ইসলামের নৈতিক দৃষ্টিকোণ
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী
অনুবাদ: মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম
স্ক্যান কপি ডাউনলোড
স্বাভাবাবিক অবস্থায় জীবন-নদী ধীর-স্থীর-মন্থর গতিতে প্রবাহিত হয়,তখন মানুষ এক ধরনের নিশ্চিন্ততা অনুভব করে। কেননা উপরিভাগটা হয়ে যায় স্বচ্ছ আবরণের মতো। ময়লা, আবর্জনা ও দূষিত পদার্থ এর নীচেস্তরে স্তরে জমা হয়ে আত্মগোপন করে থাকে। আবরণের ওপরের স্বচ্ছতা ও পরিচ্ছন্নতায় মানুষভেতরের দিকে দৃষ্টি দেবারএবং আবরণের নীচের স্তরগুলোর মধ্যে আত্মগোপনকারী বস্তুকে গভীর অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে নিরীক্ষণ করার প্রয়োজনীয়াতা খুব কমই অনুভব করে।কিন্তু যখন এই নদীতে তুফান আসে এবং নীচের আত্মগোপনকারী সমস্ত আবর্জনা ও দূষিত পদার্থ আচানকভেসে উঠেনদীরন উপরিভাগে প্রবাহিত হতে থাকে, তখন একমাত্র অন্ধ ছাড়া প্রত্যেক ব্যক্তিই যার চোখে ক্ষীণতম দৃষ্টিশক্তিও আছে- নির্বিঘ্নে স্পশ্ট এবং পরিষ্কার দেখতে পায় যে, জীবননদী কত সব আবর্জনা বুকে নিয়েসামনের দিকে ছুটে চলচে। অনুরূপ পরিস্থিতিতেই সাধারণলোক জীবননদীতে প্রবাহিত এই আবর্জনার উৎস অনুসন্ধানের প্রয়োজন অনুভব করতে পারে। একে আবর্জনামুক্ত করার এবং বিশুদ্ধ ও পরিষ্কার রাখার উপায় উদ্ভাবনের চিন্তা করার সুযোগও তারা পায়। সত্যি বলতে কি, এমন উল্লেখ্য মুহূর্তেও যদি মানুষের মনে এ প্রয়োজনের অনুভূতি জাগ্রত না হয়, তাহলেবুঝতে হবে যে, মানব জাতির গাফলতির নেশায় বিভোর হয়ে লঅভ-ক্ষতি সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে বসে আছে।
আজ আমরা ঠিক এ ধরনের অস্বাভাব্কি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছি। জীবন-নদীতে বান ডেকেছে। বিভিন্ন দেশ ও জাতির মধ্যে ভীষণ দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুরু হয়েছে। এ সংঘর্ষ তো ব্যক্তিকেও এর মধ্যে টেনে এনেছে। এভাবে মানবজগতের বিভিন্ন অংশ তাদের সমস্ত নৈতিক গুণাবলী- যেগুলোকে তারা দীর্ঘকাল থেকে ভেতরে ভেতরে জিইয়ে রেখেছিল- উদগীরণ করে জনসমক্ষে রেখে দিয়েছে।
[প্রবন্ধটি ১৯৪৪ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারী পেশোয়ার ইসলামিয়া কলেজে পঠিত হয়।]
যেসব আবর্জনার অনুসন্ধানের জন্যে কিছু না কিছু গভীর দৃষ্টির প্রয়োজন ছিল, এখন সেগুলোকে আমরা দেখছি জীবন-নদীর উপরিভাগে। রোগীর অবস্থা ভালো, একথা কোন জন্মান্ধই বলতে পারে। যারা পশুর মতো নৈতিক অনুভূতিহীন অথবা যাদের নৈতিক অথবা যাদের নৈতিক অনুভূতি জরাগ্রস্ত কেবল তারাই এখন রোগ নির্ণয় এবং তার চিকিৎসার চিন্তা থেকে গাফেল থাকতে পারে।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, অনেক জাতি সামগ্রিকভাবে ব্যাপকহারে এমন সব নিকৃষ্ট ধরনের নৈতিকতা বিরোধী কাজের প্রদর্শনী করে বেড়াচ্ছে. যেগুলোকে মানুষের বিবেক হামেশা অত্যন্ত ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখেছে। অন্যায়, নিষ্ঠুরতা, যুলুম, নির্যাতন, মিথ্যা, প্রতারণা, প্রচারণা, ওয়াদাভংগ, নির্লজ্জতা, স্বার্থপূজা, আমানতের খেয়ানত, অন্যায়ভাবে বল প্রয়োগ এবং এ ধরনের অন্যান্য অপরাধ আজ আর নিছক ব্যক্তিগত পর্যায়ে আবদ্ধ থাকেনি, এগুলোর মাধ্যমে আজ জাতীয় চরিত্রের প্রকাশ ঘটছে। দুনিয়ার বড়ো বড়ো জাতিরা সামগ্রিকভাবে এমন সব কাজ করে যাচ্ছে, যা পৃথকভাবে অনুষ্ঠানের অপরাধে তাদের দেশের জনগণকে আজৌ লৌহ কপাটের অণ্তরালে পাঠিয়ে দেয়া হয। প্রত্যেক জাতির বেছে বেছে তার সবচেয়ে বড়ো অপরাধীগণকে নিজের নেতা ও শাসক পদে অধিষ্ঠিত করেছে এবং তাদের নেতৃত্বে সমগ্র জাতি প্রকাশ্যভাবে নেতায়েত নির্লজ্জতার সংগে ব্যাপকহারে দুনিয়ার যাবতীয় নিকৃষ্টতম অপরাধ অনুষ্ঠানে ব্রত হয়েছে। প্রত্যেক জাতি অন্য জাতির বিরুদ্ধে