১৬।
হারুন (আঃ)
কি তাঁর পরিচয়?
নাম হারুন। তিনি আল্লাহর একজন রাসুল। মুসা কালিমুল্লাহ (আঃ) এর বড় ভাই। তিন বছরের বড় তিনি মুসার চেয়ে। আল্লাহ যখন মুসা (আঃ) কে রাসুল নিয়োগ করেন, তখন তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন তিনি যেনো তাঁর ভাই হারুনকেও রাসুল নিয়োগ করে তাঁর হাত শক্ত করেন। আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করেন এবং হারুনকে মুসার সহযোগী রাসুল নিয়োগ করেন। হযরত হারুন ছিলেন বনী ইসরাইলদের শ্রেষ্ঠ রাসুলগনের একজন। তিনি ছিলেন সুবক্তা।
দাওয়াতী ও সাংগঠনিক জীবন
মহান আল্লাহ বলেন –
“আমি মূসা ও হারুনের প্রতি অনুগ্রহ করেছি। তাঁদের উভয়কে আমি উদ্ধার করেছি মহাকষ্ট থেকে। আমি তাঁদের সাহায্য করেছি। ফলে তারা বিজয়ী হয়েছে। তাঁদের আমি সঠিক পথ দেখিয়েছি। তাঁদের উভয়কে আমি সুস্পষ্ট কিতাব দান করেছি। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তাঁদের উভয়ের সুনাম অক্ষুন্ন রেখেছি। মুসা ও হারুনের প্রতি বর্ষিত হোক সালাম। এভাবেই আমি উপকারী লোকদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। আসলে ওরা দু’জনেই ছিলো আমার প্রতি বিশ্বস্ত দাস।” (সূরা আস সাফফাত, আয়াত ১১৪-১২২)
আল্লাহর এ বানী থেকে হযরত হারুনের সঠিক মর্যাদা বুঝা যায়। তিনি ভাই মুসার সাথে ফেরাউনের দরবারে উপস্থিত হন। ফেরাউনকে দাওয়াত প্রদান করেন। ফেরাউন তাঁদের দুজনকেই মিথ্যাবাদী বলে অস্বীকার করে। সে বলে, এরা দুই ভাই রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার জন্যে এসেছে। অতপর ফেরাউন হযরত মুসা ও হারুন দুজনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। অতপর মুসা ও হারুনের সাথে ফেরাউনের যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত হয়, তাঁর পরিনতিতে আল্লাহ ফেরাউনকে ধংস ও নির্মূল করে দেন। ফেরাউন ডুবে মরার পর সিনাই উপত্যকায় থাকাকালে হযরত মুসা হযরত হারুনকে নিজের খলিফা বা ভারপ্রাপ্ত নেতা মনোনীত করে চল্লিশ দিনের জন্যে তূর পাহাড়ে নির্জনবাসে যান। হযরত হারুন ভারপ্রাপ্ত নেতা থাকাকালেই সামেরি গ-বাছুর বানিয়ে সেটার পূজা করতে বলে সকলকে। হারুন তাঁকে বারন করেন। এ ব্যাপারে তিনি কঠোর পদক্ষেপ নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জাতি দ্বিধাবিভক্ত হবার উপক্রম হয়ে পড়ায় তিনি সেই পদক্ষেপ নেননি। হযরত মুসা চল্লিশ দিন পর তাওরাত নিয়ে ফেরত এসে হযরত হারুনের উপর ক্রোধান্বিত হন। এ ঘটনাটি কুরআনে এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে –
“(গ-বাছুর পুজাকরতে নিষেধ করে) হারুন তাঁদের বলেছিলো, হে আমার জাতি তোমরা তো পরীক্ষায় পড়েছো। তোমাদের প্রভু বড় করুনাময়। কাজেই তোমরা আমার অনুসরন করো এবং আমার নির্দেশ মানো। কিন্তু তারা তাঁকে বলে দিলো মুসা ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা এর পূজা করবো। মুসা ফিরে এসে বললো- হে হারুন তুমি যখন দেখলে এরা পথভ্রষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তখন এদেরকে আমার অনুসরনের পথে আনতে তোমাকে কিসে বাধা দিয়েছে? তুমি কি আমার হুকুম অমান্য করলে? হারুন বললো- হে আমার সহোদর ভাই, আমার দারি ও চুল ধরে টেনোনা। আমার ভয় হচ্ছিলো তুমি এসে বলবে- হারুন তুমি কেন বনী ইসরাইলদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করলে? কেন আমার কথা রক্ষা করোনি।” (সূরা তোয়াহা, আয়াত ৯০-৯৪)
অন্যস্থানে বলা হয়েছে-
“মুসা নিজের ভাইয়ের চুল ধরে টানলো। হারু বললো – হে আমার সহোদর, এই লোকগুলো আমায় কোণঠাসা করে ফেলেছিলো এবং আমাকে হত্যা করার জন্যে উদ্যত হয়েছিলো। কাজেই তুমি শত্রুদের কাছে আমায় হেয় করোনা এবং আমাকে যালিম গণ্য করোনা। তখন মুসা দোয়া করলো – হে প্রভু, আমাকে আর আমার ভাইকে ক্ষমা করে দাও। আর আমাদেরকে রবেশ করাও তোমার অনুগ্রহের মধ্যে। তুমিই তো সব দয়াবানের বড় দয়াবান।” (সূরা আল আরাফ, আয়াত ১৫০-১৫১)
এ থেকে বুঝা যায়, হযরত হারুন জীবনের ঝুকি নিয়েও নিজ কওমকে সত্য পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করেছিলেন। তবে জাতির মধ্যে অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টি হোক এটা তিনি চাননি। আসলে তিনি ছিলেন বড়ই প্রজ্ঞাবান ও মহান রাসুল।
হযরত মুসা (আঃ) এর মৃত্যুর এগারো মাস পূর্বে তিনি ইন্তেকাল করেন। ভাই মুসার মতই তিনি ছিলেন একজন বলিষ্ঠ সংগ্রামী পুরুষ। তারা দুই ভাই নেতৃত্ব প্রদান করেন এক বিশাল জাতির।
আল কুরআনে হযরত হারুন
আল কুরআনে হযরত হারুনের নাম ২০ বার উল্লেখ করা হয়েছে। যেসব স্থানে উল্লেখ হয়েছে, সেগুলো হলো –
আল বাকারা- ২৪৮। আন নিসা- ১৬৩। আল আনয়াম- ৮৪। আল আরাফ- ১২২, ১৪২। ইউনুস- ৭৫। মারিয়াম- ২৮, ৫৩। তোয়াহা- ৩০, ৭০, ৯০, ৯২। আল আম্বিয়া- ৪৮। আল মুমিনুন- ৪৫। আলফুরকান – ৩৫। আশ শুয়ারা- ১৩, ৪৮। আল কাসাস- ৩৪। আস সাফফাত- ১১৪, ১২০।
১৭।
সম্রাট নবী দাউদ
(আঃ)
দাউদ (আঃ) এর নাম তো আপনারা সবাই জানেন। মহান আল্লাহ তাঁকে দান করেছিলেন বিরাট মর্যাদা। তাঁকে অধিকারী করেছিলেন অনেক গুনাবলীর। তিনি ছিলেন একাধারে-
১। বিরাট উচ্চ মর্যাদার নবী।
২। তাঁর উপর নাযিল হয়েছিলো ‘যবুর’ কিতাব।
৩। তিনি ছিলেন অসীম সাহসী বীর সেনানী।
৪। তিনি ছিলেন এক বিরাট সাম্রাজ্যের সম্রাট।
৫। তিনি ছিলে একজন সফল বিজ্ঞানী ও আবিষ্কারক।
৬। ছিলেন মহাজ্ঞানী, ন্যায় বিচারক।
৭। তিনি ছিলেন মুমিনদের নেতা।
৮। ছিলেন আল্লাহর আইনের শাসক। শাসন পরিচালনা করতেন আল্লাহর অবতীর্ণ বিধানের ভিত্তিতে।
৯। তিনি ছিলেন আকর্ষণীয় সুবক্তা ও সুভাষী।
১০। পাখি ও পর্বত তাঁর সাথে আল্লাহর তসবিহতে মশগুল থাকতো।
১১। তিনি ছিলেন পরম জনদরদী, জনসেবক।
১২। মহান আল্লাহ প্রাকৃতিক জগতের অনেক কিছুকেই তাঁর অনুগত করে দিয়েছিলেন।
১৩। তিনি ছিলে পরম আল্লাহভীরু, আল্লাহওয়ালা।
১৪। তিনি ছিলে একজন নবীর পিতা। তাঁর পুত্র সুলাইমানকেও আল্লাহ নবুয়্যত দান করেছিলেন।
১৫। আল কুরআনে স্বয়ং আল্লাহ তাঁর উচ্চসিত প্রশংসা করেছেন।Powerd Bangladesh |
বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হযরত দাঊদ
বিপুল শক্তি ও রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী নবী ছিলেন মাত্র দু’জন। তাঁরা হ’লেন পিতা ও পুত্র দাঊদ ও সুলায়মান (আঃ)। বর্তমান ফিলিস্তীন সহ সমগ্র ইরাক ও শাম (সিরিয়া) এলাকায় তাঁদের রাজত্ব ছিল। পৃথিবীর অতুলনীয় ক্ষমতার অধিকারী হয়েও তাঁরা ছিলেন সর্বদা আল্লাহর প্রতি অনুগত ও সদা কৃতজ্ঞ। সে কারনে আল্লাহ তার শেষ নবীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘তারা যেসব কথা বলে তাতে তুমি ছবর কর এবং আমার শক্তিশালী বান্দা দাঊদকে স্মরণ কর। সে ছিল আমার প্রতি সদা প্রত্যাবর্তনশীল’ (ছোয়াদ, আয়াত ৩৮)। দাঊদ হলেন আল্লাহর একমাত্র বান্দা, যাকে খুশী হয়ে পিতা আদম স্বীয় বয়স থেকে ৪০ বছর কেটে তাকে দান করার জন্য আল্লাহর নিকটে সুফারিশ করেছিলেন এবং সেমতে দাঊদের বয়স ৬০ হ’তে ১০০ বছরে বৃদ্ধি পায়।
জালূত ও তালূতের কাহিনী এবং দাঊদের বীরত্ব
সাগরডুবি থেকে নাজাত পেয়ে মূসা ও হারূণ (আঃ) যখন বনু ইস্রাঈলদের নিয়ে শামে এলেন এবং শান্তিতে বসবাস করতে থাকলেন, তখন আল্লাহ তাদেরকে তাদের পিতৃভূমি ফিলিস্তীনে ফিরে যাবার আদেশ দিলেন এবং ফিলিস্তীন দখলকারী শক্তিশালী আমালেক্বাদের সঙ্গে জিহাদের নির্দেশ দিলেন। সাথে সাথে এ ওয়াদাও দিলেন যে, জিহাদে নামলেই তোমাদের বিজয় দান করা হবে (সূরা মায়েদা, আয়াত ২৩)। কিন্তু এই ভীতু ও জিহাদ বিমুখ বিলাসী জাতি তাদের নবী মূসাকে পরিষ্কার বলে দিল, ‘তুমি ও তোমার রব গিয়ে যুদ্ধ কর গে। আমরা এখানে বসে রইলাম’ (মায়েদা, আয়াত ২৪)। এতবড় বেআদবীর পরে মূসা (আঃ) তাদের ব্যাপারে নিরাশ হ’লেন এবং কিছু দিনের মধ্যেই দু’ভাই পরপর তিন বছরের ব্যবধানে মৃত্যু বরণ করলেন।
জিহাদের আদেশ অমান্য করার শাস্তি স্বরূপ মিসর ও শামের মধ্যবর্তী তীহ প্রান্তরে চল্লিশ বছর যাবত উন্মুক্ত কারাগারে অতিবাহিত করার পর মূসার শিষ্য ও ভাগিনা এবং পরবর্তীতে নবী ইউশা‘ বিন নূনের নেতৃত্বে জিহাদ সংঘটিত হয় এবং আমালেক্বাদের হটিয়ে তারা ফিলিস্তীন দখল করে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে তারা পুনরায় বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দেয় এবং নানাবিধ অনাচারে লিপ্ত হয়। তখন আল্লাহ তাদের উপরে পুনরায় আমালেক্বাদের চাপিয়ে দেন। বনু ইস্রাঈলরা আবার নিগৃহীত হ’তে থাকে। এভাবে বহু দিন কেটে যায়। এক সময় শ্যামুয়েল নবীর যুগ আসে। লোকেরা বলে আপনি আমাদের জন্য একজন সেনাপতি দানের জন্য আল্লাহর নিকট দো‘আ করুন, যাতে আমরা আমাদের পূর্বের ঐতিহ্য ফিরে পাই এবং বর্তমান দুর্দশা থেকে মুক্তি পাই। এই ঘটনা আল্লাহ তার শেষনবীকে শুনিয়েছেন নিম্নোক্ত ভাষায়-‘তুমি কি মূসার পরে বনু ইস্রাঈলদের একদল নেতাকে দেখনি, যখন তারা তাদের নবীকে বলেছিল, আমাদের জন্য একজন শাসক প্রেরণ করুন, যাতে আমরা (তার নেতৃত্বে) আল্লাহর পথে যুদ্ধ করতে পারি। নবী বললেন, তোমাদের প্রতি কি এমন ধারণা করা যায় যে, লড়াইয়ের নির্দেশ দিলে তোমরা লড়াই করবে? তারা বলল, আমাদের কি হয়েছে যে, আমরা আল্লাহর পথে লড়াই করব না? অথচ আমরা বিতাড়িত হয়েছি নিজেদের ঘর-বাড়ি ও সন্তান-সন্ততি হ’তে! অতঃপর যখন লড়াইয়ের নির্দেশ হ’ল তখন সামান্য কয়েকজন ছাড়া বাকীরা সবাই ফিরে গেল। বস্ত্ততঃ আল্লাহ যালেমদের ভাল করেই জানেন’ (বাক্বারাহ -২৪৬)। ঘটনাটি ছিল নিম্নরূপ:-
‘‘তাদের নবী তাদের বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তালূতকে তোমাদের জন্য শাসক নিযুক্ত করেছেন। তারা বলল, সেটা কেমন করে হয় যে, তার শাসন চলবে আমাদের উপরে। অথচ আমরাই শাসন ক্ষমতা পাওয়ার অধিক হকদার। তাছাড়া সে ধন-সম্পদের দিক দিয়েও সচ্ছল নয়। জওয়াবে নবী বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের উপরে তাকে মনোনীত করেছেন এবং স্বাস্থ্য ও জ্ঞানের দিক দিয়ে তাকে প্রাচুর্য দান করেছেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান করেন। তিনি হ’লেন প্রাচুর্য দানকারী ও সর্বজ্ঞ’। ‘নবী তাদেরকে বললেন, তালূতের নেতৃত্বের নিদর্শন এই যে, তোমাদের কাছে (তোমাদের কাংখিত) সিন্দুকটি আসবে তোমাদের প্রভুর পক্ষ হ’তে তোমাদের হৃদয়ের প্রশান্তি রূপে। আর তাতে থাকবে মূসা, হারূণ ও তাদের পরিবার বর্গের ব্যবহৃত কিছু পরিত্যক্ত সামগ্রী। সিন্দুকটিকে বহন করে আনবে ফেরেশতাগণ। এতেই তোমাদের (শাসকের) জন্য নিশ্চিত নিদর্শন রয়েছে, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও’ (বাক্বারাহ, আয়াত, ২৪৭-২৪৮)। এক্ষণে যখন বনু ইস্রাঈলগণ পুনরায় জিহাদের সংকল্প করল, তখন আল্লাহ তাদেরকে উক্ত সিন্দুক ফিরিয়ে দিতে মনস্থ করলেন। অতঃপর এই সিন্দুকটির মাধ্যমে তাদের মধ্যেকার নেতৃত্ব নিয়ে ঝগড়ার নিরসন করেন। সিন্দুকটি তালূতের বাড়ীতে আগমনের ঘটনা এই যে, জালূতের নির্দেশে কাফেররা যেখানেই সিন্দুকটি রাখে, সেখানেই দেখা দেয় মহামারী ও অন্যান্য বিপদাপদ। এমনিভাবে তাদের পাঁচটি শহর ধ্বংস হয়ে যায়। অবশেষে অতিষ্ট হয়ে তারা একে তার প্রকৃত মালিকদের কাছে পাঠিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিল এবং গরুর গাড়ীতে উঠিয়ে হাঁকিয়ে দিল। তখন ফেরেশতাগণ আল্লাহর নির্দেশমতে গরুর গাড়ীটিকে তাড়িয়ে এনে তালূতের ঘরের সম্মুখে রেখে দিল। বনু ইস্রাঈলগণ এই দৃশ্য দেখে সবাই একবাক্যে তালূতের নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করল। অতঃপর তালূত আমালেক্বাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার প্রস্ত্ততি শুরু করলেন।
