ঐতিহাসিক ওয়াকেদি এবং খলীফা মামুনের দানশীলতা
আরব ঐতিহাসিক ওয়াকেদি আব্বাসীয় খলীফা মামুনের অধীনে একজন বিচারক ছিলেন। তিনি তাঁর দানশীলতার জন্যে বিখ্যাত ছিলেন- যেমন মামুন ছিলেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিরাট সহযোগী।
এমনকি ওয়াকেদি ঋণ দান করতেন। এইভাবে তিনি বিরাট ঋণে জড়িয়ে পড়লেন। একদিন ওয়াকেদি মামুনকে লিখলেন, ‘আমি আমর ঋণ নিয়ে বড় বিপদে পড়েছি।’
খলীফা মামুন তাঁর স্বহস্তে লিখিত পত্রে তাঁকে বললেন, ‘আপনার দুটি বড় গুন রয়েছেঃ একটা হলো দানের হাত, অপরটি প্রয়োজন। প্রথম গুণটি আপনাকে অপরিমিত খরচে বাধ্য করে। আর দ্বিতীয়টি আপনার যা ঋণ বা প্রয়োজন তার একটি অংশমাত্র প্রকাশে সুযোগ দিয়েছে। তাই আমি নির্দেশ দিয়েছি যা আপনি চেয়েছেন তার দ্বিগুণ আপনাকে দেবার জন্য। এ দিয়েও যদি আপনার প্রয়োজন পূরণ না হয়, তাহলে দোষ আপনার। আর যদি প্রয়োজন পূরণে যথেষ্ট হয়ে যায়, তাহলে আগের চেয়েও মুক্তহস্ত হতে আপনার বাঁধা নেই। কারণ আল্লাহ দানশীলতাকে ভালবাসেন।’
রাজ্যের পরিবর্তে পুস্তক
অষ্টম শতকের শেষ ভাগ।পূর্ব রোম সাম্রাজ্যের সিংহাসনে আরোহণ করেছেন নিসোফোরাস। শক্তিগর্বে অন্ধ হয়ে তিনি বাগদাদের খলীফাকে পূর্ব নির্ধারিত কর দেয়া বন্ধ করে দিলেন। কর বন্ধ করেই তিনি ক্ষান্ত হলেন না। এক ঔদ্ধত্যপূর্ণ পত্রে তিনি লিখলেন, ‘পূর্বে আপনাকে যে সমস্ত মনি-মুক্তা দেয়া হয়েছে তা অবিলম্বে ফেরত পাঠাবেন। নয়ত অস্ত্রই এর মীমাংসা করবে।’
খলীফা উত্তরে শুধু লিখলেন, ‘চিঠির উত্তর চোখেই দেখতে পাবে।’ নিসোফোরাসের পত্রের উত্তর দিতে খলীফা হারুনুর রশীদ সেই দিনই বিপুল সৈন্য বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হলেন।
হেকক্লিয়াতে ভীষণ যুদ্ধ হলো। খৃষ্টান শক্তি শোচনীয় পরাজয় বরণ করলো। নিসোফোরাস ভীত হয়ে পূর্বের চাইতে অধিক কর দিতে সম্মত হয়ে সন্ধি ভিক্ষা করলেন। খলীফা নিসোফোরাসের রাজ্য ততদিনে প্রায় অর্ধেক গ্রাস করে ফেলেছেন। তবু তিনি এক শর্তে সন্ধি করতে রাজি হলেন।
এক অপূর্ব শর্ত। পৃথিবীর কোন যুদ্ধে এরূপ শর্তে সন্ধি হয়নি। খলীফা বলে পাঠালেন, ‘আপনার রাজ্যে সাহিত্য ও বিজ্ঞান সম্বন্ধে যে সমস্ত পুস্তক আছে তার এক একটি কপি আমাকে পাঠিয়ে দিবেন। পরিবর্তে আমি আপনার রাজ্যের অর্ধেক অংশ আপনাকে ফিরিয়ে দেব।’
রাজ্যের পরিবর্তে পুস্তক। অদ্ভুত শর্ত। কিন্তু জ্ঞানের সাধক বাগদাদের খলীফার পক্ষেই এইরূপ শর্ত প্রদান সম্ভব। খলীফা এশিয়া মাইনরে দলে দলে পণ্ডিত পাঠালেন। বহুদিনের পরিশ্রমের পরে তারা খলীফাকে বহু মূল্যবান পুস্তক পাঠিয়ে দিলেন।
আসল রাজ্যতো এ ব্যক্তিরই, হারুনের নয়
রাজার থাকে রাজ্য, থাকে শক্তি। রাজাকে মান্য করে কেউ ইচ্ছায়, অনেকেই অনিচ্ছায়। যেখানে ভয় মান্য করার মানদণ্ড, সেখানে ভালবাসা থাকেনা। জ্ঞানীরা, আলেমরা, নিঃস্বার্থ ধর্মনেতারা রাজ্যহীন রাজা। মানুষের হৃদয়ে তাদের সাম্রাজ্য, তাই মানুষের হৃদয়ে সীমাহীন ভালবাসা তাদেরই জন্যে। যা রাজা-বাদশারা কল্পনা করতে পারেনা।
একবার বাদশা হারুন-অর-রশীদ রাজকীয় জাঁকজমক ও শান-শওকতের সাথে রুক শহরে অবস্থান করছিলেন। এমন সময় বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফকীহ আবদুল্লাহ ইবনে মুবারকের আগমন ঘটল শহরে। শহরের সমস্ত লোক তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য বের হয়ে আসল। ভিড়ের চাপে অনেকের জুতা ছিঁড়ে গেল। বাদশাহর এক বাদী উপর থেকে এ দৃশ্য দেখছিল। সে জিজ্ঞেস করল, ‘ব্যাপার কি? কে এলো শহরে?’ কে একজন তাঁকে জানাল, ‘খুরাসান থেকে আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক নামে একজন আলিম এসেছেন।’ বাদী বলল, ‘আসল রাজত্ব তো এই ব্যক্তির- হারুনের নয়। কারণ পুলিশ ও সহকারী কর্মচারী ছাড়া বাদশাহর জন্য একটি লোকও জমা করা যায় না। অথচ এ ব্যক্তির আগমনে সমস্ত শহরটাই ভেঙ্গে পরেছে।’
সন্তানের প্রতি সুলতান সালাহ উদ্দীন
সুলতান গাজী সালাহ উদ্দীন তাঁর পুত্র জহিরকে প্রাদেশিক শাসনকর্তার পদে নিয়োগের সময় বলেনঃ
