১৩. ইসলামী বিপ্লবের মডেল
ইসলামী বিপ্লবের যে বিশিষ্ট কর্মপন্থা তার মডেল হলেন স্বয়ং আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। কেননা অন্যান্য নবী রসূলদের জীবন কাহিনী ও কাজকর্ম সম্পর্কে আমরা খুব বেশী কিছু জানতে পারি না বা বিস্তারিত জানার সুযোগ নেই। কুরআন মাজীদে তাদের সম্পর্কে যতটুকু উল্লেখ পাওয়া যায় তাতে বিস্তারিত জানার কোন অবকাশ নেই। এ ব্যাপারে কেবলমাত্র শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছেই একটি পরিপূর্ণ চিত্র পাওয়া যায়। পৃথিবীর ইতিহাসে যত নেতার আবির্ভাব হয়েছে তাদের মধ্যে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই হলেন একমাত্র অনুসরণযোগ্য আদর্শ নেতা। ইসলামী আন্দোলনের সূচনা থেকে মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং এ রাষ্ট্র বিপ্লবকে সার্বিকভাবে সুসংহত করার ক্ষেত্রে তার ভূমিকার বিস্তারিত বর্ণনা আমরা পাই। ইসলামী রাষ্ট্রের সংবিধান, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র নীতি, প্রশাসন ও আভ্যন্তরীণ শৃংখলা এবং পরিপূর্ণ একটি কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ ইত্যাদির মাধ্যমে একমাত্র বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি আদর্শ বা মডেল উপস্থাপন করে গেছেন। বিভিন্ন অধ্যায়ে সুস্পষ্ট কতগুলো পর্যায় অতিক্রম করেই তিনি সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেন।
১৪. ইসলামী আন্দোলনের চিত্র
মাওলানা মওদূদী মহানবীর জীবন চরিত থেকে ইসলামী আন্দোলনের নিম্নোক্ত চিত্র এঁকেছেনঃ ‘‘হযরত মুহাম্মদ সা. যখন সর্বপ্রথম ইসলাম প্রচারে আদিষ্ট হলেন, তখন দুনিয়ায় নৈতিক, সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক অসংখ্য সমস্যা অত্যন্ত জটিল আকার ধারণ করেছিল। অবিলম্বে সেই সমস্যাবলীর আশু সমাধানও সকল দিক দিয়ে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অনুভূত হচ্ছিলো। রোম ও ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ সর্বগ্রাসী মুখব্যাদান করে সীমান্তের অপর পারেই দণ্ডায়মান ছিলো। অবৈধ অর্থনীতি ও শোষণের যত উপায় হতে পারে তা সবই অবাধে চলছিল। নৈতিক পতন, অপরাধ-প্রবণতা ও পাপের ঘুণ সমগ্র মানুষের অস্থিমজ্জা ও মেরুদণ্ড দুর্বল করে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছিল। হযরতের নিজের জন্মভূমিতেও এ ধরণের জটিল সমস্যা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল এবং দেশ একজন সুদক্ষ নেতার নিপুণ হস্তের উদগ্রীব প্রতীক্ষায় ছিলো। সমগ্র জাতি অজ্ঞতা, নীতিহীনতা, দারিদ্র্য, ব্যভিচার ও ঘরোয়া বিবাদ বিসম্বাদে নিমজ্জিত ছিল।
ইরাকের শস্য শ্যামল উর্বর প্রদেশসহ ইয়ামন পর্যন্ত আরবের সমস্ত সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল ইরান সরকারের অধিকৃত ছিল। উত্তরে মূল হেজাজের সীমান্ত পর্যন্ত রোমকদের প্রবল আধিপত্য চলছিল। হেজাজের পুঁজিপতি ইহুদীদের নির্মম শোষণ ও উৎপীড়ন মারাত্মক রূপ ধারণ করেছিল। আরবদেরকে তারা চক্রবৃদ্ধি সুদের জালে জড়িয়ে অক্টোপাসে বেঁধে নিয়েছিল। পূর্ব উপকূলের অপর তীরবর্তী আবিসিনিয়ায় খৃষ্টার