চট্টগ্রামের শাসনকর্তা পরাগল খান ও ছুটি খান কবি পরমেশ্বর ও শ্রীকর নন্দীকে বাংরা ভাষায় মহাভারত অনুবাদ করতে উৎসাহিত করেন।
সুলতান আলাউদ্দীন হুসাইন শাহের ছাব্বিশ বছরের শাসনকালে দেশে শান্তি-শৃংখলা বিরাজমান ছিলো। তিনি নিরপেক্ষতা ও ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার কার্য পরিচালনা করতেন। খৃষ্টীয় ১৫২০ সনে তিনি ইন্তিকাল করেন।
৪১. নাসিরুদ্দীন আবুল মুযাফাফার নুসরাত শাহ
খৃষ্টীয় ১৫২০ সনে আলাউদ্দীন হুসাইন শাহের ইন্তিকাল হলে তাঁর সভাসদগণ তাঁর পুত্র নুসরাত শাহকে বাঙালাহ সালতানাতের সুলতান নির্বাচিত করেন। তিনি নাসিরুদ্দীন আবুল মুযাফফার নুসরাত শাহ উপাধি ধারন করে মসনদে বসেন। মনে হয় তিনি একডালা থেকে রাজধানী গৌড়ে স্থানান্তরিত করেন।
গৌড়ের বড় সোনা মাসজিদ তাঁর স্মৃতি বহন করছে। তাঁর নির্দেশে সালতানাতের বিভিন্ন স্থানে বহু মাসজিদ নির্মিত হয়।
তিনি আলিমদের কদর করতেন। প্রখ্যাত হাদীসবিদ ও ফিকাহবিদ তাকীউদ্দীন ইবনু আইনুদ্দীনকে তিনি প্রধান সভাসদের মর্যাদা দেন।
উল্লেখ্য যে নাসিরুদ্দীন আবুল মুযাফফার নুসরাত শাহ যখন বাঙালাহর সুলতান তখন খৃষ্টীয় ১৫২৬ সনে দিল্লীর সুলতান ইবরাহীম লোদীকে পানিপথ রণাংগনে পরাজিত করে জহিরুদ্দীন মুহাম্মদ বাবুর দিল্লীতে মুগল শাসন পত্তন করেন।
এই সময় বিভিন্ন দেশ থেকে বহু সংখ্যক মুসলিম বাঙালাহ সালতানাতে এসে বসতি স্থাপন করেন। বিশেষ করে মুগলদের চাপের মুখে বহু সংখ্যক আফগান এই দেশে চলে আসে।
পিতার মতো নুসরাত শাহ বাংলা ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করেন। কবি শেখর একজন রাজ-কর্মচারী ছিলেন।
তাঁর শাসনকালে উপকূল অঞ্চলে পর্তুগীজ জলদস্যুদের উৎপাত বৃদ্ধি পায়। খৃষ্টীয় ১৫২৬ সনে একদল পর্তুগীজ জলদস্যুদের উৎপাত বৃদ্ধি পায়। খৃষ্টীয় ১৫২৬ সনে একদল পর্তুগীজ চট্টগ্রাম উপকূলে কিছু সংখ্যক বাণিজ্য জাহাজ লুণ্ঠন করে।
খৃষ্টীয় ১৫৩২ সনে তিনি একজন ভৃত্যের হাতে নিহত হন।
৪২. আলাউদ্দীন আবুল মুযাফফার ফিরোজ শাহ
খৃষ্টীয় ১৫৩২ সনে সুলতান নুসরাত শাহের পুত্র ফিরোজ শাহ ‘আলাউদ্দীন আবুল মুযাফফার ফিরোজ শাহ’ উপাধি ধারন করে বাঙালাহর সুলতান হিসেবে গৌড়ের মসনদে বসেন।
দাদা ও পিতার মতো তিনিও বাংলা সাহিত্যের ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা করেন।
তবে তাঁর শাসনকাল ছিলো খুবই সংক্ষিপ্ত। খৃষ্টীয় ১৫৩৩ সনে তিনি নিহত হন।
৪৩. গিয়াসুদ্দীন আবুল মুযাফফার মাহমুদ শাহ (৩য়)
খৃষ্টীয় ১৫৩৩ সনে মাহমুদ শাহ ‘গিয়াসুদ্দীন আবুল মুযাফফার মাহমুদ শাহ’ উপাধি ধারণ করে গৌড়ের মসনদে বসেন।
তাঁর শাসনকালে দিল্লীর মুগল সুলতান নাসিরুদ্দীন মুহাম্মদ হুমায়ুন ও সাসারামের (বিহারের অন্তর্গত) আফগান (পাঠান) নেতা শের খানের মধ্যে বিরোধ বাঁধে। শক্তি সঞ্চয় করে শের খান বাঙালাহ সালতানাতের বিহার অঞ্চলের একাংশের ওপর নিজের কর্তৃত্ব স্থাপন করেন।
অপর দিকে পর্তুগীজদের উপদ্রব বেড়ে যায়। খৃষ্টীয় ১৫৩৩ সনে পাঁটটি জাহাজে করে দুই শত পর্তুগীজ চট্টগ্রাম বন্দরে পৌছে। তারা একদিকে অবৈধ ব্যবসা চালাতে থাকে অপর দিকে সুলতানকে তুষ্ট করার জন্য গৌড়ে তাদের প্রতিনিধি প্রেরণ করে। তাদের অসাধুতা প্রমাণিত হলে গৌড়ে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ভারতের পশ্চিম উপকূলে গোয়াতে অবস্থিত তাদের প্রধান ঘাঁটি থেকে পর্তুগীজ কর্তৃপক্ষ খৃষ্টীয় ১৫৩৪ সনে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে একদল নৌ-যোদ্ধা প্রেরণ করে। তারা চট্টগ্রাম বন্দরে নেমে নির্বিবাদে লোক হত্যা করে, লুটতরাজ চালায় ও ঘরদোরে আগুন ধরিয়ে দেয়। বিহারের দিক থেকে চলছিলো শের খানের প্রবল সামরিক চাপ। একই সময় দুই দিক সামলানো ছিলো কঠিন। তাই সুলতান মাহমুদ শাহ পর্তুগীজদের সাথে সমঝোতা করতে বাধ্য হন। তিনি পর্তুগীজদেরকে চট্টগ্রাম ও সাতগাঁওতে ঘাঁটি স্থাপনের অনুমতি দেন। বাঙালাহ সালতানাতে এই দুইটি ছিলো ইউরোপীয়দের প্রথম ঘাঁটি।
খৃষ্টীয় ১৫৩৬ সনে শের খান সসৈন্যে গৌড় পৌছেন। প্রচুর অর্থ-সম্পদের বিনিময়ে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। শের খান বিহারে ফিরে যান। কিন্তু ১৪৩৭ সনে তিনি আবার গৌড় আক্রমণ করেন। ঠিক ঐ সময় দিল্লীর সুলতান নাসিরুদ্দীন মুহাম্মদ হুমায়ূন বিহার আক্রমণ করেন। শেরখান তাঁর ছেলে জালাল খান ও সেনাপতি খাওয়াস খানকে গৌড়ের অবরোধে রেখে নিজে চুনারের দিকে যান। কিন্তু চুনার হুমায়ুনের হস্তগত হয়। অপর দিকে গৌড় শের খানের বাহিনীর হস্তগত হয়।
খৃষ্টীয় ১৫৩৮ সনে বাঙালাহ সালতানাত শের খানের পদানত হয়। মাহমুদ শাহ উত্তর বিহারের দিকে পালিকে যান। সেখানে ভগ্ন হৃদয়ে তিনি ইন্তিকাল করেন।
৪৪. ফরিদুদ্দীন আবুল মুযাফফার শেরশাহ
খৃষ্টীয় ১৪৩৮ সনের ছয়ই এপ্রিল শের খান বিজয়ী বেশে বাঙালাহ সালতানাতের রাজধানী গৌড় শহরে প্রবেশ করেন।
ঐ সময় দিল্লীর সুলতান নাসিরুদ্দীন মুহাম্মদ হুমায়ূন শক্তি সঞ্চয় করে সসৈন্যে গৌড়ের উপকণ্ঠে পৌছেন। শেরখান এই আক্রমণ প্রতিহিত করতে পারবেন না ভেবে গৌড় শহর লুণ্ঠন করেন ও শহরটি পুড়িয়ে দেন। লূণ্ঠিত সম্পদ নিয়ে তিনি বিহারের দিকে চলে যান। হুমায়ূন ভস্মিভূত ও লুণ্ঠিত শহরে প্রবেশ করেন। তিনি রাস্তাঘাট ও বিধ্বস্ত প্রাসাদগুলো পুনঃ নির্মাণের ব্যবস্থা করেন। শেরখান কর্তৃক বিধ্বস্ত হওয়ার পরও গৌড় শহরের অবশিষ্ট সম্পদ ও সবুজ সৌন্দর্য দেখে হুমায়ূন মুগ্ধ হন এবং এর নাম রাখেন জান্নাতাবাদ। তিনি সৈন্য প্রেরমণ করে সোনারগাঁও ও চট্টগ্রাম তাঁর নিয়্ন্ত্রণে আনেন এবং উভয় স্থানে দক্ষ প্রশাসক নিযুক্ত করেন। এই প্রথমবার বাঙালাহ মুগলদের পদানত হয়। তবে হুমায়ূন এই বিজয় বেশি দিন ধরে রাখতে পারেন নি।
শের খান দক্ষিণ বিহার জয় করে রোহতাস দুর্গ দখল করেন। আগ্রাতে হুমায়ুনের ভাই বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এই পরিস্থিতিতে হুমায়ুন বাঙালাহ ছেড়ে যেতে বাধ্য হন। পথিমধ্যে শের খানের সাথে একটি শান্তি-চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু শের খান এই চুক্তির মর্যাদা রক্ষা করেননি।
খৃষ্টীয় ১৫৩৯ সনের ২৬শে জুন। হুমায়ুন ও তাঁর বাহিনী যখন সালাতুল ফাজরের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন শেরখান অতর্কিত হামলা চালিয়ে মুগল সৈন্যদেরকে ছত্রভংগ করে দেন। বহু মুগল সৈন্য নিহত হয়।
সুলতান হুমায়ূন নিজাম নামক এক মশকওয়ালার মশকে ভর করে স্বল্প সংখ্যক সৈন্যসহ নদী পার হয়ে আগ্রার দিকে অগ্রসর হন। শের খান দ্রুত এগিয়ে এসে মুগল প্রশাসক ও সৈন্যদেরকে হত্যা করে বাঙালাহ দখল করেন। অতপর তিনি ফরিদউদ্দীন আবুল মুযাফফার শেরশাহ উপাধি ধারণ করে গৌড়ের মসনদে বসেন। এইভাবে বাঙালাহ আফগান (পাঠান) শাসনাধীন হয়। শেরশাহ দেশটিকে কয়েকটি সরকার বা প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত করেন। প্রতিটি সরকার একজন আফগান (পাঠান) শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। তিনি দিল্লীতেও তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন।
খৃষ্ঠীয় ১৫৪৫ সনে (উত্তর প্রদেশের) কালিঞ্জর দুর্গ দখল করতে গিয়ে একটি বিস্ফোরণে আহত হয়ে শেরশাহ ইন্তিকাল করেন। তাঁর পুত্র জালাল খান ইসলাম শাহ উপাধি ধারণ করে দিল্লীর মসনদে বসেন।
