আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের অর্থ
আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের তাৎপর্য সম্পর্কে কুরআন মজীদে বলা হয়েছে : মানুষের জীবন-মরণ, ইবাদাত-বন্দেগী, কুরবানী ইত্যাদি সবকিছু একমাত্র আল্লাহ তাআলার জন্যই নির্ধারিত হবে। এজন্যই নির্দিষ্ট করে তাঁর ইবাদাত করবে :
নিশ্চয়ই আমার সালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মৃত্যু একমাত্র রাব্বুল আলামীন আল্লাহর জন্যই উৎসর্গীকৃত। সূরা আল আনআম : ১৬২
সে পূর্ণ একাগ্রতার সাথে দীনকে একমাত্র আল্লাহ তাআলার সম্বন্ধে এমন বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন যে, এর অর্থ ও তাৎপর্যের ভিতর কোনোটাই অস্পষ্টতা নেই।
তাঁর বাণী সমূহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের অর্থ হচ্ছে :
গোপনে এবং প্রকাশ্যে সকল কাজেই আল্লাহ তাআলাকে ভয় করো।
নিজের উপায়-উপাদানের তুলনায় আল্লাহ তাআলার মহান শক্তির উপরেই অধিক ভরসা করা এবং আল্লাহ তাআলাকে সন্তুষ্ট করার জন্য লোকের বিরাগভাজন হওয়া। এর সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থা হচ্ছে লোকের সন্তুষ্টিলাভের জন্য আল্লাহ তাআলার অসন্তোষ অর্জন করা অতপর এ সংযোগ-সম্পর্ক যখন বৃদ্ধি পেয়ে এমন অবস্থায় উপনীত হবে যে, লোকের সাথে বন্ধুত্ব, শত্রুতা এবং লেন-দেন ইত্যাদি সবকিছুই একমাত্র আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্যেই সম্পন্ন হবে, নিজের ইচ্ছা প্রবৃত্তি বা আগ্রহ ঘৃণার বিন্দুমাত্র প্রভাবও সেখানে থাকবে না, তখনই বুঝতে হবে যে, আল্লাহ তায়ালার সাথে তার সম্পর্ক পরিপূর্ণ হয়েছে।
এছাড়া প্রত্যেক রাতে আপনার দোয়ায়ে কুনুতে যা পাঠ করেন, তার প্রতিটি শব্দই আল্লাহ তাআলার সাথে আপনার এ সম্পর্কের পরিচয় দিচ্ছে। আপনারা আল্লাহ তাআলার সাথে কোন ধরনের যোগ-সম্পর্ক স্থাপনের স্বীকৃতি দিচ্ছেন, তা এ দোয়ার শব্দাবলীর প্রতি লক্ষ্য করলেই সুন্দরূপে বুঝতে পারেন।
হে আল্লাহ! আমরা তোমার কাছে সাহায্য চাচ্ছি, তোমারই কাছে সরল-সত্য পথের নির্দেশ চাচ্ছি, তোমারই কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করছি, তোমারই উপরে আস্থা স্থাপন করছি, তোমারই উপর ভরসা করছি এবং তোমার যাবতীয় উত্তম প্রশংসা তোমার জন্য নির্দিষ্ট করছি। আমরা তোমারই কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ, তোমার অকৃতজ্ঞ দলে শামিল নই। তোমার অবাধ্য ব্যক্তিকে আমার বর্জন করে চলি। হে আল্লাহ! আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদাত করি, তোমারই জন্য সালাত আদায় করি, সেজদা করি এবং তোমার জন্যই আমাদের যাবতীয় চেষ্ট-তৎপরতা নিবদ্ধ। আমরা তোমার অনুগ্রহ প্রার্থী এবং তোমার শাস্তি সম্পর্কে ভীত-সন্ত্রস্ত। নিশ্চয়ই তোমার যাবতীয় আযাব কাফেরদের জন্য নির্দিষ্ট।
