নারী সমবাদী আন্দোলন ও মুসলিম নারী
বর্তমান সময়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী একটি মৌলিক আন্দোলন যা গোটা সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন এবং সকল মানবিক সম্পর্কের পরিবর্তন দাবী করেছে, তা হচ্ছে নারী সমবাদী আন্দোলন। “নারী মুক্তি আন্দোলন” নামেই এটি অধিক পরিচিত।
‘নারী মুক্তি আন্দোলন” বর্তমান যুগের কোন একক সৃষ্টি নয়। এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট প্রাচীনকাল পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছে। প্লেটো তার “দি রিপাবলিক” গ্রন্থে পারিবারিক জীবন ও নারী পুরুষের দ্বারা চিহ্নিত সামাজিক সম্পর্কের অবসান দাবী করেছেন। প্রাচীন মিলনাত্মক নাটক লাইসিস্ট্রাটা এবং ব্যয়গত শতাব্দীতে হেনরিক ইবসেন্সের (১৮২৮-১৯০৬) লেখা “পুতুলের ঘর” নাট্যে এই নারীবাদী ধারণার পৌরোহিত্য করা হয়েছে। ভিক্টোরিয়ান যুগের অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক জন স্টুয়ার্ড মিল এবং সমাজবাদী দার্শনিক জন স্টুয়ার্ড মিল এবং সমাজবাদী দার্শনিক ফ্রেডারিখ এঞ্জেলস ১৮৬৯ সনে লেখা “নারী পরাধীনতা” (Subjection of women) নামক প্রবন্ধে নারী মুক্তিবাদের তাত্ত্বিক ভিত্তি প্রদান করেন। ১৮৮৪ সালে এঞ্জেলস জন সমক্ষে ঘোষণা করেন যে, “বিবাহ হচ্ছে এক ধরণের নিরানন্দ দাসত্ব বরন”। বিবাহ প্রথার উচ্ছেদ করে তিনি সরকারী ব্যবস্থাপনায় সন্তান লালন পালনের পরামর্শ দেন।
আমেরিকায় “নারী স্বাধীনতা” আন্দোলন শুরু হয়েছিল দাশ প্রথার বিলোপ ও মাদক বিরোধী আন্দোলনের বাড়তি অংশ হিসেবে। যে সকল মহিলা এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন তারা দেখলেন যে, তাদের দাবি জোড়াল করতে হলে তাদের রাজনৈতিক শক্তি দরকার। ১৮৪৮ সনের সেনেকা ফলস কনভেনশন (Seneca Falls Convention) এই “নারী মুক্তি আন্দোলনের” পথিকৃত। এই কনভেনশনের ঘোষণা পত্রে মহিলাদের নিজ সম্পত্তি ও উপার্জনের উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব, স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে ডিভোর্স করার ক্ষমতা, সন্তানদের ওপর মায়ের অভিভাবকত্ব, চাকুরী ক্ষেত্রে নারী পুরুষের ভেদাভেদ দূরীকরণ পূর্বক একই কাজে সম বেতন-ভাতা নির্ধারণ এবং নির্বাচনে মহিলাদের ভোটাধিকারসহ প্রতিনিধিত্বের দাবী করা হয়।
মহিলা ভোটাধিকারের প্রচারণা যখন শুরু হল অধিকতর রক্ষণশীল নারীবাদীরা তখন তাদের সকল কর্ম প্রচেষ্টা শুধু এই একটি ইস্যুতে নিবন্ধ করলেন। ১৯২০ সালে মার্কিন সংবিধানের যখন ১৯ তম সংশোধনী আনা হল তখন দেখা গেল মহিলা কর্মীরা এবং জনগণ যা ধারণা করেছিলেন অর্থাৎ নির্বাচনে মহিলাদের ভোটাধিকার, তা পুরোপুরি এই সংবিধানে মেনে নেয়া হয়েছে। এরপর থেকে চল্লিশ বছরেরও অধিককাল নারীবাদী আন্দোলন অন্তর্নিহিত ছিল।
১৯৬১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট এফ, কেনেডি মহিলাদের সামাজিক মর্যাদা সংক্রান্ত একটি প্রেসিডেন্টস কমিশন গঠন বিষয়ে প্রশাসনিক আদেশে স্বাক্ষর প্রদান করেন। এই আদেশের বিষয়বস্তু ছিল, যে সকল প্রচলিত ধারণা, প্রথা, রীতি-নীতি, “নারী অধিকার” বাস্তবায়নে বাঁধা দেয় সেগুলো চিহ্নিত করা এবং তার প্রতিকারের সুপারিশ করা। এই প্রেসিডেন্টস কমিশন গঠনই হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মহিলাদের অবস্থান নির্ধারণ সম্পর্কিত প্রথম সরকারী পদক্ষেপ। এভাবে ১৯৬০ এর দশকের প্রথম ভাগেই সভা, সমাবেশ, মিছিল ও প্রতিরোধ কর্মসূচীর মাধ্যমে ৫০ বছরের সুপ্ত নারীবাদী আন্দোলন আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো এবং কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা এ সকল রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশ নিতে শুরু করলো। ১৮৪৮ সালে সেনেকো ফলস কনভেনশনে উপস্থিত মহিলারা তো শুধু মাতাল স্বামীদের দ্বারা গালি গালাজ ও দূর্ব্যবহারের প্রতিবাদ এবং বিবাহে নারীর আইনগত অধিকার, সম্পত্তি সংরক্ষণ, রোজগারের অধিকার ও একই কাজে মহিলা পুরুষের সম-বেতন দাবী করেছিলেন। কিন্তু তাদের এই উত্তরাধিকারিণীরা ছিলেন তাদের চেয়ে অনেক বেশী চরমপন্থী।
ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এবং দৃষ্টি আকর্শনী নারী সাম্যবাদী বিক্ষোভ সমাবেশ হয় ১৯৭০ এর ২৬শে আগস্ট। এই দিন হাজার হাজার মহিলা প্লাকার্ড বহন করে নিউ ইয়োর্কের ফিফথ এভিনিউতে সমবেত হন। এ সকল প্লাকার্ডে লেখা ছিলঃ “গৃহ বঁধুরা বিনা মাহিনায় দাসী মাত্র”, “গৃহ কর্মের জন্য সরকারী ভাতা চাই”, “নির্যাতিতা নারী, ভাত রেঁধো না, স্বামীকে সারা রাত উপোষ রাখো”, “মানবিক সহানুভূতি ভুলে যাও”, “বিবাহে জড়িয়োও না”, “তোয়ালে ধোয়া মহিলাদের কাজ নয়”, “গর্ভমোচন বৈধ কর”, “অধীনতা সুস্থ জীবনের জন্য কাম্য নয়” ইত্যাদি।