৪৫. মুহাম্মদ খান শূর
খৃষ্টীয় ১৫৪৫ সনে দিল্লীর আফগান (পাঠান) সুলতান জালালুদ্দীন আবুল মুযাফফার ইসলাম শাহ (জালাল খান) মুহাম্মদ খান শূরকে বাঙালাহর গভর্ণর নিযুক্ত করেন। ইসলাম শাহ বিহারে গভর্ণর নিযুক্ত করেন সুলাইমান কররানীকে। মুহাম্মদ খান শূরের শাসনকালে ভুলুয়া (নোয়াখালী)- চট্টগ্রাম অঞ্চল অশান্ত হয়ে ওঠে। এই অঞ্চলে কখনো আরাকানের মগ, কখনো বা পর্তুগীজদের দৌরাত্ম দেখা দেয়। কোচবিহারের রাজা নরনারায়ণও বিদ্রোহের পতাকা উড়ান। ঢাকা-মোমেনশাহী অঞ্চলে সুলাইমান খান নামক এক ব্যক্তি স্বাধীনভাবে শাসনকার্য চালাতে থাকেন।
সুলতান ইসলাম শাহ তাজ খান ও দরিয়া খানের নেতৃত্বে একটি সৈন্য দল প্রেরণ করেন সুলাইমানের বিরুদ্ধে। যুদ্ধে সুলাইমান খান নিহত হন। তাঁর দুই পুত্র হচ্ছেন ঈসা খান ও ইসমাঈল খান। পূর্ব বাঙালাহতে ঈসা খান একজন শক্তিশালী শাসক হিসেবে আবির্ভূত হন।
ইসলাম শাহের পর মুবায়িয খান ‘মুহাম্মদ শাহ আদিল’ উপাধি ধারণ করে দিল্লীর মসনদে বসেন।
বাঙালাহর গভর্ণর মুহাম্মদ খানশূর স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং শামসুদ্দীন আবুল মুযাফফার মুহাম্মদ শাহ উপাধি ধারণ করেন।
খৃষ্টীয় ১৫৫৫ সনে উত্তর ভারতে দিল্লীর সৈন্যদের সাথে যুদ্ধে তিনি নিহত হন।
৪৬. গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর শাহ
খৃষ্টীয় ১৫৫৫ সনে দিল্লীর সুলতান শাহবাজ খানকে বাঙালাহর গভর্ণর নিযুক্ত করেন। তিনি যথারীতি গৌড়ে পৌছেন। অপরদিকে মুহাম্মদ শাহের অনুগত বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ যোশি নামক স্থানে মিলিত হয়ে তাঁর পুত্র খিজির খানকে বাঙালাহর সুলতান নির্বাচিত করেন। তিনি গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর শাহ উপাধি ধারণ করেন এবং রাজধানী গৌড়ের দিকে সসৈন্যে অগ্রসর হন। যুদ্ধে দিল্লীর নিযুক্ত গভর্ণর শাহবাজ খান নিহত হন। গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর শাহ স্বাধীন সুলতান রূপে দেশ শাসন করতে থাকেন।
গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর শাহ রাজমহলে একটি, রাজশাহীর কুসুম্বাতে একটি ও বর্ধমানের কালনাতে একটি মাসজিদ নির্মাণ করেন।
তিনি খৃষ্টীয় ১৫৬০ সন পর্যন্ত বাঙালাহর সুলতান ছিলেন।
৪৭. গিয়াসুদ্দীন আবুল মুযাফফার জালাল শাহ
খৃষ্টীয় ১৫৬০ সনে বাহাদুর শাহের ভাই জালাল শাহ ‘গিয়াসুদ্দীন আবু মুযাফফার জালাল শাহ, উপাধি ধারণ করে বাঙালাহর সুলতান হিসেবে গৌড়ের মসনদে বসেন।
তিনি দিল্লীর সুলতান আকবরের সংগে সুসংম্পর্ক রক্ষা করে চলেন।
খৃষ্টীয় ১৫৬৩ সনে তিনি ইন্তিকাল করেন।
৪৮. তাজ খান কররানী
খৃষ্টীয় ১৫৬৩ সনে জালাল শাহের ই্ন্তিকাল হলে তাঁর পুত্র গৌড়ের মসনদে বসেন, কিন্তু অল্পকাল পরেই গিয়াসুদ্দীন নামক এক ব্যক্তির হাতে নিহত হন।
এমতাবস্থায় দক্ষিণ বিহারের গভর্ণর সুলাইমান খান কররানী তাঁর ভাই তাজ খান কররানীর সেনাপতিত্বে গৌড়ের দিকে একদল সৈন্য পাঠান। যুদ্ধে গিয়াসুদ্দীন নিহত হন। তাজ খান কররানী গৌড়ের মসনদে বসেন।
কিন্তু ঐ বছরই তিনি ইন্তিকাল করেন।
৪৯. সুলাইমান খান কররানী
খৃষ্টীয় ১৫৬৩ সনে বিহারের শাসক সুলাইমান খান কররানী বাঙালাহর শাসন ভার নিজের হাতে তুলে নেন। এইভাবে বিহার ও বাঙালাহ আবার একটি রাজ্যে পরিনত হয়।
সুলাইমান খান কররানী আগ্রার সুলতান জালালুদ্দীন মুহাম্মদ আকবরের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখঅর চেষ্টা করেন। তিনি স্বাধীনভাবে বিহার ও বাঙালাহ শাসন করছিলেন, কিন্তু কৌশলগত করণে ‘সুলতান’ উপাধি ধারণ করেননি।
উড়িশার মুকুন্দ দেব সুলাইমান খান কররানীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। সুলাইমান খান তাঁর পুত্র বায়েজিদকে উড়িশার দিকে প্রেরণ করেন। তাঁর সহকারী রূপে প্রেরিত হয়েছিলেন নও মুসলিম ব্রাহ্মণ কালাপাহাড়।
পরবর্তী সময়ে সুলাইমান খান কাররানী নিজেই সসৈন্যে উড়িশা আসেন ও শক্র পক্ষকে পরাজিত করে রাজধানী তাজপুর দখল করেন। এইভাবে বিহার ও বাঙালার সাথে উড়িশাও যুক্ত হয়।
সুলাইমান খান কররানী তান্ডা নামক স্থানে একটি নতুন শহর গড়ে তুলে গৌড় থেকে সেখানে সালতানাতের রাজধানী স্থানান্তরিত করেন।
উল্লেখ্য যে সুলাইমান খান কররানী একজন নিষ্ঠাবান মুসলিম ছিলেন। তিনি সালতানাতে ইসলামী শারীয়াহ কার্যকর করেন। প্রতিদিন সকাল বেলা তিনি একশত পঞ্চাশ জন আলিমের সাথে আলোচনা করতেন।
খৃষ্টীয় ১৫৭৩ সনে তিনি ইন্তিকাল করেন।
৫০. বায়েজিদ খান কররানী
খৃষ্টীয় ১৫৭৩ সনে সুলাইমান খান কররানীর পুত্র বায়েজিদ খান কররানী বাঙালাহর সুলতান হিসেবে তান্ডার মসনদে বসেন। তিনি আগ্রার সুলতানের প্রতি আনুগত প্রদর্শনে নারাজ ছিলেন। তবেঅল্প কাল পরেই তিনি এক কুচক্রী আত্মীয়ের হাতে নিহত হন।
৫১. দাউদ খান কররানী
খৃষ্টীয় ১৫৭৩ সনে লোদী খানের নেতৃত্বে সভাসদগণ একত্রিত হয়ে বায়েজিদ শাহের হত্যাকারীতে হত্যা করে বায়েজিদ খানের ছোট ভাই দাউদ খান কররানীকে বাঙালাহর সুলতান নির্বাচন করেন। তিনিও তাঁর ভাইয়ের মতো স্বাধীন-চেতা ছিলেন।
গুজরাট বিজয়ের পর আগ্রার সুলতান জালালূদ্দীন মুহাম্মদ আকবর মোটামুটি নির্বিঘ্ন হন। এবার তিনি বাঙালাহ-বিহার-উড়িশার দিকে নজর দেন।
খৃষ্টীয় ১৫৭৪ সনে তিনি তাঁর সেনাপতি মুনীম খানকে বাঙালাহ সালতানাত আক্রমনের জন্য পাঠান। মুনীম খান প্রথমে পাটনার দিকে আসেন। দাউদ খান কররানী পাটনায় গিয়ে মুগল বাহিনীর মুকাবিলা করেন। মুনীম খান পাটনা অবরোধ করেন। অবরোধ দীর্ঘস্থায়ী হয়। এবার আকবর নিজেই এক বিশাল বাহিনী নিয়ে পাটনা আসেন। দাউদ খান কররানী পাটনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
মুনীম খান সামরিক অভিযান অব্যাহত রাখেন। খৃষ্টীয় ১৫৭৪ সনের অকটোবর মাসে মুনীম খান বাঙালাহর রাজধানী তান্ডা দখল করেন। দাউদ খান কররানী উড়িশা চলে যান। মুনীম খান সেখানেও আক্রমণ চালান। অবশেষে একটি শান্তি-চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বাঙালাহ ও বিহার মগলদের হাতে চলে যায়। কেবল উড়িশার ওপর দাউদ খান কররানীর কর্তৃত্ব স্বীকৃত হয়।
খৃষ্টীয় ১৫৭৫ সনে মুনীম খান তান্ডাতে ইন্তিকাল করেন।
মুনীম খানের ইন্তিকালের খবর পেয়ে দাউদ খান কররানী উড়িশা থেকে এসে তান্ডা আক্রমণ ও দখল করেন। পশ্চিম বংগ, উত্তর বংগ ও উড়িশার ওপর তিনি কর্তৃত্বশীল হন। পূর্ব বংগে মুগল সেনাপতি শাহ বারদী ঈসা খানের প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হন। ঈসা খান ঐ অঞ্চল থেকে মুগল সৈন্যদেরকে তাড়িয়ে দেন।
এবার আকবর খান জাহান হুসাইন কুলী বেগকে সেনাপতি করে পাঠান। আগ্রার সৈন্য ও বাঙালাহর সৈন্যদের মধ্যে যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয। আকবর সেনাপতি মুযাফফার খান তুরাবাতির নেতৃত্বে দাউদ খান কররানীর বিরুদ্ধে নতুন সৈন্য দল পাঠান
খৃষ্টীয় ১৫৭৬ সনের বারই জুলাই রাজমহলে প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে সুলতান দাউদ খান কররানী পরাজিত ও বন্দী হন। তাঁকে মৃত্যু দন্ড দেয়া হয়। এইভাবে দ্বিতীয় বারের মতো বাঙালাহ মুগলদের কর্তৃত্বাধীনে চলে যায়।
৫২. খান জাহান হুসাইন কুলী বেগ