রাজত্ব চলছিলো। এ খৃষ্টার সরকারই মাত্র কয়েক বছর পূর্বে মক্কানগরী আক্রমণ করেছিল। হেজাজ ও ইরানের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থানরত ‘‘নাজরান’ জাতি খৃষ্টধর্মের অনুসারী এবং তাদের সাথে অর্থনৈতিক চুক্তিতে আবদ্ধ ছিলো। এভাবে তখন ছোট বড় অসংখ্য প্রকার সমস্যা বর্তমান ছিল। কিন্তু যে ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা বিশ্বমানবতার পথনির্দেশ ও নেতৃত্বের জন্য পাঠিয়েছেন, তিনি তদানীন্তন বিশ্বের এবং তার নিজ দেশের এসব জটিল সমস্যার দিকে মোটেই ভ্রুক্ষেপ করেননি। বরং তিনি সকল দিক হতে দৃষ্টি ফিরিয়ে একমাত্র মূল কথার উপর পর্বতের ন্যায় অটল হয়ে দঁড়িয়েছিলেন এবং উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন- ‘‘আল্লাহ ছাড়া অন্য সব প্রভুত্ব শক্তিকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ কর এবং কেবলমাত্র এক আল্লাহরই দাসত্ব কবুল কর।’’ [ইসলামী বিপ্লবের পথ, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী]
১৫. ইসলামের মূল দাওয়াত
ক. একটি কেন্দ্রবিন্দুর দিকে আহ্বান
অন্যসব সমস্যা থেকে মুখ ফিরিয়ে তিনি এজন্যই একটি মাত্র মূল কথার প্রতি মনোনিবেশ করেছিলেন যে, ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে যে কোন বিপর্যয়ের মূলীভূত কারণ হচ্ছে নিখিল বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালাকে ত্যাগ করে অন্য কাকেও প্রভুত্ব ও নিরংকুশ কর্তৃত্বের অধিকারী মনে করা। আল্লাহ ছাড়া অন্য কাকেও প্রভুত্ব ও কর্তৃত্বের অধিকারী মনে করার মারাত্মক বিষ যতদিন পর্যন্ত ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে দৃঢ়ভাবে বদ্ধমূল হয়ে থাকবে, ততদিন ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে কোন বাহ্যিক সংশোধন প্রচেষ্টাই সফল হতে পারে না, ততদিন ব্যক্তিগত অধঃপতন বা সামাজিক উচ্ছৃংখলতা দূর করাও সম্ভবপর নয়। যেহেতু স্থায়ী ও কার্যকরী সংশোধন প্রচেষ্টার একটি মাত্র উপায় হচ্ছে মানুষকে সম্পূর্ণরূপে সকল প্রকার দাসত্ব মুক্ত করে এক আল্লাহর বন্দেগী ও দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করা, সেহেতু তিনি সেই কেন্দ্রবিন্দুর দিকেই মানুষকে আহ্বান জানিয়েছিলেন। সমগ্র বিশ্ব প্রকৃতিতে মাত্র একজন প্রভু বিধানদাতা, মালিক তিনি- মহান আল্লাহ। প্রভুত্ব বা হুকুম চালাবার ব্যাপারে অন্য কারো কোন হুকুম চলবে না। মানুষ অন্য কারো প্রভুত্ব, দাসত্ব স্বীকার করতে পারে না, কারো আনুগত্য করতে পারে না বা কারো সামনে মাথা নত করতে পারে না। আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ছাড়া আর সবকিছুই এখানে অচল। কোন সরকার, অন্নদাতা, ভাগ্য নিয়ন্তা, প্রার্থনা ও ফরিয়াদ শুনার মত শক্তিমান আর কেউ নেই। সকল শক্তির উৎস আল্লাহ তায়ালা। আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর কর্তৃত্বাধীন। তিনিই একমাত্র রব, সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রক্ষাকর্তা, ক্রমবিকাশদাতা, মালিক প্রভূ ও মাওলা। অন্যসব গোলামী আনুগত্য এবং আইনের বশ্যতা পরিহার করে একমাত্র আল্লাহর গোলাম অনুগত হতে হবে। আল্লাহর নবী সরাসরিভাবে এই বুনিয়াদী আহ্বান জনগণের সামনে পেশ করেছেন।
খ. কোন বাঁকা পথে নয়
আল্লাহর নবীর এই দাওয়াত ছিল অত্যন্ত সরল এবং পরিচ্ছন্ন। এ সম্পর্কে আবুল আ’লা মওদূদী র. বলেন, ‘‘এই দাওয়াতকে কার্যকরী করার জন্য এবং এই ইসলামী আন্দোলনকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য তিনি বাঁকা পথে অগ্রসর হননি। কিংবা প্রথমে সামাজিক বা মানবহিতকর কাজ করে লোকদের উপর প্রভাব বিস্তার করে এ আহ্বান পেশ করার পন্থা অবলম্বন করেননি। রাজনৈতিক আধিপত্য অর্জন করে সরকারী ক্ষমতা দ্বারা তার মতবাদ জনগণের উপর চাপাবার চেষ্টা করেননি। এভাবে বাঁকাচোরা পথ বা কাজ হাসিল করার অবৈধ উপায়ের আশ্রয় নেয়া তিনি মাত্রই পছন্দ করতেন না।’’ [ইসলামী বিপ্লবের পথ, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী]
কেবলমাত্র ইসলামের বিপ্লবী কালেমায় তাওহীদের দাওয়াত যারা কবুল করেন কেবলমাত্র এ মহান সত্যকেই সমগ্র জীবনের কর্মবিধানের বুনিয়াদ বলে যারা গ্রহণ করেন এবং তার ভিত্তিতে যারা এ বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে প্রস্তুত তারাই পারেন ইসলামের বিপ্লবী আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে। ইসলামী আন্দোলনের এ অপরিহার্য বাস্তবতা থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে, তাওহীদের এ বিপ্লবী দাওয়াতের জন্য কোন প্রাথমিক কার্যক্রমের আবশ্যক নেই, বরং তা প্রত্যক্ষভাবেই পেশ করতে হবে।
গ. তাওহীদের বিপ্লবী দাওয়াত
ইসলামী দাওয়াতের এ বিপ্লবী আহ্বানকে অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী ভাষায় বর্ণনা করেছেন তিনি। ‘‘তাওহীদের এ বিপ্লবী ধারণাকে বিশেষ একটি ধর্মীয় মতবাদ মনে করলে ভুল হবে। বস্তুত তা একটি বাস্তব সত্য এবং মৌলিক তত্ত্ব। সাম্প্রতিক কালে মানুষের গোটা জীবন ব্যবস্থাকে মানুষের স্বেচ্ছাচারিতা, অন্য কথায় গায়রুল্লাহর প্রভুত্ব ও খোদায়ীর যে বুনিয়াদ গঠন করা হয়েছে, তাওহীদের এ বিপ্লবী দাওয়াত সেই বুনিয়াদের মূলোৎপাটন করে আল্লাহর একত্ব ও সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে মানব জীবনের এক অভিনব ইমারত রচনা করে। আজও পৃথিবীর চারিদিকে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে ‘‘আশ্হাদু আল্লা ইলাহার’’ ধ্বনি উচ্চারিত হয়ে চারিদিকে মুখরিত করে তুলেছে। এ বিপ্লব বাণীর ঘোষক মুয়াজ্জিন নিজেই জানে না সে কি ঘোষণা করছে। আর শ্রোতারাও তার তাৎপর্য বা উদ্দেশ্য হৃদয়ঙ্গম করছে না। আশ্হাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এই ছোট ঘোষণাটুকুর অর্থ এই যে, আমি উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করছি যে, আল্লাহ ছাড়া আমার কোন বাদশাহ নেই, কোন শাসনকর্তা নেই, কোন গভর্নমেন্ট বা কোন সরকার আমি স্বীকার করি না। আল্লাহর বিধান ব্যতীত কোন আইন শৃখলা আমি মানি না, কোন বিচার আদালতের আওতায় মধ্যে আমি পড়তে বাধ্য নই। কারও আদেশ আমার পক্ষে আদেশ নয়। কোন নিয়ম, শাসন, কোন প্রথাও আমি পালন করে চলতে বাধ্য নই, আল্লাহ ছাড়া কারো বিশেষ কোন বৈষম্যমূলক অধিকার, কারও রাজশক্তি কারো অতি প্রকৃতিক পবিত্রতা ও পাপ হীনতা এবং আরো স্বেচ্ছাচারমূলক উচ্চতর ক্ষমতা আমি আদৌ স্বীকার করি না। এক আল্লাহ ছাড়া বিশ্বভূবনের আর সবকিছুর বিরুদ্ধে আমি স্পষ্টভাবে বিদ্রোহ, সবকিছু থেকেই আমি স্বতন্ত্র, নির্ভীক ও বিমুখ।’’ [ইসলামী বিপ্লবের পথ, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী]
