এই যেসব বিশৃংখলার কথা আমি উল্লেখ করলাম এগুলো নিছক তথ্যমূলক প্রবন্ধ ও দার্শনিক আলোচনা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নেই বরং দুনিয়ার সভ্যতা-সংস্কৃতিতে কার্যত এগুলোর সুস্পষ্ট প্রতিফলন হচ্ছে। আপনার নিজের সভ্যতা-সংস্কৃতিতেও যে সমস্ত লোক কর্মরত আছেন- তারা কর্তা বা কর্মীর আসনে সমাসীন থাকুন অথবা কর্তা ও কর্মী তৈরীর কাজে লিপ্ত থাকুন- তারা সবাই ভাল ও মন্দ এবং ভুল নির্ভুলকে জানবার জন্যে নিজেদের ক্ষমতানুযায়ী ঐসব বিভিন্ন উৎসের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তাদের প্রত্যেক ব্যক্তি ও প্রত্যেক দলের ভাল-মন্দ অন্যের ভাল-মন্দ থেকে পৃথক। এমনকি একজনের ভালো অন্যের জন্য চরম মন্দ এবং একজনের মন্দ অন্যের জন্যে চরম ভালয় পরিণত হয়েছে। এই বিশৃংখলা নৈতিকতার কোন স্থায়ী ভিত্তিকে প্রতিষ্ঠিত থাকতে দেয়নি। দুনিয়ার যেসব জিনিসকে হামেশা অপরাধ ও গুনাহ মনে করা হয়েছে আজ কোন না কোন দলের দৃষ্টিতে সেগুলো মূর্তিমান ভাল অথবা প্রত্যক্ষ ভাল না হলেও পরোক্ষ ভালয় পরিণত হয়েছে। অনুরূপভাবে যেসব সৎগুণাবলীকে মানুষ ভাল মনে করে এসেছে তাদের অধিকাংশই আজ নির্বুদ্ধিতা এবং হাস্যষ্পদ বলে গণ্য হয়েছে এবং বিভিন্ন দল লজ্জার সাথে নয়, সগর্বে প্রকাশ্যে এগুলোকে নেস্তনাবুদ করছে। আগের যুগে মিথ্যাবাদী মিথ্যা কথা বলতো কিন্তু সত্যকেই নৈতিকতার মানদন্ড বলে স্বীকার করতো। কিন্তু আজকের যুগের মিথ্যাকে ভাল ও সৎ বানিয়ে দিয়েছে। আজ মিথ্যা বলার জন্যে একটি স্থায়ী শিল্প সৃষ্টি করা হচ্ছে এবং বিভিন্ন জাতি ও রাষ্ট্র ব্যাপক হারে মিথ্যার বেসাতি করে বেড়াচ্ছে। দিকে দিকে তার বীজ ছড়িয়ে ফিরছে। প্রত্যেক অসৎ গুণের অবস্থাও অনুরূপ। পূর্বে অসৎগুণাবলী অসৎই ছিল কিন্তু আজ নতুন দার্শনিক মতবাদের বদৌলতে এগুলো প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ সৎ ও ভালয় পরিবর্তিত হয়েছে।
নৈতিকতা দর্শনের মৌলিক প্রশ্নাবলীর মধ্যে তৃতীয় প্রশ্নটি হচ্ছে এই যে, নৈতিক সংবিধানের পেছনে কোন শক্তি সক্রিয় রয়েছে যার জোরে এ সংবিধান প্রবর্তিত হয়? এর জবাবে আনন্দ পূর্ণতার প্রসাদভোগীরা বলেন যে, যেসব সৎগুণ আনন্দ ও পূর্ণতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় তাদের আনুগত্য করার শক্তি তারা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে রাখে এবং যেসব অসৎগুণ দুঃখ-কষ্ট অবনতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় তারাও নিজেদের শক্তির জোরেই তাদের থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করে। এছাড়া নৈতিক সংবিধানের জন্যে বাইরের কোন কর্তৃত্বের প্রয়োজন নেই। দ্বিতীয় দল বলেন, কর্তব্য বিধান হলো মানুষের সুসংগত ইচ্ছা শক্তি কর্তৃক নিজের সংস্থাপিত বিধান। এর জন্যে কোন বহিঃপ্রকাশ প্রয়োজন নেই। তৃতীয় দল রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে নৈতিক বিধানের আসল প্রবর্তক শক্তি মনে করেন। িএ মতের প্রেক্ষিতে আল্লাহর জন্যে পূর্বে যেসব ক্ষমতা নির্ধারিত ছিল- অর্থাৎ দেশবাসীদের কি করা উচিত এবং কি না করা উচিত এর ফয়সালা করা- তা সবই রাষ্ট্রের দিকে স্থানান্তরিত হয়। চতুর্থ দল রাষ্ট্রের পরিবর্তে সমাজকে এ মর্যাদা দিয়েছে। এ জবাবগুলো কার্যত দুনিয়ায় অগণিত বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে এবং এখনো করে যাচ্ছে। প্রথম জবাব দু’টো ব্যক্তিগত জুলুম, হঠধর্মিতা ও বিপথগামিতা এত বেশী বাড়িয়ে দিয়েছে যে, সমাজ জীবনের যাবতীয় ব্যবস্থা ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে বসেছে। অতপর এর পতিক্রিয়া অন্য দার্শনিক মতবাদের রূপে আত্মপ্রকাশ করলো। এ মতবাদগুলো রাষ্ট্রকে খোদা বানিয়ে ব্যক্তিকে পূর্ণতাতরে বান্দায় পরিণত করেছে অথবা ব্যক্তির ভাত-রুটির সংগে সংগে তার ভালো-মন্দ, সৎ ও অসতের লাগামও তুলে দিয়েছে সমাজের হাতে। অথচ রাষ্ট্র বা সমাজ এ দু’টো কোনটাই নিষ্কলুষ ও মহাপবিত্র নয়।