সকল প্রস্ত্ততি সম্পন্ন হ’লে তিনি কথিত মতে ৮০ হাযার সেনাদল নিয়ে রওয়ানা হন। অল্প বয়ষ্ক তরুণ দাঊদ ছিলেন উক্ত সেনা দলের সদস্য। পথিমধ্যে সেনাপতি তালূত তাদের পরীক্ষা করতে চাইলেন। সম্মুখেই ছিল এক নদী। মৌসুম ছিল প্রচন্ড গরমের। পিপাসায় ছিল সবাই কাতর। এ বিষয়টি কুরআন বর্ণনা করেছে নিম্নরূপ: ‘অতঃপর তালূত যখন সৈন্যদল নিয়ে বের হ’ল, তখন সে বলল, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে পরীক্ষা করবেন একটি নদীর মাধ্যমে। যে ব্যক্তি সেই নদী হ’তে পান করবে, সে ব্যক্তি আমার দলভুক্ত নয়। আর যে ব্যক্তি স্বাদ গ্রহণ করবে না, সেই-ই আমার দলভুক্ত হবে। তবে হাতের এক আজলা মাত্র। অতঃপর সবাই সে পানি থেকে পান করল, সামান্য কয়েকজন ব্যতীত। পরে তালূত যখন নদী পার হ’ল এবং তার সঙ্গে ছিল মাত্র কয়েকজন ঈমানদার ব্যক্তি (তখন অধিক পানি পানকারী সংখ্যাগরিষ্ট) লোকেরা বলতে লাগল, আজকের দিনে জালূত ও তার সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার শক্তি আমাদের নেই। (পক্ষান্তরে) যাদের বিশ্বাস ছিল যে, আল্লাহর সম্মুখে তাদের একদিন উপস্থিত হ’তেই হবে, তারা বলল, কত ছোট ছোট দল বিজয়ী হয়েছে বড় বড় দলের বিরুদ্ধে আল্লাহর হুকুমে। নিশ্চয়ই ধৈর্যশীলদের সাথে আল্লাহ থাকেন’ (বাক্বারাহ, আয়াত ২৪৯)।
বস্ত্ততঃ নদী পার হওয়া এই স্বল্প সংখ্যক ঈমানদারগণের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩১৩ জন, যা শেষনবীর সাথে কাফেরদের বদর যুদ্ধকালে যুদ্ধরত ছাহাবীগণের সংখ্যার সাথে মিলে যায়। পানি পানকারী হাযারো সৈনিক নদী পারে আলস্যে ঘুমিয়ে পড়ল। অথচ পানি পান করা থেকে বিরত থাকা স্বল্প সংখ্যক ঈমানদার সাথী নিয়েই তালূত চললেন সেকালের সেরা সেনাপতি ও শৌর্য-বীর্যের প্রতীক আমালেক্বাদের বাদশাহ জালূতের বিরুদ্ধে। বস্ত্তবাদীগণের হিসাব মতে এটা ছিল নিতান্তই আত্মহননের শামিল। এই দলেই ছিলেন দাঊদ। আল্লাহ বলেন, ‘আর যখন তারা জালূত ও তার সেনাবাহিনীর সম্মুখীন হ’ল, তখন তারা বলল, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের ধৈর্য দান কর ও আমাদেরকে দৃঢ়পদ রাখ এবং আমাদেরকে তুমি কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সাহায্য কর’ (বাক্বারাহ, আয়াত ২৫০)। জালূত বিরাট সাজ-সজ্জা করে হাতীতে সওয়ার হয়ে সামনে এসে আস্ফালন করতে লাগল এবং সে যুগের যুদ্ধরীতি অনুযায়ী প্রতিপক্ষের সেরা যোদ্ধাকে আহবান করতে থাকল। অল্পবয়ষ্ক বালক দাঊদ নিজেকে সেনাপতি তালূতের সামনে পেশ করলেন। তালূত তাকে পাঠাতে রাযী হ’লেন না। কিন্তু দাঊদ নাছোড় বান্দা। অবশেষে তালূত তাকে নিজের তরবারি দিয়ে উৎসাহিত করলেন এবং আল্লাহর নামে জালূতের মোকাবিলায় প্রেরণ করলেন। বর্ণিত আছে যে, তিনি এ ঘোষণা আগেই দিয়েছিলেন যে, যে ব্যক্তি জালূতকে বধ করে ফিলিস্তীন পুনরুদ্ধার করতে পারবে, তাকে রাজ্য পরিচালনায় শরীক করা হবে। অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত জালূতকে মারা খুবই কঠিন ছিল। কেননা তার সারা দেহ ছিল লৌহ বর্মে আচ্ছাদিত। তাই তরবারি বা বল্লম দিয়ে তাকে মারা অসম্ভব ছিল। আল্লাহর ইচ্ছায় দাঊদ ছিলেন পাথর ছোঁড়ায় উস্তাদ। সমবয়সীদের সাথে তিনি মাঠে গিয়ে নিশানা বরাবর পাথর মারায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। দাঊদ পকেট থেকে পাথর খন্ড বের করে হাতীর পিঠে বসা জালূতের চক্ষু বরাবর নিশানা করে এমন জোরে মারলেন যে, তাতেই জালূতের চোখশুদ্ধ মাথা ফেটে মগয বেরিয়ে চলে গেল। এভাবে জালূত মাটিতে লুটিয়ে পড়লে তার সৈন্যরা পালিয়ে গেল। যুদ্ধে তালূত বিজয় লাভ করলেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর তারা আল্লাহর হুকুমে তাদেরকে পরাজিত করল এবং দাঊদ জালূতকে হত্যা করল। আর আল্লাহ দাঊদকে দান করলেন রাজ্য ও দূরদর্শিতা এবং তাকে শিক্ষা দান করলেন, যা তিনি চাইলেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ যদি এভাবে একজনকে অপরজনের দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহ’লে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহ বিশ্ববাসীর প্রতি একান্তই দয়াশীল’ (বাক্বারাহ, আয়াত ২৫১)।
দাঊদ (আঃ)-এর জীবনের স্মরণীয় ঘটনাবলী
(১) ছাগপাল ও শস্যক্ষেতের মালিকের বিচার: একদা দু’জন লোক হযরত দাঊদের নিকটে একটি বিষয়ে মীমাংসার জন্য আসে। তাদের একজন ছিল ছাগপালের মালিক এবং অন্যজন ছিল শস্য ক্ষেতের মালিক। শস্যক্ষেতের মালিক ছাগপালের মালিকের নিকট দাবী পেশ করল যে, তার ছাগপাল রাত্রিকালে আমার শস্যক্ষেতে চড়াও হয়ে সম্পূর্ণ ফসল বিনষ্ট করে দিয়েছে। আমি এর প্রতিকার চাই। সম্ভবতঃ শস্যের মূল্য ও ছাগলের মূল্যের হিসাব সমান বিবেচনা করে হযরত দাঊদ (আঃ) শস্যক্ষেতের মালিককে তার বিনষ্ট ফসলের বিনিময় মূল্য হিসাবে পুরা ছাগপাল শস্যক্ষেতের মালিককে দিয়ে দিতে বললেন। বাদী ও বিবাদী উভয়ে বাদশাহ দাঊদ-এর আদালত থেকে বেরিয়ে আসার সময় দরজার মুখে পুত্র সুলায়মানের সাথে দেখা হয়। তিনি মোকদ্দমার রায় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তারা সব খুলে বলল। তিনি পিতা দাঊদের কাছে গিয়ে বললেন, আমি রায় দিলে তা ভিন্নরূপ হ’ত এবং উভয়ের জন্য কল্যাণকর হ’ত’। অতঃপর পিতার নির্দেশে তিনি বললেন, ছাগপাল শস্যক্ষেতের মালিককে সাময়িকভাবে দিয়ে দেওয়া হউক। সে এগুলোর দুধ, পশম ইত্যাদি দ্বারা উপকার লাভ করুক। পক্ষান্তরে শস্যক্ষেতটি ছাগপালের মালিককে অর্পণ করা হউক। সে তাতে শস্য উৎপাদন করুক। অতঃপর শস্যক্ষেত্র যখন ছাগপালে বিনষ্ট করার পূর্বের অবস্থায় পৌঁছে যাবে, তখন তা ক্ষেতের মালিককে ফিরিয়ে দেওয়া হবে এবং ছাগপাল তার মালিককে ফেরৎ দেওয়া হবে’। হযরত দাঊদ (আঃ) রায়টি অধিক উত্তম গণ্য করে সেটাকেই কার্যকর করার নির্দেশ দেন। এই ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন, ‘আর স্মরণ কর দাঊদ ও সুলায়মানকে, যখন তারা একটি শস্যক্ষেত সম্পর্কে বিচার করেছিল, যাতে রাত্রিকালে কারু মেষপাল ঢুকে পড়েছিল। আর তাদের বিচারকার্য আমাদের সম্মুখেই হচ্ছিল’। ‘অতঃপর আমরা সুলায়মানকে মোকদ্দমাটির ফায়ছালা বুঝিয়ে দিলাম এবং আমরা উভয়কে প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দান করেছিলাম’ (আম্বিয়া, আয়াত ৭৮-৭৯)।
(২) ইবাদত খানায় প্রবেশকারী বাদী-বিবাদীর বিচার: হযরত দাঊদ (আঃ) যেকোন ঘটনায় যদি বুঝতেন যে, এটি আল্লাহর তরফ থেকে পরীক্ষা, তাহ’লে তিনি সাথে সাথে আল্লাহর দিকে রুজু হ’তেন ও ক্ষমা প্রার্থনায় রত হ’তেন। এরই একটি উদাহরণ বর্ণিত হয়েছে নিম্নোক্ত আয়াতগুলিতে। যেমন আল্লাহ বলেন,
‘আপনার কাছে কি সেই বাদী-বিবাদীর খবর পৌঁছেছে, যখন তারা পাঁচিল টপকিয়ে দাঊদের ইবাদতখানায় ঢুকে পড়েছিল’? (ছোয়াদ ২১) ‘যখন তারা দাঊদের কাছে অনুপ্রবেশ করল এবং দাঊদ তাদের থেকে ভীত হয়ে পড়ল, তখন তারা বলল, আপনি ভয় পাবেন না, আমরা দু’জন বিবদমান পক্ষ। আমরা একে অপরের প্রতি বাড়াবাড়ি করেছি। অতএব আমাদের মধ্যে ন্যায় বিচার করুন, অবিচার করবেন না। আমাদেরকে সরল পথ প্রদর্শন করুন’। ‘(বিষয়টি এই যে,) সে আমার ভাই। সে ৯৯টি দুম্বার মালিক আর আমি মাত্র একটি মাদী দুম্বার মালিক। এরপরও সে বলে যে, এটি আমাকে দিয়ে দাও। সে আমার উপরে কঠোর ভাষা প্রয়োগ করে’। ‘দাঊদ বলল, সে তোমার দুম্বাটিকে নিজের দুম্বাগুলির সাথে যুক্ত করার দাবী করে তোমার প্রতি অবিচার করেছে। শরীকদের অনেকে একে অপরের প্রতি বাড়াবাড়ি করে থাকে, কেবল তারা ব্যতীত, যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে। অবশ্য এরূপ লোকের সংখ্যা কম। (অত্র ঘটনায়) দাঊদ ধারণা করল যে, আমরা তাকে পরীক্ষা করছি। অতঃপর সে তার পালনকর্তার নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করল এবং সিজদায় লুটিয়ে পড়ল ও আমার দিকে প্রণত হ’ল’। অতঃপর আমরা তাকে ক্ষমা করে দিলাম। নিশ্চয়ই তার জন্য আমাদের নিকটে রয়েছে নৈকট্য ও সুন্দর প্রত্যাবর্তন স্থল’ (ছোয়াদ, আয়াত ২১-২৫)।
(৩) শনিবার ওয়ালাদের পরিণতি: বনু ইস্রাঈলদের জন্য শনিবার ছিল সাপ্তাহিক ছুটির দিন এবং ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট ও পবিত্র দিন। এ দিন তাদের জন্য মৎস্য শিকার নিষিদ্ধ ছিল। তারা সমুদ্রোপকুলের বাসিন্দা ছিল এবং মৎস্য শিকার ছিল তাদের পেশা। ফলে দাঊদ (আঃ)-এর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই তারা ঐদিন মৎস্য শিকার করতে থাকে। এতে তাদের উপরে আল্লাহর পক্ষ হ’তে ‘মস্খ’ বা আকৃতি পরিবর্তনের শাস্তি নেমে আসে এবং তিনদিনের মধ্যেই তারা সবাই মৃত্যু মুখে পতিত হয়। ঘটনাটি পবিত্র কুরআনে নিম্নরূপে বর্ণিত হয়েছে। যেমন আল্লাহ মদীনার ইহুদীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আর তোমরা তো তাদেরকে ভালভাবে জানো, যারা শনিবারের ব্যাপারে সীমা লংঘন করেছিল। আমরা তাদের বলেছিলাম, তোমরা নিকৃষ্ট বানর হয়ে যাও’। ‘অতঃপর আমরা এ ঘটনাকে তাদের সমসাময়িক ও পরবর্তীদের জন্য দৃষ্টান্ত হিসাবে এবং আল্লাহভীরুদের জন্য উপদেশ হিসাবে রেখে দিলাম’ (বাক্বারাহ, আয়াত ৬৫-৬৬)।
উক্ত বিষয়ে সূরা আ‘রাফের ১৬৪-৬৫ আয়াতের বর্ণনায় প্রতীয়মান হয় যে, সেখানে তৃতীয় আরেকটি দল ছিল, যারা উপদেশ দানকারীদের উপদেশ দানে বিরত রাখার চেষ্টা করত। বাহ্যতঃ এরা ছিল শান্তিবাদী এবং অলস ও সুবিধাবাদী। এরাও ফাসেকদের সাথে শূকর-বানরে পরিণত হয় ও ধ্বংস হয়ে যায়। যেমন আল্লাহ বলেন,
‘আর যখন তাদের মধ্যকার একদল বলল, কেন আপনারা ঐ লোকদের উপদেশ দিচ্ছেন, যাদেরকে আল্লাহ ধ্বংস করে দিতে চান কিংবা তাদের আযাব দিতে চান কঠিন আযাব? ঈমানদারগণ বলল, তোমাদের পালনকর্তার নিকট ওযর পেশ করার জন্য এবং এজন্য যাতে ওরা সতর্ক হয়’। ‘অতঃপর তারা যখন উপদেশ ভুলে গেল, যা তাদেরকে দেওয়া হয়েছিল, তখন আমরা সেসব লোকদের মুক্তি দিলাম, যারা মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করত এবং পাকড়াও করলাম যালেমদেরকে নিকৃষ্ট আযাবের মাধ্যমে তাদের পাপাচারের কারণে’ (আ‘রাফ, আয়াত ১৬৪-৬৫)।