এ নির্ভীক ঘোষণার সাথে সাথে দুনিয়া পূজারী শক্তির উপর হিংস্রতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। অনেক বাধা বিপত্তি এবং জুলুম আসবে। মক্কার বুকে প্রিয় নবী সা.-এর সংগ্রামের সূচনায় অনুরূপ বাধা ও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয়। যাদের উদ্দেশ্যে এ ঘোষণা ছিল তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, এ ঘোষণার মর্মবাণী কি। ফলে তারা শোনামাত্র বিক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদী হয়ে উঠে। ঘোষণাকারীর কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেবার জন্য উদ্যত হয়েছে। তার এ ঘোষণা প্রতিষ্ঠিত কায়েমী স্বার্থবাদী শক্তির উপর প্রচণ্ড আঘাত হানে। ইসলামী শক্তি উত্থানের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত কায়েমী স্বার্থবাদী শক্তি নিজেদের বিলুপ্তির আশংকা ও মৃত্যুর ঘণ্টা ধ্বনি বাজতে দেখে। তাওহীদের বিপ্লবী বাণী ধ্বনিত হওয়ার সংগে সংগে তদানীন্তন সমাজ ব্যবস্থার শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা এক আসন্ন বিপদের ভয়াবহ আশংকায় আতংকগ্রস্থ হয়ে পড়ে। নিজেদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব কলহ, হিংসা-দ্বেষ, স্বার্থের সংঘাত ভুলে রাসূলের মহান আন্দোলনের বিরুদ্ধে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এবং মহানবীর আন্দোলন স্তব্ধ করে দিতে সচেষ্ট হলো। এহেন পরিস্থিতিতে হযরত মুহাম্মদ সা.-এর সংগে যোগ দিয়েছিলেন তারা যাদের মন ছিল নিষ্কলুষ ও স্বচ্ছ। সত্য দ্বীনকে যারা গ্রহণ করেছিল জীবনের উদ্দেশ্য হিসেবে, সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য যারা যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট ও লাঞ্ছনা সহ্য করতে তথা অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে এবং মৃত্যুর সাথে সংগ্রাম করতে সদা প্রস্তুত। সত্যের এ আন্দোলনকে সফল করে তোলার জন্য দৃঢ়, অটল এবং নিষ্ঠাবান যেসব মুজাহিদদের প্রয়োজন ছিলো মহানবী সা- এর পাশে তাদেরই এক মহা সম্মিলন ঘটেছিল।
আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায় বর্ণনা করতে গিয়ে মাওলানা মওদূদী উল্লেখ করেন, ‘‘ক্রমশঃ কাফের মুশরিকদের সাথে সত্যের সৈনিকদের সংগ্রাম প্রচণ্ডরূপ ধারণ করল। ফলে ইসলামী মুজাহিদীনের কারো কারো আয় উপার্জন বন্ধ হয়ে গেল, কাউকে বিতাড়িত হয়ে গৃহহারা হতে হলো। কারো আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও স্বজনগণ তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে তাকে সামাজিকভাবে বর্জন করল। কাউকে নির্মম প্রহার করা হলো, কেউ বা নির্বাসিত বা কারাবন্দী হলো, কেউবা প্রখর রৌদ্র তপ্তময় বালুকারাশির উপর, কেউবা হাটে বাজারে জনবহুল রাজপথে