যাকাতের নিসাবও পরিমাণ সুন্নাত কর্তৃক নির্ধারিত
যে সব ধন-মালে যাকাত ফরয হয়, তার পূর্ণ বিবরণ সুন্নাতে উদ্ধৃত হয়েছে। প্রতিটির নিসাব অর্থাৎ কত পরিমাণের হলে যাকাত ফরয হবে এবং কোন্ জিনিসে যাকাতের পরিমাণ কত, তা বিস্তারিতভাবেবলে দেয়া হয়েছে। উপরন্তু যাকাত বাবদ লব্ধ সম্পদ কোন্ কোন্ খাতে ব্যয় করা হবে, কোন্ কোন্ ধরনের লোক তা পাবে, তার মৌল কথা কুরআনের আয়াতে বলা হলেও তার বিস্তারিত আলোচনা সুন্নাতে পাওয়া যায়। আমরাও এ গ্রন্থে সে পর্যায়ে যথাস্থানে বিস্তারিত আলোচনা উপস্থাপিত করব। এখানে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য হল, সুনির্দিষ্ট নিসাব ও পরিমাণসহ যাকাতে ফরয হওয়ার ইতিহাস।
আমরা জানতে পেরেছি যে, নিঃশর্ত ও পরিমাণ-অনির্ধারিত যাকাত মক্কী পর্যায়েই ফরয হয়েছে। বহু সংখ্যক ফকীহ ইমামও মত দিয়েছেন। কুরআনের আয়াত ও রাসূলের হাদীসের ভিত্তিতে তা-ই প্রমাণিত হয়। মাদানী সূরার আয়অতে ফরয যাকাতের উপর তাকীদ এসেছে, তার কোন কোন আইন ও বিধান বিস্তারিতভাবে বলে দিয়েছে। নিসাব, যাকাতের পরিমাণ ও তার সীমা-শর্ত উপস্থাপিত করেছে। এখানে অবশ্য প্রশ্ন উঠে এ সব নির্ধারণ হিজরতের পর কখন এবং কোন্ সনে সুসম্পন্ন হয়েছে।
সকলের জানা ও প্রসিদ্ধ কথা হচ্ছে, হিজরতের দ্বিতীয় বছরেই তা ফরয হয়েছে—রমযানের রোযা ফরয হওয়ার পূর্বে। সা’দ ইবনে উবাদা বর্ণিত হাদীস থেকেও তা-ই প্রমাণিতহয়।
তিনি বলেন:
(আরবী*********)
রাসূলে করীম (স) যাকাত সংক্রান্ত হুকুম নাযিল হওয়ার পূর্বে ‘সাদকায়ে ফিতর’ দেয়ার জন্যে আমাদের আদেশ করেছিলেন। যাকাত ফরয হওয়ার কথা নাযিল হয়েছে তার পরে।
হাফেয ইবনে হাজার বলেছেন, এ হাদীসটির সনদ সহীহ্। তা প্রমাণ করে যে, ‘সাদকায়ে ফিতর’ ফরয হয়েছে যাকাত ফরয হওয়ার পূর্বে। কাজেই তা রমযানের রোযা ফরয হওয়ার পরেই হয়ে থাকবে। [(আরবী*********)] আর বিশেষজ্ঞগণ এ বিষয়ে সম্পূর্ণ একমত যে, রমযানের রোযা ফরয হয়েছিল হিজরতের পর। কেননা যে আয়াত এ ফরয ঘোষণা করেছে, তা সর্বসম্মতভাবেই মদীনায় অবতীর্ণ।
ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর দৃঢ়তা সহকারে লিখেছেন: যাকাত ফরয হয়েছে হিজরতের নয় বছর পর। সা’লাবা ইবনে হাতিব সংক্রান্ত ঘটনা থেকেওএ কথার সমর্থন মেলে। তাতে বলা হয়েছে: ‘সাদকা’র যাকাতের আয়াত নাযিল হলে নবী করীম(স) তা আদায় করার উদ্দেশ্যে কর্মচারী পাঠালেন। সে গিয়ে বলল: ‘এটা জিযিয়া ছাড়া কিছু নয়, তা জিযিয়ার বোন।’ জিযিয়া ওয়াজিব হয়েছে নবমহিজরী সনে। অতএব যাকাত ফরয হয়েছে এ নবম হিজরীতে, একথা বলতে হয়।
‘ফতহুল বারী’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, এ হাদীসটি যয়ীফ। এটাকে দলীল হিসেবে পেশ করা (গ্রহণ করা) যায় না। [(আরবী*********)-৭৭ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, হাদীসটি খুব বেশী যয়ীফ।]
হাফেয ইবনে হাজার বলেছেন: যাকাত ফরয হওয়ার ব্যাপারটি ঘটে নবম হিজরী সনের পূর্বে। জিমাম ইবনে মা’লাবাত সংক্রান্ত একটি হাদীস হযরত আনাস থেকে বুখারী ও মুসলিমে উদ্ধৃত হয়েছে। তিনি এসে নবী করীম (স)-কে নানা বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলেন এবং রাসূয়ে করীম (স) যেসব প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন, তন্মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল:
“আল্লাহ কি আপনাকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, আপনি আমাদের মধ্যকার ধনী লোকদের কাছ থেকে এ সাদকা (যাকাত) গ্রহণ করবেন তা আমাদের মধ্যকার দরিদ্রের মধ্যে মন্টন করবেন?”
নবী করীম (স) এর জবাবে বললেন: “হ্যাঁ।
এ জিমাম রাসূলে করীম (স)-এর কাছে হিজরী পঞ্চম সনে এসেছিলেন ও তখন এই প্রশ্নোত্তর হয়েছিল্ তবে যাকাত আদায়ের জন্যে কর্মচারী প্রেরণের ব্যাপারটি নবম হিজরী সনেই সংঘটিত হয়েছিল। তাহলে তার পূর্বেই যাকাত ফরয হওয়া আবশ্যক হয়ে পড়ে।
সূরা তাওবার পূর্বোদ্ধৃত আয়াত (আরবী*********)-টি লোভী লোকদের লোভ নিবারণের উদ্দেশ্যে নাযিল হয়েছিল। তারা ছিল মুনাফিক, তারা রাসূলে করীম (স)-এর সাদকা বন্টনের ব্যাপার নিয়ে তাঁকে নানাভাবে অভিযুক্ত করেছিল—এ আয়াতটি প্রমাণ করে যে, যাকাত কার্যকর ও কায়েম ছিল তার পূর্ব থেকেই। আর রাসূল (স) তার সংগ্রহ বন্টনের জন্যে দায়িত্বশীল ছিলেন। তা যে আয়াতটির নাযিল হওয়ার পূর্ব থেকেই চলে আসা ব্যাপার এটা নিঃসন্দেহে।
রোযার পরই যাকাত
হাদীস সমষ্টি থেকে এবং ইসলামী আইন প্রণয়নের ইতিহাস দৃষ্টে আমাদের কাছে স্পষ্ট প্রতিভাত যে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযই মুসলিমদের প্রতি সর্বপ্রথম ফরয হয়েছিল। আর তা হয়েছিল মক্কা শরীফে মি’রাযের পরই। অতঃপর মদীনায় হিজরতের দ্বিতীয বছর রমযানের রোযা ফরয হয়। সেই সাথে করা হয় ফিতরার যাকাত; ফরয রোযাদারের বেহুদা কাজ—ইত্যাদি থেকে তাকে পবিত্র রাখার ব্যবস্থাস্বরূপ এবং ঈদের দিনে গরীব-মিসকীনের দরিদ্র্য-মুক্তি বিধানের উদ্দেশ্যে।তার পরে ধন-মালের যাকাত ফরয ঘোষিত হয় নিসাব ও পরিমাণ নির্ধারণ সহ। অবশ্য এই নির্ধারণ ঠিক কোন্ সনে হয় তা আমরা নির্দিষ্টভাবে বলতে পারছি না। আর জিমাম ইবনে মা’লাবাতা রাসূলের কাছে উপস্থিত হয়েছিলেন পঞ্চম হিজরী সনে। সেখানকার কথাবার্তা ও প্রশ্নত্তোর থেকে একথা অকাট্যভাবে জানা যায় যে, তাঁর আগমনের পূর্ব থেকেই যাকাত সুপরিচিত ফরয হিসেবে সমাজে চালূ ও কার্যকর ছিল।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা)-থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন:
আল্লাহ তা’আলা তাঁর নবীকে পাঠিয়েছেন ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ কালেমার সাক্ষ্যসহ। লোকেরা যখন তা গ্রহণ করে নিল, তাদের জন্যে নামায ফরয করা হল। তা-ও যখন তারা পালন করতেলাগল, তখন রোযা ফরয করা হল। তাকে যখন তারা সত্যরূপে গ্রহণ করে নিল, তখনতাদের উপর যাকাত ফরয করা হল। তা মেনে নেয়ার পর হজ্জ ফরয করাহল। তারপর ফরয করা হল জিহাদ। অতঃপর তাদের জন্যে আল্লাহ্ তা’আলা দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলেন। বললেন:
(আরবী*********)
আজকের দিনে তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করেদিলাম। সম্পূর্ণ করে দিলাম তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত। আর তোমাদের দ্বীন হিসেবে ইসলামকে মনোনীত করলাম।
ইবনে আকীল (***) গ্রন্থে লিখেছেন:
(আরবী*********)
যাকাত ফরয হয়েছে রোযা ফরয হওয়ার পর—।
যাকাত ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ
নবী করীম (স) মদীনা শরীফে যাকাত ফরয হওয়া সম্পর্কে তাকীদ করেছেন, দ্বীন-ইসলামেতার স্থান ও গুরুত্ব স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তাঁর ব্যাখ্যানুযায়ীই তা দ্বীন-ইসলামের অন্যতম মৌল স্তম্ভ। তিনি তা আদায় করার জন্যে উৎসাহ দিয়েছেন, দিতে যারা অস্বীকার করে তাদের জন্যে সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছেন, বহু সংখ্যক হাদীসের মাধ্যমে বিভিন্ন পদ্ধতি ও ভঙ্গীতে। প্রখ্যাত ‘হাদীসে জিবরীলে’ উদ্ধৃত হয়েছে, তিনি জিজ্ঞেস করলেন: ‘ইসলাম কি?” রাসূলে করীম (স) জবাবে বললেন, “ইসলাম হচ্ছে তুমি সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসুল। তুমি নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে, রমযান মাসের রোযা রাখবে এবং আল্লাহর ঘরের হজ্জ করবে যদি তার সামর্থ্য তোমার থাকে।” (বুখারী, মুসলিম)
হযরত ইবনে উমর (রা) বর্ণিত প্রখ্যাত হাদীসের বক্তব্য হল: ‘ইসলাম পাঁচটি জিনিসের উপর ভিত্তিশীল। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র সাক্ষ্যদান, নামায কায়েম করা, যাকাত দেয়া, রমযানের রোযা রাখা, সামর্থ্য থাকলে আল্লাহর ঘরের হজ্জ করা।’ (বুখারী, মুসলিম)
উপরোক্ত হাদীস দুটির মাধ্যমে নবী করীম(স) ঘোষণা করেছেন—(এ পর্যায়ে আরও বহু সংখ্যক হাদীস রয়েছে): ইসলামের ‘রুকন’ –স্তম্ভ পাঁচটি। তার প্রথমহল, দুটি কথার সাক্ষ্য দান। দ্বিতীয় হল নামায এবং তৃতীয যাকাত।
অতএব বলা যায়, কুরআন যেমন, হাদীসেও তেমনি যাকাত হচ্ছে ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ। এটা না হলে ইসলামের ভিত্তিই রচিত হতে পারে না। ইসলাম এ কয়টির উপরই প্রতিষ্ঠিত।
অবশ্য রাসূলে করীম(স) কখনও কখনও পাঁচটির পরিবর্ত দুটি বা তিনটিরও উল্লেখ করেছেন। কিন্তু নামায ও যাকাতের উল্লেখ সর্বত্রিই হয়েছে কথার সূচনা-স্বরূপ। এই দুটির প্রতিই লোকদের আহ্বান জানিয়েছেন, মুসলমানের কাছ থেকে বায়’আত গ্রহণ করেছেন প্রধানত এ দুটির উপরই।
বুখারী-মুসলিমে উদ্ধৃত হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে, নবী করীম (স) হযরত মুআয ইবনে জাবাল (রা)-কে ইয়েমেনে প্রেরণকালে বলেছিলেন:
[ইমাম শাওকানী লিখেছেন: এটা দশ হিজরীর ঘটনা, রাসূলের বিদায় হজ্জের পূর্বের। কারো মতে তা ছিল নবমসনের ঘটনা, তবুক যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তন কালে। কেউ বলেছেন, তা ছিল মক্সা বিজয়ের বছরের ঘটনা। তবে এ ব্যাপারে পূর্ণ ঐকমত্য রয়েছে যে, হযরত মুআয হযরত আবূ বকরের খিলাফতকাল পর্যন্ত ইয়েমেনে অবস্থান করেছেন। ইবনে আব্দুল বার-এর মতে তিনি ছিলেন বিচারপতি। আর নাসায়ীল মতে তিনি ছিলেন গভর্ণর।]
তুমি আহলে-কিতাবের একটা জাতির কাছে যাবে [ওসীয়ত বা উপদেশের গুরুত্ব বোঝাবার জন্যে একথা বলেছিলেন, যেন তার গুরুত্ব তিনি অনুধাবন করেন। কেননা তদানীন্তন ‘আহলে কিতাব’ মোটা-মুটি শিক্ষিত লোক ছিল। তাই তিনি যেন তাদের সাথে তেমনভাবে কথা না বলেন, যেমন মূর্খ লোকদের সাথে বলা হয়।] তাদের তুমি দাওয়াত দেবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ও মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ সাক্ষ্যদানের জন্যে। তারা যদি তা মেনে নেয়, তাহলে তাদের জানাবে যে, আল্লাহ্ তাদের উপর ফরয করেছেনদিন-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামায। তা-ও তারা মেনে নিলে তাদের জানাবে, আল্লাহ তা’আলা তাদের উপর ‘সাদকা’ (যাকাত) ফরয করে দিয়েছেন, যা তাদের ধনীদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হবে এবং তাদেরই গরীবদের মধ্যে বন্টন করা হবে। [কেবল (****) গরীব লোকদেরই উল্লেখ করা হয়েছে অথচ যাকাত ব্যয়েল খাত (****) রয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, তখন ওরাই ছিল বেশী সংখ্যক।] তারা এ কথাও মেনে নিলে পর তোমাকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, যেন তাদের ধন-মালের উত্তম অংশই তুমি নিয়ে নাও, আর মজলুমের ফরিয়াদকে অবশ্যই ভয় করবে। কেননা তার ও আল্লাহ্র মাঝে কোন আবরণ বা অন্তরাল নেই।
এই ভাষণে নবী করীম (স) নামায ও যাকাত উল্লেখ করাকেই যথেষ্ট মনে করেছেন। কেননা শরীয়াতে প্রকৃতপক্ষে এ দুটির উপরই সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। বিশেষ করে ইসলামের দিকে লোকদের দাওয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে এটাই করা হয়েছে। কুরআন ও সুন্নাহ্তে ঈমানের সাক্ষ্যের পর এ দুটির উল্লেখ অবশ্যই পাওয়া যাবে। যেমন আল্লাহ্ নিজেই বলেছেন:
(আরবী*******)
তারা যদি তওবা করে, নামায কায়েম করে ও যাকাত দেয়, তবে তারা তোমাদের দ্বীনী ভাই।
উপরের হাদীসটি থেকে একথা প্রমাণিত হয় যে, যাকাত সংগ্রহ ও বণ্টনের জন্যে নবী করীম(স) দায়িত্বশীল কর্মচারী নিযুক্ত করেছিলেন। যাকাতের বিশেষত্ব হচ্ছে, তা আদায় করে নিতে হবে, সংগ্রহ করতে হবে। ব্যক্তিদের উপর তা ছেড়ে দেয়া যাবেনা। রাসূলের প্রতি যাকাত গ্রহণের যে নির্দেশ কুরআনের আয়াতে এসেছে, এখানে তার সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে।
বুখারীতে হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ থেকে উদ্ধৃত হয়েছে, তিনি বলেছেন:
(আরবী*********)
আমি রাসূলের হাতে বায়’আত করেছি নামায কায়েম করা, যাকাত দেয়া ও প্রত্যেক মুসলিমের জন্যে কল্যাণ কামনার উপর।
বুখারী-মুসলিমে হযরত উমর (রা) থেকে উদ্ধৃত হয়েছে, রাসূলে করীম (স) বলেছেন:
(আরবী*********)
আমি আদিষ্ট হয়েছি এ জন্যে যে, আমি যুদ্ধ করব লোকদের সাথে যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ ছাড়া কেউ ইলাহ নেই, মুহাম্মাদদ আল্লাহ্র রাসূল, নামায কায়েমকরবে এবং যাকাত দেবে।
এখানে ‘লোকদের’ বলতে সেসব মূর্তি পূজারী আরবদের বুঝিয়েছেন, যারা চুক্তি ভঙ্গ করেছে ও সীমালংঘন করেছে এবং যাতের সাথে সন্ধি করার আর কোন পথ থাকেনি। কেননা আসলেতাদের কোন ধর্ম ছিল না যা বিলীন করা যেত, কোন আইন-বিধান ছিল না, যা তাদের সুশৃংখলিত করতে পারত। তাদের শাসকও কেউ ছিলনা, যার কথা তারা মানতে প্রস্তুত হতে পারে। এদিকে আল্লাহ তা’আলা আরব জমীনকে ইসলামে হেরেম ও কেন্দ্রভূমি বানাবার ইচ্ছা করেছিলেন। এ কারণে দেশটিকে শিরকের ময়লা থেকে পবিত্র করার এবং এই ভূমির জনগণকে জাহিলিয়াতের অন্ধকার থেকে মুক্ত করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।
হযরত আনাস (রা) বলেছৈন, রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করেছেন:
(আরবী*********)
আল্লাহর প্রতি পরম আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা, তাঁর মুক্ত ইবাদত নামায কায়েম ও যাকাত দিতে থাকা অবস্থায় যে লোক দুনিয়া ত্যাগ করল সে আল্লাহর সন্তুষ্টি প্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবেই দুনিয়া ছেড়ে গেল।
হযরত আনাস (রা) বলেছেন: আল্লাহ এ দ্বীন নিয়েই নবী-রসূলগণ এসেছেন এবং আল্লাহর পক্ষথেকে তা প্রচার করেছেন, ঘটনা-দুর্ঘটনার উত্তেজনা ও ইচ্ছা-বাসনার বিভিন্নতা সৃষ্টির পূর্বে। আল্লাহ্র কিতাবের সর্বশেষ অবীর্ণ আয়াতে তার সমর্থন রয়েছে। বলেছেন, ‘তারা যদি তওবা করে, নামায কায়েম করে ও যাকাত দেয়, তাহলে তাদের পথ উন্মুক্ত করে দাও।’ বলেছেন, ‘মূর্তিপূজা পরিহার করা, একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা, নামায কায়েম করা ও যাকাত দেয়াই হচ্ছে তাদের তওবা।’ অবর এক আয়াতে বলেছেন: ‘তারা যদি তওবা করে, নামায কায়েমকরে ও যাকাত দেয় তাহলে তারা তোমাদের দ্বীনী ভাই।’
যাকাত না দেয়ায় কঠোর আযাবের ভয় প্রদর্শন