তালূতের পরে বনু ইস্রাঈলগণের অবস্থা ক্রমেই শোচনীয় পর্যায়ে চলে যায়। যালেম বাদশাহদের দ্বারা তারা শাম দেশ হ’তে বিতাড়িত হয়। বিশেষ করে পারস্যরাজ বুখতানছর যখন তাদেরকে শাম থেকে বহিষ্কার করলেন, তখন তাদের একদল হেজাযে গিয়ে বসবাসের সিদ্ধান্ত নিল। এই উদ্দেশ্যে যে, আমরা দাঊদ ও সুলায়মানের নির্মিত বায়তুল মুক্বাদ্দাস হারিয়েছি। ফলে এক্ষণে আমরা আমাদের পূর্বপুরুষ ইবরাহীম-ইসমাঈলের নির্মিত কা‘বা গৃহের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। যাতে আমরা বা আমাদের বংশধররা শেষনবীর সাক্ষাৎ লাভে ধন্য হয়। সেমতে তারা আরবে হিজরত করে এবং ইয়াছরিবে বসবাস শুরু করে।
দাঊদ (আঃ)-এর জীবনীতে শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ
১. নেতৃত্বের জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্যবান ও আমানতদার হওয়া। আরও প্রয়োজন প্রজ্ঞা, ন্যায়নিষ্ঠা ও উন্নতমানের বাগ্মিতা। যার সব কয়টি গুণ হযরত দাঊদ (আঃ)-এর মধ্যে সর্বাধিক পরিমাণে ছিল।
২. এলাহী বিধান দ্বীন ও দুনিয়া দু’টিকেই নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে। বরং দ্বীনদার শাসকের হাতেই দুনিয়া শান্তিময় ও নিরাপদ থাকে। হযরত দাঊদ-এর শাসনকাল তার জাজ্জ্বল্যমান প্রমাণ।
৩. দ্বীনদার শাসককে আল্লাহ বারবার পরীক্ষা করেন। যাতে তার দ্বীনদারী অক্ষুণ্ণ থাকে। দাঊদ (আঃ) সে পরীক্ষা দিয়েছেন এবং উত্তীর্ণ হয়েছেন। বস্ত্ততঃ তিনি ছিলেন আল্লাহর দিকে সদা প্রত্যাবর্তনশীল।
৪. যে শাসক যত বেশী আল্লাহর শুকরগুযারী করেন, আল্লাহ তার প্রতি তত বেশী সদয় হন এবং ঐ রাজ্যে শান্তি ও সমৃদ্ধি নাযিল করেন। বস্ত্ততঃ দাঊদ (আঃ) সর্বাধিক ইবাদতগুযার ছিলেন এবং একদিন অন্তর একদিন ছিয়াম পালন করতেন।
৫. যে শাসক আল্লাহর প্রতি অনুগত হন, আল্লাহ দুনিয়ার সকল সৃষ্টিকে তার প্রতি অনুগত করে দেন। যেমন দাঊদ (আঃ)-এর জন্য পাহাড়-পর্বত, পক্ষীকুল এবং লোহাকে অনুগত করে দেওয়া হয়েছিল।
কুরআনে উল্লেখ
আল কুরআনে হযরত দাউদ (আঃ) এর নাম উল্লেখ হয়েছে ১৬ বার। কোথায় কোথায় উল্লেখ হয়েছে তা আপনাদের বলে দিচ্ছি – সূরা আল বাকারা ; ২৫১। আন নিসা ; ২৬৩। আল মায়িদা ; ৭৮। আল আনয়াম ; ৮৪। বনি ইসরাইল ; ৫৫। আল আম্বিয়া ; ৭৮, ৭৯। আন নামল ; ১৫, ১৬। সাবা ; ১০, ১৩। সোয়াদ ; ১৭, ২২, ২৪, ২৬, ৩০।
১৮।
বিশ্বের অনন্য সম্রাট সুলাইমান
(আঃ)
হযরত দাঊদ (আঃ)-এর মৃত্যুর পর সুযোগ্য পুত্র সুলায়মান তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আবির্ভাবের ন্যূনাধিক দেড় হাযার বছর পূর্বে তিনি নবী হন। সুলায়মান ছিলেন পিতার ১৯জন পুত্রের অন্যতম। আল্লাহ পাক তাকে জ্ঞানে, প্রজ্ঞায় ও নবুঅতের সম্পদে সমৃদ্ধ করেন। এছাড়াও তাঁকে এমন কিছু নে‘মত দান করেন, যা অন্য কোন নবীকে দান করেননি। ইমাম বাগাভী ইতিহাসবিদগণের বরাতে বলেন, সুলায়মান (আঃ)-এর মোট বয়স হয়েছিল ৫৩ বছর। তের বছর বয়সে রাজকার্য হাতে নেন এবং শাসনের চতুর্থ বছরে বায়তুল মুক্বাদ্দাসের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। তিনি ৪০ বছর কাল রাজত্ব করেন। তবে তিনি কত বছর বয়সে নবী হয়েছিলেন সে বিষয়ে কিছু জানা যায় না। শাম ও ইরাক অঞ্চলে পিতার রেখে যাওয়া রাজ্যের তিনি বাদশাহ ছিলেন। তাঁর রাজ্য তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে সুখী ও শক্তিশালী রাজ্য ছিল। কুরআনে তাঁর সম্পর্কে ৭টি সূরায় ৫১টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। আমরা সেগুলিকে একত্রিত করে কাহিনীরূপে পেশ করার চেষ্টা পাব ইনশাআল্লাহ।
বাল্যকালে সুলায়মান
(১) আল্লাহ পাক সুলায়মানকে তার বাল্যকালেই গভীর প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি দান করেছিলেন। ছাগপালের মালিক ও শস্যক্ষেতের মালিকের মধ্যে পিতা হযরত দাঊদ (আঃ) যেভাবে বিরোধ মীমাংসা করেছিলেন, বালক সুলায়মান তার চাইতে উত্তম ফায়ছালা পেশ করেছিলেন। ফলে হযরত দাঊদ (আঃ) নিজের পূর্বের রায় বাতিল করে পুত্রের দেওয়া প্রস্তাব গ্রহণ করেন ও সে মোতাবেক রায় দান করেন। উক্ত ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন, ‘‘আর স্মরণ কর দাঊদ ও সুলায়মানকে, যখন তারা একটি শস্যক্ষেত সম্পর্কে বিচার করছিল, যাতে রাত্রিকালে কারু মেষপাল ঢুকে পড়েছিল। আর তাদের বিচারকার্য আমাদের সম্মুখেই হচ্ছিল’। ‘অতঃপর আমরা সুলায়মানকে মোকদ্দমাটির ফায়ছালা বুঝিয়ে দিলাম এবং আমরা উভয়কে প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দান করেছিলাম’’ (আম্বিয়া, আয়াত ৭৮-৭৯)।
ছোটবেলা থেকেই জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় ভূষিত সুলায়মানকে পরবর্তীতে যথার্থভাবেই পিতার সিংহাসনের উত্তরাধিকারী করা হয়। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘‘সুলায়মান দাঊদের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন’ (নমল, আয়াত ১৬)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘‘আমরা দাঊদের জন্য সুলায়মানকে দান ‘করেছিলাম। কতই না সুন্দর বান্দা সে এবং সে ছিল (আমার প্রতি) সদা প্রত্যাবর্তনশীল’’ (ছোয়াদ, আয়াত ৩০)।
(২) আরেকটি ঘটনা হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, যা নিম্নরূপ: ‘দু’জন মহিলার দু’টি বাচ্চা ছিল। একদিন নেকড়ে বাঘ এসে একটি বাচ্চাকে নিয়ে যায়। তখন প্রত্যেকে বলল যে, তোমার বাচ্চা নিয়ে গেছে। যেটি আছে ওটি আমার বাচ্চা। বিষয়টি ফায়ছালার জন্য দুই মহিলা খলীফা দাঊদের কাছে এলো। তিনি বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলার পক্ষে রায় দিলেন। তখন তারা বেরিয়ে সুলায়মানের কাছে এলো এবং সবকথা খুলে বলল। সুলায়মান তখন একটি ছুরি আনতে বললেন এবং বাচ্চাটাকে দু’টুকরা করে দু’মহিলাকে দিতে চাইলেন। তখন বয়োকনিষ্ঠ মহিলাটি বলল, ইয়ারহামুকাল্লাহু ‘আল্লাহ আপনাকে অনুগ্রহ করুন’ বাচ্চাটি ঐ মহিলার। তখন সুলায়মান কনিষ্ঠ মহিলার পক্ষে রায় দিলেন’।
সুলায়মানের বৈশিষ্ট্য সমূহ :
দাঊদ (আঃ)-এর ন্যায় সুলায়ামন (আঃ)-কেও আল্লাহ বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য দান করেছিলেন, যা আর কাউকে দান করেননি। যেমন: (১) বায়ু প্রবাহ অনুগত হওয়া (২) তামাকে তরল ধাতুতে পরিণত করা (৩) জিনকে অধীনস্ত করা (৪) পক্ষীকূলকে অনুগত করা (৫) পিপীলিকার ভাষা বুঝা (৬) অতুলনীয় সাম্রাজ্য দান করা (৭) প্রাপ্ত অনুগ্রহ রাজির হিসাব না রাখার অনুমতি পাওয়া। নিম্নে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হ’ল:
১. বায়ু প্রবাহকে তাঁর অনুগত করে দেওয়া হয়েছিল। তাঁর হুকুম মত বায়ু তাঁকে তাঁর ইচ্ছামত স্থানে বহন করে নিয়ে যেত। তিনি সদলবলে বায়ুর পিঠে নিজ সিংহাসনে সওয়ার হয়ে দু’মাসের পথ একদিনে পৌঁছে যেতেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘এবং আমরা সুলায়মানের অধীন করে দিয়েছিলাম বায়ুকে, যা সকালে এক মাসের পথ ও বিকালে এক মাসের পথ অতিক্রম করত…’ (সাবা, আয়াত ১২)।
আল্লাহ বলেন,
‘‘আর আমরা সুলায়মানের অধীন করে দিয়েছিলাম প্রবল বায়ুকে। যা তার আদেশে প্রবাহিত হ’ত ঐ দেশের দিকে, যেখানে আমরা কল্যাণ রেখেছি। আর আমরা সকল বিষয়ে সম্যক অবগত রয়েছি’ (আম্বিয়া, আয়াত ৮১)। অন্যত্র আল্লাহ উক্ত বায়ুকে رُخَاء বলেছেন (ছোয়াদ, আয়াত ৩৬)। যার অর্থ মৃদু বায়ু, যা শূন্যে তরঙ্গ-সংঘাত সৃষ্টি করে না। عَاصِفَةٌ ও رُخَاء দু’টি বিশেষণের সমন্বয় এভাবে হ’তে পারে যে, কোনরূপ তরঙ্গ সংঘাত সৃষ্টি না করে তীব্র বেগে বায়ু প্রবাহিত হওয়াটা ছিল আল্লাহর বিশেষ রহমত এবং সুলায়মানের অন্যতম মু‘জেযা।
২. তামার ন্যায় শক্ত পদার্থকে আল্লাহ সুলায়মানের জন্য তরল ধাতুতে পরিণত করেছিলেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আমরা তার জন্য গলিত তামার একটি ঝরণা প্রবাহিত করেছিলাম…’ (সাবা, আয়াত ১২)। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, ঐ গলিত ধাতু উত্তপ্ত ছিল না। বরং তা দিয়ে অতি সহজে পাত্রাদি তৈরী করা যেত। সুলায়মানের পর থেকেই তামা গলিয়ে পাত্রাদি তৈরী করা শুরু হয় বলে কুরতুবী বর্ণনা করেছেন। পিতা দাঊদের জন্য ছিল লোহা গলানোর মু‘জেযা এবং পুত্র সুলায়মানের জন্য ছিল তামা গলানোর মু‘জেযা। আর এজন্যেই আয়াতের শেষে আল্লাহ বলেন, ‘‘হে দাঊদ পরিবার! কৃতজ্ঞতা সহকারে তোমরা কাজ করে যাও। বস্ত্ততঃ আমার বান্দাদের মধ্যে অল্প সংখ্যকই কৃতজ্ঞ’’ (সাবা, আয়াত ১৩)।
দু’টি সূক্ষ্মতত্ত্ব :
(ক) দাঊদ (আঃ)-এর জন্য আল্লাহ তা‘আলা সর্বাধিক শক্ত ও ঘন পদার্থ লোহাকে নরম ও সুউচ্চ পর্বতমালাকে অনুগত করে দিয়েছিলেন। পক্ষান্তরে সুলায়মান (আঃ)-এর জন্য আল্লাহ শক্ত তামাকে গলানো এবং বায়ু, জিন ইত্যাদি এমন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বস্ত্তকে অনুগত করে দিয়েছিলেন, যা চোখেও দেখা যায় না। এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, আল্লাহর শক্তি বড়-ছোট সবকিছুর মধ্যে পরিব্যাপ্ত।
(খ) এখানে আরেকটি বিষয়ে ইঙ্গিত রয়েছে যে, আল্লাহর তাক্বওয়াশীল অনুগত বান্দারা আল্লাহর হুকুমে বিশ্বচরাচরের সকল সৃষ্টির উপরে আধিপত্য করতে পারে এবং সবকিছুকে বশীভূত করে তা থেকে খিদমত নিতে পারে।
৩. জিনকে তাঁর অধীন করে দিয়েছিলেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আর জিনের মধ্যে কিছুসংখ্যক তার (সুলায়মানের) সম্মুখে কাজ করত তার পালনকর্তার (আল্লাহর) আদেশে…’ (সাবা, আয়াত ১২)।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘এবং আমরা তার অধীন করে দিয়েছিলাম শয়তানদের কতককে, যারা তার জন্য ডুবুরীর কাজ করত এবং এছাড়া অন্য আরও কাজ করত। আমরা তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতাম’ (আম্বিয়া, আয়াত ৮২)।
অন্যত্র বলা হয়েছে,
‘‘আর সকল শয়তানকে তার অধীন করে দিলাম, যারা ছিল প্রাসাদ নির্মাণকারী ও ডুবুরী’। ‘এবং অন্য আরও অনেককে অধীন করে দিলাম, যারা আবদ্ধ থাকত শৃংখলে’’ (ছোয়াদ, আয়াত ৩৭-৩৮)।
বস্ত্ততঃ জিনেরা সাগরে ডুব দিয়ে তলদেশ থেকে মূল্যবান মণি-মুক্তা, হীরা-জহরত তুলে আনত এবং সুলায়মানের হুকুমে নির্মাণ কাজ সহ যেকোন কাজ করার জন্য সদা প্রস্ত্তত থাকত। ঈমানদার জিনেরা তো ছওয়াবের নিয়তে স্বেচ্ছায় আনুগত্য করত। কিন্তু দুষ্ট জিনগুলো বেড়ীবদ্ধ অবস্থায় সুলায়মানের ভয়ে কাজ করত। এই অদৃশ্য শৃংখল কেমন ছিল, তা কল্পনা করার দরকার নেই। আদেশ পালনে সদাপ্রস্ত্তত থাকাটাও এক প্রকার শৃংখলবদ্ধ থাকা বৈ কি!
