অনুবাদকের আরয
অবশেষে ইমাম হাসানুল বান্নার ডাইরী প্রকাশিত হওয়ায় আমরা মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করছি। হাসানুল বান্নার ডাইরী অনুবাদ করা আমার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছি। ইতিপূর্বে মরহুম আব্দুল খালেক একটি অনুবাদের কাজে হাত দেন এবং সিলেটের আল-আমীন লাইব্রেরীর মালিক বন্ধবর ফরীদ উদ্দিন চৌধুরী তা প্রকাশের উদ্যোগ নেন। কিন্তু তার সে উদ্যোগ সফল হয়নি। আমি হাসানুল বান্নার ডাইরী পাঠ করে নিতান্ত প্রীত হই এবং অনুবাদের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করি। কিন্তু প্রকাশক সংগ্রহ করতে না পারায় এর স্বত্বাধিকারী এ, এম, আমিনুল ইসলাম এটি ছাপতে রাজী হয় এবং অনুবাদ সম্পন্ন করার জন্য পুনঃপুন তাগাদা দেয়। ইতিমধ্যে ডাইরীর দ্বিতীয় খন্ড সংগ্রহ করার জন্য লাহোরে যোগাযোগ করি। লাহোরস্থ ইসলামীক পাবলিকেশন্স এর বর্তমান ম্যানেজার জনাব মুনীর আফজাল এক পত্রে জানান যে, ডাইরীর দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশিত হয়নি। এমতাবস্থায় কোন পাঠক এর দ্বিতীয় খন্ড মূল কপি (আরবী মুনাককেরাত) বা এর অনুবাদ আমাকে সরবরাহ করতে পারলে যথাসময়ে তা অনুবাদ করে সহ্নদয় পাঠক মহলের নিকট উপস্থাপন করা হবে ইনশাআল্লাহ।
ইখওয়ানুল মুসলিমুন এবং জামায়াতে ইসলামী বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ইসলামী আন্দোলন। জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা মওদুদী আত্মজীবনী মূলক কোন গ্রন্হ রচনা না করলেও সংগঠনকে জানা এবং বুঝার জন্য অসংখ্য গ্রন্হ রচনা করেছেন। কিন্তু ইখওয়ান এ থেকে ব্যতিক্রম। সাইয়েদ কুতুব শহীদ এবং মুহাম্মদ কুতুব রচিত গ্রন্হ বাদ দিলে ইখওয়ানের সাহিত্যের পরিমান খুবই নগণ্য। ইমাম হাসানুল বান্না এ ডাইরী রচনা করে সংগঠনকে জানা এবং বুঝার বিশেষ করে প্রতিকূল পরিবেশে সংগঠন গড়ে তোলা আর দ্বীনের দাওয়াত দেয়া উভয়ই উদ্ভাবন করে গেছেন। হারাম প্রতিরোধ কমিটি থেকে শুরু করে বৃহত্তর ক্ষেত্রে কিভাবে দীনের দাওয়াত দিতে হয়, কিভাবে জনতাকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করতে হয়, তা চমৎকার, আকর্ষণীয় এবং হৃদয়গ্রাহী ভাষায় এ ডাইরীতে তিনি বিবৃত করেছেন। ব্যক্তিকে দারুণভাবে আন্দোলিত করবে হাসানুল বান্নার এ ডাইরী। এ থেকে পাঠক এটাও জানতে পারবেন যে, আন্দোলনের নেতা বা পরিচালকের মধ্যে কোনসব গুণের সমাবেশ আবশ্যক। কফি শপ তথা হোটেল রেস্টুরেন্ট থেকে শুরু করে রাজপথ পর্যন্ত সর্বত্র এক গণজোয়ার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন ইমাম হাসানুল বান্না। শৈশব থেকেই সৎ প্রকৃতি আর নেক সীরাতের অধিকারী ছিলেন মহান ব্যক্তিত্ব। সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি যেভাবে সংশোধনের চেষ্টা করেছেন তাঁর সে পথ ধরে আজো যে কোন সমাজে সংস্কার সাধন করা যায়। তার ডাইরী পাঠে পাঠক মহলের সম্মুখে এ সত্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে ইনশাআল্লাহ।
গোলাম সোবহান সিদ্দীকী
১২–ই ১/৩৮ মিরপুর ঢাকা ১২২১।
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
ইমাম হাসানুল বান্নার ডাইরী
রাশাদ মাদ্রাসার স্মৃতি
আমাদের ওস্তাদ শায়খ মুহাম্মদ যাহরানের প্রতি আল্লাহ তা’আলা রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ করুন। তিনি ছিলেন আর রাশাদ দ্বীনী মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল। নিতান্ত প্রাজ্ঞ-বিচক্ষণ এবং খোদা পোরোস্ত আলেমে দ্বীন এবং অতিশয় বু্দ্ধিমান ব্যক্তি ছিলেন তিনি। মানুষের মধ্যে তিনি এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যিনি জ্ঞানের আলোক দ্বারা সর্বত্র আলো বিকিরণ করে চলেছিলেন। প্রথাগত জ্ঞানের বিচারে তিনি প্রথাসিদ্ধ আলেমদের স্তরে পৌঁছেননি ঠিক, কিন্তু প্রজ্ঞা-বিচক্ষণতা, যোগ্যতা এবং শিষ্টাচার ও জিহাদের বদৌলতে জ্ঞানবত্তা আর জনসেবার কাজে তিনি অনেক অগ্রসর ছিলেন। সাধারণ মানুষের জন্য তিনি একটা মসজিদে দারসের ব্যবস্থা করেছিলেন। এ ছাড়া নারীদের মধ্যেও গৃহে গৃহে তিনি দ্বীন প্রচার করতেন। এসব কিছুর পরও ১৯১৫ সালের দিকে তিনি শিশুদের শিক্ষার জন্য ‘মাদ্রাসা আর রাশাদ আদ দ্বীনিয়্যাহ’ নামে একটা সংস্কারমূলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। সেকালে গ্রামে-গঞ্জে যেসব মক্তব চালূ ছিল এবং সাধারণ মানুষের সাহায্যের উপর নির্ভল করে চলতো, এটা সে ধরনের একটা মাদ্রাসা হলেও এর শান-শওকত ছিল উন্নত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুরূপ। এখানে ছাত্রদেরকে কেবল শিক্ষাই দেয়া হতো না, বরং তাদের প্রতিপালন এবং মন-মানসিকতাও গঠন করা হতো। পাঠ্যসূচী আর পাঠদান রীতি উভয় দিক থেকে এ প্রতিষ্ঠান ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। তৎকালের মাদ্রসাগুলোতে প্রচলিত পাঠ্যসূচীতে পড়ানো হতোই, উপরন্তু নবীজীর হাদীসও মুখে মুখে পড়ানো হতো, সেগুলো ছাত্রদেরকে মুখস্ত করানো হতো এবং তার অর্থ এবং তাৎপর্যও তাদের হৃদয়ঙ্গম করানো হতো। প্রতি সপ্তাহে বৃহস্পতিবার ছাত্রদেরকে একটা হাদীস শিক্ষা দেয়া হতো, তাদের সম্মুখে হাদীসটি ব্যাখ্যা করা হতো। ছাত্ররা সকলে মিলে এক সঙ্গে হাদীসটি আবৃত্তি করতো, যার ফলে হাদীসটি তাদের মুখস্থ হয়ে যেতো। এর সঙ্গে তার আগের সপ্তাহে পড়া হাদীসটিও পুনরাবৃত্তি করতো।
এভাবে এক বৎসরের মধ্যে ছাত্ররা হাদীসের এক বিরাট ভান্ডার মুখস্থ করে ফেলতো। আমার মনে পড়ে, আজ যেসব হাদীস আমার মুখস্থ আছে, তার অধিকাংশই তখন আমার মানসপটে অংকরিত হয়। অনুরূপভাবে রচনা লিখা, আরবী ব্যাকরণ, আরবী সাহিত্যের নির্বাচিত অংশ, চমৎকার গদ্য-পদ্যের নির্বাচিত অংশ, শ্রুতলিপি এবং বাস্তত অনুশীলনও সে মাদ্রাসার পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। অথচ অন্যান্য মক্তবে এসব পড়ানো হতো না।
শায়খ যাহরানের রীতি-পদ্ধতি ছিন নিতান্ত হৃদগ্রাসী ও ফলপ্রসূ। অথচ তিনি কোন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহন করেননি। মনস্তাত্ত্বিক দর্শনও শিক্ষা লাভ করেননি। তিনি এ বিষয়টার প্রতি সবচেয়ে বেশী গুরুত্বারোপ করতেন, যাতে ছাত্রদের সঙ্গে তাঁর মানসিক ঐক্য আর সাযুজ্য প্রতিষ্ঠিত হতে পা রে। তিনি অত্যন্ত সুক্ষ্মভাবে ছত্রদের সমস্ত কর্মকাণ্ড সমস্ত আচার-আচরণ পর্যবেক্ষণ করতেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ছাত্রদেরকে এটাও ভালোভাবে বুঝাতেন যে, তাদের উপর তাঁর পরিপূর্ণ আস্থা রয়েছে। তিনি ছাত্রদেরকে ভালো-মন্দ কাজের জন্য নৈতিক পুরস্কারও দান করতেন। ছাত্ররা ভালো কাজ করলে সে জন্য তিনি এমন পুরস্কার দিতেন, যা আনন্দে তাদের মনকে ভরে তুলতো। পক্ষান্তরে খারাপ কাজের জন্য কঠোর তিরস্কার করতেন। ফলে ছাত্ররা সে জন্য অনুতাপ করতো। ভালো কাজ কলে তিনি তাদের জন্য ভালো দোয়া করতেন, ভালো কবিতা পাঠ করে শোনাতেন। আর মন্দ কাজ করলে সেজন্য টিপ্পনী কাটতেন। একটা কবিতা এখনো আমার মনে পড়ে। একজন ছত্র বাস্তব অনুশীলনকালে একটা প্রশ্নের এমন জবাব দেয়, যা তাঁর বেশ পছন্দ হয়। তিনি তাকে খাতায় একটা কবিতা লিখে নিতে বলেন। কবিতাটি ছিল এইঃ
**********************************
-বেশ জবাব দিয়েছে এবং জবাবে কৃতিত্ব দেখিয়েছে।
আল্লাহ তাকে সন্তুষ্টি আর হিদায়াতে ধন্য করুন।
এরকম আর একটা কবিতাও আমার মানসপটে গেঁথে আছে। আমার এক সঙ্গীকে অপছন্দনীয় জবাবের জন্য ‘পুরস্কার’ স্বরূপ তিনি এ কবিতাটি উপহার দেন। তাকেও খাতায় জবাবের নীচে কবিতাটি লিখে নিতে বলেনঃ
**********************************
-হে খোদার পাকড়াও, দ্রুত ছুটে এসো আর এ ছোকরাবে ছোঁ মেরে নিয়ে যাও।
এ কবিতাটি প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয় এবং ‘গারাতুল্লাহ’ পদবীটা সে ছাত্রের নামে পরিণত হয়। আমরা তাকে চটাবার জন্য ‘গারাতুল্লাহ’ নামে ডাকতাম। তাঁর দৃষ্টিশক্তি রহিত ছিল। এ কারণে তিনি নিজ হাতে ছাত্রদেরকে কিছু লিখে দিতে পারতেন না। বরং তিনি মুখে মুখে বলতেন আর ছাত্ররা খাতায় তা লিখে নিতো। তাঁর দৃষ্টিশক্তি ছিল না বটে, তবে তাঁর দর্শন শক্তি ছিল দৃষ্টিশক্তির চেয়েও তীব্র এবং প্রখর। কারণ আল্লাহ বলেনঃ
