পঞ্চম ধারা
ইসলামী শাসনতন্ত্রের পঞ্চম ধারা ছিলঃ বায়তুলমান আল্লাহর সম্পত্তি এবং মুসলমানদের আমানত। আল্লাহর নির্দেশিত পথ ছাড়া অন্য কোনো পথ দিয়ে জিনিস তার মধ্যে প্রবেশ করা উচিত নয় এবং আল্লাহর পথ ছাড়া অন্য পথে ব্যয়িত হওয়াও উচিত নয়। কোরআনের দৃষ্টিতে এতিমের সম্পত্তিতে তার অভিভাবকের অধিকার যতোটুকু বায়তুল মালের সম্পত্তিতে খলীফাদের অধিকারও ততোটুকু
***********
অর্থঃ যে ব্যক্তি স্বচ্ছল সে যেন (এতিমের মাল থেকে ) নিবৃত্ত থাকে। আর যে অস্বচ্ছল সে যেন ততোটাই পারিশ্রমিক গ্রহণ করে যা ন্যয় সঙ্গত।
খলীফাকে বায়তুল মালের আয়-ব্যয়ের ব্যাপারে এক এক পয়সার হিসেব দিতে হবে এবং জনসাধারণ তাঁর থেকে হিসেব তলব করার পুর্ণ অধিকার রাখে। খোলাফায়ে রাশেদীন এ নীতিকেও পরিপূর্ণ দায়িত্ব সত্যানুরাগীতার সাথে বাস্তবায়িত করে দেখিয়েছেন। তাঁদের কোষাগারে শরীয়তের নির্দ্ধারিত পন্থায় অর্থাগম হতো এবং তাঁর নির্দেশিত পথেই তা ব্যয়িত হতো। তাঁদের মধ্যে যারা বিত্তবান ছিলেন তারা এক পয়সাও পারিশ্রমিক না নিয়ে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করে গেছেন। এমন কি তাঁদের কেউ কেউ নিজের পকেট থেকে জাতির জন্যে অর্থব্যয়ও করেছেন। আর বিনা বেতনে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের সামর্থ যাদের ছিলনা, তাঁরা এই দিবারাত্র পরিশ্রমের বিনিময়ে জীবিকা নির্বাহের জন্যে যে ভাতা গ্রহণ করতেন, তার পরিমাণ এতোই স্বল্প ছিল যে, যে কোনো নিষ্ঠাবান ব্যক্তিই তাদের ন্যায়সঙ্গত পারিশ্রমিকের চাইতে কমই বলবেন। তাঁদের শত্রুরাও এই পরিমাণকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত বলতে সাহস করতো না। এ ছাড়া বায়তুলমালের আয়-ব্যয়ের হিসেবে যে কোনো ব্যক্তি যে কোনো সময় তাঁদের কাছ থেকে চাইতে পারতো এবং তাঁরাও যে কোনো ব্যক্তিকে যে কোনো সময় উত্তর দিতে প্রস্তুত ছিলেন। এক বিরাট মজলিসে একজন সাধারণ লোকও খলীফাকে জিজ্ঞেসা করতে পারতো যে, বায়তুলমালে ইয়ামান থেকে যে চাদর এসেছে তা দৈর্ঘ-প্রস্থেতো এতোখানী নয় যে তা দিয়ে আপনি এতো লম্বা জামা তৈরী করতে পারেন, এই অতিরিক্ত কাপড় আপনি কোথায় পেলেন? কিন্তু যখন খেলাফত রাজতন্ত্রের রূপ পরিগ্রহ করলো তখন বায়তুলমাল আর আল্লাহ্ এবং মুসলমানের অধিকারে থাকলো না, তা হলো বাদশাহর সম্পত্তি। সম্ভাব্য সকল বৈধ ও অবৈধ উপায়ে তাতে অর্থগম হতে লাগলো এবং বৈধ ও অবৈধ উভয় পথেই তা ব্যয়িত হতে লাগলো। তাদের কাছ থেকে এর হিসেব তলব করার সাহস কারুর ছিলনা। গোটা দেশটাই ছিল যেন একটা লা-ওয়ারিশ সম্পত্তি। আর একজন ডাকপিয়ন থেকে নিয়ে রাষ্ট্রপ্রধান পর্যন্ত সরকারের সকল কর্মচারী যে যার সুযোগ মতো তার মধ্যে হাত সাফাই করেছিলো। এ ধারণাই তাদের মন থেকে উঠে গিয়েছিল যে, ক্ষমতা লাভ এমন কোনো পরোয়ানা নয় যার ফলে বেপরোয়া লুটতরাজ তাদের জন্যে হালাল হয়ে যাবে। আর জনগণের সম্পত্তি মাতৃদুগ্ধ নয় যে তাকে তারা বেমালুম হজম করতে থাকবে, এ ব্যাপারে কারুর সম্মুখে জবাবদিহী করতে হবে না।
ষষ্ঠ ধারা
ষষ্ঠ ধারা ছিল এই যেঃ দেশে আইনের (আল্লাহ্ ও রাসূলের আইন) শাসন হবে। কারুর সত্তা আইনের উর্ধে থাকবে না। আইনের সীমা পেরিয়ে বাইরে এসে কাজ করার অধিকার কারুর থাকবে না। একজন সাধারণ লোক থেকে নিয়ে রাষ্ট্রপ্রধান পর্যন্ত সবার উপর একই আইনের অবাধ শাসন চলবে। ন্যায়বিচারের ব্যাপারে কারুর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ প্রদর্শন করা হবে না। ন্যায় বিচার করার ব্যাপারে আদালতগুলোকে পুরোপুরি স্বাধীনতা দেয়া হবে। খোলাফায়ে রাশেদীন এই নীতি অনুসৃতির সর্বোৎকৃষ্ট নমুনা পেশ করেছিলেন। বাদশাহর তুলনায় অনেক বেশী ক্ষমতার অধিকারী হয়েও তাঁরা আল্লাহর আইনের শৃঙ্খলামুক্ত হননি। তাঁদের বন্ধুত্ব বা আত্মীয়তা আইনের সীমা পেরিয়ে কারুর উপকার করতে পারেনি এবং তাঁদের অসন্তুষ্টি আইনের বিরুদ্ধে কাউকে ক্ষতিগ্রস্থ করেনি। জনসাধারণের মধ্য থেকে কেউ যদি তাঁদের ব্যক্তিগত অধিকারে হস্তক্ষেপ করতো, তাহলে একজন সাধারণ মানুষের মতোই তাঁরা আদালতে শরনাপন্ন হতেন। তাঁদের বিরুদ্ধে কারুর কোনো অভিযোগ থাকলে কাজীর নিকট ফরিয়াদ করে তাঁদেরকে বিচারের কাঠগড়ায় হাযির করানো যেতো। অনুরূপভাবে প্রাদেশিক গভর্ণর ও সেনাপতিগণকেও তাঁরা আইনের শৃঙ্খলে আটকিয়ে রেখেছিলেন। আদালতের কার্যে কাজীর উপর প্রভাব বিস্তার করার অধিকার কারুর ছিল না। আইনের সীমা পেরিয়ে বিচার মুক্ত হবার ক্ষমতা কারুর ছিলনা। কিন্তু খেলাফত থেকে রাজতন্ত্রে পদার্পন করার সাথে সাথেই এই নীতি ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো। অতঃপর শুধু বাদশাহ, শাহজাদা, আমীর-উমরাহ, শাসনকর্তা এবং সেনাপতি নয়, শাহী মহলের গোলামবাদীরা পর্যন্ত আইনের উর্ধে উঠে গেলো। জনগণের অর্থ-সম্পত্তি, ইজ্জত, আব্রু গর্দান পর্যন্ত তাদের জন্য হালাল হয়ে গেলো। ইনাসাফের মানদণ্ড হলো দুটো। একটা দুর্বলের জন্য, আরেকটা শক্তিমানের। আদালতের উপর শক্তি প্রয়োগ করা হলো। ন্যায় বিচারক কাজীদের মৃত্যু ঘণ্টা বেজে উঠলো।
এমন কি আল্লাহ্ ভীরু ফকীহগণ কাজীর পদ গ্রহণ করার তুলনায় বেত্রাঘাত এবং জেলখানার শাস্তিবরণকে অধিকতর বাঞ্ছনীয় মনে করলেন। জুলুম ও নির্যাতনকে এড়িয়ে আল্লাহর আযাব ভোগ করাকে তাঁরা পসন্দ করলেন না।
সপ্তম ধারা
অধিকার এবং মর্যাদার দিক দিয়ে পূর্ণ সাম্যের প্রতিষ্ঠা ইসলামী শাসনতন্ত্রের সপ্তম ধারা ছিল। প্রারম্ভিক ইসলামী রাষ্ট্রে এই নীতিকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে সমস্ত শক্তি নিয়োগ করা হয়েছিল। মুসলমানদের মধ্যে দেশ, গোত্র, ভাষা প্রভৃতির পার্থক্য ছিল না। গোত্র এবং বংশের দিক দিয়ে কেউ কারুর চাইতে শ্রেষ্ঠতম মর্যাদার অধিকারী ছিল না। আল্লাহ্ ও রাসূলের অনুগতদের অধিকার ও মর্যাদা ছিল সমান। একজন অন্য জনের চাইতে শ্রেষ্ঠ হতেন শুধু চরিত্র, নৈতিকতা যোগ্যতা এবং জনসেবার কারণে। কিন্তু খেলাফত যখন রাজতন্ত্রের রূপধারণ করলো, তখন সংকীর্ণ বিদ্বেষ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে লাগলো সকল দিক থেকে। শাহী খান্দান এবং তাদের পরিষদের মর্যাদা সব চাইতে বৃদ্ধি পেলো। অন্যান্য বংশের তুলনায় তাদের বংশ অধিকতর অধিকার ও মর্যাদা লাভ করলো। আরবী আজমী বিদ্বেষ জাগ্রত হলো এবং স্বার্থপর আরবদের মধ্যে বংশে বংশে ঘরোয়া প্রতিদ্বন্দ্বীতা ও সংঘর্ষের বীজ দানা বেঁধে উঠলো। এ জিনিষটা ইসলামী সমাজের বিপুল ক্ষতি সাধন করেছে। ইতিহাসই এর জ্বলন্ত সাক্ষ্য।
শাহাদাতের সার্থকতা
ইসলামী খিলাফতের রাজতন্ত্রে রূপান্তরিত করার ফলে এই পরিবর্তনগুলোর আত্মপ্রকাশ ঘটলো। ইয়াযিদের উত্তারাধিকার সূত্রে সিংহাসন দখলের ফলে এই পরিবর্তনের সূত্রপাত হয়েছে ঐতিহাসিক সত্যকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। আবার একথাও অনস্বীকার্য যে, পরিবর্তনের এই প্রারম্ভিক বিন্দু থেকে কিছুদূর অগ্রসর হবার পর অল্প দিনের মধ্যেই রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে উপরোল্লিখিত দুর্ণীতিগুলো আত্মপ্রকাশ করেছিল। এই বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণের সময় যদিও এ দুর্নীতিগুলো পুরোপুরি আত্মপ্রকাশ করেনি। তবুও বিচক্ষণ ব্যক্তিমাত্রই এর পরিণাম অনুভব করতে পারতেন। একথা অনুধাবন করা মোটেই কঠিন ছিল না যে, এই পরিবর্তনের ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় ইসলাম যে পরিবর্তন সাধন করেছিল তা চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এজন্যেই হযরত ইমাম হোসাইন (রাঃ) পেরেশান হয়ে গেলেন। তিনি ফয়সালা করলেন, একটা শক্তিশালি রাষ্ট্রের বিরোধীতা করার যে ভয়ঙ্কর পরিণাম হতে পারে তার সবটুকু বিপদ হাসি মুখে গ্রহণ করেও তাঁকে এই বিপ্লবের প্রতিরোধ করতে হবে। তাঁর প্রচেষ্টার পরিণতি কারুর অজানা নেই। কিন্তু এই বিপদসাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ে আর বীরের মত এর সমগ্র পরিণতিকে গ্রহণ করে নিয়ে ইমাম যে কথা প্রমাণ করে গেছেন তা হলো এই যে, ইসলামী রাষ্ট্রের বুনিয়াদী নীতিগুলোর সংরক্ষণের জন্য মুমিন যদি তাঁর জান কুরবান করে দেয়, তাঁর আত্মীয় পরিজনকে কোরবানী করে, তাহলেও তাঁর উদ্দেশ্যের তুলনায় এবস্তু নেহায়েত কম মূল্যই রাখে। আর এই নীতিগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে উপরোল্লিখিত সাতটি পরিবর্তন ইসলাম ও মুসলমানদের জন্যে কেউ হয়তো তাচ্ছিল্ল ভরে একে নিছক একটা রাজনৈতিক কার্য বলতে পারে, কিন্তু হোসাইন ইবনে আলীর দৃষ্টিতে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এটি ছিল একটি দীনি কর্তব্য। এজন্যে শাহাদাতের জযবা নিয়েই তিনি এ কার্যে প্রাণ উৎসর্গ করেছেন।
— সমাপ্ত —