শরীয়াতের দৃষ্টিতে ‘মাল’ শব্দের অর্থ নির্ধারণে ফিকাহ্বিদগণ বিভিন্ন মত দিয়েছেন।
হানাফী ফিকাহ্বিদদের মতে যা করায়ত্ত করা যায় এবং স্বাভাবিকভাবে ব্যবহার করা যায় তা-ই ‘মাল’। এ দৃষ্টিতে দুটি গুণ ব্যতিরেকে কোন জিনিসকে ‘মাল’ বলা যাবে না। একটি হল অধিকৃত (possession) হওয়ার গুণ আর দ্বিতীয়টি স্বাভাবিকভাবে ব্যবহৃত হওয়া সম্ভাব্যতা। অতএব যে জিনিসই অধিকৃত হবে এবং কার্যত ব্যবহার করা যাবে, তা-ই ‘মাল’ বলে গণ্যহবে। জমি, পশু ইত্যাদি যে সবের আমরা মালিকহয়ে থাকি তা সব-ই মাল- তা বস্তু বা দ্রব্য হোক, কি নগদ টাকা। যেসব জিনিস উপস্থিত অবস্থায় অধিকৃত ও ব্যবহৃত হওয়ার যোগ্য নয়; কিন্তু যে সবের মধ্যে তা রূপায়িত হতে পারে তার সম্ভাব্য রয়েছে তা-ই ‘মাল’-এর মধ্যে গণ্য। নদী-সমুদ্র গর্ভস্থ মাছ বা শুন্যে উড়ন্ত পাখী, বনজংগলের পশু। এগুলোর করায়ত্ত করা সম্ভব এবং স্বাভাবিকভাবেই তা ব্যবহৃত হতে পারে।
কিন্তু যা করায়ত্ত হওয়ার যোগ্য নয়, তা ব্যবহৃত হতে পালেও ‘মাল’রূপে গণ্য হবে না। যেমন সূর্যের আলো ও তাপ, বাতাস ইত্যাদি। তেমনি যা স্বাভাবিকভাবে ব্যবহৃত হতে পারে না- কারর্যত তা অর্জিত হতে পারলেও ‘মাল’ বলা যাবেনা। যেমন একমুঠি মাটি, পানির ফোঁটা, মৌমাছি, চাউলের একটা দানা ইত্যাদি।
এ অর্থ বিশ্লেষণের লক্ষ্য হচ্ছে এ কথা স্পষ্ট করা যে, ‘মাল’ ‘বস্তু’ ছাড়া আর কিছু নয়। বস্তুই করায়ত্ব করা যায়, দখল করা যায়। বস্তু ব্যবহারের ফায়দা ‘মাল’ বলে গণ্য হবে না- যেমন ঘরবাড়িতে বসবাস, গাড়ি ঘোড়ায় আরোহণ, বস্ত্র পরিধান কেননা এগুলো দখল ও করায়ত্ব করা যায় না। অধিকারসমূহও সেইরূপ। যেমন ইত্যাদি লালন-পালনের অধিকার, অভিভাবকত্বের অধিকার। এটা হানাফী মাযহাবের মত।
শাফেয়ী, মালিকী ও হাম্বলী মাযহাবের মত হল, বস্তুর ব্যবহারকারিতাই মাল। কেননা তাঁদের মতে মূল জিনিসের অধিকৃত ও করায়ত্ত হওয়ার সম্ভাব্যতাই আবশ্যকীয় নয়, তার মৌল ও উৎস করায়ত্ত করার সম্ভাব্যতাই যথেষ্ট। আর ব্যবহারিকতার ক্ষেত্র ও উৎস করায়ত্ত করার দ্বারাই ব্যবহারিক মল্য করায়ত্ত করা সম্ভব। যেমন কেউ কোন গাড়ি করায়ত্ত করেনিলে অপরকে তার অনুমতি ভিন্ন তা ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখা যায়।
আইন প্রণয়নকারীরা এ মতই গ্রহণ করেছে বলে মালের ব্যবহারিক মূল্যকেও ‘মাল’ গণ্য করেছেন। যেমন গ্রন্থস্বত্ব, আবিষ্কারের সাক্ষ্যাদিও ‘মাল’। ফিকাহ্বিদ্দের কাছে যা ‘মাল’ বলে গণ্য, তার চাইতে অধিক সাধারণ অর্থে তারা ‘মাল’ শব্দ ব্যবহার করেন [(আরবী*********)]
এ পর্যায়ে আমাদের মত হল, ‘মাল’ শব্দের যে তাৎপর্য হানাফী মতের ফিকাহ্বিদগণ বলেছেন তা তার অভিধানের অর্থের নিকটবর্তী; আরবী অভিধানসমূহে যেমন বলা হয়েছে।যাকাত পর্যায়ে যত দলীল এসেছে তা সবই এ অর্থের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। কেননা মূল বস্তু ব্যবহারিকতা নয়; ইহা তো গৃহীত, হস্তগত ও সংগ্রহীত হতে ও বায়তুলমালে রক্ষিত হতে পারে এবং পাওয়ার যোগ্য লোকদের মধ্যে তা বন্টন করা যেতে পারে।
ইবনে নজীম বলেছেন, মাল হচ্ছে: (আরবী*********)
যা সংগৃহীত ও সঞ্চিত হতে পারে প্রয়োজনের জন্যে।
অর্থাৎ মুল বস্তু। ব্যবহারিকতার মালিক বানানো এর মধ্যে গণ্য নয়। ‘কাশফুল কবীর’ গ্রন্থে বলা হয়েছে:
(আরবী*********)
মূল দৃঢ় কঠিন বস্তুটির মালিক বানানো ছাড়া যাকাত আদায়ের উপায় নেই। এমন কি, কেউযদি তার ঘরে কোন গরীব ব্যক্তিকে বসবাসকরতে দেয় যাকাত আদায়ের নিয়তে, তাতে তা আদায় হবে না। ব্যবহারিকতা তো আর মূল বস্তু নয়। এ হল দুটি পন্থার একটি। অপরটি হল ব্যবহারিকতা ও মাল। প্রয়োগের সময়তা মূল বস্তুর দিকে প্রবর্তিত হবে। [(আরবী*****)]
যে মালে যাকাত ফরয হয়তার শর্তাবলী
মানুষ যে জিনিসের মালিক হয়, যার কোন মূল্য আছে- তা-ই মাল। তাহলে সর্ব প্রকার মালেই কি যাকাত ফরয হবে? তার পরিমাণ যা-ই হোক না কেন? তার প্রয়োজন যতটাই থাক না কেন?
মানুষের বাসগৃহও মাল, পরিধেয় বস্ত্রও মা, পড়ার জন্যে সংগৃহীত বই-পত্রও মাল। চাষ-বাস ইত্যাদি কাজেহাতে ব্যবহার্য যন্ত্র ও পাত্র ইত্যাদিও মাল। ….. তাহলে এগুলোর উপরও কি যাকাত হবে?
একজন আরববেদুই দুটি উষ্ট্রের মালিক কিংবা কিছু ব্যবহার্য দ্রব্যাদির। তার উপর যাকাত ফরয? কৃষক তার জমি চাষকরে এক বা দুই ‘আরবদের’ ফসল ফলায় তার নিজের ও পরিবারবর্গের খোরাকের জন্যে। তার উপরও কিযাকাত ধার্য হবে?
প্রায় প্রত্যেক মানুষইকিছুটচাকার মালিকহয়ে থাকে। তার উপও কি যাকাত ধার্য হবে?
ব্যবসায়ী কিছু না কিছু পরিমাণ পণ্যের মালিক হয়ে থাকে। কিন্তু নগদ টাকাও তার কাছে থাকা স্বাভাবিক, সেই সাথে তার থাকে সমপরিমাণ বা ততোধিক পরিমাণের ঋণ। এখন তাকেও কি যাকাত দিতে হবে?
ইসলাম যে ন্যায়বিচারের আহবান নিয়ে এসেছে, ইসলামী শরীয়াত মানবজীবনেযে সহজতা ও সুখ-শান্তি বিধানের প্রতিশ্রুদিবদ্ধ, তামানুষকে কষ্ট অসুবিধা কঠিনতায় নিক্ষেপ করতে অস্বীকার করে। কেননা আল্লাহই তা তাদের থেকে দূর করেদিতে চান। এরূপ অবস্থায় যে মালের উপর যাকাত ফরয হতে পারে তার গুণ, পরিমাণ ও পরিচিত সুনির্দিষ্ট হওয়া একান্ত বাঞ্ছনীয়। তার শর্তাবলীও সম্মুখে থাকা আবশ্যক।
আমরা এখানে এই শর্তাবলীর উল্লেখকরছি।
১. পূর্ণাঙ্গ মালিকানা
সমস্বত ধন-মাল আসলে আল্লাহ্র মালিকানায়। তিনি তার উদ্ভাবক, তার স্রষ্টা। তিনি তা মানুষকে দান করেছেন। তা-ই মানুষের রিযিক। এ জন্যেকুরআন বারবার এই মহাসত্যকে আমাদের সম্মুখে উপস্থাপিত করেছে। বহু সংখ্যক আয়াতে সমস্ত ধন-মাল আল্লাহ্র বলে স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে।
(আরবী*******)
এবং তোমরা তাদের দাও আল্লাহর সেই ‘মাল’ থেকে যা তিনি তোমাদের দান করেছেন।
(আরবী*******) এবং ব্যয় কর তোমরা সেই রিযিক থেকে, যা আমরা তোমাদের দিয়েছি।
(আরবী*******) তার কার্পণ্য করে তা নিয়ে আল্লাহ্ তাঁর অনুগ্রহ থেকে তাঁদের দিয়েছেন।
এ সব ধন-মালে মানুষের স্থান ও মর্যাদা হচ্ছে উকিলবা প্রতিনিধিত্বের মাত্র। তারা শুধু ধন-ভাণ্ডারে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বশীল। আল্লাহ্ নিজেই বলেছেন:
(আরবী*******)
এবং খরচ কর তোমরা সেই জিনিস থেকে, যাতে আল্লাহ্ তোমাদের খলীফা বানিয়েছেন।
আল্লাহ যদিও সব ধন-মালের প্রকৃত মালিক, প্রকৃত অধিকারী, তা সত্ত্বেও এ সব তিনি তাঁর বান্দাদের দিয়েছেন তাঁর অনুগ্রহ হিসেবে, মানুষের প্রতি সম্মান প্রদর্শন স্বরূপ। সেইসাথে তা আল্লাহ্র নিয়ামতসমূহে বান্দাদের পরীক্ষার মাধ্যমেও। আল্লাহ্ চান, আল্লাহ্ চান, তারা যেন আল্লাহ্র দানের কথা সচেতনভাবেস্বীকার করে। তারা আল্লাহ্র পৃথিভীতে তাঁর খলীফা, এ কথা যেন তারা বুলে না যায়। আল্লাহ্ এ সব তাদের মালিকানায় দিয়ে তাঁরিই প্রতি দায়িত্বশীল বানিয়েছেন, এ জন্যে তাঁর কাছে তাদের জবাবদিহি করতে হবে, এ কথা যেন সব সময় তাদের স্মরণে থাকে। তারা যেন হয় এ সবের ব্যাপারে আল্লাহ্র আমানতদার। ঠিক যেমন পিতা তার বিত্ত-সম্পত্তির একাংশ তার সন্তানদের দান করে। যেন তাদের মধ্যে ব্যক্তিত্বের চেতনা জাগ্রত হয়, তার নিজস্বভাবেতা ব্যয়-ব্যবহার করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। পিতা পরীক্ষা করে সন্তানদের, তারা তার শুভ ধারণানুযায়ী উত্তমভাবে সেগুলোর ব্যয়-ব্যবহার করতে পারছে কিনা, না তা খারাপভাবে ব্যবহার করে তাদের ব্যর্থতা প্রকট করে তোলে—বাস্তবতা তা দেখতে চায়। ধন-মালের মালিকআল্লাহ্ মানুষকে এ সব দিয়ে ঠিক সেই কাজ করেছেন। এ একটা ভালো দৃষ্টান্ত মাত্র।
এর কারণে কুরআন শরীফেই আমরা দেখতে পাই, ধন-মাল প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ্র হওয়া সত্ত্বেও তিনি তা মানুষের বলে উল্লেখ করছেন। যেমন বলেছেন:
(আরবী*********)
হে ঈমানদার লোকেরা, তোমাদের ধন-মাল (যা তোমাদের আয়ত্তে রয়েছে) যেন তোমাদের গাফিল না বানিয়ে দেয়।
(আরবী*********) তোমাদের ধন-মাল ও তোমাদের সন্তান পরীক্ষার মাধ্যম।
(আরবী*********) ভাবে- মনে করে যে, তার ধন-মাল তাকে চিরন্তন বানিয়ে দেবে।
(আরবী*********) তাকে মুখাপেক্ষীহীন বানায় নি তার ধন-মাল আর যা সে উপার্জন করছে, তা।
(আরবী*********) তাদের ধন-মালে হক রয়েছে প্রার্থী ও বঞ্চিতের।
(আরবী*********) তাদের ধন-মাল থেকে সদ্কা গ্রহণ কর।
(আরবী*********) তাদের ধন-মাল ও সন্তান যেন তোমাকে বিস্মিত ও হতচকিত না করে।
(আরবী*********) অএব তাদের ফিরিয়ে দাও তাদের ধন-মাল।
(আরবী*********) তোমরা তোমাদের ধন-মাল পারস্পরিকভাবে বাতিল পন্থায় ভক্ষণ করো না।
এ সব আয়াতে ধন-মাল মানুষের বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
আল্লাহ তা’আলা তাঁর অনুগ্রহ ও করুণা দ্বিগুণিত ও চূড়ান্ত করার উদ্দেশ্যে তাঁর দেয়া ধন-মাল থেকে মানুষেরকাছে করয চান। তিনি নিজে সবকিচুর মালিক হয়েও তা তিনি তাঁর বান্দাদের কাছ থেকে ক্রয় করেন। এটা তাঁর দয়া ও অনুগ্রহ ছাড়া আর কিছুই নয়। ইরশাদ করেছেন:
(আরবী*********)
কে আছে আল্লাহকে করযে হাসানা দিতে প্রস্তুত, তাহলে তিনি তা বহুগুণ বেশী করে ফিরিয়ে দেবেন।
(আরবী*********)
কে আছে আল্লাহ্কে উত্তম করয দিতে প্রস্তুত, তাহলে তিনি তাকে তার জন্য বহুগুণ বেশী করে ফিরিয়ে দেবেন এবং তার জন্যে উত্তম কর্মফল হবে।
(আরবী*********) অতএব তোমরা নামায কায়েম কর, যাকাত দাও এবং আল্লাহ্কে করযে হাসানা দাও।
ইরশাদ হয়েছে:
(আরবী*********)
নিশ্চয়ই আল্লাহ মু’মিনদের কাছ থেকে তাদের জানমাল ক্রয় করে দিয়েছেন এই শর্তে যে, তাদের জন্যে জান্নাত হবে।
হাসান বলেছেন: আল্লাহ্ তাদের থেকে জানমাল ক্রয় করে নিয়েছেন, যদিও তিনি তার স্রষ্টা। জান-মাল ক্রয় করে নিয়েছেন, যদিও তিনি তার প্রদাতা।’
তা সত্ত্বেও মানুষের এ মালিকানা পূর্ণাঙ্গ নয়। প্রকৃত মালিকানা একমাত্র আল্লাহ্র। কথিত মানুষের মালিকানার অর্থ করায়ত্তকরণ, ব্যয়-ব্যবহার করা মানুষের সাথে তা বিশেষভাবে নির্দিষ্ট করে দেয়া।
মানুষের কোন কিছুর মালিক হওয়ার অর্থ সেই জিনিসটি দ্বারা উপকৃত হওয়া বা তার কল্যাণ লাভ করার অধিকার অন্য কারোর তুলনায় তার বেশী হওয়া। শরীয়াত-সম্মত উপায়ে কেউ কোন জিনিস করায়ত্ত করে নিলে এরূপ হয়। আর সে উপায় হচ্ছে, শ্রম বা কাজ, চুক্তি অথবা উত্তরাধিকার; কিংবা অন্য কিছু। মানুষের এ মালিকানা আল্লাহ্র অনুমতিক্রমে এবং তাঁর শরীয়াত অনুযায়ী হয়।
মানুষকে মালিক বানানোর মর্মকথা- যা শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী বলেছেন: আল্লাহ্ তা’আলা যখন মানুষের জন্যে পৃথিবী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা ভোগ ব্যবহার করা মুবাহ করে দিয়েছেন, তখন একটা জগড়ার সৃষ্টি হল। তখন হুকুম হল, কেউ যেন অপরের দখল করা জিনিসে হস্তক্ষেপ না করে। আসলে সমস্ত পৃথিবী মসজিদ বা মুসাফিরখানার মত। পথিকদের জন্যে তা ওয়াক্ফ করা হয়েছে। তারা তাতে সকলেই শরীক। এখানে যে আগে আসবে সে আগে পাবে, এ নীতি কার্যকর হবে। আর কারোর কোন জিনিসের মালিক হওয়ার অর্থ, সে তা ভোগ ব্যবহার করার অন্যদের অপেক্ষা বেশী অধিকারী। [(আরবী*********)]
এ ভূমিকার পর ‘পূর্ণাঙ্গ মালিকানা’ বলতে আমরা কি বোঝাতে চাই, তা বলব। তা একটা ফিকাহ্শাস্ত্রের পরিভাষা। তাতে দুটো অংশ রয়েছে। এক মালিকানা, দ্বিতীয়টি পূর্ণাঙ্গ। মালিকানা আভিধানিক অর্থ তা করায়ত্ত করা, তার ওপর শক্তি প্রয়োগ করা। কেউ মালিক হয়েছে অর্থ, তা দখল করে নিয়েছে, একার ব্যবহারের অধীন বানিয়েছে।
এ আভিধানিক অর্থই শরীয়াতে গৃহীত হয়েছে। ফিকাহ্বিদ কামাল ইবনুল হুম্মাম (****) নামের গ্রন্থে লিখেছেন:
(আরবী*********) হস্তক্ষেপ করার- ব্যয়-ব্যবহার করার প্রাথমিক শক্তি, কোন বাধাদানকারী ব্যতীতই।
অর্থাৎ এটা সূচনাকারী শক্তি, অন্য ব্যক্তি পর্যন্ত বিলম্বিত নয়্
কিরাফী (****) গ্রন্থে তার সংজ্ঞা দিয়েছেন:
(আরবী*********)
কোন জিনিসে তার অস্তিত্ব পরিমাণ শরীয়াতী হুকুম, যা যে ব্যক্তিকে তার ব্যবহার বা তার বিনিময় করণের অধিকারী বানানো হবে, তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে— যতক্ষণ পর্যন্ত তাতে বাধাদানকারী কেউ থাকবে না।
‘সদরুশ্ শরীয়াহ’ সংজ্ঞা দিয়েছেন: কোন জিনিস ও ব্যক্তির মধ্যকার শরীয়াতসম্ম যোগসূত্র যা তাতে নিঃশর্ত হস্তক্ষেপের সুযোগ দেয় এবং অপর লোকের হস্তক্ষেপ স্থাপনের কথাই বলেছে। অভিধান গ্রন্থসমূহ থেকে যেমন এ কথা জানা যায়, আইনের অভিজ্ঞ লোকেরাও তাই বলেছেন। একটি সংজ্ঞা এই:
(আরবী*********)
একটা কর্তৃত্ব যা তার মালিককে একটা জিনিস ব্যবহার ও তার থেকে ফায়দা লাভের অধিকারী বানায়- সে সসর্বপ্রকারের ফায়দা সহ যা এ জিনিস থেকে লাভ করা সম্ভব- যা মালিকের জন্যে স্থায়ীভাবে হবে অথবা সঙ্কীর্ণ সময়ের জন্যে হবে।
সম্পূর্ণ মালিকানার অর্থ হল, মাল মালিকের হস্তগত, নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে থাকবে। [(আরবী*********)]
কোন কোন ফিকাহ্বিদ বলেছেন: মালিকের হাতে মাল থাকাই তার মালিকানা, যাতে অন্য কারোর অধিকার নেই এবং সে নিজ ইচ্ছামত তা ব্যয়-ব্যবহার করতে সক্ষম। তার উপকারিতা বা কল্যাণ তার লব্ধ হবে। [(আরবী*********)]
এ কারণে তাঁরা বলেছেন: ব্যবসায়ী যে পণ্য ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে ক্রয় করে তা হস্তগত করার পূর্বে তার উপর যাকাত ধার্য হবে না। কেননা তা করায়ত্ত হয়নি এখনও। যা অপহৃত হয়েছে আর যা দিতে অস্বীকার করা হয়েছে, তা যখন তার মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হবে, তখন তাতেও যাকাত হবে না। নিঃস্ব পথিকের উপরও যাকাত ধার্য হবে না। কেননা তার প্রতিনিধির হস্ত তার নিজের হস্তের মতই। যাকাত ফরয হওয়ার আর একটি প্রতিবন্ধক হচ্ছে বন্ধক রাখা, যখন সেই দ্রব্যটি ‘বন্ধ রক্ষকের’ হাতে থাকবে, কেননা তা মালিকের হাতে মজুদ নেই। [(আরবী*********)]
কোন কোন ফিকাহ্বিদ পূর্ণাঙ্গ মালিকানার শর্ত বলতে বুঝেছেন সুনিশ্চিত নির্ধারণ। যায়দীরা ফিকাহ্ণ এ মত পোষণ করেন। তাঁরা শর্ত করেছেন যে, সমস্ত বছর ধরে নিসাব পরিমাণ মাল নির্দিষ্ট থাকতে হবে। তা মালিকের হাতে থাকতে হবে, তার স্থান জানা থাকতে হবে, তা ধরতে বা আনতে যেন কোন প্রতিবন্ধকতা না থাকে অথবা তার নিজের অনুমতিক্রমে অপর কারোর হাতে থাকবে। সেই ‘অপর কেউ’ নির্ভরযোগ্য হবে, অস্বীকারকারী হবে না অথবা তা এমন হতে হবে যে, তা চাইলেই পাওয়া যাবে- তা পাওয়ার আশা আছে, তাতে নৈরাশ্য নেই। যেমন কোন জিনিস হারিয়ে গেলেও তা ফিরে পাওয়ার আশা থাকে। কিংবা অপহৃত হয়ে থাকলেও তা ফিরিয়ে দেয়ার অথবা বিনিময় দেয়ার নৈরাশ্য থাকবে না। কারো কাছে গচ্ছিত থাকলে তা যদি দিতে অস্বীকার করা হয়, মালিকের কাছে দলীল-প্রমাণ আছে, যার বলে তা পাওয়ার আশা করা যায়। এগুলোকে ‘আশা আছে’ পর্যায়ে গণ্য করতে হবে। কিন্তু কোন মাল যদি আয়ত্তযোগ্য না হয়, ফিরে পাওয়ারওআশা না থাকে, তা কখনও ফিরিয়ে দিলে যে কয়টি বছর তার হাতের বাইরে রয়েছে, ততটি বছরের যাকাত ফরয হবে না। যদি কখনও ফিরে পাওয়া যায়, তাহলে তখন থেকে বছর গণনা শুরু করতে হবে ও তদনুরূপ যাকাত দিতে হবে।
এই শর্তটির যৌক্তিকতা
এ শর্তটির যৌক্তিকতা হচ্ছে, মালিকানা একটা মহান নিয়ামত। কেননা তা স্বাধীনতার প্রতীক, স্বাধীনতার ফলশ্রুতি। আর সত্যিকথা হচ্ছে তা মানবতার ফসল। কেননা জন্তু-জানোয়ার কোন কিছুর মালিক হয় না। মানুষই কোন কিছুর মালিক হয়, মালিকত্ব মানুষের মধ্যে শক্তি ও শ্রেষ্ঠত্বের চেতনা জাগিয়ে তোলে। তার মধ্যে যে স্বাভাবিক প্রবণতা তীব্রভাবে বর্তমান, তার চাহিদা পূরণ করে ও মালিকত্ব। পূর্ণাঙ্গ মালিকত্বই মানুষকে মালিকানাধীন জিনিস ভোগ-ব্যবহার করার এবং তার নিজের তার প্রতিনিধির পক্ষে তার প্রবৃদ্ধি সাধন ও তার উৎপাদন চালিয়ে যাওয়ার অধিকার দেয়।
এ নিয়ামতটি যে পেয়েছে, এ পাওয়ার জন্যে তার উচিত শোকর আদায় করা। তাই ইসলামযদি তার মালিকের কাছে যাকাতের দাবি করে, তবেতা কোন বিস্ময়ের ব্যাপার হবে না। অতএব মালিকানাধীন ধন-মালের হক আদায় করা মালিকের কর্তব্য। এ হক আদায় করার জন্যেই যাকাত দিতে হবে।
এই শর্তের দলীল
এই শর্তটি আরোপের দুটি দলীল রয়েছে।
প্রথম- কুরআন ও সুন্নাহ্তে ধন-মালকে তার মালিকের জিনিস বলে ঘোষণা করা হয়েছে। যেমন কুরআনে বলা হয়েছে:
‘তাদের ধন-মাল’ থেকে যাকাত গ্রহণ কর।
‘তাদের ধন-মালে’ হক রয়েছে:
হাদীসের কথা: (আরবী*********)
‘আল্লাহ্ তা’আলা ‘লোকদের ধন-মালে’ তাদের উপর ফরয করেছেন’ ….. ‘তোমরা তোমাদরে ধন-মালের’ দশভাগের চারভাগের এক ভাগ দিয়ে দাও।
এ সব কথা থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায় যে, আল্লাহ নিজেই সব ধন-মালের মালিক হয়েও ‘মানুষের ধন-মাল’ বলে দিয়েছেন। অন্য কথায় তিনিই মানুষকে সে সবের মালিক বানিয়ে দিয়েছেন। তাদের মাল’ ‘তোমাদের মাল’ কথাগুলোই তার জ্বলন্ত প্রমাণ। এ ধরনের কথা তখনই বলা চলে, যখনমানুষ তার বিশেষভবে মালিকহয়। তার ফলে সেই বিশেষ জিনিসের ক্ষেত্রে সে অন্যদের থেকে বিশিষ্ট হয়ে পড়ে। সেই জিনিস ভোগ-ব্যবহার করার কেবল তারই অধিকার হয়ে যায়।
দ্বিতীয়- যাকাত বলতে বোঝায়, যারা পাওয়ার উপযুক্ত ও অধিকারী তাদেরকেতার মালিক বানিয়ে দেয়া। পাওয়ার উপযুক্ত ও অধিকারী যারা, তাদের কথা কুরআনে স্পষ্ট ভাষায় বলে দেয়া হয়েছে। আর ‘মালিক বানানো’ মালিকানারই প্রশাখা মাত্র। যে নিজে কোন কিছুর মালিক সে-ই অন্যকে সেই জিনিসের মালিক বানিয়ে দিতে পারে। যে তা নয়, সে তা পারেও না।
এ শর্তের আনুসঙ্গিক কথা
যে ধন-মালের নির্দিষ্ট মালিক নেই:
যে ধন-মালের নির্দিষ্ট কোন মালিক নেই, তার যাকাত নেই। যেমন সরকারায়ত্তাধীন ধন-মাল।সরকার নিজেই যাকাত ও কর ইত্যাদি আদায় বা সংগ্রহ করে। কাজেই তার আয়ত্তাধীন ধন-মালের যাকাত ফরয নয়। তার কারণ, তার কোন নির্দিষ্ট মালিক নেই। তা সমগ্র জাতির মিলিত সাধারণ বিত্ত-সম্পত্তি। তা ছাড়া সরকারই যাকাত সংগ্রহের অধিকরী। তাই তার উপর যাকাত ফরয হওয়ার কোন অর্থ হয় না। এ কারণেই বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন: ‘ফাই’ মালে যাকাত নেই। গনীমতের এক-পঞ্চমাংশেও যার মালিক সরকার-তারও যাকাত দিতে হয় না। কেননা তা তো মুসলিম জনগণের কল্যাণে ব্যয়িত হয়। সর্বসাধারণের সমান অধিকারের বিত্ত-সম্পত্তির ক্ষেত্রেও এই কথা। [(আরবী*********)]
ওয়াক্ফকৃত জমি
সাধারণভাবে ওয়াক্ফকৃত জমিবা জিনিসের উপর কোন যাকাত নেই। গরীব, মিসকীন, মসজিদ, মুজাজিদ, অথবা ইয়াতীম, কিংবা মুসাফিরখানা, মাদরাসা প্রভৃতির জন্যে ওয়াক্ফত করা জমি বা জিনিস সম্পর্কে এ কথা প্রযোজ্য। কেননা এ কাজ জনকল্যাণমূলক। অতএব সহীহ্ কথা হচ্ছে তাতে যাকাত ধার্য হবে না।
কিন্তু যা কোন নির্দিষ্ট এক বা সমষ্টির জন্যে ওয়াক্ফক করা হয়েছে, যেমন কারোর পুত্র বা সন্তানাদি অথবা একটা নির্দিষ্ট গোত্রে লোকদের জন্যে ওয়াক্ফ করা হয়, তাতে যাকাত ধার্য হওয়া সহীহ কথা। কেননা ওয়াক্ফ করা সম্পদ সম্পত্তির ক্ষেত্রে মালিকানা হস্তান্তরিত হয় যার জন্যে ওয়াক্ফ করা হয়েছে তার প্রতি। সে-ই তার স্থায়ী মালিকহয়ে বসে, ঠিক যেন তা ওয়াক্ফ হয়নি এমনি। [(আরবী*********)] কিন্তু সে মূল ওয়াক্ফ করা সম্পত্তির উপর কোন যথেচ্ছ হস্তক্ষেপ করতে পারে না। মালিকত্বের স্পষ্ট অর্থ হচ্ছে মালিক অন্যদের তুলনায় তা ব্যয়-ব্যবহার করার অধিকারী। তাকে তার থেকে উৎখাতও কেউ করতে পারে না।
কোন কোন ফিকাহ্বিদ মত দিয়েছেন যে, প্রতিটি ওয়াক্ফ সম্পত্তির উপরই যাকাত ফরয। তা সাধারণভাবে ওয়াক্ফ করা হোক কিংবা বিশেষভাবে ইবনে রুশ্দ বলেছেন, মিসকীনের উপর যাকাত ফরয- এ কথা বলার কোন অর্থ নেই, যদি জমিবা অন্য কিছু তাদের জন্যে ওয়াক্ফ করা হয়। কেননা তাতে দুটি জিনিসের সমাবেশ ঘটে।
িএকটি, তা অসম্পূর্ণ মালিকানা,
দ্বিতীয়- তা যাকাত ব্যয়ের জন্যে নির্দিষ্ট খাতসমূহের কোন প্রকারের মধ্যে নির্দিষ্টভাবে ওয়াক্ফ করা হয়নি। যাদের উপর যাকাত ফরয, তারা তাদের মধ্যেও নয়। [(আরবী*********)]
হারাম সম্পদের যাকাত হয় না
যাকাত ফরয হওয়ার জন্যে মালিকানা শর্ত বিধায় ঘুষ বা হারাম কোন উপায়ে অর্জিত সম্পদ বা সম্পত্তিতে যাকাত ফরয হতে পারে না। পরস্পরাপহরণ, চুরি, মিথ্যা বা প্রতারণা, সুদ, মজুদকরণ, ধোঁকাবাজি বা ঘুষের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদও এ পর্যায়ে গণ্য। কেননা এগুলো বাতিল পন্থায় লোকদের মাল গ্রহণের ব্যাপারে যা কুরআনে নিষিদ্ধ। অত্যচারী রাজা-বাদশাহ্ ও চরিত্রহীন রাজন্যবর্গের ধন-সম্পদের ক্ষেত্রেও এ কথা।
কেননা তারা এ সব সম্পদের প্রকৃত মালিক নয়। তারা যদি তাদের হালাল মালকে তার সাথে মিশ্রিত করে এবং তা আলাদা করা সম্ভব না হয়, তাহলেও যাকাত হবে না।
বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, খারাপ (হারাম) মাল নিসাব পরিমাণের হলেও তার উপর যাকাত ধার্য হবে না। কেননা তা প্রকৃত মালিকের সন্ধান পাওয়া গেলে তার বা তার উত্তরাধিকারীর কাছে তা ফেরত দেয়াই তার কর্তব্য। আর তার সন্ধান পাওয়া না গেলে তা দরিদ্রের মধ্যে বিতরণ করে দিতে হবে। এক্ষণে সবকিছুই ‘সদকা করে দিতে হবে। তার কতকাংশ দান করলে কোন লাভ হবে না। [ ইবনে নজীম লিীখত (******) এবংইবনে আবেদীন লিখিত তার টীকা ২য় খণ্ড, ২২১ পৃঃ এ পর্যায়ে ইমাম আবূ হানীফা (র) মনে করন- কেউ যদি কিচু পরিমাণ টাকা অপহরণ করে ও তার নিজের টাকার সাথে তা মিশ্রিত করে তাহলে মনে করতে হবে, সেতা খরচ করে ফেলেছে। সেতা মালিককেফিরিয়ে দেয়ার জন্যে দায়ী থাকবে। অবশ্য ইমাম ইউসুফ ও মুহাম্মাদের মতে দায়ী হবে না। কেননা সেখানে মালিকানাই প্রমাণিত নয়; তা সম্মিলিত সম্পদ। তার উপর যাকাত ফরয হবে না।]
হারাম মালের যাকাত না নেয়ার যুক্তি স্বরূপ উল্লেখ করা হয়েছে যে, তা তো দাতার নিজের মালিকানাভুক্ত সম্পদ নয়। তাতে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করাই নিষিদ্ধ। যাকাত দেয়াও এক প্রকারের হস্তক্ষেপ। তা গ্রহণ করা হলে তার অবস্থা এই দাঁড়াবে যে, তা একদিক দিয়ে আদিষ্ট ও অপর দিক দিয়ে নিষিদ্ধ। কিন্তুতা সম্ভব। [(আরবী*********)]
সারকথা, হারাম মালের মালিক শরীয়াতের দৃষ্টিতে ধনী প্রমাণিত নয়। তা স্তূপাকারে হলেও এবং তা দীর্ঘদিন ধরে একজনের মালিকানাভুক্ত থাকলেও। ইমাম সারাখ্শীর মতে সে মাল জালিম রাজা-বাদশাহ্কেও দিয়ে দেয়া যেতে পারে। তিনি এদেরকে ‘দরিদ্র’ গণ্য করেছেন। কেননা তাদের হাতে যে ধন-মাল রয়েছে তা তো মুসলিম জনগণের, তাদের নিজেদের নয়। তা যদি ফিরিয়ে দেয়, তা হলে তাদের কাছে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। ফলে তারা দরিদ্রতম ব্যক্তি হয়ে যাবে। [(আরবী*********)] মুহাম্মাদ ইবনেমুসলিমা বলেছেন, খোরাসানের শাসক আলী ইবনে ঈসা ইবনে হামানকে যাকাত দেয়া জায়েয, বলখের আমীরের উপর কাফ্ফারা দেয়া ওয়াজিব হয়েছিল। তাঁকে ফতওয়া দেয়া হয়েছিল তিন দিনের রোযা রাখার। তা শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল। বলেছিল: যার কিছুই নেই, তার যা কাফ্ফারা, আমাকেও সেই কাফ্ফারা দিতেবলা হচ্ছে। [পূর্বোল্লিখিত উৎস। ইবনুল হুম্মাম বলেছৈন, এ কাফফারা জরুরী নয়।]
ইবনুল হুম্মাম বলেছেন, ওদের নিজের মাল এবং যা অন্যদের কাছ থেকে নিয়েছে তা মিলিয়ে-মিশিয়ে ফেলেছে, এক্ষণে উভয়ের মধ্যে পার্থক্র করা সম্ভব না হলে ইমাম আবূ হানীফার মতে তা নিঃশেষ করে ফেলা হয়েছে। তখন সে তার মালিক হয়ে বসেছে। অতএব তাকে তার ক্ষতপিূরণ দিতে হবে। এমনকি তার উপর যাকাত ফরযও বলা হয়েছে। কোনরূপ ক্ষতি ব্যতিরেকেই তার উত্তরাধিকার কার্যকর হবে। কেননা অনুরূপ পরিমাণ মাল ফেরত দেয়া তার দায়িত্ব হয়ে পড়েছে। আর যার হাতে যত পরিমাণ মাল আছে সে সেই পরিমাণ মালের ঋণগ্রস্ত হলে সে তো দরিদ্র ব্যক্তি।
এই ফতওয়ার আলোকে যে কথাটি প্রতিভাত হচ্ছে তা হল, হারাম মালের মালিক হওয়া যায় না। তা গ্রহণকারীর জন্যেও শুভনয়। তার উত্তরাধিকারীদের জন্যেও নয়।
তবে উপরিউক্ত ধরনের জালিম শাসক-প্রশাসকের দান করেদেয়া- এজন্যে যেতারা প্রকৃতপক্ষেদরিদ্র কিংবা ঋণগ্রস্ত আদৌ জায়েয নয়। কেননা যে দরিদ্র ব্যক্তি অর্থ সাহায্য পেয়ে আল্লাহ্র নাফরমানীর কাজ বেশী করবেবলে আশংকা হবে, তাকে যাকাতের মাল দেয়াই জায়েয নয়। অনুরূপভাবে যে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি টাকা পেয়ে নাফরমানীর কাজে লিপ্ত হয় তা থেকে তওবা না করে, যাকাতরে অংশতাকে দেয়াও অবৈধ। যাকাত ব্যয়ের ক্ষেত্র পর্যায়ে আমরা এ বিসয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
ঋণের যাকাত
