ওসীলা সম্পর্কে জনাবের মতামত কি?
আমি বললাম, “আমার মনে হয়, কেবল একটা বিষয়েই আপনারা আমাকে প্রশ্ন করছেন না। বরং আপনারা এটাও জিজ্ঞঅসা করবেন যে, আযানের পর দরুদ ও সালাম পড়তে হবে কিনা? জুমার বিন সূরা কাহফু তিলাওয়াত করা জায়েয কি না? তাশাহহুদে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম মুবারকের পর ‘সাইয়্যেদুনা’ শব্দ যোগ করা যাবে কিনা? নবীজীর পিতা-মাতা কি অবস্থায় আছেন? এখন তাঁদের ঠিকানা কোথায়? কুরআনখানীল সাওয়াব মুর্দার কাছে পৌঁছে কিনা? সুফিয়া আর তরীকতপন্হীদের বর্তমান মজলিশ পাপ, না আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম?” আমি সেসব মতবিরোধপূর্ণ প্রসঙ্গ শুমার করা শুরু করি, অতীত ফেৎনায় যেসবকে কেন্দ্র করে ঝগড়া বাধে এবং যেসব নিয়ে মানুষের মধ্যে প্রচন্ড মাথা ফাটাফাটি হয়। প্রশ্নকর্তা আমার বক্তব্য শুনে আঙ্গুলে কামড়ায়। বলেঃ জি, আমি এ সমস্ত বিষয়ের জবাব জানতে চাই।
আমি আরয করি:
“আমার প্রিয় ভাই! আমি আলেম নই। আমি একজন শিক্ষক-দারস আর ওয়াযের প্রতি আকর্ষণ আছে, এমন একজন সাধারণ নাগরিক। কুরআন মজীদের কিছু আয়াত আমার মুখস্থ আছে। কিছু হাদীস শরীফও মুখস্থ আছে এবং কিতাব অধ্যয়ন করে দ্বীনের আহকাম আর মাসায়েল সম্পর্কে আমার কিছু জ্ঞান হয়েছে। আমি স্বেচ্ছায় মানুষকে দ্বীনের দারস দান করি। আপনারা আমাকে এসব চৌহদ্দী থেকে বাইরে নিয়ে খুবই নাজুক পজিশনে ফেলে দেবেন। কেউ যদি লা. আদরী- আমি কিছুই জানি না- বলে তবে এটাও তার একটা ফতওয়া। আমার কথা যদি আপনাদের ভালো লাগে এবং তাতে মঙ্গলের কোন দিক নজরে পড়ে, তবে দয়া করে তা শ্রবণ করবেন। আর যদি জ্ঞানে আরো সংযোজন করতে চান, তাহলে আমি ছাড়া অন্য আলেম-ফাযেল তথা বিজ্ঞ-প্রাজ্ঞ জ্ঞানী-গুণীজনের নিকট গমন করতে পারেন। যে বিষয়ে যে মাসালায় আপনাদের প্রয়োজন হয়, তারা আপনাদেরকে ফাতওয়া দেবেন। আমার জ্ঞানের দৌড় এতটা, যা আমি আপনাদের সামনে ব্যক্ত করেছি। আর আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেক ব্যক্তি ততটা কষ্ট দেন, যতটা তার সাধ্য আর আয়ত্বের মধ্যে রয়েছে”।
প্রশ্নকর্ত আমার কৌশলের নাগালের মধ্যে এসে যায় এবং কোন জবাবই সে দিতে পারেনা। এভাবে এক অনুপম উপায়ে- যা নিতান্ত সাদাসিদা এবং কার্যকর- তাকে বিপর্যয় সৃষ্টি করা থেকে নিবৃত্ত করি। উপস্থিত শ্রোতাদের সকলে না হোক, অধিকাংশ আমার বক্তব্যে আশ্বস্ত ও তৃপ্ত হয়। কিন্তু আমিও সুযোগ হাত ছাড়া হতে দেই না। উপস্থিত জনতার প্রতি লক্ষ্য করে আমি আরয করিঃ
“প্রিয় ভাইয়েরা আমার! আমি ভালো করেই জানি যে, প্রশ্নকর্তা এবং আপনাদের মধ্যে অধিকাংশ লোক এ প্রশ্নের অন্তরালে মূলতঃ জানতে চায় যে, এ নতুন প্রচারক কোন দলের লোক? সে কি শায় মুসার দলের লোক? নাকি শায়খ আব্দুস সামী-এর দলের সঙ্গে তার সম্পর্ক রয়েছে? এ তত্ত্বানুসন্ধান আপনাদের জন্য আদৌ উপকারী নয়। এ ফেৎনা সৃষ্টি আর পার্টিবাজীতে আপনারা গোটা আটটা বৎসর ব্যয় করেছেন। এখন এখানেই শেষ করুন। এসব বিষয়ে মুসলমানরা শত শত বৎসর বিরোধ করে আসছে। এখনো তাদের মধ্যে বিরোধ বহাল আছে। আমাদের পরস্পরের ভালোবাসা এবং ঐক্য আল্লাহ তা’আলার পছন্দ। মতবিরোধ আর ফের্কাবাজী তাঁর নাপছন্দ। আমি আশা করি, আপনারা আল্লাহর সঙ্গে অঙ্গীকার করবেন যে, এসব বিতর্ক ত্যাগ করবেন এবং দ্বীনের মূলনীতি শিক্ষার চেষ্ঠা করবেন। দ্বীনের আখলাক অনুযায়ী কাজ করবেন। সাধারণ ফাযায়েলকে গলার হার বানাবেন এবং সর্বসম্মত শিক্ষা অনুযায়ী আমল করবেন। ফরয এবং সুন্নত অনুযায়ী আমল করবেন এবং খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে বিবাদ-বিসংবাদ পরিহার করবেন। এতে অন্তর আয়নার মতো পরিষ্কার হবে। আর সত্য জানাই আমাদের সকলের লক্ষ্যবস্তু হওয়া উচিত। বিশেষ কোন মতের সমর্থন করা আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। আমাদের মধ্যে এ স্পৃহা সৃষ্টি হলে আমরা এ সমস্ত বিষয়ে পারস্পরিক আস্থা আর ভালোবাসার পরিবেশে এবং ঐক্য আর নিষ্ঠার সঙ্গে মত প্রকাশ করবো। আমি আশা করি, আপনারা আমার অনুরোধ মেনে নেবেন এবং এতে দৃঢ় থাকার জন্য আমাদের মধ্যে একটা সুদৃঢ় অঙ্গীকার গড়ে উঠবে”।
আমার দরদভরা আপীল কার্যকর হয়। এ মহফিল থেকে আমরা এ অবস্থায় বিদায় নেই যে, আমরা পরস্পরে অঙ্গীকার করি সহযোগীতা আর সরল দ্বীনের খেদমতই হবে আমাদের লক্ষ্য। দ্বীনের জন্য আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করবো। বিরোধপুর্ণ বিষয় পরিত্যাগ করবো এবং এসব বিষয়ে প্রত্যেকে নিজ নিজ মতে অটল থাকবো। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তা’আলা তাঁর অটল ফয়সালা জারী করবেন। এরপর আল্লাহর মেহেরবানীতে দারস মতবিরোধ থেকে নিরাপদে অব্যাহত থাকে। এখন আমি প্রতিটি বিষয়ে ইমানদারদের পারস্পরিত ভ্রাতৃত্ব আর সম্প্রীতির নানা দিক নেয়েই আলোচনা করি, যাতে ভ্রাতৃত্বের অধিকার অন্তরে জাগরূক হয়। এমন অনেক বিরোধপূর্ণ বিষয়ও বাছাই করতাম, যা নিয়ে তাদের মধ্যে তেমন বিরোধ ছিল না। সকলেই যাকে সম্মানীত বিষয় বলে মনে করতো, এসব বিষয়ে আমি এ জন্য আলোচনা করতাম, যাতে সালফে সালেহীন তথা অতীতের সাধু-সজ্জনদের উদারতা আর চক্ষু এড়িয়ে চলার প্রমাণ উপস্থাপন করা যায় এবং এ কথা বলতে পারি যে, মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তাতে একে অপরের প্রতি আমাদের উদারতা প্রদর্শন করা কর্তব্য।
একটা উদাহরণ
আমার মনে পড়ে, একদা আমি এ বিষয়ে তাদের সম্মুখে একটা বাস্তব উদাহরণ পেশ করি। আমি জিজ্ঞেস করি, আপনাদের মধ্যে কে হানাফী মযহাবের অনুসারী?
জনৈক ব্যক্তি উঠে আমার সামনে আসেন।
এরপর আমি জিজ্ঞেস করি, শাফেয়ী মযহাবের কে আছেন?
এ কথা শুনে অপর এক ব্যক্তি এগিয়ে আসেন।
আমিতাকে বলি, এরা উভয়ে এখনই আমার ইমামতিতে নামায পড়বেন। হে হানাফী, সূরা ফাতেহা পড়া সম্পর্কে তুমি কি মত অবলম্বন করবে?
হানাফী বললেন; আমি চুপ থাকবো, ফাতেহা সূরা পড়বো না।
শাফেয়কে জিজ্ঞেস করি: তুমি কোন পন্হা অবলম্বন করবে?
তিনি জবাব দেন: আমি অবশ্যই ফাতেহা পড়বো।
এরপর আমি বলি: যখন আমরা নামায শেষ করবো, তখন হে শাফেয়ী, বলুন তোমার ভাই হানাফী সম্পর্কে তোমার কি মত হবে?
তিনি বলেন: তার নামায বাতিল হবে। কারণ, সে ইমামের পেছনে ফাতেহা পড়েনি। আর ফাতেহা নামাযের অন্যতম রোকন বা অঙ্গ।
আমি হানাফীর প্রতি ইঙ্গিত করে বলি, হানাফী সাহেব, শাফেয়ী ভাইয়ের আমল সম্পর্কে আপনার কি মত?
তিনি জবাব দেন: সে মাকরূহ তাহরীমী কাজ করেছে। ইমামের পেছনে মোক্তাদীর ফাতেহা পড়া মাকরূহ তাহরীমী কাজ।
উভয়কে লক্ষ্য করে আমি বললাম: আপনারা কি একে অপরের কাজকে অন্যায় মনে করে তা নিশ্চিত করার চেষ্টা চালাবেন?
উভয়ে একমত হয়ে বলেন, কখনো না।
অন্য শ্রোতাদেরকে আমি জিজ্ঞেস করিব, আপনারা কি এদেরকে বারণ করবেন? সকলেই নেতিবাচক জবাব দেন।
আমি বলি, সুবহানাল্লাহ! এ ব্যাপারেতো আপনারা নীরবতা অবলম্বনের অবকাশ পান, অথচ: এটা নামায বাতেল হওয়া বা শুদ্ধ হওয়ার ব্যাপার। কিন্তু আপনারা এ ব্যাপারে কোন নামাযীর সঙ্গে উদারতা দেখাতে প্রস্তুত নন যে, সে নামাজে তাশাহহুদে আল্লাহুমা সাল্লি আলা মুহাম্মদ কেন পড়েছে, বা আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা সাইয়্যিদিনা মুহাম্মদ কেন পড়েছে। আর এতটুকু বিষয়কে আপনারা একটা বিরোধপূর্ণ বিষয়ে পরিণত করবেন এবং এক বিরাট হাঙ্গামা সৃষ্টি করবেন।
আমার দাওয়াতের এ ধারা বেশ কার্যকর হয়। সকলেই নিজ নিজ আচরণ পুনর্বিবেচনা করতে শুরু করে। তাদের মধ্যে এ ধারণা বদ্ধমূল হয় যে, আল্লাহর দ্বীন অনেক প্রশস্ত এবং অতি সহজ। আর এতে কোন ব্যক্তি বিশেষ বা দল বিশেষের ইজারাদারী নেই। আল্লাহ এবং রাসূলই হচ্ছেন সব কিছুর শেষকথা। অতঃপর মুসলিম দল বা ইমামের দিকে প্রত্যাবর্তন করা হবে। যদি বাস্তবিকই তাদের কোন দল বা ইমাম বর্তমান থাকে।
ইসমাইলিয়ার সমাজ
ইসমাইলিয়ায় শিক্ষকতা জীবনের প্রথম বর্ষের প্রথমার্ধের অধিকাংশ সময় এভাবেই কেটে যায়। অর্থাৎ ১৯৭২ সালের অবশিষ্ট মাসগুলো এবং ১৯২৮ সালের প্রথম দিক এভাবেই অতিবাহিত হয়। এ সময় আমার লক্ষ্য ছিল এখানকার জনগণ এবং শহরের অবস্থা সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতঃ যেসব কার্যকারণ এ শহরে প্রভাব বিস্তার করে, তা অনুসদ্ধান করা। অনুসদ্ধান দ্বারা আমি জানতে পারি যে, এখানে চারটা শ্রেণীর কর্তৃত্ব চলছে। এক. আলেম সমাজ, দুই. তরীকতের মাশায়েখ, তিন. শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এবং চতুর্থ. ক্লাব।
আলেম সমাজের সঙ্গে আমি বন্ধুত্ব আর পরিপূর্ণ সম্মান আর মর্যাদার রীতি অবলম্বন করি। আমি সবসময় এ চেষ্টা করি যে, দারস বা বক্তৃতা-ভাষণে কোন আলেমের সামনে আমি এগিয়ে যাই না। আমার দারস দানকালে কোন মওলবী সাহেব আগমন করলে আমি দারস ত্যাগ করে মওলবী সাহেবকে সকলের সম্মুখে উপস্থিত করি। আমার এ রীতি আলেম সমাজের মনে ভালো প্রভাব ফেলে এবং তাঁরা সব সময় আমার পক্ষে ভালো কথাই বলেছেন।
এ সময় একটা বেশ মজার ঘটনা ঘনে। জনৈক পূরাতন আযহারী শায়খ- যিনি আযহার শরীফে আযহারের প্রাচীন ব্যবস্থার অধীনে কয়েক বৎসর অতিবাহিত করেছেন, বহস আর মুনাযারায় তাঁর বেশ আগ্রহ ছিল, অজানা মাসআলা উত্থাপন করে ওয়ায়েযীন, আলেম আর দারস দানকারীদেরকে তিনি সবসময় ত্যক্ত-বিরক্তকরে তুলতেন এবং এমনসব বিষয় আর বক্তব্য নিয়ে আলোচনা করতেন, যা কিতাবের পুরাতন হাশিয়া আর সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা থেকে গৃহীত। একদিন তিনি আমাকেও জড়াবার চেষ্টা করেন। আমি লোকদের সম্মুখে হযরত ইবরাহীম (আ)- এর কাহিনী বর্ণণা করছিলাম। উক্ত শায়খ আমার নিকট হযরত ইবরাহম (আ)-এর পিতার নাম জানতে চাইলেন। আমি হেসে তাঁকে বললাম, মওলানা শায়খ আব্দুস সালাম, আল্লাহ তা’আলা আপনার প্রতি রহম করুন, বর্ণনায় দেখা যায় যে, তার নাম ছিল তারেখ। আর আযর ছিল হযরত ইবরাহীম (আ:)-এর চাচার নাম। কুরআন বলে, আযর তাঁর পিতা। আযরকে চাচা ধরে নেয়া হলেও কোন অসুবিধা নেই। কারণ, আরবী ভাষায় চাচাকেও পিতা বলা হয়। কোন তাফসীরকার বলেন যে, আযর হচ্ছে মূর্তির নাম। হযরত ইবরাহীম (আ)-এর পিতা বা চাচার নাম নয়। উহ্য এবারতসহ আয়াতটি হবে এরকম
**********************************
“যখন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তাঁর পিতাকে বললেন, আযর মূর্তিকে পরিত্যাগ করুন, আপনি কি মূর্তিকে খোদা বানাবেন?”
