এক জাতিত্ব ও ইসলাম
দারুল উলুম দেওবন্দ-এর প্রিন্সিপাল জনাব মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী ‘একজাতিত্ব ও ইসলাম’ নামে একখানি পুস্তিকা লিখেছেন। একজন সুপ্রসিদ্ধ আলেম এবং পাক-ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানের লিখিত এ পুস্তিকায় জটীল ‘জাতিতত্ত্বের’ সরল বিশ্লেষণ এবং প্রকৃত ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গীর পূর্ণ অভিব্যক্তি হবে বলেই স্বভাবতই আশা করা গিয়েছিল। কিন্তু এটা পাঠ করে আমাদেরকে নির্মমভাবে নিরাশ হতে হয়েছে এবং এ বইখানাকে গ্রন্থকারের পদমর্যাদার পক্ষে হানীকর বলে মনে হয়েছে। বর্তমান যুগে অসংখ্য ইসলাম বিরোধী মতবাদ ইসলামের মূল তত্ত্বের উপর প্রবল আক্রমন চালাতে উদ্যত-ইসলাম আজ তার নিজের ঘরেই অসহায়। স্বয়ং মুসলমান দুনিয়ার ঘটনাবলী ও সমস্যাবলী খালেছ ইসলামের দৃষ্টিতে যাচাই করে না; বলাবাহুল্য-নিছক অজ্ঞনতার ইসলামের দরুনই তারা তা করতে পারছে না। পরন্তু ‘জাতীয়তার’ ব্যাপারটি এতই জটীল যে, তাকে সুস্পষ্টরূপে হৃদয়াঙ্গম করার উপরই এক একটি জাতির জীবন-মরণ নির্ভর করে। কোনো জাতি যদি নিজ জাতীয়তার ভিত্তিসমূহের সাথে সম্পূর্ণ ভিন্ন মূলনীতির সংমিশ্রণ করে, তবে সে জাতি ‘জাতি’ হিসাবে দুনিয়ার বুকে বাঁচতে পারে না। এ জটীল বিষয়ে লেখনী ধারণ করতে গিয়ে মাওলানা হুসাইন আহমদের ন্যায় ব্যক্তির নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন থাকা বাঞ্ছনীয় ছিল। কারণ তাঁর কাছে নবীর ‘আমানত’ গচ্ছিত রয়েছে। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ও মূল তত্ত্বের উপর যদি কখনো জঞ্জাল-আবর্জনা পুঞ্জীভূত হয়, তবে এদের ন্যায় লোকদেরই তা দূরীভূত করে ইসলামের শিক্ষাকে সর্বজন সমক্ষে সুস্পষ্ট করে তোলা কর্তব্য।
বর্তমান অন্ধকার যুগে তাঁদের দায়িত্ব যে সাধারণ মুসলমানদের অপেক্ষা অনেক বেশী এবং কঠোর, সে কথা তাদের পুরোপুরিই অনুধাবন করা কর্তব্য ছিল। সাধারণ মুসলমান যদি ভ্রান্তির মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে থাকে তবে সে জন্য সর্বপ্রথম এ শ্রেণীর লোকদেরকেই দায়ী করা হবে। সেজন্য আমাকে আবার বলতে হচ্ছে যে, মাওলানা মাদানীর এ পুস্তিকায় তাঁর দায়িত্বজ্ঞান ও দায়িত্বানুভূতির কোনো প্রমাণই পাওয়া যায়নি।
অবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ
একজন গ্রন্থকারের রচিত গ্রন্থে সর্বপ্রথম তাঁর দৃষ্টিকোণেরই সন্ধান করা হয়। কারণ মূল বিষয়বস্তু পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করা এবং সর্বশেষ কোনো নির্ভুল বা ভ্রান্ত পরিণতিতে উপনীত হওয়া একমাত্র এ দৃষ্টিকোণের উপর নির্ভর করে। একটি দৃষ্টিকোণ এই হতে পারে যে, অন্যান্য সকল দিক থেকে দৃষ্টি ফিরায়ে একমাত্র প্রকৃত সত্য ব্যাপার জানতে চেষ্টা করতে হবে, মূল সমস্যাকে তার আসল ও প্রকৃতরূপে দেখতে ও বিচার করতে হবে এবং এরূপ প্রকৃত সত্যের নিরপেক্ষ পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে পৌছায়-তা কারো বিরোধী আর কারো অনুকূল, সে বিচার না করেই সরাসরিভাবে তাই গ্রহণ করা কর্তব্য। বস্তুত আলোচনা ও বিশ্লেষণের এটাই হচ্ছে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গী; আর ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গীও এটাই। কারণ এ ব্যাপারে الحُبُّ فِى اللهِ واللَغْضُ فِىْ اللهِ-“আল্লাহর জন্যই ভালবাসা এবং আল্লাহর জন্যই শত্রু“তাই” হচ্ছে ইসলামের মূলনীতি।
এ সহজ-সরল দৃষ্টিকোণ ছাড়া আরো অনেক কুটীল ও জটীল দৃষ্টিকোণ রয়েছে। বিশেষ কোনো ব্যক্তির অন্ধ ভালবাসায় মোহিত হয়ে প্রত্যেক কাজে ও ব্যাপারে কেবল তার অনুকূলেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাও একপ্রকার দৃষ্টিভঙ্গী। অনুরূপভাবে কারো অন্ধ বিরোধীতায় লিপ্ত হয়ে কেবল ঘৃণিত ও ক্ষতিকর জিনিসের সন্ধান করা এবং তা গ্রহণ করাও এক প্রকারের দৃষ্টিকোণ। কিন্তু এ ধরণের বক্র, কুটীল ও জটীল দৃষ্টিভঙ্গী যতই হোক না কেন, তা সবই প্রকৃত সত্যের বিপরীত হবে, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কাজেই তা গ্রহণ করে তার সাহায্যে কোনো আলোচনায় নির্ভুল সিদ্ধান্তে উপনীতি হওয়ার কোনোই আশা করা যায় না। অতএব এ দৃষ্টিকোণ গ্রহণ করে কোনো সমস্যা সম্পর্কে আলোচনায় লিপ্ত হওয়া অন্তত একজন আলেম ব্যক্তির কিছুতেই শোভা পায় না। কারণ, এটা সম্পূর্ণত অনৈসলামী দৃষ্টিকোণ।
এখন আমরা যাচাই করে দেখবো যে, মাওলানা মাদানী আলোচ্য পুস্তিকায় উল্লিখিত দৃষ্টিকোণসমূহের কোনটি অবলম্বন করেছেন।
পুস্তিকার সূচনাতেই তিনি বলেছেনঃ
“একজাতিত্বের বিরোধিতা এবং তাকে ন্যায়-নীতির বিপরীত প্রমাণ করার প্রসঙ্গে যা কিছু প্রকাশ করা হয়েছে, তার ভুল-ত্রু“টি দেখিয়ে দেয়া এখন জরূরী মনে হচ্ছে। কংগ্রেস ১৮৮৫ খৃস্টাব্দ থেকে ভারতবাসীর নিকট স্বাদেশিকতার ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্যের দাবী করে যথেষ্ট পরিমাণে চেষ্টা ও সাধনা করছে। তার বিরোধী শক্তিসমূহ তার অ-স্বীকারযোগ্য হওয়া-বরং নাজায়েয ও হারাম হওয়ার কথা প্রমাণ করার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করছে। বস্তুত বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে এটা অপেক্ষা মারাত্মক আর কিছুই নেই। এটা আজ নয়, ১৮৮৬ খৃস্টাব্দ কিংবা তারও পূর্ব থেকে এসব কথা প্রকাশ করা হয়েছে। এবং বিভিন্নভাবে এর ‘ওহী’ ভারতবাসীদের মন ও মস্তিষ্ক বৃটিশ কূটনীতিকদের যাদুর প্রভাবে পক্ষঘাতগ্রস্ত হয়েছে, তারা একথা কবুল করবে বলে আশা করা যায় না।” -(পৃষ্ঠাঃ ৫-৬)
এ প্রসঙ্গে ড. ইকবাল সম্পকে বলেছেন, “তাঁর ব্যক্তিত্ব কোনো সাধারণ ব্যক্তিত্ব নয়। কিন্তু এসব গুণপনা সত্ত্বেও তিনি বৃটিশ ‘যাদুকর’দের যাদু প্রভাবে পড়ে গেছেন।”
অতপর এক দীর্ঘ আলোচনার পর তিনি নিজের দৃষ্টিকোণ নিন্মলিখিত কথাগুলোর ভিতর দিয়ে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরেছেনঃ
“ভারতবাসীদের স্বাদেশিকতার ভিত্তিতে এক জাতিতে পরিণত হওয়া ইংল্যাণ্ডের পক্ষে যে কতখানি মারাত্মক, তা অধ্যাপক সীলে’র প্রবন্ধের উদ্ধৃতাংশ থেকে নিঃসন্দেহে বুজতে পারা যায়। ভারতবাসীদের মধ্যে এ ভাবধারা যদি খুব ক্ষীণ ও দুর্বলভাবে জাগ্রত হয়, তবে তাতে ইংরেজদেরকে ভারতর্বষ থেকে বহিষ্কার করার শক্তি না থাকলেও ‘বিদেশী জাতির’ সাথে সহযোগিতা করা লজ্জাকর ব্যাপার, এ ভাবটি তাদের মধ্যে বদ্ধমূল বলেই ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের সমাধি হয়ে যাবে।” – (পৃষ্ঠাঃ ৩৮)
এরপর তিনি এমন একটি আশ্চর্যজনক মত প্রকাশ করেছেন যে, তা পাঠ করলে একজন সুপ্রসিদ্ধ আল্লাহভীরু আলেম যে এটা কিরূপে লিখতে পারেন, তা ভাবতেও লজ্জা হয়!