অপরাপর বহু কয়টি হাদীসে নবী করীম(স) যাকাত দিতে অস্বীকারী লোকদের পরকালীন কঠিন আযাবের ভয় দেখিয়েছেন। এরূপ ভয় প্রদর্শনের মূলে চেতনাহীন মন-মানসে চেতনা সৃষ্টি এবং লোভী ওস্বার্থপর মানুষকে দানশীল বানানোর উদ্দেশ্য নিহিত ছিল। তিনি উৎসাহদানের ও ভয় প্রদর্শনের মাধ্যমে লোকদেরকে কর্তব্য পালনে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। জানিয়ে দিয়েছিলেন, কর্তব্য পালনে অবহেলা করলে আইনের চাবুক ও তরবারির ঝংকার তাদের প্রকম্পিত করবে।
পরকালীন আযাব
বুখারী শরীফে হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে, নবী করীম(স) বলেছেন:
(আরবী*********)
আল্লাহ যাকে ধন-মাল দিয়েছেন, সে যদি তার যাকাত আদায় না করে, তাহলে কিয়ামতের দিন তা একটি বিষধর অজগরের—যার দুই চোখের উপর দুটি কালো চিহ্ন রয়েছে—রূপ ধারণ করবে। বলবে, আমিই তোমারধন-মাল, আমিই তোমার সঞ্চয়। অতঃপর নবী করীম (স) এ আয়াতটি পাঠ করলেন: ‘যারা আল্লাহর দেয়া ধন-মালে কার্পণ্য করেত তারা যেন মনে করে না যে, তাদের জন্যে তা মঙ্গলময় বরং তা তাদের জন্যে খুবই খারাপ। তারা যে মাল দিয়ে কার্পণ্য করছে তা-ই কিয়ামতের দিন তাদের গলার বেড়ি হবে।
ইমাম মুসলিম তারই বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। নবী করীম(স) ইরশাদ করেছেন:
(আরবী*********)
স্বর্ণ ও রৌপ্যের যে মালিকই তার উপর ধার্য হক আদায় করে দেবে না, কিয়ামতের দিন সেগুলোকে তার পাশ্বে ঝুলন্ত অবস্থায় রেখে দেয়া হবে। পরে তার উপর জাহান্নামের আগুনে তাপ দেয়া হবে, সেই উত্তপ্ত বস্তু দ্বারা তার পার্শ্ব, ললাট ও পৃষ্টে দাগ দেয়া হবে; সেইদিন-যার সময়কাল পঞ্চাশ বছর হাজার বছরের সমান দীর্ঘ। শেষ পর্যন্ত লোকদের মধ্যে চূড়ান্ত ফয়সালা করা হবে। পরে তাকে তার পথ দেখানো হবে। হয় জান্নাতের দিকে নতুবা জাহান্নামের দিকে। গরু বা ছাগলের মালিকও যদি তার উপর ধার্য হক আদায় না করে, তাহলে কিয়ামতেরদিন তা নিয়ে আসা হবে, সেগুলো নিজেদের দুভাগে বিভক্ত পায়ের খুর দিয়ে মালিককে লাথি মারবে এবং তার শিং দ্বারা তাকে গুঁতোবে যখনই তার উপর অপরটি এসে যাবে, প্রথমটি প্রত্যাহার করা হবে। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্ তা’আলা কিয়ামতের দিন তার বন্দীদের মধ্যে চূড়ান্ত ফয়সালা করবেন, যে দিনের সময়-কাল তোমাদের গণনামতে পঞ্চাশ হাজার বছরকালের সমান। পরে তাকে তার পথ দেখানো হবে, হয় জান্নাতের দিকে, নয় জাহান্নামের দিকে।
যাকাত না দেয়ার বৈষয়িক শাস্তি
রাসূলের সুন্নাত যাকাত দিতে অস্বীকারকারীদের জন্যে কেবল পরকালীণ আযাবের ভয় দেখিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি, বৈষয়িক শাস্তির কথাও বলিষ্ঠভাবে বলা হয়েছে। সে শাস্তি যেমসন শরীয়াতসম্মত, তেমনি পরিণামগত।তা প্রযোজ্য হবে এমন সব ব্যক্তির, যে তার মালে ধার্য আল্লাহ্র ও ফকীরের হক আদায় করে দিতে কার্পণ্য করবে।
পরিণামগত শাস্তি- যা উচ্চতর মূল্য লাভে সক্ষম হবে। এ পর্যায়ে নবী করীম (স) বলেছেন: ‘যে লোকেরা যাকাত দিতে অস্বীকার করবে, আল্লাহ তাদের কুঠিন ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষে নিমজ্জিত করে দেবেন। [(আরবী*********) এ হাদীসের বর্ণনাকারীগণ সিকাহ্, হাকেম ও বায়হাকীতে হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন। তাঁরা অতিরিক্ত কথা নকল করেছেন (আরবী*********)-যে জাতি যাকাত দেয় না, তাদের উপর বৃষ্টিপাত বন্ধ করে দেয়া হয়। হাকেম বলেছেন, মুসলিমের শর্তানুযায়ী হাদীসটি সহীহ্।]
দ্বিতীয় একটি হাদীসে বলা হয়েছে: ‘ওরা ওদের ধন-মালের যাকাত দিতে অস্বীকার করে আকাশ থেকে বৃষ্টিপাতকে বন্ধ করিয়েছে মাত্র। তারপরও অবশ্য কেবল জন্তু জানোয়ারের কারণেই বৃষ্টিপাত হয়। (ইবনে মাজা, বাজ্জার, বায়হাকী)
অপর একটি হাদীসের কথা হল: যাকাত যে মালের সাথে মিশ্রিত হয়ে থাকবে, তা অবশ্যই বিপর্যয় হবে। (বাজ্জার, বায়হাকী)
এ হাদীসটির দুটি অর্থ হতে পারে:
প্রথম, সাদকা অর্থাৎ যাকাত কোন ধন-মালের মধ্যে রেখে দেয়া হলে তা হিসেব করে মূল ধন-মাল থেকে বিচ্ছিন্ন ও আলাদা করে না হলে তা-ই সেই ধন-মালের ধ্বংস ও বিপর্যস্ত হয়ে যাওয়অর কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
অপর একটি হাদীসের বক্তব্যেও এ কথার সমর্থন পাওয়া যায়। তাতে বলা হয়েছে:
(আরবী*********)
স্থল ও জলভাগে ধন-মাল বিনষ্ট হয় শুধু যাকাত আটকে রাখার দরুন। [তাবরানী বলেছেন, উমর ইবনে হারুন নামক বর্ণনাকারী ‘যয়ীফ’।]
দ্বিতীয়, এক ব্যক্তির যাকাত গ্রহণ করে- যদিও সে যাকাতের মুখাপেক্ষী বা এর উপর নির্ভরশীল নয়। সে এ কাজ করে তার নিজের ধন-মালের সঙ্গে যাকাতকেও ধ্বংস ও বিনষ্ট করে।
ইমাম আহমদ হাদীসটির এই ব্যাখ্যাই দিয়েছেন।
যাকাত দিতে অস্বীকারকারীর শরীয়াতসম্মত শাস্তি
যাকাত দিতে অস্বীকারকারীর জন্য একটা শরীয়াতসম্মত শাস্তিও রয়েছে। প্রশাসক বা রাষ্ট্রপ্রধানই এ শাস্তি দানের জন্যে দায়িত্বশীল। নবী করমি(স) যাকাত পর্যায়ে বলেছেন:
(আরবী*********)
যে লোক সওয়াব পাওয়ার আশায় যাকাত দিয়ে দেবে, সে তার সওয়াব অবশ্যই পাবে। আর যে তা দিতে নারায হবে, আমি তা অবশ্যই গ্রহণ করব তার ধন-মালের অংশ থেকে। তা হচ্ছে আমাদের রব্ বহু সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তের অন্যতম। মুহাম্মাদ (স)-এর বংশের লোকদের পক্ষেতা থেকে কিছু গ্রহণ করা হালাল নয়। [বায়হাকী এ হাদীসটি বর্ণনা করে লিখেছেন। আবূ দাউদও তা উদ্ধৃত করেছেন। বুখারী ও মুসলিম উদ্ধৃত করেন নি। কেননা বর্ণনাকারী মুআবিয়া ইবনে হায়দাতা দুর্বল।]
এ হাদীসটিতে যাকাত পর্যায়ের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ মৌলনীতি বলে দেয়া হয়েছে। সেগুলো হলো:
এক, যাকাত সম্পর্কে আসল কথা হল, মুসলিম ব্যক্তি তা দেবে সওয়াব পাওয়ার নিয়তে ও আশায়। সে সওয়াব মহান আল্লাহ্র কাছ থেকেই পাওয়া যাবে, এই দৃঢ় প্রত্যয় পোষণ করবে সে। কেননা সে তো তা দিয়ে আল্লাহর নির্ধারিত ইবাদত পালন করছে মাত্র। কাজেই যে তা করবে, সে তার সওয়াব—শুভ কর্মফল অবশ্যই পাবে। আল্লাহ্র কাছে তা-ই তার ইবাদতের চূড়ান্ত প্রতিফল।
দুই, যে লোক কার্পণ্য, লেঅভ-লালসা ও পার্থিব প্রেমে অন্ধ হয়ে পড়বে ও যাকাত দিতে অস্বীকার করবে, তাকে সে অবস্থায় থাকবার সুযোগ দেয়া যাবে না। তার কাছ থেকে তা জোরপূর্বক আদায় করতে হবে। সে জোর আসবে শরীয়াতের সার্বভৌমত্বের বলে। রাষ্ট্রই এই শক্তি প্রয়োগ করবে। তখন তার যাকাতের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবেএবং শাস্তি ও দণ্ডস্বরূপ তার অর্ধেক ধন-মাল নিয়ে নেয়া হবে। কেননা সে তার ধন-মালে আল্লাহর নির্ধারিত হককে গোপন ও অস্বীকার করছে। তা অন্যদের জন্যেও শিক্ষামূলক হবে। ফলে আর কেউ যাকাত অস্বীকৃতির পথে অগ্রসর হবে না।
বলা হয়েছে, ইসলামের সূচনাকালে এরূপ শাস্তিদানের ব্যবস্থা চালূ ছিল। কিন্তু উত্তরকালে তা বাতিল হয়ে যায়। [শীরাজী তাঁর গ্রন্থ (*****) –এ এই কথার উল্লেখ করেছেন।] কিন্তু এ কথার কোন দলীল বা প্রমাণ নেই। কেবল সম্ভাব্যতার ভিত্তিতে এই ধরনের কোন কথা বলাও যুক্তিসঙ্গত নয়। আমি মনেকরি, এরূপ কোন শাস্তির ব্যবস্থা করা রাষ্ট্র পরিচালকের ইচ্ছার উপর ন্যস্ত। যেখানেই দেখা যাকে লোকেরা যাকাত অস্বীকৃতিতে চরম সীমায় পৌঁছে গেছে, সেখানেই তা কার্যকর করা যাবে। কেননা এই কাজ থেকে তাদের বিরত রাখার বিকল্প কোন পন্থা নেই। আমরা ‘যাকাত আদায়’ আলোচনায় এ পর্যায়ে বিস্তারিত কথা বলব।
তিন. যাকাত আদায়ে এরূপ কঠোরতা ও দৃঢ়তা অবলম্বনের কারণ হচ্ছে সমাজের গরীব ও মিসকীনদের অধিকার আদায়ের দায়িত্বের বাধ্যবাধকতা। কেননা আল্লাহ্ই তাদের জন্যে যাকাত ফরয করেছেন। তা তাদের প্রাপ্য। কিন্তু নবী করীম (স) এবং তাঁর বংশের লোকদের জন্যে এই যাকাতে কোন অংশ নেই। তাদের পক্ষে এ থেকে একবিন্দু গ্রহণ করাও হালাল নয়। এটি ‘সাদকা’ সম্পর্কে ইয়াহুদীদের অবলম্বিত নতিরও বিরোধী। কেননা তথায় যাকাতরে দশমাংশ হযরত হারুন নবীর বংশধরদের জন্যে নির্দিষ্ট ছিল। আর অপর একটি অংশ ধর্মীয় পদাধিকারী লোকদের জন্যে নির্দিষ্ট ছিল। [আবুল হাসান নধবী লিখিত (আরবী******) দ্রষ্টব্য।]
যাকাত আদায়ে অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ
যাকাত দিতে অস্বীকারকারী লোকদের শাস্তিদান পর্যায়ে ইসলাম কোন জরিমানা ধরনের ব্যবস্থা চালু করেনি বা তাছাড়াও ভিন্ন ধরনের শাস্তির প্রয়োগ থেকে বিরত রয়েছে। বরং যাকাত দিতে অস্বীকারকারী শক্তি ও দাপট সম্পন্ন বিদ্রোহী প্রতিটি দল বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে তরবারি ব্যবহার ও যুদ্ধ ঘোষণাকেই ওয়াজিব করে দিয়েছেন। এ পথে নরহত্যা ও রক্তের বন্যা প্রবাহিত করাকেও বিন্দু মাত্র পরোয়া করা হয়নি। কেননা অধিকার রক্ষা ও আদায়ের উদ্দেশ্যে যে রক্তপাত করা হয়, তা কখনই নিষ্ফল যায় না। আল্লাহ্র পথে—পৃথিবীতে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় যে প্রাণ দান করা হয়, তা কখনই মরে না, কখনই মরতে পারে না।
এ কথঅটি আমাদের সম্মুখে প্রকট হয়ে দেখা দেয়, যখন আমরা সত্যের জন্যে আর্লাহর বিধান কার্যকর করার উদ্দেশ্যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অবলম্বনকারী ঈমানদার লেঅকদের প্রতি দৃষ্টিপাত করি। তাদের ছাড়া অন্যান্য যেসব লোক আল্লাহ ও রাসূলের নাফরমানী করেছে, তাদের ধন-মালের ধার্য আল্লাহ্র হক আদায় করতে অস্বীকার করেছে, তাদের উপর অর্পিত আমানত রক্ষায় যত্নবান হয়নি, তারা নিষ্ফল ও অন্যায়ভাবেই রক্ত দিয়েছে, প্রাণ বিসর্জন করেছে। যার প্রতি সম্মান প্রদর্শন ছিল তাদের কর্তব্যই তারই উপর তারা বিপরীতভাবে হস্তক্ষেপ করেছে। তাদের জান ও মালের নিরাপত্তার যা ছিল ভিত্তি, তারা নিজেরাই তাকে চূর্ণ করেছে।
বস্তুত যাকাত দিতে অস্বীকারকারী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার যৌক্তিকতা ও প্রয়োজনীয়তা বহু সংখ্যক সহীহ্ হাদীস দ্বারা মেযন প্রমাণিত, তেমনি এর উপর সাহাবায়ে কিরামের ঐকমত্য (ইজমা)-ও কায়েম হয়েছে।
বস্তুত যাকাত দিতে অস্বীকারকারী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার যৌক্তিকতা ও প্রয়োজনীয়তা বহু সংখ্যক সহীহ্ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত, তেমনি এর উপর সাহাবায়ে কিরামের ঐকমত্য (ইজমা)-ও কায়েমহয়েছে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) থেকে বুখারী মুসলিমে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছে। নবী করীম(স) ঘোষণা করেছেন:
(আরবী*********)
লোকদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে আমি আদিষ্ট হয়েছি, যতক্ষণ না তারা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র সাক্ষ্য দেবে, নামাযকায়েমকরবে ও যাকাত দেবে। তারা যদি তা করে, তাহলে তাদের রক্ত আমার কাছ থেকে নিরাপত্তা পেয়ে গেল—তবে ইসলামের অধিকার আদায়ের জন্যে কিছু করার প্রয়োজন হলে ভিন্ন কথা। আর তার হিসাব-নিকাশ গ্রহণ আল্লাহ্র কর্তৃত্বাধীন।
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, নবী করমি(স) বলেছেন: আমাকে আদেশ করা হয়েছে লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যতক্ষণ না তারা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র সাক্ষ্য দেবে, আমার ও আমি যে দ্বীন নিয়ে এসেছি তার প্রতি ঈমান আনবে। তারা তা করলে তাদের রক্ত ও ধন-মাল আমার কাছ থেকে নিরাপত্তা লাভ করবে। তবে তার হক আদায়ের জন্যে কিচু করার প্রয়োজন হলে ভিন্ন কথা। তাদের হিসাব আল্লাহ্র কাছে।
ইমাম বুখারী, মুসলিম এবং নাসায়ী এ হাদীসটি নিজ নিজ গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন। মুসলিম ও নাসায়ী হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ্ থেকেও এ রকমের হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। [(আরবী*********)]
এসব হাদীস অকাট্যভাবে প্রমাণ করেছে যে, যাকাত দিতে অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে এবং তা চালিয়ে যেতে হবে যতক্ষণ না তারা তাদিয়ে দেয়। বাহ্যত মনে হয়, হযরত আবূ বকর (রা) ও হযরত উমর (রা)-এর কাছে এরূপ স্পষ্ট বলিষ্টভাষার হাদীস পৌঁছায়নি; [তা অসম্ভব বা অস্বাভাবিকও কিছু নয়, কেননা কোন কোন সাহাবী হয়ত একটা হাদীস শুনেছেন, অন্যরা তা শুনেন নি।] পৌছালেতাঁরা ইসলামের নামায-রোযা ইত্যাদি শরীয়াতী বিধান পালনে প্রস্তুতলোকেরাযাকাত দিতে অস্বীকৃত হলে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যাবে কি না, তা নিয়ে সেরূপ কথোপকথনে প্রবৃত্ত হতেন না, যা তাঁরা করেছিলেন।
ঐতিহাসিক তথ্য সর্বজনবিদিত যে, রাসূলের প্রথম খলীফার আমলে আরবেরবিভিন্ন গোত্র যাকাত দিতে অস্বীকার করে। যদিও তারা নামায-রোযা পালনে প্রস্তুত ছিল। মুসায়লাম কায্যাব, সাজাহ্ ও তুলায়হা প্রভৃতি মিথ্যা নবুওয়ত দাবিকারী এবং তাদের লোকজন তাদের নীতিকে প্রবল সমর্থন জানায়।
এ পর্যায়ে হযরত আবূ বকর (রা)-এর ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক ও অনন্য। তিনি দৈহিক ইবাদাত—নামায এবং আর্থিক ইবাদত—যাকাত এর মধ্যে কোনরূপ বিচ্ছিন্নতা বা পার্থক্যকে বরদাশত করতে ও মেনে নিতে প্রস্তুত হনন নি। এর কোন একটির প্রতি একবিন্দু উপেক্ষাও তাঁর সহ্য হতে পারে নি। কেননা তাঁর পূর্বে রাসূলের যামানায় তার করা সম্ভব ছিল না। একটা ছোট ছাগল বা উষ্ট্র বাঁধার একটা রজ্জুর ক্ষেত্রেও নয়।
এ পর্যায়ে মহান সাহাবী হযরত আবূ হুরায়রা (রা)-র বর্ণনা এখানে অবশ্যই উদ্ধৃত করতে হবে। তা থেকে প্রকৃত পরিস্থিতি িস্পষ্ট হয়ে উঠবে। তিনি বলেন:
নবী করীম (স) যখন ইন্তিকাল করলেন, তখন হযরত আবূ বকর (রা) খলীফা হলেন। এ সময় আরবের কিছু লোক কুফরী অবলম্বন করে। তখন হযরত উমর (রা) বললেন: আপনি কি করে এ লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন? অথচ রাসূলে করীম(স) বলেছৈন: আমি লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আদিষ্ট হয়েছি, যতক্ষন না তারা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র সাক্ষ্য দেবে। তারা যদি তা বলে, তাহলে তাদের রক্ত ও ধন-মাল আমার কাছে রক্ষা পাবে। তবে তার হক্ রক্ষার জন্যে কিছু করতে হলে ভিন্ন কথা। আর তাদের হিসাব আল্লাহর উপর ন্যস্ত!
