শর্ষিনা হতে বিদায় ও আমতলী মাদ্রাসায় ভর্তিঃ
শর্ষিনার আবহাওয়ায় আমার স্বাস্থ্য না টেকায় আমি শর্ষিনা হতে বিদায় নিয়ে আমতলী মাদ্রাসায় এসে ভর্তি হই। এ মাদ্রাসা ছিল আমার গ্রামের বাড়ি হতে ছয় কিলোমিটার দূরে। এ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হযরত মাওলানা আব্দুল লতীফ সাহেব। তিনি দেওবন্দ মাদ্রাসার ডিগ্রীধারী একজন উচ্চমানের আলেম ছিলেন। তিনি ফুরফুরার মরহুম পীর আবু বকর সিদ্দিকী সাহেবের মুরীদ ও খলিফা ছিলেন।
আমতলী মাদ্রাসায় আমি একাধারে চার বছর পড়া-শুনা করি। প্রকাশ থাকে যে, আমি পড়া-শুনায় ভাল হওয়ার কারণে, আর পরীক্ষায় সবসময় প্রথম স্থান অধিকার করার কারণে আমার ওস্তাদগণ সকলেই আমাকে অত্যাধিক স্নেহ করতেন। আমতলী মাদ্রাসায় তখন আমি উচ্চমানের কয়েকজন প্রতিভাধর বুজর্গ ওস্তাদের সাহচার্য লাভ করে তাদের কাছ থেকে তাফসিরুল কোরআন, হাদীস, নাহু ছরফ সহ বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা লাভ করি। এই মাদ্রাসা হতেই ১৯৪৮ সনে আমি আলিম পরীক্ষায় পূর্ব পাকিস্তান মাদ্রাসা বোর্ডের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে সরকারী বৃত্তি লাভ করি।
আমতলী মাদ্রাসা হতে বিদায় ও ঢাকা সরকারী আলীয়া মাদ্রাসায় ভর্তিঃ
আমতলী মাদ্রাসা হতে বিদায় নিয়ে আমি ঢাকা সরকারী আলীয়া মাদ্রাসায় গিয়ে ফাজিল ক্লাসে ভর্তি হই। ১৯৪৭ সনে যখন বাংলাদেশ বিভক্তির ফয়সালা হয়, তখন সেই সময়ের কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসার সুযোগ্য প্রিন্সিপাল খান বাহাদুর জিয়াউল হক নাজিমুদ্দীন মন্ত্রী সভার অনুমোদন নিয়ে কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসা থেকে তার যাবতীয় সহায় সম্পদ ও বিরাট লাইব্রেরীর কিতাবাদি ও ফার্র্নিচার ইত্যাদিসহ সামুদ্রিক জাহাজে করে ঢাকায় স্থানান্তর হন। সে সময়ের আলীয়া মাদ্রাসার সুযোগ্য ওস্তাদগণও হিজরত করে কলিকাতা হতে ঢাকায় চলে আসেন। আমি যখন ঢাকা আলীয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হই, তখন আলীয়া মাদ্রাসার প্রিসিনসপাল ছিলেন খান বাহাদুর জিয়াউল হক, হেড মাওলানা ছিলেন হযরত মওলানা জাফর আহমদ ওসমানী, আরবী আদবের শিক্ষক ছিলেন মাওলানা আব্দুর রহমান কাশগরী, তাফসীরের ওস্তাদ ছিলেন মাওলানা হুজ্জ্বাবুল্লাহ লাখনবী ও ফখরেবা,লাগার মাওলানা নাসির ভোলাবী। এছাড়া মুফতী আমিমুল ইহসান ও মাওলানা নাজির আহমদ সহ বেশ কয়েকজন হাদীসের ওস্তাদও ছিলেন। আমি ওসমানী সাহেব ও মুফতী আমিমুল ইহসানের কাছে বোখারী শরীফ পড়েছি।
১৯৫০ সনে ফাজিল পরীক্ষায় পূর্ব পাকিস্তান মাদ্রাসা বোর্ডে প্রথম স্থান অধিকার করে আমি সরকারী বৃত্তি লাভ করি। টাইটেল পরীক্ষায় কৃতিত্বের সহিত পাশ করে মুমতাজুল মুহাদ্দেসীন উপাধি লাভ করি।
ছাত্র জীবনে, ছাত্র জীবনের বাইরে আমার তৎপরতাঃ
ছাত্র জীবনেই আমি বেশ রাজনৈতিক সচেতন ছিলাম। যুক্ত ভারতে (ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে) তখন চলছিল ব্রিটিশ শাসন। এই ব্রিটিশ শাসনের নাগ-পাস হতে মুক্তি লাভ করার জন্য হিন্দু প্রধান কংগ্রেসের নেতৃত্বে ও মুসলিম প্রধান মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পৃথক পৃথক আন্দোলন চলছিল। কংগ্রেসের দাবী ছিল স্বাদীন অখন্ড ভারত, আর মুসলিম লীগেরে দাবী ছিল মুসলিম প্রধান প্রদেশ সমূহের সমন্বয় স্বাধীন পৃথক দেশ পাকিস্তান। আমি তখন কলিকাতা হতে প্রকাশিত মুসলিম লীগের মুখপত্র দৈনিক আযাদ ও কংগ্রেসের মুখপত্র বসুমতির নিয়মিত পাঠক ছিলাম। যাতে স্বাধীনতা আন্দোলনে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়ের কার্যক্রম সম্পার্কে অবহিত হতে পারি। এ ছাড়া দিল্লী ও লাহোর হতে প্রকাশিত দুটি সাপ্তাহিক উর্দ্দু পিত্রিকাও আমি নিয়মিত পড়তাম। মাসিক মুহাম্মদী, মাসিক সওগাত ও শিশু সওগাতেরও আমি পাঠক ছিলাম। ছাত্র জমিয়তের মাধ্যমে জমিয়তের লাইব্রেরীতে প্রচুর বই আমি সংগ্রহ করার ব্যবস্থা করেছিলাম। আর এসব বই আমিও পড়তাম, আর ছাত্রদেরকেও পড়ার জন্য উৎসাহিত করতাম।
যেহেতু আমি জমিয়তে তালাবার নেতা ছিলাম। তাই ছাত্রদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও বহির্মুখী প্রতিভা বিকাশের জন্য নিয়মিত আলোচনা সভা ও প্রতিযোগিতামূলক সভা সমিতি অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতাম। ছাত্র জীবন থেকেই আমি এলাকার রাজনৈতিক সভা-সমিতি ও নির্বাচনী তৎপরতায় আগ্রহের সাথে রাজনৈতিক কর্মীর মত অংশগ্রহন করতাম।
প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা, বিষয় ভিত্তিক বক্তৃতা প্রতিযোগিতা ও প্রতিযোগিতামূলক খেলাধুলায়ও আমি আগ্রণী ছিলাম, তবে যেসব বহির্মূখী তৎপরতা আমাকে কখনও আমার মূল লেখা-পড়া হতে গাফেল বা অমনোযোগী করতে পারেনি। বরং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সব সময় আমি প্রথম স্থান অধিকার করেছি।
আমি যখন ১৯৪৫ সনে আমতলী মাদ্রাসার ছাত্র, তখন কলিকাতা মুহাম্মদ আলি পার্কে দেওবন্দের হযরত মাওেলানা সাব্বির আহম্মদ ওসমানী ও বালাদেশের হযরত মাওলান আব্দুল হাই সিদ্দিকীর নেতৃত্বে নিখিল ভারত ওলামা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনের কার্যক্রম আমি পত্রিকার মাধ্যমে এবং সম্মেলনে যোগদানকারী আমার ওস্তাদ আমতলীর হযরত মাওলানা আব্দুল লতিফ সাহেবের মাধ্যমে অবহিত হয়েছিলাম। মুহাম্মদ আলী পার্কের এই ওলামা সম্মেলন হতে পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন দানের ঘোষণা দেওয়া হয়। ফলে পাকিস্তান আন্দোলন সমগ্র উপমাহাদেশে মুসলমানদের সমর্থন লাভ করে। আমি ছাত্র ও স্বল্প বয়সি হলেও সব সময়ে মুসলিম লীগের পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক ছিলাম।
১৯৪৬ সনে পাঞ্জম ক্লাসে জামেয়া পরীক্ষা দেয়ার জন্য (তখন নোয়াখালী জেলায়, জেলা ভিত্তিক পাঞ্জম ক্লাশে একটি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা হত) আমি নোয়াখালীর টুমচর মাদ্রাসায় গিয়ে ভর্তি হই। তখন চলছিল দেশভিত্তিক জাতীয় নির্বাচন। ইস্যু ছিল পাকিস্তান না অখন্ড ভারত। টুমরে আমার ওস্তাদরা দস্তুর মত দুভাগে বিভক্ত ছিলেন। এক ভাগ দেওবন্দের হযরত মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানীর সমর্থনে কংগ্রেসের পক্ষে। আর এক ভাগ আল্লামা সাব্বির আহমদ ওসমানী আর উব্দুল হাই সিদ্দীকি সাহেবের সমর্থনে মুসলিম লীগের পক্ষে। দুটি গ্রুপই বেশ শক্তিশালী ছিল। ওস্তাদদের এই গ্রুপিংয়ে আমি বেশ চিন্তাযুক্ত হয়ে পড়ি। আমি কোন পক্ষ অবলম্বন করব, এটা ভেবে খুবই পেরেশানীবোধ করছিলাম। তবে শেষ পর্যন্ত একটা খাব (স্বপ্ন) আমাকে পথ প্রদর্শন করে। খাব কোন হুজ্জ্বতে শরয়ী’ নাহলেও রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন উত্তম খাব নুবুয়াতের ৪০ ভাগের এক ভাগ।
উপরে যে খাব বা স্বপ্নটির কথা আমি উল্লেখ করেছি তা হল এই যে, ‘আমি আমার ওস্তাদদের দুই গ্রুপের পরস্পর বিরোধী অবস্থানে কোন গ্রুপকে সমর্থন করব এটা চিন্তা করে রাত্রে ঘুমিয়ে পড়ি। হঠাৎ স্বপ্নে দেখি যে হযরত মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী ইলেকশান ক্যাম্পেনের জন্য ট্রেনযোগে লক্ষ্মীপুর ষ্টেশনে এসেছেন। আমরা বেশ কিছু লোক মিলে তাকে অভ্যার্থনা জানাতে গিয়েছি। তিনি আসলেন এবং আমাদের সামনে ছামান পত্র নিয়ে স্টেশানে অবতরন করলেন। স্টেশানে নেমে আমাদেরকে বললেন, ‘আমার কাছে গান্ধীজির বাক্স ও বেডিং রয়েছে। উহা তাকে পৌছাতে হবে’। ব্যাস এই স্বপন দেখে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল, আমি স্বপ্নের মাধ্যমে দিক নির্দ্দেশনা পেলাম যে, আল্লামা সাব্বির আহমদ ওসমানী ও হযরত আব্দুল হাই সিদ্দিকী সাহেবের গৃহিত পথই ইসলাম ও মুসলমানের সেবার পথ। আর হযরত মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানীর পথ হিন্দু নেতা গান্ধী ও হিন্দু কংগ্রেসের সেবার পথ। সুতরাং এর পর আমি কংগ্রেস সমর্থক ওস্তাদদের পথ বাদ দিয়ে, মুসলিমলীগ সমর্থক ওস্তাদদের পথ অবলম্বন করলাম। আমি হযরত মাদানী সাহেবের গৃহিত পথকে তার ইজতেহাদী ভুল বলে গ্রহন করলাম। আর আয়েম্মাদের সর্বসম্মত মত যে মুজতাহিদ ইজতেহাদে ভুল কারলে তার গুনাহ হবেনা ঠিকই, তবে ভুলর খেসারত বা মাশুল অবশ্যই দিতে হবে।
আমি আমতলি মাদ্রাসায় আলিম ক্লাসে পড়াকালিন আমাদের মাদ্রাসায় যুক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মরহুম হুসাইন সরওয়ারদী, নওয়াবজাদা খাজা নসরুল্লাহ সহ বেশ কয়েকজন মুসলিম লীগের প্রাদেশিক মন্ত্রী ও নেতাদের প্রগ্রাম হয়। ছাত্রদের পক্ষ হতে এই সভায় মূখ্য মন্ত্রী সরওয়ারদী সাহেবরে উদ্দেশ্যে মান পত্র আমাকেই পড়তে হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে শর্ষিনা মাদ্রাসায় ১৯৪৭ সনে যে নিখিল ভারত ওলামা সম্মেলন হয়, আমতলীর আমার ওস্তাদ হযরত মাওলানা আব্দু লতিফ সাহেবের সাথে ঐ সম্মেলনে আমিও যোগদান করেছিলাম। ঢাকা আলীয়া মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালেও আমি জমিয়তে তালাবার নেতা হিসেবে অনেক প্রানবন্ত ও আকর্ষনীয় প্রগ্রাম করেছি, যা দেখে আমার ওস্তাদরা আমাকে খুবই উৎসাহিত করেছিলেন। এভাবেই আমি আমার ছাত্র জীবনেও বিভিন্নমূখী কার্যক্রম আনজাম দিয়েছি।