“এক জাতীয়তা যদি এমনিই অভিশপ্ত ও নিকৃষ্ট বস্তু হয়েও থাকে, কিন্তু তবুও ইউরোপীয়গণ যেহেতু এ অস্ত্র প্রয়োগ করেই ইসলামী বাদশাহ ও উসমানী খিলাফতের (?) মূলোচ্ছেদ করেছিল, তাই এ হাতিয়ারকে বৃটিশের মূলোতপাটনের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা আজ মুসলমানদের কর্তব্য।” -(পৃষ্ঠাঃ ৩৮)
এ আলোচনা প্রসঙ্গে মাওলানা মাদানী প্রথমত একথা স্বীকার করেছেন যে, “বিগত দুই শতাব্দীকাল পর্যন্ত মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ যতোদূর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ইসলামী ঐক্য ও সংহতির বিরুদ্ধে ইউরোপীয়দের কঠিন ও মারাত্মক প্রচার-প্রোপাগাণ্ডার কারণেই তা হয়েছে।” “ইউরোপীয়গণ মুসলমানদের মধ্যে বংশীয়, স্বাদেশিক ও ভাষাগত বৈষম্য ও বিভেদ সৃষ্টি করেছে” তাদের মধ্যে এ ভাবধারাও জাগিয়ে দিয়েছে যে, ধর্ম ও আধ্যাত্মিকা রক্ষার জন্য কোনো জিহাদ করা উচিত নয়, তা করতে হবে বংশ-গোত্র ও জন্মভূমির জন্য। অতএব ধর্মীয় ভাবধারা পরিহার করাই বাঞ্ছনীয়।”- (পৃষ্ঠাঃ ৩৫-৩৬)
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নিগূঢ় সত্যের এতো নিকটে পৌছে তিনি ইংরেজ বিদ্বেষের গোলকধাঁধায় দিগভ্রান্ত হয়েছেন। তিনি লিখেছেনঃ
“দুঃখের বিষয় মুসলমানদের তখন একজাতিত্ব, স্বাদেশিকতা, বংশ-ও গোত্রের বিরুদ্ধে ওয়াজ বর্ণনাকারী কেউই দণ্ডায়মান হয়নি। এমনকি ইউরোপের পত্র-পত্রিকা ও বক্তাদের বক্তৃতার সর্বপ্লাবী বন্যারও প্রতিরোধ করা হয়নি। এর ফলে প্যান-ইসলামবাদ এক অতীত কাহিনীতে পরিণত ও তার পরিসমাপ্তি ঘটেছে এবং ইসলামী রাজ্যসমূহ ইউরোপীয় জাতিদের কবলে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে। এখন মুসলমানদেরকে যখন আফ্রিকা, ইউরোপ, এশিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে খণ্ড-বিখণ্ড করে ধ্বংস করেছে, তখন আমাদেরকে বলা হয় যে, কেবল একই মিল্লাতের লোকদের ঐক্য ও সংহতির গুরুত্ব দেয়-এরূপ কোনো অমুসলিমের সাথে মিলিত ও সংযুক্ত হতে পারে না এবং কোনো অমুসলিমের সাথে মিলিত ‘একজাতি’ও গঠন করতে পারে না।” – (পৃষ্ঠাঃ ৩৬-৩৭)
উল্লিখিত উদ্ধৃতাংশ পাঠ করলেই সুস্পষ্টরূপে বুঝতে পারা যায় যে, মাওলানা মাদানীর দৃষ্টিতে সত্য ও মিথ্যা, হক ও বাতিলের চূড়ান্ত মাপকাঠি হচ্ছে বৃটিশ। তিনি সমস্ত ব্যাপার নিরপেক্ষ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে যাচাই করে দেখতে চান না যে, প্রকৃত ও অন্তর্নিহিত সত্যের বাস্তবরূপ কি! তিনি মুসলমানদের কল্যাণকামী দৃষ্টি থেকেও বিচার করেন না যে, মুসলমানদের জন্য প্রকৃতপক্ষে হলাহল কোনটি! এ উভয় দৃষ্টিকোণকেই তিনি পরিত্যাগ করেছেন। শুধু ‘বৃটিশ-শত্রু“তার’ দৃষ্টিকোণেই তাঁর উপর সর্বাত্মক প্রভাব বিস্তার করেছে। এখন বৃটিশের পক্ষে যে জিনিসটি হলাহল, মাওলানা মাদানী ঠিক সেটিকেই সঞ্জীবনী সুধা মনে করেন। এমতাবস্থায় উক্ত জিনিসকেই যদি কেউ মুসলমানদের জন্যও হলাহল বলে মনে করে এবং এজন্য সে তার বিরোধীতা করে, তবে মাওলানার দৃষ্টিতে এ ব্যক্তি ‘বৃটিশভক্ত’ ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। কারণ বৃটিশের মৃত্যুতে তিনি যতোদূর উৎসাহী মুসলমানদের জীবনলাভের ব্যাপারে তিনি ততোটা উৎসাহী নন। এজন্যই তিনি জানতে পেরেছেন যে, ভারতবাসীদের ‘একাজাতিত্ব’ বৃটিশের জন্য মারাত্মক; এখন এ একজাতিত্বের বিরোধী প্রত্যেকটি মানুষই মাওলানা মাদানীর দৃষ্টিতে বৃটিশভক্ত ছাড়া আর কি-ইবা হতে পারে? বৃটিশ ধ্বংসের আর একটি অব্যর্থ পন্থা যদি কেউ মাওলানাকে বলে দিতো; যদি বলতো, ভারতের ৩৫ কোটি অধিবাসীদের এক সাথে সামগ্রিক আত্মহত্যা বৃটিশ সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত সমাধি নিশ্চিত; আর মাওলানা যদি নোস্খাটির অব্যর্থতা বুঝতে পারতেন, তবে এর বিরোধী প্রত্যেকটি ব্যক্তিকেই তিনি বৃটিশভক্ত বলে দোষী করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করতেন না। আত্মহত্যা নিতান্ত নিকৃষ্ট ও অভিশপ্ত কাজ হলেও, এর দ্বারা বৃটিশের মূলোতপাটন করা সম্ভব বলে, মাওলানার দৃষ্টিতে এ পাপানুষ্ঠান করাও কর্তব্য হয়ে পড়তো।
বস্তুত এ ধরণের কথা ও মতবাদের দৃষ্টিতে ‘আল্লাহর জন্য ভালবাসা ও আল্লাহর জন্য ক্রোধ’কে ইসলামী সত্যের মানদণ্ড করার যৌক্তিকতা এবং তার নিগূঢ় রহস্য বুঝতে পারা যায়। আল্লাহর সম্পর্ক যদি মাঝখান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং অন্য কোনো বস্তু যদি প্রত্যভাবে প্রিয় বা অপ্রিয় হয়ে পড়ে. তবে সেখান থেকেই বর্বরতামূলক হিংসা-দ্বেষ শুরু হয়ে যায়। তখন মানুষের প্রেম ও অ-প্রেমের সকল ভাবধারা চরিতার্থ করার অনুকূল সকল উপায় ও পন্থাই হালাল ও সংগত হয়ে পড়ে। মূলত তা আল্লাহর বিধানের অনুকূল কি-না, সে বিচার তখন আদৌ করা হয় না। এজন্যই বলা হয়েছে যে, ব্যক্তিগত শত্রু“তা শয়তানের সাথেও হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়, তাতেও আল্লাহর সম্পর্ক মাঝখানে থাকা আবশ্যক। অন্যথায় এ শয়তান শত্রু“তাই একটি আইনে পরিণত হতে এবং শয়তানের অন্ধ শত্রু“তায় আল্লাহর নির্ধারিত সীমাগুলো লংঘন হতে পারে। ফলে শয়তানের কাজ করা হবে।
নিজের কথা প্রমাণের জন্য অন্ধ আবেগ
এরূপ মানসিকতার ফলেই মাওলানা মাদানী নিজের দাবী প্রমাণের অন্ধ আবেগে ইতিহাসের সুপ্রসিদ্ধ ও উজ্জ্বল ঘটনাগুলোকেও উপেক্ষা করতে কুন্ঠিত হননি। ইউরোপ মুসলমানদের মধ্যে যখন বংশ-গোত্রীয়; স্বাদেশিক ও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তা প্রাচার করছিল, তখন মুসলমানদের মধ্যে থেকে তার প্রতিরোধের জন্যে সত্যিই কি কেউ দাঁড়াননি ? ………টিপু সুলতান, জামালুদ্দীন আফগানী, মুফতি মাহাম্মাদ আবদুহু, মোস্তফা কামেল মিশরী, আমীর শাকীব আরসালান, আনোয়ার পাশা, জালাল নুরী, শিবলী নোমানী, সাইয়্যেদ সুলাইমান নদভী, মাহমুদুল হাসান, মুহাম্মাদ আলী, শওকত আলী, ইকবাল, আবুল কালাম (মরহুম) প্রমুখ কারো নাম কি তিনি শুনতে পাননি? উক্তরূপ জাতীয়ভাবে জাহেলী বিভেদ মুসলমানদেরকে যে চূর্ণবিচূর্ণ ও ছিন্নভিন্ন করে দিবে-এ বলে কি উল্লিখিত লোকদের মধ্যে থেকে কেউই মুসলমানদেরকে সাবধান করেননি? এ প্রশ্নের উত্তরে মাওলানা মাদানী হয়তো ‘না’ বলতে পারবেন না। কিন্তু তবুও তিনি এসব বাস্তব ঘটনা থেকে দৃষ্টি ফিরায়ে ‘মুসলমানদের একজাতিত্ব সম্পর্কে ওয়াজকারী কেউ দণ্ডায়মান হয়নি’ বলেই দুঃখ প্রকাশ করছেন। …… এরূপ ভ্রান্ত দাবী উত্থাপন করার কি প্রয়োজনীয়তা ছিল? ……… শুধু এ কথাই প্রমাণ করা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল যে, মুসলমানদের জাতীয় ঐক্য ও সংহতি বৃটিশের স্বার্থের বিপরীত, এজন্যই সকল মুসলমান বংশীয়-গোত্রীয়, স্বাদেশিক এবং ভাষাগত বৈষম্য ও বিভেদ বিস্তারে আত্মনিয়োগ করেছিল। আর এখন ইসলামিক ঐক্য সংহতি বৃটিশ স্বার্থের অনুকূল হয়েছে (?) বলে মুসলমানদের জাতীয় ঐক্যের ওয়াজ প্রচার করা শুরু হয়েছে। অতএব প্রমাণ হলো যে, স্বাদেশিকতার বিরোধী প্রত্যেকটি মানুষই বৃটিশভক্ত, বৃটিশের যাদুই তাদের মুখে একথা বলাচ্ছে। বস্তুত এটা জাহেলী বিদ্বেষ রীতিরই পরিণাম, সন্দেহ নেই। সত্য ও মিথ্যা, হক ও বাতিলের মানদণ্ড ‘বৃটিশ’ হওয়ার কারণে প্রকৃত সত্য ও বাস্তবের বিপরীত কথা রটনা করাও সংগত হতে পারে-যদি তা বৃটিশ স্বার্থের উপর আঘাত হানতে পারে।
মাওলানা মাদানীর গোটা পুস্তিকাতেই এরূপ মানসিকতার স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তি হয়েছে। তাতে অভিধান, কুরআনের আয়াত, হাদীস ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলীকে ভেঙে-চুরে নিজের মন মতো সাজিয়ে নিজের দাবী প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছে এবং নিজ দাবীর বিপরীতে প্রত্যেকটি সত্যকে তিনি অকুন্ঠচিত্তে অস্বীকার ও উপোক্ষা করেছেন-তা ভিতর বাইর সবদিক দিয়ে যতোবড় সত্যই হোক না কেন। এমনকি শব্দগত ভ্রান্তিবোধের সৃষ্টি করতে, সাদৃশ্যহীন উদাহরণ দিতে এবং ভুলের উপর ভুল মতের ভিত্তি স্থাপন করতেও তিনি বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেননি। বস্তুত একজন আল্লাহভীরু আলেমের এরূপ কর্মকাণ্ড দেখে লজ্জায় মাথানত হয়ে আসে।
আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে জাতি গঠন কোথায় হয়?
