ইসলামী সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য
সাহিত্যের সাথে সমাজের সম্পর্ক নিবিড়। প্রত্যেক সমাজের কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তেমনি সমাজের সাথে সম্পর্কিত সাহিত্যও কিছু বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়। সে নিজের মধ্যে এমন কিছু ঐতিহ্য সৃষ্টি করে নেয় যা আর কোথাও পাওয়া যায় না। একক পরিবেশ ও একক ঐতিহ্য এবং আকীদা-বিশ্বাসের একাত্মতা সব কিছু মিলে একটা বিশেষ ধরনের চিন্তাধারার জন্ম দেয়। বিশেষ চিন্তাধারা আবার একটা বিশেষ প্রকাশভঙ্গীর উদ্ভব ঘটায়। অনেক সময় দেখা যায় বক্তব্য এক হওয়া সত্ত্বেও তার ওপর চিন্তা করার, তাকে কার্যকর করার, তার মধ্যে উত্থাপিত সমস্যাগুলো সমাধান করার এবং তার ফলাফল থেকে প্রভাব গ্রহণ করার পদ্ধতি প্রত্যেক সমাজের আলাদা। মুসলমান ও তাদের সাহিত্যের ব্যাপারেও একথা সত্য। ইসলাম এমন একটা ধর্ম যা জীবনের সমস্ত নীতি-পদ্ধতির ওপর কর্তৃত্ব করে। সে দীন ও দুনিয়ার জীবনের মধ্যে কোন পার্থক্য করে না। জীবনের প্রত্যেকটি বিভাগের জন্য ইসলাম বিস্তারিত বিধান তৈরি করেছে। তার কাছে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক জীবনের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। সে অর্থনৈতিক ও সমাজ জীবনের জন্য যেমন আইন ও বিধান দেয় তেমনি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক জীবনের জন্যও বিধান দিয়ে থাকে। ইসলামে বিশ্বাসী কোন ব্যক্তি ধর্মীয় জীবনের আওতাধীনে মসজিদে যাবে, নামাজ পড়বে আবার বৈষয়িক জীবনে নেমে সুদের কারবার করবে, অন্যের জমি বেআইনীভাবে দখল করবে এবং সমাজ জীবনের আঙিনায় এসে অশ্লীল নাচ-গানের আসর বসাবে ও মদের নেশায় চুর হয়ে থাকবে আর এমন সাহিত্য সৃষ্টি করবে যা সমাজের নৈতিক চরিত্র ধ্বংস করে দেবে, ইসলাম কোন ক্ষেত্রে এর অনুমতি দেয় না। এটা কেবল ইসলামের কথাই নয়, যে কোন অবস্থায় সেগুলো পুরণ করিয়ে নেবার জন্য সে সচেষ্ট থাকে। কোন বুদ্ধিমান সমাজ নিজেকে নৈরাজ্যের শিকার করতে চায় না। কাজেই ইসলামী সমাজও কোন অবস্থায়ই মুসলমানদের ওপর এনার্কি ও নৈরাজ্য চাপিয়ে দিতে চায় না। যদি খোদা-না-খাস্তা কখনো এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়ে যায়, তাহলে তখন আমাদের জীবন আর স্বাভাবিক মানুষের তথা আশরাফুল মাখলুকাতের জীবন থাকবে না। বরং সে জীবন তখন হয়ে দাঁড়াবে মানবেতর – ‘বাল হুম আদল’ – বরং তার চাইতেও খারাপ। আমার মনে হয় এ ধরনের সমাজ ব্যবস্থা কোন বিবেকবান ব্যক্তির কাম্য হতে পারে না। প্রত্যেক বুদ্ধিমান ব্যক্তিই চাইবেন তার জীবনের জন্য কোন পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা ও বিধান। প্রত্যেকেই নিজের জীবনের বিভিন্ন বিভাগের জন্য কোন নীতি পদ্ধতি নির্ণয় করে নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারণ করে নিতে চাইবেন। পরস্পরের মধ্যে কোন বিরোধ দেখা দিলে এই সমগ্র আইন ও বিধানকেই নিজেদের একমাত্র ফয়সালাকারী হিসাবে মেনে নেবেন। ইসলাম কুরআনের আকারে আল্লাহর বিধানের একটি সংকলন মুসলমানদের দান করেছে। এই বিধানগুলো এবং এই সঙ্গে রসূলের বাণীসমূহ ও তাঁর সুন্নাতই হচ্ছে মুসলমানদের জীবনের জন্য একটি বিশ্বজনীন ব্যবস্থা। মুসলমান দুনিয়ার যেখানেই বাস করুক না কেন, এই বিধান ও সুন্নাতের সামনে অকপটে মাথা নত করে। জীবনের সব সমস্যার সমাধান তারা খোঁজে এরই মধ্যে। সব বিষয়ে তারা এখান থেকেই নেয় দিক নির্দেশনা।
কাজেই ইসলামী সাহিত্যও নিজেকে এই বিধানের আওতার বাইরে রাখতে পারে না। এর বাইরের কোন মানদণ্ড অন্যের কাছে যতই মূল্যবান হোক না কেন, ইসলামী সাহিত্যের কাছে তার কানাকড়িও মূল্য নেই। ইসলামী সাহিত্য জীবনের সমগ্র আওতা থেকে বিচ্ছিন্ন কোন বিশেষ ধরনের সাহিত্যকর্ম নয়। বরং সমগ্র জীবনের সাথে এর সমান সম্পর্ক। জীবনের সমগ্র বিভাগের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ভারসাম্যপূর্ণ সাহিত্য সৃষ্টিই এর কাজ।
ইসলামী সাহিত্য কী?
একটা অদৃশ্য মহান ক্ষমতাসম্পন্ন সত্তার হাতে মানুষের প্রাণ। মানুষকে তিনি সৃষ্টি করেছেন। জগত তাঁরই সৃষ্টি। মানুষকে তিনি স্বাধীন ক্ষমতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। জগতের অন্যান্য প্রাণী ও বস্তুকে তা দেননি। তাই মানুষ তার সমাজ সভ্যতা সৃষ্টি করে, গড়ে তোলে। তার রূপ আজ এক রকম, আগামীকাল অন্য রকম। অতীত যেমনটি ছিল বর্তমানে তেমনটি নেই। অথবা তার সম্পর্কে বলা যায় যে, তার এরকম নয় ওরকম হওয়া উচিত। কিন্তু প্রাণী বা বস্তু জগতের বেলায় এ ধরণের কোন কথা বা নীতি খাটে না। মানুষের সমাজ-সভ্যতার রূপ এই যা ছিল, যা আছে, যা হবে বা হওয়া উচিত তার সবটুকুই ইসলামী সাহিত্যের বিষয়বস্তু। ইসলামী সাহিত্য জীবনের প্রতিনিধিত্ব করে। আর জীবন বলতে যা ছিল, যা হচ্ছে বা হবে এবং যা হওয়া উচিত সবগুলোকেই বুঝায়। ব্যাপক অর্থে বলতে গেলে ইসলাম যে সমস্ত নৈতিক মূল্যবোধ সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে, যে সাহিত্যে এই মূল্যবোধগুলো পত্র-পল্লবে শাখা-প্রশাখায় চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে, সেটিই ইসলামী সাহিত্য। জগত ও জীবনের অসংখ্য দিক রয়েছে। ইসলামী সাহিত্য এই সব দিকের ওপর ইসলামের নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে আলোকপাত করে। এ থেকে পরোক্ষভাবে একথাও প্রমাণ হয় যে, ইসলামী সাহিত্য একটি উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যাভিসারী। জীবনের যেমন একটি উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য রয়েছে ইসলামী সাহিত্যও তেমন একটি উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে কেন্দ্র এগিয়ে চলে। তাহলে দেখা যায়, ‘আর্ট ফর আর্টস সেক’ ধরনের কোন সাহিত্য যদি থেকেই থাকে তবে ইসলামী সাহিত্যে তার কোন স্থান নেই। আমাদের জীবন যদি উদ্দেশ্যবিহীন না হয়ে থাকে তাহলে আমাদের সাহিত্য উদ্দেশ্যবিহীন হবে কেন? আমাদের জীবন যেমন কয়েকটা নিয়মের অধীন তেমনি আমাদের সাহিত্যও। ইসলামী সাহিত্যে ব্যাপকতা আছে, চিন্তা ও লেখার স্বাধীনতাও আছে। অন্য কোন সাহিত্যে এগুলো যে চেহারায় আত্মপ্রকাশ করেছে ইসলামী সাহিত্যে তাঁর অবকাশ নেই। অন্য সাহিত্য নিজেকে নৈতিক বোধ, বিধি-নিষেধ ও নিয়ম-শৃংখলার উর্ধ্বে রাখতে চায়। কিন্তু ইসলঅমী সাহিত্যে তা সম্ভব নয়।