হযরত রাসূলে করীম (স) তাহাজ্জুদের জন্য উঠার সময় যে দোয়া পাঠ করতেন তাতেও আল্লাহ তাআলার সাথে এ সম্পর্কের একটি চিত্র পাওয়া যায়। তিনি আল্লাহ তাআলাকে উদ্দেশ্য করে বলতেন:
হে আল্লাহ! আমি তোমারই অনুগত হলাম, তোমার প্রতি ঈমান আনলাম, তোমার উপর ভরসা করলাম, তোমার দিকে আমি নির্বিষ্ট হলাম, তোমার জন্যই আমি লড়াই করছি এবং তোমার দরবারেই আমি ফরিয়াদ জানাচ্ছি।
আল্লাহর সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির উপায়
আল্লাহ তাআলার সাথে একজন মুমিনের যে সম্পর্ক থাকা উচিত, উপরে তার সঠিক বর্ণনা দেয়া হলো। এখন এ সম্পর্ক এবং তা বৃদ্ধি করা যায় কিভাবে তা-ই আমাদের চিন্তা করে দেখতে হবে।
এ সম্পর্ক স্থাপনের একটি মাত্র উপায় রয়েছে, তা এই যে, মানুষকে সর্বান্তকরণে এক ও লা-শরীক আল্লাহ তাআলাকে নিজের এবং সমগ্র জগতের একমাত্র মালিক, উপাস্য এবং শাসকরূপে স্বীকার করতে হবে। প্রভূত্বের যাবতীয় গুনাবলী, অধিকার ও ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ তাআলার জন্যই নির্দিষ্ট বলে গ্রহণ করতে হবে। নিজের মন-মস্তিষ্ককে নির্মল ও পবিত্র রাখতে হবে। এ কাজটি সম্পাদনের পরই আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এসম্পর্ক দুটি উপায়ে বৃদ্ধি করা যেতে পারে। প্রথমটি হলো চিন্তা ও গবেষণার পন্থা আর দ্বিতীয়টি হলো বাস্তব কাজের পন্থা।
চিন্তা ও গবেষণার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির উপায় হলো পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসসমূহের সাহায্য এ ধরনের সংযোগ সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান লাভ করা।এভাবে আল্লাহ তাআলার সাথে আপনার যে স্বাভাবিক সম্পর্ক রয়েছে কার্যত যে রূপ সম্পর্ক থাকা উচিত সেই বিষয়ে আপনাকে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করতে হবে। এ ধরনের যোগসূত্র সম্পর্ক স্পষ্ট ধারণা লাভ করতে হবে। এধরনের যোগসূত্র সম্পর্ক স্পষ্ট ধারণা ও অনুভূতি লাভ এবং এটাকে সর্বদা স্মরণ রাখতে হবে, পবিত্র কুরআন-হাদীস বুঝে পাঠ করতে হবে এবং বারবার অধ্যয়ন করতে হবে। পবিত্র কুরআন-হাদীসের আলোকে যে সকল বিষয়ে আল্লাহ তাআলার সাথে আপনার যোগ সম্পর্ক আপনাকে বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে। আল্লাহ তাআলার সাথে আপনি কোন কোন বিষয়ে কতখানি দাবী আপনি পূরণ করেছেন, কোন বিষয়ে কতখানি ত্রুটি অনুভব করেছেন, আপনাকে তা যাচাই করে দেখতে হবে। এ অনুভূতি সমীক্ষা যতখানি বৃদ্ধি পাবে, ইনশাআল্লাহ আপনার সাথে আল্লাহ তাআলার যোগ সম্পর্কও ততই বাড়তে থাকবে।