বুদ্ধি
এখন মানুষের বুদ্ধি সম্পর্কে আলোচনা করে দেখা যাক। বুদ্ধির ক্ষমতা অসাধারণ, তার যোগ্যতা ও প্রতিভা অনস্বীকার্য। মানব জীবনে তার গুরুত্ব এবং মর্যাদাও কেউ উপেক্ষা করতে পারে না। পরন্তু মানুষের অভ্যন্তরে এটা অত্যন্ত তীব্র প্রেরণাদায়ক শক্তি, তাও স্বীকার না করে উপায় নেই; কিন্তু সমস্যা এই যে, মানুষের জন্য জীবন ব্যবস্থা রচনা করার দায়িত্ব তার উপর ন্যস্ত করা হলে তা করবে কার বুদ্ধি? জায়েদের বুদ্ধি না বকরের বুদ্ধি? না সমগ্র মানুষের বুদ্ধি? না মানুষের বিশেষ কোনো দল বা শ্রেণীর বুদ্ধি? বর্তমান যুগের মানুষের বুদ্ধি? না অতীত কোনো যুগের মানুষের বুদ্ধি? কি অনাগত যুগের মানুষের বুদ্ধি? আর এ প্রশ্ন না হয় না-ই করলাম, কারণ এর সঠিক জবাব দেয়া সম্ভব নয়। এ প্রসংগে সহজ একটি প্রশ্নই জিজ্ঞেস করতে চাই। মানব বুদ্ধির চৌহদ্দি পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করে দেখলে মানুষের জীবন ব্যবস্থা রচনা করার মতো বিরাট ও জটিল কাজ তার উপর ন্যস্ত করা কি কোনো রকমেই শোভা পায়?
বস্তুত কোনো কিছু সম্পর্কে বুদ্ধির সিদ্ধান্ত গ্রহণ একান্তরূপে নির্ভর করে পঞ্চইন্দ্রিয় কর্তৃক সংগৃহীত তথ্যের উপর। এটা ভুল তথ্য সংগ্রহ করলে বুদ্ধি ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য। তা অসম্পূর্ণ তথ্য উপস্থিত করলে বুদ্ধির সিদ্ধান্ত অসম্পূর্ণই হবে এবং যেসব ব্যাপারে ইন্দ্রিয় কোনো তথ্যই সংগ্রহ করতে পারবে না, বুদ্ধির আত্মজ্ঞান থাকলে সেসব ব্যাপারে তা কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করারই দুঃসাহস করবে না। আর তা অন্ধ ও দাম্ভিক হলে অন্ধকারে কাষ্ঠ নির্মিত তীর নিক্ষেপ করে অবশ্যই ব্যর্থ হবে। যে বুদ্ধির পরিধি এতো সীমাবদ্ধ ও সংকীর্ণ, মানব জাতির জন্য এক পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা রচনা করার দায়িত্ব তার উপর অর্পণ করা কিছুতেই সমীচিন হতে পারে না। ব্যবস্থা রচনার জন্য গোড়াতেই যে উচ্চতর সমস্যাগুলোর সমাধান অপরিহার্য, ইন্দ্রিয়নিচয় তার একটিরও কোনো সমাধান পেশ করতে পারে না। তবে কি এসব সমস্যার সমাধান করা হবে অবাস্তব ধারণা-বিশ্বাস, অমূলক কল্পনা-খেয়াল এবং কুসংস্কার ও আজগুবী কিচ্ছা-কাহিনীর উপর নির্ভর করে? ‘আদ্-দীন’ বা পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা রচনার জন্য যেসব স্থায়ী নৈতিক মূল্য নির্ধারণ সংগ্রহ করতে একেবারে অক্ষম। এমতাবস্থায় মানব বুদ্ধি, বিশুদ্ধ, খাঁটি ও পরিপূর্ণ নৈতিক মূল্য নির্ধারণ করতে সমর্থ হবে বলে কিছুমাত্র ভরসা করা যায় কি? তদ্রুপ জীবন ব্যবস্থা (আদ্-দীন) রচনার জন্য যেসব প্রয়োজনীয় বিষয়ের আমি উল্লেখ করেছি, তার জন্য ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে নির্ভুল, বিশুদ্ধ ও পরিপূর্ণ উপাদান সংগ্রহ করা আদৌ সম্ভব নয়। কাজেই মানব বুদ্ধি কেন ব্যাপক ও পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা রচনা করতে সক্ষম নয়। উপরন্তু মানব বুদ্ধির সাথে ইচ্ছাশক্তি বলতে আর একটা বস্তু শনিগ্রহের ন্যায় স্বতন্ত্র সত্তা নিয়ে বিরাজ করছে। তা বুদ্ধিকে কোনো সুষ্ঠু ও বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে প্রতি পদক্ষেপ বাধা প্রদান করে এবং তাকে সহজ ও সঠিক পথে চলার গতি ব্যাহত করে বাঁকা ও ভুল পথে পরিচালিত না করে ছাড়ে না। কাজেই মানব বুদ্ধি ইন্দ্রিয়নিচয়ের সংগৃহিত তথ্যের সুবিন্যাসে এবং তা দ্বারা যুক্তি প্রদান করার ব্যাপারে কোনোরূপ ভুল করবে না বলে যদি ধরেও নেয়া হয়, তবুও তার আভ্যন্তরীণ দুর্বলতা নিবন্ধন জীবন ব্যবস্থা রচনার ন্যায় বিরাট দায়িত্ব বহন করার কোনো ক্ষমতাই নেই, একথা স্বতঃসিদ্ধ। এ দায়িত্ব তার উপর অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দিলে এক দিকে যেমন তার উপর যুলুম করা হবে, অন্যদিকে নিজের উপরও কম যুলুম করা হবে না।
