দ্বাদশ অধ্যায়ঃ উপসংহার
দ্বাদশ অধ্যায়
উপসংহার
হে বিশ্বাসীগণ! আল্লাহর দিকে তাঁর রাসূলের ডাকে সাড়া দাও যখন তিনি তোমাদের সেদিকে আহবান করেন যা তোমাদেরকে জীবন দান করবে।
আল কোরআন ৮:২৪
যদি শহরের লোকগুলো কোলমাত্র বিশ্বাস করত এবং সে অনুসারে জীবনযাপন করত, তাহলে আমরা তাদের জন্য জান্নাত ও দুনিয়ার আশাবাদের দুয়ার খুলে দিতাম।
আল কোরআন ৭:৯৬
আমরা কঠিন সময়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি এবং এ ব্যাপারে খুব বেশি কিছু করার নেই। স্বল্পমেয়াদী ব্যবসাচক্র সম্বদ্ধে বিতর্কের মতো ভাসাভাসা বিষয়সমূহ অথবা রিপাবলিকান বনাম ডেমোক্রেটিক রাজনৈতিক দর্শন অথবা আয়কর নীতিতে পরিবর্তনের দৃষ্টিভঙ্গিকে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন করতে পারে না।
জে ফরেস্টার
Paradox: হেঁয়ালি
মুসলিম দেশগুলো যে চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করছে তা হলো, তাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও প্রত্যেক মানুষের জন্য ‘ফালাহ’ ও ‘হায়াতে তাইয়্যিবা’র ইসলামী দর্শন বাস্তবে রূপদান করা। এর জন্য কেবলমাত্র নৈতিক উন্নয়নেরই প্রয়োজন নয়, সেই সাথে প্রয়োজন ভ্রাতৃত্ব ও আর্থ-সামাজিক ন্যায়বিচার। আর তা অর্জন করা ততক্ষণ পর্যন্ত সম্ভব নয়, যতক্ষণ না দুর্লভ সম্পদ দারিদ্র্য দূরীকরণ, চাহিদা পূরণ এবং আয় ও সম্পদের বৈষম্য নিম্নতম পর্যায়ে নিয়ে আসায় ব্যবহৃত হয়। এর পরিবর্তে মুসলিম দেশগুলো অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশের মতো বিশ্ব অর্থনৈতিক ও বহিস্থ ভারসাম্যহীনতার এক কঠিন গোলকধাঁধায় নিপতিত হয়েছে। ফলে তারা লক্ষ্যের নাগালের কাছাকাছি পৌঁছুতে পারছে না। এ গ্রন্থে একথা বলার চেষ্টা করা হয়েছে যে, পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র ও কল্যাণ রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির আওতায় তারা যে নীতি অনুসরণ করে আসছে, এ পরিস্থিতি হচ্ছে তারই যৌক্তিক পরিণতি। যদি তা না হতো তাহলে যেসব দেশ এসব পদ্ধতি অনুসরণ করছে, তারা তাদের জনগণের জন্য উন্নত জীবনের নিশ্চয়তা দিতে সক্ষম হতো। কিন্তু তারা তা পারেনি। এটাই হচ্ছে সম্পদের হেঁয়ালি। ‘ধনী দেশ মাত্রই গরীব দেশের চেয়ে সুখি নয়’-রিচার্ড ইস্টারলিন ১৯টি উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে ৩০টি গবেষণার মাধ্যমে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছান। তাই ডাহরেনডরফ এর যুক্তিসংগত জিজ্ঞাসা-‘চার দশকের শান্তি ও সমৃদ্ধির পরেও ধনী সমাজের এত লোক কেন অসুখি; সেখানে কেন এরকম এত কষ্ট, শুধু অর্থের অভাবে নয় বরং প্রাচুর্যের মধ্যে রয়েছে বিচ্ছিন্নতাবোধ ও বিশৃঙ্খলা’।
দু’টি কারণ
এ হেঁয়ালির দু’টি প্রাথমিক কারণ আছে। প্রথমত, সুখ বস্তুগত উন্নতি ও শারীরিক পরিতৃপ্তি থেকে আসে বলে পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র ও কল্যাণ রাষ্ট্রের সেকুলার মতাদর্শগুলো খুব জোর দিয়ে যা বলেছে তা সঠিক নয়। দ্বিতীয়ত, সম্পদের বস্তুগত কল্যাণও অর্জন করা সম্ভব নয়, যতক্ষণ লভ্য সম্পদ দক্ষতা ও ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে ব্যবহৃত না হচ্ছে।
আজকাল একথা সাধারণভাবে স্বীকৃত যে, সুখ হচ্ছে মনের প্রশান্তির প্রতিফলন (কোরআনের ভাষায় আল নাফ্স আল-মুত’মা ইন্নাহ: ৮৯:২৭) যা কেবল তখনই অর্জন করা সম্ভব, যখন কোনো মানুষের জীবন তার আত্মিক প্রকৃতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়। এটা ঘটে যখন তার ব্যক্তিত্বের আধ্যাত্মিক ও বস্তুগত চাহিদা পর্যাপ্তভাবে পরিতৃপ্ত হয়। যেহেতু বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক সত্তা পৃথক নয়, ঈপ্সিত পরিতৃপ্তি তখনই সম্ভব, যখন সকল বস্তুগত লাভ-লোকসানের পিছনে আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্য ক্রিয়াশীল থাকে।
সম্পদের সীমাবদ্ধতার প্রেক্ষিতে সমাজের সকল সদস্যের চাহিদা পূরণ সম্ভব নয়, যতক্ষণ না সম্পদের অপব্যবহার নির্মূল বা কমিয়ে ফেলা যায় এবং অন্যায়ের উৎস সকল আর্থ-সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সংশোধন হয়। তবে এটাও সম্ভব হবে না, যদি প্রত্যেক মানুষ সম্পদ ব্যবহারে সামজিক অগ্রাধিকারকে অবজ্ঞা করে এবং কেবল তাদের আর্থিক সংগতি ও ব্যক্তিগত সুযোগ সুবিধাকে বিবেচনায় আনে। অতএব প্রত্যেককেই উদ্বুদ্ধ করতে হবে যাতে সম্পদ ব্যবহারে সামাজিক অগ্রাধিকার চিহ্নিত করা হয় এবং সে অগ্রাধিকারের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ আচরণ সম্পর্কে সে সচেতন থাকে। তাকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে হবে যাতে নিজের কল্যাণ্যের চেষ্টা চালানোর সময় অন্যদের ‘কল্যাণের’ ব্যাপারেও চিন্তুা করে। এ ধরনের জবাবদিহিদা ছাড়া সহায়ক আর কী হতে পারে। এমন ধরনের শৃঙ্খলার একটি কাঠামোর আওতায় বস্তুগত সম্পদ তাদের নিজেদের কোনো মূল্য বহন করে না। হাদের মূল্য ততক্ষণই থাকে, যতক্ষণ তারা মূল্যবোধ ব্যবস্থার বর্ণনা অনুসারে সৃষ্টির লক্ষ্য পূরণ করে। এ ধরনের মনোভাব দুর্লভ সম্পদ ব্যবহারে একটি স্বয়ংক্রিয় বাধা সৃষ্টি করে, যে বাধা অপ্রয়োজনীয় দাবি সর্বনিম্ন পর্যায়ে কমিয়ে আনে এবং দুষ্প্রাপ্যতা সত্ত্বেও সকলের প্রয়োজন পূরণ সম্ভব করে তোলে। আর এভাবেই মানব ভ্রাতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়। এতে সামাজিক বন্ধন শক্তিশালী হয় এবং সামাজিক অস্থিরতা ও অপরাধ হ্রাস পায়।
