জননেতা হয়ে উমার বিন আব্দুল আযীয জনতার কাতারে নেমে এলেন
খলীফা সুলাইমানের মৃত্যুর পর উমার বিন আব্দুল আযীয ইসলামী বিশ্বের খলীফার দায়িত্ব নিয়ে দামেস্কের সিংহাসনে বসেন।
খলীফা হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত রাজকীয় প্রাচুর্যের মধ্যে তাঁর জীবন কেটেছে।কিন্তু জনগণের নেতা হবার পর সব প্রাচুর্য তিনি ছুড়ে ফেললেন, নেমে এলেন জনগণের কাতারে।
তিনি খলীফা নির্বাচিত হবার পর খলীফার প্রাসাদের দিকে চলছেন। রাস্তার দুধারে কাতারে কাতারে দাঁড়ানো আছে সৈন্যের দল।
খলীফা জিজ্ঞেস করলেন, ‘এরা কারা?’ উত্তর এলো, ‘এরা আপনার দেহরক্ষী সৈন্য’।
খলীফা বললেন, ‘প্রয়োজন মতো এদের বাইরে পাঠিয়ে দাও। আমার দেহরক্ষীর প্রয়োজন নেই। জনগণের ভালবাসাই আমার প্রতিরক্ষা।’
প্রধান সেনাপতি সশ্রদ্ধ সালাম জানিয়ে তাঁর নির্দেশ পালনের প্রতিশ্রুতি দিলেন।
উমার বিন আব্দুল আযীয প্রাসাদে ঢুকলেন। দেখলেন, সেখানে ৮শ’ দাস তাঁর অপেক্ষায়ে দণ্ডায়মান। জিজ্ঞাসা করে জানলেন,এরা তাঁরই সেবার জন্য।খলীফা প্রধানমন্ত্রীকে বললেন, ‘এদের মুক্ত করে দিন। আমার সেবার জন্য আমার স্ত্রীই যথেষ্ট।’
প্রধানমন্ত্রী তাঁর হুকুম তামিল করলেন।
খলীফা উমার ইবনে আব্দুল আযীযের কান্না
বিশাল ইসলামী সাম্রাজ্যের শক্তিমান খলীফা উমার ইবনে আব্দুল আযীয।দামেস্কে তাঁর রাজধানী। রাজধানীতে থাকলেও তাঁর অতন্দ্রচোখ রাজ্যের খুঁটি-নাটি সব বিষয়ের প্রতি।কিন্তু সব কি তিনি জানতে পারেন? সব সমস্যার সমাধান কি তিনি দিতে পারেন?অপারতার ভয় সব সময় তাঁকে অস্থির করে রাখে।
একদিন খলীফা উমার বিন আব্দুল আযীযের স্ত্রী নামাযের পর খলীফাকে অশ্রুসিক্ত অবস্থায় দেখতে পেয়ে ক্রন্দনের কারণ জানতে চাইলেন। খলীফা বললেন, ‘ওহে ফাতিমা, আমি মুসলমান এবং অন্য ধর্মাবলম্বীদের খাদেম নিযুক্ত হয়েছি। যে কাঙ্গালগণ অনশনগ্রস্ত, যে পীরিতগন অসহায়, যে বস্ত্রহীনগণ দুর্দশাগ্রস্ত, যে উৎপীড়িতগণ নিষ্পেষিত, যে অচেনা-অজানাগণ কারারুদ্ধ এবং যে সকল সম্মানিত বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি তাদের নগণ্য উপার্জন দ্বারা কষ্টে-সৃষ্টে বৃহৎ পরিবারের ভরণ-পোষণ করেন, তাদের বিষয় এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ও দূরবর্তী প্রদেশে অনুরূপ দুর্দশাগ্রস্ত মানবকুলের বিষয়াদি চিন্তা করছিলাম। শেষ বিচারের দিন মহাপ্রভু আমার কাছে হিসেব চাইবেন। সেই জবাবদিহিতে কোন আত্মরক্ষার কৌশলই কাজে লাগবে না। আমি তা স্মরণ করে কাঁদছিলাম।’
