ছয়: রাষ্ট্রপ্রধানের অপরিহার্য গুণ-গরিমা
রাষ্ট্রপ্রধানের গুণ-গরিমা ও যোগ্যতার (Qualifications) প্রশ্ন ইসলামের দৃষ্টিতে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি, আমি এতদূর বলতে চাই যে, ইসলামী শাসনতন্ত্র কার্যকরী হওয়া না হওয়া সম্পূর্ণরূপে এরই উপর নির্ভর করে।
রাষ্ট্রপ্রধান এবং মজলিসে শু’রার (পার্লামেন্ট) সদস্য পদের জন্যএক প্রকারের গুণ ও যোগ্যতার দরকার হয়, আইনগত ইলেকশন-সেক্রেটারী এবং একজন বিচারপতি সেই আইনগত যোগ্যতার দৃষ্টিাতে যাচাই করে কোন ব্যক্তির যোগ্য (Eligible) হওয়া না হওয়ার ফায়সালা করেন। আরও এক প্রকারের যোগ্যতা ও গুণ-গরিমা অপরিহার্য হয়, যার দৃষ্টিতে নির্বাচক মণ্ডলী লোকদের বাছাই করা এবং মনোনয়ন দান করার কাজ সম্পনন করে- ভোটদাতাগণ এর মানদণ্ডে ভোট প্রার্থীদের ওজন করে ভোট দেয়। প্রথম প্রকারের যোগ্যতা- গুণপণা এক একটি দেশের লক্ষ কোটি বাসিন্দাদের প্রত্যেকের মধ্যেই বর্তমান পাওয়া যায়। কিন্তু এই দ্বিতীয় প্রকারের গুণপণা ও যোগ্যতা দুর্লভ, লক্ষ কোটি বাসিন্দাদের মধ্যে খুব মুষ্টিমেয় লোকদেরকেই এটা কার্যত উপরে আসার সুযোগ দেয়। প্রথম প্রকারের যোগ্যতার মানদণ্ড করার জন্যই নির্ধারিত হয়, কিন্তু দ্বিতীয় প্রকারের যোগ্যতার মানদণ্ড সমগ্র শাসনতন্ত্রের আভ্যন্তরীণ প্রাণ কেন্দ্রে বর্তমান থাকা একান্ত অপরিহার্য, এমনকি, একটি শাসনতন্ত্রের বাস্তবিক পক্ষেই সাফল্যমণ্ডিত হওয়া সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে জনগণের মনোভাব ও চিন্তাধারাকে সুদীক্ষিত করে তুলে নির্ভুল ও সঠিক পন্থায় নির্বাচন অনুস্ঠান করার উপর। কারণ একমাত্র এরূপ নির্বাচন পন্থায়ই শাসনতন্ত্রের প্রকৃত ভাবধারা অনুসারে যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের নির্বাচন করা সম্ভব।
কুরআন এবং হাদীস এই উভয় প্রকার যোগ্যতা সম্পর্কে সুস্পষ্টরূপে আলোচনা করেছে। প্রথম প্রকারের যোগ্যতা সম্পর্কে কুরআন মজীদে চারটি মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে।
এক: তাকে মুসলমান হতে হবে। কুরআন মজীদে বলা হয়েছে:
(আরবী **********)
“হে ঈমানদারগণ, আনুগত্য কর আল্লাহর, অনুসারী হও তাঁর রাসূলের এবং মেনে চল তোমাদের মধ্য হতে (নির্বাচিত) রাষ্ট্র পরিচালকদের।” –(সূরা আন নিসা: ৫৯)
দুই: তাকে পুরুষ হতে হবে। কুরআন মজীদ বলে:
(আরবী **********) “পুরুষ স্ত্রীদের উপর কর্তৃত্বসম্পন্ন ও প্রভাবশালী (নেতা)।”
হযরত নবী করীম (সা) বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে এই আয়াতের প্রয়োগ দেখিয়ে বলেছেন:
(আরবী **********)
“যে জাতি নিজেদের নেতৃত্ব এবং (সমগ্র) কাজের কর্তৃত্ব নারীদের কাছে সোপর্দ করবে, সে জাতি কখনই কল্যাণ লাভ করতে পারে না।”
তিন: সুস্থ বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন এবং বয়সপ্রাপ্ত বালেগ হতে হবে। কুরআন মজীদ বলেছে:
(আরবী **********)
“তোমাদের ধন-সম্পদ- যাকে আল্লাহ তোমাদের অস্তিত্ব বজায় রাখার উপায় স্বরূপ করে দিয়েছেন তা নির্বোধ লোকদের হাতে সোপর্দ করো না।” –(সূরা আন নিসা: ৫)
চার: তাকে দারুল ইসলামের বাসিন্দা হতে হবে। কুরআন মজীদ সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছে:
(আরবী **********)
“যারা ঈমান এনেছে কিন্তু হিজরাত করে (দরুল ইসামে) আসেনি, তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তোমাদের কোন অংশ নেই, যতক্ষণ না তারা হিজরাত করবে।” –(সূরা আন আনফাল: ৭২)
ইসলামের দৃষ্টিতে এ চারটিই হচ্ছে আইনগত গুণপণা ও যোগ্যতা। এই যোগ্যতা যার মধ্যে বর্তমান পাওয়া যাবে আইনের দৃষ্টিতে সে-ই রাষ্ট্রপ্রধান এবং শু’রা বা পার্লামেন্টের সদস্য নিযুক্ত হতে পারবে। কিন্তু এই আইনগত যোগ্যতাসম্পন্ন লোকদের মধ্যে কোন্ সব লোককে ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্বপূর্ণ পদসমূহের জন্য নির্বাচিত করা হবে, আর কাদের করা হবে না- কুরআনএবং হাদীসে এ প্রশ্নের সুস্পষ্ট জবাব পাওয়া যায়:
(আরবী **********)
“আল্লাহ তোমাদের আদেশ করেছেন যে, আমানতসমূহ (দায়িত্বপূর্ণ পদ) আমানতদার ও বিশ্বাসপরায়ণ লোকদের হাতে সোপর্দ কর।” –(সূরা আন নিসা: ৫৮)
(আরবী **********)
“তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক সম্মানিত সেই ব্যক্তি, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক মুত্তাকী- আল্লাহভীরু।” –(সূরা হুজুরাত: ১৩)
(আরবী **********)
“হে নবী) বলুন, আল্লাহ তায়ালা শাসনকার্যের জন্য তোমাদের উপর তাঁকে (তালুতকে) মনোনীত করেছেন এবং তাঁকে জ্ঞান-বিদ্যা-বুদ্ধি এবং দৈহিক শক্তিতে সমৃদ্ধ দান করেছেন।” –(সূরা আল বাকারা: ২৪৭)
(আরবী **********)
“এমন ব্যক্তির আনুগত্য স্বীকার করো না, যার মন আল্লাহর স্মরণশূন্য যে প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং যার কাজ-কর্ম সীমালংঘনকারী।” –(সূরা আল কাহাফ: ২৮)
নবী করীম(সা) বলেছেন: (আরবী **********)
“যে কেউ বেদয়াতপন্থী ব্যক্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলো সে ইসলামকে ধ্বংস করার কাজে সহায্য করলো।” –(বায়হাকী)
(আরবী **********)
“আল্লাহর শপথ, এমন ব্যক্তিকে আমরা কখনো কোন রাষ্ট্রীয় পদে নিযুক্ত করবো না, যে নিজে উহা পেতে চাইবে কিংবা এর জন্য লালায়িত হবে।” –(বুখারী, মুসলিম)
(আরবী **********)
“আমাদের দৃষ্টিতে পদপ্রার্থীই তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় অবিশ্বস্ত ও আত্মসাৎকারী।” –(আবু দাউদ)
উল্লিখিত গুণাবলীর কতগুলো আমরা অনায়াসেই আমাদের মাসনতন্ত্রের ব্যবহারিক ধারা হিসেবে বিধিবদ্ধ করে নিতে পারি। যথা: পদপ্রার্থীকে নির্বাচনের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করা যেতে পারে। অন্যান্য যেসব গুণপণাকে আইনের সীমার মধ্যে সুনিধারিতভাবে গণ্য করা যায় না সেগুলোকে আমাদের শাসনতন্ত্রের নীতিনির্ধারক মূলনীতি হিসেবে গণ্য করতে হবে। এবং রাষ্ট্র-প্রধানের জন্য ইসলামের দৃষ্টিতে অপরিহার্য উল্লিখিত গুণাবলী সম্পর্কে প্রত্যেক নির্বাচনের সময় জনগণকে বিস্তারিতভাবে অবহিত করা নির্বাচক মণ্ডলীল অন্যতম কর্তব্য করে দিতে হবে।
সাত: নাগরিকত্ব এবং এর ভিত্তি
অতপর নাগরিকত্ব সম্পর্কে আলোচনা করবো। ইসলাম চিন্তা এবং কর্মের এক ব্যাপক ও পূর্ণাংগ ব্যবস্থা, এরই ভিত্তির উপর ইসলাম একটি রাষ্ট্রও কায়েম করে। এজন্য ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিকত্বকে দু’ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। পরন্তু সততা ও ন্যায়পরায়ণতা এবং সত্য কথা বলা ইসলামের এক মূলগত ভাবধারা। এজন্য কোন প্রকার ধোঁকা ও প্রতারণা ব্যতিরেকেই নাগরিকত্বের এই দুই প্রকারকেসুস্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করা হয়েছে।মুখে মুখে সকল নাগরিককে সমান মর্যাদাদানের কথা বলা এবং কার্যত তাদের মধ্যে কেবল পার্থক্যই করা নয়- এদের বিরাট অংশকে মানবীয় অধিকার দিতেও কুণ্ঠিত হওয়ার মত বিরাট প্রতারণা ও ধোঁকা দে?য়ার কাজ ইসলাম কিছুতেই করতে পারে না; আমেরিকায় নিগ্রোদের এবং রাশিয়ার অ-কমিউনিষ্টদের এবং দুনিয়ার সমগ্র ধর্মহীন গণতন্ত্রে (Secular Democracy) জাতীয় সংখ্যালঘুদের মর্মবিদারক দুরাবস্থার কথা দুনিয়ার কারো অজ্ঞাত নয়।
ইসলাম রাজ্যের নাগরিকদের দু’ভাগে বিভক্ত করেছে:
প্রথম- মুসলমান।
দ্বিতীয- জিম্মী।
এক: মুসলিম নাগরিকদের সম্পর্কে কুরআন মজীদে বলা হয়েছে:
(আরবী **********)
“যারা ঈমান এনেছে, হিজরাত করেছে এবং নিজেদের জান-মাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে; আর যারা তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে এবং তাদের সাহায্য করেছে, তারা পরস্পর বন্ধু ও পৃষ্ঠপোষক। কিন্তু যারা (শুধু) ঈমান এনেছে কিন্তু হিজরাত করে দারুল ইসলামে চলে আসেনি, তাদের বন্ধুতাও পৃষ্ঠপোশকতায় তোমাদের কোনই অংশ নেই- যতক্ষণ না তারা হিজরাত করবে।” –(সূরা আল আনফাল: ৭২)
এইআয়াতে নাগরিকত্বের দু’টি ভিত্তির উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম ঈমান, দ্বিতীয় দরুল ইসলামের (ইসলামী রাজ্যের) প্রজা (পূর্ব থেকেই কিংবা পরে) হওয়া। একজন মুসলমান- ঈমান তার আছে; কিন্তু কাফেরী রাজ্যের অধীনতা পরিত্যাগ করে- হিজরাত করে- দারুল ইসলামে এসে যদি বসবাস শুরু না করে; তাদের সে দারুল ইসলামের নাগরিক বলে বিবেচিত হতে পারে না।
পক্ষান্তরে দারুল ইসলামের সমগ্র ঈমানদার বাসিন্দাগণ- দারুল ইসলামে তাঁদের জন্ম হোক কিংবা দারুল কুফর হতে হিজরাত করেই এসে থাকুক- সমানভাবে তারা দারুল ইসলামের নাগরিক এবং পরস্পর পরস্পরের সাহায্যকারী। [হিজরাত করে যারা আসে তাদের সম্পর্কে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করার কথা কুরআনে বলা হয়েছে। কুরআন বলেছে: এই ধরনের লোকদের ‘ইমতিহান’ (Examine) করে নেয়া আবশ্যক। -(সূরা মুমতাহিনা, ২ রুকু’) এই ব্যবস্থা যদিও মুহাজির স্ত্রীলোকদের ব্যাপারে প্রয়োগ করতে বলা হয়েছে, কিন্তু ইহা হতে এই মূলনীতি গৃহীত হয়েছে যে, বহিরাগত ও হিজরাতের দাবীদার ব্যক্তিকে দারুল ইসলামে গ্রহণ করার পূর্বে তার প্রকৃত মুসলমান ও মুহাজির হওয়া সম্পর্কে নিশ্চয়তা লাভ করতে হবে। ফলে হিজরাতের সুযোগে ভিন্ন উদ্দেশ্য সম্পন্ন কোন লোক দারুল ইসলামে প্রবেশ করতে পারবে না। কোন ব্যক্তির প্রকৃত ঈমানের অবস্থা আল্লাহ ভিন্ন কেউই জানতে পারে না, কিন্তু বাহ্যিক উপায়ে যতদূর সম্ভব তালাশী-তদন্ত ও যাঁচাই করে নেয়া অপরিহার্য।]
এই মুসলিম নাগরিকদের উপরই ইসলামের পরিপূর্ণ জীবন ও সমাজ ব্যবস্থার দায়িত্বভার চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। কারণ নীতিবাদ ও আদর্শবাদের দৃস্টিতে একমাত্র এই মুসলিম নাগরিকরাই ইসলামী রাষ্ট্রকে ‘সত্য’ বলে স্বীকার করে। এদেরই উপর ইসলামী রাষ্ট্রের পরিপূর্ণ আইন জারী হবে, তাদেরকেই ইসলামের সমগ্র ধর্মীয়, নৈতিক, তামাদ্দুনিক এবং রাজনৈতিক বিধি-নিষেধের অনুসারী হতে বাধ্য করে। এর যাবতীয় কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনের ভারও এদেরই উপর অর্পণ করা হয়। দেশ ও রাষ্ট্রের রক্ষা কার্যের জন্য সকল প্রকার কুরবানী ও আত্মদানের জন্য একমাত্র এদেরই নিকট দাবী করা হয়। অতপর এই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা নির্বাচনেরও অধিকার এদেরই দান করা হয়, এর পরিচালক পার্লামেন্টে শরীক হওয়া এবং এর মূল দায়িত্বপূর্ণ পদসমূহে নিযুক্ত হওয়ার সুযোগও এরাই লাভ করে। কারণ, তদ্রূপ হলেই এই আদর্শবাদী রাষ্ট্রের কর্মকৌশল ঠিক এর মূলগত নীতিসমূহের সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্য রক্ষা করে বাস্তবায়িত হতে পারে। নবী করীম (সা)-এর জীবনকাল এবং খিলাফতে রাশেদার স্বর্ণযুগই উল্লিখিত মূলনীতির সত্যতা, যৌক্তিকতা ও বাস্তব প্রমাণ। এই সময় শু’রার সদস্য হিসেবে, কোন প্রদেশের গবর্ণর হিসেবে, কিংবাসরকারী কোন বিভাগের মন্ত্রী সেক্রেটারী বা সৈন্য বিভাগের কমাণ্ডার হিসেবে কোন জিম্মীকে নিযুক্ত করা হয়েছে- এমন একটি উদাহরণও কোথাও পাওয়া যাবে না। খলীফা নির্বাচনের ব্যাপারেও তাদের মত প্রকাশের সুযোগ দেয়া হয়নি। অথচ স্বয়ং নবী করীম (সা)-এর জীবদ্দশায় ইসলামী রাজ্যের অধীনে তারা বর্তমান ছিল; আর খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগে তো তাদের সংখ্যা কোটি পর্যন্ত পৌঁছেছিল। এসব রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে তাদের অংশগ্রহণ করার বস্তুতই যদি কোন অধিকার থাকতো, তাহলে আল্লাহর নবী তাদের অধিকার কি করে হরণ করতে পারেন এবং স্বয়ং নবী করীম(সা)-এর নিকট সরাসরিভাবে দীক্ষা প্রাপ্ত লোকগণ ক্রমাগতভাবে ত্রিশ বছর পর্যন্ত তাদের অধিকার আদায় না করে কেমন করে থাকলেন, তা আমরা বুঝে উঠতে পারি না।
দুই: জিম্মী বলতে সেসব অমুসলিম নাগরিকদের বুঝায় যারা ইসলামী রাষ্ট্রের সীমার মধ্যে থেকে এর আনুগত্য ও আইন পালন করে চলার অংগীকার করবে- মূলত তারা দারুল ইসলামে জন্মগ্রহণ করেছে কি বাইরের কোন কাফের রাজ্য হতে এসে ইসলামী রাজ্যের প্রজা হয়ে থাকার আবেদন করেছে এদিক দিয়ে তাদের মধ্যে কোন পার্থর্ক করা হয় না। ইসলাম এই প্রকার নাগরিকদের ধর্ম ও সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ এবং জান-মাল ও সম্মানের পূর্ণ নিরাপত্তা দান করে। তাদের উপর রাষ্ট্রের কেবল দেশীয় আইনই (Law of the Land) জারী করা হবে। এই দেশীয় আইনের দৃষ্টিতে তাদেরকেও মুসলমান নাগকিরদের সমান অধিকার ও মর্যাদা দেয়া হয়। দায়িত্ব সম্পন্ন পদ (Key Post) ছাড়া সকল প্রকার সরকারী চাকুরীতেই তাদের নিযুক্ত করা যাবে। নাগরিক স্বাধীনতাও তারা মুসলমানদের সমান সমান লাভ করতে পারবে, অর্থনৈতিক ব্যাপারেও তাদের সাথে মুসলমানদের অপেক্ষা কোনরূপ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমূলক আচরণ করা হয় না। রাজ্য রক্ষার দায়িত্ব হতে তাদেরকে অব্যাহতি দিয়ে তা সম্পূর্ণরূপে মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে েএবং অমুসলমানদের সকল প্রকার তামাদ্দুনিক ও মানবিক অধিকার রক্ষার পূর্ণ নিরাপত্তা দেয়া হয়।
আট: নাগরিক অধিকার
এরপর নাগরিকদের ইসলাম প্রদত্ত মৌলিক অধিকার (Fundamental Rights) সম্পর্কে আলোচনা করবো।
সর্বপ্রথম ইসলাম নাগরিকদেরকে জান-মাল ও ইয্যত-আব্রুর পূর্ণ নিরাপত্তা দান করে। আইনসংগত কারণ ও যুক্তি ছাড়া কোনরূপেই তাদের উপর হস্তক্ষেপ করা যেতে পারে না। হযরত নবী করীম(সা) বিভিন্ন হাদীসের মারফতে একথাটি সুস্পষ্টরূপে ব্যক্ত করেছেন। বিদায় হজ্জের সুপ্রসিদ্ধ বক্তৃতায় তিনি ইসলামী জীবনব্যবস্থার নিয়ম প্রণালী বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন:
(আরবী **********)
“তোমাদের জান, তোমাদের মাল, তোমাদের সম্মান-ইয্যত তেমনি (হারাম) সম্মানার্হ, যেমন সম্মানার্হ আজিকার এই হজ্জের দিনটি।” কেবল একটি অবস্থায় এটা সম্মানার্হ (হারাম) থাকবে না, যা তিনি অন্য একটি হাদীসে বলেছেন: (******) অর্থাৎ ইসলামের আইনের দৃষ্টিতে কারো জান-মাল কিংবা ইয্যতের উপর যদি কোন ‘হক’ প্রমাণিত হয়, তবে আইন অনুমোদিত পন্থায় তা নিশ্চয়ই আদায় করতে হবে।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হচ্ছে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সংরক্ষণ। দেশ প্রচলিত ও সর্বজন বিদিত আইনসম্মত পন্থায় দোষ প্রমাণ না করে এবং নিজের নির্দোষিতা প্রমাণ করার সুযোগ না দিয়ে কারো ব্যক্তিগত স্বাধীনতা হরণ করা ইসলাম মোটেই বরদাস্ত করতে পারে না। আবু দাুদ শরীফে উল্লিখিত একটি হাদীসেবর্ণিত হয়েছে: একসময়ে মদীনার কিছু সংখ্যক লোক কোন সন্দেহের কারণে বন্দী হয়েছিল। নবী করীম (সা) মসজিদে নামাযের খোতবা দিতে থাকার সময় একজন সাহাবী দাঁড়িয়ে নবী করীম (সা)-কে প্রশ্ন করলেন: “আমার প্রতিবেশীদের কোন্ অপরাধে গ্রেফতার করা হয়েছে?” নবী করীম (সা) তাঁর এই প্রশ্নের প্রথম ও দ্বিতীযবার কোন জবাবই দিলেন না। শহরের কোতয়াল (পুলিশ কমিশনার) গ্রেফতারীর কোন সংগত কারণ থাকলে তা সে পেশ করবে এই আশায় তিনি নিরুত্তর রইলেন। কিন্তু তৃতীয়বারও যখন সেই সাহাবী পুনরাবৃত্তি করলেন এবং কোতয়ালও তখন পর্যন্ত কোন কারণ পেশ করলেন না, তখন নবী করীম (সা) স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ দিলেন: (*****) “এই লোকটির প্রতিবেশীদের ছেড়ে দাও।” এই ঘটনা হতেই নিসন্দেহে প্রমান হচ্ছে যে, কোন নির্দিষ্ট অপরাধে দোষী সাব্যস্ত না করা পর্যন্ত কাউকেও আটক করা ইসলামী আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত। ইমাম খাত্তাবী তাঁর “মায়ালিমুস্সুননা” (****) নামক গ্রন্থে এই হাদীসের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছেন: ইসলামে মাত্র দুই প্রকারের আটক বা গ্রেফতারী জায়েয। একটি শাস্তি স্রূপ আটক করা। অর্থাৎ আদালতের বিচারে কাউকে কয়েদের শাস্তি দেয়া হলে আটক করা; এটা সম্পূর্ণরূপে সংগত আটক, তাতে সন্দেহ নেই। আর এক প্রকার হচ্ছে তদন্তের জন্য আটক করা। অর্থাৎ অভিযুক্ত ব্যক্তি বাইরে থাকলে তদন্তকার্য ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা হলে তখন তাকে আটক করা যেতে পারে, এছাড়া অন্য কোন প্রকার আটকই ইসলামে জায়েয নয়। ইমাম আবু ইউসুফ (র) কিতাবুল খিরাজেও এ একই কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন যে, কাউকে নিছক সন্দেহের কারণে বন্দী করা যেতে পারে না। নবী করীম (সা) কেবল দোষারোপ করা হলেই কাউকে আটক করতেন না। বাদী বিবাদী উভয়কেই আদালতের সামনে হাজির হতে হবে। সেখানে বাদী তার দাবী প্রমাণসহ পেশ করবে। দাবীর প্রমাণ উপস্থিত করতে অসমর্থ হলে বিবাদীকে ছেড়ে দিতে হবে। হযরত উমর ফারুক (রা)-ও একটি মোকদ্দমার ফায়সালা করতে গিয়ে ঘোষণা করেছিলেন:
(আরবী **********)
“ইসলামে কোন ব্যক্তিকে বিনা বিচারে আটক রাখা যেতে পারে না।”
তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ অধিকার- মত ও ধর্মের স্বাধীনতা। এ ব্যাপারে ইসলামী আইনের ব্যাখ্যা হযরত আলী (রা) অধিকতর সুস্পষ্ট করে পেশ করেছেন। তাঁর খিলাফতকালে খাওয়ারিজ দলের অভ্যুত্থান হয়েছিল। বর্তমান যুগের নৈরাজ্যবাদী ও নিহিলীয় (Nihilist) দলসমূহের সাথে এদের অনকটা সামঞ্জস্য বিদ্যমান। তারা হযরত আলী (রা)-এর যুগে রাষ্ট্রের অস্তিত্বকেই সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করতো এবং শক্তি প্রয়োগ করে উহাকে নির্মূল করার জন্য বদ্ধপরিকর হয়েছিল। হযরত আলী (রা) এ সময় তাদেরকে এই পয়গাম পাঠিয়েছিলেন:
(আরবী **********)
“যেখানে ইচ্ছা তোমরা বসবাস করতে পার, তোমাদের ও আমাদের এই চুক্তি রইল যে, তোমরা রক্তপাত করবে না, ডাকাতি ও লুটতরাজ করবে না- যুলুম হতে বিরত থাকবে।”
অন্য এক সময়ে হযরত আলী (রা) তাদের বললেন:
(আরবী **********)
“তোমরা নিজেরা যতক্ষণ বিপর্যয় ও ভাঙ্গন সৃষ্টি করবে না, ততক্ষণ আমরা তোমাদের উপর (পূর্বাহ্নেই) কোন আক্রমণ করবো না।”
ইহা হতে সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয় যে, দেশের বিভিন্ন দলের মতবাদ ও ধর্ম বিশ্বাস যাই হোক না কেনএবং শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের মতবাদ যে রূপেই প্রচার করুক না কেন, ইসলামী রাষ্ট্র তাতে কোনরূপ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে না। কিন্তু তারা নিজেদের মতবাদ যদি শক্তি প্রয়োগের সাহায্যে (By Violent Means) স্থাপিত করতে এবং দেশের শাসন ব্যবস্থা চূর্ণ-বিচূর্ণ করতে চেষ্টা করে, তবে তাদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিশ্চিয় গ্রহণ করা হবে।
এছাড়া আর একটি মৌলিক অধিকারের প্রতিও ইসলাম যথেষ্ট জোর দিয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্রের সীমার মধ্যে কোন নাগরিককেই জীবনযাত্রার মৌলিক প্রয়োজন হতে বঞ্চিত থাকতে দেয়া যেতে পারে না। এই উদ্দেশ্যেই ইসলাম যাকাত আদায়ের সামগ্রিক ও সর্বাত্মক ব্যবস্থাকে এতদসংক্রান্ত যাবতীয় কাজের মূলভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছে। নবী করীম (সা) এ সম্পর্কে বলেছেন:
(আরবী **********)
“তাদের ধনীদের নিকট হতে ইহা আদায় করা হবে এবং তাদের অভাবী লোকদের মধ্যে তা বন্টন করা হবে।”
একটি হাদীসে নবী করীম (সা) মূলনীতি হিসেবে এরশাদ করেছেন:
(আরবী **********)
“যার বন্ধু ও সাহায্যকারী বা পৃষ্ঠপোষক কেউই নেই, ইসলামী রাষ্ট্রই তার বন্ধু, সাহায্যকারী ও পৃষ্ঠপোষক হবে।
(আরবী **********)