তখন হযরত আবূ বকর (রা) জবাবে বললেন:
(আরবী***********)
আল্লাহ্র শপথ; আমি অবশ্যিই যুদ্ধ করব সেই লোকের বিরুদ্ধে, যে নামায ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য করবে। কেননা যাকাত হল ধন-মালেল হক। আল্লাহ্র কসম, ওরা যদি একটা উষ্ট্রও দিতে অস্বীকার করে, যা রাসূল (স)-এর যামানায় তারা দিত, তা হলে আমি তাদের এই অস্বীকৃতির কারণে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব।
এ কথা শুনে হযরত উমর (রা) উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন:
(আরবী**********)
আল্লাহ্র শপথ! এ আর কিছু নয়, আর্লাহ্ই আবূ বকরের অন্তরকে যুদ্ধের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। আমি বুঝতে পেরেছি, এটাই সত্য ও সঠিক সিদ্ধান্ত।
হযরত উমর (রা) প্রথমে বাহ্যিক কথার মধ্যেই জড়িত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি কথার শেষ দিকটার দিকে লক্ষ্য দেন নি এবং তার শর্তসমূহও অনুধাবন করেন নি। তিনি মনে করেছিলেন কালেমা সিলামে দাখিল হলেই বুঝি ব্যক্তির রক্ত ও ধন-মাল নিরাপত্তা পেয়ে যেতে পারে। সাধারণ কতিপয় হাদীস থেকে যদিও এ কথাই বোঝা যায় কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তা সত্য নয়।
হযরত আবূ বকর (রা)-এর যুক্তির দুটি দিক:
একটি, হাদীসটির মূল বক্তব্য, যার সাথে এ নিরাপত্তার শর্ত যুক্ত করা হয়েছে, তা হল (****) তবে তার হক রক্ষার জন্যে কিছু করতে হলে ভিন্ন কথা।’ আর যাকাত হচ্ছে ধন-মালের হক্। এ হক রক্ষার জন্যে যুদ্ধও করা যাবে। এ কথা হযরত উমর (রা) ও অন্যরা অস্বীকার করতে পারে না।
দ্বিতীয়টি, যাকাতকে নামাযের মতই মনে করতে হবে। কেননা তা নামাযেরই ‘বোন’। কুরআন ও সুন্নাতে এ দুটি এক সঙ্গে ও পাশাপাশি উদ্ধৃত হয়েছে সর্বত্র।
হযরত আবূ বকর (রা) দলীল পেশ করেছেন, তা থেকে মনে হয়, হযরত উমর (রা) ও অন্যান্য সাহাবা প্রকাশ্যে নামায অস্বীকারকারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত ছিলেন। এটা ঐকমত্যের ক্ষেত্রে। পরে মতদ্বৈধতার বিষয়টিকে ঐকমত্যে নিয়ে আসা হয়। হযরত উমরের নিকট হযরত আবূ বকরের অভিমত সত্য বলে স্থিতি লাভ করে। তিনি তা নির্ভুল মনে করেন এবং যাকাত অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ঘোষিত যুদ্ধকে তিনি মনে প্রাণে মেনেও নেন। তার উপরোদ্ধৃত স্বতঃস্ফূর্ত স্বীকৃতি থেকেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠে।
রাসূলে করীম (স)-এর পর যে সব আরব গোত্র যাকাত দিতে অস্বীকার করে বসে, তাদের ব্যাপার প্রথম খলীফার অনুসৃত নীতি ছিল এই। সকল সাহাবায়ে কিরাম (রা) তাঁর এ নীতি অকুন্ঠিতভাবে সমর্থন করেন এবং যুদ্ধে শরীক হন। এমনকি প্রথমে এ ব্যাপারে যাঁর মনে সংশয় জেগেছিল তিনিও। এ থেকে যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ব্যাপারে সম্পূর্ণ ঐকমত্য (ইজমা) প্রতিষ্ঠি হল। ইসলামী শরীয়াতে এ ইজমা একটা অন্যতম দলীল। এ প্রেক্ষিতে ইমাম নববী লিখেছেন: এক ব্যক্তি বা একটা জনগোষ্ঠী যদি যাকাত দিতে অস্বীকৃত হয়, যুদ্ধ করতেও তারা রাযী না হয়, তবুও তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা রাষ্ট্রপ্রধানের কর্তব্য। হযরত আবূ হুরায়রা (রা)-র কথা থেকে এরই সমর্থন পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন: প্রথমদিকে সাহাবায়ে কিরাম যাকাত দিতে অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ব্যাপারে বিভিন্ন মত পোষণ করতেন। কিন্তু যখন হযরত আবূ বকর (রা) যখন যুদ্ধের পক্ষে মত ব্যক্ত করন, তাঁর দলিলও তিনি সকলের সমক্ষে পেশ করেন, তখন এ মতের যৌক্তিকতা সকলের কাছে প্রতিভাত হয়ে ওঠে। তখন সকলেই তা মেনে নেন এবং সর্বসম্মতভাবে এ যুদ্ধ কার্যকর হয়। [(আরবী************)]
সম্ভবত ইতিহাসে হযরত আবূ বকর (রা) পরিচালিত ইসলামী রাষ্ট্রই সর্বপ্রথম দরিদ্র, মিসকীন ও সমাজের দুর্বল ব্যক্তিদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায় করার উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করে। সমাজের শক্তিমান লোকেরা দীর্ঘদিন পর্যন্ত এদেরই শোষণ করে আসছিল। কিন্তু তারা কোন শাসকের কাছে এর প্রতিকার পায় নি। ধনী ও শক্তিমানদের কাতার ছেড়ে দুর্বলদের পক্ষেদাঁড়াতে এ পর্যন্ত কেউই রাযী হয়নি। কিন্তু হযরত আবূ বকর (রা) ও তাঁর সঙ্গী-সাথী সাহাবিগণ যাকাত দিতে অস্বীকারকারী লোকদের সৃষ্ট সংশয়ে বিভ্রান্ত হতে রাযী হননি। তাঁরা অকুণ্ঠ চিত্তে সেইযুদ্ধ করে দরিদ্রের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
যাকাত অস্বীকারকারীরা কুরআনেরই (সূরা তাওবা) আয়াত: (আরবী***********) দিয়েই এই বিভ্রান্তির জাল বিস্তার করেছিল। তাদের বক্তব্য ছিল, এ নির্দেশ তো বিশেষভাবে নবী করীম(স)-এর প্রতি। তিনি ছাড়া অন্য কারো প্রতি এই নির্দেশ ছিল না এবং অন্য কেউ সেই যাকাত আদায় করার অধিকারও পেতে পারে না। ফলে রাসূল (স)-এর ইন্তিকালের সাথে সাথেই যাকাত দেয়ার বাধ্যবাধকতাও নিঃশেষ হয়ে গেছে। তারা আরও বলেছিল যে, “রাসূলে করীম (ষ) আমাদের কাছ থেকে যাকাত নিয়ে তার বিনিময়ে আমাদরে দিতেন পবিত্রকরণ ও বিশুদ্ধকরণ কাজ। আমাদরে জন্যে তিনি রহমতের দোয়া করতেন। আর তাঁর দোয়া বঞ্চিত হয়ে গেছি। কিন্তু তাদের এ ধারণা ছিল মারাত্মক বিভ্রান্তিপ্রসূত, একটা ভিত্তিহীন সংশয়মূলক ব্যাপার। কাযী আবূ বকর ইবনুল আরাবী তাই লিখেছেন যে, কুরআনের ব্যাপারে এরূপ ধারণা মূর্খ লোকদের মনেই জাগতে পারে, যে লোক শরীয়াতের উৎস সম্পর্কে স্পষ্ট জ্ঞান থেকে বঞ্চিত। অথবা যে লোক দ্বীন নিয়ে খেল-তামাশায় অভ্যস্ত, দৃষ্টি সংকীর্ণ। [(আরবী***********)]
তার কারণ এই যে, উপরিউক্ত আয়াতে স্পষ্টত নির্দেশ যদিও রাসূলেকরীম (স)-এর প্রতি ছিল কিন্তু আসলে এই নির্দেশ সব রাষ্ট্র পরিচালকদের প্রতিই- যারা মুসলিম উম্মতের উপর কর্তৃত্বসম্পন্ন হয়। এ আয়াতটির সম্বোধন সেই বিশেষ সম্বোধন নয়, যেরূপ নিম্নে এ আয়াতটির রয়েছে:
(আরবী***********)
হে নব, িআমরা তোমার জন্যে তোমার স্ত্রীদের হালাল করে দিয়েছি।
অথবা (আরবী***********)
রাতের বেলা তুমি তাহাজ্জুদ পড়, তোমার জন্যে তা নফল।
এ দুটি আয়াতেই সম্বোধন বিশেষভাবে রাসূলে করীম (স)-এর প্রতি। অন্য কারোর প্রতি নয়।
ইমাম খাত্তাবী লিখেছেন: কুরআন মজীদের সম্বোধন তিন প্রকারের- একটি সম্বোধন সাধারণ, যার সম্মুকে সাধারণ লোকজন রয়েছে। যেমন:
(আরবী***********)
হে ঈমানদার লোকেরা। তোমরা যখন নামাদের জন্যে প্রস্তুতি নেবে, তখন তোমরা দৌত করবে তোমাদের মুখমন্ডল…
দ্বিতীয় প্রকারের সম্বোধন বিশেষভাবে রাসূলে করীম(স)-এর প্রতি। তাতে অন্য কেউই শরীক নেই। এ ধরনের সম্বোধন বিশেষ একটা স্পষ্ট লক্ষণ থাকে, অন্য কারো না হওয়ার কথা নিঃসন্দেহে বোঝা যায়। যেমন:
(আরবী***********)
রাতের বেলা তাহাজ্জুদের নামায পড় এটা তোমার জন্যে নফল।
অথবা (আরবী***********)
একান্তভাবে তোমার জন্যে, মু’মিনদের ছাড়াই।
তৃতীয় এক প্রকারের সম্বোধন যদিও রাসূলে করীম (স)-কে লক্ষ্য করেই হয়েছে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনিসহ গোটা মুসলিম উম্মত শামিল রয়েছে।
যেমন আল্লাহ্ বলেছেন: (আরবী***********)
নামায কায়েম কর সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়া সময় থেকে শুরু করে রাত্রি আচ্ছন্ন হওয়ার সময় পর্যন্ত….।
অথবা (আরবী***********)
যখন তুমি কুরআন পাঠ করবে, আল্লাহর নামে পানা চাইবে-
এ নির্দেশসমূহ বাহ্যত রাসূলের প্রতি হলেও তা সকলেরই পালনীয়। যাকাত সম্পর্কিত আয়াত: (আরবী***********) টিও এ পর্যায়ের এবং এ সম্বোধনও বাহ্যত রাসূলের প্রতিহলেও তা সাধারণভাবে সব মুসলিমকেই পালন করতে হবে। কেবল রাসূলই তা পালনে বাধ্য নন। এই ধরনের সম্বোধনে একটা বিশেষ ফায়দা নিহিত আছে। প্রথমত তিনিই দ্বীনের আহ্বানকারী- আল্লাহর দিকে। আল্লাহর কথার মুল বক্তব্যের ব্যাখ্যাদাতা তিনিই। কাজেই এ ধরনের নির্দেশ তাঁকে সম্বোধন করা হলে দ্বীনের শরীয়অত প্রথমে তাঁরই দ্বারা পালিত হবে এবং তাঁর দেখানো পদ্ধতিতে গোটা উম্মতই তা পালন করতে সমর্থ হবে।
যাকাত অমান্যকারীরা বলেছৈ যে, রাসূলে করীম (স) যাকাত নিতেন, আর তার বদলে তিনি আমাদরে পবিত্র-পরিশুদ্ধ করতেন, আমাদের জন্য দোয়া করতেন- অন্য কারো কাছ থেকে পাওয়া যাবে না, এটা একটা ভিত্তিহীন কথা। কেননা এই পবিত্রকরণ ও পরিশুদ্ধকরণ যাকাতের মাধ্যমেই সম্পনন হয়। কাজেই তা রাসূলের বেলয় যেমন, তাঁর পরে অন্যদের বেলায়ও ঠিক তেমনিভাবেই সম্পন্ন হতে থাকবে। রাসূল ছাড়া অন্যদের মাধ্যমে তা হবে না, এমন কথা নয়।
তাদের জন্যে দোয়ার ব্যাপারটিও অনুরূপ। যিনিই লোকদের কাছ থেকে যাকাত গ্রহণ করবেন—তিনি রাষ্ট্রপ্রধান হোন, কি তাঁর ভারপ্রাপ্ত প্রতিনিধি—তিনি যাকাতদাতাদের ধন-মালে বরকত ও শুভ-প্রতিফলের জন্য দোয়া করতে আদিষ্ট। আর এই দোয়াতেই ধন-মালের মালিকের জন্যে সান্ত্বনা নিহিত রয়েছে। এভাবেই কার্য ও কারণে আল্লাহর বিধান সামঞ্জস্য বিধান সম্ভব। এ এক সাধারণ ব্যাপার, রাসূল (স)-এর জন্যে বিশেষভাবে নির্দিষ্ট নয়। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, রাসূল (স)-এর দোয়ার মর্যাদা সর্বোচ্চ এবং তার তাসীরও মনে প্রাণে অনেক ব্যাপক ও গভর যার তুলনা হয় না।
এ দিকে দৃষ্টি রেখে বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন: যাকাতদাতার জন্যে রাসূল (স)-এর পবিত্রকরণ পরিশুদ্ধকরণ ও দোয়া সবই পাওয়া যাবে আল্লাহ্ ও রাসূল (স)-এর আনুগত্য করার মাধ্যমে। নবীর জীবদ্দশায় নেক আমলের যে সওয়াব নির্ধারিত ছিল, তাই চিরদিনই কার্যকর থাকবে, কোনদিনই তা ফুরিয়ে যাবে না। [দেখুন (আরবী***********) অথবা (আরবী***********)]
হযরত আবূ বকর (রা)-এর বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহ করেছিল, এরা তাদের একটা গোষ্ঠী। তাদের পন্থায় বিদ্রোহকারী আরো ছিল। তারা নিঃসন্দেহে প্রকাশ্যে কুফরী অবলম্বন করেছিল। নবুয়্যাত মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। মুসায়লামা, কায্যাব প্রভৃতি নবুয়্যাতের মিথ্যা দাবিকারীদের সহায়তা করেছিল। নামায ও যাকাত সমান ও অভিন্নভাবে ফরয হওয়ার কথা তারা অস্বীকার করেছিল।
দ্বীন-ইসলামেযাকাতের গুরুত্ব
অতঃপর দ্বীন-ইসলামে যাকাতরে গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা পর্যায়ে আলোচনা আবশ্যক। ইসলামের অন্যতম ‘রুকন’ বা স্তম্ভ হচ্ছে যাকাত। এ কথা বিশেষ ও সাধারণ সকলেই জানেন। যাকাত যে ফরয, তা বার বার আবৃত্ত কুরআনের আয়াতে স্পষ্ট ঘোষণার দ্বারা প্রমাণিত। নবীর ‘মুতাওয়াতির’ সুন্নাত দ্বারা প্রমাণিত। পুর্বের ও পরের গোটা উমএতর লোকদের সামষ্টিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে তা অস্বীকৃত। যুগের পর যু- বংশের পর বংশের মাধ্যমে তা প্রচলিত ও প্রতিপালিত।
[করআন, সুন্নাহ ও ইজমা ছাড়া নিতান্ত বিবেক-বুদ্ধির বিচারেও যাকাত ফরয প্রমাণিত। অবশ্য এ বিবেক-বুদ্ধি ঈমানদার লোকের-বেঈমানের নয়। ঈমানদার ব্যক্তিমাত্রই আল্লাহর ন্যা বিচার ও সৃষ্টির প্রতি তাঁর অফুরন্ত রহমতের কথা বিশ্বাস করে। অন্তত তিনটি দিক দিয়ে বিবেচনা করা চলে: (১) যাকাত দিলে গরীব, মিসকীন, অক্ষমের সাহয্য হয়। তা পেয়ে তারা আল্লাহ্র নেক বান্দার দায়িত্ব পালন করে বেঁচে থাকার সুযোগ পেতে পারে। আল্লাহর ধার্যকৃত ফরয আদায় করার যোগ্যতা হয় তাদের; (২) যাকাত আদায়কারীর মন-অন্তর পবিত্র করে, পাপের গ্লানি ও মলিনতা থেকে পরিচ্ছন্ন করে। তার চরিত্রকে দানশীলতা গুণে বিভুষিত করে। সে কার্পণ্য ও লোভ-লালসা থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারে। যদিও মানুষ স্বভাবগতভাবেই লোভী ও স্বার্থপর। যাকাত দেয়ার ফলে তার মধ্যে বদান্যতা ও মহানুভবতা জেগে ওঠে। আমানত সমূহ আদায় করতে অভ্যস্ত হয়। পাওনাদারদের পাওনা ও হকদারদের হক দিয়ে দিতে প্রস্তুত হয়। আর (৩) আল্লাহ্ তা’আলা ধনী লোকদের নিয়ামত দিয়েছেন, নানা ধন-সম্পত্তি ও মর্যাদায় ভূসিত করেছেন। প্রয়োজনের তুলনায় বেশী ধন-মাল দিয়েছেন। সে তা দিয়ে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্য সহকার জীবন-যাপন করে। এ জন্যে তার শোকর আদায় করা কর্তব্য। যাকাত দিয়ে সে এ শোকর আদায়ের সুযোগ পায়।]
যাকাত অমান্যকারী কাফির
ইসলামী শরীয়াতে যাকাত ফরয হওয়ার ব্যাপারটি এতই গুরুত্বপূর্ণ বলে আলিমগণ বলেছেন যে, লোক তা অস্বীকার করবে, তার ফয হওয়াকে অমান্য করবে, সে অবশ্যই কাফির হয়ে যাবে এবং ধনুক থেকে তীর যেমন করে বের হয়ে যায়, সেও ঠিক তেমনিভাবে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাবে।
ইমাম নববী বলেছেন: যাকাত দেয়া ফরয একথা স্বীকার করে কেউ যদি তা দিতে অস্বীকার করে, তাহলে দেখতে হবে সে কি নও-মুসলি হিসেবে এ সম্পর্কে এখনও জানতে পারে নি বলে তা করছে কিংবা সমাজসভ্যতা থেকে বহু দূরে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার কারণে এরূপ মনোভাব পোষণ করছে? যদি তা হয়, তাহলে তাকে কাফির বলা যাবে না। তখন তাকে ভালোভাবে জানাতে ও বোঝাতে হবে এবং এরপর তার কাছ থেকে যাকাত নিয়ে নিতে হবে। তখন দিতে অস্বীকার করলে অবশ্যই তাকে কাফির বলতে হবে।
যদি লোকটি এমন হয় যে প্রকৃত ব্যাপার তার কাছে প্রচ্ছন্ন থাকতে পারে না। যেমন মুসলিম সমাজে মিলেমিশে বসবাসকারী মুসলমান; সে যদি তা অস্বীকার করে, তা হলে যে নির্ঘাত কাফির বলে গণ্য হবে। তার উপর মুরতাদ হওয়ার শাস্তি কার্যকর হবে। প্রথমে তাকে তওবা করতে বলা হবে এবং তওবা না করলেতাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। কেননা যাকাত ফরয হওয়ার ব্যাপারটি সর্বজনবিদিত, তা দ্বীন-ইসলামের অবিচ্ছিন্ন অঙ্গ। কাজেই তা অস্বীকার করা হলে আল্লাহকে অস্বীকার করা হয়। রাসূলকেও অমান্য করা হয়। অতএব তাদের কাফির হওয়ার কোনেই সন্দেহ থাকে না। ইবনে কুদামা প্রমুখ বড় বড় ফিকাহ্বিদেরও এই মত। [আরবী*************]
শরীয়াতের এই সুস্পষ্ট, বলিষ্ঠ ও ঐকমত্য ভিত্তিক সিদ্ধান্তের আলোকেই আমরা সেসব লোক সম্পর্কে ধারণা করতে পারি, যারা যাকাতকে অবহেলা ও উপেক্ষার চোখে দেখে এবং বলে, “তা এ যুগের উপযুক্তনয়” তারা নাকি আবার মুসলমান। মুসলিম বংশের সন্তান এবং মুসলিম জাহানের প্রাণকেন্দ্রে লালিত-পালিত। প্রকৃতপক্ষে এটা সুস্পষ্ট মুরতাদ হওয়ার কাজ, যদিও তাদের শাসনের জন্যে আবূ বকরের মত খলীফা নেই। [আবুল হাসান নদভী লিখিত এক পুস্তিকা।]
ইসলামের যাকাত ও অন্যান্য ধর্মের যাকাতের মধ্যে পার্থক্য
দ্বীন-ইসলামে যাকাত ফরয হওয়া ও তার স্থান বা মর্যাদা সম্পর্কে কুরআন, সুনআহ ও ইজমা’র ভিত্তিতে বিস্তারিত আলোচনা পেশ করা হল। এক্ষণে আমরা এ ফরযকে কেন্দ্র করে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিচার-বিচেনা সংক্ষিপ্ত আকারে পেশ করতে পারি। এ পর্যায়ে প্রথম কথা হল, প্রাচীণ ধর্মসমূহ দরিদ্র ও অক্ষমলোকদের প্রতি যে করুণা ও অনুগ্রহ তুলনা করা চলে না। এখানে কয়েকটি দিক দিয়ে আমাদের বক্তব্য পেশ করা হচ্ছে:
এক. ইসলামে যাকাত কখনই একটা নিছক নেক কাজ বা খুব ভালো অভ্যাসের ব্যাপা ছিল না। তা সব সময়ই ইসলামের একটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ ‘রুকন’ রূপে গণ্য। তা ইসলামের এক তুলনাহীন অবদান। চারটি প্রধান ইবাদতের অন্যতম হচ্ছে এই যাকাত।তা দিতে অস্বীকার করা চিরকালই ফিস্ক—ইসলামের সীমালংঘন বলে চিহ্নিত। তার ফরযিয়াত অস্বীকার করাকে কুফর বলা হয়েছে। এটা কোন ইচ্ছামূলক নেক কাজ বা অনুগ্রহ বিশেষ কোন দিনই ছিল না। আর এটি নফল সাদ্কাও নয়। বরং এটা বড় ফরয কাজ, অতীব উচ্চমানের, নৈতিক ও ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা পর্যায়ে গণ্য।
দুই. ইসলামের দৃষ্টিতে তা ধনীদের ধন-মালে গরীবদের সুনির্দিষ্ট হক। ধন-মালের প্রকৃত মালিক মহান আল্লাহ্ই এ হক নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। তাঁর বান্দাদের মধ্যে যারাই খলীফা হবে, তাদের কর্তব্য করে দেয়া হয়েছে তা আদায় ও বন্টন করা। তারা হচ্ছে যাকাতরে ভাণ্ডারী। এ কারণে তাতে গরীবদের উপর ধনীদের অনুগ্রহ হওয়ার কোন ভাবধারাই নেই। কেননা ধন-ভাণ্ডারের আসল মালিকের নির্দেশে তার কোন অংশ কাউকে দিলে তাতে ভাণ্ডারী বা বন্টন কারীর অনুগ্রহের কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না।
তিন. এ ‘হক’ সুপরিজ্ঞাত। ইসলামী শরীয়াতই তার ‘নিসাব’ ও পরিমাণ সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে। এর সীমা ও শর্তও তার নির্ধারিত। কখনতা দিতে বা আদায় করতে হবে, তার পন্থা ও নিয়ম কি, এই সব কিছুইআগে থেকে বলে দেয়া। প্রতিটি মুসলিমই জানে তার দলিল ও প্রমাণ।
চার. এই অধিকরটি ব্যক্তিদের মনের ভাল-না-লাগার উপর ছেড়ে দেয়া হয় নি। তা সংগ্রহ বা আদায় করা ন্যায়নীতির ভিত্তিতে এবং বন্টন করা ইনসাফের নীতি অনুযায়ী সরকারের উপর অর্পিত দায়িত্ব। আর তা করা হবে এই কাজে নিযুক্ত বিশেষ কর্মচারীর মাধ্যমেএবং কর্তৃপক্ষ ধার্যকৃত করের মতই তা আদায় করা হবে। এই কারণে কুরআনর ‘তাদের-ধন-মাল থেকে সাদ্কা গ্রহণ কর।’—এ নির্দেশেরব্যাখ্যায় সুন্নাত বলেছে: ‘তা গ্রহণ করা হবে ধনীদের কাছ থেকে।’
পাঁচ. এই ফরয কাজ করতে অর্থাৎ যাকাত দিতে অস্বীকারকারী প্রত্যেকব্যক্তিকেই সরকার শাস্তি দেবে। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সে শাস্তি মালিকের অর্ধেক সম্পদ নিয়ে নেয়া পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। যেমন হাদীসে বলা হয়েছে রাসূলের কথা—“আমি তা গ্রহণ করবই এবং তার সম্পদের অর্ধেক।”
ছয়. এই ফরয আদায়ে যে প্রভাবশালী জনগোষ্ঠীই বিদ্রোহ করবে, মুসরমানদের রাষ্ট্রপ্রধানের কর্তব্য হল তার বিরুদ্ধে প্রবল বিক্রমে যুদ্ধ করা। যতক্ষণ না তাদের ধন-মাল থেকে আল্লাহ নির্ধারিত গরীবদের হক দিয়ে দিতে প্রস্তুত হয়। সহীহ্তম হাদীসসমূহ িএকথা স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে। ইসলামের প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর (রা) তাঁর সঙ্গী-সাথী, সাহাবায়ে কিরাম বাস্তবে তা-ই করছেন।
সাত. মুসলিম ব্যক্তি এই ফরয আদায় করার জন্যে আদিষ্ট- রাষ্ট্র ও সরকার বা সমাজ-সংস্থা যদি তাআদায় করার কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ নাও করে। কেননা এই ফরযটি প্রথমেতো একটা বড় ইবাদত, যা পালন করে মুসলিম ব্যক্তি আল্লাহ্র নৈকট্য অর্জন করতে পারে এবং স্বীয় মন-মানসিকতা ও ধন-মাল পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করতে পারে। কাজেই রাষ্ট্র সরকার তার দাবি না করলেও তার ঈমান ও কুরআন তার প্রতি এজন্যে তাকীদ করছে। অতএব শরীয়াতের বিধান অনুযায়ী তাকে তা অবশ্যই আদায় করতে হবে।
আট. যাকাত বাবদ সংগ্রহীত সম্পদ শাসক-প্রশাসকদের খামখেয়ালীর ওপর ছেড়ে দেয়া যায় না। ইয়াহুদী সমাজে যেরূপ করা হয়েছিল। বরং পাওয়ার অধিকারী নয় এমন লোভী লোকদের লোভ-লালসা বা খেয়াল-খুশি অনুযায়ীও তা যথেচ্ছ ব্যয়-ব্যবহার করা যেতে পারে না। এজন্যে ইসলামতার সীমা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে এবং পাওনাদারদের তালিকাও স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে। যেমন কুরআনের আয়াত—নিঃসন্দেহে যাকতা-সাদকাত হচ্ছে গরীব ও মিসকীনদের জন্যে। হাদীসেও তার স্পষ্ট ও সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা রয়েছে। লোকেরা তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জানতে পেরেছে যে, এখানে ধন-সম্পদ সংগ্রহ করাটাই সমস্যা নয়, তার ব্যয়-বন্টনটাও অতি বড় সমস্যা। এই কারণে নবী করীম (স) ঘোষণা করেছিলেন যে, আমার ও আমার বংশের লোকদের জন্যে তাতে কিছু নেই। তা প্রতিটি এলাকার সমাজের ধনী লোকদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হবে এবং সেই সমাজেরই গরীবদের মধ্যে বন্টন করা হবে।”
নয়. গরীবদের উপস্থিত প্রয়োজন পূরণ কিংবাতাদের সাময়িক দৈন্য-দুর্দশা বিদূরণের জন্যে এইযাকাত কোন বাদান্যতার ব্যাপার নয়। তা দারিদ্র্য ও দৈন্যের ব্যবদান করা গ্রাসের মুখে ছেড়ে দিলেই চলবে না। আসলে তার লক্ষ্য হচ্ছে দারিদ্র্যের উপর চূড়ান্ত আঘাত হানা, দরিদ্রদেরকে দারিদ্র্য থেকে চিরমুক্তির ব্যবস্থা করা।তাদের জীবনথেকে অভাব তাড়নার মূলোৎপাটন করা, জীবিকার ক্ষেত্রে তাদের স্বাধীনভাবে বিচরণ করার যোগ্য করে তোলা। কেননা এ একটি নিয়মিত আবর্তনশীল কর্তব্য। গরীবদের জৈবিক মেরুদণ্ড শক্ত ও সোজা করে দেয়া তার কাজ। ‘যাকাত ব্যয়ের ক্ষেত্র’ পর্যায়ে আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
দশ. কুরআন নির্ধারিত ও সুন্নাহ কর্তৃক বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যাকৃত যাকাত ব্যয়ের ক্ষেত্রসমূহের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে স্পষ্ট মনে হয়, তা দিয়ে বহু সংখ্যক আত্মিক, নৈতিক, সামাজিক, সামষ্টিক ও রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করাই উদ্দেশ্য। এই কারণে যাদের মন জয় করতে হেব, যারা বন্দী, ঋণগ্রস্ত এবং আল্লাহ্র পথে—এই সবকে ব্যয়ের ক্ষেত্র হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। আর এগুলো যে প্রশস্ত ক্ষেত্র অন্যান্য ধর্মের প্রবর্তিত যাকাত ব্যবস্থার তুলনায় অনেক সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যসম্পন্ন, তা সহজেই বুঝতে পারা যায়।
এ সব পার্থক্যকারী দিক আমাদের কাছে স্পষ্ট করে তোলা যে, ইসলামের যাকাত একটা নবতর বিধান, অন্যান্য ধর্ম প্রবর্তিত ব্যবস্থাসমূহ থেকে তা সম্পূর্ণ ভিন্নতর ও স্বাতন্ত্র্য-বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। অন্যান্য ধর্মের উপদেশ-নসীহত. পুণ্য কাজের উৎসাহদান এবং কার্পণ্য সম্পর্কিত সতর্কবাণী ইত্যাদির সাথে ইসলামের প্রবর্তিত যাকাত ব্যবস্থার কোন তুলনাই হতে পারে না। অনুরূপভাবেরাজা-বাদশাহ ও শাসক-প্রশাসকদের আদায় করা ট্যাক্স বা খাজনা ইত্যাদির সাতেও তার কোন সাদৃশ্য নেই। বরং সে ব্যবস্থায় গরীবদের কাছ থেকে নিয়ে ধনীদের মধ্যেই বন্টন করা হয়, কর্তাদের ভোগ-বিলাস ও আরাম-আয়েশের ব্যবস্থাপনায় ও তাদের আত্মীয়-স্বজনের মনের অভিলাষ চরিতার্থ করার কাজে, তাদের রাষ্ট্রীয় গদী রক্ষার্থে উদারহস্তে উড়ানো হয়।
যাকাতের প্রকৃতি সম্পর্কে শাখ্ত (Joseph Schacht)-এর ধারণা ভুল
ইসলামে যাকাতের গুরুত্ব, স্থান ও প্রকৃতি সম্পর্কে যে দীর্ঘ ও বিস্তারিত আলোচনা উপরে পেশ করা হল এই প্রেক্ষিতে যাকাত সম্পর্কে কতিপয় ভিত্তিহীন ধারণা ও মন্তব্য সম্পর্কে একটা পর্যালোচনা উপস্থাপিত করা হচ্ছে। এ সব ধারণা ও উক্তি যাদের, তারা আসলে জ্ঞান ও বিদ্যা-বুদ্ধির দিকপাল কিছু নন। কেনা জ্ঞানের ব্যাপারে সাধারণ দায়িত্বই এখানে উপেক্ষিত।
ইসলামী বিশ্বকোষ-এর প্রবন্ধকার ‘যাকাত’ সম্পর্কে লিখেছেন:
হাদীসে এমন কিছু অবস্থার উল্লেখ আছে, যখন যাকাত দেয়া হয় তা পরে প্রবর্তিত যাকাত ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সে যাই হোক, যাকাতের প্রকৃতি নবী করীমেরজীবদ্দশায়সব সময়ই প্রচ্ছন্ন ও অস্পষ্ট রয়ে গেছে; তা দ্বীনের ধার্য করা কোন করও ছিল না। এই কারণে নবীর ইন্তেকালের পর বহু সংখ্যক আরব গোত্র তা দিতে অস্বীকার করে। কেননা তারা মনে করে নিয়েছিল যে, মূল চুক্তিকারীর ইন্তেকাল যাকাত দেয়ার চুক্তিটি বাতিল হয়ে গেছে। কোন কোন মু’মিনও তা দিতে অস্বীকার করে। তাদের মধ্যে হযরত উমর (রা) অন্যতম। পরে তাঁরা তা মেনে নেন। (আরবী অনুবাদ-৩৫৮ পৃঃ)
কিন্তু শাখ্ত (Joseph Schacht) যে হাদীসেরকথা বলেছেন, তা চিহ্নিত করেন নি। করলে সে সব হাদীস সম্পর্কে আমাদের মতামত দিতে পারতাম। িএখন আমরা বলতে পারি যে, শাখত-এর এই অন্তঃসারশূণ্য দাবির এক কানাকড়িও মূল্য নেই। তার বক্তব্যের ‘পরে প্রবর্তিত যাকাত ব্যবস্থা’ বলে তিনি এই ধারণা দিতে চেয়েছেন যে, ইসলামেরযাকাত ব্যবস্থা বুঝি নবী করীম(স)-এর ইন্তেকালের পর মুসলিমজনগণই উদ্ভাবন করেছেন, এটা আল্লাহ্র কাছ থেকে অবতীর্ণ ওহী-প্রবর্তিত নয়। বরং তা অবস্থা ও মানবীয় অভিজ্ঞতার ফলশ্রুতি, যা মুসলমানরা পারস্য ও রোমান সমাজ থেকে লাভ করেছে। শাখ্ত এবং তাঁর মত অন্যান্য অরিয়েন্টালিস্টদের মুখে এ ধরনের কথাই শোনা যায়, যার সত্যিই কোন ভিত্তি নেই।
বস্তুত কুরআন মজীদের আয়াত, সহীহ্ হাদীস, সাহাবা ও খুলাফায়ে রাশেদুনের অনুসৃত আদর্শ প্রকৃত সত্য উদ্ভাসিত করেছে। অকাট্যভাবে প্রমাণিত করেছে যে, যাকাত-ব্যবস্থা একান্তভাবে ইসলাম উদ্ভাবিত ও প্রবর্তিত, অন্য কোন ব্যবস্থা থেকে তা গ্রহণ করা হয় নি। তার পূর্ববর্তী, কোন ধর্মব্যবস্থা বা মানব রচিত বিধানে যাকাত-সদৃশ কোন অর্থ ব্যবস্থার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। যে কোন ইনসাফগার ব্যক্তি এ পর্যায়ে বলতে বাধ্য হবেন যে, এটা সম্পূর্ণ ও মৌলিকভাবেই আল্লাহ্ তা’আলার অবদান:
(আরবী***********)
আল্লাহ্র রং, আল্লাহর চাইতে উত্তম রং আর কার হতে পারে?