বিজ্ঞান
এখন তৃতীয় উপায়টি সম্পর্কে আলোচনা করতে চাই। বিজ্ঞান বাস্তব অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণলব্ধ জ্ঞানকেই বুঝায়। এ জ্ঞানের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের ব্যাপারে বিজ্ঞানের কোনো ছাত্র অপেক্ষা আমি পশ্চাদপদই নই এবং তার একবিন্দু অবমাননাও আমি মোটেই পছন্দ করি না। কিন্তু তার স্বাভাবিক সসীমতাকে উপক্ষে করে তাকে অধিকতর প্রশস্ত, বিশাল ও অসীম শক্তিসম্পন্ন মনে করাকে আমি নিতান্ত অবৈজ্ঞানিক আচরণ বলে আখ্যা না দিয়ে পারি না। কারণ বিজ্ঞানে মূলতই সে শক্তি বর্তমান নেই। মানব বিজ্ঞানের নিগূঢ় তত্ত্ব সম্পর্কে অভিজ্ঞ প্রত্যেক ব্যক্তিই একতা স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে, অতি প্রাকৃতিক ও জড় অতীত সমস্যাবলী সম্পর্কে কোনো নির্দেশ দেয়ার ক্ষমতা বিজ্ঞানের নেই। যেহেতু সেই নিগূঢ় তত্ত্বও রহস্যের জগতে পৌঁছবার কোনো অবলম্বন আসলেই মানুষের করায়ত্বে নয়। অধিকন্তু তার প্রত্যক্ষ ও সরাসরি পর্যবেক্ষণ করার এবং অভিজ্ঞতালব্ধ তথ্য ও জ্ঞান রাশির সাহায্যে এমন কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা মানুষের নেই, যাকে কোনোরূপ ‘বিজ্ঞান’ নামে অভিহিত করা যেতে পারে। জীবন ব্যবস্থা (আদ্-দীন) রচনার জন্য যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সুষ্ঠু মিমাংসা করা সর্বপ্রথম অপরিহার্য হয়ে পড়ে, তাই বিজ্ঞানের আওতার বাইরে অবস্থিত। তারপরে নৈতিক মান নির্ধারণ, তামাদ্দুন ও সংস্কৃতির মূলনীতি নির্বাচন এবং ভ্রান্ত পথ হতে বিরত রাখার জন্য সীমা নির্দেশ করার কর্তব্য বিজ্ঞানের সাহায্যে সমাধা করা যায় কিনা, এ প্রশ্ন অবশ্য জাগতে পারে। কিন্তু তার উপর পাল্টা প্রশ্ন উঠবে যে, তা যদি সম্ভব বলে ধরে নেয়া যায়, তাহলে কোন্ ব্যক্তির বা কোন্ দলের অথবা কোন্ কালের বিজ্ঞান এ কাজ সমাধা করবে? কাজেই অর্থহীন বিতর্কে না গিয়ে আমরা শুধু নীতি হিসেবে বিষয়টির আলোচনা করে দেখবো। প্রথম আমরা বিশ্লেষণ করে দেখবো যে, নিছক বৈজ্ঞানিক পন্থায় এ কাজ সম্পন্ন করার জন্য কি কি বুনিয়াদী শর্ত রয়েছে। সেজন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন হলো মানুষ এ দুনিয়াতে যেসব প্রাকৃতিক নিয়মের অধীন বসবাস করছে, সে সমস্ত নিয়মের তত্ত্বজ্ঞানের পরিপূর্ণ সমাহার। তার পরে মানুষের নিজের জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট নানা প্রকার জ্ঞান-বিজ্ঞানের পূর্ণতা লাভও অত্যাবশ্যক। তৃতীয়ত, এহেন বিশ্ব-প্রাকৃতিক এবং মানবিক এ উভয় প্রকারের জ্ঞান তথ্যের সমাহার একত্রীভূত হওয়াও অপরিহার্য। এবং এমন একটি পরিপূর্ণ মননশক্তির আবশ্যক যা এ তথ্য সমাহারকে পরস্পর শ্রেণীবিন্যাস করে, তা দ্বারা সুষ্ঠু নিয়মে যুক্তি প্রয়োগ করে মানুষের জন্য নৈতিক মূল্য সমাজ ও তামাদ্দুনিক নীতি নির্ধারণ এবং সর্বপ্রকার ভুল ভ্রান্তি হতে তাকে বাঁচাবার উপায় নির্দেশ করার কাজ করবে। কিন্তু সত্য বলতে কি, এ শর্তগুলো পূরণ করা, এতে প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো সংগ্রহ করা যেমন আজ পর্যন্ত আদৌ সম্ভব হয়নি। অনুরূপ আরো পাঁচ হাজার বছর পরেও তা কখনো সম্ভব হতে পারে বলে কোনো আশাও করা যায় না। অবশ্য দুনিয়ার সাথে সাথে গোটা মানবতার ধ্বংস প্রাপ্তির একদিন পূর্বে তা সম্ভব হলেও হতে পারে, কিন্তু তখন আর সেগুলোর কোনোই সার্থকতা থাকবে না।