ঋণের যাকাত পর্যায়ের আলোচনা এ শর্তের প্রসঙ্গেই আসে। প্রশ্ন হচ্ছে, যে ব্যক্তি মালের প্রকৃত ঋণদাতা, সে যাকাত দেবে, না গ্রহণকারী দেবে? যে সেমাল ব্যয় করছে এবং তা দিয়ে ফায়দা পেয়েছে অথবা উভয়ই সে দায়িত্ব থেকে মুক্ত? কিংবা উভয়েই সে যাকাত দিতে বাধ্য? উভয়েই ঋণের টাকার যাকাত দেবে, একথা কেউ বলেন নি। ইকরামা ও আতা প্রমুখ ফিকাহ্বিদ বলেছেন, কাউকেইসে টাকার যাকাত দিতে হবে না। ইমাম আবূ ইউসুফ ও মুহাম্মাদ বলেছেন, ঋণগ্রহণকারীকে ঋণেরযাকাত দিতে হবে না। আর ঋণ-দাতা- টাকার আসল মালিক তার যাকাত দেবে যখন তা সে ফেরত পাবে। [(****) ইমাম মালিকের ছাত্র ইবনুল কাসেম বলেছেন, অহহরণকারী যখন মাল অপহরণ করেছে তখন তার দায়িত্ব সে ফেরত দিতে বাধ্য। অতএব তার উপর যাকাত ধার্য হবে।]
ইবনে হাজম হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন, ঋণ দেয়া টাকার যাকাত নেই অর্থাৎ ঋণগ্রহীতা ও ঋণদাতাকেতার যাকাত দিতেহবে না। যাহেরী মাযহাবের এটাই মত।
তার কারণ, এ টাকার মালিকত্ব উভয়ের ক্ষেত্রেই অসম্পূর্ণ। ঋণগ্রহীতার হাতে ঋণ করা টাকা এলেও সে তার প্রকৃত মালিক নয়। তার দখলে তা থাকলেও এ দখলটা মালিকত্বের নয়, যদিও সেতা ব্যয়-ব্যবহার করছে। এ টাকা তো মূলত ঋণদাতার। সে যখনই চাইবে, তা ফেরত দিতে হবে।
আর ঋণদাতা যাকাত দেবেনা এজন্যে যে, টাকা তো তার হাতে নেই। অন্য লোকে তা ব্যয়-ব্যবহার করছে। অতএব, তার মালিকত্বও সম্পূর্ণ নয়।
‘কিতাবুল আমওয়াল’-এ ইমাম নখরী’র মত বলে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ঋণের টাকার রস ভক্ষণকারীকেই তার যাকাত দিতে হবে। কেউ যদি ব্যবসায়ীকে ঋণ দেয়, যে ব্যবসায়ী তা বৃদ্ধি করে তা দিয়ে ফায়দা পায় ও ফিরিয়ে দিতে বিলম্ব করে, তার যাকাত তাকেই দিতে হবে।
এ কথাটি বলা হল যার হাতে মাল রয়েছে তার দিকে দৃষ্টি দিয়ে; যে তার আসল মালিকতার দিকে দৃষ্টি দিয়ে নয়। অথচ তা পূর্ণাঙ্গ মালিকত্ব ধারণার পরিপন্থী। আর এ পূর্ণাঙ্গ মালিকত্বের ব্যাপারটিতে সব ফিকাহ্বিদই সম্পূর্ণ একমত। সম্ভবত ঋণগ্রহীতার উপর যাকাত ধার্য করা হয়েছে এজন্যে যে, সে তা ফিরিয়ে দিতে গড়িমসি করে।
সাহাবী ও তৎপরবর্তীকাল থেকে অধিকাংশ ফিকাহ্বিদ মনে করেন যে, ঋণ দুই প্রকারের:
১. এমন ঋণ যা আদায় হওয়ার ও ফিরিয়ে পাওয়ার আশা আছে। মেযন একজন সচ্ছল ব্যক্তি ঋণ গ্রহণ করেছে, সেতা স্বীকারও করে, তার কাছ থেকে তা ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়ই আশা আছে। এরূপ অবস্থায় সে অর্থাৎ ঋণদাতা তার ও তার অন্যান্য হস্তস্থিত মালামালের যাকাত দেবে।
এ কথাটি হযরত উমর, উসমান, ইবনেউমর ও জাবির ইবনে আবদুল্লাহ প্রমুখ সাহাবী থেকে বর্ণিত। জারির ইবনে যায়দ, মুজাহিদ, ইবরাহিম ও মায়মুন ইবনে মাহরান প্রমুখ তাবেয়ীও এ মত পোষণ করেন।
২. দ্বিতীয় প্রকার ঋণ হল যা ফেরত পাওয়ার কোন আশা নেই। হয়ত ঋণগ্রহীতা খুব অর্থকষ্টে দিন কাটাচ্ছে, তা সচ্ছলতার কোন সম্ভাবনা নেই। অথবা সে ঋণের কথা অস্বীকার করেছে কিংবা সে ঋণের প্রমাণপত্র কিছু নেই। এরূপ অবস্থায় কি করা হবে, সে পর্যায়ে কয়েকটি মত ব্যক্ত হয়েছে:
প্রথম ঋণেল টাকা যে কয় বছর পর ফেরত পাওয়া যাবে, তখনই সেই কয় বছরের যাকাত এক সাথে দিয়ে দেবে।হযরত আলী ও ইবনে আব্বাসএ মত দিয়েছেন।
দ্বিতীয়, ফেরত পাওয়ার মাত্র এক বছরের যাকাত দেবে। হাসান ওউমর ইবনে আবদুল আযীয প্রমুখ এ মত দিয়েছেন। আর সর্ব প্রকারের ঋণের ক্ষেত্রে তা ফেরত পাওয়ার আশা থাক আর নাই থাক; ইমাম মালিকের এটাই মত।
তৃতীয়, অতীত বছরগুলোর কোন যাকাত দিতে হবে না, সেই বছরেরও যাকাত দিতে হবে না- যে বছর ঋণের টাকা ফেরত পাওয়া গেছে। ইমাম আবূ হানীফা ও তাঁর সঙ্গীদ্বয় এ মত প্রকাশ করেছেন। ঠিক যেমন নতুন পাওয়া মালের বছরটি গণনা করা হয়, এখানেও তাই করতে হবে।
ইমাম আবূ উবাইদ এ মত পোষণ করেন। তিনি হযরত উমর, উসমান, জাবির ও ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণিত উচ্চমানের হাদীসমূহের ভিত্তিতে বলেছেন, যে মালিক তার নিজহাতে বর্তমান ধন-মালের সাথে তারও যাকাত প্রতি বছরই দেবে যদ্দিন সে ঋণ ধনশালী লোকদের উপর ধার্য থাকবে। কেননা তার প্রাপ্য টাকা তো তার নিজের হাতে ও ঘরে রক্ষিত ধন-মালের মতই।
এ ভয়ে সতর্কতা স্বরূপ ঋণের টাকার যাকাত তা ফেত পাওয়া পর্যন্ত বিলম্বিবত করার পক্ষে ইমাম আবূ উবাইদ মত দিয়েছেন। তাই ঋণের টাকার যে অংশই প্রত্যর্পিত হবে তারই যাকাত দিতে হবে।
আর যে ঋণের টাকা ফেরত পাওয়ার কোন আশা নেই কিংবা নৈরাশজনক, সেক্ষেত্রে হযরত আলীও ইবনে আব্বাস (রা)-এর মত অনুযায়ী আমল করতে বলেছেন। আর তা হল, খুব তাড়াহুড়া করে যাকাত দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই। যখন তা নিজের হাতে ফেরত পাওয়া যাবে তখনই যাকাত দিতে হবে অতীত বছরগুলোর বাবদ, যেহেতু তা তার মালিকানায়ই রয়ে গেছে। তা হলে তার উপর আল্লাহ্র যে হক ধার্য তা নকচ হবে কেমন করে? মালিকত্ব তো সেই আল্লাহ্র কাছ থেতেই প্রাপ্য। [আল-আমাওযাল, পৃঃ ৪৩৪-৩৫]
ফেরত পাওয়ার আশা আছে যে ঋণ, তাতে আবূ উবাইদের মতকে আমরা সমর্থন করি। কেননা তা তো তার হাতের সম্পদের মতই। কিন্তু যে ঋণের টাকা ফেরত পাওয়ার আশা নেই, তা তার মুল মালিকানায় থাকলেও তার যাকাত দিতে হবে না। কেননা তার হাতে নেই। এমতাবস্থায় তার উপর তার মালিকত্ব অসম্পূর্ণ। আর অসম্পূর্ণ মালিকত্ব সম্পূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ নিয়ামত নয়। যাকাত তো সেই পূর্ণাঙ্গ মালিকানার উপরই ধার্য হয়, যার সাথে অপর কারোর হক সম্পৃক্ত নয় এবং সে নিজ ইচ্ছামত তা ব্যয়-ব্যবহার করতে পারে। [(আরবী*********)]
পূর্ণাঙ্গ মালিকত্বের দাবি হচ্ছে, মালিকতার মালিকানা ধন-সম্পদ সম্পত্তি নিজ ইচ্ছানুযায়ী ব্যয়-ব্যবহার করতে সক্ষম হবে। উপরিউক্ত অবস্থায় তা বাস্তবায়িত নয়।
ফেরত পাওয়ার আশা নেই, এমন ঋণের ক্ষেত্রে ইমাম আবূ হানীফা এবং তাঁর সে সম্পর্কেও এই কথা। কেননা যে সব ধন-সম্পদের মালিকতো ভোগ-ব্যবহার করতে পারে না, তার দরুন সে ধনী বলে গণ্য হবে না। আর যাকাততো কেবল ধনী ব্যক্তিদের উপর ধার্য হয়ে থাকে। [(আরবী*********)]
যেসব ঋণ ফেত দিতে অস্বীকার করা হয়েছে বা ফেরত পাওয়ার আশা নেই তার ক্ষেত্রে আমরা ইমাম আবূ হানীফার মত সমর্থন করি। আর সাধারণব্যবহারের অযোগ্য ধন-মাল যখন হস্তগত হবে তখন তা নতন প্রাপ্ত ধন-মালের মতই গণ্য হবে।কাজেইঅতীত বছরগুলোর যাকাতদিতে হবেনা। যদিও আমরা হাসান, উমর ইবনে আবদুল আযীয ও ইমাম মালিকের এই মতকে অগ্রাধিকার দিতামযে তা ফেরত পাওয়া গেলে এক বছরের মালিক হয়েব্যয়-ব্যবহার করার সময়ই তার যাকাত দিতে হয় তাতে এক বছর অতীত শর্ত থাকবে না। এ বিষয়ে আমরা যথাস্থানে বিস্তারিত বলব।
চাকরীজীবিদের বেতন ও সঞ্চয়
এ পর্যায়ে সাধারণত একটি প্রশ্নই উঠে। চাকুরীজীবিরা সরকার বা প্রতিষ্ঠান-সমূহে যেখানে তারা কাজ করে- তাদের নগদ পাওনা জমা হয়ে থাকে। তা তাদেরই প্রাপ্য বটে অথবা তাদের হিসেবেই তা সঞ্চয় ও জমা করে রাখা হয়।তারকি যাকাত দিতে হবে?
এর জবাব এ সম্পদের প্রকৃতি ও অবস্থার নির্ধারণের উপর নির্ভরশীল। প্রথমেই টিককরতে হবে, তা চাকুরীজীবিদের পূর্ণ মাত্রায় মালিকত্বের অধীন কি-না? অর্থাৎ তারা কি তা যখন ইচ্ছা তখন ব্যয়-ব্যবহার করতে পারে? কিংবা পারে না? তাতাদেরই হক, না তা সংশ্লিষ্ট সরকার বা প্রতিষ্ঠানের অনুগ্রহের দান? যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে তা হস্তগত না পাওয়া পর্যন্ত তার উপর মালিকত্ব কার্যকর হয় না। আর যদি তা চাকুরীজীবির অধিকার হয়ে থাকে, তাহলে তা রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠান অকেজো করে রাখতে পারে না। সে যখনই ইচ্ছা করবে, তা সে ব্যয়-ব্যবহার করতে পারবে। কাজেই আমার মতে তার উপর তার পূর্ণাঙ্গ মালিকানা স্থাপিত। আর তা এমন ঋণ, যা ফেত পাওয়ার আশা রয়েছে। ইমাম আবূ উবাইদ এ পর্যায়ে বলেছেন: এই সম্পদ যেন তার হাতেই মজুদ রয়েছে এমন। কাজেই তার উপর প্রতি বছরই যাকাত ফরয হবে, যদিতার পরিমাণ নিসাব সমান হয় এবং অন্যান্য শর্তও মজুদ থাকে। [কিন্তু ইমাম মালিকের মত হলো- এই সম্পদের উপর যাকাত ধার্য হবে তখন, যখন তা তার হাতে আসবে। তখন মাত্র এক বছর যাকাত দিলেই অতীতের দায়িত্ব থেকে মুক্ত হওয়া যাবে।]
তাঁরা বলেছেন, বৃদ্ধিশীল সম্পদ দু’রকমের। একটা প্রকৃত, অপরটা পরিমাণগত। প্রকৃত প্রবৃদ্ধি জন্ম-প্রজনন, বংশবৃদ্ধি, ব্যবসা ইত্যাদির মাধ্যমে হয়ে থাকে। আর পরিমাণগত প্রবৃদ্ধি হচ্ছো তা এমনভাবে বেড়ে যাওয়া যে, তার গ্রহণকারীর বা তার প্রতিনিধির হাতে তা বৃদ্ধি পাবে। [(আরবী*********)]
প্রবৃদ্ধি শর্ত করার যৌক্তিকতা
ইবনুল হুম্মাম বলেছেন, যাকাত ফরয করার আসল উদ্দেশ্য যদিও সম্পদ-মালিককে পরীক্ষা করা; কিন্তু সেই সঙ্গে দরিদ্রদের দারিদ্র্য মোচনও তার অন্যতম লক্ষ্য এবং তা এমনভাবে, যেন সে নিজে দরিদ্র হয়ে না যায়। সে তার অতিরিক্ত সম্পদ থেকেই একটা অংশ দেবে মাত্র। তাই যে সম্পদ মূলত প্রবৃদ্ধিশীল নয়, তার উপর যাকাত ফরয করা হলে পর পর বছরগুলোতে যাকাত দেয়াটা তাই বিপরীত পড়ে যাবে। বিশেষত খরচের প্রয়োজন দেখা দিলে তা অস্বাভাবিক হয়ে পড়বে।[(আরবী*********)]
এই প্রেক্ষিতে রাসূলে করীম(স)-এর বাণীটির যথার্থতাপ্রকাশিত হয়: (***) যাকাত দিলে মূল সম্পদের ঘাটতি পড়ে না। [(আরবী *********)]
কেননা যাকাত বাবদ যে অল্প পরিমাণ মালদিয়ে দেয়া হয় বিপুল পরিমাণ সম্পদ থেকে, তা তো ক্রমবৃদ্ধিশীল। তা কখনই ঘাটতি সৃষ্টি করে না। এটাই আল্লাহ্র নিয়ম।
এ পর্যায়ে লক্ষ্যকরার বিষয় হচ্ছে, মাল মূলত বৃদ্ধিশীল কিনা, তাতে প্রবৃদ্ধির বৈশিষ্ট্য আছে কিনা। কার্যত তা বৃদ্ধি পাচ্ছে কিনা, তা বিবেচ্য। যেহেতু শরীয়াতে কার্যত প্রবৃদ্ধির গুরুত্ব নেই। কেননা এভাবে করতে গেলে তা কোন সীমায় সীমিত করা সম্ভবপর হবে না এবং তাতে অপরিমেয় মতভেদ দেখা দেবে।
ইমাম কাসানী লিখেছেন, যাকাত মানেই প্রবৃদ্ধি। তাই তা ক্রমবৃদ্ধিশীল সম্পদ থেকেই নেয়া হবে। আমরাও এই কথার যথার্থতা স্বীকার করছি। মূল সম্পদের বৃদ্ধি পাওয়ার যোগ্যতা থাকাই যথেষ্ট। তা ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমেহতে পারে, ঘাস ইত্যাদি দিয়ে পশু পালনের মাধ্যমেওহতে পারে। কেননা গাভীকে ঘাস খাওয়ালে তার দুগ্ধ পাওয়া যাবে, তার বাচ্চা হবে, দুগ্ধ দিয়ে মাখন তৈরী হবে। তার ব্যবসা করে মুনাফা লাভকরাযায়। তখন মুনাফা লব্ধ সম্পদ মূল সম্পদ হয়ে দাঁড়ায়। আর তার উপরও যাকাত ফরয হয়। [তিরমিযী, আবূ কাবশা-আল-আসমায়ী বর্ণিত হাদীসের অংশ। হাদীসটি হাসান ও সহীহ্]
আমলও এই সুন্নাতকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। নবী করীম (স) ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্যে সংগ্রহীতি মাল-সম্পদের উপর যাকাত ধার্য করেন নি। নবী করীম (স) বলেছেন:
(আরবী*********)
মুসলিম ব্যক্তির নিজ ব্যবহার্য ঘোড়া ও ক্রীতদাসের উপর কোন যাকাত নেই।
ইমাম নববী বলেছেন: এই হাদীসটির মূল কথা হল, নিজ ব্যবহার্য দ্রব্য-সম্পদের উপর যাকাত হয় না। [সহীহ মুসলিম: ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৫৫] নবী করীম (স) কেবলমাত্র ক্রমবর্ধনশীল বা বর্ধনপ্রবণ সম্পদের উপরই যাকাত ধার্য করেছেন। তদানীন্তন সময়ে আরব দেশেএই পর্যায়ের বহু প্রকারের সম্পদ মজুদ ছিল।
তন্মধ্যে উট, গরু ও ছাগল, স্বর্ণ ও রৌপ্য-ব্যবসায়ে মূলধন হিসেবে ব্যবহৃত হত, অনেকেতা পুঁজি করেও রাখত। ফল ও ফসর- যব, গম, খেজুর, কিশমিশ, মনাক্কা প্রভৃতি উল্লেখ্য। মধুও এ পর্যায়ে গণ্য। পূর্বের লোকদের মাটির নীচে জমা করে যাওয়া সম্পদ, যখন তা হস্তগত হবে। খনিজ সম্পদ এ পর্যায়ে গণ্য। পূর্বের লোকদের মাটির নীচে জমা করে যাওয়া সম্পদ, যখন তা হস্দগত হবে। খনিজ সম্পদওও এ পর্যায়ে গণ্য, -যদিও তা ‘ফাই’ গণ্য হবে না যাকাত ধার্য হওয়ার ক্ষেত্রে গণ্য হবে, সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে।
শরীয়াতের আইন-বিধানের মূল কারণ নিহিত আছে, এ কথায় বিশ্বাসী ফিকাহ্বিদগণ বলেছেন, উপরোল্লিখিত দ্রব্য-সামগ্রীর উপর যাকাত ফরয হওয়ার কারণ হল সেগুলোর কার্যত প্রবৃদ্ধি। অথবা প্রবৃদ্ধি প্রবণ।
গৃহপালিত পশু কার্যত বৃদ্ধিশীল। তা পরিপুষ্ট ও মোটা হয়, বাচ্চা দেয়, দুগ্ধ দেয়। এদের প্রবৃদ্ধি স্বভাবসম্মত ও স্বাভাবিক। আর তার ফলে পশু সম্পদও বৃদ্ধি পায়। গোশ্ত ও দুগ্ধের কথা তো না বললেও চলে।
ব্যবসা পণ্যও কার্যত ক্রবর্ধনশীল। কেননা ব্যবসায়ে মুনাফা লাভ একটা সাধারণ ব্যাপার। যদিও তা পশু সম্পদ বা কৃষি সম্পদের মত ক্রমবৃদ্ধিশীল নয়। তা শৈল্পিক প্রবৃদ্ধি, স্বাভাবিকতার সাথে সাদৃশ্য সম্পন্ন। িইসলাম এই প্রবৃদ্ধিকে শরীয়াতসম্মত ও হালাল ঘোষণা করেছে। আজ পর্যন্তকার সব ধর্ম রাষ্ট্রীয় আইন ও মানবীয় বুদ্ধি-বিবেকও তা-ই গণ্য করেছে।
নগদ অর্থ ও বৃদ্ধিমান সম্পদ। তা পণ্যের বিকল্প বিনিময় মাধ্যম দ্রব্য সমূহের মূল্য নির্ধারণের মান। তা যখন শিল্প ও ব্যবসা ইত্যাদিতে বিনিয়োগকৃত হবে, তখনমুনাফা দেবে। আর এই প্রবৃদ্ধি কাম্য। এই নগদ অর্থ যদি পুঁজি করা হয় তখন উৎপাদন বিনিময় ও আবর্তনের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা পালন থেকে তাকে আটকে রাখা হয়, তাহলে একটা সামগ্রিক অচলাবস্থা দেখা দেবে। পুঁজিকারী ব্যক্তি সেজন্যে দায়ী হবে; এ ঠিক একটা সুস্থ সবল ও কল্যাণকদায়ক যন্ত্রকেঅচল করে রাখার মত অবস্থা। ইসলামী শরীয়াত এ অবস্থা থেকেমুক্ত রাখারজ্যে নগদ অর্থ-সম্পদের উপর যাকাত ফরয করেছে- যেন তা কার্যত বৃদ্ধি লাভ করতে পারে। তাহলে মালিক নিজে এবং গোটা সমাজ তা থেকে উপকৃত হতে পারবে।
কৃষি ফসল ও ফল-ফলাদি মূলত বৃদ্ধিমান। তা নব উৎপাদনে সক্ষম। মধু, সঞ্চিত ধন ও খনিজ দ্রব্যও তাই।
ফিকাহ্বিদগণ নবী করীম (স)-এর কাছ থেকে পাওয়া হিদায়াতের ভিত্তিতেই এ শর্তটি আরোপ করেছেন। খুলাফায়ে রাশেদুনের কার্যাবলীও তা৭দের সম্মুখে প্রতিভাত। ‘যাকাত’ শব্দটি এই ভাবধারাসম্পন্ন। কেননা তার প্রকাশ্য অর্থই হল প্রবৃদ্ধি বা বৃদ্ধিপ্রাপ্তি, সম্পদ থেকে গ্রহীত পরিমাণটিকে যাকাত বলা হয় এজন্যে যে, তার চূড়ান্ত পরিণতিই হচ্ছে বরকত ও বৃদ্ধি। স্বয়ং আল্লাহ্ তা’আলা এ ওয়াদাই করেছেন:
(আরবী*********) তোমরা যা কিছু আল্লাহর জন্যে ব্যয় করবে পরে তিনি তা এনে দেবেন।
(আরবী*********)
তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যে যাকাত দাও, সেই দাতারাই আসলে তাদের মাল-সম্পদ বৃদ্ধি করে।
তার আরও একটা দিক প্রকট। যাকাত আদায় করা হবে কেবলমাত্র সেসব ধন-মাল থেকে যা ক্রমবৃদ্ধির কাজে নিয়োজিত। এ কারণে নিত্য ব্যবহার্য জিনিসের যাকাত দিতে হয় না। কেননা তা প্রবৃদ্ধির কাজে লিপ্ত নয়। অনুরূপভাবে যেসব মাল-সম্পদ অপহৃত বা বিনষ্ট হওয়ার দরুন প্রবৃদ্ধির কাজে নিয়োজিত হতে পারছে না, তাতেও যাকাতফরয হয় না। বলা যায়, ধন-মাল প্রবৃদ্ধির কাজে নিয়েঅজিত হতে পারছে না, তাতেও যাকাত ফরয হয় না। বলা যায়, ধন-মাল প্রবৃদ্ধির কাজে নিয়োজিত কর এবং এই প্রবৃদ্ধি প্রাপ্ত সম্পদ থেকে যাকাত দাও।
প্রথম যুগ থেকেই মুসলিম সমাজ এই শর্তারোপ সম্পূর্ণ ঐকমত্যে কাজ করে এসেছে। নিজের ব্যবহার্য যানবাহন, বসাবসের ঘর, দালান-কোঠা, শিল্পী-কারিগরের যন্ত্রপাতি, ঘরের ব্যবহার্য দ্রব্যসম্ভার প্রভৃতির উপর যাকাত ধার্য নয়, তেমনি তার যোগ্যতাও নেই।
এর সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করেলোকজন এও বলেছেন যে, যে লোক নিজের বা তার প্রতিনিধি তার ধন-মালে প্রবৃদ্ধি সাধনে সক্ষম নয়, তাতেও যাকাত দিতে হয় না। যেসব মাল ফিরে পাওয়ার আশা নেই, তাতেও যাকাত নেই। পাওয়ার আশা থাকলে অবশ্য যাকাত হবে। যে মাল ব্যবহারের সুযোগ নেই-সামর্থ্য বহির্ভূত, তার উপর মূল মালিকত্ব বহাল থাকলেও তাতে যাকাত দিতে হয় না।
যাকাতের মালে প্রবৃদ্ধির শর্ত আরোপের দরুন বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, কৃষি ফসল ও ফল-ফলাদির যাকাত বছর আবর্তিত হওয়ার দরুন বার-বার দিতে হবে না। যেমন কৃষি ফল-ফলাদিতে ওশর ফরয হয় কিন্তু তাতে অতঃপর আর কিছুই ফরয হবে না, তা মালিকের হাতে কয়েক বছর পর্যন্ত মজুদ হয়ে থাকলেও। কেননা যাকাত তো বর্ধনশীল ধন-মালে ধার্য থাকে। আর যেসব ফসল ও ফল সঞ্চয় করে রাখা হয়েছে, তা প্রবৃদ্ধিবঞ্চিত। ক্রমশ ধ্বংস ও বিনাসমান।
প্রবৃদ্ধির শর্ত আরোপে ইমাম মালিকের মত অধিক প্রশস্ত। কেননা ঋণ বাবদ দেয়া সম্পদে- যা অন্য লোকের কাছে পাওনা- তিনি যাকাত ফরয মনে করেন না। তবে তা যখন ফেরত পাবে, তখন তাতে যাকাত ধার্য হবে এক বছরের মাত্র। অপহৃত ও মাটির তলায় গচ্ছিত মাল- যার সন্ধান নেই এর যাকাত দিতে হয় না। যেসব মাল বিনষ্ট হয়ে গেছে কিংবা মালিকানাচ্যুত হয়ে গেছে, তারও যাকাত নেই। তা ফেরত পাওয়া গেলে মাত্র এক বছরের যাকাত দিতে হবে।
সর্বপ্রকারের ঋণ বাবদ দেয় সম্পদের বেলায়ই এ নিয়ম। তবে যেসব ব্যবসায়ী পণ্য ক্রয় করে ও নগদ মূল্যে বিক্রয় করে, তাদের দেয়া ঋণ যেহেতু আতায় হবে বলে আশা আছে, এজন্যে সেঋণের ব্যাপার স্বতন্ত্র। এসব ঋণ নগদ ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত বলে তাতে অবশ্যই প্রতি বছর যাকাত ধার্য হবে।
ঋণ বাবদ দেয়া টাকার যাকাত ফরয না হওয়া পর্যন্ত মালিকী মতে যুক্তি হল তাঁর উপর যাকাত ফরয হতে পারে না। যেসব ব্যবসায়ী পণ্য কিনে পুঁজি করে রাখে ও মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকে, তারা সেই সব জমি ক্রয়কারীর মত, যারা জমি খরিদ করে তার মূল্য বৃদ্ধি পাবে এই আশায়। তাদের পণ্যের উপর প্রতিবছর যাকাত ধার্য হবে না। তারা যেসব নিসাপ পরিমাণ যদি বিক্রি করে তবে তার উপর যাকাত হবে এক বছরের জন্যে, যদিও তা তার হাতে বিক্রয়ের পূর্বে বেশ কয়টি বছর ধরে পুঁজিকৃত হয়েছিল। কেননা এসব আটকে রাখা পণ্য একবারই মাত্র মুনাফা দিয়েছে। তাই একবারই যাকাত ফরয হবে।[(আরবী*********)]
বর্ধনশীলতা রহিত সম্পদ
যাকাত ফরয হওয়ার জন্যে সম্পদের বর্ধনশীলতা যখন শর্ত, তখন যে মাল-সম্পদ বর্ধনশীলতা রহিত, সে সম্পর্কে কি সিদ্ধান্ত হবে? তাতে কি যাকাত ফরয হবে? যদি হয় তাহলে বছরের আবর্তনের সাথে সাথে যাকাত দেয়ার দরুন মুল সম্পদই নিঃশেষহয়ে যাবে, নাকি তা যাকাত মার্যনা পাবে? বস্তুত তাহলে তা অবশিষ্ট থাকতে পারে।
এই প্রশ্নের জবাবে বলতে হয় যে, বর্ধনশীলতা রহিত মাল-সম্পদ দুই প্রকারের হতে পারে:
প্রথম, যেসব মাল স্বতঃই বর্ধন-রহিত। আর দ্বিতীয, মালিকের অক্ষমতার দরুন বর্ধনশীলতা থেকে বঞ্চিত।
যেসব ধন-মাল স্ততঃই বর্ধনশীলতা রহিত, যেমন তা লুণ্ঠিত বা অপহৃত হয়েছে; কিন্তু তার কোন প্রমাণ নেই কিংবা ঋণ দেয়া হয়েছে, যা ফেরত পাওয়ার কোন আশা নেই। অথবা মাটির তলায় প্রোথিত হয়েছে কিন্তু কোথায় রাখা হয়েছে তা ভুলে গেছে। এমতাবস্থায় তার যাকাত দেয়া সম্ভব হয় না- যতক্ষণ না তা হস্তগত হচ্ছে।
তবে যে সব মালের মালিক নিজেই বর্ধনশীলতায় বিনিয়োগ করতে অক্ষম, তার এই অক্ষমতা শরীয়াতের বিধানদাতার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। তাই তার উপর যাকাত ফরয। অক্ষমতার কারণ সম্পর্কে কোন প্রশ্নই নেই। কেননা মুসলমান মাত্রের প্রতিই এটা ধরে নেয়া কথা যে, সে তার ধন-মালে প্রবৃদ্ধি সাধনে সর্বপ্রকারের প্রচেষ্টা চায়ে যাবে। হয় সে নিজে তাকরবে, না হয় অন্যকে এই কাজে শরীককরবে। আর সেজন্যে কার্যকরণের ব্যবস্থা করা ও প্রতিবন্ধক দূর করা মুসলমানের পক্ষে অসম্ভব বা কঠিন কিছু নয়।
অতএব অক্ষমতা ইসলামের দৃষ্টিতে কোন ‘ওযর’ নয়, এ কারণে সম্পদের মালিক যাকাত দেয়ার দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারে না। বরং এজ্যে তাকে তিরস্কৃত হতে হবে। কেননা ব্যক্তির অক্ষমতা কিংবা সমষ্টির বিপর্যয়ের কারণে তা ঘটেছে।
এ কারণে নবী করীম(স) এই অক্ষমতা থেকে আল্লাহ্র কাছে পানাহ চেয়েছেন, অক্ষম হতে নিষেধ করেছেন, অক্ষম ব্যক্তিকে তিরস্কার করেছেন।
নবী করীম (স) সব সময় দোয়া করতেন এই বলে:
(আরবী*********) হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে অক্ষমতা ও অবসাদগ্রস্ততা থেকে পানা চাই।
তিনি বলেছেন: (আরবী*********)
তোমার জন্যে যা কল্যাণকর তা তুমি লাভ করতে আগ্রহী হও এবং আল্লাহ্র কাছে সাহায্য চাও, আর তুমি অক্ষম হয়ে পড়ো না।
এক ব্যক্তিকে তিনি বলেছিলেন:
(আরবী*********) আল্লাহ্ অক্ষমতার জন্যে তিরস্কার করেন।
বর্ধনপ্রবণ সব সম্পদেই যাকাত
এই শর্তের আলোকে আমরা বলব, সর্বপ্রকারের বর্ধনশীল ধন-মালই যাকাত ধার্য হওয়ার ক্ষেত্র, যদিওঠিক সেই প্রকারের মালের নাম করে নবী করীম(স) যাকাত ধার্য করেন নি। সে ক্ষেত্রে কুরআনও হাদীসের সাধারণ অর্থবোধক ঘোষণাই আমাদের জন্যে যথেষ্ট দলীল।
এ মতটি এক শ্রেণীর ফিকাহ্বিদের মতের বিপরীত। যাকাত ফরয হওয়ার ব্যাপারে তাঁরা খুবই সংকীর্ণ মত প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, নবী করীম(স) নিজে যে সব জিনিস থেকে যাকাত আদায় করেছেন, কেবলমাত্র সেসব জিনিস থেকেই যাকাত নেয়া যাবে। তা চাড়া অন্য কোন জিনিসথেকে নয়। ইমাম ইবনে হাজম এই মতের বড় প্রকক্তা। তিনি তাঁর ‘আল-মুহাল্লাহ’ গ্রন্থে মাত্র আটটি জিনসের উপর যাকাত ফরয বলে ঘোষণা করেছেন। তা হচ্ছে: উষ্ট্র, গরু, ছাগল, গম, যব, খেবুর স্বর্ণ ও রৌপ্য। এমনকি কিশমিশের উপর যাকাত ফরয হওয়ার কথা বলেন নি।’ পশু সম্পদের মধ্যে কেবলমাত্র উষ্, গরু ও ছাগলের কথাই বলেছেন। কৃষি সম্পদের মধ্যে কেবল ধান, গম, যব ও খেজুর ইত্যাদির উল্লেখ করেছেন। আর স্বর্ণ-রৌপ্য ছাড়া আর কোন খনিজ ও নগদ সম্পদের যাকাত দেয়ার কথা বলেন নি। তাঁর মতে ব্যবসা পণ্যের উপর যাকাত ধার্য হয় না।
অন্যান্য ফিকাহ্বিদের মতে অনেকেই অনুরূপ বা তার কাছাকাছি মত দিয়েছেন। অনেকে আবার এই ক্ষেত্রকে বহু বিস্তীর্ণ করে দিয়েছেন। ইমাম আবূ হানীফা এ ক্ষেত্রে অধিক প্রশস্তা ও ব্যাপকতার কথা প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, জমিতে যা-ই উপন্ন হবে- তার উদ্দেশ্য যদি প্রবৃদ্ধি সাধন হয- তবে তার উপর যাকাত ফরয হবে। এজন্যে তিনি কোন নিসাবেরও শর্ত আরোপ করেন নি। ঘোড়ার উপর যাকাত ফরয হওয়ার কথা তিনিই বলেছেন। অলংকারাদিকেও তিনি বাদ দেন নি। তবে তা কেবল শরীয়াত পালনে বাধ্য এমন বয়স্কদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অল্প বয়স্ক ও পাগলের অলংকারে যাকাত হবে না বলে রায় দিয়েছেন। তিনি খারাজী জমিতে ওশর ধার্য হওয়ার স্বপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। ফলে বিপুল সংখ্যক জমিই ওশর ফরয হওয়ার বাধ্যতা থেকে মুক্ত হয়ে যায়।
ইবনে হাজম এবং তাঁর সাথে ঐকমত্য প্রকাশকারী শেষদিকের দুজন প্রখ্যাত বিশেষজ্ঞ ইমাম শাওকানী ও নওয়াব সিদ্দীক হাসান প্রমুখের যাকাতক্ষেত্র সংকীর্ণতাকরণের মত দুটি ভিত্তির উপর স্থাপিত:
প্রথম, মুসলমানের মাল ‘হারাম’ সম্মানার্হ, কোন অকাট্য দলীল ছাড়া তা গ্রহণ করা যেতে পারে না।
আর দ্বিতীয়, যাকাত হচ্ছে একটা শরীয়াত ভিত্তিক বাধ্যবাধকতা। মানুষ মূলত সর্বপ্রকার দায়-দায়িত্বমুক্ত। তার উপর কেবল তা-ই পালন করার দায়িত্ব চাপানো যেতে পারে, যা অকাট্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত। এমন কি আল্লাহ্ যে বিসয়ে কোন অণুমতি দেন নি সে কাজ করা রবাধ্যবাধকতাও তার উপর চাপানো যেতে পারে না। এ ক্ষেত্রে ‘কিয়াসা’কে ব্যবহার করা যেতে পারে না- বিশেষ করে যাকাতের ব্যাপারে।
আমাদের মত কিন্তু এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তা এ দুটি ভিত্তি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর ভিত্তির উপর স্থাপিত। নিম্নে আমরা তার ব্যাখ্যা পেশ করছি:
১. কুরআন ও সুন্নাহের সাধারণ ঘোষণাবলী সর্বপ্রকারের ধন-মালে গরীবের হক ধার্য করেছে, তা যাকাত বা সাদ্কা নামেই অভিহিত হোক-না কেন। যেমন বলা হয়েছে:
(আরবী*********) আর তারা যাদের ধন-মালে সুনির্দিষ্ট হক রয়েছে।
(আরবী*********) তাদের ধন-মাল থেকে ‘সাদকা’ গ্রহণ কর।
নবী করীম (স) ইরশাদ করেছেন: (আরবী*********)
তাদের জানিয়ে দাও, আল্লাহ্ তাদের ধন-মালে যাকাত ফরয করে দিয়েছেন, যা তাদের ধনীদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হবে এবং তাদেরই গরীবদের মধ্যে বন্টন করা হবে।
বলেছেন: ‘তোমরা তোমাদের ধন-মালের যাকাত আদায় কর।’ এসব বাণীতে ধন-মালের যে কোন পার্থক্য করা হয়নি। আর হাদীসের আলোকে আমরা এ কথাও জানতে পেরেছি যে, এসব অকাট্য দলীল ক্রমবর্ধনশীল ধন-মালের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্যে রক্ষিত দ্রব্যাদির ব্যাপারে নয়।