স্তুপীকৃত মিথ্যার ইতিহাস রচনা করে প্রকাশ্যভাবে তা প্রচার করে বেড়াচ্ছে। রেডিওর মাধ্যমে এ মিথ্যাগুলো আকাশ-বাতাস দুর্গন্ধময় করে তুলেছে। এক একটি দেশ ও মহাদেশের সমগ্র অধিবাসী লুঠতরাজকারী এবং দস্যুতে পরিণত হয়েছে। দস্যুবৃত্তি করার সময় প্রত্যেক দস্যু নির্লজ্জতার সংগে তার বিরোধী দস্যুর যাবতীয় পাপ কাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানচ্ছে, যে পাপে সেনিজেও তার প্রতিদ্বন্দ্বির তুলনায় কিছু কমক নিমজ্জিত নয়। এ জালেমদের নিকট ইনসাফের অর্থ হলো, শুধু নিজের জাতির সংগে ইনসাফ করা। নিজের জাতির অধিকারই শুধু সংরক্ষিত থাকবে। অন্যের অধিকারের ওপর সব রকমের হস্তক্ষেপ তাদের নৈতিক বিধানে শুধু বৈধই নয়, নেকীর কাজও। দুনিয়ার প্রায় সমস্ত জাতিই এখন নেবারএবং দেবার সময় ভিন্ন ভিন্ন পরিমাপ ব্যবহা করছে। নিজেদের স্বার্থোদ্ধারের সময় তারা যেসব মাপকাঠি নির্ণয় করে অন্যের বেলায় সেসব পরিবর্তিত হয়ে যায়। অন্যের কাছ থেকে তারা যেসব মানদণ্ডের দাবী করে সেগুলো মেনে চলা নিজেদের জন্যে হারাম মনে করে। ওয়াদাভংগ করার ব্যধি এমন ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করেছে যে, এক জাতির প্রতিনিধিবর্গ অত্যন্ত ভদ্র বেশে যখন আন্তর্জাতিক চুক্তির উপর দস্তখত করেন, তখনো তাদের মনের কোণে এ শয়তানী ইচ্ছা লুকিয়ে থাকে যে, প্রথম সুযোগেই জাতীয় স্বার্থের কোরবানগাহে এ পবিত্র ছাগ শিশুটির গলায় ছুরি চালিয়ে দেবো এবং যখন কোন জাতির প্রেসিডেন্ট অথবা উজিরে আজম এ উদ্দেশ্যে ছুরিতে শান দিতে থাকেন এ শয়তানী কাজের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদও সমগ্র জাতির মধ্য হতে উত্থিত হয় না। বরং সমগ্র দেশবাসী এ অপরাধে অংশগ্রহণ করে।
সমগ্র দুনিয়াকে প্রতারিত করা হচ্ছে। বড়ো বড়ো উন্নত, পবিত্র, নৈতিক বিধি-বিধানের আলোচনা করা হয় শুধু মানুষকে বেকুব বানিয়ে স্বার্থোদ্ধার করার জন্যে। সরল-মনা লোকদেরকে বুঝানো হয় যে, আমাদের নিজেদের স্বার্থে তোমাদের কাছ থেকে জান-মালের কুরবানী দাবী করছি না, বরং নিছক মানবতার স্বার্থেই আমরা সৎ এবং নিস্বার্থ সমাজসেবীরা এ কষ্ট সহ্য করছি।
অত্যাচার ও নিষ্ঠুরতা কানায় কানায় পূর্ণ হয়েছে। একটি দেশ যখন অন্য দেশের ওপর আক্রমণ করে তখন শুধু অনুভূতিহীন স্টীমরোলারের মতো আক্রান্ত দেশের অধিবাসীদেরকে পিষে গুড়ো করেই ক্ষান্ত হয় না বরং আনন্দের সংগে সমগ্র দুনিয়ার তার এ কার্যাবলী উচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা করতে থাকে। তার রকম-সকম দেখে মনে হয়, দুনিয়া থেকে যেন মানুষের বাস ওঠে গেছে। এখন বুঝি শুধু মানুষ খেকো নেকড়েরই আধিপত্য।
স্বার্থান্ধ হৃদয়হীনতা চরম আকার ধারণ করেছে। একটি জাতি নিছক নিজের স্বার্থে অন্য জাতিকে পদানত করার পর শুধু নির্দয়ভাবে তার সম্পদ লুট করেই ক্ষান্ত থাকে না, বরং তার যাবতীয় উন্নত মানবীয় গুণাবলী বিনষ্ট করে। সম্ভাব্য সকল রকমের দোষ এবং নিকৃষ্টতর অপরাধ প্রবণতা- যেগুলোকে সে নিজেও অত্যন্ত ভয়াবহ মনে করে- তার মধ্যে সৃষ্টিট করে এবং এ জন্যে সে অত্যন্ত সুসংবদ্ধ অভিযান চালায়।
এখানে নিছক কতিপয় উল্লেখযোগ্য নৈতিক ত্রুটির নমুনা দেখালাম। নয়তো বিস্তারিত পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, নৈতিক দিক দিয়ে সমগ্র মানবতার দেহ পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এক সময় বেশ্যালয় এবং জুয়ার আড্ডাকে নৈতিক অবনতির সবচেয়ে বড়ো ফোঁড়া মনে করা হতো। কিন্তু আজ যে দিকে দৃষ্টি দেয়া যায়, সমগ্র মানব সভ্যতা একটি ফোঁড়ার আকারেই পরিদৃষ্ট হচ্ছে। বিভিন্ন জাতির পার্লামেন্ট এবং জাতীয় পরিষদ, রাষ্ট্রের সেক্রেটারীয়েট এবং উজির-নিকেতন, আদালতের বিচার কক্ষ ও উকিলের মন্ত্রণাগার, প্রেস, প্রচার