জাতীয়তাবাদ কি কখনো মুক্তি বিধান করতে পারে
মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধী দীর্ঘদিন নির্বাসিত জীবন যাপনের পর যখন ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন, তখন ‘বঙ্গীয় জমিয়াতে উলাম’র পক্ষ থেকে তার কলিকাতা অধিবেশনে সভাপতিত্ব করার জন্য তাঁকে আমন্ত্রন জানানো হয়। এ অধিবেশনে তিনি যে ভাষণ দান করেন, তা পাঠ করে ভারতবাসীগণ সর্বপ্রথম তাঁর বিশেষ মতবাদ সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হবার সুযোগ পায়। তাঁর ভাষণের যেসব অংশ বিশেষভাবে মুসলমানদেরকে বিক্ষুব্ধ করে দিয়েছে, তা এখানে উল্লেখ করা যাচ্ছে : এক : “যে বিপ্লব এখন সমগ্র বিশ্বকে গ্রাস করেছে ও প্রত্যেক দিন গ্রাস পেতে চলেছে, তার অপকারিতা ও ক্ষতি থেকে আমার দেশ যদি রক্ষা পেতে চায় তবে তাকে ইউরোপীয় আদর্শের জাতীয়তাবাদকে উন্নতি ও বিকাশ দান করতে হবে। বিগত যুগে আমাদের দেশ যতোখানি সুখ্যাত ছিল, বিশ্ববাসী সে সম্পর্কে তা সুবিদিত রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে জাতিসমূহের মধ্যে নিজেদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে পূর্বখ্যাতি থেকে আমরা কিছুমাত্র উপকৃত হতে পারবো না।”
দুই : “আমি সুপারিশ করছি, আমাদের ধর্মীয় ও জাতীয় নের্তৃবৃন্দ বৃটিশ সরকারের দুশত বছর কালীন শাসন আমলের যতোদূর সম্ভব উপকারীতা লাভ করতে চেষ্টা করুন। ইউরোপের প্রতি ঘৃণা পোষণ করে আমাদের উন্নতিকে যেভাবে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি, এখন আমাদেরকে তা ত্যাগ করতে হবে। এ ব্যাপারে আমি সুলতান মাহমুদ থেকে মোস্তফা কামালের প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র পর্যন্ত তুর্কী জাতির বিপ্লবকে পূর্ণরূপে অধ্যয়ন ও পর্যবেণ করেছি। ইউরোপের আন্তর্জাতিক সম্মেলনসমূহে আমাদের দেশ সম্মানিত সদস্য হিসেবে গণ্য হোক, এটাই আমি কামনা করি। কিন্তু সেজন্য অবশ্য আমাদের সমাজ ক্ষেত্রে বিপ্লব সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা বোধ হতে হবে।”
এই সমাজ বিপ্লবের ব্যাখ্যা করে মাওলানা সিন্ধী সিন্ধু প্রদেশের জন্য একটি বিপ্লবাত্মক কার্যসূচী উপস্থাপিত করেন। তিনি বলেন : “সিন্ধুবাসী নিজেদের দেশে উৎপন্ন কাপড় পরিধান করবে; কিন্তু তা কোট ও প্যান্টের আকারে হবে কিংবা কলারধারী শার্ট ও ‘হাফপ্যান্ট’ রূপে। মুসলমানগণ হাটুর নীচ পর্যন্ত দীর্ঘ হাফপ্যান্ট পরিধান করতে পারে। এ উভয় অবস্থায়ই হ্যাট্ ব্যবহার করা হবে। মসজিদে মুসলমানগণ হ্যাট খুলে রেখে নগ্ন মাথায় সালাত আদায় করবে।”
মাওলানা সিন্ধী একজন অভিজ্ঞ ও বিশ্বদর্শী ব্যক্তি। তিনি নিজের আদর্শ ও উদ্দেশ্যের জন্য কয়েক বছর পর্যন্ত যে বিরাট ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তা থেকে তাঁর ঐকান্তিক আদর্শ-নিষ্ঠারই প্রমাণ পাওয়া যায়। এমতাবস্থায় তিনি যদি আমাদের বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার কোনো সমাধান পেশ করেন, তা বাহ্যদৃষ্টিতে যতোই অভিজ্ঞতা ও চিন্তা-গবেষণার ফল হোক না কেন, নিজেদের মনকে সকল প্রকার সন্দেহ-সংশয় থেকে মুক্ত করে তাঁর মতবাদগুলোর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে যাচাই করে দেখাই আমাদের কর্তব্য।
