পরিশিষ্ট
আইন পরিষদে নারীদের অংশগ্রহণ সমস্যা
আমাদের কাছে জিজ্ঞেস করা হয়েছে যে, ইসলামের কোন্ সব নিয়ম-কানুন নারীদেরকে আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হতে বাধা দেয়, আর কুরআনের কোন্ সব আয়াত আইন পরিষদকে কেবল পুরুষদের জন্যই ‘রিজার্ভ’ করে দেয়?
এ প্রশ্নের জবাব দেয়ার পূর্বে আইন পরিষদের প্রকৃত স্বরূপ সুস্পষ্টরূপে ব্যক্ত করা একান্ত আবশ্যক। তা না জানলে আইন পরিষদে নারীদের অংশগ্রহণ সংগত কিনা তা সঠিকরূপে নির্ধারণ করা সম্ভব হবে না।
আইন পরিষদের নাম “আইন পরিষদ” হওয়ার কারণে এ সম্পর্কে লোকদের একটি ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। ভুলবশত লোকেরা মনে করছে যে, কেবল আইন রচনা করাই বুঝি এই পরিষদের কাজ। এই ধারণা মনে বদ্ধমূল রেখে তারা যখন দেখে যে সাহাবাদের যুগে নারীগণও আইন সম্পর্কীয় বিষয়ে আলোচনা, কথাবার্তা, মত প্রকাশ ও বিতর্ক সবকিছুই করতেন। এমনকি, খলীফাগণ নিজেরাও অনেক সময় তাদের মত জিজ্ঞেস করতেন এবং তাদের মতামতের একটা মূল্য দিতেন, তখন ইসলামের নামে মহিলাদেরকে আইন পরিষদের অধিকার হতে কি করে বঞ্চিত করা যায় এবং তাতে যোগদান করাই বা কিরূপে ভুল হতে পারে?
কিন্তু আধুনিক কালের পরিচিত আইন পরিষদগুলো কেবল আইন রচনার কাজই করে না, কার্যত সমগ্র দেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে এটাই নিয়ন্ত্রিত করে থাকে। এর সদস্যগণই মিলে মন্ত্রীমণ্ডলী গঠন করেন এবং আভ্যন্তরীণ শাসন ও শৃংখলা রক্ষার নীতিও তারাই নির্ধারণ করেন। অর্থব্যবস্থা ও রাজস্ব সংক্রান্ত সকল ব্যাপারে তারাই সুসম্পন্ন করে থাকেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সম্বন্ধ এবং যুদ্ধ ও সন্ধির কর্তৃত্ব এই পরিষদের উপরই ন্যস্ত হয়। এসব কারণে বর্তমান কালের আইন পরিষদ একজন ফকীহ বা মুফতীর কজই করে না, বস্তুপক্ষে ওটাই হচ্ছে গোটা রাজ্যের ‘কর্তা’ (*****)।
এখন আমাদের দেখতে হবে কুরআন মজীদ এই সামাজিক পদমর্যাদায় কাকে অভিষিক্ত করছে, আর কাকেই বা তা হতে বঞ্চিত(?) রাখছে? কুরআন শরীফের সূরা আন নিসায় আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন:
(আরবী **********)
“পুরুষ স্ত্রীলোকদের ‘কর্তা’ কারণ, আল্লাহ তায়ালা তাদের মধ্যে একজনকে অপরজন অপেক্ষা (গুণগত) শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং তাদের (নারীদের) জন্য অর্থব্যয় করার দায়িত্বও পুরুষই পালন করছে। অতএব সৎ ও নেককার স্ত্রীলোকগণ নিজ নিজ স্বামীর আনুগত্য হয় এবং গায়েবের রক্ষণাবেক্ষণ করে- আল্লাহর রক্ষণাবেক্ষণের অধীন।” –(সূরা আন নিসা: ৩৪)
এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা সামাজিক কর্তৃত্ব করার অধিকার ও মর্যাদা একমাত্র পুরুষদেরই দান করেছেন এবং সৎ ও নেক্কার নারীদের দু’টি গুণ ও বৈশিষ্ট বর্ণনা করেছেন। প্রথম এই যে, তারা আনুগত্য প্রবণ হবে। আর দ্বিতীয এই যে, পুরুষদের অনুপস্থিতিতে তারা সেইসব জিনিসের রক্ষণাবেক্ষণ করবে, যার রক্ষণাবেক্ষণ ভার আল্লাহ তায়ালা তাদের উপর দিয়েছেন।
কেউ বলতে পারেন যে, এ আয়াতে কেবল পারিবারিক জীবন সম্পর্কেই বলা হয়েছে, দেশীয় রাজনীতি সম্পর্কে এ আয়াত প্রযোজ্য নয়। কিন্তু আমি বলব: এখানে প্রকৃত “পুরুষ স্ত্রীলোকদের কর্তা” বলা হয়েছে- “ঘরেরমধ্যে” কথাটি বলা হয়নি। কাজেই এই শব্দ না থাকা সত্ত্বেও এই আয়অতকে কেবল পারিবারিক বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট মনে করা কিছুতেই যুক্তিসংগত হবে না। আর তা যদি স্বীকার করেও নেয়া হয় তবুও জিজ্ঞাসা এই যে, আল্লাহ যাকে ঘরের মধ্যে ‘কর্তা’ করেননি, করেছেন অনুগত; তাকে অসংখ্য ঘরের সমষ্টি- রাষ্ট্র ও রাজ্যের ব্যাপারে আনুগত্যের মর্যাদা হতে অপসৃত করে ‘নেতৃত্ব’ ও ‘কর্তৃত্বের’ গদীতে বসাতে চান কোন্ যুক্তিতে? বস্তুত ঘরের কর্তৃত্ব অপেক্ষা রাষ্ট্র রাজ্যের কর্তৃত্ব অনেক বিরাট এবং উঁচুদরের দায়িত্ব, সন্দেহ নেই। এখন আল্লাহ যাদেরকে ঘরের মধ্যে ‘কর্তা’ বানাননি, তাকে তিনি সহস্র লক্ষ ঘরের সমষ্টির উপর ‘কর্তা’ নিযুক্ত করবেন- আল্লাহ সম্পর্কে এরূপ ধারণা করা যায় কি?
আরো দেখুন, কুরআন শরীফ স্ত্রীলোকদের কর্মসীমা নির্ধারণ করতে গিয়ে বলেছে:
(আরবী **********)
“তোমরা নিজেদের ঘরে সসম্মানে অবস্থান কর এবং বিগতকালের চরম জাহেলিয়াতের ন্যায় ‘তাবাররুজ’ করে বেড়াইও না।” –(সূরা আল আহযাব: ৩৩)
(তাবাররুজ অর্থ রসে-রঙে, হাস্যে-লাস্যে, সজ্জিত ও লীলায়ীত ভংগীতে প্রকাশ্যবাবে ও অবাধে চলাফিরা করা।)
যদি বলা হয় যে, নবী করীম (সা)-এর স্ত্রীদের লক্ষ্য করে এই আদেশ করা হয়েছে, অতএব সাধারণ মুসলমান স্ত্রীলোদরেক প্রতি এই আদেশ প্রযোগ্য নয়; তবে আমরা জিজ্ঞেস করি, নবী করীম (সা)-এর স্ত্রীদের মধ্যে বিশেষ কোন দোষ বা ত্রুটি ছিল নাকি- যে জন্য তাঁরা ঘরের বাইরের দায়িত্বভার বহন করতে পারতেন না? এবং তাঁদের ছাড়া অন্যান্য সকল নারীই কি তাঁদের অপেক্ষা কোন দিক দিয়েই শ্রেষ্ঠ বলে তাদেরকে এই নিষেধ হতে মুক্তি দেয়া হয়েছে? এই ধরনের যাবতীয় আয়াত যদি কেবল নবী করীম(সা)-এর পরিবারবর্গের সাথেই সংশ্লিষ্ট হয় তবে অন্যান্য মুসলিম মহিলাগণ কি জাহেলী যুগের ন্যায় জাঁকজমকপূর্ণ সাজে সজ্জিতা হয়ে অভিসারে বের হবে? তারপর পুরুষদের সাথে তারা কি এমনভাবে কথা বলবে, যাতে তাদের মন লালসায় ফেনায়িত হয়ে উঠে এবং নবীর ঘর ভিন্ন অন্যান্য সকল মুসলমানদের ঘরকেই কি আল্লাহ তায়ালা ‘পংকিল’ দেকতে চান?… তা কখনই হতে পারে না।