দপ্তর, বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক এবং শিল্প ও বাণিজ্য কেন্দ্রসমূহ সমস্তই এক একটি পাকা ফোঁড়ার মতো। এ ফোঁড়াগুলো যেন একটা শানিত ছুরির অপেক্ষায় আছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে মর্মান্তিক ব্যাপার হলে এই যে, যে জ্ঞান মানবতার সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ বলে বিবেচিত হয়, আজ তাকে মানবজাতির সকল দিকের ধ্বংসের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রকৃতি যে শক্তি-সম্পদ এবং জীবনের উপায়-উপকরণ মানবজাতির জন্যে সৃষ্টি করেছিল, আজ তা বিপর্যয় সৃষ্টি এবং ধ্বংসের কাজে ব্যয় করা হচ্ছে। সাহসিকতা, ত্যাগ, কুরবানী, দানশীলতা, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, হিম্মত, বলিষ্ঠ প্রত্যয় প্রভৃতি যেসব গুণাবলীকে মানুষের শ্রেষ্ঠ এবং উন্নততর নৈতিকতা বিরোধী দুষ্কর্মের দাসে পরিণত করা হয়েছে।
বলা বাহুল্য ব্যক্তিগত ত্রুটি যখন কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় তখনই এসব সামগ্রিক ত্রুটির আত্মপ্রকাশ ঘটে। আপনি একথা চিন্তাও করতে পারবেন না যে, কোন সমাজের অধিকাংশ লোক সৎ হওয়া সত্ত্বেও সামগ্রিকভাবে সেখানে অসৎ প্রবণতার বিকাশ ঘটবে। সৎ লোকেরা তাদের নেতৃত্ব এবং প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব অসৎ লোকদের হাতে তুলে দেবে এবং তারা তাদের যাবতীয় আভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক ব্যাপার অনৈতিক বিধান মোতাবিক পরিচালিত করবে এবং ঐ সৎলোকদের হাতে তুলে দেবে এবং তারা তাদের যাবতীয় আভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক ব্যাপার নৈতিক বিধান মোতাবিক পরিচালিত করবে আর ঐ সৎলোকেরা তাদের এসব কার্যকলাপের ওপর সন্তুষ্ট থাকবে, এ কখনো সম্ভভপর নয়। কাজেই দুনিয়ার বিভিন্ন জাতির যখন আজ বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসব নিকৃষ্টতর অনৈতিকতার প্রকাশ করছে, তখন এত্থেকে প্রমাণ হয় যে, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তমুদ্দুনের যাবতীয় উন্নতী সত্ত্বেও মানবজাতি নৈতিক অবনতির গভীরে পদক্ষেপ করেছে এবং অধিকাংশ মানুষ এতে প্রতারিত হয়েছে। এ পরিস্থিতি যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে অনতিবিলম্বে মানবতা একটি বিরাট ধ্বংসের মুখোমুখী হবে এবং এক সুবিস্তীর্ণ তমসার আড়ালে ঢেকে যাবে তার সমগ্র ইতিহাস।
যদি আমরা চোখ বন্ধ করে বেধড়ক ধ্বংসের আবর্তে নেমে যেতে না চাই তাহলে আমাদের এ ত্রুটির সন্ধানে বেরুতে হবে, দেখতে হবে কোত্থেকে তুফানের বেগে এগুলো বয়ে চলে আসছে। যেহেতু এগুলো নৈতিক ত্রুটি, তাই এর সন্ধান পাবো আমরা দুনিয়ায় বর্তমানে প্রচলিত নৈতিক চিন্তা-ধারণার মধ্যে।
দুনিয়ার নৈতিক চিন্তা-ধারণা কি? এ প্রশ্ন সম্পর্কে অনুসন্ধান করার পর আমরা জানতে পারি যে, নীতিগতভাবে সমস্ত চিন্তা-ধারণা দু’টো বৃহত্তম ভাগে বিভক্ত।
একটি চিন্তার ভিত্তি হলো আল্লাহ এবং মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবনের বিশ্বাসের ওপর। দ্বিতীয়টির ভিত্তি এসব বিশ্বাস থেকে পৃথক অন্য কোন বুনিয়াদের ওপর রাখা হয়েছে।
আসুন, এখন আমরা এ দু’ধরনের চিন্তাধারা বিশ্লেষণ করে দেখি, বর্তমানে এগুলো দুনিয়ায় কি অবস্থায় আছে এবং এর পরিণাম কি হচ্ছে। আল্লাহ এবং মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবনের বিশ্বাসের ওপর যতগুলো নৈতিক চিন্তার বুনিয়াদ রাখা হয়েছে, এ সবগুলোর আকৃতি আল্লাহ এবং মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবন সম্পর্কে মানুষের মধ্যে যে ধরনের বিশ্বাস পাওয়া যায়, তার ওপর নির্ভর করে। কাজেই আমাদের দেখতে হবে বর্তমানে দুনিয়ার মানুষ আল্লাহকে কোন্ আকৃতিতে মেনে নিয়েছে এবং জীবন সম্পর্কে তাদের সাধারণ ধারণা কি?