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, আল্লাহ তাআলার সাথে আপনার একটি সম্পর্ক এই যে, তিনি আপনাদের মাবুদ এবং আপনারা তাঁর গোলাম। দ্বিতীয় সম্পর্ক হলো, পৃথিবীর বুকে আপনার তাঁর প্রতিনিধি। আর তিনি অসংখ্য জিনিস আপনাদের কাছে আমানত রেখেছেন। তৃতীয় সম্পর্ক এই যে, আপনারা তাঁর প্রতি ঈমান এনে একটি বিনিময় চুক্তি সম্পাদন করেছেন। সেই অনুসারে আপনাদের জান ও মাল বিনিময়ে চুক্তি সম্পাদন করেছেন। সেই অনুসারে আপনাদের জান ও মাল তাঁকে প্রদান করেছেন। এবং তিনি জান্নাতের বিনিময়ে তা খরিদ করে দিয়েছেন। চতুর্থ সম্পর্ক এই যে, আপনাকে তাঁর নিকট জবাবাদিহি করতে হবে এবং তিনি শুধু আপনার প্রকাশ্য বিষয়সমূহের প্রতি লক্ষ্য রেখেই হিসেবে গ্রহণ করবেন না। বরং আপনার প্রত্যেকটি কাজ, আপনার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ইত্যাদি সম্পর্কে তাঁর নিকট সুস্পষ্ট দলীল-প্রমাণ রয়েছে: তার দৃষ্টিতে তিনি আপনার পুংখানুপুংখ হিসেবে গ্রহণ করবেন। মোটকথা, এরূপ অনেক বিষয়ে আল্লাহ তাআলার সাথে আপনার সম্পর্ক রয়েছে। এই সকল সংযোগ-সম্পর্ক স্পষ্ট ধারণা লাভ করা, তাংপর্য উপলব্ধি করা ও এর সদাসর্বদা স্মরণ রাখা এবং এর দাবীগুলো পূরণ করার উপরই আল্লাহ তাআলার সাথে আপনাদের সম্পর্ক-সংযোগ গভীর ও ঘনিষ্ঠতর হওয়া নির্ভর করেছে। পক্ষান্তরে এ ব্যাপারে আপনারা যতখানি সর্তক ও মনোযোগী হবেন, ততই আল্লাহ তাআলার সাথে আপনাদের সম্পর্ক গভীর ও মযবুত হবেন, ততই আল্লাহ তাআলার সাথে আপনাদের সম্পর্ক গভীর ও মযবুত হবেন, ততই আল্লাহ তাআলার সাথে আপনাদের সম্পর্ক গভীর ও মযবুত নিয়ে বেশীদুর অগ্রসর হওয়াই সম্ভব নয়। বাস্তব কাজ বলতে বুঝায় নিষ্ঠার সাথে আল্লাহ তাআলার যাবতীয় নির্দেশিত কাজ সম্পন্ন করা।
এ সমস্ত কাজে কোনো পার্থিব স্বার্থ নয় বরং আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিলাভ করাকেই একমাত্র উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। আল্লাহ তাআলা যে সমস্ত কাজ নিষিদ্ধ করেছেন, গোপনে ও প্রকাশ্যে যে কোনো অবস্থায় তা আন্তরিক ঘৃণার সাথে বর্জন করতে হবে। এবং এর মূলেও কোনো প্রকার পার্থিব ক্ষতি বা বিপদের আশাংকা নয়, বরং আল্লাহ তাআলার গযব বা শাস্তির ভয়কেই বিশেষভাবে সক্রিয় রাখতে হবে। এভাবে আপনার যাবতীয় কার্যকলাপ তাকওয়ার পর্যায়ে উপনীত হবে এবং এর পরবর্তী কর্মপন্থা আপনাকে ইহসানের স্তরে উন্নীত করবে। অর্থ্যাৎ আল্লাহ তাআলার পছন্দ অনুসরে প্রত্যেকটি ন্যায় ও সৎকাজের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় আপনি আগ্রহের সাথে আত্মনিয়েগের করবেন এবং তার অপছন্দীয় প্রত্যেকটি অন্যায় ও অসৎকাজের প্রতিরোধ চেষ্টায় ব্রত হবেন। এ পথে আপনি নিজের জান-মাল, শ্রম এবং মন-মগযের শক্তি সামর্থ কুরবানী করার ব্যাপারে কোনো প্রকার কার্পণ্য করবেন না। শুধু তাই নয়, এপথে আপনি যা কিছু কুরবানী করবেন সেই জন্য আপনার মনে বিন্দুমাত্র গর্ব অনুভূত হওয়া উচিত নয়। আপনি কারো প্রতি কিছুমাত্র অনুগ্রহ করেছেন এরূপ ধারণাও কখনো পোষণ করবেন না। বরং বৃহত্তর কুরবানীর পরও যেন আপনার মনে একথাই জাগ্রত থাকে যে, সৃষ্টিকর্তার প্রতি আপনার যে দায়িত্ব রয়েছে, এতসব করার পরও তা পালন করা সম্ভব হয়নি।
আল্লাহর সাথে সম্পর্কের বিকাশ সাধনের উপকরণ
প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের কর্মপন্থা অনুসরণ করা মোটেই সহজসাধ্য নয়। এটা অত্যন্ত দুর্গম লক্ষ্যস্থল। এ পর্যন্ত পৌছুতে হলে বিশেষ শক্তি সামর্থের প্রয়োজন। নিম্নলিখিত উপায়ে এ শক্তি অর্জন করা সম্ভব।
এক . সালাত : শুধু ফরজ ও সুন্নত ই নয় , বরং সাধ্যানুযায়ী নফল সালাতও আদায় করা দরকার। কিন্ত নফল সালাত অত্যন্ত গোপনে আদায় করতে হবে, এবং আপনার মধ্যে নিষ্ঠার ভাব জাগ্রত হয়। নফল পড় বিশেষত তাহাজ্জুদ পড়ার কথা বাহির করতে থাকলে মানুষের মধ্যে এক প্রকার মারাত্মক। অন্যান্য নফল সাদকা এবং যিকর-আযকারের প্রচারের মধ্যেও অনুরূপ ক্ষতির আশাংকা রয়েছে।
দুইঃ আল্লাহর যিকর- জীবনের সকল অবস্থাতেই আল্লাহ তাআলার যিকর করা উচিত। কিন্তু বিভিন্ন সুফী সম্প্রদায় এজন্য যে সমস্ত প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেছেন কিংবা অপরের নিকট হতে গ্রহণ করেছেন,তা মোটেই ঠিক নয়। বরং এ সম্পর্কে রাসূলে করীম (স) যে পন্থা অনুসরণ করেছেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে শিক্ষা দিয়েছেন তাই হচ্ছে উত্তম ও সঠিক প্রক্রিয়া। হুজুরে আকরাম (স) এর অনুসৃত দোয়া, যিকর ইত্যাদির মধ্যে যতখানি সম্ভব আপনারা মুখস্ত করে নিবেন এবং শব্দ এ তার অর্থ উত্তমরূপে বুঝে নিবেন; অর্থের প্রতি লক্ষ্য রেখে তা মাঝে মাঝে পড়তে থাকবেন। বস্তুত আল্লাহ তাআলার কথা স্মরণ রাখা তা মাঝে মাঝে পড়তহে থাকবেন। বস্তুত আল্লাহ তাআলার কথা স্মরণ রাখা এবং তাঁর প্রতি মনকে নিবিষ্ট রাখার জন্য এটা একটি বিশেষ কার্যকরী পন্থা।
তিনঃ সওম : শুধু পরয নয় ; বরং নফল সওমও প্রয়োজন। প্রত্যেক মাসে নিয়মিত তিনটি সওম রাখাই উত্তম। নফল সম্পর্ক এটাই বিশেষ উপযোগী ব্যবস্থা। এ সময়ে সওমের মূল উদ্দেশ্য অর্থাৎ কুরআন শরীফে বর্ণিত তাকওয়া অর্জনের জন্য বিশেষভাবে চেষ্টা করা উচিত।
