মুসলিম নারীর সামাজিক দায়িত্ব
আধুনিক জীবন যাত্রার শ্রেষ্ঠত্বে যারা বিশ্বাসী তারা (১) কন্যাদের বিবাহে অভিভাবকত্ব, (২) বহু বিবাহ, (৩) তালাক ও (৪) পর্দা প্রথার মত ইসলামী মূল্যবোধকে নারী জাতির সামাজিক মর্যাদার হানিকর জ্ঞান করে থাকেন।
বিশ্বের সকল মুসলিম দেশেই অধুনা “সংস্কার আন্দোলন” নামে একটি আন্দোলন চলছে যা ইসলামের প্রারম্ভকাল থেকে ইসলামী বলে বিবেচিত বিধানগুলোকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চায় এবং সে সকল ক্ষেত্রে অমুসলিম দেশগুলোতে প্রচলিত বিধানকেই চালু করতে চাচ্ছে।
এই নিবন্ধে আমি তাই নারী জাতি সম্পর্কিত ইসলামী শিক্ষার স্বাভাবিক শ্রেষ্ঠত্ব এবং এ ব্যাপারে তাদের ওপর অন্যায় আচরণ যে মারাত্মক সামাজিক ক্ষতির কারণ তা সবিস্তরে বর্ণনা করব। আধুনিক নারী সাম্যবাদীরা মুসলিম বালিকার স্বামী নির্বাচনে পিতা-মাতা কিংবা অভিভাবকের মতামতের প্রাধান্যকে খুবই দুঃখজনক বলে মনে করেন এবং এটাকে তারা তার প্রতি পিতার নিষ্ঠুর জুলুম ও ব্যক্তি স্বাধীনতার হস্তক্ষেপ বলে বর্ণনা করেন। তারা বহু বিবাহের মত ইসলামের অন্য কোন বিধানকেই এত খারাপভাবে নিন্দা করেননি। একে তারা মুসলিম নারীত্বের চরম অবমাননা ও স্বেচ্ছাচারী কামুকতার প্রমাণ হিসেবে পেশ করেছেন। এই “সংস্কারবাদীরা” একে কেবল চরম অধঃপতিত সমাজের জন্যই উপযুক্ত প্রথা বলে মনে করেন এবং একে শুধুমাত্র বিশেষ ব্যতিক্রমধর্মী অবস্থাতেই মেনে নেয়া যায় বলে দায়ী করেন।
আমাদেরকে অবশ্যই বুঝতে হবে যে, আমাদের এই আধুনিকতাবাদীদের এহেন দুঃখজনক স্বীকারোক্তির ভিত্তি আদৌ কুরআন কিংবা হাদিসে নেই। এটা সম্পূর্ণ পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রতি তাদের মানসিক দাসত্বের ফলশ্রুতি।
পাশ্চাত্য সমাজ যে তীব্র ঘৃণার সাথে বহু বিবাহ প্রথাকে দেখছে তার কারণ হলো তারা একাকীত্বের একটি অতিরঞ্জিত ধারণার দ্বারা অধিক মাত্রায় প্রভাবিত এবং সে ক্ষেত্রে তারা ব্যাভিচারকেও তেমন বীভৎস মনে করে না।
এটা অত্যন্ত লজ্জা ও দুঃখের ব্যাপার যে, অনেক মুসলিম প্রধান দেশেও ইসলামের পারিবারিক বিধানকে এমনভাবে অংগচ্ছেদ করা হয়েছে যে, তাদের সমকালীন আইনে নবী (স), তার সাহাবায়ে কেরাম (রা) ও অন্যান্য মহাপুরুষগণ যাঁরা একাধিক বিবাহ করেছেন তাঁদেরকে অপরাধী হিসেবেই সাব্যস্ত করা হয়ে থাকে। তালাক সম্পর্কিত ইসলামী আইনকেও তারা বহু বিবাহ প্রথার মত কর্কশভাবে অভিযুক্ত করেছেন। কোন ব্যক্তিকে শরীয়ত কর্তৃক তার স্ত্রীকে তালাক দেয়ার অনুমতি প্রদানকে ইসলামী নারী জাতিকে হেয় প্রতিপন্ন করার আর একটি প্রমান হিসেবে তারা উল্লেখ করেছেন। তারা একথা জোরে শোরেই বলেছেন যে, তালাকের মত এক তরফা স্ত্রী প্রত্যাখ্যান অবশ্যই ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। কারণ এটা খুবই সামান্য ও তুচ্ছ কারণে কাউকে তার স্ত্রী পরিত্যাগের অনুমতি প্রদান করে। সুতরাং তালাক অবশ্যই একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং ব্যাভিচার ও দুরারোগ্য পাগলামীর মত কোন মারাত্মক অবস্থার উদ্ভব হলেই শুধু কোর্টের অনুমোদন সাপেক্ষে কাউকে তালাক দেয়া যেতে পারে।
যেখানে ইসলামী শরীয়ত পারস্পরিক সহাবস্থানে অসহনশীল একটি অসুখী দম্পতিকে তাদের সমস্যার একটি সুন্দর ও সম্মানজনক সমাধানের ব্যাবস্থা প্রদান করেছে, সেখানে ঐ সকল “সংস্কারবাদী”রা বলেছেন যে, এই অসঙ্গত মেজাজের দু’টো নারী-পুরুষকেও তাদের বিবাহ বন্ধনকে ধরে রাখতে বাধ্য করতে হবে।
দু’জন নারী-পুরুষ যদি পারস্পরিক সন্তুষ্টি খুঁজে না পায় তবে কোন ধর্মহীন নৈতিকতাই যেহেতু তাদের একে অপরকে ভালবাসতে বাধ্য করতে পারে না, সুতরাং তারা অন্যত্র ভালোবাসা খুঁজবেই। পারিস্পরিক অসন্তুষ্টিপূর্ণ এ দুঃসহ সহাবস্থান থেকে মুক্তি পেতে তাদের একটি মাত্র উপায় থাকে, তা হলো মিথ্যা ও কুৎসার মাধ্যমে তালাকের জন্য কোর্টকে প্ররোচিত করা, আর যেহেতু এই মিথ্যা অপবাদ তাদের জন্য সামাজিক গ্লানির কারণ হয়, সেহেতু পুরো ব্যাপারটাই তাদের নৈতিক অধঃপতন ও ধ্বংস ডেকে আনে।
কোর্টে প্রমাণযোগ্য যথার্থ কারণ ছাড়া যে তার স্ত্রীকে তালাক দেয় সে খারাপ লোক বলে বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু মানসিক পীড়নের মধ্যে আজীবন ধরে না রেখে মেয়ে লোকটিকে পছন্দমত বিবাহ বন্ধনের সুযোগ দেয়া যেকোন মানবিক বিচারেই খারাপ হবার নয়। তথাপি আমাদের আধুনিক সংস্কারবাদীরা এহেন অবস্থায়ও নারীটিকে আজীবন ঝগড়া-ঝাঁটি ও মানসিক পীড়নের মধ্যে রাখার জন্য আইন তৈরিতে উঠে পড়ে লেগেছেন।
পর্দা বা নারী-পুরুষের অবাঞ্ছিত মেলামেশা থেকে পৃথকীকরণ ব্যাবস্থাকেও আধুনিক শিক্ষিতরা মোটেই কম ক্রোধের দৃষ্টিতে দেখছেন না। তারা অমুসলিমদের মতই নারী দেহের অবগুণ্ঠন উন্মোচনে বদ্ধপরিকর। তাই তারা নারীদের জন্য সহশিক্ষা, ভোটাধিকার, দেশের বাইরে চাকরি গ্রহণ এবং সাধারণ্যে সকল কাজে পূর্ণাঙ্গ অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করেছেন।
রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বশীলদের প্রবর্তিত এই “নারী স্বাধীনতার” সর্বোচ্চ চিত্র হলো- রাজপথে নেকাব উন্মোচিত মেয়েদের জাতীয় সঙ্গীতের তালে তালে ব্যানার দুলিয়ে উন্মত্ত কুচকাওয়াজ, নির্বাচনে পুরুষের পাশাপাশি মহিলাদের ভোট প্রদান, সেনাবাহিনীতে পুরুষ সৈনিকের পোশাকে সজ্জিত নারী, কল কারখানায় পুরুষের সাথে কর্মরত মেয়েলোক এবং আনন্দ মেলার উপহার বিপণীর সজ্জিত পশুর মত জাতীয় সুন্দরী প্রতিযোগীতার বিচারকগণ কর্তৃক আগত সুন্দরী ললনাদের দেহ ও সৌন্দর্য চোখে দেখার দৃশ্য।
আধুনিক সভ্যতায় নারীর সম্মান ও শ্রদ্ধার মাপকাঠি নির্ধারিত হয়ে থাকে পুরুষের সকল কাজে তার অংশগ্রহণ এবং এর সঙ্গে তার সকল সৌন্দর্য ও মাধুর্যকে উন্মুক্ত করার মাধ্যমে। ফলে সমসাময়িক ঐ সমাজে নারী ও পুরুষের উভয়ের পার্থক্য নির্ধারক সকল কর্মকান্ড সম্পূর্ণরূপে গুলিয়ে যায়।
