মানব মনের স্বাভাবিক প্রশ্ন
এ দুনিয়ায় জীবনটাই কি একমাত্র জীবন, না এরপরেও কোন জীবন আছে? অর্থাৎ মরণের সাথে সাথেই কি মানব জীবনের পরিসমাপ্তি, না তারপরেও জীবনের জের টানা হবে? মানব মনের এ এক স্বাভাবিক প্রশ্ন এবং সকল যুগেই এ প্রশ্নে দ্বিমত হয়েছে এবং এর ভিত্তিতে দুই বিপরীতমুখী সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।
মানুষ ভূমিষ্ঠ হবার পর কিছুকাল দুনিয়ায় অবস্থান করতঃ বিদায় গ্রহণ করে। এ অবস্থানকাল কারো কয়েক মুহূর্ত মাত্র। কারো বা কয়েক দিন, কয়েক মাস, কয়েক বছর। আবার কেউ শতাধিক বছরও বেঁচে থাকে। কেউ আবার অতি বার্ধক্যে শিশুর চেয়েও অসহায় জীবনযাপন করে।
বেঁচে থাকাকালীন মানুষের জীবনে কত আশা-আকাঙ্খা, কত রঙিন স্বপ্ন। কারো জীবন ভরে উঠে অফুরন্ত সুখ সাচ্ছন্দে, লাভ করে জীবনকে পরিপূর্ণ উপভোগ করার সুযোগ-সুবিধে ও উপায়-উপকরণ। ধন-দৌলত, মান-সম্মান, যশ ও গৌরব – আরও কত কি। অবশেষে একদিন সবকিছু ফেলে, সকলকে কাঁদিয়ে তাকে চলে যেতে হয় দুনিয়া ছেড়ে। তার তাখতে-তাউস, বাদশাহী, পারিষদবৃন্দ, উজির-নাজির, বন্ধু-বান্ধব ও গুণগ্রাহীবৃন্দ, অঢেল ধন-সম্পদ কেউ তাকে তাকে ধরে রাখতে পারেনি আর কেউ পারবেও না ভবিষ্যতে। রাজা-প্রজা, ধনী-গরীব, সাদা-কালো সবাইকেই স্বাদ গ্রহণ করতেই হয় মরণের।
কারো জীবনে নেমে আসে একটানা দুঃখ-দৈন্য। অপরের অবহেলা, অত্যাচার-উৎপীড়ন, অবিচার-নিষ্পেষণ। সারা জীবনভর তাকে এ সবকিছুই মুখ বুজে জয়ে যেতে হয়। অবশেষে সমাজের নির্মম বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে সেও একদিন এ দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়।
আবার এমনটিও দেখা যায় যে, এক ব্যক্তি অতিশয় সৎ জীবনযাপন করছে। মিথ্যা, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা তার স্বভাবের বিপরীত। ক্ষুধার্তকে অন্নদান, বিপন্নের সাহায্য, ভাল কথা, ভাল কাজ, ভাল চিন্তা তার গুণাবলীর অন্যতম।
কিন্তু সে তার জাতির কাছ থেকে পেল চরম অনাদর, অত্যাচার ও অবিচার। অবশেষে নির্মম নির্যাতনের মধ্যে কারাপ্রাচীরের অন্তরালে অথবা ফাঁসির মঞ্চে তার জীবনলীলার অবসান হলো। এ জীবনে সে তার সত্য ও সুন্দরের কোন পুরষ্কারই পেল না। তাহলে তার মানবতা শুধু আরতনাদ করেই কি ব্যর্থ হবে? আবার এ দৃষ্টান্তও পাওয়া যায় ভুরি ভুরি যে, কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ সত্যের আওয়াজ তুলতে গিয়ে, সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রাম করতে গিয়ে অসত্যের পূজারী জালেম শক্তিধরকে করেছে ক্ষিপ্ত, করেছে তার ক্ষমতার মসনদকে কম্পিত ও টলটলায়মান। অতঃপর সে তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে গিয়ে সত্যের পতাকাবাহীকে করেছে বন্দী। বন্দীশালায় তার উপরে চালিয়েছে নির্মম নির্যাতনের স্টীমরোলার, আঘাতে আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত ও জর্জরিত করেছে তার দেহ। তথাপি তাকে বিচলিত করা যায়নি সত্যের পথ থেকে। তার অত্যাচার নির্যাতনের কথা যার কানেই গেছে তার শরীর রোমাঞ্চিত হয়েছে। হয়তো সমবেদনায় দু’ ফোঁটা চোখের পানিও গড়ে পড়েছে।
ন্যায়, সত্য ও সুন্দরের অনুসারী যারা তাঁরা কি চায় না যে, নির্যাতিত ব্যক্তি পুরস্কৃত হোক এবং জালেম স্বৈরচারীর শাস্তি হোক? কিন্তু কখন এবং কিভাবে?
আবার এমনও দৃষ্টান্তও রয়েছে যে, এক ব্যক্তি স্ত্রী-পুত্র পরিজন নিয়ে সুখে জীবন যাপন করছে। সে কারো সাথে অন্যায় করেনি কোনদিন। হঠাৎ একদিন একদল সশস্ত্র দুর্বৃত্ত তার বাড়ী চরাও করলো অন্যায়ভাবে। গৃহস্বামী ও তার পুত্রদেরকে হত্যা করলো, নারীদের উপর করলো পাশবিক অত্যাচার। গৃহের ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করলো। অবশিষ্টের উপর করলো অগ্নি সংযোগ। ঘটনাটি জেই শুনলো সেই বড়ো আক্ষেপ করলো। সকলের মুখে একই কথাঃ আহ! এমন নির্মম নিষ্ঠুর আচরণ? এর কি কোন বিচার নেই?
হয়তো তার বিচারের কোন সম্ভাবনাও নেই। কারণ বিচারের ভার যাদের হাতে তাদের হয়তো সংযোগ সহযোগিতা রয়েছে উক্ত নরপিশাচদের সাথে। তাহলে কি মানব সন্তানদের উপর এমনি অবাধ অবিচার চলতেই থাকবে? বিচার হবার আগেইত উক্ত নির্যাতিত মানব সন্তানদের প্রাণবায়ু নির্বাপিত হয়েছে। এখন তারা কোথায়? নির্যাতিত আত্মাগুলো কি মহাশূন্যে বিলীন হয়ে গেছে? নিঃশেষ হয়ে গেছে না এখনও তারা আর্তনাদ করে ফিরছে? তাদের মৃত্যুর পরের অধ্যায়টা কেমন? পরিপূর্ণ শূন্যতা, না অন্য কিছু?