“হে আমার পুত্র, আমি তোমার মনোযোগকে সমস্ত মঙ্গলের উৎস আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দিকে আকর্ষণ করছি। যেখানে বা যে কাজে তাঁর মঞ্জুরি আছে, সেখানেই শান্তি নিহিত। রক্তপাত থেকে বিরত থাকবে। এর উপর কখনও ভরসা করো না। কারণ যে রক্ত প্রবাহিত হয় তা কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না করে যায়না। তোমরা জনগণের মন জয় করার চেষ্টা করবে, তাদের উন্নতির জন্য কাজ করবে। স্মরণ রেখ, তাদের মঙ্গল বিধানের জন্যই আল্লাহ তোমাকে এই দায়িত্ব দিয়েছেন, আমার নিয়োগও এই জন্যই। আমি যদি উল্লেখযোগ্য কোনও কারণে হয়ে থাকি, তাহলে তা এই জন্যই যে, আমি ভদ্রতা ও দয়ার মাধ্যমে যথাসাধ্য মানুষের হৃদয় জয় করতে চেষ্টা করেছি।”
মিসরের এক কাজীর কথা
ইসলামী সাম্রাজ্যের রাজধানী তখন বাগদাদ। আব্বাসীয় খলীফা আল-মানসূরের তখন শাসনকাল। আল-মানসূরের অধীনে মিসর তখন সমৃদ্ধশালী ও সুখী একটি প্রদেশ। ইসলামী বিচার-ব্যবস্থার তখনও স্বর্ণযুগ।
সে সময় মিসরে এক কাজী ছিলেন। ৭৬১ খৃষ্টাব্দে তিনি তাঁর পদে নিয়োগ লাভ করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধর্মভীরু। তিনি সরকারী কাজের জন্য যে বেতন নিতেন, তা খরচের ব্যাপারে খুব হুঁশিয়ার ছিলেন। তিনি মনে করতেন, যে বেতন তিনি নেন, সেটা তাঁর সরকারী কাজের সময়ের জন্যে। সুতরাং তিনি যে সময় নিজের কাজ করতেন, সে সময়ের জন্য বেতন নেয়াকে তিনি হক মনে করতেন না। তাই দেখা যেত, তিনি যখন নিজের কাপড় কাচতেন কিংবা কোন জানাজায় যেতেন বা নিজের কোন কাজ করতেন, তখন হিসেব করে সে সময়ের পয়সা বেতন থেকে বাদ দিতেন।
তিনি তাঁর বিচার কাজের অবসরে, প্রতিদিন দু’টি করে ঘোড়ার মুখের সাজ তৈরি করতেন। দু’টি সাজের একটির বিক্রয়লব্ধ টাকা তিনি নিজের জন্য খরচ করতেন, অপর টাকা আলেকজান্দ্রিয়ায় তাঁর এক বন্ধুর নামে পাঠাতেন, যিনি কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদে লিপ্ত ছিলেন।
সুলতান সালাহ উদ্দীন এবং এক শত্রু শিশু
মুসলিম এবং খৃষ্টান ক্রুসেডারদের মধ্যে আক্রায় তখন ঘোরতর যুদ্ধ চলছিল। এ সময় একদিন একজন খৃষ্টান মহিলা কাঁদতে কাঁদতে তাঁবু থেকে বেরিয়ে সুলতান সালাহ উদ্দীনের তাঁবুর দিকে ধাবিত হলো। কিন্তু তাঁবুতে পৌঁছার আগেই প্রহরীরা তাকে থামিয়ে দিল। মহিলাটি প্রহরীর প্রতি করুন আবেদন জানিয়ে বলল, ‘আমাকে সুলতানের নিকট নিয়ে চলুন।’ প্রহরী মহিলার আবেদনে নরম হয়ে সুলতানের কাছে নিয়ে গেল। ক্রন্দনরত মহিলাকে সুলতান জিজ্ঞেস করলেন, তার কি হয়েছে। মহিলাটি অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, “আমার শিশু সন্তানকে মুসলিম সৈন্যরা ধরে এনেছে।” এ কথা শুনে সুলতান খুব ব্যথিত হলেন এবং শিশুটিকে খুঁজে এনে দেয়ার জন্য তৎক্ষণাৎ নির্দেশ দিলেন। সহজে শিশুটি পাওয়া গেল। সন্তানকে ফেরত পেয়ে মা আনন্দিত হলো। প্রহরীরা তখন সন্তানসহ মহিলাকে খৃষ্টান তাঁবুতে পৌঁছে দিল।
একজন শাহজাদার প্রকৃত কাজ
গজনীর সুলতান সবুক্তগীন। মাহমুদ তাঁর সন্তান। গজনীর কাছে শাহজাদা মাহমুদ একটি মনোরম বিনোদন প্রাসাদ তৈরি করেছিলেন। যখন এর নির্মাণ সমাপ্ত প্রায়, তখন একদিন তিনি তাঁর পিতা সবুক্তগীনকে এই বাড়িটি দেখার জন্য আমন্ত্রণ করলেন।
তাঁর পিতা সবুক্তগীন সভাসদসহ সেই প্রাসাদ দেখতে এলেন। আমন্ত্রিতদের সকলেই সেই প্রাসাদের বিভিন্ন দিক, বিভিন্ন কাজের ভূয়সী প্রশংসা করলেন। কিন্তু মাহমুদ পিতার মন্তব্য কি তা জানার জন্য উদগ্রীব ছিলেন। প্রাসাদ পরিদর্শন শেষে সুলতান সবুক্তগীন বললেন, “আমার বিবেচনায় গোটা জিনিসটাই একটা খেলনা। দেশের যে কোন প্রজাই অর্থ খরচ করে এ ধরনের প্রাসাদ গড়তে পারে। একজন শাহজাদার প্রকৃত কাজ হলো সুকর্ম-সুখ্যাতির এমন ভিত রচনা করা যা যুগ যুগ ধরে অনুকরণ করা হবে এবং কারও পক্ষে অনায়াসে যা অতিক্রম করা দুরূহ হবে।”
এই শাহাজাদা মাহমুদই পরবর্তীকালের মহান বিজেতা সুলতান মাহমুদ।
ফকিরের দরবারেই সুলতান হাযির হলেন
গজনীর সুলতান মাহমুদ একদিন সমরখন্দের খারকান গ্রামে গেলেন। শেখ আবুল হাসান নামে একজন বুজুর্গ ব্যক্তিকে অনুরোধ করে পাঠালেন তাঁর তাঁবুতে আসার জন্য। সুলতানের বেয়ারা যখন সুলতানের বার্তাটি ঐ বুজুর্গ ব্যক্তিকে দিলেন, তখন তিনি বললেন, ‘আমি উপরের মহারাজাধিরাজের হুকুম পালনে এতই ব্যস্ত যে, অধঃস্তন এই রাজার হুকুম পালনের জন্য আমার সময় নেই বলে আমি দুঃখিত।’