**********************************
“যার চক্ষুর দৃষ্টিশক্তি রহিত, সে অন্ধ নয়। অন্ধ হচ্ছে সে ব্যক্তি, যার পাঁজরের অন্তর আলোক থেকে বঞ্চিত”। তখন থেকেই ছাত্র আর শিক্ষকের মধ্যে মানসিক সাযুজ্য এবং ভাব আর আবেগের মিল সম্পর্কে আমার ধারণা জন্মেছে। যদিও সে সম্পর্কে পূর্ণ অনুভূতি জাগ্রত হয়নি তখন। তিনি আমাদেরকে হাঁড় ভাঙ্গা কাজে খাটাতেন। তা সত্ত্বেও তাঁর প্রতি আমাদের অন্তরে ছিল অকুণ্ঠ ভালোবাসা আর ভক্তি-শ্রদ্ধা। আমার মনে হয়, আত্মিক প্রেরণা ছাড়াও আমি তাঁর নিকট থেকে অধ্যয়ন আর জ্ঞান-গবেষণার স্পৃহাও লাভ করেছি। কারণ তিনি অধিকন্তু আমাকে তাঁর লাইব্রেরীতে নিয়ে যেতেন। সেখনে বেশ মূল্যবান গ্রন্হরাজীর বিপুল সমাহার ছিল। তাঁর দরকার মতো আমি বইগুলো ঘাটাঘাটি করতাম এবং প্রয়োজনীয় অংশ তাঁকে পাঠ করে শোনাতাম। কোন কোন সময় তাঁর বাসায় জ্ঞানী-গুণীজনদের সমাবেশ হতো এবং নানা বিষয়ে আলোচনা, বিতর্ক এমনকি বিতণ্ডাও চলতো। আমি মনোযোগ দিয়ে সেসব শুনতাম। ছাত্র আর শিক্ষকের মধ্যে এ ধরনের সরাসরি সম্পর্ক শুভ ফল বয়ে আনে। শিক্ষক সমাজ এ ধরনের সম্পর্কের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারলে মঙ্গল হবে। এদিকে তাঁদের বিশেষ গুরুত্ব দেয়া দরকার। ইনশাআল্লাহ এতে বেশ কল্যাণ হবে। ৮ বৎসর বয়স থেকে ১২ বৎসর বয়স পর্যন্ত সময়টা আমি এই মুবারক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অতিবাহিত করেছি।
মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি
এরপর ওস্তাদ মরহুদ মাদ্রাসা ছেড়ে অন্য কাজে নিয়োজিত হন। মাদ্রাসা অন্য পরিচালকদের হাতে ন্যস্ত করা হয়। নতুন পরিচালকরা ওস্তাদ যাহরানের মতো মনোবল, বিপুল জ্ঞান আর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও নৈতিক শক্তির অধিকারী ছিলেন না। ওস্তাদ যাহরানের আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ-অভিভূত ছিলাম আমি। সুতরাং নতুন শিক্ষকদের সংসর্গ আমার মনঃপুত হয়নি। তখনো আমার গোটা কুরআন মজীদ হিফয করা হয়নি। কেবল সূরা ইসরা পর্যন্ত ইয়াদ করা হয়েছে। আর আব্বাজান তাঁর সন্তানকে হাফেযে কুরআন হিসাবে দেখতে আগ্রহী। একদিন আমি দৃপ্ত কণ্ঠে আব্বাজানকে জানালাম যে, এহেন মক্তবে পড়ে থাকা এখন আমার কাছে ভীষণ অসহ্য। এখন আমাকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যেতে হবে। তখন মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ধারায় আসতো। অবশ্য তখনো মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বিদেশী ভাষা পড়ানো হতো না। তার পরিবর্তে দেশের আইন, অর্থনীতি এবং বাগান পরিচর্যা শিক্ষা দেয়া হতো। উপরন্তু জাতীয় ভাষা এবং দ্বীনিয়াত পড়ানো হতো বেশ গুরুত্ব দিয়ে।
পিতা মনেপ্রাণে কামনা করতেন তাঁর ছেলে হাফেযে কুরআন হোক। তাই তিনি আমার প্রস্তাবের বিরো্ধিতা করেন। কুরআন মজীদের অবশিষ্টাংশ ঘরে হিফয করার আশ্বাস দিলে পিতা আমাকে স্কুলে ভর্তি করার প্রস্তাব মেনে নেন। সে সপ্তাহেই এ অধম মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্র হয়েছে। তার দিনের সময়টা কাটতো স্কুলে। স্কুল থেকে ফিরে এসে এশা পর্যন্ত সে ঘড়ি মেরামতের কাজ শিখে আর এশার পর থেকে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত সে স্কুলের পড়া শেষে আর ভোরে শয্যা ত্যাগ করে ফজরের নামাজের পর থেকে স্কুলে গমনের আগ পর্যন্ত সে কুরআন মজীদ হিফয করার কাজে আত্মনিয়োগ করে।
চরিত্র শুদ্ধি সংস্থা
স্কুলের শিক্ষকদের একজন ছিলের মুহাম্মদ আফেন্দী আব্দুল খালেক। তিনি ছিলেন অংকের শিক্ষক। উন্নত চারিত্রিক গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন ওস্তাদ আফেন্দী। তিনি উপরের শ্রেণীর ছাত্রদের নিকট প্রস্তাব করেন তাদের নিজস্ব একটা সংস্থা গড়ে তোলার জন্য। তিনি তার নামকরণ করেন ‘জমিয়তে আখলাকে আদরিয়্যাহ’। সংস্থার কর্মসূচী তিনি নিজে প্রণয়ন করেন এবং তিনি ছিলেন এর পৃষ্টপোষক। সংস্থার পরিচালনা পরিষদ গঠন করার জন্য তিনি ছাত্রদেরকে নির্দেশ দেন। এ সংস্থার লক্ষ্য উদ্দেশ্য আর নীতিমালার সারকথা ছিল এইঃ
যে ছাত্র তার ভাইকে গালি দেবে, তাকে এক মিলিয়ন জরিমানা দিতে হবে। আর যে ছাত্র পিতাকে গালমন্দ দেবে, তাকে দু মিলিয়াম জরিমানা দিতে হবে। মায়ের সঙ্গে বেয়াদবী করলে এক ক্রোশ জরিমানা দিতে হবে। দ্বীন সম্পর্কে অশালীন কথাবার্তা বললে দু’ ক্রোশ জরিমানা দিতে হবে। অপরের সঙ্গে দাঙ্গা-ফ্যাসাদ করলেও দু’ ক্রোশ জরিমানা দিতে হবে। পরিচালনা পরিষদের সভাপতি আর সদস্যদেরকে উপরোক্ত অসদাচরণের জন্য দ্বিগুণ জরিমানা দিতে হবে। কোন ছাত্র এ নীতিমালা মেনে না চললে সঙ্গীরা তাকে বয়কট করবে এবং নীতিমালা মেনে না নেয়া পর্যন্ত এবং বয়কট অব্যাহত থাকবে। জরিমানা লব্ধ অর্থ কণ্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা হবে। দ্বীনের অনুসরণে একে অপরকে উপদেশ দান, যথা নামায আদায়ে উৎসাহ দান, আল্লাহর আনুগত্য, পিতামাতার বাধ্যতা এবং বয়স অনুপাতে বড়দেরকে সম্মান করার জন্য উদ্বদ্ধ-অনুপ্রাণিত করার সংস্থার সদস্যদের কর্তব্য।
রাশাদ দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এ অধম যে রুহানী পুঁজি সঞ্চয় করতে পেরেছিল, তার বরকতে ছাত্রদের মধ্যে এসব কাজে সে ছিল অগ্রসর। অতি অল্পদিনের মধ্যে সে সকলের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। সংস্থার পরিচালনা পরিষদের নির্বাচনে তাকে সভাপতি করা হয়। সংস্থা তার কার্যক্রম শুরু করে। সংস্থার নীতিমালা লংঘনের দায়ে অনেক সদস্যকে অভিযুক্ত করা হয় এবং বিষয় অনুযায়ী তাদের নিকট থেকে জরিমানা আদায় করা হয়। জরিমানা বাবদ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ সংগৃহীত হয়। এ অর্থের কিছু অংশ ব্যয় করা হয় লবীব ইসকান্দার নামে জনৈক সঙ্গীর বিদায়ী অনুষ্ঠানে। ছাত্রটা ছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জনৈক চিকিৎসকের ভাই। চিকিৎসককে অন্যত্র বদলী করা হলে বাধ্য হয়ে লবীবকে বিদায় নিয়ে চলে যেতে হয়। জরিমানার কিছু অংশ জনৈক অসহায় ব্যক্তির দাফন-কাফনের কাজে ব্যয় করা হয়। লোকটি নীলনদে ডুবে মারা গেলে তার লাশ ভেসে আসে। সংস্থার বায়তুল মাল থেকে তার দাফন-কাফনের সমস্ত খরচ চালানো হয়। এ ধরনের সংস্থা দ্বারা এমন ফল পাওয়া যায়, যা অনেক তাত্ত্বিক ওয়ায মাহফিল দ্বারা সম্ভব নয়। এ ধরনের সংস্থ-সংগঠন গড়ে তোলার প্রতি অধিক মাত্রায় গুরুত্বারোপ করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের উচিত।
নীল নদের তীরে
এ সংস্থা কচি শিশুদের মনে বেশ রেখাপাত করে। একদিন আমি নীল নদের তীরে দিয়ে যাচ্ছিলাম। সেখানে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক বাদামওয়ালা নৌকা বানাবার কাজে নিয়োজিত ছিল। মাহমুদিয়ায় এ শিল্পের বেশ বিস্তার ঘটেছে। সেখানে আমি দেখতে পাই যে, জনৈক ব্যক্তি তার নৌকার মাস্তুলের উপর একটা অশ্লীল নগ্ন মূর্তি ঝুলিয়ে রেখেছে। এমন উলঙ্গ মুর্তি ঝুলিয়ে রাখা সাধারণ নৈতিকতারও পরিপন্হী। বিশেষ করে নীল নদের তীরের এ অংশে বিপুল সংখ্যক নারী আগমন করে পানি নেওয়ার জ ন্য। এ দৃশ্য দেখে আমার অন্তর কেঁপে উঠে। আমি তৎক্ষণাৎ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জের কাছে গিয়ে এ অশ্লীল দৃশ্যেল বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাই। ইনচার্জ আমার এ আবেদকে গালমন্দ দিয়ে তৎক্ষণাৎ মূর্তিটা নামিয়ে ফেলার নির্দেশ দেন। নির্দেশ তৎক্ষণাৎ কার্যকর হয়। পরদিন ফাঁড়ির ইনচার্জ আমাদের স্কুলে আসেন এবং প্রধান শিক্ষককে এ ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ওস্তাদ মাহমুদ আফেন্দীও ছিলেন বেশ গুণী ব্যক্তি। পরবর্তীকালে তিনি শিক্ষা বিভাগের বড় কর্মকর্তা হয়েছিলেন। এ কাহিনী শুনে তিনিও আনন্দিত হন। পরদিন তিনি স্কুলের সমস্ত ছাত্রকে এ ঘটনা জানান। মানুষকে সদুপদেশ দেয়ার জন্য তিনি ছাত্রদেরকে উৎসাহিত করেন। তিনি ছাত্রদেরকে বলেন, অন্যায়-অশ্লীল কিছু দেখলে ছাত্রদের উচিত তার প্রতিবাদ করা। শৈশবে ওস্তাদ যাহরানের নিকট য শিক্ষা পেয়েছি, তার বরকতেই আমি এ প্রতিবাদ করতে পেরেছি নারী-পুরুষের যুগল ছবির বিরুদ্ধে। বর্তমানে এসবের প্রতি মনোযোগ দেয়ার গরজ বোধ করে না কেউই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান আর পুলিশ কর্মকর্তা সকলেই এ দয়িত্ব এড়িয়ে চলেন।
ছোট মসজিদের চাটাইয়ের উপর