আর জালেম নরপিশাচ যারা, তাদের কোন বিচার হলো না এ দুনিয়ায়, তারাওত মরণ বরন করবে। মৃত্যুর পরেও কি তাদের কিছু হবে না? কোন শাস্তির ব্যবস্থা কি থাকবে না?
আবার দেখুন, এ দুনিয়ার বুকে কাউকে তার অপরাধের শাস্তি এবং মহৎ কাজের পুরস্কার দিতে চাইলেই কি তা ঠিকমতো দেয়া যায়?
মনে করুন এক ব্যক্তি শতাধিক মানব সন্তানকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে। তার অত্যাচারে শত শত পরিবার ধ্বংস হয়েছে। অবশেষে তাকে একদিন কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হলো। এখানে পৌঁছে সে আইনের চোরাপথে অথবা অন্য পন্থায় বেঁচেও যেতে পারে। তার বাঁচার কোন পথই না থাকলে আপনি তাকে শাস্তিই দেবেন। কি শাস্তি? সর্বচ্চো শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। প্রকৃত খুনির মৃত্যুদণ্ড মওকুফও হয়ে যায়। সর্বচ্চ ক্ষমতাসীন ব্যক্তি উক্ত খুনীকে তার নিজের স্বার্থে ব্যবহারের জন্য মুক্তও করে দিতে পারে। আর যদি মৃত্যুদণ্ড কার্যকরই হয়, তাহলে শতাধিক ব্যক্তির হত্যার দায়ে কি একটি মাত্র মৃত্যুদণ্ড? এ দণ্ড কি তার যথেষ্ট হবে? কিন্তু এর বেশিকিছু করার শক্তিও যে আপনার নেই।
অপরদিকে এক ব্যক্তি সারা জীবনের চেষ্টা-সাধনায়, অক্লান্ত শ্রম ও ত্যাগ-তিতিক্ষায় একটা গোটা জাতিকে মানুষের গোলামির নাগ-পাশ থেকে মুক্ত করে এক সর্বশক্তিমান সত্তার সুবিচারপূর্ণ আইনের অধীন করে দিল। তাদের জন্য একটা সুন্দর ও সুখকর সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে দিল। তারা হল সুখী, সমৃদ্ধ ও উন্নত। তাদের জান-মাল, ইজ্জত-আবরু হলো সম্পূর্ণ নিরাপদ। এমন মহান ব্যক্তিকে কি যথাযোগ্য পুরস্কারে পুরস্কৃত করা যায়?
উপরোক্ত ব্যক্তির জের যদি মৃত্যুর পরেও টানা হয় এবং কোন এক সর্বশক্তিমান সত্তা যদি তাদের উভয় শ্রেণীকে যথাযোগ্য দণ্ডে দণ্ডিত ও পুরস্কারে পুরস্কৃত করেন – যাদের যেমনটি প্রাপ্য – তাহলে কি সত্যিকার ন্যায় বিচার হয় না? তাহলে বিবেককে জিজ্ঞেস করে দেখুন, মৃত্যুর পরের জীবনটাও কি অপরিহার্য নয়?
এটাই সেই স্বাভাবিক প্রশ্ন যা আবহমান কাল থেকে মানব মনকে বিব্রত ও বিচলিত করে এসেছে।
এর সঠিক জবাব মানুষ চিন্তা-গবেষণা করে পায় না, পেতে পারে না। এর সঠিক জবাব পেতে হবে এক সর্বজ্ঞ ও নির্ভুল সত্তার কাছ থকে। এ গ্রন্থখানি সে প্রশ্নেরই সঠিক জবাব।
পরকাল সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ
উপরে বর্ণিত মানব মনের স্বাভাবিক প্রশ্নের জবাব তালাশ করতে গিয়ে বিভিন্ন মতবাদ গড়ে উঠেছে প্রাচীনকাল থেকে।
এ প্রশ্নের সাথে আর একটি প্রশ্ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সেটা হচ্ছে এ জীবন-মরণের কোন মালিক, কোন নিয়ন্তা আছে, না নেই? এ জগত ও অসংখ্য সৃষ্টি নিচয়, আকাশমণ্ডলী, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ ও নক্ষত্ররাজি, পাহাড়-পর্বত, নদ-নদী প্রভৃতি এ সবেরও কি কোন স্রষ্টা আছে, না নেই? এসব প্রশ্নের জবাব একই সাথে পাওয়া যায়।
১। একটা মতবাদ হলো – স্রষ্টা বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। এ জগত, আকাশ, মানুষ, জীবজন্তু এবং আরও যত সৃষ্টি – সবই হয়েছে হঠাৎ কোন দুর্ঘটনার ফলশ্রুতি স্বরূপ। মানুষের জন্ম ও মৃত্যু সেই দুর্ঘটনারই ফল। পরকাল বলে কোন জিনিস নেই। মানবজাতিসহ যা কিছুই ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে তার পুনর্বার অস্তিত্ব লাভ করার কোন সম্ভাবনা নেই। এ জগতটা এক সময়ে অবশ্যি ধ্বংস হয়ে যাবে। তারপর আর কিছুই থাকবে না।
২। কেউ বলে যে, এ জগত অনাদি ও অনন্ত। এর কোন ধ্বংস নেই। শুধু জীবকুল ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু পুনর্জীবন লাভ সম্ভব নয়।
৩। কেউ আবার পুনর্জন্মবাদে বিশ্বাসী। তার অর্থ হলো – মানুষ তার ভাল অথবা মন্দ কৃতকর্ম ভোগ করার জন্য মৃত্যুর পর বার বার এ দুনিয়ায় জন্মগ্রহণ করবে।* [ যারা পুনর্জন্মবাদে বিশ্বাসী, তাদের এ মতবাদ সঠিক হলে মৃত্যুর পর যারা পুনর্বার জন্মগ্রহণ করে তাদের মৃত্যুর পরবর্তী অধ্যায়ের কিছু জ্ঞান থাকার কথা। কিন্তু কেউ কি বলেছে মৃত্যুর পরবর্তী অবস্থার কথা? পুনর্জন্মলাভ করার পর পূর্ববর্তী পার্থিব জীবনের জ্ঞান থাকাও আবশ্যক। নতুবা পরবর্তী জন্ম যে পূর্ববর্তী জন্মেরই পরিণাম ফল তা কি করে জানা যাবে? আর তা যদি জানাই না গেল, তাহলে পুনর্জন্মের পুরস্কার অথবা শাস্তি কিভাবে অনুভুত হবে? – গ্রন্থকার]
৪। আবার কারো মত এই যে, মৃত্যুর পর মানুষের জন্য দোযখ বেহেশত বা নরক ও স্বর্গ আছে। তবে পাপী নরকে শাস্তি ভোগ করার পর পুনরায় জন্মগ্রহণ করবে ইহলৌকিক জীবনেও লাঞ্ছিত জীবনযাপন করার জন্যে। এখানেও প্রশ্ন রয়ে যায়। তাহলে কি পাপীর জন্য নরকের শাস্তিই যথেষ্ট নয়?