সুলতান মাহমুদ যখন এই খবর শুনলেন তিনি অভিভূত হয়ে পড়লেন এবং বললেন, ‘উঠ তোমরা, আমরাই তাঁর কাছে যাব। তিনি এখানে আসবেন এমন মানুষ তিনি নন।’
সুলতান শেখ আবুল হাসানের কাছে গেলেন এবং তাঁকে অভিনন্দন জানালেন। শেখ স্বাগত জানালেন সুলতানকে। কিন্তু আসন থেকে উঠলেন না। সুলতান তাঁর কাছে কিছু উপদেশ চাইলেন। শেখ বললেন, ‘মসজিদে নামায পড়বে, দান করবে এবং নিজ জনগণকে ভালবাসবে।’
সুলতান তাঁর আশীর্বাদ চাইলেন। শেখ বললেন, ‘তুমি সর্বশেষ মাহমুদের (প্রসংসিতের) সাথে থাক।’ সুলতান এক থলে টাকা শেখের সামনে রাখলেন। শেখ এক খণ্ড বার্লির রুটি তুলে নিয়ে সুলতানকে বললেন, ‘খাও।’ সুলতান মুখ ভরে রুটি চিবালেন কিন্তু গিলতে পারলেন না। শেখ বললেন, ‘এই বার্লির রুটি যেমন তোমার গলায় বাধছে, তোমার স্বর্ণ মুদ্রাগুলো তেমনি আমার গলায় বাধবে। এই স্বর্ণ মুদ্রাগুলো নিয়ে যাও এবং দরিদ্রের মধ্যে বিলি করে দাও।’
হাকাম উত্তপ্ত উত্তেজনার মধ্যে এক খণ্ড বরফ
৮১৪ খৃষ্টাব্দের কথা। হাকাম তখন স্পেনের শাসক। কর্ডোভায় এক ভয়ানক বিদ্রোহ দেখা দিল। বিদ্রোহীরা সমুদ্র গর্জনের মত ভয়ানক রূপ নিয়ে এগিয়ে আসছে।
হাকাম ঘোড়সওয়ার এক বাহিনীকে নির্দেশ দিলেন ওদের প্রতিরোধ করতে। কিন্তু তারা পরাজিত হয়ে ফিরে এলো। তাঁর প্রাসাদের রক্ষীরাও হতাশ ও আতংকিত হয়ে পড়ল। কিন্তু হাকামকে দেখা গেল অত্যন্ত শান্ত। চারদিকের উত্তপ্ত উত্তেজনার মধ্যে যেন তিনি একখণ্ড বরফ। দরবারে বসেই তিনি তাঁর হেরেম থেকে মৃগনাভি আনালেন। তারপর তিনি চুল ও দাড়ি সুবিন্যস্ত করে তাতে মৃগনাভি লাগালেন।
তাঁর ঘনিষ্ঠ একজন সহচর চিৎকার করে বলে উঠল, ‘জাঁহাপনা, আমাকে মাফ করুন, নিজেকে সুগন্ধচর্চিত করার আশ্চর্য এক সময় আপনি বেছে নিয়েছেন। যে বিপদ আমাদের আতংকিত করছে তা কি আপনি দেখতে পাচ্ছেন না?’
হাকাম ধমক দিলেন, ‘চুপ কর বোকা, যদি আমার মুখ মাথা সুগন্ধচর্চিত না করি, তাহলে কেমন করে বিদ্রোহীরা শত মাথার মধ্যে আমার মাথা চিহ্নিত করবে?’
তারপর হাকাম পূর্ণভাবে অস্ত্রসজ্জিত হয়ে সিংহাসন থেকে নামলেন। ধীর ও শান্তভাবে সেনাবাহিনী পরিদর্শন করলেন। তারপর তিনি তাঁর সৈন্যদের ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিলেন। বিদ্রোহীরা ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পরাজিত হলো ও পশ্চাদপসরণ করল।
সুলতান মাহমুদ বাতি নিভিয়ে অপরাধীর শিরচ্ছেদ করলেন
সুলতান মাহমুদ ছিলেন পরাক্রমশালী শাসক এবং অতুলনীয় বিত্তবৈভবের মালিক। কিন্তু শক্তি ও বিত্ত তাঁকে স্বেচ্ছাচারী করে তোলেনি। ন্যায়বিচারকে তিনি ব্যক্তিগত ইছছা- অনিচ্ছার উর্ধে স্থান দিতেন।
একবার এক ব্যক্তি সুলতান মাহমুদের কাছে এসে নালিশ করল, তার সুন্দরী স্ত্রীর প্রতি আসক্ত হয়ে সুলতানের ভ্রাতুস্পুত্র প্রায়ই তার গৃহে হানা দেয় এবং তাকে প্রহার করে বের করে দিয়ে তার স্ত্রীর উপর অবৈধ কামনা চরিতার্থ করে। অভিযোগ শুনে ক্রোধে সুলতানের চোখ থেকে অশ্রুপাত হতে লাগল। তিনি বললেন, ‘আবার যখন সে যাবে আমাকে খবর দিও।
তিনদিন পর একরাতে লোকটি ছুটে এসে খবর দিল সুলতানকে। সুলতান একাই তার সাথে ছুটলেন। গিয়ে দেখলেন, ঘরে একটা মোমবাতি জ্বলছে আর তার ভ্রাতুস্পুত্র লোকটির স্ত্রীর পাশে ঘুমিয়ে। সুলতান মোমবাতি নিভিয়ে দিয়ে তলোয়ারের এককোপে তাঁর ভ্রাতুস্পুত্রের শিরচ্ছেদ করলেন। তারপর সুলতান আলো আনিয়ে দ্রুত এক গ্লাস পানি ঢক ঢক করে পান করে ফেললেন। লোকটি বিস্ময়ে সুলতানের কাছে জানতে চাইলেন কেন তিনি বাতি নিভিয়ে ছিলেন এবং কেনইবা পানি পানের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন।
সুলতান বললেন, ‘ঐ যুবককে আমি খুব স্নেহ করতাম। ভয় হয়েছিল তার মুখ দেখলে আমি তার প্রতি স্নেহ প্রবন হয়ে পড়ব। তাই বাতি নিভিয়ে ছিলাম। আর পানি পান করলাম কারণ, তোমার অভিযোগ পেয়ে শপথ করেছিলাম, অপরাধীকে শাস্তি না দিয়ে আমি আহার করবনা। আমি তিনদিন ধরে আহার করিনি।’
সুলতান মাহমুদ মূর্তি বিক্রেতা নয়
সুলতান মাহমুদ সতেরবার ভারতে অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। তিনি যেমন জয় করেছিলেন বহু রাজ্য, তেমনি প্রভূত সম্পদও সংগ্রহ করেছিলেন। অনেকেই তাঁকে সম্পদ লোলুপ বলে অভিযুক্ত করেন। কিন্তু সম্পদের জন্যই তিনি অভিযান গুলো পরিচালনা করেছিলেন তা প্রমাণ হয়না।