নৈতিক আবেদনের অনুপস্থিতিতে বস্তুগত সম্পদ অর্জন ও চাহিদা পূরণই একমাত্র লক্ষ্য হয়ে থাকে। পরিতৃপ্তি তখন আর চাহিদা পূরণের বিষয় থাকে না। বরং তার চেয়ে বেশি অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা, জাঁকজমক ও সকলকে ডিঙ্গিয়ে এগিয়ে যাওয়ার আদর্শ আচরণ ধারায় পরিণত হয়। তবে দৃষ্টি আকর্ষক ভোগ কেবল অস্থায়ী পরিতৃপ্তি দেয়। জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছাড়া ফ্যাশন ও মডেল একটির পরিবর্তে আরেকটি শূন্যতার অবতারণা করে। জোর কেনাকাটা চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রত্যেকেই সৎ বা অসৎ পথে সম্পদ অর্জনে প্রতিনিয়ত ব্যস্ত। পরিবার বা বন্ধু-বান্ধবের প্রতি দায়িত্ব পালনের ইচ্ছা সময়ের উপরে চাপ সহ্য করার ক্ষমতার গণ্ডি ছাড়িয়ে যায়। ফলে মনের শান্তি ব্যাহত হয়। উৎপাদনের সমগ্র যন্ত্র ঐ বেশি পরিমাণ চাহিদার পরিতৃট্তি ঘটাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পরিচালিত হয়। যদি ব্যাংকব্যবস্থা সহযোগীর ভূমিকা পালন করে, তবে মানুষ তার আয়ের চেয়েও বেশি ব্যয় করতে সক্ষম হয়। অতএব সম্পদের চাহিদা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়, ভারসাম্যহীনতা বাড়ে এবং এ সংগ্রামে যারা সমানতালে চলতে পারে না তারা পিছিয়ে পড়ে। দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক বৈষম্য উর্ধ্বমুখী হয়। প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্য ক্রমাগত ব্যাহত হয়। অসন্তোষ ও সামাজিক অস্থিরতা আরো বৃদ্ধি পায় এবং বিশৃঙ্খলা ও বিচ্ছিন্নতাবোধ ব্যক্তিগত ও সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়।
ভবিষ্যতের কর্মসূচি
শিল্পোন্নত দেশগুলো যে সমস্যার সম্মুখীন, মুসলিম দেশগুলোর সমস্যা তার চেয়ে আরো বেশি কঠিন। তাদের সম্পদ আরো দুর্লভ। তাদের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ও বৈদেশিক ভারসাম্যহীনতা হ্রাসের জন্যে সামগ্রিক চাহিদা হ্রাসের প্রয়োজন। মাকাসিদ অর্জন করতে হলে এর বিপরীত অবস্থানের প্রয়োজন-তা হলো কতিপয় অপরিহার্য অথচ অবহেলিত লক্ষ্যের জন্য বর্ধিত ব্যয়। মুসলিম দেশসমূহের সামনে চ্যালেঞ্জই হচ্ছে কিভাবে এ সংঘাতের সমাধান করা সম্ভব। ব্যর্থ কর্মকৌশল অনুসরণ করে তারা সাফল্যজনভাবে এ চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে পারে না, ব্যর্থ কর্মকৌশল শুধু ব্যর্থতার দিকেই নিয়ে যায়।
মুসলিম দেশগুলোর যা করা প্রয়োজন, তা হলো নিজস্ব কর্মকৌশল উদ্ভাবন, যা ‘হায়াতে তাইয়্যেবা’র দাবি অনুসারে দুষ্প্রাপ্য সম্পদ দক্ষতা ও ন্যায়পরতার সঙ্গে বিতরণে তাদেরকে সাহায্য করে। এটি তাদেরকে অন্য দেশের জন্য যোগ্য উদাহরণ ‘কুদওয়াহ হাসানাহ’ হওয়ার নৈতিক বাধ্যবাধকতা পূরণে সাহায্য করবে। এটি এমন উদাহরণ যা তারা তাদের আর্থ-সামাজিক সমস্যা সমাধানে অনুসরণ করতে পারে। যে কর্মকৌশল উন্নয়ন করতে হবে, তাতে যে তিনটি উপাদান থাকতে হবে সেগুলো নিয়ে এ বইয়ের সকল আলোচনা আবর্তিত হয়েছে। যেমন: (ক) সমাজসম্মত বিশোধক কর্মপদ্ধতি যা দিয়ে অদক্ষ অন্যায় ব্যবহার থেকে দুর্লভ সম্পদের দক্ষ ও ন্যায়ভিত্তিক ব্যবহার আলাদা করা যায়; (খ) এ বিশোধক কর্মপদ্ধতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে এসব সম্পদ ব্যবহারে প্রত্যেক ব্যক্তিকে প্রবৃত্ত করার জন্য উদ্বুদ্ধকারী ব্যবস্থা; এবং (গ) হায়াতে তাইয়্যেবার দাবি অনুসারে সম্পদ বিতরণ ও পুনর্বণ্টনের লক্ষ্যে উপর্যুক্ত দুটি উপাদানকে জোরদার করার জন্য আর্থ-সামাজিক পুনর্গঠন।
ব্যর্থ কর্মকৌশলসমূহ
ধনতন্ত্র
সম্পদ বরাদ্দে দক্ষতা ও ন্যায়পরায়ণতা অর্জন এবং সার্বিক চাহদা ও সরবরাহের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য বিশোধক কর্মপদ্ধতি ও উদ্বুদ্ধকারী শক্তি হিসেবে মূলত মূল্য ও ব্যক্তিগত মুনাফার উপর ভর করা ছাড়া ইহুদী-খৃস্টিয় মূল্যবোধ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর ধনতন্ত্রের কোনো গত্যন্তর ছিল না। যুক্তি দেখানো হয় যে, বাজার-নির্ধারিত মূল্য শুধু সার্বিক চাহিদাই নিয়ন্ত্রণ করে না, অসমতার সঙ্গে মুনাফাকে প্রভাবিত করার মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত কম লাভজনক ক্ষেত্র থেকে অধিকতর লাভজনক ক্ষেত্রে সম্পদ স্থানান্তর করে। দাবি করা হয় যে, বাজার শক্তিসমূহের মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে আনীত চাহিদা ও সরবরাহের এ সমন্বয় একটি নতুন ভারসাম্য সৃষ্টি করে এবং এতে সরকারি হস্তক্ষেপ বা মূল্য বিচারের প্রয়োজনীয়তা ছাড়াই সর্বোচ্চ দক্ষতা ও ন্যায়পরায়ণতা অর্জন করা যায়।