৫। কারো কারো মতবাদ এই যে, এ জগতটা মহাপাপের স্থান। এখানে জীবনটাই এক মহাশাস্তি। যতোকাল পর্যন্ত এ জড়জগতের সংগে মানবাত্মার সংযোগ থাকবে, তত ততোকাল তাকে মৃত্যুর পর পুনঃপুন জন্মগ্রহণ করে এখানে ফিরে আসতে হবে। মানবাত্মার প্রকৃত মুক্তি ( মহানির্বাণ (Emancipation of soul) বা তার ধ্বংসে। আর তা হতে পারে এভাবে যে প্রতি জন্মে মানুষকে কিছু পুণ্য অর্জন করতে হবে। অতঃপর তার কয়েক জন্মের পুণ্য একত্র করলে তার পুণ্য যদি উল্লেখযোগ্য হয়; তাহলে তখনই তার ‘ফানা’ বা ধ্বংস হবে। এটাই ছিল তার পাপপূর্ণ জগত থেকে মুক্তি বা মহানির্বাণ।
এখানেও পাপ-পুণ্যের কোন স্থায়ী শাস্তি বা পুরস্কার নেই।
৬। পরকাল, বেহেশত ও দোযখে বিশ্বাসী অন্য একটা দলও আছে। তাদের কথা এই যে, তারা এমন এক বংশের উত্তরাধিকারী যা ছিল খোদার অতীব প্রিয় ও মনোনীত। অতএব পরকালে তাদের ভয়ের কোন কারণ নেই। পাপের জন্য তারা দোযখে নিক্ষিপ্ত হলেও কিছুক্ষণের জন্য। তাদের বংশমর্যাদার প্রতি লক্ষ্য রেখে খোদা তাদেরকে অতি সত্বরই বেহেশতে প্রমোশন দেবেন।
৭। পরকাল, দোযখ ও বেহেশতে বিশ্বাসী আর একটি দল আছে। তাদের কথা এই যে, খোদা তার একমাত্র পুত্রকে (?) শূলবিদ্ধ করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। তারই বিনিময়ে তিনি সমগ্র মানবজাতির সমূদয় পাপ ক্ষমা করে দিয়েছেন। তাঁর এ পুত্রের উপর ঈমান এনে তাঁর কিছু গুণগান করলেই পরকালে মুক্তি পাওয়া যাবে।
৮। আবার কেউ পরকাল, দোযখ ও বেহেশতে বিশ্বাসী বটে। কিন্তু তারা আবার এ দুনিয়াতেই কিছু লোককে (মৃত অথবা জীবিত) বিশেষ গুণসম্পন্ন ও অতি শক্তিশালী মনে করে। তাদের বিশ্বাস পরকালে এ লোকগুলো খোদার কাছে তাদের প্রভাব বিস্তার করে তাদের মুক্তি এনে দেবে। এ বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে তারা খোদাকে বাদ দিয়ে এসব তথাকথিত ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী লোকদেরকে সন্তুষ্ট রাখতে চায়। এরা মৃত হলে তাদের কবরে ফুল, শিরনী, নযর-নিয়ায, মানত এবং এমনকি কবরকে সেজদাও করা হয়। আর জীবিত হলে তাদেরকে নানান মূল্যবান উপঢৌকন বা নযর-নিয়ায দিয়ে সন্তুষ্ট করা হয়।
উপরে পরকাল সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ আলোচনা করা হলো। প্রশ্ন হচ্ছে – উপরোক্ত মতবাদগুলোর সত্যতার প্রমাণ কি? এসব মতবাদ কি নির্ভুল ও সুষ্ঠু জ্ঞানভিত্তিক, না নেহায়েৎ আন্দাজ-অনুমানের ভিত্তিতেই এসব গড়ে তোলা হয়েছে? অথবা বংশানুক্রমে চলে আসা এক অন্ধ কুসংস্কারের মায়াজাল? অথবা ধর্মের নাম করে পুণ্য অর্জনের উদ্দেশে কোন সুচতুর স্বার্থান্ধ ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের অর্থ লুটের প্রতারণার জাল?
যদি তা কাল্পনিক ও আন্দাজ-অনুমান ভিত্তিক হয়, অথবা অন্ধ কুসংস্কার অথবা ধর্মীয় গুরুর লেবাস পরিহিত অর্থলোলুপ ব্যক্তির প্রতারণার জাল হয়, তাহলে তা যে কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য নয়, তা সকলেই স্বীকার করবেন। যদি তা জ্ঞান ভিত্তিক হয়, তাহলে সে জ্ঞানের উৎসই বা কি? তাই নির্ভুল জ্ঞানের কষ্টিপাথরেই বিষয়টি যাচাই করে দেখতে হবে বৈ কি?
প্রকৃত জ্ঞানের উৎস
এখন প্রকৃত জ্ঞানের উৎস কি তাই নিয়ে আলোচনা করা যাক। জ্ঞানের উৎস প্রধানতঃ
১। পঞ্চেন্দ্রিয়-(ইন্দ্রিয় ভিত্তিক ও ইন্দ্রিয় লব্ধ জ্ঞান)
২। অহী-(খোদার পক্ষ থেকে নবীগণ কর্তৃক প্রাপ্ত অভ্রান্ত নির্ভুল জ্ঞান)।
জ্ঞানের সূত্র মাত্র উপরের দু’টি। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণের (Experiment & Observation) দ্বারা এ জ্ঞান লাভ করেন। কিন্তু তার মূলেও রয়েছে ইন্দ্রিয়নিচয় ও কিছু মৌলিক বস্তু সমষ্টি (Basic Material)।
সাক্ষ্য প্রমানাদির দ্বারাও জ্ঞান লাভ করা যায়। কিন্তু সে জ্ঞান সাক্ষ্যদাতার ইন্দ্রিয়লব্ধ। তেমনি ইতিহাস পাঠে যে জ্ঞান লাভ করা যায় তাও ইতিহাস লেখকের চোখে দেখা অথবা কানে শুনা জ্ঞান। তার অর্থ ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান। এ জ্ঞানও সবসময়ে নির্ভুল হয় না। সত্যের বিপরীত সাক্ষ্যও দেয়া হয়ে থাকে এবং সত্যকে বিকৃত করেও ইতিহাস লেখা হয়ে থাকে। তথাপি সত্য-মিথ্যা জ্ঞানের উৎসই এগুলোকে বলতে হবে।
এখন পরকাল সম্পর্কে যে জ্ঞান, অর্থাৎ পরকাল আছে বলে যে জ্ঞান, অথবা পরকাল নেই বলে যে জ্ঞান, তার কোনটাই ইন্দ্রিয়লব্ধ হতে পারে না। কারণ মৃত্যুযবনিকার ওপারে গিয়ে দেখে আসার সুযোগ কারো হয়নি অথবা মৃতাত্মার সাথে সংযোগ (Contact) রক্ষা করারও কোন উপায় নেই, যার ফলে কেউ একথা বলতে পারে না যে, পরকাল আছে বা নেই।
কেউ কেউ বিজ্ঞানীর মতো ভান করে বলেন যে, পরকাল আছে তা যখন কেউ দেখেনি, তখন কিছুতেই তা বিশ্বাস করা যায় না। কিন্তু তাঁর এ উক্তি মোটেই বিজ্ঞানসুলভ ও বিজ্ঞোচিত নয়। কারণ কেউ যখন মৃত্যুর পরপারে গিয়ে সেখানকার হাল-হকিকত দেখে আসেনি, তখন কি করে বলা যায় যে, পরকাল নেই?
আমার বাক্সটিতে কি আছে, কি নেই, তা আপনি বাক্সটি খুলে দেখেই বলতে পারেন। কিন্তু বাক্সটি না খুলেই কি করে আপনি বলতে পারেন, বাক্সটিতে কিছু নেই, আপনি শুধু এততুকু আলবৎ বলতে পারেন, বাক্সটিতে কিছু কি নেই তা আমার জানা নেই।
একজন প্রকৃত বিজ্ঞানী তাঁর পরীক্ষা পর্যবেক্ষণ দ্বারা (অবিশ্যি তা অনেক সময় ভুলও হয়) কোন কিছুর সত্যাসত্য নির্ণয় করতে পারেন। কিন্তু তার সে পরীক্ষা পর্যবেক্ষণের পূর্বে কোন কিছুর অস্তিত্ব সম্পর্কে হাঁ বা না কোন কিছুই বলতে পারেন না। তাঁকে একথাই বলতে হয়-এ সম্পর্কে আমার কিছু জানা নেই। অতএব সত্যিকার বৈজ্ঞানিকের উক্তি হবে-পরকাল আছে কি নেই-তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি। অতএব আছে বললে যেমন ভুল হবে, ঠিক তেমনি নেই বললেও ভুল হবে।
উপরের আলোচনা দ্বারা জানা গেল, জ্ঞানের প্রথম উৎস পঞ্চ ইন্দ্রিয় পরকাল সম্পর্কে আমাদের কোনই ধারণা দিতে পারলো না। এখন রইলো দ্বিতীয় সূত্র অহী। দেখা যাক অহী আমাদের কি জ্ঞান দান করে।
যুগে যুগে নবীর আগমন
অহীর প্রতি বিশ্বাস খোদার প্রতি বিশ্বাস থেকেই হতে পারে। উপরে পরকাল সম্পর্কে যেখানে বিভিন্ন মতবাদ পেশ করা হয়েছে, সেখানে ১নং ২নং এবং ৫নং-এ বর্ণিত মতবাদে বিশ্বাসীগণ ব্যতীত অন্য সকল মতবাদীগণ মোটামুটিভাবে একজন স্রষ্টা বা খোদায় বিশ্বাসী। আবার খোদার উপর বিশ্বাসী হয়েও অনেকে পরকাল অবিশ্বাস করেছে। কিন্তু যারা খোদার অস্তিত্বে বিশ্বাসী নয়, তারা স্বভাবতই পরকালের প্রতি অবিশ্বাসী। এ আলোচনা পরকাল সম্পর্কে-খোদার অস্তিত্ব প্রমাণের উদ্দেশ্যে নয়। তবুও পরকালের আলোচনা দ্বারা খোদার শুধু অস্তিত্বেরই প্রমাণ পাওয়া যাবে না, বরঞ্চ তাঁর একত্বেরও প্রমাণ পাওয়া যাবে।
পৃথিবী ও আকাশমণ্ডলী এবং উভয়ের মধ্যে যা কিছু আছে, এমন কি ভূগর্ভ ও সমুদ্রগর্তে যা কিছু আছে, সবেরই একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন। তিনিই সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ তায়ালা। মানুষ সৃষ্টি করার পর তাদের সঠিক জীবনবিধান সম্পর্কে তাদের জানাবার জন্য তিনি যুগে যুগে বিভিন্ন দেশের জাতির মধ্যে নবী পাঠিয়েছেন। বলা বাহুল্য নবীগণ মানুষই ছিলেন। তবে আল্লাহ্ তায়ালা সমাজের উৎকৃষ্টতম মানুষকেই নবী হিসেবে বেছে নিয়েছেন। নবীর কাছে আল্লাহ্ যে জ্ঞান প্রেরণ করেন তাঁকে বলা হয় অহীর জ্ঞান। এ জ্ঞান নবী সরাসরি খোদার কাছ থেকে লাভ করেন, অথবা ফেরেশতা জিবরাঈল (আ) মাধ্যমে অথবা স্বপ্নযোগে। এ জ্ঞান যেহেতু খোদার নিকট থেকে লাভ করা, তাই এ একেবারে অভ্রান্ত ও মোক্ষম সত্য।
এ দুনিয়াতে প্রথম নবী ছিলেন স্বয়ং আদি মানব হযরত আদম (আ)। সর্বশেষ নবী আরবের হযরত মুহাম্মদ (সা)। সর্বমোট এক লক্ষ চব্বিশ হাজার অথবা মতান্তরে আরও বেশি বা কম নবী এ দুনিয়ায় এসেছেন। কিছু সংখ্যক নবীর উল্লেখ কুরআনে আছে। আবার অনেকের উল্লেখ নেই। একথা কুরআনেই বলে দেয়া হয়েছে।
সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ (সা) এবং আর যত নবী, তাঁদের প্রত্যেকেই পরকাল সম্পর্কে একই প্রকার মতবাদ পেশ করেছেন। পরকাল সম্পর্কে নবীদের উক্তির মধ্যে সামান্যতম মতভেদও নেই। তাঁরা সকলে বলেছেন একই কথা।
মনে রাখতে হবে যে, এই লক্ষাধিক নবী একই যুগের এবং একই জনপদের ছিলেন না যে, তাঁরা কোন একটি সম্মেলন করে বহু আলাপ-আলোচনার পর একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। একমাত্র হযরত নূহের (আ) মহাপ্লাবনের পর থেকে শেষ নবী মুহাম্মাদ (সা) পর্যন্ত প্রায় ছ’হাজার বছর ধরে বিভিন্ন জাতির কাছে নবী প্রেরিত হয়েছেন। হযরত আদম (আ) এবং হযরত নূহের (আ) মধ্যবর্তী সময়েও অনেক নবী এসেছেন।
সাধারণত একজন নবীর তিরোধানের পর তাঁর শিক্ষা ও আদর্শ মানুষ একেবারে ভুলে বসলে আরেকজন নবী প্রেরিত হয়েছেন। হযরত ঈসার (আ) তিরোধানের ছ’শ বছর পর শেষ নবীর আবির্ভাব হয়। মুষ্টিমেয় কয়েকজন ব্যতীত এক নবীর সাথে অন্য নবীর সাক্ষাতও হয়নি। কিন্তু বিভিন্ন সময় ও বিভিন্ন যুগের মানুষের হওয়া সত্ত্বেও সকলে বলেছেন একই কথা। তাঁর কারণ এই যে, তাঁরা মানুষের কাছে যে বানী প্রচার করেছেন, তা ছিল না তাঁদের মনগড়া কথা। একমাত্র আল্লাহ্ প্রদত্ত জ্ঞানই তাঁরা মানুষের মাঝে পরিবেশন করেছেন। এ আল্লাহ্ প্রদত্ত জ্ঞান থেকেই তাঁরা পরকাল সম্পর্কে অভিন্ন মতবাদ পেশ করেছেন।
নির্ভুল উত্তর মাত্র একটি
একথা সর্ববাদিসম্মত যে নির্ভুল উত্তর শুধুমাত্র একটিই হয়ে থাকে। যা ভুল তা হয় বহু। যারা ভুল করে তাঁদের মাঝে চিন্তার ঐক্য থাকে না। কোন নির্ভুল সূত্র থেকে তাদের চিন্তা প্রবাহিত হয় না। তাই আপনি একটি ক্লাসে বিশজন ছাত্রকে একটা অংক কষতে দিন। দেখবেন সঠিক উত্তর একই রকম হয়েছে। যারা উত্তর দিতে ভুল করেছে তারা একমত হতে পারেনি। তাদের উত্তর হয়েছে বিভিন্ন প্রকারের। কারণ তাদের উত্তর হয়নি সঠিক জ্ঞানের ভিত্তিতে।
পরকাল সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন আল্লাহ্র নবীগণ। তাদের জবাব সঠিক এ জন্য যে তাদের সকলের জবাব হুবুহু একই হয়েছে। আর তার সঠিকটা ও সত্যতার কারণ ছিল এই যে, তাঁদের জ্ঞান ছিল খোদা প্রদত্ত।
অতএব পরকাল সম্পর্কে নবীদের যে জ্ঞান তা একদিকে যেমন ছিল মহাসত্য, অপরদিকে তা ছিল সকলেরই এক ও অভিন্ন।
পরকাল সম্পর্কে ইসলামী মতবাদ
পরকাল সম্পর্কে নবী প্রদত্ত যে ধারণা, যাকে বলে ইসলামী ধারণা বা মতবাদ, তহলো সংক্ষেপে এই যে, পৃথিবী, আকাশমণ্ডলী ও তন্মধ্যস্থ যাবতীয় সৃষ্টি একদিন অনিবার্যরূপে ধ্বংস হয়ে যাবে। এ ধংসের সূচনা ও বর্ণনা কুরআনে দেয়া হয়েছে বিস্তারিতভাবে। একমাত্র খোদা ব্যতীত আর যত কিছু আছে সবই ধ্বংস হয়ে যাবে। অতঃপর খোদারই নির্দেশে এক নতুন জগত তৈরী হবে। প্রতিটি মানুষ পুনর্জীবন লাভ করে খোদার দরবারে উপস্থিত হবে। দুনিয়ার জীবনে সে ভালো মন্দ যা কিছুই করেছে, তার হিসাব-নিকাশ সে দিন তাকে দিতে হবে খোদার দরবারে। এটাকে বলা হয়েছে- বিচার দিবস। এ দিবসের একচ্ছত্র মালিক ও বিচারক স্বয়ং আল্লাহ্ তায়ালা।
এ বিচারকালে আসামী পক্ষ সমর্থনে থাকবে না কোন উকিল-মোক্তার, এডভোকেট-ব্যারিস্টার। কোন মানুষ সাক্ষীরও প্রয়োজন হবে না। দোষ অস্বীকার করলে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যংগই সঠিক সাক্ষ্য দেবে। দোষ স্বীকার না করে উপায় নেই। কারণ মানুষের প্রতিটি মুহূর্তের কাজ-কর্ম নিখুঁতভাবে রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে এ দুনিয়ার জীবনেই। কথা-বার্তা, হাসি-কান্না, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চালনা, এমনকি গোপন ও প্রকাশ্য প্রতিটি কাজেরই অবিকল ফিলম তৈরী হচ্ছে। এ মূর্তিমান সাক্ষ্য প্রমাণই তার সামনে রাখা হবে। কোন কিছু অস্বীকার করার উপায়ই নেই।
সে দিনের বিচারে কেউ উত্তীর্ণ হলে, তার বাসস্থান হবে বেহেশত। এ এক অফুরন্ত সুখের স্থান। যারা সেদিনের বিচারে হবে অকৃতকার্য, তাদের স্থান হবে জাহান্নাম বা দোযখে। সে এক অনন্তকাল ব্যাপী প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ড। মানুষ বেহেশতেই যাক অথবা জাহান্নামে, তার জীবন বা আয়ু হবে অনন্ত। মানুষ লাভ করবে এক অমর জীবন।এ জীবনকালকেই বলা হয় পরকাল, কুরআনের পরিভাষায় যাকে বলে ‘আখেরাত’।
পরকালের বিরোধিতা
প্রত্যেক যুগেই অজ্ঞ মানুষেরা পরকালের তীব্র প্রতিবাদ করেছে। তারা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায়নি যে, মৃত্যুর পর মানুষ আবার পুনর্জীবন লাভ করবে। একজন সৃষ্টিকর্তায় তাদের বিশ্বাস থাকলেও তাঁর গুণাবলী ও পরিচয় সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিল ভ্রান্ত ও নিকৃষ্ট। তাই পরকাল তারা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারেনি।
মৃত্যুর পর মানুষের প্রতিটি অংগ-প্রত্যংগ, অস্থি, চর্ম, মাংস, প্রতিটি অণু-পরমাণু, ধ্বংস ও ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে বিলীন হয়ে যায়। অথবা মৃত্তিকা এ সবকিছুই ভক্ষন করে। অতঃপর তা আবার কি করে পূর্বের ক্ষয়প্রাপ্ত দেহ ও জীবন লাভ করবে? এ ছিল তাদের জ্ঞান-বুদ্ধির অতীত। তার জন্যে প্রত্যেক নবী পরকালের কথা বলে যখন মানুষের দায়িত্ববোধ জাগ্রত করার চেষ্টা করেছেন, তখন জ্ঞানহীন লোকেরা তাঁকে পাগল বলে অভিহিত করেছে। তাঁর মতবাদ শুধু মানতেই তারা অস্বীকার করেনি, বরঞ্চ সে মতবাদ প্রচারের অভিযোগে তাঁকে নির্যাতিত করেছে নানানভাবে।
পরকাল বিরোধিতা কেন?
পরকালের প্রতি বিশ্বাস এতো মারাত্মক ছিল কেন? এ মতবাদের প্রচার বিরুদ্ধবাদীদেরকে এতটা ক্ষেপিয়ে তুলেছিল কেন? এ প্রচারের ফলে তাদের কোন সর্বনাশটা হচ্ছিল যার জন্যে তারা তা বরদাশত করতে পারেনি?
এর পশ্চাতে ছিল এক মনস্তাত্ত্বিক কারণ। তাহলো এই যে, যারা পরকালে বিশ্বাসী, তাদের চরিত্র, কার্যকলাপ, আচার-আচরণ রুচি ও মননশীলতা, সভ্যতা সংস্কৃতি হয় একধরনের। পক্ষান্তরে অবিশ্বাসীদের এসব কিছুই হয় সম্পূর্ণ বিপরীত ধরনের। এ এক পরীক্ষিত সত্য।
পরকাল বিশ্বাসীদের এমন এক মানসিকতা গড়ে উঠে যে, সে প্রতি মুহূর্তে মনে করে তার প্রতিটি গোপন ও প্রকাশ্য কাজের জন্য তাঁকে মৃত্যুর পর খোদার কাছে জাবাবদিহি করতে হবে। তার প্রতিটি কথা ও কাজ নির্ভুলভাবে এক অদৃশ্য শক্তির দ্বারা লিপিবদ্ধ হচ্ছে বলে তার দৃঢ় বিশ্বাস। তার কোন একটি গোপন করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তার প্রতিটি মন্দ কাজের জন্যে তাকে শাস্তি পেতেই হবে। এ হচ্ছে তার দৃঢ় প্রত্যয়। তাই সে বিরত থাকার চেষ্টা করে সকল মন্দ কাজ থেকে।
ঠিক এর বিপরীত চরিত্র হয় পরকাল অবিশ্বাসীদের। যেহেতু তাদের ধারণা বা বিশ্বাস অনুযায়ী মৃত্যুর পরে আর কিছু নেই, তাই তাদের কৃতকর্মের জন্যে তাদেরকে কারো কাছে জবাবদিহি করতে হবে না। দুনিয়ার জীবনে তারা যদি চরম লাম্পট্য ও যৌন অনাচার (Sexual anarchy) করে, তারা যদি হয় দস্যু ও লুণ্ঠনকারী, তারা যদি মানুষকে তার ব্যক্তি স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করে পশুর চেয়ে হীন জীবনযাপন করতে বাধ্য করে, তবুও তাদের কোন ভয়ের কারণ নেই। কারণ তাদের বিশ্বাস এসবের জন্যে তাদেরকে মৃত্যুর পর কারো কাছে জবাবদিহি করতে হবে না। তাদের মৃত্যুর পরে তো আর কিছুই নেই। না নতুন জীবন, আর না হিসাব-নিকাশের ঝঞ্ঝাট-ঝামেলা।
একজন সৃষ্টিকর্তা ও পরকাল অস্বীকার করে এক নতুন মতবাদ গড়ে তোলা হয়েছে। সেটা হলো এই যে, যেহেতু সৃষ্টি জগতের কোন স্রষ্টাও নেই, পরকাল বলেও কিছু নেই, অতএব জীবন থাকতে এ দুনিয়াকে প্রাণভরে উপভোগ করতে হবে। কারণ মৃত্যুর পরত সবকিছুই শেষ হয়ে যাবে। অতএব খাও দাও আর জীবনকে উপভোগ কর-(Eat, Drink and Be Merry) আরও বলা হয় যে, এ দুনিয়ার জীবনটা হল একমাত্র বেঁচে থাকার সংগ্রাম (A Struggle for existence)। যে সবল, ধূর্ত ও বুদ্ধিমান তারই একমাত্র বেঁচে থাকার অধিকার আছে (Survival of the fittest)। আর যে দুর্বল, হোক সে সৎ ও ন্যায়পরায়ণ, তার বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই।
স্রষ্টা ও পরকাল স্বীকার করলেই প্রবৃত্তির মুখে লাগাম লাগাতে হবে, স্বেচ্ছাচারিতা ও উচ্ছৃঙ্খলতা বন্ধ করতে হবে এবং অন্যায় ও অসদুপায়ে জীবনকে উপভোগ করা যাবে না। উপরন্তু জীবনকে করতে হবে সুনিয়ন্ত্রিত ও সুশৃঙ্খল। আর তা করলে তো জীবনটাকে কানায় কানায় ভোগ করা যাবে না। অতএব খোদা ও পরকালের অস্তিত্বকে অস্বীকার করার পিছনে তাদের এই ছিল মনস্তাত্ত্বিক কারণ।
উপরের দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতা তৈরী হয় পরকাল অবিশ্বাস করার দরুন। নৈতিকতা, ন্যায়, সুবিচার, দুর্বল ও উৎপীড়িতদের প্রতি সহানুভূতি ও দয়া প্রদর্শন প্রভৃতি গুণাবলিতে তারা বিশ্বাসী নয়। নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা, হত্যাকাণ্ড, প্রতিশ্রুতি ভংগ ও বিশ্বাসঘাতকতা তাদের কাছে কোন অপরাধ বলে স্বীকৃত নয়। যৌন বাসনা চরিতার্থ করার জন্য নারীজাতিকে ভোগ লালসার সামগ্রীতে পরিনত করতে, স্বীয় স্বার্থসিদ্ধির জন্যে একটি মানবসন্তান কেন একটা গোটা দেশ ও জাতিকে গোলামে পরিণত করতে অথবা ধংস করতে তাদের বিবেক কোন দংশন অনুভব করে না। তাই ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, অতীতের বহু জাতি পার্থিব উন্নতি ও সমৃদ্ধির উচ্চ শিখরে আরোহণ করলেও পরকাল অবিশ্বাস করার কারণে তারা নিমজ্জিত হয়েছিল নৈতিক অধঃপতনের অতল তলে। তারা হয়ে পড়েছিল চরম অত্যাচারকারী রক্ত পিপাসু নরপিশাচ। তাই আল্লাহ্ তাদেরকে সমূলে ধ্বংস করেছেন এবং তাদের নাম নিশানা মিটিয়ে দিয়েছেন দুনিয়ার বুক থেকে।
এটাই ছিল আসল কারণ, যার জন্যে কোন নবী পরকালের প্রতি বিশ্বাস-স্থাপনের আবেদন জানালে পরকালে অবিশ্বাসী লোকেরা তাঁকে করেছে অপদস্থ, প্রস্তরাঘাতে ক্ষতবিক্ষত অথবা করেছে মাতৃভূমি থেকে নির্বাসিত। পরকালের প্রতি বিশ্বাসস্থাপন করে তারা তাদের জীবন ধারাকে করতে চায়নি সুশৃঙ্খল অ সুনিয়ন্ত্রিত, তাদের উদগ্র ভোগলিপ্সাকে করতে চায়নি দমিত। মানুষকে গোলাম বানিয়ে তাদের উপর খোদায়ী করার আকাংখাকে করতে চায়নি নিবৃত্ত। নবীদের সাথে তাদের বিরোধের মূল কারণই ছিল তাই।
পরকালে অবিশ্বাস ও চরম নৈতিক অধঃপতনের কারণে অতীতে হযরত নূহের (আ) জাতি, লুতের (আ) জাতি, নমরুদ, ফেরাউন, আদ ও সামুদ জাতি, তুব্বা প্রভৃতি জাতিসমুহ ধ্বংসস্তুপে পরিনত হয়েছে। মানব সমাজে তাদের নাম উচ্চারিত হয় ঘৃণা ও অভিশাপের সাথে। প্রাচীন গ্রীক ও রোমান সভ্যতা শুধুমাত্র অতীত ইতিহাসের বস্তুতে পরিণত হয়েছে।
একমাত্র খোদাভীতি অপরাধ প্রবণতা দমন করে
অপরাধ দমনের জন্য প্রত্যেক দেশেই বিভিন্ন দণ্ডবিধি প্রণয়ন করা হয়। অবিশ্যি এর প্রয়োজনীয়তাও অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু শুধু মাত্র দণ্ডবিধি প্রণয়ন ও অপরাধীর প্রতি দণ্ড প্রদানের দ্বারাই কি অপরাধ প্রবণতা দমন করা যায়?
দেশে আইন ও দণ্ডবিধি থাকা সত্ত্বেও হত্যা, লুট, রাহাজানি, ব্যভিচার, দুর্নীতি, হানাহানি ও অন্যান্য জঘন্য ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয় কেন? এ সবের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করে দেখা দরকার।
অপরাধ প্রবণ ব্যক্তি সাধারণত লোক চক্ষুর অন্তরালে অতি সংগোপনে তার কুকার্য সম্পাদন করে। এরপরে আইনকে ফাঁকি দেয়ার বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। সে জন্য দেখা যায়, অপরাধীর জন্য আইনে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও অপরাধী নির্বিঘ্নে মুক্তি পেয়ে যায়। অপরাধ করার পর মুক্তিলাভ তাকে অপরাধ করার জন্য দ্বিগুণ-চতুর্গুণ উৎসাহিত করে। আমাদের আইন ও বিচার ব্যবস্থা মানব রচিত হওয়ার কারণে ত্রুতিপূর্ণ। আইন ব্যবসায়েও সততার অভাব আছে। উপরন্তু অনেক সময় বিচার বিভাগকে প্রভাবিত করে অথবা দণ্ড পরও বিশেষ মহলের প্রভাবে অপরাধী রেহাই পেয়ে যায়। ফলে মজলুম নিপীড়িত অসহায় মানুষ সুবিচার থেকে বঞ্চিত হয়। সে জন্য দেখা যায় প্রকৃত হত্যাকারী, লক্ষ কোটি টাকা লুণ্ঠন ও আত্মসাৎকারী ও নানাবিধ অপরাধে অপরাধী ব্যক্তি নানান অসাধু উপায়ে আইনকে ফাঁকি দিয়ে বুক ফুলিয়ে সমাজে বিচরণ করে।
অপরাধীর শাস্তিই শুধু কারো কাম্য হওয়া উচিত নয়, অপরাধের মূলোৎপাটনই কাম্য হওয়া উচিত। তা কিভাবে সম্ভব?
অপরাধ প্রবণতা সর্বপ্রথম জন্মলাভ করে মনের গোপন কোণে। চারদিকের পাপপূর্ণ পরিবেশ, পাপাচারীদের সাহচর্য, অশ্লীল কুরুচিপূর্ণ সাহিত্য ও নাটক উপন্যাস পাঠ, যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী ছায়াছবি ও টেলিভিশন অপরাধ প্রবণতা সৃষ্টিতে সহায়ক হয়। অতপর অপরাধ সংঘটিত করার কামনা-বাসনা, ইচ্ছা ও সংকল্প মানুষকে অপরাধে লিপ্ত করে। এখন প্রয়োজন মনের মধ্যেই এ প্রবণতাকে অংকুরে বিনষ্ট করা। কিন্তু তা কোন আইন করে, ভীতি প্রদর্শন করে অথবা কোন বহিঃশক্তির দ্বারা বিনষ্ট করা কিছুতেই সম্ভব নয়। মনের অভ্যন্তরেই এমন এক শক্তি সঞ্চারিত হওয়া বাঞ্ছনীয়- যা অপরাধ প্রবণতা দমন করতে সক্ষম। একমাত্র খোদা ও পরকালভীতিই সে শক্তির উৎস হতে পারে। মানুষের মধ্যে যদি এ দৃঢ় বিশ্বাস থাকে যে দুনিয়ার জীবনই একমাত্র জীবন নয়- বরঞ্চ মৃত্যুর পরেও এক জীবন রয়েছে- যার কোন শেষ নেই এবং দুনিয়ার জীবনের কর্মকাণ্ডের উপরই পরকালীন জীবন নির্ভরশীল। এ জীবনে মানুষ যা কিছু করে গোপনে এবং প্রকাশ্যে তার প্রতিটি পুংখানুপুংখ হিসাব দিতে হবে পরকালে আল্লাহ্ তায়ালার দরবারে, এ জীবনের পাপ ও পুণ্য কোনটাই গোপন করা যাবে না, পাপের শাস্তি থেকে কেউ কাউকে বাঁচাতে পারবে না এবং পুণ্যের পুরষ্কার থেকেও কেউ কাউকে বঞ্চিত করতে পারবে না, তাহলে মানুষের মধ্যে এ বিশ্বাস সৃষ্টি এবং তদনুযায়ী মানসিক প্রশিক্ষণ ও বাস্তব চরিত্র গঠন সকল প্রকার পাপাচার থেকে সমাজকে রক্ষা করে।
অতএব খোদা ও পরকাল ভীতিই মানুষকে পাপাচার থেকে দূরে রাখতে পারে। ইসলামের ইতিহাসে এর স্বর্ণোজ্জল দৃষ্টান্ত রয়েছে। একটা উল্লেখ এখানে করছি।
দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ফারুকের (রা) যুগে মদীনার উপকণ্ঠে বাস করত এক বৃদ্ধা। সংসারে সে আর তার কন্যা। তারা বিভিন্ন স্থান থেকে দুগ্ধ সংগ্রহ করার পর তা বাজারে বিক্রি করে জীবিকা অর্জন করতো।
একদা রাত্রিকালে বৃদ্ধা তার মেয়েকে বলল- দুধে কিছু পানি মিশিয়ে বেশি দাম পাওয়া যাবে।
মেয়ে বলল- সে কি করে সম্ভব? তুমি কি শুননি আমীরুল মুমেনীন দুর্নীতিকারীদের জন্যে শাস্তি ঘোষণা করেছেন?
বৃদ্ধা- দূর ছাই। রাত্রি বেলা এ নিভৃত পল্লীতে কোথায় আমীরুল মুমেনিন, আর কোথায় তার গুপ্ত পাহারাদার যে দেখে ফেলবে?
মেয়ে- এটা ঠিক যে আমাদের এ দুষ্কর্ম কোন মানুষই দেখতে পারবে না। কিন্তু খোদার চক্ষুকে কি তুমি ফাঁকি দিতে পারবে মা? রোজ কেয়ামতে আমরা যে ধরা পড়ে জাব।
বৃদ্ধা তার সম্বিৎ ফিরে পেল। খোদা ও পরকালের ভীতি তাকে সন্ত্রস্ত করে তুললো। সে তওবা করে তার অপরাধ প্রবণতা দমন করলো।
খলিফা হযরত উমর (আ) ছদ্মবেশে শহর পরিভ্রমণকালে ঘটনাক্রমে এ দুটি নারীর কথোপকথন শুনতে পান। বালিকাটির খোদাভীতিতে প্রীত হয়ে তিনি তাকে তাঁর পুত্র বধু করে নিয়েছিলেন।
সমাজে এ ধরনের ঘটনা হয়তো অহরহ ঘুরছে। কিন্তু জনসংখ্যার তুলনায় তার শক্তি অতি নগণ্য।
মানুষের চরিত্র যদি তৈরী হয় এমনি খোদা ও পরকালভীতির ভিত্তিতে তাহলে সমাজ থেকে অপরাধ ও দুর্নীতির মূলোৎপাটনের জন্যে কোন প্রকাশ্য বাহিনী পোষণ করার প্রয়োজন হবে না। দুর্নীতি দমন বিভাগ বা বাহিনীর লোকের হৃদয়ে যদি খোদা ও পরকালের ভয় না থাকে, তাহলে তাদেরও দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে পড়া অস্বাভাবিক কিছু হবে না। অতপর সে দেশে দুর্নীতি ও অপরাধ দমনের পরিবর্তে সকলে একত্রে মিলে তা পোষণ করাই হবে সবার কাজ।