স্কুলের অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রীরা মসজিদে নামায আদায় করতো। মসজিদটি ছিল স্কুলের নিকটে। বিশেষ করে ছাত্ররা এখানে যোহরের নামায আদায় করতো। দুপুরে খাবার পর মসজিদের প্রশস্ত আঙ্গিনায় ছাত্ররা জড়ো হতো। মসজিদটি ওয়াকফ বিভাগের অধীনে ছিল না। এ প্রসঙ্গে এক চিত্তাকর্ষক কৌতুকের কথা আমার মনে পড়ে। এই মসজিদের ইমাম ছিলেন শায়খ মুহাম্মদ সাঈদ। একদিন তিনি মসজিদে এসে দেখেন তাতে ছাত্রদের মধ্য থেকে একজন আযান দিয়েছে। এরপর জামায়াত। ইমমা সাহেবের ভয় হলো, মসজিদের পানি অপচয় হবে। চাটাইও ভেঙ্গে যাবে। নামায শেষ হলে তিনি গায়ের জোরে ছাত্রদেরকে বের করে দেন। তাদেরকে ভয় দেখান, ধমক দেন। ভয়ংকর শাস্তিরও ভয় দেখান। তাঁর কথায় কিছু ছাত্র পালিয়ে যায়। আর কিছু ছাত্র ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। আমার মনে শিশুসুলভ চপলতা জেগে উঠে। আমি সিদ্ধান্ত নেই, ইমাম সাহেবের নিকট থেকে এ আচরণের প্রতিশোধ অবশ্যই নিতে হবে। আমি তাঁকে এক পত্র লিখি। পতে এই আয়াত উল্লেখ করিঃ
**********************************
“যারা আপন প্রভুর সন্তুষ্টি কামনায় সকাল-সন্ধা তাদের পালনকর্তাকে ডাকে, তুমি তাদেরকে তাড়িয়ে দেবে না। তাদের হিসাব নেয়া তোমার দায়িত্ব নয়। আর তোমার হিসাব নেয়াও তাদের কাজ নয়। তাদেরকে তাড়িয়ে দিলে তুমি যালিমের অন্তর্ভূক্ত হবে”। (সূরা আন’আমঃ ৫২)
আমি তাঁর কাছে এ চিঠি বেয়ারিং করে প্রেরণ করি এবং মনে করি য, জরিমানা হিসাবে এক ক্রোশই যথেষ্ট। এ চিঠি পেয়ে তিনি বুঝতে পারেন, কোথা থেকে তাঁর উপর এ আঘাত এসেছে। তিনি আমার পিতার সঙ্গে দেখা করে তাঁর কাছে আমার বিরুদ্দে নালিশ করেন এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কিন্তু আব্বাজান তাঁকে উপদেশ দিয়ে বলেন যে, শিশুদের সঙ্গে সদাচার করতে হয়। তাদের ব্যাপারে উত্তম পন্হা অবলম্বন করা উচিত। এরপর তিনি আমাদের সঙ্গে হাসিখুশী করেছেন। সদাচার করেছেন। তিনি আমাদের উপর শর্ত আরোপ করেন যে, মসজিদ থেকে বের হওয়ার আগে পানির টাংকী ভরে দিতে হবে এবং চাটাই ভেঙ্গে গেলে চাঁদা আদায় করে চাটাই কিনে দিতে হবে। আমরা এ শর্ত মেনে চলেছি।
হারাম প্রতিরোধ সমিতি
বিদ্যালয়ের চৌহাদ্দির মধ্যে সীমাবদ্ধ সংস্কারমূলক তৎপরতা যুব সমাজের আগ্রহের আগুন নিবাতে পারেনি। তাই তাদের মধ্যে কয়েকজন একত্র হয়ে ‘হারাম প্রতিরোধ সমিতি’ নামে একটা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এসব আগ্রহী যুবকদের মধ্যে কয়েকজনের নাম উল্লেখযোগ্য। যেমন ওস্তাদ মোহাম্মদ আলী বেদাইর। যিনি পরবর্তীকালে শিক্ষা বিভাগে যোগদান করেন। লবীব আফেন্দী নাওয়ার। ইনি পরবর্তীকালে ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করেন। আব্দুল মুতাআল আফেন্দী ও ওস্তাদ আব্দুর রহমান। ইনি শিক্ষা জীবন শেষে রেলওয়ে বিভাগে চাকুরী নেন। ওস্তাদ সাঈদ বুদাইর। ইনি পরবর্তীকালে ইঞ্জিনিয়ার হয়েছেন। এদের উদ্যোগে হারাম প্রতিরোধ সমিতি গঠিত হয়। সমিতির সদস্যপদের চাঁদা ছিল সপ্তাহে পাঁচ মিলিয়াম থেকে দশ মিলিয়াম। সদস্যদের মধ্যে কাজ ভাগ করে দেয়া হয়। কারো দায়িত্ব ছিল কুরআন-হাদীস এবং ফিকহ থেকে প্রয়োজনীয় আয়াত, হাদীস এবং ফিকহের উদ্ধৃতি খুঁজে বের করে পত্রের খসড়া প্রস্তুত করা। কারো দায়িত্ব ছিল পত্র লিখা আর কারো দায়িত্ব ছিল পত্রগুলো মুদ্রণ করা। অন্যান্য সদস্যরা এসব পত্র লোকদের মধ্যে বন্টন করতো। যাদের সম্পর্কে সমিতি জানতো যে, এরা কোন গুনাদের কাজে লিপ্ত আছে বা ইবাদাত বিশেষ করে যারা সঠিকভাবে নামায আদায় করে না, সেসব লোকের নিকট এ পত্র প্রেরণ করা হতো। যে ব্যক্তি রমযান মাসে রোযা রাখতো না এবং সমিতির কোন সদস্য তাকে দিনের বেলা পানাহার করতে দেখতে পেতো, তার সম্পর্কে তৎক্ষণাৎ সমিতিকে অবহিত করা হতো। সমিতির পক্ষ থেকে এমন লোককে চিঠি দেয়া হতো। যাতে রোযা না রাখার কঠোর গুনাহের প্রতি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হতো। যে ব্যক্তি অনিয়মিত নামায আদায় করে, বা নামায আদায়ের প্রয়োজনীয় শর্তাবলী পালন কনে না, ঠিকমতো বিনয় আর দীনতার সাথে নামায আদায় করে না, বা নামায আদায়ে শৌথিল্য করে, এমন লোকের নিকট পত্র প্রেরণা করে এদিকে তার দৃষি।ট আকর্ষণ করা হয়। কোন পুরুষকে স্বর্ণ ব্যবহার করতে দেখা গেলে পত্র মারফত এ হারাম কাজ থেকে তাকে বারণ করা হতো এবং এ ব্যাপারে শরীয়তের বিধান সম্পর্কে তাকে অবহিত করা হতো। শোকে-দুঃখে কোন নারীকে মাথা কুটতে দেখলে তার স্বামী বা অভিভাবকের নিকট পত্র প্রেরণ করে এহেন জাহেলী রসম থেকে বিরত থাকার জন্য দীক্ষা দেয়া হতো।
মোটকথা, বড়-ছোট এমন ব্যক্তি ছিল না, যাকে পাপ কাজে লিপ্ত হতে দেখা গেছে; অথ সমিতি পত্র মারফত তাকে সংশোধন করার চেষ্টা চালায়নি। যেহেতু সমিতির সদস্যরা বয়সে ছিল তরুণ। সাধারণতঃ তারা মানুষের চোখে ধর্তব্য হতো না, আর এ ধরনের কাজ তারা করতে পারে বলে মানুষ মনেও করতো না, এ কারণে মানুষ তাদের থেকে নিজেদেরকে লুকাতো না। ফলে যুবকরা তাদের সব কাজ জানতে পারতো। মানুষ মন করতো এটা ওস্তাদ শায়খ যাহরানের কাজ। এ কারণে লোকেরা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বলতো, যা কিছু বলার আছে আপনি মুখে বলবেন। এসব পত্র প্রেরণ কেন? এ কাজের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই- এ কথা তিনি বললেও মানুষ তা বিশ্বাস করতো না। শেষ পর্যন্ত একদিন সমিতির পক্ষ থেকে শায়খ যাহরানের নিকটও পত্র প্রেরণ করা হয় যে, অমুক দিন আপনি যোহরের ফরয নামায আদায় করেছেন খাম্বার মধ্যখানে। অথচ এটা মাকরূহ। শায়খ যাহরান শহরের নামকরা আলেমে দ্বীন। মাকরূহ কাজ থেকেও তাঁর বিরত থাকা উচিত। তবেই তো সাধারণ মানুষ হারাম কাজ থেকে বিরত থাকবে। এ সময় আমি শায়খ যাহরানের লাইব্রেরী ত্যাগ করলেও তাঁর দারসে আমি শরীক থাকতাম। ফলে তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। একদিন তিনি আমাকে ডেকে পাঠান। যাতে আমরা উভয়ে মিলে উপরোক্ত মাসআলা বোখারী শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্হ ‘ফাতহুল বারী’তে অনুসন্ধান করতে পারি। এ প্রসঙ্গটা এখনো আমার মনে জাগে। আমি শায়খের সম্মুখে ফাতহুল বারীর এবারত পড়ছিলাম আর তাঁর ওষ্ঠে হাসির রেখা ফুটে উঠছিল। তিনি জানতে চাইলেন, কে যুবকদেরকে এই মাসআলা অবহিত করেছে। অনুসন্ধান দ্বারা প্রমাণ হয়েছে যে, যুবকরাই ঠিক। তাদের মতই বিশুদ্ধ। আমি গোটা ঘটনা সমিতির সদস্যদেরকে অবহিত করলে তাদের আনন্দের সীমা ছিল না।
৬ মাসেরও বেশী সময় ধরে সমিতি এ অভিযান অব্যাহত রাখে। মানুষ এ অভিযানে বিস্মিত এবং কেউ কেউ আতঙ্কিত হয়ে উঠে। অবশেষে এক কফি হাউসের মালিকের হাতে সমিতির রহস্য উদঘাটিত হয়। তিনি জনৈকা নর্তকীকে কফি হাউসে নিমন্ত্রণ করে নাচ-গানের আয়োজন করেন। এতে সমিতির পক্ষ থেকে তাকে একটা পত্র দেয়া হয়। অর্থ শ্রাদ্ধ করার জ্য সমিতির পত্র ডাকযোগে প্রেরণ না করে হাতে হাতে পাঠানো হতো। সমিতির সদস্যরা হাতে হাতে পত্র নিয়ে যেতো এবং এমন স্থানে ফেলে আসতো, যেখান থেকে সহজেই তা প্রাপকের নজর পড়তো। কফি হাউসের মালিক ছিল বেশ চতুর। তিনি পত্রবাহকের আগমন আঁচ করতে পেরে পত্রসহ তাকে ধরে ফেলেন এবং কফি হাউসে নিয়ে সকলের সামনে তিরস্কার করেন। ফলে সমিতি উন্মোচিত হয়ে পড়ে। এরপর সমিতির সদস্যরা তৎপরতা শিথিল করার সিদ্ধান্ত নেয়। হারাম প্রতিরোধের দায়িত্ব পালনের জন্য অন্য কোন পন্হা অবলম্বন করার বিষয় তারা চিন্তা করে।
শিক্ষক প্রশিক্ষণ স্কুল অভিমুখে
এ ছত্রগুলোর লেখক তার ওয়াদা পূরণ করেছে। যে যথারীতি কুরআন মজীদ হিফয করে চলেছে। রাশাদ মাদ্রাসায় সে যতটুকু হিফয করেছিল, তার সঙ্গে আরো এক চতুর্থাংশ যোগ করে সূরা ইয়াসীন পর্যন্ত হিফয সম্পন্ন করেছে। মাহমুদিয়ার জেলাবোর্ডে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচী পরিবর্তন করে সেগুলোকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরিণত করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সিদ্ধান্তের পর তার সামনে দুটি পথ খোলা রয়েছে, তন্ম্যে যে কোন একটা তাকে বাছাই করে নিতে হয়। হয় তাকে আলেকজান্দ্রিয়ার দ্বীনী শিক্ষা কেন্দ্রে ভর্তি হতে হবে এবং সেখান থেকে সে আযহারী শায়খ হবে, অন্যথায় তাকে দামানহুরের শিক্ষক প্রশিক্ষণ স্কুলে ভর্তি হতে হবে। এতে তার পথ সংক্ষিপ্ত হবে এবং তিন বৎসরের মধ্যে সে শিক্ষক হতে পারবে। শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয়টির পাল্লা ভারী হয় এবং আবেদন করার সময়ও ঘনিয়ে পড়ে। সে নামমাত্র আবেদন পত্রও পেশ করে। কিন্তু এখন তাকে দু’টি বড় প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। এরমধ্যে একটা হচ্ছে বয়সের বাধা। কারণ এখন তার বয়স সাড়ে ১৩ বৎসর। অথচ ভর্তির জন্য বয়স রাখা হয়েছে পূর্ণ ১৪ বৎসর। দ্বিতীয়তঃ কুরআন মজীদ হিফয সমাপ্ত করা্ কারণ এটাও ভর্তির জন্য অন্যতম শর্ত। ভর্তি হতে হলে কুরআন মজীদের মৌখিক পরীক্ষা বাধ্যতামূলক। শিক্ষক প্রশিক্ষণ স্কুলের প্রিন্সিপাল ছিলেন ওস্তাদ বশীর মূসা। ইনি ছিলেন বেশ ভদ্র ও নরম মানুষ? লেখকের সঙ্গে তিনি কোমল ব্যবহার করেন। বয়সের শর্ত তিনি শিথিল করেন এবং কুরআন মজীদের অশিষ্টাংশ হিফয করার ওয়াদাও তিনি মেনে নেন। তিনি ভর্তির জন্য লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষার অনুমতি দান করেন, যাতে লেখক সফল হয়। সেদিন থেকে সে দামানহুরস্থ শিক্ষক প্রশিক্ষণ স্কুরের ছাত্র।