“বর্তমান সময় জাতি আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে গঠিত হয়” বলে মাওলানা মাদানী দাবী কেরছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটা সম্পূর্ণরূপে ভুল ও প্রতারণাময় এবং আগাগোড়া ভিত্তিহীন। কেবল একটি অঞ্চলের অধিবাসী হওয়ার কারণে কোথাও একটি জাতি গঠিত হয়েছে-মানবতার ইতিহাস থেকে এরূপ একটি উদাহরণও পেশ করা যেতে পারে না। বর্তমান দুনিয়ার জাতিসমূহও সকলেরই সামনে বিরাজমান। এদের মধ্যে নিছক আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে কোন্ জাতিটি গঠিত হয়েছে? আমেরিকার নিগ্রো ও রেড ইণ্ডিয়ান এবং শ্বেতবর্ণের লোকেরা কি একই জাতির অন্তর্ভূক্ত? জার্মানির ইহুদী ও জার্মানরা কি এক জাতি? পোল্যাণ্ড, রুশিয়া, তুরস্ক, বুলগেরিয়া, গ্রীক, যুগোশ্লাভিয়া ও চেকোশ্লোভিয়া, লাথুনিয়া, ভিনল্যাণ্ড-কোথাও কি মার্তৃভূমি এক হওয়ার কারণেই ‘একাজাতি’ রয়েছে, কেবল মার্তৃভূমির ঐক্যই কি তা সৃষ্টি করেছে? এসব বাস্তব ঘটনা অস্বীকার করা যায় না। আপনি যদি বলতে চান যে, এখন থেকে স্বাদেশিকতার ভিত্তিতে জাতি গঠন হওয়া উচিত, তবে তা বলতে পারেন। কিন্তু যুক্তি ও প্রমাণ ছাড়া-স্বাদেশিকতা ও মার্তৃভূমির ঐক্যের ভিত্তিতে জাতি গঠিত হয়- এরূপ উক্তি করার আপনার কি অধিকার আছে?
একটি দেশের সমগ্র অধিবাসীকে বৈদেশিক লোকগণ সেই দেশের অধিবাসী বলে জানে এবং অভিহিত করে। ‘আমেরিকান’ বলতে আমেরিকা নামীয় দেশের প্রত্যেকটি অধিবাসী বুঝায়-সে নিগ্রো হোক কি শ্বেতাঙ্গ; বাইরের লোক তাকে ‘আমেরিকান’ই বলবে। কিন্তু মূলত এরা যে দুটি বিভিন্ন জাতির লোক, সে সত্য এতে মিথ্যা হয়ে যায় না। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের েেত্র প্রত্যেক ব্যক্তিই নিজ নিজ রাজ্যের ‘ন্যাশনাল’ বলে পরিচিত হয়, এতে সন্দেহ নেই। যদি মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী বর্হিভারতে চলে যান, তবে তাঁকে ‘বৃটিশ ন্যাশনালিটি’ বলে অভিহিত করা হবে। কিন্তু এরূপ পারিভাষিক জাতীয়তা কি মাওলানার প্রকৃত জাতীয়তার পরিণত হবে। তাহলে “ভারতের অধিবাসী হিসেবে হিন্দু, মুসলমান, শিক, খৃস্টান ও পার্শী সকলেই ‘একজাতি’ বলে পরিচিত হয়”- একথায় বিজ্ঞানসম্মত যুক্তি কি থাকতে পারে? ‘পরিগণিত’ হওয়া এবং প্রকৃতপে ‘একজাতি হওয়ায়’ আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে। কাজেই এর একটিকে প্রমাণ করার জন্য অন্যটিকে যুক্তি হিসাবে পেশ করা যেতে পারে না।
আভিধান ও কুরআন থেকে ভুল প্রমাণ পেশ
অতঃপর আরবী অভিধান থেকে মাওলানা মাদানী প্রমাণ করেছেন যে, ‘কওম’ শব্দের অর্থ হচ্ছে, ‘পুরুষের দল’ কিংবা ‘বহু পুরুষ ও স্ত্রীলোকের সমষ্টি’ বা ‘এক ব্যক্তির নিকটাত্মীয়গণ’, অথবা ‘শত্রু“দের দল’। কুরআনের আয়াত পেশ করেও তিনি এর প্রমাণ করতে চেয়েছেন এবং যেসব আয়াতে কাফেরদেরকে নবী কিংবা মুসলমানদের ‘কওম’ (জাতি) বলা হয়েছে, তাই তিনি পেশ করেছেন। অথচ এসব আয়াতে জাতি শব্দটি উল্লিখিত চারটি অর্থের তৃতীয় কি চতুর্থ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেসব আয়াতে ‘কওম’ (জাতি) শব্দটি থেকে প্রথম কিংবা দ্বিতীয় অর্থ প্রকাশ পায় তাও তিনি পেশ করেছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে জাতি শব্দের আভিধানিক বা প্রাচীন অর্থ সম্পর্কে এখানে কোনোই তর্ক নেই, তর্ক হচ্ছে আধুনিক যুগের পরিভাষা নিয়ে। জাওয়াহের লাল এবং সাইয়্যেদ মাহমুদ আরবী অভিধান এবং কুরআনের ভাষায় কথা বলে না, কংগ্রেসের কর্মসূচীতেও এ প্রাচীন ভাষার ব্যবহার হয় না। তাঁদের ব্যবহৃত শব্দ থেকে সেই শব্দসমূহ থেকে বর্তমানে সাধারণত গ্রহণ করা হয়ে থাকে। বর্তমান সময়ে ‘কওম’ ও ‘কওমিয়াত’ শব্দটি ইংরেজী Nation ও Nationality-র প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। লর্ড ব্রাইস তার “Intertational Relations” গ্রন্থে তার ব্যাখ্যা করে বলেনঃ
“এক জাতীয়তার অর্থ হচ্ছে অসংখ্য লোকের এমন একটা সমষ্টি, যাদেরকে কয়েকটি বিশেষ উচ্ছাসমূলক আকর্ষণ (Sentiments) পরস্পর মিলিত ও সংহত করেছে। তার মধ্যে দুটি আকর্ষণ সর্বাপেক্ষা অধিকতর শক্তিশালী-একটি হচ্ছে বংশ বা গোত্রের আকর্ষণ, আর অপরটি হচ্ছে ধর্ম বা জীবন ব্যবস্থার আকর্ষণ। কিন্তু একটি যুক্ত ভাষার ব্যবহার, একই প্রকার সাহিত্য, অতীতকালের সম্মিলিত জাতীয় কার্যকলাপ, সম্মিলিত দুঃখ-কষ্টের স্মরণ, মিলিত উৎসব অনুষ্ঠান, মিলিত চিন্তাধারা ও মতবাদ এবং উদ্দেশ্যের অনুভূতিও এ একই সমাবেশ সৃষ্টির অন্যতম কারণ হতে পারে। কখনো এসব সম্পর্ক একস্থানে সমন্বিত হলে এটা মানব সমষ্টিকে পরস্পর বিজড়িত করে থাকে। আবার কখনো তাদের মধ্যে কোনো আকর্ষণ না থাকা সত্ত্বেও ‘জাতীয়তা’র সৃষ্টি হয়।”-(পৃষ্ঠাঃ ১১৭)
জাতি বা জাতীয়তার ব্যাখ্যা “Encyclopedia of Religon and Ethics”- লিখিত হয়েছেঃ
জাতীয়তা সাধারণ গুণ কিংবা বহুবিধ এমনসব গুণের সৃষ্টি, যা একটি দলের সকল লোকের মধ্যে একইভাবে বর্তমান এবং এটাই তাদের পরস্পর সম্মিলিত করে এক জাতিতে পরিণত করে। …প্রত্যেকটি সমাজে এমন সব লোক থাকে, যারা বংশ-গ্রোত্র, সম্মিলিত ঐতিহ্য, অভ্যাস ও ভাষার সাদৃশ্যের পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে থাকে। তারা পরস্পরকে খুব ভাল করে বুঝতে পারে। প্রকৃতপক্ষে তাদেরকে পরস্পর বিজড়িত রাখার এটাই প্রধান সম্পর্ক। অনিচ্ছা সত্ত্বেও এরা একে অপরের সাথে সংযুক্ত। নানা দিক দিয়ে তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও প্রীতিভাব জন্মে। ভিন্ন জাতির লোকদেরকে তারা আপনা থেকেই ‘ভিন্ন’ ও অপরিচিত বলে বুঝতে পারে, কারণ তার রুচি, ভাবভঙগী ও অভ্যাস-স্বভাব আশ্চার্য্য ধরণের মনে হয় এবং তার প্রকৃতি, মতবাদ ও হৃদয় নিহীত উচ্চাসিত ভাবধারা। হৃদয়াঙ্গম করা বড়ই কঠিন ও অসুবিধাজনক মনে হয়। এজন্যই প্রাচীন জাতির লোকেরা ভিন্ন জাতির লোকদেরকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতো। আধুনিক কালের সভ্য ব্যক্তিরাও ভিন্ন জাতির লোকদের অভ্যাস-স্বভাব ও জীবনযাপনের ধারাকে নিজেদের রুচির বিপরীত দেখে তার প্রতি ঘৃণা পোষণ করতে থাকে।”
