স্কুলে ইসলামী রীতিনীতি মেনে চলা
অধিকাংম সময় আমার উপর এ অবস্থা বিরাজ করতো। এরপরও দাওয়াত ও তাবলীগের জলসা অধিকন্তু প্রবল হয়ে দেখা দিতো। বিদ্যালয়ের মসজিদে যোহার আর আসরের আযান আমিই দিতাম। এজন্য আমাকে শিক্ষকের নিকট থেকে অনুমতি নিতে হতো। কারণ আসরের নামাযের সময় আমাদের ক্লাশ চলতো। নামাযের সময়ের সঙ্গে এ সংঘাত ছিল আমার পীড়াদায়ক। কোন কোন শিক্ষক সন্তুষ্টচিত্তে আমাকে অনুমতি দিতেন, আবার কেউ কেউ বিদ্যালয়ের শৃংখলা মেনে চলাকে প্রাধান্য দিতেন। সেক্ষেত্রে আমি তাঁকে স্পষ্ট জানিয়ে দিতাম।
**********************************
“সৃষ্টিকর্তার নাফরমানী করে কারো আনুগত্য করা যাবে না”।
এ বিষয়ে আমি তাঁর সঙ্গে একটা তিক্ত বিতর্কে প্রবৃত্ত হতাম, যে বিতর্ক থেকে প্রাণ বাঁচানো আর আমার থেকে নাজাত পাওয়ার জন্য তিনি অনুমতি দিয়ে দিতেন। যোহরের সময়ও আমি ঘরে যেতাম না; বিরতির এ সময়টা মসজিদে বা বিদ্যালয়ের বারান্দায় কাটাতাম। এ সময় আমি বিদ্যালয়ের সঙ্গীদেরকে নামাযের জন্য ডাকতাম। যোহরের নামাযের পর আমি ওস্তাদ মুহাম্মদ শরফের নিকট গিয়ে বসতাম, যিনি পরবর্তীকালে শিক্ষা বিভাগের চাকুরীতে যোগ দিয়েছিলেন। আমরা দু’জনে কুরআন মজীদ দায়ের করতাম। তিনি পড়লে আমি শুনতাম, আর আমি পড়লে তিনি শুনতেন। ইতিমধ্যে ক্লাশ শুরু হলে আমরা ক্লাশে হাজির হতাম।
ইউনিফর্ম প্রসঙ্গ
মনে পড়ে, একদিন শিক্ষক প্রশিক্ষণ স্কুলের প্রিন্সিপালের কক্ষে গমন করি অনুপস্থিত ছাত্রদের তালিকা দেয়ার জন্য। কারণ, এটা ছিল আমারই দায়িত্ব। প্রিন্সিপালের কক্ষে ছিলেন ডিপিআই ওস্তাদ সৈয়দ রাগিব। পরবর্তীকালে তিনি শিক্ষা বিভাগে সহকার কন্ট্রোলার পদে উন্নীত হয়েছিলেন। আমার পোশাকের প্রতি তাঁর নজর পড়ে। তখন আমার মাথায় ছিল পাগড়ি, তার একাংশ পেছনের দিকে ঝুলানো ছিল। হজ্বকালে এহরাম অবস্থায় যে জুতা পরা হয়, পায়ে ছিল তেমন জুতা। আর ঢিলা-ঢোলা জামার উপর ছিল কালো রুমাল। ডাইরেক্টর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এমন লেবাস কেন পরিধান করেছ? এজন্য যে, এজন্য যে এটা সুন্নাত- আমি জবাব দিলাম। তিনি বললেন, তুমি কি অন্যসব সুন্নাত কায়েম করে ফেলেছ? কেবল এই একটা সুন্নাতই কি বাকী রয়ে গেছে? আমি আরয করলাম, না অন্য সুন্নাতগুলো কোথায় পালন করতে পারছি। এক্ষেত্রে অনেক ক্রটি হচ্ছে। কিন্তু যতটুকু আমার সাধ্যে কুলায় তা করার চেষ্টা করছি। ডাইরেক্টর সাহেব বললেন, কিন্তু এহেন অদ্ভূত রূপ ধারণ করে তুমি তো বিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছ। আমি বললাম: জনাব, তা কিভাবে? বিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা হচ্ছে নিয়মিত বিদ্যালয়ে উপস্থিত হওয়া এবং নিয়মিত পাঠ মুখস্থ করা। আমি কখনো অনুপস্থিত থাকি না। বিদ্যালয়ের শৃংখলা হচ্ছে ভালো স্বভাব চরিত্র। আমি আমার সেকশনে প্রথম। তাহলে বিদ্যালয়ের শৃংখলা কিভাবে ভঙ্গ হলো? তিনি বলতে লাগলেন, তুমি যখণ এখান থেকে পাশ করে বের হবে এবং এই ইউনিফর্ম কঠোরভাবে পরবে, তখন শিক্ষা অধিদপ্তর শিক্ষক হিসাবে নিযুক্তি অনুমদোন করবে না। কারণ, পোশাকে তুমি ছাত্রদের পরিহাসের বস্তু আর কিম্ভুৎকিম্বাকার হিসাবে চিত্রিত হবে। আমি বললাম, এখনো সে সময় হয়নি। সময় হলে অধিদফতর তার সিদ্ধান্তে স্বাধীন থাকবে আর আমিও আমার সিদ্ধান্তে স্বাধীন থাকবো। জীবিকা অধিদফতরের হাতেও নয়, মন্ত্রণালয়ের হাতেও নয়। এটা কেবল আল্লাহর হাতে। ডাইরেক্টর সাহেব চুপ করে গেলেন এবং প্রিন্সিপাল সাহেবও কথায় বাধা দিয়ে অন্য কথা জুড়লেন। তিনি ডাইরেক্টরেরর নিকট ভালোভাবে আমাকে পরিচয় করালেন। তিনি আমাকে ক্লাশে ফেরত পাঠালেন। আমি তাঁর কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলাম আর ভালোভাবেই প্রসঙ্গটা শেষ হলো।
জাতীয় আজাদী আন্দোলনের সুচনা
১৯১৯ সাল মিশরের প্রসিদ্ধ বিদ্রোহের বৎসর। আমি তখন মাহমুদিয়ায় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র। বয়স ১৩ বৎসর। সে সময় কিভাবে বিরাট বিক্ষোভ হয়েছে, কিভাবে সর্বাত্মক হরতাল হয়েছে, যা এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত গোটা শহরকে গ্রাস করছিল- এসব দৃশ্য এখনো আমার চোখের সামনে ভাসছে। শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এসব বিক্ষোভ মিছিলে নেতৃত্ব দিতেন। তাদের হাতে থাকতো পতাকা। একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার জন্য তাদের মধ্যে কী প্রতিযোগিতা। বিক্ষোভকারীরা আগ্রহ সহকারে যে গান গাইতো, এখনো তা আমার মনে গেঁথে আছে।
**********************************
স্বদেশ প্রেম ঈমানের অঙ্গ
আল্লাহর ফেরেশতা ডাকছে আমাদেরকে
আজাদীর ছায়াতলে জমা হতে না পারলেও
জান্নাতুল ফিরদাউসে সাক্ষাৎ হবে নিশ্চয়ই।
ইংরেজ সৈন্যদের দৃশ্যও আমার স্মৃতিতে সংরক্ষিত আছে। এরা গ্রামে গঞ্জে আর শহর-জনপদে শিবির স্থাপন করতো। তারা জনগণের উপর নির্যাতন চালাতো। আর জনগণও কোন ইংরেজ সৈন্যকে একা পেলে তার খবর নিয়ে ছাড়তো। ফলে মুখ কালো করে তাদের শিবিরে ফিরে যেতে হতো। ন্যাশনাল গার্ড (*****************)-এর কথাও আমার মনে আছে। জনতা নিজেদের পক্ষ থেকে এ বাহিনী গঠন করেছিল। ন্যাশনাল গার্ডের স্বেচ্ছাসেবীরা রাত্রিবেলা এলাকা পাহারা দিতো, যেন ইংরেজ সৈন্যরা গৃহে প্রবেশ করে লুটপাট আর সম্ভ্রমহানী করতে না পারে।
এসব গোলযোগে ছাত্র হিসাবে আমাদের কেবল এতটুকু অংশ ছিল যে, কখনো কখনো আমরা হরতাল ডাকতাম, বিক্ষোভে যোগ দিতাম। দেশের সমস্যা আর পরিবর্তিত বিষয়ে রাজনৈতিক নেতাদের বক্তৃতা শুনতাম।
কিছু স্মৃতি, কিছু কবিতা
এ সময় একদিন আমদের ওস্তাদ শায়খ মুহাম্মদ খালফ নূহ- যিনি পরবর্তীকালে আলেকজান্দ্রিয়ায় শিক্ষক নিযুক্ত হয়েছিলেন- আমাদের নিকট আগমন করেন। তাঁর চক্ষু থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। আমরা জানতে চাইলাম, কী হয়েছে, তিনি বললেন, আজ ফরীদ বেক ইনতিকাল করেছেন। এরপর তিনি ফরীদ বেকের জীবনী এবং দেশের জন্য তাঁর জিহাদ আর কুরবানীর কথা বলতে লাগলেন। এমনভাবে তিনি বলতে শুরু করেন, যাতে আমরা সকলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি। এ ঘটনা প্রভাবিত হয়ে আমি কয়েকটা কবিতা রচনা করি। এ কবিতার অংশবিশেষ এখনো আমর মনে পড়ে:
**********************************
হে ফরীদ! শান্তি আর ঈমানের সঙ্গে ঘুমিয়ে থাকো,
হে ফরীদ! দেশের জন্য বিচলিত হবে না।
হে ফরীদ! সকল পরীক্ষা তোমার জন্য কোরবান হোক।
মিলস কমিশন সম্পর্কে লোকজনের মন্তব্য আর কথাবার্তাও আমার মনে আছে (১৯১৯ সালে মিশরে যে বিদ্রোহ দেখা দেয়, সে সম্পর্কে তদন্ত করার জন্য মিঃ মিলস- এর নেতৃত্বে বৃটেন যে কমিশন গঠন করে, এখানে সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। গোটা মিশর জাতি এ কমিশন বয়কট করে- খলীল হামেদী)। কমিশনের বিরুদ্ধে জাতির ঘৃণা বণ্যার মতো উপচে পড়ে। একজন তরুণ ছাত্র, যার জীবনের মাত্র ১৩টি বসন্ত অতিবাহিত হচ্ছে, সেও কবিতার মাধ্যমে জাতির প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেঃ
**********************************
হে মিলস! ফিরে যাও আর জিজ্ঞেস করো,
প্যারিসে অবস্থানরত প্রতিনিধি দলকে,
স্বজাতির নিকট ফিরে যাও এবং তাদেরকে বল,
রে কমিনার দল! ওদেরকে ধোঁকা দেবে না।
দীর্ঘ কবিতার মাত্র দু’টি ছত্রই এখন মনে আছে। যৌবনে আমি জাতীয় উদ্দীপনামূলক অনেক কবিতা রচনা করি। একটা বড় খাতায় লিপিবদ্ধ এসব কবিতা পরবর্তীকালে পুড়িয়ে ফেলি। আর এ কাজটা করেছি তাসাউউফে উদ্বুদ্ধ হওয়ার ফলে। শিক্ষক প্রশিক্ষণ স্কুলের গোটা সময়টা তাসাউউফে ডুবে থাকার সময়, চার মযহাবের ফিকহ সম্পর্কেও আমি কিছু লিখেছিলাম এবং তথা কুমারীর প্রেম গ্রন্হের অনুকরণে কিছু সাহিত্যও সৃষ্টি করেছিলাম। ওস্তাদ মুহাম্মদ আলী বুদাইর- এর সঙ্গে ছোট মসজিদের অভ্যন্তরীণ চবুতরায় বসে আমি এসব লিখেছিলাম। কিন্তু এসব কিছুই অবহেলার শিকার হয়েছে এবং বর্তমানে এসবই নষ্ট হয়ে গেছে। আমি সে যুগকে কর্মের যুগ বলি। এ যুগে আমি মনে করতাম, বেশী জ্ঞান অর্জনে নিমগ্ন হওয়া কল্যাণকর আমল আর আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন হওয়া থেকে বারণ করে। দ্বীন সম্পর্কে মানুষের এতটুকু জ্ঞান লাভ করা যথেষ্ট, যাতে দ্বীনের বিধানের শুদ্ধাশুদ্ধি সে স্মরণ করতে পারে আর দুনিয়ার জন্যও তার এতটুকু জ্ঞানই যথেষ্ট, যদ্বারা রুটি-রুজির ব্যবস্থা করতে পারে। এরপর তার কর্তব্য হচ্ছে কায়োমনোবাক্যে সদা আমল আর ইবাদতে নিমগ্ন থাকা। এটা ছিল আমার সে সময়ের চিন্তা।
হরতাল আর বিক্ষোভ
আমি যখন প্রশিক্ষণ স্কুলে ভর্তি হই, তখন বিদ্রোহ অনেকটা স্তিমিত হয়ে গেছে। অবশ্য আন্দোলনের স্মৃতি তখনো তাজা ছিল। তবে হরতাল বিক্ষেঅভ তখনো চলতো, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষও হতো। এহেন পরিবেশেই আমার দামানহুরের দিনগুলো অতিবাহিত হয়। এক্ষেত্রে প্রথম দায়িত্ব ন্যস্ত হতো সেসব ছাত্রদের উপর, যারা ছিল বিশিষ্ট এবং যাদেরকে শীর্ষস্থানীয় মনে করা হতো। এ সময় আমি তাসাউউফ ও সুলুকে ডুবে থাকলেও আমার স্বদেরশের সেবা করা জিহাদ। এটা এমন এক কর্তব্য, যা থেকে অভ্যাহতির কোন অবকাশ নেই। এ বিশ্বাসের ভিত্তিতে এবং ছাত্রদের মধ্যে আমার স্থান ও মর্যাদার কারণে জাতীয় আন্দোলনে আমি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতাম। কারণ, আমি ছিলাম ছাত্রদের প্রথম সারিতে।
স্কুলের প্রিন্সিপাল শায়খ দাসূতী মূসার কথা আমি ভূতে পারবো না। তিনি আমাদের এসব তৎপরতায় ভীষণ সন্ত্রস্ত ছিলেন। একদিন তিনি আমাদেরকে ধরে নিয়ে যান বাহীরার পরিচালকের নিকট (তখন পরিচালক ছিলেন মাহমুদ পাশা আব্দুর রাজ্জাক)। ছাত্রদের হরতালের জন্য আমাকে দায়ী করে তিনি বলেন, এখন এরাই ছাত্রদেরকে হরতাল থেকে বিরত রাখতে পারে। মাহমুদ পাশা কখনো লোভ, কখনো হুমকী আবার কখনো উপদেশের মাধ্যমে আমাদেরকে এসব কাজ থেকে বিরত রাখার ব্যর্থ প্রয়াস চালান। বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করার কথা বলে তিনি আমাদেরকে ছেড়ে দেন। এ ব্যাপারে একটা উপায়ও আমরা অবলম্বন করি। ছাত্রদেরকে বুঝায়ে বলি যে, আজ ১৮ ই ডিসেম্বর ইংরেজদের মিশর অধিকারের কালো দিবস (১৮৮২ সালে আরবী পাশার আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ায় এই দিনে ইংরেজরা মিশর অধিকার করে নেয়। তখন মিশর শাসন করতেন মোহাম্মদ আলী পাশার পুত্র ইসমাঈল পাশা- খলীল হামেদী)। আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে, সারাদিন ছাত্ররা আশপাশের ক্ষেত-খামারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে। অবশ্য আমি নিজে স্কুলে গমন করি। স্কুল প্রশাসন এবং আমি নিজে ছাত্রদের আগমনের অপেক্ষায় থাকি, কিন্তু কোন ছাত্রই আসেনি। কিছুক্ষণ পর আমি নিজেও স্কুল ত্যাগ করি। এভাবে হরতাল সফল হয় এবং শান্তিপূর্ণভাবে কালো দিবস পালিত হয়।
গোলযোগপূর্ণ দিনগুলোর কথা। একদিন ছাত্ররা হরতাল করে। ছাত্রদের এ্যাকশন কমিটি আমার বাসভবনে এক সমাবেশের আয়োজন করে। তখন আমি থাকতাম দামানহূরের হাজন খাযরা শায়ীরার বাসায়। হঠাৎ পুলিশ বাসা অবরোধ করতঃ ভেতরে প্রবেশ করে বাসার মালিক হাজন শায়ীরাকে জিজ্ঞাসা করে অধিবেশনে যোগদানকারী ছাত্র নেতাদের সম্পর্কে। তিনি বললেন, তারা তো ভোরে ভোরেই এখান থেকে বেরিয়ে গেছে, আর ফিরে আসেনি। হাজন শায়ীরা তখন তরকারী কুটছিলেন। পুলিশও তা দেখতে পায়। হাজনের এই অসত্য জবাব আমার কাছে অসহ্য ঠেকে। আমি জিজ্ঞাসাবাদকারী পুলিশ অফিসারের নিকট গমন করতঃ প্রকৃত অব্সথা সম্পর্কে তাকে অবহিত করি। যদিও এতে হাজন শায়ীরার পজিশন খুবই নাজুক হয়ে পড়েছিল, কিন্তু আমি নিতান্ত জোশের সঙ্গে পুলিশ অফিসারের সঙ্গে তর্ক করে তাকে বলি: আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়া আপনার জাতীয় কর্তব্য। আমদের চেষ্টা ভন্ডুল করে ধরপাকড় করা আপনার উচিত নয়। আমার কথার ফল এই হয়েছে যে, তিনি আমার আবেদন মেনে নিয়ে পুলিশদেরকে ফেরত পাঠান এবং আমাদেরকে আশ্বস্ত করে তিনি নিজেও স্থান ত্যাগ করেন। আমি লুকিয়ে থাকা সঙ্গীদের কাছে এসে বলি, এটা হচ্ছে সত্য কথা বলার বরকত। আমাদেরকে অবশ্যই সত্যবাদী হতে হবে এবং নিজেদের কাজের দায়িত্ব নিজেদেরকেই বহন করতে হবে। অবস্থা আর পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, মিথ্যার আশ্রয় নেয়ার আদৌ কোন প্রয়োজন নেই।
মাহমুদিয়া আর দামানহুরের মধ্যস্থলে
আমি পড়াশুনার দিনগুলো কাটাতাম দামানহুরে এবং বৃহস্পতিবার যোহরের সময় চ লে আসতাম মাহমুদিয়ায় এবং শুক্র ও শনিবার রাত মাহমুদিয়ায় কাটাতাম। শনিবার ভোরে সোজা স্কুলে গমন করতাম এবং প্রথম পিরিয়ডে যথাসময় উপস্থিত থাকতাম। মাহমুদিয়ায় আমার অনেক কাজ থাকতো। এ সময় সেসব কাজ সারাতাম। ভাই আহমদ আফেন্দী সাকারীর সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক এমনই গভীর হয়েছিল যে, সারা সপ্তাহে একেবারেই সাক্ষাৎ হবে না, আমরা কেউই তা সহ্য করতে পারতাম না। উপরন্তু শুক্রবার রাত্রে শায়খ শালবীল রিজালের বাসায় আসর বসতো এবং তাসাউউফের কিতাব যথা এহইয়াউল উলূম, আহওয়ালূল আওলিয়া, আল ইয়াকুত ওয়াল জাওয়াহের ইত্যাদির সামষ্টিক পাঠ হতো। এরপর ভোর পর্যন্ত আল্লাহর যিকির হতো। এসব ব্যস্তথা ছিল আমাদের জীবনের পবিত্রতার প্রোগ্রাম। ঘড়ি মেরামত আর পুস্তক বাঁধাইয়ের কাজেও আমি উন্নতি করেছিলাম। দিনের কিছু সময় দোকানে এসব কাজে কাটাতাম আর রাত্রি কাটাতাম হোছাফী ইখওয়ানদের সঙ্গে আল্লাহর স্মরণে। এসব ব্যস্ততা আর উদ্দেশ্যের কারণে কোন অপরিহার্য প্রয়োজন ছাড়া বৃহস্পতিবার মাহমুদিয়ায় না এসে পারতাম না। আমি ডেলটা মিল থেকে নেমে সোজা দোকানে গমন করতাম। সোমবার আর বৃহস্পতিবার রোজা রাখা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। এরপর ছোট মসজিদে গমন করে দারস আর মজলিশে যোগদান করতাম। সেখান থেকে যেতাম শায়খ শালবীর রিজাল বা আহমদ আফেন্দী সাকারীর বাসভবনে কুরআন মজীদ দায়ের করা বা যিকর ও দোয়া-দরুদ পাঠের উদ্দেশ্যে। এরপর ফজনের নামায আদায় করার জন্য মসজিদে গমন করতাম। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে দোকানে যেতাম। দুপুরের খাবার খেতাম এবং জৃমার নামায আদায় করতাম। মাগরিব পর্যন্ত দোকানে বসতাম। এরপর যথানিয়মে মসজিদে আর ঘরে। অতঃপর ভোরে ভোরে স্কুলের উদ্দেশ্যে দামানহুরের পথে। পরবর্তী সপ্তাহেও একই নিয়মে এই প্রোগ্রামে চলতো। কোন জরুরী আর অস্বাভাবিক প্রয়োজন ছাড়া মাহমুদিয়ায় উপস্থিতি কামাই হয়েছে বলে আমার মনে পড়ে না।
গ্রীষ্মের ছুটি
গ্রীষ্মের ছুটি ছিল এ কর্মসূচী মেনে চলার উপযুক্ত সময়। অবশ্য এক নতুন ব্যস্ততা যোগ হতো। আর তা ছিল এই যে, প্রতিদিন ভোরে সূযোর্দয় থেকে অস্ত পর্যন্ত সময়টা মুহতারাম ওস্তাদ শায়খ মুহাম্মদ খালফ নূহ-এর বাসায় আলোচনায় কাটতো। আরবী ব্যাকরণের প্রসিদ্ধ গ্রন্হ ইবনে মালেক রচিত আলফিয়া আমি মুখস্থ করা শুরু করি। আলফিয়ার ব্যাখ্যা গ্রন্হ ইবনে আকীল- এর পাঠও নিতে শুরু করি। ফিকহ, উসূল এবং হাদীসের অনেক কিতাবও অধ্যয়ন শুরু করি। এসব কিতাব নিয়ে ওস্তাদ নূহ-এর সঙ্গে আলোচনা করি। এই অতিরিক্ত অধ্যয়ন ছিল একটা বড় কারণ, যার ফলে আমি দারুল উলূমে ভর্তি হওয়ার যোগ্য হই। অন্যথায় সে সময়ে দারুল উলূমে ভর্তি হওয়ার কথা ধারণাও করা সম্ভব ছিল না। আমরা বলতাম, কেবল নামকা ওয়াস্তেই আমরা জ্ঞঅন লাভ করছি।
ভোরের আযান
গ্রীষ্মের ছুটিতে মাহমুদিয়ায় আমাদের কাজের একটা অংশ এটাও যে, জুমার দিন ভোরে গোটা জনপদকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতাম। আমরা নিতজন বা ততোধিক ছিলাম- আমি নিজে, ভাই মুহাম্মদ আফেন্দী দিমইয়াতী এবং ভাই আব্দুল মুতা’আল। আমরা মহল্লায় বেরিয়ে পড়তাম। ফজরের কিছু আগেই নামাযের জন্য লোকজনকে জাগাতাম। বিশেষ করে হোছাফী ভাইদেরকে জাগাতাম। আমি যখন মুয়াযযিনকে ফজরের আযানের জন্য জাগাতাম, তখন এক বিরাট স্বাদ অনুভব করতাম এবং গভীর আনন্দে ডুবে যেতাম। তাদেরকে জাগবার পর আমি এহেন বিস্ময়কর অবস্থায় নীলনদের তীরে গিয়ে দাঁড়াতাম এবং আযান শুনার জন্য কান পেতে দিতাম।
প্রায় কাছাকাছি দূরত্বে ছিল মাহমুদিয়ার মসজিদগুলো। এ কারণে যখন আযানের আওয়াজ বুলুন্দ হতো, তখন মনে হতো যেন একই আযান বিভিন্ন মুয়াযযিনের কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে। একই সঙ্গে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুলতো সে আযানের ধ্বনি। আমার অন্তর বলছে, বিপুল সংখ্যক মুসল্লী জোগাবার আমিই উপলক্ষ এবং রাসূলে খোদার মুবারক বাণী অনুযায়ী নামাযীদের সমান পূর্ণ আমিও লাভ করবো।
**********************************
“যে ব্যক্তি কোন হিদায়াতের দিকে আহ্বান জানায়, সে এজন্র পুণ্য পাবে এবং কিয়ামত পর্যন্ত সে ব্যক্তির আমলের পূণ্যও পাবে, যে ব্যক্তি তদনুযায়ী আমল করবে। এতে তার পুণ্য একটুও হ্রাস করা হবে না”।
এরপর আমি যখন মসজিদে গমন করতাম, তখন এ স্বাদ আরো বহুগুণে বৃদ্ধি পেতো। মসজিদে যারা আসতেন, তাদের মধ্যে আমি থাকতাম সবচেয়ে কম বয়সের। সমস্ত প্রশংসা কেবলমাত্র আল্লাহরই প্রাপ্য আর তাঁর কাছেই চিরন্তন তাওফীক কামনা করছি।
দারুল উলূমে ভর্তির প্রস্তুতি
টিচার্স ট্রেনিং স্কুলের গোটা তিন বৎসরের সময়টা ছিল তাসাউউফ আর ইবাদাতে ডুবে থাকার সময়। এহেন ব্যস্ততা সত্ত্বেও এ সময়টা স্কুলের নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তক ছাড়াও অতিরিক্ত জ্ঞান অর্জনের আগ্রহ থেকে মুক্ত ছিল না। আমার ধারণায় এর দুটি কারণ রয়েছে। এর প্রথম কারণ ছিল আব্বাজানের লাইব্রেরী এবং অধ্যয়ন আর জ্ঞানচর্চার জন্য আমাকে উদ্বুদ্ধ অনুপ্রাণিত করা। তিনি আমাকে ভালো কিতাব উপহার দিতেন, যার মধ্যে কয়েকটা আজও আমার মুখস্থ আছে। এসব কিতাবের মধ্যে যে কয়টা আমার মনের উপর গভীল ছাপ মুদ্রিত করেছে, তার মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে নাবহানী প্রণীত *********** এটা কাসতালানী রচিত ************* গ্রন্হের সংক্ষিপ্তসার; অপর গ্রন্হটা হচ্ছে শায়খ মুহাম্মদ খাজরী বেক প্রণীত ************* (উভয়ই রাসূলের পাকের জীবনী গ্রন্হ)। আব্বাজানের অনুপ্রেরণায় আমার মধ্যে অধ্যয়নের অদম্য আগ্রহ সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে আমি স্বতন্ত্র একটা বিসয়ের এক বিপুল গ্রন্হ ভাণ্ডার গড়ে উঠে। আমার মধ্যে অধ্যয়নের আগ্রহ এতটা তীব্র হয়ে উঠে যে, আহমুদিয়ায় অবস্থানকালে আমি যখন মাধ্যমিক স্তরের ছাত্র ছিলাম, তখন বাজারের দিন আমি শায়খ কুতুবীর জন্য অধীর আগ্রহে অপেকষা করতাম, যাতে কিছু পয়সার বিনিময়ে সারা সপ্তাহের জন্য আমি তাঁর নিকট থেকে কিছু কিতাব ধার নিতে পারি। এ কিতাবগুলো পড়া শেষ করে ফেরত দিয়ে অন্য কিতাব নিতাম। এ ধারা দীর্ষদিন চালু ছিল।
এ সময় যে গ্রন্হগুলো আমার উপর সবচেয়ে বেশী প্রভাব ফেলেছে, তন্মধ্যে একটা ছিল ************ বাহাদুর শাহজাদী। আমার যখন মনে হয় যে, সেদিনগুলোতে আমরা যেসব কিচ্ছা-কাহিনী আর গল্পের বই পড়তাম, তাতে থাকতো আত্মমর্যাদা, বীরত্ব, দেশ রক্ষা, দ্বীনের অনুসরণ, জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ আর শওকত-শ্রেষ্ঠত্বের পাঠে পরিপূর্ণ। আর বর্তমানে আমি যখন দেখতে পাই যে, অধুনা আমাদের যুবক শ্রেণী যেসব গল্প আর উপন্যাস পড়ে, তা আগাগোড়া অশ্লীলতা-নির্লজ্জতা, নারীপনা, হীন-নীচ চরিত্রের প্রতি আহ্বান ছাড়া আর কিচুই নয়, তনক আমি অনুমান করতে পারি নিটবর্তী অতীতকালের গনসংস্কৃতি আর বর্তমানকালের গণ সংস্কৃতিতে কতই না বিস্ময়কর পার্থক্য সূচিত হয়েছে। আমার মতে এই সাংস্কৃতিক খাদ্য ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করা ্মাদের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে, গল্প-কাহিনী আর পত্র-পত্রিকার আকারে যে সাংস্কৃতিক খাদ্য আমাদের নতুন প্রজন্মকে গলধঃকরণ করানো হচ্ছে।
আমার অধ্যয়নের আগ্রহ বৃদ্ধিতে অপর একটা কারণও সহায়ক হয়েছে। তখন টিচার্স ট্রেনিং স্কুলে বাছা বাছা যোগ্য শিক্ষকের ভিড় ছিল। যেমন মুহতারাম ওস্তাদ আব্দুল আযীয আতিয়্যা। পরবর্তীকালে ইনি আলেকজান্দ্রিয়ার চিচার্স ট্রেনিং স্কুলের প্রিন্সিপাল এবং তথাকার ইখওয়ানুল মুসলিমুনের নেতা হয়েছিলেন। মহান ওস্তাদ শায়খ ফরহাত সলীম, শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু আল্লাম, ওস্তাদ আলহাজ্ব আলী সোলায়মান এবং ওস্তাদ শায়খ বাসইউনী। আল্লাহ তা’আলা এঁদের সকলকে নেক প্রতিদান দিন। সততা, সরলতা আর সাধুতায় এঁরা ছিলেন অনন্য। ছাত্রদেরকে এঁরা সবসয় অধ্যয়ন আর গবেষণার উৎসাহিত করতেন। এঁদের সঙ্গে আমার রূহানী সম্পর্ক ছিল, যা আমার জন্য উৎসাহ-উদ্দীপনার কারণ হয়েছে। আমার আজও মনে পড়ছে ওস্তাদ আব্দুল আযীয আতিয়্যাহ আমাদের প্রাকটিক্যাল ক্লাশ করতেন। একবার তিনি আমার মাসিক পরীক্ষা নেন। আমার জবাব তাঁর বেশ পছন্দ হয়। আমার খাতায় তিনি লিখেন; তুমি বেশ ভালো জবাব দিয়েছ। পূর্ণ নম্বরের অতিরিক্ত নম্বর দেওয়া গেলে তাও আমি তোমাকে দিতাম। উত্তর পত্র ফেরত দেয়ার সময় তিনি আমার খাতাটা রেখে দেন এবং পরে আমাকে ডেকে নিয় হাতে হাতে নিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে কিছু কথা বলেন, যাতে উপদেশ ছিল, উৎসাহ ছিল, আরো ছিল অধ্যয়ন আর গবেষণার দীক্ষা। তাঁর রচিত ‘আল মুয়াল্লিম’ গ্রন্হের প্রুফ দেকার জন্য তিনি আমাকেই বাছাই করেন। তখন দামানহুরের আল-মুসতাকুবিল প্রেস থেকে গ্রন্হটি ছাপা হচ্ছিল।
এসব কার্যকারণ আমার উপর বিরাট প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এ সময় পাঠ্য পুস্তুকের বাইরর অনেক গ্রন্হ আমি মুখস্থ করে ফেলি। হারীরীর মিলহাতুল এ’রাব মুখস্থ করি। ইবনে মালেক রচিত আলফিয়া ইয়াদ করি।
হাদীসের পরিভাষা বিষয়ে আল-ইয়াকূতিয়া, তাওহীদ বিষয়ে আল-জাওহারা, ফরায়েয বিষয়ে আল রজবিয়া এবং তর্কশাস্ত্রের সুল্লামুল উলমের অংশবিশেষ মুখস্থ করি। হানাফী ফিকহের গ্রন্হ কুদুরীর অধিকাংশ, ফিকহে শাফেয়ীর আল-গায়াহ ওয়াত তাকবীর-এর কিছু অংশ, মালেকী মযহাবে ইবনে আমের রচিত মানযূমা গ্রন্হের কিচু অংশও আমি মুখস্থ করি। মুহতারাম আব্বাজানের উপদেশ আমি কিছুতেই ভুলতে পারবো না। তিনি বলতেনঃ
**********************************
“যে আসল মতন (গ্রন্হের মূল পাঠ) মুখস্থ করে নেয়, সে নানা বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করে”।
তাঁর এ দীক্ষা আমার মনের উপর এত গভীর ছাপ মুদ্রিত করে যে, আমি কেরায়াত বিষয়ের গ্রন্হ শাতেবিয়া পুরোপুরি হিফয করার চেষ্টা করি। অথচ তখন এ গ্রন্হের পরিভাষাগুলো ছিল আমার কাছে দুর্বোধ্য। এরপরও আমি এ গ্রন্হের দীর্ঘ ভূমিকা মুখস্থ করে ফেলি। যা অধ্যবধি আমার মুখস্থ আছে।
এ সময় একটা মজার ঘটনা ঘটে। জনৈক পরিদর্শক আমাদের ক্লাশে আগমন করেন। তখন আরবী ভাষার ক্লাশ চলছিল। আমি তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। এ সময় হারীরীর মিলুহাতুল এ’রাব আমার মুখস্থ ছিল। পরিদর্শন সাহেব প্রশ্ল করেন; আরবী ব্যকরণে ইসম, ফেয়েল এবং হরফের আলামত কি? তখন যে ওস্তাদ আমাদের ক্লাশ নিচ্ছিলেন, তাঁর নাম ছিল শায়খ মুহাম্মদ আলী নাজ্জার। তিনি জবাব দেয়ার জন্য আমাকে বাছাই করেন। জবাবে আমি মিলহাতুল এ’রাবের এ কবিতাটা…….
**********************************
হরফ হচ্ছে তাই, যার কোন আলামত নেই। আমার এ কথায় অনুমান করে নাও, তাহলে তুমি হতে পারবে আল্লামা-মহাজ্ঞানী। ইন্সপেক্টর সাহেব আমার কথায় হেসে পড়েন এবং বলেন; বেশত। আমি যাতে আল্লামা হতে পারি, সেজন্য তোমার কথামতো অনুমান করবো। এরপর তিনি ওস্তাদকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে চলে যান।
জ্ঞানের এ দৌলত কিছু কিচু বন্ধুর দৃষ্টি আমার প্রতি আকৃষ্ট করে। এসব বন্ধু দারুল উলূমে ভর্তিল জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আর এরা সকলেই টিচার্স ট্রেনিং স্কুলের অধীন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিল। তারা আমার নিকট প্রস্তাব পেশ করে যে, আমরা সকলে মিলে এক সঙ্গে প্রস্তুতি নেবো এবং দারুল উলূমে ভর্তি হবো। এদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রসর ছিল শায়খ আলী নওফল, পরবর্তীকালে ওস্তাদ আলী নওফল বলে খ্যাত। তারই প্রস্তাব ছিল যে, এক সঙ্গে প্রস্তুতি নেবো এবং একই সঙ্গে ভর্তি হবো। তখন দারুল উলূ দুটি বিভাগে বিভক্ত ছিল। একটা বিভাগ ছিল প্রস্তুতিমূলক। আল-আযহারের ছাত্র এবং টিসার্চ ট্রেনিং স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে যাদের ইচ্ছা এ বিভাগে ভর্তি হতে পারতো। অপরটি ছিল উচ্চতর ঐচ্ছিক বিভাগ। এ বিভাগে সাধারণতঃ আযহারের ছাত্ররাই ভর্তি হতো, যারা আল-আযহার থেকে মাধ্যমিক সার্টিফিকেট লাভ করেছে। ১৯২৩-২৪ শিক্ষা বর্ষেই কেবল এ বিভাগে ভর্তি হওয়া যাবে। এরপর এ বিভাগ বন্ধ করে প্রস্তুতিমূলক বিভাগের ছাত্রদের ভর্তির জন্য তা নির্ধারিত করা হবে। আমাদের বিদ্যালয়ের কোন কোন ছাত্র প্রস্তুতিমূলক বিভাগে ভর্তির ইচ্ছা পোষণ করে। কিন্তু উচ্চতর বিভাগে ভর্তি হওয়ার দিকেই বেশীর ভাগ ছাত্রের ঝোঁক। কারণ, এ বিভাগে ভর্তি হওয়ার এটাই শেষ সুযোগ।
শায়খ আলী নওফল আমার সঙ্গে মিলে প্রস্তুতি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আমি তখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। অর্থাৎ এ বৎসর আমার প্রাইমারী শিক্ষায় ডিপ্লোমা-মিশরীয় পরিভাষায় শাহাহাতুল কাফায়াহ লাভের জন্য পরীক্ষা দেয়ার কথা। আর শায়খ আলী নওফল ছিলেন টিচার্স ট্রেনিং স্কুলের প্রাথমিক শাখার শিক্ষক। তাই সামষ্টিক পাঠে আমি অক্ষমতা প্রকাশ করি। কিন্তু তিনি অন্য দরজা দিয়ে প্রবেশ করেন। বলেন, ভ্রাতৃত্বের কিছু হক আছে। বন্ধুদের সহায়তা করা কর্তব্য এবং তাদের পরামর্শ গ্রহণ করা জরুরী। এবার তার কথাকে গুরুত্ব দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
শিক্ষা আর ডিগ্রী সম্পর্কে আমার অভিমত
সে সময় জ্ঞান অর্জন আর ডিগ্রী লাভ করা সম্পর্কে আমার একটা বিশেষ মতামত ছিল। আমার এ বিশেষ মতামত ছিল ইমাম গাযালী (র)এর এহইয়াউল উলূম অধ্যয়নের ফল। জ্ঞানের প্রতি আমার ছিল তিব্র ভালোবাসা। অধ্যয়নের প্রতি আমার ছিল অস্বাভাবিক ঝোঁক আর জ্ঞান-বৃদ্ধির প্রতি ছিল অসীম আগ্রহ। ব্যক্তি আর দল উভয়ের জন্য জ্ঞানের উপকারিতা আমি স্বীকার করতাম এবং মানুষের মধ্যে জ্ঞানের বিস্তারকে আমি ফরয মনে করতাম। এমনকি মনে পড়ে, ‘আশ শামস নামে একটা মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করার দৃঢ় সংকল্পও আমি করেছিলাম, বরং এর প্রথম দু’টি সংখ্যা আমি ঠিকঠাকও করে রেখেছিলাম”। এটা করেছিলাম শায়খ মুহাম্মদ যাহরানের অনুকরণে। তিনি ‘আল ইসআদ’ নামে ‘আল মানার’-এর স্টাইলে একটা মাসি পত্রিকা প্রকাশ করেন। আমি তাঁর পত্রিকাটি বেশী বেশী পড়তাম। কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞঅন আহরণ আর অন্বেষণ সম্পর্কে ইমাম গাযালীর দর্শন আমার মনে বিরাট প্রবাব বিস্তার করে বসেছিল। এর ফলে আমি এক তীব্র মানসিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ি। একদিকে অতিরিক্ত জ্ঞান অর্জনের আগ্রহ আমাকে টানছিল, অন্যদিকে ইমাম গাযালীর উক্তি এবং প্রয়োজনীয় জ্ঞান সম্পর্কে তাঁর এই সঙ্ঘা- “ফরয কার্যাদি পালন এবং জীবিক অর্জনের জন্য যতটুকু জ্ঞান অর্জন করা আবশ্যক, কেবল ততটুকু জ্ঞান অর্জন করাই ফরয। এটুকু জ্ঞান অর্জনের পর তাকে আমল তথা কর্মের দিকে আসতে হবে”। তাঁর এ দর্শন আমাকে বাধ্য করছিল কেবল প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করতঃ সময়ের অপচয় না করে অন্যসব জ্ঞান পরিত্যাগ করতে।
দারুল উলূমের শিক্ষাপ্রাপ্ত ছাত্রদের মধ্যে যারা উচ্চতর ডিপ্লোমা অর্জন করে, বৃত্তি দিয়ে তাদেরকে বিদেশে প্রেরণ করা হয়-এ কথা মনে করে দারুল উলূম এবং তার অধীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার কথা মনে জাগ্ এখন মানসিক দ্বন্দ্ব আরো চরমে উঠে। আমি সবসময় আমার মনকে বলতাম, কেন তুমি দারুল উলূমে ভর্তি হতে চাও? পদমর্যাদা লাভ করার জন্য, যাতে মানুষ বলে যে, তুমি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নও, বরং উচ্চতর বিদ্যালয়ের শিক্ষক? কিন্তু এটাতো হারাম। আর পদ-পর্যাদার লোভ-লালসা নাফসের অন্যতম ব্যধি। এটা নাফসের খায়েশের একটা অংশ। এটা উৎপাটন করা ফরয। নাকি অর্থ-সম্পদের জন্য? যাতে তোমার ভাতা দ্বিগুণ হয়ে যায়, যাতে তুমি বেশী সম্পদ আহরণ করতে পার, গর্ব করার মতো পোশাক পরিধান করতে পার, ভালো ভালো খাবার খেতে আর দামী গাড়ী দৌড়াতে পার- এ জন্য কি? কিন্তু এটাতো মানুষের চেষ্টা-সাধনার সবচেয়ে নিকৃষ্ট ফল। ধ্বংস হয়েছে দীনারে দাস, হালাক হয়েছে দিরহামের গোলাম। ধ্বংস হোক রেশম আর মখমলের গোলাম। বিনাশ হোক তার। সে যদি বিপদে পতিত হয় তবে তার তাওবা করার তাওফীক না হোক। (এগুলো হাদীসের কথা। বোখারী শরীফে হযরত আবু হোরায়রা থেকে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে।)
আল্লাহ তা’আলা যথার্থই বলেছেন-
**********************************
নারী, সন্তান, রাশিকৃত স্বর্ণ, রৌপ্য, আর চিহ্নিত অশ্বরাজি, গবাদিপশু এবং ক্ষেত-খামারের প্রতি আসক্তি মানুষের নিকট মনোরম করা হয়েছে। এসব হচ্ছে ইহজীবনের ভোগ্য বস্তু। আর আল্লাহ, তাঁর নিকট রয়েছে উত্তম আশ্রয়স্থল। বল, আমি কি তোমাদেরকে এসব বস্তুর চেয়ে উৎকৃষ্টতর কোন কিছুর সংবাদ দেবো? যারা তাকওয়া অবলম্বন করে চলে, তাদের জন্য রয়েছে উদ্যানরাজি, যার পাদদেশে নহর প্রবাহিত। সেখানে তারা স্থায়ী হবে। (সূরা আলে-ইমরানঃ ১৪-১৫)
নাকি জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিপুল সম্ভার আহরণ করার জন্য? যাতে তুমি আলেমদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে পার, জাহেল, অজ্ঞ-মূর্খদের সঙ্গে বাক-বিতণ্ডায় মত্ত হতে পার এবং নিজের অধিকার স্বীকার করাবার জন্য মানুষের উপর বিজয়ী হতে পার? কিন্তু কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যে ব্যক্তির জন্য জাহান্নামের আগুন প্রজ্জ্বলিত করা হবে, সে হবে ঐ ব্যক্তি, আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে যে জ্ঞান অর্ঝন করেছে এবং অর্জিত জ্ঞান অনুযায়ী যে ব্যক্তি আমল করেনি। যে আলেমের জ্ঞানকে আল্লাহ তা’আলা তার জন্য কল্যাণকর করেননি, কিয়ামতের দিন তাকে কঠিনতর আযাব দেয়া হবে। আমি নিজেকে বলি: তোমার নফস তোমাকে এটাও বুঝাতে পারে যে, তুমি এজন্য জ্ঞান অর্জন করছো, যাতে তুমি আলেম হয়ে মানুষের উপকার করবে এবং আল্লাহ তা’আলাও তাঁর ফেরেশতারা মানুষকে কল্যাণের শিক্ষাদানকারীদের প্রতি দরূদ পাঠায় এবং এটাও যে, স্বয়ং নবীজীকে শিক্ষক করে প্রেরণ করা হয়েছে-নাফস তোমাকে এসব বাহানা শিক্ষ দিতে পারে। কিন্তু তুমি নাফসকে জিজ্ঞেস করো, তুমি যদি সত্য বলে থাক যে, কেবল মানুষের কল্যাণের জন্যই তুমি জ্ঞান অর্জন করছো, কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই তুমি ইলম হাসিল করছো, তবে দারুল উলূমে ভর্তি হতে কেন যিদ ধরেছ? অথচ জ্ঞান তো পুস্তকের মধ্যে নিহিত রয়েছে, নিহিত রয়েছে ওলামা-মাশায়েখের আঁচলের তলে। সনদ-সার্টিফিকেটতো একটা ফেৎনা। দুনিয়ার দিকে লম্ফ দিয়ে ছুটা আর বিত্ত-বিভব অর্জনের জন্য এটা একটা হাতিয়ার। আর এ দুটি বস্তু-দুনিয়া পূজা এবং টাকা কড়ি অন্বেষণ করা- গ্রাণ সংহারক বিষ। এটা আমল বিনাশ করে, অন্তর আর দেহকে বিকৃত করে। সুতরাং জ্ঞান অর্জন করতে হলে গ্রন্হ থেকে অর্জন কর। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সনদ আর প্রথাগত ডিপ্লোমার প্রতি ছুটবে না।
এ দর্শন আমার মন-মানসে পুরাপুরি বিস্তার করতে বসেছিল, বরং কার্যত বিস্তার করেছিলও। এ কারণে ঘৃণাবশত: ওস্তাদ আলী নওফলের সঙ্গে সহ-পাঠ শুরু করিনি। কিন্তু মুহতারাম ওস্তাদ শায়খ ফরহাত সলীম (র) আমাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন এবং সকল উপলক্ষে আমার প্রতি স্নেহ-ভালোবাসা প্রকাশ করতেন আর আমার অন্তরেও তাঁর উঁচু স্থান ছিল। তিনি অত্যন্ত প্রজ্ঞা- বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে অতি সুন্দরভাবে এক সঙ্গে মিলে অধ্যয়নের জন্য আমাকে উদ্বুদ্ধ করেন এবং দারুল উলূমের দরজা খটখটাবার জন্য আমার মধ্যে কার্যত আগ্রহ সৃষ্টি করেন। তিনি আমাকে বলেন: এখনতো তুমি ডিপ্লোমা লাভের কাছাকাছি এসে গেছ। জ্ঞান কোন ক্ষতিকর বস্তু নয়। দারুল উলূমের পরীক্ষার জন্য তোমার অগ্রসর হওয়া আরো বড় পরীক্ষার জন্য একটা অভিজ্ঞতা হবে। এটা এমন এক সুযোগ, যা হাতছাড়া হয়ে গেলে আর পাওয়া যাবে না। ভর্তি হও এবং নিজের অধিকার সংরক্ষণ কর। তোমার সাফল্য অর্জন সম্পর্কে আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত- ইনশাআল্লাহ। উপরন্তু ভর্তি হওয়ার পরও ব্যাপারটা নিজের হাতেই থাকবে। তোমার যেমন খুশী, চিন্তা করে দেখতে পার। মন চাইলে ইচ্ছা ত্যাগ করতে পার, আাবর মন চাইলে ভর্তিও হতে পার। এভাবে মুহতারাম ওস্তাদ ভীষণ জোর দিয়ে অন্যদের সঙ্গে আমাকেও দরখাস্ত পেশ করতে উদ্বুদ্ধ করেন। ডিপ্লোমা পরীক্ষার কিছুদিন পর ভর্তি পরীক্ষঅ হওয়ার কথা।
দুটি স্মৃতি
এখানে আমি দু’টি স্মৃতির কথা উল্লেখ করতে চাই। এ দু’টি স্মৃতির একটি হচ্ছে বাস্তবিক, অপরটি তাত্ত্বিক। এ দু’টি স্মৃতি আমার মনে গেঁখে যায় এবং দীর্ঘদিন তা আমার অন্তরকে সেদিকে আকৃষ্ট করে রাখে।
প্রথমটি হচ্চে মহান আল্লামা শায়খ আহমদ শারকাবী আল হুরীনী (র)-এর। এ মহান ব্যক্তিকে আমি কেবল একবার দেখেছি। সন্তান, ছাত্র, মুরীদ এবং বন্ধুদেরকে দেখার জন্য একবার তিনি দামানহুরে আগমন করেন। সকলের সঙ্গে ঘরে ঘরে গিয়ে তিনি দেখা করেন। সকলের খোঁজ-খবর নেন। তাঁর সঙ্গে একটা রজনী অতিবাহিত করার সুযোগ আামার হয়েছে। এ রজনীতে তিনি স্বভাবসিদ্ধ আচরণ থেকে একটুও সরে দাঁড়াননি। আমি তাঁর সম্পর্কে এমনসব বিষ অবগত হতে পেরেছি, যা আমার অন্তরে তাঁর জন্য স্থায়ী আসন করেছে এবং আমার মন তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিয়েছে। আজও তাঁর স্মৃতি আমার অন্তরে গেঁথে আছে। তাঁর সম্পর্কে আমি জানতে পেরেছি যে, জ্ঞান আর শিক্ষার প্রতি তাঁর ছিল অন্তরের আকর্ষণ। তিনি তাঁর শহরের অধিবাসীদেরকে শিক্ষার প্রতি ধাবিত করেন। শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করার সাধ্য যাদের নেই, তাদের শিক্ষঅ সমাপ্ত করার জন্য নিজের পকেটের টাকা দিয়ে সাহায্য করতেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির প্রতি তিনি শর্ত আরোপ করেন যে, নিজের শিক্ষা সমাপ্ত করে কোন অসহায় ব্যক্তির শিক্ষার দায়িত্ব নেবে। আর এভাবে নগদে নাহলেও শিক্ষা বিস্তারের আকারে এ ঋণ শোধ করতে হবে। এ কর্মসূচীর ফলে তাঁর অঞ্চল ‘হুরীন’ এলাকায় শিক্ষা লাভে বঞ্চিত কোন ব্যক্তি ছিল না, সে যতই দরিদ্র পরিবারের সন্তান হোক না কেন। শিক্ষা ক্ষেত্রে এই পারস্পরিক সহযোগিতা সকলকে শিক্ষালাভে ধন্য করে তোলে। উপরন্তু এসব ব্যক্তিদের মধ্যে এক সুদূর আত্মিক সম্পর্কও গড়ে উঠতো। শায়খ আহমদ শারকাবীর একমাত্র চিত্ত বিনোদন ছিল এই যে, গ্রীষ্মের ছুটিতে ‘হুরীন’ অঞ্চলের ছাত্ররা তাঁর চতুষ্পার্শে দল বেঁধে বসে আছে আর তিনি দেখতে পাচ্ছেন আযহারী ছাত্রদের পাশাপাশি দেরআমী (দারুল উলূমের সংক্ষিপ্ত রূপ। দারুল উলূমের ছাত্রদেরকে তিনি দেরআমী বলতেন) ছাত্ররাও বসেছে। প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ স্কুলের ৫০ জন ছাত্রও বসে আছে। অন্যান্য শিক্ষঅ প্রতিষ্ঠানের কিছু ছাত্রও বসা আছে মজলিশে আর তিনি সকলের সঙ্গে কথা বলছেন, গল্প করছেন। কেউ তাঁর সমালোচনা করছে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে। এতে তাঁর মন পরিচ্ছন্ন হচ্ছে এবং শিক্ষা আর জ্ঞানের আলো বিস্তারের জন্য তাঁর মনোবল আরো দৃঢ় হচ্ছে। দামাননুরস্থ প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিদ্যালয়ে ‘হুরীন’-এর ছঅত্রদের সংখ্যাধিক্যের এটাই হচ্ছে রহস্য। এখন শায়খ শারকাবী তাদেরকে দেখতে এসেছেন, এসেছেন তাদেরকে আরো উদ্বুদ্ধ-অনুপ্রাণিত করতে। জ্ঞানের আলোচনা আর হাসি-কৌতুকের মধ্য নিয়ে এ সংক্ষিপ্ত সফর তিনি অতিবাহিত করেন। তাঁর প্রশ্ন, আপত্তি আর কৌতুক থেকে এ লেখকও রেহাই পায়নি। আল্লাহ তা’আলা নিজ রহমতের ছায়ায় তাঁকে আশ্রয় দিন এবং জান্নাতকে তাঁর জন্য প্রসারিত করুন।
আর অপর স্মৃতি শায়খ ছাবী দারাজ (র) সম্পর্কে। শায়খ ছাবী এক সৎ যুবক চাষী। তখন তাঁর বয়স ২৫ বৎসরের বেশী ছিলনা। কিছু দিন পরে এ অল্প বয়সে তিনি ইনতিকাল করেন। প্রজ্ঞা- বিচক্ষণতা, সম্ভ্রম, জৌলূস আর ঘটনা বর্ণনায় তিনি ছিলেন এক বিস্ময়। একদা আমি আওলিয়া আর ওলামা সম্পর্কে তাঁর সঙ্গে আলোচনা শুরু করি। সাইয়্যেদ ইবরাহীম দাসূতী- শহরের নিকটেই যার মাজার রয়েছে, থেকে সাইয়েদ আহমদ বাদবী পর্য্ত, তানতায় যাঁকে দাফন করা হয়েছে- আলোচনা চলে। শায়খ ছাবী দারায বললেন: সাইয়্যেদ আহমদ বাদবীর ঘটনা কি জানা আছে? আমি বলি: তিনি ছিলেন বড় বুযুর্গ, ওলী, পরহেযগার, মুত্তাকী এবং জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি। শায়খ বললেন, কেবল এতটুকুই জান? বললাম, আমি তো কেবল এটুকুই জানি তাঁর সম্পর্কে। শায়খ ছঅবী বললেন, শুন আমি তোমাকে বলছি।
সাইয়্যেদ বাদবী মক্কা থেকে হিজরত করে মিশরে আগমন করেন। আসলে তিনি ছিলেন মরক্কোর অধিবাসী। মিশরে যখন দাশ বংশের শাসন চলছিল, তখন তিনি আগমন করেন (তিনি ছিলেন মিশরের প্রসিদ্ধ আওয়াদের অন্যতম।পাকিস্তানে হযরত আলী ওরফে দাতা গঞ্জ বখশ যেমন প্রসিদ্ধ, অনুরূপ মিশরে তিনিও খ্যাত ছিলেন। মূলতঃ তিনি ছিলেন মরক্কোর অধিবাসী, সেখান থেকে মক্কা শরীফ গমন করেন। মক্কা শরীফ থেকে চলে যান ইরাক, ইরাকে দীর্ঘদিন অবস্থান করে ইসলামী সংস্কারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ইরাক থেকে পুনরায় তিনি মক্কায় ফিরে যান, অবশেষে হিজরী ১২৩১ সালে তিনি মিশর গমন করে ‘তানতা’য় অবস্থঅন গ্রহণ করেন-খলীল হামেদী)। তাঁর মতে মামলূক তথা দাসদের শাসন শুদ্ধ নয়। কারণ, তারা স্বাধীন নয়, পরাধীন- গোলাম, আর সৈয়দ বাদাবী ছিলেন হযরত আলীর বংশধর সৈয়দ। সব রকম শ্রেষ্ঠত্ব তাঁর মধ্যে ছিল- বংশের শ্রেষ্ঠত্ব, জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব এবং বেলায়াত তথা শাসন করার যোগ্যতা। আহলে বায়ত খিলাফতকে নিজেদের অধিকার মনে করতো। খিলাফাতে আব্বাসিয়ার অবসান ঘটেছে এবং বাগদাদে তাঁদের গদী উল্টে গেছে। মুসলমানরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত। এমন সব লোকেরা তাদের উপর কর্তৃত্ব করছিল, যারা বাহুবলে ক্ষমতায় এসেছে। মিশরের মামলূক শাসকরাও ছিল এদের অন্তর্গত। সাইয়্যেদ বাদবীর সম্মুখে দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল, সেজন্য তাঁকে সংগ্রাম করতে হয়েছে। এক. খিলাফত পুনর্বহাল করা। দুই. মামলূকদের শাসন শরীয়ত অনুযায়ী শুদ্ধ নয়। এদের থেকে শাসন ক্ষমতাকে মুক্ত করানো। এ দুটি কাজ কিভাবে সাধন করতে হবে? এ জন্য কাজের বিশেষ নকশা আঁকা প্রয়োজন ছিল। এ উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর বিশিষ।ট বন্ধুবর্গ এবং পরামর্শদাতাদেরকে একত্র করেন। এদের মধ্যে সাইয়্যেদ মুজাহিদ এবং সাইয়্যেদ আব্দুল ‘আল প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এসব বুযুর্গরা সিদ্ধান্ত নেন যে, দাওয়াত দিয়ে যেতে হবে এবং যিকর আর তিলাওয়াতের মাধ্যমে লোকজনকে সমবেত করতে হবে। এ যিকর- এর জর্ন িতন কিছু প্রতীকও নির্ণয় করেন। যেমন কাঠের তরবারী বা মজবুত লাঠি, এটাকে তরবারী আর তবলার স্থলাভিষিক্ত জ্ঞান করে তিনি সমাবেশের আয়েঅজন করেন। একটা ঝান্ডা, যা ছিল তাঁর বিশেষ পতাকা আর একটা চামড়ার ঢাল। এসবকে বাদাবীর প্রতীক বা বিশেষ চিহ্ন সাব্যস্ত করা হয়। যিকর ও তিলাওয়াতের উদ্দেশ্যে সকলে সমবেত হতো এবং দ্বীনের বিধি-বিধানের জ্ঞান লাভ করার পর তাদের মধ্যে আপনা আপনি এ অনুভূতি জাগ্রত হতো যে, সরকারের বিকৃতির শিকার হয়েছে তাদের সমাজ এবং খিলাফাত ব্যবস্থারও অবসান ঘটেছে। দ্বীনের চেতনা আর ভালো কাজের নির্দেশ আর মন্দ কাজের নিষেধের কর্তব্য তাদের মধ্যে অবস্থার পরিবর্তনের জন্য জিহাদের জযবা সৃষ্টি করতো। সাইয়্যেদ বাদাবীর অনুসারীরা প্রতি বৎসর একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো। তিনি ‘তানতা’কে আন্দোলনের কেন্দ্রে পরিণত করেছিলেন। কারণ, জমজমাট আর আলোয় ঝলমল শহরগুলোর মধ্যস্থলে ছিল তানতা’র অবস্থান এবং রাজধানী কায়রো থেকে তা ছিল দূরে। মীলাদুন্নবী উপলক্ষে লোকজন বার্ষিক সমাবেশে সমবেত হলে সাইয়্যেদ বাদাবীর পক্ষে অনুমান করা সহজ হতো যে, তাঁর দাওয়াত ও আন্দোলন মানুষের মনে কেমন প্রবাব বিস্তার করেছে। তিনি নিজেকে মানুষের সামনে প্রকাশ করতেন না; বরং তিনি বালাখানায় অবস্থান করতঃ চেহারা ঢেকে রাখতেন। তাঁর এ অবস্থা মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার করতো। সে যুগে এমন রীতিরই রেওয়াজ ছিল। আর তাঁর অনুসারীরা মানুষের মধ্যে এ কথা ছড়াতো যে, তাঁকে দেখার অর্থই হচ্ছে মৃত্যু। যারা কুতুবকে এক নজর দেখতে চায়, এর ফলে তাদেরকে নিজেদের জীবন বিসর্ঝন দিতে হবে। এভাবে তাঁর দাওয়াত বেশ প্রসার লাভ করে এবং এক বিমাল জনগোষ্ঠী তাঁর আশপাশে জড়ো হয়।
কিন্তু পরিস্থিতি এ আন্দোলনের সাফল্যের পক্ষে অনুকূল ছিল না। মিশরের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল আযযাহের বায়বার্স আলবন্দ কেদারী। আর ক্রশেড় শক্তির বিরুদ্ধে কয়েকবার সে বিজয়ও অর্জন করে। এবং মুযাফফর কতয-এর সহযোগিতায় তাতারীদের উপরও সে বিজয় লাভ করে। সুতরাং তার নাম বেশ ছড়িয়ে পড়ে আর তার ভাগ্য নক্ষত্র উচ্চ শিখরে পৌঁছে। জনগণ হয়ে উঠে তার ভক্ত। কেবল এখানেই তার শেষ নয়; বরং আব্বাসী রাজবংশের জনৈক শাহযাদাকে মিশর ডেকে এনে তার হাতে সে খিলাফতের বায়য়াতও গ্রহণ করে। এভাবে সে সাইয়্যেদ বাদাবীল সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতাও স্থাপন করে। তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করে এবং তাঁর মর্যাদাও বৃদ্দি করে। শক্র অঞ্চল থেকে মুক্ত হয়ে যুদ্ধবন্দীরা ফিরে এলে তাদের বন্টনের দায়িত্বও তাঁর উপর ন্যস্ত করে। এটাকে বেশ সম্মান ও মর্যাদার কাজ মনে করা হতো। সাইয়্যেদ বাদাবীর পরিকল্পনা সম্পূর্ণ করার পূর্বেই এসব ঘটে। আর শাসন কর্তৃত্ব কার্যত মামলূক তথা দাশ বংমের হাতেই থেকে যায়। আর নাম নেয়া হতো নামকাওয়াস্তে খলীফার। দীর্ঘদিন এ পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। সাইয়্যেদ আহমদ বাদাবীর ইতিহাস সম্পর্কে শায়খ ছাবী দারায-এর ধারাবাহিক বিবরণ আর ব্যাখ্যা আমি কান পেতে শুনছিলাম এবং একজন যুবক কৃষকের প্রজ্ঞা-বিচক্ষণতায় স্তম্ভিত হচ্ছিলাম। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উর্ধ্বে শিক্ষা গ্রহণ করার কোন সুযোগ তাঁর হয়নি। মিশরে প্রজ্ঞা-বিচক্ষণতা আর যোগ্যতা- প্রতিভার অনেক গুপ্ত ভান্ডার রয়েছে। এমন কোন আল্লাহর বান্দা যদি তাঁর ভাগ্যে জুটতো, যিনি তাকে উর্ধ্ব তুলে ধরতে পারেন এবং মানস জগৎ থেকে কর্মের জগতে নিয়ে আসতে পারেন- শায়খ ছাবী দারায-এর এ কথাগুলো এখনো আমার কানে বাজে। তাঁর এ কথাগুলোর মধ্যে শিক্ষণীয় বিষয় আছে। আছে নতুনত্বও। সব কিছুই আল্লাহর হাতে নিহিত।
**********************************
দুনিয়ার মালিক আল্লাহ। তিনি যাকে ইচ্ছা পৃথিবীর উত্তরাধিকারী করেন। আর শুভ পরিণতি মু্ত্তাকীদের জন্য। (সূরা আ’রাফ: ১২৮)।
কায়রোর পথে
হ্যাঁ, আমি বলছিলাম যে, দারুল উলূমে ভর্তির জন্য দরখাস্ত দাখিল করেছি। এরপর ডাক্তারী পরীক্ষা আর ভর্তি পরীক্ষার তারিখের নোটিশও আমি পেয়েছি। নোটিশ অনুযায়ী এখন আমাকো কায়রো যেতে হবে ডাক্তারী পরীক্ষার আর ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য। তখন ছিল রমযান মাস। আব্বাজান সঙ্গে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমি তাঁর প্রয়োজন অনুভব করিনি। তিনি শুভ কামনা আর নেক দোয়ার সম্বল সঙ্গে দিয়েছিলেন- আমার জন্য এটাই ছিল যথেষ্ট। সমস্ত পথও তিনি আমাকে ভালোভাবে বলে-বুঝিয়ে দিয়েছিলেন এবং তাঁর এক বন্ধুর নামে একটা চিঠিও দিয়েছিলেন, যিনি ছিলেন কায়রোর অন্যতম সুখী মানুষ এবং খ্যাতনামা পুস্তক বিক্রেতা। আব্বাজান তাঁর অনেক উপকার করেছিলেন এবং তাঁকে সদগুণে বিভূষিত মনে করতেন।
জীবনে প্রথমবারের মতো আমি কায়রো গমন করি। তখন আমার বয়স ১৬ বৎসর কয়েক মাস। প্রায় আসরের সময় আমি ‘বাবুল’ হাদীদে অবতরণ করি। আর সেখান থেকে ‘আতবার’ উদ্দেশ্যে ট্রামে সওয়ার হই। ‘আতবা’ থেকে টমটম যোগে ‘সাইয়্যেদুনা হুসাইন’ গমন করি। টমটম থেকে নেমে সোজা কিতাব বিক্রেতার কাছে যাই এবং তাঁর হাতে আব্বাজানের চিঠি দেই। তিনি চিঠি দেখেনওনি, কেবল এটুকু করেন যে, জণৈক কর্মচারীকে বলেন, আমার প্রতি লক্ষ্য রাখতে। কর্মচারী ছিল বেশ ভদ্র ও নেক মানুষ। পূর্ব থেকেই তিনি আব্বা এবং আমার সম্পর্কে জানতেন। কর্মচারী আমাকে অভিভাদন জানিয়ে বাসায় নিয়ে যায়। আমি সেখানে ইফতার করি। এরপর আমি শহরে বেরিয়ে পড়ি এবং সাহরীর সময় ফিরে আসি। ফজরের নামাযের পর কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে উঠে মেযবানকে বলি, দারুল উলূমের অবস্থান সম্পর্কে আমাকে বলূন। আমার বিশেষ বন্ধু ওস্তাদ মুহাম্মদ শরফ হাজ্জাজ এক বৎসর পূর্বে দারুল উলূম এসেছেন। পরে তিনি শিক্ষা বিভাগে চাকুরীতে যোগদান করেন। ইচ্ছা ছিল তাঁর সঙে।গ দখঅ করে ডাক্তারী পরীক্ষা আর ভর্তি পরীক্ষা সম্পর্কে জেনে নেবো। মেযবান আমাকে দারুল উলূম পৌঁছার গোটা পথ বাতলে দেন। তাঁর পথ নির্দেশ সামনে রেখে আমি টমটমে চড়ে ‘আতাবা’ পৌঁছি। সেখান থেকে ট্রামযোগে গমন করি ‘শারেয়ে কাছরুল আইনী’- কাছরুল আইনী সড়কে। সামনেই ছিল দারুল উলূমের ইমারত। সেখানে দাঁড়িয়ে ছাত্রদের বেরিয়ে আসার অপেক্ষা করি। ইতিমধ্যে আমার বন্ধু উপস্থিত হয়। আমরা পরস্পর আলিঙ্গন করি এবং বন্ধু আমাকে বারাকাতুল ফীল-এ অবস্থিত আব্দুল বাকী মহল্লার বাসায় নিয়ে যায়। তার বাসা ছিল দোতলায়। একদল ছাত্রের সঙ্গে সেখানে সে থাকতো।
পরদিন ভোরে আমার বন্ধু দারুল উলূম গমন করলে আমি সে কিতাব বিক্রেতার কাছে যাই। এরপর তাঁর কাছে একজন চশমা মেকারের সন্ধান নেয়া, যার নিকট থেকে আমি চশমা তৈয়ার করাতে পারি এবং মেডিক্যাল পরীক্ষার জন্য ভালোভাবে প্রস্তুত হতে পারি। কিন্তু অভ্যাস অনুযায়ী এবারও তিনি মুখ ঘুরায়ে নেন, আর আমিও সময় নষ্ট করতে চাই না। তাই তৎক্ষণাৎ আমি আল আযহার গমন করি। আল-আযহারে এ প্রথম আমার প্রবেশ। সেখানকার প্রশস্ততা আর সরলতা দেখে আমি বিস্মিত হই। ছাত্রদের নানা দল স্থানে স্থানে পঠন-পাঠনে নিমগ্ন। আমি এক এক করে সব দলের কাছে ঘুনি। অবশেষে একটা দল পাই, যেখানে ছাত্ররা দারুল উলূমে ভর্তি হওয়ার ব্যাপারে আলোচনা করছিল। আমি বুঝতে পারি যে, এরা দারুল উলূমে ভর্তি পরীক্ষা দেবে। প্রায় ১০ দিন পরে এ ভর্তি পরীক্ষা হবে। এ উদ্দেশ্যে তিনবার তাদের মেডিক্যাল পরীক্ষা হবে। আমিও তাদের মধ্যে ঢুকে পড়ি। তাদের কাছে আমার আগ্রহ ব্যক্ত করি। তাদেরকে বলি, এমন একজন লোক আমার দরকার, যে আমাকে একজন চশমা মেকারের সন্ধান দিতে পারে। একজন ছাত্র স্বেচ্ছায় এ দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং তখনই আমাকে নিয়ে যায় একজন মহিলা ডাক্তারের ক্লিনিকে। আমার ধারণা, এ মহিলা ডাক্তার গ্রীক দেশের। অবশ্য সে মিশরের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছে। ছাত্রটি ডাক্তারের যোগ্যতা- অভিজ্ঞতার অনেক প্রশংসা করে। বলে, আমি নিজেও এ মহিলা ডাক্তারের নিকট থেকে চশমা নিয়েছি। ডাক্তারের কাছে যাওয়া মাত্রই তিনি চক্ষু পরীক্ষা করেন। পরীক্ষা ফী নেন ৫০ ক্রোশ। এরপর নাম্বার দিয়ে চশার দোকানে প্রেরণ করেন। দোকানদার ১শ ৫০ ক্রোশ নিয়ে তৎক্ষণাৎ চশমা বানিয়ে দেয়। এখন মেডিক্যাল পরীক্ষার জন্য দু’নি অপেক্ষা করা ছাড়া আমার অন্য কোন ব্যস্ততা নেই।
মেডিক্যাল পরীক্ষা
আমি মেডিক্যাল পরীক্ষায় বিস্ময়করভাবে সফল হয়েছি- এ কথা বললে বেশী বলা হবে না। কারণ, অনেক বন্ধু দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছে।
**********************************
“পবিত্র সে স্বত্ত্বা, যিনি কিসমত বন্টন করেছেন। সুতরাং কারো প্রতি অসন্তুষ্টি নেই, নেই কারো প্রতি দোষারোপ”। তিনজন ডাক্তার ছিলেন। আমি প্রথম ডাক্তারের তালিকার শেষ ব্যক্তি। তিনজনের মধ্যে ইনি সবচেয়ে ভালো এবং কোমল প্রকৃতির। ওস্তাদ আলী নওফলের ভাগে পড়ে তৃতীয় ডাক্তার। ইনি ছিলেন পাষাণ হৃদয়ের এবং পরীক্ষার ক্ষেত্রেও ভীষণ বেরহম। আমার ডাক্তারের কাছে সফল ব্যক্তিদের হার যত উঁচু ছিল, তৃতীয় ডাক্তারের কাছে এ হার ছিল তত নীচু। আমার সাফল্য সম্পর্কে বেশ সন্দেহ ছিল, কিন্তু আমি সফল হলাম। আর ওস্তাদ আলী নওফল হলেন বিফল। অথচ চক্ষুর সুস্থতা, দেহের সুস্থতা এবং পুরো প্রস্তুতির পরিপ্রেক্ষিতে সাফল্য সম্পর্কে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ নিশ্চিত। ডাক্তার তাকে চশমা বানানোর পরামর্শ দিয়ে বলেন, পুনঃপরীক্ষা করা হবে। তৎক্ষণাৎ তিনি পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করেন। কিন্তু ডাক্তারের বদমেজাজী আলী নওফলের সাফল্যে আবারও অন্তরায় হয়। এভাবে তার হাতছাড়া হয়ে যায় এ সোনালী সুযোগ। পরবর্তীকালে তিনি আর্টস কলেজের আরবী সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হয়ে লেসানস তথা বিএ ডিগ্রী লাভ করেন। সত্য বটে, প্রবল ইচ্ছা থাকলে কোন কিছু বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।
আল-আযহারে এক সপ্তাহ
মেডিক্যাল পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলো। অপ্রত্যাশিতভাবে সফল ছাত্রদের তালিকায় আমার নামও ছিল। এবার সব কিছু ছেড়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য ভালোভাবে প্রস্তুত হতে থাকি। পরীক্ষার এক সপ্তাহ বাকী। একান্ত অভিনিবেশই এখন কেবল কাজে আসতে পারে। প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র আর বই পুস্তক নিয়ে আমি আল-আযহারে গমন করি। আলোয় ঝলমল আর মনমাতানো আল-আযহার। সেখানে ঠিক ‘মেহরাবে কাদীম’- এর নিকটে ডেরা ফেলি। অনেক সঙ্গীর সঙ্গে পরিচয় হয়। আমরা সকলে নিয়ত করি, ইলম আর বরকত লাভের উদ্দেশ্য আমরা এ’তেকাফ করবো। পালাক্রমে আমরা সাহরী আর ইফতারের খানা পাকাবো। আমরা পালাক্রমে ঘুমাবো এবং সবচেয়ে কম সময় ঘুমাবো। আল্লাহ ইলমুল আরূজ তথা ছন্দ বিদ্যার বিনাশ করুন। এর মাথামুন্ড কিছুই আমার বুঝে আসছিল না। আমি কেবলই তা আওড়াতে শুরু করলাম। কারণ, এটা আমার জন্য সম্পূর্ণ একটা নতুন বিষয়। আওড়ানো ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না। অংক আর সমাজ বিদ্যা সম্পর্কেও আমার কোন শংকা ছিল না। অবশ্য আরবী ব্যাকরণ- ছরফ এবং নাহু সম্পর্কে কিছু শংকা জাগতো। কারণ, আামার ধারণা ছিল, এ ক্ষেত্রে আযহারের যেসব ছাত্র দারুল উলূমে ভর্তি হতে চায়, আমি তাদের ধারে কাছেও ঘেষতে সক্ষম হবো না। এরা ‘শাহাদাতুল আহলিয়্যার’ চেয়েও অগ্রসর (এটা আল আযহারের একটা সার্টিফিকেট)। তারা আরো উঁচু শ্রেণীতে পড়াশুনা করেছে। অবশ্য এটা ঠিক যে, আমি ইবনে মালেক প্রণীত ‘আলফিয়্যাহ’ পড়েছি। আর ইবনে আকীল প্রণীত আলফিয়্যার ব্যাখ্যা গ্রন্হও আমি নিজে নিজে পড়েছি। কোন কোন বিষয়ে আব্বাজানও সহায়তা করেছেন। কিন্তু নিয়মসিদ্ধ শিক্ষার অধীনে এসব করা হয়নি, যাতে মন নিশ্চিত হতে পারে।
পরীক্ষার দিন এসেছে এবং শান্তিতে কেটে গেছে। ইলমে আরূয তথা ছন্দবিদ্যার যে কবিতা দিয়ে আমার পরীক্ষা নেয়া হয়েছে, তা এখনো আমার মনে আছে। ছন্দ বিদ্যার আলোকে এ কবিতা সম্পর্কে আলোচনা করে তা ছন্দের কোন বাহর অনুযায়ী, তা বলার জন্য আমাকে বলা হয়। কবিতাটি ছিল এইঃ
**********************************
সত্য স্বপ্ন
এই মহান আল্লাহর বিরাট অনুগ্রহ যে, তিনি বান্দাহদের শান্তি-নিরাপত্তা দান করেন। আর তিনি কোন ইচ্ছা করলে তার কার্যকরণও করে দেন। আমার মনে পড়ে, যেদিন আমার নাহু-ছরফের পরীক্ষা হওয়ার কথা, সে রাত্রে আমি স্বপ্নে দেখি যে, কয়েকজন মহান আলেমের সঙ্গে আমি একটা নওকায় সওয়ার। নীলনদের বুকে মৃদুমন্দ বায়ূ আমাদের নৌকা ধীরে ধীরে নিয়ে চলেছে। আলেমদের একজন এগিয়ে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করেনঃ আলফিয়্যার শরাহ ইবনে অকীল কোথায়? আমি বললাম, এই তো। তিনি বললেন, এসো, এর কোন কোন অধ্যায় আমরা পুনরাবৃত্তি করি। অমুক অমুক পৃষ্ঠা খোল। আমি পৃষ্ঠাগুলো খুলি এবং বিষয়গুলো পুনরাবৃত্তি করি। এরি মধ্যে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। ভীষণ আনন্দেদ মন ভরে যায়। আর সকালে যখন পরীক্ষা দিতে যাই, তখন অধিকাংশ প্রশ্ন আসে সেসব পৃষ্ঠা থেকেই। এটা ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে আমার জন্য সহজ করার বিশেষ ব্যবস্থা। সত্য স্বপ্ন মু’মিনের জন্য তাৎক্ষণিক সুসংবাদ। আলহামদুলিল্লাহ- সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর প্রাপ্য।
পরীক্ষার হলে
ভর্তি পরীক্ষার দেয়ার পর আমি কায়রো থেকে ফিরে আসি এবং কিছুদিন পরই টিচার্স ট্রেনিং স্কুলে ডিপ্লোমা পরীক্ষা দেই। পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলে দেখা যায় স্কুলে আমি প্রথম হয়েছি, আর সারা দেশে হয়েছি পঞ্চম। দারুল উলূমে ভর্তি পরীক্ষার ফলও বের হয়েছে এবং আমি সফল হয়েছি। এ সাফল্যও ছিল আমার জন্য অপ্রত্যাশিত। এ মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে ওস্তাদ আহমদ বুদাইর- এর কথা। তিনি মৌকি পরীক্ষঅ নেন। বেশ হাসিখুশী কৌতুকপ্রিয় মানুষ। নুতন লোক তাঁর কৌতুক বেশী অনুভব করতো। আমি পরীক্ষার জন্য তার সামনে বসলে বিজ্ঞেস করেন: দারুল উলূমের উচ্চতর বিভাগে ভর্তি হতে চাও? বললাম, জনাব, ইচ্ছা আছে। তিনি আমাকে বাঁকা চোখে বললেনঃ দারুল উলূম কি ছোট হয়ে গেছে> তোমার বয়স কত? বললাম: ১৮ বৎসর ৬ মাস। তিনি বললেন, বড় হওয়ার জন্য অপেক্ষা করলেন না কেন? বললাম: সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে। বললেন: আচ্ছা জমাা তাকসীরের বাব শুনাও। আলফিয়্যাহ মুখস্থ আছে? বললাম: জি হ্যাঁ, আছে। বললেন: পড় দেখি। তাঁর সঙ্গে সহপরীক্ষক ছিলেন ওস্তাদ আব্দুল ফাত্তাহ আশূর। নতুন লোকের সঙ্গে এমন হাসি-কৌতুক করতে আমি অভ্যস্ত ছিলাম না। আমার কম বয়স হওয়াটা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল। কোন কোন সঙ্গীতো আমাকে দেখে বলতো: এখানে উচ্চতর বিভাগের পরীক্ষা হচ্ছে। আর নিম্ন বিভাগের পরীক্ষা সম্মুখে ওখানে নেয়া হচ্ছে। আমি যখন বলতাম, আমাকেও উচ্চতর বিভাগের পরীক্ষা দিতে হবে, তখন দৃষ্টি গেড়ে আমাকে দেখে চলে যেতো। ওস্তাদ বুদাইর-এর হাসি-কৌতুকে আমি ভারী আপ্লুত হই। এমনকি জবাবদানে বিরত থাকার উপক্রম হয়। কিন্তু উস্তাদ আশূর হস্তক্ষেপ করে ওস্তাদ বুদাইরকে এ ধরনের হাসি-কৌতুক করতে বারণ করেন। ওস্তাদ বুদাইর মনোযোগ দিয়ে আমার জবাব শুনেন আর আমি ফর ফর করে আলফিয়্যাহ শুনাতে থাকি। এরপর সাধারণ জ্ঞান, আরবী সাহিত্য এবং মৌখিক বিতর্কের পালা। সবশেষে ওস্তাদ বুদাইর আমার জন্য দোয়া করেন আর আমাকে উৎসাহিত করেন। আমি উঠে আসি। কুরআন মজীদের পরীক্ষা ছিল ওস্তাদ আহমদ বেক যানাতীর কাছে। তিনিও ছিলেন বেশ হাসিখুশী। এসব কারণে আমি সাফল্য সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলাম না। ফলাফল অপ্রত্যাশিতভাবে আমার সাফল্যের সুসংবাদ বহন করে আনে।
জীবিকা নয় জ্ঞানের অন্বেষণ
তৃতীয় অপ্রত্যাশিত একটা পরিস্থিতি সামনে আসে। তা হচ্ছে এই যে, বুহাইরা’র শিক্ষা বোর্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমাকে শিক্ষক নিয়োগ করতঃ গ্রীষ্মের ছুটি শেষে আমাকে চার্জ বুঝে নিতে বলে। সুতরাং আমাকে দুটি পথের যে কোন একটি অবলম্বন করতে হবে- হয় চাকুরী গ্রহণ করতে হবে, না হয় জ্ঞান অন্বেষণ অব্যাহত রাখতে হবে। শেষ পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণের কাজে যোগদান করাকেই আমি প্রাধান্য দেই। এজন্য আমাকে কায়রো গমন করতে হবে। দারুল উলূম সেখানেই অবস্থিত আর শায়খ আব্দুল ওয়াহহাব হোছাফীর আসল ঠিকানাও কায়রোতেই। একটা বিষয় আমাকে অস্থির করে রাখে। আর তা হচ্ছে মাহমুদিয়া থেকে অনুপস্থিতির দীর্ঘ অনুভতি। মাহমুদিয়া হচ্ছে সেই প্রিয় শহর, যেখানে আমার প্রিয় বন্ধু আহমদ আফেন্দী সাকারী বাস করে। অবশ্য আমর এ ব্যাপারে একমত হই যে, যখন এ পদক্ষেপই উত্তম, তখন এটাই করতে হবে। পরবর্তীতে আমরা মিলিত হবো, বা চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ অব্যাহত রাখবো। জ্ঞান অর্জনও এক ধরনের জিহাদ। এ পথে সবচেয়ে প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করার জন্যও আমাদেরকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
দারুল উলূমের প্রথম বৎসর
গ্রীষ্মের ছুটি শেষে আমি কায়রো গমন করি এবং সাইয়্যেদা যয়নব (রা)-এর মহল্লায় মারাসিনা সড়কের ১৮ নং বাসায় কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে অবস্থান করি। কায়রোয় এটা হচ্ছে আমার প্রথম বাসস্থান।
ক্লাশের প্রথম দিন আমি দারুল উলূম গমন করি। তখন আমার মনে জ্ঞান অর্জনের তীব্র আকাংখা। পড়ালেখার প্রতি আল্লাহ তা’আলা আমাকে বেশ মনোযোগ দান করেন। প্রথম ঘন্টার কথা আমার বেশ ভালোভাবেই মনে আছে। তখনো বই-পুস্তক এবং অন্যান্য উপকরণ সংগ্রহ করা হয়নি। আমাদের শিক্ষক শায়খ মুহাম্মদ আব্দুল মুত্তালিক লম্বা পা ফেলে চবুতরায় ঝুলানো ব্লাকবোর্ডের সম্মুখে এসে দাঁড়ান। তিনি নতুন ছাত্রদেরকে অভিভাদন জ্ঞান করেন এবং তাদের সাফল্যের জন্য দোয়া করেন। এরপর ব্লাকবোর্ডে লিখেন এবায়দ ইবনে আবরাছ-এর কবিতাটিঃ
**********************************
এরপর চিরাচরিত অভ্যাস অনুযায়ী তিনি জুব্বা টেনে ধরে এমন সুর দিয়ে কবিতাটি আবৃত্তি করতে শুরু করেন, যা থেকে গর্ব আর আভিজাত্য প্রকাশ পায়। অতঃপর তিনি আমাকে বলেন, কবিতায় হযরকত, জের-জেবর, পেশ বসাতে। আমি মনে মনে বলি: ন্যাড়া মাথায় বেল পড়ে! আমি ভাবতে থাকি ******** কি জিনিস? কবি কেন ******** বললেন, তিনিতো ********** ও বলতে পারতেন। আমি হরকত বসাবার চিন্তায় বিভোর। এ সময় আলোচনার ধারা পাল্টে যায়। কবি ওবায়দ ইবনে আবরাছ-এর ব্যক্তিত্ব নিয়ে কথা উঠে। কথা উঠে, সে যুগে আরবদের জীবন-যাপনের ধারা কেমন ছিল। তাদের জীবনধারায় কষ্ট সহিষ্ণুতা আর সরলতা কেমন ছিল। আলোচনা শুরু হয় আরবদের প্রসিদ্ধ যুদ্ধ-বিগ্রহ, তাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য, শান্তি আর যুদ্ধকালে তাদের অস্ত্র, বর্শা, তরবারী আর তীন-ধনুকের নানা রকম আর প্রকার নিয়ে। বিশেষ করে ফলাযুক্ত তীর আর ফলাবিহীন তীর নিয়ে আলোচনা চলে। তীর নিক্ষেপের ক্ষেত্রে মুহতারাম ওস্তাদ নীচের প্রসিদ্ধ কবিতাটি প্রমাণ হিসাবে উপস্থাপন করেনঃ
**********************************
প্রেমিকা আমার প্রতি এমন এক তীর নিক্ষেপ করে,
যার ফলা শুর্মার। কিন্তু তা আমার চামড়ার
উপরিভাগকে আহত করেনি,
তবে আমার অন্তরকে আহত করেছে।
তিনি ব্লাকবোর্ডে নানা ধরনের তীরের ছবি আঁকা শুরু করেন। এহেন ব্যাপার আলোচনা শুনে আমি আনন্দে নেচে উঠি। বেশ আগ্রহ অভিনিবেশ নিযে তন্ময় হয়ে তাঁর লেকচার শ্রবণ করি। এ ধারার শিক্ষা আমার আগ্রহ আরো বহুগুণে বৃদ্ধি করে। দারুল উলূমের শিক্ষকদের প্রতি ভক্তি-সম্মান অনেক বৃদ্ধি পায়।
চিত্তের স্বাধীনতা
শায়খ আব্দুল মুত্তালিবের আলোচনা প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ে কিতাব বিক্রেতার দোকানের কর্মচারীর কথা। কায়রোয় আগমন করে আমি প্রথমে তার কাছেই উঠেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, দারুল উলূমের শিক্ষকদের সঙ্গে, বিশেষ করে শায়খ আব্দুল মুত্তাবিল এবং ওস্তাদ আল্লামা সালামার সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক আছে। আমার ব্যাপারে তিনি তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন এবং ডাক্তারী পরীক্ষা আর ভর্তি পরীক্ষা এবং মৌখিক পরীক্ষা ইত্যাদির ব্যাপারে তাঁদের কাছে সুপারিশ করতে পারেন। আজ রাত্রেই তিন শায়খ আব্দুল মুত্তালিবের বাসায় যাবেন কিছু কিতাব নিয়ে। ইচ্ছা করলে আমিও তার সঙ্গে যেতে পারি। তখন শায়খ আব্দুল মুত্তালিব থাকতেন সানজার আলখাযেন সড়কের একটা বাসায়। আমি প্রথমবারের মতো সাজ্জার আলখাযেন-এর নাম শুনলাম। মনে মনে ভাবি, কে এই সাজ্জার আলখাযেন? মামলূক তথা দাস বংশের, না তুর্কি? মেযবানের পরমর্শের পরও আমি নিজের মনকে রাজী করাতে পারিনি সুপারিশ গ্রহণ করার জন্য। তবে এ পরামর্শের জন্য আমি তাকে ধন্যবাদ জানাই। তবে তার কথায় শায়খ মূসা আবু কামার-এর কথা আমার মনে পড়ে। তিনি আমার আত্মীয় এবং দারুল উলূমের শিক্ষক ছিলেন। তখন শায়য়খ মূসা থাকতেন আল-খালীজ আল মিছরী সড়কে। পরীক্ষার দু’দিন আগে আমি অবসর ছিলাম। আমি এ সুযোগ কাজে লাগাই এবং শায়খ মুসা আবু কামার-এর বাসায় গমন করি। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একবার নক করি। এ সময় আমার মনে একটা ভাবের উদয় হয় এবং এতই প্রবল হয় যে, ভেতর থেকে জবাবের অপেক্ষা না করেই তৎক্ষণাৎ আমি ফিরে আসি। আমার মনের সে ভাবটি ছিল এই যে, আমি গায়রুল্লাহর আশ্রয় নিচ্ছি, গায়রুল্লাহর উপর নির্ভর করা সম্পর্কে ভাবছি এবং মানুষের সামনে মাথা নত করছি। তখনই আমি দৃঢ় সংকল্প করি যে, আমি কেবল এক আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়েই ক্ষ্যান্ত করবো। ডাক্তারী পরীক্ষা আর ভর্তি পরীক্ষা দু’টা শেষ করে তবেই শায়খ মুসা আবু কামার-এর সঙ্গে দেখা করবো। আর মুলত তা-ই হয়েছে। পরবর্তীকালে দেখা করলে তাঁর বাসাঁ কেন উঠিনি, এ কারণে তিনি আমার উপর রুষ্ট হন। শায়খ আবু মুসা ছিলেন অত্যন্ত ভদ্র, বিনয়ী এবং দরাজ দিলের মানুষ। তাঁর বাসা কখনো অতিথি আর অভাবী মুক্ত থাকতো না। আমি তাঁকে আসল ঘটনা বলি যে, আমি তাঁর বাসায় এসে ফিরে গেছি। শুনে তিনি বেশ হাসেন এবং এহেন মনোভাবের জন্য আমার পিঠে হাত বুলান। তাঁর একজাও আমার মনে গেঁথে আছে। আল্লাহ তা’আলা তাঁর নেকী কবুল করুন এবং তাঁর জন্য জান্নাত প্রশস্ত করুন।
নতুন বাসা
নতুন বাসা সন্ধানের কাহিনীও ভুলবার মতো নয়। যে বাসায় আমরা অবস্থান গ্রহণ করেছিলাম, তা ছিল আলে আকেফের। কাগজ ব্যবসায়ী ইবরাহীম বেক-এর নিকট থেকে তিনি এ বাসাটি ক্রয় করে দেন। নতুন মালিক বাসাটা খালী করাতে বাধ্য। প্রয়োজনীয় মেরামতের পর তা ব্যবহার করবেন। নতুন বাসার সন্ধানে আমরা বেশ গলদঘর্ম হই। অবশেষৈ আল কাবাশ কেল্লায় দাহীরা সড়কে আমরা একটা বাসায় সন্ধান পাই। বৎসরের বাকী দিনগুলো আমরা এ বাসায়ই অবস্থান করি।