একজন সচেতন মুসলিম, যে তার জীবনের সব ক্ষেত্রে ইসলামী বিধান মেনে চলে, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক-ব্যবহারিক জীবনের প্রতি পদক্ষেপে ইসলাম নির্ধারিত সীমার মধ্যে অবস্থান করে, যার চলাফেরা, ওঠাবসা, লেন-দেন, কথা-বার্তা চিন্তা-ভাবনা সবকিছু ইসলামের গণ্ডীর মধ্যে আবর্তিত হয়, সে কেমন করে কেবলমাত্র সাহত্য ক্ষেত্রে, কবিতা-গল্প-উপন্যাস-নাটক লেখার সময় একটি অনৈসলামী মতবাদের আওতাধীন হযে যাবে? তবে সাহিত্য তথা কবিতা ও গল্প ইসলামী হওয়া মানে নিশ্চয়ই কেউ একথা মনে করবেন না যে, তার মধ্যে অযু-গোসল ও নামাজ রোজার মাসলা-মাসায়েল থাকবে বা সেখানে হবে কেবল হামদ ও না’তের অবাধ রাজত্ব অথবা ধর্মের গুণকীর্তনই হবে সে সাহিত্য অঙ্গনের বিষয়বস্তু। বরং ইসলামী সাহিত্য, ইসলামী গল্প ও ইসলামী কবিতা তাকেই বলা হবে যার মধ্যে জীবনের এমন সব নীতি ও মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটবে যেগুলোকে ইসলঅম মানবতার জন্য কল্যাণপ্রদ গণ্য করেছে এবং যার মধ্যে এমন সব মতবাদের বিরোধিতা করা হবে যেগুলোকে ইসলাম মানবতার জন্য ক্ষতিকর বলে চিহ্ণিত করেছে। কুরআন যে ধরনের মানুষ তৈরি ও যে ধরনের চরিত্র গঠনের উদ্যোগ নেয় এবং তাদের সুস্পষ্ট চিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরে। আর কোরআন যে ধরনের মানুষকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে, এবং যে ধরনের চরিত্রকে অনভিপ্রেত গণ্য করেছে ইসলামী কবিতায় ও গল্পে তার সম্ভাবনার সমস্ত পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়। ইসলামী সাহিত্য তাকেই বলা হবে যা মানবতাকে নৈতিকতার অনৈসলামী মূল্যবোধ থেকে সরিয়ে আনে এবং তাকে ইসলামী মূল্যবোধের দিকে আহ্বান জানায়। আবার ইসলামী কবিতা ও গল্প হচ্ছে এমন এক পর্যায়ের সাহিত্য যার পিছনে সক্রিয় চিন্তাধারা ও মন-মস্তিষ্ক ইসলামী চিন্তার সীমারেখাকে মেনে নিয়েছে এবং বিষয়বস্তু উপস্থাপনা, বর্ণনা ও প্রকাশের ক্ষেত্রে ইসলাম আরোপিত নৈতিক বিধি নিষেধকে নিজের জন্য অবশ্য পালনীয় গণ্য করেছে। ইসলামী সাহিত্যে মানুষের সাধারণ আশা-আকাংখা এমন স্বাভাবিক পদ্ধতিতে মূর্ত হয়ে ওঠে যার ফলে তা একটি সৎ ও সুন্দর জীবন গঠনের ক্ষেত্র তৈরি করে বা তাতে সহায়তা দান করে।
কোন জাতি যখন ইসলামকে তার নিজের জীবন বিধান হিসাবে গ্রহণ করে তখন সে কেবল নিজের জীবনকে সেই অনুযায়ী ঢেলে সাজায় না বরং সেই জীবন বিধানের সাথে তার চিন্তাগত ও আবেগময় সম্পর্ক এবং মানব জাতির প্রতি স্বাভাবিক প্রীতি তাকে আল্লাহর এই অফুরন্ত অনুগ্রহটি অন্যের নিকট পৌঁছিয়ে দিতে উদ্বুদ্ধ করে। সেই জাতির প্রত্যেক ব্যক্তির মনে আকাংখা জাগে, দীনের যে অন্তহীন কল্যাণের সাগরে সে অবগাহন করেছে অন্যরাও তার স্বাদ অন্তত কিছুটা হলেও আস্বাদন করুক। টলস্টয়, গ্যেটে, রবীন্দ্রনাথ, ইলিয়ট, বার্ণার্ড’শ তাঁদের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য কর্মের মাধ্যমে তাদের হৃদয়ের অনুভূতি ও মতবাদ যদি তার যথার্থ স্বাভাবিক কাঠামোয় পাঠকের দ্বারে পৌঁছিয়ে দিতে সক্ষম হন তাহলে সাদী, ইকবাল ফররুখ সক্ষম নন কেন? ইকবাল তো ইসলামের সমগ্র চিন্তা দর্শনকে কবিতার নরম আবরণে ঢেকে বিশ্ব মানবতার দরবারে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। কোন অনুভূতিশীল মানুষের মানসিক প্রতিক্রিয়ার সফল প্রকাশের নাম যদি আর্ট হয়ে থাকে, তাহলে একজন ভালো মুসলিম একজন ভালো আর্টিস্ট বা ভালো সাহিত্যিক (যেহেতু সাহিত্য আর্টেরই একটি অঙ্গ) হতে পারবে না কেন? বরং একজন মুসলিম সাহিত্যিক আন্তরিকতা ও হৃদয়ানুভুতির দিক দিয়ে সবার উর্ধ্বে স্থান পাবার যোগ্য। কারণ আল্লাহ ভীতি তার হৃদয়ের তারগুলোকে এত বেশী সংবেদনশীল বানিয়ে দেয় যার ফলে মানুষের সামান্যতম দুঃখ বেদনা তার মনে দোলা লাগাবার জন্য যথেষ্ট হয়। সে কেবল উপমা-উৎপ্রেক্ষার তেলেসমাতি দেখিয়ে পাঠককে মুগ্ধ করে না বরং তার সাহিত্য হয় যুদ্ধক্ষেত্রের উদ্দাম সঙ্গীতের মতো, রক্তের প্রতিটি কণায় তা প্রচণ্ড আলোড়ন তোলে। মানুষকে জীবনের গতিশীলতার সাথে পরিচিত করিয়ে দেয়। ইকবালের কথায় –
“তু রাহে না ওয়ারদে শওক হ্যায় মনযিল না কর কবুল
লায়লা ভী হামনাশী হো তো মাহমিল না কর কবূল।“
প্রেম পথের পথিক তুমি?
কোন মনযিলে নিয়োনা বিশ্রাম
লায়লা তোমার পার্শ্বচরী হলেও
উটের হাওদায় করো না আরাম।
তার কলম কেবল আনন্দের গীত গায়না বরং একই সংগে গায় জাগরণী সংগীত, যা মানুষের ভেতরের ঘুমন্ত মানবতাকে জাগিয়ে তোলে। সে নিজের সমালোচনা শক্তির সাহায্যে একজন অভিজ্ঞ সার্জনের মত সমাজ দেহের অসুস্থতার মূল কেন্দ্রে হাত রাখে, অত্যন্ত সতর্কতা ও আন্তরিকতার সাথে ফোঁড়া টিপে টিপে তাঁর সব পুঁজ বের করে দেয় এবং এভাবে সমগ্র সমাজ দেহের রক্ত পরিশুদ্ধ করে।
ইসলামী সাহিত্য সমগ্র মানব জাতির কল্যাণকামী। এ সাহিত্য প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সবরকমের জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর। ধনী-দরিদ্রের ওপর যে জুলুম করে, শক্তিশালী দুর্বলের ওপর যে নির্যাতন চালায়, মালিক শ্রমিককে উৎপীড়নের যে স্টীমরোলারে পিষে স্তব্ধ করতে চায়, সাদারা কালোদের বিরুদ্ধে যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ অভিযান চালায়, সমাজ ব্যক্তির ওপর এবং ব্যক্তি সমাজের ওপর যে অন্যায় বাড়াবাড়ি করে- এ সাহিত্য সে সবের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে। ইসলাম কোন স্থবির আকীদা বিশ্বাস ও নিষ্প্রাণ ধর্ম নয়। বরং একটি জীবন্ত ও গতিশীল জীবন দর্শন ও জীবন ব্যবস্থা। মানব জীবনের সমস্ত বিভাগে ইসলাম নেতৃত্ব দেয়। বস্তুবাদী জীবন মানুষের মধ্যে পশুত্ব ও হিংস্রতার জন্ম দিয়েছে। নৈতিতকতা ও আধ্যাত্মিকতার কাঠামো ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। ঈমানের স্ফুলিংগ স্তিমিত হয়ে গেছে। আল্লাহ প্রেমের আগুন নিভে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। মানবতা আজ একরাশ ছাই ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই আজ এমন সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়োজন সবচেয়ে বেশী অনুভূত হচ্ছে, যার ভিত্তি আল্লাহ ও আখেরাত বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত। একদিকে তা উন্নত চিন্তার আলোকে উদ্ভাসিত হবে আবার অন্য দিকে তাতে থাকবে ঈমান ও প্রত্যয়ের উষ্ণতা।