এ অর্থে কাফের, মুশরিক ও মুসলমানদেরকে একই জাতির অন্তর্ভূক্ত হবার জন্যে কুরআন মজিদ কি বিন্দুমাত্রও অনুমতি দিয়েছে? এ অর্থে ঈমানদার ও অঈমানদার সকলেই এক জাতিতে পরিণত করার জন্যই দুনিয়াতে কোনো নবী এসেছিলেন কি? যদি তা না হয় তবে এ অহেতুক আলোচনার অবতারণা করা হয়েছে কেন? ইতিহাসের আবর্তনের সাথে সাথে শব্দ অসংখ্যবার নিজের অর্থের পরিবর্তন করেছে। একটি শব্দের গতকাল একরূপ অর্থ ছিল, আর আজ অন্য অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে। আভ্যন্তরীণ বিবরণকে উপেক্ষা করে “কুরআনের দৃষ্টিতে মুসলমান ও কাফেরের এক জাতি হওয়া সম্ভব” বলে উক্তি করলে তা শব্দগত বিভ্রান্তি ছাড়া আর কি হতে পারে! কারণ কুরআনের ভাষায় ‘জাতীয়তা’র যে অর্থ একদিন ছিল, বর্তমানের অর্থের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। পূর্ববর্তী ফিকাহ শাস্ত্রবিদগণ ‘মাকরূহ’ ও ‘হারাম’ শব্দদ্বয়ে পরিভাষার দিক দিয়ে বিশেষ কোনো পার্থক্য করেননি। এজন্য অনেক স্থানে ‘হারাম’ অর্থে মাকরূহ শব্দের প্রয়োগ হয়েছে। কিন্তু বর্তমান সময় এ দু’প্রকার নিষেধের মাত্রা বুঝাবার জন্য স্বতন্ত্র পরিভাষা রচিত হয়েছে। এখন ‘হারাম’কে ‘মাকরূহ’ অর্থে ব্যবহার করা এবং প্রমাণ হিসেবে পূর্ববর্তী লেখকদের কোনো রচনাংশ পেশ করা প্রতারণা ছাড়া আর কিছূ হতে পারে কি? জাতীয়তা শব্দটিও বর্তমান সময় এরূপ একটি পরিভাষায় পরিণত হয়েছে। এমন মুসলমান ও কাফের উভয়ের জন্য ‘জাতীয়তা’ শব্দ প্রয়োগ করা ও আপত্তিকারকের মুখ বন্ধ করার জন্য প্রাচীন প্রয়োগকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করায় গোলকধাঁধা সৃষ্টি ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।
শাব্দিক বিভ্রান্তি
সম্মুখে অগ্রসর হয়ে মাওলানা দাবী করে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনা শরীফে ইহুদী এবং মুসলমানদের মুক্ত জাতীয়তা গঠন করেছিলেন। আর এ দাবীর প্রমাণ স্বরূপ তিনি হিজরতের পর নবী করীম (সা.) এবং ইহুদীদের মধ্যে স্থাপিত সন্ধি চুক্তির কথা উল্লেখ করেছেন। এ চুক্তিপত্রের কোথাও এ বাক্যাংশটি মাওলানা হস্তগত হয়েছে : وَاَنْ يَّهُود بنى عَوفٍ امَّةُ مع المؤمنين – “বনু আওফের ইহুদীরা মুসলমানদের সাথে এক উম্মত বলে পরিগণিত হবে।”
বর্তমান সময়েও মুসলিম এবং অমুসলিমের মুক্ত জাতীয়তা গঠিত হতে পারে-একথা প্রমাণ করার জন্য এ বাক্যংশকেই যথেষ্ট মনে করা হয়েছে। কিন্তু এটাতো নিছক একটা শাব্দিক গোলকধাঁধা। আরবী ভাষায় উম্মত অর্থ এমন একটা দল কোনো কিছু যাকে একত্র করে; তা স্থান-কাল, ধর্ম বা অন্য কিছুই হোক না কেন এ বিবেচনায় দুটি ভিন্ন কওম কোনো একটা যৌথ স্বার্থে সাময়িকভাবে একমত হলে তাদেরকেও এক উম্মত বলা যেতে পারে। তাইতো আরবী ভাষার প্রামাণ্য অভিধান ‘লিসানুল আরাব’ গ্রন্থের রচয়িতা লিখেছেন : وقوله فى الحديث ان يهود بنى عوف امة من المؤمنين يريد انهم بالصلح الذى وقع بينهم وبين المؤمنين كجماعة منهم كلمتهم وايديهم واحدة – “হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে বলেছেন-বনু আওফের ইহুদী এবং মুসলমানরা মিলে এক উম্মত হবে, একথার মর্ম এই যে, ইহুদী এবং মুসলমানদের মধ্যে যে সন্ধি স্থাপিত হয়েছে, তারা বলে তারা যেন মুসলমানদেরই একটা দলে পরিণত হয়েছে এবং তাদের ব্যাপার এক ও অভিন্ন।”
উল্লিখিত আভিধানিক শব্দ ‘উম্মাত” আধুনিক পরিভাষার ‘একজাতিত্ব’-এর সমার্থবোধক কি করে হতে পারে? খুব বেশী হলেও তাকে আধুনিক পরিভাষায় ‘সামরিক মৈত্রী’ (Military alliance) বলা যেতে পারে। বস্তুত এটা একটি পারস্পারিক চুক্তি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। ইহুদীরা নিজেদের ধর্ম এবং মুসলমানরা নিজেদের ব্যবস্থার অনুসারী থাকবে, উভয়ের তfমদ্দুনিক ও রাজনৈতিক ভূমিকা স্বতন্ত্র থাকবে; তবে একটি দলের উপর বাহির থেকে কোনোরূপ আক্রমণ হলে উভয় পক্ষই একত্রিত হয়ে তার প্রতিরোধ করবে এবং এ যুদ্ধে নিজ নিজ ধন-সম্পদ খরচ করবে-এটাই হলো উক্ত চুক্তির মূলকথা। দু-তিন বছরের মধ্যেই এ চুক্তির সমাপ্তি হয়েছিল। মুসলমানগণ কিছু সংখ্যক ইহুদীকে নির্বাসিত করেন, কিছু সংখ্যককে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করেন। ……এরূপ চুক্তিকে কি কখনো ‘একজাতিত্ব’ বলা চলে? বর্তমান সময় ‘একজাতিত্ব’ বলতে যা বুঝায়, উল্লিখিত চুক্তিতে তার বিন্দুমাত্র সাদৃশ্যও খুঁজে পাওয়া যাবে কি? মদীনায় কি কোনো যুক্ত জাতীয়তা রাষ্ট্র স্থাপন করা হয়েছিল? কোনো যুক্ত আইন পরিষদ কি গঠন করা হয়েছিল? ‘ইহুদী ও মুসলমানরা’ এক সমষ্টিতে পরিণত হবে এবং তার মধ্যে যারা সংখ্যাধিক্য লাভ করবে, তারাই মদীনার শাসনকার্য পরিচালনা করবে, আর তাদেরই মঞ্জুরীকৃত আইন মদীনায় জারী হবে-এরূপ কোনো চুক্তি কি স্বাক্ষরিত হয়েছিল? কোনো যুক্ত আদালতও কি তথায় কায়েম করা হয়েছিল এবং তাতে ইহুদী ও মুসলমানদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচারকার্য একত্রে ও একই দেশীয় আইনের মারফতে সম্পন্ন করা হতো কি? বস্তুত সেখানে কোনো দেশীয় কংগ্রেস গঠন করা হয়নি এবং ইহুদী সংখ্যগুরু নির্বাচিত হাইকমাণ্ড ইহুদী ও মুসলমানদেরকে অঙ্গুলি সংকেতে নাচাতো না। দ্বিতীয়ত সেখানে সন্ধিচুক্তি অনুষ্ঠিত হয়েছিল রাসূলুল্লাহ (সা.) এবং ইহুদী নেতাদের মধ্যে; কা’ব বিন আশরাফ ও আব্দুল্লাহ বিন উবাই সরাসরিভাবে মুসলমান ব্যক্তিদের সাথে ‘মাসকন্ট্রাক্ট’ (জনসংযোগ) করতে চেষ্টা করেনি। মুসলমান ও ইহুদী বালকদেরকে এক যুক্ত সমাজের উপযোগী শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য ওয়ার্ধাস্কীমের ন্যায় শিক্ষা সংক্রান্ত কোনো স্কীমও তথায় রচিত হয়নি। মোটকথা সেই সন্ধিচুক্তি ও বর্তমানের একজাতিত্বের মধ্যে কোনো দূরতমও সম্পর্ক ও সাদৃশ্য বর্তমান নেই। মাওলানা মাদানী যে ‘একজাতিত্ব’ আজ হযরত রাসূলে করীম (সা.)-এর প্রতি আরোপ করেছেন, তাতে আধুনিক কালের ‘একজাতি’ গঠনের উপাদানসমূহের কোন উপাদানটি বর্তমান পাওয়া যায়? আমি নিশ্চিত বলতে পারি, কোনো উপাদানই তাতে পাওয়া যেতে পারে না। কাজেই নবী করীম (সা.)-এর চুক্তিতে ‘মুসলমানদের সাথে এক উম্মাত’ বাক্যাংশটুকু দেখেই মাওলানা মাদানী মুসলমানদের মনে এ বিশ্বাস জন্মাতে চান যে, আজ কংগ্রেস যে, ‘একজাতি’ গঠন করতে চেষ্টা করছে, নবী করীম (সা.) স্বয়ং তাই একদিন মদীনায় করেছিলেন। অতএব ‘পরিপূর্ণ নিশ্চয়তা ও নিশ্চিন্ততার সাথে বর্তমানের একজাতির অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাও’-মাওলানা মাদানীর এ প্রচারণা ব্যাপদেশে তাঁর মনে এতোটুকু ভয়ও কি জাগ্রত হলো না যে, আল্লাহ তাঁর নিকট এ মিথ্যা প্রচারণার জন্য কৈফিয়ত তলব করতে পারেন? এটা কি নবী করীম (সা.) সম্পর্কে সম্পূর্ণ মিথ্যা উক্তি নয়?
