চতুর্থ সংঘর্ষ
চৌদ্দই নভেম্বর, আঠারো শো একত্রিশ সাল।
নিসার আলীকে নির্মূল করার জন্যে বরাসাতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ আলেকজান্ডার একজন হাবিলদার, একজন জমাদার এবং পঞ্চাশ জন বন্দুক ও তরবারিধারী সিপাহী নিয়ে পৌঁছেন নারিকেল বাড়িয়োর তিন ক্রোশ দূরে- বাদুড়িয়ায়।
বশির হাটের দারোগা নিমাই জমাদার সহ বাদুরিয়ায় আলেকজান্ডারের সাথ মিলিত হলো।
উভয়েল মোট সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় একশ বিশজন।
মুসলিম দলের নেতৃত্বে ছিলেন দুঃসাহসিক মুজাহিদ গোলাম মাসুম।
গোলাম মাসুমের সাথে আলেকজান্ডারের প্রচণ্ড সংঘর্ষ হলো বাদুড়িয়ায়।
সংঘর্ষে তারা পরাজিত হলো।
উভয় পক্ষের অনেক লোক হতাহত হলো।
গোলাম মাসুমের নেতৃত্বে মুসলমানদের দুঃসাহস এবং বীরত্ব দেখে বিস্মিত হলো আলেকজান্ডার।
এই সংঘর্ষে একজন দারোগা ও একজন জমাদার মুসলিম বাহিনীর হাতে বন্দী হলো।
অবস্থা বেগতিক দেখে আলেকজান্ডার পালিয়ে গেল।
ঐতিহাসিক বাঁশের কেল্লা
আঠারো শো একত্রিশ সাল।
গোটা বছরই নিসার আলীর জন্যে ছিল একটি কঠিন অগ্নিপরীক্ষার কাল।
এই বছরই তাঁকে মুকাবিলা করতে হয়েছে হিন্দু জমিদারদের চ্যালেঞ্চ ও আক্রমণ। একের পর এক।
এরই মধ্যে সংঘর্ষে তাঁকে বেশ কয়েকজন হতাহতও হয়েছে।
অনেকের ঘরবাড়ি, সহায় সম্পদ জ্বালিয়ে ভস্মিভূত করে দিয়েছে জমিদাররা। এসবই ঘটেছে একটি বছরের মধ্যে।
নিসার আলী লক্ষ্য করলেন, এখন আর কেবল হিন্দু জমিদার বা নীল কুঠিয়ালরাই নয়, তাদের সাথে ইংরেজরাও যুক্ত হয়েছে। তারা সম্মিলিতভাবে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ব্যাপারটি বুঝতে পেরে সতর্ক নিসার আলী পূর্ব থেকেই আত্মরক্ষার জন্যে প্রস্তুতি নিলেন।
প্রস্তুতি কার্যক্রম হিসেবে তিনি তৈরি করলেন নারিকেল বাড়িয়ায় বাঁশের কেল্লা।
নিসার আলীর হুজরাকে কেন্দ্র করে তাঁর সাথীরা চারদিকে মোটা মোটা ও মজবুত বাঁশের খুঁটি দিয়ে ঘিরে ফেলেছিলেন।
বাঁশ দিয়ে কেল্লাটি তৈরি করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে ইতিহাসে এটি ‘তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা’ নামে বিখ্যাত হয়ে ওঠে।
মহা সংঘর্ষের সূচনা পর্ব
জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ আলেকজান্ডার পালিয়ে গিয়ে বারাসতে পৌঁছুলো।
সেখানে পৌঁছে সে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে নিসা আলীকে শায়েস্তা করার জন্যে আবেদন জানিয়ে একটি রিপোরট পেশ করলো।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী আলেকজান্ডারে রিপোর্ট পওয়ার পর কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিল।
দেরি না করে কোম্পানী সরকার কর্ণেল স্টুয়ার্টকে সেনাপতি নিযুক্ত করে তার অধীনে একশো ঘোড়সওয়ার গোরা সৈন্য, তিনশো পদাতিক সৈন্য, দুটি কামান ও প্রচুর গোলা বারুদসহ পাঠিয়ে দিল নারিকেল বাড়িয়ার দিকে।
কোম্পানীর সৈন্যরা নারিকেল বাড়ি পৌঁছে গ্রামটিকে অবরোধ করে ফেললো।
সময়টা ছিল আঠেো শো একত্রিশ সালের উনিশে নভেম্বর।
কর্ণেল স্টুয়ার্ট নিসার আলীর হুজরাঘরের সামনে গিয়ে দেখলো, এক ব্যক্তি সাদা তহবন্দ, সাদা পিরহান ও সাদার পাগড়ি পরে তসবিহ হাতে আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন।
স্টুয়ার্ট অবাক হয়ে রামচন্দ্রকে জিজ্ঞেস করলো, “এই ব্যক্তিই তি তিতুমীর? একে তো বিদ্রোহী বলে মনে হয় না?”