ইতিহাস
মানুষের জ্ঞান অর্জনের সর্বশেষ উপায় হচ্ছে ইতিহাস। অন্য কথায় তাকে বলা যেতে পারে, অতীত মানুষের অভিজ্ঞতাসমূহের ঐতিহাসিক সঞ্চয় কিংবা আমলনামা। এ জিনিসটির গুরুত্ব ও সার্থকতা আমি অস্বীকার করি না। কিন্তু তবুও আমি একথা বলতে চাই একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে আপনিও তা বলতে বাধ্য হবেন যে, মানুষের জীবন ব্যবস্থা রচনার মতো বিরাট দায়িত্বপূর্ণ কাজ সুসম্পন্ন করার জন্য ঐতিহাসিক জ্ঞান সম্পদ মোটেই যথেষ্ট নয়। অতীতকাল হতে ইতিহাসের এ সম্পদ পূর্ণ বিশুদ্ধতা ও ব্যাপকতার সাথে আমাদের নিকট পৌছেছে কিনা, সে প্রশ্ন আমি তুলতে চাই না। পরন্তু, এহেন ঐতিহাসিক সম্পদের সাহায্যে মানুষের জন্য জীবন ব্যবস্থা রচনা করবে কোন্ ব্যক্তি? হেগেল? না মার্কস? না আর্নেষ্ট হেইকল? না অন্য কেউ? এ প্রশ্ন আমি জিজ্ঞেস করবো না। আমি শুধু এটাই জিজ্ঞেস করতে চাই যে, অতীত, বর্তমান, কিংবা ভবিষ্যতের কোন্ তারিখ পর্যন্ত ঐতিহাসিক রেকর্ড মানুষের জীবন ব্যবস্থা রচনার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহ করতে পারবে? তেমন কোনো তারিখ নির্দিষ্ট করা যদি বাস্তবিকই সম্ভব হয়, তবে বলতেই হবে যে, তার পরবর্তীকালের মানুষ বড়ই ভাগ্যবান। আর পূর্বে যারা চলে গেছে, তাদের কথা আমাদের ভাবার প্রয়োজন নেই।
নৈরাশ্যের অন্ধকার
মানুষের জীবন ব্যবস্থা রচনা করার জন্য অপরিহার্য মানবীয় উপাদানগুলো সম্পর্কে আলোচনা এখানেই শেষ করলাম। আমার বিশ্বাস এ আলোচনা ও বিশ্লেষণের ব্যাপারে আমি বিজ্ঞান বা যুক্তি প্রয়োগের দিক দিয়ে কোনো ভুল করিনি। মানুষের জ্ঞান লাভের উপায়সমূহের যে বিশ্লেষণ আমি করলাম, তা যদি সত্য হয়, তাহলে এখন আমি আমার সিদ্ধান্ত স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করতে পারি। উপরোক্ত কারণে আমার দৃঢ় ও সন্দেহাতীত বিশ্বাস জন্মেছে (এবং এ বিশ্বাস নষ্ট করার কোনো কারণই থাকতে পারে না) যে, মানুষ নিজের জন্য এসব উপায়ের সাহায্যে অসম্পূর্ণ অবাস্তব, ভুল-ত্রুটিতে পরিপূর্ণ আঞ্চলিক কিংবা সাময়িক কোনো ব্যবস্থা রচনা করতে সমর্থ হতেও পারে; কিন্তু মানুষের পক্ষে এ উপায়ে কোনো পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা (الدين) রচনা করা একেবারেই অসম্ভব পূর্বেও তা সম্ভব ছিলো না, আজও সম্ভব নয় এবং অনাগত ভবিষ্যতের জন্যও এর সম্ভবনা সম্পর্কে নিরাশ হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।
এখন মানুষের পথপ্রদর্শনের জন্য যদি সত্যই কোনো ‘রব’ বর্তমান না থাকে আল্লাহদ্রোহী কাফেরদের যেমন ধারণা তবে তার আত্মহত্যা করা ভিন্ন অন্য কোনো উপায়ই থাকে না। যে পথিকের কোনো পথপ্রদর্শক নেই, যে নিজে পথ চেনে না, পথ চিনার কোনো উপায়ও যার জানা নেই, তার পক্ষে চরম ও চূড়ান্তভাবে নিরাশ হওয়া ছাড়া উপায় থাকতে পারে না। এমতাবস্থায় তার একজন হিতাকাংখী ব্যক্তি তাকে প্রকাশ্য রাজপথে পাথরের সাথে মাথা ঠুকে সকল মুশকিল আসান করার উপদেশ দেয়া ছাড়া তার আর কিই বা উপকার করতে পারে! আর ‘আল্লাহ’ বলতে যদি সত্যিই কেউ থাকে, কিংবা থেকেও যদি সে মানুষের কর্মজীবনের পথ বাতলিয়ে দিতে সমর্থ না হয় কোনো কোনো দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকের যেমন বিশ্বাস তবে এটা আরো অধিকতর দুঃখের বিষয়। যে আল্লাহ দুনিয়ার প্রত্যেকটি বস্তুর স্থিতি, পরিবর্ধন ও ক্রমবিকাশ লাভের জন্য নিখুঁত ব্যবস্থা করে রেখেছেন, সেই আল্লাহ-ই যদি মানুষের সর্বাপেক্ষা বেশি প্রয়োজনীয় জিনিসটি না দিয়ে থাকেন যা না হলে মানুষের জীবন একেবারে অর্থহীন, সেই জিনিসের কোনো ব্যবস্থাই যদি তিনি না করে থাকেন, তবে তাঁর সৃষ্ট এ দুনিয়ায় জীবন যাপন করা মানুষের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। তাহলে মানুষের এ জীবন একটি দুরূহ জীবন এবং একটি মস্তবড় বিপদ বিশেষ হয়ে পড়ে, এমনি বিপদ যা অপেক্ষা বড় বিপদ আর কিছু ধারণা করাও যায় না। এমতাবস্থায় গরীব, দুঃখী, সর্বহারা, রুগ্ন, আহত, মজলুম ও শোষিত জনতার দুঃখের জন্য কেঁদে কি হবে, একান্তই যদি কাঁদতে হয়, তবে এই গোটা মানবতার সীমাহীন দুঃখের জন্য কাঁদুন। এমতাবস্থায় বলতে হবে যে, মানুষকে এক অন্তহীন দুঃখ সাগরে নিক্ষেপ করা হয়েছে। তার অবস্থা এই হয়েছে যে, সে বারবার ভুল অভিজ্ঞতা লাভ করে ব্যর্থ হয়। আঘাতের পর আঘাত খেয়ে পড়ে যায়, চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়, আবার উঠে চলতে শুরু করে; কিন্তু পুণরায় সে আঘাত খেয়ে ধুলোয় লুণ্ঠিত হয়ে পড়ে। প্রত্যেক আঘাতে দেশের পর দেশ, জাতির পর জাতি তাবাহ ও বরবাদ হয়ে যায়। বড়ই দুঃখের বিষয় এ অর্বাচীন মানুষ এতোটুকুও জানে না যে, তার জীবন ও জন্মের উদ্দেশ্য কি? সে কিসের উদ্দেশ্যে চেষ্টা করবে, সাধনা করবে, শ্রম ও কষ্ট স্বীকার করবে আর তা সে করবেই বা কোন্ প্রণালী ও পদ্ধতি অনুসারে এতোটুকু পর্যন্ত তার জানা নেই। কিন্তু মানবতার এ মর্মান্তিক দূরবস্থা নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করেছেন সেই আল্লাহ যিনি মানুষকে এ দুনিয়াতে সৃষ্টি করেই কি ক্ষান্ত হয়েছে, তাকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করার কোনো দায়িত্বই কি তাঁর নেই।
আশার একটি আলোক রেখা
কুরআন শরীফ এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। উপরে মানুষের যে চরম দূরবস্থার কথা বলা হয়েছে, কুরআন শরীফ তার সম্পূর্ণ বিপরীত এক নুতন তত্ত্বের দ্বার উদঘাটিত করেছে। কুরআন বলছেঃ আল্লাহ তাআলা শুধু সৃষ্টিকর্তাই নন, মানুষকে সৎপথের সন্ধানদাতাও তিনি। তিনি বস্তুজগতের প্রত্যেকটি জিনিসকে তার প্রকৃতির প্রয়োজনকে লক্ষ্য করে হেদায়াত দান করেছেনঃ
الذى اعطى كل شئ خلقه ثم هدى
এ হেদায়াত দান যে কতখানি সত্য, যে কোনো পিপীলিকা, মধুমক্ষিকা কিংবা মাকড়সা ধরে দেখলেই তার অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যাবে। আল্লাহ তাআলা এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণীকে যেরূপ জন্মগতভাবেই পথের সন্ধান জানিয়ে দিয়েছেন শিখিয়ে দিয়েছেন তাদের কাজ এবং কাজের পন্থা, সেরূপ তিনি মানুষের কর্মজীবনের জন্য পথ নির্ধারণ করে দিয়েছেন কাজেই নিজের সর্বপ্রথম অহমিকা ভুলে গিয়ে সে আল্লাহর সম্মুখে আত্মসমর্পণ করা এবং তার পয়গাম্বরদের মারফত যে ব্যাপক জীবন ব্যবস্থা (الدين) তিনি নাযিল করেছেন, তা অনুসরণ করাই মানুষের পক্ষে একান্তভাবে কর্তব্য।
এখন দু’টি সিদ্ধান্ত আমাদের সামনে উপস্থিতঃ একটি মানুষের যাবতীয় শক্তি সামর্থ এবং তার জ্ঞান লাভের সমগ্র উপায়-উপাদানের বিশ্লেষণ করার পর লাভ হয়েছে আর অন্যটি পাচ্ছে কুরআনের সিদ্ধান্ত। এখন দুনিয়ার মানুষের পক্ষে হয় কুরআনের বাণী এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে, নতুবা তাকে এমন এক নৈরাশ্যের অন্ধকারাচ্ছন্ন গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হতে হবে, যেখানে আশার কোনো আলোক রেখাই বিচ্ছুরিত হয় না। ‘আদ্-দীন’ বা জীবন ব্যবস্থা লাভের জন্য মানুষের সামনে যদি দু’টি উপায় থাকতো এবং যদি প্রশ্ন করা হতো যে, মানুষ এ দু’টির কোন্টিকে গ্রহণ করবে তবে অবশ্য অনেক সুবিধা ছিলো। মূলত এখানে মোটেই সেই ব্যাপার নয় সে প্রশ্নও এখানে নয়।