কাজেই যাকাত বা সাদ্কা আদায়ের বাধ্যবাধকতা থেকে কোন প্রকারের মালই বাদ যেতে পারে না। তবে সেজন্যে কোন দলীল থাকলে ভিন্ন কথা। কিন্তু এখানে তেমন কোন দলীলই নেই।
২. প্রত্যেক ধনী ব্যক্তিরই পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা লাভ করা কর্তব্য। আর সা সে লাভ করতে পারে ব্যয় ও দানের মাধ্যমে। পবিত্রতা লাভ করবে স্বার্থপরতা ও লোভ-লালসার পংকিলতা থেকে, আত্মম্বরিতা ও আত্মপ্রেম থেকে। এ জন্যেই আল্লাহ বলেছেন: ‘তাদের ধন-মাল থেকে যাকাত গ্রহণ কর- তাদের পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন কর এবং দ্বারা।’ এ কাজটি কেবলমাত্র গম ও যব উৎপাদনকারীদেরই করত্ব্য হবে এবং বড় প্রশস্ত ফলের বাগানের মালিকের কর্তব্য হবে না, কল-কারখানা মালিক ও বিশাল দালান-কোঠার অধিকারী এ থেকেমুক্ত থাকবে, তা কোনক্রমেই বোধম্য নয়। কেননা কৃষি উৎপাদকের তুলনায় এসব মালিকদের মুনাফা ও আয় শত শথ গুণ বেশী।
৩. প্রত্যেক ধন-মালেরই পবিত্রতা পরিচ্ছন্নতা লাভ জরুরী, কেননা তা উপার্জন নানা প্রকারের শোবাহ্-সন্দেহের সংমিশ্রণ ঘটে। আর ধন-মালের পবিত্রতা কেবল যাকাত দেয়ার মাধ্যমেই। হযরত ইবনে উমর (রা) থেকে হাদীস বর্ণিত হয়েছে:
(আরবী*********) আল্লাহ তা’আলা ধন-মালের পবিত্রতা বিধানের উদ্দেশ্যেই যাকাত ফরয করেছেন।
অপর এক হাদীসে বলা হয়েছে: (আরবী*********)
তুমি যখন তোমার মালের যাকাত দিয়ে দিলে, তখন তুমি তা থেকে খারাবীটা দূর করে দিলে।
কাজেই এ কাজটি ইবনে হাজম উল্লেখিত মাত্র আটটি জিনিসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকবে। অন্যান্য ধন-মালের উপর প্রযোজ্য হবে না; বিশেষ করে বর্তমানে যেগুলো জাতি ও সরকারের সম্পদের প্রধান স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়েছে তা কল্পনাও করা যায় না। তাই বলতে হবে, সর্ব প্রকারের ধন-মালেরই পবিত্রতা অর্জন ও তার খারাপ দিক থেকে নিষ্কৃতি একান্তই জরুরী। আর তা সম্ভব যাকাত আদায় করে।
৪. যাকাত ফরয করা হয়েছে গরবি, মিসকীন, ঋণগ্রস্ত ও নিঃস্ব পথিকের প্রয়োজন পূরণার্থে, সাধারণ মুসলিম জনতার কল্যাণ বিধানের জন্যে। যেমন আল্লাহ্র পথে জিহাদ, ইসলামের দিকে অমুসলিমের দিল আকৃষ্টকরণ, তাদের পরিবারবর্গের ভরণ-পোষণ, পারস্পরিক সম্পর্ক সুষ্ঠূ রাখার জন্যে সকল ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সাহায্যে। কেননা এসব কাজের দ্বারাই তো ইসলামকে শক্তিশালী ও দুর্জয়ী করে তোলা যায়।
তাই এসব প্রয়োজন পরিপূরণ ও এসব কল্যাণ বাস্তবায়নের জন্যে সর্বপ্রকারের ধন-মালের মালিকের উপরই যাকাত আদায় করা কর্তব্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ প্রেক্ষিতে বলা যায়, আল্লাহ্ তা’আলা পাঁচটি উটের মালিক বা চল্লিশটি ছাগলের মালিক কিংবা পাঁচ ‘অসাক’ যবের মালিকের উপর যাকাত ধার্য করবেন, আর বড় বড় কল-কারখানা শিল্পোৎপাদনের মালিক পুঁজিপতি বিশাল দালন-কোঠার মালিক, বড় বড় নামকরা ডাক্তার, আইন ব্যবসায়ী, বড় বড় বেতনভুক্ত চাকুরীজী ও বড় বড় স্বাধীন উপার্জনকারীদের এ দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি দেবেন, আল্লাহ্ সম্পর্কে এ কথা চিন্তাও করা যায় না। কেননা প্রথমোক্তরা বছরের পর বছর ধরে ম্রম করে যা আয় করে, তা শেষোক্ত একদিনে বা এক ঘন্টায় আয় করে বসে।
ধন-মাল সম্পর্কে ইসলামের চিন্তা ও বিশ্বাসই হল এই যে, তার প্রকৃত মালিক মহান আল্লাহ্ তা’আলা। মানুষতাতে শুধু খলীফা বা প্রতিনিধি মাত্র। প্রকৃত মালিকের প্রতিনিধিত্ব করাই তার দায়িত্ব। সমাজের গরীব-মিসকীন ও অভাবগ্রস্ত লোকেরা যেহেতু আল্লাহ্পর প্রতিপালিত, তাই এ সব মালেই তাদের হক রয়েছে। তা ছাড়া জাতির জনগণের সার্বিক কল্যাণ- ফী সাবীলিল্লাহ- আল্লাহর পথে উৎসর্গীত। কাজেই সর্ব প্রকারের ধন-মালই তার অন্তর্ভুক্ত এবং সব ধন-মালিকই যাকাত আদায় করতে বাধ্য। তা কৃষিলব্ধ হোক, শিল্পলব্ধ হোক, আর ব্যবসালব্ধই হোক-না কেন।
৫. ‘কিয়াস’ ইসলামী আইন প্রণয়নে গোটা মুসলিম উম্মাতের কাছে স্বীকৃত ও সমর্থিত একটি মৌল ধারা। ইবনে হাজম ও অন্যান্য যাহেরী মতালম্বীরা যতই বিরোধিতা করুন না কেন, রাসূলে করীম (স) যেসব মাল থেকে যাকাত গ্রহণ করেছেন, সেগুলোর উপর কিয়াস করে অন্যান্য সর্ব প্রকারের ধন-মালকেই যাকাতের ক্ষেত্ররূপে গণ্য করতে হবে।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, শরীয়াত দুটি সদৃশ মালের মধ্যে কোন পার্থক্য করেনি- যেমন দুটি পরস্পর বিপরীত জিনিসের উপর একই সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করেনি। কোন প্রকারের মাল থেকে যাকাত গ্রহণ করা ফরয বলে আমরা যখন কিয়াসের সাহায্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব, তখন তা শরীয়াতেই সিদ্ধান্ত হবে। আল্লাহ্র অনুমতি ছাড়াই সিদ্ধান্ত গ্রহণ তখন হবে না। আর পূর্বে যেমন বলেছি যাকাত নিছক একটা ইবাদতের কাজই নয়, তা ইসলামের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশও।
৬. মুসলিমের ধন-মাল ‘হারাম’ –সম্মানার্হ, এতে আমাদরে দ্বিমত নেই। বরং তার এ বিশেষ মালিকানাভুক্ত ধন-মালেই তো ‘হক’ ধার্য হবে। আমরা লক্ষ্য করেছি, ধনীর ধন-মালে আল্লাহ্র হক, অন্য কথায় সমাজ-সমষ্টির হক, অভাবগ্রস্ত লোকদের হক অকাট্য দলীল দ্বারাই তা প্রমাণিত।
তবে ইবনে হাজম নিজেই অন্যভাবে আমাদরে মতের সমর্থন যুগিয়েছেন। তিনি ধন-মালে যাকাত ছাড়াও হক্ ধার্য করেছেন; আর তা গরীব-মিসকীনের জন্যে আদায় করা- সেজন্যে ধনীদের উপর বল প্রয়োগ করা রাষ্ট্রকর্তাতের কর্তব্য ও অধিকার বলে ঘোষণা করেছেন। এজন্যে গরীবদের যুদ্ধ করা পর্যন্ত জায়েয বলেছেন।
কিন্তু যাকাত ছাড়া অন্যান্য মালথেকে হক্ আদায়ের সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে, সর্বপ্রকারের মাল থেকেই যাকাত আদায় করা। তাতে সব ধনীই সমানভাবে যাকাত দিতে বাধ্য হবে। কোন ধনীই বাদ পড়বে না। যখনই প্রয়োজন অপূরিত থাকবে, সব ধনী লোকদের কাছে গিয়েই আমরা বলব, তোমাদরে ধন-মালের যাকাত ছাড়াও লোকদের হক রয়েছে, তা দিতে হবে।
তবে নবী করীম(স) তাঁর যুগে কোন কোন বর্ধনশীল মালথেকে যে যাকাত গ্রহণ করেন নি, তার দুটি কারণ বলা যেতে পারে।
একটি হচ্ছে, তার বর্ধনশীলতা তখনদুর্বল ছিল। মালিকদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে এবং তার বর্ধনশীলতা বাড়াবার সুযোগ দান ও সেই সঙ্গে উৎসাহ দানের উদ্দেশ্যে তিনি যাকাত গ্রহণ করেন নি।
দ্বিতীয়, তিনি সেই লোকদের ঈমানও মন প্রশস্ত করার উদ্দেশ্যে তাদের কাছ থেকে যাকাত গ্রহণ করা ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর এ না গ্রহণ করার দরুন সেই লোকদের চিরদিন পবিত্রকরণ ও পরিচ্ছন্নকরণ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতেহবে এমনকোন কথাই হতে পারে না। অথচ তারা তাদের দ্বীন থেকে জানতে পেরেছে যে, তাদের ধন-মালে হক রয়েছে এবং তা যাকাত বাবদ আদায় না করা পর্যন্ত তাদের কল্যাণ হতে পারে না।
৩. নিসাবের শর্ত
ইসলাম ক্রমবর্ধনশীল ধন-মালের যে-কোন পরিমাণের উপরই যাকাত ফরয করেনি, তা যতই দুর্বল ও ক্ষীণ হোক-না কেন, বরং যাকাতফরয হওয়ার জন্যে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের মাল হওয়া অপরিহার্য শর্ত বিশেষ। ফিকাহ্র পরিভাষায় তাকেই নিসাব’ বলে। যেমন হাদীসে নবী করীমের স্পষ্ট উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে যে, পাঁচটির কম সংখ্যক উষ্ট্র ও চল্লিশটির কম ছাগলে যাকাত নেই। অনুরূপভাবে দুইশত নগদ রৌপ্যমুদ্রার কমের উপর এবং ফল ও দানার পাঁচ অসাকের কম পরিমাণের উপর যাকাত নেই।
যাকাতরে জন্যে এ পরিমাণ নির্ধারণের কারণ হল এ জন্যে যে, এর কম পরিমাণ একটা পরিবারের বছরের প্রয়োজনের জন্যে যথেষ্টনয়। পরিবারেরস্বামী-স্ত্রী ও তৃতীয় একজন লোক অবশ্যই থাকবে। সেই সাথে একজন সেবক ও সন্তানরাও থাকতে পারে। খুবকম পরিবারই এর বিপরীত হতে পারে আর মানুষের বেশীর ভাগের খাদ্য এক ‘তরল’ কিংবা একমদ্ পরিমাণ শস্য। উপরিউক্ত লোকেরা সকলেই যদি খাদ্য গ্রহণ করে, তাহলে উক্ত পরিমাণ এক বছরের জন্যে যথেষ্ট হতে পারে। আর অবশিষ্ট যা থাকবেতা তাদের বিপদ-আপদ ও আনুষঙ্গিক প্রয়োজনের জন্যে যথেষ্ট হবে।
আর পাঁচ অসাক্ ও দুইশ দিরহাম নির্ধারণ করা হয়েছে এজন্যে যে, তা এমন একটি পরিমাণ যা একটা পরিবারেরসম্বৎসরের ব্যয়ের জন্যে যথেষ্ট; যদি অধিকাংশ এলাকায় দ্রব্যমূল্য সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় আর ভারসাম্যপূর্ণ দেশগুলোর দ্রব্যমূল্যের বেশী কমের খোঁজ খবর নিলে এটাই পাওয়া যাবে।
পাঁচটি উটের যাকাত বাবদ একটি ছাগী দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যদিও মূলত যাকাত বাবদসেই মালই গ্রহণ করা হয় যার যাকাত দেয়া হবে। তারই একটা পরিমাণকে নিসাব নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এরূপ করার কারণ এই যে, উষ্ট্র বড় আকারের জন্তু।তার ফায়দা অনেক। তা যেমন যবাই করা যায়, তেমনিতার পিঠে সওয়ারও হওয়া যায়। তার দুগ্ধ দোহন ও সেবন করা যায়, তার বংশ বৃদ্ধি করা চলে, তার পশম ও চামড়া ব্যবহারের জন্যে প্রস্তুত করা যায়, তার বাছাই করা চামড়া দিয়ে জুতা বানানো যায়। আর সেকালে একটি উষ্ট্রকে দশটি ছাগলের সমান ধরাহত। …যেমন বহু কয়টি হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে। এভাবে পাঁচটি উষ্ট্রকে ছাগলের নিকটবর্তী বনিয়ে দেয়া হয়েছে। এজন্যেতাতে একট ছাগল নির্দিষ্ট করা হয়েছে। [(আরবী****)]
যাকাতের মালের নিসাব পরিমাণ হওয়ার শর্ত আরোপ ইসলামী বিশেষজ্ঞগণের কছে সর্ববাদীসম্মত ও সমর্থিত। অবশ্য তা কৃষি ফসল, ফলফঅঁকড়া ও খনিজ দ্রব্য পর্যায়ে। ইমাম আবূ হানীফার মত হচ্ছে, জমি যা-ই উৎপাদন করবে, তার পরিমাণ বেশী হোক বাকম, তাতেই ওশর দিতে হবে। ইবনে আব্বাস ও উমরইবনে আব্দুল আযীয প্রমুখ থেকে বর্ণিত হয়েছে যে শাক-সব্জির প্রতি দশটি বোঝার উৎপাদন থেকে একটি বোঝা যাকাত বাবদ দিতে হবে।
কিন্তু জমহুর ফিকাহ্বিদগণ প্রত্যেক মালের যাকাত ধার্য করার জন্যে তার একটা নিসাব নির্দিষ্ট হওয়া একান্তই জরুরী মনে করেন, যা জমির উৎপাদনের সাথে সামস্যপূর্ণ হবে। এ পর্যায়ে তাদের দলীল হচ্ছে এ হাদীস:
(আরবী********) পাঁচ অসাকের কমে যাকাত নেই। [পাঁচ অসাক হিজাজী ওজনে ১৮ মণ ৩০ সেরএবং ইরাকী ওজনে ২৮ মণ ৫ সের হয়।]
তা অন্যান্য মালের উপর কিয়াস করার দাবি রাখে, যেমন পশু, নগদ টাকা ও ব্যবসা পণ্য ইত্যাদি।
বস্তুত যাকাতের নিসাব নির্ধারণের শর্ত খুবই স্পষ্ট ও প্রকট। কেননা যাকাত হচ্ছে ধনীদের কাছ থেকে গরীবদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশের জন্যে গ্রহণ করা কর। ইসলাম ওমুসলিমের কল্যাণে অংশ গ্রহণের উদ্দেশ্যে। কাজেই সহানুভূতি কার্যত এমন পরিমাণই গ্রহণ করতে হবে। গরীবদের কাছ থেকে কর গ্রহণের তো কোন অর্থ হয় না। তারা তোসাহায্য পাওয়ারই অধিকারী, সাহায্য করতে তারা সক্ষম নয়। নবী করীম (স) এর নিম্নোক্ত কথাটি এ পর্যায়েরই:
(আরবী************) প্রকাশ্য ধনীর কাছ থেকেই যাকাত গ্রহণ করতে হবে।
আধুনিককালে কর ধার্যকরণ বিধানে একটা সীমাবদ্ধ পরিমাণ সম্পদ-সম্পত্তির মালিককে কর দেয়ার দায়িত্বথেকে এজন্যেএ নিষ্কৃতি দেয়া হয়ে থাকে। এটাও তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন। তাদের অবস্থার দাবি অনুযায়ী তা কম করা হয়। কেননা তারা তা দেয়ার সামর্থ রাখে না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে চৌদ্দশত বছর পূর্বেই ইসলাম সঠিক পথ-নির্দেশ করেছে।
৪. মৌল প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়া
কোন কোন ফিকাহ্বিদ মালের বর্ধনশীলতা ছাড়াও নিসাবের পরিমাণটা মালিকের মৌল প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়ার শর্ত করেছেন। হানাফী ফিকাহ্বিদদের সাধারণ কিতাবাদিতে এ কথা স্থিরভাবে লিখিত হয়েছে। কেননা এর ফলেই ধনাঢ্যতাও নিয়ামতের তাৎপর্য বলে প্রতিভাত হতে পারে। আর তা মনের খুশীর সাথেই দিয়ে দেয়া যেতে পারে। যে অভাবগ্রস্ত তার পক্ষে প্রয়োজনমুক্ত হওয়া সম্ভব হয় না, সেটা তার জন্যে নিয়ামত হয় না। নিম্নতম প্রয়োজনীয় পরিমাণ সামগ্রী পাওয়া গেলে সুখ-সম্ভোগ হয় না। কেননা তা তো বেঁচে থাকার সামগ্রী। জীবন রক্ষার জন্যই তা প্রয়োজন। তার শোকর আদায় তো দৈহিক নিয়ামতের শোকর আদায়। এরূপ অবস্থায় কিছু দিতে হলে তা মনের সুখে ও আনন্দ সহকারে দেয়া হয় না। ফলে তখনকার দেয়াটা রাসূলে করীম(স)-এর এ হাদীস অনুযায়ী হবে না, যাতেতিনি বলেছেন:
(আরবী*******)
তোমরা তোমাদের ধন-মালের যাকাত দাও তোমাদরে মনের সুখ ও সন্তুষ্টি সহকারে।
তাউ উপরিউক্ত লোকদের যাকাত দিতে হলে যাকাত আদায় হবে না।
কতিপয় ফিকাহ্বিদ এ শর্তটি এড়িয়ে গিয়ে বর্ধনশীলতার শর্তের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। আর তা এজন্যে যে, মৌলিক প্রয়োজন পূরণের দ্রব্যাদি সাধারণত বর্ধনশীল হয় না। তার প্রবণতা বা যোগ্যতাও সে সবের মধ্যে থাকে না। বসবাসের ঘর, চলাচলের জন্তু বা যানবাহন, পরিধানের কাপড়, ব্যবহার্য দ্রব্যাদি, পড়ার বই এবং কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি এ পর্যায়ের দৃষ্টান্ত; এগুলো অ-বর্ধনশীল।
তাঁরা আরও বলেছেন, প্রকৃত প্রয়োজনের ব্যাপারটি নিগুঢ় রহস্য-আচ্ছন্ন। তা সাধারণভাবে জানা যায় না। ফলে সেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত কি এবং কতটুকু তা-ও জানা সম্ভব হয় না। অতএব প্রয়োজনের অতিরিক্ত বলে যে দলীল পেশ করা হয়েছে, তা যথাস্থানে দাঁড়িয়ে। আর তা হচ্ছে ব্যবসায়েল জন্যে প্রস্তুতকরণ। িএ প্রস্তুতকরণের দ্বারাই বর্ধনশীলতা বাস্তবায়িত হতে পারে।
সত্যি কথা হচ্ছে, বর্ধনশীলতার শর্ত পূর্ণ হওয়াটাই যাকাত ফরয হওয়ার জন্যে যথেষ্ট নয়; তাকে প্রয়োজনের অতিরিক্তও হতে হবে। কেনা উক্ত ফিকাহ্বিদগণ নগদ অর্থ সম্পদকে স্বভাবতই বর্ধনশীল বলে দাবি করেছেন। কেননা উক্ত ফিকাহ্বিদগণ নগদ অর্থ সম্পদকে স্বভাবতই বর্ধনশীল বলে দাবি করেছেন। কেননা তা আবর্তিত ও উৎপাদনশীল হওয়ার জন্যে সৃষ্ট। তার মালিক তার প্রবর্ধন কার্যত না করলেও তার এপ্রকৃত অপরিবর্তিত থাকবে। কাজেই এ শর্তটি আরোপিত না হলে নিসাব পরিমাণ নগদ অর্থের মালিক তার নিজের ও তার পরিবারবর্গের খোরাক-পোশাক, বসবাস, চিকিৎসা ইত্যাদির জন্যে তার প্রতি মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে। কেননা এগুলো পরিপূরণ করা তার কর্তব্য। ফলে সে এতটা ধনী নয়, যাতে সে যাকাত দিতে পারে। যদিও বহু বিশেষজ্ঞ আলিমের মতে মৌল প্রয়োজন পূরণ নিয়োজিত সম্পদ অস্তিত্বহীনরূপেই গণ্য।
আমরা মৌল প্রয়োজনের কথা বলেছি। কেননা মানুষের প্রয়োজন তো সীমাহীন, অশেষ। আমাদের এ যুগে বহু বিলাস দ্রব্য ‘প্রয়োজনীয়রূপে’ গণ্য। কাজেই মানুষের মন যা চায় তাকেই ‘মৌল প্রয়োজন’ মনে করা যায় না। কেননা মানুষের মনস্তত্ত্ব হচ্ছে, সে স্বর্ণের দুটি খনি লাভ করলে তৃতীয়টির জন্যে তার কামনা তীব্রহয়ে উঠবে। আসলে ‘মৌল প্রয়োজন’ বলতে আমরা বুঝি, যা না হলে মানুষের বেঁচে থাকাই সম্ভব নয়। যেমন খাবার, পোশাক, পানীয়, বাসস্থান, প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জনের বই পত্র, তার পেশা উপযোগী যন্ত্রপাতি ইত্যাদি।
হানাফী আলিমদের কেউ কেউ মৌলিক প্রয়োজনের খুব সূক্ষ্ম ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েচেন। বলেছেন: যা মানুষকে ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা করে সুস্পষ্টভাবে, যেমন দৈনন্দিন খরচাদি, ঘরের প্রয়োজনীয়, যুদ্ধাস্ত্রসমূহ, শীত-গ্রীষ্ম উপযোগী পোশাক, অথবা ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা, যা দিয়ে সেনিজেকে পাওনাদারের দাবি থেকে রক্ষা করতে পারে। কেননা সে কারণে জেলে যেতে হলে তো নিজেকে ধ্বংসের মধ্যে ফেলা হবে। আর পেশায় কাজের জন্যে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, যানবাহন, শিক্ষার বই পত্র- কেননা মূর্খতা তো ধ্বংসেরই নামান্তর। কারো কাছে যদি এ সব প্রয়োজন পরিপূর্ণ পরিমাণের নগদ অর্থ থাকে, যা নিসাব পরিমাণ হয়, তাহলে তা থাকারই শামিল। যেমন কারো কাছে পিপাসা নিবৃত্তির জন্যে প্রয়োজন পরিমাণ পানি থাকলেও সে তায়াম্মুম করতে পারে। কেননা সেই পানি দিয়ে ওযু করা হলে পিপাসা নিবৃত্তির কোন ব্যবস্থা তার কাছে থাকবে না। [আরবী*****]
আমরা খুবই গুরুত্ব সহকারে এখানে উল্লেখ করতে চাই যে, উক্ত আলিমগণ জ্ঞানকে জীবন ও মূর্খতাকে মৃত্যু ও ধ্বংসগণ্য করেছেন। আর মূর্খতা থেকে রক্ষাকারী জিনিসসমূহকে ক্ষুধা নিবৃত্তিকারী খাদ্যের, উলংগতাও কষ্ট বিদূরণে পোশাকের মত মৌল প্রয়োজনের মধ্যে শামিল করেছেন। যেমন তাঁরা স্বাধীনতাকে জীবন এবং কারাগার ও কয়েদকে ধ্বংস গণ্য করেছেন।
আমরা প্রায়ই দেখতে পাই, মানুষের মৌলিক প্রয়োজনকাল, অবস্থা ও পরিবেশের পরিবর্তনের ফলে পরিবর্তিত হয়ে যায় ও বিভিন্ন রূপ ধারণ করে। কাজেই এ ব্যাপারটি বিশেষজ্ঞদের নির্ধারণ ও ইজতিহাদের উপরই ছেড়ে দেয়া আবশ্যক।
আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে, যাকাত দিতে বাধ্য লোকদের মৌলিক প্রয়োজনের কথা। তাদের স্ত্রী, পুত্র, পরিজন ও পিতামাত্র, নিকটাত্মীয়দের ভরণ-পোষণ ইত্যাদির ব্যাপার। কেননা তা-ও তাদের মৌলিক প্রয়োজনের অন্তর্ভুক্ত।
ইসলামী ফিকাহ্ বহু পূর্বেই এক্ষেত্রে বিশেষ পথনির্দেশ উস্থাপিত করেছে। আধুনিক কর ধার্যকরণের ক্ষেত্রে চিন্তা সম্পূর্ণ একালের জিনিস। তাতে জীবন ধারণের নিম্নতম পদ্ধতি ছিল মূল সম্পদের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখা। ব্যক্তি, তার অবস্থা, প্রয়োজন, ঋণ, পারিবারিক দায়-দায়িত্ব ইত্যাদির প্রতি কোনরূপ সহানুভূতিপূর্ণ দৃষ্টি না রাখা। কিন্তু বহু দেশে অর্থশালী বহু লোকই ও দৃষ্টিকোণের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলতে পারে নি। তারা বড়জোর কেবলমাত্র ব্যক্তির জৈবিক প্রয়োজন কিংবা তার দুই তিনটি ছেলে মেয়ের ব্যাপারকে মেনে নেয়, যদিও তাদের ছেলে-সন্তানদের সংখ্যা ৮-১০টি রয়েছে। পিতাম তা ও অন্যান্য নিকটাত্মীয়দের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব তার উপর যতই থাক না কেন, তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করা হয় না।
কুরআন ও সুন্নাহ থেকে এই শর্তের দলীল
১. ফিকাহ্বিদগণ এ শর্তের পক্ষে যতই যুক্তি দিন-না কেন, কুরআন হাদীসেওএর দলীল রয়েছে। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবী করীম (স) বলেছেন:
(আরবী*********) ধনাঢ্যতার প্রকাশ থেকেই যাকাত হবে।
হাফেয ইবনে হাজার এ শিরোনামের ব্যাখ্যায় লিখেছেন- যাতে তিনি হাদীসটির ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, সদকা যাকাত দানকারীর জন্যে শর্ত হচ্ছে সে নিজে ও যার যার ব্যয় বহন তার দায়িত্ব, তারা দরিদ্র হবেনা।
(ক) কুরআনের আয়াত:
(আরবী********) লোকেরা জিজ্ঞাসা করে তারা কি (কত) খরচ করবে? তুমি বল যা অতিরিক্ত।
হযরত ইবনে আব্বাস(রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে:
‘অতিরিক্ত’ বলতে বোঝায় পরিবার বহনের সব দায়িত্ব পালনের পর যা অতিরিক্ত বা অবশিষ্ট হবে তা।
হযরত ইবনে উমর, মুজাহিদ, আতা, ইকরামা, সাঈদ ইবনে যুবায়র, মুহাম্মদ ইবনে কা’ব, হাসান, কাতাদাহ, কাসেম, সালেম, আতা খোরাসানী, রবী ইবনে আব্বাস প্রমুখ ফিকাহ্বিদও এই মতই দিয়েছেন। [আরবী ******]
তার অর্থ মহাজ্ঞানী আল্লাহ্ তা’আলা যাকাত বাবদ ব্যয়ের ক্ষেত্র হিসেবে নির্ধারণ করেছেন মৌল প্রয়োজন পূরণের পর যা অতিরিক্ত থাকে তা। কেননা ব্যক্তির নিজের প্রয়োজন অপর লোকদের প্রয়োজনের তুলনায় অগ্রাধিকারের দাবিদার। আর নিজের পরিবারবর্গের প্রয়োজন নিজেরই প্রয়োজন গণ্য। কাজেই এজন্যে যা দরকার তা দান করার জন্যে শরীয়াত কোন দাবি করতে পারে না। কেননা তার সাথে ব্যক্তির মনের সম্পর্ক রয়েছে, সে ব্যয়ে ব্যক্তির মনের সন্তুষ্টি ও প্রশান্তি নিহিত।
হাসানউক্ত আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে বলেছেন: ‘এটা এজন্য যে, তুমি যেন তোমার ধন-মাল ব্যয় করে পরের কাছে ভিক্ষা চাইতে বাধ্য নাহও।’
ইবনে জরীর আবূ হুরায়রা(রা) থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন: “একব্যক্তি এসে বলল, হে রাসূল! আমার কাছে একটি মুদ্রা রয়েছে। বললেন, তা তুমি নিজের জন্যে ব্যয়কর। বলল, আমার কাছে আরও একটি আছে। বললেন, তা তোমারদ স্ত্রীর জন্যে ব্যয় কর। বলল, আমার কাছে আরও একটি আছে। বললেন, তা তোমার সন্তানের জন্যে ব্যয় কর। বলল, আমার কাছে আরও একটি আছে। বললেন, তুমি নিজেই বোঝ।”
এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, ব্যক্তির নিজের, তার স্ত্রীর ও সন্তানাদির প্রয়োজন সর্বাগ্রে পূরণ করতে হবে।
হযরত জাবির (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলেকরীম(স) এক ব্যক্তিকে বললেন:
(আরবী********)
তোমার নিজেকেই প্রথমে রাখবে। এর জন্যে ব্যয় করবে। অতিরিক্ত কিছু হলে তোমার পরিবারবর্গের জন্যে ব্যয় করবে। পরিবারববের্গর জন্যে ব্যয় করার পর কিছু অতিরিক্ত থাকলে তা তোমার নিকটাত্মীয়দের জন্য ব্যয় করবে। তার পরও অতিরিক্ত থাকলে এমনি…. এমনি ভাবে…..।
এ সব হাদীসের কোন কোনটিতে যদিও নফল ব্যয় সম্পর্কে বলা হয়েছে, তবুও তা-ই সাধারণ নিয়ম। ব্যয় পর্যায়ে ইসলামের হিদায়েত এমনিই। অতিরিক্ত হচ্ছে সাদ্কা-যাকাতের ক্ষেত্র। জমহুর আলিম ও ফিকাহ্বিদগণ তা-ই বুঝেছেন।
৫. ঋণমুক্তি
পূর্বে পূর্ণাঙ্গ মালিকানার যে শর্তের উল্লেখ করা হয়েছে তারপর মৌল প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ থাকার সে কথা বলা হয়েছে, সেই সঙ্গে যাকাত ফরয হওয়ার জন্যে ঋণমুক্ত হওয়ার পর নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকারও একটি জরুরী শর্ত। যদিও সম্পদের মালিক ঋণগ্রস্ত হয়, যার মধ্যে যাকাতের নিসাব পরিমাণ সম্পদ নিমজ্জিত হয়ে যায় বা তার চাইতে কম হয়ে পড়ে, তাহলে তার উপর যাকাত প্রদান করা ফরয হবে না।
এ পর্যায়ে ফিকাহ্বিদগণ বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে বাহ্যিক ধন-মালের ঋণটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ মতপার্থক্য মূলত যাকাত সংক্রান্ত ধারণার বিভিন্নতার দরুনই দেখা দিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, যাকাত কি শুধু একটা ইবাদত? না, ধন-মালে মিসকীন লোকদের আরোপিত অধিকার?’
তাঁরা এই শেষোক্ত মত গ্রহণ করেছেন, তাঁদের মতে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে যাকাত দিতে হবে না। কেননা মিসকীনের অধিকারের আগেই তার উপর পাওনাদারের অধিকার আরোপিত। তখন আসলে তা পাওনাদারের টাকা যার হাতে ইবাদত মনে করেছেন, তাদের মতে মাল যার হাতেই রয়েছে তাকেই যাকাত দিতে হবে। কেননা এই ইবাদতের শর্তই হল মাল বর্তমান থাকা। তার উপর ঋণ চাপানো আছে কি নেই, তা এখানে অবান্তর প্রশ্ন। এখানে আসলে দুটি অধিকারের দ্বন্দ্ব। একটি আল্লাহ্র হক, অপরটি মানুষের হক। আর আল্লাহর হক অগ্রাধিকার পাওয়ার অধিক অধিকারী। [(আরবী*********)]
ইবনে রুশ্দ লিখেছেন, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির উপর থেকে যাকাত দেয়ার দায়িত্ব তুলে নেয়াই শরীয়াতের লক্ষ্য। শরীয়াতের দলীলাদি, তার অন্তর্নিহিত ভাবধারা ও তার সাধারণ মৌলনীতি সবকিছু থেকেই এ কথা বোঝা যায়।
এ পর্যায়ের দলীলসমূহ নিম্নরূপ
প্রথম, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির মালিকানা দুর্বল ও অসম্পূর্ণ। কেননা ঋণদাতার পাওনা তার উপর চেপে বসে আছে। সে অনবরত তার পাওনা ফেরত চাচ্ছে। পাওনাদার তার পাওনা অবশ্যই নিয়ে নেবে। ইমাম আবূ হানীফার এই মত। আর পূর্ণ মালিকানা হওয়ার যাকাত ফরয হওয়ার জন্যে যে শর্ত, তা আমরা আগেই বলেছি।
দ্বিতীয়, ঋণদাতা তার মালের যাকাত দিতে বাধ্য। কেননা ঋণ বাবদ দেয়া অর্থ তার মালিকানাভুক্ত, সে-ই মালিক। এক্ষণে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিও যদি যাকাত দেয় তাহলে একই মালেল দুইবার যাকাত দেয়া হবে। কিন্তু তা শরীয়াতে নিষিদ্ধ।
তৃতীয, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির ঋণ যদি নিসাব পরিমাণ হয় কিংবা তার কম হয়, তাহলে তার নিজের পক্ষেই যাকাত গ্রহণ সম্পূর্ণ হালাল। কেননা সে তো দরিদ্র ব্যক্তি। সে ‘ঋণগ্রস্ত’ –তাহলে তার যাকাত দেয়া কি করে কর্তব্য হতে পারে?