রামচন্দ্র বানিয়ে বানিয়ে মনগড়া মিথ্যা বললো, “হ্যা, এই ব্যক্তিই বিদ্রোহী তিতুমীর। নিজেকে তিতু বাদশাহ বলে পরিচয় দেয়। আজ আপনাদের আসার কারণে ভোল পাল্টে সাধু সেজেছে হুজুর!”
স্টুয়ার্ট রামচন্দ্রকে বললো,
“তিতুকে বলুন, আমি বড়ো লাট লর্ড বেন্টিংক-এর পক্ষ থেকে সেনাপতি হিসাবে এসেছি। তিতুমীর যেন আত্মসমর্পণ করেন অথবা তিনি যা বলতে চান তা যেন হুবহু আমাকে বলুন।”
রামচন্দ্র সেসব না বলে বরং তিতুমীরকে বললো: “আপনি কোম্পানী সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এখন জপমালা ধারণ করেছেন। আসুন তরবারি ধারণক বাদশাহর যোগ্য পরিচয় দিন।”
তিতুমীর বললেন, “আমি কোম্পানী সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিনি। হিন্দুদের মতো আমরাও কোম্পানী সরকারের প্রজা। জমিদার নীলকদের অত্যাচার দমনের জন্যে এবং মুসলমান নামধারীদেরকে প্রকৃত মুসলমা বানানোর জন্যে সামা্য চেষ্টা করছি মাত্র।”
নিসার আলীর জবাব শুনার পর রামচন্দ্র দোভাষী হিসাবে স্টুয়ার্টকে সম্পূর্ণ মিথ্যা বললো। সে স্টুয়ার্টকে বুঝালো, “তিতুমীর বলছে আত্মসমর্পণ করবে না। যুদ্ধ করবে। সে বলে যে, তোপ ও গোলাগুলীকে সে তোয়াক্কা করেনা। সে বলে, যে তার ক্ষমতা বলে সবাইকে টপ টপ করে গিলে খাবে। সেই এদেশের বাদশাহ, কোম্পানী আবার কে?”
রামচন্দ্র দোভাষীর কাজ করার সুযোগ নিয়ে মুহূর্তেই জ্বালিয়ে দিল মহা সংঘর্ষের বিধ্বংসী আগুন।
রামচন্দ্রের বিধ্বংসী আগুন।
রামচন্দ্রের বিধ্বংসী আগুন।
রামচন্দ্রের এই বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ মিথ্যাচার এতটুকুও বুজে উঠতে পারেনি স্টুয়ার্ট। রামচন্দ্রের মুখে নিসার আলীর না বলা এইসব বানানো কথা শুনেই স্টুয়ার্ট হিংস্র পশুর মতো ক্ষেপে গেল। এবং তারপর নির্দেশদিল যুদ্ধের।
স্টুয়ার্টের সাথে আরো ছিল তুখোর সৈনিক ক্যাপ্টেন সাদারল্যান্ড, ক্যাপ্টেন শেক্স্পীয়র প্রমুখ।
শেষ সংগ্রাম
রামচন্দ্রের জ্বালিয়ে দেয়া আগুনে জ্বলে উঠলো নারিকেল বাড়িয়া।
মুখোমুখি হলো কোম্পানী সরকারের সশস্ত্র সৈন্য এবং নিসার আলীর সাথীরা।
সে এক অসম যুদ্ধ!
