১. আধুনিক বিশ্বে ইসলামী পুনর্জাগরণ
বিশ্ব মানবতা আজ এক মহা সংকটের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। মানুষের উপর মানুষের প্রভুত্ব, দুর্বলের উপর সবলের আধিপত্য এবং জুলুম, পারমাণবিক রণসজ্জা এবং বিবেকহীন অস্ত্র প্রতিযোগিতা বিশ্ববাসীকে অশান্তির অনলে নিক্ষেপ করেছে। বিপথগামী মানুষের মুক্তির জন্য যুগে যুগে এ বিশ্বজাহানের মহান স্রষ্টা ও প্রভু আল্লাহ তায়ালা পাঠিয়েছেন নবী-রাসূল ও আম্বিয়ায়ে কেরাম (আ)। তাঁরা মানব জাতির শান্তি ও মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। মানবতাকে ধ্বংস ও বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আল্লাহ প্রেরিত ঐসব মহা মনীষীগণ দুনিয়াতে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার দুর্জয় সংগ্রাম চালিয়েছেন। মানব জাতির মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁরা নিরবিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।
সর্বকালের, সর্বযুগের সকল মানুষের মুক্তিদূত, মানবতার মহান বন্ধু ও শিক্ষক রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন আল্লাহর পক্ষ থেকে ঐসব মহাপুরুষদের সর্বশেষ ব্যক্তিত্ব, আখেরী নবী। আইয়ামে জাহেলিয়াতের সমাজে আবির্ভূত হয়ে তিনি বিশ্ব ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় বিপ্লব সাধন করে প্রতিষ্ঠা করেন শান্তির সমাজ। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থার অনুকরণে গড়ে উঠে ‘খেলাফত আলা মিনহাজিন নবুয়াত’ বা নবুয়াতের পদ্ধতিতে খেলাফত ব্যবস্থা। বত্রিশ বছরকাল এই ইসলামী খেলাফত সঠিক পদ্ধতির উপর কায়েম ছিলো।
হযরত হুসাইন রা.- এর কারবালার প্রান্তরে মর্মান্তিক শাহাদাতের মধ্য দিয়েই সূচনা হয় ইসলামী পুনর্জাগরণ আন্দোলনের। পরবর্তী সময়ে ইসলামী ব্যবস্থাকে সঠিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য চলেছে এক নিরন্তর প্রচেষ্টা। এজন্য প্রতি শতাব্দীতেই আবির্ভাব হয়েছে অসম সাহসী, স্বচ্ছ চিন্তার অধিকারী, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বুদ্ধিদীপ্ত মুজাদ্দিদের। এই মুজাদ্দিদগণ নিজের পরিবেশ, সমসাময়িক জটিলতা, যুগের বিকৃত গতিধারা, ভ্রান্ত চিন্তার বিরুদ্ধে জেহাদ করার ক্ষমতা ও সাহস, নেতৃত্বের জন্মগত যোগ্যতা এবং ইজতিহাদ ও পুনর্গঠনের অসাধারণ ক্ষমতার বৈশিষ্ট্যে ছিলেন সমুজ্জ্বল। পরিবেশ-পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন, সংস্কারের পরিকল্পনা প্রণয়ন, চিন্তার রাজ্যে বিপ্লব সৃষ্টি, ইসলামী নেতৃত্বদানের মতো লোক তৈরী, দ্বীন ইসলামের গবেষণা-ইজতিহাদ, ইসলামের প্রসার ও বিকাশ তথা বিশ্বজনীন বিপ্লব সৃষ্টির জন্য সংগ্রাম চালিয়ে তারা ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন।
ইসলামী পুনর্জাগরণের এ সংগ্রামে হযরত উমর ইবনে আবদুল আজিজ র. (৬১-১০১ হিজরী), ইমাম আবু হানিফা র. (৮০-১৫০ হিজরী), ইমাম মালেক র. (৯৫-১৭৯ হিজরী), ইমাম শাফেয়ী র. (১৫০-২৪০ হিজরী), ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল র. (১৬৪-২৪১ হিজরী), ইমাম গাজ্জালী র. (৪৫০-৫০৫ হিজরী), ইমাম ইবনে তাইমিয়া র. (৬৬১-৭২৮ হিজরী), শায়খ আহমদ সরহিন্দ মুজাদ্দিদে আলফেসানী র. (৯৭৫-১০৩৪ হিজরী), শাহ ওয়ালিউল্লাহ র. (১১১৪-১১৭৬ হিজরী), সৈয়দ আহমদ শহীদ র. (১২০১-১২৪৬ হিজরী), এবং শাহ আবদুল আজিজ র. প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁরা যে জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং ত্যাগের আদর্শ স্থাপন করেছেন তা ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
ইসলামী পুনর্জাগরণের এ ধারা ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় আজও অব্যাহত রয়েছে। সমস্যা সংক্ষুব্ধ আজকের পৃথিবীর দেশে দেশে চলছে এ পুনর্জাগরণ প্রচেষ্টা। পুঁজিবাদী এবং সমাজতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদের যাঁতাকলে নিষ্পিষ্ট বিশ্ব মানবতা ছুটে চলেছে আজ শান্তির অন্বেষায়। সেদিন বেশী দূরে নয় যেদিন মানুষের তৈরী পুঁজিবাদ এবং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটবে এবং অবসান ঘটবে বিশ্বময় জুলুম, শোষণ, নির্যাতন এবং নিপীড়নের। আবার দুনিয়ায় কায়েম হবে ‘খিলাফত আলা মিনহাজিন নবুয়াত’ অর্থাৎ নবুয়াতের পদ্ধতিতে খিলাফত। নবী করীম সা. এ সম্পর্কে হাদীসে সুস্পষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। এ প্রসঙ্গে শাহ ইসমাঈল শহীদ র. তাঁর ‘মানসাবে ইমামত’ গ্রন্থে যে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন তাঁর উল্লেখ করা যেতে পারেঃ
(****************************)
‘‘তোমাদের দ্বীন এর আরম্ভ নবুয়াত ও রহমতের মাধ্যমে এবং তা তোমাদের মধ্যে থাকবে যতক্ষণ আল্লাহ চান। অতঃপর মহান আল্লাহ তা উঠিয়ে নেবেন। তারপর নবুয়াতের পদ্ধতিতে খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে যতদিন আল্লাহ চান। অতঃপর আল্লাহ তাও উঠিয়ে নেবেন।
তারপর শুরু হবে দুষ্ট রাজতন্ত্রের জামানা এবং যতদিন আল্লাহ চাইবেন তা প্রতিষ্ঠিত থাকবে। অতঃপর আল্লাহ তাও উঠিয়ে নেবেন।
অতঃপর জুলুমতন্ত্র শুরু হবে এবং আল্লাহ যতদিন চাইবেন, ততদিন থাকবে। অতঃপর আল্লাহ তাও উঠিয়ে নেবেন।
অতঃপর আবার নবুয়াতের পদ্ধতিতে খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে। নবীর সুন্নাত অনুযায়ী তা মানুষের মধ্যে কাজ করে যাবে এবং ইসলাম পৃথিবীতে তার কদম শক্তিশালী করবে। সে সরকারের উপর আকাশবাসী ও পৃথিবীবাসী সবাই খুশী থাকবে। আকাশ মুক্ত হৃদয়ে তার বরকত বণ্টন করবে এবং পৃথিবী তার পেটের সমস্ত গুপ্ত সম্পদ উদ্গীরণ করে দেবে।’’ – (তিরমিযী)
এ হাদীসে ইতিহাসের পাঁচটি পর্যায়ের দিকে ইশারা করা হয়েছে। তার মধ্যে তিনটি পর্যায় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে এবং চতুর্থ পর্যায়টি বর্তমানে চলছে। শেষে যে পঞ্চম পর্যায়টি সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে সমস্ত আলামত একথা ঘোষণা করছে যে, মানুষের ইতিহাস দ্রুত সেদিকে অগ্রসর হচ্ছে। মানুষের গড়া সকল মতবাদের পরীক্ষা হয়ে গেছে এবং তা ভীষণভাবে ব্যর্থও হয়েছে। বর্তমানে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত মানুষের ইসলামের দিকে অগ্রসর হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। [ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী, পৃষ্ঠা-২২] সাইয়েদ কুতুম শহীদ এ সম্পর্কে নিম্বরূপ মন্তব্য করেছেনঃ
এতদসত্ত্বেও এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, ভবিষ্যৎকাল এ ধর্মের জন্য নির্ধারিত। এ ধর্মীয় ব্যবস্থার সুউচ্চ ও মহান পরিকল্পনা এবং এমন একটা ব্যবস্থার জন্য মানবজাতির স্বাভাবিক প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, ইসলামই হচ্ছে আগামী সভ্যতার ধর্ম। এক নজিরবিহীন ভূমিকা পালনের জন্য সে আহুত হবে। কেননা ইসলামের শত্রুরা স্বীকার করুক আর নাই করুক এ ভূমিকা অপর কোন ধর্ম বা মতবাদ দ্বারা পালিত হতে পারে না। আমরা বিশ্বাস করি, গোটা মানবজাতি আর অধিক কাল এ ধর্মকে এড়িয়ে থাকতে পারবে না। আত্মরক্ষার মহা তাগিদেই মানুষ একে গ্রহণ করবে।
আজকের মানুষের জন্য ইসলামের প্রয়োজন রাসূলুল্লাহ সা.-এর যুগের মানুষের জীবনে ইসলামের প্রয়োজনের মতোই তীব্র। আমাদের নিশ্চিত বিশ্বাস যে, এমনি এক পরিস্থিতিতে অতীতে যা ঘটেছে আজকে বা আগামীতেও তাই ঘটবে। বস্তুবাদী সভ্যতার প্রসার ও ইসলামী আন্দোলনের নেতা ও কর্মীদের উপর জুলুম-নির্যাতন চলা সত্ত্বেও আমাদের মনে যেন সংশয়বাদ সামান্যতম রেখাপাত না করতে পারে। ইসলামের বিরুদ্ধে জঘন্য অন্যায় ও অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে এটা সত্য মহা্গ্রন্থ আল কোরআনের অবমাননা করা হচ্ছে। কিন্তু সত্যের শক্তি ইসলামের পক্ষে। সব প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতার চড়াই উতরাই পেরিয়ে কালজয়ী হবার সামর্থ আছে ইসলামের।
আমরা একা নই। প্রকৃতি আমাদের পক্ষে। অস্তিত্বের প্রকৃতি এবং মানব প্রকৃতি মহাশক্তিধর এ শক্তি সভ্যতার অপরাপর শক্তির চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতি ও সভ্যতার মধ্যে যখন সংঘর্ষ বাধে তথন সংঘর্ষকাল যত দীর্ঘ বা সংক্ষিপ্ত হোক না কেন প্রকৃতি বিজয়লাভ করে। [অনাগত মানব সভ্যতা ও ইসলাম, সাইয়েদ কুতুব শহীদ, পৃষ্ঠাঃ ৭২-৭৪]
২. বর্তমান প্রেক্ষাপট
ইসলামী বিপ্লব, ইসলামী শাসন, ইসলামী সমাজ, শরীয়তের শাসন, ইসলামী ব্যংকিং ও অর্থব্যবস্থা এবং ইসলামীকরণ, ইসলামী আন্দোলন এসব পরিভাষা আজকের বিশ্বে বেশ পরিচিত ও আলোচিত একথা বললে বোধহয় অতিশয়োক্তি হবে না। প্রায় অর্ধ শতাধিক মুসলিম দেশ ছাড়া অন্যত্র এসবের চর্চাও তুলনামূলকভাবে বেড়েই চলেছে। আধুনিকীকরণের মত ইসলামীকরণ বা প্রগতিবাদীর মত মৌলবাদী শব্দগুলোই পাশ্চাত্য সংবাদ মাধ্যমসমূহ অহরহ ব্যবহার করছে। সবকিছুর মধ্য দিয়েই একটি সত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছে বলে বিশ্লেষণ করার অনেক যুক্তিসংগত ভিত্তি রয়েছে। আর ঐ সত্যটি হলো ইসলাম একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ধর্ম, জীবন দর্শন, যা নাস্তিক্যবাদী কিংবা সমাজতান্ত্রিক শাসন শোষণ ও ত্রাসনেও তার শক্তি এবং কার্যকারিতা হারায়নি। বরং মানব জীবনের জন্য, বিশ্ব মানবতার সত্যিকার মুক্তি ও কল্যাণের জন্য ইসলামই আধুনিকতম প্রগতিশালী এবং অসাধারণ শক্তিসম্পন্ন জীবন ব্যবস্থা বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। সময় যতই অতিবাহিত হচ্ছে ততই মানব রচিত ব্যবস্থার অন্তসারশূণ্যতা, দুর্বলতা, অবাস্তবতা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মানব সভ্যতার হেফাজত এবং বিকাশের জন্য ইসলামের শাশ্বত এবং চিরন্তন মূল্যবোধের প্রয়োজনীয়তাই যেন তীব্রতর হচ্ছে।
পশ্চিমী ধ্যান-ধারণা, ধর্মনিরপেক্ষতা, অবাধ পুঁজিবাদ, লেবাসী গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রেও জাতীয়তাবাদের জয়-জয়কার এবং বৃহৎ শক্তিবর্গের মোড়লিপনার এ স্বর্ণযুগে উল্লেখিত মন্তব্য অসংলগ্ন চিন্তার প্রকাশ বলেও মনে হতে পারে। কিন্তু যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন বা যে ভাষাই ব্যবহার করা হোক না কেন আজকের দুনিয়ায় ইসলাম একটি বাস্তবতারই নাম।
সর্বশেষ অবতীর্ণ জীবন বিধান ইসলাম এমনই এক মূল্যবোধ ও জীবন ব্যবস্থার প্রবক্তা যার আধ্যাত্মিক এবং যুক্তিভিত্তিক শক্তি সামর্থের মুকাবিলায় দুনিয়ায় আর কোন দ্বিতীয় ব্যবস্থা নেই।
নাম উল্লেখ না করেও বলা চলে বর্তমান বিশ্বে ইসলাম ছাড়া যে কয়টি ধর্ম প্রধান বলে বিবেচিত ওসবের ভিত্তিও খুব দুর্বল কিংবা ইসলামের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা মত ক্ষমতা সম্পন্ন নয়।
পুঁজিবাদের প্রতিক্রিয়া হিসেবে সমাজতন্ত্র যে ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছে সেটাও তার কার্যকারিতা প্রমাণ করতে পারেনি। এমন কি এক সময় সমাজতন্ত্রকে যতটা ভয় পুঁজিবাদ করতো সেই ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদও সমাজতন্ত্রকে আর আদর্শিক চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছে না।
পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে একের পর এক বিপর্যয় নেমে এসেছে। লৌহ প্রাচীরের অন্তরাল থেকে বের হয়ে এসেছে জনগণ। জনতার রুদ্ররোষে ধস নেমেছে ঐসব দেশের সমাজতান্ত্রিক সরকারগুলোর। সমাজতন্ত্র সেখানকার জনগনই প্রত্যাখ্যান করছে। প্রত্যাখ্যান করছে দীর্ঘদিনের কম্যুনিষ্ট শাসন। সুচতুর মিঃ গর্বাচেভ পেরেস্ত্রয়কা ও গ্লাসনষ্টের নীতি ঘোষণা করে সমাজতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখার শেষ প্রয়াস চালিয়ে ছিলেন। খোদ সোভিয়েত ইউনিয়ন এর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা হয়েছে। কার্লমার্ক্সের চিন্তাধারা পাঠ্যসূচি থেকে বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। ব্যক্তি মালিকানা ও বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগ আইনসিদ্ধ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ভিন্নমতের রাজনৈতিক বক্তব্য প্রচার করা হচ্ছে। অকম্যুনিষ্টদের নির্বাচনে দাঁড়ানোর সুযোগ দেয়া হয়েছে। অস্ত্র সীমিতকরণসহ বৈদেশিক নীতিতেও পরিবর্তন আনয়নের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। এখন পালা চলছে ইউরোপ থেকে সোভিয়েত ও মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করার। তৃতীয় বিশ্বে দুই পরাশক্তির তথাকথিত স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছে। এক পক্ষে মার্কিন অপর পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়ন এই মেরুকরণ পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। নতুন বিশ্ব রাজনীতি আরেকটি নতুন মেরুকরণের দিকে এগিয়ে চলছে। ভেঙে ফেলা হয়েছে বার্লিন প্রাচীর এবং দুই জার্মানী এখন ঐক্যবদ্ধ। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো এখন ঘর সামলাতে ব্যস্ত। আপাতঃ দৃষ্টিতে পশ্চিমা পুঁজিবাদের সর্দার যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অন্তসারশূণ্যতাও তো বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করছে। সমাজতন্ত্রের বিশ্বব্যাপী বিপর্যয়ের ফলে কার্যতঃ দুনিয়াতে একদিকে পুঁজিবাদ ও অন্যদিকে অবস্থান করছে ইসলামী ব্যবস্থা। সোভিয়েত মার্কিন ঐক্যের মাধ্যমে একটা নতুন পরিস্থিতি অত্যাসন্ন। বিশেষ করে সমাজতন্ত্রের লৌহযবনিকার অন্তরালের জনগন, ধর্ম, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের যে আওয়াজ তুলেছে, ক্ষয়িষ্ণু এবং পরীক্ষিত পশ্চিমা পুঁজিবাদ তা মিটাতে পারবে বলে আশাবাদ পোষণ করা একেবারেই অর্থহীন। মানুষের প্রকৃতির ধর্মের প্রতি পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের প্রায় অভিন্ন নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মানবতা সমাজতন্ত্রের বিকল্প হিসেবে আবারও পুরনো পুঁজিবাদ গ্রহণ করে এগিয়ে যাবে তা আশা করা আদৌ সমীচীন নয়। বরং সোভিয়েত ইউনিয়নের মুসলিম প্রজাতন্ত্রগুলোর জনগন মার্ক্সবাদের পতনের পর ইসলামকেই বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। এ আলামত আজ সুস্পষ্ট। অথচ মার্ক্স-লেলিন-স্ট্যালিনরা মানুষের জীবন থেকে ধর্মের প্রভাব সম্পূর্ণ উৎখাত করার জন্য চালিয়েছিলেন নারকীয় অনেক অভিযান। ইসলামের প্রভাব মুছে ফেলার জন্য সর্বপ্রকার নিবর্তনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা সত্ত্বেও ইসলামকে ঐসব অঞ্চলের জনগণের হৃদয় থেকে উপড়ে ফেলা সম্ভব হয়নি। সামান্য ধর্মীয় স্বাধীনতা লাভের পর তারা উদ্দীপনার সাথে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে এটা সুস্পষ্ট যে, সোভিয়েত ইউনিয়নে বসবাসরত ৭/৮ কোটি মুসলমানের জীবনে ইসলামের শিকড় গভীরভাবে প্রোথিত আছে।
সম্প্রতি টাইমস সাময়িকীতেও এ মন্তব্য করা হয়েছে যে, মানুষের জীবন থেকে ধর্মকে নিশ্চহ্ন করার যে নীতি সোভিয়েত ইউনিয়নে দীর্ঘদিন অনুসৃত হয়েছে তা খুব একটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। কম্যুনিষ্ট শাসনের বিরোধী মনোভাবে সাথে সাথে সেখানকার জনগণের ধর্মীয় চেতনার বহিঃপ্রকাশও ঘটেছে। আজারবাইজানের সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহে ইসলামী চেতনার প্রভাব অতি সুস্পষ্ট। মধ্য এশীয় মুসলিম প্রজাতন্ত্রসমূহে যে সাহসী ইসলামী তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ তাতে উদ্বিগ্ন। সংস্কারের প্রবক্তা মিঃ গর্বাচেভ নিজে মাত্র চার বছর আগেও ইসলামকে ‘প্রগতি ও সমাজতন্ত্রের শত্রু’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আজারবাইজানে সোভিয়েত সহিংসতায় নিহত মুসলমানদের জানাজায় প্রায় ১৫ লাখ লোকের সমাগম হয়। এ থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, ঐসব অঞ্চলে ইসলামী জাগরণ অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। এমতাবস্থায় দুই বিশ্ব শক্তির ভূমিকা ইসলামের বিপরীত মেরুতে অবস্থান নেয়া অস্বাভাবিক নয়। সুতরাং আজকের দুনিয়ায় সুপার পাওয়ারের দ্বন্দ্ব কোন আদর্শিক দ্বন্দ্ব নয়। এ দ্বন্দ্ব রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাব প্রতিষ্ঠার দ্ব্ন্দ্ব। ঐ পতনোন্মুখ দু’টো মতাদর্শই সমানভাবে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হারাতে বসেছে। যেহেতু জীবন ও জগত সম্পর্কে প্রায় অভিন্ন ধারণা পেশ করেছে সেহেতু অর্থনৈতিক প্রশ্নে ভিন্নমুখী কাঠামোর প্রবক্তা হওয়া সত্ত্বেও ইসলামের দৃষ্টিতে ঐ দু’টি মানব রচিত মতাদর্শের মধ্যে কোন মৌলিক পার্থক্য নেই। দু’টি মতাদর্শই মানবতার কল্যাণের চাইতে অকল্যাণই করেছে। তাছাড়া ঐ দুই মতাদর্শ ও নেতৃত্বদানকারী দু’টি বৃহৎ রাষ্ট্রশক্তির টানাপোড়েনে বিশ্ব আজ অশান্তি ও জুলুমের অগ্নি গহ্বরে নিমজ্জিত। ওরা বিশ্বকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে একটি ধ্বংস ও বিপর্যয়ের দিকে।
যুগে যুগে মুক্তিকামী মানবতা যেমন মুক্তির জন্য লড়াই করেছে, সংঘবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম করেছে ইসলামের ইতিহাসের মহামনীষী এবং মহানায়কদের নেতৃত্বে, তেমনি আজ অব্যাহত আছে সেই সংগ্রাম এবং আন্দোলন। ইসলামকে রাষ্ট্রীয় আইনের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তথা বিজয়ী শক্তি হিসেবে পরিগণিত করার এ সংঘবদ্ধ প্রয়াস পৃথিবীর অনেক দেশেই আজ রাজনৈতিকভাবে স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে।
ইসলামিী পুনর্জাগরণের এ প্রচেষ্টা নানা প্রতিবন্ধকতা কিংবা অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে দিন দিন অগ্রগতিই লাভ করছে। চরমপন্থী, মৌলবাদী, ফ্যানাটিক, ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক ইত্যাদি বিশেষণে আখ্যায়িত করে কোথাও কোথাও অবতীর্ণ জীবন বিধানের আলোকে পরিচালিত মানবতার কল্যাণ ও মুক্তির লক্ষ্যে নিবেদিত মহান ইসলামী আন্দোলনকে হেয় করার কিংবা এ সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টির সাম্রাজ্যবাদী অপকৌশল অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় কাঠামো বা রাষ্ট্র পরিচালনায় ইসলামের ভূমিকা অনবদ্য হয়ে উঠেছে। প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রশক্তি কায়েমী স্বার্থপূঁজারী এবং অনাকাঙ্ক্ষিত বিত্তবান, অবৈধ সম্পদের অধিকারী ও ধর্মের নামে প্রবঞ্চনাকারী ক্ষমতালিপ্সু গোষ্ঠী সর্বাবস্থায় ইসলামী পুনর্জাগরণ বা ইসলামী আন্দোলনের বিকাশ স্তব্দ করে দেয়ার জন্য সমানভাবে প্রস্তুত। উপরন্তু সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ইসলামের পুনরাবির্ভাবে শংকিত বলে ওরা দেশে দেশে ইসলামী আন্দোলনসূহ খতম করে দেয়ার জন্যে মদদ যোগায়। কিন্তু এতদসত্তেও ইসলামের অগ্রাভিযান থেমে নেই।