এখানে আসল ব্যাপার এই যে, পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা (الدين) মানুষ কেবল একটি উপায়েই লাভ করতে পারে। এখন মানুষের সামনে এ প্রশ্ন মাথা জাগিয়ে উঠেছে যে, মানুষ এই একমাত্র উপায়ের সাহায্যে প্রাপ্ত জীবন গ্রহণ করবে, না এই একমাত্র পন্থার আশ্রয় অস্বীকার করে জাহেলিয়াত ও নিরুদ্দেশের অন্ধকারে জীবন-যাপনের সিদ্ধান্ত করবে? এ দু’টি পথের যে কোনো একটিকে মানুষ অনায়াসেই গ্রহণ করতে পারে তাকে এতোটুকু স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে মাত্র।
কুরআনের যুক্তি
এই পর্যন্ত যতোকিছু আলোচনা করা হয়েছে, তা হতে আমরা শুধু এ সিদ্ধান্তই লাভ করতে পারি যে, কুরআনের দাবি এবং তার প্রদর্শিত পথ গ্রহণ না করে মানুষের সর্বকালীন কল্যাণ লাভের জন্য কোনো উপায় নেই। অন্য কথায় বলা যায়, “কাফের হওয়ার তো উপায় নেই, কাজেই বাধ্য হয়ে মুসলমান হও।” কিন্তু কুরআন নিজের দাবির সত্যতা সম্পর্কে যেসব যুক্তি প্রমাণ উপস্থিত করেছে, তা এ বাধ্যতামুলক পরিস্থিতির অনেক উর্ধ্বে তা অনেক সারগর্ভ ও অকাট্য। কুরআন মানুষকে ঠেকে মুসলমান হতে বলেনি। তার পরিবর্তে সে মানুষকে নিজ ইচ্ছা ও অনুপ্রেরণায় মুসলমান হবার উৎসাহ দিয়েছে। কুরআনের যুক্তিগুলোই মানুষের মনে এ আগ্রহের সঞ্চার করে। কুরআনের এ সম্পর্কীয় প্রমাণগুলোর মধ্যে নিম্নলিখিত চারটি অত্যন্ত বলিষ্ঠ যুক্তি। এজন্য চারটিকেই বারবার উল্লেখ করা হয়েছে।
একঃ মানুষের জন্য ইসলামই একমাত্র সঠিক জীবন ব্যবস্থা। কারণ এটাই প্রকৃত তত্ত্ব এবং আসল সত্যের অনুরূপ। এছাড়া অন্য সব পন্থা প্রকৃত সত্যের সম্পূর্ণ বিরোধী।
اَفَغَيۡرَ دِيۡنِ اللّٰهِ يَبۡغُوۡنَ وَلَهٗۤ اَسۡلَمَ مَنۡ فِىۡ السَّمٰوٰتِ وَالۡاَرۡضِ طَوۡعًا وَّكَرۡهًا وَّاِلَيۡهِ يُرۡجَعُوۡنَ.
“এরা কি আল্লাহ তাআলার দীন (জীবন ব্যবস্থা) ছাড়া অন্য কোনো পন্থা পেতে চায়? অথচ আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, তা সবই ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক, সেই এক আল্লাহরই সামনে নত হয়ে আছে এবং শেষকালে সকলকে তাঁরই দিকে ফিরে যেতে হবে।” (সূরা আলে ইমরানঃ ৮৩)।
দুইঃ মানুষের জন্য এটাই একমাত্র সঠিক এবং নির্ভুল জীবন ব্যবস্থা, কারণ এটাই একমাত্র সত্য। সূক্ষ্নভাবে বিচার করে দেখলে এছাড়া কোনো পন্থাই নির্ভুল ও খাঁটি হতে পারে না।
اِنَّ رَبَّكُمُ اللّٰهُ الَّذِىۡ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَالۡاَرۡضَ فِىۡ سِتَّةِ اَيَّامٍ ثُمَّ اسۡتَوٰى عَلَى الۡعَرۡشِ يُغۡشِىۡ الَّيۡلَ النَّهَارَ يَطۡلُبُهٗ حَثِيۡثًاۙ وَّالشَّمۡسَ وَالۡقَمَرَ وَالنُّجُوۡمَ مُسَخَّرٰتٍۭ بِاَمۡرِهٖۤؕ اَلَا لَهُ الۡخَلۡقُ وَالۡاَمۡرُؕ تَبَارَكَ اللّٰهُ رَبُّ الۡعٰلَمِيۡنَ.
“প্রকৃতপক্ষে তোমাদের ‘রব’ মালিক ও বাদশাহ হচ্ছেন আল্লাহ তাআলা, যিনি আকাশ ও পৃথিবীকে কালের দু’টি অধ্যায়ে সৃষ্টি করেছেন এবং তার পর তিনি নিজ ‘সিংহাসনে’ আরোহন করেন। তিনি দিনকে রাতের পোশাক পরিয়ে দেন এবং তার পর রাতের পশ্চাতে দিন খুব দ্রুত গতিতে চলে আসে। সূর্য, চন্দ্র এবং নক্ষত্র সবকিছুই তাঁর অধীন ও অনুগত। শুনে রাখ, সৃষ্টি তাঁরই এবং আইন শাসনও কেবল তাঁরই চলবে। সারা জাহানের ‘রব’ আল্লাহ বড়ই মহান।” (সূরা আল আরাফঃ ৫৪)।
তিনঃ মানুষের পক্ষে এ পন্থাই ঠিক পন্থা, এটাই খাঁটি পথ। সমগ্র সত্য সম্পর্কে নির্ভুল জ্ঞান কেবল আল্লাহ তাআলারই থাকতে পারে এবং নির্ভুল বিধানও কেবল তিনিই দিতে পারেন।
اِنَّ اللّٰهَ لَا يَخۡفٰى عَلَيۡهِ شَىۡءٌ فِىۡ الۡاَرۡضِ وَلَا فِىۡ السَّمَآءِؕ.