কুরআনের দলীল পেশ করার পর এখন হাদীস হতেও যুক্তি পেশ করা যাচ্ছে। নবী করীম (সা) সুস্পষ্ট ও দ্ব্যার্থহীন ভাষায় এরশাদ করেছেন:
(আরবী **********)
“যখন তোমাদের শাসক হবে তোমাদরে মধ্যে সর্বাপেক্ষা দুষ্ট ও শয়তান প্রকৃতির, তোমাদের ধনীক যখনই হবে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী কৃপণ লোক এবং তোমাদের পারস্পরিক (জাতীয়) কাজ-কর্মের দায়িত্ব যখন সোপর্দ হবে তোমাদের স্ত্রীলোকদের হাতে, তখন পৃথিবীর তলভাগ (অর্থাৎ মৃত্যু) উপরভাগ (অর্থাৎ জীবন) অপেক্ষা উত্তম।” –(তিরমীজি)
(আরবী **********)
“আবু বাক্রা হতে বর্ণিত হয়েছে, ইরানের কিসরা তনয়াকে ইরানবাসীগণ নিজেদের বাদশাহ বানিয়েছে এই খবর যখন নবী করীম(সা)-এর খিদমতে পৌঁছল, তখন তিনি বললেন, ‘যে জাতি নিজেদের জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপার এবং দায়িত্বসমূহ কোন নারীর উপর সোপর্দ করে, সে জাতি কখনো প্রকৃত কল্যাণ ও স্বার্থকতা লাভ করতে পারে না’।”
এই দু’টি হাদীস আল্লাহর বাণী (আরবী **********) কথাটির সঠিক ব্যাখ্যা করছে। ইহা হতে একথাও সুস্পষ্ট রূপে জানতে পারা যায় যে, রাজনীতি ও দেশ শাসনের ব্যাপার নারীদের কর্মসীমার বহির্ভূত। তবে নারীদের কর্মসীমার পরিধি কি? এ প্রশ্নের জবাব দিয়ে নবী করীম (সা) নিম্নলিখিত হাদীসসমূহ এরশাদ করেছেন:
(আরবী **********)
“নারী তার স্বামীর ঘরবাড়ী এবং তার সন্তানদের প্রহরী ও রক্ষণাবেক্ষণকারীণী এবং সেই জন্য তাদেরকে জবাবদিহি করতে হবে।” –(আবু দাউদ)
কুরআনের নির্দেশ “তোমরা তোমাদের ঘরে অবস্থান কর” কথাটির এটাই প্রকৃত ব্যাখ্যা। এর আরো অধিক বিস্তৃত ব্যাখ্যা পাওয়া যায় সেই সব হাদীসে, যাতে রাজনীতি ও দেশ শাসন প্রভৃতি সমষ্টিগত কাজের দায়িত্ব অপেক্ষা কম গুরুত্বপূর্ণ কাজ- যা করতে ঘরের বাহির হতে হয়- হতে নারীকে নিষ্কৃতি দেয়া হয়েছে:
(আরবী **********)
“জুময়া জামায়াতের সাথে পড়া প্রত্যেক মুসলমানের উপর কর্তব্য। কিন্তু চারজন এই নির্দেশের বাইরে- ক্রীতদাস, স্ত্রীলোক, শিশু এবং রোগাক্রান্ত ব্যক্তি।” –(আবু দাউদ)
(আরবী **********)
“উম্মে আতীয়া হবে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন: আমাদেরকে ‘জানাযার’ অনুগমন করতে নিষেধ করা হয়েছে।” –(বুখারী)