“মৃত ব্যক্তি যে বোঝা (ঋণ বা জীবিকা উপায়হীন অসহায় পরিবারবর্গ) রেখে যাবে তার দায়িত্ব আমার উপর বর্তিবে।”
এ ব্যাপারে ইসলাম মুসলিম নাগরিক ও অমুসলিম নাগরিকদের মধ্যে কিছুমাত্র পার্থক্য করেনি। কোন নাগরিককেই যে অন্নহীন-বস্ত্রহীন এবং আশ্রয়হীন থাকতে দেয়া হবেনা, এর নিরাপত্তা ইসলাম মুসলিম নাগরিকদের ন্যায় জিম্মী (অমুসলিম) নাগরিকদেরও দিয়ে থাকে। হযরত উমর (রা) একদা এক জিম্মীকে ভিক্ষা করতে দেখে তখনি তার “জিযিয়া” মাফ করে দিলেন। তার জন্য তখনি মাসিক বৃত্তি মঞ্জুর করলেন এবং বায়তুলমালের ভারপ্রাপ্ত অফিসারকে লিখে পাঠালেন:
(আরবী **********)
“আল্লাহর শপথ, এই লোকটির যৌবনকালে যদি এর দ্বারা কাজ করিয়ে থাকি এবং এখন এই বার্ধক্যকালে তাকে নিরুপায় ছেড়ে দেই, তবে এর সাথে মোটেই সুবিচার করা হবে না।”
হযরত খালিদ ‘হীরা’ (****) নামক স্থানের অমুসলিমদের জন্য যে চুক্তিপত্র লিখে দিয়েছিলেন, তাতে সুস্পষ্টরূপে বলা হয়েছিল যে, যে ব্যক্তি বৃদ্ধ হয়ে যাবে, কিংবা যে ব্যক্তি কোন আকস্মিক বিপদে পতিত হবে, অথবা যে দরিদ্র হয়ে যাবে তার নিকট হতে জিযিয়া আদায় করার পরিবর্তে মুসলমানদের ‘বায়তুলমাল’ হতে তার এবং পরিবারবর্গের জীবিকার ব্যবস্থা করা হবে।” –(কিতাবুল খিরা: ৮৫ পৃঃ)
নয়: নাগরিকদের উপর রাষ্ট্রের অধিকার
নাগরিকদের এসব অধিকারের প্রতিকূলে তাদের উপর রাষ্ট্রেরও কতকগুলো অধিকার আরোপ করা হয়েছে। তার মধ্যে সর্বপ্রথম শোনা হচ্ছে আনুগত্য পাওয়ার অধিকার। ইসলামী পরিভাষায় একে বলা হয়েছে “শোনা এবং মেনে চলা।” নবী করীম (সা) এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট করে বলেছেন:
(আরবী **********)
“শ্রবণ করা, অনুসরণ করা ও মেনে চলা- অসময়ে সুসময়ে, আনন্দ ও নিরানন্দ সকল অবস্থায়।”
এর অর্থ এই যে, রাষ্ট্রের আইন নাগরিকদের পসন্দ হোক, অপসন্দ হোক, তা সহজসাদ্য হোক কি কষ্টসাধ্য হোক- তা পালন করা ও মান্য করা সকলের পক্ষেই অবশ্য কর্তব্য।
ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিকগণ রাষ্ট্রের বিশ্বস্ত বন্ধু এবং হিতাকাংখী হবে- নাগরিকদের প্রতি এটা ইসলামী রাষ্ট্রের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। কুরআন ও হাদীসে একথা বুঝবার জন্য ‘নুছহ’ (****) পরিভাষা ব্যবহৃত হয়েছে। আরবী ভাষায় এর ভাবার্থ Loyalty এবং Allegiance হতেও অধিকতর ব্যাপক ও প্রশস্ত। প্রত্যেকটি নাগরিক আন্তরিকতা ও ঐকান্তিক নিষ্ঠা সহকারে রাষ্ট্রের কল্যাণ কামনা করবে, তার পক্ষে ক্ষতিকর কোন কাজকেই নাগরিকগণ বরদাশত করবে না। এর কল্যাণ ও মঙ্গলের সাথে আন্তরিক সম্পর্ক স্থাপন করবে- ‘নুছহ’ শব্দের অন্তর্নিহিত ভাবধারা এটাই।
এখানেই শেষ নয়, ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিকদের উপর এটা হতেও অধিকতর কর্তব্য চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। ইসলামী হুকুমাতের পূর্ণ সহযোগিতা করা নাগরিকদের অবশ্য কর্তব্য। তার রক্ষণাবেক্ষণ এবং তার উদ্দেশ্যের বাস্তবায়নের জন্য জান ও মালের কুরবানী দিতে তারা বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হবে না। এমনকি, ইসলামী হুকুমাতের উপর যদি কোন বিপদ ঘনীভূত হয়ে আসে, তখনযে সমর্থ ব্যক্তি দারুল ইসলামের প্রতিরক্ষা কার্যে জান-মাল কুরবানী করলে আল্লাহর কোন না কোন বান্দাহ উঠে তার বিরুদ্ধে বিরাট ও প্রকাশ্য জিহাদ করেছেন। ফলে এই মারাত্মক উদ্দেশ্যের পথ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। ইমাম ইবনে তাইমিয়া ও মুজাদ্দিদে আলফেসানী (র) এই ধরনের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে কি কি করেছেন ইতিহাসই তার সাক্ষী।
প্রশ্ন: আল্লাহর আদেশ: “তাদের রাষ্ট্রীয় কাজ-কর্ম তাদের পারস্পরিক পরামর্শক্রমেই সম্পন্ন হয়ে থাকে” বাক্যটির ‘তাদের’ শব্দের মধ্যে স্ত্রীলোকেরা গণ্য হবে কিনা? অর্থাৎ স্ত্রীলোকদেরও পরামর্শ সভায গ্রহণ করা হবে কিনা?