চতুর্থ, যাকাত-সাদকা ফরয হয়েছে ধনী লোকদের প্রতি। হাদীসে তা-ই বলা হয়েছে। আর ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি তো ধনী নয়। তার ঋণ শোধন করাই প্রধান দায়িত্ব। কেননা সেজন্যে তার উপর দিনরাতের ভাবনা চিন্তা ও অপমান ভয় ছাড়াও কারাবরণের আতংক সওয়ার হয়ে আছে।
পঞ্চম, একথা সুস্পষ্ট যে, যাকাত ফরয হয়েছে অভাবগ্রস্ত লোকদের প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্যে তাদের প্রতি সহানুভূতি স্বরূপ। ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি দরিদ্র ব্যক্তির মতই কিংবা তার চাইতেও বেশী দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। সে অহর্নিশ ঋণ শোধের জন্যে চিন্তান্বিত। এমতাবস্থায় অপরের প্রয়োজন পূরণের জন্যে দেয়ার পরিবর্তে ঋণদাতার পাওনা ফেরত দেয়াই অধিক যুক্তিযুক্ত। এ জন্যেই নবী করীম (স) বলেছেন: ‘প্রথমে নিজের প্রয়োজন, তারপরে তোমার উপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের প্রয়োজন পূরণ কর।’
ষষ্ঠ, হযরত উসমান (রা) বলেছেন: এটা তোমাদের যাকাত দেয়ার মাস। যার ঋণ আছে তা প্রথমে দিয়ে দাও। তারপরে তোমাদের ধন-মালের যাকাত দাও। [(আরবী*******)] অর বর্ণনানুযায়ী কথাটি হল ‘যার ঋণ রয়েছে, সে তার ঋণ প্রথমে আদায় করবে। পরে তার অবশিষ্ট মালের যাকাত দেবে।’ [(আরবী*******)] একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে, রাসূলের মিম্বরে দাঁড়িয়ে হযরত উসমান (রা) উক্ত কথাটি বলেছিলেন বিপুল সংখ্যক সাহাবীর উপস্থিতিতে। কিন্তু কেউ তার প্রতিবাদ করেন নি। তার অর্থ সব সাহাবীই এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত ছিলেন।
এসব কারণে জমহুর ফিকাহ্বিদ এই মত গ্রহণ করেছেন যে, ঋণ যাকাত ফরয হওয়ার প্রতিবন্ধক অথবা তা গোপন মালেল- নগদ টাকা ও ব্যবসা পণ্যের পরিমাণ হ্রাস করে দেয়। আতা সুলায়মান ইবনে ইয়াসার, হাসান নখয়ী, লাইস, মালিক, সওরী, আওযায়ী, আহমদ, ইসহাক, আবূ সওর, আবূ হানীফা ও তাঁর সঙ্গিগণ এই মতই গ্রহণ করেছেন। রবীয়া, হাম্মাদ ও শাফেয়রি নতুন মত ছাড়া এর বিপরীত মত আর কারো নেই।
প্রকাশমান ধন-মাল, পালিত পশু ও কৃষি ফসল পর্যায়ে কোন কোন ফিকাহ্বিদের মত হচ্ছে, এক্ষেত্রেও ঋণ যাকাত দেয়ার পথে বাধা। এই দুই ধরনের সম্পদের মধ্যে পার্থক্য এই যে, দ্বিতীয় প্রকারের সম্পদের যাকাত অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। এজন্যে যে, তা প্রকাশমান ও গরীবদের দৃষ্টি তার উপরই নিবন্ধ। এ কারণে মালিকদের কাছ থেকেই যাকাত আদায় করে নেয়ার জন্যে সরকারী কর্মচারী পেরণের বিধান করা হয়েছে। নবী করীম(স) ও তাঁর খলীফাগণ তাই করতেন। তখন যে তা দিতে চায়নি, তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন হযরত আবূ বকর (রা)। তাঁরা অপ্রকাশমান ধন-মালের যে যাকাত পেত, তা-ই তারা গ্রহণ করত। তার উপর কোন ঋণ চাপানো আছে কিনা তা জিজ্ঞাসা করত না। এ থেকে বোঝা যায় যে, ঋণ প্রকাশমান ধন-মালের যাকাতের পথে প্রতিবন্ধক নয়। আর দরিদ্রদের মনের চাহিদাও তার প্রতিই অধিক। তার সংরক্ষণের প্রয়োজন বেশী। কাজেই তার যাকাত দেয়া অধিকতর তাকিদপূর্ণ। [(আরবী*******)]
ইমাম মালিক, আওযায়ী ও শাফেয়ী এ মত দিয়েছেন। ইমাম আহমদেরও একটি মত এর পক্ষে।
ইমাম আবূ হানীফা মনে করন, ঋণ ফসল ও ফল-ফঅঁকড়ার যাকাত ছাড়া সব যাকাতেরই প্রতিবন্ধক।
কৃষির উপর ঋণের ইবনে উমর ও ইবনে আব্বাস ভিন্ন ভিন্ন মত দিয়েছেন। ইবনে আব্বাস বলেছেন, ফসলের ঋণ শোধ করার পর অবশিষ্টের যাকাত দিতে হবে। আর ইবনে উমর বলেছেন, ফসল থেকে ঋণ ও পরিবারবর্গের খরচাদি বাদ দিয়ে অবশিষ্টের যাকাত দেবে; আমাদের বিবেচনায় প্রকাশমান ও অপ্রকাশমান ধন-মালের মধ্যকার কথিত পার্থক্য অস্পষ্ট। এটা আপেক্ষক ব্যাপার। অনেক সময় একালের পণ্যদ্রব্য পশু ও কৃষি ফসলের অপেক্ষা অধিক প্রকাশমান হয়ে পড়ে। কাজেই বলতে হয়, উপরিউক্ত কারণ পূর্বোক্ত সাধারণ দলীলকে নাকচ করতে পারে না। ঋণ সর্বপ্রকার মালের যাকাতের পথেই প্রতিবন্ধক হবে। শরীয়াত ঋণগ্রস্তদের প্রতি সব সময় উদার দৃষ্টি রাখে।
আতা, হাসান, সুলায়মান, মায়মুন ইবনে মাহ্রান, নখ্য়ী, সওরী, লাইস, ইসহাক ও আহমদের একটি বর্ণনা এ মতের স্বপক্ষে। আবূ উবাইদ ও তায়ুসও এ ধরনেরই মত দিয়েছেন।
আবূ উবাইদ বলেছেন, ঋণ সত্য প্রমাণিত হলে কৃষি ফসল ও পশু মালিকের উপর যাকাত ফরয হবে না। সুন্নাতের অনুসরণ এভাবেই সম্ভব। কেননা নবী করীম (স) বলেছেন: ‘যাকাত ধনীদের কাছ থেকে আদায় করতে হবে ও দরিদ্রদের মধ্যে বন্টন করতে হবে।’ আর ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি তো যাকাত প্রাপক, তার কাছ থেকে যাকাত কিভাবে নেয়া যাবে।
আর ঋণ থাকার কথা যদি কেবল মৌখিক হয় এবং তার সত্যতা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত না হয়, তাহলে তার কাছ থেকে কৃষি ফসল ও পালিত পশু উভয়েরই যাকাত আদায় করা হবে। কেননা কৃষি ফসল ও পশুর যাকাত একটা প্রকাশমান কর্তব্য। তা অবশ্যই দিতে হবে। আর সে যে ঋণ থাকার কথা বলছে, তা প্রকাশমান, জানা যায় না, সে হয়ত মিথ্যা বলছে। তাই সে দাবি গ্রহণ করা হবে না। যেমন এক ব্যক্তির উপর বহু লোকের পাওনা রয়েছে। সে তা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার এবং তা আদায় করে দেয়ার দাবি করল। তখন তাকে সত্য বলে মেনে নেয়া যাবে না। মোটকথা ঋণ যাকাত ফরয হওয়ার প্রতিবন্ধক এ শর্তে যে, ঋণ হওয়ার কথা সত্য প্রমাণিত হতে হবে। যেন ঋণের দাবি দ্বারা আল্লাহ্ ও গরীবের হক বিনষ্ট হতে না পারে।
যাকাতের প্রতিবন্ধক ঋণের শর্ত
এ পর্যায়ে যে শর্তে কোন মতপার্থক্য নেই, তা হচ্ছে ঋণের পরিমাণ নিসাব সমান বা তার কম হতে হবে এবং এ নিসাব পরিমাণ ছাড়া ঋণ শোধের আর কিছুই পাবে না। তা ছাড়া তার উপায়ও কিছু থাকবে না। যেমন একজনের হাতে বিশটি মুদ্রা রয়েছে আর ঋণ রয়েছে একটি মুদ্রা অথবা তার বেশী কিংবা কম। এক্ষণে ঋণ শোধ করা হলে নিসাব পরিমাণে ঘাটতি পড়বে। নিসাব ছাড়া অন্য কিছু থেকে দিয়ে তা পূরণ করাও কিছু পাচ্ছে না। আর যদি তার ত্রিশটি মুদ্রা থাক, আর ঋণ থাকে দশটি মুদ্রা। তা হলে তাকে বিশটি মুদ্রার যাকাত দিতে হবে। আর যদি দশটি মুদ্রার অধিক ঋণ থাকে, তাহলে তাকে যাকাত দিতে হবে না। আর পাঁচটি মুদ্রার ঋণ থাকলে পঁচিশ মুদ্রার যাকাত দিতে হবে।
যদি কারোর কাছে একশত ছাগল থাকে, আর তার ঋণ থাকে ষাটটি ছাগলের মূল্য পরিমাণ, তা হলে সে অবশিষ্ট চল্লিশটি ছাগলেল যাকাত দেবে। আর তার ঋণ পরিমাণ যদি একষট্টিটি ছাগল সমান হয়, তাহলে তার উপর যাকাত ফরয হবে না। কেননা তা নিসাবের কম হয়ে যাচ্ছে। [(আরবী*******)]
এই ঋণ বর্তমানকালের হওয়া কি শর্ত?
আসলে বর্তমান ও বিলম্বিতকালের ঋণের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কেননা এ পর্যায়ের দলীলসমূহ নির্বিশেষ। যদিও কোন কোন আলিম বলেছেন, বিলম্বিত ঋণ যাকাত ফরয হওয়া প্রতিবন্ধক নয়। কেননা বর্তমানে তা ফেরত চাওয়া হচ্ছে না। [(আরবী*******)]
এ বিলম্বিত ঋণেরর মধ্যে স্ত্রীর বিলম্বে দেয় মোহরানাও গণ্য হবে; যা তালাকবা মৃত্যু পর্যন্ত বিলম্ব হয়ে থাকে। কিন্তু তা যাকাত ফরয হওয়ার পথে প্রতিবন্ধক হবে কি হবে না, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে।
কেউ কেউ বলেছেন, বিলম্বিত মোহরানা প্রতিবন্ধক হবে না। কেননা তা সাধারণভাবে তাৎক্ষণিকভাবে দাবি করা হচ্ছে না। নগদ দেয় মোহরানার কথা ভিন্ন।
অপর লোকেরা বলেছেন, প্রতিবন্ধক হবে। কেননা তা-ও অন্যান্য ঋণের মতই একটা ঋণ বিশেষ।
অন্যান্যরা বলেছেন, স্বামী তা নগদ আদায়ের সংকল্প রাখে, তবে প্রতিবন্ধক হবে, নতুবা নয়, কেননা তা ঋণরূপে গণ্য নয়।
স্ত্রীর ভরণ-পোষণ যদি স্বামীর উপর ঋণ হয়ে দাঁড়ায়, কোন সমঝোতার ভিত্তিতে অথচা চুকিয়ে দেয়ার দরুন নিকটাত্মীয়দের ভরণ-পোষণও অনুরূপ তাহলে তা যাকাতের প্রতিবন্ধক হবে। [(আরবী*******)]
এ ক্ষেত্রে আল্লাহ্র ঋণ ও মানুষের ঋণ কি সমান?
শাফেয়ী মাযহাবের ইমাম নববী বলেছেন, আমরা যখন বলি যে, ঋণ যাকাতের প্রতিবন্ধক, তখন অর্থই হয় যে, আল্লাহর ঋণ ও মানুষের ঋণ সমান।
হানাফী মাযহাবের লোকেরা বলেছেন, ঋণ যাকাতের প্রতিবন্ধক, যতক্ষণ তা জনগণের দাবি হিসেবে উত্থিত। যাকাত এ পর্যায়ের। কেননা তাতেই সমগ্র দাবি নিবন্ধ। তাতে পাওনাদাররা ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির উপর প্রভাবশালী হয়ে দাঁড়ায়। তখন প্রশাসকের অধিকার হবে পাওনাদারদের অধিকার আদায় করার জন্যে তার কাছ থেকে মাল গ্রহণ করা। তাই বলতে হয়, তার মালিকানা দুর্বল, অস্থায়ী। কিন্তু মানত ও কাফ্ফারা প্রভৃতি আল্লাহ্র হক্ সম্পূর্ণ ভিন্নতর। যদি কারো উপর অতীত কয়েক বছরের যাকাত অবশিষ্ট থাকে, তাহলে তা সেই ঋণের মধ্যে গণ্য হবে, যদি দাবি জনগণের পক্ষথেকে হবে। তখন এ প্রশাসক পাওনাদারদের পক্ষের প্রতিনিধি বলে গণ্য হবেন।
আমরা এ মত গ্রহণকরতে পারি যদি সরকার মুসলিম ও ইসলামীহয়। তা-ই যাকাতের ব্যাপার নিয়ে দাঁড়াবে। যেন মালদার লোকদের মধ্য থেকে কেউ এ দাবি না করতে পারে যে, তার উপর অনেক মানত ও অনেক কাফ্ফারা চেপে বসেছে। কেননা এ দাবি এমন, যার সত্যতা ও যথার্থতা প্রমাণ করা কঠিন। হবে।
মুসলিম ব্যক্তি নিজেইযদি নিজের যাকাত আদায় করে, তাহলে সে তার এ সব ঋণ হিসাব করে তার মাল থেকে আদায় করে দেবে যাকাত দেয়ার পূর্বেই। কেননা হাদীসের কথা হল, ‘আল্লাহ্র ঋণ সর্বাগ্রে আদায় করতে হবে।’
৬. একবছর অতিক্রমণ
অর্থাৎ মালিকানা সম্পদ মালিকের হাতে একটি বছর-পূর্ণ বারটি মাস- অবস্থিত থাকলেই যাকাত ফরয হবে। পশু, নগদ সম্পদ ও ব্যবসায়ের পণ্য সম্পর্কে এই শর্ত আরোপিত হয়েছে। বলা যায়, এ হচ্ছে মূলদনের যাকাতয়। কিন্তু কৃষি ফসল, ফল-ফাঁকড়া, মধু, খুনি ও গচ্ছিত ধন ইত্যাদির ক্ষেত্রে। এ এক বছরকালের মালিকানার কোন শর্ত নেই। তা হল উৎপাদনের যাকাত।
কতিপয় মালে এক বছরের শর্তের কারণ
যাকাত ফরয হওয়ার জন্যে যে সব মালের মালিকানা এক বছরকাল থাকার শর্ত করা হয়েছে ও যে সব মালেতা করা হয়নি, এদুইয়ের মধ্যকার পার্থক্য সম্পর্কে ইমাম ইবনে কুদামাহ্ বলেছেন, প্রথম পর্যায়ের ধন-মাল হচ্ছে বর্ধনশীল পর্যায়ের। পালিত পশুর বংশবৃদ্ধি হয়, ব্যবসায়ের পণ্য মুনাফা লাভকরে। এ জন্যে এ ক্ষেত্রে এক বছরকালের সময় অতিবাহিত হওয়ার শর্ত রাখা হয়েছে, কেননা প্রবৃদ্ধি লাভেরজন্যে অন্তত এ সময়টা প্রয়োজন, যেন তার বাবদ যা দেয়া হবে তা মুনাফার ভাগ থেকে দেয়া যায়। এটাই সহজ ও কল্যাণময়। আর যাকাত তো সহানুভূতিমূলক ব্যবস্থা।
বর্ধনশীলতার প্রকৃত রূপ কি? তা আয়ত্ত করা হয়নি। কেননা এতে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। তা সুসংবদ্ধও করা হয়নি। আর যার সম্ভাব্যতা স্বীকার করা হয়েছে, তার নিগূঢ় তত্ত্ব উদ্ঘাটনের দিকে লক্ষ্য দেয়া হয়নি। এসব মালে যাকাত বারবার ধার্য হয়। সেজন্যে একটা স্থির নিয়মের প্রয়োজন, যেন একটি বছরে একই মাল থেকে কয়েকবার যাকাত দিতে না হয়, তাহলে তো মালিকের সমস্ত ধনই ফুরিয়ে যাবে।
কিন্তু কৃষি ফসল ও ফল-ফঅঁকড়ার স্বতঃই বর্ধিষ্ণু। তা থেকে যাকাত বের করার সম্পূর্ণ মাত্রায়ই বর্তমান থাকে। কাজেই তার যাকাত তাৎক্ষণিকভঅবে আদায় করা হবে। পরে তো কমতির দিকে যাবে, প্রবৃদ্ধির দিকে নয়। তাই তার উপর দ্বিতীয়বার যাকাত ফরয হবে না এজন্যে যে, তার প্রবৃদ্ধি আকাঙ্ক্ষিত নয়। আর ধনীর উৎপাদন কৃষি ফসল ও ফল-ফাঁকড়ার মতই ভূমি-উৎপন্ন। এ সব ক্ষেত্রে একটি বছর অতিবাহিত হওয়া শর্ত নয়।
এক বছরের শর্তের প্রমাণ
ইবনে রুশ্দ লিখেছেন, সর্ব সাধারণ ফিকাহ্বিদগণ স্বর্ণ-রৌপ্য ও পালিত পশুর যাকাত ফরয হওয়ার জন্যে মালিকানার একটি বছর অতিবাহিত হওয়ার শর্ত করেছেন। কেননা চার খলীফা থেকেই তা প্রমাণিত। সাহাবিগণও তদনুযায়ী আমল করেছেন। তাদের মধ্যে কোন মতবিরোধ নেই। তা নিশ্চয়ই আল্লাহ্র তরফ থেকে নির্ধারিত। হযরত উমর (রা) বর্ণনা করেছেন, নবী করীম (স) বলেছেন:
(আরবী*******)
একটা বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বে কোন মালে যাকাত ফরয হয় না।
সব ফিকাহ্বিদই এ ব্যাপারে একমত। ইসলামের প্রাথমিক যুগে এ পর্যায়ে কোন মতভেদ ছিল না। তবে ইবনে আব্বাস ও মুআবিয়া থেকে ভিন্ন মত প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু সে পর্যায়ে কোন হাদীস উদ্ধৃত হয়নি।
কতিপয় সাহাবী ও তাবেয়ীনের ভিন্ন মত
ইবনে মাসউদ, ইবনে আব্বাস ও মুআবিয়া (রা) বলেছেন: যখনই মাল ব্যবহারযোগ্য হবে, তখনই তাতে যাকাত ফরয হবে। এক বছর অতিবাহিত হওয়ার কোন শর্ত নেই। ভিন্ন মতাবলম্বী এ সাহাবিগণের সাথে কতিপয় তাবেয়ীন একমত্য প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মত হচ্ছে, কারো মাল যখনই নিসাব পরিমাণ হবে, তখনই তার যাকাত দিতে হবে। মালিকানার এক বছর অতিবাহিত হোক আর না-ই হোক।
ইবনে রুশ্দ এ পার্থক্যের কারণ উল্লেখ করে বলেছেন যে, এ পর্যায়ে কোন হাদীস উদ্ধৃত হয়নি।
সমন্বয়ের কেন্দ্রবিন্দু
প্রাচীন ও পরবর্তীকালের মনীষদের পার্থক্যমুক্ত মত হচ্ছে, পশু ও নগদ সম্পদ, ব্যবসায়ী সম্পদ প্রভৃতি মূলধনে িএক বছরে মাত্র একবারই যাকাত দেয়া ফরয। এক বছরে একই মাল-সম্পদ থেকে একাধিকবারযাকাত গ্রহণ করা হবে না। ইমাম জুহ্রী বলেছৈন, এ জাতির কোন প্রশাসক মদীনা কেন্দ্রিক আবূ, বকর, উমর ও উসমান- কেউই দুইবারযাকাত আদায় করেছেন এমন খবর আমাদের কাছে পৌঁছেনি। তাঁরা প্রতি বছর ফলনশীরতা বা বন্ধ্যাত্ব অবস্থায়ই যাকাত সংগ্রহকারী পাঠাতেন। কেননা তা আদায় করা রাসূলের সুন্নাত। আসলে এটা ইসলামী শরীংয়াতের সর্বাগ্রে দেয়া বিধান। এটিই তার সুবিচার এবং তার মুজিযায়। কাজেই যাকাত ফরয হওয়ার ব্যাপারটি প্রশাসক ও লালসাকারীদের ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেয়া যায় না। তারা যখন-ইচ্ছা তা আদায়ও করতে পারে না। তা একটি আবর্তনশীল নির্দিষ্ট ফরয। তা বৎসরান্তর সময়ে দিতে হবে। এই এক বছরে অনেক পরিবর্তন ঘটে, মালদার লোকদের উপার্জন নতুনত্ব পায় এবং অবাবগ্রস্তদের প্রয়োজনও প্রবল হয়ে ওঠে। এই মেয়াদটি খুবই যুক্তিসংগত। মূলধনের প্রবৃদ্ধি এই সময়কালের মধ্যে প্রকাশিত হয়। ব্যবসায়ে মুনাফা প্রকাশ পায়। পালিত পশুরা বাচ্চা জন্ম দেয়, আর ছোটরা বড় হয়।
যাকাত পর্যায়ে রাসূলে করীম (স)-এর আদর্শ হচ্ছে, তিনি সাধারণ মালের ক্ষেত্রে তা বছরে একবার মাত্র ফরয করেছেন। আর কৃষি ফসল ও ফল-ফঅঁকড়ার ক্ষেত্রে তার পরিপক্কতাই তার এক বছর। এটা সুবিচারপূর্ণ নীতি। কেননা প্রতি মাসে বা প্রতি শুক্রবার দিন যাকাত আদায় করা হলে মালদার লোকদের পক্ষে কঠিন অবস্থা দেখা দিত্ আর সারাজীবনে একবার দেয়ার ব্যবস্থা হলে গরীব লোকদের হক মারা যেত। পক্ষান্তরে ফল-ফাঁকড়ার ক্ষেত্রে প্রতি বছর একবার যাকাত ফরয হলেও তা সুবিচারপূর্ণ হত না।
প্রাপ্ত ধনমালের ব্যাপারে মত পার্থক্য
এক ব্যক্তির কোন ধন-মাল ছিল না, পরে সে পেয়ে গেল। সে তার মালিক হল। তা সে বেতন থেকে পেয়েছে, কি পারিশ্রমিকরূপে ক্ষতিপূরণ, অস্থায়ী মুনাফা বা হেবা ইত্যাদি বাবদ পেয়েছে সে প্রশ্ন অবান্তর। তার মধ্যে ফসল, ফল-ফাঁকড়া, মধু, গচ্ছিত ধন বা খনি, তা ব্যবহারকারোপযোগী হলেই তার যাকাত দেয়া ফরয। অবশ্য যতি তা নিসাব পরিমাণের হয়। এ ব্যাপারে বিপরীত কোন মত নেই।
তবে একজন মুসলমান যখন এমন ধন-মালের মালিক হয় ও ব্যবস্থা করতে পারে যে, তা যদি এক বছরকাল ব্যবহারোপযোগী না থাকে যেমননগদ অর্থ, ব্যবসায় পণ্য ও পালিত পশু তাহলে কি করা হবেচ? সে বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলা রয়েছে। ইবনে কুদামাহ এ পর্যায়ে তিন প্রকার কথা বলেছেন।
১. ব্যাবহারোপযোগী মাল যদি কারো কাছে পূর্ব থেকে রক্ষিত মালের প্রবৃদ্ধি হয়ে থাকে, তা হলে তাতে যাকাত ফরয হবে। যেমন ব্যবসা পণ্যের মুনাফা ও পশুর বাচ্চা দান। এসব ক্ষেত্রে পূর্ব থেকে রক্ষিত কোন মূল্যের সাথে তাকেশামিল মনেকরতে হবে। তখন তার এক বছরেই প্রবৃদ্ধির ও বছর গণনা করতে হবে। ইবনে কুদামাহ বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে কোন মতবিরোধের কথা আমরা জানি না। কেননা তা তো তারই স্বজাতীয় প্রবৃদ্ধি। যেমন ব্যবসাপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিজনিত অতিরিক্ত লাভ।
২. মালিকের কাছে যদি প্রাপ্ত মাল তার কাছে পূর্ব থেকে রক্ষিত মালের স্বজাতীয় না হয়- যেমন কারো কাছে নিসাব সংখ্যক উষ্ট্র রয়েছে, পরে যে একটি গাভী লাভ করল। সে ক্ষেত্রে সেই নতুন প্রাপ্ত মাল নিয়েই মাসলা সাব্যস্ত করতে হবে। পূর্ব থেকে রক্ষিত ও বছর অতিক্রান্ত মালের সাথে তা মেলান হবে না তাও তা শামিল ধরে নিসাবের হিসাব করা হবে না। বরং সেই নতুন প্রাপ্ত মাল যদি নিসাব পরিমাণ হয় ও এক বছর অতিবাহিত হয়, তবেই তার যাকাত দিতে হবে, নতুবা নয়। সর্বসাধারণ আলিমদের এটাই সিদ্ধান্ত। ইবনে মাসউদ, উবনে আব্বাস ও মুআবিয়া থেকে বর্ণিত হয়েছে: ‘তাতে যাকাত ফরয হবে যখন তা ব্যবহারোপরোযী হবে।’ ইমাম আহমদ বলেছেন, ‘তা যখন ব্যবহার করা হবে, তখন যাকাত দিতে হবে।’ ইবনে মাসউদ বর্ণনা করেছেন: ‘আবদুল্লাহ আমাদেরকে দান করতেন এবং তা থেকেই তার যাকাত দিতেন। যে ব্যক্তি তার ঘর কিংবা দাস বিক্রয় করল সে প্রাপ্ত মূল্যে যাকাত দেবে তখন, যখন সেই মূল্য তার হাতে আসবে। তাঁর জন্য যদি যাকাত দেয়ার একটা নির্দিষ্ট মাস থাকে, তবেসেই মাস পর্যন্ত বিলম্বিত করেঅন্যান্য মালেরসাথে এক সাথে যাকাত দিয়ে দেবে।
৩. পরে প্রাপ্ত মাল যদি তার কাছে পূর্বে থেকে রক্ষিত নিসাব পরিমাণ মালের স্বজাতীয় হয়ে যার উপর যাকাত হওয়ার একটি বছর অতিবাহিত হয়েছে স্বতন্ত্র কারণে- যেমন কারো কাছে যদি চল্লিশটি ছাগল থাকে, যার উপর একটি বছর অতিবাহিত হয়েছে, অতঃপর সে আর একশটি ছাগল ক্রয় করল কিংবা দান হিসেবে পেয়ে গেল। তাহলে তার এই ছাগলের উপর একটি বছর অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত যাকাত ফরয হবে না- ইমাম আহমদ শাফেয়ীরমতে। ইমাম আবূ হানীফা বলেছেন, বিগত বছরে তার কাছে যা ছিল তার সাথে পরে পাওয়া ছাগল একসঙ্গে হিসেবে করে সবকিছুরই যাকাত দিতে হবে, তার কাছে পূর্ব থেকে রক্ষিত মালের একটি বছর পূর্ণ হওয়ার পর। তবে যাকাত দেয়া মালের বিনিময় হলে অন্য কথা। কেননা তা এক জাতীয় মালের সাথে শামিল হচ্ছে নিসাব গঠনে। ফলে বছর গুণতিতেও তারই সাথে গুণিত হবে। কেননা এই শেষেপাওয়া মালের বছর স্বতন্ত্রভাবে গণণা করা হলে ফরয আদায় খণ্ডিত হয়ে যাবে; যাকাত ফরয হওয়ার সময়ও বিভিন্ন হয়ে দাঁড়াবে। মালিকানা লাভে সময় স্বতন্ত্রভাবে সংরক্ষিত করতে হবে। আর সম্পদের প্রতি অংশের যাকাতের পরিমাণ আলাদাভাবে নির্ধারণ করতে হবে। এভাবে সামান্য পরিমাণ আলাদা করে দিয়ে দেয়া কঠিন হবে, পরের বছরগুলোতেও অনুরূপ অবস্থাই দেখা দেবে। আর এটা খুব িকঠিন কাজের দায়িত্ব চাপানো ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ
(আরবী*******) দ্বীনের ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তোমাদের উপর কোন কষ্ট চাপিয়ে দেন নি।
শরীয়াতে এরূপ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে, শুধু ভিন্ন জাতীয় জিনিসের ক্ষেত্রে, পঁচিশটি উষ্ট্রের কম হলে আর মুনাফা ও উৎপাদন তার মূল ও আসলের বছরের সাথে গণনা করতে হবে। এই অসুবিধা দূর করাই এরূপ ব্যবস্থার উদ্দেশ্য। [আল-মুগনী, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৬১৭]
ইবনে কুদামাহ যদিও হানাফী মাযহাবের এই মতের প্রতিবাদ করেছেন, কিন্তু সত্য কথা এই যে, বাস্তবায়নে হানাফী মতই অধিকতর সহজ। অতএব তা-ই গ্রহণীয়।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
পশুসম্পদের যাকাত
পশু জগত বিশালও বহু প্রকার। তার বিভক্তি কয়েক হাজারে পৌছতে পারে। কিন্তু মানুষ তার মধ্য থেকে খুব কম সংখ্যক পশুই ব্যবহার করে থাকে। পশুর মধ্যে সবচাইতে বেশী ব্যবহৃত হয় সেই শ্রেণী, যাকে আরবগণ আল-আন’আম (***) বলে চিনে। আর তা হচ্ছে উষ্ট্র, গরু, মহিষ- এগুলো। ছাগল ভেড়া, দুম্বা এরই অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ্ তা’আলা এগুলো দিয়ে তাঁর বান্দাদের প্রতি বিরাট কল্যাণ এনে দিয়েছেন। কুরআনমজীদে এই পশুগুলোর কল্যাণের কথা বিভিন্নভাবে বলা হয়েছে। সূরা আন-নাহলে বলা হয়েছে:
(আরবী**********)
(আল্লাহ) জন্তু পয়দা করেছেন, তাতে তোমাদের জন্যে পোশাকও রয়েছে আর খাদ্যও। আরও নানাবিধ অন্যান্য ফায়দাও নিহিত রয়েছে। সেসবের মধ্যে তোমাদের সৌন্দর্য রয়েছে, যখন সকালবেলাতোমরা সেগুলোকে বিচরণের জন্যে পাঠাও এবং যখন সন্ধ্যায় সেগুলোকে ফিরিয়ে আন। ওরা তোমাদের ভার বোঝা বহন করে এমন-এমন স্থান পর্যন্ত নিয়ে যায়, যেখানে তোমরা খুব কঠোর শ্রম ছাড়া পৌঁছতে পার না। আসল কথা এই যে, তোমাদের আল্লাহ্ বড়ই অনুগ্রহসম্পন্ন ও মেহরবান।
এ সূরারই অপর আয়াতে বলা হয়েছে:
(আরবী**********) আর তোমাদের জন্যে চতুষ্পদ গৃহপালিত জন্তুতেও এক শিক্ষা নিহিত রয়েছে। ওদের পেট থেকে গোপর ও রক্তের মাঝখান থেকে তোমাদের খাঁটি দুগ্ধ পান করাই যা পানকারীদের জন্যে খুবই উপাদেয়।
অপর আয়াতে বলা হয়েছে:
(আরবী**********)
কিন্তু জন্তু জানোয়ারের চামড়া থেকে তোমাদের জন্যে এমন ঘর সৃষ্টি করেছেন, যা তোমাদের জন্য বিদেশ সফরে ও একস্থানে অবস্থান-উভয় অবস্থাতেই খুব হাল্কা থাকে। জিনি জন্তুর পশমউষ্ট্র ও খরগোসের পশম ও চুল দ্বারা তোমাদের জন্যে পরিধানের ব্যবহারের অসংখ্য জিনিস বানিয়েদিয়েছেন, যা জীবনের নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত তোমাদের কাজে আসে।
সূরা ইয়াসীন-এর আয়াত: (আরবী**********)
এ লোকেরা কি দেখে না যে, আমরা আমাদের হাতে তৈরী করা জিনিসগুলো দিয়ে তাদের জন্যে গৃহপালিত পশু সৃষ্টি করেছি আর এখন এসবের মালিক? আমরা এগুযলোকে এমনভাবে তাদের আয়ত্তাধীন করে দিয়েছি যে, এগুলোর কোন একটির উপর তারা সওয়ার হয়, কোনটির গোশত খায় তারা। এগুলোর মধ্যে তাদের জন্যে রকম-বেরকমের কল্যাণ ও পানীয় রয়েছে। তাহলে তারা শোকার গুযার হয় না কেন?