বর্তমান সময়ের নারীবাদীরা লিঙ্গের ভিন্নতা দ্বারা নির্ধারিত যে কোন সামাজিক কর্মকান্ডের ঘোর বিরোধী। তারা পুরুষের সাথে নারীর নিরংকুশ ও শর্তহীন সমতা দাবী করছেন, এমনকি তা দেহের গঠনগত বিষয়েও। নারী ও পুরুষের মধ্যে সৃষ্টিগত কোন পার্থক্য থাকতে পারে নারীবাদীরা তা স্বীকার করেন না। তাই স্ত্রীকে ঘরণী ও সন্তানের মা হতে হবে এবং স্বামী হবেন উপার্জনকারী ও গৃহকর্তা তা তারা মানতে রাজী নন। তারা বিশ্বাস করেন- নারীকেও পুরুষের মত যৌন কার্যে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে, নিষ্ক্রিয় হলে চলবে না। তারা এ জন্য বিবাহ পদ্ধতি, সংসার ও পরিবার প্রথার বিলোপ এবং সরকারী ব্যবস্থাপনায় সন্তান লালন পালনের ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে নারী জাতির পূর্ণ যৌন স্বাধীনতা দাবী করেন। তারা সকল নারীকে যৌন জীবনের ওপর পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জোর দেন। এ জন্য তারা জন্ম নিরোধক সকল সামগ্রীর ওপর সরকারী নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার জোর দাবী করেন, যাতে এ সকল সামগ্রী বিক্রয়ের জন্য বিজ্ঞাপন প্রচারিত হতে পারে এবং বিবাহিত অবিবাহিত সকল বয়সের সকল মেয়েরাই ডাক্তারি ব্যাবস্থাপত্র ছাড়াই যে কোন ঔষধের দোকান থেকে তা ক্রয় করতে পারে। তারা দাবী করেন, গর্ভপাত সংক্রান্ত সকল বাধা নিষেধ তুলে দিতে হবে এবং যে কোন বয়সের গর্ভবিমোচনে নারীকে পূর্ণ অধিকার দিতে হবে। শুধু প্রয়োজনে গর্ভপাতের সুযোগ থাকলেই চলবে না বরং গরীব মহিলারা যাতে ইচ্ছা করলেই গর্ভপাত করতে পারে, সে জন্য সরকারী ব্যবস্থাপনায় বিনামূল্যে গর্ভপাতের ব্যাবস্থা করতে হবে। স্কুলগুলোতে সকল বিষয়ে সহশিক্ষা প্রবর্তন করতে হবে। গার্হস্থ অর্থনীতি শুধু মেয়েদের জন্য এবং বিপণন ও কারিগরি শিক্ষা শুধু ছেলেদের জন্য নির্ধারিত থাকবে তা হবে না। ব্যায়ামাগার গুলোতে এবং শারীরিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ছেলে মেয়েদীর জন্য পৃথক ব্যবস্থা তুলে দিতে হবে। মেয়েদেরকে সকল বয়সের ছেলেদের সাথে খেলাধুলা ও শরীর চর্চা প্রতিযোগীতা করার অনুমতি দিতে হবে। প্রচার মাধ্যম গুলোকে যৌনতার পার্থক্য সূচক শব্দও পরিহার করে “কর্মে ও উৎপাদনে নারী-পুরুষ সমান” এ ধারণার প্রচারণা চালাতে হবে। নারীবাদীরা শিশুতোষ পুস্তকাদির সমালোচনা করেন এ জন্য যে, এগুলোতে একক মা কিংবা বাবার পরিবারের উদাহরণ নেই এবং অবিবাহিতা ও স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া নারীর মাতৃত্বকে আদর্শ হিসেবে দেখানো হয়নি। তারা বলেন, মায়েদের খেলার জন্য দিতে হবে মেকানিক্যাল টয় এবং ছেলেদের হন্য যান্ত্রিক পুতুল। চরমপন্থি নারীবাদীরা বিবাহ, সংসার ও পরিবার সংক্রান্ত সকল প্রচলিত পদ্ধতি তুলে দিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এলাকায় বসবাসরত সকল নারী পুরুষকে একটি বৃহৎ যৌন জোনে পরিণত করার প্রস্তাব দেন এবং সন্তান লালন পালন সম্পুর্ণ সরকারী ব্যবস্থাপনাধীনে রাখার দাবী করেন। এ জন্য তারা আমেরিকায় যেমন প্রায় সকল এলাকায় জনগণের চিত্তবিনোদনের জন্য পার্ক, লাইব্রেরী ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা গড়ে উঠেছে তেমনি সকল এলাকায় সরকারী ব্যবস্থাপনায় বিনামূল্যে শিশু যত্ন কেন্দ্র চালু করার দাবী করেন। তাদের দাবী হল পেশা গ্রহণে নারীত্ব কোন রূপ বাধা হতে পারবে না।
১৯৭১ সালে “দি নিউ ইয়র্ক টাইমস” পত্রিকায় প্রকাশিত “নারীবাদের পূনর্জন্ম” নামক এক প্রবন্ধে লিখিত হয়ঃ
“অনেক মহিলা বলতে পারেন যে, তারা সনাতন পন্থা অবলম্বন করতে চান। কিন্তু সেটা খুবই ভীতিজনক অথবা সেটা ভাবাই কঠিন বলে করতে পারছেন না। হ্যাঁ, পুরাতন নিয়মগুলোর মধ্যে একটা নিরাপদ ব্যাবস্থা আছে বলে মনে হতে পারে। তবে সেটা তেমনি, যেমন কেউ জেলখানার মধ্যে কোন ক্ষমতা অর্জন করলো, আর তার কাছে মনে হল বাইরের জগতটা ভয়াবহও। সম্ভবত এ সকল মহিলা কোন বিষয়টি পছন্দ করবেন তা স্থির করতে পারছেন না, ভয় পাচ্ছেন। আমরা মহিলাদের ওপর কোন কিছু চাপিয়ে দিতে চাই না। আমরা চাই শুধু তাদের নিকট গ্রহণীয় হতে পারে এমন সব বিকল্প দিকগুলো তুলে ধরতে। আমরা খুঁজে বের করেছি এমন সব পছন্দনীয় জিনিস যা গ্রহণ করলে একজন মানুষ সত্যকারের মানুষ হতে পারে। আমরা চাই মানুষকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে। কোন প্রথা, আইন বা মানসিক দাসত্বের দ্বারা তাদেরকে শৃঙ্কখলাবদ্ধ করতে চাই না। প্রকৃতিতে যদি এর জন্য স্থান না থাকে তবে প্রকৃতি এর জন্য স্থান করে দিতে বাধ্য।”
নারীবাদীরা মহিলাদের জন্য যে সকল “বিকল্প পছন্দ” খুঁজে বের করেছেন তার মধ্যে একটি হল নারী সমকামীতা (লেসবিয়ানিজম)। নারী স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি শাখা হল সমকামী সংগঠন যা “দি ডটারস অব বিলিটিস” নামে পরিচিত। এর লক্ষ্য হল নারী সমকামীটার প্রসার ঘটানো।
“নারীবাদের পূণর্জন্ম” বইয়ের অন্যত্র বলা হয়েছে, “নারী স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক সদস্যা রয়েছেন যারা এ আন্দোলন শুরু করার আগেই সমকামী ছিলেন এবং কিছু সদস্যা যারা এই আন্দোলনে অংশগ্রহণের পর সমকামী হয়েছেন। পরে সমকামী হওয়াদের মধ্যে কতিপয় রয়েছেন যারা এটা বেছে নিয়েছেন রাজনৈতিক প্রতিবাদ হিসেবে। এই চরম নারীবাদীদের মতে “নারী সমকামীতা” পুরুষের অত্যাচার থেকে নারীর আত্মরক্ষার একটি মাধ্যম।”
নিউ ইয়র্ক থেকে ১৯৭০ সালে প্রকাশিত নারী স্বাধীনতার উদ্দেশ্য সংক্রান্ত “দি নিউ ওম্যান” নামক একটি সংকলন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছেঃ আমেরিকায় লেসবিয়ানরা সংখ্যালঘু, কিন্তু এই সংখ্যা এক কোটির কম নয়। লেসবিয়ান হচ্ছে সে সকল নারী যারা পুরুষদের চেয়ে মেয়েদের প্রতি বেশী প্রেমাসক্ত হয়। সমকামিতা সম্পর্কে সম্ভবত সবচেয়ে বেশী যুক্তি প্রয়াসী এবং সবচেয়ে কম বাতিকগ্রস্থ মন্তব্য করেন দু’জন প্রখ্যাত মানসিক রোগের চিকিৎসক ডঃ জোয়েল ফোর্ট ও ডঃ জো, কে, অ্যাডামস। ১৯৬৬ সনে প্রকাশিত তাদের এই মন্তব্যটি হচ্ছেঃ ভিন্ন কামীদের মত সমকামীরাও একই মানব গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। কোন আইন বা কোন সামাজিক সংগঠক কিংবা চাকুরী দাতাদের দ্বারা এদেরকে একটি ভিন্ন মানব গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। যৌন আচরণ সংক্রান্ত আইনের সংশোধন করতে হবে যাতে তা সমাজ বিরোধী যুব আচরণ, বলাৎকার ও উৎপীড়ন ইত্যাদি নিয়ে কাজ করতে পারে। পারস্পরিক সম্মতিতে বয়স্কদের মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে সংঘটিত যে কোন যৌন আচরণকে রাষ্ট্রীয় কিংবা সরকারী হস্তক্ষেপ যোগ্য কোন বিষয় হিসেবে গণ্য করা চলবে না।”
