নবম অধ্যায়ঃ অর্থনৈতিক কাঠামো পুনর্গঠন
নবম অধ্যায়
অর্থনৈতিক কাঠামো পুনর্গঠন
সম্পদের স্বল্পতা ও সামাজিক অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতার কারণে ‘মাকাসিদ’ অর্জিত নাও হতে পারে। এজন্য ভোগ এমনভাবে কমাতে হবে, যাতে চাহিদার পরিপূরণ এবং সঞ্চয় ও মূলধন, আত্ম-কর্মসংস্থান ও কর্মসংস্থানের সুযোগের সম্ভাব্য সর্বোচ্চ সমপ্রসারণ ঘটে। এজন্য অর্থনীতির কাঠামো, বিশেষ করে সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতের ভোগ ও বিনিয়োগ পদ্ধতির পুনর্গঠন প্রয়োজন, যাতে ‘মাকাসিদ’ অর্জনে সম্পদের যে সকল ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা নেই, সে সকল ব্যবহারে সম্পদের সরবরাহ যেন না হয়। চতুর্থ অধ্যায়ে এরূপ পুনর্গঠন সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। মূল্যবোধ নিরপেক্ষা কাঠামোর মধ্যে উদারীকরণ দ্বারা এরকম পুনর্গঠন সাধন করা কখনই সম্ভব নয়। ইসলামী জীবন পদ্ধতির সকল উপাদানের সম্মিলিত অনুসরণের মাধ্যমেই কেবল এ পুনর্গঠন সম্ভব। এরূপ পুর্গঠনের জন্য কতিপয় সংশ্লিষ্ট বিষয় এখানে আলোচনা করা হচ্ছে।
ভোক্তার চাহিদা পরিবর্তন: দ্বৈত ছাঁকনির ব্যবস্থা
সঞ্চয় ও মূলধন সৃষ্টির জন্য ভোগ সংকুচিত করার উদ্দেশ্য দ্বৈত সমস্যার সৃষ্টি করে। ইসলামী সৌভ্রাতৃত্ব ও সামাজিক সাম্যের দ্ব্যর্থহীন দাবি হচ্ছে, সামগ্রিক ভোগ এমনভাবে কমাতে হবে, যাতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণ কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়ে বরং তা যেন পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পায়। সীমিত সম্পদের সীমাবদ্ধতার মধ্যে যদি সকলের চাহিদা পূরণ করার সাথে যুগপৎভাবে মূলধন গঠন করতে হয়, তবে সমাজ যতটুকু বহন করতে পারে কেবল ততটুকু ভোগ সীমিত করা সমীচীন। বিশেষ করে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের প্রচলিত জীবনযাপন পদ্ধতিতে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে হবে। এজন্য পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার ন্যায় ভোগকে ব্যক্তি জীবনের একমাত্র লক্ষ্যে পরিণত হওয়াকে অনুমোদন করা যাবে না।
কয়েক দশক ধরে মুসলিম দেশসমূহ নিজেদের ভোগ পদ্ধতিতে পাশ্চাত্যের ভোগসংস্কৃতির হুবহু অনুকরণ করে চলেছে, যেখানে বিলাসবহুল জীবনযাত্রা ও ভোগর পৌনঃপুনিকতা দিয়ে কোনো ব্যক্তির গুরুত্ব পরিমাপ করা হয়্ ফলে যে ধরনের বিলাসবহুল জীবনযাপন পদ্ধতি দরিদ্র মুসলিম দেশে মর্যাদার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেরূপ বিলাসী জীবনযাপন অনেক শিলেপান্নত ধনী দেশেও সম্ভব নয়। এ ধরনের জীবনযাত্রার পদ্ধতি এবং জন্ম থেকে বিবাহ ও মৃত্যু পর্যন্ত অগণিত অনৈসলামিক প্রথা ও অনুষ্ঠানাদি পূর্বোক্ত ধনাঢ্য ব্যক্তিদেরকে অবাস্তব ভোগ প্রবণতার দিকে ঠেলে দিয়েছে, যা তাদের মূল্যবোধ এবং সামর্থ্যের নিরিখে কাম্য নয়। এই প্রতিযোগিতায় আক্রান্ত ব্যক্তিগণ অবাস্তব সামর্থ্যের বাইরে জীবনযাপনের ফলে আয়ের অতিরিক্ত ব্যয়ের ঘাটতি পূরণ করার জন্য দুর্নীতি ও অনৈতিক পন্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হন। এতে সামগ্রিক ভোগ বৃদ্ধি পায়, সঞ্চয় পিছিয়ে পড়ে ও অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়ের ভিত্তিতে মূলধন গঠন অপর্যাপ্ত থেকে যায়। অধিকন্তু প্রায় সকল বিলাস দ্রব্য ও সেবা বিদেশ থেকে আমদানি হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার উপর চাপ প্রচণ্ড বৃদ্ধি পায়। সম্পদের এ ঘাটতি বৈদেশিক ঋণ দ্বারা পূরণ করতে হয়, যা থেকে উচ্চহারে ঋণভার সৃষ্টি হয় এবং এতে ভবিষ্যতের জন্য সম্পদ আরো সীমিত হয়ে পড়ে।
নৈতিক ছাঁকনির প্রয়োজনীয়তা
সম্পদের অপ্রয়োজনীয় চাহিদা থেকে প্রয়োজনীয় চাহিদা পৃথক করার মধ্যে কিভাবে সকলকে অপ্রয়োজনীয় চাহিদা সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকতে উদ্বুদ্ধ করা যায়, তার মধ্যেই সমস্যার মূল নিহিত আছে। এজন্য একটি ছাঁকনি কৌশল ও উদ্বুদ্ধকরণ পদ্ধতি অত্যাবশ্যক।
বস্তুবাদী পরিবেশে মূল্যব্যবস্থা সম্পদের প্রয়োজনীয় চাহিদা ছাঁটাই করতে একদিকে যেমন কার্যকরী নয়, অন্যদিকে পূর্ণায্গ উদ্বুদ্ধকরণেও সক্ষম নয়। যদিও সম্পদ ব্যবহারে দক্ষতা সৃষ্টি ও ভারসাম্যহীনতা দূরীকরণে মূল্যব্যবস্থার ব্যবহার অপরিহার্য, কিন্তু ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্য এ ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত, বিশেষ করে যে অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতার পূর্বশর্ত অনুপস্থিত থাকে। মূল্যব্যবস্থার অধীনে কর, শুল্ক ও মুদ্রামান হ্রাস দ্বারা বিলাস সামগ্রীর মূল্র যতই বাড়ানো হোক না কেন, ধনাঢ্য ব্যক্তিগণ মর্যাদার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত বিলাসসামগ্রী ক্রয় করতে সক্ষম হবে। যদি কোনো পরিবারের এসব সামগ্রী থাকে তবে অন্য পরিবার সেগুলোকে অপরিহার্য। বিবেচনা করবে। যারা এসব বিলাসদ্রব্য অর্জন করতে সক্ষম নয়, তারাও সমানভাবে চলার জন্য সেসব দ্রব্য অর্জনের প্রচেষ্টা চালায় এবং এজন্য প্রয়োজনীয় চাহিদা মুলতবী রাখে বা দুর্নীতি ও নৈতিকতা বর্জিত পন্থার আশ্রয় নেয়। উন্নয়নশলি দেশের অদক্ষ ও দুর্নীতি ও নৈতিকতা বর্জিত পন্থার আশ্রয় নেয়। উন্নয়নশীল দেশের অদক্ষ ও দুর্নীতিপরায়ন কর প্রশাসনের কারণে আমদানীকৃত দ্রব্যের মূল্য কম দেখানোর (under invoicing) এবং ঘুষ বা চোরাচালানের সাহায্যে উচ্চ শুল্ক বা কর ফাঁকি দেয়া সম্ভব। কিন্তু শল্ক ও করের ফলে সৃষ্ট উচ্চ মূল্য থেকে উচ্চ মুনাফার সৃষ্টি হয় এবং আমদানিই কেবল বৃদ্ধি পায় না, বরং এসব বিলাসসামগ্রীর দেশীয় উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়। এতে অনিচ্ছাকৃতভাবে মর্যাদার প্রতীকরূপী বিলাসসামগ্রীর দিকে সম্পদের প্রবাহ পরিবর্তিত হয় এবং প্রকৃত চাহিদা পূরণে সম্পদের যোগান হ্রাস পায়। ফলে প্রকৃত চাহিদা পূরণকারী সামগ্রীর মূল্য যা হওয়ার কথা তার চেয়ে বেশি হয় এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগ বৃদ্ধি পায়।
এর অর্থ এ নয় যে, মূল্য পদ্ধতির প্রয়োগে আনীত শৃঙ্খলা পরিহার করতে হবে। বরং এর অর্থ হলো অপ্রয়োজনীয় ভোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য কেবলমাত্র মূল্য পদ্ধতি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না। এজন্য নৈতিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে অপর একটি বাছাই পদ্ধতি ও উদ্বুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া দ্বারা ভোক্তার অগ্রাধিকার তালিকায় পরিবর্তন এনে প্রচলিত মূল্য পদ্ধতিকে শক্তিশালী করতে হবে। এটি এমন হবে যেন ধনাঢ্য ব্যক্তিরাও তা মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ হয়। এ পদ্ধতি বাস্তবায়িত হলে বাজারে প্রভাব বিস্তারের আগেই একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ চাহিদা বিলোপ করা সম্ভব হবে। তখন সম্পদের সামগ্রিক সরবরাহ ও সামগ্রিক চাহিদার মধ্যে তুলনামূলক নিম্নতর সাধারণ মূল্যস্তরে এক নতুন ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। এ ব্যবস্থা প্রকৃত চাহিদা পূরণ এবং দারিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সাহায্য করবে।
নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতিতে নৈতিক ছাঁকনি বা বাছাই পদ্ধতি ও ভোক্তার স্বাধীনতা না থাকায় সম্পদের বরাদ্দ পরিটব্যুরোর সদস্য ও অন্যান্য রাজনৈতিক ক্ষমতাধরদের খেয়ালখুশি ও কায়েমী স্বার্থ দ্বারা নির্ধারিত হয়। অধিকন্তু বাজার পদ্ধতি দ্বারা নির্ধারিত মূল্যব্যবস্থার অনুপস্থিতির ফলে সম্পদ ব্যবহারে দক্ষতা অর্জনের সেকুলার প্রণোদনা দূরীভূত হয়ে যায়। বর্তমানের বহু সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ন্যায় উৎপাদনের উপকরণের উপর ব্যক্তি মালিকানাসহ বাস্তবভিত্তিক মূল্য পদ্ধতি ও ভোক্তার স্বাধীনতা প্রবর্তন করলেও নৈতিক ছাঁকনি বা বাছাই পদ্ধতি ও উদ্বুদ্ধকরণ ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে সম্পদের প্রবাহ ও মূল্য কাঠামো এমনভাবে পরিচালিত হচ্ছে যাকে কিছুতেই পুঁজিবাদের চেয়ে উত্তম বলা সম্ভব নয়।
তিন প্রকার শ্রেণীবিন্যাস
যতদিন মুসরিম দেশসমূহ পুঁজিবাদী বা সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করবে, ততদিন তারা অগুরুত্বপূর্ণ খাতে সম্পদের ব্যবহার প্রতিহত করতে পুঁজিবাদী বা সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর চেয়ে বেশি সফল হবে না। প্রকৃত চাহিদা পূরণের জন্য স্বাভাবিকভাবেই সম্পদ সংকুচিত হয়ে পড়বে এবং সম্পদ বৃদ্ধি পেলেও মাকাসিদ অর্জন করা কঠিন হবে। মুসলিম দেশসমূহের কর্তব্য হবে অপ্রযেঅজনীয় থেকে প্রয়োজনীয চাহিদা পৃথক করা এবং এ লক্ষ্যে সকল সামগ্রী ও সেবাকে ৩টি শ্রেণীতে ভাগ করা, যা হলো প্রকৃত চাহিদা, বিলাসসামগ্রী এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের সামগ্রী। প্রকৃত চাহিদা (মৌলিক প্রয়োজন ও আয়েশের ব্যবস্থাসহ) বলতে এমন সকল দ্রব্য ও সেবাকে বুঝাবে, যা প্রকৃত প্রয়োজন পূরণ করে ও কষ্ট হ্রাস করে এবং মানবকল্যাণের বাস্তব অর্থ প্রকাশ করে। বিলাসসামগ্রী বলতে ঐ সকল দ্রব্য ও সেবাকে বুঝাবে যেগুলো, প্রধানত তাদের সৌখিন প্রকৃতির জন্য প্রত্যাশা করা যায় এবং যা ব্যক্তির কল্যাণের কোনো পরিবর্তন ঘটায় না। মাধ্যমিক পর্যায়ের সামগ্রী বলতে ঐ সকল দ্রব্য ও সেবাকে বুঝাবে, যেগুলোকে প্রকৃত চাহিদা অথবা বিলাসসামগ্রী হিসেবে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায় না। এখানে কিছুটা নমনীয়তা রক্ষা করা বাঞ্ছনীয়।
ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে দ্রব্য সেবার এরকম শ্রেণীবিন্যাস করা সম্ভব। ফিকাহ শাস্ত্রে প্রয়োজনীয় (জরুরিয়াত), সুবিধাজনক (হাজিয়াত) ও আরামপ্রদ (তাহসিনিয়াত) দ্রব্য সামগ্রী সম্পর্কে বাস্তবানুগ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ফকীহগণের বিশ্লেষিত উপযুক্ত সকল শ্রেণীই আমাদের আলোচনায় প্রকৃত চাহিদার পর্যায়ভুক্ত; এগুলোকে লিাসসামগ্রী বা মর্যাদার প্রতীকরূপে চিহ্নিত করা যায় না। ফকীহগণের দৃষ্টিতে যা কিছু প্রকৃত প্রয়োজন নয় তাই অমিতব্যয়িতা ও অমিতাচার এবং সেগুলোকে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। ফিকাহশাস্ত্রের এ বিশ্লেষণ কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে সমৃদ্ধ করা যেতে পারে, যাতে মুসলিম দেশসমূহ বিরাজমান ভারসাম্যহীনতা দূরীভূত করে ‘মাকাসিদ’ হাসিল করতে সক্ষম হয়।
একথা স্মরণ রাখা দরকার যে, ইসলাম সংসার ত্যাগের ধর্ম নয় এবং দ্রব্য ও সামগ্রীর পূর্বোক্ত তিন শ্রেণীতে বিভক্তকরণ অপরিবর্তনীয় থাকার প্রয়োজন নেই। ব্যক্তিকে তার প্রকৃত চাহিদা পূরণ করার, এমনকি তার দক্ষতা ও কল্যাণ বৃদ্ধি করে এমন সকল আরামপ্রদ সামগ্রীও ইসলাম অনুমোদন করে। যেহেতু দ্রব্যসামগ্রীর পূর্বোক্ত ৩টি শ্রেণীবিন্যাস একটি মুসলিম দেশের সম্পদ ও জীবনযাপনের সাধারণ মান অনুসারেই নির্দিষ্ট হওয়া জরুরি, সেহেতু প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, সম্পদের প্রবৃদ্ধি ও জীবনযাপনের সাধারণ মানের উন্নতির সাথে সাথে চাহিদার পরিপ্রেক্ষিত পাল্টে যেতে বাধ্য। প্রকৃতপক্ষে প্রাথমিক মুসলিম সমাজের তুলনায় বর্তমানে অধিকাংশ মুসলিম দেশ অধিক সম্পদের অধিকারী এবং উন্নততর জীবনযাপনের মান অর্জনে সক্ষম। অবশ্য এক্ষেত্রে স্রষ্টার প্রতিনিধি হিসেবে মুসলিম সমাজের সকল মানুষের মৌলিক চাহিদাসমূহ অবশ্যই পূরণ করার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। এ লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে না, যদি ব্যক্তিগণের সামাজিক মর্যাদা ও আয়ের পার্থক্য অনুযায়ী ভোগের পার্থক্যকে দেশের সম্পদের সামর্থ্য অতিক্রম করে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারা না যায়। তাদের বিলাসী চালচলন প্রদর্শন করা ও সামাজিক ব্যবধানকে ব্যপক করে তোলা সমীচীন হবে না। তা ইসলামী সৌভ্রাতৃত্ব বন্ধনকে শিথিল করা ছাড়া আর কিছুই করবে না। মুসলিম সমাজে একঘেঁয়ে ও শ্রেণীহীন সমতা প্রতিষ্ঠা করা এর উদ্দেশ্য নয়। বরং এর দ্বারা সৃজনশলিতা ও বৈচিত্র্যের পাশাপাশি জীবনযাপনের আড়ম্বরহীনতা আনয়ন করাও সম্ভব। সুতরাং পূর্বোক্ত তিন প্রকার শ্রেণীর বিন্যাস সম্পদের প্রাপ্যতা অনুযায়ী ভ্রাতৃত্ব ও সামাজিক ইনসাফের উপর প্রভাব বিস্তারকারী ইসলামী ভোগ পদ্ধতির নিরিখে নির্ধারিত হওয়া উচিত। যখন বিরাজমান ভারসাম্যহীনতা সহনীয় সীমা অতিক্রম করে, তখনই ঐ ভারসাম্যহীনতাও দূরীকরণ ও অতিরিক্ত শর্ত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
প্রকৃত চাহিদাপূরণ সহজীকরণ
পূর্বে আলোচিত তিনটি শ্রেণীবিন্যাসের মধ্যেই উদারীকরণকে ব্যাখ্যা করা যায়। যে সকল দ্রব্য ও সেবা প্রকৃত চাহিদার অন্তর্ভুক্ত সেগুলোর উৎপাদন, আমদানি ও বণ্টন সহজীকরণ করা উচিত। বাজার শক্তিকে তার গঠনমূলক ভূমিকা পালন করার সুযোগ দিতে হবে। সরকারের উচিত এ শ্রেণীভুক্ত দ্রব্য ও সেবার সরবরাহ বৃদ্ধির সম্ভব সকল প্রকার সুযোগ সৃষ্টি করা ও প্রয়োজনীয় উৎসাহ প্রদান করা। এ সকল দ্রব্য ও সেবার উপর যদি কোনো পরোক্ষ কর আরোপ করা একান্ত প্রয়োজন হয়, তবে সে ক্ষেত্রে নিম্নহারে ও ঐ দ্রব্য বা সেবার গুরুত্বের বিপরীত হারে (in the reverse order of priority) করা উচিত। নৈতিক প্রচারণা ও তুলনামূলক উচ্চ শুল্ক ও কর দ্বারা মাধ্যমিক পর্যায়ের দ্রব্যসামগ্রীর ভোগ নিরুৎসাহিত করা প্রয়োজন।
যাইহোক, বিলাসসামগ্রীর পর্যায়ভুক্ত ও মর্যাদার প্রতীক হিসেবে গণ্য হয় এরকম দ্রব্য ও সেবার ব্যবহারকে উদারীকরণ করা জরুরি নয়। অর্থনীতিতে সম্পদের প্রবাহ যাতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রাধিকারের প্রতিফলন ঘটায় তা নিশ্চিত করার জন্যই এ ব্যবস্থা প্রয়োজন। পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে যে, কেবলমাত্র মূল্য পদ্ধতি এ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সক্ষম নয়। নৈতিক সংশোধনের মাধ্যমে ভোক্তার অগ্রাধিকার তালিকায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। যদি জনসাধারণ তাদের সামাজিক দায়িত্ব ও স্রষ্টার সামনে জবাবদিহিতার বিষয়টি বুঝতে পারে, যদি তারা উপলদ্ধি করতে পারে যে, দেশের সীমিত সম্পদের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহারের ফলে অন্য লোকেরা তাদের অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন পূরণ করা থেকে বঞ্চিত হবে, তাহলে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই নিজেদের আচরণ পরিবর্তন করে দেবে। অবশ্য যখন কোনো ভোগ দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত থাকার ফলে সমাজের মানসিক কাঠামোর অংশে ভোগ দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত থাকার ফলে সমাজের মানসিক কাঠামের অংশে পরিণত হয়, তখন এমনকি নৈতিক প্রণোদনাও অপর্যাপ্ত প্রমাণিত হতে পারে। এজন্য সমাজের মানবিক কাঠামের পরিবর্তন প্রয়োজন। একক ব্যক্তি স্রোতের গতি পরিবর্তন করতে পারে না, বরং তাল মিলাতে বাধ্য হয়।
সুতরাং, সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টির বৃহত্তর স্বার্থে সরল জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে প্রচারণা চালানো এবং সাথে সাথে এ জাতীয় দ্রব্য ও সেবা, যেমন বিলাসদ্রব্যের আমদানি, আড়ম্বরপূর্ণ উৎসব অনুষ্ঠান, যৌতুক এবং সামাজিক মর্যাদার প্রদর্শনী সরকারি আইন দ্বারা নিষিদ্ধ করা যেতে পারে, বিশেষ করে প্রাথমিক পর্যায়ে যখন ইসলামী মূল্যবোধ পুরোপুরি আত্মস্ত হয়ে ওঠেনি এবং ভারসাম্যহীনতা একটি কঠিন সমস্যা হিসেবে বিরাজমান থাকে। ব্যক্তি যেই হোন না কেন, তিনি যত ধনী বা ক্ষমতাধরই হোন না কেন, তার উপর নিষেধাজ্ঞা নিশ্চিত করার মধ্যে এক্ষেত্রে সাফল্যের চাবিকাঠি নিহিত। একটি ক্ষুদ্র ব্যতিক্রম থেকে নিষেধাজ্ঞা অমান্যের ঢল নামতে পারে। এভাবে সম্পদের অপ্রয়োজনীয় চাহিদা নির্মূল করার ফলে এবং প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই মুদ্রার বিনিময় হার ও অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখতে এ পদ্ধতি সাহায্য করবে। এমনকি মুসলিম দেশসমূহের সরকারগুলো যদি মুসলিম বিশ্বে বিরাজমান দুর্নীতির অন্যতম প্রধান কারণ অসংগতিপূর্ণ বিলাসী জীবনযাপন পদ্ধতিতে প্রথমেই আঘাত হানতে না পারে, তবে দুর্নীতি হ্রাসের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। এ ধরনের জীবনযাপন পদ্ধতি প্রায়শই মানুষকে অবৈধ উপার্জনের দিকে ধাবিত হতে বাধ্য করে। যখণ তারা উপলদ্ধি করবে যে, ব্যয়বহুল ভোগ বিলাসের মাধমে নাম কেনার চেষ্টা তাদের সুনাম বিনষ্ট করবে এবং তাদের আয়ের উৎস সম্পর্কে মানুষের মনে প্রশ্ন সৃষ্টি হবে, তখণ লোকের অধিক উপার্জনের প্রবৃত্তি ও দুর্নীতি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পাবে।
সরকারি অর্থব্যবস্থার পুনর্গঠন
অপচয়ে লাগাম দেয়া
নিঃসন্দেহে সরল জীবনযাপন বেসরকারি খাতে সম্পদের উপর চাপ কমাবে এবং বিনিয়োগ ও উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সঞ্চয় বৃদ্ধি করবে। তবে এটুকুই পর্যাপ্ত নয়। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের ন্যায় মুসলিম দেশের সরকারসমূহও সম্পদের উপর অধিক চাপ সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের চেয়ে অধিক না হলেও বেসরকারি খাতের অনুরূপ নিন্দনীয়। তারা তাদের সরকারি অর্থায়নের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রায় হারিয়ে ফেলেছে এবং ঘাটতি বাজেটের অসুস্থ পদ্ধতি অনুসরণ করে চলছে। মুদ্রা সমপ্রসারণ এবং অতিরিক্ত অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণ দ্বারা এ অতিরিক্ত ঘাটতি অর্থায়ন করা হচ্ছে। এর ফলে তুলনামূলক উচ্চহারে মুদ্রাস্ফীতি ও ঋণভার সৃষ্টি হয়েছে এবং তাদের এ দুর্দশা দীর্ঘদিন ধরে চলবে।
ব্যয়ের অগ্রাধিকারসমূহ
মাত্রাতিরিক্ত সরকারি খরচ সত্ত্বেও সরকারসমূহ একদিকে যেমন ভারসাম্যপূর্ণ ও দ্রুত উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম অবকাঠামো নির্মাণ করতে পারেনি, তেমনি মাকাসিদ হাসিলের জন্য অপরিহার্য সেবার পর্যাপ্ত সরবরাহ সৃষ্টি করতে পারেনি। সংখ্যাগুরু জনসাধারণের কল্যাণ যার উপর নির্ভর করে; সেই গ্রামীণ অবকাঠামো ও কৃষি সমপ্রসারণ সেবাও অবহেলিত। সরকারি বাজেটে গুরুত্ব লাভ করা সত্ত্বেও মুসলিম দেশসমূহে শিক্ষাব্যবস্থা সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাহিদা ব্যর্থ হয়েছে, যদিও তা ইসলামী সমাজব্যবস্থার ভিত্তিপ্রস্তর স্বরূপ হওয়া উচিত ছিল। চরিত্র গঠনের প্রতি মনোযোগ দেয়া হয়নি এবং সকল স্তরের জনসাধারণের নিকট সমানভাবে শিক্ষা মনোযোগ দেয়া হয়নি এবং সকল স্তরের জনসাধারণের নিকট সমানভাবে শিক্ষা ও কারিগরী প্রশিক্ষণ লাভের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়নি। স্বাস্থ্যখাতের ব্যয় প্রধানত বড় বড় শহরে, বৃহদায়তন মূলধন-নিবিড় হাসপাতালে ও নিরাময় চিকিৎসা কার্যে কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ গ্রামাঞ্চলে বাস করে, যাদের জন্য প্রয়োজন সাধারণ ক্লিনিক, প্যারামেডিক ডাক্তার, সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং সর্বোপরি বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, পয়ঃ সুবিধা ও অপুষ্টি দূর করা। এদিকে কোনো গুরুত্বই দেয়া হয়নি। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর গৃহায়নের বিষয়টি সরকারি খাতের মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হয়নি বললেই চলে এবং নাগরিক সুবিধাদি ও পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা ছাড়াই ব্যাঙের ছাতার মতো বস্তি গাজিয়ে উঠেছে। সুদক্ষ গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন ব্যাপকভাবে উপেক্ষিত হয়েছে। ফলে যাদের নিজস্ব যানবাহন নেই, সেই সব দরিদ্র লোকেরা নিদারুণ কষ্ট ভোগ করে চলেছে। এতদসত্ত্বেও ইসলাম ও তার আর্থ-সামাজিক ন্যায়বিচার সম্পর্কে সর্বদাই ফাঁকা বুলি আওড়ানো হয়েছে। এ বেদনাদায়ক অবস্থঅর ফলে ধীর প্রবৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক বৈষম্য স্থঅয়ী রূপ নিয়েছে এবং সামাজিক উত্তেজনা ও অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং মুসলিম সরকারগুলোর জন্য তাদের ব্যয় বরাদ্দ এমনভাবে পুনর্গঠন করা প্রয়োজন, যাতে তাদের মোট খরচই শুধু হাস পাবে না, বরং ঐ সকল প্রকল্পে মনোযোগ দেয়া সম্ভব হবে, যা তাদেরকে ত্বরিত উন্নয়ন ও মাকাসিদ হাসিলে সাহায্য করবে।
কতিপয় কারণে সরকারগুলো তাদের সীমিত সম্পদ অধিকতর দক্ষতার সাথে ব্যবহারের জন্য প্রবল প্রচেষ্টা গ্রহণে উদ্যোগী হয়নি। যেমন- প্রথমত, তাদের নিকট ন্যস্ত সম্পদসমূহ যে স্রষ্টার পক্ষ থেকে আমানত-এ বিষয়ে উপলদ্ধির অভাব রয়েছে। এ ব্যর্থতার সাথে সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যয়বহুল জীবনযাপন সংযুক্ত হয়ে দুর্নীতির জন্ম দেয়। এ ক্ষেত্রে কেবলমাত্র সমাজের নৈতিক সংশোধনসহ জীবন পদ্ধতির পুনর্গঠন ত্রুটি নিরসন করতে পারে।
দ্বিতীয়ত, দেশের নিজস্ব সম্পদ ও মূল্যবোধের সাথে সংবেদনশীল দেশজ উন্নয়ন দর্শনের অভাবের ফলে স্থায়ী অগ্রাধিকারের অভাব সৃষ্টি হয়েছে। এ অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠা ছাড়া সম্পদের অপ্রয়োজনীয় থেকে প্রয়োজনীয় এবং অপচয় থেকে গণউৎপাদনমুখী ব্যবহার বাছাই করার স্বীকৃত মানদণ্ড স্থাপন করা সম্ভব নয়। ইসলামী উন্নয়ন দর্শনের প্রতি দীর্ঘস্থায়ী অঙ্গীকার ব্যতীত নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে বর্তমানে বিরাজমান বিশৃঙ্খলা ও দ্বন্দ্ব নিরসন সম্ভবপর বলে মনে হয় না।
তৃতীয়ত, সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ‘মূল্য’ ব্যবস্থা অনুসরণ করা হয় না এবং সম্পদ, বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রা সুযোগ পরিব্যয়ের (opportunity cost) চেয়ে কম মূল্যে অর্জন ও বিক্রয় করা হয়। এ ব্যবস্থা সম্পদের অদক্ষ ব্যবহারের কারণ হয়।
চতুর্থত, নির্বাচিত সরকার ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অভাবে জনগণ সরকারের সমালোচনা করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। জনগণের নিকট দায়বদ্ধ বৈধ সরকার প্রতিষ্ঠা ছাড়া এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
ব্যয়ের নীতিমালা
ইসলামী মূল্যবোধ ও মাকাসিদের প্রতি অঙ্গীকার পূর্বোক্ত চারটি ক্ষেত্রেই সহযোগিতা করবে। বিশেষ করে মাকাসিদের প্রতি অঙ্গীকার প্রণয়নের মানদণ্ড দিয়ে প্রচলিত সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতা কমিয়ে আনতে সাহায্য করবে। মুসলিম আইনবেত্তাগণ বহু শতাব্দী ধরে ইসলামী আইনশাস্ত্রেরই একটি যৌক্তিক ও সুবিন্যস্ত ভিত্তি তৈরির লক্ষ্যে যে আইনগত নীতিমালা প্রণয়ন করেছেন, তা থেকে সঞ্চয়িত ছয়টি ব্যাপকভিত্তিক নীতির প্রতি অবিচল থাকলে ‘মাকাসিদ’কে আরো দৃঢ় করা সম্ভব হবে। আইন সূত্রগুলো হলো :
১. জনগণের কল্যাণই সকল ব্যয় বরাদ্দের মূল নির্ণায়ক হবে (ধারা : ৫৮)
২. কষ্ট ও ক্ষতি লাঘব করা আরামপ্রদ ব্যবস্থার উপর প্রাধান্য পাবে (ধারা : ১৭, ১৮, ১৯, ২০, ৩০, ৩১ ও ৩২)।
৩. সংখ্যালঘিষ্ঠের সংকীর্ণ স্বার্থের উপর সংখ্যাগরিষ্ঠের বৃহত্তর স্বার্থ প্রাধান্য পাবে (ধারা ঃ ২৮)।
৪. জনসাধারণের ত্যাগ বা ক্ষতি এড়ানোর জন্য ব্যক্তিগত ত্যাগ বা ক্ষতি আরো করা এবং বৃহত্তর ত্যাগ বা ক্ষতি নিবারণের জন্য ক্ষুদ্রতর ক্ষতি আরোপ করা যায় (ধারা : ২৬, ২৭ ও ২৮)।
৫. যে কল্যাণ লাভ করে সে অবশ্যই ব্যয় বহন করবে (ধারা : ৮৭ ও ৮৮)।
৬. যা ব্যতীত কোনো দায় পূরণ করা যায় না সেটিও দায় বলে গণ্য হবে।
মুসলিম দেশসমূহে করারোপ ও সরকারি ব্যয়ের সাথে পূর্বোক্ত নীতিমালার গুরুত্বপূর্ণ সম্বন্ধ রয়েছে। সরকারি ব্যয় কর্মসূচির উপর এগুলোর কার্যকারিতা বিশ্লেষণের জন্য কিচু দৃষ্টান্ত বিবেচনায় আনা সহায়ক হতে পারে।
যেহেতু এক নম্বর সূত্র অনুযায়ী সকল সরকারি ব্যয় বরাদ্দের আবশ্যকীয় উদ্দেশ্য হচ্ছে সাধারণ কল্যাণ সাধন, সেহেতু সূত্র ছয় অনুযায়ী ত্বরিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, অত্যাবশ্যক প্রয়োজন পূরণ দ্বারা পূর্বোক্ত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে অবদান রাখতে সক্ষম, সে সকল বস্তুগত ও সামাজিক অবকাঠামো প্রকল্প অপরাপর প্রকল্পের উপর প্রাধান্য পাবে যেগুলো অনুরূপ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে অবদান রাখে না। এমনকি অপরিহার্য অবকাঠামো প্রকল্পসমূহের মধ্যে সূত্র দুই এর দাবি হলো, সেই প্রকল্পগুলোর উপর প্রধান্য দেয়া, যা পুষ্টিহীনতা, নিরক্ষরতা, গৃহহীনতা, মহামারী ও চিকিৎসা সেবা, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাব ইত্যাদি থেকে সৃষ্ট কষ্ট ও দুর্ভোগ লাঘব করতে সাহায্য করে। একইভাবে একটি সুদক্ষ গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন সূত্র তিন মোতাবেক প্রাধান্য পাবে, কারণ এর অভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ নগরবাসীর কষ্ট হয় এবং দক্ষতা ও উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং মোট গাড়ি ও পেট্রোলের অতিরিক্ত আমদানি দরকার হয়ে পড়ে। আবার মোটর গাড়ি সীমিত সংখ্যক উপশহরবাসীর অতিরিক্ত আয়েশ বৃদ্ধি করে। যদি এর আমদানি হ্রাস করে এ বাবদ সঞ্চয়কে গণপরিবহনের যানবাহন আমদানিতে সঞ্চালন করা হয়, তবে তা সূত্র চার অনুযায়ী যুক্তিযুক্ত হবে। এ ধরনের ব্যবস্থা বৈদেশিক মুদ্রার উপর চাপই কেবল হ্রাস করবে না, বরং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে আরামদায়ক পরিবহন সেবা প্রদান করবে এবং যানজট ও পরিবেশ দূষণ কমে যাবে। যদি সূত্র তিন মোতাবেক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের স্বার্থকে প্রধান্য দেয়া হয়, তবে পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচিতে কম গুরুত্ব প্রদানের কোনো ভিত্তি নেই। যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ পল্লী অঞ্চলে বাস করে এবং পল্লী সমাজ ও পরিবার থেকে জনশক্তির ব্যাপক স্থানান্তর আর্থ-সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করে, সেহেতু কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, আত্ম-কর্মসংস্থান ও কর্মসংস্থান সুবিধা সমপ্রসারণের লক্ষ্যে পল্লী অঞ্চলের উন্নয়ন এবং পল্লীবাসীর অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন পূরণ অবশ্যই অগ্রাধিকার পাবে। এতে স্বাভাবিকভাবেই যানজট ও সেবাসমূহের উপর চাপ হ্রাসের মাধ্যমে নগর জীবনের উন্নয়ন ঘটবে।
যদি আয় ও সম্পদের বৈষম্য হ্রাস করতে হয়, তবে উন্নত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সুবিধাসমূহের অর্থ সরবরাহে ব্যাপক ও অধিক সুবিধাজনক অংশগ্রহণের ব্যবস্থা সৃষ্টি করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উপার্জনক্ষমতা বৃদ্ধি করা সূত্র ছয় অনুযায়ী অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এর দাবি হচ্ছে, সরকারি ব্যয় কর্মসূচিতে পল্লী অঞ্চলে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান স্থাপন অগ্রাধিকার পাবে, যাতে যোগ্যতাসম্পন্ন সকল নাগরিকের এতে সমান অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে। এছাড়া অর্থব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করা প্রয়োজন, যাতে পল্লী ও শহরাঞ্চলের সকল ধরনের শ্রেণীর উদ্যোক্তাগণ আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ও অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্য ও সেবার সরবরাহ বৃদ্ধিকল্পে অর্থ সংগ্রহের সুযোগ পায়।
কোথায় সংকোচন করতে হবে
বর্তমান বাজেট ঘাটতির অসুস্থ অবস্থায় ‘মাকাসিদ’ হাসিল করা সম্ভব নয়, যদি না পূর্বালোচিত অগ্রাধিকার-সূত্র মোতাবেক সম্পদের পুনঃবরাদ্দ করার সাথে সাথে সামগ্রিক ব্যয় হ্রাস করা হয়। সুতরাং কোথায় কোথায় খরচ কমানো যায়, এ বিষয়ে অবশ্যই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। এরূপ ব্যয় হ্রাস করা না হরে, হয় মাকাসিদ হাসিলের ক্ষেত্রে ছাড় দিতে হবে অথবা প্রত্যেক খাতে ব্যয়প্রাপ্ত সম্পদের সীমা অতিক্রম করে যাবে এবং সমাজিক অর্থনীতি ও বহিঃভারসাম্য অধিকতর সংকটাপন্ন হয়ে পড়বে। এখন প্রশ্ন হলো কোথায় খরচ কমানো সম্ভব? তাই এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে বাছাই করতে হবে যেখানে সঞ্চয় বাড়ানোর সুযোগ আছে।
দুর্নীতি, অদক্ষতা ও অপচয়
উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সঞ্চয় অর্জনের সর্বপ্রথম ও সর্বাধিক সুস্পষ্ট পথ হলো, দুর্নীতি, অদক্ষতা ও অপচয় সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে আসা। কারণ সরকারের সীমিত সম্পদ দক্ষতার সাথে ব্যবহারের ক্ষমতাকে এগুলো সাংঘাতিকভাবে ক্ষয় করে দিচ্ছে। ১৯৫৫ সালে তিবর মেনডে লিখেচন যে, ‘সম্ভবত দুর্নীতি অপেক্ষা অন্য কোনো লক্ষণ পাকিস্তানী জনসাধারণকে অধিক হতাশ করে নাই’। অবৈধ কার্যকলাপ এতদূর গেছে যে, ‘এর ফলে নতুন অর্থনৈতিক প্রকল্পসমূহ যে কল্যাণ সৃষ্টি করতে পারত, তা প্রায় নিঃশেষ হয়ে যায়’। দুর্নীতি হ্রাসে কার্যকর কোনো ব্যবস্থার অনুপস্থিতি অব্যাহত দুর্নীতি বৃদ্ধি থেকে এমনভাবে প্রতিভাত হয় যে, মেনডে একথা লেখার দুই দশকেরও অধিক পরে পাকিস্তান জাতীয় সংসদের পাবলিক একউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান জোর দিয়ে বলতে বাধ্য হন, ‘উন্নয়ন বাজেটের সিংহভাগ আত্মসাৎ হয়ে যায়’। তিনি যে সকল দৃষ্টান্ত দেন তা হলো, নির্মাণের কয়েক বছর পরই ত্রুটিপূর্ণ ভবন ধসে পড়ে, একটিমাত্র বর্ষতেই রাস্তা ধুয়ে যায়, ব্যবহার করার আগেই আমদানিকৃত রেলওয়ে যন্ত্রপাতি লোহালক্কড়ে পরিণত হয়; আমদানিকৃত দ্রব্য পাকিস্তানে পৌঁছার আগেই অন্যত্র বিক্রি হয়ে যায় এবং জাতীয়করণকৃত ব্যাংক কর্তৃক প্রভাবশালী ব্যক্তিগণের নামে প্রদত্ত ঋণ মওকুফ করায় হয়। এ ব্যাপক দুর্নীতি কেবলমাত্র পাকিস্তানেই নয়, বরং সকল মুসলিম দেশেই বিরাজমান, যদিও ইসলামী মূল্যবোধের সঙ্গে তা সাংঘর্ষিক। যাইহোক, নৈতিক সংশোধন, জীবনযাপন পদ্ধতির পরিমার্জন ও অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তন ছাড়া দুর্নীতি হ্রাসের কোনো প্রচেষ্টা সফল হতে পারে না।
ভর্তুকি
উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সঞ্চয়ের দ্বিতীয় ক্ষেত্র হলো ভর্তুকি। যদিও দরিদ্র জনসাধারণের কল্যাণ সাধন ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য, তথাপি মুসলিম সরকারসমূহ কর্তৃক প্রদত্ত বহু ভর্তুকি (তা সরাসরি হোক বা রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হোক এবং তা স্বচ্ছ হোক বা অস্বচ্ছ হোক) জোরালোভাবে সমর্থন করা যায় না। সাধারণত ইনসাপ বা অর্থনৈতিক বিবেচনায় ভর্তুকি সমর্থন করা হয়। কিন্তু মাকাসিদ হাসিলের লক্ষ্যে এবং পূর্ববর্ণিত সরকারি ব্যয়ের সূত্রসমূহের মানদণ্ডে- এ দুটো কারণের কোনোটির জন্যই ভর্তুকি যুক্তিযুক্ত বিবেচিত হয় না।
যদি ইনসাফ ভর্তুকির উদ্দেশ্য হয়, তাহলে ভর্তুকি দ্বারা প্রকৃত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে আয় পুনর্বণ্টন করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। ভর্তুকি দ্বারা হ্রাসকৃত মূল্যে (যা সূত্র-পাঁচ অনুযায়ী উৎপাদন খরচ বহন করে) দরিদ্র জনগোষ্ঠীর তুলনায় ধনীদের বেশি উপকার হয়। কারণ তাদের ভোগের পরিমাণ ও ক্ষমতা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর তুলনায় অধিক। আর্থ-সামাজিক ন্যায়বিচারের উদ্দেশ্যে অঙ্গীকারাবদ্ধ কোনো ব্যবস্থায় এটি সমর্থনযোগ্য নয়। মূল্যবোধ যদি অভিশাপ না হয়, তবে ধনী ব্যক্তি, যাদের মূল্য পরিশোধের সামর্থ্য আছে তাদের জন্য হ্রাসকৃত মূল্য বা ভর্তুকির কোনো যৌক্তিকতা নেই। যারা বাস্তবসম্মত মূল্য পরিশোধ করতে অক্ষ, কেবলমাত্র তাদেরকেই সাহায্য করা উচিত। যেহেতু প্রভেদমূলক মূল্য পদ্ধতি (price descrimination) প্রশাসনিকভাবে জটিল এবং এটাই কাম্য যে, প্রত্যেকেই বাস্তবসম্মত মূল্য পপরিশোধ করুক, সেহেতু দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সাহায্য করার উত্তম পদ্ধতি হলো, সরকার কর্তৃক এতদুদ্দেশ্যে বরাদ্দকৃত তহবিল অথবা সমাজকল্যাণ সংস্থা, যাকাত তহবিল, অন্যান্য স্বেচ্ছামূলক বা বাধ্যতামূলক দান থেকে উল্লেখযোগ্য হারে বৃত্তি, ত্রাণ ও আয় পরিপূরক সাহায্য প্রদান করা। এভাবে সাধারণ ভর্তুকি বাবদ মোট ব্যয়ের মাত্র একটি অংশ দ্বারা সরকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে অধিক হারে ত্রাণ সাহায্য দিতে সক্ষম হবে। আয় পরিপূরক সাহায্য দরিদ্র জনগণের নিজস্ব পছন্দ মতো চাহিদার অগ্রাধিকার নিরূপণের সুযোগ দেবে এবং সাধারণ ভর্তুকির ফলে দ্রব্য ও সেবার যে অপচয় হয়, তা ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনতে বাস্তবসম্মত মূল্য সাহায্য করবে।
দক্ষতাই যদি উদ্দেশ্য হয়, তাহলে ভর্তুকি দ্বারা মাকাসিদ হাসিলে উদ্দীপনা শক্তিশালী হওয়া ও সম্পদের বরাদ্দ অধিকতর কার্যকরভাবে হওয়া উচিত। কিন্তু তা হয় না। কৃষিতে ভর্তুকি প্রধানত বৃহৎ কৃষকদেরকে সাহায্য করে, ‘যারা অসামঞ্জস্যপূর্ণ অংশ ভোগ করে এবং অন্য সম্পদের পাহাড় গড়তে তা কাজে লাগায়’।
শিশু শিল্প বিবেচনায় বৃহদায়তন শহরে শিল্পে যে ভর্তুকি দেয়া হয়, তা খুব কম সময়েই ‘নাবালকত্ব’ অতিক্রম করতে উৎসাহিত করে। অবশ্যই ভর্তুকি যদি ক্ষুদ্র কৃষক এবং ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক উদ্যোক্তাগণকে উন্নত প্রযুক্তি ও উপকরণ প্রয়োগে এবং তাদেরকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম করে, তাহলে ‘মাকাসিদ’ এর ভিত্তিতে তাকে বিবেচনাপ্রসূত বলা হয়। কিন্তু গ্রাম ও শহরের দরিদ্র জনগোষ্ঠী শহর ও গ্রামের অভিজাত শ্রেণীর তুলনায় ‘বিচ্ছিন্ন, অসংগঠিত ও রাজনৈতিকভাবে অবিকশিত’। সুতরাং যেভাবে বৃহদায়তন শিল্প প্রতিষ্ঠান ও প্রভাবশালী ভূস্বামীগণ উৎপাদকের ভর্তুকি পেয়ে থাকেন, সেভাবে দরিদ্র জনগণ কখনো পায় না। তথাপিও ভর্তুকির জন্য দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে টিকই করভার বহন করতে হয়, কারণ এবং দেশে সাধারণত পশ্চাৎমুখী (regressive) কর ব্যবস্থা চালু আছে।
সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানসমূহ
সঞ্চয়ের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো, রাষ্ট্রয়ত্ব প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে পর্যায়ক্রমে পৃষ্ঠপোষকতা প্রত্যাহার করা। ‘সাধারণত উন্নয়নশীল দেশের রাষ্ট্রয়ত্ব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কর্মসম্পাদন (Performance) কর ব্যবস্থা চালু আছে।
সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানসমূহ
সঞ্চয়ের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো, রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে পর্যায়ক্রমে পৃষ্ঠপোষকতা প্রত্যাহার করা। ‘সাধারণত উন্নয়নশীল দেশের রাষ্ট্রায়ত্ব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কর্মসম্পাদন (Performance) হতাশাব্যঞ্জক’। সরকারসমূহ যেভাবে প্রত্যাশা করেছিল সেভাবে শিল্পায়নকে দ্রুত এগিয়ে নিতে ও দ্রুততর প্রবৃদ্ধি অর্জনে এ প্রতিষ্ঠানসমূহ শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এদের আর্থিক সাফল্যই শুধুমাত্র অনুল্লেখযোগ্য নয় বরং সামাজিক অবদানও নগণ্য। এর কারণ হচ্ছে, তারা কোনো প্রকার প্রতিযোগিতা ছাড়াই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেছে। সরকারও দক্ষতার উপর নগণ্য গুরুত্ব দিয়েছে এবং দেউলিয়া হওয়ার কারণে শাস্তি প্রয়োগের উদাহরণও বিরল। নিম্ন মুনাফার ফলে এ সকল প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগে নিজস্ব অর্থায়ন সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। ফলে প্রায়শই এ প্রতিষ্ঠাসমূহ বৃহৎ বাজেট ঘাটতি, মুদ্রা সমপ্রসারণ ও বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি করেছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ১৯৭৬-৭৯ সালে ২৭টি উন্নয়নশীল দেশে অ-আর্থিক রাষ্ট্রয়ত্ব প্রতিষ্ঠানে সরকারি বাজেট থেকে ব্যয়ের পরিমাণ ছিল মোট দেশজ উৎপাদনের (GDP) শতকরা তিন ভাগ।
প্রতিরক্ষা
যেখানে ব্যাপক সঞ্চয় সম্ভব সে রকমের চতুর্থ ক্ষেত্র হলো প্রতিরক্ষা। বিশ্ব ব্যাংকের মতে, ‘উচ্চহারে সামরিক ব্যয়ের ফলে আর্থিক ও ঋণ সংকট সৃষ্টি হচ্ছে, স্থিতিশলিতা ও সমন্বয় জটিল রূপ ধারণ করেছে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করেছে।’ মাকাসিদ কাঠামোর মধ্যে ও পূর্বালোচিত নীতিমালার আলোকে একথা বলা যায়, বহিঃশত্রুর আগ্রাসনের ভীতিকর পরিস্থিতির অনুপস্থিতিতে বাজেট বরাদ্দের সিংহভাগ প্রতিরক্ষার জন্য সংরক্ষিত রাখার কোনো যুক্তি নেই। একথা প্রায়ই ভুলে যাওয়া হয় যে, প্রতিরক্ষা ব্যয় কেবল আর্থিক ব্যয়ই নয়, বরং এর মাঝে অন্য ত্যাগও সংশ্লিষ্ট। এতে দরিদ্র জনগণের কল্যাণ হ্রাস পায়। ফলে সামাজিক অস্থিরতা ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয়।
কেবলমাত্র কয়েকটি মুসরিম রাষ্ট্র প্রতিরক্ষা ঝুঁকির মধ্যে আছে। অন্য প্রায় সকল মুসলিম রাষ্ট্রই অবাস্তব অনুমানের উপর প্রতিরক্ষা বিষয়ে অপ্রয়োজনীয় গুরুত্ব আরোপ করে থাকে। অধিকন্তু যদি সম্পদের ব্যবহারে দক্ষতা নিশ্চিত করা যায়, দুর্নীতি দূর করা যায় (যা যে কোনো ক্ষেত্রের চেয়ে সামরিক বাহিনীতে বেশি) এবং যদি সমঝোতার নীতি গ্রহণ ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে অপ্রয়োজনীয় বিবাদ এড়ানো সম্ভব হয়, তবে ¯^í খরচেই উত্তম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অর্জন করা সম্ভব।
মুসলিম দেশসমূহে দারিদ্র্য ও চরম অসাম্য বিরাজমান এবং পর্যাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও গণউপযোগের ব্যাপক অভাব রয়েছে, বিশেষ করে পল্লী অঞ্চলে। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ দুর্দশা ও অর্থনৈতিক অনগ্রসরতার মধ্যে জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে। এমতাবস্থায় সামরিক অস্ত্রশস্ত্রের জন্য বিপুল সম্পদ খরচ করার কোনো নৈতিক বা অর্থনৈতিক যুক্তি থাকতে পারে না। প্রতিরক্ষা ভুঁকির অনুপস্থিতি সরকারসমূহকে তাদের নিজেদের ও ধনীদের নিকট থেকে প্রতিরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক ও আর্থিক ত্যাগ দাবি করা থেকে বিরত রাখে। বিপরীত ক্ষেত্রে জীবনযাপন পদ্ধতিতেও সরকারি ব্যয়ে যথানিয়মে আনুপাতিক সমন্বয় সাধন করা হয় না এবং এভাবে মুদ্রাস্ফীতি সরকারি ব্যয় ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অত্যাবশ্যকীয় চাহিদা পূরণের প্রতি স্বল্প গুরুত্ব প্রদানের মাধ্যমে সামরিক ব্যয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার সম্পূর্ণই শহর ও গ্রামের দরিদ্র জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়।
সরকারসমূহ যেরূপ দাবি করে থাকে, সেরূপ নিরাপত্তা ব্যবস্থা উচ্চ সামরিক ব্যয় দ্বারা বাস্তবে অর্জিত হয় না। দরিদ্র মুসলিম দেশসমূহের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ শক্তিই হচ্ছে নিরাপত্তার প্রকৃত উৎস। নৈতিক সংশোধন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আর্থ-সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই এটি অর্জন করা সম্ভব। মুসলিম দেশসমূহে অভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, যার বিরুদ্ধে যে কোনো বিপুল অংকের সামরিক ব্যয় দ্বারা নিরাপত্তা অর্জন করা সম্ভব নয়। বরং জাতীয় ও ভৌগলিক অখণ্ডতার যে উদ্দেশ্যে সামরিক অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়, কখনও কখনও অত্যধিক সামরিক ব্যয়ের কারণেই তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। পল কেনেডি যথার্থই বলেছেন, একটি জাতির জন্য সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের চেয়ে দীর্ঘমেয়াদী শক্ত অর্থনৈতিক ভিত অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অধিকতর মৌলিক বিষয়। যে সকল জাতি তাদের অর্থনৈতিক সামর্থ্যের চেয়ে অধিক সামরিক কার্যকলাপের উপর গুরুত্ব দেয়, তারা পতনের জন্য অপেক্ষা করছে।
সুতরাং, বন্ধুত্ব স্থাপন ও শান্তিপূর্ণ সাহাবস্থানের মাধ্যমে সামরিক ব্যয় ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনা মুসলিম দেশসমূহের সরকারি নীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হওয়া উচিত। এতে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রকৃত চাহিদা পূরণে সম্পদের সমপ্রসারণ ঘটানো যায়। যদি এভাবে কোনো মুসলিম রাষ্ট্র উদ্যোগ গ্রহণ করে, তবে যে সকল প্রতিবেশী দেশ থেকে তারা মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধভীতি অনুভব করে, সেসব দেশের সামরিক ব্যয় হ্রাসের লক্ষ্যে জনমতের চাপ সৃষ্টি হতে বাধ্য হবে। তখন সকল দেশই অধিক সমৃদ্ধ জীবনযাপনে সক্ষম হবে। সুদের উপর ইসলামের নিষেধাজ্ঞা থাকার ফলে ঋনের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করা মুসলিম দেশের পক্ষে সম্ভব হয় না। এ পরিস্থিতিতে মুসলিম দেশসমূহ বন্ধুত্ব স্থাপন ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি অনুসরণ করতে বাধ্য। রাসূল (স) এর আদর্শ থেকেও তাদের অনুপ্রেণা গ্রহণ করা উচিত, যিনি শান্তি ও নিরাপত্তার সময় লাভের উদ্দেশ্যে চরম প্রতিকূল শর্ত সত্ত্বেও মক্কাবাসীদের সাথে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন।
ন্যায়ানুগ ও সুদক্ষ করব্যবস্থা
কম গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যাবশ্যক নয় এমন প্রকল্পসমূহ বাতিল করা বা কমিয়ে আনার মাধ্যমে উন্নয়ন ও আর্থ-সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কিছু পরিমাণ সম্পদ পাওয়া যাবে। তবে এভাবে যে সম্পদ পাওয়া যাবে তা পর্যাপ্ত নয়। সুতরাং, রাষ্ট্রীয় কোষাগারে অন্য পন্থায়, বিশেষত করব্যবস্থার মাধ্যমে, সম্পদ সংগ্রহ করার প্রয়োজন। মুসলিম দেশসমূহে করব্যবস্থা এমনভাবে পুনর্বিন্যাস করা দরকার, যাতে সরকার ন্যায়ানুগ ও সুদক্ষ পন্থায় পর্যাপ্ত রাজস্ব বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়।
করারোপের অধিকার
সকল মতের বেশ কিছু ইসলামী আইনবেত্তাগণ ‘যাকাত’ ছাড়াও করারোপের মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্রের সম্পদ সংগ্রহের অধিকারকে সমর্থন করেছেন। কারণ যাকাতের মাধ্যমে সংগৃহীত সম্পদ প্রাথমিকভাবে দুঃস্থ জনগণের কল্যাণে ব্যয় করা হয়। কিন্তু বরাদ্দ, বণ্টন ও স্থিতিমূলক সকল দায়িত্ব কার্যকরভাবে সম্পাদনের জন্য রাষ্ট্রের তহবিল সংগ্রহের অন্য উৎসও প্রয়োজন। আইনবেত্তাগণ রাসূল (স) এর নিম্নোক্ত উক্তির ভিত্তিতে রাষ্ট্রের এ অধিকার সমর্থন করেছেন। রাসূল (স) বলেছেন, “তোমাদের সম্পদে ‘যাকাত’ ছাড়াও আরো বাধ্যবাধকতা রয়েছে”। ইতঃপূর্বে বর্ণিত ইসলামী আইনের ৪ ও ৫ নং নীতিসূত্র দ্বারাও এ অধিকারকে সমর্থন করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘বৃহত্তর ত্যাগ এড়ানোর লক্ষ্যে ক্ষুদ্রতর ত্যাগ আরোপ করা যায়’। আবু ইউসুফ জনগণের বহন ক্ষমতা অনুযায়ী শাসক কর্তৃক কর বৃদ্ধি বা হ্রাস করার অধিকার সমর্থন করেছেন। মার্গিনানী বলেন, যদি রাষ্ট্রের সম্পদ পর্যাপ্ত না হয়, তবে জনস্বার্থে কাজ করার জন্য জনগণের নিকট থেকে তহবিল সংগ্রহ করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। যদি এর দ্বারা জনগণের কল্যাণ হয়, তবে এর ব্যয়ভার বহন করা জনগণেরই কর্তব্য।
অবশ্য যাকাত ছাড়া করারোপের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সম্পদ সংগ্রহের অধিকার সম্পর্কে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম আইনবেত্তাগণ প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। হাসান তুরাবীর মতে এ প্রত্যাশিত দৃষ্টিভঙ্গির কারণ হচ্ছে, ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য সময় ধরে মুসলিম দেশসমূহে অধিষ্ঠিত সরকারসমূহের ‘প্রায় সবাই অবৈধ’। এ কারণে আইনবেত্তাগণ আশংকা করেছিলেন যে, করারোপের অনুমতি দেয়া হরে তার অপব্যবহার হতে পারে এবং নিপীড়নের হাতিয়ারে পরিণত হতে পারে। অবশ্য এ মতকে অলঙ্ঘনীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। কারজাভী সঠিকভাবেই মন্তব্য করেছেন, ‘সে সময় রাষ্ট্রের দায়-দায়িত্ব ছিল সীমিত’। যেহেতু কালের বিবর্তনে রাষ্ট্রের দায়-দায়িত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে সেহেতু তার সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে যে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন যে, তাহলে রাষ্ট্র কোন উৎস থেকে তহবিল সংগ্রহ করবে?
ন্যায়ানুগ করব্যবস্থার শর্তাবলী
যে সকল আইনবেত্তা কর আরোপকে সমর্থন করেছেন তাদের প্রতি সুবিচার করতে হলে একথা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে যে, তারা কেবলমাত্র ইসলামী মূল্যবোধের সাথে সংগতিপূর্ণ একটি ন্যায়ানুগ করব্যবস্থার কথা বিবেচনা করেছেন। তাদের মতে একটি করব্যস্থা কেবলমাত্র তিনটি শর্ত পূরণ সাপেক্ষেই ন্যায়ানুগ বিবেচিত হতে পারে। প্রথমত, লক্ষ্য হাসিলের উদ্দেশ্যে অত্যাবশ্যক বিবেচিত হয় এমন কাজে অর্থ সংগ্রহের জন্য যখন করারোপ করা হয়। দ্বিতীয়ত, জনগণের বহন ক্ষমতার তুলনায় করভার অতিরিক্ত হবে না এবং কর প্রদানে সক্ষম জনগোষ্ঠীর মধ্যে করভার ন্যায়পরায়ণভাবে বণ্টিত হয়; এবং তৃতীয়ত, যে উদ্দেশ্যে কর আরোপ করা হয় কেবলমাত্র সেই উদ্দেশ্যেই সুবিবেচনা সম্মতভাবে আদায়কৃত সম্পদ ব্যয় করা হয়। যে করব্যবস্থা উপর্যুক্ত শর্তাবলী পূরণ করে না, সেই করব্যবস্থাকে নিপীড়নমূলক ও সর্বসম্মতভাবে নিন্দনীয় গোষণা করা হয়েছে। খোলাফায়ে রাশেদীনের সকল খলিফাই, বিশেষ করে হযরত ওমর, আলী ও ওমর-বিন আবদুল আজিজ সম্পর্কে জানা যায় যে, তারা করারোপের ক্ষেত্রে এ বিষয়ে গুরুত্ব দিতেন যে, ন্যায়পরায়ণতা ও নমনীয়তার সাথে যেন কর আদায় করা হয়, জনগণের বহন ক্ষমতার অধিক পরিমাণ কর আরোপ করা না হয় এবং এর ফলে তারা যেন জীবনযাপনের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ করা থেকে বঞ্চিত না হয়। আবু ইউসুফ বলেন, ন্যায়ানুগ করব্যবস্থা কেবল রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করে না, বরং দেশকে উন্নয়নের দিকে ধাবিত করে। মাওয়ার্দি বলেন, ন্যায়ানুগ করব্যবস্থা করদাতা ও রাষ্ট্রীয় কোষাগার উভয়ের প্রতিই সুবিচার করে, অর্থাৎ এটি এমন অবস্থা যখন অধিক করারোপ জনগণের অধিকারের বিবেচনায় অসম হয়, অন্য দিকে নিম্ন করারোপ রাষ্ট্রীয় কোষাগারের বিবেচনায় অবিচারমূলক হয়। ইবনে খলদুন তার সময়ের মুসলিম পণ্ডিতগণের করে আরোপ সম্পর্কিত চিন্তাধারাকে যখার্থভাবে প্রতিফলিত করতে একটি পত্রের উদ্বৃতি দেন। পত্রটি তাহির ইবনে আল-হুসাইন তার পুত্রকে লেখেন, যিনি একটি প্রদেশের গভর্ণর ছিলেন। তাতে বলা হয়েছিল-
‘সুতরাং, ন্যায়পরায়ণতা ও সুষমভাবে জনগণের মধ্যে কর আরোপ করো। কারো আভিজাত্য ও প্রাচুর্যের জন্য এমনকি তোমার কর্মচারী, সভাসদবৃন্দ বা অনুসারীগণকেও কর থেকে অব্যাহতি দিও না, এবং সাধারণভাবে সকলের উপর কর আরোপ করবে এবং কারো উপর তার সাধ্যের অতিরিক্ত কর আরোপ করবে না’।
সামাজিক ন্যায়বিচার ও আয়ের সুষম বণ্টন ব্যবস্থার আলোকে প্রগতিশীল কর পদ্ধতি ইসলামের উদ্দেশ্যের সাথে যথার্থভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে প্রতয়িমান হয়। যাইহোক, ন্যায়ানুগভাবে ইসলামী রাষ্ট্রের করারোপের অধিকার কতটুকু, বর্তমানের এই প্রাসঙ্গিক বিষয়টি আইনশাস্ত্রবিদগণের পর্যালোচনার আলোকে বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। কারণ একথা বলা অযৌক্তিক হবে যে, বর্তমানকালেও মুসলিম রাষ্ট্রসমূহকে পুরাতন আইন শাস্ত্রবিদগণের আলোচিত কর ব্যবস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। অতীতের পারিপার্শ্বিকতার পরিবর্তন হয়েছে। সুতরাং, এমন একটি কর পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে হবে, যা পরিবর্তিত বাস্তবতাকে বিবেচনায় এনে কাজ করতে পারে। বিশেষ করে বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে একটি উন্নয়নশলি ও সুদক্ষ আধুনিক অর্থনীতি ও মাকাসিদ হাসিলের প্রতিশ্রুতি পূরণের লক্ষ্যে ব্যাপক সামাজিক ও বস্তগত অবকাঠামো নির্মাণ চাহিদার আলোকে এ নতুন কর পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে হবে। এ কর পদ্ধতি বিনির্মাণে একথা অবশ্যই বিবেচনায় আনতে হবে যে, এটি কেবলমাত্র সুষম হলেই চলবে না; বরং এর কর ব্যবস্থা একদিকে যেমন উপার্জন, সঞ্চয় ও বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করবে না, তেমনি অন্যদিকে রাষ্ট্রের যাবতীয় দায়দায়িত্ব কার্যকরভাবে প্রতিপালনের জন্য পর্যাপ্ত রাজস্ব ইসলামী রাষ্ট্রের কোষাগারে জমা করবে।
করদাতাগণের দায়
মুসলিম দেশের করদাতাগণকে একথা মনে রাখতে হবে যে, কর প্রদানের মাধ্যমে তারা রাষ্ট্র বা অন্য কারো প্রতি কোনো অনুগ্রহ করছে না। রাষ্ট্র যাতে তার কার্যাবলী যথাযথভাবে পালনে সক্ষম হয়, সে লক্ষ্যে তারা তাদের কর্তব্য পালন করছে মাত্র। তাদেরকে অবশ্যই একথা উপলব্ধি করতে হবে যে, রাষ্ট্রের নিকট তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যে সেবা লাভ করে থাকে, তার বিনিময়েই তারা কর প্রদান করে থাকে। যেমন, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নিরাপত্তা, সড়ক, নৌ ও বিমানবন্দর, পানি সরবরাহ, সড়ক পরিচ্ছন্নকরণ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা। পূর্বোল্লেখিত পাঁচ নম্বর সূত্র অনুযায়ী সরকারের উচিত এ সকল সেবা ব্যবহারকারীদের নিকট থেকে ‘সমহারে’ মূল্য আদায়ের চেষ্টা করা। কিন্তু প্রশাসনিক জটিলতা ও ন্যায়পরায়ণতার স্বার্থে সকল সময় তা করা যায় না। সুতরাং, সরকারি সেবামূলক কাজের ব্যয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ‘কর প্রদানের সামর্থ্য’ মোতাবেক আদায় করতে হয়। এক্ষেত্রে সমান্তরাল ও উল্লম্ব সাম্যের দাবি হচ্ছে, সমদেরকে সমভাবে ও অসমদেরকে অসমভাবে বিবেচনা করতে হবে।
যেহেতু কর হলো প্রধানত করদাতাগণ কর্তৃক প্রত্যক্ষ বা পারোক্ষভাবে প্রাপ্ত সেবার মূল্য, সুতরাং মুসলিম সমাজে কর এড়ানো কেবলমাত্র আইনগত অপরাধ নয়, বরং আল্লাহ কর্তৃক পরকালে শাস্তিযোগ্য নৈতিক অপরাধ। এছাড়া করদাতাগণের এরূপ কর এড়ানোর ফলে কার্যকরভাবে কর্তব্য সম্পাদনে সরকারের ক্ষমতা যতখানি হ্রাস পায়, মাকাসিদ হাসিল ততখানিই বাধাগ্রস্ত হয়। একটি ইসলামী সমাজে এর চেয়ে গুরুতর অপরাধ আর কী হতে পারে? কাজেই আইনবিশারদগণ যখন রাষ্ট্রকে কর আরোপের ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণ হতে বলেছেন, তখন তারা জনগণকে তাদের কর্তব্য পালনের কথা বলেছেন। এমনকি ইবনে তাইমিয়া অন্যায় কর পরিশোধ না করাকেও নিষিদ্ধ বলেছেন। কারণ কতিপয় করদাতা কর্তৃক কর পরিশোধ না করার ফলে অন্যদেরকে অন্যায়ভাবে অধিকতর গুরুভার বহন করতে হয়।
সুতরাং, এটি পরিষ্কার যে করদাতা ও ইসলামী রাষ্ট্র উভয়ের প্রতিই ইসলাম কতিপয় দায়িত্ব অর্পণ করেছে। একদিকে যখন কর প্রদান করা ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিকদের কর্তব্য, তখন অন্যদিকে দুটি শর্ত পূরণ করা সরকারের জন্য অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। প্রথমত, সরকার কর্তৃক কররাজস্ব একটি আমানত হিসেবে বিবেচিত হবে এবং যে লক্ষ্যে কর আদায় করা হয়েছে সেই লক্ষ্যে ন্যায়ানুগ ও দক্ষতার স্বার্থে রাজস্ব ব্যয় করতে হবে। দ্বিতীয়ত, যারা কর প্রদানের সক্ষম সরকারকে তাদের মদ্যে করভার সমানুপাতিক হারে বণ্টন করতে হবে। যে অবস্থায় করদাতা এ শর্তে নিশ্চিত না হয় যে তারা সরকারকে যে তহবিল প্রদান করছে তা মাকাসিদ হাসিলের জন্য সততা ও কার্যকারিতার সাথে ব্যয় করা হবে, সেই অবস্থায় করদাতাগণকে নৈতিক দায়িত্বের উপর যতই গুরুত্ব দেয়া হোক না কেন, তারা কর সংগ্রহে সরকারের সাথে প ুরোপুরি সহযোগিতা করবে বলে মনে করা যায় না।
সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা
মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ সাধারণত এ সকল শর্তাবলী পূরণ করে না। এখানে ব্যয়ের প্রতিষ্ঠানসমূহ অদক্ষ ও দুর্নীতিপরায়ণ, এমনকি কর ব্যবস্থাও অদক্ষ, অন্যায্য ও দুর্নীতিপরায়ণ। এ অবস্থা সরকারের কর মরফত তহবিল সংগ্রহের ক্ষমতাকে সংকুচিত করে দেয়। নিশ্চিতই মুসলিম দেশসমূহে অধিক করারোপ করা হয়নি। তাদের মোট দেশজ উৎপাদনের শতকরা হার হিসেবে কররাজস্ব তুলনামূলকভাবে কম। কিন্তু তারা অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতোই খারাপ কর পদ্ধতির মধ্যে আছে। তাদের কর রাজস্বের সামান্য অংশই প্রত্যক্ষ কর থেকে আসে। ফলে করব্যবস্থা হয়ে পড়েছে পশ্চাৎমুখী। কারণ প্রত্যক্ষ কর থেকে আসে। ফলে করব্যবস্থা হয়ে পড়েছে পশ্চাৎমুখী। কারণ প্রত্যক্ষ করদাতাদের সংখ্যা নগণ্য। এছাড়া রয়েছে নানা ধরনের কর অব্যাহতি ও রেয়াত। ফলে করভিত্তি সংকীর্ণ ও করব্যবস্থা অনমনীয় হয়ে পড়ে। জনসাধারণের আয় বৃদ্ধি পায় ও কালো টাকার সৃষ্টি হয় এবং এর ফলাফল হচ্ছে অপচয় ও মূলধন পাচার। করভিত্তি, করহার, কর এড়ানো ও কালো টাকা হচ্ছে একই দুষ্ট চক্রের অংশ বিশেষ। করভিত্তি যত দুর্বল হবে, নিদিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব আদায়ের জন্য করহারও ততই অধিক হবে। আর করহার যত বেশি হবে, ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা ও কালো টাকা ততই বেশি হবে। এ দুষ্ট চক্র কেবল উৎপাদনমুখী বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নিম্নহার সৃষ্টি করে না; বরং নেতিবাচক পরোক্ষ করের প্রতি নির্ভরতাও বাড়িয়ে দেয়। এটি সবাই জানে, ‘সামর্থ্যবান ব্যক্তিরা বিপুল কর ফাঁকি দেয় এবং তাদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে নগণ্য ক্তিু দরিদ্র জনগোষ্ঠী সংখ্যায় বিপুল। এতে করব্যবস্থা পশ্চাৎমুখী পরোক্ষ করের প্রতি নির্ভর করতে বাধ্য হয়।’
সুতরাং করব্যবস্থাকে ন্যায়ানুগ করা এবং এর নমনীয়তা বৃদ্ধির জন্য এ ব্যবস্থার আমূল সংস্কার সাধন প্রয়োজন। যদি করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধি, অধিকাংশ অপ্রয়োজনীয় কর মওকুফ ও রেয়াত বাতিল এবং করহার যুক্তিসংগত পর্যায়ে আনা না হয়, তবে এ ব্যবস্থার বাধ্যবাধকতা ব্যতীত জনগণের আস্থা বৃদ্ধি করতে এবং কোষাগারে পর্যাপ্ত রাজস্ব প্রদানে উৎসাহিত করতে সক্ষম হবে না। ব্যাপকভাবে করভিত্তি সমপ্রসারণ ও ন্যায়পরায়ণ করদাতাগণের উপর করভার হ্রাস করে এবং করব্যবস্থাকে সুবিচারমূলক করতে মুসলিম দেশগুলো যত শিগগির সংস্কার সাধন করতে পারবে, উন্নয়ন ও আর্থ-সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ত্বরান্বিত করতে তা ততই সহায়ক হবে। নিঃসন্দেহে এটি কঠিন কাজ, তবে যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে তাহেল অসম্ভব নয়।
সংযত ঘাটতি বাজেট
এতদসত্ত্বেও খরচের কর্মপরিকল্পনা ও করব্যবস্থা সংস্কারের বদলে মুসলিম দেশসমূহ সহজতম পন্থায় অর্থাৎ মুদ্রা সমপ্রসারণ ও ঋণ গ্রহণের পথে অগ্রসর হয়েছে। এ পদ্ধতি এমন একটি অসংযত আর্থিক সামর্থ্য দিয়েছে যা দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে না। এর ফলে তুলনামূলক উচ্চহারে মুদ্রাস্ফীতি এবং অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণ ও দায় পরিশোধের বার দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। এ পদ্ধতি নিজে নিজেই স্থায়িত্ব লাভ করে এবং উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, অধিকতর মুদ্রামান হ্রাস, অ-টেকসই লেনদেন ঘাটতি ও অধিক উচ্চহারে ঋণভার সৃষ্টি করে। ফলে এ অবস্থায় উন্নয়নের জন্য পুনরায় সম্পদের ঘাটতি সৃষ্টি হয়, প্রবৃদ্ধি হ্রাস পায়, বেকারত্ব ও সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়।
মুসলিম সরকারসমূহ ঋণ সম্পর্কে প্রচলিত ধারণার আশ্রয় গ্রহণ করেছে। প্রচলিত ধারণার একটি গ্রহণযোগ্য নীতি হলো, চলতি ব্যয় নির্বাহের জন্য নয়, মূলধন ব্যয় নির্বাহের জন্যই ঋণ ব্যবহার করা যায়। কিন্তু দুর্বোধ্য কারণে এ সকল সরকার পূর্বোক্ত নীতিকে অগ্রাহ্য করে চলছে। এমনকি তারা তাদের চলতি ব্যয় নির্বাহের জন্যও ঋণ গ্রহণ করে থাকে। এটি কেবল সাংঘাতিক অব্যবস্থাই নয়, বরং ভাবী বংশধরদের প্রতিও চরম অবিচার, যারা ঋণভার বহন করতে বাধ্য হবে। ত্যাগের প্রয়োজনীয়তা ঋণ দ্বারা দূরীভূত হয় না, কেবল মুলতবি থাকে মাত্র। কিভাবে এটিকে ন্যায়বিচার বলা যায় বা নৈতিকভাবে সমর্থন করা যায় যে, বর্তমান প্রজন্ম তাদের চলতি অনুৎপাদনশীল ব্যয়ের দায় পরবর্তী প্রজন্মের উপর চাপিয়ে দেবে।
ইসলামী পদ্ধতিতে ঘাটতি ব্যয়
সুদের অবলুপ্তি মুসলিম সরকারসমূহের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পৌঁছে দেয়, তা হলো তারা অবশ্যই তাদের ঋণ গ্রহণের পরিমাণকে ন্যূনতম পর্যায়ে রাখবে। এটা তখনই সম্ভব যখন তরা ব্যয়ের ক্ষেত্রসমূহে কঠোর মৃঙ্খলা আনয়ন করবে এবং সরকারের ব্যাপ্তি মাত্রারিক্ত সমপ্রসারণ না করবে। সরকারসমূহ তাদের সকল চলতি ও অনুৎপাদনশীল ব্যয় নির্বাহের জন্য অবশ্যই করের উপর নির্ভর করবে। এমনকি তাদের উন্নয়ন বাজেটের একটি অংশ বিশেষত ইসলামী নীতিমালার অধীনে বিকল্প অর্থায়ন হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়, তেমন ব্যয়ের ক্ষেত্রেও তা করবে। ঋণ গ্রহণ ছাড়া ইসলামী শরীয়তে গ্রহণযোগ্য একাধিক পন্থায় তাদের প্রায় সকল যুক্তিসিদ্ধ প্রকল্পের অর্থায়ন করা তাদে পক্ষে সম্ভবপর হতে পারে। সরকারি মান নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলো বেসরকারি খাতে অর্থায়ন বাস্তবায়নের জন্য ব্যাপকতর হারে লিজ দেয়া যেতে পারে। এতে দক্ষতা বৃদ্ধি ও দুর্নীতি হ্রাস পাবে এবং রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি খাতের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি পাবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের পক্ষে কিস্তি ভিত্তিতে বাকিতে বা ভাড়ায় ক্রয় পদ্ধতিতে অর্থায়ন করা সম্ভবপর হতে পারে। বাণিজ্যিকভাবে সফল, কিন্তু যার ব্যবস্থাপনা যুক্তিসংগত কারণে বেসরকারি খাতে ন্যাস্ত করা উচিত নয়, এমন সব প্রকল্পে বেসরকারি খাতকে মূলধন বিনিয়োগে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে। এ পদ্ধতি অর্থায়নে শৃঙ্খলা আনয়ন করবে এবং সরকারসমূহকে সুদভিত্তিক সহজলভ্য ঋণ গ্রহণ পরিহারের পথে পরিচালিত করবে। দুঃসহ ঋণগ্রস্ত শ্বেতহস্তীরূপী প্রকল্পসমূহ ও অদক্ষ রাষ্ট্রয়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠানসমূহ, যা অধিকাংশ মুসলিম দেশে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে তা এভাবে এড়ানো সম্ভবপর হতে পারে।
বেসরকারি হিতৈষী কর্মকাণ্ড
সরকারের আরো উচিত বেসরকারি হিতৈষীদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে অধিক সংখ্যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বসতবাড়ি, এতিমখানা ও অন্যান্য সমাজসেবামূলক প্রকল্প নির্মাণ ও পরিচালনা করতে উৎসাহ দেয়া। মুসলিম ইতিহাসের অধিকাংশ সময় জুড়ে ওয়াকফ প্রতিষ্ঠানসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু সামপ্রতিক অতীতে বিভিন্ন কারণে ব্যয়বহুল জীবনযাত্রা ও নড়বড়ে করনীতির কারণে ওয়াকফ প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রভূত সম্ভাবনা অব্যবহৃত রয়ে গেছে। এ সকল প্রতিষ্ঠানের পুনরুত্থান সরকারের সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্পে অর্থায়নের দায়কে উল্লেযোগ্যভাবে হ্রাস করবে। ইতঃপূর্বে আলোচিত কর পদ্ধতি সংস্কারের মাধ্যমে এ সকল প্রতিষ্ঠানের পুনরুত্থানের পথের প্রধান বাধা দূর হবে। সরকার সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য অত্যন্ত সীমিত আকারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার তাগিদে তা প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখা দিতে পারে।
সরকারের ভূমিকার উপর প্রভাব
ঋণ গ্রহণ স্বল্পকালে যেরূপ আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য সৃষ্টি করে, অর্থায়নের পূর্ববর্ণিত বিকল্প পদ্ধতিগুলোর কোনোটিই সেরূপ আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য সৃষ্টি করবে না। তাই সরকার কম সম্পদ দ্বারা অধিক সর্মসম্পাদনে বাধ্য হবে। তাদেরকে সকল প্রকল্পের উপযোগিতা ও ব্যয় সতর্কতার সাথে মূল্যায়ন করতে হবে। সকল নতুন প্রকল্পের ব্যয় সর্বনিম্ন করতে হবে এবং বর্তমান সকল সুবিধা অধিকতর কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে হবে। সুতরাং, সরকারি অর্থব্যবস্থার অধিকতর দক্ষতা ও ন্যায়পরায়ণতা আনয়নে ও ঘাটতি বাজেট প্রক্রিয়া হ্রাসকরণে কঠোর প্রচেষ্টা গ্রহণ ব্যতীত মুসলিম সরকারসমূহের জন্য ইসলামীকরণের কথা বলা অবাস্তব।
সরকার অর্থব্যবস্থায় যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম, সুদভিত্তিক অর্থায়নের উপর নিষেধাজ্ঞা আবশ্যিকভাবে সেই ভূমিকাকে সীমিত করে না। ব্যাপক করারোপ ও ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ের উপর মূলত তাদের মাকাসিদ হাসিলের সাফল্য নির্ভর করে না। বরং সরকারি কার্যক্রমে অধিকতর সততা আনয়ন, ব্যয় ও প্রকল্প নির্বাচনে যথাযথ অগ্রাধিকার প্রদান নিশ্চিত করা, সরকারি খাতে উৎপাদিত দ্রব্য ও সেবার মূল্য নির্ধারণে খরচ তুলে নেয়া পদ্ধতির প্রয়োগ এবং মাকাসিদ হাসিলের জন্য অর্থব্যবস্থার প্রয়োজনীয় পুনর্গঠনের উপর এর সাফল্য নির্ভর করে। অধিক কার্যকর ভূমিকা পালনের লক্ষ্যে বেসরকারি খাতকে সহযোগিতা করা ও শক্তিশালী করে গড়ে তোলার উপরেও সাফল্য নির্ভরশলি। প্রথমেই বড় ধরনের সংকোচন এড়ানোর জন্য সরকারসমূহ একবারে ঋণ গ্রহণ বন্ধ না করে পর্যায়ক্রমে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। তবে ঋণ সংকোচনের লক্ষ্যে তাদের প্রত্যয় বার্ষিক বাজেটে ঘাটতি চূড়ান্তভাবে কমে আসার দ্বারা প্রতিফলিত হতে হবে। অবশ্য জরুরি অবস্থঅয় ফেরতযোগ্য কর (সুদবিহীন ঋণ) আদায় করা সম্ভব। যখন অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতিতে অর্থায়ন সম্ভবপর হয় না তখন মুসলিম সরকারের জন্য প্রচলিত পদ্ধতিতে ঋণ গ্রহণ আইনগতভাবে অনুমোদিত।
মুসলিম দেশসমূহের বাজেট ঘাটতি হ্রাস করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কারণ বৈদেশিক সাহায্যের উপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা সম্ভব নয়। প্রথমত, শিল্পেন্নত দেশসমূহে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার নিম্ন এবং অন্তত মধ্যমেয়াদী সময়ে এ নিম্নহার অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। বেকারত্বের হার বেশি থাকায় মুদ্রাস্ফীতি পুনরায় ভীতির সৃষ্টি করেছে। সুতরাং তাদের বাজেট সীমাবদ্ধতা অব্যাহত থাকতে পারে এবং বৈদেশিক সাহায্যের ভাণ্ডার সমপ্রসারিত নাও হতে পারে। বস্তুতপক্ষে বৈদেশিক সাহায্য প্রকৃত মূল্যে সংকুচিত হয়েই পড়েছে। দ্বিতীয়ত, সোভিয়েত ভীতি কমে যাওয়ায় এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সাহায্য পূর্ব ইউরোপীয় দেশসমূহে চলে যাওয়ায় মুসলিম দেশসমূহে সাহায্যের প্রবাহ হ্রাস পেতে পারে। তৃতীয়ত, একথা মনে রাখা দরকার যে, সামান্য পরিমাণ অনুদান ব্যতীত প্রায় সকল সাহায্যই ঋণ। এমনকি, যদিও এ সকল ঋণ পরিশোধ করতে হয় রেয়াতি হারে, তবু সুদসহ তা পরিশোধযোগ্য। এটি কেবল তখনই সমর্থনযোগ্য, যখন ঋণগ্রহীতা দেশের উৎপাদন ও ঋণভার পরিশোধ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে যে, শেষ পর্যন্ত মূলধন গঠন ও প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানোর জন্য বৈদেশিক সাহায্যের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যবহৃত হয় না। এ সাহায্য ব্যক্তিগত ভোগ, চলতি সরকারি ব্যয় ও সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ে ব্যবহার করা হয়। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ অভিযোগ করে থাকেন যে, বৈদেশিক সাহায্য একটি দেশের দীর্ঘমেয়াদী প্রবৃদ্ধির হারে খুব সামান্যই অবদান রাখে, এমনকি তা নেতিবাচকও হতে পারে। কারণ বৈদেশিক সাহায্য দাতা দেশের রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প সংশ্লিষ্ট স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য রেখে প্রদান করা হয়ে থাকে এবং সাধারণভাবে দূরবর্তী দারিদ্র্য দূরীকরণ তাদের উদ্দেশ্য নয়। আরো অভিযোগ করা হয়ে থাকে যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বৈদেশিক সাহায্য দেয়া হয় সামরিক ও অন্যান্য স্বৈরতান্ত্রিক সরকারকে মদদ দেয়ার জন্য, যারা গরীবদের উপর জুলুম করে থাকে। এমনকি বহুজাতির সাহায্যদাতা সংস্থাগুলোর অলিখিত অভিসন্ধির কথাও বলা হয়ে থাকে। দাতাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, তারা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসে, দরিদ্র দেশগুলোকে অধিকতর সাহায্যের উপর নির্ভরশীল করে রাখে এবং তাদের আর্থিক ক্ষমতাকে তৃতীয় বিশ্বের সর্বত্র বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক পুঁজির স্বার্থকে পৌঁছে দেয়ার জন্য কাজে লাগায়।
এ অভিযোগের পেছনে যে সত্যই থাকুক না কেন, দরিদ্র মুসলিম দেশগুলোর সামনে কোনো বিকল্প নেই। তাদের সাহায্যের প্রয়োজন এবং বিশেষত তারা বর্তমানে যে পরিমাণ বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যহীনতা মোকাবিলা করছে, তার কারণে তাদের পক্ষে সাহায্য গ্রহণ পরিহার করা সম্ভব নয়। তবে তাদের ভূ-রাজনৈতিক স্বাধীনতার স্বার্থে সাহায্যের উপর যতদূর সম্ভব কম নির্ভর করা উচিত এবং যেটুকু সাহায্য পাওয়া যায়, তাকে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা এবং নিজস্ব অর্থব্যবস্থায় প্রত্যাশিত কাঠামোগত সমন্বয় সাধন করা সমীচীন। যখন এ সমন্বয় সাধনের প্রত্যাশা ধীরে ধীরে বিকশিত হচ্ছে, তখন কষ্টকর সমন্বয় এড়ানোর জন্য অথবা ব্যক্তিগত প্রদর্শনীমূলক ভোগ বা চলতি সরকারি ব্যয় নির্বাহ ও প্রকৃত ভীতিজনক অবস্থা ব্যতীত সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণের লক্ষ্যে সাহায্য চাওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। নবী (স) এর হাদিস হচ্ছে, “নিজের হাত অপেক্ষা উপরের হাত উত্তম”। হাদিসটি ব্যক্তিগত বিষয়ের চেয়ে জাতীয় বিষয়ে অধিকতর প্রযোজ্য।
বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নয়ন
প্রতিবন্ধক অপসারণ
উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা, প্রকৃত চাহিদা পূরণ করা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। ইসলামী ভোগ পদ্ধতি বাস্তবায়নের ফলে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত সঞ্চয় আবশ্যিকভাবে মূলধন গঠন নাও করতে পারে। অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, এমনকি অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশের বর্তমান নিম্নহারে সংগঠিত সঞ্চয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অনুৎপাদনশীল খাতে (যেমন স্বর্ণ, মূল্যবান রত্ন ও অলংকারাদি) ও মূলধন পাচারে পরিচালিত হয়। অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশে মূলধন পাচার একটি মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত এগার বছরে মূলধন আমদানিকারক দেশসমূহের ২৫০ বিলিয়ন ডলার মূলধন বহির্গমনের মধ্যে প্রায় ১৫০-২০০ বিলিয়ন ডলার মূলধন পাচার হয়েছে। এরূপ বিপুল মূলধন বহির্গমনের ফলে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগে হতাশা সৃষ্টি হয় এবং স্থায়ী প্রবৃদ্ধি অর্জনকে আরো কঠিন করে তোলে।
মুসলিম দেশসমূহে সঞ্চয় জমা রাখা ও মূলধন পাচার নিশ্চয়ই উৎপাদনশীল নিয়োগ বৃদ্ধিতে উৎসাহদানকারী মূল্যবোধের অনুপস্থিতির কারণে সৃষ্টি হয়নি। পূর্বোল্লিখিত ছয় নম্বর সূত্র অনুযায়ী মাকাসিদ হাসিলে অবদান রাখার উদ্দেশ্যে উৎপাদনশলি কাজে বিনিয়োগ করা প্রত্যেক মুসলমানের একটি সামাজিক দায়িত্ব। উক্ত সূত্রে বলা হয়েছে, ‘যা ছাড়া কোনো দায় সম্পাদন করা যায় না, তাও দায় হিসেবে গণ্য। মহানবী (স) এ কথা বলে বিনিয়োগ না করাকে নিরুৎসাহিত করেছেন, “যে (প্রয়োজন ব্যতীত) কোনো বাড়ি বিক্রয় করে, কিন্তু বিক্রয়লব্ধ অর্থ অনুরূপ কোনো কাজে বিনিয়োগ করে না, আল্লাহ তার বিক্রয়লব্ধ অর্থে রহমত করেন না”। খলিফা ওমর (রা) বলতেন, “যার সম্পদ আছে, তাকে তা উন্নত (উন্নয়ন) করতে দাও এবং যার জমি আছে তাকে তা চাষঅবাদ করতে দাও”। মুসলিম সমাজের এ সকল নীতিমালা মর্যাদার প্রতীকরূপে গণ্য, যা আড়ম্বরপূর্ণ ভাগের স্থলে উৎপাদনশীল বিনিয়োগ সৃষ্টিতে সাহায্য করতে পারে। অর্থ এবং স্বর্ণ ও রৌপ্য নির্মিত ললংকারাদিসহ মোট সম্পদের উপর যে যাকাত ধার্য করা হয়, তা সঞ্চয়কারীদেরকে উপার্জনমূলক আর্থিক ও স্থাবর সম্পত্তি অর্জনের মাধ্যমে সঞ্চয়ের উপর ধার্যকৃত যাকাতের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে।
যথাযথ বিনিয়োগ পরিবেশ
যা হোক, কেবলমাত্র এ সকল মূল্যবোধের উপস্থিতি অথবা জনগণের বিশ্বাস বা দেশপ্রেমের প্রতি আহবান উৎপাদনমুখী বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট নয়। জনগণ যদি বিনিয়োগ থেকে যুক্তিসংগত হারে মুনাফা অর্জনের ব্যাপারে প্রত্যাশা করতে না পারে, তবে তারা দীর্ঘমেয়াদী উৎপাদনমুখী বিনিয়োগ তহবিল গঠন করবে না। এজন্য যথাযথ বিনিয়োগ পরিবেশ প্রয়োজন, যে পরিবেশ বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণে উৎসাহিত করে, বাধা ও অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকি অপসারণ করে বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করে এবং প্রয়োজনীয় সুবিধার যোগান দেয়। যে সকল বিষয় বিনিয়োগের পরিবেশ বিনষ্ট করে, তার মধ্যে কতগুলো হলো ঃ যে সকল বিষয় বিনিয়োগের পরিবেশ বিনষ্ট করে, তার মধ্যে কতগুলো হলো ঃ পর্যাপ্ত সামাজিক ও ভৌত অবকাঠামোর অভাব, অসম করব্যস্থা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও অনিশ্চিত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। প্রথমোক্ত দু’টি বিষয়ে ইতঃপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে অবশিষ্ট তিনটি বিষয় সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা থেকে আকস্মিক সরকারি নীতি পরিবর্তনের ভীতি সৃষ্টি হয়, যার ফলে উদ্যোক্তাকে গুটিয়ে ফেলার ক্ষতি স্বীকার করতে হতে পারে। এ অনিশ্চয়তার কারণ হলোঃ গণতান্ত্রিক পদ্ধতির অনুপস্থিতি এবং বিভিন্নমুখী কায়েমী স্বার্থ ও আন্তর্জাতিক ক্ষমতার রাজনীতির সাথে তাল মিলিয়ে শাসক শ্রেণীর পুঁজিবাদ বা সমাজতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য পরিবর্তন। পরিবর্তশীল আনুগত্য রাজনীতিতে বিশৃঙ্খল অবস্থায় জন্ম দেয় এবং সুবির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণে বাধার সৃষ্টি করে। ইসলামের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য নির্ধারণ করা সম্ভব হবে স্থিতিশীলতার দৃঢ় ভিত্তি রচিত হবে।
ইসলামী শরীয়তে সম্পদে মালিকানার অধিকার ও সীমা সম্পর্কে পরিষ্কার নির্দেশনা রয়েছে। এগুলোকে বৈধভাবে কার্যকর করলে বিনিয়োগকারীদের মন থেকে সম্পদের নির্বিচার আটক ও রাষ্ট্রীয়করণের ভীতি দূর হবে। মহানবী (স) তাঁর বিদায় হজের ভাষণে ঘোষণা করেন, “তোমাদের জীবন ও তোমাদের সম্পত্তি আজকের হজ্জের দিনের মতোই পবিত্র”। এর অনুসরণে আইনবিদগণ সর্বসম্মতভাবে রাষ্ট্র কর্তৃক সম্পত্তির যথেচ্ছা বাজেয়াপ্তকরণ ও রাষ্ট্রীয়করণের ধারণার বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন। আবু ইউসুফ এ রায়কে সংক্ষিপ্তভাবে আইনের ভাষঅয় বলেছেন, “প্রতিষ্ঠিত ও জ্ঞাত অধিকার ব্যতীত কোনোশাসকের কোনো কিছুর স্বত্ত্ব বিলোপ করার অধিকার নাই”। এমনকি কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাষ্ট্রীয়করণ বা জনগণের ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন হলেও সে ক্ষেত্রে আইনগত নীতি অনুসারে শরীয়াহ ন্যায়সংগত ক্ষতিপূরণ প্রদানের আদেশ দেয়। আইনের সূত্রটি হলো, “জনগণের প্রয়োজন কোনো ব্যক্তিগত অধিকারকে রহিত করে না।”।
কোন্ কোন্ কেবলমাত্র রাষ্ট্রয়ত্ব প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দেয়া হবে এবং কোন্ কোন্ খাতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্বাধীনভাবে কাজ করবে, সেসব বিষয়ে আইনগতভাবে শ্রেণীবিন্যাস করতে শরীয়াহর সুস্পষ্ট নির্দেশ অনুসারে মুসলিম দেশসমূহের আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। এরূপ শ্রেণীবিন্যাস ও ন্যায়সংগত ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যবস্থা সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে স্বেচ্ছাচারী নীতি পরিবর্তনের সম্ভাবনাকে নূন্যতম পর্যায়ে নিয়ে আসবে। সুদ নিষিদ্ধ হওয়ায় এবং কর ও শেয়ার বিক্রয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠানের জন্য পর্যাপ্ত অর্থায়নে সরকারের অসামর্থ্যের কারণে এ সকল প্রতিষ্ঠানকে যে কেনোভাবে ন্যূনতম মাত্রায় রাখতে হবে। একবার শরীয়াহর ভিত্তিতে এরূপ নিরপত্তা দেশের সংবিধান ও াইন কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করা হলে যে কোনো সরকারের জন্য তার অভ্যন্তরীণ জনপ্রিয়তা ও আন্তর্জাতিক অবস্থানের কারণে এগুলোকে অবজ্ঞা করা কঠিন হবে।
মুদ্রামান অবমূল্যায়ন ও বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ
বেসরকারি ভোগ ও সরকারি ব্যয় ইতঃপূর্বে আলোচিত পদ্ধতি অনুযায়ী পুনর্গঠনপূর্বক সম্পদের চাহিদা হ্রাস করা ব্যতীত অধিকাংশ মুসলিম দেশে অব্যাহত মুদ্রার অবমূল্যায়ন প্রতিরোধ করা যাবে না। পক্ষান্তরে অধিকাংশ মুসলিম সরকার মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ (আমদানি নিয়ন্ত্রণসহ বৈদেশিক মুদ্রার উচ্চ মূল্য), উচ্চ শুল্ক ও আমদানি বিকল্প শিল্পের উন্নয়নের উপর তাদের মূল্য নির্ভরতা স্থাপন করেছে।
অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে, বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ ব্যাপকভাবে অকার্যকর হয়েছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার সরকারি ও কালোবাজারী দ্বৈত বিনিময় হার সৃষ্টি হয়। মুদ্রার সরকারি মূল্যহার কৃত্রিমভাবে বৃদ্ধির ফলে আমদানি উৎসাহিত এবং রপ্তানি নিরুৎসাহিত হয়। এতে বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্য অধিকতর খারাপ হয়, সম্পদের প্রবাহ বিকৃত হয় এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে মন্দা দেখা দেয়। এ অবস্থা ভোক্তা ও রপ্তানিকারকগণের ত্যাগের মূল্যে আমদানিতে ভর্তুকি দেয়ার মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক অবিচারের সহায়ক হয়। কারণ ভোক্তাগণ সাধারণত আমদানিকৃত দ্রব্যের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার সুযোগ পরিব্যয় অনুযায়ী মুল্য প্রদান করে, কিন্তু রপ্তানিকারকগণ তাদের সামগ্রীর জন্য স্বল্প মূল্য প্রাপ্ত হয়। এতে দুর্নীতি ও অদক্ষতাও বৃদ্ধি পায়। বৈদেশিক মুদ্রার বাস্তবসম্মত বিনিময় মূল্যের অনুপস্থিতিতে রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ধরনের বোনাস প্রদানের কর্মসূচি কেবলমাত্র অবিচার ও দুর্নীতিকেই বাড়িয়ে তোলে। এ সকল কর্মসূচির উপকার প ্রকৃত উৎপাদক পর্যন্ত পৌঁছায় না। ফলে তাদে সম্পদ বৃদ্ধি না পাওয়ায় তারা উন্নত উপকরণ ও প্রযুক্তি সংগ্রহ করতে পারে না। তাদের উৎপাদন ক্ষমতা পূর্বের মতোই নিম্নমানের থেকে যায়।
শুল্প ও আমদানি বিকল্প
উচ্চ শুল্প হার একধারী তলোয়ারর ন্যায়। যদি কার্যকরভাবে উচ্চ শুল্কহার প্রয়োগ করা যায়, তবে আমদানি নিরুৎসাহিত হয়, কিন্তু রপ্তানি উৎসাহিত হয় না। এতদসত্ত্বেও কোনো উন্নয়নশীল দেশে সামাজিক মূল্যমান পরিবর্তনের লক্ষ্যে নৈতিক সংশোধন ছাড়াই অকার্যকর ও দুর্নীতিপরায়ণ শুল্কব্যবস্থার দ্বারা যদি উচ্চ শুল্কহার কার্যকর করা হয়, তবে আমদানিকৃত দ্রব্যের স্বল্প মূল্য প্রদর্শন (under invoicing), চোরাচালান ও কর ফাঁকি দেয়া বৃদ্দি পায়। এতে উচ্চ করারোপ বাড়ে, কিন্তু চোরাপথে আমদানিকৃত বিলাসদ্রব্যের মুনাফা পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পায় এবং প্রকৃত প্রয়োজন পূরণকল্টে সম্পদের সরবরাহ বিঘ্নিত হয়। সুতরাং এ ক্ষেত্রে অধিকতর কার্যকরী পন্থা হলো পূর্বালোচিত বিলাসদ্রব্যের শ্রেণীভুক্ত দ্রব্য ও সেবার আমদানি ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা।
নিওক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদগণের ধারণা মোতাবেক আমদানি বিকল্প শিল্প ততটা খারাপ নাও হতে পারে, যদি করদাতাগণের বিপুল কষ্টের বিনিময়ে অদক্ষ শ্বেতহস্তী সৃষ্টি করা না হয়। যখন পৃথিবীর সকল দেশ এ নীতি অনুসরণ করছে এবং তা অব্যাহত রেখেছে, তখন মুসলিম দেশগুলোর পক্ষে এ নীতি অনুসরণ না করার কোনো যুক্তি নেই। এটি কেবল কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর জন্যই প্রয়োজনীয় নয়, বরং এটি রপ্তানি বৃদ্ধির ব্যাপক ভিত্তি সৃষ্টির জন্যও প্রয়োজন। তবে আমদানি বিকল্প হিসেবে যে শিল্পকে নির্বাচন করা হবে, জটিল প্রশ্ন তার জন্যই। যথাযথ উন্নয়ন দর্শনের অভাবে এ নির্বাচন স্বেচ্ছাচারী হওয়ার এবং মাকাসিদ হাসিল ও সম্পদ বরাদ্দের জাতীয নীতির সাথে সম্পৃক্ত না হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। একটি সত্যিকার ইসলামী সমাজে এ দু’টি বিষয়ই গভীরভাবে বিবেচনা করতে হবে।
স্বেচ্ছাচারীভাবে নির্বাচিত শিল্পসমূহ ভর্তুকিভিত্তিক অর্থায়ন, উচ্চ শুল্ক সংরক্ষণ, মূলধন ও কাঁচামাল আমদানিতে কর মওকুফ ও রেয়াতি মেয়াদ আকারে সর্বোচ্চ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে থাকে। সাধারণত এরূপ শিল্প প্রতিষ্ঠান বৃহদায়তন হয় এবং শহরাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে। যেহেতু এ সকল শিল্প প্রতিষ্ঠান মূলধন-নিবিড় হয়ে থাকে এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে, সেহেতু কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক আয়তনের প্রতিষ্ঠানের তুলনায় এগুলো পর্যাপ্ত অবদান রাখতে সক্ষম হয় না। এ সকল শিল্প সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে প্রতিযোগী পণ্যের উপর উচ্চহারে শুল্ক আরোপ করার ফলে ভোক্তাগণ কেবল উচ্চ মূল্য দিতেই বাধ্য হয় না; বরং এ সকল শিল্পের জন্য মূলধন, দ্রব্য ও কাঁচামাল আমদানির লাইসেন্স প্রাপ্ত ব্যক্তিগণ অনুপার্জিত সম্পদে ধনী হওয়ার সুযোগ লাভ কলে। এছাড়া আমদানিকৃত দ্রব্যের মূল্য কম প্রদর্শনের মাধ্যমে কর ফাঁকি দেয়ারও সুযোগ সৃষ্টি হয়। জাতীয় সম্পদ যত বেশি এ ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত করা হবে, সম্পদের প্রবাহ ততই বিশৃঙ্খল হবে এবং শহরের ও গ্রামীণ ধনাঢ্য ব্যক্তিগণ অধিকতর ধনাঢ্য হওয়ার সুযোগ লাভ করবে। অধিকন্তু ব্যাপক সংরক্ষণ লাভকারী শিল্পে সাধারণত কোনো প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয় না।
প্রবৃদ্ধি প্রকৃত চাহিদা পূরণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির সম্ভাবনার বিবেচনায় কৃষি এবং ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক প্রতিষ্ঠানের সর্বাধিক সংরক্ষণ লাভ করার অধিকারী। কিন্তু এগুলো উপেক্ষিত হয়। এ খাতগুলো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, বৈদেশিক মুদ্রার উচ্চমূল্য, আমদানি ভর্তুকি ও পণ্য সাহায্যের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ খাতে কার্যরত ইউনিটগুলো আকারে ক্ষুদ্র, অসংগঠিত ও অবিকশিত হওয়ায় কোনো রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টিতে সক্ষম হয় না। ভূমির মালিকানা একীভূত হওয়ায় ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অনুপস্থিতিতে এ খাতগুলোর অবস্থা আরো খারাপ হয়। ফলে উপেক্ষা ও দারিদ্র্য এবং উন্নতর প্রযুক্তিতে বিনিয়োগে অর্থায়নের ক্ষেত্রে অসামর্থ্যের মতো একটি দুষ্টচক্র সৃষ্ট হয়। নিঃসন্দেহে এ অবস্থা ‘মাকাসিদের’র সাথে প্রত্যক্ষভাবে সাংঘর্ষিক।
আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ
অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের ন্যায় মুসলিম দেশসমূহেও সম্ভবত আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বা লাল ফিতার দৌরাত্ম্য বিনিয়োগের প্রধান বাধা। সরকারের উদ্দেশ্য সাধনের পক্ষে নৈতিক সংশোধন ও যথোপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির বদলে নিয়ন্ত্রণের উপর অধিক নির্ভরশলি হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। নিয়ন্ত্রণের ফলে বিনিয়োগকারীগণের সময় ও শক্তির অপচয় ও অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বৃদ্ধি পায়। এরূপ অধিকাংশ নিয়ন্ত্রণ বিলোপ করা ব্যতীত বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করা কষ্টকর। ইসলামী মূল্যবোধ কাঠামোর অধীনে উদ্যোগের স্বাধীনতা হচ্ছে, ইসলামী আদর্শের সাধারণ প্রকৃতি। নিঃসন্দেহে নিয়ন্ত্রণ দুর্নীতির অপরিহার্য উৎস। এমনকি ইসলামের নৈতিক সংশোধন সত্ত্বেও কর্মচারীগণ প্রলোভনের শিকার হওয়া থেকে রক্ষা নাও পেতে পারে। সুতরাং, স্থায়ী উৎপদন এবং প্রকৃত চাহিদা পূরণকারী পণ্য ও সেবার আমদানি এবং এগুলো উৎপাদন এবং প্রকৃত চাহিদা পূরণকারী পণ্য ও সেবার আমদানি এবং এগুলো উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও মূলধন সামগ্রীর আমদানি নিয়ন্ত্রণ করার কোনো যুক্তি নেই। আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ দূরীকরণ ও করব্যবস্থার সংস্কার মজুত সম্পদের উৎপাদনমুখী ব্যবহার ও মূলধন পাচার হ্রাসের মাধ্যমে উল্লেকযোগ্য পরিমাণ মূলধন গঠনে সহায়ক হতে পারে।
বৈদেশিক মূলধন বিনিয়োগ
ইসলামে সুদ নিষিদ্ধ হওয়ায় মুসলিম দেশগুলোর জন্য বৈদেশিক মূলধন বিনিয়োগে উৎসাহ দান ও সুযোগ সৃষ্টি করা অপরিহার্য। নিঃসন্দেহে এটি প্রত্যাশিত হওয়া উচিত, কারণ ‘উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মূলধন বিনিয়োগ লাভজনক বলে প্রমাণিত হয়েছে’। এজন্য অনূকুল পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে মূলধন বিনিয়োগ আকৃষ্ট করাও সম্ভব। যে সকল বৈদেশিক বিনিয়োগ ইসলামী মূল্যোবোধের সাথে সাংঘর্ষিক নয় এবং যেগুলো মাকাসিদ হাসিলে সাহায্য করে, সে সকল বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শর্ত আরোপ সমর্থন করা কঠিন। এতে বরং এই সুবিধা রয়েছে যে, এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রা, প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনার পর্যাপ্ততা রয়েছে যা মুসলিম দেশগুলোতে উপাদান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অভাব রয়েছে, কিন্তু উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য এগুলো খুবই প্রয়োজনীয়। যদিও পরবর্তী পর্যায়ে এর দ্বারা বৈদেশিক ধনাত্মক ফলাফল অর্জন করতে সক্ষম হবে। এভাবে ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে সম্পূর্ণ বিনিয়োগ ঝুঁকি গ্রহীতা দেশের এককভাবে বহন করার বদলে বৈদেশিক বিনিয়োগকারীর সাথে বিনিয়োগ ঝুঁকি বিভাজন করে নেয়া সম্ভব হয়।
ইসলামের আলোকে অর্থনৈতিক নীতিমালার পুনর্বিন্যাস সাধনের ফলে যে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হবে, তা নিজেই বৈদেশিক মূলধন বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে ইতিবাচক উপাদান গঠন করবে। এজন্য সম্ভবত কোনো অতিরিক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার হবে না। চুক্তির শর্তাবলী পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেনে চলার জন্য ইসলামের অনুশাসন রয়েছে। সুতরাং, বৈদেশিক বিনিয়োগকারীর জন্য এ নিশ্চয়তা প্রয়োজন।
সাধারণ শান্তিপূর্ণ সময়ে সকল চলতি হিসেবের লেনদেনের ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার করা ও মুনাফ প্রেরন পদ্ধতি সহজসাধ্য করা ইসলামী মূল্যবোধ কাঠামোর আওতায় গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়। মূলধন প্রত্যাহারের নিশ্চয়তা প্রদান করাও এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়। একটি রাষ্ট্র কিভাবে একজন ভিনদেশী বিনিয়োগকারীর অধিকার ফেরত পাওয়ায় বাধা দেয়ার কথা বিবেচনা করতে পারে, যখন উভয় পক্ষের স্বীকৃত শর্ত মোতাবেক মূলধন প্রত্যাহার অনুমোদিত? বিশ্বব্যাংকের মতানুসারে, ‘যে সকল দেশ উন্মুক্ত উন্নয়ন কৌশল অনুসারণ করেছে, তাদের প্রত্যক্ষ বিনিয়োগে সমস্যা ছিল তুলনামূলকভাবে কম’। যাইহোক, যতক্ষণ পর্যন্ত মুসলিম দেশসমূহ অধিক বৈদেশিক মূলধন বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে সক্ষম না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের জন্য প্রচলিত ঋণগ্রহণ পদ্ধতি অনুসরণ করা অনিবার্য বলে মনে করা যায়। কিন্তু তা একান্তই উৎপাদনশীল ও নিজস্ব আয়ে পরিচালনাযোগ্য (self-liquidating) প্রকল্পের জন্য যেগুলো মাকাসিদ হাসিলের ক্ষেত্রে সত্যিকারভাবে প্রয়োজন।
উৎপাদনের আকৃতি পুনঃনির্ধারণ
বিনিয়োগ পরিবেশের পুনর্গঠন কেবলমাত্র বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধিতে সাহায্য করতে সক্ষম। কিন্তু এটি নিশ্চিত করা প্রয়োজন যে, বৃদ্ধিপ্রাপ্ত বিনিয়োগ যেন বিলাসদ্রব্য ও অপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদনে পরিচালিত হয়। এ ব্যবস্থা কতিপয় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে বাস্তবায়ন করা সম্ভবপর নয় এবং এমনটি করা উচিতও নয়। এক্ষেত্রে প্রত্যাশিত ও অধিকতর কার্যকরী কৌশল হচ্ছে নৈতিক ও সামাজিক সংশোধনের মাধ্যমে ব্যক্তিগত চাহিদার অগ্রাধিকার পরিবর্তন করা, প্রতিবন্ধকতা দূর করা এবং উদ্যোক্তাগণকে চাহিদার উৎসাহ ও সুযোগ দান করা, যাতে বেসরকারি উদ্যোক্তাগ এ ধরনের খাতে তহবিলের দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগকে আকর্ষণীয় বলে বিবেচনা করে। বিলাসদ্রব্য ও মর্যাদার প্রতীক স্বরূপ দ্রব্যসামগ্রীর উৎপাদন ও আমদানির উপর প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য সুযোগ বা ভর্তুকি, যা এগুলোর উৎপাদন ও আমদানির উপর প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য সুযোগ বা ভর্তুকি, যা এগুলোর উৎপাদন বা আমদানিকে প্রভাবিত করে, অবশ্যই প্রত্যাহার করতে হবে। প্রকৃত প্রয়োজন পূরণকারী ও রপ্তানীযোগ্য দ্রব্য ও সেবা এবং মূলধন গঠনের অনুকূলে সরকারের রাজস্ব, মুদ্রা ও বাণিজ্যনীতি পুনর্বিন্যাস করতে হবে।
অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য নিয়ন্ত্রনের সাধারণ প্রবণতা এগুলোর সরবরাহে দীর্ঘমেয়াদী স্বল্পতা সৃষ্টি করে। কারণ এ সকল দ্রব্যসামগ্রীর মুনাফা হ্রাস পাওয়ায় এগুলো উৎপাদনে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হয়। এটি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্থায়ী ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে বিলাসদ্রব্যের দীর্ঘমেয়াদী সরবরাহ বৃদ্ধি পায় এবং এভাবে সামর্থ্যবান লোকদের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়। সুতরাং জাতীয় জরুরি অবস্থা (যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ) ব্যতীত স্বাভাবিক এবং যখন বাণিজ্য ব্যবস্থায় একক কারবার, যোগসাজশ বা মজুতদারীর মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা না হয়, সেই অবস্থায় শরীয়াহ মূল্য নিয়ন্ত্রণ নিষিদ্ধ করেছে। অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যের উপর মূল্য নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বল্পমেয়াদী কষ্ট দূর করা বা হ্রাস করার পর্যায়ক্রমিক ব্যবস্থা গ্রহণ (একবারে সকল দ্রব্যের উপর থেকে মূল্য নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার না করা), প্রত্যক্ষ হস্তান্তরজনিত আয় (transfer payment) ও পূর্বের আলোচিত অন্যান্য পন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন এবং ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক উদ্যোগের প্রতি আনুকূল্য প্রকৃত প্রয়োজন পূরণ ও রপ্তানি বৃদ্ধিতে উৎসাহ সৃষ্টি করতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। এছাড়া ইসলামী নীতিমালার আলোকে ব্যাংব্যবস্থার পুনর্গঠন সমগ্র সংস্কার কর্মসূচির একটি অপরিহার্য অঙ্গ বলে বিবেচিত হবে।
কৃষি ও পল্লী সংস্কার
যদিও সম্পদের কেন্দ্রীভূতকরণ হ্রাস করার জন্য ভূমি সংস্কার অপরিহার্য, তবুও কেবলমাত্র ভূমি সংস্কার মুসলিম দেশগুলোকে মাকাসিদ হাসিলে বেশি দূর অগ্রসর করবে না, যদি যুগপৎভাবে কৃষি খাতের অন্যান্য অসুবিধাগুলো যা দ্বারা সমগ্র কৃষি সেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সেসব দুর্ভোগের কারণ ও অন্যান্য প্রতিকূল অবস্থা দূর করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা না হয়। এ প্রতিকূল অবস্থা কৃষি খাতের দক্ষতা ও উৎপাদন হ্রাস করে, গ্রামীণ বেকারত্ব বৃদ্ধি করে, গ্রামীণ আয়-উপার্জনে মন্দা সৃষ্টি করে এবং বৈষম্য বাড়িয়ে তোলে।
প্রতিকূল অবস্থা দূরীকরণ
সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিকূলতা হলো একটি কার্যকর অবকাঠামের বাহ্যিক অর্থনীতির (External Economies) অনুপস্থিতি, যার মধ্যে সেচ ও পানি নিষ্কাশন, সমপ্রসারণ সার্ভিস, সড়ক, বিদ্যালয়, বিদ্যুৎ ও স্বাস্থ্য সুবিধাগুলো থাকার কথা। এর কারণ হলো সরকারি বাজেট ব্যয় বরাদ্দে কৃষি খাতের প্রতি অবহেলা। ধনী শিল্পোন্নত দেশসমূহে যেখানে কৃষকগণকে আমদানি সংরক্ষণসহ বিভিন্ন পদ্ধতিতে উৎসাহ দেয়া হয়ে থাকে, সেখানে উন্নয়নশলি দেশসমূহে কৃষিখাতের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়। তারা বৈদেশিক মূল্য বাড়িয়ে এবং খাদ্যদ্রব্যের মূল্য প্রশাসনিক পন্থায় নিয়ন্ত্রণ করে সরকারি ঘাটতি বাজেটজনিত মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব হ্রাস করতে চেষ্টা করে। এ পদ্ধতির ফলে বাণিজ্যের ভারসাম্য কৃষি এবং ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক প্রতিষ্ঠানের বিপক্ষে যায়, কৃষি উৎপাদন হ্রাস পায়, আমদানির উপর নির্ভরশলিতা বাড়ে, রপ্তানি সংকুচিত হয় এবং গ্রামীণ আয়-উপার্জনে মন্দা দেখা দেয়। অন্যায্য ভূমি মালিকানা ব্যবস্থার সাথে গ্রামীণ আয়-উপার্জনে মন্দাভাবের ফলে বর্গাচাষীর হাতে এমন কোনো উদ্বৃত্ত থাকে না, যা দ্বারা তারা কৃষি খাতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করতে পারে (যেমন- উন্নত বীজ ও যন্ত্রপাতি, সার কীটনাশক)। একই অবস্থা ঘটে ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও। এর ফলে বেকারত্ব ও আংশিক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়। এভাবে দারিদ্র্য, বিনিয়োগ স্বল্পতা, কম উৎপাদন ও বেকারত্বের এই দুষ্ট চক্রের আবির্ভাব ঘটে। ফলাফল হিসেবে শহরাঞ্চলে জনসংখ্যার চাপ বৃদ্ধি পায়, শহরে শ্রমের মজুরি হ্রাস পায় এবং বস্তির সৃষ্টি হয় যেখানে জীবনযাপন অত্যন্ত কষ্টকর। সুতরাং, proverty and Hunger গ্রন্থের লেখক সঠিকভাবেই বলেছেন, ‘গ্রামীণ এলাকায় কৃষি উৎপাদনের কৌশলের চেয়ে আয় বণ্টনই হলো আসল সমস্যা’।
অর্থায়ন
কৃষি খাতের অপর গুরুত্বপূর্ণ প্রতিকূলতা হলো, ক্ষুদ্র কৃষক ও ব্যষ্টিক প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে সুযোগের অভাব। যদিও অর্থায়নের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য, তথাপি কেবলমাত্র ধনী কৃষকগণই সাধারণত সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণ ক্ষুদ্র কৃষকগণের পক্ষে কঠিন হয়। ফলে তারা উন্নতমানের কৃষি উপকরণ ক্রয় এবং ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক ধরনের প্রতিষ্ঠান পরিচালনার মাধ্যমে নিজেদের আয় বৃদ্ধি করতে এবং নিজেদের ও পরিবারের সদস্যদের পূর্ণরূপে নিয়োজিত রাখতে প্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহ পায় না। এভাবে ‘ব্যবসায়ী, অপ্রতিষ্ঠানিক মহাজন, সুদখোর ও আত্মীয়স্বজনদের নিকট অব্যাহতভাবে ঋণগ্রস্ত থাকায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যে স্থায়ী রূপ লাভ করে’। যদিও সমানুপাতিক ভূমিব্যবস্থা অপরিহার্য, কিন্তু এটি অধিক সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হবে না, যদি কৃষকদের পর্যাপ্ত অর্থায়ন করার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয়। কৃষদের কেবলমাত্র তাদের কৃষিখামারে নিয়োগের জন্য অর্থায়ন করলেই চলবে না, তাদেরকে ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক ধরনের প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্যও অর্থায়ন করতে হবে, যাতে তারা বাড়তি আয় ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই ইসলাম প্রদর্শিত সুদমুক্ত ব্যবস্থার বিকল্প কাঠামের মধ্যে এ কাজগুলো করতে হবে। সরকার ও বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ বৃহদায়তন শহুরে প্রতিষ্ঠানকে দশকের পর দশক ধরে ভর্তুকি দিয়ে এসেছে। তারা যদি ভরসাম্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত কৃষি খাতে এবং ব্যষ্টিক প্রতিষ্ঠানকে রেয়াতি পন্থায় বা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের মাধ্যমে অর্থায়ন না করে, তবে হয়ত পূর্বোক্ত কাজগুলো করা সম্ভবপর হবে না। কিভাবে এগুলো করা সম্ভব তা পরিবর্তীতে আলোচনা করা হবে।
আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন
গ্রামীন খাত যে সকল প্রতিকূলতায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সেগুলো দূর করা ও গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন সাধন করা হলে কেবলমাত্র যে কৃষিক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হারে উৎপাদশীলতা বৃদ্ধি পাবে তাই নয়, বরং গ্রামীণ অর্থনীতির বহুমুখী বিকাশ ঘটবে এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক আত্ম-কর্মসংস্থান ও কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে। এতে শহর থেকে জনসংখ্যা গ্রামে স্থানান্তর হতে সাহায্য করবে এবং নগর জীবনের ভিড় ও দুষকৃতি হ্রাস পাবে। যদি এ সুযোগগুলো সরল জীবনযাপন প্রণালীর সাথে একত্রে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহেল গ্রামীণ অর্থনীতির বহুমুখীকরণকে অব্যাহত রাখা ও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে গ্রামের সমৃদ্ধি বিনিয়োগে রূপান্তরিত হবে। অর্থনৈতিক উৎপাদনের ফলে কৃষকেরা ইতিবাচকভাবে সাড়া দেবে তাতে সন্দেহ করার কোনো কারণ নেই। এতদসত্ত্বেও গ্রামীণ জনসাধারণের মনোভাব ও কর্মঅভ্যাসে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন হবে। এটি অধিকতর স্বল্প সময়ে অর্জন করা সম্ভব হবে যদি ইসলামকে সামাজিক পরিবর্তন ও সংশোধনের কৌশল হিসেবে গ্রহণ করা হয়। মসজিদগুলোকে গ্রামীণ জীবনে স্বাভাবিক দায়িত্ব পালনে সক্ষম করে তুললে কাঙ্ক্ষিত আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন সাধন ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করতে পারে।
বেকার ও আংশিক বা অপূর্ণভাবে কাজে নিয়োজিতদের জন্য নতুন ব্যবসা/পেশা
মাকাসিদ হাসিলের অন্যতম গঠনমূলক পন্থা হলো, মুসলিম দেশগুলোর জনশক্তিকে এমনভাবে দক্ষ ও উৎপাদনমুখী কাজে ব্যবহার করা, যাতে প্রত্যেক নারী ও পুরুষ তার সৃজনশলি ও শৈল্পিক যোগ্যতার পরিপূর্ণ ব্যবহার করতে সক্ষম হয়। যদি বিরাজমান উচ্চহারে অনিচ্ছাকৃত বেকারত্ব বা আংশিক কর্মে নিয়োজিতরা বহাল থাকে তবে, এ লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয়। বেকারত্ব এ এইধারা হ্রাস করার জন্য সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধি করা এবং মূলধননিবিড় বৃহদায়তন ও ব্যষ্টিক আয়তনের শহুরে শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করাকে কৌশল হিসেবে অবলম্বন করা হয়েছে।
চাহিদা সমপ্রসারণ সীমা
মোট চাহিদা সমপ্রসারণের প্রচলিত নীতি নিঃসন্দেহে প্রয়োজনীয়, কিন্তু এটি পর্যাপ্ত নয়। বরং একে অন্যান্য নীতিমালা দ্বারা শক্তিশালী করা দরকার। বর্তমানে সরকারের প্রচলিত নগরমুখী নীতিমালা, আয় ও সসম্পদের অত্যধিক বৈষম্য, পাশ্চাত্য জীবনযাপন প্রণালীর প্রদর্শনী- এ সকল নীতিমালা প্রধানত ধনাঢ্য ব্যক্তিদেরকেই সাহায্য করে এবং প্রদর্শনীমূলক ভোগের উদ্দেশ্যে দ্রব্য ও সেবার আমদানিতে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিচালিত হয়। শেষ পর্যন্ত এর পূর্ণ উপকারিতা দেশজ কারিগর ও শিল্পকর্মীগণের নিকট পৌঁছায় না। তাদের উৎপাদিত দ্রব্যের চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায় না এবং এর ফলে কর্মসংস্থান সমপ্রসারণের লক্ষ্য অর্জন বাধাগ্রস্ত হয়। অবশ্য যদি এ নীতি প্রকৃত প্রয়োজন পূরণ এবং ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক শিল্প উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে পরিচালিত হতো, তাহলে এর উপকারিতা ব্যাপকভাবে জনসাধারণের নিকট পৌঁছাতে সক্ষম হতো।
ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক প্রতিষ্ঠানের সম্ভাবনা
বৃহদায়তন মূলধননিবিড় প্রতিষ্ঠানসমূহ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর একটি ক্ষুদ্র অংশের চেয়ে বেশি জনগণকে সার্থকভাবে কর্মে নিয়োজিত করতে সক্ষম নয়। যেহেতু দরিদ্র মুসলিম দেশগুলোতে উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তি আছে, কিন্তু মুলধন ও বৈদেশিক মুদ্রার এবং জটিল প্রযুক্তি সম্পর্কে প্রশিক্ষণের শিক্ষাগত অবকাঠামোর অভাব রয়েছে, সেহেতু ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক শিল্পের দ্রুত বিকাশের মাধ্যমে আত্ম-কর্মসংস্থানের সুযোগ সমপ্রসারণ করা তাদের জন্য উত্তম হবে। ইমাম হাসান আল-বান্না ইসলামী আদর্শের আলোকে অর্থনৈতিক সংস্কার আলোচনায় কুটির শিল্পকে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দিয়েছে। তিনি মনে করেন, কুটির শিল্প দরিদ্র পরিবারের সকল সদস্যের জন্য উৎপাদনমুখী কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং বেকারত্ব ও দারিদ্র্য দূরীকরণে সহায়ক হবে। মুহাম্মদ ইউনুস ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক উদ্যোগের অনন্য বৈশিষ্ট্য এভাবে বর্ণনা করেন, ‘দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য মজুরি ভিত্তিতে নিয়োগ কোনো ভালো পন্থা নয়’ এবং আত্ম-কর্মসংস্থান ‘ব্যক্তিগত সম্ পদ ভিত্তিক উন্নয়নের মজুরিভিত্তিক নিয়োগ অপেক্ষা অধিকতর কার্যকর’। যেহেতু সকল জনশক্তিকে আত্ম-কর্মসংস্থানে নিয়োজিত করা সম্ভব হবে- এরূপ প্রত্যাশা করা যুক্তিযুক্ত নয়, সেহেতু মজুরিভিত্তিক নিয়োগ একদম বাদ দেয়া যাবে না। সুতরাং, এ বিষয়টি নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা চালাতে হবে, যাতে ইসলামী আদর্শ অনুযায়ী শ্রমিকগণ ন্যায্য মজুরি পায়, ভ্রাতৃসুলভ সম্মানজনক ও মানবিক আচরণ পায় এবং তাদেরকে যেন সৃজনশীল ও শৈল্পিক গুণাবলী বিকাশের সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে বৃহৎ যন্ত্রের চাকার মর্যাদায় অবনমতি করা না হয়। ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক প্রতিষ্ঠানে যত বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, মানবিক উদ্দেশ্য সাধনের সাফল্যের সম্ভাবনা ততই অধিক হবে।
সমপ্রতি এ সম্পর্কে সচেতনা সৃষ্টি হয়েছে যে, ‘বিগত দশক ধরে চলে আসা বৃহদায়তন আধুনিক শিল্পায়ন পদ্ধতি পৃথিবীর অনুন্নয়ন ও দারিদ্র্য সমস্যা দূর করতে ব্যর্থ হয়েছে’। মিচিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি কর্তৃক কয়েকটি দেশে পরিচালিত এক গবেষণায় সুস্পষ্টভাবে দেখা গেছে যে, কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধিতে ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক প্রতিষ্ঠান বিপুল অবদান দেখা গেছে যে, কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধিতে ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক প্রতিষ্ঠান বিপুল অবদান রাখতে সক্ষম। এগুলো কেবল প্রত্যক্ষভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে তাই নয়, বরং পরোক্ষভাবে আয়, দ্রব্য ও সেবার চাহিদা, যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের চাহিা এবং রপ্তানিও বৃদ্ধি করে। এগুলো শমঘন প্রতিষ্ঠান এবং এজন্য স্বল্প মূলধন ও স্বল্প বৈদেশিক মুদ্রা প্রয়োজন হয়। প্রাথমিকভাবে এ সকল প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিগত সঞ্চয় ও অব্যবহৃত আয়ের উপর নির্ভর করে এবং বৃহদায়তন শিল্পের তুলনায় সরকার ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ সুবিধা কম প্রয়োজন হয়। এগুলো নতুন পণ্য উদ্ভাবন করে, হারানো দক্ষতা ফিরিয়ে আনে এবং অর্থনীতিকে নতুন কর্মের দিকে পরিচালিত করতে সাহায্য করে। এ সকল প্রতিষ্ঠান ব্যাপক এলাকায় সমপ্রসারিত হতে পারে। ফলে ব্যক্তির কর্মক্ষেত্রে এবং গৃহের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষায় সাহায্য করে। কিন্তু বৃহদায়তন শিল্প প্রতিষ্ঠান ব্যাপক নগরায়ণ ও সামাজিক পরিবেশের উপর ক্ষতিকর অবদান রাখে। অধিককন্তু এ সকল প্রতিষ্ঠান অন্ততপক্ষে বৃহদায়তন শিল্পের মতা দক্ষতায় কাজ করতে সক্ষম। মিচিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, এ সকল প্রতিষ্ঠান সর্বাদাই বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠানের তুলনায় মূলধনের একক প্রতি অধিক উৎপাদন করে। লিটন, স্কিটভস্কি ও স্কট মন্তব্য করেছেন, “ক্ষুদ্র হস্তশিল্প ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠানের তুলনায় বৃহদায়তন আধুনিক শিল্প প্রতিষ্ঠান সাধারণত কম লাভজনক মূলধন ও স্বল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিবেচনায় অধিকতর ব্যববহুল। কতিপয় বিশেষজ্ঞ অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশে উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তি ও মূলধন ঘাটতি বিরাজমান থাকায় এ সকল দেশে বৃহদায়তন শিল্প আদৌ উপযোগী কিনা এ বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। সুতরাং, ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক প্রতিষ্ঠানকে ‘প্রবৃদ্ধি ও ইনসাফ- উভয় অর্জনের লক্ষ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বেসরকারি খাতের ভূমিকা বিকাশের ক্ষেত্রে একটি কার্যকর পন্থা’ হিসেবে ব্যাপকভাবে বিবেচনা করা হয়।
এমনকি ওইসিডি দেশসমূহ ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মসংস্থান সৃষ্টির সম্ভাবনা উপলব্ধি করতে পেরেছে। বিগত দশক ধরে এ দেশগুলোতে আনুপাতিক হারে অধিক নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং এসব শিল্পোন্নত দেশগুলোতে ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানসমূহ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে ও বেকারত্বের হার কমাতে অধিক সাফল্য অর্জন করেছে। ক্ষুদ্র শিল্প দীর্ঘদিন ধরে বণিক সম্প্রদায়ের নিকট অস্বীকৃত থাকেনি, বরং সকল মতাবলম্বী রাজনৈতিক ব্যক্তিগণই একে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করে থাকেন। ইটালিতে কারিগরবৃন্দ প্রধানত পারিবারিক ব্যবসায় নিযুক্ত থাকেন এবং এটি ইটালীর অলংকার, স্বর্ণ, রৌপ্য, চামড়া শিল্প, নকশা, কাঁচের কাজ, আসবাবপত্র, মৃৎশিল্প, জুতা তৈরি ও পোশাক শিল্পের মতো খাতগুলোর উন্নয়নের পশ্চাতে প্রধান কারণ হিসেবে অবদান রেখেছে। জার্মানীতে পারিবারিক মালিকানাভুক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ অর্থনীতিতে একটি প্রধান ভূমিকা পালন করেছে এবং সেখানে ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে নতুনভাবে সচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে।
জাপানের রপ্তানি সাফল্যের গুরুত্বপূর্ণ কারণ হরো তাদের অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতার শক্তি। জাপানের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কাজের উল্লেখযোগ্য অংশ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীগণকে সাব-কন্ট্রাক্ট প্রদানের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করেছে। জাপানের অভ্যন্তরীণ বাজারেও ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানসমূহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রতিষ্ঠানসমূহ জাপানের মোট শিল্প-উৎপাদনের 50% উৎপাদ কর এবং 75% কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে থাকে। জাপানে এখনো খুচরা বিক্রয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিশেষত্ব প্রাপ্ত খুচরা বিক্রেতা ও পারিবারিকভাবে পরিচালিত ক্ষুদ্র দোকানের মাধ্যমে সমপ্রাদিত হয়। এগুলো আইনের দ্বারা সংরক্ষিত। এ ব্যবস্থা এবং ব্যাপক লভ্যাংশে অংশগ্রহণ পদ্ধতির (profit-sharing system) কারণেই সম্ভবত শিল্পেন্নত দেশগুলোর মাধ্যে জাপানের বেকারত্বের হার সবেচেয়ে কম। যে সকল উন্নত দেশে ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান ঐতিহ্যগতভাবে দুর্বল, সে সকল দেশে বেকারত্বের হার বেশি। এজন্য ঐ সকল সরকারসমূহ ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানের নিকাশে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। ফলে ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের জন্য সরকারি ও বেসরকারি খাতে বহু উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
উৎপাদনের বিক্রেন্দীকরণ এবং কম মূলধননিবিড় ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক প্রতিষ্ঠানের বিকাশ সম্ভবত মুসলিম দেশসমূহে গ্রামীণ ভূমিহীনদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে লাভজনকভাবে কর্মে নিয়োগ করার ক্ষেত্রে সর্বাধিক কার্যকর পন্থা। শুধু তাই নয়, স্বল্পভূমির মালিকানা বিশিষ্ট পরিবারসমূহের কর্মে আংশিকভাবে নিয়োজিত সদস্যদেরকেও (স্বামী, স্ত্রী, মাতাপিতা, সন্তান) লাভজনকভাবে কাজে নিয়োগ করার জন্যও এটি শ্রেষ্ঠ পন্থা। এ নীতি হবে পূর্বের আলোচিত কৃষি সংস্কারের পরিপূরক এবং গ্রাম উন্নয়নে সহায়ক। এ দ্বারা গ্রামীণ জনগণের আয় এবং উন্নত বীজ, সার ও প্রযুক্তি ক্রয়ের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। এর দ্বারা কৃষি উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া গ্রাম থেকে শহরে জনসংখ্যা স্থানান্তর হ্রাস পাওয়ায় পারিবারিক সংহতি রক্ষা পাবে এবং নৈতিক উন্নয়ন ও দুষকৃতি কমানে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যসমূহের মধ্যে একটি অন্যতম। অন্যান্য উন্নয়নশলি দেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলোও তাদের উপনিবেশিক প্রভুরদেরকে সমালোচনা করে যে, তারা সমাজের সকল ভিত্তি ও সূত্র পদ্ধতিগতভাবে ধ্বংস করেছিল। কিন্তু তারা স্বাধীনতা লাভের পর ধ্বংসপ্রাপ্ত দক্ষতা ও হস্তশিল্প কৌশল পুনরুদ্ধারের জন্য কমই প্রচেষ্টা চালিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক প্রতিষ্ঠানকে অবদমন করা এবং ব্যাপক সংরক্ষণ সুবিধা, উদার আমদানি লাইসেন্স, রেয়াতি আর্থিক সুবিধা, ভর্তুকি মূল্যে উপকরণ প্রদান ও কর রেয়াতের সময় দেয়ার মাধ্যমে বৃহদায়তন শিল্প ও বাণিজ্যকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এ মন্তব্য এমন বৃহদায়তন শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো রায় নয়, যেগুলো অর্থনীতির বিশেষ বিশেষ খাতে অপরিহার্য। যেক্ষেত্রে প্রয়োজন সে ক্ষেত্রে এগুলো উৎসাহিত করা ও প্রতিষ্ঠিত করা উচিত, তবে শর্ত এটাই যে এগুলোর ব্যয় অপেক্ষা আর্থ-সামাজিক সুফল অবশ্যই অধিক হতে হবে এবং স্থায়ী ও ব্যাপক সংরক্ষণ ব্যবস্থা প্রয়োজন হবে না।
ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন
কিন্তু দেশের সকল স্থানে কিভাবে ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক শিল্পের বিকাশ উৎসাহিত করা সম্ভব? এজন্য আর্থ-সামাজিক পরিবেশে অনেকগুলো বৈপ্লবিক পরিবর্তন প্রয়োজন। প্রথমত, জীবনযাপনের ধরনে এমন পরিবর্তন আনতে হবে, যা মর্যাদার প্রতীকরূপী আমদানি দ্রব্য থেকে মুক্ত এবং দেশে উৎপাদিত; সাধারণ পণ্যের প্রতি আসক্ত যেগুলো প্রকৃত প্রয়োজন পূরন করে ও ব্যাপকহারে শ্রমশক্তি ব্যবহার করে। দ্বিতীয়ত, সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি ও নীতিমালা ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে পরিবর্তন করতে হবে যাতে সেগুলোকে অদক্ষ ও ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে পরিবর্তন করতে হবে যাতে সেগুলোকে অদক্ষ ও ক্ষুদ্র বিবেচনায় বাতিল করা না হয় এবং অতীতের ন্যায় যুগের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ অভিহিত করে পরিত্যাগ করা না হয়। বরং তাদের বিপুল সম্ভাবনাকে পরিপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করতে উৎসাহ দান ও সহযোগিতা করতে হবে। তৃতীয়ত, এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে উত্তম উপকরণ, উপযুক্ত প্রযুক্তি কার্যকর বাজারজাতকরণ কৌশল ও অন্যান্য সমপ্রসারণমূলক সেবাসমূহ সংগ্রহে সাহায্যের মাধ্যমে বৃহদায়তন শিল্পের উৎপাদিত ও আমদানিকৃত দ্রব্যের সাথে মান ও মূল্যে প্রতিযোগিতা করার উপযুক্ত করে তুলতে হবে। চতুর্থত, উত্তম প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের কর্মকুশলতা উন্নত করতে সক্ষম করে তুলতে হবে। এজন্য কর্মকুশলতা প্রকৃত চাহিদা ও প্রদত্ত শিক্ষার মধ্যকার বৈসাদৃশ্য দূর করার জন্য শিকষা প্রতিষ্ঠানসমূহের পূর্ণায্গ পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন। পঞ্চমত, তাদের অর্থায়নের সুযোগ প্রদান করতে হবে, কারণ এদের উন্নয়নে অর্থায়নের অভাবই সবচেয়ে বড় বাধা। সবশেষে, বর্তমানে প্রচলিত বৃহদায়তন শিল্পের প্রতি ঝোঁক যদি সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী করা সম্ভব না হয় তবে বিলুপ্ত করতে হবে। কারণ ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক প্রতিষ্ঠানের সমপ্রসারণে এটি অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধকতা।
যদি ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে কার্যকরভাবে প্রতিযোগিতায় সক্ষম করে তোলার লক্ষ্যে অধিকতর দক্ষ প্রযুক্তি অর্জনে সাহায্য করা না হয়, তাহলে তাদের মাধ্যমে আমদানি বিকল্প ও রপ্তানি বৃদ্ধির উদ্দেশ্য অর্জিত নাও হতে পারে। যাই হোক, যদি এ প্রযুক্তি সহজ হয় তবে ভালো। কারণ এতে নিম্নোক্ত সুবিধাসমূহ পাওয়া যাবে। এতে স্বল্প মূলধন বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে। এভাবে ক্রমবর্ধমান শ্রমশক্তিকে স্বল্প মূলধন বিনিয়োগ কাজে নিয়োজিত করা যাবে। এতে উচ্চ দক্ষতার চাহিদা সর্বনিম্ন করবে এবং মুসলিম দেশগুলোর দক্ষতা কারিগরী দক্ষতার তুলনামূলক নিম্নমানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। এতে স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য সামগ্রীর ব্যাপক ব্যবহার সম্ভব হবে এবং বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা হ্রাস পাবে। স্থানীয়ভাবে এর উন্নয়ন ও উৎপাদন করা সম্ভব হবে। ফলে আমদানিকৃত প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস পাবে। এ প্রতিষ্ঠানসমূহ ছোট শহর ও পল্লী অঞ্চলেও চালু হতে পারবে। ফলে মূলধননিবিড় ও জটিল প্রযুক্তিসম্পন্ন বৃহদায়তন শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহ যে সকল সমস্যা সৃষ্টি করে সেগুলো হ্রাস পাবে। যেমন ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক প্রতিষ্ঠানসমূহের বিস্তৃতি দ্বারা আঞ্চলিক আয়ের ব্যবধান কমে আসবে এবং কতিপয় বৃহৎ শহরে জনসংখ্যার কেন্দ্রীকরণ সর্বনিম্ন হবে। স্যুমাখার এর ভাষায় এটি হলো, technology with a human face. এরূপ সহজ ও কম ব্যয়বহুল প্রযুক্তির মধ্যে ‘অনুন্নত দেশগুলোর উৎপাদনশীলতা অতি দ্রুত বৃদ্ধি’ করার মতো সম্ভাবনা নিহিত রয়েছে। সুতরাং, এর দ্বার কেবল আয় ও জীবনযাপনের মানই বৃদ্ধি পাবে না, বরং সম্পদের পুনর্বণ্টনও এর দ্বারা সাধিত হবে।