নবূওয়াতের পদমর্যাদা
[পূর্ববর্তী পৃষ্ঠাগুলোতে সুন্নাতের আইনগত মর্যাদা সম্পর্কে ডকটর আবদুল ওয়াদূদ সাহেব ও প্রবন্ধকারের মধ্যে যে পত্রবিনিময় হয় তা পাঠকগণের গোচরিভূত হয়েছ। এ সম্পর্কে ডকটর সাহেবের আরও একটি পত্র হস্তগত হয়েছে, যা নিম্নেগ্রন্থকারের জওয়াবসহ উল্লেখ করা হল]।
ডকটর সাহেবের পত্র
মুহাতারাম মাওলানা!
আসসালামু আলাইকুম। ৮আগষ্ট আপনার চিঠি পেয়েছি। আশা করি এরপর কিছুটা প্রসন্নতার সাথেই কথা বলা যাবে। আপনার ২৬ জুনের জত্রে আমার প্রথম পত্রের জওয়াবের সমাপ্তিতে আপনি বলেছিলেন:
“পরের প্রশ্নগুলো উত্থাপনের পূর্বে আপনার একথা পরিষ্কারভাবে বলা দারকার ছিল যে, রসূলুল্লাহ (স) কুরআন মজীদ পাঠ করে শুনিয়ে দেয়া ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনও কাজ করেছিলেন কিন, যদি করে থাকেন তবে কি হিসাবে?”
অনন্তর একথাও লিখেছিলেনঃ “প্রথমে আপনাকে পরিষ্কার বলতে হবে যে, রসূলুল্লাহ (স) -এর সুন্নাত স্বয়ং কোন জিনিস কি না? তাকে আপনি কুরআনের পাশাপাশি আইনের উৎস হিসাবে মানেন কি না, যদি না মানেন তার পেছনে আপনার যুক্তি কি?”
অতএব আমার বর্তমান পত্রে আলোচ্য বিষয়ের কেবল এই অংশ সম্পর্কে কথা বলাই যুক্তিসংগত মনে হচ্ছে। আর এর অবশিষ্ট অংশের আলোচনা ভবিষ্যতের জন্য মুলতবি রাখলাম। আপনার হয়ত মনে আছে, সুন্নাতের বাস্তব গুরুত্বকে না অস্বীকার করি, আর না তার গুরুত্বকে খতম করার কোন উদ্দেশ্য আমার আছে।”
অতএব “আমার মতে রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাত স্বয়ং কোন জিনিস কি না”-আপনার এরূপ প্রশ্ন অপ্রয়োজনীয়। অবশ্য সুন্নাত বলতে যা বুঝায় এ ব্যাপারে আপনার সাথে আমার মতবিরোধ আছে। এখন অবশিষ্ট থাকল এই প্রশ্ন যে, আমি সুন্নাতকে কুরআনের পাশাপাশি আইনের উৎস হিসাবে স্বীকার করি কি না? এ প্রসংগে আমার উত্তর নেতিবাচক। আপনি জিজ্ঞেস করেছেন, এর সপক্ষে আমার প্রামণ কি? প্রথমে আমাকে একথা পরিষ্কার করবার অনুমতি দিন যে, রসূলুল্লাহ (স) কুরআন মজীদ পাঠ করে শুনানো ছাড়া দুনিয়াতে আরও কোন কাজ করেছেন কিনা? যদি করে থাকেন তবে কি হিসাবে? এর উত্তর সামনে এসে গেলে সাথে সাথে যুক্তিপ্রমাণও সামনে এসে যাবে।
আমি আপনার সাথে শতকরা একশো ভাগ একমত যে, মহানবী (স) শিক্ষক ছিলেন, বিচারকও ছিলেন, সেনাপতিও। তিনি লোকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকদের একটি সুসংগঠিত জামাআতও প্রতিষ্ঠা করেছেন, অতপর একটি রাষ্ট্রও কায়েম করেছেন ইত্যাদি। কিন্তু আপনার একথার সাথে আমি একমত নই যে, “তেইশ বছরের নবূওয়াতী জীবনে রসূলুল্লাহ (স) যা কিছু করেছেন তা সেই সুন্নাত যা কুররআনের সাথে মিলিত হয়ে সর্বোচ্চ বিধানদাতার মহান আইনের গঠনও পূর্ণতা প্রদান করে।”
নিসন্দেহে মহানবী (স) সর্বোচ্চ বিধানদাতার আইন অনুযায়ী সমাজ সংগঠন করেছেন, কিন্তু আল্লাহর কিতাবের আইন (ন্উাযুবিল্লাহ) অসম্পূর্ণ ছিল এবং মহানবী (স) কার্যতক যা কিছু করেছেন তার দ্বারা এই আইন পূর্ণতা লাভ করে, এ কথা আমার বোধগম্য নায়। আমার মতে ওহী প্রাপ্তির ধারাবাহিকতা মহানবী (স) এর সাথে চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু রিসালাতের দায়িত্ব যা রসূলুল্লাহ (স) সম্পাদন করেছেন তার উদ্দেশ্য এই ছিল যে, মহানবী (স)-এর পরেও তাঁর পদাংক অনুসরণে সমাজ পরিচালনা করা যেতে পারে এবং এই ধারা অব্যাহত থাকবে। মহানবী (স) যদি আল্লাহ যা নাযিল করেছেন)-অন্যদের নিকট পৌছে দিয়ে থাকেন, তবে উম্মাতের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে কে অন্যদের পর্যন্ত পৌছে দেয়া। মহানবী (স) যদি “আল্লাহ যা নাযিল করেছেন” অনুযায়ী জামাআত গঠন করে থাকেন, রাষ্ট কায়েম করে থাকেন এবং আমর বিল-মা‘রূফ ওয়া নাহী আনিল-মুনকার (সত্যন্যায়ের আদেশ এবং অন্যায় ও অসত্যের প্রতিরোধ)-এর দায়িত্ব পালন করে থাকেন তবে উম্মাতেরও কর্তব্য হচ্ছে, ঠিক এভাবে কাজ করা। মহানবী (স) যদি “আল্লাহ যা নাযিল করেছেন“ তদনুযায়ী বিভিন্ন বিষয়ের মীমাংসা করে থাকেন তবে উম্মাতকেও
“আল্লাহ যা নাযিল করেছেন” তদনুযায়ী মীমাংসা করতে হবে। মহনবী (স) যদি (‘কাজকর্মে তাদের সাথে পরামর্শ কর’) অনুযায়ী রাষ্টীয় কার্যবলী পরামর্শের ভিত্তিতে পরিচালনা করে থাকেন তবে উম্মাতও তাই করবে। মহনবী (স) যদি তেইশ বছরের নবূওয়াতী জীবনে যুদ্ধ সমূহে ঘোড়ার পিঠে অতিবাহিত করে থাকেন তবে উম্মাতও ঐসব মূলনীতি সামনে রেখে যুদ্ধ করবে।
অতএব “আল্লাহ যা নাযিল করেছেন” তদনুযায়ী উম্মাত যদি প্রশিক্ষণ,সংগঠন, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, পরামর্শ, বিচার, যুদ্ধসংগ্রাম প্রভৃতি কাজ করে তবে তা রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাতেরইড অনুসরণ। মহানবী (স)-ও তাঁর যুগের দাবী অনুযায়ী “আল্লাহ যা নাযিল করেছেন” তদনুযায়ী আমল করে সমাজ গঠন করেন। আর রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাতের অনুসরণ হচ্ছে এই যে, প্রতিটি যুগের উম্মাত নিজ যুগের দাবী অনুযায়ী “আল্লাহ যা নাযিল করেছেন” তদনুযায়ী আমল করে সমাজ গঠন করবে। বর্তমান সময়ে আমরা যে ধরনের সরকার ব্যবস্থা পরিবেশ, পরিস্থিতি এবং বর্তমানের দাবী অনুযায়ী উপযুক্ত মনে করব তদ্রুপ সরকার গঠন করব। কিন্তু “আল্লাহ যা নাযিল করেছেন” তার চৌহদ্দির মধ্যে অবস্থান করে তা করতে হবে। এটাই হচ্ছে রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাতের উপর আমল। আমরা এই উদ্দেশ্য সামনে রেখে “আল্লাহ যা নাযিল করেছেন” শীর্ষক আয়াত যা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, তদনুযায়ী যদি যুদ্ধ করি তবে এটা হবে রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাতের উপর আমল।
সুনানাতের অর্থ যদি এই হয়, যেমন এক মৌলভী সাহেব একটি স্থানীয় পত্রিকায় গত সপ্তাহের লিখেছিল যে, হযরত উমার (রা)-র সেনাবাহিনীর একটি দুর্গ দখলে এজন্য বিলম্ব হচ্ছিল যে, সৈনিকগণ কয়েক দিন ধরে মেসওয়াক করেননি, অথবা আজকের আনবিক যুগে যুদ্ধক্ষেত্রে তীরের ব্যবহার সুন্নাত অর্থে অত্যাবশ্যকীয় হয়ে থাকে, কারণ মহানবী (স) যুদ্ধের সময় তীর ব্যবহার করেছেলেন, তবে মহানবী (স) এর সুন্নাতের সাথে এর চেয়ে অধিক উপহাসের বিষয় আর কি হতে পারে!
উপরোক্ত সমস্ত কাজে মহানবী ( স) তেইশ বছরের নবূৗয়াতী জীবনে যার অনুসরণ করেছেন তা আল্লাহর কিতাবে বর্তমান-রই অনুসরণ করেছেন এবং উম্মাতকেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারাও এর অনুসরণ করবে। যেখানে (“তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট যা নাযিল করা হয়েছে-তোমরা তার অনুসরণ কর”- আ‘রাফ: ;৩) বলে উম্মাতের সদস্যদের অনুপ্রাণিত করা হয়েছে, সেখানে এই ঘোষণাও দেয়া হয়েছে যে, মহনবী (স)-ও এর অনুসরণ করেন “বল, আমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আমার নিকট যে ওহী করা হয় আমি তো শুধু তারই অনুসরণ করি”-(আরাফ:২০৩)। না জানি আপনি কোন সব কারণের ভিত্তিতে আল্লাহর কিতাবের বিধানকে অসম্পূর্ণ বলেছেন। অন্তত আমার দেহে তো এই ধারণাও কম্পন সৃষ্টি করে। আপনি কি কুরআন মজীদ থেকে এমন কোন আয়াত পেশ করতে পারেন যা থেকে জানা যাবে যে, কুরআনের বিধান অসম্পূর্ণ? আল্লাহ তাআলা তো মানবজাতির পথ প্রদর্শনের জন্য শুধুমাত্র একটি আইন বিধানের দিকেই ইংগিত প্রদান করেছেন, যা সংশয় সন্দেহের উর্ধে,বরং তার শুরুই হয়েছে নিম্নোক্ত বাক্যর দ্বারা- “এটা সেই কিতাব, এত কোন সন্দেহ নাই।” আবার জীবনের যাবতীয় বিষয়ের ফয়সালার জন্য এই জীবন-বিধানের দিকে প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং এটাও পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে, এই আইন-বিধান ব্যাপক ও বিস্তারিত।
“তবে কি আমি আল্লাহ ব্যতীত অন্যকে সালিশ মানব-যদিও তিনিই তোমাদের প্রতি সুস্পষ্ট কিতাব নাযিল করেছেন?”-(আনআম:১১৪)।
বরং মুমিন ও কাফেরের মধ্যে এই পার্থক্য রাখা হয়েছে যে-
“আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তদনুযায়ী যারা বিধান দেয় না তরাই কাফের”- (মায়েদা:৪৪)।
কুরআন মজীদকে (মহিমাময় গ্রন্থ) বলে কি সম্বোধন করা হয়নি? (সত্য ও ন্যায়ের দিক দিয়ে তোমার প্রতিপালকের বাণী সম্পূর্ণ”)- এর ঘোষণা কি একাথা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট নয় যে, আল্লাহর বিধান পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়েছে? আর যা কিছু অবশিষ্ট ছিল তা পূণৃ হয়ে গেছে। কাফেররাও তো এই কিতাব ছাড়া কোন জিনিস নিজেদের সান্ত্বনার জন্য আশা করত,যখন আল্লাহ তা‘আলা বললেন যে, এই কিতাব কি তাদের জন্য যথেষ্ট নয়?
