ইসলামী সাহিত্যের নিদর্শন
ইসলামী দাওয়াত প্রথম দিন থেকেই সঠিক বিপ্লবের রূপে আত্মপ্রকাশ করে। চিন্তার মোড় ফিরিয়ে দেয়া, কথা ও কাজের ধারার পরিবর্তন করা এবং সমাজ কাঠামো বদলে দেয়াই হয় তার লক্ষ্য। সাহিত্যের যে ধারা জাহেলী যুগ থেকে চলে আসছিল ইসলাম এসে তার খোল নলচে পাল্টে দেয়। জাহেলী যুগের কবিদের সম্পর্কে কুরআনের সূরা আশ্শূ’আরায় বলা হয়: ওয়াশ শু’আরাউ ইয়াত্তাবিউ হুমুল গবূন, আলাম তারা আন্নাহুম ফী কুল্লি ওয়াদিঁই ইয়াহীমূন, ওয়া আন্নাহুম ইয়াকূলূনা মা-লাইয়াফআলূন – “আর কবিরা! ওদের পেছনে তো চলে পথভ্রষ্ট যারা, দেখছোনা তারা মাথা খুঁড়ে ফেরে প্রতি ময়দানে আর বলে বেড়ায় যা করে না তাই।“ এভাবে জাহেলী যুগের সাহিত্য চিন্তার মূলধারাকে ইসলাম ভ্রষ্টতার আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে। জাহেলী যুগের সাহিত্য চিন্তা কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্যাভিসারী ছিল না। বিভ্রান্ত চিন্তার বিভিন্ন অলিতে গলিতে সে চিন্তা ছুটে বেড়াতো। চিন্তার স্থিরতার মাধ্যমে জীবনকে কোন এক লক্ষ্যবিন্দুতে পৌঁছিয়ে দেয়ার দায়িত্ব সেখানে নেয়া হয়নি। তাই জাহেলী যুগের কবিদের কথা ও কাজের কোন মিল ছিল না। বড় বড় বুলি আওড়ানোই ছিল তাদের পেশা। সেই অনুযায়ী কাজ করা বা নিজেদের দাবী অনুযায়ী জীবন গড়ে তোলার দায়িত্বই তারা নেয়নি।
বিপরীতপক্ষে কুরআন যে সাহিত্য ভাণ্ডার মানুষের সামনে তুলে ধরেছে তা একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে তার অনুসারীদের এগিয়ে নিয়ে গেছে। আর কুরআনের অনুসারীরা সে অনুযায়ী নিজেদের জীবন ও সমাজ গড়ে তুলে তার বাস্তবতা প্রমাণ করেছেন। কুরআন প্রথম পর্যায়ে ইসলামী সাহিত্যের একটি মডেল নির্দেশ করেছে। আসলে কুরআন তো কোন সাহিত্যের বই নয়। কুরআন মানুষের জন্য একটি হেদায়েত এবং জীবন যাপনের জন্য একটি খসড়া সংবিধান। এ খসড়া সংবিধান ইসলামী সাহিত্যেরও দিক নির্দেশ করেছে। সূরা আশ শু’আরার উপরে বর্ণিত আয়াতের পরপরই বলা হয়েছে : ইল্লাল্লাযীনা আ-মানু ওয়া আমিলুস সা-লিহাত্ ওয়ানতাসারু মিম বা’দি মা যুলিমূ – “ তবে যারা ঈমান আনে, সৎকাজ করে এবং জুলুমের প্রতিবিধান করে।“ অর্থাৎ ইসলাম এমন কাব্য-সাহিত্যের পক্ষপাতি যা ঈমানী শক্তি ও সৎ কর্মের প্রেরণায় পরিপূর্ণ এবং এই সঙ্গে মানবতাকে জুলুম, অত্যাচার, অন্যায়, অবিচার থেকে মুক্তি দেবার জন্য লড়ে যাচ্ছে।
ইমাম মুসলিম তাঁর হাদীস গ্রন্থের কবিতা অধ্যায়ে বেশ কয়েকটি মূল্যবান হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। সাহাবী শারীদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন: একদিন আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে কোন বাহনের পিঠে সওয়ার ছিলাম। এমন সময় তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, উমাইয়া ইবনে আবী সাল্তের কোন কবিতা কি তোমার মনে আছে? আমি জবাব দিলাম: হাঁ, মনে আছে। তিনি বললেন: পড়। আমি তার একটি কবিতা পড়লাম। তিনি বললেন: আর একটি পড়। আমি আর একটি কবিতা পড়লাম। তিনি বললেন আরো পড়। এমনকি এভাবে আমি তার একশোটি কবিতা পড়লাম।
অন্য কয়েকটি হাদীসে রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, কবি উমাইয়া ইবনে আবী সাল্ত তার কবিতার মধ্যে মুসলিম হবার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। উমাইয়া ইবনে আবী সাল্ত জাহেলী যুগের একজন বড় কবি ছিলেন। জাহেলীয়াতের মধ।যে তাঁর মৃত্যু হয়। কিন্তু তার কবিতার মধ্যে তাওহীদের স্বীকৃতি ও কিয়ামতের ধারণা অত্যন্ত সুস্পষ্ট। তার কবিতার মধ্যে আল্লাহর একজন অনুগত বান্দার কণ্ঠই অনুরণিত হয়েছে। তাই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কবিতা পছন্দ করেছেন ও তাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং বার বার পড়িয়ে শুনেছেন। এ থেকে প্রমাণ হয়, কবিতা ও সাহিত্য চর্চা যদি ইসলামী মূল্যমান, মূল্যবোধ ও ভাবাদর্শের অনুসারী হয় তাহলে অমুসলিম সাহিত্যিকের সাহিত্য কর্ম হলেও ইসলাম তার স্বীকৃতি দেয়।
কবি লবীদের জাহেলী যুগের একটি কবিতা রসূলুল্লাহ (স) খুব বেশী পছন্দ করতেন। তিনি বলেতেন, কবিতায় যেসব সত্য কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে সত্য কথাটি হচ্ছে লবীদের এই কবিতাটি। এতে বলা হয়েছে: ‘জেনে রাখো, আল্লাহ ছাড়া আর সবকিছুই বাতিল।‘ এ কবিতার মধ্যে একটি চিরন্তন সত্যকে তুলে ধরা হয়েছে।
অন্যদিকে অশ্লীল কবিতা ও ইসলামী চরিত্র হননকারী সাহিত্য চর্চাকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অপছন্দ করেছেন। এ প্রসংগে ইমাম মুসলিম সাহাবী আবু সাঈদ খুদরীর (রা) একটি রেওয়ায়েত উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেছেন: মদীনা থেকে ৭৮ মাইল দূরে অবস্থিত আরজ নামক এক পল্লীর মধ্য দিয়ে আমরা রসূলুল্লাহর (স) সাথে যাচ্ছিলাম। এমন সময় আমাদের সামনে এসে পড়লো এক কবি। কবি তার কবিতা পাঠ করে চলছিল। রসূলুল্লাহ (স) বললেন: ‘এই শয়তানটাকে ধরো, তোমাদের কারোর পেট কবিতায় ভরে থাকার চেয়ে পুঁজে ভরে থাকা ভালো।‘
এই কবির কবিতা ছিল অশ্লীল। সমাজ দেহে দুর্গন্ধ ছড়ানো ও পচন ধরানোই ছিল তার কাজ। শেরেক ও আল্লাহর সার্বভোম সত্তার প্রতি আনুগত্যহীনতাই ছিল তার মূল সুর। তাই এই ধরনের সাহিত্যচর্চাকে রসূলুল্লাহ (স) কেবল অপছন্দই করেননি, এর নিন্দা করেছেন জোড়ালো কণ্ঠে। এ থেকে বুঝা যায়, কোন ধরনের সাহিত্যচর্চা রসূলের অভিপ্রেত। একমাত্র ইসলামী ভাবধারার সাথে সামঞ্জস্যশীল সাহিত্যচর্চার তিনি অনুমতি দিয়েছেন।
এ ধরনের সাহিত্য সৃষ্টির প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আটানব্বই হিজরীতে হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয (র) উমাইয়া আমলের তদানীন্তন সাহিত্য ধারাকে উপেক্ষা করেছিলেন। তিনি খলীফা হবার পর আরব, সিরিয়া ও ইরাকের বড় বড় কবিরা তাঁর শানে কাসীদা লিখে দরবারে হাজির হন তাঁর কাছ থেকে পুরষ্কার লাভের আশায়। কিন্তু তিনি কাউকেও তাঁর কক্ষে প্রবেশের অনুমতি দেননি। অবশেষে মহাকবি ফরয্দক সেখানে উপস্থিত হন। তিনি অপেক্ষমান কবিদের ম্লান মুখ দেখে আতংকিত হন। কিন্তু কোনক্রমে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি লাভ করেন। হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয (র) তাঁকে দ্ব্যার্থহীন কণ্ঠে জানিয়ে দেন, তোমাদের ঐ ‘মদাহর’ (বাদশার প্রশংসা গীতি) জন্য বায়তুল মালে একটি কানাকড়িও নির্দিষ্ট নেই। অর্থাৎ মানুষের প্রশংসা কীর্তন ও মানুষের দুর্ণাম গাইবার জন্য ‘মাদাহ’ ও ‘হিজওয়া’ এর যে সাহিত্য ধারা সৃষ্টি হয়েছে, ইসলামী রাষ্ট্র এর পৃষ্ঠপোশকতা করতে পারে না।
ইসলামের প্রাথমিক কয়েকশো বছর ছিল যথার্থ ও আদর্শ ইসলামী সাহিত্য সৃষ্টির যুগ। কিন্তু তখন শ্রেষ্ঠ ইসলামী প্রতিভাগুলো কুরআন, হাদীস, ফিকাহ, উসূল ও ইসলামী সাহিত্য সৃষ্টির দিকে বিশেষভাবে নজর দেয়া হয়নি। বলা যায়, ইসলামী সাহিত্য সৃষ্টির দিকে বিশেষভাবে নজর দেয়া হয়নি। জাহেলী যুগের আরবী কবিতা যে মানে পৌঁছে গিয়েছিল তাকে ডিঙ্গিয়ে নতুন ধারয় কবিতা সৃষ্টি চাট্টিখানি কথা ছিল না। যে কারণে সাবা মু’আল্লাকার (আরবের জাহেলী যুগের সাতজন শ্রেষ্ঠ কবি) অন্যতম কবি লবিদ (রা) ইসলাম গ্রহণের পর কবিতা লেখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। জিজ্ঞেস করলে তিনি বলতেন: কুরআনের সামনে কবিতা লিখতে লজ্জা অনুভব করি। আসলে জাহেলী কবিতার মানকে পেছনে ফেলে কুরআনের মানে উত্তীর্ণ নতুন কবিতার ধারা সৃষ্টি তাঁর পক্ষে সম্ভবপর হয়নি। ফলে দেখা যায় পরবর্তী ইসলামী যুগে যে কাব্য সাহিত্যের সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যে জাহেলী যুগের কাব্য ধারার প্রভাব অত্যন্ত সুস্পষ্ট।
উমাইয়া ও আব্বাসীয় যুগ এক্ষেত্রে বিশিষ্টতা অর্জন করেছে। উমাইয়া যুগ থেকেই মুসলিম আরবরা ব্যাপকভাবে আজমী সভ্যতার সংস্পর্শে আসতে থাকে। এই সাথে অর্থ ও সম্পদের প্রাচুর্যও দেখা দেয়। ফলে আজমীদের সংস্কৃতি চর্চা, সঙ্গীত ও রাগরাগিনী আরবদের মধ্যে ব্যাপক প্রসার লাভ করে। নজ্দ, হিজায, সিরিয়া, ইরাক, মিসর, খোরাসান ইত্যাদি এলাকার সমস্ত বড় বড় শহরে সঙ্গীত চর্চা এবং আজমী ও জাহেলী কায়দায় সাহিত্য সৃষ্টির প্রচেষ্টা ব্যাপকতা লাভ করে। সমগ্র উমাইয়া যুগে ও আব্বাসীয় যুগের প্রথম দিকে মুসলমানরা একটি বিজেতা জাতি হিসাবে দুনিয়ার বুকে প্রতিষ্ঠিত হলেও তাদের বিপ্লবী চেতনা অনেকাংশে স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল। ফলে সাহিত্য ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা থেকে তারা অবস্থান করছিল অনেক দূরে। তাফসীর, হাদীস, ফিকাহ, উসূল প্রভৃতি ক্ষেত্রে মুসলমানরা নতুন শাস্ত্রের উদ্ভাবন করেছিল। দর্শনের ক্ষেত্রে ইসলামী চিন্তাধারা অনুযায়ী আলাদা শাস্ত্র উদ্ভাবনের জন্য তারা প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছিল। এ শাস্ত্রটিকে নতুন চেহারায় উপস্থাপন করার জন্য তারা সংগ্রাম ও সাধনা চালাচ্ছিল শত শত বছর ধরে। কিন্তু সাহিত্য ক্ষেত্রে ইসলামী সাহিত্যের চেহারাকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরার জন্য কোন ব্যাপকতর আন্দোলন ও প্রচেষ্টার খবর আমরা এখনো পাইনি। হযরত আলী (রা), হযরত আয়েশা (রা) থেকে শুরু করে উমাইয়া ও আব্বাসীয় যুগের অনেক বড় বড় ইসলামী ব্যক্তিত্ব কবিতা ও সাহিত্য চর্চা করেছেন কিন্তু কাব্য-সাহিত্য চর্চা তাদের কাছে দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ের গুরুত্ব লাভ করেছিল। ফলে কাব্যধারার মোড় ফিরিয়ে দেয়া এবং ইসলামী সাহিত্য চর্চার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করার প্রচেষ্টা চালানো তাদের পক্ষে সম্ভবপর হয়নি। অন্তত হযরত আলী (রা) যে ধারায় কবিতা চর্চা করেছেন তা ছিল তদানিন্তন ইসলামী সাহিত্যের একটি আদর্শ। এই ধারাটি সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে পরিপুষ্টি লাভ করলে ইসলামী সাহিত্যের একটি সুস্পষ্ট, উজ্জ্বল ও পূর্ণাঙ্গ নিদর্শন আমাদের সামনে থাকতো।
কিন্তু তা পুরোপুরি সম্ভব হয়নি। এই ধারাই হয়তো সামনের দিকে এগিয়ে এসেছে কিন্তু দুর্বল ও ক্ষীণতর স্রোত হিসাবে, প্রবল বন্যার বেগে নয়। ফলে জাহেলী ধারার প্রবল আক্রমণে বার বার মাঝপথে এর আয়ু ফুরিয়ে গেছে।
আবদুল কাহের জুরজানী ও তাঁর মত আরও কোন কোন আরবী সাহিত্য সমালোচকের মতে উমাইয়া ও আব্বাসীয় যুগের সাহিত্য যথাযথ সমালোচনার অভাবে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী সাহিত্যের রূপ নিতে সক্ষম হয়নি। মোট কথা এই যুগে ইসলামী সাহিত্য সৃষ্টির প্রচেষ্টায় কোন ব্যাপকতা দেখা যায়নি। যার ফলে ইসলামী সাহিত্যের কোন সুষ্ঠু ধারা গড়ে ওঠেনি। ‘তারিখুল আদাবিল আরাব’ – এর লেখক ডঃ শওকী দইফ উমাইয়া যুগের আরবী সাহিত্যের ছয়টি প্রবল প্রতাপান্বিত কেন্দ্রের কথা উল্লেখ করেছেন। কেন্দ্রগুলো হচ্ছে: (১) মদীনা ও মক্কা, (২) নজ্দ ও হিজায, (৩) কূফা ও বসরা, (৪) খোরাসান, (৫) সিরিয়া ও (৬) মিসর। পরবর্তীকালে এই কয়টি কেন্দ্র ছাড়াও আন্দালুসিয়ায় আর একটি শক্তিশালী কেন্দ্র গড়ে ওঠে।
কিন্তু দুঃখের বিষয় এই সব ক’টি কেন্দ্রই জাহেলী যুগের সাহিত্য চিন্তাকে ঝেড়ে ফেলতে সক্ষম হয়নি। বরং ধীরে ধীরে ইসলামী ভাবধারা ও মূল্যবোধের বিপরীত মেরুতে অবস্থানকারী চিন্তাদর্শনের কাছে তারা নতি স্বীকার করেছে। আব্বাসীয় যুগের যে গল্প সাহিত্য ‘আলফু লাইলিউ ওয়া লাহ’ (আরব্য রজনী) বিশ্ব সাহিত্যে বিশেষ স্থান অধিকার করেছে এবং এক সময় দুনিয়ার বড় বড় ভাষায় ও সাহিত্যে অনুদিত হয়ে গল্প সাহিত্যের ক্ষেত্রে নতুন দিক নির্দেশনা দিয়েছিল, তার মধ্যেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে যথার্থ ইসলামী মূল্যবোধের বিকৃতি দেখা যায় এবং ইসলামী সাহিত্যের মূল ভাবধারার অভাব গভীরভাবে অনুভূত হয়।
পার্শ্ববর্তী ফারসী সাহিত্যে আত্তার, রুমী প্রভৃতি সুফীবাদে আক্রান্ত কবিদের কবিতায় ইসলামী সাহিত্যের বেশ কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়। তবে তাঁদের মধ্যে শেখ সাদীর কবিতাই সবচেয়ে বেশী উজ্জ্বল।
আধুনিক যুগের কবি আল্লামা ইকবাল উর্দু ভাষায় সাহিত্যের এমন নিদর্শন সৃষ্টি করেছেন যা বিংশ শতাব্দীতে ইসলামী সাহিত্যের বিপ্লবী চেতনাকে পরিপূর্ণ রূপ দানে সক্ষম হয়েছে। ইসলামী ভাবধারা যে উন্নতমানের বিশ্বজনীন সাহিত্য সৃষ্টিতে সক্ষম ইকবালের সাহিত্যে তার প্রমাণ। ইকবাল সাহিত্য সুফিবাদে আক্রান্ত নয় বরং ইসলামের আধ্যাত্ম চিন্তায় পরিপূষ্ট, যাকে হাদীসের পরিভাষায় বলা হয়েছে ‘ইহ্সান’। হযরত জিব্রীল আলাইহিস সালাম রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে ইহ্সানের যে চেহারা তুলে ধরেছিলেন তা হচ্ছে এই: “তা’বুদুল্লাহা কাআন্নাকা তারা-হু ফাইন্ লাম তাকুন তার-হু ফাইন্নাহু ইয়ারা-ক।‘ অর্থাৎ “এমনভাবে আল্লাহর বন্দেগী কর যেন তুমি তাঁকে দেখছো। আর যদি তাঁকে দেখতে না পাও তাহলে অবশ্যই তিনি তোমাকে দেখছেন।“ নিজেকে এমন পর্যায়ে উন্নীত করতে হবে যার ফলে আল্লাহর অস্তিত্ব প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করা যায়। এটিই হচ্ছে ইসলামী অধ্যাত্মিকতার চরমতম পর্যায়। এ পর্যায়ে আল্লাহ আল্লাহর জায়গায় অবস্থান করবেন এবং বান্দা বান্দার জায়গায় অবস্থান করে নিজের মধ্যে বন্দেগীর পরিপূর্ণতা সৃষ্টি করবে। বান্দা নিজেকে আল্লাহর মধ্যে বিলীন করে দেবে না। কারণ বান্দার ব্যক্তি-সত্তা, খুদী ও অহম্ – এর বিকাশই ইসলামের লক্ষ্য, তার বিলোপ নয়। ইকবাল সাহিত্যে এই আধ্যাত্ম দর্শনের বিকাশ ঘটেছে।
এভাবে ইকবাল ইসলামের চিন্তাধারাকে কুরআন ও হাদীস থেকে সরাসরি গ্রহণ করেছেন। প্রচলিত চিন্তার ও মতবাদের প্রতাপে তিনি কোথাও আড়ষ্ট হননি। এ ছাড়া পাশ্চাত্য চিন্তার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করার সময় তিনি কোথাও তার বিভ্রান্তি, ক্ষতি ও ধ্বংসকারিতা সম্পর্কে যুগ মানসকে সতর্ক করতে ভোলেননি। কুরআন ও হাদীসের স্বচ্ছ চিন্তার মাধ্যমে তাঁর সাহিত্যে একটি নতুন চিন্তা জগত সৃষ্টি করেছেন। এ জগতের প্রতিটি বাসিন্দা জাগতিক শান্তি ও সমৃদ্ধির সাথে সাথে পরকালীন সাফল্যের সীমান্তেও পৌঁছে গেছে। বাংলায় ফররুখ আহমদ বিশেষ পদ্ধতিতে প্রায় তাঁরই ধারার অনুসরণ করেছেন। ফররুখ সাহিত্যে আমরা একদিকে দেখি জীবন সংগ্রাম। এই জীবন সংগ্রামের মর্দে মুমিনের আত্মা ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত নয়। হতাশার বিরুদ্ধে তার জিহাদ। হতাশার সাত সাগর পারি দিয়ে সে হেরার রাজ তোরণে উপনীত হবেই। অন্যায়-শোষণ-জুলুমের বিরুদ্ধে তার জিহাদ। এই অন্যায়-জুলুমের টুটি চেপে ধরার জন্য সে উমরের মত সিপাহসালারের অনুসন্ধান করে ফিরছে।
আধুনিক আরবী, উর্দু ও ফারসী ভাষায় বেশ কিছুকাল থেকে ইসলামী সাহিত্য আন্দোলন চলছে। বাংলা ভাষায়ও আজ এর যথার্থ সময় উপস্থিত। বাংলার মধ্যযুগ থেকে মুসলিম সাহিত্য সাধনার যে একটা স্বতন্ত্র ধারা চলে আসছে তার মধ্যেই রয়েছে এই ইসলামী সাহিত্যের বীজ। আসলে ইসলামী সাহিত্য আন্দোলন ইসলামী জীবন বিধান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেরই একটি অংশ। তাই বাংলা ভাষায় আজ ইসলামী সাহিত্য সৃষ্টিকে একটি আন্দোলনের রূপ দিতে হবে। এ আন্দোলনের মূল কথা হবে:
আল্লাহর প্রতি ঈমান
আখেরাতে বিশ্বাস ও
মানবতার কল্যাণ
এ আন্দোলনের একটি মাত্র কর্মসূচী: বাংলা সাহিত্যে ইসলামী মূল্যবোধের উজ্জীবন।
— সমাপ্ত —