‘শয়তান’ হচ্ছে আগুন দ্বারা সৃষ্ট বুদ্ধি ও চেতনা সম্পন্ন এক প্রকার সূক্ষ্ম দেহধারী জীব। জিনের মধ্যকার অবাধ্য ও কাফির জিনগুলিকেই মূলতঃ ‘শয়তান’ নামে অভিহিত করা হয়। আয়াতে ‘শৃংখলবদ্ধ’ কথাটি এদের জন্যেই বলা হয়েছে। আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে থাকায় এরা সুলায়মানের কোন ক্ষতি করতে পারত না। বরং সর্বদা তাঁর হুকুম পালনের জন্য প্রস্ত্তত থাকত। তাদের বিভিন্ন কাজের মধ্যে আল্লাহ নিজেই কয়েকটি কাজের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন,
‘‘তারা সুলায়মানের ইচ্ছানুযায়ী দুর্গ, ভাষ্কর্য, হাউয সদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং চুল্লীর উপরে স্থাপিত বিশাল ডেগ নির্মাণ করত…’’ (সাবা, আয়াত ১৩)। উল্লেখ্য যে, تماثيل তথা ভাষ্কর্য কিংবা চিত্র ও প্রতিকৃতি অংকন বা স্থাপন যদি গাছ বা প্রাকৃতিক দৃশ্যের হয়, তাহ’লে ইসলামে তা জায়েয রয়েছে। কিন্তু যদি তা প্রাণীদেহের হয়, তবে তা নিষিদ্ধ।
৪. পক্ষীকুলকে সুলায়মানের অনুগত করে দেওয়া হয়েছিল এবং তিনি তাদের ভাষা বুঝতেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘‘সুলায়মান দাঊদের উত্তরাধিকারী হয়েছিল এবং বলেছিল, হে লোক সকল! আমাদেরকে পক্ষীকুলের ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে এবং আমাদেরকে সবকিছু দেওয়া হয়েছে। নিশ্চয়ই এটি একটি সুস্পষ্ট শ্রেষ্ঠত্ব’’ (নমল, আয়াত ১৬)।
পক্ষীকুল তাঁর হুকুমে বিভিন্ন কাজ করত। সবচেয়ে বড় কথা এই যে, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পত্র তিনি হুদহুদ পাখির মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী ‘সাবা’ রাজ্যের রাণী বিলক্বীসের কাছে প্রেরণ করেছিলেন। এ ঘটনা পরে বিবৃত হবে।
৫. পিপীলিকার ভাষাও তিনি বুঝতেন। যেমন আল্লাহ বলেন,
‘‘অবশেষে সুলায়মান তার সৈন্যদল নিয়ে পিপীলিকা অধ্যুষিত উপত্যকায় পৌঁছল। তখন পিপীলিকা (নেতা) বলল, হে পিপীলিকা দল! তোমরা স্ব স্ব গৃহে প্রবেশ কর। অন্যথায় সুলায়মান ও তার বাহিনী অজ্ঞাতসারে তোমাদের পিষ্ট করে ফেলবে’’। ‘তার এই কথা শুনে সুলায়মান মুচকি হাসল… (নমল, আয়াত ১৮-১৯)।
৬. তাঁকে এমন সাম্রাজ্য দান করা হয়েছিল, যা পৃথিবীতে আর কাউকে দান করা হয়নি। এজন্য আল্লাহর হুকুমে তিনি আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করেছিলেন। যেমন আল্লাহ বলেন,
‘‘সুলায়মান বলল, হে আমার পালনকর্তা! আমাকে ক্ষমা কর এবং আমাকে এমন এক সাম্রাজ্য দান কর, যা আমার পরে আর কেউ যেন না পায়। নিশ্চয়ই তুমি মহান দাতা’’ (ছোয়াদ, আয়াত ৩৫)।
উল্লেখ্য যে, পয়গম্বরগণের কোন দো‘আ আল্লাহর অনুমতি ব্যতিরেকে হয় না। সে হিসাবে হযরত সুলায়মান (আঃ) এ দো‘আটিও আল্লাহ তা‘আলার অনুমতিক্রমেই করেছিলেন। কেবল ক্ষমতা লাভ এর উদ্দেশ্য ছিল না। বরং এর পিছনে আল্লাহর বিধানাবলী বাস্তবায়ন করা এবং তাওহীদের ঝান্ডাকে সমুন্নত করাই মূল উদ্দেশ্য ছিল। কেননা আল্লাহ জানতেন যে, রাজত্ব লাভের পর সুলায়মান তাওহীদ ও ইনছাফ প্রতিষ্ঠার জন্যই কাজ করবেন এবং তিনি কখনোই অহংকারের বশীভূত হবেন না। তাই তাঁকে এরূপ দো‘আর অনুমতি দেওয়া হয় এবং সে দো‘আ সর্বাংশে কবুল হয়।
৭. প্রাপ্ত অনুগ্রহরাজির হিসাব রাখা বা না রাখার অনুমতি প্রদান। আল্লাহ পাক হযরত সুলায়মান (আঃ)-এর রাজত্ব লাভের দো‘আ কবুল করার পরে তার প্রতি বায়ু, জিন, পক্ষীকুল ও জীব-জন্তু সমূহকে অনুগত করে দেন। অতঃপর বলেন, ‘‘এসবই আমার অনুগ্রহ। অতএব এগুলো তুমি কাউকে দাও অথবা নিজে রেখে দাও, তার কোন হিসাব দিতে হবে না’। ‘নিশ্চয়ই তার (সুলায়মানের) জন্য আমার কাছে রয়েছে নৈকট্য ও শুভ পরিণতি’’ (ছোয়াদ, আয়াত ৩৯-৪০)।
বস্ত্ততঃ এটি ছিল সুলায়মানের আমানতদারী ও বিশ্বস্ততার প্রতি আল্লাহর পক্ষ হ’তে প্রদত্ত একপ্রকার সনদপত্র। পৃথিবীর কোন ব্যক্তির জন্য সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে এ ধরনের কোন সত্যায়নপত্র নাযিল হয়েছে বলে জানা যায় না। অথচ এই মহান নবী সম্পর্কে ইহুদী-নাছারা বিদ্বানরা বাজে কথা রটনা করে থাকে।
সুলায়মানের জীবনে উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী :
(১) ন্যায় বিচারের ঘটনা : ছাগপালের মালিক ও শস্যক্ষেতের মালিকের মধ্যকার বিরোধ মীমাংসায় তাঁর দেওয়া প্রস্তাব বাদশাহ দাঊদ (আঃ) গ্রহণ করেন ও নিজের দেওয়া পূর্বের রায় বাতিল করে পুত্র সুলায়মানের দেওয়া পরামর্শ অনুযায়ী রায় দেন ও তা কার্যকর করেন। এটি ছিল সুলায়মানের বাল্যকালের ঘটনা, যা আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করেছেন (আম্বিয়া, আয়াত ৭৮-৭৯)। এ ঘটনা আমরা দাঊদ (আঃ)-এর কাহিনীতে বলে এসেছি।
(২) পিপীলিকার ঘটনা : হযরত সুলায়মান (আঃ) একদা তাঁর বিশাল সেনাবাহিনী সহ একটি এলাকা অতিক্রম করছিলেন। ঐ সময় তাঁর সাথে জিন, মানুষ পক্ষীকুল ছিল। যে এলাকা দিয়ে তাঁরা যাচ্ছিলেন সে এলাকায় বালির ঢিবি সদৃশ পিপীলিকাদের বহু বসতঘর ছিল। সুলায়মান বাহিনীকে আসতে দেখে পিপীলিকাদের সর্দার তাদেরকে বলল, তোমরা শীঘ্র পালাও। নইলে পাদপিষ্ট হয়ে শেষ হয়ে যাবে। সুলায়মান (আঃ) পিপীলিকাদের এই বক্তব্য শুনতে পেলেন। এ বিষয়ে কুরআনী বর্ণনা নিম্নরূপ: ‘‘সুলায়মান দাঊদের স্থলাভিষিক্ত হ’ল এবং বলল, হে লোক সকল! আমাদেরকে পক্ষীকুলের ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে এবং আমাদেরকে সবকিছু দেওয়া হয়েছে। নিশ্চয়ই এটি একটি সুস্পষ্ট শ্রেষ্ঠত্ব’ (নমল, আয়াত ১৬)। ‘অতঃপর সুলায়মানের সম্মুখে তার সোনাবাহিনীকে সমবেত করা হ’ল জিন, মানুষ ও পক্ষীকুলকে। তারপর তাদেরকে বিভিন্ন ব্যুহে বিভক্ত করা হ’ল’। ‘অতঃপর যখন তারা একটি পিপীলিকা অধ্যুষিত এলাকায় উপনীত হ’ল, তখন এক পিপীলিকা বলল, ‘হে পিপীলিকা দল! তোমরা তোমাদের গৃহে প্রবেশ কর। অন্যথায় সুলায়মান ও তার বাহিনী অজ্ঞাতসারে তোমদেরকে পিষ্ট করে ফেলবে’। ‘তার কথা শুনে সুলায়মান মুচকি হাসল এবং বলল, ‘হে আমার পালনকর্তা! তুমি আমাকে ক্ষমতা দাও, যেন আমি তোমার নে‘মতের শুকরিয়া আদায় করতে পারি, যা তুমি আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে দান করেছ এবং যাতে আমি তোমার পসন্দনীয় সৎকর্মাদি করতে পারি এবং তুমি আমাকে নিজ অনুগ্রহে তোমার সৎকর্মশীল বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত কর’’ (নমল, আয়াত ১৬-১৯)।
উপরোক্ত আয়াতগুলিতে প্রমাণিত হয় যে, সুলায়মান (আঃ) কেবল পাখির ভাষা নয়, বরং সকল জীবজন্তু এমনকি ক্ষুদ্র পিঁপড়ার কথাও বুঝতেন। এজন্য তিনি মোটেই গর্ববোধ না করে বরং আল্লাহর অনুগ্রহের প্রতি শুকরিয়া আদায় করেন এবং নিজেকে যাতে আল্লাহ অন্যান্য সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত করেন সে প্রার্থনা করেন। এখানে আরেকটি বিষয় প্রমাণিত হয় যে, তিনি কেবল জিন-ইনসানের নয় বরং তাঁর সময়কার সকল জীবজন্তুরও নবী ছিলেন। তাঁর নবুঅতকে সবাই স্বীকার করত এবং সকলে তাঁর প্রতি আনুগত্য পোষণ করত। যদিও জিন ও ইনসান ব্যতীত অন্য প্রাণী শরী‘আত পালনের হকদার নয়।
(৩) ‘হুদহুদ’ পাখির ঘটনা : হযরত সুলায়মান (আঃ) আল্লাহর হুকুমে পক্ষীকুলের আনুগত্য লাভ করেন। একদিন তিনি পক্ষীকুলকে ডেকে একত্রিত করেন ও তাদের ভাল-মন্দ খোঁজ-খবর নেন। তখন দেখতে পেলেন যে, ‘হুদহুদ’ পাখিটা নেই। তিনি অনতিবিলম্বে তাকে ধরে আনার জন্য কড়া নির্দেশ জারি করলেন। সাথে তার অনুপস্থিতির উপযুক্ত কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করলেন। উক্ত ঘটনা কুরআনের ভাষায় নিম্নরূপ: ‘সুলায়মান পক্ষীকুলের খোঁজ-খবর নিল। অতঃপর বলল, কি হ’ল হুদহুদকে দেখছি না যে? না-কি সে অনুপস্থিত’ (নমল, আয়াত ২০)। সে বলল, ‘আমি অবশ্যই তাকে কঠোর শাস্তি দেব কিংবা যবহ করব অথবা সে উপস্থিত করবে উপযুক্ত কারণ’। ‘কিছুক্ষণ পরেই হুদহুদ এসে হাযির হয়ে বলল, (হে বাদশাহ!) আপনি যে বিষয়ে অবগত নন, আমি তা অবগত হয়েছি। আমি আপনার নিকটে ‘সাবা’ থেকে নিশ্চিত সংবাদ নিয়ে আগমন করেছি’ (নমল, আয়াত ২০-২২)।
এ পর্যন্ত বলেই সে তার নতুন আনীত সংবাদের রিপোর্ট পেশ করল। হুদহুদের মাধ্যমে একথা বলানোর মাধ্যমে আল্লাহ আমাদেরকে একথা জানিয়ে দিলেন যে, নবীগণ গায়েবের খবর রাখেন না। তাঁরা কেবল অতটুকুই জানেন, যতটুকু আল্লাহ তাদেরকে অবহিত করেন।