উত্তর: কুরআনমজীদের এক আয়াত অন্য কোন আয়াতের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। বরং একটি অন্যটির পরিপোষক ও ব্যাখ্যাতা। যে কুরআনে উক্ত কথা বলা হয়েছে, সেই কুরআন মজীদেই (আরবী **********) “পুরুষগণ নারীদের নেতা” একথাও বলা হয়েছে। এজন্যই মজলিসে শু’রা বা পার্লামেন্ট যেহেতু সমগ্র রাষ্ট্র ও রাজ্যের কর্তা, কাজেই কুরআন মজীদ তাতে নারীদের অংশগ্রহণের দুয়ার বন্ধ করে দিয়েছে। উপরন্তু আমাদের সামনে নবী করীম (সা) ও খিলাফতে রাশেদা যুগের কার্যক্রম আদর্শ হিসেবে বর্তমান আছে। কুরআন মজীদের মূল লক্ষ্যের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের পক্ষে এটা আমাদের নিকট এক মূল্যবান প্রামাণিক উপায় সন্দেহ নেই। নবী করীম(সা) এবং খোলাফায়ে রাশেদীন মজলীসে শু’রায় স্ত্রীলোকদেরকে কখনো শরীক করেছেন- এরূপ কোন উদাহরণ ইতহিাস বা হাদীসের বিরাট সম্পদে কোথাও পাওয়া যায় না।
প্রশ্ন: ইসলামী রাষ্ট্রের আয়ের উপায় কি হবে? সাধারণত যাকাত, জিযিয়া ও খারাজ ভিন্ন আর কোন ট্যাক্স থাকবে না বলে সকলের ধারণা। তাই যদি সত্য হয়, তবে বর্তমানকালে ইসলামের সীমার মধ্যে থেকে একটি আধুনিক রাষ্ট্রের অপরিহার্য ব্যয় ভার কিভাবে সম্পন্ন করা যেতে পারে?
উত্তর: ইসলামী রাষ্ট্রের প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য কোন ট্যাক্স আদায় করা যাবে না- একথাটি সম্পূর্ণ ভুল। আর যাকাতকে সরকারের প্রয়োজন পূরণার্থে ধার্য কেটি ট্যাক্স মনে করা আরো মারাত্মক ভ্রান্তি। মূলত যাকাত সামাজিক ইনসিওরিন্সের একটি ফাণ্ড মাত্র। নির্দিষ্ট ও বিশেষ লোকদের মধ্যেই বন্টন করার জন্য এটা আদায় করা হয়। তারপর সরকারের প্রয়োজন পূর্ণ করা সম্পর্কে চূড়ান্ত কথা এই যে, তা সরকারের প্রয়োজন নয়, মূলত তা জনগণেরই করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হবে, কুরআন মজীদে তাকে প্রকাশ্য ‘মুনাফিক’ বলে অভিহিত করেছে।
উপরের আলোচনা হতে রাষ্ট্রের যে বাস্তব রূপ উজ্জল উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে, তাকেই আমরা বলি “ইসলামী হুকুমাত।” এরূপ শাসনপদ্ধতিকে আধুনিক কালের পরিভাষায় যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন, সেকিউলার (ধর্মহীন) বা ডেমোক্রেটিক (গণতান্ত্রিক) ইত্যাদি যা-ই বলুন না কেন, বলতে পারেন- তাতে কিছুমাত্র বাধা নেই। কারণ পরিভাষা নিয়ে- নাম নিয়ে- আমাদের কোন তর্ক নেই। আমাদের মূল লক্ষ্য এই যে, যে ইসলামকে স্বীকার করার আমরা দাবী করি, আমাদের জীবনব্যবস্থা ও শাসন বিধান এরই নির্ধারিত মূলনীতির উপর স্থাপিত হোক। এটাই আমাদের দাবী এবং এরই জন্য আমাদের সকল চেষ্টা ও সাধনা একান্তভাবে নিয়োজিত।
সওয়াল ও জওয়াব
[বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর উপস্থিত লোকদের পক্ষ হতে বক্তার কাছে যেসব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল এবং বক্তা সে সবের যে জবাব দিয়েছিলেন এখানে তার বিবরণ দেয়া গেল।]
প্রশ্ন: খিলাফতে রাশেদার পর মুসলমানদের যেসব হুকুমাত বিভিন্নকালে স্থাপিত হয়েছে, সেগুলো ইসলামী হুকুমাত ছিল, না অন্য কিছু?
উত্তর: মূলত সেগুলো না পূর্ণ ইসলামী হুকুমাত ছিল, না পূর্ণ অনৈসলামিক। ইসলামী শাসনতন্ত্রের দু’টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি তাতে পরিবর্তন করে দেয়া হয়েছিল। ইসলামী শাসনতন্ত্রের প্রথম কথা এই যে, এর প্রধান কর্তৃত্বের পদ নির্বাচনমূলক হবে। দ্বিতীয় কথা এই যে, শাসনব্যবস্থা পরামর্শের মারফতে কার্যকরী হবে। এছাড়া শাসনতন্ত্রের অন্যান্য দিকগুলো যদি ইসলামের সঠিক ভাবধারাসহ বর্তমান নাও থাকে; কিন্তু এ দু’টি নীতিকে কিছুতেই বদলানো বা বাতিল করা যেতে পারে না। পূর্বকালের মুসলিম রাষ্ট্রসমূহে কুরআন ও সুন্নাহকেই আইনের উৎস বলে স্বীকার করা হতো। আদালতসমূহে ইসলামী আইন চালু ছিল। সেকালের মুসলিম শাসকগণ ইসলামী আইনকে বাতিল করে মানুষের রচিত আইন জারি করার বিন্দুমাত্র সাহসও করতো না। কখনো কোন শাসনকর্তা তেমন কিছু করার দুঃসাহস প্রয়োজন। জনগণ রাষ্ট্রের মারফতে যে যে কাজ সম্পন্ন করাতে চায় সেসব কাজ সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ-সম্পদ সংগ্রহ করে দেয়াও তাদের কর্তব্য। অন্যান্য সামাগ্রিক কাজ-কর্মে চাঁদা আদায় করার যে রীতি রয়েছে, জনগণের রাষ্ট্রায়ত্ত কাজ-কর্ম সম্পন্ন করার জন্য সরকারকে তাদের ‘চাঁদা’ দিতে হবে। ট্যাক্স মূলত একটি চাঁদা ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের প্রাচীন ফিকাহ গ্রন্থে (****) নামে যেসব ট্যাক্সের প্রতিবাদ করা হয়েছে তা এবং বর্তমান যুগের রাজস্বের মধ্যে নীতিগত বিরাট পার্থক্য রয়েছে। সেকালে ট্যাক্স মূলত জনগণের ফাণ্ড হিসেবে গণ্য হতো না। তা এক প্রকারের শুল্ক ছিল, শাহী সরকার তা প্রজাদের কাছ থেকে আদায় করতো এবং বাদশাহদের মর্জি অনুসারে তা ব্যয় করা হতো। জনগণের কাছ থেকে আদায়কৃত এই অর্থ-সম্পদ জনগণেরই কাজে ব্যয় করতে হবে এবং জনগণের সামনে এর হিসাব পেশ করতে হবে- এমন কোন দায়িত্ব তাদের উপর ছিল না। এজন্যই ইসলামে এই ধরনের ট্যাক্সকে হারাম ও নাজায়েয ঘোষণা করা হয়েছে। এখন ট্যাক্সের মূল অবস্থা যখন পরিবর্তিত হয়েছে, তখন ট্যাক্স সম্পর্কীয় নির্দেশও অনিবার্যরূপে পরিবর্তিত হবে।
প্রশ্ন: বর্তমানে ইসলামে বাহাত্তর ফিরকা রয়েছে, এমতাবস্থায় খিলাফতের সমস্যা কি সহজেই মীমাংসা করা যেতে পারে?