সম্পদ বরাদ্দের একমাত্র কর্মকৌশল হিসেবে মূল্য পদ্ধতির ব্যবহার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা রক্ষা করে, তবে আয় ও সম্পদের সমবণ্টন ও নির্ভেজাল প্রতিযোগিতাসহ কতিপয় পূর্বশর্ত পূরণ না হলে দক্ষতা ও ইনসাফ অর্জন সম্ভব হয় না। যেহেতু এসব শর্তসমূহ স্বাভাবিক অবস্থায় পূরণ হয় না এবং হতে পারে না, সেহেতু ব্যক্তিগত অগ্রাধিকার অনুসারে চাহিদার সর্বোচ্চ পরিতৃপ্তির স্বাধীনতা দুর্লভ সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ধনীদের অধিকতর প্রভাব বিস্তারের সুযোগ করে দেয়, যদিও সম্পদের উপর তাদের দাবি নিয়ন্ত্রণ করতে মূল্য ছাড়া আর কোনো কর্মপদ্ধতি ব্যবহৃত না হয়। চাহিদার সর্বোচ্চ পরিতৃপ্তির দ্বন্দ্ব থেকে সৃষ্ট সম্পদের উপর চাপের ফলে সকল প্রকার জিনিস ও সেবার তুলনামূলক উচ্চ মূল্য অর্থনীতিতে একটি ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার প্রবণতা সৃষ্টি করে। এ উচ্চ মূল্য প্রয়োজন পূরণের জন্য যেসব জিনিস ও সেবা আছে তার ক্ষেত্রে ঘটে।
ধনীরা যখন যা ইচ্ছা তা পয়সা দিয়ে কিনতে পারে। কিন্তু গরীবরা সাধারণত তাদের অপর্যাপ্ত আয় নিয়ে মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সমতালে চলতে পারে না। এভাবে প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবায় মূল্য পরিশোধে তাদের ক্ষমতা আরো হ্রাস পায়। ফলে চাহিদা পূরণ অপর্যাপ্ত থেকে যায়। এতে তাদের দক্ষতা ও বঞ্চনার অভিশপ্ত চক্রে আরো বেশি আবদ্ধ হতে হয়। যদি ভারসাম্যহীনতা অপসারণে ও সম্পদ বিতরণে কেবলমাত্র মূল্য পদ্ধতির উপর নির্ভর করা হয়, তাহলে আয় ও সম্পদের বৈষম্য যত বেশি হবে, গরীবদের চাহিদা পূরণ থেকে সম্পদ অন্যত্র অপসারণে ধনীদের ক্ষমতা তত ব্যাপক হবে। গতানুগতিক সুদভিত্তিক ব্যবস্থায় এ অবস্থার আরো অবনতি ঘটে। কারণ এ ব্যবস্থা সমাজের সঞ্চয়সমূহ প্রধানত ধনীদের কাছেই দেয়া হয়, কেননা তারা জামানত দিতে পারে। ফলে তারা আরো ধনী ও আরো ক্ষমতাধর হয় এবং প্রয়োজন পূরণ থেকে দুর্লভ সম্পদ আরো দূরবর্তী স্থানে সরিয়ে নিতে পারে। প্রত্যেক সমাজেই যেখানে সম্পদের অসম বিতরণ বিরাজ করছে, সেখানে ন্যায়ভিত্তিক বিতরণ ব্যবস্থা চালু করার যে কোনো উদ্যোগ ধনীদেরকে আহত করতে বাধ্য। ধনীরা কেন ‘প্যারেটো অপটিমালিটি’ শক্তির প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ একটি সেকুলার, মূল্যবোধমুক্ত সমাজে খারাপ থাকতে রাজি হবে? অন্যদের কল্যাণের স্বার্থে অপেক্ষাকৃত খারাপ থাকতে তাদের উদ্বুদ্ধকরণের জন্য সমাজসম্মত মূল্যবোধ, যার প্রতি প্রত্যেকেই নিবেদিত থাকবে, কেবল প্রয়োজন তাই নয়, বরং এমন একটি উদ্বুদ্ধকারী ব্যবস্থা দরকার, যাতে তাদেরকে যে ত্যাগ স্বীকার করতে বলা হচ্ছে, তার একটি আকর্ষণীয় প্রতিদান নিশ্চিত করা যায়।
সেকুলার মতবাদ যদি নীতিনির্ধারক দর্শন হয় তবে সমাজসম্মত মূল্যবোধ পাওয়া সম্ভব নয়। সেকুলার মতবাদ যা করে তা হচ্ছে, ধর্ম প্রদত্ত সামষ্টিক বিধিনিষেধের মূল্যবোধ থেকে বঞ্চিত করা। এ ধরনের বিধিনিষেধ ছাড়া কোনো সমাজ বা রাষ্ট্রের পক্ষে একটি সামাজিক ঐকমত্যে পৌঁছানো কঠিন। আর এ ঐকমত্য দুর্লভ সম্পদ ব্যবহারে সেসব সামাজিক অগ্রাধিকারের একটি পর্যায়ে লক্ষ্য ও মূল্যবোধ উপনীতকরণে প্রয়োজন, সে অগ্রাধিকার জনগণ তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও মেনে নিতে প্রস্তুত। উপরন্তু সেকুলার মতবাদের স্বল্পমেয়াদী, ইহজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা এবং ইন্দ্রিয় পরিতৃপ্তিই মানব জীবনের প্রাথমিক লক্ষ্য বলে বিবেচিত হয়। যদি সে ইহজাগতিক আত্মস্বার্থ ছাড়া অন্য কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে, তবে তার পক্ষে অপেক্ষাকৃত খারাপ থাকতে সম্মত হওয়া যুক্তিসম্মত হবে না।
পুঁজিবাদ যদিও বহিরাবরণে ধর্মের মানবিক লক্ষ্যসমূহ অবুণ্ণ রাখে, কিন্তু কর্মকৌশলের কারণে তাকে গুলিয়ে ফেলেছে। দুর্লভ সম্পদ বিতরণ ও বণ্টনে নৈতিক মূল্যবোধের ভূমিকা মূল্য পদ্ধতির উপর প্রাথমিক নির্ভরতা ও ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের উপর অসংগত গুরুত্ব প্রদানের ফলে ভোঁতা হয়ে গেছে। এভাবে বাজার শক্তির অন্ধ সক্রিয়তা যত রকমের বৈষম্য সৃষ্টি করতে সক্ষম, তা করার বাধাহীন সুযোগ পেয়েছে। লক্ষ্য ও কর্মকৌশলের মধ্যে সংঘর্ষ এভাবে মানবতাবাদী নিষ্পাপ ছদ্মাবরণে সামজিক দ্বান্দ্বিকতার জন্ম দিয়েছে।
এভাবে বাজারব্যবস্থার কর্মকৌশল ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের সুযোগ প্রদান করে। ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা এবং উচ্চতর প্রবৃদ্ধির হার অর্জনে সক্ষম হলেও সামাজিক স্বার্থ পূরণ করতে সক্ষম হবেনা, যদি ব্যক্তিগত স্বার্থ ও সামজিক স্বার্থ এক না হয়। এতে আংশিকভাবে বোঝা যায় যে, বাজারব্যবস্থা কেন দক্ষতা ও ন্যায়পরতা উভয় মানদণ্ডে ব্যর্থ হয়েছে। এ ব্যবস্থা তার নিজের শক্তিবলে সকলের প্রয়োজন পূরণ করতে পারে কোথাও তেমন আকারের পণ্য ও সেবা উৎপাদন