উল্লেখ্য যে, ‘হুদহুদ’ এক জাতীয় ছোট্ট পাখির নাম। যা পক্ষীকুলের মধ্যে অতীব ক্ষুদ্র ও দুর্বল এবং যার সংখ্যাও দুনিয়াতে খুবই কম। বর্ণিত আছে যে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) একদা নও মুসলিম ইহুদী পন্ডিত আব্দুল্লাহ বিন সালাম (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেন, এতসব পাখী থাকতে বিশেষভাবে ‘হুদহুদ’ পাখির খোঁজ নেওয়ার কারণ কি ছিল? জওয়াবে তিনি বলেন, সুলায়মান (আঃ) তাঁর বিশাল বাহিনীসহ ঐসময় এমন এক অঞ্চলে ছিলেন, যেখানে পানি ছিল না। আল্লাহ তা‘আলা হুদহুদ পাখিকে এই বৈশিষ্ট্য দান করেছেন যে, সে ভূগর্ভের বস্ত্ত সমূহকে এবং ভূগর্ভে প্রবাহিত পানি উপর থেকে দেখতে পায়। হযরত সুলায়মান (আঃ) হুদহুদকে এজন্যেই বিশেষভাবে খোঁজ করছিলেন যে, এতদঞ্চলে কোথায় মরুগর্ভে পানি লুক্কায়িত আছে, সেটা জেনে নিয়ে সেখানে জিন দ্বারা খনন করে যাতে দ্রুত পানি উত্তোলনের ব্যবস্থা করা যায়’। একদা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) ‘হুদহুদ’ পাখি সম্পর্কে বর্ণনা করছিলেন। তখন নাফে‘ ইবনুল আযরক্ব তাঁকে বলেন, ‘জেনে নিন হে মহা জ্ঞানী! হুদহুদ পাখি মাটির গভীরে দেখতে পায়। কিন্তু (তাকে ধরার জন্য) মাটির উপরে বিস্তৃত জাল সে দেখতে পায় না। যখন সে তাতে পতিত হয়’। জবাবে ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ‘যখন তাক্বদীর এসে যায়, চক্ষু অন্ধ হয়ে যায়’। চমৎকার এ জবাবে মুগ্ধ হয়ে ইবনুল ‘আরাবী বলেন, ‘এরূপ জওয়াব দিতে কেউ সক্ষম হয় না, কুরআনের আলেম ব্যতীত’।
(৪) রাণী বিলক্বীসের ঘটনা : হযরত সুলায়মান (আঃ)-এর শাম ও ইরাক সাম্রাজ্যের পার্শ্ববর্তী ইয়ামন তথা ‘সাবা’ রাজ্যের রাণী ছিলেন বিলক্বীস বিনতুস সারাহ বিন হাদাহিদ বিন শারাহীল। তিনি ছিলেন সাম বিন নূহ (আঃ)-এর ১৮তম অধঃস্তন বংশধর। তাঁর ঊর্ধ্বতন ৯ম পিতামহের নাম ছিল ‘সাবা’। সম্ভবতঃ তাঁর নামেই ‘সাবা’ সাম্রাজ্যের নামকরণ হয়।আল্লাহ তাদের সামনে জীবনোপকরণের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন এবং নবীগণের মাধ্যমে এসব নে‘মতের শুকরিয়া আদায় করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে তারা ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে আল্লাহর অবাধ্য হয় এবং ‘সূর্য পূজারী’ হয়ে যায়। ফলে তাদের উপরে প্লাবণের আযাব প্রেরিত হয় ও সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায়। আল্লাহ সূরা সাবা ১৫ হ’তে ১৭ আয়াতে এই সম্প্রদায় সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন।
দুনিয়াবী দিক দিয়ে এই ‘সাবা’ সাম্রাজ্য খুবই সমৃদ্ধ এবং শান-শওকতে পূর্ণ ছিল। তাদের সম্পর্কে হযরত সুলায়মানের কিছু জানা ছিল না বলেই কুরআনী বর্ণনায় প্রতীয়মান হয়। তাঁর এই না জানাটা বিস্ময়কর কিছু ছিল না। ইয়াকূব (আঃ) তাঁর বাড়ীর অনতিদূরে তাঁর সন্তান ইউসুফকে কূয়ায় নিক্ষেপের ঘটনা জানতে পারেননি। স্ত্রী আয়েশার গলার হারটি হারিয়ে গেল। অথচ স্বামী রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তা জানতে পারেননি। বস্ত্ততঃ আল্লাহ যতটুকু ইলম বান্দাকে দেন, তার বেশী জানার ক্ষমতা কারো নেই। পার্শ্ববর্তী ‘সাবা’ সাম্রাজ্য সম্পর্কে পূর্বে না জানা এবং পরে জানার মধ্যে যে কি মঙ্গল নিহিত ছিল, তা পরবর্তী ঘটনাতেই প্রমাণিত হয়েছে এবং রাণী বিলক্বীস মুসলমান হয়ে যান। বস্ত্ততঃ হুদহুদ পাখি তাদের সম্পর্কে হযরত সুলায়মানের নিকটে এসে প্রথম খবর দেয়। তার বর্ণিত প্রতিবেদনটি ছিল কুরআনের ভাষায় নিম্নরূপ :
‘‘আমি এক মহিলাকে সাবা বাসীদের উপরে রাজত্ব করতে দেখেছি। তাকে সবকিছুই দেওয়া হয়েছে এবং তার একটা বিরাট সিংহাসন আছে’। ‘আমি তাকে ও তার সম্প্রদায়কে দেখলাম তারা আল্লাহর পরিবর্তে সূর্যকে সিজদা করছে। শয়তান তাদের দৃষ্টিতে তাদের কার্যাবলীকে সুশোভিত করেছে। অতঃপর তাদেরকে সত্যপথ থেকে নিবৃত্ত করেছে। ফলে তারা সঠিক পথ প্রাপ্ত হয় না’’ (নমল, আয়াত ২৩-২৪)।
সুলায়মান বলল, ‘‘এখন আমরা দেখব তুমি সত্য বলছ, না তুমি মিথ্যাবাদীদের একজন’। ‘তুমি আমার এই পত্র নিয়ে যাও এবং এটা তাদের কাছে অর্পণ কর। অতঃপর তাদের কাছ থেকে সরে পড় এবং দেখ, তারা কি জওয়াব দেয়’। ‘বিলক্বীস বলল, হে সভাসদ বর্গ! আমাকে একটি মহিমান্বিত পত্র দেওয়া হয়েছে’। ‘সেই পত্র সুলায়মানের পক্ষ হ’তে এবং তা হ’ল এই: করুণাময় কৃপানিধান আল্লাহর নামে (শুরু করছি)’। ‘আমার মোকাবেলায় তোমরা শক্তি প্রদর্শন করো না এবং বশ্যতা স্বীকার করে আমার নিকটে উপস্থিত হও’। ‘বিলক্বীস বলল, হে আমার পারিষদ বর্গ! আমাকে আমার কাজে পরামর্শ দিন। আপনাদের উপস্থিতি ব্যতিরেকে আমি কোন কাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি না’। ‘তারা বলল, আমরা শক্তিশালী এবং কঠোর যোদ্ধা। এখন সিদ্ধান্ত আপনার হাতে। অতএব ভেবে দেখুন আপনি আমাদের কি আদেশ করবেন’।
‘রাণী বলল, রাজা-বাদশাহরা যখন কোন জনপদে প্রবেশ করে, তখন তাকে বিপর্যস্ত করে দেয় এবং সেখানকার সম্ভ্রান্ত লোকদের অপদস্থ করে। তারাও এরূপ করবে’। ‘অতএব আমি তাঁর নিকটে কিছু উপঢৌকন পাঠাই। দেখি, প্রেরিত লোকেরা কি জওয়াব নিয়ে আসে’। ‘অতঃপর যখন দূত সুলায়মানের কাছে আগমন করল, তখন সুলায়মান বলল, তোমরা কি ধন-সম্পদ দ্বারা আমাকে সাহায্য করতে চাও? আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছেন, তা তোমাদের দেওয়া বস্ত্ত থেকে অনেক উত্তম। বরং তোমরাই তোমাদের উপঢৌকন নিয়ে সুখে থাক’। ‘ফিরে যাও তাদের কাছে। এখন অবশ্যই আমরা তাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী সহ আগমন করব, যার মোকাবেলা করার শক্তি তাদের নেই। আমরা অবশ্যই তাদেরকে অপদস্থ করে সেখান থেকে বহিষ্কার করব এবং তারা হবে লাঞ্ছিত’। ‘অতঃপর সুলায়মান বলল, হে আমার পারিষদবর্গ! তারা আত্মসমর্পণ করে আমার কাছে আসার পূর্বে কে আছ বিলক্বীসের সিংহাসন আমাকে এনে দেবে?’ ‘জনৈক দৈত্য-জ্বিন বলল, আপনি আপনার স্থান থেকে ওঠার পূর্বেই আমি তা এনে দেব এবং আমি একাজে শক্তিবান ও বিশ্বস্ত’। ‘(কিন্তু) কিতাবের জ্ঞান যার ছিল সে বলল, তোমার চোখের পলক ফেলার পূর্বেই আমি তা এনে দিব। অতঃপর সুলায়মান যখন তা সামনে রক্ষিত দেখল, তখন বলল, এটা আমার পালনকর্তার অনুগ্রহ, যাতে তিনি আমাকে পরীক্ষা করেন যে, আমি শুকরিয়া আদায় করি, না অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। যে ব্যক্তি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, সে নিজের কল্যাণের জন্য তা করে থাকে এবং যে অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, সে জানুক যে, আমার পালনকর্তা অভাবমুক্ত ও কৃপাময়’ (নমল, আয়াত ৪০)।
‘সুলায়মান বলল, বিলক্বীসের সিংহাসনের আকৃতি বদলিয়ে দাও, দেখব সে সঠিক বস্ত্ত চিনতে পারে, না সে তাদের অন্তর্ভুক্ত যারা সঠিক পথ খুঁজে পায় না?’ ‘অতঃপর যখন বিলক্বীস এসে গেল, তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হ’ল: আপনার সিংহাসন কি এরূপই? সে বলল, মনে হয় এটা সেটিই হবে। আমরা পূর্বেই সবকিছু অবগত হয়েছি এবং আমরা আজ্ঞাবহ হয়ে গেছি’। ‘বস্ত্ততঃ আল্লাহর পরিবর্তে সে যার উপাসনা করত, সেই-ই তাকে ঈমান থেকে বিরত রেখেছিল। নিশ্চয়ই সে কাফের সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল’। ‘তাকে বলা হ’ল, প্রাসাদে প্রবেশ করুন। অতঃপর যখন সে তার প্রতি দৃষ্টিপাত করল, তখন ধারণা করল যে, এটা স্বচ্ছ গভীর জলাশয়। ফলে সে তার পায়ের গোছা খুলে ফেলল। সুলায়মান বলল, এটা তো স্বচ্ছ স্ফটিক নির্মিত প্রাসাদ। বিলক্বীস বলল, হে আমার পালনকর্তা! আমি তো নিজের প্রতি যুলুম করেছি। আমি সুলায়মানের সাথে বিশ্বজাহানের পালনকর্তা আল্লাহর নিকটে আত্মসমর্পণ করলাম’ (নমল, আয়াত ২৭-৪৪)।
সূরা নমল ২২ হ’তে ৪৪ আয়াত পর্যন্ত উপরে বর্ণিত ২৩টি আয়াতে রাণী বিলক্বীসের কাহিনী শেষ হয়েছে। এর মধ্যে ৪০তম আয়াতে ‘যার কাছে কিতাবের জ্ঞান ছিল’ বলে কাকে বুঝানো হয়েছে, এ বিষয়ে তাফসীরবিদগণ মতভেদ করেছেন। তার মধ্যে প্রবল মত হ’ল এই যে, তিনি ছিলেন স্বয়ং হযরত সুলায়মান (আঃ)। কেননা আল্লাহর কিতাবের সর্বাধিক জ্ঞান তাঁরই ছিল। তিনি এর দ্বারা উপস্থিত জিন ও মানুষ পারিষদ বর্গকে বুঝিয়ে দিলেন যে, তোমাদের সাহায্য ছাড়াও আল্লাহ অন্যের মাধ্যমে অর্থাৎ ফেরেশতাদের মাধ্যমে আমাকে সাহায্য করে থাকেন। ‘আর এটি হ’ল আমার পালনকর্তার অনুগ্রহ’ (নমল ৪০)। দ্বিতীয়তঃ গোটা ব্যাপারটাই ছিল একটা মু‘জেযা এবং রাণী বিলক্বীসকে আল্লাহর সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রদর্শন করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। বস্ত্ততঃ এতে তিনি সফল হয়েছিলেন এবং সুদূর ইয়ামন থেকে বায়তুল মুক্বাদ্দাসে বিলক্বীস তার সিংহাসনের আগাম উপস্থিতি দেখে অতঃপর স্ফটিক স্বচ্ছ প্রাসাদে প্রবেশকালে অনন্য কারুকার্য দেখে এবং তার তুলনায় নিজের ক্ষমতা ও প্রাসাদের দীনতা বুঝে লজ্জিত ও অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। অতঃপর তিনি আল্লাহর নিকটে আত্মসমর্পণ করে মুসলমান হয়ে যান। মূলতঃ এটাই ছিল হযরত সুলায়মানের মূল উদ্দেশ্য, যা শতভাগ সফল হয়েছিল।
(৫) অশ্ব কুরবানীর ঘটনা :
পিতা দাঊদের ন্যায় পুত্র সুলায়মানকেও আল্লাহ বারবার পরীক্ষায় ফেলেছেন তাকে সর্বদা আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনশীল রাখার জন্য। ফলে তাঁর জীবনের এক একটি পরীক্ষা এক একটি ঘটনার জন্ম দিয়েছে। কুরআন সেগুলির সামান্য কিছু উল্লেখ করেছে, যতটুকু আমাদের উপদেশ হাছিলের জন্য প্রয়োজন। কিন্তু পথভ্রষ্ট ইহুদী-নাছারা পন্ডিতগণ সেই সব ঘটনার উপরে রং চড়িয়ে এবং নিজেদের পক্ষ থেকে উদ্ভট সব গল্পের অবতারণা করে তাদেরই স্বগোত্র বনু ইস্রাঈলের এইসব মহান নবীগণের চরিত্র হনন করেছে। মুসলিম উম্মাহ বিগত সকল নবীকে সমানভাবে সম্মান করে। তাই ইহুদী-নাছারাদের অপপ্রচার থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখে এবং পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বর্ণনার উপরে নির্ভর করে। সেখানে যতটুকু পাওয়া যায়, তার উপরেই তারা বাক সংযত রাখে। আলোচ্য অশ্ব কুরবানীর ঘটনাটি সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের বর্ণনা নিম্নরূপ :