দ্বিতীয়, রাসূলের যুগে যাকাত দুর্বোধ্য ছিল বলে শাখ্ত যে অভিযোগ তুলেছেন সেটা সত্যিই আজব কথা।
আমি বুঝতে পারি না, এই আলোচনাকারী এমন কথা কি করে বলতে পারলেন, অথচ তিনি ইসলামী শরীয়াত ও ফিকাহ্-এর বড় বিশেষজ্ঞ হওয়ার দাবি করেছেন, আর রাসূলের যুগে ‘যাকাত’ ব্যবস্থা দুর্বোধ্য ছিল, তা দ্বীন-ইসলামের দাবি অনুযায়ী প্রবর্তিত কোন ‘কর’ ছিলনা, বলে যুক্তি প্রদর্শন করার সাহস করেছেন।
তিনি দুর্বোধ্রতা কোথায় দেখতে পেলেন? অথচ রাসূলে করীম (স) নিজেই যাকাত সংক্রান্ত সব বিষয়ের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কোন্ কোন্ ধন-মালে যাকাত ফরয হয়, তা-ও স্পষ্ট করে বলে গেছেন। তাতে নবী যুগের আরব সমাজে সর্বপ্রকারের ক্রমবর্ধনশীল ধন-মালই শামিল ছিল। গৃহপালিত পশু, ফসল, ফল-পাকড়, স্বর্ণ-রৌপ্য ইত্যাদি সব বিষয়ের কথাই বলেছেন। সেইসাথে তিনি পরিমাণও বলে দিয়েছেন। ফসলের দশভাগের এক ভাগ কি বিশ ভাগের এক ভাগ দিতে হবে, তা বলতেও বাকি রাখেন নি। তা ফরয হওয়ার জন্য সময়সীমাও নির্ধারণ করেছেন। বলেছৈন, প্রতিবারের ফসলেই তা ফরয হবে। যাকাতলব্ধ সম্পদ কোথায়, কিভাবে ব্যয় বন্টন করা হবে, তাও স্পষ্ট করে ব্যক্ত করেছেন। এ পর্যায়ে কুরআনের আয়াত নাযিল হয়েছে। হাদীসেও তার ব্যাখ্যা রয়েছে। যাকাত আদায় করার পন্থা কি হবে, তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। বললেন, এ জন্যে সতন্ত্রভাবে সংগ্রহ ও বন্টন করার ব্যবস্থা করতে হবে। কুরআনের শব্দ (*****) (Collectors)-এ-ই তার ভিত্তি রয়েছে। তিনিনিজে মুসলিম জাহানের সর্বত্র কর্মচারী ও দায়িত্বশীল লোক প্রেরণ করেছেন। তারা যাকাত আদায় করেছ, বন্টনও করেছে ইসলামের সুস্টন বিধান অনুযায়ী। এ ব্যাপারটি এতই সর্বজনবিদিত যে, সে সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার প্রয়োজন নাই।
এতদ্সত্ত্বেও একথা বলা কিসঙ্গত যে, রাসূলের জীবদ্দশায় যাকাতের ব্যাপারটি দুর্বোধ্য ছিল? এবং তা কোন দ্বীনি বিধানভিত্তিক নয়।
তা কি করে সম্ভব হতে পারে? রাসূল (স) তো ইসলামের মৌল স্তম্ভের উল্লেখের সাথে সাথে সব সময়ই যাকাতের কথা গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করেছেন। বেশকিছু হাদীস আমরা এমনও দেখতে পাই, যাতে হজ বা রোযার হয়ত উল্লেখ নেই; কিন্তু নামায ও যাকাতরে কথা শাহাদাদের কালেমাদ্বয়ের সাথে মিলিত সব সময়ই উল্লেখ করেছেন। শুধুতা-ই নয়, এই যাকাত আদায়েল জন্যে প্রয়োজন হলে যুদ্ধ করার কথাও বলেছেন। হযরত ইবনে উমর, আবূ হুরায়রা ও জাবির (রা) বর্ণিত হাদীসসমূহে তা-ই রয়েছে। রাসূলে করীম(স) নব দীক্ষিত আরব গোত্রসমূহের সাথে যত চুক্তি করেছেন তার সবটাতেই নামাযও যাকাতের উল্লেখসমান গুরুত্ব সহকারে রয়েছে। তিনি তাঁর নিয়োজিত কর্মচারী ও গভর্নরদের প্রতি যেসব চিঠি পাঠিয়েছেন, তাতেও এর কোন ব্যতিক্রম ঘটেনি। তাঁর কাছে বিভিন্ন দেশও গোত্রের পক্ষথেকে যে প্রতিনিধি দল এসেছে, তাদের কাছেও তিনি নামায ও যাকাতের কথা এক সাথে বলেছেন।
ইসলামে নামাযের গুরুত্ব ও স্থান শাখ্ত ও তাঁর মত অন্যান্য প্রাচ্যবিদরা নিশ্চয়ই অস্বীকার করতে পারেন না। তাহলে সকল প্রকার চুক্তি ও সরকারী চিঠিপত্রে যাকাত, তার পরিমাণ, নিসাব ও প্রকারসমূহের স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে।তাতে কোন প্রকারের দুর্বোধ্যতা, অস্পষ্টতা বা শোবাহ্-সন্দেহের প্রশ্নই উঠতে পারে না। তবে কোথাও মোটামুটিভাবে বলা হয়ে থাকতে পারে। সেখানে হয়তো বিস্তারিত ও খুঁটিনাটি সহ বলা হয়নি, তা অস্বীকার করা যায় না।
এ পর্যায়ে আর অধিক স্পষ্ট ও বলিষ্ঠ তথ্য জানতে হলে ডঃ হামিদুল্লাহ রচিত-
(আরবী***********)
নবী করীমও খিলাফতে রাশেদা আমলের চুক্তিসমষ্টি পাঠ করুন।
শাখ্ত নবী যুগের যাকাতের ব্যাপারটি অস্পষ্ট থাকার কথা প্রমাণ করতে গিয়ে যুক্তি হিসেবে উল্লেখ করেছেন যে, রাসূলের ইন্তেকালের বহু সংখ্যক আরব গোত্র যাকাত দিতে অস্বীকার করে। কেননা তারা মনে করেছিল যে, রাসূলের ইন্তেকালেল সাথে-সাথেই যাকাত দেয়ার চুক্তিও নাচক হয়ে গেছে। আরও অন্যান্য মুসলমানদের সঙ্গে হযরত উমরও তা সমর্থন করেছেন। শাখ্তের এ কথাটি সম্পূর্ণ বাতিল। প্রকৃত অবস্থার সাথে এর দূরতম সম্পর্কও নেই।
সত্যকথা হল, গোত্রগুলো ছিল বিভিন্ন প্রকৃতির বিভিন্ন চরিত্রের।
তন্মধ্যে কিছু কিছু গোত্রে মুসায়লাম সাজাহ, আস্ওয়াদ, তুলায়হা প্রভৃতি নামের লোকের মিথ্যা নবুয়্যাতের দাবিদার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাদের বহুসংখ্যক সাহায্য-সমর্থনকারীও দাঁড়িয়েছিল। এসব গোত্রের লোকদের থেকে। তাই বলে নবুয়্যাতের ব্যাপারটিও অস্পষ্ট ছিল নাকি?
এমন গোত্রও ছিল, যারা নামায ও শরীয়াতের অপরাপর হুকুম-আহকাম পালন করতে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু যাকাতের ব্যাপারে তাদের মনে সংশয়ের উদ্রেক হয়ে পড়ে। পূর্বেই বলা হয়েছে, তার কাণ নতুন মুসলিমহওয়া ও দূর মরুভূমিতে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করা। যাকাত-প্রকৃতির দুর্বোধ্যতার দরুন নয়। ইমাম আবূ সুলায়মান আল-খাত্তাবী প্রমুখ মনীষী তাই এদের মুরতাদ বলেন নি, বলেছেন ‘বিদ্রোহী’। যদিও এদের মধ্যে রাসূলের ইন্তেকালের পর যাকাত ফরয থাকার কথা অস্বীকারকারী লোকও ছিল। আর তারা মরুবাসী ছিল, নও-মুসলিম ছিল বিধায় তাদের অন্যান্যের মত কাফির আখ্যায়িত করা হয়নি, তাদের মধ্যে অনেকে আবার যাকাতকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেনি। বরং তারা যাকাত অমান্যকারী গোত্র সরদারদের অধীনে বাস করত বলে তারা যাকাত দিতে পারেনি- কাবীলা সরদাররা প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বনূ ইয়ারবু কাবলীরা এই অবস্থাই হয়েছিল। তারা তাদের যাকাত সংগ্রহ করে একত্রিত করেছিল এবং খলীফার কাছে তা পাঠাবার ইচ্ছাও করেছিল। কিন্তু মালিক ইবনে নুয়াইরা তা পাঠাতে বাধা দান করে। তবে হযরত উমর ফারূক (রা)-এর মনেও সংশয় জাগার কথাটি সত্য।
কিন্তু তা শুধু যাকাত অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ব্যাপারে সন্দেহ। তিনি হযরত আবূ বকর (রা)-এর সাথে কথা বলেছেন। তিনি তাঁর যুক্তি পেশ করেছেন; হযরত উমর তা মেনে নিয়েছেন। অতঃপর সর্বসম্মতভাবেই সে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। ফলে এ নিয়ে আর কোন কথা উঠতে পারে না।
শাখ্ত মনে করেছেন, যাকাত অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে হযরত আবূ বকর কর্তৃক গ্রহীত নীতিই এ ফরযটির স্থিত ও চিরন্তনতার ব্যবস্থা করেছে। শাখ্ত এ কথাটি হযরত আবূ বকর (রা)-কে ভালবেসে বলেন নি। বলেছেন এ কথা লোকদের সামনে স্পষ্ট করে তোলার কুমতলবে যে, যাকাতের ব্যাপারটি মুসলমানদের কাছে—এমন কি হযরত উমর ফারূক (রা)-এর কাছেও স্পষ্ট ছিল না। তিনি ভুলে গেছেন যে, এটা হযরত আবূ বকরের নিজস্বভবে উদ্ভাবিত কোন নীতি ছিল না। তিনি রাসূলে করীমের প্রবর্তিত নীতিরই অনুসরণ করেছেন মাত্র। এ করণেই তিনি বলেছিলেন: “রাসূলেল সময়ে লোকেরা যে যাকাত দিত, তার একটা রশিও যদি তখন দিতে অস্বীকার করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আমি লড়াই করব।”
এ থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা গেল যে, হযরত আবূ বকর (রা) রাসূলের নীতিকে বাস্তবায়িত করেছেন মাত্র্ নতুন কোন নীতির প্রচলন করেন নি। রাসূলের নীতিতে তিনি অক্ষরেরও পরিবর্তন করেন নি।
হযরত উমর (রা) এবং তাঁর সঙ্গীরা মনে করেছিলেন: ওদের নামাযকে মুসলমানিত্বের প্রমাণস্বরূপ গ্রহণকরা হোক, আর যাকাত ওদরে জন্যে ছেড়ে দেয়া হোক। শেষ পর্যন্ত সব ঠিক হয়ে যাবে। বিরোধ নির্মূল হবে এবং আল্লাহর দল জয়ী হবে।
কিন্তু হযরত আবূ বকরের নীতি ছিল অত্যন্ত দৃঢ় ও বলিষ্ঠ। কেননা তাঁর দলীল ছিল অকাট্য এবং কুরআন ও সুন্নাত থেকে গ্রহীত। আল্লাহ্ সত্যিই বলেছেন:
(আরবী***********)
যদি তারা তওবা করে, নামায কায়েম করে ও যাকাত দিতে থাকে, তাহলে তারা তোমাদের দ্বীনি ভাই গণ্য হবে।
দ্বিতীয় অধ্যায়
যাকাত কার উপর ফরয
-অমুসলিমের উপর যাকাত ফরয নয়
-বালক ও পাগলের ধন-মালে যাকাত
প্রথম পর্ব
ইসলামের বিশেষজ্ঞগণ এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত যে, যাকাত কেবলমাত্র স্বাধীন, বয়স্ক মুসলমানের উপর ধার্য কর, সুনির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের মালিকানা রয়েছে। [ফিকাহ্বিদগণ এ পর্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। আমরা এখানে তার পুনরাবৃত্তি করছি না। কেউ প্রয়োজন বোধ করলে দেখুন- (আরবী***********)]
পূর্বে দলীলাদির ভিত্তিতে একথা বলা হয়েছে। কুরআনের স্পষ্ট আয়াত উল্লেখ করা হয়েছে, রাসূলের প্রমাণিত হাদীসসমূহেরও উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। সে সবের দ্বারা যাকাতের ফরয হওয়া সম্পর্কে দৃঢ় প্রত্যয় জন্মেছে। মুসলমানরা যুগের পর যগ ধরে এ গুলোর উদ্ধৃতি দিয়ে এসেছে। মুতাওয়াতির বর্ণনাসমূহ রয়েছে রাসূলের কথা এবং কাজের। দ্বীন-ইসলামের মৌলিক বিধানের ভিত্তিতে জানা গেছে যে, নও-মুসলিম নয় এমন যে কোন মুসলিম ব্যক্তি যাকাতকে অস্বীকার করলে কাফির হবে।
মুসলমানদের এ ব্যাপারে ঐকমত্য রয়েছে যে, কোন অমুসলিমের উপর যাকাত ফরয নয়। কেননা এটা ইসলামের স্তম্ভ। যারা ইসলামকেই মানে না তাদের উপর তা ফরয হতে পারে না। হ্যাঁ, তবেকোন অমুসলিমইসলাম কবুল করলে ও যাকাত দেয়ার পরিমাণ ধনসম্পদ তার থাকলে তখন অবশ্যই তাকে তা দিতে হবে। এ কথার দলীল হচ্ছে বুখারী-মুসলিমে উদ্ধৃত হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বর্ণিত হাদীস। তা এই-
রাসূলেকরীম (স) যখন হযরত মুআযকে ইয়েমেনে পাঠালেন তখন তিনি তাঁকে বললেন: তুমি আহলে-কিতাবের একটা জাতির কাছে যাচ্ছ। তাদের প্রতি তোমার সর্বপ্রথম দাওয়াত হবে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র সাক্ষ্য দানের। তারা তা মেনে নিলে তাদের জানিয়ে দেবে, আল্লাহ্ তাদের প্রতি দিনরাতে পাঁচ ওয়াক্ত নাময ফরয করে দিয়েছেন। তা মেনে নিলে তাদের বলবে, আল্লাহ্ তাদের উপর যাকাত ফরয করেছেন, যা তাদের ধনীদের কাছ থেকে নিয়ে তাদেরই গরীবদের মধ্যে বন্টন করা হবে। [দেখুন ফতহুল বারী, ৩য় খণ্ড, পৃঃ ২২ন]
ইবাম নব্বী যেমন লিখেছেন, এ হাদীসটি প্রমাণ করেছে যে, ইসলাম কবুল করলেই একজনকে ইসলামের ফরযসমূহ পালন করার কথা বলা যেতে পারে, তার পূর্বে নয়। এ পর্যন্তকার কথা সর্বসম্মত। [মৌলনীতির ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নমত রয়েছে। কাফিররা শরীয়াতের খুঁটিনাটি পালনে বাধ্য কি? তাহলে তা পালন না করার অপরাধে পরকালে তাদের আযাব অনেক বেশী হতে হবে কি? অধিকাংশ ফিকাহইবদ এ মত দিয়েছেন। তবে হানাফীরা ভিন্নমত দিয়েছেন। আসলে এ একটা অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক।]
বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, যাকাত যেহেতু ইসলামেরই একটি অন্যতম রুকন কাজেই তা কাফিরদের প্রতি ধার্য হতে পারে না যেমন নামায পড়া ও রোযা রাখা। এ পর্যায়ে ভিন্ন একটা কারণ প্রদর্শন করা হয়েছে। শাফিয়ী মাযহাবের শীরাজ ও নববী বলেছেন, আসল কাফিরের প্রতি তা ফরয নয়। এ একটা হক, যা সে নিজের জন্যে বাধ্যতামূলক করে নেয়নি বলে সে জন্যে সে বাধ্য নয়। সে যুধ্যমান ব্যক্তি হোক, কি যিম্মী, তাতে কোন পার্থক্য সূচিত হবে না। কাজেই তার কুফরী অবস্থায় তার প্রতি শরীয়াতের হুকুম পালনের দাবি করা যায় না। আর ইসলাম কবুল করলে কুফরী জীবনের যাকাত দাবি করা যাবে না।
অমুসলিমের উপর যাকাত ফরয নয় বলে তার যাকাত দেয়াটাও একটি ইবাদত হিসেবে সহীহ্ কাজ হতে পারে না। কেননা ইবাদত কবুল হওয়ার প্রথম শর্ত ঈমান ও ইসলামই এখানে অনুপস্থিত। আল্লাহ বলেছেন:
(আরবী***********)
আর যা কিছু তাদের কৃতকর্ম রয়েছে, তা নিয়ে আমরা ধূলিকণার মত উড়িয়ে দেব।
তবে এ কথা খুব ব্যাপকভাবে প্রচলিত যে, নেক-আমল পরকালীন আযাব অনেক পরিমাণে হালকা করে দেবে।
সব আসল কাফিরদের ব্যাপারেই একথা প্রযোজ্য। তবে যে লোক ফিত্নার সৃষ্টি করে ও মুরতাদ হয়ে যায়, মুসলিম থাকা অবস্থায় তার উপর যাকাত ফরয করা হয়ে থাকলে তাতার কাছ থেকে অবশ্যই নিতে হবে। কেননা এটা তো একটা হক, যা তার মুরতাদ হয়ে যাওয়অর দরুন নাকচ হয়ে যেতে পারে না। এটা ইমাম শাফিয়ীর মত। ইমমা আবূ হানীফঅ ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন।
তবে মুরতাদ হয়ে যাওয়া কাল সম্পর্কে শাফিয়ী মাযহাবের ফিকাহ্বিদগণ ভিন্ন মত পোষণ করেন। তাঁদের কেউ কেউ যাকাত ফরয হওয়ার ব্যাপারটিকে চূড়ান্ত মনে করেন। কেননা তা গরীব ও অভাবগ্রস্তদের হক। তাই মুরতাদ হয়ে যাওয়ার দরুন তা বাতিল হতে পারে না।
ইসলাম অমুসরিমদের উপর যাকাত ফরয করেনি কেন
এ পর্যায়ে কোন কোন লোকের মনে প্রশ্ন জেগেছে: ইসলাম অন্যান্য অমুসলিমদের জন্যে বিপুল সুযোগ-সুবিধা করে দিয়েছে। তাদের প্রতি আল্লাহ্ ও রাসূলের দায়িত্ব ঘোষিত হয়েছে। তারা ইসলামী রাষ্ট্রের নিরাপদমূলক আশ্রয় নিশ্চিত জীবন-যাপনের সুযোগ পায়। তাদের মর্যাদা তথায় সুরক্ষিত, তাদরে স্বাধীনতা উন্মুক্ত ও অ-প্রভাবিত। সেখানে তারা মুসিলম নাগরিকদের সমান অধিকার লাভ করে, সমান দায়িত্বতাদের উপরও বর্তে। তাহলে যাকাত ফরয করার ব্যাপারে মুসলিম-অমুসিমের মধ্যে পার্থক্য করা হল কেন? অথচ যাকাত একটা সামাজিক দায়িত্বের ব্যাপার। একটা অর্থনৈতিক কর বিশেষ। তদলব্ধ অর্থ-সম্পদ তো দেশেরদুর্বল, অভাবগ্রস্ত ও সাধারণ দরিদ্র নাগরিকদের মধ্যেই বন্টন করা হয়?
প্রশ্নটির জবাব দীর্ঘ আলোচনা সাপেক্ষ। মূলত এখান দুটি দিক দিয়ে যাকাত ফরয হওয়ার মর্মকথা অনুধাবনের চেষ্টা করতে হবে।
প্রথম, যাকাত একটি সামাজিক ও সামষ্টিক দায়িত্বের ব্যাপার, একটি সুনির্দিষ্ট অধিকার (Determined Claim)। প্রার্থী ও বঞ্চিত লোকদের জন্য। তা একটা অর্থনৈতিক কর। আল্লাহ্ তা’আলাই তা ফরয করেছেন। জাতির ধনীদের কাছ থেকে তা গ্রহণ করা হবে, যেন তাদেরই গরীবদের মধ্যে বন্টন করা যায়। এতে করে ভাই ভাইয়ের অধিকার রক্ষা করার সুযোগ পায়। এটা সামষ্টিক অধিকারের ব্যাপারে যেমন তেমনি আল্লাহ্রও হক।
দ্বিতীয, তা ইসলামের ইবাদতসমূহের অন্যতম। যে পাঁচটি স্তম্ভের উপর ইসলামের গোটা কাঠামো দাঁড়িয়ে রয়েছে যাকাত তার মধ্যে একটি। কালেমার সাক্ষ্যদান ও নামায কায়েম করা, রমযানের রোযা ও আল্লাহর ঘরের গহ প্রভতির মতই তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পূর্বে বহুবার আমরা দেখিয়েছি, কুরআন মজীদে যাকাতকে নামাযের পাশেই উল্লেখ করা হয়েছে। শিরক থেকেতওবা করার একটা ভিত্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। নামায কায়েম করা ইসলামে প্রবেশের প্রকাশ্য লক্ষণ, মুসলিম ভ্রাতৃত্বের অধিকার লাভের একটা মাধ্যম। যাকাতের কোন কোন অংশ যেমন ইসলামের সাহায্যে ও দ্বীনের কালেমা প্রচারে ব্যয় হতে পারে—দ্বীনের দাওয়াতের সুবিধার্থে সাধারণ জনকল্যাণমূরক কাজে ব্যয় করা যেতে পারে-এ কারণে ‘ফী সাবীলিল্লাহ’ –আল্রাহর পথে’ বলে একটা খাত আছে। নির্দিষ্ট লোকদের মন রক্ষার কাজেও তা ব্যয় হতে পারে। ‘আল-মুয়াল্লাকাতুল কুলুব’ একটি খাত রয়েছে বলে।
বিভিন্ন হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে, “তা ধনীদের কাছ থেকে নেয়া হবে, যেন গরীবদের মধ্যে বন্টন করা যায়” –এ অনুযায়ী যাকাতরে প্রথম উদ্দেশ্য আদায় হতে পারে, আর তা হল গরীবদের পরমুখাপেক্ষিতা থেকে মুক্তিদান। কিন্তু কুরআন তো আটটি খাতের উল্লেখ করেছে। পূর্বোল্লিখিত দুটি এরই মধ্যে শামিল।
এ দিকে লক্ষ্য রেখেই ইসলামের উদারতা ও অনুভূতিশীলতা অমুসলিমদের কাছে যাকাত গ্রহণে তাদের ধর্মীয় আকীদার প্রতি সম্ব্রমবোধকে গুরুত্ব দিয়েছে। আসলে ইসলামের এ একটি দ্বীনি ব্যবস্থা বলে তা অমুসলিমদের উপর ধার্য করতে চায়নি। যাকাত তো ইসলামের একটা বড় অনুষ্ঠান (Religious Cermony)-রূপে গণ্য চারটি বড় ইবাদতের একটি, পাঁচ ‘রুকন’-এর অন্যতম। তা অমুসলিমদের উপর কি করে ধার্য হতে পারে?
অমুসলিমদের কাছ থেকে যাকাত-পরিমাণ কর গ্রহণ করা হবে কি না
এ পর্যায়ে আর একটি প্রশ্ন উঠেছে। যাকাত একটা দ্বীনি ইবাদত ও ফরয হিসেবে অমুসলিমদের কাছ থেকে নেয়া যাবে না, বুঝলাম। কিন্তু সেই পরিমাণ অর্থ বাসম্পদ কর হিসেবে তাদের কাছ থেকে গ্রহণ করা যাবে কিনা, যা ধনীদের কাছ থেকে নিয়ে দরিদ্রের মধ্যে বিতরণ করা হবে? তখন মুসলমানরা যাকাত দেবে ফরয ইবাদত হিসেবে, আর অন্যরা দেবে কর হিসেবে? এ ব্যবস্থা দ্বারা একই দেশের অধিবাসীদের মধ্যে পার্থক্য ও তারতম্য সৃষ্টি থেকে বাঁচা যাবে এবং মুসলিমদের উপর অমুসলিম নাগরিকদের তুলনায় অতিরিক্ত অর্থ চাপ প্রয়োগ করা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে?
এ একটি বিতর্কিত বিষয়। এর মীমাংসার জন্যে ইজতিহাদের যোগ্যতাসম্পন্ন লোকদের সামষ্টিক ইজতিহাদ প্রয়োজন। তবে এই ধরনের ইজতিহাদ সম্পন্ন হওয়া যখন কঠিন, তখন যদ্দিন তা না হচ্ছে, তার পূর্বে আমরা এ প্রসঙ্গে একটা অভিমত অবশ্যই প্রকাশ করতে পারি। সংশ্লিস্ট বিষয়ে যতটা অধ্যয়ন ও চিন্তাভাবনা করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছে, তার ভিত্তিতেই এ মত প্রকাশ করা হবে। আর আসলেও ব্যক্তিপর্যায়ের ইজতিহাদ সামষ্টিক ইজতিহাদের পথ সুগম করে দেয় বলে আমার এ মত প্রকাশ কিচুমাত্র অবান্তর হবে না বলে মনে করি।
আমার এ মত নির্ভুল হলে তা আল্লাহ্র অনুগ্রহ বলে মনে করতে হবে। আর ভুল হলে সেজন্যে আমাকে ও শয়তানকেই অভিযুক্ত করা যাবে। আমার সুস্পষ্ট মত হল: ইসলামী রাষ্ট্রের অমুসিলম যিম্মী নাগরিকদের কাছ থেকে যাকাতের মতই একটা কর গ্রহণ করার পথে প্রকৃতপক্ষে কোন বাধা নেই, যদি রাষ্ট্র পরিচালক তা গ্রহণ করা সমীচীন বা প্রয়োজন মনেকরেন। ওই মতের সমর্থনে নিম্নোক্ত যুক্তিগুলো পেশ করা যাচ্ছে:
১. অমুসলিমদের উপর যাকাত ফরয নয় ব লে ইসলামের আলিমগণ যে মত দিয়েছেন, তা হহ্ছে দ্বীনি ফরয হিসেবের কথা, তা দুনিয়ার দাবি করা ও পরকালীন সওয়াব ও আযাবের সাথে সংশ্লিষ্ট। কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক ‘পরামর্শ পরিষদের’ (Parliament) বিবেচনা অনুযায়ী সামষ্টিক কল্যাণের জন্যে একটি রাজনৈতিক কর্তব্যরূপে অমুসলিমদের উপর ধার্য করা হলে তা কোনোক্রমেই অন্যায় হবে না।
২. অমুসলিমদের উপর যাকাত ধার্য না করার কারণস্বরূপ বলা হয়েছে যে, এটা এমন একটা হক যার বাধ্যবাধকতা তারা গ্রহণ করেনি, তাই সে জন্যে তাদের বাধ্য করা যায় না। তার অর্থ এই দাঁড়াবে যে, তারা যদি তা দেয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়, তাহলে তা গ্রহণ করতে কোন অসবিধা নেই।
৩. ইসলামী রাষ্ট্রের যিম্মিগণ সব সময়ই একটা আর্থিক কর দিত, কুরআন তার নাম দিয়েছে ‘জিযিয়া’। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের সাধারণ ব্যয় নির্বাহে, জনকল্যাণমূরক কাজে ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায—তারা শরীক হচ্ছিল। তাদের অক্ষমতা, বার্ধক্য ও জীবিকার দায়িত্ব গ্রহণও এর মধ্যে তাদের দারিদ্র্যের সময়ে রয়েছে। এদিক দিয়ে তারা সাধারণ মুসলিম সমান সুযোগের অধিকার। হযরত উমর (রা) এক ইয়াহুদীকে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষাকরতে দেখেতার জন্যে মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থা করেছিলেন বায়তুল মাল থেকে। কিন্তু বর্তমান সময়ের বাস্তব অবস্থা হচ্ছে, মুসলিম দেশগুলোতে বসবাসকারী আহলে-কিতাব লোকেরা ‘জিযিয়া’ দেয় না, তারা তার নাম শুনতেও রাযী নয়। তাই তার পরিবর্তে যাকাতরে সমপরিমাণ একটা ‘কর’ অনায়াসে দিতে পারে এবং তার ‘জিযিয়া’ নামকরণ কিছুমাত্র জরুরী নয়।
ঐতিহাসেক, হাদীসবিদ ও ইসলামী অর্থনীতিবিদগণ বনূ তাগলিব নামক খৃস্টান গোত্রের সাথে হযরত উমরের অবলম্বিত যে নীতির বর্ণনা দিয়েছেন, তার আলোকে আমরা বাস্তবতা ও সাধারণ কল্যাণের প্রয়োজনে এ পর্যায়ে নতুন করে বিবেচনা করতে পারি।
হযরত উমর (রা) তাগলিবের কাছ থেকে জিযিয়া গ্রহণ করার ইচ্ছা করেছিলেন। তখন নু’মান ইবনে জুর্য়া বললেন: ‘হে আমীরুল মু’মিনীন। বনু তাগলিব একটা আরব গোত্র। ওরা ‘জিযিয়া’ দেয়া পছন্দ করে না, স্বর্ণ-রৌপ্য বলতেও ওদের মালিকানায় কিছু নেই। ওরা কৃষিজীবি, পশুপালক। শত্রুদের মধ্যে ওদের একটা প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে, এ জন্যে তাদের বিরুদ্ধে আপনার শত্রুদের আপনি সাহায্য করবেন না।’ তখন হযরত উমর (রা) যাকাতরে দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থ দেয়ার শর্তে তাদের সাথে সন্ধি করলেন। কোন কোন হাদীসের বর্ণনানুযায়ী হযরত উমর বলরেন, ‘তোমরা তার নাম যা ইচ্ছা রাখতে পার।’
বায়হাকী উবাদা ইবনে নু’মান থেকে এক দীর্ঘ হাদীসে এই কথাটুকু বর্ণনা করেছেন: হযরত উমর (রা) যখন বনূ তাগলিবের সাথে দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থদানের শর্তে সন্ধি করলেন, তখন তারা বলল, ‘আমরা তো আরব, অনারবরা যা দেয় আমরা তো দেব না। বরং আমাদের কাছ থেকে সেভাবে গ্রহণ করুন যেমন করে পরস্পর থেকে লোকেরা নিয়ে থাকে। হযরত উমর বললেন, ‘না, এটা তো মুসলমানদের অংশ।’ তারা বলল, ‘তা হলে আপনি যতটা ইচ্ছা বাড়িয়ে দিন, কিন্তু জিযিয়া’র নামে নয়।’ হযরত উমর (রা) তাই করলেন। তখন উভয় পক্ষই মুসলমানদের দেয় পরিমাণের দ্বিগুণ দেয়ার শর্তে রাযী হয়ে গেল। কোন কোন বর্ণনামতে হযরত উমর বলেছিলেন: ‘নাম তোমরা যা-ই দাও না কেন, তাতে কিছু যায় আসে না।’ [কিতাবুল আমওয়াল, পৃঃ ৫৪১। ইবনে হাজম বনূ তাগলিব সংক্রান্ত গোটা ইতিহাসকেই দুর্বল বর্ণনা বলেছেন (আল-মুহাল্লা, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃঃ ১১১)। কিন্তু আসলে এ ইতিহাসটি বহুল প্রচারিত। ইবনে আবূ শায়বা, ইমাম আবূ ইউসুফ (আল-খারাজ, পৃঃ১৪৩) ও ইয়াহ্ ইয়া ইবনে আদাম উদ্ধৃত করেছেন(কিতাবুল খারা, পৃঃ ৬৬-৬৭)। বালাযুরী ফুতুহুল-বূলদানেও এর উল্লেখ করেছেন। (পৃঃ ১৮৯)
বনূ তাগলিব সম্পর্কে হযরত উমর (রা) কর্তৃক গৃহীত এ নীতি সম্পর্কে ইমাম আবূ উবাইদ লিখেছেন: যখন তাদের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করেছিলেন, তখন তার নাম—অপরাপর যিম্মীদের ন্যায় ‘জিযিয়া’ রাখলেন না; বরং তার নাম রাখলেন “সিস্তনিক সদ্কা’। তাদের এরূপ করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল এবং ‘জিযিয়া প্রত্যাহার করা হয়েছিল শুধু এজন্যে যে তার প্রতি তাদের মনে একটা ঘৃণা—একটা হীনতাবোধ জেগেছিল। এর ফলে মুসলমানদের ক্ষতি কিছুই হয় নি। কেননা ‘জিযিয়া’ বাবদ যা কিছু পাওয়অর ছিল, তা তো পাওয়াই গেলই; বরং সাদ্কা নামে তার দ্বিগুণ আদায় করা হল। যে ভাঙনটা তাদের দিক থেকে এসেছিল এভাবে সেটা মেরামত করা হল। তবে মুসলমানদের হক আদায় করে নিতে ত্রুটি করা হল না। হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে, নবী করীম (স) বলেছেন:
(আরবী***********)
আল্লাহ্ তা’আলা উমরের কণ্ঠ ও দিলের উপর সত্যকে মুদ্রিত করে দিয়েছেন।
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা) বলেছেন: ‘আমি উমর (রা)-কে যখনই দেখেছি, তাঁর দুটি চোখের উপর ফেরেশতাকে তা বন্ধ করতে দেখেছি।’ হযরত আলী (রা) বলেছেন: উমরের মুখের প্রশান্তি কথা বলে, তা বুঝতে আমাদের বিলম্ব হয়নি।’ হযরত আয়েশা (রা) বলেছেন: ‘তিনি কুণ্ডলি পাকানো একক বুনট ছিলেন। সর্ব ব্যাপারে তিনি প্রস্তুত থাকতেন।
ইমাম আবূ উবাইদ বলেছেন: ‘হযরত উমরের এ কাজটি তাঁর অসংখ্য সৌন্দর্যের মধ্যে অন্যতম।’ [(আরবী***********)] এই উমর ফারুক (রা) তা*র থিলাফতের অধীনে বসবাসকারী খৃস্টানদের কাছ থেকে ‘সাদকা’ নামে একটা কর বা জিযিয়া গ্রহণ করায় কোন দোষ দেখতে পান নি। কেননা তারা ‘জিযিয়া’ নামটাকে অপছন্দ করত। মুসলিমদের উপর ফরয করা সাদ্কা অপেক্ষা তার পরিমাণও দ্বিগুণ ছিল।
এই শর্তেই তাদের সাথে সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এ কারণেই জুহ্রী বলেছেন:
আহে্-লে কিতাবের পালিত গরু-ছাগল ইত্যাদির কোন যাকাত নেই। তবে তাগলিব খৃস্টানদের কথা ভিন্ন অথবা বলেছেন আরবের খৃস্টানদের সাধারণ ধন-মাল ছিল গৃহপালিত পশু। [(আরবী***********)]
এটা হযরত উমরের অবদান। তাঁর সঙ্গী সাহাবায়ে কিরামও এ অবদানকে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
এই প্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠে—এ কালের ইসলামী রাষ্ট্রসমূহে বসবাসকারী যিম্মিী কেন? তা তো ইসলামী ব্যবস্থার একটা বিধান; মুসলমানদের উপর অর্পিত দুটি দায়িত্ব ও কর্তব্যের বিকল্প ব্যবস্থামাত্র। মুসলমানদের একটি কর্তব্য জিহাদ, যাতে রক্ত ও জীবন দিতে হয়। আর দ্বিতীয় করব্য হল যাকাত, যা ধন-মাল থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণে দিতে হয়।
ইসলামী রাষ্ট্রের পরামর্শ পরিষদের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে এই কর অমুসলিম নাগরিকদের কাছ থেকে নেয়া হবে না কেন? তারা তা জিযিয়া বা যাকাত নামেদিতে না চাইলে হযরত উম (রা) বনু তাগলিবের ক্ষেত্রে যে নীতি গ্রহণ করেছিলেন, তা অনুসরণ করতে বাধা কোথায়?
