রায়ের পর্যালোচনা
-সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী
কিছুকাল যাবত আমাদের বিচারালয়সমূহের কোনো কোনো বিচারকের বক্তব্য, বিবৃতি ও লেখায় সুন্নাহ (হাদীস)-এর যথার্থতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ এবং তাকে ইসলামী আইনের ভিত্তি মানতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনের প্রবণতা বেড়েই চলছে। এমনকি কোন কোন বিচার বিভাগীয় রায়ে পর্যন্ত এ জাতীয় ধারণা প্রতিভাত হতে থাকে। উদাহরণস্বরূপ আজ থেকে তিন-চার বছর পূর্বে পশ্চিম পাকিস্তান হাইকোর্টের এক রায়ে বলা হয়েছেঃ
“হাদীসের ব্যাপারেই আসল সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, যা সুন্নাহ বা রাসূলের আমল ও কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত করে। প্রথমত এটা তো বাস্তব ঘটনা যে, কোন বিশেষ বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি হাদীদসের সহীহ হওয়ার ব্যাপারটি বিতর্কিত হওয়া থেকে খুব কমই নিরাপদ আছে। অধিকন্তু কতিপয় ক্ষেত্রে তো মহানবীর প্রামাণ্য সুন্নাত থেকেও কোন কোন খলীফায়ে রাশেদার বিশেষত হযরত উমার (রা) সরে দাঁড়িয়েছেন। এর বিভিন্ন উদাহরণ উর্দূ ভাষায় একটি উত্তম (?) পুস্তিকায় সংকলন করা হয়েছে, যা করাচীস্থ ইদারয়ে তুলূয়ে ইসলাম “ইসলাম মে কানূনসাযী কে উসূল” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশ করেছে। আমি এ গ্রন্থের যথেষ্ট সহায়তা গ্রহণ করেছি। এখানে আমার জন্য একথা বলা জরুরী নয় যে, সুন্নাতের ওহীভিত্তিক হওয়ার দলীল-প্রমাণ মোটেই শক্তিশালী নয়”-(পি.এল.ডি, নভেম্বর ১৯৫৭ খৃ., পৃ. ১০১২-১৩)।
এই প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে পেতে এখন বিচারপতি মুহাম্মাদ শফী সাহেবের পর্যালোচনাধীন রায়ে এক চরম সুস্পষ্ট ও মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে এবং হাদীস অস্বীকারকারীদের দল তার পুরা সুযোগ নিচ্ছে। তাই আমরা এই রায়ের বিস্তারিত বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যালোচনা করা এবং দেশের বিচারালয়সমূহের বিচারক ও আইনজ্ঞদেরকে এই চিন্তাধারার দুর্বলতা সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়া অবশ্য কর্তব্য মনে করি। যে মামলার এই রায় দেয়া হয়েছে তার বিবরণ সম্পর্কে আমাদের মোটেই কোন বিতর্ক নেই, এবং বিজ্ঞ বিচারপতি এর যে ফয়সালা প্রদান করেছেন সে সম্পর্কেও আমরা আলোচনা করতে চাই না। এই রায়ে কুরআন, সুন্নাহ ও ফিকহ-এর মর্যাদা সম্পর্কে যে মৌলিক সমস্যার কথা উত্থাপন করা হয়েছে, আমাদের আলোচনা তার মধ্যেই সীমিত রাখতে চাই।
দুটি মূলনীতিগত প্রশ্ন
এই প্রসংগে মূল রায়ের উপর পর্যালোচনা শুরু করার পূর্বে দুটি মূলনীতিগত প্রশ্ন আমাদের সামনে আসে। প্রথম প্রশ্ন আদালতের এখতিয়ারের সাথে সংশ্লিষ্ট। ইসলামী আইন সম্পর্কে চৌদ্দশত বছর থেকে একথা পৃথিবীর মুসলমানদের মধ্যে স্বীকৃত হয়ে আসছে যে, কুরআনের পর এর দ্বিতীয় উৎস হচ্ছে রসূলুল্লাহ (সা)-এর সুন্নাত। এই শতাব্দীগুলোর দীর্ঘ পরিক্রমায় এই আইনের উপর যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গ্রন্থকার যা কিছুই লিখেছেন, চাই তিনি মুসলমান হোন অথবা অমুসলিম, তাঁরা এ সত্য স্বীকার করেছেন। মুসলমানদের মধ্যে এমন কোন School of thought অথবা এমন কোন ফকীহর (jurist) বরাত দেয়া যাবে না মুসলমানদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক যাঁর অনুসরণ করেছে, অথচ তিনি সুন্নাতকে আইনের উৎস হিসাবে মানতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে থাকবেন। অবিভক্ত ভারতে যে ‘এ্যাংলো-মোহামেডান ল’ প্রচলিত ছিল তার মূলনীতিতেও সব সময় এই পর্যন্ত কোন আইন প্রণয়ন পরিষদেরও এমন কোন সিদ্ধান্ত আসেনি যার আলোকে ইসলামী আইনের মূলনীতিসমূহে এই মৌলিক রদবদল করা হয়ে থাকবে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই অবস্থায় কোন একক বিচারক, অথবা কোন হাইকোর্ট, বরং স্বয়ং সুপ্রিম কোর্টও কি আইনের মধ্যে এই মৌলিক পরিবর্তন সাধনের অধিকার রাখে? যতদূর আমাদের জানা আছে, বিচারালয় স্বতন্ত্রভাবে কোন আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান নয়। আমাদের আইন প্রণয়কারী প্রতিষ্ঠান নয়। আমাদের দেশের বিচারব্যবস্থা ও আইন যেসব নীতিমালার উপর ভিত্তিশীল তার আলোকে আইন প্রণয়নকারী সংস্থার পক্ষ থেকে প্রদত্ত আইন অনুযায়ী কার্য পরিচালনা করতে বিচারালয়সমূহ বাধ্য। তারা আইনের ব্যাখ্যা অবশ্যই করতে পারবে এবং বিচারব্যবস্থায় তাদের ব্যাখ্যা নিঃসন্দেহে আইনের মর্যাদা পাবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমাদের জ্ঞানে একথা আসেনি যে, তারা স্বয়ং আইন অথবা তার স্বীকৃত মূলনীতির মধ্যে রদবদল করার অধিকার রাখেন। আমরা জানতে চাই, বিচারালয়সমূহ এই অধিকার কবে এবং কোথা থেকে লাভ করেছে?
দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, আইনের ক্ষেত্রে এ ধরনের নীতিগত পরিবর্তনের অধিকার মূলত কার? এ সময় পর্যন্ত পাকিস্তান রাষ্ট্রের সম্পর্কে দাবী এই যে, এই রাষ্ট্র গণতন্ত্রের নীতিমালার উপর কায়েম হয়েছে এবং গণতন্ত্রের কোন অর্থই হতে পারে না যদি তাতে নাগরিকদের অধিকাংশের কাংখিত সরকার না হয়। এখন যদি পাকিস্তানের মুসলমানদের সাধারণ জনমত যাচাইয়ের (Referendum) ব্যবস্থা করা হয় তবে আমরা পূর্ণ নিশ্চয়তার সাথে বলতে পারি, তাদের প্রতি দশ হাজারে ৯,৯৯৯ জনেরও অধিক সংখ্যক লোক এই আকীদা ব্যক্ত করবে যে, কুরআনের পর সুন্নাতে রসূল ইসলামী আইনের অপরিহার্য ভিত্তি। এর সাথে দ্বিমত পোষণকারী খুব সম্ভব দশ হাজারে একজনও পাওয়া যাবে না। এই অবস্থা যতক্ষণ বিদ্যমান থাকবে –ইসলামী আইনের উৎসসমূহের মধ্য থেকে সুন্নাতকে বাদ দেয়া বিচারালয়ের কোন বিচারকের এখতিয়ারাধীন আছে কি? অথবা কোন সরকার তা করতে পারে কি? এসব প্রশ্নের ইতিবাচক উত্তর দেয়া যেত যদি এখানে কোন বিশেষ শ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত থাকত। কিন্তু গণতান্ত্রিক নীতির ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি না যে, কোন ব্যক্তি এর ইতিবাচক জওয়াব কিভাবে দিতে পারে? যতক্ষণ না এখানে গণতন্ত্রের চূড়ান্ত মৃত্যু হবে, ততোক্ষভণ কোন ক্ষমতাসীন ব্যক্তির পক্ষে নিজের খেয়াল খুশিমত এখানে নিজের এখতিয়ার প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। বরং সে এখানে অধিকাংশের মতের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত আইন অনুযায়ী নিজের ক্ষমতার প্রয়োগ করতে বাধ্য। বিচারকদের মধ্যে যেসব ব্যক্তি কিছুটা অধিক শক্তিশালী ধারণা পোষণ করেন, তাদের জন্য এই সোজা রাস্তা খোলা আছে যে, বিচারকদের পদে ইস্তফা দিয়ে নিজের পূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা মুসলিম সর্বসাধারণের আকীদা-বিশ্বাসের পরিবর্তন করায় ব্যয় করুন। কিন্তু তিনি যতক্ষণ কোন কর্তৃত্বসম্পন্ন পদে আসীন আছেন, ততক্ষণ এই পরিবর্তনের জন্য নিজের ক্ষমতার ব্যবহার করতে পারবেন না। এটা গণতন্ত্রের পরিস্কার যৌক্তিক দাবী। তা অস্বীকার করার মত কিছু যুক্তি প্রমাণ যদি কারো কাছে থেকে থাকে তবে তা আমরা জানতে চাই।
উপরোক্ত দুটি নীতিগত প্রশ্ন সম্পর্কে আমরা যে দৃষ্টিভংগী উপরে পেশ করেছি তা যদি সঠিক বলে স্বীকার করা হয়, তবে বিচারালয়ের মর্যাদার প্রতি পূর্ণ খেয়াল রেখে আমরা আরজ করব, বিজ্ঞ বিচারপতির জন্য তার নিজের এই বিশেষ চিন্তাধারা তার একটি বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্তের মধ্যে বিবৃত করা ঠিক ছিল না। তিনি তা ব্যক্তিগতভাবে একটি প্রবন্ধের আকারে লিপিবদ্ধ করে পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করলে এতটুকু আপত্তিকর হত না। সে অবস্থায় অধিকতর স্বাধীনভাবে এর উপর আলোচনা হতে পারত এবং বিচারালয়ের সম্মান হানির ভয়ও থাকত না।
হানাফী ফিকত –এর আসল মর্যাদা
এখন আমরা মূল রায়ের নীতিগত আলোচনার উপর দৃষ্টি দেব। তা পাঠান্তে পাঠকদের সামনে এসেছে যে, এটা অভিভাবকত্ব সংক্রান্ত একটি মামলার রায়। এ পসংগে অভিভাবকত্ব সম্পর্কে হানাফী ফিকহ –এর নীতিমালার বরাত দিয়ে বিজ্ঞ বিচারক বলেছেন, ইংরেজদের শাসনামলে প্রিভি কাউন্সিল পর্যন্ত সমস্ত বিচারালয় এসব নীতিমালার পূর্ণ অনুসরণ করত এবং এর কারণ তার রায়ে এই বলা হয়েছেঃ
“ইংরেজগণ অথবা অন্য কোন অমুসলিম জাতি স্বীয় উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অনুযায়ী কুরআন পাকের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করুক এবং আইন প্রণয়ন করুক, তা মুসলিম আইনজ্ঞগণ পছন্দ করতেন না। মুসলিম আইনের সাথে সম্পর্কিত যাবতীয় ব্যাপারে ফাতওয়া আলমগীরী নামক গ্রন্থের যে গুরুত্ব রয়েছে তা এই সত্যের প্রতি দিকনির্দেশ করে। কিন্তু পরিস্থিতি এখন সম্পূর্ণ বদলে গেছে”। -(প্যারাগ্রাফ ৪)।
অতপর অভিভাবকত্ব সম্পর্কে হানাফী আইনের বিস্তারিত বিবরণ দেয়ার পর তিনি পুনরায় এই প্রশ্ন তোলেনঃ
“এসব নিয়ম কানূনকে কি কোন পর্যায়ে চূড়ান্তভাবে ইসলামী আইন বলা যেতে পারে, যা সেই অত্যাবশ্যকীয় বিধানের মর্যাদা পেতে পারে, গ্রন্থবদ্ধ আইনের যে মর্যাদা রয়েছে”? (প্যারা ৭)।
আমাদের ধারণামতে এই রায় প্রকাশের সময় সেইসব কার্যকারণের উপর বিজ্ঞ বিচারপতির দৃষ্টি ছিল না, যেগুলোর ভিত্তিতে হানাফী আইন শুধু ইংরেজ যুগেই নয় এবং শুধু আমাদের দেশেই নয়, বরং তৃতীয় হিজরী শতক থেকে ইসলামী দুনিয়ার এক বিরাট অংশে ইসলামী আইন হিসাবে স্বীকার করা হচ্ছে। তিনি এর একটি খুব্ট হালকা ও ক্ষুদ্র আনুষংগিক কারণের উল্লেখ করেছেন, আর এ কারণেই তার নিম্নোক্ত বক্তব্যও প্রকৃত ঘটনার সঠিক প্রতিনিধত্ব করে নাঃ “এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে গেছে”।
ইসলামী আইনের ইতিহাস সম্পর্কে যারা অবহিত আছেন তাদের সামনে একথা গোপন নয় যে, খিলাফতে রাশেদার স্থলে রাজতান্ত্রিক পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা কায়েম হওয়ায় ইসলামের আইন ব্যবস্থায় এক বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল যা এক শতকের অধিক কাল অব্যাহত ছিল। খিলাফতে রাশেদার ‘শূরা’ (পরামর্শ পরিষদ) ঠিক সেই কাজ করত যা বর্তমনা কালে আইন পরিষদ করে থাকে। মুসলিম রাষ্ট্রে এমন যেসব সমস্যার উদ্ভব হত যে সম্পর্কে একটি আইনগত বিধানের প্রয়োজন পড়ত, খলীফার মজলিসে শূলরা তার উপর আল্লাহর কিতাব ও রসূলুল্লাহ (সা)-এর সুন্নাতের আলোকে সামষ্টিক চিন্তাভাবনা ও ইজতিহাদের সাহায্যে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হতেন এবং সেই সিদ্ধান্ত সমগ্র আইন হিসাবে কার্যখর হতো। কুরআন মজীদের কোন নির্দেশের ব্যাখ্যার মতভেদ দেখা দিলে অথবা রসূলুল্লাহ (সা)-এর সুন্নাতের তথ্যানুসন্ধানে অথবা নতুনভাবে উদ্ভুত কোন সমস্যার উপর শরীআতের মূলনীতির প্রয়োগের ক্ষেত্রে মতভেদ সৃষ্টি হলে মজলিসে শূরার সামনে এরূপ প্রতিটি মতভেদ যে কোন সময় পেশ করা হত এবং ইজমা (ঐক্যমত) অথবা অধিকাংশের তমে সে সম্পর্কে যে ফয়সালাই হত তা আইনে পরিণত হত। খেলাফতে রাশেদার ঐ মজলিসের এই মর্যাদা কেবলমাত্র রাজনৈতিক শক্তিবলে অর্জিত হয়নি, বরং খলীফা ও তাঁর ‘শূরার’ সদস্যদের খোদাভীরুতা, বিশ্বস্ততা, নিষ্ঠা, এবং দীন সম্পর্কিত জ্ঞানের উপর মুসলিম জনসাধারণের আস্থাই ছিল এই মর্যাদার মূল কারণ।
এই ব্যবস্থা যখন অবশিষ্ট থাকল না এবং রাজতান্ত্রিক সরকার এর স্থানে দখল করে নিল, তখন রাষ্ট্রপ্রধান যদিও মুসলিম ছিল এবং তার কর্মচারীবৃন্দ ও সভাসদগণও মুসলিম ছিল, কিন্তু তাদের মধ্যে কেউই বিভিন্ন সমস্যা ও বিষয়ের উপর খোলাফায়ে রাশেদীনের মত রায় প্রদানের দুঃসাহস দেখাতে পরত না। কারণ তারা নিজেরাই জানত যে, তাদের উপর মুসলিম জনসাধারণের আস্থা নেই এবং তাদের সিদ্ধান্ত ইসলামী আইনের অংশ হতে পারে না। তারা যদি খোলাফায়ে রাশেদীনের শূরার অনুরূপ মুসলিম জনগণের আস্থাভাজন, খোদাভীরু ও জ্ঞানবান ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি মজলিস গঠন করত এবং তাকে শূরার অনুরূপ মর্যাদা দিত তবে তাদের বাদশাহী অচল হয়ে পড়ত। তারা যদি নিজেদের মনোপূত লোকদের সমন্বয়ে মজিলসে শূরা গঠন করে সিদ্ধান্ত জারি করা শুরু করত তবে মুসলমানগণ তাদের এসব সিদ্ধান্তকে শরীআত ভিত্তিক সিদ্ধান্ত হিসাবে গ্রহণ করতে প্রস্তুত হত না। এ ধরনের সিদ্ধান্ত গায়ের জোরে চাপিয়ে দেয়া যেত, কিন্তু চাপিয়ে দেয়া শক্তির পতনের সাথে সাথে এগুলো তাদের মুখের উপর ছুঁড়ে মারত। এগুলোর শরীআতের একটি স্বতন্ত্র অংর্শ হিসাবে টিকে থাকা কোনক্রমেই সম্ভব ছিল না।
এই অবস্থায় ইসলামী আইন ব্যবস্থার মধ্যে একটি শূন্যতার সৃষ্টি হয়। খিলাফতে রাশেদার আমলে বিভিন্ন সমস্যা ও বিষয়াবলী সম্পর্কে ইজমার ভিত্তিতে যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল তা তো গোটা রাষ্ট্রে আইন হিসাবে কার্যকর থাকে, কিন্তু এরপর উদ্ভুত সমস্যাবলী ও বিষয়াবলী সম্পর্কে কুরআনের ব্যাখ্যা, সুন্নাতের পর্যালোচনা এবং ইজতিবাদী শক্তির প্রয়োগের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রদান করার মত কোন প্রতিষ্ঠান বর্তমান ছিল না, যার ফলে তা দেশের আইন হিসাবে স্বীকৃত পেতে পারত। এই যুগে বিভিন্ন কাযী (বিচারক) ও মুফতী (আইনের ভাষ্যকার) ব্যক্তিগতভাবে যেসব ফতোয়া ও সিদ্ধান্ত প্রদান করতে থাকেন তা তাদের প্রভাবাধীন ও ক্ষমতাধীন এলকায় কার্যকর হতে থাকে। এসব বিচ্ছিন্ন ফতোয়া ও সিদ্ধান্তসমূহের দ্বারা দেশের মধ্যে আইনগত নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়ে যায়। এমন একটি আইনও ছিল না যা সমভাবে সমস্ত বিচারালয়ে কার্যকর হতে পারত এবং তদনুযায়ী প্রশাসন বিভাগ কার্য পরিচালনা করতে পারত। আব্বাসী খলীফা মানসূরের রাজত্বাকালে ইবনুল মুকান্না এই বিশৃংখলা ও নৈরাজ্য গুরুতরভাবে অনুধাবন করেন এবং খলীফাকে এই শূন্যতা পূরণের চেষ্টা করার পরামর্শ দেন। কিন্তু খলীফা নিজের মর্যাদা ও অবস্থান সম্পর্কে স্বয়ং অবগত ছিলেন। তিনি অন্তত এতটা হস্যকর ভুলের উপর ছিলেন না যতটা ভুলের উপর আজকাকার একনায়কগণ আছেন। তাঁর সভাপতিত্ব এবং তাঁর নিজের মনোনীত লোকদের হাতে যে বিধান প্রণীত হবে এবং তাঁর অনুমোদন সাপেক্ষে কার্যকর হবে তা কতজন মুসলমান শরীআতের বিধান হিসাবে মান্য করবে সে সম্পর্কে তিনি সজাগ ছিলেন।
প্রায় এক শতাব্দীকাল এ অবস্থায় অতিবাহিত হওয়ার পর ইমাম আবু হানীফা ( রহ) এই শূন্যতা পূরণের জন্য এগিয়ে আসেন। তিনি কোন রাজনৈতিক শক্তি এবং কোন আইনানুগ মর্যাদার অধিকারী হওয়া ছাড়াই নিজের হাতে গর্ড়ে তোলা ছাত্রদের একটি বেসরকারী আইন পরিষদ ( Private Legislature ) গতন করেন। এখানে কুরআনিক বিধানসমূহের ব্যাখ্যা- বিশ্লেষণ, সন্নাতসমূহের পর্যালোচনা, পূর্ববর্তী বিশেষজ্ঞগণের ইজমা ভিত্তিক সিদ্ধান্তসমূহের অনুসন্ধান, সাহাবা, তাবিঈন ও তাবউ তাবেঈনের ফতোয়াসমূহের যাচাই ও মূল্যায়ন এবং বিভিন্ন বিষয়ের সমস্যাবলীর উপর শরীআতের নীতিমালার প্রয়োগ ইত্যাদি কাজ ব্যপকভাবে করা হয়েছিল এবং পঁচিশ-তিরিশ বছররের মধ্যে ইসলামের পুরো আইন-কানূন সংকলন করে রাখা হয়। এই আইন কোন বাদশার মর্জি মাফিক সংকলন করা হয়নি। কোন শক্তি এর পেছনে ছিল না যার মাধ্যমে তা কার্যকর হত। কিন্তু পঞ্চাশ বছর অতিক্রন্ত না হতেই তা আব্বাসী রাজত্বের আইনে পরিণত হয়ে গেল। তার কারণ শুধূমাত্র এই ছিল যে, তা এমন সব লোকের দ্বারা প্রণীত হয়েছিল যাদের সম্পর্কে মুসলিম জনসাধারণের দৃঢ় আস্থা ছিল যে, তাঁরা ছিলেন বিজ্ঞ আলেম, খোদাভীরু, সঠিক ইসলামী চিন্তাধারার অধিকারী, ইসলাম-বিরোধী চিন্তাধারা ও মতবাদ তাদের প্রভাবিত করতে পারে না এবং ইসলামী আইন- বিধান রচনায় নিজেদের অথবা অপর কারো ব্যক্তিগত স্বার্থ, ঝোঁক প্রবণতা বা কামনা-বাসনাকে অনু পরিমাণ প্রবশাধিকার দেয়ার মত লোক তাঁরা নন। মুসলমানগণ তাদের সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিত ছিল যে, তাঁরা অনুসন্ধান, পর্যলোচনা ও গবেষণার পর শরীআতের যে বিধানই বর্ণনা করবেন তার মধ্যে মানবায় ভলক্রটি তো হতে পারে, কিন্তু আদর্শহীন ও লাগামহীন গবেষণা অথবা ইসলামে অনিসলামের মিশ্রণের কোন আশংকা তাদের ক্ষেত্রে নেই। এই খালেছ নৈতিক শক্তির প্রভাব এই ছিল যে, প্রথমে প্রচ্যের মুসলিম জনসাধারণ স্বয়ং তাকে ইসলামী আইন স্বীকার করে নেয় এবং নিজেদের যাবতীয় ব্যাপারে স্বেচ্ছায় তার অনুসরণ শুরু করে দেয়। অতপর এগুলোকে আব্বাসী সালতানাত আইন হিসাব মেনে নিয়ে দেশের আইন-বিধানরূপে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। অতপর সেই নৈতিক বলে এই আইন-বিধান মুসলিম পাশ্চাত্যের তুর্কী সালতানাতের এবং প্রাচ্যে ভারতের মুসলিম রাজত্বের আইন-বিধানে পরিণত হয়। ইমাম আবু হানীফা (রহ)-এর পর ইমাম মালেক (রহ) ইসলামী আইন প্রণয়ণের কাজ আঞ্জাম দেন। তাও কেবলমাত্র নৈতিক শক্তি বেল স্পেন এ উত্তর আফ্রিকার মুসলিম বাজ্যসমূহের আইন-বিধানে পরিণত হয়। অতপর ইমাম শাফিঈ (রহ) এবং তাঁর পরে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ) সম্পূর্ণ বেসরকারী পর্যায়ে ইসলামী আইনের পরিপুষ্টি সাধন করতে থাকেন এবং তাও শুধুমাত্র মুসলিম জনসাধারণের সম্মতিতে বিভিন্ন মুসলিম রাজ্যের আইন হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে। অনুরূপভাবে যায়দী ও জাফরী ফিকহসমূহও বিভিন্ন লোক ব্যাক্তিগত উদ্যোগে সংকলন করেন এবং তাও কেবলমাত্র নিজের নৈতিক বলে শীআ রাষ্ট্রের আইনে পরিণত হয়। অতপর আহলে হাদীসগণের দৃষ্টিভংগীতে যে ফিকহী বিধান প্রণীত হয় তাতেও কোন রাজনৈতিক প্রভাব ব্যতীত লাখো মুসলমান নিজেদের সর্জিমত নিজেদের জীবনের বিধান হিসাবে গ্রহণ করেছে। পরের শতাব্দীগুলোতেও এই সব আইন ঠিক সেই স্থানে স্থবির হয়ে থাকেনি, যেখানে ইমাম আবু হানীফা (রহ) তা রেখে গিয়েছিলেন। বরং প্রতিটি শতকে এর মধ্যে অনেক সংস্কার হয়েছে এবং নতুন সমস্যার সমাধানও তাতে শামিল হতে থেকেছে। যেমন যাহিরু রিওয়ায়াতের গ্রন্থাবলী এবং পরবর্তী কালের ফতোয়ার কিতাবসমূহের মধ্যে তুলনা করলে এর প্রমাণ পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু পরবর্তী কালের এসব কাজও সরকারী প্রভাবের সম্পর্ণ বাইরে থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ফতোয়া প্রতিষ্ঠানসমূহে হতে থাকে। করণ মুসলিম বাদশাহগণ এবং তাদের আমীর-ওমরা ও প্রশাসকগণের জ্ঞানের পরিধি ও খোদাভীতি সম্পর্কে মসলিম জনগণের আস্থা ছিল না, খোদাভীরু আলেমগণের প্রতিই তাদের আস্থা ছিল। তাই তাদের ফতোয়াসমূহ এই আইনের অংশে পরিণত হতে থাকে এবং তাদের হাতে ইসলামী আইনের ক্রমোন্নতি হতে থাকে। দুই-একটি দৃষ্টান্ত বাদে এই গোটা শতকসমূহে কোন নিকৃষ্টতম বাদশাও নিজের সম্পর্কে এই ভুল ধারণার শিকার হয়নি যে,সে একটি আইন-বিধান রচনা করবে আর মুসলমানগণ তা বিনা প্রতিবাদে শরীআতের বিধান হিসাবে মেনে নেবে। আওরাংযেবের মত খোদাভীরু শাসকও সমকালীন বিশিষ্ট আলেমগণকেই একত্র করেন যাদেরকে মুসলমানগণ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণে থেকে নির্ভরযোগ্য মনে করত এবং তাদের সহায়তায় তিনি হানাফী ফকীহগণের ফতোয়ার সংকলন তৈরী করে আইন-বিধান হিসাবে স্বীকৃতি দেন। এই আলোচনা থেকে তিনটি কথা সুন্দরভাবে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেঃ
(এক) হানাফী ফিকহ, যা ইংরেজদের আগমনের শতশত বছর পূর্ব থেকে প্রাচ্যের মুসলিম দেশসমূহের আইন-বিধান ছিল এবং যাকে ইংরেজরা আগমন করে তাদের গোটা শাসনকালে অন্তত ব্যাক্তিগত আইনের সীমা পযর্ন্ত মুসলমানদের আইন হিসাবে মান্য করতে থাকে, তা মূলত মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তাকে সরকারসমূহ তাকে এজন্য আইন হিসাবে গ্রহণ করে যে, এসব দেশের মুসলমানগণ তাছাড়া অন্য কোন জিনিসের আনুগত্য অন্তত ও বিবেকের প্রশান্তি সহকারে করতে পারত না।
(দুই) মুসলমানগণ যেভাবে ইংরেজ আমলে নিজেদের দীন ও শরীআত ইংরেজ বা অপর কোন অমুসলিমদের হাতে ছেড়ে দিতে প্রন্তুত ছিল না, অনুরূপভাবে তারা উমাইয়্যা যুগ থেকে নিয়ে আজ পযর্ন্ত কখনও এমন কোন মুসলমানের হাতেও তাদের দীন ও শরীআত অর্পণ করতে প্রস্তুত ছিল না এবং নেই যাদের ধর্মীয় জ্ঞান, খোদাভীতি ও সাবধানতা সম্পর্কে তারা আশ্বস্ত নয়।
(তিন) এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পরিবর্তন হওয়া তো দূরের কথা, আংশিকও পরিবর্তন হয়নি। ইংরেজদের পরিবর্তে কেবল মুসলমানদের সিংহাঙ্গনে আসীন হয়ে যাওয়ার মধ্যে স্বয়ং কোন চমকপ্রদ পার্থক্র নেই। খেলাফতে রাশেদার পর যে শনাতার সৃষ্টি হয়েছিল মুসলিম রাষ্টসমূহের সীমা পযর্ন্ত তা এখনও পর্ববৎ অবশিষ্ট রয়েছে। আর এই শূন্যতা ততক্ষণ পযর্ন্ত বিরাজ করতে থাকবে যতক্ষণ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এমন খোদাভীরু ফকীহ সৃষ্টি করতে না পারবে যাদের জ্ঞান ও তাকওয়ার উপর মুসলমানগণ আস্থা স্থাপন করতে পারে, এবং আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা উল্লেখিত ধরনের আস্থাভাজন ব্যক্তিদের আইন রচনার দায়িত্বে নিয়োজিত না করবে। আমরা যদি ও দেশে আমাদের জাতির বিবেক ও আইনের মধ্যে সংঘর্ষ সৃষ্টি করতে না চাই তবে যতক্ষণ না এই শূন্যতা বাস্তবিকই সঠিক পন্থায় পূর্ণ হবে, ততক্ষণ তা অসার বস্তু দিয়ে পূর্ণ করার কোন চেষ্টা না করাই উচিৎ।
বিজ্ঞ বিচারপতির মৌলিক দৃষ্টিভংগী
এরপর প্যারা ৮ থেকে ১৬ পর্যন্ত বিজ্ঞ বিচারপতি ইসলামী আইন সম্পর্কে নিজের কিছু দৃষ্টিভংগী বর্ণনা করেন যা পর্যায়ক্রমে নিম্নরূপঃ
১. ইসলামের আলোকে একজন মুসলমানের উপর তার জীবনের প্রতিটি শাখায় যে আইন প্রভাবশীল হওয়া উচিৎ চাই তা তার জীবনের ধর্মীয় শাখা হোক, অথবা রাজনৈতিক, সামাজিক বা অর্থনৈতিক শাখা হোক, তা কেবলমাত্র আল্লাহর আইন।
২. কুরআন যে সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে তার আওতার মধ্যে থেকে মুসলমানদের চিন্তা করার ও কাজ করার পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে।
৩. আইন যেহেতু মানুষের স্বাধীনতার উপর বিধিনিষেধ আরোপকারী শক্তি, তাই আল্লাহ তাআলা আইন প্রণয়নের সার্বিক কর্তৃত্ব সম্পূর্ণরূপে নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছেন। ইসলামে কোন ব্যক্তির এমনভাবে কাজ করার এখতিয়ার নাই যার ফলে মনে হতে পারে যে, সে অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর।
৪. রসূলুল্লাহ (স) ও খোলাফায়ে রাশেদীনের কর্মপন্থা এই ছিল যে, তাঁরা যা কিছু করতেন মুসলমানদের সাথে পরামর্শের ভিত্তিতে করতেন। ইসলামের মূল আকীদা স্বীয় মেজাজের দৃষ্টিকোণ থেকে কোন ব্যক্তির অন্যদের উপর প্রাধান্যকে নাকচ করে দেয়। তা সামগ্রিক চিন্তা ও কর্মের পথ দেখায়।
৫. এই দুনিয়ায় যেহেতু মানবীয় অবস্থা ও সমস্যাবলীর পরিবর্তন হতে থাকে, তাই এই পরিবর্তনশীল দুনিয়ায় স্থায়ী ও অপরিবর্তনযোগ্য বিধান চলতে পারে না। স্বয়ং কুরআনও এই সাধারণ নীতিমালার ব্যতিক্রম নয়। এ কারণে কুরআন বিভিন্ন বিষয়ে কতিপয় ব্যাপক ও সাধারণ নীতিমালা মানুষের পথপ্রদর্শনের জন্য দিয়ে দিয়েছে।
৬. কুরআন সহজ-সরল ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে যাতে প্রত্যেক ব্যক্তি তা বুঝতে পারে! তা পড়ার এবং অনুধাবন করার অধিকার এক-দুই ব্যক্তির জন্য একচেটিয়া নয়। সমস্ত মুসলমান ইচ্ছা করলে বুধতে পারে এবং তদনুযায়ী আমল করতে পারে। এই অধিকার সব মুসলমানকে দেয়া হয়েছে এবং তা কেউ তাদের নিকট থেকে ছিনিয়ে নিতে পারে না, চাই সে বিরাট উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ও বিজ্ঞ ব্যক্তির হোক না কেন।
৭. কুরআন মজীদ পড়ার এবং তা বুঝার বিষয়টি স্বয়ং দাবী করে যে, পাঠক তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করবে এবং তার ব্যাখ্যা প্রদানের সময় যে সমকালীন পরিস্থিতি ও পৃথিবীর পরিবর্তিত প্রয়োজনের উপর তার প্রয়োগ করবে।
৮. ইমাম আবু হানীফা (রহ). ইমাম মালেক (রহ) এবং অতীতের অপরাপর তাফসীরকারগণ কুরআনের যেসব ব্যাখ্যা করেছিলেন তা আজকের যুগে হুবহু অনুসরণ করা যেতে পারে না। সমাজের পরিবর্তিত পরিস্থিতির উপর কুরআনের সাধারণ মূলনীতিসমূহের প্রয়োগ করার জন্য তার বুদ্ধিদধীপ্ত ব্যাখ্যা করতে হবে এবং এমন পন্থায় ব্যাখ্যা করতে হবে –যেন লোকেরা তদনুযায়ী নিজেদের ভাগ্য, চিন্তাধারা ও নৈতিক দৃষ্টিভংগী গড়ে তুলতে পারে এবং নিজের দেশ ও যুগের উপযোগী পন্থায় কাজ করতে পারে। অন্য জাতির লোকদের মত মুসলমানগণও জ্ঞান ও বুদ্ধিবিবেকের অধিকারী এবং এই শক্তি ব্যবহারের জন্যই দেয়া হয়েছে। সমস্ত মুসলমানকে কুরআন পড়তে হবে এবং এর ব্যাখ্যা করতে হবে।
৯. কুরআন বুঝবার এবং তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য কঠোর পরিশ্রমের নামই হচ্ছে ইজতিহাদ। কুরআন সব মুসলমানের নিকট, শুধু তাদের বিশেষ শ্রেণীর নিকটই নয়, এই আশা পোষণ করে যে, তারা কুরআনের জ্ঞান অর্জন করবে, তা উত্তমরূপে হৃদয়ংগম করবে এবং তার ব্যাখ্যা প্রদান করবে।
১০. যদি প্রত্যেকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কুরআনের ব্যাখ্যা করে তবে অসংখ্য রকমের ব্যাখ্যা অস্তিত্ব লাভ করবে যার ফলে মারাত্মক বিশৃংখল পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। অনুরূপভাবে যেসব বিষয়ে কুরআন নীরব রয়েছে –যদি এসব ব্যাপারে এখতিয়ার প্রদান করা হয় তবে একটি বিশৃংখল ও অসংহত সমাজের সৃষ্টি হয়ে যাবে। তাই লোকদের সর্বাধিক সংখ্যকের রায় কার্যকর হওয়া উচিৎ।
১১. এক ব্যক্তি অথবা কয়েক ব্যক্তি প্রকৃতিগতভাবে বুদ্ধিজ্ঞান ও শক্তিতে অপূর্ণাংগ হয়ে থাকে। কোন ব্যকিত্ যত অধিক শক্তিশালী ও মেধাশক্তির অধিকারীই হোক না কেন তার কামেল (পূর্ণাংগ) হওয়া আশা করা যায় না। লাখ লাখ ও কোটি কোটি মানুষ সম্মিলিতভাবে একটি ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যে সামাজিক জীবন পরিচালিত করছে তা নিজেদের সামষ্টিক দিক থেকে ব্যক্তির তুলনায় অধিক জ্ঞান ও শক্তির অধিকারী। কুরআন মজীদের আলোকেও আল্লাহর কিতাবের ব্যাখ্যা এবং পরিস্থিতির উপর তার সাধারণ মূলনীতিসমূহের প্রয়োগের কাজটি এক ব্যক্তির উপর ছেড়ে দেয়া যায় না, বরং একাজ মুসলমানদের পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে হওয়া উচিৎ।
১২. আইন বলতে সেই বিধান ও প্রণালীকে বুঝায় যে সম্পর্কে অধিকাংশ লোক এই ধারণা পোষণ করে যে, তাদের যাবতীয় বিষয় তদনুযায়ী পরিচালিত হওয়া উচিৎ। কয়েক কোটি অধিবাসীর একটি দেশে বাসিন্দাদের অধিকাংশের কুরআনের একাধিক ব্যাখ্যা সাপেক্ষ আয়াতসমূহের এমন ব্যাখ্যা পেশ করা উচিৎ যা হবে তাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ।
উপরোক্ত দৃষ্টিভংগীর সমালোচনা
উপরের ১৩টি নম্বরের অধীনে আমরা বিজ্ঞ বিচারপতির সকল মৌলিক দৃষ্টিভংগীর সংক্ষিপ্ত ও সঠিক বর্ণনা তুলে ধরার সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। এর ভাষা ও ধারাবাহিক বিন্যাসেও আমরা বিজ্ঞ বিচারপতির নিজস্ব ভাষা ও যৌক্তিক বিন্যাসের দিকে লক্ষ্য রেখেছি, যাতে পাঠকদের সামনে সেই ধারণার সঠিক চিত্র ফুটে উঠে, যার উপর ইতিপূর্বে তিনি তার রায়ের ভিত্তি স্থাপন করেছেন। এইসব মৌলিক দৃষ্টিভংগীর কয়েকটি কথা গভীর চিন্তা ও সমালোচনার যোগ্য।
১. বিজ্ঞ বিচারপতির দৃষ্টিতে আল্লাহর বিধান বলতে কুরআনে বর্ণিত বিধান। সুন্নাত যে বিধান ও দিকনির্দেশনা দেয় তাকে তিনি আল্লাহর বিধানের মধ্যে গণ্য করেন না। উপরের বক্তব্যে একথা গোপন রয়েছে, কিন্তু সামনে অগ্রসর হয়ে তিনি তার রায়ে এই ব্যাখ্যা দেন। যথাস্থানে আমরা তার দৃষ্টিভংগীর ভ্রান্তি তুলে ধরব।
২. তিনি যখন বলেন, কোন ব্যক্তিরই অন্য লোকদের উপর প্রাধান্য নেই, এবং কুরআন বুঝা ও তার ব্যাখ্যা করা মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোকের বিশেষ অধিকার নয়, তখন তিনি এর মধ্যে মহানবী (সা)-একও অন্তর্ভুক্ত মনে করেন। এ জিনিসটিও উপরোক্ত বক্তব্যের মধ্যে প্রতীয়মান নয়, কিন্তু সামনে অগ্রসর হয়ে তিনি নিজেই এর ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন। অতএব তার এই মূলনীতিও সমালোচনার মুখাপেক্ষী।
৩. তিনি রসূলুল্লাহ (সা) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের একই পাল্লায় রেখে বলেছেন, “তাঁরা যা কিছুই করতেন মুসলমানদের সাথে পরামর্শের ভিত্তিতে করতেন”। একথা বাস্তবতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। স্বীয় ধরন ও বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে রসূলুল্লাহ (স) –এর মর্যাদা খোলাফায়ে রাশেদীনসহ সকল মুসলিম শাসকগণের মর্যাদার তুনায় মৌলিকভাবে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। মহানবী (স) –কে তাদের কাতারে দাঁড় করানো স্বয়ং সেই কুরআনের পরিপন্থী যাকে বিজ্ঞ বিচারপতি আল্লাহর বিধান বলে স্বীকার করেছেন। অতপর তার এই দাবীও সত্য নয় যে, খোলাফায়ে রাশেদীনের মত মহানবী (স) –ও যা কিছু করতেন মুসলমানের সাথে পরামর্শের ভিত্তিতে করতেন। যেসব বিষয়ে মহানবী (স) আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশনা লাভ করতেন সেসব ক্ষেত্রে তাঁর কাজ ছিল কেবল নির্দেশ প্রদান এবং মুসলমানদের কাজ ছিল তার অনুসরণ। এক্ষেত্রে পরামর্শের প্রশ্ন তো দূরের কথা কোন মুসলমানের কিছু বলারও কোন অধিকার ছিল না। আর আল্লাহর বিধান রসূলুল্লাহ (স) –এর নিকট অপরিহার্যরূপে শুধুমাত্র কুরআনের আয়াতের আকারেই আসত না, বরং তা ওহী গায়র মাতলূর আকারেও আসত।
৪. বিজ্ঞ বিচারপতি সাধারণ মুসলমানদের ইজতিহাদ করার অধিকারের উপর জোর দেয়ার পর স্বয়ং একথা স্বীকার করেছেন যে, একটি সুসংগঠিত সুশৃংখল সমাজে ব্যক্তিগত বা একক ইজতিহাদ চলতে পারে না, অধিকাংশ লোকের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ইজতিহাদই কেবল আইনের মর্যাদা পাবে। প্রশ্ন হচ্ছে, অধিকাংশ কর্তৃক নির্বাচিত কয়েকজন মাত্র ব্যক্তিকে ইজতিহাদের অধিকার প্রধান এবং এই কয়েকজন ব্যক্তির উপর আস্থা স্থাপন করে তাদের ইজতিহাদ গ্রহণ করা –এতদোভয়ের মধ্যে নীতিগতভাবে কি পার্থক্য আছে? এই দেশের সর্বাধিক সংখ্যাসরিষ্ঠ অংশ যদি হানাফী ফিকহ –এর উপর আস্থা স্থাপন করে কুরআন ও সুন্নাত সম্পর্কে তাদের ব্যাখ্যাসমূহ এবং তাদের ইজতিহাদসমূহকে ইসলামী আইন হিসাবে স্বীকার করে নেয়, তবে বিজ্ঞ বিচারপতি তার নিজের বিবৃত নীতিমালার আলোকে এর বিরুদ্ধে কি অভিযোগ করতে পারেন এবং কিভাবে করতে পারেন? এর উপর মুসলমানদের যে গভীর আস্থা রয়েছে তার অবস্থা তো এরূপ যে, যখন এই বিধান কার্যকর করার মত কোন ক্ষমতাসীন শক্তি বর্তমান ছিল না এবং অমুসলিম শাসক গোষ্ঠী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় তখনও মুসলমানগণ নিজেদের বাড়ীতে এবং নিজেদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের ক্ষেত্রসমূহে তাঁদের বর্ণিত আইন-কানূনেরই অনুসরণ করতে থাকে। এর অর্থ এই যে, মুসলিম জনসাধারণ কোনরূপ চাপের সম্মুখীন হওয়া ছাড়াই আন্তরিক নিষ্ঠার সাথে এবং মন ও বিবেকের পূর্ণ প্রশান্তি সহকারে তাকে সঠিক আইন মনে করে। দুনিয়ার কোন পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রণীত বিধানের সপক্ষে এতটা শক্তিশালী ও ব্যাপক জনসমর্থন লাভের ধারণা করা যায় কি? এর মোকাবিলায় কোন এক ব্যক্তির-চাই সে একজন বিজ্ঞ বিচারপতিই হোক না কেন –এই যুক্তির কি মূল্য আছে যে, এই ফকীহগণের ব্যাখ্যাসমূহ আজকের যুগে মান্য করা যেতে পারে না? বিচারপতি মুহাম্মদ শফী সাহেব স্বয়ং বলেন যে, আইন বলতে তাকেই বুঝায় যা অধিকাংশ লোক মান্য করে। অতএব সর্বাধিক লোক ফিকহ –এর এই বিধান মেনে চলছে। অবশেষে কোন যুক্তির ভিত্তিতে তার এই ব্যক্তিগত রায় এসব বিধান রদ করতে পারে?
৫. বিজ্ঞ বিচারক একদিকে স্বয়ং স্বীকার করেন যে, আইন প্রণয়ন এবং তাতে রদবদল সাধন অধিকাংশ লোক কর্তৃক নির্বাচিতক প্রতিনিধিদের কাজ, কতিপয় ব্যক্তির কাজ নয়, তা সে যত বড় শক্তিশালী ও মেধার অধিকারীই হোক না কেন। কিন্তু অপর দিকে তিনি নিজেই সংখ্যাগরিষ্ঠ কর্তৃক স্বীকৃত আইনের নীতিমালার পরিবর্তনও করেছেন এবং অভিভাবকত্ব সম্পর্কে অধিকাংশের অনুসৃত বিধানও রদ করেছেন। এটা যদি স্ববিরোধীতা না হয়, তবে এ দুটি কথার মধ্যে কিভাবে সমন্বয় সাধন করা যেতে পারে তা জানতে পারলে আমরা খুবই আনন্দিত হব।
ইজতিহাদের কয়েকটি নমুনা
এরপর প্যারা ১৬ থেকে ২০-এর মধ্যে বিজ্ঞ বিচারপতি স্বয়ং কুরআন মজীদের কতিপয় আয়াতের ব্যাখ্যা পেশ করে নিজের ইজতিহাদের কয়েকটি নমুনা তুলে ধরেছেন। এর মাধ্যমে তিনি বলতে চেয়েছেন যে, এই যুগে ইজতিহাদী শক্তির প্রয়োগের দ্বারা কুরআন থেকে কিভাবে বিধান আবিষ্কার করা উচিৎ।
একাধিক স্ত্রী গ্রহণ সম্পর্কিত বিষয়ে বিজ্ঞ বিচারকের ইজতিহাদ
এ বিষয়ে তিনি সর্বপ্রথম সূরা নিসার তৃতীয় আয়াত উধৃত করেনঃ
(আরবী********************************************************************************)
উপরোক্ত আয়াত সম্পর্কে তার বক্তব্য হচ্ছে, “এ আয়াতটি বেশীর ভাগই ভ্রান্তভাবে ব্যবহার করা হয়েছে”। এ আয়াতের উপর আলোচনার সূত্রপাত করতে গিয়ে তিনি প্রথমেই বলেছেনঃ “কুরআন পাকের কোন হুকুমের কোন অংশই অর্থহীন মনে করা উচিৎ নয়”। কিন্তু এর পরপরই তিনি বলেনঃ “জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাজ হল, তারা এ বিষয়ে আইন প্রণয়ন করবে যে, একজন মুসলমান একের অধিক বিবাহ করতে পারবে কি না, যদি পারে তবে কি অবস্থার কি কি শর্ত সাপেক্ষে?”
এই ইজতিহাদের প্রথম ভ্রান্তি
আশ্চর্যের ব্যাপার, বিজ্ঞ বিচারক তার এই দুটি বাক্যের মধ্যে স্ববিরোধিতা উপলব্ধি করতে কিভাবে ব্যর্থ হলেন! প্রথম বাক্যে তিনি নিজে যে নীতিগত কথা বলেছেন তার আলোকে আলোচ্য আয়াতের কোন শব্দ প্রয়োজনের অতিরিক্ত বা অর্থহীন নয়। এখানে দেখুন, আয়াতের মূল পাঠ পরিস্কার বলে দিচ্ছে, এ আয়াতে মুসলিম সমাজের সদস্যদের সম্বোধন করা হয়েছে। তাদের বলা হচ্ছেঃ “তোমাদের যদি আশংকা হয় যে, তোমরা এতীমদের ব্যাপারে সুবিচার করতে পারবে না, তবে নারীদের মধ্যে যাকে তোমাদের পছন্দ হয় তাকে বিবাহ কর –দুজনকে, তিনজনকে অথবা চারজনকে। কিন্তু তোমাদের যদি আশংকা হয় যে, তোমরা ন্যায়বিচার করতে পারবে না তবে একজনই যথেষ্ট….”।
একথা স্পষ্ট যে, বিবাহের জন্য নারীদের বাছাই, পছন্দ করা, তাদের বিবাহ করা এবং নিজেদের স্ত্রীদের সাথে ইনসাফ করা অথবা না করা ব্যক্তির কাজ, গোটা জাতি বা সমাজের কাজ নয়। অতএব আয়াতের অবশিষ্ট সব অংশেও যাতে বহুবচনের ক্রিয়াপদে সম্বোধন করা হয়েছে, অবশ্যম্ভাবীরূপে ব্যক্তিদেরই সম্বোধন করা হয়েছে, একথা স্বীকার না করে উপায় নেই। এভাবে গোটা আয়াতটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মূলত প্রত্যেক ব্যক্তিকে স্বতন্ত্রভাবে সম্বোধন করছে এবং বিষয়টি তাদের মর্জির উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে যে, তারা যদি ভারসাম্য বজায় রাখতে সক্ষম হয় তবে অনধিক চারের সীমা পর্যন্ত যে কজন স্ত্রীলোককে ইচ্ছা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করতে পারে। ইনসাফ বা ভারসাম্য বজায় রাখতে না পারার আশংকা হলে এক স্ত্রী নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবে। প্রশ্ন হচ্ছে, যতক্ষণ (আরবী****************) এবং (আরবী***********************) ততক্ষণ অত্র আয়াতের কাঠামোর মধ্যে জাতির প্রতিনিধিগণ কোন পথ দিয়ে প্রবেশ করতে পারে? আয়াতের কোন শব্দটি তাদের জন্য প্রবেশপথ উন্মুক্ত করে দেয়? আবার প্রবেশও এতদূর পর্যন্ত যে, তারাই ফয়সালা করে দেবে একজন মুসলমান দ্বিতীয় বিবাহ করতে পারবে কি না? অথচ একাধিক বিবাহের অধিকার তাকে স্বয়ং আল্লাহ-ই সুস্পষ্ট বাক্যে প্রদান করেছেন। আবার “করতে পারার” ফয়সালা করার পর তারা এও নির্ধারণ করবে যে, “কোন অবস্থায় এবং কি কি শর্তাধীনে করতে পারবে?” অথচ আল্লাহ তাআলা বিষয়টি ব্যক্তির নিজস্ব সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দিয়েছেন যে, সে যদি নিজের মধ্যে ন্যায়-ইনসাফ করার শক্তি রাখে তবে একাধিক বিবাহ করবে, অন্যথায় একজনকে নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবে।
দ্বিতীয় ভ্রান্তি
দ্বিতীয় কথা তিনি এই বলেন, “কিয়াসের দৃষ্টিকোণ থেকে এ ধরনের বিবাহ (একাধিক স্ত্রী গ্রহণ) এতীমদের স্বার্থে হওয়া উচিৎ”। এ আয়াতের তাৎপর্য গ্রহণে আধুনিক কালের কোন কোন ব্যক্তি যে ভুল করছে এখানেও সেই সাধারণ ভুলটি করা হয়েছে। তাদের ধারণামতে আয়াতে যেহেতু ইয়াতীমদের সাথে সুবিচার করার উল্লেখ রয়েছে, তাই একাধিক বিবাহ করার ক্ষেত্রে অবশ্যই যে কোন প্রকারে হোক ইয়াতীমদের বিষয়টি একটি অপরিহার্য শর্ত হিসাবে যুক্ত হওয়া উচিৎ। অথচ একথাটিকে যদি একটি মূলনীতিতে পরিণত করা হয় যে, কুরআনে কোন বিশেষ স্থানে বা উপলক্ষে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, ঐ নির্দেশটি কেবলমাত্র ঐ স্থানের জন্যই নির্দিষ্ট থাকবে, তবে তা মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে। যেমন, আরবের লোকেরা অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে নিজেদের ক্রীতদাসীদের বেশ্যাবৃত্তিতে লিপ্ত হতে বাধ্য করত। কুরআন নিম্নোক্ত বাক্যে তা নিষিদ্ধ করেঃ
(আরবী**********************************)
“নিজেদের ক্রীতসাদীসের বেশ্যাবৃত্তিতে লিপ্ত হতে বাধ্য কর না যদি তারা সতীত্ব রক্ষা করতে চায়”-(সূরা নূরঃ ৩৩)।
এখানে কি কিয়াসের আশ্রয় নিয়ে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছা যাবে যে, এই নির্দেশ কেবলমাত্র বাঁদীদের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং বাঁদী নিজে যদি বেশ্যাবৃত্তিতে লিপ্ত থাকতে চায় তবেই তাকে দিয়ে এ পথে অর্থ উপার্জন করা যেতে পারে?
মূলত এসকল শর্তাবলী ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট যতক্ষণ দৃষ্টিতে থাকবে ততক্ষণ কোন ব্যক্তি কুরআন মজীদের এসব আয়াতের, যেগুলোতে কোন হুকুম বর্ণনা করতে গিয়ে কোন বিশেষ অবস্থার উল্লেখ করা হয়েছে, ঠিকভাবে বুঝতে পারবে না। (আরবী***************************************) আয়াতের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এই যে, আরবদেশে এবং প্রাচীনকালে সব সমাজে শতশত বছর ধরে বহু বিবাহ সাধারণভাবে বৈধ ছিল। এজন্য নতুনভাবে কোন অনুমতি প্রদানের মোটেই প্রয়োজন ছিল না। করণ কুরআন কর্তৃক কোন প্রচলিত প্রথা নিষিদ্ধ না করা ছিল স্বয়ং ঐ প্রথার অনুমোদন দান করার নামান্তর। তাই উপরোক্ত আয়াত মূলত বহুবিবাহের অনুমতি দানের জন্য নাযিল হয়নি, বরং উহুদের যুদ্ধের পর যেসব মহিলা কয়েকটি বাচ্চাসহ বিধবা হয়ে যায়, তাদের সমস্যার সমাধানের জন্য নাযিল হয়েছিল। এ আয়াতে মুসলমানদের দৃষ্টি আর্কষণ করে বলা হয়েছে, মোমরা যদি ুহুদের শহীদদের ইয়াতীম শিশুদের সাথে এমনিতে ন্যায় বিচার করতে না পার, তবে তো তোমাদের জন্য একাধিক স্ত্রী গ্রহণের পথ প্রথম থেকেই উন্মুক্ত আছে। তাদের বিধবাদের মধ্যে যাদেরকে তোমাদের পছন্দ হয় তাদের বিবাহ কর, যাতে তাদের স্বার্থ রক্ষার প্রতি তোমাদের নিজেদের আকর্ষণ সৃষ্টি হয়। এ থেকে কোন যুক্তিতেই এই সিদ্ধান্তে পৌছা যায় না যে, ইয়াতীম শিশুদের লালন- পালনের সমস্যা দেখা দেলেই কেবল সেই অবস্থায় একাধিক বিবাহ করা যেতে পারে। এই আয়াত যদি কোন নতুন বিধান প্রণয়ন করে থাকে তবে তা বহুবিবাহের অনুমতি প্রদান নয়। করণ এ অনুমতি প্রথম থেকেই বিদ্যমান ছিল এবং সমাজে হাজার হাজার বছর ধরে তার প্রচলন ছিল। বরং এ আয়াতে মূলত যে নতুন বিধান দেয়া হয়েছে তা কেবলমাত্র এই যে, স্ত্রীর সংখ্যা চার-এ সীমিত করা হয়েছে, যা পূর্বে ছিল না।
তৃতীয় ভ্রান্তি
বিজ্ঞ বিচারক তৃতীয় কথা এই বলেন, “যদি কনে একজন মুসলমান একথা বলতে পারে যে, আমি একের অধিক বিবাহ করব না, কারণ সে সামর্থ আমার নেই, তবে আট কোটি মুসলমানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল গোটা জাতির জন্য এই বিধান প্রণয়ন করতে পারে যে, জাতির অর্থনৈতিক, সামাজিক অথবা রাজনৈতিক পরিস্থিতি কনো ব্যক্তিকে একের অধিক বিবাহ করার অনুমতি দেয় না।“
এই অদ্ভুত যুক্তিপদ্ধতি সম্পর্কে আমাদের আবেদন এই যে, মুসলমান যখন বলে যে, সে একের অধিক বিবাহ করবে না, তখন সে তার পরিবারিক জীবন সম্পর্কে তাকে আল্লাহ প্রদত্ত স্বাধীনতারই ব্যবহার করে। সে এই স্বাথীনতাকে বিবাহ না করার ব্যাপারেও ব্যবহার করতে পারে, এক স্ত্রী নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার ব্যাপারেও ব্যবহার করতে পারে, স্ত্রী মারা যাওয়ার পর পুনর্বিবাহ করা বা না করার ব্যাপারেও ব্যবহার করতে পারে এবং কোন সময় মত পরিবর্তিত হলে একের অধিক বিবাহ করার ক্ষেত্রেও ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু জাতি সমস্ত লোকের জন্য কোন স্বতন্ত্র বিধান প্রণয়ন করলে তা ব্যক্তির আল্লহ প্রদত্ত স্বাধীনতা ছিনেয়ে নেয়া ছাড়া আর কিছু নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এই কিয়াসের ভিত্তিতে জাতি কোন সময় কি এই সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা পেতে পারে যে, তার অর্ধেক অধিবাসী বিবাহ করবে আর অর্ধেককে অবিবাহিত থাকতে হবে? অথবা যার স্ত্রী বা স্বামী মারা যাবে সে পুনর্বিবাহ করতে পাবে না? প্রত্যেক ব্যক্তিকে প্রদত্ত কোন স্বধীনতাকে যুক্তির ভিত্তি বানিয়ে জাতিকে তার সদস্যদের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়ার অধিকার প্রদান একটি যৌক্তিক ভ্রান্তি তো হতে পারে, কিন্ত আমাদের জানা নাই যে, আইনের ক্ষেত্রে এই যুক্তি গ্রহণ পদ্ধতি কবে থেকে স্বীকার্য হয়েছে? তথাপি আমরা ক্ষণিকের জন্য একথা স্বীকার করে নেই যে, আট কোটি মুসলানের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যেমন চার কোটি এক হাজারজন একত্রিত হয়ে এরূপ কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার রাখে। কিন্তু প্রশ্ন হল, যদি আট কোটি মুসলমানের মধ্যে মাত্র কয়েক হাজার ব্যাক্তি একত্র হয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত মত অনুযায়ী এ ধরনের কোন আইনের প্রস্তাব করে এবং অধিকাংশের মতের বিরুদ্ধে তা তাদের উপর চাপিয়ে দেয় তবে বিজ্ঞ বিচারপতির বর্ণিত নীতিমালার আলোকে তার কি বৈধতা আছে? আট কোটি মুসলিম অধিবাসীর মধ্যে একলাখ, বরং পঞ্চাশ হাজারেরও দৃষ্টিভংগী এট নয় যে, জাতির অর্থনৈতিক, সামাজিক ও বাজনৈতিক পরিস্থিতি এই দাবী করে যে, একজন মুসলমানের জন্য একাধিক স্ত্রী রাখা তো আইনত নিষিদ্ধ হবে, অবশ্য তার “মেয়ে বন্ধুর” সাথে অবাধ মেলামেশা অথবা গণিকাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন অথবা স্বতন্ত্রভাবে রক্ষিতা রাখা আইনত বৈধ। স্বয়ং সেইসব মহিলাও যাদের জন্য সতীনের সল্পনা করাও দুষ্কর, খন কমই এরূপ পাওয়া যাবে যাদের মতে এক নারীর সাথে তার স্বামীর বিবাহ হলে তার জীবনটা চিতায় সহমরণের চেয়েও নিকৃষ্ট হয়ে যাবে, কিন্তু সেই রমনীর সাথে তার স্বামীর অবৈধ সম্পর্ক থাকলে তার জীবনটা জান্নাতের মুখময় নমুনা হয়ে থাকবে।
চতুর্থ ভ্রান্তি
পুনরায় বিজ্ঞ বিচাপতি বলেন, “এ আয়াতকে কুরআনের অন্য দুটি আয়াতের সাথে মিলিয়ে পড়তে হবে। প্রথমটি সূরা নূর-এর ৩৩ নং আয়াত, যাতে বলা হয়েছে- বিবাহ করার উপায়-উপকরণ যার নাই তার বিবাহ করা অনুচিৎ। উপায়-উপকরণের স্বল্পতার কারণে যদি কোন ব্যক্তিকে এক বিবাহ থেকেও বিরত রাখা যায় তবে এসব কারণে বা এ জাতীয় কারণে তাকে একের অধিক বিবাহ থেকেও বিরত রাখা উচিৎ।“
বিচাপতি সাহেব স্বয়ং এখানেও নিজের বর্ণনাকৃত মূলনীতি ভংগ করেছেন। আয়াতের মূল পাঠ এই যেঃ
(আরবি**********************************)
“যারা বিবাহের মুযোগ পায় না তারা যেন সংযমের সাহায্য নেয়, যতক্ষণ না আল্লহ নিজ অনুগ্রহে তাদের ধনবান করে দেন।“
এই বক্তব্যের মধ্যে এরূপ তাৎপর্য কোথ থেকে পাওয় গেল যে, এ ধরনের লোকের বিবাহ করতে পারবে না? কুরআনের কোন আয়াতের শব্দাবলীকে যদি “অপ্রয়োজনীয় ও অর্থহীন” মনে করা বৈধ না হয় তবে বিবাহ নিষিদ্ধ করে দেয়ার ধারণা এ আয়াতে কোন প্রকারেই প্রবশ করানো যেতে পারে না। এখানে তো শধু বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা যতক্ষণ বিবাহের উপায়-উপকরণের ব্যবস্থা না করে দেবেন ততক্ষণ অববাহিত লোকেরা সংযমের সাথে পবিত্র জীবন যাপন করবে এবং খারাপ কাজে লিপ্ত হয়ে আত্নতুষ্টি লাভ করে ফিরবে না। তথাপি যদি কোন না কোন প্রকারে বিবাহ থেকে বিরত রাখার অর্থ উক্ত শব্দসমূহের মধ্যে প্রবেশও করানো হয়, তবেও এ নির্দেশ ব্যক্তির প্রতি, জাতি বা সরকারের প্রতি নয়। কোন ব্যক্তি নিজেকে কখন বিবাহ করার উপযক্ত মনে করে এবং কখন উপযুক্ত মনে করে না তা নির্ধারণের বিষয়টি তার সুবিবেচনার উপরই ছেড়ে দেয়া হয়েছে এবং তাকে পথনির্দেশ দেয়া হয়েছে ( যদি বাস্তবিকই এ ধরনের কোন পধনির্দেশ দেয়া থাকে ) যে, যতক্ষণ সে বিবাহ কারার উপায়-উপকরণ না পাবে ততক্ষণ বিবাহ করবে না। এখানে সরকারকে ব্যক্তি যতক্ষণ বিচারালয়ের সামনে নিজেকে একজন স্ত্রী এবং হাতে গোনা কয়েকটি সন্তানের ( যার সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেয়ার অধিকারও বিজ্ঞ বিচারকের রায় অনুযায়ী এই আয়াত সরকারকে দান করে) ভরণ-পোষণ করার উপযুক্ত প্রমাণ করতে না পারবে, ততক্ষণ সে বিবাহ করতে পারবে না? আয়াতের শব্দাবলী যদি “অপ্রয়োজনীয় ও অর্থহীন” না হয়ে থাকে তবে আমাদের বলে দিতে হবে যে, আয়াতের ভিত্তিতে আরও সামনে অগ্রসর হয়ে একাধিক স্ত্রী এবং নির্দিষ্ট সংখ্যার অধিক সন্তানের ব্যাপারে সরকারকে আইন প্রণয়নের অধিকার কিভাবে দেয়য় যেতে পারে?
পঞ্চম ভ্রান্তি
দ্বিতীয় আয়াতে যাকে সূরা নিসার ৩য় আয়াতের সাথে মিলিয়ে পড়তে এবং তা থেকে একই বিধান বের করতে বিজ্ঞ বিচারক চেষ্টা করেছেন, তা হচ্ছে এই সূরার ১২৯ নম্বর আয়াতে। আয়াতের বরাত দিয়েই তিনি ক্ষান্ত হননি, বরং তার মূল পাঠও তিনি স্বয়ং নকল করেছেন। তা এই যেঃ
( আরবি*********************************)
“ আর তোমরা যতই ইচ্ছা কর না নেন মহিলাদের (স্ত্রীদের) মধ্যে ন্যায় বিচার করতে কখনও সক্ষম হবে না। অতএব (এক স্ত্রী প্রতি) সম্পূর্ণ ঝুঁকে পড় না যে, ( অপর স্ত্রীকে) ঝুলানো অবস্থয় রাখবে। তোমরা যদি নিজেরদের কর্মপন্থা সঠিক রাখ এবং আল্লাহকে ভয় করতে থাক তবে নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।“
এই শব্দাবলীর ভিত্তিতে বিজ্ঞ বিচারক প্রথমে তো বলেন, “আল্লাহ তাআলা একথা সম্পূর্ণ পরিস্কার করে দিয়েছেন যে, স্ত্রীদের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা মানবীয় সত্তর ক্ষমতা বহির্ভুত।“ অতপর তিনি এই সিদ্ধান্ত পৌছেন যে, “এই দুটি আয়াতের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য আইন প্রণয়ন এবং একের অধিক বিবাহের উপর বাধানিষেধ আরোপ সরকারের কাজ। সরকার বলতে পারে যে, দুই স্ত্রী রাখার ক্ষেত্রে যেহেতু দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত হয়েছে এবং কুরআনেও স্বীকার করে নেয়া হয়েছে যে, উভয় স্ত্রী সাথে সমান ব্যবহার সম্ভব নয়, অতএব এই পন্থা চিরকালের জন্য খতম করা হয়।“
চরম হতবাক হতে হয় যে, আয়াত থেকে এতবড় বিষয়বস্তু কিভাবে এবং কোথা থেকে বের হয়ে আসল? অত্র আয়াতে আল্লহ তাআলা একথা তো অবশ্যই বলেছেন যে, মানুষ দুই অথবা ততোধিক স্ত্রীর মধ্যে পরিপূর্ণ ন্যায়ইনসাফ করতে চাইলেও তা করতে সক্ষম হবে না। কিন্তু এ কারণেই কি আল্লহ তাআলা স্বয়ং সূরা নিসার তিন সম্বর আয়াতে ন্যায়ইনসাফের শর্ত সহকারে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের যে অনুমতি দিয়েছিলেন তা প্রত্যাহার করেছেন? আয়াতের শব্দসমষ্টি পরিষ্কার বলে দিচ্ছে যে, এই প্রকৃতিগত সত্যকে পরিষ্কার বাক্যে বর্ণনা করার পর আল্লাহ তাআলা দুই অথবা ততোধিক স্ত্রী স্বামীর নিকট শধু এই দাবী করেন যে, সে যেন স্ত্রীর প্রতি এমনভাবে ঝুঁকে না পড়ে যে, অপর বা অপরাপর স্ত্রীকে ঝুলন্ত অবস্তায় রেখে দেবে। অন্য কথায়, কুরআনের দৃষ্টিতে পরিপূর্ণরূপে ইনসাফ না করতে পারার সারকথা একাধিক বিবাহের অনুমতিই মূলত রহিত হয়ে যাওয়া নয়। বরং পক্ষান্তরে এর সারকথা এই যে, দাম্পত্য সম্পর্কের জন্য স্বামী এক স্ত্রীর প্রতি বিশেষভাবে ঝুঁকে পড়া থেকে বিরত থাকবে এবং সকল স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখবে, তার অন্তর একজনের প্রতি আকৃষ্ট থাকলেও। স্বামী তার অপর স্ত্রী বা স্ত্রীদের জুলন্ত অবস্থায় রেখে দিলেই কেবল এই অবস্থায় রেখে দিলে ন্যায়ইনসাফ ব্যাহত হবে এবং এই পরিস্থিতিতে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতির সুযোগ নেয়া যেতে পারে না। কিন্তু কোন যুক্তির আলোকে এই আয়াতের শব্দাবলী এবং তার পারস্পরিক বিন্যাস ও অর্থ থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় না রাখার ক্ষেত্রে একই ব্যক্তির জন্য একাধিক স্ত্রী গ্রহণ নিষিদ্ধ করার সুযোগ বের করা যেতে পারে না। আর কোথায় তা থেকে সরকার কতৃর্ক সমস্ত লোকের জন্য একধিক স্ত্রী রাখার বিষয়টি চিরতরে নিষিদ্ধ করার এত বিরাট বক্তব্য নির্গত হয়? কুরআনের যতগুলো আয়াত ইচ্ছা লোকের মিলিয়ে পড়ুক, কিন্তু কুরআনের বাক্যের মধ্যে কুরআনের বক্তব্যই পড়তে হবে। অন্য কোন বক্তব্য কোথাও থেকে ধার করে এনে তা কুরআনের মধ্যে পড়া এবং অতপর একথা বলা যে, এই বক্তব্য কুরআনেই পাওয়া গেছে, কোন প্রকারেই কুরআন পাঠর সঠিক পন্থা নয়, তাকে সঠিক পন্থার ইজতিহাদ বলে গ্রহণ করা তো দূরের কথা!
সামনে অগ্রসর হওয়ার পূর্বে আমরা বিজ্ঞ বিচারপতিকে এবং তার অনুরূপ চিন্তাধারার লোকদেরও একটি প্রশ্ন সম্পর্কে চিন্তা করার আহবান করছি। কুনআন মজজীদের যে আয়াতের উপর তিনি বক্তব্য রাখছেন, তা নাযিল হওয়ার পর ১৪০০ বছর অতিবাহিত হয়েছে। এই গোটা কাল ব্যপী মুসলিম জনগোষ্ঠী পৃথিবীর এক বিরাট অংশ জড়ে অব্যাহতভাবে বসবাস করে আসছে। আজ এমন কোন অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক অথবা সাংস্কৃতিক অবস্থার নির্দেশ করা যেতে পারে না যা পূর্বে কোন কালে মুসলিম সমাজ উদ্ভুত না হয়নি যে, একাধিক বিবাহ প্রতিরোধ করার অথবা তার উপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের প্রয়োজন আছে? এর কোন যুক্তিসংগত কারণ এছাড়া আর কি হতে পারে যে, আজ আমাদের মধ্যে পাশ্চাত্যের সেইসব জাতির আধিপত্যের কারণে এই ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যারা একের অধিক স্ত্রী রাখাকে একটি নিকৃষ্ট ও কাজ এবং বিবাহ ছাড়াই মেয়ে বন্দুর সাথে (অবশ্য উভয়ের সম্মতি সাপেক্ষ) সম্পর্ক রাখা বৈধ, পবিত্র অথবা অন্তত উদার দৃষ্টিতে দেখার মত ব্যাপার মনে করে এবং যাদের সমাজে রক্ষিতা প্রথা বলতে গেলে প্রায় গ্রহণযোগ্য হয়ে গেছে, বরং ঐ রক্ষিতাকে বিবাহ করাই অপরাধ মনে করা হয়? এই ধারণা সৃষ্টি হওয়ার পেছনে যদি সততার সাথে বাস্তবিকই এছাড়া অন্য কোন কারণ নির্দেশ করা না যায়, তবে আমাদের জিজ্ঞাস্য হচ্ছে, এভাবে বাইরের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে কুরআনের আয়াতের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা কি ইজতিহাদের কোন সঠিক পন্থা হতে? মুসলিম জনগণের বিবেক কি এ ধরনের ইজতিহাদের দ্ধারা আশ্বস্ত করা যাবে?
২য় ইজতিহাদ-চুরির শাস্ত সম্পর্কে
এরপর বিজ্ঞ বিচারপতি সূরা মাইদার ৩৭-৩৯ নং আয়াত টেনে এনেছেন এবং তার উপর ইজতিহাদ (গবেষণঅ) করে বলেছেন যে, “এ স্থানে কুরআন চুরির চরম শাস্তি হাত কর্তন বলেছে।“ অথচ কুরআন এই অপরাধের চরম শাস্তি ( Maximum Punishment) নয়, বরং একমাত্র শাস্তি ( Only Punishment) হাত কর্তন সাব্যস্ত করেছে। কুরআনের মূল পাঠ নিম্নে দেয়া হলঃ
(আরবি***************************************)
“আর পুরুষ চোর অথবা নারী চোর-উভয়ের হাত কেটে দাও। তাদের কৃতকর্মের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হিসাব আল্লাহর পক্ষ থেকে তা নির্দিষ্ট।“ কুরআন যদি অপ্রয়োজনীয় বা অর্থহীন শব্দ ব্যবহার না করে থাকে তবে এই বাক্যে প্রত্যেক ব্যক্তি দেখতে পারে যে, পুরুষ চোর এ নারী চোর-উভয়ের জন্য পরিষ্কারভাবে একই শাস্তি বর্ণনা করা হয়েছে এবং তা হচ্ছে হাত কর্তন। এর মধ্যে ‘চুরান্ত বা সর্বশেষ পযায়ের শাস্তি’-র ধারণা কোন পথে প্রবেশ করতে পারে?
৩য় ইজতিহাদ-সন্তানের অভিভাবকত্ব সম্পর্কে
বিজ্ঞ বিচারপতি ইজতিহদের সর্বশেষ নমুনা পেশ করেছেন এমন সন্তানদের অভিভাবকত্ব সম্পর্কিত বিষয়ে যাদের মায়ের নিজ নিজ স্বামী থেকে পৃথক হয়ে গেছে। এ বিষয়ে তিনি সূরা বাকারর ২৩৩ নং আয়াত এবং সূরা তালাকের ৬নং আয়াত উল্লেখ করে নিম্নোক্ত দুটি কথা বলেছেন এবং দুটি কথাই পরিষ্কারভাবে কুরআনের বক্তব্যের সীমার বাইরে। প্রথম কথা এই বলেছেন যে, “এসব আয়াতের আলোকে মায়েদেরকে তাদের সন্তানদের পূর্ণ দুই বছর স্তন দান করতে হবে।“
অথচ তিনি যে আয়াতগুলো উধৃত করেছেন তার আলোকে পূর্ণ দুই বছর তো দূরের কথা, স্বয়ং দুধপান করানোই বাধ্যতামূলক করা হয়নি। সূরা বাকারার আয়াতে বালা হয়েছেঃ
(আরবি****************************************)
“আর মায়েরা তাদের সন্তানদের পূর্ণ দুই বছর স্তন দান করবে-সেই ব্যক্তির উদ্দেশ্যে যে দুধপান-কাল পূর্ণ করতে চায়।“
(আরবি****************************************)
“অতএব তারা যদি তোমাদের জন্যে বাচ্চাদের দুধপান করায় তবে তাদের পারিশ্রমিক তাদের দিয়ে দাও
তিনি দ্বিতীয় কথা এই বলেছেন যে, “কুরআনে এমন কোন নির্দেশ নাই যে কোন মহিলা তালাকপ্রাপ্তা হওয়ার পর দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করার কারণেই যদি সন্তান থেকে বঞ্চিত হতে পারে, তবে আমি এর কোন কারণ বুঝতে পারছি না যে, কোন পুরুষ দ্বিতীয় বিবাহ কারার ক্ষেত্রে কোন বাচ্চা থেকে বঞ্চিত হবে না।“
উপরোক্ত কথা বলার সময় বিজ্ঞ বিচারপতি খব সম্ভব খেয়াল করতে পারেননি যে, কয়েক লাইন পূর্বে তিনি নিজে যেসব আয়াত উল্লেখ করেছেন তাতে পিতাকে সন্তানের মালক সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং প্রথম থেকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত এসব আয়াতে পিতাই সন্তানের মালিক এই ভিত্তির উপর সমস্ত বিধান রচিত হয়েছে।
(আরবি************) “সন্তানের মালিক যে-তাকেই স্তন দায়িন মায়ের খাওয়া পরার ব্যবস্থা করতে হবে”। (আরবি*********************************************************) “তোমরা যদি (অন্য কোন মহিলার দ্বারা) নিজেদের সন্তানদের দুধ পান করাতে চাও তবে তাতে তোমাদের উপর কোন অভিযোগ নেই”।
“অতএব তারা যদি তোমাদের জন্য বাচ্চাদের দুধ পান করায় তবে তাদের পারিশ্রমিক তাদের দিয়ে দাও।“ হাইকোটের একজন বিজ্ঞ বিচারপতির নিকট একথা গোপন থাকতে পারে না যে, কুরআনের এই শব্দবলা সন্তানের ব্যাপারে পিতা ও মতোর মর্যাদার মধ্যে কি পার্থক্য নির্দেশ করছে?
মৌলিক ভ্রান্তি
উপরোক্ত তিনটি বিষয়ে বিজ্ঞ বিচারক এমন ভংগীতে আলোচনা করেছেন যে, মনে হয় কুরআন শূন্যলোকে পরিভ্রমণ করতে করতে সরাসরি আমাদের নিকট এসে পৌছে গেছে। মুসলিম সমাজের কোনো অতীত নাই, যখন এই কিতাবের বিধানসমূহ বঝবার এবং বুঝাবার এবং তদনুযায়ী আমল কারার কোন কাজ কখনো হয়ে থাকবে এবং যা থেকে আমরা কোন প্রকারের কোন নজীর কোথাও পেতে পারি। যেন কোন নির্দেশের তাৎপর্য বর্ণনা করে থাকবেন অথবা তদনুযায়ী কাজ করে দেখিয়ে থাকবেন। যেন কোন কাযী (বিচারক) এই উম্মখীন হয়েছি যে, এই যে কুরআন যা একাধিক বিবাহের অনুমতি দেয়া, অথবা চুরির অপরাধে হাত কাটার শাস্তি নির্ধারণ করে, অথবা সন্তানদের অভিভাবকত্ব সম্পর্কে কিছু নির্দেশনা দান করে, এ সম্পর্কে আমরা কি বিধিবিদান প্রণয়ন করবো। এ জাতীয় সমল ব্যাপারে তের-চৌদ্দশত বছরের ইসলামী সমাজ যেন আমাদের জন্য কিছুই রেখে যায়নি। সব কিছুই আমাদেরকে কুরআন হাতে নিয়ে সম্পূর্ণ নতুনভাবে গড়ে তুলতে হবে এবং তাণ্ড ঠিক সেইভাবে যার কয়েকটি নমুনা ইতপূর্বে আমাদের সামনে এসছে।
সুন্নাত সম্পর্কে বিজ্ঞ বিচারকের দৃষ্টিভংগী
এ ধরনের আলোচনা হঠাৎ শুরু করা হয়নি, বরং ২১ প্যারা থেকে যে আলোচনা শুরু হয়েছে তা পড়লে বুঝ যায় যে, তা বিজ্ঞ বিচারপতির চিন্তাভাবনা প্রসূত রায়ের ফল। তা যেহেতু তার রায়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ তাই আমরা এর প্রতিটি বিষয় ক্রমিক নম্বরের অধীনে নকল কারার সাথে তার উপর সমলোচনা পেশ করে যাব যাতে প্রতিটি বিষয়ের আলোচনা পরিষ্কারভাবে বুঝা যায়।
সুন্নাত সম্পর্কে উম্মতের দৃষ্টিভংগী
বিজ্ঞ বিচারক বলেন, “মুসলমানদের একটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য অংশ কুরআন মজীদ ছাড়াও হাদীস অর্থাৎ সুন্নাহকেও ইসলামী আইনের একটি অশেষ গুরুত্বপূর্ণ উৎস মনে করে নিয়েছে”- (প্যারা ২১)।
যে ব্যক্তিই ইসলামী আইন ও তার ইতিহাস সম্পর্কে সামান্য পরিমাণও অধ্যয়ন করেছে, সে কখনো একথা মেনে নিতে পারে না যে, উপরোক্ত বাক্যে ঘটনার সঠিক বর্ণনা দেয়া হয়েছে। ঘটনার সঠিক অবস্থা এই যে, রিসালতের যুগ থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত গোটা উম্মাত সমগ্র ইসলামী দুনিয়ায় সুন্নাতে রসূল (স)-কে কুরআনের পরে আইনের বুনিয়াদী উৎস এবং হাদীসকে সুন্নাত সম্পর্কে জানার মাধ্যম হিসাবে স্বীকার করে আসছে এবং করছে। যেমন আমরা এই গ্রন্থের ভূমিকায় বলে এসেছে-ইসলামের ইতিহাসে প্রথমবার একটি ক্ষুদ্র দল দ্বিতীয় হিজরী শতকে আত্মপ্রকাশ করেছিল যারা সন্নাতকে অস্বীকার করেছিল। মুসলমানদের মধ্যে এদের সংখ্যা একেবারে বাড়িয়ে বললেও প্রতি দশ হাজারে একজনের অধিক ছিল না। তৃতীয় হিজরী শতকের শেষ মাথায় পৌছতে পৌছতে এই দলটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। কারণ সুন্নাতের আইনের উৎস হওয়ার সপক্ষে এমন শক্তিশালী কার্যকর সাক্ষ্য প্রমাণ বিদ্যমান ছিল যে, এই ভ্রান্ত চিন্তাধারা বেশক্ষণ টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। অতপর নবম হিজরী শতক পর্যন্ত ইসলামী দুনিয়ার এ ধরনের কোন দলের অস্তিত্ব ছিল না। এমনকি ইসলামের ইতিহাসে কোন এক ব্যক্তিরও উল্লেখ করা যাবে না যে এরূপ ভ্রান্ত ধারণা ব্যক্ত করে থাকবে। এখন এই ভ্রান্ত চিন্তাধারার লোকের গত শত্ব্দী থেকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে আত্মপ্রকাশ শুরু হয়েছে। কিন্তু যদি দেখা যায় যে, এ ধরনের লোকের অনুসারী ইসলামী দুনিয়াতে কতজন আছে তবে তাদের সংখ্যা লাখে একজনের অধিক পাওয়া যাবে না। এই সত্য ঘটনাকে নিম্নোক্ত বাক্যে বর্ণনা করা “মুসলমানদের একটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য অংশ সুন্নাতকে আইনের উৎস মনে করে নিয়েছে” কি বাস্তব সত্যের সঠিক প্রতিনিধিত্ব করা হয়? পক্ষান্তরে এরূপ বলাই যথার্থ হবে যে, “মুসলমানদের একটি সম্পূর্ণ অনু্ল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক সুন্নাতের আইনের উৎস হওয়াকে অস্বীকার করতে শুরু করেছে”।
বিচারকের দৃষ্টিতে ইসলামে নবীর মর্যাদা
এরপর বিজ্ঞ বিচারক প্রশ্ন তুলেছেন যে, ইসলামে নবীর মর্যাদা কি? এই প্রশ্নের উপর আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেনঃ
“ইসলামী আইনের উৎস হাদীসের মূল্য ও মর্যাদা কি তা পূর্ণরূপে অনুধাবন করার জন্য আমাদের জানতে হবে যে, ইসলামী দুনিয়ায় রসূলে পাকের মর্যাদা ও স্থান কি? আমি এই রায়ের প্রাথমিক অংশে বলেছি যে, ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত একটি দীন। তা নিজের সনদ আল্লাহ এবং একমাত্র আল্লাহর নিকট থেকে লাভ করে। এটা যদি ইসলামের সঠিক ধারণা হয়ে থাকে তবে তা থেকে অপরিহার্যরূপে এই সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসে যে, নবীর কথা, কাজ ও আচার-ব্যবহারের আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত ওহীর সমান মর্যাদা হতে পারে না। তা থেকে সর্বাধিক এতটুকু অবগত হওয়ার জন্য সাহায্য নেয়া যেতে পা র যে, বিশেষ পরিস্থিতিতে কুরআনের ব্যাখ্যা কিভাবে করা হয়েছিল, অথবা কোন বিশেষ ব্যাপারে কুরআনের সাধারণ নীতিমালাকে বিশেষ ঘটনার উপর কিভাবে প্রয়োগ করা হয়েছিল। কোন ব্যক্তি অস্বীকার করতে পারে না যে, মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ যে সম্মান ও মর্যাদা পাওয়ার অধিকারী অথবা আমরা তাঁর জন্য যে সম্মান ও মর্যাদা প্রকাশ করতে চাই তার প্রকাশের শক্তি ও যোগ্যতা তার রয়েছে। কিন্তু তথাপি তিনি না খোদা ছিলেন আর না তাকে খোদা মনে করা হত। অন্য সব রসূলদের মত তিনিও মানুষই ছিলেন”।–(প্যারা ২১)।
‘তিনি আমাদের মতই নশ্বর ছিলেন –তিনি একটি দৃষ্টান্ত ছিলেন, কিন্তু নিশ্চিত খোদা ছিলেন না –তাঁকেও ঠিক সেভাবে আল্লাহর বিধানের আনুগত্য করতে হত, যেভাবে আমাদের করতে হচ্ছে, বরং সম্ভবত তাঁর যিম্মাদারী কুরআন মজীদের আলোকে আমাদের যিম্মাদারীর তুলনায় অনেক বেশী ছিল। তাঁর উপর যতটুকু নাযিল হত তার অধিক তিনি মুসলমানদের দিতে পারতেন না”।(প্যারা ২১)।
এসব কথার সমর্থনে কুরআন মজীদের কতিপয় আয়াত প্রমাণ হিসাবে পেশ করার পর তিনি পুনরায় বলেনঃ
“মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ যদিও বড়ই উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন লোক ছিলেন, কিন্তু তাঁকে আল্লাহর পরে দ্বিতীয় স্থান দেয়া যেতে পারে। তাঁর নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত ওহী ছাড়ও মানুষ হিসাবে তিনি নিজে কিছু ধারণার অধিকারী ছিলেন এবং নিজের এই ধারণার প্রভাবাধীন কাজ করতেন। একথা সত্য যে, মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ কোন পাপ করেননি, কিন্তু তাঁর দ্বারা ভুলত্রুটি তো হতে পারত এবং এই সত্য স্বয়ং কুরআনে স্বীকার করে নেয়া হয়েছেঃ
(আরবী********************************************************)
কুরআনের একাধিক স্থানে বলা হয়েছে যে, মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ বিশ্বের জন্য এক অতীব উত্তম আদর্শ, কিন্তু তার অর্থ কেবলমাত্র এতটুকুই যে, কোন ব্যক্তিকে তাঁর মতই ঈমানদার, সত্যবাদী কর্মতৎপর, ধর্মভীরু ও মুত্তাকী হওয়া উচিৎ। তার অর্থ এই নয় যে, আমরাও হুবহু তার মতই চিন্তা-ভাবনা করব এবং কাজকর্ম করব। কারণ তা হবে স্বভাব বিরুদ্ধ কথা এবং তদ্রুপ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। যদি আমরা তদ্রুপ করার চেষ্টা করি তবে জীবনটাই দুর্বিসহ হয়ে উঠবে”।–(প্যারা ২২)।
“একথাও সত্য যে, কুরআন মজীদ মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (সা)-এর আনুগত্য করার উপর জোর দিয়েছে, কিন্তু তার অর্থ শুধু এই যে, তিনি যেখানে আমাদেরকে একটি বিশেষ কাজ একটি বিশেষ পন্থায় করার নির্দেশ দিয়েছেন, আমরা সেই কাজটি সেভাবেই করব। আনুগত্য তো কোন নির্দেশেরই হতে পারে। যেখানে কোন নির্দেশ নাই সেখানে না কোন আনুগত্য হতে পারে আর না আনুগত্যহীনতা। রসূলুল্লাহ (সা) যা কিছু করেছেন আমরাও ঠিক তাই করব, কুরআনের আয়াত থেকে এরূপ অর্থ গ্রহণ অত্যন্ত কষ্টকর। পরিষ্কার কথা হচ্ছে, কোন একক ব্যক্তির জীবনকালের ঘটনাবলীর অভিজ্ঞতা একটি সীমিত সংখ্যার অধিক লোকের জন্য নজীর সরবরাহ করতে পারে না, সেই একক ব্যক্তি নবীই হোন না কেন। একথা জোরের সাথে বলা উচিৎ যে, কুরআন হাদীসের মধ্যে মৌলিক ও বাস্তব পার্থক্য রয়েছে”।–(প্যারা ২৩)।
কুরআনের আলোকে নবীর আসল মর্যাদা
আমরা অত্যন্ত সৌজন্যবোধের সাথে আরজ করব যে, উপরোক্ত গোটা বক্তব্যের মধ্যে অপ্রাসংগিক আলোচনাই বেশী আছে এবং মূল আলোচ্য বিষয়ের সাথে মিল খুব কমই আছে। যে আসল বিষয়টির বিশ্লেষণ এখানে বাঞ্চিত ছিলো তা এই নয় যে, মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম (মাযাল্লাহ) খোদা কি না, তিনি মানুষ না অন্য কিছু এবং ইসলামী শরীআতের হুকুম। বরং যে জিনিসের পর্যালোচনা করার প্রয়োজন ছিল তা এই যে, রসূলে পাক (স)-কে আল্লাহ তাআলা কি কাজের জন্য নিয়োগ করেছিলেন, দীন ইসলামে তাঁর মর্যাদা ও এখতিয়ারসমূহ কি এবং কুরআনের আয়াতে উল্লেখিত বিধানই কি শুধুমাত্র আল্লাহর বিধান, না রসূলুল্লাহ (সা) আমাদেরকে কুরআন পাক ছাড়াও যে বিধান দিয়েছেন তাও? বিজ্ঞ বিচারকের উধৃত আয়াতসমূহের দ্বারা এসব প্রশ্নের পর্যালোচনা হতে পারে না। কারণ এসব আয়াতে মূলতই উপরোক্ত প্রশ্নাবলীর উত্তর দেয়া হয়নি। এসব প্রশ্নের উত্তর নিম্নোক্ত আয়াতসমূহের মধ্যে পাওয়া যাবে যার প্রতি বিজ্ঞ বিচারপতি মোটেই ভ্রুক্ষেপ করেননিঃ
(আরবী*************************************************)
১. “আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন তাদের নিজেদের মধ্য থেকে তাদের নিকট রসূল প্রেরণ করে। সে তাদের নিকট তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করে, তাদের পরিশোধন করে এবং তাদের কিতাব ও বিচক্ষণতা শিক্ষা দেয়”-(সূরা আল-ইমরানঃ ১৬৪)।
(আরবী****************************************************************)
২. “এবং আমরা তোমার উপর এই যিকির (কুরআন) নাযিল করেছি –যাতে তুমি লোকদের তা সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিতে পার –যা তাদের উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ করা হয়েছে”-(সূরা নাহলঃ ৪৪)।
(আরবী*******************************************************************)
৩. “সে (নবী) তাদেরকে সৎকাজের নির্দেশ দেয়, অসৎ কাজ নিষেধ করে, তাদের জন্য পবিত্র জিনিসসমূহ বৈধ করে এবং কলুষ জিনিস নিষিদ্ধ করে”-(সূরা আরাফঃ ১৫৭)।
(আরবী*************************************************************************)
৪. “রসূল তোমাদের যা কিছু দেয় তা গ্রহণ কর এবং যা থেকে বিরত থাকতে বলে তা থেকে বিরত থাক”-(সূরা হাশরঃ ৭)।
(আরবী*******************************************************)
৫. “আমরা রসূল এই উদ্দেশ্যেই প্রেরণ করেছি যে, আল্লাহর নির্দেশে তার আনুগত্য করা হবে”-(সূরা নিসাঃ ৬৪)।
(আরবী*****************************************************)
৬. “যে ব্যক্তি রসূলের আনুত্য করল –সে তো আল্লাহরই আনুগত্য করল”-(সূরা নিসাঃ ৮০)।
(আরবী*****************************************************************)
৭. “তোমরা রসূলের আনুগত্য করলে সৎপথ পাবে”-(সূরা নূরঃ ৫৪)।
(আরবী******************************************************************)
৮. “তোমাদের জন্য রসূলের সত্তায় রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ”-(সূরা আহযাবঃ ২১)।
(আরবী**************************************************************)
৯. “কিন্তু না, তোমরা প্রতিপালকের শপথ! তারা কখনও মুমিন হতে পারবে না –যতক্ষণ পর্যণ্ত তারা নিজেদের মধ্যেকার পারস্পরিক মতবিরোধের মীমাংসার ভার তোমার উপর অর্পণ না করে, অতপর তুমি যে সিদ্ধান্ত দিবে সে সম্পর্কে নিজেদের মনে দ্বিধা অনুভব না করে এবং সর্বান্তকরণে তা মেনে নেয়”-(সূরা নিসাঃ ৬৫)।
(আরবী***********************************************************************)
১০. “হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর আনুগত্য কর, রসূলের আনুগত্য কর এবং সেইসব লোকের যারা তোমাদের মধ্যে কর্তৃত্বের অধিকারী। অতপর তোমাদের মধ্যে কোন ব্যাপারে মতভেদ হলে তা আল্লাহ ও রসূলের নিকট পেশ কর –যদি তোমরা আল্লাহ ও আখেরাতের উপর ঈমানদার হয়ে থাক”-(সূরা নিসাঃ ৫৯)।
(আরবী*************************************************)
১১. “(হে নবী!) তাদের বল, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালবাস তবে আমার অনুসরণ কর –আল্লাহ তোমাদের ভালবাসবেন”।–(সূরা আল-ইমরানঃ ৩১)।
উল্লেখিত ১১টি আয়াত একত্রে পাঠ করলে দীন ইসলামে রসূলে পাক (সা)-এর প্রকৃত মর্যাদা অকাট্য ও সুস্পষ্টভাবে আমাদের সামনে ফুটে উঠে। নিসন্দেহে তিনি খোদা ছিলেন না, মানুষই ছিলেন। কিন্তু তিনি এমন মানুষ আল্লাহ যাকে নিজের কর্তৃত্বসম্পন্ন প্রতিনিধি বানিয়ে পাঠিয়েছেন। আল্লাহর বিধান আমাদের নিকট সরাসরি আসেনি, বরং তাঁর মাধ্যমে এসেছে। তাঁর উপর নাযিলকৃত আল্লাহর কিতাবের আয়াতসমূহ পড়ে শুনিয়ে দেয়ার জন্যই শুধু তাঁকে নিয়োগ করা হয়নি, বরং তাঁকে নিয়োগ করার উদ্দেশ্য এই যে, তিনি কিতাবের আয়াসমূহ বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে দেবেন, একজন অভিভাবক হিসাবে আমাদের ব্যক্তি ও সমাজের পরিশুদ্ধি-[“পরিশুদ্ধি” (তাযকিয়া) অর্থ “পাপ-পংকিলতা থেকে পবিত্রকরণ এবং পুণ্য ও কল্যাণের ক্রমবিকাশ সাধন”। উক্ত শব্দের মধ্যে স্বয়ং এ অর্থও নিহিত রয়েছে যে, পরিশুদ্ধকারীই সেইসব পংকিলতা নির্দেশ করবেন যা থেকে ব্যক্তি ও সমাজকে পবিত্র করতে হবে এবং তিনিই পুণ্য ও কল্যাণ নির্দেশ করবেন যেগুলোর ব্যক্তি ও সমাজে ক্রমবিকাশ সাধন করতে হবে।] সাধন করবেন এবং আমাদেরকে আল্লাহর কিতাব, জ্ঞান ও বিচক্ষণতার প্রশিক্ষণ দিবেন।
৩ নম্বর আয়াত পরিস্কার বলে দিচ্ছে যে, তাঁকে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা (Legislative power)-ও আল্লাহ তাআলাই সোপর্দ করেছেন এবং তাতে তাঁর ক্ষমতাকে শুধুমাত্র কুরআনিক বিধানের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পর্যন্ত সীমিত করার কোন শর্ত নেই। ৪ নম্বর আয়াত সাধারণভাবে নির্দেশ দেয় যে, তিনি যা কিছু দেন তা গ্রহণ কর এবং যে জিনিসে বাধা দেন তা থেকে বিরত থাক। এ আয়াতেও এমন কোন শর্ত নেই যা থেকে এই সিদ্ধান্ত বের করা যেতে পারে যে, তিনি কুরআনের আয়াতের আকারে যা কিছু দেন কেবল তাই গ্রহণ কর। ৮ নম্বর আয়াত তাঁর জীবনাচার, চালচলন ও কার্যাবলীকে আমাদের জন্য অনুসরণীয় আদর্শ সাব্যস্ত করে। এ স্থানেও এরূপ কোন শর্ত আরোপ করা হয়নি যে, তাঁর যে কথা ও কাজের সমর্থন কুরআন থেকে পেশ করতে পারবেন শুধু সেগুলোকেই নিজেদের জন্য আদর্শ হিসাবে গ্রহণ কর, বরং পক্ষান্তরে তাঁকে সাধারণভাবে সত্যের মানদন্ড হিসাবে আমাদের সামনে পেশ করা হয়েছে।
৫, ৬ ও ৭ নম্বর আয়াত আমাদেরকে তাঁর আনুগত্য করার নির্দেশ দেয় এবং এখানেও এমন কোন ইঙ্গিত মোটেই নাই যে, তিনি আমাদের যে নির্দেশ কুরআনের আয়াতের আকারে দেবেন, কেবল সেইসব নির্দেশেরই আনুগত্য করতে হবে। ৯ নম্বর আয়াত তাঁকে এমন একজন বিচারপতি হিসাবে দাঁড় করিয়েছে, যাঁর নিকট মীমাংসার জন্য রুজু হওয়া এবং যাঁর সিদ্ধান্ত শুধু বাহ্যতই নয়, বরং আন্তরিকভাবে মেনে নেয়া ঈমানের শর্তাবলীর অন্তর্ভুক্ত। তা এমন এক পদমর্যাদা যা দুনিয়ার কোন বিচারালয় অথবা কোন বিচারককেও দেয়া হয়নি। ১০ নম্বর আয়াত তাঁর মর্যাদাকে মুসলমানদের জন্য সমস্ত কর্তৃত্বসম্পন্ন ব্যক্তিদের মর্যাদা থেকে স্বতন্ত্র করে দিয়েছে। কর্তৃত্ব সম্পন্ন ব্যক্তি বা উলিল-আমর (যার মধ্যে রাষ্ট্রপ্রধান, সরকার প্রধান, তার মন্ত্রীবর্গ, সংসদ সদস্য, সরকারী কর্মকর্তাবৃন্দ, বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাবৃন্দ সকলে অন্তর্ভুক্ত) আনুগত্য পাওয়ার দিক থেকে ৩ নম্বরে আসে এবং আল্লাহর আনুগত্য এক নম্বরে আসে। এই উভয়ের মাঝখানে রসূলুল্লাহ (স)-এর স্থান এবং এ স্থানে রসূল (স) এর মর্যাদা এই যে, উলিল-আমর-এর সাথে মুসলমানদের মতবিরোধ হতে পারে, কিন্তু রসূলের সাথে হতে পারে না। বরং যে মতবিরোধই সৃষ্টি হবে তার মীমাংসার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রসূলের দিকে রুজু হতে হবে। এই মর্যাদা স্বীকার করে নেয়াকেও ঈমানের শর্ত সাব্যস্ত করা হয়েছে, যেমন আয়াতের শেষাংশ (আরবী***********************************) থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়। অতপর শেষ আয়াত আল্লাহর ভালবাসার একমাত্র দাবী এবং তাঁর ভালবাসা লাভ করার একমাত্র রাস্তা বলে দিচ্ছে এবং তা এই যে, ব্যক্তি আল্লাহর রসূলের আনুগত্য করবে।
এ হল দীন ইসলামে রসূলের আসল মর্যাদা যা কুরআন মজীদ এতটা সুস্পষ্ট করে তুলে ধরেছে। তা অধ্যয়নপূর্বক বিজ্ঞ বিচারপতি কি ২১ নং প্যারায় বর্ণিত তাঁর রায়ের পুনর্বিবেচনা করবেন? দুটি চিত্র সামনাসামনি রেখে কি পরিস্কার লক্ষ্য করা যায় না যে, তিনি রসূলে পাক (সা)-এর মর্যাদা তাঁর আসল মর্যাদার তুলনায় অনেক কম, বরং মৌলিকভাবে ভিন্নরূপ করেছেন?
ওহী কি শুধু কুরআন পর্যন্ত সীমিত?
বিজ্ঞ বিচারপতির একথা আক্ষরিকভাবে সম্পূর্ণ ঠিক যে, রসূলে করীম (স)-এর নিকট কি শুধু কুরআনে সন্নিবেশিত ওহীই আসত, না তা ছাড়াও ওহীর মাধ্যমে তিনি পথনির্দেশ লাভ করতেন? যদি প্রথমটি হয়ে থাকে তবে তার যথার্থতা স্বীকার করা যায় না। কুরআনের কোথাও একথা বলা হয়নি যে, মহানবী (স)-এর নিকট আল্লাহর কিতাবের আয়াত ব্যতীত আর কোন কিতাবুল্লাহর আয়াত ছাড়াও নবী আল্লাহর নিকট থেকে নির্দেশনা লাভ করেন। আর যদি দ্বিতীয় কথা হয়ে থাকে তবে কুরআনের সাথে সুন্নাতকেও আইনের উৎস না মেনে উপায় নেই, কারণ তাও সেই খোদার পক্ষ থেকে প্রাপ্ত যাঁর পক্ষ থেকে কুরআন নাযিল হয়েছে।
মহানবী (স) কি নিজের চিন্তাভাবনার অনুসরণ করার ব্যাপারে স্বাধীন ছিলেন?
পুনশ্চ বিজ্ঞ বিচারকের নিম্নোক্ত কথা কঠোরভাবে পুনর্বিবেচনার মুখাপেক্ষী যে, রসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট “আল্লাহর পক্ষ থেকে যে ওহী এসেছিল তা ছাড়াও স্বয়ং নিজস্ব কিছু চিন্তা ভাবনা ধারণ করতেন এবং এই চিন্তাভাবনার প্রভাবাধীন কাজ করতেন”।
না কুরআনের সাথে এ বক্তব্যের কোন সামঞ্জস্য আছে আর না বুদ্ধিবিবেক তা বিশ্বাস করতে পারে। কুরআন মজীদ বারবার এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে যে, রসূল হিসাবে মহানবী (সা)-এর উপর যে দায়িত্ব ও কর্তব্য অর্পণ করা হয়েছিল তা আঞ্জাম দেয়ার ক্ষেত্রে তাঁর ব্যক্তিগত খেয়াল-খুশী ও কামনা-বাসনা অনুযায়ী কাজ করার জন্য তাঁকে স্বাধীন ছেড়ে দেয়া হয়নি, বরং তিনি ওহীর অনুসরণ করতে বাধ্য ছিলেন। (আরবী*********************************)
“আমার প্রতি যা ওহী হয় আমি কেবল তারই অনুসরণ করি”-(সূরা আনআমঃ ৫০)।
(আরবী**************************************************)
“বল, আমার প্রভুর পক্ষ থেকে আমার নিকট যে ওহী করা হয়, আমি তো শুধু তারই অনুসরণ করি”-(আরাফঃ ২০৩)।
(আরবী*****************************************************************)
“তোমাদের সংগী বিভ্রান্তও নয়, বিপথগামীও নয়। আর সে মনগড়া কথাও বলে না। এ তো ওহী যা তার প্রতি প্রত্যাদেশ হয়”-(সূরা নাজমঃ ২, ৩, ৪)।
এখন বুদ্ধিবিবেকের দিক থেকে বলা যায় যে, তা কোনক্রমেই একথা মানতে প্রস্তুত নয় যে, এক ব্যক্তিকে আল্লাহর পক্ষ থেকে রসূলও নিযুক্ত করা হবে, আবার তাকে রিসালাতের দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে নিজের প্রবৃত্তি, ঝোঁক প্রবণতা ও ব্যক্তিগত অভিমত অনুযায়ী কাজ করার জন্য স্বাধীন ছেড়ে দেয়াও হবে। একটি মামুলি সরকারও যদি কোন ব্যক্তিকে কোন এলাকার রাজপ্রতিনিধি অথবা গভর্নর অথবা কোন দেশে নিজের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করে, তবে তাকে তার সরকারী দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে স্বয়ং নিজের মর্জি অনুযায়ী কোন কর্মপন্থা তৈরী করে নেয়ার এবং নিজের ব্যক্তিগত খেয়ালখুশী মোতাবেক কথা বলার ও কাজ করার জন্য স্বাধীন ছেড়ে দেয় না। এতবড় দায়িত্বপূর্ণ পদ দেয়ার পর তাকে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কর্মপন্থা ও নির্দেশনামার অনুসরণ করতে বাধ্য করা হয়। তার উপর কঠোর পাহারা নিযুক্ত করা হয়, যাতে সে সরকারী নীতিমালা ও নির্দেশনামার পরিপন্থী কোন কাজ করতে না পারে। যেসব বিষয় তার সুবিবেচনার উপর ছেড়ে দেয়া হয় সে ক্ষেত্রে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হয় যে, সে তার সুবিবেচনাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করছে, না ভ্রান্তভাবে। তাকে শুধু জনসাধারণকে শুনিয়ে দেয়ার জন্য অথবা যে জাতির মধ্যে তাকে রাষ্ট্রদূত বানিয়ে পাঠানো হচ্ছে, তাদের শুনিয়ে দেয়ার জন্যই পথনির্র্দেশ দেয়া হয় না, বরং তার নিজের পথনির্দেশের জন্য তাকে গোপনেও উপদেশ দেয়া হয়। সে যদি উর্ধতন কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য-বিরোধী কোন কাজ করে তবে তাৎক্ষণিকভাবে তাকে সংশোধন করে দেয়া হয় অথবা ফেরত ডেকে পাঠানো হয়। তার কথা ও কাজের জন্য পৃথিবী সেই সরকারকে দায়ী মনে করে, যার প্রতিনিধিত্ব সে করছে এবং তার কথা ও কাজ সম্পর্কে অপরিহার্যভাবে মনে করা হয় যে, এর প্রতি তার নিয়োগদাতা কর্তৃপক্ষের অনুমোদন রয়েছে, অথবা অন্তত এই সরকার তা অপছন্দ করে না। এমনকি তার ব্যক্তিগত বা পারিবারিক জীবনের ভালোমন্দ পর্যন্ত তাঁর নিয়োগদাতা সরকারের সুনামের উপর প্রভাব ফেলে।
এখন আল্লাহ সম্পর্কে কি এতটা অসতর্কতার আশংকা করা যায় যে, তিনি এক ব্যক্তিকে নিজের রসূল নিয়োগ করেন, দুনিয়াবাসীকে তাঁর উপর ঈমান আনার আহবান জানান, তাঁকে নিজের তরফ থেকে আদর্শ মানব নিযুক্ত করেন, বিনা বাক্যব্যয়ে তাঁর আনুগত্য ও অনুসরণের বারবার জোরালো নির্দেশ দেন এবং এসব কিছু করার পর তাঁকে এভাবে ছেড়ে দেন যে, তিনি নিজের ব্যক্তিগত খেয়াল-খুশি মোতাবেক যেভাবেই ইচ্ছা রিসালাতের দায়িত্ব পালন করবেন?
মহানবী (স) –এর সুন্নাত ভুলত্রুটি থেকে পবিত্র কি না?
বিজ্ঞ বিচারপতি বলেন, “একথা সঠিক যে, মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ কোন গুনাহ করেননি, কিন্তু তিনি ভুল করতেপারেন এবং এ সত্য স্বয়ং কুরআনেও স্বীকার করা হয়েছে”।
এ সম্পর্কে যদি কুরআন মজীদের অনুসরণ করা হয় তবে আমরা জানতে পারি যে, আল্লাহ তাআলা মাত্র পাঁচটি জায়গায় মহানবী (স)-কে ভুলত্রুটি সম্পর্কে সতর্ক করেছেনঃ সূরা আনফালের ৬৭-৬৮ নং আয়াতে, সূরা তওবার ৪৩ নং আয়াতে, সূরা আহযাবের ৩৭ নং আয়াতে, সূরা তাহরীমের ১ নং আয়াতে এবং সূরা আবাসার ১-১০ নং আয়াতে। ৬ষ্ঠ স্থান যেখানে ধারণা করা যেতে পারে যে, হয়ত এখানেও কোন ত্রুটি সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে তা হচ্ছে সূরা তওবার ৮৪ নং আয়াত। তেইশ বছরের গোটা নবুয়াতী জীবনে এই পাঁচ অথবা ছয়টি স্থান ব্যতীত কুরআন মজীদে না মহানবী (সা)-এর কোন ভুল-ত্রুটির উল্লেখ এসেছে আর না তার সংশোধনের।
এ থেকে যে কথা প্রমাণিত হয় তা এই যে, এ গোটা সময় ব্যাপী মহানবী (স) সরাসরি আল্লাহ তাআলার দৃষ্টি রাখতে থাকেন যে, তাঁর অনুমোদিত প্রতিনিধি কোথাও যেন তাঁর ভুল প্রতিনিধিত্ব অথবা লোকদের ভুল পথে পরিচালনা না করেন। আর যে পাঁচ-ছয়টি স্থানে মহানবী (স)-এর সামান্য ত্রুটি বিচ্যুতি হয়ে গিয়েছিল সে সম্পর্কে তৎক্ষণাৎ বাধা প্রদান করে তার সংশোধণ করে দেয়া হয়। এই কয়টি স্থান ছাড়া যদি তাঁর আরও কোন ত্রুটিবিচ্যুতি হয়ে যেত তবে তারও সাথে সাথে সংশোধন করে দেয়া হয়, যেভাবে উপরোক্ত স্থানসমূহে সংশোধণ করে দেয়া হয়েছে। অতএব এই জিনিস মহানবী (স)-এর পথপ্রদর্শনের উপর থেকে আমাদের বিশ্বস্ততা ও নিশ্চয়তাকে প্রত্যাহার করে নেয়ার পরিবর্তে তাকে আরও শক্তিশালী করে দেয়। আমরা এখন নিশ্চয়তার সাথে বলতে পারি যে, মহানবী (স)-এর তেইশ বছরের নবুয়াতী জীবনের সমস্ত স্মরণীয় কার্যাবলী ত্রুটি-বিচ্যুতি ও পদস্খলন থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র এবং তাঁর প্রতি আল্লাহর অনুমোদন (approval) রয়েছে।
রসূলের আনুগত্যের প্রকৃত অর্থ
মহানবী (সা)-এর আনুগত্যের যে হুকুম কুরআন মজীদে দেয়া হয়েছে তাকে বিজ্ঞ বিচারক এই অর্থে গ্রহণ করেন যে, “আমাদেরকেও সেই রকম ঈমানদার, সৎ এবং সেই রকম কর্মতৎপর, দীনদার ও খোদাভীরু হতে হবে- যেমনটি ছিলেন মহানবী (স)”। তার মতে আনুগত্যের এই (কুরআনে উল্লেখিত) অর্থ “স্বভাববিরোধী এবং অবাস্তব যে, আমাদেরকেও ঠিক সেইভাবে চিন্তাভাবনা করতে হবে এবং কাজকর্ম করতে হবে –যেভাবে মহানবী (সা) চিন্তা করতেন এবং কাজ করতেন”। তিনি বলেন, এই অর্থ গ্রহণ করলে জীবনটাই দুর্বিসহ হয়ে পড়বে।
এ ব্যাপারে আমাদের নিবেদন এই যে, এতবড় মৌলিক বিষয়টিকে খুবই হালকাভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। আনুগত্যের অর্থ কেবলমাত্র রং-বৈশিষ্ট্যের সমরূপ হওয়া নয়, বরং চিন্তাধারার পদ্ধতি, মূল্যবোধের মানদন্ড, মূলনীতি ও দৃষ্টিভংগী, চরিত্র-নৈতিকতা ও আচার-ব্যবহার, জীবনাচার ও কার্যক্রম-সব কিছুরই আনুগত্য করা তার মধ্যে অপরিহার্যরূপে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, মহানবী (স) যেখানে শিক্ষক হিসাবে দীনের কোন হুকুম অনুযায়ী কাজ করে বলে দিয়েছেন, সেখানে ছাত্রের মতই সেই কাজে তাঁর অনুসরণ করা আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক। এর অর্থ কখনও এই নয় যে, তিনি যে কাঠামোর পোশাক পরিধান করতেন আমাদেরও তাই পরিধান করতে হবে। তিনি যে ধরনের আহার করতেন আমাদেরও সেই জাতীয় খাদ্য আহার করতে হবে। তিনি যে ধরনের যানবাহন ব্যবহার করতেন আমাদেরও অনুরূপ যানবাহনে ভ্রমন করতে হবে। অথবা তিনি যে ধরনের যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করতেন তা ছাড়া অন্য কোন প্রকারের অস্ত্র আমরা ব্যবহার করতে পারব না। আনুগত্যের এ ধরনের অর্থ গ্রহণ করলে নিসন্দেহে জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে পড়বে। কিন্তু উম্মাতের মধ্যে আজ পর্যন্ত এমন কোন জ্ঞানবান ব্যক্তি অতীত হননি, যিনি আনুগত্যের উপরোক্তরূপ অর্থ গ্রহণ করে থাকবেন। আনুগত্যের অর্থ সূচনা থেকে আজ পর্যন্ত মুসলমানরা এই বুঝেছে যে, মহানবী (স) তাঁর কথা ও কাজের মাধ্যমে ইসলামী চিন্তাপদ্ধতি এবং দীনের মূলনীতি ও হুকুম-আহকামের যে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন তাতে আমরা তাঁর অনুসরণ করব।
উদাহরণস্বরূপ ঐ একাধিক বিবাহ সম্পর্কিত বিষয়টিই নেয়া যেতে পারে, যে সম্পর্কে বিজ্ঞ বিচারক ইতিপূর্বে বিস্তারিতভাবে নিজের মত প্রকাশ করেছেন। এই বিষয়ে মহানবী (স)-এর কথা ও কাজের দ্বারা চূড়ান্তভাবেই এই চিন্তাভংগীর প্রকাশ পায় যে, একাধিক বিবাহ মূলত কোন খারাপ কিছু নয়, যার উপর বিধিনিষেধ আরোপের প্রয়োজন রয়েছে এবং এক বিবাহ মূলত কোন কাংখিত মূল্যবোধ নয় যাকে মানদণ্ড হিসাবে দৃষ্টির সামনে রেখে আইন প্রণয়ন করতে হবে। অতএব মহানবী (সা)-এর আনুগত্যের দাবী এই যে, উল্লেখিত বিষয়ে আমাদের চিন্তাপদ্ধতিও তদ্রুপ হতে হবে। তাছাড়া এ প্রসংগে কুরআনের পথনির্দেশের উপর মহানবী (সা)-এর নিজের শাসনকালে যেভাবে আমল করা হয়েছিল তা ঐ পথনির্দেশের যথার্থ ব্যাখ্যা যার আনুগত্য আমাদের করতে হবে। তাঁর যুগে জনগণের অর্থনৈতিক অবস্থা আমাদের বর্তমান অবস্থার তুলনায় অনেক গুণ বেশী খারাপ ছিল। কিন্তু তিন ইংগিতেও এসব কারণে একাধিক বিবাহের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করেননি। দ্বিতীয় বিবাহে আগ্রহী কোন ব্যক্তিকে তিনি একথা বলেননিঃ প্রথমে প্রমাণ কর যে, বাস্তবিকই তোমার দ্বিতীয় বিবাহের প্রয়োজন এবং তুমি দুই বা ততোধিক স্ত্রীর খোরপোষ বহনে সক্ষম। তিনি কাউকে জিজ্ঞেস করেননি যে, কোন ইয়াতীম শিশুর লালন-পালনের জন্য তুমি দ্বিতীয় বিবাহ করতে চাও? তিনি কাউকেও বলেননি যে, প্রথমে তোমার বর্তমান স্ত্রীকে সম্মত কর। তাঁর শাসনকালে কোন ব্যক্তির জন্য স্বেচ্ছায় চারজন পর্যন্ত স্ত্রী গ্রহণের পরিস্কার অনুমতি ছিল। তাঁর যুগে যদি কখনও হস্তক্ষেপ হয়ে থাকে তবে তা কেবল তখনই হয়েছে, যখন কোন ব্যক্তি স্ত্রীদের মধ্যে ন্যায়বিচার করেনি। এখন আমরা যদি রসূলুল্লাহ (সা)-এর অনুসারী হয়ে থাকি তবে আমাদের কাজ এই হওয়া উচিৎ নয় যে, দুই-তিনটি আয়াত নিয়ে স্বয়ং ইজতিহাদ করতে বস যাব। বরং আমাদের অবশ্যই দেখতে হবে যে, যে রসূলের উপর এসব আয়াত নাযিল হয়েছিল তিনি এর কি উদ্দেশ্য অনুধাবন করেছিলেন এবং কিরূপে তা বাস্তবায়ন করেছিলেন।
মহানবী (স) এর পথনির্দেশ কি তাঁর যুগ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল?
বিজ্ঞ বিচারকের বক্তব্য হলো, মহানবী (সা)-এর কথা, কাজ ও আচার-ব্যবহারকে সর্বাধিক যতটুকু কাজে লাগানো যেতে পারে তা শুধু এই যে, তার মাধ্যমে “এটা জানার জন্য সাহায্য নেয়া যেতে পারে যে, বিশেষ পরিস্থিতিতে কুরআনের ব্যাখ্যা কিভাবে করা হয়েছিল, অথবা কোন বিশেষ ব্যাপারে কুরআনের সাধারণ নীতিমালাকে কিভাবে প্রয়োগ করা হয়েছিল”।
উপরোক্ত বক্তব্য তার পাঠকের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে তা এই যে, বিজ্ঞ বিচারকের মতে মহানবী (স)-এর পথনির্দেশ গোটা বিশ্ববাসীর জন্য ছিল না এবং চিরকালের জন্যও ছিল না, বরং তাঁর যুগের একটি বিশেষ সমাজের জন্য ছিল। তার নিম্নোক্ত বাক্য থেকেও একই প্রতিক্রিয়া হয়ঃ ‘একজন একক ব্যক্তির জীবনকালের ঘটনাবলীর অভিজ্ঞতা একটি সীমিত সংখ্যার অধিক লোকের জন্য দৃষ্টান্ত সরবরাহ করতে পারে না”।
এ বিষয়ে তিনি যেহেতু বিস্তারিতভাবে নিজের দৃষ্টিভংগী ব্যক্ত করেননি, তাই এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা তো করা যায় না, কিন্তু তার বক্তব্য যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে সে সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে কয়েকটি কথা নিবেদন করা আমরা জরুরী মনে করি।
কুরআন মজীদ সাক্ষী যে, তা (কুরআন) স্বয়ং একটি বিশেষ যুগে একটি বিশেষ জাতিকে সম্বোধন করা সত্ত্বেও যেমন একটি বিশ্বজনীন ও চিরস্থায় নির্দেশনামা, অনুরূপভাবে তার বাহক রসূলও একটি সমাজে কয়েক বছর যাবত রিসালাতের দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়া সত্ত্বেও গোটা মানব জাতির জন্য আজ পর্যণ্ত এবং অনাগত কাল পর্যন্ত পথপ্রদর্শক। যেভাবে কুরআন সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ
(আরবী*****************************************************************)
“এই কুরআন আমার নিকট ওহী করা হয়েছে –যাতে আমি এর সাহায্যে তোমাদেরকে এবং যাদের নিকট তা পৌঁছে তাদেরকে সতর্ক করতে পারি”।–(সূরা আনআমঃ ১৯)।
ঠিক তদ্রুপ কুরআনের বাহক রসূল (সা) সম্পর্কেও বলা হয়েছেঃ
(আরবী********************************************************************)
“(হে মুহাম্মদ!) বল, হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলের জন্য আল্লাহর রসূল”-(সূরা আরাফঃ ৫৮)।
(আরবী************************************************************************)
“আমরা তো তোমাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসাবে প্রেরণ করেছি”।–(সূরা সাবাঃ ২৮)।
(আরবী**************************************************************)
“মুহাম্মদ তোমাদের মধ্যে কোন পুরুষের পিতা নয়, বরং সে আল্লাহর রসূল এবং নবীগণের শেষ”-(সূরা আহযাবঃ ৪০)।
এদিক থেকে “কুরআন ও মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ” (স)-এর পথনির্দেশের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। যদি সাময়িক ও সীমিত হয় তবে উভয়ই হবে, যদি বিশ্বজনীন ও চিরস্থায়ী হয় তবে উভয়ই হবে। কে না জানে যে, ৬১০ খৃষ্টাব্দে কুরআন নাযিল শুরু হয় এবং ৬৩২ খৃষ্টাব্দে তার অবতরণের ধারাবাহিকতা সমাপ্ত হয়। কে না জানে যে, এই কুরআনের সম্বোধনকৃত লোক ছিল তৎকালীন আরবজাতি এবং তাদের অবস্থা সামনে রেখে তাতে পথনির্দেশ দান করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কিসের ভিত্তিতে এই পথনির্দেশকে সর্বকালের জন্য এবং আগত-অনাগত গোটা মানবজাতির জন্য হেদায়াতের উৎস বলে স্বীকৃতি দেই? এই প্রশ্নের যে উত্তর হতে পারে –নিম্নোক্ত প্রশ্নেরও ঠিক একই উত্তর হবে যে, এক ব্যক্তির নবুওয়াতী জীবন যা সপ্তম শতকে মাত্র ২২টি সৌর বছর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল তার অভিজ্ঞতা সর্বকালের জন্য এবং গোটা মানবজাতির জন্য কিভাবে পথনির্দেশের মাধ্যম হতে পারে? হেদায়াতের এই দুটি উৎস বা মাধ্যম স্থান-কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও কিভাবে সর্বকালীন ও বিশ্বব্যাপক পথনির্দেশ দান করতে পারে, তা বিস্তারিতভাবে আলোচনার অবকাশ এখানে নাই। এখানে আমরা শুদু এতটুকু জানতে চাই যে, যেসব লোক কুরআনের সর্বকালীন ও বিশ্বজনীন হওয়ার প্রবক্তা, তারা আল্লারহ কিতাব ও আল্লাহর রসূলের মধ্যে কিসের ভিত্তিতে পার্থক্য করে? অবশেষে কোন যুক্তিতে একের (কুরআনের) পথনির্দেশ সাধারণ বা ব্যাপক এবং অপরের (রসূলের) পথনির্দেশ সীমিত ও নির্দিষ্ট?
খোলাফায়ে রাশেদীন কর্তৃক সুন্নাত অনুসরণের কারণ
এই নীতিগত আলোচনার পর ২৪ নং প্যারায় বিজ্ঞ বিচারপতি প্রশ্ন উত্থাপন করেন যে, খোলাফায়ে রাশেদীন নিজ নিজ যুগে যদিও সুন্নাতের অনুসরণ করেছিলেন, কিন্তু তার কারণ কি? এ সম্পর্কে তিনি বলেনঃ
“চারজন খলীফা মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (সা)-এর কথা ও কাজ ও আচার-ব্যবহারের কতটা গুরুত্ব দিতেন তা জ্ঞাত হওয়ার মত কোন নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য বিদ্যমান নাই। কিন্তু তর্কের খাতিরে যদি মেনেও নেয়া হয় যে, তাঁরা লোকদের সমস্যাবলী এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলীর সমাধান পেশ করার জন্য ব্যাপকভাবে হাদীসের প্রয়োগ করতেন, তবে তাঁরা ঠিকই করেছেন। কারণ তাঁর স্থান-কারের বিচারে আমাদের তুলনায় মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর অধিকতর নিকটবর্তী ছিলেন”।
আমাদের নিবেদন এই যে, অতীত কালের কোন ঘটনা সম্পর্কে যে সাক্ষ্য সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য হওয়া সম্ভব এতটা নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্যই নিম্নোক্ত বিষয়ে বর্তমান রয়েছে যে, খোলাফায়ে রাশেদীনের চারজনই অত্যন্ত কঠোরতার সাথে রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাতের অনুসরণ করতেন এবং তার কারণ এই ছিল না যে, তাদের যুগের পরিস্থিতি রসূলুল্লাহ (স)-এর যুগের পরিস্থিতির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল, বরং তার কারণ এই ছিল যে, তাদের মতে কুরআনের পরেই সুন্নাত ছিল আইনের উৎস। তার থেকে সীমাতিক্রম করাকে তাঁরা নিজেদের জন্য বৈধ মনে করতেন না। এ সম্পর্কে তাদের নিজেদের সুস্পষ্ট বক্তব্য আমরা এই গ্রন্থের ১১১ পৃষ্ঠা থেকে ১১৮ নং পৃষ্ঠা পর্যন্ত “খোলাফায়ে রাশেদীনের বিরুদ্ধে অপবাদ” শীর্ষক অনুচ্ছেদে উধৃত করে এসেছি। তাছাড়া এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ এই যে, দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে চতুর্দশ হিজরী শতক পর্যন্ত প্রতি শতকের ফিকহ সাহিত্য অব্যাহত ও অবিচ্ছিন্নভাবে খোলাফায়ে রাশেদীনের এই মত ও কর্মধারাই বর্ণনা করে আসছে। বর্তমান কালে কতিপয় লোক তাঁদের সুন্নাত অমান্য করার যেসব নজীর পেশ করছে তার মধ্যে একটিও মূলত একথার নজীর নয় যে, কোন খলীফায়ে রাশেদাও কার্যত সুন্নাত অমান্য করেছেন। এর মধ্যে কতিপয় নজীরের তাৎপর্য আমরা এই গ্রন্থের ১৯২-১৯৬ পৃষ্ঠায় ব্যক্ত করে এসেছি (২৬-২৮ নং অভিযোগের উত্তর দ্র.)।