একজন পারদর্শী ও বৃদ্ধিমান ব্যক্তি সদুদ্দেশ্যে যা কিছু বলেন, তার অন্তর্নিহিত ভুলভ্রান্তি তাঁর সামনে সুস্পষ্ট হয়ে উঠলে তিনি তা ত্যাগ করতে কুন্ঠিত হবেন না, এটাই আমাদের বিশ্বাস। আর যদি তিনি তা পরিত্যাগ করতে একান্তই প্রস্তুত না হন, তবে বৈজ্ঞানিক সমালোচনার তীব্র আঘাতে এ ভুল মতবাদের মূলোৎপাটন একান্ত অবশ্যক।
সুবিধাবাদের ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদ
ইউরোপীয় নীতির ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদকে উৎকর্ষ দানের জন্যে ভাষণদাতা যেসব কারণ ও যুক্তি-পরামর্শ দিয়েছেন, তা নিম্নররূপ : এক : গোটা পৃথিবীকে যে বিপ্লবী ভাবধারা আচ্ছন্ন করে রেখেছে এবং আরো গ্রাস করে চলেছে, তা থেকে আমাদের দেশ রা পেতে চাইলে …..” ঐরূপ করতে হবে।
দুই : “আমাদের অতীত কীর্তি ও যশঃগাথা দুনিয়াবাসী জানে বটে; কিন্তু তা থেকে আমরা কিছুমাত্র উপকৃত হতে পারবো না, যদি না বর্তমান জাতিসমূহের মধ্যে আমরা যথাযথ স্থান ও মর্যাদা দখল করে নিতে পারি।”
আর এ স্থান ও মর্যাদা একমাত্র পাশ্চাত্য জাতিসমূহের অনুকরণ করলেই লাভ করা যায়-এটা সুস্পষ্ট কথা। তিন : আমাদের ভারতীয় সভ্যতার প্রাচীন অধ্যায়-যা হিন্দু-সভ্যতা নামে পরিচিত এবং আধুনিক যুগ-যা ইসলামী সভ্যতা নামে খ্যাত-উভয়েই ধর্মীয় মতাদর্শের ভিত্তিতে স্থাপিত। কিন্তু আধুনিক ইউরোপীয় মতবাদ ধর্মীয় ভাবধারা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। তা কেবল বিজ্ঞান ও দর্শনের ভিত্তিতেই স্থাপিত। কাজেই আমাদের দেশে যদি এ বিপ্লব অনুধাবন করার যোগ্যতা সৃষ্টি না হয়, তাহলে আমাদের ক্ষতিগ্রস্থই হতে হবে।”
এখানে ‘অনুধাবন করার যোগ্যতা’ বলতে খুব সম্ভব গ্রহণ করার কথাই বুঝাতে চেয়েছেন। কেননা বক্তার পূর্বোক্ত সূত্রগুলো তাই প্রমাণ করে।
এ তিনটি কথাই যাচাই ও বিশ্লেষণ করা আবশ্যক। প্রথমত: একটি জিনিস সত্য কিংবা নীতিগতভাবে গ্রহণযোগ্য বলে তা গ্রহণ করার আহ্বান দেয়া হয়নি, দেয়া হয়েছে অবস্থার গতিতে ও সুবিধাবাদী নীতিতে (Expediency) দরকার বলে। এমতাবস্থায় একজন মুসলমান আদর্শবাদী ব্যক্তির দৃষ্টিতে এ উপমহাদেশের কি মূল্য হতে পারে। অমুক কি ক্ষতি থেকে বাঁচতে হলে এ কাজ করা দরকার, এটা করলে এ স্বার্থ লাভ হবে; কিংবা অমুক জিনিস এখন দুনিয়ায় চলতে পারে না, তার পরিবর্তে ‘এটা’ চালাতে হবে-এরূপ দৃষ্টিভংগী কোনো আদর্শবাদী, নৈতিক ও মতাদর্শশীল কোনো ব্যক্তি গ্রহণ করতে পারে না। এটা নিতান্ত সুবিধাবাদী দৃষ্টিভংগী (Opportunism) ছাড়া আর কিছুই নেই। জ্ঞান-বুদ্ধি ও নীতি-দর্শনের সাথে এর কোনোই সম্পর্ক থাকতে পারে না। একজন নীতিবাদী ও আদর্শানুসারী মানুষ চিন্তা-গবেষণা ও যাচাই-বিশ্লেষণের পর যে মত ও আদর্শ সত্য মনে করে গ্রহণ করবে, সে দৃঢ়তার সাথেই সেই অনুযায়ী কাজ করবে, এটাই একমাত্র সঠিক কর্মনীতি। দুনিয়ার অন্যান্য দেশে কোনো ভ্রান্তনীতি অনুসারে কাজ হতে থাকলে তার পশ্চাদনুগামী না হয়ে নিজ আদর্শের দিকেই গোটা মানব সমাজকে টেনে আনার জন্য চেষ্টা করাই তার কর্তব্য। দুনিয়ার অনুগমন না করলে যদি আমাদের কোনো দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে হয়, তবে তা বিশেষ ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতার সাথে বরদাশত করাই বাঞ্ছণীয়। দুনিয়ার পশ্চাতে না চলার কারণেই যদি তার নিকট আমাদের কোনো মর্যাদা স্বীকৃত না হয় তবে এমন দুনিয়ার উপর আমাদের পদাঘাত করাই উচিত। পার্থিব মান ও মর্যাদা আমাদের মাবুদ নয়-প্রভু নয়, তার মনস্তুষ্টির জন্য আমরা যত্র-তত্র ধাবিত হতে পারি না। আমরা যাকে সত্য মনে করি, তার ‘যুগ’ যদি অতীত হয়েও থাকে তবুও আমাদের মধ্যে যুগের ‘কান’ ধরে সত্যের দিকে ফিরিয়ে আনার মতো ব্যক্তিত্ব ও আত্মজ্ঞান বর্তমান থাকা বাঞ্ছণীয়। কালের পরিবর্তনের সাথে সাথে নিজেকে পরিবর্তিত করা কাপুরুষের নীতি হতে পারে, কোনো আদর্শবাদী মানুষের নয়।
এ ব্যাপারে মুসলমানদের অন্ততঃ এতোখানি দৃঢ়তা ও আদর্শবাদীতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করা উচিত, যতোখানি কার্লমার্কসের পদাংক অনুসারীরা প্রথম মহাযুদ্ধের সময় দেখিয়েছিল। ১৯১৪ সালে যখন বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ছিল, তখন ‘দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক’ মেম্বরদের মধ্যে এ জাতীয়তাবাদ নিয়ে ভায়ানক মতভেদের সৃষ্টি হয়েছিল। সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক ফ্রন্টে যেসব সোশ্যালিষ্ট কাজ করতো তারা নিজ নিজ জাতিকে যুদ্ধের অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখে অন্ধ জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণ ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয় এবং তারা সাম্প্রতিক যুদ্ধে নিজ নিজ জাতির পক্ষ সমর্থন করতে ইচ্ছুক হয়। কিন্তু মার্কবাদীরা ঘোষণা করলো যে, আমরা যে আদর্শ (?) নিয়ে লড়াই শুরু করেছি, তার দৃষ্টিতে দুনিয়ার সকল জাতির পুঁজিবাদীরাই আমাদের শত্রু এবং সকল মজুর-শ্রমিকগণ আমাদের বন্ধু, এমতাবস্থায় আমরা জাতীয়তাবাদকে কি করে সমর্থন করতে পারি! কারণ এটা মজুরদেরকে পরস্পর বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন করে পুঁজিবাদীদের সাথে মিলে পরস্পর বিরুদ্ধে লড়াই করতে উব্ধুদ্ধ করে ও এ নীতির ভিত্তিতেই মার্কসবাদীগণ নিজেদের বহু প্রাচীন কমরেডদের সম্পর্ক ত্যাগ করে। অধিকন্তু পাক্কা কমিউনিষ্টগণ নিজ নিজ হাতে এ সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের দেবমূর্তিকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করেছিল। জার্মানের কমিউনিস্টগণ নিজেদের আদর্শের জন্য জার্মানীর বিরুদ্ধে, রুশীয় কমিউনিস্টগণ নিজেদের আদর্শের জন্য রাশিয়ার বিরুদ্ধে এবং এভাবে প্রত্যেক দেশের কমিউনিস্টগণ নিজেদের আদর্শের জন্য নিজ দেশের সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। কমিউনিস্টদের যেমন একটি মত ও আদর্শ রয়েছে, একজন মুসলমানেরও অনুরূপভাবে