খলীফা দিনের পর দিন ডাল খান
বিশাল ইসলামী সাম্রাজ্যের খলীফা উমার বিন আব্দুল আযীয। তাঁর সাম্রাজ্য তখন পূর্বে ভারত থেকে পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর, দক্ষিনে মধ্য আফ্রিকা থেকে উত্তরে স্পেন ও চীন পর্যন্ত বিস্তৃত।
খলীফা উমার ইবনে আব্দুল আযীযের রাজধানী দামেস্ক তখন শক্তি ও সমৃদ্ধিতে দুনিয়ার সেরা।সেই খলীফা উমার বিন আব্দুল আযীযের জীবন ছিল দারিদ্রে ভরা।একদিনের ঘটনা।
সেদিন খলীফার স্ত্রী তাঁর চাকরকে খেতে দিলেন। আর দিলেন শুধু ডাল।নতুন চাকর খাবার দেখে বিস্মিত হল। বিস্ময় ভরা চোখে বলল, ‘এই আপনাদের খাদ্য।’খলীফা পত্নী উত্তরে বললেন, ‘এই সাধারণ খাদ্যই খলীফা দিনের পর দিন গ্রহণ করে যাচ্ছেন।’
ইসলামে রাষ্ট্রের সকল সম্পদের মালিক জনগন, শাসকেরা সে সম্পদের রক্ষক মাত্র।
খলীফা ছেলের মুখ থেকে খেজুর কেড়ে নিয়ে রাজকোষে দিলেন
খলীফা উমার ইবন আবদুল আযীযের কাছে বাইতুলমালের জন্যে কিছু খেজুর এলো। তাঁর শিশুপুত্র সেখান থেকে একটা খেজুর নিয়ে মুখে পুরে দিল। তিনি দেখতে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই তার গাল থেকে খেজুর বের করে বাইতুলমালের ঝুড়িতে রেখে দিলেন। ছেলে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে চলে গেল।
বাড়ি ফিরে খলীফা স্ত্রীর মলিন মুখ দেখে বললেন, ‘ছেলের মুখ থেকে খেজুর কেড়ে নেবার সময় আমার কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু কি করবো বল। বাইতুলমাল জনসাধারণের সম্পত্তি। এতে জনসাধারণ হিসেবে আমারও অংশ আছে। কিন্তু ভাগ হবার পূর্বে কেমন করে আমি তা নিতে পারি?’
আরেক দিনের কথা। সানাআ থেকে একজন মহিলা খলীফার কাছে আর্জি নিয়ে এলেন। সরাসরি খলীফার কাছে না গিয়ে তিনি খলীফার অন্তঃপুরে গেলেন। বারান্দায় বেগমের কাছে বসে নিজের সুখ-দুঃখের কাহিনী বলতে লাগলেন।
এমন সময় বাইরে থেকে এক ব্যক্তি ভেতরে এলো কুয়ার পানি তুলতে। পানির বালতি টানতে টানতে লোকটি বারবার বেগমের দিকে চাইলেন। বিদেশী মহিলার কাছে বড়ই দৃষ্টিকটু লাগল ব্যাপারটা। তিনি বেগমকে বললেন, গোলামটিকে বাইরে যেতে বলছেন না কেন, দেখছেন না আপনার দিকে কেমন বারবার তাকাচ্ছে।বেগম একটু মুচকি হাসলেন।
