ইসলামী সাহিত্য : মূল্যবোধ ও উপাদান
আবদুল মান্নান তালিব
বাংলা সাহিত্য পরিষদ, ঢাকা
প্রসঙ্গ কথা
মুসলমানরা যা কিছু লেখে তাই ইসলামী সাহিত্য বলে অনেকের ধারণা। আবার ধর্মীয় বিষয়ে যা কিছু লেখা হয় সেগুলোকেও অনেকে ইসলামী সাহিত্য মনে করেন। ইসলঅমকে একটি ধর্ম মাত্র মনে করার কারণে দ্বিতীয় ধারণাটি এসেছে। আর মুসলমানের লেখা যদি ইসলামের উদ্দেশ্যের বিপরীত এবং ইসলামের স্বার্থের পরিপন্থী হয় তাহলে জানি না কে তাকে ইসলামী সাহিত্য আখ্যা দেবার সাহস করবে।
তাই ইসলামী সাহিত্য যথার্থই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইসলাম যেমন একটি বিশ্বজনীন মতবাদ ও আদর্শ- তেমনি ইসলামী সাহিত্যও একটি বিশ্বজনীন সাহিত্য। ত্রয়োদশ শতকে আমাদের এদেশে মুসলমানরা যখন প্রথম ইসলামী সমাজের গোড়া পত্তন করেন তখন স্বাভাবিকভাবেই কুরআনের আদর্শকেই তারা গ্রহণ করেছিলেন। এই আদর্শের ভিত্তিতে সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়াস তারা চালিয়েছিলেন, এতে সন্দেহ নেই। এর প্রথম প্রমাণ হচ্ছে ইসলামের মানবতাবাদকে তারা বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। ফলে দেবদেবীর পরিবর্তে মানুষ হয়ে উঠেছিল সে সাহিত্যের বিষয়বস্তু। এভাবেই আমরা দেখি ইসলাম যে দেশেই বিস্তার লাভ করেছে সে দেশের সমাজ, সভ্যতা, জীবন ব্যবস্থার সাথে সাথে সাহিত্যের উপরও পড়েছে তার সুগভীর প্রভাব। কোন বিষয়ে ইসলামের একটি আদর্শকে গ্রহণ করা আর ইসলামের সার্বিক মতবাদ ও আদর্শের ভিত্তিতে কোন বিষয় গড়ে তোলার মধ্যে নিশ্চয়ই সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। এখানে এই দ্বিতীয়টাই আমাদের আলোচ্য।
বাংলা ভাষায় পূর্ণাঙ্গ ইসলামী সাহিত্য সৃষ্টিকেই আমরা লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছি। সাহিত্যে ইসলামী আদর্শের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ছাড়া এদেশে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে সফল করে তোলা সম্ভবপর নয়। ইসলামী জীবন ব্যবস্থা যেমন সমগ্র মানবতার জন্য কল্যাণের বার্তাবহ তেমনি ইসলামী সাহিত্যও মানবতার আশা আকাংখা পূরণের যথার্থ ধারক। ইসলামী সাহিত্য মানুষের সমাজকে কল্যাণ ও সফলতায় ভরে দেয়। বোধ হয় মানুষের প্রত্যেকটা কাজের উদ্দেশ্য কল্যাণ ও সফলতা অর্জন। নিজের অকল্যাণ ও ব্যর্থতা ডেকে আনার উদ্দেশ্যে নিশ্চয়ই মানুষ কোন কাজ করে না। আশা করি এ কথা সবাই স্বীকার করবেন। কাজেই সাহিত্য ক্ষেত্রে অকল্যাণ ও ব্যর্থতার প্রতিষ্ঠাকে আমরা উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারি না। সাহিত্য মানবতার জন্য, সাহিত্য জীবনের জন্য। সাহিত্য কল্যাণের জন্য, সাহিত্য ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের উৎখাতের জন্য। ইসলামী সাহিত্যের এটিই হচ্ছে মৌল পরিচয়। মানুষের সমাজ গড়ায় সাহিত্যের যতটুকু অংশ রয়েছে তা তার এই উদ্দেশ্যের সাফল্যের সাথে বিজড়িত।
দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, মুসলমানরা বিপুল সাহত্য সম্ভার গড়ে তুলেছেন। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় বড় বড় মুসলিম সাহত্যিকের জন্ম হয়েছে। তাঁদের সৃষ্ট সাহিত্য ইসলামী সাহিত্যের জন্য বিপুল প্রেরণার উৎস। তাঁদের মধ্য থেকে যাঁরা ইসলামী মতাদর্শ ও ইসলামী মূল্যবোধকে নিজেদের সাহিত্য কর্মের মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করেছেন তাঁরাই আমাদের আদর্শ।
বিগত আট ন’শো বছর থেকে বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে মুসলমানদের পদচারণা। বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারে মুসলমানদের সৃষ্টি সম্ভারও কম নয়। কিন্তু তাদের রচনার একটি বিরাট অংশ ভিন্ন মতবাদ আশ্রিত। বিশেষ করে বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এসে মুসলিম সাহিত্যিকদের বৃহত্তর অংশ সাহিত্যের ক্ষেত্রে ইসলাম বিরোধী মতবাদে বিশ্বাসী হয়ে পড়েছেন। এক্ষেত্রে ইসলামী সাহিত্য সৃষ্টির ব্যাপারে তাদের এগিয়ে না আসারই কথা। তাই অপেক্ষাকৃত তরুণ তাজাদের মধ্যে এ আগ্রহটা দেখা দিয়েছে সাম্প্রতিক কালে। ইসলামী সাহিত্য সৃষ্টির জন্য একদল বিশ্বাসী তরুণ এগিয়ে এসেছেন। প্রবীণদের কিছু সংখ্যক মাথাও তাদের মধ্যে গণনা করার মত।
তাদেরই অনুরোধে ইসলামী সাহিত্য সম্পর্কিত এ আলোচনাটির অবতারণা। বাংলা ভাষায় ইসলামী সাহিত্য সৃষ্টিতে তৎপর সাহিত্য সংগঠন বাংলা সাহিত্য পরিষদের প্রথম সাধারণ সাহিত্য সভায় ১৯৮৩ সালের জুন মাসে প্রবন্ধটি পড়ে শুনানো হয়। বিষয়-বস্তুর অভিনবত্বের জন্য অনেকেই আলোচনাটির ব্যাপক প্রচারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। বাংলা সাহিত্য পরিষদ যথাসময়ে এর প্রকাশনার দায়িত্ব নিয়ে লেখককে দায়মুক্ত করেছেন এ জন্য পরিষদ কর্তৃপক্ষকে অবশ্য ধন্যবাদ জানাতে হয়।
আবদুল মান্নান তালিব
১৮০ শান্তিবাগ, ঢাকা
জীবন ও জগতের সম্পর্ক
আমরা প্রথম চোখ মেলি পৃথিবীর কোলে। পৃথিবীর আলো বাতাসে আমাদের প্রাণ স্পন্দিত হয়। এর খাদ্য শস্য ফলমূলে দেহ পরিপুষ্ট হয়। জীবনে জোয়ার আসে। জীবনের নৌকা ভেসে চলে গভীর পানিতে। আমাদের চারপাশের এই পৃথিবী, আকাশ-বাতাস, আলো-আঁধার, প্রকৃতি-পরিবেশ সবটা নিয়ে আমাদের জগত। আমাদের চিন্তা ভাবনা, আশা-আকাংখা, আগ্রহ-অনাগ্রহ তার ঘোড়া ছুটিয়ে চলে যতক্ষণ আমরা এই জগতের বুকে আছি ততক্ষণ। যখনই চোখ দু’টি মুদে জগতের বুক থেকে বিদায় নিই মুহূর্তেই সেই দূরন্ত ছুটন্ত ঘোড়া উধাও হয়।
আমাদের জীবন আমাদের জগতের সাথে এক সূতোয় বাঁধা। একটা টানলে আরটা আসে, আরটা টানলে অন্যটা আসে। জীবন শেষ হয়ে গেলে মনে হয় জগতও বুঝি নেই। আবার জগতের যেদিন শেষ মুহূর্ত ঘোষিত হবে সেদিন জীবনেরও বিলোপ ঘটবে। কল্পনার পাখায় ভর করে আমরা জগতের সীমানাও পেরিয়ে যাই। কিন্তু চৈতন্য ফিরে পাওয়ার সাথে সাথেই কল্পনার পাখিটি দুম করে আছড়ে পড়ে জগতের বুকে। জগতের সূতোয় আমাদের জীবন আষ্টে-পৃষ্ঠে বাঁধা। একটু নড়াচড়া করে পটপট করে যে এই সূতোগুলো ছিড়ব সে আশায়ও গুড়ে বালি।
যতদিন জগতের বুকে থাকি আমরা কাজ করে যাই। ভালো মন্দ সব রকম কাজ আমরা করি। জগতটা যেন যন্ত্র আমরা তার চালক। এই যন্ত্রে হাত রাখলেই তার চাকা ঘুরতে থাকে। পেছনের দিকে ঘুরুক বা সামনের দিকে ঘুরুক, এদিকে ঘুরুক বা ওদিকে ঘুরুক, তা ঘুরতেই থাকে, অনবরত ঘুরতে থাকে। অথবা আমরা যেন যন্ত্র আর জগতটা তার চালক। যে রকম ইচ্ছে সে আমাদের চাকা ঘুরাতে থাকে। তার দরবারে করুনার আর্জি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া তখন আমাদের আর কোন উপায় থাকে না। এ অবস্থায় আমরা হয়ে পড়ি মানবেতর। মহত কিছু সৃষ্টি, বৃহত কিছু করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। আমাদের সৃষ্টি আমাদের কাজ তাই কালে আমাদের বা আমাদের উত্তর পুরুষদের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। আর জগতকে যখন আমরা বশ করি, কাজে লাগাই তখন আমাদের সৃষ্টি হয়ে ওঠে মহত্তর, কালোত্তীর্ণ। আমরা জগত থেকে বিদায় নিই। কিন্তু আমাদের সৃষ্টি থেকে যায় আমাদের কৃতিত্বের স্বাক্ষর হয়ে।
জগতের সাথে আমাদের জীবনের সম্পর্ক কী তা মনে হয় এই আলোচনা থেকে অনেকটা খোলাসা হয়ে গেছে। এখন এই জীবন ও জগতের উদ্দেশ্য জানতে হবে। তবে তার আগে জীবন ও জগতের স্রষ্টা কে তা অবশ্য জানা প্রয়োজন।
স্রষ্টা কে?
স্রষ্টা আছে কি নেই এ বিতর্কে না গিয়ে আমরা এখানে এক পক্ষ নিচ্ছি, যেহেতু এ বিতর্ক আমাদের আলোচ্য নয়। আমরা মানি আমাদের স্রষ্টা আল্লাহ। তিনি জীবন ও জগত সৃষ্টি করেছেন। যা কিছু দৃশ্য, অদৃশ্য, বর্তমান, ভবিষ্যত, যা কিছু কালের গর্ভে নিহিত, যা কিছু কালের অতীত, কল্পনায় যা ধরা দেয় এবং যা অকল্পনীয়- সে সব বস্তু, শক্তি এবং অন্যান্য সব কিছু তাঁরই সৃষ্টি। তিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন তাঁর একান্ত অনুগত হিসাবে। তিনি নিজেই বলেছেন: ওয়া খালাকা কুল্লা শাইইন ফাকাদ্দারাহু তাকদীরা – আর তিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন আবার সবার জন্য একটা বিশেষ পরিমাপ ঠিক করেছেন। এর মানে হচ্ছে প্রত্যেকটা সৃষ্টির বুকে সম্ভাবনাও তিনিই নিহিত রেখেছেন। সৃষ্টি তার সম্ভাবনার স্রষ্টা নয়, তার বিকাশ সাধন করে মাত্র।
জীবনের উদ্দেশ্য কী?
জগত ও জীবনের স্রষ্টা আমাদের এমনি সৃষ্টি করেছেন? না আমাদের সৃষ্টির পেছনে রয়েছে কোন উদ্দেশ্য? আমরা যখন সামান্য, খুব ছোট একটা জিনিস তৈরি করি, সেখানে আমাদের একটা না একটা উদ্দেশ্য থাকেই। তাকে আমরা কোন না কোন কাজে লাগাই। তাহলে বস্তু-অবস্তু নির্বিশেষে বিশাল জগতের মহান স্রষ্টা আমাদের কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেননি, এটা কেমন করে হতে পারে? আমাদের দিয়ে তিনি কোন কাজ করাতে চান না, এটা কি কখনো কল্পনাও করা যায়? জগতের বুকে আমাদের টিকে থঅকার ও কাজ করার যাবতীয় উপকরণ তিনি আমাদের এখানে আসার লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি বছর আগে তৈরি করেছেন।
এই লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি বছর ধরে এই উপকরণগুলোকে কেবল আমাদের উপযোগী করেছেন। এত কিছু সাজ-সরঞ্জাম, যোগাড়যন্ত্র করে তিনি আমাদের সৃষ্টি করলেন। আর এ সৃষ্টির পেছনে কোন উদ্দেশ্য নেই, এটা কেমন করে বলা যায়? একজন বুদ্ধিভ্রষ্ট মানুষই কেবল এ সত্যটি অস্বীকার করতে পারে। আর যদি এখানে স্রষ্টাকে স্বীকারই করা না হয় তাহলে বিশ্ব জগতের এই সব সাজ সরঞ্জামের যেকোন ব্যাখ্যাই এখানে অচল।
আমাদের সৃষ্টির প্রথম দিনে স্রষ্টা সৃষ্টির যে উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেছিলেন তা ছিল: ইন্নী জা-‘ইলুন ফিল আর্দি খালীফাহ – ‘আমি পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি পাঠাতে চাই।‘ অর্থাৎ মানুষকে দেখতে চান নিজের প্রতিনিধি হিসাবে। আর আল্লাহর প্রতিনিধি হতে হলে মানুষকে নিজেদের মধ্যে সৃষ্টি করতে হবে আল্লাহর গুণাবলী। মানুষকে হতে হবে আল্লাহর গুণাবলীর প্রতিচ্ছায়া। আর দ্বিতীয়ত প্রতিনিধিত্বের দায়িত্বের অপরিহার্য অংশ হিসাবে সার্বভৌম কর্তৃত্বের মালিক যেসব নীতি-নিয়ম, আইন-কানুন তৈরি করেছেন, সেগুলো তাকে কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগ ও প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এই বিশ্ব ব্যবস্থাকে সেই নিয়ম ও আইন অনুযায়ী চালাতে হবে, মানুষের সমাজে সেই আইনের প্রচলন করতে হবে। দুনিয়া থেকে ফিতনা ফাসাদ দূর করে শান্তি শৃংখলা ন্যায় ও কল্যাণের প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সর্বোপরি আল্লাহর হুকুম পুরোপুরি মেনে চলে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করতে হবে। আর আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই হচ্ছে এই জীবনের মূল লক্ষ্য। জীবনের যাত্রা এ জগতেই শেষ হয়ে যায় না। বরং এটা তো সাময়িক জীবন। আসল জীবন শুরু হবে এর পর থেকে। জীবনের এই পরীক্ষাগার থেকে বের হয়ে মানুষ তখন তার প্রকৃত স্রষ্টা, মালিক, মাবুদ, প্রভূ, প্রতিপালক আল্লাহর দরবারে হাজির হয়ে যাবে।
আল্লাহর দরবারে হাজির হবার সময় দুনিয়ার সমস্ত করতৃত্ব-ক্ষমতা মানুষের থেকে বিদায় নেবে। সে হবে দস্তুরমতো একজন আসামী। সেখানে তাকে তার দুনিয়ার সমস্ত কাজের হিসাব দিতে হবে। চুলচেরা হিসাব। দুনিয়ায় তাকে যে প্রতিনিধিত্বের ক্ষমতা ও যোগ্যতা দান করা হয়েছিল তাকে সে কিভাবে ব্যবহার করেছে? প্রতিনিধিত্বের হক সে পুরোপুরি আদায় করেছে কিনা? না কি পথের নেশায় মেতে সে তার প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব ভুলে গেছে এবং এই সাময়িক জীবনটাকে সম্পূর্ণ ও চুড়ান্ত মনে করে জীবনটা শুধু উপভোগই করে গেছে- এ ব্যাপারে তার প্রতিনিধিত্বের দায়িত্বের কোন পরোয়াই সে করেনি?
প্রতিনিধিত্বের দায়িত্বের বোঝা মানুষ নিজেই একদিন কাঁধে তুলে নিয়েছিল। এ বোঝা বইতে আকাশ, পৃথিবী, পাহাড় অস্বীকার করেছিল। তারা এর গুরুভার উপলব্ধি করতে পেরেছিল। বুদ্ধিমান মানুষ সেই গুরুদায়িত্ব ঠিকমত পালন করে আল্লাহর সামনে সফলকাম হবার চেষ্টা করবে।
এ দুনিয়ায় আমাদের একটা বিশেষ মর্যাদা ও দায়িত্ব রয়েছে। আমাদের নিজেদের এই দায়িত্ব ও মর্যাদা অনুভব করতে হবে। আমাদের জীবনের সমগ্র কর্মনীতি এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথে আমরা সকল অবস্থায় এগিয়ে যেতে পারি। আর জীবনের সকল বিভাগে মহান আল্লাহ কুরআন মাজীদ ও রসূলের আদর্শের আবরণে আমাদের যে বিধান ও নীতি পদ্ধতি দান করেছেন সেগুলি বাস্তবায়নের মাধ্যমেই আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি। আল্লাহর বিধানের অনুসারী প্রত্যেকটি কাজই আমাদের জন্য কল্যাণকর। যে সব কাজ দুনিয়ায় কল্যাণ ও সৎ বৃত্তির প্রসার ঘটায় এবং অসৎবৃত্তি ও মন্দকে অন্ধকারের অতলে ঠেলে দেয় আর যা আমাদের দীন ও দুনিয়ার সাফল্য এবং পরকালীন মুক্তিলাভের পথ দেখায়, তাই আমাদের জন্য কল্যাণকর। দুনিয়ার সাথে দীনি উন্নতিও আমাদের একান্ত প্রয়োজন। এজন্য আল্লাহ তাঁর বান্দাদের দুনিয়ার সাথে সাথে দীনি সাফল্য অর্জনের জন্যও দোয়া করতে বলেছেন। দুনিয়ায় কল্যাণ ও আখেরাতে কল্যাণ এবং দুনিয়ায় সাফল্য ও আখেরাতে সাফল্য আমাদের কাম্য। যে ব্যক্তি কেবলমাত্র দুনিয়ার সাফল্য কামনা করে তার তো ক্ষতির শেষ নেই। তবে দুনিয়ার সাফল্য ও দুনিয়ার কল্যাণ লাভ করার আকাংখাকে বৈধথ গণ্য করা হয়েছে একথা ঠিক এবং এজন্য সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জীবন যাপন করাকে পছন্দ করা হয়নি। সন্ন্যাস ও বৈরাগ্যবাদী জীবন যাপনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
সংসারত্যাগী বৈরাগী দরবেশী জীবন যদি আকাংখিত হতো তাহলে কুরআন ও হাদীসে সামাজিক ব্যবস্থাপনার নীতি-নিয়ম, আইন-কানুন ও অনুশাসন দান করার এবং এর আওতায় বিস্তারিত ও পুংখানুপুংখ বিধান জারি করার প্রয়োজন হতো না। সমগ্র কুরআন ও হাদীসে সংসারত্যাগী জীবনের কোন বিধানই নেই। বিপরীতপক্ষে সেখানে সমগ্র জীবনের কর্মসূচী রয়েছে। আমাদের জীবনের সম্ভাব্য এমন কোন দিকই নেই যার জন্য কোন বিধান ও নীতি-নিয়ম সরবরাহ করা হয়নি। তাই কুরআন মাজীদ আমাদের কাছে দাবী জানায়- তোমাদের সমগ্র জীবন ইসলামের হাতে সোপর্দ করে দাও: উদ্খুলু ফিস্ সিলমি কা-ফ্ফাহ – ইসলামের মধ্যে প্রবেশ করো পুরোপুরি। কুরআনে আরো দ্ব্যার্থহীন কণ্ঠে বলা হয়েছে: “তোমরা কি কুরআনের একটা অংশ মেনে নেবে আর একটা অংশ মেনে নেবে না? যারা এহেন আচরণ করবে তারা এই দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছিত হবে এবং আখেরাতে কঠিনতম শাস্তির সম্মুখীন হবে।“ তাই আকীদা-বিশ্বাসের দিক দিয়ে একজন মুসলমান তার সাহিত্যিক জীবনকে ইসলামী বিধঅন ও ইসলাম প্রদত্ত নিয়ম-শৃঙ্খলার অধীন রাখতে বাধ্য। মুসলমানদের জীবনে সাহিত্য চর্চার যে অংশ রয়েছে তা পুরোপুরি ইসলামী বিধানের অনুসারী হবে।
এখানে আমরা শুধু মুসলমানের কথা বলছি। আচ্ছা, যদি সমস্ত মানুষের কথাই বলি তাহলেও কি এর মধ্যে কোন বড় রকমের ফারাক দেখা দেবে? প্রত্যেকটা মানুষই আস্তিক হোক বা নাস্তিক কোন না কোন বিশ্বাসের অনুসারী। আর এই বিশ্বাস অনুযায়ী সে তার সমস্ত কাজ করে যায়। তবে কিছু লোক আছেন তারা কোন স্থির বিশ্বাসী নন। বুদ্ধি বিবেককে খোলা ছেড়ে দেন। উপস্থিত পছন্দ মত বিশ্বাসের পেছনে গা ভাসিয়ে দেন। আমি বলবো, এরাও বিশ্বাস বিহীন নয়। বিশ্বাস বৈচিত্রই এদের বিশ্বাস। কাজেই জীবনকে তারা সেভাবেই গড়ে তোলে। তাই মুসলমান যেমন সাহত্য চর্চার ক্ষেত্রে ইসলামী বিধানের অনুসারী তেমনি এই সব অমুসলিম আস্তিক ও নাস্তিক গোষ্ঠীও সাহিত্য চর্চার সঙ্গে তাদের নিজস্ব বিশ্বাস ও বিশ্বাস বৈচিত্রের অনুসারী।
এখানে ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী সাহিত্য চর্চা করলে সংকীর্ণতা দুষ্ট হবার ভয়ও করা হয়। ব্যাপার হচ্ছে মুসলমানের যেমন জীবন আছে তেমনি অমুসলিম আস্তিক ও নাস্তিক এক জীবনের অধিকারী। তারা তাদের জীবন বিশ্বাস অনুযায়ী কাজ করলে এবং সাহিত্য চর্চায় লিপ্ত হলে যদি তা সংকীর্ণতায় আবদ্ধ না হয় তাহলে ইসলামী বিশ্বাসের ক্ষেত্রে সংকীর্ণতার প্রশ্ন আসে কেন?
সাহিত্য কী?
হৃদয়ের সূক্ষ্ম অনুভূতির প্রকাশই সাহিত্য। বাইরের কোন কিছু সূক্ষ্মভাবে অনুভব করার পর ব্যক্তিমাত্রই তা প্রকাশের আকাংখা পোষণ করে। সাহিত্যিক হৃদয়ের এই সুক্ষ্ম অনুভবকে অলংকার, রূপক, ছন্দ এবং ভাষা ও শব্দের কারুকার্যের মাধ্যমে প্রকাশ করেন। এভাবে আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে সাহিত্যিক পারিপার্শ্বিকের সাথে নিজের সংযোগ স্থাপন করেন। সাহিত্য ও সমাজের সম্পর্ক নিবিড়। জীবনের মূল্যবোধগুলো নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে সাহিত্য সবসময় সচেতন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তাই সাহিত্যিকের মন, সমাজ-পরিবেশ ও প্রকাশভঙ্গী এই তিনটি বিষয়ই বিবেচনার যোগ্য। সাহিত্যিক যা কিছু প্রকাশ করেন তা কেবল তার আত্মগত ভাবোচ্ছ্বাস নয়। বাইরের জিনিসকে তিনি নিজের মনের মত করে, নিজের মনের অনভূতি দিয়ে নিবিড় করে, নিজের দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে বিশ্লেষণ করে হৃদয়গ্রাহী করে পেশ করেন। সাহিত্যিক শুধু নিজের সাথে কথা বলেন না, তাকে পাঠকের সাথে কথা বলতে হয়। ফলে সাহিত্যিক যেমন একদিকে নিজের মনের আবেগ প্রকাশ করেন, তেমনি অন্যদিকে পাঠকের চাহিদাও পূরণ করেন।
সাহিত্য আমাদের সমাজ-সভ্যতা সংস্কৃতির মান উন্নত করে। আমাদের চেতন-অবচেতন জগতের সর্বত্র অবাধে বিচরণ করে আমাদের শক্তিমত্তা ও দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে। সাহিত্য আমাদের সুখ-দুঃখ হাসি-কান্নার সহযোগী হয়। গরীবের কুটীরে যেমন তার অবাধ যাতায়াত তেমনি ধনীর প্রাসাদের সকল দুয়ারও তার জন্য উন্মুক্ত। সাহিত্য আসলে আমাদের হৃদস্পন্দনের প্রতিধ্বনি, শব্দের মনোরম পোশাকে সজ্জিত হয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়। সামগ্রিকভাবে বিচার করলে একথা অবশ্য স্বীকার করতে হবে যে, সাহিত্য একটি বিশ্বজনীন নিয়ম, একটি সর্বব্যাপী আইন, যা মানবিক সভ্যতার একটি অপরিহার্য অংশ। সাহিত্য শুধুমাত্র মনের কারিগরী নয় আবার শুধুমাত্র বস্তুজগতের অনুরণনও নয়। সাহিত্য সভ্যতার নির্মাতা আবার সভ্যতার প্রাসাদও। একথা সবাই স্বীকার করেন যে, সমাজের প্রভাব সাহিত্যের ওপর পড়ে এবং সাহিত্যের প্রভাব পড়ে সমাজের ওপর। সমাজ ব্যবস্থা, সমাজের শ্রেণী বিভাগ, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক সংগঠন, শিক্ষা ব্যবস্থা, সামাজিক ঐতিহ্য, সমাজের বিশেষ আবেগ-অনুভূতি, অতীতের স্মৃতি, ভবিষ্যতের আশা-আকাংখা এসব কিছু্ই নিজেদের স্বাভাবিক ও বিশেষ পদ্ধতিতে আমাদের সাহিত্যকে প্রভাবিত করে।
সাহিত্যের উদ্দেশ্য
এ আলোচনা থেকে একটা কথা অন্তত সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, নিছক আনন্দ দান করা সাহিত্যের খাতিরে সাহিত্য করাও (Art fro Art’s sake) সাহিত্যের উদ্দেশ্য নয়। সাহিত্য সমাজের নিছক প্রতিচ্ছবিও নয়। সমাজের ঘটনা, ইতিহাস, অনুভূতি, আশা-আকাংখা সাহিত্যে রূপায়িত হয় ঠিকই কিন্তু তা সাহিত্যিকের দৃষ্টি-ভংগী ও আবেগ-অনুভূতির জারক রসে সিঞ্চিত হয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপে আত্মপ্রকাশ করে। সাহিত্যকে এই অর্থে জীবন সমালোচনা (Criticism of life) বলা হয়। সাহিত্যকে জীবনের প্রতিনিধিও বলা হয়। কিন্তু তা এই অর্থে যে, সাহিত্যিক তার সাহিত্য সৃষ্টির উপাদানগুলো বাইরের জগত থেকে সংগ্রহ করে। এক্ষেত্রে এ উপাদানগুলোর যথাযোগ্য নির্বাচনের ওপরই সাহিত্যের মূল্যায়ণ নিরূপন নির্ভর করে। কিন্তু সাহিত্য ক্ষেত্রে আসল গুরুত্বের অধিকারী হচ্ছে সাহিত্যিকের মানসিক কার্যক্রম, যা সে ঐ উপাদানগুলো গ্রথিত করার ও সেগুলোকে উপযোগী শব্দের পোশাকে সজ্জিত করে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে কাজে লাগায়। সাহিত্যে ঘটনাবলীর একটা নির্জীব কাঠামোর কোন গুরুত্ব নেই। বরং সাহিত্যিকের অনুভূতিশীল হৃদয় তার মধ্যে যে প্রাণ সঞ্চার করে সেটিই মৌল গুরুত্বের অধিকারী। এ প্রেক্ষিতে যদি বলা হয়, সাহিত্য হচ্ছে সাহিত্যিকের মানসিক কাঠামোয় নির্মিত জীবনের একটি প্রাসাদ, তাহলে তাই বেশী নির্ভুল হবে বলে মনে হয়। ফরাসী দেশের একটি প্রবাদে বলা হয়: শিল্পই জীবন। কিন্তু সেই শিল্পকে শিল্পীর আয়নায় দেখা যেতে পারে। একজন শিল্পী যে আবরণের আড়াল থেকে জীবনের আঙিনায় উঁকি মারে সেটি হচ্ছে তার নিজের ব্যক্তিত্ব। বালা বাহূল্য শিল্পির ব্যক্তিত্ব কোন নিষ্প্রাণ ক্যামেরা নয়। তার সাহায্যে জীবনের কোন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ছবি তোলা সম্ভব নয়। একজন সাহিত্যিক যখন তার মনের পাতায় জীবনের ছবি আঁকে, তার সাথে তার ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতি ও ঝোঁকপ্রবণতা ব্যাপকভাবে মিশে যায়। কাজেই সাহিত্যিক যদি সমাজ থেকে তার সাহিত্যের উপাদান গ্রহণ করে থাকেন তাহলে তা আবার কয়েকগুণ বৃদ্ধি করে সাহিত্যের আকারে সমাজকে ফেরত দেন। শিল্পকারিতার ক্ষেত্রে এই নগদ লাভটাই হচ্ছে সাহিত্যের প্রাণ।
মানুষের জীবনে উদ্দেশ্যহীন কোন বিষয়ের কথা কল্পনাই করা যায় না। সে উদ্দেশ্য ভালো হতে পারে, মন্দ হতে পারে, ছোট হতে পারে, বড়ও হতে পারে। তেমনি সাহিত্যেরও উদ্দেশ্য রয়েছে। উদ্দেশ্য সাহিত্যের ওপর ছেয়ে গেলে চলবে না। তবে সাহিত্য উদ্দেশ্যের ওপর ছেয়ে গেলে কোন ক্ষতি নেই। সাহিত্যকে প্রপাগান্ডায় পরিণত করা কোনক্রমেই উচিত নয়। এদিক দিয়ে ইকবাল সাহিত্য একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত। ইকবাল তাঁর কবিতায় এমন কিছু পরিভাষা ব্যবহার করেছেন যা পূর্ণ সাহিত্য রসে সিঞ্চিত, কিন্তু সাথে সাথে তাঁর আদর্শ ও উদ্দেশ্যের সহজ প্রকাশও তার মধ্য দিয়ে সম্ভব হয়েছে। যেমন তিনি গতি, দ্বন্দ্ব ও সংগ্রাম প্রবণতাকে ‘প্রেম’ নামে আখ্যায়িত করেছেন এবং এই প্রবণতা থেকে তাঁর কাব্যের একটি স্বতন্ত্র চরিত্র সৃষ্টি করেছেন ‘শাহীন’, ‘ইকাব’, ‘কালিন্দর’ ও ‘মর্দে মুমিন’ নামে। এই গতি ও পরিবর্তনপ্রিয়তা এবং দ্বন্দ্ব ও সংগ্রাম প্রবণতাই তাঁর সাহিত্যকে উদ্দেশ্যমুখী করে তুলেছে। যে সাহিত্যিক নিছক ব্যক্তিগত ভাব-কল্পলোকে বিচরণ করে, যে প্রসারিত দৃষ্টির অধিকারী নয়, সমগ্র জীবনকে করতলগত করার মত মতাদর্শ থেকে যে বঞ্চিত, জীবনের খণ্ড খণ্ড ঘটনাবলী, মানবিক কার্যক্রম ও খণ্ডিত আবেগ-অনুভূতিকে একটি বিশ্বজনীন সত্যের ছাঁচে ঢালাই করার ক্ষমতা যার নেই, যে সমগ্র মানবতা ও তার সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা অধ্যয়নের ক্ষমতাই রাখে না, সে আসলে উদ্দেশ্য ও লক্ষাভিসারী সাহিত্য সৃষ্টির মহান দায়িত্ব থেকে দূরে পালিয়ে বেড়ায়। তার দৃষ্টি কখনো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ঘুলঘুলিতে আটকে যায়। কখনো সে বিলাসিতার শুঁড়িখানায় হাত পা ছড়িয়ে চিত হয়ে পড়ে থাকে। কখনো কোন প্রমিকার নরম চুলের ভেতর মুখ লুকিয়ে সে পারিপার্শ্বিককে ভুলে যায়। আবার কখনো হতাশার অফিম খেয়ে নিজেকেও ভুলিয়ে বসে। জীবন তাকে আহ্বান জানাতে থাকে। কর্তব্যের ডাক তার কানে ঘণ্টার মত বাজে। তার ব্যক্তিত্ব, তার ব্যক্তিসত্তা তার হাত ধরে টানতে থাকে। মানবতা তার পেছনে কান্নার রোল তোলে। কিন্তু সে পড়ে থাকে নির্বিকার। অন্যদিকে আদর্শ ও লক্ষাভিসারী সাহিত্যিক ঝাঁপিয়ে পড়ে যুদ্ধক্ষেত্রে শিকারী বাজপাখির মত। হতাশা ও নৈরাশ্যকে গলা টিপে হত্যা করার এবং দুঃখ-শোক, অন্যায়-অকল্যাণ, ফিতনা-ফাসাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম মুখর হয়ে প্রতিকুল পরিবেশের প্রাচীর ভেঙে নতুন দুনিয়া গড়ে তোলার জন্য সে মানুষকে আহ্বান জানাতে থাকে।