আমি তারেখ শব্দটি রায় যের দিয়ে পড়ি। সংক্ষেপে এ কথাগুলো আমার মতো লোকের জন্য সান্ত্বনাদায়ক ছিল। তাই বলে শায়খ বিষয়টা এত সহজে ছেড়ে দিতে চাননি। তিনি বললেন:
“হযরত ইবরাহীম আলাইহিম সালামের পিতার নাম তারুখ (রা’য় পেশ দিয়ে) আর আপনি রায় যের দিয়ে তারেখ পড়েছেন”।
আমি বললাম, “ঠিক আছে। পেশ দিয়েই পড়লাম। নামটাতো আজমী- অ- আরবী শব্দ। এর সঠিক উচ্চারণ সে ভাষা জানার উপর নির্ভর করছে। আসল ব্যাপার হচ্ছে নছিহত আর শিক্ষা গ্রহণ”। উক্ত শায়খ প্রতিটি দারসেই আমার সঙ্গে অনুরূপ পরিহাস করতেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, সাধারণ শ্রোতারা যাতে এসব অর্থহীন বিতর্কে বিরক্ত হয়ে চলে যায়। আর অর্থহীন বিতর্কের দায়-দায়িত্ব দু’জন মওলবীর উপর ন্যস্ত করা যায়। আমি শায়খের চিকিৎসার একটা উপায় অবলম্বন করি। একদিন তাঁকে আমার বাসায় দাওয়াত করি। তাঁর প্রতি ভক্তি দেখাই। ফিকহ এবং তাসাউউফ বিষয়ের দু’টি কিতাব হাদিয়া স্বরূপ তাঁর খেদমতে পেশ করি। তাঁকে আশ্বাস্ত করে বলি, যে কিতাব আপনার পছন্দ হয়, তা হাদিয়া স্বরূপ আপনাকে দান করতে আমি প্রস্তুত। হযরত শায়খ এ প্রস্তাবে আমার প্রতি বেশ সন্তুষ্ট হন। এরপর বেশ নিয়মিত তিনি দারসে শরীক হন এবং বেশ মনোযোগের সঙ্গে শোনেন। অন্যদেরকেও দারসে শরীক হওয়ার জন্য গুরুত্বের সঙ্গে দাওয়াত দেন। আমি মনে মনে বলি: রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাহ যথার্থই বলেছেনঃ
**********************************
“তোমরা পরস্পরে হাদিয়া বিনিময় করবে, একে অপরকে হাদিয়া দেবে; এর ফলে উভয়ের মধ্যে ভালোবাসার বিনিময় হবে”।
বেশ কিছুকাল এ পন্হা বেশ কার্যকর ছিল। কিন্তু মানুষের মন সবসময় ডিগবাজী খেলে।
এ শহরের অধিবাসীরা অতি সরলমনা মানুষ। এখানে আলেম আর পীরমাশায়েখদের বেশ প্রাচুর্য। আর বাইরে থেকে অনেক মাশায়েখও এখানে আগমন করেন। শায়খ হাসান আব্দুল্লাহ আল আসলামী, শায়খ আবূদ শাযেলী এবং শায়খ আব্দুল ওয়াহহাব দাদারাবী প্রমূখের মজলিশের কথা এখনো আমার মনে আছে। এ সময় শায়খ আব্দুর রহমান সা’আদ ইসমাঈলিয়া সফরে আগমন করেন। তিনি ছিলেন শায়খ হোছাফীর অন্যতম খলীফা এবং আমাদের পীরভাই। তাঁর নিয়ম ছিল এই যে, তিনি আগে দারস দিতেন, ওয়ায করতেন এবং সবশেষে যিকরের মাহফিলে নেতৃত্ব দিতেন। তিনি মসজিদে আগমন করেন। আমি তাঁকে চিনতাম না, তিনিও জানতেন না আমাকে। যিনি আগে মসজিদে দারস দেন, ওয়াজ করেন, এরপর লোকদেরকে যিকরের মহফিলে শরীক হওয়অর দাওয়াত দেন। আমি দেখতে পাই যে, এ যিকর হোছাফী তরীকার নিয়ম অনুযায়ী হচ্ছে। তাই তাঁর কাছে আমি নিজের পরিচয় দেই। কিন্তু সত্য কথা এই যে, একটা বিশেষ পদ্ধতিতে দাওয়াত বিস্তারের কোন আগ্রহ আদী আমার ছিল না। এর অনেক কারণ ছিল। সবচেয়ে বড় কারণ ছিল এই যে, অন্য সিলসিলার সমর্থকদের সঙ্গে শক্রতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্ম দিতে চাই না আমি। আমি এটাও চাই না যে, আমাদের দাওয়াত মুসলমানদের কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকুক, অথবা ইসলামের সংস্কার মিশন কেবল একটা কেন্দ্রে কেন্দ্রীভূত থাকুক। বরং আমি পারিপূর্ণ চেষ্টা চালাই, যাতে আমার দাওয়াত ব্যাপক ভিত্তিক হয়। তার কেন্দ্রবিন্দু হয় জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, তরবিয়ত আর তাযকিয়া, জিহাদ এবং আমল। আর এ তিনটি বিষয় হচ্ছে ইসলামী দাওয়াতের সবচেয়ে বড় স্তম্ভ। এরপরও যে ব্যক্তি কোন বিশেষ ধরনের তরবিয়তে তরক্কী করতে চায়, সে নিজের পছন্দ অনুযায়ী আমল করতে পারে। কিন্তু আমার এই দৃষ্টিভঙ্গি সত্ত্বেও আমি হোছাফী সিলসিলার একজন পথপ্রদর্শক শায়খ আব্দুর রহমান সা’দকে মেনে নেই, তাঁকে বিপুল অর্ভর্থনা জ্ঞাপন করি। এবং হোছাফী সিলসিলার ভক্তদেরকে দীক্ষা দেই তাঁর কাছ থেকে উপকৃত হওয়অর এবং তাঁর ওয়াজ-নছিহত শোনার জন্য। কিছুদিন অবস্থান করে শায়খ আব্দুর রহমান ফিরে যান।
এ সময় সাইয়্যেদ মুহাম্মদ হাফেয তীজানীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। লোকজনকে বাহায়ীদের চক্রান্ত সম্পর্কে সতর্ক করার বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি ইসমাঈলিয়া আগমন করেন। কারণ, সে সময় ইসমাঈলিয়ার আশপাশে বাহায়ীরা চরমভাবে ছড়িয়ে পড়ছিল আর বাহায়ী প্রচারকরাও কোমর বেঁধে মাঠে অবতীর্ণ হয়েীছ। সাধারণ মানুষকে বাহায়ীদের সম্পর্কে সতর্ক করা, বাহায়ীদের চক্রান্তের জাল ছিন্ন করা এবং তাদের ভ্রান্ত চিন্তাধারার রহস্য উন্মোচনের ক্ষেত্রে সাইয়্যেদ মুহাম্মদ হাফেয মূল্যবান ভূমিকা পালন করেন। তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, দ্বীন-ইসলামের প্রতি তাঁর আগ্রহ দেখে আমি নিজেও অনেক প্রভাবিত হই। তীজানী সিলসিলা সম্পর্কে বাড়াবাড়ি আর শরীয়তের বিরুদ্ধাচরণের যেসব অভিযোগ মানুষ উত্থাপন করতো, এ প্রসঙ্গে আমি তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করি এবং এসব কথাবার্তায় কয়েক রাত নিদ্রাহীন অবস্থায় কাটাই। এসব ফের্কার যেসব চিন্তাধারা সম্পর্কে ব্যাখখ্যার অবকাশ রয়েছে, তিনি তা ব্যাখ্যা করে কাটাতেন, আর যেসব চিন্তাধারা ইসলামের স্বচ্ছ আকীদা-বিশ্বাসের সঙ্গে সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটায়, সেসব সম্পর্কে বারণ করতেন এবং কঠোরভাবে সে সবের সঙ্গে তাঁর কোন সম্পর্ক নেই বলে প্রচার করতেন।
মোটকথা, যেসব পীর-মাশায়েখ সময়ে সময়ে ইসমাঈলিয়া আগমন করতেন, আমার নীতি এই ছিল যে, তরীকতের আদব অনুযায়ী আমি তাদের সম্মুখে নত হতাম এবং তরীকতের ভাষায়ই তাঁদের সঙ্গে কথা বলতাম। এরপর যখন তাঁদের সঙ্গে একান্তে মিলিত হতাম, তখন তাদেরকে মুসলমানদের দুঃখ ভরা কাহিনী শুনাতাম যে, কিভাবে মুসলমানরা দ্বীনের বুনিয়াদী বিষয় সম্পর্কেও বেখবর হয়ে পড়েছে। তাদের ঐক্য অনৈক্যের শিকারে পরিণত হয়েছে। দ্বীন এবং দুনিয়ার স্বার্থের হুঁশও তাদের নেই। তাদের দ্বীনও বিরাট বিপদের কবলে পতিত হয়েছে। কারণ, ধর্মদ্রোহিতা আর নাস্তিকতার সয়লাব তাদের আসল কেন্দ্রেই আঘাত হানছে। আর তাদের দুনিয়াও ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছে। কারণ, বিদেশী হামলাকারীরা তাদের দেশের সম্পদের উপরও অধিকার প্রতিষ্ঠা করে বসছে। ইসমাইলিয়ার পশ্চিম দিকে বৃটিশ সৈন্যদের শিবির আর পূর্বদিকে সুয়েজ ক্যানেল কোম্পানীর অফিস আমার রোদনের জীবন্ত উদাহরণ। আমি তরীকতের এসব পীরদেরকে স্মরণ করাতাম যে, আপনাদের অনুসারীদের পরিপূর্ণ আস্থা রয়েছে আপনাদের প্রতি। তারা নিজেদের রশি আপনাদের হাতে দিয়ে রেখেছে। সুতরাং তাদের পক্ষ থেকে আপনাদের স্কন্ধে এই ভারী দায়িত্ব ন্যস্ত হয় যে, আপনারা তাদেরকে আল্লাহর পথের সন্ধান দেবেন এবং মঙ্গল ও কল্যাণের পথ দেখাবেন। অতঃপর সব শেষে আমি এ দাবীও জানাতাম যে, আপনারা নিজেদের সমস্ত চেষ্টা-সাধনা এ ব্যাপারে নিয়োজিত করুন, যাতে মুরীদদের মন-প্রাণ জ্ঞান আর প্রজ্ঞার আলোকে আলোকিত হতে পারে। তারা যাতে ইসলামের সত্যিকার তরবিয়তে বিভূষিত হতে পারে। ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব আর ইসলামের শান-শওকত পুনর্বহাল করার জন্য তারা যেন এক দেহ এক প্রাণ হয়ে কাজ করতে পারে।
শায়খ আব্দুল ওয়াহহাব দান্দারাবী (র)-এর সঙ্গে সাক্ষাতের স্মৃতি এখনো আমার স্মরণ আছে। আমি তাঁকে প্রায় আমারই সমবয়সী নওজোয়ান হিসাবে দেখতে পেয়েছি। বয়স বড় জোর ২০/২১ বৎসর হবে। তাঁর মধ্যে পরিদৃষ্ট হয় সততা আর পূণ্যাত্ম। আদব আর সম্মানের সঙ্গে আমি তাঁর মজলিশে বসি, মজলিশ শেষ হলে একান্তে মিলিত হওয়ার জন্য আমি তাঁর কাছে আবেদন জানাই। আমি তাঁর কক্ষে প্রবেশ করে মাথা থেকে রুমী টুপি খুলে কুরসীর উপর রেখে দেই। টুপির উপর যে পাগড়ি বাঁধা ছিল, তা-ও খুলে টুপির সঙ্গে রেখে দেই। আমার এ কান্ড দেখে তিনি অবাক হন। কারণ, ইতিপূর্বে তাঁকে এ ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়নি কখনো। আমি তাঁকে বলি: ভাই, আমার এ কান্ডকে সমালোচনার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করবেন না। এ কাজ আমি এ জন্য করেছি, যাতে আপনার আর আমার মধ্যে যে বাহ্যিক পার্থক্য রয়েছে, তা দূর হয়ে যায়। যাতে আমি একজন মুসলমান নওজোয়ানের সঙ্গে কথা বলতে পারি, যাঁর নাম আব্দুল ওয়াহহাব দান্দরাবী। আর শায়খ আব্দুল ওয়াহহাবকে তো আমরা সাধারণ মজলিশে রেখে এসেছি। ভাই, আপনি জীবনের কুড়িটা বসন্ত অতিক্রম করছেন। আলহামদু লিল্লাহ, আপনি পরিপূর্ণ যুবক। আপনার মধ্যে রয়েছে উৎসাহ-উদ্দীপনা আর কর্মচাঞ্চল্য। মানুষের এসব সমাবেশ রয়েছে আপনার সম্মুখে। আল্লাহ তা’আলা আপনার আশপাশে এসব লোককে সমবেত করেছেন। এরা যিকর আর মুনাজাতে রাত অতিবাহিত করে। এ ছাড়া আর কিছুই এরা করে না। কিন্তু এদের অধিকাংশের অবস্থা অন্যান্য মুসলমান থেকে ভিন্ন নয়। দ্বীন সম্পর্কে সেই একই অজ্ঞতা, ইসলামের মর্যাদা আর শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে সেই অনুভূতিহীনতা, সেই অপরিচিতি। এ পরিস্থিতি কি আপনার পছন্দ?
তিনি তাৎক্ষণিক জবাব দেন: আমি কি করবো? আমি আরয করি: তাদের মধ্যে জ্ঞান ও চেতনার সহ্ছার করুন, তাদেরকে সংগঠিত করুন এবং মোহাসাবা করুন, তাদেরকে সাফলে সালেহীনের সীরাত-চরিত্র শিক্ষা দিন এবং ইসলামের নামকরা মুজাহিদদের ইতিহাস সম্পর্কে তাদেরকে অবহিত করুন।
মোটকথা, এসব বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার দীর্ঘক্ষণ কথাবার্তা চলে। শায়খ আব্দুল ওয়াহহাব আমার কথায় বেশ প্রভাবিত হন। আমরা উভয়ে বাস্তব প্রচেষ্টা চালানের অঙ্গীকার করি। অর্থাৎ আমরা উভয়ে দ্বীনি ভাই হিসাবে ইসলামের সর্বাত্মক খেদমত করবো। মানুষের অন্তরে ইসলামের দাওয়াত অংকুরিত করবো। আমাদের মধ্যে প্রত্যেকে স্ব স্ব ক্ষেত্র আর পরিমন্ডলে এ দায়িত্ব পালন করবে। আমি এ কথার সাক্ষ্য দিতে পারি যে, এরপর যখনই তিনি ইসমাঈলিয়া আগমন করেন, সর্বপ্রথম আমার সঙ্গে দেখা করতেন এবং আমাকে আশ্বস্ত করতেন যে, তিনি তাঁর অঙ্গীকারে যথারীতি অটল আছেন এবং তদনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছেন। ওফাত পর্যন্ত তিনি এ রীতি মেনে চলেন। আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রতি রহমত নাযিল করুন এবং ওফাদারীর নেক প্রতিদান তাঁকে দান করুন।
শহরের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে
সে সময়ে ইসমাঈলিয়ার সম্মানিত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ দু’ধরনের চিন্তাধারার প্রতিনিধিত্ব করতেন। মূলতঃ এর পেছনে ছিল সে ধর্মীয় মতবিরোধ, নানা মাসআলা নিয়ে আলেম সমাজের মধ্যে যা দেখা দেয়। কিন্তু মূলতঃ এসব মতবিরোধ চাঙ্গা করায় ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক বিষয়ের বিরাট ভূমিকা ছিল। আর মিশরের সমাজে সাধারণতঃ এটাই দেখা যেতো। শহরে বাইরে থেকে কোন শ্রমিক এখানে আগমন করলে শহরের বিশিষ্ট ব্যাক্তিবর্গের সঙ্গে যোগাযোগ করা এবং তাদের গৃহে যাতায়াত করা তাদের জন্য অপরিহার্য ছিল। সরকারী কর্মচারী, শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে যাদের যোগাযোগ ছিল, তারা দু’টি শিবিরে বিভক্ত ছিল। শহরে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের দু’টি শিবিরের মধ্যে কোন একটা শিবিরের সঙ্গে প্রতিটি ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু আমার অনুভূতি ছিল এই যে, দাওয়াতের সাধারণ মেজায-কারণ, এ দা’ওয়াত হচ্ছে ভ্রাতৃত্বের দা’ওয়াত এবং প্রীতি-ভালোবাসা দ্বারাই এর গাড়া তৈয়ার হয়েছে- একই সঙ্গে উভয় শিবিরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা আমার জন্য অপরিহার্য। তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক হওয়া উচিত সম্পূর্ণ স্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থহীন। সুতরাং আমি যখন উভয় শিবিরের নেতাদের মধ্যে কারো বাসায় গমন করতাম, তখন আমি এ সিদ্ধান্ত নিয়ে গমন করতাম যে, প্রতিপক্ষ সম্পর্কে আমি অবশ্যই কিছু বলবো। আমি এ ধারণা সৃষ্টি করার চেষ্টা করবো যে, আপনার পক্ষে মঙ্গল আর কল্যাণ কামনা ছাড়া অন্য কোন স্পৃহাই তার নেই। সে সব সময় ভালো নামের সঙ্গেই আপনাকে স্মরণ করে। এখন উভয়ের উপর কর্তব্য বর্তায় তাদের শহরের মঙ্গল আর কল্যাণের কাজে একে অপরের সহযোগিতা করা। আর স্বয়ং ইসলামও তো ভালো কাজে সহায়তার নির্দেশ দেয়।
মোটকথা, এসব মহফিলে আমি এমনসব বিষয় উত্থাপন করতাম, যাতে অন্তর কাছাকাছি আসে, মনের ঐক্য গড়ে উঠে। অন্য কাউকেও প্রতিপক্ষের সমালোচনা করতে দেখলে আমি তৎক্ষণাৎ বাধা দিয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতঃ বলতাম, ঐক্য ও সংহতির দূত হওয়ার মধ্যেই কল্যাণ নিহিত। এ ভালো কাজে সহায়ক হয় না, এমন কোন কথাই এদিক সেদিক চালাচালী করা ঠিক নয়। গীবৎ আর বদ কথায় পংকীল হওয়ার কোনই প্রয়োজন নেই। আর গীবততো কবীরা গুনাহ। আমার এ কথাগুলো ভিন্ন শিবিরেও অবশ্যই পৌঁছানো হতো। একটা ছোট মাপের শঞরে এ ব্যাধি সাধারণতঃ পাওয়া যায়। ভিন্ন শিবিরে এটা আনন্দের কারণ হতো। এ কর্মপন্হার বদৌলতে আমি একই সময়ে উভয় শিবিরের বন্ধুত্ব ও শ্রদ্ধা অর্জনে সফল হই। আর পরবর্তীকালে যখন যথারীতি ইখওয়ানুল মুসলিমূন সংগঠন গড়ে উঠে, তখন ইখওয়ানের আহ্বানে বিভিন্ন চিন্তাধারার মানুষের সমবেত হওয়ায় আমার এ রীতি-পদ্ধতির বিরাট ভূমিকা ছিল।
ক্লাবের জগৎ
সে সময় ইসমাঈলিয়ার একটা লেবার ক্লাব ছিল। পারস্পরিক সহায়তা সমিতি এ ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে। শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে এ ক্লাব ভালোভাবেই তাদের মিশন চালিয়ে যাচ্ছিল। এ ক্লাবে শিক্ষিত যুবকদের একটা বাছাই করা দলও ছিল। যারা ভালো কথা শুনতে প্রস্তুত ছিল। নেশা প্রতিরোধ সংগঠনের একটা শাখাও ছিল। যেখানে মাদক দ্রব্য সম্পর্কে আলোচনা আর লেকচার দেওয়া হতো। আমি এ সুযোগের পুর্ণ সদ্ব্যবহার করি এবং উভয় সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলি। এখন সেখানে ধর্ম, সমাজ এবং ইতহাস বিষয়ে ধারাবাহিক বক্তৃতা শুরু করি। অনেক শিক্ষিত ব্যক্তির অন্তরকে ভবিষ্যৎ দাওয়অতের জন্য প্রস্তুত করায় আমার এসব বক্তৃতা কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
কায়রোর সঙ্গে যোগাযোগ
যদিও ইসমাঈলিয়ায় আমার সর্বশক্তি নিয়োজিত ছিল চিন্তামূলক আহ্বান বদ্ধমূল করা এবং মন-মানসকে প্রস্তুত করার কাজে। কিন্তু এর পরও তখন কায়রোয় সে ক্ষীণ ইসলামী শ্রোত দেখা দিচ্ছিলো, তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কেও আমি অনবহিত ছিলাম না। আলফাতাহ পত্রিকার সঙ্গে আমার পুরাপুরী যোগাযোগ ছিল। ইসমাঈলিয়ায় আমি সর্বশক্তি নিয়োগ করে আলফাতাহ পত্রিকার দাওয়াত ছড়াচ্ছিলাম এবং তার জন্য সর্বাধিক খরিদ্দার সংগ্রহ করছিলাম। কারণ, এ পত্রিকা ছিল আলোর সেই প্রথম কিরণ, যার আলোকে ইসলামী আন্দোলনের পতাকাবাহীরা সফর শুরু করেছিলেন।
জমিয়তে শুব্বানুল মুসলিমীন
নওজোয়ানদের সে গ্রুপটির সঙ্গে আমার যথারীতি যোগাযোগ ছিল, কায়রোয় যাদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল এবং যাদের সঙ্গে এ অঙ্গীকার হয়েছিল যে, আমরা সকলে মিলে এক সঙ্গে ইসলামের সর্বাত্মক দাওয়াতের কাজ চালাবো।
একদিন ভোরে যখন সংবাদপত্রে এ খবর পাঠ করি যে, শুব্বানুল মুসলিমীন নামে একটা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং মরহুম আব্দুল হামীদ বেক সাঈদকে এ সংগঠনের সভাপতি করা হয়েছে, তখন আমি খুবই খুশী হয়েছিলাম। এসব কিছু ছিল সেসব ঈমানদার নওজোয়ান ভাইদের প্রচেষ্ঠার ফল, যাদের সম্পর্কে পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। মনে পড়ে খবর পাঠ মাত্রই আমি আব্দুল হামীদ বেক সাঈদকে একখানা পত্র লিখি, যাতে আমি ঘোষণা করেছিলাম যে, আমিও এ সংগঠনে শরীক আছি। আমি নিয়মিত চাঁদা দিতাম সংগঠনকে এবং তাঁর কাজের অগ্রগতি পর্যালোচনা করতাম নিয়মিত। বেশ মনোযোগ সহকারে সংগঠনৈর খবরাখবর পাঠ করতাম। কায়রোয় আমার ভাষণ হয়েছিল সংগঠনের ক্লাবে মজলিসুন নবাব সড়কে। আমার মনে পড়ে, সে ভাষণের শিরোনাম ছিল দু’টি সংস্কৃতির তুলনামুলক আলোচনা আমি সব সময় জমিয়তে শুব্বানুল মুসলিমীন-এর প্রতিষ্ঠাতা আর কর্মীদের সোনালী ইসলামী খেদমতের কদর করতাম এবং এখনো করি। তাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম এখনো আমার মনে আছে: ডা. ইয়াহইয়া দারদীরী, ওস্তাদ মাহমুদ আলী ফযলী, ওস্তাদ মুহাম্মদ আল-গামরাবী এবং সাইয়্যেদ মুহিবুদ্দীন আল খতীব প্রমুখ। আল্লাহ তা’আলা এদের সকলকে ইসলাম এবং মুসলমানদের পক্ষ থেকে নেক প্রতিদান দান করুন।
একটা চিত্তাকর্ষক ঘটনা
একটা চিত্তাকর্ষক ঘটনা ঘটে। আমি ইসমাঈলিয়ায় এসেছি চল্লিশ দিন হয়ে গেছে। ছোট মাপের হোটেলগুলোতে (আমরা যাকে বলি বিনসিউনাত) আরো বেশীদিন অব্স্থান করতে ভালো লাগছিল না। তাই আমরা একটা প্রাইভেট বাসা ভাড়া নেই। ঘটনাক্রমে বাসার সবচেয়ে উঁচু তলায় আমারদের স্থান হয়। বাসার দোতলার সবটা ভাড়া নেয় মিশরীয় খৃস্টানদের একটা গ্রুপ এবং সেখানে তারা একটা ক্লাব এবং একটা গীর্জাও স্থাপন করে। আর গোটা নীচের তলাটা ভাড়া নেয় একদল ইহুদী। তারাও সেখানে কিছু অংশ ক্লাব আর কিছু অংশ গীর্জার জন্য নির্দিষ্ঠ করে রাখে। আমরা ছিলাম সবচেয়ে উপর তলায়। সেখানে আমরা যথারীতি নামায কায়েম করতাম এবং এ জন্য আমরাও একটা স্থান মসজিদের জন্য নির্দিষ্ট করি। এ ঘরটি যেন তিনটি ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করছিল। গীর্জার চাবিধারক বৃদ্ধা উম্মে শালূমের কথা কিছুতেই ভুলা যাবে না। বৃদ্ধা প্রতি শনিবার রাত্রে আমাদের নিকট নিবেদ করতো বাতি জ্বালানো এবং গ্যাসের চুলা জ্বালানোর কাজে তার সহায়তা করার জন্য (কারণ, ইহুদীরা শনিবার রাত্রে কোন কাজ করা বৈধ মনে করে না)। আমরা তাকে উত্যক্ত করে বলতামঃ
এসব ভান-ভনিতা আর প্রতারণার কারবার আর কতকাল চালাবে? আল্লাহর সামনে এসব প্রতারণা চলবে না। আল্লাহ তা’আলা যদি শনিবার দিন তোমাদের জন্য আলো আর আগুন দু’টাই হারাম করে থাকেন, তোমরা যা দাবী কর, তবে কি আলো আর আগুন দ্বারা উপকৃত হওয়াও হারাম করেছেন?
বৃদ্ধা আমাদের কথা শুনে মাফ চাইতো। আর এভাবে আমাদের বিবাদ শান্তিতে নিষ্পত্তি হতো।
ইসমাঈলিয়ার প্রতিচ্ছবি
ইসমাঈলিয়া মন-মানসে এক বিস্ময়কর অবস্থা সৃষ্টি করে। তার পূর্বদিকে রয়েছে ইংরেজ সৈন্যদের ছাউনী। এ ছাউনী আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন দেশপ্রেমিক মানুষের মনে দুঃখ আর ক্ষোভের জন্ম দেয়। ঘৃণ্য সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাস স্মরণ করতে তাদেরকে বাধ্য করে। তাদেরকে স্মরণ করতে হবে এ সাম্রাজ্যবাদ মিশরে কোনসব বিপদ ডেকে এনেছে। বস্তুগত আর জ্ঞানগত কোনসব সুবর্ণ সুযোগ থেকে মিশরকে কিভাবে বঞ্চিত করেছে। মিশরের উন্নতি-অগ্রগতির পথে কিভাবে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং ৬০ বৎসর থেকে আরব ঐক্য এবং মুসলিম সংহতিতে কিভাবে বাধা সৃষ্টি করছে।
সুদর্শন আর জাঁকজমকপূর্ণ দফতর- সুয়েজ ক্যানেল কোম্পানীর প্রশাসনিক দফতর দাঁড়িয়ে আছে তার গাম্ভীর্য নিয়ে। মিশরীরা এখানে আসে চাকুরীর সন্ধানে। আর এখানে তাদের সঙ্গে করা হয় দাসসূলভ আচরণ। কিন্তু বিদেশীদেরকে এখানে সম্মান করা হয়। তাদেরকে দেয়া হয় শাসক শ্রেণীর মর্যাদা। এ দফতর শহরের সমস্ত কর্মকাণ্ডের একক কর্তা আর ইজারাদার। আলো, পানি, পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি পৌরসভার যাবতীয় কর্মকাণ্ড কোম্পানী নিজ হাতে নিয়ে রেখেছে। এমনকি মিশরের ঐতিহ্যবাহী শহর ইসমাঈলিয়ায় যাতায়াতের সমস্ত রাস্তাঘাটও কোম্পানীর করায়ত্ত্ব। কোম্পানীর অনুমতি ছাড়া কেউ সেখানে প্রবেশ করতে পারে না এবং কোম্পানীর ছাড়পত্র ব্যতীত কেউ সেখান থেকে যেতেও পারে না।
ফিরিঙ্গী কলোনীতে ছড়িয়ে আছ বিশাল অট্টালিকা। এখানে বাস করে কোম্পানীল বিদেশী কর্মারীরা। এদের বিপরীতে রয়েছে আরব শ্রমিকদের সংকীর্ণ-অন্ধকার প্রকোষ্ঠ, যেখানে তারা বাস কর। বড় বড় সড়কগুলোর নামফলক পর্যন্ত অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদীদের ভাষায় লেখা। এমনকি মসজিদ সড়কের নাম পর্যন্ত লেখা হয়েছে এভাবে I RUE DELE MOSQUE. আর এসব ফলক দ্বারা এখানে বিদেশী নাম স্থায়ী করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এসব ঘটনা আর বাস্তবতা মনে প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে এ প্রভাব আরো তীব্র হয়। যখন কোন ব্যক্তি ইসমাঈলিয়ার গহীন বন, মনমাতানো উদ্যান, কুমীর ঝিলের মনোরম তীর বা প্রাকৃতিক জঙ্গলে বসে এসব বিষয় নিয়ে চিন্তা করে। ইসমাঈলিয়ার পরিবেশ এ লেখকের মনে এমন অনেক প্রভাব ফেলেছে। মুদ্রিত করেছে অ-মুছণীয় ছাপ। দাওয়াত সংগঠন আর আহ্বানকারীর মনমানস গঠনে এসব ঘটনা আর বাস্তবতার বিরাট ভূমিকা রয়েছে।
ইখওয়ানুল মুসলিমুন প্রতিষ্ঠা
আমার যতদূর মনে পড়ে, ১৩৪৭ হিজরীর যিলকদ মাস, মোতাবেক ১৯৮ সালের মার্চ মাসের ঘটনা। নিম্নোক্ত ৬ জন বন্ধু আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করর জন্য বাসায় আগমন করেন; হাফেয আব্দুল হামীদ, আহমদ আল-হাছরী, ফুয়াদ ইবরাহীম, আব্দুর রহমান হাসবুল্লাহ, ইসমাঈল ইজ্জ এবং যাকী আল মাগরেবী। আমি সময় সময় ইসমাঈলিয়ায় যেসব দারস আর বক্তৃতা করতাম, এরা ছিলেন তার দ্বারা প্রভাবিত। তাঁরা আমার সঙ্গে দাওয়াতের প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। তখন তাঁদের আওয়াজে গর্জন, চোখে চমক আর চেহারায় ঈমান ও উদ্দীপনার আলো ফুটে উঠছিল। তাঁরা বলে চললেন:
“আমরা আপনার বক্তৃতা শুনেছি, মনের গভীরে তা গেঁথে রেখেছি। আর সেসব বক্তৃতার অসম্ভব প্রভাব পড়েছে আমাদের উপর। কিন্তু আমরা জানি না, ইসলামের মর্যাদা আর মুসলমানদের কোন স্থান নেই, নেই কোন মান-মর্যাদা। তারা কেবল বিদেশীদের অনুগত শ্রমিক। আমাদের কাছে আছে কেবল টগবগ করা রক্ত, খুদী আর আত্মমর্যাদার উষ্ণতা নিয়ে তা শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত হচ্ছে। এ প্রাণগুলো ঈমান আর মর্যাদার অনুভূতিতে ভরপুর। আমাদের হাতে আছে এ কয়টা দিরহাম, যা আমরা নিয়ে এসেছি শিশুদের পেট কর্তন করে। কাজের পন্হা আপনি যতটা বুঝেন, আমরা ততটা বুঝি না। দেশ-জাতি আর মিল্লাতের খেদমতের উপায় আপনি যেমনটা জানেন, তেমনটা আমরা জানতে পারি না। আমরা এখন যে খাহেশ নিয়ে এখানে আগমন করেছি, তা হচ্ছে এই যে, আমাদের অধিকারে যা কিছু আছে, তা আপনার খেদমতে পেশ করে আমরা আল্লাহর নিকট নিজেদের দায়িত্ব থেকে মুক্ত হবো। আমাদেরকে কি করতে হবে, সে দায়িত্ব আপনারা। যে দল নিষ্ঠা সহকারে আল্লাহর সঙ্গে এ অঙ্গীকার করে যে, আল্লাহর দ্বীনের জন্য তারা বেঁচে থাকবে এবং দ্বীনের পথেই তারা মৃত্যুবরণ করবে এবং একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্ঠিই তাদের কাম্য, এমন দলই সফল হবে; তাদের সংখ্যা যতই নগণ্য এবং তাদের উপায়-উপকরণ যতই তুচ্ছ হোক না কেন?”
এ উদাত্ত আহ্বান আমার মনে গভীর প্রভাব ফেলে। যে বোঝা আমার উপর চাপানো হয়েছে, তা থেকে পলায়নের পথ ধরতে পারিনি। এতো সে বোঝা, যার দাওয়াত দিয়ে আসছিলাম আমি নিজেই, যে জন্য আমি নিজেই চেষ্টা-সাধনা চালিয়ে আসছিলাম। যার চারপাশে লোকজন জড়ো করার জন্য চেষ্টা করে আসছিলাম। আহ্বানে সাড়া দেয়ার উদ্দীপনায় ডুবে তাদেরকে বলি:
“আল্লাহ তা’আলা আপনাদের চেষ্টা কবুল করুন। আপনাদের নেক বাসনায় বরকত দান করুন এবং আমাদের সকলকে নেক আমল করার তাওফীক দান করুন, যাতে তাঁর সন্তুষ্ঠি অর্জিত হয় এবং সৃষ্টিকূলের উপকার হয়। আমাদের কর্তব্য হচ্ছে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। সফলতা আল্লাহর হাতে। আসুন আমরা আল্লাহর সঙ্গে অঙ্গীকার করি যে, আমরা হবো ইসলামের দাওয়াতের সৈনিক। দেশ ও জাতির মঙ্গল এ দাওয়াতের মধ্যেই নিহিত”।
এরপর অঙ্গীকার আর বায়য়াত গৃহীত হয়। আমরা এ মর্মে শপথ করি যে, ভাই ভাই (ইখওয়ান) হয়ে আমরা জীবন যাপন করবো, ইসলামের জন্য কাজ করবো এবং ইসলামের পথে জিহাদ হবে আমাদের ব্রত।
একজন বন্ধু দাঁড়িয়ে বললেন, আমরা নিজেদেরকে কি নামে ডাকবো? আমরা কি কোন সংগঠন? কোন ক্লাব? না কোন সমিতি? আমাদেরকে কোন আনুষ্ঠানিক নাম ধারণা এবং একটা বিশেষ কর্মপন্হা। ইসলামের খেদমতের জন্য আমরা পরস্পরে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। সুতরাং আমরা মুসলমান ভাই ভাই এবং আমাদের নাম হবে ‘আল ইখওয়ানুল মুসলিমুন’।
সকলের মুখে মুখে এ নাম উচ্চারিত হয়। পরে এটা প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয়। ৬ জনের সমন্বয়ে ইখওয়ানুল মুসলিমূন গঠিত হয় উপরোক্ত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্মুখে রেখে একটা অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।
তাহযীব-তরবিয়ত মাদ্রাসা
কোথায় সমাবেশ করা হবে আর সমাবেশের প্রোগ্রাম কি হবে- অতঃপর তা নিয়ে আমরা পরামর্শ করি। শেষ পর্যন্ত আমরা এ বিষয়ে একমত হই যে, শাহ ফারুক সড়কে শায়খ আলী শরীফের নিকট থেকে মাসিক ৬০ ক্রোশ ভাড়ায় একটা সাদামাটা কক্ষ ভাড়া নেয়া হবে। এতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও রাখা যাবে এবং বিশেষ সমাবেশও করা যাবে। এখানে একটা মক্তব বসতো। আমরা একটা শর্ত দেই যে, ছাত্ররা গৃহে চলে গেলে আমরা আসর থেকে নিয়ে রাত পর্যন্ত মক্তবের সামান ব্যবহার করতে পারবো।এ স্থানের নাম দেয়া হবে ইখওয়ানুল মুসলিমুনের মাদ্রাসাতুত তাহযীব। এর পাঠ্যসূচী হবে ইসলামিয়াত শিক্ষা। যার বুনিয়াদী বিষয় হবে সহীহ-শুদ্ধভাবে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত। এ মাদ্রাসার সঙ্গে অন্য কথায় এ দাওয়াতের সঙ্গে সম্পৃক্ত ভাইয়েরা তাজবীদের নিয়ম অনুযায়ী কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করবে। এরপর কতিপয় আয়াত আর সূরা মুখে মুখে হিফয করার চেষ্টা করা হবে এবং এসব আয়াত আর সূরার উপযুক্ত তাফসীরও করা হবে। কতিপয় হাদীসও মুখস্থ করা হবে এবং তার ব্যাখ্যাও করা হবে। আকাইদ-ইবাদাত সহীহ-শুদ্ধ করা হবে, ইসলামী আইন এবং ইসলামের সামাজিক বিধানের দর্শন ব্যাখ্যা করা হবে; ইসলামের ইতিহাস, রাসূলে করীমের জীবন চরিত এবং সালফে সালেহীনের জীবনধারা সরলভাবে শিক্ষা দেয়া হবে, যার লক্ষ্য হবে আমলী এবং রূহানী দিক স্পষ্ট করে তুলে ধরা। উপরন্তু যোগ্য ব্যক্তিদেরকে বক্তৃতা আর তাবলীগের প্রশিক্ষণও দেওয়া হবে। আর এ উদ্দেশ্যে তাদেরকে পদ্য এবং গদ্যের প্রয়োজনীয় অংশ মুখস্থ করানো হবে। এসব বিষয় মাদ্রাসার পার্ঠ তালিকার অন্তর্ভুক্ত হবে। উপরন্তু বাস্তব অনুশীলন হিসাবে মাদ্রাসার ভাইদেরকে প্র্রথমে নিজেদের পরিবেশে পাঠদান আর বক্তৃতা করতে দেয়া হবে। ধীরে ধীরে পরে তাদেরকে বৃহত্তর পরিবেশে এ কাজে লাগানো হবে। এ বিশেষ শিক্ষা দানের আওতায় ১৯২৭-২৮ সালের শিক্ষা বর্ষ শেষে ইখওয়ানুল মুসলিমূনের প্রথম গ্রুপের সংখ্যা ৭০-এর কাছাকাছি দাঁড়ায়।
তরবিয়তের ফলাফল
কিন্তু এসব শিক্ষাক্রমই আমাদের জন্য সবকিছু ছিল না। বরং তাদের পরস্পরে মেলামেশা, বাস্তব লেনদেন, কাজকারবার, ভালোবাসা-সম্প্রীতি, জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ সহযোগিতা এবং যে কোন ভালো কাজের জন্য তাদের অন্তরে যে প্রস্তুতি সৃষ্টি হয়, তার বাস্তব অনুশীলনের লক্ষণ ছিল এ দলের গঠন প্রকৃতিতে সবচেয়ে সুদূর এবং শক্তিশালী কার্যকারণ। আমার মনে পড়ে, একবার আমি ভাই সাঈদ আবূ সউদের দোকানে গমন করি। ভাই মুস্তফা ইউসুফ তাঁর দোকান থেকে এক বোতল সুগন্ধী তেল ক্রয় করেন। ক্রেতা দশ ক্রোশ মূল্য দিতে চায়, কিন্তু বিক্রেতা ৮ ক্রোশের বেশী গ্রহণ করতে রাজী নয়। দু’জনের কেউই নিজের জিদ ছাড়তে রাজী নয়। এ দৃশ্য আমার মনে বিরাট প্রভাব ফেলে। আমি এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করি। ক্রয়মুল্যের বিল দেখতে চাই। আমি দেখতে পাই ক্রয়মুল্য পড়েছে ডজন প্রতি ৯৬ ক্রোশ। আর ক্রয়মূল্যেই তিনি বিক্রী করতে চান ভাই সাঈদের নিকট। আমি ভাই সাঈদকে বললাম, আপনি যদি বন্ধুর নিকট থেকে লাভ কনা করেন এবং আপনার বিরোধীরা আপনার নিকট থেকে কিছু ক্রয় না করে, তবে আপনি খাবেন কি? তিনি বললেন:
আমার আর আমার ভাইয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। তিনি আমার প্রস্তাব মেনে নিলেই আমি খুশী হবো।
আমি ভাই মুস্তফা ইউসূফকে বললাম, তুমি কেন তার প্রস্তাব মানছ না? তিনি বললেন: আমি যদি অন্য দোকানদারের নিকট থেকে দশ ক্রোশে এই জিনিস কিনতে পারি, তাহলে আমার ভাই এই মূল্যের বেশী হকদার। তিনি যদি আরো বেশী দাম নিতে রাজী হন, তাহলেও আমি দিতে প্রস্তুত আছি।
যাই হোক, আমি হস্তক্ষেপ করি এবং ৯ ক্রোশে নিশ্পত্তি করি। আসলে ব্যাপারটা এক ক্রোশ বা দুই ক্রোশের নয়। বরং আসল ব্যাপারটা হচ্ছে মানিসকতার। সে মানসিকতা যদি সকলের মধ্যে গড়ে উঠে, সকলেই যদি তা অনুভব করে এবং সকলের মন-মানসে তা বিস্তার লাভ করে, তবে তার বরকতে ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং আন্তর্জাতিক সকল সমস্যার সমাধান হতে পারে। মানুষ শান্তি আর সৌভাগ্যের জীবন যাপন করতে পারে।
সে ভাইয়েরা জানতে পারে যে, তাদের এক সঙ্গীর কোন আয়-উপার্জন নেই, তাদের মধ্যে দশজনের বেশী সঙ্গেী তার কাছে গমন করতঃ একান্তে কানে কানে কিছু কথা বলে এবং নিজেদের সঞ্চিত অর্থের একটা অংশ তার নিকট পেশ করে, যাতে কিছু পুঁজি হাতে এলে তাদের বেকার ভাইটা একটা কিছু করতে পারে। আমি কয়েকজনের প্রস্তাব মেনে নিয়ে অন্যদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে অক্ষমতা প্রকাশ করি। তারা মনে দুঃখ নিয়ে ফিরে যায়। কারণ, সাহায্যে সাওয়াব থেকে তারা বঞ্চিত হয়েছে।
দলের স্থপতিদের চরিত্রের কিছু নমুনা
ইখওয়ানরা সকল কাজ-কারবারে ইসলামের বিধান মেনে চলে। সকল কথা আর কাজে, তা সঙ্গীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হোক, বা অন্য লোকদের সঙ্গে ইসলামী চরিত্র আর অনুভূতি প্রকাশে উত্তম উদাহরণ আর পবিত্র নমুনায় পরিণত হয়েছিলেন তাঁরা।
সুয়েজ ক্যানেল কোম্পানীর চীফ ইঞ্জিনিয়ার মিঃ সভল্যান্ট ভাই হাফেযকে ডেকে তাঁর বাসার কিছু যন্ত্রপাতি তাঁর দ্বারা মেরামত করাতে চান। মিঃ সভল্যান্ট তাঁর কাছে মজুরী জানতে চাইলে ভাই হাফেয ১৩০ ক্রোশ মজুরী দাবী করেন।
মিঃ সভল্যান্ট শুনেই আরবী ভাষায় বললেন: তুমি কি লুটেরা?
ভাই হাফেয নিজেকে সংবরণ করতঃ শান্তকণ্ঠে বললেন: কিভাবে?
মিঃ সভল্যান্ট বললেন: তুমি অতিরিক্ত মুজুরী দাবী করছো।
ভাই হাফেয বললেন, আমি আপনার নিকট থেকে কিছুই নেবো না। আপনি কোন অধীনস্থ ইঞ্জিনিয়ারকে জিজ্ঞাসা করে নিন। কেউ যদি বলে যে, আমি ন্যায্য মজুরীর চেয়ে বেশী দাবী করেছি, তাহলে শাস্তি হিসাবে আমি বিনা পারিশ্রমিকে এ কাজ করে দেবো। আর যদি বলে যে, আমার দাবী ন্যায্যা, তবে এ বাড়াবাড়ির জন্য আমি আপনাকে কিছুই বলবো না।
মিঃ সভল্যান্ট একজন ইঞ্জিনিয়ারকে ডেকে এ কাজের মজুরী কতো হতে পারে জানতে চান। ইঞ্জিনিয়ার অনুমান কর বললেন, ২শ ক্রোশ হতে পারে। মিঃ সভল্যান্ট ভাই হাফেযকে বললেনঃ চলো কাজ শুরু কর।
ভাই হাফেয বললেনঃ আমি কাজ শুরু করবো, কিন্তু তুমি আমাকে অপমান করেছ। সুতরাং, আগে তোমাকে ক্ষমা চাইতে হবে এবং তোমার কথা প্রত্যাহার করে নিতে হবে।
ফরাশী অফিসার রাগে লাল হয়ে যায়। বিশেষ মেজাজ প্রকাশ পায় তার চেহারায়। কুরআন মজীদে আয়াতঃ
**********************************
“(পাপ তাকে অহংকারে উদ্বুদ্ধ করে), সে যেন এর প্রতীক হয়ে দেখা দেয়। সে বলতে থাকে: তোমার কাছে আমাকে ক্ষমা চাইতে বলছ। কে তুমি? স্বয়ং বাদশাহ ফুয়াদ এলেও আমি তার কাছে ক্ষমা চাইবো না।
ভাই হাফেয নিতান্ত শান্তভাবে বলেন: মি: সভল্যান্ট, এবার আপনি দ্বিতীয় ভুল করছেন। আপনি বাদশাহ ফুয়াদের দেশে আছেন। মেহমানদারী আর অনুগ্রহ স্বীকার করা- উভয়েরই দাবী হচ্ছে এমন কথা মুখে উচ্চারণ না করা। শিষ্টাচার আর সম্মান বিসর্জন দিয়ে বাদশাহ ফুয়াদের নাম উচ্ছারণ করার অনুমতি আমি কিছুতেই আপনাকে দেবো না।
মিঃ সভল্যান্ট ভাই হাফেয থেকে মুখ ফিরায়ে নেন এবং বিশাল হল ঘরে পায়চারী শুরু করেন। তার হস্তদ্বয় প্যান্টের পকেটে। ভাই হাফেয তাঁর যন্ত্রপাতি নিচে রেখে একটা চেয়ারে বসেন। কিছুক্ষণ পরিবেশে নিস্তব্ধতা বিরাজ করে। ক্রুব্ধ উদ্ভ্রান্ত মিঃ সভল্যান্টের পদচারণার শব্দই কেবল কানে ভেসে আসছিল। কিছুক্ষণ পর মিঃ সভল্যান্ট হাফেযের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন: মনে কর আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইলাম না। তুমি আমার কি করতে পারবে?
হাফেয বললেন, ব্যাপারটা সোজা। প্রথমে তোমাদের কনস্যুলেট আর রাষ্ট্রদূতের নিকট রিপোর্ট করবো। এরপর প্যারিসে সুয়েজ কোম্পানীর ঊর্ধ্বতন প্রশাসনিক কর্মকর্তার দফতরকে অবহিত করবো। অতঃপর ফ্রান্সের স্থানীয় পত্রপত্রিকা এবং অন্যান্য বিদেশী পত্র-পত্রিকায় এ ব্যাপারে চিঠিপত্র লিখবো। এরপর প্রশাসনিক কাউন্সিলের যে সদস্যই এখানে আসবেন, তার কাছে এ অভিযোগ পেশ করবো। এতসব কিছুর পরও যদি আমার অধিকার ফেরত না পাই, তবে আমার সর্বশেষ কৌশল এ হতে পারে যে, প্রকাশ্য রাজপথে তোমাকে অপদস্থ করবো। সম্ভবতঃ এভাবে আমি আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে সক্ষম হবো। আমার সিদ্ধান্তে আমি অটল। মনে করবেন না যে, আমি মিশর সরকারের কাছে তোমার বিরুদ্ধে নালিশ করবো। কারণ, তোমার বিদেশীরাতো মিশর সরকারের হাত-পা বেঁধে রেখেছ। কোন না কোন উপায়ে নিজের মর্যাদা পুনর্বহাল না করে আমি শান্ত হবো না।
মিঃ সভল্যান্ট বললোঃ মনে হচ্ছে যেন কোন সূত্রধরের সঙ্গে নয়, বরং একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে আমি কথা বলছি! তুমি কি জান না যে, আমি সুয়েজ কোম্পানীর চীফ ইঞ্জিনিয়ার? সুতরাং আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইবো, তুমি কেনম করে তা কল্পনা করতে পার?
ভাই হাফেয জবাব দেন: আপনার কি জানা নেই যে, সুয়েজ কোম্পানী আমার দেশে রয়েছে, তোমার দেশে নয়। সুয়েজ কোম্পানীর উপর তোমাদের অধিকার সাময়িক। শেষ পর্যন্ত তার মালিকানা আমাদের হাতে আসবে। তখন তুমি আর তোমার মতো এমন আরো অনেকেই হবে আমাদের কর্মচারী। সুতরাং আমি নিজের অধিকার ত্যাগ করবো, তুমি তা কেমন করে কল্পনা করতে পার?
এসব কথাবার্তার পর মিঃ সভল্যান্ট পুনারায় পায়চারী শুরু করে। কিছুক্ষণ পর পুনরায় সে ভাই হাফেযের কাছে আসে। এখন রাগে-ক্ষোভে তার চেহারা ঘর্মাক্ত। সে কয়েক দফা সজোরে টেবিলে করাঘাত করে। বলে: হাফেয, আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি এবং আমার কথাগুলো প্রত্যাহার করছি। ভাই হাফেয ধীরে সুঙ্গে উঠে দাঁড়ান এবং মিঃ সভল্যান্টকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে কাজ শুরু করেন। অল্পসময়ের মধ্যে তিনি কাজ শেস করেন।
কাজ শেষ হলে মিঃ সভল্যান্ট ভাই হাফেযকে একশ ৫০ ক্রোশ দান করেন। হাফেয একশ ৩০ ক্রোশ গ্রহণ করে বাকী ২০ ক্রোশ ফেরত দেন। সভল্যান্ট বললেন, এই ২০ ক্রোশও গ্রহণ কর। এটা তোমাকে বখশিখ দিলাম।
কিন্তু হাফেয বললেন: না, না, কিছুতেই হবে না। অধিকারের চেয়ে বেশ নিয়ে আমি ‘লূটেরা’ হতে চাই না।
মিঃ সভল্যান্ট এ জবাব শুনে হতভম্ব হয়ে যায়। বলে, আমার অবাক লাগে; সকল আরব কারিগর কেন তোমার মতো হয় না? তুমি কি মোহামেডান ফ্যামিলীর লোক?
হাফেয বললেন: মিঃ সভল্যান্ট, সব মুসলমানই মোহামেডান ফ্যামিলীর লোক। কিন্তু তাদের মধ্যে কিছু লোক ‘সাহেবদের’ সঙ্গে থেকে তাদের অনুকরণ করা শুরু করেছে। আর এভাবে তাদের স্বভাব-চরিত্র নষ্ট হয়ে যায়।
মিঃ সভল্যান্ট এ কথার কোন জবাব দেয় না। করমর্দন করার জন্য সে হাত বাড়ায়। বলে: মুতাশাককের, কাতুরা খায়রুন (শুকরিয়া, শুকরিয়া, তোমার অনেক মঙ্গল হোক)। এই বলে বিদায় নেয়।
ভাই হাসান মারসী এক জায়গায় কাজ করতেন এবং রেডিও বাক্সের উন্নতমানের নমুনা তৈরী করতেন। তখন একটা রেডিও বাক্স তৈয়ার করতে প্রায় এক পাউন্ড ব্যয় হতো। তিনি যার কাছে কাজ করতেন, তার নাম ছিল মানিও। মানিওর জনৈক বন্ধু তার নিকট আগমন করতঃ গোপনে তার সঙ্গে কথা বলে যে, ভাই হাসান তার জন্য কয়েকটা বাক্স তৈয়অর করে দেবেন অর্ধেক দামে। শর্ত হচ্ছে, এ সম্পর্কে মানিওকে কিছুই বলা যাবে না। এভাবে প্রতিটি বাক্সে ভাই হাসান পাবেন অর্ধেক পাউন্ড আর মানিওর লাভ হবে এই যে, অর্ধেক মূল্যে সে বাক্স পেয়ে যাবে। ভাই হাসানের উপর মানিওর ছিল অগাধ আস্থা। ওয়ার্কশপের সমস্ত কাঁচাকাল আর যন্ত্রপাতি সে ভাই হাসানের হাতে ছেড়ে দিয়েছিল। মানিওর বন্ধু এই আস্থার অবৈধ সুবিধা আদায় করতে চেয়েছিল। কিন্তু ভাই হাসান এর জবাবে তাকে একটা কড়া নৈতিক শিক্ষা দেন। তিনি বলেনঃ
কেবল ইসলামই নয়, বরং দুনিয়ার সকল ধর্মই খেয়ানত তথা অসাধুতাকে হারাম মনে করে। আমার প্রতি যার রয়েছে অগাধ আস্থা, তার সঙ্গে খেয়ানত করা আমার পক্ষে অসম্ভব। আমাকে অবাক হতে হচ্ছে যে, তাঁর বদ্ধু এবং তাঁর ধর্মের লোক হয়েও এমন খেয়ানতের কথা আপনি চিন্তা করতে পারছেন। আর এ জন্য আমাকেও উস্কানী দিচ্ছেন। এ জন্য আপনার লজ্জিত হওয়া উচিত। আপনি নিশ্চিত থাকবেন যে, আপনার এ আচরণ সম্পর্কে আমি মানিওকে কিছুই জানাবো না। এমনটা করলে আমি হবো আপনাদের দু’জনের বন্ধুত্ব নষ্ট করার কারণ। তবে একটা শর্ত দিচ্ছি যে, ভবিষ্যতে আর কখনো আপনি আমার সঙ্গে এমন আচরণ করবেন না।
লোকটার দুর্বুদ্ধি ছিল অনেক। সে বললো: আমি নিজেই মানিওকে বলবো যে, আপনার কারিগ র আমার কাছে এমন প্রস্তাব দিয়েছে, আমার বিশ্বাস, মানিও আমার কথা বিশ্বাস করবে। ফলে তোমাকে কানে ধরে ওয়ার্কশপ থেকে বের করে দেবে। তার কাছে তোমার যে আস্থা আর সম্মান রয়েছে, সবই শেষ হয়ে যাবে। সুতরাং তোমার জন্য মঙ্গলজনক হচ্ছে আমার কথা মতো কাজ করা।
ভাই হাসানের রাগ ধরে। তিনি বললেন, তোমার যা খুশী, করতে পার। ইনশাআল্লাহ তুমি অপদস্ত হবে।
লোকটা ভাই হাসানকে যে হুমকি দিয়েছিল, বাস্তবে তাই করলো। ওয়ার্কশপের মালিক ব্যাপারটা অনুসদ্ধান করলেন। সত্যের আলো মিথ্যার অন্ধকার দূরীভূত করলো। ভাই হাসান আসল ব্যাপারটা মানিওকে খুলে বললেন। মানিও ভাই হাসানের কথায় কোন রকম সন্দেহ করলো না। অবশেষে কপট বদ্ধুকে ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিলেন এবং তার সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। আমানতদারী আর বিশ্বস্ততার জন্য ভাই হাসানের বেতন বৃদ্ধি করলেন।
আব্দুল আযীয গোলাম নবী ছিলেন আমাদের সাথী। মূলতঃ তিনি ছিলেন হিন্দুস্থানের লোক। ইংরেজ সেনানিবাসে তিনি দর্জীর কাজ করতেন। একজন বড় অফিসারের স্ত্রী তাঁকে কাজের কথা বলে বাংলোয় নয়ে যায় এবং নানা কৌশলে তাঁকে অপকর্মে প্ররোচিত করতে থাকে। কিন্তু তিনি প্রথমে তাকে উপদেশ দ্বারা বুঝাবার চেষ্টা করেন। পরে তাকে তিরস্কারও করেন। কিন্তু মেম সাহেব কখনো আব্দুল আযীযকে হুমকী দেন যে, আমি উল্টা সাহেবের কাছে তোমার হাত বাড়াবার নালিশ করবো। আবার কখনো তার প্রতি পিস্তল তাক করে ধরতেন। কিন্তু আব্দুল আযীয তার ভুমিকায় অটল। তিনি এতটুকুও নড়বড় করেন না। তিনি বললেনঃ
**********************************
“আমি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে ভয় করি”।
উভয়ের বিবাদ একটা কৌতুককর, এমনকি একটা হাস্যকর দৃশ্যের অবতারণা করেছে। একদিকে সে লম্পট আর কপট রমণী নিতান্ত আস্থার সঙ্গে আব্দুল আযীযকে এ ধারণায় ফেলে, যার ফলে সে রমণী আব্দুল আযীযকে হত্যা করতে উদ্যত হতে পারে। আর এর যুক্তি খাড়া করায় যে, আব্দুল আযীয তার উপর হামলা চালিয়েছে এবং অসৎ উদ্দেশ্যে তাকে জাপটে ধরেছে। আর সে রমণী কার্যতঃ আব্দুল আযীযের প্রতি পিস্তল তাক করে ধরে। আব্দূল আযীযও নিশ্চিত যে, এটাই তার জীবনের শেষ মুহূর্ত। তাই তিনি চক্ষু বন্ধ করে চিৎকার দিয়ে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ পড়তে থাকেন। তাঁর চিৎকারে রমণীর অন্তর থরথর করে কেঁপে উঠে। পিস্তল তার হাত থেকে পড়ে যায়। উড়ে যায় তার হাতের পাখি। ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় আব্দুল আযীযকে ঘর থেকে। আব্দুল আযীয বাংলো থেকে বেরিয়ে সোজা ইখওয়ানের অফিসে এসে সমস্ত ঘটনা খুলে বলে।
প্রথমদিকের ইখওয়ানরা ছিলেন এ ধরনের। তাদের নৈতিক পবিত্রতা আর রূহানী বলিষ্ঠতা সম্পর্কে অনেক ঘটনা উল্লেখ করা যায়। এই নিষ্ঠা, ইখলাস আর লিল্লাহিয়াতের বদৌলতে আল্লাহ তা’আলা এ দাওয়াতে অনেক বরকত দান করেছেন। অনেকেন অন্তরকে তিনি এমনই আলোকধন্য আর পূত-পবিত্র করেছেন। আল্লাহ বলেন,
**********************************
পবিত্র বাক্য হলেঅ পবিত্র বৃক্ষের মতো, যার শিকড় মজবুত এবং শাখা আকাশে উত্থিত। সে পালনকর্তার নির্দেশে অহরহ ফলদান করে। আল্লাহ মানুষের জন্য দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেন- যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে (সূরা ইবরাহীমঃ ২৪-২৫)।
এরপর ছুটির সময় এসে পড়ে। আমি এ সময়টার কিছু অংশ কায়রোয় আর কিছু অংশ মাহমূদিয়ায় অতিবাহিত করি। এ সময়ে মাহমূদিয়ার হোছাফিয়া জামায়াত শৃংখলা আর লক্ষ্য- উদ্দেশ্যের দিক থেকে ঠিক অনুরূপ নতুনরুপ ধারণ করে, যেরূপ ধারণ করেছিল ইসমাঈলিয়ায় আমাদের দাওয়াত। অর্থাৎ ইখওয়ানুল মুসলিমূন-এর ধরনের রূপ আর সংগঠনে পরিণত হয় হোছাফিয়া জামায়াত। ছুটি শেষে আমি ইসমাঈলিয়া ফিরে আসি। আমার শিক্ষকতার দ্বিতীয় বর্ষ অসংখ্য আনন্দঘন আর ব্যক্তিগত ও দায়াতী গুণাবলীতে ভরপুর ছিল।
হেজায গমনের প্রোগ্রাম
এ দীর্ঘ সময়টায় জমিয়তে শুব্বানুল মুসলিমীন তথা মুসলিশ যুবদলের সঙ্গে আমার যথারীতি সম্পর্ক বহাল থাকে। আমিও নিজের পক্ষ থেকে জমিয়তকে অনেক রিপোর্ট, সমালোচনা আর পর্যালোচনা প্রেরণ করি। জমিয়তের দায়িত্বশীল মহলও আমাদের আত্মিক সম্পর্ক পুরোপুরি অনুভব করতেন। কায়রো থেকে দূরে অবস্থান করা সত্ত্বেও যা আমাদেরকে এক অপরের সঙ্গে যুক্ত করে রেখেছিল। বাদশাহ আব্দুল আযীয ইবনে সউদের উপদেষ্টা হাফেয ওয়াহাবা কায়রো আগমন করেন এবং তিনি শিক্ষা বিভাগের পক্ষ থেকে কিছু সংখ্যক শিক্ষক হেজায নিয়ে যেতে চান, যারা নব প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করবেন। মিশর সরকার তখনো সউদী সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি (সুলতান আব্দুল আযীয হেজাযে শরীফে মক্কার শাসনের অবসান ঘটিয়ে হেজাযকে তাঁর শাসনাধীন করে নেন। মিশর সরকার আব্দুল আযীয ইবনে সউদের সঙ্গে বিরোধের কারণে দীর্ঘদীন হেজায অধীকারকে স্বীকৃতি দেননি)। এটা ছিল ইংরেজদের কূটকৌশল। দু’ভাইয়ের মধ্যে বিচ্ছেদের নীতিই ইংরেজেদের রাজনীতির মূলকথা। মিশর জাতি ছিল এহেন অস্বাভাবিক পরিস্থিতির বিরোধী। মিশরের শিক্ষিত শ্রেণী হেজাযের নব জাগরণের মধ্যে নিজেদের আশা-আকাঙ্খার চমক এবং নিজেদের কামনার ব্যাখ্যা দেখতে পাচ্ছিলো। হাফেয ওয়াহাবা জমিয়তে শুব্বানুল মুসলিমীন-এর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং শিক্ষক বাছাইয়ে জমিয়তের সহযোগিতা কামনা করেন। সাইয়্যেদ মুহিব্বুদ্দীন আল- খতীব আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ বিষয়ে কথাবার্তা বলেন। আমি নীতিগতভাবে তাঁর সঙ্গে একমত হই। এরপর জমিয়তে শুব্বানুল মুসলিমীনের সেক্রেটারী ওস্তাদ মাহমূদ আলী ফযলী ১৯২৮ সালের ৩ই অক্টোবর আমাকে লিখেন:
প্রিয় বান্না! সালাম ও শুভেচ্ছা! আশা করি ভালো আছেন। ওস্তাদ মুহিব্বুদ্দীন আল-খতীব হেজাযে শিক্ষকতার ব্যাপারে আপনার সঙ্গে কথা বলেছেন। আব্দুল হামীদ বেক সাঈদ আমার নিকট পয়গাম প্রেরণ করেছেন আপনাকে অবহিত করার জন্য যে, আপনি শিক্ষামন্ত্রীর বরাবরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দরখাস্ত লিখবেন। তাতে এ আগ্রহ ব্যক্ত করবেন যে, মক্কা শরীফের আল-মা’হাদুস সউদীতে আপনি শিক্ষক হিসাবে যোগ দিতে চান। এ শর্তে যে, মিশরের শিক্ষা বিভাগে চাকুরীর অধিকার সংরক্ষিত থাকবে এবং ফিরে আসার পর আপনার সমপেশার সঙ্গীরা যেসব ভাতা আর সুযোগ-সুবিধা লাভ করবে, তা আপনাকেও দেওয়া হবে। আমি আশা করছি আপনি এ মর্মে অতি সত্ত্বর দরখাস্ত করবেন, যাতে তা মন্ত্রিসভার বৈঠকে পেশ করা যায়। সবশেষে আমার উষ্ণ অভিনন্দন গ্রহণ করুন।
এরপর ১৯৮২ সালের ৬ই নভেম্বর আমি আরো একখানা পত্র পাই। এত জমিয়তে শুব্বানুল মুসলিমীন-এর প্রধান কর্মকর্তা ড. ইয়াহইয়া দারদীরী প্রাথমিক কথাবার্তার পর লিখেন:
আমি আশা করি আপনি দয়া করে আগামী বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাতটায় পত্রিকা অফিসে আগমন করবেন। সেখানে শাহ ইবনে সউদের উপদেষ্টা জাহাপনা হাফেয ওয়াহবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে সফরের প্রোগ্রাম এবং মক্কা শরীফের মাদ্রাসায় শিক্ষকতার কাজের শর্তাবলী চূড়ান্ত করবেন। আমরা আপনার আগমনের অপেক্ষায় থাকবো। আমার চরম ভক্তি আর উষ্ণ অভিনন্দন গ্রহণ করুন।
নির্ধারিত সময় আমাদের সাক্ষাৎ হয়। আমি হাফেয ওয়াহাবার সম্মুখে গুরুত্বপূর্ণ যে শর্ত পেশ করি, তা হচ্ছে এই যে, আমাকে নিছক বেতনভূক কর্মচারী বিবেচনা করা যাবে না, যার কাজ হবে নির্দেশ গ্রহণ আর তা বাস্তবায়ন করা; বরং আমাকে একটা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির ধারক-বাহক মনে করতে হবে। আমি চেষ্টা করবো, যাতে একটা নব প্রতিষ্ঠিত রাষ্ঠ্রে আমার দর্শন সুন্দর পরিবেশে বাস্তবায়িত হতে পারে। যে রাষ্ট্র হচ্ছে ইসলাম আর মুসলমানদের আশা-আখাঙ্খার কেন্দ্রস্থল। যে নব প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের ব্রত হচ্ছে কিতাবুল্লাহ এবং সুন্নাতে রাসূলের অনুসরণ এবং সালফে সালেহীনের রীতি অনুসন্ধান। বাকী থাকে অন্যান্য বিষয়, যেমন বিনিময় কি হবে, আর বস্তুগত কি কি সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে। আমরা আদপেই এসব প্রসঙ্গ তুলিনি। হাফেয ওয়াহাবা আমার এহেন আগ্রহে আনন্দ ব্যক্ত করেন এবং আমাকে কথা দেন যে, তিনি মিশরের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন এবং এ ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে সমঝোতার পর আমাকে অবহিত করবেন। এরপর আমি ইসমাঈলিয়া ফিরে যাই। হাফেয ওয়াহাবা ১৯২৮ সালের ১২ই নভেম্বর আমাকে লিখেন:
শ্রদ্ধেয় ওস্তাদ হাসানুল বান্না! আমার শ্রদ্ধা আর অভিনন্দন গ্রহণ করুন। আমি আজ মহামান্য পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি এবং আপনার বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি আমাকে বলেছেন যে, আপনি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তিনি আনন্দিত হবেন এবং আপনার হাতে শিক্ষামন্ত্রীর নামে একখানা পত্রও দেবেন। আপনার সঙ্গে আরো যারা হেজায গমন করতে চান, শিক্ষামন্ত্রী সকলের সঙ্গে পরিপূর্ণ সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছেন। আমার উষ্ণ শ্রদ্ধা গ্রহণ করুন।
আমি ইসমাঈলিয়া থেকে কায়রো আগমন করি এবং হাফেয ওয়াহাবাকে নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। খুব সম্ভব তখন শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন আহমদ পাশা লুতফী। কিন্তু তাঁকে পাওয়া যায়নি। এরপর আমি ইসমাঈলিয়া ফিরে যাই। হাফেয ওয়াহাবা যথারীতি চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। কিন্তু তিনি সফল হননি। মিশর সরকার তখন পর্যন্ত হেজায সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি- এ প্রতিবন্ধকতা অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
আমি হাফেয ওয়াহাবাকে একখানা পত্র লিখি। তাতে জানতে চাই যে, তাঁর চেষ্টা কতদূর পৌঁছেছে। জবাবে তিনি লিখেনঃ
আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।
উচ্চতর সম্মান আর শ্রদ্ধা প্রদর্শনপূর্বক আরয এই যে, আপনার পত্র পেয়ে প্রীত হয়েছি। অতীব দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে যে, শিক্ষামন্ত্রী আমাদের আবেদন নাচক করে দিয়েছেন। অথচ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং শিক্ষামন্ত্রী স্বয়ং আব্দুল হামীদ বেক সাঈদকে দরখাস্ত গ্রহণ করা সম্পর্কে আশ্বাস দিয়েছিলেন। যাই হোক, আমি আমার চেষ্টা অব্যাহত রাখবো। আল্লাহ তা’আলা আমাদের সকলকে তাঁর সন্তুষ্ঠি লাভের তাওফীক দান করুন। আমার সম্পর্কে আপনি যেসব পবিত্র অনুভূতি আর সৌহার্দপূর্ণ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, সে জন্য আমি আন্তরিক শুকরিয়া জ্ঞান করছি। আমার উষ্ণ শ্রদ্ধা গ্রহণ করুন।
স্বাভাবিকভাবেই হাফেয ওয়াহাবার এসব চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি (হাফেয ওয়াহাবা সউদী আরবের অন্যতম বিচক্ষণ রাজনীতিক। প্রথমে তিনি সুলতান আব্দুল আযীয ইবনে সউদের উপদেষ্টা ছিলেন। পরে তাঁকে ইংল্যান্ডে সউদী আরবের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করা হয়। সউদী আরবের আধুনিক ইতিহাস বিষয়ে একটা নজীরবিহীন গ্রন্হও রচনা করেছেন। যার নাম দিয়েছেন তিনি **********************************
বিংশ শতাব্দীতে জাযীরাতুল আরব। এই অধম ১৯৬৭ সালে আমীর আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুর রহমানের প্রাসাদে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে। পরবর্তী কালে তিনি ইনতিকাল করেন- খলীল হামেদী)। আর এ মিশনের জন্য আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ওস্তাদ ইবরাহীম শূরার সহযোগিতাও গ্রহণ করা হয়।
তিনি ভালোভাবে এ মিশন পরিচালনা করেন (ওস্তাদ ইবরাহীম শূরা পরবর্তী কালে রাবেতায়ে আলমে ইললামী মক্কা মুকাররামায় ইসলামী সংস্কৃতি বিভাগে যোগদান করেন। দীর্ঘ দিন থেকে তিনি সউদী আরবে অবস্থান করছেন। রাবেতার মাসিক মুখপাত্রের প্রধান সম্পাদকও ছিলেন)। পর্যালোচনা করলে দেখতে পাবো, আগে আমরা কি ছিলাম, আর এখন আমাদের মধ্যে কি পরিবর্তন সূচীত হয়েছে। কারণ এখন মিশর সরকার উদার মনে আরয এবং ইসলামী দেশগুলোতে শিক্ষক আর প্রতিনিধি দল প্রেরণ করছে এবং সেসব দেশের সঙ্গে আমাদের সাংস্কৃতিক সহযোগিতা আশাপ্রদ উন্নতি লাভ করছে। আলহামদু লিল্লাহ।
ওয়ায আর প্রচারের পরিকল্পনা
ইসলামী দাওয়াতের প্রচার-প্রসারের অন্যতম কারণ এই ছিল যে, ওস্তাদ আল-মারাগী আল-আযহারের শায়খ থাকাকালে কোন কোন মর্যাদা সম্পন্ন সহযোগীর সহায়তায় স্বয়ং আল-আযহার জনগণের মধ্যে দীনী শিক্ষা-সংস্কৃতি প্রসারের এক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে (আহমদ মুস্তফা আল-মারাগী ছিলেন আল আযহারের শায়খ বা রেক্টর। তিনি ছিলেন আধুনিক কালের অত্যন্ত দূরদৃষ্টি সম্পন্ন আলেমদের অন্যতম। ‘তাফসীরুল মারাগী’ নামে কুরআন মজীদের একখানা তাফসীর লিখেন। ভাষা আর বর্ণনাধারা বিচারে আধুনিক কালের জনপ্রিয় তাফসীল সমূহের অন্যতম তাঁর এ তাফসীর। ১৯৩৮ সালে ইনি ইনতিকাল করেন)। তাঁর প্রস্তাব অনুযায়ী আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ওয়ায ও প্রচার বিভাগ খোলা হয় এবং এ বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয় বিশিষ্ট আলেম শায়খ আব্দুরাব্বিহী মিফতাহকে। এটা ছিল আমাদের দীর্ঘদিনের লালিত একটা আকাংখার প্রতিফলন। সে সময় দাওয়াতের কাজে আমার নবীন সহকর্মী এবং আল-আযহারের দায়িত্বশীল আলেমদের সঙ্গে এ বিষয়ে মতবিনিময় হয়। দাওয়াত ও প্রচারের দায়িত্ব পালনের জন্য শুরুতে যাদের নাম বাছাই করা হয়, তাদের মধ্যে প্রিয় ভাই শায়খ হামেদ আসকারিয়ার নামও ছিল। এটা আল্লাহর খাছ রহমত যে, তিনি ইসমাঈলিয়ায় নিযুক্ত হয়েছেন। ইসমাঈলিয়ায় দাওয়াতের ময়দানে আমরা একত্র হই। দাওয়াতের কাজে তিনি আমাদের জন্য বিরাট সহায়কের ভূমিকা পালন করেন।
ইসমাঈলিয়ায় ইখওয়ানের কেন্দ্র ও মসজিদ
ইখওয়ানের এক বিশেষ অধিবেশনে এ আলোচনা স্থান পায় যে, ইসমাঈলিয়ার মূল অধিবাসীদের মধ্যে আমাদের বাণী বিশেষভাবে ছড়ানো অত্যন্ত প্রয়োজন। এটা প্রয়োজন এ কারণে যে, যারা এখানে দাওয়াতের দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁরা সরকারী কর্মচারী। তাঁরা নানা স্থানে বদলী হয়ে যান। সুতরাং জনৈক সহকর্মী দলের একটা কেন্দ্র স্থাপন করার প্রস্তাব পেশ করেন। অন্যজন এ প্রস্তাবে সংশোধনী এনে বলেন যে, কেন্দ্রের সঙ্গে একটা মসজিদও স্থাপন করা দরকার। একে তো শহরে মসজিদের অভাব। দ্বিতীয়তঃ এভাবে দলের কেন্দ্র স্থাপনে সাধারণ মানুষও আমাদের সহায়তা করবে। এ সমাবেশে উপস্থিতির সংখ্যা ছিল কুড়িজনের বেশী। সকলেই এ প্রস্তাবের পক্ষে আগ্রহ-উদ্দীপনা প্রকাশ করেন। আমি চুপচাপ এসব কথাবার্তা শুনছিলাম। এরপর আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, এ ব্যাপারে তোমার কি মত? আমি আরয করলাম নীতিগতভাবে প্রস্তাবটা চমৎকার। কিন্তু তা বাস্তবায়ন করার জন্য কয়েকটা শর্ত প্রয়োজন। প্রথম শর্ত এই যে, এ কাজের নিয়ত হতে হবে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্য। দ্বিতীয়তঃ কষ্ঠ আর ধৈর্য্য ও দৃঢ়তার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। বিষয়টা গোপন রাখতে হবে এবং এ জন্য নীরবে একটানা কাজ করে যেতে হবে। বদান্যতার সূচনা করতে হবে নিজেদের থেকেই। এটা যদি একান্তই আপনাদের কাম্য হয়, তাহলে আলামতস্বরূপ প্রথমে আপনারা নিজেদের মধ্য থেকে ৫০ পাউন্ড সংগ্রহ করুন। এই পরিমাণ চলতি অধিবেশনেই নিজেদের মধ্যে বাঁটোয়ারা করে নিন। এরপর এক সপ্তাহের মধ্যে নিজ নিজ পরিমাণ আফেনদঈ আবু সউদের কাছে জমা করুন। এ পরিকল্পনার কথা আপনারা কারো কাছে ব্যক্ত করবেন না। কোন বিশেষ বা সাধারণ মহফিলে একথা মুখেও আনবেন না। আগামী সপ্তাহে এই রাত্রে আমরা পুনরায় মিলিত হবো। আপনার যদি তহবিল পুরা করতে পারেন এবং গোপনও রাখতে পারেন; তবে মনে করবেন যে, আল্লাহর ইচ্ছায় আপনাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে। নির্ধারিত রাত্রে আমরা পুনরায় মিলিত হই এবং আফেনদঈ আবু সউদের নিকট আমরা ৫০ পাউন্ড জমা করি। এ সূচনা ছিল একটা শুভ লক্ষণ এবং ইতিবাচক প্রচেষ্টার ইঙ্গিতবহ।
কোরবানীর একটা দৃষ্টান্ত
আমরা দেখতে পাই যে, ভাই আস্তী আলী আবুল আ’লা আমাদের রাত্রের বৈঠকে নির্ধারিত সময়ের আধা ঘন্টা পরে উপস্থিত হন। আমি তার কাছে এভাবে নিয়মিত বিলম্ব করার কারণ জানতে চাই। তিনি নানা ওযর দেখান, যা এ বিলম্বের কারণ হতে পারে না। তথ্যানুসন্ধান দ্বারা জানতে পারলাম যে, তিনি তহবিলে দেড়শ ক্রোশ দান করার ওয়াদা করেছিলেন। যেহেতু তাঁর কাছে এ পরিমাণ অর্থ ছিল না, তাই বাধ্য হয়ে তাঁকে সাইকেল বিক্রী করতে হয়। এখন তাঁকে অফিস থেকে ৬নং বাসে আসতে হয়। শহর থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে বাস থেকে নেমে তাঁকে পায়ে হেঁটে আসতে হয়। সাইকেলের মূল্য তিনি দারুল ইখওয়ান নির্মাণ তহবিলে দান করেন। ইখওয়ানদের অন্তরে তাঁর এ কোরবানীর বিরাট প্রভাব পড়ে। তাঁরা একটা নতুন সাইকেল ক্রয় করার জন্য চাঁদা সংগ্রহ করেন এবং এ নতুন সাইকেলটি তাঁদের ভাইয়ের নিষ্ঠাপূর্ণ ত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ হাদিয়া হিসাবে পেশ করা হয়।
মসজিদের জন্য এক খন্ড জমি দান
এখন আমরা আসল অবস্থা সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে অবহিত করে তাদেরকে পরীক্ষা করতে মনস্থ করি। সুতরাং আমরা এক খন্ড জমি খুঁজতে শুরু করি; যা আমরা মূল্য দিয়ে খরীদ করবো, অথবা জমির মালিক ভালো কাজের জন্য তা দান করবে। তালাশ করতে গিয়ে আমরা জানতে পারি যে, হাজী আবদুল করীমের নিকট এমন এক খন্ড জমি আছে, যা আমাদের উদ্দেশ্যের জন্য বেশ উপযোগী। হাজী সাহেব ছিলেন বড়ই নেককার এবং মালদার মানুষ। আল্লাহ তাঁর প্রতি রহমত নাযিল করুন। আমরা এটাও জানতে পারি যে, তিনি নিজেই সেখানে মসজিদ স্থাপনের বাসনা পোষণ করেন। আমরা এ প্রসঙ্গে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলি। তিনি বেশ খুশী হন এবং আমাদের আকাংখা মনযুর করেন। তাঁর সঙ্গে আমরা প্রাথমিক চুক্তি সম্পাদনাও করি। এ চুক্তির ফলে তিনি জমির মালিকানা ত্যাগ করেন। এ অভিযানকে প্রথম সাফল্য বিবেচনা করি।
কাঁটা আর প্রতিবদ্ধকতা
সব যুগে আর সব দেশেই সত্যের আহ্বানকে এমন সব বিরুদ্ধবাদীর সম্মুখীন হতে হয়, যারা সত্যের প্রতিন্ধকতা সৃষ্টি করে। সত্যের আহ্বানকে ব্যর্থ করার জন্য তারা সর্বশক্তি নিয়োজিত করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফলতা সত্যের পদচুম্বন করে। এটাই আল্লাহর নীতি। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
**********************************
তোমরা আল্লাহর নীতিতে রদবদল পাবে না। (সূরা ফাতহ: ২৩)।
**********************************
তোমরা আল্লার রীতিতে পরিবর্তন পাবে না। (সূরা গাফের: ৪৩)।
**********************************
আর এভাবেই আমরা প্রত্যেক নবীর জন্য অপরাধীদের মধ্য থেকে দুশমন বানিয়েছি, হিদায়াতকারী আর সাহায্যকারী হিসাবে তোমার পালনকর্তাই যথেষ্ট। (আল ফুরকান: ৩১)।
**********************************
আর এভাবেই প্রত্যেক নবীর জন্য আমরা মানুষ আর জিনের মধ্য থেকে শক্র নিয়োজিত করে দিয়েছি। সুতরাং তারা এক অপরকে কারুকার্যখচিত কথাবার্তা শিক্ষা দেয়। তোমার পালনকর্তা চাইলে তারা তা করতে পরতো না। সুতরাং তুমি তাদেরকে আর তাদের অপরাধকে ত্যাগ কর (সূরা আন’আম: ১১২)।
**********************************
এবং আমরা তোমার পূর্বে যত নবী-রাসূলই প্রেরণ করেছি, যখনই তাঁরা কোন কিছু কল্পনা করেছেন, তখনই তাঁদের কল্পনায় শয়তান কিছু মিশ্রণ ঘটিয়েছে। অতঃপর আল্লাহ রহিত করেন শয়থানের মিশ্রণ, অতঃপর আল্লাহ সুপ্রতিষ্ঠিত করেন তাঁর আয়াতসমূহ। আর । আল্লাহ মহাজ্ঞানী, মহাপ্রজ্ঞাময়। (সূরা আল-হজ্জ: ৫২)।
ইসমাঈলিয়ায়ও ইসলামী দাওয়াতের ভাগ্যে এটাই জুটেছে। যখনই এ দাওয়াতের প্রতি মানুষের আসক্তি প্রকাশ পেয়েছে, লোকেরা যখন এর আশপাশে জড়ো হতে শুরু করেছে এবং এ দাওয়াতের কর্মীদেরকে ইজ্জত আর মর্যাদার চোখে দেখতে শুরু করেছে, তখনই কিছু স্বার্থান্বেষী লোকের মনে হিংসা-বিদ্বেষের সাঁপ দংশন করতে শুরু করেছে। তারা দাওয়াত আর দাওয়াতদাতাদের মনে নানা সংশয়-সন্দেহ সৃষ্টি করতে শুরু করে দিয়েছে। কখনো তারা বলে যে, এরা- ইখওয়ানুলম মুসলিমুন- পঞ্চম বাহিনীর রূপ নিচ্ছে। কখনো তারা বলেছে যে, এরা কতিপয় উদাসীন যুবকের দল, এদের দ্বারা কোন কাজ হবেনা; এরা কোন পরিকল্পনারও যোগ্য নয়। আবার কখনো এ অভিযোগ করা হয়েছে- এরা ভাগ্যান্বেষী আর ঠগের দল, অন্যায়ভাবে পরস্ব অপহরণ করে। এ ধরনের আরো অনেক অভিযোগ আমাদের বিরুদ্ধে উত্থাপন করা শুরু হয়। এরা যখন জানতে পারে যে, শায়খ আলী আব্দুল করীম আমাদেরকে মসজিদের জন্য এক খন্ড জমি দান করেছেন, তখনই এরা তাঁর পেছনে পড়ে এবং তাঁর জীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে। নানা রকম চোগলখোরী আর প্ররোচনা দ্বারা তাঁর মনকে বিষিয়ে তোলে। শায়খ আলী ছিলেন একজন সরল মনা মানুষ। তিনি তাদের কথায় প্রভাবিত হন। একটা ফেৎনা-ফাসাদের পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে শান্ত মনে ভূমি হস্তান্তরের কাগজ পত্র তাকে ফেরৎ দিয়ে আমি ফেৎনা দূর করি। কারণ, আমার মনে পূর্ণ বিশ্বাস ছিল যে, আল্লাহর সাহায্যে আমাদের পরিকল্পনা অবশ্যই সফল হবে।
কিন্তু অকল্যাণকামীরা আরো একটা মওকা পেয়ে যায়। তারা প্রোপাগান্ডা শুরু করে দেয়, আমাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে বলে। আমরাও এ সুযোগ কাজে লাগাই এবং লোকজন আমাদর দিকে ঝুকছে দে্খে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে মানুষের মন থেকে সন্দেহ-সংশয় দূর করার চেষ্টা চালাই। আসল ব্যাপার তাদের সম্মুখে স্পষ্ট করি এবং যুক্তি-প্রমাণ দ্বারা তাদেরকে আমাদের সমর্থক করার চেষ্টা চালাই। আর এসব লোকের নিকট থেকে চাঁদা সংগ্রহের কাজও শুরু হয়। আল্লাহ তা’আলা ভাই হামেদ আসকারিয়াকে নেক প্রতিদান দিন এবং জান্নাতে তাঁর মনযিল প্রশস্ত করুন। তিনি এ ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে অগ্রসর হন। এ অভিযানে তিনি এতটা শ্রম আর সময় দেন যে, তার সত্যিকার মর্যাদা কেবল আল্লাহই দিতে পারেন। তিনি অধিকাংশ রাত এশা থেকে ফজর পর্যন্ত জাগ্রত থাকেন এবং মানুষের ঘরে ঘেরে এবং দোকানে দোকানে ঘুরেন। বহুবার এমনও হয়েছে যে, এ কাজে তিনি এতটা নিমগ্ন হয়ে পড়েন যে, তিনি নিজেকেও ভুলে যান। রমযান মাসে সাহরী খাওয়ার কথাও তাঁর মনে থাকেনা। আরেকজন জিন্দা দিল সৎ স্বভাবের মানুষের কথাও আমি উল্লেখ না করে পারছি না। তিনি হচ্ছেন শায়খ মুহাম্মদ হোসাইন মামলুত। তিনিও অর্থ এবং বাস্তব সহায়তা দ্বারা আমার পরিকল্পনায় বিরাট সহায়তা করেছেন। তিনি নিজেই ৫শ পাউন্ড দান করেন। তখনো তিনি আমাদের অর্থ বিভাগের সেক্রেটারী হননি। তাঁর এ কাজ অন্যদের মনেও আস্থা আর উদ্দীপনার সঞ্চার করে। পরিকল্পনা বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত তিনি এর পৃষ্ঠপোষকতা অব্যাহত রাখেন।
এরপর আমরা এক খন্ড জমি খুঁজতে থাকি। আরব মহল্লার শেষ মাথায় আমরা এক খন্ড জমি পাই। আমরা তা ক্রয় করি এবং দলীলে দু’জন নেককার মানুষের স্বাক্ষর নেই। একজন হচ্ছেন শায়খ মুহাম্মদ হোসাইন মামলূত আর অপর জন হাজী হোসাইন সূলী। আল্লাহ তা’আলা তাঁদেরকে প্রফুল্ল রাখুন এবং তাঁদের হায়াতে বরকত দান করুন। সংগঠনের পক্ষ থেকে তাঁরা দু’জন স্বাক্ষর করেন। সরকারের সংগঠন নীতি অনুযায়ী তখন সংগঠন গড়ে তোলা হয়। লক্ষ্য উদ্দেশ্য এবং গঠনতন্ত্রও গৃহীত হয়। একটা পরিচালক মন্ডলী এবং সাধারণ পরিষদও গঠন করা হয়।
শায়খ হামেদ আসকারিয়ার শুবরাখীত বদলী
অবশেষে স্বার্থান্বেষী মহলের শক্রতামূলক কর্মকান্ডের অবসান ঘটে। আর তা ঘটেছে এভাবে যে, তারা ওয়ায ও প্রচার বিভাগে বেনামী অভিযোগ প্রেরণ করে, যার ফলে ভাই হামেদ আসকারিয়াকে শুবরাখীত-এ বদলী করা হয়। একদিক থেকে এ বদলী দাওয়াতের জন্য কল্যাণ ও বরকতের কারণ হয়। ফলে শুবরাখীত-এও সংগঠনৈর একটা শাখা খোলা হয়। এ শাখা এতটা উন্নতি করে যে, হিফয- কুরআনের একটা মাদ্রাসাও জারী করে। সেখানে একটা বিরাট মসজিদ এবং একটা জাঁকজমকপূর্ণ ভবনও নির্মাণ করা হয় এবং মাদ্রাসা আর মসজিদের সাথে এ ভবন ওয়াকফ করা হয়। আল্লাহ তা’আলা শায়খ কাসেম জুবদকে আপনি রহমতে স্থান দান করুন। ইনি ছিলেন শুবরাখীতের একজন নেক ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিত্ব। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে তিনি ছিলেন শায়খ হামেদ আসকারিয়ার দক্ষিণ হস্ত। সে সময় শায়খ হামেদ আসকারিয়অর ইসমাঈলিয়া ত্যাগ করে যাওয়া ছিল একটা প্রচন্ড দুঃখজনক ঘটনা। কিন্তু পরে এর বরকত ও রহস্য সকলের কাছেই প্রকাশ পেয়েছে।
সে দিনটির কথা আমি কিছুতেই ভুলতে পারবো না। সে দিনটা ছিল ভীষণ গরমের। প্রাণ বের হওয়ার উপক্রম হয়েছিল সেদিন গরমে। সেদিন বিকাল বেলা আমরা আরিশ-এ অবস্থিত বাসার সামনে বসে কাটাই। বেশ শীতল ছায়ায় আমরা বসেছিলাম। মৃদুমন্দ শীতল সমীরণ প্রবাহিত হচ্ছিল। নানা বিষয় নিয়ে আমরা কথা বলছিলাম, আমরা আকাংখার মহল নির্মাণ করছিলাম এবং নিতান্ত আত্মিক শান্তি-স্বস্তির পরিবেশে আস্থা আর দৃঢ়তার সঙ্গে সেসব আকাংখা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করছিলাম। এ মাহফিল আমার অন্তরে চাপাপড়া একটা অনুভূতি জাগ্রত করে। আমি শায়খ হামেদ আসকারিয়া বললাম, যেমন আত্মিক শান্তি আর মানসিক সুস্থিতি আমি এখন অনুভব করছি, তা ইতিপূর্বে আর কখনো অনুভব করতে পারিনি, এ সময় আমার মনে একটা প্রবাদ বাক্য উঁকি মারে:
**********************************
(রজনী যখন মনোরম হয়, তখন তা পংকিল করার মতো বস্তুও সৃষ্টি হয়)।
আমার মানসিক প্রশান্তির স্বচ্ছ ঝণৃাকে কর্দমাক্ত করতে পারে যেসব বিষয়, তখন আমি তার গভীরে পৌঁছতে পারছিলামনা। শায়খ হামেদ আসকারিয়া আমাকে শান্তনা দিতে লাগলেন। আর এ সময় আমরা ‘দারুল ইখওয়ান’ অভিমুখে রওয়ানা হই। সেখানে গিয়ে হামেদ আসকারিয়ার বদলির চিঠি দেখতে পাই। আমরা একে অপরেও মুখপানে চেয়ে থাকি। আমরা একে অপরকে বলি, যা হয়েছে, ভালই হয়েছে। এ পরিবর্তনের ফলে নিঃসন্দেহে দাওয়াত উকৃত হবে। মু’মিন যেখানেই থাকে, কল্যাণের দূত হিসেবে কাজ করে। আমার এটাও স্মরণ আছে যে, এ ঘটনার আগে ইসমাঈলিয়ায় ওয়াজ ও প্রচার দফতরের পরিদর্শক শায়খ আব্দু রব্বিহী মিফতাহ আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য আগমন করেন এবং আরীশ এর বাসায় তিনি আমাদের সঙ্গে রাত্রি যাপন করেন। শায়খ মিফতাহ দেখতে পান যে, আমাদের প্রায় প্রত্যেক ভাইয়ের কাছেই বাসার চাবি ছিল। ভোরে প্রায় সকলেই নাশতা নিয়ে আসেন, কারণ সেখানে পাক করার কোন ব্যবস্থা ছিলনা। প্রীতি-ভালোবাসার এ দৃশ্য তাঁর মনে ক্রিয়া করে। তিনি অত্যন্ত মুগ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করেনঃ
আপনি এদের সঙ্গে কি করছেন? কিভাবে আপনি এদেরেকে এক দেহ এক প্রাণে পরিণত করে রেখেছেন? তাদের অন্তরে প্রীতি-ভালোবাসার এহেন উন্নত আত্মিক ক্রিয়ার যাদু কিভাবে আপনি সৃষ্টি করলেন?
আমি তাঁকে আরয করি; আমি কিছুই করিনি, এতে আমার কোন কীর্তির স্থান নেই। বরং এটা হচ্ছে আল্লাহ তা’আলার এ বাণীর প্রতফিলনঃ
**********************************
পৃথিবীতে যা কিছু রয়েছে, সবকিছুই ব্যয় করলেও তুমি তাদের মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি করতে পারতেনা; কিন্তু আল্লাহই তাদের অন্তরে ভালোবাসা সৃষ্টি করেছেন। (সূরা আল আনফাল: ৬৩)।
গ্রীস্মের ছুটি এসে পড়ে। কিছু সময় কায়রো আর কিছু সময় মাহমূদিয়ায় অতিবাহিত হয়। স্কুল খোলা হলে আমি ইসমাঈলিয়ায় ফিরে যাই। মসজিদের পরিকল্পনা তখনো বাস্তবায়িত হয়নি। আমি লক্ষ্য করলাম, এ সম্পর্কে নানা কথাবার্তা হচ্ছে। সর্বত্র একই কথা। টিপ্পনি কেটে বলা হচ্ছে- মসজিদের পরিকল্পনা আরামের সঙ্গে ছুটি কাটাচ্ছ! এসব কথা শুনেও আমি কর্ণপাত করিনি। এ সবের জবাব দেয়ার কোন চেষ্টাও করিনি। আমি একটা মলূনীতি জানি। এ মূলনীতি দাওয়াতের কাজে অনেক উপকারে এসেছে। মুলনীতি এই:
জবাবী গুজব আর মিথ্যা দ্বারা গুজব প্রতিরোধ করা যায়না। বরং ইতিবাচক এবং কার্যকর পদক্ষেপই গুজবের অবসান ঘটাতে পারে। ইতিবাচক পদক্ষেপ মানুষের দৃষ্টি আকৃষ্ট করে এবং সকলে মুখে মুখে তা চর্চা করে। আর এভাবে নতুন গুজব, যা সত্য ও বাস্তব, মিথ্যা ও পুরাতন গুজবের স্থান গ্রহণ করবে।
এ মূলনীতি অনুযায়ী কাজ শুরু করা আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। তাই ইখওয়ানদের সঙ্গে পরামর্শ ক্রমে আমি তখনই বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করি। আমরা দু গাড়ি পাথর ক্রয় করি। আমরা একমত হই যে, বন্দর থেকে মসজিদের স্থান পর্যন্ত নিজেরা এ এ পাথর বহন করে আনবো। আমরা তাই করেছি।
এদিনটি ইখওয়ানের পক্ষে এক মহান দিন বলে প্রমাণিত হয়েছে। সাধারণ মানুষ এ ঘটনা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করে। তাদের বিশ্বাস জন্মেছে যে, এবার মসজিদ ঠিকই নির্মিত হবে। এটা কোন নিছুক ছেলেখেলা নয়। সাধারণ মানুষের মধ্যেও সাহস সঞ্চার হয় এবং তারাও মসজিদের জন্য চাঁদা দান করা শুরু করে। আমরা ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের ঘোষণা প্রচার করি। আমার মনে পড়ে যে, এ কাজের জন্য আমরা ১৩৪৮ হিজরীর ৫ই মহররম দিনটা নির্ধারণ করি। আল্লাহ তা’আলা মুহাম্মদ আফেন্দী সুলায়মানকে নেক প্রতিদান দিন। আমরা তাঁর নিকট থেকেই ভূমিখন্ড ক্রয় করেছিলাম। তিনি মসজিদের স্কীমে অংশ গ্রহণ করত: এর ন্যায্য মূল্য গ্রহণ করেন। যায়গার দখল নেওয়ার জন্যও তিনি সব রকম সহায়তা করেন। এসব ছিল আল্লাহ তা’আলার বিশেষ রহমতের প্রকাশ, আর এ স্কীমের প্রতি পদেপদে আল্লাহর তাওফীক শামিল ছিল।
ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন
মসজিদ আর মাদ্রাসা, আমরা যার নামকরণ করেছিলাম ‘দারুল ইখওয়ান’ বা ইখওয়ান ভবন-এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের দিন ঘনিয়ে আসে। ইখওয়ানরা একটা সমাবেশ করে সিদ্ধান্ত নেয় যে, এ অধম ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করবে। আমি তাদেরকে বুঝবার চেষ্টা করি যে, আমি সামনে এলে স্কীমের কোন বস্তুগত লাভ হবে না। এ অনুষ্ঠানকেও স্কীমের কল্যাণে ব্যবহার করাই হবে উত্তম। তাই সকলেই বড় বড় সরকারী কর্মচারী এবং শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নাম নিয়ে ভাবতে থাকেন। মজার ব্যাপার এই দাঁড়ায় যে, আমি কোন বড় সরকারী কর্মচারীর নাম উল্লেখ করলে কোন কোন ইখওয়ান সমালোচনা করে বলতেনঃ তিনি কোন নেককার ব্যক্তি নয় যে, তাঁর দ্বারা বরকতের আশা করা যেতে পারে, আর তিনি কোন মালদার ব্যক্তিও নয় যে, তার দ্বারা কোন আর্থিক সহায়তা লাভের আশা করা যায়্ ইখওয়ানের নিকট কথাটা একটা প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয়। অবশেষে তারা আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে, আপনার মত কি? আমি বললাম, শায়খ মামলূত সম্পর্কে তোমাদের কি ধারণা? এ বুযুর্গ নেককার ব্যক্তিটি শুরু থেকেই তোমাদের সঙ্গে আছেন। নিজের যোগ্যতা আর টাকা পয়সা দ্বারা তিনি তোমাদের সহায়তা করেছেন। তিনি আল্লাহ তা’আলার নেককার বান্দা। তাঁর কাছে ধন-দওলাতও আছে। তাঁর হাতে তোমরা বরকত লাভ করবে এবং টাকা পয়সাও পাবে। সকলেই একবাক্যে বললো, বেশ ভালো প্রস্তাব। তাই ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের জন্য তাঁর ব্যাপারে সকলেই একমত হন।
নির্ধারিত তারিখে ইখওয়ানরা এক বিরাট প্যান্ডেল স্থাপন করে। সকল স্তরের লোকজনকে দাওয়াত দেওয়া হয়। বিরাট ধুমধামে বিপুল আয়োজন, শায়ক মুহাম্মদ হোসাইন যামলূত এগিয়ে এসে ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ইখওয়ানরা এ ঘটনাকে শুভ লক্ষণ বলে মনে করে এবং ঘোষণা করে যে, আল্লাহর মেহেরবাণীতে রমযানের আগমনের পূর্বেই মসজিদ নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হবে।
শাবরাখীত-এ একটা শাখা স্থাপন
শায়খ হামেদ আসকারিয়া শাবরাখীত-এ দাওয়াতের প্রসারে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। শাবরাখীত-এ তাঁর বদলী হওয়র কয়েক মাসের মধ্যেই সেখানে ইখওয়ানুল মুসলিম এর শাখা স্থাপন করা হয়। মুহররমের মাস এলে নবীজীর হিজরত উপলক্ষে, অনুষ্ঠান শুরু হলে এ দ্বারা আমরা বেশ উপকৃত হই এবং এ সময়েই আমরা শাবরাখীত শাখা উদ্বোধনের পরিকল্পনা গ্রহণ করি। আমরা ইসমাঈলিয়ার ভাইয়েরা একটা গাড়ীর ব্যবস্থা করি। গাড়ী চালাচ্ছিলেন ভাই হাসান আফেন্দী মুস্তফা। মহান আল্লাহর উপর ভরসা করে আমরা মাহমূদিয়া রওয়ানা হই। মাহমূদিয়ায় ভাইদের সঙ্গে রাত্রি যাপন শেষে ভোরে আমরা শাবরাখীত পৌঁছি। মাহমূদিয়ার ভাইয়েরা অপর একটি গাড়ীতে আমাদের সঙ্গে আগমন করেন এবং আমরা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করি। অনুষ্ঠান শেষে আমরা ইসমাঈলিয়ায় ফিরে আসি। দশ ঘন্টায় এ সফর সম্পন্ন করি। ফেরার পথেও অনুরূপ সময় ব্যয় হয়। গাড়ীর গতি ছিল বেশ দ্রুত।
রাখে আল্লাহ মারে কে?
আমার মনে পড়ে যে, রাত দু’টায় আমরা জাফতী পৌঁছে জানতে পারি যে, নদীর উপর পুল বন্ধ করে দেয়অ হয়েছে। এখন দাহতূরা ব্যারেজ হয়ে গমন করা ছাড়া আমাদের জন্য আর কোন উপায় নেই। পথটা ছিল উঁচু-নিচু এবং আঁকাবাঁকা। এ রাস্তা সম্পর্কে ড্রাইভারের কোন জ্ঞান ছিল না এমন রাস্তায় গাড়ী চালনার কোন অভিজ্ঞতাও ছিল না তার। আরবী মাসের ১০ তারিখ ছিল। পানির উপর চাঁদের আলো পড়ছিল। চাঁদের আলোয় সবকিছু সমান মনে হতো। দাহতূরা পুল অতিক্রম করেছি বলে আমাদের ভ্রম হয়। ড্রাইভার গাড়ী চালানায় নিমগ্ন। আমরাও নিশ্চিন্তে গাড়ীতে বসে আছি। হঠাৎ ড্রাইভার গাড়ী থামালে আমরা বিচলিত হয়ে পড়ি। ভালভাবে তাকিয়ে দেখে বুঝতে পারি যে, আমরা যেখানে পৌঁছেছি, তা একটা সরু পথ। পানির মধ্য দিয়ে চলে গেছে এ সরু পথ। এ পথের প্রস্থ গাড়ীল প্রস্থের চেয়ে বেশী নয়। এর অর্থ এই যে, আমরা গাড়ী থেকে নামার চেষ্টা করলে সোজা পানিতে গিয়ে পড়তে হবে আর গাড়ী পানিতে গিয়ে পড়ার আশংকা রয়েছে। উপরন্তু তাজ্জবের ব্যাপার এই যে, গাড়ীর অগ্রভাগ এতটা সামনে চলে গেছে যে, তার আর অবশিষ্ট শুষ্ক অংশের মধ্যে কেবল এক গজ ব্যবধান রয়ে গেছে।
কোন কোন ইখওয়ান ব্যকুলতা প্রকাশ করে। তারা স্বস্থান থেকে সরবার চেষ্টা করে, কিন্তু পরিস্থিতির দাবী ছিল নিতান্ত সতর্কতা অবলম্বন করা। আদৌ নড়াচড়া না করাই ছিল একান্ত প্রয়োজনীয়। কেবল এতেই গাড়ী টিকতে পারে এবং আমাদের মনেও শ্বস্তি অর্জিত হতে পারে। এরপর কি করা যায়, তা ভেবে দেখতে হবে। এ দৃশ্য দেখে আকস্মাৎ আমার হাসি পায়। আমি খাদ্য বিভাগের দায়িত্বশীলকে বললাম, আপনি যে চা বাঁচিয়ে রেখেছিলেন, তা কোথায়? তিনি বললেন, কেন? আমি বললাম, এখন আমরা এক দফা চা পান করবো। তিনি বললেন, এহেন নাজুক মুহূর্তে আপনি পরিহাস করার কথা ভাবছেন? ইনি ছিলেন ভাই মাহমূদ আফেন্দী জা’ফরী। বড়ই হাসিখুশী, মিষ্টভাষী, প্রশস্ত চিত্তের অধিকারী এবং ভদ্র মানুষ ছিলেন তিনি। আমি তাঁকে বললাম, মাহমুদ সাহেব, আমি আপনাকে নিতান্ত সুস্থ মনে বলছি যে, চা পান করান। তিনি হুকুম তামীল করেন এবং থার্মাস থেকে চা ঢেলে দেন। আর আমরা বেশ মজা করে চা পান করতে শুরু করি। অথচ তখন আমরা মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়েছিলাম। কিন্তু রাখে আল্লাহ মারে কে? আমরা সকলে, ড্রাইভার আর গাড়ী সবই যখন নিঃসাড়, তখন আমাদের দলপতি ভাই হাসান ইউসুফ, যিনি ছিলেন আমাদের ড্রাইভার, তিনি ধীরে ধীরে পেছনে সরে আসার চেষ্টা করেন। পেছনে সরে আসার গতি কেঁচোর গতির চেয়ে বেশী ছিলনা। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে তিনি পেছনে সরতে থাকেন। প্রায় অর্ধ ঘন্টা এ অবস্থায় কেটে যায়। এরপর আমরা উপযুক্ত প্রশস্ত পথে আমি এবং শেষ পর্যন্ত আমরা বড় সড়কে উঠি। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে ভয়ংকর বিপদ থেকে নাজাত দেন। আরো তাজ্জবের ব্যাপার এই যে, ভোর দু’টার দিকে আমরা ইসমাঈলিয়ায় পৌঁছে দেখি যে, গাড়ীতে পেট্রোল একদম নেই। কিভাবে গাড়ী চলেছে, তা আল্লাহই ভালো জানেন। মনযিলে পৌছার পরই এ সম্পর্কে আমরা জানতে পেরেছি। আল্লাহ তা’আলার মেহেরবানীর জন্য লাখ লাখ শুকরিয়া। আল্লাহ তা’আলা বান্দাহদের প্রতি বড়ই অনুগ্রহশীল।