“এটা কি তাদের জন্য যথেষ্ট নয় যে, আমি তোমার উপর কিতাব নাযিল করেছি যা তাদের নিকট পাঠ করা হয়?-(আনকাবূত:৫১)।
একথা আমি তীব্রভাবে অনুভব কারছি যে, দীনের দাবী যেহেতু এই ছিল যে, সামগ্রিকভাবে কিতাবের উপর আমল হবে এবং এটা হতে পারে না যে, প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ নিজ বুঝ অনুযায়ী কুরআনের উপর আমল করবে। তাই সার্বিক ব্যবস্থা কায়েম রাখার জন্য একজন জীবিত ব্যক্তির প্রয়োজন এবং আমি এও অনুভব করি যে, সেখানে সামগ্রিক ব্যবস্থা কায়েমের প্রশ্ন রয়েছে-সেই লক্ষ্যে যে ব্যক্তি পৌছিয়ে দেন তার স্থান ও মর্যাদা অনেক উপরে। কারণ তিনি পয়গাম এজন্য পৌছে দেন যে,ওহী তিনি ছাড়া আর কারো কাছে আসে না। সুতরাং কুরআন মজীদ এজন্য পরিষ্কার করে দিয়েছে যে- “ কেউ রসূলের আনুগত্য করলে সে তো আল্লাহরই আনুগত্য করল“-(নিসা:৮০)। অতএব রসূলুল্লাহ (স) উম্মাতের কেন্দ্রবিন্দুও ছিলেন। আর রসূলুল্লাহ (স)-এর পরেও এই কেন্দ্রিকতাকে কয়েম রাখা হবে। অতএব এই বিষয়টি কুরআন মজীদ নিম্নোক্ত বাক্যে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছে-
“মুহাম্মদ একজন রসূল মাত্র, তার পূর্বে রসূলগণ গত হয়েছে। অতএব যদি সে মারা যায় অথবা নিহত হয় তবে তোমরা কি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে?”-(আল-ইমরান:১৪)
প্রকাশ থাকে যে, আমর বিল-মারূফ ওয়া নাহয়ু আনিল মুনকার এর ধারাবাহিকতা (যদি এর উদ্দেশ্য ওয়াজ-নসীহত না হয়) এই অবস্থায় কয়েম থাকতে পারে যে, রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাতের উপর আমল করার মাধ্যমে জাতির কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতাকে অব্যাহতভাবে কার্যকর রাখা হবে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, যে আইন-ব্যবস্থার উপর চালানো মহানবী (স) এর উদ্দেশ্য ছিল এবং ভবিষ্যত উম্মাতের কেন্দ্রের উদ্দেশ্য হবে, এই আইন ব্যবস্থাকে অসম্পূর্ণ করা হবে।
আপনার আগের প্রশ্ন এই যে, মহানবী (স) তেইশ বছরের নবূওয়াতী জীবনে যে কাজ করেছেন তাতে তাঁর মর্যাদা কি ছিল? আমার উত্তর এই যে, মহানবী (স) যা কিছু করে দেখিয়েছেন তা একজন মানুষ হিসাবে, কিন্তু “যা আল্লাহ নাযিল করেছেন” তদনুযায়ী করে দেখিয়েছেন। মহানবী (স)-এর রিসালাতের দায়িত্ব সম্পাদন ছিল ব্যক্তি হিসাব, আমার এই উত্তর আমার নিজের মনমগজ প্রসূত নয়, বরং আল্লাহর কিতাব থেকে এর প্রমাণ পাওয়াম যায়। মহানবী (স) বারবার একথার উপর জোর দিয়েছেন যে, (‘আমি তোমাদের মতই মানুষ’)। কুরআনের আয়াত থেকে পরিষ্কার জানা যায় যে, রাষ্টীয় ব্যবস্থা পরিচালনার ক্ষেত্রে মহানবী (স)-এর মর্যাদা ছিলঃ একজন ব্যক্তি হিসাবে এবং কখনও কখনও তাঁর ইজতিহাদী ভুলও হয়ে যেত।
“বল! আমি বিভ্রান্ত হলে বিভ্রান্তির পরিণাম আমারই এবং যদি আমি সৎপথে থাকি তবে তা এজন্য যে, আমার নিকট আমার প্রতিপালক ওহী প্রেরণ করেন। তিনি সর্বশ্রোতা,অতীব নিকটে”-(সাবা:৫০)।
দীন ইসলামের কোন গুরুত্বপূর্ন বিষয়ের উপর প্রভাব বিস্তার করার মত ইজতিহাদী ভুল হয়ে গেলে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তার সংশোধনীও এসে যেত। যেমন এক যুদ্ধের প্রাক্কালে কতিপয় লোক যুদ্ধে যোগদান না করে পেছনে থেকে যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করল এবং মহানবী (স)-ও অনুমতি প্রদান করলেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নাযিল হলঃ
“আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করেছেন। কারা সত্যবাদী তা তোমার নিকট স্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত এবং কারা মিথ্যাবাদী তা না জানা পর্যন্ত তুমি কেন তাদের অব্যাহতি দিলে?”(তওবা:৪৩)।
অনুরূপভাবে সূরা তাহরীমেও সংশোধনী এসেছে:
“ হে নবী ! আল্লাহ তোমার জন্য যা বৈধ করেছেন তুমি তা নিষিদ্ধ করছ কেন?-” (তাহরীম:১)
অনুরূপভাবে সূরা আবাসায়:
“ সে ভ্রু কুঞ্চিত করল এবং মুখ ফিরিয়ে নিল। কারণ তার নিকট অন্ধ লোকটি এসেছে। তুমি কেমন করে জানবে, সে হয়ত পরিশুদ্ধ হত, অথবা উপদেশ গ্রহণ করত, ফলে উপদেশ তার উপকারি আসৎ। পক্ষান্তরে যে পরোয়া করে না তুমি তার প্রতি মনোযোগ দিয়েছ। অথচ সে নিজে পরিশুদ্ধ না হলে তোমার কোন দায়িত্ব নাই। পক্ষান্তরে যে তোমার নিকট ছুটে এলো এাবং সে সশংকচিত্ত, তুমি অবজ্ঞা করলে“-(আয়াত নং ১-১০)।
উপরোক্ত আলোচনা প্রতিভাত হল যে, ওহীর আলোকে রাষ্ট্রীয় কার্যাবলী পরিচালনার ক্ষেত্রে আনুষংগিক বিষয়াদিতে রসূলুল্লাহ (স)-এর ইজতিহাদী ভুলও হয়ে যেত। আর মহনবী (স) মানুষ হিসাবে এসব কাজ সম্পাদন করার ক্ষেত্রেই এরূপ হওয়া সম্ভব ছিল। যদি এরূপ না হত তবে এর দুটি অবশ্যম্ভাবী পরিণতির সৃষ্টি হত।
প্রথমত এই ধারণা যে, মহানবী (স) যা কিছু করেছেন তা যেহেতু নবী হিসাবে করেছেন তাই সাধারণ মানুষের পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। সুতরাং আজও নিরাশার জগতে কোন স্থানে এই ধারণা পাওয়া যাচ্ছে যে, মহানবী (স) যে সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা সাধারণ মানুষের সাধ্যাতীত এবং তা পুর্নবার কায়েম করা সম্ভব নয়। এই ধারণা স্বয়ং রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাতের অনুসরণ নাকচ করে দেয়।
এর দ্বিতীয় পরিণতি এই ধারণার আকারে প্রকাশ পেতে পারে যে, এজন্য মহানবী (স)-এর পরেও নবীগণের আগমন অত্যাবশ্যক-যাতে তারা পুর্নবার এই ধরনের সমাজ কায়েম করতে পারেন যেহেতু সাধারণ মানুষের পক্ষে তা সম্ভব নয়)।
আপনি নিজেই চিন্তা করুন যে, এই দুটি পরিণতি কত ভয়াবহ যা এই ধারণার ফলশ্রুতি হিসাবে আত্মপ্রাকাশ করে সামনে আসছে যে, মহানী (স) যা কিছুই করেছেন একজন নবী হিসাবেই করেছেন। খতমে নবূওয়াত (নবূওয়াতের পরিসমাপ্তি) মানবতার পরিভ্রমণ পথে একটি মাইল-ফলকের মর্যাদা সম্পন্ন। এখানে থেকে ব্যক্তিত্বের যুগ শেষ হয়ে যায় এবং মূলনীতি ও মূল্যবোধের যুগ শুরু হয়। সুতরাং “মহানবী (স) যা কিছু করেছেন একজন নবী হিসাবে করেছেন” এই ধারণা খতমে নবূওয়াতের মূলনীতি প্রত্যাখ্যানের কারণ হয়ে দাঁড়ায় (মুহাম্মদ একজন রসূলমাত্র-৩: ১৪৪)-এর মত সুস্পষ্ট আয়াত থাকতে একথা বলা যে, রসূলুল্লাহ (স) যা কিছু করতেন ওহীর আলোকেই করতেন [এবং ওহীর ধারাবাহিকতা মহানবী (স)-এর সত্তার সাথে শেষ হয়ে গেছে]-এই কথারই সুস্পষ্ট ঘোষণা যে, মহানবী (স) এর পর দীন ইসলামের ধারাবাহিকতা কায়েম থাকতে পারে না। খলীফাগণ উত্তমরূপেই বুঝতেন যে, ওহী আল-কিতাব এর মধ্যে সংরক্ষিত আছে এবং এরপর মহানবী (স) যা কিছু করতেন পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে করতেন। তাই তাঁর ইন্তেকালের পর প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার মধ্যে কোন পরিবর্তন আসতে পারেনি। রাষ্ট্রের সীমা বর্ধিত হওয়ার সাথে সাথে প্রয়োজনের তালিকাও দীর্ঘ হতে থাকে। সামনের দিনগুলোতে নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভব হতে থাকে। এর সমাধানের জন্য পূর্বের কোন সিদ্ধান্ত পাওয়া গেলে এবং তার মধ্যে পরিবর্তনের প্রয়োজন না হলে খলীফাগণ তাকে সঅসস্থায় বহাল রাখতেন। আর যদি পরিবর্তনের প্রয়োজন হতে তবে পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন্ এসব কিছুই কুরআনের আলোকে করা হত। এটা রসূলুল্লাহ (স)-এর প্রদর্শিত পন্থাই ছিল এবং তাঁর স্থলাভিষিক্তগণও তা কায়েম রাখেন। এরই নাম ছিল রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাতের অনুসরণ।
যদি ধরে নেয়া হয়, যেমন আপনি বলেন যে, মহানবী (স) কিছু করতেন ওহীর আলোকে করতেন, তবে এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে, আল্লাহ তাআলা নিজের পক্ষ থেকে যে ওহী প্রেরণ করতেন তার উপর (ন্উাযুবিল্লাহ)আশ্বস্ত না হতে পারায় আরেক প্রকারের ওহী নাযিল শুরু হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত এই দুই রংগের ওহী কেন? পূর্বে আগত নবীগনের উপর যে ওহী নাযিল হত তাতে কুরআন নাযিল হওয়ার ইংগিত থাকত। অতএব আপনি যে দ্বিতীয় প্রকারের ওহীর কথা বলছেন,কুরআন মজীদে তার দিকে ইংগিত করাটা কি আল্লাহর জন্য খুব কঠিন ব্যাপার ছিল, যিনি সব কিছুর উপর শক্তিমান? কুরআনে তো এমন কোন জিনিস আমার নজরে পড়ছে না। আপনি যদি এ ধরনের কোন আয়াতের দিকে ইংগিত করতে পারেন তবে আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব। ওয়াসসালাম।
অকৃত্রিম
আবদুল ওয়াদূদ
প্রবন্ধকারের জবাব
মুহতারামী ওয়া মুকাররামী
আসসালামু আলঅইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ। ১৭ আগষ্ট, ১৯৬০ খৃ. আপনার পত্র হস্তগত হয়েছে। সদ্য প্রাপ্ত এই পত্রে আপনার পূর্বেকার চারটি প্রশ্নের মধ্যে প্রথম প্রশ্নের উপর আলোচনা সীমাবদ্ধ রেখে নবূওয়াত ও সুন্নাত সম্পর্কে আপনার যে অভিমত ব্যক্ত করেছেন তা থেকে একথা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, আপনার নবূওয়াত সম্পর্কিত ধারণাই মৌলিকভাবে ভ্রান্ত। প্রকাশ থাকে যে, ভিত্তির মধ্যেই যদি গলদ থাকে তবে এই ভিত্তির সাথে সংশ্লিষ্ট পরের প্রশ্নগুলোর উপর আলোচনা করে আমরা কোন সিদ্ধান্তে পৌছতে পারছি না। এজন্যেই আমি আবেদন করেলিলাম যে, আপনি আমার প্রদত্ত উত্তরের উপর আরো প্রশ্ন উত্থাপন করার পরিবর্তে আমার উত্তরের মধ্যে উল্লেখিত আসল বিষয়ের উপর বক্তব্য রাখুন। আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ যে, আপনি আমার এই আবেদন গ্রহণপূর্বক সর্বপ্রথম মৌলিক প্রশ্নের উপর নিজের অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এখন আমি আপনার এবং যেসব লোক এই ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত আছেন তাদের কিছু খেদমত করার সুযোগ পাব।
নবূওয়াত ও সুন্নাতের যে ধারণা ব্যক্ত করেছেন তা কুরআন মজীদের নিত্যন্ত ক্রটিপূর্ন অধ্যয়নেরই ফল। সবচেয়ে বড় বিপদ এই যে, আপনি এই নেহায়েত ক্রটিপূণৃ ও স্বল্প অধ্যয়নের উপর এতটা নির্ভর করে বসে আছেন যে, ১ম হিজরী শতক থেকে আজ পর্যন্ত এ সম্পর্কে গোটা উম্মাতের আলেম সমাজ ও সর্বসাধারণের যে ঐক্যবদ্ধ আকীদা ও কার্যক্রম চলে আসছে তাকে আপনি ভ্রান্ত মনে করে বসেছেন এবং আপনি নিজের কাছে এই ধারণা করে বসে আছেন যে, পৌনে চৌদ্দশত বছরের দীর্ঘ সময়ব্যাপী সমস্ত মুসলমান মহানবী (স) এর পদমর্যাদা অনুধাবন করার ব্যাপারে হোঁচট খেয়েছে, তাদের সমস্ত আইনজ্ঞ আলেম সুন্নাতকে আইনের উৎস মেনে নিয়ে ভুল করেছেন এবং তাদের সমগ্র সাম্রাজ্য নিজের আইন-ব্যবস্থার ভিত্তি সুন্নাতের উপরন রেখে ভ্রান্তির শিকার হয়েছে। আপনার এই ধারণার উপর বিস্তারিত আলোচনা তো সামনে অগ্রসর হয়ে করব। কিন্তু এই আলোচনা শুরু করার পূর্বে আমি চাচ্ছি যে, আপনি শান্ত মনে আপনার দীনী জ্ঞানের পরিমাণটা স্বয়ং যাচাই করুন এবং নিজেই চিন্তা করুন যে, এ সম্পর্কে আপনি যতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছেন তা কি এতবড় একটি ধারণার জন্য যথেষ্ট? কুরআন মজীদ তো কেবল আপনি একাই পড়েননি, কোটি কোটি মুসলমান প্রতিটি যুগে এবং পৃথিবীর প্রতিটি অংশে তা অধ্যয়ন করেছেন এবং এমন অসংখ্য ব্যক্তিত্ব ইসলামের ইতিহাসে অতীত হয়েছেন এবং আজও পাওয়া যাচ্ছে, যাদের জন্য কুরআনের অধ্যয়ন তাদের অসংখ্য ব্যস্তাতার মধ্যে একটি আনুষংগিক (গৌন) ব্যস্ততা ছিল না, বরং তারা নিজেদের গোটা জীবন কুরআনের এক একটি শব্দ সম্পর্কে চিন্তা করার মধ্যে, তার অন্তর্নিহিত ভাব হৃদয়ংগম করায় এবং তার থেকে সিদ্ধান্ত বের করায় অতিবাহিত করে দিয়েছেন এবং এখনও করছেন। শেষ পর্যন্ত আপনি কিভাবে এই ভ্রান্তির শিকার হলেন যে, নবূওয়াতের মত গুরূত্বপূর্ন মৌলিক বিষয়ে এসব লোক কুরআন মজীদের উদ্দেশ্যে সম্পূর্ণ উল্টা বুঝেছেন এবং সঠিক উদ্দেশ্য কেবল আপনার নিকট ও আপনার মত গুটিকয়েক ব্যক্তির সামনে উদ্ভাসিত হয়েছে? গোটা ইসলামের ইতিহাসে আপনি উল্লেখযোগ্য একজন আলেমের নামও নিতে পারবেন না যিনি কুরআন মজীদের আলোকে নবূওয়াতের পদমর্যাদা সম্পর্কে আপনার অনুরূপ ধারণা ব্যক্ত করেছেন এবং সুন্নাতের মর্যাদাও আপনার অনুরূপ সাব্যস্ত করেছেন। আপনি যদি এ ধরনের কোন একজন আলেমেরও বরাত দিতে পারেন তবে অনুগ্রহপূর্বক তার নামটা বলে দিন।
১.নবূওয়াতের পদমর্যাদা ও তার দায়িত্ব
আপনার বুদ্ধি ও বিবেকের নিকট এই অকৃত্রিম আবেদন করার জর এখন আমি আপনার পেশকৃত ধারণা সম্পর্কে কিছু আরজ করব। আপনার গোটা আলোচনা দশটি দফা সম্বলিত। তার মধ্যে প্রথম দফা স্বয়ং আপনার বাক্য অনুযায়ী এই যে:
“আমি আপনার সাথে শতকরা একশো ভাগ একমত যে, মহানবী (স) শিক্ষকও ছিলেন, বিচারকও ছিলেন এবং সেনাপতিও। তিনি লোকদের প্রশিক্ষণ দেয়েছেন এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের নিয়ে একটি সুসংগঠিত জামাআতও প্রতিষ্ঠা করেছেন, অতপর একটি রাষ্ট্রও কায়েম করেছেন।”
আপনি যে শতকরা ১০০% ভাগ ঐক্যমতের কথা বলেছেন তা মূলত শতকরা একভাগ বরং হাজারের একভাগওনয়। কারণ আপনি মহানবী (স) কে শুধুমাত্র শিক্ষক, বিচারক, রাষ্ট্রপ্রধান ইত্যাদি মেনে নিয়েছেন,কিন্তু আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত’ হওয়ার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যসহ মানেননি। অথচ এই বৈশিষ্ট্য স্বীকার করা বা না করার করণেই সমস্ত পার্থক্য সৃষ্টি হচ্ছে। সামনে অগ্রসর হয়ে আপনি নিজেই একথা পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে, আপনার মতে মহানবী (স) এই সমস্ত কাজ রসূল হিসাব নয় বরং একজন সাধারণ মানুষ হিসাবে করেছেন। আর একারণেই সাধারণ মানুষ হিসাবে তিনি যেসব কাজ করেছেন তাকে আপনি সেই সুন্নাত বলে স্বীকার করেন না যা আইনের উৎস হিসাবে গণ্য। অন্য কথায় মহানবী (স) আপনার মতানুযায়ী একজন শিক্ষক ছিলেন, কিন্তু আল্লাহ তাআলার নিয়োগকৃত নয়, বরং দুনিয়াতি যেমন অন্যান্য শিক্ষক হয়ে থাকে তিনিও তদ্রুপ একজন শিক্ষক ছিলেন। অনুরূপভাবে তিনি বিচারকও ছিলেন,কিন্তু আল্লাহ তাআলা নিজের পক্ষ থেকে তাকে বিচারক নিয়োগ করেননি, বরং তিনিও দুনিয়ার সাধারণ বিচারকদের ন্যায় একজন বিচারক ছিলেন। শাসক, সংস্কারক নেতা ও পথপ্রদর্শকের ক্ষেত্রেও আপনি একই দৃষ্টিভংগী গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে কোন পদই আপনার ধারণায় মহানবী (স) আল্লাহর পক্ষ থেকে ‘দায়িত্ব প্রাপ্ত’ হিসাবে লাভ করেননি।
প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে মহানবী (স) এই পদগুলো কিভাবে লাভ করলেন? মক্কার ইসলাম গ্রহণকরী লোকের কি স্বেচ্ছায় তাকে নিজেদের নেতা নির্বাচন করেছিল এবং তারা নেতৃত্বের এই পদ থেকে তাকে পদচ্যুত করারও অধিকারী ছিল? মদীনায় পৌছে যখন ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করা হল, সেই সময় কি আনসার ও মুহাজিরগণ কোন পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম আমাদের এই রাষ্ট্রের কর্ণধার, প্রধান বিচারপতি এবং সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হবেন? মহানবী (স) এর বর্তমানে কি অপর কোন মুসলমান এসব পদের জন্য নির্বাচিত হতে পারত? মহানবী (স) এর নিকট থেকে এসব পদ অথবা এর মধ্যে কোন একটি পদ ফেরত নিয়ে কি মুসলমানগণ পারস্পরিক পরামর্শেরভিত্তিতে অপর কাউকে প্রদান করার অধিকারী ছিল? তাছাড়া এমন কিছুও ঘটেছে কি যে, মদীনার এই রাষ্ট্রের জন্য কুরআন মজীদের আওতায় ব্যাপক বিধানও সংবিধান রচনার উদ্দেশ্যে মহানবী (স) এর যুগে কোন আইন পরিষদ গঠন করা হয়েছিল যেখানে তিনি তার সাহবীগণের সাথে পরামর্শের ভিত্তিতে কুরআন মজীদের উদ্দেশ্য অনুধাবনের চেষ্টা করে থাকবেন এবং পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কুরআনের যে অর্থ নির্দিষ্ট হয়ে থাকত তদনুযায় আইন-কানূন রচিত হয়ে থাকবে? এসব প্রশ্নের উত্তর যদি ইতিবাচক হয় তবে অনুগ্রহপূর্বক তার কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ পেশ করুন। আর যদি নেতিবাচক হয় তবে অনুগ্রহপূর্বক তার কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ পেশ করুন। আর যদি নেতিবাচক হয় তবে আপনি কি বলতে চান যে, মহানী (স) গায়ের জোরে নিজেই পথপ্রদর্শক, রাষ্টপ্রধান,বিচারপতি,আইনপ্রণেতা ও মহান নেতা হয়ে বসেছেন?
দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো,মহানবী (স) এর যে মর্যাদা আপনি সাব্যস্ত করছেন কুরআন মজীদও কি তার অনুরূপ মর্যাদা সাব্যস্ত করে? এ প্রসংগে একটু কুরআন শরীফ খুলে তার ভাষ্য দেখুন।
রসূলুল্লাহ (স) শিক্ষক ও মুরুব্বী হিসাবে
এই পবিত্র কিতাবে চার স্থানে মহানবী (স) এর রিসালাতের পদমর্যাদা সম্পর্কে নিম্নোক্ত বক্তব্য রয়েছে:
“স্মরণ কর, ইবরাহীম ও ইসমাঈল যখন এই (কা’বা) ঘরের প্রাচীর নির্মাণ করছিল (তখন এই বলে তারা দোয়া করেছিল:) —- হে খোদা ! এদের নিকট এদের জাতির মধ্য থেকেই এমন একজন রসূল প্রেরণ কর, যিনি তাদেরকে তোমার আয়াতসমূহ পাঠ করে শুনাবেন, তাদেরকে কিতাব ও জ্ঞানের শিক্ষা দান করবেন এবং তাদের বাস্তব জীবনকে পরিশুদ্ধ করবেন” (বাকারা:১২৭-২৯)।
“ যেমন আমি তোমাদের নিকট স্বয়ং তোমাদের মধ্য থেকে একজন রসূল পাঠিয়েছি-যে তোমাদের আয়াত পাঠ করে শুনায়, তোমাদের জীবন পরিশুদ্ধ করে, তোমাদের কিতাব ও হিকমতের জ্ঞান দান করে এবং তোমরা যে জ্ঞান সম্পর্কে কিছুই জানতে না তা তোমাদের শিক্ষা দেয়”-(বাকারা:১৫১)।
“প্রকৃতপক্ষে ঈমানদার লোকদের প্রতি আল্লাহ এই বিরাট অনুগ্রহ করেছেন যে, স্বয়ং তাদের মধ্যে থেকে ইমন একজন নবী বানিয়েছেন যিনি তাদেরকে আল্লাহর আয়াত পড়ে শুনায়, তাদের জীবনকে পরিশুদ্ধ করে এবং তাদের কিতাব ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের শিক্ষা দেয়”-(আল-ইমরান: ১৬৪)।
“তিনিই উম্মীদের মধ্যে (এমন) একজন রসূল স্বয়ং তাদেরই মধ্য থেকে প্রেরণ করেছেন যে তাদেরকে তাঁর আয়াত শুনায়, তাদের জীবন পরিশুদ্ধ করে এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমতের শিক্ষা দেয়”-(জুমুআ:২)।
উপরোক্ত আয়াতসমূহে বারবার যে কথাটি অত্রন্ত গুরুত্ব সহকারে পুনর্ব্যক্ত হয়েছে তা এই যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর রসূলকে শুধুমাত্র কুরআনের আয়াতসমূহ শুনিয়ে দেয়ার জন্য পাঠাননি, বরং তার সাথে নবী হিসাবে প্রেরণের আরও তিনটি উদ্দেশ্য ছিল:
(এক) তিনি লোকদের কিতাবের শিক্ষা দান করবেন।
(দুই)এই কিতাবের উদ্দেশ্য অনুযায়ী কাজ করার কৌশল (হিকমাহ) শিক্ষা দেবেন।
(তিন) তিনি ব্যক্তি ও তাদের সমাজের পরিশুদ্ধি করবেন। অর্থাৎ নিজের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক দোষক্রটি দূর করবেন এবং তাদের মধ্যে উত্তম গুণাবলী ও উন্নত সমাজব্যবস্থার বিকাশ সাধন করবেন।
প্রকাশ থাকে যে, কিতাব ও হিকমাতের শিক্ষা শুধুমাত্র কুরআনের শব্দগুলো শুনিয়ে দেয়ার অতিরিক্ত কোন কাজই ছিল, অন্যথায় পৃথকভাবে তার উল্লেখ অর্থহীন। অনুরূপভাবে ব্যক্তি ও সমাজের প্রশিক্ষণের জন্য তিনি যেসব উপায় ও পদ্ধতিই গ্রহণ করতেন, তাও কুরআনের শব্দসমূহ পাঠ করে শুনিয়ে দেয়ার অতিরিক্ত কিছু ছিল, অন্যথায় প্রশিক্ষণের এই পৃথক কার্যক্রমের উল্লেখের কোন অর্থ ছিল না। এখন বলুন যে, কুরআন মজীদ পৌছে দেয়া ছাড়াও এই শিক্ষক ও মুরব্বীর পদ যা মহানবী (স) এর উপর ন্যস্ত ছিল, তা কি তিনি শক্তিবলে দখল করেছিলেন, না আল্লাহ তাআলা তাকে এ পদে নিয়োগ করেছেন? কুরআন মজীদের এই সুস্পষ্ট ও পুনরুক্তির পরও এই কিতাবের উপর ঈমান পোষণকারী কোন ব্যক্তি কি একথা বলার দুসাহস করতে পারে যে, এই দুটি পদ রিসালাতের অংশ ছিল না এবং মহানবী (স) এসব পদের দায়িত্ব ও কার্যক্রম রসূল হিসাবে নয়,বরং ব্যক্তিগতভাবে আঞ্জাম দিতেন? সে যদি তা বলতে না পারে তবে আপনি বলুন, কুরআন মজীদের পাঠ শুনিয়ে দেয়ার অতিরিক্ত যেসব কথা মহানবী (স) কিতাবের শিক্ষা ও হিকমাত (কৌশল)প্রসংগে বলেছেন এবং নিজের কথা ও কাজের মাধ্যমে ব্যক্তি ও সমাজের যে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত বলে স্বীকার করতে এবং তাকে সনদ (দলীল-প্রমাণ) হিসাবে মেনে নিতে অস্বীকার করলে তা স্বয়ং রিসালাত অস্বীকার করা নয় তো কী?
রসূলুল্লাহ (স) আল্লাহর কিতাবের ভাষ্যকার হিসাবে
সূরা নাহল-এ আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:
“এবং ( হে নবী !) এই যিকির তোমার উপর নাযিল করেছি, যেন তুমি লোকদের,সামনে সেই শিক্ষাধারার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে থাক, যা তাদের উদ্দেশ্যে নাযিল করা হয়েছে” (নাহল:৪৪)।
উপরোক্ত আয়াত থেকে পরিষ্কার জানা যায় যে, মহানবী (স) এর উপর এ্ই দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল যে, কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা যে হুকুম-আহকাম ও পথনির্দেশ দিয়েছেন, তিনি তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দান করবেন। স্থুলবুদ্ধি সম্পন্ন এক ব্যক্তিও অন্তত এতটুকু কথা বুঝতে সক্ষম যে, কোন কিতাবের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ শুধুমাত্র সেই কিতাবের মূল পাঠ পরে শুনিয়ে দিলেই হয়ে যায় না, বরং ব্যাখ্যা দানকরী তার মূল পাঠের অধিক কিছু বলে থাকেন,যাতে শ্রবণকারী কিতাবের অর্থ পূর্ণরূপে বুঝতে পারে। কিতাবের কোন বক্তব্য যদি কোন ব্যবহারিক (practical) বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত হয় তাহলে ভাষ্যকার ব্যবহারিক প্রদর্শনী (Practical dimonstration) করে বলে দেন যে, গ্রন্থকারের উদ্দেশ্য এভাবে কাজ করা। তা না হলে কিতাবের বিষয়বস্তুর তাৎপর্য ও দাবী সম্পর্কে জিজ্ঞাসাকারীকে কিতাবের মূল পাঠ শুনিয়ে দেয়াটা মকতবের কোন শিশুর নিকটও ব্যাখ্যা বা ভাষ্য হিসাবে স্বীকৃতি পেতে পারে না। এখন আপনি বলুন, এই আয়াতের আলোকে মহানবী (স) কুরআনের ভাষ্যকার কি ব্যক্তিগত ভাবে ছিলেন, না আল্লাহ তাআলা তাকে ভাষ্যকার নিয়োগ করেছিলেন? এখানে তো আল্লাহ তাআলা তার রসূলের উপর কিতাবের তাৎপর্য তুলে ধরবেন। অতপর কিভাবে এটা সম্ভব যে, কুরআনের ভাষ্যকার হিসাবে তাঁর পদমর্যাদাকে রিসালাতের পদমর্যাদা থেকে পৃথক সাব্যস্ত করা হবে এবং তার পৌছে দেয়া কুরআনকে গ্রহন করে তারে প্রদত্ত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানানো হবে? এই অস্বীকৃতি কি সরাসরি রিসালাতের অস্বীকৃতির নামান্তর নয়?
রসূলুল্লাহ (স) নেতা ও অনুসরণীয় আদর্শ হিসাবে
সূরা আল-ইমরানের আল্লাহ তাআলা বলেন:
“বল ( হে নবী), তোমরা যদি আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা পোষণ কর তবে আমার অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদের ভালো বাসবেন…বল, আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্য কর। অতপর তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে কাফেরদের আল্লাহ পছন্দ করেন না”- (আয়াত নং-৩১-৩২)।
সূরা আহযাবে আল্লাহ তাআলা বলেন:
“তোমাদের জন্য আল্লাহর রসূলেন মধ্যে এক অণুসরণীয় আদর্শ রয়েছে এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য যে আল্লাহ ও আখেরাতের আকাংখী”-(আয়াত নং ২১)।
উপরোক্ত আয়াতদ্বয়ে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা তার রসূল (স) কে নেতা সাব্যস্ত করছেন, তার আনুগত্য করার নির্দেশ দিচ্ছেন. তার জীবন চরিতকে অনুসরণীয় আর্দশ হিসাবে স্বীকৃতি দিচ্ছেন এবং পরিষ্কার বলছেন যে, এই নীতি অবলম্বন না করলে আমার নিকট কোন আশা রেখ না। এ ছাড়া আমার ভালোবসা লাভ করা যায় না, বরং তা থেকে মূখ ফিরিয়ে নেয়া কুফরী। এখন আপনি বলূন, রসূলুল্লাহ (স) কি স্বয়ং নেতা ও পথপ্রদর্শক হয়ে গিয়েছিলেন? অথবা মুসলমানগন তাকে নির্বচন করেছিল? আর নাকি আল্লাহ তাআলাই তিাকে এই পদে সমসীন করেছেন? কুরআনুল করীমের এ আয়াত যদি দ্ব্যর্থহীনভাবে মহানবী (স) কে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নিযুক্ত পথপ্রদর্শক ও নেতা সাব্যস্ত করে, তাহলে এরপরও তার আনুগত্য ও তার জীবনচরিত অনুসরণ করার ব্যাপরটি কিভাবে প্রত্যাখ্যান করা যেতে পারে? এই প্রশ্নের জওয়াবে একথা বলা সম্পূর্ণ অর্থহীন যে, এর দ্বারা কুরআন মজীদের অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে যদি তাই হত তবে (কুরআনের অনুসরণ কর) বলা হত (আমার অনুসরণ কর) বলা হত না। এ অবস্থায় রসূলুল্লাহ (স) এর জীবন চরিতকে উত্তম আদর্শ বলার তো কোন অর্থই ছিল না।
শরীআত প্রণেতা হিসাবে রসূলুল্লাহ (স)
সূরা আ‘রাফে মহান আল্লাহ রসূলুল্লাহ (স) এর উল্লেখপূর্বক ইরশাদ করেন:
“ সে তাদেরকে ন্যয়ানুগ কার্যের আদেশ করে, অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে, তাদের জন্য পাক জিনিসসমূহ হালাল এবং নাপাক জিনিসসমূহ হারাম করে, আর তাদের উপর থেকে সেই বোঝা সরিয়ে দেয় যা তাদের উপর চাপানো ছিল এবং সেই বন্ধনসমূহ খুলে দেয় যাতে তারা বন্দী ছিল”
উল্লেখিত আয়াতের শব্দসমূহ একটি বিষয় সম্পূর্ণ সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছে যে, আল্লাহ তাআলা মহানবী (স) কে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা (Legislative Powers) প্রদান করেছেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে আদেশ নিষেধ, হালাল-হারাম শুধু কুরআন মজীদে বর্ণিতগুলোই নয় বরং এর সাথে মহানবী (স) যা কিছু হালাল অথবা হারাম ঘোষণা করেছন, অথবা যেসব জিনিসের হুকুম দিয়েছেন বা নিষেধ করেছেন তাও আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতার অন্তর্ভুক্ত। এজন্য তাও আল্লাহর বিধানের একটি অংশ। এ কথাই সূরা হাশরে পরিষ্কার ভাষায় ইরশাদ হয়েছে:
“রসূল তোমাদের যা কিছু দেয় তা গ্রহণ কর, আর যে জিনিস থেকে বিরত রাখে (নিষেধ করে) তা থেকে বিরত থাক, আল্লাহকে ভয় কর, নিশ্চয় আল্লাহ কঠিন শাস্তিদাতা”
উল্লেখিত আয়াতদ্বয়ের কোনটিরই এই ব্যাখ্যা করা যায় না যে, তার মধ্যে কুরআনের আদেশ-নিষেধ ও কুরআনের হালাল-হারামের কথা বলা হয়েছে। এটা ব্যাখ্যা নয়, বরং আল্লাহর কালামের পরিবর্তনই হবে। আল্লাহ তাআলা তো এখানে আদেশ নিষেধ ও হালাল হারামকে রসূলুল্লাহ (স) এর কার্য়ক্রম সাব্যস্ত করেছেন, কুরআনের কর্যক্রম নয়। এরপরও কি কোন ব্যক্তি আল্লাহ বেচারাকে বলতে চায় যে, আপনার বক্তব্যে ভুল হয়ে গেছে। আপনি ভুল করে কুরআনের পরিবর্তে রসূলের নাম উল্লেখ করেছেন। (নাউযুবিল্লাহ)?
বিচারক হিসাবে রসূলুল্লাহ (স)
কুরআন মজীদে এক স্থানে নয় বরং অসংখ্য স্থানে আল্লাহ তাআলা এই বিষয়টি পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছেন যে, তিনি মহানবী (স) কে বিচারক নিয়োগ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি আয়াত এখানে উল্লেখ করা হলঃ
“( হে নবী!) আমরা এই কিতাব পূর্ণ সত্যতা সহকারে তোমার উপর নাযিল করেছে, যেন আল্লাহ তোমাকে যে সত্যপথ দেখিয়েছেন, তদনুসারে লোকদের মধ্যে মীমাংসা করতে পার”-(সূরা নিসা: ১০৫)
“আর ( হে নবী) বল! আল্লাহ যে কিতাব নাযিল করেছেন আমি তার প্রতি ঈমান এনেছি। আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে আমি যেন তোমাদের মাঝে ইনসাফ করি” (সূরা শূরা: ১৫)।
“তাদের যখন বলা হয়, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সেদিকে এবং তাঁর রসূলের দিকে আস তখন এই মুনাফিকদের তুমি দেখতে পাবে যে,তারা তোমার নিকট আসতে ইতস্তত করছে এবং পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছ” (নিসা : ৬১)।
“অতএব ( হে নবী) তোমার প্রতিপালকের শপথ! তারা কখনও ঈমানদার হতে পারে না-যতক্ষণ তার নিজেদের পারস্পরিক মতভেদের ব্যাপারসমূহে তোমাকে বিচারপতিরূপে মেনে না নিবে”-(নিসা: ৬৫)।
উপরোক্ত আয়াতগুলেঅতে সুস্পষ্টভাপবে ব্যক্ত হচ্ছে যে, মহানবী (স) স্বয়ংসিদ্ধভাবে অথবা মুসলমানদের নিযুক্ত বিচারক ছিলেন না, বরং আল্লাহ তাআলার নিয়োগকৃত বিচারক ছিলেন। তৃতীয় আয়াতটি বলে দিচ্ছে, তাঁর বিচারক ছিলেন। তৃতীয় আয়াতটি বলে দিচ্ছে, তাঁর বিচারক হওয়ার মর্যাদা বা পদ রিসালাতের পদ থেকে স্বতন্ত্র ছিলনা, বরং রসূল হিসাবে তিনি বিচারকও ছিলেন এবং একজন মুমিনের রিসালাতের প্রতি ঈমান তখন পর্যন্ত সঠিক ও যথার্থ হতে পারেনা যতক্ষণ না সে তাঁর এই মর্যাদার সামনেও শ্রবণ ও আনুগত্যের ভাবধারা গ্রহণ করবে। চতুর্থ আয়াতে
(আল্লাহ যা নাযিল করেছেন) অর্থাৎ কুরআন এবং রসূল উভয়ের ভিন্ন ভিন্ন উল্লেখ করা হয়েছে, যা থেকে পরিষ্কারভাবে প্রতিভাত হয় যে, মীমাংসা লাভের জন্য দুটি স্বতন্ত্র প্রত্যাবর্তনস্থল রয়েছে। (এক) কুরআন, আইন, বিধান হিসাবে এবং (দুই) রসূলুল্লাহ (স) বিচারক হিসাবে। আর এই দুই জিনিস থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া মুনাফিকের কাজ, মুমিনের কাজ নয়। পঞ্চম আয়াতে সম্পূর্ণ দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ (স) প্রদত্ত ফয়সালা সম্পর্কে যদি কোন ব্যক্তি নিজের অন্তরে সংকীর্ণতা অনুভব করে তবে তার ঈমান বরাবাদ হয়ে যায়। কুরআন মজীদের এই সুস্পষ্ট বস্তব্যের পরও কি আপনি বলতে পারেন যে, মহানবী (স) রসূল হিসাবে বিচারক ছিলেন না, বরং দুনিয়ার সাধারণ জজমেজিষ্ট্রেটের ন্যায় তিনিও একজন বিচারক ছিলেন মাত্র? তাই তাদের ফয়সালাসমূহের ন্যায় মহানবী (স) এর ফয়সালাও আইনের উৎস হতে পারে না?দুনিয়ার কোন বিচারকের কি এরূপ মর্যাদা হতে পারে যে, তার ফয়সালা যদি কেউ না মানে, অথবা তার সমালোচনা করে, অথবা অন্তরে তাকে ভ্রান্ত মনে করে তবে তার ঈমান নষ্ট হয়ে যায়?
রাষ্ট্রপ্রধান হিসবে রসূলুল্লাহ (স)
কুরআন মজীদ একইভাবে বিস্তারিত আকারে এবং পুনরুক্তি সহকারে অসংখ্য স্থানে একথা বলেছে যে, মহানবী (স) আল্লাহর পক্ষ থেকে নিযুক্ত রাষ্ট্রপ্রধান ও রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন এবং তাকে রসূল হিসাবেই এই পদ প্রদান করা হয়েছিল:
“আমরা যে রসূলই পাঠিয়েছি তাকে এজন্যই পাঠিয়েছি যে, আল্লাহর অনুমোদন অনুযায়ী তার আনুগত্য করা হবে”-(নিসা :৬৪)।
“যে ব্যক্তি রসূলের আনুগত্য করল, সে মূলত আল্লাহরই আনুগত্য করল”-(নিসা:৮০)।
“( হে নবী) নিশ্চিত যেসব লোক তোমার নিকট বাইআত গ্রহণ করে তারা মূলত আল্লাহর নিকটই আইআত গ্রহণ করে”-(আল-ফাতহ:১০)।
“হে ইমানদারগণ! আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রসূলেরও আনুগত্য কর, নিজেদের আমল বিনষ্ট কর না”-(মুহাম্মদ :৩৩)।
“কোন মুমিন পুরুষ ও কোন মুমিন স্ত্রীলোকের এই অধিকার নাই যে, আল্লাহ ও তার রসূল যখন কোন বিষয়ে ফয়সালা করে দেবেন তখন সে নিজের সেই ব্যাপরে নিজে কোন ফয়সালা করার এখতিয়ার রাখবে। আর যে ব্যাক্তি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের অবাধ্যাচরণ করবে, সে নিশ্চয়ই সুস্পষ্ট গোমরাহীর মধ্যে লিপ্ত”-(আহযাব: ৩৬)।
“হে ঈমাণদারগণ! আনুগত্য কর আল্লাহর আনুগত্য কর রসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা সামগ্রিক দায়িত্ব সম্পন্ন তাদেরও। অতপর তোমাদের মধ্যে যদি কোন ব্যাপারে মতভেদ সৃষ্টি হয় তবে তা আল্লাহ ও রসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও, যদি তোমরা প্রকৃতই আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমানদার হয়ে থাক“-(নিসা : ৫৯)।
এসব আয়াত পরিষ্কার বলছে যে, রসূল এমন কোন রাষ্টনায়ক নন যিনি নিজের প্রতিষ্ঠিত রাষ্টের স্বয়ং কর্ণধার হয়ে গেছেন, অথবা লোকেরা তাঁকে নির্বাচন করে রাষ্ট্রপ্রধান বানিয়েছে,বরং তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে নিয়োককৃত রাষ্ট্রপ্রধান। তার রাষ্ট্রনায়ক সুলভ কাজ তাঁর রিসালাতের পদমর্যাদা থেকে ভিন্নতর কোন জিনিস নয়, বরং তাঁর রাসূল হওয়াটাই আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুগত রাষ্ট্রনায়ক হওয়ার নামান্তর। তাঁর আনুগত্য করা হলে তা মূলত আল্লাহরই আনুগত্য করা হল। তাঁর নিকট বাইআত হওয়াটা মূলত আল্লাহর নিকট বাইআত হওয়ার শামিল। তাঁর আনুগত্য না করার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর অবাধ্যাচরণ এবং এর পরিণতি ব্যক্তির কোন কার্যক্রমই আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য না হওয়া। পক্ষান্তরে ঈমানদার সম্প্রদায়ের (যার মধ্যে বাহ্যত সমগ্র উম্মাত,তাদের শাসক গোষ্ঠী ও তাদের “জাতির কেন্দ্রবিন্দু” সব অন্তভূক্ত) সর্বোতভাবেই এ অধিকার নাই যে, কোন বিষয়ে আল্লাহর রসূলের সিদ্ধান্ত দেয়ার পর তারা ভিন্ন কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
এসব সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থেকে আরও অগ্রসর হয়ে সর্বশেষ আয়াত চুড়ান্ত ব্যাখ্যা প্রদান করেছে যার মধ্যে পরপর তিনটি আনুগত্যের হুকুম দেয়া হয়েছে:
১. সর্বপ্রথম আল্লাহর আনুগত্য।
২. অতপর রসূলুল্লাহ (স) এর আনুগত্য।
৩. অতপর তৃতীয় পর্যায়ে সামগ্রিক দায়িত্ব সম্পন্ন ব্যক্তিগণের (অর্থাৎ আপনার জাতীয় কেন্দ্রবিন্দুর) আনুগত্য।
এর পূর্বেকার কথা থেকে জানা গেল যে, রসূল উলিল আমর (সামগ্রিক দায়িত্ব সম্পন্ন কর্তৃপক্ষ) এর অন্তর্ভুক্ত নন, বরং তার থেকে পৃথক ও উর্ধে এবং তারঁ স্থান আল্লাহর পরে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। এ আয়াত থেকে দ্বিতীয় যে কথা জানা যায় তা হলো, উলিল আমর এর সাথে বিতর্ক ও মতপার্থক্য হতে পারেনা। তৃতীয়ত জানা গেল যে, বিতর্ক ও মতবিরোধের ক্ষেত্রে মীমাংসার জন্য দুটি প্রত্যাবর্তনস্থল রয়েছে: (এক) আল্লাহর (দুই) অতপর আল্লাহর রসূল। প্রকাশ থাকে যে, যদি প্রত্যাবর্তনস্থল শুধুমাত্র আল্লাহ হতেন, তবে সুস্পষ্ট ও স্বতন্ত্রভাবে রসূল (স) এর উল্লেখ সম্পূর্ণ অর্থহীন হত। তাছাড়া আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনের অর্থ যখন আল্লাহর কিতাবের প্রতি প্রত্যাবর্তন ছাড়া আর কিছুই নয়, তখন রসূলের দিকে প্রত্যাবর্তনের অর্থও এছাড়া আর কিছুই হতে পারেনা যে, রিসালাতের যুগে স্বয়ং রসূলুল্লাহ (স) এর নিকট প্রত্যাবর্তন এবং এই যুগের পর রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাতের দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।[বরং যদি গভীর দৃষ্টিতে দেখা হয় তবে যায় যে, স্বয়ং রিসালাতের যুগেও ব্যাপক অর্থে রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাতই ছিল প্রত্যাবর্তনস্থল। কারণ মহানবী (স) এর শেষ যুগে ইসলামী রাষ্ট গোটা আরব উপদ্বীপে বিস্তার লাভ করেছিল। দশ-বার লাখ বর্গমাইলের এই দীর্ঘ ও প্রশস্ত দেশে প্রতিটি বিষয়ের সিদ্ধান্ত সরাসরি মহানবী (স) এর নিকট থেকে গ্রহণ করা কোনক্রমেই সম্ভব ছিল না। অধিকন্তু এই যুগেও ইসলামী রাষ্টের গর্ভনরগণ, বিচারকগণ এবং প্রশাসকগণকে বিভিন্ন বিষয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য কুরআন মজীদের পরে আইনের দ্বিতীয় যেউৎসের দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হত, তা ছিল রসূলুল্লাহ (স) এরই সুন্নাত।]
সুন্নাত আইনের উৎস হওয়ার বিষয়ে উম্মাতের ইজমা
এখন আপনি যদি বাস্তবিকই কুরআন মজীদকে মানেন এবং এই পবিত্র গ্রন্থের নাম নিয়ে আপনার নিজের মনগড়া মতবাদের অনুসারী না হয়ে থাকেন তবে দেখে নিন যে, কুরআন মজীদ পরিষ্কার, সুস্পষ্ট এবং সম্পূর্ণ দ্ব্যর্থহীন বাক্যে রসূলুল্লাহ (স) কে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নিযুক্ত শিক্ষক, অভিভাবক, নেতা, পথপ্রদর্শক, আল্লাহর কালামের ভাষ্যকারত, আইনপ্রনেতা (Law Giver) বিচারক, প্রশাসক ও রাষ্টনায়ক সাব্যস্ত করছে এবং মহানবী (স) এর এ সমস্ত পদ এই পাক কিতাবের আলোকে রিসালাতের পদের অবিচ্ছেদ্য অংগ। কালামের পাকের এই ভাষণের ভিত্তিতে সাহাবায়ে কিরামের যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সমস্ত পদের অধিকারী হিসাবে মহানবী (স) যে কাজ করেছেন তা কুরআন মজীদের পরে আইনের দ্বিতীয় উৎস (Source of Law)। কোন ব্যক্তি চরম বিভ্রান্ত না হলে এরূপ কল্পনা করতে পারে না যে, গোটা দুনিয়ার মুসলমান এবং প্রতিটি যুগের সমস্ত মুসলমান কুরআন পাকের এসব আয়াতের তাৎপর্য অনুধাবনে ভুল করে কেবল সঠিক অর্থ সে-ই অনুধাবন করতে পেরেছে যে, মহানবী (স) কুরআন পাঠ করে শুনিয়ে দেয়া পর্যন্ত রসূল ছিলেন এবং অতপর তাঁর মর্যাদা ছিল একজন সাধারণ মুসলমানের মত। অবশেষে এমন কি অদ্ভুত অভীধান তার হস্তগত হয়েছে যার সাহয্যে সে কুরআন মজীদের শব্দাবলীর এই অর্থ অনুধাবন করতে পেরেছে যা গোটা উম্মাতের বুঝে আসেনি?
২. রসূলুল্লাহ (স)-এর আইন প্রণয়নের ক্ষমতা
দ্বিতীয় বিষয়টি আপনি এই বলেছেন: “কিন্তু আপনার একথার সাথে আমি একমত নই যে, তেইশ বছরের নবূওয়াতী জীবনে রসূলুল্লাহ (স) যা কিছু করেছেন তা সেই সুন্নাত যা কুরআনের সাথে মিলিত হয়ে সর্বোচ্চ বিধানদাতার মহান আইনের গঠন অনুযায়ী সমাজ সংগঠন করেছেন, কিন্তু আল্লাহর কিতাবের আইন (নাউযুবিল্লাহ) অসম্পূর্ণ ছিল এবং মহানবী (স) কার্যত যা কিছু করেছেন তার দ্বারা এই আইন পূর্ণতা লাভ করে, এরূপ কাথা আমার নিকট অবোধগম্য।”
উপরোক্ত ছত্রগুলোতে আপনি যা কিছু বলেছেন তা একটা বড় ধরনের ভ্রান্ত ধারণা। আইন শাস্ত্রের একটি স্বত:সিদ্ধ মূলনীতি হৃদয়ংগম করতে না পারার কারণে আপনি এর শিকার হয়েছেন। পৃথিবীর এই নীতি স্বীকার করে নেয়া হয় যে, আইন প্রণয়নের সর্বোচ্চ ক্ষমতা যার রয়েছে তিনি যদি একটি সংক্ষিপ্ত নির্দেশ প্রদান করেন, অথবা একটি কাজের নির্দেশ প্রদান করেন, অথবা একটি নীতি নির্ধারণ করে নিজের অধীনস্থল কোন ব্যক্তি বা সংস্থাকে তার বিস্তারিত কাঠামো সম্পর্কে নীতিমালা প্রণয়নের এখতিয়ার প্রদান করেন, তবে তার প্রনীত নীতিমালা আইন-বিধান থেকে স্বতন্ত্র কোন জিনিস নয়, বরং তা ঐ আইনের অংশ হিসাবে গণ্য হয়। আইন প্রণেতার নিজের উদ্দেশ্য এই হয়ে থাকে যে, তিনি যে কাজের নির্দেশ দিয়েছেন, আনুষংগিক বিধান তৈরী করে তার কার্যপ্রণালী (Procedure) নির্দিষ্ট করে দেয়া, তিনি যে মূলনীতি নির্ধারণ করেছেন তদনুযায়ী বিস্তারিত বিধান প্রণয়ন করা এবং তিনি সংক্ষিপ্তাকারে যে পথনির্দেশ দিয়েছে তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বিস্তারিত আকারে বর্ণনা করা। এই উদ্দেশ্য তিনি নিজের অধীনস্থ ব্যক্তি, অথবা ব্যক্তিবর্গ, অথবা প্রতিষ্ঠানসমূহকে আইন কানূন তৈরীর অনুমতি প্রদান করেন। এই আনুষংগকি বিধান নিঃসন্দেহে প্রাথমিক মৌল বিধানের সাথে মিলিত হয়ে তার পুনর্গঠন ও পরিপূর্ণতা দান করে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, আইন প্রণেতা ভুলবশত ক্রটিপূর্ণ বিধান তৈরী করেছিলেন এবং অপর কেউ এসে তার ক্রটি দূরীভূত করেছেন। বরং তার অর্থ এই যে, আইন প্রণেতা স্বীয় আইনের মৌলিক অংশ নিজেই বর্ণনা করেছেন এং বিস্তারিত ও ব্যাখ্যামূলক অংশ নিজের নিয়োগকৃত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রচনা করে দিয়েছেন।
মহানবী (স)- এর আইন প্রণয়ন কর্মের ধরন
আল্লাহ তাআলা স্বীয় আইন প্রণয়নে এই নিয়মই ব্যবহার করেছেন। তিনি কুরআন মজীদে সংক্ষিপ্তাকারে বিধান ও পথনির্দেশনা দান করে অথবা কতিপয় মূলনীতি বর্ণনা করে, অথবা নিজের পছন্দ ও অপছন্দের কথা প্রকাশ করে এই কাজ তাঁর রসূলের উপর অর্পণ করেছেন যে, তিনি শুধুমাত্র অক্ষরিকভাবেই এই আইনের বিস্তারিত রূপ দান করবেন না, বরং বাস্তবে তা কার্যকর করে এবং তদনুযায়ী কাজ করেও দেখিয়ে দেবেন। আইন প্রণয়নের এখতিয়ার প্রদানের এই নির্দেশ স্বয়ং আইনের মূল পাঠেই (অর্থাৎ কুরআন মজীদেই ) বর্তমান রয়েছেঃ
“আর ( হে নবী!) আমরা এই যিকির তোমার নিকট এজন্য নাযিল করেছি যাতে তুমি লোকদের উদ্দেশ্যে নাযিলকৃত শিক্ষাধারার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তাদের সামনে তুলে ধরতে পার”-(নাহল: ৪৪)।
এখতিয়ার প্রদানের এই সুস্পষ্ট নির্দেশের পর আপনি একথা বলতে পারেন না যে, রসূলুল্লাহ (স) এর বক্তব্যমূলক ও কর্মমূলক বর্ণনা কুরআন মজীদের বিধান থেকে পৃথক কোন জিনিস। তা মূলত কুরআনের আলোকে এই আইনের একটি অংশ। তাকে চ্যালেঞ্জ করার অর্থ স্বয়ং কুরআনকে এবং আল্লাহর এখতিয়ার অর্পণের নির্দেশনামাকে চ্যালেঞ্চ করার নামান্তর।
এই আইন প্রণয়নমূলক কাজের কয়েকটি দৃষ্টান্ত
আপনার উত্থাপিত প্রশ্নবলীর যদিও এটাই পৃর্ণাংগ উত্তর, কিন্তু আরও অধিক অবগতির জন্য আমি কয়েকটি দৃষ্টান্ত পেশ করছি যার সাহায্যে আপনি বুঝতে পারবেন যে, কুরআন মজীদ এবং মহানবী (স)-এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও বর্ণনার মধ্যে কি ধরনের সম্পর্ক রয়েছে।
কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, “তিনি পবিত্রতা অর্জনকারীদের পছন্দ করেন”-তওবা: ১০৮) এবং মহানবী (স) কে নির্দেশ দেন যে, “তিনি যেন নিজের পোশাক পবিত্র রাখেন” আল-মুদ্দাসসির :৪)। মহানবী (স) উপরোক্ত আয়াতদ্বয়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ পূর্বক তা কার্যে পরিণত করার জন্য পায়খানা-পেশাবের পর পরিচ্ছন্নতা অর্জন এবং দেহ ও পরিধেয় বস্ত্র পবিত্র রাখার ব্যাপারে বিস্তারিত বর্ণনা দান করেছেন এবং তদনুযায়ী কাজ করে দেখিয়ে দেয়েছেন।
কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা নির্দশ দিয়েছেন যে, তোমরা যদি (সহবাস জনিত কারণে) অপবিত্র হয়ে যাও, তবে পবিত্রতা অর্জন না করে নামায পড় না (দ্র.নিসা: ৪৩; মায়েদা: ৬)। মহানবী (স) বিস্তারিতভাবে বলে দিয়েছেন যে, এখানে নাপাক (জানাবাত) অর্থ কি? এই নাপাক কোন অবস্থার উপর প্রযোজ্য আর কোন অবস্থার উপর প্রযোজ্য নয় এবং এই নাপাকি থেকে পাক হওয়ার পন্থা কি?
কুরআন পাকে আল্লাহ তাআলা হুকুম করেছেন যে, তোমরা যখন নামাযের জন্য উঠো,তখন নিজেদের মুখ এবং কনুই পর্যন্ত উভয় হাত ধৌত করে, মাথা মাসেহ কর এবং পদদ্বয় ধৌত কর বা তা মাসেহ কর (মায়েদা: ৬)। মহানবী (স) বলে দেন যে, মুখ ধৌত করার নির্দেশের মধ্যে কুলকুচা করা ও নাক পরিষ্কার করাও অন্তভুক্ত রয়েছে। কান মাথার একটি অংশ, তাই মাথার সাথে কানও মাসেহ করতে হবে। পদদ্বয়ে মোজা পরিহিত থাকলে তা মাসেহ করবে এবং মোজা পরিহিত না থাকলে তা ধৌত করবে। সাথে সাথে তিনি এটাও সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন যে, কোন অবস্থায় উযু ছুটে যায় এবং কোন অবস্থায় তা অবশিষ্ট থাকে।
কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন, যে, রোযাদার ব্যক্তি রাতের বেলা ফজরের সময় কালো সূতা সাদা সূতা থেকে পৃথক না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত পানাহার করতে পারে-(বাকারা: ১৮৭)।
মহানবি (স) বলেন যে, এর অর্থ রাতের অন্ধকার থেকে ভোরের শুভ্র আলো উদ্ভাসিত হওয়া।
কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা পানাহারের জিনিসসমূহের মধ্যে কোন কোন জিনিস হালাল এবং কোন কোন জিনিস হারাম হওয়ার কথা বলার পর অবশিষ্ট জিনিসসমূহের ব্যাপারে এই সাধারণ নির্দেশ দেন যে, তোমাদের জন্য পাক জিনিস হালাল এবং নাপাক জিনিস হারাম করা হয়েছে (দ্র. মায়েদা:৪)। মহানবী (স) স্বীয় বক্তব্য ও বাস্তব কর্মের মাধ্যমে এর বিস্তারিত বর্ণনা দান করেছেন যে, পাক জিনিস কি যা আমরা খেতে পারি এবং নাপাক জিনিস কি যা থেকে আমাদের দূরে থাকা উচিত।
কুরআন পাকে আল্লাহ তাআলা উত্তরাধিকার আইনের বর্ণনা প্রসংগে বলেন যে, মৃত ব্যক্তির যদি কোন পুত্র সন্তান না থাকে এবং একটি মাত্র কন্যা সন্তান থাকে, তবে সে তার পরিত্যক্ত সম্পদের অর্ধেক পাবে এবং তাদের সংখ্যা দুইয়ের অধিক হলে তারা সকলে মিলে পরিত্যক্ত সম্পত্তির দুই- তৃতীয়াংশ পাবে (দ্র. নিসা: ১১)। এখানে এ কাথা বলে দেয়া হয়নি যে, যদি দুইজন কন্যা সন্তান থাকে তবে তারা কতটুকু অংশ পাবে? মহানবী (স) ব্যাখ্যা করে বলে দেন যে, দুই কন্যা সন্তানও দুয়ের অীধক কন্যা সন্তানের সমান অংশ পাবে।
আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদে দুই সহোদর বোনকে একই সময় একই ব্যক্তির বিবাহাধীনে একত্র করতে নিষেধ করেছেন (দ্র. নিসা: ২৩)। মহানবী (স) বলে দেন যে, ফুফু-ভাইঝি এবং খালা বোনঝিও এই হুকুমের মধ্যে শামিল রয়েছে।
কুরআন মজীদ পুরুষদের একসংগ দুই-দুই, তিনি -তিন অথবা চার-চার মহিলাকে বিবাহ করার অনুমতি প্রদান করে (দ্র. নিসা ৩)। এ আয়াতে চূড়ান্তভাবে সুস্পষ্ট করা হয়নি যে, এক ব্যক্তি একই সময় নিজের বিবাহাধীনে চারের অধিক স্ত্রী রাখতে পারবে না। হুকুমের এই উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের ব্যাখ্যা মহানবী (স) প্রদান করেছেন এবং যাদের বিবাহাধীনে চারের অধিক স্ত্রী ছিল, মহানবী (স) তাদেরকে চারের অধিক স্ত্রীদের তালাক দেয়ার নির্দেশ দেন।
কুরআন মজীদ হজ্জ ফরজ হওয়া সম্পর্কে সাধারণ নির্দেশ প্রদান করেছে এবং পরিষ্কারভাবে বলেনি যে, এই ফরজ কার্যকর করার জন্য প্রত্যেক মুসলমানকে প্রতি বছর হজ্জ করতে হবে, নাকি জীবনে একবা হজ্জ করাই যথেষ্ট, অথবা একাধিকবার হজ্জে যাওয়া উচিত (দ্র. আল-ইমরান: ৯৭)? এটা আমরা মহানবী (স) এর ব্যাখ্যার মাধ্যমেই জানতে পারি যে, জীবনে একবার মাত্র হজ্জ করেই কোন ব্যক্তি হজ্জের ফরজিয়াত থেকে অব্যাহতি পেতে পারে।
কুরআন মজীদ সোনা-রূপা সঞ্চিত করে রাখার ব্যাপারে ভীতিকর শাস্তির কথা উল্লেখ করেছে (দ্র. তওবা: ৩৪)। এ আয়াতের সাধারণ অর্থের মধ্যে এতটুকু অবকাশ দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না যে, আপনি দৈনন্দিন খরচের অতিরিক্ত একটি পয়সাও নিজের কাছে রাখতে পারবেন, অথবা আপনার পরিবারের মহিলাদের নিকট অলংকারের আকারে এক চুল পরিমাণ সোনাও রাখতে পারেন। একথা মহানবী (স) ই বলে দিয়েছেন যে, সোনা-রূপার বা তার অতিরিক্ত সোন-রূপা জমাকারী ব্যক্তি যদি তা থেকে শতকরা আড়াই ভাগ যাকাত আদায় করে তবে সে এই ভীতিকর শাস্তির আওতায় পড়বে না]।
এই কয়টি উদাহরণ থেকে আপনি বুঝতে পারবেন যে, মহানবী (স) আল্লাহ তাআলার সোপর্দকৃত আইন প্রণয়নের একতিয়ার প্রয়োগ করে কুরআন মজীদের বিধানবলী, পথনির্দেশ, ইশারা-ইংগীত ও অন্তর্নিহিত বিষয়সমূহের কিভাবে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। এই জিনিস যেহেতু কুরআন মজীদে প্রদত্ত ক্ষমতা অর্পণের নির্দেশের উপর ভিত্তিশীল ছিল, তাই তা কুরআন থেকে স্বতন্ত্র কোন বিধান ছিল না, বরং কুরআনের বিধানেরই একটা অংশ।
৩. সুন্নাত এবং তা অনুসরণের অর্থ
আপনার তৃতীয় দফা হলো: “রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাতের অনুসরণের অর্থ হচ্ছে, রসূলুল্লাহ (স) যে কাজ করেছেন; তাই করা তার অর্থ এই নয় যে, মহানবি (স) যে ভাবে করেছেন” তা অন্যদের নিকট পৌছিয়ে থাকেন তবে উম্মাতরও কর্তব্য হচ্ছে যে আল্লাহ যা নাযিল করেছেন” তা অন্যদের পর্যন্ত পৌছিয়ে দেয়া………..”।[একথা বলার সময় ডকটর সাহেব এই বাস্তব ঘটনা ভুলে গেছেন যে, মহানবী (স) সর্বপ্রথম যে কাজ করেছেন তা ছিল “নবূওয়াতের দাবী”। এই দৃষ্টিকোণ থেকে রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাত অনুসরণের সর্বপথম উপাদান এই সাব্যস্ত হয় যে, প্রথমে নবূওয়াতের দাবী করতে হবে (মাআযাল্লাহ)]
সুন্নাত ও তার অনুসরণের এই যে অর্থ আপনি নির্ধারণ করেছেন সে সম্পর্কে আমি শুধু এতটুকু যথেষ্ট মনে করি যে, এটা স্বয়ং “আল্লাহ যা নাযিল করেছেন” এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় যার অনুসরণ আপনি অপরিহার্য মনে করেন। “আল্লাহ যা নাযিল করেছেন” তার আলোকে সুন্নাতের অনুসরণ তো এই যে, রসূলুল্লাহ (স) আল্লাহ পাকের নিয়োগকৃত শিক্ষক,অভিভাবক,পৃষ্ঠপোষক, আইনপ্রণেতা,বিচারক, প্রশাসক, রাষ্ট্রপ্রধান ও কুরআনের ভাষ্যকার হিসাবে যা কিছু বলেছেন এবং কাজে পরিণত করে দেখিয়েছেন, তাকে আপনি রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাত হিসাবে মানবেন এবং তার অনুসরণ করবেন। এর দলীল-প্রমাণ আমি পেছনের পৃষ্ঠাগুলোতে উল্লেখ করে এসেছি, তাই তার পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন মনে করি।
এ প্রসংগে আপনি মিসওয়াক সম্পর্কিত যে কথা লিখেছেন তার সোজা উত্তর এই যে, গভীর চিন্তা প্রসূত জ্ঞানভিত্তিক আলোচনায় এই প্রকারের অস্পষ্ট ও অীনর্ভরযোগ্য কথা নজীর হিসাবে পেশ করে কোন বিষয়ের মীমাংশা করা যায় না। প্রত্যেক চিন্তাগোষ্ঠীর সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যে এমন কিছু লোক পাওয়া যায় যারা নিজেদের অযৌক্তিক বক্তব্যের মাধ্যমে নিজেদের দৃষ্টিভংগিকে কৌতুক ও প্রহসনে পরিণত করে পেশ করে তাদের বক্তব্য প্রমাণ হিসাবে পেশ করে আপনি যদি স্বয়ং ঐ দৃষ্টিভংগি প্রত্যাখ্যানের চেষ্টা করেন তবে তার অর্থ এ ছাড়া আ কিছুই হতে পারে না যে, অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য দলীল-প্রমাণের মোকাবিলা করা থেকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে আপনি কঠিন পরীক্ষার জন্য শুধু দুর্বল যুক্তি অনুসন্ধান করে বেড়াচ্ছেন।
অনুরূপভাবে আপনার এই যুক্তিও দুর্বল যে, সুন্নাত অনুসরণের অর্থ আজকের আনবিক যুগে তীর-ধনুক দিয়ে যুদ্ধ করা। কারণ রসূলুল্লাহ (স)-এর যুগে তীর-ধনুক দিয়েই যুদ্ধ করা হত। শেষ পর্যন্ত এ কথা আপনাকে কে বলেছে যে, সুন্নাত অনুসরণের অর্থ এটাই? সুন্নাত অনুসরণের এই অর্থ কখনও কোন বিশেষজ্ঞ আলেমই গ্রহণ করেননি যে, আমরা যুদ্ধের ময়দানে সেই অস্ত্রই ব্যবহার করব, যা রসূলুল্লাহ (স) এর যুগে ব্যবহার করা হত। বরং চিরকালই তার অর্থ এই মনে করা হত যে, যুদ্ধের ময়দানে আমরা সেই উদ্দেশ্য,সেই নৈতিক মূল্যবোধ এবং ইসলামী বিধান অনুসরণ করব যার অনুসরণের জন্য রসূলুল্লাহ (স) তার কথা ও কাজের মাধ্যমে আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন এবং যেসব উদ্দেশ্যে তিনি যুদ্ধ করতে এবং যেসব কার্যক্রম অনুসরণের করতে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকবো।
৪. রসূলে পাক (স) কোন ওহী অনুসরণে আর্দিষ্ট ছিলেন এবং আমরা কোনটি অনুসরণে আদিষ্ট?
আপনার নিজের ভাষায় আপনার চতুর্থ দফাটি হলো, উপরোক্ত সমস্ত কাজে মহানবী (স) তেইশ বছরের নবূওয়াতী জীবনে যার অনুসরণ করেছেন তা আল্লাহর কিতাবে বর্তমান (“আল্লাহ যা নাযিল করেছেন) এরই অনুসরণ করেছেন এবং উম্মাতকেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারাও এর অনুসরণ করবে। যেখানে বলে উম্মাতের সদস্যদের অনুপ্রাণিত করা হয়েছে, সেখানে এই ঘোষণাও দেয়া হয়েছে যে, মহানবী (স)-ও এর অনুসরণ করেন।
এই বক্তব্যে আপনি দুইটি আয়াত উল্লেখ করেছেন এবং আয়াত দুটি শুধু ভুলই নকল করেননি,বরং উদ্বৃত করতে গিয়ে এমন ভুল করেছেন যা আরবী ভাষায় প্রাথমিক জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিও করতে পারে না। প্রথম আয়াতটি মূলতঃএরূপঃ
“(তোমাদের প্রতিপাকের পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট যা নাযিল করা হয়েছে-তোমরা তার অনুসরণ কর।” অথচ আপনার নকলকৃত ব্যাক্যের এরূপ অর্থ হবে: “আল্লাহ তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে যা নাযিল করেছেন তার অনুসরণ কর।” আপনি যে পাঠ উল্লেখ করেছেন তার অর্থ দাড়ায়: “বল! অনুসরণ কর সেই ওহীর যা আমার নিকট আমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে পাঠানো হয়।” আমি এই ভুল সম্পর্কে আপনাকে এজন্য সৎর্ক করছি যে, আপনি কোন এক সময় ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখুন যে, একদিকে কুরআন সম্পর্কে আপনার জ্ঞানের এই দুর্দশা এবং অন্যদিকে আপনি এই ধারণার শিকার হয়েছেন যে, গোটা উম্মাতের বিশেষজ্ঞ আলেমগণ কুরআনকে অনুধাবন করতে ভুল করেছেন এবং আপনি তা সঠিকভাবে অনুধাবন করেছেন।
এখন আসল বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। এখানে আপনি দুটি কথা বলেছেন এবং উভয়টিই ভ্রান্ত। একটি কথা আপনি এই বলেন যে, রসূলূল্লাহ (স) এর নিকট শুধুমাত্র কুরআনে বিদ্যমান ওহীই আসতো এবং তিনি কেবলমাত্র এর অনুসরণ করতেই আদিষ্ট ছিলেন। অথচ কুরআন মজীদ থেকেই স্বষং প্রমাণিত হয় যে, কুরআন মজীদ ছাড়াও ওহীর মাধ্যমে মহানবী (স) এর উপর বিধান নাযিল হত এবং তিনি উভয় প্রকার ওহীর অনুসরণ করতে আদিষ্ট ছিলেন (এর প্রমাণ সর্বশেষ প্রশ্নের উত্তরে পেশ করা হবে।) দ্বিতীয় কথা আপনি এই বলেন যে, উম্মাতকে কেবলমাত্র কুরআন মজীদ অনুসরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অথচ কুরআন মজীদ বলে যে, উম্মাতকে রসূলূল্লাহ (স) এর অনুসরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
“হে নবী! বরে দাও যে, তোমরা যদি আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা পোষণ কর তবে আমার অনুসরণ কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদর ভালোবাসবেন” (আল-ইমরান:৩১২)।
“আমার রহমাত সকল জিনিসকেই পরিব্যাপ্ত করে আছে। আর তা আমি সেই লোকদের জন্য লিখে দিব যারা অবাধ্যাচরণ থেকে বিরত থাকে, যাকাত দান করে এবং আমার আয়াতসমূহের প্রতি ঈমান আনে। অতএব যারা এই উম্মী রসূল ও নবীর অনুসরণ করে-যার উল্লেখ তাদের নিকট রক্ষিত তাওরাত ও ইনজীলে লিখিত পাওয়া যায়”-(আ‘রাফ: ১৫৬-৭)।
“তুমি এ যাবত যে কিবলার অনুসরণ করছিলে তা এই উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম যাতে আমরা জানতে পারি, কে রসূলের অনুসরণ করে আর কে ফিরে যায়” (বাকারা: ১৪৩)।
এসব আয়াতেই রসুলুল্লাহ (স) এর আনুগত্য করার নির্দেশকে ব্যাখ্যার কুদযন্ত্রে চড়িয়ে এই অর্থ বেড় করা সম্ভব নয় যে, এর দ্বারা মূলত কুরআন মজীদের আনুগত্য করাই বুঝানো হয়েছে। যেমন আমি পূর্বে আরয করে এসেছি যে, বাস্তবিকই অনুসরণ করবে তবে শেষ পর্যন্ত এমন কি কারণ রসূলুল্লাহ (স) এর নয়, বরং কুরআনের অনুসরণ করবে তবে শেষ পর্যন্ত এমন কি করণ ছিল যে, এক নম্বরে উল্লেখিত আয়াতে আল্লাহ তাআলা ব্যবহার করার পরিবর্তে শব্দ ব্যবহার করেছেন? তাহলে আপনার ধারণামতে আল্লাহ তাআলার কি এখানে ভুলচুক হয়ে গেছে? (নাউযুবিল্লাহ)।
পুনশ্চ দুই নম্বরে উল্লেখিত আয়াতে তো এই ব্যাখ্যারও সুযোগ নাই। কারণ তাতে পৃথকভাবে আল্লাহ পাকের আয়াতের উপর ঈমান আনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং মহানবী (স) এর আনুগত্যের উল্লেখও পৃথকভাবে রয়েছে।
তৃতীয় নম্বরে উল্লেখিত আয়াত এর চেয়েও খোলাভাবে বিষয়টি সুস্পষ্ট করে দিয়েছে এবং এ ধরনের মনগড়া ব্যাখ্যার শিকাড় কেটে দিয়েছে, সাথে সাথে আপনার এই কল্পনারও মূলোচ্ছেদ করে দিয়েছে যে, রসূলুল্লাহ (স) এর উপর কুরআন মজীদ ব্যতীত আর কোন আকারে ওহী আসতো না। মাসজিদুল- হারামকে কিবলা নির্ধারণের পূর্বে মূসলমানদের যে কিবলা ছিল তাকে কিবলা বানানোর কোন হুকুম কুরআনে আসেনি। যদি এসে থাকে তবে আপনি তার উল্লেখ করুন। এই ঘটনা অনস্বীকার্য যে, ইসলামের প্রারম্ভিক কালে মহানবী (স) ই এই কিবলা নির্ধারণ করেছিলেন এবং প্রায় চৌদ্দ বছর যাবত সেদিকে মুখ করে মহানবী (স) ও সাহাবগণ নামায আদায় করতে থাকেন। চৌদ্দ বছর পরে আল্লাহ তাআলা সূরা বাকারার এই আয়াতে মহানবী (স) এর উপরোক্ত কাজের সত্যায়ন করলেন এবং এই ঘোষনা দিলেন যে, এই কিবলা আমাদের নির্ধারিত ছিল এবং আমরা আমাদের রসূলের মাধ্যমে তা এজন্য নির্দিষ্ট করেছিলাম যে, আমরা দেখতে চাচ্ছিলাম কে রসূলের আনুগত্য করে আর কে তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়? রসূলুল্লাহ (স) এর উপর কুরআন ছাড়াও যে ওহীর মাধ্যমে হুকুম-আহকাম নাযিল হত, এটা একদিকে তার সুস্পষ্ট প্রমাণ এবং অপর দিকে এই আয়াত সম্পূর্ণ পরিষ্কারভাবে বলে দিচ্ছে যে, মুসলমানগণ রসূলুল্লাহ (স) এর সেইসব হুকুম মানতেও আদিষ্ট যা কুরআন মজীদে উল্লেখ নাই। এমনকি আল্লাহ তাআলার নিকট রিসালাতের প্রতি মুসলমানদের ঈমানের পরীক্ষাও এভাবে হয়ে থাকে যে, রসূলের মাধ্যমে যে নির্দেশ দেয়া হয় তা তারা মান্য করে কি না?
এখন আপনি এবং আপনার অনুরুপ একই মত পোষণকারীগণ স্বয়ং চিন্তা করে দেখুন, আপনারা নিজেদের কি বিপদের মধ্যে নিক্ষেপ করেছেন। বাস্তবিকই আপনার অন্তরে যদি এতটুকু খোদাভীতি থেকে থাকে যে, তার দেয়া হেদায়াতের পরিপন্থী কর্মপন্থায় চিন্তা করতেও আপনার দেহে কম্পন ধরে যায় তবে আমার আবেদন এই যে, বিতর্ক ও বাহাসের জযবা থেকে নিজের মন-মানসিকতাকে পবিত্র করে উপরের কয়েকটি লাইন পুনপুন পাঠ করুণ। আল্লাহ করুন আপনার দেহে কম্পন ধরে যায় এবং আপনি এই গোমরাহী ও পথভ্রষ্টতা থেকে বেচে যান মধ্যে আপনি ক্রটিপূর্ন অধ্যয়নের কারণে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছেন।
৫. জাতিক কেন্দ্র
পঞ্চম যে বিষয়টি আপনি বলেছেন তা আপনার ভাষায় এই যে: “দীনের দাবী যেহেতু এই ছিল যে, সামগ্রিকভাবে কুরআনের উপর আমল হবে এবং এটা হতে পারে না যে, প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ নিজ বুঝ অনুযায়ী কুরআনের উপর আমল করবে। তাই সার্বিক ব্যবস্থা কায়েম রাখার জন্য একজন জীবিত ব্যক্তির প্রয়োজন এবং আমি এও অনুভব করি যে, যেখানে সামগ্রিক ব্যবস্থা কায়েমের প্রশ্ন রয়েছে, সেই লক্ষে যে ব্যক্তি পৌছিয়ে দেন তার স্থান ও মর্যাদা অনেক উপরে। কারণ তিনি পয়গাম এজন্য পৌছিয়ে দেন যে, ওহী তিনি ছাড়া আর কারও নিকট আসে না। সুতরাং কুরআন মজীদ এজন্য পরিষ্কার করে দিয়েছে যে “কেউ রসুলের আনুগত্য করলে সে তো আল্লাহরই আনুগত্য করল” অতপর রসূলুল্লাহ (স) উম্মাতের কেন্দ্রবিন্দুও ছিলেন। আর রসূলূল্লাহ (স) এর সুন্নাতের উপর আমল করার অর্থ এই যে, তাঁর অবর্তমানেও (ইন্তেকালের পরও) এই কেন্দ্রিকতাকে কায়েম রাখা হবে। অতপর এই বিষয়টি কুরআন মজীদ নিম্নোক্ত বাক্য তুলে ধরেছে:
এই বিষয়টি আপনি ভালোভাবে খুলে বর্ণনা করেননি। আপনার সামগ্রিক বক্তব্য থেকে আপনার যে উদ্দেশ্য বুঝা যায় তা এই যে, রসূলুল্লাহ (স) কে শুধুমাত্র সমাগ্রিক ব্যবস্থা কায়েমের জন্য নিজ যুগে রসুল ছাড়াও “জাতির কেন্দ্রবিন্দু” ও বানানো হয়েছিল। তার “রসূল” হওয়ার মর্যাদা তো চিরস্থায়ী ছিল বটে, কিন্তু “জাতির কেন্দ্র” হওয়ার মর্যাদা কেবলমাত্র সেই সময় পর্যন্ত ছিল যতক্ষণ তার জীবন্ত ব্যক্তিত্ব সামগ্রিক ব্যবস্থা পরিচালনা করছিল। অতপর তিনি যখন ইন্তেকাল করেন তখন তার পরে যে জীবন্ত ব্যক্তিত্বকে এই ব্যবস্থা কায়েম রাখার জন্য নেতা বানানো হয়েছিল এবং এখন বানানো হবে সে নিজ যুগের জন্য রসূলুল্লাহ (স) এর অনুরূপই ‘জাতির কেন্দ্র’ ছিলেন এবং থাকবেন। এখন রসুলূল্লাহ (স) এর সুন্নাতের অনুসরণের অর্থ এই যে, আমরা সামগ্রিক ব্যবস্থা কায়েম রাখার জন্য একের পর এক ধারাবাহিকভাবে ‘জাতির কেন্দ্রবিন্দু’ কায়েম করতে থাকব। এ ক্ষেত্রে পরবর্তী কালের ‘জাতির কেন্দ্রবিন্দুগনের’ উপর যদি রসূলুল্লাহ (স) এর কোন প্রাধান্য থেকে থাকে তবে শুধু এতটুকু যে, কুরআন মজীদ পৌছে দেয়ার কারণে তাঁর স্থান অনেক উপরে।
কয়েকটি মৌলিক প্রশ্ন
আপনার বক্তব্যের যে ব্যাখ্যা আমি করেছি তা যদি সঠিক না হয় তবে আপনি সংশোধন করে দিন। বক্তব্য প্রদানকারী হিসাবে আপনার নিজের ব্যাখ্যা অপেক্ষাকৃত সঠিক হবে। কিন্তু আমি যদি আপনার উদ্দেশ্য সঠিক অনুধাবন করে থাকি তবে এর উপর কয়েকটি প্রশ্নের উদ্ভব হয়:
“জাতির কেন্দ্র” বলতে আপনি কি বুঝাতে চাচ্ছে? আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদে রসূলুল্লাহ (স) এর রিসালঅতের দায়িত্বের যে বিস্তারিত বিবরণ
১. এখানেও আয়াত উধৃত করতে গিয়ে ভুল করা হয়েছ। নয় বরং হবে। নয় বরং হবে।(৪৪ পৃ )
দান করেছেন তা হলো-আল্লাহর কিতাব পৌছে দেয়ার দায়িত্ব তাঁর উপর অর্পিত, তিনি এই কিতাবের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকারী, তদনুযায়ী কাজ করার কৌশল শিক্ষাদানকারী, ব্যক্তি ও সমাজের পরিশুদ্ধকারী, মুসলমানদের জন্য অনুসরণীয় আদর্শ, তিনি পথপ্রদর্শক, তার আনুগত্য আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী বাধ্যতামূলক, আদেশ-নিষেধ ও হালাল-হারমের ক্ষেত্রে কর্তৃত্বের অধিকারী, আইন প্রণেতা(Law Giver), বিচারক ও রাষ্টপ্রধান। কুরআন মজীদ আমাদের বলে এসব পদ রসূল হওয়ার কারণেই মহানবী (স) লাভ করেন এবং রিসালাতের পদে সমাসীন হওয়ার অর্থই এই ছিল যে, আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকেই তিনি এসব পদে অভিষিক্ত হয়েছিলেন। এ সম্পর্কিত কুরআনের সুস্পষ্ট বক্তব্য আমি ইতিপূর্বে নকল করে এসেছি যার পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রোয়জন।
এখন যেহেতু ‘জাতির কেন্দ্র’ কুরআনের পরিভাষা নয়, বরং আপনাদের সকল কল্পিত পরিভাষা, তাই অনুগ্রহপূর্বক আপনি বলুন, ‘জাতির কেন্দ্র’ নামক পদটি কি উপরোক্ত পদসমূহ ব্যতীত স্বতন্ত্র কোন পদ? নাকি এসব পদের সমষ্টি? অথবা ঐসব পদের কতগুলো এর অন্তুভূক্ত এবং কতগুলো এর বহির্ভূত? যদি তা উপরোক্ত পদসমূহের সমষ্টি হয়ে থাকে তবে আপনি এটাকে কিভাবে রিসালাত থেকে পৃথক সাব্যস্ত করতে পারেন? আর যদি উপরোক্ত পদসমূহের কতিপয় পদ ‘জাতির কেন্দ্র’ শীর্ষক পদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে এবং কতেক রিসালাতের পদের অন্তর্ভুক্ত হয়, তবে তা কোন কোন পদ যা জাতির কেন্দ্র এর অন্তর্ভুক্ত এবং সেগুলোকে কোন সব দলীল প্রমাণের ভিত্তিতে আপনি রিসালাতের পদ থেকে বিছিন্ন করছেন?
দ্বিতীয় প্রশ্ন ‘জাতির কেন্দ্রে’ সমাসীন হওয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট। প্রকাশ থাকে যে, এই সমাসীন তিনটি পন্থায় হতে পারে। (এক ) আল্লাহ তাআলা কোন ব্যক্তিকে মুসলমানদের জন্য জাতির কোন্দ্রবিন্দু নিয়োগ করবেন। (দুই) মুসলমানগণ নিজেদের মর্জি মাফিক তাকে নির্বাচন করবে। (তিন) কেউ জাতির কেন্দ্রবিন্দুর পদটি জোরপূর্বক দখল করবে। এখন প্রশ্ন হল, জাতির কেন্দ্র বলতে যাই বুঝানো হোক, মহানবী (স) উপরোক্ত তিন পন্থার মধ্যে কোন পন্থায় শেষ পর্যন্ত উক্ত পদে সমাসীন হয়েছিলন?আল্লাহতাআলাকিতাঁকেউক্তপদেনিয়োগকরেছিলেন?নাকি মুসলমানগণ তাকে এই পদের জন্য নির্বাচন করেছিলেন? অথবা মহানবী (স) নিজেই জাতির কেন্দ্রবিন্দু হয়েছিলেন? এর মধ্যে যে পন্থাটির কথাই আপনি গ্রহন করবেন তার সষ্পষ্টব্যাখ্যা প্রদান করা উচিত। আর একথারও ব্যাখ্যা হওয়া দরকার যে, মহানবী (স) এর পর যে ব্যক্তিই ‘জাতিই কেন্দ্রবিন্দু’ হবে সে কি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তালিকাভুক্ত ও সমাসীন হবে, নাকি মুসলমানগণ তাকে জাতির কেন্দ্রবিন্দু নির্বাচন করবে? অথবা সে নিজেই বাহুবলে এই পদে সমাসীন হবে? যদি উভয়ের নিয়োগ পদ্ধতির মধ্যে আপনার মতে কোন পার্থক্য না থেকে থাকে তবে খোলাখুলিভাবে একথা বলে দিন যাতে আপনার অবস্থান অস্পষ্ট না থাকে। আর যদি পার্থক্য থেকে থাকে তবে বলে দিন যে, সেই পার্থক্যটা কি এবং এই পার্থক্যের কারণে উভয় প্রকারের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মর্যাদা ও এখতিয়ারের মধ্যে. কোন মৌলিক পার্থক্য সূচীত হয় কি না?
তৃতীয় প্রশ্ন হলো, “যিনি পৌছিয়ে দেন তার স্থান ও মর্যাদা অনেক উপরে” একথা বলে আপনি অনুগ্রহপূর্বক রসূলুল্লাহ (স) কে জাতির অন্যান “কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের” উপর যে প্রাধান্য ও অগ্রাধিকার দিয়েছেন তা কি শুধু স্তর ও মর্যাদাগত প্রাধান্য অথবা আপনার মতে উভয়ের পদের ধরন ও প্রকৃতির মধ্যেও কোন পার্থক্য আছে? আরও অধিক পরিষ্কার বাক্যে আমি জিজ্ঞাসা করতে চাই যে, আচ্ছা আপনার ধারণা মতে জাতির কেন্দ্রীয় নেতা হিসাবে রসূলুল্লাহ (স) এর যেসব এখতিয়ার ছিল তার ইন্তেকালের পর সেই এখতিয়ার কি তারা উভয়ে কি সম মর্যাদার অধিকারী? আর অন্যদের উপর মহানবী (স) এর প্রধান্য কি শুধু এতটুকুই যে, তিনি তাঁর পরের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তুলনায় কিছুটা অধিক সম্মানের যোগ্য, কারণ তিনিকুরআন পৌছিয়ে দিয়েছেন? এটাই যদি আপনার ধারণা হয়ে থাকে তবে বলুন যে, মহানবী (স) এর পরে যে ব্যক্তি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আসীন হবে অথবা যাকে আসীন করানো হবে তার মর্যাদাও কি এরূপ হবে যে, তার সিদ্ধান্ত অমান্য করা তো দূরের কথা, এর বিরুদ্ধে মনের মধ্যে সংকীর্ণতা অনুভব করলেও ব্যক্তির ঈমান চলে যায়? তার মর্যাদাও কি এরূপ যে, সে নিজে কোন সিদ্ধান্ত প্রদান করলে তার বিপরীত মত পোষণ করার অধিকারটুকুও মুসলমানদের নেই? তার অবস্থান ও কি এরূপ যে, তার সাথে মুসলমানগণ বিতর্ক করতে পারবে না এবং তার নির্দেশ বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নেয়া ছাড়া উম্মাতের কোন উপায় নেই যদি সে মুমিন থাকতে চায়? এই জীবন্ত ব্যক্তিত্ব বা ব্যক্তিগণ যারা জাতির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে সমাসীন হবে তারা কি অনুসরণীয় আদর্শ যে, মুসলমানগণ তাদের জীবন যাপন পদ্ধতি দেখবে এবং সম্পূর্ণ নিশ্চিন্তে নিজেদেরকে তাদের মত গড়ে তুলবে? তারাও কি আমাদের পরিশুদ্ধি, কিতাব ও হিকমতের শিক্ষাদান এবং “আল্লাহ যা নাযিল করেছেন”
তার ভাষ্য প্রদানের জন্য ‘প্রেরিত’ হয়েছেন যে, তাদের বক্তব্য দলীল প্রমাণ হিসাবে স্বীকৃত?
আপনি এসব প্রশ্নের উপর কিছুটা সবিস্তার আলোকপাত করলে কতই না ভালো হয় যাতে এই “জাতির কেন্দ্রের” সঠিক অবস্থান ও মর্যাদা সকলের সামনে প্রতিভাত হয়ে যায়, যার চর্চা দীর্ঘদিন যাবত শুনে আসছি।