একটি মত ও আদর্শ রয়েছে। এমতাবস্থায় ক্ষয়-ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্যে কিংবা কারো নিকট থেকে সামান্য মর্যাদা লাভ করার জন্য সে একজন মুসলমান তার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হবে কেন? ….. সে যদি একান্তই বিচ্যুত হয়-তবে সে কি ত্যাগ করে কি গ্রহণ করতে যাচ্ছে, তা সর্বপ্রথম ভাল করে বুঝে নেয়া তার কর্তব্য। কেননা একটি নীতি পরিত্যাগ করা নিছক দুর্বলতা ছাড়া আর কিছুই নয়; কিন্তু নীতি বিচ্যুত হওয়ার পরও নিজেকে নীতির অনুসারী মনে করা যেমন দুর্বলতা তেমনি অচৈতন্যের লক্ষণও বটে। আমি যতোক্ষণ পর্যন্ত জীবনের প্রত্যেক ব্যাপারে ইসলামী মত ও বিধান অনুসারে কাজ করবো, ঠিক ততোক্ষনই আমি ‘মুসলিম’ থাকতে পারবো। আমি যদি এ মত কখনো পরিত্যাগ করে অন্যকোন মতবাদ গ্রহণ করি, তবে তখনো আমার নিজেকে ‘মুসলমান’ মনে করা মারত্মক অজ্ঞতা ছাড়া কিছুই নয়। মুসলমান হয়েও অনৈসলামিক মতবাদ গ্রহণ করা সুস্পষ্টভাবে অর্থহীন। ‘জাতীয়তাবাদী মুসলমান ’, ‘কমিউনিস্ট মুসলমান’ প্রভৃতি পরস্পর বিরোধী পরিভাষা-এটা ঠিক ততোখানি ভুল যতোখানি ভুল ‘ফ্যাসিস্ট কামিউনিস্ট’, ‘যৈন-কশাই’ ‘কমিউনিস্ট জমিদার’ ‘তাওহীদবাদী মুশরিক’ ইত্যাদি বলা।
জাতীয়তাবাদ ও ইসলাম
জাতীয়তাবাদের অর্থ ও তার নিগূঢ় তত্ত্ব সম্পর্কে যারা চিন্তা করবে তারা নিঃসন্দেহে স্বীকার করবে যে, অন্তর্নিহিত ভাবধারা, লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যের দৃষ্টিতে ইসলাম এবং জাতীয়তাবাদ পরস্পর বিরোধী দুটি আদর্শ। ইসলাম নির্বিশেষে সমগ্র মানুষকে আহ্বান জানায় মানুষ হিসেবে। সমগ্র মানুষের সামনে ইসলাম একটি আদর্শগত ও বিশ্বাসমূলক নৈতিক বিধান পেশ করে-একটি সুবিচার ও আলাহভীরুমূলক সমাজ ব্যবস্থা উপস্থিত করে এবং নির্বিশেষে সকল মানুষকেই তা গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানায়। অতপর যারাই তা গ্রহণ করে, সমান অধিকার ও মর্যাদা সহকারে তাদের সকলকেই তার গণ্ডীর মধ্যে গ্রহণ করে নেয়। ইসলামের ইবাদত, অর্থনীতি, সমাজ, আইনগত অধিকার ও কর্তব্য ইত্যাদি কোনো কাজেই ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে জাতিগত, বংশগত, ভৌগলিক কিংবা শ্রেণীগত বৈষম্য সৃষ্টি করে না। ইসলামের চরম উদ্দেশ্য হচ্ছে এমন একটি বিশ্বরাষ্ট্র (World state) গঠন করা, যাতে মানুষের মধ্যে বংশগত ও জাতিগত হিংসা-বিদ্বেষের সমস্ত শৃংখলা ছিন্ন করে সমগ্র মানুষকে সমান অধিকার লাভের জন্য সমান সুবিধা দিয়ে একটি তামাদ্দুনিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করা হবে। সমাজের লোকদের মধ্যে শত্রুতামূলক প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিবর্তে পারস্পারিক বন্ধুত্বমূলক সহযোগিতা সৃষ্টি করা হবে। ফলে সকল মানুষ পরস্পরের জন্য বৈষয়িক উৎকর্ষ ও সমৃদ্ধি লাভ এবং আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনে সাহায্যকারী হবে। মানুষের কল্যাণ সাধনের জন্য ইসলাম যে নীতি ও জীবন ব্যবস্থা পেশ করে, সাধারণ মানুষ তা ঠিক তখন গ্রহণ করতে পারে, যখন তার মধ্যে কোনোরূপ জাহেলী ভাবধারা ও হিংসা-বিদ্বেষ বর্তমান থাকবে না। জাতীয় ঐতিহ্যের মায়া, বংশীয় আভিজাত্য ও গৌরবের নেশা, রক্ত এবং মাটির সম্পর্কের অন্ধ মোহ থেকে নিজেকে মুক্ত করে কেবল মানুষ হিসেবেই তাকে সত্য, সুবিচার, ন্যায় ও সততা যাচাই করতে হবে-একটি শ্রেণী, জাতি বা দেশ হিসেবে নয়, সামগ্রিকভাবে গোটা মানবতার কল্যাণের পথ তাকে সন্ধান করতে হবে।
