৬. মাহানবী (স) কি কুরআন পৌছে দেয় পর্যন্তই নবী ছিলেন?
আপনার নিজের বাক্য “আপনার আগের প্রশ্ন এই যে, মহানবী (স) তেইশ বছরের নবূওয়াতী জীবনে যে কাজ করেছেন তাতে তার মর্যাদা কি ছিল? আমার উত্তর এই যে, মহানবী (স) যা কিছু করে দেখিয়েছেন তা একজন মানুষ হিসাবে। কিন্তু “আল্লাহ যা নাযিল করেছেন” তদনুযায়ী করে দেখিয়েছে। মহানবী (স) এর রিসালাতের দায়িত্ব সম্পাদন ছিল ব্যক্তি হিসাবে। আমার এই উত্তর আমার নিজের মন-মগজ প্রসূত নয়, বরং আল্লাহর কিতাব থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। মহানবী (স) বারংবার একথার উপর জোর দিয়েছেন যে, (আমি তোমাদের মতই মানুষ)।
উপরোক্ত বাক্যে আপনি আমার যে প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তা মূলত: এই ছিল যে, এই নবূওয়াতী জীবনে রসূলুল্লাহ (স) কুরআন মজীদ পৌছে দেয়া ছাড়াও অন্যান্য যেসব কাজ করেছিলেন তা কি নবী হিসাবে করেছিলেন, যার মধ্যে তিনি কুরআন মজীদের অনুরূপ আল্লাহ তাআলার ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করতেন? অথবা এসব কাজে কি তার পজিশন একজন সাধারণ মুসলমানের অনুরূপ ছিল? এই প্রশ্নের যে উত্তর আপনি দিয়েছেন তা এই যে, ‘মহানবী (স) একাজ ব্যক্তি হিসাবে করেছেন’ কিন্তু “আল্লাহ যা নাযিল করেছেন” তদনুযায়ী করেছেন’। অন্য কথায় আপনি বলতে চান যে,মহানবী (স) শুধুমাত্র কুরআন মজীদ পৌছে দেয়ার সীমা পর্যন্তই নবী ছিলেন। এরপরে একজন নেতা ও পথপ্রদর্শক, শিক্ষক, মুরুব্বী, আইন প্রণেতা, বিচারক এবং রাষ্ট্র প্রধান হিসাবে তিনি যা কিছু করেছেন তা নবী হিসাবে নয়, বরং একজন সাধারণ মুসলমান হিসাবে করেছেন। অর্থাৎ এসব ক্ষেত্রে তিনি নবী ছিলেন না, বরং একজন সাধারণ মুসলমান ছিলেন, যিনি কুরআন অনুযায়ী আমল করেছিলেন। আপনি দাবী করছেন যে, কুরআন মজীদ মহানবী (স) এর এই মর্যাদাই বর্ণনা করেছে। কিন্তু ইতিপূর্বে আমি কুরআন পাকের যে সুস্পষ্ট আয়াত উধৃত করেছি তা পাঠ করার পর কোন বোধশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিই এটা মেনে নিতে পারে না যে, বাস্তবিকই কুরআন মজীদ মহানবী (স) কে এই মর্যাদা দিয়েছে।
আপনি কুরআন মজীদ থেকে একটি অর্ধ সমাপ্ত কাথা উদ্ধৃত করেছেন যে, মহানবী (স) বারবার (আমি তোমাদর মতই মানুষ) বলতেন। পূর্ণাংগ কথা যা কুরআন পাকে রয়েছে তা হচ্ছে-মুহাম্মদ (স) এমন একজন মানুষ যাকে রসূল বানানো হয়েছে।
“বল হে মুহাম্মদ! পবিত্র আমার প্রতিপালক, আমি তো কেবল একজন মানুষ, একজন রসূল” (ইসরা:৯৩)এবং মহানবী (স) এমন একজন মানুষ যাঁর উপর আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ওহী আসে “বল, আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ, তবে আমার নিকট ওহী পাঠানো হয” (আল-কাহফ: ১১০)। আপনি কি একজন সাধারণ মানুষ এবং রিসালাতের অধিকারী ওহীপ্রাপ্ত মানুষের মধ্যে কোন পার্থক্য দেখছেন না? যে মানুষ আল্লাহর রসূল, তিনি তো অবশ্যম্ভাবীরূপে আল্লাহর বার্তাবাহক, এবং যে মানুষের কাছে ওহী আসে তিনি তো সরাসরি আল্লাহর দেয়া পথনির্দেশনার অধীনে কাজ করেন। তাঁর মর্যাদা এবং একজন সাধারণ মানুষের মর্যাদা কি করে এক সমান হতে পারে?
আপনি যখন একথা বলেন যে,মহানবী (স) “আল্লাহ যা নাযিল করেছেন” তদনুযায়ি কাজ করতেন, তখন আপনার মতে “আল্লাহ যা নাযিল করেছেন”- এর অর্থ কুরআন মজীদ। তাই আপনি শব্দগতভাবে একটি সত্য কথা কিন্তু অর্থগতভাবে একটি ভ্রান্ত কথা বলেন। নিঃসন্দেহে মহানবি (স) “আল্লাহ যা নাযিল হত না যা কুরআনে পাওয়া যায়, বরং এ ছাড়াও তিনি ওহীর মাধ্যমে নির্দেশ প্রাপ্ত হতেন। এর একটি প্রমাণ আমি আপনার চতুর্থ দফার জওয়াব দিতে নির্দেশ প্রাপ্ত হতেন। এর একটি প্রমাণ আমি আপনার চতুর্থ দফার জওয়াব দিতে গিয়ে পেশ করেছি। আরও প্রমাণ ইনশাআল্লাহ আপনার দশম দফা সম্পর্কে আলোচনাকালে পেশ করব।
৭.মহাবনী (স) এর ইজতিহাদী ভুলকে ভ্রান্ত প্রমাণ হিসাবে পশ করা হয়েছে
সপ্তম দফায় আপনি লিখেছেন: “কুরআনের আয়াত থেকে পরিষ্কার জানা যায় যে, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা পরিচালনার ক্ষেত্রে মহানবী (স) এর মর্যাদা ছিল একজন ব্যক্তি হিসাবে এবং কখন ও কখনও তার ইজতিহাদী ভুল হয়ে যেত।
দীন দইসলামের কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর প্রভাব বিস্তার করার মত ইজতিহাদী ভুল হয়ে গেলে আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে তার সংশোধনীও এসে যেত। যেমন এক যুদ্ধের প্রক্কালে কতিপয় লোক যুদ্ধে যোগদান না করে পেছনে থেকে যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করল এবং মহানবী (স) ও অনুমতি প্রদান করেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ওহী নাযিল হয়:
অনুরূপভাবে সূরা তাহরীমেও সংশোধনী এসেছে:
অনুরূপভাবে সূরা আবাসায়:( ৪৭পৃ)
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, কতটা অগভীর ও সামান্যতম অধ্যয়নের উপর ভিত্তি করে লোকেরা কত বড় গুরূত্বপূর্ণ ও নাজুক বিষয় সম্পর্কে মত ব্যক্ত করে বসে। আপনার ধারণা কি এই যে, আল্লাহ তাআলা নিজের পক্ষ থেকে একজন রসূল পাঠিয়েছেন, আবার স্বয়ং তিনিই তাঁকে অনির্ভরযোগ্য, ভুলের শিকার ও পথভ্রষ্ট প্রমাণ করার জন্য উপরোক্ত আয়াতসমূহও কুরআন মজীদে নাযিল করেছেন, যাতে লোকেরা যেন নিশ্চিন্ত মনে তাঁর আনুগত্য না করে? আফসোস আপনি যদি কুরআনের পোষ্ট মর্টেম করার পূর্বে এসব আয়াতের উপর এতটা চিন্তা করে দেখে থাকতেন যতটা চিন্তাভাবনা একজন ডাকতার তার রোগীর এক্স-রে রিপোর্ট সম্পর্কে করে থাকেন।
প্রথম আয়াত দ্বারা আপনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, স্বয়ং কুরআনের আলোকে রসূলুল্লাহ (স) কখনও কখনও পথভ্রষ্ট হয়ে যেতেন এবং তার জীবন মূলত পথভ্যষ্টতা ও হেদায়াতের সমষ্টি ছিল (আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করি)। এটা প্রমাণ করার সময় আপনি একটুও চিন্তা করে দেখেননি যে, আয়াতটি কোন প্রেক্ষাপট্ নাযিল হয়েছে।মক্কার কাফেররা মহানবী (স) এর প্রতি যে অপবাদ আরোপ করত আল্লাহ তাআলা সূরা সাবায় প্রথমে তা উল্লেখ করেন:
“এ ব্যক্তি সজ্ঞানে হয় আল্লাহর প্রতি অপবাদ আরোপ করছে অথবা সে পাগল”-(আয়াত নং ৮)।
অতপর এই অপবাদের উত্তর দিতে গিয়ে ৪৬-৫০ নং আয়াতে দুই নম্বর অপবাদ সর্ম্পকে বলেন যে, তোমরা এককভাবেও এবং সমাষ্টিগতভাবেও জিদ ও হঠকারিতা পরিত্যাগ করে আল্লাহর ওয়াস্তে নির্ভেজালভাবে চিন্তা কর। স্বয়ং তোমাদের অন্তরই সাক্ষ্য দেবে যে, এই ব্যক্তি যিনি তোমাদের ইসলামের শিক্ষা দিচ্ছেন তার মধ্যে পাগলামীর লেশমাত্রও নেই। অতপর তাদের দ্বিতীয় অপবাদ (এ ব্যক্তি সজ্ঞানে আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করেছে) এর উত্তরে আল্লাহ তাআলা তাঁর নবীকে বলেন, হে নবী! বল মূলত এই সত্য বাণী আমার প্রতিপালক নাযিল করেন, “যদি আমি পথভ্রষ্ট হয়ে যাই যেমন তোমরা অপবাদ দিচ্ছ) তবে আমার এই পথভ্রষ্টতার পরিণতি আমার উপর পতিত হবে”, “আর আমি যদি সত্যপথে থাকি তবে তা আমার উপর আমার প্রতিপালকের নাযিলকৃত ওহীর ভিত্তিতে ” “তিনি সবকিছু শ্রবণকারী নিকটবর্তী।” অর্থাৎ আমি পথভ্রষ্ট না তার পক্ষ থেকে হেদায়াত প্রাপ্ত তা তাঁর নিকট গোপন নয়। এই প্রেক্ষাপটে যে কথা বলা হয়েছে, আপনি তার এই অর্থ গ্রহণ করেছেন যে, আল্লাহ তাআলা যেন মক্কার কাফেরদের সামনে তাঁর রসূলকে স্বীকার করিয়ে নিয়েছেন যে, তিনি (স) বাস্তবিকই কখনও পথভ্রষ্ট হয়ে যান, আবার কখনও সোজা রাস্তায়ও চলে থাকেন। সুবহানাল্লাহ! কি আশ্চর্য ধরনের কুরআন অধ্যায়ন ও অনুধাবন।
৩. নম্বরে উল্লেখিত আয়াতে নয়, বরং হবে। (৪৭ পৃ)
৪. নম্বরে উল্লেখিত আয়াতেও মারাত্মক ভুল রয়েছে। সঠিক আয়াত হবে অনুরূপভাবে (৫) কুরআন মজীদে রছেছে নয়।
আপনার উধৃত দ্বিতীয় আয়াতে থেকে আপনি এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন যে, মহানবী (স) কর্তৃক প্রদত্ত ফয়সালাসমূহে তিনি অনেক ভুলভ্রান্তি করেছেন যার
কয়েকটি নমুনা আল্লাহ তাআলা এখানে তুলে ধরেছেন যাতে লোকেরা সাবধান হয়ে যায়। অথচ তা থেকে মূলত সম্পূর্ণ বিপরীত বক্তব্য পাওয়া যায়। তা থেকে তো জানা যায় যে, মহানবী (স) এর গোটা নবূওয়াতী জিন্দেগীতে মাত্র ঐ কয়েকটি পদঙ্খলন ঘটেছিল যা আল্লাহ তাআলা সাথে সাথে সংশোধন করে দিয়েছেন। এখন আমরা সম্পূর্ণ নিশ্চিন্তে তাঁর প্রমাণিত সুন্নাতসমূহের উপর আমল করতে পারি। তার মধ্যে যদি আরও ক্রটি-বিচ্যুতি থাকত তবে আল্লাহ তাআলা সেগুলোরও সংশোধন করে দিতেন, যেভাবে তিনি ঐকয়টি ক্রটি-বিচ্যুতির সংশোধন করে দিয়েছেন।
অতপর আপনি যদি কিছুটা চিন্তাভাবনা করে থাকতেন যে, এগুলো কি ধরনের ক্রটি যার কারণে আল্লাহ তাআলা আয়াত নাযিল করে তাঁকে সৎর্ক করেছেন! যুদ্ধের সময় আবেদনের পেক্ষিতে কাউকে সামরিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ থেকে অব্যাহতিদান, কোন হালাল জিনিস না খাওয়ার প্রতিজ্ঞা,এক বৈঠকে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে ইসলামের দাওয়াত দানকালে বাহ্যত একজন সাধারণ ব্যক্তির প্রতি লক্ষ্য না করা-এগুলেf কি এতই বৃহত বিষয় যার প্রভাব দীন ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ দিকের উপর প্রতিফলিত হতে পারে? এমন কোন নেতা, রাষ্ট্রনায়ক, অথবা আপনার পরিভাষায় “জাতির কেন্দ্রবিন্দু” আছে কি যিনি জীবনে একাধিকবার এই ধরনের, বরং এর চেয়েও মারাত্মক ভুলের শিকার হননি? আর এসব ভুলের সংশোধানের জন্য কি সব সময আসমান থেকে ওহী নাযিল হত? শেষ পর্যন্ত এমন কি কারণ থাকতে পারে যে, এতটা সামান্য ভুল-ক্রটি যখন রসূলুল্লাহ (স) এর দ্বারা হয়ে গেল কখন সাথে সাথে তার সংশোধনের জন্য ওহী এসে গেল এবং তাকে কিতাবে লিপিবদ্ধ করে রাখা হল? আপনি বিষয়টি অনুধাবনের চেষ্টা করলে জানতে পারতেন যে, রিসালাতের পদের গুরুত্ব ও মর্যাদা হৃদয়ংগম করতে গিয়ে আপনি কত বড় হোঁচট খেয়েছেন। কোন নেতা, সমাজ প্রধান বা জাতির কেন্দ্রবিন্দু আল্লাহর বাণীবাহক নয়। তার নিয়োগকৃত আইন প্রণেতা এবং তার নিয়োগকৃত কোন ব্যক্তি অনুসরণীয় আদর্শও নয়। এজন্য তার কোন মারাত্মক ভুলও ইসলামী আইনের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না, কারণ এর দ্বারা শরীআতের মূলনীতির কোন পরিবর্তন হতে পারে না।
কিন্তু রসূলুল্লাহ (স) যেহেতু আল্লাহ তাআলার স্বীয় ঘোষণা অনুযায়ী দুনিয়াবাসীর সামনে আল্লাহর ইচ্ছায় প্রতিনিধিত্ব করতেন এবং স্বয়ং আল্লাহ তাআলা ঈমানদার সম্প্রদায়কে নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তার আনুগত্য ও অনুসরণ কর, তিনি যা কিছু হালাল বলেন তাকে হালাল মেনে নাও এবং যা কিছিু হারাম বলেন তা হারাম হিসাবে বর্জন কর, তাই তার কথা ও কাজে সামান্যতম ক্রটিও মারাত্বক ছিল, আর তা কোন সাধারণ মানুষের ভুল ছিল না, বরং এমন একজন আইন প্রণেতার ভুল যার প্রতিটি গতি ও স্থিতি আইনে পরিণত হয়। তাই আল্লাহ তাআলা তাঁর রসূলকে সঠিক পথে কায়েম রাখার, ভুল-ক্রটি থেকে নিরাপদ রাখার এবং তার সামান্যতম ক্রটি হয়ে গেলেও ওহীর সাহায্যে এর প্রতিবিধানের দায়িত্ব নিজের উপর নিয়েছেন।
৮. কাল্পনিক ভীতি
অষ্টম দফায় আপনি বলেছেন যে, মহানবী (স) যদি এসব কাজ মানুষ (অর্থাৎ একজন সাধারণ ও পাপ থেকে অমুক্ত ব্যক্তি) হিসাবে নয়, বরং নবী হিসাবে করে থাকতেন তবে তা থেকে অবশ্যম্ভাবীরূপে দুটি পরিনতির সৃষ্টি হয়। (এক) মহানবী (স) এর পরে একাজ অব্যাহত রাখা অসম্ভব বিবেচিত হত এবং লোকেরা মনে করত যে, মহানবী (স) যে জীবন-ব্যবস্থা কায়েম করে অব্যাহত রেখেছিলেন তা কায়েম করা ও অব্যাহত রাখা সাধারণ লোকদের সাধ্যের অতীত। (দুই) এই কাজ অব্যাহত রাখার জন্য লোকেরা মহানবী (স) এর পরও নবীদের আগমনের প্রয়োজন অনুভব করেবে।
এই দুটি পরিণতি থেকে বাঁচার জন্য আপনার মতে একমাত্র পন্থা হলো, কুরআনের প্রচার ব্যতীত মহানবী (স) এর জীবনের অন্যসব কাজ রসূলের নয়, বরং একজন অ-নবী ব্যক্তির কাজ হিসাবে গণ্য করতে হবে। এই প্রসংগে আপনি আরও দাবী করেন যে, এগুলোকে রসূলের কাজ মনে করাটা খতমে নবুওয়াতের আকীদাকে নাকচ করে দেয়। কারণ রসূলূল্লাহ (স) যদি এসব কাজ ওহীর নির্দেশনায় করে থাকেন তবে এরপরও এসব কাজ করার জন্য সর্বকালে ওহী আসার প্রয়োজন অবশিষ্ট থেকে যাবে, অন্যথায় দীন কায়েম থাকবে না।
আপনি এই যা কিছু বলেছেন তা কুরআন ও তার নাযিলের ইতিহাস থেকে চোখ বন্ধ করে নিজের কল্পনার জগতে উদভ্রান্তের মত হাবুডুবু খেয়ে চিন্তা করেছেন এবং বলেছেন। আপনার এসব কথায় আমার সন্দেহ হয় যে, আপনার দৃষ্টির সামনে কুরআন পাকের কেবল সেই সব আয়াত পতিত হয়েছে যেগুলো সুন্নাত-বিরোধীগণ তাদের সাহিত্য একটি বিশেষ মতবাদ প্রমাণের জন্য নকল করেছ এবং সেগুলোকে একটি বিশেষ ক্রমানুসারে জোড়াতালি দিয়ে তারা যে তাৎপর্য বের করেছেন, আপনি তার উপর ঈমান এনেছেন। তাই যদি না হত এবং আপনি যদি একটি বারও গোটা কুরআন মজীদ বুঝে পাঠ করে থাকতেন তবে জানতে পারতেন যে, আপনার মতে সীরাতে পাককে রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাত মানার কারণে যে বিপদের সৃষ্টি হয়, এসব বিপদ কুরআন পাককে আল্লাহর ওহী মানার কারণেও সৃষ্টি হয়। স্বয়ং কুরআন মজীদ সাক্ষ্য যে, এই গোটা কিতাব একই সময়ে একটি আইন গ্রন্থ হিসাবে নাযিল হয়নি, বরং তা সেই সব ওহীর সংকলন যা একটি আন্দোলনের দিক নির্দেশনা দানের জন্য তেইশ বছর ধরে আন্দোলনের প্রতিটি স্তরে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ্যে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নাযিল হতে থাকে। তা অধ্যয়ন করতে গিয়ে পরিষ্কার জানা যায় যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন মনোনীত ব্যক্তি ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্ব দানের জন্য প্রেরিত হয়েছেন এবং পদে পদে আল্লাহর ওহী তাঁকে দিকনির্দেশনা দিচ্ছে। বিরুদ্ধবাদীরা তাঁর উপর অীভযোগের তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করছে এবং আসমান থেকে এর জবাব আসছে। বিভিন্ন রকমের বাধাবিপত্তি চলার পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে এবং তা অতিক্রমের পন্থা উপর থেকে বলে দেয়া হচ্ছে যে, এই প্রতিবন্ধকতা এভাবে দূর কর এবং ঐ বিরোধিাতার এভাবে মোকাবিলা কর। অনুসারীরা বিচিত্র রকমের অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে এবং তার সমাধান উপর থেকে বলে দেয়া হচ্ছে যে, তোমাদের এই অসুবিধা এভাবে দূর হতে পারে এবং অমুক অসুবিধা এভাবে দূর হতে পারে। অতপর এই আন্দোলন যখন অগ্রগতি লাভ করতে করতে একটি রাষ্ট্রের স্তরে প্রবেশ করে তখন নতুন সমাজ গঠন ও রাষ্ট্র নির্মাণের সমস্যা থেকে শুরু করে মুনাফিক, ইহুদী এবং আরব মুশরিকদের সাথে দ্বন্দ-সংঘাত পর্যন্ত যত সমস্যাই দশ বছর ধরে উদ্ভত হতে থাখে সেসব ক্ষেত্রেই ওহী এই সমাজের নির্মাতা, এই রাষ্ট্রের কর্ণধার এবং এই সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতির পথপ্রদর্শন করে। শুধু এতটুকুই নয় যে, এই নির্মাণ ও সংঘাতের প্রতিটি পর্যায়ে যে সমস্যার উদ্ভব হয় তার সমাধানের জন্য আসমান থেকে হেদায়াত আসে, বরং কোন যুদ্ধের সম্মুখীন হলে সেজন্য লোকদের উদ্ধুদ্ধ করার জন্য প্রধান সেনাপতির ভাষণও আসমান থেকে আসে। আন্দোলনের সদস্যদের মধ্যে কখনও দুর্বলতা দেখা দিলে তার প্রতিবিধানের জন্য আসমান থেকে উপদেশবাণী নাযিল হয়। নবীর স্ত্রীর উপর শত্রুরা অপবাদ আরোপ করলে তার প্রতিবাদ আসমান থেকেত আসে। মুনাফিকরা ক্ষতিকর সমজিদ (সমজিদে দিরার) নির্মাণ করে, তা ধ্বংসের নির্দেশ ওহীর মাধ্যমে দেয়া হয়। কিছু লোক যুদ্ধে যোগদান থেকে পালিয়ে থাকলে তাদের বিষয়টির ফয়সালা সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদান করা হয়। কোন ব্যক্তি শত্রুপক্ষের নিকট গোপন পত্র লিখে পাঠালে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা সেদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপকরেন।
বাস্তবিকই যদি আপনার নিকট এগুলো হতাশাপূর্ণ কথা হয়ে থাকে যে, দীন প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বপ্রতম যে আন্দোলন উত্থিত হয় তার পথনির্দেশনা ওহীর মাধ্যমে হোক, তবে এই হতাশার কারণ তো স্বয়ং কুরআন মজীদেও বর্তমান রয়েছে। এক ব্যক্তি আপনার প্রথম পদক্ষেপ থেকে নিয়ে কৃতকার্যতার শেষ মনযিল পর্যন্ত প্রতিটি প্রয়োজনের এবং প্রতিটি সংকটপূর্ণ পর্যায়ে আন্দোলনের নেতার পথ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে আয়াতসমূহ নাযিল হতে থাকে তাকে এখন কিভাবে কায়েম করা যেতে পারে যতক্ষণ একইভাবে দীনের ব্যবস্থা কায়েমের জন্য চেষ্টাসাধনাকারী “জাতির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের” সাহায্যের জন্যও আল্লাহর তরফ থেকে আয়াত নাযিলের ধারা শুরু না হবে?
এই দৃষ্টিকোণ থেকে আলল্লাহর জন্য তো সঠিক কমপন্থা এই ছিল যে, মহানবী (স) এর নবূওয়াতের প্রথম দিনই একটি পূর্ণাংগ আইনগ্রন্থ তাঁর হাতে দিয়ে দেয়া হত যার মধ্যে আল্লাহ তাআলা মানব জীবনের সমস্যাবলী সম্পর্কে নিজের সমস্ত নির্দেশনা একই সময় তাঁকে দিয়ে দিতেন। অতপর খতমে নবূওয়াতের ঘোষণা দিয়ে অবিলম্বে মহানবী (স) এর স্বীয় নবূওয়াতও খতম করে দেয়া হত। এরপর তিনি মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ নন, বরং আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদের কাজ ছিল যে, তিনি অ-নবী হিসাবে এই আইনের কিতাব নিয়ে চেষ্ট-সাধনা করতেন এবং “আল্লাহ যা নাযিল করেছে” তদনুযায়ী একটি সমাজ ও রাষ্ট কায়েম করে দেখাতেন। মনে হয় যেন আল্লহ তাআলা মোক্ষম সময়ে সঠিক পরামর্শ পাননিএবং তিনি এমন অনুপযুক্ত পন্থা অবলম্বন করলেন যা ছিল ভবিষ্যতে দীন কায়েমের ক্ষেত্রে হতাশাব্যঞ্জক। বিপদ তো এই যে, তিনি এই পরিণামদর্শিতার কথা সেই সময়ও অনুধাবন করতে পারেননি যখন তিনি খতমে নবূওয়াতের ঘোষণা সূরা আহযাবে প্রদান করা হয়েছে যা সেই যুগের কাছাকাছি সময়ে নাযিল হয়েছিল যখন হযরত যায়েদ (রা) তাঁর স্ত্রীকে তালাক দিয়েছিলেন, অতপর মহানবী (স) আল্লাহর নির্দেশে তাঁর তালাকপ্রাপ্তাকে বিবাহ করেন। এই ঘটনার পর কয়েক বছর পর্যন্ত রসূলুল্লাহ (স) ‘জাতির কেন্দ্রবিন্দু’ ছিলেন এবং খতমে নবূওয়াতের ঘোষণা হয়ে যাওয়া সত্বেও না মহানবী (স) এর নবূওয়াত খতম করা হয়েছিল, আর না ওহীর মাধ্যমে তাঁকে দিকনির্দেশনা দানের অব্যাহত ধারা বন্ধ করা হয়েছিল।
আল্লাহ পাকের এই পরিকল্পনার আপনার ঐক্যমত বা বিরোধ যাই থাক না কেন, কুরআন মজীদ আমাদের বলে দিচ্ছে যে, প্রথম থেকেই তাঁর পরিকল্পনা এরূপ ছিল না যে, মানব জাতির হাতে একটি কিতাব তুলে দেয়া হবে এবং তাদের বলা হবে, এই কিতাব দেখে তোমরা নিজেরাই ইসলমী জীবন-ব্যবস্থা গড়ে তোল। এটাই যদি তাঁর পরিকল্পনা হত তবে একজন মানুষ বেছে নিয়ে চুপে চুপে তাঁর হাতে কিতাব তুলে দেয়ার কি প্রয়োজন ছিল? এজন্য তো উত্তম পন্থা এই ছিল যে, একটি কিতাব মুদ্রিত আকারে আল্লাহ তাআলা সরাসরি গোটা মানব গোষ্ঠীর হাতে পৌছে দিতেন এবং ভুমিকায় এই কথা লিখে দিতেন যে, আমার এই কিতাব পাঠ কর এবং সত্য সঠিক ব্যবস্থা কায়েম কর। কিন্তু আল্লাহ পাক এই পন্থা পছন্দ করেননি। এর পরিবর্তে তিনি যে পন্থা গ্রহণ করেছেন তা হলো, তিনি একজন মানুষকে রসূল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করান এবং তাঁর মাধ্যমে সংস্কার ও বিপ্লবের একটি আন্দোলন পরিচালনা করান।
এই আন্দোলনে আসল কর্মকর্তা কিতাব ছিল না, বরং ছিলেন সেই জীবন্ত মানুষটি যাঁকে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য নিযুক্ত করা হয়েছিল। এই মহামানবের সাহায্যে আল্লাহ তাআলা নিজের তত্ত্বাবধানে ও দিকনির্দেশনায় একটি পরিপূর্ণ চিন্তা ও নৈতিক ব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা এবং ন্যায়-ইনসাফ, আইন-কানুন, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা গঠন করে এবং তা কার্যকর করে সর্বকালের জন্য একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসাবে দুনিয়ার সামনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, যাতে কল্যাণকামী ও মুক্তিকামী যে কোন ব্যক্তি এই দৃষ্টান্ত সামনে রেখে তদনুযয়ী নিজের জীবন ব্যবস্থা গঠন করার চেষ্টা চালাতে পারে। এই দৃষ্টান্তের মধ্যে ক্রটি থাকার অর্থ হচ্ছে, হেদায়াত ও পথ-নির্দেশনার মধ্যে ক্রটি ও অপূর্ণতা থেকে যাওয়া। এজন্য আল্লাহ তাআলা এই নমুনা সরাসরি নিজের নিজের তত্ত্ববধানে গঠন করেছেন,এর নির্মাতাকে নির্মাণ কাঠামোও দিয়েছেন এবং তার তাৎপর্যও নিজেই বুজিয়ে দিয়েছেন, তাঁকে নির্মাণ কৌশলও শিক্ষা দিয়েছেন এবং প্রসাদের এক একটি কক্ষ নির্মানের সময় তার দেখাশুনাও করেছেন। নির্মাণকার্য চলাকালীন প্রত্যক্ষ ওহীর মাধ্যমেও তাকে পথনিদের্শনা দান করেছেন এবং পরোক্ষ ওহীর মাধ্যমেও। কোথাও কোন ইটের গাথুনি দিতে গিয়ে সামান্য ভুল হয়ে গেলে সাথে সাথে তিনি তার সংশোধন করে দেয়েছেন,যাতে চিরকালের জন্য নমুনাস্বরূপ নির্মিত প্রাসাদে সামান্যতম ক্রটিও না থাকতে পারে। অতপর এই নির্মাতা (রসূল) যখন নিজের মনিবের সঠিক মর্জি অনুযায়ী এই নির্মাণকার্য শেষ করেন তখন দুনিয়ার সামনে ঘোষণা দেয়া হল:
“আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দীন পূণাংগ করলাম তোমাদের প্রতি, আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দীন মনোনীত করলাম”-(সূরা মাইদা:৩)।
ইসলামের ইতিহাস সাক্ষ্য যে, এই কর্মপন্থা বাস্তাবকই উম্মাতের মধ্যে কোন নৈরাশ্যর সৃষ্টি করেনি। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পর যখন ওহীর দরজা বন্ধ হয়ে গেল তখন খুলাফায়ে রাশেদীন একের পর এক ওহীর ধারা বন্ধ হওয়া সত্ত্বেও এই নমুনা স্বরূপ নির্মিত প্রাসাদের রক্ষণাবেক্ষণ এবং নমুনার আরও ব্যপ্তির জন্য কি চেষ্টাসাধনা করেননি? উমার ইবন আবদুল আযীয (রহ) কি তা একটি ভিত্তির উপর সম্পূর্ণ নতুনভাবে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেননি? যুগে যুগে সৎও নেককার শাসকগণ এবং মহান সংস্কারকগণও এই নমুনার অনুসরণের জন্য পৃথিবীর প্রত্যন্ত এলাকাসমূহে আত্মপ্রকাশ করেননি? তাদের মধ্যে শেষ পর্যন্ত কে এই কথা বলেছেন যে, রসূলুল্লাহ (স) তো ওহীর সাহায্যে এই কাজ করে গেছেন এখন তা আমাদের সাধ্যাতীত? বাস্তবিকপক্ষে এটা তো আল্লাহ তাআলারই অনুগ্রহ যে, তিনি মানবেতিহাসে তাঁর রসূলের বাস্তব অবদানকে আলোর মীনার হিসাবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন, যা শত শত বছর ধরে মানব জাতিকে সত্য সঠিক জীবন ব্যবস্থার নকশা প্রদর্শন করছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত দেখাতে থাকবে। আপনার মন চাইলে আপনি তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকুন অথবা তা থেকে চোখ বন্ধ করে রাখুন।
৯। খুলাফয়ে রাশদীনের প্রতি অপবাদ
আপনার নবম দফা হলো: “খলীফাগন উত্তমরূপেই জানতেন যে, ওহী আল-কিতাব এর মধ্যে সংরক্ষিত আছে এবং অতপর মহানবী (স) যা কিছু করতেন তা পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে করতেন। তাই তার ইন্তেকালের পর প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার মধ্যে কোন পরিবর্তন আসতে পারেনি। রাজ্যের সীমা বর্ধিত হওয়ার সাথে সাথে প্রয়োজনের তালিকাও দীর্ঘ হতে থাকে। এজন্য সামনের দিনগুলোতে নিত্য নতুন সমস্যার উদ্ভব হতে থাকে। এর সামাধানের জন্য পূর্বের কোন সিধান্ত পাওয়া গেলে এবং তার মধ্যে পরিবর্তনের প্রয়োজন হলে তারা পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। এসব কিছুই কুরআনের আলোকে করা হত। এটাও ছিল রসূলল্লাহ (স) এর প্রদর্শিত পন্থা এবং তার স্থলাভিষিক্তগণও তা কায়েম রাখেন। এরই নাম ছিল রসূলুল্লাহ (স) যা কিছু করতেন তা পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে করতেন। অথচ রসূলুল্লাহ (স) কেবল কাজ সমাধার পন্থা-পদ্ধতি সম্পর্কেই পরার্মশ করেছেন এবং সেগুলোও ঐসব পন্থাপদ্ধতি যে সম্পর্কে ওহীর সাহায্যে তিনি কিছু প্রাপ্ত হননি। কুরআন পাকের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও তার কোন শব্দের বা বাক্যাংশের বিশেষ উদ্দেশ্য নির্ধারণে তিনি কারও পরামর্শ গ্রহণ করেননি। এ ক্ষেত্রে তার নিজের ব্যাখ্যাই ছিল চুড়ান্ত। অনুরূপভাবে তার গোটা নবূওয়াতী জিন্দেগীতে কখনও লোকের জন্য কোন কিছু ফরজ, ওয়াজিব, হালাল-হারাম, জায়েয-নাজায়েয, সিদ্ধ-নিষিদ্ধ সাব্যস্ত করার জন্য কোন পারামর্শ সভা অনুষ্ঠিত হয়নিএবং সমাজে কি রীতিনীতি ও বিচার-ব্যবস্থা কায়েম করা হবে সে সম্পর্কেও এ ধরনের কোন পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত হয়নি। মহানবী (স) এর পবিত্র জিন্দেগীতে কিবলমাত্র তার বক্তব্য এবং তার বাস্তব জীবনধারাই ছিল আইন পরিষদ। কোন ঈমানদার ব্যক্তি উপরোক্ত বিষয়ে মহাবনী (স) এর সামনে মুখ খোলার চিন্তাও করতে পারত না। আপনি কি এমন কোন উদাহরণ পেশ করতে পারেন যে, রিসালাত যুগে কুরআন পাকের কোন নির্দেশের ব্যাখ্যা পরামর্শের ভিত্তিতে করা হয়েছে, অথবা কোন আইন পরামর্শের ভিত্তিতে রচিত হয়েছে? অনেকগুলোর প্রয়োজন নাই, আপনি কেবল একটি দৃষ্টান্তই পেশ করুন।
দ্বিতীয়ত, বাস্তব ঘটনার পরিপন্থী কথা আপনি এই বলেছেন যে, খুলাফায়ে রাশেদীন শুধুমাত্র কুরআন মজীদকে হেদায়াতের উৎস মনে করতেন এবং রসূলুল্লাহ (স) এর কথা ও কাজকে অপরিহার্যরূপে অনুসরণীয় আইনের উৎস মনে করতনে না। এটা তাদের প্রতি আপনার আরোপিত মারাত্মক অপবাদ যার সমর্থনে আপনি তাদের কোন কথা বা কার্যক্রম পেশ করতে পারবেন না। যদি এর কোন প্রমাণ আপনার নিকট থেকে থাকে তবে তা পেশ করুন। তাদের কার্যক্রমের যে সাক্ষ্য তাদের যুগের সাথে সম্পৃক্ত লোকেরা পেশ করেছেন তা তো নিম্নরূপ:
ইবনে সীরিন (৩৩-১১০ হি:) বলেন, “আবু বাবর (রা) এর সামনে যখন কোন বিষয় পেশ করা হত এবং তিনি যদি আল্লাহর কিতাবে কোন সমাধান না পেতেন আর সুন্নাতেও না পেতেন তার কোন নযীর, তখন তিনি নিজের ইজতিহাদের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন এবং বলতেন: এটা আমার ব্যক্তিগত মত, যদি সঠিক হয় তবে তা আল্লাহর-ই অনুগ্রহ” (ইবনুল কায়্যিম, আলামুল মুওয়াক্কিঈন, ১খ,পৃ. ৫৪)।
মায়মূন ইবনে মিহরান (২৭-১০৭ হি.) বলেন, আবু বাকর সিদ্দীক (রা) এর কর্মনীতি এই ছিল যে, তাকে কোন বিষয়ের ফয়সালা করতে হলে তিনি প্রথমে আল্লাহর কিতাবে অনুসন্ধান করতেন। যদি তাতে নির্দেশ নাপাওয়া যেত তবে তিনি রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাতে তালাশ করতেন। যদি তাতে হুকুম পাওয়া যেত তবে তিনি তদনুযয়ী ফয়সালা করতেন। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যদি তার কাছে সুন্নাতের জ্ঞান না থাকতে তবে তিনি অন্যদের নিকট জিজ্ঞাসা করতেন যে, এ ধরনের কোন বিষয়ে রসূলুল্লাহ (স ) এর কোন ফয়সালা তোমাদের কারো জানা আছে কি?”(ঐ গ্রন্থ, পৃ৬২)।
আল্লামা ইবনুল কায়্যিম (রহ) পরিপূর্ণ পর্যালোচনা পর তার গবেষণার ফল এভাবে ব্যক্ত করেন
“আবু বাকর সিদ্দিক (রা) এর জীবনে কুরআন ও সুন্নাতের বিরোধীতা করার একটি দৃষ্টান্তও পাওয়া যায় না”-(ঐ গ্রন্থ.৪খ.পৃ.১২০)।
একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা এই যে, এক দাদী তার নাতির ওয়ারিশী স্বত্বের দাবী নিয়ে উপস্থিত হয়। মৃতের মা জীবিত ছিল না। আবু বাকর (রা) বলেন, আমি আল্লাহর কিতাবে কোন হুকুম পাচ্ছি না যার ভিত্তিতে তোমকে নাতির ওয়ারিশ বানানো যেতে পারে। অতপর তিনি লোকদের নিকট জিজ্ঞসা করেন যে, মহানবী (স) এ জাতীয় ব্যাপরে কোন হুকুম দিয়েছিলেন কি না। একথা শুনে মুগীরা ইবনে শো‘বা (রা) এবং মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা (রা) দাড়িয়ে সাক্ষ্য দেন যে, মহানবী (স) দাদীকে এক-ষষ্ঠাংশ (অর্থ্যাত মায়ের প্রাপ্য) দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব আবু বাকর (রা) তদনুযায়ী ফয়সালা করে দেন (বুখারী ও মুসলিম সহ হাদীসের সমস্ত প্রসিদ্ধ গ্রন্থে ঘটনাটির উল্লেখ আছে।
ইমাম মালিক (রহ) এর আল-মুওয়াত্তা গ্রন্থে এই ঘটনা উল্লেখ আছে যে, হযরত আবু বাকর সিদ্দীক (রা) নিজ কন্যা হযরত আয়েশা (রা) কে নিজের জীবদ্দশায় কিছু মাল দেয়ার জন্য বলেছিলেন। কিন্তু তার স্মরণ ছিল না যে, এই মাল তার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে কিনা। মৃত্যুর কাছাকাছি সময় তিনি তাকে বলেন, যদি সেই মাল তুমি ইতিমধ্যে হস্তগত করে নিয়ে থাক তবে তা তোমারই মালিকানায় থাকবে (কারণ তা দান বা হেবা হিসাবে গন্য হবে)। আর তুমি যদি এখন পর্যন্ত তা হস্তগত না করে থাক তবে তা এখন আমার সকল ওয়ারিসের মধ্যে বন্টিত হবে। কারণ এখন আর তা হেবার পর্যায়ে নাই, বরং ওসীয়াতের পর্যায়ভুক্ত এবং “লা ওয়াসিয়্যাতা লি ওয়ারিছ” (ওয়ারিসদের জন্য কোন ওসিয়াত করা যাবে না) শীর্ষক হাদীসের আলোকে ওয়ারিসের জন্য কোন ওসীয়াত মৃতের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে কার্যকর হতে পার না। এ ধরনের অসংখ্য উদাহরণ প্রথম খলীফার জীবনে পাওয়া যায় যাতে প্রমাণিত হয় যে, তিনি রসূলুল্লাহ (স) এর তরীকা থেকে চুল পরিমাণ দূরে সরে যাওয়াও জায়েয মনে করতেন না।
কে না জানে যে, খলীফা হওয়ার পার হযরত আাবু বাকর (রা)-র সর্বপ্রথম ঘোষণা এই ছিল যে:
“তোমরা আমার আনুগত্য কর যতক্ষণ আমি আল্লাহ ও তার রসূলের আনুগত্য করি। আমি যদি আল্লাহ ও তার রসূলের অবাধ্যাচরণ করি তবে আমার আনুগত্য করা তোমাদের কর্তব্য নয়।”
কে না জানে, তিনি মহানবী (স) এর ইন্তেকালের পর উসামা বাহিনীকে কেবলমাত্র এজন্য অভিযানে পাঠাতে জোর দিয়েছেন, যে কাজের ফয়সালা স্বয়ং মহানবী (স) করেছেন তার পরিবর্তন করার অধিকার তার নেই বলেই তিনি মনে করতেন। আরবে যে ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব লক্ষ্য করা যাচ্ছিল,সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে সাহাবায়ে কিরাম (রিদওয়ানুল্লাহি আলাইহিম) এই মুহুর্তে সিরিয়ায় সেনাবাহিণী পাঠানো যুক্তিসংগত মনে করেননি তখন হযরত আবু বাকর (রা) এই জওয়াব দিয়েছিলেন:
“কুকুর ও নেকড়ে বাঘেরা যদি আমাকে ছিনিয়েও নিয়ে যায় তবুও আমি রসূলুল্লাহ (স) এর কৃত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করব না।”
হযরত উমার ফরূক (রা) আকাংখা ব্যক্ত করেন যে,অন্তত উসামাকে এই বাহিনীর সেনাপতিত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হোক। কারণ অনেক প্রবীণ
(৫২ পৃ)১. হাদীস অস্বীকারকারীগণ বলে যে,কুরআন মজীদে যেখানেই “আল্লাহ ও রসূল” শব্দদ্বয় এসেছে তার অর্থ “জতির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব”। কিন্তু এই সূক্ষ্ম বিষয়টি হযরত আবু বাকর (রা)-র বুঝে আসেনি। তিনি বেচারা বুঝেছেন যে, “জাতির কেন্দ্রীয় নেতা” হিসাবে আমি আল্লাহ ও তার রসূলের অনুগত থাকতে বাধ্য। প্রথম খলীফার শপথ গ্রহণের সময় হয়ত যদি“তুলূয়ে ইসলাম” প্রকাশিত হযে থাকত তবে তা তাকে বলে দিত যে, হে জাতির কেন্দ্রবিন্দু! আল্লাহ ও রসূল তো এখন তুমি নিজেই। তুমি আবার কোন আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্য করতে যাচ্ছ!
সাহাবী এই যুবক ছেলের নেতৃত্বে কাজ করতে আগ্রহী নন। আবু বাকর (রা) তাঁর দাড়ি ধরে বলেন:
“হে খাত্তাবের পুত্র! তোমার মা তোমার জন্য ক্রন্দন করুক এবং তোমাকে হারিয়ে ফেলুক। তাকে স্বয়ং রসূলুল্লাহ (স) নিয়োগ করেছেন, আর আমাকে বলছ আমি তাকে বরখাস্ত করি!”
উক্ত সেনাবাহিনীকে বিদায় দেয়ার প্রক্কালে তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন তাতে বলেছিলেন:
“আমি তো অনুসরণকারী ও আনুগত্যকারী মাত্র, বিদআত সৃষ্টিকারী নাই।”
তাছাড়া একথাই বা কে না জানে যে, হযরত ফাতিমা যোহরা (রা) ও হযরত আব্বাস (রা)-র মীরাসের দাবী হযরত আবু বাকর সিদ্দিক (রা) রসূলুল্লাহ (স)-এর হাদীসের ভিত্তিতেই মেনে নিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছেন এবং এই “অপরাধের” জন্য তিনি আজও (শীআদের) গালি খাচ্ছেন। যাকাত প্রদানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারীদের বিরুদ্ধে তিনি যখন জিহাদের সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন তখন হযরত উমার (রা) এর মতে ব্যক্তিত্বের এই সিদ্ধান্তের যথার্থতা সম্পর্কে এজন্য সংশয় ছিল যে, যেসব লোক কলেমা (আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নাই) এর প্রবক্তা তাদের বিরুদ্ধে কি করে অস্ত্র ধরা যেতে পারে? কিন্তু আবু বাকর (রা) এর যে জওয়াব দিয়েছেন তা হলো:
“আল্লাহর শপথ! তারা যদি উট বাঁধার একটি রশিও এই যাকাত থেকে রেখে দেয় যা তারা রসূলুল্লাহ (স) এর যুগে দিত, তবে আমি এজন্য তাদের বিরুদ্বে যুদ্ধ করব।”
এই কথা এবং এই কাজ ছিল সেই মহান ব্যক্তির যিনি মহানবী (স) এর পরে সর্বপ্রথম উম্মাতের নেতৃত্বের লাগাম শক্ত হাতে তুলে নেন। আর আপনি বলেছেন যে, মহান খলীফাগণ নিজেদেরকে রসূলূল্লাহ (স) এর সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের অধিকারী মনে করতেন। হযরত আবু বাকর (রা) এর পর হযরত উমার ফারূক (রা)-র এক্ষেত্রে যে দৃষ্টিভংগি ছিল তা তিনি নিজেই কাযী সুরাইহ (রহ) কে লিখিত এক পত্রে এভাবে উল্লেখ করেছেন:
“তুমি যদি কোন হুকুম আল্লাহর কিতাবে পেয়ে যাও তবে তদনুযায়ী ফয়সালা করবে এবং তার বর্তমানে অন্য কোন জিনিসের প্রতি দৃষ্টিপাত করবে না। আর যদি এমন কোন বিষয় উপস্থিত হয় যার মীমাংসা আল্লাহর কিতাবে নেই, তবে রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাতে যে মীমাংসা পাওয়া যায় তদনুযায়ী ফয়সালা কর। যদি এমন কোন বিষয়ে আল্লাহর কিতাব ও রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাত উভয়ই নীরব থাকে তবে তোমার এ অধিকার রয়েছে যে, সামনে অগ্রসর হয়ে নিজের ইজতিহাদের ভিত্তিতে সমাধান পেশ কর অথবা মীমাংসা স্থগিত রেখে অপেক্ষা কর।১ তবে আমার মতে তোমার জন্য অপেক্ষা করাই অধিক শ্রেয়”-(ইলামুল মুওয়ক্কিঈন, ২খ.পৃ. ৬১-৬২)।
এটা হযরত উমার (রা)-র স্বলিখিত সরকারী নির্দেশনামা যা তিনি সমসাময়িক খলীফা হিসাবে বিচারালয়ের নীতিমালা সম্পর্কে কূফা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির নিকট পাঠিয়েছিলেন। এরপরও কি তার দৃষ্টিভংগি সম্পর্কে কারো ভিন্নতর ব্যাখ্যা দেয়ার অধিকার থাকে?
(হযরত উমার (রা)-পরে তৃতীয় খলীফা ছিলেন হযরত উসমান (রা)।২ শপথ অনুষ্ঠানের পর তিনি মুসলিম সর্বসাধারণের সামনে যে প্রকাশ্য ভাষণ দিয়েছিলেন তাতে বলেন:
“সাবধান! আমি আনুহ্যকারী ও অনুসরণকারী, বিদআত সৃষ্টিকারী নই। আল্লাহর কিতাব ও রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাতের আনুগত্য করার পর আমার উপর তোমাদের তিনটি অধিকার রয়েছে যার যিম্মাদারী আমি নিচ্ছি। (এক) আমার পূর্ববর্তী খলীফাগণের আমলে তোমদের ঐক্যমত অনুযায়ী যেসব সিদ্ধান্ত ও পন্থা গৃহীত হয়েছে আমি তার অনুসরণ করব। (দুই) উত্তম ও যোগ্য লোকদের ঐক্যমতের ভিত্তিতে এখন যেসব ফয়সালা হবে আমি তা কার্যকর করব। (তিন) তোমাদের উপর হস্তক্ষেপ থেকে আমি বিরত থাকব, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা আইনের আওতায় গ্রেফতার হওয়ার যোগ্য না হও”-(তারীখে তাবারী, ৩খ.,পৃ.৪৪৬)।
চতুর্থ খলীফা ছিলেন হযরত আলী (রা)। খলীফা হওয়ার পর তিনি মিসরবাসীদের নিকট থেকে আনুগত্যের শপথ গ্রহণের জন্য স্বীয়
১. (৫২ পৃ)অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ঐক্যমত প্রসূত সিদ্ধান্ত হয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় থাক।
২. এই অংশ পরে সংযোজন করা হয়েছে।
গর্ভনর কায়স ইবনে সাদ ইবনে উবাদাকে প্রেরণের সময় তার হাতে যে সরকারী ফরমান অর্পন করেন তাতে তিনি বলেন:
“সাবধান! আমার উপর তোমাদের অধিকার এই যে, আমি মহান আল্লাহর কিতাব এবং তার রসূলের সুন্নাত অনুযায়ী কাজ করব, তোমাদের কিতাব ও সুন্নাহ প্রদত্ত অধিকারসমূহ প্রতিষ্ঠা করব, রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাত কার্যকর করব এবং তোমাদের অজ্ঞাতেও তোমাদের কল্যাণ চিন্তা করব”-(তারীখে তাবারী,৩খ.পৃ.৫৫০)।
খুলাফায়ে রাশেদীনের চারজন খলীফার বক্তব্যই উপরে উল্লেখ করা হল, আপনি কোন খলীফাদের কথা বলেছেন যারা নিজেদেরকে রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাতের অনুসরণ থেকে মুক্ত ছিল? তাদের সেই দৃষ্টিভংগী আপনি কি কি উপায়ে অবগত হলেন?
আপনার এই ধারণাও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন যে, খুলাফায়ে রাশেদীন কুরআন মজীদের হুকুম-আহকাম তো চূড়ান্তভাবে এবং অপরিহার্যরূপে অনুসরণীয় মনে করতেন, কিন্তু রসূলুল্লাহ (স) এর সিদ্ধান্তসমূহের মধ্যে যেগুলোকে তারা বহাল রাখা যুক্তিসংগত মনে করতেন সেগুলোকে বহাল রাখতেন এবং যেগুলোর পরিবর্তনের প্রয়োজন মনে করতেন সেগুলো পরিবর্তন করে পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। আপনি এর নযীর পেশ করুন যে খিলাফতে রাশেদার সমগ্র যুগে মহানবী (স) এর কোন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়েছে, অথবা কোন খলীফা বা কোন সাহাবী মত ব্যক্ত করেছেন যে, তাঁরা প্রয়োজনমত মহানবী (স) এর কোন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে দেয়ার অধিকার রাখতেন।
১০.মহানবী (স) এর নিকট কুরআন ছাড়াও কি ওহী আসত?
এখন কেবল আপনার সর্বশেষ দফা অবশিষ্ট থাকল যা আপনি নিম্নোক্ত বাক্য ব্যক্ত করেছেন: “যদি ধরে নেয়া হয় যেমন আপনি মনে করেন যে, মহানবী (স) যা কিছু করতেন ওহীর আলোকে করতেন-তবে এর অর্থ এই দাড়ায় যে, আল্লাহ তাআলা নিজের পক্ষ থেকে যে ওহী প্রেরণ করতেন তার উপর (নাউযুবিল্লাহ) আশ্বস্ত না হতে পারায় আরেক প্রকারের ওহী নাযিল শুরু হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত এই দুই রং এর ওহী কেন? পূর্বকালে আগত নবীগণের উপর যে ওহী নাযিল হত তাতে কুরআন নাযিল হত তাতে কুরআন নাযিল হওয়ার ইংগিত থাকত। অতএব আপনি যে দ্বিতীয় প্রকার ওহী নাযিল হওয়ার কথা বলেছেন-কুরআন মজীদে তার প্রতি ইংগিত করাটা কি আল্লাহর জন্য খুব কঠিন ব্যাপার ছিল যিনি সব কিছুর উপর শক্তিমান? কুরআনে তো এমন কোন জিনিস আমার নজরে পরড়ছে না। আপনি যদি এ ধরনের কোন আয়াতের দিকে ইংগিত করতে পারেন তবে আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব।”
খুবই সান্ত্বনার কথা। আপনার রায় অনুযায়ী মনে হয় আল্লাহ মিয়া বান্দাদের হেদায়াতের জন্য নয়, বরং নিজের সান্ত্বনার জন্য ওহী নাযিল করতেন এবং তার সান্ত্বনার জন্য বাস এক ধরনের ওহী যথেষ্ট হওয়া প্রয়োজন ছিল।
আপনি তো দুই রং-এর ওহীর কথা শুনেই অস্থির। কিন্তু চোখ মেলে যদি আপনি কুরআন মজীদ পাঠ করে থাকতেন তবে জানতে পারতেন যে, এই কিতাব ছয় রং-এর ওহীর কথা উল্লেখ করেছে-যার মধ্যে শুধুমাত্র এক রং-এর ওহী কুরআন মজীদে সংকলন করা হয়েছে।
“কোন মানুষের এমন মর্যাদা নাই যে, আল্লাহ তার সাথে কথা বলবেন ওহীর মাধ্যমে ব্যতিরেকে, অথবা পর্দার অন্তরাল ব্যতিরেকে, অথবা এমন বার্তাবাহক প্রেরণ ব্যতিরেকে যে তার অনুমতিক্রমে তিনি যা চান তা ব্যক্ত করেন। তিনি সমুন্নত,প্রজ্ঞাময়”-(সূরা শূরা:৫১)।
উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে কোন মানুষের উপর নির্দেশনামা এবং হেদায়াত নাযিল হওয়ার তিনটি পন্থার কথা বলা হয়েছে। সরাসরি ওহী (ইলকা ও ইলহাম), অথবা পর্দার অন্তরাল থেকে কথোপকথন,, অথবা আল্লাহর বার্তাবাহকের(ফেরেশতা) মাধ্যমে ওহী প্রেরণ। কুরআন মজীদে যেসব ওহী সংকলন করা হয়েছে তা উপরোক্ত তিন প্রকারের ওহীর মধ্যে কেবলমাত্র তৃতীয় প্রকারের ওহী। এর বিবরণী আল্লাহ তাআলা সরাসরি কুরআন মজীদেই পেশ করেছেন।
“(হে নবী ) বল, যে কেউ জিবরীলের শত্রু এজন্য যে, সে আল্লাহর নির্দেশে তোমার অন্তরে কুরআন নাযিল করেছে-যা এর পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সমার্থক এবং যা মুমিনদের জন্য পথপ্রদর্শক ও শুভ সংবাদ — আল্লাহ নিশ্চয় কাফেরদের শত্রু”- (শত্রু বাকারা:৯৭-৯৮)।
“তা বিশ্বজাহানের প্রতিপালকের নাযিলকৃত কিতাব। রুহুল আমীন কা নিয়ে তোমার হৃদয়ে অবতীর্ হয়-যাতে তুমি সৎর্ককারী হতে পার” –(সূরা শুআরাঃ ১৯২-৯৪)
এ থেকে জানা গেল যে, কুরআন মজীদ কেবলমাত্র এক প্রকারের ওহীর সংগ্রহ। রসূলূল্লাহ (স) আর যে দুটি উপায়ে হেদায়াত লাভ করতেন যার উল্লেখ সূরা শূরার আয়াতে করা হয়েছে-তা উপরোক্ত ওহী থেকে স্বতন্ত্র। এখন স্বয়ং কুরআন মজীদ আমাদের বলে দিচ্ছে যে, এসব উপায়েও মহানবী (স) হেদায়াত লাভ করতেন।
১. যেমন আমি আপনার চতুর্থ দফার উপর আলোচনা করতে গিয়ে বলে এসেছি-সূরা বাকারার ১৪৩-৪৪ নং আয়াত থেকে পরিষ্কার জানা যায় যে, মসজিদুল হারামকে কিবলা বানানোর পূর্বে মহানবী (স) ও মুসলমানগণ অন্য কোন কিবলার দিকে মুখ করে নামায পড়তেন। আল্লাহ তাআলা কিবলা পরিবর্তনের হুকুম দিতে গিয়ে জোরালো ভাষায় বলেছেন, প্রথম যে কিবলার দেকে মুখ করে নামায পড়া হত তাও আমার হুকুমে নির্ধারিত হয়েছিল। কিন্তু কুরআন মজীদে এমন আয়াত কোথাও নাই যাতে ঐ কিবলার দিকে মুখ করার প্রাথমিক নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। প্রশ্ন হচ্ছে-মহানবী (স) এর উপর কুরআন ব্যতীত আর কোন প্রকারের ওহী না এলে তিনি কি উপায়ে এই হুকুম লাভ করেছিলেন? এ থেকে কি পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হয় না যে, মহানবী (স) এমন নির্দেশও লাভ করতেন যা কুরআন মজীদে উল্লেখ নাই?
২. রসূলুল্লাহ (স) মদীনায় স্বপ্ন দেখেন যে, তিনি মক্কা মুআজ্জমায় প্রবেশ করেছেন এবং বাইতুল্লাহ শরীফ তাওয়াফ করছেন। তিনি সাহাবায়ে কিরামের নিকট এই স্বপ্নের কথা বলেন এবং চৌদ্দশত সাহাবী সাথে নিয়ে উমরা আদায়ের জন্য রওনা হয়ে যান। মক্কার কাফেররা তাঁকে হুদাইবিয়া নামক স্থানে বাধা দেয় এবং তার ফলশ্রুতিতে হুদাইবিয়ার সন্ধি অনুষ্ঠিত হয়। কোন কোন সাহাবীর মনে সংশয় ও অস্থিরতার সৃষ্টি হলে হযরত উমার (রা) প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, হে আল্লাহর রসূল! “আপনি কি আমাদের অবহিত করেননি যে, আমরা মক্কায় প্রবেশ করব এবং তাওয়াফ করব? তিনি বলেন: “আমি কি বলেছিলাম, এই সফরেই তা হবে? এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা কুরআন পাকে আয়াত নাযিল করেনঃ
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর রসূলের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করেছেন, আল্লাহর ইচ্ছায় তোমরা অবশ্যই মসজিদুল হারামে প্রবেশ করবে নিরাপদে-কেউ মাথা কামিয়ে, কেউ চুল ছোট করে। তোমাদের কোন ভয় থাকবে না। আল্লাহ জানেন তোমরা যা জান না। এছাড়াও তিনি তোমাদের দিয়েছেন এক সদ্য বিজয়”-(সূরা ফাতহ:২৭)।
এ থেকে জানা গেল যে, মহানবী (স) কে স্বপ্নের মাধ্যমে মক্কা মুআজ্জমায় প্রবেশের এই পন্থা বলে দেয়া হয়েছে যে, তিনি তার সাহাবীদের নিয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হবেন, কাফেররা বাধা দেবে এবং শেষে সন্ধি স্থাপিত হবে-যার ফলে পরবর্তী বছল উমরা করার সুযোগ পাওয়া যাবে এবং ভবিষ্যত বিজয়ের পথও খলে যাবে। এটা কি কুরআন মজীদ ছাড়াও ভিন্নতর পন্থায় পথনির্দেশনা লাভের সুস্পষ্ট প্রমাণ নয়?
৩. মহানবী (স) তার স্ত্রীদের কোন একজনের নিকট একটি একান্ত গোপন কাথা বলেন। তিনি (স্ত্রী) তা অন্যদের নিকট ফাঁস করে দেন। মহানবী (স) এজন্য তাকে অীভযুক্ত করলে তিনি জিজ্ঞেস করেন, আপনি কিভাবে জানতে পারলেন আমি অন্যদের নিকট একথা বলে দিয়েছি? মহানবী (স) জওয়াব দেন, আমাকে মহাজ্ঞানী ও সর্ব বিষয়ে জ্ঞাত সত্তা (আল্লাহ) অবহিত করেছে।
“যখন নবী তার স্ত্রীদের একজনকে গোপনে কিছু বলেছিল, অতপর সে তা যখন অন্যদের বলে দিয়েছিল এবং আল্লাহ নবীকে তা জানিয়ে দিয়েছিলেন, তখন নবী এই বিষয়ে কিছু ব্যক্ত করল এবং কিছু অব্যক্ত রাখল, যখন নবী তা তার সেই স্ত্রীকে জানালো তখন সে বলল, কে আপনাকে তা অবহিত করল? নবী বলল, আমাকে তিনি অবহিত করেছেন-যিনি সর্বজ্ঞ, সম্যক অবগত”-(সূরা তাহরীম:৩)।
এখন বলুল, কুরআন মজীদে সেই আয়াতটি কোথায় যার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা মহানবী (স) কে অবহিত করেছিলেন যে. তোমার স্ত্রী তোমার গোপন কথা অন্যদের নিকট ফাস করে দিয়েছে? যদি এরূপ কোন আয়াত না থেকে থাকে তবে তি প্রমানিত হল না যে, আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদ ছাড়াও মহানবী (স) এর নিকট পয়গান পাঠাতেন?
৪. মহানবী (স) এর মুখডাকা পুত্র যায়েদ ইবনে হারিসা (রা) নিজ স্ত্রীকে তালাক দেন। অতপর মহানবী (স) তার তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে বিবাহ করেন এটাকে কেন্দ্র করে মুনাফিক ও কাফেররা মহানবী (স) এর বিরূদ্ধে প্রপ্রাগান্ডার এক ভয়ংকর তুফান উত্থিত তরে এবং অভিযোগের পাহাড় দাঁড় করায়। আল্লাহ তাআলা এই অভিযোগের জবাব সূরা আহযাবের একটি পূর্ণ রুকুতে দান করেন এবং এই প্রসঙ্গে লোকদের বলেন, আমার নবী স্বয়ং এই বিবাহ করেননি, বরং আমার নির্দেশে করেছেন।
“অতপর যায়েদ যখন তার (যয়নবের) সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করল তখন আমি তাকে তোমার সাথে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ করলাম যাতে মুমিনদের পোষ্যপুত্রগণ নিজ স্ত্রীর সাথে বিবাহসূত্র ছিন্ন করলে তাদের বিবাহ করায় মুমিনদের কোন বিঘ্ননা হয়”-(সূরা আহযাব:৩৭)।
এ আয়াতে তো উপরোক্ত ঘটনার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে এই ঘটনার পূর্বে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মহানবী (স) কে হুকুম করা হয়েছিল,তুমি যায়েদের তালাকপ্রাপ্তাকে বিবাহ কর, তা কুরআনের কোথায় উল্লেখ আছে?
৫. মহানবী (স) বানূ নাদীর গোত্রের একের পর এক প্রতিশ্রুতি ভংগে অতিষ্ঠ হয়ে মদীনার সংলগ্ন তাদের বসতি এলাকায় সৈন্য পরিচালনা করেন এবং অবরোধ চলাকালীন ইসলামী ফৌজ আশপাশের বাগানসমূহের অনেক গাছগাছালী কেটে ফেলেন যাতে আক্রমণের রাস্তা পরিষ্কার হয়ে যায়। বিরুদ্ধবাদীরা অপপ্রচার চালায় যে, বাগানসমূহ বিরান করে এবং ফলবান বৃক্ষকেটে ফেলে মুসলমানরা জমীনের বুকে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। এর প্রতিবাদে আল্লাহ তাআলা বলেন:
“তোমরা খেজুর গাছগুলো কেটেছ এবং যেগুলো কান্ডের উপর স্থির রেখে দিয়েছ তা তো আল্লহার-ই অনুমতিক্রমে-”(সূরা হাশর:৫)।
আপনি কি বলতে পারেন-এই অনুমতি কুরআন মজীদের কোন আয়াতে নাযিল হয়েছিল?
৬. বদরের যুদ্ধ শেষে গণীমতের মাল বন্টনের প্রশ্ন দেখা দিলে সূরা আল-আনফাল নাযিল হয় এবং তাতে গোটা যুদ্ধের পর্যালোচনা করা হয়। আল্লাহ তাআলা এই পর্যালোচনার সূত্রপাত করেন সেই সময় থেকে যখন মহানবী (স) যুদ্ধের উদ্দেশ্যে বাড়ী থেকে রওনা হয়ে যান এবং এ প্রসঙ্গে মুসলমানদের সম্বোধন করে বলেন:
“এবং আল্লাহ তাআলা যখন তোমাদের প্রতিশ্রুতি দেন যে-দুই দলের (ব্যবসায়ী কাফেলা এবংকুরাইশ সেনাবাহিনী) চাচ্ছিলে নিরস্ত্র দলটি (অর্থাৎ ব্যবসায়ী কাফেলা) তোমাদের আয়ত্তাধীন হোক। আর আল্লাহ চাচ্ছিলেন যে, তিনি সত্যকে তার বাণী দ্ধারা প্রতিষ্ঠিত করেন এবং কাফেরদের নির্মূল করেন-”(সূরা আনফাল:৭)।
এখন আপনি কি সমগ্র কুরআন মজীদ থেকে এমন কোন আয়াতের উল্লেখ করতে পারেন যার মধ্যে আল্লাহ তাআলা এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, মদীনা থেকে বদরের দিকে অভিযাত্রীগণ! আমি দুই দলের এক দল তোমাদের আয়াত্তাধীন করে দেব?
৭. ঐ বদর যুদ্ধের পর্যালোচনা করতে গিয়ে সামনে অগ্রসর হয়ে ইরশাদ হচ্ছে;
“তোমরা যখন তোমাদের প্রতিপালকের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করছিলে তখন তিনি তা কবুল করেছিলেন এবং বলেছিলেন-আমি তোমাদের সাহায্যের জন্য একাধারে এক হাজার ফেরেশতা পাঠাব”-(সূরা আনফাল:৯)।
আপনি কি বলতে পারেন যে, আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মুসলমানদের দোয়ার এই উত্তর কুরআন মজীদের কোন আয়াতে নাযিল হয়েছিল?
আপনি মাত্র একটি উদাহরণ চাচ্ছিলেন। আমি আপনার সামনে কুরআন মজীদে থেকে সাতটি উদাহরণ পেশ করলাম যার সাহায্যে প্রমাণিত হয় যে, মহানবী (স) এর নিকট কুরআন মজীদ ছাড়াও ওহী আসৎ। এরপর আরো আলোচনা সূত্রপাত করার পূর্বে আমি দেখতে চাই যে, আপনি সত্যের সামনে মাথা নত করতে প্রস্তুত কি না?
তরজমানুল কুরআন, অক্টোবর ও নভেম্বর ১৯৬০ খৃ.।
বিনীত
আবুল আ‘লা