সোমনাথ মন্দিরের ঘটনা। সোমনাথ জয়ের পর সুলতান মাহমুদ সোমনাথ মন্দিরে প্রবেশ করলেন। বিশাল সোমনাথ মন্দির। পাঁচশ’ নর্তকী, তিনশ’ গায়ক এবং মন্দিরে প্রবেশের পূর্বে ভক্তদের মাথা মুণ্ডনের জন্যই ৩০০ নাপিত ছিল এ মন্দিরে।
সুলতান মন্দিরে প্রবেশের পর পাঁচ গজ দীর্ঘ বিশাল সোমনাথ মূর্তির নাক ভেঙে দিলেন এক আঘাতে। তারপর মূর্তিটি গুড়িয়ে দিতে উদ্যত হলে ব্রাহ্মণরা প্রস্তাব করল মূর্তিটি না ভাঙলে সুলতানকে তারা প্রচুর স্বর্ণ উপহার দেবে।
সুলতানের কতিপয় কর্মচারীও সুলতানকে বুঝাল, মূর্তি ভেঙে কি লাভ। তার চেয়ে স্বর্ণ পেলে তা দান করে দিলেও প্রচুর পুণ্য হবে। সুলতান মাহমুদ হাসলেন তাদের প্রস্তাব শুনে। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘সুলতান মাহমুদ মূর্তি বিক্রেতা নয়, মূর্তি ধ্বংসকারী।’
মূর্তি ভাঙা হল। মূর্তির বিশাল পেট থেকে বের হলো প্রচুর হীরা, পদ্মরাগ মণি, অঢেল মুক্তা যার মূল্য ছিল ব্রাহ্মণদের প্রতিশ্রুত উপহারের চেয়ে বহু বহু গুণ বেশী।
মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত উজিরের মা
হাসান ছিলেন সুলতান মাহমুদের একজন বিখ্যাত উজির। সুলতান মাহমুদের সন্তান ও উত্তরাধিকারী সুলতান মাসুদের সময় তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার হলেন। তাঁকে বিদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হলো। তাঁকে লাঞ্ছিত করা হলো। অবশেষে প্রাণদণ্ড দেয়া হলো।
পাগড়ী-পাজামা পরে উজ্জ্বল মুখ এবং দ্যুতিময় দেহ নিয়ে বিজ্ঞ আসামী মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলেন। যারা হাযির ছিল, তারা কেউ এ বেদনাদায়ক মৃত্যুতে না কেঁদে থাকতে পারলো না।
শুধু কাঁদলো না হাসানের মা। একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বললেন, ‘আমার সন্তানের কি ভাগ্য। সুলতান মাহমুদ তাকে দিয়েছিল দুনিয়া আর মাসুদের মত সুলতান তাকে দান করলো আখিরাত।’
সুলতান মালিক শাহের প্রার্থনা
আফগানিস্তান, পারস্যসহ মধ্য এশিয়ার বিশাল অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত সেলজুক সুলতানদের শাসন।
১০৭২ সাল। সেলজুক বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ সুলতান মালিক শাহ তখন ক্ষমতায়। ছোট ভায়ের সাথে বিরোধ চলছিল মালিক শাহের। সিংহাসনের দাবী করে বিদ্রোহ করেছিল তাঁর ছোট ভাই।
সে সময়ের একটি ঘটনা।
সেলজুক সুলতান মালিক শাহ একদিন তাউস এর একটা মসজিদ পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। মসজিদ থেকে বের হবার পথে তিনি প্রধান উজির নিজামুল মুলককে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি মসজিদে যে দোয়া করেছেন সেটা কি?’
নিজামুল মুলক বললেন, ‘আমি দোয়া করেছি আল্লাহ যাতে আপনাকে আপনার ভাইয়ের উপর বিজয় দান করেন।’ মালিক শাহ বললেন, ‘আর আমি কি দোয়া করেছি জানেন?’ জিজ্ঞেস করার পর তিনিই উত্তরে বললেন, ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামিনকে আমি এটুকুই বলেছি, হে আল্লাহ, জনগণের জন্য যার শাসন মঙ্গলকর হবে, তাকেই আপনি শাসন ক্ষমতা দান করুন।’
পরিচারিকার কথায় কাঁপতে লাগলেন রাজা ইবরাহীম আদহাম
বলখের রাজা ইবরাহীম আদহাম একদিন পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে শিকারে গেলেন। সেই সময়ে রাজ প্রাসাদের এক দাসী বালিকা তার শয়নকক্ষে এলো এবং দেখল বেগম বাইরে গেছেন। রাজকক্ষের বহুমূল্য আসবাবপত্র, সুশোভিত বিছানা, আতরদানি থেকে আসা মনোহর সুগন্ধ সব মিলে দাসী-বালিকাকে আত্মহারা করে তুলল। সে ভুলে গেল নিজের অবস্থার কথা। তার লোভ হলো সে বিছানায় একটু শয়নের। সে সন্তর্পণে সেই রাজকীয় বিছানায় শুয়ে পড়ল এবং ঘুমিয়ে গেল।
ঘুমন্ত অবস্থায়ই তাকে ঐ রাজকীয় বিছানায় পাওয়া গেল। ইবরাহীম আদহাম শিকার থেকে ফেরার সাথে সাথেই এই গুরুতর ব্যাপারটা তাঁকে জানানো হলো। শুনে রাজা ভয়ানক ক্ষিপ্ত হলেন। একজন দাসী বালিকা তাঁর রাজ-বিছানা স্পর্শ করেছে এত বড় ঔদ্ধত্য।
ক্রুদ্ধ রাজা ইবরাহীম আদহাম নির্দেশ দিলেন, দাসী বালিকাটিকে ৫০টি বেত্রাঘাত করা হোক। যখন তাঁর আদেশ প্রতিপালিত হলো, তখন রাজা বললেন, ‘হে বালিকা, তুমি তোমার কৃতকর্মের জন্য নিশ্চয় দুঃখবোধ করছ?’