পক্ষান্তরে জাতীয়তাবাদ মানুষের মধ্যে জাতীয়তার দৃষ্টিতে পার্থক্য সৃষ্টি করে। জাতীয়তাবাদের ফলে অনিবার্য রূপে প্রত্যেক জাতির জাতীয়তাবাদী ব্যক্তি নিজ জাতিকে অন্যান্য সমগ্র জাতি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর মনে করবে। সে যদি অত্যন্ত হিংসুক জাতীয়তাবাদী (Aggressive Nationalist) না-ও হয়, তবুও নিছক জাতীয়তাবাদী হওয়ার কারণে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, আইন-কানুনের দিক দিয়ে সে নিজ জাতি ও অপর জাতির মধ্যে পার্থক্য করতে বাধ্য হবে। নিজ জাতির জন্যে যতোদূর সম্ভব অধিক স্বার্থ ও সুযোগ-সুবিধা সংরক্ষণের চেষ্টা করবে। জাতীয় স্বার্থের জন্য অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রাচীর দাঁড় করাতে বাধ্য হবে। উপরন্তু যেসব ঐতিহ্য ও প্রাচীন বিদ্বেষভাবের উপর তার জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত, তার সংরক্ষণের জন্যে এবং নিজের মধ্যে জাতীয় আভিজাত্যবোধ জাগ্রত রাখার জন্য তাকে চেষ্টানুবর্তী হতে হবে। অন্য জাতির লোককে সাম্যনীতির ভিত্তিতে জীবনের কোনো বিভাগেই সে নিজের সাথে শরীক করতে প্রস্তুত হতে পারবে না। তার জাতি যেখানেই অন্যান্য জাতি অপেক্ষা অধিকতর বেশী স্বার্থ ও সুযোগ-সুবিধা লাভ করতে থাকবে বা লাভ করতে পারবে, সেখানে তার মন ও মস্তিষ্ক থেকে সুবিচারের একটি কথাও ব্যক্ত হবে না। বিশ্বরাষ্ট্রের (World State) পরিবর্তে জাতীয় রাষ্ট্র (National state) প্রতিষ্ঠা করাই হবে তার চরম লক্ষ্য। সে যদি কোনো বিশ্বজনীন মতাদর্শ গ্রহণ করে, তবুও তা নিশ্চিতরূপে সাম্রাজ্যবাদে পরিণত হবে। কারণ তার রাষ্ট্রে অন্যান্য জাতীয় লোকদেরকে সমান অংশীদার হিসেবে কখনো স্থান দেয়া যেতে পারে না। অবশ্য গোলাম ও দাসানুদাস হিসেবেই তাকে গ্রহণ করা যেতে পারে।
এখানে এ দ্বিবিধ মতবাদের নীতি, উদ্দেশ্য ও অন্তর্নিহিত ভাবধারার সাধারণ আলোচনাই করা হলো। এতোটুকু আলোচনা থেকে সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয় যে, এ দুটি সম্পূর্ণরূপে পরস্পর বিরোধী। যেখানে জাতীয়তাবাদ হবে, সেখানে ইসলাম কখনোই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। অনুরূপভাবে যেখানে ইসলাম কায়েম হবে, তথায় এ জাতীয়তাবাদ এক মূহুর্তও টিকতে পারে না। জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও উৎকর্ষ হলে ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার পথ সেখানে অবরুদ্ধ হবে। আর ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হলে জাতীয়তাবাদের মূল উৎপাটিত হবেই। এমতাবস্থায় এক ব্যক্তির পক্ষেএকই সময় এ উভয় সময় কেবলমাত্র একটি মতকে গ্রহণ করতে পারে। একজন লোক একই সময় কেবলমাত্র একটি মতকে গ্রহণ করতে পারে। একই সময় এ দুই বিপরীতমুখী নৌকায় আরোহণ করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। একটি অনুসরণ করে চলার দাবী করার সাথে সাথেই তার ঠিক বিপরীত আদর্শের সমর্থন, সাহায্য ও পক্ষপাতিত্ব করা মানসিক বিকৃতির পরিচায়ক। যারা এরূপ করছে তাদের সম্পর্কে আমাদেরকে বাধ্য হয়েই বলতে হবে যে, হয় তারা ইসলামকে বুঝতে পারেনি, নয় জাতীয়তাবাদকে, কিংবা এ দুটির মধ্যে কোনোটিকেই তারা সঠিকরূপে অনুধাবন করতে সমর্থ হয়নি।
ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের প্রকৃত অবস্থা
জাতীয়তাবাদের প্রাথমিক সূত্র সম্পর্কে চিন্তা করলেই যা বুঝতে পারা যায়, উপরে শুধু তারই উল্লেক করা হয়েছে। কিন্তু আমাদেরকে আরো অগ্রসর হয়ে ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদকেও যাচাই করতে হবে।
প্রাচীন জাহেলী যুগে জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে লোকদের ধারণা খুব পরিপক্কতা লাভ করতে পারেনি। মানুষ তখনো জাতীয়তাবাদ সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে পারেনি বলে বংশীয় বা গোত্রীয় ভাবধারায়ই অধিকতর নিমজ্জিত ছিল। ফলে সে যুগে জাতীয়তাবাদের নেশায় বড় বড় দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক পর্যন্ত অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এরিস্টোটল-এর ন্যায় একজন উচ্চ শ্রেণীর চিন্তাশীল তাঁর Politics গ্রন্থে এ মত প্রকাশ করেছেন যে, অসভ্য ও বর্বর জাতিগুলো গোলামী করার জন্যই সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর মতে এসব মানুষকে গোলাম বানাবার জন্য যুদ্ধ করা অর্থোৎপাদনের অন্যতম উপায়। কিন্তু আমরা যখন দেখি গ্রীকরা সকল অ-গ্রীক লোকদেরকেই ‘বর্বর’ বলে মনে করতো, তখনি এরিস্টোটলের উলিখিত মতের মারাত্মকতা অনুভব করা যায়। কারণ তারা নিশ্চিতরূপে মনে করতো যে, গ্রীসের লোকদের নৈতিক চরিত্র ও মানবিক অধিকার দুনিয়ার অন্যান্য মানুষ অপো সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।
জাতীয়তাবাদের এ প্রাথমিক বীজই উত্তরকালে ইউরোপে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। অবশ্য খৃস্টীয় মতবাদ এর অগ্রগতি দীর্ঘকাল পর্যন্ত প্রতিরোধ করে রেখেছিল। একজন নবীর শিক্ষা-তা যতোই বিকৃত হোক না কেন-স্বাভাবিকভাবে গোত্রবাদ ও জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণ দৃষ্টির পরিবর্তে বিশাল মানবিক দৃষ্টিভংগীই গ্রহণ করতে পারে। উপরন্তু রোমান সাম্রাজ্যবাদের সর্বাত্মক রাষ্ট্রনীতি বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিকে একটি মিলিত কেন্দ্রিয় শক্তির অধীন ও অনুসারী করে দিয়েছিল বলে জাতীয় ও গোত্রীয় হিংসা-বিদ্বেষের তীব্রতা অনেকখানি হ্রাস করে দিয়েছিল। এভাবে কয়েক শতাব্দীকাল পর্যন্ত পোপের আধ্যাত্মিক এবং সম্রাটের রাজনৈতিক প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব পরস্পর মিলে খৃস্টান জ