হোছাফিয়া সিলসিলার প্রতি আগ্রহ
আগে ছোট মসজিদের কথা বলা হয়েছে। সেখানে আমি হোছাফী ইখওয়ানদেরকে দেখতে পাই। তারা প্রতিদিন এশার নামাজের পর আল্লাহর যিকির করতেন। আমিও সেখানে শায়খ যাহরানের দারসে মাগরিব এবং এশার মধ্যবর্তী সময়ে নিয়মিত উপস্থিত থাকি। যিকরের এই মাহফিল আমার জন্য ছিল বড়ই আকর্ষণীয়। ছোট-বড় সব বয়সের লোক এবং শিক্ষিত অশিক্ষিত সর্বস্তরের মানুষ এতে যোগ দিতো, এমনকি শিশুরাও বাদ যেতো না। শিশুদের প্রতি বড়দের স্নেহের আচরণ আমাকে বেশ আকৃষ্ট করে। আমি ও নিয়মিত এ মাহফিলে যোগ দিতে শুরু করি। ধীরে ধীরে হোছাফী ইখওান-এর যুব সমাজের সঙ্গে আমার বেশ হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড় উঠে। এদের মধ্যে তিনজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য; শায়খ শালবীর রিজাল, শায়খ মুহাম্মদ আবু শোশা এবং শায়খ মুহাম্মদ ওসমান। যাকেরীনদের মধ্যে যেসব যুবক বয়সে আমার কাছাকাছি ছিলেন, তাদের মধ্যে মুহাম্মদ আফেন্দি দিমাইয়াতী, সাবী আফেন্দী সাবী আব্দুল মোতাআল আফেন্দী এবং এমন আরো অনেক ছিল। এ পূর্ণবানদের দলে ওস্তাদ আহমদ সাকারী (যিনি পরে ইখওয়ানের সেক্রেটারী জেনারেল হয়েছিলেন) এর সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। এ সাক্ষাৎ আমাদের দু’জনের জীবনেই এক গভীর রেখাপাত করেছে। যে মুহূর্ত থেকে শায়খ হোছাফীর নাম কানে আসে এবং তাঁর নামটাই মনের উপর দারুণ শুভ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তাঁকে দেখার, তাঁর মজলিশে বসার এবং তাঁর কাছে থেকে উপকৃত হওয়ার আগ্রহ প্রতি মুহূর্তে বৃদ্ধি পেতে থাকে। আমি সকাল-সন্ধা নিয়মিত ‘রযুকী ওযীফা’, পড়তে শুরু করি। এ ওযীফার প্রতি আমার আগ্রহ এজন্য বৃদ্ধি পায় যে, মরহুম আব্বাজান এর চমৎকার ব্যাখ্যা গ্রন্হ রচনা করেছেন। এতে তিনি স্পষ্ট বলেছেন যে, এর সমস্ত শব্দ হাদীস থেকে গৃহীত। মরহুম আব্বাজান এ ব্যাখ্যা গ্রন্হের নামকরণ করেনঃ
**********************************
সকাল-সন্ধ্যা যেসব দোয়া পড়া মাসনূন, সেসব আয়াত আর হাদীসের সমন্বয়ে এই ওযীফা প্রণীত হয়েছে। কুরআন-হাদীসের বাইরের কোন শব্দ এই ওযীফার নেই। এ সময় আমার হাতে আসে একটা কিতাব, যার না-
**********************************
হাসনাইন আল হোছাফী সিলসিলার প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রাণ পুরুষ। এ সিলসিলার বর্তমান নেতা মুহতারাম শায়খ আব্দুল ওয়াহাবের তিনি পিতা। আল্লাহ তাঁর হায়াত দারাজ করুন এবং তাঁর ফয়েজকে ব্যাপক করুন। হিপরী ১৩২৮ সালের ১৭ই জুমাদাসসানী যখন তাঁর ইনতিকাল হয়, তখন আমার বয়স মাত্র চার বৎসর। এ কারণে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগ আমার ভাগ্যে জুটেনি। অবশ্য আমাদের এলাকায় তাঁর বেশ যাতায়াত ছিল। আমি কিতাবটি অধ্যয়নে ডুবে যাই। এ গ্রন্হ পাঠে আমি জানতে পারি যে, হোছাফী (র) আল-আযহারের শিক্ষাপ্রাপ্ত আলেম ছিলেন। শাফেয়ী মযহাবে তাঁর অগাধ পান্ডিত্য ছিল। গভীর অভিনিবেশ সহকারে তিনি দ্বীনী ইলম হাসিল করেছেন। নিতান্ত ইবাদাত ও বুযুর্গ আল্লাহর যিকরে ডুবে থাকতেন। রাসূলের আনুগত্য আর দুনিয়া ত্যাগের রীতিতে তিনি অটল ছিলেন। কয়েক দফা হজ্ব করেছেন আর প্রতিবারই হজ্বকালে কয়েক দফা ওমরা করেছেন। তাঁর সঙ্গী সাথীরা সকলেই এক কথায় এক ভাষায় বলেন যে, পাবন্দীর সঙ্গে ফরয, সুন্নাত এবং নফল আদায় করা তথা আল্লাহর আনুগত্যে আমরা তাঁর চেয়ে বেশী আগ্রহী অন্য কাউকে দেখিনি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এ পথে অটল ছিলেন। অথ তখন তার বেশ বয়স হয়েছে, ষাট বছরেরও বেশী। তরীকতপন্হীদের রীতি-পন্ধতি অনুযায়ী আল্লাহর দিকে ডাকার কাজও করতেন। অবশ্য তিনি তা করতেন তরীকত আর নূরে ডুবে থেকে এবং সঠিক ও পবিত্র মূলনীতি অনুযায়ী। জ্ঞান ও তরবিয়াত, ফিকহ ও ইবাদাত এবং আনুগত্য ও যিকরের ভিত্তিতে তাঁর দাওয়াত প্রণীত ছিল। তাসাউউফ ও তরীকতের অনুরক্তদের মধ্যে যেসব বেদায়ত আর বিকৃতি বিস্তার লাভ করেছে, তিনি সে সবের ঘোর বিরোধী ছিলেন। সবসময় এবং সর্বাবস্থায় তিনি কেবল কিতাব ও সুন্নাহকেই মশাল হিসাবে গ্রহণ করতেন। ভূল ব্যাখ্যা আর বিভ্রান্তিকর বিকৃতি থেকে দূরে থাকতেন। ভালো কাজের নির্দেশ দিতেন আর মন্দ কাজ থেকে বারণ করতেন। উপদেশ আর শুভ কামনার কাজ প্রতি মুর্হর্তে জারী রাখতেন। তাঁর মতে কিতাব ও সুন্নাহবিরোধী এমন অনেক ক্ষেত্রে তিনি পরিবর্তন সাধন করেন, যা স্বয়ং তাঁর শায়খ আর ওস্তাদরা মেনে চলতেন। তাঁর চরিত্রের যে দিকটি আমাকে সবচেয়ে বেশী আকৃষ্ট করেছে, তা হচ্ছে আমর বিল মারূফ ও নাহী আনিল মুনকার সম্পর্কে তাঁর কড়াকড়ি। এটাই আমার মনকে আপ্লুত করেছে। তিনি এ ব্যাপারে কারো তিরস্কার-ভর্ৎসনাকে ভয় পেতেন না এবং যতবড় মহান ব্যক্তিত্বই তাঁর সামনে থাকুক না কেন, ভালো কাজের নির্দেশ আর মন্দ কাজে নিষেধ তিনি ত্যাগ করতেন না। এর অনেক উদাহরণ পেশ করা যায়:
রিয়াজ পাশা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে একদিন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান। এ সময় পাশার নিকট একজন আলেম আসেন এবং তাঁর সামনে এমনভাবে ঝুঁকে পড়েন, যেন রুকু করছেন আর কি! শায়খ ক্রুব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন এবং মওলবী সাহেবের মুখে এক চড় বসিয়ে দেন। কঠোর ভাষায় তাকে নিষেধ করে বলেন:
মিয়া সাব সোজা হয়ে দাঁড়াও। আল্লাহ ছাড়া কারো সামনে মাথানত করা জায়েয নেই। নিজের দ্বীন আর জ্ঞানকে কলংকিত করবে, তাহলে আল্লাহ তোমাকে কলংকিত করবেন। মওলবী সাহেব এবং পাশা উভয়ে অবাক হয়ে যায়। শায়খকে কোনভাবেই কিছু বলার সাহস কারো হয়নি। তিনি তখনো মজলিশে বসে আছেন, এমন সময় আরেকজন পাশা আসেন, যিনি রিয়াজ পাশার বন্ধু। তার হাতে ছিল স্বর্ণের আংটি। হাতে একটা লাঠি ছিল, যার হাতল ছিল স্বর্ণের। শায়খ তাঁকে লক্ষ্য করে বলেন: ভাই সাহেব, এভাবে অলংকার হিসেবে স্বর্ণের ব্যবহার পুরুষের জন্য হারাম। নারীর জন্য হালাল। এ দুটি কোন নারীকে দান করে নবীজীর স্পষ্ট নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ থেকে বিরত থাকুন। পাশা সাহেব কিছু আপত্তি করতে চাইলেন, কিন্তু রিয়াজ পাশা হস্তক্ষেপ করে অন্য একজনকে পরিচয় করালেন। এরপর শায়খ পীড়াপীড়ি করতে থাকেন যে, আংটি এবং হাতলটা খুলে ফেলা উচিত, যাতে নিষিদ্ধ কাজ না করা হয়।
একদা বিশেষ কোন অনুষ্ঠান উপলক্ষে আলেমদের সঙ্গে খেদিভ তাওফীক পাশার নিকট গমন করেন। খেদিভকে উচ্চস্বরে সালাম করেন। খেদিত হাতের ইশারায় সালামের জবাব দেন। শায়খ দৃঢ়তার সঙ্গে তাকে বললেনঃ
সালামের অনুরূপ বা তার চেয়ে উত্তম জবাব দেয়া উচিত। ওয়ালাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু বলা উচিত। কেবল হাতের ইশারায় জবাব দেয়া জায়েয নেই। খেদিভকে নিরূপায় হয়ে মুখে সালামের জবাব দিতে হয়। শায়খের সত্যপ্রীতি এবং দ্বীনের ব্যাপারে কড়াকড়ির প্রশংসা করেন তিনি।
একবার সার্ভে বিভাগের কর্মচারীদের মধ্যে তাঁর জনৈক মুরীদের নিকট গমন করেন। তার অফিসে একটা মূর্তি দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করেন, এটা কি? মুরীদ বললেন, এটা প্রতিকৃতি, কাজের সময় দরকার হয়। শায়খ বললেন, এটা হারাম। তিনি প্রতিকিৃতি হাতে নিয়ে তা ভেঙ্গে ফেলেন। সে সময় জনৈক ইংরেজ পরিদর্শক আসে। এ দৃশ্য দেখে শায়খের কাজের ব্যাপারে বিতণ্ডা শুরু করে দেয়। শায়খ তাকে উত্তম উপায়ে জবাব দেন। তিনি তাকে বুঝিয়ে বলেন যে, নির্ভেজাল তাওহীন প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামের আগমন হয়েছে। ইসলাম যে কোন আঙ্গিকে মূর্তিপূজার চিহ্ন খতম করতে চায়। ইসলাম প্রতিকৃতিকে এ কারণে হারাম করেছে, যাতে এসব প্রতিকৃতি পূজা-উপাসনার মাধ্যম না হয়ে পড়ে। শায়খ এ বিষয়ে এতটা আলোকসম্পাৎ করেন যে, পরিদর্শক মাথা ঠুকতে থাকে। কারণ, তার ধারনা ছিল, ইসলামেও মূর্তিপূজার সংমিশ্রণ রয়েছে। সে শায়কের কথা মেনে নেয় এবং তাঁর প্রশংসা করে।
একবার এক মুরীদের সঙ্গে মসজিদে হোসাইনে গমন করেন (আল আযহার এলাকায় এ মসজিদ অবস্থিত। এখানে হোসাইন (রা)-এর রওজা রয়েছে। ঐতিহাসিক দিক থেকে হযরত ইমাম হোসাইনের লাশ এখানে এনে দাফন করা প্রমাণ সিদ্ধ নয়-খলীল হামেদী)। কবরের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি সুন্নাত দোয়া পড়েন:
**********************************
-কবরবাসী মু’মিনদের প্রতি সালাম….. জনৈক মুরীদ বলে উফলোঃ আমাদের গুরু! সাইয়েদুনা হোসাইনকে বলূন, তিনি যেন আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট হন। শায়খ হোছাফী বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকান এবং বলেন: তাঁর প্রতি আমাদের এবং তোমাদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট হোন। মসজিদ পরিদর্শন আর কবর জিয়ারতের পর তিনি মুরীদদেরকে নিয়ে বসেন। তাদের সম্মুখে কবর জিয়ারতের বিধান ব্যাখ্যঅ করেন এবং স্পষ্ট করে বলেন, শরীয়তসম্মত আর বেদায়াতী জিয়ারতের মধ্যে কি পার্থক্য রয়েছে।
আব্বাজান আমাকে বলেছেন যে, মাহমুদিয়ার সম্মানিত ব্যক্তি হাসান বেক আবু সৈয়দ হাসান-এর গৃহে তিনি শায়খ হোছাফীর সঙ্গে মিলিত হন। অন্যান্য বন্ধু এবং হাছাফী ইখওয়ানরাও ছিল। গৃহের যুবতী সেবিকা কফি নিয়ে আসে। তার দুই বাহু এবং মাথা সম্পূর্ণ উলঙ্গ ছিল। শায়খ ক্রুব্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, যাও, দেহের নগ্ন অংশ ঢেকে এসো। তিনি কফি পান করতেও অস্বীকার করেন। মেজবানকে উদ্দেশ্য করে তিনি জ্বালাময়ী ওয়াজ করেন। এতে তিনি বলেন, যুবতীরা সেবিকা হলেও দেহের এসব অংশ ঢেকে রাখা তাদের জন্যও ফরয! তাদেরকে কখনো বেগানা পুরুষদের সামনে আসা উচিৎ নয়।
মোটকথা, শায়খ হোছাফীর জীবনে এ ধরনের ঘটনা অনেক। এসব ঘটনা অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। গোটা জীবনে তাঁর এমনই ভূমিকা ছিল। তাঁর এসব সৌন্দর্য আমার অন্তরে তাঁর প্রতি ভক্তিশ্রদ্ধার অদম্য জোয়ার সৃষ্টি করে। হোছাফী ইখওয়ানরা সব সময় তাঁর কেরামতির কথা প্রচার করতো। কিন্তু আমার অন্তরে যেসব কেরামতির তেমন প্রভাব ছিল না, যেমনটা ছিল তাঁর কর্মের। আমার বিশ্বাস ছিল, আল্লাহ তা’আলা শায়খকে সবচেয়ে বড় কারামাতে ধন্য করেছেন, তা হচ্ছে সঠিক পদ্ধতিকে ইসলামী দাওয়াত পেশ করার তাওফীক ও সাহস। এবং হারামের ব্যাপারে তাঁর মনে জেগে ওঠা এক অস্বাভাবিক আবেগ-অনুভূতিও ছিল তাঁর এক বড় কারামাত। এর ফরেয ও বরকতেই তিনি ভালো কাজের নির্দেশ আর মন্দ কাজ থকে বিরত রাখার তিক্ত ও কঠিন দায়িত্ব পালন করতে পেরেছেন। আমি যখন শায়খেখর সঙ্গে যুক্ত হই, তখন আমার বয়স ১৮ বৎসরের বেশী হবে না।
আমি তাঁর রচিত গ্রন্হ কয়েকবার পড়েছি। এ সময় আমি স্বপ্নে দেখি যে, আমি শহরের কবরস্তানে গিয়েছি। আমি দেখি, কবরস্তানের একটা কবর শূন্যে ঝুলছে। কবরের কম্পন আর অস্থিরতা বেড়ে চলেছে। শেষ পর্যন্ত কবরটি ফেটে গেছে এবং কবর থেকে আগুন বের হচ্ছে। আগুন এত উপরে উঠছে যে, আসমান ছুঁই ছুঁই করছে। পরে তা একজন মানুষের রূপ ধারণ করেছে। এক বিশেষ মানুষ। লোকটি ভয়ংকর লম্বা। এক ভয়াল দৃশ্য। চারদিক থেকে লোকজন ছুটে এসে তার চতুর্দিকে জড়ো হচ্ছে। লোকটি জোরে জোরে চিৎকার করে সকলকে বলছে; লোক সকল! তোমাদের জন্য যেসব বিষয় হারাম ছিল, আল্লাহ তা মোবাহ করে দিয়েছেন। এখন তোমরা যা ইচ্ছা করতে পার। আমি সে বিশাল জনতার ভিড় থেকে বেরিয়ে এসে তার বিরোধিতা করে চিৎকার জুড়ে দিয়ে তার মুখের উপর বলছি; তুমি মিথ্যা বলছো। সকলের দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ। আমি তাদেরকে বলছি; ভাইসব! এ লোকটা হচ্ছে ইবলীস। তোমাদেরকে প্ররোচনা দিয়ে দ্বীন থেকে দূরে সরিয়ে নেয়ার জন্য এসে এসেছে। তার কথায় তোমরা মোটেই কর্ণপাত করবে না। এতে লোকটা রাগন্বিত হয়ে আমাকে বলছৈ, এখন সকলের সামনে আমাদের দু’জনকে দৌড় প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে হবে। তুমি যদি আমার আগে যেতে পার এবং আমি তোমাকে ধরতে না পারি, তবে তুমিই সত্য্ আমি তার এ শর্ত মেনে নিয়ে তার আগে দ্রুত ছুটে যাচ্ছি। কিন্তু কোথায় আমি আর কোথায় তার লম্বা লম্বা পা। এ সময় এক কোণা থেকে শায়খ হোছাফী দেখা দেন। তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। তিনি বাম হাত দিয়ে আমাকে ধরে রেখেছেন আর ডান হাত উপরে তুলে একটা কিছুর দিকে ইঙ্গিত করে বলছেন, মরদূদ, দূর হও। সে কোথাও গিয়ে আত্মগোপন করে। শায়খও চলে যান। আমি ফিরে এসে লোকজনকে বলি; তোমরা দেখতে পেলে, এ মরদুদ কেমন করে তোমাদেরকে আল্লাহর দ্বীন থেকে গোমরাহ করতে চেয়েছিল! এরপর আমার চক্ষু খলে যায়। এখন আমি অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষার প্রহর গুনছি, কখন শায়খ হোছাফী (র)-এর সুযোগ্য সন্তান সৈয়দ আব্দুল ওয়াহাব হোছাফী উপস্থিত হবেন এবং তাঁর দর্শন লাভে আমি জীবনকে ধন্য করবো, তাঁর নিকট থেকে তরীকতের রীতিনীতি শিক্ষা করবো। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে তার আগমন হয়নি। এ ঘটনার পর থেকে শায়খ হোছাফীর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা আরো গভীর হয়।
কবরস্থানের কথা
কবরস্থানের কথা প্রসঙ্গে মাহমুদিয়ার ব্যবসায়ী শায়খ মোহাম্মদ আবু শোশার কথাও আমার মনে পড়ে। আমার রুহানী তরবিয়তে তাঁরও বিরাট ভূমিকা রয়েছে। তিনি ৮/১০ জন ছাত্র যোগাড় করে আমাদেরকে করবস্তানে নিয়ে যেতেন। সেখান আমরা কবর জিয়ারতের সুন্নাত আদায় করে শায়খ নজিলীর মসজিদে বসে ওযীফা পাঠ করতাম। শায়খ মুহাম্মদ আবু শোশা আমাদেরকে ওলী আল্লাহদের কাহিনী শোনাতেন। এসব কাহিনী শ্রবণ করে আমাদের অন্তর বিগলিত হতো আর চক্ষু থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়তো। এরপর তিনি আমাদেরকে খোঁড়া কবর দেখিয়ে স্মরণ করিয়ে দিতেন যে, শেষ পর্যন্ত এই কবরেই আমাদেরকে ঠাঁই নিতে হবে। কখনো কখনো তিনি আমাদের মধ্যে একজনকে কবরে নেমে কিছুক্ষণ নিজের শেষ পরিণতি স্মরণ করার জন্য বলতেন। কবরের অন্ধকার আর ভয়াবহতার কথা স্মরণ করতে বলতেন। শায়খ আবু শোশা নিজেও অঝোরে কাঁদতেন এবং আমাদের চক্ষুও অশ্রুসিক্ত হতো। আমরা বিনয় আর দীনতার সঙ্গে তওবা করতাম। কোন কোন সময় তিনি স্মৃতিস্বরূপ আমাদের বাহুতে সূতা বেঁধে দিতেন। তিনি আমাদেরকে বুঝাতেন যে, আমাদের কারো অন্তরে যদি মন্দ ভাব জাগে বা কারো উপর যদি শয়তান সওয়ার হয় তখন সে যেন তওবার কথা স্মরণ করে। আল্লাহর আনুগত্য এবং পাপ কাজ ত্যাগ করার প্রতিশ্রুতির কথা যেন স্মরণ করে। শায়খের এ উপদেশ আমাদের অনেক উপকার হয়েছে। আল্লাহ তাঁকে শুভ প্রতিদানে ধন্য করুন।
আমার অন্তর সর্বদা শায়খ হোছাফীর সঙ্গে আটকা ছিল। এ অবস্থায় আমি দামানহুরস্থ শিক্ষক প্রশিক্ষণ স্কুলে ভর্তি হই। এ শহরেই রয়েছে তাঁর কবর আর অসমাপ্ত মসজিদ। তখন পর্যন্ত যার কেবল ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে। অবশ্য পরে মসজিদ সম্পূর্ণ করা হয়েছে। আমি প্রতিদিন নিয়মিত তাঁর কবর জিয়ারত করতে যেতাম। আমি হোছাফী ইখওয়ানদের সংসর্গ করি এবং ‘তাওবা মসজিদের’ যিকরেরর মাহফিলে নিয়মিত যোগদান করি। আমি হোছাফী ইখওয়ানদের যিকরের মাহফিলের আমীর সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেই। তাঁর নাম শায়খ বাসইউনী। নিতান্ত নেক মানুষ, ব্যবসা করেন। শায়খ হোছাফীর নিকট আমাকে বায়য়াত করাবার জন্য আমি তাঁর কাছে আবেদন জানাই। তিনি আমার আবেদন মঞ্জুর করতঃ আমাকে কথা দেন যে, সৈয়দ আবদুল ওয়াহাব দামানহুরে আগমন করলে আমি তোমাকে তাঁর সম্মুখে উপস্থিত করবো। এ যাবৎ আমি তাসাউউফের পন্হায় কারো হাতে সরাসরি বায়য়াত করিনি। তাদের পরিভাষায় তখনো আমি কেবল প্রেমিকই ছিলাম। তখন পর্যন্ত কারো মুরীদ হইনি। (একটা কবিতা থেকে এ পরিভাষাটি গৃহীত হয়েছে। কবিতাটি এ রকমঃ
**********************************
“আমি নেককারদেরকে ভালোবাসি, তবে আমি নিজে নেককার নই। আশা করা যায়, আল্লাহ আমাকে নেকীর তাওফীক দান করবেন”।
হাছাফী ইখওয়ানরা দামানহুরে সৈয়দ আব্দুল ওয়াহহাবের আগমন সম্পর্কে আমাকে অবহিত করলে আমার আনন্দের সীমা থাকে না। আমি শায়খ বাসইউনীর নিকট গমন করে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আমাকে শায়খ আবদুল ওয়াহহাবের খেদমতে নিয়ে যাওয়ার জন্য আবেদ করি। তিনি আমাকে নিয়ে যান। দিনটি ছিল হিজরী ১৩৪১ সালের রমযান মাসের চার তারিখ। আসরের নামাজের পর তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। আমার স্মরণশক্তি প্রতারণা না করলে দিনটা ছিল রবিবার। এ সাক্ষাতে আমি সৈয়দ আব্দুল ওয়াহাহাবের হাতে হোছাফী এবং শাযেলী সিলসিলায় বায়য়াত করি। তিনি আমাকে এ সিলসিলার সমস্ত ওযীফা-কালামের অনুমতি দেন।
আল্লাহ তা’আলা সৈয়দ আব্দুল ওয়াহহাবকে শুভ প্রতিদান দান করুন। তাঁর সোহবাত থেকে আমি প্রভূত কল্যাণ আহরণ করেছি। তাঁর তরীকতে কল্যাণ ছাড়া অন্য কিছু আমি দেখতে পাইনি। ব্যক্তিগত জীবন এবং রুশদ আর সুলুকের বিচারেও তিনি অনেক পূত-পবিত্র স্বভাবে বিভূষিত ছিলেন। বরং এসব ক্ষেত্রে তাঁর স্থঅন ছিল অনন্য। মানুষের ধন-দৌলতের প্রতি তাঁর কোন মোহ ছিল না। লেনদেন, আচার-আচরণে তিনি একান্ত্র পবিত্রতা-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতেন। তিনি একা থাকেন বা মুরীদ পরিবেষ্টিত, সর্বাবস্থায়, গঠন-পাঠন, ইবাদাত, আনুগত্য বা যিকর-ফিকর ব্যতীত অন্য কোন কাজে তিনি সময় ব্যয় করতেন না। তিনি অতীব উত্তম উপায়ে ইওয়ান তথা মুরীদদের পথ প্রদর্শন করতেন। ভ্রাতৃত্ব, জ্ঞান অর্জন এবং আল্লাহর আনুগত্যের বাস্তব অনুশীলন করাতেন তিনি। আমার মনে পড়ে, তরবিয়ত আর তাযকিয়ার যে বিজ্ঞজনোচিত পন্হা তিনি অবলম্বন করতেন, তার আলোকে তিনি সাধারণ মুরীদদের সম্মুখে বিতর্কিত বা সন্ধিগ্ধ বিষয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করার অনুমিত দিতেন না শিক্ষিত ইখওয়ান তথা মুরীদদেরকে। তাদের সামনে নাস্তিক-জিন্দীক আর খৃস্টান মিশনারী ইত্যাদির প্রসঙ্গ উত্থাপন করারও অনুমতি দিতেন না। তিনি বলতেন, এ ধরনের কথাবার্তা বলবে একান্ত্র নিজেদের আসরে-মজলিশে। সেসব আসরে তোমরা এ নিয়ে বিতর্কও করতে পার। এসব অশিক্ষিত লোকদের সম্মুখে এমনসব কথাবার্তা বলবে, যা তাদেরকে আল্লাহর বন্দেগীল প্রতি উদ্বুদ্ধ-অনুপ্রাণিত করে। হতে পারে তোমাদের কথাবার্তা শুনে তাদের মনে সন্দেহ সৃষ্টি হবে আর সে সন্দেহের জবাব তার বুঝে আসবে না। আর এ কারণে শুধু শুধু তার বিশ্বাস নড়বড়ে হয়ে পড়বে।আর তোমরাই হবে এর কারণ। এক মজলিশে তিনি আমাকে এবং ওস্তাদ আহমদ সাকারীকে উদ্দেশ্য করে যে কথাগুলো বলেছিলেন, তা আজও আমার মনে পড়ে। তিনি বলেছিলেন; আমি এমন অনেক আলামত দেখতে পাচ্ছি যে, আল্লাহ তা’আলা অনেক লোকের অন্তর তোমাদের দিকে ঘুরায়ে দেবেন, অনেক লোককে তোমাদের সঙ্গী করবেন। ভালোভাবে জেনে রাখবে, যেসব লোক তোমাদের আশপাশে জড়ো হবে, তাদের সময় সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা তোমাদেরকে জিজ্ঞাস করবেন, তোমরা কি তাদের সময়কে ভালো কাজে ব্যয় করেছিলে, না সময়ের অপচয় করেছিলে। প্রথমটি করলে তারাও প্রতিদান পাবে এবং তাদের মতো তোমরাও পাবে। আর দ্বিতীয়টা হলে তোমরাও ধরা পড়বে এবং তারাও। এভাবে তাঁর সকল আদেশ-উপদেশ নেকী ও কল্যাণের জন্য উদ্বুদ্ধ করতো। মোটকথা, আমরা তাঁর মধ্যে নেকী ও কল্যাণ ছাড়া অন্য কিছুই দেখতে পাইনি।
**********************************
আমরা যা কিছু জানতে পেয়েছি, তারই সাক্ষ্য দিচ্ছি। গায়েব সম্পর্কে আমরা পর্যবেক্ষক নই। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৮১)
এ সময় মাহমুদিয়ায় একটা সংস্কারমূলক সংগঠন গড়ে তোলার চিন্তা আমাদের মনে জাগে। এ সংগঠন ছিল।
**********************************
হোছাফী কল্যাণ সংগঠন। মাহমুদিয়ার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আহমদ আফেন্দী সাকারী ছিলেন এ সংগঠনেনর সভাপতি আর আমি ছিলাম সেক্রেটারী। এ সংগঠন দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে নিজের চেষ্টা-সাধনা নিয়োজিত করে। প্রথম ক্ষেত্রটি ছিল সচ্চরিত্রের প্রতি আহ্বান, ক্রমবর্ধমান অপরাধ আর হারাম কার্য যেমন- মদ-জুয়া ও শোক পালনে বেদয়াত ইত্যাদির মূলোৎপাটন। আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রটি ছিল বাইবেল মিশন প্রতিরোধ, যা শহরে শিকড় গেড়ে বসেছিল। তিনজন যুবতী ছিল সে মিশনের প্রাণশক্তি, যাদের কর্মকর্তা ছিল মিসেস ওয়েস্ট। এ মিশন চিকিৎসা সেবা, হস্তশিল্প এবং অনাথ বালক-বালিকাদের সেবার আড়ালে খৃষ্টবাদ প্রচার শুরু করেছিল। হোছাফী কল্যাণ সংগঠন উক্ত মিশনের তৎপরতার তীব্র মোকাবিলা করে, সকল মহল থেকে যা প্রশংসিত হয়। পরবর্তীকালে ইখওয়ানুল মুসলিমুন এ সংঘাতে হোছাফী সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব করে।
ইখওয়ানুল মুসলিম মুসলিমুন প্রতিষ্ঠা এবং সারা দেশে তা বিস্তার লাভ করা পর্যন্ত সৈয়দ আব্দুল ওয়াহহাব হোছাফীর সঙ্গে আমাদের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে ইখওয়ানুল মুসলিমুন সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে পড়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভিন। তিনি এবং আমরা নিজ নিজ মতে অটল থাকি। কিন্তু এখনো আমি তাঁর সম্পর্কে মনে মনে শ্রদ্ধা পোষণ করি, যা একজন নিষ্ঠাবান মুরীদ তাঁর শায়খ সম্পর্কে পোষণ করতে পারে। তিনি নিঃস্বার্থভাবে ওয়াজ ও উপদেশ দানের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
তাসাউউফ সম্পর্কে আমার অভিমত
আমার ডাইরীতে ইসলামী দাওয়াতের ইতিহাসে তাসাউউফ ও তরীকতের নানা সিলসিলার কীর্তি সম্পর্কে আমার অনুভূতি ব্যক্ত করলে তা কল্যাণকর হবে। তাসাউউফের সূচনা কিভাবে হয়েছে, এর প্রভাব-পরিণতি কি ছিল এবং ইসলামী সমাজের অভ্যন্তরে তরীকতের নানা সিলসিলা কতটা কল্যাণকর- এসব বিষয়ে আমি পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনার অবতারণা করবো না,’ পারিভাষিক তত্ত্বের গভীরে প্রবেশ করার চেষ্টাও আমি করবো না। আমি স্মৃতিকথা লিখতে বসেছি। স্মৃতিকথায় মনের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া লেখা হয়, মনের কোণে যেসব বিষয় উঁকি-ঝুঁকি মারে, যেসব আবেগ-অনুভূতি দোলা খায়, তা স্মৃতিকথায় লিপিবদ্ধ করা হয়। আমার ব্যক্ত করা মনোভাব সঠিক হলে এটা হবে আল্লাহর তাওফীকেরই দান। আল্লাহই হচ্ছেন প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। আর যদি তা সঠিক না হয় তবে লেখকের অভিপ্রায় মঙ্গল ও কল্যাণ ছাড়া অন্য কিছুই নয়।
**********************************
“শুরুতে এবং শেষে হুকুমের মালিক আল্লাহ”। (সূরা রূমঃ ৪)
প্রথম শতাব্দীর সূচনায় যখন ইসলামী রাষ্ট্রের সীমা দূর-দুরান্ত পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে বিপুল বিজয় সাধিত হয়, যখন চতুর্দিক থেকে লোকজন মুসলমানদের দিকে ধাবিক হতে শুরু করে, যখন সব রকম সম্পদ মুসলমানদের ধন-ভাণ্ডারে প্রবেশ করতে শুরু করে; তখন খলীফাতুর মুসলিমীন আকাশের মেঘনালাকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন- প্রাচ্য আর প্রতীচ্যের যেখানেই বারি বর্ষিত হোক না কেন, সেখানকার রাজস্ব আমার কাছে আসবেই। এ সময় দুনিয়ার প্রতি মুসলমানদের ঝুঁকে পড়া, দুনিয়ার নিয়ামত উপভোগ করা এবং সেসবের স্বাদে-গন্ধে নিজেদেরকে পরিতৃপ্ত করা-কখনো ভারসাম্য রক্ষা আর মধ্যপন্হা অবলম্বন করে, আবার কখনো বা অপব্যয়-অপচয় করে-এটা ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। সমাজ যখন নবুওয়াতের উজ্জ্বল যুগের কষ্ট-ক্লেশ আর সরলতাকে বিসর্জন দিয়ে জাগতিক স্বাচ্ছন্দ্য আর আরাম-আয়েশের দিকে দ্রুত ছুটে যাচ্ছিল, তখন এহেন সামাজিক পরিবর্তনের সামনে তাকওয়া ও কল্যাণের বাহক একদল জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি এবং তাদের মধ্য থেকে একটা প্রভাবশালী দল দাওয়াত ও তাবলীগ তথা প্রচার ও প্রসারের জন্য সম্মুখে এগিয়ে আসবেন- এটাও ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। এ দলটি এগিয়ে এসে দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী ভোগের বস্তুর প্রতি মানুষের ভালোবাসা আর আকর্ষণ হ্রাস করাবেন এবং তাদেরকে পরকালের কথা স্মরণ করাবেন- এটাও খুবই স্বাভাবিক। তাঁরা এসে লোকদেরকে বলবেনঃ
**********************************
“আর পরকালের গৃহই হচ্ছে চিরন্তন, যদি তারা জানতে পারতো”। (সূরা আনকাবুত: ৬৪)
দাওয়াত ও সংস্কারের এ কাজ করার জন্য যারা সর্বপ্রথম দাঁড়ান, তাঁদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তিত্ব ছিলেন বিশিষ্ট ইমাম ও ওয়অজকারী হযরত হাসান বসরী (র)। তাঁরপর তাঁর মতো আরো অনেক সত্যের আহ্বানকারী এবং উম্মতের সাধু সজ্জন উত্থিত হয়েছেন। মানুষের মধ্যে এঁরা এই হিসাবেই পরিচিত হয়েছেন যে, এরা আল্লাহর যিকর এবং আখিরাতকে ভয় করার প্রতি আহ্বান জানান। দুনিয়া সম্পর্কে অল্পে তুষ্টি আর বর্জন করে চলার দীক্ষা দেন এবং মানুষের অন্তরকে আল্লাহর আনুগত্য ও তাকওয়অর লালন দ্বারা আলোকিত করে তোলেন।
কিন্তু এহেন পবিত্র আর বিশুদ্ধ বিষয়ের সঙ্গেও তাই ঘটটেছে, যা ঘটেছে অন্যান্য ইসলামী জ্ঞান আর চিন্তা-ধারার ক্ষেত্রে। ফলে এ বিষয়গুলো একটা যথারীতি জ্ঞানের রূপ ধারণ করে নেয়। আর এ জ্ঞঅনের আলোচ্য বিষয় সাব্যস্ত করে বলা হয় যে, এটা হচ্ছে সে জ্ঞান, যা মানুষের চরিত্র আর আচরণকে পরিশীলিত করে এবং মানুষের জন্য জীবনের একটা ধারণা প্রবর্তন করে। সে বিশেষ ধারার পর্যায়গুলো হচ্ছে যিকর, ইবাদাত এবং আল্লাহর মারিফাত বা সঠিক পরিচয় আর এর চরম লক্ষ্য হচ্ছে জান্নাত এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ। ইলমে তাসাউউফের এ অংশটা, আমি যার নামকরণ করি তরবিয়ত ও সুলুকের জ্ঞান নিঃসন্দেহে এটা ইসলামের সার নির্যাস এবং তারই মূল প্রাণসত্ত্বা। সন্দেহ নেই যে, সুফিয়ায়ে কিরাম এ জ্ঞানের মাধ্যমে অন্তরের চিকিৎসা ও সংশোধন এবং পরিশীলন-পরিশুদ্ধির ক্ষেত্রে এমন উঁচু স্থানে হাসিল করেছেন, ইছলাহ ও তরবিয়ত তথা লালন আর সংস্কারের অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা সে মর্তবায় কখনো পৌঁছতে পারেননি। সুফিয়ায়ে কিরাম এ রীতির সাহায্যে আল্লাহর নির্দেশিত ফরয সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করা, আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকা এবং আল্লাহর প্রতি সত্যিকার মনোনিবেশের একটা বাস্তব পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তদনুযায়ী পরিচালিতও করেছেন। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ও প্রক্রিয়া বাড়াবাড়ি থেকে মুক্ত নয় এবং যেসব যুগ আর কালের দাবী দ্বারা তা প্রভাবিত হয়েছে, সেসব যুগের সঙ্গে তারা দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে লিপ্ত ছিলেন। যেমন নীরবতা সম্পর্কে বাড়াবাড়ি; উপোষ সম্পর্কে বাড়াবাড়ি, অনিদ্রা সম্পর্কে বাড়াবাড়ি এবং নির্জন বাস বিষয়ে বাড়াবাড়ি। দ্বীনে এসব আমলের ভিত্তি বর্তমান আছে। যেমন নীরবতার ভিত্তি হচ্ছে বাজে কথা থেকে বিরত থাকা। উপোষ ব্রতের ভিত্তি হচ্ছে নফল রোযা। বিনিদ্র রজনী যাপনের ভিত্তি হচ্ছে কিয়ামূল লাইল তথা রাত্রিতে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করা আর নির্জন বাসের ভিত্তি হচ্ছে কষ্টদায়ক বিষয় থেকে নফসকে নিবৃত করা আর নাফসের সঠিক পরিচর্যা করা। শরীয়তের নির্ধারিত সীমার মধ্যে এসব বিষয়ের বাস্তব প্রয়োগ সীমিত রাখা হলে তা হতো আগাগোড়া কল্যাণকর।
কিন্তু সুফীবাদ সুলূক আ তরবিয়্যতের জ্ঞান পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকেনি। এ সীমার মধ্যে সীমিত থাকলে তা তার জন্যও ভালো হতো। আরো ভালো হতো মানুষের জন্যও। কিন্তু পরবর্তীকালের তা নিজের সীমা অতিক্রম করে যায় এবং মনস্তাত্ত্বিক আর দার্শনিক তত্ত্বের জটিলতা নিরসনের প্রবৃত্ত হয়। দর্শন, তর্কশাস্ত্র এবং অতীত জাতির অন্যান্য দর্শন আর চিন্তাধারার সংমিশ্রণ ঘটে তাতে। তা দ্বীনের মধ্যে এমনসব বিষয়কে ঘুলিয়ে ফেলে, যেসব বিষয়ের কোনই সম্পর্ক নেই দ্বীনের সঙ্গে। নাস্তিক-যিন্দিীকরা বক্র চাল আর বক্র চিন্তার অধিকারী মানুষের সম্মুখে এমন বিস্তীর্ণ সুযোগ করে দিয়েছে, যাতে তারা তাসাউউফের নামে এবং দরবেশী ও আরাম-আয়েশ ত্যাগের আড়ালে এবং রূহানী পরিচ্ছন্নতা অর্জনের আগ্রহের অন্তরালে দ্বীনের বিকৃতি সাধনের কাজ করছে। ব্যাপারটা এতটুকু গড়িয়ে গেছে যে, এ বিষয়ে লিখিত বা ঐতিহ্যগত যে সমস্ত ভান্ডার সন্নিবিষ্ট হয়ছে, তা এতটা অবিশ্বাস্য যে, সত্য দ্বীনের সমঝদার ব্যক্তি আর দ্বীনকে স্বচ্ছ-পরিচ্ছন্ন দেখতে আগ্রহী ব্যক্তিবর্গের জন্য তাকে সূক্ষ্মদর্শী দৃষ্টির কষ্টিপাথরে তুলে আসল আর নকল পৃথক করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
এরপর শুরু হয়েছে সূফীবাদের কার্যতঃ বিভক্তির যুগ। সৃষ্টি হয়েছে সূফীদের নানা ফের্কা আর নানা সিলসিলা। প্রত্যেকে নিজস্ব বিশেষ তরবিয়ত রীতির অধীনে নিজের একটা ফের্কা সৃষ্টি করেছে। পরবর্তীকালে এ ক্ষেত্রে রাজনীতিও অনুপ্রবেশ করতে থাকে। আর তা সূফীদের দলনে নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধির আশ্রয় হিসাবে ব্যবহার করে। কখনো এসব ফের্কাকে সামরিক কায়দায় সংগঠিত করা হয় (তুরস্কের ওসমানী যুগে ইনিচেরী ব্যবস্থা মূলত: তাসাউউফকে ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠা করা হয়, পরবর্তীকালে যাকে নিয়মিক সামরিক সংগঠনে পরিণত করা হয়- খলীল হামেদী)। আবার কখনো তাকে প্রাইভেট সংগঠনের রূপ দেয়া হয়। শেষ পর্যন্ত তাসাউউফ নানা পর্যায়ে অতিক্রম করে এমন এক চিহ্নিত রূপ ধারণ করেছে, যা আমাদের সম্মুখে বর্তমান রয়েছে। তাসাউউফের দীর্ঘ ইতিহাসে সৃষ্ট নানা রঙের অবশিষ্ট নিদর্শনই এই চিত্রে দেখা যায়। তরীকতের বিভিন্ন সিলসিলার শায়খ আর তাঁদের মুরীদ আর ভক্তদের মাধ্যমে অধুনা মিশরে এ দর্শনের প্রতিনিধিত্ব চলছে।
সন্দেহ নেই যে, অনেক দেশে ইসলামের প্রচার-প্রসার এবং দূরান্ত পর্যন্ত ইসলামকে নিয়ে যাওয়ার কাজে তাসাউউফ ও তরীকত বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। সূফীয়ায়ে কেরামের চেষ্টা-সাধনা ব্যতীত যেসব অঞ্চলে ইসলাম পৌঁছানো সম্ভব ছিল না। উদাহরনস্বরূপ বলা যায়, আফ্রিকার বিভিন্ন শহর আর মরু অঞ্চল এবং মধ্য আফ্রিকায় ইসলামের প্রবেশ সূফিয়ায়ে কেরামের বদৌলতেই সম্ভব হয়েছে এবং বর্তমানেও এ কাজ চলছে। এশিয়ার অনেক দেশে (বিশেষ করে উপ-মহাদেশে) এ অবস্থাই হয়েছে। উপরন্তু এ কথাও সন্দেহ-সংশয়ের অতীত যে, তরবিয়ত আর সুলুকের ক্ষেত্রে তাসাউউফের রীতি-নীতির উপর আমল করা মন-মানসের উপর বিরাট ছাপ মুদ্রিত করে। এ ক্ষেত্রে সুফিয়ায়ে কেরামের বাণী এমন উদ্যম আর আবেগ-উচ্ছাসের সঞ্চার করে, যা অন্য কোন বাণী করতে পারে না। কিন্তু তাসাউউফের মধ্যে বিভিন্ন দর্শন আর চিন্তাধারার সংমিশ্রণ-এর বেশীরভাগ কল্যাণকে বিনষ।ট করে দিয়েছে।
সূফীদের এসব দলের সংস্কার-সংশোধন আর পরিশুদ্ধির জন্য দীর্ঘ চিন্তা-ভাবনা করা উম্মতের সংস্কারকদের কর্তব্য। এদের সংস্কার-সংশোধন অতি সহজ। সংস্কার গ্রহণ করার পরিপূর্ণ যোগ্যতা এদের মধ্যে রয়েছে। বরং অন্যসব মানুষের চেয়ে বেশীই রয়েছে। শর্ত হচ্ছে সঠিকভাবে সংস্কারের প্রতি তাঁদের মনোযোগ আকর্ষণ করা। এ দায়িত্ব পালন করার জন্য কেবল এতটুকুই যথেষ্ট যে, কিছু সৎ আর সত্যনিষ্ট আমলদার আলেম এবং নিষ্ঠাবান ও সত্যাশ্রয়ী মোবাল্লেগকে অন্যসব কাজ ত্যাগ করে কেবল এদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং তাসাউউফের বিশাল জ্ঞান ভান্ডার থেকে কল্যাণ লাভ করতে হবে এবং এতে যেসব বিকৃতি অনুপ্রবেশ করেছে, তা পরিস্কার করতে হবে। এরপর এ ক্ষে্রের অভিসারীদের সঠিক নেতৃত্বের ব্যবস্থা করতে হবে। আমার মনে পড়ে যে, সাইয়্যেদ তাওফীক বেকরী (র), এ বিষয়টি নিয়ে বেশ চিন্তাভাবনা করেছিলেন এবং মাশায়েখে কেরাম সম্পর্কে তাত্ত্বিক আর বাস্তবিক দিক থেকে গবেষণাধর্মী চেষ্টা সাধনা করেছিলেন। তিনি এ বিষয়ে একটা গ্রন্হও প্রণয়ন করেছিলেন। কিন্তু তাঁর এ পরিকল্পনা সমাপ্তিতে উপনীত হতে পারেনি। এবং তাঁর পরে অন্য আলেমরা এ ব্যাপারে মনোযোগই দেননি। আমার মনে পড়ে, শায়খ আব্দুল্লাহ আফীফী (র) ও এ বিষয়ে বেশ মনোযোগ দিয়েছেন। কিন্তু এ চিন্তা কেবল তাত্ত্বিক দিক পর্যনত্ সীমাবদ্ধ ছিল, এতে বাস্তব পদক্ষেপের কোন আলামত ছিল না। আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞান-ক্ষমতা, সূফীদের সিলসিলার রূহানী ক্ষমতা এবং ইসলামী আন্দোলন সমূহের কর্ম-ক্ষমতা এ তিনটি শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে একে অপরের সঙ্গে মিশে যেতে পারলে এ জাতি এক নজিরবিহীন জাতির রূপ ধঅরণ করতে সক্ষম হতো। তারা এমন এক উম্মতে পরিণত হতো, যা অন্যদের অনুসারী নয়, বরং পথ প্রদর্শক, অন্যদের অনুগামী নয়, বরং নেতা হতো, অন্যদের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে বরং অন্যদের উপর প্রভাব সৃষ্টিকারী হতো। আর সে জাতি বর্তমান মানব গোষ্ঠীকে সঠিক পথ প্রদর্শন করতে সক্ষম হতো। কিন্তু আল্লাহ যা চান, তা-ই হয়।
দামানহুরের দিনগুলো
দামানহুর আর শিক্ষক প্রশিক্ষণ স্কুলের দিনগুলো ছিল তাসাউউফ এবং ইবাদাতের সেবায় ডুবে থাকার সময়। বলা হয়ে থাকে যে, মানুষের জীবন কয়েকটা পর্যায়ে বিভক্ত। এসব পর্যায়ের অন্যতম ছিল মিশরের বিদ্রোহের অব্যবহিত পরে ১৯২০ থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত তিন বৎসর (মিশর জাতি ১৯১৯ সালে সা’আদ জগলুলের নেতৃত্বে ইংরেজদের মিশর অধিকারের বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহ শুরু করে এবং মিশরের স্বাধীনতার দাবী তোলে। এ বিদ্রোহের ফলে বৃটেন মিশরের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেয়-খলীল হামেদী)। এ বিদ্রোহ যখন শুরু হয় আমার বয়স তখন ১৪ বৎসরের চেয়ে কিছু কম ছিল। আর এ পর্যায় যখন শেষ হয় তখন আমার বয়স ১৭ বৎসরের চেয়ে কয়েক মাস কম। আমার জন্য এ পর্যায় ছিল তাসাউউফ আর ইবাদাতে নিমগ্ন থাকার পর্যায়। কিন্তু এরপরও ছাত্রদের উপর যে দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছিল, তাতে কার্যতঃ অংশগ্রহণ থেকে এ পর্যায় মুক্ত ছিল না মোটেই।
আমি যখন দামানহুর পৌঁছি, তখন আমি হোছাফী চিন্তা দ্বারায় আকষ্ঠ ডুবে ছিলাম। এ ধারার প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ হাসানাইন হোছাফীর কবর মোবারক ছিল দামানহুরেই। সেখানে বর্তমান ছিল শায়খের বাছাই করা মূরীদদের দল। এ পরিবেশে বিলীন হয়ে এ চিন্তা ধারায় সম্পূর্ণ ডুবে থাকা ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। আমাদের ওস্তাদ আলহাজ্ব হালুমী সুলাইমান তখনো দামানহুরে শিক্ষক হিসেবে কাজ করছিলেন। তিনি ছিলেন ইবাদাত পালন, সততা, তাকওয়া আর তরীকতের আদব পারবন্দীর সঙ্গে পালন করার উত্তম নমুনা। এ কারণে তাঁর আর আমার মধ্যে রূহানীী সম্পর্ক বিশেষ গভীর ছিল, যার ফলে আমার তাসাউউফে নিমগ্ন থাকা আরো গভীলতর হয়ে উঠে। তাঁর সহকর্মী এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু ওস্তাদ শায়খ হাসান খাযবেকও তখন দামানহুরে শিক্ষক ছিলেন। তাঁর বাসায় বসতো জ্ঞান আর তাবলীগের আসর। ইনি রমযানুল মুবারকে মসজিদুল জায়শে ইমাম গাজ্জালীর এহইয়াউল উলূমের দারস দিতেন। এসব সমাবেশে আলহাজ হালমী আমাকে তাঁর সঙ্গে নিয়ে যেতেন। এমনিভাবে অল্প বয়সের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও বড়দের সংসর্গ লাভের সুযোগ আমার হয়েছে। এদের মধ্যে আমার স্কুলের শিক্ষকরা ছাড়াও অন্যান্য জ্ঞানী গুণী ব্যক্তিরাও ছিলেন। এরা এবং অন্যান্য বুযুর্গরা আমাকে এবং আমার মতো অন্যান্য যুবকদেরকে আল্লাহর বন্দেগীর পথে অগ্রসর থাকার জন্য নিয়মিত উৎসাহিত করতেন। এসব কার্যকারণ সূফীসুলভ কর্মকাণ্ডে আমাকে নিয়োজিত রাখে।
আমার ওস্তাদ শায়খ আব্দুর ফাত্তাহ আবু আল্লামের সঙ্গে দীর্ঘ বিতর্কের কথা আমি কিছুতেই ভুলতে পারবো না। তিনি স্কুলে হাদীস- তাফসীর আর ফিকহ পড়াতেন। তাসাউউফের সিলসিলা আর সুফিয়া ও আওলিয়াদের সম্পর্কে আপত্তি প্রসঙ্গে এসব দীর্ঘ আলোচনা আর বিতর্কের সূচনা হতো। প্রিয় ওস্তাদ তর্কবিতর্ক করতে করতে শেষ পর্যায়ে হেসে পড়তেন। আনুগত্য আর দরবেশীর কর্মে আজীবন থাকার জন্য আমাকে উৎসাহিত করে গভীল অধ্যয়নের দীক্ষা দিতেন। তিনি বলতেন, গভীর অধ্যয়ন, ফিকহের বিভিন্ন মযহাব আর ইলমে কালামের নানা ফের্কা এবং তাসাউউফের সিলসিলার ইতিহাস সম্পর্কে গভীর অধ্যয়ন করলেই আমল তত্ত্ব উল্লাসিত হবে। আলোচনা আর তথ্যানুসন্ধান ছাড়া আমল তত্ত্ব আনুগত্য হওয়া যায় না। অধিকন্তু ওস্তাদদের সঙ্গে আমার মতবিরোধ ঘটতো; কিন্তু এরপরও আমি অনুভব করতাম যে, ওস্তাদের স্নেহ পুরোপুরি বহাল আছে এবং সঠিক পথ দেখাবার জন্য তাঁর মধ্যে সত্যিকার আগ্রহের অভাব নেই। আমাদের বিতর্ক আর যুক্তি প্রদর্শন সত্য উদ্ধারের আগ্রহ অতিক্রম করে যেতো না।
মসজিদুল জায়শের রজনী
দামানহুরের মসজিদুল জায়শ এবং ফূলাকা পুলের নিকট অবস্থিত হাতাতেবা মসজিদের রজনীগুলোর কথাও কিছুতেই ব্স্মিৃতি হতে পারব না। রমযান মাসে ফজর নামাযের পর শায়ক হাসান খাযবেক- এর দারসে শরীক হতাম। এখানেই উৎসাহ উদ্দীপনা আরো বৃদ্ধি পায়। এ মসজিদে হোছাফী ইখওয়ানদের একটা সত্যনিষ্ঠ দলের সঙ্গে গোটা রজনী এ’তেকাফে অতিহাহিত হতো। এখানে শায়খ মুহাম্মদ আমের ওস্তাদ হোসাইন ফাওজী আফেন্দীর সঙ্গে আমরা সামান্য আহার করে কিছুক্ষণ আল্লাহর যিকরে মশগুল হতাম। এরপর ঘন্টা দুয়েক ঘুমিয়ে ঠিক মধ্যরাতে তাহাজ্জুদের নামাযের জন্য উঠতাম এবং ফজরের নামায পর্যন্ত তাহাজ্জুদে নিমগ্ন থাকতাম। এরপর শুরু হতো ওযীফা কালামের ধারা। তারপর স্কুল অভিমুখে গমন করতাম। ছাত্ররা নিজ নিজ পাঠে মনোনিবেশ করতো, আর অছাত্ররা নিজ নিজ কাজের ধান্দায় গমন করতো। অধিকন্তু এমনও হতো যে, ঘরে থাকলে রাত্রে ফজরের অনেক আগে জেগে উঠতাম। তখনো মসজিদের দরজা খোলা হয়নি। তাই হাতাতেবা মসজিদে গমন করতাম। এ মসজিদটা ছিল হাতাতেবা নদীল তীল ফুলাকা পুলের নিকট অবস্থিত। ফজরের পূর্ব পর্যন্ত সেখানে ইবাদাত বন্দেগীতে ডুবে থাকতাম। এরপর ফজরের জামায়াতে শরীক হওয়ার জন্য দ্রুত ছুটে আসতাম মসজিদুল জায়শ অভিমুখে।
ওলী-আওলিয়াদের যিয়ারত
জুমার দিন দামানহুরে থাকলে অধিকন্তু আশপাশের কোন না কোন ওলীর যিয়ারতের প্রোগ্রাম করতাম। কোন কোন সময় এ উদ্দেশ্যে আমরা ‘ওসুক’ গমন করতাম। ফজরের নামাযের পরপরই পায়ে হেঁটে রওয়ানা হতাম এবং সকাল আটটা নাগাদ সেখানে পৌঁছতাম। ওসুকের দূরত্ব ২০ কিলোমিটার। তিন ঘন্টায় আমরা তা অতিক্রম করতাম। যিয়ারতের আনুষ্ঠানিকতা পালন করতাম, এরপর জুমার নামায আদায় করতাম। দুপুরের খাবার কেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতাম। আসরের নামায পড়ে দাসানহুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করতাম এবং প্রায় মাগরিবের সময় দামানহুরের কাছাকাছি পৌঁছতাম। কখনো কখনো চলে যেতাম আযবা আততাওয়াম অভিমুখে। সেখানে ছিল শায়খ সানজারের মাকবারা। ইনি ছিলেন হোছাফী তরীকার বাছাই করা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অন্যতম। দরবেশী আর নেককারীর জন্য ইনি ছিলেন প্রসিদ্ধ। যেখানে সারাদিন অবস্থান করে রাত্রে ফিরে আসতাম।
নীরবতা আর নির্জনতার দিনগুলো
আমরা এমন কিছুদিন নির্দিষ্ট করে রেখেছিলাম, যে দিনগুলোতে নীরবতা পালন এবং লোকজন থেকে দূরে থাকার মান্নত করতাম। এদিনগুলো আমরা কেউ কারো সঙ্গে কোন কথা বলতাম না। কথা বলার কোন প্রয়োজন দেখা দিলে আল্লাহর যিকর বা কুরআন মজীদের কোন আয়াত দ্বারা তা প্রকাশ করতাম। স্কুলের ছাত্ররা আমাদের এ অবস্থাকে তাদের অভ্যাস অনুযায়ী উত্যক্ত করার উপযুক্ত মওকা বলে মনে করতো এবং স্কুলের প্রিন্সিপাল বা শিক্ষকের নিকট গমন করে বলতো, অমুক ছাত্রের মুখ বন্ধ হয়ে গেছে। আসল অবস্থা জানার জন্য শিক্ষক আগমন করতেন। আমরা কুরআন মজীদের কোন উপযুক্ত আয়াত শুনালে তিনি চলে যেতেন। মনে পড়ে, ওস্তাদ শায়খ ফরহাত সলীম আমাদের এ অবস্থাকে (মুখ বন্ধ রাখা) বেশ সম্মানের চোখে দেখতেন এবং ছাত্রদেরকে শাঁষাতেন। আমাদের নীরবতার রোযা পালনকালে প্রশ্ন দ্বারা আমাদের বিঘ্ন না ঘটাবার জন্য অন্যান্য শিক্ষকদেরকে তিনি হিদায়াত করতেন। শিক্ষকরা ভালোভাবেই জানতেন যে, আমাদের এ পন্হা উত্তর দান থেকে বিরত থাকা বা পরীক্ষা থেকে অব্যহতির জন্য নয়, কারণ পাঠে আমরা সব সময় অন্যদের চেয়ে অগ্রসর ছিলাম এবং ভালোভাবে পাঠ শিখে আসতাম। এ ব্যাপারে শরীয়তের হুকুম কি, তা না জেনেই আমরা নীরবতা পালন করি। নাফসকে শিক্ষা দেয়া এবং আজেবাজে কথা থেকে বিরত থাকার জন্যই ছিল আমাদের এই খামুশী। এর দ্বারা আমরা ইচ্ছাশক্তিকে মজবুত করতাম, যাতে মানুষ নাফসের উপর কর্তৃত্ব করতে পারে এবং নাফস মানুষের উপর কর্তৃত্ব করতে না পারে।
কখনো কখনো আমাদের এ অবস্থা উন্নতি করে যেতো। এমনকি মানুষের প্রতি ঘৃণার ভাব জেগে উঠতো, যা আমাদেরকে নির্জনবাস আর সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতো। আমার মনে পড়ে এ সময় আমি কোন কোন বন্ধুর চিঠি পেতাম, কিন্তু আমি তা খোলার এবং পড়ার চেষ্টাও করতাম না। বরং চিঠিগুলো সে অবস্থায়ই ছঁড়ে ফেলে দিতাম। আর এটা করতাম এ আশংকার পরিপ্রেক্ষিতে যে, চিঠির কোন বিষয় মনের জন্য কাঁটা হতে পারে। আর সূফীকে তো হতে হবে সমস্ত বোঝা থেকে মুক্ত। আল্লাহ ছাড়া সবকিছুর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা তার কর্তব্য। আর যতদূর সাধ্যে কুলায়, এ পথে তাকে পুরাপুরি মুজাহাদা করতে হবে।