বালিকাটি উত্তর দিল, ‘হ্যা, মহামান্য রাজা। কিন্তু আমি আমার নিজের অবস্থার চেয়ে আপনার জন্যেই বেশি দুঃখবোধ করছি।’
রাজা সরবে বললেন, ‘কেন এই অমূলক চিন্তা করছ?’
বালিকা বলল, ‘কারণ এক ঘণ্টা আপনার বিছানায় শোয়ার জন্যে যদি আমার এই শাস্তি হয়ে থাকে, তাহলে বছরের পর বছর ঐখানে শোয়ার জন্যে আপনার কেমন শাস্তি হবে, তা ভেবে আমি দুঃখবোধ করছি।’
বালিকার এই কথা যেন রাজার উপর বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটাল। তিনি হতবাক হয়ে গেলেন। তাঁর মুখের চেহারা বদলে গেল। তিনি দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে কাঁপতে কাঁপতে তাঁর পরিচারকদের বললেন, ‘এই বালিকাকে নিয়ে যাও, তার ভালভাবে চিকিৎসা কর। আমাকে একাকী থাকতে দাও।’
বাদশাহর পরিচারিকা রাখার সঙ্গতি নেই
দিল্লীর বাদশাহ নাসির উদ্দিন। বাদশাহ আলতামাশের পুত্র তিনি। বাদশাহর পুত্র হলেও স্বহস্তে পুস্তক নকল করে তার বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়ে তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন। দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণের পরও তিনি এভাবেই নিজ পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করতেন।
তাঁর বেগম নিজ হাতে রান্না-বান্নাসহ সংসারের যাবতীয় কাজ করতেন। একদিন রুটি সেকবার সময় বাদশাহর বেগমের হাত পুড়ে গেল।
বেগম এসে বললেন, ‘বাদশাহ, একলা আর পেরে উঠিনে, একজন পরিচারিকার ব্যবস্থা করে দিন।’ বাদশাহর চক্ষে দেখা গেল অশ্রু। তিনি বললেন, ‘পরিচারিকা রাখার সঙ্গতি আমার নেই। ধৈর্য ধরে কাজ করে যাও বেগম, আল্লাহ তার পুরস্কার দেবেন। দাসী রাখা অসম্ভব। রাজকোষ জনসাধারণের – আমি তার রক্ষক মাত্র। অনাবশ্যক ব্যয় বৃদ্ধি দ্বারা রাজ্যের ব্যয়ভার বৃদ্ধি করতে আমি পারবো না।’
সুলতান বাহমানীর উচিত শিক্ষা
দক্ষিণ ভারতের বাহমানী রাজ্যের সুলতান আলাউদ্দিন শাহ বাহমানী (দ্বিতীয়) একজন বাগ্মী লোক ছিলেন। মাঝে মাঝে তিনি মসজিদে খুতবা দিতেন এবং বলতেন তিনি সংযমী, ন্যায়পরায়ণ, উদার ও দয়ালু রাষ্ট্রনায়ক।
একজন আরবীয় বণিক শাহ বাহমানীর কাছে একটি ঘোড়া বিক্রয় করেছিলেন, কিন্তু দাম তখনও পাননি। শাহ বাহমানী খুতবা দেয়ার সময় একদিন তিনি মসজিদে হাযির এবং রাজা যে নিজের প্রশস্তি গাইছিলেন তা শুনছিলেন। এসব কথা শুনে তার প্রতি দুর্ব্যবহার এবং নিরপরাধ সাইয়েদদের সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডের কথা তার মনে পড়ে গেল। তিনি চিৎকার করে উঠলেন এই বলে- “আপনি না ন্যায়পরায়ণ, না দয়ালু, না ধৈর্যশীল, না উদার; বরং আপনি সত্যিকারের মুমিনের জন্য নির্দিষ্ট মসজিদের মিম্বর থেকে বাগাড়ম্বর প্রকাশের সাহস করেছেন”
শাহ বাহমানী তৎক্ষণাৎ ঐ বণিকের ঘোড়ার দাম ঐখানেই দিয়ে দিতে বললেন এবং তিনি প্রাসাদে চলে গেলেন। এরপর তিনি আর মসজিদের মিম্বরে উঠেননি।
এক রাজা, এক রাজ্যের ইসলাম গ্রহণ
১৫০১ খ্রিস্টাব্দ। শেখ আবদুল্লাহ নামে একজন আরব ধর্ম প্রচারক মালয় উপদ্বীপের সর্ব উত্তর কুয়েদায় আসলেন। শেখ কুয়েদার রাজার সাথে দেখা করতে চাইলেন। সাক্ষাতের ব্যবস্থা হলো। তারপর দুজনের মধ্যে নিম্নোক্ত কথোপকথন হলোঃ
আবদুল্লাহঃ আপনার দেশের ধর্ম কি?
রাজাঃ পূর্ব পুরুষের কাছ থেকে যা আমরা পেয়েছি সেটাই আমাদের ধর্ম। আপনার ধর্ম কি?
আবদুল্লাহঃ আমাদের ধর্ম স্বয়ং আল্লাহর কাছ থেকে তাঁর রাসুলের মাধ্যমে আমাদের কাছে এসেছে।
রাজাঃ স্বয়ং আল্লাহর কাছ থেকে? ঐ ধর্মের নাম কি?