ঠিক একই ব্যাপার দেখা দেয় এ প্রশ্নের ক্ষেত্রেও যে, কোন্ প্রেরণা মানুষকে তার স্বভাবজাত খাহেশের বিরুদ্ধে নৈতিক নির্দেশাবলীর অনুগত করে? কারুর মতে কেবল আনন্দ-লিপসা ও দুঃখ-কষ্টের ভয়ই এর জন্যে যথেষ্ট প্রেরণাদায়ক। কেউ নিছক পূর্ণতার আকাংখা এবং অপূর্ণতা থেকে বাঁচবার কামনাকে এর জন্যে যথেষ্ট মনে করেন। কেউ এ জন্যে নিছক আইনের প্রতি মানুষের ঐচ্ছিক সম্মানবোধের ওপর আস্থা রাখেন। কেউ রাষ্ট্রের পুরস্কারের আশা এবং তার রোষাণলের ভয়কে গুরুত্ব দেন। কেউ সমাজের পুরস্কার এবং তার ক্রোধকে ভীতু ও লালসার জন্যে ব্যবহার করার ওপর জোর দেন। এর মধ্য থেকে প্রত্যেকটি জবাবই কার্যত আমাদের নৈতিক ব্যবস্থার মধ্য থেকে কোন না কোনটির মধ্যে অগ্রবর্তীর আসন দখল করেছে। সামান্য অনুসন্ধান করলে সহজেই এ সত্যের দ্বারোদ্ঘাটিত হয় যে, এ প্রেরণাদায়ক শক্তিগুলো সৎকর্মেরও যতটচা সুষ্ঠু প্রেরণা যোগায়, অসৎকর্মেরও ঠিক ততটা সুষ্ঠু প্রেরণা যোগাতে পারে। বরং অসৎকাজের প্রেরণা যোগাবার ক্ষমতা এদের মধ্যে অনেক বেশী আছে। বলা বাহুল্য কোন উন্নত পর্যায়ের নৈতিকতার জন্যে এ প্রেরণাদায়ক শক্তিগুলো একেবারেই অকিঞ্চিত।
দুনিয়ার বর্তমান নৈতিক অবস্থার এই যে পর্যালোচনাটুকু আমি করলাম এ থেকে প্রথম দৃষ্টিতেই একথা অনুভূত হবে যে, বর্তমান দুনিয়া একটি সর্বব্যাপী নৈতিক নৈরাশ্যের মধ্যে অবস্থান করছে। আল্লাহ থেকে বেনিয়াজ হয়ে মানুষ নিশ্চিন্তে তার নৈতিক পুনর্গঠন কার্য সম্পাদনের জন্যে কোন বুনিয়াদ হাসিল করতে পারেনি। নৈতিকতায় যাবতীয় মৌলিক প্রশ্নাবলীর আসলে কোন সদুত্তর তার কাছে নেই। যে শ্রেষ্ঠতম সততার প্রচেষ্টার শেষ অধ্যায়ে পরিণত হতে পারে এবং যার পরিপ্রেক্ষিতে ভাল বা মন্দ এবং ভুল বা নির্ভুল কাজের ফয়সালা করা যেতে পারে তার কোন সন্ধান সে লাভ করতে পারেনি। ভাল ও মন্দ, সৎ ও অসৎ সম্পর্কে নির্ভুল জ্ঞান লাভ করার জন্যে কোন উৎসের সন্ধানও সে পায়নি। যে কর্তৃত্বের বলে নৈতিকতার কোন উন্নত ও সার্বজনীন বিধান প্রবর্তন করার শক্তি লাভ করা যায় তা হাসিল করতেও সে সক্ষমহয়নি এবং এমন কোন প্রেরণাদায়ক শক্তিও সে লাভ করতে পারেনি যা মানুষকে সত্য পথে চলার িএবং অসত্য থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে সত্যিকারভাবে প্রলুব্ধ করে। আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে মানুষ হঠধর্মিতার সংগে ঐ প্রশ্নগুলো সমাধান করতে চেয়েছিল এবং নিজেদের মতানুযায়ী সমাধান তারা করেছেও কিন্তু এই সমাধানের পরিণাম ফলই আজ আমরা দুনিয়ার চতুর্দিকে পরিব্যপ্ত দেখছি- যা নৈতিক পতনের ভয়াবহ তুফান রূপে অগ্রসর হয়ে সমগ্র মানব সভ্যতাকে ধ্বংসের বাণী শোনাচ্ছে।
মানুষের নৈতিক বৃত্তির নির্ভুল সংগঠনের জন্যে বুনিয়াদ তালাশ করার সময় কি এখনো সমুপস্থিত হয়নি? আসলে এ তালাশ ও অনুসন্ধান নিছক একটি পুঁথিগত আলোচনা নয় বরং এটি আমাদের জীবনের একটি বাস্তব প্রয়োজন এবং পরিস্থিতির নাজুকতা একে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনে পরিণত করেছে। এ প্রেক্ষিতে আমি নিজের অনুসন্ধানের ফলাফল পেশ করছি। আমি চাই যেসব লোক এ প্রয়োজনের অনুভূতি রাখেন তারা শুধু আমার এ ফলাফলের ওপর ঠাণ্ডা মস্তিষ্কে চিন্তা করেই ক্ষান্ত হবেন না বরং মানুষের নৈতিক বৃত্তির নির্ভুল বুনিয়াদ কি হতে পারে এ সম্পর্কে তারা নিজেরাও চিন্তা করবেন।
আমি অনেক অনুসন্ধান ও গবেষণা করার পর যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি তাহলো এই যে, নৈতিকতার জন্যে স্রেফ একটি বুনিয়াদই নির্বুল এবং ইসলাম সে বুনিয়াদটি সরবরাহ করে। নৈতিকতার দর্শনের সমস্ত মৌলিক প্রশ্নের জবাব আমরা এখানে পাই। এমন জবাব পাই যার মধ্যে দার্শনিক জবাবসমূহের দুর্বলতাগুলোর অস্তিত্ব নেই। ধর্মীয় নৈতিকতার যেসব দুর্বলতার ফলে সে কোন শক্তিশালী চরিত্র গঠন করতে পারে না এবং মানুষকে তমদ্দুনের ব্যাপকতার দায়িত্ব গ্রহণ করার যোগ্যও করে না তার ছিটেফোঁচাও এখানে নেই। এখানে আমরা এমন একটি সর্বব্যাপী নৈতিক নেতৃত্ব লাভ করি যা আমাদেরকে জীবনের সমস্ত বিভাগে উন্নতির চরমতম পর্যায়ে উপনীত করতে পারে। এখানে আমরা এমন নৈতিক বিধান লাভ করি যার ওপর একটি সৎ ও সর্বোত্তম তমুদ্দনিক ব্যবস্থা কায়েম করা যেতে পারে এবং এ বিধানের ওপর ব্যক্তি ও সমাজ চরিত্রের ভিত্তি স্থাপন করলে মানব জীবন বর্তমানে যে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে তাথেকে রেহাই পেতে পারে। কোন্ যুক্তি-প্রমাণের মাধ্যমে আমি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আমাদের সামনে পেশ করছি।
দর্শন যে স্থান থেকে নৈতিকতার আলোচনা শুরু করলে আসলে তা নৈতিক বিষয়ের প্রারম্ভিক বিন্দু নয় বরং মাঝখানের কতিপয় বিন্দু। প্রারম্ভিক বিন্দুকে ছেড়ে এখান থেকেই আলোচনা শুরু করা হয়েছে। এটিই হলো প্রথম ভুল। মানুষের কর্মকান্ডের ভুল ও নির্ভুলের মানদন্ড কি এবং কোন্ সৎগুণাবলী পর্যন্ত পৌঁছাবার জন্যে প্রচেষ্টা চালানো মানুষের প্রধানতম উদ্দেশ্য হওয়া উচিত- এ প্রশ্নগুলো আসলে পরের পর্যায়ের। এর আগের আসল প্রশ্নটি এই হওয়া উচিত যে, এ জগতে মানুষ কোন্ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত? অন্যান্য প্রশ্নগুলো থেকে এ প্রশ্নটির অগ্রবর্তী হবার কারণ আছে। মর্যাদার স্থান নির্দেশ ছাড়া নৈতিকতার প্রশ্ন শুধু অনর্থকই নয় বরং এতে খুব বেশী সম্ভাবনা থাকে যে, এভাবে যে নৈতিক বিধান নির্ধারিত হবে তা মূলতই হবে ত্রুটিপূর্ণ। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, কোন সম্পত্তি সম্পর্কে আপনাকে ফয়সালা করতে হবে যে, তার মধ্যে কিভাবে আপনার কাজ করা উচিত, তাকে কিভাবে ব্যবহার করার অধিকার আপনার আছে আর কিভাবে ব্যবহার করার অধিকার আপনার নেই। এ সম্পত্তির ব্যাপারে আপনি কোন্ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত এবং এর সংগে আপনার সম্পর্ক কোন্ ধরনের, এ বিষয়টি নির্ধারিত না করেই কি আপনি এ প্রশ্নের নির্ভুল মীমাংসা করতে পারেন? যদি এ সম্পত্তির মালিক অন্য কেউ হয় এবং আপনি এতে আমানতদার ও রক্ষকের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত থাকেন, তাহলে এতে আপনার নৈতিক কর্মপদ্ধতি অনেকটা অন্য ধরনের হবে। আর যদি আপনি নিজেই এর মালিক হন এবং এর ওপর আপনার সীমাহীন মালিকানা ক্ষমতা থাকে, তাহলে এ ক্ষেত্রে আপনা্র নৈতিক কর্মপদ্ধতি হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের। মর্যাদার প্রশ্ন নৈতিক কর্মপদ্ধতির ধরন হিসেবে চূড়ান্ত হবে- ব্যাপা’র শুধু এতটুকু নয় বরং আসলে এ বিষয়ের ফয়সালা এরই ওপর নির্ভর করবে যে, এ সম্পত্তিতে কে আপনার জন্যে নির্ভুল কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করার অধিকার রাখে, আপনি নিজে অথবা আপনি যার আমানতদার সে?
ইসলাম সর্বপ্রথম এ প্রশ্নের দিকে মনসংযোগ করে এবং সকল দ্বিধা সন্দেহের ঊর্ধে থেকে সুস্পষ্টভাবে আমাদেরকে বাতলিয়ে দেয় যে, এ দুনিয়ায় মানুষ আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর সহকারীর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। এখানে যত সব জিনিসের সংগে মানুষের সম্পর্ক সমস্তর-ই মালিক আল্লাহ এমনকি মানুষের নিজের দেহ এবং তার এ দেহের মধ্যে যত শক্তি আছে কোন কিছুরই মালিক সে নিজে নয়। আল্লাহ-ই এ সবের মালিক। আল্লাহ তাকে এসব জিনিস ব্যবহার করার ক্ষমতা দিয়ে নিজের সহকারী হিসেবে এখানে নিযুক্ত করেছেন এবং নিযুক্তির মধ্যে রয়েছে তার পরীক্ষা। পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফল এ দুনিয়ায় প্রকাশ হবে না বরং যখন ব্যক্তি, জাতি তথা সমগ্র মানবজাতির কাজ খতম হয়ে যাবে এবং মানুষের প্রচেষ্টার প্রভাব ও ফলাফল পূর্ণতার সীমায় পৌঁছে যাবে, তখনই আল্লাহ একই সময়ে সবার হিসেব নেবেন এবং এ বিষয়ে ফয়সালা করবেন যে, কে তাঁর বন্দেগী ও সহকারীত্বের হক সঠিকভাবে আদায় করেছে এবং কে আদায় করেনি। এ পরীক্ষা শুধু কোন একটি ব্যাপারেই নয়, বরং সমস্ত ব্যাপারেই জীবনের শুধু একটি বিভাগেই নয় বরং সামগ্রিকভাবে, সমগ্র জীবনব্যাপী। দেহ ও আত্মার যত রকমের শক্তি মানুষকে দেয়া হয়েছে, সবার জন্যে এ পরীক্ষা এবং বাইরে যেসব জিনিসের ওপর যে ধরনের ক্ষমতা তাকে দেয়া হয়েছে, সবগুলোর মধ্যে পরীক্ষা হচ্ছে- কিভাবে সে এগুলোর ওপর নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করেছে দেখার জন্যে।
মর্যাদা নির্ধারণের স্বাভাবিক ফল এই দাঁড়ায় যে, দুনিয়ায় নিজের জন্যে নৈতিক কর্মপদ্ধতি নির্ধারণের অধিকার মানুষের আর থাকে না বরং এ ফয়সালা করা আল্লাহর অধিকারে পরিণত হয়। অতপর দার্শনিকগণ নৈতিকতা দর্শনের যেসব প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন তার সবগুলোরই সমাধান হয়ে যায়। আর শুধু সমাধানই নয় বরং এরপর এক-একটি প্রশ্নের ছত্রিশটি জবাবের এবং এক-একটি জবাবের ভিত্তিতে মানুষের এক-একটি দলের নৈতিকতার এক ভিন্নতর দিকে পরিচালিত হবার এবং একই সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবনের আওতায় বাস করেও এ বিভিন্ন দিকে পরিচালিত লোকদের নিজেদের বিপথগামিতার মাধ্যমে বিশৃংখলা, বিপর্যয় ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করার আর কোন মওকাই থাকে না। ইসলাম মানুষের যে মর্যাদা নির্ধারণ করেছে, তা যদি স্বীকার করে নেয়া হয়, তাহলে একথা আপনা আপনি নির্ধারিত হয়ে যায় যে, আল্লাহর পরীক্ষায় কামিয়াব হওয়া এবং তাঁর সন্তুষ্টি লাভ করাই হলো সে উন্নততর ভাল ও সৎ, যাকে হাসিল করা প্রত্যেক মানুষের প্রধানতম উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। এবং কোন্ পদ্ধতি এ সৎ হাসিল করার পক্ষে কতটুকু সহায়ক বা প্রতিবন্ধক- সে কথার ওপর তার ভুল বা নির্ভুল হওয়া নির্ভর করে। অনুরূপভাবে এখান থেকে একথাও নির্ধারিত হয়ে যায় যে, মানুষের জন্যে ভালো-মন্দ ও ভুল-নির্ভুলকে জানার আসল উৎস হলো আল্লাহর হেদায়াত এবং এছাড়া জ্ঞান লাভের অন্যান্য মাধ্যম এ আসল উৎসের সাহায্যকারী হতে পারে কিন্তু আসল উৎস হতে পারে না। এছাড়া একথাও স্থিরীকৃত হয়ে যায় যে, নৈতিক বিধান অবশ্য পালনীয় হবার আসল বুনিয়াদ হলো শুধু এই যে, এ বিধান আল্লাহ প্রবর্তিত। এবং এই সংগে একথাও পরিষ্কার হয়ে যায় যে, সচ্চারিত্রিক গুণাবলীর আনুগত্য করা এবং অসচ্চারিত্রিক গুণাবলীকৈ এড়িয়ে যাবার জন্যে আসল প্রেরণাদায়ক শক্তি আল্লাহ প্রেম, তাঁর সন্তুষ্টি অনুসন্ধান এবং তাঁর বিরাগভাজনের আশংকা হওয়া উচিত।
অতপর এথেকে শুধু নৈতিকতা দর্শনের সমস্ত নীতিগত প্রশ্নের মীমাংসাই হয়ে যায় না বরং এর ভিত্তিতে যে নৈতিক পদ্ধতি গড়ে উঠে তার মধ্যে চরম ভারসাম্যপূর্ণ ও সুসংগত পদ্ধতিতে সেসব নৈতিক পদ্ধতি নিজেদের উপযোগী স্থান লাভ করে, যা নৈতিকতা দর্শনের চিন্তাবিদগণ করেছেন। দর্শন ভিত্তিক নৈতিক ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে সত্যের কোন অংশ নেই, এটিই এর আসল ত্রুটি নয় বরং এর আসল ত্রুটি হলো এই যে, এরা সত্যের একটা অংশ গ্রহণ করে তাকে পূর্ণ সত্য বানিয়ে নিয়েছে। অংশকে পূর্ণ বস্তু বানাবার জন্যে যত পরিমাণ অতিরিক্ত বস্তুর প্রয়োজন হয় তার পূর্ণতার জন্যে অবশ্যি এদেরকে বাতিলের অনেক অংশ গ্রহণ করতে হয়। এর বিপরীত পক্ষে ইসলাম পূর্ণ সত্য পেশ করে এবং মানুষের কাছে যেসব আংশিক সত্য পৃথক পৃথকভাবে এবং অপূর্ণ অবস্থায় ছিল তা সব এ পূর্ণ সত্যের মধ্যে একীভূত হয়ে যায়।
এখানে আনন্দেরও একটা স্থান আছে, কিন্তু তাহলো আল্লাহর বিধানের আনুগত্য করার ফলে সৃষ্ট আনন্দ ও সমৃদ্ধি। এ আনন্দ ও সমৃদ্ধি শারীরিক ও বস্তু ভিত্তিক, মানসিক ও আর্থিক এবং শৈল্পিক ও আধ্যাত্মিক সব রকমের। উপরন্তু এ আনন্দ ও সমৃদ্ধি ব্যক্তি, দল এবং সসগ্র মানব জাতিরও। এ বিভিন্ন আনন্দের মধ্যে সংঘর্ষ নেই বরং সংযোগ আছে।
এখানে পূর্ণতারও একটা স্থান আছে, কিন্তু সে পূর্ণতা আল্লাহর পরীক্ষার শতকরা একশো নম্বর লাভ করার অধিকারী। এবং এ পূর্ণতা শুধু ব্যক্তির নয় বরং দলের, জাতির এবং দুনিয়ার সমস্ত মানুষের। নির্ভুল নৈতিক কর্মপদ্ধতির পরিচয় হলো এই যে, এর মাধ্যমে শুধু ব্যক্তি নিজেই পূর্ণতার দিকে অগ্রগমন করে না বরং সে অন্যের পূর্ণতার সহায়কও হয় এবং কেউ কারুর পূর্ণতা লাভের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না।
এখানে ক্যান্টের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য বিধানও। (Categorical Imperative) পূর্ণ মর্যাদা সহকারে স্থান লাভ করে। এবং যে নোংগর লাভ না করার দরুন দর্শনের দরিয়ায় এ জাহাজ দোদুল্যমান ছিল তাও সে লাভ করে। ক্যান্ট যে অবশ্য পালনীয় বিধানের কথা উল্লেখ করেছেন এবং যার কোন ব্যাখ্যা তিনি নিজে করতে পারেন নি আসলে তাহলো আল্লাহর বিধান। আল্লাহর পক্ষথেকেই তার রূপ নির্ধারণ করা হয়েছে। আল্লাহর বিধান হবার কারণেই তা অবশ্য পালনীয় এবং বিনা দ্বিধায় এরই আনুগত্য করার নাম হলো নেকী।
অনুরূপভাবে এখানে নৈতিক ভাল-মন্দের জ্ঞান লাভের জন্যে যে উৎসের কথা আমাদেরকে বলা হয়েছে তা দার্শনিকগণ কথিত জ্ঞানলাভের অন্যান্য মাধ্যমকে অস্বীকার করে না বরং ওগুলোকে একটি পদ্ধতির অংশীভূত করে। অবশ্যি যে জিনিসটাকে অস্বীকার করে তাহলো শুধু এই যে, এগুলোকে অথবা ওদের মধ্য থেকে কোন একটিকে জ্ঞানলাভের আসল ও শেষ মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা। আল্লাহর হেদায়াতের মাধ্যমে ভাল-মন্দ যে জ্ঞান আমাদের দান করা হয়েছে তাহলো আসল জ্ঞান। এছাড়া অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান, জীবনবিধান ও অস্তিত্বের অবস্থা লব্ধ জ্ঞান, বিবেক-বুদ্ধি প্রসুত জ্ঞান এ সবই ঐ আসল জ্ঞানের সাক্ষ্যস্থল। আল্লাহর হেদায়াত যে