আমাদের দৃষ্টিভংগী ও মতের সমর্থনে অসংখ্য মযবুত বৈজ্ঞানিক যুক্তি-প্রমাণও পেশ করা যেতে পারে। কেউ চ্যালেঞ্জ করলে তা আমরা পেশ করতেও পারবো। কিন্তু সাধারণত এ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক যুক্তির দাবী করা হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, মুসলমানগণ আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশ জেনে নেয়ার পরও তদনুযায়ী কাজ করার জন্য বৈজ্ঞানিক যুক্তির শর্ত পেশ করবেন এ অধিকার আমরা আদৌ স্বীকার করি না। মুসলমানকে- যদি সে প্রকৃতই মুসলমান হয়ে থাকে- প্রথমেই আল্লাহর নির্দেশ পালন করতে হবে, তারপর মন ও মস্তিষ্ককে সন্দেহ শূন্য করার জন্য বৈজ্ঞানিক যুক্তি-প্রমাণ চাইলে তা নিশ্চয়ই চাইতে পারেন এবং এটা কুবই যুক্তিপূর্ণ পদ্ধতি। কিন্তু কোন মুসলমান যদি প্রথমেই বৈজ্ঞানিক যুক্তি-প্রমাণ পেতে চায়, আর তা না হলে আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশ পালন করবে না বলে সিদ্ধান্ত করে, তবে আমরা তাকে মূলতই মুসলমান বলতে পারি না- ইসলামী রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের অধিকারী মনে করাতো দূরের কথা। হুকুম পালনের জন্য বুদ্ধিসম্মত যুক্তির শর্ত আরোপকরীদের স্থান ইসলামের সীমার বাইরে- ভিতরে নয়।
রাজনীতি এবং দেশ শাসনের ব্যাপারে নারীর অধিকার প্রমাণকারীগণ ইসলামের-ইতিহাস হতে নজীর পেশ করে থাকে। সে নজীর বহু নয়- একটি দু’টি মাত্র। তারা বলে, হযরত আয়েশা (রা) হযরত উসমান (রা)-কে শহীদ করার প্রতিবাদে বিচারের দাবী করেছিলেন। এবং হযরত আলী (রা)-এর বিরুদ্ধে ‘জামাল’ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন এই সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য এই যে, প্রথমত এই প্রমাণটি নীতিগতভাবেই ভুল। কারণ যে ব্যাপারে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে, কোন সাহাবী কর্তৃক ব্যক্তিগতভাবে এর বিপরীত কাজ হতে দেখলে তা কখনোই একটি যুক্তি হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে না। আসহাবদের পবিত্র জীবন আমাদের জন্য আদর্শ ও পথনির্দেশক সন্দেহ নেই। কিন্তু তা শুধু এজন্যই যে, তাদের বিচ্ছুরিত আলোকে আমরা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের প্রদর্শিত পথে চলবো। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের পথনির্দেশ ত্রাগ করে কোন সাহাবীর ব্যক্তিগত অন্ধ অনুসরণ করার জন্য তা নয়। তাছাড়া, সেকালের প্রধান সাহাবাগণের যে কাজকে ভুল বলে ঘোষণা করেছিলেন এবং যে কাজের জন্য উত্তরকালে উম্মুল মু’মেনীন নিজেই অনুতাপ করেছিলেন, তাকে ইসলামের মধ্যে এক নতুন পন্থার (বিদয়াত) প্রচলন করার জন্য প্রমাণহিসেবে কিরূপে গণ্য করা যেতে পারে?