কিছুক্ষণ পর খলীফার ডাকে বিদেশী মহিলাটি তার কাছে গিয়ে হাজির হলেন। খলীফাকে দেখে তিনি অবাক। এতো সেই ব্যক্তি, জে কুয়ার পানি তুলছিল। হায় হায়, পোশাকে আশাকে তো তার চাইতে গরীব মনে হচ্ছে খলীফাকে।
ঈদে খলীফার ছেলে মেয়ে নতুন জামা-কাপড় পেলনা
দামেস্ক। ইসলামী সাম্রাজ্যের রাজধানী। খলীফা উমার ইবন আবদুল আযীযের শাসনকাল। ঈদের মওসুম।
দামেস্কে ঈদের আনন্দ-উৎসবের সাড়া পড়ে গেছে। আমীর-উমরা, গরীব-মিসকীন সকলেই সাধ্যমত নতুন কাপড়-চোপড় তৈরি করে, রকমারি খাবার বানিয়ে উৎসবের আয়োজনে ব্যস্ত। আমীরদের ছেলে-মেয়েরা রঙিন পোশাক পড়ে আনন্দ করে বেড়াচ্ছে।
খলীফা অন্দর মহলে বসে আছেন। স্ত্রী ফাতিমা এসে উপস্থিত হলেন। স্বামীকে বললেন, ‘ঈদ এসে গেল, কিন্তু ছেলেমেয়েদের নতুন পোশাক তো খরিদ করা হলো না।’
খলীফা বললেন, ‘তাই তো, কিন্তু কি করবো। তুমি যা আশা করছো, তা পূর্ণ করা আমার পক্ষে অসম্ভব। প্রতিদিন খলীফা হিসেবে আমি যা ভাতা পাই তাতে সংসারের দৈনন্দিন খরচই কুলোয় না, তারপর নতুন পোশাক পড়া, সে অসম্ভব। ফাতিমা বললেন, ‘তবে আপনি এক সপ্তাহের ভাতা বাবদ কিছু অর্থ অগ্রিম নিয়ে আমাকে দিন, তাই দিয়ে আমি ছেলেমেয়েদের কাপড় কিনে নেই।’
খলীফা বললেন, ‘তাও সম্ভব নয়। আমি যে এক সপ্তাহ বেঁচে থাকবো তারই বা নিশ্চয়তা কি। আর কালই যে জনগণ আমাকে খলীফার পদ থেকে সরিয়ে দেবে না, তাই বা কি করে বলি। তার চেয়ে এ বিলাস বাসনা অপূর্ণই থেকে যাক- তবু ঋণের দায় থেকে যেন সর্বদা মুক্ত থাকি।’
একজন নাগরিকের অধিকার রক্ষার জন্যে একটি যুদ্ধ
ইসলামী সাম্রাজ্যের খলীফা আবু জাফর আল-মানসুর। প্রবল প্রতাপশালী খলীফা তিনি। তিনি যেমন ভালবাসেন তাঁর রাজ্যকে, তেমনি ভালবাসেন রাজ্যের প্রতিটি নাগরিককে।প্রতিটি নাগরিকের জীবন, সম্পদ ও অধিকার তাঁর কাছে পরম পবিত্র।
একদিন খলীফা আল-মানসুরকে জানানো হলো, একজন মুসলিম মহিলা নোভারী রাজ্যে বন্দী রয়েছে। এই খবর শোনার পরই খলীফা সসৈন্যে নোভারী রাজ্যের দিকে যাত্রা করলেন। নোভারীর রাজা গারসিয়া অদম্য আল-মানসুরের এই অভিযানে ভীত হয়ে পড়লেন এবং আল-মানসুরেরে কাছে দূত পাঠিয়ে বললেন, “খলীফা যে তাকে শাস্তি দিতে আসছেন, তার অপরাধ কি?”
