৭৮. আযীমুদ্দীন
খৃষ্টীয় ১৬৯৭ সন আওরঙজেব তাঁর নাতি আযীমুদ্দীনকে বাঙালাহর শুবাদার নিযুক্ত করেন।
আযীমুদ্দীনের সেনাপতি হামিদ খান কোরেশী উড়িশার বিদ্রোহী রহীম খানকে পরাজিত করেন। আযীমুদ্দীনের মাঝে-সম্পদ মওজুদ করার তীব্র বাসনা ছিলো। আর ইংরেজগণ তা টের পেয়েছিলো।
খৃষ্টীয় ১৬৯৮ সনের জুলাই মাসে ইংরেজগণ আযীমুদ্দীনকে ১৬ হাজার টাকা উপহার দিয়ে সূতানটি, কলকাতা ও গোবিন্দপুর নামক তিনটি গ্রাম ক্রয়ের অনুমতি হাছিল করে।
আযীমুদ্দীনের শাসনকালে মুবা বাঙালাহর রাজস্ব ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। এই জন্য আওরঙজেব হায়দারাবাদে নিযুক্ত সৎ ও যোগ্য দিওয়ান কারতালাব খানকে (মুর্শিদকুলী খান) বাঙালাহর দিওয়ান নিযুক্ত করেন।
খৃষ্টীয় ১৭০২ সনে উড়িশার শুবাদার আসকার খান ইন্তিকাল করলে আওরঙজেব উড়িশাকে শুবা বাঙালাহর সাথে যুক্ত করে দেন। খৃষ্টীয় ১৭০২ সনে কারতালাব খান (মুর্শিদকুলী খান) তাঁর দিওয়ানী কার্যালয় জাহাঁগীরনগর থেকে মাখসুসাবাদে (মুর্শিদাবাদ) স্থানান্তরিত করেন।
খৃষ্টীয় ১৭০৩ সনে বিহারকেও আযীমুদ্দীনের শুবাদারীর অন্তর্ভুক্ত করে দেয়া হয় তখন তিনি পাটনাতে অবস্থান করতে থাকেন। আর বাঙালাহতে তাঁর নায়েব শুবাদার হিসেবে কর্তব্য পালন করতে থাকেন তাঁর পুত্র ফাররুখ সিয়ার। উড়িশার নায়েব শুবাদার হিসেবে কর্তব্য পালন করতে থাকেন কারতালাব খান (মুর্শিদ কুলী খান) তবে বাঙালাহ, বিহার ও উড়িশার দিওয়ানী এককবাবে কারতালাব খানের (মুর্শিদ কুলী খান) ওপরই থাকে। তিনি মাখসুসাবাদে অবস্থান করেই তাঁর ওপর অর্পিত সকল দায়িত্ব নিষ্ঠাসহকারে পালন করতে থাকেন। খৃষ্টীয় ১৭০৩ সনই কারতালাব খান দাক্ষিণাত্যে গিয়ে দিল্লীর অধিপতি আওরঙজেবের সংগে সাক্ষাত করেন। আওরঙ্গজেব তাঁকে মুশিদকুলী খান উপাধি দেন এবং মাখসুসাবাদের নাম তাঁর নাম অনুযায়ী মুর্শিদাবাদ রাখার অনুমতি দেন।
খৃষ্টীয় ১৭০৪ সনে মুর্শিদ কুলী খান মুর্শিদাবাদ ফিরে আসেন আর ঐ বছরই আওরঙজেব আযীমুদ্দীনকে পাটনার নাম আযীমাবাদ রাখার অনুমতি দেন।
খৃষ্টীয় ১৭০৭ সনে দিল্লীর সুলতান আওরঙ্গজেব ইন্তিকাল করেন। তাঁর পুত্র মুহাম্মদ মুয়াযযাম শাহ আলম বাহাদুর শাহ (১ম) উপাধি ধারণ করে দিল্লীর মসনদে বসেন। বাহাদুর শাহেরই পুত্র ছিলেন আযীমুদ্দীন। বাহাদুর শাহ তাঁকে বাঙালাহ-বিহার-উড়িশার শুবাদার পদে বহাল রাখেন এবং তাঁকে আযীমুশশান উপাধিতে ভূষিত করেন।
৭৯. খান-ই-জাহান
খৃষ্টীয় ১৭১২ সনে দিল্লীর সুলতান শাহ আলম বাহাদুর শাহ (১ম) ইন্তিকাল করেন। তাঁর ইন্তিকালের পর মসনদ নিয়ে যেই যুদ্ধ হয় তাতে আযীমুশশান নিহত হন। মুয়ীযুদ্দীন জাহাঁদার শাহ দিল্লীর মসনদে বসেন।
জাহাঁদার শাহ খান-ই-জাহানকে শুবা বাঙালাহর শুবাদার নিযুক্ত করেন।
৮০. ফারখুন্দা সিয়ার
খৃষ্টীয় ১৭১৩ সনে ফাররুখ সিয়ার সুরতান জাহাঁদার শাহকে পরাজিত করে দিল্লীর মসনদে বসেন।
তিনি নামকাওয়াস্তে তাঁর শিশুপুত্র ফারখুন্দা সিয়ারকে বাঙালাহর শুবাদার নিযুক্ত করেন। আর মুর্শিদ কুলী খানকে করেন তাঁর নায়েব শুবাদার। অবশ্য উড়িশার শুবাদারী মুর্শিদ কুলী খানের উপরই ন্যাস্ত থাকে।
৮১. মীর জুমলা উবাইদুল্লাহ
খৃষ্টীয় ১৯১৩ সনেই ফারখুন্দা সিয়ার ইন্তিকাল করেন। দিল্লীর সুলতান ফাররুখ সিয়ার মীর জুমলা উবাইদুল্লাহকে বাঙালাহর শুবাদার নিযুক্ত করেন। নায়েব শুবাদার পদে বহাল থাকেন মুর্শিদ কুলী খান।
৮২. মুর্শিদকুলী খান
খৃষ্টীয় ১৭১৬ সনে দিল্লীর সুলতান ফাররুখ সিয়ার উড়িশার শুবাদার ও বাঙালাহর নায়েব শুবাদার মুর্শিদ কুলী খানকে উড়িশার সাথে বাঙালাহর শুবাদার পদ প্রদান করেন।
খৃষ্টীয় ১৭১৯ সনে ফারুখ সিয়ার নিহত হন। দিল্লীর মসনদে বসেন রাফীউদদাওলাত। ঐ সনে দুই ভাই-ই ইন্তিকাল করেন।
শাহজাদা রওশন আখতার ‘মুহাম্মদ শাহ’ উপাধি ধারণ করে দিল্লীর মসনদে বসেন। মুর্শিদ কুলী খান দিল্লীর নতুন সুলতানদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে থাকেন। তাঁরাও তাঁকে বাঙালাহ ও উড়িশার শুবাদার পদে বহাল রাখেন।
মুর্শিদ কুলী খান ছিলেন একজন শিয়া। তবে তিনি একজন ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি নিয়মিত সালাত আদায় করতেন। তিনি জ্ঞানী ব্যক্তিদের কদর করতেন। তিনি ছিলেন একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক। এক প্রতিবেশির স্ত্রীর সাথে অবৈধ যৌন সম্পর্ক স্থাপন করার কারণে তিনি তাঁর একমাত্র পুত্রকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। তিনি সাধারণ জীবন যাপন করতেন। মোটা ভাত খাওয়াই ছিলো তাঁর পছন্দ। আম ছিল তার প্রিয় ফল। তিনি মুর্শিদাবাদের কাটরা মাদ্রাসা নির্মাণ করেন।
অপরাধ দমনে তিনি ছিলেন কঠোর। ফলে দেশে শান্তি-শৃংখলা বিরাজমান ছিলো। অমুসলমানদেরকেও তিনি মর্যাদা দিতেন। বহু অমুসলিম তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। তাদের মধ্যে ছিলেন উমিচাঁদ, ফতেহ চাঁদ জগৎ শেঠ প্রমুখ।
খৃষ্টীয় ১৭২৭ সনে তিনি ইন্তিকাল করেন।
৮৩. শুজাউদ্দীন মুহাম্মদ খান
মুর্শিদ কুলী খানের একমাত্র জীবিত সন্তান ছিলেন জীনাতুন্নিসা। তাঁর স্বামী ছিলেন শুজাউদ্দীন মুহাম্মদ খান। অপর স্ত্রী দিকে বেশি মনোযোগী হয়ে পড়ায় জীনাতুন্নিসা স্বামীর বাড়ি থেকে চলে এসে আব্বা মুর্শিদ কুলী খানের সাথে বসবাস করতে থাকেন। তাঁর পুত্র ছিলেন সরফরাজ খান।
মুর্শিদ কুলী খান সরফরাজ খানকে তাঁর উত্তরাধিকারী অর্থাৎ বাঙালাহ ও উড়িশার শুবাদার মনোনীত করেন। শুজাউদ্দীন মুহাম্মদ খান তখন উড়িশার নায়েব শুবাদার। তিনি এই মনোনয়ন মেনে নিতে পারেন নি। তিনি বাঙালাহর শুবাদার হতে আগ্রহী ছিলেন। তিনি ফতেহ চাঁদ জগৎ শেঠ, হাজী আহমদ ও হাজী আহমাদের ভাই মির্যা মুহাম্মদ আলীর (আলীবর্দী খান) সমর্থন লাভ করেন।
শুজাউদ্দীন মুহাম্মদ খান তাঁর পক্ষে নিযুক্তিপত্র লাভের জন্য দিল্লীতে তাঁর প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। একই সময় তাঁর সেনাদল নিয়ে তিনি মুর্শিদাবাদের দিকে অগ্রসর হন। পথিমধ্যে তিনি খবর পান যে, মুর্শিদ কুলী খান ইন্তিকাল করেছেন। আবার দিল্লীর সুলতান মুহাম্মদ শাহের নিযুক্তি পত্রও তাঁর হাতে এসে পৌঁছে।
খৃষ্টীয় ১৭২৭ সনে শুজাউদ্দীন মুহাম্মদ বাঙালাহ-উড়িশার শুবাদার হিসেবে মুর্শিদাবাদের মসনদে বসেন।
শুজাউদ্দীন মির্যা মুহাম্মদ আলীকে আলীবর্দী খান উপাধি দেন। তিনি আলীবর্দী খান, হাজী আহমাদ, ফতেহ চাঁদ জগৎশেঠ ও রায় রায়ান আলম চাঁদকে নিয়ে একটি প্রশাসনিক কমিটি গঠন করেন।
তিনি তাঁর বড় ছেলে সরফরাজ খানকে বাঙালাহর দিওয়ান ও দ্বিতীয় ছেলে মুহাম্মদ তাকী খানকে উড়িশার নায়েব শুবাদার পদে বহাল রাখেন।
হাজী আহমাদের ছিলেন তিন ছেলে। তাঁরা হলেন মুহাম্মদ রিদা খান (নাওয়াজিস মুহাম্মদ, আগা মুহাম্মদ খান (মির্যা সাঈদ আহমাদ খান) ও মুহাম্মদ হাশেম আলী খান (মির্যা যাইনুদ্দীন আহমাদ খান)।
হাজী আহমাদের ভাই মির্যা মুহাম্মদ আলীর (আলীবর্দী খান) ছিলেন তিন কন্যা। তারা হাজী আহমদের তিন পুত্রের সাথে বিবাহিতা হন। শুজাউদ্দীন হাজী আহমাদের তিন ছেলেকে গুরুত্বপূর্ণ সরকারী পদে নিযুক্ত করেন। তিনি তাঁর জামাতা মুর্শিদ কুলী জাফর খানকে (দ্বিতীয় মুর্শিদ কুলী খান) জাহাঁগীর নগরের (ঢাকা) নায়েব শুবাদার নিযুক্ত করেন। আর মীর হাবিবকে নিযুক্ত করেন তাঁর সহকারী।
শুজাউদ্দীন মুহাম্মদ খান একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তোলেন। এর সৈন্য সংখ্যা ছিলো পঁচিশ হাজার।
পার্বত্য ত্রিপুরা রাজার মৃত্যু হলে যুবরাজকে মসনদে বসতে না দিয়ে তাঁর চাচা নিজেই মসনদে বসেন। যুবরাজ পালিয়ে জাহাঁগীরনগর পৌঁছেন এবং নায়েব শুবাদার মুর্শিদ কুলী জাফর খানের নিকট সামরিক সাহায্য চান।
মুর্শিদ কুলী জাফর খান মীর হাবিবের সেনাপতিত্বে একদল সৈন্য পাঠান যুব রাজের সাহায্যে। তাঁর সহযোগী হন আগা সাদিক। পার্বত্য পথ অতিক্রম করে তাঁরা পার্বত্য ত্রিপুরা পৌঁছালে ক্ষমতা জবর দখলকারী রাজা গভীর জংগলে পালিয়ে যান। মীর হাবীব যুবরাজকে মসনদে বসান। তবে তিনি পার্বত্য ত্রিপুরার বিভিন্ন স্থানে সামিরক ফাঁড়ি স্থাপন করেন ও গোটা পার্বত্য ত্রিপুরার ফৌজদার নিযুক্ত করেন আগা সাদিককে।
মীর হাবীব জাহাঁগীরনগর (ঢাকা) ফিরে এসে মালে গানীমাহর প্রধান অংশ ও অনেকগুলো হাতী মুর্শিদাবাদে পাঠান। শুবাদার শুজাউদ্দীন মুহাম্মদ খান পার্বত্য ত্রিপুরার নাম রাখেন রওশনাবাদ।
খৃষ্টীয় ১৭৩৩ সনে বিহারের শুবাদার ফাখরুদ্দৌলাহ পদচ্যুত হন। অতপর শুবা বিহারকে শুবা বাঙালাহর সাথে যুক্ত করে দেয়া হয়। অর্থাৎ শুজাউদ্দীন মুহাম্মদ খান এবার একই সময় বাঙালাহ-বিহার-উড়িশার শুবাদার হন। মির্যা মুহাম্মদ আলী (আলীবর্দী খান) নিযুক্ত হন বিহারের নায়েব শুবাদার।
এই পদে নিযুক্তি লাভের পূর্বে মির্যা মুহাম্মদ আলীর (আলীবর্দী খান) কনিষ্ঠ কন্যা আমীনাহর গর্ভে ও মুহাম্মদ হাশেম আলী খানের (যাইনুদ্দীন আহমাদ খান) এক পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহণ করেন। আলীবর্দী খান তাঁর নাম রাখেন (নিজের নামের অনুরূপ) মির্যা মুহাম্মদ আলী খান। এই মির্যা মুহাম্মদ আলী খানই পরবর্তী কালে উপাধি পেয়ে ছিলেন সিরাজুদ্দৌলাহ খান।
ইংরেজগণ বাঙালায় তাদের প্রাইভেট ব্যবসা চালাতেই থাকে। শুবাদার মুর্শিদ কুলী খানের ইন্তিকালের পর থেকে তারা কলকাতা, সূতানটি ও গোবিন্দপুর গ্রামের রাজস্ব দেয়া বন্ধ করে দেয়। শুজাউদ্দীন তাদেরকে বকেয়া রাজস্ব পরিশোধের তাকিদ দেন। তারা তাঁর কথায় কান দেয়নি।
খৃষ্টীয় ১৭৩৬ সনে শুজাউদ্দীন মুহাম্মদ খান মুর্শিদাবাদের নিকটবর্তী আজিমগঞ্জে ইংরেজদের পণ্য আটক করেন। ফলে ইংরেজদের কাসিমবাজার কুঠির কর্মকর্তা পঞ্চাশ হাজার টাকা পরিশোধ করেন।
দিল্লীর সুলতান আওরঙ্গজেবের শাসনকালে মহারাষ্ট্রের মারাঠাগণ উগ্র হিন্দুত্ববাদী শিবাজীর নেতৃত্বে সংগঠিত হয়ে মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে লড়তে থাকে। এই ধারা অব্যাহত থাকে। সুলতান মুহাম্মদ শাহের শাসনকালে মারাঠাগণ দিল্লীর ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে। অপর দিকে ইরানে ক্ষমতাসীন হন নাদির শাহ। তিনিও দিল্লীর প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়ান।
শুজাউদ্দীন মুহাম্মদ খান একজন দীনদার ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ছিলেন ন্যায়পরায়ণ শাসক। গুণী জ্ঞানীদের তিনি কদর করতেন। তিনি অকাতরে অর্থ দান করতেন। খৃষ্টীয় ১৭৩৯ সনে তিনি তাঁর পুত্র সরফরাজ খানকে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। ঐ সনেরই ১৩ই মার্চ বাঙালাহ-বিহার-উড়িশার শুবাদার শুজাউদ্দীন মুহাম্মদ খান ইন্তিকাল করেন।
৮৪. আলাউদ দাওলাত সরফরাজ খান
ইরানের অধিপতি নাদির শাহের আক্রমণে তখন দিল্লীতে মুগল শাসনের চরম দুর্দিন। এই গোলযোগের সময় তাঁর পুত্রের নামে নিযুক্তি পত্র প্রদানের জন্য শুজাউদ্দীন মুহাম্মদ খান দিল্লীর সুলতানের নিকট আবেদন জানিযে ছিলেন কিনা তা জানা যায় না।
তিনি তাঁর পুত্রকে উপদেশ দিয়ে যান হাজী আহমাদ, রায়রায়ন আলম চাঁ ও ফতেহ চাঁদ জগৎ শেঠের সাথে পরামর্শ করে শাসন কার্য পরিচালনা করতে।
শুজাউদ্দীন মুহাম্মদ খানের ইন্তিকালের পর আলাউদদাওলাত সরফরাজ খান বাঙালাহ-বিহার-উড়িশার শুবাদার হিসেবে মুর্শিদাবাদের মসনদে বসেন।
দিল্লীতে কর্তৃত্ব স্থাপন করে ইরান-সম্রাট নাদির শাহ বাঙালাহ-বিহার-উড়িশার দিল্লীতে কর্তৃত্ব স্থাপন করে ইরান-সম্রাট নাদির শাহ বাঙালাহ-বিহার-উড়িশার শুবাদার শুজাউদ্দীন মুহাম্মদ খানকে তাঁর আনুগত্য স্বীকার করা ও রাজস্ব প্রেরণের জন্য চিঠি পাঠান। ইতিমধ্যে শুজাউদ্দীন ইন্তিকাল করেন। চিঠি পান সরফরাজ খান। হাজী আহমাদ ও আলম চাঁদ সরফরাজ খানকে নাদির শাহের আনুগত্য স্বীকার করতে, তাঁর নামে খুতবাহ পাঠ করতে ও তাঁর নামে মুদ্রা জারি করতে পরামর্শ দেন। তিনি তাই করেন।
নদির শাহ অল্পকাল পর ভারত ছেড়ে চলে যান। হাজী আহমদ ও তাঁর ভাই আলীবর্দী খান গোপনে দিল্লীর সুলতান মুহাম্মদ শাহের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে শুবাদার সরফরাজ খান সম্পর্কে তাঁর কান ভারি করেন। আলীবর্দী খান একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির মাধ্যমে নিজের নামে শুবাদারীর নিয়োগপত্র হাছিলের চেষ্টা চালান।
খৃষ্টীয় ১৭৪০ সনের প্রথম ভাগে আলীবর্দী খান তাঁর জামাতা মুহাম্মদ হাশেম আলী খানকে (যাইনুদ্দীন আহমাদ খান) বিহারের নায়েব শুবাদার নিযুক্ত করে নিজে সসৈন্যে মুর্শিদাবাদের দিকে অগ্রসর হন। সরফরাজ খান মুর্শিদাবাদ থেকে ২২ মাইল উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত গিরিয়া নামক স্থানে আলীবর্দী খানকে বাধা দেন। যুদ্ধে আলীবর্দী খান সুবিধা করে উঠতে পারেন নি। তিনি শান্তি চু্ক্তির জন্য প্রস্তুত বলে ভাণ করেন।
৯ই এপ্রিল ভোর বেলা তিনি সরফরাজ খানের ছাউনীতে অতর্কিত হামলা চালান। সরফরাজ খান তখন সালাতুল ফাজর আদায় করছিলেন। এই আকস্মিক হামলা মুকাবিলা করার জন্য তিনি সৈন্যদেরকে সংগঠিত করার সুযোগও পেলেন না। তবুও অল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে তিনি রুখে দাঁড়ান। কপালে গুলির আঘাত লেগে তিনি শাহাদা বরণ করেন। রায় রায়ান আলম চাঁদ যুদ্ধে আহত হয়ে আত্মহত্যা করেন। সরফরাজ খানের হাতী চালক তাঁর লাশ মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসেন।
৮৫. আলীবর্দী খান
খৃষ্টীয় ১৭৪০ সনের ৯ই এপ্রিল আলীবর্দী খান বাঙালাহ-বিহার-উড়িশার নাযিম হিসেবে মুর্শিদাবাদের মসনদে বসেন। তিনি নিহত সরফরাজ খানের পরিবার-পরিজনের সাথে ভালো ব্যবহার করেন এবং তাদেরকে জাহাঁগীরনগর (ঢাকা) পাঠিয়ে দেন।
খৃষ্টীয় ১৭৪০ সনের নভেম্বর মাসে তিনি দিল্লীর সুলতান মুহাম্মদ শাহের নিযুক্তি পত্র লাভ করেন।
আলীবর্দী খান যাইনুদ্দীন আহমাদ খানকে বিহারের নায়েব শুবাদার পদে বহাল রাখেন।
জাহাঁগীরনগর-সিলেট-রওশানাবাদের নায়েব শুবাদার নিযুক্ত করেন নাওয়াজিস মুহাম্মদ খানকে। সাঈদ আহমাদ খানকে নিযুক্ত করেন উড়িশার নায়েব শুবাদার।
তাঁর নাতী (যাইনুদ্দীন আহমাদ খানের পুত্র) সিরাজুদ্দৌলাহ খানকে জাহাঁগীর নগরের নাওয়ারা বা নৌ-বাহিনীর কমাণ্ডার পদে নিযুক্তি দেন। অবশ্য তরুণ সিরাজদদ্দৌলাহ খান রাজধানী মুর্শিদাবাদেই অবস্থান করতেন।
উড়িশা তখনো সাবেক শুবাদার সরফরাজ খান কর্তৃক নিযুক্ত নায়েব শুবাদার মুর্শিদ কুলী জাফর খানের শাসনাধীনে ছিলো। আলীবর্দী খান সসৈন্যে এগিয়ে আসেন। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মুর্শিত কুলী জাফর খান দাক্ষিণাত্যে পালিয়ে যান। আলীবর্দী খান সাঈদ আহমাদ খানকে পূর্বেই উড়িশার নায়েব শুবাদার পদে নিযুক্তি নিদেয় ছিলেন। এবার তিনি কার্যতঃ নায়েব শুবাদার হন। আলীবর্দী খান তাঁকে নাসিরুল মুলক সাওলাত জঙ উপাধি দেন।
জাহাঁগীর নগরের (ঢাকা) প্রশাসক মির্যা হাবীব সরফরাজ খানের প্রতি কৃত আলীবর্দী খানের আচরণে দারুণভাবে বিক্ষুব্ধ হন। তিনি এতোখানি বিক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে আলীবর্দী খানের বিরোধিতা করতে গিয়ে তিনি মারাঠাদের সাথে হাত মিলাতে কুণ্ঠিত হন নি।
উল্লেখ্য যে মারাঠাদের মূল আবাসভূমি মহারাষ্ট্র। দিল্লীর সুলতান মুহীউদ্দীন মুহাম্মদ আওরঙজেব আলমগীরের শাসনকালে উগ্র হিন্দু শিবাজীর নেতৃত্বে মারাঠাগণ বিদ্রোহী হয়। হত্যা, লূণ্ঠন ও আগুন লাগানো ছিলো তাদের কর্মতৎপরতার প্রধান বৈশিষ্ট্য।
খৃষ্টীয় ১৬৮০ সনে শিবাজীর মৃত্যু হলে তাঁর পুত্র শম্ভুজী বিদ্রোহ অব্যাহত রাখেন। মুগল বাহিনীর নিকট পরাজিত হয়ে তিনি বন্দী হন। শম্ভুজী বন্দী অবস্থায় থেকেও অসদাচারণ করতে থাকেন। ফলে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। অতপর সুলতান শম্ভুজীর সতর বছরের ছেলে সাহুকে রাজা উপাধি দিয়ে একটি এলাকায় রাজা বানিয়ে দেন।
মারাঠাগণ তাদের খাসলত বদলাতে পারেনি। আলীবর্দী খানের শাসনকালে বেরারে মারাঠাদের শাসক ছিলেন রঘুজী ভোঁসলে। মীর্যা হাবীব তাঁকে বাঙালাহ আক্রমণের উস্কানি দেন। রঘুজী ভোঁসলে তাঁর সেনাপতি ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে পচিশ হাজার অশ্বারোহী মারাঠা সৈন্য বাঙালাহর দিকে পাঠান। খৃষ্টীয় ১৭৪২ সনে মারাঠাগণ পশ্চিম বংগের বর্ধমান শহরে আগুন লাগিয়ে দেয়। মূল্যবান দ্রব্যাদি লুণ্ঠন করে। আলীবর্দী খান সসৈন্যে বর্ধমান এসে তাদের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এই সুযোগে মির্যা হাবীব একদল মারাঠা সৈন্য নিয়ে মুর্শিদাবাদের একাংশে ঢুকে ব্যাপক লুটতরাজ চালান। মির্যা হাবীব হুগলী দখল করে সেখানেও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন।
আলীবর্দী খান বিহারের নায়েব শুবাদার যাইনুদ্দীন আহমাদ খানকে (হাশেম আলী খানকে) সৈন্য নিয়ে এগিয়ে আসার নির্দেশ দেন। তিনি নিজেও একটি বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন। পশ্চিম বংগ ও উড়িশায় মারাঠাদের সাথে কয়েক দফা মুকাবিলা হয়। মীর হাবিব ও ভাস্কর পণ্ডিত যদ্ধে পরাজিত হয়ে দক্ষিণ দিকে সরে যান। খৃষ্টীয় ১৭৪৩ সনে আলীবর্দী খান আবদুন নবী খানকে উড়িশার নায়েব শুবাদার ও রায় দুর্লভ রাম তাঁর সহকারী নিযুক্ত করে রাজধানী মুর্শিদাবাদ ফিরে আসেন।
কিন্তু অল্পকাল পরেই মারাঠাগণ দুই দিক থেকে এগিয়ে আসে। একটি দল উড়িশা থেকে রঘুজী ভোঁসলের নেতৃত্বে এবং আরেকটি দল পেশওয়া বালাজী রাওয়ের নেতৃত্বে বিহার থেকে বাঙালাহর দিকে অগ্রসর হয়। আলীবর্দী খান ২২ লাখ টাকা প্রদান করে বালাজী রাওয়ের সাথে সন্ধি করেন। রঘুজী ভোঁসলে একলা যুদ্ধের ঝুঁকি না নিয়ে উড়িশার দিকে ফিরে যান।
খৃষ্টীয় ১৭৪৪ সনে ভাস্কর পণ্ডিত ২০ হাজার অশ্বারোহী যোদ্ধা নিয়ে বাঙালাহর ওপর হামলা চালান। তাঁর ধ্বংস ও লুণ্ঠনের মাত্রা এবার ছিলো আরো অনেক বেশি। রাজা জানকী রামের দূতিয়ালীর ফলে ভাস্কর পণ্ডিত আলীবর্দী খানের সাথে সাক্ষাত করতে আসেন। আলীবর্দী খানের সৈন্যগণ হামলা চালিয়ে তাঁকে হত্যা করেন।
মারাঠাদের সাথে লড়াইকালে আলীবর্দী খান অন্যতম আফগান (পাঠান) সরদার মুসতাফা খানকে বিহারের নায়েব শুবাদার নিযুক্ত করবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। পরে তিনি তাঁকে বিপজ্জনক মনে করেন। মুসতাফা খান শিয়া মতাবলম্বী আলীবর্দী খানের বিরুদ্ধে সুন্নী আফগান সরদারদেরকে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে আলীবর্দী খানের কাছ থেকে তাঁর প্রাপ্য টাকা বুঝে নিয়ে বিহারের দিকে চলে যান। আকস্মিকভাবে তিনি বিহারের রাজধানী পাটনা আক্রমণ করেন। নায়েব শুবাদার যাইনুদ্দীন আহমাদ খান (হাশেম আলী খান) সতর্ক ছিলেন বলে সহজেই এ আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হন।
খৃষ্টীয় ১৭৪৫ সনে মারাঠা সরদার রঘুজী ভোঁসলে ও মীর হাবিব উড়িশা দখল করে পশ্চিম বংগের কাটওয়াতে আসেন। অতপর তাঁরা বিহারে প্রবেশ করে ব্যাপক লুটতরাজ চালান। আলীবর্দী খান এগিয়ে আসেন। এই সুযোগে মীর হাবিবের পরামর্শে মারাঠাগণ ঝড়ের বেড়ে রাজধানী মুর্শিদাবাদে প্রবেশ করে তা লূণ্ঠন করে কাটওয়াতে গিয়ে অবস্থান গ্রহণ করে। আলীবর্দী খান তাদেরকে শায়েস্তা করার জন্য কাটওয়ার দিকে আসেন। এইভাবে যুদ্ধ চলতে থাকে। তবে উড়িশা মীর হাবিবের নিয়ন্ত্রণে থেকে যায়।
খৃষ্টীয় ১৭৪৮ সনের জানুয়ারী মাসে বিদ্রোহী আফগান কমাণ্ডারণগ পাটনাতে যাইনুদ্দীন আহমাদ খান হাজী আহমাদসহ অনেককেই হত্যা করে। এই দুঃসংবাদ শুনে আলীবর্দী খান, পাটনার দিকে রওয়ানা হন। মীর হাবিব মারাঠাদেরকে নিয়ে তাঁর পিছু পিছু অগ্রসর হন ও ডানে-বামে অসংখ্য গ্রাম পুড়িয়ে ছারখার করেন। আফগানদের বিরুদ্ধে পাটনার যদ্ধে আলীবর্দী খান বিজয়ী হলে মীর হাবিব উড়িশার দিকে চলে যান। পাটনার যুদ্ধে সিরাজুদ্দৌলাহ খান নানার পাশে থেকে বীরত্বের সাথে লড়াই করেন।
খৃষ্টীয় ১৭৫১ সনে মীর হাবিবের নেতৃত্বাধীন মারাঠাদের সাথে আলীবর্দী খান একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এর ফলে মীর হাবিব উড়িশার শাসন কর্তৃত্ব লাভ করেন। মারাঠাগণও অনেক আর্থিক সুবিধা লাভ করে। মীর হাবিব বাঙালাহর মুসলিম রাজনৈতিক শক্তিকে দুর্বল করার ক্ষেত্রে বড়ো রকমের ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁকে সাথে না পেলে মারাঠাগণ বাঙালাহর মানুষের এতো বেশি ক্ষতি করতে পারতো না। শান্তি-চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার এক বছর পর রঘুজী ভোঁসলের পুত্র জানোজীর হাতে মীর হাবিব নিহত হন। আলীবর্দী খান মীর হাবিবের আত্মীয় মির্যা সালিহকে উড়িশার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। কার্যতঃ উড়িশা মারাঠাদের কর্তৃত্বাধীনে চলে যায়।
এই মারাঠাদেরকে গ্রাম বাংলার মানুষ ‘বর্গী’ নামে আখ্যায়িত করে। প্রায় দশটি বছর ধরে প্রধানতঃ পশ্চিম বংগের মানুষ নিদারুণ কষ্ট ভোগ করেছেন। মারাঠাগণ গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দিতো। লোকদের মূল্যবান সম্পদ লুণ্ঠন করতো। পশু সম্পদ নিয়ে যেতো। লোকদের হাত, পা, কান, নাক কেটে দিতো। সুন্দরী নারীদেরকে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যেতো। তাদের ভয়ে ব্যবসায়ীরা পালিয়ে বেড়াতো। বহু ব্যবসায়ী দেশান্তর পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। তারা হঠাৎ আসতো, আবার হঠাৎ চলে যেতো। তাদের উপর্যুপরি হামলার ফলে বাঙালাহর অর্থনীতি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আলীবর্দী খান যখন মারাঠাদের নিয়ে ব্যস্ত তখন ইংরেজগণ নীরবে কলকাতায় নিজেদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে চলে।
আলীবর্দী খান অমুসলিমদের ওপর বেশ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। খৃষ্টীয় ১৭৫২ সনে বিহারের নায়েব শুবাদার মারা গেলে তিনি তাঁর ছেলে রাম নারায়ণকে ঐ পদে নিযুক্ত করেন। রাজা রামসিংহকে নিযুক্ত করেন মেদিনীপুরের ফৌজদার। নাওয়াজিস মুহাম্মদ খান জাহাঁগীরনগরের (ঢাকা) প্রশাসক ছিলেন। তিনি প্রধানত মুর্শিদাবাদেই থাকতেন। ওখানকার শাসনকার্য পরিচালনা করতেন রাজা রাজ বল্লভ ও গোকুল চাঁদ। শেষ দিকে আলীবর্দী খানের দিওয়ান ছিলেন রায়রায়ান উমিচাঁদ। সামরিক বাহিনীর দিওয়ান নিযুক্ত হন রায় দুর্লভ রাম।
আলীবর্দী খান তাঁর ছোট মেয়ে আমীনাহর ছেলে সিরাজদ্দৌলাহ খানকে তাঁর উত্তরাধীকারী মনোনীত করেন। বড় মেয়ে মেহেরুন্নিসা ওরফে ঘসেটি বেগম এই মনোনয়ন মেনে নিতে পারেননি। তিনি নিজেই মসনদ পেতে আগ্রহী ছিলেন। আলীবর্দী খানের দ্বিতীয় মেয়ে রাবেয়ার ছেলে শাওকাত জঙ তখন পূর্ণিয়ার শাসনকর্তা। তিনিও সিরাজুদ্দৌলাহ খানের মনোনয়ন মেনে নিতে পারেন নি। সামরিক বাহিনীর বখশী মীর জাফর আলী খানও ছিলেন উচ্চভিলাষী। মসনদের দিকে তাঁরও ছিলো লোলুপ দৃষ্টি।
খৃষ্টীয় ১৭৪৮ সনে ইংরেজগণ আর্মেনিয়ানদের কয়েকটি জাহাজ দখল করে। আলীবর্দী খান জাহাজগুলো মালিকদেরকে ফেরত দেবার জন্য ইংরেজদেরকে বলেন। নির্দেশ জারির সাথে সাথে তিনি বিভিন্ন ইংরেজ কুঠির দিকেও সৈন্যও পাঠান। তাঁর দৃঢ়তা দেখে ইংরেজগণ আর্মেনিয়ান বণিকদের জাহাজগুলো ফেরত দেয়।
এই ধরনের বিভিন্ন কারণে ইংরেজগণ আলীবর্দী খানের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করতো। বাঙালাহ বিহার উড়িশায় তাদের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব স্থাপনের পথে তারা আলীবর্দী খানকে পথের কাঁটা মনে করতো। তাঁকে সরিয়ে নিজেদের পছন্দের লোক মুর্শিদাবাদের মসনদে বসানোর প্রয়োজনীয়তা তারা তীব্রভাবে অনুভব করে।
আলীবর্দী খানের আত্মীয়দের মধ্যে বিরাজমান অনৈক্য ও রেষারেষি ইংরেজদের দৃষ্টি এড়ায়নি। তদুপরি বাঙালায় একটি শক্তিশালী অমুসলিম বণিক শ্রেণীর উত্থান ঘটে। এই শ্রেণীটিও ক্রমশ বাঙালাহর রাজনৈতিক অংগনে একটি ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়। এইটিও ইংরেজদের দৃষ্টি এড়ায়নি।
ইংরেজগণ বাঙালাহতে তাদের ব্যবসা চালাবার জন্য হিন্দদের মধ্যে থেকে এজন্ট ও কন্ট্রাকটর নিযুক্ত করতো। হিন্দুগণও অনুভব করতে শুরু করে যে ইংরেজদের সাথে ব্যবসা বাণিজ্যে জড়ালেই রাতারাতি ধনী হওয়া যায়।
ইংরেজগণ কলকাতায় তাদের ফোর্ট ইউলিয়াম নামক দুর্গটিকে আরো বেশি দুর্ভেদ্য করে তোলে। কলকাতায় তারা সার্বভৌম অধিকার প্রয়োগ করতে থাকে। শুবাদার শক্রদেরকে তার বিনা কুণ্ঠায় আশ্রয় দিতে শুরু করে। চোরাচালানীর অপরাধে অভিযুক্ত রামকৃষ্ণ শেঠকে তারা আশ্রয় দেয় ও তাকে ফেরত দেয়ার নির্দেশ অমান্য করে। ব্যবসা ক্ষেত্রেও তারা চরম অসাধুতার আশ্রয় নিতে থাকে।
আলীবর্দী খান বার্ধক্যের কারণে দুর্বল হয়ে গেছেন। কয়েকজন নিকটাত্মীয়ের ইন্তিকালে তিনি মন ভাংগা। ইংরেজদের সব চক্রান্তই তিনি আঁচ করতে পারছিলেন। কিন্তু পদক্ষেপ নিতে ছিলেন দ্বিধান্বিত। সিরাজুদ্দৌলাহ খান কিন্তু ইংরেজদের চক্রান্ত নস্যাৎ কার জন্য কঠোর পদক্ষেপের পক্ষপাতী ছিলেন। এই মনোভংগির জন্য তিনি ছিলেন ইংরেজদের চক্ষুশূল। ইংরেজগণ আলীবর্দী খানের ইন্তিকালের আগেই ঘসেটি বেগমের প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করে।
জাহাঁগীরনগরের (ঢাকা) দিওয়ান রাজা রাজবল্লভও ছিলেন ঘসেটি বেগমের সমর্থক।
অসুস্থ আলীবর্দী খানের পক্ষ থেকে সিরাজুদ্দৌলাহ খান ইংরেজদেরকে ডেকে ঘসেটি বেগমের সাথে সংশ্রব না রাখার জন্য বলেন। সিরাজুদ্দৌলাহ খান জাহাঁগীরনগরের (ঢাকা) দিওয়ান রাজা রাজ বল্লভের নিকট কয়েক বছরের টাকা পয়সার হিসাব চান। তিনি কলকাতার ইংরেজদের সাথে গোপনে যোগাযোগ করে তাদের আশ্রয় চান। তাঁর ছেলে কৃষ্ণ বল্লভ তিপ্পান্ন লাখ টাকা মূল্যের ধন সম্পদ নিয়ে সপরিবারে কলকাতায় ইংরেজদের নিকট চলে যান। রাজা রাজবল্লভ সিরাজুদ্দৌলাহ খানকে জানান যে তাঁর ছেলে কৃষ্ণ বল্লভ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে পালিয়ে যাওয়ায় তার পক্ষে হিসাব দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা। খৃষ্টীয় ১৭৫৬ সনের দশই এপ্রিল বাঙালাহ-বিহার-উড়িশার শুবাদার আলীবর্দী খান ইন্তিকাল করেন।
৮৬. সিরাজুদ্দৌলাহ খান
আলীবর্দী খান সিরাজোদ্দৌলাহ খানকে হীরাঝিল নামে একটি প্রাসাদ তৈরি করে দিয়েছিলেন। সিরাজুদ্দৌলাহ খান ঐ প্রাসাদেই বসবাস করতেন। ইন্তিকালের কিছুকাল আগে আলীবর্দী খান তাঁকে নিজের কাছে ডেকে নিয়ে এসে কিছু উপদেশ দেন।
খৃষ্টীয় ১৭৫৬ সনের এপ্রিল মাস আলীবর্দী খানের ইন্তিকাল হলে সিরাজুদ্দৌলাহ খান বাঙালাহ-বিহার-উড়িশার নাযিম হিসেবে মুর্শিদাবাদের মসনদে বসেন। উল্লেখ্য যে বহুকাল আগে থেকেই বাঙালাহ-বিহার-উড়িশার নাযিমগণ ‘নওয়াব’ বলেও আখ্যায়িত হতে থাকেন। আরো উল্লেখ্য যে ঐ সময় দিল্লীর সুলতান ছিলেন দ্বিতীয় আলমগীর।
নওয়াব সিরাজুদ্দৌলাহ খানের বড়ো খালাম্মা মেহেরুন্নিসা ওরফে ঘসেটি বেগম মোতিঝিল প্রাসাদে বসবাদ করতেন। এই প্রাসাদটি তাঁকে তৈরি করে দিয়েছিলেন আলীবর্দী খান। ঘসেটি বেগম মোতিঝিল প্রাসাদে বসে তাঁর ধন-রত্ন বন্টন করে একদল সৈন্যকে তাঁর পক্ষে ভিড়িয়ে একটি অতর্কিত হামলার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। সিরাজুদ্দৌলাহ খান দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে মোতিঝিল প্রাসাদে তাঁকে অন্তরীণ করে রাখেন।
দৃঢ়চেতা সিরাজুদ্দৌলাহ খান ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্ণর রোজার ড্রেককে বলেন কৃষ্ণ বল্লভকে ফেরত পাঠাতে। রোজার ড্রেক এক ধৃষ্ঠতাপূর্ণ চিঠির মাধ্যমে জানান যে ইংরেজগণ একজন আশ্রিত ব্যক্তিকে কিছুতেই ফেরত দিতে পারেনা। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নয়, কোন স্বাধীন রাষ্ট্রের শক্তিশালী শাসকের পক্ষ থেকেই এই ধরনের বক্তব্য উচ্চারিত হতে পারে।
সিরাজুদ্দৌলঅহ খান চাচ্চিলেন ইংরেজদের সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলোর শান্তিপূর্ণ সমাধান। হুগলীর অন্যতম ব্যবসায়ী খাজা ওয়াজিদের মাধ্যমে তিনি চারবার মীমাংসার প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু ইংরেজগণ তাঁর কথায় কান দেয়নি।
সিরাজুদ্দৌলাহ খান ছিলেন একজন সাহসী তরুণ। ইংরেজদের ধৃষ্টতায় রাগান্বিত হয়ে তিনি তাঁর সৈন্যদল সহ কাসিম বাজার পৌঁছেন ও ইংরেজদের বাণিজ্য কুঠিতে তালা লাগিয়ে দেন।
অতপর তিনি সসৈন্যে কলকাতার দিকে অগ্রসর হন। কাসিমবাজার অভিযানের আগেই ফোর্ট উইলিয়াম গভর্ণর রোজার ড্রেক সাহায্য চেয়ে চিঠি পাঠান মাদ্রাজের ফোর্ট জর্জের অধিনায়কের কাছে। সিরাজুদ্দৌলাহ খান কলকাতা পৌঁছার আগেই রোজার ড্রেক নওয়াবের ভাটি অঞ্চলে অবস্থিত থানা দুর্গ ও সুখ সাগর ফাঁড়ি দখল করে নেন। অবশ্য নওয়াবের প্রেরিত একটি অগ্রবাহিনী সেখান থেকে ইংরেজদের তাড়িয়ে দেয়।
খৃষ্টীয় ১৭৫৬ সনে ১৬ই জুন সিরাজুদ্দৌলাহ খান ত্রিশ হাজার সৈন্য নিয়ে কলকাতা পৌঁছেন। যুদ্ধ শুরু হয়। দুই দিন যুদ্ধ করার পর অবস্থা বেগতিক দেখে রোজার ড্রেক তাঁর সৈন্য বাহিনীর প্রধান অংশ নিয়ে নদীপথে ফলতা চলে যান। হলওয়েলের নেতৃত্বে বাকি সৈন্যরা ২০শে জুন নওয়াবের নিকট আত্মসমর্পণ করে। অর্থাৎ ১৭৫৬ সনের ২০শে জুন ফোর্ট উইলিয়াম সিরাজুদ্দৌলাহ খানের হস্তগত হয়।
রাতে ৪০/৫০ জন ইংরেজ সৈন্য মদ খেয়ে মাতলামি শুরু করে। নওয়াবের রক্ষীরা তাদেরকে ধরে একটি রুমে আটক করে রাখে। চার দিন যুদ্ধ করে তারা ছিলো দারুণ ক্লান্ত। বন্দীদের মধ্যে ২০ জন মারা যায়
হলওয়েল ইংরেজদেকে ক্ষেপিয়ে তোলার জন্য এই ঘটনাকে ব্ল্যাক হোল ট্রাজিডি বা অন্ধকূপ হত্যা নাম দিয়ে অতিরঞ্জিত এক কাহিনী রচনা করেন যার সারকথা নিম্নরূপঃ দূর্গের একটি অন্ধকার ছোট্ট কক্ষ। দৈর্ঘ আঠার ফিট। প্রস্থ চৌদ্দ ফিঠ দশ ইঞ্চি। এখানে ১৪৬ জন ইংরেজকে বন্দী করে রাখা হয়। দম বন্ধ হয়ে মারা যায় ১২৩ জন। বেঁচে থাকে মাত্র ২৩ জন।
পর দিন অর্থাৎ ২১শে জুন সেনাপতি মীরমদন মিঃ হলওয়েল, মিসেস উইলিয়াম কেরী ও আরো তিনজন বিশিষ্ট ইংরেজ বন্দীকে নওয়াবের সামনে হাজির করেন। মহানুভব নওয়াব তাঁদের সকলকে মুক্তি দেন।
সিরাজুদ্দৌলাহ খানের আসল নাম ছিলো মির্যা মুহাম্মদ আলী খান। তাঁর নামের একাংশ অনুসারে কলকাতার নাম রাখা হয় আলী নগর। সিরাজুদ্দৌলাহ খান মানিক চাঁদকে আলী নগরের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন।
কলকাতার দেশীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন উমিচাঁদ। তিনি ছিলেন একজন শিখ। তাঁর আসল নাম আমিন চাঁদ রূঢ়ি। উমিচাঁদ নামেই তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেন।
উমিচাঁদ আলীবর্দী খানের সাথে বিহার থেকে মুর্শিদাবাদ এসেছিলেন। আলীবর্দী খানের অর্থানুকূলে তিনি কলকাতায় একটি বাড়ি ও একটি দোকান কিনেন। তাঁর ব্যবসা ছিলো জমজমাট। কালক্রমে ইংরেজদের সাথে তাঁর সখ্যতা গড়ে উঠে।
ফোর্ট উইলিয়াম জয়ের পর সিরাজুদ্দৌলাহ খান যখন মুর্শিদাবাদ ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন উমিচাঁদ এলেন ইংরেজদের পক্ষে ওকালীত করতে। তাঁর অনুনয় বিনয়ের ফলে নওয়াব আবার ইংরেজদের ব্যবসা চালিয়ে যাবার অনুমতি দিয়ে মুর্শিদাবাদ ফিরলেন।
খৃষ্টীয় ১৭৫৬ সনের অক্টোবর মাস। সিরাজুদ্দৌলাহ খানের খালাতো ভাই (রাবেয়া বেগমের পুত্র) পূর্ণিমার শাসনকর্তা শাওকাত জঙ বিদ্রোহী হয়ে উঠেন। তিনি মুর্শিদাবাদের দিকে অভিযান চালাবার ফন্দি ফিকির করছিলেন। খবর পেয়ে সিরাজুদ্দৌলাহ খান ঝড়ের বেগে পৌঁছে গেলেন পূর্ণিয়া। যুদ্ধ শুরু হয়। কামানের গোলায় আহত হয়ে ইন্তিকাল করলেন শাওকাত জঙ।
সিরাজুদ্দৌলাহ খান তাঁর নানা আলীবর্দী খানের মতোই সাহসী যোদ্ধা ছিলেন। মসনদে বসার আট মাসের মধ্যে তাঁকে ঘসেটি বেগমের মোতিঝিল প্রাসাদ, ইংরেজদের কাসিম বাজার কুঠি, ইংরেজদের শক্ত ঘাঁটি ফোর্ট উইলিয়াম ও পূর্ণিয়াতে সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে হয়। প্রতিটি অভিযানেই তিনি সফল হন। সেনাপতি মীরমদন ও মোহন লাল অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সাথে তাঁকে সহযোগিতা করতে থাকেন।
কলকাতায় পরাজয়ের খবর পেয়ে মাদ্রাজের ফোর্ট জর্জে মিটিংয়ে বসলেন শীর্ষস্থানীয় ইংরেজ কর্মকর্তাগণ। কলকাতায় কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সৈন্য পাঠাবার সিদ্ধান্ত হয় ঐ মিটিংয়ে।
খৃষ্টিীয় ১৭৫৬ সনের ১৬ই অক্টোবর কর্ণেল রবার্ট ক্লাইভ ও এডমিরাল ওয়াটসন কয়েকটি রণ-তরী বোঝাই সৈন্য নিয়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। ১৫ই ডিসেম্বর তারা ফলতা পৌঁছেন। এরপর তাঁরা কলকাতার দিকে এগুতে থাকেন। ইতিমধ্যে কলকাতার শাসনকর্তঅ মানিক চাঁদ অর্থের বিনিময়ে গোপনে ইংরেজদের দলে ভিড়ে যান। তাই তিনি যুদ্ধের ও পরাজয়ের ভাণ করে কলকাতা ছেড়ে দিয়ে মুর্শিদাবাদ চলে আসেন।
খৃষ্টীয় ১৭৫৭ সনের ২রা জানুয়অরী কর্ণেল রবার্ট ক্লাইভ ও এডমিরাল ওয়াটসন ফোর্ট উইলিয়াম প্রবেশ করেন। এরপর তাঁদের পরিচালিত সৈন্যগণ হুগলী শহর দখল করে ব্যাপক লুটতরাজ চালায়।
সিরাজুদ্দৌলাহ খান ইংরেজদের ঔদ্ধত্য চূর্ণ করার জন্য সসৈন্যে কলকাতার নিকটে পৌঁছে শিবির স্থাপন করেন।
এই সময় ইউরোপে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধে। ধূর্ত কর্ণেল রবার্ট ক্লাইভ দেখলেন এই সময়টি সিরাজুদ্দৌলাহর সাথে যুদ্ধ করার অনুকূল সময় নয়। ফ্রেঞ্চগণ যদি সিরাজুদ্দৌলাহ খানের বাহিনীর সাথে যোগ দেয় তাহলে সমূহ বিপদ। তাই তিনি সন্ধির অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। খৃষ্টীয় ১৭৫৭ সনের ৯ই ফেব্রুয়ারী একটি শান্তি-চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ইংরেজগণ অনেক সুবিধা আদায় করে নেয়। এই চুক্তিরই নাম আলীনগর চুক্তি।
আলীনগর চুক্তি স্বাক্ষরের পর ইংরেজগণ ফ্রেহ্চদের চান্দেরনগর (চন্দন নগর) কুঠি আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। খবর পেয়ে সিরাজুদ্দৌলাহ খান হুগলীর নতুন ফৌজদার নন্দ কুমারকে চান্দের নগরের পথে ইংরেজদের গতিরোধ করার নির্দেশ দেন। রবার্ট ক্লাইভ এগিয়ে এসে সসৈন্যে নন্দ কুমারকে উপস্থিত দেখে ভড়কে যান। তিনি উমি চাঁদে সহযোগিতায় বহু টাকার বিনিময়ে চান্দের নগর আক্রমণ করে দখল করে নেয়। পরাজিত ফ্রেঞ্চগণ মুর্শিদাবাদে এসে সিরাজুদ্দৌলাহর শরণাপন্ন হয়।
ফতেহ চাঁদ জগৎ শেঠ প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন যাতে সিরাজুদ্দৌলাহ খান ইংরেজদের বিরুদ্ধে কোন কঠোর পদক্ষেপ না নেন।
ফ্রেঞ্চদের চান্দের নগর কুঠি দখলের পর রবার্ট ক্লাইভ বিশিষ্ট ইংরেজদের একটি সভা ডেকে বললেন যে মুর্শিদাবাদও দখল করতে হবে।
খৃষ্টীয় ১৭৫৭ সনের ২৩ শে এপ্রিল ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল সিরাজুদ্দৌলাহ খানের পতন ঘটাবার প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন করে। রবার্ট ক্লাইভ উমি চাঁদ, ফতেহ চাঁদ জগৎ শেঠ ও রায় দুর্লভ রামের মাধ্যমে সেনাপতি মীর জাফর আলী খানকে মুর্শিদাবাদের মসনদে বসাবার প্রলোভন দেন। ৩রা জুনের মধ্যেই আঁতাত পাকাপাকি হয়ে যায়।
রবার্ট ক্লাইভ ফ্রেঞ্চদেরকে ধাওয়া করার জন্য সৈন্য বাহিনী নিয়ে পাটনা যওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। সিরাজুদ্দৌলাহ খান সেনাপতি মীর জাফর আলী খানকে নির্দেশ দেন পলাশীতে গিয়ে অবস্থান নিতে যাতে ইংরেজদের পাটনামুখী অভিযানে বাধা দেয়া যায়। পরে ইংরেজগণ ঐ পরিকল্পনা বাদ দেয়। মুর্শিদাবাদই তাদের প্রধান টার্গেট হয়ে দাঁড়ায়। সিরাজুদ্দৌলাহ খান মীর জাফর আলী খানকে মুর্শিদাবাদ ডেকে নেন।
সিরাজুদ্দূলাহর গুপ্তচর মতিরাম কলকাতা থেকে ইংরেজদের গতিবিধির খবর পাঠান। এই দিকে মীরজাফর আলী খানের চক্রান্তের খবরও পেয়ে যান নওয়াব। ঘরে বাইরে শক্র। তিনি অস্থির হয়ে পড়েন। সিরাজুদ্দৌলাহ খান তাঁর হীরাঝিল প্রাসাদে মীর জাফর আলী খানকে ডেকে পাঠান এবং দেশের এই দুর্দিনে তাঁর আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করেন। আল কুরআন স্পর্শ করে মীরজাফর আলী খান বললেন যে এই বারের যুদ্ধে তিনি প্রাণপণ লড়বেন। সিরাজুদ্দৌলাহ খাঁন তাঁকে প্রধান সেনাপতি পদ প্রধান করে আবার পলাশীর দিকে যাবার প্রস্তুতি নিতে বললেন। মীরজাফর আলী খান, মোহন লাল, রায়ূদুর্লভ, মীর মদন, ইয়ার লতিফ খান, ফ্রেহ্চ সেনাপতি সিন ফ্রে প্রমুখ সিরাজুদ্দৌলাহর সহযাত্রী হন। তাঁরা যথাসময়ে পলাশী প্রান্তরে এসে ছাউনী ফেলেন।
সেনাপতি মীরজাফর আলী খান তাঁর গুপ্তচর উমার বেগের মাধ্যমে সিরাজুদ্দৌলাহ খানের রণ-প্রস্তুতি সম্পর্কে ইংরেজদেরকে অবহিত করতে থাকেন।
ভাগিরথী নদীর তীরে ছিলো কাটওয়া দুর্গ। এই দুর্গটি ছিলো বাঙালাহর দুর্ভেদ্য দুর্গগুলোর একটি। রবার্ট ক্লাইভ কাটওয়ার ওপর হামলা চালান। মীরজাফর আলী খানের গোপন নির্দেশ পেয়ে দুর্গের অধিপতি ইংরেজ সৈন্যদেরকে বাধা দিলেন না। রবার্ট ক্লাইভ কাটওয়া দুর্গ দখল করেন।
খৃষ্টীয় ১৭৫৭ সনের ২২ জুন কর্ণেল রবার্ট ক্লাইভ তাঁর বাহিনী নিয়ে পলাশীর আম বাগানে এসে পৌঁছেন। তিনি ইংরেজ বাহিনীকে চারভাগে বিভক্ত করে মেজর কুট, মেজর গ্র্যান্ট, মেজর কিলপ্যাট্রিক ও ক্যান্টিন গপ-এর অধীনে ন্যাস্ত করেন। মাঝখানে ইংরেজ সৈন্য, আর ডানে বায়ে ভাড়াটিয়া দেশীয় সৈন্যদেরকে মোতায়েন করেন। সামনে বসান ছয়টি কামান।
অপর দিকে, সেনাপতি মীরমদন আমবাগানের সামনে দীঘির নিকটে তাঁর সৈন্যদেরকে মোতায়েন করেন। পশ্চিম পাশে অবস্থান গ্রহণ করেন ফ্রেঞ্চ সেনাপতি সিন ফ্রে। পূর্ব দিকে থাকেন সেনাপতি মোহন লাল। সম্মুখ বাহিনীল শেষ সীমানায় দাঁড়ান সেনাপতি মীরজাফর আলী খান।
খৃষ্টীয় ১৭৫৭ সনের ২৩শে জুন। সকাল আটটায় মীরমদনের কামান গর্জে উঠে। তারপর উভয় পক্ষ থেকে কামানের গোলা আর বন্দকের গুলি বর্ষিত হতে থাকে ঝাঁকে ঝাঁকে। আধ ঘন্টা ধরে যুদ্ধ চলে। উভয় পক্ষে বেশ কিছু সৈনিক হতাহত হয়। বরার্ট ক্লাইভ ভয় পেয়ে যান। তিনি উমিচাঁদকে তিরস্কার করতে শুরু করেন। উমিচাঁদ তাঁকে আশ্বস্ত করেন যে মীরমদন আর মোহনলাল ছাড়া বাকি সেনাপতিরা যুদ্ধে অংশ নেবেন না। এই দুইজনকে সামলাতে পারলেই বিজয়।
মীরজাফর আলী খান, ইয়ার লতিফ খান, রায় দুর্লভ, আমীর বেগ, খাদিম হুসাইন খান প্রমুখ সেনাপতিগণ পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকলেন তাঁদের সৈন্যদল নিয়ে মীর মদন, মোহন লাল ও সিনফ্রের কামান গর্জে উঠতে থাকে বারবার। ইংরেজদের একটি গোলার আঘাতে মীর মদন আহত হন। সিরাজুদ্দৌলাহ খানে শিবিরে আনার পর তিনি ইন্তিকাল করেন। বীর বিক্রমে লড়ে যাচ্ছিলেন মোহনলাল। ইংরেজদের অবস্থান তখন খুব সংগীন। প্রধান সেনাপতি মীরজাফর আলী খান সিরাজুদ্দৌলাহ খানকে পরামর্শ দেন যে, রাত ঘনিয়ে এসেছে, অতএব আজকের মতো যুদ্ধ বন্ধ রাখা হোক। সিরাজুদ্দৌলাহ তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করেন ও যুদ্ধ বন্ধের নির্দেশ দেন। মোহনলাল দৌড়ে আসেন তাঁর কাছে এবং বিজয়লাভের কাছাকাছি এসে যুদ্ধ না থামাবার জন্য তাঁকে অনুরোধ করেন। প্রতিবাদ করলেন মীর জাফর আলী খান। ক্ষুণ্ন মনে আপন শিবিরে চলে যান মোহন লাল।
মীর জাফর আলী খান রবার্ট ক্লাইভের নিকট চিটি পাঠালেন আবার হামলা করার জন্য। কর্ণেল রবার্ট ক্লাইভ ও মেজর কিলপ্যাট্রিক তাঁদের সৈন্য দল নিয়ে সিরাজুদ্দৌলাহ খানের বাহিনীর দিকে অগ্রসর হচ্ছেন দেখে সেনাপতি মোহনলাল ও সিনফ্রে আবার ফিরে দাঁড়ান। আবার প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়। মীর জাফর আলী খান ও অন্যান্য সেনাপতিদের সৈন্যরা যুদ্ধের নির্দেশ না পেয়ে এদিক-ওদিক পালাতে শুরু করে। রায় দুর্লভ ও রাজা রাজবল্লভ সিরাজুদ্দৌলাহ খানকে ফুসলাতে থাকেন রণাংগণ ছেড়ে যাবার জন্য। তিনি তাঁদের কথা মতো রণাংগণ থেকে সরে যান। এত তাঁর সৈন্যদের মধ্যে হতাশা ছড়িয়ে পড়ে। হাতীর ওপর বসে মীর জাফর আলী খান ও রায়দুর্লভ যুদ্ধের তামাসা উপভোগ করতে থাকেন। এই নাজুক অবস্থায় সেনাপতি মোহনলাল ও সেনাপতি সিনফ্রে বাধ্য হয়ে রণাংগন ত্যাগ করেন। পলাশী প্রান্তরে বাঙালাহ-বিহার-উড়িশার স্বাধীন নাযিম সিরাজুদ্দৌলাহ খান পরাজিত হন। বাঙালাহ-বিহার-উড়িশার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা চলে যায় সুদূর ইউরোপ থেকে আসা ইংরেজদের হাতে।
খৃস্টীয় ১৭৫৭ সনের ২৪শে জুন। মুর্শিদাবাদে এসে সিরাজুদ্দৌলাহ খান আবার চেষ্টা করলেন তাঁর লোকদেরকে সংগঠিত করতে। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন। তাই বেগম লুৎফুন্নিসা, শিশুকন্যা উম্মু জুহরা ও একজন মাত্র দেহরক্ষী নিয়ে তিনি প্রাসাদ ত্যাগ করেন। ভগবানগোলা অতিক্রম করে তিনি পৌঁছেন গোদাগাড়ি। এখান থেকে নৌকায় চড়ে মহানন্দা নদীপথে তিনি রওয়ানা হন উত্তর দিকে। তিনি যেতে চেয়েছিলেন বিহার। উদ্দেশ্য ছিলো সেখানে গিয়ে ফ্রেঞ্চ সৈন্যদের সাহায্য নিয়ে তিনি আবার লড়বেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে।
অপর দিকে সেনাপতি মীর জাফর আলী খান তাঁর পুত্র মীরনকে নিয়ে দাদপুরে গিয়ে রবার্ট ক্লাইভের সাথে সৌজন্য সাক্ষাত করেন। রবার্ট ক্লাইভ তাঁকে পরামর্শ দেন অবিলম্বে মুর্শিদাবাদ গিয়ে সিরাজুদ্দৌলাহ খানকে গ্রেফতার করতে।
কালিন্দী নদী পেরিয়ে সিরাজুদ্দৌলাহ শাহপুর নামক একটি গ্রামে পৌঁছেন। তিনি নৌকা থেকে নেমে একটি মাসজিদে আসেন খাদ্যের সন্ধানে। পরনে তাঁর ছদ্মবেশ। কিন্তু তাঁর সুদর্শন চেহারা তো লুকাবার কোন উপায় ছিলো না। শাহপুর গ্রামের আশেপাশে যেই দলটি সিরাজুদ্দৌলাহ খানকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলো তাঁদের নেতৃত্বে ছিলেন মীর জাফর আলী খানের জামাতা মীর কামিস আলী খান। একজন লোক গিয়ে তাঁকে আগন্তুকের কথা জানায়। মীর কাসিম আলী খান ছুটে আসেন সেখানে। তিনি সিরাজুদ্দৌলাজ খান, বেগম লূৎফুন্নিসা ও তাঁদের শিশু কন্যা উম্মু জুহরাকে গ্রেফতার করে মুর্শিদাবাদে পাঠিয়ে দেন মীর জাফর আলী খানের পুত্র মীরনের কাছে। তাঁকে জাফরাগঞ্জ প্রাসাদের একটি নিভৃত কক্ষে বন্দী করে রাখা হয়।
খৃষ্টীয় ১৭৫৭ সনের ২রা জুলাই ভোর বেলা বন্দীশালায় প্রবেশ করে মীরনের প্রেরিত ঘাতক। হাতে তার নাঙা তলোয়ার। সিরাজুদ্দৌলাহ খান তাকে লক্ষ্য করে কিছু কথা বলেন। হিংস্র মূর্তি নিয়ে তাঁর দিকে এগিয়ে আসতে থাকে মুহাম্মদী বেগ। তিনি বললেন, “আমাকে একটু অযুর পানি এনে দাও। আমি করুণাময় আল্লাহর উদ্দেশ্যে শেষ নামায পড়ে যেতে চাই”।
মুহাম্মদী বেগ তাঁর ঘাড়ে সজোরে তলোয়ারের আঘাত হানে। অস্ফুট ‘আল্লাহ’ শব্দ বের হয় সিরাজুদ্দৌলাহ খানের মুখ থেকে। আঘাতের পর আঘাত হেনে মুহাম্মদী বেগ ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে নওয়াবের দেহটি। রক্ত স্রোতের উপর লুটিয়ে পড়েন বাঙালাহ-বিহার-উড়িশার নাযিম, নবাব, শেষ স্বাধীন মুসলিম শাসক সিরাজুদ্দৌলাহ খান।
উপসংহার
ইসলামের সোনালী যুগে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শাসককে বলা হতো আমীরুল মুমিনীন। তিনি মুমিনদের প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিবর্গের মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচিত হতেন। কেউ নেতৃত্ব পদ চাইতেন না। ফলে নেতৃত্ব পদ নিয়ে কাড়াকাড়ি ছিলো না। উম্মাহর সর্বোত্তম ব্যক্তির ওপর নেতৃত্ব পদ চাপিয়ে দিতো শাসিতরা।
আমীরুল মুমিনীনের প্রধান কর্তব্য ছিলো আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা। তিনি আল কুরআন ও আসসুন্নাহকে আইনের প্রধান উৎস মনে করতেন। জনসাধারণকে আল কুরআন ও আসসুন্নাহর অনুসারী বানাবার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালাতেন। তদুপরি ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ও সৌন্দর্য সম্পর্কে জনগণকে ওয়াকিফহাল করে তোলার জন্য আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন।
আমীরুল মুমিনীন একাকী কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতেন না। তাঁকে পরামর্শ ও সার্বিক সহযোগিতা প্রদানের জন্য থাকতো মাজলিসুশ শূরা বা পরামর্শ পরিষদ। মাজলিসুশ শূরার সাথে পরামর্শ করে তিনি রাষ্ট্র-পরিচালনা করতেন। ফলে তিনি থাকতেন স্বেচ্ছাচারিতা দোষ মুক্ত।
আমীরুল মুমিনীর ও মাজলিসুশ শূরার সদস্যগণ ছিলেন আল্লাহ ভীরু। আখিরাতে আল্লাহর আদালতে দাঁড়িয়ে তাঁদের জীবনের ছোট-বড়ো সকল কাজ সম্পর্কে জওয়াবদিহি করতে হবে- এই অনুভূতি সদা জাগ্রত থাকতো তাঁদের অন্তরে। তাই তাঁরা ছিলো স্বার্থপরতা, হিংসা-বিদ্বেষ ও দুনীতির উর্ধে। তাঁদের মাঝে ছিলো সম্প্রতিপূর্ণ সম্পর্ক। তাঁদের ঐক্য ছিলো গলিত সিসা দিয়ে তৈরী প্রাচীরের মতো মজবুত।
কালক্রমে মুসলিম উম্মাহ সোনালী যুগের এই সব সোনালী ঐতিহ্য থেকে দূরে সরে পড়ে। খিলাফাত ব্যবস্থা পরিত্যঅগ করে। ফলে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজার থাকতেন একাধিক ছেলে। রাজা মারা গেলে কে হবেন রাজা, তা নির্ধারিত হতো ছেলেদের মধ্যে যুদ্ধের ফলাফলের ভিত্তিতে। ফলে কোন রাজা মারা গেলে তাঁর ছেলেদের মধ্যে হানাহানি ছিলো অবশ্যম্ভাবী।
এই মৌলিক বিচ্যুতির ফলে আরো অনেক ক্রটি ঢুকে পড়ে মুসলিম উম্মাহর সামষ্টিম জীবনে। ফলে উন্নতি নয়, অবনতির দিকে ধাবিত হতে থাকে মুসলিম উম্মাহ।
এমনি তরো একটি পর্যায়ে শাসনদণ্ড হাতেনিয়ে বাংলাদেশে ঘটে মুসলিমদের আবির্ভাব। তবুও এই কথা স্বীকার না করে উপায় নেই যে পতন যুগের মুসলিম শাসকদের মধ্যে এমন অনেকেই ছিলেন যাঁরা ইসলামের অনুসরণের ক্ষেত্রে আজকের মুসলিম শাসকদের চেয়ে অনেক উন্নতমানের ছিলেন।
খৃষ্টীয় ১২০৩ সনে তুর্ক মুসলিম ইখতিয়ারউদ্দীন মুহাম্মদ বাখতিয়ার খালজী বাংলাদেশে মুসলিম শাসনের সূচনা করেন। বাংলাদেশে মুসলিম শাসনের স্থপতি একজন নিষ্ঠাবান মুসলিম ছিলেন।
বাংলাদেশের সর্বশেষ মুসলিম শাসক ছিলেন সিরাজুদ্দৌলাহ খান। খৃষ্টীয় ১৭৫৭ সনের ২৩শে জুন পলাশীর প্রান্তরে তাঁর পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে ৫৫৪ বছরের মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে।
সোনালী যুগের আমীরুল মুমিনীনদের মতো না হওয়া সত্বেও বাংলাদেশের মুসলিম শাসকগণ দেশ ও জাতির কল্যাণে যেই সব অবদান রেখেছেন তার মূল্য অনেক। তাঁদের অবদানের দিব বিবেচনা করতে গেলে আমরা বিস্মিত না হয়ে পারি না।
মুসলিম শাসকগণ এই দেশে ইসলামের মুবাল্লিগ হিসেবে আসেন নি। কিন্তু তাঁদের শাসনকাল ইসলামের মুবাল্লিগদের আগমন পথ প্রশস্ত করে। শত শত মুবাল্লিগ আসেন এই দেশে। তাঁরা শহরে বন্দরে গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ও সৌন্দর্য উপস্থাপন করতে থাকেন। তাঁদের সংস্পর্শে এসে বহু অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করে। মুসলিমদের নৈতিক মান উন্নত করার জন্য মুসলিম শাসনকগণ এই দেশে বহু মাসজিদ নির্মাণ করেন। আবার প্রতিটি মাসজিদই ছিলো এক একটি শিক্ষালয়। তাছাড়া উচ্চতর ইসলামী জ্ঞান প্রদানের জন্য স্থানে স্থানে স্থাপিত হয়েছিলো মাদ্রাসা।
মুসলিম শাসকদের অধিকাংশই ছিলেন দক্ষ শাসক। আইন শৃংখলা নিশ্চিত করার জন্য তাঁরা ত্বরিৎ ও কঠোর পদক্ষেপ নিতেন। দেশে সংঘটিত অপরাধের সংখ্যা ছিলো খুবই কম। ইসলামী বিচার ব্যবস্থা অনেকাংশে প্রতিষ্ঠিত ছিলো। জনগণ শান্তিতে বসবাস করতো।
জনগণের আর্থিক অবস্থা ছিলো উন্নত। দেশে প্রচুর ফসল উৎপন্ন হতো। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হতো। কাপড়, পাটজাত দ্রব্য, চাল, চিনি, লবণ, মরিচ, আদা, হরিতকি দেশের প্রয়োজন মিটিয়ে বিদেশে রফতানী হতো। তাছাড়া শুটকী, ছাগল, ভেড়া, হরিণ ও ঘৃতকুমারী কাঠও রফতানী দ্রব্যের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। কাপড় শিল্পে বাংলাদেশের কোন জুড়ি ছিলো না। সারাদেশের বিভিন্ন এলাকায় তাঁতে কাপড় তৈরি হতো। মসলিন নামক এক প্রকার সূক্ষ্ম কাপড় তৈরি হতো এই দেশে। বিদেশে এই কাপড়ের দারুণ সমাদৃতি ছিলো। সেই কালেই একখন্ড মসলিন কাপড় চারহাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে বলে জানা যায়।
মুসলিম শাসনকালে এই দেশ কুটির শিল্পেও ছিলো সমৃদ্ধ। বাঁশ শিল্প, বেত শিল্প, মৃৎ শিল্প, পাট শিল্প ইত্যাদিতে এই দেশের মানুষ ছিলো সুদক্ষ।
মুসলিশ শাসনকালে বাংলাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলিমগণ পাশাপাশি বসবাস করতো। চমৎখার সম্প্রীতি ছিলো তাদের মাঝে। কেউ কারো আদর্শিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতো না।
মুসলিশ শাসনের পূর্বে এই দেশের রাজ-ভাষা ছিলো সংস্কৃত। এই কঠিন ভাষা অল্প সংখ্যক লোকের মধ্যে প্রধানত ব্রাহ্মণদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো। বাংলা ছিলো জনগণের ভাষা। হিন্দু শাসকগণ বাংলা ভাষাকে ঘৃণার চোখে দেখতেন। মুসলিশ শাসকগণ বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভাষাকে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। এই প্রথম বাংলা ভাষা রাজ-দরবারে প্রবেশের অধিকার পায়। বাংলা ভাষায় অনূদিত হয় বহু বই। অনেক মৌলিক বই লিখিত হয় এই ভাষায়। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে বাংলা ভাষা মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়, উৎকর্ষতার পথে দ্রুত অগ্রসর হয়।
মুসলিশ শাসনকালের একেবারে শেষের দিকের ঘটনা-প্রবাহ খুবই বেদনাদায়ক। দেশ ও জাতির যাঁরা ছিলেন কর্ণধার তাঁর চরম হিংসা-বিদ্বেষের শিকারে পরিণত হন। তাঁদের মাঝে প্রতিহিংসা পরায়ণতা এমন জঘণ্য রূপ ধারণ করে যে প্রতিপক্ষকে হেনস্তা করার জন্য তাঁরা বিদেশীদের সাহায্য নিতেও বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হননি। আর বিদেশীদের সাহায্য নিতে গিয়ে তাঁরা দেশের স্বাধীনতা বিপন্ন করে তুলছেন কিনা তা খাতিয়ে দেখার মতো মানসিক অবস্থাও তাঁদের ছিলো না। দেশ ও জাতির ভাগ্য নির্ধারণের দায়িত্ব যখন এই ধরনের ব্যক্তিদের হাতে এসে পড়ে তখন সেই দেশ ও জাতির সর্বনাশ না হয়ে পারে না।
সময় প্রবাহের এক অধ্যায়ে এসে নেতৃস্থানীয় একদল অপরিণামদর্শী মুসলিম ও একদল অর্থলিপ্সু অমুসলিম দি ইংলিস ইস্ট ইণ্ডিয়া কম্পেনীল সাথে অশুভ আঁতাত গড়ে তুলে বাঙালাহ-বিহার-উড়িশার মুসলিম শাসনের অবসান ঘটানোর নিয়ামক শক্তিতে পরিণত হন।
খৃষ্টীয় ১৭৫৭ সনের ২৩শে জুন পলাশী প্রান্তরে দি ইংলিস ইস্ট ইণ্ডিয়া কম্পেনীর বিজয় লাভের পরিণতিতে এই দেশের জনগণকে পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ হতে হয়। তাদের ওপর নেমে আসে দুর্দিন। ইংরেজগণ মুসলিম রাজশক্তিকে তছনছ করে ফেলে। তাদের সুপরিকল্পিত অর্থনৈতিক শোষণের ফলে মুসলিমদের মেরুদণ্ড ভেংগে যায়। দেশে গোলাম বানানোর উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। অপ-সংস্কৃতি চালু হয়।
অপরিণামদর্শী স্বার্থান্ধ ও প্রতিহিংসাপরায়ণ নেতৃবৃন্দের ভুল সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপের ফলে এই দেশের গণমানুষকে ইংরেজদের গোলামী করতে হয় ১৯০ বছর।
ঋণ স্বীকার
১. হিস্ট্রি অব দ্যা মুসলিম অব বেঙল, ডঃ মুহাম্মদ মোহর আলী
২. বাংলাদেশের ইতিহাস, ডঃ মুহাম্মদ আবদুর রহিম প্রমুখ
৩. বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, ডঃ এম. এ. রহিম
৪. ভারতে মুসলিম রাজত্বের ইতিহাস, এ.কে.এম. আবদুল আলীম
৫. আমি স্মৃতি আমি ইতিহাস, মোজহারুল ইসলাম
৬. বাংলাদেশে ইসলাম, আবদুল মান্নান তালিব