চারঃ আল্লাহর পথে অর্থ খরচ করা :
এ ব্যাপারে শুধু ফরযই নয়; সাধ্যানুসারে নফলও আদায় করতে হবে। এ সম্পর্কে একটি কথা উত্তমরূপে বুঝে নেয়া দরকার যে, আপনি আল্লাহ তাআলার পথে কি পরিমাণ অর্থ-সম্পদ ব্যায় করেছেন,মূলত তার কোনো গুরুত্ব নেই; বরং আপনি আল্লাহর জন্য কতখানি কুরবানী করলেন তা-ই হচ্চে প্রকৃত আপনি আল্লাহর জন্য কতখানি কুরবানী করলেন তা-ই হচ্ছে প্রকৃত বিচার্য। একজন গরীব যদি অভূক্ত থেকে আল্লাহর রাস্তায় একটি পয়সাও ব্যয় করে তবে তার সেই পয়সাটি ধনী ব্যক্তির এক হাজার টাকা হতে উত্তম। ধনী ব্যক্তির এক হাজার টাকা হয়তো তার ভোগ সামগ্রীর দশমাংশ কিংবা বিশ ভাগের এক ভাগ মাত্র। এ প্রসংগে আরও একটি কথা স্মরণ রাখা দরকার, আত্মার বিশুদ্ধিকরণের (তাযকিয়ায়ে নাফস) জন্য আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (স) যে সব পন্থা নির্দেশ করেছেন তার মধ্যে সাদকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এর কার্যকরী ক্ষমতা সম্পর্কে আপনি অনুশীলন করে দেখতে পারেন কোনো ব্যাপারে আপনার একমাত্র ত্রুটি-বিচ্যুতি হলে আপনি অনুতপ্ত হৃদয়ে শুধু তাওবা করেই ক্ষান্ত হবেন। ঘটনাক্রমে পুনরায় যদি ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটে তখন আপনি তাওবা করার সাথে সাথে সাদকা করলে আত্মা অধিকতর বিশুদ্ধ হয়ে থাকে এবং অসৎ চিন্তার মুকাবিলায় আপনি অধিক সাফল্যের সাথে অগ্রসর হতে পারবেন।
পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ আমাদেরকে এ সহজ-সরল পন্থা অনুসরণেরই নির্দেশ দান করেছে। নিষ্ঠার সাথে এর অনুশীলন করলে কঠোর সাধনা, তপস্যা কিংবা মোরাকাবা ছাড়াই আপনি নিজ গৃহে স্ত্রী-পুত্রাদির সাথে অবস্থান করে এবং সমস্ত সাংসারিক দায়িত্ব পালন করেই আল্লাহ তাআলার সাথে সংযোগ সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে সক্ষম হবেন।
আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পর্ক যাচাই করার উপায়
এখন একটি সমস্যার সমাধান হওয়া আবশ্যক। তা এই যে, আল্লাহ তাআলার সাথে আমাদের সংযোগ-সম্পর্ক কতখানি স্থাপিত হয়েছে তা কিভাবে ও কি উপায়ে বুঝবো? আল্লাহ তাআলার সাথে আমাদের সম্পর্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে, না হ্রাস পাচ্ছে তা-ই বা আমরা কি উপায় বুঝবো? এর জবাবে আমি আপনাদেরকে বলতে চাই যে, এটা অনুভব করার জন্য স্বপ্নযোগে সু-সমাচার প্রাপ্ত অথাব কাশফ ও কারামত যাহির করার প্রয়োজন নেই; কিংবা অন্ধকার কুঠরীর মধ্যে বসে আলোক প্রাপ্তির অপেক্ষা