জিনিসগুলোকে ভাল ও সৎ বলে মানুষের অভিজ্ঞতা তার ভাল ও সৎ হবার সাক্ষ্য দেয়, জীবন বিধান তার সত্যতা প্রমাণ করে। বিবেক, বুদ্ধি উভয়ই তার সাক্ষ্য প্রদান করে। কিন্তু সত্যতার মানদন্ড হলো একমাত্র আল্লাহর হেদায়াত, জ্ঞানের এসব মাধ্যমগুলো নয়। মানবজাতির ইতিহাস লব্ধ অভিজ্ঞতা অথবা জীবন বিধান থেকে যদি এমন কিছু প্রমাণ করা হয় অথবা জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধির সাহায্যে এমন কোন রায় কায়েম করা যায় যা আল্লাহর হেদায়াত বিরোধী তাহলে আল্লাহর হেদায়াতকেই প্রকৃত স্বীকৃতি দেয়া হবে, ঐ প্রমাণ অথবা রায়কে নয়। আমাদের নিকট জ্ঞানের একটা সনদযুযক্ত মানদন্ড থাকায় এই লাভ হয় যে, আমাদের জ্ঞান রাজ্যে শৃংখলা কায়েম থাকে এবং সে বিশৃংখলা ও নৈরাজ্য থেকেও আমরা নিষ্কৃতি লাভ করি যা কোন মানদন্ড না থাকায় এবং প্রত্যেক ব্যক্তির নিজের নিজের রায় পেশ করার কারণে সৃষ্টি হয়।
অনুরূপভাবে এখানে নৈতিক বিধানের শক্তি-সহায়ক (Sanction) ও প্রেরণা সৃষ্টিকপারীর সমস্যাও এভাবে সমাধান করা হয় যে, এর ফলে দার্শনিকগণ যেসব জিনিসের কথা বলেছেন তা অস্বীকার করা হয় না। বরং সেগুলোর সংশোধন হয়ে যায় এবং যেসব ভুল পরিসরে সেগুলোকে সম্প্রসারিত করে দেয়া হয়েছে অথবা তারা নিজেরাই সম্প্রসারিত হয়েছে সেখান থেকে সরিয়ে তাদেরকে একটি পূর্ণাঙ্গ পদ্ধতিতে সঠিক স্থানে রাখা হয়। আল্লাহর বিধান নিজেকে আল্লাহর বিধান হবার কারণেই প্রতিষ্ঠিত করার শক্তি রাখে। এ শক্তি সেই মু’মিনের মধ্যেও আছে যে আল্লাহর সন্তুষ্টি চাওয়ার মধ্যে আনন্দ অনুভব করে এবং যে সেই পূর্ণতা অনুসন্ধান করে ফিরছে যা আল্লাহর দিকে অগ্রসর হবার পর লাভ করা যায়। এছাড়াও এ শক্তি মু’মিন সমাজ এবং আল্লাহর বিধানের ওপর প্রতিষ্ঠিত সৎ রাষ্ট্রের মধ্যে রয়েছে। আইনের আনুগত্য করার জন্যে মু’মিনকে উৎসাহদান করে তার নির্ভেজাল কর্তব্যজ্ঞান, তার সত্যকে সত্য জেনে তাকে পছন্দ করার ক্ষমতা, বাতিলকে বাতিল জেনে তাকে ঘৃণা করার ক্ষমতা এবং তার আল্লাহপ্রীতি।
এভাবে মানুষকে আল্লাহর কর্তৃত্বের বাইরে ধারণা করে নিয়ে তার জন্যে একটি নৈতিক ব্যবস্থা স্থিরীকৃত করার প্রচেষ্টা চালানোর ফলে মানুষের চিন্নতা ও কর্মজগতে যে নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয় এসলাম তাকে পুরোপুরি খতম করে দেয়। অতপর আলোচনাটাকে আর একটু এগিয়ে নেয়া যাক। ইসলাম আল্লাহর যে ধারণা পেশ করে তাহলো এই যে, মানুষ ও সমগ্র বিশ্বজাহানের একমাত্র মালিক, স্রষ্টা, মাবুদ ও শাসক হলেন আল্লাহ। এ খোদায়ীর কাজে কেউ তাঁর শরীক নেই। তাঁর নিকট নেক দোয়া ছাড়া অন্য এমন কোন সুপারিশের স্থান সংকুলনা নেই যা জোর করে মানিয়ে নেয়া অথবা প্রত্যাখ্যান করা যেতে পারে। তাঁর নিকট প্রত্যেক ব্যক্তির সাফল্য ও ব্যর্থতা নির্ভর করে তার নিজের কার্যাবলীর ওপর। সেখানে কেউ কারুর গুনাহর কাফ্ফারা হতে পারে না, একজনের কাজের জন্যে অন্যজনকে দায়ী করা হয় না, একজনের কাজের ফল অন্যজন পায় না। তাঁর নিকট পক্ষপাতিত্ব নেই। কোন একটি খান্দান, জাতি অথবা বংশের ব্যাপারে তিনি অন্য সবার চেয়ে বেশী আগ্রশীল নন। তাঁর দৃষ্টেোত সব মানুষ সমান। সবার জন্যে একই নৈতিক বিধান রয়েছে এবং নৈতিক শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠিতে একজনের ওপর অন্যজনের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন হয়। তিনি নিজে রহীম এবং রহম পছন্দ করেন। তিনি নিজে দাতা এবং দানশীলতা পছন্দ করেন। তিনি নিজে ক্ষমাশীল এবং ক্ষমাশীলতা পছন্দ করেন। তিনি নিজে ইনসাফকারী এবং ইনসাফ পছন্দ করেন। তিনি নিজে জুলুম, সংকীর্ণ দৃষ্টিভংগী, সংকীর্ণ মনোভাব, নির্দয়তা, নিষ্ঠুরতা, বিদ্বেষ এবং স্বার্থদুষ্ট পক্ষপাতিত্ব থেকে মুক্ত। এজন্যে তাদেরকেই পছন্দ করেন যারা এসব অসৎগুণাবলী মুক্ত। আবার শ্রেষ্ঠত্বে একমাত্র তাঁরই অধিকার রয়েছে তাই তিনি অহঙ্কার পছন্দ করেন না। উলুহিয়াত একমাত্র তাঁরই জন্যে আর সবাই তাঁর বান্দা। এজন্যে এক বান্দার ওপর অন্য বান্দার খোদায়ী তিনি পছন্দ করেন না। তিনি একই মালিক এবং অন্যের কাছে যা কিছু আছে সব তাঁর আমানত হিসেবে রক্ষিত হয়েছে। এ জন্যে কোন বান্দার স্বাধীন ক্ষমতা, কারুর অন্যের জন্যে আইন প্রণয়ন এবং কারুর আনুগত্য অপরের জন্যে অবশ্য স্বীকৃত হওয়া- এসব আসলে ভুল। সবই একমাত্র তাঁরই আনুগত্য করবে এবং বিনা বাক্য ব্যয়ে তাঁর আনুগত্য করার সবার জন্যে বেহতের। আবার তিনি উপকারীও। এই কৃতজ্ঞতা, শুকুরগুজারী ও ভালবাসার ওপরও তাঁর পূর্ণ অধিকার আছে। তিনি নেয়ামত দানকারী এবং তাঁর নেয়ামতসমূহকে তাঁরই ইচ্ছানুসারে ব্যবহার করার অধিকার রাখেন। তিনি ন্যায় বিচারক এবং মানুষ অবশ্যি তাঁর ন্যায় বিচারে সাজা লাভের ভয় এবং পুরস্কার লাভের লোভ করবে। তিনি সর্বজ্ঞ ও মহাজ্ঞানী এবং দিলের গভীরতম প্রদেশে প্রচ্ছন্ন নিয়ত সম্পর্কেও অবগত। এজন্যে বাহ্যিক সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে তাঁকে প্রতারিত করা যেতে পারে না। তিনি সর্বত্রই বিরাজমান, কাজেই অপরাধ করে তাঁর হাত থেকে নিস্তার পাবার আশাও কেউ করতে পারে না।
আল্লাহ সম্পর্কিত এ ধারণা সম্পর্কে চিন্তা করুন। এথেকে একেবারে স্বাভাবিক ফল হিসেবে মানুষের জন্যে একটি পূর্ণাংগ নৈতিক জীবনের নকশা অস্তিত্ব লাভ করে এবং এ নকশা শির্কবাদী ধর্ম ও নাস্তিক্যবাদী ব্যবস্থার নৈতিক বিধানের মধ্যে যেসব দুর্বলতা পাওয়া যায় তাথেকে পুরোপুরি মুক্ত। এখানে নৈতিক দায়িত্ব থেকে গা বাঁচিয়ে বেরিয়ে আসার জন্যে কোথাও কোন চোরা দরজা নেই। সেসব অত্যাচার ও দুষ্ট-দর্শনের কোন স্থানও এখানে নেই- যাদের কারণে মানুষ তার নিজের ইচ্ছানুসারে মানব জগতকে বিভক্ত করে তার এক অংশের জন্যে মূর্তিমান ফেরেশাত এবং অন্য অংশের জন্যে মূর্তিমান শয়তানে পরিণত হয়। নাস্তিক্যবাদী দর্শনের সেসব মৌলিক দুর্বলতাগুলোও এর মধ্যে পাওয়া যায় না যেগুলোর কারণে নৈতিকতায় কোন প্রকার দৃঢ়তা সৃষ্টি হতে পারে। এ নেতিবাচক সৎগুণাবলীর সংগে ঐ নকশার ইতিবাচক সৎগুণও রয়েছে, এবং তাহলো এই যে, এটি নৈতিক শ্রেষ্ঠত্বের একটি উন্নততর ও ব্যাপকতর সীমারেখা পেশ করে যার ব্যাপকতা ও উচ্চতার কোন সীমা পরিসীমা নেই এবং ঐ সীমান্তের দিকে অগ্রসর হবার জন্যে এমন সব প্রেরণাদায়ক শক্তি সংগ্রহ করে যা সর্বাধিক পবিত্র।
অতপর এ ধারণা যে, পরীক্ষা কোন একটি জিনিসের মধ্যে নয় বরং আল্লাহ মানুষকে যতো জিনিস দিয়েছেন সবের মধ্যে কোন একটি অবস্থায় নয় বরং মানুষ এখানে যত অবস্থার সম্মুখীন হয় সমস্তর মধ্যে এবং কোন একটি বিভাগে নয় বরং সমগ্র জীবনে- এটি নৈতিকতার পরিসরকে ঠিক ততটাই সম্প্রসারিত করে যতটা সম্প্রসারিত হয়ে আছে পরীক্ষার পরিসর। মানুষের বুদ্ধি, তার জ্ঞানের মাধ্যমে তার মানসিক ও চিন্তার শক্তি, তার ইন্দ্রিয়, তার ভাবাবেগ, তার আশা আকাংখা, তার দৈহিক শক্তি সবাই পরীক্ষায় শরীক আছে। অর্থাৎ পরীক্ষা হলো মানুষের সমগ্র ব্যক্তিত্বের। আবার বাইরের দুনিয়ায় মানুষ যেসব জিনিসের সংস্পর্শে আসে, যেসব জিনিস ব্যবহার করে, বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব মানুষের সে মুখোমুখি হয় তাদের সবার সাথে তাঁর ব্যবহারের মধ্যে রয়েছে এবং সবচেয়ে বেশী পরীক্ষা হলো এ বিষয়ের মধ্যে যে, মানুষ কি এসব কিছু আল্লাহর উলুহিয়াত এবং নিজের বান্দা ও প্রতিনিধি হবার অনুভূতির সংগে অথবা আজাদী ও স্বাধীন মনোবৃত্তির স্রোতে গা ভাসিয়ে করছে? অথবা আল্লাহ ছাড়া অন্যের বান্দা হয়ে করছে? নেতিকতার েএ ব্যাপকতর ধারণার মধ্যে ধর্মের সীমিত ধারণা সৃষ্টি সংকীর্ণতা নেই। এটি মানুষকে জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে অগ্রবর্তী করে। প্রতি ক্ষেত্রের নৈতিক দায়িত্ব সম্পর্কে তাকে অবহিত করে। এবং জীবনের প্রতি ক্ষেত্রের সংগে সম্পর্কযুক্ত পরীক্ষায় কামিয়াব হবার জন্যে যেসব নৈতিক বিধানের আনুগত্যের প্রয়োজন হয়, তা সবই তাকে দান করে।
অতপর পরীক্ষার আসল ও চূড়ান্ত ফয়সালা এ জীবনে নয় বরং অন্য জীবনে হবে এবং আসল সাফল্য ও ব্যর্থতা এখানে নয় বরং ওখানে হবে- এ ধারণা দুনিয়ার জীবন ও তার যাবতীয় সমস্যার ব্যাপারে মানুষের দৃষ্টির (Out Look) মৌলিক পরিবর্তন সাধন করে। এ ধারণার কারণেই এ দুনিয়ায় যে ফলাফল বের হয় তা আর আমাদের ভাল-মন্দ, ভুল-নির্ভুল, হক-বাতিল এবং সাফল্য-ব্যর্থতার সন্দেহাতীত, আসল ও শেষ মানদন্ড থাকে না। এজন্যে নৈতিক আইনের আনুগত্য বা অআনুগত্য এই ফলাফলের উপর নির্ভরও করতে পারে না। যে ব্যক্তি এ ধারণাটি গ্রহণ করে নেবে সে অবশ্যি নৈতিক আইনের আনুগত্যের ক্ষেত্রে দৃঢ়পদ থাকবে- তাতে এ দুনিয়ায় দৃশ্যত এর ফলাফল ভাল বা মন্দ অথবা এতে সাফল্য বা ব্যর্থতা যাই হোক না কেন। এর অর্থ এই নয় যে, তার দৃষ্টিতে দুনিয়ার ফলাফল হবে একেবারেই অবিচেনা যোগ্য। বরং এর অর্থ হলো শুধু এই যে, সে আসল ও চরম বিবেচনা এর নয়- আখেরাতের চিরন্তন ফলাফল সম্পর্কে করবে এবং নিজের জন্যে শুধু সে কর্মপদ্ধতিকে পরিত্যাগ অথবা গ্রহণ করার ফয়সালা করার জন্যে সে দেখবে না যে, সেটি জীবনের এ প্রারম্ভিক পর্যায়ে আনন্দ, মজা ও লাভের কারণ কিনা। বরং সে দেখবে জীবনের শেষ পর্যায়ে চূড়ান্ত ও অনিবার্য ফলাফলের দিক দিয়ে সেটা কেমন। এভাবে তার নৈতিক ব্যবস্থা অবশ্যি উন্নয়নমুখী থাকবে কিন্তু তার নৈতিক বিধান পরিবর্তনশীল হবে না। তার চরিত্র ও বিভিন্নতা দোষে দুষ্ট হবে না। অর্থাৎ তাহজীব-তমদ্দুনের উন্নতি ও অগ্রগতির সংগে সংগে তার নৈতিক ধ্যান-ধারণার মধ্যে অবশ্যি ব্যাপকতার সৃষ্টি হবে কিন্তু এ কখনো সম্ভব হবে না যে, ঘটনার পার্শ্ব পরিবর্তন হতে থাকবে এবং গিরিগিটের রং পরিবর্তনের মতো মানুষের নৈতিক ভংগীর মধ্যেও কোন স্থায়িত্ব থাকবে না।
কাজেই নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে আখেরাতের এ ইসলামী ধারণা দু’টো গুরুত্বপূর্ণ সুফল দান করে- যা অণ্য কোন উপায়ে লঅভ করা যেতে পারে না। এক: এর কারণে নৈতিক বিধি-বিধান ভীষণ শক্তিশালী হয়। তার দোদুল্যমান হবার কোন আশংকাই থাকে না। দুই: এর কারণে মানুষের নৈতিক চরিত্র এমন দৃঢ়তা অর্জন করে যে, ঈমানের শর্তে তার ভিন্নমুখী হবার কোন আশংকা থাকে না। দুনিয়ায় সত্যতার দশটি বিভিন্ন ফলাফল বের হতে পারে এবং ঐ ফলাফলগুলোর ওপর দৃষ্টি স্থাপনকারী কোন সুযোগ সন্ধানী ব্যক্তি সুযোগ ও সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে দশটি বিভিন্ন কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু আখেরাতের সত্যতার ফল অবশ্যি একটি মাত্র হয় এবং এর ওপর দৃষ্টি স্থাপনকারী মু’মিন ব্যক্তি দুনিয়ার লাভ-ক্ষতির পরোয়া না করে অবশ্যি একটিমাত্র কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করবে। দুনিয়ার ফলাফলের কথা বিচার করলে দেখা যাবে, ভাল-মন্দ কোন নির্দিষ্ট জিনিসের নাম নয় বরং একই জিনিস নিজের বিভিন্ন ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে কখনো ভাল আবার কখনো মন্দে পরিণত হচ্ছে এবং এর অনুপস্থিতিতে দুনিয়া-পরস্ত লোকের ভূমিকাও পরিবর্তিত হচ্ছে। কিন্তু আখেরাতের ফলাফলের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে দেখা যাবে,ম ভাল ও মন্দ উভয়ই চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে। তখন আখেরাতে বিশ্বাস স্থাপনকারী মু’মিনের জন্যে কখনো ভালকে অশুভ পরিণতি এবং মন্দকে শুভ পরিণতি মনে করে নিজের ভূমিকা পরিবর্তন অসম্ভব হয়ে পড়ে।
আবার মানুষ এ দুনিয়ায় আল্লাহর খলীফা এবং এখানকার যাবতীয় জিনিস ব্যবহার করার ক্ষমতা আসলে আল্লাহর খলীফা এবং এখানকার যাবতীয় জিনিস ব্যবহার করার ক্ষমতা আসলে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে তাকে দেয়া হয়েছে- এ ধারণা মানব জীবনের জন্যে পথ ও উদ্দেশ্য দু’টোই নির্ধারিত করে দেয়। এ ধারণার ফলে মানুষের জন্যে স্বাধীন ক্ষমতা, অন্যের বন্দেগী এবং খোদায়ীর শ্রেষ্ঠত্বের যাবতীয় দৃষ্টিভংগী ভুল প্রমাণিত হয় এবং স্রেফ এ একটিমাত্র দৃষ্টিভংগী তার জন্যে নির্ভুল প্রমাণিত হয় যে, নিজের যাবতীয় ব্যাপারে সে আল্লাহর ইচ্ছার অনুগত এবং তাঁর অবতীর্ণ নৈতিক আইনের বাধ্য থাকবে। তাছাড়া এথেকে এও প্রমাণ হয় যে, মানুষ একদিকে তার নৈতিক দৃষ্টিভংগীর ব্যাপারে এমন প্রত্যেকটি কর্মপদ্ধতিকে কঠোরভাবে এড়িয়ে চলবে যাতে স্বাধীন মনোবৃত্তি ও বিদ্রোহী, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারুর বন্দেগী অথবা উলুহিয়াতের শ্রেষ্ঠত্বের সামান্যতম গন্ধও পাওয়া যায়। কেননা এ তিনটি জিনিস তার প্রতিনিধি মর্যাদা বিরোধী। কিন্তু অন্যদিকে আল্লাহর সম্পদকে কাজে লাগানো, আল্লাহর সৃষ্ট শক্তির সংগে তার ব্যবহার এবং আল্লাহর প্রজাদের ওপর তার শাসন পরিচালনা হবে সে নৈতিকতা ও ব্যবহার মোতাবিক, যা এ রাজ্যের আসল মালিক নিজের দেশ ও প্রজাদের ক্ষেত্রে গ্রহণ করছে। কেননা প্রতিনিধি মর্যাদার স্বাভাবিক দাবীর তাগিদেই শাসকের প্রতিনিধির নীতি শাসকের নীতি থেকে এবং শাসকের প্রতিনিধির নৈতিকবৃত্তি শাসকের নৈতিকবৃত্তির থেকে ভিন্নতর হবে না। এছাড়াও এ ধারণা থেকে এও প্রমাণ হয় যে, আল্লাহ তায়ালা মানুষকে যেসব শক্তি দান করেছেন এবং দুনিয়ায় তাকে যেসব উপায়-উপকরণ দিয়েছেন, সেসব ব্যবহার করার এবং আল্লাহর ইচ্ছানুসারে ব্যবহার করার জন্যেই তিনি মানুষকে