আল্লাহকে যারা মেনে নিয়েছে বর্তমানে তাদের অধিকাংশই শির্কের মধ্যে লিপ্ত আছে। তাদের জীবনের সংগে আল্লাহর যে সমস্ত ইখতিয়ারের সম্পর্ক রয়েছে, সেগুলোকে তারা ইচ্ছামতো অন্যান্য সত্তার মধ্যে ভাগ করে দিয়েছে। এবং নিজেদের মনের মতো করে তারা ঐসব সত্তার এমন কাল্পনিক চিত্র বানিয়ে নিয়েছে যে, তারা তাদের খোদায়ীর ইখতিয়ারগুলো ঠিক সেই ভাবেই ব্যবহার করছে, যেভাবে তারা ব্যবহার করতে চায়।
এরা গোনাহ করে এবং তারা মাফ করে দেয়। এরা কর্তব্যে গাফেল হয়ে অধিকার অনধিকারের সীমা লংয়ঘন করে এবং হালাল হারামের পার্থক্য উঠিয়ে দিয়ে দুনিয়ার খেত-খামারে বল্গাহারা অশ্বের মতো ছুটে বেড়ায় আর তারা যৎসামান্য নজরানা গ্রহণ করে এদের মুক্তির জামীন হয়ে যায়। এরা চুরি করতে বেরুলে তাদের মধ্যে এভাবে সওদাবাজী হয়েছে যে, পুলিশ ঘুমিয়ে পড়ে। এদের এবং তাদের মধ্যে এভাবে সওদাবাজী হয়েছে যে, এরা তাদের ওপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখবে ও নজরানা পেশ করতে থাকবে এবং এর প্রত্যুত্তরে তারা এদের যাবতীয় কাজ, যা এরা করতে চায় সবকিছুই সুসম্পন্ন করে যাবে ও মৃত্যুর পর যখন আল্লাহ এদের শাস্তি দিতে চাবেন, তখন তারা মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াবে এবং বলবে, হে আল্লাহ, এরা আমাদের ছায়াতলে আছে, এদেরকে কিছুই বলবেন না। আবার অনেক ক্ষেত্রে আল্লাহ্র কোন প্রশ্নের সম্মুখীন হবার প্রয়োজনই হবে না। কেননা এদের গোনাহর কাফ্ফারা পূর্বেই একজন আদায় করে দিয়েছেন। এ শির্ক মিশ্রিত বিশ্বাস মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবনের ধারণাকেও অর্থহীন করে দিয়েছে। এর ফলেধর্ম যেসব নৈতিকতার ভিত্তি গড়ে তুলেছিল, তা সবই অন্তসারশূন্য হয়ে গেছে। ধর্মীয় নৈতিকতার বই-পত্র লিখিত রয়েছে। সম্মানের সংগে এগুলোর নামোচ্চারণ করা হয়। কিন্তু কার্যত এর বাঁধন এড়িয়ে চলার জন্যে শির্ক অসংখ্য চোরা দরজার ব্যবস্থা করেছে। এ ব্যবস্থার মধ্যে খুঁত বের করা সহজ ব্যাপার নয়। যে কোন দরজা দিয়ে বেরুলেই নিশ্চিন্তে নাজাতের মঞ্জিলে পৌঁছুনো যায়।
শির্কের কথা বাদ দিয়ে যদি আমরা এমন জায়গার কথা আলোচনা করি, যেখানে আল্লাহ্পরস্তি এবং আখেরাতের বিশ্বাস কিছুটা উন্নত পর্যায়ে অবস্থান করছে, তাহলে দেখতে পাবো যে, আল্লাহর নির্দেশাবলী সেখানে জীবনের একটি ক্ষুদ্রতম গন্ডীর মধ্যে সংকুচিত হয়ে রয়েছে। কয়েকটা কাজ, কয়েকটা রসম-রেওয়াজ আর কয়েকটা বিধি-নিষেধেরই শুধু সেখানে অস্তিত্ব রয়েছে। আল্লাহ্ সেখানে এগুলোর দাবী করেন মানুষের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনেরসীমিত পরিসরে। এবং এগুলোর বিনিময়ে তিনি তাদের জন্যে একটি বিরাট বেহেশত তৈরী করে রেখেছেন। তারা শুধু এ দাবীগুলো পূর্ণ করলেই হলো, ব্যাস, তাহলে আল্লাহর তরফ থেকে আর তাদের জন্যে করার মতো কিছু বাকী থেকে যায় না। এরপর তারা নিজেদের জীবনের যাবতীয় ব্যাপারে ইচ্ছামতো চালাতে পারে, এ ব্যাপারে তাদের স্বাধীনতার হস্তক্ষেপ করার কেউ নেই। এতো সবকিছুর পরও যদি আল্লাহ্র ঐ দাবী পূরণের ব্যাপারে তাদের কিছু ত্রুটি থেকে যায়, তাহলে তাঁর মেহেরবানী এবং করুণার ওপর নির্ভর করা যায়। তিনি গোনাহর স্তুপগুলো তাদের কাছ থেকে নিয়ে জান্নাতের দরজায় রেখেদিয়ে তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশের জন্য সম্মানসূচক টিকেট দান করবেন। এ সংকীর্ণ ধর্মীয় ধারণা প্রথমত জীবনের ক্ষেত্রে ধর্মীয় নৈতিকতার গতিকে সীমাবদ্ধ নেতৃত্বএবং বিধি-নিষেধ লাভ করা যেতো, জীবনের যাবতীয় বৃহত্তম অংশ তাত্থেকে স্বাধীন হয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, এ সংকীর্ণ গন্ডীর মধ্যেও নৈতিকতার বাঁধন এড়িয়ে চলার জন্যে একটা পথ খোলা রয়েছে। খুব কম লোকই এ সুযোগটি ব্যবহারের ব্যাপারে গড়িমসি করে।