আল-মানসুর গর্জন করে দূতকে বললেন, “কি, আপনার মনিব কি আমার কাছে শপথ করে বলেননি যে, কোন মুসলমান বন্দী তার দেশে নেই। এখন আমি জানতে পেরেছি একজন মুসলিম মহিলা তার দেশে। আমি নোভারী থেকে যাব না যতক্ষণ না আপনার মনিব ঐ মহিলা বন্দিকে আমার হাতে ফেরত দেন।”
এই খবর পেয়ে গারসিয়া সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মহিলা বন্দীকে এবং সেই সাথে খুঁজে পেয়ে আরও দুজন মুসলিম বন্দীকে আল-মানসুরের কাছে ফেরত পাঠালেন এবং শপথ করলেন যে, কোন মুসলিম বন্দীই আর তার দেশে নেই।
বিরুদ্ধে রায় পেয়ে খলীফা পুরস্কৃত করলেন কাজীকে
ইসলামী সাম্রাজ্যের অত্যন্ত শক্তিমান ও প্রতাপশালী খলীফা আল-মানসুর। ঐতিহাসিকরা একবাক্যে তাঁকে নিষ্ঠুরতার প্রতিমূর্তি হিসেবে অভিহিত করেছেন। এ সত্ত্বেও সংযম ও নীতি নিষ্ঠতার জন্যে তিনি ইতিহাসে স্থান রেখে গেছেন।
৭৭৫ খ্রিস্টাব্দের কথা। খলীফা আল-মানসুর রাজধানী বাগদাদ থেকে মদীনায় এলেন। মুহাম্মাদ বিন ইমরান তখন মদীনার কাজী।
কাজী সেদিন তাঁর বিচারাসনে আসীন ছিলেন। এমন সময় একজন উট চালক আদালতে এসে খলীফার বিরুদ্ধে একটি সুস্পষ্ট অভিযোগ উত্থাপন করে সুবিচার প্রার্থনা করল।
অভিযোগ শুনেই কাজী মুহাম্মাদ বিন ইমরান তাঁর সহকারীকে খলীফার নামে কোর্টে হাজির হবার জন্যে লিখিত সমন পাঠাবার নির্দেশ দিলেন। তাঁর সহকারী এই আদেশের ব্যাপারে একটু নরম হবার জন্যে অনুরোধ করলেন। কিন্তু কাজী রাজি হলেন না। অবশেষে তাঁর সহকারী লিখিত সমন পাঠালেন খলীফার কাছে।
খলীফা আল-মানসুর কাজীর সমন পেলেন। সমন পড়ে সভাসদদের বললেন, ‘কাজীর আদালত থেকে সমন পেয়েছি। আমি সেখানে যাচ্ছি, কেউ আমার সাথে যাবে না। এটা আমার ইচ্ছা।’
যথা সময়ে খলীফা কাজীর আদালতে হাজির হলেন। কাজী তাঁর আসন থেকে উঠলেন না। খলীফার প্রতি কোন ভ্রূক্ষেপ না করেই তিনি তাঁর কাজ করে যেতে লাগলেন।
খলীফার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিচার শুরু হলো। কাজীর বিচারে খলীফার বিরুদ্ধে রায় গেল।
যখন বিচারের রায় ঘোষণা করা হলো, খলীফা আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন এবং কাজীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘এই রায়ের জন্য আল্লাহ আপনাকে বিরাট পুরস্কারে পুরস্কৃত করুন। আর আমি আপনার জন্য ১০ হাজার দিরহাম পুরস্কার ঘোষণা করছি।’
উপহার ফিরিয়ে দিলেন উমার ইবনে আবদুল আযীয
বারশ বাহাত্তর বছর আগের কথা। ইসলামী দুনিয়ায় তখন উমাইয়া খলিফাদের শাসন। উমাইয়া বংশের উমার বিন আবদুল আযীয দামেস্কের সিংহাসনে আসীন।
একদিনের ঘটনা। খলীফা উমার ইবনে আবদুল আযীযের কাছে উপহার এলো। আপেলের উপহার। আপেলের পক্কতা এবং সুমিষ্ট গন্ধে খলীফা খুবই খুশী হলেন। আপেল কিছুক্ষণ নেড়ে-চেড়ে তিনি আপেল মালিকের কাছে ফেরত পাঠালেন। সেখানে উপস্থিত একজন এটা দেখে অনুযোগ করে বললেন, ‘খলীফা, মহানবী (সা) তো এরূপ উপহার গ্রহণ করতেন।’ উত্তরে খলীফা বললেন, ‘এরূপ উপহার আল্লাহর নবীর কাছে সত্যই উপহার, কিন্তু আমাদের বেলায় ঘুষ।’
খলীফার উপঢৌকন ও ইমাম আবু হানিফা
স্বেচ্ছাচারী শাসকের অধীনে কোন চাকুরী নেয়া কিংবা তাকে কোন সহযোগিতা করা ইমাম আবু হানিফা ঠিক মনে করতেন না। শাসকদের বিশেষ কোন আনুকূল্যও তিনি চাইতেন না।