আবদুল্লাহঃ এর নাম ইসলাম। আমরা আল্লাহর রাসুল মুহাম্মাদ (সা) এর মাধ্যমে এই ধর্ম পেয়েছি। সর্ব ধর্মের উপরে এটা বিজয়ী হয়েছে।
রাজাঃ তাহলে ঐ ধর্ম সম্পর্কে আমাকে কিছু বলুন।
শেখ আবদুল্লাহ ইসলামের শিক্ষা ও সৌন্দর্যের কিছু বিবরণ দিলেন।সঙ্গে সঙ্গে রাজা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন। তাঁর সাথে সাথে অন্যান্য সভাসদ এবং প্রজারাও ইসলামে দীক্ষিত হলো।
অভাববোধ করলে আল্লাহকেই বলব
তাপসী রাবেয়া বসরী ছিলেন পরিপূর্ণ সন্তুষ্ট হৃদয়। তাঁর এ সন্তুষ্ট হৃদয়ে কোন অভাব বোধ ছিল না, তাই ছিলনা কোন অভিযোগও। চাইবারও ছিলেনা কারও কাছে কিছু তাঁর।
হযরত রাবেয়াকে অনেক সময়ই ছিন্ন বসনে দেখা যেত। একদিন বসরার একজন অভিজাত লোকের এটা হৃদয় স্পর্শ করল। সে বলল, ‘মা, যদি আপনি অনুমতি দেন, তাহলে অনেকেই আছে যারা আপনার সকল অভাব দূর করতে কৃতজ্ঞ বোধ করবে।’
রাবেয়া উত্তরে বললেন, ‘হে আমার পুত্র, বাইরের লোকের কাছে আমার অভাবের কথা বলতে লজ্জাবোধ করি। সমগ্র দুনিয়ার মালিক আল্লাহ। যদি আমি অভাব বোধ করি, তাহলে এটা দূর করার জন্য আল্লাহকেই আমি বলবো।’
অভিযোগের ব্যান্ডেজ আছে, কৃতজ্ঞতার ব্যান্ডেজ নেই
আল্লাহর, আল্লাহর জন্যে সব যারা বিলিয়ে দেন, বিলিয়ে দেন নিজের সুখ-সম্ভগ-সব, হযরত রাবেয়া বসরী এমনি একজন মহিলা। মানুষ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অফুরন্ত নিয়ামত ভোগ করে, খুব কমই তার জন্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। অথচ সামান্য দুঃখ-কষ্টে তাদের হা-হুতাশের অন্ত থাকে না।
এই কথাটাই তাপসী রাবেয়া বসরী কত সুন্দর ভাবে বললেন।
একদা মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা একজন লোক রাবেয়া বসরীর কাছে এলেন। তারপর এভাবে দুজনের মধ্যে কথা শুরু হলঃ
রাবেয়াঃ মাথায় ব্যান্ডেজ কেন?
আগন্তুকঃ গত রাত থেকে আমার ভীষণ মাথাব্যথা।
রাবেয়াঃ আপনার বয়স কত?
আগন্তুকঃ ৩০ বছর।
রাবেয়াঃ জীবনের অধিকাংশ সময় কি আপনার কষ্ট ও বেদনায় কেটেছে?
আগন্তুকঃ না।
রাবেয়াঃ ত্রিশ বছর ধরে আল্লাহ আপনার দেহকে সুস্থ রেখেছেন, কিন্তু এর জন্যে কোন কৃতজ্ঞতার ব্যান্ডেজ আপনি ধারণ করেননি। আর মাথায় এক রাতের বেদনাতে আপনি অভিযোগের ব্যান্ডেজ ধারণ করলেন?
সাক্ষী হওয়ার যোগ্যতা
কাজী আবু জাফর বিন আব্দুল ওয়াহিদ হাশমী বর্ণনা করেছেনঃ একদিন কাজী আবু উমার রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। পথে মদের পাত্র ভেঙে প্রচুর মদ ছড়িয়ে থাকার দৃশ্য তাঁর চোখে পড়ল। একজন প্রত্যক্ষদর্শী যিনি কাজীর সাথে হাঁটছিলেন তিনি বললেন, ‘এভাবে মদ ছড়িয়ে উৎকট গন্ধ ছড়ায়।’ কাজী শুনলেন কিছুই বললেন না। কিন্তু একদিন ঐ লোক সাক্ষী হয়ে তাঁর আদালতে আসল কোন এক ব্যাপারে, কাজী তাঁর সাক্ষ্য গ্রহণে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলেন। সাক্ষী লোকটি খুব ভীত হয়ে পড়ল। সে অন্য লোকের দ্বারা জানতে চাইলো এর কারণ কি?
কারণ হিসেবে কাজী সে দিনের ঘটনা উল্লেখ করে বললেন, ‘মদ ইসলামে হারাম। এর গন্ধ খারাপ কিংবা ভাল বিবেচ্য বিষয় নয়। কিন্তু সে এ বিষয়টাকে বিবেচ্য বিষয়ে পরিণত করেছে। সুতরাং হয় সে প্রবঞ্চনা করছে অথবা মিথ্যা বলছে কিংবা সে কিছুই বুঝে না অজ্ঞ। সুতরাং আমি তার সাক্ষ্য গ্রহণ করতে পারি না।’
বসন্তের যিনি স্রষ্টা তার সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে দেখ
আল্লাহর ধ্যানে সর্বদা মশগুল থাকতেন তাপসী রাবেয়া বসরী। সকল সৃষ্টির স্রষ্টা, সব সৌন্দর্যের উৎস পরম প্রভু আল্লাহই ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান।
বসরায় সেদিন বসন্তের সকাল। বসরায় বিখ্যাত গোলাপ বাগান গুলো ফুল সম্ভারে পূর্ণ। বাতাস সে ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে চারদিক মোহিত করছিল। পাখি গান গাইছিল। বুলবুলি গুলো যেন ফিসফিস করে গোলাপের প্রতি তাদের ভালবাসা প্রকাশ করছিল। চারদিকটা বসন্তের নতুন প্রাণচাঞ্চল্যে নেচে উঠছিল।
পরিচারিকা তাপসী রাবেয়াকে গিয়ে বললেন, বাইরে আসুন। দেখুন, বসন্তে প্রকৃতি কি অপূর্ব রূপ সম্ভারে সেজেছে। রাবেয়া তাঁর নামাযের ঘর থেকে বললেন, ‘বাইরের দুনিয়া স্বতঃ পরিবর্তনশীল। রূপবৈচিত্র্য আর কি দেখব, তুমি আস এবং একবার বসন্তের যিনি স্রষ্টা তাঁর অকল্পনীয় সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে দেখ।’
পরম প্রভুর পরম সৌন্দর্য যারা উপলব্ধি করেন, দুনিয়ার কোন সৌন্দর্যই তাঁদের কাছে সৌন্দর্য নয়।
আল বিরুনীর জ্ঞান পিপাসা
জ্ঞানানুসন্ধিৎসু আল বিরুনীর মৃত্যুকালীন অবস্থা সম্পর্কে ফকিহ আবুল হাসান বলেনঃ
যখন আমি তাঁর শয্যাপাশে গেলাম, তখন দেখলাম তিনি শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। তিনি আমাকে দেখে বললেন, “একদিন আপনি আমাকে নানীর সম্পত্তির অংশ ভাগ সম্পর্কে বলেছিলেন। আপনি কি অনুগ্রহ করে সে কথা বলবেন যাতে আমি তা স্মরণ করতে পারি।”
আমি বললাম, ‘আপনার আই অবস্থায় সেই আলোচনা আমি কিভাবে তুলি?”