অপমানিত এবং নির্যাতিত হলো, আবার কারো মস্তক চূর্ণ করা হলো। আবার কাউকে সুন্দরী নারী, বিপুল অর্থ, রাজসম্পদ ও আধিপত্য এবং সম্মান প্রতিপত্তি দ্বারা প্রলুব্ধ করে ইসলামী আন্দোলনের বন্ধুর পথ হতে বিরত করার কুটিল ষড়যন্ত্র করা হলো। ইসলামী আন্দোলনের বীর মুজাহিদদের উপর এ ধরণের দুঃসহ বিপদের দুর্ণিবার দিক প্লাবী সয়লাব প্রয়োজনও ছিল অত্যন্ত বেশি, কারণ তা না হলে সত্যের সৈনিকদের আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যেতো না। অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নিখাদ সোনায় পরিণত হওয়ার সুযোগও তাদের জীবনে আসতো না। সর্বোপরি এ ছাড়া সত্য প্রতিষ্ঠার আন্দোলন কোনদিনই মজবুত অনমনীয় হতে পারে না। এর ক্রমিক প্রসার লাভ ও উত্তরোত্তর অগ্রগতিও সম্ভব হতো না।
বস্তুতঃ সত্যের সৈনিকগণ যখন এহেন কঠিন অগ্নি পরীক্ষার সম্মুখীন তখন তাদের অটল, অনড় ও অনমনীয় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সকল প্রকার প্রলোভন, বিপদ, আপদ, আশংকা ও্ আতংক তাদের সংকল্পের সামনে প্রতিহত হতে দেখে সমগ্র দুনিয়া জাহান বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছিল। ইসলামী আন্দোলনের প্রথম অধ্যায়ই এই সংগ্রাম ও দুঃখ-কষ্ট ভোগের প্রধান ফল এই হলো যে, দুর্বল চিত্ত ও সংকল্পে দৃঢ়তাহীন ব্যক্তিগণ বীর মুজাহিদের দলভুক্ত হতে পারলো না, ফলে সমাজের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিগণই এ আন্দোলনের পুরোধা হয়ে যোগদান করলেন এবং প্রকৃতপক্ষে আন্দোলনের সাফল্যের জন্য তাদের প্রয়োজন ছিল সর্বাধিক। যে কেউ এই আন্দোলন যোগদানেচ্ছু হলে তাকে এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হতো। লোক নির্বাচনের এর চাইতে শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি আর কিছুই হতে পারে না। এর ফলে নৈতিক দিক দিয়ে অযোগ্য ব্যক্তিগণ স্বতঃই আন্দোলন হতে বাদ পড়ে গেল।
এতদসত্ত্বেও যারা এ সংগ্রামের পথে অগ্রসর হলোনা, তারা কোন ব্যক্তিগত স্বার্থ ও পারিবারিক কিংবা জাতীয় উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে এতে যোগদান করেননি। এর দুঃখ-কষ্ট ও লাঞ্ছনা সব তারা অকাতরে ভোগ করেছিলেন কেবলমাত্র সত্য ও সততার জন্য, খোদার সন্তুষ্টি লাভের জন্য; এরই জন্য তারা আহত প্রহৃত হয়েছেন। ফলে তাদের মধ্যে প্রকৃত ইসলামী মনোবৃত্তি গড়ে উঠলো। তাদের মধ্যে খালেছ ইসলামী চরিত্র ও স্বভাব প্রকৃতি সৃষ্টি হলো। খোদার ভয় ও এবাদত বন্দেগীতে তাদের নিষ্ঠা পরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে ইসলামের বিপ্লবী ভাবধারা ও অনুপ্রেরণাও অতি স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পেল। এক ব্যক্তি যখন নির্দিষ্ট কোন উদ্দেশ্য সাধনে মনে প্রাণে আত্মনিয়োগ করে এবং সেই পথে অবিশ্রান্তভাবে চেষ্টা-সাধনা, সংগ্রাম, দুঃখ, বিপদ-মুসিবত, হয়রানী, আঘাত, কারাবরণ, অনাহার-অনশন, নির্বাসন প্রভৃতি দূরতিক্রমনীয় পর্যায় অতিক্রম করে সম্মুখে দিকে অবলীলাক্রমে অগ্রসর হতে থাকে তখন সেই নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের গুরুত্ব এবং এর অভ্যন্তরীণ ভাব সৌন্দর্যও