আমার বিশ্বাস, হযরত উমরের এই নীতি একটা বড় আলোকবর্তিকা, যা এ ক্ষেত্রে আধুনিক যুগের চাহিদা ও সমস্যা পূরণের উদ্দেশ্যে কোন একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণেচ্ছু ব্যক্তির চলার পথ সমুদ্ভাসিত করে দিয়েছে।
শাফিয়ী ও হাম্বলী মাযহাবের ফিকাহ্বিদগণ মত প্রকাশ করেছেন: ‘অমুসলিম জনগোষ্ঠী যদি খুব শক্তিশালী ও দাপসম্পন্ন এবং জিযিয়া দিতে প্রস্তত না হয়ে বনূ তাগলিবের ন্যায় অন্য কিছু দিতে রাযী হয়ে সন্ধিচুক্তি করতে প্রস্তুত হয় এবং তাদের এই চুক্তি মেনে না নিলে যদি ক্ষতির আশংকা দেখা দেয় এবং রাষ্ট্রপ্রধান তা মেনে নেয়ার যৌক্তিকতা অনুধাবন করেন, তাহলে মেনে নেয়া জযায়েয হবে। হযরত উমর (রা) বনূ তাগলিবেরপ্রতি যে নীতি অনুসরণ করেচিলেন সেই নীতি অনুযায়ী এ কাজ সঙ্গত হবে। [(আরবী***********)] এ কথাটি খুবই যুক্তি সঙ্গত এবং এর দলীল অকাট্য বলে মনে করি।
এ কথায় সন্দেহ নেই যে, প্রতিটি বর্ধনশীল সম্পদ থেকে যে যাকাত গ্রহণ করা হয় তা নিশ্চিতরূপে ‘জিযিয়া’র পরিমাণের তুলনায় অনেক বেশী, জিযিয়ার পরিমাণ তো” খুবই সামান্য হয়ে থাকে।– আর তা গ্রহণ করা হয়ে থাকে কেবলমাত্র অস্ত্র ধারণে সক্ষম ব্যক্তিদের কাছ থেকে। অথচ যাকাত গ্রহণ করা হয় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল ধনশালী ব্যক্তির কাছ থেকেই। এমন কি, বালক ও পাগলের কাছ থেকেও। এটাই অধিকাংশ ফিকাহ্বিদরে মত।
যিম্বীদের কাছে থেকে দ্বিগুণ পরিমাণ যাকাত গ্রহণ করা কোন অত্যাবশ্যকীয় ব্যাপার নয়। হযরত উমর (রা) তা কেবলমাত্র বনূ তাগলিব গোত্রের প্রতিই প্রয়োগ করেছিলেন। কেননা তারা তো এর জন্যেই দাবি করেছিল, এই শর্তেই তাদের সাথে সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। আর তা মেনেও নিয়েছিল। িএটা শরীয়অতের প্রয়োগ নীতির ব্যাপার, দ্বীন ও রাষ্ট্রের সাধারণ কল্যাণ বিবেচনার ফলশ্রুতি মাত্র।
ইবনে রুশ্দ বিষয়টির উল্লেখ করেছেন এবং তার শিরেনাম দিয়েছেন (আরবী***********) –‘যিম্মীদের উপর যাকাত’। অতঃপর লিখেছেন অধিকাংশ ফকীহ্র মত হল, সমস্ত ‘যিম্মী’র উপরই যাকাত ধার্য হবে না। বনূ তাগলিব খৃস্টান গোত্রের যাকাত পরিমাণ দ্বিগুণ করার ব্যাপারটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। অন্য কথায়, প্রতিটি জিনিস বাবদ মুসলমানদের কাছ থেকে যতটা পরিমাণ যাকাত গ্রহণ করা হবে, যিম্মীদের কাছ থেকেও তা-ই গ্রহণ করা হবে। ইবনে রুশ্দের এ কথাটি খুবই যথার্থ। ইমাম শাফেয়ী, আবূ হানীফা, আহমদ ও সওরী প্রমুখ ফিকাহ্র ইমামগণ এই মতই দিয়েছেন। এ পর্যায়ে ইমাম মালিকের কোন মত জানা যায় নি। হযরত উমর (রা) তা-ই করেছিলেন বলেই ইমামগণ এই মত প্রকাশ করেছেন। মনে হচ্ছে, তাঁরা সকলে এটাকে শরীয়াতসিদ্ধ কথা বলে ধরে নিয়েছেন। কিন্তু ফিকাহ্র মৌলনীতি তা সমর্থন করে না। [(আরবী***********)]
আমার বক্তব্য এই যে, আবূ উবাইদ হযরত উমরের কাজের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা আমরা দেখেছি। তাতে কিন্তু ফিকাহ্র মৌলনীতির সাথে এর সংঘর্ষ দেখতে পাইনি। মূলত মুসলমানদের সার্বিক কল্যাণ ও তাদের ক্ষতি বিদূরণই আসল লক্ষ্য। আর তা সব সময়ই শরীয়তভিত্তিক হতে হবে, এমনটা জরুরীও নয়। খুলাফায়ে রাশেদুনের সুন্নাত অনুসরণ করে চলার নির্দেশও আমাদের প্রতি রয়েছে।
৪. আমাদের কথার সমর্থনে উল্লেখ্য, ইমাম আবূ হানীফার সঙ্গী ইমাম মুহাম্মদ ইবনুল হাসান (র) বলেছেন: মুসলিমব্যক্তি যদি তার ওশরী জমি ‘যিম্মীর’ কাছে বিক্রয় করেদেয় যার খারাজ নেই, তাহলে যিম্মীকে ওশরই দিতে হবে। কেননা তার ক্রয় করা জমির উপর তো ওশর ধার্য হয়ে আছে। অতএব মালিকের পরিবর্তনে জমির ব্যবস্থা বদলে যাবেনা। ইসরামী রাষ্ট্রে যিম্মী জমি ভোগ করবে আর তার বিনিময় দেবে না, তা হতে পারে না। [(আরবী***********) এই মত দিতে গিয়ে মুহাম্মাদ (রা) প্রধান দুজন ইমামের বিরোধিতা করেছেন। ইমাম আবূ হানীফা বলেছৈন, “যিম্মীকে খারাজ দিতেহলে জমি খারাজী হয়ে যাবে।” ইমাম মুহাম্মাদ বলেছেন, তাকে দুই ওশর দিতে হবে- বনূ তাগলিবের মত।”]
৫. আহলে-কিতাবের লোকদেরও তাদরে ধর্মগ্রন্থ যাকাত দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে; দরিদ্রদের কল্যাণ-কাজে ব্রতী হতে বলা হয়েছে। পূর্বে আমরা কুরআনের আয়াত এ পর্যায়ে দলীল হিসেবে উদ্ধৃত করেছি, যেখানে বলা হয়েছে:
(আরবী***********)
তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে শুধু এ কাজের জন্যে যে, তারা আল্লাহ্র বন্দেগী করবে, দ্বীনকে তাঁরই জন্যে খালঅস করে—একমুখীহয়ে এবং নামায কায়েম করবে ও যাকাত দেবে।
তাদের ধর্মীয় গ্রন্থাদি থেকেও আমরা পূর্বৈবিস্তারিত উদ্ধৃতির উল্লেখ করেছি। কাজেই তাদের কাছে ‘যাকাত’ চাওয়া হলে তা তাদের ধর্মের বিধানের ভিত্তিতেই চাওয়া হবে।তাতে নতুন হবে শুধু পরিমাণ নির্ধারণ, সীমানা ঠিক করণ এবং বাধ্যবাধকতা আরোপ।
৬. হযরত উমর (রা) ও কতিপয় তাবেয়ী যিম্মীদের জন্যে যাকাত সম্পদ ব্যয় করা জায়েয হওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন বলে বর্ণিত হয়েছে। আমরা এ গ্রন্থে ‘কার জন্যে যাকাত হারাম’ শীর্ষক আলোচনায় এ পর্যায়ে কথা বলেছি।
মুসলমানদের কাছ থেকে গৃহীত যাকাত বা তার একটা অংশ যখন যিম্মীদের জন্যে ব্যয় করা যায়েজ, তখন তাদরে ধনীদের কাছ থেকে এ বাবদ ‘যাকাত’ গ্রহণ করাও অবশ্যই জায়েয হবে, যেন তাদের সমাজেরই দরিদ্রের জন্যে তা ব্যয় করা যায়। কেননা ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব হল মুসিলম-অমুসিলম সব নাগরিকেরই অর্থনৈতিক নিরপত্তা বিধান করা।
তাই তা ‘সামষ্টিক নিরাপত্তা কর’ নামে অভিহিত হবে। তাতে করে তা ইসলামের যাকাত থেকে স্বতন্ত্ররূপে চিহ্নিত হতে পারবে। এর ফলে তাদের মনের দ্বিধা-সংকোচও দূর হবে এবং মুসলমানদের মনেও কোন উদ্বেগের কারণ থাকবে না।
বস্তুত মুসলমানদের যাকাত ও অমুসলিমদের কাছ থেকে গৃহীত কত ভিন্ন ভিন্ন খাতে ব্যয়িত হওয়া বাঞ্ছনীয়, পাত্র, শর্ত ও পরিমাণে এ দুটো অভিন্ন তাকলেও নাম, পরিস্থিতি ও ব্যয়ের ক্ষেত্র ভিন্ন ভিন্ন হয়ে আছে। কেননা প্রতিটি প্রকৃতি আলাদা আলাদা, লক্ষ্য ও ফরয হওয়ার মূলও এক নয়।
দ্বিতীয় পর্ব
বালক ও পাগলের ধন-মালে যাকাত
প্রত্যেক মুসলিম সুস্থ, বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন ও বয়স্ক ব্যক্তির ধন-মালেই যাকাত ফরয। এ ব্যাপারে সব আলিম একমত হলেও বালক ও পাগলের ধন-মালে যাকাত ফরয কিনা, সে ব্যাপারে তাঁদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বালক ও পাগলের ধন-মালে যাকাত ফরয কিনা? কিংবা বালক যতক্ষণ পূর্ণবয়স্ক না হবেএবং পাগল যতদিনে সুস্থ বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন না হবে, ততদিন তাদের ধন-মালে যাকাত ফরয হবে কিনা?
এ পর্যায়ে ফিকাহ্বিদগণ যে বিষূটি মতভেদের মধ্যে রয়েছেন, তাতে করে তাঁদের দুটো বড় বড় ভাগে বিভক্ত চরা চলে:
(১) এক ভাগের ফিকাহ্বিদগণ তাদের ধন-মালে অথবা তাদের কোন কোন ধন-মালে আদৌ যাকাত হয় বলে মনে করেন না।
(২) দ্বিতীয় ভাগের ফিকাহ্বিদগণ এ দুই পর্যায়ের ব্যক্তিদের সকল প্রকার ধন-মালে যাকাত ফরয হয়বলে মত দিয়েছেন।
যাকাত ফরয হয় না বলে যাঁরা মত দিয়েছেন
(ক) আবূ উবাইদ, আবূ জা’ফর ও শা’বী থেকে বর্ণনা করেছেন, এ দুজন ফিকাহ্বিদের মত হচ্ছে, ইয়াতীমের মালে যাকাত হয় না। [(আরবী***********)]
ইবনে হাজম নখয়ী শুরাইয়অহ্-ও এই মতই উল্লেখ করেছেন।
(খ) ইমাম হাসান থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: ইয়াতীমের মাল-সম্পদে যাকাত হয় না, তবে কৃষি ফসল বা অনুরূপ জিনিসে (যাকাত হবে)।
ইবনে হাজম তাঁর ‘আল-মুহাল্লা’ গ্রন্থে অনুরূপ কথারই উল্লেখ করেছেন শিবরামা থেকে। [(আরবী***********)]
(গ) কিতাবুল আমওয়াল’ গ্রন্থে মুজাহিদ থেকে উদ্ধৃত হয়েছে ইয়াতীমের যে ধন-মাল বর্ধনশীল অথবা বলেছেন, গরু, ছাগল বা কৃষি ফসল কিংবা যে মাল দ্বারা কর দেয়া হয়, তার সবগুলোতেই যাকাত ফরয হবে। যা বন্ধ্যা, ফল দেয় না, তা থেকে যাকাত দিতে হবে না। তবে ‘ফল’ ধরতে শুরু করলে তাতে যাকাত হবে। [(আরবী***********)]
মালিকী মাযহাবের আলিমগণের মধ্যে লাখ্মী বলেছেন, বালকের ধন-মালে যাকাত ধার্য হবে না। কেননাতার ধন-মাল তো বৃদ্ধি হয় না, সেনিজে তা বাড়াতেও অক্ষম।যেমন মাটির তলায় রক্ষিত মালের মালিক যদি তার সন্ধান হারিয়ে ফেলে, তাহলে তা না পাওয়া পর্যন্ত তাতে যাকাত হবে না। কোন ধন-সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হওয়ার কথা যদি কেউ এক বা একাধিক বছর পর জানতে পারে, তাহলে তা না পাওয়া পর্যন্ত তার যাকাত দিতে হবেনা।
ইবনে বশীল এ যুক্তির জবাব দিয়ে বলেছেন, বালকের মাল বৃদ্ধি সাধনে অক্ষমতা হচ্ছে মালিকানার দিকথেকে। আর যে লোকতার ধান-মালে প্রবৃদ্ধি সাধনে অক্ষম, তার ধন-মালেরও যাকাত হবে। তাতে কারোরই দ্বিমত নেই। তবে প্রবৃদ্ধি না হওয়াটা যদি মালের প্রকৃতির কারণে হয়, তা হলে ভিন্ন কথা। ইবনুল হাজেব বলেছেন: উপরে লাখ্মীর যে উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে, তা একটা দুর্বল মত। [(আরবী***********)]
(ঘ) আবূ হানীফা ও তাঁর সঙ্গীগণ মত দিয়েছেন যে, বালকের শুধু কৃষি ফসল ও ফল-ফাঁকড়ায় যাকাত ধার্য হবে। তার অন্যান্য ধন-মালে হবে না। [(আরবী***********)]
ইবনে হাজম বলেছেন, এ ধরনের বন্টন-বিভাগ আরকেউ করেছেন বলে আমরা জানি না। তবে যায়দীয়া মতের ফিকাহ গ্রন্থ (****)-এর প্রণেতা যায়েদ ইবনে আলী ও জা’ফর সাদিকের এ মত উদ্ধৃত করেছেন। [(আরবী***********)] আর এঁরা দুজনই ইমাম আবূ হানীফার সমসাময়িক। [যায়েদ ১২২ হিজরী সনে নিহত হন, জা’ফর ইন্তিকাল কনে ১৪৮ হিজরীতে।তাঁরসম্পর্কে ইমাম আবূ হানীফা বলেছেন, “তাঁর মত ফিকাহ্বিদ আমি আর দেখিনি।”
কিন্তু বড়ই আশ্চর্যের বিষয়, যায়েদ সাদেক ও আহলে বায়ত থেকে নাসির হযরত আলী (রা) থেকে সহীহ্ বর্ণনার মাধ্যমেজানা মতের সম্পূর্ণ ভিন্ন ও বিপরীত মত প্রকাশ করেছেন। হযরত আলী (রা) তো আবূ রাফে’র ইয়াতীম বংশধরদের কাছ থেকে যাকাত গ্রহণ করতেন। যায়েদকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছিলেন, “আমরা রসূলের বংশধরেরা এ মত অস্বীকার করি।” [(আরবী***********)]
এঁদের দলীল
(ক) উপরিউক্ত আলিমগণ দ্বিতীয় দিকটির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছেন, যেমন পূর্বে বলেছি। তা হচ্ছে, যাকাত নামাযের মতেই একটা নিছক ইবাদতের কাজ। আর ইবাদতে নিয়ত জরুরী। কিন্তু বালক ও পাগল নিয়ত নির্ধারণে অক্ষম। অতএব তাদের উপর ইবাদত তো ফরয নয়। সেজন্যে তাদের উপর থেকে নামাযও নাকচ হয়ে গেছে। কাজেই অনুরূপ কারণে তাদের উপর থেকে যাকাত নাকচ হওয়াও বাঞ্ছনীয়। [(আরবী***********)]
(খ) এ মতের সমর্থনে নবী করীম (স)-এর বাণী উল্লেখ করা যায়। তিনি ইরশাদ করেছেন:
(আরবী***********)
তিন জনের আমল লেখা হয় না। তারা হল: বালক—যতদিন পূর্ণ বয়স্ক না হবে, নিদ্রাচ্ছন্ন—যতক্ষণে জেগে না উঠবে এবং পাগল—যতক্ষণে সুস্থ বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন না হবে। [নববী বলেছেন: এ হাদীসটি সহীহ্, আবূ দাউদ ও নাসায়ী ‘কিতাবুল হুদুদে’ এ হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। আলী (রা) তার বর্ণনাকারী।]
‘লেখা হয় না’-র অর্থ এদের উপর শরীয়াত পালনের দায়িত্ব নেই। কেননা শরীয়াতের নির্দেশপালনে বাধ্য সেইলোক, যে শরীয়াতদাতার কথা বুঝতে সক্ষম। কিন্তু বাল্যকাল, নিদ্রা ও পাগলত্ব তার বড় প্রতিবন্ধক।
(গ) কুরআনের আয়াত এ মতকে সমর্থন করে। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন:
(আরবী***********)
তুমি তাদের কাছ থেকে যাকাত গ্রহণ কর, তাদের পবিত্র ও পরিশুদ্ধি কর এর দ্বারা।
পবিত্র ও পরিশুদ্ধিকরণের কাজ হয় গুনাহের মলিনতা থেকে। কিন্তু বালকও পাগলের কোন গুনাহ নেই। কাজেইযাকাত নিয়ে তাদের পবিত্র ও পরিশুদ্ধিকরণের কোন প্রশ্ন উঠে না। অতএব যাকাত গ্রহণ করতে হবে যাদের কাছ থেকে, এ দুইজন তাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।
সত্য কথা এই যে, উপরিউক্ত দলীল তিনটি এমন নয়, যাকে ভিত্তি করে হানাফী মাযহাবেরলোকেরা –যাঁরা বালক ও পাগলের কোন মাল থেকে যাকাত গ্রহণ করা ফরয মনে করেন—কোন কথা বলতে পারেন না। মুজাহিদ, হাসান ও ইবনে শবরামা প্রমুখ এরূপ বক্তব্য রেখেছেন।
উপরিউক্ত দলীল তিনটি ইমাম বাকের, শা’বী, নখয়ী ও শুরাইহ্-এর মতের সমর্থন দিচ্ছে। কেননা তাঁরা বালক ও পাগলের কোন শ্রেণীর ধন-মালের যাকাত ফরয হয় বলে মনে করেন না।
(ক) ইসলাম সকল প্রকারের আইন-বিধানে সার্বিক কল্যাণের দিকে নযর রেখেছে। এখানেও সে দিকটি কিছুমাত্র উপেক্ষিত নয়্ আর অল্প বয়স্ক ও পাগলের ধন-মাল যথাযথ অক্ষুণ্ণ রাখায়ই নিহিত রয়েছে। তাদের কল্যাণ। তাই তাদের ধন-মালে যাকাত ধার্য হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। অন্যথায় যাকাতই তা নিঃশেষ করে দেবে। যাকাত ফরয হওয়ার যে মৌল কারণ (***) তা এখানে অনুপস্থিত। নাবালেগ, বালক ও পাগল নিজেদের জন্যে কিছুই করতে পারে না, তাদের ধন-মালের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্যে কিছু চিন্তা করার সাধ্যও তাদের নেই। এমতাবস্থায় প্রতি বছর যাকাত গ্রহণ করা হলে তাদের ধন-মাল শেষ হয়ে গিয়ে তাদরে কঠিন দারিদ্র্য ও অর্থাভাব নিপতিত করবে।
এ ধরনের ব্যক্তির বর্ধনশীল ধন-মালে যাকাত ধার্য হওয়ার মূলে সম্ভবত এই তত্ত্বই নিহিত, যেমন কৃষিফসল ও গৃহপালিত পশু অথবা কাজ করার দরুন যা বৃদ্ধি পায়—যেমন মূলধন, যদি তার দ্বারা ব্যবসা করা যায়।
হাসান বসরী ও ইবনে শাব্রামা নাবালেগের ধন-মালের যাকাত ফরয হওয়া থেকে কেবল তাদের স্বর্ণ ও রৌপ্যকেই বাদ দিয়েছেন। কৃষি ফসল ও গৃহপালিত পশুর ক্ষেত্রে যাকাত ধার্য করেছেন। কেননা শেষোক্ত দুটিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রবৃদ্ধি কাজ করছে, স্বর্ণষ ও রৌপ্য নিজস্বভবে প্রবৃদ্ধিপ্রবণ মাল নয়। তা নিয়ে ব্যবসা করলে বা মুনাফয় বিনিয়োগ করা হলে তবেই তাতে প্রবৃদ্ধি ঘটে। বালক ও পাগল উভয়ই এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অক্ষম। অতএব এই প্রকারের ধন-মালে যাকাত দেয়ার বাধ্যবাধকতা থেকে তাদের অব্যাহিত দেয়া হয়েছে।
বালক ও পাগলের মালে যাকাত ফরয হওয়ার পক্ষের লোকদের কথা
আতা, জাবির ইবনে যায়দ, তায়ুম, মুজাহিদ ও জুহরী প্রমুখ তাবেয়ী ফিকাহ্বিদ এবং তাঁদের পরবর্তীকালের রবীয়া মালিক, শাফেয়ী, আহমদ ইসহাক, হাসান ইবনে সালেহ, ইবনে আবূ ইয়ালা, ইবনে উয়াইনাহ্, আবূ দউবায়িদ ও সওর প্রমুখ ফকীহ বালক ও পাগলের সকল প্রকারের ধন-মালে যাকাত ফরয হয় বলে মত প্রকাশ করেছেন। হাদী ও মুয়াইদ বিল্লাহ প্রমুখ শিয়া ফিকাহ্বিদও এ মত দিয়েছেন। হযরত উমর (রা) তাঁর পুত্র, আলী, আয়েশা, জাবির প্রমুখ সাহাবীরও এই মত। মুজাহিদ বা হাসান ও ইবনে আবূ শায়বা কিংবা আবূ হানীফা যেমন কিছু কিছু ধন-মালকে যাকাত থেকে বাদ দিয়েছেন, পূর্বোক্ত তা-ও করেন নি।
বালকের ধন-মালে যাকাত হওয়ার দলীল
তাঁরা কয়েকটি যুক্তির উল্লেখ করেছেন:
১. প্রথম যুক্তি হল কুরআনের আয়াত ও হাদীসসমূহ সাধারণভাবেই সব ধনী লোকের ধন-মালে যাকাত ফরয হওয়ার কথাই বলেছে, তাতে কোন তারতম্য হয়নি। যেমন:
(আরবী ***********)
তাদের ধন-মাল থেকে যাকাত গ্রহণ কর, তা দিয়ে তাদের পবিত্র পরিশুদ্ধ কর।
আবূ মুহাম্মাদ ইবনে হাজম বলেছেন, এ আয়াতটিতে ছোট-বড়, সুস্থ বিবেকবান ও পাগলের মধ্যে কোন পার্থক্য করা হয় নি। কেননা তাদের সকলেরই প্রয়োজন আর্লাহর পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধি লাভ। কেননা এরা সকলেই ঈমানদার। [(আরবী ***********)]
নবী করীম(স) হযরত মুআয (রা)-কে যখন ইয়েমেনে পাঠিয়েছিলেন, তখন বলেছিলেন, তাদের জানিয়ে দেবে যে, তাদের ধন-মালে আল্লাহ্ যাকাত ফরয করেছেন, যা তাদের ধনীদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হবে এবং তাদের গরীবদের মধ্যে বন্টন করা হবে। এই কথাটিও এ পর্যায়ের একটি দলীল। কেননা বালক ও পাগল দরিদ্র হলে এ হাদীস অনুযায়ী তাদের জন্যে যাকাতের অর্থ ব্যয় করতে হবে। তাহলে তারা যদি ধনী হয়, তবে তাদের কাছ থেকে তা আকায় করা হবে না কেন?
২. তাদের দ্বিতীয় দলীল ইউসুফ ইবনে মালিক থেকে শাফেয়ী বর্ণিত হাদিসটি। নবী করীম(স) বলেছেন:
(আরবী ***********)
তোমরা ইয়াতীমের মালের দিকে লক্ষ্য দিও। যাকাত যেন তহা নিঃশেষ করে না ফেলে।
এই হাদীসটির সনদ সহীহ্। বায়হাকী ও নববীও তাই বলেছেন, কিন্তু ইউসুফ ইবনে মালিকতাবেয়ী, তিনি রাসূলে করীম (স)-কে দেখেন নি। কাজেই তাঁর হাদীসটি ‘মুরসাল’। কিন্তু ইমাম শাফেয়ী অন্যান্য সাধারণ দলীলের ভিত্তিতে এই মুরসাল হাদীসটিকে অধিক শক্তিশালী করে তুলেছেন। ইয়াতীমের মালে যাকাত ফরয হওয়া সম্পর্কে সাহাবীদের পক্ষ থেকে বর্ণিত সহীহ্ হাদীসও উদ্ধৃত হয়েছে। [(আরবী ***********)]
তাবরানী আনাস ইবনে মালিক িথেকে বর্ণন উদ্ধৃত করেছেন, নবী করীম (স) বলেছেন:
(আরবী ***********)
তোমরা ইয়াতীমের ধন-মাল নিয়ে ব্যবসা করবে, যেন যাকাত তা খেয়ে না ফেলে।
হায়সামীবলেছেন, এই হাদীসটির সনদ সহীহ। [(আরবী ***********)] হাফেয যয়নুদ্দিন আল আল-ইরাকীও তাই বলেছেন। [সুয়ূতীও তাঁর (*****) গ্রন্থে এই হাদীসটির সহীহ্ হওয়ার পক্ষে ইংগিত করেছেন। কিন্তু সে ইংগিত যথার্থ নয়; বরং বিকৃত মনে হয়। তাঁর ব্যাখ্যাকার আল-মুনাতী বলেছেন, সুয়ূতী (*****) গ্রন্থে বলেছেন এটি সহীহ্।]
‘তিরমিযী’ গ্রন্থে আমর ইবনে শুয়াইব তাঁর পিতার কাছ থেকে- তিনি তাঁর পিতার কাছ থেকে- তিনি নবী করীম (স)-এর কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন:
(আরবী ***********)
যে লোক ইয়াতীমের অভিভাবক হবে, সে যেন তার পক্ষে ব্যবসা করে। তার ধন-মালযেন বেকার ফেলে না রাখে।তাহলে যাকাত তা খেয়ে ফেলবে।
হযরত উমরের কথানুযায়ী এই হাদীসটি সহীহ্।
বায়হাকী সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব থেকে বর্ণনা করেছেন, হযরত উমর (রা) বলেছেন: “তোমরা ইয়াতীমের মালের দিকে নযর দাও। তা যেন যাকাত দিয়ে শেষ করা না হয়।” বায়হাকী বলেছৈন, এর সনদ সহীহ্। এখানেও সাদ্কা অর্থ যাকাত। বেশকয়েকটি বর্ণনায় এর সমর্থন রয়েছে।
এ হাদীসটির তাৎপর্য এই যে, নবী করীম (স) বিশেষ করে ইয়াতীমের অভিভাবকদের প্রতি এবং সাধারণভাবে গোটা সমাজের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন ইয়াতীমের মাল বৃদ্ধি সাধনের চেষ্টা করার জন্যে। পাগলদের ব্যাপারেও সেই কথা। মুনাফার আশায় ব্যবসা করার তাকীদ করা হয়েছে। তার ফল বৃদ্ধির চেষ্টা না করার পরিণাম সম্পর্কে সাবধান করে দিয়েছেন- ‘অন্যথায় যাকাতই তা খেয়ে ফেলবে।’ বস্তুত ধন-মালের প্রবৃদ্ধির ব্যবস্থা না করে তা থেকে নিয়মিত যাকাত দিয়ে যাওয়ার অর্থই হচ্ছে মুলধনটিকে সম্পূর্ণ নিঃশেষ করা। আর যাকাত যদি প্রকৃতপক্ষে ফরযই হয়, তবেই তা রীতিমত দেয়ার প্রশ্ন উঠে। আর ইয়াতীমের অভিভাবকের পক্ষেতার ধন-মাল থেকে ফরয নয় এমন কাজে ব্যয় করা জায়েয হতে পারে না। তাহলে যা উত্তম নয়, এমনকাজে তার সব ধন-মাল উজাড় হয়ে যাবে। অথচ আল্লাহ্ আমাদের প্রতি নির্দেশ জারী করেছেন যে, আমরা যেন যা উত্তম নয় এমনকাজে ব্যয় করার জন্যে ইয়াতীমদের ধন-মালের কাছেও না যাই-যদ্দিনস না সেপূর্ণ বয়স্ক হচ্ছে। [যেমন সূরা আন’আম-১৫২ আয়াত এবং সূরা আল-ইসরা-৩১ আয়াতে বলা হয়েছে]
৩. এ ব্যাপারে সাহাবীদের কাছ থেকে যে বর্ণনা সহীহ্ প্রমাণিত হয়েছে, তা-ই হয়েছে এ পর্যায়ে তৃতীয় দলীল।
আবূ উবাইদ, বায়হাকী ও ইবনে হাজম বর্ণনা করেছেন, হযরত উমর, আলী, আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর, আয়েশা ও জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বালকের ধন-মালে যাকাত ফরয হওয়ারর কথা বলেছেন। [***১] কোন সাহাবী তার বিরোধিতা করেছেন বলে জানা যায়নি। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে যে বর্ণনাটি রয়েছে, তা যয়ীফ বলে দলীল হিসেবে গ্রহণীয় নয়। [(*****) ৫ম খণ্ড, ২-৮পৃঃ (****) ৫ম খণ্ড, ৩২৯ পৃঃহাদীসটির যয়ীফ হওয়অর কারণ ইবনে লাহ্ইয়া।]
৪. এ মতের চতুর্থ দলীল হচ্ছে সেই বিবেকসম্মত তাৎপর্য যার জন্যে যাকাত ফরয করা হয়েছে।
তাঁরা বলেছেন, ধনীদের- ধন-মালের অংশ দিয়ে গরীবদের দারিদ্র্য বিদূরণই যাকাতের আসল লক্ষ্য। তাতে করে যেমন আল্লাহ্র শোকার আদায় হবে, তেমনি ধন-মালের পবিত্রতা বিধাও হবে। আর বালক ও পাগলের ধন-মালথেকে যখন সাধারণ ব্যয়ভার বহন করা যায়, ঋণ শোধ করা যায়, তখন যাকাত আদায় করা যাবে না কোন্ কারণে, কোন যুক্তিতে? [(আরবী *****) ৫ম খণ্ড, পৃঃ ২০৮]
তাঁরা বলেছেন: একথা যখন সুনিশ্চিত হয়ে দাঁড়াল যে, অভিভাবককেই বালক ও পাগলের ধন-মাল থেকে যাকাত দিতে থাকতে হবে, তখন তা বয়স্ক ও সুস্থ বুদ্ধিসম্পন্ন লোকে যাকাতের মতই আদায় করা ফরয হবে।তার সর্ব দেয় আদায় করার ব্যাপারে অভিভাবকই তার স্থলাভিষিক্ত হবে। তা যেহেতু বালক ও পাগলের ধন-মাল থেকে আদায় করা ফরয, কাজেই যাকাত তাদের পক্ষথেকে আদায় করা অভিভাবকের পক্ষেই কর্তব্য। হবে। যেমন নিকটাত্মীয়দের প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার বহন করা ইত্যাদি।যাকাত দেয়ার ক্ষেত্রে মালের মালিকের নিয়তের মতই অভিভাকের নিয়ত গ্রহণযোগ্য হবে। [(আরবী ***********)]
মালিকীমাহযাবের কোন কোন ফকীহ্ বলেছেন, বালকেরধন-মালথেকে অভিভাবক যাকাত দেবে তখন, যদি সেজন্যে তার জবাবদিহি করার কোন আশংকা না থাকে। নতুবা দেবে না, আর যখন তা দেবে তার জন্যে সাক্ষ্য রাখবে। সাক্ষী না রাখা হলে ইবনে হুবাইব বলেছেন, সে যদি জবাবদিহি থেকে নিরাপদ থাকে, তাহলে তাকে সত্যবাদী বলে মেনে নেয়া হবে। [(আরবী ****) প্রথম খণ্ড, পৃঃ ২০৮]
অভিাবক যদি ভয় করে যে, যাকাত দিলে বালক বড় হয়ে কিংবা পাগল ভাল হয়ে তার কাছে তা ফের চাইবে তাহলে ব্যাপারটি বিচারকের কাছে সোপর্দ করতে হবে। [(আরবী ***********)]
তুলনা ও অগ্রাধিকার দান
বালক ও পাগলের ধন-মাল যাকাত আদায় করা ফরয—এ মতের সমর্থনে যে সব দলীলের যুক্তি দেয়া হয়, তা উপরের এক এক করে উদ্ধৃত হল। প্রায় সমস্ত সাহাবী, তাবেয়ীন ও পরবর্তীকালেল আলিমরাই এ মত পোষণ করতেন। স্বীকার করতে হবে যে, এদের দলীল ও যুক্তি বিপরীত মতের যুক্তি ও দলীলৈর তুলনায় অনেক শক্তিশালী, অকাট্য এবং বলিষ্ঠ।
ক. যাকাতের পক্ষের সব দলীলই ছোট-বড়, অল্প বয়স্ক, পূর্ণ বয়স্ক এবং সুস্থ, বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন ও পাগল সবাইকেই পরিব্যাপ্ত করে। এ দলীল অকাট্য, সে সম্পর্কে কোন আপত্তি নেই। কেননা ধনীদের অর্থে সব গরীব-মিসকীনের জন্যেইআল্লাহ্ তা’আলা হক নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। ধরী হলেই এ হক স্বীকার করতে হবে। তাকে পূর্ণ বয়স্ক হতে হবে, এমন কোন শর্ত আরোপ করা হয় নি। যদিও ইয়াতীমেরধন-মালের সংরক্সণের ওপর শরীয়াতে খুব বেশী গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এক্ষণে যদি কেউ কোন শর্ত আরোপ করতে চায়, তাহলে তার মতের পক্ষে দলীল পেশ করা তারই কর্তব্য। কিন্তু সে দলীল কোথায়?
খ. ইয়াতীমেরধন-মাল বৃদ্ধি করার তাকীদ সম্পন্ন পূর্বোদ্ধৃত ইউসুফ ইবনে মাহাক বর্ণিত হাদীসটির সনদ সহীহ কথা স্পষ্ট, যদিও তা মুরসাল (অর্থাৎ হাদীসটির সাহাবী বর্ণনাকারীর নাম উল্লেখ ন করেই রাসূল (স)-এর কথারূপে বর্ণনা করেছেন একজন তাবেয়ী), কিন্তু তা অন্যান্য বর্ণনার সাহায্যে যথেষ্ট মজবুত হয়ে আছে। সমার্থক সহীহ হাদীস আরও রয়েছে। সাহাবীদের বহু উক্তিও রয়েছে তার সমর্থনে।হযরত আনাসের যে হাদীসটি তাবরানী উদ্ধৃত করেছেন তাও এ পর্যায়েরই।
গ. হযরত উমর, আলী, আয়েশা, ইবনে উমরও জাবির(রা) প্রমুখের উক্তি এ ধরনের বিষয়ে যখন অভিনন হয়, তখন বুঝতেই হবে যে, এটা সাধারণ ঘটনা, বিশেষ করে সেই সমাজে, যেখানে লোকেরা যুদ্ধ-বিহাদে পর পর শাহাদত বরণ করেছেন এবং ইয়াতীমের সংখ্যা ছিল গণনার বাইর। তাদের উপরিউক্ত ধরনের উক্তি থেকেই তাই বোঝা যায়। এ সম্মিলিত উক্তিসমূহকে মূল্যহীন মনে করার অধিকার কারোরই থাকতে পারে না। তাঁরা যেমন পরিস্থিতি বুঝতেন, তেমনি রাসূল (স)-এর সমসাময়িকও ছিলেন। ইয়াতীমের ধন-মাল সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা যা কিছু নাযিল করেছেন, তার করাঘাত তাঁরা বুঝতে পারতেন। আর সত্য কথা এই যে, ইয়াতীমের মালে যাকাত ফরয না হওয়া পর্যায়ে সাহাবীদের কোন উক্তি কারো কাছ থেকেই সহীহ প্রমাণিত হয়নি। হযরত ইবনে মাসউদ ও ইবনে আব্বাস (রা) থেকে যা বর্ণিত, তা যয়ীফ। এ ধলনের কোন বর্ণনা দলীল হিসেবে পেশ করা বা গ্রহণ করা যায় না। [ আল্লামা মুবারকপুরীলিখিত (****) ২৫ পৃঃ দ্রষ্টব্য।]
ঘ. যাকাতের বিধান কার্যকরকরার তাৎপর্য বিবেচনা করলে আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, তা গরীব, মিস্কীন ও ধনীদের ধন-মালের অধিকারীদের হক। আর বালক ও পাগলের ধন-মালেও তাদের হক ধার্য হতে পারে। কেনো তারা দুজনও এমন যে, তাদের ধন-মালে যাকাত ধার্য হওূা কিছুমাত্র অযৌক্তিক নয়। যাকাতকে জগণের, অধিকারসমূহের মধ্যকার একটি হক বলা হয় এজন্য যে, তা নিম্নোদ্ধৃত আয়াতে অন্তর্ভুক্ত:
(আরবী***********)
আর যাদের ধন-মালে সুপরিজ্ঞাত হক রয়েছে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের জন্যে।
অপর আয়াতটি হল: (আরবী***********)
যাকাত ফকির, গরবী ও মসিকীনদের জন্যে…………
আয়াতে যে, (****) বলা হয়েছে, তার তাৎপর্য হচ্ছে যাকাত মালিকানার দিক দিয়ে গরীবদের জন্যে খাস……।
‘যাকাত’ একটা অর্থনৈতিক অধিকার। প্রথম খলীফা হযরত উমর (রা)-কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন:
(আরবী***********)
আল্লাহর শপথ, আমি অবশ্যই যুদ্ধ করব তার বিরুদ্ধে, যে মানায ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য করবে। কেননা যাকাত হচ্ছে ধন-মালের হক।
বালক ও পাগলের মালিকানাধীন ধন-মালে জনগণের ফরয হতে পারে এ কথাটি সর্বসম্মতভাবে প্রমাণিত। কেননা নাবালকত্ব ও পাগলামী জনগণের অধিকার আদায়ের পথে প্রতিবন্ধক হয় না। এ কারণে তাদের ধন-মাল থেকে ক্ষতিপূরণ, অপরাধের বিনিময় বা জরিমানা স্ত্রী-পুত্র পরিজনের জন্যে ব্যয় ইত্যাদি গ্রহণ করায়কোনই বাধা নেই। [(আরবী***********)]
এ প্রেক্ষিতে আমরা বলব, বালক ও পাগলের ধন-মালে যাকাত ফর হবে সেই সব শর্তের ভিত্তিতে, যা আমরা এই পর্যায়ে বলে এসেছি। একটি হ মৌল প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়া। তাদের নিজেদের প্রয়োজনে অপরিহার্য ব্যয়ের জন্যে নগদ অর্থ বের করা হবে এই শর্তের ভিত্তিতেই। কেনো তা তাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত নয়।
এ সব কথা থেকেই ইমাম আবূ হানীফার মাযহাবের উপর অপর তিনজন ইমামের মতের অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। বিশেষ করে তাঁরা বালক ও পাগলের জমির ফসলের ওপর ফরয বলে মত প্রকাশ করেছেন। ফিত্রার যাকাত দেয়াও কথাও তাঁরা বলেছেন। কিন্তু এসব ছাড়া তাদরে অন্যান্য ধন-মালে যাকাত ফরয বলেন নি।
অথচ বিবেকের দৃষ্টিকে বিবেচনা করলে যার কৃষি ফসলের ওশর ফরয হয় তার সমস্ত ধন-মালের যাকাত ফরয হওয়ার যৌক্তিকতা সহজেই বুঝতে পারা যায়। কেননা নিম্নোদ্ধৃত দুটি আয়াতের মধ্যে মৌলিক কোন পার্থক্য নেই:
(আরবী***********) ফসল কাটার দিনই তার হক দিয়ে দাও।
(আরবী***********) তাদের ধন-মালে প্রার্থী ও বঞ্তিদের হক রয়েছে।
প্রথমটি থেকে ওশর প্রমাণিত হয় এবং দ্বিতীয়টি থেকে প্রমাণিত হয় যাকাত।
অনুরূপভাবেরাসূল (স)-এর বাণী:
(আরবী***********) বৃষ্টির পানিতে সিক্ত জমি মাত্রেই ওশরধার্য হয়।
(আরবী***********) মুদ্রায় দশ ভাগের চার ভাগের এক ভাগ দিতে হবে।
এ দুটির মধ্যেও কোন পার্থক্য হয় না।
হানাফী ফকীহগণ যেকৃষি ফসল ও ফল-ফাঁকড়া এবং অন্যান্য ধন-মালের মধ্যে পার্থক্য করেছেন এবং বলেছেন যে, প্রথমটিতে সাহায্যের তাৎপর্য প্রবল; দ্বিতীয়টিতে নয়—এই পার্থক্য করণের কোন যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি নেই। তেমনি কিছু বর্ণিত হয়নি।
ইমাম ইবনে হাজম এই পার্থক্যকরণ দেখে চিৎকার করে উঠেছেন। বলেছেন কৃষি ফসল ও ফল-ফাঁকড়া এবং গৃহপালিত পশু ও স্বর্ণ-রৌপ্যের যাকাতের মধ্যে কি করে পার্থক্যকরা যায়, তা আমার বোধগম্য নয়।
তাদের এইকথাকেযদি উল্টিয়ে ধরা হয় এবং তাদের স্বর্ণ-রৌপ্য ইত্যাদিতে যাকাত ধরা হয় আর ফসল ও ফল০ফাঁকড়ার যাকতা নাকটকরা হয়, তাহলে এ দুটি জবরদস্তির হুকুমের বিপর্যয়ের দিক দিয়ে কোন পার্থক্য হবে কি?
ইবনে রুশ্দ বলেছৈন, যা জমির উৎপাদন এবং জমির উৎপাদন নয়, যা প্রচ্ছন্ন ও যা প্রকাশমান এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য করার কোন দলীল আছে বলে আজ পর্যন্ত আমি জানতে পারিনি। [(আরবী***********)]
ফরয না হওয়া মতের বাতুলতা
ক. বালক ও পাগলের ধন-মালেযাকাত ফরয হয় না, এ মতের পক্ষের দলীল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে:
(আরবী**********)
লোকদের ধন-মাল থেকে যাকাত গ্রহণ করে তার দ্বারা তাদের পবিত্র ও পরিশুদ্ধ কর।
এখানে যে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করণের কথা বলা হয়েছে, ম তা বালক ও পাগলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কেননা এ উদ্দেশ্য কার্যকর হয় গুনাহের প্রতিকূলে।আর দুজনের কোনগুনাহ্ই হয় না। তাই তাদের ধন-মাল থেকে যাকাত গ্রহণেরও কোন প্রশ্ন উঠে না।
এ কথার জবাবে বলা যায় যে, ‘পবিত্র ও পরিশুদ্ধকরণ’ কাজটি বিশেষভাবে কেবল গুনাহের প্রতিকূলে হবে তা হতে হবে এমন কোন কথা নেই। চরিত্র-গঠন মনের পবিত্র ভাবধারার বৃদ্ধি সাধন এবং তাকে লোকদের প্রদি দয়া-সহানুভূতিতে পরিপূরর্ণ করে তোলার জন্যেও তা হতে পারে। তাছাড়া ধন-সম্পদ পবিত্রকরণও একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তখন ‘তাদের পবিত্র করবে’ –এ কথার অর্থ করা হবে ‘তাদের ধন-মাল পবিত্র করবে।’
আমরা যদি স্বীকারও করি- যেসব ইমাম নববী বলেছেন। [ইমাম নববী বলেছেন, যাকাত ফরয হওয়ার বড় ও প্রধান কারণ হচ্ছে পরিশুদ্ধিকরণ; কিনতউ তা শর্ত নয়। কেননা তাদের ধন-মালে ফিতরা ও ওশর ফরয হওয়াকে আমরা একমত হয়ে মেনে নিয়েছি। দিও তার আসল লক্ষ্য পরিশুদ্ধকরণ।] আয়তাটি দ্বারা স্পষ্ট বোঝা যায় যে, পবিত্র ও পরিশুদ্ধিকরণই যাকাত ফরয হওয়ার মৌল উদ্দেশ্য, তবুও কেবল বিশেষ ধরনের ‘পবিত্র পরিশুদ্ধিকরণ’ই তার লক্ষ্য নয়। আর তা ফরয হওয়ার সেটাই একমাত্র কারণও নয়। আলিমগণ একমত হয়ে বলেছেন যে, যাকাত ফরয হওয়ার আর একটা কারণ রয়েছে এবং তা হচ্ছে, ইসলাম ও মুসলিমের দারিদ্র্য দূর করা। আর বালক ও পাগল উভয়িই মুসলিম সমাজের লোক।
খ. (আরবী*****) তিনজন লোকের আমল লেখা হয় না…… কথাটির তাৎপর্য সম্বন্ধে ইমাম নববী বলেছেন: গুনাহ্ এবং কোন কিচু ফরয হওয়া থেকে এ তিনজন মুক্ত; আমরা বলব, হ্যাঁ, এ কথা ঠিক যে তিনজনের কোন গুনাহ্ লেখা হয় না। আর যাকাতও তাদের উপর ফরয হয় না। তা ফরয হয় এবং তাদের ধন-মালের উপর। তা তাদের অভিভাকের কাছ থেকে আদায় করে নিতে হবে। মেযন তারা যদি কোন জিনিসসষ্ট করে ফেলে, তাহলে, তাদের সম্পত্তি থেকে তার ক্ষতিপূরণ দেয়া অবশ্যই ফরয হবে এবং তাদের অভিভাবক তা দিতে বাধ্য হবে। [(আরবী**********)]
গ. তাঁরা যে বলেছেন যাকাত নামাযের মতই ইবাদত বিশেষ, এ কারণে কুরআন মজীদে নামাযের পাশাপাশিই যাকাতের উল্লেখ রয়েছে। আর ইবাদতে নিয়্যাতের প্রয়োন; কিন্তু বালক ও সুস্থ বিবেক-বুদ্ধিহীন লোকের নিয়্যাত হয় না। এ কারণে নামাযও তাদের জন্যে ফরয নয়। অতএব যাকাত দেয়ার দায়িত্বও তাদের উপর অর্পিত হতে পারে না।
এ কথার জবাব এই যে, যাকাত একটা ইবাদত, কুরআনে তা নামাযের পাশাপাশি উল্লিখিত হয়েছে এবং তা ইসলামের পাঁচটি রুকনের অন্যতম, এ কথা আমরা অস্বীকার করছি না। কিন্তু আমরা বলছি যাকাত অর্থনৈতিক সামষ্টিক ব্যাপার বলে তা প্রকৃতিগতভাবেই এক স্বতন্ত্র ধরনের ইবাদত। তা একটি অর্থনৈতিক ইবাদত বলে তাতে প্রনিধিত্ব চলে। তার অভিভাবক আদায় করে দিলে তা অবশ্যই আদায় হয়ে যাবে। এ কারণে তাতে জোর প্রয়োগ এবং সে কাজেনিযুক্ত কর্মচারীর কাছে হল্ চাওয়ার অবকাশরয়েছে, এ দুইটি কাজ জনগণের অধিকার আদায়ে অবশ্যই চলবে। যেমন হানাফী ফকীহ্গণের মতে যিম্মীকেযাকাত আদায় করার জন্যে দায়িত্বশীল বানানো জায়েয। অথচ যিম্মী ইবাদতের যোগ্য লোকদের মধ্যে গণ্য নয়।
যাকাত নিয়্যাত ছাড়া আদায় হয় না বলে যাঁরা মত দিয়েছেন, তাঁদের জবাবে ইবনে হাজম বলেছেন: আল্লাহ্র আদেশক্রমে যকাত আদায় করবে মুসলিমসমাজ ও তার রাষ্ট্রকর্তা। আর যাকাত আদায়ের উদ্দেশ্রেই যখন নেয়া হবে, তখন এ নেওয়াটা অনুপস্থিত, মূর্ছা যাওয়া বক্তি ও পাগল ও বালক-নিয়্যাত করতে পারে না- এমন সব লোকের তরফ থেকেই তা যথাযথভাবে আদায় হয়ে যাবে।
সারকথা: যাকাত অর্থনৈতিক ইবাদত, তাতে প্রতিনিধিত্ব বা স্থলাভিষিক্ততা চলে। অভিভাবক িএ ব্যাপারে বালকের প্রতিনিধি। কাজেই এ ফরয কাজ সম্পন্নকরণে সে স্থলাভিষিক্ত হবে। তবে নামায ও রোযা ইত্যাদি দৈহিক ইবাদতের কথা স্বতন্ত্র। কেননা তা ব্যক্তিগত ইবাদত, তাতে অন্যকে দায়িত্বশীল বা প্রতিনিধি বানানো চলে না, তা ব্যক্তির নিজেরই সম্পন্ন করা উচিত। কেননা তাতে দৈহিক কষ্টের প্রয়োজন বলে ইবাদতের দিকটি স্পষ্ট। আল্লাহর হুকুম পালনের উদ্দেশ্যেই তা করা হবে।
কিন্তু নামায ও যাকাতরে মধ্যে এমন অবিচ্ছেদ্য ও অবিচ্ছিন্নতা নেই, যার দরুন দুটো এক সঙ্গে প্রমাণিত হলে এক সাথে নাকচও হতে হবে। কাজেই তাদের দুজনের নামায আদায়ের বাধ্যতা বাতিল হলে এবং যাকাত আদায়ের বাধ্যতা হলে বহাল থাকলে শরীয়াতের দলীলের দিক দিয়ে কোনই অসুবিধা হয় না। [(আরবী**********)] কেননা আল্লাহ্ তা’আলা সবগুলোর ফরয কাজ এমনভাবে ধার্য করেন নি যে, তা তার একটি প্রমাণিত হলে অপরটিও প্রমাণিত হয়ে যাবে, আর একটি নাকচ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে অপরটিকেও নাকচ হয়ে যেতে হবে।কাজেই নামায পত্যাহৃত হলে যাকাতকেও প্রত্যাহৃত হতে হবে এমন কথার কোন যুক্তি নেই। তারও কারণ এই যে, আল্লাহ্ বা তাঁর রাসূল যা ফরয করেছেন তা নাকচ হতে পারে যদি আল্লাহ ও রাসুল তা নাকচ করেন। আর একটি ফরয নাকচ হলে সেই কারণে ভ্রান্ত মতের ভিত্তিতে অন্যটিকেও নাকচ করে দেয়া যায় না—কুরআন ও হাদীসের অকাট্য দলীল ছাড়া। [(আরবী**********)]
এ পর্যায়ে আবূ উবাইদ যা লিখেছেন, তা অবশ্যই প্রনিধানযোগ্য। তা হল: ইসলামী শরীয়াতের কিছু অংশের উপর ভিত্তি করে চিন্তা করা যায় না। কেননা সেগুলো মৌলিক। আর তার প্রতিটিই নিজস্ব ফরয হওয়ার ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে। [(আরবী**********)]
নামায বান্দাদের কাছে আল্লাহর হক, তা বন্দা ও মাবুদের মধ্রকার সম্পর্কের ব্যাপারে বিশেষ অবদান রাখে। পক্ষান্তরে যাকাত হচ্ছে আল্লাহর নির্ধারিত ধনীদের ধন-সম্পদে গরীব-মিসকীনের হক। [(আরবী**********)]
একদিকে বালক ও পাগলের কল্যাণ, আর অপরদিকে গরীব-মিসকীনের কল্যাণ। দ্বীন ও রাষ্ট্রের কল্যাণের ব্যাপারে। তা সত্ত্বেও শরীয়াত বালক-পাগলের ধন-মালে যাকাত ফরয করে আল্লাহ্ তা’আলা তাদের কল্যাণের প্রতি কিছুমাত্র উপেক্ষা প্রদর্শন করেন নি। কেননা যে কোন বর্ধনপ্রবণ ধন-মালেই যাকাত ফরয হওয়া অবধারিত; কার্যত তা বৃদ্ধি না পেলেও। যেমন মৌল প্রয়োজন পূরণের পর উদ্বৃত্ত ধন-মালছাড়া যাকাত ফরয হয় না। কোন কোন হানাফী ফিকাহ্বিদ মত দিয়েছেন, যে সব নগদ টাকা মালিকের প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্যে নির্দিষ্ট, তাতে যাকাত ফরয হয় না, তা নিসাব পরিমাণ হলেও; এবং একটি বছরকাল অতিক্রান্ত হলেও। কেননা তা যেন অস্তিত্বহীন (তৃতীয় অধ্যায়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে)। বালক ও পাগলের ক্ষেত্রেও আমরা চিন্তাই যথার্থ মনে করছি, যদি বালকের পূর্ণ বয়স্ক হওয়ার সময় এবং পাগলের সুস্থ হওয়ার সময় তাদের মৌল প্রয়োজন পূরণের পরিমাণের অধিক নগদ টাকার মালিক না হয়।
এখানে কয়েকটা জরুরী কথা অবশ্যই স্মরণে রাখতে হবে:
প্রথম. বালক যে ইয়াতীমহবেই (এবং এই সুবাদে যাকাতরে ক্ষেত্রে সে সুবিধা পাওয়ার অধিকার) বলে মনে করতে হবে—এমন কোন কথা নেই। বালক তার মা’র সম্পদ-সম্পত্তিরও উত্তরাধিকারী হতে পারে, কেউ-তাকে ‘হেবা’ করতে পারে, দাতা বা অন্য কোন নিকটাত্মীয়—কোন অপরিচিত ব্যক্তি তার জন্যে ওসীয়ত করতে পারে। এ কারণে এ আলোচনার শিরোনাম হওয়া উচিতঃ বালকের মালের যাকাত’; ইয়াতীমের মালের যাকাত নয়।
দ্বিতীয়. ইয়াতীমদের ধন-মালের প্রবৃদ্ধি সাধনে মনোযোগী হওয়ার জন্যে কুরআন-হাদীসে অভিভাবকদের প্রতি সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে, যেন যাকাত তা নিঃশেষ করে না দেয়। আমর ইবনে শুয়াইব কর্তৃক- তাঁর পিতা তাঁর দাদা থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছৈন, রাসূলে করীম (স) লোকদের সামনে ভাষণ দিয়ে বলেছেন:
(আরবী**********)
তোমরা যারা ইয়াতীমের অভিভাবক হবে, সে ইয়াতীমের ধন-মাল থাকলে তা নিয়ে যেন ব্যবসাকরা হয়, তা বেকার ফেলে রাখা না হয়। নতুবা যাকাত তা খেয়ে ফেলবে। (তিরমিযী, দারে কুতনী)
ইউসুফ ইবনে মাহাক বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে, রাসূল করীম(স) বলেছেন:
(আরবী**********)
ইয়াতীমের ধন-মালের প্রতি তোমরা লক্ষ্য রাখ, যাকাত যেন তা শেষ করে না ফেলে। (তিরমিযী, দারে কুত্নী)
অতএব ইয়াতীমের ধন-মালের দায়িত্বশীলদের কর্তব্য হল তার প্রবৃদ্ধি সাধনে মনোযোগী হওয়া, অনুরূপভাবে তা থেকে যাকাত হিসেব করে দিয়ে দেওয়াও তাদেরই কর্তব্য।
স্বীকার করছি, সম্পদের দিক দিয়ে এ দুটো হাদীসের দুর্বলতা রয়েছে, অথবা তার বর্ণনা পরম্পরা অবিচ্ছিন্ন নয়। কিন্তু তা নানাভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে:
প্রথমত. অনেক কয়েটি সূত্রে এ অর্থের হাদীস বর্ণিত হয়েছে, যার একটি অপরটিকে শক্তিশালী করে তোলে। হাফেয ইরাকী তো কয়েকটি সূত্রকেই সহীহ বলেছেন।
দ্বিতীয়ত, কোন কোন সাহাবী থেকে অনুরূপ কথা বর্ণিত হয়েছে।
তৃতীয়ত, ইয়াতীমেরধন-মাল নিয়ে ব্যবসায় করার কথাটি কুরআনের এ আয়াতটির প্রতিধ্বনিত:
(আরবী**********)
তোমরা তাতে তাদের খোরাক-পোশাকের ব্যবস্থা কর। তা থেকে এ ব্যবস্থা করতে বলা হয় নি।
উক্ত কথাটি ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সম্পাদকে উৎপাদনের কাজে লাগানো এবং পুঁজিকরণ নিষিদ্ধ হওয়া। উপরোদ্ধৃত হাদীসমূহে ইয়াতীমদের ধন-মালের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখতে বলা হয়েছে বিশেষভাবে তাদের অভিভাবকদের প্রতি এবং সাধারণভাবে মুসলিম সমাজে রাষ্ট্রপ্রধানের প্রতি। কাজেই সরকারীভাবে ইয়াতীমেরধন-মালের সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে দায়িত্বশীল লোক নিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে, যেন তার প্রবৃদ্ধি সাধনে উত্তম ব্যবস্থার দ্বারা নিশ্চিত হওয়া যায়, শরীয়াতের বিধান তাতে কার্যকর করা হয়, ক্ষতিপূরণসমূহ দেয়া হয়, ইয়াতীমের প্রয়োজন পূরণ ও তার প্রবৃদ্ধি সাধন সম্ভব হয়। তা হলে যাকাত সে ধন-মাল খেয়ে ফেলতে পারবে না।
ইয়াতীমের জন্যে কোন আশংকা বোধ করার কারণ নেই। প্রথমত, তারা সচ্ছল অবস্থার নিকটাত্মীয়দের রক্ষণাবেক্ষণ পাবে, অন্তত রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনার উপর তারা নির্ভরশীল হতে পারবে। আল্লাহ্ বলেছেন:
(আরবী*******)
লোকেরা তোমাকে জিজ্ঞেস করে, তারা কি খরচ করবে? তুমি বলে দাও, তোমরা যে ভাল জিনস ব্যয় করবে, তা করবে পিতামাতার জন্যে, নিকাটত্মীয়, িইয়াতীম, মিসকীন ও নিঃস্ব পথিকের জন্যে। আর তোমরা যে ভালো জিনিসই ব্যয় করবে, সে বিষয়ে আল্লাহ্ পুরাপুরি অবহিত।
(আরবী*******)
পূর্বে ও পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফেরানোই প্রকৃত ধর্মপ্রাণতা (Righteousness) নয়।; বরং প্রকৃত ধর্মপ্রাণতা আছে তার, যে ঈমান এনেছে, আল্লাহ্ পরকাল, ফেরেশ্তা, কিতাব ও নবী-রাসূলগণের প্রতি এবং আল্লাহ্র প্রতি ভালোবাসার দরুন অর্থ সাহায্য দিয়েছে, নিকটাত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকীন, নিঃস্ব পথিক, প্রার্থী ও দাস বা বন্দীদের মুক্তির জন্যে।
(আরবী*******)
তোমরা জেনে রাখ, যে জিনিসিই তোমরা গনীমত হিসেবে পাবে, তারই এক-পঞ্চমাংশ আল্লাহ্র জন্যে, রাসূলের জন্যে নিকটাত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকীন ও নিঃস্ব পথিকের জন্যে।
(আরবী*******)
নগরবাসীদের থেকে যা কিছু আল্লাহ্ তাঁর রাসূলকে দান করেছেন, তা আল্লাহ্র জন্যে, রাসূলের জন্যে, নিকটাত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকীন ও নিঃস্ব পথিকের জন্যে, যেন তা তোমাদের ধনীদের মধ্যেইি আবর্তনশীল হয়ে না থাকে।
এ সব আয়াতের আলোকে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, ব্যক্তিদের ধন-মালে ইয়াতীমের অংশ রয়েছে যখন তারা যাকাত বা যাকাত ছাড়া অন্যভাবে কোন কিছু ব্যয় করবে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ- যাকাত, গণীমত ও ‘ফাই’ যাই হোক- তাতেই ইয়াতীমের অংশ রয়েছে। এটা তাদের প্রতি আল্লাহ্র অনুগ্রহ ব্যবস্থা। তাদের অক্ষমতা-দুর্বলতার প্রতি লক্ষ্য রেখেকই তা করা হয়েছে। নবী করীম (স) বলেছেন:
(আরবী*******)
প্রতিটি মুসলমানেরকাছে তার নিজের তুলনায় আমি অধিক উত্তম। যে লোক ধন-মাল রেখে যাবেতার উত্তরাধিকারীদের জন্যে হবে। আর যে লোককোন ঋণ বা ধ্বংসহয়ে যাওয়ার মত সন্তানাদি রেখে যাবে, তাদের ব্যাপারে আমারদিকেএবং তাদের দায়িত্ব আমার উপর।
বস্তুত ইয়াতীম ইসলামী সমাজের সামষ্টিক দায়িত্বে থাকবে। এ কারণে তার বিপদে পড়ার বা অর্থাভাবে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কোনই আশংকা থাকতে পারে না।
সারকথা
বালক ও পাগলের ধন-মালে অবশ্যই যাকাত ফরয হবে। কেননা তা একটা হক, ধন-মালের সাথে তার সম্পর্ক। কাজেই তার মালিক ছোট বা পাগল হলে সে হ ক নাকচ হয়ে যেতে পারে না। আর সে ধন-মাল গৃহপালিত পশুহোক কিংবা কৃষি ফসলবা ফল-ফাঁকড়া, ব্যবসা পণ্য বা নগদ টাকা-তাতে কোন পার্থক্য নেই। অবশ্য যে নগদ টাকা স্বীয় মৌল প্রয়োজন পূরণের জন্যে রাখা হয়েছে তার কথা নয়, কেননা তা তো তখন আসল প্রয়োজনের পরিমাণের অতিরিক্ত হবে না। বালক ও পাগলের অভিভাবকের কাছে যাকাত দাবি করা হবে। মালিকী মাযহাবের কোন কোন ফিকাহ্বিদের মত অনুযায়ী ‘শরীয়াত বিভাগ’-এ তা আদায় করে নেবে।
তৃতীয় অধ্যায়
যেসব ধন-মালে যাকাত ফরয হয় তার নিসাব পরিমাণ
১. যে ধন-মালে যাকাত ফরয হয়
২. জন্তু ও পশুসম্পদের যাকাত
৩. স্বর্ণ ও রৌপ্যের নগদ অর্থ ও অলংকারের যাকাত
৪. ব্যবসা পণ্যের যাকাত
৫. কৃষি সম্পদের যাকাত
৬. মধু ও পশু উৎপাদনের যাকাত
৭. খনিজ ও সামুদ্রিক সম্পদের যাকাত
৮. ঘর-বাড়ী ও শিল্প-কারখানা প্রভৃতি উৎপাদনের যাকাত
৯. স্বাধীন শ্রম ও উপার্জনলব্ধ সম্পদের যাকাত
১০. বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন বিষয়ের আলোচনা শেয়ার, বণ্ডস্ ইত্যাদি।
যেসব ধন-মালে যাকাত ফরয এবং যাকাতের নিসাব পরিমাণ
এ অধ্যায়ে যাকাতের নিয়ম বিধান আলোচিত হয়েছে, যাকাত কোন্ কোন্ ধন-মালে ফরয হয়, কত পরিমাণের মাল থাকলে যাকাত ফরয হবে তৎসংশ্লিষ্ শর্তাবলী- ইত্যাদির আলোচনা সন্নিবেশিত হয়েছে। এ অধ্যায়ে মোট দশটি পরিচ্ছেদ রয়েছে:
প্রথম পরিচ্ছেদ : যে সব ধন-মালে যাকাতফরয হয় তার প্রাথমিক লাচনা ও শর্তাবলী
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পশু সম্পদের যাকাত
তৃতীয পরিচ্ছেদ : স্বর্ণ-রৌপ্যের যাকাত
চতুর্থ পরিচ্ছেদ : ব্যবসা সম্পদের যাকাত
পঞ্চম পরিচ্ছেদ : কৃষি সম্পদ ও ফল-ফাঁকড়ার যাকাত
ষষ্ট পরিচ্ছেদ : মধু ও পশু উৎপাদনের যাকাত
সপ্তম পরিচ্ছদ : খনিজ ও সামুদ্রিক সম্পদের যাকাত
অষ্টম পরিচ্ছেদ : ভাড়ায় লাগানো ঘর-বাড়ি ও কল-কারখানা ইত্যাদির যাকাত
নবম পরিচ্ছেদ : স্বাধীন শ্রম-মেহনত ও কর্মোপার্জন-উদ্ধৃত্তে যাকাত
দশম পরিচ্ছেদ ; বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা
প্রথম পরিচ্ছদ
যে সম্পদে যাকাত ফরয হয়
যে সব ধন-সম্পদে যাকাত ফরয হয় কিংবা ফরয হওয়ার শর্ত কি, এ পর্যায়ে কুরআনের নির্দিস্ট করে কিছু বলেনি। এমনকি কোন্ সম্পদে কি পরিমাণ যাকাত ফরয, সে ব্যাপারেও কুরআন নীরব। এ কাজটির দায়িত্ব সুন্নাতের উপর অর্পিত হয়েছে, তা কথার মাধ্যমে জানা যাক, কি কাজের বর্ণনার মাধ্যমে।বস্তুত কুরআনে যা মোটামুটিভাবে বলা হয়েছে, সুন্নাতই তা বিস্তারিতভাবে বলে দিয়েছে ও তার বাস্তব কর্মরূপ উপস্থাপিত করেছে। কুরআনে যা অস্পষ্ট রয়েছে, সুন্নাত তা স্পষ্ট করে দিয়েছে। কুরআনে যা সাধারণভাবে বলা হয়েছে, সুন্নাত তা বিশেষভাবে চিহ্নিত করেছে; আর বাস্তবায়নের পন্থা নির্দেশ করেছে। কুরআনে যে মতাদর্শের রূপরেখা পেশ করা হয়েছে, সুন্নাতে তার বাস্তব রূপ তুলে ধরেছে, মানব জীবন অনুসরণের পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছে। কেননা রাসূলে করীম(স)-ই আল্লাহর নাযিল করা বিধানের বাস্তব ব্যাখ্যাদানের জন্যে দায়িত্বশীল। আর তা তিনি করেছেন তাঁর মুখের কথা দ্বারা, কাজের দ্বারা এবং সমর্থনের দ্বারা। আল্লাহর কালামের আসল বক্তব্য কি, তা দুনিয়ার সব মানুষের তুলনায় তিনিই অধিক ভাল জানেন।
এ পর্যায়েই আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন:
(আরবী********)
আর তোমার প্রতি কুরআন এ জন্যে নাযিল করেছি যে, লোকদের জন্যে তাতে যা কিছু নাযিল করা হয়েছে, তা তুমি লোকদের সবিস্তারে ও সঠিকভাবে বলে দেবে এবং সম্ভবত তারাও চিন্তা-ভাবনা করবে।
দুনিয়ার মানুষের কাছে ধন-মাল সম্পদ বিচিত্র ধরনের। কুরআন এই কথার উল্লেখ করেছে এবং তার যাকাত দেয়া সম্পর্কে আমাদের অবহিত করেছে। তাতে আল্লাহর হক থাকার কথাও মোটামুটি বলেছে।
প্রথম—স্বর্ণ ও রৌপ্য। এর উল্লেখ হয়েছে কুরআনের এ আয়াতে:
(আরবী********)
আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য জমা করেতা আল্লাহর পথে ব্রয় করে না, তাদের পীড়ানকারী আযাবের সুসংবাদ দাও।
দ্বিতীয়-কৃষিফসল ও ফল-ফাঁকড়া। কুরআনে বলা হয়েছে: (আরবী********)
তোমরাসকলে তার ফল খাও যখন তা ফল দেবে। আর তা কাটার দিনই তার হক আদায় করে দাও।
তৃতীয়-ব্যবসা ইত্যাদির উপার্জন। কুরআনে বলা হয়েছে: (আরবী********)
হে ঈমানদার লোকেরা। তোমরা যে সব পবিত্র ধন-মাল উপার্জন কর, তা থেকে ব্যয় কর।
চতুর্থ—জমি, খনি িইত্যাদির উৎপাদন। ইরশাদ হয়েছে: (আরবী********)
আর সেই জিনিস থেকেও, যা আমরা জমি থেকে তোমাদের জন্যে উৎপাদন করেছি।
এসব ছাড়াও কুরআন সাধারণ ও নিঃশর্ত কথা দ্বারা যাকাত ফরয হওয়ার ধন-সম্পদের প্রতি ইংগিত করেছে। কুরআনে উদ্ধৃত একটি শব্দ হচ্ছে (***) অর্থাৎ ধন-মাল-সম্পদ-সম্পত্তি। বলা হয়েছে:
(আরবী********) তাদের ধন-মালসম্পদ থেকে যাকাত আদায় কর।
অপর আয়াতে রয়েছে: (আরবী********)
তাদের ধন-মালে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের হক রয়েছে।
‘মাল’ শব্দের অর্থ- আভিধানিক শরীয়াতের পরিষাভায়
কুরআন মজীদে এবং হাদীসেও যে ‘মাল’-এর কথা বলা হয়েছে যার বহু বচর ‘আমওয়াল’-তার অর্থ কি?
যে-আরবদের ভাষায় কুরআন নাযিল হয়েছে, তাদের কাছে ‘মাল’ বলতে বোঝায় এমন জিনিসই যা অর্জন-দখল করা এবং মালিক হওয়ার কামনা-বাসনা ও চেষ্টা মানুষের মধ্যে থাকে। এই দিক দিয়ে উষ্ট্র মাল, গরুও মাল, ছাগলও মাল, খেজুর গাছ, স্বর্ণ ও রৌপ্য এ সবই ‘মাল’। আরবী অভিধান ‘কামুসুল মুহীত’ ‘লিসানুল আরব’-এ বলা হয়েছে: (আরবী********) –‘জিনিস-পত্রের মধ্যে তুমি যারই মালিক হবে, তা-ই ‘মাল’। তবে মরুবাসীরা সাধারণত ‘মাল’ বলতে কেবল গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তুই বুঝে। আর নগরবাসীরা সাধারণ ‘স্বর্ণ-রৌপ্যকেই ‘মাল’ মনে করে। যদিও সব জিনিসই ‘মাল’।
ইবনুল আসীর লিখেছেন : মুলত ‘মাল’ বলতে মালিকানায় লব্ধ বোঝায়। কিন্তু চলতি অর্থে যেসব জিসের মালিকানা লাভ হয় ও দখলে আনতে চাওয়া হয়, তা সবই ‘মাল’ রূপে গণ্য।