তৃতীয় যুগ
তৃতীয় শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদ হইতে পঞ্চম শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত ইহা প্রায় তিন শতাব্দীর যুগ। এ যুগে হাদীছের শিক্ষাকরণ ও শিক্ষাদান, উহা হেফজকরণ ও উহার মোতাবেক আমলকরণের ধারা পূর্বের ন্যায় অব্যাহত থাকে এবং লিখনের ধারা আরো জোরদার হইয়া উঠে।
এ যুগকে হাদীছের স্বর্ণযুগ বলা যাইতে পারে। এ যুগে এমন সকল হাফেজে হাদীসের জন্ম হয় যাঁহাদের নজীর দুনিয়া খুব কমই দে্খিয়াছে। এভাবে এ যুগে এমন এমন হাদীছ গ্রন্থাকারের আবির্ভাব হয় যাঁহাদের গ্রন্থাবলী দুনিয়ার এলমী ভাণ্ডারে আল্লাহর বিশেষ দানরূপে পরিগণিত। এ যুগেই ছেহাহ ছেত্তা প্রণেতা বোখারী, মোছলেম প্রমুখ ইমামগণের আবির্ভাব হয়। এ যুগেই ছনদ বিচার দ্বারা ছহীহ হাদীছকে গায়র ছহীহ হইতে চূড়ান্তরূপে বাছাই করা হয়। পূর্ব যুগে ইমাম মালেক ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল যাহার সূচনা করেন ইমাম বোখারী (১৯৪-২৫৬ হিঃ) ও মোছলেম (২০৪-২৬১ হিঃ) এ যুগে তাঁহাদের কিতাবে ইহার চূড়ান্ত রূপ দান করেন। এ যুগেই রছুলুল্লাহর হাদীছকে ছাহাবা ও তাবেয়ীনদের আছার হইতে সম্পূর্ণরূপে পৃথক করার নীতি গৃহীত হয় -[ইহার পূর্ব পর্যন্ত যাহারা লিখিয়াছেন তাঁহাদের অনেকেই যেখানে যে বিষয়ে একটি হাদীছে রছুল লিখিয়াছেন সেখানে সে বিষয়ে যদি ছাহাবা ও তাবেয়ীনদের কোন আছার থাকিয়া থাকে তাহাও তাহার পাশে লিখিয়া লইয়াছেন। ইমাম মালেক তাঁহার ‘মোআত্তা’য় এরূপই করিয়াছেন। ইহাতে একটি উপকার এই হইয়াছে যে, ছাহাবা ও তাবেয়ীনদের আছার মাহফুজ (রক্ষিত) হইয়া গিয়াছে। যদ্দ্বারা হাদীছে রছুলের প্রকৃত ব্যাখ্যা জানা যায়। ছাহাবা ও তাবেয়ীনদের আছার প্রকৃতপক্ষে হাদীছে রছুলেরই ব্যাখ্যা। আবার কেহ কেহ আছারকে পৃথকভাবেও সংকলন করিয়াছেন। যথা –ইমাম আবূ ইউছুফ ও ইমাম মোহাম্মদ (রঃ) তাঁহাদের ‘কিতাবুল আছার’ এই ধরনেই দুইটি সংকলন। অবশ্য ইমাম আহমদ (রঃ) তাঁহার ‘মোছনাদ’ কিতাবে শুধু হাদীছে রছুলই সংগ্রহ করিয়াছেন।] এবং ইমাম বোখারী ও মোছলেম তাঁহাদের কিতাবে প্রধানতঃ হাদীছে রছুলকেই স্থান দেন। এ যুগেই সমস্ত হাদীছ রাবীদের নিকট হইতে সংগৃহীত হইয়া কিতাবে লিপিবদ্ধ হইয়া যায়। অতঃপর এমন কোন হাদীছ কাহারও নিকট রহিয়াছে বলিয়া অনুমান করা যায় না যাহা কোন না কোন কিতাবে লিপিবদ্ধ হয় নাই।
তৃতীয় যুগের কতিপয় প্রসিদ্ধ হাদীছের ইমাম
১। ইমাম বোখারী (রঃ)
[১৯৪-২৫৬ হিঃ মোঃ ৮১০-৮৭০ ইং]
ইমাম আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে ইছমাঈল বোখারী বর্তমান সোভিয়েট ইউনিয়নের অন্তর্গত উজবেকিস্তানের বোখারা নগরে জন্মগ্রহণ করেন। ইমাম বোখারী অসাধারণ মেধাসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ১৬ বৎসর বয়সে ইমাম আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক ও ইমাম ওকী’ ইবনে জাররাহর হাদীছের কিতাবসমূহ মুখস্থ করিয়া লন এবং ১৮ বৎসর বয়সে কিতাব লিখিতে আরম্ভ করেন। হাদীছের জগদ্বিখ্যাত কিতাব ‘আল জামেউচ্ছহীহ’ ব্যতীত তিনি আরো বহু কিতাব লিখিয়া গিয়াছেন।
তিনি বলেনঃ ‘হাদীছ শিক্ষার জন্য আমি বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণ করিয়াছি, দুইবার মিছর ও শামে এবং চারিবার বছরায় গিয়াছি। একাধারে ছয় বৎসর হেজাজে (মক্কা ও মদীনায়) অবস্থান করিয়াছি এবং বহুবার বাগদাদ সফর করিয়াছি। আমি এক হাজার ৮০জন শায়খের নিকট হইতে হাদীছ শিক্ষা করিয়াছি ও লিখিয়াছি। এইভাবে ৬লক্ষ হাদীছ সংগ্রহ করিয়া উহা হইতে অতি অল্প সংখ্যক হাদীছকে আমার ‘জামেয়ে ছহীহ’ কিতাবে স্থান দিয়াছি এংব বহু ছহীহ হাদীছকেও বাদ দিয়াছি’।
ইমাম বোখারী প্রচুর অর্থের মালিক ছিলেন। কিন্তু তাঁহার সমস্ত অর্থই শিক্ষার্থী ও দরিদ্রদের জন্য ব্যয়িত হইয়াছে। তিনি কখনও জাঁকজমকের সহি চলেন নাই। কথিত আছে, তিনি ৪০ বৎসর যাবৎ রুটির সহিত কোন তরকারী ব্যবহার করেন নাই। কোন কোন সময় মাত্র দুই তিনটি বাদাম খাইয়া দিন কাটাইয়াছেন।
ইমাম তিরমিজী বলেনঃ ‘ইমাম বোখারী এ উম্মতের ভূষণ। তাঁহার মত লোক আমি কোথাও দেখি নাই’। মোহাদ্দেছ ইবনে খোজাইমা বলেনঃ ‘দুনিয়ায় ইমাম বোখারী হইতে অধিক অভিজ্ঞ ও হাদীছের হাফেজ আর কেহ নাই। ইমাম মোছলেমের মত লোক তাহার পদচুম্বন করিতে চাহিতেন’। কেহ কেহ বলিয়াছেন যে, ‘ইমাম বোখারী দুনিয়াতে আল্লাহর নিদর্শনস্বরূপ’। ৯০ হাজার লোক তাঁহার নিকট তাঁহার কিতাব ‘জামেউছ্ছহীহ’ পড়িয়াছেন।
একবার বোখারার শাসনকর্তা তাঁহার নিকট অনুরোধ করিয়া পাঠাইলেন যে, ‘আপনি আপনার ‘জামেউছ্ছহীহ’ ও ‘তারীখে কবীর’ আমাকে পড়িয়া শুনাইলে আমি খুশী হইব’। উত্তরে তিনি বলিয়া পাঠাইলেনঃ ‘আমি এলমকে বে-ইজ্জত করিতে পারি না। যাহার আবশ্যক সে এখানে আসিয়া শুনিয়া যাইতে পারে’। আর কাহারো মতে শাসনকর্তা তাঁহার ছেলেদের পড়াইবার জন্য ইমাম ছাহেবের নিকট এমন একটা সময় নির্দিষ্টড় করিয়া লইতে চাহিয়াছিলেন, যে সময় অন্য কেহ তাহাদের সহিত শরীক না হয়। ইহাতে তিনি রাজী হইলেন না; বরং বলিয়া দিলেনঃ ‘এলমের দরওয়াজা সকলের জন্য সমানভাবেই খোলা। আমি এরূপ ভেদনীতি অবলম্বন করিতে পারি না’। ইহাতে অসন্তুষ্ট হইয়া শাসনকর্তা তাঁহাকে বোখারা ত্যাগ করিতে নির্দেশ দেন। ইমাম ছাহেব বোখারা ছাড়িয়া ছমরকন্দের নিকট খরতং নামক স্থানে চলিয়া যান। কিন্তু তথাকার অধিবাসীরা (বিপদাশঙ্কায়) তাঁহাকে স্থান দিতে ইতস্ততঃ করে। ইহা দেখিয়া তিনি তাহাজ্জুদের পর আল্লাহর নিকট দো’আ করিলেনঃ ‘আল্লাহ! তোমার জমিন যখন আমার পক্ষে তংগ (সংকীর্ণ) হইয়া গিয়াছে তখন আমাকে দুনিয়া হইতে উঠাইয়া লও’। অতঃপর তিনি তথায় এন্তেকাল করেন।
২। ইমাম মোসলেম (রঃ)
[২০৪-২৬১ হিঃ মোঃ ৮১৭-৮৬৫ ইং]
ইমাম মোছলেম ইবনে হাজ্জাজ ইবনে মোছলেম কোশাইরী নিশাপুরী (রঃ) প্রাচীন খোরাছানের প্রধান নগর নিশাপুরে জন্মগ্রহণ করেন (খোরাছান এখন ইরান, আফগানিস্তান ও সোভিয়েট রাশিয়ার মধ্যে ভাগ হইয়া গিয়াছে।)। এবং তথায়ই এন্তেকাল করেন।
প্রাথমিক শিক্ষার পর তিনি হাদীছের তালাশে বহু দেশ সফর করেন এবং খোরাছান, রায়, মিছর, ইরাক ও হেজাজ প্রভৃতি দেশের মাশায়েখদের নিকট হইতে হাদীছ শিক্ষা করেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি বহুবার বাগদাদও গিয়াছেন এবং ইমাম বোখারী যখন তাঁহার শেষ জীবনে নিশাপুরে আগমন করেন তখন তিনি ইমাম বোখারীর খেদমতেও হাজির হন। এভাবে তিনি তিন লক্ষ হাদীছ সংগ্রহ করেন থখন তিনি ইমাম বোখারীর খেদমতেও হাজির হন। এভাবে তিনি তিন লক্ষ হাদীছ সংগ্রহ করেন এবং উহা হইতে বাছাই করিয়া মাত্র ৪ হাজার হাদীছ দ্বারা ‘ছহীহ’ নামক হাদীছের কিতাব সংকলন করেন। এছাড়া তিনি আরো বহু কিতাব রচনা করিয়া গিয়াছেন।
৩। ইমাম আবু দাউদ (রঃ)
[২০২-২৭৫ হিঃ মোঃ ৮১৭-৮৮৮ ইং]
ইমাম আবু দাঊদ ইবনে আশআছ ছিজিস্তানী পূর্ব ইরানের ছিজিস্তান বা সীস্তানে জন্মগ্রহণ করেন্ (উহা এখন ইরান ও আফগানিস্তানের মধ্যে ভাগ হইয়া গিয়াছে।) তিনি খোরাছান, ইরাক, শাম ও মিছর পরিভ্রমণ করেন এবং সে সকল দেশের ওলামা ও মাশায়েখগণের নিকট হইতে হাদীছ শিক্ষা করেন। অতঃপর তিনি বছরায়ই স্থায়ীভাবে বসবাস এখতেয়ার করেন। তবে বাগদাদেও তিনি আসা-যাওয়া করিতেন। বাগদাদে বসিয়াই তিনি তাঁহার প্রসিদ্ধ হাদীছের কিতাব ‘ছুনান’ সংকলন করেন। তিনি বলিয়াছেনঃ ‘আমি ৫লক্ষ হাদীছ সংগ্রহ করিয়া উহা হইতে মাত্র সাড়ে চার হাজারের মত হাদীছ আমার কিতাবে গ্রহণ করিয়াছি। মানুষের জন্য উহার মধ্যে এই চারিটি হাদীছই যথেষ্টঃ হুজুর (ছঃ) বলিয়াছেনঃ (১) নিয়তের উপরই মানুষের আমল নির্ভর করে অর্থাৎ, নিয়ত অনুসারেই তাহার ছওয়াব দেওয়া হয়। (২) যাহা মানুষের পক্ষে জরুরী নহে তাহা ত্যাগ করাই তাহার খাটিঁ মুসলমানিত্বের পরিচায়ক। (৩) কোন মু’মিন প্রকৃত মু’মিন হইতে পারিবে না, যে পর্যন্ত না সে নিজের জন্য যাহা ভালবাসে অন্যের জন্যও তাহা ভালবাসে এবং (৪) হালাল স্পষ্ট ও হারামও স্পষ্ট, উভয়ের মধ্যস্থলে রহিয়াছে সন্দেহজনক জিনিস (সুতরাং উহা হইতে বাঁচিয়া থাকিবে)।
আবু ছোলাইমান খাত্তাবী বলেনঃ দ্বীনের এলম সম্পর্কে আবু দাঊদের ‘ছুনানের’ ন্যায় কিতাব এযাবৎ লেখা হয় নাই। আলেমগণের মতে দ্বীনের কথা জানার জন্য কাহারো নিকট কোরআন এবং ‘ছুনানে আবু দা্ঊদ’ থাকিলেই যথেষ্ট। ইহাতে দ্বীনের প্রায় সমস্ত আহকাম সম্পর্কীয় হাদীছই রহিয়াছে। মূছা ইবনে হারূন বলেনঃ আবু দাঊদ আসিয়াছেন দুনিয়ায় হাদীছের জন্য আর আখেরাতের বেহেশতের জন্য।
৪। ইমাম তিরমিজী (রঃ)
[২০৯-২৭৯ হিঃ মোঃ ৮২৪-৮২৯ ইং]
ইমাম আবু মোহাম্মদ ইবনে ঈসা তিরমিজী উত্তর ইরানের তিরমিজ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন এবং এলমের অনুসন্ধানে খোরাছান, হেজাজ প্রভৃতি দেশ পরিভ্রমণ করেন। তিনি ইমাম বোখারীর নিকটও হাদীছ শিক্ষা করিয়াছেন। তাঁহার কিতাব ‘আল জামে’ ‘ছেহাহ ছেত্তা’র অন্যতম কিতাব। উহাতে তিনি ছনদের জারহ ও তা’দীল বা দোষ-গুণ বিচার সম্পর্কে যে পদ্ধতি অবলম্বন করিয়াছেন তাঁহার পূর্বে কেহই তাহা করেন নাই। এ কারণে মোহাদ্দেছগণ তাঁহার এ কিতাবেই হাদীছের ছনদ সম্পর্কে বহছ (আলোচনা) করিয়া থাকেন। তিনি হাদীছে যেমন অদ্বিতীয় ছিলেন ফেকাহতেও তেমন অসাধারণ ছিলেন।
৫। ইমাম নাছায়ী (রঃ)
[২১৫-৩০৩ হিঃ মোঃ ৮৩০-৯১৫ ইং]
ইমাম আবু আবদুর রহমান আহমদ ইবনে শো’আইব নাছায়ী খোরাছানের প্রসিদ্ধ শহর নাছায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তাঁহার জিন্দেহীর বেশীর ভাগই মিছরে কাটান এবং শেষ জীবনে দামেশকে (দেমাশক) আগমণ করেন। তিনি বহু দেশ পরিভ্রমণ করিয়া বহু মাশায়েখ হইতে হাদীছ সংগ্রহ করেন। ইমাম আবু দাঊদ তাঁহার একজন বিশিষ্ট উস্তাদ। তিনি প্রথমে ‘ছুনানে কবীর’ নামে হাদীছের একটি বিরাট গ্রন্থ সংকলন করেন। অতঃপর উহাকে সংক্ষেপ করিয়া ‘আল মুজতাবা’ নাম দেন। এই মুজতাবা ‘ছেহাহ ছেত্তা’র অন্যতম কিতাব। ইহা ‘নাছায়ী’ নামে প্রসিদ্ধ। হাকেম আবু আবদুল্লাহ নিশাপুরী বলেনঃ আমি আবু আলী নিশাপুরীকে এইরূপ বলিতে শুনিয়াছিঃ মুসলমানদের মধ্যে চারি জন হাদীছের হাফেজ রহিয়াছেন। নাছায়ী ইহাদের অন্যতম। একবার দামেশকের মুআবিয়াপন্থী লোকেরা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলঃ হজরত আমীর মুআবিয়ার ফজীলত সম্পর্কে আপনি কিছু লিখিয়াছেন কি? তিনি উত্তর করিলেনঃ ‘না’ ইহাতে অসন্তুষ্ট হইয়অ তাহারা তাঁহাকে ভীষণভাবে প্রহার করে। ফলে তিনি গুরুতররূপে রোগগ্রস্ত হইয়া পড়েন। অতঃপর রমলায় কাহারো মতে মক্কায় নীত হন এবং তথায় এন্তেকাল করেন।
৬। ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ)
[২০৯-২৭৩ হিঃ মোঃ ৮২৪-৮৮৬ ইং]
ইমাম আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে ইয়াজীদ ইবনে মাজাহ কাজরিনী ইরাকে আজম বা উত্তর-পশ্চিম ইরানের কাজবীন নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি এলম অন্বেষণে ইরাক, শাম, মিছর ও আরবদেশ সফর করেন এবং ইমাম মালেকের শাগরেদগণ –বিশেষ করিয়া ইমাম লায়ছ ইবনে ছা’দ হইতে হাদীছ শিক্ষা করেন। তাঁহার ‘ছুনান’ ছেহাহ্ ছেত্তার একটি কিতাব।