উত্তর: আমি এখানে সমগ্র দুনিয়ার খিলাফত সম্পর্কে আলোচনা করছি না। এ দেশে ইসলামী হুকুমাত কায়েম করা পর্যন্তই আমার বক্তব্য সীমাবদ্ধ। আমার বর্ণিত মূলনীতিসমূহের ভিত্তিতে বিভিন্ন মুসলিম রাজ্যসমূহে যদি ইসলামী হুকুমাত কায়েম হয়ে যায়, তখন অবশ্যতাদের সকলকে মিলিয়ে একটি ‘ফেডারেশন’ গঠন করা এবং সমগ্র ইসলামী দুনিয়ার একজন খলীফা নির্বাচন করার আবশ্যকতা হতে পারে। কিন্তু ‘বাহাত্তর ফিরকা?’… তার উল্লেখ কেবল প্রাচীন কালামশাস্ত্রের পৃষ্ঠায়ই পাওয়া যায়, কার্যত এ দেশে বর্তমান মাত্র তিনটি দলই পাওয়া যায়। এক হানাফী, দ্বিতীয় আহলি হাদীস এবং তৃতীয় শীয়া। আর এই তিন দলের আলেমগণ সম্মিলিতভাবে ইসলামী রাষ্ট্রের মূলনীতি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কাজেই এই কয়টি দলের অবস্থান যে ইসলামী হুকুমাত প্রতিষ্ঠার প্রতিবন্ধকত হবে এমন আশংকা করার কোনই হেতু নেই।
প্রশ্ন: এই দেশের খিলাফতের কথাই বলুন; বর্তমান এই পদে নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য ব্যক্তি আমাদের মধ্যে কে আছেন?
উত্তর: যোগ্য ব্যক্তি আছে কি নেই এবং তিনি কে, তার মীমাংসা করার দায়িত্ব ভোটাদাতাদের; আর তাদের মধ্যে আমিও একজন ভোটার মাত্র। নির্বাচনের সময় আমরা সকলে মিলে উপযুক্ত ব্যক্তিকে তালাশ করে নিশ্চয়ই বের করবো ইনশাআল্লাহ।
প্রশ্ন: আজ পর্যন্ত আপনারা ইসলামী শাসনতন্ত্রের কেবল মূলনীতিরই প্রচার করে আসছেন। একটি শাসনতন্ত্রের খসড়া রচনা করে পেশ করলেই ল্যাঠা চুকিয়ে যায়। তা করা হলে আপনারই বক্তব্য অনুসারে অধিক কল্যাণকর হতো এবং আপনি কোন্ ধরনের শাসনব্যবস্থা চান, তাও লোকজন সঠিকভাবে জানতো পারতো!
উত্তর: এখতিয়ার ও ক্ষমতা না পেয়ে যে ব্যক্তি বা দল শাসনতন্ত্র রচনা করতে চেষ্টা করে, আমার দৃষ্টিতে তার অপেক্ষা নির্বোধ, অজ্ঞ ও মূর্খ আর কেউ হতে পারে না। যে দলের হাতে শাসনতন্ত্র কার্যকরী করার মত শক্তি এবং ক্ষমতা রয়েছে, শাসনতন্ত্র রচনা করাও বস্তুপক্ষে একমাত্র তারই কাজ। জারী করার ক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও শাসনতন্ত্র রচনা করার মত নির্বুদ্ধিতা (বিভাগ পূর্ব ভারতে) নেহেরু রিপোর্ট রচয়িতারা একবার করেছেন। এই রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর ভারতের হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে মিলন ও মৈত্রির কোন সম্ভাবনাই বাকী থাকলো না। ফলে দেশ বিভক্ত হয়। এখন আমরাও নূতন করে এরূপ নির্বুদ্ধিতা করি- এই কি আপনারা চান? আমরা কেবল মূলনীতিই পেশ করতে পারি। শাসনতন্ত্র রচনা করার কাজ তারাই করবে, যাদের হাতে উহা জারী ও কার্যকরী করার ক্ষমতা রয়েছে।