করার কোনো আবশ্যক নেই। এ সম্পর্ক পরিমাপ করার ব্যবস্থা তো আল্লাহ তাআলা প্রত্যেকটি মানুষের অন্তরে করেই রেখেছেন। আপনি জাগ্রত জীবন ও কর্ম প্রচেষ্টা এবং দিনের বেলায়ই তা পরিমাপ করে দেখতে পারেন। নিজের জীব্ন ও কর্ম প্রচেষ্টা এব আপনার চিন্তা-ভাবধারা সম্পর্কে পর্যালোচনা করে দেখুন। নিজের হিসেব-নিকেশ আপনি নিজেই ঠিক করে দেখুনঃ আল্লাহ তাআলার সাথে যে চুক্তিতে আপনি আবদ্ধ রয়েছেন তা কতখানি পালন করেছেন। আল্লাহ তাআলার আমানাতসমূহ কি আপনি একজন আমানাতদার হিসেবে ভোগ-ব্যবহার করেছেন, না আপনার দ্বারা কোনো প্রকার খেয়ানত হচ্ছে? আপনার সময়, শ্রম, যোগ্যতা, প্রতিভা, ধন-সম্পদ ইত্যাদির কতটুকু আল্লাহ কাজে ব্যয়িত হচ্ছে আর কতটুকু অন্য পতে নিয়োজিত হচ্ছে? আপনার স্বার্থ কিংবা মনোভাবের উপর আঘাত লাগলে আপনি কতখানি বিরক্ত ও রাগান্বিত হন। তখনই বা আপনার ক্রোধ, মর্মপীড়া, মানসিক অশান্তি কতখানি হয়? এরূপ আরো অনেক প্রশ্ন আপনি নিজের বিবেকের কাছে জিজ্ঞেস করতে পারেন এবং এ সমস্ত প্রশ্নের জবাবের উপর ভিত্তি করে আপনি প্রত্যেহ বুঝতে পারেন যে, আল্লাহ তাআলার সাথে আপনার কোনো সম্পর্ক ও যোগ আছে কিনা? থাকলে তা কতখানি এবং তা বৃদ্ধি পাচ্ছে, না কমে যাচ্ছে? কাজেই স্বপ্নের সুসংবাদ, কাশফ-কারামত, কিংবা নূরের তাজাল্লী ইত্যাদি অতি-প্রাকৃতিক উপায় অবলম্বনের চেষ্টা হতে আপনি বিরত থাকুন। প্রকৃতপক্ষে এ বস্তুজগতের প্রবঞ্চনামূলক বৈচিত্রের প্রলোভন ও ভয়ভীতির মুকাবিলায় সরল-সত্য পথে মযবুতভাবে কায়েম থাকা অপেক্ষা বড় কারামত আর কিছুই হতে পারে না। কুফরী, ফাসেকী ও গুমরাহীর ঘনঘোর অন্ধকারের মধ্যে সত্যের আলো দেখতে পাওয়া এবং তা অনুসরণ করার চেয়ে কোনো বড় নূরের তপস্যা থাকতে পারে না। তার মুমিনগণ সবচেয়ে বড় সুসংবাদ লাভ করতে চাইলে-আল্লাহ তাআলাকে নিজের রব (প্রভু ও পালনকর্তা) হিসেবে স্বীকার করে এর উপর দৃঢ়ভাবে কায়েম থাকা এবং তাঁর প্রদর্শিত পথে চলাই হচ্ছে এর একমাত্র উপায়।
যারা বলছে যে, আল্লাহ আমাদের রব অতপর তারা এ ব্যাপারে অটল-অবিচল থাকে, নিসন্দেহে তাদের উপর ফেরেশতা নাযিল হয় (এবং তাদেরকে বলে) তোমরা ভয় করো না, দু:খ করো না, বরং তোমাদের সাথে যে জান্নাতের ওয়াদা করা হয়েছে তার সুসংবাদে আনন্দিত হও। সূরা হা-মীম আস সিজদা : ৩০
আখেরাতের অগ্রাধিকার দান
আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পর্ক-সংযোগ স্থাপনের পর আমি আপনাদের আরো একটি কথা বলতে চাই। তা এই যে, আপনারা সকল অবস্থায়ই পার্থিব সুযোগ-সুবিধার চেয়ে আখেরাতের প্রতি অধিক গুরুত্ব আরোপ করবেন ও নিজেদের কাজের মূলে আখেরাতের সাফল্য লাভের আকাঙ্ক্ষাকেই একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করবেন।