‘‘যখন তার সামনে অপরাহ্নে উৎকৃষ্ট অশ্বরাজি পেশ করা হ’ল’ (ছোয়াদ ৩১)। ‘তখন সে বলল, আমি তো আমার প্রভুর স্মরণের জন্যই ঘোড়াগুলিকে মহববত করে থাকি (কেননা এর দ্বারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ হয়ে থাকে। অতঃপর সে ঘোড়াগুলিকে দৌড়িয়ে দিল,) এমনকি সেগুলি দৃষ্টির অন্তরালে চলে গেল’। ‘(অতঃপর সে বলল,) ঘোড়াগুলিকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনো। অতঃপর সে তাদের গলায় ও পায়ে (আদর করে) হাত বুলাতে লাগল’ (ছোয়াদ, আয়াত ৩১-৩৩)। উপরোক্ত তরজমাটি ইবনু আববাস (রাঃ)-এর ব্যাখ্যার অনুসরণে ইবনু জারীরের গৃহীত ব্যাখ্যার অনুকূলে করা হয়েছে।
(৬) সিংহাসনের উপরে একটি নিষ্প্রাণ দেহ প্রাপ্তির ঘটনা :
আল্লাহ বলেন- ‘আমরা সুলায়মানকে পরীক্ষা করলাম এবং রেখে দিলাম তার সিংহাসনের উপর একটি নিষ্প্রাণ দেহ। অতঃপর সে রুজু হ’ল’ (ছোয়াদ, আয়াত ৩৪)। এ বিষয়ে কুরআনের বর্ণনা কেবল এতটুকুই। এক্ষণে সেই নিষ্প্রাণ দেহটি কিসের ছিল, একে সিংহাসনের উপর রাখার হেতু কি ছিল, এর মাধ্যমে কি ধরনের পরীক্ষা হ’ল- এসব বিবরণ কুরআন বা ছহীহ হাদীছে কিছুই বর্ণিত হয়নি। অতএব এ বিষয়ে কেবল এতটুকু ঈমান রাখা কর্তব্য যে, সুলায়মান (আঃ) এভাবে পরীক্ষায় পতিত হয়েছিলেন। যার ফলে তিনি আল্লাহর প্রতি আরো বেশী রুজু হন ও ক্ষমা প্রার্থনা করেন। যা সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রতি তাঁর অটুট আনুগত্যের পরিচয় বহন করে।
(৭) ‘ইনশাআল্লাহ’ না বলার ফল :
ছহীহ বুখারী ও মুসলিমে এ বিষয়ে বর্ণিত ঘটনার সারমর্ম এই যে, একবার হযরত সুলায়মান (আঃ) এ মনোভাব ব্যক্ত করলেন যে, রাত্রিতে আমি (আমার ৯০ বা ১০০) সকল স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হব। যাতে প্রত্যেকের গর্ভ থেকে একটি করে পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে ও পরে তারা আল্লাহর পথে ঘোড় সওয়ার হয়ে জিহাদ করবে। কিন্তু এ সময় তিনি ‘ইনশাআল্লাহ’ (অর্থঃ ‘যদি আল্লাহ চান’) বলতে ভুলে গেলেন। নবীর এ ত্রুটি আল্লাহ পসন্দ করলেন না। ফলে মাত্র একজন স্ত্রীর গর্ভ থেকে একটি অপূর্ণাঙ্গ ও মৃত শিশু ভূমিষ্ট হ’ল’। এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, সুলায়মান বিশ্বের সর্বাধিক ক্ষমতাসম্পন্ন বাদশাহ হ’লেও এবং জিন, বায়ু, পক্ষীকুল ও সকল জীবজন্তু তাঁর হুকুম বরদার হ’লেও আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত তার কিছুই করার ক্ষমতা ছিল না। অতএব তাঁর ‘ইনশাআল্লাহ’ বলতে ভুলে যাওয়াটা ছোটখাট কোন অপরাধ নয়। এ ঘটনায় এটাও স্পষ্ট হয় যে, যারা যত বড় পদাধিকারী হবেন, তাদের ততবেশী আল্লাহর অনুগত হ’তে হবে এবং সর্বাবস্থায় সকল কাজে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে। সর্বদা বিনীত হয়ে চলতে হবে এবং কোন অবস্থাতেই অহংকার করা চলবে না।
অনেক তাফসীরবিদ সূরা ছোয়াদ ৩৪ আয়াতে বর্ণিত ‘সিংহাসনের উপরে নিষ্প্রাণ দেহ’ রাখার ঘটনার সাথে কিছুটা সাদৃশ্য দেখে ছহীহ বুখারীতে বর্ণিত উপরোক্ত ঘটনাকে উক্ত আয়াতের তাফসীর হিসাবে সাব্যস্ত করেছেন। তারা বলেন যে, সিংহাসনে নিষ্প্রাণ দেহ রাখার অর্থ এই যে, সুলায়মান (আঃ)-এর জনৈক চাকর উক্ত মৃত সন্তানকে এনে তাঁর সিংহাসনে রেখে দেয়। এতে সুলায়মান (আঃ) বুঝে নেন যে, এটা তাঁর ‘ইনশাআল্লাহ’ না বলার ফল। সেমতে তিনি আল্লাহর দিকে রুজু হ’লেন ও ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। ক্বাযী আবুস সাঊদ, আল্লামা আলূসী, আশরাফ আলী থানভী প্রমুখ এ তাফসীর বর্ণনা করেছেন। এতদ্ব্যতীত ইমাম রাযীও আরেকটি তাফসীর করেছেন যে, সুলায়মান (আঃ) একবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে এমন দুর্বল হয়ে পড়েন যে, সিংহাসনে বসালে তাঁকে নিষ্প্রাণ দেহ বলে মনে হ’ত। পরে সুস্থ হ’লে তিনি আল্লাহর দিকে রুজু হন…। এ তাফসীর একেবারেই অনুমান ভিত্তিক। কুরআনী বর্ণনার সাথে এর কোন মিল নেই।
বস্ত্ততঃ কুরআন পাকে এই ঘটনা উল্লেখ করার আসল উদ্দেশ্য হ’ল মানুষকে একথা বুঝানো যে, তারা কোন বিপদাপদে বা পরীক্ষায় পতিত হ’লে যেন পূর্বাপেক্ষা অধিকভাবে আল্লাহর দিকে রুজু হয়। যেমন সুলায়মান (আঃ) হয়েছিলেন।
(৮) হারূত ও মারূত ফেরেশতাদ্বয়ের কাহিনী :
সুলায়মান (আঃ)-এর রাজত্বকালে বেঈমান জিনেরা লোকদের ধোঁকা দিত এই বলে যে, সুলায়মান জাদুর জোরে সবকিছু করেন। তিনি কোন নবী নন। শয়তানদের ভেল্কিবাজিতে বহু লোক বিভ্রান্ত হচ্ছিল। এমনকি শেষনবী (ছাঃ)-এর সময়েও যখন তিনি সুলায়মান (আঃ)-এর প্রশংসা করেন, তখন ইহুদী নেতারা বলেছিল, আশ্চর্যের বিষয় যে, মুহাম্মাদ সুলায়মানকে নবীদের মধ্যে শামিল করে হক ও বাতিলের মধ্যে সংমিশ্রণ ঘটাচ্ছেন। অথচ তিনি ছিলেন একজন জাদুকর মাত্র। কেননা স্বাভাবিকভাবে কোন মানুষ কি বায়ুর পিঠে সওয়ার হয়ে চলতে পারে? (ইবনু জারীর)।
এক্ষণে সুলায়মান (আঃ) যে সত্য নবী, তিনি যে জাদুকর নন, জনগণকে সেটা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য এবং নবীগণের মু‘জেযা ও শয়তানদের জাদুর মধ্যে পার্থক্য বুঝাবার জন্য আল্লাহ পাক হারূত ও মারূত নামে দু’জন ফেরেশতাকে ‘বাবেল’ শহরে মানুষের বেশে পাঠিয়ে দেন। ‘বাবেল’ হ’ল ইরাকের একটি প্রাচীন নগরী, যা ঐসময় জাদু বিদ্যার কেন্দ্র ছিল। ফেরেশতাদ্বয় সেখানে এসে জাদুর স্বরূপ ও ভেল্কিবাজি সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করতে থাকেন এবং জাদুকরদের অনুসরণ থেকে বিরত হয়ে যেন সবাই সুলায়মানের নবুঅতের অনুসারী হয়, সেকথা বলতে লাগলেন।
জাদু ও মু‘জেযার পার্থক্য এই যে, জাদু প্রাকৃতিক কারণের অধীন। কারণ ব্যতীত জাদু সংঘটিত হয় না। কিন্তু দর্শক সে কারণ সম্পর্কে অবহিত থাকে না বলেই তাতে বিভ্রান্ত হয়। এমনকি কুফরীতে লিপ্ত হয় এবং ঐ জাদুকরকেই সকল ক্ষমতার মালিক বলে ধারণা করতে থাকে। আজকের যুগে ভিডিও চিত্রসহ হাযার মাইল দূরের ভাষণ ঘরে বসে শুনে এবং দেখে যেকোন অজ্ঞ লোকের পক্ষে নিঃসন্দেহে বিভ্রান্তিতে পড়া স্বাভাবিক। তেমনি সেযুগেও জাদুকরদের বিভিন্ন অলৌকিক বস্ত্ত দেখে অজ্ঞ মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়ত।
পক্ষান্তরে মু‘জেযা কোন প্রাকৃতিক কারণের অধীন নয়। বরং তা সরাসরি আল্লাহর নির্দেশে সম্পাদিত হয়। নবী ব্যতীত আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের প্রতি তাঁর ‘কারামত’ বা সম্মান প্রদর্শনের বিষয়টিও একইভাবে সম্পাদিত হয়। এতে প্রাকৃতিক কারণের যেমন কোন সম্পৃক্ততা নেই, তেমনি সম্মানিত ব্যক্তির নিজস্ব কোন ক্ষমতা বা হাত নেই। উভয় বস্ত্তর পার্থক্য বুঝার সহজ উপায় এই যে, মু‘জেযা কেবল নবীগণের মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়। যারা আল্লাহভীতি, উন্নত চরিত্র মাধুর্য এবং পবিত্র জীবন যাপন সহ সকল মানবিক গুণে সর্বকালে সকলের আদর্শ স্থানীয় হন।
আর নবী ও অলীগণের মধ্যে পার্থক্য এই যে, নবীগণ প্রকাশ্যে নবুঅতের দাবী করে থাকেন। কিন্তু অলীগণ কখনোই নিজেকে অলী বলে দাবী করেন না। অলীগণ সাধারণভাবে নেককার মানুষ। কিন্তু নবীগণ আল্লাহর বিশেষভাবে নির্বাচিত বান্দা, যাদেরকে তিনি নবুঅতের গুরুদায়িত্ব অর্পণ করে থাকেন। নবীগণের মু‘জেযা প্রকাশে তাদের নিজস্ব কোন ক্ষমতা বা কৃতিত্ব নেই। পক্ষান্তরে দুষ্ট লোকেরাই জাদুবিদ্যা শিখে ও তার মাধ্যমে নিজেদের দুনিয়া হাছিল করে থাকে। উভয়ের চরিত্র জনগণের মাঝে পরিষ্কারভাবে পার্থক্য সৃষ্টি করে।
বস্ত্ততঃ সুলায়মান (আঃ)-এর নবুঅতের সমর্থনেই আল্লাহ তাঁর বিশেষ অনুগ্রহে হারূত ও মারূত ফেরেশতাদ্বয়কে বাবেল শহরে পাঠিয়ে ছিলেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘(ইহুদী-নাছারাগণ) ঐ সবের অনুসরণ করে থাকে, যা সুলায়মানের রাজত্বকালে শয়তানরা আবৃত্তি করত। অথচ সুলায়মান কুফরী করেননি, বরং শয়তানরাই কুফরী করেছিল। তারা মানুষকে জাদু বিদ্যা শিক্ষা দিত এবং বাবেল শহরে হারূত ও মারূত দুই ফেরেশতার উপরে যা নাযিল হয়েছিল, তা শিক্ষা দিত। বস্ত্ততঃ তারা (হারূত-মারূত) উভয়ে একথা না বলে কাউকে শিক্ষা দিত না যে, আমরা এসেছি পরীক্ষা স্বরূপ। কাজেই তুমি (জাদু শিখে) কাফির হয়ো না। কিন্তু তারা তাদের কাছ থেকে এমন জাদু শিখত, যার দ্বারা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। অথচ আল্লাহর আদেশ ব্যতীত তদ্বারা তারা কারু ক্ষতি করতে পারত না। লোকেরা তাদের কাছে শিখত ঐসব বস্ত্ত যা তাদের ক্ষতি করে এবং তাদের কোন উপকার করে না। তারা ভালভাবেই জানে যে, যে কেউ জাদু অবলম্বন করবে, তার জন্য আখেরাতে কোন অংশ নেই। যার বিনিময়ে তারা আত্মবিক্রয় করেছে, তা খুবই মন্দ, যদি তারা জানতো’। ‘যদি তারা ঈমান আনত ও আল্লাহভীরু হ’ত, তবে আল্লাহর কাছ থেকে উত্তম প্রতিদান পেত, যদি তারা জানত’ (বাক্বারাহ, আয়াত ১০২-১০৩)।