খলীফা আল-মানসূর একবার ইমাম আবু হানিফাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি তো আমার উপহার গ্রহণ করেন না।” জবাবে আবু হানিফা বললেন, “আমীরুল মুমিনীন, আপনি নিজের সম্পদ থেকে কবে আমাকে দিয়েছেন আমি গ্রহণ করিনি? আপনি তো মুসলমানদের বাইতুলমাল থেকে আমাকে দিয়েছেন যাতে আমার কোন হক নেই। তাদের প্রতিরক্ষার জন্য আমি লড়িনা। কাজেই একজন সিপাহীর মতো প্রাপ্য আমার নেই। আমি মুসলিম সমাজের কোন শিশু-কিশোর নই যে, তাদের জন্য বরাদ্দ প্রাপ্য আমি বাইতুলনমাল থেকে পাবো। আমি কোন ফকির-মিসকীনও নই যে, তাদের মত অধিকার আমি লাভ করবো।”
ইমাম আবু হানিফা খলীফার কাছে হাত পাতলেন
ইমাম আবু হানিফা (র)-এর একজন মুচি প্রতিবেশী ছিল। মুচি তার ঘরের দরজায় বসে সারাদিন কাজ করতো এবং সারারাত ধরে মদ খেয়ে মাতলামি করতো এবং অশ্লীল হৈচৈ ও গন্ডগোল করে ইমামের মনোযোগ নষ্ট করতো।
এক রাতে ইমাম মুচির ঘর থেকে হৈচৈ শুনলেন না। সে রাতে তিনি নিরিবিলি ইবাদত করতে পারলেন, কিন্তু মনে শান্তি পেলেন না। পরদিন খুব সকালে ইমাম মুচির ঘরে গেলেন এবং মুচির খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারলেন যে, তার মদ খেয়ে মাতলামির জন্যে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে জেলে পুরেছে। খলীফা মানসূর তখন রাষ্ট্র ক্ষমতায়। ইমাম আবু হানিফা (র) কোনদিন কোন ব্যাপারেই খলীফার দ্বারস্থ হননি। বরং খলীফাই মাঝে মাঝে তাঁর দ্বারস্থ হয়েছেন। কিন্তু আজ প্রতিবেশীর বিপদ তাকে অস্থির করে তুলল এবং তিনি দরবারে গিয়ে হাজির হলেন।
দরবারের দ্বাররক্ষকরা মহান অতিথির সম্মানে দ্বার খুলে দিলেন। ইমামকে দেখে দরবারের আমীর-উমরাদের চোখ বিস্ফোরিত হল এবং স্বয়ং খলীফা আসন থেকে উঠে তাঁর দিকে অগ্রসর হলেন। তিনি ইমাম কে নিয়ে তাঁর আসনে বসালেন এবং জানতে চাইলেন, কষ্ট করে তাঁর এ আগমনের কারণ কি?
ইমাম বললেন, ‘আপনার পুলিশ আমার একজন প্রতিবেশীকে গ্রেফতার করে জেলে পুরেছে। আমি তার মুক্তির প্রার্থনা নিয়ে এসেছি।’খলীফা একটু চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, ‘হে সম্মানিত ইমাম, শুধু তাকে নয়, আপনার সম্মানে ঐ জেলের সবাইকে আমি মুক্তি দিলাম।’
ইমাম আবু হানিফা (র) তাঁর প্রতিবেশীকে নিয়ে ফিরে এলেন। প্রতিবেশী ঐ মুচি এরপর আর কোনদিন মদ স্পর্শ করেনি।
চাকুরীর চেয়ে শাস্তিই পছন্দ করলেন ইমাম আবু হানিফা
খলীফা আল-মানসুর ইমাম আবু হানিফাকে উচ্চ পদমর্যাদা দান করে তাঁকে বশীভূত করতে চাইলেন। তিনি তাঁকে প্রধান বিচারপতির পদে নিযুক্ত করলেন। কিন্তু ইমাম সঙ্গে সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করলেন। খলীফা অপমানিত বোধ করলেন এবং ভীষণ ক্রুদ্ধ হলেন। সরকারী নির্দেশ না মানার অভিযোগে ইমাম কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হলেন। শাস্তি হিসাবে শাহী জল্লাদ তাঁকে নির্মমভাবে প্রহার করলো। তিরিশটি কোড়ার আঘাত তাঁর পিঠে করা হল। শরীর তাঁর ফেটে গেল। শিরাগুলো ছিঁড়ে রক্তের স্রোত বইল দেহ থেকে। খলীফা আল-মানসুরের চাচা খলীফাকে তিরস্কার করে বললেন, ‘হায় হায়! তুমি এ কি করলে, এক লাখ উন্মক্ত তরবারি তোমার মাথার উপর বিছিয়ে নিলে! আবু হানীফা হচ্ছে ইরাকের ফকীহ, সমস্ত পূর্ব ও পশ্চিমের তথা সারা বিশ্বের ইমাম।’
এ কথায় খলীফা আল- মানসুর লজ্জিত হলেন এবং তিনি ক্ষতিপূরণ দিতে চাইলেন। প্রত্যেক কোড়ার জন্য এক হাজার দিরহাম হিসেবে তিরিশ হাজার দিরহাম তাঁর কাছে পাঠালেন। কিন্তু তিনি তা নিতে চাইলেন না। বলা হলো, ‘এগুলো আপনি নিজে না রাখেন খয়রাত করে দিন।’ ইমাম জবাব দিলেন, ‘খলীফার কাছে কি কোন হালাল অর্থ আছে যা নিয়ে আমি খয়রাত করবো?’
সেনাপতি তারিক ফেরার জাহাজ পুড়িয়ে দিলেন
স্পেনের আকাসে-বাতাসে তখন গথিক শাসনে নিষ্পেষিত মানুষের আর্তনাদ। স্পেনের অত্যাচারিত জনগণ গোপনে মুসলিম সেনাধ্যক্ষ মূসার নিকট আবেদন পাঠাল, অত্যাচারের হাত থেকে আমাদের ত্রাণ করুন। মূসা ছিলেন উত্তর আফ্রিকার খলীফা ওয়ালিদের প্রতিনিধি। ৭১১ সালে মূসার আহবানে তারিক সাগরের তীরে এক পর্বতের বুকে এসে পৌঁছলেন। তারিকের নাম বহন করে আজ পর্যন্ত এই স্থানে জাবালে তারিক (তারিকের পর্বত) বা জিব্রালটার নামে খ্যাত। সাগর পার হয়ে তারিক স্পেনের ভূমি স্পর্শ করলেন। নবসূর্যের রশ্মিপাত এই প্রথম স্পেনের ভূমিদেশকে অভিনন্দিত করল।
স্পেনরাজ রডারিক এই মুষ্টিমেয় মুর সৈন্যের আবির্ভাবে তিলমাত্র বিচলিত হলেন না। তাঁর বিপুল সৈন্যসামন্ত যে অতি সহজেই এ নবাগত মুরদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলবে সে বিষয়ে তাঁর সন্দেহ ছিলনা। তারিক দেখলেন, তাঁর দুঃসাহসী রোমাঞ্চপ্রিয় বীর সৈনিকদের মনেও দ্বিধা উপস্থিত হয়েছে। স্পেনের এত সৈন্যবল, তাঁর সম্মুখে কি তারা? তারিক সৈন্যদের এই বিচলিত ভাব দেখে এক অদ্ভুত কাজ করে বসলেন। যে সকল তরীতে তিনি জিব্রালটার প্রণালী পার হয়েছিলেন,তা সমস্ত নষ্ট করে ফেললেন।
তিনি পিছনের পথ বন্ধ করে মুর সৈন্যদের সম্বোধন করে বললেন, ‘বন্ধুগণ, অনন্ত গভীর সমুদ্র আমাদের পিছনে গর্জন করে চলছে। আজ যদি কাপুরুষের মত ফিরে যাই তবে সাগরের অতলগর্ভে আমাদের ডুবে যেতে হবে। আর যদি দেশ, জাতি ও ধর্মের গৌরব রক্ষা করে সত্যের পতাকা উড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে চলে জয়লাভ করি, তবে জয়মালা আমাদের বরণ করে নেবে। নয়ত মৃত্যু বরণ করে শহীদের দরজা লাভ করব। এই জিবন-মরণ সংগ্রামে কে আমার অনুগামী হবে’
সকলেই সেনাপতির আহবানে এক বাক্যে সম্মতি জানালো। ‘আল্লাহু আকবর’ আল্লাহ মহান- এই ধ্বনি করতে করতে মুর সৈন্য বিপুল স্পেনীয় বাহিনীর মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লো। সে প্রচন্ড আক্রমণের তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে স্পেন বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলো।
স্পেন বিজয়ী তারিকের অপূর্ব শৌর্যবীর্য ও সাহস দেখে স্পেন সেনাপতি থিওডমির বিস্মিত ও স্তম্ভিত হয়ে রাজা রডারিককে লিখে পাঠালেন, “সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেও এই অদ্ভুত শৌর্যবীর্যের অধিকারী নবাগতদের অগ্রগতি আমি কিছুতেই রোধ করতে পারলাম না।”
আল-মানসুরের এক বিজয় অভিযান
একদা স্পেনের মুসলিম সেনাপতি আল-মানসূর তাঁর এক অভিযানে একটি সংকীর্ণ এলাকা দিয়ে খৃষ্টান এলাকায় ঢুকে গেলেন। তাঁর যাবার পরেই খৃস্টানরা সে এলাকা দখল করে ফেলল। মুসলিম বাহিনী দৃশ্যত অবরুদ্ধ অবস্থায় ভীষণ বিপদে পড়ে গেল।
কিন্তু অদম্য মনোবলের অধিকারী আল-মানসূর অধিকৃত এলাকায় নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি উঠাবার নির্দেশ দিলেন এবং সৈন্যদের চাষাবাদে লাগালেন। খৃস্টানরা মুসলিম সেনাপতির এ কাণ্ড দেখে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলো। আল-মানসূর বললেন, সৈন্যরা বললো যে, ‘বাড়ী ফেরার আগে তারা কিছু চায়। অবশ্য আর সময় ওরা পাবেনা- অভিযানের সময় হয়েছে।’
মুসলিম সেনাপতির এমন নিশ্চিত, অবিচলিত ও দৃঢ়তাপূর্ণ উক্তি শুনে খৃস্টানরা ভয় পেয়ে গেল। তারা আল-মানসুরের অনুকূল শর্তে সন্ধি করলো এবং তারা মুসলিম সৈন্যদের ভারবহনকারী অনেক পশু সরবরাহ করে তাদের স্বদেশ যাত্রাকে সহজ ও আরামদায়ক করে দিল।
শাসক আল-মানসূর প্রিয় ঢাল রক্ষকের বিচার করলেন
স্পেনের নাবালক সুলতান দ্বিতীয় হিশামের সময় রাজ্যের প্রকৃত শাসক ছিলেন আল-মানসূর। তাঁর কৃতিত্বের জন্য ঐতিহাসিকরা তাঁকে ‘দশম শতাব্দীর বিসমার্ক’ বলে অভিহিত করেছেন। ঐতিহাসিক ডোজি বলেছেন, ‘শুধু দেশ নয়, সভ্যতাও তাঁর কাছে ঋণী।’
আল-মানসূর ন্যায়ে বিচারক হিসেবেও ছিলেন বিখ্যাত। বিচারে তিনি ব্যাক্তিকে দেখতেন না, দেখতেন ন্যায়-নীতিকে।
একদিনের ঘটনা। একজন সাধারণ মানুষ আল-মানসূরের কাছে গিয়ে অভিযোগ করলো, ‘হে ন্যায়বিচারক , আপনার ঢাল রক্ষক, যাকে আপনি প্রভূত সম্মান দিয়েছেন, আমার সাথে চুক্তি ভঙ্গ করেছে। বিচারের জন্য কাজীর এজলাসেও তাকে পাওয়া যায়নি।’
আল-মানসূর চিৎকার করে বললেন, ‘কি! সে কোর্টে হাযির হতে অস্বীকার করেছে। আর কাজী তাকে হাযির হতে বাধ্য করেনি?’ আল-মানসূর ঢালরক্ষককে বললেন, ‘তুমি তোমার পরবর্তী লোককে তোমার দায়িত্ব দিয়ে বিনীতভাবে গিয়ে কাজীর দরবারে হাযির হও।’ তারপর তিনি পুলিশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই দুই লোককে কাজীর কাছে নিয়ে যাও। কাজীকে গিয়ে বলো, আমার ঢালরক্ষক একজনের সাথে চুক্তি ভঙ্গ করেছে, তার উপযুক্ত শাস্তি আমি চাই।’
