অধ্যায়-৮৪
হিজরী চতুর্থ শতকের আগে ও পরের লোকের অবস্থা
জেনে নিন, হিজরী চতুর্থ শতকের আগের লোকেরা কোনো বিশেষ এক মাজহাবের অনুসারী হতে একমত ছিলেন না। শায়েখ আবু তালেব মক্কী তাঁর ‘কিতাবুল কুলুবে’ বলেন, বিভিন্ন কিতাব ও সংকলন পরবর্তী কালের সৃষ্টি। লোকদের ভাষ্যের ভিত্তিতে হুকুম জারি করা, লোককে কোনো এক মাজহাবের ভিত্তিতে ফতোয়া দেয়া, কোনো এক ভাষ্যের অনুসারী হওয়া এবং সব ব্যাপারেই সেটা উদ্বৃত করা এবং এক এক মাজহাব নিয়ে অনুসন্ধান ও গবেষণা করা, আগেকার লোকদের ভেতর অর্থাৎ পয়লা শতক, দ্বিতীয় শতক ও তৃতীয় শতকে ছিল না।
আমি বলছি, পয়লা ও দ্বিতীয় শতকের পর কিছু কিছু তাখরীজ বা মাসআলা উদ্ভাবন শুরু হয়েছে। কিন্তু চতুর্থ শতক পর্যন্ত লোকেরা কোনো বিশেষ মাজহাব অনুসরণ, তা নিয়ে গবেষণা ও অনুসন্ধান চালানো এবং তার ভাষ্য উদ্ধৃত করে বেড়ানোর ব্যাপারে একমত হয়নি। মূলত অনুসন্ধানে এটাই জানা যায়।
তাদের ভেতর আলেম ও সাধারণ মুসলমান ছিলেন। সাধারণ মুসলমানদের অবস্থঅ এই ছিল যে, তারা সামাজিক জীবনের মাসায়েলের প্রশ্নে যে ব্যাপারে মুসলমানদের মতভেদ পোষণ করতেন না, সে সব সর্বসম্মত মাসআলার ক্ষেত্রে কেবলমাত্র শরীআত প্রণেতা ছাড়া কারো অনুসরণ করতেন না। তারা নিজেদের বাপ-মা বা শহরের মুআল্লিমদের কাছে ওযু, গোসল, নামায, যাকাত ইত্যাদির নিয়ম-কানুন শিখতেন এবং তদানুসারে আমল করতেন। যখন কোনো নতুন ঘটনা সামনে আসত, তখন নির্দিষ্ট কোনো মাজহাবের ভাবনা ছাড়াই কাছাকাছি যে মুফতি পেতেন তার কাছ থেকেই জেনে নিতেন।
পক্ষান্তরে, আলেমদের অবস্থা এই ছিল যে, তারা হাদীসের অনুসারী ছিলেন এবং নিজেরাও মোহাদ্দেস ছিলেন। হাদীস নিয়েই তারা নিমগ্ন ছিলেন। রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস ও সাহাবায়ে কেরামের আছার তাদের কাছে এত বেশি মওজুদ ছিল যে, কোনো মাসআলার জবাবের জন্যে তাদের অন্য কিছুর মুখাপেক্ষী হতে হতো না। তাদের কাছে মশহুর বা সহীহ হাদীস ছিল। তার ওপর কোনো কোনো ফকীহর আমলও ছিল। তাই তা বর্জনের কোনো কারণ ছিল না। তাছাড়া তাদের অধিকাংশ সাহাবীর ও তাবেঈনের আছার বা বিখ্যাত ভাষ্য ছিল যার বাইরে যাওয়া ঠিক ছিল না। যদি পরস্পর বিরোধের কারণে রেওয়ায়াত অনুসরণে অসুবিধা দেখা দিত ও তার কোনোটিকে প্রাধান্য দেবার কোনো ব্যাখ্যা না পেত, ফলে মানসিক অস্বস্তি দেখা দিত, তখন তারা পূর্বসূরিদের কারো ভাষ্য পেলে তা অনুসরণ করতেন, হোক তা মদীনাবাসীর কিংবা কূফাবাসীর।
পক্ষান্তরে তাদেরভেতর যারা তাখরীজ পন্থী হতেন, তারা যে হাদীসের বিধান সুস্পষ্ট ছিল না, কেবলমাত্র সেগুলো থেকেই ইজতেহাদ করে মাসআলা বের করতেন। ফলে তারা যে কোনো এক মাজহাবের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যেতেন। তখন বলা হতো, অমুক হানাফী কিংবা অমুক শাফেঈ মাজহাবের লোক। কখনো কোনো মোহাদ্দেসও মতৈক্যগত কারণে কোনো মাজহাবের সাথে চিহ্নিত হয়ে যেতেন। কারণ, বহু মাসায়েলে তিনি সেই মাজহাবের সাথে মতৈক্য রাখেন। যেমন ইমাম নাসায়ী (রহঃ) ও ইমাম বায়হাকী (রহঃ)-কে শাফেঈ মাজহাবের লোক বলা হয়। তবে ক্বাযা ও ইফতা বিভাগের দায়িত্ব শুধু মোজতাহেদকেই দেয়া হতো। আর ফকীহও বলা হয় শুধু মোজতাহেদকে।
এ চার যুগের পর দুনিয়ায় এমন লোক এল যারা এদিক-ওদিক মনোনিবেশ করলেন। ফলে কতিপয় নতুন ব্যাপার দেখা দিল। তারভেতর একটা তো হলো ফেকাহ শাস্ত্র্রের মতভেদ ও ঝগড়া। গাজ্জালী (রহঃ)-এর বর্ণনামতে তার বিশ্লেষণ হচ্ছে এইঃ
যখন খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগ শেষ হলো, তখন তাদের হাতে খেলাফত চলে গেল যারা খেলাফতের অন্যায় দাবি করত। অথচ তাদের ফতোয়া ও শরয়ী আহকামের বিশেষ জ্ঞান ছিল না। ফলে তারা ফকীহদের সাহায্য লাভ ও সর্বাবস্থায় তাদের সাথে রাখার জন্যে বাধা ছিল। কিন্তু কিছু প্রবীণ আলেম তাদের পুরনো ভাবের ওপর বজায় থাকলেন এবং স্বচ্ছ দ্বীনের অনুসারী থেকে গেলেন। খলীফা যখন তাদের ডাকতেন তখন তারা তাঁর কাছ থেকে দূরে থাকতেন এবং সে ডাকে সাড়া না দিয়ে ফিরে থাকতেন। ফলে সে যুগের লোকেরা আলেমদের ইজ্জত ও শাসকদের তাদের প্রীতি সুদৃষ্টি দেখতে পেল এবং এও দেখতে পেল যে, আলেমরা তাদের এড়িয়ে চলেন। এ ইজ্জত ও ঠাঁট অর্জনের জন্যে তারা তালেবে ইলেম হবার জন্যে খুবই উৎসাহিত হলো।
এর আগে ফকীহরা ছিল আকাঙ্ক্ষিত। একালের ফকীহরা সুলতানদের আকাঙ্ক্ষিত বানালেন। সুলতানদের এড়িয়ে চলাই ছিল তাদের ইজ্জতের সনদ। কিন্তু সুলতানদের পেছনে ধর্ণা ধরে এরা লাঞ্ছনার সনদ হাসিল করলেন। শুধু আল্লাহ পাক যাদের রক্ষা করেছেন তারাই বেঁচে গেলেন।
ইতিপূর্বে অনেকেই কালাম শাস্ত্রের ওপর গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। তাতে তারা বহু তর্ক-বিতর্ক করেছেন, বহু প্রশ্ন তুলে তার জবাব লিখেছেন। তাতে তারা বহাস-মোবাহেসার পদ্ধতি নির্ধারণ করেছেন। এ বিদ্যাটি তাদের মন মগজে ততদিন সক্রিয় ছিল যতদিন সুলতান ও উজীররা ফেকহী মাজহাবের হানাফী মাজহাব শ্রেষ্ঠ, না শাফেঈ মাজহাব শ্রেষ্ঠ, এ ঝগড়া ও মোনাজেরার দিকে মনোনিবেশ না করেছেন। যখন এ পরিস্থিতি এল, তখন লোকেরা কালাম শাস্ত্র ছেড়ে দিল এবং জ্ঞানচর্চার বিষয়গুলো বর্জন করে হানাফী ও শাফেঈ মাজহাবের মধ্যকার মতানৈক্যের ব্যাপারগুলো বর্জন করে হানাফী ও শাফেঈ মাজহাবের মধ্যকার, মতানৈক্যের ব্যাপারগুলো নিয়ে মাথা ঘামাতে লাগলেন। মালেক (রহঃ), সুফিয়ান (রহঃ) ও আহম্মদ ইবনে হাম্বলের (রহঃ) সাথে তাদের যে মতানৈক্য ছিল, সেদিকে তারা ভ্রুক্ষেপ করলেন না। তারা ভাবলেন, এ সব ইমামের উদ্দেশ্য হচ্ছে শরীআতের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়গুলো উদঘাটন করা, মাজহাবের ত্রুটি-বিচ্যুতি বর্ণনা করা ও ফতোয়ার মূলনীতি নির্ধারণ করা। ফলে তাদের সামনে জ্ঞানচর্চার বিষয়গুলো মুখ্য হয়ে গেল। তারা সেক্ষেত্রে অনেক কিছু উদ্ভাবন করলেন। তার ভেতর নানা ধরনের বিতর্ক ও বহাছের গ্রন্থ সৃষ্টি হলো। এখনও সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে। জানিনা আল্লাহ তাআলা ভবিষ্যতে এ সব জ্ঞানচর্চার কোন ভাগ্য নির্ধারণ করে রেখেছেন।
তার ভেতর একটি ব্যাপার হলো এই যে, এ কালের লোকেরা তাকলীদের ওপর নিশ্চিন্তে বসে গেছেন। তাদের অন্তরে অজ্ঞাতেই অন্ধ অনুসরণের প্রভাব ছেয়ে গেছে। মূলত ফকীহদের পারস্পরিক মতভেদ ও বহাস-মোবাহাসাই এর কারণ। যখনই তাদের ভেতর ফতোয়ার ক্ষেত্রে ঝগড়া ও বিরোধ সৃষ্টি হলো, তখন একজন ফতোয়া দিলে আরেকন তার ওপর প্রশ্ন তুলে তা রদ করতেন এবং শেষ পর্যন্ত গিয়ে পূর্বসূরিদের কারো সুস্পষ্ট ভাষ্যের ওপর একমত হয়ে তারা বহাস খতম করতেন।
তাছাড়া কাজিদের জুলুমও তাকলীদের অন্যতম কারণ ছিল। ক্বাজিরা আমানতদার ছিলেন না। এ অবস্থায় তাদের ফয়সালা তখনই মানা হতো যখন সে ব্যাপারে জনগণের কোনো সন্দেহ না থাকত এবং তার সমর্থনে আগেকার কারো বক্তব্য পাওয়া যেত।
একটা কারণ এও ছিল যে, শাসকরা অজ্ঞ হয়ে গিয়েছিলেন। তাই লোকেরা তাদের কাছে ফতোয়া জানতে চাইত, তাদের না হাদীস জানা ছিল, না তাখরীজের পদ্ধতি জানা ছিল। যেমন আখেরী যমানার অধিকাংশের বাহ্যিক অবস্থা তোমরা দেখতে পাচ্ছ। ইবনে হুমাম প্রমুখ সতর্ক করে গেছেন এ ব্যাপারে। এখন তোএকজন অমুজতাহিদকেও ফকীহ বলা হয়।
এটাও একটা ব্যাপার ছিল যে, প্রত্যেকেই সব বিষয় নিয়ে ঘাটাঘাটি ও গবেষণা চালাচ্ছে। কেউ ভাবছেন, তিনি আসমায়ে রেজাল-এর ভিত কায়েম করছেন এবং যাচাই বাছাই করার স্তর জানার জ্ঞান আবিস্কার করছেন। অতঃপর লোকদের দৃষ্টি নতুন ও পুরাতন ইতিহাসের দিকে নিবদ্ধ হলো। কিছু লোক নাদের ও গরীব হাদীস তালাশ করতে লাগলেন, হোক তা মাওজু স্তরের হাদীস।
কিছু লোক অসূলে ফেকাহর ভেতর বহু কূটতর্ক সৃষ্টি করলেন। প্রত্যেকে তার সাহাবাদের জন্যে ঝগড়ার নীতিমালা ও পদ্ধতি তৈরি করে দিলেন এবং প্রতিপক্ষের মোকাবেলার জন্যে প্রশ্নাবলির এক পশলা বৃষ্টি সৃষ্টি করে দিলেন। প্রতিপক্ষ আবার তার জবাব তৈরি করেছেন এবং তার জন্যে যথেষ্ট অনুসন্ধান চালিয়েছেন। প্রত্যেকটি ব্যাপারের তারা সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছেন ও শ্রেণীবিন্যাস ঘটিয়েছেন। কোথাও পর্যালোচনা দীর্ঘ করেছেন, কোথাও তা সংক্ষেপে সেরেছেন।
কিছু লোক এ পথও ধরেছেন যে, সুদূর ভবিষ্যতের কাল্পনিক মাসআলা বানিয়ে তা নিয়ে বহাস করেছেন। উদ্দেশ্য কোনো জ্ঞানী ব্যক্তি যেন কখনো তার মাজহাবের যৌক্তিকতার ব্যাপারে কথা না বলতে পারে।
কিছু লোক তাখরীজ পন্থীদের ও এমনকি তারও নিম্নমানের লোকদের ভাষ্যের ব্যাপক অর্থ ও ইশারা-ইঙ্গিত নিয়ে অনুসন্ধান ও বহাস চালিয়েছেন যা না কোনো আলেম শোনা পসন্দ করেছেন আর না অজ্ঞ লোকেরা শুনতে চেয়েছে। এ ঝগড়া, মতানৈক্য ও গবেষণার ফেতনা সেই প্রাথমিক যুগের ফেতনার কাছাকাছি পৌঁছে গেল যখন লোকেরা রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে ফাসাদ সৃষ্টি করেছিল। সেই ফেতনার পরিণামে জালেম শাসক চেপে বসল, কলঙ্কজনক ও অস্বস্তিকর ঘটনা ঘটতে লাগল। তেমনি এ ইলমী ফেতনার পরিণামে দেখা দিল মূর্খতা, ভেজাল, সংশয় ও অবিশ্বাসের আঁধার যুগ। তা থেকে মুক্তিরও কোনো আশা নেই।
এরপর এল শুধুই অন্ধ তাকরীদের যুগ। তারা এখন আর হক ও বাতিল যাচাই করার প্রয়োজন ভাবে না। ঝগড়া ও উদ্ভাবনের তারতম্য জ্ঞানও এখন বাকি নেই। এখন তো অবস্থা এই যে, গলা ফুলিয়ে যে ব্যক্তি ফকীহদের সবল ও দুর্বল ভাষ্যগুলো কোনো যাচই ছাড়াই মুখস্ত করে মুখ চিবিয়ে চিবিয়ে তা বলতে পারে সেই ফকীহ হয়ে যায়। তেমনি যে ব্যক্তি সহীহ ও দুর্বল হাদীসের তারতম্য না করে কাহিনীকারের মতো চিৎকার দিয়ে দিয়ে বলে যেতে পারে সেই মুহাদ্দিস বনে যায়। আমি এ কথা বলছি না যে, সবাই এরূপ হয়ে গেছে। বরং আল্লাহর বান্দাদের ভেতর একদল সর্বদা এরূপ রয়েছে যাদের কেউ কোনো ক্ষতি সাধন করতে পারে না। এ দলটি আল্লাহর পৃথিবীতে আল্লাহর প্রমাণ হিসেবে বিরাজ করে। হোক তা যতই ক্ষুদ্র দল।
এরপর যে যুগ এল তাতে উক্ত ফেতনা বেড়েই চলল। তাকলীদ চরম রূপে বেড়ে গেল। মানুষের অন্তর থেকে আমানতদারী উঠে গেল। অবশেষে লোকেরা দ্বীনি ব্যাপারগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ছেড়ে দিল। তারা একথাই বলতে লাগল, আমরা আমাদের বাপ-দাদাদের অমুক মাজহাবের ওপর চলতে দেখেছি এবং আমরা তাদেরই অনুসরণ করে চলছি।
তাই ফরিয়াদ কেবল আল্লাহর কাছেই করছি, তাঁরই মদদ চাচ্ছি, তাঁর ওপরই ভরসা করছি এবং তিনিই নির্ভরযোগ্য আশ্রয় ও তাঁর ওপরই নির্ভর করছি।
সাধারণ অধ্যায়
এ অধ্যায়ে উচিত হবে কয়েকটি জরুরি মাসআলা সম্পর্কে লোকদের অবহিত করা। কারণ, লোকদের জ্ঞান বুদ্ধি আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। তাদের পা ফসকে গেছে। তাদের লেখনী ভুল বর্ণনা করছে ও বাঁকা পথে চলছে।
১। একটি মাসআলা হলো এই যে, ফিকাহর যে চারটি মাজহাব রচিত হয়েছে ও তা লিপিবদ্ধ হয়ে গেছে, তার ওপর উম্মতদের এজমা হয়ে গেছে। অথবা বলা যায়, ভারসাম্যপূর্ণ সমঝদার লোকদের মতৈক্য ঘটেছে যে, সেগুলোর তাকলীদ করা জায়েয। তার ভেতর যে অনেক কিছু কল্যাণ রয়েছে তা অস্পষ্ট নয়। কারণ এ যুগে তাকলীদ এ জন্যে বৈধ যে, লোকদের সাহস হারিয়ে গেছে, তাদের নফসের খাহেশ অনেক বেড়ে গেছে এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ অভিমত নিয়ে গৌরক করে বেড়ায়। ইবনে হাজম যে বলেছেনঃ
‘তাকলীদ করা হারাম’ এবং কারো জন্যে জায়েয নয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী ব্যতীত অন্য কারো ভাষ্য থেকে দলীল নেয়া। কারণ আল্লাহর তাআলা বলেনঃ
“তোমাদের প্রতিপালক প্রভু থেকে তোমাদের কাছে যা অবতীর্ণ হয়েছে তা অনুসরণ কর এবং তিনি ছাড়া অন্য কোনো মুরুব্বীদের গায়রবীর পেছনে ছুটো না।
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন, “যখন তাদের বলা হয়, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তা অনুসরণ কর, তখন বলে –না, আমরা তো সেই পথ অনুসরণ করব যে পথে আমাদের বাপ-দাদা চলে গেছেন”।
তেমনি যারা তাকলীদ করে না তাদের প্রশংসা করে আল্লাহ পাক বলেনঃ
“অনন্তর সুসংবাদ দাও আমার সেই বান্দাদের যারা আমার কথা শোনে ও সেই পুণ্যবাণী যথাযথভাবে অনুসরণ করে, আল্লাহ তাদেরই পথ দেখিয়েছেন এবং তারাই যথার্থ জ্ঞানী”।
অন্যত্র আল্লাহ পাক বলেন, “অতঃপর তোমরা যদি কোনো মতবিরোধে পড়ে যাও, তাহলে আল্লাহর দিকে ও তাঁর রাসূলের দিকে মনোনিবেশ কর –যদি তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের ওপর ঈমান রাখ”।
উপরোক্ত আয়াতসমূহে আল্লাহ তাআলা মতবিরোধের ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহ ছাড়া অন্য কারো দিকে মনোনিবেশ করার অনুমতি দেননি। তেমনি মতবিরোধের প্রশ্নে অন্য কারো ভাষ্যের দিকে মনোনিবেশ করাকে হারাম বলে নির্ধারণ করেছেন। কারণ, কোনো ব্যক্তির বক্তব্যও কুরআন-সুন্নাহ বহির্ভূত ব্যাপার। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সাহাবা ও তাবেঈদের এ ব্যাপারে এজমা ছিল যে, তাদের কাতারের পূর্ববর্তীদের কোনো ব্যক্তির ভাষ্যের দিকে মনোনিবেশ করা বা ব্যক্তি বিশেষের সব কথা মেনে নেয়া নিষিদ্ধ। এক্ষণে যে ব্যক্তি ইমাম আবু হানিফা (রহঃ), ইমাম মালেক (রহঃ), ইমাম শাফেঈ (রহঃ) ও ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)-এর যে কারো সব কথা মেনে নেয় ও অনুসরণ করে, অথবা অন্য যেকোনো ইমাম বা মান্যবরের সব কথাই মেনে চলে ও অনুসরণ করে এবং ততক্ষণ পর্যন্ত কুরআন সুন্নাহর কোনো বাণী গ্রহণ করে না যতক্ষণ তা সেই ব্যক্তি বিশেষের ভাষ্যের অনুকূল না হয়; তো স্মরণ রাখুন, সে ব্যক্তি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গোটা উম্মতের বিরোধিতা করল। অবশ্য এতে সন্দেহ নেই যে, উত্তম তিন যুগের সালফে সালেহীনদের কাউকেই কেউ যদি সাথী না পেয়ে থাকে তো সে ঈমানদারের রাস্তা ছেড়ে ভিন্ন রাস্তায় চলছে। নাউজুবিল্লাহ। আমরা সেরূপ অবস্থা থেকে আল্লাহ পাকের আশ্রয় চাই। অধিকন্তু উক্ত সব ফকীহর সালফে সালেহীন ছাড়া অন্য কারো তাকলীদ করতে নিষেধ করেছেন। ফলে সেরূপ ব্যক্তি তো যার তাকলীদ করছে, সেই ইমামেরই বিরোধিতা করছে। তা ছাড়া এমন কোনো ব্যক্তি রয়েছে যে লোক উক্ত ইমামদের কারো কিংবা অন্য কোনো ইমামের তাকলীদ করাকে উমর (রহঃ), আলী (রহঃ), ইবনে মাসউদ (রহঃ), ইবনে উমর (রহঃ), ইবনে আব্বাস (রহঃ) কিংবা উম্মুল মুমেনীন হযরত আয়েশা (রাঃ)-দের কারো তাকলীদ করার চেয়ে উত্তম ভাসতে পারে। যদি তাকলীদ বৈধ হতো তা হলে তাদের যে কোনো সাহাবীর তাকলীদ করা বেশি গুরুত্ব পেত অন্য যে কোনো ইমামের তাকলীদ থেকে।
ইবনে হাজমের উপরোক্ত বক্তব্য তার বেলায় প্রযোজ্য হতে পারে যার ভেতরে অন্তত কিছুটা ইজতেহাদী শক্তি রয়েছে। হোক তা একটি মাসআলা উদ্ভাবনের শক্তি। আর তার বেলায় প্রযোজ্য হবে যার সুস্পষ্টভাবে এ বিদ্যা অর্জিত হয়েছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কাজ করতে বলেছেন, এ কাজ নিষেধ করেছেন এবং এ কাজের হুকুমটি মানসুখ হয়নি। তার পন্থা এই যে, হয় সে ব্যক্তি হাদীস ও মাসায়েলের ব্যাপারে পক্ষ-বিপক্ষের হাদীস ও ভাষ্য খুব ভালোভাবে যাচাই করবে এবং জেনে নিবে কোনিট মানসুখ আর কোনটি নাসেখ, আর শ্রেষ্ঠ আলেমদের কোন মাজহাবে এজমা রয়েছে। তখনই সে তাদের বিরোধিদের দেখতে পাবে যে, তারা শুধু কেয়াস, ইজতেহাদ ও চিন্তাভাবনা দ্বারা প্রমাণ দেন। তখন সে এটাও বুঝবে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীসের বিরোধিতার কারণ সুপ্ত নেফাক অথবা হেমাকাত ছাড়া আর কিছুই নয়।
তেমনি শায়েখ আযযুদ্দীন ইবনে আবদুল মালিক বলেনঃ এটা চরম বিস্ময়কর কথা যে, মুকাল্লেদ ফকীহদের কিছু লোক এরূপ যে, তারা নিজ ইমামের মাসআলার উৎস দুর্বল দেখতে পায়, তার কোনো জবাবও তারা খুঁজে পায় না, তথাপি তারা সেই মাসআলায় তাদের ইমামের তাকলীদ করেন। কিতাব, সুন্নাহ ও সহীহ কেয়াস যে মাজহাবের মাসআলার সত্যতা প্রমাণ করে, শুধুমাত্র ইমামের তাকলীদে দৃঢ়তার কারণে সেটাও তারা বর্জন করে। বরং কিতাব ও সুন্নাহর প্রকাশ্য বিধান ছেড়ে তারা তার দূরতম বাতিল ব্যাখ্যা করে বেড়ায়। তিনি আরও বলেনঃ
“এতকাল লোকেরা সর্বদা কাছে যে আলেম পেত তার কাছেই মাসআলা জেনে নিত। তারা কোন মাজহাবের প্রশ্ন তুলত না, কে কার কাছে মাসআলা জানতে গেল তা নিয়েও মাথা ঘামাত না। যে যখন যার কাছ থেকে সুযোগ পেত, মাসআলা জেনে নিত। অবশেষে যত সব মাজহাব দেখা দিল এবং সেগুলোর অন্ধ অনুসারী সৃষ্টি হলো। এ অন্ধ মুকাল্লিদদের অবস্থা এই ছিল যে, যদিও তাদের মাজহাব দলীল প্রমাণ থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে, তথাপি তার তাকলীদ করে চলে। মনে হয় যেন তা কোনো প্রেরিত নবীর বাণী। এ পদ্ধতিটি সত্য থেকে ও সততা থেকে বিচ্যুত হয়ে দূরে চলে গেছে। কোনো জ্ঞানী ব্যক্তি এটা পসন্দ করতে পারে না।
ইমাম আবু শামাহ বলেন, “ফিকাহ নিয়ে যারা মশগুল থাকেন তাদের নির্দিষ্ট কোনো মাজহাবকে যথেষ্ট মনে করা অনুচিত। পরন্তু প্রত্যেক মাসআলার ক্ষেত্রে সেটাকেই সঠিক ভাববেন, যেটা কুরআন-সুন্নাহর প্রমাণ ও তাৎপর্যের সর্বাধিক অনুকূল। এ পদ্ধতিটি গ্রহণ করা তার জন্যেই সহজ হবে যখন সে ব্যক্তি পূর্বেকার জ্ঞান গবেষণার যথেষ্ট সমৃদ্ধ হবে। তার জন্যেও এটা জরুরী যে, মাজহাবী সংকীর্ণতা ও শেষ যুগের আলেমদের মতভেদ নিয়ে চিন্তা ভাবনা থেকে দূরে থাকবে। কারণ যে কাজটি সময়ের অপচয় ঘটায় আর স্বচ্ছ মন মানসিকতাকে ঘুলিয়ে ফেলে। ইমাম শাফেঈ (রহঃ) থেকে এ প্রমাণ মেলে যে, তিনি তাকে সহ যেকোনো ইমামকে অন্ধভাবে অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন। ইমাম শাফেঈর (রহঃ) সহচর ইমাম মুজনী (রহঃ) তার ‘মুখতাসার’ গ্রন্থে বলেনঃ আমি আমার এ কিতাবে শাফেঈ (রহঃ)-এর জ্ঞান-গবেষণা ও তার ভাষ্যের ব্যাখ্যা সংক্ষেপে বর্ণনা করেছি। এজন্যে যে, তাকে যে জানতে চায় তাকে আমি তার মন মগজের কাছে পৌঁছে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে এও বলে দিচ্ছি যে, ইমাম শাফেঈ তার ও অন্যান্যদের তাকলীদ করতে নিষেধ করেছেন যেন তার বদলে দ্বীনের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখা হয় এবং নিজকে বাঁচিয়ে রাখা হয়। অর্থাৎ তিনিও ইমাম শাফেঈর জ্ঞান গবেষণা জানতে বলেছেন, কিন্তু তার তাকলীদ করতে নিষেধ করেছেন।
তাছাড়া ইবনে হাজমের বক্তব্য তার জন্যে প্রযোজ্য হতে পারে, যে লোক সাধারণ পর্যায়ের এবং কোনো ইমামের তাকলীদ করে আর মনে করে, ইমাম সাহেব কোনো ভুল করতে পারেন না। আরও বলে যে, সর্বাবস্থায় তিনি নিঃসন্দেহে বিশুদ্ধ মত পোষণ করেন এবং মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় যে, তার মতের বিরুদ্ধে যত দলীলই আসুক, আমি তার তাকলীদ ছাড়ব না। ইমাম তিরমিজী (রহঃ) আদী ইবনে হাতেম (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এ আয়াত তেলাওয়াত করতে শুনেছি, ‘তারা নিজেদের আলেম ও দরবেশদের আল্লাহকে বাদ দিয়েই গ্রহণ করে ফেলেছে। অতঃপর হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তারা তাদের (আলেমদের) ইবাদত করত না, তবে তারা যেটাকে হালাল বলত সেটাকেই হালাল ভাবত আর যেটাকে হারাম করত সেটাকেই হারাম ভাবত।
তেমনি সেই ব্যক্তির ব্যাপারেও ইবনে হাযমের বক্তব্য ঠিক হতে পারে যে লোক ভিন্ন মাজহাবের কারো কাছে মাসআলা জিজ্ঞেস করা জায়েয মনে করে না। যেমন হানাফী হলে কোনো শাফেয়ীর কাছে এবং শাফেঈ হলে কোনো হানাফীর কাছে। তেমনি হানাফী মোক্তাদী শাফেঈ ইমামের পেছনে এবং শাফেঈ মোক্তাদী হানাফী ইমানের পেছনে নামায পড়া জায়েয মনে করে না। এ ধরনের লোক প্রথম যুগের লোকদের বিরোধী এবং সাহাবা ও তাবেঈদের বিরোধিতা করছে।
পক্ষান্তরে, ইবনে হাজমের বক্তব্য তার বেলায় প্রযোজ্য নয় যে ব্যক্তি শুধু নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ফরমানের ওপরেই চলে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যে বস্তুকে হালাল বলেছেন সেটাকেই হালাল ভাবে আর যেটাকে হারাম বলেছেন সেটাকে হারাম ভাবে। অবশ্য যদি সে লোক হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ফরমান না জানে, না সে বিভিন্ন হাদীস একত্র করে তা থেকে ফরমান অনুধাবনের পদ্ধতি না জানে, না তা থেকে মাসআলা উদ্ভাবনের ক্ষমতা রাখে, তাহলে সে এক সত্যনিষ্ঠ আলেমের আনুগত্য করবে এবং ধারণা রাখবে যে, সে আলেম সত্যভাষী ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ফরমান মোতাবেক ফতোয়া দেন। তারপর যদি সে দেখে যে, সে আলেম সম্পর্কে তার ধারণা ভুল তাহলে কোনো ঝগড়া না করে সেখান থেকে সরে আসে, তাহলে সে রকম আনুগত্য কে অস্বীকার করতে পারে?
ঘটনা যখন এই যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগ থেকেই মুসলমানদের ভেতর ফতোয়া চাওয়া ও ফতোয়া দেয়ার রীতি চলে আসছে। তাই কেউ সর্বদা একই ব্যক্তি থেকে মাসআলা জেনে নেয় বা কখনো এর থেকে আর কখনো ওর থেকে তা জেনে নেয়, তো এর ভেতরে কোনো পার্থক্য নেই। তাই এর ভেতর খারাপ এমন কি জিনিস থাকতে পারে যদি কেউ অনুসরণ করতে গিয়ে কোনো ফকীহর ওপর এরূপ ঈমান না রাখে যে, আল্লাহ তাআলা ওহীর মাধ্যমে তার ওপর ফিকাহ নাযিল করেছেন এবং আমাদের ওপর তার আনুগত্য করা ফরজ ও তিনি নিষ্পাপ ব্যক্তি?
আজকাল আমরা যদি কোনো ফকীহর অনুসরণ করি তো এ কারণে করি যে, তিনি কুরআন-সুন্নাহর বিজ্ঞ আলেম। তাঁর বক্তব্য হয় কুরআন-সুন্নাহর সুস্পষ্ট ভাষ্য থেকে নেয়া হয়েছে, নয়তো তার ইশারা-ইঙ্গিত ও মর্ম থেকে উদ্ভাবন করে নেয়া হয়েছে। অথবা তিনি তার লক্ষণাদি থেকে এটা জেনে নিয়েছেন যে, শরীআত প্রণেতা অমুক পরিস্থিতিতে যে হুকুমটি দিয়েছেন তা আসলে অমুক কারণটির ওপর নির্ভরশীল। সে কারণটি তিনি ভালোভাবে জেনে নিয়ে যখন প্রত্যয়ী হয়েছেন, তখন উক্ত নির্দিষ্ট আয়াত বা হাদীসের ওপর কেয়াস করে কুরআন হাদীসের নির্দেশ বহির্ভূত ব্যাপারটির হুকুম বের করেছেন। সেই ফকীহ যেন বলছেন –আমার প্রবল ধারণা এটাই যে, পরগাম্বর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেন বলছেন, যখনই এ কারণটি পাওয়া যাবে, তখন এ হুকুমটিও জারি হবে। এরূপ ব্যাপ্তির ক্ষেত্রে যার ভিত্তিতে কেয়াস করা হয় সেটাও অন্তর্ভুক্ত হয়। এ কারণেই এটাকেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সম্পৃক্ত করা হয়।
অবশ্য তারা অস্পষ্ট বা অনুল্লেখিত বিধানের ব্যাপারেই ইজতেহাদ করে থাকেন। যদি তা না হতো তা হলে কোনো মুসলমানই মুজতাহিদের তাকলীদ করত না। এখন যদি এমন হয় যে, রাসূলে মা’সুমের সহীহ সনদের কোনো হাদীস পৌঁছে যার যার আনুগত্য আমাদের ওপর ফরজ এবং তা হয় মাজহাবী ইমামের মতের পরিপন্থী, এ অবস্থায় যদি আমরা রাসূলের হাদীস ছেড়ে ইমামের ইজতেহাদী মত অনুসরণ করি তা হলে আমাদের চেয়ে বড় জালেম আর কে হতে পারে? যখন সব মানুষ রব্বুল আলামীনের দরবারে হাজির হবে সেদিন আমরা কি অজুহাত পেশ করব?
আলোচ্য সমস্যাগুলোর অন্যতম হলো এই যে, ফকীহদের ভাষ্য থেকে মাসআলা নেয়া ও হাদীসের ভাষ্যে তা অনুসন্ধান করা। এ দুটোর জন্যে দ্বীনের আওতায় মজবুত মূলনীতি রয়েছে। প্রত্যেক যুগেই বিজ্ঞ আলেমরা এ দুটো ব্যাপার অনুসরণ করে আসছেন। একদল আলেম হাদীসের প্রকাশ্য ভাষ্যের ওপর গুরত্ব বেশি আরোপ করেছেন এবং তাখরীজের দিকে কম গুরত্ব দিয়েছেন। অপর দল এর বিপরীত করেছেন। মানে, হাদীসের প্রকাশ্য ভাষ্যের ওপর কম গুরুত্ব দিয়ে তার তাৎপর্য ও ইশারা চাহিদা থেকে মাসআলা উদ্ভাবনের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তাই এটা উচিত নয় যে, একদলের সবকিছুই বর্জন করে অপর দলের সব কিছুই গ্রহণ করা। সাধারণত সবাই তাই করছে। বরং সঠিক কাজ হলো এই যে, একটাকে আরেকটার সাথে মিলিয়ে যে মাসআলার অভাব রয়েছে তা পূরণ করা। হযরত হাসান বসরী (রাঃ) বলেনঃ
“সেই আল্লাহর কসম যিনি ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই, তোমার পন্থা এ দুদলের মাঝামাঝি পন্থা, মধ্যবর্তী পন্থা। বস্তুত আহলে হাদীসদের (মোহাদ্দেস) উচিত যে, তারা তাদের অনুসৃত পদ্ধতি ও মাজহাবকে তাবেঈ মুজতাহিদদের রায়ের সামনে পেশ করবেন। পক্ষান্তরে তাখরীজ পন্থীদের উচিত যে, তারা এমন পদ্ধতি মেনে চলে যাতে সহীহ সুস্পষ্ট ভাষ্যের বিরোধ থেকে তারা বাঁচতে পারে এবং যে মাসআলার ক্ষেত্রে কোনো হাদীস বা আছার পাওয়া যায়, সে মাসআলায় যথাসম্ভব নিজের তরফ থেকে তারা কিছু না বলেন।
মুহাদ্দিসদের জন্যে এটা ঠিক নয় যে, আসহাবে হাদীসরা যে অনড় নীতি চালু করে গেছেন তার ওপরেই মজবুত হয়ে তা নিয়েই গভীরভাবে মগ্ন থাকে। অথচ শরীআত প্রণেতার তার সমর্থনে কোনো ভাষ্যও নেই। তাছাড়া সহীহ হাদীস ও বিশুদ্ধ কিয়াসও তারা বাতিল করে দেয়। তারা মুনকার বা মুরসাল হবার নূন্যতম সন্দেহ হলেও সে হাদীস বাতিল করে দেয়। যেমন ইবনে হাজম বলেছেন, তিনি ‘তাহরীমে মাসালেফ’ বা সচ্ছল জীবন যাপন হারাম হওয়ার হাদীসটি বুখারী শরীফের বর্ণনায় সামান্য সন্দেহের কারণে বাতিল করেছেন। অথচ সে হাদীসটি সহীহ মুত্তাসিল। আর এরূপ কিছু করা কেবল পরস্পর বিরোধের ক্ষেত্রেই বিবেচ্য হতে পারে। মুহাদ্দিসরা বলেন, অমুক ব্যক্তি অমুকের হাদীসের অধিকতর হাফেজ। এ কারণেই তার বর্ণিত হাদীস প্রাধান্য পাবে। সেক্ষেত্রে অন্য হাদীসের প্রাধান্য পাবার যত ধরনেরই কারণ থাক না কেন।
রেওয়ায়াত বিল মানায় (নিজের ভাষায় হাদীসের বক্তব্য বর্ণনা) ক্ষেত্রে বর্ণনাকরীরা সর্বদা খেয়াল রাখতেন যেন হাদীসের মূল অর্থ পুরোপুরি আদায় হয়। সেক্ষেত্রে তারা আরবী ভাষাবিদ পণ্ডিতদের ব্যাকরণের বিশুদ্ধতা নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। যেমন ‘ওরা’ বা ‘ফা’ এর সংযোজন-বিয়োজন অথবা বাক্যাংশের পূর্বাপর প্রয়োগ ইত্যাদি বিবেচনা রাখতেন না। তাই এ সব সূক্ষ্ম বৈয়াকরণিক প্রশ্ন তুলে হাদীসের ভিন্ন অর্থ সৃষ্টি করে দলীল দাঁড় করানো নিছক পাণ্ডিত্য প্রকাশ বৈ নয়। অনেক সময় এরূপ হয় যে, অপর বর্ণনাকরী বর্ণনা করতে গিয়ে পূর্ববর্তী বর্ণনাকারীর বিশেষ কোনো বর্ণের বদলে অন্য কোনো বর্ণ প্রয়োগ করেছেন। সত্য তো এটাই যে, বর্ণনাকারী হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যে কথা বর্ণনা করেন প্রকাশ্যত তা হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এরই কথা। তবে যদি কোনো অন্য হাদীস যথাযথভাবে এসে যায় তো সেটাই নেয়া হবে।
তেমনি কোনো তাখরীজপন্থরি জন্যে এটা ঠিক নয় যে, তিনি এমন কোনো ভাষ্য থেকে মাসআলা নেবেন না যা তার সহচরদের জন্যে জটিলতা সৃষ্টি করবে এবং তাদের কাছে ভাষ্যটি দুর্বোধ্য হবে। এমনকি ভাষাভাষীরাও সে ভাষ্য বুঝবে না। পরন্তু ভাষাবিদ পণ্ডিতরাও তার অর্থ খুঁজে পাবে না। এ ধরনের তাখরীজের জন্যে হয় কোনো অবলম্বন বা মৌলভিত্তি থাকে নয়হো উপেক্ষাযোগ্য কোনো মাসআলা প্রতিষ্ঠিত থাকে। ফলে ব্যাপারটিতে কার্যকারণ ও অভিমতগত পার্থক্য ও বিরোধ দেখা দেয়। যখন তার সহচরদের কাছে এ মাসআলা চানতে চাওয়া হয়, তখন দেখা যায়, কখনো অসুবিধা দেখে সে অনুরূপ অপর এক মাসআলা নজীর হিসেবে পেশ করেন, নয়তো এমন এক কারণ বর্ণনা করেন যা তাখরীজকারীর দেখানো কারণের বিপরীত হয়ে দেখা দেয়।
অবশ্য তাখরীজ এ জন্যে জায়েজ যে, সেটা মূলত মুজতাহিদদের তাকলীদেরই একটি ব্যাপার। তব তা তাখরীজ তখনই পূর্ণ ত্ব পায় যখন মুজতাহিদের ভাষ্য বোধগম্য হয়। এটা কখনো ঠিক নয় যে, তাখরীজ করতে গিয়ে জাতির ঐকমত্যের কোনো হাদীস প্রত্যাখ্যান করা হবে। আর তা এ নীতির মাধ্যমে যা সে নিজে বা তার কোনো সহচর উদ্ভাবন করেছেন। যেমন তারা হাদীসে মিসরাত ও সাহমে জবিলকুরবা বাতিল করেছেন। অথচ উদ্ভাবিত নীতিমালার মোকাবেলায় হাদীসের গুরুত্ব বেশি দিতে হবে। ইমাম শাফেঈ (রহঃ) এ ব্যাপারটির ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, আমি যখন কোনো কথা বলব বা কোনো নীতি নির্ধারণ করব তা যদি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস বিরোধী হয়েছে বলে জানতে পাও তা হলে হাদীসই গ্রহণ করবে। কারণ, সেটাই বিশুদ্ধ বাণী”।
এ জাটিল সমস্যাগুলোর অন্যতম হলো এই যে, শরীআতের বিধান জানার ভিত্তি হচ্ছে কিতাব ও আছার অনুসন্ধান এবং তার আবার কয়েকটি স্তর রয়েছে। অনুসন্ধানের সর্বোচ্চ স্তরে রয়েছেন তারা যাদের জন্যে বিধিবিধানের জ্ঞান সহজাত হয়ে গেছে অথবা তা কষ্টার্জিত হলেও স্বতঃস্ফুর্ততার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। তাদের শরীয়ী আহকাম সম্পর্কিত জ্ঞান ও পরিচিতি ও পরিমাণ অর্জিত হয়েছে যে, সাধারণ মাসআলা-মাসায়েলের ব্যাপারে ফতোয়া প্রার্থীদের তারা অনায়াসে জবাব দিতে পারে। হয়ত দু-চারটা ব্যাপারে তাদের সময় নিতে হয় মাত্র। এ ধরনের ধারণা সৃষ্টিকেই বলে ইজতেহাদ। এ যোগ্যতা অর্জিত হয় ব্যাপার বর্ণনার সমাবেশ ঘটানো এবং শাজ-নাদের বর্ণনার ও অনুসন্ধান ও গবেষণা থেকে। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহঃ) এ দিকেই ইঙ্গিত করেছেন। পরন্তু তাদের ভাষ্যের পটভূমি সম্পর্কেও পরিচিতি থাকা দরকার যা শুধু এক বিজ্ঞ ভাষাবিদেরই থাকতে পারে। সাথে সাথে পরস্পর বিরোধী বর্ণনাগুলোর সমন্বয় ঘটানোর পদ্ধতি এবং দলীল প্রমাণ উপস্থাপনের জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ থাকতে হবে। এ জন্যে পূর্বসূরিদের আছার সম্পর্কেও তাদের অবহিত থাকতে হবে।
এ জ্ঞান কখনো এভাবে অর্জিত হয় যে, কেউ ফেকাহর মাশায়েখদের কোনো এক শায়েখের মাজহাবের ওপর অধ্যয়ন করে তার তাখরীজের পদ্ধীত সম্পর্কে পাকাপোক্তা ধারণা অর্জন করবে। সাথে সাথে সে সুনান ও আছার পর্যাপ্ত পরিমাণে অবহিত হবে। সে জানার পর্যায় এই হবে যে, সে বুঝতে পাবে তার বক্তব্র এজমা বিরোধী নয়। এটাই হচ্ছে তাখরীজ পন্থীদের পদ্ধতি।
এ অনুসন্ধানীদের মধ্যবর্তী স্তরের লোকের অবস্থা হলো এই যে, তার কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞান ও পরিচিতি এরূপ অর্জিত হবে যাতে করে সে ফিকাহর সর্বসম্মত মাসায়েলগুলো বিস্তারিত দলীল প্রমাণসহ অবহিত হতে পারে এবং কিছু কিছু ইজতেহাদী মাসআলারও বেশ কিছু জ্ঞান অর্জিত হয়। যদিও এক মুজতাহিদের উপায়-উপকরণ জ্ঞান তার পুরোপুরি আয়ত্তে থাকবে না, তথাপি কোনো কোনো ইজতেহাদী মাসআলার দলীল-প্রমাণ, পরস্পর বিরোধী ভাষ্যের একটি প্রাধান্য দেয়ার পদ্ধতি ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে যাচাই বাছাই ও ভালো বুঝার ক্ষমতা অর্জন করা চাই। এ ধরনের লোকের জন্যে বৈধ হবে দু’মাজহাবের ভেতরের ভালো-মন্দ যাচাই করে চলা। কারণ সে উভয় দলের দলিল প্রমাণ সম্পর্কে অবহিত রয়েছে। সে এটাও বুঝতে পায় যে, তার বক্তব্য সেই ব্যাপারগুলোর ক্ষেত্রে নয়, যেখানে মুজতাহিদের ইজতেহাদ চলে না। এমনকি সে সব ব্যাপারে তো কাজিরও কোনো ফয়সালা চলে না। পরন্তু মুফতির ফতোয়াও সেখানে অচল। এ স্তরের লোকের জন্যে এটাও বৈধ যে, কোনো কোনো উদ্ভাবন যা পয়লা শুরু হয়েছিল তা বর্জন করবে। অবশ্য যদি তা অশুদ্ধ হবার ব্যাপারে সে অবহিত থাকে। এ কারণেই এ স্তরের আলেমগণ ব্যাপক ইজতেহাদের দাবিদার না হয়েও গ্রন্থ প্রণয়ন করতে থাকেন, বিন্যাসের বাচ্য করেন। উদ্ভাবন করতে থাকেন ও পরস্পর বিরোধী ভাষ্য ও অভিমতের কোনোটিকে প্রাধান্য দিতে থাকেন। যেহেতু জমহুরের নিকট ইজতেহাদ আংশিক ক্ষেত্রে হয়, উদ্ভাবনও আংশিক ক্ষেত্রে হয়, আর তাতে উদ্দেশ্য হলো প্রবল ধারণাটি অর্জন করা এবং মুকাল্লাফ হবার ভিত্তিই হলো প্রবল ধারণা, সেক্ষেত্রে উপরোক্ত ব্যাপারগুলোর কোনোটিকেই দূরের ভাবা যেতে পারে না।
তৃতীয় স্তরের লোকের তো মাজহাব হলো এই যে, তাদের সামনে যা কিছু মাসআলা ও সমস্যা আসুক বলতে গেলে প্রায় সবটাতেই তাদের সহচর, বাপ, দাদা ও শহরবাসীর অর্জিত মাজহাব। মানে সেই মাজহাব যা তারা অনুসরণ করে চলছে। অবশিষ্ট দু-চারটা ব্যাপার তারা মুফতীদের কাছে ফতোয়া চেয়ে ও ক্বাজিদের কাছে বিচার চেয়ে মীমাংসা করে নেয়। তখন মুফতি ও কাজির মাজহাবই তাদের মাজহাব হয়ে থাকে। আমরা প্রত্যেক মাজহাবের সেকালের ও একালের বিজ্ঞ আলেমদের এ পথে চলতে দেখেছি। মাজহাবের ইমামরাও তাদের সহযোগীদের জন্যে এ অসিয়তই করে গেছেন।
আল ইয়াওয়াকীত ওয়াল জাওয়াহেরে হযরত আবু হানীফা (রহঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেনঃ “যে ব্যক্তি আমার দলীল প্রমাণ জানল না, তার জন্যে আমার ভাষ্যের ভিত্তিতে ফতোয়া দেয়া উচিত নয়। ইমাম আবু হানীফা (রাঃ) যখন ফতোয়া দিতেন, তখন বলতেন –এটা নোমান ইবনে ছাবেত অর্থাৎ আমার রাস্তা এবং আমার সাধ্যমতে যা জানতে ও বুঝতে পেয়েছি তাতে এ মতটি উত্তম ভেবেছি। যদি এর থেকে উত্তম মত পাওয়া যায় তাহলে সেটাই বিশুদ্ধ মত”।
ইমাম মালেক (রহঃ) বলতেন –রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া প্রত্যেক ব্যক্তির বক্তব্য গ্রহণ বা বর্জনের অধিকার থাকে।
ইমাম হাকেম ও ইমাম বায়হাকী (রহঃ) ইমাম শাফেঈ (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলতেনঃ “যদি কোনো সহীহ হাদীস পাওয়া যায় তা হলে সেটাই আমার মাজহাব”।
এক বর্ণনায় তিনি বলেন- “যখন তোমরা আমার কোন অভিমত হাদীস বিরোধী দেখতে পাও, তখন হাদীস অনুসরণ কর ও আমার অভিমত দেয়ালে ছুড়ে মার”।
একদিন তিনি ইমাম মুজনী (রহঃ)-কে বলেনঃ “হে ইবরাহীম! সব ব্যাপারে আমার তাকলীদ কোরো না। নিজেও কিছু চিন্তা ভাবনা করে বের কর। কারণ, এটা দ্বীনের ব্যাপার”।
ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলতেন –“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বক্তব্য ছাড়া অন্য কারো বক্তব্য দলীল নয়। হোক তা যত বেশি লোকের বক্তব্য। তেমনি কেয়াস কিংবা অন্য কিছুও প্রমাণ নয়। তেমনি শুধু আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্যই শুধু স্বীকৃত ও সমর্থনযোগ্য”।
ইমাম আহমদ (রহঃ) বলতেনঃ “আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মোকাবেলায় কারো বক্তব্যই নির্ভরযোগ্য নয়। এক ব্যক্তিকে তিনি বলেন –আমার তাকলীদ করো না। তেমনি মালেক, আওযাঈ ও নাখঈ (রহঃ)-এর তাকলীদও কোরো না। তোমরাও কুরআন-সুন্নাহ থেকে সেভাবে বিধানাবলি নাও যেভাবে তারা নিয়েছেন। যে ব্যক্তি শরয়ী ফতোয়ার ব্যাপারে আলেমদের মতামত জানে না তার জন্যে ফতোয়া দেয়া অনুচিত। তেমনি ফতোয়া দেয়ার জন্যে বিভিন্ন মাজহাব সম্পর্কে জানা দরকার। যদি কোনো মাসআলা জানতে চাওয়া হয় এবং যার কাছে জানতে চাওয়া হয় সে যদি জানে যে, তার স্বীকৃত মাজহাবের আলেমদের সে ব্যাপারে মতৈক্য রয়েছে তা হলে সে নির্দ্বিধায় বলে দিতে পারে ‘এটা জায়েজ’ এবং ‘এটা জায়েয নয়’। তখন তার বক্তব্য হওয়া উচিত নিছক বর্ণনামূলক। যদি সে মাসআলায় তাদের আলেমরা একমত না হয়ে থাকেন তাহলে এ কথঅ বলতে দোষ নেই –‘এটা অমুকের মতে জায়েয এবং অমুকের মতে জায়েয নয়’। তবে এই দুটি মতের মাঝে একটিকে নিজে পছন্দ করে সে অনুসারে ফতোয়া দেয়া জায়েয নয়। কারণ তার তো দলীল জানা নেই।
ইমাম আবু ইউসুফ ও যুফার (রহঃ) প্রমুখ থেকে বর্ণিত রয়েছে যে, তারা বলেছেন –“আমরা কোথা থেকে কি বলেছি তা জেনে শুনে আমাদের বক্তব্য মতে কারো ফতোয়া দেয়া উচিত নয়’।
ইমাম আবু ইউসুফ ও যুফার (রহঃ) প্রমুখ থেকে বর্ণিত রয়েছে যে, তারা বলেছেন –“আমরা কোথা থেকে কি বলেছি তা জেনে শুনে আমাদের বক্তব্য মতে কারো ফতোয়া দেয়া উচিত নয়’।
ইমাম ইবনে ইউসুফ (রহঃ)-কে প্রশ্ন করা হলো, আপনি কেন অনেক ক্ষেত্রে আবু হানীফা (রহঃ) থেকে ভিন্নমত পোষণ করেন? তিনি জবাব দিলেন –তার কারণ এই যে, আবু হানীফা (রহঃ)-কে যে বুঝ দান করা হয়েছে তা আমাদের দেয়া হয়নি। ফলে তিনি তার বুঝ মোতাবেক যা বলেছেন তা আমরা বুঝি না। ফলে আমাদের তো এ অনুমতি নেই যে, যতক্ষণ আমরা তার বক্তব্য না বুঝি ততক্ষণ তার বক্তব্য মতে ফতোয়া দিতে পারি।
ইমাম মুহাম্মদ ইবনে হাসান (রহঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তার কাছে কোনো এক শহরের এক আলেম সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলো যে, সেখানে তার চেয়ে যেহেতু কোনো বড় আলেম নেই, তাই তার জন্যে ফতোয়া না দেয়া জায়েয হবে কি? তিনি জবাব দিলেন, তিনি যদি ইজতেহাদের যোগ্যতা রাখেন তা হলে তো জায়েয নয়। প্রশ্ন করা হলো, কি হলে তিনি ইজতেহাদের যোগ্য হবেন? তিনি বললেন, তাকে মাসআলার কার্যকারণ সম্পর্কে অবহিত হতে হবে এবং তার সমসাময়িক আলেমরা যদি তার বিরোধিতা করে তা হলে তাদের সাথে যেন সে দলীল প্রমাণ দিয়ে বহাস করতে পারে। বলা হয়েছে যে, ইজতেহাদের জন্যে নূন্যতম যোগ্যতা হলো ‘মাবসূত’ স্মৃতিস্থ করা”।
‘আনা বাহরুর রায়েক’ কিতাবে আবুল লাইস থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, আবু নসর থেকে একটি মাসআলা জানতে চাওয়া হলে যিনি তার সামনে ছিলেন তাকে তিনি প্রশ্ন করলেন, এ ব্যাপারে আপনি কি বলেন? আপনার সামনে তো ইবরাহীম ইবনে রুস্তমের কিতাব, আল মাসাফের ‘আদাবুল ক্বাজি’ কিতাবুল মুজাররাদ ও হিশামের কিতাবুন নাওয়াদের মোট চারখানা কিতাব রয়েছে। আমাদের জন্যে কি তার মধ্য থেকে যে কোনো এক কিতাবের ভিত্তিতে ফতোয়া দেয়া জায়েয হবে? এ কিতাবগুরো তো আপনার পসন্দনীয় কিতাব। তিনি জবাব দিলেন –আমাদের সহচরদের থেকে বিশুদ্ধভাবে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে সেটাই আমাদের প্রিয়, আকর্ষণীয় ও পসন্দনীয় ইলেম। কিন্তু ফতোয়ার ব্যাপার হলো এই যে, আমি কারো জন্যে এমন কিছুর ভিত্তিতে ফতোয়া দেয়া জায়েয মনে করি না যা সে বুঝে না। সে যেন লোকদের বোঝা ঘাড়ে না নেয়। তবে যদি এমন কোনো মাসআলা হয় যা আমাদের সহচরদের ভেতর মাশহুর, প্রকাশ্য ও সুস্পষ্ট তো আমি আশা করি যে, তার ওপর নির্ভর করা বৈধ হবে।
বাহরুর রায়েকে আছে, কেউ যদি শিঙ্গা লাগায় কিংবা গীবাত করে তা হলে রোযা ভেঙে যায়। সেমতে কেউ যদি খানা খায় ও কোনো মুফতীর কাছে ফতোয়া না চায় এবং তার কাছে কোনো হাদীসও না পৌঁছে থাকে তা হলে তার কাফফারা ওয়াজিব হবে। কারণ সেটা নিছক অজ্ঞতার ব্যাপার। অথচ ইসলামী রাষ্ট্রে এ অজুহাত চলে না। তবে যদি সে কোনো ফকীহর কাছে ফতোয়া চেয়ে থাকে এবং তিনি রোযা ভঙ্গের ফতোয়া দিয়ে থাকেন, তা হলে তার কাফফারা লাগবে না। কারণ, সাধারণ মানুষের জন্যে কোনো আলেমের তাকলীদ করা জরুরি যদি সে তার ফতোয়ার ওপর আস্থা রাখে। সেক্ষেত্রে তার কৃতকর্মের জন্যে মাজুর বিবেচিত হবে, এমনকি মুফতী যদি ফতোয়ায় ভুলও করে থাকে। যদি সে কারো কাছে ফতোয়া নাও চেয়ে থাকে আর তার কাছে এ হাদীস পৌঁছে থাকে যে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, শিংগা লাগাবে যে আর যে গীবাত করবে তার রোযা ভেঙে গেল এবং তেমনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীসও পৌঁছেছে যে, গীবাত করলে রোযা ভঙ্গ হয় এবং সে এসবের মানসুখ হওয়া কিংবা এ সবের ব্যাখ্যাও জানে না, তা হলে ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) ও ইমাম মুহাম্মদের মতে কাফফারা ওয়াজিব হবে না। কারণ হাদীসের প্রকাশ্য অর্থের ওপর আমল করা অপরিহার্য।
অবশ্য ইমাম আবু ইউসুফের মতানৈক্য রয়েছে। তাঁর মতে নাসেখ ও মানসুখের জ্ঞান না থাকলে কোনো সাধারণ ব্যক্তির জন্যে হাদীসের ওপর আমল করা জায়েয নয়। যদি কেউ কোনো নারীকে যৌনাবেগ নিয়ে স্পর্শ করে কিংবা তাকে চুমু দেয়া অথবা চোখে সুরমা লাগায় তারপর ভাবে যে, তার রোযা ভঙ্গ হয়েছে ও ইফতার করে নেয়, তা হলে তার ওপর কাফফারা ওয়াজিব হবে। অবশ্য যদি সে ফকীহর কাছ থেকে ফতোয়া নিয়ে রোযা ভাঙে তো কাফফারা দিতে হবে না। তবে যদি সে সূর্য হেলার আগে রোযার নিয়ত করে সেই রোযা ভাঙে তা হলে ইমাম আবু হানীফার (রহঃ) মতে কাফফারা জরুরি নয়। অবশ্য সাহেবাইনের (আবু ইউসুফ ও মুহাম্মদ) তাতে মতানৈক্য রয়েছে। আল মুহীতে এভাবে বলা হয়েছে। এতে বুঝা গেল যে, সাধারণ মুসলমানদের মাজহাব হলো তাদের মুফতীর ফতোয়া। আল মুহীতের ক্বাজাউল ফাওয়ায়েত অধ্যায়ে রয়েছে, যদি এরূপ কোনো সাধারণ ব্যক্তি হয় তার নির্দিষ্ট কোনো মাজহাব নেই, তা হলে তার মাজহাব হলো তার মুফতীর ফতোয়া। ওলামায়ে কেরাম এ মতই পোষন করেন।
যদি কোনো হানাফী আলেম ফতোয়া দেয় যে, তুমি আসর ও মাগরেব নামায দ্বিতীয়বার পড়ে নাও আর কোনো শাফেঈ আলেম যদি বলেন, তোমাকে পুনর্বার পড়তে হবে না, এ ক্ষেত্রে সে নিজের রায় কাজে লাগাতে পারবে না। সে যদি কাউকে জিজ্ঞেস না করে অথবা হঠাৎ করেই সে কোনো মাজহাব মতে ঠিক কাজ করে ফেলে তা হলে তার জন্যে তা যথেষ্ট হবে। তার সে কাজ আর পুনর্বার করতে হবে না।
শায়েখ ইবনে সালাহ বলেনঃ যদি কোনো শাফেঈ মাজহাবের লোক নিজ মাজহাবের বিরোধী হাদীস দেখতে পায় তখন যদি তার পূর্ণভাবে অথবা সাধারণভাবে ইজতেহাদের উপায় উপকরণ অর্জিত হয়ে থাকে, অথবা সেই অধ্যায়ের বা মাসআলার ব্যাপারেও তা জ্ঞাত থাকে, তা হলে সে হাদীসের স্বাধীনভঅবে আমল করতে পারে। তবে যদি ইজতেহাদের কার্যকারণ ভালোভাবে জানা না থাকে এবং আলোচনা পর্যালোচনার পরেও হাদীসের বিরোধীতা করাটা যদি তার জন্যে কষ্টকর মনে হয় এবং তার মাধ্যমে যে হাদীসটির কোনো সন্তোষজনক জবাব না পায়, তার জন্যেও হাদীসের ওপর আমল করা জায়েয হবে। তবে শর্ত এই যে, ইমাম শাফেঈ ছাড়া যদি কোনো স্বতন্ত্র ইমাম সে হাদীসের ওপর আমল করে থাকেন। কেবল এরূপ ক্ষেত্রেই সে নিজ ইমামের মাজহাব ছাড়ার অজুহাত পেতে পারে। ইমাম নববী এটাকে ভালো বলেছেন এবং এটাকে সুপ্রমাণিত করেছেন।
একটি সমস্যার ক্ষেত্র হলো এই যে, ফকীহদের ভেতর মতভেদের রূপ তখনই দেখা দেয় যখন উভয় দিকেই সাহাবায়ে কেরামের বাণীসমূহ বর্ণিত হয়। যেমন তাকবীরে তাশরীক, তাকবীরাতে ঈদাইন ও এহরামের অবস্থায় বিয়ে। তেমনি ইবনে আব্বাস ও ইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর থেকে বর্ণিত তাশাহহুদ ও বিসমিল্লাহ আস্তে পড়া, আমীন আস্তে বলা, একামাতে দু-দুবার বা এক একবার বাক্যগুলো পড়া ইত্যাদি। এ মতভেদ মূলত দুটো ভাষ্যের একটিকে প্রধান্য দেয়ার ব্যাপারে দেখা দেয়। পূর্বসূরিদের পদ্ধতি এটাই ছিল যে, তাদের মাসআলার বৈধতার ব্যাপারে মতভেদ ছিল না, মতভেদ ছিল দুটোর ভেতরে একটাকে প্রাধান্য দেবার ব্যাপারে তার উপমা হলো ক্বারীদের কিরাত পাঠের বিভিন্ন পদ্ধতি। এ সব ব্যাপারে অধিকাংশ দলীল এটাই দেয়া হয় যে, পঠন পদ্ধতিতে সাহাবায়ে কেরামের মতভেদ ছিল। অথচ সব সাহাবাই হেদায়েতের ওপর রয়েছেন। এ কারণেই আলেমগণ সর্বদা মুফতীদের ফতোয়া ও ক্বাজিগদের ফয়সালা বৈধ রেখে চলেছেন। কখনো তারা নিজ মাজহাবের বিরোধী আমলও করে আসছেন। তোমরা মাজহাবের ইমামদের দেখতে পাবে যে, তারা এ সব ব্যাপারে বিরোধীদেরও মতামত বলে দেন। আর তা তারা সুস্পষ্টভাবেই বলে দেন। এমনকি তাদের মতও তারা এভাবে বলে থাকেন যে, এ মতটি অধিক সতর্কতামূলক, এটা আমার কাছে বেশি পসন্দনীয় এবং আমি তো এটাই জানতে পেয়েছি।
আল মবসুতে এ ব্যাপারটির নজির অনেক দেখা যায়। তেমনি ইমাম মুহাম্মদের আছার ও ইমাম শাফেঈর ভাষ্যেও তার যথেষ্ট প্রমাণ মেলে।
পরবর্তীকালে এক দল সাহাবাদের বক্তব্যকে সংক্ষিপ্ত করে ফেলল। তারা বিরোধীদের দিকটাই জোর দিল এবং নিজ ইমামদের পসন্দনীয় মতের ওপর মজবুত হয়ে বসে গেল। তা ছাড়া পূর্বসূরীদের থেকে যে বর্ণিত হয়েছে ‘নিজ সহচরদের মাজহাবের অবশ্যই পাবন্দী করবে এবং কোনো অবস্থাতেই তার বাইরে যাবে না’ সেটা মূলত ছিল নিছক প্রকৃতিগত ব্যাপার। কারণ প্রত্যেক মানুষ সেটাই পসন্দ করে যা তার সহচর ও সমগোত্রীয়রা পছন্দ করে। এমনকি তারা খানাপিনা ও পোশাক-আশাকেও তাই করে। অথবা দলীল প্রমাণের জোর দেখে কিংবা অন্য কোনো উপকরণের কারণে প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ সমগোত্র ও সহচরদের পছন্দনীয় ব্যাপারগুলোকে পসন্দ করে থাকে। অবশ্য কিছু লোক সেটাকে মাজহাবী সংকীর্ণতা বলে আখ্যায়িত করে থাকে। মূলত সে ব্যক্তি তা থেকে মুক্ত।
সাহাবা ও তাবেঈন এবং তাদের পরবর্তী কিছু লোক ‘বাসমালাহ্’ পড়তেন আর কিছু লোক তা পড়তেন না। কিছু লোক বাসমালাহ নিঃশব্দে পড়তেন, কিছু লোক সশব্দে পড়তেন। তাদের কিছু লোক ফজর নামাযে দোয়া কুনুত পড়তেন। কিছু লোক শিংগা টানালে, নাক দিয়ে রক্ত ঝরলে ও বমি করলে ওযু করা জরুরী ভাবতেন, আবার কিছু সাহাবা তা ভাবতেন না। কিছু সাহাব লজ্জাস্থানে হাত লাগলে এবং যৌনাবেগ নিয়ে নারী স্পর্শ করলে ওযু করা জরুরী বলতেন। অন্য সাহাবারা তা বলতেন না। এক দল আগুনে রান্না করা কিছু খেলে ওযু করতেন, অন্যরা তা জরুরি মনে করতেন না। তাদের কিছু লোক উটের গোশত খেলে পুনরায় ওযু করতেন এবং অন্যরা তা করতেন না। এতকিছু সত্ত্বেও তারা একজন আরেকজনের পেছনে নামায পড়তেন। যেমন ইমাম আবু হানীফা কিংবা তাঁর অনুসারীবৃন্দ এবং ইমাম শাফেঈ প্রমুখ মদীনায় মালেকী ও অন্য কোনো মাজহাবের ইমামের পেছনে নামায পড়তেন। সেই ইমাম বাসমালাহ পড়ুক বা না পড়ুক, আস্তে পড়ুক বা জোরে পড়ুক তা নিয়ে তাদের কোনো দ্বিধা ছিল না। খলীফা হারুনুর রশীদ ও ইমাম আবু ইউসুফ (রহঃ) এমন এক ইমামের পেছনে নামায পড়লেন যিনি শিঙ্গা টানিয়ে ওযু করতেন না। তা বলে তারা দ্বিতীয়বার নামায পড়া প্রয়োজন ভাবেন নি। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহঃ) নাক দিয়ে রক্ত ঝরলে কিংবা শিঙ্গা টানালে ওযু করা জরুরি ভাবেন। তাকে যখন প্রশ্ন করা হলো, যদি কোনো ইমামের শরীর থেকে রক্ত ঝরে ও সে পুনর্বার ওযু না করে তা হলে তার পেছনে আপনি নামায পড়বেন কি? তিনি জবাব দিলেন, ভাই! আমি ইমাম মালেক ও সাঈদ ইবনে মুসাইয়াবের পেছনে কেন নামায পড়ব না?