(৯) বায়তুল মুক্বাদ্দাস নির্মাণ ও সুলায়মান (আঃ)-এর মৃত্যুর বিস্ময়কর ঘটনা :
বায়তুল মুক্বাদ্দাসের নির্মাণ সর্বপ্রথম ফেরেশতাদের মাধ্যমে অথবা আদম (আঃ)-এর কোন সন্তানের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় কা‘বাগৃহ নির্মাণের চল্লিশ বছর পরে। অতঃপর স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে হযরত ইয়াকূব (আঃ) তা পুনর্নির্মাণ করেন। তার প্রায় হাযার বছর পরে দাঊদ (আঃ) তার পুনর্নির্মাণ শুরু করেন এবং সুলায়মান (আঃ)-এর হাতে তা সমাপ্ত হয়। কিন্তু মূল নির্মাণ কাজ শেষ হ’লেও আনুসঙ্গিক কিছু কাজ তখনও বাকী ছিল। এমন সময় হযরত সুলায়মানের মৃত্যুকাল ঘনিয়ে এল। এই কাজগুলি অবাধ্যতাপ্রবণ জিনদের উপরে ন্যস্ত ছিল। তারা হযরত সুলায়মানের ভয়ে কাজ করত। তারা তাঁর মৃত্যু সংবাদ জানতে পারলে কাজ ফেলে রেখে পালাতো। ফলে নির্মাণ কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যেত। তখন সুলায়মান (আঃ) আল্লাহর নির্দেশে মৃত্যুর জন্যে প্রস্ত্তত হয়ে তাঁর কাঁচ নির্মিত মেহরাবে প্রবেশ করলেন। যাতে বাইরে থেকে ভিতরে সবকিছু দেখা যায়। তিনি বিধানানুযায়ী ইবাদতের উদ্দেশ্যে লাঠিতে ভর করে দাঁড়িয়ে গেলেন, যাতে রূহ বেরিয়ে যাবার পরেও লাঠিতে ভর দিয়ে দেহ স্বস্থানে দাঁড়িয়ে থাকে। সেটাই হ’ল। আল্লাহর হুকুমে তাঁর দেহ উক্ত লাঠিতে ভর করে এক বছর দাঁড়িয়ে থাকল। দেহ পচলো না, খসলো না বা পড়ে গেল না। জিনেরা ভয়ে কাছে যায়নি। ফলে তারা হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে কাজ শেষ করে ফেলল। এভাবে কাজ সমাপ্ত হ’লে আল্লাহর হুকুমে কিছু উই পোকার সাহায্যে লাঠি ভেঙ্গে দেওয়া হয় এবং সুলায়মান (আঃ)-এর লাশ মাটিতে পড়ে যায়। উক্ত কথাগুলি আল্লাহ বলেন নিম্নোক্ত ভাবে- ‘অতঃপর যখন আমরা সুলায়মানের মৃত্যু ঘটালাম, তখন ঘুনপোকাই জিনদেরকে তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে অবহিত করল। সুলায়মানের লাঠি খেয়ে যাচ্ছিল। অতঃপর যখন তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন, তখন জিনেরা বুঝতে পারল যে, যদি তারা অদৃশ্য বিষয় জানতো, তাহ’লে তারা (মসজিদ নির্মাণের) এই হাড়ভাঙ্গা খাটুনির আযাবের মধ্যে আবদ্ধ থাকতো না’ (সাবা, আয়াত ১৪)। সুলায়মানের মৃত্যুর এই ঘটনা আংশিক কুরআনের আলোচ্য আয়াতের এবং আংশিক ইবনে আববাস (রাঃ) প্রমুখ থেকে বর্ণিত হয়েছে (ইবনে কাছীর)।
সুলায়মানের এই অলৌকিক মৃত্যু কাহিনীর মধ্যে শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ :
(১) মৃত্যুর নির্ধারিত সময় উপস্থিত হ’লে নবী-রাসূল যে-ই হৌন না কেন, এক সেকেন্ড আগপিছ হবে না।
(২) আল্লাহ কোন মহান কাজ সম্পন্ন করতে চাইলে যেকোন উপায়ে তা সম্পন্ন করেন। এমনকি মৃত লাশের মাধ্যমেও করতে পারেন।
(৩) ইতিপূর্বে জিনেরা বিভিন্ন আগাম খবর এনে বলত যে, আমরা গায়েবের খবর জানি। অথচ চোখের সামনে মৃত্যুবরণকারী সুলায়মান (আঃ)-এর খবর তারা জানতে পারেনি এক বছরের মধ্যে। এতে তাদের অদৃশ্য জ্ঞানের দাবী অসার প্রমাণিত হয়।
সুলায়মান (আঃ)-এর জীবনী থেকে শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ :
১. নবুঅত ও খেলাফত একত্রে একই ব্যক্তির মাধ্যমে পরিচালিত হওয়া সম্ভব।
২. ধর্মই রাজনীতির প্রধান চালিকা শক্তি। ধর্মীয় রাজনীতির মাধ্যমেই পৃথিবীতে প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
৩. প্রকৃত মহান তিনিই, যিনি সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হয়েও অহংকারী হন না। বরং সর্বদা আল্লাহর প্রতি বিনীত থাকেন।
৪. শত্রুমুক্ত কোন মানুষ দুনিয়াতে নেই। সুলায়মানের মত একচ্ছত্র এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী বাদশাহর বিরুদ্ধেও চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র ও মিথ্যাচার চালানো হয়েছে।
৫. সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে প্রজাসাধারণের কাজ করলেও তারা অনেক সময় না বুঝে বিরোধিতা করে। যেমন বায়তুল মুক্বাদ্দাস মসজিদের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত না হওয়ায় আল্লাহ বাকী সময়ের জন্য সুলায়মানের প্রাণহীন দেহকে লাঠিতে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখেন জিন মিস্ত্রী ও জোগাড়েদের ভয় দেখানোর জন্য। যাতে তারা কাজ ফেলে রেখে চলে না যায় এবং নতুন চক্রান্তে লিপ্ত হবার সুযোগ না পায়।
সুলায়মানের মৃত্যু ও রাজত্বকাল :
সুলায়মান (আঃ) ৫৩ বছর বেঁচেছিলেন। তন্মধ্যে ৪০ বছর তিনি রাজত্ব করেন। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র রাহবা‘আম ১৭ বছর রাজত্ব করেন। অতঃপর বনু ইস্রাঈলের রাজত্ব বিভক্ত হয়ে যায়। সুলায়মান মনছূরপুরীর হিসাব মতে শেষনবী (ছাঃ)-এর আবির্ভাবের প্রায় ১৫৪৬ বছর পূর্বে সুলায়মান (আঃ) মৃত্যুবরণ করেন।
কুরআনে উল্লেখ
এবার আপনাকে বলে দিচ্ছি কুরআন থেকে হযরত সুলাইমানকে জানার সুত্র। আল কুরআনে হযরত সুলাইমানের নাম ১৭ বার উল্লেখ করা হয়েছে। যেসব জায়গায় উল্লেখ হয়েছে সেগুলো হলো – সূরা আল বাকারা ; ১০২। আন নিসা ; ১৬৩। আল আনয়াম ; ৮৪। আল আম্বিয়া ; ৭৮, ৭৯, ৮১। আন নামল ; ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ৩০, ৩৬, ৪৪। সাবা ; ১২। সোয়াদ ; ৩০, ৩৪। তবে বিস্তারিত ঘটনা আপনারা আরো জানতে পারবেন সূরা আল আম্বিয়া ; ৭৮-৮২ আয়াতে। সূরা আন নামল ; ১৫-৪৪ আয়াতে। সূরা সাবা ; ১২-১৪ আয়াতে এবং সূরা সোয়াদ ; ৩০-৪৪ নম্বর আয়াতে। আপনারা তো নিশ্চয়ই জানেন, আল কুরআনের বাংলা অনুবাদ হয়েছে, তাফসির হয়েছে। একবার সরাসরি কুরআন থেকে হযরত সুলাইমান (আঃ) এর জীবনী পড়ে নিন।
১৯।
ইলিয়াস
(আঃ)
ইলিয়াস (আঃ) ছিলেন বনী ইসরাইলদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নবী। ছিলেন বড় ইবাদাত গুজার, আল্লাহভীরু এবং বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী। কুরআন মাজীদে তাঁর নাম তিন বার উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখ হয়েছে সূরা আনয়ামের ৮৫ আয়াতে এবং সূরা সাফফাতের ১২৩ ও ১৩০ আয়াতে। তিনি আল্লাহর কাছে বড় মর্যাদাবান ও সম্মানিত ছিলেন। কুরআন মাজীদে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর উপর সালাম বর্ষিত হয়েছে। বাইবেলে তাঁর নাম বলা হয়েছে ‘ইলিয়া’।
হযরত ইলিয়াসের কাল ও এলাকা
আধুনিক কালের গবেষকগন খ্রিষ্টপূর্ব ৮৭৫ থেকে ৮৫০ এর মাঝামাঝি সময়টাকে তাঁর নবুয়্যত কাল বলে চিহ্নিত করেছেন। হযরত ইলিয়াস ছিলেন জিল’আদের অধিবাসী। সেকালে জিল’আদ বলা হত জর্ডানের উত্তরাঞ্চলকে। এলাকাটি ইয়ারমুক নদীর দক্ষিনে অবস্থিত। আপনি কি কখনো সে এলাকায় গিয়েছেন?
কুরআনে তাঁর মর্যাদার বর্ণনা
কুরআনে হযরত ইলিয়াস (আঃ) –কে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর বংশধর শ্রেষ্ঠ নবীদের একজন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা আল আনয়ামে বলা হয়েছে –
“ইব্রাহীমকে আনি ইসহাক ও ইয়াকুবের মতো সন্তান দিয়েছি। তাঁদের সবাইকে সত্য পথ প্রদর্শন করেছি, যা প্রদর্শন করেছিলাম ইতোপূর্বে নূহকে। তাছাড়া তাঁর বংশধরদের মধ্যে দাইদ, সুলাইমান, আইয়ুব, ইউসুফ, মুসা এবং হারুনকে সঠিক পথ দেখিয়েছি। উপকারী লোকদের আমি এভাবেই প্রতিদান দিয়ে থাকি। তাঁর সন্তানদের মধ্য থেকে যাকারিয়া, ইয়াহিয়া, ঈসা এবং ইলিয়াসকেও সঠিক প্রদর্শন করেছি। এরা প্রত্যেকেই ছিলো যোগ্য সংস্কারক। তাঁরই বংশ থেকে ইসমাঈল, আলইয়াসা, ইউনুস এবং লুতকেও সঠিক পথ দেখিয়েছি। এদের প্রত্যেককে আমি বিশ্ববাসীর উপর মর্যাদা দিয়েছি।” (সূরা আল আনয়াম, ৮৪-৮৬)
তাঁর সংস্কারমুলক কাজ
কুরআনের বর্ণনা থেকেই আপনারা জানতে পারলেন হযরত ইলিয়াস (আঃ) কতো বিরাট মর্যাদার অধিকারী নবী ছিলেন এবং আল্লাহর কতটা প্রিয় ছিলেন? সূরা আস-সাফফাতে তাঁর সংস্কারমুলক আন্দোলনের একটি সংক্ষিপ্ত অথচ চমৎকার বর্ণনা দেয়া হয়েছে –
“আর ইলিয়াসও ছিলো একজন রাসুল। স্মরণ করো, সে তাঁর জাতিকে যখন বলেছিলো, তোমরা কি সতর্ক হবেনা? তোমরা কি তোমাদের এবং তোমাদের পূর্ব পুরুষদের প্রভু মহামহিম স্রষ্টা আল্লাহকে পরিত্যাগ করে বা’আলের পূজা অর্চনা করবে? কিন্তু তারা তাঁকে অস্বীকার করলো। কাজেই এখন অবশ্যি তাঁদের হাজির করা হবে শাস্তি ভোগের জন্যে, তবে আল্লাহর নিষ্ঠাবান দাসদের নয়। আর পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আমি ইলিয়াসের সুখ্যাতি অব্যাহত রেখেছি। ইলিয়াসের প্রতি সালাম। উপকারী লোকদের আমি এভাবেই প্রতিফল দিয়ে থাকি। সে ছিলো আমার একনিষ্ঠ মুমিন দাসদেরই একজন।” (সূরা ৩৭, আস-সাফফাত, আয়াত ১২৩-১৩২)
বা’আল কে?
আল্লাহর উপরোক্ত বানী থেকে আমরা জানতে পারলাম হযরত ইলিয়াসের জাতি বা’আলের পূজা অর্চনা করতো। বা’আলের কাছেই প্রার্থনা করতো এবং তাকেই খোদা বলে ডাকতো। তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে বা’আলকে মাবুদ বানিয়ে নিয়েছিলো। আপনারা কি জানেন এই বা’আল কে?
