দশম অধ্যায়ঃ আর্থিক পুনর্গঠন
দশম অধ্যায়
আর্থিক পুনর্গঠন
আধুনিক বিশ্বে অর্থব্যবস্থা একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনেতিক অস্ত্র। অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের মধ্যে অগ্রাধিকার নির্ণয় করে তাদের মধ্যে প্রয়োজন মোতাবেক সীমিত সম্পদের বিলিবণ্টনে অর্থব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি এবং স্থিতিশীলতায়ও এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। অর্থনীতিতে ব্যক্তি মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থান, সামাজিক মর্যাদা ও ক্ষমতার ভিতও অর্থব্যবস্থা দ্বারা নির্ধারিত হয়। তাই দেখা যায়, অর্থব্যবস্থার সংস্কার ছাড়া আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন আনয়ন সম্ভব নয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠান, এর কাঠামো, ব্যবস্থাপনা ও কর্মপদ্ধতির সার্বিকভাবে পুনর্গঠন করা প্রয়োজন, যাতে অর্থব্যবস্থার সম্ভাবনাময় সকল শক্তিকে আর্থিক সম্পদের দক্ষ ও সুষম ব্যবহারের কাজে লাগানো যায় এবং অর্থনীতির উন্নতির পথে সকল বাধাবিঘ্নকে অপসারণ করা যায়।
ব্যাংক তথা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পুঁজি আসে সাধারণ জনগণের ডিপোজিট বা আমানত হতে। পানির ট্যাংক হতে যেমন পানির সরবরাহ হয়, তেমনি জনগণের উৎস হতে ব্যাংকের আমানত সঞ্চিত হয়। শুধু বিত্ত ও ক্ষমতাশালীদের জন্য নয়, সর্বসাধারণের কল্যাণের জন্য ব্যাংক আমানত ব্যবহৃত হওয়া উচিত। পানির সরবরাহের তুলনায় ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঞ্চয়ী আমানত অনেক বেশি দুষ্প্রাপ্য। তাই সর্বোচ্চ দক্ষতা ও সুষ্ঠতার সাথে এর ব্যবহার কাম্য। ব্যাংক আমানত ব্যবহারের সার্বিক লক্ষ্য হওয়া উচিতঃ (ক) সবার্ধিক সংখ্যক শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ঋণ প্রদান; এবং (খ) সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মৌলিক প্রয়োজন পূরণের জন্য দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন, আমদানি ও সুষ্ঠ বিতরণ ব্যবস্থা পরিচালনায় প্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহ। সুদভিত্তিক প্রচলিত অর্থব্যবস্থা এ দু’লক্ষ্যের কোনোটিই পূরণ করতে পারেনি। ব্যাংক আমানতের ব্যবহার ও ঋণ দান পদ্ধতিতে প্রচলিত ব্যবস্থা চরম বৈষম্য ও অদক্ষতা প্রদর্শন করেছে।
সুষম মধ্যস্থতা
প্রচলিত ব্যাংকব্যবস্থা ঋণ বিতরণ ও ব্যবস্থাপনায় যে ইনসাফ পরিপন্থী নীতি অনুযায়ী চালিত হচ্ছে তা আজ সর্বজন স্বীকৃত। আর্নি বিগস্টেনের মতে, ‘ভূমি বৈষম্য হতেও পুঁজি ও ঋণ বিতরণ ব্যবস্থায় বৈষম্য অধিকতর প্রকট; বর্তমান ব্যাংকব্যবস্থা পুঁজি বিতরণ বৈষম্যকে আরো প্রকটতর করে তুলেছে’। এ অবস্থা কোনো দৈব-দুর্ঘটনা নয়, বরং সুদভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার স্বাভাবিক কুফল। যে অর্থনীতিতে সম্পদ বৈষম্য পাহাড় সমতুল্য, সেখানে ব্যাংক বা ঋণদানকারী সংস্থা চায় ঋুঁকিমুক্তভাবে প্রদত্ত ঋণ হতে নিশ্চিত মুনাফা অর্জন করতে; সেখানে ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ বিত্তশালীদের যে সহজ শর্তে ঋণ দিচ্ছে, সেই একই শর্তে সমাজের আর্থিকভাবে দুর্বল শ্রেণীকে ঋণ প্রদান করবে, তা আশা করা যায় না। প্রচলিত প্রথায় ব্যাংক তাদের ঋণ দেয়, যাদের অতিরিক্ত জামানত (Collateral) প্রদানের সামর্থ্য আছে; অথবা লেস্টার থুরোর ভাষায়, ‘যাদের কলকারখানায় বিনিয়োগের জন্য প্রচুর সঞ্চয় রয়েছে’। অন্য কোনো যোগ্যতা বিবেচনায় আনা হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের ষষ্ঠ বৃহত্তম ব্যাংক মর্গান গ্যারান্টি ট্রাস্ট কোম্পানিও স্বীকার করেছে, তাদের ব্যাংক বিশাল ও বিত্তশালী কোম্পানীকেই ঋণ দিতে অধিক আগ্রহী। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ও কোম্পানীসমূহকে প্রতিযোগিতামূলক সুদের হারে ঋণ প্রদানে তাদের অনাগ্রহ সুস্পষ্ট। এ প্রবণতা সমাজের জন্য এক গভীর সংকটের পূর্বাভাস। কেননা স্পষ্টতই একটি বিশেষ সামাজিক শ্রেণীর উদ্যোক্তাদের প্রষ্ঠপোষকতায় বর্তমান ব্যাংকব্যবস্থা আস্থাশীল। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী ও স্তরে যে বিশাল উদ্যোক্তা প্রতিভার ভাণ্ডার ছড়িয়ে আছে, তার সম্ভাবনাকে যথাযথ ব্যবহারে বর্তমান ব্যাংকব্যবস্থা উদাসীন।
ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক শিল্পে অর্থায়ন
বৈষম্যমূলক প্রচলিত ঋণ বিতরণের ব্যবস্থা এক তিক্ত বাস্তবতা। ঋণ বিতরণের বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সম্পদের কেন্দ্রীকরণ প্রবণতা সংশোধন করা প্রয়োজন। নচেৎ আয় ও সম্পদের সুষম বণ্টনের প্রত্যাশা দুরাশা মাত্র। গ্রাম ও শহরাঞ্চলে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও বেকার সমস্যার সমাধানের জন্য ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক শিল্প দ্রুত হারে বেড়ে চলেছে। কিন্তু এসব শিল্পে অর্থায়নের যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া না হলে এ লক্ষ্য অর্জন স্বপ্নই থেকে যাবে। ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক শিল্পের উন্নয়নের পথে অর্থসংস্থানই সবচেয়ে বড় বাধা। গরীব গরীব নয় এ কারণে যে, তারা কঠোর পরিশ্রমে অনাগ্রহী বা তাদের দক্ষতার অভাব রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তারা ধনীদের চেয়ে বেশি পরিশ্রম করে। তাদের দক্ষতার পূর্ণ ব্যবহার তারা করতে পারে না। তাদের সমস্যা হচ্ছে আত্ম-কর্মসংস্থানের জন্য তাদের অর্থের কোনো সংস্থান নেই। যারা মজুরিভিত্তিক চাকরি করে তাদের ক্ষেত্রেও তাদের চাকরি তাদের দক্ষতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে পারে না। মজুরির পরিমাণও এমন যে বিনিয়োগের জন্য সঞ্চয় করা দূরে থাকুক, তারা নিজেদের ন্যূনতম প্রয়োজনও মেটাতে পারে না। ড. মুহাম্মদ ইউনুস তাই যথার্থই বলেছেন, আত্ম-কর্মসংস্থানের জন্য প্রতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার মাধ্যমে জনসাধারণের প্রয়োজনীয় অর্থ ও সম্পদ প্রাপ্তির নিশ্চয়তা হচ্ছে সর্বপ্রথম মৌলিক অধিকার যা অন্যান্য মানবাধিকার অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
Select Committe on Hunger- এর এক রিপোর্ট অনুযায়ী দেখা যায়, উন্নয়নশীল দেশের ক্ষুদ্র শিল্পসমূহে সামান্য পরিমাণ ঋণ সরবরাহ দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রার মান উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করতে পারে। খাদ্য নিরাপত্তা ও স্থানীয় অর্থনীতির প্রভূত উন্নতি সাধন করতে পারে। কমিটি আরো অভিমত ব্যক্ত করে যে, উন্নয়নশীল দেশসমূহে শহর ও গ্রামের ভূমিহীন দরিদ্র মানুষদের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র হতে বেরিয়ে আসতে সহায়তা করার অন্যতম উপায় হচ্ছে, অতিক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদেরকে তাদের প্রথম উদ্যোগ গ্রহণকালেই ঋণ সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা করা। কিন্তু এসব দেশের প্রতিষ্ঠানিক ঋণদানকারী সংস্থাসমূহ স্বল্পবিত্ত মানুষের উদ্যোগে চালিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের লাভজনকতায় আস্থাশীল নয়। তাই আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের মৌলিক ভিত্তি হওয়া উচিত অর্থব্যবস্থার সংস্কার।
প্রকৃত প্রস্তাবে ইসলামী অর্থব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমেই এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। গরীব জনসাধারণের মাঝে শিল্প-ব্যবসা-বাণিজ্যে উদ্যোগ গ্রহণে যে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে, তাকে তখন কাজে লাগানো যাবে। আয়, উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যে সমৃদ্ধ অবদান রাখতে পারে তা ফলপ্রসূ হয়ে উঠবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভাগ্যের উপর নির্ভর করার অনিশ্চিত অবস্থা হতে রক্ষা পাবে। দুঃসময়ে কোমর ভাঙা সুদের ভার বহনের পরিবর্তে তারা সুসময়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে অধিক মুনাফার ভাগ দিতে প্রস্তুত থাকবে এটাই স্বাভাবিক। অর্থ ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ঝুঁকি বহনের ক্ষমতা ও যোগ্যতা রয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের সমৃদ্ধির সময় অধিক মুনাফা অর্জন করে তারা মন্দাকালীন দুঃসময় দেউলিয়া হবার ভয় না করে ঝুঁকি বহনে সক্ষম।
প্রতিবন্ধকতাসমূহ দূরীকরণ
আর্থিকব্যবস্থা ও অর্থলগ্নীকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে, যাতে লোকসানের ঝুঁকি গ্রহণ ও মুনাফা অর্জন উভয়ের ভিত্তিতেই তা চালিত হয়। শুধুমাত্র এতটুকুই যথেষ্ট নয়। ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক শিল্প ও কৃষকদের ঋণদানে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অনীহা বা ব্যর্থতার যে দু’টি প্রধান কারণ রয়েছে, তা অপসারণ করতে হবে। প্রথম কারণটি হচ্ছে, ক্ষুদ্র শিল্প ও কৃষি খাতকে নানা গুরুতর অসুবিধার মধ্যে কাজ করতে হয়। দ্বিতীয়ত, বর্তমান কাঠামো ও পদ্ধতিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণদান ব্যবস্থা ব্যয় ও ঝুঁকিবহুল।
প্রথম প্রতিবন্ধকতা অপসারণ করার জন্য প্রয়োজন শহরকেন্দ্রিক বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রতি সরকারি নীতির পক্ষপাতিত্ব দূর করা এবং এর পরিবর্তে ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক শিল্প ও কৃষকদের জন্য সরকারি সহায়তার দুয়ার খুলে দেয়া। যথোপযুক্ত সরকারি নীতি ও বাজেট সহায়তার মাধ্যমে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ধীরে ধীরে ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক শিল্প ও কৃষকদের ঋণদানে আগ্রহী আস্থাশীল হয়ে উঠবে।
দ্বিতীয় প্রতিবন্ধকতাটি হচ্ছে, ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক শিল্প ইউনিটগুলোকে ঋণদানের ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ কঠিন শর্তের ও চড়া দামের সিকিউরিটি বা জামানত দাবি করে, যা এদের সাধ্যের বাইরে। ফলে উৎপাদন, আয় ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বিপুল সম্ভাবনাময় এ খাতের প্রসার ও প্রবৃদ্ধি ব্যাহত ও বাধাগ্রস্ত হয়। অপরদিকে ধনী ও বিত্তশালীদের ঋণদানের ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ সহজ শর্তে জামানত বা কোলেটারালেই সন্তুষ্ট থাকে। সম্পদশালী হবার কারণে এ সহজ শর্তের জামানত তারা কোনো প্রকার অসুবিধা ছাড়াই পূরণ করতে পারে।
যেসব শিল্পোন্নত দেশে ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা হয়েছে, দেখা গেছে সেসব ক্ষুদ্র শিল্পসমূহের হার তুলনামূলকভাবে ভালো। সুতরাং সংগতভাবে আশা করা যায় যে, সরকারি সমর্থন ও সাহায্যপুষ্ট হলে এসব ক্ষুদ্র শিল্প ইউনিটের লাভজনক অবস্থা দেখে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ তাদের ঋণ প্রদানে এগিয়ে আসবে। মিচিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির এক সমীক্ষা অনুযায়ী, এমনকি উন্নয়নশীল দেশে যেখানে ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক শিল্পগুলো কঠিন বিরূপ পরিস্থিতির শিকার, সেসব দেশে বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের তুলনায় ক্ষুদ্র শিল্পে বিনিয়োগকৃত প্রতি একক পুঁজির উৎপাদন মাত্রা ও দক্ষতা বেশি। ফলে দেখা যায়, বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানের তুলনায় ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠানের মুনাফার মাত্রাও অধিক।
ঝুঁকির পরিমাণ কমানোর অন্যতম উপায় হতে পারে, যদি সরকার ও বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ যৌথভাবে দায়ভার বহন করে একটি ‘ঋণ গ্যারন্টি স্কিম’ চালু করে। অবশ্য ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থায় এ গ্যারান্টি স্কিম প্রচলিত ব্যাংকব্যবস্থার মতো সুদে-আসলে সম্পূর্ণ ঋণ পরিশোধের নিশ্চয়তা দিতে পারবে না। তবে এ স্কিম বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ প্রদানের বিপরীতে নৈতিক দায়ভার বহন করবে। ঋণ প্রার্থী ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক শিল্পসমূহের প্রাক-পরিচিতি, অবস্থান, মুনাফা অর্জনের সম্ভাব্যতা প্রভৃতি সঠিকভাবে পরীক্ষা ও যাচাই করে সরকারি এ স্কিম বাণিজ্যিক ব্যাংকের নিকট এদের পক্ষে জামানত হিসেবে কাজ করবে। এভাবে প্রচলিত পদ্ধতির সিকিউরিটি ছাড়াই বহুসংখ্যক ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক শিল্প প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক ব্যাংক হতে ঋণ লাভে সমর্থ হবে। নৈতিক স্খলন বা প্রতারণামূলকভাবে যদি কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ঋণ পরিশোধ না করে, তবে সরকার- প্রবর্তিত এ স্কিম হতে বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রদত্ত ঋণ আদায়ের সুবিধা পাবে (অবশ্য সরকারও ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবে)। আর যদি বাজারের স্বাভাবিক নিয়মে লোকসান ঘটে, তবে ঋণ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান ও বাণিজ্যিক ব্যাংক যৌথভাবে বিনিয়োগকৃত পুঁজির অনুপাতে লোকসানের ভার বহন করবে।
ঋণ গ্যারান্টি স্কিমের কার্যকারিতা সম্পর্কে সংশয় প্রকৃতপক্ষে অমূলক। কেননা এ স্কিমকে সম্ভাব্য লোকসানের সম্পূর্ণ ভার বহন করতে হবে না। এ ক্ষেত্রে ঋণ গ্রহীতা ও ব্যাংক উভয়কে নৈতিক ঝুঁকি ও ব্যবসার ঝুঁকি নিতে হবে। অবশ্য এ স্কীমে গতানুগতিক পদ্ধতির মত বড় ধরনের বোঝা বহন করতে হবে না। ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট (IFAD) তাদের অভিজ্ঞতা হতে মন্তব্য করেছে যে, উদ্যমী দরিদ্র মানুষ তাদের প্রদত্ত ঋণ নিষ্ঠা ও পরিশ্রমের সাথে খেটে দ্রুত পরিশোধ করে দেয়। ‘সিলেক্ট কমিটি অন হাংগার’ এর রিপোর্ট অনুযায়ী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্প ব্যবসা ইউনিটের যথাসময়ে ঋণ পরিশোধের হারের রেকর্ড উল্লেখযোগ্যভাবে প্রশংসনীয়। বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংকের জন্মলগ্ন হতে ঋণ পরিশোধের হার ৯৯% বলে দেখা গেছে। অন্যান্য ক্ষুদ্র প্রকল্পে ঋণদান কর্মসূচির ফলাফলও অনুরূপভাবে ইতিবাচক। তাই এরূপ অর্থব্যবস্থা বা ঋণদান কর্মসূচি সম্পর্কে অযথা ও অমূলক আশংকা প্রকাশ করার কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ নেই।
তাছাড়া ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক শিল্প ইউনিটকে ঋণদান প্রক্রিয়াকরণে যদি কিছু অতিরিক্ত ব্যয় হয়ও, ইসলামী ন্যায়নীতির নিরিখে ও অগ্রগতির স্বার্থে তা গ্রহনযোগ্য। বিশেষত যখন বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন যাবৎ স্বল্প সুদে ঋণ, ভর্তুকির মাধ্যমে নিম্নমূল্যে উৎপাদন উপকরণ সরবরাহ প্রভৃতি বিপুল সরকারি সুবিধা ভোগ করে আসছে। সুতরাং, অত্যন্ত সংগতভাবেই সরকারের এখন ক্ষুদ্র, ব্যষ্টিক শিল্প ও কৃষকদের প্রতি দৃষ্টি দেবার সময় এসেছে। সরকারি সম্পদ ও অর্থের উল্লেখযোগ্য অংশ এখন অর্থনীতির সার্বিক স্বার্থে এদের জন্য ব্যবহার করা প্রয়োজন। তবে দায়িত্বশীলতা ও দক্ষতা নিশ্চিতকরণের জন্য এ ঋণ প্রদানের ঝুঁকি ও ব্যয়ভারের একাংশ অবশ্যই ঋণ গ্রহীতা ও ব্যাংককে যৌথভাবে বহন করতে হবে। একবার ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক শিল্প এবং কৃষি খাতের দক্ষতা ও লাভজনক দিক প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে এবং নতুন ঋণদান ব্যবস্থা স্থিতিশীলতা লাভ করলে, এ ব্যবস্থা চালু করার জন্য সরকারকে যে অর্থ বরাদ্দ করতে হতো তা বহুলাংশে হ্রাস পাবে।
দক্ষ মধ্যস্ততা
প্রচলিত ব্যাংকব্যবস্থায় ঋণদান পদ্ধতি, আর্থিক সম্পদের বিনিয়োগ ও বিলিবণ্টনে যে অদক্ষতা প্রকট তা বিদ্যমান ব্যবস্থারই প্রত্যক্ষ ফসল। বর্তমান ব্যবস্থাপনায় জামানতের ভিত্তিতে অথবা কোনো প্রতিষ্ঠানের সুদ প্রদানের সামর্থ্যের বিবেচনায় বেসরকারি খাতে ঋণ প্রদান করা হয়। আর সরকারি খাতকে ঋণ দেয়া হয় সরকারের সার্বভৌম ক্ষমতার বিবেচনায়। এভাবে সরকারি বা বেসরকারি খাতের কোনো ঋণের আবেদনপত্রকেই যথাযথ মানদণ্ডে পরীক্ষা বা বিশ্লেষণ করা হয় না। প্রকৃতপক্ষে কী উদ্দেশ্যে ঋণ নেয়া হচ্ছে ব্যাংকের পক্ষ হতে তা যথাযথ বিচার বিবেচনায় নেয়া হয় না। সুদ প্রদানের সামর্থ্য ও সিকিউরিটিভিত্তিক বর্তমান ব্যাংকের ঋণদান ব্যবস্থায় উৎপাদনশীল বিনিয়োগ বা অন্য যে কোনো উদ্দেশ্যেই হোক ঋণ লাভ করা যায়। ভোগবিলাস ব্যয় বা ফটকাবাজারীর জন্য বেসরকারি খাত ঋণ লাভ করছে। যদ্ধংদেহী প্রতিরক্ষা ও শ্বেতহস্তী ধরনের প্রকল্প নির্মাণের জন্য সরকারি খাত ব্যাংকিং ব্যবস্থা হতে ঋণের বিপুল প্রবাহ টেনে নিচ্ছে। সমাজের কষ্টার্জিত সঞ্চয়ী আমানত এভাবে অপচয়মূলক ও উৎপাদনশীল খাতে বিনষ্ট হচ্ছে। উপরন্তু অপ্রয়োজনীয়ভাবে সরকারকে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি করতে হচ্ছে। সীমিত অর্থনৈতিক সম্পদের উপর সৃষ্টি হচ্ছে অবাঞ্ছিত ও অপ্রয়োজনীয় টানাপোড়েন। ফলশ্রুতিতে অত্যাবশ্যক দ্রব্যসামগ্রীর উৎপাদন উপকরণ সম্পদের সামাজিক ন্যায়নীতির পরিপন্থি, এ ধরনের বিলিবণ্টন ব্যবস্থাকে কোনোভাবে দক্ষ বণ্টন ব্যবস্থা বলা যায় না। মুনাফা ও লোকসানের দায়ভার সমভাবে বহনের ন্যায়নীতিমূলক ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শ্রেণীর প্রতি নৈতিক দায়িত্ব ও টেকসই প্রকল্প প্রস্তাব উভয়দিকই যথাযথভাবে বিবেচনায় আনা হবে। ফলে চাহিদা ও সরবরাহ উভয়দিক থেকেই ঋণ বণ্টনব্যবস্থা অধিকতর দক্ষতা অর্জন করবে। চাহিদার দিক থেকে নবম অধ্যায় আলোচিত ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন নীতিমালা বাস্তবায়ন অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসবহুল দ্রব্যসামগ্রীর চাহিদা হ্রাস করবে। সরবরাহের দিকে, লাভ-লোকসান উভয় বহনের দায়বদ্ধতা বাণিজ্যিক ব্যাংককে ঋণদানের ক্ষেত্রে প্রকল্প টেকসই হবে কিনা তা যথাযথ বিচার বিশ্লেষণে অধিকতর সতর্ক ও যত্নশীল করে তুলবে। এভাবে সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই শুধুমাত্র উৎপাদনশীল প্রকল্পগুলোই ঋণ লাভ করবে। জামানত বা সুদ প্রদানের সামর্থ্য ঋণ মঞ্জুরের প্রধান মানদণ্ড হবে না। ভোগ্যপণ্যের জন্য ঋণ প্রদান অবশ্য সম্পূর্ণ তুলে দেয়া হবে না। তবে তা হবে শরীয়াহর সীমারেখার মধ্যে এবং কেবলমাত্র অত্যাব্শ্যক স্থায়ী ভোগ্যসামগ্রী কেনার জন্য। ফলে অনুৎপাদনশীল খাতে অপচয়মূলক ঋণপ্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে। ইসলামী অর্থ ও ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাস্তবায়ন এভাবে অর্থনীতিতে ভারসাম্যহীনতা দূরীকরণ এবং দক্ষতা ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় আনয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।
গ্রামীণ এলাকার বিশাল জনগোষ্ঠীর একাংশের সুদভিত্তিক প্রচলিত ব্যাংকব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা এবং এভাবে তাদের প্রতি ব্যাংকের অনাগ্রহের ফলে উল্লেখযোগ্য গ্রামীণ সঞ্চয়কে ব্যাংক কাজে লাগাতে পারছে না। ইসলামী শরীয়াহর আলোকে বাণিজ্যিক ব্যাংকব্যবস্থাকে পুনর্বিন্যস্ত করা হলে গ্রামীণ এ বিশাল সঞ্চয়কে কাজে লাগানো সম্ভব হবে। অলসভাবে পড়ে থাকা গ্রামীণ সঞ্চয় সচল হবে এবং অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি না ঘটিয়ে প্রবৃদ্ধি আনয়নে সহায়ক হবে। গ্রামের মানুষের সঞ্চয়ের ভাণ্ডার হিসেবে স্বর্ণ মজুতের যে প্রবণতা রয়েছে তা হ্রাস পাবে। নতুনভাবে আস্থাশীল গ্রামের জনসাধারণ তাদের সঞ্চয় ব্যাংকে জমা রাখতে উৎসাহিত হবে।