বর্ণিত আছে যে, ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ উভয়ই দু ঈদের নামাযে ইবনে আব্বাসের (রহঃ) তাকবীর পাঠ করতেন, কারণ হারুনুর রশীদ তার পরদাদার তাকবীর পসন্দ করতেন। ইমাম শাফেঈ (রহঃ) একবার ইমাম আবু নাহীফা (রহঃ)-এর মাযারের কাছে নামায পড়লেন। তখন তাঁর আদব রক্ষার্থে তিনি ফজর নামাযে দোয়া কুনুত পড়লেন না এবং বললেন, অনেক সময় আমরা ইরাকীদের মাজহাবও মেনে নেই।
ইমাম মালেক (রহঃ) খলীফা মানসুর ও খলীফা হারুনকে যা বলেছিলেন তা আমি আগেই বলে এসেছি। ফাতাওয়ায়ে বাজ্জাসিয়ায় ইমামে চানি কাজি ইউসুফ (রহঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি জুমআর দিন হাম্মাম খানায় গোসল করে জুমআর নামাযে ইমামতি করলেন। তারপর তিনি জানতে পেলেন যে, হাম্মাম খানার কুয়ায় একটি মরা ইঁদুর পাওয়া গেছে। তখন তিনি বললেন, এ ক্ষেত্রে এখন আমি আমার মাজহাবী ভাইদের মাসলাক মতে চলব। যখন কুয়ার পানির পরিমাণ এক কুল্লা হবে, তখন আর তা নাপাক হবে না।
ইমাম খাজান্দী (রহঃ)-এর কাছে প্রশ্ন করা হলো যে, শাফেঈ মাজহাবের এক ব্যক্তি এক বছর কি দু’বছরে নামায পড়েনি। এখন সে হানাফী মাজহাবে এসেছে। এখন তার জন্যে কোন মাজহাবের পদ্ধতিতে নামায কাজা করতে হবে? তিনি জবাব দিলেন –যখন সে উভয় মাজহাব বৈধ মনে করছে, তখন যে কোনো মাজহাব অনুসারে নামায আদায় করা বৈধ হবে।
জামেউল ফাতওয়ায় রয়েছে যে, এক হানাফী ব্যক্তি যদি বলে যে, আমি অমুককে বিয়ে করলে তিন তালাক, তারপর সে যদি এক শাফেঈ মুফতীর কাছে ফতোয়া চায় এবং সে বলে তালাক হবে না ও কসম বাতিল হয়ে যাবে, তখন তার জন্যে শাফেঈ মাজহাব অনুসরণে কোন ক্ষতি নেই। কারণ ইমাম শাফেঈর মাজহাবের পক্ষেও বহু সাহাবা রয়েছেন।
ইমাম মুহাম্মদ তার আমালী গ্রন্থে বলেন –যদি কোনো ফকীহ তার স্ত্রীকে বলে, তোমাকে তালাক দিলাম এবং তিনি তা তিন তালাকের নিয়তেই বলে থাকেন, তারপর যদি কোনো কাজি ফয়সালা দেন যে, তার তালাক রেজয়ী তালাক, তা হলে তিনি স্ত্রীকে সাথে রাখতে পারবেন। মোট কথা, ফকীহদের মতভেদের সব মাসআলারই এরূপ অবস্থা। হালাল করা, হারাম করা, আজাদ করা, সম্পদ পাওয়া না পাওয়া ইত্যাদি সব ব্যাপারেই যে কোনো ফকীহর উচিত কাজির ফয়সালা মেনে চলা, নিজের মত ত্যাগ করা, কাজি তার ওপর যা অপরিহার্য করে সেটাই নিজের ওপর অপরিহার্য করা এবং কাজি তাকে যা দান করেন সেটাই গ্রহণ করা।
ইমাম মুহাম্মদ (রহঃ) বলেনঃ অজ্ঞ লোকের অবস্থাও অনুরূপ। যদি সে কোনো সমস্যায় পড়ে ও ফকীহদের কাছে ফতোয়া চেয়ে সে বস্তুর হালাল বা হারাম হওয়ার ফতোয়া পায় অতঃপর মুসলমানদের কাজি তার বিপরীত ফয়সালা প্রদান করে এবং মাসআলাটি নিয়ে ফকীহদের ভেতর মতভেদ থাকে, তখন তার উচিত কাজির ফয়সালা অনুসারে চলা ও ফকীহর ফতোয়া বর্জন করা।
জটিল বিষয়গুলোর এও একটি যে, কিছু কিছু আলেম মনে করেন যে, বড় বড় ফতোয়া ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের কিতাবাদিতে যা কিছু লেখা আছে তা সবই ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) ও সাহেবাইনের মতামত। তারা উদ্ভাবিত অভিমত ও ইমামের মূল ভাষ্যের ভেতরে কোনো পার্থক্য সৃষ্টি করে না। না তারা ফকীহদের এ কথার অর্থ বুঝে যে, কারখীর উদ্ভাসিত মাসআলা এরূপ, তাহাভীর উদ্ভাবিত মাসআলা এটি এবং ফকীহদের বক্তব্য ইমাম আবু হানীফা এ কথা বলেছেন অথবা হানাফী মাজহাব মতে জবাব এই, কিংবা আবু হানীফার পদ্ধতি মতে এরূপ জবাব হবে’। মূলত তারা এ দুয়ের পার্থক্যই বুঝে না। গবেষণা কর্ম ও মাজহাবী মাসআলার তারতম্য বোধ তাদের নেই। তারা হানাফী মোহাক্কেক ইবনে হুমাম ও ইবনে নাজীমের দিক পরশে দশ দশ হাত কুয়ার মাসআলায় এবং তায়াম্মুমের জন্যে পানি এক মাইল দূরে হবার শর্ত সম্পর্কে যা কিছু বলেছেন সেদিকেও নজর দেন না যে, এরা গবেষণা করেছেন মাত্র এবং মূলত এটা মাজহাব নয়।
কিছু লোকের ধারণা যে, মাজহারে বুনিয়াদ সে সব বিতর্ক ও বাড়াবাড়ির ওপর প্রতিষ্ঠিত যা ইমাম সারাখসীর আল মাবসূত কিংবা হেদায়া ও তাবয়ীন কিতাবে বিদ্যমান। তারা এ কথা জানে না যে, বিতর্ক ও বাহাসমূলক এ সব কথা পয়রা মুতাযিলারা শুরু করেন। তাই তা মাজহাবের ভিত্তি নয়। অতঃপর পরবর্তী যুগের আলেমরা সেসব পছন্দ করেছেন জ্ঞানের প্রসারতা, মেধা, তীক্ষ্মতা বৃদ্ধি কিংবা অন্য কোনো কারণে। আল্লাহই ভালো জানেন। আমি এ অধ্যায়ে যা কিছু আলোচনা করলাম তাতে এ ধরনের সন্দেহ সংশয়ের সমাধান রয়েছে।
আরেকটি জটিল সমস্যা হলো এই যে, আমি কিছু আলেমকে দেখতে পেয়েছি যে, তারা মনে করেন, আবু হানীফা (রহঃ) শাফেঈ (রহঃ)-এর মতবিরোধের ভিত্তি হলো সে সব নীতিমালা যা অসূলে বজব বা অনুরূপ গ্রন্থে আলোচিত হয়েছে। অথচ সত্য কথা এই যে, সে সবের অধিকাংশ নীতিমালাই তাদের ভাষ্য থেকে উদ্ভাবিত হয়েছে। আমার মতে নির্দিষ্ট বস্তু তো সুস্পষ্ট ও প্রকাশ্য ব্যাপার। তার জন্যে কোনো বর্ণনার প্রয়োজন হয় না। তেমনি বাড়াবাড়ি যেখানে যা তা মানসুখ। তেমনি সাধারণ বস্তু তো নির্দিষ্ট বস্তুর মতোই সুস্পষ্ট। তেমনি বর্ণনার আধিক্যই কোনো কিছুর প্রাধান্য পাবার কারণ নয়। যদি কোনো হাদীস কেয়াস বিরোধী হয়ে যায়, তথাপি গায়রে ফকীহর বর্ণিত হাদীস আমল করা ওয়াজিব নয়। তা ছাড়া শর্ত ও গুণাবলির তাৎপর্যের কোনো নির্ভরযোগ্যতা নেই। আর কোনো নির্দেশের দাবি হলো তা ওয়াজিব হওয়া। অন্যান্য মাসআলার ব্যাপারও অনুরূপ।
এরূপ নীতিমালাও রয়েছেছ যা ইমামদের ভাষ্য থেকে উদ্ভাবিত হয়েছে। অথচ তা ইমাম আবু হানীফা ও সাহেবাঈনের কাছ থেকে বিশুদ্ধভাবে বর্ণিত হয়নি। তা আবার সেগুলোর যথাযথ সংরক্ষণ ও পূর্বসূরিদের উদ্ভাবনের ওপর গুরুত্ব দেননি যতখানি দিয়েছেন বিরোধীদের নীতিমালার সংরক্ষণ ও তার ওপর উত্থাপিতব্য প্রশ্নাবলির জবাব দানের ব্যাপারটিকে। তার উদাহরণ এই যে, তিনি একটি নীতি নির্ধারণ করেছেন যে, খাস যা তা সুস্পষ্ট এবং সেটাকে আরও স্পষ্ট করে বলার প্রয়োজন নেই। তারপর তিনি আল্লাহ পাকের ফরমান –‘রূকু কর ও সিজদা কর’ এর ওপর পূর্বসূরীদের পর্যালোচনা থেকে তিনি উক্ত নীতিটি উদ্ভাবন করেছেন। তেমনি হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীসের ওপর পূর্বসূরিরা যা আলোচনা করেছেন তা থেকে তিনি বের করলেন, মানুষের নামায বৈধ হবে না যতক্ষণ না রুকু ও সিজদায় তার পিঠ সোজা হয়। অথচ পূর্বসূরিরা পিঠ সোজা করে স্বস্তির অবস্থা সৃষ্টিকে ফরজ বলেন নি এবং হাদীসটিকেও উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা বলে আখ্যায়িত করেননি। ফলে তারা আল্লাহ পাকের ফরমানের ওপর যা কিছু আলোচনা করেছেন তার এ উদ্ভাবন সেই আলোচনাকেই প্রশ্ন সাপেক্ষ করে ফেলেছে। আল্লাহ পাকের ফরমান হচ্ছে, মাথা মাসেহ কর এবং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ কপাল মাসেহ করেছেন বলে বর্ণিত হয়েছে। তেমনি ব্যভিচারী পুরুষ ও ব্যভিচারী নারীকে কোড়া মারা হচ্ছে আল্লাহ পাকের ফরমা। তেমনি আল্লাহ পাকের ফরমান হচ্ছে নারী চোর ও পুরুষ চোরের হাত কাট। অন্যত্র আল্লাহ পাক বলেন –এমনকি সে অন্য স্বামীকে বিয়ে করেবে।
এসব ছাড়াও অন্যান সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে পূর্বসূরিরা বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে যে কষ্ট স্বীকার করেছেন তা তাদের কিতাবসমূহে বিদ্যমান রয়েছে। তারা সে সব ক্ষেত্রে এ নীতি নির্ধারণ করেছেন যে, যা সাধারণ হুকুম তাও যেমন সুস্পষ্ট, তেমনি যা নির্দিষ্ট হুকুম তাও সুস্পষ্ট।
তারা পূর্বসূরিদের পর্যালোচনা থেকে উদ্ভাবন করলেন যে, আল্লাহ পাকের ফরমান কুরআন থেকে যতটুকু পার পড় এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী ‘সূরা ফাতিহা ছাড়া নামায নেই’ নির্দিষ্ট কারণ হয়ে দেখা দেয়নি।
তেমনি ‘নালা-খাল থেকে প্রাকৃতিকভাবে সিঞ্চিত জমির ফসলের এক-দশমাংশ প্রদেয়’ হাদীসকে ‘পাঁচ উকিয়ার কম ফসলে যাকাত নেই’ হাদীসের জন্যে তারা নির্দিষ্ট কারণ বলে আখ্যায়িত করেন নি। এভাবে আরও অনেক মাসআলা রয়েছে।
তাদের এ প্রশ্নের জবাব দিতে হলো যে, আল্লাহ পাকের ফরমান, ‘যা পার কুরবানি কর’ তো ব্যাপকার্থক হুকুম নির্দেশক, কিন্তু তারা তো হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীসের ভিত্তিতে সেটাকে বকরী বা তার বড় কিছু কুরবানির কথা বলে হাদীসকে আয়াতের নির্দিষ্ট কারণ হিসেবে মেনে নিলেন? ফলে এ প্রশ্নের তাদের জবাব দিতে হলো।
তেমনি তাদের নীতি হলো, শর্ত ও গুণাবলির তাৎপর্যের কোনো গুরুত্ব নেই। তারা পূর্বসূরিদের সেই আমল থেকে উদ্ভাববন করেছেন যা তারা ‘তোমাদের সে প্রশস্ততা যাদের নেই’ আয়াতের ব্যাপারে অনুসরণ করেছেন।
তাদের সৃষ্ট নীতিমালার ওপর পূর্বসূরিদের আরও কিছু আমল প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে। যেমন হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘মুক্ত চারণ ভূমিতে প্রতিপালিত উটের যাকাত দিতে হবে। তারা এর জবাব দিতে গিয়ে কষ্টার্জিত জবাব দিয়েছেন। এ কারণে তারা এ নীতি স্থির করেন যে, যদি কোনো হাদীস কেয়াসের খেলাপ হয়, তা হলে ফকীহ নয় এমন লোকের হাদীসের ওপর আমল করা অপরিহার্য হবে। মিসরাতের হাদীস বর্জনের ব্যাপারটিও তারা পূর্বসূরিদের আমল থেকে উদ্ভাবন করেছেন। ফলে অট্টহাসি বা ভুলে যাওয়ায় রোযা ভেঙ্গে যাবার হাদীসের সাথে তার জটিলতা দেখা দিয়েছে। অগত্যা তাদের কষ্টার্জিত জবাব দিতে হয়েছে।
আমি যা কিছু বললাম অনুসন্ধান করলে যে তা ভুরিভুরি নজির পাওয়াযাবে তা অনুসন্ধানীদের কাছে গোপন নয়। তবে যারা অনুসন্ধানী নয় তাদের জন্যে তো ইশারায় ইঙ্গিতে বেশ কিছু বলে দিলাম। এ নিয়ে লম্বা বহাস নিষ্প্রয়োজন। আর তোমাদের জন্যে এ ব্যাপারে বিজ্ঞ আলেমদের প্রদত্ত দলীল প্রমাণই যথেষ্ট।
মাসআলা হলো এই, যে ব্যক্তির স্মরণশক্তি ও সততা মশহুর হয়ে আছে অথচ সে ফকীহ নয়, তা হলে কেয়াস পরিপন্থী হাদীস বর্জনের জন্যে তার ওপর আমল অপরিহার্য নয়। যেমন, হাদীসে মিসরাত। ঈসা ইবনে আবানের এ মাজহাব। পরবর্তীকালের বহু আলেম এটাকে পছন্দ করেছেন।
ইমাম কারখী ও তাঁর অনুসারী বহু আলেমের মাজহাব এই যে, কেয়াসের ওপর সর্বদা হাদীস প্রাধান্য পাবে। এমনকি সে ক্ষেত্রে বর্ণনাকারী ফকীহ হওয়াও শর্ত নয়। তিনি বলেন, আমাদের সমমনাদের থেকেও এটা বর্ণিত হয়নি। দেখুন, তারা আবু হুরায়রা (রহঃ)-এর সেই হাদীসের ওপর আমল করেনে যাতে বলা হয়েছে যে, ভুলে কেউ খানাপিনা করলে রোযা ভঙ্গ হয় না। অথচ এ ব্যাপারটি কেয়াসের পরিপন্থী। এমনকি ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর বক্তব্য হচ্ছে ‘যদি হাদীস না হতো তাহলে কেয়াসের ভিত্তিতে আমি রোযা ভঙ্গ হবার বিধান দিতাম।
তোমরা এ ব্যাপারটি আরও ভালোভাবে জানতে পাবে যখন দেখতে পাবে যে, মোতাকাদ্দেমীনের ভাষ্য থেকে তারা নীতিমালা উদ্ভাবন করতে গিয়ে, নিজেরাই অনেক মতানৈক্যের শিকার হয়েছেন ও একে অন্যের মত খণ্ডনে ব্যস্ত থেকেছেন।
একটি জটিল সমস্যা হলো এই যে, আমি লোকদের ভেতর দেখেছি তারা দুটো দল ছাড়া আর কোনো দলের খবরই রাখে না। তাদের জ্ঞাত দল দুটোর একটি হলো বুদ্ধি বিবেক পন্থী, অপরটি হলো জাহেরী হাদীসপন্থী। যারা কেয়াসের মাধ্যমে মাসআলা উদ্ভাবন করেছেন তারাই হলেন বুদ্ধিবিবেকপন্থী। খোদার কসম! ব্যাপারটা এরূপ নয়। আহলে রায়দের রায় শুধু বুদ্ধি-বিবেক নির্ভর নয়। কারণ কোনো আলেমই বুদ্ধি বিবেকশূন্য নয়। তাই তাদের সে রায় সুন্নাহর ভিত্তিতে নয়। এটা আদৌ ঠিক নয়। কোনো মুসলমানই সেরূপ রায় মেনে নেয় না। কেয়াস ও উদ্ভাবন শক্তি ব্যবহার করলেই সে আহলে রায় হয়ে যায় না। তা হলে ইমাম আহমদ, ইমাম ইসহাক, এমনকি ইমাম শাফেঈ পর্যন্ত কেয়াস ও উদ্ভাবন অনুসারী ছিলেন। বরং আহলে রায় দ্বারা সেই দলকে বুঝায় যারা অধিকাংশ ফকীহ ও মুসলমানদের মতৈক্য ভিত্তিক মাসআলাগুলো উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে পূর্বসূরীদের কারো ভাষ্যকে গ্রহণ করেছেন। তাদের অধিকাংশ কাজ এটাই ছিল যে, অতীতের নজিরের ভিত্তিতে নতুন হুকুম বের করা এবং তাকে কোনো একটি মূলনীতির সাথে সেটাকে সম্পৃক্ত করতেন। তারা হাদীস ও আছার অনুসন্ধানের দিকে দৃষ্টি দিতেন না। পক্ষান্তরে জাহেরপন্ধী বলতে তাদের বুঝায় যারা না কেয়াস মানে, না সাহাবী ও তাবেঈর আছার অনুসরণ করে। যেমন দাউদ ইবনে হামম (রাঃ)। এ দুটির মাঝখানে অনেক বিজ্ঞ আলেম রয়েছেন। তারা সবাই আহলে সুন্নত। যেমন ইমাম আহম্মদ ও ইমাম ইসহাক (রাঃ)। এ ব্যাপারে আমি বেশ দীর্ঘ আলোচনা করলাম। এমনকি যে বিশ্বাস নিয়ে আমি এ গ্রন্থ রচনা করেছি, তা থেকেও আমি সরে গিয়েছি। এটা আমার পদ্ধতি নয়, অভ্যাসও নয়। তবে দুটো কারণে তা করেছি।
১। আল্লাহ তাআলা আমার অন্তরে মুহুর্তের মধ্যে এমন এক মানদণ্ড সৃষ্টি করে দিলাম যার সাহায্যে আমি উম্মতে মুহাম্মদীর মধ্যে সৃষ্ট প্রত্যেকটি মতভেদের কারণ বুঝে ফেলি। এটাও বুঝতে পাই যে, আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে তার কোনটি সত্য? আল্লাহ পাক আমাকে এ শক্তিও দান করেছেন যে, দলীল প্রমাণ ও যুক্তিতর্ক দ্বারা আমি তা প্রমাণও করতে পারি। আর তা এমনভাবে পারি যে, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ থাকে না, এমনকি তাতে কোনো জটিলতাও অবশিষ্ট থাকে না। তাই আমি একটি কিতাব রচনার ইচ্ছা করলাম আর তার নাম দিলাম ‘গায়াতুল ইনসাফ ফী বয়ানে আসবাবুল এখতেলাফ’ (মতভেদের কারণ বর্ণনায় চূড়ান্ত সুবিচার।) উক্ত কিতাবে আমি এই ব্যাপারটি পরিপূর্ণভাবে বর্ণণা করব ও তার ভেতর বহু প্রমাণ উপমা ও খুঁটিনাটি ব্যাপার উপস্থাপন করব। সাথে সাথে প্রতিটি ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি থেকে বাঁচার ও বাক্যের বিভিন্ন দিক, তার উদ্দেশ্য ও দাবি সম্পর্কিত রীতিনীতি আয়ত্ত করার চেষ্টা করব। অতঃপর এখন পর্যন্ত উক্ত কিতাব রচনায় আমি সুযোগ পাইনি। এখন যখন মতভেদের উৎস পর্যন্ত কথা পৌঁছে গেল, তখন অন্তরে এ উদ্দীপনা ও আকাঙ্ক্ষা জাগল যে, যা কিছু তাওফীক হয় বর্ণনা করে দেই।
২। এ দীর্ঘ আলোচনার দ্বিতীয় কারণ এই ছিল যে, এ যুগের লোকদের ভেতর মতভেদের সৃষ্টি হয়ে গেছে যা আমি ওপরে তুলে ধরলাম। তার ভেতর কিছু কিছু ব্যাপারে মানুষ অন্ধ রয়ে গেছে। এমনকি একদল তাদের সাথে লড়াইয়ের মুখোমুখি হয়েছে যারা তাদের সামনে আল্লাহ পাকের এ বাণী তুলে ধরেঃ “আমাদের প্রতিপালক অশেষ দয়ালু। তোমরা যা কিছু বর্ণনা করছ আমরা তা থেকে তাঁরই কাছে সাহায্য চাই”।
(হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগার) পয়লা খণ্ডে হাদীসের তত্ত্ব জ্ঞান সম্পর্কে যা আমি বর্ণনা করার ইচ্ছা করেছিলাম এটাই হলো তার শেষ কথা। শুরু ও শেষে, প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে আল্লাহর জন্যেই প্রশংসা। এরপর ইনশাআল্লাহ দ্বিতীয় খণ্ড আসবে। তাতে সেই সব রহস্যের উল্লেখ করব যা স্বয়ং হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে ব্যাপকভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
দ্বিতীয় খণ্ড
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে ব্যাপক হারে প্রকাশিত ঘটনাবলির রহস্য বর্ণনা
এখানে হাদীসের এমন এক পর্যাপ্ত গুচ্ছের বর্ণনা আমার উদ্দেশ্য যা মুহাদ্দিসদের কাছে সুপরিচিত, আলেম সমাজে প্রচলিত সহীহ বুখালী, সহীহ মুসলিমে ও আবু দাউদ, তিরমিজীর সুনানে বিদ্যমান রয়েছে। এ ছাড়া যা উল্লেখ করা হয়েছে তা সে সবের আওতায় বর্ণিত হয়েছে। এ কারণেই প্রত্যেক হাদীসের বর্ণনাকারী ও উৎসের দিকে দৃষ্টি দেইনি। এ কারণে যে, হাদীসের যে কোনো ছাত্রের জন্যে সে সব কিতাবের দিকে মনোনিবেশ ও সেগুলোর অনুসন্ধান সহজ ব্যাপার।
ঈমানের বিভিন্ন অধ্যায়ের বর্ণনাঃ জেনে রাখা দরকার যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন নিখিল সৃষ্টির জন্যে ব্যাপকতা নিয়ে প্রেরিত হলেন, আর তা এ জন্যে যে, তাঁর দ্বীন যেন অন্যান্য দ্বীনের ওপর বিজয়ী ও মর্যাদাপ্রাপ্ত হয় এবং অন্য সব বাতিল দ্বীনগুলো পরাভূত ও লাঞ্ছিত হয়, তখন তাঁরা এ ব্যঅপক দ্বীনে নানা ধরনের লোক প্রবেশ করল। ফলে এটা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়াল যে, যারা তাঁর দ্বীন মেনে নিলেন আর যারা মানলেন না, তাদের মাঝে সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্য ও পার্থক্য সৃষ্টি হোক। তারপর এটাও জরুরি হয়ে দেখা দিল যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিয়ে আসা হেদায়েতের আলো কাদের অন্তরে প্রবেশ করে তা উদ্ভাসিত করল আর যাদের অন্তরে সেভাবে তা প্রবেশ করল না তাদের ভেতরেও পার্থক্য সৃষ্টি করা। বস্তুত ঈমান দু’শ্রেণীর।
১। এক শ্রেণীর ঈমানের ওপর পার্থিব জীবনের বিধান নির্ভরশীল। মানে জান-মালের হেফাজত হওয়া ও আনুগত্য প্রকাশের প্রকাশ্য ব্যাপারগুলো তার ভিত্তিতে শৃঙ্খলিত হয়। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ফরমানও তাই বলছে। তিনি বলেন, আমাকে ততক্ষণ জেহাদ চালিয়ে যাবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে যতক্ষণ পর্যন্ত তারা সাক্ষ্য না দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই ও মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল এবং নামায কায়েম করে ও যাকাত দেয়। যখন তারা এ কাজ করবে তখন তার জান ও মাল আমার তরফ থেকে হেফাজতে থাকবে যদি না ইসলামের কোনো বিধি-ব্যবস্থা তার ওপর আরোপিত হয় এবং তার আসল হিসাব-নিকাশ আল্লাহর ওপর রয়েছে। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একথাও বলেন –যে ব্যক্তি আমাদের নামায পড়ল, আমাদের কেবলার মুখ ফিরাল এবং আমাদের জবাই করা জীব ভক্ষণ করল সে মুসলমান এবং তার জন্য আল্লাহ ও রাসূলের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। তোমরাও আল্লাহর প্রদত্ত দায়িত্বে খেয়ানত করো না। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেনঃ তিনটি কথা হলো ঈমানের ভিত্তি। যে ব্যক্তি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু পড়ল তার থেকে বিরত থাক। গুনাহের জন্যে তাকে কাফের বলো না। কোনো কাজের জন্যে তাকে ইসলাম থেকে খারিজ করো না।