কুরআন মজীদ আমাদেরকে বলছে, স্থায়ী অনন্ত জীবন ক্ষেত্র হচ্ছে আখেরাত। দুনিয়ার এ অস্থায়ী বাসস্থানে আমাদেরকে শুধু পরীক্ষার জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। আল্লাহ প্রদত্ত সামান্য সাজ-সরঞ্জাম, সীমাবদ্ধ ক্ষমতা-ইখতিয়ার, সামান্য অবকাশ ও সুযোগোর সদ্ব্যবহার করে আমাদের মধ্যে হতে কতো লোক আল্লাহ তাআলার জান্নাতের স্থায়ী সাসিন্দা হওয়ার যোগ্য প্রতিপন্ন হতে পারে আমাদেরকে সেই পরীক্ষা দিতে হবে। কিন্তু শিল্প,বাণিজ্য, কৃষি কাজ ও রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে আমাদের কতখানি কৃতিত্ব রয়েছে, রাস্তাঘাট ও বাড়ী নির্মাণে আমরা কতখানি পটু কিংবা এক শানদার সভ্যতা সংস্কৃতি গঠনে আমরা কতখানি সাফল্য লাভ করতে পারি, সেই বিষয়ে আমাদের কোনো পরীক্ষা দিতে হবে না। বরং আল্লাহ তাআলার প্রদত্ত আমানাতসমূহের ব্যাপারে আমরা তাঁর খিলাফতের দায়িত্ব পালনে কতখানি যোগ্যতার অধিকারী এটাই হচ্ছে আমাদের পরীক্ষার মূল বিষয়। আমরা কি এখানে বিদ্রোহী ও স্বাধীন হয়ে বসবাস করি, না তাঁর অনুগত বান্দাহ হিসেবে; আল্লাহর দুনিয়ায় আল্লাহর মর্জি পূরণ কির; আল্লাহর দুনিয়াকে তাঁর ইচ্ছানুসারে সুসজ্জিত করি, না বিভেদ-বিশৃংখলা সৃষ্টির চেষ্টা করতে থাকি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য শয়তানী শক্তিগুলোর সামনে আত্মসমর্পণ করি, না তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে থাকি, এটাই হলো আমাদের পরীক্ষা। জান্নাতে হযরত আদম ও হাওয়া আলাইহিমাস হলো আমাদের পরীক্ষা হয়েছিলো মূলত তাও ছিলো ঠিক এ পরীক্ষা। আর আখেরাতের জান্নাতের স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে মানব জাতির মধ্যে হতে যাদেরকে নির্বাচিত করা হবে তাও হবে। এ চূড়ান্ত প্রশ্নটির ভিত্তিতে। সুতরাং সাফল্য ও ব্যর্থতার মূল মাপকাঠি এটা মোটেই নয় যে, কে রাজ সিংহাসনে বসে পরীক্ষা দিয়েছে, আর কে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে, কাউকে বিরাট সাম্রাজ্য দান করে পরীক্ষা করা হয়েছে আর কাউকে জীর্ণ কুটিরে বসিয়ে। পরীক্ষা কেন্দ্রের সাময়িক সুযোগ-সুবিধা যেমন সাফল্যের কোনো প্রমাণ নয়, তেমনি তা কোনো অসুবিধা ও ব্যর্থতার ও লক্ষণ নয়। আসল কামিয়াবী-যেদিকে এ পরীক্ষা কেন্দ্রের যেখানে যে অবস্থাতেই থাকি না কেন আমাদের সাজ-সরঞ্জাম যাই হোক না কেন, আমরা যেন নিজেদেরকে আল্লাহ তাআলার অনুগত বান্দাহ এবং তাঁর মর্জির সঠিক তাবেদার সাব্যস্ত করতে পারি। একমাত্র এভাবেই আমরা আখেরাতে আল্লাহ তাআলার অনুগত বান্দাহদের নির্দিষ্ট মর্যাদা লাভে সক্ষম হবো।