কুরআন যে শোকর-এর জন্যে উদ্বুদ্ধ করেছে, তার সর্বাধিক প্রকাশ ক্ষেত্র হচ্ছে সুন্নাত প্রবর্তিত যাকাত। তারা নিসাব নির্দিষ্ট করে নিয়েছে এবং প্রতি বছর আদায়কারী পাঠিয়ে মালিকদের কাছ থেকে তা আদায় করার ব্যবস্থা করেছে। যারা তা দিয়ে অস্বীকৃত হবে তাদের দুনিয়ার শাস্তি ও আখিরাতের আযাবের ভয় প্রদর্শন করা হয়েছে।
বস্তুত আরবদের জন্যে বিশেষ করে উহা খুবই কল্যাণকর ছিল। অনেক দেশেই এ সম্পদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক শক্তিরূপে গণ্য।তা প্রায় সর্বত্রই এ উদ্দেশ্যে লালিত-পালিত হয়। তাই শরীয়াত তার উপর যাকাত ফরয হওয়ার নিসাব নির্ধারিত করে দিয়েছে।
এ পর্যায়ের যাকাতের বিস্তারিত বিধান আমরা এখানে পেশ করছি।
প্রথম আলোচনা
পশুর যাকাতের সাধারণ শর্ত
যে কোন সংখ্যক মালিকানার পশুর উপর শরীয়াত যাকাত ধার্য করেনি। সর্বপ্রকারের জন্তুর উপরও করা হয়নি। যে সব জন্তুর মধ্যে বিশেষ কতগুলো শর্ত পাওয়া যাবে, কেবল সেগুলোতে যাকাত ফরয করা হয়েছে। শর্তগুলো এই:
১. তার সংখ্যা নিসাবমাত্রা পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে
প্রথম শর্ত হচ্ছে, শরীয়াত নির্ধারিত নিসাব সংখ্যক পর্যন্ত তার সংখ্যা পৌঁছাতে হবে। কেননা ইসলামে কেবলমাত্র ধনী ব্যক্তিদের উপরই যাকাত ধার্য হয়েছে। কিন্তু একটি বা দুটি উষ্ট্রের মালিকই তো আর ধনী গণ্যহতে পারে না। এ জন্যে উষ্ট্রের ক্ষেত্রে সে সংখ্যা হচ্ছে পাঁচ। এ ব্যাপারে সর্বকালের মুসলমান সম্পূর্ণ একমত। অতএব তার কম সংখ্যক উষ্ট্রের মালিকানায় যাকাত ফরয হবে না। আর চল্লিশ ছাগলের দাম কম সংখ্যক হলেও যাকাত দেয়া লাগবে না। হাদীসসমূহে তা-ই বলা হয়েছে এবং রাসূলে করীম(স)ও খুলাফায়ে রাশেদুনের আমলও এ নীতিতেই চ লেছে।
গুরুর নিম্নতম নিসাব কত তা নিয়ে কিছুটা মতভেদ রয়েছে। পাঁচটা থেকে ত্রিশটা- পঞ্চাশটার কথা বলা হয়েছে।
২. মালিকানার এক বছর
মালিকের মালিকানায় একটি বছর অতিবাহিত হওয়ার দ্বিতীয় শর্ত। নবী করীম (স) ও খুলাফায়ে রাশেদুনের আমলও তাই ছিল। তাঁরা যাকাত আদায়কারী লোক বছরে মাত্র একবারই পাঠাতেন পশুর যাকাত আদায়ের জন্রে।
পূর্বেই বলেছি, ব্যবহার্য সম্পদে এক বছরে মালিকানার শর্ত সর্বসম্মত। এমন কি, যে সব ফিকাহ্বিদ ব্যবহার্য মালে এক বছরকাল অতিক্রান্ত হওয়ার শর্ত করেছে, তাঁরা গৃহপালিত পশুর উৎপাদনের ক্ষেত্রে তা করেন নি। পশুর মায়েদের এক বছরকে বাচ্চাদেরও এক বছর ধরা হয়েছে।
৩. ‘সায়েমা’ হতে হবে
‘সায়েমা’র শাব্দিক অর্থ বিচরণশীল। শরীয়াতের পরিভাষায় সেই পশুকে ‘সায়েমা’ বলা হয়, যা বছরের অধিকাংশ সময় বিচরণ করে আহার গ্রহণকরতে সক্ষম। দুগ্ধ, মাখান ও পনিরের মাত্রা বেশী হওয়াই লক্ষ্য। তাই ‘সায়েমা’ বলা হয় সেই পশুকে, যা নিজেই ঘাসে বিচরণ করে। মালিক নিজে ঘাস সংগ্রহ করে খাওয়ালে তা এর মধ্যে গণ্য নয়।
শর্ত হচ্ছে, জন্তু বছরের অধিকাংশ সময় নিজেই বিচরণ করে খাদ্য গ্রহণ করবে, বছরের সমস্ত দিনগুলোতে বিচরণ করা শর্ত নয়। কেননা অধিকাংশ সময়ের ব্যাপারকেই সমগ্র সময়ের ব্যাপার ধরা যায়। ‘সায়েমা’ তো বছরের কোন না-কোন দিন নিজেই ঘাস খেয়ে নিতে পারে। দুগ্ধ, চর্বি ও মাখন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে পালন করা হলেই তাকে ‘সায়েমা’ মনে করা হবে ও তাতে যাকাত ফরয হবে। কিন্তু যদি ভার বহন বা তার যানবাহন হিসেবে ব্যবহার অথবা গোশ্ত খাওয়ার উদ্দেশ্যে পালা হয়, তাহলে তার উপর যাকাত ফরয হবে না। কেননা এ প্রবৃদ্ধিটা ব্যক্তিগত ফায়দার জন্যে।
‘সায়েমা’ মনে করা হবে ও তাতে যাকাত ফরয হবে। কিন্তু যদি ভার বহন বা যানবাহন হিসেবে ব্যবহার অথবা গোশ্ত খাওয়ার উদ্দেশে পালা হয় তাহলেতার উপর যাকাত ফরয হবে না। কেননা এ প্রবৃদ্ধিটা ব্যক্তিগত ফায়দার জন্যে।
‘সায়েমা’ হওয়ার শর্ত আরোপের কারণ হচ্ছে, যাকাত ফরয হয়েছে- এমনভাবে যেন মালিকের পক্ষেতা দিয়ে দেয়া সহজ হয়। কুরআনের ‘অতিরিক্তটা গ্রহণ কর’ কথার দ্বারা তা-ই বোঝানো হয়েছে। ‘লোকেরা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, কি ব্যয় করবে তারা?’ বল, ‘অতিরিক্ত।’ আর এ ‘অতিরিক্ত’ শব্দটি বাস্তবায়িত হবে যদি তার জন্যে কষ্ট কম হয়, প্রবৃদ্ধি বেশী হয়। ‘সায়েমা’ হলেই তা হয়। কিন্তু যে জন্তুকে ঘাস এনে খাওয়াতে হয়, তাতে মালিকের কষ্ট বেশী হয়। এবং তা যাকাত বাবদ দিতে মানসিক কষ্ট হয়।
এ শর্তের দলীল হচ্ছে রাসূলের হাদীস:
(আরবী*******) সায়েমা উষ্ট্রের প্রতি চল্লিশটি যাকাত বাবদ একটা বিনতেল লাবুন।
দুই বছর পার হয়ে তৃতীয় বর্ষে উপনীত উষ্ট্রী শাবক দিতে হবে। হাদীসের ইমামগণ এ হাদীসটিকে সহীহ্ মনে করেছেন। উষ্ট্রের ‘সায়েমা’ হওয়ার শর্ত করায় বোঝা যায় যে, যে সব উষ্ট্রকে ঘাস খাওয়ার জন্যে মাঠে পাঠানো হয় না, এনে খাওয়ানো হয়, তাতে যাকাত ধার্য হবে না। নিজের বিচরণ করার শর্ত করার অবশ্যই একটা ফায়দা থাকতে হবে। কেননা শরীয়াতের বিধানদাতার কালচক্র তো আর অর্থহীন হতে পারে না; স্পষ্ট মনে হয় যার যার উল্লেখ করা হয়েছে সে সম্পর্কে একটি বিশেষ হুকুম রয়েছে, যার উল্লেখক করা হয়নি, সে সম্পর্কিত হুকুমের বিপরীত। ইমাম খাত্তাবী বলেছেন: আরবরা যখন কোন জিনিসের দুটি অপরিহার্য গুণের উল্লেখ করে বিকল্প হিসেবে, তখন তার একটা গুণের সাথে সংশ্লিষ্ট হুকুম হবার পূর্ণ সম্পন্ন জিনিস থেকে ভিন্নতর হবে। [আরবী *******]
গুণের তাৎপর্য অনুযায়ীই ভাষাভাষীদের আমল হয়ে থাকে। কাজেই কোন একটি বিশেষ গুণ নির্ধারণ করা হলে তার লক্ষ্যটা সম্মুখে রাখতে হবে। আল্লাহ্ ও রাসূলের কালামে এ বিষয়ের গুরুত্ব সর্বাধিক।[(আরবী ********)]
বুখারী উদ্ধৃত ও হযরত আনাস (রা) বর্ণিত একটি হাদীস এ কথার সমর্থক। তা হচ্ছে:
(আরবী ********)
স্ববিচরণকারী ছাগলের যাকাত হচ্ছে চল্লিশটিতে একটি ছাগী।
আর ছাগলের ক্ষেত্রে যখন স্ববিচরণকারী হওয়ার শর্ত আরোপিত, তখন উষ্ট্র ও গরুর ক্ষেত্রে তো তা অবশ্যই আরোপিত হবে ফিকাহ্র নীতি কিয়াস অনুযায়ী। কেননা এ দুইয়ের মাঝে কোন পার্থক্য নেই।
রবীয়া, মালিক ও লাসি প্রমুখ ফকীহ্ সর্বসাধারণ ফিকাহ্বিদদের সিদ্ধান্তের সাথে একমত হতে পারেন নি। তাঁরা উষ্ট্র, গরুও ছাগলের মধ্যে যে সবকে ঘাস খাওয়ানো হয়, তার উপর যাকাত ধার্য করেছেন। [(আরবী ********)]
চতুর্থ শর্ত হচ্ছে, এ জন্তু মালিকের কোন কাজে- জমি চাষ, ক্ষেত-খামারের সেচ বা বোঝা বহন ইত্যাদি ধরনের কাজে নিয়োজিত হবে না। এ শর্তটি উষ্ট্র ও গরুর ক্ষেত্রে বিশেষভাবে আরোপিত।
হযরত আলী (রা) বলেছেন: (আরবী ********)
কর্মে নিয়োজিত গরুর কোন যাকাত হয় না।
হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ্ বলেছেন: (আরবী ********)
কৃষি কাজে নিয়োজিত জন্তুর যাকাত নেই। [আল-আমওয়াল, পৃঃ ৩৮০]
এছাড়া রাসূলে করীম(স) থেকে বর্ণিত এক হাদীসের ভাষা এই:
(আরবী ********) প্রতি চল্লিশ দিরহামের দশের চার ভাগের এক ভাগ এক দিরহাম যাকাত বাবদ দাও।
বলা হয়েছে: কাজে নিয়োজিত পশুর যাকাত হয় না। ইবরাহীম, মুজাহিদ, জুহরী, উমর ইবনে আবদুল আযীয প্রমুখ ফিকাহ্বিদের এ মত বর্ণিত হয়েছে এবং আবূ হানীফা, সওরী, শাফেয়ী, যায়দিয়া ও লাইসও এ মতই সমর্থন করেছেন।
দুটো দিক দিয়ে পূর্বোক্ত বর্ণনাসমূহের সমর্থন পাওয়া যায়: প্রথম যে সব মাল মালিকের সুখ বিধানের কাজে নিয়েঅজিত- যেমন কাপড়, চাকর-গোলাম, বসবাসের ঘর ও আরোহণের যানবাহন, পড়ার বই-কিতাব- এ সবের কোন যাকাত হয় না। এ দৃষ্টিতে চাষবাষে গরুর ও পানি তোলার চাকা বহনকারী বলদেরও যাকাত হওয়ার কথা নয়। বিবেচনাও তাইবলে আর শরীয়াতের দলীলও এর সমর্থক।
‘সায়েমা’ ও এই গরু-বলদের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট। এগুলো ক্রমবৃদ্ধির দিকদিয়ে কাজে নিয়োজিত এবং তা কাপড় ও ঘরের মতই।
দ্বিতীয, পানি বহনের বলদ ও গাভী এবং চাষের গরুর কোন যাকাত নেই, কেননা তা কৃষির পানি বহন ও কৃষিকাজে নিয়োজিত। এ কথা জুহরী থেকে বর্ণিত। [***১]
সাঈদ ইবনে আব্দুল আযিয বলেছেন: চাষের কাজে নিয়েঅজিত গরুর যাকাত নেই। কেনা কৃষি উৎপন্ন গমের যাকাত রয়েছে। আর এ সব তো গরুরই সাহায্যেই পাওয়া গেছে। কেননা এগুলো যন্ত্রপাতি পর্যায়ের; কৃষি কাজে এগুলো ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এর ফলে জমি যা উৎপন্ন গমের যাকাত রয়েছে। আর এ সব তো গরুর সাহায্যেই পাওয়া গেছে। কেননা এগুলো যন্ত্রপাতি পর্যায়ের; কৃষিকাজে এগুলো ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এর ফলে জমি যা উৎপাদন করে তাতে যাকাত ফরয। এক্ষণে এগুলোর উপরও যদি যাকাত ফরয হয়, তাহলে একই জিনিসের উপর দ্বিগুণ যাকাত ফরয হবে। ইমাম মালিক ভিন্ন মত পোষণ করেন। তাঁর মতে কর্মে নিয়োজিত হোক আর নাই হোক, গরু ও বলদের উপর অবশ্যই যাকাত ফরয হবে।
মালিকীমতের কোন কোন ফিকাহ্বিদ অধিকাংশ ফিকাহ্বিদের পূর্বোক্ত মতকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। কেননা এঁদের মত হচ্ছে, ভূমি হিসেবে ফরয হওয়া ও অনুরূপ অপরটি যাকাত ফরয না হওয়া পরস্পর বিরোধী কথা। আমাদের দৃষ্টিতে এটাই সুবিচারপূর্ণ মত।
দ্বিতীয় আলোচনা
উটের যাকাত
সমস্ত মুসলমান, নবী করীম(স) থেকে বর্ণিত হাদীস ও সাহাবিগণের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত হচ্ছে, পাঁচটি থেকে একশথ বিশটি উষ্ট্রের যাকাতের নিসাব ও যাকাতের পরিমাণ নিম্নোক্ত তালিকা অনুযায়ী হবে:
বলদের নিসাব যাকাতের পরিমাণ
১টি থেকে ৯টি উষ্ট্রের যাকাত ১টি ছাগী
১০টি থেকে ১৪টি উষ্ট্রের যাকাত ১টি ছাগী
১৫টি থেকে ১৯টি উষ্ট্রের যাকাত ৩টি ছাগী
২০টি থেকে ২৪টি উষ্ট্রের যাকাত ৪টি চাগী
২৫টি থেকে ৩৫টি উষ্ট্রের যাকাত ১টি গরুর মাদী বাচ্চা যার বয়স ১ বছর অতিক্রান্ত হয়ে ২ বছরে পদার্পণ করেছে।
৩৬টি থেকে ৪৫টি উষ্ট্রের যাকাত দুই বছর পর তৃতীয বছরে শুরু বয়স্ক একটি গাভী।
৪৬টি থেকে ৬০টি উষ্ট্রের যাকাত তিন বছর অতিক্রমকারী একটি গাভী।
৬১টি থেকে ৭৫টি উষ্ট্রের যাকাত চার বছর বয়স অতিক্রম করে পাঁচ বছরে প্রবেশকারী একটি গাভী।
৭৭টি থেকে ৯০টি উষ্ট্রের যাকাত দুই বছর অতিক্রম করে তৃতীয বর্ষে অতিক্রমকারী উষ্ট্রীর বাচ্চা।
৯১টি থেকে ১২০টি উষ্ট্রের যাকাত তিন বছর বয়স অতিক্রম করে চতুর্থ বছরে প্রবেশকারী উষ্ট্রীর দুটি বাচ্চা।
যাকাতরে এ নিসাব ও পরিমাণ সম্পর্কে ইজমা- সম্পূর্ণ ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে হযরত আলী (রা) থেকে একটা ভিন্ন কথা বর্ণিত হয়েছে।তিনি বলেছেন: ২৫টি উটের যাকাত বাবদ পাঁচটি ছাগী দিতে হবে। আর উটের সংখ্যা ২৬টি হলে দুই বছরের একটি উষ্ট্রী শাবক দিতে হবে।
ইবনে মনযির বলেছেন: পঁচিশটি উষ্ট্রের যাকাত যে একটি দুই বছর বয়স চলা উষ্ট্রী শাবক, এ বিষয়ে ইজমা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ ব্যাপারে হযরত আলী থেকে বর্ণিত কোন মত নির্ভুল সূত্রে প্রমাণিত হয়নি।
উটের সংখ্যা একশ’ বিশটির ঊর্ধে হলে অধিকাংশ ফিকাহ্বিদের মত ও আমল নিম্নোদ্ধৃত তালিকায় অনুরূপ:
প্রতি পঞ্চাশটিতে একটি তিন বছর বয়স অতিক্রমকারী উষ্ট্রী শাবক; আর প্রতি চল্লিশটিতে তৃতীয় বর্ষে উপনীত উষ্ট্রী শাবক।
১২১ থেকে ১২৯টি সংখ্যার যাকাত তিনটি তৃতীয় বর্ষের উষ্ট্রী শাবক।
১৪০থেকে ১৪৯ টি সংখ্যার যাকাত একটি ৪ বছর বয়সে পড়া উষ্ট্রী, ২টি তৃতীয় বর্ষে উপনীত উষ্ট্রীর শাবক।
১৫০ থেকে ১৬৯টি সংখ্যার যাকাত ৩টি চতুর্থ বর্ষে উপনীত উষ্ট্রী শাবক।
১৬০ থেকে ১৬৯টি সংখ্যার যাকাত ৪টি তৃতীয় বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী
১০ থেকে ১৯৯টি সংখ্যার যাকাত ৩টি ৪র্থ বর্ষে উপনীতা উষ্ট্র শাবক+১টি তৃতীয় বর্ষে উপনীতা উস্ট্র শাবক।
২০০ থেকে ২০৯ সংখ্যার যাকাত ৪টি ৪র্থ বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক অথবা ৫টি ৩য় বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক।
এ ভাবে দশটির কম সংখ্যক উষ্ট্রে কোন যাকাত হবে না। দশটি পূর্ণ হলে পূর্বে যেমন বলেছি, প্রতি ৫০টিতে একটি ৪র্থ বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক। আর প্রতি ৪০টিতে একটি তৃতীয় বর্ষে উপনীতা উষ্টী শাবক।
পূর্বোক্ত তালিকাদুটি থেকে স্পষ্ট হয় যে, উষ্ট্রের যাকাত ফরয হওয়ার নিম্নতম সংখ্যা হচ্ছে পাঁচটি। তাই যার চারটি উস্ট্র আছে, সে যাকাত দেবে না। দান-সাদ্কা করলে ভিন্ন কথা। পাঁচটি সংখ্যায় গেলেই তাকে একটি ছাগী যাকাত বাবদ দিতে হবে। বলাহয়েছে, এ পরিমাণ-নির্ধারণ মূল্যের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে।কেননা উষ্ট্রের যাকাত ফরয হওয়ার নিম্নতম বয়স সীমা হচ্ছে একটি তৃতীয় বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক। সেকালে তার মূল্য হতো ৪ দিরহাম। আর একটি ছাগীর মূল্যও তাঁই পাঁচ দিরহাম ছিল। তাই পাঁচটি উষ্ট্রের যাকাত ফরযহওয়ার অর্থ দুইশত দিরহাম মূল্যের রৌপ্য যাকাত ফরয হওয়া।
পঁচিশটির কম সংখ্যার উষ্ট্রের যাকাতে ছাগী দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে- উষ্ট্রী নয়। যদিও প্রত্যেক জিনিসেরযাকাত সেই জিনিসের অংশ থেকে দেয়া সাধারণ নিয়ম।এর কারণ হচ্ছে, উষ্ট্র মালিকের উষ্ট্রের সংখ্যা কমহওয়া। এর ফলে ধন-মালিক ও দরিদ্র উভয় পক্ষের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে। কেননা পাঁচটি উষ্ট্র তো বিরাট সম্পদ বটে। তার উপর যাকাত ফরয করা না হলে দরিদ্রের অধিকার নষ্ট হয়। কিন্তু তারই একটা যাকাত বাবদ দিতে হলে মালের মালিকদের স্বার্থ বিনষ্ট হয়। আর একটি উষ্ট্রের কতকাংশ দেয়া সাব্যস্ত হলে মালিকের ধনের ক্ষতি সাধন হয়।
উপরে যে পরিসংখ্যানের উল্লেখ করাহয়েছে, তা খোদ নবী করীম (স) থেকে বর্ণিত ও তৎকর্তৃক অনুসৃত।
ইমাম নববী লিখেছেন: গৃহপালিত পশুর যাকাত নির্ধারণের ব্যাপারটি হযরত আনাস ও ইবনে উমর বর্ণিত দুটি হাদীসের উপর ভিত্তিশীল।
হযরত আনাস বর্ণিত হাদীসটি হচ্ছে- হযরত আবূ বকর (রা) তাঁকে বাহরাইনের শাসনকর্তা নিযুক্ত করে তাঁকে লিখেছিলেন:
‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’
রাসূলে করীম(স) মুসলমানদের জন্যে যে যাকাত ফরয করেছেন, যে বিষয়ে স্বয়ং আল্লাহ্ তাঁর রাসূলকে নির্দেশ দিয়েছেন, তার হার তোমাকে লিখে পাঠাচ্ছি। মুসলমানদের কাছে যে তা চাইবে, সে যেন তাকে তা দিয়ে দেয়। এর বেশী চাইলে দেবেনা। চব্বিশবা তার চাইতে কম সংখ্যক উষ্ট্রের যাকাত ছাগী দ্বারা দিতে হবে অর্থাৎ পাঁচটি একটিতে ছাগী। ২৫টি থেকে ৩৫টি পর্যন্ত উষ্ট্রের যাকাত একটি ৪র্থ বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক। ৪৬থেকে ৬০টি পর্যন্ত উষ্ট্রের যাকাত ৪র্থ বর্ষে উপনীতা একটি উষ্ট্রী শাবক। ৬১ থেকে ৭৫টি পর্যন্ত বর্ষে উপনীতা একটি উষ্ট্রী শাবক (***)। ৭৬টি থেকে ৯০টি পর্যন্ত তৃতীয় বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক। ৯১টি থেকে ১২০ টি পর্যন্ত দুটি চতুর্থ বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক। তার ঊর্ধ্ব সংখ্যক হলে প্রতি চারটিরজনেস্য একটি তৃতীয় বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক। আর প্রতি পঞ্চাশটিতে একটি চতুর্থ বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক। যার মাত্র চারটি উষ্ট্র রয়েছে তাকে যাকাত দিতে হবে না। ৫টি হলেই একটি ছাগী দিতে হবে।
নিজস্বভাবে বিচরণকারী ৪০টি থেকে ১২০টি পর্যন্ত ছাগলের যাকাত বাবদ ১টি ছাগীদিতে হবে। তার ঊর্ধ্বে ২০০টি পর্যন্ত ২টি ছাগী। ২০০ থেকে ৩০০টি পর্যন্ত ৩টি ছাগীর সংখ্যা ৪০টির কম হয়, তাহলে যাকাত দিতে হবে না। আর নগদ সমএদর দশ ভাগের এক ভাগের চতুর্থাংশ পরিমাণ দিতে হবে। যদি ১৯৯ সংখ্যক নগদ মুদ্রা হয় তাহলে তাতে যাকাত দিতে হবে না।
এ চিঠিতে আরও লিখিত ছিল:
যার যাকাত হবে একটি দ্বিতীয় বর্ষে উপনীত শাবক, কিন্তু তার কাছে তা যদি না থাকে, আর থাকে তৃতীয় বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক, তাহলে তাঁর কাছ থেকেতা গ্রহণ করা হবে। আদায়কারী তা৭কে বিশটি দিরহাম ফেরত দেবে অথবা তার দুটি ছাদী। আর যদি না থাকে, আর থাকে তৃতীয় বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক, তাহলেতাঁর কাছ থেকেতা গ্রহণ করা হবে। আদায়কারী তাঁকে বিশটি দিরহামফেরত দেবে অথবা দেবে দুটি ছাগী। আর যদি তার কাছে দ্বিতীয় বর্ষে উপনীত উষ্ট্রী শাবক না থাকে, থাকেতৃতীয় বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক, তাহলেতার কাছ থেকে গ্রহণ তা গ্রহণ করা হবে, কিন্তু সে সঙ্গে কিছুই নেয়া হবে না। যার যাকাত হবে পঞ্চম বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক কিন্তু তার কাছে তা না থাকে, তার কাছে থাকে চতুর্থ বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক, তাহলে তার কাছ থেকেতাই গ্রহণ করা হবে, তার সঙ্গে আরও দুটি ছাগী বা বিশ দিরহামনিয়ে নেয়া হবে। যার যাকাত হবে একটি চতুর্থ বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক: কিন্তু তা যদি তার কাছে না থাকে, থাকে পঞ্চম বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক; তবে তার কাছ থেকে তা গ্রহণ করাহবে, আর আদায়কারী তাকে বিশটি দিরহাম ফেরত দেবে অথবা দুটি ছাগী। আর যাকাত যাকাত দিতে হবে একটি চতুর্থ বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক, কিন্তু তার কাছে তা না থাকে- থাকে তৃতীয় বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক, তা না হলে তার কাছ থেকে তা গ্রহণ করে তাকে দুটি ছাগী বা বিশটি দিরহাম ফেরত দেবে। যার যাকাত একটি তৃতীয় বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক, তার কাছে রয়েছে একটি চতুর্থ বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক, তার কাছ থেকে সেটি নিয়ে বিশটি দিরহাম কিংবা দুটি ছাগী তাকে দিতে হবে। যার যাকাত হবে তৃতীয বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক; কিন্তু তার কাছে তা নাথাকে, থাকে দ্বিতীয় বর্ষে উপনীত উষ্ট্রী শাবক তারকাছ থেকে তা নিয়ে বিশ দিরহাম কিংবা দুটি ছাগী তাকে ফেরত দেবে। দাঁত পড়া, দোষযুক্ত বা পাঠা যাকাত বাবদ দেয়া যাবে না। তবে আদায়কারী তা নিতে চাইলে স্বতন্ত্র কথা। খুচরা অংশ কখনো মিশানো হবে না। আর যাকাত দেয়ারভয়ে একত্রে রাখা জন্তুগুলোকে বিচ্ছিন্ন করেও দেখানো যাবেনা। দুই মিলনো অংশে সমান হারে যাকাত ধার্য হবে।
এ দীর্ঘ চিঠির বর্ণনা বুখারী শরীফের ‘কিতাবুয যাকাত’ অধ্যায়ে বিচ্ছিন্নভাবে উদ্ধৃত হয়েছে। এখানে তা একত্রিত করে লেখা হয়েছে। আহমদ, আবূ দাউদ, নাসায়ী, দারে কুতনীওএ বর্ণনা নিজ নিজ গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন। এর সনদ সহীহ। শাফিয়ী, বায়হাকী ও হাকেমও এ চিটির উদ্ধৃতি দিয়েছেন। ইবনে হাজমবলেছেন, ‘এ অত্যন্ত সহীহ্ বর্ণনা।’
ইবনে উমরের বর্ণিত হাদীস হচ্ছে:
‘রাসূলে করীম(স) যাকাত সম্পর্কিত ফরমান লিখে রেখেছিলেন। কিন্তু ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীদের প্রতি তা পাঠানোর পূর্বেই দুনিয়া ছেড়ে চলে যান। পরে হযরত আবূবকর (রা) ও হযরত উমর ফারুক (রা) তদনুযায়ী আমল করেছেন। তাতে লেখা ছিল:
পাঁচটি উষ্ট্রের যাকাত িএকটি ছাগী। আর দশটিতে দুটি ছাগী…।
হাদীসটি আবূ দাউদ ও তিরমিযী শরীফে উদ্ধৃত হয়েছে। এর সনদ উত্তম। দারে কুত্নী, হাকেম ও বায়হাকীও তা উদ্ধৃত করেছেন।
ইবনে হাজম হযরত আনাস (রা) বর্ণিত হাদীস সম্পর্কে বলেছেন, তাচূড়ান্ত মাত্রায় সহীহ।হযরত আবূবকর সিদ্দীক অন্যান্য সব সাহাবীর উপস্থিতিতে তদনুযায়ী আমল করেছেন। এ থেকে ভিন্নমত পোষণকারী কেউ কোথাও নেই। আমাদের বিপরীত মতের লেকেরা তো এর চাইতেও কম অবস্থায় ইজমা হওয়ারদাবি করেন তাদের বিরোধী মতের প্রতিবাদে।
মুসলিম উম্মতের বিপুল সংখ্যক বিশেষজ্ঞ উপরিউক্ত দুটি বর্ণনানুযায়ী আমল করেছেন। যদিও ইয়াহ্ইয়া ইবনে মুইন প্রমুখ কয়েকজন হাদীসবিদ্ এ দুটি বর্ণনার সহীহ হওয়ার ব্যাপারে কোনরূপ মন্তব্য করা থেকে বিরত রয়েছেন।
প্রখ্যাত প্রাচ্যবিদ এ নীরবতাকে যাকাত পর্যায়ের সব হাদীস সম্পর্কে সন্দেহ বলে ধরে নিয়েছেন। তাঁর মতে গোটা যাকাত ব্যবস্থাটাই সন্দেহযুক্ত। মনে করেছেন, যাকাত পর্যায়ে যে সব ফিক্হী মত গ্রহীত হয়েছে, তা হাদীসের উপর প্রভাব বিস্তার করেছে।
আমরা এ পর্যায়ে গোটা যাকাত ব্যবস্থা সবিস্তারে উল্লেখ করতে চাই, যা প্রধানত হযরত আবূ বকরের উপস্থাপিত। তা অনেক সময় স্বয়ং নবী করীম(স)-এর অথবা হযরত উমর ফারূকের কিংবা হযরত আলীর নামেও উল্লেখ করা হয়।
উপরিউক্ত প্রাচ্যবিদ হযরত মুহাম্মাদ (স)-এরসুন্নাতের প্রতি যে চরম শত্রুতা পোষণ করেন, তা সর্বজনবিদিত। তিনি সন্দেহের উদ্রেক করার ও তার উপর ঘৃণা প্রকাশ খরার কোন সুযোগই ছেড়ে দেন না। তিনি এ বিষয়ে একখানি গ্রন্থ রচনা করে সর্বপ্রকারের সংশয়-সন্দেহ ও গালাগাল একত্রিত করে দিয়েছেন। কিন্তু ডঃ মুস্তফা আযমী তাঁর লিখিত গ্রন্থে ব্যক্তির বিষদাঁত ভেঙে দেন এবং তার হিংস্র মস্তক চূর্ণ করে করে দিয়েছেন। [***১]
বস্তুত মিঃ শাখ্ত যদি একটু ন্যায়পরায়ণতার আশ্রয় দিতেন, তাহলে তিনি নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পারতেন যে, উষ্ট্র ছাগলের যাকাতের ন্যায় অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নবী করীম (স) কিছুই বলে যান নি, তা কিছুতেই কল্পনা করা যায় না। তিনি নিশ্চয়ই তার হার নির্ধারণ করে গেছেন। কেননা তা-ই ছিল তদানীন্তন আররেবর সবাচাইতে বড় ধনও অধিক গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। তখন যাকাত আদায়কারী লোকেরা প্রতিবছর কবীলাসমূহের লোকদের কাছে উপসিথত হয়ে তা-ই গ্রহণ করত ও যা পাওয়া যেত, তা নিয়ে এসে বন্টন করেদিত। তা তারা গ্রহণ করত ধনী লোকদের কাছ থেকে তাদের ধন-মাল থেকে প্রাপ্য অংশ হিসেবে। কিন্তু কি তারা গ্রহণ করত? কি তারা রেখে আসত? তাদের সাথে কিভাবে কার্য সম্পাদন করত? এ পর্যায়ে বিপুল সংখ্যক হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে। সেইসব হাদীসই মিথ্যা-কল্পরচিত, এমন কথা কোন সুস্থ বিবেক বুদ্ধিসম্পনন ব্যক্তিই চিন্তা করতে পারে না।
কাজেই নবী করীম(স)-এ পর্যায়ে কোন ‘চিঠি’ লিখাবিন ও তাতে তার পরিমাণ ও নিসাব স্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করবেন, তা কিছুমাত্র অসম্ভব বা বিচিত্র নয়। তাতে বিশেষ করে নিজেস্বভাবে ঘাস খেয়ে বেড়ানো জন্তু ও সেকালের বর্ধনশীল ধন-মালের যাকাত নির্ধারণ করবেন এটা খুবই স্বাভাবিক।
এ পর্যায়ে হযরত আবূ বকর ও হযরত উমর ফারুকের চিঠিও উদ্ধৃত হয়েছে। দুটোর মূল উৎসনবী করীম(স) স্বয়ং। যেমন হযরত আবূ বকরের চিঠির শুরুতে বলা হচ্ছে:
যাকাতরে দেয় ফরযের এ বিবরণ যা রাসূলে করীম(স) মুসলমানদের উপর ধার্য করেছেন।
আর হযরত উমর ফারূকের চিঠিখানার বর্ণনা, তাঁর পুত্র আব্দুল্লাহ্ থেকে বর্ণিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে:
‘নবী করীম(স) যাকাত সংক্রান্ত এই চিঠি লিখেচিলেন।’
হযরত আলীর নামের চিঠি নবী করীমের চিঠি না তাঁর নিজের; তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে বটে এবং তা হযরত আবূ বকর ও হযরত উমরের চিঠির মত খ্যাত ও প্রসিদ্ধও নয়। সনদের দিক দিয়েতা অপর দুটির ন্যায় শক্তিশালীও নয়। আর জন্তু জানোয়ারের যাকাত পর্যায়ে এই চিঠি কয়টিই চূড়ান্ত দলীল নয়। আরও কয়েকটি চিঠিও রয়েছে।তাতেও ফরয যকাতা ও দিয়ত সংক্রান্ত মসলার উল্লেখ রয়েছে।
গরুর যাকাত পর্যায়ে রয়েছে হযরত মুআযের চিঠি। এই সব চিঠিতে সম্মিলিতভাবে নিম্নোদ্ধৃত কথাগুলোর উল্লেখ রয়েছে:
১. পাঁচটি কম উষ্ট্রের কোন যাকাত নেই,
২. চল্লিশটির কম ছাগলের কোন যাকাত নেই,
৩. দুইশত দিরহাম মূল্যের রৌপ্যের (টাকার) কমে যাকাত নেই
৪. পঁটিশটির কম সংখ্যক উষ্ট্রের যাকাত হচ্ছে ছাগল,
৫. আর তার যাকাতের পরিমাণ হচ্ছে প্রতি পাঁচটির উষ্ট্র বাবদ একটি ছাগী,
৬. পঁচিশটি থেকে একশ’ বিশটি পর্যন্ত উষ্ট্রের যাকাত সমান হারে ধরা হয়েছে।
৭. এ কথায় ঐকমত্য হয়েছে যে, মধ্যম মানের মাল যাকাত বাবদ গ্রহণ করা হবে। বাছাই করা সর্বোত্তম মালও নয় এবং সর্ব নিম্ন মালও নয়।
অতঃপর কতিপয় খুঁটিনাটি বিষয়ে বিভিন্ন মতের উল্লেখ রয়েছে। যেমন একশ’ বিশটি উষ্ট্রের পর আরও যে উষ্ট্র রয়েছে, তার যাকাত বাবদ কি দিতে হবে? হযরত আবূ বকরের চিঠি বলছে, প্রতি চল্লিশটি বাবদ একটি তৃতীয বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক দিতে হবে। আর প্রতি পঞ্চাশটি বাবদ একটি তৃতীয় বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক দিতে হবে। আর প্রতি পঞ্চাশটিতে একটি চতুর্থ বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক। হযরত আলী ও আমর ইবনে হাজমের চিঠিতে বলা হয়েছে: ‘অতঃপর প্রথম থেকে হিসাব ধরে আসতে হবে।’
এই দুই ধরনের মতের মধ্যে সমন্বয় সাধনের পন্থা হচ্ছে, তাৎপর্যের দিক দিয়ে উভয় দলীলকেই অভিন্ন মনে করতে হবে এবং দলীলের ব্যাখ্যায়ই মতপার্থক্য ধরে নিতে হবে। মূল দলীলের কোনরূপ মতপার্থক্য নেই।
এই চিঠিসমূহ নগদ স্বর্ণমুদ্রা বা গরু ইত্যাদির ক্ষেত্রে কোন অকাট্য দলীল পেশ করছে না। আমার মতে এসব বিষয়ে কোন অকাট্য দলীল না দেওয়াই এ চিঠিসমূহের সত্যতার অকাট্য দলীল এবং এসব চিঠির মৌল উৎস নবী করীম(স), তা-ও নিঃসন্দহভাবে প্রমাণিত।তা কখনো কৃত্রিম বা মিথ্যা হতে পারে না। তা যদি শাখ্ত্-এর ধারণানুযায়ী পরবর্তীকালে ফিকহী মতের প্রভাবে রচিত হত, তাহলে তাতে বিষয়গুলো সম্পর্কে নিশ্চয়ই বক্তব্য পাওয়া যেত এবং পরবর্তীকালে যেসব ধন-মাল আবিষ্কৃত ও উদ্ভূত-উদ্ভাবিত হয়েছে, তা তার যাকাত পরিমাণের উল্লেখসহ সুন্দরভাবে সুমার্জিত ও সুবিন্যস্ত পাওয়া যেত। কিন্তু নবী করীম (স) প্রত্যেক জাতি ও গোত্রকে তাদের সম্মুখবর্তী বাস্তবভাবে উপস্থিত বিষয়ে পথ নির্দেশদিয়ে চিঠি পাঠাতেন। এ কারণে নগদ স্বর্ণমুদ্রা সম্পর্কে তিনি কোন স্পষ্ট কথা উল্লেখ করেছেন বলে কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না। কেননা তদানীন্তন সমাজে তা খুব বেশী ও ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল না। ছিল রৌপ্য মুদ্রা, তাই সে বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া গেছে। গরু তখনকার দিনে সে দেশে বেশী ছিল না। এই কারণে সে বিষয়ে কেবলমাত্র ইয়েমেনে প্রেরিত মুআযকে লেখা চিঠিতেই তার উল্লেখ পাওয়া যায়, অন্যত্র নয়।
একশ’টির উপর সংখ্যক উষ্ট্রের যাকাতে মতভেদ ও তার কারণ
আমরা পূর্বেই বলেছি, উষ্ট্রের সংখ্যা একশটির ঊর্ধ্বে উঠলে কি হিসেবে যাকাত দিতেহবে, তা নিয়ে বিভিন্ন মত প্রকাশিত হয়েছে।
ইমাম মালিক, শাফেয়ী, আহমদ ও জমহুর ফিকাহ্বিদগণ মনে করেন প্রতি পঞ্চাশটিতে একটি করে চতুর্থ বর্ষে উপনীতা উষ্ট্র শাবক দিতে হবে। আর প্রতি চল্লিশটিতে দিতে হবে একটি করে তৃতীয় বর্ষে উপনীত উষ্ট্রী শাবক। হযরত আনাসও ইবনেউমর বর্ণিত হাদীস অনুযায়ী আবু বকর ও উমর ফারূকের চিঠিতে তা-ই বলা হয়েছে। আর আমর ইবনে হাজম ও হাজারমাউতের প্রতি যিয়াদ ইবনে ওয়ালীদ লিখিত পত্রে রাসূলে করীম(স)-এর কথা উদ্ধৃত হয়েছে।
একশ’ বিশটির ঊর্ধ্ব সংখ্যক উষ্ট হলে প্রতি চল্লিশটিতে একটি করে তৃতীয় বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক যাকাত বাবদ দিতে হবে। আর প্রতি পঞ্চাশটিতে দিতেহবে একটি করে চতুর্থ বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক।
কোন কোন বর্ণনায় সংক্ষিপ্তভাবে শুধু বিশেষ কথাটুকু উদ্ধৃত হয়েছে। কেননা নবী করীম(স) ইচ্ছা করেই ‘চল্লিশ’টির উল্লেখ ত্যাগ করেছেন। তবে এ বর্ণনাসমূহ পরস্পর পরিপূরক।
হানাফী মাযহাবের মত ও তার পর্যালোচনা
নখ্য়ী, সাওরী ও আবূ হানীফা প্রমুখ ইমাম বলেছেন: উষ্ট্র যদি একশ’ বিশটিরও অধিক থাকে, তাহলে নতুন করে ফরয সাব্যস্ত হবে অর্থাৎ চাগল দিয়ে যাকাত দিতে হবে- প্রতি পাঁচটিতে একটি ছাগী, ২৫টিতে একটি দুই বছর বয়সে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক এমনিভাবে।