২। দ্বিতীয় শ্রেণীর ঈমান হলো পারলৌকিক জীবনের বিধানের ভিত্তি। মানে, নাজাত প্রাপ্তি ও মর্যাদা লাভ সংশ্লিষ্ট বিধান। এ সব কিছু সার্বিক আকীদা, পুণ্য কাজ ও উত্তম যোগ্যতা নিয়ে গঠিত। এটা কম ও বেশি হতে থাকে। শরীআত প্রণেতার রীতি হলো যে, এর সব কিছুকেই তিনি ঈমান নামে অভিহিত করেন, যেন সবাই ঈমানের অংশগুলো সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন থাকে। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথাই বলেছেন। যেমন যার ভেতর আমানতদারী নেই তার ঈমান নেই এবং যে ব্যক্তি ওয়াদা রক্ষা করে না তার দ্বীন নেই। অন্যত্র তিনি বলেনঃ মুসলমান তাকেই বলি জিহবা ও হাত থেকে অন্যান্য মুসলমান নিরাপদ থাকে। আল হাদীস।
ঈমানের বহু শাখা। তার উদাহরণ হলো সেই গাছ যার কাণ্ড, ডালপালা, পাতা, ফুল ও ফল রয়েছে। যদি তার ডালপালা কাটা হয়, পাতা ঝরে যায় ও ফলগুলো ছিঁড়ে ফেলা হয়, তা হলে বলা হয় একটা ঠুঁটো গাছ। আর যখন তার কাণ্ডও উপড়ে ফেলা হয় তো পুরো গাছটাই শেষ হয়ে যায়। স্বয়ং আল্লাহ বলেন, সে ব্যক্তিই ঈমানদার আল্লাহর নাম শুনে যার অন্তর সন্ত্রস্ত হয়। এ সব ব্যাপার যখন একই ধরনের নয়, তাই হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এগুলোকে দুটো স্তরে ভাগ করেছেন।
১। পয়লা স্তরে হলো আরকান যা ঈমানের সর্বোত্তম অংশাবলি, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাই বলেনঃ ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি –(১) সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল (২) নামায কায়েম করা (৩) যাকাত দেয়া (৪) হজ্ব করা ও (৫) রমযানের রোযা রাখা। এ ছাড়া যত অন্যান্য শাখা আছে তা এগুলোরই অংশ বিশেষ। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, ঈমানের সত্তরের অধিক শাখা রয়েছে। সর্বোত্তম শাখা হলো লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলা ও সর্বনিম্ন শাখা হলো রাস্তা থেকে কাঁটা সরানো এবং লজ্জা ঈমানের অঙ্গ বিশেষ।
প্রথম শ্রেণীর ঈমানের বিপরীত ঘটলে কুফরী আসে। আর ঈমানের দ্বিতীয় শ্রেণীর ঈমানে ব্যতায় ঘটলে দুটো অবস্থা দেখা দেয়।
এক. যদি অন্তরে স্বীকৃতি না থাকে, শুধু তরবারির বিজয়ের কারণে ইবাদত ও আনুগত্য হবে, পরকালে তো সেটা নিছক নেফাক। এ তাৎপর্য মতে যে ব্যক্তি মোনাফেক হবে, পরকালে তার আর কাফেরের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না। পরন্তু মোনাফেকের ঠাঁই হবে দোযখের সর্বনিম্ন স্তরে।
দুই. আর যদি অন্তরের স্বীকৃতি থাকে, কিন্তু বাহ্যিক অবয়বের ইবাদতগুলো না করে, তাহলে তাকে ফাসেক বলা হবে। তেমনি যদি অন্তরে এখলাস না থাকে তাহলে সেটা আরেক ধরনের নেফাক। কোনো কোনো পূর্বসূরি সেটার নাম দিয়েছেন আমলের নেফাক। তার রূপ হলো এই যে, মানুষের ওপর নিজ স্বভাব বা সামাজিক রীতিনীতির প্রভাব দেখা দেয় কিংবা কুসংস্কারের আবরণ চড়ে যায়। ফলে সে পার্থিব জীবন, গোত্র ও সন্তানাদির মায়ায় আচ্ছন্ন হয়। আর অন্তরে একথা জাগে যে, পারলৌকিক শাস্তি বা পুরস্কার তো অনেক পরের ব্যাপার। তাই সে সদম্ভে পাপের পথে পা বাড়ায়। সাধারণত সে তা অজ্ঞাতেই করতে থাকে। তবে যদি সে ঘোষণা করে তা করে আর সেটার মানুষ করা বাঞ্ছনীয় অথবা সে ইসলামের ওপর চলাটা কঠিন ও বিপজ্জনক দেখে তা অনুসরণ করা অপছ্দ করে কিংবা কাফেরদের সাথে বন্ধুত্বের কারণে আল্লাহর বাণী ঘোষণা থেকে বিরত থাকে, তা হলে সে আমলের মোনাফেক হবে।
ঈমানের আরও দুটো স্তর রয়েছে। এক. অন্তরে সে সব ব্যাপারের স্বীকৃতি দান যা যা নিতান্তই জরুরি। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিব্রাঈল (আঃ)-এর প্রশ্নের জবাবে বলেন, ঈমান হলো আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাদের ওপর বিশ্বাস স্থাপন। -আল হাদীস। দুই, নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাদের অন্তরে যে পবিত্রতা ও প্রশান্তি বিরাজ করে তা অর্জিত হওয়া। এ ব্যাপারে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, পবিত্রতা ঈমানের অঙ্গ। যখন কোনো বান্দা ব্যভিচারে লিপ্ত হয়, তখন তার ঈমান বেরিয়ে গিয়ে মেঘের মতো তার মাথার ওপর বিরাজ করে। অতঃপর যখন সে তা থেকে মুক্ত হয় তখন তা আবার ফিরে আসে।
হযরত মুআজ (রাঃ) বলেন –এস, ঘন্টা খানিকের জন্যে ঈমান লই। মানে অন্তরের স্বস্তি ও নির্মলতা বাড়িয়ে নেই।
বস্তুত, শরীআতের পরিভাষায় চারটি অর্থ। যদি তোমরা ঈমানের অধ্যায়ের পরস্পর বিরোধী হাদীসগুলো যথাযথ স্থানে রেখে নজর বুলিয়ে নাও তা হলে তোমাদের সকল সন্দেহ –সংশয় দূর হয়ে যাবে। ঈমানের পয়লা অর্থ যে ইসলাম তা সুস্পষ্ট হয়ে ধরা দেবে। তাই আল্লাহ বলেন, তোমরা ঈমান এনেছ একথা না বলে বল, আমরা মুসলমান হয়েছি। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত সাদ (রহঃ)-কে বললেন, মুসলামনও কি? অর্থাৎ বল, আমি মুসলমান। তেমনি ঈমানের চতুর্থ অর্থ যে এহসান তাও সুস্পষ্ট।
নেফাকে আমল ও এখলাস পরস্পর বিপরীত ব্যাপার। দুটোই যেহেতু অদৃশ্য ব্যাপার তাই প্রত্যেকটির লক্ষণ ও নিদর্শন বলে দেয়া জরুরি। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ চারটি স্ববাব যার ভেতর রয়েছে সে নির্ভেজাল মোনাফেক। যদি তার একটি স্বভাবও থাকে তাহলে সে সেই স্বভাবের মোনাফেক যতক্ষণ না তা বর্জন করে। (১) তার কাছে আমানত রাখলে খেয়ানত করে (২) যখন কথা বলে তো মিথ্যা বলে (৩) যখন ঝগড়া করে তো ফাহেশা কথা বলে (৪) যখন ওয়াদা করে তো ভঙ্গ করে।
পক্ষান্তরে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তিনটি অবস্থা যার ভেতর বিদ্যমান সে ঈমানের স্বাদ পেয়েছে।
১। সব কিছুর চাইতে তার কাছে আল্লাহ ও রাসূল প্রিয়।
২। কোনো বান্দাকেও ভালোবাসলে তা আল্লাহর জন্যই ভালোবাসে।
৩। আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে যেভাবে সে অপসন্দ করে ঠিক তেমনি অপসন্দ করে কুফরীতে ফিরে যাওয়াকে।
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যখন তুমি কোনো বান্দাকে মসজিদে পড়ে থাকতে দেখবে, তখন তার ঈমানদার হওয়ার সাক্ষ্য দেবে। তেমনি তিনি অন্যত্র বলেনঃ আলীকে ভালোবাসা ঈমানের লক্ষণ এবং আলীর সাথে শত্রুতা পোষণ নেফাকের লক্ষণ। এ হাদীসের রহস্য এই যে, হযরত আলী (রাঃ) আল্লাহর ইবাদতের ক্ষেত্রে অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। তাঁর সেই কঠোরতা তার পক্ষেই সহ্য করা সম্ভব যার প্রবৃত্তি পরাভূত থাকে ও ঠিক হয়ে যায় এবং যার জ্ঞান তার ফাহেশের ওপর প্রধান্য লাভ করে।
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এও বলেছেনঃ আনসারদের ভালোবাসা ঈমানের নিদর্শন। তার রহস্য এই যে, সাদিয়্যা ও ইয়ামনী আরবদের মধ্যে সার্বক্ষণিক শত্রুতা বিরাজ করছিল। অবশেষে ঈমান তাদের এক করে দিয়েছে। যে ব্যক্তি আল্লাহর বাণী উচ্চকিত করার জন্যে সাহসে বুক বাঁধে, তার ভেতরে শত্রুতা ও বিদ্বেষ বিলুপ্ত হয়। এক্ষেত্রে হিম্মতের অভাব দেখা দিলেই মন্দ স্বভাব থেকে যায়।
এক হাদীসে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি। সিসাম ইবনে ছালাবার ও জনৈক আরাবীর হাদীসে আছে যে, আরাবী হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলল, ‘আমাকে এমন কাজ বলে দিন যা আমি সম্পাদন করলে জান্নাতে প্রবেশ করব’। উক্ত পাঁচটি জিনিস ইসলামের রুকন। যে ব্যক্তি তা করল ও অন্য কোনো ইবাদত করল না তার গর্দান আজাব থেকে বেঁচে যাবে এবং জান্নাতের অধিকারী হবে।
তেমনি তিনি বলে দিয়েছেন, নামাযের নূন্যতম স্তর কি? ওযুর নূন্যতম স্তর কি? বিশেষভাবে ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি বেনার কথা এজন্যে উল্লেখ করা হলো যে, এ পাঁচটিই মানুষের সর্বাধিক বিখ্যাত ইবাদত। দুনিয়ার কোনো জাতিই নেই যারা সেগুলোর কোনো না কোনোভাবে অনুসারী নয়। যেমন –ইয়াহুদি, ঈসায়ী, মাজুসী ও আরবের অন্যান্য বাসিন্দারা। অবশ্য তাদের সেগুলো পালন করার পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন। তাই এগুলো অন্যান্য ইবাদতের বদলে যথেষ্ট, কিন্তু অন্যান্য ইবাদত এগুলোর পরিবর্তে যথেষ্ট নয়। তার কারণ এই যে, পুণ্য কাজের সব নীতির মূলনীতি হলো তাওহীদ, নবওয়াত ও শরীআতে এলাহিয়ার স্বীকৃতি। যেহেতু ব্যাপক হারে নবী প্রেরিত হয়েছেন, তাই দলে দলে মানুষ আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করেছে। তখন জরুরী হয়ে দেখা দিল তাদের ও অন্যান্য মানুষের ভেতরে পার্থক্য সৃষ্টিকারী প্রকাশ্য নিদর্শন চালু করা। সেই নিদর্শনই হলো ইসলামের বিধিবিধানের ভিত্তি এবং সেগুলোর জন্যেই মানুষ জবাবদিহি হবে। যদি তা না হতো, তা হলে কিছুকাল পরে ইসলামী ও গায়রে ইসলামী লোকের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টির জন্যে নিজেরাই যার যার ধ্যান-ধারণামতে কিছু নিদর্শন চালু করত। ফলে ইসলামের বিধি-বিধানে প্রচুর মতভেদ দেখা দিত। তখন বহু বিধানের যে গরমিল সৃষ্টি হতো তা সুস্পষ্ট।
অন্তরের বিশ্বাসকে ফুটিয়ে তোলার জন্যে উক্ত স্বীকৃতির চেয়ে উত্তম এমন কিছুই নেই যা স্বেচ্ছায় ও সানন্দে স্বীকার করা যায়। ইসলামের এ সব রোকন নিয়ে আমি আগেই সবিস্তারে আলোচনা করে এসেছি। মূলত যথার্থ সৌভাগ্য ও পারলৌকিক মুক্তির ভিত্তি হলো চারটি চরিত্র। একটি হলো চারিত্রিক পুত পবিত্রতা। ওযু সহ নামাযের মাধ্যমে মানুষের সেই দৈহিক ও মানসিক পবিত্রতা অর্জিত হয়। তাই নামায হলো পবিত্র চরিত্রের মানদণ্ড। তেমনি পরিপূর্ণ শর্তসহ যাকাত আদায় ও তা যথাযথ মাসরাফে বা খাতে ব্যয় করা সামাজিক সহানুভূতি ও সুবিচারের ভিত্তি ও মানদণ্ড। আমি আগেই বলে এসেছি, নফস বা প্রবৃত্তির ওপর এমন কিছু বাহ্যিক ইবাদত চাপানো দরকার যা তার স্বভাবগত দুর্বলতা ও সংকীর্ণতার পর্দা বিলুপ্ত করে। এসব ক্ষেত্রে রোযার চাইতে বেশি সফল আর কোনো ব্যবস্থা হতে পারে না। আমি একথাও ইতিপূর্বে বলে এসেছি যে, শরীআতের নীতিগুলোর মূলনীতি হলো আল্লাহর নিদর্শনাবলির প্রতি সম্মান প্রদর্শন। তার ভেতর একটি হচ্ছে সম্মানিত কাবাঘর । তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের পথ এই যে, সেখানে হজ্ব করা হবে। পূর্ববর্তী আলোচনায় আমি এ ইবাদতের কল্যাণকারিতা বর্ণনা করে এসেছি। তাতে দেখা গেছে যে, হজ্ব অন্যান্য ইবাদতের স্থলে যথেষ্ট। কিন্তু অন্য কোনো ইবাদতই হজ্বের বদলে যথেষ্ট নয়।
শরীআত ও মিল্লাতের দৃষ্টিতে পাপ দুধরনের। সগীরা বা ছোট পাপ ও কবীরা বা বড় পাপ। কবীরা গুনাহ তাকে বলে যা শক্ত জৈবিকতা, হিংস্রতা ও শয়তানী প্ররোচনার কারণে প্রকাশ পায়। কবীরা গুনাহ করার ফলে সত্যের পথ রুদ্ধ হয় ও আল্লাহর নিদর্শনের মর্যাদা চূর্ণ হয়। অথবা সামাজিক জীবনে অপরিহার্য ব্যবস্থার বিরোধিতা অনিবার্য হয় এবং জনগণের জন্যে কঠিন ক্ষতিকর বিপদ সৃষ্টি হয়। তদুপরি তা করার অর্থ দাঁড়ায় শরীআতকে পেছনে ছুড়ে ফেলা। কারণ, শরীআত কঠোর ভাষায় কবীরা গুনাহ নিষিদ্ধ করেছে এবং তা অনুসরণকারীদের কঠিন শাস্তির কথা শুনিয়েছে। আর সেটাকে এভাবে চিহ্নিত করেছে যে, তা যে অনুসরণ করে সে যেন মিল্লাত থেকেই খারিজ হয়ে যায়।
সগীরা গুনাহ তার চেয়ে কম স্তরের পাপ। পাপাচারের পথে তা এগিয়ে দেয় ও ডেকে নেয়। শরীআত নিঃসন্দেহে সেটাও নিষিদ্ধ করেছে। তবে তার নিষিদ্ধতা কবীরা-গুনাহের নিষিদ্ধতার মতো শক্ত ও কঠোর নয়।
সত্যিকথা বলতে কি, কবীরাহ গুনাহের সংখ্যা সীমা নির্ধারিত নয়। তার পরিস্কার এই যে, কুরআন ও সহীহ হাদীসে যে পাপের জন্যে দণ্ডবিধি দোযখের প্রতিশ্রুতি ও ভীতির উল্লেখ রয়েছে এবং তার জন্যে দণ্ড নির্ধারিত হয়েছে সেটাই বড় পাপ। সে পাপকে দ্বীন থেকে খারিজ করে দেবার পাপ বলা হয়েছে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে ধরনের পাপকেই কবীরা গুনাহ বলে আখ্যায়িত করেছেন, সে পাপগুলো অনাচার সৃষ্টির ব্যাপারে কবীরা গুনাহর পর্যায়ের কিংবা তার চেয়েও বেশি। যেমন তিনি বলেন, যখন কোনো ব্যভিচারী ব্যভিচালে লিপ্ত হয়, তখন সে ঈমানদার থাকে না –আল হাদীস। এ হাদীসের তাৎপর্য এই যে, এ ধরনের কাজ প্রচণ্ড জৈবিক তাড়না কিংবা হিংস্র প্রবণতার প্রাধান্য লাভ থেকে সৃষ্টি হয়। বস্তুত, তখন তার বিবেক ও মানবতা লোপ পায়। ফলে তার যেন ঈমানই চলে যায়। এ থেকে জানা যায় যে, এ পাপটি কবীরা গুনাহর অন্যতম।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ সেই সত্তার শপথ যাঁর মুঠোয় আমার জীবন। যদি কোনো ইয়াহুদি কিংবা নাসারা এ উম্মত থেকে এ ‘দ্বীন ইসলাম’ শুনতে পায় ও যে দ্বীন নিয়ে আমি অবতীর্ণ হয়েছি তা কবুল না করেই মারা যায়, তা হলে সে জাহান্নামী।
আমি বলছি, তার অর্থ এই যে, যার কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছার পরও কুফরী আকড়ে থাকবে, সে দোযখে যাবে। কেননা সেটা বান্দার জন্যে আল্লাহ পাকের বিধি ব্যবস্থা ভঙ্গ করা বৈ নয় এবং সে নিজের ওপর আল্লাহ পাক ও নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতাদের অভিশাপ ডেকে নিল। পরন্তু সে মুক্তি লাভের পর থেকে বিচ্যুত হলো।
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেনঃ সে কখনো ঈমানদার নয় যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতা, তার সন্তান-সন্ততি ও অন্যান্য সব লোক থেকে বেশি প্রিয় হব। তিনি এও বলেনঃ এমনকি তার প্রবৃত্তি তার অনুগত হয় যা আমি নিয়ে এসেছি। অর্থাৎ তখনই সে কেবল ঈমানদার হতে পারে।
আমি বলছি, পরিপূর্ণ ঈমান হচ্ছে প্রকৃতির ওপর বিবেক বুদ্ধির প্রাধান্য লাভ। এমনকি বাহ্যিক কার্যকলাপে প্রবৃত্তির চহিদার ওপর বিবেকের চাহিদা তার কাছে উত্তম হয়ে দেখা দেবে, আল্লাহর রাসূলকে ভালোবাসার ব্যাপারটিও অনুরূপ। আমি নিজের জীবনের কসম খেয়ে বলছি, কামেল মোমেনদের ভেতর এ অবস্থাটি সর্বদা বিরাজ করে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এক ব্যক্তি আরজ করল –হে আল্লাহর রাসূল! ইসলামের ব্যাপারে আমাকে এমন একটা কথা বলে দিন যেন আপনার পরে আমাকে আর কারো কাছে কিচু জিজ্ঞেস করতে না হয়। এক বর্ণনায় আছে, আপনি ছাড়া যেন অন্য কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে না হয়। তিনি বললেন- বল, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, অতঃপর এর ওপর দৃঢ় হয়ে থাক।
আমি বলছি, তার অর্থ এই যে, মানুষ সর্বদা তার নজরে আল্লাহর আনুগত্য ও ইসলামের অনুসরণকে প্রতিভাত রাখবে এবং তদনুসারে কাজ করে যাবে ও তার বিপরীত কার্যকলাপ বর্জন করবে। এটা একটা সামগ্রিক মূলনীতি। এর মাধ্যমে মানুষের ভেতর বিভিন্ন শরীআত সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি অর্জিত হয়। সবিস্তার জ্ঞান অর্জিত না হলেও সামষ্টিক জ্ঞান অবশ্যই অর্জিত হবে, মানুষকে এগিয়ে যাবার যোগ্যতা দান করবে।
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যে ব্যক্তি সরল অন্তকরণে এ সাক্ষ্য দেয় যে, ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল’ আল্লাহ পাক তার জন্যে আগুন হারাম করে দেবেন। এমনকি হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন –যদি সে জ্বেনাও করে থাকে এবং চুরিও করে থাকে। তিনি এও বলেনঃ সে যে কাজই করে থাক না কেন।
আমি বলছি, উপরোক্ত হাদীসের তাৎপর্য এই যে, আল্লাহ তাআলা তার জন্যে সেই কঠিন ও স্থায়ী আগুন হারাম করবেন যা তিনি কাফেরের জন্যে প্রস্তুত করে রেখেছেন, এমনকি যদি সে কবীরা গুনাহও করে। এ ধরনের বাচনভঙ্গির ভেতর এ রহস্য নিহিত রয়েছে যে, পাপের বিভিন্ন স্তরের ভেতর সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। যদিও সামগ্রিক অর্থে সবই পাপ।
বস্তুত কুফরের সাথে যখন কবীরা গুনাহের তুলনা করা হয়, তখন কবীরা গুনাহের তেমন গুরুত্ব ও মান থাকে না, না তার কোনো মাত্রাতিরিক্ত প্রভাব পরিজ্ঞাত হয়, আর না তা স্থায়ী জাহান্নামে প্রবেশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ঠিক তেমনি কবীরা গুনাহের তুলনায় সগীরা গুনাহের অবস্থা। তাই হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উভয়ের পার্থক্য পাকাপাকি ভাবে বলে দিয়েছেন যা ব্যাধি ও সুস্থতার সাথে তুলনীয়। যদি কখনো কুণ্ঠ রোগের মোকাবেলায় সর্দি ও অবসন্নতার তুলনায় হয় তা হলে সর্দি ও ক্লান্তিকে সুস্থতা বলে ঘোষণা করা যায়। তখন আর সে সর্দির রোগীকে রুগী বলা যাবে না। শুধু এতটুকু বলা হবে, তার স্বাস্থ্যগত অসুবিধা রয়েছে।
তেমনি কিছু বিপদ এমন রয়েছে যা অন্যান্য বিপদকে ভুলিয়ে দেয়। যেমন কারো পায়ে কাঁটা বিঁধল। তারপর যদি তার পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদ লুট হয়ে যায়, তখন সে বলে, এর আগে আমার ওপর আর কোনো বিপদ দেখা দেয়নি।
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ শয়তান পানির ওপর আসন পাতে। তারপর সে তার চেলাচামুণ্ডাদের চারদিকে পাঠায়। তারা লোকদের বিপদে ফেলে। -আল হাদীস।
জানা দরকার যে, আল্লাহ তাআলা শয়তানদের সৃষ্টি করেছেন এবং তার স্বভাবই হচ্ছে নাফরমানীর স্বভাব। এক ধরনের পোকা যেরূপ তার স্বভাব মোতাবেক কাজ করে চলে যেমন নর্দমার কীট নোংরা পানিতে সাঁতরে বেড়ায়, শয়তানও নাফরমানীর কাজে ছুটাছুটি করে বেড়ায়। তাদের একজন সর্দার থাকে। তার আসন থাকে পানির ওপর। সে তার চেলাচামুণ্ডাদের শয়তানী কাজের যে পরিকল্পনাটি তার সামনে থাকে পূর্ণতা সম্পাদনের জন্যে ডেকে থাকে। এর ফলে সে তার দুর্ভাগ্য ও বিভ্রান্তিকে পরিপূর্ণতা দান করে।
প্রত্যেক জাতি ও প্রজাতির ক্ষেত্রে আল্লাহ পাকের এ রীতিই চলতে থাকে এবং তাতে কোনো ব্যত্যয় দেখা দেয় না। আমার কাছে এ ব্যাপারগুলো এতই প্রত্যক্ষ ও বাস্তব যে, আমি যেন তা স্বচক্ষে অবলোকন করছি।
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ শয়তান এ ব্যাপারে নিরাশ হয়েছে যে, আরব উপদ্বীপের মুসলমানরা তার উপাসনা করবে। অব্যশ সে তাদের পারস্পরিক শত্রুতার ব্যাপারে হতাশ হয়নি। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এও বলেছেন –‘এটাই সুস্পষ্ট ঈমান’।
জেনে রাখুন, শয়তানের কুমন্ত্রণা ব্যক্তির যোগ্যতা অনুসারে বিভিন্ন রূপ হয়। যে লোক যে ধরনের তাকে সেই ধরনের কুমন্ত্রণা দেয়া হয়। বস্তুতঃ শয়তানের কুমন্ত্রণার শ্রেষ্ঠতম ফসল হলো কুফরে লিপ্ত হওয়া ও দ্বীন থেকে বেরিয়ে যাওয়া। যদি কেউ ঈমানী দৃঢ়তার বরকতে আল্লাহর ইচ্ছায় বেঁচে যায় তো তার প্রভাব ভিন্নভাবে দেখা দেয়। তা হচ্ছে পারস্পরিক লড়াই, রাষ্ট্র ও পরিবারে ঝগড়া ফাসাদ ও ব্যক্তি বা দলগত শত্রুতা সৃষ্টি। যখন আল্লাহ তাআলা সেরূপ প্রভাব থেকেও বাঁচিয়ে রাখেন, তখন সে প্রভাব শুধু ধ্যান ধারণার ক্ষেত্রে দুর্বলভাবে আনাগোনা করে। তার ফলে কেউ মন্দ কাজে উদ্বুদ্ধ হয় না, তাই তা ক্ষতিকর নয়। পক্ষান্তরে সে প্রভাবকে যদি ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখা হয় তা হলে তা সুস্পষ্ট ঈমানের দলীল হয়ে দাঁড়ায়। তবে হ্যাঁ, পুণ্যাত্মা লোকদের ধারে কাছেও কুমন্ত্রণা পৌঁছতে পারে না। হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাই বলেনঃ জেনে রাখ, আল্লাহ পাক আমাকে তার ওপর প্রাধান্য লাভে সহায়তা করেছেন। ফলে সে মুসলমান হয়ে গেছে। এখন সে আমাকে শুধু ভালো কথাই বলে।
শয়তানের কুমন্ত্রণার প্রভাব যেন সূর্য কিরণ। তা যেভাবে লোহা ও জং ধরার পদার্থের ওপর যেরূপ প্রভাব বিস্তার করে, অন্যান্য পদার্থের ওপর সেভাবে করে না। তার প্রভাবও বস্তু বিশেষ স্বতন্ত্র হয়ে দেখা দেয়।
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ শয়তানের যেমন এক প্রভাব এবং তেমনি ফেরেশতারও এক প্রভাব দেখা দেয় –আল হাদীস। এর সার কথা হচ্ছে এই যে, ভালো কাজে আগ্রহ ও আকর্ষণ সৃষ্টির প্রেরণারূপে ফেরেশতার প্রভাব দেখা দেয় এবং নেককাজে বিরাগ ও অনীহা সৃষ্টির প্রেরণা শয়তানের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
শয়তানের প্রভাব থেকে বেঁচে থাকার ব্যাপারে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ‘যে ব্যক্তি সেরূপ কোনো কিছু টের পায়, তার উচিত একথা বলা যে, আমি আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের ওপর ঈমান এনেছি। তিনি আরও বলেন যে, ‘সে যেন আউজুবিল্লাহ পড়ে ও বাম দিকে থুক মারে’।
এসব হাদীসের রহস্য এই যে, আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া, তাঁকে স্মরণ করা ও শয়তানী প্রেরণাকে খারাপ ভাবা ও শয়তানকে লাঞ্ছিত করার ফলে নফসের দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয় ও শয়তানের প্রভাব কবুলের পথে অন্তরায় সৃষ্টি হয়ে যায়। আল্লাহ পাক তাই বলেনঃ “যারা মুত্তাকী তাদের যখন শয়তানের কোনো দল স্পর্শ করে, তখন তারা আল্লাহকে স্মরণ করে ফলে তাদের অন্তর্দৃষ্টি খুলে যায়”।
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ‘হযরত আদম (আঃ) ও হযরত মূসা (আঃ) আল্লাহ তা’আলার সামনে বহাস করেছেন’। আমি বলছি, ‘তাদের প্রভুর সামনে’ বাক্যাংশের তাৎপর্য এই যে, মূসা (আঃ)-এর রূহ হাযিরাতুল কুদসীর আকর্ষণে পুণ্যাত্মাদের পুণ্য মজলিসে উপনীত হলে সেখানে হযরত আদম (আঃ)-এর আত্মার সাথে সাক্ষাত হয়। এ ঘটনার তাৎপর্য এই যে, আল্লাহ তাআলা আদম (আঃ)-এর জবানের মাধ্যমে মূসা (আঃ)-কে একটি বিশেষ জ্ঞান দান করলেন। যেভাবে নিদ্রিত ব্যক্তি স্বপ্নযোগে কোনো ফেরেশতা বা পুণ্যাত্মাকে দেখতে পায় এবং জিজ্ঞাসাবাদ করে ও কথাবার্তা বলে, এমনকি তার মাধ্যমে সে এমন কিছু জানতে পায় যা অন্যের জানা নেই, এও অনেকটা তেমনি ব্যাপার। এক্ষেত্রে এমন একটি সূক্ষ্ম জ্ঞানের ব্যাপার ছিল যা মূসা (আঃ)-এর জানা ছিল না। অবশেষে আল্লাহ পাক তাঁকে সেই গুপ্ত জ্ঞানটি অবহিত করলেন। আর তা হচ্ছে এই যে, এ ঘটনার ভেতর দুটো ব্যাপারের সমন্বয় ঘটেছে।
১। একটি ব্যাপার সংশ্লিষ্ট ছিল হযরত আদম (আঃ)-এর ব্যক্তি সত্তার সাথে। তা হলো এই যে, যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি নিষিদ্ধ বৃক্ষটির ফল খাননি ততক্ষণ পর্যন্ত না তাঁর পিপাসা লাগত, না তাপ অনুভূত হতো, না ক্ষুধা পেত আর না তিনি নগ্ন হতেন। তিনি ছিলেন ঠিক ফেরেশতার মতোই। তারপর যখন তিনি সেই বৃক্ষের ফল খেলেন, তখন তার ভেতরে জৈবিক চেতনা প্রবল হলো এবং ফেরেশতার স্বভাব দুর্বল ও সুপ্ত হলো। এখানে এটা আবশ্যিক হয়ে দেখা দিল যে, নিষিদ্ধ বৃক্ষ থেকে কিছু খাওয়া পাপ এবং তার জন্যে তওবা করা অপরিহার্য।
২। দ্বিতীয় ব্যাপারটি হলো আদম সৃষ্টির সামগ্রিক উদ্দেশ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট। আল্লাহ পাক জগৎ সৃষ্টির সময়ে সে ব্যাপারটিকেই সামনে রেখেছেন। তাই আদম সৃষ্টির প্রাক্কালে তিনি ফেরেশতাদের তা জানিয়ে দিলেন। সেটা হচ্ছে এই যে, আল্লাহ তাআলা আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করতে গিয়ে এ ইচ্ছা পোষণ করেন যে, মানব জাতি পৃথিবীতে আল্লাহর খলীফা হবেন। তাদের থেকে কখনো পাপ প্রকাশ পাবে এবং তারা ক্ষমা চাইবে। অতঃপর আল্লাহ পাক তাদের ক্ষমা করে দেবেন। তাদের ভেতর বাধ্যবাধকতা ও আনুগত্য, নবী প্রেরণ, পুরস্কার, শাস্তি পথ প্রাপ্তি ও বিভ্রান্তির বিভিন্ন ব্যবস্থা চালু ও স্তরবিন্যাস করা হবে। ফলে তারা স্বতন্ত্র এক শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হয়ে দাঁড়াবে। মূলত নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণ আল্লাহ পাকের হেকমত অনুসারেই দেখা দিয়েছে। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যদি তোমাদের থেকে পাপ প্রকাশ না পেত তা হলে আল্লাহ তাআলা তোমাদের বিলুপ্ত করে অন্য এমন এক জাতি সৃষ্টি করতেন যারা পাপ করে ফেলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইত আর তিনি তাদের ক্ষমা করে দিতেন।
হযরত আদম (আঃ) পয়লা ব্যক্তি যার ওপর জৈবিক তাড়না জয়ী হয়। ফলে তার দ্বিতীয় জ্ঞান লোপ পেল এবং তার আদিমরূপ প্রকাশ পেল। এ কারণে তিনি কঠোর ভৎসনা শুনলেন। অতঃপর এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেলেন এবং তার দ্বিতীয় জ্ঞান পুনরায় চমকিত হলো তারপর যখন তিনি পুণ্যাত্মাদের মজলিসে ফিরে এলেন, তখন মূল ব্যাপারটি তিনি ভালোভাবে অবহিত হলেন। হযরত আদম (আঃ) পয়লা যে ধারণা পোষণ করেছিলেন, হযরত মূসা (আঃ) ও সেই ধারণঅর বশবর্তী হয়ে বহাসে লিপ্ত হয়েছিলেন। অবশেষে হযরত মূসা (আঃ)-এর ওপরেও দ্বিতীয় জ্ঞানের চমক দেখা দিল।
আমি আগেই বলেছি, স্বপ্নের যেরূপ ব্যাখ্যা হয়, তেমনি বাহ্যিক ঘটনাবলিরও ব্যাখ্যা হয়। কোনো বিধিনিষেধই হাওয়ার ওপর হয় না। তার পেছনে এমন কার্যকারণ থাকে যা সেটাকে অপরিহার্য করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, প্রত্যেক শিশু স্বাভাবিক ধর্মের ওপর জন্ম নেয়। অতঃপর তার বাপ-মা তাকে ইয়াহুদি বানিয়ে নেয়, খ্রিষ্টান বানিয়ে নেয়, কিংবা মজুসী বানিয়ে নেয়। যেমন পশুর প্রতিটি বাচ্চা স্বাভাবিক অবয়ব নিয়ে জন্ম নেয়। তোমরা কি সেটাকে নাক কান কাটা অবস্থায় দেখতে পাও?
আমি বলছি, জেনে নাও যে, আল্লাহ তাআলার চিরন্তর নীতি এটাই যে, তিনি জীব-জানোয়ার ও গাছপালার প্রতিটি শ্রেণীকে এক একটি বিশেষ রূপ দিয়ে সৃষ্টি করেন। যেমন মানুষকে তিনি বিশেষ এক আকৃতি দান করেছেন। তাদের চামড়া মসৃণ ও স্বচ্ছ। তাদের আকৃতি সোজা ও নখ চেপ্টা। সে কথা বলে, হাসে। এ সব বৈশিষ্ট্য থেকে জানা যায় সে মানুষ। তবে হ্যাঁ, এর ব্যতিক্রম যে আদৌ নেই তা নয়, তবে তা এতই নগণ্য যে ধর্তব্য নয়। যেমন কখনো কোথাও এমন বাচ্চা জন্ম নিল যার শূঁড় অথবা খুরা দেখা দিল।
তেমনি আল্লাহ পাকের এটাও এক স্থায়ী রীতি যে, প্রত্যেক শ্রেণীকে তিনি সীমিত ও স্বল্প পরিমাণের প্রয়োজনীয় অনুভূতি ও উপলব্ধি দান করেছেন এবং সেটা সেই শ্রেণীর বৈশিষ্ট্য। অন্য কোনো জীবের ভেতর তা অনুপস্থিত। তা ছাড়া বিশেষ শ্রেণীর নির্দিষ্ট অনুভূতি ও উপলব্ধি তাদের সবার ভেতরেই সমানে পাওয়া যায়। বস্তুত, মৌমাছিকে নির্দিষ্টভাবে এ উপলব্ধি দান করা হয়েছে যে, সে তার কাজের উপযোগী একটা গাছ খুঁজে বের করবে। তারপর তাতে বাসা বাঁধবে ও তাতে মধু জমা করবে। তুমি দেখতে পাবে, প্রতিটি মৌমাছির ভেতরেই এ উপলব্ধিটি বিদ্যমান। তেমনি কবুতরকে বিশেষভাবে এ উপলব্ধি দান করা হয়েছে যে, কিভাবে বাচ্চাদের আহার খাওয়াবে।
ঠিক তেমনি আল্লাহ তাআলা মানুষকে এ প্রকৃতিগত অনুভূতি ও উপলব্ধি ছাড়া বিশেষভাবে অতিরিক্ত এক উপলব্ধি ও পরিপূর্ণ এক বুদ্ধি দান করেছেন। তার ভেতর স্রষ্টার পরিচিতি ও তাঁর উপাসনার জ্ঞান ও উপলব্ধি বিদ্যমান। পরন্তু তার জীবন জীবিকার জন্যে যে সব ব্যবস্থা নিতে হবে তাও তার স্বভাবগত উপলব্ধি ও জ্ঞানে নিহিত রয়েছে। এটাই প্রকৃতির ধর্ম বা ফিতরাত। যদি তার পথে কোনো বাধা সৃষ্টি না হয় তা হলে জন্ম থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত তার ওপরেই থাকতে পারে। অবশ্য কখনো প্রতিবন্ধকতা এসে যায়। যেমন বাপ-মা বিভ্রান্ত করে। তখন তার স্বাভাবিক জ্ঞান মূর্খতায় পর্যবসিত হয়। যেমন সন্ন্যাসীরা বিভিন্ন পন্থায় নারীর যৌন প্রেরণা ও ক্ষুধার তাড়না বিলুপ্ত করে থাকে। অথচ এদুটো ব্যাপার মানুষের জন্মগত স্বভাব।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তাআলা মানুষকে তাদের পিতার পৃষ্ঠকোষে থাকতেই স্বভাবজাত ধর্মের জন্যে সৃষ্টি করেছেন। তিনি আরও বলেছেন, তখন তারা তাদের পূর্বপুরুষের স্বভাবে নিহিত ছিল। তিনি এও বলেন, তারা কে কি কাজ করার লোক ছিল তাও আল্লাহ পাক ভালোভাবে জানতেন। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দীর্ঘ স্বপ্ন বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেনঃ আদম সন্তানদের সব আত্মা ইবরাহীম (আঃ)-এর নিকট অবস্থান করে।
জেনে রাখ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এরূপ হয় যে, শিশু সহজাত প্রকৃতির ওপর জন্ম নেয়। আগেই তা বলা হয়েছে। তবে কখনো তার জন্মই এমন হয় যে, কোনো আমল ছাড়াই অভিশাপযোগ্য হয়। যেমন খিজির (আঃ) যে ছেলেটিকে হত্যা করলেন সে। কারণ –তার ওপরে কাফির সীল মারা ছিল।
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তখন সে তারপূর্বপুরুষের স্বভাবে ছিল। তার তাৎপর্য পার্থিব ব্যাপারের সাথে সংশ্লিষ্ট। কারণ, শরীআত কখনো না জানার অজুহাতে চুপ থাকে না। বরং কখনো তা এ জন্যে চুপ থাকে যে, প্রকাশ্য মানদণ্ডের অভাবে বিধান নির্ধারিত হয় না। অথবা এ জন্যে চুপ থাকে যে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অথবা এ জন্যে কোনো ব্যাপার এড়িয়ে যায় যে, শ্রোতারা তা বুঝবে না।
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ পাকের হাতেই মানদণ্ড রয়েছে। তিনি যাকে চান নিচে ফেলেন আর যাকে চান ওপরে তোলেন।
আমি বলছি, এ বক্তব্যের ইঙ্গিত রয়েছে তদবীরের দিকে। কারণ,তদবীরের ভিত্তিই হলো সবচাইতে কল্যাণকর ব্যবস্থার অনুসরণ। কারণ, যে কোনো ঘটনায় যখন কোনো পরস্পরবিরোধী কারণ দেখা দেয় তখন আল্লাহ তাআলা ইনসাফ ভিত্তিক ফয়সালাই প্রদান করেন। আল্লাহ পাকের ফরমানও তাই বলছে, ‘তিনি প্রতিদিন কোনো এক কাজে রয়েছেন’। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, বনী আদমের অন্তরগুরো আল্লাহ পাকের দু’আঙুলের মাঝে রয়েছে। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, অন্তরের অবস্থা হলো বিরান ময়দানে পড়ে থাকা এক পালকের মতো। বাতাস তাকে উল্টাতে পাল্টাতে থাকে।
আমি বলছি, বান্দারকাজ তার ইচ্ছাধীন। কিন্তু তার ইচ্ছার ওপরতার কোনো হাত নেই। তার উদাহরণ এই যে, এক ব্যক্তি কাউকে পাথর মারতে চাইল। যদি লোকটি জ্ঞানসম্পন্ন ও বিজ্ঞ হয় যে, সে পাথরের ভেতর শক্তি সৃষ্টি করে দেয় এবং পাথরটি নিজে ফিরে সে কাজটি করে। সেক্ষেত্রে এ প্রশ্ন কেউ তোলে না যে, বান্দাদের তো আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন এবং তার ইচ্ছাটাও তার গড়া। এখন লোকটাকে শাস্তি দেয়া হবে কেন? (এটা এ কারণে যে, সে খোদাদত্ত ইচ্ছা ও শক্তির অপব্যবহার করেছে।) মূলত প্রতিফল দানের তাৎপর্য এই যে, আল্লাহ পাকের কিছু কাজ তার অন্য কিছু কাজের উপর বিন্যস্ত হয়। মানে, আল্লাহ তাআলা বান্দার ভেতর এ অবস্থার সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আল্লাহ পাকের হেকমতের এ চাহিদা দেখা দিল যে, তিনি তাঁর বান্দাদের ভেতর পুরস্কার ও শাস্তি দানের আরেকটি অবস্থা সৃষ্টি করবেন। যেমন তিনি পানিতে উত্তাপ সৃষ্টি করেন এবং তাপের দাবি এটাই হয় যে, সেটাকে হাওয়ায় রূপান্তরিত করবে। বান্দার জন্যে যে ইচ্ছা ও চেষ্টাকে শর্ত করা হয়েছে, সেটা মৌলিক নয় বরং যৌগিক। তার কারণ এই যে, বাঙময় সত্তা কখনো সেই কাজের রঙ মেনে নেয় না যা সে নিজে করে না বরং অন্যের কাজ হয়। অথবা এমন কাজের রঙও মেনে নেয় না যা স্বেচ্ছায় করেনা। তা ছাড়া আল্লাহ পাকের হেকমতেরও খেলাপ যে, তিনি তার বান্দাদের এমন কাজের জন্যে শাস্তি দেবেন, যার রঙ তার বান্দার বাঙময় সত্তা গ্রহণ করেনি।
ব্যাপার যখন এই, তখন শরীআতে পরাধীন ইচ্ছাই যথেষ্ট। যখন সে সেই কাজের রঙ মেনে নেয়ার যোগ্য হয়। শরীআতে পরাধীন প্রচেষ্টাও শর্ত হবার প্রশ্নে যথেষ্ট। যখন সে উপার্জন এটা প্রমাণ করে যে, এ পরবর্তী অবস্থাটি বিশেষত সেই বান্দার ভেতরই সৃষ্টি হওয়া চাই, অন্য কারো ভেতরে নয়। এটাই উত্তম বিশ্লেষণ। সাহাবা ও তাবেঈনদের বক্তব্য থেকে এটাই বুঝা যায়। তাই ব্যাপারটি ভালোভাবেই স্মরণ রাখবে।
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তাআলা তাঁর সৃষ্টিকূলকে অন্ধকারের ভেতর সৃষ্টি করেছেন। তারপর তাদের ওপর নিজ নূরের আলো বর্ষণ করেছেন। যার ভাগ্যে সে নূরের অংশ জুটেছে সে পথপ্রাপ্ত হয়েছে। আর যে লোক সেই নূর থেকে বঞ্চিত হয়েছে, সে পথভ্রষ্ট হয়েছে। তাই আমি বলে থাকি, আল্লাহর ইলমের ওপর কলমের কালি শেষ হয়ে গেছে।
এ কথার তাৎপর্য এই যে, আল্লাহ তাআলা লোকদের সৃষ্টির আগেই জেনে ফেলেছেন যে, তারা মানুষ হিসেবে পূর্ণতা নিয়ে জন্মিবে না। তাই তাদের পথ প্রদর্শনের জন্যে রাসূল পাঠাতে হবে ও কিতাব নাযিল করতে হবে। এর ফলে কিছু লোক পথ পাবে আর কিছু লোক পথহারা থেকে যাবে। আল্লাহ তাআলা শুরুতেই এসব ধাণা করে নিয়েছিলেন। তবে আপনা থেকেই তিনি যা জ্ঞাত ছিলেন তা এরও আগের ব্যাপার। নবী পাঠিয়ে তিনি যে সবিস্তারে সব কিছু জানতে পেলেন তারও বহু আগে তিনি মোটামুটি ব্যাপারগুলো জ্ঞাত ছিলেন। যেমন আল্লাহ পাক থেকে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেন, “আমি যাকে খাওয়াব সে ছাড়া তোমরা সবাই ভুখা থাকবে আর আমি যাদের পথ দেখাব তারা ছাড়া তোমরা সবাই পথভ্রষ্ট”।
আমি বলছি, এটা এমন এক ঘটনার দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে যা বনী আদম সৃষ্টির আদিপূর্বে ঘটিত হয়েছে। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যখন আল্লাহ তাআলা কোনো বান্দার ব্যাপারে এ ফয়সালা করেন যে, অমুক স্থানে সে মারা যাবে, তখন তার সেখানে যাবার এক প্রয়োজন সৃষ্টি করে দেন”।
আমি বলছি, এর ভেতরে এ ইঙ্গিত রয়েছে যে, বেশ কিছু ঘটনা বা দুর্ঘটনা এ জন্যে সৃষ্টি হয় যাতে কার্যকারণের রীতিনীতি ধ্বংস না হয়ে রক্ষা পায়। এ ক্ষেত্রে যদি তার কোনো প্রয়োজন দেখা নাও দিত তবু তার অন্তরে আপনা থেকে সেখানে যাবার প্রবণতা সৃষ্টি হতো অথবা আল্লাহ পাক অন্য কোনো উপায় সৃষ্টি করে তার ফয়সালার বাস্তবায়ন ঘটাতেন।
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর আগে সৃষ্টিকূলের ভাগ্যলিপি রচিত হয়েছে। তখন তাঁর আরশ ছিল পানির ওপর।
আমি বলছি, আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিকুলের ভেতর প্রথম সৃষ্টি করেন আরশ ও পানি। তারপর যা যা হওয়ার তিনি ইচ্ছা করেছেন সেগুলো আরশে সংরক্ষিত পরিকল্পনার আওতায় এক এক পরিকল্পনা মোতাবেক সৃষ্টি করেছেন। আমাদের ভাষায় তা পরিকল্পনা ও ঐশী ভাষায় তা জিকর বা স্মরণ। ইমাম গাজ্জালী সেটাই বলেছেন।
আমার এ অভিমত হাদীস বিরোধী নয়। তাই তা কখনো ভাবা উচিত নয়। কারণ হাদীসের বিজ্ঞ আলেমদের নিকট কলম ও লাওহে মাহফুজ আগে সৃষ্টি হওয়ার বর্ণনা বিশুদ্ধ নয়। যদিও সাধারণ মানুষের ভেতর এটা সুপ্রচলিত বর্ণনা। নির্ভরযোগ্য কোনো হাদীস এর সমর্থনে পাওয়া যায়নি। সাধারণ মানুষ যা বলে বেড়ায় তা ইসরাঈলী কাহিনী মাত্র। তা আদৌ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস নয়। পরবর্তী কালের কিছু গবেষক আলেম নগণ্য সূত্রের ভিত্তিতে এ ব্যাপারে কিছু বলেছেন বটে, কিন্তু পূর্বসূরিদের এ ব্যাপারে কোনো বক্তব্য বর্ণিত হয়নি।
সারকথা এই যে, আরশে সৃষ্টিকূলের সব পরিকল্পনা ও রূপরেখা নির্ধারিত হয়েছিল। সেটাকেই ‘কিতাব’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। এটা মূলত রাষ্ট্রীয় বিধিবিধান নির্ধারণ ও অপরিহার্যকরণ সংশ্লিষ্ট ব্যাপার লিপিবদ্ধ করার ভিত্তি থেকে সৃষ্ট। যেমন আল্লাহ পাক বলেন, ‘তোমাদের ওপর রোযা লিপিবদ্ধ করা হলো’। কিংবা ‘তোমাদের ওপর লিপিবদ্ধ করা হলো যখন তোমাদের মৃত্যু হাজির হয়, অসিয়ত করা’। তেমনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দার ওপর তার জ্বেনার অংশের কথাও লিপিবদ্ধ করেছেন’। এক সাহাবী বলেন, ‘আমি অমুক যুদ্ধে এভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছি’। অথব এ ক্ষেত্রে কিতাবের কোনো ব্যাপারই নেই। এটা কা’ব ইবনে মালেক (রাঃ)-এর বক্তব্য। আরব কবিতের কবিতায়ও এ ধরনের পরিভাষা ব্যবহারের ভুরিভুরি নজির রয়েছে।
তারপর ‘পঞ্চাশ হাজার বছর’ এর উল্লেখ নির্ধারিত সময়ের অর্থেও হতে পারে। তা আবার দীর্ঘকালের অনির্ধারিত অর্থেও হতে পারে।
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আল্লাহ তাআলা আদমকে সৃষ্টি করলেন। অতঃপর তাঁর পিঠে হাত বুলালেন ইত্যাদি।