মাওলানা মাদানী নিজে একজন শ্রেষ্ঠ আলেম ও মুহাদ্দিস। তাঁর নিকট আমি হযরত আয়েশা (রা.) বর্ণিত একটি হাদীস সম্পর্কে একটি কথা জিজ্ঞেস করতে চাই। হাদীসে বলা হয়েছে, كان النَبِىُّ صلى الله عليه وسلَّمَ يَقْبَلُ ومباشر وهو صائم “নবী করীম (সা.) রোযা রেখেও চুমো দিতেন এবং ‘মুবাশারাত’ করতেন। এখানে ‘মুবাশারাত’ শব্দের সাধারণ প্রচলিত অর্থ গ্রহণ করলে রোযা রেখেও ‘স্ত্রী সহবাস’ করা জায়েয প্রমাণিত হয়। কিন্তু তাই বলে তার প্রকাশ্য অর্থ গ্রহণ করে এরূপ শরীয়াত বিরোধী মত হাদীস থেকে বের করা কি সংগত হতে পারে?
এ দুটি যুক্তি সম্পূর্ণরূপে একই ধরণের। কাজেই উভয় ক্ষেত্রেই এরূপ নীতির ব্যাপারে কোনোরূপ তারতম্য করা যায় না। বিশেষত যুক্তি প্রদাতা যদি জনগণের আস্থাভাজন হন এবং জনগণ তাঁর নিকট থেকে হেদায়াত লাভ করতে চায়, তবে ব্যাপারটি আরো কঠিন হয়ে পড়ে। জনস্বাস্থ্য বিভাগ থেকে যদি বিষ বন্টন করা হয়, তবে মৃতসঞ্জীবনীর সন্ধান কোথায় পাওয়া যাবে?
ভুল প্রমাণের উপর ভুল মতের ভিত্তি স্থাপন
সমগ্র ভারতবাসীর ‘একজাতিত্ব’কে সংগত বলে প্রমাণ করার জন্য মাওলানা মাদানী আর একটি দলীল পেশ করেছেন। তিনি বলেছেন :
“আমরা প্রতিদিন সম্মিলিত স্বার্থের জন্য জনসংঘ বা সমিতি গঠন করে থাকি এবং তাতে শুধু অংশই গ্রহণ করি না, তার সদস্য পদ লাভ করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টাও করে থাকি। …শহর এলাকা, ঘোষিত এলাকা, মিউনিসিপাল বোর্ড, জেলা বোর্ড, ব্যবস্থা পরিষদ, শিক্ষা সমিতি এবং এ ধরণের শত শত সমিতি রয়েছে-যা বিশেষ উদ্দেশ্যের জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম-নীতি অনুসারে গঠিত হয়েছে। এসব সমিতিতে অংশগ্রহণ করা এবং সেজন্যে সম্পূর্ণ কি আংশিকভাবে চেষ্টা করাকে কেউ নিষিদ্ধ করে না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এ ধরণের কোনো ‘সমিতি’ যদি দেশের স্বাধীনতা এবং বৃটিশ প্রভূত্বের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্যে প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে তাতে অংশগ্রহণ হারাম, ন্যায় পরায়নতার বিপরীত, ইসলামের শিক্ষার পরিপন্থী এবং জ্ঞান-বুদ্ধি ইত্যাদিও বিপরীত হয়ে যায়।”-(পৃষ্ঠা : ৪১) বস্তুত একেই বলে ভুলের ভিত্তিতে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ। মাওলানা মাদানী একটি পাপের কাজকে ফরয গণ্য করতঃ তারই অন্ধপ্রেমে পড়ে অনুরূপ আর একটি পাপকে সংগত প্রমাণ করতে চেষ্টা করছেন। অথচ! উভয় ক্ষেত্রেই হারাম হওয়ার একই মূল কারণ বিদ্যমান। আমি স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, কাউন্সিল ও এসেম্বলীতে যোগ দেয়াকে ওলামায়ে হিন্দের একদিন হারাম এবং অন্যদিন হালাল বলে ঘোষণা করা একেবারে পুতুল খেলার শামিল হয়েছে। কারণ প্রকৃত ব্যাপার লক্ষ্য করে কোনো জিনিসকে হারাম ঘোষণা করার নীতি তাদের নয়। গান্ধীজির একটি শব্দেই তাদের ফতোয়া দান ক্ষমতা সক্রিয় হয়ে উঠে। কিন্তু আমি ইসলামের শ্বাশ্বত ও অপরিবর্তনীয় নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে বলছি, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যেসব বিষয়ে সুস্পষ্ট ফয়সালা করেছেন, সে সম্পর্কে নতুনভাবে ফয়সালাকারীর নিরংকুশ অধিকার মানুষকে দেয় যেসব সামগ্রিক প্রতিষ্ঠান, মুসলমানদের পক্ষে তা সমর্থন করা এক চিরন্তন অপরাধ, সন্দেহ নেই। কিন্তু এরূপ নিরংকুশ অধিকার ও কর্তৃত্ব সম্পন্ন সামগ্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহে অমুসলিমদের সংখ্যা যখন অধিক হয়ে পড়ে এবং তাতে সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতেই যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, তখন এটা দ্বিগুণ অপরাধরূপে পরিগণিত হয়। অতএব এসব সামগ্রিক প্রতিষ্ঠানের কর্মসীমা আল্লাহর শরীয়তের নির্দিষ্ট সীমা থেকে স্বতন্ত্র করে দেয়াই মুসলমানদের প্রথম কর্তব্য এবং তাদের পক্ষে এটাই প্রকৃত আযাদী যুদ্ধ। কর্তৃত্ব প্রয়োগের উলিখিত সীমা উভয়েরই যদি স্বতন্ত্র হয়, তবে মুসলিম-অমুসলিম উভয় জাতির কোনো মিলিত স্বার্থের জন্য গঠিত দলের সহযোগিতা করা মুসলমানদের পক্ষে সংগত হবে। তা কোনো শত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য হোক, কি কোনো অর্থনৈতিক বা শৈল্পিক কাজকর্ম আনজাম দেয়ার জন্য হোক, তাতে কোনোরূপ পার্থক্য নেই।
কিন্তু উভয় জাতির কর্ম ও ক্ষমতার সীমা যতোদিন পরস্পর যুক্ত থাকবে, মিলন ও সহযোগিতা তো দূরের কথা, এরূপ যুক্ত শাসনতন্ত্রের অধীন জীবন-যাপন করাও মুসলমানদের পক্ষে সম্পূর্ণ অসংগত। এ ব্যাপারে নির্বিশেষে সকল মুসলমানই অপরাধী বলে বিবেচিত হবে-যতোদিন না তারা সকলে মিলে মিলিত শক্তির সাহায্যে উক্ত শাসনতন্ত্রকে চূর্ণ করে দিবে। আর যারা সাগ্রহে এ শাসনতন্ত্র গ্রহণ করবে এবং তাকে চালু করার জন্যে চেষ্টা করবে, তারা তদপেক্ষা বেশী অপরাধী হবে। কিন্তু যে ব্যক্তি-সে যে-ই হোক না কেন-সেই শাসনতন্ত্র চালু করার অনুকূলে কুরআন-হাদীস থেকে যুক্তি পেশ করবে, তার অপরাধ হবে সর্বাপেক্ষা বেশী।
একটি ব্যাপারে যখন একই সময় একদিক দিয়ে হারামের কারণ পাওয়া যায় এবং অন্যদিক দিয়ে তাকে জায়েয বলার কারণও দেখা যায়, তখন মাত্র জায়েয হওয়ার কারণটিকে পৃথক করে দেখে তার অনুকূলে সিদ্ধন্ত গ্রহণ করা এবং হারামের কারণটির দিকে ভ্রুক্ষেপ মাত্র না করা, আমার মতে কোনো পরহেযগার ও আল্লাহভীরু প্রমাণ নয়-আর না এতে শাস্ত্রজ্ঞানের কোনো পরিচয় আছে। মাওলানা মাদানী দেশের স্বাধীনতা ও বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের উচ্ছেদ সাধনের জন্যে চেষ্টা করাকে অপরিহার্য বলে ঘোষণা করেন; কিন্তু তখন তিনি একথা আদৌ মনে রাখেন না যে, যে দলটি এরূপ ধারণা নিয়ে আযাদীর জন্যে চেষ্টা করে, প্রকৃতপে তারাই এ শাসনতন্ত্র রচনা করে, পরিচালিত করে এবং পূর্ণ পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। অথচ এ শাসনতন্ত্রে মানবীয় আইন পরিষদকে আলাহর বিধান রদবদল করার নিরংকুশ ক্ষমতা দান করা হয়েছে। এর দ্বারা আলাহর আইন তো জারী হতেই পারে না; আর যদি কখনো জারী হয়ও, তবে তা হবে আইন পরিষদের মঞ্জুরী লাভের পর। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠঅমুসলিম মুসলমানদের সামাজিক ও সামগ্রিক জীবনের নিয়ম-প্রণালী রচনার পূর্ণ কর্তৃত্ব লাভ করবে এবং এর দরুন তাদের নৈতিক চরিত্র, সামাজিকতা ও ভবিষ্যত বংশধরের উপর তার তীব্র প্রভাব পড়তে পারে। এরূপ শাসনতন্ত্র সহকারে দেশের যে স্বাধীনতা লাভ হবে, তার পশ্চাতে আপনারা দৌড়াচ্ছেন-কারণ, কেবল বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের অবসানই আপনাদের ল্ক্ষ্য-সে অবসান যে রকমেই হোক না কেন। এজন্য এরূপ দলে যোগ দেয়ার অনুকূল কারণটিকেই সামনে পেশ করা হচ্ছে; কিন্তু তার নিষিদ্ধ হওয়ারও যে একটি বিরাট যুক্তি সংগত কারণ তাতে রয়েছে, সেদিকে মাত্রই লক্ষ্য দেয়া হয় না। কিন্তু আমরা এ উভয় দিকের উভয় প্রকারের কারণ সামনে রেখেই ব্যাপারটি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য এবং নিষেধের কারণ দূর না করে জায়েযের কারণ গ্রহণ করতে আমরা প্রস্তুত হতে পারি না। যেহেতু বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের অবসান এবং ইসলামের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা-এ উভয়ই আমাদের লক্ষ্য। এরূপ দৃষ্টিকোণকে যদি কেউ বৃটিশ পূজা বলে আখ্যায়িত করেন, তবে আমরা তার এ বিদ্রুপের মাত্রই পরোয়া করি না।
দুঃখজনক অজ্ঞতা
মাওলানা মাদানী অন্যত্র লিখেছেন : “সম্মিলিত স্বাদেশিক জাতীয়তার বিরোধীতা করে শুধু এজন্য ফতোয়া দেয়া হয় যে, পাশ্চাত্য পরিভাষা অনুযায়ী স্বাদেশিক জাতীয়তা বলতে বুঝায় এমন এক সামগ্রিক রূপ, যা সম্পূর্ণরূপে ধর্মের বিরোধী এবং একমাত্র ঐ পারিভাষিক অর্থের সাথেই তা সংশিষ্ট থাকবে। কিন্তু এ অর্থ সাধারণত সকলের মনে বদ্ধমূল নয়, কোনো ন্যায়পরায়ন মুসলমানও তা সমর্থন করতে পারে না। আর বর্তমান আন্দোলনও এ অর্থের ভিত্তিতে হচ্ছে না, কংগ্রেস এবং তার কর্মীরা এ আন্দোলন চালাচ্ছেও না, আর দেশের সামনে আমরা এটা পেশও করছি না।” -(পৃষ্ঠাঃ ৪১)
এ দাবীর সমর্থনে বহু পুরাতন কথার উল্লেক করা হয়েছে, অথচ তার মূলতত্ত্ব ইতিপূর্বে কয়েকবারই উদঘাটিত হয়েছে-অর্থাৎ কংগ্রেসের বিঘোষিত মৌলিক অধিকার দানের ঘোষণা। এটা থেকে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হচ্ছে যেঃ
“কংগ্রেস যে সম্মিলিত জাতীয়তাকে ভারতের বুকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তাতেও সে এমন কোনো কাজ করতে চায় না, যার ফলে ভারতবাসীদের ধর্ম কিংবা সংস্কৃতি, সভ্যতা ও ব্যক্তিগত আইনের উপর কোনোরূপ ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে। সম্মিলিত স্বার্থ ও দেশীয় প্রয়োজনের সাথে সংশিষ্ট বিষয়গুলোকে সুষ্ঠু ও সুশৃংখলিত করাই তার একমাত্র ইচ্ছা। কারণ এগুলোকে বিদেশী শাসকবর্গ নিজেদের করায়ত্ত করে রেখে ভারতের অধিবাসীদেরকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করেছে। বিঘোষিত এলাকা, মিউনিসিপাল বোর্ড, জিলা বোর্ড, কাউন্সিল, এসেম্বলী ইত্যাদিতে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ব্যাপার হিসেবে সিদ্ধান্ত করা হয়। এগুলোর ক্ষেত্রে কোনো জাতি বা ধর্ম মিলে যাওয়ার কোনো কথা নেই।” -(পৃষ্ঠা : ৫৭)
মুসলমানদের এক কঠিন সংকটজনক মুহুর্তে কিরূপ স্থূল দৃষ্টি ও অবিমৃশ্যকারিতার সাথে তাদের পথনির্দেশ করা হচ্ছে, উলেখিত উদ্ধৃতিই তার সুস্পষ্ট নিদর্শন। যে বিষয় ও সমস্যার উপর আট কোটি মুসলমানের কল্যাণ অকল্যাণ একান্তভাবে নির্ভর করে, সে সম্পর্কে সামান্য মাত্র ত্রুটিও তাদের ভবিষ্যত সামাজিক ও নৈতিক জীবনে বিরাট বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে, সেসব ব্যাপারে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাকে ‘ছেলে খেলা’ বলে মনে করা হয়-সে জন্য কোনো চিন্তা-গবেষণা, অধ্যয়ন-অনুশীলন করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করা হয় না। অথচ তালাক, মীরাসী আইন ইত্যাদি সংক্রান্ত মামলার রায় দেয়ার ব্যাপারে এক একজন লোককে কত না চিন্তা ও গবেষণা করতে হয়। উল্লেখিত উদ্ধৃতির এক একটি শব্দ থেকে পরিষ্কার বুঝতে পারা যায় যে, মাওলানা মাদানী জাতীয়তার পারিভাষিক অর্থ জানেন না-কংগ্রেসের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কেও তিনি একেবারেই অনবহিত। ‘মৌলিক অধিকারে’র অর্থ সম্পর্কেও তিনি এতোটুকু চিন্তা করেননি। এমনকি তিনি যেসব সামগ্রিক সংঘের বারবার উলেখ করেন, সেসবের কর্ম ও মতার সীমা বর্তমান গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কোন পথে তাহযীব-তামাদ্দুন, ধর্ম বিশ্বাস ও নৈতিক চরিত্রের সীমার মধ্যে প্রবেশ করে থাকে, তাও তিনি মাত্রই জানেন না। কালচার, তাহযীব, ব্যক্তিগত আইন ইত্যাদি শব্দসমূহকে তিনি যেভাবে ব্যবহার করেছেন, তা থেকে পরিষ্কার প্রমাণিত হচ্ছে যে, তিনি এতোবড় ‘আলেম ও বুজূর্গ’ ব্যক্তি হয়েও এসব শব্দের অর্থ ও তত্ত্ব মাত্রই বুঝতে পারেননি-একথা আমি বিশেষ দায়িত্ব সহকারে এবং বুঝে-শুনে বলছি। আমি অনুভব করতে পেরেছি যে, যারা সত্যের মাপকাঠিতে ব্যক্তির যাচাই করার পরিবর্তে ব্যক্তির মানদণ্ডে সত্যের যাচাই করতে অভ্যস্ত, আমার এ সুস্পষ্ট ভাষণ তাদের অসহ্যবোধ হবে। এজন্য একথার উত্তরে আরো কয়েকটি গালাগালি শুনার জন্য আমি নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়েছি। কিন্তু আমি যখন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি যে, ধর্মীয় নের্তৃত্বের পবিত্র সনদ থেকে মুসলমানদেরকে ভ্রান্ত পথে পরিচালিত করা হচ্ছে, প্রকৃত সত্য ও নির্ভুল তত্ত্বের পরিবর্তে তাদেরকে মিথ্যা ও অমূলক ধারণার দিকে চালানো হচ্ছে এবং বিরাট ও অতল গভীর খাদযুক্ত পথকে সরল ঋজু উন্মুক্ত রাজপথ বলে তাদেরকে সেদিকে ঠেলে নেয়া হচ্ছে তখন এটা দেখে ধৈর্যধারণ করা আমার পক্ষে অসম্ভব হলো। কাজেই আমার স্পষ্ট সত্য কথায় কারো ক্রোদের উদ্রেক হলে সেজন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত থাকাই আমার কর্তব্য।
আঞ্চলিক জাতীয়তার মূল লক্ষ্য
জাতীয়তার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে উপরে লর্ড ব্রাইসের ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্ক’ এবং ‘নৈতিক চরিত্র ও ধর্মসমূহের বিশ্বকোষ’ থেকে যে কথা ইতিপূর্বে উদ্ধৃত করা হয়েছে, তা আর একবার পাঠ করুন। এ অর্থের দিক দিয়ে ব্যক্তিগণ একটি মাত্র মৌলিক কারণে একটি জাতিতে পরিণত হতে পারে। তা এমন একটি আকর্ষনীয় শক্তি, যা এ সকলের মধ্যে প্রাণের ন্যায় বর্তমান থাকবে এবং তাদেরকে পরস্পর সংযুক্ত রাখবে। কিন্তু এ আকর্ষণ শুধু বর্তমান থাকলেই একটি ‘জাতি’ গঠিত হওয়ার জন্য তা কিছুমাত্র যথেষ্ট হয় না। একে অত্যন্ত বেশী শক্তিশালী হতে হবে, যেন যেসব ভাবধারা ব্যক্তিগণকে কিংবা ব্যক্তিদের ছোট ছোট দলকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে সেসবকে চূর্ণ করে দিতে পারে। কারণ বিচ্ছেদকারী জিনিসগুলো যদি মিলন সৃষ্টিকারী ভাবধারার প্রতিরোধ করার জন্য অত্যাধিক দৃঢ় হয় তবে তা মিলন সৃষ্টির কাজে সাফল্য লাভ করতে পারে না-আর অন্য কথায় তা একটি ‘জাতি’ গঠন করতে পারে না। এতদ্ভিন্ন একটি জাতীয়তার জন্য ভাষা, সাহিত্য, ঐতিহাসিক ঐতিহ্য, রসম-রেওয়াজ, সামাজিকতা ও জীবনধারা, চিন্তাধারা ও মতবাদ, অর্থনৈতিক স্বার্থ ও বৈষয়িক উদ্দেশ্যেরও প্রয়োজন হয়। এসব জিনিসকেই মিলন সৃষ্টিকারী ভাবধারার প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল হতে হবে। অন্য কথায় বিচ্ছেদকারী ভাবধারাকে জাগ্রত করার মতো কোনো জিনিসই যেন এতে বর্তমান থাকে না। কারণ, এটা সবই ব্যক্তিদের সম্মিলিত করার ব্যাপারে প্রভাব বিস্তার করে। এসবের ঝোঁক ও প্রবণতা যদি ‘মিলন-বাণীর’ মূল উদ্দেশ্যের অনুকূল হয়, তবেই এটা মিলন সৃষ্টি করার কাজ সম্পন্ন করতে পারে। অন্যথায় এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন পদ্ধতিতে দল গঠন করবে এবং ‘জাতি’ সৃষ্টি করার কাজ অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়বে।
এখন চিন্তা করার বিষয় এই যে, যে দেশে এরূপ অর্থের দৃষ্টিতে বিভিন্ন জাতি বসবাস করে, তাদেরকে সম্মিলিত ও সংযুক্ত করার সম্ভাব্য উপায় কি হতে পারে। এ সম্পর্কে যতই চিন্তা করা যায়, মাত্র দুটি উপায়ই সম্ভব বলে মনে হয়- প্রথমত এই যে, এসব জাতিকে তাদের স্বতন্ত্র জাতীয়তার সাথে স্থায়ী রেখে তাদের মধ্যে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট শর্তে একটি ‘ফেডারেল’ চুক্তি স্বারিত হবে। যার দরুন তারা উভয়েই শুধু মিলিত স্বার্থের জন্য একত্র হয়ে কাজ করবে। এবং অন্যান্য সমগ্র ব্যাপারেই তারা সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম হবে। কিন্তু কংগ্রেস কি এ পন্থা অবলম্বন করেছে? এর উত্তরে ‘না’ বলা ছাড়া উপায় নেই। দ্বিতীয় উপায় হচ্ছে এ সময় জাতিকে ‘একজাতি’ কিভাবে বানানো যেতে পারে? ……….সেজন্য অনিবার্যভাবেই সর্বপ্রথম একটি সম্মিলিত আকর্ষণীয় শক্তি ও একটি কেন্দ্রিয় মিলনবাণী স্বীকৃত হতে হবে। তেমন একটি আকর্ষণী শক্তি কেন্দ্রীয় মিলনবাণী নিম্মলিখিতরূপ জিনিসের সমন্বয়েই গঠিত হতে পারে- একঃ স্বাদেশিকতাবাদ,
দুইঃ বৈদেশিক শত্রুদের প্রতি ঘৃণা এবং
তিনঃ অর্থনৈতিক সমস্বার্থের উৎসাহ।
এছাড়া উপরে যেমন বলেছি, এ আকর্ষণী শক্তি এতোদূর শক্তিশালী হওয়া আবশ্যক যে, যেসব ভাবধারা ও কারণ এ জাতিসমূহকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে, তা এ শক্তির সামনে যেন একেবারে ম্নান হয়ে যায়। কারণ মুসলমান যদি ইসলামের প্রতি, হিন্দু যদি হিন্দু ধর্মের প্রতি এবং শিক যদি শিখ ধর্মের প্রতি খুব প্রবল আকর্ষণ অনুভব করে, আর ধর্ম ও জাতীয়তার প্রশ্ন যখনি দেখা দিবে, তখনি যদি মুসলমান মুসলমানদের সাথে, হিন্দু হিন্দুদের সাথে এবং শিখ শিখদের সাথে মিলিত হয় এবং প্রত্যেকেই যদি নিজ নিজ সমর্থনে স্বতন্ত্র দল নিয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে, তবে তার অর্থ এই যে, ‘স্বদেশের প্রেম’ এ একাধিক জাতিত্বে ‘একজাতি’তে পরিণত করতে পারেনি। মুসলমান ইসলামকে স্বীকর করুক, হিন্দু হিন্দু মতবাদে বিশ্বাসী থাকুক, মন্দিরেও মাঝে মাঝে যাক-সেই কথা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, কিন্তু ‘একজাতি’ হওয়ার জন্য স্বাদেশিকতাকে অত্যাধিক গুরুত্ব প্রত্যেককেই দিতে হবে, যেন প্রত্যেক ধর্মাবলম্বীই নিজ নিজ ধর্ম ও মত বিশ্বাসকে স্বদেশের জন্য কুরবান করতে সমর্থ হয়। এরূপ ঐকান্তিক নিষ্ঠাপূর্ণ ভাবধারা না হলে ‘স্বাদেশিক’ জাতীয়তা মাত্রই গঠিত হতে পারে না।
স্বাদেশিক বা আঞ্চলিক জাতীয়তার এটাই তো মূল বীজ। এ বীজ কখনো বৃক্ষ উৎপাদন করতে পারে না, যতক্ষণ না এর উপযোগী আবহাওয়া ও পরিবেশ সৃষ্টি করা হবে। সে জন্য অনুকূল ক্ষেত্র ও মৌসুম আবশ্যক। পরে বলেছি জাতীয়তার আকর্ষণ সৃষ্টির জন্য ভাষা, সাহিত্য, ঐতিহ্য, রীতিনীতি ও প্রথা, সামাজিকতা ও জীবনধারা, চিন্তাধারা ও মতবাদ এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ ও বৈষয়িক উদ্দেশ্য প্রভৃতি একান্ত অপরিহার্য। মানুষের দল সমাজকে এসব জিনিসই সুসংগঠিত করে থাকে। এটা সবই জাতীয়তার আকর্ষণী শক্তির প্রকৃতিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বর্তমান থাকা আবশ্যক। কারণ বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে যোগাযোগ সৃষ্টিকারী এ বিভিন্ন শক্তি নিশ্চয়ের ঝোঁক যদি বিচ্ছেদের দিকে হয়, তবে মিলন সৃষ্টিও সংঘবদ্ধ করার ব্যাপারে এটা প্রচণ্ডভাবে বিরোধিতা করবে এবং এটা কিছুতেই ‘একজাতি’ হতে দিবে না। কাজেই একটি সম্মিলিত জাতি গঠনের জন্য প্রত্যেক জাতির মধ্যে স্বতন্ত্র জাতীয়তার ভাবধারা সৃষ্টিকারী শক্তিসমূহকে নেস্তানাবুদ করা একান্ত আবশ্যক; তদস্থলে সমগ্র জাতিকে একই রঙে রঙিন করা এবং ধীরে ধীরে তাদের সকলকে একই জাতীয়তার আদর্শে ঢেলে গঠন করা, তাদের মধ্যে সম্মিলিত স্বভাব-প্রকৃতি, সম্মিলিত নৈতিক ভাবধারা সৃষ্টি করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে একই প্রকার চিন্তাধারা, মতবাদ ও আদর্শ প্রচার করে তাদেরকে এমন বানিয়ে দিতে হবে, যেন অতপর সকলেই একই সমাজের লোক বলে পরিচিত ও পরিগণিত হতে পারে। তাদের মনোভাব, দৃষ্টিকোণ ও দৃষ্টিভঙ্গী সম্পূর্ণ এক হবে-একই ইতিহাসের উতস থেকে তাদের প্রাচীন গৌরবের ভাবধারা ফুটে বের হবে এবং শেষ পর্যন্ত তাদের বিরোধ ও বৈষম্য সৃষ্টির কোনো কারণ আদৌ বর্তমান থাকবে না। এ উদ্দেশ্যেই ‘ওয়ার্ধা স্কীম’ রচনা করা হয়েছে। ‘বিদ্যামন্দির স্কীমের’ও এটাই উদ্দেশ্য ছিল। এ উদ্দেশ্য এ উভয় স্কীমেই স্পষ্ট ভাষায় লিখে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু মাওলানা মাদানী এসব স্কীম এবং তাদের পাঠ্য তালিকা মোটেই দেখেননি। পণ্ডিত নেহরু কয়েক বছর পর্যন্ত এ জাতীয়তারই শিংগা ফুঁকছেন। কিন্তু তাঁর কোনো বক্তৃতা বা রচনাও মাওলানা মাদানীর গোচরীভূত হয়নি। কংগ্রেসের দায়িত্ব সম্পন্ন প্রত্যেকটি ব্যক্তি একথাই ঘোষণা করেছেন, লিখেছেন এবং নতুন শাসনতন্ত্রলব্ধ রাষ্ট্রশক্তির সাহায্যে তা প্রবলভাবে প্রচার করেও বেড়াচ্ছেন। কিন্তু মাওলানা মাদানী এর কিছু শুনতে, দেখতে ও অনুভব করতে পারছেন না। অথচ তিনি যেসব সামগ্রিক প্রতিষ্ঠানের উল্লেখ করেছেন, তাদের প্রত্যেকটি দ্বারাই এসব কাজ সম্পন্ন করা হচ্ছে। যেহেতু এসব প্রতিষ্ঠানেরই কর্মসীমা তাহযীব-তামাদ্দুন, কৃষ্টি, ব্যক্তিগত আইন ইত্যাদি সবকিছূ পর্যন্ত বিস্তারিত হয়ে আছে। কিন্তু প্রতিদিন ভারতের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত যে এসব কাজ হচ্ছে, তার একটি ক্ষীণতম আওয়াজও মাওলানা মাদানীর কর্ণকুহুরে প্রবেশ করে না। এসব জিনিসের মধ্যে তিনি কেবল একটি জিনিসই লাভ করেছেন-যার নাম ‘মৌলিক অধিকার’। একমাত্র এর উপর ভরসা করে তিনি ‘এক জাতীয়তার’ নীতিকে নবী করীম (সা.)-এর আদর্শ বলে প্রচার করার দুঃসাহস করছেন। অথচ প্রকৃতপে এ (মৌলিক অধিকার) সম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়ার বিখ্যাত ঘোষণা অপেক্ষা কোনো দিক দিয়ে উত্তম নয়। পাশ্চাত্য কূটনীতির এরূপ ক্রুর চালকে রাসূল পাক (সা.)-এর কাজের সাথে তুলনা করার সাহস আমাদের ন্যায় গুনাহগারদের পক্ষে সম্ভব নয়। অবশ্য যাদের নিকট তাকওয়া-পরহেযগারী এতোবেশী আছে যে, এরূপ অন্যায় সাহস করার পরও মার্জনা পাবার আশা করতে পারেন, তাঁদের কথা স্বতন্ত্র।
একাধিক অর্থবোধক শব্দের সুযোগ গ্রহণ
মাওলানা মাদানী ‘একজাতীয়তার’ একটি বিশেষ অর্থ নিজের মনে বদ্ধমূল করে নিয়েছেন। এটা তিনি নিজে সকল প্রকার শয়তানী শর্ত লক্ষ্য রেখে এবং সকল প্রকার সম্ভাব্য পথ বন্ধ করে তার সীমা নির্ধারণ করে নিয়েছেন। একে তিনি সতর্কতার সাথে পেশ করে থাকেন, যেন শরীয়তী নিয়মের দিক দিয়ে কেউ তাঁর উপর প্রশ্ন করতে না পারে। কিন্তু এর প্রধান ভুল এখানেই যে, তিনি নিজে যা ধারণ করে নিয়েছেন, কংগ্রেসও তাই ধারণ করে বলে তিনি চূড়ান্তভাবে ধরেছেন। অথচ কংগ্রেস এটা থেকে বহু বহু মন্জিল দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মাওলানা মাদানী যদি শুধু এতোটুকুই বলতেন যে, ‘একজাতীয়তা’ বলতে আমি এটা বুঝি, তবে তাঁর সাথে আমাদের তর্ক কিছুই ছিল না। কিন্তু তিনি এখানেই ক্ষান্ত না হয়ে-সামনে অগ্রসর হয়ে এটাও বলছেন যে, কংগ্রেসের ল্ক্ষ্যও এটাই, কংগ্রেস সম্পূর্ণ নবী করীম (সা.)-এর আদর্শানুসারেই চলছে। সম্পূর্ণ নির্ভয় ও নিঃশংক মনে এ একজাতীয়তার আন্দোলনে নিজেদেরকে উৎসর্গ করে দেয়াই মুসলমানদের কর্তব্য। বস্তুত এখান থেকেই তাঁর সাথে আমাদের মতবিরোধের সূচনা। একটা উদাহরণ দেয়া যাক। ‘পানি ঢালা’ বলতে একজন মনে করে পানি বর্ষণ করা, আর অপরজন আগুন লাগিয়ে দেয়ার নাম রেখেছে ‘পানি ঢালা’। এখন এ শাব্দিক বৈষম্য উপেক্ষা করে দ্বিতীয় ব্যক্তির হাতে সকলেরই ঘরবাড়ী সোপর্দ করতে উপদেশ দিলে যে কত বড় জুলুম হবে, তা সহজেই বুঝতে পারা যায়। এসব ক্ষেত্রের জন্যই পবিত্র কুরআন মজীদে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, “কোনো শব্দ থেকে যদি যখন ভুল ও শুদ্ধ উভয় অর্থ গ্রহণ করা সম্ভব এবং সেই শব্দ ব্যবহার করে কাফেরদের অশান্তিকর পরিস্থিতির উদ্ভব করতে দেখতে পাও, তখন মুসলমানগণ যেন এ ধরণের শব্দ ব্যবহার না করে।” يايُّها اللَّذِينَ اَمَنُوا لا تقولوا راعنا وقولوا انظرنا واسمعوا ط وللكافرينَ عذابٌ اَليْمٌ – (البقرة : ১০৪)
“ওহে যারা ঈমান এনেছো, তোমরা ‘রায়িনা’ বলো না, বরং ‘উনযুরনা’ বলো এবং শুনতে থাকো। আর কাফেরদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি।” -সূরা আল বাকারা: ১০৪
সুতরাং মাওলানা মাদানী যদি তাঁর নিজের মনোভাব ব্যক্ত করার জন্য ‘পারস্পারিক বন্ধুতা’ ইত্যাদি কোনো শব্দ ব্যবহার করতেন এবং একে কংগ্রেসের নীতি ও কর্ম হিসেবে পেশ না করে নিজের তরফ থেকে একটি প্রস্তাব ও সুপারিশ হিসেবে পেশ করতেন, তবেই ভাল হতো। অন্তত এখনো যদি তিনি এ জাতির প্রতি এতোটুকু অনুগ্রহ করেন, তবে তা বড়ই মেহেরবানী হবে। অন্যথায় তাঁর লেখনীতে মহা বিপর্যয় সৃষ্টি হওয়ার পূর্ব সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে প্রাচীনকালে একথাটির পুনরাবৃত্তিরও সম্ভাবনা রয়েছে-“জালেম রাজা-বাদশাহ ও ফাসেক রাষ্ট্র নেতারা যা কিছু করেছে, আলেমগণ তাকেই কুরআন-হাদীসের দলীল দিয়ে সত্য প্রমাণ করত: ধর্মকে অত্যাচার ও শোষণের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন।” رَبَّنَا لاَ تجعلنَأ فتنةً لِّقَومٍ الظَّلِمِيْنَ – (يونس : ৮৫)
“হে আমাদের রব! আমাদেরকে জালেম লোকদের জন্য ফেতনা বানিও না।’-সূরা ইউনুস : ৮৫
মাওলানা মাদানীর উল্লিখিত পুস্তিকা প্রকাশিত হওয়ার পর খালেস বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে ‘জাতীয়তার’ বিশ্লেষণ করা এবং এ ব্যাপারে ইসলামী ও অনৈসলামী মতবাদের পারস্পারিক মূলগত পার্থক্য উজ্জ্বল করে ধরা অত্যন্ত জরূরী হয়ে পড়েছে। তা করা হলে এ সম্পর্কীয় যাবতীয় ভুল ধারণা লোকদের মন থেকে দূর হবে এবং উভয় পথের কোনো একটি পথ বুঝে-শুনে গ্রহণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে। এটা আলেমদেরই কর্তব্য ছিল, কিন্তু আলেম সমাজের ‘প্রধান’ ব্যক্তি যখন ‘একজাতীয়তা’র পতাকা উত্তোলন করেছেন এবং কোনো আলেমই যখন তাঁদের প্রকৃত কর্তব্য পালনে প্রস্তুত হচ্ছেন না, কথন আমাদের ন্যায় সাধারণ লোককেই তার জন্য তৎপর হতে হবে। -তরজমানুল কুরআন : ফেব্র“য়ারী, ১৯৩৯ ইং