তবুও একটুও ঘাবড়ালেন না নিসার আলীর সাহসী সৈনিকরা। তাঁরা ক্রমাগত এগিযে গেলেন।
এগিযে গেলেন ইংরেজদের কামানের গোলাকে উপেক্ষা করে।
একদিকে ইংরেজদের ভারী কামান, রাইফেল এবং সুশিক্ষিত সৈন্য।
অপরদিকে নিসার আলীর লাঠি, শড়কী ও তীর ধনুকের সজ্জিত একদল জানবাজ দুঃসাহসী বাহিনী।
তারপরও কাঁপলো না মুসলমান বাহিনীর বুক।
তাঁরা তখনো এগিয়ে যাচ্ছেন।
ক্রমাগত সামনে।
এক সময় ইংরেজদের প্রচণ্ড কামানের গোলার মুখে ধ্বংস হয়ে গেল ঐতিহাসিক বাঁশের কেল্লা।
তবুও ভীত সন্ত্রস্ত হলেন না তারা।
আনুগত্য বা আত্মসমর্পণও করলেন না ইংরেজ বাহিনীর কাছে।
নিসার আলী তার সাথীদেরকে জানিয়ে দিলেন, যুদ্ধ চালিয়ে যাও! শাহাদাতই আমাদের সর্বশেষ মঞ্জিল!
নেতার নির্দেশ।
তাঁদের বুকেও ঈমানের সাহসী তুফান।
সেই অশান্ত তুফানে দুলে দুলে উঠছে তাঁদের প্রশস্ত বুক।
তাঁরা ইংরেজ দস্যুদের কামান গোলাকে উপেক্ষা করে সমানে এগিয়ে চলেছেন। এবং তারপর।–
তারপর যুদ্ধ করতে করতে একসময় নিসার আলীসহ অনেকেই ঢলে পড়লেন শাহাদাতের কোমল বিছানায়।
শহীদ হলেন নিসার আলী!
শহীদ হলেন তাঁর পুত্র জওহর আলী ও আন্দোলনের অন্যতম নায়ক ময়েজউদ্দীন।
এভাবে একে একে শহীদ হলেন পঞ্চাশ জন তেজদীপ্ত সৈনিক।
ইংরেজদের হাতে বন্দী হলেন সাড়ে তিনশো বীল মুজাহিদ।
ইংরেজ দস্যুরা যুদ্ধ শেষে মৃতদেহগুলো আগুনে পুড়িয়ে ফেললো।
নিসার আলীর দলের লোকদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিল।
তাঁরেদ সহায় সম্পদ লুট করে নিল এবং সন্দেহভাজনদেরকে গ্রেফতার করলো।
এই সংঘর্ষের পর ইংরেজ সরকার সর্বমোট একশো সাতানব্বই জনের বিচার করেছিল।
এদের মধ্যে প্রধান সেনাপতি- নিসার আলীর ভাগ্নে গোলাম মাসুমকে প্রাণদণ্ড দেয়া হয়েছিল।
এগার জনের যাবজ্জীবন এবং একশো আঠাশ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল।
বিচারকালে চার জনের মৃত্যু হয় এবং তিপ্পান্ন জন খালাস পায়।
এদের মধ্যে ছিলেন- তিতুমীরের দুই পুত্র মীর তোরাব আলী ও মীর গাওহর আলী।
নিসার আলর জ্যেষ্ঠপুত্র গাওহার আলীর বাম হাত গোলার আঘাতে উড়ে গিয়েছিল বলে তাকে কারাদণ্ড থেকে মুক্তি দিযেছিল। আর অন্য পুত্র তোরাব আলীর বয়স কম ছিল বলে তাঁর দু বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল।
নিসার আলীল প্রধান সেনাপতি গোলম মাসুমকে গ্রেফতার করার পর তাঁকে দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে বলা হয়েছিল।
গোলাম মাসুম ইংরেজদের এই প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলেন।
এরপরই কেল্লার পুবপশে গোলাম মাসুমকে ফাঁসি দিয়ে শহীদ করা হয়।
এই যুদ্ধ সম্পর্কে ইংরেজ সেনাপতি মেজর স্টক আফসোসের সাথে মন্তব্য করে বলেছেন:
“যুদ্ধে আমরা জয়ী হয়েছি ঠিকই। কিন্তু এতে প্রাণ দিয়েছেন একজন ধর্মপ্রাণ দেশপ্রেমিক মহাপুরুষ।”
স্কটেরে এই ছোট্ট মন্তব্যটি অবশ্যই ব্যাপক বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
ইংরেজদের সাথে নিসার আলীর এই সর্বশেষ অসম মহা সংঘর্ষেটি বাধে আঠারো শো একত্রিশ সালের উনিশ নভেম্বর।
ফজর নামাযের পর।
শেষের কথা