বিবর্তনকারী এই নারী স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিণতি কি এবং কি ধরণের সমাজ ব্যবস্থা তারা চাচ্ছেন তা এখন ভেবে দেখুন।
একই পুস্তকের ১২২-১২৫ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছেঃ “এভাবে পুরুষের কাছে নারী- যেমন দেবতার কাছে উপাসক। দেবতা উপাসকের পূজা গ্রহণ করতে পারে, কিন্তু তাকে আপন করে নিবে না, বরং তাকে পরে পায়ে ঠেলে দিতে। দেবতা উপাসক কখনো এক হতে পারে না। যৌন জীবন সম্পর্কে আমাদের সামাজিক শিক্ষা হল যৌবন উন্মেষের প্রথম দশ বছর কঠোর সংযম অবলম্বন করতে হবে (এমন কি হস্ত মৈথুনকেও এ ক্ষেত্রে বড় জোর একটি অপারগতা গোছের অপরাধ বলে গণ্য করা হয়)। এরপর সারাজীবন শুধু একজনকেই যৌনসংগিনী হিসেবে ধরে রাখতে হবে। প্রকৃতপক্ষে সমাজ আমাদেরকে একটি উন্নত যৌন জীবন সম্পর্কে অজ্ঞ এবং সন্ধিঘ্ন করে রাখার চেষ্টা করছে এবং বুঝাতে চাচ্ছে যে, পাঁচমিশালী যৌনতার নিষিদ্ধ ফল নৈতিকতা সম্পন্ন ব্যক্তিরা যা পাচ্ছেন তার চেয়ে কখনো ভালো হতে পারে না। প্রচলিত প্রতিবাদের কি এক বাধা! যদি আমরা এই বাধাকে অতিক্রম করে আমাদের সমকামী মনোবৃত্তি ও কৌতূহল চরিতার্থ করে দেখতে পারি, তবেই আমরা বিচার করতে পারবো যে, আমাদের আবেগটি কতটুকু নৈতিক বা অনৈতিক এবং তখনই সম্ভব হবে তার আপাত ফলাফল, গুনাগুণ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধীরে ধীরে পরিচিতি লাভ করে তার প্রতিকারের কার্যকারী পদক্ষেপ নেয়া। যদি পুরুষ তার পুরুষত্বকে অস্বীকার করে এবং একত্ব, বিনয়, পারস্পরিক আলোচনা, বিবেচনা, সহযোগীতা, ভদ্রতাপূর্ণ অস্বীকৃতি ও বিরোধের সকল মূল্যবোধকে মেনে নেয় তখন কি ঘটবে? আমরা যেমন যৌনতা সম্পর্কিত আমাদের কল্পনার উৎকর্ষতাকে অস্বীকার করতে পারি না, তেমনি আমাদের সম্পর্কের সকল স্বাভাবিক যৌন উপাদানকেও অস্বীকার করা যায় না। এই যৌন সম্পর্ক যেভাবে ঘটে, অর্থাৎ আলাপচারিতা, স্পর্শ, অঙ্গভঙ্গি ও প্রেম নিবেদন ইত্যাদিকে রক্ষণশীলদের নৈতিক পবিত্রতার ধরন থেকে পৃথক করে আমাদের নির্দোষ পছন্দের ওপর ছেড়ে দিতে হবে।
শুধু একজনের সাথে আজীবন বিবাহের রজ্জুতে ঝুলে থাকা ভালো, না বহুবিধ জীবন ভালো? কাকেও বিবাহ করার আগে অনেকেই চায় তার প্রাথমিক সম্পর্ক। এই প্রাথমিক সম্পর্ক খুবই দরকারি এবং একটি প্রশংসনীয় কাজ। এটাকেও যদি কেহ সমস্যা মনে করেন তবে সেটা করেছেন এজন্য যে আমরা যেন কোন নষ্ট মেয়ের খপ্পরে না পড়ি। এটা একটি পলায়নপর মনোবৃত্তি। এটা একটি অন্যায়। তবে তা কারো সাথে যৌন সম্পর্ক ঘটে যাওয়ার জন্য নয়; বরং তা কারো সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা থেকে সরে পড়ার মনোবৃত্তির কারণেই। তাই সমস্যা থেকেই যাবে।
আমাদের সকল আত্মীয়তার সম্পর্ক অতিরিক্তভাবে সংরক্ষিত রাখার প্রবণতা রয়েছে। আমরা চাই এটাকে শিথিল করে দিতে, যাতে সকলে খোলাখুলি ও সরাসরি যৌন আবেদন প্রকাশ করতে পারে। নারী ও পুরুষের এ ধরণের স্বাধীনতা কি আমেরিকার সনাতন পরিবার পদ্ধতিকে ভেঙ্গে দিবে? আমি তো তাই মনে করি। কারণ, এই পরিবার প্রথা এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা নানা সমস্যার সূতিকাগার। অভাব, অভিযোগ ও দক্ষতার প্রকাশ এবং অনেকগুলো মানুষের একত্র বাস ও রুজি রোজগারের এক গোষ্ঠীগত প্রচেষ্টার পরীক্ষা কেন্দ্র এই পরিবার।”
ভাগ্যিস, মুসলিম দেশগুলোতে এখনো নারীবাদী আন্দোলন এতটা চরম আকার ধারণ করেনি। কিন্তু আধুনিকীকরণ তথা পাশ্চাত্যকরণ নীতির ফলে পর্দা প্রথার দ্রুত অবলুপ্তি ঘটছে, মহিলারা ধর্মীয় ঐতিহ্যের প্রতি বিদ্রোহী হয়ে উঠছে এবং পশ্চিমা মেয়েদের ধাঁচে তারা নিজেদেরকে গড়ে তুলছে।
নিউ ইয়র্ক থেকে ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত রাফায়েল পটাই লিখিত “আধুনিক বিশ্বে নারী” নামক বইয়ে বর্ণিত হয়েছেঃ
“শহুরে ধনাঢ্য ও প্রচলিত রীতি সম্পন্না মহিলারা, বিশেষ করে তেহরান শহরে এ ধরণের মহিলারা এখন ঘর কন্যার কাজে খুব সামান্য সময়ই ব্যয় করেন। তারা প্রায় সারাক্ষণই সামাজিক, পেশাগত, বিনোদনমূলক ও জনকল্যাণধর্মী কাজে ব্যাস্ত থাকেন, পোশাক প্রস্তুতকারী ও চুল পরিচর্যাকারীর কাছে যাওয়া, বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে সকালের নাস্তা ও দুপুরের খাবারের জন্য হোটেল রেস্তোরায় যাতায়াত এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদীতে অংশগ্রহণ এ সকল মহিলাদের নিত্যদিনের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়াও তারা খেলাধুলা ও ছুটি উপভোগের জন্য ঘরের বাইরে কাটাচ্ছেন। এই শ্রেণীর এক বিরাট সংখ্যক মহিলা সাংস্কৃতিক ও জনকল্যাণ কাজের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছেন। (পৃঃ ৭৭)
লেবাননের বিভিন্ন শহরে ঘর বহির্মুখী মহিলাদের সংখ্যা ব্যাপক হারে বেড়ে চলেছে। প্রতি রোববারে বৈরুতে সমুদ্র সৈকত সমূহে যত সংখ্যক জনসমাগম হচ্ছে তার মধ্যে মহিলাদের সংখ্যা পুরুষদের চেয়ে মোটেই কম নয়। এরা সকলেই প্রায় নতুন প্রজন্মের অল্প বয়সী তরুণ-তরুণী।
সৈকতের এই মেলামেশা নিঃসন্দেহে সামাজিক বাঁধনের শৈথিল্যের প্রমাণ। লেবাননে পাশ্চাত্যমুখী উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মহিলাদের পোশাক পরে ঘোরাফিরা করতে চায় তাদেরকেও তেমন বাধা দেয়া হয় না। সমাজের প্রায় সকল শ্রেণীর মেয়েরাই পোশাক পরিচ্ছদে অদ্ভুত রকমের তন্ময়তা প্রকাশ করছে, যা শুধু সমুদ্র সৈকত কিংবা বিনোদন কেন্দ্রই নয় বরং সকল অনুষ্ঠানাদিতেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা শীতকালে শীতের পোশাক পড়েন ঠিকই, কিন্তু গ্রীষ্মকালে তারা পড়ছেন সিল্কের আঁটসাঁট পোশাক কিংবা স্কার্ট ও পাতলা ব্লাউজ। এর সাথে থাকছে হিলতোলা জুতা, নাইলনের মোজা ও আকর্ষণীয় মেকআপ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নয় এমন কিছু মুসলিম মেয়েরা মুখের ওপর খুবই পাতলা ও প্রতীকী নেকাব ঝুলিয়ে দিয়ে থাকেন। এই ক’বছর আগেও মেয়েরা সমুদ্র সৈকতে স্নান করতে লজ্জা বোধ করতো। এখন তারা এটাকে লুফে নিচ্ছে এবং অনেকেই খুব খাটো টুপিস পড়ে সমুদ্র স্নানে নামছে।”
নারীবাদ (Feminism) প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে দেয়ার জন্য একটি অস্বাভাবিক, কৃত্রিম ও উদ্দেশ্যমূলক আন্দোলনের ফসল। এর লক্ষ্য হল সকল অদৃশ্য বিশ্বাস, নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধকে অস্বীকার করা নৃবিজ্ঞান ও ইতিহাসের ছাত্র-ছাত্রীরাই এই নারীবাদী আন্দোলনের অসারতা ও অযৌক্তিকতার পক্ষে নিশ্চিত ধারণা দিতে পারবেন। কারণ, প্রাগৈতিহাসিক ও ঐতিহাসিক যুগের সকল মানব সভ্যতা ও মানুষের আচরণ থেকে এটা অত্যন্ত পরিষ্কার যে, সমাজে নারী ও পুরুষের মধ্যে একটি ব্যবধান থাকবেই এবং নারী ও পুরুষ এই দুই পৃথক সত্ত্বার সমন্বয়েই সমাজ গড়ে ওঠে। সংসার ও পরিবারের পৃথকীকরণ, পরিবারে পিতার কর্তৃত্বের বিলোপ এবং যৌন বিশৃঙ্খলা যে সকল সমাজে ব্যাপক হারে প্রচলিত হয়েছে শেষ পর্যন্ত সে সকল কাজই অধঃপতিত ও ধ্বংস হয়েছে।
কেউ হয়তো বলবেন, যদি তাই হয় তবে কিভাবে পাশ্চাত্য তার নৈতিক অবক্ষয় ও দুর্নীতি সত্ত্বেও বিশ্ব নেতৃত্বের ক্ষেত্রে এত বেশী গতিশীল, বলবান ও শক্তিধর হয়ে থাকলো?
সাইয়েদ আবুল আ”লা মওদুদী বীরোচিত ‘পর্দা ও ইসলাম’ পুস্তকে নারীর মর্যাদা শীর্ষক আলোচনায় এ সম্পর্কে বিবৃত হয়েছেঃ
“যখন সমাজে নৈতিক লাম্পট্যপনা, আত্মপূজা ও যৌন অবক্ষয় চরম আকার ধারণ করে; নারী-পুরুষ ও যুবক-বৃদ্ধ যৌন উন্মাদনায় হারিয়ে যায়; অর্থাৎ গোটা সমাজের মানুষ যখন পুরোপুরিভাবে যৌন বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তখন সে সমাজ স্বাভাবিকভাবেই ধ্বংসের অনিবার্য পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। যারা এ ধরণের ধবংসশীল সমাজের উন্নতি ও সমৃদ্ধি প্রত্যক্ষ করছে তারা আসলে সেই সমাজকেই দেখছে যা একটি অগ্নি গহ্বরের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে এবং যে কোন সময় তার সকল আত্ম-অহঙ্কার নিয়ে তাতে নিপতিত হবে। তারা ভাবে, কোন সামাজ তখনই সম্মৃদ্ধির উচ্চ শিখরে ওঠে যখন ঐ সমাজের সকল মানুষ নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে আত্মসেবী হয়ে যায়। কিন্তু এটা একটি দুঃখজনক সিদ্ধান্তও। যখন কোন সমাজে ধবংসশীল ও গঠনশীল উপাদানগুলো পাশাপাশি কাজ করতে থাকে এবং গঠনশীল উপাদানগুলো ধবংসশীল উপাদানগুলোর ওপর কোন না কোন দিক দিয়ে অগ্রগামী থাকে তখন ধ্বংসশীল কাজগুলো কে গঠনশীল কাজগুলোর ওপর বিজয়ী হয়েছে ভাবাটা নিতান্তই অন্যায়। উদাহরণ স্বরূপ ধরা যাক, একজন চতুর ব্যাবসায়ী যিনি কঠোর পরিশ্রম, তীক্ষ্ণ অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধিমত্তার দ্বারা উচ্চ অংকের মুনাফা অর্জন করেছেন। কিন্তু তিনি তা ব্যয় করছেন মদ, জুয়া ও লাগামহীন জীবনাচারের মাধ্যমে। তার কর্মের এই অংশ কি তাকে কোন সমৃদ্ধি ও কল্যাণ এনে দিতে পারবে? বাস্তব সত্য কথা হল, প্রথম প্রকারের গুণ তাকে যেমন উন্নতির দিকে নিয়ে যায়, দ্বিতীয় প্রকারের গুণ তেমনি তাকে অধঃপতিত করে। ভাল গুনগুলোর কারণে তার যদি উন্নতি ঘটে তবে তার অর্থ এ হয় না যে, তার অসৎ গুণাবলী অকার্যকরী। হতে পারে জুয়ার শয়তান তার সমস্ত সম্পদ এক মূহুর্তেই কেড়ে নিবে, মদ্যপানের ফলে তার এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটবে যে, সে দেউলিয়া হয়ে যাবে এবং এও হতে পারে যে, যৌন অপকর্মের শয়তান তাকে আত্মহত্যা, খুন বা অন্য কোন দুঃখজনক অবস্থায় ঠেলে দিবে। এখন সমৃদ্ধি, বৈভব ও আপাত ফুর্তির মধ্যে আছে বলে সে যে একদিন এ সকল দুঃখজনক অবস্থায় নিপতিত হবে না তা কেউ জোর করে বলতে পারে না। একইভাবে একটি জাতি প্রাথমিকভাবে গঠনশীল শক্তি থেকে উন্নতির উদ্যমতা পায়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে উপযুক্ত তত্ত্বাবধানের অভাবে এর চারপাশে ধ্বংসের বীজ বপিত হতে থাকে। আস্তে আস্তে এই গঠনশীল শক্তি নিজ গতি হারিয়ে ফেলে এবং চারিদিকে তৎপর অপশক্তিগুলো তাকে আরো অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করে।”
মানবতার মুক্তি কোথায় নিহিত? সমাজ গঠনের দিক দিয়ে ইসলামী শরীয়া পরিবারকে সমাজের মৌলিক ইউনিটি হিসেবে প্রাধান্যও দেয়। এই পরিবার শব্দটি একটি বৃহৎ অর্থ বহন করে। এটা বর্তমান সময়ের আণবিক ও পারমানবিক আকারের কোন পারিবারিক ধারণা নয়।
স্থানীয় অধিবাসী ও বদ্দু আরবদের মধ্যে প্রচলিত সকল রকম রেওয়াজ ও কু-সংস্কারের মূলোচ্ছেদ করে পুরোপুরি ধর্মের ভিত্তিতে নতুন একটি সমাজ গড়ে তুলতে পারাই ছিল মদিনায় মহানবী (স) এর বড় সাফল্য। নতুন এই সমাজের বন্ধন একদিকে যেমন ছিল গোটা মুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যদিকে তেমনি তা ছিল প্রত্যেক মুসলিম পরিবারের সাথে সংযুক্ত। মুসলিম পরিবার গুলো হচ্ছে মুসলিম সমাজের এক একটি ক্ষুদ্র চিত্র ও সমাজের মূল ভিত্তি। ইসলামের গোষ্ঠিতান্ত্রিক প্রকৃতিতে পিতা হচ্ছেন পরিবারের ইমাম বা নেতা। পরিবারের ধর্মীয় কর্মকান্ডের মূল দায়িত্বশীল ব্যক্তি তিনিই। পিতা পরিবারের ধর্মীয় বিশ্বাস, আচরণ ও নিয়ম নীতি তুলে ধরেন এবং তার বাস্তবায়ন ঘটান। পিতা পরিবারে আল্লাহরই প্রতিনিধি, তার কর্তৃত্ব প্রতীকী অর্থে আল্লাহরই কর্তৃত্ব। একজন পুরুষ পরিবারের সম্মানার্থ হন এ জন্য যে, তিনি পরিবারের ধর্মীয় গুরু। পরিবারের সদস্যদের ধর্মীয় সকল প্রয়োজন তিনিই পূরণ করেন। পুরুষরা যখনই পরিবারের এই ধর্মীয় প্রয়োজন পূরণে বিরত হল এবং পুরুষোচিত কর্তৃত্ব পালনে ব্যর্থ হল, তখনই মুসলিম দেশগুলোতে কোথাও কোথাও মহিলারা ধর্মদ্রোহী আচরণ করতে সাহস পেল। আর এ সকল পুরুষরা ঐ সকল ‘উন্নত’(?) মহিলাদের অধার্মিক আচরণের জবাব দিল নিজেদের পুরুষত্বকে বিসর্জন দিয়ে মহিলাদের অনুগামী হওয়ার মাধ্যমে।
১৯৬৬ সনে লন্ডনে প্রকাশিত সাঈয়েদ হোসেইন নছর রচিত “ইসলামের আদর্শ ও বাস্তবতা” (Ideals and realities of Islam) নামক পুস্তকে বর্ণিত হয়েছেঃ
ঐতহ্যবাহী সনাতনধর্মী পরিবার স্থিতিশীল সমাজেরই এক একটি ইউনিট। একজন মুসলিম পুরুষ এক সংগে যে চারটে বিয়ে করতে পারে তা যেন চার কোণা কাবাগৃহের মতই স্থায়িত্বের প্রতীক। অনেকে হয়তো বুঝে উঠতে পারেন না যে, ইসলাম কেন এ ধরণের পারিবারিক কাঠামো অনুমোদন করে এবং এ কারণেই তারা ইসলামের বহবিবাহ প্রথাকে সমালোচনা করে থাকেন। মুসলিম আধুনিকতাবাদীরা খৃষ্টান সম্প্রদায়ের মত এ জন্য ইসলামের ওপর বিদ্বেষ পোষণ করেন, এমনকি তারা বহুবিবাহ প্রথাকে অনৈতিক বলেও দাবী করেন।
অবৈধ যৌন সম্পর্ক কমিয়ে আনার জন্য তারা পাঁচ মিশালী যৌনতাকে (Promiscuity) পর্যন্ত সামাজিক কাঠামোতে নীয়র আস্তে সুপারিশ করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমা পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টিভঙ্গি যতটা না মারাত্মক তার চেয়ে ঢের বেশি ক্ষতিকর এই আধুনিকতাবাদী ক্ষুদ্র মুসলিম সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গি। কারণ, তারা ইসলামী শরীয়ার শিক্ষাকে বুঝতে চান না এবং আধুনিক পাশ্চাত্য শ্রেণীগত ধারণার ওপর শরীয়াকে কোন মতেই স্থান দিতে রাজী নন।
নিঃসন্দেহে বর্তমান মুসলিম সমাজের একটি ক্ষুদ্র, কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশের মহিলারা প্রচলিত ও ঐতিহ্যগত ইসলামী প্রথার বিরুদ্ধাচারণ করছে। প্রত্যেক সভ্যতার ইতিহাসেই দেখা যায় বিদ্যমান শক্তির বিরুদ্ধে একটি প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর তৎপরতা চালু রয়েছে। হিন্দু ধর্মে সব সময়ই দেখা যায় মাতৃত্বের দিকটা শক্তিশালী। কিন্তু ইসলাম ধর্মে পুরুষের কর্তৃত্বই প্রধান। আধুনিকতাবাদী উগ্র প্রকৃতির মহিলারা ইসলামের এই প্রথাটিকে আক্রমণের সবচেয়ে বড় বিষয় বানিয়েছে। এই চৌদ্দশত বছর ধরে মুসলিম সমাজের ভিতরকার শত্রুরা মুসলিম সমাজকে ভেঙ্গে দেয়ার জন্য যে প্রচেষ্টা চালিয়েছে আধুনিকতাবাদী এ মুসলিম মহিলাদের বিদ্রোহ প্রকৃতপক্ষে তারই ফল। পরুষ কর্তৃত্ববাদই এ সকল মহিলাদের প্রতিক্রিয়াশীল হওয়ার কারণ। পুরুষদের চেয়ে অতি নগণ্য সংখ্যক এই মহিলারা চাচ্ছেন যে, তাদের সব কিছুই হোক পশ্চিমা ধাঁচের। তারা প্রচণ্ড আবেগের সাথে স্বভাবে ও পোশাকে পশ্চিমা হয়ে যেতে চাচ্ছেন। এই ভাবাবেগের কারণ বুঝা কঠিন হবে যদি এর পেছনে নিহিত মানসিক কারণগুলো বিশ্লেষণ করা না হয়।
ইসলামী দৃষ্টির বিচারে নারী ও পুরুষের সাম্য কথাটি গোলাপ-জুঁই এর গুনাগুণ সমান বলার মতই একটি অযৌক্তিক কথা। কারণ, এ দু’টো ফুলেরই রয়েছে পৃথক পৃথক ঘ্রাণ, বর্ণ, আকৃতি ও সৈন্দর্য। তেমনি নারী-পুরুষও এক নয়। এদের প্রত্যেকেরই রয়েছে ভিন্ন গঠন প্রকৃতি ও আচার আচরণ। মহিলারা যেমন হতে পারে না পুরুষের সমান, তেমনি পুরুষেরাও হতে পারে না মহিলাদের সমান। ইসলাম তাই এদের উভয়কে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় না করিয়ে বিবেচনা করেছে একে অপরের সহযোগী হিসেবে। নিজস্ব গঠন প্রকৃতি অনুযায়ী এদের প্রত্যেকের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছে পৃথক পৃথক দায়িত্ব ও কর্তব্য।
পুরুষের যেহেতু বহু গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিন কাজ সম্পাদন করতে হয়; তাই তাকে কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের মত কিছু সামাজিক প্রাধান্য ও সুবিধা ভোগের সুযোগ দেয়া হয়।
প্রথমতঃ তাকে অর্থনৈতিক গুরু দায়িত্ব বহন করতে হয়। পরিবারের সার্বিক ব্যয় নির্বাহের দায়িত্বই তার। অপরদিকে স্ত্রী যদি ধনী হন, এমনকি তিনি যদি আর্থিকভাবে স্বাধীন হয়েও থাকেন, তবুও তার ভরণ পোষণের দায়িত্ব স্বামীর ওপর। আদর্শবাদী মুসলিম সমাজে নারীকে জীবিকার জন্য কোন দুঃশ্চিন্তা করতে হয় না। এখানে এমন বৃহত্তর পারিবারিক পরিসর রয়েছে যে, কোথাও না কোথাও সে তার স্থান করে নিতে পারবে। এমনকি তার স্বামী বা পিতার অবর্তমানেও এ পারিবারিক পদ্ধতি তার আশ্রয়ের এবং অর্থনৈতিক চাপ থেকে আত্মরক্ষার পথ বের করে দিবে। এই বৃহত্তর ইসলামী পরিবারে একজন দায়িত্বশীল শুধু তার স্ত্রী ও সন্তানদের লালন পালনের দায়িত্ব বহনই করেন না, বরং প্রয়োজনবোধে তার মাতা, ভগ্নি, ফুফু, খালা, শালী, শ্বাশুড়ী এবং এমনকি চাচাতো-মামাতো বোন ও আরো দূরের আত্মীয় স্বজনদের পর্যন্ত সহযোগীতা করে থাকেন। সুতরাং শহুরে জীবনে যেমন একজন মুসলিম নারীকে সকল শক্তি ব্যয় করে চাকুরী খুঁজে বের করতে এবং জীবনের প্রতিটি পরিবারই এক একটি অর্থনৈতিক ইউনিট হওয়ায় পরিবারের সকল প্রয়োজন ভেতর থেকে অথবা যৌথ প্রচেষ্টায় অর্জিত হয়। ফলে নারীকে অনর্থক অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে জড়াতে হয় না।
দ্বিতীয়তঃ একজন মুসলিম নারী তার নিজের জন্য নিজেই একজন স্বামী খুঁজে নিতে পারে না এবং সে তার সৈন্দর্যের প্রদর্শনীও করতে পারে না- যা দিয়ে কাউকেও আকৃষ্ট করে ভবিষ্যতে তাকে স্বামী হিসেবে পাওয়ার আশা পোষণ করতে পারে। ফলে একজন মুসলিম নারী কাউকেও স্বামী হিসেবে খুঁজে পাওয়ার ভয়াবহ দুঃশ্চিন্তা এবং না পাওয়ার দুঃসহ বেদনা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। নারীর স্বাভাবিক চারিত্রিক দাবী অনুযায়ী তার পিতা-মাতা বা অভিভাবকগণ তার জন্য কোন উপযুক্ত বর খুঁজে না আনা পর্যন্ত সে গৃহেই অবস্থান করে থাকে। এ ধরণের বিবাহই হয়ে থাকে প্রকৃত ধর্মসম্মত বিবাহ এবং এতেই স্থায়িত্ব পায় পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন। মুহূর্তের আবেগের বশে যে সকল বিবাহ সংঘটিত হয় সেগুলো প্রায়শই স্থায়ী হতে পারে না। কিন্তু অভিভাবকদের স্থির বিবেচনার মাধ্যমে সংঘটিত বিবাহ সমূহ প্রায়শই স্থায়ী হয় এবং এ সকল বিবাহে সাধারণত তালাকের ঘটনা ঘটে না।
তৃতীয়তঃ বিরল দু’একটি প্রয়োজন ছাড়া মুসলিম মহিলাগণ রক্তাত্ব যুদ্ধ ও রাজনীতিতে সরাসরি অংশগ্রহণ থেকে মুক্ত। এটাকে অনেকের কাছে একটি বঞ্চনা বলে মনে হতে পারে। কিন্তু নারী প্রকৃতির প্রকৃত প্রয়োজনের আলোকে বিচার করলে দেখা যাবে যে, অধিকাংশ নারীর পক্ষেই এ সকল কাজে অংশগ্রহণ খুবই ভারী ও কঠিন বলে প্রমাণিত। এমনকি আধুনিক সে সকল সমাজে ‘সাম্যবাদী’ পদ্ধতিতে নারী ও পুরুষকে সমান করার প্রক্রিয়া চলছে যে সকল সমাজেও চরম কোন অবস্থা না দেখা দেয়া পর্যন্ত মহিলাদেরকে সামরিক বাহিনীতে অংশগ্রহণ থেকে দূরে রাখা হচ্ছে।
‘ইসলামের আদর্শ ও বাস্তবতা’ গ্রন্থের অন্যত্র সাঈয়েদ হোসেইন নছর বলেন, “ইসলাম নারীকে যে সকল সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে তার প্রতিদানে তাকে কয়েকটি নির্দিষ্ট দায়িত্ত্ব পালন করতে হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, পরিবারের জন্য একটি শান্তির নীড় উপহার দেয়া এবং সন্তানদেরকে সঠিকভাবে মানুষ করে তোলা। পরিবারে স্ত্রীর ভূমিকা হয় সম্রাজ্ঞীর মত। আর পুরুষ তার পরিবারের হয় স্ত্রীর সম্মানিত মেহমান। গৃহ রবং যে বৃহৎ পারিবারিক পরিমণ্ডলের মধ্যে সে বাস করে তা-ই হচ্ছে মুসলিম নারীর দুনিয়া। নারীর জন্য গৃহ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া মানে হচ্ছে দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া বা মৃত্যুর বুকে ঝাঁপ দেয়া। মুসলিম নারী বৃহৎ পারিবারিক অবকাঠামোর মধ্যেই তার অস্তিত্বের মর্ম খুঁজে পায় এবং এই পরিবারের মধ্যেই রয়েছে তার সকল প্রয়োজন পূরণ ও আত্মতৃপ্তির উপাদান।
শরীয়াহ নারী ও পুরুষের প্রকৃতি অনুযায়ী একে অপরের পরিপূরক হিসেবে সমাজে তাদের কর্ম ও অবস্থান নির্দেশ করে। এটি পুরুষকে সামাজিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য প্রদান করে এ জন্য যে, সে তার পরিবারের সকল দায়-দায়িত্ব বহন করে এবং পারিবারিক আর্থিক, সামাজিক ও অন্যবিধ সকল চাপ থেকে রক্ষ করে। যদিও পুরুষ গৃহের বাইরের রাজ্যে রাজত্ব করে এবং পরিবারের কর্তা, তথাপি গৃহে স্ত্রীর অনুশাসন সে শ্রদ্ধার সাথে মেনে চলে।
মহান আল্লাহ নারী ও পুরুষের ওপর পৃথক পৃথক ভাবে যে দায়িত্ব অর্পণ করেছেন প্রতিটি মুসলিম পরিবারে স্বামী ও স্ত্রী তা পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে মেনে নিয়ে এমন একটি দৃঢ় ভিত্তি সম্পন্ন পরিবার গড়ে তোলে যা হয় গোটা সামাজিক সুষ্ঠু কাঠামোর জন্য এক একটি মৌলিক ইউনিট।”
খৃষ্টান জগতে যারা নারী স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থক তারা নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের প্রতি বিদ্রোহ ও পারিবারিক পদ্ধতির অপরিহার্যতাকে অস্বীকৃতির মাধ্যমে আসলে নিজ সভ্যতার গোটা উত্তরাধিকারকেই অস্বীকার করছে এবং তার প্রতি বিদ্রোহী হয়েছে।
আধুনিক ইউরোপ এ কথা ভালো করেই জানে যে, মধ্যযুগীয় খৃষ্টান সমাজে সামন্ত প্রথার অনিষ্টকারিতা এবং যাজকদের অত্যাচার সত্বেও সামাজিক সংহতি, শান্তি, স্থায়িত্ব ও একতা বিরাজমান ছিল। মধ্যযুগীয় ইউরোপে খৃষ্টান পরিবারগুলোতে যে সকল মূল্যবোধ আচারিত হতো তার একটি উজ্জ্বল বর্ণনা বিখ্যাত জার্মান চিত্রশিল্পী আলব্রেট ডিউরার (১৪৭১-১৫২৮), যিনি একজন ধর্মনিষ্ঠ খৃষ্টান ছিলেন- তার পারিবারিক ঘটনাপঞ্জী থেকে নিম্নে বর্ণিত হলঃ ডিউরার পরিবারের এক সদস্যের বর্ণিত এই পারিবারিক জীবন ইসলামী পারিবারিক পদ্ধতির খুব কাছাকাছি।
“আমার শ্রদ্ধেয় পিতা, আলব্রেট ডিউরার জার্মান গেলেন এবং সেখানে এক নিচু পল্লী এলাকায় দীর্ঘদিন অবস্থান করলেন। তারপর তিনি ১৪৫৫ সনের সেন্ট ইলিজিয়াস দিবসে (২৫শে জুলাই) নিউরেমবার্গ চলে এলেন। ঐদিন ছিল ফিলিপ পার্কিমারের বিবাহের দিন। এ জন্য বাড়ি সাজানো হয়েছিল এবং বৃহৎ লাইম গাছের নিচে মেহমান অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। এরপর থেকে ১৪৬৮ সন পর্যন্ত দীর্ঘ বছর আমার প্রিয় পিতা আলবার্ট ডিউরার বৃদ্ধ হাইরনোনাইমাস হপারের দেখাশুনা করেন। এরপর হপার তার ১৫ বছরের সুশ্রী, সুঠাম ও ধার্মিক কন্যা বারবারাকে তার সাথে বিয়ে দেন। এই বিয়ে হয়েছিল সেন্ট ভাইটাস দিবসের (৮ই জুন) ৮ দিন আগে। আমার এই মহীয়সী মা ৮টি সন্তান জন্মদান করেন এবং তাদেরকে বড় করে তুলেন। কখনো তাকে সম্মুখীন হতে হয়েছে সংক্রামক ব্যাধি ও মারাত্মক অসুস্থতার এবং সহ্য করতে হয়েছে প্রচণ্ড অনাহার, বিদ্রূপ, উপহাস, অবজ্ঞা ও উদ্বিগ্নতা; কিন্তু তিনি কখনো অন্তরে পোষণ করেননি কোন অস্থিরতা ও প্রতিশোধ স্পৃহা। আমার প্রিয় পিতার সন্তান, আমার এক ভাই ও বোনেরা সকলেই মারা গেছে কেউ অল্প বয়সে আর কেউ বড় হয়ে। শুধু আমরা তিন ভাই এখনো বেঁচে আছি এবং ততদিন বেঁচে থাকবো যতদিন প্রভু চাইবেন। আমরা এই তিন ভাই হচ্ছি আমি আলব্রেট, আমার ভাই অ্যান্ড্রেয়াস ও আমার ভ্রাতৃতুল্য হ্যান্স। হ্যান্স আমার পিতার সন্তান নন। আমার পিতা ছিলেন তার ভাইদের মধ্যে জ্যৈষ্ঠও। সারা জীবনই তিনি কঠোর পরিশ্রম করে গেছেন। নিজের এবং তার স্ত্রী ও সন্তানদের ভরণ পোষণের জন্য নিজ হাতেই রোজগার করেছেন। তার জীবনে ছিল অনেক দুঃখ, প্রলোভন ও প্রতিকূলতা।
ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞ, মানুষের প্রতি কল্যাণময়ী, ধৈর্যশীল, বিনম্র এই মানুষটি ছিলেন একজন আদর্শ খৃষ্টান। তাকে যারাই জানতো তারা সকলেই তার প্রশংসা করতো। সমাজের কাছে তার সামান্যই চাওয়া পাওয়া ছিল। তিনি ছিলেন খুব কম কথার লোক ও খোদাভীরু মানুষ। আমার এই মহান পিতা তার সন্তানদেরকে খোদাভীরুতা শিক্ষা দেয়ার জন্য খুবই পেরেশান ছিলেন। তার সবচেয়ে বড় আশা ছিল তার সন্তানদেরকে খোদা ও মানুষের দৃষ্টিতে কল্যাণধর্মী করে গড়া তোলা। এ জন্য তিনি সব সময় আমাদেরকে উপদেশ দিতেন ঈশ্বরকে ভালবাসতে এবং মানুষের সাথে সদাচরণ করতে। আমি শিক্ষার প্রতি খুবই আগ্রহী ছিলাম বলে তিনি আমার প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট ছিলেন। এ জন্যই তিনি আমাকে স্কুলে পাঠালেন। এখন আমি পড়তে ও লিখতে শিখলাম তখন তিনি আমাকে স্কুল থেকে নিয়ে এলেন এবং স্বর্ণকারের শিক্ষা ও কলাকৌশল শিখালেন। যখন আমি এই বিদ্যায় পারদর্শী হলাম তখন আমি অনুভব করলাম যে, স্বর্ণকারের চেয়ে চিত্রকর হওয়াই ভালো। যখন আমি এ কথা আমার পিতাকে জানালাম তখন তিনি তা শুনে খুশি হতে পারলেন না এবং তাঁর অধীনে শিক্ষানবিস হিসেবে যে সময় হারিয়েছে তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি আমাকে আমার ইচ্ছামত অগ্রসর হতে অনুমতি দিলেন এবং ১৪৮৬ সনের সেন্ট এন্ড্রিট দিবসে (৩০শে নভেম্বর তারিখে) আমার পিতা আমাকে মিখাইল ও লজিমিউটের অধীনে তিন বছরের জন্য শিক্ষানবিস নিয়োগ করলেন। এই সময়েও প্রভু আমাকে পরিশ্রম করার শক্তি দিলেন এবং এ সময়ই বিষয়টি ভালভাবে শিখলাম। কিন্তু আমার শিক্ষকের সহযোগীদের হাতে খুবই অত্যাচারিত হয়েছিলাম। শিক্ষা শেষে আমি যখন ঘরে ফিরলাম তখন হ্যানসফ্রে আমার পিতার সাথে আলাপ আলোচনা করে তার কন্যা অ্যাগনেসকে আমার সাথে বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। অ্যাগনেসের সাথে তিনি আমাকে ২০০ ফ্লোরিনও দান করলেন। ১৪৯৪ সনের সেন্ট মার্গারেট দিবসের কিছু আগে ৭ই জুলাই সোমবার আমাদের এই বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়।
এর কিছুকাল পর আমার পিতা আমাশয় রোগে আক্রান্ত হলেন এবং কারো চিকিৎসাতেই তিনি সুস্থ হলেন না। যখন তিনি দেখলেন যে, মৃত্যু এসে যাচ্ছে তখন তিনি তার কাছে নিজেকে খুব শান্তভাবে ও ধৈর্যের সাথে সমর্পন করলেন এবং আমাকে আমার মায়ের যত্ন নিতে এবং আমাদের সকলকে খোদার বিধান মত জীবনযাপন করতে নির্দেশ দিলেন। তার জীবনের শেষ স্যাক্রামেন্টস দিবস (খৃষ্টীয় ভোজ দিবস) অতিবাহিত হল এবং তিনি বরণ করলেন একজন খৃষ্টান ধার্মীকের মরণ। রেখে গেলেন আমার মাকে একজন বিধবা হিসেবে। আমার পিতা জীবিত অবস্থায় সব সময়ই আমার নিকট আমার মায়ের ভূয়সী প্রশংসা করতেন। তিনি বলতেন ‘তোমার মা একজন খুবই ভালো মেয়েলোক।’ এজন্যই আমি আমার মাকে কখনো ভুলে না থাকার সংকল্প করেছি।
হে আমার বন্ধুগণ, আমি তোমাদেরকে ঈশ্বরের নামে বলছি, তোমরা যখন আমার এই ধার্মিক পিতার মৃত্যুর কাহিনী পড়বে তখন তোমরা তার পারলৌকিক কল্যাণের জন্য এবং তোমাদের নিজেদের মঙ্গলের জন্য খৃষ্টের নিকট এবং মাতা মারিয়মের নিকট এই বলে পার্থনা করবে, ঈশ্বর যেন আমাদেরকে তাঁর সেবার মাধ্যমে সার্থক জীবন ও কল্যাণময় মৃত্যু দান করেন। এটা কখনো সম্ভব নয় যে, এক ব্যক্তি উত্তম জীবন যাপন করবেন আর তার মৃত্যু হবে একটা অশুভ মৃত্যু। কারণ, ঈশ্বর করুণাময়।
এখন আমি আপনাদেরকে জানাচ্ছি যে, ১৫১৩ সালের ‘রোগেশন’ দিবসের আগের মঙ্গলবার আমার মাতা যাকে আমি আমার পিতার মৃত্যুর দু’বছর পরই যখন তিনি কর্পদক শূন্য হয়ে গেলেন তখন আমার তত্ত্বাবধানে নিয়ে এসেছিলাম, দীর্ঘ নয় বছর আমার সেবাধীনে থাকার পড় খুবই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আমরা ঐদিন সকাল বেলা তার ঘরের দরজা ভেঙ্গে তাকে বের করে আনলাম। কারণ তিনি এতই দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন যে, দরজা খুলে দেয়ার মত কোন শক্তি তার ছিল না এবং দরজা ভেঙ্গে বের করাই ছিল একমাত্র উপায়। আমরা তাকে নীচ তলায় নিয়ে এলাম এবং তার জন্য উভয় ‘সেক্রামেন্ট (প্রভুর উদ্দেশ্যে ভোজ)’ অনুষ্ঠান করা হল। কারণ, সকলেই ধারণা করলেন যে, তিনি মারা যাচ্ছেন। আমার পিতার মৃত্যুর পড় থেকেই তিনি কখনই শারীরিকভাবে ভালো ছিলেন না।
অসুস্থ হয়ে পড়ার দিন থেকে এক বছরেরও অধিককাল পরে খৃষ্টীয় ১৫১৪ সনের ১৭ই মে রাতের আধার ঘনিয়ে আসার দু’ঘণ্টা আগে আমার এই মহিয়ষী মা বারবারা ডিউরার ইহলোক ছেড়ে চলে গেলেন এবং পোপ ধর্মগুরুদের মাধ্যমে তার পাপ ও দুঃখ মোচনের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধানুষ্ঠান করা হল। মৃত্যুর আগে তিনি আমার জন্য আশীর্বাদ ও পারলৌকিক কল্যাণ কামনা করলেন এবং পাপ কাজ থেকে বেঁচে থাকার জন্য অনেক উপদেশ দিলেন। তিনি যদিও মৃত্যুর ভয়ে খুবই ভীত ছিলেন, কিন্তু তিনি জানালেন যে, ঈশ্বরের সাথে সাক্ষাত করতে তিনি মোটেই ভীত নন। আমার মায়ের মৃত্যুতে এতই ব্যথিত হলাম যে, তা আমার পক্ষে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ঈশ্বর তার আত্মার মঙ্গল করুন। সর্বদা ঈশ্বরের স্তুতিকীর্তনে এবং আমরা যাতে ঈশ্বরকে শ্রদ্ধা জানাই তা দেখতে তিনি খুবই প্রশান্তি অনুভব করতেন। নিয়মিত গীর্জায় যাওয়া তার অভ্যাস ছিল। আমি কোন ভুল করে ফেললে তিনি খুবই ক্ষেপে যেতেন এবং তীব্র ভৎর্সনা করতেন। আমি আমার ভাইয়েরা কোন অন্যায় কাজ করে ফেলি এ ভয়ে তিনি সব সময় ভীত থাকতেন। যখনই ঘরের বাইরে যেতাম কিংবা বাহির থেকে ঘরে ফিরতাম তখনই তিনি বলতেন ঈশ্বর তোমার সহায় হউন। তিনি সব সময়ই আমাদেরকে আমাদের আত্মা, জৈবিকতা ও ধর্ম সম্পর্কে সজাগ করে দিতেন। তার সবকর্ম, মানুষের প্রতি দয়া অথবা তার প্রশংসার দিকগুলো এমনই বলে শেষ করতে পারব না। তিনি যখন মারা গেলেন তখন তার বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর এবং আমি আমার সাধ্যমত খুব ভালো ভাবেই তাকে সমাহিত করলাম। মহান প্রভু আমাকেও একজন সত্যিকার খৃষ্টানের মৃত্যু দান করুন এবং তাঁর সাথে, তাঁর স্বর্গীয় সেবক আমার বাবা, মা, ও বন্ধুদের সাথে মিলিত হওয়ার তাওফিক দিন এবং আমাদেরকে পারলৌকিক কল্যাণময় অনন্ত জীবন দান করুন। আমীন! আজীবন আমার মা মৃত্যুর পরপারেই অধিক সুখের স্বপ্ন দেখতেন।”
সম অধিকারবাদীদের প্রস্তাবিত অদ্বৈত-যৌনতার (Uni-sexual) সমাজ হচ্ছে এমন একটি সমাজ যেখানে সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে নারী ও পুরুষের মধ্যে কোন পার্থক্য স্বীকৃত নয় এবং সে সমাজটি এমন একটি সমাজ যেখানে বিবাহ, সংসার ও পরিবার, লজ্জা, সতীত্ব ও মাতৃত্ব ঘৃণিত বিষয় এবং এগুলো ‘প্রগতি’ ও ‘স্বাধীনতার’ পরিচায়ক না হয়ে বরং চরম অধঃপতনের কারণ বলেই বিবেচিত। এর ফলাফল নির্ভেজাল অরাজকতা, সীমাহীন বিশৃঙ্খলা ও সম্পূর্ণ সামাজিক অব্যবস্থা ছাড়া আর কিছুই নয়।
যদি তাই হয়, তবু কেন সম অধিকারবাদ (Feminism) এত জনপ্রিয় ? লখনৌ থেকে ১৯৭০ সনে প্রকাশিত আবুল হাসান আলী নদভী বিরচিত ‘ধর্ম ও সভ্যতা’ প্রবন্ধে বলা হয়ঃ
“বস্তুবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থা খুবই পুরাতন এবং অধিক জনপ্রিয়ও। এর চেয়ে আর কোন সমাজ ব্যবস্থা কোন দেশ ও কালের অধিকাংশ মানুষের কাছে এত বেশী সহজ গ্রহণযোগ্য, সন্তোষজনক ও অনায়াসে বিকাশযোগ্য হয়নি। জনসাধারণের কাছে এর প্রতি মোহনীয় এমনি একটি গভীর আকর্ষন রয়েছে যে, এর শিকড় সমাজের গভীরে প্রবেশ করাতে হয় না, কিংবা এর জন্য মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে জাগিয়ে তুলতে হয় না। অথবা এর জন্য প্রয়োজন হয় না কোন ত্যাগ ও কোরবানির। এতে কারো জন্য কারো কোন দুঃখ-কষ্টও স্বীকার করতে হয় না। শুধু চলতে হয় সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে গড্ডালিকা প্রবাহে। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে বস্তুবাদের ন্যায় আর কোন সামাজিক ব্যবস্থারই মানব জাতির ওপর এত অধিক ও ব্যাপক কর্তৃত্ব করার সুযোগ হয়নি।”
বর্তমান সময়ের মত কোন কালেই মানব জাতির ওপর নৈতিক অধঃপতন ও সামাজিক অবক্ষয় এত বিশ্বজনীনভাবে বিস্তার লাভ করেনি। নারী পুরুষের সাম্যতার ধারণাটি মানব জাতিকে পশুর চেয়েও নিম্নস্তরে নিয়ে এসেছে। পশু তার সহজাত প্রবৃত্তি দ্বারা চালিত হয় এবং তার স্বভাবের বিরুদ্ধে সে কোন কিছুই করতে পারে না। পশুদের মাঝে কোন সমকামিতা নেই। একই জাতের পুরুষ পশু শুধু ঐ জাতীয় স্ত্রী পশুদের প্রতিই আকৃষ্ট হয়। কোন পুরুষ পশু কখনই কোন পুরুষ পশুর প্রতি এবং কোন স্ত্রী পশু কখনই কোন স্ত্রী পশুর প্রতি কামভাব পোষণ করে না। পশুদের মধ্যে বাচ্চারা যখন বড় হয় এবং নিজেদের যত্ন নিজেরাই নিতে শিখে তখন থেকে মাতৃত্বের সম্পর্কটি সম্পুর্ণরূপে ছিন্ন হয়ে যায়। অধিকাংশ প্রজাতির পুরুষ পশুর মধ্যে ঔরসজাতকদের প্রতি কোন আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় না। পশুদের মধ্যে লজ্জা, সতীত্ব, বিবাহ ও কন্যাপুত্র সহ পারিবারিক বন্ধন ইত্যেদি কোন বিষয় নেই। এই ধারণা ও বন্ধন শুধু মানবীয় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচিত। নারী সাম্যবাদীরা মানুষের এই মানস পরিচায়ক গুণাবলীকেই ধ্বংস করে দিতে এবং মানুষে মানুষে বিদ্যমান সকল সম্পর্কের ভিত্তি ও সামাজিক সকল বন্ধন ধীরে ধীরে দূর্বল করে দিতে চাচ্ছে। এর পরিণতি হবে আত্মহত্যা। আর সেই আত্মহত্যা কোন একক জাতির নয়, বরং তা হবে গোটা মানব প্রজাতির জন্য।
— সমাপ্ত —