নিকটাত্মীয়দের ব্যাপারে হযরত ওসমান (রাঃ)-এর কর্মধারা ব্যাখ্যা
সাইয়্যেদেনা হযরত ওসমান (রাঃ) নিকটাত্মীয়দের ব্যাপারে যে কর্মধারা অবলম্বন করেছেন, তা কোন অসদুদ্দেশ্যের ওপর ভিত্তি করে গ্রহণ করেছেন, আমার মনে (নাউযুবিল্লাহি) এমন কোন ধারণার উদ্রেকও হয়নি। তিনি ছিলেন রাসুলুল্লাহর একনিষ্ঠ এবং প্রিয়তম সাহাবীদের অন্যতম। ঈমান আনয়নের পর থেকে শাহাদাত লাভ কপর্যন্ত তাঁর গোটা জীবন এ কথারই প্রমাণ বহন করে। সত্য দ্বীনের জন্য তাঁর ত্যাগ কুরবানী, একান্ত পুত-পবিত্র এবং তাকওয়া-তাহারাত-আল্লাভীতি এবং নির্মলতা দৃষ্টে কোন বুদ্ধিমান লোক কি এমন কথা ভাবতেও পারে যে, এমন নির্মল-পুত-পবিত্র স্বভাবের লোক অসদুদ্দেশ্যে তেমন কর্মধারা অবলম্বন করতে পারেন, বর্তমান সালের রাজনৈতিক পরিভাষায় যাকে স্বজনভীতি (Nepotism) বলা হয়। বস্তুত তাঁর এহেন কর্মধারার ভিত্তি সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছেন যে, তিনি এটাকে আত্মীয়তার সম্পর্কের দাবী বলে মনে করতেন। [কানযুল ওম্মাল, ৫ম খণ্ড, হাদীস সংখ্যা-২৩২৪। তাবাকাতে ইবনে সাআ’দ, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৬৪।] তাঁর ধারণা ছিল কুরআন সুন্নায় আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সদাচারের যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তার দাবী পূর্ণ হতে পারে কেবল এভাবে যে, আত্মীয়-স্বজনদের সাথে যতটুকু ভাল ব্যবহার করা মানুষের পক্ষে সম্ভব, তা করতে সে বিন্দুমাত্রই কুণ্ঠাবোধ করবে না। এটা নিয়াত বা উদ্দেশ্যের ত্রুটি নয়, বরং সিদ্ধান্তের ত্রুটি বা অন্য কথায় ইজতিহাদের ত্রুটি ছিল। উদ্দেশ্যের ত্রুটি হতো তিনি যদি এ কাজকে না জায়েয মনে করেও নিছ সার্থে বা আত্মীয়-স্বজনদের স্বার্থে তা করতেন। কিন্তু এটাকে ইজতিহাদের ত্রুটি বলা ছাড়া কোন উপায় নেই; কারণ, আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সদাচারের নির্দেশ ছিল তাঁর নিজের, খেলাফতের পদের নয়। তিনি সারা জীবন নিজে আত্মীয়-স্বজনদের সাথে যে উদার সদাচার করেছে সন্দেহ নেই, তা ছিল এর সর্বোত্মম দৃষ্টান্ত। তিনি তার নিজের সমস্ত বিষয় সম্পত্তি এবং টাকা কড়ি সবই আত্মীয়জনদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে দিয়েছেন এবং পুত্র পরিজনকেও তাদের সমান করে রেখেছেন। তাঁর এ কাজের যতই প্রশংসা করা হোক তা বেশী হবে না। কিন্তু খেলাফতের পদের সাথে আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সদ্ব্যবহার করার কোন সম্পর্ক ছিল না। খলীফা হিসেবে আত্মীয়-স্বজনদের কল্যাণ সাধন ছিল না এ নির্দেশের সত্যিকার দাবী।
আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সদাচারের জন্য শরীয়াতের বিধানের ব্যাখ্যা করে যতরত ওসমান (রাঃ)-আত্মীয়-স্বজনদের সাথে যে ব্যবহার করেছেন, শরীয়াতের দৃষ্টিতে তার কোন অংশকেও না-জায়েয বা অন্যায় বলা যায় না। স্পষ্ট যে, খলীফা তাঁর বংশ-গোত্রের কোন লোককে কোন পদ দেবেন না-শরীয়াতের এমন কোন বিধান নেই। গণমাতের মাল বন্টন বা বায়তুল মাল থেকে সাহায্যের ব্যাপারেও শরীয়াতের এমন কোন বিধান ছিল না, যা তিনি ভঙ্গ করেছেন। এ প্রসঙ্গে আমি হযরত ওমর (রাঃ)-এর যে ওসিয়্যাতের কথা উল্লেখ করেছি, তাও কোন শরীয়াত ছিল না যে, তিনি বৈধ সীমালংঘন করেছেন-এ ব্যাপারে তাঁর ওপর এমন আরো কোন অভিযোগ উত্থাপন করা যায় না কিছুতেই। কিন্তু এ কথাও কি অস্বীকার করা যায় যে, আত্মীয়-স্বজনদের ব্যাপারে হযরত আবু বকর (রাঃ)-এবং হযরত ওমর (রাঃ)-যে নীতি অনুসরণ করেছিলেন, হযরত ওমর তাঁর সম্ভাব্য উত্তরসূরীদেরকে যে নীতি মেনে চলার উপদেশ দান করছেন, শাসন ব্যবস্থার বিচারে তা-ই সবচেয়ে বিশুদ্ধ নীতি। সাইয়্যেদেনা হযরত ওসমান (রাঃ)-এ নীতি থেকে দূরে সরে গিয়ে যে কর্মপন্থা অবলম্বন করেন, প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ থেকে তা ছিল অসমীচীন এবং কার্যত তা অত্যন্ত ক্ষতিকরও প্রমাণিত হয়েছে-এ কথা স্বীকার করতেও কী কোন দ্বিধা-দন্দ্বের অবকাশ রয়েছে? সন্দেহ নেই, এ সব ক্ষতি সম্পর্কে তাঁর কোন ধারণা ছিল না, পরে এর যে পরিণতি দেখা দিয়েছে, তার জন্যই উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে তিনি তা করেছেন, এমন কথা কেবল বোকা-ই কল্পনা করতে পারে। কিন্তু প্রশাসনিক ভুলকে অবশ্যই ভুল স্বীকার করতে হবে। রাষ্ট্রপ্রধান তাঁর বংশেরই এক ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের চীফ সেক্রেটারী করেন। [দাবী করা হয় যে, বর্তমান যুগের মতো সেকালে খেলাফতের কোন দফতর ছিল না, ছিল না তার কোন আমলা, সেক্রেটারি বা চীফ সেক্রেটারী। তখন খলীফা কোন ব্যক্তিকে দিয়ে মামুলী পত্র যোগাযোগের কাজ চালাতেন। এমনি করে আমাদের সামনে খেলাফতে রাশেদার শাসন কালের এক অদ্ভুত চিত্র অংকিত হয় যে, আফগানিস্তান, তুর্কিস্তান থেকে শুরু করে দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যন্ত যে সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল, কোন কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা ছাড়াই তা শাসিত হতো। সাম্রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে রিপোর্ট আসতো কিন্তু তার কোন রেকর্ড রাখাই হতো না। সাম্রাজ্যের প্রান্তে প্রান্তে জিযিয়া, খারাজ, যাকাত, মালে গণীমাত, খোমস ইত্যাকার অসংখ্য আর্থিক লেনদেন হতো, কিন্তু কোন কিছুরই কোন হিসেব-নিকেশ ছিল না। গভর্ণর এবং সেনাবাহিনীর কমাণ্ডারদেরকে প্রতিদিন নির্দেশ দেয়া হতো, কিন্তু এ সব কিছুরই রেকর্ড থাকতো একজন লোকের মস্তিষ্কে; আর তিনি প্রয়োজন পড়লে কোন ব্যক্তিকে ডেকে তার দ্বারা মামুলী পত্র যোগাযোগের কাজ সারাতেন! যেন এটা যুগের মেরা রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা নয়, বরং তা ১৫/২০ জন তালেবে এলম-এর একটা মাদ্রাসা, যা পরিচালনা করতেন একজন মৌলভী সাহেব।] এবং জাযিরাতুল আরবের বাইরের সমস্ত মুসলিম অধিকৃত এলাকায় তাঁর বংশেরই গভর্ণর নিয়োগ করবেন-কোন ব্যাখ্যা করেই এটাকে সঠিক বলে চিহ্নিত করা যাবে না। এখানে জেনে রাখা ভাল যে, সে কালের শাসন-শৃংখলার দৃষ্টিতে আফ্রিকার সমস্ত বিজীত অঞ্চল ছিল মিসরের গভর্ণরের অধীনে, শাম-এর সমস্ত অঞ্চল ছিল দামেশকের গভর্ণরের অধীনে, ইরাক আযাব-বাইজান, আর্মেনিয়া এবং খোরাসন ও পারস্যের সমস্ত এলাকা ছিল কুফা এবং বসরার গভর্ণরের অধীনে। সাইয়্যেদেনা হযরত ওসমান (রাঃ)-এর শাসনকালে এমন এক সময় এসেছিল, যখন এ সকল প্রদেশেরই গভর্ণর (বরং প্রকৃত প্রসতাবে গভর্ণর জেনারেল) ছিল তাঁরই আত্মীয়-স্বজন। এটা এক অনস্বীকার্য ঐতিহাসিক ঘটনা, বাস্তবতার দৃষ্টিতে স্বপক্ষের সকলেই তা স্বীকার করেছেন। এমন কথা কেউ বলেনি যে, মূলত এ ধরনের কোন ঘটনাই ঘটেনি।
তাঁর এ কার্যকে সত্যনিষ্ঠ প্রমাণিত করার জন্য অনেক বুযুর্গ যুক্তি উপস্থিত করে বলেছেন যে, নিজ বংশের যাদেরকে হযরত ওসমান (রাঃ)-পদ দান করেছেন, তাঁদের অধিকাংশই হযরত ওমর (রাঃ)-এর সময়েও পদ লাভ করেছেন। কিন্তু এ যুক্তি অত্যন্ত দুর্বল। প্রথমত, এরা হযরত ওমর (রাঃ)-এর নয় বরং হযরত ওসমান (রাঃ)-এর নিকটাত্মীয় ছিলেন। আর এটা কারো জন্যই অভিযোগের কারণ ছিল না। রাষ্ট্র প্রধান যখন তাঁর নিকটাত্মীয়দেরকে বড় বড় পদ দিতে লাগলেন, জনগণ তখন অভিযোগের সুযোগ লাভ করে। দ্বিতীয়, হযরত ওমর (রাঃ)-এর শাসনামলে তাদেরকে এত বড় পদ দেয়া হয়নি কখনো, যা পরে তাদেরকে দেয়া হয়েছে। আবদুল্লা ইবনে সাআ’দ ইবনে আবি সারাহ তাঁর শাসনকালে নিছক একজন সামরিক অফিসার ছিলেন, পরে তাঁকে মিসরের সাঈদ শহরের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়। হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ)-ছিলেন কেবল দামেশক এলাকার গভর্ণর। [দামেশক মানে কেবল দামেশক শহর নয়, বরং শাম-এর সে অংশ যার রাজধানী ছিল দামেশক। তাবারী স্পষ্ট করে বলেছেন যে, হযরত ওমর (রাঃ)-এর ওফাতের সময় হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ) দামেশক এবং জর্ডানের গভর্ণর ছিলেন-(৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৩৯) হাফেয ইবনে কাসীর বলেনঃ
*************
বরং আসল কথা হচ্ছে এই যে, হযরত ওসমান (রাঃ)ই মুআ’বিয়া (রাঃ)-কে গোটা এলাকার গভর্ণর নিয়োগ করেন। অবশ্য হযরত ওমর (রাঃ) তাঁকে কেবল শাম এর অংশ বিশেষের গভর্ণর নিযুক্ত করেন।] আল-জাযিরার আরব এলাকার যেখানে বনু তালীবরা বাস করতো, ওয়ালীদ ইবনে ওকবা ছিলেন কেবল সে এলাকার গভর্ণর। সাঈদ ইবনুল আ’স এবং আবদুল্লা ইবনে আ’মেরও নিয়োজিত ছিলেন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পদে। জাযিরাতুল আরবের বাইরের গোটা মুসলিম অধিকৃত অঞ্চল একই বংশের গভর্ণরদের অধীনে থাকবে, আর সে গভর্ণরও হবে সেকালের খলীফার আপন বংশের লোক [কোন কোন মহল এখানে যুক্তি পেশ করেন যে, রাসুলুল্লাহ (সঃ) তো কুরাইশের লোকদেরকে বড় বড় পদে নিয়োগ করেছেন, এমনকি খেলাফতের ব্যাপারেও তিনি তাদেরকে অন্যদের ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন। কিন্তু তাদের ্র যুক্তি ঠিক নয়। কুরাইশ তাঁর বংশের লোক বলে তিনি তাদেরকে প্রাধান্য দেননি, বরং তিনি নিজেএর কারণ এ বর্ণনা করেনঃ আরবে হেমইয়ার গোত্রের সর্দারীর অবসানের পর কুরাইশের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন থেকে ভাল-মন্দ উভয় ক্ষেত্রে তারাই ছিল দীর্ঘ দিন ধরে আরবদের নেতা। আরবরাও তাদের নেতৃত্বই স্বীকার করতো। এ কারণে তাদেরকই সামনে রাখতে হবে; কারণ, তাদের মুকাবিলায় অন্যদের নেতৃত্ব চলতে পারে না। এ ব্যাপারে হুযুরের এরশাদ আমি বিস্তারিত আলোচনা করেছি রাসায়েল ও মাসায়েল ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৬৪-৬৯ এবং তাফহীমাত, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৩৯-১৪২-এ। আত্মীয়তার ভিত্তিতে তিনি কাউতে সামনে বাড়ালে বনী হাশেমকে সকলের চেয়ে বেশী আগে বাড়াতেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে কেবল হযরত আলী (রাঃ)-কে তিনি সময়ে সময়ে কোন কোন পদে নিয়োগ করেন। অথচ বনী হাশেমের মধ্যে যোগ্য লোকের অভাব ছিল, এমন কেউ কথা বলতে পারে।] তাঁর শাসনকালে এমন পরিস্থিতির উদ্ভবও হয়নি কখনো।
এ কথাও অনস্বীকার্য যে, হযরত ওসমান (রাঃ)-এর শাসনামলের শেষের দিকে যারা এত বড় গুরুত্ব লাভ করে, তাদের অধিকাংশই মক্কা বিজয়ের পর ইসলাম গ্রহণ করেন, রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর সান্নিধ্য এবং দীক্ষা দ্বারা তাদের উপকৃত হওয়ার সুযোগ হয়েছে খুব কমই। এদের বয়কট করা হোক বা ইসলামী রাষ্ট্রে কাজ করার সকল সুযোগ সুবিধা থেকে দূরে রাখা হোক-এমন নীতি হুযুর (সঃ) এবং তাঁর পরে প্রথম খলীফাদ্বয় তাদের হৃদয় জয় করে এবং তাদেরকে দীক্ষা দিয়ে সমাজে তাদেরকে ভালভাবে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। তাঁরা তাদেরকে নিজেদের সমর্থ অনুযায়ী কাজেও নিয়োজিত করেন। কিন্তু প্রাথমিক যুগের লোকদেরকে বাদ দিয়ে এদেরকেই সম্মুখে ঠেলে দেয়ার নীতি হুযুরি (সঃ)-এরও ছিল না, ছিল না প্রথম খলীফাদ্বয়েরও। মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের আসনে তাদের অধিষ্ঠিত হওয়ারও কোন অবকাশ ছিল না। হুযুর (সঃ) এবং প্রথম খলীফাদ্বয়ের শাসনামলে প্রথমতঃ এরা কঠোর নিয়ম-শৃংখলায় বাঁধা ছিলেন, এ শৃংখলায় কোন ঢিলেমি ছিল না, ছিল না কোন শৈথিল্য। তাছাড়া একই সাথে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে তাদেরকে নিয়োগ করে ভারসাম্য বিনষ্ট করাও হয়নি তাঁদের শাসনামলে। উপরন্তু রাষ্ট্র প্রধানের নৈকট্যও তাদের পক্ষে কোন শৈথিল্যের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারতো না। তাই, সে সময়ে তাদেরকে কাজে নিয়োগ করা সে সকল দোষ-ত্রুটির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারতো না। তাই, সে সময়ে তাদেরকে কাজে নিয়োগ করা সে সকল দোষ-ত্রুটির কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি, যা পরবর্তীকালে তাদেরকে কাজে নিয়োগের ফলে দেখা দেয়। পরবর্তীকালে বনী উমাইয়াদের হাতে সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভুত হওয়ার পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ কার্যত এ কথা প্রমাণ করে যে, এরা অনৈসলামিক রাষ্ট্রের যোগ্য শাসক এবং প্রাশাসনিক ও সামরিক দিক থেকে সর্বোত্তম যোগ্যতার অধিকারী হলেও মুসলিম মিল্লাতের নৈতিক এবং ধর্মীয় নেতৃত্বের যোগ্য ছিল না। এ বাস্তব সত্য ইতিহাসে এতই স্পষ্ট যে, প্রতিপক্ষের কোন সাফাই-এর ওপর পর্দা টানার কাজে সফলতা লাভ করতে পারে না।
হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ)-কে একটানা ১৬-১৭ বছর একই প্রদেশের গভর্ণর থাকতে দেয়া শরীয়াতের দৃষ্টিতে না জায়েয ছিল না; অবশ্য রাজনৈতিক বিচক্ষণতার দৃষ্টিতে তা অসমীচীন ছিল শরীয়াতের দৃষ্টিতে না জায়েয ছিল না; অবশ্য রাজনৈতিক বিচক্ষণতার দৃষ্টিতে তা অসমীচীন ছিল অবশ্যই। বিনা অপরাধে শুধু শুধু তাঁকে অপসারণ করা উচিত ছিল এমন কথা আমি বলি না। কয়েক বছর পর পর এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে তাঁকে বদলী করাই যথেষ্ট ছিল। ফলে তিনি কোন একটি প্রদেশেও এতটা শক্তিশালী হতে পারতেন না এবং কখনো কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তরবারী নিয়ে দাঁড়ানো তাঁর পক্ষে সম্ভব হতো না।
তায়তুল মাল থেকে আত্মীয়-স্বজনদের সাহায্য প্রসঙ্গে
বায়তুল মাল থেকে আত্মীয় স্বজনদের সাহায্যের ব্যাপারে হযরত ওসমান (রাঃ) যা কিছু করেছেন, শরীয়তের দৃষ্টিতে সে সম্পর্কে আপত্তি করার কোন অবকাশ নেই। মাআ’যাল্লাহ। আল্লাহ এবং মুসলমানদের সম্পদে তিনি কোন প্রকার খেয়ানত করেননি কিন্তু এ ব্যাপারেও তাঁর কর্মনীতি প্রশাসনের দৃষ্টিতে এমন ছিল, যা অন্যদের জন্য অভিযোগ আপত্তির কারণ না হয়ে পারেনি।
মুহাম্মদ ইবনে সাআ’দ ‘তাবাকাতে’ ইমাম যুহরীর এ উক্তি উদ্ধৃত করেছেনঃ
***********
হযরত ওসমান (রাঃ) তাঁর শাসনের শেষ ৬ বছরে আত্মীয়-স্বজন এবং খান্দানের লোকজনকে সরকারী পদে নিয়োগ করেন। তিনি মারওয়ানকে মিসরের মালে গণীমাতের এক-পঞ্চমাংশ (অর্থাৎ আফ্রিকার মালে গণীমাতের এক পঞ্চমাংশ, যা মিসরের পক্ষ থেকে আসতো) লিখে দেন। তিনি আত্মীয়-স্বজনকে অর্থও দান করেন। এ ব্যাপারে তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, এটা হচ্ছে আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সদাচার, আল্লাহ যার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বায়তুল মাল থেকে টাকাও গ্রহণ করেন, ঋণও দেন। তিনি বলেন, আবুবকর (রাঃ) ও ওমর (রাঃ) বায়তুল মালে তাঁদের অধিকার ত্যাগ করেন, আর আমি তা গ্রহণ করে আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে বন্টন করেছি। লোকেরা এটাকেই না-পছন্দ করেছে। [তাবাকাত, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৬৪। কেউ কেউ বলেন, ইবনে খালদুন মারওয়ানকে আফ্রিকার মালে গণীমাতের অংশ দেয়ার প্রতিবাদ করেছেন। অথচ ইবনে খালদুন লিখেছেনঃ
**********
-আসলে কথা হচ্ছে এই যে, মারওয়ান এ এক-পঞ্চামাংশ ৫ লক্ষ টাকায় ক্রয় করেন, আর হযরত ওয়মান (রাঃ) তাঁকে এ মূল্য মাফ করে দেন। তারীখে ইবনে খালদুন, ২য় খণ্ডের পরিশিষ্ট, পৃষ্ঠা-১৩৯-১৪০ দ্রষ্টব্য।]
এটা ইমাম যুহরীর বর্ণনা, যিনি ছিলেন সাইয়্যেদেনা হযরত ওসমান (রাঃ)-এর সময়ের অনেক নিকটবর্তী কালের লোক। আর মুহাম্মাদ ইবনে সাআ’দের সময় ইমাম যুহরীর সময়ের অতি নিকটবর্তী। ইবনে সাআ’দ কেবল দু’টি মাধ্যমে তাঁর এ উক্তি উদ্ধৃত করেন। এ কথাটি ইবনে সাআ’দ ইমাম যুহরীর প্রতি এর প্রতিবাদ জানাতেন। তাই এ বর্ণনাকে সত্য বলে স্বীকার করতেই হবে।
ইবনে জারীর তাবারীর একটি বর্ণনা থেকেও এর সমর্থন মেলে। তিনি বললেন, আফ্রিকায় আব্দুল্লাহ ইবনে সা’আদ ইবনে আবি সারাহ সেখানকার বাতরীক এর সাথে ৩শ’ কিনতার স্বর্ণের ওপর সমঝোতা করেন।
***********
-অতঃপর হযরত ওসমান (রাঃ) এ মুদ্রা আল-হাকাম অর্থাৎ মারওয়ান ইবনে হাকামের পিতার বংশকে দান করার নির্দেশ দেন। [আত-তাবারী, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩১৪।]
হযরত ওসমান (রাঃ) নিজেও একদা এক অনুষ্ঠানে-সেখানে হযরত আলী (রাঃ), হযরত সাআ’দ (রাঃ) ইবনে আবু ওয়াকাকাস, হযরত যুবাইর (রাঃ), হযরত তালহা (রাঃ) এবং হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ) ও উপস্থিত ছিলেন, সে অনুষ্ঠানে তাঁর অর্থ সাহায্য সম্পর্কে আলোচনা চলছিল-তাঁর কর্মপন্থা ব্যাখ্যা করে বলেনঃ
“আমার পূর্বসূরীদ্বয় তাঁদের নিজেদের এবং আত্মীয়-স্বজনদের ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোরতা অবলম্বন করেছে। কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সঃ) তো তাঁর আত্মীয়-স্বজনকে অর্থ দান করতেন। আমি এমন এক খান্দানের লোক, যারা দরিদ্র। এ কারণে আমি রাষ্ট্রের যে দখদমত আঞ্জাম দিচ্ছি, তার বিনিময়ে বায়তুল মাল থেকে টাকা গ্রহণ করেছি, এবং আমি মনে করি, এটা গ্রহণ করার অধিকার আমার আছে। আপনারা এটাকে ভুল বা অন্যায় মনে করলে এ টাকা ফেরত দানের সিদ্ধান্ত নিন। আমি আপনাদের সিদ্ধান্ত মেনে নেব। সকলেই বলেন, আপনি অত্যন্ত নির্ভুল কথা বলেছেন। অতঃপর উপস্থিত ব্যক্তিরা বলেনঃ আপনি আবদুল্লাহ ইবনে খালেদ ইবনে আসীদ এবং মারওয়ানকে টাকা দিয়েছেন। তাঁরা বলেন, এ টাকার পরিমাণঃ মারওয়ানকে ১৫ হাজার টাকা এবং ইবনে আসীদকে ৫০ হাজার টাকা। তদানুযায়ী তাদের নিকট থেকে উসুল করে বায়তুল মালে ফেরত দেয়া হয় এবং সকলে সন্তুষ্ট হয়ে অনুষ্ঠান ত্যাগ করেন।” [আত-তাবারী, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৮২। ইবনুল আসীর, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭৯। ইবনে খালদুন, দ্বিতীয় খণ্ডের পরিশিষ্ট, পৃষ্ঠা-১৪৪।
এ সকল বর্ণনা থেকে যে কথাটি জানা যায় তা হচ্ছে এই যে, হযরত ওসমান (রাঃ) আত্মীয়-স্বজনকে অর্থ সাহায্য দানের ব্যাপারে যে কর্মপন্থা গ্রহণ করেন, তা কিছুতেই শরীয়াত সম্মত সীমা লঙ্ঘন করেনি। তিনি যা কিছু গ্রহণ করেছেন, তা রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে রাষ্ট্রের খেদমতের বিনিময় হিসেবে গ্রহণ করে নিজে ব্যবহার না করে প্রিয় জনদের দান করেছেন, অথবা বায়তুল মাল থেকে ঋণ নিয়ে দিয়েছেন যা আদায় করতে তিনি বাধ্য ছিলেন, অথবা নিজের বিচার-বুদ্ধি অনুযায়ী তিনি মালে গণীমতের এক-পঞ্চামাংশ বন্টন করেন, যার জন্য শরীয়াতের কোন বিস্তারিত বিধান ছিল না। স্পষ্ট যে, হযরত আবুবকর (রাঃ) এবং হযরত ওমর (রাঃ)-এর মতো তিনি আপন আত্মীয়-স্বজনদের পরিবর্তে অন্যান্যদের সাথে এ ধরণের দানশীলতা প্রদর্শন করলে কারোই কিছু করার ছিল না। কিন্তু খলিফা তাঁর বঙশের লোকদের ব্যাপারে এহেন দানশীলতা প্রদর্শন অপবাদের কারণ হয়েছে। এ কারণেই হযরত আবুবকর (রাঃ) এবং হযরত ওমর (রাঃ) নিজেকে সকল সংশয়ের ঊর্ধ্বে রাখার খাতিরে নিজের ব্যাপারে কঠোরতা অবলম্বন করেছেন; আন্যান্যদের সাথে যে বদান্যতা দেখাতেন আপনজনদেরকে তা থেকে বঞ্চিত করেছেন। হযরত ওসমান (রাঃ) এ সতর্কতা অবলম্বন করতে পারেননি, তাই তিনি অভিযোগের শিকার হয়েছেন।
সন্ত্রাসের কারণ
হযরত ওসমান (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে যে সন্ত্রাস দেখা দেয়, কোন কারণ ব্যতীতই নিছক সাবাঈদের ষড়যন্ত্রের ফলে তা দেখা দিয়েছে, অথবা তা ছিল ইরাকের অধিবাসীদের সন্ত্রাসবাদিতারই ফল-এমন কথা বলা ইতিহাসের সঠিক অধ্যয়ন নয়। জনগণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টির সত্যিই কোন কারণ বিদ্যমান না থাকলে, এবং সত্যিসত্যিই অসন্তুষ্টি বিদ্যমান না থাকলে কোন ষড়যন্ত্রকারীর দল সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে এবং সাহাবী ও সাহাবী তনয়দেরকে তাদের দলে ভিড়াতে সফল হতো না। আত্মীয়-স্বজনদের ব্যাপারে হযরত ওসমান (রাঃ) যে কর্মনীতি গ্রহণ করেন, তাতে কেবল সাধারণ লোকদের মধ্যেই নয়, বরং বড় বড় সাহাবীদের মধ্যেও অসন্তোষ দেখা দেয়-কেবল এ কারণেই তারা দৃষ্টামীতে সাফল্য লাভ করেছে। এ থেকেই তারা সুযোগ গ্রহণ করেছে এবং যে দুর্বল দলটি তারা লাভ করে, তাঁকে নিজেদের ষড়যন্ত্রের শিকারে পরিণত করে। এ কথা ইতিহাস থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, বিপর্যয় সৃষ্টিকারীরা এ ছিদ্র থেকেই তাদের দুষ্টামীর পথ বের করার সুযোগ লাভ করেছে। ইবনে সাআ’দের বর্ণনাঃ
**********
-জনগণ হযরত ওসমান (রাঃ)-এর ওপর এ জন্য অসন্তুষ্ট ছিলেন যে, তিনি মারওয়ানকে তার আশির্বাদপুষ্ট করে রেখেছিলেন এবং তার কথা মেনে চলতেন, তাদের ধারণা ছিল যে, হযরত ওসমান (রাঃ)-এর বলে যে সকল কাজ চালিয়ে দেয়া হতো হযরত ওসমান (রাঃ)-তার অধিকাংশেরই নির্দেশ দেননি। বরং মারওয়ান তাঁকে জিজ্ঞেস না করেই নিজের পক্ষ থেকে তা করতেন। এ কারণে মারওয়ানকে আশির্বাদপুষ্ট করায় এবং তাকে এ মর্যাদা দেয়ায় জনগণ আপত্তি করে। [তাবাকাত, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৬।]
ইবনে কাসীর বলেন, কুফা থেকে হযরত ওসমানের বিরোধীদের যে প্রতিনিধি দলটি তাঁর নিকট অভিযোগ পেশ করার জন্য আগমন করে তারা যে বিষয়টির ওপর সবচেয়ে বেশী জোর দেয়, তা ছিল এইঃ
******************
-তারা এ ব্যাপারে ওসমান (রাঃ)-এর সাথে বহস করার জন্য কিছু লোককে প্রেরণ করে যে, আপনি অনেক সাহাবীকে পদচ্যুত করে তাদের স্থলে বনী উমাইয়া থেকে আপনার আত্মীয়দেরকে গভর্ণর করেছেন। এ ব্যাপারে তারা হযরত ওসমান (রাঃ)-এর সাথে অত্যন্ত কটুক্তি করে এবং এদেরকে পদচ্যুত করে অন্যদেরকে নিয়োগ করার দাবী জানায়। [আল-বেদায়া, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৬৮।]
হাফেয ইবনে কাসীর সামনে অগ্রসর হয়ে আরো লিখেন যে, হযরত ওসমান (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে জনগণকে উত্তেজিত করার জন্য তাঁর বিরোধীদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ছিল এই যেঃ
****************
-হযরত ওসমান (রাঃ)-বড় বড় সাহাবীদেরকে পদচ্যুত করে তার আত্মীয় স্বজনকে গভর্ণর নি য়াগ করায় জনগণ অসন্তোষ প্রকাশ করে। অনেক লোকের মনেই এ বিষয়টি স্থান লাভ করেছিল। [আল-বেদায়া, পৃষ্ঠা-১৬৮।]
এ বিপর্যয়কালে হযরত আলী (রাঃ)-এবং হযরত ওসমান (রাঃ)-এর মধ্যে যে কথাবার্তা হয়েছে, তাবারী ইবনে আসীর, ইবনে কাসীর এবং ইবনে খালদুন তার বিস্তারিত বিবরণ উল্লেখ করেছেন। তাঁরা বলেন যে, মদীনায় যখন সকল দিক থেকে হযরত ওসমান (রাঃ) সম্পর্কে সমালোচনা শুরু হয়, যখন পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, কতিপয় সাহাবী যায়েদ ইবনে সাবেত, আবু আসীদ আস সায়েদী, কাআ’ব ইবনে মালেক এবং হাসসান ইবনে সাবেত (রাঃ) ব্যতীত অপর কোন সাহাবী তাঁর সমর্থনে মুখ খোলার মতো ছিল না। [এ সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, মদীনায় যদি এমনি পরিস্থিতি দাঁড়ায় তখন মিসর থেকে আগত সন্ত্রাসীদেরকে বুঝাবার জন্য এবং বিপর্যয় থেকে বিবৃত্ত করার জন্য হযরত ওসমান (রাঃ) হযরত আলী (রাঃ)-কে প্রেরণ করে থাকলে তখন মুহাজের আনসারদের মধ্যে ৩০ জন লোক কি করে তার সাথে চলে যায়? কিন্তু এ অভিযোগ ঠিক নয়। কারণ, জাতীয় আস্থাভাজন ব্যক্তিদের খরীফার কোন বিশেষ নীতিকে পছন্দ না করা ্রকে কথা আর খলীফার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস সৃষ্টি হতে দেখে তা প্রতিরোধের চেষ্টা করা ভিন্ন কথা। সমালোচকরা সমালোচনা করতেন সংস্কার-সংশোধনের উদ্দেশ্যে। হযরত ওসমান (রাঃ)-এর সাথে তাদের কোন শত্রুতা ছিল না যে, একটি ষড়যন্ত্রীদলকে তার বিরুদ্ধে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে দেখেও তারা চুপচাপ বসে থাকবে এবং তাদেরকে যা খুশী, করতে দেবে।] তখন লোকেরা হযরত আলী (রাঃ) কে বলেন, আপনি হযরত ওমান (রাঃ)-এর সাথে সাক্ষাত করে এ ব্যাপারে আলাপ করুন। তিনি তাঁর খেদমতে উপস্থিত হয়ে আপত্তিকর নীতিসমূহ পরিবর্তন করার পরামর্শ দেন। হযরত ওসমান (রাঃ) বলেন, আমি যাদেরকে পদ মর্যাদা দিয়েছি, ওমর ইবনুল খাত্তাবও তো তাদেরকে নিয়োগ করেছিলেন। তবে লোকেরা আমার ওপর কেন আপত্তি করছে? হযরত আলী (রাঃ) জবাবে বলেনঃ “ওমর (রাঃ) যাকে কোন স্থানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করতেন, তার সম্পর্কে কোন আপত্তিকর বিষয় তার কানে পৌঁছলে ভালভাবেই তার খবর নিয়ে ছাড়তেন, কিন্তু আপনি তা করেন না। আপনি নিজের আত্মীয়-স্বজনদের সাথে শৈথিল্য প্রদর্শন করেন।” জবাবে হযরত ওসমান (রাঃ) বলেনঃ “তারাতো আপনারও আত্মীয়।” হযরত আলী (রাঃ) জবাব দেন-
***************
-“সন্দেহ নেই, তাদের সাথে নিকটাত্মীয়র সম্পর্ক রয়েছে, কিন্তু অন্যরা তাদের চেয়েও উত্তম।” হযরত ওসমান (রাঃ) বলেনঃ ওমর (রাঃ) কি মুআ’বিয়া (রাঃ)-কে গভর্ণর নিযুক্ত করেননি? হযরত আলী (রাঃ) জবাব দেনঃ ওমর (রাঃ)-এর গোলাম ইয়ারফা-ও তাকে ততটা ভয় করতো না, যতটা ভয় করতো মুআ’বিয়া। আর এখন অবস্থা এই যে, মুআ’বিয়া আপনাকে জিজ্ঞেস না করেই যা খুশী তা করে বেড়ান, এবং বলে বেড়ান এটা ওসমান (রাঃ)-এর হুকুম। কিন্তু আপনি কিছুই বলেন না। [আত-তাবারী, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৭৭; ইবনুল আসীর, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭৬। আল-বেদায়া, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৬৮-১৬৯। ইবনে খালদুন, ২য় খণ্ডের পরিশিষ্ট, পৃষ্ঠা-১৪৩।]
অপর এক উপলক্ষে হযরত ওসমান (রাঃ) হযরত আলী (রাঃ)-এর গৃহে গমন করে আত্মীয়তা নৈকট্যের দোহাই দিয়ে তাঁকে বলেন, আনি এ বিপর্যয় নিরসনে আমায় সাহায্য করুন। জবাবে তিনি বলেনঃ “এ সব কিছুই হচ্ছে মারওয়ান ইবনুল হাকাম, সাঈদ ইবনুল আ’স, আবদুল্লাহ ইবনে আমের এবং মুআ’বিয়া (রাঃ)-এর বদৌলতেই। আপনি এদের কথা শুনেন, আমার কথা শুনেন না।” হযরত ওসমান (রাঃ) বলেনঃ “আচ্ছা, এখন আমি তোমার কথা শুনবো।” অতঃপর হযরত আলী (রাঃ) আনসার মুহাজেরদের একটি দলকে সাথে নিয়ে সন্ত্রাসবাদীদের নিকট গমন করেন এবং তাদেরকে ফিরে যেতে রাযী করান। [তাবারী, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৯৪। ইবনুল আসীর, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৮১-৮২, ইবনে খালদুন, ২য় খণ্ডের পরিশিষ্ট, পৃষ্ঠা-১৪৬।]
এ বিপর্যয়কালে আর এক উপলক্ষে হযরত আলী (রাঃ) কঠোর অভিযোগ করেন যে, আমি বিষয়টি নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করি, কিন্তু মারওয়ান তা পণ্ড করে দেয়। আপনি নিজে রাসূল (স:)-এর মিম্বারের ওপর দাঁড়িয়ে জনগণকে আশ্বস্ত ও শান্ত করেন। কিন্তু আপনার চলে যাওয়ার পর আপনার দরযায় দাঁড়িয়েই মারওয়ান জনগণকে গালি দেয়। আগুন আবার দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে। [তাবারী, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৯৮। ইবনুল আসীর, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৮৩-৮৪। ইবনে খালদুন, ২য় খণ্ডের পরিশিষ্ট, পৃষ্ঠা-১৪৭।]
হযরত তালহা (রাঃ) হযরত যোবায়ের (রাঃ) এবঙ হযরত আয়েশা (রাঃ) সম্পর্কেও ইবনে জারীর রেওয়ায়াত উল্লেখ করেন যে, এঁরাও এ পরিস্থিতিতে সন্তুষ্ট ছিলেন না। [তাবারী, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪৭৭, ৪৮৬। এ সব উদ্ধৃতি ভুল বলে জনৈক বন্ধু দাবী করেছেন। উর্দুভাষীরা মূল গ্রন্থ দেখে সত্যিকার বিষয় জানতে পারবে না, সম্ভবত এ ভরসায়ই এ দাবী করা হয়েছের। তাহলেও যাদের আরবী জানা আছে তারা তো মূল গ্রন্থ দেখতে পারেন। ৪৭৭ পৃষ্ঠায় এ কথার উল্লেখ রয়েছে যে, হযরত আয়েশা (রাঃ) যখন বলেন যে, আল্লার শপথ। আমি হযরত ওসমান (রাঃ)-এর রক্তের প্রতিশোধ দাবী করবো, যখন আবদ ইবনে উম্মে কেলাব বলেন, আল্লার শপথ! সকলের আগে তো আপনিই তাঁর বিরোধিতা করেছেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) জবাব দেনঃ ”তারা হযরত ওসমান (রাঃ)-কে তাওবা করিয়ে নেয়, অতঃপর তাঁকে হত্যা করে।” এমনিভাবে ৪৮৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে যে, হযরত তালহা (রাঃ) এবং হযরত বুযায়ের (রাঃ) বসরাবাসীদের সম্মুখে ভাষণ দান করেন। এ ভাষণে তিনি বলেনঃ
**********
-আমীরুল মো’মিনীন ওসমান (রাঃ)-কে রাযী করানোই ছিল আমাদের উদ্দেশ্য…….। এতে লোকেরা হযরত তালহা (রাঃ)-কে বলেনঃ
***********
-আবু মুহাম্মদ। আমাদের নিকট তোমার পত্র রয়েছে। তাতে তো এ উদ্দেশ্যের উল্লেখ নেই। হযরত যুবায়ের (রাঃ)-এর জবাবে বলেন, হযরত ওসমান (রাঃ)-এর ব্যাপারে তোমাদের কাছে কি কখনো আমার চিঠি এসেছে? ইবনে খালদুও এসব ঘটনা উল্লেখ করেছেন। ২য় খণ্ডের পরিশিষ্ট-১৫৪-১৫৭ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য। মূল কারণ। আর এ অসন্তোষই তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী-বিপর্যয়কারীদের সহায়ক হয়ে দাঁড়ায়। আমি একাই কেবল এ কথা বলেছেন। উদাহরণ স্বরূপ ৭ম শতকের শাফেয়ী ফকীহ এবং মুহাদ্দেস হাফেজ মুহেব্বুদ্দীন আত-তাবারী হযরত ওসমান (রাঃ)-এর শাহাদাতের কারণ বর্ণনা প্রসঙ্গে হযরত সাঈদ ইবনুল মুসায়্যেবের এ উক্তি উদ্ধৃত করেনঃ
************
হযরত ওসমান (রাঃ) শাসকর্তা হলে সাহাবীদের মধ্যে কিছু লোক তাঁর ক্ষমতাসীন হওয়াকে না-পছন্দ করেন; কারণ, তিনি আপন কবীলার লোকদেরকে ভাল বাসতেন। তিনি ১২ বছর ক্ষমতাসীন ছিলেন। তিনি বারবার বনী উমাইয়ার ্রমেন সব লোকদেরকে সরকারী পদে নিয়োগ করেন, যারা রাসুলুল্লাহ (রাঃ)-এর সান্নিধ্য লাভ করেনি। তাঁর নিযুক্ত কর্মকর্তাদের দ্বারা এম সব কাণ্ড সংঘটিত হতো, রাসুলুল্লাহ (রাঃ)-এর সাহাবীরা যা পছন্দ করতেন না। তাঁর শাসনকালের শেষ ৬ বছরে তিনি তাঁর বংশের লোকদেরকে বিশেষ অগ্রাধিকার দান করেন এবং তাদেরকে শাসন-কর্তৃত্বের পদে নিয়োগ করেন। [আর-রিয়াযুন নাযেরা কী মানাকিবিল আশরাহ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১২৪।]
হাফেয ইবনে হাজারও হযরত ওসমান (রাঃ)-এর শাহাদাতের কারণে আলোচনা প্রসঙ্গে এ কথাই বলেছেনঃ
***********
– তাঁর হত্যার কারণ ছিল এই যে, বড় বড় অঞ্চলের শাসকরা ছিল তাঁরই নিকটাত্মীয়। গোটা শাম ছিল হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-এর অধীনে। বসরায় চিলেন সাঈদ ইবনুল আস, মিসরে ছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে সা’আদ ইবনে আবি সারাহ, খোরাসানে আবদুল্লাহ ইবনে আমের। এ সকল অঞ্চল থেকে হজ্জে আগত ব্যক্তিরা তাদের আমীরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতো; কিন্তু হযরত ওসমান (রাঃ)-ছিলেন কোমল স্বভাব, অতি দয়ালু এবং ধৈর্যশীল ব্যক্তি। কোন আমীরকে তিনি বদলী করে জনগণকে খুশী করতেন এবং পরে আবার তাদেরকে নিয়োগ করতেন। [আল-এছাবা ফি তামঈযিস সাহাবা, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪৫৫-৪৫৬।]
মাওলানা আনওয়ার শাহ সাহেব বলেনঃ
**********
-আমীরুল মুমিনীন হযরত ওসমান (রাঃ)-তাঁর আত্মীয়-স্বজনকে সরকারী পদে নিয়োগ করেন। এটা এ সকল বিপর্যয় তীব্র হওয়ার কারণ। এদের কারো কারো কর্মধারা ভাল ছিল না। এতে লোকেরা আপত্তি জানায় এবং তাদের বিরুদ্ধে হযরত ওসমান (রাঃ)-এর নিকট অভিযোগ করে। কিন্তু তিনি তাতে সত্য বলে মনে করেননি। বরং তিনি মনে করেন যে, এরা আমার আত্মীয়-স্বজনদের বিরুদ্ধে শুধু শুধু ক্ষিপ্ত হচ্ছে। সম্ভবত এরা আমার আত্মীয়দেরকে নিয়োগে সন্তুষ্ট নয়, তাই এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে। ………… হযরত ওসমান (রাঃ) জনগণের আপত্তির মুখে তাঁর আত্মীয়দেরকে পদচ্যুত না করলেও তিনি তাদের সমর্থনও করেননি। [ফয়যুল বারী, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-২২২, মসজিসে ইলমী ঢাভিল, প্রথম সংস্করণ, ১৯৩৮ ইসায়ী।]
হযরত আলী (রাঃ)-এর খেলাফত
হযরত ওসমান (রাঃ)-এর শাহদাতের পর যে পরিস্থিতিতে হযরত আলী (রাঃ)-কে খলীফা মনোনীত করা হয়, তা কারো অজানা নয়। বাইরে থেকে আগত ২ হাযার সন্ত্রাসবাদী রাজধানী অবরোধ করে রেখেছে। তারা খলীফাকে হত্যা পর্যন্ত করেছে। স্বয়ং রাজধানীতেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক তাদের সমমনা ছিল। নতুন খলীফা নির্বাচনে তারা নিঃসন্দেহে অংশ নিয়েছে, এমনসব বর্ণনাও নিঃসন্দেহে বর্তমান রয়েছে যে,হযরত আলী (রাঃ)-কে খলীফা নিযুক্ত করা হলে এরা কাউকে কাউকে বায়আত গ্রহণে জোর করে বাধ্য করে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এর নির্বাচন কি ভুল ছিল? কেবল মদীনায় নয়, গোট মুসলিম জাহানে তখন কেউ কি বর্তমান ছিলেন, যাকে খলীফা নিযুক্ত করা উচিত ছিল? [জনৈক বন্ধু দাবী করেছেন যে, হযরত আলী (রাঃ) তখন সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি ছিলেন না, ফেলাফতের জন্য জনসাধারণের দৃষ্টি তাঁর প্রতি নিবন্ধ হবে-এমন মর্যাদাও তাঁর ছিল না। কিন্তু আজকের দিনের কোন ব্যক্তি এর সঠিক ফায়সালা করতে পারে না। বরং সে যুগের লোকেরাই এর সঠিক ফায়সালা করতে পারবেন। এ ব্যাপারে তাদের মতামত কি ছিল, তা হযরত ওমর (রাঃ)-এর শাহাদাতের পর শুরার সদস্যরা যখন খলীফা নির্বাচনের ব্যাপারটি হযরত আবদুর ইবনে আওফ (রাঃ)-এর ওপর ন্যস্ত করেন এবং তিনি মদীনায় জনমত যাঁচাই করেন, তখনই তা স্পষ্ট প্রকাশ পেয়েছিল। এ প্রসঙ্গে হাফেযইবনে কাসীর লিখেনঃ
অতঃপর আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ) লোকদের সাথে পরামর্শ এবং সাধারণ মুসলমানদের মতামত যাচাইয়ের জন্য বেরিয়ে পড়েন। তিনি প্রকাশ্যে এবং গোপনে, একক এবং সমবেতভাবে জনগণের নেতা এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মতামত যাচাই করতে থাকেন। এমনকি, তিনি পর্দানশীল মহিলা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাধারণ ছাত্র এবং মদীনায় বহিরাগতদেরকেও জিজ্ঞেস করেন। তিন রাত তিন দিন তিনি এ কাজে ব্যস্ত ছিলেন। ………… অতঃপর তিনি হযরত আলী (রাঃ) এবং হযরত ওসমান (রাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলেনঃ আমি আপনাদের উভয়ের ব্যাপারে জনগণের মতামত যাচাই করেছি। অন্য কাউকে আপনাদের দু’জনের সমান মনে করে, এমন কাউকে আমি দেখতে পায়নি। …………….. এরপর তিনি (মসজিদে নববীর সমাবেশে ভাষণদান প্রসঙ্গে) বলেনঃ বন্ধুগণ। আমি প্রকাশ্যে এবং গোপনে আপনাদের মতামত যাচাই করেছি। আপনাদের কেউ অপর কাউকে এদের সমান মনে করেন-এমন কাউকে আমি পাইনি। -আল-বেদায়া, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৪৬।
এ থেকে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, হযরত ওসমান (রাঃ)-এর শাহাদাতের পর হযরত আলী (রাঃ)-এর প্রতিই জনগণের দৃষ্টি নিবন্ধ ছিল।] তখনকার প্রচলিত এবং সর্বসম্মত ইসলামী রীতি অনুযায়ী হযরত আলী (রাঃ) কে কি বৈধ খলীফা নির্বাচিত হননি? নতুন খলিফা নির্বাচনে সাবেক খলীফার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদীরাও যদি অংশ নেয়, তবে তার নির্বাচন অবৈধ হবে-ইসলামী সঙবিধানে কোথাও কি এমন কিছু পাওয়া যায়? [বিপর্যয় বা বিরোধকালে খলিফা নির্বাচন জায়েয নয় কেবল মু’তাযিলারাই এ মত পোষণ করতো। ভাবতে অবাক লাগে, আমাদের যুগের আহলে সুন্নার কিছু সংখ্যক আলেম হযরত আলী (রাঃ)-এর খেলাফত সম্পকেও সংশয় প্রকাশ করেছেন। কারণ তা সংঘটিত হয়েছিল বিপর্যয়কালে। অবশ্য এ ব্যাপারে আহলে সুন্নার দৃষ্টিভঙ্গি আমরা পরে আলোচনা করবো হেদায়া, ফাতহুল কাদীর এবং শরহে আকবরের উদ্ধৃতি দিয়ে ইতিপূর্বে কাযী আবুবকর ইবনুল আরাবীর আহকামুলকুরআনের উদ্ধৃতি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে।] এক খলীফা শহীদ হয়েছেন, তাঁর স্থলে যথাশীঘ্র সম্ভব অপর খলীফা নিযুক্ত না করে মুসিলম জাহান দীর্ঘদিন খলীফা বিহীন থাকবে-এটাই কি সঠিক-নির্ভল ছিল? এমনটিই কি হওয়া উচিত ছিল? যদি এ কথা স্বীকারও করে নেয়া হয় যে, হযরত আলী (রাঃ) জেনে শোনেই হযরত ওসমানের হন্তাদের গ্রেপতার এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনায় শৈথিল্য করছিলেন অথবা তিনি তাদের সামনে অক্ষম ছিলেন, তাহলেও ইসলামী আইন এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনায় শৈথিল্য করছিলেন অথবা তিনি তাদের সামনে অক্ষম ছিলেন, তাহলেও ইসরামী আইন এবং শাসনতন্ত্র অনুযায়ী এটা কি তাঁর খেলাফতকে না-জায়েয অবৈধ এবং তাঁর বিরুদ্ধে তরবারী নিয়ে দাঁড়ানো বৈধ করার জন্য যথেষ্ট? ্র সবই হচ্ছে মৌলিক প্রশ্ন। পরবর্তীকালের ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে সঠিক নির্ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার প্রশ্নে গুরুত্ব অপরসীম।
কেউ এ সকল প্রশ্নের ইতিবাচক জবাব দিতে চাইলে তাকে তার দলীল পেশ করতে হবে। কিন্তু প্রথম শতক থেকে আজ পর্যন্ত সকল আহলে সুন্নাহ সর্বসম্মতভাবে হযরত আলী (রাঃ)-কে খোলাফায়ে রাশেদীনের চতুর্থ খলীফা স্বীকার করে আসছেন। স্বয়ং আমাদের দেশেও প্রতি শুক্রবার যথারীতি তার খেলাফতের কথা ঘোষণা করা হচ্ছে। অল্প-বিস্তর হযরত আলী (রাঃ)-এর খেলাফত কালেও এ পরিস্থিতি ছিল। কেবল শাম প্রদেশ বাদ দিয়ে জাযিরাতুল আরব ্রবেং বাইরের গোটা মুসলিম জাহানে তাঁর খেলাফত স্বীকৃতি লাভ করে। রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা কার্যত তাঁর খেলাফতের ওপরই প্রতিষ্ঠিত হয় এবং উম্মতের বিপুল সংখ্যাধিক্য তাঁর নেতৃত্ব স্বীকার করে নেয়। আমি যতদূর অনুসন্ধান করতে পেরেছি, হযরত ওসমান (রাঃ)-এর পর হযরত আলী (রাঃ)-কে চতুর্থ খলীফায়ে রাশেদ স্বীকার করেনি, এমন একজন আলেমও ছিলেন না। এমন কোন আলেমও ছিলেন না, যিনি তাঁর বায়আ’তের সত্যতার ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। বরং হানাফী মাযহাবের আলেমরা তো তাঁর খেলাফত স্বীকার করে নেয়াকে আহলে সুন্নার অন্যতম আকীদা বলে গ্রহণ করেছেন। এ ব্যাপারে আলোচ্য গ্রন্থের ৭ম অধ্যায়ে শারহুত তাহাবিয়ার উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছি। এটাও সত্য যে, সকল মুহাদ্দিস, মুফাসসির এবং ফকীহ জামাল, সিফফীন খারেজীদের বিরুদ্ধে হযরত আলী (রাঃ)-এর সংঘটিত যুদ্ধকে কুরআন মজীদের আয়াত-
*************
(একদল যদি অপর দলের ওপর বাড়াবাড়ি করে, তাহলে তোমরা বাড়াবাড়িকারী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো, যতক্ষণ না তা আল্লার নির্দেশ পূর্ণ করে দেয়) অনুযায়ী হযরত আলী (রাঃ)-এর যুদ্ধকে ন্যায়ানুগ বলে স্বীকার করে নিয়েছেন। কারণম তাদের মতে তিনি ছিলেন সত্য-সঠিক ইমাম। তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ জায়েয নয়। এর বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেছেন ্রমেন একজন ফকীহ মুহাদ্দিস বা মুফাসসিরের নাম আমার জানা নেই। বিশেষ করে হানাফী মাযহাবের আলেমরা তো ঐকমত্য হয়ে বলেছেন যে, এ সকল যুদ্ধেই হযরত আলী (রাঃ) ছিলেন সত্যাশ্রয়ী। আর তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধকারীরা ছিল বিদ্রোহী। উদাহরণ স্বরূপ হেদায়া গ্রন্থ রচয়িতার নিম্নোক্ত উদ্ধৃতি লক্ষণীয়ঃ
-অত্যাচারী শাসকের পক্ষ থেকে বিচারপতির পদ গ্রহণ করা জায়েয, যেমন জায়েয ন্যায়-পরায়ণ শাসকের পক্ষ থেকে গ্রহণ করা। কারণ, সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুম হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ)-এর পক্ষ থেকে বিচারপতির পদ গ্রহণ করেছিলেন। অথচ তাঁর খেলাফতের সুযোগ লাভের পর হক ছিল হযরত আলী (রাঃ)-এর হাতে। [হেদায়া, আদাবুল কাযী অধ্যায়।]
আল্লামা ইবনে হুমাম এ উক্তির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ’ফাতহুল কাদীর’-এ লিখেনঃ
এটা হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ)-এর অন্যায়ের স্পষ্ট স্বীকারোক্তি। আর এর অর্থ আদালতের ফায়সালায় তাঁর অবিচার নয় বরং এর অর্থ হচ্ছে তাঁর বিদ্রোহ। …………. আসল কথা এই যে, সত্য হযরত আলী (রাঃ)-এর পক্ষে ছিল। কারণ, তাঁর পালা আসার পর তিনি সঠিক বায়আতক্রমে খলীফা নিযুক্ত হয়েছিলেন। আর তাঁর খেলাফত গৃহীত হয়েছিল। সুতরাং জামাল যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে এবং সিফফীন ময়দানে হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি ছিলেন সত্যের পক্ষে। উপরন্তু, ‘তোমাকে একটি বিদ্রোহী দল হত্যা করবে’-হযরত আম্মার (রাঃ) সম্পর্কে রাসুলুল্লা (রাঃ)-এর উক্তি এ কথা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করবে যে, হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ)-এর সঙ্গীরা বিদ্রোহী ছিল। কারণ, হযরত আম্মার (রাঃ)-কে তারাই হত্যা করেছিল। [ফতহুল কাদীর, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪৬১, মিসর ১৩১৬ হিজরী।]
মোল্লা আলী বারী হানাফী দৃষ্টিকোণের প্রতিনিধিত্ব করে ‘ফিকাহে আকবার’-এর ভাষ্য হযরত আলী (রাঃ)-এর ফেলাফত সম্পর্কে যে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন, তার সম্পূর্ণটাই দেখার মতো। তিনি লিখেনঃ
হযরত ওসমান (রাঃ)-এর শাহাদাতের পর বড় বড় মুহাজের-আনসাররা হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহুর নিকট সমবেত হয়ে ফেলাফত গ্রহণ করার জন্য আবেদন জানান এবং তাঁরা তাঁর হাতে বায়আত করেন। কারণ, সমকালীনদের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বোত্তম এবং খেলাফতের জন্য সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি। তিনি যে সবচেয়ে হকদার ছিলেন-এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই। অবশ্য সাহাবা (রাঃ)-দের একদল তাঁর সাহায্য-সহায়তা থেকে বিরত থাকে। সাহাবা (রাঃ)-দের একদল জামাল এবং সিফফীন যুদ্ধে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। কিন্তু এটা তাঁর খেলাফত শুদ্ধ না হওয়ার কোন দলীয় নয়। ….. রাসুলুল্লা (সঃ)-এর একটি মশহুর হাদীস-
***********
(আমার পর ৩০ বছর খেলাফত থাকবে, এরপর রক্তক্ষয়ী বাদশাহীর সূচনা হবে)-এ হাদীসটি তাঁর খেলাফতের বিশুদ্ধতার অন্যতম প্রমাণ। আর এটা সত্য যে, রাসুলুল্লা (সঃ)-এর ওফাতের ৩০ বছরের সূচনায় হযরত আলী (রাঃ) শহীদ হয়েছেন। হযরত আম্পার ইবনে ইয়াসের (রাঃ) সম্পর্কে রাসুলুল্লা (সঃ)-এর উক্তিঃ
একটি বিদ্রোহী দল তোমাকে হত্যা করবে-হযরত আলী (রাঃ)-এর ইজতিহাদের নির্ভুলতা এবং হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ) এর উদ্দেশ্যের ভ্রান্তি প্রমাণ করে। ………… এ থেকে এটাও প্রমাণিত হয় যে, মুআ’বিয়া (রাঃ)-এবং তৎপরবর্তীরা খলীফা ছিলেন না, ছিলেন রাজা-বাদশাহ।
সামনে অগ্রসর হয়ে মোল্লা আলী কারী আরও লিখেনঃ
উম্মাতের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা খেলাফত সংগঠনের শর্তের পর্যায়ভুক্ত নয়। বরং উম্মাতের কিছুসংখ্যক সাধু নজ্জন ব্যক্তি এ পদের কোন যোগ্য লোকের ওপর খেলাফতের দায়িত্ব ব্যস্ত করলে তা সংঘঠিত হয়। এরপর তার বিরোধীতা করার অধিকার কারো নেই। এ জন্য ঐকমত্যের শর্ত আরোপের কোন কারণ নেই। কারণ, ্র শর্ত আরোপের ফলে আশংকা দাঁড়ায় যে, ইমাম নিযুক্তির প্রয়োজন দেখা দিলে তাতে বিলম্ব ঘটতে পারে। তাছাড়া খলীফা নিযুক্তি এবং বায়আ’তের ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) ঐকমত্যকে কখনো শর্ত মনে করেননি। ……. যারা বলে যে, হযরত তালহা (রাঃ) এবং হযরত যুবায়ের (রাঃ) বাধ্য হয়ে বায়আ’ত করেছিলেন এবং তাঁরা বলেছিলেনঃ আমাদের হস্ত আলী (রাঃ)-এর বায়আ’ত করেছিল কিন্তু আমাদের অন্তর তাঁর বাযআ’ত করেনি, এ থেকে তাদের এ উক্তির অসারতাও প্রতিপন্ন হয়। এমনি করে তাদের এ উক্তিও অসার প্রতিপন্ন হয় যে, হযরত সাআ’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রাঃ), সাঈদ ইবনে যায়েদ (রাঃ) এবং আরও অনেকে আলী (রাঃ)-এর সাহায্য থেকে বিরত থাকেন এবং তাঁর আনুগত্য করেননি। তাঁদের এ উক্তি এ জন্য বাতেল যে, এদের বায়আ’ত ছাড়াও হযরত আলী (রাঃ)-এর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিল। বাকী থাকে, হযরত আলী (রাঃ) হযরত ওসমান (রাঃ)-এর হত্যাকারীদেরকে হত্যা করেননি। এর কারণ ছিল এই যে, তারা নিছক হত্যাকারী ছিলো না, বরং তারা বিদ্রোহীও ছিল। বিদ্রোহী তাকে বলে যার কাছে শক্তি থাকে এবং থাকে বিদ্রোহের বৈধতার ব্যাখ্যাও। তাদের শক্তিও ছিল এবং ব্যাখ্যাও ছিল। হযরত ওসমান (রাঃ)-এর কোন কোন কার্য সম্পর্কে তাদের আপত্তি ছিল এবং এ কারণে তারা তাদের বিদ্রোহকে হালাল বা বৈধ মনে করতো। শরীয়াতে এ ধরণের বিদ্রোহীদের বিধান এই যে, তারা ইমাম এবং ন্যায়পরায়ণদের আনুগত্য স্বীকার করে নিলে ইতিপূর্বে সত্য ও ন্যায়পরায়ণদে জান-মালের যে ক্ষতি সাধন করেছে; তার জন্য শাস্তি দেয়া হবে না। এ কারণে তাদেরকে হত্যা করা বা হত্যার প্রতিশোধের (কেসাস) কাছে তাদেরকে সোপর্দ করা হযরত আলী (রাঃ)-এর ওপর ওয়াযেব ছিল না। যে সকল ফকীহদের মতে এমন বিদ্রোহীদের গ্রেফতার করা ওয়াযেব তারাও বলেন যে, ইমামের উচিত তাদেরকে তখন গ্রেফতার করা, যখন তাদের শক্তি খর্ব হয় তাদের ক্ষমতার দর্প চুর্ণ হয়, পুনরায় বিপর্যয় মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে না-এ ব্যাপারে ইমাম নিশ্চিত ও নিশ্চিন্ত হন। হযরত আলী (রাঃ) এ সবের কোন একটিও লাভ করেননি। বিদ্রোহীদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল অবশিষ্ট্ এবং স্পষ্ট। তাদের প্রতিরোধ-প্রতিশোধ গ্রহণের ক্ষমতা ছিল অটুট এবং অব্যাহত। তাদের যথারিত এ প্রতিজ্ঞাও ছিল যে, যে কেউ তাদের নিকট হযরত ওসমান (রাঃ)-এর রক্তের প্রতিশোধ দাবী করবে, তারা তার বিরুদ্ধে লড়াই করবে। এ ব্যাপারে হযরত তালহা (রাঃ) এবং হযরত যুবায়ের (রাঃ)-এর কর্মপন্থা (যা জামাল যুদ্ধের কারণ হয়েছিল) ছিল ভুল। যদিও তাঁরা যা কিছু করেছেন, ইজতিহাদের ভিত্তিতেই করেছিলেন। এবং তাঁরা ইজতিহাদের যোগ্য ছিলেন। …………… এবং পরে উভয়ে তাঁদের কাজের জন্য লজ্জিত অনুতপ্ত হয়েছিলেন। অনুরূপভাবে হযরত আয়েশা (রাঃ)-তাঁর কাজের জন্য লজ্জিত হয়েছিলেন। আর এ জন্য তিনি এত কাঁদতেন যে, তাঁর দোপাট্টার আঁচল সিক্ত হয়ে যেতো। আর মুআ’বিয়া (রাঃ)-ও ভুল করেছিলেন। অবশ্য তিনি যা কিছু করেছিলেন তা করেছিলেন ব্যাখ্যার ভিত্তিতে। এ কারণে সে ভুলের জন্য তিনি ফাসেক হননি। তাঁকে বিদ্রোহী বলে অভিহিত করা যায় কিনা আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মধ্যে এ ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। তাঁদের কেউ কেউ এ থেকে বিরত থাকেন। কিন্তু তাদের কথাই সত্য, যারা তাঁর সম্পর্কে এ শব্দটি প্রয়োগ করেন। কারণ, রাসুলুল্লাহ হযরত আম্মার (রাঃ)-কে বলেছিলেন, একটি বিদ্রোহী দল তোমাকে হত্যা করবে। [ফিকহে আকবার-এর ভাষ্য, পৃষ্ঠা-৭৮-৮২।]
এ আলোচনা থেকে গোটা শরীয়াত ভিত্তিক পজিশন স্পষ্ট প্রতিভাত হয়। হযরত আলী (রাঃ)-এর খেলাফত এবং তাঁর বিরোধীদের ব্যাপারে আহলে সুন্নার সত্যিকার মত এবং পথও জানা যায়। হযরত আলী (রাঃ)-এর খেলাফতে সন্ধিগ্ধ ছিল, অপ্রমাণিত আর তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণের জন্য শরীয়াতের অনুমতির অবকাশও আছে-এ দাবীর জন্য বিপুল প্রমাণ আবশ্যক। বিশেষ করে যারা একদিকে ইয়াযীদের খেলাফতকে সত্য এবং হযরত হুসাইন (রাঃ)-কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার জন্য তৎপর এবং অন্যদিকে হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ)-এর পক্ষে সাফাই পেশ করার জন্য আদা-নুন খেয়ে লেগেছেন, তাদের এ কাণ্ড দেখে আমি অত্যন্ত বিস্মিত নই। অথচ যেসব প্রমাণ দ্বারা ইয়াযীদের খেলাফত সত্য প্রমাণ করা হয়, তার তুলনায় হাজার গুণ বেশী শক্তিশালী প্রমাণ দ্বারা হযরত আলী (রাঃ)-এর খেলাফত নির্ভুলভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। হযরত ওসমান (রাঃ)-এর হত্যার প্রতিশোধের জন্য যারা তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছে, তাঁদের এ কাজের সপক্ষে কোন শরীয়াত সম্মত প্রমাণ পেশ করা যায় না। আল্লার শরীয়াত অটুট। কারো মর্যাদার বিচার করে ভুলকে সত্য প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করার কোন অবকাশ নেই।
হযরত ওসমান (রাঃ)-এর হত্যাকারীদের ব্যাপার
শরীয়াতের বিধান সম্পর্কে আমি যতটুকু চিন্তা-ভাবনা করেছি, তার ভিত্তিতে আমার মতে হযরত ওসমান (রাঃ)-এর হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের একটি মাত্র শরীয়াত সম্মত উপায় ছিল। তা ছিল এই যে, সমকালীন খলীফার খেলাফত স্বীকার করে নিয়ে তার নিকট দাবী জানান যে, তিনি হযরত ওসমান (রাঃ)-এর হত্যাকারীদের গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন এবং এ বিরাট অপরাধে যার যতটুকু অংশ ছিল, সাক্ষ্য-প্রমাণ দ্বারা তা নির্নীত করে আইন অনুযায়ী তার শাস্তি বিধান করবেন। অপর দিকে তৎকালীন পরিস্থিতি সম্পর্কে আমি যতটুকু অধ্যয়ন করেছি, তার ভিত্তিতে আমি মনে করি যে, হযরত আলী (রাঃ)-এর সাথে সকলের সহযোগিতা এবং তাঁকে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করার সুযোগ দেয়া ছাড়া এ আইনানুগ ব্যবস্থা কার্যতঃ গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। ঐতিহাসিক ঘটনা দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, যারা ষড়যন্ত্র করে মদীনায় হামলা চালিয়েছিল, তাদের সঙখ্যা ছিল ২ হাযারের কাছাকাছি। স্বয়ং মদীনায়ও তাদের কিছু সংখ্যক সমর্থক বর্তমান ছিল। মিসর, বসরা এবং কুফায়ও তাদের পেছনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল উপস্থিত ছিল। সকল সত্যসন্ধানী ব্যক্তি হযরত আলী (রাঃ)-এর পাশে সমবেত হলে এবং তার সাথে সহযোগিতা করলে তিনি এ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলগুলোকে ছত্রভঙ্গ করে তাদের দিকে হাত বাড়াতে পারতেন। কিন্তু একদিকে যখন প্রভাবশালী সাহাবী (রাঃ)-দের একটি অংশ পক্ষপাতহীনের ভূমিকা গ্রহণ করে অপরদিকে বসরা এবং শাম এ শক্তিশালী সেনাবাহিনী হযরত আলী (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সমবেত হয়, তখন তাঁর জন্য এদের ওপর হস্ত প্রসারিত করাই কেবল অসম্ভব হয়ে ওঠেনি, বরং শক্তিশালী বাহিনীর বিরুদ্ধে যাদের কাছ থেকেই সাহায্য লাভ করা যায়, তা গ্রহণ করতে তিনি কার্যত বাধ্য হন, বাধ্য হন হযরত ওসমান (রাঃ)-এর হত্যাকারীদের দলের সাথে তৃতীয় একটি যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়তে। আমার এ মতের সাথে কেউ যদি দ্বিমত হন তাহলে বলুন হযরত আলী (রাঃ) হযরত ওসমান (রাঃ)-এর শক্তিশালী হত্যাকারর দলকে কখন পাকড়াও করতেন? খেলাফতের দায়িত্ব তার গ্রহণের পরপরই? না জামাল যুদ্ধের সময়ে? না সিফফীন যুদ্ধ কালে? না সিফফীন যুদ্ধের পর এমন সময়ে যখন হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ) তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের এক এক একটি প্রদেশকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছিলেন আর অপর দিকে খারেজীরা তাঁর বিরুদ্ধে কাতার বন্দী হয়েছিল?
ইজতিহাদী ভুল কি আর ভুল নয়?
উপরে আমি যা কছু আরয করেছি, তা থেকে এ কথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, হযরত ওসমান (রাঃ)-এর হত্যাকারীদের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য যারা যুগের খলীফার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণা করেছে, তাদের এ কাজ শরীয়াতের দৃষ্টিতে বৈধ ছিল না, কৌশলের দিক থেকেও ছিল ভুল।
এ কথা স্বীকার করতে আমার বিন্দুমাত্রও দ্বিধা নেই যে, তাঁরা এ কাজ করেছিলেন সদুদ্দেশ্যে নিজেদেরকে সত্যাশ্রয়ী মনে করে। কিছু আমি একে ‘নিছক ভুল’ মনে করি, এটাকে ‘ইজতিহাদী ভুল বলে স্বীকার করতে আমার ভীষণ দ্বিধা-দ্বন্দ্ব রয়েছে।
আমার তে যে মতামতের ব্যাপারে শরীয়াতে কোন অবকাশ পাওয়া যায়, কেবল তার সম্পর্কেই ইজতিহাদ প্রযোজ্য। যে মতামতের সপক্ষে শরীয়াতের কোন যুক্তি-প্রমাণ রয়েছে, কিন্তু তা সত্য সঠিক নয়, অথবা একান্ত দুর্বল, কেবল তাকেই আমরা ইজতিহাদী ভুল বলে অভিহিত করতে পারি। হযরত আলী (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণের বৈধতার কোন দুর্বলতম অবকাশও শরীয়াতে থেকে থাকলে তা কি ছিল, কোন জ্ঞানী ব্যক্তি অনুগ্রহ করে বলুন। নির্ভরযোগ্য বর্ণনা মতে হযরত তালহা (রাঃ) এবং হযরত যুবায়ের (রাঃ)-উভয়েই জামাল যুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বক্ষণে তাদের ভুল স্বীকার করে যুদ্ধের ময়দান থেকে সরে দাঁড়ান। আর হযরত আয়েশা (রাঃ) পরে তাঁর ভুল স্বীকার করে নিয়েছেন। অবশ্য হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ) সর্বদা নিজেকে সত্যাশ্রয়ী মনে করতেন। কিন্তু তাঁর যুদ্ধের জন্য বৈধতার যুক্তিযুক্ত অবকাশ কোন বিষয়টিকে করা যেতে পারে। নুতন খলীফা একজন গভর্নরকে পদচ্যুত করেছেন, এটা? না, নুতন খলীফা সাবেক খলীফার হত্যাকারীদেরকে গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের না করা? না নুতন খলীফার ওপর সাবেক খলীফার হত্যাকারীদের প্রভাব বিস্তার? না, একটা প্রদেশের গভর্ণরের মতে নূতন খলীফার খেলাফত আইননুগ প্রতিষ্ঠিত না হওয়া? অথচ কেন্দ্র এবং অন্যান্য প্রদেশে তাঁর খেলাফত স্বীকৃত হয় এবং কার্যতঃ তা প্রতিষ্ঠিতও ছিল। এর কোন একটিকেও যুগের খলীফার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণের বৈধ কারণ বলে অভিহিত করার কোন দুরতম অবকাশও যদি শরীয়াতে থাকে, তবে তা উল্লেখ করা হোক।
এ ক্ষেত্রে হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ) এ আয়াত দ্বারা যে যুক্তি পেশ করেছেন তা ছিল সর্বতোভাবে ভুল। কারণ, এ আয়াতের উদ্দেশ্য কখনো এটা নয় যে, যুগের খলিফা হত্যাকারীদের গ্রেফতার না করলে নিহত ব্যক্তির ওলী অভিভাবকরা খলীফার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অধিকার লাভ করবে। তাছাড়া হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ) নিহত ব্যক্তির শরীয়াত সম্মত ওলী ছিলেন না। যদি ধরেও নেয়া হয় যে, তিনি নিহত ব্যক্তির ওলী ছিলেন, তা হলেও কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তাঁর বিদ্রোহের কোন অধিকার আদৌ ছিল না।
হযরত আমর ইবনুল আস (রাঃ)-এর ব্যাপারেও একই অবস্থা দাঁড়ায়। সিফফীন যুদ্ধে বর্শা ফল ক কুরআন উত্তোলনের প্রস্তাব এবং দুমাতুল জান্দাল-এ সালিসির বিবরণী সমস্ত নির্ভরযোগ্য বর্ণনায় যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, তা দেখে এ কথা বলা ছাড়া উপায় নেই যে, এটা ছিল নিছক ’ভুল’। এটাকে ইজতিহাদী ভুল বলে অভিহিত করার কোন অবকাশ দেখা যায় না।
ইবনে সাআ’দ ইমাম যুহরীর বর্ণনা উল্লেখ করেন যে, সিফফীন যুদ্ধে লড়াই যখন চরম পর্যায়ে পৌছেঁছে, জনগণের সাহস যখন ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম, তখন হযরত আমর ইবনুল আ’স (রাঃ) হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ)-কে বলেনঃ
– আপনি আমার কথা মানলে জনগণকে নির্দেশ দিন যে, তারা যেন কুরআন খুলে দাঁড়িয়ে যায় এবং বলে যে, ইরাকবাসীরা! আমরা তোমারদেরকে কুরআনের প্রতি আহবান জানাই। আলহামদু থেকে ওয়ান-নাস পর্যন্ত এতে যা কিছু রয়েছে, তদনুযায়ী ফায়সালা হোক। আপনি এ কাজটি করলে ইরাকবাসীদের মধ্যে বিচ্ছেদ ও অনৈক্য সৃষ্টি হবে, আর শামবাসীদের ঐক্য অটুট থাকবে। হযরত মু’আনিয়া (রাঃ) তাঁর এ প্রস্তাব গ্রহণ করেন। [তাবাকাত, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৫৫।]
এ কথাই আরও সবিস্তারে উল্লেখ করেছেন ইবনে জারীর, ইবনে কাসীর, ইবনে আসীর এবং ইবনে খালদুন। এদের সকলের সর্বসম্মত বর্ণনা এই যে, হযরত আমর (রাঃ) কুরআনকে হাকাম (সালিস) করার প্রস্তাব পেশকাল এর যৌক্তিকতা সম্পর্কে বলেনঃ “এর ফল হয় এ দাঁড়াবে যে, হযরত আলী (রাঃ)-এর বাহিনীতে ভাঙ্গন দেখা দেবে। অথবা তাদের সকলে এটা স্বীকার করে নিলে কিছু দিনের জন্য যুদ্ধ বন্ধ রাখার সুযোগ লাভ করবো আমরা।” [তাবারী, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৪। আল-বেদায়া, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৭২। ইবনুল আসীর, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৬০। ইবনে খালদুন, দ্বিতীয় খণ্ডের পরিশিষ্ট, পৃষ্ঠা-১৭৪।] এছাড়া কুরআন উত্তোলনের অপর কোন উদ্দেশ্য যতদূর আমার জানা আছে, কোন ঐতিহাসিক উল্লেখ করেননি। আর এ সর্বসম্মত বর্ণনা থেকে এ কথা অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে যায় যে, মূলত এ প্রস্তাবের উদ্দেশ্য কুরআনের ভিত্তিতে ফায়সালা করানোর ছিল না। বরং এটাকে পেশ করা হয়েছিল নিছক যুদ্ধের চালবাযী হিসেবে। সত্যি কি এটাকে ‘ইজতিহাদ’ নামে অভিহিত করা যায়।
অতঃপর দুমাতুল জান্দাল-এ তাহকীম উপলক্ষে যা কিছু সংঘটিত হয়েছে, সে সম্পর্কে তাবাকাত-ই ইবনে সাআ’দ, তারীখে তাবারী, আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ইবনে আসীর এবং ইবনে খালদুনের সর্বসম্মত বর্ণনা এই যে, হযরত আমর ইবনুল আ’স (রাঃ) এবং আবু মুসা আশআ’রী (রাঃ)-এর মধ্যে একান্তে যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল, হযরত আবু মুসা (রাঃ) সমাবেশে উপস্থিত হয়ে তা-ই ঘোষণা করেন। আর হযরত আমর (রাঃ)-এর সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে ফায়সালা করেন। [তাবাকাতে, ইবনে সাআ’দ, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৫৬, ২৫৬। তাবারী, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪৯-৫২; আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৮১-২৮৩। ইবনুল আসীর, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৬৭-১৬৮। ইবনে খালদুন, দ্বিতীয় খণ্ডের পরিশিষ্ট, পৃষ্ঠা-১৭৮।] এ বিবরণী পাঠ করে কোন ইনসাফ প্রিয় ব্যক্তি এ কথা বলতে পারে যে, এটা ‘ইজতিহাদ’ ছিল?
ইয়াযীদের উত্তরাধিকারীর প্রসঙ্গ
যে যুক্তি দেখিয়ে ইয়াযীদের উত্তরাধিকারীকে বৈধ প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়, তা দেখে আমার সবচেয়ে বিস্ময় হয়। কোন কোন বন্ধু এ কথা স্বীকার করেন, যে, এর ফল হয়েছিল খারাপ। কিন্তু তাঁরা বলেন যে, হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ) তার জীবদ্দশায় ইয়াযীদকে উত্তরাধিকার না করলে তাঁর পরে মুসলমানদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হতো, রোম সম্রাট হামলা চালাতো এবং ইসলামী রাষ্ট্রেরই অবসান ঘটতো। এ কারণে ইয়াযীদকে উত্তরাধিকার করার ফলে যে কুফল দেখা দিয়েছে, তা সে সকল কুফলের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম খারাপ। আমি জিজ্ঞেস করি, সত্যিই যদি তাঁর উদ্দেশ্য এই থাকে, যে তাঁর পরে উত্তরাধিকারকে কেন্দ্র করে উম্মাতের মধ্যে গৃহযুদ্ধ না ঘটুক, আর এ জন্য তাঁর জীবদ্দশায়ই উত্তরাধিকারের বায়আত গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তাই তিনি অনুভব করে থাকেন, তবে কি তিনি এ পবিত্র উদ্দেশ্য কার্যকর করার জন্য ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতে পারতেন না? তিনি কি অবশিষ্ট সাহাবী এবং বড় বড় তাবেয়ীদের সমবেত করে তাদেরকে বলতে থাকতেন না? তিনি কি অবশিষ্ট সাহাবী এবং বড় বড় তাবেয়ীদের সমবেতন করে তাদেরকে বলতে পারতেন না যে, আমার উত্তরাধিকারের জন্য একজন উপর্যুক্ত ব্যক্তিকে আমার জীবদ্দশায়ই বাছাই করে নিন। তিনি তাঁদের নির্বাচিত ব্যক্তির সম্পর্কে বায়আত গ্রহণ করতে পারতেন না? এ কর্মপন্থা গ্রহণে কি বাধা ছিল? হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ)-এ পথ অবলম্বন করলে আপনি কি মনে করেন যে, তারপরও গৃহযুদ্ধ দেখা দিতো? তারপরও কি রোম সম্রাট হানা দিয়ে ইসলামী রাষ্ট্রের অবসান ঘটাতো?
হযরত আলী (রাঃ)-এর অহেতুক ওকালতীর অভিযোগ
সমালোচক বন্ধুরা আমার প্রতি এ সন্দেহও প্রকাশ করেছেন যে, আমি হযরত আলী (রাঃ)-এর পক্ষে অহেতুক ওকালতী করছি। কিন্তু সাহাবায়ে কেরাম, বিশেষ করে খোলাফায়ে রাশেদীন সম্পর্কে আমার স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি আমি ইতিপূর্বেও উল্লেখ করেছি যে, তাঁদের কোন বাক্য বা কর্ম বাহ্যত ভুল মনে হলে তাঁদের নিজস্ব কোন উক্তি বা তৎকালীন পরিবেশ-পরিস্থিতি অথবা তাঁদের সামগ্রিক কর্মধারায় তার সঠিক সমাধান খুঁজে বের করার পরিপূর্ণ চেষ্টা করতে হবে। আর তার স্বপক্ষে এমন সব যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা করতে হবে, যা অহেতুক এবং নিকৃষ্ট ওকালতীর সীমায় না পৌঁছে। সাইয়্যেদেনা হযরত আলী (রাঃ)-এর ব্যাপারে রাসায়েল ও মাসায়েল, ১ম খণ্ডে হযরত আলী (রাঃ)-এর খেলাফতের ‘পদ প্রার্থনা’ বিষয়ে এবং বক্ষমান নিবন্ধে আমি যে পন্থা অবলম্বন করেছি, তা মূলত এ নীতির ওপরই প্রতিষ্ঠিত, কোন অহেতুক ওকালতি নয়, আমাকে যার জন্য দোষারোপ করা হচ্ছে। আমি যখন দেখি যে, সমস্ত নির্ভরযোগ্য বর্ণনা মতে হযরত আবুবকর (রাঃ) হযরত ওমর (রাঃ) এবং হযরত ওসমান (রাঃ)-এর গোটা খেলাফতকালে তাঁরা যে নিষ্ঠা এবং ঐকান্তিকতার সাথে খলীফাত্রয়ের সহযোগিতা করেছেন, এবং তাঁদের মধ্যে যে প্রীতি-ভালোবাসা সম্পর্ক ছিল, হযরত আবুবকর (রাঃ) এবং ওমর (রাঃ)-এর ইন্তেকালের পর তাঁরা যেভাবে প্রাণ খুলে তাঁদের প্রশংসা করেছেন, তখন সে সব বর্ণনা আমার কাছে দুর্বল মনে হয়, যাতে বলা হয়েছে যে, তাঁরা এদের প্রত্যেকের খলীফা নির্বাচন অসন্তুষ্ট ছিলেন। আমার নিকট সে সব বর্ণনা অধিক শক্তিশালী বলে মনে হয়, যাতে বলা হয়েছে যে, তাঁরা প্রত্যেকেই শুরুতেই মনে প্রাণে খেলাফত গ্রহণ করেছিলেন। যখন উভয় পক্ষের বর্ণনা বিদ্যমান, এবং সনদের সাথে বর্ণিত, তখন আমরা কেন সেসব বর্ণনাকে অগ্রাধিকার দেবো না, যা তাঁদের সামগ্রিক কর্মধারার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, কেন শুধু শুধু সেসব বর্ণনা করবো, যা তার পরিপন্থী প্রতীয়মান হয়? এমনি করে হযরত ওসমান (রাঃ)-এর শাহাদাত থেকে শুরু করে তাঁর (আলী) নিজের শাহাদাত পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে তাঁর যে কর্মধারা ছিল, তার প্রতিটি খণ্ড চিত্রের একটা সুষ্ঠু ব্যাখ্যা আমি সন্ধান করেছি, এবং তার নিজস্ব বর্ণনা, তৎকালীন পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং ঘটনা প্রবাহের মধ্যে আমি তা খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু মালেক আল-আশতার এবং মুহাম্মাদ ইবনে আবু বকরকে গভর্ণরের পদে নিয়োগ করার ব্যাপারটি এমন ছিল, যাকে কোন ব্যাখ্যায়ই সত্যাশ্রয়ী বলে মনে করার কোন অবকাশ আমি খুঁজে পাইনি। এ কারণে কার্যের সমর্থনে আমি আমার অক্ষমতা প্রকাশ করেছি।
কোন কোন বন্ধু বারবার এ প্রশ্ন উত্তাপন করেন যে, হযরত ওসমান (রাঃ)-এর মতো হযরত আলী (রাঃ)-ও তো তাঁর খেলাফত কালে আত্মীয়-স্বজনকে বড় বড় পদ দান করেছেন। কিন্তু তাঁরা এ কথা ভুলে যান যে, আমার এ গ্রন্থের আলোচ্য বিষয় কি। আমি এ গ্রন্থে ইতিহাস লিপিবদ্ধ করছি না, বরং কোন ঘটনা প্রবাহ বিপর্যয় সৃষ্টির কারণ হয়েছিল, সে প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করছি। স্পষ্ট যে, এ প্রসঙ্গ আলোচনা করতে গিয়ে হযরত ওসামন (রাঃ)-এর শাসনকালই আলোচ্য বিষয়ের পর্যায়ভুক্ত হবে, হযরত আলী (রাঃ)-এর শাসনামল নয়। তিনি তাঁর শাসনাকালে যা কিছুই করেছেন, তাকে বিপর্যয় সৃষ্টির কারণ বলে গণ্য করা যায় না।