অধ্যায়-৭৪
হাদীস থেকে শরয়ী বিধান উদ্ভাবন পদ্ধতি
উলূমে নববীর শ্রেণীভেদঃ একথা সুস্পষ্ট যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে তা দু’শ্রেণীতে বিভক্ত।
একঃ রিসালাতের প্রচার সংশ্লিষ্ট ব্যাপারসমূহ। সেগুলো সম্পর্কে আল্লাহ পাক বলেনঃ
(আরবী********************************************************************)
অর্থাৎ আর রাসূল তোমাদের যা কিচু প্রদান করে তা গ্রহণ কর এবং যা কিছু বারণ করে তা থেকে বিরত থাক। উপরোক্ত ব্যাপারগুলোর ভেতর পারলৌকিক জ্ঞান ও ঐশী বিস্ময়কর কার্যাবলী অন্তর্ভুক্ত। সব জ্ঞান কেবল ওহীর মাধ্যমেই অর্জিত হয়। শরীআত, ইবাদত পদ্ধতি অতীত ইবাদতের পদ্ধতির সাথে তার সামঞ্জস্য বিধান ও সভ্যতা সংস্কৃংতির রীতিনীতিগুলো তার অন্তর্ভুক্ত। এ সবের কিছু ব্যাপার ওহীর মাধ্যমে পাওয়া গেছে এবং কিছু ব্যাপার ইজতেহাদের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে।
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইজতেহাদ ওহীর স্থলাভিষিক্ত হয়ে থাকে। কারণ, আল্লাহ তাআলা তাঁকে ভ্রান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা থেকে মুক্ত ও পবিত্র রেখেছেন। তাঁর জন্যে এটাও জরুরি নয় যে, তিনি কোনো ঐশীবাণীকে ভিত্তি করে ইজতেহাদ করবেন। কিছু লোক সেটাই ভেবে থাকেন। বরং সাধারণত এটাই হয় যে,
খোদাতাআলা তাঁকে শরীআতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, শরীআতের মৌল বিধানাবলি ও তার প্রয়োগের সহজ পদ্ধতি জানিয়ে দেন এবং তিনি তারই আলোকে ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত ব্যাপারকে বিশ্লেষণ প্রদান ও উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে থাকেন।
উপরোক্ত ব্যাপারগুলোর ভেতর সাধারণত প্রায়োগিক কৌশল ও পরিস্থিতি পরিবেশ বিবেচনাও শামিল রয়েছে। অবস্থাভেদে যে কোনো সময় ব্যবস্থা নেয়া যাবে, কোনো সময় সীমা তাতে নেই। যেমন শিষ্টাচার ও অশিষ্টাচার। সাধারণত তা ইজতেহাদের মাধ্যমে নির্ণয় করতে হয়। আল্লাহ পাক যেহেতু তাঁকে মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির শিক্ষা দান করেছেন, তাই তিনি মাতা খাটিয়ে কোন ব্যাপার কখন শিষ্টাচার আর কখন কোনো ব্যঅপার অশিষ্টাচার বলে বিবেচিত হবে তা তিনি উদ্ভাবন করে বলে দিয়েছেন এবং তার জন্যে কিছু মূলনীতি নির্ধারণ করেছেন।
সে সব ব্যাপারের ভেতর আমলের ফজিলাত ও আলেমদের মর্যাদাও অন্তর্ভুক্ত। আমার ধারণা মতে তার কিছু এসেছে ওহীর মাধ্যমে ও কিছু এসেছে ইজতেহাদের মাধ্যমে। এসব কানুনের আলোচনা আগে করে এসেছি এ শ্রেণীরই আমি বিশ্লেষণ প্রদান ও সবিস্তার আলোচনার ইচ্ছা রাখি।
দুইঃ এ শ্রেণীর ব্যাপারগুলোর সাথে রিসালাতের প্রচার প্রসারের কোনো সম্পর্ক নেই।
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
(আরবী*************************************************************************)
“নিঃসন্দেহে আমি একজন মানুষ। যখন আমি তোমাদের দ্বীনের ব্যাপারে কোনো নির্দেশ দেই, তা গ্রহণ কর। আর যখন আমি নিজের তরফ থেকে তোমাদের কোনো কথা বলি, তখন তা একজন মানুষ হিসেবেই বলি।
খেজুরের ফলন বৃদ্ধির জন্যে পুরুষ গাছ ও নারী গাছ জুড়ে দেয়ার ব্যাপারে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর পরামর্শ সম্পর্কে বলেনঃ সেটা ছিল আমার ব্যক্তিগত ধারণামাত্র। তোমাদের সে ধারণা অনুসরণ জরুরী নয়। তবে আল্লাহর তরফ থেকে যখন কিছু বলি তখন তা মেনে চল। কারণ, আল্লাহর ব্যাপারে আমি কখনো ভুল বলি না”।
এ শ্রেণীর কার্যাবলীর ভেতর চিকিৎসা বিজ্ঞান অন্যতম। এ ব্যাপারে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি বর্ণনায় রয়েছেঃ “যে কালো ঘোড়ার কপাল সাদা তা অবশ্যই রাখবে”। তাঁর এ নির্দেশের সনদ বা দলীল হলো অভিজ্ঞতা।
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবাদত হিসেবে নয় বরং অভ্যেস বশত যা করতেন তাও এর অন্তর্ভুক্ত। তাও আবার তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে করেন না, মাঝে মাঝে ঘটনাচক্রে করে থাকেন।
এ শ্রেণীর ব্যাপারগুলোর ভেতর হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সঙ্গী ও পাড়াপড়শীর সাথে যে সব আলাপ আলোচনা করতেন সেগুলো অন্তর্ভুক্ত। যেমন উম্মে যুরআর হাদীস ও খুজাফার হাদীস। হযরত যায়েদ ইবনে ছাবিত (রাঃ) এ কথাই বলেন। যখন তার কাছে কতিপয় লোক এসে বলতে লাগল, আমাদেরকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস শুনান। তখন তিনি বললেনঃ আমি হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পড়শী ছিলাম। যখন তাঁর ওপর কোনো ওহী নাযিল হতো, তখন তিনি আমাকে ডাকতেন। আমি এসে তাঁকে ওহীটি লিখে দিতাম। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অভ্যেস ছিল, যখন আমরা পার্থিব কোনো ব্যাপার আলোচনা করতাম, তখন তিনিও আমাদের সাথে সে আলোচনায় যোগ দিতেন। যখন আমরা পারলৌকিক ব্যাপারে আলোচনা করতাম, তিনিও আমাদের সাথে সে ব্যাপারেই কথা বলতেন। যখন আমরা খানাপিনার আলোচনা উঠাতাম, তিনিও তাতে অংশ নিতেন। আমি তাই হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এর সবগুলোই বর্ণনা করব।
এ শ্রেণীর ভেতরে সে ব্যাপারও রয়েছে যা হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাময়িক কোনো উদ্দেশ্য অর্জনের জন্যে ফলপ্রসূ উপায় ভেবে করেছেন। তার উদাহরণ হচ্ছে এই –“যেমন কোনো বাদশাহ তার সৈন্য সারিবদ্ধ করলেন। তার জন্যে তিনি কোনো চিহ্ন বা নিশানা নির্ধারণ করলেন। হযরত উমর ফারুক (রাঃ) তাই বললেন –‘তাওয়াফে আমাদের রমল করার কি দরকার? আমরা তো এটা তাদের দেখাতাম, আল্লাহ যাদের ধ্বংস করেছেন’। তাই তিনি ভয় করতেন যে, এটা করা আবার সেরূপ অবস্থা সৃষ্টির কারণ না হয় যখন আবার এটা জরুরী হয়ে যায়।
মূলত বেশ কিছু বিধান এ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। যেমন হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন –‘যে ব্যক্তি (জেহাদে) কাউকে হত্যা করল, সে তার আসবাবপত্রের মালিক বিধায় সেই তা নেবে’।
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সব সালিসি মীমাংসা করতেন তাও এ শ্রেণীভুক্ত। তাতে তিনি সাক্ষী ও শপথের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী (রাঃ)-কে বললেনঃ “উপস্থিত ব্যক্তি যা দেখে অনুপস্থিত ব্যক্তি তা দেখে না”।
অধ্যায়-৭৫
মুসলেহাত ও শরীআতের পার্থক্য
জেনে নিন, শরীআত প্রণেতা আমাদের দু’ধরনের শিক্ষাগত কল্যাণ দান করেছেন যার বিধি-বিধান ও মর্যাদা ভিন্ন ভিন্ন। তার ভেতর একটি শ্রেণী হলো সেই শিক্ষা যা প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রিত ও সুশোভিত করে। মানে, তা হচ্ছে ফ্যাসাদ নির্ণয় ও তা সংশোধনের শিক্ষা। আর তার এভাবে বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে যাতে দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণ অর্জনের চরিত্র সৃষ্টি হয়। সে ক্ষেত্রে নিন্দনীয় স্বভাব দূর করা চাই।
মূলত পারিবারিক ব্যবস্থাপনা, সামাজিক নিয়মনীতি ও রাষ্ট্রীয় বিধি-বিধান সম্পর্কে শরীআত প্রণেতা কোনো ধরাবাঁধা হুকুম-আহকাম বিন্যস্ত করে যাননি। তিনি কোনো অস্পষ্ট কিংবা সন্দিগ্ধ ব্যাপার চিহ্নিতকরণ বা উদঘাটনের কোনো বিধিবদ্ধ নিয়ম নির্ধারিত করেননি। বরং প্রশংসনীয় কাজগুলো করতে বলেছেন ও নিন্দনীয় কাজ থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। এমনকি তিনি এ সম্পর্কে যা কিছু বলে গেছেন তার তাৎপর্য অনুধাবনের ব্যাপারটি নিজ ভাষাভাষীর ওপর ন্যস্ত করে গেছেন। কোনটি করা হবে আর কোনটি করা হবে না তার চিহ্নিতকরণ কাজটি পরিবেশ পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল করে গেছেন। যেমন তিনি বিজ্ঞতা ও বীরত্বের প্রশংসা করেছেন। তা ছাড়া নম্রতা, প্রীতি ও মধ্যপন্থা অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন। এক্ষণে বিজ্ঞতার সীমারেখা কি এবং কিরূপ বিজ্ঞতা প্রশংসনীয় আর কোন ক্ষেত্রে তার কি ধরনের প্রয়োগের জন্যে বিজ্ঞরা জবাবদিহি হবেন তা সবিস্তার ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। এরূপ ক্ষেত্রেই মুসলেহাত তথা কল্যাণের পথ অনুসৃত হয়।
শরীআত আমাদের যে মুসলেহাত বা কল্যাণকর পন্থার জন্যে উৎসাহ জুগিয়েছে এবং অকল্যাণকর পথ থেকে বিরত রেখেছে তা নিচের তিনটি মূলনীতির যেকোনো একটির সাথে সংশ্লিষ্ট।
১। আখেরাতের কল্যাণদায়ক স্বভাবের মাধ্যমে আত্মাকে পরিমার্জিত করা কিংবা পার্থিব কল্যাণ অর্জনের যাবতীয় স্বভাবের মাধ্যমে আত্মাকে পরিশীলিত করা।
২। সত্য বাণীকে উচ্চাসনে প্রতিষ্ঠিত করা, শরীআতকে সুদৃঢ় ভিত্তিতে কায়েম করা এবং তা প্রচার ও প্রসারের জন্যে আপ্রাণ সংগ্রাম করা।
৩। জনগণের অবস্থার বিন্যাস ঘটানো, তাদের কাজ-কারবার ঠিকঠাক রাখা ও তাদের রীতিনীতি সংশোধিত ও সুশোভিত কর।
কল্যাণ ও অকল্যাণ উপরোক্ত তিনটি মূলনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার তাৎপর্য এই যে, যেকোনো ব্যঅপার তা হ্যাঁবাচক হোক বা না বাচক হোক, সে তিনটির কোনো না কোনোটির অন্তর্ভুক্ত। মানে, সে ব্যাপারটি কল্যাণকর স্ববাবের হবে অথবা অকল্যাণ স্বভাবের হবে। কিংবা সে দুটোর যে কোনো একটির অপরিহার্য অঙ্গ হবে। অথবা তার যে কোনো একটির পক্ষে বা বিপক্ষের কারণ হবে।
মূলত কল্যাণধর্মী কাজের সাথে আল্লাহর সন্তুষ্টি জড়িত থাকে। তেমনি অকল্যাণকর কাজের সাথে থাকে আল্লাহর অসন্তুষ্টি। হোক সে কাজ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আগমনের আগের কিংবা পরের। ব্যাপার একই। যদি সে দু’ধরনের স্বভাব ও কাজের সাথে আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টি জড়িত না থাকত, তা হলে রাসূল পাঠানোই প্রয়োজন হতো না। তাই দেখা যায়, রাসূলগণ এসেই কল্যাণ-অকল্যাণ ও ভালো-মন্দের বিধি-বিধান ও সীমারেখা প্রণয়ন করেছেন।
বস্তুত, প্রাথমিক পর্যায়েই লোকদের সেসব ব্যাপারে দায়ভার প্রদান ও তার জন্যে জবাবদিহি করা আল্লাহ পাকের কৃপাদৃষ্টির পরিপন্থী ছিল। অবশ্য কল্যাণ-অকল্যাণের ব্যাপার, আত্মশুদ্ধি কিংবা বিকৃতি, জনগণের অবস্থার তথা লেন-দেন ও আচার-আচরণের নিয়ন্ত্রণ বা অনিয়ন্ত্রণ নবীদের আগমনের পূর্বেও মানব সমাজে প্রভাব ফেলত।
তাই খোদার মেহেরবানীর এটাই দাবি হয়ে দাঁড়ায় যে, লোকদের এসব ক্ষেত্রে জরুরী ব্যাপারগুলো বদলে দিয়ে তাদের কাঁধে তা প্রতিপালনের দায়-দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া আর সেটা তখনই হতে পারে যখন সেগুলোর সীমারেখা ও বিধি-বিধান নির্ধারণ হয়। তাই আল্লাহ পাকের অনুগ্রহ পরোক্ষভাবে সেই রূপরেখা ও বিধি-নিষেধ চালু করার ইচ্ছা করলেন। বস্তুত এ ব্যাপারটি যুক্তিযুক্তও বটে।
সেগুলোর ভেতর এমন কিছু কিছু ব্যাপার রয়েছে যা সাধারণ বুদ্ধিতেই বুঝা যায়। আবার বেশ কিছু এমন ব্যাপারও রয়েছে, যা কেবল প্রখর বুদ্ধি সম্পন্ন যে সব লোকের অন্তরে নবীদের নূর বর্ষিত হয় তারাই বুঝতে পায়। শরীআত তাদের সতর্ক করারসাথে সাথেই সতর্ক হয়ে গেছে। তারা ইঙ্গিতমাত্রেই ব্যাপার বুঝে গেছে। যে ব্যক্তি আমাদের পূর্বালোচিত নীতি কটি ভালোভাবে আয়ত্ত করেছে, তারসে সবের কোনোটির ব্যাপারেই দ্বিধা থাকবে না।
ইলমে নববীর দ্বিতীয় শ্রেণীটি হচ্ছে শরীআত, হদুদ ও ফরায়েজের ইলম। মানে, শরীআত যে বিধি-বিধান ও সীমারেখা বর্ণনা করেছে তা জানা। বস্তুত মুসলেহাতের জন্যে কিছু স্থান, নীতি-নিয়ম ও জ্ঞাত নিদর্শনাবলি নির্ধারণ করা হয়েছে। সেগুলোর ভিত্তিতেই হুকুম দেয়া হবে। আর সেগুলো প্যালনের দায়িত্বই লোকদের উপর বর্তাবে। সেগুলোর অবয়ব, শর্তাবলি ও নিয়মনীতি নির্ধারণের ওপরই পাপ-পুণ্যের স্তর বিন্যস্ত হয়েছে। প্রত্যেকটি শ্রেণীর একটি সীমারেখা নির্ধারিত হয়েছে। সকলের জন্যে তা অবশ্য অনুসরণীয়। অপর একটি সীমা এরূপ নির্ধারিত হয়েছে যা অনুসরণ করা ওয়াজিব নয়, তবে মুস্তাহাব। তেমনি পুণ্যেরও একটি সংখ্যা ওয়াজিব করা হয়েছে ও অপর একটি সংখ্যা মুস্তাহাব করা হয়েছে।
বস্তুত, দায়-দায়িত্ব বর্তানোর ব্যাপারটি যেরূপ উপরোক্ত পটভূমি ও কার্যকারণের ওপর নির্ভরশীল, তেমনি উক্ত নিদর্শনাবলিই বিধি-বিধানের ভিত্তি। উক্ত শ্রেণীর লক্ষ্যবস্তু মূলত মিল্লাতের রাজনৈতিক আইন-কানুন প্রণয়ন। বলা বাহুল্য, মুসলেহাতের প্রতিটি আনুমানিক বা ইজতেহাদী ব্যবস্থাপনা জনগণের জন্যে অবশ্য পালনীয় নয়; বরং সেই ইজতেহাদী বিধান তাদের জন্যে অপরিহার্য যার কাজটি উপলব্ধিযোগ্য ও বিধিবদ্ধ কিংবা যার গুণাগুণ প্রকাশ্য ও সুস্পষ্ট। প্রতিটি সাধারণ ও বিশিষ্টজন যেন সে সম্পর্কে অবহিত থাকে।
অনেক সময় ওয়াজিব ও হারাম হওয়ার সাময়িক কারণ দেখা দেয়। যে কারণ, সর্বোচ্চ পরিষদে তা ওয়াজিব বা হারাম বলে লিপিবদ্ধ হয়। যেমন কারো প্রশ্ন তোলা এবং জনগণের সেদিকে আকৃষ্ট হওয়া কিংবা তা থেকে মুখ ফেরানো। এগুলো যুক্তিগ্রাহ্য কোনো অর্থ হয় না। মানে, যদিও শরীআত ও তার বিধানের সীমারেখা আমরা জানি, কিন্তু তার সর্বোচ্চ পরিষদে লিপিবদ্ধ হওয়া ও পবিত্র মজলিসে তার নকশা চিত্রিত হওয়া শুধু শরীআতের দলীল দ্বারাই আমরা জানতে পাই। কারণ এটা এমন ব্যাপারের অন্তর্ভুক্ত যা বুঝার উপায়ই হচ্ছে আল্লাহ পাকের জানিয়ে দেয়া। তার উদাহরণ হচ্ছে বরফ। আমরা জানি প্রচণ্ড ঠাণ্ডার কারণে বরফ জমে। কিন্তু আমরা জানিনা অমুক পাত্রের পানি জমল কিনা। কারণ, তা স্বচক্ষে না দেখে কিংবা কেউ দেখে এসে না বলে দিলে তা বলা যায় না।
এ কেয়াসের ভিত্তিতেই আমরা জানতে পাই, যাকাতের একটা নেসাব হওয়া জরুরী। আমরা এও জানি, দু’শ দিরহাম ও পাঁচ ওসাক শস্য বা ফল একটি যথোপযুক্ত পরিমাণ। কারণ, এ উদ্ধৃত্ত ধন-সম্পদ ধনী হওয়ার জন্যে যথেষ্ট। জাতির কাছেও এ দুটো দ্রব্য ব্যবহৃত ও বিধিসম্মত। অথচ আমরা জানিনা আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্যে এ নেসাবই নির্ধারণ ও অপরিহার্য করেছেন কিনা? তিনি এর ভিত্তিতেই তাঁর সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টি বিবেচনা করবেন কিনা তাও আমাদের জানা নেই। সে ব্যাপারটি আমরা শুধু শরয়ী দলীলের মাধ্যমেই জানতে পারি। এভাবের আরও কয়েকটি ব্যাপার রয়েছে যা ওহী বা হাদীস ছাড়া আমরা জানতে পারি না। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মুসলমানদের ভেতর সব চাইতে বড় অপরাধী সেই ব্যক্তি ….. ইত্যাদি। অন্যত্র তিনি বলেন, আমার ভয় হয়, এটা আবার তোমাদের উপর ফরজ না হয়ে যায়।
বহু সংখ্যক নির্ভরযোগ্য আলেম এ ব্যাপারে একমত যে, পরিমাণ নির্ধারণেল ব্যাপারগুলোয় কেয়াস চলে না। তা ছাড়া এ ব্যাপারেও তারা একমত যে, কিয়াসের মূল কথা হচ্ছে, কোনো মিশ্র কারণের ভিত্তিতেই মূলের হুকুমটি শাখা-প্রশাখায় স্থানান্তরিত করা। তার অর্থ এ নয় যে, কোনো মুসলেহাতের চিন্তাকে তার কারণ বানানো হবে কিংবা কোনো উপযোগী বস্তু পেলেই সেটাকে উদ্দিষ্ট অংশ বা শর্ত বানানো হবে। এ ব্যাপারেও তারা একমত যে, কেয়াস কোনো মুসলেহাতকে বিবেচনায় আনে না। বরং এমন কারণ বিবেচনায় রাখে যার ওপর বিধানটি নির্ভরশীল হয়। এ কারণেই রুগ্ন ও অন্য কোনো কারণে অপরাগ মুকীমের নামাযের প্রশ্নে মুসাফিরের প্রাপ্ত সুযোগের ওপর কেয়াস করা চলে না। কারণ তার প্রতিবন্ধকতার জন্যে তাকে সময় দেয়া মুসলেহাতের দাবি হতে পারে বটে, সেটা কসর পড়া বা রোযা ভঙ্গ করার কারণ হতে পারেনা। সে দুটোর জন্যে সফরই একমাত্র কারণ।
এ সব প্রশ্নে মোটামুটিভাবে আলেমদের কোনো মতভেদ নেই। অবশ্য এ সবের শাখা-প্রশাখায় গিয়ে কোথাও হয়ত মতভেদ দেখা দিয়েছে। তার কারণ এই যে, মুসলেহাত কখনো কার্য-কারণের অনুরূপ হয়ে ধরা দেয়। কিছু ফিকাহবিদ যখন কিয়াস নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা করলেন তো হতভম্ব হয়ে পথচ্যুত হলেন। তারা কোনো একটি পরিমাণের মানদণ্ড হাতে নিলেন। কিন্তু তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বস্তুর বিনিময়কে ভ্রান্ত ভাবলেন। তেমনি কিছু বস্তুর ক্ষেত্রে তাদের দৃষ্টিভ্রম ঘটায় অন্য বস্তু তার স্থলাভিষিক্ত করলেন।
তার উদাহরণ হলো এই, তারা তুলার পরিমাণ নির্ধারণ করেন পাঁচ গাঠুরী। নৌকারোহীর মাথা ঘুরায়। এই মাথা ঘুরানোকে কারণ স্থির করে তারা বসে নামায পড়া বৈধ বলেন। পানির পবিত্রতা অক্ষুণ্ন থাকার জন্য তারা দশের ভেতর দশের মানদণ্ড কায়েম করলেন। শরীআত যখনই কোনো ব্যাপারে মুসলেহাতকে বিবেচনায় এনেছে, আমরা অন্য ব্যাপারেও মুসলেহাত দেখতে পেয়ে ভেবেছি, আল্লাহর সন্তুষ্টি এই মুসলেহাতের সাথে রয়েছে, শরীআত নির্দেশিত বিশেষ ব্যাপারটির সাথে নয়। অথচ শরীআত নির্দেশিত পরিমিতি ও মানদণ্ডের সাথেই আল্লাহর সন্তুষ্টির সম্পর্ক।
উক্ত বক্তব্যের বিশ্লেষণ হলো এই, যে ব্যক্তি কোনো ওয়াক্তের নামায ছেড়ে দিলে সে গুনাহগার হবে। হোক সে সেই সময় জিকির-আজকার বা অন্যান্য ইবাদতে ব্যস্ত থাক। তেমনি যে ব্যক্তি ফরজ যাকাত আদায় না করে ভালো ভালো নেক কাজে তার সব সম্পদ উজাড় করল, সেও গুনাহগর হবে। তেমনি যে ব্যক্তি এরূপ গোপনে রেশমি কাপড় ব্যবহার করল যা গরিব লোকদের মন ভাঙার কারণ হয়নি, না পার্থিব সম্পদ জমানোর জন্যে তা অন্যকে উৎসাহিত করেছে, আর না সে পোশাক সে বিলাসিতার জন্যে ব্যবহার করেছে, তথাপি সে গুনাহগার হবে। তেমনি যে ব্যক্তি ওষুধের নিয়ত করে শরাব পান করল এবং তাতে তার মাতলামীও দেখা দিল না, এমনকি তার নামাযও তরক হলো না, তথাপি সে গুনাহগার হবে। কারণ, আল্লাহর অনুমোদন ও অননুমোদন বস্তুর সাথে জড়িত, কারণগুলোর সাথে নয়। যদিও মূল উদ্দেশ্য থাকে লোকদের ফাসাদ থেকে মুক্ত রাখা ও কল্যাণের পথে উৎসাহিত করা, কিন্তু আল্লাহ পাক জানেন, উম্মতের নিয়ম শৃঙ্খলা রক্ষার্থে বস্তু বিশেষকেই ওয়াজিব বা হারাম করা সময়ের দাবি। সে মতে অনুমোদন ও অননুমোদনের ব্যাপারটি বস্তুগেলার সাথেই সংশ্লিষ্ট রয়েছে এবং সর্বোচ্চ পরিষদে সেটাই লিপিবদ্ধ হয়েছে। পক্ষান্তরে কেউ যদি উঁচুমানের পশমি পোশাক পরিধান করে যা রেশমি বস্ত্রের চেয়েও উন্নত ও দামি তাতে গুনাহ নেই। তবে যদি তা দেখে অভাবী ও দরিদ্রের মনঃকষ্ট দেখা দেয় কিংবা অন্যলোক তা করার জন্যে উৎসাহিত হয় অথবা বিলাসিতাই যদি তার উদ্দেশ হয়, তা হলে সেই সব কারণে তার গুনাহ হবে, অন্যথায় নয়।
আপনি যেখানেই সাহাবায়ে কেরামকে কিংবা তাবেঈনদের পারিমাপকে ভিত্তি নির্ধারণ করতে দেখবেন, সেখানে তাদের লক্ষ্য হলো মুসলেহাত বর্ণনা করা ও তার জন্যে উৎসাহিত করা। অথবা তার অকল্যাণ বর্ণনা করে তা থেকে সতর্ক করা। সেটা তারা নিছক উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছেন। সেটা তাদের লক্ষ্যবস্তু নয়, লক্ষ্য বস্তু হলো যার পরিমাপ বলা হলো সেই বস্তুটি। বাহ্য দৃষ্টিতে তা ধরা পড়ুক বা নাই পড়ুক।
তবে শরীআত যেখানে পরিমাপ নির্ধারণ করে তার বিনিময় গ্রহণের অনুমতি দিয়েছে, যেমন ‘বিন্তে মাখাস’কে পূর্ণদেহী জন্তুর সাথে আন্দাজ করে বিনিময় নির্ধারণের সমর্থন জানিয়েছে, সেটাও তো পরিমাপকে মানদণ্ড বা ভিত্তি বানানোর শামিল। সেক্ষেত্রেও কথা হচ্ছে, অনুমান-আন্দাজ কখনো যথাযথ ও পূর্ণ হয় না এবং তাতেও সমস্যা সৃষ্টি হয়। অনেক সময় এমন কিছুর সাথে আন্দাজ করা হয় যার সাথে অনেক কিছুই সংশ্লিষ্ট। উদাহরণ স্বরূপ বিন্তে মাখাসকেই ধরুন। একটি বিন্তে মাখাস অপর একটি বিন্তে মাখাস থেকে উত্তম। তাই একটির ভিত্তিতে বিধান দেয়া যায় না। কখনোমূল্যের সাথে আন্দাজ লাগানো সামগ্রিকভাবে কোনো জ্ঞান সীমারেখার সাথে হতে পারে। যেমন হাত কাটার জন্যে চোরাই মালের নেসাবের আন্দাজ ঠিক করা হয় তিন দিরহাম বা এক-চতুর্থাংশ দীনার মূল্যের ভিত্তিতে।
মনে রাখা দরকার যে, কোনো কিছু ওয়াজিব হওয়া হারাম হওয়া মূলত পরিমাপ নির্ধারণের দুটি শ্রেণী। তার কারণ, কখনো কোনো কল্যাণ বা অকল্যাণের কয়েকটি রূপ হতে পারে। পক্ষান্তরে ওয়াজিব হওয়া বা হারাম হওয়ার নির্দিষ্ট একটি রূপ রয়েছে। কারণ এ দুটো বিধিবদ্ধ হওয়ার ব্যাপারগুলোর অন্তর্ভুক্ত। কিংবা তার অবস্থা পূর্বেকার দ্বীনগুলোয় জানা যায়। অথবা সে ব্যাপারে প্রচুর আগ্রহ বিদ্যমান। এ কারণেই হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তারাবীহর নামাযের ব্যাপারে এ ওজর পেশ করলেন যে, আমারভয় হয়, তোমাদের ওপর এ নামায ফরজ না করা হয়। তেমনি তিনি বলেছেন –যদি আমি আমার উম্মতের জন্যে কষ্টকর না ভাবতাম তাহলে প্রত্যেক নামাযের আগে তাদের মিসওয়াক করতে বলতাম।
ঘটনা যখন এই, তখন যে ব্যাপারে সরাসরি কুরআন-হাদীসের দলীল নেই তার সাথে যে ব্যাপারের বিধানের সমর্থনে দলীল রয়েছে তার কোনো কেয়াস চলে না। অবশ্য মুস্তাহাব বা মাকরূহর ব্যাপারে প্রশস্ততা রয়েছে। তবে শরীআত প্রণেতা যে মুস্তহাব পালনের নির্দেশ দিয়েছেন ও তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন এবং লোকদের জন্যে সেটাকে সুন্নাতরূপে নির্ধারণ করেছেন, তার অবস্থা ওয়াজিবের পর্যায়েরই। পক্ষান্তরে তিনি যে মুস্তাহাব বা পছন্দনীয় এবং অপরের জন্যে তা সুন্নাতও করে যাননি, তার অবস্থা শরীআতের পূর্ণাবস্থার মতোই হবে। সেক্ষেত্রে ছাওয়াব শুধু সে কাজের সৃষ্ট কল্যাণের জন্যে মিলবে, কাজটির জন্যে নয়। মাকরূহ বা অপছন্দনীয় কাজের বিশ্লেষণও অনুরূপ হবে।
উপরোক্ত পর্যালোচনাসমূহ যখন সন্দেহাতীতভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো, তখন আপনাদের সামনে এটা সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, কেয়াস নিয়ে বড়াই করা হচ্ছে এবং যা নিয়ে মুহাদ্দেসীনদের পর্যন্ত করুণার পাত্র ভাবা হচ্ছে, তার অধিকাংশই তাদের জন্যে যে বিপদ হয়ে দেখা দেবে তার খবরও তাদের নেই।
অধ্যায়-৭৬
উম্মতে মুহাম্মদীর শরীআত অর্জনের পন্থা
মনে রাখতে হবে, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শরীআত লাভের দুটো পদ্ধতি রয়েছে।
১। একটি পদ্ধতি হলো তাঁর প্রকাশ্য বক্তব্য থেকে শরীআত আহরণ করা। তার জন্যে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী উদ্ধৃত করা জরুরী। হোক সে রেওয়ায়েতে মুতাওয়াতের কিংবা গায়রে মুতাওয়াতের। মুতাওয়াতের বর্ণনার একটি শ্রেণী হলো যার শব্দার্থগুলোও সবাই একইভাবে বর্ণনা করেছেন।
যেমন, কুরআনের বাণী ও কতিপর্য হাদীস। এ শ্রেণীর একটি হাদীস এইঃ
(আরবী******************************************************************)
অর্থাৎ শীঘ্রই তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের সাথে দেখা করবে।
মুতাওয়াতের বর্ণনার অপর শ্রেণী হলো যার শব্দে তারতম্য হলেও সবাই একটি তাৎপর্যের বর্ণনা প্রদান করেছেন। যেমন তাহারাত, সালাত, সাওম, যাকাত, হজ্ব, ক্রয়-বিক্রয়, বিয়ে-শাদি, যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদি সম্পর্কিত বর্ণনাসমূহ। এ সবের অধিকাংশ বিধানের ক্ষেত্রেই ইসলামী ফেরকাগুলোর কোনো মতানৈক্য নেই।
গায়রে মুতাওয়াতের রেওয়ায়েতের ভেতর সর্বোচ্চ মর্যাদা হলো মুস্তাফীজ রেওয়ায়েতের। যে বর্ণনাটি তিন কিংবা তৎ-অধিক সাহাবী থেকে পাওয়া গেছে সেটাই হচ্ছে মুস্তাফীজ বর্ণনা। পর্যায়ক্রমে পঞ্চম স্তর পর্যন্ত এর বর্ণনাকারী বেড়েই চলেছে। এ ধরনের হাদীসের সংখ্যা অনেক। ফেকাহ শাস্ত্রের অনেক বড় বড় মাসাআলার ভিত্তি হলো এ সব হাদীস।
এর পরের স্থান হলো সে সব হাদীসের যেগুলোকে হাদীসের হাফেজ ও হাদীস বিশারদ আলেমরা সহীহ ও হাসান বলেছেন। অতঃপর সে সব হাদীসের স্থান যেগুলোর বিশুদ্ধতার ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। মানে, একদল মুহাদ্দিস বিশুদ্ধ বলেছেন ও অন্যদল বিশুদ্ধ বলেননি। এ শ্রেণীর হাদীসগুলোর যে সবের পর্যাপ্ত সাক্ষ্য কিংবা অধিকাংশ আলেমের সমর্থন অথবা বক্তব্যের সুস্পষ্টতার কারণে শক্তি বৃদ্ধি হয়েছে, সেগুলোর ওপর আমল করা ওয়াজিব।
২। শরীআতের বিধান আহরণের দ্বিতীয় পন্থা হলো দালালাতে হাদীস। তা হচ্ছে এই, সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কিছু বলতে বা করতে দেখলেন। তা থেকে তারা কোনো কাজকে ওয়াজিব বা অন্য কিছু বলে উদ্ভাবন করলেন। তারপর লোকদের জানিয়ে দিলেন অমুক কাজ ওয়াজিব ও অমুক কাজ জায়েয ইত্যাদি। পরবর্তী স্তরে তাবেঈনরা তা থেকেই বিধি-বিধানের বিন্যাস ঘটান। তৃতীয় স্তরে তাবে তাবেঈনদের হাতে তা ফতোয়া ও বিচার বিধিরূপে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
এ পদ্ধতিতে শরীআতের বিধানাবলি যারা আহরণ করেছেন তারা হলেন হযরত উমর, হযরত আলী, হযরত ইবনে মাসউদ, ও হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)।হযরত উমর (রাঃ)-এর অভ্যেস এটাই ছিল যে, তিনি যেকোনো ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের সাথে মতবিনিময় করতেন। যতক্ষণ তিনি সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ আশ্বস্ত হতেন তখন তা চালু করতেন। এ কারণেই তাঁর সিদ্ধান্ত ও ফতোয়া পৃথিবীর সর্বত্র নির্দ্বিধায় সমাদৃত ও অনুসৃহ হচ্ছে। তাঁর ইন্তেকালের খবর পেয়ে ইবরাহীম (রহঃ) বললেন, ইলমের নয়-দশমাংশ বিদায় নিলেন।
হযরত ইবনে মাসউদ (রা) বলেনঃ যখন আমরা হযরত উমর (রাঃ)-এর মাসআলাকে শুনি তখন আরাম পাই। হযরত আলী (রাঃ) সাধারণত পরামর্শ করতেন না। তাঁর বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত ও ফতোয়া কুফায় প্রদত্ত হয়। অবশ্য তা খুব কম লোকই গ্রহণ করেছেন।
হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) কুফায় ছিলেন। তাই তাঁর সিদ্ধান্ত ও ফতোয়া সে এলাকায় চালু ছিল। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) তাদের পরে ইজতেহাদ শুরু করেন। ফলে বেশ কিছু মাসআলায় তিনি পূর্ববর্তীদের সাথে একমত হননি। মক্কাবাসীদের একদল তাঁর অনুবর্তী হন। তবে অধিকাংশ মুসলমান তাঁর ব্যক্তিগত মতকে গুরুত্ব দেননি।
উপরোক্ত চারজন ছাড়া অন্যান্য সাহাবারাও দালালাতে হাদীস সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। কিন্তু তারা তা থেকে মাসআলা আহরণের শর্ত, রুকন, রীতি ও পদ্ধতির পার্থক্য জানতেন না। তারা পরস্পর বিরোধী বর্ণনা ও দলীল আদিল্লার ব্যাপারে কিছু বলতে ও করতে সাহসী হতেন। হযরত ইবনে উমর, হযরত আয়েশা, হযরত যায়েদ ইবনে ছাবেত (রাঃ) প্রমুখ এ স্তরে রয়েছেন।
তাবেঈনদের ভেতর এ পদ্ধতিতে শরীআতের বিধান আহরণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হলেন মদীনার সাত ফকীহ। বিশেষত মদীনায় ইবনে মুসাইয়াব, মক্কায় আতা ইবনে আবু রুবাহ, কুফায় ইবরাহীম নাখঈ, শুরায়েহ, সা’বী ও বসরায় হাসান (রহঃ) অবস্থান করতেন।
বলা বাহুল্য, শরীআতের বিধিবিধান উদ্ভাবনের যে দুটো পদ্ধতি বলা হলো তার ভেতরকার যে ব্যবধান বিদ্যমান তা ঘুচাবার উপায় হলো পরস্পর সম্পূরক হওয়া। এর কোনো পদ্ধতিই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয় বরং একটি অপরটির সহায়ক।
পয়লা পদ্ধতি অর্থাৎ সরাসরি কুরআন-হাদিসের আয়াত ও বাণী থেকে বিধান আহরণের ক্ষেত্রে এ ক্ষতির আশংকা থাকে যে, তার যে তাৎপর্য নেয়া হয় তা যথাযথ নাও হতে পারে। পটভূমির প্রেক্ষাপটে তাৎপর্য ভিন্নতর হতে পারে। দ্বিতীয় শংকা এই যে, বিশেষ এক ঘটনার প্রেক্ষিতে প্রদত্ত বক্তব্যকে সকল ক্ষেত্রের জন্যে সামগ্রিক বিধান হিসেবেই বর্ণনাকরী গ্রহণ করে থাকেন। তৃতীয় ক্ষতির আশংকা এই যে, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো একটি পছন্দনীয় কাজ যাতে সবাই করে তার জন্যে জোর দিয়ে হয়ত কোনো বক্তব্য রাখলেন। অথচ বর্ণনাকারী সেটাকে ওয়াজিব ভাবলেন ও তা বর্জনকে হারাম বলে দিলেন। অথচ ব্যাপারটি কার্যত তা নয়। বস্তুত, সে লোক ফকীহ এবং ঘটনার সময় উপস্থিত থাকেন, তিনিই কেবল ঘটনার সব কার্যকারণ বিশ্লেষণ করে মূল অবস্থাটি অনুধাবন করে থাকেন। যেমন মুযাবআতের ক্ষেত্রে ফল পাকার আগে আগাম বেচা-কেনা সম্পর্কে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বক্তব্যকে হযরত যায়েদ (রাঃ) বললেনঃ নিষেধ করাটা ছিল নিছক পরামর্শ।
দ্বিতীয় পদ্ধতি অর্থাৎ ইজতেহাদী পদ্ধতিতেও এ ক্ষতির আশংকা থাকে যে, তার ভেতর কুরআন-সুন্নাহ থেকে বিধান উদ্ভাবনে সাহাবা ও তাবেঈনদের অনুমান আন্দাজেরও সংযোগ ঘটে। অনেক সময় এমন হয় যে, ইজতেহাদকারীর কাছে প্রয়োজনীয় হাদীসটি পৌঁছেনি অথবা তা পৌঁছলেও গ্রহণযোগ্যভাবে পৌঁছেনি। তাই তিনি হাদীসটি কাজে লাগাননি। অথচ দেখা গেল, তারপর অন্য কোনোসাহাবীর বর্ণনায় ব্যাপারটি সুস্পষ্ট হয়ে গেল। যেমন, ফরজ গোসলের ক্ষেত্রে, তায়াম্মুমের ব্যাপারে হযরত উমর (রাঃ) ও হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর বক্তব্য।
অনেক সময় শীর্ষস্থানীয় সাহাবায়ে কেরাম কোনো সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তি-শৃঙ্খলার জন্যে কোনো একটি কল্যাণপ্রদ নীতির ওপর একমত হয়েছেন। সেখানে আকলী দলীলের ওপরেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে গেছেনঃ
(আরবী**********************************************************************)
অর্থাৎ আমার পরে তোমাদের ওপর আমার সুন্নাত ও খোলাফায়ে রাশেদীনের অনুসৃত নীতি ওয়াজিব করা হলো।
অথচ শরীআতের মূলনীতিতে এ ধরনের মতৈক্যের উল্লেখ নেই। মূলত যে ব্যক্তির বর্ণনা ও তার ব্যবহৃত শব্দাবলি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রয়েছে, তার জন্যে পদস্খলন থেকে বেঁচে থাকা সহজ।
ব্যাপার যখন এই, তখন ফিকাহ শাস্ত্র নিয়ে ধ্যান-গবেষণাকারীদের জন্যে অপরিহার্য হচ্ছে বিধান উদ্ভাবনের উভয় পদ্ধতিকে তৃপ্তি সহকারে পুরোপুরি কাজে লাগানো। সে জন্যে তাদের উভয় মজহাবের ব্যাপারে পুরোপুরি জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে হবে।
জাতির সর্বোত্তম বিধান সেগুলো যার ওপর অধিকাংশ বর্ণনাকারী ও ইলমের ধারক ও বাহকরা মতৈক্যে পৌঁছেছেন এবং সেবিধান উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে উভয় পদ্ধতির সামঞ্জস্য বিধান করা হয়েছে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
অধ্যায়-৭৭
হাদীস গ্রন্থের স্তরবিন্যাস
মনে রাখা দরকার, শরীআত ও তার বিধান জানার জন্যে আমাদের একটি মাধ্যম, আর তা হচ্ছে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বার্তা ও বাণী। তবে অভিজ্ঞতা, সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি, দূরদর্শিতা ইত্যাদির মাধ্যমে কিছু জনকল্যাণমূলক জ্ঞান অর্জিত হতে পারে। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বার্তা পৌঁছাবার একটাই মাধ্যম আর তা হচ্ছে খবরে মুত্তাসিল বা অবিচ্ছিন্ন সনদের বার্তা যা অমুক থেকে অমুক নিয়মে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছে থাকে। হোক তা হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সরাসরি কথা কিংবা কোনো সাহাবীর মাধ্যমে পাওয়া কথা। তাও আবার হওয়া চাই সাহাবা ও তাবেঈনদের একটি দলের থেকে পাওয়া বিশুদ্ধ বর্ণনা। তাও এভাবেই বর্ণনা হতে হবে যে, শরীআত প্রবর্তকের ইঙ্গিত না পেয়ে তার নামে এরূপ দৃঢ়তার সাথে তারা বর্ণনা করতে পারতেন না। এ ধরনের বর্ণনা হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সামান্যরূপে গৃহীত হয়।
আমাদের যুগে সে সব বর্ণনা লাভের একমাত্র উপায় হলো হাদীস সংকলনসমূহ। কারণ, এখন আর এমন কোনো বর্ণনা অবশিষ্ট নেই যা গ্রন্থাকারে সংকলিত হয়নি। তবে হাদীস সংকলনগুলোর কয়েকটি স্তর ও বিভিন্ন মর্যাদা বিন্যস্ত হয়েছে। তাই এ স্তর ও মর্যাদার পার্থক্যগুলো জানা দরকার। যেমন বিগত পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, হাদীসের সর্বোত্তম শ্রেনী হলো মুতাওয়াতের হাদীস। সমগ্র উম্মত তা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ব্যাপারে একমত। দ্বিতীয় স্তরে রয়েছে বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত মুস্তাফীজ হাদীস। কারণ তাতে কোনো নির্ভরযোগ্য সংশয় অবশিষ্ট নেই। যুগের অধিকাংশ ফিকাহবিদ তা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে একমত হয়েছেন। অথবা সে সব হাদীস বিশেষত হারামাইন শরীফের আলিমদের মাঝে সেগুলোর ব্যাপারে কোনো মতভেদ নেই। যেহেতু প্রাথমিক যুগে খোলাফায়ে রাশেদীনের রাজধানী ছিল হারামাইন এবং সব যুগের হাদীসের আলেমগণ সেখানে যাতায়াত করতেন, তাই সেখানকার হাদীসবেত্তা আলেমগণ কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিতে কিংবা সমর্থন করতে পারেন না। অথবা সে সব হাদীস যা এক বিশাল এলাকায় মশহুর ও সুপরিচিত এবং সে এলাকার সব মুসলমান তা মেনে চলছে। আর তা বর্ণিত হয়েছে সাহাবা ও তাবেঈনদের বড় একদল থেকে।
তৃতীয় স্তরে রয়েছে সে সব হাদীস যার সনদ সহীহ কিংবা হাসান এবং হাদীস বিশারদ আলেমগণ তার সপক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন। কিন্তু সে হাদীস এরূপ মাতরুক নয় যে, কেউ তার দিকে ভ্রুক্ষেপ করেননি।
পক্ষান্তরে যে হাদীসের সনদ ও মতন অর্থাৎ সূত্র ও বাক্য মাওজু ও জঈফ হয় কিংবা মাকবুল বা মজহুল হয় বর্ণনাকারী দ্বারা বর্ণিত হয় কিংবা সে যুগের মরুস্তরের পূর্বসূরিগণ সে বর্ণনার বিরুদ্ধে একমত, এ ধরনের বর্ণনা গ্রহণের কোনো উপায় নেই।
সহীহ বা শুদ্ধ সংকলনের অর্থ এই যে, গ্রন্থের সংকলক নিজকে সীমিত রেখেছেন শুধুমাত্র সহীহ ও হাসান হাদীস সংকলনের জন্যে। তিনি মাকলুব, শাজ কোনো হাদীস সংকলিত না করার জন্য সংকল্পবদ্ধ। যদি তিনি সে ধরনের কোনো হাদীস তার সংকলনে ঠাঁই দেন তো তার অবস্থাও সাথে সাথে বলে দেবেন। অবস্থা বর্ণনাসহ সেরূপ কোনো হাদীস উদ্ধৃত করা অন্যায় নয়।
মশহুর হাদীস মানে উক্ত হাদীসগুলো সংকলিত হবার আগে ও পরে সব যুগেই হাদীসবেত্তাদের মুখে মুখে চলে আসছিল। হাদীসের ইমামগণ কিতাব সংকলনের আগেই বিভিন্ন সূত্রে সে সব হাদীস বর্ণনা করেছেন। তারপর সেগুলো নিজ নিজ মুসনাদ বা জামে সংকলনে সন্নিবেশিত করেছেন। পরিশেষে সে সব সংকলনের বর্ণনাগুলো হিফজ করার ব্যবস্থা করেছেন। তার ওপর যত প্রশ্ন তোলা হয়েছিল তার বিশ্লেষণ দেয়া হয়েছে। গরীব হাদীসের ব্যাখ্যা দেয়া হয়েচে। তার হরকত ঠিক করা হয়েছে। তার সূত্রগুলো বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এমনকি সে সব থেকে ফিকাহর মাসআলা বের করা হয়েছে। তার বর্ণনাগুলোর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ প্রদত্ত হয়েচে। এমনকি এ কাজ আজও অব্যাহতভাবে চলছে। অবশেষে ইল্লা মাশাআল্লাহ এমন কোনো সংশ্লিষ্ট দিক হাদীসের অবশিষ্ট নেই যা বিশ্লেষিত ও পর্যালোচিত হয়নি।
হাদীসের চুলছেড়া বিশ্লেষক ও সমালোচকগণ হাদীস সংকলকের সংকলনপর্ব বর্ণনা ও পরবর্তী গ্রন্থনা উভয় ব্যাপারে পর্যালোচনা করে হাদীসের বিশুদ্ধতা ও সংকলনের নির্ভুলতার ব্যাপারে সবাই একমত হয়েছেন। তারা সংকলকের মতামতের সাথেও মতৈক্য প্রকাশ করেছেন এবং তাকে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। অধিকন্তু ফিকাহর ইমামগণ সে সংকলন থেকে হাদীস নিয়ে শরীআতের মাসআলা উদ্ভাবন করেছেন; সেগুলোর ওপর নির্ভর করেছেন ও আস্থা স্থাপন করেছেন। শুধু তাই নয়, তারা সংকলকের ভক্ত হয়েছেন ও তার প্রতি শ্রদ্ধ নিবেদন করেছেন।
মোটকথা, যখন কোলে কিতাব এ দুটো বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ ঘটে তখন সেটি প্রথম স্তরের বলে গণ্য হয়। পক্ষান্তরে যার ভেতরে এ দুটো বৈশিষ্ট্য অনুপস্থিত তা অনির্ভরযোগ্য। পয়লা স্তরের কিতাবের ভেতর সর্বোচ্চ মর্যাদা সেই কিতাবের, যার ভেতর মুতাওয়াতার হাদীসের সমাবেশ ঘটেছে। পরবর্তী মর্যাদায় রয়েছে অকাট্য বিশুদ্ধ হাদীসের কিতাব। অকাট্য বিশুদ্ধ সেগুলোকে বলা হয় যার দ্বারা হাদীস শাস্ত্রের ক্ষেত্রে জ্ঞান অর্জনের সহায়ক হয়।
দ্বিতীয় স্তরের হাদীস সংকলনে মুস্তাফীজ, কেতঈ বা জন্নী হাদীসের প্রায় সমমানের হাদীস রয়েছে। এভাবে হাদীস ও তার সংকলন গ্রন্থের মর্যাদার ক্রমহ্রাস ঘটবে।
অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, পয়লা স্তরে মাত্র তিনটি গ্রন্থ রয়েছে।
১। সহীহ বুখারী, ২। সহীহ মুসলিম ৩। মুআত্তা ইমাম মালিক। ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) বলেনঃ আল্লাহর কিতাবের পর বিশুদ্ধতার কিতাব হলো মুআত্তা ইমাম মালিক। এ ব্যাপারে সকল মুহাদ্দিস একমত যে, ইমাম মালেক ও তাঁর মতাবলম্বীদের মতানুসারে মুআত্তার সকল হাদীসই বিশুদ্ধ। পক্ষান্তরে, তাঁর বিরোধীদের মতানুসারেও তাতে কোনো মুরসান ও মুনকাতে হাদীস নেই যার সনদ ধারার মাধ্যমে মুত্তাসিল হয়নি। এ দিক বিবেচনায়ও সংকলনটি সহীহ।
ইমাম মালিক (রহঃ)-এর যুগে বহু মুআত্তা সংকলিত হয়েছে। তাতে মুআত্তায়ে মালিক থেকে হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে মুনকাতে হাদীসগুলোকে মুত্তাসিল বলা হয়েছে। যেমন ইবনে আবু জি’ব, ইবনে উআইন,া ছাওরী, শি’মারী প্রমুখের সংকলন। তাদের এবং ইমাম মালিকের (রহঃ) উস্তাদগণ এক।
আরেক কথা, ইমাম মালিক (রহঃ) থেকে এক হাজারের বেশী লোক হাদীস বর্ণনা করেছেন। দূর দূরান্তর থেকে লোক ইমাম মালিকের (রহঃ) কাছে ইলম হাসিলের জন্যে উটে চড়ে আনতেন। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরূপ ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে বড় বড় ফকীহ রয়েছেন। যেমন ইমাম শাফেঈ (রহঃ), মুহাম্মদ ইবনে হাসান (রহঃ), ইবনে ওহাব, ইবনে কাসেম প্রমুখ। তেমনি রয়েছেন বড় বড় মুহাদ্দিস। যেমন ইয়াহিয়া ইবনে সাঈদ কাত্তান, আবদুর রহমান ইবনে মাহুদী ও আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ।
তাঁর অনুসারী রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন হারুনুর রশীদ ও তাঁর ছেলে আমীন ও মামুনুর রশীদ। ইমাম মালিকের যুগেই তাঁর এ কিতাব অত্যন্ত খ্যাতি লাভ করে। সমগ্র মুসলিম জাহানেই তা ছড়িয়ে পড়েছিল। পরবর্তী যুগে উত্তরোত্তর তাঁর সুখ্যাতি বেড়েই চলল। কিতাবটির দিকে সবারই দৃষ্টি আকৃষ্ট হতে লাগল। বিভিন্ন শহরের ফকীহগণ বিশেষত বাগদাদের বাসিন্দারা এ কিতাবকে বিভিন্ন ব্যাপারে ভিত্তি হিসেবে নির্ধারণ করল। হাদিসবেত্তারা এ গ্রন্থ থেকে হাদীস সংগ্রহ করে চললেন। তারা এর হাদীসের গুণাবলি ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তুলে ধরলেন। তার মুতাবেআত ও শাওয়াহেদ বর্ণনা করলেন। তা থেকে সৃষ্ট মাসআলা নিয়ে পর্যালোচনা চালালেন। তার বর্ণনাকারীদের পরিচিতি ও অনুসন্ধান এ পর্যায়ে পৌঁছলেন যে, তা নিয়ে আর কারো ভাবার অবকাশ থাকল না।
যদি সুস্পষ্ট সত্য বুঝতে চান তো মুয়াত্তার সাথে ইমাম মুহাম্মদের কিতাবুল আছার ও ইমাম আবু ইউসুফের কিতাবুল আমাল তুলনা করুন। অনেক পার্থক্য দেখতে পাবেন। আপনি কি কখনো দেখেছেন যে, কোনো মুহাদ্দিস বা ফকীহ সে কিতাব দুটোর দিকে আদৌ ভ্রুক্ষেপ করেছেন?