হযরত আয়েশা (রা)-এর এই পদক্ষেপের সংবাদ পেয়ে উম্মুল মুমেনীন হযরত উম্মে সালমা তাঁকে যে চিঠি লিখেছিলেন, ইবনে কোতাইবা ‘আল ইমামাতু আস সিয়াসাতু’ গ্রন্থে এবং ইবনে আবদু রব্বিহি ‘ইকদুল ফরীদ গ্রন্থে তা পুরোপুরিই উদ্ধৃত করেছেন। তাতে তিনি কত দৃঢ়তা সহকারেই না বলেছৈন- “কুরআন মজীদ আনাকে সংযত ও নিয়ন্ত্রিত করেছে, আজ এই বাঁধন ছিন্ন করবেন না। আপনার একথা স্মরণ নেই যে, নবী করীম (সা) আপনাকে দ্বীন ইসলামের সীমালংঘনকারী পদক্ষেপ হতে বিরত থাকতে বলেছেন? এবং আপনাকে যদি এভাবে মরুভূমির মধ্যে একটি ঘাঁটি হতে অন্য ঘাঁটির দিকে দৌড়া-দৌড়ি করতে দেখতে পেতেন তবে আপনি তাঁকে কি জবাব দিতেন?”
হযরত আবদুল্লাহ বিন উমর বলেছেন- “আয়েশার জন্য তাঁর ঘর তাঁর উষ্ট্রপৃষ্ঠের আসন অপেক্ষা উত্তম” –একথাটিও স্মরণ করতে হবে।
হযরত আবু বকরার একটি কথা বুখারী শরীফে উদ্ধৃত হয়েছে। তিনি বলেছেন- জামাল যুদ্ধের ফেতনায় নিমজ্জিত হওয়ার হাত হতে একটি জিনিসই আমাকে বাঁচিয়েছে। “যে জাতির সামগ্রিক কাজ-কর্মের দায়িত্ব নারীদের উপর ন্যস্ত হয়, সে জাতি কখনোই কল্যাণ লাভ করতে পারে না” নবী করীমের এই বাণী যথাসময় আমার স্মরণে এসেছিল।
সে যুগে শরীয়াতের আইন সম্পর্কে হযরত আলী অপেক্ষা অধিক অভিজ্ঞ আর কে হতে পারে? তিনি স্পষ্ট ভাষায় হযরত আয়েশা (রা)-কে লিখেছিলেন: “আপনার িএই পদক্ষেপ ইসলামী শরীয়াতের সীমালংঘনকারী হয়েছে।” হযরত আয়েশা (রা) তাঁর উঁচুদরের মেধা ও সূক্শজ্ঞান গরিমা সত্ত্বেও একথার কোন জবাব দিতে পারছিলেন না। আলী (রা) বলেছিলেন, “আপনি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলেরই জন্য ক্রুদ্ধ হয়ে বের হয়েছিলেন সন্দেহ নেই, কিন্তু আপনি একটি কাজের দিকে অগ্রসর হয়েছেন, যার একবিন্দু দায়িত্ব আপনার উপর আরোপিত হয়নি। যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং সমাজ সংস্কারের দায়িত্বপূর্ণ কাজে নারীদের হস্তক্ষেপ করার কি প্রয়োজন রয়েছে? আপনি উসমান (রা)-এর রক্তের বিচারের দাবী তুলেছেন; আমি বলতে চাই: যে ব্যক্তি আপনাকে এই বিপদের মুখে ঠেলেদিয়েছে এবং এই পাপকার্যে উদ্বুদ্ধ করেছে, আপনার স্বপক্ষে সে উসমানের হত্যাকারী অপেক্ষাও অধিক বড় পাপী, সন্দেহ নেই।”
এই চিঠিতে হযরত আলী (রা) হযরত আয়েশার কাজকে দ্ব্যার্থহীন ভাষায় শরীয়াতের খেলাফ বলে ঘোষণা করেছেন। এর উত্তরে হযরত আয়েশা (রা) শুধু এতটুকু কথাই মাত্র বলতে পারলেন যে, (আরবী **********) ব্যাপার এখন তিরস্কার ও ভর্ৎসনার সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