তিনি বললেন, “এ বিষয়টি না জেনে পৃথিবী থেকে যাওয়ার চেয়ে জেনে যাওয়াই ভাল।”
আমি সেই ভাগ-বণ্টনের ফর্মুলা বললাম। আল বিরুনী তা মুখস্থ করে আমাকে শুনালেন তাঁর ভুল শুধরাবার জন্যে। এরপর তাঁর শয্যাপাশ থেকে চলে এলাম। রাস্তায় পা দেবার আগেই শুনতে পেলাম সেই জ্ঞানতাপস আর দুনিয়াতে নেই।
বাবরের আমানতদারী
ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর। মধ্য এশিয়ার ফারগানা রাজ্যের শাসন কর্তার তিনি ছেলে। পরে তিনি ফারগানার শাসনকর্তা হন। বহু উত্থান-পতনে ভরা ছিল তাঁর জীবন। সবকিছু ছাপিয়ে তাঁর চরিত্র ছিল হিরকের মত উজ্জ্বল। তাঁর সততা, মানবিকতা ছিল কিংবদন্তির মত মানুষের মুখে মুখে।
বাবর যখন ফারগানার শাসনকর্তা, তখন একটি বানিজ্য কাফিলার মালিক ইন্দিজান পাহাড় এলাকায় বজ্রপাতে মারা যান। বাবর এ কাফিলার সমস্ত সম্পদ সংগ্রহ করতে এবং মালিকের উত্তরাধিকারীদের কাছে ফেরত দেয়ার নির্দেশ দেন।
দুবছর পর এ উত্তরাধিকারীরা আসে এবং সমস্ত জিনিস ফেরত পায়। বাবরকে তারা উপঢৌকন দিতে চায়। কিন্তু বাবর শুধু প্রত্যাখ্যানই করেন নি উপরন্তু তাদের আসা-যাওয়ার সব খরচ বহন করেন।
মুজাদ্দিদের মাথা মানুষ-সম্রাটের কাছে নত হলোনা
মোগল আমল। সম্রাট আকবরের ছেলে জাহাঙ্গীর তখন মোগল সাম্রাজ্যের প্রতাপশালী সম্রাট। একদা তিনি শায়খ আহমদ সরহিন্দীকে দরবারে ডেকে পাঠালেন। জাহাঙ্গীরের দরবারে এ রেওয়াজ ছিল যে, কোন ব্যক্তি দরবারে আগমন করলে প্রথমে বাদশাহকে কুর্নিশ করতে হতো।
বাদশাহ আশা করেছিলেন শায়খ আহমদ তাই করবেন। কিন্তু তিনি দরবারে প্রবেশ করে ইসলামী বিধান অনুযায়ী সালাম করলেন। বাদশাহ রাগান্বিত হয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার সাহস তো কম নয়। আপনি কেন দরবারের বিধি লঙ্ঘন করলেন? কেন সম্মান সূচক কুর্নিশ করেননি?’
জবাবে শায়খ আহমদ বলেন, ‘হে সম্রাট! যে মস্তক প্রত্যহ কমপক্ষে পাঁচবার সম্রাটের সম্রাট রাব্বুল আলামিনের সামনে নত হয়, সে মাথা দুনিয়ার কোন মানুষের সামনে নত হতে পারে না, তিনি যত বড় শক্তিধরই হন না কেন।’
আওরঙ্গজেব নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে সন্তানকে কারাগারে পাঠালেন
বাদশাহ আওরঙ্গজেব যে কত ন্যায়বিচারক ছিলেন, তাঁর ৫০ বছর রাজত্ত্বকালের হাজার হাজার ন্যায়বিচারের ঘটনা থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি বলতেন, বিচার ক্ষেত্রে শাহজাদাদেরকেও আমি সাধারণ লোকের পর্যায়ভুক্ত মনে করি। বাদশাহ আওরঙ্গজেব ১০৮২ হিজরি সনে এক আদেশ জারি করেন, জিলায় জিলায় প্রতিনিধি নিযুক্ত করে জনসাধারণকে জানিয়ে দেয়া হোক যে, বাদশাহর বিরুদ্ধে যদি কারো কোন অভিযোগ থাকে তাহলে নির্ভয়ে তা পেশ করতে পারবে। সরকারী প্রতিনিধি সে সব অভিযোগের কৈফিয়ত প্রদান করবে। অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে অভিযোগকারী তার অধিকার ফিরে পাবে। বাদশাহ সরাসরি দায়ী হলে বাদশাহ নিজেই তার প্রতিকার করবেন।
মির্জা কামবখশ আলমগীরের অত্যন্ত স্নেহপরায়ণ পুত্র ছিলেন। তাঁর দুধ ভাইয়ের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আরোপিত হয়। আলমগীর আদেশ দিলেন, বিচারালয়ে এর তথ্যানুসন্ধান করার হোক। তদন্তের নিরপেক্ষতা যাতে কোনভাবেই নষ্ট না হয়, কোন সুপারিশ যেন গ্রাহ্য করা না হয়, সুপারিশকারী যদি বাদশাহর সন্তানও হন। কিন্তু কামবখশ তার দুধ বাইয়ের পক্ষে দাঁড়ালেন। আলমগীর কামবখশকে দরবারে ডাকলেন। কামবখশ দুধ ভাইকে সঙ্গে নিয়ে আসলেন।
আলমগীর নিজ সন্তানকে গ্রেফতার করে তদন্ত কমিটিকে বললেন, ‘এবার নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করতে পারবে।’
জাভার রাজপুত্র হাজী পুরওয়া