ইসলামী শিক্ষা এই ধরনের বিপথগামী যৌনতামূলক সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে কিছুতেই বরদাশত করতে পারে না।
ইসলাম নারীকে পুরুষের অঙ্গনে নেতৃত্বের দায়িত্ব দেয়নি। তার দায়িত্ব নির্ধারিত হয়েছে তার ঘরে, তার স্বামীর সংসারে। তার সার্থকতা ও সফলতা নির্ধারিত হয়েছে স্বামীর প্রতি তার আনুগত্য ও বিশ্বস্ততা এবং মানিক-রতন সন্তানদের লালন-পালনের মধ্যে। সকল মুসলিম নারীরই পছন্দের বিষয় হলো গোপনীয়তা, আর এ জন্য পর্দাই হচ্ছে অপরিহার্য মাধ্যম।
জীবন নাট্যের যে দৃশ্যের পুরুষ হবেন ইতিহাসের নায়ক, সে পটভূমিকায় পর্দার অন্তরালে নারী হবেন তার সকল কর্মকান্ডের সহায়ক। নারীর এই কর্মকান্ড কম উত্তেজক হলেও অধিকতর বিনম্র এবং সুষ্ঠু জীবন ধারার স্থিতিশীলতা, বিকাশ ও পবিত্রতা রক্ষায় তা কোনমতেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
মা হিসেবে মুসলিম নারীর দায়িত্ব
একজন মুসলিম জননীর প্রাথমিক দায়িত্ব হল সন্তানদেরকে কুরআন ও সুন্নাহর শিক্ষা অনুযায়ী অনুপ্রাণিত করা।
অনারবীয় এলাকায় যে সকল মুসলিম নারী প্রত্যহ সকালে ভক্তিভরে কুরআন পড়েন তাদের অধিকাংশই তার সামান্যতম অর্থও জানেন না, কিংবা জানার চেষ্টাও করেন না।
ধর্মীয় ঝোঁক প্রবণ অথচ আধুনিক শিক্ষায় গড়ে ওঠা অনেক মেয়েই কুরআন, হাদিস ও ইসলামী সাহিত্য অধ্যয়ন করে থাকে। কিন্তু এগুলোকে তারা নোবেল নাটকের মতই ভাবে, কিংবা ভাবে কোন বিমূর্ত দর্শন হিসেবে। ইসলাম সম্পর্কিত এই পড়াশুনা তাই তাদেরকে এক মুহুর্তের জন্যও নোংরা ছায়াছবি দর্শন, অশ্লীল সংগীত শ্রবণ ও গানের তালে তালে অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন কিংবা অশালীন দেহ-আটা পোশাক পড়ে সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখতে সমর্থ হয় না।
এক্ষেত্রে মুসলিম মায়েদের কর্তব্য তাদের বেড়ে ওঠা ছেলে-মেয়েদেরকে এ কথা বুঝানো যে, স্কুল-কলেজে তাদের অন্যান্য বন্ধু-বান্ধব যা করছে তা আসলে ঠিক নয়। মুসলিম নারী কুরআন-হাদীস পড়বেন এই উদ্দেশ্যে যেন তাদের দৈনন্দিন জীবনে তার শিক্ষা বাস্তবায়িত হয়।
অনেক মুসলমানের ঘরেই দেখা যায়, তাকের ওপরে সুন্দর সিল্কের কাপড়ে আবৃত করে কুরআন শরীফ রেখে দেয়া হয়েছে, যেন ময়লা পড়ার জন্যই। অব্যবহৃত এই অসংখ্য কুরআন আর্তি করে বলছে “ওহে মানুষ আমাকে বন্ধন মুক্ত কর, আমাকে পড়, আমাকে অনুসরণ কর।”
যে মায়েরা মহিলা বিষয়ক পত্রিকাদি পড়তে অভ্যস্ত তারা সমাজে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি তাদের যুব সন্তানদের তীব্র বিদ্রোহাত্মক দৃষ্টিভংগিকেও সহজেই সমর্থন করে বসেন। এমনকি তাদের নির্বোধ, ঘৃণ্য আচরণ ও তুচ্ছ চপলতার প্রতি তীব্র আকর্ষণ এবং গতানুগতিকতার প্রতি সর্বাত্মক অনীহাকেও তারা প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন। এই মায়েরা মনে করেন, “নাস্তিকতা ও বস্তুবাদ হচ্ছে যুব কিশোরদের জন্য উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত এক জৈবিক বাস্তবতা। একে তারা একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন হিসেবে গ্রহণ করবেই। সুতরাং তাদেরকে এ সর্বব্যাপি ঝোঁক প্রবণতার ওপর ছেড়ে দেয়াই উচিত।”
এটা সম্পূর্ণ একটি প্রতারণাপূর্ণ কথা। এর কোন যৌক্তিকতাই থাকতে পারে না। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তথাকথিত প্রগতিবাদীদের প্রচার প্রচারনাই তাদেরকে এ নৈরাশ্যের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
গণ মাধ্যমগুলোতে তারা যা শোনে ও দেখে এবং তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তারা যা শেখে, তাদের গৃহে আচরিত কিংবা শিখানো মূল্যবোধের সাথে তার কোন মিল না থাকায় স্বাভাবিকভাবেই তারা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। এসব গণমাধ্যম যদি পাশ্চাত্য জীবন-পদ্ধতি শিক্ষা না দিয়ে ইসলামী জীবন ধারার শিক্ষা দিতো তাহলে এই যুবক-যুবতীরা চিন্তা-বিশ্বাস এবং অনুভূতি ও আচরণে সম্পূর্ণ বিপরীত হতে পারতো। এই অত্যাবশ্যকীয় পরিবর্তন সাধনে শিক্ষিত জননীরাই কেবল তাদের সন্তানদের ওপর পরম কার্যকরী প্রভাব খাটাতে মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারেন।
পর্দা সম্পর্কিত ইসলামী শিক্ষার দাবীই হচ্ছে মহিলাগণ ব্যক্তিত্ব ও সম্মানের সাথে একাকীত্বে বাস করবেন, নিতান্ত প্রয়োজনে আত্মীয়-সজন ও পুরুষ বন্ধু-বান্ধবের সাথে সাক্ষাতের জন্য বের হওয়া ছাড়া অধিকাংশ সময় তারা নিজ গৃহে অবস্থান করবেন। একজন মা তার বেড়ে ওঠা সন্তানদের সামনে তার ব্যক্তি জীবনে অনুশীলিত কার্যাদির দ্বারাই সুন্দর উদাহরণ উপস্থাপন করতে পারেন। যে জননী সর্বদা তার ঘর-কন্যার কাজে নিজেকে সাচ্ছন্দ রাখেন, রান্না-বান্না, তদারকী ও শিশুদের পরিচর্যায় ব্যাপৃত থাকেন, নিয়মিত নামায পড়েন, কুরআন অধ্যয়ন ও অন্যান্য ইবাদত বন্দেগীর কাজে ব্যস্ত থাকেন, তিনিই তার পরিবারে এমন একটি অনুকূল ইসলামী পরিবেশ সৃষ্ট করতে সক্ষম, যার দ্বারা তার শিশু সন্তানেরা গভীরভাবে প্রভাবিত হবে এবং বয়ঃবৃদ্ধির সাথে সাথে সে যখন বাইরের পরিবেশে মিশবে তখন অবাঞ্ছিত আচরণ দ্বারা আকৃষ্ট হবে না। এজন্য খুব অল্প বয়স থেকে শিশুদের ইসলামী শিক্ষা প্রদান করা উচিত। হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি যে, রাসুল (স) এঁর সাহাবা-ই-কেরাম (রা) এঁর সন্তানগণ এমনকি ন্যাংটা থাকাকালীন বয়সেও কুরআন আবৃত্তি করতে পারতেন।
শিশুরা যখন কথা বলতে শিখে তখনই তাকে কালিমা শিক্ষা দেয়া উচিত এবং বিসমিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ্, আল্লাহু আকবার, ইনশাআল্লাহ্, মাশাআল্লাহ প্রভৃতি ইসলামী ভাবাবেগপূর্ণ কথামালাও শিক্ষা দেয়া প্রয়োজন। শিশু যখনই দাঁড়াতে ও হাঁটতে শিখে তখনই মায়ের অনুকরণে তাকে নামাযের মহড়া করতে অনুপ্রাণিত করা উচিত। শিশুর বয়স যখন সাত বছর হবে তখন মায়েদের উচিত তাদেরকে নামায পড়তে চাপ দেয়া এবং দশ বছরেও নামায না পড়লে শিশুদের শাস্তি দেয়া প্রয়োজন। এভাবে শিক্ষা দিলেই শিশুরা বুঝদার হওয়ার অনেক আগে থেকেই স্রষ্টা ও মানুষের প্রতি দায়িত্ব পালনে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে।
বয়স ও মেধা অনুসারে এ সকল কর্তব্য পালনের গুরুত্ব সম্পর্কে শিশুদেরকে সহজ-সরল ও পরিষ্কার ব্যাখ্যা প্রদান করা উচিত। এ ক্ষেত্রে মায়েদের কর্তব্য শিশুদেরকে অতীত ও বর্তমেনের মুসলিম মহৎ ব্যক্তিত্বের রোমাঞ্চকর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে পরিচিত করে তোলা এবং তাদের নিজেদের জীবনে ঐ সকল মূল্যবোধ মেনে চলার তীব্র আকাংখা সৃষ্টি করা। শিশুরা যখন একটু বড় হয়ে ওঠে এবং নিজেরা ইচ্ছা করে বই পুস্তক পড়তে পারে তখন বাসগৃহের পরিবেশ এমন সব ইসলামী বই পুস্তক রাখা প্রয়োজন যা শিশুদেরকে পড়তে আকৃষ্ট করে।
যে সব ছেলেমেয়ে বেশ বড় হয়েছে কিংবা যৌবনে অবতীর্ণ হয়েছে তাদেরকে প্রেক্ষাগৃহে নোংরা ছায়াছবি ও রেডিও-টিভির অর্থহীন প্রোগ্রামগুলো কেবল দেখতে নিষেধ করলেই চলবে না বরং সেগুলোর খারাপ দিকটা তাদেরকে ব্যাখ্যা করে বুঝাতে হবে। ঘরে যদি রেডিও অথবা টেলিভিশন সেট থাকে তবে মায়েদের উচিত কুরআন তিলাওয়াত, সংবাদ বুলেটিন, ভালো কবিতা আবৃত্তি ও স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রোগ্রামগুলো ছাড়া অন্য সব প্রোগ্রাম শোনা থেকে সন্তানদেরকে সম্পূর্ণ বিরত রাখা। কোন অবস্থাতেই শিশুদেরকে পাপ সংগীত শুনতে দেওয়া উচিত নয়। কারণ শিশু চরিত্রের ওপর এর চেয়ে খারাপ নৈতিক প্রভাব ফেলার মত আর কোন প্রোগ্রাম নেই। যদি শিশু কখনো প্রতিবেশীর রেডিও-টিভি থেকে শুনে এ সকল খারাপ গান গাইতে শুরু করে তবে মায়েদের উচিত তাদেরকে চুপ থাকতে ব্যাধ করা এবং এসব নোংরা গান গাইতে লজ্জাবোধ থাকা উচিত বলে ধিক্কার দেয়া।
মুসলিম মায়েদের কোন অবস্থাতেই তাদের সন্তানদেরকে খৃস্টান মিশনারী স্কুলে বা আশ্রমে লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে পাঠাতে সম্মত হওয়া উচিত নয়। কারণ সেগুলোতে ছেলেমেয়েরা খৃষ্টধর্ম ও সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হবেই। এমনকি সরকারি স্কুলগুলোতেও নৈতিক শিক্ষার জন্য তেমন ভালো ফল আশা করা যায় না।
তাই এ ক্ষেত্রে সামর্থ থাকলে গৃহ শিক্ষকের মাধ্যমে কিংবা অসমর্থ হলে মসজিদে পাঠিয়ে ছেলেমেয়েদেরকে আরবী ভাষা, কুরআন ও হাদিসের শিক্ষা প্রদানের সাহায্যে বস্তুবাদী শিক্ষার ক্ষতিপূরণ করা যেতে পারে। পারলে মা নিজেও তার সন্তানদেরকে এ ধরনের শিক্ষা দিতে পারেন।
প্রত্যেক মায়ের উচিত বাচ্চাদের স্কুল পাঠ্য সমস্ত টেক্স বই ভালোভাবে পড়ে দেখা। এগুলোতে যেসব বিষয় অসত্য, ভুল ও ক্ষতিকারক তা বাচ্চাদেরকে ধরিয়ে দেয়া এবং নিঃসন্দেহ প্রমাণে সেগুলোর অসত্যতা বুঝিয়ে দেয়া।
মুসলিম মায়েদের উচিত তার সাধ্যের সীমার মধ্যেই বাসগৃহকে আকর্ষনীয় করে তোলা। এ দেশের প্রায় সকল গৃহই, এমনকি মধ্যবিত্তের ঘরবাড়ীও অনেক ক্ষেত্রে অপরিচ্ছন্ন ও নোংরা। অনেক মহিলাই মেঝেতে, বিশেষ করে উঠোন ও রান্না ঘরে আবর্জনা ছড়িয়ে রাখেন। তাদের এ একটা খারাপ অভ্যাস যে, তারা ময়লার মধ্যে থাকবেন তবুও নিজ হাতে তা পরিষ্কার করবেন না। ইসলামী শিক্ষা মেয়েদেরকে অবশ্যই পরিচ্ছন্নতা ও নিয়মানুবর্তিতা শিখায়। নিজেদের হাতে ঘর ঝাড়ু দিতে কিংবা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মুসলিম নারীকে কখনই লজ্জাবোধ করা উচিত নয় এবং চাকর-চাকরানীদের ওপর সবসময় এ ব্যাপারে নির্ভরশীল হওয়া ঠিক নয়। যদি সম্পদশালী হন তবে সর্বদা জাঁক-জমক ও অপচয় এড়িয়ে চলতে হবে এবং পশ্চিমা ধাঁচের সোফা, ড্রেসিং টেবিল, খেলোগয়না ইত্যাদি ব্যয় বহুল গৃহসামগ্রী পরিহার করতে হবে। কুরআন ও হাদিসের বানী সম্বলিত কারুকার্যপূর্ণ ক্যালিগ্রাফি দিয়ে ঘরের দেয়াল সজ্জিত করা যেতে পারে। এতে একদিকে যেমন ঘর সাজানো হবে অন্যদিকে তা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেবে যে, এটা মুসলিম বাসগৃহও। ইসলামী শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক ধরণের ছবি, পারিবারিক কিংবা বন্ধু-বান্ধবের একক ও গ্রুপ ফটোগ্রাফ ইত্যাদি কিছুতেই ফ্রেমে আটকিয়ে ঘরে টাঙ্গিয়ে রাখা ঠিক নয়। ইসলামী শিক্ষা একজন বালিকাকে গৃহকর্মের জন্য অন্তত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মুল্যনীতি, প্রাথমিক চিকিৎসা এবং মজাদায়ক হালাল খাদ্য তৈরির পদ্ধতি শেখায়। অনেক মুসলিম নারীই খাদ্যের পরিপুষ্টি জ্ঞান সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। তাই প্রয়োজনীয় ও উপযোগী প্রচুর খাদ্য হাতের কাছে থাকতেও তারা তাদের বাচ্চাদেরকে তা খাওয়াতে জানেন না।
একজন অশিক্ষিত ও উদাসীন মুসলিম নারী কিছুতেই অনৈসলামিক প্রভাব যা দিবারাত্রি তার সন্তানকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে তা প্রতিহত করতে পারেন না। শুধুমাত্র একজন শিক্ষিত, চতুর ও অত্যন্ত আগ্রহশীল মুসলিম নারীই পারেন বর্তমান প্রতিকুল পরিবেশের সামনে সাহসের সাথে মুখোমুখি হতে।
—————————-
নারী স্বাধীনতা ও কাসেম আমীন
নারী ও পুরুষের যৌন পবিত্রতার সংরক্ষণ, পর্দা করা, মেয়েদেরকে বিশ্বস্ত স্ত্রী হিসেবে গৃহে অবস্থান করা, সন্তান পালনে ও ঘরণীর কাজে নারীকে নিয়োজিত থাকা, স্বামীকে পরিবারের কর্তা ও জীবিকা উপার্জনকারী হিসেবে মেনে নেয়া, স্ত্রী তালাক ও বহু বিবাহে পুরুষের অধিকার থাকা প্রভৃতি প্রথাগুলো মুসলিম সমাজে মহানবী (স), তাঁর সাহাবায়ে কেরাম ও ইমামদের যুগ থেকে দীর্ঘ তেরশত বছরেরও অধিককাল ধরে অনুশীলিত হয়ে আসছে। কোন ফকিহ কিংবা কোন মাজহাবের কোন আলেমই এ ব্যাপারে কখনো কোন প্রশ্ন তোলেননি। সকলেই নির্দ্বিধায় এ বিধানগুলো মেনে নিয়েছেন। ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ মুসলিম বিশ্বের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়ার পূর্ব পর্যন্ত কোন নামধারী মুসলিমও কোরআন ও সুন্নাহ নির্দেশিত মুসলিম নারীর এই সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে কোন কটাক্ষ করার সামান্যতম সাহসও পায়নি।