নিযুক্ত করেছেন। অন্য কথায় বলা যায় যে, মাসকের প্রতিনিধি শাসকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার মালিকানা ও রক্ষক স্বত্বকে ব্যবহার করেছে সে মহা অপরাধী এবং সে প্রতিনিধিও মহা অপরাধী গণ্য হবে যে, শাসক প্রদত্ত ক্ষমতাবলীর মধ্যে কোন একটি ক্ষমতাকেও ব্যবহার করেনি বরং তিনি যেসব ক্ষমতা দান করেছেন তার মধ্য থেকে কোন কোন ক্ষমতাকে অনর্থক নষ্ট করেছে, তার উপায়-উপাদানের সাহায্যে কাজ নেবার ক্ষেত্রে জেনে বুঝে ত্রুটি-বিচ্যুতি করেছে সে কর্তব্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে যা পালন করার হুকুম শাসক তাকে দিয়েছিল। আবার এ ধারণার অবশ্যম্ভাবী ফল স্বরূপ সমগ্র মানবজাতির সমাজ জবিন এমন কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় যে, সমস্ত মানুষ অর্থাৎ আল্লাহর সকল খলীফা আল্লাহ কর্তৃক তাদের ওপর অর্পিত যাবতীয় কর্তব্য আদায় করার জন্যে পরস্পরের সহযোগী হয়ে যায় এবং সামাজিক ও তমদ্দুনিক ব্যবস্থায় কোন এমন জিনিস সক্রিয় থাকে না যার কারণে একজন মানুষ অন্য মানুষের অথবা একদল মানুষ অন্য একদলের খেলাফতকে কার্যত খতম করে দেয় অথবা তার প্রবর্তনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তবে অবশ্যি শুধু অবস্থায় এটি হতে পারে- যখন একজন বা একদল মানুষ মানুষের কেলাফত থেকে বঞ্চিত হয়ে নিজের আসল শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অপরাধে অপরাধী হয়।
খেলাফতের ধারণা অবশ্যম্ভাবী ফল স্বরূপ মানুষের জন্যে এ নৈতিক পথের উদ্ভব হয়। মানুষের নৈতিক জীবনের উদ্দেশ্য এবং তার যাবতীয় কর্ম ও প্রচেষ্টও। এ ধারণার মাধ্যমে একেবারে অবশ্যম্ভাবীরূপে নির্ধারিত হয়। আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে পৃথিবীতে মানুষের নিযুক্তি স্বতস্ফূর্তভাবে একথাই দাবী করে যে, মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য পৃথিবীতে আল্লাহর ইচ্ছা পূর্ণ করা ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। পৃথিবীর ব্যবস্থাপনার যতটুকুন অংশকে আল্লাহ মানুষের সংগে সম্পর্কযুক্ত করেছেন ততটুকুন অংশে আল্লাহর আইন জারি করা, আল্লাহর ইচ্ছানুসারে শান্তি, সুবিচার ও সংস্কার ব্যবস্থা কায়েম করা ও কায়েম রাখা ঐ ব্যবস্থার মানুষ ও জিন জাতির শয়তানরা যে বিপর্যয় ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে তাকে দাবিয়ে দেয়া ও নির্মূল করা এবং সেসব সৎগুণকে অত্যধিক সম্প্রসারিত করা যেগুলো আল্লাহর প্রিয় এবং যেগুলোর মাধ্যমে বিশ্বজাহানের মালিক আল্লাহ নিজের পৃথিবী ও প্রজা সাধারণকে সুসজ্জিত দেখতে চান- এ উদ্দেশ্যের জন্যেই প্রত্যেকটি মানুষ- সযার মধ্যে আল্লাহর খলীফা হবার অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে- তার যাবতীয় প্রচেষ্টাকে কেন্দ্রীভূত করবে। এ উদ্দেশ্যে শুদু যে কেবল ঐসব উদ্দেশ্যকে অস্বীকার করে, যা বিলাসপ্রিয়, বস্তুবাদী, জাতীয়তাবাদী এবং অন্যান্য বাজে জিনিসের আনুগত্যকারীরা নিজেদের জীবনের জন্যে নির্ধারিত করেছে, তা নয় বরং এটি ঐসব নিরর্থক উদ্দেশ্যকেও জোরেশোরে অস্বীকার করে যা আধ্যাত্মিকতার একটি ভ্রান্ত ধারণার মাধ্যমে ধর্মবাদীদের নির্ধারিত করে রেখেছে। এ উভয় ভ্রান্ত চরম পন্থার মাঝামাঝি খেলাফতে ইলাহিয়ার ধারণা মানুষের সম্মুখে এমন একটি উন্নততর ও পবিত্রতর জীবনোদ্দশ্য সংস্থাপিত করে যা তার সমগ্র শক্তি ও যোগ্যতাকে জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে কার্যকরী করে এবং একটি সৎ সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা ও উন্নতির কাজে তাদেরকে ব্যবহার করে।
মানুষের ণৈতিক চরিত্র গঠনের জন্যে ইসলাম আমাদেরকে যে বুনিয়াদ দিয়েছে, তাহলো এই। ইসলাম কোন একটি জাতির সম্পত্তি নয় বরং সমগ্র মানবজাতি উত্তরাধিকার সূত্রে এক যোগে একে লাভ করেছে এবং সমস্ত মানুষের কল্যাণই এর উদ্দেশ্য। এ জন্যে যে ব্যক্তি নিজের ও মানব জাতির কল্যাণকামী তাকে অবশ্যি চিন্তা করা উচিত যে, মানুষের নৈতিক চরিত্র গঠনের জন্যে ইসলাম আমাদেরকে যে বুনিয়াদগুলো দিয়েছে সেগুলো ভাল, না আধ্যাত্মিকতাবাদী ধর্ম বা দার্শনিক মতবাদগুলো যা দেয় তাই? কারুর মনসায় দেয় যে, নৈতিকতার জন্যে এ বুনিয়াদগুলো নির্ভুলতর, তাহলে এ বুনিয়াদগুলো গ্রহণ করার ক্ষেত্রে তার কোন জাহেলী বিদ্বেষের প্রতিবন্ধখতা সৃষ্টি করা উচিত নয়।
সমাপ্ত