তবে সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের ব্যাপারে সকল মুহাদ্দিস একমত যে, সে দু’গ্রন্থে যে সব মুত্তাসিল ও মারফূ বর্ণনা রয়েছে তা সবই অকাট্যরূপে বিশুদ্ধ। আর সে বর্ণনাগুলো গ্রন্থকারদের পর্যন্ত মুতাওয়াতার বর্ণিত হয়েছে। যে লোকই এ দুটোকে সাধারণ কিছু ভাববে সে বিদআতী। সে ঈমানদারদের পথ ছেড়ে ভিন্ন পথে পা বাড়িয়েছে।
যদি এ সত্যটি সুস্পষ্টভাবে বুঝতে চান তাহলে সে গ্রন্থদ্বয়ের সাথে ইবনে আবি সায়বার কিতাব, তাহাভীর কিতাব ও মুসনাদে খাওয়ারিযমীর তুলনা করুন। তাহলে সেক্ষেত্রে বিরাট পার্থক্য দেখতে পাবেন। ক
ইমাম হাকেমের সংকলিত ‘মুস্তাদরাক’-এ সেসব হাদীস সংকলিত হয়েছে যা ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের শর্ত মুতাবেক বিশুদ্ধ, অথচ তাঁরা তার উল্লেখ করেননি। আমি ইমাম হাকেমের মুস্তাদরাক অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণ করে বুঝতে পেলাম –এক বিবেচনায় তা সঠিক হলেও অন্য বিবেচনায় সঠিক নয়। কারণ,ইমাম হাকেম সে সব বর্ণনাকারীর হাদীসই নিয়েছেন যাদের থেকে শায়খাইন নিয়েছেন। বিশুদ্ধতা ও অবিচ্ছিন্নতা সম্পর্কিত তাঁদের শর্তও তাতে বিদ্যমান। তবে শায়খাইন তাদের সেসব হাদীসই নিয়েছেন যেসব বর্ণনা তাঁদের উস্তাদরা বিশ্লেষণ করে এজমায় পৌঁছেছেন। যেমন ইমাম মুসলিম বলেছেন: ‘আমি আমার সংকলনে সে সব বর্ণনারই সমাবেশ ঘটিয়েছি যার ওপর মুহাদ্দিসদের ইজমা রয়েছে।
ইমাম হাকেম স্বতন্ত্রভাবে যে সব বড় বড় হাদীস বর্ণনা করেছেন তা নির্ভরযোগ্য। সেগুলো শায়খাইনের উস্তাদদের যুগে প্রকাশ পায়নি। হয়ত পরে তা খ্যাতি লাভ করেছে, অথবা তার বর্ণনাকারীদের ব্যাপারে মুহাদ্দিসদের মতভেদ ছিল। বস্তুত শায়খাইন তো তার উস্তাদ ছিলেন। তাঁরা বিচ্ছিন্নতা ও অবিচ্ছিন্নতার ব্যাপারে হাদীসগুলোর বক্তব্য বিশ্লেষণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করতেন। ফলে অবশেষে ব্যাপারটি পরিস্কার হয়ে যেত।
ইমাম হাকেম বেশির ভাগ সেসব নিয়ম পদ্ধতির ওপর নির্ভর করেছেন যা তিনি মুহাদ্দিসদের হাদীসশাস্ত্র বিষয়ক রচনা থেকে অর্জন করেছেন। যেমন তিনি বলেনঃ ‘নির্ভরযোগ্যতায় আধিক্য গ্রহণযোগ্য’। মানে, যখন লোকদের ভেতর মুত্তাসিল, মুরসাল, মওকূফ ও মারফূ প্রভৃতি প্রশ্নে মতভেদ দেখা দেয়, তখন যে বেশি স্মরণ রাখতে পেরেছেন তারটা প্রাধান্য পাবে, যে সেরূপ স্মরণ রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন তার ওপর। সত্য ঘটনা এটাই যে, সাধারণত হাফেজদের স্মৃতি বিভ্রাটের কারণেই মাওকূফ ও মুনকাতেকে মুত্তাসিল বানানোর ভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। এ কারণে যে, তাদের ভেতর হাদীসটিকে মারফূ বা মুত্তাসিল বানানোর তীব্র আকাঙ্ক্ষা বিরাজ করে এবং সেদিকেই তারা অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করে। বস্তুত, শায়খাইন এমন বহু হাদীসকে স্বীকৃতি দেননি যেগুলো ইমাম হাকেম গ্রহণ করেছেন। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
কাযী আয়ায তাঁর “মাশারিকুল আনওয়ার” গ্রন্থে উক্ত তিনটি সংকলনের জটিল ব্যাপারগুলো বিধিবদ্ধ করেছেন ও যা কিছু বিকৃতি-বিচ্যুতি ঘটেছে তা দূর করার ব্যবস্থা করেছেন।
দ্বিতীয় স্তরে সে সব সংকলন রয়েছে যার মান সহীহাইনবা মুআত্তার পর্যায়ে নয়। অবশ্য তার কাছাকাছি বলা যায়। সেগুলোর রচয়িতাদের নির্ভরযোগ্যতা, ন্যায়ানুগ, স্মৃতিশক্তি ও হাদীস শাস্ত্র সংশ্লিষ্ট জ্ঞানের গভীরতা রয়েছে। তাদের সংকলনে হাদীস নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে সব শর্ত অনুসরণ করেছেন তাতেও কোনো দুর্বলতা নেই। পরবর্তী যুগের লোক তাদের স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং সব যুগের ফকীহ ও মুহাদ্দিসগণ তাদের সংকলনের ওপর আস্থা স্থাপন করেছেন। ফলে সর্বস্তরের লোকদের ভেতর তা খ্যাতি অর্জন করেছে। উলামায়ে কিরামও সে সবের গরীব হাদীসের ব্যাখ্যা দিয়েছেন, বর্ণনাকারীদের বিশ্লেষণ করেছেন, মাসআলা মাসায়েল উদ্ভাবন করেছেন ও সেগুলোকে জ্ঞান অর্জনের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। যেমন সুনানে আবু দাউদ, মাজে তিরমিজী ও মুসতাবান, নাসায়ী। এ সংকলনগুলো পয়লা স্তরের কাছাকাছি স্তরে রয়েছে। ইমাম রাযীন, ‘তাজরীদুস সিহাহ’ ও ইবনে আছীর ‘জামেউল উসুল’ গ্রন্থে সে সব সংকলনের হাদীসগুরো সন্নিবেশিত করেছেন।
মুসনাদে আহমদও এ স্তরের কাছাকাছি রয়েছে। কারণ, ইমাম আহমদ এ মূলনীতি গ্রহণ করেছেন যে, সংকলন দ্বারা সহীহ ও গায়রে সহীহ হাদীসের পার্থক্য জানা যাবে। বস্তুত তিনি বলেছেন –এ কিতাবে যে হাদীস ঠাঁই পায়নি তা গ্রহণ করো না।
তৃতীয় স্তরের হাদীসের কিতাব হলো সে সব মুসনাদ, জামে ও মুসাল্লাফ রয়েছে যেগুলো বুখারী ও মুসলিম সহ সমসাময়িক কালে রচিত কিতাবসমূহের আগের যুগের কিংবা পরে রচিত হয়েছে। তার ভেতরে সহীহ, হাসান, জঈফ, মা’রূফ, গরীব, শাজ, মুনকার, ভুল, সঠিক, ছাবেত, মাকলূব –এ কথায় সব ধরনের হাদীস জমানো হয়েছে। আলেমদের ভেতর সেগুরো তেমন খ্যাতিও অর্জন করেনি। অবশ্য সেগুলোর সাধারণ পরিচিতি রয়েছে।
সেগুলোর ভেতরে যে সব হাদীস তারা স্বতন্ত্রভাবে সংকলিত করেছেন, ফিকাহবিদরা সেগুলো বেশি ব্যবহার করেননি। মুহাদ্দেসগণও সেগুলোর সহীহ বা গায়রে সহীহ হওয়া নিয়ে তেমন আলোচনা ও বিশ্লেষণ করতে যাননি।
তার ভেতর এমন কিতাবও রয়েছে ভাষাবিদরা গরীব হাদীসের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তা থেকে কোনো হাদীস নেননি। কোনো ফিকাহবিদও পূর্বসূরিদের মজহাবের সাথে তার সমন্বয় বা সংযোগ দেখতে যাননি। কোনো মুহাদ্দিসগও তার কোনো জটিলতা ব্যাখ্যা করেননি। কোনো ইতিহাসকারও তার বর্ণনাকারীর পরিচিতি লেখা প্রয়োজন ভাবেননি। আমি যাদের কিতাব সম্পর্কে বলছি, তারা পূর্বযুগের হাদীসের ইমাম ছিলেন, পরবর্তী যুগের সূক্ষ্মদর্শী মুহাদ্দিসদের কথা বলিনি। বস্তুত সে কিতাবগুলো এভাবেই অখ্যাত ও অপরিচিত অবস্থায় ছিল। যেমন আবূ আলীর মুসনাদ, আবদুর রাযযাকের মুসান্নাফ, আবূ বকর ইবনে শায়বার মুসান্নাফ, আব্দ ইবনে হামীদের মুসনাদ, মুসনাদে তায়ালেসী, বায়হাকীর কিতাব, তাহাবীর কিতাব ও তাবরানীর কিতাব।
সে সব মুহাদ্দিসদের উদ্দেশ্যই ছিল যা কিছু বণনা পাওয়া যায় তা সবই সংকলিত করা। সেগুলো ছাঁটকাট করা, বিন্যস্ত করা ও কালোপযোগী করা তাদের উদ্দেশ্য ছিল না।
চতুর্থ স্তরের কিতাব সেগুলো যার রচয়িতারা দীর্ঘকাল পর এ নিয়ত করলেন যে, পর্ববর্তী দু’স্তরের কিতাবে যে সব হাদীস নেয়া হয়নি সেগুলো একত্রিত করবেন। সে সব হাদীস মূলত যত অখ্যাত ও অপরিচিত কিতাবে মওজুদ ছিল। তারা সে হাদীসগুলোর গুরত্ব দিলেন। এ সব হাদীস এমন সব রাবীদের থেকে বর্ণিত হয়েছে যাদের হাদীস মুহাদ্দিসরা লিপিবদ্ধ করেননি। সে সব বর্ণনাকারীরা ছিলেন যত সব ওয়ায়েজ, অনুসঙ্গিক কথা বলার লোক ও দুর্বল স্মৃতিসম্পন্ন লোক। তারা মূলত সাহাবা ও তাবেঈনদের কথাকেই হাদীস বলেছেন, অথবা বনী ইসরাঈলের প্রচারিত কাহিনী বর্ণনা করেছেন কিংবা জ্ঞানী গুণী ও ওয়ায়েজদের কথাকেই ইচ্ছায় কি অনিচ্ছায় নবীর হাদীস বলে চালিয়েছেন। অথবা কুরআন ও সহীহ হাদীসের এক অস্বচ্ছ ধারণাকে একদল নেককার লোক মারফু হাদীস বলে চালিয়ে দিয়েছেন। কারণ, রিওয়ায়েতের তত্ত্বই তাদের জানা ছিল না। কিংবা কিতাব ও সুন্নাতের ইঙ্গিতবহ একটি তাৎপর্যকে বর্ণনাকারী ইচ্ছাকৃতভাবে মুত্তাসিল হাদীসরূপে বর্ণনা করেছেন। অথবা সে বর্ণনাটির বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন হাদীসে ছিল। সেগুলো একত্রিত করে একটি স্বতন্ত্র হাদীস বানিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে।
এ সব হাদীসের সংকলন হলো ইবনে হাব্বানের আসুআফা ও ইবনে আদীর আল কামিল। তেমনি খতীব, আবু নাঈস, জুযকানী, ইবনে আসাকের, ইবনে নাজ্জার দায়লামীর সংকলনে সেগুলোই ঠাঁই পেয়েছে। মুসনাদে খাওয়ারিজমও প্রায় এই স্তরের কিতাব।
এ স্তরের কিতাবের সবচেয়ে উত্তম হাদীস হলো জঈফ ও মুহতামাল হাদীস এবং সবচয়ে নিকৃষ্ট হাদীস হলো মাউজু ও মাকলূব হাদীস এবং চরম পর্যায়ের মুনকার হাদীস। ইবনে জাওযীর ‘আল মাওজুআত’ এ স্তরের কিতাব।
এরপর পঞ্চম স্তরও রয়েছে। এ স্তরের হাদীসগুলো ফকীহ, সূফী, ইতিহাসকার প্রমুখের মুখে মুখে চালু হয়ে গেছে, অথচ আগের চার স্তরে তার কোনো ভিত্তি নেই। এ স্তরের হাদীসের ভেতর সে সব হাদীসও রয়েছে যা বেদ্বীন ভাষাভাষীরা তৈরী করে চালু করেছে। তারা এমন সব শক্তিশালী সূত্রের বরাত দিয়ে তা চালু করেছে যাদের সমালোচনাও চলে না। তদুপরি এরূপ আল তারিফ ভাষায় তা বানানো হয়েছে যা হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভাষার মতোই মনে হয়। তারা ইসলামের ভেতর মারাত্মক গোলযোগ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু যখন বড় বড় হাদীসবেত্তা আলেম সেসব হাদীস পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তার মুতাবিআত ও শাওয়াহেদ পরখ করেছেন, তখনই তার আবরণ উন্মোচিত হয়েছে এবং তাকীকাত জাহের হয়েছে। অবম্য মুহাদ্দিসগণ পয়লা দুই স্তরের হাদীসকেই নির্ভরযোগ্য মনে করেন।
তবে তৃতীয় স্তরের হাদীসের ওপর আমল করা ও তার স্বীকৃতি দানের ব্যাপারে শুধু বড় বড় উঁচুদরের মুহাদ্দিসরাই পদক্ষেপ নিতে পারেন। কারণ, তারা রাবীদের পরিচিতি ও বর্ণনার ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল রয়েছেন। অবশ্য এ স্তরের হাদীসগুলো থেকে অধিকাংশ মুতাবিআত ও শাওয়াহেদ সংগ্রহ করা হয়েছে। কারণ (আরবী********************************************) অর্থাৎ আল্লাহ সব বস্তুর একটা পরিমাপ নির্ধারণ করেছেন। তবে চতুর্থ স্তরের হাদীসগুলো সংকলিত করা, তা থেকে মাসআলা উদ্ভাবন ও তা নিয়ে গবেষণা চালানো উত্তরসূরীদের কাজ।
যদি সত্য কথা জানতে চান সেটা এই যে, রাফেজী, খারেজী ও বিদআতীরা এসব হাদীস থেকেই তাদের স্বপক্ষে দলীল ও সাক্ষ্য সংগ্রহ করে থাকে। এ কারণেই হাদীসবেত্তা উলামায়ে কেরাম এসব হাদীস থেকে দলীল প্রদান বৈধ ভাবেন না। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
অধ্যায়-৭৮
বাক্যের মর্মানুধাবনের অবস্থা
জানা দরকার, বক্তার মনের কথা ব্যক্ত করা ও শ্রোতার তা উপলব্ধি করার কয়েকটি স্তর রয়েছে। সেগুলো প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত অবস্থার ভিত্তিতে বিন্যস্ত হয়। সর্বোন্নত অবস্থা সেটি যাতে কোনো একটি নির্দিষ্ট ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশ প্রমাণিত হয়। বাক্যটি একটি নির্দিষ্ট ব্যাপারই প্রকাশ করবে এবং তাতে অন্য কিছু বোঝার কোনো অবকাশ থাকবে না।
পরবর্তী বিদ্যমান স্তরে রয়েছে সেই বাক্য যাতে পূর্বোক্ত তিনটি শর্ত সীমার কোনোটাই বিদ্যমান নেই। মানে, নির্দেশটি সাধারণ ও ব্যাপক অর্থবোধক। এ ব্যাপকতা বস্তুরত নামোল্লেখ করেও হতে পারে কিংবা স্থলাভিষিক্ত দ্বারা পরিবর্তনের মাধ্যমেও হতে পারে। যেমন –মানব জাতি, মুসলিম জাতি, নারী জাতি বা পুরুষ জাতি। যখন ইঙ্গিতবহ নাম ব্যবহৃত হয় এবং উদ্দিষ্ট বস্তু ব্যাপক হয়, তাও এ শ্রেণীভুক্ত। তেমনি গুণবাচক বিশেষ্য যদি অনির্দিষ্ট গুণের অধিকারী হয় কিংবা অনির্দিষ্ট বস্তুর নিষিদ্ধতা আসে, তাও এ শ্রেণীভুক্ত। তা এ কারণে যে, অনেক ক্ষেত্রে ব্যাপকতার সাথেও নির্দিষ্টতার সংযোগ ঘটে যায়। অথবা বিশেষ উদ্দেশ্য বুঝাবার জন্যে বাক্যটি না হলা হলেও সেই নির্দিষ্ট স্থানে উদ্দেশ্যটি আপনা থেকেই অনিবার্যভাবে ব্যক্ত হয়ে যায়। যেমন ‘আমার কাছে বিজ্ঞ যায়েদ এল’ অথবা ‘দরিদ্র যায়েদ এল’। এখানে বিজ্ঞতা বা দরিদ্রতা যায়েদের সাথে অনিবার্যভাবে জুড়ে যাবে।
যে বাক্যে দ্ব্যর্থবোধক শব্দ রয়েছে তাও এ স্তরভুক্ত। শব্দটির যদিও মূল অর্থই ব্যবহৃত হয়, তথাপি তার পারিভাষিক অর্থও বেশ মশহুর।
অথবা এমন শব্দ যার অর্থ উদাহরণ ও শ্রেণীভুক্তকরণের মাধ্যমেই মশহুর হয়, অন্যথায় জানা যায়। যেমন সফর। এ সফর মক্কা-মদীনায় হতে পারে, এ সফর প্রমোদ ভ্রমণ হতে পারে, এ সফর এমন কোনো প্রয়োজনীয় কারণে হতে পারে যা শেষ করে সেদিনই বাড়ি ফিরতে হবে। আবার কোনো সফর এমনও হয় যার সময় সীমা থাকে না।
কখনো ইঙ্গিতবহ বিশেষ্য দ্বারা দু’ব্যক্তির যে কোনো এক জনকে বুঝানো হয়, অথচ লক্ষণ দ্বারাও তা ধরা যায় না। এরূপ বিশেষ্যযুক্ত বাক্যও এ স্তরের অন্তর্ভুক্ত। তেমনি একই অবস্থার সর্বনামও এর অন্তর্ভুক্ত। উভয়ের যখন উদ্দিষ্ট বস্তু একই হয়, অথচ লক্ষণে তারতম্য সৃষ্টি হয়, তা হলেই এ শ্রেণীর বাক্য উদ্ভুত হয়।
তার পরবর্তী স্তরে রয়েছে সেই বাক্য যার অর্থ শব্দ ব্যবহারের মাধ্যম ছাড়াই বুঝা যায়। এরূপ বড় বড় তিনটি পন্থা বিদ্যমান রয়েছে।
১। বাক্যের বক্তব্য বা তাৎপর্যঃ তা হচ্ছে এই, বাক্য শোনামাত্র উহ্য তাৎপর্য বা বিষয়বস্তু বুঝা যায়। মানে, যে উদ্দেশ্যে নির্দেশটি এল তার তাৎপর্য বাক্যের বক্তব্য থেকে জানা যায়। যেমন, “তাদের ‘উফ’ বলো না” বাক্য থেকে এ বক্তব্যই বেরিয়ে আসে যে, তাদের নির্যাতন করো না। মানে, তাদের কষ্ট দেয়া হারাম। আরেক উদাহরণ এইঃ যে ব্যক্তি রোযার দিনে খেল তার উপর ক্বাযা ওয়াজিব হলো। এখঅনে বুঝা যায় যে, খাওয়া বলে মূলত রোযা ভঙ্গ বুঝানো হয়েছে। সুতরাং কোনোভাবে রোযা ভঙ্গ হলে ক্বাযা ওয়াজিব হবে। খাওয়া শব্দটি সহজবোধ্য বলেই ব্যবহৃত হয়েছে।
২। বাক্যের চাহিদা বা দাবিঃ তা হচ্ছে এরূপ যে, স্বভাবগত, জ্ঞানগত বা শরীআত মতে বাক্যের যে অর্থটি অপরিহার্য হয়। যেমন, আমি মুক্ত করেছি কিংবা আমি বিক্রয় করেছি। এ বাক্যদ্বয় দাবি করে যে, মুক্তিদাতা বা বিক্রেতার মুক্ত ব্যক্তি বা বিক্রিত বস্তুর মালিকানা রয়েছে। যেমন বলা হলো, সে চলছে। এ চলা কাজটি দাবি করে যে, তার পা দুটো ঠিক আছে। তেমনি যদি বলা হয়, সে নামায পড়ছে, তাহলে তা দাবি করছে যে, তার ওজুও রয়েছে।
৩। বাক্যের ইঙ্গিতঃ তা হচ্ছে এই যে, বাক্যের ভেতর যথোপযোগী বাক্যাংশ যোগ করে উদ্দেশ্য আদায় করা। বস্তুত অলংকারিকদের লক্ষ্য হয়, আসল উদ্দেশ্যের অতিরিক্ত কিছু পেতে গিয়ে বাক্যের কাঠামোকে এরূপ উপযোগী করা যেন বাক্য থেকেই অতিরিক্ত অর্থটি বুঝা যায়। যেমন- কোনো বস্তুর ব্যাপারে বিশেষ গুণ বা শর্ত জুড়ে দেয়া যাতে বুঝা যায় যে, সেই গুণ বা শর্ত না পাওয়া গেলে নির্দেশটি অকার্যকর হবে। হ্যাঁ, তবে যদি এখানে প্রশ্নোত্তরের উদ্দেশ্য না থেকে থাকে, আর না বিভিন্ন নির্দেশের কল্যাণকারিতা বুঝানো উদ্দেশ্য হয়, তা হলেই কেবল তখনই তা ঘটবে। ঠিক এরূপই ব্যতিক্রমধর্মীতা সীমাবদ্ধতা ও সংখ্যা নির্ধারণের তাৎপর্য গ্রহণের অবস্থা।
ইঙ্গিতবাহী বাক্যের বিবেচনার শর্ত এই যে, তার কারণে ভাষাভাষির জ্ঞাত অর্থের ভেতর সংকট সৃষ্টি হয়। যেমন কেউ বলল, আমার ওপর দশটির দেয়া অপরিহার্য শুধু একটি বস্তু ছাড়া অবশ্য আমার ওপর একটা অপরিহার্য। জমহুর উলামার অভিমত, এ বাক্যটি পরস্পর বিরোধী। যে বাক্যের তাৎপর্য শুধু ন্যায়শাস্ত্রের গভীর জ্ঞান অনুশীলনে জানা যায় তা নির্ভরযোগ্য হয় না।
তারপরের স্তরে হলো সে সব বাক্য যা থেকে তার বিষয়বস্তুর প্রমাণ পাওয়া যায়। তা তিনটি প্রধান শ্রেণীতে বিভক্ত।
১। কোনো কিছুকে ব্যাপকতাবোধক বক্তব্যের অন্তর্ভুক্ত করা। যেমন, দন্ত-নখর বিশিষ্ট জীবের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় বাঘের মতোই অন্যান্য হিংস্র জীব হারাম হওয়া। সাযুজ্যপূর্ণ লক্ষণ দ্বারা তা প্রমাণিত হয়। তেমনি হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ গাধার ব্যাপারে আমার কাছে এ ব্যাপকার্থে বোধক আয়াত ছাড়া আর কিছুই নেই, আয়াতটি হচ্ছেঃ
(আরবী*********************************************************************************)
“অনন্তর যে ব্যক্তি বিন্দুমাত্র ভালো কাজ করেন তা তিনি দেখেন এবং যে ব্যক্তি বিন্দুমাত্র খারাপ কাজ করেন তাও তিনি দেখেন।
এ আয়াত থেকে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) এ দলীল নিলেন যে, ‘অতএব তাঁর পথেই চল’।
২। অন্যত্র আল্লাহ পাক বলেনঃ
(আরবী******************************************************************************)
অর্থাৎ দাউদের ধারণায় এল, নিঃসন্দেহে আমি তাকে পরীক্ষায় ফেলেছি। তাই সে তার প্রতিপালকের কাছে ক্ষমতা চাইল ও মাথা ঝাঁকিয়ে রুকু করল এবং নিকটবর্তী হলো।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ তোমাদের নবীর ওপর নির্দেশ ছিল যে, তাকে অনুসরণ করেন।
দলীল নেয়ার ব্যাপারটি কখনো হ্যাঁ বাচক আর কখনো না বাচক দ্বারা হয়। যেমন, বিতর নামায যদি ওয়াজিব হতো তো হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাহনে বসে তা আদায় করতেন না, অর্থাৎ তিনি সেটাই করেছেন।
৩। কখনো শর্তযুক্ত কিয়াস দ্বারা দলীল বের করা হয়। যেমন আল্লাহ পাক বলেনঃ
(আরবী******************************************************************)
অর্থাৎ যদি আসমান ও যমিনে আল্লাহ ছাড়া আরও প্রভু থাকত তা হলে দুটোই ধ্বংস হতো।
কখনো কিয়াস করা হয় এক বস্তুর সাথে অন্য বস্তুর সাদৃশ্যের কোনো একটি যোগসূত্র বা কারণকে ভিত্তি করে। যেমন, গমের মতোই চানাতেও সুদ ধার্য হবে। এর অপর উদাহরণ হলো হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ বাণীঃ
“যদি তোমরা বাপের ওপর ঋণ থাকত, তা হলে তুমি তা আদায় করলে আদায় হতো? সাহাবী বললেন, হাঁ, হতো। তিনি তখন বললেন, তা হলে বাপের পক্ষে থেকে হজ্ব কর”। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
অধ্যায়-৭৯
কিতাব ও সুন্নাহ থেকে শরীআত বুঝার উপায়
জেনে নিন, যে সব শব্দ সন্তোষ কিংবা অসন্তোষের প্রমাণ দেয় তা হচ্ছে, ভালোবাসা, ঘৃণা, অভিশাপ, দয়া, নৈকট্য ও দূরত্ব। তেমনি যে সব শব্দে আদেশ বা নিষেধমূলক কাজের পরিণাম ব্যক্ত হয়। যেমন প্রশংসনীয় কার্যাবলী বা নিন্দনীয় কার্যাবলি। তেমনি সে সব ক্রিয়া যা হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করার কিংবা না করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। অবশ্য ওয়াজিব, মুস্তাহাব, হারাম ও মাকরূহর ভেতর পার্থক্য থাকা চাই। তার সুস্পষ্ট পন্থা হলো এই যে, সে কাজটি যে করবে না তার অবস্থা কি হবে সেটা বর্ণনা করা। যেমন, যে ব্যক্তি তার সম্পদের যাকাত আদায় করবে না, কেয়ামতের দিন তার সম্পদ তার সামনে সাপ হয়ে আত্মপ্রকাশ করবে (হাদীস)। অন্যত্র হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে তা করে না, তার কোনো ক্ষতি নেই’।
পার্থক্য সৃষ্টির জন্যে ব্যবহৃত শব্দাবলি এরূপও হয়, য়্যাজিবু অর্থাৎ ওয়াজিব, হালাল নয়। তা ছাড়া কোনো কিছুকে ইসলাম বা কুফরের অঙ্গ কিংবা কঠোরভাবে কোনো কাজ করা বা না করার নির্দেশ দেয়া হয় তা থেকেও বিধানের পার্থক্য ও বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। তেমনি যদি বলা হয় এ কাজটা মানবতা পরিপন্থী এবং এটা অনুচিত কাজ, এতেও বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। তেমনি সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈন যদি কোনো বিধান বলে থাকেন। যেমন- উমর ফারুক (রাঃ) বলেছেন, তেলাওয়াতের সিজদা ওয়াজিব নয়। হযরত আলী (রাঃ) বলেছেন, বিতর নামায ওয়াজিব নয়। তারপর উদ্দেশ্যের অবস্থা বিচার করে দেখতে হবে কাজটি ইবাদতে প্রদায়ক কিংবা পাপ পথের প্রতিবন্ধক কিনা? অথবা ব্যক্তিত্ব সৃষ্টি ও সংরক্ষণ এবং উত্তম শিষ্টাচারের কাজ কি না?