ইতিহাসে প্রথম যে মুসলিম নামধারী ব্যক্তি পর্দা প্রথার বিরুদ্ধে কথা তোলেন তার নাম কাসেম আমীন (১৮৬৫-১৯০৪) । কাসেম আমীন চুকেন একজন কুর্দী। পেশায় বিচারক। তিনি শেখ মোহাম্মদ আবদুহের শিষ্য ছিলেন। তিনি তার জীবনের অধিকাংশ সময় কায়রোতে অতিবাহিত করেন। তার ফার্ষি ভাষা শিক্ষাকালে খৃষ্টান মিশনারীদের প্রচারণায় তার মনে বিশ্বাস জন্মায় যে, পর্দা, বহুবিবাহ ও তালাক প্রথা মুসলিম সমাজের পিছিয়ে যাওয়ার একমাত্র কারণ। এই ফরাসী শিক্ষা যতই তাকে পাশ্চাত্য সভ্যতার উৎকৃষ্টতার পক্ষে যুক্তি দেয়, ততই তার নিজের সম্পর্কে নিকৃষ্টতার ধারণা জমতে থাকে। পরবর্তীতে তিনি লিখেন, “সত্যিকার সভ্যতা হবে বিজ্ঞান নির্ভর। সত্যিকার বিজ্ঞানের বিকাশের পুর্বেই ইসলাম যেহেতু তার পূর্ণতায় পৌঁছেছে; সুতারাং একে সভ্যতার আদর্শ ধরা যায় না”। তিনি আরও বলেন ইসলামের নৈতিক ভিত্তি দূর্বল। তিনি বলেন, “মুসলমানগণ, এমনকি মহানবী (স)-এর সময়ের মুসলমানগণও অন্য লোকদের চেয়ে কোন দিক দিয়ে ভালো ছিল না।” তার মতে, “পূর্ণতা ও চরম শ্রেষ্ঠত্বের পথ হল বিজ্ঞান। ইউরোপ বিজ্ঞানে যত বেশী অগ্রবর্তী হয়েছে, সামাজিক শ্রেষ্ঠত্বেও তত বেশী এগিয়ে গেছে।” তিনি আরও লিখেন, “ইউরোপ সকল দিক দিয়েই আমাদের থেকে অগ্রবর্তী। যদিও আমরা ভেবে আনন্দ পাই যে, ইউরোপীয়রা বস্তুগতভাবে আমাদের চেয়ে সম্পদশালী হলেও নৈতিক দিক দিয়ে আমরা তাদের চেয়ে উৎকৃষ্টতরও; কিন্তু কথাটি ঠিক নয়। ইউরোপীয়রা আমাদের চেয়ে নৈতিক দিক দিয়ে অনেক বেশী অগ্রগামী। তাদের সকল শ্রেণীর মধ্যেই সামাজিক নৈতিকতা রয়েছে। ইউরোপে নারী স্বাধীনতাও কোন প্রথা বা অনুভূতি সৃষ্টি হয়নি। বরং তা বিজ্ঞান ও নৈতিকতা নির্ভর। তাই ইউরোপীয় বিজ্ঞানকে এর নৈতিক দিকটিকে বাদ দিয়ে গ্রহণ করা অর্থহীন। এ দু’টো জিনিস অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কশীল। সুতারাং আমাদের জীবনের সকল দিক ও বিভাগে পরিবর্তন সাধনের জন্য প্রস্তুত হওয়া উচিৎ।”
এই চিন্তাধারাই কাশেম আমীনকে ১৯০১ সালে পর্দা বিরোধী ‘দি নিউ ওম্যান’ নামক বইটি লিখতে আরম্ভ করে। এই বিষয়ে তিনি মুসলিম পারিবারিক জীবনকে ভীষণ খারাপভাবে চিত্রিত করেছেন। স্যামুয়েল জেম্মার নামক একজন পাশ্চাত্য লেখকের ‘চাইল্ড হুড ইন দি মোসলেম ওয়ার্ল্ড’ নামক বই থেকে কাশেম আমীন তার বইয়ে এমন উদ্ধৃতি টেনেছেন যে, “মুসলিম সমাজে পুরুষ হল নারীর নিরঙ্কুশ প্রভু। নারী তার আনন্দের বস্তু, যেমন একটি খেলনা, যা নিয়ে সে যেমন ইচ্ছা খেলতে পারে। জ্ঞান সমস্ত পুরুষের, আর নারী নির্বোধ, সব অজ্ঞতা তার জন্য। মুক্ত আকাশ ও সব আলো পুরুষের জন্য, আর নারীর জন্য সকল অন্ধকার ও বন্দীদশা। পুরুষ শুধু আদেশ করবে, আর নারী তা নীরবে মেনে চলবে। সব কিছুই পুরুষের, আর নারী তার এই সব কিছুর একটি তুচ্ছ অংশ মাত্র।” এই কাশেম আমীনই হলো মুসলিম নামধারী প্রথম ব্যক্তি যে মুসলিম পরিবারকে পশ্চিমা ধাঁচে পুনর্বিন্যাস করে গড়ে তোলার পরামর্শ দেন। এ প্রসঙ্গে তিনি তার বইয়ে আলবার্ট হয়রানীর, “এরাবিক থট ইন দি লিবারেল এজ” নামক বই থেকে এভাবে উদ্ধৃতি টানেন যে, “প্রাচ্য দেশগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখো, দেখবে নারীরা পুরুষের নিকট দাসত্বের শিকলে বন্দী হয়ে আছে। পুরুষরা তাদের শাসক। পুরুষ অত্যাচারী এবং সে যতক্ষণ ঘরে থাকে ততক্ষণ সে এই অত্যাচার চালাতে থাকে। পক্ষান্তরে তাকিয়ে দেখ ইউরোপীয় দেশগুলোর দিকে, সেখানে প্রতিটি সরকার মানুষের স্বাধিকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করেছে এবং নারীকে দিয়েছে চিন্তা ও কাজে উচ্চতর স্বাধীনতা ও সম্মান।”
কাশেম আমীন উক্ত বইয়ে আরো লিখেন, “মুসলমানদের অধঃপতনের মূল কারণ হলো, অজ্ঞতার কারণে সামাজিক মূল্যবোধের বিনাশ সাধন। এই অজ্ঞতা শুরু হয় পরিবার থেকে। এই অবস্থার উন্নতির জন্য পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন প্রয়োজন। এ শিক্ষার মাধ্যমে নারী শুধু পারিবারিক সমস্যা থেকেই বাঁচবে না, বরং পুরুষ উৎপীড়কের হাত থেকে বাঁচার জন্য নিজেকে স্বাবলম্বী করতেও পারবে। এই শিক্ষা নারীকে অবগুণ্ঠন, নির্জনবাস ও উৎপীড়ন থেকে মুক্তি দিবে।” নারীর গৃহে অবস্থানকে কাশেম আমীন এই বলে ক্ষতিকর মনে করেন যে এটি নারীর প্রতি পুরুষের অবিশ্বাস থেকেই উৎসারিত। পুরুষ নারীকে শ্রদ্ধা করে না, তারা তাদেরকে গৃহ বন্দী করে রাখে। কারণ, তারা নারীকে পুরোপুরি মানুষই বলে স্বীকার করে না। পুরুষ নারীর মানবীয় গুণাবলীকে অস্বীকার করে এ জন্য যে, সে শুধুই নারীর দেহকেই ভোগ করতে চায়। বহু বিবাহ সম্পর্কেও কাশেম আমীন একই ধারণা পোষণ করেন। তার মতে, কোন নারীই পারেনা তার স্বামীকে অন্য নারীর সাথে অংশীদার করতে। যদি কোন পুরুষ দ্বিতীয় বিবাহ করে, তবে তা তার প্রথম স্ত্রীর ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষাকে অগ্রাহ্য করেই সম্ভব। তালাক প্রথাকেও তিনি ঘৃণার সাথে দেখেন। তিনি বলেন, যদি এই প্রথা চালুই রাখা হয়, তবে নারীকেও এ ব্যাপারে সমঅধিকার দিতে হবে। তিনি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের সমঅধিকার না পাবার কোন যুক্তি নেই বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। তবে তিনি নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণের পূর্বে সুদীর্ঘকাল শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত বলে জোর দেন।
কাসেম আমীনের ‘দি নিউ ওম্যান’ আধুনি মুসলিম নারীকে খৃষ্টান ও মানবতাবাদী আদর্শের শৃঙ্খলে বন্দী করার এক সুস্পষ্ট ঘোষণা। যে কেউ এ বই পড়বে তাকে বাস্তবিকই বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে যে, এর লেখক একজন মুসলমান, কোন খৃস্টানধর্ম প্রচারক নন।
মুসলিম সমাজের বিরুদ্ধে ‘দি নিউ ওম্যান’ পুস্তকের এই বাদানুবাদের কোন বাস্তব ভিত্তি নেই। কাসেম আমীন যা বলেছেন তা সম্পুর্ণরুপে মুসলিম নারীদের প্রকৃত অবস্থাকে নিরপেক্ষ ও খোলা মন নিয়ে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে দেখার সামান্যতম চেষ্টা ব্যাতিরেকে এবং খৃষ্টান মিশনারীদের সকল আক্রমণকে অন্ধভাবে গ্রহণের ফলেই হয়েছে। প্রকৃত সত্য কথা হল- এই অধঃপতনের যুগেও অধিকাংশ মুসলিম পরিবার থেকে পারস্পারিক ভালোবাসা ও সহানুভূতির দ্বীপ্তি বিকীর্ণ হচ্ছে। বিশ্বের সকল দেশের মধ্যে মুসলিম দেশগুলোতেই পারিবারিক বন্ধন মজবুত। এই ঐতিহ্যগত পারিবারিক বিন্যাসের ফলে মুসলিম নারীগণ পরিবারের মা ও বধূ হিসেবে প্রভূত সম্মান, শ্রদ্ধা ও মর্যাদা পাচ্ছেন। তারা তথাকথিত পুরুষ নিপীড়কের ভয়ে পর্দা পালন করছে না; বরং এতে তার জন্য প্রচুর কল্যাণ নিহিত আছে জেনেই করছেন। এতে তাকে যে কিছু মানসিক চাপ সহ্য করতে হয়, তা নয়। তবে সেটা নারীর সামাজিক অমর্যাদার কারণে নয়, বরং তা প্রচলিত নৈতিক অবক্ষয় ও বঞ্চনার কারণেই।
১৯৬১ সনের ১লা এপ্রিল আমাকে লেখা একটি ব্যক্তিগত পত্রে মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী উল্লেখ করেন, “পাশ্চাত্য সভ্যতা নারী জাতির প্রতি খুবই নিষ্ঠুর প্রমাণিত হয়েছে। এই সভ্যতা নারীকে একদিকে প্রকৃতগত নারীত্বের দায়িত্ব পালন করাচ্ছে, অন্যদিকে তাকে একই সাথে পুরুষের বহুবিধ কাজে অংশগ্রহণের জন্য ঘরের বাইরে নিয়ে এসেছে, এভাবে তারা নারীকে দু’টো শানপাথরের মাঝখানে চৌকোণাভাবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। অধিকন্তু তাদের প্রচারণা নারী সমাজকে পুরুষদের কাছে নিজেকে প্রতিযোগীতামূলকভাবে আকর্ষণীয় করে তুলতে প্রলুব্ধ করেছে। এই প্রতিযোগীতায় তারা স্বাভাবিক শালীনতাকে বিসর্জন দিয়ে অপর্যাপ্ত পোশাক, এমনকি নগ্নতা পর্যন্ত গড়িয়েছে। এভাবে তারা পুরুষের হাতের খেলনায় পরিণত হয়েছে। একমাত্র ইসলামই নারীকে এই দূর্গতি থেকে রক্ষা করতে পারে। কারণ, ইসলাম একজন নারীকে শুধুমাত্র একজন পুরুষের জন্যই নির্দৃষ্ট করে দেয় এবং তার প্রকৃতিগত কাজে নিরাপত্তা দিয়ে উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। অন্যদিকে পাশ্চাত্য সভ্যতা নারীকে অসংখ্য পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য সেবাদাসীতে পরিণত করেছে। এবং যে সকল কাজ সত্যকারভাবে একজন রমণীর জন্য শোভনীয় সে সকল কাজের প্রতি তার হৃদয়ে একটি মিথ্যা লজ্জার ধারণা সৃষ্টি করে দিয়েছে। পরিবার ও সংসারকর্ম সংক্রান্ত ইসলামী নীতিমালাই একজন নারীর জন্য যথার্থভাবে উপযুক্ত এবং তার প্রকৃতির সাথে সম্পূর্ন সামঞ্জস্যশীল।”
পাশ্চাত্য সভ্যতার জন্য অন্ধ আনুগত্যের ফলে ১৯০১ সনে কাসেম আমীন বুঝতেই পারেননি যে, পাশ্চাত্যের এই নারী মুক্তিবাদী প্রচারণা পরবর্তী প্রজন্মকে ব্যাপকভাবে অবাধ, সার্বজনীন ও অবৈধ যৌনতা চরিতার্থতার দিকে নিয়ে যাবে এবং তা মানুষের সহজাত পারিবারিক বন্ধনকে সম্পূর্ণরুপে ছিন্ন করে দেবে।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে কাসেম আমীন তার এই বইয়ের মাধ্যমে মুসলিম রমণীর পর্দার বিরুদ্ধে প্রচারণার যে তুফান তুলেছিলেন তার প্রতি খৃষ্টান মিশনারী ও পশ্চিমা আধিপত্যবাদীদের সর্বাত্বক সমর্থনের ফলে তা মুসলিম সমাজের অভাবনীয় পরিবর্তন সাধন করে। এই প্রচারণার ফলে প্রত্যেক মুসলিম দেশে আগাছার মত একদল উশৃংখল মহিলা বেড়িয়ে আসলো- যারা মুসলিম নারীর সঠিক দায়িত্বানুভূতিকে ধ্বংস করে দিয়ে তাদের জীবন পদ্ধতিকে পশ্চিমা নষ্ট মেয়েদের জীবন পদ্ধতির সাথে একাকার করে দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো।
——————-
নারী স্বাধীনতা ও ইসলাম
আধুনিক বিশ্বে এমন কোন মুসলিম দেশই হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে দেশ পাশ্চাত্যের নারী স্বাধীনতাবাদীদের মারাত্বক প্রচারণার স্বীকার হয়নি এবং পর্দা প্রথাকে একটি প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মীয় বিধানরুপে চিহ্নিত করেনি, কিংবা তথাকথিত নারী স্বাধীনতাকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির অপরিহার্য অংশ হিসেবে মেনে নেয়নি। যেমন- ১৯৭৬ সনের ১৯শে অক্টোবর পাকিস্তান টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ডক্টর মুহাম্মদ মুকাদ্দাম বলেন, “কোন দেশেই আধুনিকীকরণ করা সম্ভব নয় যদি না সে দেশের নারী সমাজকে ধর্মীয় গোঁড়ামী থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করা যায়। প্রাচ্যের অনেক দেশেই আধুনিকতার ছোঁয়া লাগতে দেরী হয়েছে নারী সমাজকে স্বাধীনতা দানের ব্যাপারে সে সকল দেশের জনগণের মাঝে প্রোথিত গোঁরামী ও আদিম বিশ্বাসের কারণেই। পৃথিবীর অপরাপর দেশের সাথে যদি তাল মিলিয়ে না চলতে পারি তাহলে আমরাও স্বাধীন জাতি হিসেবে টিকে থাকতে পারবো না। এশিয়ার ও আফ্রিকার সকল উন্নয়নশীল দেশে নারী সমাজের ভূমিকা সুস্পষ্ট। দেশের উন্নয়নের জন্য তাদেরকে অবশ্যই সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সকল কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ জরতে হবে। কিন্তু সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো দেশের কিছু সংখ্যক লোক বিষয়টি বুঝতেই চায় না।”
১৯৭৬ সনের আগস্ট মাসে পাকিস্তান জাতীয় সংহতি পরিষদের উদ্যোগে লাহোরে অনুষ্ঠিত “পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দু’দশকে নারী স্বাধিকার” শীর্ষক সেমিনারে উপরোক্ত বক্তব্যের ঠিক এইরূপ মন্তব্য করা হয়। যদি আমরা নিজেদেরকে মুসলিম বলে দাবী করি এবং আমাদের এই দেশ গঠনের আদর্শিক ভিত্তি ইসলাম বলে মনে করি তবে কি এটা জানা আমাদের জন্য কর্তব্য হয় না যে, ইসলাম নারী স্বাধীনতার ব্যাপারে আমাদের কি শিক্ষা দিয়েছে ?
নারী অধিকার সম্পর্কে মত প্রকাশ করতে গিয়ে সূরা নিসার ৩৪নং আয়াতে বলা হয়েছে, “পুরুষরা হচ্ছে নারীদের তত্বাবধায়ক। কারণ, আল্লাহ্ পুরুষদেরকে নারীদের চেয়ে বেশী যোগ্যতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন এবং পুরুষেরা নারীদের জন্য তাদের অর্থ ব্যয় করে।”
এ কথার তাৎপর্য হলো, কোন মুসলিম নারীই ততক্ষণ পর্যন্ত নিজের জীবিকা অর্জনে বাধ্য নয় যতক্ষণ পর্যন্ত না তার জীবন ধারণের মত সামর্থ থাকবে, তার স্বামী মারা না যাবে কিংবা সে তালাক প্রাপ্তা না হবে অথবা তার ভরণপোষণ দেয়ার মত কোন পুরুষ আত্মীয় থাকবে।
কোরআনের শিক্ষা অনুযায়ী স্বামী তার স্ত্রীর জন্য বন্ধু ও কর্তা। স্বামীর কর্তব্য হলো স্ত্রীর প্রতি ন্যায়নিষ্ঠা, ভালোবাসা ও দয়া প্রদর্শন করা এবং এর প্রতিদানে স্ত্রীর দায়িত্ব হলো স্বামীর প্রতি বাধ্য ও অনুগত থাকা এবং স্বামী যাতে চরিত্রহীন হতে না পারে সে জন্য তার প্রতি অকৃত্রিম আস্থা নিবেদন করা।
কোরআনে স্বামীকে স্ত্রীর চেয়ে একমাত্রা ওপরে স্থান দেয়া হয়েছে এ জন্য নয় যে, সে নির্মম অত্যাচারী হবে, বরং তার দ্বারা পারিবারিক সুরক্ষা প্রতিষ্ঠিত হবে সে জন্যেই। যে পরিবারে স্ত্রী আর্থিকভাবে স্বয়ম্ভর সে পরিবারে স্বামী স্বাভাবিকভাবেই পরিবারের কর্তৃত্বের ভূমিকা হারায়। পক্ষান্তরে পরিবারে মায়ের কর্তৃত্ব বেড়ে গেলে পিতার প্রতি সন্তানদের শ্রদ্ধাশীলতা হ্রাস পায়।
সুরা আন-নূরের ৩০-৩১ নং আয়াতে মুসলমান পুরুষদেরকে গায়ের মুহাররাম নারীদের প্রতি এবং মুসলিম নারীদেরকে গায়ের মুহাররাম পুরুষদের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে নিষেধ করা হয়েছে। পুরুষ ও নারী উভয়কেই বলা হয়েছে পরস্পরের চক্ষুকে অবনমিত রাখতে। মেয়ে লোকদেরকে মাথায় চাঁদর পরতে বলা হয়েছে এবং তার আঁচল দিয়ে মুখমণ্ডল ও বক্ষদেশ ঢেকে রাখতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাদেরকে তাদের স্বামী ও বিবাহ নিষিদ্ধ নিকটাত্মীয়দের ছাড়া আর কারো সামনে নিজেদের সৌন্দর্যের প্রদর্শনী করতে নিষেধ করা হয়েছে। প্রায়োগিক ভাবে এই আয়াত দ্বারা মুখমণ্ডলে কসমেটিক্স লাগানো এবং যৌন আবেদন সৃষ্টি করে এমন সব পোশাক পরিধান নিষিদ্ধ হয়েছে।
হাদিস থেকে জানা যায়, রসূল (স)-এঁর স্ত্রী হযরত আয়েশা (রা)-এঁর ছোট বোন হযরত আসমা (রা) একদিন পাতলা কাপড়ের পোশাক পরে রসূল (স)-এঁর সামনে আসলে মহানবী তাঁকে এই বলে তিরস্কার করেছিলেন যে, যখন কোন মেয়েলোক বয়ঃপ্রাপ্ত হয় তখন থেকে তার মুখমণ্ডল ও হস্তদ্বয় ছাড়া কোন কিছুই প্রকাশ করা উচিত নয়। সূরা আল আযহাবের ৫৫নং আয়াতে মহান আল্লাহ্ নবী (স)-এঁর স্ত্রীদের ঘরে গায়রে মুহাররাম পুরুষ ও বেগানা মহিলাদেরকে প্রবেশ করতে নিষেধ করেছেন এবং ৫৯নং আয়াতে মুসলিম নারীদেরকে আকর্ষণীয় পোশাক ও অলঙ্কারাদি পরে বাইরে বের হতে বারণ করা হয়েছে এবং জনসম্মুখে পোশাক ও আচরণে এমন কিছু প্রদর্শন কতে মানা করা হয়েছে যাতে তাদের প্রতি মানুষের আকর্ষণ সৃষ্টি হতে পারে।
স্ত্রীলোকেরা পরিবারের মুহাররামা পুরুষ, চাকর ও দাসদের সাথেই কেবল খোলামেলা কথাবার্তা বলতে পারবে।
সূরা আযহাবের ৫৩ নং আয়াতে বিশ্বাসীগণকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে রসূল (স)-এঁর স্ত্রীদেরকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের এবং তাঁদের নিকট কিছু চাইতে হলে তা পর্দার বাহির থেকে চাইতে। ৫৯ নং আয়াতে যখন কোন কারণে কোন মুসলিম মহিলাকে ঘরের বাইরে যেতে হয় তখন তাকে তার পুরো দেহ একটি চাঁদর দিয়ে ঢেকে নিতে বলা হয়েছে, যাতে করে তাদেরকে ধার্মিক মহিলা হিসেবে চেনা যায় এবং যাতে তারা উত্যক্ত না হয়। কোরআন মহানবী (স)-এঁর স্ত্রীদেরকে এবং প্রয়োগিকভাবে সকল মুসলিম মহিলাদেরকে নির্দেশ দিয়েছে যখন কোন জরুরী প্রয়োজনে কোন গায়ের মুহাররাম পুরুষের সাথে সাক্ষাত করতে হয় তখন যেন সে তার সাথে এমন আবেগময় ভঙ্গি ব্যাবহার না করে যাতে লোকটির মনে প্রেমাভাব উৎপন্ন হতে পারে। বরং কথাবার্তা যেন সাদামাটা ও প্রথাগত হয়। হাদিসে মুসলিম নারীদেরকে স্বামী এবং বিবাহ নিষিদ্ধ নিকটাত্মীয়দের ছাড়া অন্য কারো সাথে (অর্থাৎ মুহাররাম কোন পুরুষের পরিচালনা ব্যতিরেকে) একাকী দূর যাত্রায় বের হতে নিষেধ করা হয়েছে।
যেখানে অধিকাংশ সহীহ হাদিসে মুসলিম নারীদেরকে মসজিদে নামাজের জামায়াতে একত্রিত হতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে এবং গৃহের নিভৃত কোণে নামাজ আদায় করাকেই খোদার কাছে অধিক পছন্দনীয় বলে বর্ণনা করা হয়েছে; সেখানে একজন মুসলিম মহিলার প্রাইভেট সেক্রেটারী, ব্যাংক ক্লার্ক, বিমান বালা, হোটেল পরিচারিকা, বিজ্ঞাপন মডেল, গায়িকা, ড্যান্সার এবং সিনেমা, টেলিভিশন ও রেডিওতে অভিনেত্রীর ভূমিকায় আসাকে কিভাবে বরদাস্ত করা যেতে পারে ?
সুরা আন-নুরের ১-২৪ নং আয়াতে যারা বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক রাখে তাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে কঠিন শাস্তি প্রদানের ভয় দেখানো হয়েছে। ইসলামে এ ব্যাপারে কোন দ্বৈত মাপকাঠির ব্যবস্থা নেই। যারা অবৈধ যৌন সম্পর্ক রাখে সে সকল নারী ও পুরুষের শাস্তির মধ্যে কোরআন ও হাদীসে কোন পার্থক্য করা হয়নি। উভয়ের জন্যই একই রূপ কঠিন শাস্তির উল্লেখ করা হয়েছে। কোরআন ও হাদিসের এই প্রমাণ ছাড়া পর্দার সপক্ষে ইসলামের অধিক আর কি প্রমাণ দরকার হতে পারে ? মুসলিম মহিলাদের চলাফেরার ক্ষেত্রে এই নিষেধাজ্ঞা শুধুমাত্র নারীদের প্রতিরক্ষা এবং পুরুষদেরকে তাদের প্রতি অশুভ পদক্ষেপ থেকে সংযত রাখার উদ্দেশ্যেই আরোপিত হয়েছে। পৃথিবীতে ইসলামই হলো একমাত্র ধর্ম যা শুধু অনৈতিকতাকে মন্দ বলেই ক্ষান্ত হয় না বরং অনৈতিকতাকে উদ্দীপ্ত করে এমন যে কোন সামাজিক কর্ম থেকে বিশ্ববাসীদেরকে ফিরে থাকতে আদেশ দেয়।
নারী স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম প্রবক্তা হচ্ছেন সাম্যবাদের প্রতিষ্ঠাতা মার্কস ও এঙ্গেলস। ১৮৪৮ সনে প্রকাশিত তাদের কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো বইয়ে তারা লিখেন, “গৃহ ও পরিবার একটি অভিশাপ ছাড়া কিছুই নয়। কারণ, এটি নারীদেরকে চিরস্থায়ীভাবে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রাখে।” তারা বলেন, “ নারীদেরকে পারিবারিক বন্ধন থেকে মুক্তকরে দিতে হবে এবং কল-কারখানায় সার্বক্ষনিক কর্মসংস্থানের মাধ্যমে তাদেরকে পুরোপুরি অর্থনৈতিক স্বয়ংম্ভরতা অর্জনের সুযোগ দিতে হবে।” তাদের পরবর্তী নারীবাদী প্রবক্তারা সহশিক্ষা, ঘরের বাইরের একই কর্মস্থলে সহকর্মাবস্থান, সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে নারী-পুরুষের একত্র মিলন, অর্ধনগ্ন পোশাকে বিবাহপূর্ব প্রেম-অভিসার এবং যূথ সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে মদ্যপান, নেশাপান ও নৃত্যগানের মাধ্যমে নারী-পুরুষের অবাধ যৌনাচারের সুযোগদানের জন্য জিদ ধরেন। এক্ষেত্রে তারা সরকারি ব্যবস্থাপনায় জন্মনিরোধক সামগ্রী, বন্ধাকরণ ব্যবস্থা, অবাঞ্ছিত গর্ভের বিমোচন, অবৈধ সন্তানদের লালন পালনের জন্য রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত নার্সারী ও বোর্ডিং- এর ব্যবস্থা রাখার দাবী করেন। এটাই হচ্ছে আধুনিক “নারী অধিকার” তত্ত্বের মূলগত ধারণা।
লাহোরের গুলবার্গ গার্হ্যস্ত অর্থনীতি বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে তেহরান ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যাঞ্চেলর শ্রোতাদের এ কথা বুঝাতে চেষ্টা করেন যে, “আধুনিক সভ্যতার যেটুকি খারাবী যোগ হয়েছে তা অতি উদ্বিগ্ন রক্ষণধর্মী প্রতিক্রিয়াশীল ধারণার চেয়ে অনেক কম।” কিন্তু এই ভীতির কারণগুলো কি কারো জানা আছে? দেখুন না, নারী স্বাধীনতার কি ফল পশ্চিমারা ভোগ করছে!
আমেরিকান এক ঐতিহাসিক ও কলামিস্ট ম্যাক্সলার্নার বলেন, “আমরা একটি বেবিলিনীয় সমাজে বাস করছি। ইন্দ্রিয় সেবার প্রতি গুরোত্বারোপ ও যৌন স্বাধীনতার ফলে সমাজের সকল পুরাতন নীতি-নৈতিকতার বন্ধন ভেঙ্গে গেছে।” কিছুদিন আগেও কি জনসম্মুখে প্রকাশ করা যাবে কিংবা যাবে না তা নির্ধারণ করতো চার্চ, রাষ্ট্র, পরিবার ও সম্প্রদায়। কিন্তু অধুনা এ সকল প্রতিষ্ঠানগুলো জনসাধারণের দাবির কাছে পরাজিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর এখন দায়িত্ব দাঁড়িয়েছে শুধুমাত্র শোনা ও দেখা। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্র দর্শকরা প্রতিদিন আর্ট গ্যালারী ও নাট্য গৃহসমূহে একত্রিত হচ্ছে উলঙ্গপ্রায় সুইডিশ নায়িকার ‘আমি এক নারী’ সিরিজের পর্ণ নাচ গান দেখে যৌন উত্তেজনা প্রবল করার জন্য। ইটালীয় সিনেমা পরিচালক ম্যাকিল্যানজেলো এন্টোনিওনি তার ‘ভেঙ্গে দাও’ ছায়াচিত্রে নগ্নতা বিরোধী সকল ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার মাথা খেয়েছেন। ফরাসী কৌতুক প্রিয় নায়িকা জেনফন্ডা সীমাহীন প্রলোভনধর্মী ছায়াছবি বারবারেলায় মুক্ত প্রেমাভিসারের গুণ কীর্তন করতে করতে একটি নগ্নতার দৃশ্য থেকে পরবর্তী অধিকতর আর একটি নগ্নতার দৃশ্যে ভেসে বেড়াচ্ছেন। কমপক্ষে দু’ঘণ্টা স্থায়ী ‘জেসনের প্রতিকৃতি’ নামক ছায়াচিত্রে একজন নিগ্রো বেশ্যা পুরুষের বিকৃত আত্মার ভ্রমণ কাহিনী এখন আমেরিকার প্রায় সকল পেক্ষাগৃহগুলোতেই খোলাখুলিভাবে দেখানো হয়ে থাকে, যা মানব জীবনের দিকগুলোকে সংকুচিত করেছে। খৃষ্টীয় ধর্মতত্ত্ববিদ ফাদার ওল্টার জে. ওং বলেন, “আমরা শীঘ্রই জানা অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে অধিক মাত্রায় স্বাধীন জীবন যাপনের সুযোগ পাচ্ছি…..।” (রিডার্স ডাইজেস্টের ১৯৬৮ সালের এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত “সমাজ যেদিকে যাচ্ছে আমাদের সব কিছু সেদিকে যাচ্ছে” নামক নিবন্ধ থেকে)।
আসুন পাশ্চাত্যের এই সামাজিক অবক্ষয়ের কি প্রভাব মুসলিম দেশগুলোর ওপর পড়েছে তা দেখা যাক। নারী স্বাধীনতা ও নৈতিক অধঃপতনের একটি প্রধান ও কার্যকর মাধ্যম হলো সিনেমা। “লাহোরের হিরামন্ডি জেলার প্রতিটি মেয়েরই আকাংখা হচ্ছে অভিনেত্রী হওয়া। তারা সকলেই চাচ্ছে চিত্রনায়িকা হতে। এই ইচ্ছার বাস্তবায়নের জন্য তারা যে কোন প্রকার ত্যাগ স্বীকার করতে রাজী আছে। এদের একটি বিরাট সংখ্যক মেয়ে তাদের নায়িকা হওয়ার আকাংখা পূরণের শর্তে তাথাকথিত সিনেমা পরিচালক ও প্রযোজকদের খুশী করার জন্য যে কোন জায়গায় উপস্থিত হতে রাজী রয়েছে। সিনেমা শিল্পের দ্বারা খুব সহজে ও সাধারণভাবে বিভ্রান্ত মেয়েলোক এরাই। এদের অধিকাংশই টুকিটাকি কিছু অভিনয়ের সুযোগ পেলেই খুশী। অতিরিক্ত বেশ কিছু মেয়ে এভাবেই সিনেমার সাথে সংশ্লিষ্ট হয়। এদের মধ্যে সামান্য কয়েকজন অবশ্যি প্রতিষ্ঠাও পায়। শহরের অনেক হোটেলেই “শুভ সময়” এর কাজে ব্যবহৃত হয়। কতিপয় হোটেল পরিচালক থাকে কোটনার ভূমিকায়। অধিকাংশ রেস্তোরাঁ ব্যবহৃত হয় খদ্দেরের সাথে নষ্টা মেয়েদের সাক্ষাতের স্থান হিসেবে। এ সকল মেয়ে লোকদেরকে নগরীর বাস স্ট্যান্ডগুলোতেও দেখা যায়। শহরের প্রেক্ষাগৃহগুলোও খদ্দের ধরার জন্য খুবই পরিচিত স্থান। প্রেক্ষাগৃহগুলো যে সিনেমা দেখা ছাড়া অন্য কোন কাজে ব্যবহৃত হয় না তাও নয়। এ সকল ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা খুবই শিথিল।” (১৯৬৮ সালের ২৯ ও ৩০শে মার্চ তারিখে ‘দি পাকিস্তান টাইমস’-এ প্রকাশিত ‘লাহোরে বেশ্যাবৃত্তি’ নামক প্রতিবেদন থেকে)।
ক্রিস্টাইন কিলার অথবা মেরিলিন মনরোর মত মহিলা সেনাবাহিনী গঠন করা কি আমাদের জাতীয় উন্নয়নের অংশ হতে পারে?