“বস্তুত আকাশ ও পৃথিবীর কোনো জিনিসই আল্লাহর অগোচরে নয়।” (সূরা আলে ইমরানঃ ৫)
يَعۡلَمُ مَا بَيۡنَ اَيۡدِيۡهِمۡ وَمَا خَلۡفَهُمۡۚ وَلَا يُحِيۡطُوۡنَ بِشَىۡءٍ مِّنۡ عِلۡمِهٖۤ اِلَّا بِمَا شَآءَۚ
“তিনি মানুষের সম্মুখে যা আছে তাও জানেন, আর যা তাদের অগোচরে ও অজ্ঞাত তাও তিনি জানেন। মানুষ তার জ্ঞানকে কোনোক্রমেই আয়ত্ত করতে পারে না। অবশ্য আল্লাহ নিজেই যদি কোনো জ্ঞান মানুষকে দান করেন, তবে সেই কথা স্বতন্ত্র।” (সূরা আল বাকারাঃ ২২৫)।
قُلْ إِنَّ هُدَى اللّهِ هُوَ الْهُدَىَ.
“হে নবী! বলে দাও যে, আল্লাহর হেদায়াতই মানুষের জন্য একমাত্র সত্য পথ নির্দেশকারী বিধান।” (সূরা আল আনআমঃ ৭১)।
চারঃ মানুষের জন্য এটাই একমাত্র সঠিক পথ। যেহেতু এ পথ ছাড়া প্রকৃত সুবিচার স্থাপন সম্ভব নয়। এটা ছাড়া অন্য যে পথেই মানুষ চলবে একদিন না একদিন তা যুলুমেই রূপান্তরিত হবে।
ومن يتعد حدود الله فاولئك هم الظلمون .
“যারা আল্লাহর নির্ধারিত সীমালংঘন করে, তারাই যালেম।”
وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أنزَلَ اللّهُ فَأُوْلَـئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ .
“যারা আল্লাহর দেয়া বিধান অনুসারে নিজেদের যাবতীয় কাজ-কর্মের ফায়সালা করে না, তারাই যালেম।” (সূরা আল মায়েদাঃ ৪৫)।
কুরআনের এসব যুক্তি-প্রমাণের ভিত্তিতে আল্লাহর সম্মুখে মাথা নত করা এবং তাঁর নিকট প্রাপ্ত বিধান অনুসারে জীবন-যাপন করাই প্রত্যেকটি জ্ঞানী লোকের কতর্ব্য।
আল্লাহর বিধান পরীক্ষার মাপকাঠি
এখানে এসে প্রত্যেকটি মানুষের মনে এ প্রশ্ন জাগতে পারে যে, কোন্টি আল্লাহর বিধান আর কোন্টি নয়, তা কিরূপে প্রমাণিত হবে? এক একজন এসে বলবে এটা আল্লাহর বিধান, এটা গ্রহণ কর, আর অমনি কি আমরা তা গ্রহণ করবো? যদি তা না হয়, তবে আল্লাহর ব্যবস্থা এবং মানুষের তৈরি ব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য করার কি মানদণ্ড আছে? এ প্রশ্ন প্রত্যেকের মনেই জাগতে পারে, জাগা স্বাভাবিক। আমার নিজের মনেই গভীরভাবে চিন্তা করার সময় এ প্রশ্ন জেগে উঠেছে এ প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে হলে বহু দীর্ঘ ও বিস্তারিত বিশ্লেষণ আবশ্যক। কিন্তু এ ক্ষুদ্র পুস্তিকায় তার অবকাশ নেই। এখানে আমি সংক্ষেপে এর জবাব দিতে চেষ্টা করবো।
মানুষের চিন্তা আর আল্লাহর বুদ্ধির মধ্যে পাথর্ক্য করার জন্য চারটি বড় বড় মাপকাঠি আছে। এখানে তা পর্যায়ক্রমে উল্লেখ করা হয়েছে।
মানুষের চিন্তাধারার প্রথম বৈশিষ্ট্য এই যে, তাতে জ্ঞানের ভ্রান্তি ও সসীমতা অবশ্যম্ভাবীরূপে বর্তমান পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে আল্লাহর ব্যবস্থায় সীমাহীন জ্ঞান এবং সঠিক ও নির্ভুল তত্ত্বের সুস্পষ্ট নিদর্শন স্বতঃস্ফূর্তভাবে পরিলক্ষিত হয়। বস্তুত যে ব্যবস্থা আল্লাহর তরফ হতে হবে তার কোনো কথাই কোনো কালের বৈজ্ঞানিক সত্যের বিরোধী হবে না কিংবা সেই সম্পর্কে কোনো দিনই একথা বলা যাবে না যে, ‘ব্যবস্থাদাতা’ ব্যাপারটির সকল দিক যথাযথভাবে বিচার করে দেখেননি। কিন্তু বিশ্লেষণ ও যাচাই করার এ মানদণ্ড প্রয়োগকালে একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, প্রকৃত জ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক কল্পনা এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আকাশ পাতালের পার্থক্য রয়েছে। এক যুগে যেসব বৈজ্ঞানিক কল্পনা আর দৃষ্টিভঙ্গি মানুষের মস্তিষ্ককে আচ্ছন্ন করে রাখে, ভুলবশত প্রায়ই সেগুলোকে ‘বিজ্ঞান’ বলে মনে করা হয়। অথচ প্রকৃতপক্ষে সেগুলোর নির্ভুল হওয়ার যতো সম্ভাবনা, ভুল হওয়ারও ঠিক ততোদূরই সম্ভাবনা বর্তমান। মানুষের ধারণা-কল্পনা আর মতবাদ শেষ পর্যন্ত নির্ভুল বিজ্ঞান বলে প্রমাণিত হয়েছে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের ইতিহাসে তার নজীর খুব কমই পাওয়া গেছে।
মানুষের চিন্তা-গবেষণার আর একটি মারাত্মক দূর্বলতা হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গীর সসীমতা ও সংকীর্ণতা। কিন্তু আল্লাহর ব্যবস্থায় চিন্তা ও দৃষ্টি ব্যাপক এবং সুদুরপ্রসারী হয়ে থাকে। আল্লাহর ব্যবস্থার যে কোনো ধারাকেই আপনি লক্ষ্য করবেন, নিঃসন্দেহে আপনার মনে হবে যে, এর ব্যবস্থাপক আদি হতে অন্ত পর্যন্ত নিজ চোখে প্রত্যক্ষভাবে দেখতে পাচ্ছেন। গোটা সৃষ্টিজগতকে দেখছেন, সমগ্র সত্য আর তত্ত্ব সমবেতভাবে তাঁর সম্মুখে সুস্পষ্টভাবে বিদ্যমান। এর প্রতিকূলে বড় বড় দার্শনিক আর বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে একটি শিশুর চিন্তা বলে প্রতীয়মান হবে। মানুষের চিন্তার তৃতীয় বিশেষত্ব এই যে, তাতে বিজ্ঞান ও বুদ্ধি মানুষের আবেগ-উচ্ছ্বাস ও বাসনা-লালসার সাথে কোথাও না কোথাও সন্ধি বা ষড়যন্ত্র করছে বলে পরিষ্কার মনে হবে। আল্লাহর ব্যবস্থা এটা হতে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত। তাতে স্বচ্ছ জ্ঞান-বুদ্ধি এবং অনাবিল বুদ্ধিমত্তার পরিচয় উজ্জ্বলরূপে দেখতে পাওয়া যায়। তার আদেশ-নির্দেশে কোথাও আবেগ উচ্ছ্বাস ও একদেশদর্শিতার আবিলতা মোটেই পরিলক্ষিত হবে না।
মানুষের চিন্তার আর একটি দুর্বলতা এই যে, যে জীবন ব্যবস্থা সে নিজে রচনা করবে তাতে পক্ষপাতিত্ব, মানুষে মানুষে অবাঞ্ছনীয় বৈষম্য এবং অবৈজ্ঞানিক বুনিয়াদে একজনকে অন্যজনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দানের ভাবধারা অবশ্যম্ভাবীরূপে বর্তমান পাওয়া যাবে। কারণ প্রত্যেকটি মানুষেরই কিছু না কিছু ব্যক্তিগত স্বার্থ বা কোনো কোনো মানুষের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট ভাবাবেগের দুর্বলতা থাকেই এবং তার ফলেই মানুষ একদেশদর্শী ও পক্ষপাতদুষ্ট ব্যবস্থা রচনা করতে বাধ্য হয়। কিন্তু আল্লাহর ব্যবস্থা এসব কলুষতা হতে সর্বোতভাবে মুক্ত ও পবিত্র।
যেসব জীবন ব্যবস্থা নিজেকে আল্লাহর ব্যবস্থা বা ‘আদ্-দীন’ বলে প্রমাণ করতে সচেষ্ট, তার প্রত্যেকটিকেই এ মানদণ্ডে যাচাই করে দেখতে হবে। যদি তা মানবীয় চিন্তা গবেষণার উল্লিখিত বিশেষত্ব হতে মুক্ত হয় তবে তাকে ‘আদ্-দীন’ বা মানুষের পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা বলে বিশ্বাস করতে কোনোই আপত্তি থাকতে পারে না।
ঈমানের দাবি
এখন প্রশ্ন এই যে, কুরআনের এই দাবি মানলে এবং যে জীবন বিধান আল্লাহর তরফ হতে নাযিল হয়েছে বলে বিশ্বাস হবে তাকে গ্রহণ করলে, মানুষের প্রতি কি কতর্ব্য আবর্তিত হয়? উপসংহারে এ প্রশ্ন সম্পর্কেই আলোচনা করতে চাই।
পূর্বেই বলা হয়েছে যে, ইসলামের অর্থ নত হওয়া, আত্মসমর্পণ করা এবং নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সোপর্দ করে দেয়া। এ নতি স্বীকার ও আত্মসমর্পণের সাথে আত্মম্ভরিতা এবং চিন্তা ও কর্মের নিরংকুশ আযাদীর কোনো সামঞ্জস্য হতে পারে না। যে জীবন ব্যবস্থার প্রতিই মানুষ বিশ্বাস স্থাপন করবে, তার নিকট তার সমগ্র ব্যক্তি সত্তাকে সম্পূর্ণরূপে সোপর্দ করে দিতে হবে। জীবনের কোনো; একটি ব্যাপারকেও তার বাইরে রাখতে পারবে না। ঈমানের অর্থ এই যে, ‘দীন’ বা জীবন ব্যবস্থাই মানুষের মন ও মস্তিষ্কের উপর পূর্ণ আধিপত্য বিস্তার করে থাকবে; এটাই হবে তার চোখ ও কানের ধর্ম, হাত ও পায়ের ধর্ম, পেট ও দেহের ধর্ম, তার কলম ও মুখের ধর্ম, তার আজীবনের চেষ্টা-সাধনা ও কর্মের ধর্ম, ভালবাসা ও ঘৃণার ধর্ম, তার বন্ধুত্ব আর শত্রুতার ধর্ম। মোটকথা মানুষের ব্যক্তি সত্তার কোনো একটি দিক ও বিভাগই এহেন ধর্মের বাইরে থাকতে পারবে না। জীবনের যে কাজ বা দিকই এক দীন বা জীবন ব্যবস্থার প্রভাবমুক্ত হবে এবং যে কাজে বা জীবনের যে দিকেই এ জীবন ব্যবস্থার অনুসরণ পরিত্যক্ত হবে তার প্রতি ঈমানের দাবিতে ততোই মিথ্যা ও প্রতারণার যোগ থাকবে, এতে কিছু মাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। আর জীবনকে মিথ্যা ও প্রতারণার কলুষ হতে মুক্ত রাখা প্রত্যেক বুদ্ধিমান ও সত্যসিদ্ধ মানুষের পক্ষে অবশ্যই কতর্ব্য। এ পুস্তকের প্রথমদিকে একথাও বলা হয়েছে যে, মানুষের জীবন একটি সামগ্রিক ও অভিন্ন সত্তা; তাকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করা যায় না। কাজেই মানুষের পূর্ণ জীবনের জন্য একটি মাত্র ধর্ম বা জীবন ব্যবস্থাই হতে পারে। একই সময় একাধিক জীবন ব্যবস্থা অনুসরণ করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। কেননা তা করতে গেলে ঈমানের অনিশ্চিত অবস্থা, মতের বিশিষ্টতা ও অসংবদ্ধতা এবং জটিল ব্যাপার সম্বন্ধে স্থির-সিদ্ধান্ত গ্রহণে অক্ষমতাই প্রমাণ হবে। বস্তুত ‘কোনো আদর্শকে’ যখন মানুষ ‘আদ্-দীন’ বা জীবন ব্যবস্থা হিসাবে গ্রহণ করে এবং তার জীবন ব্যবস্থা হওয়া সম্পর্কে স্থির সিদ্ধান্ত করে তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা হয়, তখন তা তার পূর্ণ জীবনকে সকল দিক ও বিভাগের ‘একমাত্র ব্যবস্থা’ হওয়া চাই এবং বাধ্য হওয়াই তাকে এভাবেই গ্রহণ করতে হবে, তাছাড়া গত্যন্তর নেই।
তাকে যদি ব্যক্তিগত ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করা হয়, তবে তা ঘরের ব্যবস্থা হবে, শিশু শিক্ষার ব্যবস্থা হবে, তার শিক্ষা-দীক্ষা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থা হবে, তার কায় -কারবার, ব্যবসায়-বাণিজ্য ও আয়-উপার্জনের, তার ঘরোয়া জীবন এবং জাতীয় কর্মনীতির, তার রাজনীতি ও তামাদ্দুনের, তার সাহিত্য ও শিল্পের ব্যবস্থা হবে, বস্তুত এরূপ না হওয়ার কোনোই কারণ থাকতে পারে না যে, একটা মুক্তাকে যখন আরো অনেক মুক্তার সাথে একই সূত্রে গেথে দেয়া হবে, তখন আর তা মুক্তা থাকবে না। তখন তা ছোলা বুট হয়ে যাবে, এমন কোনো কথাই হতে পারে না। অনুরূপভাবে একথাও যদি আমি বুঝতে পারি না যে, ব্যক্তিগতভাবে তো আমরা একটি ব্যবস্থা অনুসরণ করবো কিন্তু যখন আমাদের একাধিক লোকের জীবনকে সংঘবদ্ধ করবো তখন সেই সংঘবদ্ধ ও সমাজবদ্ধ জীবনের কোনো কোনো দিক সেই ব্যবস্থার আওতার বাইরে থাকবে। এ ধরনের কথার অন্তসারশূন্যতা সুস্পষ্ট।
ঈমান সম্পর্কে সর্বাপেক্ষা বড় কথা এই যে, কোনো ব্যবস্থাকে যখন জীবন ব্যবস্থা হিসাবে বিশ্বাস ও গ্রহণ করা হয়, তখন সমগ্র জাতিকে তার কল্যাণ ও সৌন্দর্য গ্রহণ করার সুযোগ দেয়া অবশ্য কর্তব্য এবং তাকে সমগ্র দুনিয়ার ব্যবস্থা হিসাবে প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করা বাঞ্ছনীয়। সত্য যেমন স্বভাবতই সর্বজয়ী হতে চায় তেমনি সত্য প্রেমিকও সত্যকে বাতিলের উপর জয়ী করার জন্য চেষ্টা না করে থাকতে পারে না। যে ব্যক্তি প্রত্যক্ষভাবে দেখবে যে, বাতিল চারদিক হতে পৃথিবী এবং পৃথিবীর অধিবাসীগণকে গ্রাস করছে তখন এ দৃশ্য দেখে তার মধ্যে যদি কোনোরূপ ব্যস্ততা ব্যাকুলতা, ব্যাথা এবং অস্থিরতা জেগে না উঠে তবে মনে করতে হবে যে, সত্যের জন্য তার মনে প্রকৃতই কোনো দরদ নেই, সত্যিকার কোনো প্রেম নেই। আর তা থাকলেও একেবারে অচেতন ও গভীর নিন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। কিন্তু চেতনা ও অনুভূতির এ নিদ্রা পরিণামে কাল-নিদ্রায় পরিণত না হয়, সময় থাকতেই সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করা বাঞ্ছনীয়।
— সমাপ্ত —