ইসলামী নেতৃত্ব
এ কে এম নাজির আহমদ
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
ইসলামী নেতৃত্ব
আল ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত দীন বা জীবন বিধান। আল্লাহর যমীনে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠিত হওয়াকে বলে ইকামাতে দীন। কোন একটি ভূ-খন্ডে সমাজের সকল স্তরে, সকল দিকে ও বিভাগে ইসলামী বিধান পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হলেই বলতে হবে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
আল্লাহর যমীনে আল্লাহর দীন কায়েমের প্রচেষ্টা চালিয়ে আল্লাহর সন্তোষ অর্জনই হচ্ছে মুমিন জীবনের আসল লক্ষ্য। আল্লাহর যমীনে আল্লাহর দীন কখনো আপনা আপনি কায়েম হয়ে যায় না। এর জন্য প্রয়োজন আন্দোলন। আর আন্দোলন মানে হচ্ছে লক্ষ্য হাসিলের জন্য একদল মানুষের সমন্বিত প্রয়াস।
আল্লাহর যমীনে আল্লাহর দীন কায়েমের আন্দোলনকে বলা হয় আল্লাহর পথে জিহাদ। বাংলা ভাষায় ‘ইসলামী আন্দোলন’ পরিভাষা আল্লাহর পথে জিহাদকেই বুঝায়। আন্দোলনের জন্য চাই সংগঠন। নেতৃত্ব এবং একদল কর্মী না হলে সংগঠন হয় না। সংগঠনে বহু সংখ্যক কর্মী থাকে। নেতার সংখ্যা থাকে কম। কম সংখ্যক হলেও নেতৃত্বকেই সংগঠনে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয়।
১. ইসলামী নেতৃত্ব ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নবীদের উত্তরসূরী
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দূর অতীতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্ব দেবার জন্য নবী রাসূলদেরকে পাঠিয়েছেন। আদম আ. থেকে শুরু করে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা. পর্যন্ত বহু সংখ্যক নবী রাসূল পৃথিবীর বিভিন্ন ভূ-খণ্ডে আবির্ভূত হয়ে আল্লাহ-প্রদত্ত জীবন বিধান আল ইসলামকে মানব সমাজে কায়েম করার আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। এই প্রসংগে মহান আল্লাহ বলেন,
وَجَعَلْنَاهُمْ أَئِمَّةً يَهْدُونَ بِأَمْرِنَا
‘‘আমি তাদেরকে নেতা বানিয়েছিলাম (যাতে) আমার নির্দেশে তারা লোকদেরকে সঠিক পথের দিশা দেয়।’’ (সূরা আল আম্বিয়াঃ ৭৩)
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ সা. সর্বশেষ নবী। তাঁর পর আর কোন নবী আবির্ভূত হবেন না। কিন্তু তাঁর প্রতি নাযিলকৃত আল-কুরআন এবং সেই আল-কুরআনকে আল্লাহর যমীনে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে তাঁর সুন্নাহ অবিকৃতভাবে বিদ্যমান। আল্লাহর রাসূলের সা. ইন্তিকালের পর যুগে যুগে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতৃত্ব আল ইসলামকে আল্লাহর যমীনে কায়েম করার জন্য বিভিন্ন ভূ-খণ্ডে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। আজো সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে। যেইসব মহান ব্যক্তি আল্লাহর রাসূলের সা. দেখানো পদ্ধতিতে আল ইসলামকে মানব সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁরা দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নবী রাসূলদের উত্তরসূরীর ভূমিকাই পালন করছেন।
এই নিরিখে বিচার করলে ইসলামী নেতৃত্বের রয়েছে একটি বড়ো মর্যাদা। সেই কারণে তাঁদের দায়িত্ব বড়ো। তাঁদের সব সময় সজাগ থাকা উচিত যাতে তাঁদের কথা, কাজ এবং আচরণে এমন কিছু প্রকাশ না পায় যা নবীর উত্তরসূরীর জন্য শোভনীয় নয়।
২. ‘কথার অনুরূপ কাজ’ ইসলামী নেতৃত্বের প্রধান ভূষণ
অনুগামী ও কর্ম এলাকার লোকদের মাঝে আল ইসলামের জ্ঞান বিতরণ ইসলামী নেতৃত্বের অন্যতম প্রধান কাজ। কিন্তু অনুগামীগণ কিংবা কর্ম এলাকার লোকেরা যদি নেতৃত্বের বাস্তব জীবনে আল ইসলামের অনুশীলন দেখতে না পায়, শুধু মুখের কথা শুনেই তারা অনুপ্রাণিত হয় না। যেইসব নেতা মুখে সুন্দর সুন্দর কথা বলেন অথচ তাঁদের জীবনে সেইসব সুন্দর কথার প্রতিফলন থাকে না, লোকেরা তাঁদেরকে কপট নেতা গণ্য করে। এই ধরণের নেতৃবৃন্দ কখনো লোকদের শ্রদ্ধাভাজন হতে পারেন না। কোন স্বার্থ হাসিলের জন্য লোকেরা কখনো কখনো তাঁদের কথা মেনে নিতে বাধ্য হলেও তাদের অন্তরে এইসব নেতার প্রতি কোন শ্রদ্ধাবোধ, কোন ভালোবাসা থাকে না।
লোকেরা যখন দেখতে পায় যে নেতাগণ যেইসব কাজ করার জন্য লোকদেরকে উদ্বুদ্ধ করছেন, তাঁরা নিজেরাও সেইসব কাজ করে থাকেন, তখন তারা নেতাদেরকে নীতিবান নেতা বলে স্বীকার করে, তখন তারা তাঁদের কথা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে। নীতিবান নেতৃত্বের নিরাপোষ ভূমিকাই সাধারণ লোকদের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে থাকে। এমন নেতৃত্বের নির্দেশ মতো কাজ করতে তারা উৎসাহ বোধ করে।
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ সা. আল-কুরআনের শিক্ষা লোকদের সামনে পেশ করতেন। লোকেরা দেখতে পেতো যে তিনি যেই শিক্ষার কথা মুখে উচ্চারণ করছেন সেই শিক্ষা অনুযায়ীই তাঁর জীবন পরিচালনা করছেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁর জীবন ছিলো আল-কুরআনেরই জীবন্ত রূপ। বৈসাদৃশ্যহীন, বৈপরীত্যহীন পরিচ্ছন্ন জীবন তাঁকে অসাধারণ করে তুলেছিলো, তাঁকে অনুকরণীয় অনুসরণীয় করে তুলেছিলো।
‘কথার অনুরূপ কাজ’ না করা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দৃষ্টিতে খুবই গর্হিত। এমন চরিত্রের লোকদের সমালোচনা করেই তিনি বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لَا تَفْعَلُونَ – كَبُرَ مَقْتًا عِندَ اللَّهِ أَن تَقُولُوا مَا لَا تَفْعَلُونَ
‘ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, যেই কাজ তোমরা নিজেরা কর না তা বল কেন? আল্লাহর নিকট এটি গর্হিত কাজ যে তোমরা এমন কথা বল যা তোমরা কর না।’ (সূরা আস সাফঃ ২,৩)
ইসলামী নেতৃত্বকে অবশ্যই পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করতে হবে। তাঁদের কথা ও কাজের মাঝে যাতে কোন বৈপরীত্য না থাকে সেই ব্যাপারে তাঁদেরকে খুবই সতর্ক থাকতে হবে। ‘কথার অনুরূপ কাজ’ই তাঁদেরকে লোকদের নিকট শ্রদ্ধাস্পদ করে তুলবে। নেতৃত্ব যদি লোকদের স্বতঃস্ফূর্ত শ্রদ্ধা কুড়াতে না পারেন তবে তো তাঁদেরকে ব্যর্থ নেতৃত্বই বলতে হবে।
৩. মানুষের কল্যাণ কামনা ইসলামী নেতৃত্বের বিশেষ বৈশিষ্ট্য
ইসলামী নেতৃ্ত্ব মানুষের সুখ, শান্তি এবং কল্যাণের কথা ভেবে থাকেন। তাঁরা নিশ্চিত যে মানব রচিত মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করে মানুষের সুখ, শান্তি এবং কল্যাণ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। মানুষের দুনিয়ার জীবনের কল্যাণ এবং আখিরাতের জীবনের নাজাতের কথা ভেবেই তাঁরা পেরেশান। কল্যাণ এবং মুক্তির পথে মানুষেকে নিয়ে আসার জন্যই তাঁরা তৎপর।
প্রাচীন ইরাকের কুর্দিস্তান অঞ্চলে আবির্ভূত হয়েছিলেন নূহ (আ)। তিনি লোকদেরকে বলেন,
أُبَلِّغُكُمْ رِسَالَاتِ رَبِّي وَأَنصَحُ لَكُمْ وَأَعْلَمُ مِنَ اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ
‘আমি তোমাদের নিকট আমার রবের পয়গাম পৌঁছাই। আমি তোমাদের কল্যাণ কামনা করি। আমি আল্লাহর নিকট থেকে এমন সব বিষয় জানি যা তোমরা জান না।’ (সূরা আল আরাফঃ ৬২)
প্রাচীন আরবের আদ জাতির নিকট প্রেরিত হয়েছিলেন হূদ (আ)। তিনি লোকদেরকে বলেন,
أُبَلِّغُكُمْ رِسَالَاتِ رَبِّي وَأَنَا لَكُمْ نَاصِحٌ أَمِينٌ
‘আমি তোমাদের নিকট আমার রবের পয়গাম পৌঁছাই। আমি তোমাদের নির্ভরযোগ্য কল্যাণকামী।’ (সূরা আল আরাফঃ ৬৮)
প্রাচীন আরবের আরেক জাতি ছিলো ছামূদ জাতি। এই জাতির নিকট প্রেরিত হন ছালিহ (আ)। লোকদেরকে সম্বোধন করে তিনি বলেন,
يَا قَوْمِ لَقَدْ أَبْلَغْتُكُمْ رِسَالَةَ رَبِّي وَنَصَحْتُ لَكُمْ وَلَٰكِن لَّا تُحِبُّونَ النَّاصِحِينَ
‘ওহে আমার কাউম, আমি তোমাদের নিকট আমার রবের পয়গাম পৌঁছে দিয়েছি। আমি তোমাদের কল্যাণই চেয়েছি। কিন্তু তোমরা তো কল্যাণকামীদেরকে পছন্দ কর না।’ (সূরা আল আরাফঃ ৭৯)
প্রাচীন আরবের উত্তরাঞ্চলে বাস করতো মাদইয়ান জাতি। এদের নিকট প্রেরিত হন শুয়াইব (আ)। তিনি লোকদেরকে ডেকে বলেন,
يَا قَوْمِ لَقَدْ أَبْلَغْتُكُمْ رِسَالَاتِ رَبِّي وَنَصَحْتُ لَكُمْ ۖ فَكَيْفَ آسَىٰ عَلَىٰ قَوْمٍ كَافِرِينَ
‘ওহে আমার কাউম, আমি আমার রবের বাণী তোমাদের নিকট পৌঁছে দিয়েছি। আমি তোমাদের কল্যাণ চেয়েছি।’ (সূরা আল আরাফঃ ৯৩)
তাঁদের মতো সকল নবীই মানুষের কল্যাণকামী ছিলেন। সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ সা. নবুওয়াত লাভের পূর্বেও ছিলেন একজন অসাধারণ মানবদরদী মানুষ। মানুষের কল্যাণকামী ছিলেন বলেই তিনি সতর বছর বয়সে ‘হিলফুল ফুদুল’ নামক সংস্থার অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন।
চল্লিশ বছর বয়সে জাবালে নূরের হিরা গুহায় অবস্থানকালে জিবরীলকে (আ) দেখে তিনি ভীত হয়ে পড়েন। বাড়িতে ছুটে এসে স্ত্রী খাদীজাহ বিনতু খুয়াইলিদকে বলেন তাঁর গায়ে কম্বল জড়িয়ে দিতে। কিছুক্ষণ পর তাঁর গায়ের কম্পন দূর হয়। তিনি স্ত্রীকে বলেন, ‘আমার তো জীবনের ভয় ধরে গেছে।’ খাদীজাহ রা. তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘‘আপনি আশ্বস্ত হোন, আল্লাহ আপনাকে কখনো লাঞ্ছিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয় স্বজনের সাথে ভালো ব্যবহার করে থাকেন। সর্বদা সত্য কথা বলেন। অসহায় লোকদের দায়িত্ব গ্রহণ করে থাকেন। নিজের উপার্জিত অর্থ দরিদ্রদেরকে দান করেন। ভালো কাজে লোকদের সহযোগিতা করেন।’’
খাদীজাহ বিনতু খুয়াইলিদের (রা) বক্তব্যে মানব দরদী, মানুষের কল্যাণকামী মুহাম্মাদের সা. পরিচয় ফুটে উঠেছে। শুধু দুনিয়ার জীবন নয় মৃত্যুর পরবর্তী অনন্ত জীবনেও মানুষ যাতে সুখী হতে পারে সেই জন্য তিনি লোকদেরকে আল্লাহর পথে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাতে থাকেন।
আল্লাহর পথ পরিহার করে মানুষ যখন ইবলীসের পথে চলে তখন তাদের জীবনে সৃষ্টি হয় অসংখ্য জটিলতা। সমস্যার আবর্তে তারা ঘুরপাক খেতে থাকে। অশান্তির আগুনে তারা পুড়তে থাকে। তদুপরি আখিরাতের কঠিন আযাব তো তাদের জন্য অপেক্ষমান।
এই অবস্থা দেখে ইসলামী নেতৃত্ব কখনো উল্লসিত হন না। মনের গভীরে তাঁরা দারুণ ব্যথা অনুভব করেন। দুঃখী মানুষের দুঃখ বেদনা লাঘবের জন্য তাঁরা এগিয়ে আসেন। মানুষের সার্বিক কল্যাণ সাধনের জন্য মানুষের চিন্তা-চেতনা থেকে জাহিলিয়াতের মূলোৎপাটন করে তাদেরকে পরিশুদ্ধ করে কল্যাণময় সমাজ গঠনের উপাদানে পরিণত করার চেষ্টা চালাতে থাকেন।
ইসলামী নেতৃত্ব জানেন যে মানুষের মন্দ আচরণের মূলে রয়েছে মন্দ চিন্তা-চেতনা। এই মন্দ আচরণ দেখে মানুষকে ঘৃণা না করে মানুষের মন্দ চিন্তা-চেতনা দূর করার দিকেই তাঁরা নজর দেন। কারণ মন্দ চিন্তা-চেতনা দূর হলেই মানুষের জীবন থেকে মন্দ আচরণ বিদূরিত হয়।
ইসলামী নেতৃত্বই মানুষের প্রকৃত কল্যাণকামী। দুর্ভাগা মানুষেরা এই মহা সত্যকে উপলব্ধি করতে পারে না। ফলে তারা তাদের কল্যাণকামীদেরকেই তাদের দুশমন মনে করে এবং তাঁদের সাথে দুর্ব্যবহার করে থাকে। ইসলামী নেতৃত্ব এই দুর্ভাগাদের প্রতি দরদী এবং ক্ষমাশীল মন নিয়ে তাকান। দিনরাত তাদের কল্যাণের কথাই ভাবেন। যাঁদের অন্তরে মানব প্রেমের ফল্গুধারা নেই ইসলামী নেতা হওয়ার যোগ্যতা তাঁদের নেই। ‘রাহমাতুললিল্ আলামীনের’ উত্তরসূরী হওয়ার বিশেষ বৈশিষ্ট্য তাঁদের মাঝে নেই।
৪. ইসলামী নেতৃত্বের বুনিয়াদী কাজ ইসলামী ব্যক্তিত্ব গঠন
ইসলামী সমাজ গঠনের জন্য চাই ইসলামী ব্যক্তিত্ব। যাদের জীবনে ইসলাম নেই। তারা সমাজে ইসলাম কায়েম করবেন কিভাবে? আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنفُسِهِمْ
‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না যেই পর্যন্ত না তারা তাদের বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে।’’ (সূরা আর রাদঃ ১১)
এই আয়াতটিকে রয়েছে সমাজ পরিবর্তন প্রক্রিয়া সংক্রান্ত ইসলামী কনসেপ্ট। এই আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অত্যন্ত স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে একটি জাতির ব্যক্তিবর্গ তাদের জীবনধারা যেইভাবে গড়ে তোলে, সামগ্রিকভাবে জাতীয় জীবনে সেই ধারাই বিকশিত হয়। অর্থাৎ কোন জাতিকে যদি সামগ্রিকভাবে পরিবর্তন করতে হয় তাহলে প্রথমে জাতির লোকদের চরিত্রে পরিবর্তন আনতে হবে। আবার এটাও সত্য যে চিন্তাধারায় পরিবর্তন সাধন না করে কারো চরিত্রে পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়।
আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষের প্রকৃতি। মানুষের জীবনে পরিবর্তন সাধনের প্রক্রিয়া একমাত্র তাঁরই জানা।
মেহেরবান আল্লাহ যুগে যুগে নবী রাসূল পাঠিয়েছেন। ওহীর মাধ্যমে প্রদত্ত তাঁর জীবন দর্শন মানুষের সামনে উপস্থাপন করার দায়িত্ব দিয়েছেন তাঁদেরকে। নবী রাসূলগণ প্রথমে মানুষের চিন্তা-চেতনাকে আলোড়িত করতে চেয়েছেন। মানুষের চিন্তাজগতে ইসলামী জীবন দর্শনের বীজ বপন করার চেষ্টা করেছেন। যাদের চিন্তাজগত ইসলামী জীবন দর্শন ধারণ করেছে তাদের কর্ম জগতে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে স্বাভাবিক নিয়মেই।
সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ সা. একই পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন।
এই সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,
هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِّنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِن كَانُوا مِن قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ
‘তিনিই সেই সত্তা যিনি উম্মীদের জন্য তাদের মধ্য থেকে একজন রাসূলের আবির্ভাব ঘটিয়েছেন যে তাদেরকে তাঁর আয়াত পড়ে শুনায়, তাদের তাযকিয়া করে এবং তাদেরক আল কিতাব ও আল হিকমাহ শিক্ষা দেয়।’’ (সূরা আল জুমুআঃ ২)
كَمَا أَرْسَلْنَا فِيكُمْ رَسُولًا مِّنكُمْ يَتْلُو عَلَيْكُمْ آيَاتِنَا وَيُزَكِّيكُمْ وَيُعَلِّمُكُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُعَلِّمُكُم مَّا لَمْ تَكُونُوا تَعْلَمُونَ
‘‘যেমন আমি তোমাদের নিকট তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রাসূল পাঠিয়েছি যাতে সে তোমাদেরকে আমার আয়াত পড়ে শুনায়, তোমাদের জীবন পরিশুদ্ধ করে, তোমাদেরকে আল কিতাব ও আল হিকমাহ শিক্ষা দেয় এবং যেইসব কথা তোমাদের জানা ছিলো না তা তোমাদেরকে জানিয়ে দেয়।’’ (সূরা আল বাকারাঃ ১৫১)
لَقَدْ مَنَّ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِّنْ أَنفُسِهِمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِن كَانُوا مِن قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ
‘‘আল্লাহ মুমিনদের প্রতি এই অনুগ্রহ করেছেন যে তিনি তাদের মধ্য থেকে একজন রাসূল বানিয়েছেন, যে তাদেরকে আল্লাহর আয়াত পড়ে শুনায়, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করে এবং তাদেরকে আল কিতাব ও আল হিকমাহ শিক্ষা দেয়।’’ (সূরা আলে ইমরানঃ ১৬৪)
মুহাম্মাদ সা. সর্বশেষ নবী। তাঁর প্রতি অবতীর্ণ আল-কুরআন সর্বশেষ আসমানী কিতাব। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কিয়ামাত পর্যন্ত আল-কুরআনকে অবিকৃতভাবে সংরক্ষিত রাখার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। মহানবীর সা. দীর্ঘ ২৩ বছরের নবুওয়াতী যিন্দেগীর যাবতীয় কর্মকাণ্ডের বিবরণও অবিকৃতভাবে সংরক্ষিত রয়েছে।
এই যুগের ইসলামী নেতৃত্বের কর্তব্য হচ্ছে মহানবীর সা. অনুকরণে আল-কুরআনকে মানুষের সামনে পেশ করা, আল-কুরআনে উপস্থাপিত জীবন দর্শনকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করার জন্য তাদেরকে অনুপ্রাণিত করা এবং আল-কুরআন ও আল-হাদীসের আলোকে জীবনকে ঢেলে সাজানোর জন্য তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করা। যারা আল-কুরআনের জীবন দর্শনকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করে তারাই খাঁটি মুমিন। আর এই মুমিনগণ যাবতীয় গর্হিত কাজ থেকে বেঁচে থাকে এবং যাবতীয় নেক আমল অনুশীলন করে তাদের জীবনকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করে নিক, এটাই আল্লাহর অভিপ্রায়।
কোন ভূ-খণ্ডের বিপুল সংখ্যক লোক যখন এইভাবে গড়ে ওঠে তখনই তৈরী হয় ইসলামী গণভিত্তি। আর এই গণভিত্তি ইসলামী সমাজ নির্মাণের বুনিয়াদ। ইসলামী সমাজ বিনির্মাণের জন্য ইসলামী ব্যক্তিত্ব গঠন হচ্ছে ইসলামী নেতৃত্বের বুনিয়াদী কাজ।
৫. কঠোরতা নয় কোমলতা অবলম্বনই ইসলামী নেতৃত্বের প্রধান সাংগঠনিক নীতি
ইসলামী আন্দোলনের মূল নেতৃত্ব অর্থাৎ আম্বিয়ায়ে কিরাম তাঁদের অনুগামীদের প্রতি খুবই কোমল ছিলেন। তাঁরা অনুসারীদের সাথে কঠোর আচরণ করতেন না। তাদের সাথে কর্কশভাবে কথা বলতেন না। তাদেরকে তিরস্কার করতেন না। তাদেরকে গালমন্দ করতেন না।
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের সা. জীবন চরিত বিস্তারিতভাবে লিখিত রয়েছে। তাঁর জীবনে মন্দ আচরণের কোন উদাহরণ নেই। তিনি অনুগামীদেরকে তাদের আগেই সালাম দিতেন। হাসিমুখে তাদের সাথে কথা বলতেন। কখনো রাগান্বিত হলে তিনি তা কাউকে বুঝতে দিতেন না। তিনি যখন রাগতেন চেহারায় রক্তিমাভা ফুটে ওঠতো। চেহারায় ঘাম দেখা দিতো। এ থেকে লোকেরা আন্দাজ করতো যে রাসূলুল্লাহ সা. রাগান্বিত হয়েছেন। রাগান্বিত অবস্থায় তিনি কাউকে বকাঝকা করতেন না। কটুকথা বলতেন না।
আল্লাহ তাঁর রাসূলকে সা. সম্বোধন করে বলেন,
خُذِ الْعَفْوَ
‘‘ক্ষমাশীলতার নীতি অবলম্বন কর।’’ (সূরা আল আরাফঃ ১৯৯)
অনুগামীদের প্রতি তিনি সব সময়ই ছিলেন সহনশীল ও ক্ষমাশীল। তিনি ছিলেন بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ ‘‘মুমিনদের প্রতি দরদী ও করুণাসিক্ত।’’ (সূরা আত তাওবাঃ ১২৮)
আল্লাহর রাসূলের সা. অনুগামীগণই মানুষই ছিলেন। ফলে তাঁদের ভুলভ্রান্তি হতো। কিন্তু তাঁদের ভুলভ্রান্তি দেখে তিনি ক্ষেপে ওঠতেন না। সংশোধনের লক্ষ্যে বিনম্র ভাষায় তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন।
তাঁর কথা ও কাজে ছিলো মাধুর্য। তাঁর অমায়িক ব্যবহার তাঁকে এক আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিলো। তাঁর মুখে মধুর বাণী শুনার জন্য, তাঁর সান্নিধ্যে থেকে প্রাণ জুড়াবার জন্য যখনই সুযোগ পেতো তাঁর অনুগামীগণ তাঁর কাছে ছুটে আসতো। তারা সহজে তাঁর সান্নিধ্য ত্যাগ করতে চাইতো না। মহানবীর সা. আচরণ সম্পর্কে মহান আল্লাহ নিজেই বলেন,
فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللَّهِ لِنتَ لَهُمْ ۖ وَلَوْ كُنتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ
‘‘এটা আল্লাহর অনুগ্রহ যে তুমি তাদের প্রতি নম্র স্বভাবের হয়েছো। যদি তুমি কঠোর ভাষা ও কঠোর চিত্তের লোক হতে লোকেরা তোমার চারদিক থেকে ভেগে চলে যেতো।’’ (সূরা আলে ইমরানঃ ১৫৯)
مُّحَمَّدٌ رَّسُولُ اللَّهِ ۚ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ
‘‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল এবং তার সাথীগণ কাফিরদের প্রতি কঠোর, কিন্তু পরস্পর রহম দিল।’’ (সূরা আল ফাতহঃ ২৯)
কাফিরদের প্রতি কঠোর মানে এই নয় যে, তাঁরা তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করতো। বরং কাফিরদের অনুসৃত মত ও পথের প্রতি তাঁদের ভূমিকা ছিলো নিরাপোষ। আবার কাফিরগণ যখন তাঁদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিতো তখন ইস্পাতের দৃঢ়তা নিয়ে তাঁরা তাদের সাথে যুদ্ধ করতো। কিন্তু এই ইস্পাত কঠিন মানুষগুলো যখন একের সাথে অপরজন মেলামেশা করতো, আলাপ করতো, তখন একটি মধুর পরিবেশ সৃষ্টি হতো। তাঁদের আচরণে সহমর্মিতা ও প্রীতি সম্প্রীতির উষ্ণতা প্রকাশ পেতো।
পরবর্তীকালে ইসলামী নেতৃত্ব যাতে অনুগমীদের প্রতি কোমল আচরণ করে সেই দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ সা. বলেছেন, ‘‘নিকৃষ্ট দায়িত্বশীল ওই ব্যক্তি, যে অধীন ব্যক্তিদের প্রতি কঠোর। সাবধান থাকবে যাতে তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত না হয়ে পড়।’’ (সহীহ আল–বুখারী, সহীহ মুসলিম)
আয়িশা রা. বলেন যে নবী সা. বলেছেন, ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ কোমল। তিনি কোমলতা ভালোবাসেন। তিনি কোমলতা দ্বারা ওই জিনিস দান করেন যা কঠোরতা দ্বারা দান করেন না।’’ (সহীহ মুসলিম)
এই যুগের ইসলামী নেতৃত্বকেও আল-কুরআন ও আল-হাদীসের আলোকে উদারতা-ক্ষমাশীলতা-কোমলতাকে প্রাধান্য দিয়ে তাঁদের অনুগামীদের সাথে আচরণ করা উচিত। ইসলামী শারীয়ার বিধান লঙ্ঘন করার কারণে আল্লাহর রাসূল সা. তাঁর কোন কোন অনুগামীকে কঠোর শাস্তি দিয়েছেন। কিন্তু ওই ব্যক্তিদেরকেও তিনি গালমন্দ করেননি। তাদের সাথে অশোভন আচরণ করেননি।
এই যুগের ইসলামী নেতৃত্বকেও তাদের অনুগামীদের কারো কারো বিরুদ্ধে বিশেষ কারণে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হতে পারে। এতদসত্ত্বেও তাঁদের ব্যক্তিগত আচরণ বিন্দুমাত্র অভদ্রজনোচিত হবে না।
সংগঠনের সকল কর্মী একই মানের থাকে না। তাই সকলের কাজও একই মানের হয় না। মেধার পার্থক্য, বয়সের পার্থক্য, সুস্থতা-অসুস্থতা, সমস্যার স্বল্পতা কিংবা আধিক্য ইত্যাদি কারণে সকলের কাজের মান এক হবে না, হতে পারে না।
বিভিন্ন সময়ে নেতৃত্বকে অনুগামীদের ওপর বিশেষ বিশেষ কাজ চাপাতে হয়। কাজ চাপানোর আগে উপরোক্ত বিষয়গুলো ভালোভাবে বিবেচনা করে সঠিক ব্যক্তির ওপর সঠিক কাজ চাপানো উচিত। কাজ চাপানোর আগেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিষয় ভালোভাবে অবহিত হয়ে তবেই কাজ চাপানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।
৬. শূরা ইসলামী নেতৃত্বের নিরাপত্তা বেষ্টনী
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নেতৃত্বকে নির্দেশ প্রদানের অধিকার দান করেছেন। নেতৃত্বের নির্দেশ পালন অনুগামীদের ওপর ফারয করেছেন। নেতৃত্ব কোন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্যই অনুগামীদেরকে নির্দেশ দিয়ে থাকেন। যদিও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশ প্রদানের অধিকার নেতৃত্বকে দেয়া হয়েছে কিন্তু এককভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার নেতৃত্বকে দেয়া হয়নি। মহাবিজ্ঞ আল্লাহ বলেন,
وَأَمْرُهُمْ شُورَىٰ بَيْنَهُمْ
‘‘তাদের কার্যাবলী পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে নিষ্পন্ন হয়।’’ (সূরা আশ শূরাঃ ৩৮)
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা. ব্যক্তিগতভাবে খুবই বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন। নবী হওয়ার পূর্বেই কা’বা সংস্কারের পর হাজরে আসওয়াদ যথাস্থানে সংস্থাপনের জন্য বিবাদমান গোত্রগুলোর বিবাদ তিনি যেইভাবে মীমাংসা করেছিলেন তাতে তাঁর অসাধারণ বিচক্ষণতার পরিচয় মেলে। কিন্তু এই বিচক্ষণ ব্যক্তিটির প্রতিও আল্লহর নির্দেশ ছিলো,
وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ
‘‘সামষ্টিক বিষয়ে তাদের সাথে পরামর্শ কর।’’ (সূরা আলে ইমরানঃ ১৫৯)
যেই বিষয়ে আল্লাহ ওহী পাঠিয়ে রাসূলুল্লাহকে সা. নির্দেশ দিতেন না, সেইসব বিষয়ে তিনি বিশিষ্ট সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিতেন। বদর প্রান্তরে পৌঁছে একটি স্থান দেখিয়ে রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর সাহাবীদেরকে তাঁবু স্থাপন করতে বলেন। যুদ্ধ বিশারদ সাহাবীগণ জানতে চান যে ওই স্থানে তাঁবু স্থাপনের জন্য তিনি কি আল্লাহ কর্তৃক আদিষ্ট। রাসূলুল্লাহ সা. না সূচক জবাব দিলে তাঁরা অপর একটি স্থানের দিকে অংগুলি নির্দেশ করে বলেন যে তাঁদের মতে যুদ্ধ কৌশলের দৃষ্টিতে ওই স্থানটিতে তাঁবু স্থাপন করলে ভালো হয়। আল্লাহর রাসূল সা. তাঁদের পরামর্শ গ্রহণ করেন এবং দ্বিতীয় স্থানটিতে তাঁবু স্থাপনের নির্দেশ দেন।
উহুদ যুদ্ধের প্রাক্কালে মাসজিদে নববীতে সাহাবীগণের সাথে পরামর্শ করতে বসলেন আল্লাহর রাসূল সা.। বিবেচ্য বিষয় ছিলোঃ শহরে অবস্থান করে যুদ্ধ করা, না শহরের বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করা। অধিকাংশ সাহাবী শহরের বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন। তাঁদের পরামর্শ গ্রহণ করে আল্লাহর রাসূল সা. যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে উহুদ প্রান্তরে গিয়ে সৈন্য সমাবেশ করেন।
যেইসব সিদ্ধান্তের সাথে বহু সংখ্যক লোকের ভাগ্য জড়িত সেইসব সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় তাদের সকলের অথবা তাদের প্রতিনিধিদের পরামর্শ নেয়া প্রয়োজন। আন্দোলনের জীবনে এমন সময়ও আসে যখন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এমন সিদ্ধান্ত নেতৃত্ব যদি একা একা গ্রহণ করেন এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যদি জান ও মালের বিপুল ক্ষতি হয়, তাহলে পরবর্তী সময়ে নেতৃত্বকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতে পারে। ব্যর্থতার সব গ্লানি তাঁদের ঘাড়ে চাপানো চেষ্টা হতে পারে। কিন্তু সিদ্ধান্তটা যদি সকলের সাথে কিংবা তাদের প্রতিনিধিদের সাথে পরামর্শ করে গ্রহণ করা হয় তখন নেতৃত্বের ঘাড়ে দোষটা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবে না কেউ।
তাছাড়া এটা অনস্বীকার্য যে বহু সংখ্যক লোক বিভিন্ন দিক দেখে শুনে ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিলে সঠিক সিদ্ধানেরত উপনীত হওয়াটাই স্বাভাবিক। একজন মাত্র ব্যক্তি সিদ্ধান্ত নিলে তাঁর দ্বারা একটি বেঠিক সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়ে যেতে পারে। দুনিয়ার ডিকটেটরদের ইতিহাস তার সাক্ষী। দুনিয়াতে যেইসব ডিকটেটারের আবির্ভাব ঘটেছে তারা কিন্তু বোকা লোক ছিলো না। তাদের বহু সিদ্ধান্তই সঠিক ছিলো। কিন্তু একা একা সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে তারা কখনো কখনো এমন সব সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে যা একদিকে তাদের নিজের জন্য, অপরদিকে তাদের জাতির জন্য বড়ো রকমের অকল্যাণ ডেকে এনেছে। তারা ধিকৃত হয়েছে, অপমানিত হয়েছে। তাদের কারো কারো অপমৃত্যু ঘটেছে।
মহান আল্লাহর নির্দেশে ইসলামী নেতৃত্বকে শূরা বা পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তাই তাদেরকে ডিকটেটারদের করুণ পরিণতির সম্মুখীন হতে হয় না। সেই জন্যই বলছিলাম, শূরা ইসলামী নেতৃত্বের নিরাপত্তা বেষ্টনী।
৭. বাগ্মিতা ইসলামী নেতৃত্বের শানিত হাতিয়ার
বক্তৃতা-ভাষণের যোগ্যতাই বাগ্মিতা। বক্তৃতা-ভাষণের মাধ্যমেই নবী রাসূলগণ তাঁদের কাউমের নিকট ইসলামী জীবন দর্শন ও জীবন বিধান সম্পর্কিত বিভিন্ন কনসেপ্ট তুলে ধরেন। সকল নবীই ছিলেন সুবক্তা।
মূসা আ. ভালো বক্তা ছিলেন। কিন্তু তাঁর বড়ো ভাই হারুন আ. ছিলেন আরো বেশি ভালো বক্তা। আদদাওয়াতু ইলাল্লাহর কাজ করার জন্য বক্তৃতা-ভাষণের পারদর্শিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর হারুণ আ. যেহেতু এই ক্ষেত্রে পারদর্শী ছিলেন সেহেতু মূসা আ. আল্লাহর নিকট আবেদন রাখেন যাতে হারুনকে আ. তাঁর সহযোগী বানিয়ে দেন।
وَأَخِي هَارُونُ هُوَ أَفْصَحُ مِنِّي لِسَانًا فَأَرْسِلْهُ مَعِيَ رِدْءًا يُصَدِّقُنِي ۖ إِنِّي أَخَافُ أَن يُكَذِّبُونِ
‘‘আর আমার ভাই হারুন আমার চেয়ে বেশি বাগ্মিতা সম্পন্ন, তাকে আমার সাহায্যকারী হিসেবে পাঠান যাতে সে আমার সত্যতা প্রমাণ করতে পারে।’’ (সূরা আল কাছাছঃ ৩৪)
দাউদ আ. এর বাগ্মিতা সম্পর্কে আল্লাহ নিজেই বলেন,
‘‘আমি তার রাজত্বকে সুদৃঢ় করেছি, তাকে আল হিকমাহ দান করেছি। আর দিয়েছি চূড়ান্ত বক্তব্য পেশ করার যোগ্যতা।’’ (সূরা ছোয়াদঃ ২০)
অর্থাৎ দাউদের আ. কথা পেঁচানো ও অস্পষ্ট হতো না। তিনি কি বুঝাতে চান তা বুঝতে কারো কষ্ট হতো না। তিনি যেই বিষয়ে কথা বলতেন তা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠতো। আর শ্রোতাদের অন্তর বলে ওঠতো এই বিষয়ে এটাই তো প্রকৃত কথা, এটাই তো চূড়ান্ত কথা।
এই গুণটি কেবল দাউদকে আ. দেয়া হয়েছিলো তা নয়, অন্যান্য নবী-রাসূলও এই গুণে গুণান্বিত ছিলেন।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহও সা. একজন সুবক্তা ছিলেন। তাঁর বক্তৃতা দীর্ঘ হতো না। কিন্তু তার সংক্ষিপ্ত বক্তৃতার মাঝেই ভাব ও তত্ত্বজ্ঞান থাকতো অনেক বেশি। এই সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘আমি সংক্ষিপ্ত অথচ ব্যাপক ভাব প্রকাশক বক্তৃতা ভাষণের যোগ্যতাসহ আবির্ভূত হয়েছি।’’
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ সা. বিদায় হাজ্জে যেই ভাষণ দেন তা খুবই সংক্ষিপ্ত। কিন্তু এই ভাষণের প্রতিটি বাক্যে যেই তাৎপর্য লুকিয়ে আছে তা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে বড়ো বড়ো গ্রন্থ রচনা করা সম্ভব।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর সা. বক্তৃতার ভাষা ছিলো প্রাঞ্জল। শব্দগুলো ছিলো সহজ। ভাষণের গুরুত্বপূর্ণ অংশ তিনি পুনরাবৃত্তি করতেন। প্রতিটি শব্দ স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করে বক্তব্য রাখতেন। তাঁর বক্তৃতা-ভাষণে আল-কুরআনের উদ্ধৃতি প্রাধান্য পেতো।
এই যুগের ইসলামী নেতৃত্বকেও বক্তৃতা-ভাষণে পারদর্শী হতে হবে। তাঁদেরকে আল-কুরআন এবং আল-হাদীসের জ্ঞান বক্তৃতা ভাষণের মাধ্যমেই অপরাপর মানুষের কাছে উপস্থাপন করতে হবে। কিছু লোক বক্তৃতা-ভাষণের পারদর্শিতা সহজেই আয়ত্ত করতে পারেন। আবার কিছু লোককে তা আয়ত্ত করতে হয় খেটে খুটে। অর্থাৎ বক্তৃতা-ভাষণের প্রশিক্ষণ নিতে হয় তাদেরকে। দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে কিছুকাল প্র্যাকটিস করলেই ভালো বক্তা হওয়া যায়।
৮. আমানাতদারী ইসলামী নেতৃত্বের মর্যাদার গ্যারান্টি
আবদুল্লাহ ইবনুল আব্বাস রা. বলেন, ‘আল্লাহ তাঁর বান্দাহদের ওপর যা কিছু ফারয করেছেন তাই আমানাত। আর আল্লাহর আদেশ কিংবা নিষেধ অমান্য করাই আমানাতের খিয়ানত।’ আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রা. বলেন, ‘ছালাত, অযু, গোসল, ক্রয়-বিক্রয়, দাঁড়িপাল্লা সবই আমানাত। আর গচ্ছিত সম্পদ হচ্ছে সবচে’ বড়ো আমানাত।’
নেতা নির্বাচন কালে যোগ্যতম ব্যক্তির পক্ষে নিজের ভোট প্রদান করা আমানাতদারীর দাবি।
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَن تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَىٰ أَهْلِهَا
‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন আমানাতের হকদারের হাতে তা সোফর্দ করতে।’’ (সূরা আন্ নিসাঃ ৫৮)
কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণকালে নিঃসংকোচে নিজের অভিমত ব্যক্ত করা আমানাতদারীর দাবি। সঠিক ব্যক্তিদেরকে তালাশ করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করা আমানাতদারীর দাবি। যেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য অনুগামীগণ নেতৃত্বকে কেন্দ্র করে সংগঠিত হয়েছে সেই লক্ষ্যাভিসারী কর্মকাণ্ডে তাদেরকে নিয়োজিত রাখা আমানাতদারীর দাবি।
সংগঠনের টাকা-পয়সা, ফাইলপত্র, আসবাব ইত্যাদি ছোট বড়ো সকল সম্পদ সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা এবং সংগঠনের লক্ষ্য হাসিলের জন্য ব্যয়-ব্যবহার করা আমানাতদারীর দাবি।
আল্লাহর রাসূল সা. বলেছেন, ‘‘মুনাফিকের আলামত তিনটি। যখন সে কথা বলে মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে তা ভঙ্গ করে এবং তার কাছে কিছু আমানাত রাখলে তার খিয়ানত করে।’’ (সহীহুল বুখারী, সহীহ মুসলিম)
আল্লাহর রাসূল সা. বলেছেন, ‘‘যাঁর আমানতদারী নেই তার ঈমান নেই। যার ওয়াদা পালনে নেই তার দীনদারী নেই।’’ (আহমাদ, সহীহুল বুখারী, আত্তাবারানী)
আল্লাহর রাসূল সা. বলেছেন, ‘‘মানুষের মধ্য থেকে সর্বপ্রথম যেই সদগুণটি তিরোহিত হবে তা হচ্ছে আমানতদারী।’’ ইসলামী নেতৃত্বকে আমানাতদারীর পূর্ণাঙ্গ কনসেপ্ট-এর সাথে পরিচিত হতে হবে। তাঁদেরকে সর্ববস্থায় আমানাতের হিফাযতের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
আমানাতের খিয়ানতকারীকে কেউ পছন্দ করে না। তাকে কেউ শ্রদ্ধা করে না। তার কথায় কেউ আস্থা স্থাপন করে না। তাকে কেউ নির্ভরযোগ্য মনে করে না। তাকে কেউ মর্যাদাবান লোক গণ্য করে না।
পক্ষান্তরে আমানাতদার লোককে লোকেরা ভালোবাসে। শ্রদ্ধা করে। তাকে নির্ভরযোগ্য গণ্য করে। তাকে মর্যাদাবান লোক বলে স্বীকার করে। এ থেকে প্রমানিত হয় যে আমানাতদারী গুণটি একজন ব্যক্তির মর্যাদার হিফাযতকারী হয়ে থাকে। তাই ইসলামী নেতৃত্বকে অবশ্যই সকল বিষয়ে আমানাতদার হতে হবে।
৯. যোগ্য উত্তরসূরী সৃষ্টি ইসলামী নেতৃত্বের বড়ো সফলতা
কোন মানুষই দুনিয়ায় অমর নয়। আজ যাঁরা ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাঁরাও অমর নন। তাই আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায়ের জন্য নেতৃত্ব তৈরী করে যাওয়া তাদের কর্তব্য। ইবরাহীম আ. দুনিয়ার বিশাল এলাকায় আল ইসলামকে বিজয়ী আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আবার, আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায়ে নেতৃত্ব দেবার জন্য তিনি ইসমাইল আ., ইসলাম আ. এবং লূতকে আ. তৈরী করে গেছেন।
মূসা আ. বানু ইসরাইলকে নিয়ে ট্রান্স জর্ডনের বিশাল এলাকায় ইসলামের প্রাধান্য পতিষ্ঠিত করেন। তাঁর পরবর্তী মানযিল ছিলো ফিলিস্তিন। কিন্তু সেখানে পৌঁছার আগেই তিনি ইন্তিকাল করেন। তাঁর হাতে গড়া ইউশা বিন নূন এবং কালিব বানু ইসরাইলকে নেতৃত্ব দিয়ে ফিলিস্তিনে এনে প্রতিষ্ঠিত করেন।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা. ২৩ বছরের আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে মাদীনাকে কেন্দ্র করে গোটা জাযিরাতুল আরবে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করেন। আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার সাথে সাথে তিনি একদল লোকও গঠন করে যান। তাঁর ইন্তিকালের পর আবু বাকর আছ ছিদ্দিক রা., উমার ইবনুল খাত্তাব রা., উসমান ইবনু আফফান রা. এবং আলী ইবনু আবি তালিব রা. একে একে আমীরুল মুমিনীন হিসেবে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনা করেন।
বর্তমানে যাঁরা ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাঁদেরকে এই বিষয়টি অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য বিষয়ের তালিকায় রেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। সংগঠনের জনশক্তিকে স্টাডি করে মৌলিক মানবীয় গুণসম্পন্ন লোক বাছাই করতে হবে।
সাধারণত পরিশ্রমপ্রিয়তা, বিচক্ষণতা, দূরদৃষ্টি, সূক্ষ্ণদৃষ্টি, প্রখর স্মৃতি শক্তি, প্রশস্তচিত্ততা, স্থির চিত্ততা, ভারসাম্যপূর্ণ মিজাজ, উদ্ভাবন শক্তি, বাগ্মিতা, সাংগঠনিক প্রজ্ঞা প্রভৃতি গুণকে মৌলিক মানবীয় গুণ বলা হয়। ইসলামী আন্দোলনের জন্য শুধু মৌলিক মানবীয় গুণ যথেষ্ট নয়। এর সাথে সমন্বিত থাকতে হবে চিন্তার বিশুদ্ধতা এবং উন্নত নৈতিকতা। নেতৃত্বকে বাছাই করতে হবে মৌলিক মানবীয় গুণ, চিন্তার বিশুদ্ধতা এবং উন্নত নৈতিকতা সম্পন্ন ভারসাম্যপূর্ণভাবে অগ্রসরমান কিছু সংখ্যক কর্মী।
বাছাইকৃত ব্যক্তিদেরকে ইসলামী আন্দোলনের লক্ষ্য, প্রকৃতি, নির্বাচন পদ্ধতি, সিদ্ধান্ত গ্রহণ পদ্ধতি, সংশোধন পদ্ধতি, সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা পদ্ধতি, পরিকল্পনা প্রণয়ন পদ্ধতি, রেকর্ডপত্র সংরক্ষণ পদ্ধতি, হিসাব সংরক্ষণ পদ্ধতি ইত্যাদি শেখাতে হবে।
বাছাইকৃত কর্মীদেরকে বিশুদ্ধভাবে আল-কুরআন তিলাওয়াত, উন্নত মানের দারসুল কুরআন প্রদান এবং আকর্ষণীয় বক্তৃতা-ভাষণ প্রদানের পদ্ধতি শেখাতে হবে। তাদের জন্য বিভিন্নমুখী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া মাঝে মধ্যে তাদের সাথে ব্যক্তিগত আলাপ করা এবং বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দেয়াও জরুরী। যতো বেশি সম্ভব তাদেরকে সাহচর্য দান করা উচিত।
এইভাবে যাদের পেছনে শ্রম দেয়া হবে ভবিষ্যতে নেতৃত্ব তাদের মধ্য থেকেই বেরিয়ে আসবে।