পরিশিষ্ট
সমালোচনার জবাবে-
[এ গ্রন্থের কোন কোন অধ্যায় ‘তারজামানুল কুরআন’-এ প্রকাশিত হলে তার বিষয়বস্তু সম্পর্কে কোন কোন বন্ধু তাঁদের পত্রে এবং অন্যান্যরা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় কঠোর সমালোচনা করেন। আর কোন কোন বন্ধু এর বিরুদ্ধে গ্রন্থ রচনা করেন। আমি এ সব কিছু বিশেষ মনোযোগের সাথে দেখেছি। এসব আপত্তির যা লক্ষণীয়, এখানে তার সামগ্রিক জবাব সন্নিবিষ্ট করা হচ্ছে।]
আলোচ্য বিষয়ের গুরুত্ব
এ আলোচনায় যেসব ঐতিহাসিক তথ্য পেশ করা হয়েছে, তা ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য গ্রন্থরাজি থেকে সংগৃহীত। যতোসব ঘটনা আমি উল্লেখ করেছি, তার পূর্ণ উদ্ধৃতিও নির্দেশ করেছি। উদ্ধৃতি ছাড়া কোন একটি কথাও লিপিবদ্ধ করিনি। বিজ্ঞ পাঠকরা নিজে মূল গ্রন্থের সাথে মিলিয়ে দেখতে পারেন।
এসব ইতিহাস কোথাও গোপনে সংরক্ষিত ছিল না, যা হঠাৎ বের করে আমি জনসমক্ষে উপস্থিত করেছি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এ সব দুনিয়ায় ছড়িয়ে ছিল এবং প্রকাশনা-প্রচারণার আধুনিক ব্যবস্থাপনা বিশ্বের লক্ষ-কোটি মানুষের নিকট তা পৌঁছে দিয়েছে। এবং কাফের-মুমিন, দোস্ত-দুশমন সকলেই তা পাঠ করেছেন। কেবল আরবী ভাষা-ভাষীদের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ নয়, বরং প্রাচ্যবিদরা পাশ্চাত্যের সকল ভাষায় এবং আমাদের নিজেদের ভাষায় অনুবাদক-সংকলকরা তা ব্যাপকভাবে প্রচার করেছেন। এমন আমরা তা গোপ করতে পারি না; জনগণকে এ কথাও বলতে পারি না যে, তোমরা ইসলামের ইতিহাসের এ অধ্যায়টি পাঠ করো না। আল্লার সৃষ্টিকূলকে এ নিয়ে কথা বলা থেকে বারণও করতে পারি না। বিশুদ্ধ উদ্ধৃতি এবং যুক্তিনির্ভর, প্রমাণসিদ্ধ ও ভারসাম্যপূর্ণ উপায়ে আমরা নিজেরা এ ইতিহাস বর্ণনা না করলে এবং তা থেকে সত্যিকার ফলাফল আহরণ করে সুবিন্যস্তভাবে বিশ্বের সামনে উপস্থাপন না করলে পাশ্চাত্যের মনীষী এবং অসামঞ্জস্যশীল মন -মানসের অধিকারী মুসলিম লেখকরা-যারা ইসলামের ইতিহাসকে অত্যন্ত বিকৃতরূপে উপস্থাপন করে আসছেন এবং এখনও করছেন-মুসলমানদের নয়া বংশধরদের মনমগযে কেবল ইসলামের ইতিহাসের নয়, বরং ইসলামী রাষ্ট্র এবং ইসলামী জীবন ব্যবস্থারও বিকৃত ধারণা সৃষ্টি করবে। বর্তমান পাকিস্তানে সকল স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ইসলামের ইতিহাস এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কে ইসলামের দর্শন অধ্যয়ন করছে। কিছুদিন আগে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরীক্ষায় প্রশ্ন করা হয়ঃ রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে কুরআন কি মূলনীতি বিবৃত করেছে রাসুলুল্লার শাসনাকালে কিভাবে সে সকল নীতি বাস্তাবায়িত করা হয়েছে, খেলাফত কি, কেন এবং কিভাবে ফেলাফত রাজতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়েছে? পাশ্চাত্যের লেখকরা এসব প্রশ্নের যে জবাব দিয়েছেন, সমালোচক বন্ধুরা কি চান যে, মুসলমান ছাত্ররাও সে সব জবাবই দিক? অথবা অপর্যাপ্ত অধ্যয়নের ফলৈ স্বয়ং নিজেরাই উল্টা-সিধা অভিমত ব্যক্ত করেক? অথবা তাদের দ্বারা প্রতারিত হোক, যা ইতিহাসকেই নয়, বরং খেলাফত দর্শনকেই বিকৃত করছে? আমরা কেন সাহসিকতার সাথে আমাদের ইতিহাসের এসব ঘটনার মুকাবিলা করবো না? নিরপেক্ষভাবে তা পর্যালোচনা করে সুষ্ঠু ভাবে কেন এ কথা স্পষ্ট ব্যক্ত করবো না যে, খেলাফত মূলত কি, কি তার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য, রাজতন্ত্রের সাথে তার নীতিগত পার্থক্য কি, আমাদের মধ্যে ফেলাফতের পরিবর্তে রাজতন্ত্রের উত্তরণ কেন এবং কিভাবে হয়েছে, খেলাফতের পরিবর্তে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ফলে আমাদরে সামাজিক জীবনে কার্যতঃ কি পার্থক্য সূচিত হয়েছে, এ পার্থক্যের অনিষ্ট থেকে মুক্ত থাকার জন্য, বা তা হ্রাস করার জন্য উম্মাতের স্মরণীয়=বরণীয় ব্যক্তিরা কি ব্যবস্থা লবলম্বন করেছেন? আমরা যতক্ষণ এ সকল প্রশ্নের স্পষ্ট, প্রমাণসিদ্ধ এবং সুসংগঠিত জবাব না দেবো, ততক্ষণ মন-মানসের অস্থিরতা দূর হবে না।
আজ যাহারাই রাষ্ট্র বিজ্ঞান প্রসঙ্গে ইসলামের রাষ্ট্র দর্শন অধ্যয়ন করে তাদের সামনে একদিকে সে রাষ্ট্রনীতি ফুটে ওঠে, যা রাসুলুল্লাহ (রঃ) ও খোলাফ য়ে রাশেদীনের শাসনকালে প্রতিষ্ঠিত ছিল, অপরদিকে পরবর্তীকালের রাজতন্ত্রের স্বরূপও তাদের সামনে প্রতিভাত হয়। তা উভয়ের মধ্যকার নীতি, আদর্শ, দে্দেশ্য, কর্মপন্থা এবং প্রাণশক্তি ও মন-মানসের সুস্পষ্ট পার্থক্য অনুধাবন করে। কিন্তু এতদসত্তেও তারা দেখতে পান যে, মুসলমানরা দুটি শাসন ব্যবস্থারই সমান আনুগত্য করেছে, উভয় ব্যবস্থার অধীন্েই জেহাদ অব্যাহত ছিল, কাযী শরীয়াতের বিদান জারী করেছেন, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক জীবনে সকল বিভাগই স্ব-স্ব ধারায় অব্যাহত ছিল। এ থেকে প্রতিটি রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ছাত্রের মনে স্বতই এ প্রশ্নের উদ্রক হয় যে, সত্যকার ইসলামী রাষ্ট্র দর্শন কি? এ দুট্ই কি যুগপৎ এবং সমভাবে ইসলামী নীতির না ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে দুটোর মধ্যে কোন পার্থক্য আছে? পার্থক্য থাকলে মুসলমানরা এ দুটোর অধীনে বাহ্যত একই ধরনের যে কর্মপন্থা গ্রহণ করেছে তা ব্যাখ্যা কি? আমি বুঝি না, মন-মানসকে এ সকল প্রশ্ন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা থেকে কি করে নিবৃত্ত করা যায়? আর কেনই বা এ সকল প্রশ্নের জবাব দেয়া হবে না?
ইসলামের ইতিহাসের পাঠকের সামনে ঘটনা পরস্পরার এ চিত্র পরিস্ফুট হয় যে, ইসলামী রাষ্ট্রের সর্বোত্তম বৈশিষ্ট্য নিয়ে খেলাফতে রাশেদা হিজরী ৩৩-৩৪ সাল পর্যন্ত টিকে ছিল। অতঃপর তার পতন শুরু হয়। অবশেষে হিজরী ৬০ সাল পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতে সে সকল বৈশিষ্ট্যের অবসান ঘটে এবং তার স্থলে পার্থিব শাসনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য উজ্জ্বল হয়ে দেখা দেয়। জোরপূর্বক বায়আত, বংশানুক্রমিক রাজত্ব, কাইজার-কিসরার অনুরূপ জীবনধারা, শাসক-শাসিতের মধ্যে ব্যবধান, বায়তুল মালের ব্যাপারে দায়িত্বনুভূতির বিলুপ্তি, শরীয়াত অনুসরণ থেকে রাজনীতির মুক্তি লাভ, আমর বিল মারুফ নাহই আনিল মুনকার-ন্যায়ের নির্দেশ এবং অন্যায় থেকে নিবৃত্তি-এর আযাদী থেকে মুসলমানদের বঞ্চিত হওয়া, শুরা ব্যবস্থার াবসান, এক কথায় যেসব বিষয় পার্থিব রাষ্ট্রকে ইসলামী রাষ্ট্র থেকে স্বতন্ত্র করে, হিজরী ৬০ সালের পর থেকে তার সবকিছুই একটি স্বতন্ত্র ব্যাধি হিসেবে মুসলমানদের পেয়ে বসেছিল বলে দেখা যায়। এ বিরাট এবং স্পষ্ট পরিবর্তন সম্পর্কে এখন আমরা কি বলবো? অথবা আমরা কি বলবো যে, সে যুগের ইতিহাস তো বর্তমান রয়েছে, কিন্তু সে ইতিহাসের যেসব ঘটনা এ পরিবর্তনের কারণ নির্দেশ করে, তা নির্ভরযোগ্য নয়। যদিও সে সকল ঐতিহাসিকদের বর্ণনা তৎপূর্ববর্তী এবং তৎপরবর্তী যুগের ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য? অথবা আমরা কি বলবো যে, সে সময়ের ইতিহাস সম্পর্কে চক্ষু বন্ধ করে নেয়া উচিত ও এ সকল বিষয় চিন্তা-ভাবনা এবং আলোচনা-পর্যালোচনা কিছুই করা যাবে না। কারণ, এ ২৬-২৭ বছরে যে সকল পরিস্থিতি এ সকল পরিণতির জন্য দায়ী। কোন কোন সাহাবীর ওপর তার দায়িত্ব ন্যস্ত হওয়ার আশংকা রয়েছে। অবশেষে এ সবের কোন কথাটি আমরা বিশুদ্ধতা এবং যৌক্তিকতার সাথে বলতে পারি, যা ইতিহাসের একজন সাধারণ পাঠককে আশ্বস্ত নিশ্চিন্ত করতে পারে?
সন্দেহ নেই, হাদীসের ব্যাপারে যেসব যাঁচাই-বাছাই, সনদ বর্ণনা এবং গবেষণা করা হয়েছে, ইতিহাসের ব্যাপারে তা হয়নি। কিন্তু, ইবনে সাআদ, ইবনে আবদুল বার, ইবনে জারীর, ইবনে হাজার, ইবনে কাসীর এবং ইবনে আসীরের মতো ঐতিহাসিকরা বিরোধকালের অবস্থা বর্ণনায় এতটুকু শৈথিল্য এবং অসাবধানতা অবলম্বন করেছেন যে, সাহাবীদের সম্পর্কে তাঁদের গ্রন্থে একেবারেই ভিত্তিহীন কথা লিপিবদ্ধ করেছেন-এমন কথা বলাও তো কঠিন। এ সকল বিষয় বর্ণনাকালে তারা কি এ ব্যাপারে একেবারেই বেখবর ছিলেন যে কোন সব বুযুর্গ সম্পর্কে আমরা এ সকল কথা চলছি?
****************** -এর সঠিক তাৎপর্য
আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে যে, এ ধরনের আলোচনা দ্বারা সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)-এর মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়, তাঁদের প্রতি মুসলমানদের যে আস্থা থাকা উচিত, তা ব্যাহত হয়, এ ব্যাপারেও কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট করে দেয়া প্রয়োজন মনে করি।
সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে আমার বিশ্বাস তাই, যা সাধারণ মুহাদ্দেসীন, ফোকাহা এবং উম্মাতের আলেম সমাজের আকীদাঃ *************** স্পষ্ট যে, আমাদের নিকট দ্বীন পৌঁছার মাধ্যম তাঁরাই। তাদের ন্যায়পরায়ণতার বিন্দুমাত্র সন্দেহ দেখা দিলে দ্বীনই সংশয়যুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু ************* -সাহাবীরা সকলেই সত্যাশ্রয়ী ছিলেন- আমার মতে এর অর্থ এ নয় যে, সকল সাহাবীই দোষ-ত্রুটি মুক্ত ছিলেন, তাদের প্রত্যেকেই ছিলেন মানবীয় দুর্বলতার ঊর্ধে; তাদের কেউ কখনো কোন ভুল করেননি। বরং আমার মতে এর অর্থ হচ্ছেঃ রাসূলুল্লাহ (সঃ) থেকে বর্ণনা করা তা তাঁর প্রতি কোন বিষয়ের উল্লেখে কোন সাহাবী কখনো সততা ন্যায় ন্যায়পরায়ণতা লংঘন করেননি। প্রথম অর্থ গ্রহণ করা হলে কেবল ইতিহাসই নয়, হাদীসের নির্ভরযোগ্য এবঙ বিশ্বস্ত বর্ণনাও তার সমর্থন করবে না। দ্বিতীয় অর্থ গ্রহণ করা হলে তা নিঃসন্দেহে প্রমাণ সিদ্ধ; কোন ব্যক্তি এর বিরুদ্ধে কোন নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পেশ করতে পারবে না। এমনকি, সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)-এর পারস্পরিক যুদ্ধ যখন তাঁদের মধ্যে ব্যাপক রক্তপাত ঘটে-তখনও কোন পক্ষ নিজের উদ্দেশ্যে কোন হাদীস গড়ে তা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বলে চালিয়ে দেয়নি, স্বের্থের বিরুদ্ধে যায় বলে কোন নির্ভুল হাদীসকে অস্বীকার করেননি। তাই সাহাবায়ে কেরামের বিরোধের বিষয় আলোচনাকালে এ মানসিক বিভ্রান্তি দেখা দেয়া উচিত নয় যে, কাউকে ন্যায়ের পক্ষে এবং কাউকে অন্যায়ের পক্ষে বলে স্বীকার করে নিলে তাতে দ্বীন ক্ষুণ্ন হবে। রাসূলু্লাহ (সা) থেকে বর্ণনার ব্যাপারে আমরা নিঃসন্দেহে সকল সাহাবীকেই বিশ্বস্ত-নির্ভরযোগ্য দেখতে পাই, সকলের বর্ণনাকেই মনে প্রাণে গ্রহণ করি।
সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) -এর আদালতের যদি এ অর্থ করা হয় যে, সকল সাহাবীই রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পরিপূর্ণ ওফাদার ছিলেন, তাদের সকলেরই অনুভুতি ছিল যে, হুযুরের সুন্নাহ এবং হেদায়াত উম্মাতের নিকট পৌঁছাবার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তাদের ওপর ন্যস্ত; এ জন্য তাদের কেউই ভুল কোন বিষয় আরোপ করেননি। তাহলে **************** -এর এ ব্যাখ্যা তাদের সকলের ব্যাপারে কোন ব্যতিক্রম ছাড়াই প্রযোজ্য হবে। কিন্তু যদি এর ব্যাখ্যা করা হয় যে, কোন ব্যতিক্রম ছাড়াই সকল সাহাবী তাদের জীবনের সমস্ত বিষয়ে সম্পূর্ণরূপে আদালত-ন্যায়পরায়ণতার-গুণে বিভুষিত ছিলেন, তাদের কারো থেকে কখনো আদালতের পরিপন্থী কোন কাজ সম্পন্ন হয়নি, তাহলে এ ব্যাপারে তাদের সকলের ব্যাপারে প্রযোজ্য হয় না। সন্দেহ নেই যে, তাদের বিপুল সংখ্যাধিক্য আদালতের সর্বোচ্চ আসনে উন্নীত হয়েছিলেন, কিন্তু এ কথাও অস্বীকার করা যায় না যে, তাদের খুব কম সংখ্যক এমনও ছিলেন যাদের কোন কোন কাজ আদালতের পরিপন্থী ছিল। তাই ********** -এর দ্বিতীয় ব্যাখ্যাকে নীতি হিসেবে উল্লেখ করা যায় না। কিন্তু এর মূলনীতি না হওয়ার অর্থ এই নয় যে, হাদীসের বর্ণনার ব্যাপারে তাদের কেউই নির্ভরযোগ্য নন। কারণ, এর প্রথম ব্যাখ্যা নিঃসন্দেহে মূলনীতির মর্যাদা পায় এবং কখনো এর বিরুদ্ধে কিছুই পাওয়া যায়নি।
এখানে প্রশ্ন দাঁড়ায় কোন ব্যক্তি দ্বারা ‘আদালত’ পরিপন্থী কোন কাজ সংঘটিত হওয়ার ফল কি এই হতে পারে যে, আদালতের বৈশিষ্ট্য তার থেকে সম্পূর্ণ তিরোহিত হবে, আমরা আদপেই তার ‘আদেল’ হওয়াকে অস্বীকার করবো, হাদীস বর্ণনায় যে কি অবিশ্বাস্য প্রতিপন্ন হবে? আমার জবাব এইঃ কোন ব্যক্তি আদালতের পরিপন্থী দু একটি বা কয়েকটি কাজ করে বসলে তার আদালত সর্বতোভাবে তিরোহিত হয় না, হয় না সে আদেল-এর স্থলে ফাসেক প্রতিপন্ন, যদি তার জীবনে সামগ্রিকভাবে আদালত পাওয়া যায়। হযরত ‘মায়েয আসলামী দ্বারা ব্যভিচারের মতো মারাত্মক পাপ সংঘটিত হয়। এটা নিঃসন্দেহে আদালতের পরিপন্থী কাজ ছিল। কিন্তু তিনি কথায় এবং কাজে তাওবা করেছিলেন নিজেকে শাস্তির জন্য পেশ করেছেন, তাঁর ওপর ব্যভিচারের দণ্ড আরোপ করা হয়েছে। আদালতের পরিপন্থী একটি কাজ করায় তাঁর আদালত তিরোহিত হয়ে যায়নি। তাই মুহাদ্দেসীনরা তাঁর হাদীস গ্রহণ করছেন।
আল্লাহ তাআলা যখন তাঁকে মাফ করেছেন, তখন এ সব ঘটনা উল্লেখ করা উচিত নয়-এ উদাহরণ থেকে এ কথার জবাবও পাওয়া যায়। হযরত মায়েয-এর ক্ষমায় কোন সন্দেহ করা যায় না। তিনি এমন এক তাওবা করেছেন, যা দুনিয়ায় কেউ খুব কমই করে থাকবে। রাসুলুল্লাহ (সঃ) স্বয়ং তাঁর ক্ষমার কথা স্পষ্ট ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু, তাঁর দ্বারা ব্যভিচার সংঘটিত হয়েছিল-এ বাস্তব ঘটনা উল্লেখ করা কি নিষিদ্ধ? নিছক পেশা হিসেবে এ সব ঘটনা উল্লেখ করা নিঃসন্দেহে খুব খারাপ। কিন্তু, যেখানে সত্যিসত্যি এ ধরনের ঘটনা বর্ণনা করার প্রয়োজন দাঁড়ায়, সেখানে ঘটনার র্বণনা হিসেবে তা উল্লেখ করতে ইতিপূর্বেও জ্ঞানীরা নিবৃত্ত থাকেননি, এখনও নিবৃত্ত থাকার নির্দেশ দেয়া যায় না। অবশ্য এ সকল ঘটনা বর্ণনাকালে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, যাতে কেবল ঘটনার বর্ণনা পর্যন্ত বিষয়টি সীমাবদ্ধ থাকে, সামগ্রিকভাবে যাতে কোন সাহাবীর অবজ্ঞা না করা হয়। আমি আমার সাধ্য পরিমাণ এ সতর্কতা অবলম্বন করেছি। যদি কোথাও এর চেয়ে বেশী কিছু পাওয়া যায়, তবে আমাকে অবহিত করা হলে ইনশাআল্লাহ আমি তৎক্ষণাৎ তা সংশোধন করে নেবো।
কোন কোন বন্ধু এ ব্যাপারে বিরল মূলনীতি পেশ করেন যে, সাহাবায়ে কেরামের ব্যাপারে আমরা কেবল সে সব বর্ণনা গ্রহণ করবো, যা তাঁদের মর্যাদার অনুকূল; তাঁদের মর্যাদায় আঁচড়-লাগে, এমন যে কোন বিষয়কে আমরা প্রত্যাখ্যান করবো।- কোন বিশুদ্ধ হাদীসে তার উল্লেখ থাকলেও আমরা তা গ্রহণ করবো না। কিন্তু আমি জানিনা, মুহাদ্দেসীন, মুফাসসেরীন এবং ফকীহদের কে এ মূলনীতি বর্ণনা করেছেন, কোন ফকীহ মুহাদ্দেস বা মুফাসসের কখনো এ নীতি মেনে বলেছেন, তাও আমার জানা নেই। রাসূলুল্লাহ (সঃ)- ‘ঈলা’ এবং ‘তাখয়ীর’-এর ঘটনা কী হাদীস, তাফসীর এবং ফিকাহ-এর গ্রন্থে উল্লেখিত হয়নি? অথচ এ থেকে উম্মাহাতুল মুমিনীনদের বিরুদ্ধে এলযাম আরোপিত হয় যে, তাঁরা ভরণ পোষণের জন্য হুযুরকে উত্যক্ত করেছিলেন। ইফক এর ঘটনা কোন কোন সাহাবী (রাঃ)-এর লিপ্ত হওয়া এবং তাদের ওপর অপবাদের দণ্ড আরোপের ঘটপনা কি যে সব গ্রন্থে উক্ত হয়নি? অথচ এ অপরাধ যে কতো মারাত্মক তা স্পষ্ট। মায়েয আসলামী এবং গামেদিয়ার ঘটনাবলী কি যে সব গ্রন্থে উক্ত হয়নি? অথচ সাহাবী হওয়ার মর্যাদা তো তাঁরাও লাভ করেছেন এবং এতে মনগড়া রীতি অনুযায়ী মুহাদ্দেসীনকে সে সব বর্ণনা প্রত্যাখ্যান করতে হয়, যাতে কোন সাহাবী পুরুষ বা স্ত্রীর দ্বারা ব্যভিচারের মতো জঘন্য কার্য সংঘটিত হওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। এটা যদি কোন স্বীকৃত বিধান হয়ে থাকে, তাহলে হযরত ওমর (রাঃ) হযরত মুগীরা ইবনে শোবা (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অপরাধে সাক্ষী তলব করে এ বিধান লংঘন করেছিলেন। কারণ এ বিধান অনুযায়ী একজন সাহাবী এ ধরনের কাজ করতে পারেন, তা কল্পনা করাও আদৌ গ্রাহ্য নয়, তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য তলব করা তো দূরের কথা। এমন কি, যেসব বন্ধুরা আজ এ মূলনীতি পেশ করেছেন, তারা নিজেরাও তা পুরোপুরি মেনে চলেন না। সত্যি তারা এ মূলনীতি স্বীকার করলে বলতেন জামাল-সিফফীন যুদ্ধ আদৌ সংঘটিতই হয়নি। কারণ সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)-একে অন্যের বিরুদ্ধে তরবারী ধারণ করবেন, তাঁদের হাতে ঈমানদারদের রক্ত প্রবাহিত হবে-এ থেকে তাঁদের মর্যাদা ঊর্ধে হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
ভুল-ভ্রান্তি দ্বারা বুযুর্গী ব্যাহত হয় না
আসল কথা এই যে, সাহাবাসহ কোন অ-নবী মানুষ মাসুম বা নিষ্পাপ নয়; কেবল নবী-রাসুলরাই নিষ্পাপ নিষ্কলুষ। এটা শুধু তাঁদেরই বৈশিষ্ট্য। অ-নবীদের মধ্যে কোন মানুষ এ অর্থে বুযুর্গ হতে পারে না যে, তার দ্বারা ভুল করা অসম্ভব, বা তিনি কখনো কার্যত ভুল করেননি। বরং তাঁরা বুযুর্গ এ অর্থে যে, জ্ঞান এবং কর্মের দিক থেকে তাদের জীবনে কল্যাণ-মঙ্গল প্রবল। অতঃপর যার মধ্যে ভাল যতটুকু প্রবল, তিনি ততবড়ো বুযুর্গ। তাঁর কোন কাজ ভুল বলে বুযুর্গীতে কোন পার্থক্য দেখা দেয় না।
এ ব্যাপারে আমার এবং অন্যান্যদের দৃষ্টিভঙ্গিতে এক মৌলিক পার্থক্য রয়েছে, যার ফলে আমার পজিশন উপলব্ধি করার ব্যাপারে লোকদের মধ্যে অনেক সময় ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি হয়। লোকেরা মনে করেন যে, যিনি বুযুর্গ তিনি ভুল করেন না, আর যিনি ভুল করেন, তিনি বুযুর্গ হতে পারে নান। এ মতবাদের ভিত্তিতে তাঁরা চান, কোন বুযুর্গের কোন কাজকে ভুল আখ্যায়িত না করা হোক। উপরক্তু তারা এ-ও মনে করেন যে, যারা তাঁদের কোন কাজকে ভুল বলেন, তারা তাঁকে বুযুর্গ বলে স্বীকার করেন না। আমার নীতি এর বিপরীত। আমার মতে একজন অ-নবী বুযুর্গের কোন কাজ ভুল হতে পারে এবং তা সত্ত্বেও তিনি বুযুর্গ থাকতে পারেন। কোন বুযুর্গের কোন কাজকে আমি তখন ভুল বলি, যখন তা নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রমাণিত হয় এবং কোন যুক্তি সিদ্ধ দলীল দ্বারা তার ব্যাখ্যা করা চলে না। কিন্তু এ শর্তের সাথ আমি যখন জানতে পারি যে, কোন কাজ ভুল তখন আমি তাকে ভুল বলে স্বীকার করি। অতঃপর সে কাজ পর্যন্তই আমার সমালোচনা সীমিত রাখি। সে ভুলের কারণে আমার দৃষ্টিতে সে বুযুর্গের বুযুর্গীতে ও তার মর্যাদায় কোন ব্যতিক্রম হয় না। আমি যাদেরকে বুযুর্গ মনে করি, তাদের প্রকাশ্য ভ্রান্তি অস্বীকার করা, প্রলেপ দিয়ে তা ঢেকে রাখা বা অযৌক্তিক ব্যাখ্যা করে তাকে সঠিক প্রমাণ করার কোন প্রয়োজনীয়তা আমি উপলব্ধি করিনি কখনো। ভুলকে শুদ্ধ বলার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি এ দাঁড়াবে যে, আমাদের মানদণ্ড বিগড়ে যাবে এবং বিভিন্ন বুযুর্গরা স্ব-স্ব স্থানে যেসব ভুল করেছেন, তা সব এক সাথে আমাদের মধ্যে সমবেত হবে। প্রলেপ দেয়া বা প্রকাশ্য দৃষ্টিগোচর হয় এমন কাজের ওপর আচ্ছাদন টেনে দেয়ার ফলে কাজের চেয়ে অকাজ বেশী হয়। এতে লোকেরা সংশয়ে পড়বে যে, আমরা আমাদের বুযুর্গের যেসব মাহাত্ম্য বর্ণনা করি, সম্ভবত তাও বনোয়াট।
সাহাবা (রাঃ)-দের মধ্যে মর্যাদার ব্যবধান
সাহাবায়ে কেরামের ব্যাপারে হাদীস এবং জীবন চরিত পাঠে আমি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, তাঁরা সাহাবীর মর্যাদায় সমান ছিলেন; কিন্তু জ্ঞান-মাহাত্ম্য, মহানবীর নিকট থেকে ফয়েয হাসিল এবং তাঁর শিক্ষা-দীক্ষা দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার ক্ষেত্রে মর্যাদার ব্যবধান ছিল। যে পরিবেশে নবুয়াতের আলো বিকশিত হয়েছিল, তা অবশ্য মানুষের সমাজ ছিল? সে সমাজের সকল মানুষ আলোর মশাল থেকে আলো গ্রহণ করতে পারেনি, সকলে সমান সুযোগ -সুবিধা পায়নি। তাছাড়া প্রত্যেকের প্রকৃতি ছিল স্বতন্ত্র, মন-মানস ছিল ভিন্ন, সকলের যোগ্যতা-প্রতিভা সমান ছিল না। তাদের প্রত্যেকেই স্ব স্ব যোগ্যতা অনুযায়ী হুযুরের শিক্ষা ও সান্নিধ্যের প্রভাব কম-বেশী গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তাদের মধ্যে এমন লোকও থাকতে পারেন এবং ছিলেনও, আত্মশুদ্ধির এ উত্তম দীক্ষার পরও যাদের মধ্যে কোন না কোন দিক থেকে দুর্বলতা রয়ে যায়। এটা এমন এক বাস্তবতা, যা অস্বীকার করা যায় না, আর তা অস্বীকার করা সাহাবায়ে কেরামের আদবের কোন অনিবার্য দাবীও নয় যে, তাকে অস্বীকার করতে হবে।
বুযুর্গদের কাজের সমালোচনার সঠিক পন্থা
সাধারণতঃ সমস্ত বুযুর্গানে দ্বীনের ব্যাপারে এবং বিশেষত সাহাবায়ে কেরামের ব্যাপারে আমার কর্মধারা এই যে, কোন যুক্তিসিদ্ধ ব্যাখ্যা বা কোন নির্ভরযোগ্য বর্ণনার সাহায্যে যতক্ষণ তাদের কোন কথা এবং কাজের সঠিক ব্যাখ্যা সম্ভব, তাকেই গ্রহণ করতে হবে; তাকে ভুল বলে আখ্যায়িত করার ঔদ্ধত্য ততক্ষণ পরিত্যাগ করতে হবে, যতক্ষণ তা ছাড়া উপায় না থাকে। কিন্তু অপর দিকে, আমার মতে যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যার সীমালংঘন করে এবং প্রলেপ দিয়ে ভুলকে গোপন করা বা অন্যায়কে ন্যায়ে পরিণত করার চেষ্টা কেবল ইনসাফ এবং বুদ্ধিবৃত্তির চর্চারই পরিপন্থি নয়, বরং আমি তাকে ক্ষতিকরও মনে করি, কারণ এ ধরণের দুর্বল ওকালতি কাউকে আশ্বস্ত করতে পারে না আর এর ফল দাঁড়ায় এই যে, সাহাবা এবং অন্যান্য বুযুর্গদের সত্যিকার গুণাবলীর ব্যাপারে আমরা যা কিছু বলি তাও সংশয়ের আবর্তে নিক্ষিপ্ত হয়। এ কারণে সেখানে দিবালোকের মতো স্পষ্ট আলোকে একটি জিনিসকে ভুল বা অন্যায় বলে দেখা যাচ্ছে, সেখানে কথা কাটাকাটি না করে আমার মতে সরাসরি এটা ভাল যে, অমুক কথা বা কাজ ভুল। মহা মানবদেরও ভুল হয়, তাতে তাদের মহত্ব খাটো হয় না, সুচিত হয় না কোন পার্থক্য। কারণ, তাদের মহা কীর্তির ওপরই তাদের মর্যাদা নির্নীত হয়, দু’একটি ভুলের ওপর নয়।
উৎস সম্পর্কে
‘খেলাফতে রাশেদা ও তার বৈশিষ্ট্য’-এর শেষাংশ এবং “খেলাফত থেকে রাতন্ত্র পর্যন্ত” গোটা আলোচনায় যে সকল গ্রন্থ থেকে আমি উপকরণ সংগ্রহ করেছি, কোন কোন বন্ধু সেসব গ্রন্থ সম্পর্কেও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। মূলতঃ এ সকল উপকরণ দু’ধরণের। এক ধরনের উপকরণ থেকে আমি প্রাসঙ্গিক কোন ঘটনা গ্রহণ করেছি, যেমনঃ ইবনে আবিল হাদীদ, ইবনে কোতায়বা এবং আল-মাসউদী। আর দ্বিতীয় ধরনের উপকরণের ওপর আমার আলোচনা অনেকাংশে নির্ভরশীল, যেমনঃ মুহাম্মাদ ইবনে সাআ’দ ইবনে আবদুল বার, ইবনুল আসীর, ইবনে জরীর, তাবারী এবং ইবনে কাসীর।
ইবনে আবিল হাদীদ
প্রথম ধরনের উৎসের মধ্যে ইবনে আবিল হাদীদের শীআ’ হওয়াটা স্পষ্ট। কিন্তু তা থেকে আমি শুধু এ ঘটনাটি গ্রহণ করেছি যে, সাইয়্যেদেনা আলী (রাঃ) তাঁর ভাই আকীল ইবনে আবুতালিবকেও অধিকারের চেয়ে বেশী কিছু দিতে অস্বীকার করেন। এমনিতেই এটা সত্য ঘটনা, অন্যান্য ঐতিহাসিকরাও বলেন যে, এ কারণে অকীল ভাইকে ত্যাগ করে বিরোধী শিবিরে যোগ দেন। উদাহরণস্বরূপ এসাবা এবং আল-ইস্তীআ’ব-এ হযরত আকীলের বর্ণনা দ্রষ্টব্য। এ কারণে ইবনে আবিল হাদীদ শীআ’ বলেই এ সত্য ঘটনা অস্বীকার করা যায় না।
ইবনে কোতায়বা
ইবনে কোতায়বা শীআ’ ছিল -এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। তিনি ছিলেন আবু হাতেম আস-সিজিস্তানী এবং ইসহাক ইবনে রাহ্ওয়াইহ-এর মতো ইমামদের শাহরেদ এবং দিনাওযার-এর কাযী। ইবনে কাসীর তাঁর সম্পর্কে লিখেনঃ ********** তিনি ছিলেন নির্ভরযোগ্য এবং মর্যাদা ও যোগ্যতার অধিকারী। হাফেয ইবনে হাজার বলেনঃ ****** তিনি ছিলেন অতি সত্যবাদী। খতীব বাগদাদী বলেনঃ ******** তিনি নির্ভরযোগ্য. দ্বীনদার এবং মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। মাসলামা ইবনে কাসেম বলেনঃ
*********************
-“তিনি ছিলেন একান্ত সত্যভাষী। আহলুস সুন্নার পর্যায়ভুক্ত। বলা হয়ে থাকে, তিনি ইসহাক ইবনে রাহওয়াইর অনুসারী ছিলেন।” ইবনে হাযম বলেনঃ ********* “দ্বীন এবং জ্ঞনের ব্যাপারে তিনি নির্ভরযোগ্য ছিলেন।” ইবনে হাজার তাঁর ধর্মমত সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেনঃ
***************
-“আস-সালাফী বলেনঃ ইবনে কোতায়বা ছিলেন নির্ভরযোগ্য এবং সুন্নার অধিকারী। কিন্তু ধর্মমতের কারণে হাকেম তাঁর বিরোধী ছিলেন।…… আমার মনে হয়, ধর্মমত দ্বারা সালাফীর উদ্দেশ্য নাসিবিয়্যাত। কারণ, ইবনে কোতয়বার মধ্যে আহলে বায়তের প্রতি অনীহা ছিল। আর হাকেম ছিলেন তার বিপরীত।” [আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ১১শ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪৮, ৫৭। লিসানুল মীযান, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৫৭-৩৫৯।] এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, শীআ’ হওয়া তো দূরের কথা, তাঁর বিরুদ্ধে তো নাসেবী হওয়ার অভিযোগ ছিল।
বাকী থাকে তদীয় গ্রন্থ আল-ইমামা ওয়াস সিয়াসা’-নেতৃত্ব ও রাজনীতি। এ গ্রন্থটি তাঁর নয়-নিশ্চয়তার সাথে এমন কথা কেউই বলেনি। কেবল সন্দেহ প্রকাশ করা হয়। কারণ, এতে কোন কোন বর্ণনা এমন পাওয়া যায়, ইবনে কোতায়বার বিজ্ঞতা এবং অন্যান্য গ্রন্থের সাথে যার কোন তুলনা পরিদৃষ্ট হয় না। আমি আদ্যোপান্ত গ্রন্থটি পাঠ করেছি, এর কতিপয় বর্ণনাকে আমিও অন্যের সংযোজন বলে মনে করি। কিন্তু সে জন্য গোটা গ্রন্থটি প্রত্যাখ্যান করা আমার মতে বাড়াবাড়ি। এতে অনেক কাজের কথা আছে। এবং সে সবের মধ্যে এমন কোন লক্ষণ নেই, যার জন্য তা অগ্রাহ্য হবে। উপরন্তু এ গ্রন্থ থেকে আমি এমন কোন বর্ণনা গ্রহণ করিনি, অর্থের দিক থেকে যার সমর্থক বর্ণনা অন্যান্য গ্রন্থে নেই। আমার দেয়া উদ্ধৃতি থেকে এ কথা স্পষ্ট।
আল-মাসউদী
সন্দেহ নেই, আল-মাসউদী শীআ’ ছিলেন। কিন্তু তিনি চরমপন্থী ছিলেন, এমন কথা বলা ঠিক নয়। তিনি মুরুজুয্ যাহাব’-এ হযরত আবুবকর এবং হযরত ওমর (রাঃ) সম্পর্কে যা কিছু লিখেছেন, তা পড়ে দেখুন। কোন চরমপন্থী শীআ’ এদের সম্পর্কে এভাবে আলোচনা করতে পারে না। তা হলেও শী’আদের প্রতি তার আকর্ষণ ছিল। কিন্তু আমি তাঁর এমন কোন কথা উল্লেখও করিনি, যার সমর্থনে অন্যান্য গ্রন্থ থেকে ঘটনাবলী উদ্ধৃতি পেশ করিনি।
এবার দ্বিতীয় পর্যায়ের উৎস সম্পর্কে আলোচনা করছি। আমার আলোচনার মূল বিষয়বস্তু এ পর্যায়ের ওপর নির্ভরশীল।
ইবনে সাআ’দ
এ সবের মধ্যে মুহাম্মাদ ইবনে সাআ’দ সর্বাগ্র উল্লেখযোগ্য। আমি তাঁর বর্ণনাকে অন্যান্য বর্ণনার ওপর অগ্রাধিকার দিয়েছি। তাঁর বর্ণনার পরিপন্থী কোন বর্ণনা অপর কোন গ্রন্থ থেকে গ্রহণ না করারও যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি। এর কারণ এই যে, তিনি খেলাফতে রাশেদার নিকটতর যুগের লেখক। হিজরী ১৬৮ সালে তাঁর জন্ম আর ২৩০ সালে ইন্তেকাল হয়েছে। তাঁর জ্ঞানের পরিধি ছিল অতি বিস্তৃত। সিয়ার-মাগাযীর ব্যাপারে তাঁর বিশুদ্ধতা সম্পর্কে মুহাদ্দীসীন-মুফাসসিরীন সকলেই ছিলেন আস্থাবান। আজ পর্যন্ত কোন বিজ্ঞ ব্যক্তি তাকে শীআ’ বলে সন্দেহও প্রকাশ করেননি। খতীব বাগদাদী বলেনঃ
***************
-‘আমার মতে মুহাম্মাদ ইবনে সাআ’দ ছিলেন ন্যায় পরায়ণদের অন্যতম। তাঁর হাদীসই এ কথার সত্যতার প্রমাণ বহন করে। কারণ, আপন অধিকাংশ বর্ণনায় তিনি যাচাই-বাছাই করেছেন। হাফেয ইবনে হাজার বলেনঃ
**************
-‘তিনি ছিলেন অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য এবং সংযত হাফেযে হাদীসের অন্যতম।’ ইবনে খাল্লেকান বলেন ***************** ‘তিনি সভ্যভাষী এবং নির্ভরযোগ্য।’ হাফেয সাখাবী বলেনঃ
**************
-‘তাঁর ওস্তাদ (ওয়াকেদী) দুর্বল ছিলেন বটে, কিন্তু তিনি ছিলেন নির্ভরযোগ্য। ইবনে তাগরী বেরদী বলেনঃ
****************
-‘ইয়াহ্ইয়া ইবনে মুঈন ব্যতীত সমস্ত হাফেযে হাদীসই তাঁকে নির্ভরযোগ্য বলে স্বীকার করেন।’
-তাঁর ওস্তাদ ওয়াকেদীকে হাদীস সম্পর্কে যঈক বলা হলেও সিয়ার-মাগাযীর ব্যাপারে সকল হাদীসবেত্তা তাঁর বর্ণনা গ্রহণ করেছেন। ইবনে সাআ’দের অন্যান্য শিক্ষক যথা হিশাম ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে সায়েব আল-কালবী এবং মা’শারের অবস্থাও তাই। অর্থাৎ
***************
-‘সিয়ার-মাগাযীর ব্যাপারে তাঁরা সকলেই তাঁকে নির্ভরযোগ্য বলে স্বীকার করেন। ‘উপরন্তু ইবনে সাআ’দ সম্পর্কে সকল জ্ঞানী ব্যক্তিই এ কথা স্বীকার করেন যে, তিনি ভাল-মন্দ বিচার-বিশ্লেষণ না করে শিক্ষকদের নিকট থেকে নির্বিচারে সবকিছু উল্লেখ করেননি, বরং অনেক যাচাই-বাছাই করে তিনি বর্ণনা গ্রহণ করেছেন।
ইবনে জারীর তাবারী
দ্বিতীয় হচ্ছে ইবনে জারীর তাবারী। মুহাদ্দেস-মুফাসসির ফকীহ এবং ঐতিহাসিক হিসেবে তাঁর মহান মর্যাদা স্বীকৃত। এলম ও তাকওয়া-জ্ঞান এবং আল্লাভীতি হিসেবে তাঁর মর্যাদা অতি উচ্চে। তাঁকে কাযীর পদ দেয়া হলে তিনি তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। অপরাধ দমন বিভাগের কর্তৃত্ব পেশ করা হলে তিনি তা-ও অস্বীকার করেন। ইমাম ইবনে খোযায়মা তাঁর সম্পর্কে বলেনঃ
*******************
-“বর্তমান বিশ্বে তাঁর চেয়ে বড় কোন আলেম (জ্ঞানী আছে বলে আমার জানা নেই। ইবনে কাসীর বলেনঃ
****************
-“কিতাব-সুন্নার জ্ঞান এবং তদনুযায়ী আমলের বিচারে তিনি ছিলেন ইসলামের অন্যতম ইমাম।“ ইবনে হাজার বলেনঃ
****************
-“তিনি ছিলেন ইসলামের অন্যতম বড় নির্ভরযোগ্য ইমাম।” খতীব বাগদাদী বলেনঃ
******************
-“ঐতিহাসিকদের মধ্যে আবু জাফর ছিলেন সব চেয়ে নির্ভরযোগ্য।” হাদীসে তাঁকে মুহাদ্দিস বলে স্বীকার করা হয়। ফিকহে তিনি ছিলেন স্বতন্ত্র মুজতাহিদ। আর তাঁর মাযহাব আহলে সুন্নার মাযহাবের মধ্যে শুমার হতো। ইতিহাসের ক্ষেত্রে এমন কে আছে, যে তাঁর ওপর নির্ভর করেনি? বিশেষ করে বিপর্যের কালের ইতিহাসের ব্যাপারে তো বিশেষজ্ঞরা তাঁর মতামতের ওপরই সবচেয়ে বেশী নির্ভর করেন। ইবনুল আসীর তাঁর তারিখুল কামেল” গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেনঃ রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর সাহাবীদের বিরোধের ব্যাপারে অন্যান্য ঐতিহাসিকের তুলনায় তাঁর ওপরই আমি সবচেয়ে বেশী নির্ভর করেছি। কারণঃ
****************
-“সত্যিই তিনি ছিলেন নির্ভরযোগ্য ইমাম। জ্ঞান বিশ্বাসের বিশুদ্ধতা এবং সত্যাশ্রয়ীতায় তিনি ছিলেন, সর্বব্যাপী।” সমকালীন ইতিহাসের ব্যাপারে ইবনে কাসীরও তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তন করতেন। তিনি লিখেনঃ শিআ’দের বর্ণনা থেকে দূরে সরে আমি ইবনে জারীরের ওপরই সবচেয়ে বেশী নির্ভর করেছি। কারণ,
*****************
-“তিনি ছিলেন এ ব্যাপারে যোগ্য ইমামদের অন্যতম।” ইবনে খালদুনও জামাল যুদ্ধের ঘটনাবলী র্বণনা করার পর লিখেছেন যে, অন্যান্য ঐতিহাসিকদের বাদ দিয়ে তাবারীর ইতিহাস থেকেই ঘটনাবলীর এ সংক্ষিপ্তসার আমি বের করেছি। কারণ, তিনি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য। ইবনে কোতায়বা এবং অন্যান্য ঐতিহাসিকদের গ্রন্থে যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখা যায়, ইবনে জারীর তা থেকে মুক্ত ছিল। ইবনে খালদুনের ভাষায়ঃ
*****************
-“কোন কোন ফিকহী মাসআলা এবং গাদীরে খোম” এর হাদীসের ব্যাপারে শীআ’ চিন্তা ধারার সাথে ঐক্যমতের কারণে কেউ কেউ তাকেঁ শুধু শুধু শীআ’ বলে চিহ্নিত করেছেন।” এক বুযুর্গতো তাকে। **************** শীআ’দের ইমামিয়া ফেরকার ইমাম বলেও অভিহত করেছেন।” অথচ আহলুস সুন্নার অন্যতম এমন কোন ইমাম আছেন, কোন ফিকাহী মাসাআলা বা কোন হাদীসের সত্যাসত্য নিরুপণের ব্যাপারে যাঁর কোন না কোন উক্তি শীআ’দের সাথে মিলে যায়নি। ইমাম ইবনে ‘তাইমিয়া সম্পর্কে তো সকলেই জানেন যে, যার মধ্যে শীআ’র সামান্যতম গন্ধও পাওয়া যায়, তিনি তাকে ক্ষমা করতেন না। কিন্তু মুহাম্মাদ ইবনে জারীর তাবারীর তাফসীর সম্পর্কে তিনি তার ফতোয়ায় বলেনঃ প্রচলিত পরিচিত সকল তাফসীরের মধ্যে তাঁর তাফসীর বিশুদ্ধতম। তিনি বলেনঃ
****************
-“তাতে কোন বেদয়াত নেই, নেই সুন্নার পরিপন্থী কিছু।” [ফাতওয়া ইবনে তাইমিয়া ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৯২। কুর্দিস্তান আল-এলমিয়্যা প্রেস, মিসর, ১৩২৬ হিজরী।] আসলে তিনি ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বালকে কেবল মুহাদ্দিস বলে স্বীকার করতেন, ফকীহ বলে স্বীকার করতেন না-এ ক্রোধের বশবর্তী হয়ে হাম্বলীরা সর্বপ্রথম তাঁর ওপর রাফেজী হওয়ার ইসযাম আরোপ করে। এ কারণে হাম্বলীরা তাঁর জীবদ্দশায়ই শত্রু হয়ে দাঁড়ায়। তারা তাঁর কাছে যাওয়া থেকে জনগণকে বারণ করতো। তাঁর ইন্তেকালের পর তারা মুসলমানদের কবরস্থানে তাঁকে দাফন পর্যন্ত করতে দেয়নি। শেষ পর্যন্ত তাঁকে তার গৃহেই দাফন করা হয়। [আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ১১শ খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৪৬।] এ বাড়াবাড়ি দেখে ইমাম ইবনে খোযায়মা বলেনঃ
*****************
-“হাম্বলীরা তাঁর ওপর যুলুম করেছে।” এ ছাড়া তাঁর দুর্নামের ভাগি হওয়ার আর একটি কারণ ছিল এই যে, তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে অপর এক ব্যক্তি মুহাম্মাদ ইবনে জারীর তাবারী নামে পরিচিত ছিলেন, তিনি ছিলেন শীআ’। কিন্তু যে ব্যক্তি চক্ষু উন্মীলিত করে নিজে তাফসীরে ইবনে জারীর এবং তারীখে তাবারী অধ্যয়ন করেছে, এর রচয়িতা শীআ’ ছিল বা এ গ্রন্থদ্বয় শীআ’ মুহাম্মাদ ইবনে জারীর তাবারী-এমন ভুল ধারণা সে পড়তে পারে না। [সুন্নী ইবনে জারীর আর শীআ’ইবনে জারীর উভয়ের জীবন বৃত্তান্ত জানার জন্য ইবনে হাজারের লিসানুল মীযান-এর ১০০ থেকে ১০৩ পৃষ্ঠা-দ্রষ্ট্ব্য। অধুনা কেউ কেউ পাইকারীভাবে তারীখ-ই-তাবারীর লেখককে শীআ’ ঐতিহাসিক এমনকি গোঁড়া-চরমপন্থী শীআ’ বলেও চিত্রিত করেছেন। সম্ভবত তাদের ধারণা, বেচারা উর্দুভাষীরা মূল গ্রন্থ পাঠ করে সত্যিকার অবস্থা জানার সুযোগ পাবে কোথায়?]
ইবনে আবদুল বার
তৃতীয় হচ্ছেন হাফেয আবু ওমর ইবনে আবদুল বার। হাফেয যাহাবী তাযকেরাতুল হোফফায গ্রন্থে তাঁকে শায়খুল ইসলাম বলে উল্লেখ করেছেন। আবদুল ওয়ালীদ আল-বাজী বলেনঃ
*******************
-“আন্দালুসে আবু ওমরের সমকক্ষ কোন হাদীস বিশারদ ছিলো না।” ইবনে হাযম বলেনঃ
******************
-“আমার জানামতে হাদীস অনুধাবনের ব্যাপারে কথা বলার মতো তার চেয়ে উত্তম দূরের কথা তাঁর সমকক্ষও কেউ ছিল না।” ইবনে হাজার বলেনঃ
********************
-“তাঁর রচিত গ্রন্থরাজীর কোন তুলনা নেই। এ সবের অন্যতম হচ্ছে আল-ইস্তীআ’ব। সাহাবীদের জীবন চরিত বিষয়ে এর সমক্ষক কোন গ্রন্থ নেই।” এমন কে আছেন, সাহাবীদের জীবন চরিত সম্পর্কে যিনি তাঁর আল-ইস্তীআব’-এর ওপর নির্ভর করেননি? শীআ’দের প্রতি তার ঝাঁক ছিল এমন এমন সন্দেহ প্রকাশ করেছে বা তিনি যা-তা নকল করতেন-এমন অভিযোগ করার মতো কে আছে?
ইবনুল আসীর
৪র্থ হচ্ছেন ইবনুল আসীর। তাঁর তারীখুল আমেল এবং উসুদুল গাবাহ ইসলামের ইতিহাসের অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য উৎস বলে পরিগণিত। পরবর্তী কালের এমন কোন লেখক নেই, যিনি তাঁর ওপর নির্ভর করেননি। তাঁর সমসাময়িক কাযী ইবনে খাল্লেকান লিখেছেনঃ
****************
-“হাদীস হেফযকরণ, তার জ্ঞান এবং এতদসংক্রান্ত বিষয়দীতে তিনি ইমাম ছিলেন। তিনি ছিলেন আধুনিক এবং প্রাচীন ইতিহাসের হাফেজ। আরবদের বংশ পরম্পরা এবং তাদের অবস্থা সম্পর্কে তিনি সুবিদিত ছিলেন। [ওয়াফায়াতুল আয়ইয়ান, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৩-৩৪।] শীআ’দের প্রতি তাঁর সামান্যতম আকর্ষণ সম্পর্কে কেউ সন্দেহও করেনি। তাঁর ইতিহাসের ভূমিকায় তিনি নিজে অতি স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেন যে, সাহাবীদের মতবিরোধের বর্ণনায় আমি অতি সতর্কতার সাথে দেখে শুনে পা বাড়িয়েছি।
ইবনে কাসীর
পঞ্চম হচ্ছেন হাফেয ইবনে কাসীর। মুহাদ্দিস মুফাসসির এবং ঐতিহাসিক হিসেবে তাঁর স্থান সমগ্র উম্মাতের নিকট স্বীকৃত। তাঁর ’আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া’ ইতিহাস গ্রন্থ ইসলামের উৎকৃষ্টতম উৎস বলে পরিগণিত। কাসফুযযুনুন-এর রচয়িতার উক্তি অনুযায়ী এর সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য এই যেঃ
****************************
-“তিনি বিশুদ্ধ এবং অসম্পূর্ণ বর্ণনার মধ্যে পার্থক্য করেন।” হাফেয যাহাবী তাঁর প্রশংসায় বলেনঃ
*****************
-“তিনি ছিলেন একাধারে ইমাম মুফতী বিজ্ঞ মুহাদ্দিস, বিচক্ষণ ফকীহ, বিশ্বস্ত মুহাদ্দিস-মুফাসসির। উক্তি উদ্ধৃত করার ব্যাপারে তিনি ছিলেন অভিজ্ঞ। দুটি কারণে আমি তাঁর ইতিহাসের ওপর বেশী নিভর্র করেছি। একঃ শী’আ মতবাদের প্রতি আকর্ষণ তো দূরের কথা, বরং তিনি ছিলেন তার কঠোর বিরোধী। শীআ’দের কর্ণনার কঠোর ভাষায় প্রতিবাদ করেছেন। সাহাবীদের মধ্যে কারো ওপর যথাসাধ্য আঁচড় লাগতেও দেননি। বিপযয়কালের ইতিহাস বর্ণনায় তিনি হযরত মুআ’বিয়ারই নয়, ইয়াযীদেরও সাফাই গাইতে কসুর করেননি। এতদসত্ত্বেও তিনি এতটা ন্যায়পরায়ণ যে, ইতিহাস বর্ণনায় কোন বিষয় গোপন করার চেষ্টা করেননি। দুইঃ আবুবকর ইবনুল আরাবী এবং ইবনে তাইমিয়া-উভয়েরই পরবর্তী কালের লোক ছিলেন তিনি। কাযী আবু বকর-এর আল-আওয়াসেম মিনাল কাওয়াসেম’ এবং ইবনে তাইমিয়ার ‘মিনহাজুস সুন্না’ সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন। তিনি ইবনে তাইমিয়ার কেবল মাগরেদই ছিলেন না, তাঁর ভক্তও ছিলেন। এ জন্য তাঁকে বিপদও সইতে হয়েছে প্রচুর। [আদ-দুরারুল কামেনা; ইবনে হাজার, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৭৪, দায়েরাতুল মা’আরেফ, হায়দরাবাদ, দাক্ষিণাত্য, ১৩৪৯।] তাই শীআ’ বর্ণনা দ্বারা তিনি প্রভাবিত হতে পারেন, এমন কথা আমি কল্পনাও করতে পারি না। শীআ’দের বর্ণনার ব্যাপারে তিনি প্রভাবিত হতে পারেন, এমন কথা আমি কল্পনাও করতে পারি না। শীআ’দের বর্ণনার ব্যাপারে তিনি শৈথিল্য প্রদর্শন করতে পারেন বা কাযী আবুবকর এবং ইবনে তাইমিয়া যে সকল বিষয় আলোচনা করেছেন, সে সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন না, এমন কথাও আমি ভাবতে পারি না।
এছাড়া যাদের কাছ থেকে আনুষঙ্গিকভাবে অল্প-বিস্তর তথ্য সংগ্রহ করেছি, তাঁরা হচ্ছে হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী, ইবনে খাল্লেকান, ইবনে খালদুন আবু বকর জাসসাস, কাযী আবুবকর ইবনুল আরাবী, মোল্লা আলী ক্বারী, মুহেব্বুদ্দীন আত-তাবারী ্রবেং বদরুদ্দীন আইনীর মতো ব্যক্তিত্ব। এদের সম্পর্কে সম্ভবত কেউই এমন কথা বলতে সাহস পাবে না যে, তাঁরা নির্ভরযোগ্য নন, বা শীআ’ মতবাদে কলংকিত, বা সাহাবীদের ব্যাপারে কোন কথা বলার ব্যাপারে তাঁরা শৈথিল্য প্রদর্শন করতে পারেন, বা তাঁরা অলীক কাহিনী বর্ণনা করার মতো ব্যক্তি ছিলেন। কোন কোন ঘটনার প্রমাণে আমি বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ ইত্যাদির নির্ভরযোগ্য বর্ণনারও উল্লেখ করেছি। কিন্তু কোন ব্যক্তির খাহেশের পরিপন্থী কথা হলেও তাকে ভুল বলবে-যদিও হাদীসের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থে তার উল্লেখ রয়েছে-এ হঠকারিতার কান চিকিৎসা নেই, নেই এর কোন ঔষুধ। এ হঠকারিতারও কোন চিকিৎসা নেই যে, মর্জী মতো হলেই তাকে নির্ভুল বলবে-যদিও সে যাকে দুর্বল বলছে, তার তুলনায়-এর সনদ আরও দুর্বল।
এ সকল ইতিহাস কি নির্ভরযোগ্য নয়
এখন চিন্তা করে দেখুন। এ হচ্ছে সেসব উৎস, যার থেকে আমি গোটা আলোচনায় উপকরণ গ্রহণ করেছি। সে কালের ইতিহাসের ব্যাপারে এ সব যদি নির্ভরযোগ্য না হয়, তাহলে ঘোষণা করুন যে, রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর যুগ থেকে নিয়ে ৮ম শতক পর্যন্ত ইসলামের কোন ইতিহাস দুনিয়ায় বর্তমান নেই। কারণ রাসুলুল্লাহ (সঃ) পরবর্তী যুগের কয়েক শতাব্দীর ইতিহাস-হযরত আবুবকর সিদ্দিক (রাঃ)-এবং ওমর ফারুক (রাঃ)-এর ইতিহাস সহ-এঁদের মাধ্যমেই আমাদের নিকট পৌঁছেছে। এগুলো যদি বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য না হয়, তাহলে তাঁদের বর্ণিত খেলাফতে রাশেদার ইতিহাস, ইসলামের স্মরণীয় ব্যক্তিদের জীবনেতিহাস এবং তাঁদের কীর্তি গাঁথা সবকিছুই মথ্যার ভাণ্ডার, যা কারো সামনেই আমরা তুলে ধরতে পারি না আস্থার সাথে। বিশ্ব এ নীতি কখনো মানতে পারে না, বিশ্ব কেন, স্বয়ং মুসলমানদের বর্তমান বংশধরেরও এ কথা কিছুতেই স্বীকার করবে না যে, আমাদের বুযর্গদের যে সকল গুণাবলী এ সকল ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে তা সবই সত্য। আর এ সকল গ্রন্থে তাঁদের যেসব দুর্বলতা উল্লেখ করা হয়েছে, তা সবই মিথ্যা। কারো যদি এ ধারণা হয়ে থাকে যে, শীআ’দের ষড়যন্ত্র এতই শক্তিশালী ছিল যে, তাদের প্ররোচনা থেকে আহলে সুন্নার এসব লোকেরাও বাঁচতে পারেনি, শীআ’দের বর্ণনা তাঁদের গ্রন্থরাজীতেও প্রবিষ্ট হয়ে সে যুগের গোট ইতিহাসকেই বিকৃত করে ছেড়েছে। তাহলে আমি বিস্মিত যে, তাদের এ অনুপ্রবেশ থেকে হযরত আবু বকর (রাঃ)-এবং হযরত ওমর (রাঃ)-এর জীবনেতিহাস এবং তাঁদের যুগের ইতিহাস কি করে সঙরক্ষিত রয়ে গেছে।
তা সত্ত্বেও যেসব বন্ধু যিদ ধরে বসে আছে যে, এ সকল ইতিহাসিকদের সে সকল বর্ণনা থেকেআমি উপকরণ সংগ্রহ করেছি, তা নির্ভরযোগ্য নয়, তাঁদের কাছে আমার সবিনয় নিবেদন, তাঁরা যেন দয়া করে বলেন যে, তাঁদের এ সকল বর্ণনা শেষ পর্যন্ত কোন তারিখ থেকে কোন তারিখ পর্যন্ত অবিশ্বাস্য। সে তারিখের পূর্বের বা পরের যে সকল ঘটনা এ ঐতিহাসিকরা বর্ণনা করেছেন, তা কেন নির্ভরযোগ্য? আর এ ঐতিহাসিকরা এ অন্তরবর্তীকালীন সময়ের ব্যাপারেই কেবল এতটুকু অসতর্ক হয়ে পড়েন যে, তাঁরা বিভিন্ন সাহাবী সম্পর্কে এত মিথ্যা উপকরণ তাঁদের গ্রন্থে কেনইবা সংগৃহীত করেছিলেন?
হাদীস এবং ইতিহাসের পার্থক্য
কোন কোন বন্ধু ঐতিহাসিক র্বণনা যাঁচাই এর জন্য আসমাউর রেজাল বা চরিত শাস্ত্র খুলে বসে যান এবং বলেন, অমুক অমুক বর্ণনাকারীকে চরিত শাস্ত্রের ইমামরা ত্রুটিপূর্ণ বলে অভিহিত করেছেন। আর অমুক বর্ণনাকারী যে সময়ের ঘটনা বর্ণনা করেছেন, সে সময় তিনি তো শিশু ছিলেন অথবা তাঁর জন্মই হয়নি। আর অমুক বর্ণনাকারী একটি বর্ণনা যে উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছেন, তার সাথে তিনি সাক্ষাতই করেননি। এমনি তাঁরা ঐতিহাসিক বর্ণনার ওপর হাদীস যাঁচাই-বাছাইয়ে এ নীতি প্রয়োগ করেন। আর এ কারণে তারা তা প্রত্যাখ্যান করেন যে, অমুক ঘটনা সনদ ছাড়াই বর্ণিত হয়েছে, আর অমুক ঘটনার সনদে বিচ্যুতি ঘটেছে। এ সকল কথা বলার সময় তাঁরা ভুলে যান যে, মুহাদ্দিসরা হাদীস যাঁচাই-বাছাই এর এ নীতি গ্রহণ করেছিলেন মূলত বিধি-বিধানের হাদীসের ব্যাপারে। কারণ, হালাল-হারাম, ফরয ওয়ায়েব এবঙ মাকরুহ-মোবাহর মতো গুরুত্বপূর্ণ শরীয়াত সঙক্রান্ত বিষয়াদির ফায়সালা হয় এরই ওপর। দ্বীনে কোনটি সুন্না আর কোনটি সুন্না নয়, তাও জানা যায় এরই দ্বারা। ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর ব্যাপারেও যদি এ সকল শর্ত আরোপ করা হয়, তবে ইসলামের ইতিহাসের পরবর্তী অধ্যায়ের তো প্রশ্নই উঠে না, বরং প্রথম যুগের ইতিহাসের ন্যুন পক্ষে এক-দশাঙশ অনির্ভরযোগ্য বলে পরিগণিত হয়ে যাবে। আর আমাদের বিরোধীরা যে সকল শাস্ত্রের শর্ত সামনে রেখেই সে সকল কীর্তিকে প্রনিধানের অযোগ্য বলে আখ্যায়িত করবে, যা নিয়ে আমরা গর্ব করি। কারণ, হাদীসের মূলনীতি এবং আসমাউর রেজাল বা রচিত শাস্ত্র যাঁচাই-বাছাই এর মানদণ্ডে তার অধিকাংশই উত্তীর্ণ হয় না। এমনকি এক একটি বর্ণনা নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি থেকে নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন সনদ পরস্পরায় বর্ণিত হয়েছে-পরিপূর্ণ এ শর্তে রাসুলুল্লার পূত-পবিত্র জীবন চরিতও সংগ্রহ করা যায় না।
বিশেষ করে ওয়াকেদী এবং সাইফ ইবনে ওমর এঁদের মতো অন্যান্য বারীদের যাঁচাই-বাছাই শাস্ত্রের সেরা মনীষীদের উক্তি উদ্ধৃত করে জোর দিয়ে এ দাবী করা যায় যে, কেবল হাদীসের ক্ষেত্রেই নয়, বরং ইতিহাসের ব্যাপারেও এদের কোন বর্ণনা গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু সে সকল ইমামের গ্রন্থ থেকে যাঁচাই-বাছাই এর ইমামদের এ সকল উক্তি উদ্ধৃত করা হয়, তাঁরা কেবল হাদীসের ব্যাপারে এদের বর্ণনা প্রত্যাখ্যান করেছেন। ইতিহাস, যুদ্ধ-বিগ্রহের কাহিনী এবং জীবন চরিতের ব্যাপারে এ সকল আলেম তাঁদের গ্রন্থে সেখানেই যা কিছু লিখেছেন, তারা এদের উদ্ধৃতি দিয়ে অনেক ঘটনার উল্লেখ করেছেন। উদাহরণ স্বরূপ হাফেয ইবনে হাজারের কথাই ধরুন। তাঁর তাহযীবুত তাহযীব গ্রন্থ থেকে চরিত শাস্ত্রের ইমামদের এ সকল সমালোচনা উল্লেখ করা যায়। কেবল ঐতিহাসিক গ্রন্থাদীতেই নয় বরং বুখারীর ভাষ্য ফতহুল বারীতেও তিনি যখন যুদ্ধের কাহিনী এবং ঐতিহাসিক ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করেন, তখন তাতে স্থানে স্থানে ওয়াকেদী, সাইফ ইবনে ওমর এমন করে অন্যান্য দুর্বল বর্ণনাকারীদের উক্তি দেদার উদ্ধৃত করেছেন। এমনিভাবে হাফেয ইবনে কাসীর তাঁর আল-বেদায়া ওয়ান বেহায়ায় আবুমেহনাফ-এর কঠোর নিন্দা করেছেন আর তিনি নিজেই ইবনে জারীর তাবারীর ইতিহাস থেকে বহুবার সে সকল ঘটনার উল্লেখও করেছেন, যা তিনি র্বণনা করেছেন এদেরই উদ্ধৃতি দিয়ে। এ থেকে স্পষ্ট জানা যায় যে, হাদীস শাস্ত্রের মহান ওলামায়ে কেরাম সর্বদা হাদীস এবং ইতিহাসের সুস্পষ্ট পার্থক্যের প্রতি লক্ষ্য রেখেছেন। তাঁরা এ দুটি বিষয়কে একাকার করে একটির সমালোচনার সে নীতি প্রয়োগ করতেন না, মূলত যা রচিত হয়েছে অপর জিনিসের জন্য। এ পন্থা কেবল মুহাদ্দিসীনরাই মেনে চলতেন না, বরঙ বড় বড় ফকীহরাও-রেওয়ায়াত গ্রহণ করার ব্যাপারে যারা আরও কঠোরতা অবলম্বন করতেন ্র নীতি মেনে চলতেন। উদাহারণ স্বরূপ ইমাম শাফেয়ী এক দিকে ওয়াকেদীকে কট্টর মিথ্যাবাদী বলে অভিহত করেন- অপরদিকে কিতাবুল উম্ম এ তিনি যুদ্ধ অধ্যায়ে তার বর্ণনা থেকে দলীয় উপস্থাপন করেছেন।
এর অর্থও এ নয় যে, এরা চক্ষু বন্ধ করে এ সকল দুর্বল বর্ণনাকারীদের বর্ণনা গ্রহণ করেছেন। আসলে তাঁরা এদের সমস্ত বর্ণনা প্রত্যাখ্যানও করেননি। আবার সবটুকু গ্রহণওর করেননি। আসলে তাঁরা এদের সমস্ত বর্ণনা প্রত্যাখ্যানও করেননি। আবার সবটুকু গ্রহণও করেননি। আসলে তাঁরা এ সবের মধ্য থেকে যাঁচাই বাছাই করে কেবল তাই গ্রহণ করতেন, যা তাঁদের নিকট গ্রহণ করার যোগ্য। যার সমর্থনের আরও অনেক ঐতিহাসিক তথ্যও তাঁদের সামনে থাকতো, যার মধ্যে ঘটনা পরস্পরার সাথে সামঞ্জস্যও পাওয়া যেতো। এ কারণে ইবনে সা’আদ ইবনে আবদুল বার, ইবনে কাসীর, ইবনে জারীর, ইবনে আসীর, ইবনে হাজার এবং এদের মতো অন্যান্য নির্ভরযোগ্য আলেমরা তাঁদের গ্রন্থে দুর্বল বর্ণনাকারীদের থেকে সে সকল বিষয় বর্ণনা করেছেন, তা প্রত্যাখ্যান করার কোন যুক্তিসং্গত কারণ নেই। তাঁরা দুর্বল এবং ধারাবাহিকতা বহির্ভুত সনদে যেসব বিষয় গ্রহণ করেছেন, বা বিনা সনদে বর্ণনা করেছেন, সে সব নিছক ভিত্তিহীন, কল্প কাহিনী মাত্র, তাই তা ছুড়ে ফেলে দিতে হবে-এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণেও কোন যুক্তি সংঙ্গত নেই।
অধুনা এমন ধারণাও বড় জোরেশোরে পেশ করা হচ্ছে যে, যেহেতু আব্বাসীয়দের আমলেই মুসলমানদের ইতিহাস রচনা শুরু হয়েছে, আর বনী উমাইয়্যাদের সাথে আব্বাসীয়দের যে দুশমনী ছিল তা কারো কাছে গোপন নয়; তাই সে সময়ে যেসব ইতিহাস রচিত হয়েছে সে সবই ছিল শত্রুর বিরুদ্ধে আব্বাসীয়দের প্রোপগাণ্ডায় পরিপূর্ণ। কিন্তু এ দাবী সত্য হলে এ কথার কি ব্যাখ্যা করা হবে যে, এ সকল ইতহাসেই বনী উমাইয়াদের সে সব স্মরণীয় কার্তিমালাও বর্ণিত হয়েছে, এ সকল বন্ধুরা যা গর্বের সাথে বলে বেড়ান, আর এ সব ইতিহাসই হযরত ওমর ইবনে আবদুল আযীযের উৎকৃষ্টতম জীবনেতিহাসের বিস্তারিত আলোচনাও দেখতে পাওয়া যায়, যিনি ছিলেন বনী উমাইয়াদেরই অন্যতম। সবচেয়ে বড় কথা এই যে, এ সব ইতিহাসেই আব্বাসীয়াদের অনেক দোষ-ত্রুটি এবং যুলুম-নির্যাতনের বিষয়ও বর্ণিত হয়েছে। এ সব কিছুও কি আব্বাসীয়ারা নিজেরাই প্রচার করেছেন?
একালতীর মৌলিক দুর্বলতা
উৎস সম্পর্কে এ আলোচনা শেষ করার আগে আমি এ কথাও প্রকাশ করে দিতে চাই যে, কাযী আবুবকর ইবনুল আরাবীর আল-আওয়াসেম মিনাল কাওয়াসেম, ইমাম ইবনে তাইমিয়ার মিনহাজুস সুন্নাহ এবং শাহ আবদুল আজীজের তোহফায়ে ইসনা আশারিয়্যাকে কেন্দ্র করেই আমি আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখিনি কেন। আমি এ সকল বুযুর্গের একান্ত ভক্ত। সততা বিশ্বস্ততা এবং চিন্তা-গবেষণার বিশুদ্ধতার বিচারে এরা নির্ভরযোগ্য নন, এমন কথা আমার মনের কোণেও উদয় হয়নি। কিন্তু যে কারণে এ ব্যাপারে আমি তাঁদের ওপরই সীমাবদ্ধ না থেকে মূল উৎস থেকে নিজে অনুসন্ধান চালিয়ে স্বাধীন মতামত গ্রহণ করার পথ অবলম্বন করেছি, তা হলো এই যে, মূলতঃ এরা তিন জনেই ইতিহাস হিসেবে ঘটনাবলীর বর্ণনার জন্য তাদের গ্রন্থ রচনা করেননি, বরং তাঁরা তা লিখেছেন শীআ’দের কড়া অভিযোগ এবং তাঁদের বাড়াবাড়ির প্রতিবাদে। এ কারণে কার্যত তাঁদের স্থান হয়েছে প্রতিপক্ষের উকিলের অনুরূপ। আর ওকালতী-তা বাদীপক্ষের হোক বা বিবাদীপক্ষের-তার স্বভাব হচ্ছে এই যে, মানুষ তাতে সে সব তথ্যের দিকেই ফিরে যায়, যাতে তার মামলা যুৎস ই হয়, আর সে সব তথ্য এড়িয়ে যায়, যাতে তার মামলা দুর্বল হয়। সাধারণত এটাই হচ্ছে মানুষের স্বভাব। বিশেষ করে এ ব্যাপারে কাযী আবুবকর তো সীমাতিক্রম করে গেছেন। ইতিহাস অধ্যয়ন করেছেএমন কোন ব্যক্তি তো এ থেকে কোন শুভ প্রতিক্রিয়া লাভ করতে পারে না। এ কারণে আমি তাদেরকে বাদ দিয়ে মূল ঐতিহাসিক গ্রন্থ থেকে ঘটনা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেছি, এবং সে সব ঘটনাবলী সন্নিবেশিত করে আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে নিজেই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি।
এবার আমি সে সব মূল বিষয়ে প্রত্যাবর্তন করবো, যা নিয়ে বিভিন্ন অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে।