতেনঃ একজ মানুষ যদি ষাট বছর বাঁচে, হিসেব করলে দেখা যাবে তারজীবনের তিন ভাগের এক ভাগ কুড়ি বছর শুধু সে ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। অথচ কুড়ি বছরে অনেক ভালো কাজ করা তার পক্ষে সম্ভব হতো। তাই যতদূর সম্ভব ঘুম কম করে চলা উচিত। জেগে থাকার মধ্যেই সকল প্রকার আলসেমী আর দুষ্ট বুদ্ধি লুকিয়ে থাকে।
তিনি বলতেনঃ
বেশী খাওয়া কখনো ভালো নয়। এতে শরীর খারাপ হয়, মনও নিস্তজ হয়ে পড়ে। যারা প্রয়োজনের চেয়ে বেশী খাবার খায় তারা যেনো নিজের দাঁত দিয়ে নিজের কবর তৈরী করে। যে বেশী খায়, গান করে এবং ঘুমায়, সে সমস্ত ভালো কাজ থেকে দূরে সরে যায়। মানুষের মনে রাখা উচিত যে, সে বাঁচার জন্য খায়, খাওয়ার জন্য বাঁচে না।
তিনি বলতেনঃ সাধারণত লক্ষ্য করা যায় যে হিংসা করা মানুষের স্বভাব। ধন দৌলতের জন্য, মান সম্মানের জন্য অথবা অন্য কোন অপরের ধন-দওলত দেখে হিংসা পুষণ করে। হে ঈমানদারগণ! তোমরা কেন অপরের ধন-দওলত দেখে হিংসা পোষণ করো? তোমরা কি জানো না যে, এ ধরনের হিংসা তোমাদের ঈমানকে দুর্বল করে দেয়। রসূল করীম (সঃ) বলেছেনঃ আগুন যেমনভাবে কাঠকে পুড়িয়ে ছাইকরে দেয়, হিংসাও তেমনি সকল সৎ গুণাবলী ধ্বংস করে দেয়।
হযরত আবদুল কাদির জিলানী (রঃ) বলতেনঃ একজন খাঁটি মুসলমানের অনেক গুলো গুণ থাকতে হবে।
যেমনঃ
ক. কখনো আল্লাহর নামে কসম করবে না।
খ. মিথ্যে থেকে সর্বক্ষণ দূরে থাকবে। এমন কি হাসি তামাশা করেও কখনো মিথ্যে কথা বলবে না।
গ. যা ওয়াদা করবে, জীবন গেলেও তা পালন করবে।
ঘ. কাউকে কখনো বদদোয়া করবে না, অভিশাপ দেবে না।
ঙ. কারো ক্ষতির কথা চিন্তা করবে না।
চ. জীবিকার জন্যে একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করবে।
ছ. কোন ব্যাপারেই এক আল্লাহ ছাড়া কারো উপর ভরসা করবেনা।
জ. আল্লাহই হবেন তোমার একমাত্র ভরসাস্থল।
ঝ. তোমার কথাবার্তা, চরাফেরা ও আচার-ব্যবহার হবে সব সময় বিনীত ও নম্র।
ঞ. আল্লাহর রসূল (সঃ)-এর আদেশ-নির্দেশ সব সময় মেনে চলবে।
হযরত আবদুল কাদির জিলানী (রঃ)-এর মধ্যে এই সকল গুণাবলী বিদ্যমান ছিলো পরিপূর্ণ ভাবে। তিনি ইসলামের নিয়ম নীতি অনুসরণ করে সহজ সরল জীবন যাপন করতেন বলেই তো তিনি সারা মুসলিম জাহানে সকলের শ্রদ্ধার পাত্র হয়েছিলেন। আল্লাহর মাহবুব বান্দা হয়ে তিনি দুনিয়া জোড়া খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সবাই তাকে সম্মান করে ডাকতো বড়ো পীর বলে।
সত্যিই তিনি ছিলেন বড়ো পীর হযরত আবদুলকাদির জিলানী (রঃ)।