জামাল যুদ্ধের সমাপ্তির পর হযরত আলী (রা) আয়েশা (রা)-এর সাথে যখন সাক্ষাত করতে গিয়েছিলেন, তখন তিনি বলেছিলেন:
(আরবী **********)
“হে উষ্ট্রপৃষ্ঠারোহিণী, আল্লাহ আপনাকে ঘরে বসে থাকার আদেশ করেছিলেন- কিন্তু আপনি দেখি যুদ্ধ করার জন্য বের হয়েছেন।”
কিন্তু তখন আয়েশা (রা) িএকথা বলতে পালেন না যে, “আল্লাহ আমাদেরকে ঘরে থাকবার আদেশ করেননি বরং রাজনীতি ও যুদ্ধের ব্যাপারে অংশগ্রহণ করার আমাদের পূর্ণ অধিকার রয়েছে।”
এছাড়া হযরত আয়েশা (রা) নিজেই তাঁর এ কাজের জন্য অনুতাপ করেছিলেন। আল্লামা ইবনুল বার, ‘ইস্তিয়াবে ‘(*******) গ্রন্থে লিখেছেন উম্মুল মুমেনীন আবদুল্লাহ বিন উমরের কাছে অভিযোগ সূত্রে বলেছেন –হে আবদুর রহমান, তুমি আমাকে একাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে কেন নিষেধ করলে না? তিনি উত্তরে বললেন- আমিদেখলাম এক ব্যক্তি (আবদুল্লাহ বিন জুবাইর) আপনার অভিমতকে বিশেষভাবে প্রভাবান্বিত করেফেলেছে। আপনি তার বিরুদ্ধে বলতে পারবেন এমন কোন আশা ছিল না। এরপর উম্মুল মুমেনীন বললেন, তুমিযদি আমাকে নিষেধ করতে, তবে আমি নিশ্চয়ই ঘর হতে বের হতাম না।
হযরত আয়েশা (রা)-এর এসব কথাবার্তা জানার পর তাঁর এক কালের কোন ব্যক্তিগত কাজকে কি করে যুক্তি হিসেবে পেশ করা যেতে পারে এবং এর ভিত্তিতে ইসলামের রাজনীতি রাষ্ট্র পরিচালনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের কাজে নারীদের অংশগ্রহণ সংগত ও শরীয়াতসম্মত কি করে মনে করা যেতে পারে?
তারপর দুনিয়ার তথাকথিত সভ্য(?) ও উন্নত জাতিদের কার্যকলাপই যাদের কাছে সত্যের একমাত্র মানদণ্ড এবং যারা চিরদিনই অধিক সংখ্যক লোকেরই অন্ধ অনুসরণ করে চলতে অভ্যস্ত, তাদের কথা স্বতন্ত্র- ইসলামের দোহাই দেয়ার তাদের অধিকারই বা কি তা থাকতে পারে যেদিকে তাদের চিত্ত চায়, সেদিকেই তারা চলতে পারে তারা প্রকৃতপক্ষেই যার অনুসরণ করে চলছে, তার নামই প্রকাশ করবে- অন্তত এতটুকু সততা ও সত্যবাদিতা তাদের মধ্যে বর্তমান থাকা উচিত। ইসলাম সম্পর্কে বিনা যুক্তিতে এমন কোন কথা বলা- যা দ্বারা আল্লাহর কিতাব, তাঁর রাসূলের সুন্নাত এবং ইসরামের সত্যোজ্জল স্বর্ণযুগের প্রকৃত ইতিহাসকে অস্বীকার করা হয়- কিছুতেই বাঞ্ছনীয় নয়। -(তরজুমানুল কুরআন- যিলহজ্জ, ৭১ হিঃ সেপ্টেম্বর, ৫২ ইং)
সমাপ্ত