আমি বলছিঃ এর তাৎপর্য এই যে, আল্লাহ তাআলা হযরত আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করেছেন গোটা মানবজাতির পিতারূপে। তাই তিনি তাঁর পৃষ্ঠদেশে ভাবী সন্তানদের মৌলসত্তা লেপ্টে দিলেন। তারপর আল্লাহ পাকের মর্জি মোতাবেক পর্যায়ক্রমে তা অস্তিত্ব লাভ করে চলল এবং কে কখন অস্তিত্ব নেবে তাও আল্লাহর জানা ছিল। সেটা তিনি আদম (আঃ)-কে প্রতিচ্ছবির মাধ্যমে দেখিয়ে ও জানিয়ে দিলেন। আদম সন্তানদের নেককারী ও বদকারীকে তিনি আলো ও আঁধারের রূপ দিয়ে প্রকাশ করলেন। তাদের স্বভাবে যে দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা ছিল তা তিনি প্রশ্নোত্তর ও নিজেদের ওপর দায়িত্ব আরোপের স্বীকৃতির মাধ্যমে প্রকাশ করলেন। বস্তুত তাদের মূল যোগ্যতার ভিত্তিতে তাদের জবাবদিহি করা হবে। বাহ্যত ও জবাবদিহিতা তাদের যোগ্যতার সাথেই সংশ্লিষ্ট হয়।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ প্রত্যেকটি মানুষের মৌল উপাদান তার মায়ের পেটে (চল্লিশদিন পর্যন্ত) জমা হতে থাকে। -আল হাদীস
আমি বলছি, এ সময়ে পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন ও রূপগ্রহণ চলতে থাকে। হঠাৎ একসাথে সব গড়ে যায় না। প্রত্যেকটি স্তরের পরিবর্তিত রূপ পূর্বস্তর থেকে ভিন্নতর হয়। যে অবস্থাটি রক্তের মতো ক্ষিপ্রতা নিয়ে সঞ্চালিত হয়না সেটাকে ‘নোতফা’ বলে। যে অবস্থায় দুর্বলভাবে হলেও জমাটবদ্ধতা সৃষ্টি হয় তখন তার নাম হয় ‘মুযগাহ’। অবশ্য এ স্তরে নরম নরম হাড় সৃষ্টি হয়। যেমন যখন কোনো খেজুরের বিচি মাটিতে ফেলা হয়, তখন তার অঙ্কুরোগমের জন্যে নির্দিষ্ট একটি সময় থাকে। যে ব্যক্তি খেজুরের বিচি থেকে অংকুরোগম ঘটিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, সে জানে, কখন কোন মাটিতে কিরূপ পানি সিঞ্চনে তা ঘটে থাকে। তাই সে বলতে পরে কোনো বিচিতে কিরূপ গাছ ধরবে কি ধরবে না।
তেমনি আল্লাহ তাআলা কিছু ফেরেশতাকে বাচ্চাদের অবস্থা তাদের স্বভাবের গতিপ্রকৃতি সহ জানবার কিছুটা ক্ষমতা দিয়েছেন। তারা জানতে পায়, কোন বাচ্চাটি কিরূপ স্বভাব নিয়ে জন্ম নিচ্ছে।
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে, তার ঠাঁই দোযখে হবে না বেহেশতে হবে তা লেখা হয়নি।
আমি বলছি, প্রতিটি মানুষের ভেতর সাফল্য ও বিচ্যুতি রয়েছে যার জন্যে সে ছাওয়াব ও আজাব দুটোই পাবে। হয়ত হাদীসের এ অর্থও হতে পারে যে, কারো স্থান দোযখে হবে, কারো স্থান বেহেশতে হবে।
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “যখন তোমার প্রতিপালক আদম সন্তানদের প্রতিশ্রুতি দিলেন”, এ আয়াত উপরোক্ত হাদীসের পরিপন্থী নয়। “অতঃপর তিনি তাঁর ডান হাত আদমের পিঠে বুলালেন। তার থেকে তার সন্তানদের বের করলেন”। এ সবের তাৎপর্য এই যে, হযরত আদম (আঃ) থেকে তাঁর সন্তানদের এবং সেই সন্তানদের থেকে তাদের সন্তানদের ও এভাবে কেয়ামত পর্যন্ত আদম সন্তানদের অস্তিত্ব লাভের ধারা অব্যাহত থাকবে। মূলত কুরআন মজীদে কিছু ঘটনার উল্লেখ করেছেন এবং হাদীসে তার উপসংহার টানা হয়েছে।
আল্লাহ পাক বলেন, ‘যে ব্যক্তি দান করল ও তাকওয়া গ্রহণ করল এবং ভালো কাজকে স্বীকৃতি দিল’ অর্থাৎ আমার জানা ও ধারণামতে যারা এ সব গুণের অধিকারী হলো, তাদের জন্যে দুনিয়ার এ সব কাজ করা সহজ করে দেব। আয়াতের এ ব্যাখ্যার সাথে হাদীসের বক্তব্যের সামঞ্জস্য সৃষ্টি হয়।
আল্লাহ পাক বলেনঃ আর ব্যক্তিসত্তা সৃষ্টি করে সেটাকে যথাযথ রূপ দিয়েছি। তারপর তাকে বুঝ দিয়েছি পাপাচারণ ও পরহেজগারীর। আমি বলছি –এখানে এলহাম শব্দের অর্থ হচ্ছে তার সামনে পাপাচার ও পরহেজগারী রূপ তুলে ধরব। ইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর বর্ণিত হাদীসে এ কথাই বলা হয়েছে। হাদীসটি পূর্বেই আলোচিত হয়েছে। মূলত এলহাম অর্থ হচ্ছে কারো জ্ঞানজগতে কোনোকিছুর রূপ এমনভাবে চিত্রিত করা যা তাকে সে ব্যাপারে জ্ঞানী করে দেয়। অতঃপর সেটাকে সামগ্রিক রূপ বলে বর্ণনা করা হয় যা থেকে বস্তুটির প্রকাশ ও প্রভাব শুরু হয়। তা থেকে কেউ জ্ঞান অর্জন করতে পারুক বা না পারুক। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
কুরআন সুন্নাহর অনুসরণ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিকৃতির সব ধরন সম্পর্কেই সতর্ক করেছেন এবং সবগুলোই কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছেন। এমনকি নিজ উম্মতকে তা থেকে বিরত থাকার জন্যে প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন।
বস্তুত দ্বীন থেকে উদাসীন হবার সবচেয়ে বড় কারণ হলো সুন্নতের অনুসরণকে বর্জন করা। এ সম্পর্কে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ “আমার আগে আল্লাহ তাআলা যে নবীকেই তাঁর জাতির কাছে পাঠিয়েছেন, সেই জাতির একদল লোক তাঁর সহায়ক ও সাথী হয়েছেন। তারা তাঁর সুন্নাত অনুসরণ করতেন ও তাঁর নির্দশ হুবহু মেনে চলতেন। অতঃপর পরবর্তী স্তরে এমন একদল লোক এল যারা যা বলত তা তারা করত না আর যা করত তা তারা বলত না। এ ধরনের লোকদের বিরুদ্ধে যারা হাত দিয়ে জেহাদ করেছে তারা মোমেন, যারা জিহবা দ্বারা জেহাদ করেছে তারা মোমেন, যারা অন্তর দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে জেহাদের ধারণা পোষণ করেছেন তারাও মোমেন এবং এটাও যারা করেনি তাদের অন্তরে তিলমাত্র ঈমান নেই”।
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আমি তোমাদের কাউকে এমন না পাই যে, সে গের্দায় হেলান দিয়ে আছে আর তার কাছে আমার কোনো নির্দেশ বা নিষেধাজ্ঞা পৌঁছেছে, অথচ সে বলে দিচ্ছে, এ সবের আমি কিছুই জানিনা, আমি তো আল্লাহর কিতাবে যা পেয়েছি তা অনুসরণ করছি এবং এটাই যথেষ্ট।
এভাবে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সুন্নাহ অনুসরণের জন্যে যথেষ্ট তাকিদ দিয়েছেন। বিশেষ যখন এ নিয়ে মানুষের ভেতরে মতভেদ দেখা দেয় তখন সুন্নত অনুসরণ জরুরি হয়ে যায়।
দ্বীনের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি সম্পর্কে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘নিজেরা নিজেদের ওপর কঠোরতা আরোপ করো না। অন্যথায় আল্লাহ তোমাদের ওপর কঠোরতা চাপাবেন’।
একদা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) সহ একদল সাহাবা হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশিত ইবাদতকে কম ভেবে আরও কঠোর ইবাদতের অভিলাষী হলেন, তখন হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপরোক্ত মন্তব্য করেন।
গভীর চিন্তা ভাবনা সম্পর্কে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “লোকদের কি হলো যে, আমি যা করি তা তারা পরিহার করে চলছে। আল্লাহর কসম! আমি আল্লাহর ইলম সম্পর্কে তাদের চেয়ে বেশি পরিজ্ঞাত এবং আমিই তাদের বেশি ভয় করি”।
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, ‘হেদায়েত পেয়ে যে জাতিই পথভ্রষ্ট হয়েছে তাদের ভেতরেই বিবাদ বিসম্বাদ দেখা দিয়েছে’।
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, ‘তোমাদের পার্থিব ব্যাপারে তোমরা বেশি জান। ইসলামের সাথে অন্য ধর্ম মতের সংমিশ্রণ সম্পর্কেও তিনি সতর্ক করেছেন যে সাহাবী ইয়াহুদিদের কিতাব ও ইলম নিয়ে গবেষণা করতে চেয়েছিলেন, তাকে তিনি বলেনঃ তোমরা কি সেভাবেই এদিক ওদিক ধাক্কা খেয়ে ফিরতে চাও যেভাবে ইয়াহুদি-নাসারারা ফিরছে? আমি তো তোমাদের সামনে উজ্জ্বল ও সুস্পষ্ট দ্বীন নিয়ে এসেছি। যদি মূসা (আঃ)ও জীবিত থাকতেন, তা হলে আমার আনুগত্য ছাড়া তাঁরও উপায় থাকত না’।
যে ব্যক্তি ইসলামের ভেতর জাহেলিয়াতের রীতিনীতি চালু করতেচায় তার ব্যাপারে তিনি আরও কঠোর ভাষায় মন্তব্য করেছেন। তাঁর কাছে সেটা ছিল সর্বাধিক ক্রোধ সঞ্চারক। ‘ইন্তিসান’ কিতাবে রয়েছে যে, সে ব্যাপারে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যারা আমাদের দ্বীনের ক্ষেত্রে নতুন কিছু আবিস্কার ও চালু করল, সে প্রত্যাখ্যাত।
ফেরেশতারা যে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সেই ব্যক্তির সাথে উপমা দিয়েছেন যে ব্যক্তি ঘর তৈরি করে দস্তরখানা বিছিয়ে লোকদের খানা খাবার জন্যে ডাকছেন, তার তাৎপর্য সম্পর্কে আমার বক্তব্য এই, তাঁরা এর মাধ্যমে লোকদের ওপর ও দ্বীন কবুল করা আর না করার দায়-দায়িত্ব চাপিয়েছেন। একটা বাস্তব উদাহরণের মাধ্যমে তাঁরা একটি তাত্ত্বিক ব্যাপারে পুরোপুরি শিক্ষাদান করলেন।
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আমার উদাহরণ হলো সেই ব্যক্তি যে আগুন জ্বালাল, ইত্যাদি –আল হাদীস। অন্যত্র হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন –আমার উদাহরণ আর আমাকে যা দিয়ে পাঠানো হয়েছে তার উদাহরণ হলো সেই ব্যক্তি ও তার কথা যে লোক এক জাতির কাছে এল এবং বলল –হে জাতি! আমি একদল সৈন্যকে নিজ চোখে দেখতে পেয়েছি….ইত্যাদি আল হাদীস। এটা এ কথার সুস্পষ্ট দলীল যে, কিছু কিছু কাজ এমন আছে যে, রাসূল পাঠানোর আগেও সেগুলো আজাব লাভের উপযোগী।
অন্যত্র হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আল্লাহ তাআলা আমাকে যে হেদায়েত ও ইলম সহ পাঠিয়েছেন, তার উদাহরণ হচ্ছে সেই প্রবল বর্ষণ যা কোনো ভূখণ্ডের ওপর পতিত হয়….আল হাদীস। এ হাদীসে এ কথা বর্ণিত হয়েছে যে, আলেম সম্প্রদায় হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হেদায়েত দুপদ্ধতির যে কোনো এক পদ্ধতিতে গ্রহণ করেছেন।
১. সরাসরি বর্ণনা থেকে।
২. বর্ণনার প্রামাণ্য দিক থেকে।
তারা মাসআলা ইস্তিম্বাত করবে এবং নিজের ইস্তিম্বাত করবে এবং নিজের ইস্তিম্বারাতকৃত কথাগুলো, মতগুলো লোকদের এমনভাবে জ্ঞাত করবে (যাতে লোকেরা তাতে আমল করতে সক্ষম হয়। এটাই মোজতাহেদীনদের হাকীকত)। অথবা শরীয়াতের বিধানের উপর আমল করতে সক্ষম হবে। এতে জনগণ তাদের দ্বারা সঠিক পথের সন্ধান পাবে, হেদায়েত লাভ করবে। এ হাদীসে প্রথম থেকেই জাহেল, অজ্ঞতের তা গ্রহণ না করার বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে।
এক হৃদয়গ্রাহী ভাষণে রাসূল (সা) বলেছেনঃ
(আরবী****************************************************************************)
“আমার সুন্নাহ ও সৎপথপ্রাপ্ত –হেদায়েতপ্রাপ্ত, খোলাফায়ে রাশেদীনদের সুন্নাত পালন করা তোমাদের জন্যে অবশ্য কর্তব্য”।
আমি বলছি যে, দ্বীনের শৃঙ্খলা প্রিয়নবী (সা)-এর সুন্নাতের অনুসরণের উপর নির্ভরশীল। আর খেলাফতে কোবরা তথা রাষ্ট্রীয় খেলাফত পরিচালনা খোলাফায়ে রাশেদীনদের অনুসরণেল উপর নির্ভরশীল। যে বিষয়ে তারা তাদের ইজতিহাদের মাধ্যমে জীবন জীবিকা সংক্রান্ত কল্যাণকর দিকের ও জিহাদ সংক্রান্ত বিষয়াবলিতে ও লেনদেন, কায়-কারবার, ব্যবসা চুক্তি ইত্যাদি বিষয়ে দিক নির্দেশনা প্রদান করবে। ততক্ষণ পর্যন্ত তা অনুসরণ করতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না তা শরীয়তের খেলাফ হবে এবং শরীয়তের বিষয়ে নতুন উদ্ভাবন হবে।
রাসূলুল্লাহ (সা) লোকদের বুঝনোর উদ্দেশ্যে একটি দীর্ঘ রেখা অংকন করলেন। অতঃপর বললেনঃ “এটি আল্লাহর রাস্তা”। অতঃপর সে রেখার উভয় পার্শ্বে ডানে ও বামে কয়েকটি রেখা অংকন করলেন এবং বললেন, এগুলোও রাস্তা। এ রাস্তাগুলোর প্রত্যেকটিতে শয়তান অবস্থান করে সেদিকে ডাকছে, একথা বলে এ আয়াতে কারীমা পাঠ করলেনঃ
(আরবী*******************************************************************************)
“এটি আমার সরল সঠিক পথ, এর অনুসরণ কর। অন্যান্য পথগুলো অবলম্বন করো না, তা হলে তোমরা আমার পথ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে”।
আমি বলি, মুক্তিপ্রাপ্ত দল হচ্ছে তারা, যারা কিতাব, পবিত্র কুরআন ও সুন্নাত তথা পবিত্র হাদীসকে পরিপূর্ণভাবে আকিদা-বিশ্বাসে ও আমলে-কর্মে দৃঢ়ভাবে ধারণ করবে এবং সে পথে চলবে যে পথে জমহুর সাহাবা ও তাবেয়ীনগণ চলেছেন। যদিও যে ব্যাপারে পবিত্র কুরআনের প্রকাশ্য কোনো প্রসিদ্ধ প্রমাণ সেসব ব্যাপারে তারা দ্বিমত পোষণ করে থাকেন এবং দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে সাহাবাদের মধ্যে কোনো ধরনের ঐকমত্য সৃষ্টি হয়নি। কোনো মাসয়ালার ব্যাপারে কোনো কারণে প্রমাণাদির ভিত্তিতে তাদের মধ্যে দ্বিমতের তথা মতভেদের সৃষ্টি হয়েও থাকে। অথবা কোনো সংক্ষিপ্ত বিষয়ের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দেয়ার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে মতভেদের সৃষ্টি হয়েও থাকে। পক্ষান্তরে মুক্তি না পাওয়া দল হচ্ছেঃ যারা সালফে সালেহীনদের আকিদার বিপরীত কোনো আকিদা গ্রহণ করেছে বা এমন কোনো আমল করেছে যে আমল তাদের আমলের সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়।
হুযুর (সাঃ)-এর বাণীঃ
(আরবী*****************************************************************************)
“এই উম্মত গোমরাহী পথভ্রষ্টতার বিষয়ে ঐকমত্য হবে না”। হুজুর (সাঃ)-এর বাণীঃ
(আরবী*********************************************************************************)
“এ উম্মতের জন্য প্রত্যেক শতাব্দীর শেষে আল্লাহ তায়ালা একজন মোজাদ্দেদ প্রেরণ করবেন যিনি তার দ্বীনকে তাজদীদ, সংস্কার করবেন”। অপর এক হাদীসে এর ব্যাখ্যা রয়েছে-
(আরবী*************************************************************************************)
এ দ্বীনের জ্ঞান পূর্বসূরিদের থেকে উত্তরসূরি বিশ্বস্ত ব্যক্তিরা বহন করবে। তারা তাদের প্রভাবশাল লোকদের বিকৃতি হতে তাকে রক্ষা করবে, বাতেল পন্থীদের বিভিন্ন দাবি হতেও জাহেলদের, মূর্খদের বিভিন্ন জটিল ব্যাখ্যা হতেও রক্ষা করবে।
জেনে রাখুন যে, মানুষ যখন দ্বীনের বিষয়ে ইখতেলাফ করল এবং পৃথিবীতে ফ্যাসাদ বিবাদ বিসম্বাদ সম্প্রসারিত করল তখন তা মহান আল্লাহর দরবারে কষাঘাত করল, তখন মহান আল্লাহ মুহাম্মদ (সাঃ)-কে পৃথিবীতে প্রেরণ করলেন পথহারা মানব জাতিকে সঠিক পথ প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে। তাঁর মৃত্যুর পর এর গুরুত্ব হুবহু চলে যায় তার প্রদত্ত জ্ঞানের হেফাযত, সংরক্ষণ ও পথ প্রদর্শনের প্রতি তখন তাদের মধ্যে প্রচলিত হয় ইলহামাত ও আল্লাহর নৈকট্যলাভ।
আল্লাহর ইচ্ছা হলো কেয়ামত পর্যন্ত লোকদের মাঝে দ্বীনকে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখা। তখন প্রয়োজন দেখা দিল এমন এক উম্মতের যারা আল্লাহর দ্বীনকে হেফাজত, সংরক্ষণ করবে। তাদের সকলে কখনো ভ্রষ্টতার উপর ঐকমত্য হবে না এবং তাদের মাঝে পবিত্র কুরআন সংরক্ষিত থাকবে।
তাদের প্রস্তুতির বিভিন্নতা সত্ত্বেও তাদের নিকট যা কিছু কিছু দ্বীন বিদ্যমান ছিল তা এ দ্বীনের সাথে মিলে গেল। তার সাথে সাথে কিছু পরিবর্তন সাধিত হলো। আল্লাহর ইচ্ছা এ জাতীয় লোকদের অপেক্ষমান ছিল যারা তা গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিল। তাদের অন্তরে আল্লাহ তায়ালা জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ সীমা লঙ্ঘনকারীদের পরিবর্তন বিদূরণের আকর্ষণ সৃষ্টি করে দিলেন। এর দ্বারা কঠোরতা ও গভীরভাবে গবেষণার প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। এবং বাতিল পূজারীদের মিথ্যা দাবি দূরকরণের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করা হয়েছে। এতে অনুগ্রহ ও সুনজরের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে এবং এক জাতিকে অপর জাতির সাথে মিলিত করার প্রতি ও জাহেলদের অপব্যাখ্যা দূরীকরণের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। এবং এ ক্ষেত্রে অমনোযোগীতা এবং দুর্বল ব্যাখ্যা দ্বারা আল্লাহর নির্দেশকে ত্যাগ করার মানসিকতা ত্যাগ করার প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে।
নবী করীম (সাঃ)-এর বাণীঃ
(আরবী*************************************************************************)
“আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকে দ্বীনের বিশেষ জ্ঞান দান করেন”।
নবী করীম (সাঃ)-এর বাণীঃ
(আরবী*************************************************************************)
“নিশ্চয়ই আলেমগণ নবীদের ওয়ারিশ ও উত্তরাধিকারী”।
নবী করীম (সাঃ)-এর বাণীঃ
(আরবী*****************************************************************)
“আলেমের মর্যাদা আবেদের উপর যেমন তোমাদের একজন সাধারণ ব্যক্তির উপর। আমার মর্যাদাও এরূপ অপরাপর বাণীসমূহ।
জেনে রাখুন যে, যখন কোনো ব্যক্তির প্রতি আল্লাহর দয়া হয় এবং তাকে আল্লাহ তার কার্যপ্রণালী পরিচালনার ক্ষেত্র নির্ধারণ করেন তখন তার প্রতি মেহেরবানী করা অত্যাবশ্যকীয় হয়। এবং তাকে ভালোবাসার –তার প্রতি মহব্বত করার, তাকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য ফিরিশতাদের প্রতি নির্দেশ জারি করা হয়। তখন তাকে জিবরাঈলের ভালোবাসা এবং দুনিয়াবাসীর তাকে গ্রহণ করা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
নবী করীম (সা) দুনিয়া হতে বিদায় নেবার পর নবুয়তের ইলেমের বাহকদের এবং তার বর্ণনাকারীদের তা একস্থান হতে অন্যস্থানে স্থানান্তরকারীদের প্রতি বিশেষ করে এ গুরুত্বারোপ করা হয়। আল্লাহ তায়ালা তাদের মাঝে বেহিসাব কল্যাণ দান করলেন।
নবী করীম (সাঃ)-এর বাণীঃ
(আরবী************************************************************************************)
“আল্লাহ সে বান্দার মুখমণ্ডল চিরসবুজ করে রাখবেন যে আমার বাণী শুনল এবং তা যথাযথ সংরক্ষণ করল ও যেভাবে শুনল হুবহু সেভাবে পরবর্তীদের নিকট পৌঁছে দিল”।
আমি বলছি যে, এ মর্যাদা প্রদানের কারণ হলো, সে সব মোহাদ্দেস নবী করীম (সাঃ)-এর হেদায়াতকে সৃষ্টিজগতের নিকট পৌঁছে দিয়েছে এজন্য। নবী করীম (সা)-এর বাণীঃ
(আরবী*******************************************************************)
“যে ব্যক্তি আমার প্রতি ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যারোপ করল সে জাহান্নামে তার স্থান করে নিল”।
নবী করীম (সাঃ)-এর বাণীঃ