অথবা আয় ও সম্পদের ইনসাফ ভিত্তিক বিতরণ করতে সক্ষম হয়নি। অতএব
কেউ একথা বলতে পারে যে, সেকুলার মতবাদ যে নৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি করেছে, তার ফলে বাজারব্যবস্থার পক্ষে পূর্ণ বণ্টনসহ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে না, যতক্ষণ না সার্বিক পটভূমির পরিস্থিতি সৃষ্টিতে শক্তি প্রয়োগ করা হয়, যেমনটি দখলদার বিদেশী শক্তি জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানে করেছিল। এমনকি এ ধরনের ক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্য স্বল্প হতে পারে, যদি তা টিকিয়ে রাখার জন্য একটি কর্মকৌশল অনুসৃত না হয়।
সমাজতন্ত্র
কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পিত অর্থনীতিসমূহের সাফল্য উল্লেখযোগ্যভাবে খুব ভালো কিছু নয়। একটি স্বল্পমেয়াদী জীবনমুখী সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও মুনাফার প্রেষণার অবলুপ্তি ব্যক্তিগত উদ্যোগ, প্রেরণা ও সৃষ্টিশীলতা বিনষ্ট করে। এতে দক্ষতা হ্রাস পায় এবং অর্থনীতির সরবরাহের দিকটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা ও যৌথ মালিকানা সাম্য বিস্তারেও সফল হয় না, বরং তা পলিটব্যুরোর গুটিকতক সদস্যের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে। এটা এমনকি একচেটিয়া ধনতন্ত্রের চেয়েও খারাপ। ধনতন্ত্রে সম্পদ ও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ হয় বটে, তবে তা সমাজতন্ত্রে মতো এত কঠোর নয়, কারণ সাধারণ বাজারের বিকেন্দ্রীকৃত প্রকিয়ায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ হয়ে থাকে। তাছাড়া সমাজতন্ত্রী ব্যবস্থার সহজাত সেকুলার ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তাকে সমাজসম্মত মূল্যবোধ থেকে বঞ্চিত করে। নৈতিক মূল্যবোধ ও মূল্যব্যবস্থা উভয়ের অনুপস্থিতিতে সম্পদ বরাদ্দের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য একমাত্র যে বিশোধক কর্মপদ্ধতি অবশিষ্ট থাকে, তা হচ্ছে ক্ষমতাধর পলিটব্যুরো সদস্যদের ব্যক্তিগত খেয়াল। এভাবে এ ব্যবস্থায় ধনী ও উচ্চপদস্থ লোকেরা যা চায় তাই করার সুযোগ পায়, যেমন পায় পুঁজিবাদী দেশগুলোতেও। অথচ গরীব লোকেরা তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণেও অসুবিধার সম্মুখীন হয়। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে, একনায়ক ব্যবস্থাসমূহ বস্তুগত বঞ্চনা ও মানবিক দু্র্ভোগের সৃষ্টি করেছে এবং প্রায় প্রত্যেক স্থানেই গণবিদ্রোহে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে।
কল্যাণ রাষ্ট্র
বাজারব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করে কল্যাণ রাষ্ট্র মূল্য পদ্ধতির সঙ্গে বেশ কয়েকটি পদ্ধতি, বিশেষত সাম্য নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র কর্তৃক কল্যাণ ব্যয় একত্র করার চেষ্টা করেছে। মূল্যবিচার এবং প্যারিটো অপটিমালিটির স্ব-আরোপিত মানদণ্ডের বিরুদ্ধে বিতৃষ্ণার প্রেক্ষাপটে প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয়-এ দুটির মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টি করা বা আর্থিক সংগতি পরীক্ষা পদ্ধতি ব্যবহারের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কল্যাণ রাষ্ট্র সরকারি খাতে বর্ধিত ব্যয়ের মাধ্যমে ধনী-গরীব সবার জন্য কল্যাণমূলক সেবা প্রদানের চেষ্টা করেছে। প্রথমে তা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে এই বলে যে, বরাদ্দ ও বিতরণ উভয় সমস্যারই সার্বিক সমাধান করা হয়েছে। আসলে সমস্যাগুলোর সমাধান হয়নি; কাজটির জন্য কর্মকৌশলটি ছিল অপর্যাপ্ত। সরকারি খাতে বর্ধিত ব্যয়ের পাশাপাশি সম্পদের উপর অন্যান্য দাবি হ্রাসের মতো ব্যবস্থা না থাকায় করের ভারী বোঝা সত্ত্বেও বাজেট ঘাটতি বৃদ্ধি পায়, যেহেতু ভোক্তা সংস্কৃতি একই সাথে বেসরকারি খাতের ব্যয় বৃদ্ধি ঘটায় সেহেতু বেসরকারি খাতে তার সমন্বয়ের জন্য কোনো সঞ্চয় বৃদ্ধি ঘটেনি। বরং আনুপাতিকভবে মজুদ ব্যাংকব্যস্থায় মুদ্রার অত্যধিক সম্প্রসারণ ঘটেছে। এ ব্যাংকব্যবস্থায় সরকারি ও বেসরকারি খাত যত বেশি ঋণ নিতে আগ্রহী, তত বেশি ধার দেয়া হয় জামানত ও নিম্নস্তরের ঝুঁকির ভিত্তিতে এবং সেক্ষেত্রে ঋণের অর্থ কী কাজে ব্যয় করা হবে, তার প্রতি কোনো তোয়াক্কা করা হতো না। এভাবে সম্পদের উপর দাবির আরো অবনতি ঘটেছে এবং অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক ভারসাম্যহীনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এতদসত্ত্বেও দারিদ্র্য ও বঞ্চনার সমস্যা অব্যাহত রয়েছে এবং তা আরো ঘনীভূত হয়েছে। প্রয়োজন অপূর্ণ রয়ে গেছে। বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
সংকট
কল্যাণ রাষ্ট্রের সামনে এখন সমস্যা হচ্ছে, যে ভারসাম্যহীনতা সে সৃষ্টি করেছে তা কিভাবে দূর করবে। মূল্য ছাড়া যার সাহায্যে সামগ্রিক চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তেমন কোনো স্বীকৃত বিশোধক পদ্ধতি না থাকায় বর্তমান ভারসাম্যহীনতাকে দূর করার জন্য প্রাথমিকভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির উপর নির্ভর করা হচ্ছে। বাজারব্যবস্থায় বিশ্বাসের এ পুনরুজ্জীবন বাজারের ব্যর্থতা ও বৈষম্য এবং বাজার সংশ্লিষ্ট মূল্য পরিশোধে গরীবদের অবমতাকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ফিরিয়ে এনেছে। কল্যাণ রাষ্ট্র এভাবে এক হতবুদ্ধিকর সংকটের সম্মুখীন। যদি প্রাথমিক গুরুত্ব বাজারের উপর দেয়া হয় এবং রাষ্ট্রের কল্যাণমূলক ভূমিকা ভারসাম্যহীনতা অপসারণে প্রত্যাবর্তিত হয়, তাহলে কল্যাণ রাষ্ট্র যে তিমিরে ছিল সেই ছিল তিমরেই থেকে যায়-সে তিমিরটি ধনতন্ত্রের, যেখান থেকে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল। অতএব এখন কি করণীয়? গরীবদের স্বস্তি দেয়ার জন্য কল্যাণ রাষ্ট্রের হাতে একমাত্র প্রধান অস্ত্র যা থাকে, তা হচ্ছে উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার। তবে প্রবৃদ্ধির হার উচ্চ হলেই যে আয় বণ্টন উন্নত হবে তা কিন্তু নয়। আদেলম্যান ও মরিস যেমন বিভিন্ন শ্রেণীর উপাত্তের ভিত্তিতে দেখিয়েছেন, ‘উন্নয়নের পাশাপাশি গরীবদের গড় আয়ের নিরঙ্কুশ ও আপেক্ষিক হ্রাসের অবস্থান থাকে’। উপরন্তু, নিকট ভবিষ্যতে প্রবৃদ্ধির হার ত্বরান্বিত করার সম্ভাবনা খুব বেশি উজ্জ্বল নয়, যদি মুদ্রাস্ফীতি না হয় এবং অন্যান্য ভারসাম্যহীনতার অবনতি ঘটে।
অবশ্যম্ভাবী উপসংহার হচ্ছে, বিরাজমান তিনটি ব্যবস্থা মুসলিম দেশগুলোর জন্য আদর্শ হতে পারে না। সেকুলারপন্থী হলে আত্মিক সুখ তারা দিতেই পারবে না- যে সুখের দাবি হচ্ছে মানবসত্তার আধ্যাত্মিক ও বস্তুগত উভয় চাহিদার পরিতৃপ্তি। যদি তারা মূল্যনিরপেক্ষ হয়, তবে তারা সম্পদের উপর সামগ্রিক দাবি এমনভাবে হ্রাস করতে সক্ষম হবে না, যেমনভাবে সকলের চাহিদাই কেবল পূরণ হয় না, উচ্চতর প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে পুঁজি সৃষ্টির পর্যাপ্ত পর্যায়ও বজায় থাকে। বাজার শক্তির উপর সম্পূর্ণ নির্ভরতা একই সাথে ব্যাপকভিত্তিক অর্থনৈতিক ও বাহ্যিক ভারসাম্যহীনতা দূরীকরণে সহায়তা প্রদান এবং ‘হায়তে তাইয়্যেবা’র চাহিদানুযায়ী পুনর্বণ্টন নিশ্চিত করতে পারবে না। অতএব মুসলিম দেশগুলোর একমাত্র বিকল্প হচ্ছে তাদের অর্থনীতিকে ইসলামীকরণ।
ইসলামীকরণ
ইসলামীকরণের অর্থ সকল জনগণের আধ্যাত্মিক উন্নয়ন ও বস্তুগত কল্যাণ এবং আর্থ-সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামী কর্মকৌশলের কঠোর বাস্তবায়ন, যা ইসলামের বাণীর কেন্দ্রীয় লক্ষ্য। আধ্যাত্মিক দিকে, আত্মিক সুখের জন্য অপরিহার্য মনের যে শান্তি তা সৃষ্টিকর্তার কাছে মানবসত্তার নৈকট্য ব্যতিরেকে অর্জন করা সম্ভব নয়। এ নৈকট্য ইসলাম আনয়ন করতে সক্ষম, কিন্তু সেকুলার মতবাদ তা কল্পনা করতেও পারে না। বস্তুগত দিকে ইসলাম আল্লাহর দেয়া আমানত সকল সম্পদের বরাদ্দ ও বিতরণ এমন দক্ষতা ও ইনসাফের সঙ্গে দাবি করে, যাতে ‘মাকাসিদ’ অর্জিত হয় এবং সকলের জন্য ‘হায়াতে তাইয়্যেবা’ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। এটা করতে হলে সম্পদের লভ্যতা ও লক্ষ্য অর্জনের সীমাবদ্ধতার মধ্যে সামগ্রিক দাবি উত্থাপনের জন্য ইসলামী কর্মকৌশলের সমস্ত সংশ্লিষ্ট উপাদানসমূহের ভারসাম্যপূর্ণ ও কার্যকর ব্যবহার প্রয়োজন, অবশ্য ইসলামীকরণের অর্থ উদারীকরণের অনুপস্থিতি নয়। অবশ্য এর অর্থ একটি প্রকৃতির উদারীকরণ, যাতে সরকারি খাতের সকল অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত বাজার শৃঙ্খলা পরীক্ষার মুখোমুখি করার আগে নৈতিক মূল্যবোধের বিশোধকের ভিতর পরীক্ষিত হয়।
সমস্ত উপাদানের সুষম ব্যবহার
প্রত্যেক বক্তির ভিতরের সচেতনতার উপর প্রভাব বিস্তারকারী নৈতিক ব্যবস্থা সম্পদের আমানতদারিতার প্রকৃতি সম্পর্কে তাকে সচেতন করে এবং দক্ষ ও ন্যায়ভিত্তিক বরাদ্দ ও বিতরণের প্রয়োজনীয় মানদণ্ড নির্ণয় করে। এ ব্যবস্থা সর্বজ্ঞানী আল্লাহতায়ালার সামনে তার অবশ্যসম্ভাবী জবাবদিহিতা সম্পর্কেও সচেতন করে তোলে এবং এভাবে তা একটি দৃঢ় উদ্বুদ্ধকারী শক্তি হিসেবে কাজ করে। এতে কোন ব্যক্তি সামজিক কল্যাণ অর্জন ব্যাহত করে নিজের স্বার্থ উদ্ধার ও অগ্রাধিকার পূরণের জন্য উদ্যোগী হয় না। এ ব্যবস্থা বাজারে আসবার আগেই পণ্য ও সেবার উপর দাবির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ কেটে ফেলতে সাহায্য করে। বিকেন্দ্রীকৃত সিদ্ধান্ত গ্রহণসহ মূল্যব্যবস্থা যদি তখন কার্যকর হয়, তাহলে সম্পদ বরাদ্দ আরো বেশি দক্ষ হতে পারে। তবে একটি নৈতিক ব্যবস্থাও অকার্যকর হতে পারে, যদি একই সাথে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন না হয়। এটা হয় এজন্য যে, কিছু লোক মূল্যবোধের তোয়াক্কা করতে চায় না, যতক্ষণ না আর্থ-সামাজিক পরিবেশ তাদের জন্য কঠিন ও অলাভজনক না হয়। তাছাড়া মূল্যবোধ ব্যবস্থার প্রতি নিবেদিত ব্যক্তিরাও সামাজিক অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে এবং কেবল মানুষ নিজেরা নিজেদের ক্ষেত্রে নয়, বরং যখন দুষ্প্রাপ্য সম্পদ দিয়ে ‘মাকাসিদ’ অর্জনের ক্ষেত্রে অর্থব্যবস্থা কী দিতে পারে এবং কী পারে না, সে সম্পর্কে সচেতন নাও হতে পারে।
সরকারের যদি কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হয়, তবে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন আরো কার্যকরভাবে চালু করা যেতে পারে। সরকার কর্তৃক অর্থনীতির সম্পদ ও প্রয়োজন মূল্যায়ন করা এবং সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতে ভোগ ও বিনিয়োগ প্যাটার্নে পরিবর্তনের পরিধি নির্ধারণ করে কৌশলগত নীতি নির্ধারণী পরিকল্পনা এ কাজে সাহায্য করতে পারে। একটি যথার্থ পরিবেশ সৃষ্টির জন্য তখন সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও কাঠামোগত সংস্কারের নকশা প্রণয়ন করা যেতে পারে। এসব সংস্কার বিভিন্ন ইসলামী পুনর্বণ্টন স্কিমের কার্যকর বাস্তবায়নের মাধ্যমে আরো জোরদার করা যেতে পারে, যা ছাড়া কোনো সংস্কারের লক্ষ্যে কোনো প্রচেষ্টাই ফলপ্রসূ হবে না। এসব কৌশলের সম্মিলিত ব্যবহারে বৈষম্য ও ভারসাম্যহীনতা দূরীকরণের প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। অপচয়মূলক ও অপ্রয়োজনীয় ভোগ থেকে সৃষ্ট সম্পদের উপর চাপ অপসারণ এবং এর ফলে সম্ভব উচ্চতর বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি বর্তমানে বহু মুসলিম দেশে মুদ্রাস্ফীতির যে চাপ ও মুদ্রা অবমূল্যায়নের যে ধারা চলছে তা রোধে সাহায্য করবে।
ইসলামিক উদ্বুদ্ধকরণ ব্যবস্থার দৃষ্টিভঙ্গির আওতায় যদি সমতাবাদী (egalitarian) নীতিসমূহ অনুসরণ করা হয়, তবে তা ধনীদের পক্ষ থেকে তেমন বাধার সম্মুখীন হবে না, যেমনটি তা প্যারেটো অপটিমালিটির প্রতি নিবেদিত আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় হয়ে থাকে। এ নীতিসমূহ আর্থ-সামাজিক অস্থিরতা এবং রাজনৈতিক অস্থিশীলতা হ্রাসে সাহায্য করতে এবং মুসলিম দেশসমূহের উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনেও অবদান রাখতে পারে। যে সমস্ত দেশে ভোগসামগ্রীর মারাত্মক অভাব এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ভগ্নদশা কাজের মান নিচে নিয়ে যাচ্ছে, সে সমস্ত দেশে ভরপেট খাওয়া মানুষ, স্বাস্থ্যবান এবং ভালোভাবে শিক্ষিত ও উদ্বুদ্ধ জনগণ শ্রমশক্তির মান উন্নত না করে পারে না।
ধনী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মর্যাদার লড়াই বন্ধ করার মাধ্যমে অধিকতর সামাজিক সাম্য কেবল ভ্রাতৃত্ববোধ ও সামাজিক বন্ধনই বৃদ্ধি করে না, অধিকতর সঞ্চয়ও ঘটায়। সঞ্চয়ের একটি অংশ যদিও গরীবদের বর্ধিত চাহিদা পূরণের জন্য ব্যয় হয়ে যায়, তা সত্ত্বেও একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বর্ধিত বিনিয়োগের জন্য লভ্য হতে পারে এবং শ্রমশক্তি, মান উন্নয়ন ও উদ্বুদ্ধকরণের সাহায্যে তা অধিকতর দক্ষতা ও উচ্চতর প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে। অতএব ‘অধিক সাম্য’ এর মানে কম প্রবৃদ্ধি নয়। বিভিন্ন অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ও সাম্য যদি তুলনা করা যায় তবে দেখা যাবে, ‘তাদের অর্থনৈতিক সাফল্য ও যে বৈষম্য তারা সহ্য করেছে তার মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই’। সে অনুসারে, সাম্যের দিকে অগ্রগতি কমানো হলে প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পাবে বলে যে যুক্তি দেখানো হচ্ছে, তাকে ‘কঠিন অর্থনৈতিক উপাত্তবিহীন ধুম্রজাল’ বলে বাতিল করা যেতে পারে। তথাপিও বেশ কিছু দেশের উল্লেখযোগ্য প্রমাণ থেকে দখো যায় যে, বিভিন্ন দেশে অনুসৃত ঘরোয়া অর্থনৈতিক ও সামজিক নীতিসমূহের ফলে কেবল বৈষম্যই বৃদ্ধি পায়নি, বরং দারিদ্র্য আরো প্রকট হয়েছে।
ইসলামীকরণ এভাবে বিভিন্ন মুসলিম দেশে বাজার শক্তির প্রয়োগকে মানবিকীকরণ এবং দুর্লভ সম্পদ ব্যবহারে দক্ষতা ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে। নৈতিক শুদ্ধি এবং কৌশলগত নীতিনির্ধারণী পরিকল্পনা এবং অর্থনৈতিক ও আর্থিক গঠন সম্পদ ব্যবহারে মানবিক দিকটিকে আরো বেশি বিবেকবান করতে পারে, যাতে সামাজিক স্বার্থের গণ্ডি অতিক্রম না করেও ব্যক্তিগত স্বার্থ অর্জিত হয়, এমনকি সে ক্ষেত্রেও যেখানে ব্যক্তিগত ও সামাজিক স্বার্থ একরকম নয়। ইসলামের শিক্ষা অনুসারে সরকারি রাজস্বের সংস্কার সরকারি খাতে করারোপ ও ব্যয় এবং বাজেট ঘাটতি হ্রাসে অধিকতর দক্ষতা ও সাম্য প্রচলনে সাহায্য করতে পারে। এভাবে অপচয়মূলক ও অনুৎপাদনশীল ব্যবহার থেকে চাহিদা পূরণ এবং উচ্চহারে মূলধন গঠন, রপ্তানি ও প্রবৃদ্ধিতে সম্পদ ব্যয়িত হবে।
ব্যক্তিগত সম্পত্তি মুনাফা প্রবণতার স্বীকৃতি এবং সে সঙ্গে ন্যায়ভিত্তিক বস্তুগত প্রতিদান এবং চাহিদা পূরণের জন্য অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তন ও বিবেকপূর্ণ কাজ শ্রমিকদের অধিকতর দক্ষতা এবং বর্ধিতহারে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ প্রণোদনা সৃষ্টি করবে। ভূমি সংস্কার, পল্লী উন্নয়ন ও দেশব্যাপী ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক শিল্পের বৃদ্ধি উৎপাদনের উপকরণের মালিকানার সম্প্রসারণ এবং আত্ম-কর্মসংস্থানের সুযোগ সম্প্রসারণে সাহায্য করবে। বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নতি এবং বিনিয়োগ ও রপ্তানির জন্য উৎসাহ ও সুযোগ সুবিধা প্রদান উন্নয়ন তরান্বিতকরণে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। ইসলামী শিক্ষার আলোকে প্রথাগত আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের পুনর্গঠন সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতে অপচয়মূলক ও অনুৎপাদনশীল ব্যয়ের জন্য ঋণ সুবিধা প্রদান থেকে বিরত থাকতে এসব প্রতিষ্ঠানকে সাহায্য করবে। এভাবে এসব প্রতিষ্ঠান ও উৎপাদনমুখী বিনিয়োগ, বিশেষ করে দরিদ্র শ্রেণরি মধ্যে ব্যবসায়ী প্রতিভাকে অধিক হারে অর্থ যোগান দতে সক্ষম হবে।
এর ফলে ভারসাম্য হ্রাসের প্রচেষ্টাই শুধু শক্তিশালী হবে না, তা ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের মালিকানা সম্প্রসারণের লক্ষ্য অর্জন এবং দ্রুতগতিতে উন্নয়নের জন্য জনগণের বৃহত্তর অংশের শক্তি ওসৃজনশীলতা কাজে লাগাতে সাহায্য করবে। মুদ্রাস্ফীতির চাপ কারেন্ট একাউন্ট ঘাটতি হ্রাস এবং বিনিময় হারের অব্যাহত অধঃগতিরোধ প্রবৃদ্ধি ও কল্যাণের ক্ষেত্রেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তথাপিও যেসব দরিদ্র লোক স্বাবলম্বী নয়, তাদের স্বার্থ কেবল সাধারণ ভর্তুকির মাধ্যমে না দিয়ে সংঘবদ্ধ ও অধিকহারে ত্রাণ ও সম্পূরক আয় প্রদানের মাধ্যমে রক্ষা করতে হবে। এসব অর্থ সরকার ও সামাজিক সংস্থাগুলো যাকাত, ওয়াকফ, স্বেচ্ছাভিত্তিক দান এবং বাজেটে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ বরাদ্দ থেকে মিটাবে। ইসলামী উত্তরাধিকার ব্যবস্থার বাস্তবায়ন অর্থনৈতিক বৈষম্য সর্বনিম্ন পর্যায়ে সীমিত রাখার উদ্যোগকে সহায়তা করবে।
নিওক্লাসিক্যাল সমন্বয়
উপরে যে কর্মকৌশল আলোচিত হলো তার বিপরীতে বৃহদাকারের অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা দূরীকরণে নিওক্লাসিক্যাল উদারনৈতিকতাবাদেও সেকুলার দৃষ্টিভঙ্গির কাঠামোর আওতায় যে সমন্বয় কর্মসূচির পরামর্শ দেয়া হয়েছে, তাতে আর্থ-সামাজিক পুনর্গঠনের সম্পৃক্ততা নেই। এটি সরলভাবে অনুভূত, যে অর্থনীতির উদারীকরণ শুধু ভারসাম্যহীনতা অপসারণেই সাহায্য করবে না, অধিকতর দক্ষতা ও ন্যায়পরতা অর্জনেও সহায়ক হবে। প্রাথমিক সমন্বয়গুলো হচ্ছে, বাজেট ঘাটতি হ্রাস এবং মূল্য বিকৃতির সংশোধন, বিশেষত বিনিময় হার ও সুদের হারে। সন্দেহ নেই যে, এ ধরনের সমন্বয়সমূহ ভারসাম্যহীনতা দূরীকরণ এবং এমনকি দীর্ঘমেয়াদী প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু এগুলো কি আর্থ-সামাজিক ন্যায়বিচার সম্প্রসারণে নিজেদের সাহায্য করবে? বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে যে, বাজেট ঘাটতি দূরীকরণ এবং বাজার সংশ্লিষ্ট মূল্য প্রচলন সমন্বয়ের বড় বোঝাটি গরীবদের কাঁধেই চাপিয়ে দেয়, যতক্ষণ না তা সমান্তরালভাবে ন্যায়বিচার সম্প্রসারণের কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে করা হয়। উচ্চতর মূল্য ধনীদের চাহিদায় উল্লেখযোগ্য কোনো ক্ষতি করে না, তারা যা চায় তা ক্রয় অব্যাহত রাখে। অথচ গরীব আরো সংকুচিত হয়ে পড়ে। এর ফলে দারিদ্র্য এবং বৈষম্য বৃদ্ধি পায়, সামাজিক অস্থিরতা ও রাজনৈতিক অস্থিশীলতার সৃষ্টি হয় এবং সরকার তখন তাদের অনুসৃত ব্যবস্থাগুলো গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়।
নিওক্লাসিক্যাল সমন্বয় কর্মসূচি এভাবে সমস্যার সম্মুখীন হয়। কারণ উদার মূল্যবোধ নিরপেক্ষ ঐতিহ্যের আওতায় প্রাথমিকভাবে সমস্যাটিকে তার স্থিতি ও নামমাত্র দক্ষতার দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে থাকে এবং সাম্যের প্রতি কেবল দ্বিতীয় পর্যায়ের গুরুত্ব প্রদান করে। যাইহোক, স্থিতিকরণ কর্মসূচি যদি দক্ষতা ও ন্যায়পরতা উভয় লক্ষ্য অর্জনে প্রণীত হতো, তবে তার সফল হবার অধিকতর সুযোগ থাকত। কিন্তু এ ধরনের কর্মসূচি একটি মূল্যবোধনিরপেক্ষ কাঠামোর মধ্যে তৈরি করা যায় না, যদি তা তৈরি করা হয় তবে তা একটি কার্যকর উদ্বুদ্ধকরণ ব্যবস্থা ছাড়া বাস্তবায়ন করা যায় না। সেই ব্যবস্থা এমন যা প্রত্যেক ব্যক্তিকে সামাজিক কল্যাণের সীমারেখার মধ্যে তার নিজের স্বার্থে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হবে।
কাজের গুরুত্ব ও ত্বরা
অতএব উপসংহারে বলা যায়, অর্থনীতি ও সমাজের ইসলামীকরণ ব্যতিরেকে ইসলাম যে ধরনের উন্নয়ন কল্পনা করে, মুসলিম দেশগুলোর পক্ষে ভারসাম্যহীনতা দূরীকরণের সাহায্যে তা অর্জন করা সম্ভব হবে না। মুসলিম দেশগুলোর পক্ষে ভারসাম্যহীনতা দূরীকরণের সাহায্যে তা অর্জন করা সম্ভব হবে না। মুসলিম সরকারগুলো এ পর্যন্ত ইসলামকে কেবলমাত্র শ্লোগান হিসেবে ব্যবহার করেছে, ব্যর্থ হয়েছে তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে এবং সামাজিক ও অর্থনীতির উন্নতিতে যে ইতিবাচক অবদান ইসলাম রাখতে পারে তা অর্জনে। খুরশীদ আহমদ যথার্থই উল্লেখ করেছেন, ‘এমন কোনো প্রমাণ নেই যা থেকে সাধারণভাবে বলা যায় যে, নীতিনির্ধারকরা ইসলাম থেকে সত্যিকার অর্থে কোনো উৎসাহ নিয়েছেন এবং তার অর্থনৈতিক আদর্শসমূহকে উন্নয়ন নীতিতে বাস্তবায়িত করেছেন’। এমনকি দৃষ্টিভঙ্গি ও নীতিতে পরিবর্তন সত্ত্বেও সমন্বয় পুনর্গঠনের কাজ কঠিন ও সময়সাপেক্ষ হতে বাধ্য। নীতিনির্ধারকগণ যত তাড়াতাড়ি সময়ের চিহ্ন পড়বেন ততই তা তাদের ও উম্মাহর জন্য কল্যাণকর হবে।
যাইহোক, সেকুলার দৃষ্টিভঙ্গিতে ইসলামীকরণ সামান্য সমন্বয়ের চেয়ে আরো কঠিন কাজ। এতে আরো জোরদার ও সমন্বিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। তথাপি সাধারণ জনগণ তার জন্য আবেগপ্রবণভাবে প্রস্তুত বলে মনে হয়। কারণ তাদের বিশ্বাস এটা দীর্ঘমেয়াদী কল্যাণ সাধন করতে পারবে। কায়েমী স্বার্থবাদী লোকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় সরকারগুলো নিজেরাই নিজেদের প্রধান প্রতিবন্ধক। ইসলাম যে আর্থ-সামাজিক পুনর্গঠনের কথা বলে, তা তাদের স্বল্পমেয়াদী স্বার্থকে (দীর্ঘমেয়াদী নয়) শংকাগ্রস্ত করে তোলে। এটাই অন্যতম কারণ, যে জন্যে গণতন্ত্রকে পর্যন্ত এসব দেশে শিকড় গাড়তে দেয়া হয়নি। গণতন্ত্র সরকারগুলোকে ইসলামীকরণে বাধ্য করত।
বিশেষ সুবিধাভোগী লোকদেরকে অবশ্যই অনুধাবন করতে হবে যে, তারা ইসলামের মানবতাবাদী ধারণার মহাকর্ষীয় আকর্ষণকে দৃঢ় জনসমর্থন অর্জনে বেশি দিন ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। মুসলিম দেশসমূহে ইসলামী পুনর্জাগরণ আন্দোলন যে গতি লাভ করেছে তা অবশ্যই আরো গতি সঞ্চার করবে এবং প্রতিরোধের সকল শক্তি মোকাবিলা করবে। সুবিধাভোগী শক্তি শেষ পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন হবে; যেমন কোরআনে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে, ”ফেনা তো শুকিয়ে খতম হয়ে যায় এবং যা মানুষের উপকারে আসে তা অবশিষ্ট থাকে” (১৩:১৭)। একইভাবে কেইনস মন্তব্য করেছেন, ‘আমি নিশ্চিত যে চিন্তদারা যেভাবে ধীরে ধীরে জায়গা দখল করে, তার তুলনায় সুবিধাভোগী শ্রেণীর শক্তিকে ব্যাপকভাবে অতিরঞ্জিত করা হয়েছে। অবশ্যই এখনি নয়, তবে কিছু বিরতির পর সুবিধাভোগী শ্রেণী নয়, বরং চিন্তাধারাই ভালো বা মন্দের জন্যে মারাত্মক হবে’। অতএব ধনী ও শক্তিশালী শ্রেণীর দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থেই উচিত হবে সমাজ সংস্কারের প্রবল স্রোতকে বাধা না দেয়া, বরং সংস্কারকে মেনে নেয়া।
তবে ইসলামীকরণকে মুসলিম দেশসমূহের সকল সমস্যার প্রতিষেধক হিসেবে ধরে নেয়া ঠিক হবে না। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক অধঃপতন, বিপথগামী ঘরোয়া নীতিসমূহ এবং অসুস্থ বহিঃপ্রভাবসৃষ্ট সমস্যাসমূহের কিছু কিছু অবশ্যই দীর্ঘদিন ধরে বিরাজ করবে এবং এও অবশ্যই উপলদ্ধি করতে হবে যে, ইসলামীকরণ একটি পর্যায়ক্রমিক প্রক্রিয়া যা শক্তি প্রয়োগ বা কড়াকড়ি করে তাৎক্ষণিকভাবে অর্জন করা যায় না। আল-কোরআনের প্রক্রিয়ায় (১৬:১২৫) ‘জ্ঞান ও বোধই হতে হবে ইসলামীকরণের স্তম্ভ। এমনকি নবী করীম (স) নিজে উদাহরণের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে পরিবর্তনকে উৎসাহিত করেছেন।
দুঃখজনকভাবে অধিকাংশ মুসলিম দেশ ইতোমধ্যেই যে পর্যায়ে উপনীত হয়েছে এবং এর ফলে দারিদ্র্য, অসমতা, অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা, বৈদেশিক ভারসাম্যহীনতা ও বিরাট বৈদেশিক ঋণের জন্ম দিয়েছে তাতে খুব বেশি সময় দেয়ার সুযোগ নেই। এমনকি যদি উল্লেখযোগ্য নীতিনির্ধরাণী উদ্যোগও গৃহীত হয়, যে বৈষম্য ও ভারসাম্যহীনতা রয়েছে তা অবিলম্বে উল্টিয়ে ফেলা যাবে না। তাছাড়া সোভিয়েত হুমকির হ্রাস মুসলিম দেশগুলোর কৌশলগত গুরুত্ব এবং ফলশ্রুতিতে বৈদেশিক সাহায্যের আগমন কমিয়ে দিতে পারে। এতে মুসলিম দেশগুলোর জন্য আর্থ-সামাজিক সংস্কারে গুরুত্ব সহকারে মনোনিবেশ করা আরো জরুরি হয়ে পড়েছে তাদের অধিকতর ইতিবাচক ও দৃঢ় ভূমিকা পালন করার ক্ষেত্রে। যত আন্তরিকতা ও দৃঢ়তার সাথে তারা এ ভূমিকা পালন করবে এবং সামাজিক পরিবর্তনের জন্য যত বেশি সক্রিয় সমাজ সংস্কার কাজে নিয়োজিত সংস্থা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকবে, রূপান্তরের জন্য সময় লাগবে তত কম। পবিত্র কোরআনে যেভাব বলা হয়েছে তা থেকে তাদের অবশ্যই উৎসাহ গ্রহণ করতে হবে।
“যারা আমার পথে সাধনায় আত্মনিয়োগ করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করব। নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সঙ্গে আছেন” (২৯:৬৯)।