বন্ধগণ! এটাই হচ্ছে আসল কথা। কিন্তু এটা এমন একটি বিষয় যে, একবার মাত্র জানলে, বুঝলে ও স্বীকার করলেই এ কাজটি সম্পন্ন হতে পারে না,বরং সদা-সর্বদা স্মরণ রাখার জন্য কঠোর পরিশ্রম ও যত্ন করতে নয়। নতুবা এমন অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে যে, আখেরাতকে অস্বীকার না করেও আমরা হয়তো আখেরাতের প্রতি অবিশ্বাসীদের ন্যায় নিছক পার্থিব কাজে লিপ্ত হয়ে পড়বো। কেননা পরকাল হচ্ছে আমাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে অবস্থিত, শুধু মৃত্যুর পরেই তা প্রত্যক্ষ করা সম্ভব হবে। পার্থিব জীবনে আমরা শুধু চিন্তা কল্পনা-শক্তির সাহায্যেই এর ভালো-মন্দ ফলাফল অনুভব করতে পারি। পক্ষান্তরে এ দুনিয়া ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু, এটা প্রত্যক্ষ করা সম্ভব এবং ভালো-মন্দ প্রত্যকটি বিষয় সম্পর্কে আমরা সর্বক্ষণ অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। এর বৈচিত্রপূর্ণ ঘটনবলী ও পরিণতিকে অনেক সময়ে চূড়ান্ত বলে আমাদের মনে ভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। আখেরাত সম্পর্কিত কোনো কাজ হলে সেই বিষয় শুধু আমাদের অন্তরের এক কোণায় লুক্কায়িত বিবেক সামান্য কিছুটা তিক্ততা অনুভব করি মাত্র, অবশ্য যদি তা সজীব থাকে। কিন্ত আমাদের পার্থিব কোনো স্বার্থ বিনষ্ট হলে আমাদের প্রতিটি লোমকূপও তার জন্য ব্যথা অনুভব করে। আমাদের স্ত্রী-পুত্র, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব নির্বিশেষে সমাজের সাধারণ লোকজন সকলেই তা অনুভব করতে পারে। অনুরপভাবে আখেরাত যদি সাফল্য হয়, তবে আমাদের অন্তরের একটি নিভৃত কোণ ছাড়া আমাদের গাফলতির দরুন সম্পূর্ণরূপে নিষ্পন্দ হয়ে গিয়ে না থাকে। কিন্তু আমাদের পার্থিব সাফল্যকে আমাদের গোটা সত্ত্বা ও ইন্দ্রিয়নিচয় অনায়সে অনুভব করতে পারে এবং আমাদের সমগ্র পরিবেশ তা দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়। এ কারণেই একটি ধারণা বা বিশ্বাস হিসেবে আখেরাতকে স্বীকার করা হয়তো কোনো কঠিন কাজ নয়; কিন্তু গোটা চিন্তাধারা, দৈনতিক চরিত্র ও কর্মজীবনের সমগ্র ব্যবস্থাপনার বুনিয়াদ হিসেবে এটাকে গ্রহণ করে তদানুযায়ী আজীবন কাজ করা বড়ই কঠিন ব্যাপার। মুখে দুনিয়া কিছু নয় বলা যতই সহজ হোক না কেন; কিন্তু অন্তর হতে এর বাসনা কামনা এবং চিন্তাধারা হতে এর প্রভাব-প্রতিপত্তি বিদূরিত করা মোটেই সহজ নয়। এ অবস্থায় উপনীত হবার জন্য বহু চেষ্টা-যত্ন আবশ্যক। আর অবিশ্রান্ত চেষ্টার ফলেই তা স্থায়ী হতে পারে।