অতঃপর যদি কারণ, অঙ্গ ও শর্ত জানতে হয় তা হলে তার পরিস্কার পন্থা হলো এই, সেটা কোনো বাণী দ্বারা প্রমাণিত হয়। যেমন ‘সকল নেশার দ্রব্য হারাম’। কিংবা ‘সূরা ফাতিহা ছাড়া নামায নেই’ অথবা ‘তোমাদের নামায ততক্ষণ কবুল হবে না যতক্ষণ ওজু না করবে’।
এরপর মর্যাদা হলো ইঙ্গিত, ইশারা দ্বারা প্রমাণিত হওয়া বিধান। যেমন কেউ বলল, ‘আমি রোযা রেখে স্ত্রী সহবাস করেছি’। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, একটি গোলাম আজাদ কর। তেমনি কেয়াম, রূকূ ও সিজদাকে নামায নামে দেখা থেকে জানা গেল যে, সেগুলো নামাযের অঙ্গ।
তেমনি হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “ওটা (মুজা) থাকতে দাও। আমি পবিত্র অবস্থায় তা পরিধান করেছি”। এতে জানা গেল, পবিত্রাবস্থায় মুজা পরা শর্ত।
তাছাড়া কারণ, শর্ত ও অঙ্গ জানার পদ্ধতি এটাও যে, অধিকাংশ ক্ষেদ্রে দেখা যায়, বস্তু পাওয়া গেলে হুকুম দেয়া হয়, না পাওয়া গেলে দেয়া হয় না। বস্তুর উপস্থিতিই তার কারণ, শর্ত ও অঙ্গের ধারণাকে মগজে বদ্ধমূল করে। যেমন কোনো ফার্সি ভাষাভাষী আরবী ভাষায় দক্ষতা অর্জন করল। তারপর লক্ষণ অনুসারে যথাস্থানে যথাযথ শব্দ প্রয়োগের ক্ষমতা অর্জন করল। ফলে তার মগজে আরবী ভাষার আভিধানিক অর্থ স্থায়ী হয়ে গেল। অথচ তার পারিভাষিক জ্ঞান অর্জিত হলো না। তাই শাব্দিক অর্থ অনুসারে বাক্য সাজানোই তার সার হলো। কারণ, তার তো শুধু প্রয়োগ বিধিই জানা আছে। তাই যখন আমরা শরীআত প্রণেতাকে দেখতে পাই যে, যখনই তিনি নামায পড়েন, তখন রুকু সিজদা করেন ও পাক-পবিত্র হয়ে নেন এবং প্রতিবারেই তিনি এরূপ করেন, তখন আমাদের প্রত্যয় জন্মে যে, এটাই উদ্দিষ্ট বিষয়। সত্যি কথা তো এটাই যে, সাধারণত আসল বৈশিষ্ট্য জানার পদ্ধতি ও ভিত্তি এটাই।
যখন আমরা লোকদের দেখি, তারা কাঠ জোগাড় করে তা দিয়ে বসার আসন তৈরি করে ও সেটাকে তখত নাম দেয়। আমরাতা থেকে তার মৌলিক গুণাবলী বুঝে নেই। তারপর সাজসজ্জা সাদৃশ্য ও জনপরিচিতির ভিত্তিতে মূল উপাদান আবিস্কার করি।
অবশ্য যার ওপর বিধিবিধান নির্ভরশীল সে সব উদ্দিষ্ট বস্তুর পরিচিতি অর্জন বড়ই সুসম জ্ঞানের ব্যাপার। সে জ্ঞানের সমুদ্রে সেই লোকই ডুব দিতে পারে, যার মেধা অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও তীক্ষ্ণ এবং তাঁর বোধশক্তি অত্যন্ত সত্যনিষ্ঠ। সাহাবায়ে কেরামের ফকীহবৃন্দ পুণ্য ও পাপ কাজের মূলনীতি স্থির করেছেন সে সব মশহুর কার্যাবলির ভিত্তিতে যা ছিল সেকালের সর্বজন স্বীকৃত ব্যাপার। সেক্ষেত্রে আরবের মুশরিক ও ইহুদী নাসারাও যুক্ত ছিল। সে কারণেই তাদের সিদ্ধান্ত নিতে কার্যকারণ ও সংশ্লিষ্ট ব্যাপার নিয়ে বহাস করার প্রয়োজন ছিল না। অবশ্য শরীআতের আইন-কানুন অবকাশ দান ও সহজীকরণের নিয়মনীতি এবং দ্বীনের বিধানাবলি তারা নির্দেশদান ও নিষিদ্ধ করা থেকে বুঝে নিয়েছিলেন। বিজ্ঞ হেকীমের দীর্ঘ সাহচর্য ও তার ব্যবস্থাবলি নিরীক্ষণ করে যেভাবে কোনো লোক বিভিন্ন দাওয়াইর উদ্দেশ্যাবলি বুঝতে পায় এও তেমনি ব্যাপার বৈ নয়।
সাহাবায়ে কেরাম শরীয়তী আইন কানুন জানা ও বুঝার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ স্তরে আসীন ছিলেন। এক ব্যক্তি ফরয নামায পড়েই নফল নামায পড়ার উদ্যোগ নিলে উমর ফারুক (রাঃ) বললেন- এর ফলে তুমি আগের লোকের মতোই ধ্বংস হবে। এ কথা শুনে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন –হে উমর! তোমার অভিমতকে আল্লাহ পাক যথার্থ বলেছেন। তেমনি জুমআর দিন গোসল করার কারণ বর্ণনা করেন ইবনে আব্বাস (রাঃ)। হযতর উমর (রাঃ) বলেন- আমার তিনটি কথা আল্লাহ পাকের ইচ্ছার সাথে মিলে গেছে। ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে যায়েদ (রাঃ)-এর বক্তব্যও এ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। যেমন তিনি বলেন –বিভিন্ন রোগে ফল-ফসল বিকৃত ও নষ্ট হলে —ইত্যাদি। এ শ্রেণীরই অন্তর্ভুক্ত হলো হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর বক্তব্যটিঃ নারীরা আজ যে ধরনের কাজ কারবার চালু করেছে, তা যদি হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখতেন তাহলে তাদের সেভাবেই মসজিদে আসতে বারণ করতেন যেভাবে বনী ইসরাঈলের নারীদের বারণ করা হয়েছিল।
শরীআতের মর্ম অনুধাবনের সেটাই সার্বিক পদ্ধতি যা কুরআন ও সুন্নায় বর্ণিত হয়েছে। যেমন, “তোমাদের জন্যে কিসাসের মধ্যেই জীবন রয়েছে হে জ্ঞানীবর্গ! তিনি আরও বলেনঃ “আমি জানতে পেরেছি তোমরা গোপনে কিছু করছ –তাই আমি তোমাদের ক্ষমা করলাম ও ব্যাপারটি উপেক্ষা করলাম”। অন্যত্র তিনি বলেন, এখন তোমাদের বোঝা আল্লাহ হালকা করে দিলেন এবং তিনি জেনে গেছেন যে, তোমাদের ভেতর অলসতা রয়েছে। তিনি আরও বলেনঃ যদি তোমরা এরূপ না কর তাহলেবিশ্বে ফেতনা ফ্যাসাদ সৃষ্টি হবে। অন্যত্র তিনি বলেনঃ এক নারী ভুলে গেলে অন্য নারীটি স্মরণ করিয়ে দেবে।
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ‘এ কারণে যে, সে জানেনা তার হাত রাত্রে কোথায় বিচরণ করেছে’। মানে তা কোন বস্তু স্পর্শ করেছে। তাঁর অন্য একটি বক্তব্য এই- (সকাল পর্যন্ত যে শুয়ে থাকে) শয়তান তার নাকের ভেতর রাত কাটায়”।
এর পরের মর্যাদা হলো ইশারা ইঙ্গিতের মাধ্যমে যে অর্থ বুঝা যায় তার। যেমন হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ লা’নতের দুটো কারণ থেকে বাঁচ’। অন্যত্র হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ অপবিত্রতার প্রতিবন্ধক হলো জাগ্রত দু’চোখ।
তার পরের মর্যাদা হলো ফকীহ সাহাবীদের বক্তব্যের। এর পরের মর্যাদাহলো হুকুমের কারণ এমনভাবে বের করা যা উদ্দিষ্ট বস্তুর দিকে ফিরে যায় এবং বস্তুটি মাসআলার উপমার সাথে খাপ খাইয়ে নির্ভরযোগ্য বলে প্রতীয়মান হয়। যেহেতু দ্বীনের কোনো ব্যাপারে নিরর্থক কাজ কিছু নেই, তাই জরুরী হচ্ছে পরিমিতি নিয়ে পর্যালোচনা করা এবং সব কিছুর নির্দিষ্ট পরিমাণ নির্ধারণ করা। এটাও দেখা চাই যে, তার উপমা কেন নির্ধারিত হলো না? নির্বিশেষে ও বিশেষ নিয়ে পর্যালোচনা হওয়া চাই যে, কেন বিশেষ থেকে নির্বিশেষের অন্যান্যদের ছাটাই করা হলো? সে সবে কি উদ্দিষ্ট বস্তু অবর্তমান ছিল, না তার সাথে মোকাবেলার কারণে উদ্দিষ্ট বস্তু প্রাধান্য পেল। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
অধ্যায়-৮০
পরস্পর বিরোধী হাদীসের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদ্ধতি
আসল কথা তো এটাই যে, সব হাদীসের ওপরই আমল করা হবে। হ্যাঁ, যদি পরস্পর বিরোধী হয়ে দাঁড়াবার কারণে উভয় হাদীসের ওপর আমল করা দুঃসাধ্য হয় তাহলে ভিন্ন কথা। মূলত হাদীসে কোনো মতভেদ নেই। শুধু আমলের দৃষ্টিতে মতভেদ পরিদৃষ্ট হয়। যদি দুটো পরস্পর বিরোধী হাদীস সামনে আসে, যদি উভয় হাদীসেই হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাজ বর্ণিত হয়, যদি এক সাহাবী বলেন যে, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কাজ করেছেন এবং অপর সাহাবী বলেন যে, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য কাজ করেছেন, তা হলে দুটোর ভেতরে কোনো বিরোধ নেই। সেক্ষেত্রে দুটো কাজই মোবাহ হবে। অবশ্য যদি সে কাজ দুটো ইবাদত না হয়ে অভ্যেসগত হয়। অন্যথায় একটি হবে মুস্তাহাব এবং অপরটি হবে জায়েয। তবে যদি একটিতে ইবাদতের লক্ষণ সুস্পষ্ট হয় এবং অপরটিতে না হয় কিংবা দুটো কাজই ওয়াজিব বা মুস্তাহাব হয়, তখন দুটোর একটি অপরটির জন্যে যথেষ্ট হবে। অবশ্য দুটোই যদি ইবাদত হয়।
সাহাবী হাফেজগণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে এভাবেই ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। যেমন বিতরের নামায এগারো রাকআত, নয় রাকআত, সাত রাকআত ইত্যাদির বর্ণনা। তেমনি তাহাজ্জুদ নামাযে জোরে কিংবা আস্তে পড়া। এ পদ্ধতিতেই রাফিয়্যাদাইনের ব্যাপারটি ফয়সালা করা হবে। মানে, হাত কান পর্যন্ত উঠানো হোক কিংবা কাঁধ পর্যন্ত।
হযরত উমর (রাঃ), ইবনে মাসউদ (রাঃ) ও ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর তাশাহহুদের ব্যাপারটি মীমাংসা এভাবেই করা চাই। এ পদ্ধতিতেই বিতরের নামায কি তিন রাকআত, না এক রাকআত ভিন্ন নামায যে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া চাই। এভঅবেই নামায শুরুর দোআ, সকাল সন্ধ্যার দোআ এবং সব রকমের কার্যকারণ ও কর্মসূচী নির্ধারণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
অথবা যদি সে কাজ দুটো কোনো কষ্টকর ব্যবস্থা থেকে পরিত্রাণ দাতা হয়। হয়ত পূর্বে সে কাজ অপরিহার্য করার কোনো কারণ ছিল। যেমন কাফফারা সম্পর্কিত ব্যাপারসমূহ।একটি বর্ণনামতে যুদ্ধের বিনিময় সম্পর্কিত ব্যাপার। অথবা সেক্ষেত্রে কোনো সুপ্ত কারণ ছিল যা এক সময় একটি কাজকে ওয়াজিব করেছে এবং অন্য সময় অপর কাজটি মুস্তাহাব করেছে। অথবা একটি কাজ এক সময় ওয়াজিব করেছে এবং অন্য সময়ে বর্জন করার অবকাশ দিয়েছে। তখন অপরিহার্য হবে সে কারণ অনুসন্ধান করা।
অথবা কাজ দুটোর একটি অপরিত্যাজ্য ও অপরটি বর্জনের অবকাশ রয়েছে। শর্ত হচ্ছে, প্রথমটিতে দৃঢ়তার লক্ষণ থাকবে ও দ্বিতীয়টিতে কষ্টকর দিকটি বিবেচিত হবে। তবে যদি তার ভেতর একটিতে কাজের বর্ণনা ও দ্বিতীয় হাদীসে কাজের বর্জন আসে, সেক্ষেত্রে যদি কাজটির সুস্পষ্টতঃ ওয়াজিব বা হারাম হওয়ার প্রমাণ না মিলে কিংবা অপর বর্ণনাটিতে সুস্পষ্ট বর্জন না বুঝায়, তখন তাতে কয়েকটি কারণ হতে পারে। যদি একটি বর্ণনায় সুস্পষ্ট ওয়াজিব বা হারামের ব্যাপার থাকে তা হলে উভয় হাদীসই এই অর্থে ব্যবহৃত হবে যে, ব্যাপারটি হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্যে নির্দিষ্ট।
অথবা দুটোকেই মানসুখ করা হবে। তখন উভয়ের লক্ষণাদি অনুসন্ধান করে দেখা হবে। যদি দুটোই বক্তব্যমূলক হাদীস হয়, এবং একটির অর্থ সুস্পষ্ট হয় ও দ্বিতীয়টি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করলে একই অর্থ দাঁড়ায় আর ব্যাখ্যাও কাছাকাছি হয়, তা হলে সুস্পষ্ট অর্থবোধক হাদীসের ওপরই আমল হবে। তখন স্পষ্ট হাদীসটি অস্পষ্ট হাদীসের ব্যাখ্যা বলে গ্রহণ করা হবে। পক্ষান্তরে ব্যাখ্যা যদি দূরের হয় তাহলে ব্যাখ্যার অর্থ তখনই গ্রহণযোগ্য হবে যখন তার সপক্ষে বড় কোনো নিদর্শন মিলবে কিংবা কোনো ফকীহ সাহাবী থেকে তা বর্ণিত হবে। যেমন দোয়া কবুলের সময় সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ)-এর এ বক্তব্য যে, সেটা হলো সূর্যাস্তের প্রাক্কালে। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) সে ব্যাপারে প্রশ্ন তোলে, যে, সে সময়ে নামায বৈধ নয়। অথচ হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ‘এক মুসলমান নামাযে রত অবস্থায় যে প্রার্থনা জানাবে তা পাবে’। জবাবে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ) বলেনঃ নামাযের জন্যে অপেক্ষমাণ ব্যক্তিও নামাযরত ব্যক্তির সমান।
এটা তো হলো দূরের ব্যাখ্যার ব্যাপার। এ ব্যাখ্যা শুধু তখনই গ্রহণযোগ্য হবে যখন কোন ফকীহ সাহাবীর থেকে তা পাওয়া যাবে। দূরের ব্যাখ্যা সেটাই যা সুস্থ বিবেকের সামনে পেশ করলে তার সংগতিহীনতা ও প্রমাণহীনতার জন্যে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয় না। তারপর যদি তা প্রকাশ্য ইঙ্গিত, সুস্পষ্ট তাৎপর্য কিংবা সুস্পষ্ট বক্তব্যের পরিপন্থী হয় তা হলে আদৌ বৈধ নয়।
কাছাকাছি ব্যাখ্যার অন্যতম হলো ‘কসরে আম’ বা সীমিত সাধারণ হুকুম। এ ধরনের নির্দেশে কিছু সংখ্যক লোককে শামিল করার রীতি থাকে এবং তা থেকে এমন স্থানে সাধঅরণ অর্থবোধক শব্দ ব্যবহার করা হয় যেখানে স্বভাবতই ভুল বুঝাবুঝির অবকাশ থাকে। যেমন প্রশংসাকীর্তন কিংবা নিন্দাগাথা রচনা। সাধারণ অর্থবোধক শব্দের অন্যতম হলো সেই শব্দ যা নির্দেশের মূল উদ্দেশ্য সাধনের পর যার জন্যে তা প্রযুক্ত হয় সে কাজে লাগানো হয়। সেটাকে সংশয়পূর্ণ বাক্যের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। যেমন হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ “যে জমিনে বৃষ্টির পানি ফসল দেয় তার ওশর (দশমাংশ) হবে”। অন্যত্র তিনি বলেনঃ পাঁচ ওয়াসাকের কম হলে যাকাত নেই।
একটি ব্যাখ্যা এটাও যে, প্রত্যেক হাদীসকে বিশেষ এক উপযোগী অর্থে গ্রহণ করা হবে। একটি ব্যাখ্যা এই যে, দুটোকেই মাকরূহ পর্যায়ে রেখে সামগ্রিক বিবেচনায় বৈধতা বুঝানোর জন্যে ব্যবহৃত হবে। অবশ্য যদি তা সম্ভব হয়। তখন কড়াকড়ি করাকে সতর্কীকরণ হিসেবে বিবেচনা করা হবে, যদি পূর্বে কোনো অন্যায় ঘটে থাকে। তবে এ নির্দেশ- ‘তোমাদের জন্যে মৃত জীব হারাম করা হলো, কিংবা তোমাদের জন্যে তোমাদের মাতাকে হারাম করা হলো’ অর্থাৎ তাদের বিয়ে করা হারাম, এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বক্তব্য ‘নজর লাগা সত্য’ অর্থাৎ নজরের প্রভাব হওয়া প্রমাণিত সত্য কিংবা রাসূল সত্য অর্থাৎ রাসূলের প্রেরিত হওয়া সত্য, অথবা ‘আমার উম্মতের ভুল-চুক উপেক্ষিত হবে’ অর্থাৎ ভুল বশত কৃত পাপ মাফ করা হবে, কিংবা ওযূ ছাড়া নামায নেই বা ওলি ছাড়া বিয়ে নেই’ অথবা ‘সব আমলে ভিত্তি হলো নিয়ত’ অর্থাৎ নিয়ত ছাড়া আমলের সেই প্রভাব সৃষ্টি হয় না যা শরীয়াত নির্ধারণ করেছে, কিংবা ‘যখন নামাযে দাঁড়াও ধুয়ে নাও’ অর্থাৎ যদি তুমি ওযু করে না থাকো, করে নাও ইত্যাদি কোনো ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। কারণ আরবের লোক এর প্রতিটি শব্দের যথাযথ প্রয়োগ সম্পর্কে অবহিত। তাই তারা এর যথাযথ অর্থই গ্রহণ করে, মূলত এসব তাদের অহরহ ব্যবহারের ভাষা। ফলে এর প্রকাশ্য অর্থের বাইরে কোনো অর্থ তারা বুঝে না।
তবে যদি দুটো কাজই কোনো মাসআলার জবাব হয় কিংবা কোনো ঘটনার ফয়সালা হয়, তখন যদি তার ভেতরে পার্থক্য সৃষ্টিকারী কোনো কারণ পাওয়া যায় তাহলে তদনুসারেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। যেমন কোনো যুবক তাঁর কাছে রোযা রাখা অবস্থায় স্ত্রীকে চুম্বন দান সম্পর্কে জানতে চাইল তিনি তাকে নিষেধ করলেন। পক্ষান্তরে যখন এক বৃদ্ধ প্রশ্ন করল, তখন তিনি তাকে অনুমতি দিলেন।
যদি এক হাদীসে কোনো প্রয়োজনের দিকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় কিংবা প্রশ্নকারীর অনিহার কারণে নির্দেশ তামিল না করার ব্যাপারটি এড়িয়ে যাওয়া হয়, অথবা কেউ যদি ইচ্ছা করে সেটাকে কড়াকড়িভাবে পালন করে, অথচ অপর হাদীসে তা প্রমাণিত না হয়, তাহলে প্রথমটি রোখসত ও দ্বিতীয়টি আযীমাত হিসেবে গণ্য হবে।
যদি দুটো কাজই কোনো পরীক্ষা থেকে রোহই দান কিংবা কোনো পাপের শাস্তি দান অথবা কোনো কসম ভাঙ্গার কাফফারা হয় তো উভয়টিকে সঠিক বলে গ্রহণ করা হবে। তবে নাসেখ-মানসুখ হবার সম্ভাবনাও থেকে যাবে। এ পদ্ধতির ভিত্তিতেই হায়েজগ্রস্ত নারীর ব্যাপারে ফতোয়া দেয়া হয়েছে। কখনো প্রতি দু ওয়াক্ত নামাযে গোসলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কখনো এ কথা বলা হয়েছে, স্বভাবত যতদিন হায়েজ থাকার কথা, ততদিনই হায়েজের দিন হিসেবে গণ্য হবে। কোথাও বলা হয়েছে বেশি রক্ত ঝরার দিনগুলোকে হায়েজের কাল ধরা হবে। এসব কারণে হয়েছে যে, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হায়েজ গ্রস্তা নারীকে দুটো এখতিয়ারই দিয়েছেন। ইচ্ছে করলে সে অভ্যেসগত দিনগুলো পুরো অপেক্ষা করতে পারে অথবা রক্তের রঙ বিলুপ্ত হওয়াকে হায়েজের কাল বলে গণ্য করতে পারে। কারণ দুটোই হায়েজের কাল নির্ণয়ের মানদণ্ড হতে পারে।
তেমনি যে ব্যক্তি জিম্মায় রোযা রেখে মারা গেল, তার ব্যাপারে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এক বক্তব্যে তার তরফ থেকে রোযা রাখা ও অন্য ব্যক্তিকে খানা খাওয়াবার নির্দেশ রয়েছে। তেমনি যার নামাযে সন্দেহ থাকে তাকে তিনি দুটো পথ বাতলেছেন। ইচ্ছা হয় চিন্তাভাবনা করে রাকআতের সংখ্যা ঠিক করবে, অন্যথায় নিশ্চিত জানা রাকআত ধরে নামায পূর্ণ করবে। তেমনি তাঁর এক বক্তব্যে দেখা যায় বংশ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে তিনি কখনো চেহারা ও আকৃতি অনুমান করে রায় দিয়েছেন, কখনো লটারির মাধ্যমে তা স্থির করেছেন।
যদি এসব বর্ণনায় নাসেখ-মানসুখ হবার সুস্পষ্ট দলীল থাকে তো সেটাই অনুসরণ করা হবে। এ ব্যাপারটি কখনো হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বক্তব্য ও বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়; যেমন, তিনি বললেনঃ আমি তোমাদের কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম, কিন্তু এখন তা কর। কখনো তা এভাবে জানা যায় যে, হাদীস দুটোর সমন্বয় সাধন সম্ভব নয় এবং একটি আগের ও অপরটি পরের। পরবর্তী হাদীসের বিধান চালু হয়েছে ও প্রথমটির বিধান উহ্য হয়েছে। ফলে ফকীহ সাহাবীরা বুঝে নিয়েছেন যে, দ্বিতীয় হাদীস পয়লা হাদীসকে মানসুখ করেছে অথবা হাদীস দুটোয় মতভেদ থাকায় ফকীহ সাহাবীদের কেউ বলে দিলেন, একটি অপরটির নাসেখ। অবশ্য এ নসখ দৃশ্যত ঠিক হলেও চূড়ান্ত ধরা যাবে না। ফকীহরা তা বললেও যদি দেখা যায় যে, তাদের শায়েখদের আমল তার বিপরীত তা হলে তাদের বলাটাই যথেষ্ট হবে না।
নসখের পরিণতিতে এক হুকুমের বদলে অন্য হুকুম কায়েম হয়। মূলত একটি হুকুম বিলুপ্ত হয়। তা এ জন্যে যে, সে বিধানের কারণ শেষ হয়ে গেছে। অথবা মূল উদ্দেশ্যের জন্যে তারকারণ হওয়ায় সম্ভাবনা শেষে হয়েছে। কিংবা তার কারণ হবার পথে অন্তরায় সৃষ্টি হয়েছে। অথবা আল্লাহর তরফের ওহী এসে তা রদ করেছে কিংবা হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইজতেহাদে একটির ওপর অপরটির প্রাধান্য পেয়েছে। এটা তখনই হয় যখন পয়লা হুকুমটি ইজতেহাদের মাধ্যমে প্রদত্ত হয়। যেমন মিরাজের হাদীসে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ আমার বক্তব্যে কোনো রদবদল নেই।
যদি দুটো হাদীসের সমন্বয় সাধন কিংবা ব্যাখ্যার দ্বারাও দুটো রাখার কোনো সুযোগ না থাকে, এমনকি নসখ হওয়ারও কোনো প্রমাণ না থাকে, তখন বিরোধ থেকেই যায়। সেক্ষেত্রে যদি কোনোটিকে প্রাধান্য দেয়ার কারণ দেখা দেয় তো সেটাকে প্রধান্য দেবে। অন্যথায় দুটোকেই বাদ দেবে।
বিরোধের ক্ষেত্রে একটিকে প্রাধান্য দেবার কয়েকটি কারণ থাকে-
১। সনদের ভিত্তিতে অধিক বর্ণনাকারী থাকায় প্রাধান্য পায়। সেক্ষেত্রে বর্ণনাকারীকে ফকীহ হতে হয়, মুত্তাসিল ও মারফূ হাদীস হতে হয়। সে হাদীসের বর্ণনাকারীকে হাদীসের সাথে সংশ্লিষ্ট হতে হয়। হয় সে প্রশ্নকারী হবে অথবা হাদীস সংশ্লিষ্ট কাজের কর্তা হবে।
২। এ কারণেও প্রাধান্য পায় যে, কোনো একটি হাদীসের বক্তব্যে ব্যাখ্যা ও তাকীদ থাকে।
৩। বিধান ও তার কারণের সুস্পষ্টতার জন্যে প্রাধান্য পায়। বিধানটি শরীআতের অন্যান্য বিধানের সাথে সংগতি রাখে এবং তার কারণও এরূপ জোরালো যে, বিধানের সাথে তার সম্পর্ক সুস্পষ্টভাবে জানা যায়।
৪। কখনো বাইরের কোনো ব্যাপারের কারণেও প্রাধান্য পায়। অবশ্য অধিকাংশ আলেম যদি তা মেনে নেন।
হাদীসসমূহ বাতিল হওয়াটা নিছক কাল্পনিক ব্যাপার যা কখনো ঘটে না। কোনো সাহাবীর এ কথা বলা যে, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ নির্দেশ দিয়েছেন যে, অমুক কাজ নিষেধ করেছেন, এটা করা সুন্নাত, এ কাজ যে করল সে আবুল কাসেম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নাফরমানী করল, এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন, এ ব্যাপারে অবকাশ দিয়েছেন, আমাদের এ নির্দেশ দিয়েছেন, এ কাজ করতে আমাদের নিষেধ করেছেন, এ সবই হাদীস।
তা ছাড়া সাহাবীর এ কথা বলা যে, এটা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামম-এর নির্দেশ, এ থেকে বাহ্যত হাদীসটির মারফূ হওয়া জানা যায়। তবে এ সংশয়ও থেকে যায় যে সাহাবী কারণকে নির্দেশের ভিত্তি ধরে নিয়ে নিজে ইজতেহাদ করেছেন। অথবা নিজেই বিধান নির্ধারিত করেছেন যে, এটা ওয়াজিব, এটা মুস্তাহাব, এটা ব্যাপকার্থক এবং এটা বিশেষার্থক।
কোনো সাহাবী যখন বলেন হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কাজ করতেন, তার অর্থ সে কাজ তিনি কয়েকবার করেছেন। সাহাবী যখন বলেনঃ তিনি অন্য কাজ করতেন, তার অর্থ এ নয় যে, আগের কাজটি করেননি। তবে কোনো সাহাবীর এ বক্তব্য –“আমি তাঁর সাহচর্য ছিলাম এবং তাঁকে এটা নিষেধ করতে দেখিনি, এবং আমরা তাঁর যুগে একাজ করতাম’। বাহ্যত এটা কোনো বিধানের দলীল বটে, কিন্তু হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বক্তব্য নয়।
কখনো সূত্রে বিভিন্নতার কারণে হাদীসের শব্দে পার্থক্য দেখা দেয়। এ শাব্দিক পার্থক্য মূলত হাদীসটির বক্তব্য নিজের ভাষায় বর্ণনার কারণে ঘটে থাকে। তবে যদি কোনো হাদীস এমন হয় যে, নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীদের ভাষায় কোনো পার্থক্য না থাকে তাহলে বুঝা যাবে, সেটা হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভাষা। হয়ত শব্দ প্রয়োগে আগ-পিছ হতে পারে। অথবা ‘এবং’, ‘অতঃপর’ ইত্যকায় শব্দ যোগ হতে পারে। তবে যদি বর্ণনাকারীদের ভাষায় সংশয়যোগ্য মতভেদ দেখা দেয়, এবং তারা ফেকাহ জ্ঞান, মুখস্ত শক্তি ও বর্ণনাধিক্যে কাছাকাছি ও সমমর্যাদার হন, তখন বাহ্যিক ভাষাকে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বলা যাবে না। সেক্ষেত্রে হাদীসটি শুধু সেই অর্থেই ব্যবহৃত হবে যে অর্থে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে বর্ণনা করেছেন।
অধিকাংশ বর্ণনাকারীর পদ্ধতি এটাই ছিল যে, তারা বাড়তি শব্দ বা টিকা বাদ দিয়ে মূল বক্তব্যটির গুরুত্ব দিতেন। যদি বর্ণনাকারীদের মান সমান না হয়, তাহলে নির্ভরযোগ্য রাবীর বর্ণনা কিংবা বহুল বর্ণিত বর্ণনা গ্রহণ করা হবে। অথবা তার বর্ণনা গ্রহণ করা হবে যার সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে বেশি জানা রয়েছে।
যদি জানা যায় যে, কোনো নির্ভরযোগ্য বর্ণনায় কোনো বেশি কথা বর্ণিত হয়েছে, যেমনি হযরত আয়েশা (রাঃ) ‘দাঁড়ালেন’ না বলে ‘লাফিয়ে উঠলেন’ অথবা তিনি ‘হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গোসল করলেন’ না বলে ‘তিনি চামড়ার ওপর পানি বহালেন’ কথাটি বলেছেন। এরূপ ক্ষেত্রে তার বর্ণনাটিই গ্রহণ করা হবে। তবে যদি বর্ণনাকারীদের ভেতর চরম মতভেদ দেখা দেয় এবং কোনোটিকে প্রাধান্য দেবার কোনো সূত্র না পাওয়া যায়, তা হলে যে বিশেষ ক্ষেত্রে মতভেদ দেখা দেবে সেটা বাদ দেয়া হবে।
মুরছাল হাদীসের সাথে যদি কোনো লক্ষণ যোগ হয় যেমন কোনো সাহাবীর মাওকুফ হাদীসের সমর্থন পেয়ে তা শক্তি অর্জন করল, অথবা কোনো সাহাবীর জঈফ মুসনাদ হাদীস কিংবা অন্য কোনো সাহাবীর মুরছাল হাদীস দ্বারা শক্তি পায়, এবং উভয় হাদীসের বর্ণনাকারী ভিন্ন হয় অথবা অধিকাংশ হাদীস বিশারদের বক্তব্য, অনুমান ও ইঙ্গিত দ্বারা তা সমর্থিত হয়, কিংবা এটা জানা যায় যে, সংশ্লিষ্ট বর্ণনাকারী শুধু ন্যায়নিষ্ঠ ও নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীর হাদীসই মুরছাল রূপে বর্ণনা করেন, তখন সে হাদীস দ্বারা প্রমাণ দেয়া বিশুদ্ধ হবে। অবশ্য হাদীসটি মুসনাদ হিসেবে কম মর্যাদা পাবে। তবে যদি উপরোক্ত আলোচনা অনুসারে মুরসাল হাদীস দ্বারা সমর্থিত না হয় তা হলে তা দিয়ে দলীল দেয়া যাবে না।
তেমনি দুর্বল মুখস্ত শক্তির বর্ণনাকারী যদি কোনো হাদীস বর্ণনা করেন, যদি তিনি অজ্ঞাত ও অভিযুক্ত ব্যক্তি না হন, তাহলে পছন্দনীয় কথা এটাই যে, হাদীসটি গ্রহণযোগ্য হবে। শর্ত এটাই যে, তার সমর্থনে কোনো লক্ষণ থাকতে হবে। যেমন তা কেয়াস সম্মত অথবা অধিকাংশ আলেম তা আমল করে থাকেন। যদি তা না হয় তা হলে গ্রহণযোগ্য হবে না।
যখন কোনো ছেকাহ রাবী এককভাবে কিছু বাড়তি বর্ণনা করেন এবং তা এরূপ বর্ণনা, যে ব্যাপারে অন্যান্য রাবী চুপ থাকতে পারেন, তা হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে। যেমন মুরসাল হাদীসের সনদ বর্ণনা করা কিংবা সনদের ভেতরে কোনো রাবীর বাড়তি বর্ণনা, অথবা হাদীসের উৎস বর্ণনা করা কিংবা বর্ণনা ও তার ভেতরে দীর্ঘ বক্তব্যের কারণ বর্ণনা করা, অথবা বাক্যের তাৎপর্যে পরিবর্তন না এনে স্বতন্ত্র কোনো বাক্যাংশ যোগ করা ইত্যাদি। তবে যদি সে ব্যাপারে অন্যান্য রাবী নীরব না থাকতে পারেন, যেমন তাৎপর্য পরিবর্তনকারী বাড়তি কথা অথবা এরূপ দুর্লভ বস্তুর উল্লেখ করা যা স্বভাবত বর্জনীয় নয়, তাহলে এরূপ বাড়তি বর্ণনা অগ্রাহ্য হবে।
যখন কোনো সাহাবী কোনো হাদীসকে কোনো ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন, আর সেক্ষেত্রে যদি ইজতেহাদের অবকাশ থাকে তাহলে সামগ্রিক বিবেচনায় এ প্রয়োগকে বাহ্যিক বলে ধরা হবে, যতক্ষণ না এর বিরুদ্ধে কোনো দলীল পাওয়া যায়। তবে যদি সেক্ষেত্রে ইজতেহাদের কোনো অবকাশ না থেকে থাকে, তা হলে এ প্রয়োগ জোরদার হবে। যেমন কোনো জ্ঞানী ও ভাষাবিদ অবস্থা ও বক্তব্যের লক্ষণ ও ইঙ্গিতের মাধ্যমে কোনো ব্যাপার বুঝে নেন।
সাহাবা ও তাবেঈনদের ভেতরকার মতভেদের সমাধান হলো এই যে, যদি তাতে সমন্বয় সম্ভব হয়, তা হলে সেটাই উত্তম এবং ওপরে আলোচিত পদ্ধতিগুলোর যে কোনো এক পদ্ধতিতে তা হতে হবে। তা না হলে এ প্রশ্নে দুই বা ততোধিক অভিমত রয়েছে। সেক্ষেত্রে দেখা চাই যে, কোনটি অপেক্ষাকৃত সঠিক বিবেচিত হতে পারে।
সাহাবাদের মজহাবগুলোর উৎস জানা এক গুপ্ত জ্ঞানের ব্যাপার। সেক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রয়াস চালালে কিছু না কিছু অংশ লাভ হবেই। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
অধ্যায়-৮১
সাহাবা ও তাবেঈনের খুঁটিনাটি ব্যাপারে মতভেদের কারণসমূহ
এটা সুস্পষ্ট কথা যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পুণ্য যুগে ফিকাহ শাস্ত্র গড়ে ওঠেনি। আজকের ফকীহরা যেভাবে বিভিন্ন মাসআলার চুলচেরা বিশ্লেষণ ও তা নিয়ে বিতর্ক করেন, তখন তেমনটা ছিল না। এখন তো চরম পরিশ্রম স্বীকার করে প্রত্যেক ব্যাপারের মূল কাঠামো, শর্তাবলি ও নিয়ম পদ্ধতি দলীল প্রমাণ দিয়ে ভিন্ন ভিন্নভাবে বর্ণনা করা হচ্ছে। কোনো কোনো ব্যাপারে কি কি প্রশ্ন থাকতে পারে এবং তার কি কি সমাধান হতে পারে তা যুক্তি তর্ক ও দলীল প্রমাণ দিয়ে নির্ধারিত হচ্ছে। যার সীমারেখা চিহ্নিত হওয়ার দরকার তার সীমারেখা নির্ণীত হচ্ছে এবং যা নির্দিষ্ট হওয়া দরকার তা নির্দিষ্ট করে দেয়া হচ্ছে। তারা এ ধরনের বহুকাজ করে চলছেন।
অবশ্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে এরূপ ছিল যে, তিনি ওজু করতেন ও সাহাবায়ে কেরাম তা দেখতেন। তারপর তিনি যেভাবে ওজু করেছেন তারা সেভাবে ওজু করতেন। এটা মূল কাঠামো ও এটা নিয়ম পদ্ধতি। এসব তাদের বাতলাতে হতো না। তেমনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায পড়তেন ও সাহাবায়ে কেরাম তা দেখতেন। তারপর তিনি যেভাবে নামায পড়েছেন তারাও সেভাবে পড়তেন। তিনি হজ্ব করেছেন এবং সাহাবায়ে কেরাম তা দেখেছেন এবং তিনি হজ্বে যে যে কাজ যেভাবে করেছেন, তারাও সেভাবে সে সে কাজ করেছেন।
বস্তুত হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাধারণ অভ্যেস এটাই ছিল এবং তিনি এটা বলতেন না যে, ওযুর ছয় ফরজ বা চার ফরজ। তা ছাড়া তিনি এ ধারণাও পোষণ করতেন না যে, কেউ ওজু করতেন বসে এক নাগাড়ে তা শেষ করবে না, তাই তা না করলে ওজু হবে কি, হবে না তা বলতে হবে। হ্যাঁ, কদাচিত কোনো ব্যাপারে হয়ত তিনি কিছু বলতেন। সাহাবায়ে কেরামও এ সব ব্যাপারে খুব কমই জানতে চাইতেন।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেছেন –‘আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু-এর সাহাবায়ে কেরাম থেকে উত্তম কোনো জাতি দেখিনি। তারা তাঁর গোটা জীবনে মাত্র তেরোটি মাসআলা জানতে চেয়েছেন আর সেগুলো সবই কুরআন মজীদে বিদ্যমান রয়েছে। তার ভেতর একটি হলো হারাম বা নিষিদ্ধ মাসগুলো সম্পর্কে। যেমন বলা হয়েছে –তোমার কাছে কি নিষিদ্ধ মাস সম্পর্কে জানতে চাইছে যে, তাতে লড়াই চলবে কিনা? তুমি বলে দাও, তাতে লড়াই করা মহা পাপ। অপরটি হলো তোমার কাছে কি হায়েজ সম্পর্কে জানতে চাইছে?