‘বা’আল’ এর আভিধানিক অর্থ স্বামী বা পতি। প্রাচীনকালে সিরিয়া ও জর্ডান অঞ্চলে পূজনীয়, উপাস্য, প্রভু এবং দেবতা অর্থে এ শব্দটি ব্যবহার করা হতো। সেকালে লেবাননের ফিনিকি সম্প্রদায়ের লোকেরা তাঁদের সবচে’ বড় দেবতাটিকে বলতো বা’আল। এ ছিলো পুরুষ দেবতা। এ মূর্তিটির স্ত্রীর নাম ছিলো আশারাত। এ ছিল সবচে’ বড় দেবী। আবার কোন কোন সম্প্রদায় সূর্য পূজা করতো। তারা সূর্যকেই বা’আল বলতো। আর চন্দ্র অথবা শুক্রগ্রহ ছিল এদের আশারাত। ইতিহাস থেকে জানা যায় সেকালে বেবিলন থেকে নিয়ে মিশর পর্যন্ত গোটা মধ্যপ্রাচ্যে বা’আলের পূজা বিস্তার লাভ করে। বিশেষ করে লেবানন, সিরিয়া এবং ফিলিস্তিন অঞ্চলের মুশরিক জাতিগুলো বা’আলের পুজায় আপাদমস্তক ডুবে গিয়েছিলো। এবার আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন বা’আল কে?
বনী ইসরাইলের বা’আল পূজা
হযরত মুসা (আঃ) এর পর বনী ইসরাইলদের মধ্যে বা’আল পুজার প্রবনতা শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত তারা বা’আল পুজায় চরম আসক্ত হয়ে পড়ে। জানা যায় তারা কোন একস্থানে বা’আলের যজ্ঞবেদী তৈরি করে নিয়েছিল এবং সেখানে তারা বা’আলের নামে বলিদান করতো। একবার একজন খাঁটি মুমিন এই বেদীটি ভেঙ্গে ফেলে। পরদিন লোকেরা সমাবেশ লরে তাঁর মৃত্যুদণ্ড দাবী করে। অবশেষে হযরত সামুয়েল, তালুত, দাউদ এবং সুলাইমান বনী ইসরাঈলকে মূর্তি পুজার কলুষতা থেকে মুক্ত করেন। তারা মধ্যপ্রাচ্যে বিরাট শক্তিশালী ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। সে রাষ্ট্র থেকে শিরক ও মূর্তি পূজা উচ্ছেদ করেন। কিন্তু সুলাইমান (আঃ) এর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র রহুবমের অযোজ্ঞতার কারনে বনী ইসরাইল রাজ্য ভেঙ্গে দু’ভাগ হয়ে যায়। একভাগে ছিল বাইতুল মাকদাস সহ দক্ষিন ফিলিস্তিন নিয়ে গঠিত ইহুদী রাষ্ট্র। আর উত্তর ফিলিস্তিনের নাম থাকে ইসরাইল রাষ্ট্র।
ইসরাইল রাষ্ট্রের লোকেরা আবার মূর্তি পুজায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। তারা শিরক, মূর্তিপূজা, ফাসেকী, চরিত্রহীনতা এবং যাবতীয় বদ আমলের মধ্যে নিমজ্জিত হয়। বা’আল কে তারা দেবতা বানিয়ে নেয়। তারা নবীদের বংশধর হয়েও আল্লাহকে বাদ দিয়ে বা’আলের উপাসনায় লিপ্ত হয়ে পড়ে।
মুক্তির বানী নিয়ে এলেন ইলিয়াস
বনী ইসরাইল শিরক ও চরম পাপাচারের কারনে ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাড়ায়। এ সময় মহান আল্লাহ ইলিয়াসকে নবুয়্যত দান করেন। বনি ইসরাইলকে সতর্ক করার নির্দেশ দেন। তাঁদেরকে মুক্তি এবং কল্যাণের পথে আসার আহবান জানাতে বলেন। ইলিয়াস শাসকবর্গ ও জনগনের সামনে হাজির হন। তাঁদের সতর্ক করতে বলেন। আল্লাহকে ভয় করতে বলেন। মূর্তিপূজা ও পাপাচার ত্যাগ করতে বলেন। বা’আলকে পরিত্যাগ করতে বলেন। তাঁদেরকে আল্লাহর বিধানের ভিত্তিতে জীবন যাপন করতে বলেন। তখন ইসরাইলের রাজা ছিলেন আখিয়াব। আখিয়াব লেবাননের (সেকালে লেবাননকে বলা হত সাঈদা) মুশরিক রাজ কন্যাকে বিয়ে করে নিজেও মুশ্রিক হয়ে পড়েন। হযরত ইলিয়াস আখিয়াবের কাছে এসে বলে দেন, তোমার পাপের কারনে এখন আর ইসরাইল রাজ্যে এক বিন্দু বৃষ্টিও হবেনা। শিশির এবং কুয়াশাও পড়বে না।
আল্লাহর নবীর উক্তি অক্ষরে অক্ষরে সত্য হলো। সাড়ে তিন বছর পর্যন্ত ইসরাইল রাষ্ট্রে বৃষ্টিপাত বন্ধ হয়ে থাকলো। এবার আখিয়াবের হুশ হলো। সে হযরত ইলিয়াসকে সন্ধান করে আনলো। অনুনয় বিনয় করে হযরত ইলিয়াসকে বৃষ্টির জন্যে দোয়া করতে বললো। হযরত ইলিয়াস এই সুযোগে বা’আলকে মিথ্যা প্রমান করে দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি আখিয়াবকে শর্ত দিলেন, একটি জনসমাবেশ ডাকতে হবে। সেখানে বা’আলের পূজারীরা বা’আলের নামে বলিদান করবে এবং আমি আল্লাহর নামে কুরবানী করবো। গায়েবী আগুন এসে যে পক্ষের কুরবানীকে জালিয়ে ভস্মীভূত করে দিয়ে যাবে সে পক্ষের মা’বুদকেই সত্য বলে মেনে নিতে হবে। আখিয়াব এ শর্ত মেনে নিলো, তারপর কি হলো? তারপর আখিয়াব সাধারন জনসমাবেশ ডাকলো। সেখানে সাড়ে আটশো বা’আল পূজারী একত্রিত হলো। কুরবানী হলো, বলিদান হলো। তারপর? অতপর আকাশ থেকে আগুন এসে হযরত ইলিয়াসের কুরবানীকে ভস্মীভূত করে দিয়ে গেলো। সমস্ত জনগনের সামনে বা’আল মিথ্যা খোদা বলে প্রমানিত হলো। জনগন বা’আল পূজারীদের হত্যা করলো। হযরত ইলিয়াস সেখানেই আল্লাহর কাছে বৃষ্টির জন্যে দোয়া করলেন। সাথে সাথেই আকাশে মেঘ করলো। প্রচুর বৃষ্টিপাত হলো। জনগন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
নবীর উপর নির্যাতন
কিন্তু আখিয়াব ছিলো স্ত্রৈণ। স্ত্রৈণ মানে স্ত্রীর অনুগত। সে স্ত্রীর গোলামী থেকে মুক্ত হতে পারেনি। তাঁর মুশরিক স্ত্রী হযরত ইলিয়াসের ঘোরতর শত্রু হয়ে পড়ে। স্ত্রীর খপ্পরে পড়ে আখিয়াব আল্লাহর নবীর উপর নির্যাতন শুরু করে। তাঁর স্ত্রী ইসাবেলা ঘোষণা করে দেয়, বা’আল পূজারীদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, ইলিয়াসকেও সেভাবে হত্যা করা হবে। তারা অত্যাচার নির্যাতনের দাপটে জনগনের মুখ বন্ধ করে দিলো। ইলিয়াস একাকী হয়ে পড়লেন। তিনি বাধ্য হয়ে দেশ থেকে হিজরত করেন এবং সিনাই পর্বতের পাদদেশে আশ্রয় নেন।
সংস্কার কাজ চালিয়ে যান
হযরত ইলিয়াস কয়েকবছর সিনাইর পাদদেশে অবস্থান করেন। এরি মধ্যে দক্ষিন ফিলিস্তিনের ইয়াহুদী শাসক ইয়াহুরাম ইসরাইল রাজ্যের শাসক আখিয়াবের মুশরিক কন্যাকে বিয়ে করেন।
তাঁর প্রভাবে ইহুদী রাজ্যেও ব্যাপক ভাবে মূর্তিপূজার প্রচলন শুরু হয়। ইলিয়াস এখানে আসেন। তাঁদের সতর্ক করেন। তাদের আল্লাহর পথ দেখান। মূর্তিপূজা পরিত্যাগ করতে বলেন। মর্মস্পর্শী অনেক উপদেশ দিয়ে রাজা ইয়াহুরামকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পত্রও প্রদান করেন। কিন্তু তারা শিরক, মূর্তিপূজা ও পাপাচার থেকে বেরিয়ে আসেনি। শেষ পর্যন্ত রাজা ধ্বংস হয়ে যায়।
কয়েকবছর পর ইলিয়াস আবার ইসরাইল রাষ্ট্রে ফিরে আসেন। আখিয়াব ও তাঁর পুত্র আখযিয়াকে সঠিক পথে আনার আপ্রান চেষ্টা চালান। কিন্তু তাঁরাও আল্লাহর পথে ফিরে আসেনি। অবশেষে হযরত ইলিয়াসের বদদোয়ায় আখিয়াব রাজ পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়।
হযরত ইলিয়াসের সুখ্যাতি
জীবদ্দশায় হযরত ইলিয়াসের প্রতি চরম অত্যাচার নির্যাতন চালালেও তাঁর মৃত্যুর পর বনী ইসরাইল তাঁর ভক্ত অনুরক্ত হয়ে পড়ে। বাইবেল থেকে জানা যায়, বনি ইসরাইল ধারনা করতো, ইলিয়াসকে আল্লাহ তায়ালা উঠিয়ে নিয়ে গেছেন এবং তিনি আবার পৃথিবীতে আসবেন। তারা ইলিয়াসের আগমনের প্রতীক্ষায় ছিলো। তাঁর আটশো বছর পরে হযরত ঈসা (আঃ) এর জন্ম হয়। তিনি তাঁর সাথীদের বলে যান, ইলিয়া (ইলিয়াস) আটশো বছর আগে অতীত হয়ে গেছেন। তিনি আর পৃথিবীতে আসবেননা। যাই হোক, পরবর্তী লোকদের মাঝে হযরত ইলিয়াসের প্রচুর সুখ্যাতি ছরিয়ে পড়ে। সেকথাই মহান আল্লাহ কুরআনে এভাবে বর্ণনা করেছেন-
“ আর পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে আমি ইলিয়াসের সুখ্যাতি ছড়িয়ে দিয়েছি। ” (সুরা আস সাফফাত, আয়াত ১২৯)
‘সালামুন আ’লা ইলিয়াসিন।’
২০।
আলইয়াসা (আঃ)
আল কুরআনে হযরত আলইয়াসা
“ইসমাঈল, আলইয়াসা, ইউনুস এবং লুত এদের প্রত্যেককেই আমি বিশ্ববাসীর উপর মর্যাদাবান করেছি।” (সূরা আল আনয়াম, আয়াত ৮৬)
“আর ইসমাঈল, আলইয়াসা যুলকিফলের কথা স্মরণ করো। এরা প্রত্যেকেই ছিলো মহোত্তম।’’ (সূরা সোয়াদ, আয়াত ৪৮)
আল কুরআনে হযরত আলইয়াসার নাম এই দুইটি স্থানেই উল্লেখ হয়েছে। মহান আল্লাহ তাঁকে তাঁর শ্রেষ্ঠ নবী রাসুলদের মাঝে গণ্য করেছেন। তিনি তাঁকে দিয়েছিলেন অনেক বড় মর্যাদা ও উচ্চাসন। তিনি ছিলেন বনী ইসরাইলের শ্রেষ্ঠ নবীগনের অন্যতম। ইহুদী খ্রিষ্টানদের কাছে তাঁদের গ্রন্থাবলীতে তিনি ইলিশা (Elisha) হিসেবে পরিচিত।
প্রশিক্ষন ও মনোনয়ন
আলইয়াসা ছিলেন হযরত ইলিয়াসের ছাত্র ও শিষ্য। হযরত ইলিয়াস তাঁকে উত্তম প্রশিক্ষন দিয়ে যোগ্য করে গড়ে তোলেন। কুরআন মাজীদে তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত কোন বিবরন নেই। বাইবেলে বলা হয়েছে, আল্লাহ ইলিয়াসকে নির্দেশ প্রদান করেন আলইয়াসাকে নিজের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে যোগ্য করে গড়ে তুলতে। এ নির্দেশ অনুযায়ী ইলিয়াস হযরত আলইয়াসার বসবাসের এলাকায় গিয়ে পৌঁছান।
ইলিয়াস দেখতে পান, আলইয়াসা বার জোড়া গরু নিয়ে জমিতে চাষ দিচ্ছেন। তিনি তাঁর পাশ দিয়ে যাবার কালে নিজের চাদর তাঁর গায়ে নিক্ষেপ করেন। সাথে সাথে আলইয়াসা ক্ষেতখামার চাষবাস ছেড়ে দিয়ে তাঁর সাথে চলে আসেন। প্রায় দশ বারো বছর আলইয়াসা হযরত ইলিয়াসের প্রশিক্ষনাধীনে থাকেন। অতঃপর ইলিয়াসকে উঠিয়ে নেবার পর আল্লাহ আলইয়াসাকে নবুয়্যত দান করেন এবং তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেন। কোন কোন ঐতিহাসিক বলেছেন, হযরত আলইয়াসা হযরত ইলিয়াসের চাচাত ভাই ছিলেন।
সংশোধনের কাজ
হযরত ইলিয়াসের মৃত্যুর পর হযরত আলইয়াসা বলিষ্ঠভাবে ইসরাইলী শাসক ও জনগণকে সংশোধনের পদক্ষেপ নেন। শিরক, মূর্তিপূজা ও আনাচারের মূল অভিভাবক ও পৃষ্ঠপোষক ছিলো স্বয়ং রাজ পরিবার। হযরত আলইয়াসা তাঁদের সতর্ক করে দেন। আল্লাহর ভয় দেখান। কিন্তু কিছুতেই তারা আল্লাহর পথে আসতে রাজি হয়নি।
শেষ পর্যন্ত হযরত আলইয়াসা জনৈক যিহুকে রাজ পরিবারের বিরুদ্ধে দাড় করিয়ে দিলেন। যিহু রাজ পরিবারকে হত্যা করে এবং বা’আলের পূজা নিষিদ্ধ করে দেয়। কিন্তু জনগনের মনমগজে মূর্তি পুজার কুসংস্কার বদ্ধমূল হয়ে থাকে। হযরত আলইয়াসার মৃত্যুর পর পুনরায় ইসরাইলী সমাজ শিরকের পুতিগন্ধময় গহবরে নিমজ্জিত হয়।