নারী স্বাধীনতার পক্ষে পত্র-পত্রিকা, রেডিও এবং সিনেমার প্ররোচনা স্ত্রী ও সন্তানের মা হিসেবে নারীর ভূমিকাকে তাছিল্য ও খাটো করেছে। সন্তানের লালন-পালনের জন্য নারীদের গৃহে অবস্থানকে এই প্রচারণা জাতীয় অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অর্ধেক জনশক্তির অনুপস্থিতির ফলে অমার্জনীয় ক্ষতির কারণ বলে বর্ণনা করেছে।
রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বে মুসলিম দেশসমূহে সহশিক্ষার দ্রুত প্রসারের ফলে ছেলে মেয়েদের মধ্যে অবাধ মেলামেশা ও যৌন অপরাধ প্রবণতা এমনভাবে বেড়েছে যে, তা অজস্র যুবক-যুবতীকে ধ্বংসের মুখোমুখি করে দিয়েছে এবং বিস্তর ঘটিয়েছে অসংখ্য পাপ কর্মের। সহশিক্ষা এই ভ্রমাত্মক ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে জন্মগত কোন পার্থক্য নেই, সুতারাং উভয়কেই একই কর্মক্ষেত্রে অভিন্ন কাজের জন্য নিজেদের গড়ে তুলতে হবে। ফলতঃ যে সকল মেয়ে সহ-শিক্ষা গ্রহণ করে তারা খুবই খারাপভাবে নিজেদেরকে বিবাহ ও মাতৃত্বের জন্য প্রস্তুত করে। এরপরও নারী স্বাধীনতাবাদীরা বলে থাকেন মেয়েদের প্রাথমিক দায়িত্ব স্বামীর গৃহেই। এ কথার অন্য অর্থ দাঁড়ায়, আধুনিক নারীদেরকে দ্বৈত দায়িত্ব পালন করতে হবে। নিজের জীবিকার জন্য সারাক্ষণ ঘরের বাইরে কাজ করার পরও ঘরে ফিরে তাকে সন্তানের লালন-পালন, ঘরদোর সাজানো ও স্বামীর প্রয়োজন পূরণের মত অসম্ভব প্রায় সব বাধ্যবাধকতা পালন করতে হবে। এটাও কি ন্যায় বিচার?
মুসলিম দেশসমূহে অধুনা পাশ্চাত্যের আইনের অনুরূপ যে পারিবারিক আইন পাশ করা হয়েছে, সে আইন কি বাস্তবিকভাবে আমাদের নারী সমাজের কোন উন্নয়ন ঘটিয়েছে? এই আইন সতর্কভাবে বিবাহের জন্য একটি বয়সসীমা নির্দিষ্ট করে দেয় বটে, কিন্তু এই বয়স সীমার নিচে ( বিবাহ নিষিদ্ধ বয়সে) ছেলে-মেয়েদের অবৈধ যৌন কর্মের ওপর কোন নিষেধাজ্ঞা জারী করার বিষয়টি বেমালুম ভুলে যায়।
অধিকাংশ মুসলিম দেশে আধুনিকতাবাদীরা কোরআন ও সুন্নাহর আইন লঙ্ঘন, বহুবিবাহ প্রথাকে অত্যন্ত সীমাবদ্ধ, এমনকি নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেছে। তারা কখনই এই মানসিক অবস্থাটা বুঝতে চাচ্ছেন না যে, একজন স্ত্রীর পক্ষে তার স্বামীর অন্য একজন স্ত্রী যিনি তার নিরাপত্তাধীনে রয়েছেন এবং তার সন্তানেরা পিতার ভালোবাসা ও যত্ন পাচ্ছেন তার সাথে স্বামীর ভালোবাসাকে ভাগাভাগি করে নেয়া ভালো, না দেশীয় আইনে বর্তমান স্ত্রীকে তালাক না দিয়ে এবং তার সন্তানদের সহ তাকে তাড়িয়ে না দিয়ে অন্য কোন স্ত্রী গ্রহণে বাধা আছে বলে গোপনে কোণ মহিলার সাথে অবৈধ সম্পর্ক রেখে চলছে তা দেখা ভালো?
এটা কি সেই মহিলার জন্য কল্যাণকর নয়, যে তার স্বামীর সাথে ভালোভাবে থাকতে পারছে না, তাকে তার স্বামীর ব্যক্তিগতভাবে তালাক দিয়ে দিবেন এবং এই দম্পতি শান্তিপূর্ণভাবে পৃথক হয়ে গিয়ে আবার নতুন করে পছন্দমত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবেন? না, সেইটা ভালো যে, তাদের বিষয়টি কোর্টে যাবে এবং স্বামী এই বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য কোর্ট নির্ধারিত ডিভোর্সের “প্রয়োজনীয় শর্ত” পুরণার্থে বাধ্য হয়ে স্ত্রীর ওপর অনৈতিক আচরণ ও পাগলামির মিথ্যা দোষারোপ করবে, যা মহিলাটির জন্য সামাজিক কলঙ্ক হয়ে দাঁড়াবে এবং বেচারিনীর সকল সুনাম সুখ্যাতি জীবনের তরে ধূলিস্ব্যাত করে দেবে?
প্রকিতপক্ষে নারী স্বাধীনতাবাদের প্রবক্তারা নারীর ব্যক্তিগত সুখ সুবিধার প্রতি আগ্রহশীল নয়। লাহোরে ‘নিখিল পাকিস্তান মহিলা পরিষদ’ আয়োজিত এক সিম্পোজিয়ামে পরিষদের এক সক্রিয় সমর্থক জনাবা সাতনাম মাহমুদ তার বক্তব্যে সরলতার সাথে এ কথা স্বীকার করেন যে, যদিও পাশ্চাত্যের মহিলারা বস্তুগত প্রাচূর্য এবং সামাজিক পূর্ণ স্বাধীনতা ও সম-অধিকার ভোগ করছে, তথাপি তারা কাঙ্ক্ষিত সুখে সুখী নয়। তিনি বলেন, যদি আত্মীক সুখই লক্ষ্য হয় তবে তার সমাধান তথাকথিত নারী স্বাধীনতার মধ্যে পাওয়া যাবে না। সুবিধাবাদী সমাজকর্মী এবং উক্ত মহিলা পরিষদের অন্যতম সদস্যা বেগম কাইসেরা আনোয়ার আলী তার বক্তব্যে যে সকল উচ্চ শিক্ষিতা মহিলা নিজ ধর্ম, সংস্কৃতি ও জাতীয় ভাষা সম্পর্কে অজ্ঞ তাদের বিষয়ে এমনভাবে নৈরাশ্য প্রকাশ করেন যে, তাদের সংগঠন মেয়েদের এই উন্নাসিকতার যে সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষক তা যেন তিনি জানেনই না।
“সকল মুসলিম দেশেই নারী স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে”- এ প্রচারণার আসল উদ্দেশ্য কি? এটা আসলে একটি মারাত্মক ষড়যন্ত্র যা আমাদের সংসার, পরিবার এবং এমনকি গোটা সমাজ ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে দিতে চায়। ‘নারী অধিকার’, ‘নারী স্বাধীনতা’ ও ‘নারী উন্নয়ন’ প্রভৃতি সস্তা স্লোগান শুধুমাত্র মূল উদ্দেশ্যকে কুহেলিকার আবরণে ঢেকে রাখার জন্যেই।
মুসলিম বিশ্বে নারী মুক্তি আন্দোলন সেই চরম পরিণতিই ডেকে আনবে যা বিশ্বের অন্যান্য স্থানে এখন ঘটছে। যৌন বিষয়ে বিশ্বব্যাপী আজকের মানব সম্প্রদায় যে হারে ন্যাকারজনক আচরণে লিপ্ত হয়েছে তা বন্য পশুদের বিবেককেও হার মানায়। এই আচরণের অনিবার্জ পরিণতিতে সংসার ও পরিবার পদ্ধতিসহ সামাজিক সকল নৈতিকতার বন্ধন সম্পুর্নরূপে ভেঙ্গে পরবে এবং ব্যাপকভাবে কিশোর অপরাধ, দুর্নীতি, নির্যাতন, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আইনের কার্যকরীহীনতা দেখা দিবে। অতীতের সকল ইতিহাসই এর যথার্থ সাক্ষী যে, যখনই কোন সমাজে পাপ ও অনৈতিকতার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে সে সমাজ আর বেশীদিন টিকে থাকতে পারেনি।
——————–