তার অর্থ, নিম্নোক্ত তালিকা অনুযায়ী যাকাত দিতে হবে:
উষ্ট্রের সংখ্যা চতুর্থ বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক ছাগী
১২৫ ২+ ১
১৩০ ২+ ২
১৩৫ ২+ ৩
১৪০ ২+ ৪
১৪৫ ২+ দুই বছরে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক ১
১৫০ ৩ –
১৫৫ ৩ ১টি চাগী
১৬০ ৩+ ২টি ছাগী
উষ্ট্রের সংখ্যা চতুর্থ বর্ষে উপনীতা শাবক ছাগী
১৬৫ ৩+ ৩টি ছাগী
১৭০ ৩+ ৪টি ছাগী
১৭৫ ৩+ দুই বছরে উপনীতা একটি উষ্ট্রী শাবক
১৮৬ ৩+ তৃতীয় বছরে উপনীতা একটি উষ্ট্রী শাবক
১৯৬ ৪ –
২০০ ৮ অথবা ৫টি তৃতীয় বছরে উপনীতা একটি উষ্ট্রী শাবক
দুই মতের পর প্রতি পাঁচটি উষ্ট্রের জন্য একটি ছাগী। এমনিভাবে হিসাব চলবে। পঞ্চাশটি পর্যন্ত পৌঁছলে একটি চতুর্থ বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক। তার পরে যাকাত দিতে হবে ছাগল দ্বারা। পরেদিতে হবে দুই বছরের উপনীতা উষ্ট্রী শাবক দ্বারা। তার পরে দেবে তৃতীয় বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক। পরে আবার সেউ চতুর্থ বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক।
লক্ষণীয় যে, প্রথমবার নতুন করে যে হিসাব ধরা হয়েছে, একশ বিশটির পর একশ পঞ্চাশটি পর্যন্ত, তাতে তৃতীয় বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবদ ধরা হয়নি।
হানাফী মতের দলীল হচ্ছে, আবূ দাউদে উদ্ধৃত একটি ‘মুরসাল’ হাদীস।তা ইসহাক ইবনে রাহওয়াই তাঁর মুসনাদ গ্রন্থেও উদ্ধৃত করেছেন। আর তাহাভী বর্ণনা করেছেন হাম্মাদ ইবনে সালমাতা থেকে। তিনি বলেছেন: আমি কাইস ইবনে সায়াদকে বললাম: ‘আমাকে মুহাম্মাদ ইবনে আমর ইবনে গাজমের চিঠিটি দিন। তিনি আমাকে একটি চিঠি দিলেন। বললেন, এটি তিনি আবূ বকর মুহাম্মাদ ইবনে আমর ইবনে হাজম থেকে গ্রহণ করেছেন। বলেছেন, নবী করীম (স) আমার দাদার নামে এ চিঠি লিখিয়েছিলেন। অতঃপর আমি তা পড়লাম। তাতে উস্ট্রের যাকাত বাবদ কি দিতে হবে তা লিপিবদ্ধ ছিল।’ পরে তিনি গেটা হাদীসটির উল্লেখ করলেন। একশ’ বিশটি হলে কি দিতে হবে, তার উল্লেখ ছিল।তার অধিক হলে প্রতি পঁচিশটির জন্য একটি চার বছরে উপনীতা উষ্ট্রী শাসক দেয়ার কথাও তাতে রয়েছে। এর অধিক হলে প্রথম ফরয অনুযায়ী হিসাব চালাতে হবে।
আর পঁচিশটির কম হলে ছাগল দিতে হবে। প্রতি তিন থেকে দশটি উষ্ট্রের জন্য একটি করে ছাগী দিতে হবে। এই সব সংখ্যা নির্ধারণ শরীয়াতের বিধান, তা কোন লোক কল্পনা করে বলতে পারে না। ইবনে রুশ্দ এ কথাটি বলেছেন। [আরবী *********]
জমহুর ফিকাহ্বিদগণ হানাফী মতের উপরিউক্ত দলীল প্রত্যাখ্যান করেচেন। তাঁদের মতেও সব কথা সম্পূর্ণ যয়ীফ, গ্রহণের অযোগ্য। বায়হাকী বলেছেন, ‘ইবনে মাসউদ থেকে উপরিউক্ত বর্ণনা গ্রহণযোগ্যভাবে বর্ণিত হয়নি।’
আর হযরত আলীর নিজের উক্তি কিনা, এ বিষয়েও মতভেদ রয়েছে। হযরত আবূ বকর ও হযরত উমর লিখিত চিঠির সমর্থনে যেমন বর্ণনা এসেছে, তেমনি তার বিরোধী বর্ণনাও উদ্ধৃত হয়েছে। আর কোন হাদীসের বর্ণনায় এরূপ মতভেদ সংঘটিত হলে অন্যান্য বিরোধমূলক বর্ণনাসমূহ গ্রহণ করাই শ্রেয়।
আসমের নিজের বর্ণনায় এমনসব বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে, যা প্রত্যাহার করা সম্পর্কে সকলেই একমত। যেমন পঁচিশটি উষ্ট্র বাবদ পাঁচটি ছাগী দিতে হবে, দুই বছর উপনীতা উষ্ট্রী শাবক নয়। তবে হাদীসের সাথে সংগতি সম্পন্ন শুরু থেকেই ফরয ধরা সংক্রান্ত বর্ণনা সম্ভব মনে করা যায়।
আর আমর ইবনে হাজম বর্ণিত হাদীসটি সম্পর্কে তাদের মনোভাব হল:
ক. শুরু থেকেই ফরয ধরা অর্থ তা-ই, যা হযরত আবূ বকর ও হযরত উমরের চিঠিদ্বয়ে উল্লিখিত হয়েছে অর্থাৎ প্রতি চল্লিশটিতে তৃতীয় বর্ষে উপনীতা একটি উষ্ট্রী শাবক ও প্রতি পঞ্চাশটিতে একটি করে চতুর্থ বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক দেয়া ফরয। এ মতে সমস্ত হাদীস একমত। [আরবী*******
খ. বহু লোকই উক্ত হাদীসকে যয়ীফ মনে করেন।
১) কেননা তা হযরত আনাসবর্ণিত সহীহ হাদীসের বিরোধী।
২) কেননা হযরত আবূ বকর ও উমরের চিটিদ্বয়ের সাথে সংগতিসম্পন্ন অন্যান্য হাদীসসমূহেরও তা বিপরীত। বায়হাকী প্রমুখ এ সব বর্ণনার উপর আস্থা স্থাপন করেছেন। [আরবী*******]
৩) যাকাত পর্যায়ে যে মূলনীতি, হাদীসটি তার বিরোধী। আর তা হচ্ছে, যাকাত যে মালের, সেই মালই যাকাত বাবদ গ্রহণ করতে হবে- নিতান্তই প্রয়োজন দেখা দিলে ভিন্ন কথা। পঁচিশের কম সংখ্যক উষ্ট্রে যেমন হয়। তখন অন্য জিনিস দিয়ে যাকাত আদায় করা যাবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে উষ্ট্রের বিপুলতার দরুন ছাগল গ্রহণের কোন প্রয়োজন নেই। আরও এ জন্যে যে, পাঁচটির অধিক সংখ্যক উষ্ট্র থাকলে দ্বিতীয় বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবকের পরিবর্তে চতুর্থ বর্ষের উষ্ট্রী শাবকদিতে হয়। এটা সামান্য বৃদ্ধি। এ ক্ষেত্রে এরূপ পরিবর্তনের কোন আবশ্যক নেই। একুশটির অধিক হলে প্রথম ফরযের দিকে প্রত্যাবর্তন সর্বসম্মত।
ফিকাহ্বিদদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন, আমর বিন হাজমের চিঠিতে লিখিত কথা হযরত আবূ বকরও উমর ফারুকের চিঠিদ্বয়ে উল্লিখিত কথা দ্বারা নাকচ হয়ে গেছে।
ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা জম্হুর ফিকাহ্বিদদের মত গ্রহণ করে তাকে অধিকতর শক্তিশালী করে তুলেছেন। ইমাম শাফেয়ী, আওযায়ী, আহমদ, ইবনে হাম্বল এবং আহ্লি হাদীস ফকীহ্গণ এই মতই গ্রহণ করেছেন। এঁরা এ ক্ষেত্রে রাসূলের ও তাঁর খলীফাগণের সুন্নাতেরই অনুসারী। তিনটি মতের মধ্যে যেটি মধ্যম বা উত্তম, তাই তারা গ্রহণ করেছেন। আর তা হচ্ছে, বহু সংখ্যক উষ্ট্র থাকলে প্রতি চল্লিশটিতে তৃতীয বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী এবং প্রতি পঞ্চাশটিতে চতুর্থ বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী দিতে হবে। কেননা নবী করীম(স)-এর যে দুটি কাজের বিবরণ জানা গেছে, এটি তন্মধ্যে সর্বশেষ আমল। কিন্তু একশ’ বিশটির পর নতুন করে ফরযেরহিসাব করার মতটি প্রথমে প্রকাশিত। কেননা আমর ইবনেহাজম নাজরানে নিযুক্ত হয়েছিলেন রাসূলে করীমের জীবনের শেষভাগে; মৃত্যুর প্রাক্কালে। আর হযরত আবূ বকর লিখিত চিঠি তো নবী করীম (স) কর্তৃকই শিখানো হয়েছিলো। তাঁর ইন্তেকালের পর হযরত আবূ বকরই তা সর্ব প্রথম প্রকাশ করেছেন। [(আরবী **********)]
ইবনে তাইমিয়্যা আমর ইবনে হাজমের চিঠিকে দুর্বল বলেন নি। তিনিমনে করেছেন, তা নাকচ হয়ে গেছে। কেননা তা প্রথম দিকের কাজ ছিল। আবূ বকর ও উমরের চিঠি ছিল শেষ পর্যায় সংক্রান্ত বিষয়ে আর নিয়ম হচ্ছে, দুটি মতের মধ্যে সামস্য বিধান সম্ভব না হলে শেষের মতটি গ্রহণ করতে হবে। দ্বিতীয় মতটিকে প্রথম মতটির নাকচকারী মনে করতে হবে- অবশ্য যদি প্রথম কোনটি ও শেষে কোনটি তা নির্ভরযোগ্যভাবে জানা যায়।
এ সব কথা থেকেই এ কথা স্পষ্টহয়ে উঠে যে, দলীলেরদিক দিয়ে জমহুর ফিকাহ্বিদদের মতই অকাট্য। হানাফী মতের তুলনায় এ মতটির পক্ষে দলীল অনেক বেশী। জমহুর আলিমগণ এ মতই প্রকাশ করেছেন। শেখ আব্দুল আলী বহরুর উলুম উপাধিধারী (আরবী***) গ্রন্থে (১৭০-১৭১পৃঃ) ইবনুল হুম্মামের মতের প্রতিবাদ করেছেন। পরেলিখেছেন ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আহ্মদেরমতই অধিক গ্রহণযোগ্য। [(আরবী **********)]
তাবারীর মত
ইমাম আবূ জাফর তাবারী এক মধ্যম মত গ্রহণ করেছেন। তাতে তিনি উভয় মতকেই সহীহ্ বলেছেন এবং বলেছেন: এ দুটি মতের চরম লক্ষ্যকে অবলম্বন করাই বাঞ্ছনীয়। [(আরবী **********)]
আমার দৃষ্টিতে এটি একটি উত্তম মত। কেননা একটি মতের দ্বারা অপর মতটি নাকচ হয়ে যাওয়ার ব্যাপার তো তখনই গ্রহণীয় হতে পারে, যখন উভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য ও সমন্বয় বিধান অসম্ভব হয়ে পড়ে।
এক্ষেত্রে তাবারীর সমন্বয় সাধনের মত অবশ্যই গ্রহণীয়। কেননা লক্ষণীয় যে, এ বয়স, পরিমাণ, সংখ্যা ও রকম বা প্রকার নির্ধারণ কাজের সুবিধা ও সহজের জন্যেই তা করা হয়েছে। এতে করে হিসাব করাও সহজসাধ্য, ব্যাপকভাবে কার্যকর করাও সম্ভবপর। এমতাবস্থায় যাকাত দাতা যখনই বাছাই করে কোন একটা করার অধিকারী হবে, তখন তার পক্ষে তা করাও সহজ হবে।
যাকাত সংক্রান্ত পত্রসমূহের মধ্যে সামান্য পার্থক্যের তাৎপর্য
এখানে খনিকটা অপেক্ষা করে একটি বিষয় বিবেচনা করা আবশ্যক। নবী করীম (স) ও খুলাফায়ে রাশেদুন থেকে যাকাত পর্যায়ে যেসব চিঠি বর্ণিত হয়েছে, আমরা সে সবের মধ্যে খানিকটা পার্থক্য লক্ষ্য করছি। আমরা যে সব বর্ণনার কথাই বলছি, যার সনদ গ্রহণযোগ্য। যয়ীফ ও প্রত্যাখ্যাত সনদে বর্ণিত কথার প্রতি আমরা ভ্রুক্ষেপও করছি না। এই ধরনের একটি বর্ণনা হচ্ছে, হযরত আলীর চিঠি, যাতে লিখিত রয়েছে: যাকাতদাতা যদি কোন এক বয়স অপেক্ষা অধিক জন্তু যাকাত বাবদ দিয়ে দেয় তাহলে দশ দিরহাম কিংবা দুইটি ছাগী তাকে ফেরত দিতে হবে। [(আরবী **********)]
হযরত আবূবকরের চিঠিতে নবী করীম(স)-এর ধার্য করা যাকাত পরিমাণ পর্যায়ে বলা হয়েছে: তিনি নির্দেশ দিয়েছেন য, দুটি ছাগী কিংবা বিশটি দিরহাম তাতে ফেরত দিতে হবে। পূর্বে উদ্ধৃত হযরত আনাসের হাদীসওতা-ই বলা হয়েছে।
হযরত আবূ বকর ও উমরের চিঠিদ্বয়ের বিপরীত কিছু কিছু কথা হযরত আলীর চিঠিতে এসেছে।
এ কথা সত্য, হযরত আলীর কথা নবী করীম(স) থেকে পাওয়া বলে প্রমাণিত হয়নি। এ কথাও সত্য যে, তা হযরত আলীরই কথা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, হযরত আলী নবী করীম(স)-এর লিখত কথার বিপরীত কথাকে কি করে চালু করলেন?
তাহলে আমরাকি হযরত আবূ বকর ও উমর ফারূক লিখিত চিঠিতে দোষ তালাশ করতে সচেষ্ট হব? অথচ তা অতীব বিশুদ্ধ সনদে প্রমাণিত হয়েছে?
অথবা আমরাকি বলব যে, হযরত আলী জানতে পেরেছেন, অন্যান্য চিঠি নাকচ হয়ে গেছে? আর তাঁর মতটাই সুরক্ষিত রয়েছে। কিন্তু তাহলে প্রশ্ন হয়, প্রথম দুজন খলীফার সময়ে তা অপ্রকাশিত থাকতে পারল কি ভাবে?
আসলে এসব সম্ভাবনাই অগ্রহণযোগ্য। আমার দৃষ্টিতে স্পষ্ট কথা হচ্ছে, নবী করীম(স) এসব পরিসংখ্যান ও পরিমাণ নির্ধারণেরকাজ করেছেন। এই মর্যাদা সহকারে যে তিনিই মুসলিম উম্মতের উপর নেতৃত্বের অধিকারী ছিলেন। নবী হিবেনয়। আর নেতৃত্বের বিশেষত্ব ও অধিকার হচ্ছে সময়, স্থান ও অবস্থার প্রেক্ষিতে জনগণের জন্যে যা-ই সর্বাধিক কল্যাণকর হবে, তা-ই তিনি চালু করবেন; তা কার্যকরকরার জন্যে সকলকে নির্দেশদেবেন। আর সেই সময় স্থান ও অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে গেল- অথবা এর কোন একটিও পরিবর্তিত হলে সেই অনুপাতে প্রয়োজনীয় ও উপযুক্ত ব্যবস্থা চালু করবেন। পক্ষান্তরে যা নবী হিসেবে বলা হবে, তা সংশ্লিষ্ট্য সকলের জন্যে সর্বকালে ও সর্বস্থানে অবশ্য পালনীয়।
শরীয়াতী বিধানে এই যে বিভিন্ন বয়স এবং দুই ছাগী ও বিশ দিরহামের পার্থক্য নির্ধারণ করা হয়েছে, যদিও এ ধরনের অবস্থায় একই স্থিতিশীল মূল্যের উপর পার্থক্য প্রমাণিত হয়; কেননা উষ্ট্র ও ছাগীর মধ্যে সম্পর্ক বা আনুপাতিকতা যদিও প্রমাণিত হয়, কিন্তু দুটি ছাগীর বিশ দিরহাম মূল্য নির্ধারণ কোন ক্রমেই প্রমাণিত হয় না। কেননা এতে করে ছাগীর মূল্য অত্যধিক করা হয়েছে। অথবা দিরহামের ক্রয়শক্তি হ্রাস পেয়েছে। এর বিপরীতটা হয়েছে- যেমন একালে সর্বত্র লক্ষণীয়; নবী করীম(স) যখন ছাগীর মূল্য বিশ দিরহাম নির্ধারণ করেছেন, তখন তা করেছেন রাষ্ট্রনেতা হিসেবে চলমান বাজার মূল্যেল অনুপাতে। তাই এ ছাড়াও পার্থক্য পরিমাপ করায় কোন বাধা আছে আমরা মনে করি না। কেননা বাজার মূল্য তো পার্থক্যপূর্ণ হয়ে থাকে।সব সময় বাজার মূল্য একই রকম থাকতে পারে না।
এই ভিত্তির উপর নির্ভর করেই রাষ্ট্রনেতা হযরত আলীর পরিমাণ নির্ধারণ কার্যকর হয়েছে। দুই ছাগীর বয়স কিংবা দশ দিরহামের পার্থক্য নির্ধারিত হয়েছে। এতে মনে হয় তাঁর খিলাফত আমলে ছাগলের মূল্য হ্রাস পেয়েছিল। তাই তাতে নবীর আদেশের বিরোধতার কোন প্রশ্ন উঠতে পারে না।
চিঠিসমূহের পারস্পরিক পার্থক্যের- কিছু কিছু খুঁটিনাটি ব্যাপারে পার্থক্যের- এ ব্যাখ্যা বা কারণ বিশ্লেষণ করা এসবের সনদ ও প্রমাণে সংশয় আরোপ কর তা প্রত্যাখ্যান করার পরিবর্তে অনেক উত্তম বলে মনে হয়। ইমাম ইয়াহ্ ইয়া ইবনে মুয়ীন যেমন করেছেন। বলেছেন, যাকাত ফরয হওয়ার পরিমাণের ব্যাপারে কোন হাদীস সহীহ্ প্রমাণিত হয়নি। -এই যেমন উষ্ট্রের বয়স বা পরিসংখ্যান, গরু ইত্যাদির নিসাব। ইবনে হাজম তীব্রভাবে এর প্রতি অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তিনি মনে করেন, তাঁর এ কথাটি প্রত্যাখ্যানযোগ্য। কেননা এটা একটা দলীলহীন দাবি মাত্র। আর প্রাচ্যবিদ শাখ্ত যেমন করে যাকাত সংক্রান্ত সমস্ত সহীহ্ হাদীসের প্রতিই সংশয় আরোপ করেছেন। অথচ এ হাদীসসমূহ নবী করীম (স) থেকে বর্ণিত এবং তা থেকে যাকাত ব্যবস্থার বিস্তারিত রূপ প্রাণিত হয়।
তৃতীয় আলোচনা
গরুর যাকাত
গরু বিশেষ প্রকারের গবাদিপশু। আল্লাহ তা’আরা এগুলো সৃষ্টি করে মানুষেরপ্রতি বিশেষ অনুগ্রহ প্রদর্শন করেছেন। তার সাথে মানুষের বহু প্রকারের কল্যাণ যুক্ত করে দিয়েছেন। এগুলো যেমন বংশবৃদ্ধির জন্যে পালা হয়, তেমনি চাষাবাদ ও পানি টানার জন্যেও প্রয়োজনীয়। এর গোশ্ত, চামড়া, অস্থি সবই মানুষের কাজে লাগে। আর দেশ, অবস্থা ও প্রয়োজনের পার্থক্যের ভিত্তিতে দুনিয়ার সর্বত্রই ব্যবহৃত হয়।]
মহিষ ও গরুরই পর্যায়ে গণ্য গবাদিপশু। কাজেই এ দুটির মধ্যে কোন পার্থক্য করা চলে না। ইবনুল মুনযির তাই বলেছেন। [(আরবী *********)]
আর গরুর যাকাত দেয়া তো সর্বসম্মতভাবেই ফরয। ইজমা ও হাদীস উভয়ই তা প্রমাণ করে।
উল্লেখ্য হাদীস হযরত আবূ যর থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন: আমি নবী করীম(স)-এর কাছে উস্থিত হলে তিনি বললেন; যার মুস্টির মধ্যে আমার প্রাণ (বা যিনি ছাড়া ইলাহ্ কেউ নেই), যে লোকেরই উষ্ট্রী বা গরু বা ছাগল থাকবে; কিন্তু যাকাত দেবে না, কিয়ামতের দিন তার চাইতে বড় আকারের আকৃতি হয়ে তা আসবে এবং ক্ষুর দিয়ে তাকে ক্ষতবিক্ষত করবে এবং শিং দিয়ে তাকে আহত করবে। যখন দ্বিতীয়টি আসবে, প্রথমটিকে প্রত্যাহার করা হবে- যতক্ষণ না লোকদের মধ্যে চূড়ান্ত বিচার অনুষ্ঠিত হচ্ছে।’
ইমাম বুখারী বলেছেন, হযরত আবূ হুরায়রা নবী করীম (স) থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন, ‘যে লোক যাকাত দেবে না, কিয়ামতের দিন তাকে কঠিন ও কঠোর আযাব দেয়া হবে।’ কেননা যাকাত হচ্ছে ধন-মালের দেয় হক্। হযরত আবূ বকর এজন্যেই যাকাত দিতে অস্বীকারকারী লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। হযরত উমর ও অন্যান্য সবসাহাবীই এ পদক্ষেপকে যথার্থ বলে সম্মতি দিয়েছিলেন।
সমগ্র মুসলিম সমাজ এ যাকাতের ফরয হওয়ার ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত। কোন প্রকার শোবাহ্-সন্দেহ এতে নেই। কোন এক যুগেও কোন সামান্য মত-পার্থক্য দেখা দেয়নি। অবশ্য নিসাব নির্ধারণে সামান্য মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। [আরবী *********]
গরুর যাকাতের নিসাব
একথা সকলেরই জানা যে, ইসলাম সর্বপ্রকারের ধন-মালে তা কম হোক কি বেশী, যাকাত ফরয করেনি। উপরন্তু যাকাত বাবদ খুব কম পরিমাণ মালই ফরয করা হয়েছে। কত পরিমাণ বেশী ধন-মাল থাকলে যাকাত দিতে হবে, তার সীমা নির্দিষ্ট করা হয়েছে। তাকেই পরিভাষায় ‘নিসাব’ বলা হয়। নবী করীম (স) ও খুলাফায়ে রাশেদুন থেকে বর্ণিত বহু হাদীসেই এ সীমা নির্দিষ্ট হয়েছে। বলা হয়েছে, পাঁচটি উষ্ট্র থাকলে যাকাত হবে এবং চল্লিশটি ছাগল থাকলে যাকাত দিতে হবে।
তাহলে কত সংখ্যক গরু থাকলে যাকাত দিতে হবে- যার কমহলে যাকাত ফরয হবে না? নবী করীম (স) থেকেএ পর্যায়ে কোন নিসাব নির্ধারণকারী সহীহ্ বর্ণনা উদ্ধৃত হয়নি। তবে উষ্ট্রের নিসাব ও সংখ্যা ও ফরযের পরিমাণ স্পষ্ট ভাষায় ও বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে।
হিজাজে অনেক সময় গরুর সংখ্যাল্পতা দেখা দিত। এ কারণে তিনি তাঁর লিীখত ও প্রখ্যাত যাকাত সংক্রান্ত চিঠিপত্রে গরুর যাকাত সম্পর্কে কিছুই লিখেন নি, যেমন অন্যান্য বিষয়ে লিখেছেন। এটাও সম্ভব যে, উষ্ট্রের যাকাতের কথা বলে দেয়াকেই এ পর্যায়ে যথেষ্ট মনে করেছেন। কেননা শরীয়াতের দৃষ্টিতে দুটি একই ধরনের গবাদিপশু। আর এ কারণেই গুরর যাকাতরে পরিসংখ্যানে ফিকাহ্বিদগণের মধ্য মতভেদের সৃষ্টি হয়েছে।
প্রসিদ্ধ কথা- নিসাবের সংখ্যা ত্রিশ
চারটি মাযহাবেই সমর্থিত প্রখ্যাত করা হচ্ছে, গরুর নিসাব-সর্বনিম্ন সংখ্যা- ত্রিশ। অর্থাৎ ত্রিশটি গরু থাকলেই যাকাত দিতে হবে। তার কম সংখ্যার জন্যে নয়। আর ত্রিশটি গরু থাকলে ও তার যাকাত বাবদ িএক বছর বয়সের একটা বাছুর দিতে হবে। আর চল্লিশটি থাকলে দিতে হবে দুই বছর বয়সের একটা বাছুর। অতঃপর ঊনষাটটি পর্যন্ত আর কিছুই দিতে হবে না। যদি ষাটটি হয়, তাহলে দুটি এক বছর বয়সের বাছুর দিতে হবে। ষাটের পর সত্তরটি হলে একটি দুই বছর বয়সের ও একটি এক বছর বয়সের বাছুর দিতে হবে। আশিটি হলে দুটি দুই বছর বয়সের বাছুর দিতে হবে। নব্বইটি হলে তিনটি এক বছর বয়সের, একশটি হলে একটি দুই বছর বয়সের ও দুটি এক বছর বয়সের এবং একশ’ বিশটি হলে তিনটি দুই বছর বয়সের অথবা চারটি এক বছর বয়সের বাছুর দিতে হবে।
এ কথার দলীল হচ্ছে হযরত মুআয থেকে বর্ণিত হাদীস। তিনি বলেন: রাসূলে করীম(স) আমাকে ইয়েমেনে পাঠালেন এবং আমাকে প্রতি ত্রিশটি গরুর যাকাত বাবদ একটি এক বছর বয়সের ও প্রতি চল্লিশটির জন্যে একটি দুই বছর বয়সের বাছুর গ্রহণ করতে আদশে করলেন। [(আরবী *********)]
ইমাম তিরমিযী এ হাদীসটিকে উত্তম এবং ইবনে হাব্বান ও হাকেম এ হাদীসটিকে ‘সহীহ’ বলেছেন। ইবনে আব্দুল বার্ বলেছেন, এই হাদীসটির সনদ বিঘ্নমুক্ত সহীহ্ এবং সপ্রমাণিত। মুয়াত্তা গ্রন্থেও এই হাদীসটি উদ্ধৃত হয়েছে।
তবে ইবনে হাজম এই হাদীসটিকে যয়ীফ বলেছেন। কেননা তার মতে বর্ণনাকারী মস্রুক হযরত মুআযের সাক্ষাত পান নি। কিন্তু পরে অন্যত্র এই ভুলের সংশোধন করে লিখেছেন যে, মসরুক মুআযের সাক্ষাত পেয়েছেন নিঃসন্দেহে। কাজেই গরুর যাকাত পর্যায়ে এ হাদীস অবশ্যই গ্রহণযোগ্য।
হাফেয ইবনে হাজর আল-আসকালানী লিখেছেন গরুর যাকাত পর্যায়ে হযরত মুআয বর্ণিত হাদীসেবলা কথাই সর্বসম্মত, এই বিষয়ে কোন মতভেদই নেই।
রাসূলে করীমের যে চিঠি আমর ইবনে হাজমের প্রতি লিখি, তাতেও এ কথাই উদ্ধৃত হয়েছে। বলা হয়েছে, ত্রিশটি গরুতে একটা এক বছরের বাছুর দিতে হবে।
কিন্তু মুআয ও আমর ইবনে হাজম বর্ণিত হাদীসে একথা বলা হয়নি যে, এই ত্রিশটিই সর্বনিম্ন নিসাব। কাজেই ত্রিশটির কম সংখ্যক গরুর যাকাত গ্রহণ করায় উক্ত হাদীসদ্বয়ে নিষেধ নেই।
ইবনে আবদুল বার গরুর উক্তরূপ যাকাত- নিসাব সর্বসম্মত ও তার উপর ইজমা রয়েছে বলে যে দাবি করেছেন তা অগ্রহণযোগ্য। কেননা সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যিব জুহরী, আবূ কালাবা ও তাবারী প্রমুখ ইমাম ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন।
হাফেয আবদুল হক্ থেকে বর্নিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, গরুর যাকাতের নিসাব পর্যায়ে সর্ব সমর্থিত কোন সহীহ্ হাদীস নেই।
মুআয বর্ণিত হাদীসেএকটি কথা অকাট্য যে, গরু চল্লিশটির ঊর্ধ্ব সংখ্যক হলে ষাটটি না হওয়া পর্যন্ত আর কোন যাকাত নেই। মুআয বর্ণনা করেছেন, লোকেরা ভগ্ন সংখ্যার যাকাতনিয়ে এলে তা গ্রহণ করতে তিনি অস্বীকৃতি জানান। তিনজন বড় ইমাম, আবূ ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মাদ ও জমহুর আলিমগণ এই মতই সমর্থন করেছেন। ইমাম আবূ হানীফা থেকে প্রখ্যাত মত পাওয়া গেছে যে, চল্লিশটির অধিক গরুর হিসাবে হবে প্রতিটি গরুর জন্যে দুই বছর বয়সের বাছুরের দশ ভাগের এক-চতুর্থাংশ।
হাসান বর্ণনা করেছেন, চল্শিটির বেশী হলে পঞ্চাশটি না হওয়া পর্যন্ত কোন যাকাত হবে না। পঞ্চাশটি হলে একটি দুই বছর বয়সের বাছর ও এক-চতুর্থাংশ যাকাত বাবদ দিতে হবে।
ইমাম তাবারীর মতে নিসাব পরিমাণ পঞ্চাশটি
ইমাম আবূ জাফর তাবারী মত দিয়েছেন যে, গরুর নিম্ন সংখ্যক নিসাব হল পঞ্চাশটি। এ পর্যায়ে সুনিশ্চিত ইজমা অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং এতে কোনরূপ মত বৈষম্যের অবকাশ নেই। আর তা হচ্ছে, প্রতি পঞ্চাশটিতে একটি গরু দিতে হবে। তাই তা গ্রহণ করাই জরুরী। আর তার কমে বিভিন্ন মত রয়েছে। তবে তা ফরয হওয়ার পক্ষে কোন অকাট্য দলীল নেই। ইবনেহাজম ইমাম তাবারীর এই মত গ্রহণ করেছেন। বলেছেন, এ ব্যাপারে মতবিরোধ হয়েছে এবং ফরয হওয়ার পক্ষেকোন দলীল নেই, তার ভগ্নাংশ করার পক্সেও কোন কথা বলা হয়নি। কেননা তাতে মুসলিম ব্যক্তির মাল ফরয যাকাত বাবদ গ্রহণ করা হয় নিশ্চয়তাবিহীনভাবে। কেননা তার পক্ষে কুরআন ও সুন্নাহর কোন অকাট্য দলীল নেই।
ইবনে হাজম এ মতেরসমর্থনে আমর ইবনে দীনার বর্ণিত একটি কথার উল্লেখ করেছ। তাতে বলা হয়েছে, ইবনে যুবায়র ও ইবনে আউফের কর্মচারীরা প্রতি পঞ্চাশটি গুরুর যাকাত বাবদ একটি গরু গ্রহণ করতেন। আর প্রতি একশটির জন্যে গ্রহণ করতেন দুটি গরু। তার অধিক গুরু গ্রহণ করতেন। আর প্রতি একশটির জন্যে গ্রহণকরতেন দুটি গরু। তার অধিক হলে প্রতি পঞ্চাশটিতে একটি গরু নিতেন। এ কাজটি সাহাবাগণের উপস্তিতিতেই করা হয়েছে; কিন্তু তাঁরা এর প্রতিবাদ করেন নি।
এই মতের উপর দুটি প্রশ্ন দেখা দেয়। প্রথমটি হাদীসের বর্ণনার দৃষ্টিতে, আর দ্বিতীযটি বিবেচনার দৃষ্টিতে:
ক. আমর ইবনে হাজমের সাদকা ও দীয়ত পর্যায়ে বর্ণিত দীর্ঘ হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে, প্রতি ত্রিশটি গরুতে একটি এক বছর বয়সের বাছুর দিতে হবে। আর প্রতি চল্লিশটিতে একটি গুরু। বহু সংখ্যক ইমামএ হাদীসটিকে সহীহ্ বলেছেন।
হযরত মুআয বর্ণিত হাদীসেও প্রতি ত্রিশটি ও প্রতি চল্লিশটির উপর যাকাত ধার্য করা হয়েছে। এ হাদীসটিকে সহীহ্ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
খ. বিবেচনার দৃষ্টিতে প্রশ্ন উঠে, শরীয়াতের হুকু-আহকাম কারণের উপর ভিত্তিশীল। তার লক্ষ্য মানবতার কল্যাণ। এ দৃষ্টিতে একটা স্বাভাবিক যে, সুবিচারক শরীয়াত প্রতি পাঁচটি উষ্ট্রে ও প্রতি চল্লিশটি ছাগলের উপর যাকাত ধার্য করব এবং পাঁচটির কম গরুর উপর যাকাত ধার্য করবে না। কেননা তা ঠিক উটের মত না হলেও ছাগলের তুলনায় অধিক উপকারী ও কল্যাণদায়ক।
ইনুল মুসায়্যিব ও জুহ্রীর মত
সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যিব, মুহাম্মদ িইবনে শিহাব জুহারী ও আবূ কালাবা প্রমুখ ইমাম মত প্রকাশ করেছেন যে, উষ্ট্রের নিসাবই গরুর নিসাব। গরুর যাকাত বাবদ তা-ই গ্রহণ করা হবে, যা উষ্ট্রের যাকাত বাবদ গ্রহণ করা হয়। তবে উষ্ট্রের ক্ষেত্রে যেমন বয়সের শর্ত রয়েছে, তেমন কোন শর্ত এক্ষেত্রে নেই। এ কথাটি যাকাত পর্যায়ে হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব লিখিত চিঠির বর্ণনায় উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, গরুর যাকাত বাবদ তা-ই গ্রহণ করা হচে, যা গ্রহণ করা হবে উষ্ট্রের যাকাত বাবদ। অন্যান্য মনীষীদেরও এ মতই বর্নিত হয়েছে।
হযরত জবির ইবনে আবদুল্লাহ আনসারী (রা) বলেছেন: প্রতি পাঁচটি গরুর যাকাত বাবদ একটি ছাগী দিতে হবে, প্রতি দশটিতে দুটি ছাগী, পনেরটিতে তিনটি ছাগী এবং বিশটিতে চারটি ছাগী। জুহরীর মতে গরুর ফরয যাকাত উষ্ট্রের মতই। তবেতাতে বয়সের কোন শর্ত নেই। পঁচিশটি গরু হলে িএকটি গরু দিতে হবে। এ হিসাব পঁচাত্তরটি পর্যন্ত চলবে। তার অধিক হলে একশ বিশটি পর্যন্ত দুটি গাভী দিতে হবে। তার অধিকহলে প্রতি চল্লিশটিতেও একটি গাভী দিতে হবে। একটি বর্ণনায় ইয়েমেনবাসীদের জন্যে পরিমাণ হালকা করে প্রতি ত্রিশটিতে একটি এক বছর বয়সের শাবক এবং প্রতি চল্লিশটিতে একটি গাভী দিতে হবে ঘোষণা করা হয়েছে।
ইকরামা ইবনে কালিদ বলেছেন, আমাকে যাকাত আদায়ের দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়েছিল। পরে আমি যাকাত দাতাদের সাথে সাক্ষাত করি। এটা নবী করীম (স)-এর জীবদ্দশার কথা। তারা আমাদের কাছে বিভিন্ন মত প্রকাশ করে। কেউ বলে, উষ্ট্রের যাক, গরুর যাকাত তা-ই গ্রহণ করুন। কেউ বলে, প্রতি চল্লিশটি গরু বাবদ দুই বছরের একটি বাছুর গ্রহরণ করুন। উমর ইবনে আবদুর রহমান ইবনে খালদাতাল্ আনসারী থেকেও বর্নিত হয়েছে যে, গরুর যাকাত উষ্ট্রের যাকাতের মতই।
এই মতের দলীল
ক. মুহাম্মদ ইবনে আবদুর রহমান বলেছেন: নবী করীম (স) ও উমর ইবনুল খাত্তাব লিখিত যাকাত সংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়েছে: গরুর যাকাত বাবদ তা-ই গ্রহণ করা হবে, যা গ্রহণ করা হয় উষ্ট্রের বাবদ। মা’মার থেকে বর্ণিত: সামাক ইবনুল ফযল আমাকে নবী করীম(স)-এর একটি চিঠি দিলেন যা মালিক ইবনে কুফলান্সের কাছে লেখা হয়েছিল তাতে আমিপড়লাম…. গরুতে তা-ই, যা উষ্ট্রে….।
খ. ইমাম জুহরী বলেছেন, এটাই রাসূলে করীম (স)-এর সর্বশেষ কথা। প্রথম কথা ছিল, প্রতি ত্রিশটি গরুরতে একটা এক বছরের বাচুর। এটা ইয়েমেনবাসীদের জন্যে সহজকৃত হার ছিল। এটি ‘মুরসাল’ হাদীস হলেও পূর্বোদ্ধৃত হাদীস ও সাহাবীগণের কথা এর সমর্থক। ইবন হাজম বলেছেন, কারোর ‘মুরসাল’ হাদীস গ্রহণ করা হলে ইমাম জুহরীর ‘মুরসাল’ অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। কেননা তিনি হাদীস সম্পর্কে বড়ই পারদর্শী। আরও এজন্যে যে, তিনি বহু সংখ্যক সাহাবীর সাক্ষাত পেয়েছেন।
খ. পূর্বে যে সাধারণ অর্থবোধক হাদীসটি আমরা উদ্ধৃত করেছি (যাতে বলা হয়েছে ‘যে, গরু-মালিক যাকাত দেবে না, কিয়ামতের দিন তাকে কঠিন শাস্তিদেয়া হবে’) তা প্রত্যেক গরু সম্পর্কেই বক্তব্য। তবে বিশেষ কোন দলীল কিংবা ইজমা যদি তার বিপরীত হয়, তবে সে কথা স্বতন্ত্র। তাঁরা বলেছেন, অন্যেরা যদি অপর হাদীসটিকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করেন তা হলে আমরা এ হাদীসটিকে দলীল মনে করব। আর হাদীসে ত্রিশটির কমসংখ্যক গরুতে যাকাত না হওয়ার কথার উল্লেখ নেই। এ কথার কোন দলীলও নেই।
ঘ. গরুকে উষ্ট্রের মত গবাদিপশু মনেকরা হলে উক্ত মত অধিকতর শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ফিকাহ্বিদগণ বলেন, একটি উস্ট্রে যেমন সাত জন লোকের কুরবানী চলে, তেমনি একটি গরুতেও চলে। যদিও অনেকে আমাদের সাথে একমত নয়। তাই উষ্ট্রের যাকাত যা, গরুর যাকাত তা-ই।
ইবনে হাজম এ মতের বিপরীত মত পোষণ করেন। তাঁর মতে এ পর্যায়ে রাসূল থেকে বর্ণিত হাদীসসমূহের সনদ তিনি পর্যন্ত পৌঁছেনি। এ কারণে তার দলীল হিসেবে গ্রহণীয় হতে পারে না।
সাধারণ অর্থবোধকযে হাদীসটিকে দলীল হিসেবে পেশ করা হয়েছে, তা হানাফী ও মালিকী মায্হাব অনুসারীদের জন্যে বাধ্যতামূলক। তা সব গরুর ক্ষেত্রেই সমান। আরও দলীল এই যে, কুরআনের আয়াত- তাদের ধন-মাল থেকে যাকাত গ্রহণ কর’ সাধারণ অর্থবোধক বিধায় মধুতেও যাকাত ফরয হয়। এ কারণে হানাফী মত-অনুসারীদের জন্যে তা বাধ্যতামূলক। কিন্তু তাআমাদরে উপর বাধ্যতামূলক নয়। কেননা দলীলের সাধারণ বোধগম্য অর্থ স্বীকার করেও আমাদের মত হল, তা শরীয়াতের কোন বিধানরূপে স্বীকৃত হতে পারে না। কিন্তু পাঁচটি গরুতে যাকাত ফরয হওয়া সম্পর্কে রাসূলে করীম(স) থেকে কোন সহী্ দলীল প্রমাণিত হয় না।
উষ্ট্রের যাকাত-নিসাব অনুরূপ গরুর যাকাত-নিসাব নির্ধারণ এই মতে বিশ্বাবাসীদের জন্যেই বাধ্যতামূলক হতে পারে। কোন কিয়াস যদি ‘সহীহ হয়ই, তা হলে এটা অবশ্যই সহীহ্ মানতে হবে। আর উষ্ট্র ও গরু সংক্রান্ত শরীয়াতী হুকুমেকোন সর্বসম্মত পার্থক্য আছে বলে আমরা জানতে পারিনি; ইবনে হাজম এতদূর বলেছেন যে, তাদের এ দলীল আমাদের উপর প্রযোজ্য থাকেনি। কেবলমাত্র হানাফী, মালিকী ও শাফেয়ী মাযহাবের লোকদের জন্যেই তা বাধ্যতামূলক।
মাযহাবপন্থী আলিমগণ এ মতের প্রতিবাদ করে বলেছেন, উপরিউক্ত মতের উষ্ট্রের উপর গরুকে ‘কিয়াস’ করা হয়েছে। কিন্তু নিসাব কখনও কিয়াসের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা যায় না। তা হবে অকাট্য দলীলের ভিত্তিতে। কিন্তু তাঁরা কোন দলীলের উল্লেখ করতে পারেন নি বলে তা অপ্রমাণিত। ইবনে কুদামাহ্ বলেছেন এ কিয়াস গ্রহণের অযোগ্য। কেননা পঁয়ত্রিশটি ছাগল কুরবানীরর ক্ষেত্রে পাঁচটি উষ্ট্রের সমান হয়। আর তাতে যাকাত নেই, যেমন মুআয সংক্রান্ত হাদীসকে দলীল হিসেবে পেশ করা হয়েছে।
ভিন্নমত
ইবনে রুশ্দ ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন। আর তা হল প্রতি দশটি গরুতে একটি ছাগী দিতে হবে। ত্রিশটি পর্যন্ত তাই চলবে। ত্রিশটিতে দিতে হবে একটি দুই বছরের বাছুর।
ইবনে আবূ শায়বা’র ‘আল-মুসান্নাফ’ গ্রন্থে লিখিত আছে: প্রতি দশটি গরুতে একটি করে ছাগী, প্রতি বিশটি গরুতে দুদিট ছাগী এবং প্রতি ত্রিশটিতে একটি দুই বছরের বাছুর দিতে হবে।
এ কথার অর্থ, দশটিই হল গরুর নিসাব পাঁচটি নয়। ইবনে আবূ শায়বা এ কথার পক্ষেকোন দলীলের উল্লেখ করেন নি।
আমি মনে করি, উক্ত কথার দলীলরূপে সেসব হাদীসই গণ্য করা যেতে পারে, যা দীয়তের পরিমাণ পর্যায়ে উদ্ধৃত হয়েছে। আর তা হচ্ছে, একশ’টি উষ্ট্র অথবা দুইশ’টি গরু।
হযরত উমরের কথা হিসেবে বর্ণিত হয়েছে, নবী করীমের উক্তিরূপেই উদ্ধৃত হয়েছে যে, একটি উষ্ট্র দুটি গরুর সমান। তাই উস্ট্রেরযখন একটি ছাগী, তখন প্রতি দশটি গরুতে একটি ছাগী যাকাত বাবদ দিতে হবে।
প্রাসঙ্গিক কথা
উপরে উদ্ধৃত বিভিন্ন মতের প্রেক্ষিতে আমি মনে করি, জমহুর ফিকাহ্বিদগণ যে ত্রিশ-চল্লিশ ও তদূর্ধ্ব সংখ্যার মত দিয়েছেন, উপরিউক্ত মতসমূহের মধ্যে তা-ই অগ্রাধিকার পাওয়ার উপযোগী। এই পর্যায়ে দলীল হচ্ছে, হযরত মুআয ও আমর ইবনে হাজম বর্ণিত হাদীস। তবে ত্রিশের কম সংখ্যকের ব্যাপারে হাদীস দুটির পক্ষেরবা বিপক্ষের কিছুই নেই। কেননা এ হাদীস দুটি আগেই বলে দিয়েছে ফরযের পরিমাণ ও তার পরিচয়। অতএব তা নিসাব- বর্ণনার অধিক।
আমর ইবনে হাজম বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে, প্রতি চল্লিশ দীনারে কে দীনার যাকাত। কিন্তু তাই বলে জমহুর ফিকাহ্বিদগণ বিশ দীনারে যাকাত গ্রহণ করতে নিষেধ করেন নি। কেননা হাদীসটি পরিমাণের উল্লেখ করেছে, নিসাব নয়।
কাজেই ইবনুল মুসাইয়্যির, জুহরী ও তাঁদের সমর্থক অপরাপর তাবেয়ী ফিকাহ্বিদগণ পাঁচটি গরুর যে নিসাব নির্দিষ্ট করেছেন, তা গ্রহণ করার বড় সুযোগ রয়েছে।
বিশেষ করে হযরত উমর লিখিত যাকাত সংক্রান্ত চিঠিতে বর্ণিত হয়েছে। সাহাবীদের মধ্যে জাবির ইবনে আবদুল্লাহ্ও রয়েছেন। বরং তাঁর সম্পর্ক রাসূলে করীম(স)-এর চিঠির সাথে।
যদিও আবূ উবাইদ বলেছৈন যে, অসংরক্ষিত। লোকেরা তা জানে না। কিন্তু সাহাবী ও তাবেয়িগণ তা জানেন।
সর্বোপরি, উষ্ট্রের উপর ধারণা করে গরু সম্পর্কিত নীতি গ্রহণ একটিপন্থা। এটাই ইবনে হাজমের কথা- ‘কিয়াস অগ্রহণযোগ্য-, তার কোন গুরুত্ব নেই’।
সুতরাং মুসলিম উম্মতের অধিকাংশ লোকের মতই ঠিক। তা হচ্ছে, ‘সহীহ কিয়াস্ ইসলামী শরীয়াত একটা মৌল ভিত্তিরূপে গ্রহণযোগ্য, তা ইসলামী আইন প্রণয়ণের উৎসেরও কাজ করে, যতক্ষণ তা কোনসহীহ দলীল বা প্রতিষ্ঠিত নিয়মের পরিপন্থী না হয়। তবে কোন কোন হাদীসে যেমন রয়েছে, একটি উষ্ট্রকে দুটি গরুর সমান মনে করা- যেমন দীয়তে করা হয়েছে- এর দরুন এই কিয়াসটি দুর্বল হয়ে যায়।
এ গ্রন্থকারের ধারণা, যাকাতের নিসাব ও তার পরিমাণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে রাসূলে করীম(স) ইচ্ছা করেই অনেক কথা অ-বলা রেখে গেছেন। তা অকাট্য ও সুনিশ্চিতভাবে নির্ধারণ করে যান নি। যেন মুসলিম রাষ্ট্র পরিচালকদের পক্ষে নীতি নির্ধারণে সহজতর হয়। তাঁরা যেন স্থান, সময় ও অবস্থার প্রেক্সিতে জনগণের জন্যে সুবিধাজনক কোন নীতি নির্ধারণ করবার সুযোগ পান।
কেননা রাষ্ট্রনায়কগণ অনেক সময় অনেক দেশে উষ্ট্রের তুলনায় গরুর মূল্য বেশী দেখতে পান। কল্যাণ ও বংশবৃদ্ধির দিক দিয়েও তা অধিক উত্তম বলে মনে হয়। এ যুগে বিশ্বের অনেক দেশেই এরকম গরু দেখা যায়। অতএব এখানে পাঁচটির দ্বারা নিসাবঠিক করা সম্ভব এবংতাতে একটি ছাগী, দশটিতে দুটি ছাগী এবং বিশটিতে চারটি ছাগী বাবদ ফরয ধরা যেতে পারে। তারপর হযরত মুআয বর্ণিত হাদীস অনুযায়ী কাজ করা যা। আর যেখানেই এ ধরনের গরুর মালিকানা থাকবে সেখানেই এ মত অগ্রাধিকার পাবে- যেতে পারে।
কিন্তু যেখানে গরুর মূল্য নিম্নতম হবে, কল্যাণের দিকদিয়ে সামান্য হবে, যেখানে পাঁচ বা দশটির মালিকানায় কেউ ধনী গণ্য হবে না, সেখানে ত্রিশটিতে নিসাব নির্ধারণ করাই যুক্তিসঙ্গত। ইমাম জুহ্রীর ত্রিশটির নিসাব নির্ধারণ সংক্রান্ত মতের তাৎপর্য এভাবেই বোঝা যায়। তা ছিল ইয়েমেনবাসীদের জন্যে হালকা পরিমাণ। জুহরীর কথা যদি সহীহ হয় তবু তা প্রচলিত অর্থে নাকেছকারী হয়নি। নবী করীম(স) তা করেছেন মুসলিম জনগণের নেতা ও রাষ্ট্রপ্রতি হিসেবে। তিনি তো পরিবর্তনশীল যুগ, অবস্থার সাথে সংগতি বিধানস্বরূপ এ নীতি গ্রহণ করেছিলেন। আর কালের ও অবস্থার পরিবর্তনে আইনের পরিবর্তন হয়ে যায়, এটা সর্বাবাদীসম্মত। নবী করীম(স) মুসলিম নেতা হিসেবে যা বলেছেন বা করেছেন, তা নবী হিসেবে কথা বা কাজ থেকে ভিন্নতর। এ দু’য়ের মাঝে বিরাট পার্থক্য রয়েছে।
চতুর্থ আলোচনা
ছাগলের যাকাত
ছাগলের যাকাত ফরয। সুন্নাত ও হাদীস থেকে প্রমাণিত। হাদীসের দলীলটি পূর্বোদ্ধৃত হযরত আবূ বকরের চিঠির উল্লিতি হয়েছে, ছাগলের যাকাত হচ্ছে, যখন তার সংখ্যা চল্লিশটি হবে, তখন তার যাকাত দিতে হবে একটি ছাগী; একশ’ বিশটি পর্যন্ত তা চলবে। তার অধিক হলে দুইশ’ টি পর্যন্ত দুটি ছাগী দিতে হবে। তার উপর থেকে তিনশ’টি পর্যন্ত তিনটি ছাগীদিতে হবে। তিনশ’টির ঊর্ধ্বে হলে প্রতি একশ’তে একটি ছাগী। আর চল্লিশটির একটি কম হলেও যাকাত দিতে হবেনা। তবে মালিক ইচ্ছা করে দিলে অন্য কথা। ইবনে উমর বর্ণিত ও অন্যান্য বহু হাদীসেই এরূপ কথা রয়েছে।
ছাগলের যাকাত ফরয হওয়া সম্পর্কে ইজমা অনুষ্ঠিত হয়েছে। পূর্বোদ্ধৃত হাদীস অনুযায়ী যাকাত পরিাণের তালিকা নিম্নরূপ:
হইতে পর্যন্ত ফরযের পরিমাণ
১ ৩৯ কিছুই নয়
৪০ ১২০ একটি ছাগী
১২১ ২০০ দুটি ছাগী
২০১ ৩৯৯ তিনটি ছাগী
৪০০ ৪৯৯ চারটি ছাগী
৫০০ ৫৯৯ পাঁচটি ছাগী
অতঃপর প্রতি একশ’টিতে একটি ছাগী।
যাকাত বাবদ যে ছাগলের গ্রহণ করা হবে তা স্ত্রী হবে, না পুরু? কি তার বয়স হওয়া উচিত? ভালমন্দের দিকতিয়ে তার গুণাগুণ কি রকম হবে?
এই পর্যায়ে গবাদিপশুর যাকাত সংক্রান্ত আলোচনা আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব।
বহু সংখ্যক ছাগলেরযাকাত ফরয হয় কেন
লক্ষ্য করা যায়, যাকাতের ফরয হওয়া ছাগল সংখ্যা অনেক বেশী। তাতে মালিকের অনেক সহজতর বিধান করা হয়েছে। কিন্তু অন্য কোন ক্ষেত্রে এরূপ সহজতা লক্ষ্য করা যায় না। দেখা যায় একশ’তে একটি ফরয করা হয়েছে। যদিও মূলদনের প্রচলিত যাকাত হার হচ্ছে একশ’তে ২.৫ অর্থাৎদশ-এর চারভাগের একভাগ। এর কারণ বা যৌক্তিকতা কি?
এ পর্যায়ের আলোচনাকারীদের মধ্যে কেউ কেউ এ সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেছেন যে, এরূপ নীতি নির্ধারণ করে ইসলামী শরীয়াত জৈব-সম্পদ বৃদ্ধির জন্যে উৎসাহ প্রদান করতে চেয়েছে। এ কারণে যাকাতের পরিমাণ খুবই হালকা রাখা হয়েছে। আর তাতে চক্রবৃদ্ধি হারে করও ধার্যা করা হয়েছে, যেন এই গুরুত্বপূর্ন অর্থনৈতিক লক্ষ্য বাস্তাবয়িত হয়।
কিন্তু এ ব্যাখ্যার প্রতিবাদ করা হয়েছে এই বলে যে, এরূপ দৃষ্টিভঙ্গী কোন প্রকারের পশু সম্পদে গৃহীত হয়নি। আমরা দেখতে পাচ্ছি, উষ্ট্র বেশী সংক্যক হলে প্রতি চল্লিশটিতে একটি কর তৃতীয় বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক দিতে হয়। অপরদিকে প্রতি ত্রিশটি গরুতে একটি এক বছর বয়সের বাছুর, আর প্রতি চল্লিশটি গরুতে একটি করে দুই বছরের বাছুর দিতে হয়- স্ত্রীকি পুরুষ অর্থাৎ দশের এক-চতুর্থাংশ, একশটিতে ২.৫ প্রায়। আর মূলদনের যাকাতের সাধারণ হারও হচ্ছে তাই্
এই কারণ ও যুক্তি প্রদর্শন সহীহ্ হয়ে থাকে, তাহলে উষ্ট্র ও গরুতেও তা অবশ্য প্রকাশিতহবে। কিন্তু তা যখন হয়নি, তখন ছাগলের যাকাত সংক্রান্ত অপর একটি ব্যাখ্যা নিয়ে আলোচনা আবশ্যক।
আমার দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা হচ্ছে, ছাগল বিপুল সংখ্যক হলে তাতে বহু সংখ্যক ছোট বয়সেরও থাকে। কেননা তা বছরে বহুবার জন্ম নেয়, একবার একাধিক সংখ্যায় জন্মায়। এগুলোও মালিকের সম্পদরূপে গণ্য হয়, কিন্তু তা তাদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হয় না। পঞ্চম ও ষষ্ঠ আলোচনায়এ পর্যায়ে বিস্তারিত কথা বলা হবে।
ছাগলের ব্যাপারে এই কারণেই এই হালকা ব্যবস্থা অর্থাৎ যাকাতের চাপ খুবইকম রাখা হয়েছে। সুবিচার ও ন্যায় পরায়ণতার প্রতিষ্ঠাই এ ক্ষেত্রে শরীয়াতের লক্ষ্য- অন্যথায় প্রতি চল্লিশটিতে একটি করে যাকাত ফরয হলে- যেমন গু ও উষ্ট্রে রয়েছে- বহু সংখ্যক ছোট বয়সের ছাগল থাকা সত্ত্বেও তা গ্রহণ নাহলে- ছাগলের মালিকদের প্রতি খুবই অবিচার করা হয়। গরু ও উষ্ট্র মালিকদের তুলনায় তা হত অধিক।
প্রথম চল্লিশটিতে একটি ছাগী ফরয করা হয়েছে এ শর্তে যে, সেইসবগুলো বেশী বয়সের হবে।
এ প্রেক্ষিতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, যাকাত একটি প্রমাণিক আপেক্ষিক কর। তার হার না বৃদ্ধি পায়, না হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। মালিকী মনীষী শায়খ জওরাক্ বলেছেন: ধন-সম্পদ অধিক হলে তাৎসংক্রান্ত দায়-দায়িত্বও বেশী হয়ে থাকে; মনের উপরও একটা ভীতি ভয়ংকর হয়ে চাপে। এই কারণে যাকাত কমহয়। এটা মালিকের প্রতি একটা অনুকম্পা। এ কারণে নগদ অর্থ সম্পদের দশ ভগের- এক চতুর্থাংশ দেয়া হয়।
কিন্তু শায়খ মালেকীর এই কারণ দর্শানোর তাৎপর্য আমি বুঝে উঠতে পারিনি। সাধারণ ধারণা এই যে, ধন-সম্পদ বেশী হলে ভাবনা-চিন্তা কমহয়, ব্যয়ভার হালকা হয়। এ কারণে বিভিন্ন প্রকারের গবাদিপশুর মালিকরা সব মিলিয়েই রাখেও হিসাব করে থাকে। তাদের খরচাদি কম পড়ে। সেজন্য একই রাখাল ও তার এক থাকার স্থান যথেষ্ট হয়ে থাকে। বর্তমানে অর্থনীতির ক্ষেত্রেএ একটা সনির্দিষ্ট ব্যাপার। এ একটা বিশেষ উৎপাদন পন্থাও বটে। উৎপাদন ব্যবস্থায় যতটা প্রশস্তাতা আসবে প্রতিষ্ঠানগত কষ্ট ও ব্যয় ততই কম হবে। এ কারণে ছোটখাটো উৎপাদকরা বড় বড় উদপাদকদের সাধারণ ভয় করে থাকে। ক্ষুদ্রায়তন প্রতিষ্ঠান বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে একটা ভীতি সব সময়ই বোধ করে; কেননা তাদে উৎপাদন ব্যয় খুবই কম হয়ে থাকে।
বস্তুত উপরে যে কারণ দর্শানো হয়েছে, তা যদি সঠিক হয় তাহলে তা সর্বপ্রকারের ও সর্ব সংখ্যক গবাদিপশুর ক্ষেত্র সটিক বাঞ্ছনীয়। কিন্তু তা হয়নি।
বিপুল ধন-মালের ভয় মনে জাগ্রত হওয়ার ব্যাপাটি অনুরূপ। যা সে ধন-মালের মালিকের প্রতি সহানুভূতির উদ্রেক করে বলে বলা হয়েছে, তাও গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা তা যদি সহীহ্ হত, তা হলে তা সকল প্রকার গবাদি পশু ও সাধারণ ধন-মাল সম্পর্কেই দেখা যেত। কেননা মিলিয়ন পরিমাণ ধন-মালের মালিক নিশ্চয় হাজার পরিমাণ ধন-মালের মালিকের সমান নয়। তাই তার ক্ষেত্রে ফরয ধার্যকরণে অধিক হালকা নীতি গৃহীত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
আসলে আমরা উপরে যে কারণের কথা বলেছি, হা- হচ্ছে সবদিক দিক দিয়ে উত্তম।
পঞ্চম আলোচনা
ছোট গবাদিপশুর কি যাকাত দিতে হবে
ছোট উষ্ট্র, ছোট গরু ও ছোট ছাগলের কি যাকাত দিতে হবে? মুসনাদে আহমদ, আবূ দাউদ ও নাসায়ী গ্রন্থে উদ্ধৃতহয়েছে, সুয়াইদ ইবনে গাফলাতা বলেন, রাসূল (স)-এর পক্ষথেকে যাকাত আদায়কারী এলে আমরা তার পার্শ্বে বসলাম। তখন তাকে বলতে শুনেছি, ‘দুগ্ধপোষ্য শাবকের যাকাত গ্রহণ না করাই আমার দায়িত্ব।’
এ উক্তি থেকে প্রমাণিত হয় যে, ছোট বয়সের পশুর শাবকের যাকাত গ্রহণ করা হবে না। বেশ কয়জন ইমাম এই মতই পোষণ করেন। কিন্তু আসলে উপরিউক্তি হাদীসটির সনদ সম্পর্কে বিভিন্ন কথা রয়েছে।
হযরত উমরতাঁর নিয়োজিত যাকাত আদায়কারী সুফিয়ান ইবনে আবদুল্লাহ্ সাকাফীকে বলেছেন: ‘রাখালেরা যেসব পশু শাবক হাতে ধরে লালন করে, তাও গণনা কর।’ শাফেয়ী এবং আবূ উবাইদও এই বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন।
এই উক্তিটি পূর্বোদ্ধৃত হাদীসের বিপরীত কথা প্রমাণ করে অর্থাৎ ছোট বয়সের পশুরও নিসাব গণনা করতে হবে এবংতা থেকে যাকাত নিতে হবে।’ বেশ কয়েকজন ফকীহও এই মত পোষণ করেন। অন্যান্যরা হযরত উমর ও সুয়াইদ বর্ণিত হাদীসকে ভিত্তিরূপে গ্রহণ করেচেন এবং কেবলমাত্র ছোট বয়সের পশুর শাবক হলে তার যাকাত গ্রহণ করার মত দিয়েছেন। তবে সেগুলোর সাথে মায়েরা থাকলে সেসবকেও গণনা করার কথা বলেছেন।
কেউ কেউ শর্তারোপ করছেন যে, মায়েদের সংখ্যা নিসাব পরিমাণ হতে হবে। নিসাবের অতিরিক্ত বাচ্চাদের গণনা করাহবে। তাদের সম্পূর্ণরূপে হিসাব থেকে বাদ দেয়া চলবে না। ইবনে হাজম প্রমুখ এই মত দিয়েছেন। ইমাম আবূ হানীফা ও শাফেয়ীও এই মতই সমর্থন করেচেন।সকল মতের মধ্যে এই মতটি আমারকাছে অগ্রাধিকার পাওয়ার অধিকারী। যথার্থতা ও সুবিচারের দৃষ্টিতেও তা গ্রহণীয়।
কেননা অল্প মালের মালিকদের নিষ্কৃতি দেয়ার ক্ষেত্রে শরীয়াতের যে যুক্তিপূর্ণ নীতি, তা প্রযোজ্য হবে যাকাত পরিমাণে কম হলে। তাই পাঁচটি উটের বাচ্চা বা চল্লিশটি ছাগল ছানা হলে তা থেকে যাকাত গ্রহণ করা হবে না। কেননা এই মালের মালিক কখনই ধনী গণ্য হতে পারে না। এমতাবস্থায় তার উপর যাকাত ধার্য হলে তার প্রতি জুলুম করা হবে। অতএব যাকাত পরিমাণের অতিরিক্ত হলে তাতে ছোটগুলোকেও গণ্য করা হবে ও তা থেকে যাকাত গ্রহণ করা হবে। কেননা শরীয়াত পশুর মালিকেরযাকাত দানের বোঝা অনেকটা হালকা করে দিয়েছে এবং তাদের খুব বেশী সুবিধা দান করেছে। এই কারণে নিসাব অধিক হলে সেই অধিকারের হিসাব যাকাত ধার্য করেনি; বরং দুই নিসাব পরিমাণের মধ্যবতী সংখ্যার উপর যাকাত ধার্যকরণ রহিত করেছে।যেমন পাঁচটি উট হলে একটি ছাগল দেয়া ফরয, নয়টা হলেও একটি। প৭চিশটি হলে দুই বছরের উপনীতা একটি উষ্ট্রী শাবক- পঁয়ত্রিশটি পর্যন্ত তাই চলবে। ছত্রিশটি হতে পঁতাল্লিশটি পর্যন্ত তৃতীয় বর্ষে উপনীতা উষ্ট্রী শাবক দিতেহবে। এ ভাবে দুই ফরয পরিমাণের মাঝখানের সংখ্যার উপর কোন যাকাত দিতে হবে না।
এই ক্ষমার তত্ত্ব হচ্ছে- যা আমার মনে আসে- বিপুল সংখ্যক ছোট ছোট বয়সের পশু থাকে বলেই এরূপ করা হয়েছে।
ছাগলের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটি অধিকতর স্পষ্ট। কেননা ছাগল বছরে বহু সংখ্যক বাচ্চা দান করে থাকে। এই কারণে তাতে যাকাত মাফের ব্যাপারটিও বহু ব্যাপক। প্রথম চল্লিশটিতে একটি- একশ’ বিশটি পর্যন্ত, তার অধিকহলে দুইটি ছাগল। আর তিন শতাধিক হলে প্রতি একশ’টিতে একটি দিতে হয়।
ষষ্ঠ আলোচনা
গবাদিপশুর যাকাত বাবদ কি গ্রহণ করা হবে
গবাদিপশুর মালিক যাকাত বাবদ যা দেবে এবং যাকাত আদায়কারী যা গ্রহণ করবে, তাতে নিম্নোকত দিকগুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখা আবশ্যক।
১. তা দোষত্রুটি মুক্ত হবে। কোনটি যেন রোগাক্রান্ত বা অঙ্গহীন না হয়। দাঁতপড়া বৃদ্ধও যেন না হয়। এমন না হয় যে, তার দ্বারা কোন ফায়দাই হয় না, কোন কাজেই লাগে না, কোন দামেই বিক্রয় করা যায় না।
তার দলীল হচ্ছে আল্লাহ্র নির্দেশ:
(আরবী**********)
তোমরা খারাপ জিনিসের উপর লক্ষ্য আরোপ করো না এ উদ্দেশ্যে যে, তোমরা তা আল্লাহ্র জন্যে ব্যয় করবে।
নবী করীম (স) ইরশাদকরেছেন:
যাকাত বাবদ দাঁতপড়া বৃদ্ধ, কানা-খোড়া বা ফুরিয়ে যাওয়া জন্তু দেবে না- যাকাত গ্রহণকারীতা নিতে রাযী হলে ভিন্ন কথা।
কেননা এ ধরনের ত্রুটিযুক্ত জন্তু গ্রহণ করা হলে তাতে দরিদ্র লোকদেরই ক্ষতি। এ জন্যে যে, তা তো তাদেরই প্রাপ্য, অতএব তা যাকাত বাবদ জায়েয নয়।
আর ত্রুটিযুক্ত বলতে বোঝায়, যা ক্রয়-বিক্রয়ে অচল। যার কুরবানীও চলে না।
কেবলমাত্র তখনই ত্রুটিযুক্ত গ্রহণ করা চলবে, যদি যাকাত দেয়ার সমস্ত মালই তেমন হয়, তখন আদায়কারী তা থেকেইগ্রহণ করবে।
২. স্ত্রী পশু হওয়া দরকার। এজন্যেই দুই বছরে উপনীতা, তিন বছরে উপনীতা বা চার বছরে উপনীতা উষ্ট্রী শাবকের কথা বলা হয়েছে। তবে কোথাও হাদীসে যদি পুরুষ পশুর কথা বলা হয়ে থাকে, তাহলে তা গ্রহণ করা চলবে। হানাফী মতে মূল্য ধারনের দিক দিয়ে পুরুষ পশুও গ্রহণ করা চলে। কেননাএ মতে যাকাত বাবদ দেয় জন্তুর মূল্যও আদায় করা যায়। গরুর যাকাত বাবদ প্রতি ত্রিশটিতে একটি ‘তবী’ বা তবীয়া (প্রথম বছরের বাছুর) গ্রহণের দলীল রয়েছে। এ পর্যায়ে কোন বিরোধ দেখা দেয়নি। পুরুষ পশুর গ্রহণের ক্ষেত্রে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে বটে। জমহুর ফিকাহ্বিদগণ বলেছেন, তা জায়েয নয়। হানাফী মতের ফিকাহ্বিদগণ জায়েয বলেছেন। কেননা তাঁদের মতে পুরুষও স্ত্রী পশুর মধ্যে মৌলিক কোন পার্থক্য নেই। তাঁদের দলীল হচ্ছে ইবনে আব্বাস বর্ণিত হাদীস: প্রতি ত্রিশটিতে একটি ‘তবী’ (এক বছরে বাছুর), প্রতি চল্লিশটিতে একটি দুই বছরের বাছুর- স্ত্রী বা পুরুষ। হানাফী মতে উভয়ই গ্রহণ করা চলে। কেননা এ দুইয়ের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। শরীয়াতের বিধানদাতাএকটি ছাগল দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আর তার অর্থ কেবল স্ত্রী ছাগল নয়, পুরুষ ছাগল মালিকী মাযহাবে ছাগলের দুই বছর বয়সের ছাগল ছানা (***) কিংবা স্ত্রী-ছানা (****) দিতে হবে। আর হাম্বলী মতে নিসাবের স্ত্রী পশু থাকলে পুরুষ গ্রহণ করা জায়েয নয়।– যেমন উটের ক্ষেত্রে শরীয়াত নির্ধারণ করে দিয়েছে। ইমাম মলিক ও শাফেয়ী বলেছৈন: ‘যাকাত আদায়কারী যদি মনে করে যে, পুরুষ পশু গ্রহণ করা অধিক লাভজনক, তাহলে তার পক্ষে তা গ্রহণ করা জায়েয। কেননা হাদীসে তাকে এ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে।
ইমাম নববী বলেছেন, পুরুষ পশু যাকাত বাবদ দেয়ার দুটি দিক। সর্বাধিক সহীহ দিক হল তা জায়েয। ইমাম শাফেয়ী ও তাঁর সঙ্গিগণ এ মত প্রকাশ করেচেন। কুরবানীতে যেমন পুরুষ পশু যবেহ করা যায়েয, ঠিক তেমনি। তার দ্বিতীয দিক হল, তা জায়েয নয়।
গরু ও ছাগলের ক্ষেত্রে হানাফী মতে পুরুষও স্ত্রী পশুর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। যদিও উষ্ট্রের ক্ষেত্রে তা রয়েছে। হাদীসে উষ্ট্র গ্রহণের কথা সুনির্দিষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে গরীব ও যাকাত গ্রহণকারীদের পক্ষে কোন ক্ষতির কারণ হয় না, কোন দলীলের বিরোধীতা করতে হয় না।
আমরা যা বললাম, তা ছাগলের ও পঁচিশটির কম সংখ্যক উস্ট্রের ক্ষেত্রে যে ছাগল যাকাত বাবদ দেয়া ফরয, সেই ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
৩. বয়সের ব্যাপারে কথা হল হাদীসে সুনির্দিষ্ট বয়সের কথা বলে দেয়া হয়েছে, তাই এ তাকীদ অবশ্যই মানতে হবে। কেননা তার কম বয়সের জন্তু গ্রহণকরা হলে তাতে গরীবদেরই হক নষ্ট ও ক্ষতির কারণ ঘটে। আর তার অধিক বয়সের গ্রহণ করা হলে পশুর মালিকদেরই হক নষ্ট ও ক্ষতির কারণ ঘটে। আর তার অধিক বয়সের গ্রহণ করা হলে পশুর মালিকদের ক্ষতি সাধন করা হয়। সব মাযহাবেই এ কথা সমর্থিত।
ছাগলের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মত রয়েছে। ইমাম মালিক বলেছেন: ছাগী ছানা দুই বছরের ও তিন বছরে উপনীতা হলে চলবে। কেননা হাদীসে বলা হয়েছে: দুই বছর বয়সে বাচ্চাতেই আমাদের অধিকার। আর তা এ জন্যে যে, তা একই জাতির দুই প্রজাতির মাত্র। কাজেই যা এক ক্ষেত্রে যথেষ্ট তা অন্য ক্ষেত্রেও যথেষ্ট হবে।
ইমাম শাফেয়ী ও আহমদ বলেছেন পুরুষ ও স্ত্রী পশু শাবক থেকেই দুই বছর বয়সের শাবক গ্রহণ করা হবে। কিন্তু শাফেয়ী মাযহাবের লোকেরা এ দুটির বয়স নির্ধারণের বিভিন্ন কথা বলেছেন। তাঁদের কেউ কেউ হাম্বলী মত অনুযায়ী এক বছরের বাচ্চাকেসনী (***) বলেছৈন আর ছয় মাসের বাচ্চাকে ময়য (****) বলেছেন। কেউ কেউ বলেছেন (****) ‘জযয়া’ বলতে বোঝায় সেই শাবক, যার বয়সএক বছর পূর্ণ হওয়ার পর দ্বিতীয বর্ষে পদার্পণ করেছে। আর যে শাবক দুই বছরে পূর্ণ করে তৃতীয বর্ষে উপনীত হয়েছে, তা হল (*****) ইমাম নববীর উক্তি মতে অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে এ কথাটি অধিক সহীহ।
ইবনে কুদামাহ্ হাম্বলী মতের সমর্থনে দুটি কথা বলেছেন:
(ক) সুয়াইদ ইবনে গাফলাতা বর্ণিত হাদীস হল প্রথশ কথা:
আমাদের কাছে রাসূলের পক্ষতেকে যাকাত আদায়কারী এসে বললো- আমাদেরকে গরুর যাকাত বাবদ দুই বছরের বাছুর এবং ছাগলের তৃতীয বর্ষের ছানা গ্রহণ করতে আদেশ করেছেন। এ এক স্পষ্ট কথা।
(খ) দুই বছরের বাছুর কুরবানী দেয়া চলে; কিন্তু দুই বছরের ছাগল নয়। কেননা নবী করীম(স) আবূ বুরদা ইবনে দীনারকে বলেছিলেন: ‘দুই বছরের ছাগল তোমার জন্যে কুরবানী করা জায়েয হবে। তোমার পর অন্য কারোর জন্যে তা জায়েয হবে না।’
ইবরাহীম হর্বী বলেছেন, দুই বছরের গরু কুরবানী জায়েয এ জন্যে যে, তা এ বয়সে যৌনক্রিয়া করতে সক্ষম; কিন্তু ছাগল তৃতীয় বর্ষের না হওয়া পর্যন্ত তা হয় না।
ইমাম আবূ ইউসুফ ও মুহাম্মাদ এ মত প্রকাশ করেছেন। ইমাম আবূ হানীফার একটি কথা এই যে, তৃতীয় বর্ষের না হওয়া পর্যন্ত তা যাকাত বাবদ দেয়া জায়েয নয়। দুই বছরের হলে তার মূল্য যাকাত বাবদ দিয়ে দেয়া যেতে পারে।
এখানে একটি কথা থেকে যায়। তাহল, উষ্ট্রের প্রয়োজনীয় বয়স না হলে কি করা হবে, সে বিষয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। ইবনে রুশ্দের মতে মালিককে সেই বয়সের জন্তু কিনে দিতে বাধ্য হবে। অনেকের মত তার কাছে যে বয়সের জনতু আছে, তাই দেবে এবং সেইসঙ্গে বিশ দিরহাম অতিরিক্ত দেবে- যদি কম বয়সেরজন্তু হয়ে থাকে অথবা অতিরিক্ত দুটি ছাগী দেবে। আর বেশী বয়সের জন্তু হলে যাকাত আদায়কারী সেটি নিয়ে বিশ দিরহাম বা দুটি ছাগী তাকে ফেরত দেবে। ইবনে রুশ্দ বলেছৈন, যাকাতের অধ্যায়ে এ কথাটি স্বপ্রমাণিত। অতএব এ নিয়ে বিতর্কের প্রয়োজন হয় না। সম্ভবত ইমাম মালিক এ হাদীসটি পান নি বলে তাঁর মত এর বিপরীত হয়েছে। অথচ ইমাম শাফেয়ী ও আবূ সওর উক্ত হাদীসের ভিত্তিতেই মত গঠন করেছেন। -ইমাম আবূ হানীফা বলেছেন, তার মূল্য দেয়া কর্তব্য।
অন্যান্য লোকেরা বলেছেন, বরং তার কাছে যে বয়সের জন্তু আছে, সে তা-ই দেবে অথবা দুয়ের মধ্যবর্তী মূল্য।
আমার মতে ইমাম আবূ হানীফা মূল্য দেয়ার মত দিয়ে হাদীস লংঘন করেন নি। কেননা নবী করীম(স) উষ্ট্রের ক্ষেত্রে বয়সে তারতম্যকে দুটি ছাগী বা বিশটি দিরহাম দ্বারা পরিমাপ করেছেন এ হিসেবে যে, তিনি চিলেন মুসলিম জাতির নেতা ও রাষ্ট্রপ্রধান। আর এ ধরনের ব্যবস্থাপনা কখনই চিরস্থায়ী বা সর্বকালের জন্যে হয় না। বরং তা পরিবর্তিত হয়। এ কারণে হযরত আলী থেকে দুটি ছাগী বা বিশটি দিরহাম দ্বারা এ তারতম্য পরিমাপ করার কথা যথার্থভাবেই বর্ণিত হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায় যে, তাঁর আমলে ছাগল খুব সস্তা ছিল। আর নবী করীম(স) কর্তৃক নবী হিসেবে চালু করা কোন নিয়মের বিরোধিতা তিনি করেছেন বলে ধারণাও করা যায় না, তার কারণও কিছুনেই।
এ তত্ত্বটি অনুধাবন করা হলে অনেক জটিল বিষয়েরই সহজ মীমাংসা হয়ে যেতে পারে।
৪. আর একটি শর্ত হল, যাকাতের জন্তু মধ্যম মানের হওয়া উচিত। অতএব অতীব উত্তম জন্তু বাছাই করে নেয়া যাকাত আদায়কারীর পক্ষে যেমন জায়েয নয়, তেমনি জায়েয নয় নিতান্ত রদ্দী মাল গ্রহণ করা। তবে মালিক রাযী হলে মূল্য নির্ধারণ করে নেয়া যেতে পারে। নবী করীম(স) হযরত মুআযকে বলেছিলেন, ‘তুমি অবশ্য উত্তম মাল থেকে বিরত থাকবে। আর অত্যাচারিদের ফরিয়াদ সব সময় ভয় করবে। কেননা তার ও আল্লাহ্র মধ্যে কোন অন্তরায় নেই।’
ইবনে আবূ শায়বা বর্ণনা করেছেন, নবী করীম (স) যাকাত বাবদ আদায়কৃত উষ্ট্রের মধ্যে একটি খুবই উত্তম ও সুন্দর উষ্ট্র দেখতে পেলেন। তখন তিনি যাকাত আদায়কারীর প্রতি খুবই ক্রোধ প্রকাশ করলেন। বললেন, ‘এটা কি?’ সে বলল, ‘আমি উষ্ট্র পালের মধ্য থেকে দুটি উষ্ট্রের বদলে এটা গ্রহণ করেছি।’ বললেন, ‘তা হলে দোষ নেই।’
আর যেহেতু যাকাতের ভিত্তি হচ্ছে দাতা গ্রহীতা উভয় পক্ষের সম্মতির উপর। আর সে কারণেই মধ্যম মানের মাল গ্রহণের তাকীদ। কেননা অতীব উত্তম জন্তু গ্রহণের মালের মালিকের ক্ষতি, আর নিকৃষ্টতম মালে গরীব লোকদের অধিকার হরণ। মধ্যম মানের মালে উভয় পক্ষের সম্মতি ও স্বার্থের সংরক্ষণ নিহিত।
নবী করীম (স) থেকে আবূ দাউদ উদ্ধৃত হয়েছে, তিনি বলেছেন “তিনটি কাজ যে করল, সে ঈমানের স্বাদ অস্বাদন করল। প্রথম যে কেবলমাত্র এক আল্লাহর বন্দেগী করল- কেননা সেই এক আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ মাবুদ নেই। দ্বিতীয়, যে মালের যাকাত দিল মনের সন্তুষ্টি সহকারে প্রতি বছর নিয়মিত ও সুনির্দিষ্টভাবে- বেছে বেছে বুড়ো খুনখুনে জন্তুও দিল না, ময়লা আবর্জনা রোগীও দিল না, ছোট ছোট ও খারাপ খারাপ মালও দিল না, দিলমধ্যম মানের মাল। কেননা আল্লাহ্ তোমাদের সর্বোত্তম মালও চান না, আর নিকৃষ্ট মাল দিতেও বলেন না।”
যাকাত বাবদ গাভীন বা বাছুরকে দুধ খাওয়ায় এমন জন্তুও গ্রহণ করা চলবে না। যেসব জন্তু খেয়ে দেয়ে মোটা হওয়ার জন্যে আলাদা করে রাখা হয়েছে বা যা না-খেয়ে মরণাপন্ন হয়েছে এবং খাসি- পুরুষ ছাগল তাও গ্রহণ করা হবে না।
হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন: হযরত উমর (রা) যাকাত বাবদ আদায় করা ছাগলের মধ্যে বড় পালান ও দুগ্ধ ভারাক্রান্ত ছাগী দেখতে পেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ ছাগীটি কি রকম?’ লোকেরা বলল, ‘এটি যাকাত বাবদ আদায় করা ছাগী।’ তখন তিনি বললেন, ‘এর মালিক নিশ্চয়ই ইচ্ছা করে এ ছাগীটি দেয়নি, জবরদস্তি করে আনা হয়েছে। তোমরা মানুষকে বিপদে ফেলো না, আর মুসলমানদের বাছাই করা উত্তম মালসমূহওগ্রহণ করবে না।’
মধ্যম মানের মাল লওয়ার যৌক্তিকতা এ থেকেও প্রমাণিত হয়। ছোট বয়সের বাচ্চা মালিকদের কাছে ফেরত দেয়া হবে যদি সেগুলোর মায়েদের সংখ্যা নিসাব পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সেগুলো গ্রহণ করা হবে না, যেমন করে সর্বোত্তম ও বাছাই করা –পছন্দ করা মালসমূহ গ্রহণ করা হবে না। কেননা বিশেষ মর্যাদার কারণে সেগুলোর উপর লোকদের লোভহয় থাকে বলে এ নিষেধাজ্ঞা।
এ কারণে হযরত উমর যখন সুফিয়ান ইবনে আবদুল্লাহ্ সাকাফীকে যাকাত আদায়কারী নিয়োগ করে পাঠালেন, তখন তিনি আদায়কৃত ছোট বয়সের জন্তুগুলো লোকদের কাছে ফেরত দিচ্ছিলেন। লোকেরা বললো, ‘ছোটগুলো ফেরত দিচ্ছেন, তা থেকে কিছুই গ্রহণ করছেন না কেন?’ সুফিয়ান হযরত উমরকেএ কথা জানালেন। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, ছোট বয়সের জন্তু ফেরতই দেয়া হবে। রাখাল যা পুষবে, তা গ্রহণ করবে না। অনুরূপভাবে খেয়ে মোটা হওয়ার জন্যে আলাদা করা, ছানাকে দুগ্ধ দানকারী গাভীন ও খাসিছাগল গ্রহণ করবে না। গ্রহণ করবে দুই বছর বয়সের ছাগী।’
আহমদ আবূ দাউদ ও নাসায়ীর বর্ণনায় উদ্ধৃতহয়েছে, রাসূলের দুইজন যাকাত আদায়কারী বলেছেন: ‘রাসূলে করীম (স) আমাদের গাভীন জন্তু নিতে নিষেধ করেছেন।’
সুয়াইদ বর্ননা করেছেন, রাসূল প্রেরিত জনৈক যাকাত আদায়কারীকে বলতে শুনেছি, ‘দুগ্ধদায়ী ছাগী গ্রহণ করতে রাসূলে করীম (স) আমাদের নিষেধ করেছেন।’
সপ্তম আলোচনা
যাকাতের জন্তুতে মিশ্রণের প্রভাব
গবাদিপশুর যাকাত পর্যায়ে নিসাব ও পরিসংখ্যান যা কিছু উপরে উল্লিখিত হয়েছে, তা স্পষ্ট এবং কার্যকর হবে যদি পশুর মালিক একজন হয় এবং সে নিসাব বাতার অধিক পরিমাণের মালিক হয়। কিন্তু সাধারণ লক্ষ্য করা যায়, পশুমালিকরা কেত্রিত হয়ে তাদের গরু, ছাগল ও উষ্ট্র ইত্যাদি গৃহপালিত পশুগুলোকে একত্রিত ও সংমিশ্রিত করে রাখে, তাতে ব্যয় ও শ্রম অনেকটা কম হয় বলে। এক্ষণে প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিচিত্র ধরনের পশুর মালিকদেরকে কি একক মালিক মনে করা হবে? অথবা প্রত্যেক জাতীয় পশুর মালিকানা ভিন্ন ভিন্ন ধরা হবে িএবং সেই অনুযায়ী তার কাছ থেকে যাকাত আদায় করা হবে? অন্যকথায়, এ সংমিশ্রণে যাকাতের নিসাব ও তার ফরয পরিমাণে কোন প্রভাব বা প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে কি?
এ প্রশ্নের জবাব আলোচনার পূর্বে একটি কথার ব্যাখ্যা হওয়া প্রয়োজন। যে সংমিশ্রণের কথা বলা হল, তা দু’প্রকারের। একটি হল শরীকানার সংমিশ্রণ আরঅপরটি প্রতিবেশীমূলক সংমিশ্রণ।
প্রথমটির তাৎপর্য হচ্ছে, বেশ কয়জন মালিক মিলিত হয়ে পশু পালন করবে এমনভাবে যে, তাদের প্রত্যেকের মালিকানা সম্পদ আলাদা করে গণনা করা যায় না। যেমন বহু সংখ্যক লোক উত্তরাধিকার সূত্রে পশুপালন পেয়েছে বা ক্রয় করেছে। এরা সকলেই তাতে সমানভাবে শরীক রয়েছে। তাদের কারোরই মালিকানার পশুকে আলাদা করে গণনা করা সম্ভব হয় না।
আর দ্বিতীয় প্রকারের তাৎপর্য হল, মালিকদের সকলেরই এবং প্রত্যেকেরই মালিকানা সম্পদ স্বতন্ত্র ও ভিন্ন ভিন্ন, অপর থেকে সুনির্দিষ্ট, কারোর ত্রিশটি বা ষাটটি ছাগল চিহ্নিত ও স্বতন্ত্রভাবে রক্ষিত। কারোর অনুরূপ সংখ্যক কিংবা তার বেশী বা কম রয়েছে। কিন্তু তা সুস্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট ও চিহ্নিত। অথচ এ সব মালিক পরস্পরের প্রতিবেশী, আর পশুগুলো সংমিশ্রিত- যেন তা একজনের মালিকানাভুক্ত।
এখন প্রশ্ন হল প্রত্যেক সংমিশ্রণকারীর যাকাত পরিমাণ নির্ধারণে কি স্বাতন্ত্র্য স্বীকৃত হবে? কিংবা শরীকানা মিশ্রিত বলে ধরা হবে, যা প্রতিবেশী-সূলভ সংমিশ্রণ নয়?
ইবনে রুশ্দ এ পর্যায়ে ফিকাহ্বিদদের মতামত খুবই উত্তমরূপে ওসংক্ষেপে উল্লেখ করেছেন এবং তাদের প্রত্যেকের দলীলও উল্লেখ করেছেন। বলেছেন:
অধিকাংশ ফিকাহ্বিদই যাকাতের ফরয পরিমাণ নির্ধারণে এ সংমিশ্রণের প্রভাব কার্যকর হবে বলে মত প্রকাশ করেছেন। তবে তা নিসাবের পরিমাণে হবে কিনা, সে বিষয়ে তাঁদের বিভিন্ন মত রয়েছে। িইমাম আবূ হানীফঅ কিন্তু এ প্রভাবের কথা অস্বীকার করেছেন। না ফরয পরিমাণে, না নিসাব পরিমাণে তিনি তা স্বীকার করেন।
ইমাম মালিক, শাফেয়ী ও সমকালীন বহুসংখ্যক ফিকাহ্বিদ বলেছৈন, এ সংমিশ্রণকারীরা একজন মালিকের ন্যায় যাকাত দেবে। তবে দুটি ব্যাপারে এদের মধ্যেও মতবিরোধ রয়েছে।
একটি হচ্ছে শরীকদের নিসাবের ক্ষেত্রে। শরীকদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকুক আর না-ই থাকুক, তারা কি সকলে একজন মালিক গণ্য হবে? কিংবা তারা সকলে মিলে একজন মালিক হিসেবে যাকাত দিয়ে দেবে- তাদের প্রত্যেকের আলাদা নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা সত্ত্বেও?
দ্বিতীয়টি, যে সংমিশ্রণের প্রভাব যাকাতের নিসাব নির্ধারণে কি এ সংমিশ্রণে কোন প্রভাব আছে? ফরয পরিমাণে? কিংবা কোন প্রভাব নেই? আসলে এ মত-পার্থক্যের কারণ হচ্ছে যাকাত গ্রহণ পর্যায়ে প্রমাণিত হাদীসের তাৎপর্য অনুধাবনে নিহিত পার্থক্য। হাদীসটি হচ্ছে:
(আরবী***********)
বিচ্ছিন্ন জিনিসগুলো একত্রিত করা যাবেনা, একত্রিত জিনিসগুলো বিচ্ছিন্ন করা যাবে না যাকাত দেয়ার ভয়ে। আর যে দুটো সংমিম্রিত, তা সমানভাবে প্রত্যাবর্তিত হবে।
উভয় পক্ষই নিজ নিজ ধারণা অনুযায়ী হাদীসটির ব্যাখ্যা করেছেন। যাঁরা মনে করেছেন, নিসাব ও ফরয পরিমাণে অথবা শুধু ফরয পরিমাণে সংমিশ্রণের প্রভাব রয়েছে, তাঁরা বলেছেন, রাসূলের এ কথাটির স্পষ্টভাবে প্রমাণি করছে যে, দুটো সংমিশ্রিত সম্পদে মালিকানা এক ব্যক্তির মালিকানার মতই। ফলে রাসূলের কথা: ‘পাঁচটির কম সংখ্যক উষ্ট্রের যকাত নেই’-এর পরিসর সংকীর্ণ হয়ে গেছে। ইমাম মালিকের মতে যাকাত ফরয পরিমাণে এবং যাকাত ও নিসাব উভয় ক্ষেত্রেই- শাফেয়ী ও তাঁর সঙ্গীদের মতে।
কিন্তু যাঁরা সংমিশ্রণে বিশ্বাসী নন, তাঁরা বলেছেন, দুই শরীকদের দুই সংমিশ্রণকারী বলা হয়। উপরিউক্ত হাদীসের যাকাত সংগ্রহকারীদের নিষেধ করে দেয়া হয়েছে, এক ব্যক্তির মালিকানা যেন এমনভাবে বিভখ্ত করা না হয়, যার দরুন তার উপর যাকাতের অধিক বোঝা চেপে বসতে পারে। যেমন এক ব্যক্তির একশ’ বিশটি ছাগী রয়েছে। তাকেতিনি চল্লিশে বিভখ্ত করা অথবা একজনের মালিকানা অন্যজনের মালিকানারসাথে একত্রিত করে দেয়া, ফলে অধিক যাকাত ধার্য হতে পারে। কাজেই এই (কাজ জায়েয নয়)।
তাঁরা বলেছৈন, হাদীসটিতে যখন এর অবকাশ রয়েছে, তখন তার ভিত্তিতে প্রমাণিত মৌলনীতি যেন সংকুচিত করা না হয়। কেননা তা সর্বসম্মত। অর্থাৎ নিসাব ও ফরয পরিমাণ যাকাত একই ব্যক্তির মালিকানায় গণ্য হবে।
আর যারা সংমিশ্রণে বিশ্বাসী, তাঁরা বলেছেন, সংমিশ্রণ কথাটাই শরীকানায় অধিক সুস্পষ্ট। ব্যাপারটি যখন এই, তখন রাসূলের কথা ‘দুটি সমানভাবে প্রত্যাবর্তিত হবে- এ কথাই প্রমাণ করে যে, এ দুটোর উপর যে ফরয পরিমাণ ধার্য হবে, তা একই ব্যক্তির মত হবে। আর রাসূলের উক্ত কথাটি প্রমাণ করছে যে, দুই সংমিশ্রিত মালিকানা দুই শরীক নয়। কেননা দুই শরীকের মধ্যে পারস্পরিক প্রত্যাবর্তন ধারণা করা যায় না। কেননা যাকাত তো শরীকানার মাল থেকেই গ্রহীত হবে।
যে লোক এ তাৎপর্যাকে চূড়ান্ত নে করেছেন, তার উপর নিসাব ধারণা করেন নি। তিনি বলেছৈন, দুই সংমিশ্রিত মালিকানা এক ব্যক্তির যাকাতের মতই যাকাত দেবে- যদি তাদের দুজনেরই আলাদাভাবে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থেকে থাকে। আর যিনি নিসাবকে ফরয পরিমাণ সংক্রান্ত হুকুমের অধীন মনে করেছেন, তিনি বলেছেন, তাদের দুজনের নিসাবই একব্যক্তির নিসাব। যেমন তাদের দুজনের যাকাত এক ব্যক্তির যাকাতের মত।
এদের প্রত্যেকেই রাসূলে করীম(স)-এর উপরিউক্ত হাদীসটির তাৎপর্য নিজ নিজ নীতি অনুযায়ী গ্রহণ করেছেন। ইমাম মালিক বলেছেন, ‘সম্মিলিতকে ভিন্ন ভিন্ন গণ্য করবে না’। অর্থাৎ দুই সংমিশ্রিত মালিকানার অর্থ- দুজনের প্রত্যেকের জন্যে দু’শ দু’শ করে ছাগী হলে তাতে তিনটি ছাগী ধার্য হবে, আর তা ভিন্নকরে দিলে দু’জনের প্রত্যেকের জন্যে একটি ছাগী যাকাত বাবদ ধার্য হবে। তার মতের দৃষ্টিতে সংমিশ্রণকারীদের প্রতিই নিষেদ নিবদ্ধ হয়েছে- যাদের প্রত্যেকেরই নিসাব পরিমাণ সম্পদ রয়েছে।
ইমাম শাফেয়ী বলেছেন, ‘একত্রিতকে ভিন্ন ভিন্ন করা যাবে না’ অর্থ, দুজনের চল্লিশটি ছাগী রয়েছে। তাদের মালিকানা বিচ্ছিন্ন করা হলে তাদের কারোর উপরই যাকাত হবে না, যদি তার মতে সংমিশ্রণকারীদের নিসাব একক মালিকানার নিসাব অনুযায়ী হয়।
যাঁরা সংমিম্রণকে গুরুত্ব দেন, তাঁরা যাকাতে কোন্ ধরনের সংমিশ্রণ প্রভাব রাখে এ বিষয়ে বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। ইমাম শাফেয়ী বলেছৈন, সংমিশ্রণের জরুরী শর্ত হচ্ছে জন্তুগুলোকে একত্রিত ও সংমিশ্রিত করতে হবে। একজনের জন্যেই চলবে, একজনের জন্যেউ দুধ দেবে, একজনের জন্যেই বিহারে ছেড়ে দেয়া হবে, একসঙ্গে পানি পান করা হবে। দুজনের বলদগুলো সংমিশ্রিত হবে। তাঁর মতে সংমিশ্রিত ও শরীকানার মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। এ কারণে দুই শরীকের কারোরই মালিকানা পূর্ণ নিসাব সমান গণ্য করা হয় না।
ইমাম মালিকের পানি তোলার পাত্র, কূপ, চাকি, রাখাল ও বলদ- এই সবে শরীক দুই ব্যক্তির পরস্পর সংমিশ্রণকারী। এ সবেরকোন কোনটি বা সব কয়টির ব্যাপারে তাঁর সঙ্গিগণ ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেন। আর ‘সংমিম্রণ’ নামটির মধ্যে এই সব কয়টি তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। এ কারণে কেউ কেউ যাকাতের সংমিশ্রণের কোন প্রভাব আছে বলে মনে করেন না। ইবনে হাজমের মতও তা-ই।
যাঁরা মনে করেন সংমিশ্রণ যাকাতরে প্রতিবন্ধক, ইবনে হাজম তাঁদের মত ভিত্তিহীন প্রমাণিত করেছেন। কেননা তাতে হাদীস অনুযায়ী নিসাব পরিমাণের কম যাকাত না হওয়ার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা হয়। নির্দিষ্ট পরিমাণে যাকাত ধার্য হওয়া জরুরী হয়ে পড়ে। আর ‘সংমিশ্রণের প্রভাব রয়েছে এই মতেরও তা পরিপন্থী আর প্রত্যেক ব্যক্তিই তার নিজের ও তার ধন-মালের ব্যাপারে আল্লাহ্র কাছে দায়িত্বশীল, এই কথারও বিপরীত হয়ে যায়।
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন:
(আরবী*********)
প্রত্যেক ব্যক্তিই তার উপার্জনের জন্যে দায়ী, কোন বোঝা বহনকারীই অপরের বোঝা বহন করবে না।
সংমিশ্রণ যাকাতের প্রতিবন্ধক করে যাঁরা মনে করেন, তাঁরা একজনের অপরের অধিকারের উপর উপার্জনকারী করে দেন। একজনের মালের উপর অপর জনের মালের দায়িত্ব চাপিয়ে দেন। কিন্তু তা সত্য বিরোধী, কুরআন ও সুন্নাহ্র পরিপন্থী।
যাকাত নির্ধারণে সংমিশ্রণের প্রভাব রয়েছে বলে যাঁরা মত দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ইমাম শাফেয়ীর মত অধিক প্রশস্ত। তিনি মনে করেন যে, কেবল জন্তুর মালিকানার ক্ষেত্রেইসংমিশ্রণের প্রভাব রয়েছে। বরং কৃষি ফসল ও ফল-ফাঁকড়া এবং দিরহাম-দীনারের ক্ষেত্রেও তা সম্প্রসারিত।
অংশভিত্তিক শরীকানা কারবারের মসলা নির্ধারণে এ কথাটি ভিত্তিরূপে গণ্য হতে পারে। অভিন্ন ব্যক্তিত্বের যাকাত কার্যকরণ পর্যায়ে তার প্রয়েঅজন দেখা দিলে তা যাবে। কেননা তাতে কার্যকরণ সুপ্রশস্ত হবে, কার্য সম্পাদন সহজতর হবে এবং শ্রম ও ব্যয়ও অনেক কম হবে।
অষ্টম আলোচনা
ঘোড়ার যাকাত
যানবাহন, বোঝা বহন ও জিহাদের ব্যবহৃত ঘোড়ার যাকাত নেই
এ বিষয়ে সারা দুনিয়ার মুসলমান একমত যে, যেসব ঘোড়া সওয়ারী, ভার বহন বা আল্লাহর পথে জিহাদের কাজে ব্যবহৃত হয়, সে সব ঘোড়ার কোন যাকাত দিতে হবে না। তা ছেড়ে দিয়ে পালিত হোক, কি তাকে কাটা ঘাস খাইয়ে পোষা হোক, উভয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কেননা তা মালিকের প্রয়োজন পূরণে নিয়েঅজিত। আর যাকাত দিতে হয় বর্ধনশীল ও প্রয়োজনাতিরিক্ত ধন-মালে।
ব্যবসায়ের ঘোড়ার যাকাত দিতে হবে
অনুরূপভাবে যা ব্যবসায়েল জন্যে পোষা হয়, তার যাকাত দিতে হবে। এ ব্যাপারে জাহিরী মাযহাবের ফিকাহ্বিদ ছাড়া আর সকলেই সম্পূর্ণ একমত। কেননা ব্যবসায়েল জন্যে পালিত হওয়াটাই প্রমাণ করে যে, তা ক্রমবর্ধনশীল- ছেড়ে দিয়ে পোষা হোক, কি কাটা ঘাস খাইয়ে পোষা হোক। এরূপ অবস্থায় তা পণ্যদ্রব্য সমতুল্য, অন্যান্য পণ্যদ্রব্যের মতই তার হুকুম। যেসব জন্তু গাছপালা, প্রস্তুর আদি মুনাফা লাভের আশায় কেনা-বেচা হবে, তার সম্পর্কেও এই একই কথা।
ঘরে ঘাস খাওয়ানো ঘোড়ার যাকাত নেই
ফিকাহ্বিদগণ এ বিষয়েও একমত যে, যেসব ঘোড়াকে ঘরে রেখে সারাটি বছর কিংবা বছরের অধিকাংশ সময় ঘাস খাইয়ে পোষা হয়, তার যাকাত নেই। কেননা জমহুর ফিকাহ্বিদদের মতে যাকাত দিতে হবে শুধু সেসব ঘোড়ার, যা ছেড়ে দিয়ে ঘাস খাইয়ে পোষা হয়।
প্রবৃদ্ধি লাভ ও বংশ বৃদ্ধির জন্যে পোষা ঘোড়ার যাকাত দেয়া সম্পর্কে ফিকাহ্বিদদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। এর জন্যে প্রথম শর্ত হচ্ছে, তা সবই পুরুষ ঘোড়া হবে না। যদি তা হয়, তাহলে তাতে যাকাত হবে না। কেননা পুরুষ ঘোড়ার বাচ্চা হওয়ার প্রশ্ন থাকে না। তবে যদি স্ত্রী মিশ্রিত হয় অথবা শুধু স্ত্রী ঘোড়া হয় এবং চেড়ে দিয়ে পোষা হয়, তা হলে ইমাম আবূ হানীফার মতে তার যাকাত দিতে হবে। জমহুর ফিকাহ্বিদগণ অব্য ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মতে কিছুই ফরয হবে না।
ঘোড়ার যাকাত না হওয়ার দলীল
১. প্রথমত হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীস। নবী করীম (স) ইরশাদ করেছেন:
(আরবী******) মুসলমানের ক্রীতদাস ও ঘোড়ার কোন যাকাত নেই।
এ পর্যায়ে সব ঘোড়াই শামিল, তা ছেড়ে দিয়ে পোষা হোক বা অন্যথা হোক, পুরুষহোক কি স্ত্র; কিংবা মিশ্রিত হোক, কি অমিশ্রিত।
২. দ্বিতীয় হযরত আলী নবী করীম(স) থেকে বর্ণনা করেছেন:
(আরবী **********)
ঘোড়া ও ক্রীতদাসের যাকাত মাফ করে দিয়েছি। তবে নগদ টাকার যাকাত দিতে হবে প্রতি চল্লিশ দিরহামে এক দিরহাম- তাই নিয়ে এসে।
৩. তৃতীয়ত, ঘোড়ার যাকাত গ্রহণের ব্যাপারে কোন বাস্তব সুন্নাত বর্ণিত হয়নি। অথচ গবাদিপশুর যাকাত গ্রহণের সুন্নাত অকাট্যভাবে প্রমাণিত।
কুআন মালের যাকাত গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে:
(আরবী **********) তাদের ধন-মালের যাকাত গ্রহণ করে তাদের পবিত্র কর।
রাসূলে করীম (স)-ই এ আয়াতের সঠিক ব্যাখ্যাদাতা। তিনি তাঁর কাজ দ্বারা ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, ঘোড়া এই ধন-মালের মধ্যে গণ্য নয়।
৪. চতুর্থ দলীল হচ্ছে যুক্তি। বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, আল্লাহ্ তা’আলা যেসব গবাদিপশুর মুনাফার উপর যাকাত ফরয করেছেন, তা ঘোড়ায় নেই। তাই ঘোড়াকে অন্যান্য গবাদিপশুর মত মনে করা ঠিক হয়। শরীয়াতের বিধানদাতা ঘোড়া পোষার বিশেষ উদ্দেশ্যের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন, যা অন্যান্য গবাদিপশুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কেননা ঘোড়া যেজন্য পোষা হয়, উষ্ট্র সেজন্যে পোষা হয় না। উষ্ট্র পোষাহয় বংশ বৃদ্ধি, গোশ্ত খাওয়া, বোঝা বহন, ব্যবসা ও তার উপর সওয়ার হয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত প্রভৃতি উদ্দেশ্যে। কিন্তু ঘোড়া সৃষ্টিই করা হয়েছে দাপটে-প্রতাপ, দৌঢ়-ঝাঁপ, দ্বীন কায়েম ও দ্বীনের দুশমনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-জিহাদ ইত্যাদি কাজে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে। শরীয়াতের বিধানদাতার তার সংরক্ষণ ও প্রতিপালনে ভিন্নতর লক্ষ্য।এ কারণেতার যাকাত মাফ করে দেয়া হয়েছে, যেন সে দিকে মানুষের অধিক আগ্রহ জাগে এবং আল্লাহ্ ও রাসূল যে উদ্দেশ্যে তার লালন-সংরক্ষণ বিধিবদ্ধ করেছেন, সেই কাজে তা ব্যবহার করে। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন:
(আরবী **********) শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে তোমরা যথাসাধ্য শক্তি সংগ্রহ ও অশ্বপালন করে প্রস্তুতি গ্রহণ কর।
এআয়াতের দৃষ্টিতে অশ্বপালন যুদ্ধের সরঞ্জামের মধ্যে গণ্য। আর যুদ্ধের সরঞ্জামের উপর কোন যাকাত হতে পারে না, তা যতই বিপুল হোক না কেন; যতক্ষণ তা ব্যবসায়ের জন্যে না হবে।
ইমাম আবূ হানীফার মত
ইমাম আবূ হানীফার মতে ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে পোষা হলে তার যাকাত দিতে হবে। তার কয়েকটি দলীল রয়েছে:
প্রথম- বুখারী শরীফে উদ্ধৃত হযরত আবূ হুরায়রার বর্ণনা। নবী করীম (স) বলেছৈন:
(আরবী **********)
ঘোড়া কারোর জন্যে বড় সওয়াবের কারণ, কারোর জন্যে তা আবরণ, আর কারোর জন্যে তা দুর্বহ বোঝা। সওয়াবের কারণ হয় সেই ব্যক্তির ঘোড়া যে তা আল্লাহর জন্যে পোষে (জিহাদে তা ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে), তা তার জন্যে বড় সওয়াবের কারণ। আর যে ব্যক্তি তা পোষে সম্পদ বৃদ্ধি ও আত্মরক্ষার উদ্দে্যে, পরে সে তার গলায় ও পিঠে আল্লাহ্র হক ভুলে যায় না, তা তার জন্যে আবরণ। আর যে লোক তা গৌরব প্রকাশ ও লোক দেখানোর জন্যে এবং মুসলমানদের ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে পোষে তার ঘোড়া তার জন্যে গুনাহের কারণ হবে।
ঘোড়ার গলদেশ আল্লাহর হক্ হচ্ছে যাকাত দেয়া, আর ঠেকায় পড়া লোকদের তাধার দেয়া- তাতে আরোহণের জন্যে তার পৃষ্ঠে আল্লাহ্র হক্।
গলদেশে আল্লাহর হক ধার্য হওয়া পর্যায়ে ভিন্ন মত হচ্ছে- তা যাকাত নয়, তাকে নিয়ে আল্লাহ্র পথে জিহাদ করাই আল্লাহ্ হক। কেউ কেউ মনে করেন, তার অর্থ, তার প্রতি দয়া প্রদর্শন, তার খাওয়া-দাওয়ার সুষ্ঠু ব্যবস্থাকরণ। পৃষ্ঠদেশ যাকাত ধার্য হওয়ার স্থান নয়।
দ্বিতীয়, হযরত জাবির নবী করীম(স) থেকে বর্ণনা করেছেন:
(আরবী **********) প্রতিটি উন্মুক্ত ঘোড়ার যাকাত এক দ্বীনার অথবা দশ দিরহাম।
ইমাম দারেকুত্নী ও বায়হাকী এই হাদীসটিকে ‘যয়ীফ’ বলেছেন। এই কারণে জম্হুর ফিকাহ্বিদগণ মনে করেন, পূর্বে উদ্ধৃত ঘোড়ার যাকাত ফরয না হওয়ার হাদীসটির প্রতিকূলে এই হাদীসটি দলীল হতে পারে না।
তৃতীয়- উষ্ট্রের ন্যায় ঘোড়াও যাকাত ফরয হওয়া। এ দুটোই তো গবাদিপশুর মধ্যে গণ্য, বর্ধনশীল এবং কল্যাণকর। তাতে যাকাত ফরয হওয়ার শর্ত মজুদ রয়েছে। আর তা হচ্ছে চিহ্নিত করে উন্মুক্ত করে দেয়া। এ দিক দিয়ে ঘোড়া ও অন্যান্য গবাদিপশুর মধ্যে পার্থক্য পর্যায়ে যা কিছু বলা হয়েছে, তা হিসাবের মধ্যে ধরার মত নয়। কেননা প্রত্যেক শ্রেণীর পশুরই একটা বিশেষ বিশেষত্ব রয়েছে, যার দরুন তা অন্য শ্রেণীর পশু থেকে সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য ও অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হতে পারে। উট এবং ছাগলের মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে। তা সত্ত্বেও উভয়ের উপরই যাকাত ধার্য হয়ে থাকে।
এ কারণে মনে করা হয়, ধন-মালে যাকাত ফরয হওয়ার ব্যাপারটি বুদ্ধিভিত্তিক ইবাদতমূলক নয়। আর প্রবৃদ্ধিশীলতাই হল তার যৌক্তিকতার কারণ। এটা যখন যাকাত ফরয হওয়ার কারণরূপে স্বীকৃত, তখন এই ‘কারণ‘ যেখানে এবং যাতেই পাওয়া যাবে, তার উপরই যাকাত ফরয হওয়া বাঞ্ছনীয়।
চতুর্থ, সাহাবিগণের উক্তিসমূহ, যা বর্ণনায় পাওয়া গেছে, তা সবই উপরিউক্ত প্রত্যয়কে সমর্থন ও অধিক শক্তিশালী করে দেয়।
তাহাভী ও দারে কুত্নী সহীহ্ সনদে উদ্ধৃত করেছেন, খায়ের িইবনে ইয়াযীদ বলেছৈন, ‘আমি আমার পিতাকে দেখেছি, তিনি ঘোড়া পালতেন ও তার যাকাত উমর ইবনুল খাত্তাবের কাছে পাঠিয়ে দিতেন।’
আবদুর রায্যাক ও বায়হাকী উদ্ধৃত করেছেন, ইয়ালী ইবনে উমাইয়্যা বলেছৈন, আবদুর রহমান একজনের ইয়েমেনবাসীর কাছ থেকে একটি ঘোড়া ক্রয় করলেন একশ’টি উষ্ট্রীর বিনিময়ে। পরে বিক্রেতা লজ্জিত হল ও উমরের কাছে উপস্থিত হয়েবলল, িইয়ালী ও তার ভাইরা আমার একটি ঘোড়া অপহরণ করে নিয়ে গেছে। উমর (রা) ‘ঘোড়ার মূল্য কি তোমাদের কাছে এতদূর পৌঁছে যায়? আমি তো তা জানি না। আমরা তো প্রতি চল্লিশটি ছাগল থেকে একটি ছাগী যাকাত বাবদ নিয়ে থাকি অথচ ঘোড়া থেকে কিছুই লই না। এক্ষণে প্রতিটি ঘোড়া থেকে এক দিনার গ্রহণ কর।’ অতঃপর প্রতিটি ঘোড়ার উপর এক দীনার করে যাকাত ধার্য হয়ে গেল।
ইবনে হাজম উদ্ধৃত করেছেন, খায়ের ইবনে ইয়াযীদ জানিয়েছেন যে, তিনি উমর ইবনুল খাত্তাবের কাছে ঘোড়ার যাকাত নিয়ে উপস্থিত হতেন। ইবনে শিহাব বলেছেন, উসমান ইবনে আফ্ফানও ঘোড়ার যাকাত দিতেন।
আনাস ইবনে মালিক বর্ণনা করেছেন, হযরত উমর (রা) ঘোড়া থেকে দশ দিরহাম ও পাঁচ দিরহামকরে যাকাত গ্রহণ করতেন।যায়দ ইবনে সাবিত আনসারীও এই মত সমর্থন করতেন। মারওয়ান ইবনে হাকামের শাসনামলে আলিমগণ চেড়ে দেয়া চিহ্নিত ঘোড়ার যাকাত সম্পর্কে বিতর্কে পড়ে যান। তাঁরা িএ বিষয়ে মারওয়ানের সাথে পরামর্শ করেন। তখন হযরত আবূ হুরায়রা এই হাদীসটি বর্ণনা করেন: ‘ক্রীতদাসও ঘোড়ার কোন যাকাত দিতে হবে না। মারওয়ান এজন্যে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তখন হযরত আবূ হুরায়রা বলেন, ‘আমিতো রাসূলের হাদীস বর্ণনা করছি আর আপনি তাতে বিস্ময় প্রকাশ করছেন? রাসূল (স) সত্যই বলেছেন। তিনি মুজাহিদদের ঘোড়ার যাকাত না নেয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু যদি কেউ ব্যবসা বা বংশবৃদ্ধির জন্যে ঘোড়া পোষে, তবে তাতে অবশ্যই যাকাত ধার্য হবে। কত?.. প্রতিটি ঘোড়ায় এক দিনার অথবা দশ দিরহাম।’
কিতাবুল আমওয়ালে উদ্ধৃত হয়েছে, তায়ূস হযরত ইবনে আব্বাসের কাছে ঘোড়ার যাকাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘জিহাদের ঘোড়ার কোন যাকাত নেই।’ তার অর্থ, এছাড়াও অন্য সব ঘোড়ারই যাকাত দিতে হবে।
ইবরাহীম নখয়ীও এই মত প্রকাশ করেছে। বলেছেন, বংশবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে পালিত ঘোড়ার যাকাত দিতে হবে। ইচ্ছে করলে প্রতিটি ঘোড়া বাবদ এক দীনার অথবা দশ দিরহারম দেবে। অথবা ঘোড়ার মূল্য ধরে প্রতি দুইশ’ দিরহাম বাবদ দশ দিরহাম আদায় করবে।
আবূ হানীফার মতে যাকাতের নিসাব
ইমাম আবূ হানীফা ঘোড়ার যাকাতের কোন নিসাব নির্ধারণ করেন নি। প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁর কাছে কোন নির্দিষ্ট নিসাব আছে কি নেই? অধিক সহীহ কথা হচ্ছে, নেই। কেননা তিনি তা নির্ধারণই করেন নি। কিন্তু বলা হয়েছে তার নিসাব হচ্ছে, তিনটি, কেউ বলেছেন পাঁচটি। পাঁচটি হওয়াই অধিক সম্ভব। কেননা পাঁচটি উটের বা পাঁচ অসাকের কমে যাকাত ধরা হয়নি।
কিন্তু কতটা যাকাত ফরয? ইমাম আবূ হানীফার মত বলে কথিত হয়েছে, আরবদের ঘোড়ায় ইচ্ছা করলে প্রতিটি বাবদ িএক দীনার অথবা তার মূল্য ধরে প্রতি দুইশ’ দিরহামে পাঁচ দিরহাম দেয়া যেতে পারে। অন্যদের ঘোড়া হলে তার মূল্য ধরেই যাকাত দিতে হবে।