তাদের হৃদয়পটে সুস্পষ্ট ও সুপ্রকট হয়ে উঠে। তাদের গোটা ব্যক্তি সত্ত্বাই একটি জীবন্ত উদ্দেশ্যে পরিণত হয়। এ সময় তাদের প্রতি নামায ফরজ করা হয়। নামাজ ফরজ করা হয় এজন্য যে, এর সাহায্যে যেন কর্ম লক্ষ্যের দিকে কর্মীদের প্রকাগ্রতা, গভীর নিষ্ঠা ও ঐকান্তিক আগ্রহ সৃষ্টি হয় এবং তাদের উদ্দেশ্য লাভের সাধনা যেন পরিপূর্ণতা লাভ করে। তাদের চিন্তা ও দৃষ্টি চঞ্চলতা ও অস্থিরতা যেন নামাযের মাধ্যমে দূর হয়। এ নামাযের সাহায্যে তাদের লক্ষ্য ও মানসিক ঝোঁক যেন একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে এসে কেন্দ্রীভূত হয়। জীবন পথে কোন ব্যাপারেই যেন তাদের দৃষ্টি মূল লক্ষ্য থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত না হয়। মনে ও মুখে মহান সত্তাকে তারা আইন রচয়িতা ও একচ্ছত্র বাদশাহ বলে স্বীকার করে নামাযের মধ্য দিয়ে বার বার তার প্রভুত্বের শপথ নেয়ায় তাদের বিশ্বাস যেন অধিকতর মজবুত হয়। এই আন্দোলনে যারা নতুন যোগ দিচ্ছিল, একদিকে এভাবে তাদের ট্রেনিং এবং নৈতিক গঠন হচ্ছিলো, অন্যদিকে এই দ্বন্দ্ব সংগ্রামের ফলে ইসলামী আন্দোলন অধিকতর সম্প্রসারিত হচ্ছিল। দুনিয়ায় মানুষ যখন নিজেদের চোখের সামনে প্রত্যক্ষভাবে দেখতে পায় একদল মানুষ নিরন্তর প্রহার ও আঘাত সহ্য করছে, তখন এর মূল কারণ জানার জন্যে তাদের অত্যন্ত আগ্রহ জন্মে। তারা কেন মার খাচ্ছে, কেন এত দুঃখ-কষ্ট ও নির্যাতন-নিষ্পেষণ ভোগ করছে, তা জানবার জন্য দুনিয়ার মানুষের মনে স্বতঃই ঔৎসুক্য জাগ্রত। ফলে তারা নিশ্চিত জানতে পারত যে তারা কোন নারী, ধন-সম্পদ কিংবা সম্মান ও প্রতিপত্তি লাভের জন্য এ নির্যাতন ভোগ করছে না। কোন ব্যক্তিগত স্বার্থলাভও তাদের উদ্দেশ্য নয়। বস্তুতঃ খোদার এ বান্দাগণ যে মহাসত্য লাভ করেছে, দুনিয়াতে তা প্রচার ও প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করছে বলেই তাদের উপর এরূপ অমানুষিক জুলুমের পাহাড় ভেংগে পড়েছে। এ সত্য উপলব্ধি করেই তারা সে মহান সত্যের সঠিক পরিচয় লাভের জন্য আগ্রহান্বিত হতো। সেই সংগে তারা এও জানতে পারতো যে, সেই সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য একটি বিপ্লবী দল সুসংবদ্ধ হয়ে জেগে উঠেছে। তারা যে সত্যের জন্য দুনিয়ার সব স্বার্থের উপর পদাঘাত করছে। নিজেদের জান মাল, সন্তান ও সম্পত্তি সবকিছুই অকাতরে কোরবানী করেছে। এসব জেনে ও প্রত্যক্ষ দেখতে পেয়ে সকল লোক চক্ষু ম্লান হয়ে যেতো। যাদের মন ও মস্তিষ্কের উপর হতে সকল পর্দা ছিন্ন হয়ে প্রকৃত সত্য তীরের মত তাদের মর্মমূলে প্রবিষ্ট হতো। এজন্যই আমরা দেখতে পাই যে, যেসব লোককে তাদের আজন্ম অনুসৃত আভিজাত্যের গৌরব পূর্বপুরুষের অন্ধ অনুসরণ কিম্বা পার্থিব কোন স্বার্থ অন্ধকারে রেখেছে, কেবল তারাই এদিকে অগ্রসর হতে পারেনি। কিন্তু তারা ব্যতীত তৎকালীন অন্যসব লোকই ইসলামী আন্দোলনের সাথে কোন না কোন প্রকারে জড়িত হয়ে পড়েছিল। প্রত্যেকটি সত্যানুসন্ধিৎসু ব্যক্তিকেই শেষ পর্যন্ত ইসলমী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে হয়েছিল।’’ [ইসলামী বিপ্লবের পথ, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী]