আমার সংক্ষিপ্ত আত্ম কাহিনী
– আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসুফ (মোমতাজুল মুহাদ্দেছীন)
আদি বাসস্থান ও সেখান থেকে স্থানান্তরঃ
আমাদের আদি বাড়ি ছিল বরিশাল জেলাধীন বাণারিপাড়া থানার চাখার গ্রামে। চাখার একটি প্রসিদ্ধ গ্রাম। যুক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী মরহুম শেরে বাংলার পিতা ছিলেন এই গ্রামের আধিবাসী। এ গ্রামে তখন বেশ কিছু সম্ভ্রান্ত পরিবার বসবাস করত। ফলে গ্রামটি ছিল প্রসিদ্ধ। আমার পিতার মুখে শুনা, আব্বার দাদা জহিরুদ্দীন হাওলাদার এখান থেকে এসে বরিশাল জেলার মঠবাড়িয়া থানাধীন মাছুয়া গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। আমার দাদা আপিলুদ্দীন হাওলাদারের জন্ম যতাসম্ভব এই গ্রামে। এখান থেকে এসে আমার দাদা বর্তমান শরনখোলা থানার রাজইর গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। তখন এ এলাকাটা পুরাটাই মোড়েলগঞ্জ থানার অধীনে ছিল। অনেক পরে পরবর্তি এক সময় মাত্র চারটি ইউনিয়ন নিয়ে ফাড়ি থানা হিসেবে শরন খোলা থানা সৃষ্টি করা হয়। তখন মোড়েলগঞ্জ থানার প্রায় সব এলাকা জুড়ে সুন্দরবন ছিল।
অষ্টাদশ শতাব্দির শেষের দিকে ব্রিটেনের নাগরিক মোড়েল সাহেব তদানিন্তন বাঙ্গীয় বৃটিশ প্রশাসনের কাছে থেকে পুরা এলাকাটি তার জমিদারী হিসেবে নিয়ে নেন। অতপর মোড়েল সাহেবের নামানুসারে এলাকাটর নামকরণ করা হয় মোড়েলগঞ্জ থানা। মোড়েল সাহেব তার জমিদারীর অন্তর্ভূক্ত সুন্দরবনের জমি আবাদ করে বাসপোযোগী ও চাষপোযোগী করার জন্য নামে মাত্র খাজনায় পত্তন দেয়ার জন্য ঘোষণা দেন। তখন পার্শ্ববর্তী বিরিশাল জেলা হতে বেশ কিছু লোক এসে মোড়েল সাহেবের প্রজা হিসেবে নামে মাত্র খাজনার বিনিময়ে জমি পত্তন নিয়ে জংগল কেটে জমি আবাদ করে। এ সময় আমাদের দাদা আপিলুদ্দীন হাওলাদারও অন্যান্য লোকের সাথে রাজইর গ্রামে এসে জমি পত্তন নেন এবং জংগল ছাফকরে সবতি স্থাপন করেন। তখন নাকি এ এলাকায় বাঘ, শুকর ও সাপের বেশ উপদ্রব ছিল। খুব সহসী ও দুর্ধর্ষ লোক ছাড়া এখানে অন্য কেহ বসবাস করতে সাহস করত না।
আমার পিতা ও পিতামহঃ
আমার পিতা আজিমুদ্দীন হাওলাদার যথাসম্ভব ১৮৯৮ কিংবা ১৮৯৯ সনে রাজইর গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। আমার দাদা দুই ছেলে ও এক মেয়ে রেখে অল্প বয়সেই মারা যান। আমার আব্বা ছিলেন তিন জনের মধ্যে বড়্ আমার ছোট চাচা ও ফুফী অল্প বয়সেই মৃত্যুবরণ করেন। আমার বিধবা দাদী আমার আব্বাকে নিয়ে রাজইরের বাড়িতে বসবাস করতে থাকেন। আমার দাদী ছিলেন প্রখর বুদ্ধিমতি ও সাহসী। তাকে আমি দেখেছি। আমার মাইনর স্কুলে পড়ার সময়ই তিনি পরকলোক গমন করেন।
আমার মাতা ও মাতামহঃ
আমার মাতা ছিলেন আমাদের পার্শ্ববর্তী গ্রাম মঠেরপার নিবাসী মরহুম সিরাজুদ্দীন হাওলাদারের কন্যা। আমার নানাও দুই ছেলে ও এক কন্যা রেখে আমার দাদার ন্যায় অল্প বয়সে মারা যান। আমার নানি দুই ছেলে ও এক মেয়েসহ অল্প বয়সে বিধবা হন। আমার নানি ছিলেন বরিশাল জেলার তেলিখালী গ্রামের মেয়ে। নানির ভাইয়েরা নানিকে অল্প বয়সী হওয়ার কারনে তেলিখালী নিয়ে দ্বিতীয় বিবাহ দেন। ফলে আমার মা ও দুই মামা তাদের দাদা-দাদীর কাছে লালিত-পালিত হতে থাকেন। মায়ের দাদা হাজি নাসরুদ্দিন ছিলেন এলাকার খুবই গণ্যমান্য ও শদ্ধেয় ব্যক্তি। আমা বড় হলে পরে আম্মার গার্জিয়ান ও আমার দাদীর আগ্রহ ও অনুরোধে আম্মাকে আমার আব্বার সাথে বিবাহ দেন।
আমার জন্ম ও প্রাথমিক শিক্ষাঃ
আমার জন্ম ১৯২৬ সনের ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথমার্ধে (বাংলা ১৩৩২ সনের মাঘ মাসে)। আমি আমার পিতা মাতার তৃতীয় সন্তান। জন্মস্থান রাজইর গ্রামে আমার পিত্রালয়।
আমার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় আমার গ্রামের গ্রাম্য মক্তবে। মক্তব হতে নিম্ন প্রাইমারী পাশ করার পরে আমার পিতা আমাকে রায়েন্দা বন্দরের মাইনর স্কুলে নিয়ে ভর্তি করে দেন। আল্লাহর রহমতে আমি পড়াশুনায় খুবই ভাল ছিলাম। আমার স্বরণশক্তি যেমন প্রখর ছিল, তেমনি মুখস্ত শক্তিও ছিল খুব উত্তম। আমার পিতা আমাদের লেখা পড়ার প্রতি খুবই যত্নবান ছিলেন। তিনি নুতন ক্লাশে উঠার সাথে সাথেই আমাদের সমস্ত বই কিনে দিতেন। আর বই হাতে পেয়েই নুতন ক্লাসের পড়া শুরু হওয়ার আগেই আমি বইয়ের সমস্ত পদ্যগুলি মুখস্ত করে ফেলতাম। গদ্য-পদ্য সহ বইয়ের অধিকাংশ স্থান পড়তে গিয়ে আমার মুখস্থ হয়ে যেত। মাদ্রাসায় পড়াকালীন অবস্থায়ও পাঠ্যভুক্ত কিতাবের অধিকাংশ জায়গা আমার মুখস্থ হয়ে যেত। মাইনর স্কুলের পড়া সমাপ্তিতে আমি আমার আম্মার আগ্রহ ও উৎসাহে বরিশাল জেলার গুলুয়া মাদ্রাসায় গিয়ে ভর্তি হয়ে দরসে নেজামী লাইনের পড়া-শুনা শুরু করি।
এ সময় এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল খুবই নিম্নমানের। তখন জমিদারী সিসটেম থাকার কারনে জমিদার, গ্রামের প্রজাদের অর্থ লুটে নিয়ে শহর-বন্দরে আরামের জিন্দেগী যাপন করত। গ্রামে রাস্তা-ঘাট বলতে কিছু ছিল না। তখনকার লোকেরা প্রকৃতির তৈরী প্রবাহিত খালের দুই পাড়ে সারিবদ্ধাভাবে বাড়ি করত। কেননা যোগাযোগের ও মালামাল বহনের জন্য পানিতে চালিত নৌকাই ছিল তাদের বাহন। রাস্তা ঘাট ও গাড়ি ইত্যদির কোন ব্যবস্থা তখন এলাকায় এমনকি বন্দর ও থানা সদরেও ছিল না। একমাত্র নৌকা ও পা ছিল মানুষের চলাচলের প্রধান বাহন।
তখন ছিল আমাদের দেশ ব্রিটিশ শাসনের অধীন। ব্রিটেনের সিবাসা নামক এক ইংরেজ কোম্পানীর একখানা ছোট জাহাজ বাগেরহাট ও হুলার হাটের মধ্যে চলাচল করত। এই জাহাজের একটা স্টেশান ছিল আমাদের নিকটবর্তী বন্দর রায়েন্দায়্ আমি এই জাহাজে বিশ পয়সা ভাড়া দিয়ে টিকেট কেটে বরিশাল জেলার ভান্ডারিয়া বন্দরে নেমে পায়ে হেটে গালুয়া মাদ্রাসায় যেতাম। তিন বৎসরকাল আমি গালুয়া মাদ্রাসায় পড়া-শুনা করে শর্ষীনা আলীয়া মাদ্রাসায় গিয়ে ভর্তি হই।
১৯৩৯ সনে যখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়, তখন আমি গালুয়া মাদ্রাসার ছাত্র। মূলতঃ যুদ্ধ প্রথম দিকে জার্মান ও ব্রিটেনের মধ্যে শুরু হলেও পরে গোটা বিশ্ব এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। আমাদের দেশে তখন ছিল ব্রিটিশ শাসন। তখন বৃহত্তর বাংলাদেশের রাজধানী ছিল কলিকাতায়। আর বৃহত্তর ভারত অর্থাৎ বর্তমান ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় রাজধানী ছিল দিল্লী। বৃটিশ শাসিত বাংলাদেশে তখন মন্ত্রীসভা ছিল শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক সাহেবের নেতৃত্বে। ফজলুল হকে সাহেব বাংলার আপামর জনগণের কাছে কৃষক দরদী বলে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। তিনি কৃষক প্রজাপার্টি নামে পার্টি করে জমিদারদের শোষনের বিরুদ্দে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে কৃষকদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে প্রবল আন্দোলন গড়ে তুলেন। ফলে সেই সময়ের নির্বাচনে কৃষকরা ভোট দিয়ে ফজলুল হক সাহেবের দলকে বিজয়ি করে।