খৃষ্টীয় ১৫৭৬ সনে আগ্রার সুলতান জালালুদ্দীন মুহাম্মদ আকবর খান জাহান হুসাইন কুলী বেগকে শুবা বাঙালাহর শুবাদার নিযুক্ত করেন। বিহার ও উড়িশাও তাঁর শাসনাধীন ছিলো।
বাঙালাহর সুলতান দাউদ খান কররানীর হত্যা মুগল বিরোধী তৎপরতা বন্ধ করতে পারেনি। সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আফগান (পাঠান) আমীরগণ তাঁদের অনুগত সৈন্যদেরকে নিয়ে মুগল সৈন্যদের মুকাবিলা করতে থাকেন। এই সময় কয়েকজন হিন্দু জমিদারও শক্তি সঞ্চয় করে মুগলদের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। প্রকৃত পক্ষে রাজধানী তান্ডা ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলো ছাড়া সারা বাঙালাহ ছিলো মুগলদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
ফরিদপুর অঞ্চলে দুইজন আফগান (পাঠান) সরদার মজলিস দিলাওয়ার ও মজলিস কুতব নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন। ঢাকা-মোমেনশাহী অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত ছিলো ঈসা খানের কর্তৃত্ব। নারায়নগঞ্জের খিদিরপুর ছিলো তার প্রধান কেন্দ্র। উড়িশা-বর্ধমান অঞ্চল ছিলে কুতলু খানের নিয়ন্ত্রণে। খুলনা অঞ্চলে শ্রীধর মহারাজ বিক্রমাদিত্য উপাধি ধারণ করে স্বাধীন ভাবে শাসন চালাচ্ছিলেন। তাঁরই পত্র ছিলেন প্রতাপাদিত্য। বরিশালের বৃহত্তর অংশে কর্তৃত্ব করেন কন্দর্প নারায়ণ। ভুলূয়া (উত্তর নোয়াখালী) অঞ্চলে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন লক্ষণ মানিক্য। দক্ষিনাঞ্চল, দ্বীপগুলো ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে কখনো আরাকানের মগ, কখনো পর্তুগীজগণ কর্তৃত্ব করতে থাকে।
শুবাদার খান জাহান হুসাইন কুলী বেগ বিভিন্ন বণাংগনে যুদ্ধ করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েন।
খৃষ্টীয় ১৫৭৮ সনে তিনি ইন্তিকাল করেন।
৫৩. মুযাফফার খান তুরবাতি
খৃষ্টীয় ১৫৭৯ সনের এপ্রিল মাসে আগ্রার সুলতান আকবর মুযাফফার খান তুরবাতিকে শুবা বাঙালাহর শুবাদার করে তান্ডা পাঠান।
জালালুদ্দীন মুহাম্মদ আকবর ছিলেন একজন বিভ্রান্ত ব্যক্তি। তিনি আল্লাহর প্রদত্ত দীন ইসলামকে পরিত্যাগ করে নিজেই এক আজগুবী ধর্মীয় মতবাদের প্রবর্তন করেন। তিনি এই মতবাদের নাম রাখেন দীন-ই-ইলাহী। এই মতবাদের কালেমা ছিলো- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ আকবারু খালীফাতুল্লাহ। এই মতবাদের অনুসারীদেরকে বলা হতো চেলা। চেলাগণ তাদের পাগড়ীতে আকবরের ছবি ব্যবহার করতো। প্রতিদিন সকাল বেলা আকবরের দর্শন লাভকে পুণ্যের কাজ মনে করা হতো। সকলে প্রজাগণ রাজপ্রাসাদের সামনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াতো। আকবর তাদেরকে দর্শন দেবার জন্য রাজকীয় পোষাক পরে প্রাসাদের ব্যালকনীতে এসে দাঁড়াতেন। এইটিকে বলা হতো ঝরোকা দর্শন। তাঁকে সকলে কুর্নিশ করতে হতো। রাজ-মহলে শিখা চিরন্তর জ্বালানো হয়। সারা দেশে গরু জবাই নিষিদ্ধ হয়। সুদ ও জুয়া বৈধ ঘোষিত হয়। মদ খাওয়া বৈধ করা হয়। নওরোজ উৎসবে দরবারে সাড়ম্বরে মদ পরিবেশন করা হতো। নতুন মতবাদ অনুযায়ী বাঘ ও সিংহের গোশত খাওয়া বৈধ করা হয়। মহিলাদের মতো পুরুষদের জন্য স্বর্ণালংকার ও রেশমী পোষাক পরা বৈধ করা হয়। মৃতদেহ পানিতে ভাসিয়ে দেয়া কিম্বা পুড়িয়ে ফেলা উত্তম গণ্য করা হয়। কেউ মৃতদেহ কবরস্থ করতে চাইলে লাশের পা পশ্চিম দিকে রেখে কবরস্থ করতে বলা হয়।
আকবরের ইসলাম-বিরোধী কর্মকাণ্ড সজাগ ও নিষ্ঠাবান মুসলিমদেরকে দারুণভাবে বিক্ষুব্ধ করে। জৌনপুরের কাজী মোল্লা মুহাম্মদ ইয়াযদী তাঁর বিরুদ্ধে ফতোয়া দেন। আকবরের নিদের্শে তাঁকে হত্যা করা হয়।
এতে সালতানাতে একটি অস্বস্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। বাঙালঅহ ও বিহার পরিস্ততি ছিলো বিস্ফোরন্মুখ। বিদ্রোহী আফগান (পাঠান) সরদারণগ একত্রিত হয়ে শুবা বাঙালাহর রাজধানী তাণ্ডা আক্রমণ করেন।
খৃষ্টীয় ১৫৮০ সনের উনিশে এপ্রিল শুবাদার মুযাফফার খান তুরবাতি বন্দী হন। তাঁকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়।
৫৪. খান-ই-আযম
খৃষ্টীয় ১৫৮২ সনে আকবর খান-ই-আযমকে শুবা বাঙালাহর শুবাদার করে পাঠান। তিনি বিদ্রোহী আফগানদের বিরুদ্দে বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেন ও কোন কোনটিতে সাফল্য অর্জন করেন। অতপর তিনি বাঙালাহ থেকে অন্যত্র বদলি হওয়ার আবেদন জানান। আকবর তাঁকে বিহারে বদলি করেন।
৫৫. শাহবাজ খান
খৃষ্টীয় ১৫৮৪ সনে খান-ই-আযমকে বদলি করে আকবর শাহবাজ খানকে শুবা বাঙালাহর শুবাদার নিযুক্ত করেন।
এই সময় ঈসা খান বৃহত্তর ঢাকা-মোমেনশাহী ও কুমিল্লা জিলার ওপর কর্তৃত্বশীল ছিলেন। কখনো তিনি অবস্থান করতেন খিদিরপুরে, কখনো মোমেনশাহী জিলার এগারসিন্ধুতে।
খৃষ্টীয় ১৫৮৪ সনে শুবাদার শাহবাজ খান পূর্ব বংগের দিকে অগ্রসর হন। এই সময় উড়িশা থেকে সরে আসা মাসুম খান কাবুলীকে নিয়ে ঈসা খান কুচবিহারে অবস্থান করছিলেন। শাহবাজ খান বিনা বাধায় খিদিরপুদ ও সোনারগাঁও জয় করে শীতলক্ষা নদী ধরে এগারসিন্ধুর দিকে এগিয়ে টুক নামক স্থানে অবস্থান গ্রহণ করেন। এখানে তিনি ঈসা খান ও মাসুম খান কাবুলীর প্রতিরোধের সম্মুখীন হন। একদিন একটি মুগল বাহিনী বাজিতপুর এলে ঈসা খান তাদের ওপর ঝটিকা হামলা চালান। সেনাপতি তারসুন খান সাহ বহু মুগল সৈন্য নিহত হয়। ঈসা খানের প্রবল আক্রমণের ফলে শাহবাজ খানও পিছু হটতে বাধ্য হন।
খৃষ্টীয় ১৫৮৪ সনের ত্রিশে সেন্টেম্বর ভাওয়াল রণাংগনে মুগল বাহিনী দারুণভাবে পরাজিত হয়। শুবাদার শাহবাজ খান পালিয়ে তান্ডা চলে যান। মাসুম খান কাবুলী তাঁক ধাওয়া করে বগুড়া পর্যন্ত পৌঁছেন। শাহবাজ খান তান্ডা ছেড়ে বিহারে চলে যান। শক্তি সঞ্চয় করে শাহবাজ খান ডিসেম্বর মাসে আবার তান্ডা আসেন।
খৃষ্টীয় ১৫৮৫ সনে মাসুম খান কাবুলী ফরিদপুরে সরে আসেন।
আকবর সাদিক খানকে বাঙালাহর ও শাহবাজ খানকে বিহারের কমান্ড প্রদান করেন। পরিস্থিতির কোন উন্নতি না হওয়ায় শাহবাজ খানকে পাঠান বাঙালায়।
শুবাদার শাহবাজ খান এবার তলোয়ারের পরিবর্তে বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করেন তিনি ঈসা খানের সাথে সংলাপ শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত উভয় পক্ষে একটি শান্তি-চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। শাহবাজ খান মাসুম খান কাবুলীর সাথেও চুক্তি করতে সক্ষম হন। তবে উভয় পক্ষই নিজ নিজ অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য যেই সময় প্রয়োজন তা পাওায়ার জন্যই এই চুক্তি স্বাক্ষর করে।
৫৬. সাঈদ খান
খৃষ্টীয় ১৫৮৭ সনে আকবর সাঈদ খানকে শুবা বাঙালাহর ও মানসিংহকে শুবা বিহারের শুবাদার নিযুক্ত করেন।
উড়িশার আফগান সরদার কুতলু খানের ইন্তিকালের পর তাঁর তরুণ পুত্র নাসির খান মসনদে বসেন। মানসিংহ উড়িশার উপর চাপ সৃষ্টি করেন।
খৃষ্টীয় ১৫৯০ সনে নাসির খান মুগলদের সাথে শান্তি-চুক্তি স্বাক্ষর করেন। পরে আবার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। অবশেষে ১৫৯৩ সনে উড়িশা আগ্রা সালতানাতের অধীনে চলে যায়।
৫৭. মানসিংহ
খৃষ্টীয় ১৫৯৪ সনের মধ্যভাগে আকবর মানসিংহকে শুবা বাঙালাহর শুবাদার নিযুক্ত করেন।
মানসিংহ শুবা বাঙালাহর রাজধানী তান্ডা থেকে রাজমহলে স্থানান্তরিত করেন এবং এর নাম রাখেন আকবর নগর।
মানসিংহের প্রধান মাথাব্যাথা হয়ে দাঁড়ায় পূর্ব বংগে কর্তৃত্বশীল ঈসা খানের শক্তি খর্ব করণ। তিনি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ঈসা খানও বসে ছিলেন না। তিনি উড়িশা থেকে আগত উসমান খান ও সুলাইমান খানকে সাথে নিয়ে মুগলদের মুকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। যশোরের কেদার রায় বিক্রমপুরের নিকটে বসতি স্থাপন করে ঈসা খানের মিত্রে পরিণত হন।
মানসিংহের প্রেরিত বাহিনীর সাথে ঈসা খান বগুড়া, বিক্রমপুর প্রভৃতি রণাংগনে লড়েন। মুগল বাহিনী সবখানেই প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। উল্লেখ্য যে শুবাদার মানসিংহ কখনো নিজে ঢাকা আসেননি। ঈসা খানের সাথে তাঁর সরাসরি কোন লড়াই হয়নি।
খৃষ্টীয় ১৫৯৮ সনে মানসিংহ শুবা বাঙালাহ ছেড়ে চলে যান। আর ১৫৯৯ সনে পূর্ব বংগের স্বাধীনতার নিশান বরদার ঈসা খান ইন্তিকাল করেন।
ঈসা খানের ইন্তিকালের পর মুসা খান স্বাধীনতার পতাকা সমুন্নত রাখার সংকল্প নিয়ে মসনদে বসেন।
মানসিংহ আজমীরে বসে প্রতিনিধির মাধ্যমে বাঙালাহর শাসন তত্ত্বাবধান করছিলেন। কিন্তু ১৬০১ সনে তিনি আবার বাঙালায় আসেন। এবার অবশ্য তিনি ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছেন। বিক্রমপুরের কেদার রায়কে নিজের দলে ভিড়াবার জন্য তিনি চেষ্টা চালান। কিন্তু কেদার রায় যেমন বিশ্বস্ত ছিলেন ঈসা খানের প্রতি, তেমনি বিশ্বস্ত থাকেন ঈসা খানের পুত্র মুসা খানের প্রতি।
খৃষ্টীয় ১৬০৫ সনের মার্চ মাসে মানসিংহ আগ্রা যান। আর ঐ বছরই অক্টোবর মাসে আকবর ইন্তিকাল করেন।
আগ্রার মসনদে বসেন নূরুদ্দীন মুহাম্মদ জাহাঁগীর। নতুন সুলতান মানসিংহকে আবার বাঙালায় পাঠান। তবে এবার তিনি বাঙালায় থাকেন এক বছর।
৫৮. কুতবুদ্দীন খান কোকা
খৃষ্টীয় ১৬০৬ সনে জাহাঁগীর কুতবুদ্দীন খান কোকাকে শুবা বাঙালাহর শুবাদার নিযুক্ত করেন। বছর খানেক ছিলেন তিনি রাজমহলে। কিন্তু বাঙালাহ তাঁর নিকটও দুর্ভেদ্য প্রমাণিত হয়।
৫৯. জাহাঁগীর কুলী খান
খৃষ্টীয় ১৬০৭ সনে শুবা বাঙালাহর শুবাদার হিসেবে রাজমহলে আসেন জাহাঁগীর কুলী খান। তিনিও গোটা বাঙালায় আগ্রার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হন।
৬০. শায়খ আলাউদ্দীন ইসলাম খান চিশতি
খৃষ্টীয় ১৬০৮ সনে আগ্রার সুলতান জাহাঁগীর ইসলাম খান চিশতীকে শুবা বাঙালাহর শুবাদার করে রাজমহলে পাঠান। তখন তাঁর বয়স ৩৮ বছর।
ইসলাম খান ছিলেন খুবই বিচক্ষণ ও দৃঢ়চেতা লোক। সুপরিকল্পিতভাবে তিনি অগ্রসর হন। তিনি প্রথমে সসৈন্যে গৌড় পৌছেন। তাঁর প্রেরিত সৈন্যরা যুদ্ধ ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করলে তিনি আলাইপুর আসেন। সেখান থেকে সৈন্য পাঠিয়ে তিনি যশোর দখল করেন। তার পর তারা দখল করে পাবনা। এই দিকে বর্ষা মওসুম এসে যায়। ইসলাম খান রংপুরের ঘোড়াঘাটে অবস্থান গ্রহণ করেন। উত্তর-পূর্ব মোমেনশাহীর রাজা রঘুনাথ ঘোড়াঘাট এসে তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেন। কুচবিহারের রাজা লক্ষী নারায়ণও একই পথ অবলম্বন করেন।
মুগল বাহিনী মানিকগঞ্জের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে মুসা খানের মিত্র বিনোদ রায়ের বিরুদ্ধে লড়তে এসে সুবিধা করতে পারেনি। ফরিদপুরের মজলিস কুতবের বিরুদ্ধেও মুগল সৈন্যরা সফলতা অর্জন করে। ফলে মুসা খান ও তাঁর মিত্রগণ ঢাকা-মোমেনশাহী অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েন।
বর্ষা মওসুম শেষ হলে ইসলাম খান সেনাপতি শায়খ কামালের নেতৃত্বে একদল সৈন্য পাঠান ঢাকার দিকে। আর তিনি নিজে নৌ-পথে মুসা খানের অন্যতম শক্ত ঘাঁটি যাত্রাপুরের দিকে অগ্রসর হন। ইসলাম খান কাটাসগড় এসে থামেন। মুসা খান যাত্রাপুর রক্ষার জন্য মির্যা মুমিন, দরিরা খান ও মধু রায়ের নেতৃত্বে অগ্রসেনা দল পাঠান। পরে তিনি নিজে নৌ-বহর নিয়ে অগ্রসর হন। পদ্মানদীর তীরে ডাকচরা নামক স্থানে এসে তিনি দ্রুত গতিতে মাটি দিয়ে একটি দুর্গ নির্মাণ করে ফেলেন। এই অঞ্চলে উভয় দলে কয়েক দিন যাবত যুদ্ধ চলে। কোন পক্ষই জয় লাভ করতে পারেনি। ইতিমধ্যে ইসলাম খানের একদল সৈন্য ঢাকা থেকে ডাকচরার দিকে এগিয়ে আসে। উভয় দিক থেকে আক্রমণ চালিয়ে ইসলাম খান যাত্রাপুর দখল করে নেন। বাকি থাকে ডাকচরা। মুসা খান দেড় মাস পর্যন্ত মুগলদেরকে প্রতিহত করে চলেন। অতপর কুচবিহারের রাজা রঘুনাথ একটি শুকনো খালের ভেতর দিয়ে পথ দেখিয়ে মুগল সৈন্যদেরকে ডাকচরা দুর্গের নিকটে নিয়ে আসেন। মধ্যরাতে মুগলবাহিনী ডাকচরার ওপর হামলা চালায়। ঈসা খানের বহু সৈনিক প্রাণ হারায়। ঈসা খান নিজে পদ্ম নদীর অপর তীরে সরে যান।
শুবাদার ইসলাম খান সসৈন্যে ঢাকা পৌছেন। তিনি ঢাকার নাম রাখেন জাহাঁগীর নগর। মুসা খান খিদির পুর ছেড়ে যান। সোনারগাঁওতে হাজ শামসুদ্দীন বাগদাদীকে শাসনকর্তা নিযুক্ত করে মুসা খান শীতলক্ষা নদীর পূর্ব তীরে রণাংগন সাজান। মুসা খানের ষাই আবদুল্লাহ খানকে কদমরসূল, আরেক ভাই দাউদ খানকে কত্রাভূ এবং আরেক ভাই মাহমুদ খানকে ডেমরাতে প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়।
কিন্তু মুগল বাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণের মুখে এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেংগে পড়ে। মুসা খান মেঘনা নদীর বুকে ইবরাহীমপুর নামক দ্বীপে গিয়ে অবস্থান গ্রহন করেন। মুগল বাহিনী সোনারগাঁও আক্রমণ করলে হাজী শামসুদ্দীন বাগদাদী আত্মসমর্পণ করেন।
খৃষ্টীয় ১৬১১ সনের এপ্রিল মাসে সোনারগাঁও মুগলদের পদানত হয়।
ইসলাম খান ভুলূয়ার (উত্তর নোয়াখালী) জমিদার অনন্ত মানিক্যের বিরুদ্ধে সেনাপতি শায়খ আবদুল ওয়াহিদের নেতৃত্বে একদল সৈন্য পাঠান। ডাকাতিয়া নদীর তীরে যুদ্ধ হয়। পরাজিত অনন্ত মানিক্য পালিয়ে প্রথমে ভুলূয়া ও পরে আরাকান চলে যান।
মুসা খান এবার ইসলাম খানের সাথে শান্তি আলোচনা শুরু করেন। খৃষ্টীয় ১৬১১ সনে তিনি জাহাঁগীরনগর এসে আগ্রার শুবাদার ইসলাম খানের নিকট আত্ম-সমর্পণ করেন।
খৃষ্টীয় ১৬১৩ সনে ইসলাম খান কামরূপের দিকে সামরিক অভিযান চালিয়ে রাজা পরীক্ষিত নারায়ণকে পরাজিত করে কামরূপ শুবা বাঙালাহর অন্তর্ভুক্ত করেন।
ইসলাম খান রাজমহল থেকে শুবা বাঙালাহর রাজধানী জাহাঁগীরনগর (ঢাকা) স্থানান্তরিত করেন। তিনি এখানে প্রাসাদ ও দুর্গ নির্মাণ করেন। এরপর প্রায় একশত বছর জাহাঁগীরনগর (ঢাকা) শুবা বাঙালাহর রাজধানী থাকে।
খৃষ্টীয় ১৬১৩ সনের একুশে আগস্ট বাঙালাহর শুবাদার ইসলাম খান ইন্তিকাল করেন।
উল্লেখ্য যে আগ্রার সুলতান নূরুদ্দীন মুহাম্মদ জাহাঁগীর শাসন কালের প্রথম ভাগে তাঁর পিতা আকবরের প্রবর্তিত ভ্রান্ত মতবাদ দীন-ই-ইসলাহীল পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। আকবরের শাসনকালের শেষ ভাগে শায়খ আহমাদ সরহিন্দি নির্ভেজাল ইসলামের নিমান বরদার হিসেবে আবির্ভূত হন। জাহাঁগীরের শাসন কালেও তিনি তাঁর আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। তিনি ভালোভাবে উপলব্ধি করেছিলেন যে শাসক গোষ্ঠীকে ইসলামের পথে আনতে না পারলে মুসলিম উম্মাহকে সর্বনাশের হাত থেকে বাচাঁনো যাবে না। তাই তিনি শাহজাদা, রাজ-দরবারের আমীরগণ ও সেনাপতিদেরকে ইসলাম সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দেয়ার লক্ষ্যে দীর্ঘ চিঠি লিখতে থাকেন। তাঁদের নিকট তিনি মোট পাঁচশত চল্লিশতি চিঠি লিকেন। আল্লাহর অশেষ মেহেরবাণী যে তাঁর চিঠি দ্বারা শাহজাদা খুররম (পরবর্তীকালে শাহজাহান) ও বিশিষ্ট আমীরগণ প্রভাবিত হন। আবদুর রহীম খান খানান, মির্যা দারাব, কালিজ খান, নবাব আবদুল ওয়াহহাব, সাইয়েদ মাহমুদ, সাইয়েদ আহমাদ, খিদির খান লোদী, মির্যা বাদীউজ্জামান, জাব্বার খান, সিকান্দার খান লোদী প্রমুখ তাঁর চিঠি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।
জাহাঁগীর একবার শায়খ আহমাদ সরহিন্দিকে বন্দীও করেন। কিন্তু চার দিকের অবস্থা আঁচ করে তিনি তাঁকে মুক্ত করে দেন। শাসনকালের শেষ দিকে জাহাঁগীর দীন-ই-ইলাহীর পৃষ্ঠপোষকতা পরিত্যাগ করেন।
আরো উল্লেখ্য যে, খৃষ্টীয় ১৬০৮ সনে ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমস ইংরেজদেরকে বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে একটি চিঠি সহ ক্যাপ্টন হকিংস-কে সুলতান নূরুদ্দীন মুহাম্মদ জাহাঁগীরের নিকট প্রেরণ করেন।
খৃষ্টীয় ১৬১৫ সনে রাজা প্রথম জেমস একই উদ্দেশ্যে টমাস রো-কে জাহাঁগীরের দরবারে পাঠান। টমাস রো ইংরেজ ব্যবসায়ীদের জন্য বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা আদায় করতে সক্ষম হন।
৬১. কাসিম খান
খৃষ্টীয় ১৬১৩ সনের সেপ্টেম্বর মাসে নূরুদ্দীন মুহাম্মদ জাহাঁগীর ইসলাম খানের ভাই কাসিম খানকে শুবা বাঙালাহর শুবাদার নিযুক্ত করেন। কাসিম খান খৃষ্টীয় ১৬১৪ সনের মে মাসে জাহাঁগীরনগর (ঢাকা) আসেন।
মুগল-আফগান সংঘর্ষ চলাকালে আরাকানের রাজা মেঙ খামঙ চট্টগ্রামের ওপর তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর মগ সৈন্যরা বাঙালাহর উপকূল অঞ্চলে হামলা চালিয়ে লুণ্ঠন করতো। এই সময় কখনো কখনো পর্তুগীজদর সাথে তাদের সংঘর্ষ হতো। পর্তুগীজগণ তখন তাদের দলপতি গঞ্জালিসের নেতৃত্বে সন্দীপে খুঁটি গেড়ে বসেছিলো।
বাঙালাহ পুরোপুরি মুগলদের দখলে চলে যাওয়ায় আরাকানীজ ও পতুগীজ-উভয় পক্ষই শংকিত হয়ে উঠে এবং একে অপরের সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।
খৃষ্টীয় ১৬১৪ সনে এই দুই শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুগল শাসিত ভুলূয়া (উত্তর নোয়াখালী) আক্রমণ করে বসে। ভুলূয়াতে অবস্থানরত থানাদার আবদুল ওয়াহিদ ডাকাতিয়া নদী ও মাছুয়া খাল এলাকায় সরে আসেন।
এই সময় আরাকানীজ ও পর্তুগীজদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। পর্তুগীজগিণ লুণ্ঠন কাজ করে সন্দীপ চলে যায়। আরাকানীজরা থেকে যায় ডাকাতিয়ার তীরে। থানাদার আবদুল ওয়াহিদ শক্তি সহ্ছয় করে ডাকাতিয়ার দক্ষিণ তীরে এসে আরাকানীজদের উপর হামলা চালান। পরাজিত হয়ে আরাকানের রাজা পালিয়ে যান।
কাসিম খানের শাসনকালে তিনবার আরাকানের দিকে ও দুইবার কাছাড়-আসামের দিকে সামরিক অভিযান পরিচালিত হয়।
খৃষ্টীয় ১৬১৭ সনে শুবাদার কাসিম খান বাঙালাহ ছেড়ে চলে যান।
৬২. ইবরাহীম খান
খৃষ্টীয় ১৬১৭ সনের নভেম্বর মাসে ইবরাহীম খান বাঙালাহার শুবাদার নিযুক্ত হয়ে জাহাঁগীর নগর (ঢাকা) আসেন।
ইসলাম খানের শাসনকাল থেকে মূসা খান রাজধানীতে নজরবন্দী অবস্থায় ছিলেন। খৃষ্টীয় ১৬১৮ সনে ইবরাহীম খান তাঁকে মুক্ত করে দেন। এর পর থেকে মূসা খান ইবরাহীম খানের সহযোগী হয়ে কাজ করতে থাকেন।
কামরূপ ফ্রন্টে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে ইবরাহীম খান চট্টগ্রামের দিকে নজর দেন। অবশ্য এর পূর্বি তিনি ত্রিপুরা নিয়ন্ত্রণে আনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে খৃষ্টীয় ১৬১৮ সনে ত্রিপুরা আক্রমণ করেন। মির্যা ইসফানদিয়ারের নেতৃত্বে একদল সৈন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে অগ্রসর হন। আরেক দল সৈন্য মির্যা নূরুদ্দীন ও মূসা খানের নেতৃত্বে কুমিল্লা জিলার মিহিরকুল হয়ে ত্রিপুরার রাজধানী উদয়পুরের দিকে অগ্রসর হয়। তদুপরি গোমতী নদী হয়ে বাহাদুর খান সামনে এগুতে থাকেন। ত্রিপুরা রাজ যশোমানিক্য পরাজিত হয়ে আরাকানের দিকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেন, কিন্তু পথিমধ্যে বন্দী হন।
খৃষ্টীয় ১৬১৮ সনের নভেম্ব মাসে রাজধানী উদয়পুরে মুগল বাহিনী প্রবেশ করে। ত্রিপুরা রাজ্য শুবা বাঙালাহর অংশে পরিণত হয়।
খৃষ্টীয় ১৬২০ সনে আরাকানের রাজা পর্তুগীজদের ঘাঁটি সন্দীপ দখল করে নেন ও বাঙালাহর দক্ষিণাঞ্চলগুলোর ওপর লুণ্ঠন কাজ চালাতে থাকেন। তিনি তাঁর নৌ-সেনাদের নিয়ে ঢাকার কাছাকাছি বাঘার চর পর্যন্ত পৌঁছেন। ইবরাহীম খান মগদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামেন। তাঁর সাহায্যে অগ্রসর হন মূসা খান। আরাকান বাহিনী পালিয়ে যায়।
খৃষ্টীয় ১৬২১ সনে আরাকানের মগেরা মেঘনার মোহনায় দক্ষিণ শাহবাজপুর দ্বীপ পর্য্ত এগিয়ে আসে। ইবরাহীম খান অগ্রসর হলে তারা পালিয়ে যায়।
বার্মার রাজার সাথে আরাকানের রাজার শক্রতা দেখা দিলে আরাকানের রাজা ঐদিকে মনোযোগী থাকেন। এই সুযোগে পর্তুগীজরা আবার বেপরোয়া হয়ে উঠে। তারা লুটতরাজ চালাতে চালাতে যশোর পর্যন্ত এসে পৌছে। ইবরাহীম খান সসৈন্যে এগিয়ে গেলে পর্তুগীজ-দস্যুরা দক্ষিণ দিকে সরে যায়।
খৃষ্টীয় ১৬২৩ সনে মূসা খান ও কামরূপের শাসনকর্তা শায়খ কামাল ইন্তিকাল করেন। তাঁরা উভয়ে ছিলেন সুযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিত্ব। মূসা খানের পুত্র মাসুম খান তখন উনিশ বছরের তরুণ। ইবরাহীম খান তাঁকেও মর্যাদার আসন দান করেন।
খৃষ্টীয় ১৬২৪ সনে বিদ্রোহী শাহজাদা খুররম রাজমহলের দিকে অগ্রসর হন। শুবাদার ইবরাহীম খান তাঁর মুকাবিলায় অগ্রসর হলে বিশে এপ্রিল উভয় বাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে ইবরাহীম খান নিহত হন।
শাহজাদা খুররম পান্ডয়া, ঘোড়াঘাট ও পাবনা পদানত করে শুবা বাঙালাহর রাজধানী জাহাঁগীরনগর (ঢাকা) পৌছেন। কিন্তু তিনি মাত্র সাত দিন ঢাকাতে অবস্থান করে আবার উত্তর ভারতের দিকে চলে যান। সেনাপতি মহব্বত খান তাঁকে সুখে থাকতে দেননি। শাহজাদা খুররম উত্তর ভারতে পরাজিত হয়ে রাজহলে এসে চব্বিশ দিন অপেক্ষা করে দাক্ষিণাত্যের দিকে চলে যান।
৬৩. মহব্বত খান
খৃষ্টীয় ১৬২৫ সনে নূরুদ্দীন মুহাম্মদ জাহাঁগীর সেনাপতি মহব্বত খানকে শুবা বাঙালাহার শুবাদার নিযুক্ত করেন। এই নিযুক্ত ছিলো একটি চক্রান্তের ফসল। জাহাঁগীরের বেগম নূরজাহান মহব্বত খানকে পছন্দ করতেন না। কারণ শায়খ আহমাদ সরহিন্দির আন্দোলনের প্রতি তিনি ছিলেন সহানুভূতিশীল। অতএব তাঁকে রাজধানী থেকে দূরে সরিয়ে রাখাই যুক্তিযুক্ত বিবেচনা করে সুদূর বাঙালাহর শুবাদার নিযুক্ত করা হয়।
মহব্বত খান বাঙালাহ আসেন। কিন্তু নূর জাহানের কিচু হঠকারী পদক্ষেপের কারণে তিনি বিক্ষুব্ধ হন।
খৃষ্টীয় ১৬২৬ সনে তিনি সসৈন্যে এগিয়ে গিয়ে সুরতান জাহাঁগীরকে আটক করেন। নূরজাহান পালাতে সক্ষম হন। তবে পরে আত্মসমর্পণ কর বন্দী জাহাঁগীরের সংগিণী হন।
কিন্তু অনুগত ব্যক্তিদের সাহায্যে জাহাঁগীর ও নূরজাহান নজরবন্দী অবস্থা থেকে মুক্তি লাভ করেন। ফলে মহব্বত খান দ্রুততার সাথে দক্ষিণাত্যে গিয়ে বিদ্রোহী শাহাজাদা খুররমের (শাহজাহান) সাথে মিলিত হন।
মহব্বত খানের অনুপস্থিতি কারে আরাকানের মগ বাহিনী বেপরোয়া হয়ে উঠে। তারা প্রথমে ভুলুয়া ও পরে জাহাঁগীরনগরে প্রবেশ করে ব্যাপক লুটতরাজ করে। জাহাঁগীরনগরে বহু ঘরবাড়ি তারা পুড়িয়ে দেয়। বহু বাসিন্দাকে বন্দী করে নিয়ে যায়।
৬৪. মুকাররাম খান
খৃষ্টীয় ১৬২৬ সনে জাহাঁগীর মুকাররম খানকে শুবা বাঙালাহর শুবাদার করে পাঠান। কিন্তু ১৬২৭ সনে তিনি নৌকা ডুবিতে মারা যান।
৬৫. মির্যা হিদায়াতুল্লাহ ফিদাই খান
খৃষ্টীয় ১৬২৭ সনে সুলতান জাহাঁগীর ফিদাই খানকে শুবা বাঙালাহর শুবাদার নিযুক্ত করেন। খৃষ্টীয় ১৬২৭ সনে র অক্টোবর মাসে জাহাঁগীর ইন্তিকাল করেন।
খৃষ্টীয় ১৬২৮ সনে শাহজাদা খুররম আবুল মুযাফফার শিহাবুদ্দীন মুহাম্মদ শাহজাহান উপাধি ধারণ করে আগ্রার মসনদে বসেন।
উল্লেখ্য যে জাহাঁগীর-পত্নী নূর জাহান তাঁর জামাতা শাহরিয়ারকে আগ্রার মসনদে বসাতে চেয়েছিলেন। তিনি শাহজাদা খুররমকে অপছন্দ করতেন। খুররমের ওপর শাখ আহমাদ সরহিন্দির প্রভাবই ছিলো এই অপছন্দের মূল কারণ।
শাহজাহান মসনদে বসে নূরজাহানের সাথে মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করেন এবং তাঁর সম্মানজনক ভাতা নির্ধারণ করেন।
৬৬. কাসিম খান
খৃষ্টীয় ১৬২৮ সনে শাহজাহান কাসিম খানকে শুবা বাঙালাহর শুবাদার করে পাঠান। শুবাদার ইসলাম খানের সময় কাসিম খান জাহাঙ্গীরনগরে (ঢাকা) খাজাঞ্চী হিসেবে কাজ করেছিলেন। পরে তিনি আগ্রার শাসনকর্তা হন।
উল্লেখ্য যে ১৬২১ থেকে ১৬২৪ সনের মধ্যে পর্তুগীজগণ বাঙালাহর বিভ্নি অঞ্চলে হামলা চালিয়ে ৪২ হাজার লোককে ধরে নিয়ে যায়। এদের মধ্যে চাপ সৃষ্টি করে তারা ২৮ হাজার লোককে খৃষ্টান বানায়। বাকিদেরকে দাস বানায়।
আগ্রার মসনদে বসার পর শাহজাহান তাঁর প্রজাদের লূণ্ঠিত জাহাজগুলো ফিরিয়ে দেয়ার জন্য গোয়াতে অবস্থানরত পর্তুগীজ কর্তৃপক্ষের নিকট চিঠি পাঠান। কিন্তু ফলোদয় হয়নি।
খৃষ্টীয় ১৬৩২ সনে শুবাদার কাসিম খান পর্তুগীজদের হুগলী ঘাঁটি আক্রমণ করেন। অবরোধ তিন মাস স্থায়ী হয়। অবশেষে পর্তুগীজগণ নদীপথে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে। তাদের বহু নৌকা ডুবিয়ে দেয়া হয়। হুগলী দখল করে মুগল বাহিনী পর্তুগীজ ঘাঁটি থেকে দশ হাজার বন্দীকে উদ্ধার করে। পর্তুগীজগণ এদেরকে দাস হিসেবে আটক রেখেছিলেন।
হুগলী দখলের কিছুকাল পর শুবাদার কাসিম খান ইন্তিকাল করেন।
৬৭. আযম খান
খৃষ্টীয় ১৬৩৩ সনে আগ্রার সুলতান শাহজাহান মীর মুহাম্মদ বাকির আযম খানকে শুবা বাঙালাহর শুবাদার নিযুক্ত করেন।
খৃষ্টীয় ১৬৩৩ সনে উড়িশার বালাসোরে ইংরেজদের প্রথম বাণিজ্য কুটি স্থাপিত হয়।
উল্লেখ্য যে খৃষ্টীয় ১৬৩৫ সনে সুলতান শাহজাহান আগ্রা থেকে দিল্লীতে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন।
৬৮. ইসলাম খান মাশহাদী
খৃষ্টীয় ১৬৩৫ সনে ইসলাম খান মাশহাদী শুবা বাঙালাহর শুবাদার নিযুক্ত হন।
খৃষ্টীয় ১৬৩৭ সনে অহোম (মূল আসাম) রাজের উস্কানীতে বলি নারায়ণ কামরূপে মুগল শাসনের কেন্দ্র হাজো-র উপর আক্রমণ চালিয়ে তা দখল করেন। ইসলাম খান মাশহাদী তাঁর বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণ করেন। কয়েক দিন যাবত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। অবশেষে পরাজিত হয়ে বলি নারায়ণ আসামের গভীর অরণ্যে পালিয়ে যান। মুসলিম বাহিনী হাজো উদ্ধার করেন। দাররং শুবা বাঙালাহর অন্তর্ভুক্ত হয়। খৃস্টীয় ১৬৩৯ সনে অহোম রাজের সংগে মুসলিম শাসনকর্তার শান্তি-চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী উত্তরাঞ্চলে বারনাদি নদী ও দক্ষিণাঞ্চলে আসুর আলী নদী অহোম রাজ্য ও শুবা বাঙালাহর সীমান্ত বলে স্বীকৃত হয়। ঐ অঞ্চলে মুসলিম শাসিত অংশের প্রশাসনিক কেন্দ্র স্থাপিত হয় গৌয়াহাটিতে।
৬৯. শাহজাদা মুহাম্মদ শুজা
খৃষ্টীয় ১৬৩৯ সনে দিল্লীর সুরতান শাহজাহান ইসলাম খান মাশহাদীকে দিল্লী ডেকে নেন এবং শাহাজাদা মুহাম্মদ শুজাকে শুবা বাঙালাহর মুবাদার নিযুক্ত করেন।
মুহাম্মদ শুজা জাহাঁগীরনগর (ঢাকা) থেকে রাজধানী রাজমহলে স্থানান্তর করেন।
রাজমহলে অবস্থান করার কারণে শুবাদারের পক্ষে পর্তুগীজ, ডাচ (নেদারল্যাণ্ডের অধিবাসী) ও ইংলিস ব্যবসায়ীদের ওপর নজরদারী করা সহজ হয়। কেননা তারা হুগলী হয়ে নদীপথে রাজমহল, মাখসুসাবাদ (মর্শিদাবাদ) ও পাটনা পর্যন্ত তাদের মালামাল আনা নেওয়া করতো।
খৃষ্টীয় ১৬৪২ সনে উশিড়াকেও শুবা বাঙালাহর সাথে যুক্ত করে দেয়া হয়।
পর্তুগীজদেরকে হুগলীত এসে শান্তিপূর্ণভাবে বাণিজ্য করার অনুমতি দেয়া হয়।
খৃষ্টীয় ১৬৫০ সনে দি ইংলিস ইস্ট-ইণ্ডিয়া কম্পানী দিল্লীর সুলতান শাহাজাহান থেকে পণ্য পরিবহনে বেশ কিছু সুবিধা সম্বলিত একটি ফরমান লাভ করে।
খৃষ্টীয় ১৬৫১ সনে ইংরেজগণ হুগলীতে তাদের ফ্যাক্টরী স্থাপন করে।
খৃষ্টীয় ১৬৫৭ সনে শাহজাহান অসুস্থ হয়ে পড়লে শাহজাদাদের মধ্যে বিরোধ বাধে।
খৃষ্টীয় ১৬৫৮ সনে মুহীউদ্দীন মুহাম্মদ আওরঙ্গজেব আলমগীর বিজয়ী বেশে দিল্লী প্রবেশ করেন। মুহাম্মদ শুজাও আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে লড়েন।
৭০. মুয়াযযাম খান মীর জুমলা
খৃষ্টীয় ১৬৫৯ সনে আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে শুবা বাঙালাহর শুবাদার নিযুক্ত করেন।
মীর জুমলা এগিয়ে এলে মুহাম্মদ শুজা রাজমহল ছেড়ে প্রথমে তাণ্ডা ও পরে জাহাঁগীর নগর (ঢাকা) চলে আসেন। পরে তিনি আরাকানে গিয়ে সেখানকার রাজার নিকট রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন।
আরাকানের রাজা মুহাম্মদ শুজার ধন-সম্পদ হস্তগত করা ও তাঁর কন্যাকে বিয়ে করার চক্রান্তে মেতে উঠেন। শুজা তাঁর অবস্থান স্থল থেকে গোপনে সরে পড়ে বার্মার দিকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেন। টের পেয়ে আরাকান রাজ তাঁর পিছু নেন ও সপরিবারে শাহজাদা শুজাতে হত্যা করেন।
শুবাদার মীর জুমলা খুবই সাহসী, কর্মঠ ও বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি শুবা বাঙালাহর রাজধানী রাজমহল থেকে আবার জাহাঁগীর নগর (ঢাকা) স্থানান্তরিত করেন। তিনি ইদরাকপুর (মুনশীগঞ্জ), ফতুল্লা ও বুড়িগংগার অপর তীরে আরেকটি দুর্গ নির্মাণ করেন। খিদিরপুর, সোনাকান্দা প্রভৃতি দৃর্গ মজবুত করেন। ডাচ বণিকগণ যথারীতি শুল্ক পরিশোধ করে নির্বিঘ্নে শুবা বাঙালাহতে বাণিজ্য চালিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু ইংরেজ বণিকগণ তাদের শুল্ক আদায়ে টালবাহানা করতে তাকে। ফলে শুবাদার মীর জুমলা ইংরেজদের কাসিমবাজার ফ্রাকটরি বন্ধ করে দেন। পরে তারা বার্ষিক তিন হাজার টাকা কর দেবার অংগীকার করে আবার ব্যবসা চালাতে থাকে।
খৃষ্টীয় ১৬৬১ সনে মীর জুমলা কুচবিহারে সামরিক অভিযান চালাতে বাধ্য হন। তিনি কুচবিহারের রাজধানী জয় করে মুহাম্মদ সালিহকে রাজপ্রাসাদের ছাদে উঠে আযান দিতে বলেন। চার দিকে ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে। কুচবিহারের পলাতক রাজা ভীম নারায়ণের পুত্র বিশ্বনারায়ণ গোপনে মীর জুমলার নিকট পৌছে ইসলাম গ্রহণ করেন। কুচ বিহারের রাজধানীর নামও ছিলো কুচ বিহার। এবার এর নাম রাখা হয় আলমগীর নগর। খৃষ্টীয় ১৬৬২ সনে শুবাদার মীর জুমলা সসৈন্যে অগ্রসর হয়ে গৌয়াহাটি ও কাজলি পুনর্দখল করেন। এরপর তিনি অহোম বা মূল আসামের দিকে অগ্রসর হন।
খৃষ্টীয় ১৬৬২ সনের ১৭ই মার্চ অহোম রাজ্যের রাজধানী গরহগাঁও তাঁর পদানত হয়। অহোম রাজ তাঁর রাজ্যের একেবারে পূর্ব প্রান্তস্থিত নামরূপ নামক স্থানে গিয়ে অবস্থান গ্রহণ করেন।
মীর জুমলা ছিলেন নাছোড়বান্দা। দিহিং নদী পেরিয়ে তিনি নামরূপের দিকে অগ্রসর হন। ইতিমধ্যে তিনি জ্বরাক্রান্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু জিহাদী প্রেরণা তাঁকে পিছু হঠতে দেয়নি। তিনি নামরূপের নিকটে পৌছেন। অহোম-রাজ শান্তি চুক্তির জন্য বিনীতভাবে অনুরোধ জানাতে থাকেন। অবশেষে শাক্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
গৌয়াহাটি, কাজলি প্রভৃতি স্থানে গিয়ে মীর জুমলা প্রশাসনিক ব্যবস্থা দৃঢ় করে নৌ-পথে রাজধানীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।
খৃষ্টীয় ১৬৬৩ সনের ৩০শে মার্চ খিদিরপুর থেকে কিছু দূরে থাকতেই তিনি ইন্তিকাল করেন। উল্লেখ্য যে অহোম রাজা শান্তি চুক্তির অন্যতম শর্ত হিসেবে তাঁর এক কন্যাকে মীর জুমলার তত্ত্বাবধানে প্রেরণ করেন। রাজকুমারী ইসলামী জীবন দর্শন ও মুসরিমদের চারিত্রিক সৌন্দর্য দেখে স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর নাম রাখা হয় রহমত বানু। দিল্লীর অন্যতম শাহজাদা মুহাম্মদ আযমের সাথে রহমত বানুর বিয়ে হয়।
৭১. দাউদ খান
খৃষ্টীয় ১৬৬৩ সনের সেপ্টেম্বর মাসে দাউদ খান শুবা বাঙালাহর ভারপ্রাপ্ত শুবাদার নিযুক্ত হন।
৭২. শায়েস্তা খান
খৃষ্টীয় ১৬৬৪ সনের মার্চ মাসে দিল্লীর সুলতান আওরঙ্গজেব শায়েস্তাখানকে শুবা বাঙালাহর শুবাদার নিযুক্ত করেন।
উল্লেখ্য যে আওরঙ্গজেব ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান মুসলিম। শায়খ আহমাদ সরহিন্দির চিন্তাধারা দ্বারা তিনি অনুপ্রাণিত ছিলেন। তিনি ইসলামের নির্ভেজাল রূপের সাথে পরিচিত ছিলেন। সারা ভারতে ইসলামী মূল্যবোধ উজ্জীবনে তিনি ছিলেন সদা তৎপর। বিভিন্ন শুবাতে তিনি নেক ব্যক্তিদেরকে শুবাদার করে পাঠান।
খৃষ্টীয় ১৬৬৪ সনের ১৩ই ডিসেম্বর শুবাদার শায়েস্তা খান জাহাঁগীর নগর (ঢাকা) এসে পৌঁছেন। প্রথমেই তিনি যাকাত, উশর, আয়মা, জাগীর ইত্যাদি সংক্রন্ত অসংগতি দূর করেন।
তিনি প্রতিদিন খোলাখুলি দরবারে বসতেন। লোকেরা সরাসরি তাঁর নিকট তাদের অভিযোগ পেশ করতো। তিনি সেইগুলোর মীমাংসা করতেন। জনগণের কাছ থেকে যাতে নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় করা না হয় সেই দিকে তিনি কড়া নজর রাখতেন।
আলাউদ্দিন হুসাইন শাহের শাসনকালে চট্টগ্রাম বাঙালাহ সালতানাতের অধীনে আসে। পরবর্তীকালে মুগল-আফগান দ্বন্দ্বের সময় আরাকানের রাজা চট্টগ্রাম দখল করে নেন। তখন থেকে চট্টগ্রাম মগ ও পর্তুগীজদের লুণ্ঠন ভূমিকে পরিণত হয়।
মীর জুমলা অহোম-রাজ্য জয়ের পর চট্টগ্রাম অভিযানে যাবেন বলেন পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সময় তিনি পাননি।
হুগলী থেকে বিতাড়িত পর্তুগীজ দস্যুরা আরাকান রাজ্যের পৃষ্ঠপোষকতায় চট্টগ্রামে অবস্থান করতে থাকে। তারা শুবা বাঙালাহর বিভিন্নস্থানে লুণ্ঠন চালিয়ে যেই সম্পদ লাভ করতো তার অর্ধাংশ আরাকান রাজকে দিতো।
শায়েস্তা খান সাঈদ নামক এক আফগান সরদারকে ভুলুয়াতে মোতায়েন করেন। চাঁদপুরের নিকটে অবস্থিত সংগ্রামগড়ে পাঠান মুহাম্মদ শরীফকে। চাঁদপুরের নিকটে শ্রীপুরে পাঠান আবুল হাসানকে। ধাপা নামক স্থানে নিযুক্ত হন মুহাম্মদ বেগ আবাকাস। আর চট্টগ্রামে নৌ-হামলা চালাবার জন্য তৈরী করেন তিনশত রণ-তরী।
এই সময়টিতে দলত্যাগী এককালের মুগল অফিসার দিলাওয়াল খানের নিয়ন্ত্রণে ছিলো সন্দীপ। শায়েস্তাখান আবুল হাসানের নেতৃত্বে একটি নৌ-বহর সন্দীপের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। খৃষ্টীয় ১৬৬৫ সনের ১২ই নভেম্বর আবুল হাসান সন্দীপ দখল করেন।
মুগল বাহিনীর সাথে পেরে উঠা যাবেনা ভেবে পর্তুগীজগণ আরাকান-রাজ্যের পক্ষত্যাগ করে ভুলুয়াতে এসে মুগল বাহিনীর পক্ষ অবলম্বন করার অংগীকার ব্যক্ত করে।
এরপর স্থল-পথ ও নৌ-পথে চট্টগ্রামের দিকে অভিযান পরিচালিত হয়। শায়েস্তাখানের পুত্র বুযুরগ উমেদ খান ছিলেন এই অভিযানের প্রধান সেনাপতি। ফরহাদ খান, মুনাওয়ার খান, মীর মুরতাদা, মুহাম্মদ বেগ আবাকাস প্রমুখ সহকারী সেনাপতি হিসেবে কর্তব্য পালন করেন। বিভিন্ন রণাংগনে মগ বাহিনী পরাজিত হতে থাকে।
খৃষ্টীয় ১৬৬৬ সনের ২৭শে জানুয়ারী বুযুরগ উমেদ খান চট্টগ্রাম প ্রবেশ করেন। তার অন্যতম সহকর্মী মীর মুরতাদা মগদেরকে তাড়িয়ে দক্ষিণে রামু পর্যন্ত পৌঁছেন।
চট্টগ্রাম বিজয়ের খবর দিল্লীতে পৌঁছলে আওরঙ্গজেব এর নাম রাখেন ইসলামাবাদ।
চট্টগ্রাম জয়ের পর দি ইংলিস ইস্ট ইণ্ডিয়া কম্পানী ঢাকাতে একটি বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। তারা শুবা বাঙালাহ থেমে মসলিন কাপড় সহ বিভিন্ন পণ্যদ্রব্য ইউরোপের বাজারে সরবরাহ করতো। শুল্ক প্রদানে অনীহা ও কম্পানীর কর্মকর্তাগণ কর্তক অবৈধ প্রাইভেট ব্যবসা পরিচালনার কারণে ইংরেজদের সাথে সরকারের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠে। উভয় পক্ষে আলাপ আলোচনার পর স্থির হয় যে দি ইংলিস ইস্ট ইণ্ডিয়া কম্পানী বছরে তিন হাজার টাকা কর দেবে, আর কোন শুল্ক দেবে না।
শুবাদার মীর জুমলার শাসনকাল থেকে থমাস প্র্যাট ইংরেজদের পক্ষ থেকে সরকারের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। শুবাদার শায়েস্তা খান তাঁকে তিন শত সৈন্যের মনসবদার নিযুক্ত করেন। কিন্তু থমাস প্র্যাট হঠাৎ একদিন কয়েকজন ইংরেজ ও কয়েকজন পর্তুগীজ সহ শুবাদারের পক্ষ ত্যাগ করে তাঁর বহু জাহাজের ক্ষতি করে ও দুইটি জাহাজ নিয়ে পালিয়ে আরাকান রাজের দলে ভিড়েন। শায়েস্তা খান ইংরেজ কর্মকর্তাদের নিকট মিঃ প্র্যাটকে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দেন। তা না হলে তিনি বাঙালায় তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দেবেন বলেন জানান। ইংরেজ কর্মকর্তাগণ অপারগতা প্রকাশ করে। অবশ্য মিঃ প্র্যাট কোন কারণে আরাকান রাজ কর্তৃক নিহত হন। ইতিমধ্যে দিল্লীর সুলতান আওরঙ্গজেব সকল ইউরোপীয় কম্পানীর কাছ থেকে শতকরা দুইভাগ হারে শুল্ক আদায়ের নির্দেশ জারি করেন।
খৃষ্টীয় ১৬৭৭ সনে আওরঙ্গজেব শায়েস্তা খানকে দিল্লীতে ডেকে পাঠান।
৭৩. ফিদাই খান (আযম খান)
খৃষ্টীয় ১৬৭৮ সনের জানুয়ারী মাসে শুবা বাঙালাহর শুবাদার হয়ে আসেন ফিদাই খান। চার মাস পর তিনি ইন্তিকাল করেন।
৭৪. শাহজাদা সুলতান মুহাম্মদ আযম
খৃষ্টীয় ১৬৭৮ সনের মধ্যভাগে আওরঙজেব তাঁর তৃতীয় পুত্র সুলতান মুহাম্মদ আযমকে শুবা বাঙালাহর শুবাদার করে পাঠান।
তিনি জাহাঁগীরনগর এসে ইউরোপীয় কম্পানীগুলোর কাছ থেকে শতকরা দুইভাগ হারে শুল্ক আদায় সম্পর্কিত কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ কার্যকর করার উদ্যোগ নেন। এই দিকে ইংরেজগণ পাটনাতে অবস্থিত তাদের অফিসার জব চার্ণককে নির্দেশ দেয় দিল্লীর সুলতানের কাছ থেকে তাদের অনুকূলে নতুন একটি ফরমান হাছিল করতে।
৭৫. শায়েস্তা খান
খৃষ্টীয় ১৬৭৯ সনের শেষের দিকে আওরঙজেব শাহজাদা সুলতান মুহাম্মদ আযমকে দিল্লীতে ডেকে নেন এবং শায়েস্তা খানকে আবার বাঙালাহর শুবাদার করে পাঠান।
দিল্লীর সুলতানের কাছ থেকে নতুন ফরমান হাছিলের চেষ্টা চলছে এই বাহানায় ইংরেজগণ ১৬৭৭ সন থেকেই তাদের বার্ষিক প্রদেয় তিন হাজার টাকা পরিশোধ করা থেকে বিরত থাকে।
খৃষ্টীয় ১৬৮২ সনে দি ইংলিস ইস্ট ইণ্ডিয়া কম্পানীর গভর্ণর হিসেবে হুগলীতে আসেন উইলিয়ান হেজেস। তাঁর বাসা পাহারা দেওয়ার বাহানায় একজন কর্পোরালের অধীনে বিশজন ইংরেজ সৈন্য এসে হুগলীতে অবস্থান গ্রহণ করে। এইটি ছিলো শুবা বাঙালাহতে ইংরেজদের প্রথম সামরিক স্থাপনা।
খৃষ্টীয় ১৬৮৪ সনের আগস্ট মাসে Gyfford হুগলীতে আসেন উইলিয়াম হেজেস-এর স্থলাভিষিক্ত হয়ে। ইংরেজগণ কোন শুল্কই দিচ্ছিলো না।
খৃষ্টীয় ১৬৮৬ সনে দি ইংলিস ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানী ইংল্যাণ্ডের রাজা দ্বিতীয় জেমসের কাছ থেকে প্রয়োজনে বিদেশের স্থানীয় সরকারের সাথে যুদ্ধ করার অনুমতি হাছিল করে। এর পর কম্পানী ভাইস এডমিরাল নিকলসনের কমাণ্ডে দশটি যুদ্ধ জাহাজে করে ছয় শত সৈন্য প্রেরণ কর্ মাদ্রাজ কাউন্সিলকে নির্দেশ দেয়া হয় তারা যেনো আরো চার শত সৈন্য নিকলসনের কমাণ্ডে দেয়। কম্পানীর হেড কোয়ার্টারস ভাইস-এডমিরাল নিকলসনকে প্রথমে বালাসোরে যেতে ও সেখান থেকে চট্টগ্রামে গিয়ে তা দখল করে সেখানে একটি দুর্গ নির্মাণ করতে বলে নির্দেশ ছিলো, অতপর নিকলসন চট্টগ্রাম থেকে জাহাঁগীর নগরের (ঢাকা) দিকে অগ্রসর হবেন ও শায়েস্তা খানকে তাঁদের পছন্দনীয় শর্তে সন্দি করতে বাধ্য করবেন।
কম্পানীর পক্ষ থেকে তাঁকে আরাকানের রাজা ও বাঙালাহর হিন্দু জমিদারদের সাথে মৈত্রী স্থাপনেরও পরামর্শ দেয়া হয়।
খৃষ্টীয় ১৬৮৬ সনের অক্টোবর মাসে এডমিরাল নিকলসন খারাপ আবহাওয়ার কারণে বালাসোর কিংবা চট্টগ্রাম না গিয়ে এলেন হুগলী।
২৮শে অক্টোবর হুগলীতে যুদ্ধ সংঘটিত হয় ইংরেজ ও বাঙালাহর সৈন্যদের মধ্যে। হুগলীর ফৌজদার আবদুল গনি পরাজিত হয়ে পিছু হটেন। নিকলসনের সৈন্যরা হুগলী শহরে ওপর গোলা বর্ষণ করে প্রায় পাঁচশত ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত করে। খবর পেয়ে শায়েস্তা খান বাঙালাহর অন্যান্য স্থানে অবস্থিত ইংরেজ কুঠিগুলি দখল করে নেন। তিনি হুগলীর দিকেও সৈন্য প্রেরণ করেন। শায়েস্তা খানের প্রেরিত সৈন্যরা হুগলী পৌঁছার আগেই ইংরেজগণ মাল-সামান গুটিয়ে সূতানটি নামক স্থানে সরে যায়। সেখান থেকে জব চার্ণক সংলাপ শুরু করেন। সংলাপ ব্যর্থ হওয়ায় ইংরেজ বাহিণী ১৬৮৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসে সূতানটি ছেড়ে আরো দক্ষিণে সরে গিয়ে থানা ও হিজলী দখল করে সেখানে অবস্থান করতে থাকে। মে মাসের মাঝামাঝি সেনাপতি আবদুস সামাদ ১২ হাজার সৈন্য নিয়ে হিজলী পৌঁছেন। যুদ্ধে ইংরেজগণ পরাজিত হয়ে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য আগ্রহী হয়।
খৃষ্টীয় ১৬৮৭ সনের ১৬ই আগস্ট শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ইরেজগণ সূতানটি ফিরে আসার অনুমতি পায়। ইতিমধ্যে দি ইংলিস ইস্ট ইণ্ডিয়া কম্পানী জব চার্ণকের স্থলে ক্যাপ্টিন হীথকে বাঙালায় তাদের গভর্ণর নিযুক্ত করে পাঠায়্ তিনি কয়েকটি যুদ্ধ জাহাজ ও ১৬০ জন সৈন্য নিয়ে বাঙালাহর দিকে অগ্রসর হন।
খৃষ্টীয ১৬৮৮ সনের শেষভাগে তিনি বঙালাহতে এসে পৌঁছেন। তবে ঐ বছরের জুন মাসেই শুবাদার শায়েস্তা খান বাঙালাহ থেকে চলে যান।
৭৬. খান-ই-জাহান বাহাদুর
খৃষ্টীয় ১৬৮৮ সনের শেষের দিকে খান-ই-জাহান বাহাদুর শুবা বাঙালাহর শুবাদার হিসেবে জাহাঁগীরনগর (ঢাকা) আসেন।
তাঁর শাসনকালে দি ইংলিস ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানীর গভর্ণর ক্যাক্টিন হীথ সসৈন্যে উড়িশার উপকূলবর্তী বালাসোর আক্রমণ করে মুগল ফৌজদারকে পরাজিত করে তা দখল করেন। ক্যাপ্টিন হীথের সৈন্যগণ একমাসব্যাপী শহরবাসীদের ওপর অকথ নির্যাতন চালায়। ২৩শে ডিসেম্বর ইংরেজ বাহিনী সমুদ্র পথে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। সেখানে পৌঁছে তিনি টের পান যে চট্টগ্রাম দখল করা সহজ নয়। বেশ কিছুদিন নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে খৃষ্টীয় ১৬৮৯ সনের ১৭ই ফেব্রুয়ারী তিনি মাদ্রাজের উদ্দেশ্যে সমুদ্র পাড়ি দেন।
পূর্বাঞ্চলে ইংরেজদের চট্টগ্রাম দখলের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তেমনি ব্যর্থ হয় ভারতের পশ্চিম উপকূলে তাদের কর্তৃত্ব স্থাপনের প্রয়াস। দি ইংলিস ইস্ট ইণ্ডিয়া কম্পানী বুঝতে পারলে যে মুগলরা এতোখানি দুর্বল হয়ীন যে তাদের হাত থেকে দেশের কিছু অংশ খসিয়ে নেয়া যায়। তাই তারা শান্তি স্থাপন করে বেশি বেশি বাণিজ্যিক মুনাফা হাছিলকে প্রাধান্য দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
আওরঙজেব বালাসোরে ইংরেজদের বর্বরতার খবর পেয়ে তাদের প্রতি কঠোর মনোভংগি গ্রহণ করেন। কম্পানী দেড় লাখ টাকা জরিমানা নিয়ে বিনীতভাবে ব্যবসা চালিয়ে যাবার অনুমতি প্রার্থনা করে। অবশেষে খৃষ্টীয় ১৬৯০ সনে সমঝোতা হয়।
৭৭. ইবরাহীম খান
খৃষ্টীয় ১৬৮৯ সনের জুলাই মাসে খান-ই-জাহানের স্থলে বাঙালাহর শুবাদার হয়ে আসেন ইবরাহীম খান।
জাহাঁগীরনগর এসে তিনি যুদ্ধজনিত কারণে বন্দী ইংরেজদেরকে মুক্তি দেন। জব চার্নক তখন মাদ্রাজে ছিলেন। নতুন শুবাদার তাঁকে বাঙালায় এসে ব্যবসা চালাতে বলেন।
খৃষ্টীয় ১৬৯০ সনের ২৪শে আগস্ট জব চার্নক সূতানটি ফিরে আসেন।
খৃষ্টীয় ১৬৯১ সনের ফেব্রুয়ারী মাসে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে বার্ষিক তিন হাজার টাকা কর প্রদানের শর্তে ইংরেজদেরকে বাঙালাহর ব্যবসা-বাণিজ্য চালাবার অনুমতি দেয়া হয়।
ইংরেজগণ অনুভব করে যে হুগলীর চেয়ে সূতানটি তাদের জন্য বেশি সুবিধাজনক স্থান। তাই তারা সেখানে তাদের শক্তিশালী বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে তোলে।
খৃষ্টীয় ১৬৯০ সনে ইবরাহীম খানের অনুমতি নিয়ে ফ্রেঞ্চ (ফ্রান্সের অধিবাসী) বণিকগণ হুগলী থেকে চার মাইল দক্ষিণে অবস্থিত চান্দেরনগরে তাদের বাণিজ্য কুঠি গড়ে তোলে। আর খৃষ্টীয় ১৬৯৩ সনে দিল্লীর কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিলের এককালীন চল্লিম হাজার টাকা প্রদান করে ফ্রেঞ্চগণ বাঙালাহ, বিহার, উড়িশায় কাষ্টমস শুল্ক প্রদানের শর্তে ব্যবসা করার অনুমতি লাভ করে।
ইতিমধ্যে ডাচগণ (নেদারল্যাণ্ডসের অধিবাসী) হুগলীর নিকটবর্তী চিন সূরাহতে তাদের বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে তোলে। শুবাদার ইবরাহীম খানের শাসনকালে উড়িশায় রহীম খান ও বর্ধমানে শোভা সিংহ মুগলদের বিরুদ্দে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ঐ অঞ্চলের মুগল ফৌজদারগণ বিদ্রোহীদেরকে দমন করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হন। এই বাহানায় ইউরোপীয় বণিকগণ দমন করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হন। এই বাহানায় ইউরোপীয় বণিকগণ তাদের বাণিজ্য কেন্দ্রগুলোকে নিরাপদ রাকার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গড়ে তোলার অনুমতি দিতে শুবাদার ইবরাহীম খানকে অনুরোধ জানায়। শুবাদার তাদেরকে আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলেন। এতোটুকু অনুমতির ভিত্তিতে ইংরেজগণ কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম, ফ্রেঞ্চগণ চান্দের নগরে ফোর্ট অরলিনস ও ডাচগন চিনসূরাহতে ফোর্ট গুস্তাভাস নামে দুর্গ গড়ে তোলে। এইগুলো ছিলো বাঙালাহর মাটিতে ইউরোপীয়দের সামরিক স্থাপনা।