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন –“সাহাবায়ে কেরাম শুধু সেটাই জানাতে চাইতেন, যা কল্যাণপ্রদ”। হযরত ইবনে উমর (রাঃ) বলেন- ‘যা ঘটেনি তা নিয়ে প্রশ্ন করো না। আমি হযরত ইবর (রাঃ) সম্পর্কে শুনেছি যে, তিনি তাদের অভিশাপ দিতেন, যারা এরূপ ব্যাপারে প্রশ্ন করত যা এখনো ঘটেনি।
কাসেম বলেন, ‘তোমরা কি সে বিষয়ে প্রশ্ন করছ যে বিষয়ে আমরা প্রশ্ন করিনি? তোমরা কি এমন সব ব্যাপারে অনুসন্ধান করছ যা আমরা কখনো করিনি? তোমরা এমন কিছু জানতে চাচ্ছ, যে ব্যাপারে আমরাই জানা নেই যে তা কি বস্তু? যদি আমরা তা জানতাম তা হলে তা গোপন করা আমাদের জন্যে জায়েয হতো না”।
হযরত ইসহাক ইবনে উমর থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বললেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবায়ে কেরামদের ভেতর আমি যাদের সাথে মিলিত হয়েছি তাদের সংখ্যা যারা আমার আগে চলে গেছেন তাদের চেয়ে বেশি ছিল। আমি তাদের চাইতে সহজ সরল চরিত্রের ও কম কড়াকড়ি করার লোক কাউকে দেখিনি।
হযরত উবাদা ইবনে সমরকন্দি থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তার কাছে সেই মহিলা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল যার এক গোত্রের সাথে মৃত্যু ঘটেছে এবং তার কোনো অভিভাবক ছিল না। তিনি তখন বললেন –‘আমি এমন একটি জাতির দেখা পেয়েছি যারা তোমাদের মতো এরূপ কড়াকড়ি করতেন না এবং তোমরা সে ধরনের প্রশ্ন তোল তারা যেরূপ তোলতেন না’। এ সব আছার বর্ণনাকারীরা ভর্ৎসনা করে গেছেন।
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে লোকেরা বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে প্রশ্ন করতেন। তিনি সে সব ব্যাপারে তার অভিমত জানাতেন। বিভিন্ন মকদ্দমাও সালিশি আসত। তিনি তার ফয়সালা দিতেন। তিনি লোকদের ভালো কাজ করতে দেখলে প্রশংসা করতেন এবং মন্দ কাজ করতে দেখলে নিষেধ করতেন। তিনি কোনো প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন, কোনো মকদ্দমার ফয়সালা দিয়েছেন কিংবা কোনো কাজ করতে নিষেধ করেছেন, এসব কিছুই ছিল ভর মজলিসের ব্যাপার।
হযরত আবূ বকর (রাঃ) ও হযরত উমর (রাঃ)-এর যুগেও এভাবে কেটেছে। তাদের যদি কোনো মাসআলা জানা না থাকত তা হলে লোকদের জিজ্ঞেস করতেন কেউ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এ ব্যাপারে কিছু শুনেছেন কিনা? এভাবে একদিন হযরত আবূ বকর (রাঃ) জোহরের নামাযের সমবেত মুসল্লীদের জিজ্ঞেস করলেন- ‘দাদি কত অংশ পাবে সে ব্যাপারে আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কিছু শুনিনি। তোমরা কেউ কি শুনেছ? মুগীরা বললেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাদিকে ষষ্ঠমাংশ প্রদান করেছেন। তিনি প্রশ্ন করলেনঃ তুমি ছাড়া আর কেউ তা জানে? মুহাম্মদ ইবনে সালমা বললেনঃ মুগীরা সত্য বলেছেন। অতঃপর আবু বকর (রাঃ) দাদির জন্যে ষষ্ঠমাংশ নির্ধারণ করলেন।
এভাবে গোলাম আজাদ করার ব্যাপারে হযরত উমর (রাঃ) ও লোকদের কাছে প্রশ্ন করলেন এবং মুগীরা (রাঃ)-এর বর্ণনা শুনে তিনি তার ভিত্তিতে রায় দেন। তেমনি প্লেগ মহামারীর ক্ষেত্রে তিনি লোকদের কাছে করণীয় সম্পর্কে পদক্ষেপ নেন। তদ্রুপ মাজুসীদের এক ব্যাপারে তিনি জিজ্ঞেস করে আবদুর রহমান ইবনে আওফের বর্ণনা গ্রহণ করেন। তেমনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের অভিমতের সমর্থনে হযরত মাকাল ইনে ইয়াসারের বর্ণনা গ্রহণ করার ব্যাপারটি। তেমনি হযরত উমর (রাঃ)-এর দরজা থেকে হযরত আবূ মূসা আসআরী (রাঃ)-এর ফিরে যাওয়া এবং সে ব্যাপারে উমর (রাঃ)-এর কোনো হাদীস জানতে চাওয়া ও আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) কর্তৃক আবু মূসার হাদীসের সত্যতা ঘোষণা তারই উদাহরণ। এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা সহীহদ্বয়ে ও সুনান সমূহে পরিজ্ঞাত ও বর্ণিত হয়েছে।
মোটকথা, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এটাই রীতি ছিল। প্রত্যেক সাহাবীকে আল্লাহ পাক যতটুকু তওফীক দিয়েছেন হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইবাদত, ফতোয়া, ফয়সালা দেখেছেন ও তা স্মরণে রেখেছেন ও বুঝে নিয়েছেন। তাছাড়া নানা লক্ষণ ও ইশারা ইঙ্গিত থেকেও তারা মূল বক্তব্য বুঝে নিতেন। সাহাবায়ে কেরাম এ পদ্ধতিতেই কোনো হুকুমকে মোবাহ ও কোনো হাদীসকে মানসুখ বলে সাব্যস্ত করতেন।
সাহাবায়ে কেরামের কাছে নির্ভরযোগ্যতার মানদণ্ড ছিল অন্তরে স্বস্তি, প্রত্যয় ও প্রশান্তি সৃষ্টি হওয়া। তারা নানাবিধ দলীল প্রমাণের টানা হেঁচড়ায় জড়িত হতেন না। যেমন তোমরা দেখতে পাচ্ছ যে, গ্রাম্য আরবরা কোনো কিছু খোলামেলাভাবে বলে দিলে বা ইশারা ইঙ্গিতে বললেই উদ্দিষ্ট ব্যাপারটি বুঝে ফেলে ও তারা নিশ্চিন্ত হয়ে যায়। অথচ তারা জানেও না যে, ব্যাপারটি ঘটার পেছনে কি সব কার্যকারণ রয়েছে। অবশেষে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগ শেষ হলো এবং সাহাবায়ে কেরামের যুগও একইভঅবে পার হলো।
অতঃপর সাহাবয়ে কেরাম বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়লেন। প্রত্যেক সাহাবী কোনো না কোনো এলাকার অনুকরণীয় পথিকৃৎ হয়ে গেলেন। তাছাড়া ঘটনাবলিও অনেক বেড়ে চলল। ফলে মাসআলা মাসায়েলও অনেক জানতে চাওয়া হচ্ছিল। তখন প্রত্যেক সাহাবী নিজ নিজ স্মৃতি ও মেধা থেকে জ্ঞাত ও উদ্ভাবিত ফতোয়া দিতেন। যদি জ্ঞাত বা তদনুসারে উদ্ভাবিত জবাব যথেষ্ট না হতো, তাহলে নিজ জ্ঞান প্রয়োগ করে জবাব উদ্ভাবন করতেন। তখন তারা সেসব কারণ খুঁজতেন যেসব কারণকে ভিত্তি করে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুকুম দিতেন। বস্তুত যেখানে কারণ পাওয়া যেত সেখানে তারাও হুকুম জারি করতেন এবং সে হুকুমকে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উদ্দেশ্যের সাথে খাপ খাওয়াতে তিল মাত্র কসুর করতেন না। এরূপ ক্ষেত্রেই তাদের ভেতর কয়েক ধরনের মতভেদ দেখা দেয়।
১। এক সাহাবী কোনো এক ঘটনা বা মাসআলা সম্পর্কে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কোনো হুকুম শুনেছেন এবং অন্য সাহাবী তা শুনেননি। ফলে তিনি সে ব্যাপারে ইজতেহাদ করেছেন। তাই মতভেদ দেখা দিয়েছে। ইজতেহাদও কয়েক ধরনের হয়। যেমন একজনের ইজতেহাদ হাদীসের সাথে মিলে গেছে। নাসায়ী প্রথম বর্ণনা করেছেণ যে, ইবনে মাসউদ (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হলো যে, এক মহিলার স্বামী মারা গেছে এবং সে স্ত্রীর কোনো মোহরানা নির্ধারণ করে যায়নি, এখন কি হবে? তিনি বললেন, এ ব্যাপারে আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কিছু বলতে শুনিনি। তারপর থেকে এক মাস ধরে তার কাছে লোক এসে এসে এ ব্যাপারে তার অভিমত জানার জন্যে পীড়াপীড়ি করত। অবশেষে তিনি ভেতে চিন্তে এ রায় দিলেন যে, স্ত্রীকে মোহরে মেছাল দিতে হবে, তাকে অবশ্যই ইদ্দত পালন করতে হবে এবং মীরাছের অংশ পাবে। তখন হযরত মাকাল ইবনে ইয়াসার দাঁড়িয়ে বললেন, তাদের এক মহিলার ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ফয়সালাই প্রদান করেছেন। হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) তা শুনে এত খুশী হলেন যে, ইসলাম গ্রহণের পর এরূপ খুশি আর কখনো হননি।
২। দুই সাহাবীর ভেতর হাদীসের শ্রবণ নিয়ে মতান্তর দেখা দেয়। হাদীসদ্বয়ও র্দ্ব্যর্থবোধক এবং যেদিকে ধারণা প্রবল হয়, সেটাই গ্রহণ করা যায়। অবশেষে এক সাহাবী পরে শ্রুত অন্য হাদীস মেনে নেন। যেমন হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর মজহাব এটাই ছিল যে, ফরজ গোসলের অবস্থায় সকাল হয়ে গেলে তার রোযা হবে না। অতঃপর যখন উম্মুল মুমেনীনদের কেউ কেউ তার বিপরীত হাদীস শোনালেন, তখন তিনি তার মত বদলালেন।
৩। কোনো সাহাবীর কাছে এমন হাদীস পৌঁছল যা তার প্রবল ধারণার অনুকূল নয়। ফলে তিনি ইজতেহাদ বর্জন না করে হাদীসকে ত্রুটিপূর্ণ বর্ণনা বলে আখ্যায়িত করলেন। এর উদাহরণ হচ্ছে সেই বর্ণনাটি যা অসুলশাস্ত্রবিদগণ বর্ণনা করেছেন। তা এই যে, ফাতেমা বিনতে কায়েস হযরত উমর (রাঃ)-এর কাছে সাক্ষ্য দিল যে, তাকে তিন তালাক দেয়া হয়েছে, অথচ সে জন্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার থাকা খাওয়ার কোনো ব্যবস্থার কথা বলেননি। হযরত উমর (রাঃ) তার সাক্ষ্য এই বলে প্রত্যাখ্যান করলেন যে, আমি এক মহিলার সাক্ষ্যের ওপর আল্লাহর কিতাব ছাড়তে পারি না। আমি এটাও জানিনা যে, সে সত্য সাক্ষ্য দিল, না মিথ্যা সাক্ষ্য দিল। তাই তালাকপ্রাপ্ত নারী ইদ্দত পর্যন্ত থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা পাবে। হযরত আয়েশা (রাঃ) ফাতেমাকে বললেন, তুমি কি আল্লাহকে ভয় কর না? অর্থাৎ সে থাকা-খাওয়ার সুযোগ পাবে না, এ কথা বলে সরাসরি আল্লাহর কিতাবের বিরোধিতা করতে কি ভয় পেল না?
দ্বিতীয় উদাহরণ হচ্ছে সহীহদ্বয়ের একটি বর্ণনা। তাতে বলা হয়েছে, হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ)-এর মজহাব ছিল এই যে, ফরজ গোসলের অবস্থায় যদি পানি না পাওয়া যায় তা হলে তায়াম্মুম যথেষ্ট হবে না। তখন তার সামনে হযরত আম্মার (রাঃ) এ হাদীস পেশ করলেন যে, তিনি এক সফরে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে ছিলেন। তখন তার ফরজ গোসলের ব্যাপার দেখা দিল। কিন্তু পানি পাওয়া গেল না। অগত্যা তিনি মাটিতে গড়াগড়ি গেলেন। তারপর যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে এ ঘটনা বললেন, তখন তিনি তাকে বললেন –‘তোমার তো এতটুকু করাই যথেষ্ট ছিল যে, মাটিতে দু’হাত রেখে তা নিজ মুখমণ্ডলে ও দু’হাতের কনুই পর্যন্ত মাসেহ করতে। ‘হযরত উমর (রাঃ) তা মেনে নিলেন না। একটি প্রচ্ছন্ন প্রশ্ন যা তার জানা ছিল, সে কারণে তিনি তার হাদীসকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করতে পারেননি। অবশেষে উম্মতের দ্বিতীয় স্তরে এসে যখন বিভিন্ন সূত্রে হাদীসটি বর্ণিত হয়ে মাশহুর হাদীসের মর্যাদা পেল এবং প্রচ্ছন্ন অবশিষ্ট থাকল না, তখন সবাই তার ওপর আমল করল।
৪। চতুর্থ অবস্থাটি হলো এই যে, সাহাবীটির কাছে হাদীসই পৌঁছেনি। তার উদাহরণ হচ্ছে ইমাম মুসলিমের উদ্ধৃত বর্ণনাটি। তাতে বলা হয়েছে, ইবনে উমর (রাঃ) নারীদের গোসলের সময় মাথার কাপড় খুলে নেবার নির্দেশ দিতেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) যখন তা শুনতে পেলেন, তখন ইবনে উমরের ব্যাপারে বিস্ময় প্রকাশ করে বললেনঃ সে নারীদের গোসলের সময় মাথার কাপড় খুলে নেয়ার হুকুম দিচ্ছে? তাহলে সে তাদের মাথা মুণ্ডানোর নির্দেশ দেয় না কেন? আমি ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একই পাত্র থেকে পানি নিয়ে গোসল করতাম। আমি তো তখন এতটুকুই করতাম যে, যথাবস্থায় মাথায় তিনবার পাটি ঢেলে নিতাম।
দ্বিতীয় উদাহরণ হলো এই যে, ইমাম যুহরী বর্ণনা করেনঃ হযরত হেন্দা (রাঃ) হায়েজ অবস্থায় নামায পড়তে হবে না বলে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেছেন তা জানতে পাননি বলে তিনি নামায পড়তে পারতেন না বলে কাঁদতেন।
৫। সাহাবাদের মতভেদের আরেকটি কারণ হলো এই যে, তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একটি কাজ করতে দেখার পর কেউ সেটাকে মোবাহ কাজ বলে ভেবেছেন, কেউ ভেবেছেন ইবাদত। তার উদাহরণ হলো অসুল শাস্ত্রবিদদের আলোচ্য ‘কামিয়ায়ে তাহসীব’ অর্থাৎ হজ্বের সময় হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আবতাহ প্রান্তরে অবস্থানের বর্ণনাটি। হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) ও ইবনে উমর (রাঃ) সেটাকে ইবাদত বলে ভেবেছেন এবং সেটাকে হজ্বের অন্যতম সুন্নত বলে সাব্যস্ত করেছেন। পক্ষান্তরে, হযরত আয়েশা (রাঃ) ও হযরত ইবনে উমর (রাঃ)-এর মজহাব হলো এই যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘটনাচক্রে সেখানে অবস্থান করেছিলেন, তাই তা সুন্নত নয়।
দ্বিতীয় উদাহরণ হচ্ছে, জমহুরের মজহাব হলো তাওয়াফের সময় রমল করা সুন্নাত। অথচ হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর মজহাব হলো তা সুন্নাত নয়। কারণ হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশেষ কারণে সাময়িকভাবে তা করেছিলেন। বিশেষ কারণটি এই ছিল যে, মুশরিকরা বলেছিল, মদীনার উত্তাপ মুসলমানদের দুর্বল করে ফেলেছে, তাই বুক টান করে বাহাদুরের মতো হেলেদুলে রমল করে তার জবাব দেয়া হয়েছিল। সাহাবাদের ভেতর মতভেদের আরেকটি কারণ হলো এই যে, ধারণার ভেতরে তারতম্য সৃষ্টি হওয়া। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজ্ব করেছেন, তখন লোকজন তা দেখেছেন। অতঃপর কেউ ধারণা করেছেন যে, তিনি তামাত্তু হজ্ব করেছেন। কেউ আবার ভেবেছেন, তিনি কারেন হজ্ব করেছেন। কেউ কেউ ভেবেছেন, তিনি মুফরাদ হজ্ব করেছেন।
দ্বিতীয় উদাহরণ হলো সাঈদ ইবনে জুবায়ের থেকে আবু দারদার বর্ণিত বিবরণটি। তিনি বলেছেন, আমি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম –‘হে আবু আব্বাস! আমি সাহাবায়ে কেরামের এ মতভেদ দেখে বিস্মিত হয়েছি যে, তারা হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এহরাম বাঁধা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করছেন। তখনতিনি বললেন, এ ব্যাপারটি আমি সবচেয়ে ভালো জানি। সেটা হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি হজ্বের ঘটনা এবং তা নিয়েই এ মতভেদ। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজ্বের উদ্দেশ্যে বের হয়ে জুল হালিফায় এসে নামায পড়লেন এবং সেখানেই এহরাম বাঁধলেন। তারপর দু’রাকাত নামায পড়ে হজ্বের তালবিয়াহ পাঠ করলেন। লোকেরা তা শুনতে পেয়েছে। আমি তা ভালোভাবে স্মরণ রেখেছি। অতঃপর তিনি বাহনে চড়লেন। লোকেরাও তা শুনতে পেয়েছে। মতভেদের কারণ হলো এই যে, তাঁর কাছে লোক ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে একের পর এক দল আসত। ফলে উটনী খাড়া হবার পরের তালবিয়াহ যারা শুনল, তারা এটাকেই শুরু বলে ভাবল। অতঃপর হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রওয়ানা হলেন। যখন তিনি বায়দা উপত্যকার সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছলেন তখন আবার তালবিয়াহ পাঠ করলেন। তাও লোকে শুনতে পেল। তখন তারাও ভাবল, তালবিয়াহ পাঠ এখান থেকে শুরু হলো। অথচ আল্লাহর কসম! তিনি তাঁর নামাযের জায়গা জুল হালিফায় এহমার বেঁধে সেখানে তালবিয়াহ শুরু করেন।
তারপর রওয়ানার সময় উটনীতে চড়ে এবং পথিমধ্যে বায়দা পাহাড়ের শীর্ষে উঠে তিনি তালবিয়াহ পাঠ করেন।
৬। সাহাবাদের মতভেদের আরেকটি কারণ হলো ভুল ভ্রান্তি হয়ে যাওয়া। যেমন হযরত ইবনে উমর (রাঃ) বলে বেড়াতেন, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রজব মাসে উমরা করেছেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) যখন তা শুনলেন, বললেনঃ সে ভুলে গেছে।
৭। স্মৃতি বিভ্রাটের কারণেও সাহাবাদের ভেতর মতভেদ দেখা দিয়েছে। যেমন ইবনে উমর অথবা উমর (রাঃ) হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, মৃত ব্যক্তির ওপর পরিবারবর্গের কান্নাকাটির জণ্যেও আজাব হয়। হযরত আয়েশা (রাঃ) শুনে বললেন –হাদীসটি তার ঠিকমত জানা নেই। ঘটনা এই যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরলোকগত এক ইয়াহুদী রমণীর ঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি শুনতে পেলেন, তার পরিবারের লোকজন তাকে স্মরণ করে বিলাপ করে চলছে। তখন তিনি বললেনঃ কবরে তো সে শাস্তি ভোগ করছে আর এরা ঘরে বসে তার জন্য কাঁদছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর তা শুনে ভাবলেন যে, কান্নার কারণে শাস্তি হচ্ছে এবং তিনি প্রত্যেক মুর্দারের বেলায়ই এ বিধান প্রযোজ্য ভাবলেন।
৮। বিধানের কারণ সম্পর্কে মতভেদের কারণেও সাহাবাদের ভেতর মতভেদের দেখা দেয়। যেমন জানাযার জন্যে দাঁড়ানো। কেউ বলেছেন, ফেরেশতাদের সম্মানে দাঁড়াতে হবে। এটা মোমেন ও কাফের উভয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কেউ বলেছেন, মৃত্যুকে ভয় করে দাঁড়াতে হবে। এটাও মোমেন ও কাফের উভয়ের বেলায় প্রযোজ্য। হযরত হাসান ইবনে আলী (রাঃ) বলেনঃ এক ইহুদী মহিলার জানাযার খাট হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে দিয়ে বয়ে নেয়ার সময় তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি এটা পছন্দ করলেন না যে, ইয়াহুদির জানাযার খাটের নিচে তার মাথা থাকুক। মূলত এ ব্যাপারটি কাফেরের ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট।
৯। মতভেদের অন্য এক কারণ হলো, দুটো ব্যাপারের সমন্বয় ঘটানোর ক্ষেত্রে পারস্পরিক মতান্তর। তার উদাহরণ এই যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খায়বরের যুদ্ধের বছরে মুতা বিয়ের বিয়ের অনুমতি দিয়েছিলেন। অতঃপর আওতাসের বছরেও অনুমতি দিয়েছিলেন। তারপর নিষিদ্ধ করে দেন। তাই ইবনে আব্বাস (রাঃ) এভাবে সমন্বয় ঘটালেন যে, প্রয়োজনে বৈধ ছিল, অপ্রয়োজনে হারাম হয়েছে। এখানে হারামের বিধান রয়েছে। জমহুরের অভিমত হলো এই, বিশেষ ক্ষেত্রে অনুমতি দিয়ে শুধু মুবাহ করা হয়েছিল। এখন নিষেধাজ্ঞা এসে ক্ষেত্র বিশেষে মোবাহ করাও মানসুখ করেছে।
আরেক উদাহরণ এই যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেবলামুখী হয়ে ইস্তেঞ্জা করতে নিষেধ করেছেন। এখন একদল সাহাবীর মাজহাব হলো এই যে, এ বিধান ব্যাপকার্থে প্রযোজ্য এবং মানসুখ হয়নি। অথচ হযরত জাবের (রাঃ) হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তেকালের এক বছর আগে তাকে কেবলামুখী হয়ে ইস্তেঞ্জা করতে দেখেছেন। তাই তার মজহাব হলো, পূর্বেকার নিষিদ্ধকরণ বাতিল হয়ে গেছে। তেমনি ইবনে উমর (রাঃ) দেখেছেন, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেবলার দিকে পিঠ রেখে বাহ্যাক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন। তিনি এ কারণে অধিকাংশ সাহাবীর মাজহাব মেনে নেননি। অবশেষে ইমাম শাহবী সহ একদল এ দুটো মতের এভাবে সমন্বয় ঘটালেন যে, মুক্ত এলাকার বন-বাদাড়ে কেবলা বিবেচ্য হবে, কিন্তু বন্ধ পায়খানা, গাছ বা বাথরুমে তা বিবেচনার প্রয়োজন নেই। তবে অধিকাংশের মজহাব এটাই যে, নিষেধাজ্ঞা সর্বক্ষেত্রেই প্রযোজ্য এবং যেহেতু হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা করেছেন তা তার জন্যে বিশেষ কারণে হয়ত খাস ঘটনা ছিল, তাই তাঁর নিষেধাজ্ঞা বাতিল করে না এবং তা কোনো অবস্থার সাথে নির্দিষ্টও হতে পারে না।
মোটকথা, এ সব কারণেই হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবাদের ভেতর ছোটখাটো মতভেদ দেখা দিয়েছে। তাবেঈগণের যতটুকু তাওফীক হয়েছে সাহাবাদের থেকে হাদীস সংগ্রহ করেছেন। তাঁরা হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস ও সাহাবাদের যে মাজহাব জানতে পেয়েছেন তা ভালোভাবে স্মৃতিস্থ করেছেন, তা বুঝে নিয়েছেন এবং সেগুলো সন্নিবেশ করেছেন। তারপর কোনোটির ওপর কোনোটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং কোনো কোনো বক্তব্য ও অভিমত তাদের দৃষ্টিতে দুর্বল ও বাতিল বলে গণ্য হয়েছে। এমনকি তা হয়ত কোনো বড় সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে। যেমন ফরজ গোসলের লোকেরা তায়াম্মুম করা সম্পর্কে ইবনে উমর (রাঃ) ও ইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর বর্ণিত মাজহাব যখন হযরত আম্মার (রাঃ) ও ইমরান ইবনে হেসীন প্রমুখের প্রাসঙ্গিক হাদীস মাশহুর হয়ে গেল, তখন তাদের মাজহাব অসার প্রমাণিত হলো।
এভাবে তাবেঈ আলেমদের প্রত্যেক আলেমের মাজহাব তার খেয়াল মোতাবেক দাঁড়িয়ে গেল। প্রত্যেক শহরে দ্বীনের একজন ইমাম দাঁড়িয়ে গেলেন।
যেমন মদীনায় হযরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়াব ও সালেম ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উমর ছিলেন। তাদের পরে ইমাম হলেন সেখানে ইমাম যুহরী, কাজি ইয়াহিয়া ইবনে সাঈদ ও রবীআ ইবনে আবদুর রহমান। মক্কার ইমাম ছিলেন আতা ইবনে আবি রিবাহ।কূফার ইমাম ছিলেন ইবরাহীম নাখঈ ও শাবী। বসরায় ইমাম ছিলেন হাসান বসরী (রহঃ)। ইয়ামানের ইমাম ছিলেন তাউস ইবনে কায়সার। সিরিয়ার ইমাম ছিলেন মাকহুল (রহঃ)। আল্লাহ তাআলা অজস্র অন্তরকে তাদের জ্ঞানের দিকে আকৃষ্ট করেছেন। দলে দলে লোক তাদের কাছে ছুটে গেছেন। তারা তাদের থেকে হাদীস, সাহাবায়ে কেরামের অভিমত ও ফতোয়া সংগ্রহ করেছেন এবং তাদের মাজহাব ও জ্ঞান গবেষণা জ্ঞাত হয়েছেন। তারা তাদের কাছে মাসআলা জানতে চাইতেন। ফলে তাদের ভেতর মাসআলার চর্চা চালু হলো। বিভিন্ন সমস্যা তাদের সামনে সমাধানের জন্যেপেশ করা হতো। হযরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়াব, ইবরাহীম নাখঈ প্রমুখ ফিকাহ শাস্ত্রের বিভিন্ন অধ্যায় একত্র করলেন। প্রত্যেক অধ্যায়ের তারা মূলনীতি বা অসূল নির্ধারণ করলেন যা তারা পূর্বসূরিদের কাছ থেকে অর্জন করেছিলেন।
হযরত সাঈদ ও তাঁর সহচরদের অভিমত ছিল এই যে, ফিকাহ শাস্ত্রে মদীনার আলেমদের জ্ঞানই ছিল পাকাপোক্তা। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ), হযরত আয়েশা (রাঃ), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর ফতোয়া ও মদীনার কাজিদের ফায়সালা তাদের ফিকাহর ভিত্তি ছিল। আল্লাহ পাক তাদের যা তাওফীক দিয়েছেন, তদনুসারে তারা তা সমবেত করেছেন। তারপর তা নিয়ে তারা গবেষণা ও অনুসন্ধান চালিয়েছেন। আর তার ওপর সমগ্র মদীনার আলেমরা একমত হয়েছেন। তারা মজবুতভাবে তা গ্রহণ করেছেন। যে ব্যাপারে মতভেদ ছিল তা থেকে তারা শক্তিশালী ও প্রাধান্যপ্রাপ্ত মতটি গ্রহণ করেছেন।
মতের প্রাধান্য প্রাপ্তির কারণ বিভিন্ন ছিল। হয় তা অধিকাংশ আলেমের সমর্থনপুষ্ট, নয়ত তা কোনো জোরদার কেয়াসের অনুকূল ছিল অথবা কিতাব ও সুন্নাহর সুস্পষ্ট ভাষ্যমতে তা উদ্ভাবিত হয়েছে। যখন তারা তাদের সংরক্ষিত জ্ঞান থেকে মাসআলার জবাব পাননি, তখন তারা পূর্ববতীদের অভিমত এবং ইশারা ইঙ্গিত নিয়ে অনুসন্ধান ও গবেষণা চালিয়েছেন। ফলে প্রত্যেক অধ্যায়ে তারা বহু মাসআলার সমাধান বের করেছেন।
হযরত ইবরাহীম নাখঈ ও তাঁর সহচরদের অভিমত ছিল এই যে, ফিকাহর ক্ষেত্রে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ ও তাঁর সহচরদের অভিমতই সর্বাধিক মজবুত। যেমন হযরত আরকামা (রহঃ) ইমাম মাসরূককে বললেন –আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ থেকে পাকা ফিকাহবিদ আর কেউ আছেন কি?
হযতর আবু হানীফা (রঃ) ইমাম আওযাঈকে বলেন, সালেম থেকে ইবরাহীম নাখঈ ফিকাহশাস্ত্র অধিকতর মজবুত ছিলেন। আর যদি সাহাবী হিসেবে অধিকতর মর্যাদার অধিকারী না হতেন তা হলে বলতাম, আবদুল্লাহ ইবনে উমর থেকে আলকামা ফিকাহ শাস্ত্রে অধিকতর পারদর্শী। তারপর আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ তো আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদই।
ইমাম আবু হানীফার ফিকাহর ভিত্তিই হলো হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের ফতোয়া, হযরত আলী (রাঃ)-এর ফয়সালা ও ফতোয়া, কাজি শুরাইর ফয়সালা এবং কুফার কাজিদের ফয়সালাসমূহ। তাঁকে আল্লাহ পাক যতখানি তওফীক দিয়েছেন তদনুসারে তিনি সেগুলো সমবেত করেছেন। তারপর তিনি সাহাবাদের আছার নিয়ে সেভাবে গবেষণা ও অনুসন্ধান চালিয়েছেন যেভাবে মদীনার আলেমগণ করেছেন এবং তাঁদের অনুকরণেই তিনি মাসআলা উদ্ভাবন করেছেন। এভাবেই প্রত্যেক অধ্যায়ের মাসআলা-মাসায়েল বিন্যস্ত হলো। এবং সাঈদ ইবনে মুসাইয়াব মদীনার ফকীহদের ভাষ্যকার হলেন।
তাঁর হযরত উমর (রাঃ)-এর ফয়সালা ও হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ)-এর হাদীস সর্বাধিখ স্মৃতিস্থ ছিল। কূফার ফকীহদের মুখপাত্র ছিলেন হযরত ইবরাহীম নাখঈ। যখন এ দু’জন কোনো কথা বলতেন, এবং কারো সাথে সে কথার সম্পর্ক উল্লেখ না করতেন, তা হলেও দেখা যেত, তা পূর্বসূরিদের কারো সাথে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে মিলে গেছে। উক্ত শহরদ্বয়ের ফকীহগণ সর্বসম্মতভাবে তাঁদের দুজনকে মেনে নিয়েছেন। তারা সেই অর্জিত ইলেমের ভিত্তিতেই তারা মাসআলা-মাসায়েল উদ্ভাবন করেছেন। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
অধ্যায়-৮২
ফিকাহবিদদের বিভিন্ন মজহাব সৃষ্টির কারণ
জেনে রাখুন, তাবেঈনের যুগ পার হলে আল্লাহ তাআলা ইলম চর্চার জন্যে আরেকটি দল সৃষ্টি করলেন, কারণ এর মাধ্যমে তিনি তাঁর রাসূলের প্রতিশ্রুতি পূরণ করলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে গেছেনঃ
“পরবর্তীকালে যারা আসবে তাদের প্রতিটি যুগেই একদল ন্যায়ানুগ লোক দ্বীনি ইলম অর্জন করবে”।
বস্তুত তাবেঈগণের যার সাথে যার সাক্ষাৎ হয়েছে তার কাছ থেকে পরবর্তী আলেমগণ অযু, গোসল, নামায, হজ্ব, বিয়ে, বেচা-কেনা এবং প্রয়োজনীয় যাবতীয় ব্যাপারের মাসায়েল শিখে নিয়েছেন। তাবেঈগণের কাছ থেকে তারা হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস, বিভিন্ন শহরের কাজি ও মুফতীদের ফয়সালা ও ফতোয়া এবং বিভিন্ন প্রয়োজণীয় মাসায়েল জেনে নিয়েছেন। তারপর তার ওপর তারা ইজতিহাদ করে আরও মাসায়েল তৈরী করেছেন। ফলে তারাও জাতির ভেতরে উচ্চ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তারা যাবতীয় দ্বীনি কাজকর্মের ইমামরূপে গণ্য হলেন। তারাও শেষে তাদের পূর্বসূরী ওস্তাদদের মতো বাণীসমূহের ইশারা-ইঙ্গিত ও চাহিদা নিয়ে গবেষণা ও অনুসন্ধান চালালেন। তারপর তা থেকে ফয়সালা বের করলেন, ফতোয়া দিলেন, বর্ণনা প্রদান করলেন ও শিক্ষা দিলেন।
এ স্তরের আলেমদের অনুসৃত পদ্ধতি একই ধরনের ছিল। তাঁদের পদ্ধতির সারকথা ছিল, তাঁরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুসনাদ ও মুরসাল সব হাদীসই নিতেন এবং সাহাবা ও তাবেঈদের ফতোয়া ও অভিমতকে দলীল হিসেবে দাঁড় করাতেন। তা এ কারণে যে, সাহাবা ও তাবেঈদের বর্ণিত হাদীস মুরসাল বা মওকুফ হলেও তারা হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সহচর ও নিকটবর্তী ন্যায়ানুগ দল বিধায় তা গ্রহণযোগ্য এবং এর দায়দায়িত্বও তাদেরই। তাঁরা হয়ত এ সব হাদীস কম মর্যাদার বিধায় মাওকুফ পর্যায়ে রেখেছেন এবং হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উল্লেখ করেননি। যেমন ইবরাহীম নাখঈ তাঁর কালে বলেছিলেন, যখন তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুহাকেলা ও মুসাবেনা ভিত্তিক ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ করার হাদীস উল্লেখ করলেন তখন লোকেরা তাকে প্রশ্ন করল, ‘এ হাদীস ছাড়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আর কোনো হাদীস কি আপনার স্মরণে আছে?’ তিনি জবাব দিলেন –হ্যাঁ, আছে, তবে তা আমি এভাবে বর্ণনা করব যে, আবদুল্লাহ এরূপ বর্ণনা করেছেন বা আলফামা এরূপ বর্ণনা করেছেন। যেমন শাবী থেকে যখন একটি হাদীস জেনে নেয়ার পর প্রশ্ন করা হলো, আপনার বর্ণিত হাদীসের সনদ কি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছেছে? তিনি জবাব দিলেন, না। কারণ আমি এটাই পছন্দ করি যে, আমার বর্ণনার সূত্র উম্মতের সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত থাক এবং আল্লাহর রাসূল পর্যন্ত না যাক। কারণ, যদি এর ভেতর কিছুটা কমবেশী হয় তো তার দায় উম্মতের ঘাড়ে থাক এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমা যা বলেননি, তার দায় তাঁর ওপরে না যাক।
তা ছাড়া এ স্তরের আলেমগণ সে সব থেকে এ কারণে দলীল পেশ করতেন যে, সাহাবা ও তাবেঈগণ আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মূল বাণীর ভিত্তিতেই দলীল দাঁড় করিয়েছেন এবং তাঁরা যদি ইজতেহাদও করে থাকেন তো যেহেতু তাঁরা আল্লাহর রাসূলের সান্নিধ্য বা নৈকট্য লাভ করে পরবর্তীদের থেকে সর্বক্ষেত্রে উচ্চ মর্যাদায় রয়েছেন তাই তাও নির্ভরযোগ্য ও নিঃসন্দেহে গ্রহণযোগ্য।
সাহাবাদের ইলম অধিক সুরক্ষিত ছিল এবং সর্বব্যাপী ছিল। তাদের অভিমতের ওপর আমল নির্ধারিত হয়ে গেছে। হ্যাঁ, যদি তাদের ভিতর মতভেদ থাকলে সেটা ভিন্ন ব্যাপার। তাছাড়া যদি তাদের কোনো অভিমত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোনো হাদীসের প্রকাশ্য বিরোধী বলে বিবেচিত হয় তা হলেও তা গ্রহণযোগ্য নয়। পরবর্তীদের এটা সর্বসম্মত রীতি ছিল যে, যখন কোনো মাসআলায় হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরস্পর বিপরীত হাদীস দেখা যেত, তখন তারা সে ব্যাপারে সাহাবাদের মতামতের মুখাপেক্ষী হতেন। তাঁরা হাদীসদ্বয়ের যদি কোনোটিকে মানসুখ বলতেন কিংবা কোনোটির বাহ্যিক অর্থের পরিবর্তন ঘটাতেন অথবা কোনোটির ব্যাখ্যা করে সমন্বয় ঘটাতেন, তবে তারাও সেটাই গ্রহণ করতেন। তথাপি তারা কোনো হাদীস বর্জন করতেন না এবং তা না করার ব্যাপারে তারা একমত ছিলেন। কারণ, তারা সে ব্যাপারে সাহাবাদের অনুসৃত মানসুখের হুকুম, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও সমন্বয় সাধনের রীতি পুরোপুরি মেনে চলতেন।
এ কারণেই কুকুরের ব্যবহৃত পানি সম্পর্কিত হাদীসের ব্যাপারে ইমাম মালেক (রাঃ) বললেন, এটা হাদীস তো বটেই। কিন্তু আমি হাদীসটির ব্যাপারে কিছু জানিনা। ইবনে হাজেব তার ‘মুখতাসারুল অসূল’ গ্রন্থে এটি উদ্ধৃত করেছেন। তবে আমি কোনো ফকীহকে এর ওপর আমল করতে দেখিনি।
যখন সাহাবা ও তাবেঈদের মাঝে কোনো ব্যাপারে মতভেদ দেখা গেছে, তখন আলেমদের কাজ হয় নিজ নিজ মাজহাবের ইমামদের অনুসরণ করা। কারণ, তারাই সেগুলোর সঠিক-বেঠিক যাচাই করে মাজহাব দাঁড় করিয়েছেন এবং তারাই সেটা জানতেন ভালো। তারা যাচাই বাছায়ের মূলনীতি ভালোভাবে জানতেন ও বুঝতেন এবং তাদের অন্তর সাহাবা ও তাবেঈদের অবদান ও গভীর জ্ঞানের প্রবঅবে উদ্ভাসিত ছিল। তারা হযরত উমর, হযরত উসমান, ইবনে উমর, হযরত আয়েশা, ইবনে আব্বাস, যায়েদ ইবনে ছাবেত (রাঃ) প্রমুখের মাজহাব এবং তাদের সহচর যেমন সাঈদ ইবনে মুসাইয়াব প্রমুখের মাজহাব, হযরত উমর (রাঃ)-এর ফয়সালা ও হযরত আবু হোরায়রার হাদীসসমূহ অধিক জ্ঞাত ছিলেন। তেমনি হযরত উরুয়া সালেম, আতা ইবনে ইয়াসার, কাসেম ওবায়দুল্লাহ, যুহরী, ইয়াহিয়া ইবনে সাঈদ, যায়েদ ইবনে আসলাম ও রবিআর মাজহাবও তাদের নখদর্পণে ছিল। মদীনাবাসীদের নিকট এদের মাজহাব অন্যান্যের তুলনায় বেশি গ্রহণযোগ্য ও আমলযোগ্য ছিল। যেহেতু হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনার অনেক ফজিলাত বর্ণনা করে গেছেন এবং এ শহরটি সব যুগেই ফকীহদের আস্তানা ও আলেমদের কেন্দ্রবিন্দু ছিল, তাই এখানকার ফকীহদের গুরুত্ব বেশি দেয়া হতো। এ কারণেই আপনারা দেখবেন যে, ইমাম মালেক মদীনার মাসলাকের সাথে সুদৃঢ়ভাবে জড়িত ছিলেন।
কূফাবাসীদেরক কাছে অধিকতর গ্রহণ ও আমলযোগ্য ছিল হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) ও তাঁর সহচরবৃন্দের মাজহাব। তেমনি হযরত আলী (রাঃ), শুয়ায়েহ ও শাবীর ফয়সালা এবং ইবরাহীম নাখঈর ফতোয়া তাদের কাছে অধিকতর নির্ভরযোগ্য ছিল। মাসরূক যখন তাশরীকের মাসআলায় যায়েদ ইবনে ছাবেতের অভিমতের দিকে ঝুঁকে গেলেন, তখন আলকামা বললেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ থেকে কেউ কি বেশী নির্ভরযোগ্য হতে পারে? তিনি তার জবাবে বললেন, না। তবে আমি যায়েদ ইবনে ছাবেত ও মদীনাবাসীকে তাশরীক করতে দেখেছি।
কোনো এক শহরের লোক যদি কোনো ব্যাপারে একমত হয়ে যেত, তা হলে তার ওপরে মজবুতভাবে জমে যেত। ইমাম মালেক (রহঃ)-এর ভিত্তিতেই বলেছেন, যেসব সুন্নতের ব্যাপারে আমাদের মতভেদ নেই তা হলো এইগুলো। প্রাধান্যপ্রাপ্ত বলে বিবেচিত হতো, সেটাই তারা গ্রহণ করতেন। শক্তিশালী ও প্রাধান্য প্রাপ্ত হবার কারণ ছিল এই যে, হয় তার বর্ণনাকারীর সংখ্যা অধিক হতো, নয়ত তা মজবুত কেয়াস মোতাবেক হতো কিংবা তা কুরআন ও সুন্নাহর থেকে সরাসরি উদ্ভাবিত বিষয় হতো। এ সব ধরন সম্পর্কে ইমাম মালেক বলেন, আমি যা কিছু শুনতে পেয়েছি তার ভেতর উত্তম মত এটাই।
এ স্তরের আলেমরা যখন তাদের সংরক্ষিত জ্ঞান ভাণ্ডার থেকে কোনো মাসআলার জবাব না পেতেন, তখন পূর্বসূরীদের বক্তব্যের ইশারা-ইঙ্গিত ও চাহিদা নিয়ে গবেষণা ও অনুসন্ধান চালিয়ে তার সমাধান বের করতেন। এ যুগের আলেমদের অন্তরে কিতাব সংকলন ও প্রণয়নের ঐশী ইঙ্গিত সক্রিয় হলো। ফলে মদীনায় ইমাম মালেক ও মুহাম্মদ ইবনে আবদুর রহমান ইবনে আবু জিব কিতাব প্রণয়ন ও সংকলনে হাত দিলেন।
মক্কায় ইবনে জুরাইজ ও ইবনে উআইনা কিতাব প্রণয়ন করেন। কূফায় সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) ও বসরায় রবী ইবনে সবীহ কিতাব প্রণয়ন করেন। এ সব কিছুই আমার আলোকিত পদ্ধতিতে করা হয়েছে। তাই বাগদাদের খলীফা মানসুর যখন হজ্ব করতে এলেন, তখন ইমাম মালেককে বললেনঃ
“আমার ইচ্ছা যে, আপনি যে কিতাব (মোয়াত্তা) লিখেছেন তার অনুলিপির এক এক কপি সব শহরে পাঠিয়ে দেই এবং সবাইকে নির্দেশ দেই যে, এ কিতাবে যা আছে তা মেনে চলবে এবং এর বাইরে কিছু খুঁজতে যাবে না। তিনি তা শুনে বললেন, হে আমীরুল মোমেনীন! তা করবেন না। কারণ, লোকদের কাছে আগেই বিভিন্ন অভিমত ও মাজহাব পৌঁছে গেছে। তারা বিভিন্ন হাদীস শুনে তা বর্ণনা করে চলছে। সব এলাকার লোকই তাদের কাছে যা আগে পৌঁছেছে তা অনুসরণ করে চলছে। লোকদের ভেতর মতভেদ সৃষ্টি হয়ে গেছে। তাই প্রত্যেক শহরবাসী নিজেদের জন্যে যে মাজহাব গ্রহণ করেছে তা নিয়ে তাদের থাকতে দিন।
এ ঘটনাটিই খলীফা হারুনুর রশীদের সাথেও যুক্ত করা হলো। তাতে বলা হয়, খলীফা হারুন ইমাম মলেকের সাথে মতবিনিময় প্রসঙ্গে বলেন, মুআত্তা গ্রন্থটি কাবা ঘরে লটকে রাখা হবে এবং তাতে যা লেখা হয়েছে তা আমল করার জন্যে লোকদের উদ্ধুদ্ধ করা হবে। ইমাম তখন বললেন, এটা করবেন না। কারণ, খুঁটিনাটি ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবাদের ভেতরেও মতভেদ ছিল এবং তা এখন বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়েছে, এমনকি প্রত্যেকটি মাজহাব চালু হয়ে গেছে। তা শুনে খলীফা বললেন, হে আবু আব্দুল্লাহ! আল্লাহ আপনাকে অধিকতর তাওফীক দিন।
এ ঘটনাটি ইমাম সুয়ুতী (রহঃ) বর্ণনা করেন।
মদীনার আলেমদের কাছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যে সব হাদীস পৌঁছেছে তার সংকলনগুলোর ভেতর সূত্র বিচারে ইমাম মালেকের মুআত্তা সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য। তিনি উমর (রাঃ)-এর ফয়সালা, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর ও হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর অভিমত ও বক্তব্যসমূহ এবং তাদের সহচর সপ্ত ফকীহর ফতোয়া সর্বাধিক জ্ঞাত ছিলেন। তদ্রুপ বর্ণনা ও ফতোয়া সম্পর্কিত বিদ্যা ও শাস্ত্র ইমাম মালেক ও তাঁর মতো আলেমদের দ্বারাই গড়ে উঠেছে। যখন তাদের ওপর এ দায়িত্ব স্বভাবতই এসে গেল, তখন তারা হাদীসের পাঠদান ও ফতোয়া প্রদান শুরু করলেন এবং লোকদের কল্যাণ পৌঁছাতে থাকলেন। এভাবেই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণীর বাস্তবায়ন ঘটল। উনি বলে গেছেনঃ
“শীঘ্রই লোকেরা জ্ঞান অর্জনের জন্যে উটে চড়ে সফরে বের হবে। তবে মদীনার আলেমের চেয়ে বিজ্ঞ আলেম কোথায় পাবে না”।
ইবনে উআইনা ও আবদুর রাজ্জাক এ হাদীসটি তাঁর ব্যাপারেই প্রযোজ্য বলে মন্তব্য করেছেন এবং তাদের দুজনের সাক্ষ্যই যথেষ্ট।
ইমাম মালেকের সহচরবৃন্দ তাঁর বর্ণনা ও বক্তব্যসমূহ একত্রিত করেছেন। তারা সেগুলোর সংক্ষিপ্ত সংস্করণ বের করেছেন এবং সেগুলো লিপিবদ্ধ করে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ রচনা করেছেন। তা থেকে তারা মাসআলা বের করেছেন। তাঁর নির্ধারিত মূলনীতি ও দলীল-প্রমাণগুলো পর্যালোচনা করে দেখেছেন। তাঁর শিষ্যরা পশ্চিমাঞ্চলে ও বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছেন। আল্লাহ পাক বহু মানুষকে তাদের দ্বারা কল্যাণ পৌঁছিয়েছেন। যদি আমাদের এ কথার সত্যতা যাচাই করতে চাও যা আমি তাঁর মাজহাবের মূলনীতি সম্পর্কে বললাম, তা হলে মুআত্তায়ে ইমাম মালেক খুলে দেয়। দেখতে পাবে, আমার বর্ণিত মূলনীতির প্রতিফলন তাতে বিদ্যমান।
ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) ইবরাহীম নাখঈ ও তাদের সমকালীন আলেমদের মাজহাবের অধিকতর অনুসারী ছিলেন। খুব কম ক্ষেত্রেই তিনি তাদের ব্যতিক্রম কিছু করেছেন। তাঁর মাজহাব অনুসারে তিনি মাসআলা-মাসায়েল উদ্ভাবনের কারণ নির্ণয়ের ব্যাপারে তাঁর গভীর অন্তর্দৃষ্টি ছিল। তা ছাড়া খুঁটিনাটি ব্যাপারে তার পরিপূর্ণ নজর ছিল। যদি তুমি আমার এ বক্তব্যের সারবত্তা জানতে চাও, তা হলে তুমি ইমাম মুহাম্মদের ‘কিতাবুল আছার’, ‘জামে আবদুর রাজ্জাক’ ও ‘মুসান্নাফে আবু বকর ইবনে শায়বা’ থেকে ইবরাহীম নাখঈ ও তাঁর সমকালীন আলেমদের বক্তব্যের সার কথা বের কর। তারপর তাঁর মাজহাবের সাথে তা মিলিয়ে দেখ। মুষ্টিমেয় জায়গা ছাড়া সর্বত্রই আমার কথায় প্রমাণ পাবে। তার ওপর মুষ্টিমেয় ব্যতিক্রম যা দেখা যায় তাও কূফার ফকীহদের মাজহাবের বাইরে নয়।
ইমাম আবু হানীফার বিখ্যাত শিষ্য হলেন কাজি আবু ইউসুফ (রহঃ)। খলীফা হারুন রশীদের যুগে তিনি কাজিউল কুযযাত বা প্রধান বিচারপতির পদ অলঙ্কৃত করেন। ইমাম সাহেবের মাজহার ইরাক, বসরা ও এশিয়া মাইনরে ছড়িয়ে পড়েছিল। এ কারণেই বিচার-আচার সেই অনুসারে হতো। ইমাম সাহেবের শিষ্যদের কাছে জ্ঞান অর্জন করেন। তারপর মদীনায় যান। সেখানে ইমাম মালেকের কাছে মোয়াত্তা অধ্যয়ন করেন। তারপর নিজে গবেষণা ও অনুসন্ধান চালান। তাঁর সহচরদের মাজহাবের প্রতিটি মাসআলা মোয়াত্তার সাথে মিলিয়ে দেখেন। যদি মিলে যেত তো ঠিক ভাবতেন। অন্যথায় যদি সাহাবা ও তাবেঈদের জামাতকে নিজ সহচরদের মতের অনুকূলে পেতেন তা হলে সেটাই বহাল রাখতেন। পক্ষান্তরে যদি তাদের কেয়াস দুর্বল দেখতেন এবং তার বিপরীত বিশুদ্ধ হাদীস দেখতেন কিংবা অধিকাংশ আদেশের আমল তার বিপরীত দেখতেন, তা হলে পূর্বসূরীদের মাজহাবের অপেক্ষাকৃত সবল মতটি তিনি গ্রহণ করতেন। মূলত ফকীহদের রীতি এটাই। তবে ইমাম মুহাম্মদ ও ইমাম আবু ইউসুফ যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন। ইবরাহীম নাখঈ ও তাঁর সমসাময়িক আলেমদের মাজহাব আকড়ে থাকতে। ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর তরীকাও তাই ছিল। অবশ্য দুটি অবস্থার কোনো না কোনো একটিতে তাদের মধ্যে মতভেদ হয়ে যেত।
হয় তাদের শায়েখ ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) ইবরাহীম নাখঈর মাহাব থেকে যে মাসআলা উদ্ভাবন করেছেন তা নিয়ে শায়েখের সাথে তাদের মতবিরোধ ঘটেছে। নয়ত ইবরাহীম নাখঈ ও তার মতাবলম্বীদর ভিন্ন ভিন্ন অভিমতের কোনো একটি প্রাধান্য দেবার ক্ষেত্রে শায়েখ ও শাগরিদের মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। ইমাম মুহাম্মদ কিতাব লিখে উক্ত তিন ইমামের রায়গুলো সন্নিবেশিত করেন। তা থেকে বহু লোক কল্যাণ লাভ করেছে। পরিশেষে আবু হানীফা (রহঃ)-এর সহচরবৃন্দ সেসব কিতাবের দিকে মনোনিবেশ করছেন। সেগুলোর সারসংক্ষেপ রচনা করেন ও সেগুলো দলীল প্রমাণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করেন। সেগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও টীকা টিপ্পনি লিপিবদ্ধ করেন। তা থেকে মাসআলা উদ্ভাবন করেন। সেগুলো আলোচনা পর্যালোচনা করে দলীল প্রমাণ উপস্থাপন করেন। তারপর সেই আলেমরা সেগুলো নিয়ে খোরাসান ও এশিয়া মাইনরে ছড়িয়ে পড়েন। তারা তাদের মাজহাবের নাম দিলেন হানাফী মাজহাব।
ইমাম মালেক ও ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) আত্মপ্রকাশের প্রারম্ভিক পর্যায়ে ইমাম শাফেয়ী গড়ে উঠেছিলেন। তিনি পূর্বসূরীদের ওপর গবেষণা করতে গিয়ে কিছু ব্যাপারে এমন দেখতে পেলেন যা অনুসরণ করা চলে না। তিনি তার রচিত ‘কিতাবুল উম্মে’র শুরুতে তা বর্ণনা করেছেন। তার ভেতর একটি ব্যাপার এই ছিল যে, তিনি দেখতে পেলেন, পূর্বসূরীগণ মুরসাল ও মুনকাতে হাদীসের ওপরেও আমল করতেন। অথচ সেসব হাদীসে ভুলভ্রান্তি বিদ্যমান ছিল। যখন হাদীসের সব সূত্র একত্রিত করা হতো তখন পরিস্কার দেখা যেত যে, এমন সব মুরসাল হাদীসও রয়েছে যার কোনো ভিত্তি নেই। কিছু কিছু মুরসাল রেওয়ায়েত মুসনাদ রেওয়ায়েতের পরিপন্থীও দেখা যায়। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, নির্ধারিত শর্তাবলি না পাওয়া গেলে মুরসাল হাদীস গ্রহণ করা যাবে না। উক্ত শর্তাবলি অসূলের কিতাবে বিদ্যমান।
অপর বিষয়টি এই যে, পূর্বসূরীদের কালে বিভিন্ন পরস্পর বিরোধী হাদীসের ভেতর সমন্বয় সাধনের কোনো বাঁধা-ধরা নিয়মনীতি ছিল না। তাই তাদের গবেষণায় ভুলচুক দেখা দিত। তাই তিনি তার নিয়মনীতি নির্ধারণ করে এক কিতাব রচনা কররেন। গ্রন্থাকারে রচিত অসূল ফেকাহর এটাই পয়লা কিতাব। আমাদের কাছে তার যে নমুনা পৌঁছেছে তা এই যে, ইমাম শাফেঈ (রহঃ) ইমাম মুহাম্মদ ইবনে হাসানের কাছে গিয়েছিলেন। তিনি তখন মদীনার আলেমদের ওপর প্রশ্ন তুলেছিলেন যে, তারা একজন সাক্ষ্য এবং কসমের ওপর ফয়সালা দেন। ইমাম মুহাম্মদ বলতেন যে, আল্লাহর কিতাবের ওপর তাদের এটা বাড়াবাড়ি”।
ইমাম শাফেঈ বললেন, তা হলে আপনি কেন বলছেন, ওয়ারিসের জন্যে অসিয়ত করা জায়েয নয়? আরতার দলীল হিসেবে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ বক্তব্য পেশ করছেন যে, খবরদার! ওয়ারিসের জন্যে ওসিয়াত জায়েয নয়। অথচ আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমাদের কেউ মৃত্যুর মুখোমুখি হলে তার জন্যে ফরজ হলো ওলিয়াত করা।
এ ধরনের বেশ কিছু প্রশ্ন ইমাম শাফেঈ ইমাম মুহাম্মদকে করলেন। ইমাম মুহাম্মদ চুপ থাকলেন, কোনো জবাব দিলেন না।
একটি ব্যাপার হলো এই যে, সে সব তাবেঈন আলেমদের কাছে অনেক সহীহ হাদীস পৌঁছে ছিল না যাদের হাতে ফতোয়া প্রদানের দায়িত্ব ছিল। ফলে তাদের ইজতেহাদী রায় দিতে হয়েছে। হয় তারা সাধারণভাবে জ্ঞাত জিনিসের ভিত্তিতে ফয়সালা দিয়েছেন, নয়তো সাহাবাদের কারো অনুসরণ করে রায় দিয়েছেন। অতঃপর তৃতীয় স্তরে এসে তাদের অজানা হাদীসগুলো মশহুর হয়ে গেল। তখন আবার তারা এ ন্যে তা গ্রহণ করতে পারেন নি যে, তাদের শহর যা অনুসরণ করে চলছে তা তার পরিপন্থী। মানে, তাদের সর্বসম্মত রায়ের তা বিরোধী। আর এ কারণেই তারা সে সব হাদীসের ত্রুটি-বিচ্যুতি খুঁজেছেন এবং তা বাতিল ঘোষণা করেছেন।
কিছু কিছু হাদীস তৃতীয় স্তরে এসেও খ্যাতি লাভ করেনি। বরং তারপরে এসে তখন মশহুর হয়েছে যখন মোহাদ্দেসগণ হাদীসের সূত্র জমা করার দিকে গভীরভাবে মনোনিবেশ করলেন। তারা হাদীসের বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধান চালালেন এবং বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় হাদীস সংগ্রহের জন্যে সফর শুরু করলেন। পরন্তু হাদীস বিশারদদের কাছে তারা সেগুলোর যথার্থ্য সম্পর্কে জেনে নিলেন। ফলে এমন বহু হাদীস সামনে এল যার বর্ণনা মাত্র দু’-একজন সাহাবী দিলেন। কিংবা তাদের থেকে মাত্র দু-একজন বর্ণনাকারী তা বর্ণনা করেছেন।
এভাবে সামনে এগিয়ে চলুন। বস্তুত এ সব হাদীস ফকীহদের দৃষ্টির বাইরে ছিল। এগুলো মশহুর হলো হাদীসের হাফেজগণ যখন হাদীসের সূত্রসমূহের সমাবেশ ঘটালেন। যেমন, বহু হাদীস বসরাবাসী বর্ণনা করেছেন। অথচ অন্যান্য শহরের লোক তার খবরই রাখত না। তাই ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন –সাহাবা ও তাবেঈ আলেমগণ প্রতিটি মাসআলার জন্যে হাদীস খুঁজতেন। যখন কোনো হাদীস পেয়ে যেতেন, তখন তারা ইজতেহাদ ছেড়ে হাদীসই অনুসরণ করতেন।
ঘটনা যখন এই, তখন তাদের হাদীস মোতাবেক ফয়সালা না দেয়াকে হাদীসকে ত্রুটিপূর্ণ ভাবা বলা যায় না। তবে হ্যাঁ, হাদীসে যদি মূলতঃই কোনো একটি ত্রুটি থাকে তো সেটা ভিন্ন কথা। এর উদাহরণ হচ্ছে ‘কুল্লাতাইন’ বা দু’মশকের হাদীস। হাদীসটি বিশুদ্ধ এবং বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত। সব চাইতে বড় সূত্র হলো যে, হাদীসটি আবুল ওয়ালিদ হতে বর্ণিত। তিনি তা মুহাম্মদ ইবনে জাফর ইবনে জুবায়ের থেকে, তিনি আব্দুল্লাহ বা মুহাম্মদ ইবনে ইবাদ ইবনে জাফর থেকে, তিনি উবায়দুল্লাহ ইবনে আব্দুল্লাহ থেকে এবং তারা দুজন ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন। এরপর হাদীসের সূত্র বিভিন্ন হয়ে গেল। উপরোক্ত দুজন যদিও নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী তথাপি তারা সেই পর্যায়ের নয় যাদের হাতে ফতোয়া সোপর্দ করা হয়েছে। তা না হলে তারা লোকদের কাছে নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচিত ছিলেন। এ ধলনের হাদীস সাঈদ ইবনে মুসাইয়েব ও যুহরীর যুগে খ্যাতি লাভ করেনি। এ কারণেই হানাফী ও মালেকী আলেমরা তার ওপর আমল করেননি। ইমাম শাফেঈ তার ওপর আমল করেছেন। খেয়ারে মজলিসের হাদীসের মতোই এ হাদীসটিও বিশুদ্ধ। অনেক সূত্র থেকে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। সাহাবাদের ভেতর ইবনে উমর ও আবু হোরায়রা (রাঃ) হাদীসটির ওপর আমল করেছেন। কিন্তু সপ্ত ফকীহ ও তাদের সমকালীন আলেমদের সামনে হাদীসটি প্রকাশ পায়নি। একারণেই তারা তা গ্রহণ করতে পারেননি। ইমাম মালেক ও ইমাম আবু হানীফা একক সূত্রের হাদীস ভেবে সেটাকে বাদ দিয়েছেন। অথচ ইমাম শাফেঈ (রহঃ) তা গ্রহণ করেছেন।
এর কারণ এটাও যে, ইমাম শাফেঈর (রহঃ) যুগে সাহাবাদের বাণীগুলো সমবেত করা হয়েছে এবং বহুল পরিমাণ আছারের সমাবেশ ঘটেছে। তার ভেতর মতভেদও ছিল। তার ভেতর বেশ কিছু আছার শাফেঈ হাদীস বিরোধী দেখতে পেয়েছেন। কারণ, সে ব্যাপারে কোনো কোনো সাহাবার কাছে হাদীস পৌঁছেনি।তিনি দেখতে পেলেন যে, এ ধরনের ব্যাপার পূর্বসূরিরা হাদীস অনুসরণ করতেন। তাই তিনি মাসায়েলের ক্ষেত্রে সাহাবাদের যে সব আছার সর্বসম্মত ছিল না তা বর্জন করতেন। তিনি বলতেন –তারাও মানুষ, আমরাও মানুষ।
একটি ব্যাপার এ ছিল যে, শাফেঈ (রহঃ) একদল ফকীহকে দেখতে পেলেন যে, তারা শরীআত দ্বারাযা প্রমাণিত সত্য সেটাকে কেয়াস দ্বারা প্রমাণিত বস্তুর সাথে ঘুলিয়ে ফেলেছেন। অথচ শরীআতের দৃষ্টিতে এ ধরনের কেয়াসের কোনোই গুরুত্ব নেই। তারা শরীআত সম্মত কেয়াস ও ব্যক্তিগত আনুমানিক সিদ্ধান্তের ভেতরে কোনো পার্থক্য করতেন না। কখনো বা ব্যক্তিগত আনুমানিক সিদ্ধান্তকেই এস্তেহসান বা উত্তম বলে আখ্যায়িত করতেন।
ব্যক্তিগত আনুমানিক সিদ্ধান্ত বলতে আমি বুঝিয়েছি সেটাকে যাতে কোনো ক্ষতি বা কল্যাণকে কারণ ধরে নিয়ে হুকুম দেয়া হয়। ইমাম শাফেঈ এ শ্রেণীর কেয়াসকে পুরোপুরি বাতিল করেছেন। তিনি বলতেন, ‘যে ব্যক্তি নিজেই কল্যাণ-অকল্যাণ নির্ধারণ করে মাসআলার হুকুম দেন, তিনি শরীআত প্রণেতা হতে চান’।
ইবনে হাজিব তাঁর ‘মুখতাসারুল অসূল’ গ্রন্থে এটা বর্ণনা করেছেন। তার উদাহরণ হলো এই যে, ইয়াতীম কখন সার্বিক জ্ঞানের মালিক হয় তা একটা অন্তর্নিহিত ব্যাপার। এ কারণে ফকীহরা সঠিক জ্ঞানসম্পন্ন হবার একটা আনুমানিক বয়স নির্ধারণ করেছেন পঁচিশ বছর। তারা এ অনুমিত বয়সটিকে সার্বিক জ্ঞান লাভের স্থলাভিষিক্ত করলেন এবং বললেন, পঁচিশ বছর বয়স হলেই ইয়াতীমের সম্পদ তার হাতে সোপর্দ করা যাবে। তারা এটার নাম দিয়েছেন এস্তেহসান বা উত্তম ব্যবস্থা। অথচ শরীআত সম্মত কেয়াস বলে, এভাবে তা করা যায় না।
সার কথা হলো এই যে, ইমাম শাফেঈ যখন পূর্বসূরীদের এ অবস্থা দেখতে পেলেন, তখন তিনি ফেকাহ শাস্ত্রকে নতুন করে গড়ে তুললেন। তিনি অসূলে ফেকাহ নির্ধারণ করলেন এবং তার ভিত্তিতে ফেকাহর বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা বিন্যস্ত করলেন। তার ওপর তিনি কিতাব লিখলেন। নিজে যথেষ্ট কাজ করলেন এবং লোকদের প্রচুর কল্যাণ সাধন করলেন। ফকীহরা তাঁর চারপাশে সমবেত হলেন, তাঁর কিতাবের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ লিখলেন, দলীল প্রমাণ তুলে ধরলেন ও মাসআলা-মাসায়েল তৈরি করলেন। তারপর তারা বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়লেন। অবশেষে এ মাজহাব শাফেঈ মাজহাব নামে খ্যাত হলো। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
অধ্যায়-৮৩
মোহাদ্দেসীন ও আহলে রায়ের মাঝে পার্থক্য
এটা সুস্পষ্ট যে, হযরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়েব, ইবরাহীম, যুহরী, মালেক, সুফিয়ান ছাওরীর যুগে একদল আলেম নিজেদের তরফ থেকে ইজতেহাদ করে রায় দেয়া পছন্দ করতেন না। তারা ফতোয়া দেয়া ও মাসআলা বের করার ব্যাপারেও ভয় পেতেন। শুধু বিশেষ প্রয়োজনের ক্ষেত্রে তা করতেন। তারা সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস বর্ণনার ওপর।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ)-কে এক ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, আমি এটা পছন্দ করি না যে, আল্লাহ পাক যা হালাল করেছেন তা হারাম করব কিংবা আল্লাহ পাক যা হারাম করেছেন তা হালাল করব।
হযরত মাআজ ইবনে জাবাল (রাঃ) বলেন, হে লোকসকল! পরীক্ষার মুহুর্ত না আসতেই তা চেয়ে নিও না। কারণ মুসলমানদের ভেতর এমন লোক বিদ্যমান থাকবে যাদের কোনো মাসআলা জানতে চাইলেই তারা তা বলে দেবে।
হযরত উমর, হযরত আলী, ইবনে আব্বাস ও ইবনে মাসউদ (রাঃ) ও না আসা বিপদ ডেকে আনার ব্যাপারটি অপছন্দ করেছেন। হযরত ইবনে উমর (রাঃ) হযরত জাবির ইবনে যায়েদকে বলেন, ‘তুমি তো বসরায় থাক। সর্বদা কুরআনের ভাষ্য ও সনাতন সুন্নাতের ভিত্তিতে ফতোয়া দেবে। কারণ, তা ছাড়া তুমি যদি কিছু কর তা হলে তুমিও ধ্বংস হবে এবং অপরকেও ধ্বংস করবে। আবু নসর বলেন, যখন হযরত আবু সালমা বসরায় এলেন, তখন আমি ও হযরত হাসান তাঁর কাছে গেলাম। হযরত আবু সালমা হযরত হাসানকে বললেন, তুমি কি হাসান? আমি বসরায় তোমার দেখা পাবার জন্যে বেশি উদগ্রীব ছিলাম। এ কারণে যে, আমি জানতে পেলাম, তুমি নিজের রায় মোতাবেক ফতোয়া দাও। ভবিষ্যতে শুধু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ ও আল্লাহর কিতাবের ভাষ্যমতেই ফতোয়া দেবে।
ইবনে মুকান্দার বলেন, আলেমরা মূলত আল্লাহ ও তাঁর মাখলুকের মাঝে যোগসূত্র হিসেবে কাজ করেন। তাই তাদের উচিত নাজাতের রাস্তা ধরে চলা।
ইমাম শাবীকে প্রশ্ন করা হলো, যখন আপনার কাছে মাসআলা জিজ্ঞেস করা হয়, তখন কোন পন্থা অবলম্বন করেন? তিনি বললেন, তুমি ভালো প্রশ্ন করেছ। যখন আমাদের কারো কাছে কোনো মাসআলা জানতে চাওয়া হতো, তখন তিনি তার সাথীকে বলতেন, তুমি তার জবাব দাও। এ ভাবে এ ওকে জবাব দেবার কথা বলতে বলতে মূল ব্যক্তির কাছে পৌঁছে যেত।
ইমাম শাবী বলতেন, তোমাকে যা কিছু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করা হবে তা অনুসরণ কর। আর যা কিছু কেয়াস করে নিজের রায় শুনানো হয়, তা পায়খানায় নিক্ষেপ কর। এ সব আছার ইমাম দারেমী (রহঃ) বর্ণনা করেন।
বস্তুত ইসলামী রাষ্ট্রের সর্বত্র হাদীস ও আছার গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। আল্লাহর কিতাবের প্রতিলিপি ও কপি ছড়িয়ে পড়েছে। পরিশেষে বর্ণনাকারীদের এমন লোকের সংখ্যা কমই ছিল যাদের সংকলিত সহীফা বা পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়নি। এটা এ কারণে হতো যে, বিভিন্ন এলাকায় তার প্রয়োজন দেখা দিত। সে যুগের হেজাজ, সিরিয়া, ইরাক, মিসর, ইয়ামান ও খোরাসানের বড় বড় আলেমগণ তাদের কাছে আসতেন এবং কিতাবগুলো একত্র করে তার বিভিন্ন কপি তৈরী করে তা নিয়ে গবেষণা করতেন। তার কোনটা গরীব হাদীস, কোনটা নাদের এবং আছারগুলোর কোনটা কি পর্যায়ের তা নিয়ে অনুসন্ধান চালাতেন। তাদেরই প্রচেষ্টায় সে সব হাদীস ও আছার সংগৃহীত হলো যা আগে কখনো হয়নি। তাই ইলেম চর্চার ক্ষেত্রে তারা সে সুযোগ পেয়ে গেলেন যা আগের লোকেরা পাননি। হাদীসের বিভিন্ন সূত্রও তাদের হস্তগত হলো। এমনকি এরূপ অনেক হাদীস তারা পেলেন যার এক একটির শতাধিক সূত্র বিদ্যমান। ফলে একটি সূত্রে যা সুপ্ত ছিল অপর এক সূত্রে তা ব্যক্ত হতে দেখলেন। ফলে কোন হাদীসটি গরীব আর কোনটি মশহুর তা তাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে ধরা দিল। মোতাবেআত ও শাওয়াহেদের বিন্যাস নিয়েও তারা চিন্তা-ভাবনার সুযোগ পেলেন। তখন এমন বহু সহীহ হাদীসের তারা হদিস পেলেন যা পূর্বযুগের মুত্তাকী লোকদের সামনে প্রকাশ পায়নি।
ইমাম শাফেঈ (রহঃ) ইমাম আহমদ (রহঃ)-কে বললেন, আপনি আমাদের চেয়ে বেশি সহীহ হাদীস জানেন। যখন কোনো নতুন সহীহ হাদীস আপনি পান তখন আমাকে তা জানাবেন। তা হলে আমি তার ভিত্তিতে আমার মাজহাবের মাসআলা ঠিক করে নেব। সে সহীহ হাদীস কূফা, বসরা বা সিরিয়া যে কোনো সূত্রেই পান না কেন তাতে কোনো আপত্তি নেই। এটা ইবনে হাম্মামের বর্ণনা। এর কারণ এই যে, কিছু সহীহ হাদীস এমন আছে যা বিশেষ কোনো শহরের বর্ণনাকারীরা বর্ণনা করেছেন। যেমন সিরিয়া বা ইরাকের বর্ণনাকারীগণ। কখনো তা একদল বর্ণনাকারীর বর্ণনা হয়। কখনো আবার কোনো বিশেষ কোনো বিশেষ পরিবারের বর্ণনা হয়। যেমন হযরত বুরাইদের পাণ্ডুলিপি। তিনি তা আবু বুরদাহ থেকে ও তিনি আবু মূসা থেকে বর্ণনা করেন। তেমনি আমর ইবনে শুআইবের কপি। তিনি তা তার পিতা শুআইব থেকে ওতিনি তা তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন। কিছু হাদীস এমন আছে যার বর্ণনাকারীর সংখ্যা নগণ্য এবং কোনো অখ্যাত সাহাবী থেকে তা বর্ণিত হয়েছে। সাধারণ মুফতীগণ এ সব হাদীসের খবর রাখতেন না। অতঃপর তাদের সামনে বিভিন্ন শহরের সাহাবী ও তাবেঈদের আছার ও অভিমত জমা হয়ে গেল। এর আগে তারা শুধু নিজ শহরের আছার ও অভিমত জমা হয়ে গেল। এর আগে তারা শুধু নিজ শহরের আছার ও অভিমত অবহিত ছিলেন। আগেকার আলেমগণ বর্ণনাকারীদের নাম-ধাম ঠিকানা ও তাদের ন্যায়ানুগতা বা স্মৃতিশক্তির ব্যাপারে হাদীসের পারিপার্শ্বিক ও লক্ষণাদির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতেন। পরবর্তীকালে আসমাউর রেজাল ও আদালতের স্তরভেদের ওপর যথেষ্ট তথ্য ভিত্তিক গবেষণামূলক গ্রন্থ প্রণীত হয়। তারা হাদীসের বিশুদ্ধতা ও অসিদ্ধতা নিয়ে যথেষ্ট গবেষনা করেছেন। এ গবেষণার ও গ্রন্থ রচনার ফলে তাদের সামনে মুত্তাসিল ও মুনকাতে হাদীসের রহস্য খুলে গেল। হযরত সুফিয়ান ও ওয়াকী (রহঃ) ও তাঁদের পর্যায়ের আলেমরা যথেষ্ট পরিশ্রম করেছেন। আবু দাউদ আস সাজাস্তানী এ তথ্য বর্ণনা করেছেন মক্কাবাসীদের কাছে লেখা এক পত্রে।
এ স্তরের হাদীস বিশারদগণ প্রায় চল্লিশ হাজার হাদীস বর্ণনা করেছিলেন। পরন্তু ইমাম বুখারী সম্পর্কে বিশুদ্ধ বর্ণনা এই যে, তিনি ছয় হাজার বাছাই করে তাঁর সহীহ সংকলনের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ তৈরি করেছেন। আবু দাউদ সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তিনি পাঁচ হাজার হাদীস বাছাই করে তাঁর সুনানের সংক্ষিপ্ত রূপ দিয়েছেন। ইমাম আহম্মদ (রহঃ) নিজ মুসনাদকে হাদীসের মানদণ্ড স্থির করে বললেন, এ সংকলনেই আসল হাদীসের সন্নিবেশ ঘটেছে। এর বাইরে যে সব হাদীস বিদ্যমান তা অসার ও ভিত্তিহীন। এ যুগের সেরা আলেমগণ হলেন –আবদুর রহমান ইবনে মাহদী, ইয়াহিয়া ইবনে সাঈদ আল কাত্তান, ইয়াজিদ ইবনে হারুন, আবদুর রাজ্জাক, আবু বকর ইবনে আবু শায়বা, মুসাদ্দাদ, হান্নাদ, আহমদ ইবনে হাম্বরল, ইসহাক ইবনে রাহবিয়া, ফজল ইবনে দাকীন, আলী আল মাদীনী প্রমুখ।
মুহাদ্দেসীনের স্তরের তারাই পয়লা নিদর্শন। এ স্তরের অনুসন্ধিৎসু মোহাদ্দেসগণ বর্ণনার বিষয়টিকে পূর্ণত্ব দান করেছেন এবং হাদীসের বিন্যাস সাধন করে ফেকাহ শাস্ত্রের দিকে মনোনিবে করেছেন। যখন তারা তাদের বিন্যস্ত হাদীস ও আছারগুলোকে প্রচলিত মাজহাবগুলোর পরিপন্থীও দেখতে পেলেন তখন তারা অতীতের ফকীহদের অনুসরণের ওপর একমত হওয়া সঠিক ভাবলেন না। তাই তারা তাদের রচিত নীতিমালার ভিত্তিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস ও সাহাবা, তাবেঈন ও মোজতাহেদীনের আছার নিয়ে অনুসন্ধান ও গবেষণা চালালেন। আমি সংক্ষেপে সেই নীতিমালাগুলো তুলে ধরছি।
১। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এই ছিল যে, যেখানে কুরআনের ভাষ্য সুস্পষ্ট সেখানে অন্যদিকে যাবার কোনো বৈধতা নেই।
২। যখন কুরআন পাকের ভাষ্য কয়েক দিকে ব্যাখ্যার অবকাশ থাকে, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ মোতাবেক তার ফয়সালা হবে।
৩। তারা যখন আল্লাহর কিতাব প্রশ্নের সমাধান না পেতেন, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস অনুসরণ করতেন। সে হাদীস মুস্তাফীজ হোক, ফকীহদের কাছে গ্রহণযোগ্য বা বিশেষ শহরের কাছে গ্রহণযোগ্য হোক, অথবা বিশেষ কোনো সূত্রে বর্ণিত হোক, সাহাবা ফকীহরা তা অনুসরণ করুন বা না করুন সেটা তারা দেখতেন না।
৪। কোনো মাসআলায় যদি তারা যে কোনো ধরনের হাদীস পেতেন তা হলে তার মোকাবেলায় কোনো আছার বা ইজতেহাদের অনুসারী হতেন না।
৫। যখন হাদীসসমূহের পুরোপুরি অনুসন্ধান তারা শেষ করতেন এবং নির্দিষ্ট মাসআলার জবাব তাতে না পেতেন, তখন সাহাবা ও সাবেঈদের ভাষ্য অনুসরণ করতেন। সেক্ষেত্রে তারা নির্দিষ্ট কোনো শহর বা গোত্রের অনুসারী হতেন না। অথচ তাদের পূর্ববর্তীরা তাই করতেন।
৬। যদি কোনো ব্যাপারে অধিকাংশ খলীফা বা ফকীহদের মতৈক্য দেখতে পেতেন তা হলে সেটাকে তারা যথেষ্ট ভাবতেন।
৭। যদি কখনো তাদের ভেতর মতভেদ দেখা দিত, তখন নিজেদের ভেতর যে শ্রেষ্ঠ আলেম, সেরা মুত্তাকী কিংবা যার স্মৃতিশক্তি প্রখর অথবা যার খ্যাতি সর্বাধিক তার অনুসৃত হাদীস গ্রহণ করতেন।
৮। যদি কোনো মাসআলায় দুটো মতই সমান পাল্লার দেখতে পেতেন, তখন দু’মতের যে কোনোটি অনুসরণকে বৈধ ভাবতেন।
৯। যদি তাও সম্ভব না হতো, তা হলে কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসৃত সাধারণ রীতিনীতি ও বিধিবিধান নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতেন। অতঃপর এ ধরনের অন্যান্য মাসআলার দৃষ্টান্ত মোতাবেক নতুন মাসআলার জবাব বের করতেন। যখন দুটো মাসআলার অবস্থা বাহ্যত একরূপ হতো তখনই তারা অনুরূপ হুকুম দিতেন। সেক্ষেত্রে নিজেদের রীতিনীতির অনুসারী হতেন না। তখন জ্ঞান-বুদ্ধির ওপরই নির্ভর করতেন এবং অন্তর যা কবুল করে সে পথেই পা বাড়াতেন। যেমন মোতাওয়াতার হাদীসের জন্যে তার বাহ্যিক শর্ত পূরণই যথেষ্ট নয়। বরং তার মানদণ্ড হচ্ছে অন্তরে স্বস্তি সৃষ্টি হওয়া। আমি সাহাবায়ে কেরামের অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে এ ব্যাপারটি বলে এসেছি। এ নীতিটি মূলত পূর্বসূরীদের পদ্ধতি ও তাদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ অনুসারে উদ্ভাবন করা হয়েছে। মায়মুন ইবনে সাহরান (রহঃ) বলেনঃ
হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর পদ্ধতি এটাই ছিল যে, যখনই তাঁর সামনে কোনো মকদ্দমা আসত, তখন তিনি বলতেন, আল্লাহর কিতাব দেখুন। যদি তাতে পেয়ে যেতেন তো সেই অনুসারে ফয়সালা করতেন। যদি আল্লাহর কিতাবে না পাওয়া যেত, তাহলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোনো হাদীস পেলে সেই মোতাবেক রায় দিতেন। যদি তাও না পেতেন তা হলে বেরিয়ে যেতেন মুসলমানদের কাছে। তারপর তাদের বলতেন, আমার কাছে এরূপ এরূপ এক বিচার এসেছে। তোমরা কি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ ধরনের কোনো মকদ্দমার রায় দিতে দেখেছ? অনেক সময় তার কাছে বহু লোক সমবেত হয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ধরনের মকদ্দমায় যে ফয়সালা দিতেন তা বর্ণনা করতেন। তখন হযরত আবু বকর (রাঃ) বলতেন –“সব প্রশংসা আল্লাহর জন্যে যিনি আমাদের মাঝে সে সব লোক সৃষ্টি করেছেন যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইরশাদসমূহ স্মরণ রাখে। যদি তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস না পেতেন, তা হলে শীর্ষস্থানীয় সাহাবাদের একত্র করতেন এবং তাদের সাথে পরামর্শ করতেন। যখন কোনো ব্যাপারে তারা মতৈক্যে পৌঁছতেন, তখন তদনুসারে রায় দিতেন।
কাজি শুরাইহ (রহঃ) সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, হযরত উমর (রাঃ) তাকে লিখেছেন –যদি তোমার কাছে কোনো মকদ্দমা আসে, তাহলে আল্লাহর কিতাবে সে ব্যাপারে কোনো নির্দেশ থাকলে সেই মোতাবেক রায় দেবে। এমন না হয় যেন কেউ তোমাকে আল্লাহর কিতাব থেকে ফিরিয়ে রাখে। তারপর যদি এমন মকদ্দমা আসে যে ব্যাপারে আল্লাহর কিতাবে কোনো নির্দেশ না পাও, সেক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ দেখ এবং তদনুসারে রায় দাও। অতঃপর যদি এমন মকদ্দমা আসে যার মীমাংসা কিতাবুল্লাহ ও সুন্নতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এ খুঁজে না পাও, তা হলে উম্মাহর যে ব্যাপারে এজমা রয়েছে তার ভিত্তিতে রায় দাও। তবে যদি এমন মকদ্দমা আসে যা কিতাবুল্লাহ, সুন্নাতে রাসূলিল্লাহ ও এজমায়ে উম্মতে না পাওয়া যায়, তখন দুটো পথের একটি অনুসরণ কর। হয় নিজের এজতেহাদ মোতাবেক রায় দাও এবং রায় দিতে বসেও এজতেহাদ কর। অন্যথায় এজতেহাদে বিলম্ব কর এবং রায়দানে অপেক্ষা কর। আমি বিলম্ব করাটাকেই উত্তম মনে করি।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেনঃ এমন সময় গেছে যখন আমরা ফতোয়া দিতাম না। এমনকি আমরা তার যোগ্যও ছিলাম না। আল্লাহ তাআলার এটা ফয়সালা যে, আমাদের তিনি ফতোয়া দেবার পর্যায়ে পৌঁছিয়েছেন। তোমরাও তা দেখছ। তাই বলছি, আজ থেকে যার সামনে যে মাকদ্দমা আসুক, তার উচিত হবে আল্লাহর কিতাব অনুসারে ফয়সালা দেয়া। যদি তার কাছে এমন বিচার আসে যার ফয়সালা আল্লাহর কিতাবে নেই, তার তখন উচিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ফয়সালা মোতাবেক রায় দেয়া। যদি তার কাছে এমন মকদ্দমা আসে যার ফয়সালা কুরআনে ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ফয়সালায় না পাওয়া যায়, তা হলে নেককার লোকদের ফয়সালা মোতাবেক রায় দেবে। সেক্ষেত্রে যেন সে এ কথা না বলে যে, এ ব্যাপারে রায় দিতে আমার ভয় হয়, তবে আমি যতটুকু বুঝি তা এই। কারণ আল্লাহ পাক হারামকে যেমন স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তেমনি হালালকেও স্পষ্ট করে দিয়েছেন। এ দুয়ের মাঝে অস্পষ্ট কোনো বস্তু যদি এসে যায়, তা হলে সন্দেহজনক ব্যাপার বাদ দিয়ে নিঃসন্দেহ ব্যাপারটি গ্রহণ কর।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর কাছে যখন কোনো ব্যাপার জিজ্ঞেস করা হতো, তা হলে তা কুরআন মোতাবেক বলে দিতেন। যদি তার জবাব কুরআনে না পেতেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণীতে পেয়ে যেতেন, তা হলেও বলে দিতেন। যদি তাতেও না পেতেন তাহলে সে ব্যাপারে আবু বকর (রাঃ) ও উমর (রাঃ)-এর নির্দেশ বলে দিতেন। যদি তাতেও কিছু না পেতেন, তখন নিজে ইজতেহাদ করে রায় দিতেন।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেনঃ “তোমাদের কি ভয় নেই, তোমাদের ওপর আজাব নাযিল হবে বা তোমাদের ধ্বসিয়ে দেয়া হবে? নইলে তোমরা কি করে বলে বেড়াও যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এ কথা বলেছেন এবং কাতাদা থেকে অমুক এরূপ বর্ণনা করেছেন”।
ইবনে সিরীন (রহঃ) এক ব্যক্তির কাছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি হাদীস শুনালে সে বলল, অমুক ব্যক্তি তো একথা বলেছেন। ইবনে সিরীন (রহঃ) বললেন, আমি তোমাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী শোনাচ্ছি, আর তুমি বলছ, অমুক এ কথা বলেছেন।
ইমাম আওযাঈ থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেনঃ হযরত উমর ইবনে আবদুল আজীজ (রহঃ) এক পত্রে লিখেছেন, কিতাবুল্লাহর মোকাবেলায় কারো কোনো মতের মূল্য নেই। ইমামদের মতের মূল্য সেখানেই হতে পারে যেখানে কিতাবুল্লাহর কোনো নির্দেশ নেই। এমনকি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণীও সেখানে অবর্তমান। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্ধারিত বিধানের মোকাবেলায়ও কারও মতের গুরুত্ব নেই।
হযরত আমাশ থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেনঃ ইবরাহীম (রহঃ) বলতেন, মুক্তাদি ইমামের বাম পাশে দাঁড়াবে। আমি তাকে বললাম, সামী যিয়াত হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে তাঁর ডান দিকে দাঁড় করিয়েছেন। ইবরাহীম (রহঃ) সঙ্গে সঙ্গে তা কবুল করে নিলেন।
শাবী (রহঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেনঃ তার কাছে এক ব্যক্তি একটি ব্যাপার জানতে চাইলে তিনি তাকে বলেন, এ ব্যাপারে ইবনে মাসউদ (রাঃ) এ কথা বলেছেন। তখন সে বলল, আপনি আমাকে আপনার অভিমত বলুন। তিনি তখন বললেন, আমি তার কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যাই যাকে আমি বলি, ইবনে মাসউদ (রাঃ) এ কথা বলেছেন। আর সে বলে যে, আমি আপনার অভিমত জানতে চাই। আমি তো আমার মতের চেয়ে দ্বীনকে বেশি ভালোবাসি। খোদার কসম! সে লোককে আমার মত শোনাবার বদলে গান গাওয়াটা আমি বেশি পসন্দ করব।
এ সব আছার ইমাম দারামী বর্ণনা করেছেন।
আবু সায়েব থেকে ইমাম তিরমিজী (রহঃ) বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেনঃ আমি হযরত ওয়াকী (রহঃ)-এর কাছে ছিলাম। এক ব্যক্তি নিজের মতকে বেশ গুরুত্ব দিত। ওয়াকী একদা বললেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসআর করেছেন (পশুর কাঁধে জখম করে কোরবানি করেছেন।) অথচ ইমাম আবু হানীফা বলছেন, সেটা তো মোছলা করা (নাক কান কাটা)। তা শুনে সেই লোকটি বলল, ইবরাহীম নাখঈ থেকেও বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেছেন, আশআর করা তো মোছলা করা। আবু সায়েব বলেন, আমি দেখতে পেলাম, ওয়াকী (রহঃ) অত্যন্ত ক্রুব্ধ হলেন এবং তাকে বললেন, আমি তোমাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ফরমান শোনাচ্ছি আর তুমি বলছ, ইবরাহীম এ কথা বলেছেন? তোমাকে কয়েদ করা উচিত এবং যতক্ষণ তুমি এ কথা থেকে তওবা না করবে, ততক্ষণ মুক্তি না দেয়া চাই।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ), আতা, মুজাহিদ, মালেক ইবনে আনাস (রহঃ) প্রমুখ থেকে বর্ণিত আছে যে, তারা বলতেন –যে কোনো ব্যক্তির কথা গ্রহণ বা বর্জন করা যায়। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী সর্বাবস্থায় গ্রহণযোগ্য।
মোটকথা, ওলামা সম্প্রদায় যখন এসব নীতিমালার ভিত্তিতে ফেকাহ শাস্ত্র রচনা করেন, তখন তাদের সামনে এমন কোনো মাসআলা বাকি ছিল না যা নিয়ে তারা কথা বলেননি। তখন তাদের সামনে যে ঘটনাই আসুক না কেন, সে ব্যাপারে তারা মারফূ মুত্তাসিল হাদীস বা মুরসাল কি মাওকুফ হাদীস কিংবা সহীহ ও নির্ভরযোগ্য হাদীস পেয়ে গেছেন। অথবা পয়লা দু’খলীফার অভিমত কিংবা অন্যান্য খলীফা ও কাজিদের মত এবং বিভিন্ন শহরের আছার তারা হাতে পেয়ে গেছেন। তাই তা থেকে সাধারণভাবে অথবা ইশারা-ইঙ্গিত নিয়ে তারা মাসআলা উদ্ভাবন করেছেন। আল্লাহ পাক এভাবে তাদের সুন্নাহ অনুসরণের তাওফীক দান করেছেন।
আরেক কথা, সর্বাধিক মর্যাদা সম্পন্ন ও ব্যাপকতর বর্ণনার মালিক, হাদীসের স্তরবিন্যাসের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বিশারদ ও ফেকাহ শাস্ত্রের সর্বাধিক সূক্ষ্ম বিশ্লেষক ছিলেন ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহঃ)। তার পরের মর্যাদা হলো ইসহাক ইবনে রাহভিয়ার। ফেকাহ শাস্ত্রের এরূপ স্তরবিন্যাস বহু হাদীস ও আছারের ওপর নির্ভরশীল ছিল। ইমাম আহমদ (রহঃ)-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কোনো লোকের ফতোয়া দেবার জন্যে এক লাখ হাদীস জানা কি যথেষ্ট? তিনি জবাব দিলেন, না। এমনকি সে লোক যখন বলল যে, পাঁচ লাখ জানা কি যথেষ্ট? তখন তিনি বললেন, আশা করি সেটা যথেষ্ট হতে পারে। এটা ছিল জানার শেষ সীমা নির্ধারণের জবাব। ইমাম আহমদের জবাবের তাৎপর্য হলো এই যে, ফতোয়া দেবার জন্যে অনেক বেশী হাদীস জানা চাই।
এরপর আল্লাহ তাআলা দ্বিতীয় যুগের পত্তন ঘটালেন। তারা দেখতে পেলেন, তাদের সহযাত্রীরা হাদীস সংগ্রহ ও ফেকাহ শাস্ত্রকে তার মূল কাঠামোর ওপর দাঁড় করাতে যথেষ্ট ত্যাগ ও পরিশ্রম করে গেছেন। তাই তারা অন্যান্য বিষয়ে মনোনিবেশ করলেন। যেমন, শীর্ষস্থানীয় হাদীস বিশারদদের এজমা সম্মত বিশুদ্ধ হাদীস বাছাই করা। এ দলে ছিলেন যায়েদ ইবনে হারুন, ইয়াহিয়া ইবনে সাঈদ আল কাত্তাল, আহমদ, ইসহাক প্রমুখ। তেমনি একদল ফেকাহ সংশ্লিষ্ট হাদীসগুলো একত্রিত করেন। বিভিন্ন শহর ও রাজ্যের ফকীহ ইমামরা নিজ নিজ মাজহাব সে সব হাদীসের ভিত্তিতে দাঁড় করিয়েছেন। এগুলো ছিল তারই পূর্ণাঙ্গ সংকলন। যেমন প্রত্যেকটি হাদীসকে তার যথাযথ স্তরে স্থান দিয়েছেন। যেমন, শাজ ও নাদের হাদীসগুলো সংকলিত করেছেন। পূর্বসূরীরা সেগুলো বর্ণনা করেননি। অথবা সেগুলোর এমন সব সূত্র বর্ণনা করেছেন যা পূর্বসূরিরা করেন নি। তাদের মাধ্যমে এমন সব হাদীসও প্রকাশ পেয়েছে যা মুত্তাসিল নয় বা তার সূত্রো উঁচুস্তরের নয়। তা ছিল হয় ফকীহ থেকে ফকীহর, নয়তো হাফেজ থেকে হাফেজের বর্ণনা।
এ ধরনের কয়েকটি জ্ঞানগত উদ্দেশ্যই তাদের হাতে সম্পন্ন হয়েছে। এ স্তরের মুহাদ্দেসগণের ভেতর শীর্ষস্থানীয় হলেন, ইমাম বুখারী (রহঃ), মুসলিম (রহঃ), আবু দাউদ (রহঃ), আব্দ ইবনে হুমায়েদ আদ দাবারী (রহঃ), ইবনে মাজাহ (রহঃ), আবু ইয়াকী (রহঃ), তিরমিজী (রহঃ), নাসায়ী (রহঃ), দারে কুতনী (রহঃ), হাকেম (রহঃ), বায়হাকী (রহঃ), আল খতীব (রহঃ), আদদায়লামী (রহঃ), ইবনে আব্দিল বার (রহঃ) প্রমুখ।
আমার দৃষ্টিতে তাদের ভেতর সব চাইতে ব্যাপক জ্ঞানের অধিকারী, সর্বাধিক কল্যাণকর ও বিখ্যাত গ্রন্থের প্রণেতা হলেন চারজন। তাদের যুগও খুবই কাছাকাছি ছিল। তাদের ভেতর পয়লা উল্লেখ্য হলেন আবু আবদুল্লাহ বুখারী (রহঃ)। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল সহীহ, মুস্তাফীজ, মুত্তাসিল হাদীসগুলোকে অন্যান্য হাদীস থেকে পৃথক করে ফেলা। তার ভিত্তিতে যেন নির্ভরযোগ্য ফিকাহ, জীবন চরিত্র ও তাফসীর রচনা করা যায়।
তাই তিনি ‘জামেউস সহীহ’ প্রণয়ন করলেন এবং তার জন্যে তিনি যে সব শর্ত দিয়েছিলেন তা পূর্ণ করেছেন। আমি জানতে পেয়েছি যে, জনৈক নেককার ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে স্বপ্নে দেখেন। তখন তিনি বলেছেন, “তোমার হলো কি? তুমি মুহাম্মদ ইবনে ইদরীসের ফেকাহ নিয়ে মত্ত রয়েছ এবং আমার কিতাব ছেড়ে দিয়েছ? সে প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার কিতাব কোনটি? তিনি জবাবে বললেন, সহীহ বুখারী।
আমি আমার জীবনের কসম খেয়ে বলছি, সহীহ বুখারীর সেই খ্যাতি জনপ্রিয়তা অর্জিত হয়েছে যার বেশি খ্যাতি ও জনপ্রিয়তার কথা ভাবাই যায় না।
দ্বিতীয় স্থান হলো ইমাম মুসলিম নিশাপুরীর। তিনিও নিয়ম করেছিলেন সে সব বিশুদ্ধ হাদীস সংকলনের যার ওপর মোহাদ্দেসগণের এজমা হয়েছে। সেগুলো মারফু মুত্তাসিল হাদীস এবং তা থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাত উদ্ভাবন করা যায়। সেগুলো এমনভাবে গুছিয়ে দেয়া যেন মনে রাখা ও মাসআলা বের করা সহজ হয়। বস্তুত তিনি হাদীসগুলোকে উত্তমভাবে সাজিয়েছেন। প্রত্যেক হাদীসের সব সূত্র তিনি এক জায়গায় জমা করেছেন। ফলে ভাষ্যের মতভেদ ও সনদের পার্থক্য খোলাখুলিভাবে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে। তিনি বিভিন্ন হাদীস একই স্থানে সমবেত করেছেন যেন আরবি ভাষাভাষী বা আরবি জানা লোকের হাদীস ছেড়ে অন্য কিছু খোঁজাখুঁজি করে ফিরতে না হয়।
তৃতীয় স্থানে রয়েছেন আবু দাউদ সাজিস্থানী (রহঃ)। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল সে সব হাদীস সংকলিত করা ফকীহরা যা দিয়ে দলীল পেশ করেছেন। ফকীহদের ভেতর এ সব হাদীস চর্চা হতো এবং বিভিন্ন শহর ও রাজ্যে প্রচলিত বিধিবিধানের ভিত্তি ছিল এ সব হাদীস। তিনি তাঁর সুনান প্রণয়ন করেন এবং তাতে সহীহ, হাসান, অনুসরণযোগ্য সকল হাদীস ঠাঁই দেন। আবু দাউদ মতৈক্য রয়েছে। তিনি তার সংকলনে জঈফ হাদীস যা রয়েছে তার দুর্বলতা দেখিয়ে দিয়েছেন এবং যার ভেতর কোনো ত্রুটি ছিল তা তিনি এমনভাবে নির্দেশ করেছেন যা হাদীস নিয়ে গবেষণাকারীরা সহজেই বুঝতে পান। যে সব হাদীস থেকে মাসআলা বের করা হয়েছে এবং কোন মাজহাব অনুসারী তা অনুসরণ করছেন তার প্রতিটি হাদীসেই তিনি শিরোনাম জুড়ে দিয়েছেন। এ কারণেই ইমাম গাজ্জালী ও অন্যান্যদের বিশ্লেষণ হলো এই যে, যে কোনো মুজতাহিদের জন্যে আবু দাউদই যথেষ্ট।
চতুর্থ স্থানে রয়েছেন আবু ঈসা তিরমিজী (রহঃ)। তিনি শায়খাইনের (বুখারী ও মুসলিম) পদ্ধতিকে আরও সুস্পষ্ট করেছেন এবং তাঁরা যেখানে অস্পষ্টতা রেখে গেছেন তিনি তা পছন্দনীয় পন্থায় বিশ্লেষণ করেছেন। আবু দাউদের পন্থাও তিনি গ্রহণ করেছেন এবং মাজহাবের ইমামদের মাসলাক বর্ণনা করেছেন। সেমতে তিনি এক পূর্ণাঙ্গ কিতাব প্রণয়ন করেন এবং হাদীসের সূত্রগুলোকে তিনি সংক্ষিপ্ত রূপদান করেন। তিনি একটি সূত্র উল্লেখ করে অন্য সূত্রগুলোর ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন। এমনকি কোন হাদীসটি সহীহ, কোনটি হাসান, কোনটি জঈফ ও কোনটি মুনকার এবং জঈফ হাদীসের দুর্বলতার কারণ তিনি এভাবে সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, হাদীস শিক্ষার্থীরা এ ব্যাপারে পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করতে পারে। এমনকি নির্ভরযোগ্য ও অনির্ভরযোগ্য হাদীসের তারতম্যও যেন তারা বুঝতে পায়। কোন হাদীস মুস্তাফীজ ও কোন হাদীস গরীব তাও তিনি বলে দিয়েছেন। তিনি সাহাবা ও ফকীহদের কার কি মাজহাব সেটাও নির্দেশ করেছেন। যে ব্যক্তির নাম বলা দরকার তিনি তার নাম বলেছেন এবং যার লকব বলাই যথেষ্ট তার লকব বলে দিয়েছেন। আলেমদের জন্যে কোনো কিছুই তিনি অস্পষ্ট বা গোপন রেখে যাননি। এ কারণেই বলা হয়, এ কিতাব যেমন মুজতাজিদের জন্যে যথেষ্ট, তেমনি মুকাল্লেফদের জন্যেও যথেষ্ট।
ইমাম সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) ও ইমাম মালেক (রহঃ)-এর যুগ থেকেই পরবর্তীকালে এমন লোকও ছিলেন যারা মাসআলা বলার ব্যাপারে কোনোরূপ দ্বিধাবোধ করতেন না এবং ফতোয়া দিতেও ভয় পেতেন না। তারা বলতেন, দ্বীনের ভিত্তিই হলো ফিকাহ। তাই এর প্রচার-প্রকাশ প্রয়োজন। অথচ তারা হযরত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস বর্ণনা করা ও তাঁর পর্যন্ত সনদ পৌঁছে দেয়ার ব্যাপারে ভয় পেতেন। এমনকি শাবী (রহঃ) বলেনঃ
“নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া অপর কারোদিকে সনদের সম্পর্ক নির্ণয় আমি বেশি পছন্দ করি। কারণ, ভাষ্যে যদি বেশ-কম কিছু থাকে তো তার দায়-দায়িত্ব হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর যাবে না, যাবে তার ওপর”।
ইবরাহীম নাখঈ (রহঃ) বলেন, “আমি তো এটাই বলা উত্তম মনে করি যে, আবদুল্লাহ বলেন এবং আলকামা বলেছেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) যখন হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কোনো হাদীস বর্ণনা করতেন তো ভয়ে তার চেহারা বিবর্ণ হয়ে যেত এবং তিনি বলতেন, হয়ত তিনি একথা বলেছেন, নয়তো এরূপ বলেছেন অথবা এরূপ বলেছেন।
হযরত উমর (রাঃ) একদল কূফায় পাঠানোর প্রাক্কালে বলেন, তোমার কূফায় যাচ্ছ। তোমাদের নিক এমন লোকও আসবে যারা কুরআন তিলাওয়াত করতে গিয়ে কাঁদতে থাকবে এবং বলতে থাকবে, আসহাবে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসেছেন, আসহাবে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসেছেন। তারা তোমাদের কাছে হাদীস শোনার জন্যে পীড়াপীড়ি করবে। তাই সাবধান! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে খুব কমই বর্ণনা করবে।
ইবনে আওন (রহঃ) বলেনঃ “শাবী (রহঃ)-এর কাছে কেউ যদি কোনো মাসআলা জানতে আসত তো অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতেন। পক্ষান্তরে ইবরাহীম (রহঃ) সহজেই তা বলে দিতেন এবং ব্যাপকভাবেই এ কাজ করতেন”। এসব বর্ণনাই ইমাম দারামীর (রহঃ)।
অতঃপর হাদীস, ফেকাহ ও মাসআলা-মাসায়েল ভিন্নভাবে প্রণয়নের প্রয়োজন দেখা দিল। তার কারণ ছিল এই যে, তাদের কাছে এত বেশি হাদীস ও আছার মওজুদ ছিল না যার সাহায্যে তারা মুহাদ্দিসদের অনুসৃত নীতির ওপর ফেকাহর মাসআলা উদ্ভাবন করতে পারেন। পক্ষান্তরে, বিভিন্ন শহরের আলেমদের অভিমত জমা করে তা নিয়ে বাহাস-মোহাহেসা চালাতেও তাদের মন সায় দিচ্ছিল না। তারা নিজেদের ওপরও আস্থা আনতে পারছিলেন না। ফলে তারা ফকীহ ইমামদের ওপর আস্থাবান হলেন। তাদের ধারণা, ফকীহরা বিচার-বিশ্লেষণ ও গবেষণায় উচ্চতম স্তরে রয়েছেন। তাদের অন্তরের আকর্ষণও নিজ সহচরদের প্রতি ছিল সর্বাধিক। হযরত আলকামা (রহঃ) বলেনঃ
কোনো সাহাবীই ফেকহী জ্ঞানে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রহঃ) থেকে মজবুত নন”।
ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) বলেনঃ ইবরাহীম হযরত সালেম থেকে বড় ফকীহ। যদি সাহাবী হবার বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত না হতেন, তা হলে আমি বলতাম, আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে আলকামা বড় ফকীহ।
এ ধরনের আলেমদের মেধাম, সূক্ষ্মদর্শিতা ও উদ্ভাবনী শক্তি এতই প্রখর যে, তারা নিজ সহগামীদের অভিমত পেলে খুব দ্রুত মাসআলার জবাব বের করে নেন। তাদের বক্তব্য হলো –“যাকে যে কাজের জন্যে পয়দা করা হয়েছে তাকে তার তাওফীক দেয়া হয়েছে”।
মূলত সব দলই নিজেদের কাছে যা আছে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট। এর ফলে তারা তাদের নির্ধারিত মাসআলা উদ্ভাবন পদ্ধতির ভিত্তিতে নতুন করে ফেকাহর কিতাব প্রণয়ন করেন। তার সুরাতটি এই ছিল যে, প্রত্যেকে তার কিতাবটি সংরক্ষণ করত যার দৃষ্টিভঙ্গি অপেক্ষাকৃত সঠিক বিবেবচিত হতো এবং যিনি তার সহযাত্রীতের ভাষা ও আলেমদের অভিমত সম্পর্কে অধিকতর ওয়াকিফহাল ছিলেন। তার নীতি ছিল এই যে, তিনি প্রতিটি মাসআলা নিয়ে নিজে নিজে চিন্তা ভাবনা করতেন। সেমতে যখন তার কাছে কিছু জানতে চাওয়া হতো কিংবা কোনো মাসআলার ব্যাপারে তার প্রয়োজন দেখা দিত, তখন তিনি তাঁর সহযাত্রীদের বিশ্লেষণগুলো দেখতেন। যদি তাতে জবাব পেয়ে যেতেন তো ভালো কথা, নইলে তাদের অভিমতের ব্যাপ্তি নিয়ে ভাবতেন। তারপর এ পথেই তা বের করতে প্রয়াসী হতেন, অথবা তাদের ভাষ্য থেকে কোনো ইঙ্গিত নিয়ে মাসআলার জবাব বের করতেন। অনেক সময় কোনো কোনো ভাষ্যের ইশারা অথবা চাহিদা থেকেও উদ্দেশ্য বুঝা যেত। কখনো বা সেই বিশেষ মাসআলার কোনো দৃষ্টান্ত পাওয়া গেলে তার ভিত্তিতেই হুকুম দেয়া হতো। অনেক সময় কোনো একটি সুস্পষ্ট বিধানের কার্যকারণ নির্ণয় করে তার ভিত্তিতে নতুন বিধানটি প্রমাণিত করা হতো।
কখনো কখনো কোনো আলেমের কোনো ব্যাপারে দুটো ভাষ্য দেখা যায়। তা যদি নৈকট্য ভিত্তিক বা শর্তমূলক কেয়াসের মাধ্যমে এক করে নেয়া যায় তা হলেও মাসআলার জবাব মিলে যায়। কখনো তাদের কোনো বক্তব্যের উপমা ও শ্রেণীবিন্যাসের মাঝ থেকে কোনো ব্যাপার জানা যেত। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ কোনো সংজ্ঞার মাধ্যমে তা বুঝানো যেত না। এ অবস্থায় তারা ভাষাভাষীদের শরাণাপন্ন হতেন এবং তার শ্রেণী নির্ধারণ করতেন। তারপর তার জন্যে পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা স্থির করতেন। তার ভেতরকার অস্পষ্ট ব্যাপার আয়ত্ত করতেন এবং তার দুর্বলতাগুলোকে চিহ্নিত করার ব্যাপারে যথেষ্ট প্রয়াস পেতেন।
কখনো তাদের কোনো ভাষ্যের দুটো দিক থাকত। তখন তা থেকে একটিকে প্রাধান্য দেবার জন্যে এরা গবেষণা করতেন। কখনো পূর্ববর্তীদের দলীল বর্ণনার ভেতরে কিছু রহস্য থেকে যেত। এরাসে রহস্য উদঘাটন করতেন। কখনো বা এ মাসআলা বের করার লোকেরা তাদের ইমামদের কোনো কাজ কিংবা কোনো ব্যাপারে তাদের চুপ থাকা থেকে দলীল দাঁড় করাতেন। তার নাম দিতেন তারা তাখরীজ এবং বলতেন, আমরা অমুকের বক্তব্য থেকে তাখরীজ করেছি। অথবা তারা বলতেন –অমুকের মাজহাব মতে কিংবা অমুকের মূলনীতি ও পদ্ধতি মোতাবেক এ মাসআলার জবাব হলো এই। এ তাখরীজ বা মাসআলা বের করার লোকদের বলা হয় মাজহাবের মুজতাহেদ। যে ব্যক্তি বলেন যে, যে ব্যক্তি “আল-মাবসূত” স্মৃতিস্থ করেছে সে মুজতাহেদ, তার ইজতেহাদের তাৎপর্য হচ্ছে উক্ত তাখরীজ। মানে, তার রেওয়ায়েত সম্পর্কে কোনো জ্ঞান না থাক, না জানুক সে কোনো একটি হাদীসও, তবু সে মুজতাহিদ। এভাবেই প্রত্যেক মাজহাবে তাখরীজ হয়েছে। এমনকি তার পরিমাণ বিপুল হয়ে গেছে। অতঃপর যে মাজহাবের আসহাব বিখ্যাত হয়ে গেছেন, তারা বিচার ও ফতোয়া বিভাগের দায়িত্ব পেয়ে গেছেন। লোকদের ভেতর তাদের প্রণীত গ্রন্থাবলি ছড়িয়ে পড়েছে। তারা পাঠদান ও খোলাখুলি শিক্ষাদান শুরু করলেন। ফলে সেই মাজহাব দিকে দিকে বিস্তার লাভ করল। প্রতিদিন তাদের খ্যাতি বেড়েই চলল। পক্ষান্তরে যে মাজহাবের আসহাব আখ্যাত থাকলেন, তারা কাজি বা মুফতির মসনদ অলঙ্কৃত করতে পারলেন না। লোকজনও তাদের ব্যাপারে কোনো আকর্ষণ বোধ করল না। ফলে কিছুদিন পর সে সব মাজহাব বিলুপ্ত হলো।