বাদী লোকটি তার মামলায় জিতে গেল। সে ধন্যবাদ জানানোর জন্য আল-মানসূরের কাছে এলো। আল-মানসূর বললেন, ‘তোমার ধন্যবাদ থেকে আমাকে রক্ষা করো। ভাল, তুমি মামলা জিতেছ এবং সন্তুষ্ট হতে পেরেছ। কিন্তু আমি সন্তুষ্ট হতে পারছিনা। আমার চাকরিতে থেকে যে আইন সে লঙ্ঘন করেছে, তার শাস্তি তার বাকি আছে।’
বিবেক যখন সচেতন থাকে
একদা স্পেনের শাসক আল-মানসূর কিছু বন্দীর প্রতি ক্ষমা ঘোষণার হুকুম দিলেন। সেই বন্দীদের তালিকার প্রতি তিনি যখন নজর বুলাচ্ছিলেন, তখন তালিকার একটি নামের উপর তার চোখ আটকে গেল। ঐ লোকটির সাথে তাঁর প্রবল শত্রুতা ছিল। তিনি তৎক্ষণাৎ এ বন্দীর নামের পাশে লিখে দিলেন, মৃত্যু যতদিন একে গ্রাস না করে ততদিন একে বন্দী করে রাখ।
কিন্তু সে রাতে আল-মানসূর ঘুমাতে পারলেন না। বিবেকের দংশনে তিনি ক্ষত-বিক্ষত হতে লাগলেন। আধা-ঘুম, আধা-জাগরণের মধ্যে তিনি দেখলেন, কে একজন তাঁকে বলছে, ‘সেই মানুষটিকে ছেড়ে দাও অথবা ঐ লোকটির প্রতি যে অবিচার করেছ তার জরিমানা আদায় কর।’
অবশেষে আল-মানসূর ঐ রাতেই লোকটির ফাইল আনিয়ে নিলেন এবং তাতে এই নির্দেশ লিখলেনঃ “বন্দী মুক্ত। এই বন্দীর মুক্তির জন্য সব প্রশংসা আল্লাহর।”
তাউস এবং শাসকের একটি চাদর
তাউস ইবনে কাইসান ছিলেন একজন বড় আলেমে দ্বীন। ইয়েমেনের কোন এক শহরে তিনি বসবাস করতেন। শাসক ও ক্ষমতাসীনদের অনুগ্রহ কখনো বরদাশত করতেন না তিনি।
একবার তিনি ওহাব ইবনে মাজবাহর সাথে হাজ্জাত ইবনে ইউসুফের ভ্রাতা মুহাম্মাদ ইবনে ইউসুফের ওখানে যান। শীতের মৌসুম। মুহাম্মাদ ইবনে ইউসুফ তাঁর শরীরে একটা চাদর পড়িয়ে দিলেন। কিন্তু সে চাদর তিনি শরীর থেকে ফেলে দিলেন। মুহাম্মাদ ক্রোধে ফুলে উঠলেন। কিন্তু তাউস তার কোন পরওয়াই করলেন না।
সেখান থেকে বিদায়ের পর ওহাব ইবনে মাজবাহ বললেন, ‘আপনি অন্যায় করেছেন। চাদর আপনার প্রয়োজন না থাকলেও মুহাম্মাদ ইবনে ইউসুফের ক্রোধ থেকে লোকদের বাঁচানোর জন্য তখন চাদরটা গায়ে রাখাই ভাল ছিল। পড়ে তা বিক্রি করে মিসকিনদের মধ্যে তার মূল্য বণ্টন করে দিতে পারতেন।’
তাউস বললেন, ‘তুমি যা স্বাভাবিক তা বলেছ, কিন্তু তুমি কি জান না, আজ যদি আমি এ চাদর গ্রহণ করতাম তবে আমার এ কাজ জনগণের জন্য সনদ ও দলিলে পরিনত হতো?’