(আরবী*****************************************************************************)
“শেষ জামানায় দাজ্জ্যাল হবে, মিথ্যাবাদী হবে”।
আমি বলি যে, যখন পরবর্থী সময়ে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছানোর মাধ্যম শুধুমাত্র রেওয়ায়াতই ছিল। আর যখন রেওয়ায়াতের মধ্যেই গণ্ডগোল দেখা দিল, তখন দৃঢ় সিদ্ধান্ত হলো যে, এর কোনো চিকিৎসা নেই। ফলে নবী করীম (সাঃ)-এর প্রতি মিথ্যারোপ করাকে কবিরা গুনাহ বলা হলো এবং সাবধানতা অবলম্বন ওয়াজিব তথা অত্যাবশ্যকীয় হলো, হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে। যাতে মিথ্যা হাদীস বর্ণিত না হয়।
নবী করীম (সাঃ)-এর বাণীঃ
(আরবী*************************************************************************************)
“বনী ইসরাঈল সম্পর্কে আলোচনা কর, এতে কোনো দোষ নেই।
নবী করীম (সাঃ)-এর বাণীঃ
(আরবী***********************************************************************)
“তাদেরকে সত্যবাদীও মনে করো না আবার তাদেরকে মিথ্যাবাদীও বলো না”।
আমি বলতেছি যে, কোনো বিষয়ে বিশ্বাস ও নিশ্চয়তা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আহলে কিতাবদের থেকে বর্ণনা করা যাবে। এবং সে সব ক্ষেত্রে যে সব ক্ষেত্রে দ্বীনের ঘনিষ্ঠতা পৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে তা জায়েজ নেই।
এক্ষেত্রে যে সব বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি রাখা ও জানা থাকা আবশ্যক তা হচ্ছে অধিকাংশ ইসরাঈলী বর্ণনা যা তাফসীর গ্রন্থসমূহে ঠেঁসে দেয়া হয়েছে ও ইতিহাস গ্রন্থসমূহে বিবৃত করা হয়েছে ঐগুলো আহলে কিতাবদের আলেমদের থেকে বর্ণিত। শরীয়তের কোনো বিষয়ের ক্ষেত্রে বা আকিদাগত বিশ্বাসগত কোনো ক্ষেত্রে তার উপর নির্ভর করা সঠিক হবে না। অতএব গভীরভাবে চিন্তা করে দেখুন।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বাণীঃ
(আরবী*******************************************************************************)
“যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্যে কোনো জ্ঞান লাভ করল, সে দুনিয়ার কোনো উদ্দেশ্য হাসিলের উদ্দেশ্যে তা শিক্ষা দিলে কেয়ামতের দিন সে জান্নাতের গন্ধও পাবে না”।
আমি বলছি যে, দুনিয়া লাভের উদ্দেশ্য দ্বীনি ইলেম আহরণ করা হারাম এবং যে অসৎ উদ্দেশ্যে তা কাজে লাগাতে ইচ্ছুক তাকে দ্বীনি জ্ঞান শিক্ষা দেয়াও হারাম কয়েক দিক থেকে।
তন্মধ্যেঃ দুনিয়া লাভের উদ্দেশ্যে সে দ্বীনের মধ্যে পরিবর্তন সাধন হতে মুক্ত নয়, বাতেল, জটিল ও কঠিন ব্যাখ্যা দ্বারা। সুতরাং এ জাতীয় ছিদ্রগুলো বন্ধ করা ওয়াজিব –অত্যাবশ্যকীয়।
তন্মধ্যেঃ বেপরোয়াভাবে পবিত্র কুরআন ও হাদীসের অবমাননা করা হবে।
নবী করীম (সাঃ)-এর বাণীঃ
(আরবী***********************************************************************************)
“যে ব্যক্তি কোনো দ্বীনি ইলেম শিক্ষা গ্রহণ করল ও সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়ে তা লুকিয়ে রাখল, কিয়ামতের দিন তাকে আগুনের শিকল পরানো হবে”।
আমি বলছি যে, প্রয়োজনের ক্ষেত্রে ইলেমকে লুকিয়ে রাখা হারাম। কারণ তা অবমাননাকর বড় এবং শরীয়তের আহকাম ভোলার কারণ। আখেরাতের তথা পরকালের পুরস্কারসমূহ ও পারস্পরিক সম্বন্ধের সাথে সম্পর্কিত। মুখে বলা হতে বিরত থাকাই যেহেতু গুনাহ। তার শাস্তি দেয়া হলো তাকে থামিয়ে দেয়া আর তা হবে আগুনের শিকল তথা লাগাম।
নবী করীম (সাঃ)-এর বাণীঃ
(আরবী***********************************************************)
ইলেম তিন প্রকারঃ (১) আয়াতে মুহকামা (২) সুন্নাতে কায়েমা ও (৩) ফরিজায়ে আদেলা। এছাড়া যা কিছু রয়েছে তা বাড়তি বা অতিরিক্ত জ্ঞান।
আমি বলছি যে, এটা লোকদের জন্যে যে জ্ঞানার্জন করা একান্তই কর্তব্য তাসে মীমিত ও মীমাবদ্ধকরণ। অতএব ওয়াজিব হলো- (ক) শাব্দিক দিক থেকে পবিত্র কুরআনকে জানা। বহস ও গবেষণা করে তার মুহকামকে জ্ঞাত হওয়া, তার গুঢ় রহস্য জানা। পবিত্র কুরআনের আয়াতের ও সূরার শানে নুযূল জ্ঞাত হওয়া, তার গুরুত্ব জ্ঞাত হওয়া, নাছেখ ও মানছুখ জ্ঞাত হওয়া। বাকি থাকল মোতাশাবেহগুলো –তার হুকুম মোহকামের দিকে প্রত্যাবর্তনের উপর নির্ভরশীল। (খ) সুন্নাতে কায়েমা বলতে বুঝায় ঐ সব আহকামে শরীয়া ও সুন্নাতে নববীয়াকে যা ইবাদত ও জীবনোপকরণ হিসেবে উপকারি রূপে প্রমাণিত। ইলমে ফিকহ যে সম্পর্কে আলোকপাত করে থাকে। আর কায়েমা বলতে বুঝায় যা মানসুখ তথা রহিত হয়নি। এবং যা পরিত্যাজ্যাও হয়নি, যার রাবী-বর্ণনাকারী কোথাও একজন হয়ে যায়নি এবং জমহুর সাহাবা ও তাবেয়ীগণ যা মেনে চরেছেন, অনুসরণ করেছেন।
তার সর্বোত্তম পর্যায় হলো, যে বিষয়ে মদীনা শরীফ ও কূফা নগীরর ফকীহগণ ঐকমত্য হয়েছেন। আর তার চিহ্ন হলো এর উপর চার মজহাবের ঐকমত্য রয়েছে।
তারপর ঐ স্তর রয়েছে যেগুলোর ক্ষেত্রে জমহুর সাহাবীদের দুটি বা তিনটি মত রয়েছে। আহলে ইলেম ও বিজ্ঞজনদের একদল প্রত্যেক মতের উপর আমল করেছেন। তার প্রমাণ হলো মুয়াত্তায়ে ইমাম মালেক ও আবদুর রাযযাক প্রণীত গ্রন্থাবলির ন্যায় গ্রন্থে যেসব বর্ণনার উল্লেখ রয়েছে।
তাছাড়া অন্যান্যগুলো হলো, কোনো কোনো ফকীহের ইস্তিম্বাত। হতে পারে তা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ বা তাখরিজের মধ্য হতে বা দলির প্রমাণ বা ইস্তিম্বাতের মাধ্যমে এবং তা সুন্নাতে কায়েমার মধ্যে পরিগণিত নয়। (গ) ফরিজাযে আদেলা বলতে বুঝায় ওয়ারিশ তথা উত্তরাধিকারীদের অংশ সংক্রান্ত বিষয়। তার সাথে সম্পৃক্ত হবে বিচার বিভাগীয় বিষয়াদি এবং সে সব বিষয় যেগুলো মুসলমানদের মাঝে বাদানুবাদ এড়িয়ে চলার পথ সুগম করবে।
উপর্যুক্ত তিন প্রকারের জ্ঞানের জ্ঞানী হতে কোনো শহর খালি হওয়া হারাম। কারণ দ্বীন এ জ্ঞানগুলোর উপর নির্ভরশীল। এছাড়া অপর যত জ্ঞান-উলুম রয়েছে সবই হলো অতিরিক্ত জ্ঞানের মধ্যে পরিগণিত।
হেয়ালিপনা ও পহেলিকা করতে হুযুর (সা) নিষেধ করেছেন। হেয়ালীপনা বলতে ঐ সব মাসায়েলকে বুঝায় যেগুলোতে যাকে সে মাসয়ালা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়, সে ভুলে-বিভ্রান্তিতে লিপ্ত হয়ে যায়। এসব মাসয়ালা দ্বারা লোকদের জ্ঞানের গভীরতার পরীক্ষা নেয়া হয়। বেশ কয়েকটি কারণে তা করতে বারণ করা হয়েছে।
তন্মধ্যে রয়েছেঃ এর মাধ্যমে জিজ্ঞাসিত ব্যক্তিকে কষ্ট দেয়া ও অপমানিত করা হয় এবং নিজেকে অহংকারী করা হয় ও গৌরবান্বিত করা হয়।
তন্মধ্যে রয়েছেঃ তা গভীরভাবে মনোনিবেশ করার দ্বারা উন্মোচন করে দেয়। সঠিক তো সেটাই যা সাহাবা ও তাবেয়ীদের নিকট ছিল। (ক) সুন্নাতের প্রকাশ্য দিকের উপরই অবস্থান গ্রহন করবে অথবা প্রকাশ্যের মর্যাদায় তাকে যথেষ্ট মনে করবে। যেমন –ইঙ্গিত (আরবী*********) প্রার্থনা (আরবী*************) এবং অভিপ্রাপ্ত আর অধিক গভীরতায় নিমজ্জিত হবে না। (খ) যতক্ষণ পর্যন্ত কঠিন প্রয়োজন না হবে ও বিশেষ ঘটনা না ঘটবে ততক্ষণ পর্যন্ত ইজতিহাদে প্রবৃত্ত হবে না। তখন আল্লাহ তায়ালা দয়া করে, মেহেরবাণী করে লোকদের জন্য তার জ্ঞানের দ্বার উন্মুক্ত করে দেন। কিন্তু প্রথমেই তার জন্য প্রস্তুতি থাকা চাই। এটা ভুল করার সম্ভাবনাময় জায়গা।
নবী করীম (সাঃ)-এর বাণীঃ
(আরবী**************************************************************************************)
“যে ব্যক্তি কুরআনের অর্থ নিজের মতো করল সে জাহান্নামে তার জায়গা করে নিল”।
আমি বলছি যে, যে ব্যক্তি সে ভাষা সম্পর্কে সম্যক অবগত নয় যে ভাষায় পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে, এবং নবী করীম (সাঃ) হতে ও তাঁর সাহাবাদের হতে তাবেয়ীনদের হতে যেসব রেওয়ায়েত বর্ণিত রয়েছে তা সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞাত নয় সে ব্যক্তির জন্য তাফসীর করার ক্ষেত্রে প্রবেশ করা হারাম। চাই সেটি কোনো কঠিন শব্দের ব্যাখ্যাই হোক, কি শানে নুযূলই হোক, কি নাসেখ ও মানসুখের বিষয়ই হোক।
রাসূল (সাঃ)-এর বাণীঃ
(আরবী***************************************************************************)
“কুরআনে ঝগড়া করা কুফুরী”।
আমি বলছি যে, কুরআনে ঝগড়া করা হারাম। আর তা হলো তার মনের মধ্যে কোনো সন্দেহের বশবর্তী হয়ে কোনো অকাট্য হুকুমকে-বিধানকে অগ্রাহ্য অস্বীকার ও খণ্ডন করা।
রাসূল (সাঃ)-এর বাণীঃ
(আরবী************************************************************************************)
“তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিরা আল্লাহর কিতাবের এক অংশ দ্বারা অপর অংশের (একে অপরের কথা ও মতামতকে) প্রতিহত করা হারাম। তা হলো কোনো ব্যক্তি পবিত্র কুরআনের কোনো এক আয়াত দ্বারা কোনো বিষয়ে দলিল প্রমাণ গ্রহণ করল তো দ্বিতীয় ব্যক্তি অপর আয়াত দ্বারা তা খণ্ডন করে দিল। নিজের মজহাবের প্রমাণ স্বরূপ এবং নিজের সাথীর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের জন্য অথবা কোনো ইমামের মজহাবের সহযোগীতার উদ্দেশ্যে অপর মজহাবের মোকাবেলায়। সে মূলত মূল সত্য প্রকাশের বিষয়ে সাহসী নয়। এমনিভাবে এক সাদীসকে অপর হাদীস দ্বারা খণ্ডন বা প্রতিহত করাও এর অন্তর্ভুক্ত। এরূপঃ
রাসূল (সাঃ)-এর বাণীঃ
(আরবী***************************************************************)
“প্রত্যেক আয়াতের জাহের ও বাতেন, প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য দিক রয়েছে, প্রত্যেকটি আয়াতের একটি বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে”।
আমি বলছি যে, পবিত্র কুরআনের অধিকাংশই আল্লাহ তায়ালার সেফাত, গুণাবলি এবং তাঁর নিদর্শনের বর্ণনা এবং আহকাম, বিধানাবলি, ঘটনা প্রবাহ, কাফেরদের সাথে তর্ক-বিতর্ক এবং জান্নাত ও জাহান্নামের বর্ণনার মাধ্যমে নছিহত তথা উপদেশ প্রদান।
জাহের হলো, যে বিষয়ের বর্ণনার উদ্দেশ্যে আলোচনা আরম্ভ করা হয়েছে সে বিষয়টি ভালোভাবে বুঝানো, হৃদয়ঙ্গম করানো।
আল্লাহর সেফাত তথা গুণাবলির ক্ষেত্রে গোপন ও অপ্রকাশ্য হলো আল্লাহর নেয়ামতসমূহ সম্পর্কে গভীর চিন্তা ও ধ্যান করা এবং সেগুলোকে দৃষ্টির সামনে রাখা। আহকামের তথা বিধানসমূহের আয়াতের ক্ষেত্রে গোপনীয় ও অপ্রকাশ্য হলো ইশারা-ইঙ্গিত ও ইকতিদা দ্বারা আহকাম ইস্তিম্বাত করা। যেমন মহান আল্লাহর এ বাণীঃ
(আরবী******************************************************************************)
“গর্ভধারণ ও শিশু সন্তান প্রসবের সময় হলে ত্রিশ মাস” দ্বারা হযরত আলী (রাঃ)-এর মাসয়ালা ইস্তিম্বাত করা যে গর্ভধারণের সময়সীমা কখনো কখনো ছয় মাসও হয়। মহান আল্লাহর বাণী (আরবী**************) “দু’বছর পরিপূর্ণভাবে” দ্বারা। কিছছা কাহিনী ও ঘটনাবলির ক্ষেত্রে গোপনীয় ও অপ্রকাশ্য হলো সওয়াব, শান্তি ও প্রশংসা ও অপছন্দনীয় হওয়ার ভিত্তি ও কারণগুলো অবগত হওয়া। ওয়াজ তথা উপদেশ গ্রহণের ক্ষেত্রে গোপনীয় ও অপ্রকাশ্য হলো –অন্তর নরম হওয়া, ভয় ও আশার সঞ্চার হওয়া এবং এ জাতীয় বিষয় প্রকাশ পাওয়া।
প্রত্যেক আয়াতের বিশেষ সীমা হলো সে ক্ষমতা ও যোগ্যতা অর্জন তা যার দ্বারা সে বিষয়টি জানা যায়। যেমন ভাষা ও রেওয়ায়াত জ্ঞাত হওয়া ও স্মরণ শক্তির ব্যাপকতা ও বুঝার বিশুদ্ধতা অর্জন।
আল্লাহ তায়ালার বাণীঃ
(আরবী****************************************************************************)
“পবিত্র কুরআনের কিছু আয়াত রয়েছে যার অর্থ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। এ আয়াতগুলো কুরআনের মূল ভিত্তি এবং অন্যান্য আয়াতগুলো মোতাশাবেহ যেগুলোর অর্থ পরিস্কার নয়, রহস্যাবৃত”।
আমি বলছি যে, জাহের তথা প্রকাশ্য হলো মোহকাম ঐ সব আয়াত যাদের একটি মাত্র অর্থ ব্যতীত অন্য কোনো অর্থ গ্রহণের সুযোগ নেই। যেমন পবিত্র কুরআনের আয়াতঃ
(আরবী*********************************************************************************)
“তোমাদের জন্য তোমাদের মা, তোমাদের মেয়ে এবং তোমাদের বোনদেরকে বিবাহ করা হারাম করা হয়েছে”। আর মোতাশাবেহ হলো ঐ সকল আয়াত যার বিভিন্ন অর্থ গ্রহণ করার সুযোগ রয়েছে। যেমন আল্লাহর বাণীঃ
(আরবী*******************************************************************)
“যারা ঈমান রাখে ও সৎকাজ করে তারা যা ভক্ষণ করে তাতে তাদের কোনো পাপ নেই”। কোনো কোনো বক্রচিন্তার লোক যদি মদ্যপানে সীমালঙ্ঘন ও ফাসাদ-গণ্ডগোল ও বিবাদ সৃষ্টি না করে তাহলে তাও হালাল –এ আয়াত হতে এঅর্থ গ্রহণ করেছে। অথচ বিশুদ্ধ ও সঠিক মত হলো মদকে হারামরূপে গ্রহণ করা।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বাণীঃ
(আরবী***************************************************************************************)
“সকল কাজের ফল নিয়তের উপর নির্ভরশীল”।
আমি বলছি যে, নিয়ত হলো ইচ্ছা ও সংকল্প। আর এখানে হাদীস শরীফে তার উদ্দেশ্য হলো মানুষ যা ধারণা করে, কল্পনা-ভাবনা ও চিন্তা করে –তা ব্যক্তিকে সে কাজ করার জন্য উৎসাহ উদ্দীপনা যোগায়। যেমন আল্লাহর নিকট সওয়াব চাওয়া ও আল্লাহর সন্তুষ্টি চাওয়া। হাদীসের অর্থ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ হলো আত্মাকে পরিপাটি ও সুসজ্জিত করার ক্ষেত্রে এবং তার বক্রতা বিদূরণের ক্ষেত্রে আমলের কোনো তাছির নেই, প্রভাব নেই। কিন্তু যখন আমলকারীর ভাবনা ও চিন্তা তার নফস তথা আত্মাকে সুসজ্জিত ও পারিপাটি করা হয় –অভ্যাসগত ভাবে বা কাকেও প্রদর্শনের ইচ্ছা বা কাকেও শোনানোর বা প্রকৃতির ইচ্ছা পূর্ণ করার উদ্দেশ্যে না হয়ে, আত্মাকে সুসজ্জিত করার উদ্দেশ্যে কাজটি করে, তখন তার প্রভাব সৃষ্টি হয়। যেমন যে ব্যক্তি যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে ধৈর্য ধারণ করতে অক্ষম সে বাহাদুর ব্যক্তির যুদ্ধ করা। যদি কাফেরদের সাথে যুদ্ধ সংঘটিত না হয় তাহলে সে মুসলামানদের সাথে যুদ্ধ করে সে শক্তি ক্ষয় করবে। আর তা হলো যেমন রাসূল (সাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল –এক ব্যক্তি যুদ্ধ করে প্রদর্শনের জন্য, আরেক ব্যক্তি যুদ্ধ করে বাহাদুরী দেখানোর জন্য; এদের মাঝে কার যুদ্ধ আল্লাহর পথে? তিনি বললেনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর কালেমাকে বুলন্দ করার জন্য যুদ্ধ করে শুধুমাত্র সেই আল্লাহর পথে যুদ্ধকারী। গুরুত্বপূর্ণ কথা হলোঃ এক্ষেত্রে অন্তরের ইচ্ছা আমলের প্রাণ স্বরূপ। আর আমল ইচ্ছার মুখচ্ছবি তথা চিত্র।
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বাণীঃ
(আরবী*******************************************************************************)
“হালাল স্পষ্ট এবং হারামও স্পষ্ট, এদের উভয়ের মাঝে রয়েছে সন্দেহপূর্ণ বিষয়াবলি, যে ব্যক্তি সন্দেহপূর্ণ বিষয়গুলো হতে বেঁচে থাকল নিঃসন্দেহে সে দ্বীনকে পবিত্র করল ও নিজের ইজ্জত, সম্মান, সুনাম, সুখ্যাতি রক্ষা করল”।
আমি বলছি যে, কখনো কখনো মাসয়ালার ক্ষেত্রে বিপরীত দুটি দিক দেখা দেয়, তখন সুন্নাত নববীই হয় তা হতে রক্ষাকারী ও সাবধানকারী।
এসব বিপরীত বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছেঃ (ক) উভয় বর্ণনা সরাসরি একটি অপরটির থেকে ভিন্ন বিপরীত। যেমন লিঙ্গ স্পর্শ করার বিষয়টি। এতে কি অযু ভঙ্গ হবে? কেউ তার বিপরীত বিয়ষটাকে প্রমাণিত করেছে। (কেউ বলেছে এতে অযু ভেঙ্গে যাবে, কেউ বলেছে অযু ভঙ্গ হবে না) প্রত্যেকের মতের পক্ষে হাদীস দলীল হিসেবে বিদ্যমান রয়েছে এবং যেমন মোহরেমের (যার সাথে বিবাহ বৈধ নয়) সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার বিষয়টি। একদল তাকে জায়েজ বলেছেন; অপর দল তাকে নিষিদ্ধ বলেছেন। এক্ষেত্রে রেওয়ায়েত মোখতালেফ তথা ভিন্ন ধরনের হয়েছে।
(খ) এক্ষেত্রে ব্যবহৃত শব্দটির কোনো নির্ধারিত অর্থ নেই। কোনো উপমা দ্বারা অর্থ বুঝা যায়। কোনো সীমিত অর্থ ও সংজ্ঞা দ্বারা তার অর্থ বুঝা যায় না। এ ক্ষেত্রে তিনটি অবস্থা দেখা দেয়ঃ
(১) যে ব্যাপারে ইয়াকিনীভাবে শব্দটির ব্যবহার হয়। (২) যে ব্যাপারে শব্দটির ইয়াকিনী ব্যবহার হয় না। (৩) এ ব্যাপারে শব্দটির ব্যবহার ঠিক কি বেঠিক তা জানা নেই।
(গ) বৈপরীত্যের অপর ধরনটি হলো হুকুমটি মোয়াল্লাফ তথা দোদুল্যমান হবে কোনো একটি কারণ বা উদ্দেশ্যের সাথে দৃঢ়তার সাথে গ্রহণ করা যাবে না। কোনো এক ব্যাপারে এমন হবে যে, উদ্দেশ্যের সাথে দৃঢ়তার প্রত্যয় পাওয়া যাবে না কিন্তু তার কারণ পাওয়া যাবে। যেমন কোনো ব্যক্তির নিকট হতে ক্রয়কৃত দাসীর সাথে যৌন মিলনের বিষয়টি। এক্ষেত্রে তকি তা হতে বিরত থাকবে, কি থাকবে না? এ জাতয়ি বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে এহতিয়াত তথা সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বাণীঃ
(আরবী*******************************************************************************)
“পবিত্র কুরআন পাঁচভাবে অবতীর্ণ হয়েছে –(১) হালাল (২) হারাম (৩) মোহকাম (৪) মোতাশাবেহ (৫) উপমাসমূহ।
আমি বলছি যে, এগুলো পবিত্র কুরআনের তথা আল্লাহর কিতাবের বিধানের প্রকার যদিও বিভিন্নভাবে শ্রেণীবিন্যাস হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে কোনো বৈপরীত্য নেই এটা সন্দেহাতীত। অতঃপর হুকুম কখনো হালাল হয় আবার কখনো হয় হারাম (অর্থাৎ এতদুভয় কখনো একত্রিত হতে পারে না)।
ইসলামের মূলনীতি হলোঃ মোতাশাবেহ আয়াত ও হাদীসগুলোর প্রতি গভীরভাবে মনোনিবেশ না করা। আর সে সব মোতাশাবেহাতের মধ্যে অনেক বস্তুই রয়ছে। এক্ষেতে একথা জানা যায় না যে, এক্ষেত্রে তার হাকিকী অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে, নাকি হাকিকী অর্থের নিকট রূপক অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে। এ সবই হচ্ছে সেসব ক্ষেত্রে যেক্ষেত্রে উম্মতের ঐকমত্য হয়নি এবং তা হতে শোবা-সন্দেহ নিরসণ করা হয়নি। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।