একজন ইসলামী সাহিত্যিক কোন ধরনের বিষয়বস্তু নিয়ে তার সাহিত্যের প্রাসাদ গড়ে তুলবে? এটা একটা বিচার্য বিষয়। ইসলামী সাহিত্যিক একদিকে যেমন ইসলামের ওপর পূর্ণ বিশ্বাসী হবে তেমনি অন্যদিকে হবে পুরোপুরি সমাজ সচেতন। মানুষের ও মানুষের সমাজের সমস্যাগুলো সে হৃদয় দিয়ে অনুভব করবে। মানবতার কল্যাণাকাংখা তার হৃদয়ের প্রতিটি তন্ত্রীতে অনুরণিত হবে। এজন্য যে বিষয়বস্তুগুলোকে সে তার কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে ছড়িয়ে দেবে সেগুলো হচ্ছে:
এক: ইসলামের তিনটি মৌলিক বিশ্বাস – তাওহীদ, রিসালাত ও অখেরাত। এ তিনটি বিষয়বস্তুকে কবিতায়-গল্পে-উপন্যাসে এমনভাবে উপস্থাপন করতে হবে যাতে তা সমগ্র পরিবেশকে প্রভাবিত করে। এজন্য অবশ্যই একজন ইসলামী কবি ও ইসলামী গল্পকারকে তার পরিবেশ ও সমাজ চিন্তার কাঠামোর বিরুদ্ধে সারাক্ষণ যুদ্ধে লিপ্ত থাকতে হবে। এ মৌলিক বিশ্বাস তিনটিকে একটি বিশ্বজনীন জীবন দর্শনের চিন্তাগত ভিত্তি হিসাবে পেশ করতে হবে। এ তিনটি বিশ্বাসের ভিত্তিতে পরিবেশের ধারা ও ঘটনার মোড় পরিবর্তন করতে হবে।
দুই: ইসলামী চরিত্র ও নৈতিক গুণাবলী। ইসলামী কবি ও গল্পকার ঐতিহাসিক ঘটনাবলী উপস্থাপনার মাধ্যমে তার মধ্যে সক্রিয় নৈতিক গুণাবলী ও বিষয়সমূহ সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরবেন। অন্যদিকে বর্তমান নৈতিকতা বিগর্হিত পরিবেশ ও অসুস্থ সমাজ চরিত্রের মুখোশ উন্মোচন করবেন। এ সংগে ইসলামের নৈতিক চারিত্রিক গুণাবলীর আলো না জ্বালিয়ে সমগ্র সমাজ অংগনকে আলোকিত করবেন। উন্নত নৈতেক চারিত্রিক গুণাবলীকে পরিপূর্ণতা দান করার জন্য নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাঠানো হয়েছিল। ইসলামী সাহিত্যিকদের দায়িত্ব হচ্ছে তাদের লেখনীর মাধ্যমে সমাজদেহে এই গুণাবলীকে প্রসারিত ও প্রতিষ্ঠিত করা।
তিন: আমাদের সমাজ পরিবেশ। প্রথমে দেশের সমাজ পরিবেশ। পরবর্তী পর্যায়ে আন্তর্জাতিক সমাজ পরিবেশ। এছাড়াও মানসিক ও চিন্তাগত এবং নৈতিক পরিবেশ। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশ। সব রকমের পরিবেশ। এসব পরিবেশ আমাদের প্রতিকুল। এদের সাথে আমাদের চিন্তাগত বিরোধ সুস্পষ্ট। কাজেই এই বিরোধীয় পরিবেশ ও তার কাঠামোয় প্রচণ্ড আঘাত হানতে হবে। নতুন পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য আমাদের সাহিত্যের সমস্ত শক্তিকে নিয়োগ করতে হবে।
চার: আমাদের চতুর্থ বিষয়বস্তু হচ্ছে নারী। এর কারণ হচ্ছে, বর্তমান সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থায় নারীকে যেখানে স্থাপন করা হয়েছে এবং বস্তুবাদী সমাজ ব্যবস্থা নারীকে যেভাবে উপস্থাপন করেছে আমরা তা থেকে তাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন জায়গায় স্থাপন করেত এবং ভিন্নভাবে উপস্থাপন করতে চাই। নারীকে গৃহের ও পরিবারের মধ্যমনি বানিয়ে আমরা যে উন্নত সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ও পরিবারে শান্তির নীড় রচনা করতে চাই, আমাদের কবিতায় ও গল্পে একদিকে যেমন তার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠবে তেমনি অন্য দিকে পাশ্চাত্য সমাজ নারীকে কর্মক্ষেত্রে নামিয়ে এনে তাকে পুরুষের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতার দৌড়ে ঠেলে দিয়ে যে সমাজ গড়ে তুলেছে তার ক্ষতি, বিপর্যয়, বৈপরীত্য ও ধ্বংসের চিত্রও তাতে ফুটে উঠবে।
পাঁচ: আমাদের পঞ্চম বিষয়বস্তু হচ্ছে পুঁজিবাদ ও কমিউনিজম। আধুনিক জাহেলিয়াতের এ দুটি সন্তান আমাদের দেশে এবং অন্যান্য দেশেও যে ধ্বংস ডেকে আনছে তার প্রত্যেকটা পর্যায় আমাদের জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। বিশেষ করে কমিউনিজম বিপ্লব আনার জন্য যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছে তার সাথে আমাদের সুস্পষ্ট বিরোধ। ইসলামী বিপ্লবের পদ্ধতি সম্পর্কে মুসলমানদের সঠিকভাবে অবহিত করার জন্য আমাদের এ বিষয়বস্তুটি অবলম্বন করতে হবে। এই সংগে দারিদ্র্য ও শোষণের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম হতে হবে বিরামহীন।
ছয়: দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক সুবিচার। একদিকে যেমন দুর্নীতির বিরুদ্ধে ইসলামী সাহিত্য হবে সোচ্চার তেমনি অন্যদিকে ইসলামের অর্থনৈতিক সুবিচারের দৃষ্টান্তও তুলে ধরতে হবে।
সাত: আমাদের সপ্তম বিষয়বস্তু হচ্ছে ইসলামী আন্দোলন ও ইসলামী বিপ্লব। ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত এটিই হবে আমাদের সবচাইতে আবেগময় বিষয়বস্তু। ইসলাম একটা আন্দোলন এবং ইসলামী সাহিত্য ও আন্দোলনের ফসল। মুসলমানদের জাগ্রত করার জন্য এ আন্দোলনের মূল চিন্তাধারা ও পদ্ধতি তাদের সামনে তুলে ধরা তাই এর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু।
ইসলামী সাহিত্যিকের দায়িত্ব
সাহিত্যিক সমাজ থেকে আলাদা কোন সত্তার নাম নয়। বরং তিনি হচ্ছেন সমাজের সবচেয়ে অনুভূতিশীল সদস্য। ইসলামী সাহিত্যিক যেমন ইসলামী সমাজের সবচেয়ে অনুভূতিশীল প্রতিনিধি তেমনি তার সাহিত্য ইসলামী সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে। ইসলাম তার সদস্যদের ওপর যে দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছে ইসলামী সাহিত্যিককে তা থেকে অব্যহতি দেয়নি।
ইসলাম তার বিধানের প্রতি আনুগত্যকে শুধু মুসলমানদের নিজের সত্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেনি। সারা দুনিয়ার মানুষকে ইসলামী বিধান মেনে চলার জন্য আহ্বান জানানোর দায়িত্বও মুসলমানের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। মুসলমান নিজে ভালো কাজ করবে এবং অন্যকেও দূরে রাখার চেষ্টা করবে। এভাবে মুসলমান সারা দুনিয়ার মানুষকে ভালো কাজ করার ও খারপ কাজ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করবে। মুসলিম সাহিত্যিক যে সাহিত্য সৃষ্টি করবে তা একদিকে সমাজে ন্যায়, কল্যাণ ও সৎবৃত্তির প্রসার ঘটাবে এবং অন্যদিকে অসৎবৃত্তি, অন্যায় ও অকল্যাণের স্পর্শ থেকে সমাজকে দূরে রাখবে। তাই এই ভালো ও মন্দ, ন্যায় ও অন্যায়, সৎ ও অসৎ, কল্যাণ ও অকল্যাণের মানদণ্ড কী হবে? এগুলো কি কোন আপেক্ষিক বিষয়? কুরআন এগুলোর যে মানদণ্ড দিয়েছে মুসলিম সাহিত্যিকের জন্য একমাত্র সেই মানদণ্ডই গ্রহণীয় হবে। ভালো ও মন্দ, হালাল ও হারামের নীতি কুরআন ও হাদীসই সুস্পষ্ট করে দিয়েছে এবং তাই হবে একমাত্র গ্রহণীয় নীতি। নিজের জন্য যা ভালো বা মন্দ, পরিবারের জন্য যা ভালো বা মন্দ, সমাজের, জাতির ও দেশের জন্য যা ভালো বা মন্দ, সাহিত্যের ক্ষত্রে তাই ভালো বা মন্দ। এক অবস্থায় এক পরিবেশে যা ভালো অন্য অবস্থায় অন্য পরিবেশে তা মন্দ আবার এক সময় যা ভালো অন্য সময় তা মন্দ – ভালো মন্দ সম্পর্কে এই যে ধারণা এটা ইসলামী মূলনীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। কাজেই একজন মুসলিম কবি ও মুসলিম গল্পকার ভালো ও মন্দের যাচাইয়ের ক্ষেত্রে কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত সৎবৃত্তি ও কল্যাণের প্রসারে এবং কুরআন হাদীসে বর্ণিত অসৎবৃত্তি ও অকল্যাণকে সমাজের বুক থেকে চিরতরে উৎখাত করার কাজে তিনি আত্মনিয়োগ করবেন।
কুরআনে এই ভালো ও মন্দ এবং ন্যায় ও অন্যায়কে বুঝাবার জন্য “মারূফ” ও “মুনকার” এর পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। বলা হয়েছে: কুনতুম খাইরা উম্মাতিন উখরিজাত্ লিন্নাস, তা’মুরুনা বিল মা’রূফি ওয়া তানহাওনা আনিল মুনকার – “তোমরাই শ্রেষ্ঠ মানবগোষ্ঠী, কারণ তোমাদের উত্থিত করা হয়েছে সমগ্র বিশ্ব মানবতার জন্য, তোমরা সৎ কাজের আদেশ করবে ও অসৎ কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখবে।“
কুরআনের এক স্থানে যথার্থ সৎবৃত্তির বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, “আসল সৎবৃত্তির অধিকারী হচ্ছে সেই ব্যক্তি যে আল্লাহর ওপর, আখেরাতের ওপর, ফেরেশতাদের ওপর, আল্লাহর কিতাবের ওপর এবং পয়গম্বরদের ওপর ঈমান আনে আর আল্লাহর প্রতি ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের ধন সম্পদ আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতিম, গরীব, মুসাফির ও প্রার্থীদের জন্য ব্যয় করে, নামাজ পড়ে, যাকাত দেয়, নিজের ওয়াদা পালন করে এবং বিপদ, যুদ্ধ ও কঠিন সময়ে অবিচল থাকে।“
“মুমিন অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করে না, ব্যভিচার করে না, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না এবং যেখানে কোন আজে বাজে কাজ হতে থাকে সেখান থেকে ভদ্রভাবে চলে যায়।“
দুনিয়ার প্রচলিত ধর্মগুলোর মধ্যে ইসলামই একমাত্র ধর্ম যে তার অনুসারীদের মধ্যে সাহসিকতা ও শৌর্য বীর্য প্রদর্শনের অনুভূতি সৃষ্টির পূর্ণ প্রচেষ্টা চালিয়েছে। দুনিয়ার অন্যান্য ধর্ম শক্তিকে খারাপ জিনিস গন্য করে কিভাবে শক্তির হ্রাস ও বিলোপ সাধন করা যায় এ জন্য কঠোর সাধনা করেছে। কিন্তু কুরআন মুসলমানদের এ কথা বুঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, শক্তি আসলে কোন খারাপ জিনিস নয়, তবে অনেক খারাপ জায়গায় ও খারাপভাবে তা ব্যবহার করা হয়। শক্তিকে ব্যবহার করতে হবে হক্কে প্রতিষ্ঠিত করার এবং বাতিলকে খতম করার জন্য। সৎ লোকদের হাতে যদি শক্তি না থাকে তাহলে তারা অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম, অবিচার বন্ধ করবে কিভাবে? এ শক্তি না থাকলে তারা বাতিলের মোকাবিলা করবে কিভাবে এবং কিভাবে জিহাদ করে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করবে? তাই কুরআনের বহু জায়গায় শক্তি সঞ্চয় করে বাতিলের সাথে জিহাদ করার জন্য সর্বতোভাবে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে:
“নিজেদের শক্তি-সামর্থ ও ঘোড়া প্রস্তুত রাখো। এর সাহায্যে আল্লাহর দুশমনদের এবং যাদের তোমরা জাননা তাদের ভীত করতে পারবে।“
“হে ঈমানদারগণ! যখন তোমরা যুদ্ধের ময়দানে কাফেরদের মোকাবিলা করতে থাক তখন পিছে হটোনা। আর যে সেদিন যুদ্ধের কোন কৌশল হিসাবে অথবা মুসলমানদের কোন বাহিনীর সাথে মিলে যাওয়ার জন্য ছাড়া অন্য কোন কারণে পিছে হটবে সে আল্লাহর গযব লাভের অধিকারী হবে এবং তার স্থান হবে জাহান্নাম।“
মুনাফিকদের উল্লেখ করে বলা হয়েছে:
“বিপদের সময় উপস্থিত হলে তাদের দিকে একবার চেয়ে দেখো, তারা কেমন আতংকগ্রস্তের মতো তোমাদের দিকে চেয়ে আছে, তাদের চোখদুলো এমনভাবে ঘুরছে যেন তাদের ওপর মৃত্যুর বিভীষিকা ছেয়ে গেছে।“
“যখন এমন কোন আয়াত নাযিল হয় যার মধ্যে যুদ্ধের নির্দেশ রয়েছে তখন যাদের হৃদয় রোগগ্রস্থ তাদের তোমরা দেখবে, তারা তোমাদের দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন মৃত্যু বিভীষিকায় তারা বেহুশ হয়ে গেছে।“
অন্যদিকে বীরত্ব ও সাহসিকতা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে:
“হে নবী! মুমিনদের যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ কর।“
“যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাকো, তাহলে নিজেদের ওপর থেকে মৃত্যুকে সরিয়ে নাও।“
“আল্লাহ মুমিনদের ধন-প্রাণ জান্নাতের বিনিময়ে কিনে নিয়েছেন।“
অনেক স্থানে আমাদের বদ অভ্যাসগুলো চিহ্ণিত করা হয়েছে এবং সেগুলোর হাত থেকে আমাদের চরিত্রকে মুক্ত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরস্পরকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করো না। হয়ত দ্বিতীয় পক্ষ তোমাদের চেয়ে ভালো হবে … … … কাউকে খোঁটা দিয়ো না এবং বিকৃত নামে স্মরণ করো না।“
“হে ঈমানদারগণ! বেশী বেশী অনুমানমূলক ধারণা থেকে দূরে থাকো। অনেক অনুমানমূলক ধারণা মূর্তিমান গোনাহের রূপ নেয়। আর আড়ি পেতো না এবং পরস্পরের গীবত করো না। তোমাদের কেউ কি নিজের মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করবে?”
কুরআন মুসলমানদের মধ্যে কোন্ ধরনের চরিত্র সৃষ্টি করতে এবং তাদের চরিত্রে কোন্ ধরনের নৈতিক গুণাবলীর সমাবেশ দেখতে চায়, উপরের কয়েকটি বিচ্ছিন্ন আয়াতের উপস্থাপনা থেকে তা মনে হয় বেশ কিছুটা সুস্পষ্ট হয়েছে। মুসলমানদের কার্যাবলী যাচাই করার মানদণ্ড কী হবে, সমাজে কোন ধরনের নীতি ও আচার-আচরণ সম্প্রসারণের সুযোগ দেয়া হবে, কোন আবেগ-অনুভূতি সাহিত্যে স্থান পেতে পারে, কোন ধরনের অসৎবৃত্তি থেকে সমাজকে মুক্ত রাখতে হবে – এসব কিছু সম্পরকে আমরা এ আয়াতগুলো থেকে দিক নির্দেশ পেতে পারি।
কাজেই এক কথায় বলা যায়, ইসলাম আমাদের যে নৈতিক মূল্যবোধগুলো দান করেছে সেগুলোই হবে আমাদের ইসলামী সাহিত্যের মূল ভিত্তি আর এখান থেকে একথাও সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, ইসলামী সাহিত্য ও সাহিত্যিকের মূল গাইড বুক হচ্ছে কুরআন।
ইসলামী সাহিত্যিক সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন কোন ব্যক্তিসত্তা নয়। মুসলিম সমাজে যে অবস্থা ও পরিবেশ বিরাজ করে একজন ইসলামী সাহিত্যিক সেই সমাজেরই চিত্রকে তাঁর সাহিত্যে রূপায়িত করে। কিন্তু মুসলিম সমাজ সব সময় আদর্শ হয় না। পূর্ণাঙ্গ ইসলামী সমাজ হয় মুসলিম সমাজের আদর্শ। এই আদর্শের কাছাকাছি পৌঁছার জন্য সে চেষ্টা করতে থাকে। তার এই প্রচেষ্টায় ইসলামী সাহিত্যিক সহায়তা দান করে। ইসলামী সাহিত্যিক মুসলিম সমাজের এমন কোন চিত্র রূপায়তি করতে পারে না যা ইসলামী সমাজের মান আরো নামিয়ে দেয়। তবে সমাজ পরিবর্তন ও সংশোধনের উদ্দেশ্যে এমন কোন চিত্র অবশ্যি সে অংকন করতে পারে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে ইসলামী সাহিত্যিক তার হৃদয়ের দরদ ও আন্তরিকতা দিয়ে গলদগুলো অনুভব করে। গলদের চিত্র অংকন করার সময় তার মনে একটুও আনন্দের দোলা লাগে না। তার কণ্ঠে হতাশার সুর শ্রুত হয় না। আর বিদ্রুপ ও অবিশ্বাসের কণ্ঠস্বর থেকে তো সে অবস্থান শত শত কিলোমিটার দূরে।
ইসলামী সাহিত্যে প্রেম প্রসঙ্গ
একটি ছেলে একটি মেয়ের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতে পারে। এর বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। যেমন তাদের দু’জনের চিন্তার ঐক্য, কথা বলার শালীনতা যা হৃদয় স্পর্শ করে, চরিত্র মাধুর্য, দৈহিক সৌন্দর্য ইত্যাদি। কিন্তু অধিকাংশ মনস্তত্ববিদের মতে যৌবনের স্বাভাবিক কামনা তাদের এই পারস্পারিক আকর্ষণের প্রধানতম কারণ। যদিও সামাজিক, নৈতিক, ধর্মীয় ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে তাকে দাবিয়ে দিতে হয়। আর কোন কোন কামনাকে দাবিয়ে দেয়া এবং কোন কোন আকাংখাকে অপূর্ণ রাখা এমন কোন মারাত্মক ব্যাপার নয়, যেমন অনেকে মনে করে থাকেন। আসলে জীবনে ভারসাম্য সৃষ্টির জন্য এর প্রয়োজন হয়। অনেক সময় জীবনের স্বার্থেই আমাদের অনেক কামনা বাসনা, আশা-আকাংখা পরিহার করতে হয়। এর ফলে বাড়াবাড়ি থেকে আমরা বেঁচে যাই। আর সমাজ জীবনে কোন এক ব্যক্তির সব বাসনা পূর্ণ হওয়া বা একটি বাসনার সীমাহীন চাহিদা পূরণ হওয়া কখনো সম্ভব হয়ে ওঠে না। প্রত্যেক ব্যক্তির আকাংখা পূরণের কোন একটি সীমা থাকতে হবে। এই নির্ধারিত সীমারেখাটি ঐ ব্যাক্তির জন্য যেমনি, তেমনি সমাজের জন্যও কল্যাণকর। কারণ, যদি এক ব্যক্তি তার আকাংখাকে লাগামহীন রাখার দাবী পোষণ করে তাহলে তাকে অন্যদের এ দাবী মেনে নিতে হবে। আর যদি প্রত্যেকের এ দাবী মেনে নিতে হয় তাহলে কেউ কি নিজের উদ্দেশ্য ও চাহিদা অনুযায়ী নিজের আকাংখা পূর্ণ করতে পারবে? কারণ এখানে একজনের আকাংখা পূরণ অন্যের বঞ্চনার কারণ হবে। ফলে বিরোধিতা ও সংঘর্ষ দেখা দেবে ব্যাপক হারে। মনস্তত্ববিদদের অনেকেই বিশেষ করে ফ্রয়েড ও তাঁর অনুসারীগণ এই কামনা ও আকাংখাকে দাবিয়ে দেবার অনিবার্য পরিণতির ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছেন। আমার মতে এ ব্যাপারে তাঁরা খুব বেশী বাড়াবাড়ি করেছেন। মানুষের স্বভাব ও মেজাজকে তারা কাঁচের পেয়ালার মতো ঠুনকো মনে করেছেন, পড়লেই ভেঙ্গে যাবে এবং এমনভাবে ভেঙ্গে যাবে যে তা আর জোড়া লাগানো যাবে না। মানুষের কোন কামনায় আঘাত লাগলেই তার মেজাজের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়, মানে তা একেবারে বিগড়ে যায়, একথা পুরোপুরি সত্য নয়। মানুষের মেজাজ অনুধাবন করার ব্যাপারে এখানে একটি মৌলিক ভুল করা হচ্ছে। যে মহান পরাক্রমশালী সত্তা আমাদের জীবন এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন, যার ফলে একজনের কামনা পূরণ ডেকে আনে অন্যজনের বঞ্চনার অনিবার্য পরিণতি, তিনিই মানুষকে তার কামনা পূর্ণ না হওয়ার ও আকাংখার বঞ্চনার জন্য সবর করার শিক্ষাও দিয়েছেন। আর এটিই ছিল ইনসাফের দাবী। নয়তো জীবন হয়ে পড়তো একটা বিরাট বোঝা। কালের প্রবাহে বড় বড় আঘাতের দাগও মুছে যায়। কঠিন শোকাবহ ঘটনা যা হৃদয়ের পরতে পরতে অসহনীয় বেদনার রেশ ছড়িয়ে দিয়েছিল তাও একদিন মানুষ ভুলে যায়। প্রত্যেক দুর্ঘটনার কিছুদিন পর মানুষ আবার জীবনের পথে চলতে থাকে। আবার আশা আনন্দ নরম নরম পা ফেলে নিঃশব্দে তার জীবন আঙ্গীনায় প্রবেশ করে। জীবনের যে সব কলি শুকিয়ে গিয়েছিল সেগুলো আবার তরতাজা হয়ে ওঠে। হাসি-আনন্দে আবার তার জীবন ভরে ওঠে। পেছনের দুর্ঘটনার শেষ রেশটুকুও মিলিয়ে যায়।
কাম শক্তিকে কয়েক পদ্ধতিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। এক, সাময়িক সুখ ও তাৎক্ষণিক আনন্দ লাভ করার জন্য চোখ বন্ধ করে যেখানে ইচ্ছা ও যেভাবে ইচ্ছা একে ব্যবহার করা যায়। এভাবে এর ভাণ্ডার শুণ্য করে দেয়া যায়। এর ব্যবহারের দ্বিতীয় পদ্ধতি হচ্ছে, এর ভাণ্ডার থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী কিছু শক্তি নিয়ে বংশ রক্ষার কাজে ব্যয় করা যেতে পারে। আর বাদবাকী শক্তি জীবনের অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজে লাগানো যেতে পারে। মনস্তত্ববিদগণ একে Sublimation বা উর্ধ্বপাতন নাম দিয়েছেন অর্থাৎ তরল পদার্থকে উত্তাপের সাহায্যে বাষ্পীভূত করে পুণরায় তাকে তরল করা। মনস্তত্ববিদগণের মতে কামশক্তিকে জীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। এটা এমন একটা ভাণ্ডার যার সাহায্যে কেবল বংশ রক্ষা, বংশ বৃদ্ধি বা যৌন পরিতৃপ্তি লাভই নয়, জীবনের আরো বহু প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করা যায়।
ইসলামের দৃষ্টিতে আমরা দু’টি যুবক যুবতীর বৈধ প্রেমকে অন্যায় গণ্য করতে পারি না। তবে সে প্রেমকে অবশ্যি নৈতিকতার সীমানার মধ্যে অবস্থান করতে হবে। যেমন একটি ছেলে একটি মেয়েকে ভালবাসতে পারে তার দৈহিক ও মানসিক সৌন্দর্যের জন্য, তার চরিত্র মাধুর্য এবং চিন্তা ও ভাবধারার ভারসাম্য ও একাত্মতার জন্য। তার এই ভালোবাসা বৈধ পথে অগ্রসর হয়ে তাকে লাভ করে নিজের জীবন সঙ্গিনী বানাবার জন্য বৈধ প্রচেষ্টা চালাবার সব রকমের অধিকার রাখে। হয়ত এই ধরনের ভালোবাসা তাকে উন্নতির উচ্চ শিখরে পৌঁছিয়ে দিতেও সাহায্য করতে পারে। যদি তার প্রেমিকা উন্নত জাগতিক যোগ্যতার অধিকারিনী হয় তাহলে নিজেকে তার যোগ্য প্রার্থী হিসাবে দাঁড় করাবার জন্য নিশ্চিতভাবেই সে নিজেও সমপর্যায়ের উন্নত যোগ্যতা অর্জনের জন্য প্রচেষ্টা চালাতে পারে। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যি গোপনে বা প্রকাশ্যে প্রেম চর্চা করার অনুমতি তাকে দেয়া যেতে পারে না। কারণ এর ফলে বিপর্যয় ও অনর্থ সৃষ্টির আশংকা রয়েছে। দ্বিতীয়ত তার প্রেমিকাকে লাভ করার আকাংখা যেন এমন পর্যায়ে পৌঁছে না যায় যার ফলে প্রেমিকাকে লাভ করতে ব্যার্থ হয়ে সে আত্মহত্যা করতে বসে অথবা বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে দেওয়ানায় পরিণত হয়। কারণ এখানে পৌঁছেই ভারসাম্য শেষ হয়ে যায়। এর পর থেকে শুরু হয় প্রান্তিকতার পথ। আর ইসলাম ভারসাম্যকেই ভাল পথ বলে ঘোষণা করেছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: খাইরুল উমূরি আওসাতুহা – “দুই প্রান্তের মধ্যবর্তী পথটিই ভালো।“ এছাড়াও এখানে এসে একথা চিন্তা করতে হবে যে, বহু রকমের নৈতিক ও সামাজিক নীতির কারণে আমরা অনেক সময় নিজেদের আকাংখা ও কামনা-বাসনা ত্যাগ করে থাকি, তাহলে এক্ষেত্রে কামনাটি এত বেশী গুরুত্ব লাভ করলো কেন যে, এর ব্যর্থতার ফলে আমাদের মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে এবং আমরা জীবন বিসর্জন দিতে প্রস্তুত হয়ে যাবো? অথচ আমরা জানি না ভবিষ্যতের গর্ভে কী নিহিত আছে। যার জন্য আমরা আজ প্রাণ দিতে প্রস্তুত হচ্ছি সে জিনিসটি আগামীকাল আমাদের জন্য কল্যাণ না অকল্যাণ ডেকে আনবে তাও আমরা জানিনা। অনেক ক্ষেত্রে আমরা দেখি বড়ই আশা করে আমরা কোন জিনিস গ্রহণ করি কিন্তু পরে সেটি আমাদের বিরাট ক্ষতি করে। তখন আমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকি, হে আল্লাহ! এর হাত থেকে আমাদের বাঁচাও। এটিকে কুরআনে এভাবে বলা হয়েছে: আসা আন তাক্রিহু শাইয়ান ওয়া হুয়া খাইরুল লাকুম ওয়া আসা আন তুহিব্বু শাইয়ান ওয়া হুয়া শার্রুল লাকুম – “হতে পারে তোমরা একটি জিনিসকে অপছন্দ কর অথচ সেটি তোমাদের জন্য কল্যাণকর আবার একটি জিনিসকে তোমরা নিজেদের জন্য পছন্দ কর অথচ সেটা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর।“
এ ধরনের আয়াতে আবেগের ভিত্তিতে যে সব কাজ করা হয় এবং যে সব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তার ওপর চূড়ান্ত লাভ ক্ষতিকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। ইসলাম যে স্বভাবধর্ম এবং মানব প্রকৃতির সব রকমের দুর্বলতা ও মানুষের আভ্যন্তরীণ শক্তির প্রতি যে তার পূর্ণ নজর রয়েছে তাও এ আয়াত থেকে প্রমাণ হয়। এখান থেকেই বুঝা যায় যে, মানুষের প্রেমে পাগল হয়ে যাওয়ার কোন স্বীকৃতিই ইসলামে নেই।
তবে এই সংগে একতাও সুস্পষ্ট যে, নৈতিকতার সীমানায় অবস্থান করে কোন পুরুষ কোন মেয়েকে ভালোবাসলে তাকে অপরাধ হিসাবে গণ্য করা যাবে না বরং তাকে ভাল বলা যাবে। কুরআনে বলা হয়েছে: “আমি মেয়েদের সৃষ্টি করেছি যাতি তাদের মাধ্যমে তোমরা মানসিক প্রশান্তি লাভ করতে পারো।“ আর কোন বিবেকবান ব্যক্তি একথা অস্বীকার করতে পারবে না। একজন সদাচারিণী মহিলা একজন পুরুষের হৃদয়কে পরিপূর্ণ শান্তির সাগরে অবগাহন করাতে পারে, এতে কোন সন্দেহ নেই। দুনিয়ার কোন সম্পদ এই মানসিক প্রশান্তির বিনিময় হতে পারে না একথা সবাই জানে। শুধু এখানেই শেষ নয়, কুরআনের বর্ণনা মতে সদাচারিণী স্ত্রীরা জান্নাতেও স্বামীদের সাথে থাকবে। অর্থাৎ সদাচার কেবল দুনিয়ায় তাদের একত্রিত হয়ে যাওয়ার ভিত্তি হয়নি, আখরাতে তাদের এক সাথে জীবন অতিবাহিত করারও ভিত্তি হিসাবে গৃহীত হয়েছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, নৈতিকতার সীমার মধ্যে অবস্থানকারী ভালোবাসা যদি যথার্থ সদাচারের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ও অগ্রসর হয় তাহলে তা চিরন্তন হতে পারে।
ইসলাম যেহেতু স্বভাবধর্ম, তাই তার সামাজিক আইনে প্রেম প্রবণতার পরিতৃপ্তির পুরোপুরি ব্যবস্থা করা হয়েছে। একজন পুরুষ কোন মেয়েকে ভালোবাসতে পারে। বৈধ পদ্ধতিতে তাকে নিজের জীবন সঙ্গিনী করতে পারে। ইসলাম স্ত্রীর সাথে ভালো সামাজিক সম্পর্ক স্থাপন এবং তাদের সাথে সদ্ব্যবহারের কেবল হুকুমই দেয়নি বরং একে ইবাদত হিসাবে গণ্য করেছে। বিপরীত পক্ষে খৃষ্টধর্মে নারী সত্তাকে ঘৃণার চোখে দেখতে বলা হয়েছে। তাকে বলা হয়েছে “পাপের পুত্তলী” তার সাথে সম্পর্ক রাখাকেও পাপ বলা হয়েছে।
এই অস্বাভাবিক নীতির যে পরিণতি আমরা দেখেছি তা হচ্ছে, এই নীতি নির্দেশকারীগণ এবং বাহ্যত এ নীতি বাস্তবায়নকারী গোষ্ঠী পাদরী ও যাজকগণ সবচাইতে বেশী কামপ্রবণতার শিকারে পরিণত হয়েছেন। পাশ্চাত্য সমাজ বিজ্ঞানী লেকেভ (LECKEV) তাঁর “ইউরোপীয় নৈতিকতার ইতিহাস” (HISTORY OF EUROPEAN MORALS – VOLII) গ্রন্থে লিকেছেন: “মধ্যযুগে ব্যভিচার মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। পাদরীরা প্রকাশ্যে নিজেদের মেয়েদের সাথে অবৈধ সম্পর্ক রাখতেন। পাদরীদের বিয়ে না করার রেওয়াজ ধীরে ধীরে প্রবল হয়ে উঠছিল। কিন্তু বাস্তব জীবনে তাদের ব্যভিচার চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। তাদের আমল তাদের আকিদার সাথে সহযোগিতা করতে সক্ষম হয়নি।“ বাট্রান্ড রাসেল তার “বিয়ে ও নৈতিকতা” (MARRIAGE AND MORALS) গ্রন্থে লিখেছেন: “মধ্যযুগের ইতিহাসবেত্তাগণের অধিকাংশই গীর্জার মধ্যে পাদরীদের এমন সব কক্ষের উল্লেখ করেছেন যেগুলো আসলে ছিল ব্যভিচারের আড্ডাখানা। এই কক্ষগুলোর চার দেয়ালের মধ্যে অসংখ্য নিষ্পাব মানব শিশুর প্রাণনাশ করা হয়েছিল। বারবার নির্দেশ দেয়া হতো, পাদরীরা যেন তাদের মা বোনদের সাথে অবস্থান না করে। কিন্তু এ নির্দেশের কোন বাস্তব প্রভাব পড়তো না।“
এরপর আসে সেই প্রেমের কথা – নিছক দু’টি যুবক যুবতীর দৈহিক কামনার মধ্যেই যার অবস্থান। এটা আসলে একটি যৌন কামনা ও যৌন উপভোগ এবং নেহাত স্বার্থবাদিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। সাহিত্যে একে খামাখা প্রেম নামে অভিহিত করা হয়েছে।
আসলে উঠতি বয়স ও যৌবন এমন একটি সময় যা ছেলেমেয়েদের জীবন-চরিত্র গঠনে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সময় একবার যদি তারা ভুল পথে পা বাড়ায় তাহলে সারাজীবন অনুশোচনা করা ছাড়া তাদের আর কোন পথ থাকে না। অনভিজ্ঞতার কারণে তারা ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ও ভুল পথে এগিয়ে যায়। তাই এক্ষেত্রে অভিভাবকদের সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। ছেলেমেয়েদের তাদের নৈতিক দায়িত্ব ও সামাজিক কর্তব্য সম্পর্কে যথঅযথভাবে অবহিত করতে হবে এবং জীবনের এই সংকটকালে এবং সবচাইতে জটিল পরিস্থিতিতে তাদের সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করতে হবে। এক্ষেত্রে ইসলামী সাহিত্য তাদের এই সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করবে।
ইসলামী সাহিত্য ও অশ্লীলতা
অশ্লীলতা শুধু বিষয়বস্তুতে নয়, প্রকাশভঙ্গীতেও। অশ্লীলতা আকারে-ইঙ্গিতে। বিষয়বস্তুর প্রাথমিক স্তর বিন্যাসে। ইসলামী সাহিত্যের কোন ক্ষেত্রে কোন পর্যায়েও অশ্লীলতার প্রতি সমর্থন নেই। অশ্লীলতা হচ্ছে একটা বিকৃত রুচি। আর এই বিকৃতি রুচির সাথে ইসলামী সাহিত্যিকের হৃদ্যতা কেমন করে বাড়তে পারে? “বুঈস্তু লিউতাম্মিমা মাকা-রিমাল আখলাক” – আমাদের নবীকে যেখানে আমাদের চরিত্রে নৈতিক দিকগুলোকে আরো বেশী শালীন, আরো বেশী রুচিশীল ও আরো বেশী পূর্ণতা দান করার জন্য পাঠানো হয়েছিল সেখানে আমরা কেমন করে অশালীন পরিবেশ সৃষ্টি করার দায়িত্ব নিতে পারি। কুরআনে মুমিনের রুচিবোধ সম্পর্কে বলা হয়েছে: “ওয়া ইযা মাররু বিল লাগবি মাররু কিরা-মা” – যখন তারার কোন বাজে বা অশালীন কাজের কাছ দিয়ে যায়, তখন কোন আগ্রহ প্রকাশ না করে একান্ত অনীহা দেখিয়ে ভদ্রভাবে সে স্থান অতিক্রম করে। রসিয়ে রসিয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে এটাকে বর্ণনা করা কোন মুসলিম সাহিত্যিকের কাজ হতে পারে না।
সাহিত্যে যৌনতা প্রসংগে এই কথাই বলা যায়। স্বামী স্ত্রীর গোপন বিষয় তৃতীয় ব্যক্তির সামনে বলা নবী করিম (স) নিষিদ্ধ করেছেন। আসলে এটা সাহিত্যের বিষয় নয়। সাহিত্য ক্ষেত্রে একে টেনে এনে সাহিত্যের কোন উন্নতি সাধন করা হয়নি এবং এ ধরনের কোন সাহিত্যের কল্যাণকামী চরিত্র থাকতে পারে না। এ ধরনের সাহিত্য চরিত্র ক্ষয়, চরিত্র নাশ ও চরিত্র ধ্বংসই করতে পারে শুধু। কাজেই ইসলামী সাহিত্যের সাথে এর দূরবর্তী কোন সম্পর্কও থাকতে পারে না।
অশ্লীলতা ও যৌন প্রসংগকে যারা সাহিত্যের আওতাভুক্ত করেন জীবন সম্পর্কে আসলে তাদের দৃষ্টিভঙ্গীও আলাদা। মানুষকে ও মানুষের জীবনকে তারা যে দৃষ্টিতে বিচার করেন ইসলামের সাথে তার বিরোধ সুস্পষ্ট। ফ্রয়েডের দৃষ্টিডতে মানুষকে তারা দেখেন একটি যৌন জীব হিসাবে। মানুষ ও পশুর মধ্যে এক্ষেত্রে তারা কোন পার্থক্যই করেন না। আর জীবনকে তারা শুধু উপভোগ করার কথাই চিন্তা করেন। জীবন ও যৌবন তাদের কাছে একটি সম্পদ। এজন্য দুনিয়ায় যতদিন থাকা যায় ততদিন এই সম্পদ দু’টো উপভোগ করার জন্য তারা হাজারো পন্থা উদ্ভাবন করেছেন। ধর্ম তাদের জীবন চিন্তায় পংগুত্ব বরণ করার এবং আখেরাতের জীবন সম্পর্কে সংশয় জাগার পরই তারা এই নতুন ভোগবাদী জীবন দর্শন রচনা করেছেন।
এই জীবন দর্শনের সাথে ইসলামের বিরোধ অত্যন্ত সুস্পষ্ট। ইসলাম জীবন ও যৌবনকে একটি মূল্যবান সম্পদ মনে করে এজন্য যে, এটি আল্লাহর একটি আমানত। এর মধ্যে বেঁচে থাকার ও বংশ রক্ষার একটা তাগিদ রয়েছে। কন্তু যে তাগিদটি এর সমগ্র সত্তাকে ঘিরে রেখেছে সেটি হচ্ছে আল্লাহর আনুগত্যে একে পুরোপুরি সোপর্দ করা। এমনকি বেঁচে থাকার ও বংশ রক্ষার তাগিদটিও এই দ্বিতীয় তাগিদটির আওতাধীনে থাকবে। কাজেই এখানে পাশবিক জীবন উপভোগের কোন অবকাশ নেই। জীবন ও যৌবনের মানবিক ব্যবহারকেই এখানে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। সমগ্র মানব জাতির জন্য জীবন ও যৌবনের এই ব্যবহারকেই ইসলাম কল্যাণকর গণ্য করে।
কাজেই ইসলামী সাহিত্যে অশ্লীলতা ও যৌনতার প্রসঙ্গটি কোথাও বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করতে পারে না। এমনকি আকারে ইঙ্গিতে অশ্লীলতা ও যৌনতার প্রকাশও শোভনীয় মনে করা হয়নি। যেমন ব্যভিচার সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেছেন: ওয়া-লা তাক্রাবুয যিনা ইন্নাহু কা-না ফা-হিশাতাঁও ওয়া সা-আ সাবীলা – “আর ব্যভিচারের ধারে কাছেও যেও না। নিঃসন্দেহে তা নির্লজ্জতা ও খারাপ পথ।“ এখানে ব্যভিচারের ধারে কাছে যেতে নিষেধ করে এ কথাই প্রকাশ করা হয়েছে যে, ব্যভিচার করা তো দূরের কথা, ব্যভিচারের প্রতি উৎসাহী করে তোলে, ব্যভিচারের আকাংখা সৃষ্টি করে, ব্যভিচারের ইচ্ছা মনের মধ্যে জাগ্রত করতে পারে এমন ধরনের পরিবেশ সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
এ থেকে ইসলামী সাহিত্যে অশ্লীলতার সামান্য আমেজ সৃষ্টিও যে বাঞ্ছণীয় নয়, তা সহজেই অনুমান করা যায়।
এ তো গেল স্বেচ্ছাকৃতভাবে অশ্লীলতা ও যৌনতা সৃষ্টির প্রয়াস সম্পর্কে ইসলামী সাহিত্যের ভূমিকার কথা।। তবে ঘটনার যথার্থতা ও বিপরীত পরিবেশ উপস্থাপনার ক্ষেত্রে অশ্লীলতার কতটুকু স্বীকৃতি বা তার কোন ধরনের প্রকাশভঙ্গী সাহিত্যের আওতাভূক্ত, তা অবশ্যি বিচার্য বিষয়। এক্ষেত্রে আমার মনে হয় শুধু গা ছুয়ে দেবার চেষ্টা করাটুকুই যথেষ্ট। গা ধরে নাড়া দিতে থাকা ইসলামী সাহিত্যের শালীনতাবোধের পরিপন্থী। এক্ষেত্রেও প্রকাশভঙ্গী হতে হবে সংযত। আর এই ছুয়ে দেয়া ও স্পর্শ করার ব্যাপারটারও একটা সীমাবদ্ধতা আছে। এ প্রসংগে কুরআনে বর্ণিত হযরত ইউসূফ ও ইম্রাআতুল আযীযের (মিসরের শাসনকর্তার স্ত্রী) দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে। ইমরাআতুল আযীয ইউসূফকে ঘরের মধ্যে আটকে ফেলে যখন তার কাপড় ধরে টানতে শুরু করে দিয়েছে সে সময়কার অবস্থাটা আল্লাহ এভাবে বর্ণনা করেছেন: ওয়া লাকাদ হাম্মাত্ বিহী ওয়া হাম্মা বিহা লাউলা আর্ রাআ বুরহা-না রাব্বিহ’ – “সেই মেয়েটি তার দিকে এগিয়ে এলো এবং ইউসূফ তার দিকে এগিয়ে যেতো যদি না সে তার রবের সুস্পষ্ট প্রমাণ দেখতে পেতো।“ মিসরের শাসনকর্তার স্ত্রীর জন্য প্রেমের এমনি আরো কিছু সংযত বর্ণনা কুরআনে পাওয়া যায়। এর সাহায্যে ঘটনার গভীরে পৌঁছুতে পাঠককে একটুও বেগ পেতে হয় না।
আল্লাহ চাইলে এখানে ঘটনার পুরোপুরি একটি ছবি আঁকতে পারতেন। শাসনকর্তার স্ত্রী কি করলেন এবং ইউসুফ তার দিকে কিভাবে এগিয়ে গেলেন, যাতে বুঝা যাচ্ছিল যে তিনি তার ডাকে সাড়া দিতে চাচ্ছেন – এসব কিছুর কোন বিস্তারিত বর্ণনা এখানে করেননি। কিন্তু এমন শালীন শব্দ ব্যবহার করেছেন যাতে ঘটনার পুরো একটি কল্পচিত্র পাঠকের মনের আয়নায় ভেসে ওঠে। অশালীন ঘটনাবলী বর্ণনার এই ইসলামী কায়দা কুরআন আমাদের শিখিয়েছে।
এই সাথে কুরআনের যুগে আরবী সাহিত্যে যৌনতা ও অশ্লীলতার চরম বিকাশের কথাটিও সামনে রাখা দরকার। তবেই কুরআনের এই সংযত প্রকাশভঙ্গীর সাহিত্যিক মূল্যায়ণ সম্ভবপর হবে এবং অশ্লীল ঘটনাবলী বর্ণনার সীমারেখাও চিহ্ণিত হয়ে যাবে।
ইসলামী সাহিত্য ও মুসলিম সাহিত্য
আমাদের আলোচনা থেকে ইসলামী সাহিত্যের একটা আলাদা ছবি ভেসে উঠলেও একে মুসলিম সাহিত্যের সাথে এক করে দেখার চেষ্টাও হয়তো কেউ করতে পারেন। তাই ইসলামী সাহিত্য ও মুসলিম সাহিত্যের মধ্যে একটা সুস্পষ্ট সীমারেখা টেনে দেয়াও জরুরী মনে করি।
এ প্রসঙ্গে সর্বপ্রথম আসতে হয় ইসলাম ও ইসলামী সমাজের কথায়। ইসলাম ও ইসলামী সমাজ কোন নতুন বিষয় নয়। দুনিয়ার প্রথম মানুষ ছিলেন ইসলামের অনুসারী আর প্রথম সমাজ ছিল ইসলামী সমাজ। আজকের বিশ্ব-সমাজের সর্বত্র তাই ইসলামী সমাজের অংশ রয়েছে, যে রূপে ও যে চেহারায়ই তা থাক না কেন। যুগের আবর্তনে চিন্তা ভাবনায় পরিবর্তন এসেছে, সমাজ ব্যবস্থা বদলে গেছে। আজকের ইসলামী সমাজের সীমাবদ্ধতা দেখে তাই বলে তার ব্যাপকতর রূপকে অস্বীকার করা যায় না। এখানেই সন্ধান পাই আমরা ইসলামী সাহিত্যের যৌক্তিকতার। ইসলামী সাহিত্য সৃষ্টির মাল-মসলা রয়ে গেছে মানব সমাজের সমগ্র পরিসরে। শুধুমাত্র মুসলিম সমাজ ও সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে নয়। মানব সমাজের যে যে ক্ষেত্রে ইসলামী মূল্যবোধের স্পর্শ রয়েছে ইসলামী সাহিত্য সেখান থেকেই তার উপাদান সংগ্রহ করে। কথাটাকে অন্যভাবেও বলা যায়। অর্থাৎ মুসলিম সাহিত্য যেখানে কেবলমাত্র মুসলমানের সৃষ্ট সাহিত্য সেখানে ইসলামী সাহিত্য মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে সবার সৃষ্ট সাহিত্য। ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে যে সাহিত্য সৃষ্টি হয়, কোন অমুসলিমের হাতে সৃষ্টি হলেও তা ইসলামী সাহিত্য। কাজেই মুসলিম সাহিত্যের গণ্ডি একান্তই সীমাবদ্ধ। সে তুলনায় ইসলামী সাহিত্য অনেক বেশী ব্যাপক ও বিশ্বব্যাপী।
দ্বিতীয়ত ইসলামী সাহিত্য একটি আদর্শ ও লক্ষ্যাভিসারী। কিন্তু মুসলিম সাহিত্যের বিশেষ কোন আদর্শ ও লক্ষ্যের পরোয়া নেই। অমুসলিমরা যে ঢংয়ে সাহিত্য চর্চা করে মুসলমানরাও একই ঢংয়ে সাহিত্য চর্চা করে মুসলিম সাহিত্য গড়ে তুলতে পারে। হয়তো অনেক ক্ষেত্রে সে সাহিত্য ইসলামী মূল্যবোধের বিপরীতধর্মী সাহিত্য সৃষ্টিতে তৎপর হয়ে ওঠে। কিন্তু তবুও তা মুসলিম সাহিত্য। অর্থাৎ মুসলমানের সৃষ্ট যে কোন ধরনের সাহিত্য মুসলিম সাহিত্য হতে পারে। কিন্তু মুসলমানের সৃষ্ট ইসলামী মূল্যবোধ বর্জিত কোন সাহিত্য ইসলামী সাহিত্য নামে আখ্যায়িত হতে পারে না। তাই মুসলিম সাহিত্য যেখানে একটি জাতীয় সাহিত্য সেখানে ইসলামী সাহিত্য হচ্ছে একটি আদর্শবাদী ও উদ্দেশ্যমূখী কিন্তু সার্বজনীন সাহিত্য।
ইসলামী সাহিত্যের বিশ্বজনীনতা
আগেই বলেছি ইসলামী সাহিত্য কোন নিছক ধর্মীয় সাহিত্য নয়। ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা জাতি বিশেষের ধর্মাচরণের মধ্যে এ সাহিত্য সীমাবদ্ধ নয়। যে সব মূল্যবোধের ভিত্তিতে ইসলামী সাহিত্য গড়ে ওঠে সেগুলো যেমন ব্যাপক ও বিশ্বজনীন, ইসলামী সাহিত্যের ব্যাপ্তিও তেমনি বিশ্বজনীন। তুরস্কে তূর্কীরা ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে যে সাহিত্য গড়ে তোলে বাংলাদেশের মুসলমানরা তাদের গড়া ইসলামী সাহিত্যের সাথে তার ব্যাপক সাযুজ্য অনুভব করে। জাপানে বা চীনে যে সাহিত্য গড়ে ওঠে তার মানবিক মূল্যবোধটুকুই আমাদের হৃদয় স্পর্শ করে কিন্তু তুর্কীর ইসলামী সাহিত্যের সবটুকুই আমাদের আপন মনে হয়।
ইসলামী সাহিত্যের বিশ্বজনীনতার আর একটা দিক হচ্ছে, সমগ্র বিশ্ব-মানবতার জন্য এর সুস্পষ্ট আবেদন রয়েছে। ইসলামী সাহিত্যের মূল্যবোধগুলো যে কোন সাহিত্যের আদর্শ হতে পারে। মানবতার কল্যাণ, সামাজিক সাম্য ও সুবিচার, সৌ-ভ্রাতৃত্ব ইত্যাদি বিষয়গুলো সকল দেশের সকল যুগের মানব সমাজের আপন সম্পদ। এগুলো সামগ্রিকভাবে কোন সমাজের স্বার্থবিরোধী নয়। অন্য সমাজের যে মূল্যবোধের সাথে ইসলামী সমাজের কোন কোন মূল্যবোধগুলো কোথাও ব্যক্তি স্বার্থে, গোষ্ঠী স্বার্থে বা জাতি স্বার্থে নির্ণীত হয়নি এবং ব্যবহৃত হচ্ছে না। কাজেই এ মূল্যবোধগুলো যে কোন সময় যে কোন সমাজের আদর্শ হতে পারে, যদি তারা কল্যাণ ও ন্যায়নীতির স্বার্থে তা গ্রহণ করতে প্রস্তুত হয়।
যেমন সমাজে নারীর স্থান ও মর্যাদার ব্যাপারটি ধরা যাক। ইসলামী সমাজ নারীকে যে মর্যাদার আসনে বসিয়েছে এবং গৃহের যে কেন্দ্রীয় আসনে তাকে স্থাপন করেছে সেটি তার আসল, প্রকৃতিগত ও গুণগত মর্যাদা। কোন জাগতিক বা সংকীর্ণ স্বার্থ তাকে এ আসনে বসাবার ব্যাপারে কাজ করেনি। পৃথিবীতে মানব সমাজের হাজার হাজার বছরের ইতিহাস ইসলাম প্রদত্ত নারীর এ মর্যাদা ও আসনের প্রতি সামগ্রিকভাবে সমর্থন জানাচ্ছে। বিপরীত পক্ষে বিগত তিন চারশো বছর থেকে ইউরোপ নারীকে যে আসনে বসিয়েছে তার পেছনে গোষ্ঠী স্বার্থ কাজ করছে। নারীকে পুরুষের স্বার্থের যূপকাঠে বলি দেয়া হয়েছে। তাই সামগ্রীকভাবে সমগ্র ইউরোপীয় সমাজে বিশৃংখলা ও অরাজকতা চরমে পৌঁছে গেছে। ইতিপূর্বে প্রাচীন ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে মিসরে, রোমে, ব্যাবিলনে, চীনে ও ভারতবর্ষে নারীদের এভাবেই ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছিল। বর্তমানে ইউরোপীয় তথা পাশ্চাত্য সভ্যতায় তারই আধুনিক প্রকরণ চলছে। পূর্বেও যেমন ছিল তা নারীত্বের অবমাননা, শোষণ, নির্যাতন ও নারী-প্রকৃতির সাথে সাংঘর্ষিক, তেমনি বর্তমানেও।
এক্ষেত্রে নারীর মর্যাদা সম্পর্কিত পাশ্চাত্য মূল্যবোধ যেখানে সমাজে অশান্তি ও সংঘর্ষের জন্ম দেয়, সেখানে ইসলামী মূল্যবোধ আনে স্বস্তি ও প্রশান্তি।
তাই সমাজে নারীর মর্যাদা সম্পর্কিত ইসলামী সাহিত্যের মূল্যবোধ বিশ্বজনীন আবেদনের অধিকারী। এভাবে এই বিশ্বজনীন আবেদনের পরিপন্থী সীমাহীন ভোগ লিপ্সার মত মানবতা বিরোধী বা শ্রেণী সংগ্রামের মত অমানবিক বিষয়বস্তুকেও ইসলামী সাহিত্য প্রশ্রয় দেয় না। এই সব বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইসলামী সাহিত্যের বিশ্বজনীনতা সুস্পষ্ট।
ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে সৃষ্ট বা ইসলামী মূল্যবোধগুলোর সাথে সামঞ্জস্যশীল অথবা অন্যান্য ধর্ম ও জাতির মধ্যে কিছু কিছু ইসলামী মূল্যবোধের প্রচলনের কারণে তার ভিত্তিতে সৃষ্ট সাহিত্য কর্ম অমুসলিম দেশের কোন অমুসলিম সাহিত্যিকের অবদান হলেও ইসলামী সাহিত্য তাকে যথাযথ গুরুত্ব ও স্বীকৃতি দিতে মোটেই দ্বিধা করে না। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জাহেলী যুগের একজন আরবীয় মুশরিক কবির – আলা মা খালাল্লাহু বাতিলু – “জেনে রাখ আল্লাহ ছাড়া সব কিছুই বাতিল” – লাইনটি আউড়ে বলতেন, কবি তার কবিতার এ ছত্রটিতে সত্য কথাই বলেছেন।
এ দৃষ্টিতে টলস্টয়, গ্যেটে, ইলিয়ট, রবীন্দ্রনাথ বার্নার্ডশ প্রমূখ কবি ও কথাশিল্পীরা মুসলিম না হলেও তাদের সাহিত্যকর্মের একাংশের সাথে ইসলামী সাহিত্য একাত্মতা ঘোষণা করতেও দ্বিধা করে না।