সতেরো শো সাতান্ন সালের, তেইশে জুন পলাশীর যুদ্ধে সিরাজদ্দৌলাহর পরাজয়ের পর ইংরেজরা বাংলার বুকে শোষণের হাতিয়ার নিয়ে চিরস্থায়ভাবে আসেন গেড়ে বসে যায।
নবাব সিরাজের মৃত্যুর পর ইংরেজরা নবাবের আসনে বসায় কুখ্যাত বিশ্বাসঘাতক- মীর জাফরকে।
সতেরো শো পয়ঁষট্টি সালে মীর জাফর মারাত্মক কুষ্টরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।
মীল জাফর ক্ষমতাচ্যুত হলো সতেরো শো ষাট সালে।
এরপর মীর কাসিম বাংলার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন সেই একই বছরে সতেরো শো ষাট সালে।
মীল কাসিম ছিলেন একজন যোগ্য ও দক্ষ শাসক। তিনি কঠোর হস্তে শাসন কার্য পরিচালনা করতে থাকেন।
ইংরেজদের প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে শাসন পরিচালনার জন্যে নিজস্ব সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলেন এবং রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে মুঙ্গেরে স্থানান্তর করেন।
মীর কাসিম ছিলেন ন্যায়পরায়ণ সাহসী সৈনিক। তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে দেওয়া বিনা শুল্কে বণিজ্য করার অধিকার রহিত করেন। ফলে ইংরেজ বাহিনীর কাছে মীর জাফর পরাচিত হন।
সতেরো শো সাতাত্তর সালে তিনি ইন্তিকাল করেন।
মীর কাসিমের পরাজয়ের পর ইংরেজরা আরও বেশি হিংস্র এবং ক্ষুধার্ত হয়ে উঠলো। ক্ষুধা মিটানোর জন্যে তারা সমগ্র বাংলাকে নিংড়ে চটকে শোষণ করে নিল। তবুও তাদের ক্ষুধার আগুন নেভেনি।
এই ষড়যন্ত্রকারী ইংরেজদের সাথে সেদিন হাত মিলিয়েছিল বাংলার উচ্চবর্ণের হিন্দু এবং জমিদাররা।
ইংরেজদের কৃপায় জমিদারী ক্ষমতা লাভ করার পর এই শ্রেণীর হিন্দুরাও অত্যাচারী হয়ে ওঠে। তাদের আসমুদ্র ক্ষুধা মেটাতে তারাও সকল সময়ে বাংলার সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, তাঁতী প্রভৃতি শ্রেণীর মানুষকে সাধ্য মতো শোষণ করেছে।
একদিকে ইংরেজের অত্যাচার।
অপরদিকে হিন্দু জমিদারদের নিপীড়ন।
তার পাশাপাশি চলেছে নীল কুঠিয়ালদের নির্যাতন।
এই ত্রিবিধ অত্যাচার আর শোষণের যাঁতাকলে বাংলার মানুষেরা শোষিত হয়ে এসেছে বরাবর।
তাদের শাসন আর শোষণ থেকে মুক্তির জন্যে এই বাংলার মাটিতে সংগ্রামের অগ্নিশিখা জ্বলে উঠেছে বারবার।
অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি সেইসব সংগ্রামী পুরুষ।
নবাব সিরাজুদ্দৌলাহ, মীর কাসিমসহ অসংখ্য দুঃসাহী পুরুষ নিজেদের জীবনকে বিলিয়ে দিয়ে বাংলঅর মানুষের মুক্তির জন্যে সংগ্রাম করে গেছেন। এই সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় এসেছেন মজনু শাহ। যিনি ‘ফকির বিদ্রোহের’ মাধ্যমে ইংরেজদের বিরুদ্ধে আমৃত্যু লড়ে গেচেন। তাঁর এই নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চলেছিল সতেরো শো চৌষট্টির পর থেকে একটানা আঠারো শো তেত্রিশ- চৌত্রিশ সাল পর্যন্ত।
সংগ্রামের ধারাবাহিতকায় এসেছে সাইয়েদ আহমদ বেরেলভী। এসেছেন হাজী শরীয়তুল্লাহ, সাইয়েদ নিসার আলী তিতুমীর প্রমুখ দুঃসাহসী সংগ্রামী নেতা।
বাংলার মাটি মানেই সাহসের আগ্নেয়গিরি!
এই বাংলায় প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের জন্যে সংঘটিত হয়েছে ফকির বিদ্রোহ। হয়েছে ফরায়েজী আন্দোলন, সাইয়েদ আহমদ বেরেলভীর জিহাদী আন্দোলন এবং নিসার আলীর অগ্নিময় সংগ্রামী আন্দোলন।
আঠারো শো সাতান্ন সালে আজাদী আন্দোলনও ছিলইংরেজ ও হিন্দু জমিদার কর্তৃক মুসলমানদের ওপর অমানুষিক ও পৈশাচিক আচরণের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণ।
সতেরো শো সাতান্ন সাল থেকে পরবর্তী সময়গুলো ছিল মুসলমানদের জন্যে একটি কঠিন অগ্নি পরীক্ষার সময়।
মুসলমানদরে হাত থেকে ক্ষমতা, রাজত্ব চলে যাবার পর সমগ্র বাংলায় ইংরেজ ও তাদের দোসররা কায়েম করেছিল অরাজকতার এক ভয়াবহ জাহান্নাম।
মুসলমানকে তারা কেবল রাজ্য ও ক্ষমতাচ্যুতই করেনি- তাদেরকে নিশ্চিহ্ন এবং নির্মূল করার জন্যেও চালিয়েছিল ষড়যন্ত্র আর শোষণের নব নব কৌশল।
অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় ক্ষে্রেও তারা বিস্তার করেছিল তাদের কালো থাবা। অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত নিম্নবিত্ত মুসলমানকে তারা বিভিন্ন অপকৌশলে বিভ্রান্ত করতো। নিজস্ব ধর্ম এবং সংস্কৃতি থেকে তাদের সুকৌশলে দূরে সরিয়ে রাখতো।
নিসার আলীর সময়েও মুসলমানদের ওপর চলছিল তাদের এইসব অপতৎপরতা।
সময়টা এতোই নাজুক হয়ে পড়েছিল যে, তারা ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছিল।
মুসলমানের বুকের ওপর চেপে বসেছিল ইংরেজ এবং জমিদাররা।
তারা মুসলমানী সংস্কৃত বাদ দিযে তাদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দিয়েছিল হিন্দুয়অনী সংস্কৃতি। তহবন্দের পরিবর্তে ধূতি, সালামের পরিবর্তে আদাব-নমস্কার, পূজার জন্যে পশু আদায়, চাঁদা আদায়, দাড়িরর ওপর ট্যাক্স, মসজিদ তৈরি করলে নজরানা, খাজনা, গরু জবাই করলে ডান হাত কেটে দেয়া প্রভৃতি জুলুমের অষ্টপ্রহর চলছিল মুসলমানের ওপর।
সমগ্র বাংলার অবস্থা যখন এমনি নাজুক, ঠিক তখনি জিহাদী আন্দোলনের ডাক দিরেণ সংগ্রামী এক নেতা- সাইয়েদ নিসার আলী। তাঁর সংগ্রাম ছিল জমিদার প্রথার বিরুদ্ধেও। তিনি বললেন- “লাঙ্গল যার জমি তার।”
তিনি আবার বললেন- “প্রত্যেকের শ্রমের ফসল তাকেই ভোগ করতে দিতে হবে।”
সাধারণ মুসলমানের নৈতিক অধঃপতন থেকে মুক্ত করার জন্যে তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন।
বাংলার মানুষকে মুক্ত করার জন্যে, তাদের অধিকার এবং স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্যে নিসার আলীকে একই সাথে হিন্দু জমিদার, নীল কুঠিয়াল এবং ইংরেজ দস্যুদের মুকাবিলা করতে হয়েছে।
তিনি যে সংগ্রাম করেছিলেন তা পরবর্তীকালে মুসলমানদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও আজাদীর পথে এক অসামান্য আলোকবর্তিকার কাজ করেছে।
কাজটি আদৌ সহজ ছিলনা। পথটিও ছিলনা মসৃণ।
কাজটি ছিল অত্যন্ত কঠিন। কঠিন এবং দুঃসাধ্য।
এই দুঃসাধ্য কাজটি করতে করতে বাংলার মুসলমানদের বুকে স্বপ্ন এবং সংগ্রামের আগুন উসকে দিয়ে দুঃসাহসী অগ্রসেনানী একদিন শহীদ হয়ে গেলেন।
শহীদের পেয়ালা হাসিমুখে পান করলেন বাংলার এক সাহসী সেনাপতি সাইয়িদ নিসার আলী তিতুমীর।
সাইয়েদ নিসার আলী!
নিসার আলী চিলেন বাংলার মুসলমানের জন্যে সংগ্রাম, শাহাদাত ও আজাদী আন্দোলনৈর এক অসাদারণ স্বপ্নপুরুষ।
এক নজরে নিসার আলী
নাম: সাইয়েদ নিসার আলী। পরিচিতি ও খ্যাতিতে যুক্ত হয় ‘তিতুমীর’।
পিতা : সাইয়েদ (মীর) হাসান আলী।
মাতা: আবেদা রোকাইয়া খাতুন।
জন্ম : ১৭৮২ সাল।
জন্মস্থান: গ্রাম- চাঁদপুর, জিলা- চব্বিশ পরগণা।
ছোটদাদা: সাইয়েদ ওমর দারাজ রাজী।
বিবাহ: স্ত্রী- মায়মুনা সিদ্দিকা।
শ্বশুর: শাহ সুফী মুহাম্মদ রহীমুল্লাহ সিদ্দিকী।
দাদা শ্বশুর : শাহ সুফী মুহাম্মদ আসমতুল্লাহ সিদ্দিকী।
সন্তান: প্রথম পুত্র- সাইয়েদ গাওহার আলী। ১৮৩১ সালে ১৯ নভেম্বর নারিকেল বাড়িয়ার সংঘর্ষে তার একটি হাত উড়ে যায় কামানের গোলায়।
দ্বিতীয় পুত্র : সাইয়েদ জওহার আলী। ঐ একই সংঘর্ষে পিতার সাথে শহীদ হন।
তৃতীয় পুত্র: সাইয়েদ তোরাব আলী। বয়স অল্প হওয়া সত্ত্বেও নারিকেল বাড়িয়ার সংঘর্ষে অংশগ্রহণ কনে এবং মারাত্মকভাবে আহত হন।
বংশপরম্পরা: সাইয়েদ আব্বাস আলী ও সাইয়েদ শাহাদাত আলী ছিলেন আপন দুই ভাই। তারা ছিলেন দরবেশ এবং ইসলাম প্রচারক।
শাহাদাত আলীর ওরসে জন্মগ্রহণ করেন সাইয়েদ হাসমত আলী। তিনিও ছিলেন দরবেশ এবং ইসলাম প্রচারক। এই দরবেশ এবং ইসলাম প্রচারক পরিবারের হাশমত আলীর ত্রিশতম অধস্তন হলেন সাইয়েদ নিসার আলী।
শিক্ষা জীবন: ১৭৮৬ সাল। চার বছর চার মাস চার দিন বয়সে প্রথম ধর্মীয় তালিমৈর মাধ্যমে শিক্ষা জীবন শুরু।
তারপর বাড়িতেই পণ্ডিত লাল মিয়ার কাছে আরবী, ফারসী ও উর্দু ভাষা শেখেন।
পণ্ডিদ রাম কমল ভট্টাচার্যের কাছে শেখেন বাংলা, গণিত প্রভৃতি বিষয়।
হাফেজ নিয়ামতুল্লাহকে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দিযে চাঁদপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি আধুনিক মাদ্রাসা। সেই মাদ্রাসায় হাফেজ নিয়ামতুল্লাহর কাছে নিসার আলী পরবর্তী শিক্ষা গ্রহণ করেন। এ সময়ের মধ্যে তিনি কুরআনে হাফেজ হন। আরবী ব্যাকরণ, তাসাউফ, ফারায়েজ, আরবী, ফারসী কাব্য ও সাহিত্যে তিনি যথেষ্ট পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। এসব ভাষায় তিনি অনর্গল বক্তৃতাও দিতে পারতেন।
শিক্ষাজীবন সমাপ্তি: ১৮০৪ সালে। ১৮ বছর বয়সে।
ছোট দাদার ইন্তিকাল: নিসার আলীর বিয়ের ১৪ দিন পর ইন্তিকাল করেন চোট দাদা সাইয়েদ ওমর দারাজ রাজী।
পিতার ইন্তিাকাল: এর ৬ মাস পর ইন্তিকাল করেন পিতা হাসান আলী।
ভ্রমণ:প্রিয় শিক্ষক হাফেজ নিয়ামতুল্লাহর সাথে ছাত্রাবস্থায় সেই কৈশোর বয়সে ভ্রমণ করেন বাংলার বাইরে- বিহার শরীফ ও তার আশ-পাশের বেশ কয়েকটি দেশ।
বিয়ের দেড় বছর পর কলকাতায় আসেন। ওঠেন তালতলায় বিখ্যাত ব্যক্তি হাফেজ মুহাম্মদ ইসরাইলের বাসায়।
হজ্জ পালনের জন্যে মক্কায় যাবারপর তিনি ভ্রমণ করেন মক্কা ছাড়াও মদীনা, কূফা,কারবালা, দামেশক, সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশও পবিত্র স্থানসমূহ।
কুস্তিশিক্ষা: চাঁদপুরও কলকাতার তালতলার আখড়ায়।
ধর্মীয় মুর্শিদ বা পীর: সাইয়েদ আহমদ বেরেলভী।
১৮২৩ সালে মক্কায় হজ্জ করতে গেলে বেরেলভীর সাথে সাক্ষাত হয় এবং তিনি তাঁর মুরীদ হন।
স্বদেশের পথে: ১৮২৭ সালে মক্কা থেকে ফিরে আসেন স্বদেশে। মক্কায় ছিলেন দীর্ঘ ৪ বছর।
দাওয়াতী কার্যক্রম শুরু : মক্কা থেকে ফেরার পর। অর্থাৎ ১৮২৭ সালে দাওয়াতী কার্যক্রম শুরু করেন।
প্রথম সংঘর্ষ: ১৮৩১ সালে। খাসপুরের জমিদারের সাথে এবং বিজয় লাভ।
দ্বিতীয় সংঘর্ষ :১৮৩১ সালের ১৭ অক্টোবর, পুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায়েল সাথে এবং বিজয় লাভ।
তৃতীয় সংঘর্ষ: ১৮৩১ সালের নভেম্বরের প্রথমদিকে। কয়েকজন ইংরেজ এবং কৃষ্ণদেবের সাথে। এখানেও নিসার আলীর সাথীরা বিজয় লাভ করলেন। এই সংঘর্ষের মধ্যেই প্রাণে বাঁচারজন্যে বজরায় উঠতে ব্যর্থ হয়ে কৃষ্ণদেব নদীতে ডুবে মারা যায়।
চতুর্থ সংঘর্ষ: ১৮৩১ সালের ১৪ নভেম্বর। নারিকেল বাড়িয়ার তিন ক্রোশ দূরে, বাদুরিয়ায়। প্রতিপক্ষ ছিল বরাসাতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ আলেকজান্ডার, একজন হাবিলদার, একজন জমাদার এবং পঞ্চাশজন সশস্ত্র সিপাহী। বশির হাটের দারোগাও সিপাই জমদাদারসহ বাদুরিয়ায় আলেকজান্ডারের সাথে মিলিত হয়ে আক্রমণ করে। এই সংঘর্ষেও বিজয়ী হন নিসার আলী।
বাঁশের কেল্লা নির্মাণ: ১৮৩১ সালের নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে, নারিকেল বাড়িয়ায়।
সর্বশেষ সংঘর্ষ: ১৮৩১ সালের ১৯ নভেম্বর। বাদ ফজর। নারিকেল বাড়িয়ায়। সুসজ্জিত ইংরেজ বাহিনীর সাথে তাঁর সর্বশেষ সংঘর্ষ হয়।
শাহাদাত : ১৮৩১ সালের ১৯ নভেম্বর। নারিকেল বাড়িয়ায় যুদ্ধে।
সংগ্রামেরশুরু : ১৮২৭ সাল। মক্কা থেকে স্বদেশে ফিরে এসে।
সংগ্রামী জীবনের শেষ: ১৮৩১ সালের ১৯ নভেম্বর। শাহাদাতের মাধ্যমে।
সংগ্রামের সময়কাল: ১৮২৭ থেকে ১৮৩১ সাল; ৪ বছর।
জীবন কাল: ১৭৮২ থেকে ১৮৩১ সাল; ৪৯ বছর।