জাভার পশ্চিম প্রান্তে পাজাজারান নামে একটি রাজ্য। দ্বাদশ শতকের শেষ দিকে সেখানে এক রাজা ছিলেন। রাজার ছিল দুই ছেলে। বড় ছেলে ব্যবসায়ে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। এবং ব্যবসায় উপলক্ষে তিনি ভারতে যান। এই সময় রাজার মৃত্যু হলে ছোট ছেলে সিংহাসনে আরোহণ করেন।
রাজার বড় ছেলে তাঁর বানিজ্য সফরে এক পর্যায়ে কিছু আরব বণিকের দেখা পান এবং তাদের কাছে ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর নতুন নাম হাজী পুরওয়া। পরে রাজপুত্র হাজী পুরওয়া একজন আরব ধর্ম প্রচারকসহ দেশে ফিরে গেলেন এবং রাজা ও রাজ পরিবারকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা ইসলাম গ্রহণে অস্বীকার করল এবং হাজী পুরওয়াকে হত্যার ষড়যন্ত্র করল।
ভাই এবং অন্যান্যের এই ষড়যন্ত্রের মুখে রাজপুত্র হাজী পুরওয়া জঙ্গলে আশ্রয় নিলেন। তারপর কেউ আর তাঁর সন্ধান পায়নি। কিন্তু তাঁর চেষ্টা বৃথা যায়নি, গোটা জাভাই পরে ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় নেয়।
হাজী পুরওয়া রাজা ও রাজ পরিবারকে ইসলাম গ্রহণ করাতে পারেননি, কিন্তু জঙ্গলে গিয়ে জনগণের কাতারে শামিল হয়ে গোটা দেশকেই ইসলাম গ্রহণ করিয়েছেন।
শেষ রক্তবিন্দুর লড়াই
১৭৯৯ সালের ৪ঠা মে। ইংরেজ, নিজাম ও মারাঠার মিলিত বাহিনী শ্রীরঙ্গপত্তমে বীর টিপুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। টিপু ও টিপু সুলতানের ছোট্ট বাহিনী নির্ভীকভাবে তাদের মুকাবিলা করলো। নিহত হলো অনেক শত্রু সৈন্য। কিন্তু শত্রুর বিশাল বাহিনীর প্রবল বাহিনীর প্রবল চাপে ভেঙে পড়ল দুর্গের সিংহদ্বার।
ক্ষুদ্র বাহিনী সাথে নিয়ে টিপু সুলতান দুর্গদ্বার রক্ষার জন্যে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। গুলীর অবিরাম বৃষ্টি তাদের ভয় দেখাতে পারল না। অকস্মাৎ একটা গুলী এসে টিপুর বাম পাশে বিদ্ধ হলো। কিন্তু তিনি স্থানে ত্যাগ করলেন না, তাঁর কোন সৈন্যও নয়।
টিপুর সৈন্যর মৃতদেহের স্তূপ দুর্গের দ্বার প্রায় বন্ধ করে দিল। এ সময় আরেকটি গুলি টিপু সুলতানের বাম বুক বিদ্ধ করল। অজস্র রক্তপাতে সিংহদিল টিপু লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। কিন্তু অস্ত্র তিনি ত্যাগ করেন নি। একজন ইংরেজ তাঁর স্বর্ণ নির্মিত তরবারির বাঁটের জন্যে অগ্রসর হলো। টিপু বাম বাহুর উপর ভর করে মাথাটা তুলে এক আঘাতে তাকে শেষ করে দিলেন। আরও একজন ছুটে এলো তাঁর দিকে। তাকেও তিনি শেষ করলেন। আরেকটি গুলী এসে এ সময় তাঁর কপালে বিদ্ধ হলো।
শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন টিপু। তাঁর মুখে কোন ভয়, দুশ্চিন্তা কিংবা উদ্বেগের ছাপ ছিল না, ছিল তাতে অসাধারণ এক প্রশান্তি ও দৃঢ়তার ছাপ। যেন প্রশান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছেন তিনি।
বাদশাহ ইবনে সউদের বিচার
বহু বছরের অশান্তি, অবিচার, বিশৃঙ্খলা, হানাহানির পর বাদশাহ ইবনে সউদ আরব ভূখণ্ডে শান্তি, শৃঙ্খলা ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করলেন। স্বস্তি ও নিরাপত্তা ফিরে এসেছিল মানুষের মধ্যে। বাদশাহ ইবনে সউদের বিচার কিংবদন্তির মত আলোচিত হয় মানুষের মুখে মুখে।
এক দিনে ঘটনা। ইবনে সউদ তাঁর দরবারে বসেছিলেন। স্থানীয় শেখ ও গোত্র সর্দারেরা তাঁর চারদিকে ঘিরে বসেছিল। এ সময় একজন মহিলা এসে নালিশ করল, তার প্রতিবেশীর গরু তার বাগানে ঢুকে বাগানের সবটা ক্লোভার গাছ খেয়ে ফেলেছে।
ইবনে সউদ মহিলার প্রতিবেশীকে দরবারে হাজির করার পর তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে সে শপথ করে অভিযোগ অস্বীকার করল। অবশেষে ইবনে সউদ কসাইকে নির্দেশ দিলেন গরু জবাই করে পেট ফাঁড়ার জন্যে। গরুর পেট ফেড়ে গরুর পেটে ক্লোভার গাছ পাওয়া গেল।
ইবনে সউদের রায়ে মহিলার প্রতিবেশী দোষী সাব্যস্ত হলো। রায় অনুসারে তাকে মহিলার ক্লোভার গাছের পুরো ক্ষতিপূরণ দিতে হলো এবং মিথ্যা শপথ করার জন্য দিতে হলো বিরাট রকমের জরিমানা।
— সমাপ্ত —