উপরে যে শ্রেণীগুলোর কথা আলোচনা করা হলো এদের সবার চেয়ে যে ধর্মীয় শ্রেণীটি উন্নততর পর্যায়ে অবস্থান করছে, যার মধ্যে শির্কের ছিটেফোটাও নেই, আন্তরিকতার সংগে আল্লাহকে মেনে চলে এবং মৃত্যুপারের জীবন সম্পর্কে কোন মিথ্যা নির্ভরশীলতার তোয়াক্কা রাখে না, তার মধ্যে অবশ্যি নির্ভেজাল নৈতিকতার অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয় এবং উন্নত চরিত্রের লোকের সন্ধান তার মধ্যে পাওয়া যায়, কিন্তু ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার সীমিত ধারণাই তাদেরকে নষ্ট করে দিয়েছে। তারা দুনিয়া এবং দুনিয়ার জীবনের যাবতীয় সমস্যা হতে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে সম্পর্কহীন হয়ে কতিপয় বিশেষ কাজকে- যেগুলোকে ধর্মীয় কাজ মনে করা হয়- আগলিয়ে বসে রয়েছে। অথবা নিজেদের আত্মাকে মেঝেঘসে সাফ করছে যাতে করে এ দুনিয়ার বসে তারা অদৃশ্য জগতের আওয়াজ শুনতে পারে এবং সৌন্দর্যের প্রতীক স্রষ্টার এক ঝলক সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করার যোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। তারা মনে করে মুক্তির পথ বেরিয়ে গেছে পার্থিব জীবনের কিনারা ঘেঁসে। তাদের মতে আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথ হলো একদিকে ধর্ম যে নকশা এঁকে দিয়েছে জীবনের বাইরের অংশটিকে সেই ছাঁচে ঢালাই করতে হবে এবং অন্যদিকে আত্মশুদ্ধির কতিপয় পদ্ধতি এখতিয়ার করে আত্মাকে পরিশুদ্ধ ও স্বচ্ছ করতে হবে। অতপর একটি সংকীর্ণ গন্ডীর মধ্যে কতিপয় আধ্যাত্মিক কাজে মশগুল থেকে জীবনের দিনগুলো কাটিয়ে যেতে হবে। অন্য কথায় বলা যায়, তাদের আল্লাহর প্রয়োজন ছিল কতিপয় ঝকমকে তকতকে কাঁচ পাত্রের, কতিপয় জোরদার লাউড স্পীকারের, কতিপয় উৎকৃষ্ট গ্রামোফোনের, কতিপয় জোরদার লাউড স্পীকারের, কতিপয় উৎকৃষ্ট গ্রামাফোনের, কতিপয় সূক্ষ্মতর ক্ষমতার বিশিষ্ট রেডিওর, কতিপয় সুদৃশ্য ক্যামেরার এবং একমাত্র এ উদ্দেশ্যেই তিনি এতগুলো সাজ-সরঞ্জাম দিয়ে মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, যাতে করে মানুষ নিজেদেরকে এসব বস্তুতে রূপান্তরিত করে তাঁর নিকট ফিরে যেতে পারে। ধর্ম এবং আধ্যাত্মিকতার ভ্রান্ত ধারণার ফলে সবচেয়ে বড় যে ক্ষতি হয়েছে তাহলো এই যে, যেসব মানুষ উন্নত এবং পবিত্রতর নৈতিক যোগ্যতাসম্পন্ন ছিলেন, তাদেরকে জীবনের বিস্তৃত সংগ্রাম ক্ষেত্র থেকে সরিয়ে নিয়ে গৃহকোণে আবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং নিকৃষ্ট চরিত্রের লোকদের জন্যে বিনা যুদ্ধেই ময়দান খালি করে দেয়া হয়েছে।
সমগ্র দুনিয়ার ধর্মীয় পরিস্থিতির একটা মোটামুটি চিত্র এখানে আঁকা হলো। এত্থেকে আপনারা ধারণা করতে পারেন যে, আল্লাহ পরস্তির ফলে মানুষের যে নৈতিক শক্তি লাভ করার সম্ভাবনা ছিল, বেশীর ভাগ মানুষতা আদতে হাসলই করছে না এবং মুষ্টিমেয় কতিপয় লোক তা হাসিল করছে। কিন্তু মানবজাতির নেতৃত্বের পথ থেকে তারা নিজেরাই সরে এসেছে। এ জন্যে তাদের অবস্থা বর্তমানে ঠিক সেই বালবের মতো যার মধ্যে বিজলীর ক্ষমতা সংরক্ষিত রয়েছে। আর সে বসে বসেই নিজের জীবনকাল অতিবাহিত করছে।
মানব সভ্যতার গাড়ি বর্তমানে যাদের সাহায্যে কার্যত পরিচালিত হচ্ছে, তাদের নৈতিক জগতে আল্লাহ ও আখেরাতের বুনিয়াদি ধারণার ঠাঁই নেই, জেনে বুঝেই সেখানে ঠাঁই দেয়া হয়নি। এ ছাড়াও নৈতিক জগতে আল্লাহর নেতৃত্বগ্রহণ করতে তারা পুরোপুরি অস্বীকৃতি জানিয়েছে। অবশ্যি তাদের মধ্যে বহু লোক কোন না কোন ধর্মের অনুসারী। কিন্তু তাদের মতে ধর্ম মানুষের নিছক ব্যক্তিগত ব্যাপার। ব্যক্তি সত্তার আওতায় তাকে সীমাবদ্ধ করা উচিত। সামগ্রিক জীবন ও ব্যাপারের সঙ্গে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। অতপর এসব ব্যাপারে পরিচালনার জন্যে প্রাকৃতিক জগতের বাইরে কোন নির্দেশের প্রতীক্ষা করার প্রয়োজনটাই বা কি। গত শতাব্দীর শেষের দিকে আমেরিকা থেকে যে নৈতিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল এবং অগ্রসর হয়ে ইংলিশ দ্বীপপুঞ্জ এবং অন্যান্য দেশে পরিব্যাপ্ত হয়েছিল (American Ethical Union) তার বুনিয়াদি উদ্দেশ্যের তালিকায় একথা স্পষ্ট করে বলা হয়েছিল:
“মানব জীবনের যাবতীয সমর্কের ক্ষেত্রে- তা ব্যক্তিগত, সামগ্রিক, জাতীয অথবা আন্তর্জাতিক পর্যায়েরই হোক না কেন- ধর্মীয় বিশ্বাস অথবা অতিপ্রাকৃত ধারণাকে পুরোপুরি বাদ দিয়ে নৈতিকার অপরিসীম গুরুত্বের ওপর জোর দিতে হবে।”
“মানব সেবা এবং মানুষের সংগে সাহায্য সহযোগিতার জন্যে এমন পদ্ধতির নির্দেশ দেয়া যা এ নীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হবে যে, প্রথমত, ধর্মের প্রধান উদ্দেশ্য হলো সৎপ্রীতি, দ্বিতীয় নৈতিক ধারণা ও নৈতিক জীবনের জন্যে দুনিয়ার তাৎপর্য এবং মৃত্যুপারের জীবন সম্পর্কে কোন আকীদা-বিশ্বাসের প্রয়োজন নেই এবং তৃতীয়ত, নিছক মানবিক ও প্রাকৃতিক উপায়-উপাদানের মাধ্যমে মানুষকে জীবনের যাবতীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে সত্যপ্রীতি, সত্যকে জানা এবং সত্যের জন্যে কাজ করে যাবার মতো করে তৈরী করা।”
এ শব্দগুলোর মাধ্যমে বর্তমান জগতের চিন্তা, সভ্যতা, সংস্কৃতি এবং বিভিন্ন ব্যাপারে নেতৃত্বদানকারী মানব শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করা হয়েছে। বর্তমান দুনিয়াকে ব্যবস্থাকে কার্যত যারা পরিচালিত করছে, উপরের মাত্র কয়েকটি বাক্যের মধ্যে পেশকৃত ধারণা তাদের সবার মানসজগতে পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে। তারা সবাই কার্যত তাদের নৈতিকতাকে আল্লাহ ও আখেরাতের বিশ্বাস এবং ধর্মের নৈতিক নেতৃত্ব থেকে স্বাধীন করে নিয়েছে। এখন আমাদেরকে এ ধর্মহীন নৈতিক দর্শনের অবস্থা ভালো-মন্দ পর্যালোচনা করে দেখতে হবে।
নৈতিক দর্শনের প্রথম মৌলিক প্রশ্ন হলো এই যে, আসল এবং চরম সৎ কি, যার সঙ্গে পরিচিত হওয়া মানুষের চেষ্টা ও কর্মের লক্ষ্য হওয়া উচিত এবং যার মানদন্ডে মানুষের কার্যধারা যাচাই করে তার ভালেঅ-মন্দ অথবা ভুল-নির্ভুলের ফয়সালা করা যায়?
এ প্রশ্নের কোন একটি মাত্র জবাব মানুষ দিতে পারেনি। এর বিভিন্ন জবাব পাওয়া গেছে। একদল আনন্দকে সেই সৎ বলে চিহ্নিত করেছে। দ্বিতীয় দলের মতো তাহলে পূর্ণতা। তৃতীয় দল বলেন, কর্তব্যের খাতিরে কর্তব্য।
আবার আনন্দ সম্পর্কেও বিভিন্ন প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে। যেমন কোন্ ধরনের আনন্দ? দৈহিক কামনা এবং ইন্দ্রীয় লালসা পূর্ণ করার পর যে আনন্দ লাভ হয়, তাই কি? অথবা মানসিক উন্নতির পর্যায় অতিক্রম করার পর যে আনন্দ লাভ হয়, তাই? অথবা নিজের ব্যক্তিত্বকে শিল্প অথবা আধ্যাত্মিকতার পরিপ্রেক্ষিতে সুসজ্জিত করার পর যে আনন্দ লাভ হয়? এ ছাড়াও প্রশ্ন হয়, কার আনন্দ? প্রত্যেক ব্যক্তির নিজের আনন্দ? অথবা সেই দলের আনন্দ, যার সংগে মানুষ সম্পর্কযুক্ত? অথবা সমগ্র মানবজাতির আনন্দ? অথবা অন্যের আনন্দ?
এভাবে পূর্ণতাকে চরম লক্ষ্য হিসেবে গণ্য করলেও বিভিন্ন প্রশ্নের উৎপত্তি হয়। যেমন, পূর্ণতার ধারণা এবং তার মানদন্ড কি? পূর্ণতা কার চরম লক্ষ্য: ব্যক্তির? দলের? মানবজাতির? কার?
অনুরূপভাবে যারা কর্তব্যের খাতিরে কর্তব্যের ধারক এবং একটি শর্তহীন অবশ্য পালনীয় কর্তব্য বিধানের (Categorical Imperative) শর্তহীন আনুগত্যকেই শেষ এবং চূড়ান্ত সৎ বলে গণ্য করে, তাদের ব্যাপারেও প্রশ্ন ওঠে যে, ঐ বিধানটির আসল রূপ কি? কে সেটা প্রণয়ন করলো? কার বিধান হবার কারণেই তা অবশ্য পালনীয় হয়েছে?
বিভিন্ন দল এ প্রশ্নগুলোর বিভিন্ন জবাব দিয়ে থাকে। দর্শন পুস্তকের পাতায়ই শুধু এরা বিভিন্ন নয়, বাস্তব জীবনেও এদের চেহারায় বিভিন্নতা ফুটে উঠেছে। এক বিরাট ভীড়েরমতো যে মানব সমষ্টি দেখা যাচ্ছে, যারা সবাই মিলে মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির গাড়িকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্র পরিচালক উজির, সেনাবাহিনীর সাহায্যে যুদ্ধ পরিচালনাকারী সেনাপতি, মানুষের বিভিন্ন ব্যাপারে মীমাংসাকারী জজ, মানুষের যাবতীয় ব্যাপারে আইন প্রণয়নকারী আইন প্রণেতা, মানুষকে শিক্ষাদানকারী শিক্ষক, অর্থনৈতিক উপায়-উপকরণ নিয়ন্ত্রণকারী ব্যবসায়ী, সমাজ এবং সংস্কৃতির পরিচালনাগারে কর্মরত বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মী। এদের নিকট সৎ-এর কোন একটি মাত্র মানদন্ড নেই। বরং এটা সবাই- প্রত্যেক ব্যক্তি এবং প্রত্যেক দল পৃথক পৃথক মানদন্ডের অধিকারী। একই সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার আওতায় কাজ করেও এরা প্রত্যেকেই ভিন্নতর লক্ষ্যেরদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আছে। কেউ আনন্দকেই চরম লক্ষ্য মনে করে এবং আনন্দ বলতে সে মনে করে তার দৈহিক কামনা ও ইন্দ্রিয় লালসার পরিতৃপ্তি। কেউ আনন্দের পেছনে ছুটে ফিরছে, তবে আনন্দ সম্পর্কে তার ধারণা আবার অন্য রকম। তার ব্যক্তিগত আনন্দ লাভ অথবা তাত্থেকে বঞ্চিত হবার পরিপ্রেক্ষিতেই সেসমাজ জীবনে তার জন্যে সৎ ও অসৎ কাজের ফয়সালা করে। তার ভদ্রজনোচিত চেহারাই আমাদেরকে বিভ্রান্ত করে। আমরা মনে করি যে, সে মানব সমাজের একজন সুযোগ্য উজির, জজ, শিক্ষক অথবা অন্য কোন যোগ্যতাসম্পন্ন হবার কারণে সভ্যতা-যন্ত্রের একটি মূল্যবান অংশবিশেষ। অনুরূপভাবে, আনন্দ অর্থে অনেকেই শুধু মানবজাতির যে বিশেষ অংশের সংগে তারা সম্পর্কযুক্ত তার আনন্দ ও সমৃদ্ধি মনে করে। তাদের মতে এটিই একমাত্র একমাত্র সৎ এবং এটি হাসিল করার জন্যে প্রচেষ্টা চালানোই হলো পুণ্যের কাজ। এই দৃষ্টিভঙ্গির ফলে নিজের অথবা শ্রেণী ছাড়া অন্য সবার জন্যে সে সাপ এবং বিচ্ছুর রূপ ধারণ করে। কিন্তু তার ভদ্রজনোচিত চেহারার দরুন আমরা তাকে ভদ্রলোক বলেই মনে করি। আবার পূর্ণতাকে একমাত্র সৎ বলে যারা মনে করে এবং যারা কর্তব্যের খাতিরে কর্তব্যের ধারক তাদের মধ্যেও এ ধরনের বিভিন্ন শ্রেণীর ব্যক্তিবর্গের সন্ধান পাওয়া যায়। এদের অধিকাংশের আদর্শ ও মতবাদ বাস্তব ফলাফলের দিক দিয়ে মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির জন্যে বিষময়। কিন্তু তারা সেগুলোর ওপর ‘মৃতসঞ্জীবনীর’ লেবেল লাগিয়ে আমাদের সমাজ জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সেগুলোকে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে।
এবার দ্বিতীয় প্রশ্নটির আলোচনা করা যাক। নৈতিকতা দর্শনের মৌলিক প্রশ্নগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটা হলো এই যে, আমাদের নিকট ভাল মন্দ, সৎ-অসৎ সম্পর্কে অবগত হবার কি মাধ্যম আছে? ভাল কি আর মন্দ কি, ভুল কি আর নির্ভুল কি- একথা জানবার জন্যে আমরা কোন্ উৎসবের দিকে অগ্রসর হবো?
এ প্রশ্নের কোন একটি মাত্র জবাব মানুষ পায়নি। এর জবাবও বিভিন্ন। কারুর মতে সে মাধ্যম ও উৎস হলো মানুষের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। কেউ বলেন, জীবন বিধান ও অস্তিত্বের অবস্থা সম্পর্কিত জ্ঞান। কেউ বলেন, জ্ঞান শক্তি। কেউ বলেন, বিবেক-বুদ্ধি। এখানে এসে বিশৃংখলা চরমে পৌঁছে, যা প্রথম প্রশ্নের ক্ষেত্রে আপনারা প্রত্যক্ষ করেছেন। এসব জিনিসকে উৎস ও মূল গণ্য করার পর নৈতিকতার স্থায়ী নীতি এই স্থীরিকৃত হয় যে, তার কোন নির্দিষ্ট মানদন্ডই নেই বরং প্রবাহমান ধাতুর মতোই সে গতিশীল এবং বিভিন্ন আকৃতি ও পরিমাপের ছাঁচে সে নিজেকে ঢালাই করে থাকে।
মানুষের পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে নির্ভুল জ্ঞান লাভের জন্যে-অবশ্যি সে সম্পর্কে পূর্ণ ও বিস্তারিত তথ্য একত্রিত হওয়া এবং একটি সর্বদ্রষ্টা ও পূর্ণ ভারসাম্যের অধিকারী মস্তিষ্কের তা থেকে ফলাফল লাভের প্রয়োজন। কিন্তু এ দু’টো জিনিসই অলভ্য। প্রথমত পরীক্ষা-নিরীক্ষা এখনো শেষ হয়নি বরং জারি আছে। তদুপরি আবার এতদিনকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা এখনো শেষ হয়নি বরং জারি আছে। তদুপরি আবার এতদিনকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা লব্ধ অভিজ্ঞতারও বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন লোকের সামনে রয়েছে এবং তারা বিভিন্ন পদ্ধতিতে নিজেদের বুদ্ধি-বিবেক অনুযায়ী তাত্থেকে ফলাফল লঅভ করছে। তাহলে কি ঐ ত্রুটিপূর্ণ তথ্যাবলী থেকে বিভিন্ন অসম্পূর্ণ বিবেক-বুদ্ধি নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী যে ফলাফল লাভ করবে, তা সব নির্ভুল হতে পারে? যদি না হয়, তাহলে নিজের ভাল-মন্দ জানার জন্যে যে মস্তিষ্ক ও মানসিকতা ঐ জ্ঞানের মাধ্যমকে যথেষ্ট মনে করে, তার রুগ্নতা কী ভীষণ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে, তা চিন্তা করার মতো।
জীবন বিধান ও অস্তিত্বের অবস্থার ব্যাপারটিও অনুরূপ। হয় যদি নৈতিক ভালো-মন্দ জানবার জন্যে সেই সময়ের অপেক্ষা করুন যখন ঐ বিধান ও অবস্থার সন্তোষজনক পরিমাণ জ্ঞান আপনি হাসিল করতে পারবেন, নয়তো অকিঞ্চিত তথ্যাবলীকে অকিঞ্জিত জেনে এরি ভিত্তিতে বিভিন্ন মানসিতাসম্পন্ন ও বিভিন্ন পর্যায়ের জ্ঞানী লোকেরা বিভিন্ন পদ্ধতিতে ফয়সালা করতে থাকবেন যে, তাদের জন্যে ভাল কি এবং মন্দ কি? নতুন পর্যায়ের জ্ঞান লাভ করার তারা ঐ ফয়সালাগুলো পরিবর্তন করতেও থাকবেন। এমনকি শেষ পর্যন্ত আজকের ভাল আগামীকাল মন্দে পরিণত হবে এবং আজকের মন্দ আগামীকাল ভাল বলে গণ্য হবে।
জ্ঞান-শক্তি ও বিবেক-বুদ্ধির ব্যাপারটিও এত্থেকে মোটেই ভিন্তর নয়। অবশ্যি ভাল-মন্দকে জানবার কিছুটা ক্ষমতা বুদ্ধির আছে, এতে সন্দেহ নেই। এবং প্রত্যেক মানুষের মধ্যে এ বুদ্ধির কিছু না কিছু অংশও আছে। আবার জ্ঞান শক্তির সাহায্যেও ভাল-মন্দ কিছুটা জানা যায় বৈকি এবং স্বাভাবিকভাবে প্রত্যেক মানুষের বিবেকেই ইহা অনুরণন হয়। কিন্তু এই জ্ঞানের জন্যে এদের মধ্যে কোন একটি সূত্রও তার স্বকীয়তায় যথেষ্ট নয়- যার ফলে তাকেই শেষ এবং একমাত্র জ্ঞানের মাধ্যমহিসেবে ধরে নেয়া যেতে পারে। বুদ্ধি অথবা জ্ঞান যাকেই আপনি যথেষ্ট মনে করুন না কেন অবশ্যি জ্ঞানের এমন একটি মাধ্যমের ওপর আপনি আস্থাশীল হবেনই যার মধ্যে শুধু স্বভাবজাত অসম্পূর্ণতা ও সীমাবদ্ধতাই নয় বরং বিভিন্ন ব্যক্তি, শ্রেণী, অবস্থা ও কালে উপনীত হয়ে সে একেবারে ভিন্ন ভিন্ন জিনিসকে ভাল ও মন্দ বলে গণ্য করবেই।