পরকালের ঐতিহাসিক যুক্তি
মহাজ্ঞানী আল্লাহ তায়ালা পরকালের বর্ণনা প্রসংগে একদিকে যেমন অলৌকিক সৃষ্টি কৌশল সম্পর্কে মানুষকে চিন্তা-গবেষণার আহবান জানিয়েছেন, অপর দিকে পরকালের নিশ্চয়তা সম্পর্কে অতীতের ঘটনাপুঞ্জকে সাক্ষী রেখেছেন।
(আরবী **************************************)
“তুর পর্বতের শপথ। সেই প্রকাশ্য পবিত্র গ্রন্থের শপথ যা লিপিবদ্ধ আছে মসৃণ চর্ম ঝিল্লিতে। আরও শপথ বায়তুল মা’মুর সুউচ্চ আকাশ, এবং উচ্ছসিত তরঙ্গায়িত সমুদ্রের। তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে শাস্তি অবশ্যই সংঘটিত হবে যা কেউ রোধ করতে পারবে না।”-(সূরা আত তুরঃ ১-৮)
আলোচ্য আয়াতে শাস্তি বলতে পরকালকেই বুঝানো হয়েছে। কারণ পরকাল তাঁর অবিশ্বাসীদের জন্যে নিয়ে আসবে অতীব ভয়াবহ ও যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। পরকাল যে এক অবশ্যম্ভাবী সত্য তা মানুষের মনে বিশ্বাস জন্মাবার জন্যে আল্লাহ তায়ালা পাঁচটি বস্তুর শপথ করেছেন। অর্থাৎ এ পাঁচ বস্তু পরকালের সত্যতার সাক্ষ্য বহন করছে।
প্রথমত তুর পর্বতের কথাই ধরা যাক, এ এমন এক ঐতিহাসিক পবিত্র পর্বত যার উপরে আল্লাহ তায়ালা হযরত মুসার (আ) সংগে কথোপকথন করে তাঁকে নবুয়তের শিরস্ত্রানে ভূষিত করেছিলেন। এতদ প্রসংগে একটি দুর্দান্ত প্রতাপশালী জাতির অধপতন এবং অন্য একটি উৎপীড়িত ও নিষ্পেষিত জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের সিদ্ধান্তও এ স্থানে গৃহীত হয়। এ সিদ্ধান্ত দুনিয়ার সংখ্যা ও শক্তিভিত্তিক আইনের(Physical law) বলে গৃহীত হয়নি। বরঞ্চ গৃহীত হয়েছিল নৈতিক আইন (Moral law) এবং কুকর্মের শাস্তিদান আইন (law of Retribution) অনুযায়ী। অতএব পরকালের সত্যতার ঐতিহাসিক প্রমাণের জন্যে তূর পর্বতকে একটা নিদর্শন হিসেবে পেশ করা হয়েছে।
কিভাবে একটা বিশাল ভূ-খণ্ডের অধিপতি মানুষের উপরে খোদায়ীর দাবীদার শক্তিমদমত্ত ফেরাউন তাঁর সৈন্যবাহিনী ও অমাত্যবর্গসহ লোহিত সাগরের অতলতলে নিমজ্জিত হয়েছিল, তার সিদ্ধান্ত তূর পর্বতের উপরে সেই মহান রাত্রিতে গৃহীত হয়েছিল। আর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল নিরস্ত্র, নিরীহ, নিপীড়িত ও নিষ্পেষিত বনী ইসরাইলকে গোলামীর শৃঙ্খল থেকে চিরমুক্ত করার।
বিশ্বজগতের মালিক প্রভু আল্লাহ তায়ালা জ্ঞান-বিবেকমণ্ডিত এবং স্বাধীন ইচ্ছা ও কর্মশক্তি সম্পন্ন মানুষের যে নৈতিক বিচারের দাবী রাখেন, উপরোক্ত ঘটনা মানব ইতিহাসে তার এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হিসেবে অটুট আছে ও থাকবে চিরকাল। আল্লাহ তায়ালার এ দাবী পরিপূরণের জন্যে এখন এক বিচার দিবসের অবশ্যই প্রয়োজন যে দিন বিশ্বের সমগ্র মানব জাতিকে একত্র করে তাদের চুলচেরা বিচার করা হবে। আর সেটা যুক্তিযুক্ত হবে মানব জীবনের অবসানের পরেই। সামান্য অন্যায় অবিচার করেও সেই বিচার দিনে কেউ রেহাই পাবে না।
আলোচ্য আয়াতে পবিত্র গ্রন্থ বলতে পূর্ববর্তী নবীগণের প্রতি অবতীর্ণ গ্রন্থাবলী যথাঃ তাওরাত, ইঞ্জিল, যবুর ও অন্যান্য আসমানি গ্রন্থাবলী সমষ্টিকে বুঝানো হয়েছে। এ গ্রন্থাবলী তখনো বহু লোকের কাছে রক্ষিত ছিল। এসব গ্রন্থের মাধ্যমে অন্যান্য নবীগণ পরকাল সম্পর্কে সেই মতবাদই পেশ করেছেন, যা শেষ নবী মুহাম্মদ মুস্তফা (সা) পেশ করেছেন ফুরাইশদের সামনে। প্রত্যেক নবী একথাটিই বলেছেন যে, সমগ্র মানবজাতিকে একদা খোদার সম্মুখে একত্র করা হবে এবং তখন প্রত্যেককেই আপন কৃতকর্মের জবাবদিহি করতে হবে। কোন নবীর প্রতি এমন কোন গ্রন্থ অবতীর্ণ হয়নি, যার মধ্যে পরকালের কোন উল্লেখ নেই, অথবা এমন কথা বলা হয়েছে হে, মৃত্যুর পর পরকাল বলে কিছু নেই।
অতপর আল্লাহ তায়ালা বায়তুল মা’মুরের শপথ করেছেন। প্রত্যেক আলাশে* এবং বেহেশতে একটি করে পবিত্র গৃহ প্রতিষ্ঠিত আছে যাকে কেবলা করে ফেরেশতাগন এবং আকাশবাসী আল্লাহর এবাদত বন্দেগী করে থাকেন। মক্কার পবিত্র কাবাগৃহকে দুনিয়ার বায়তুল মা’মুর বলা হয়। কারণ এ গৃহ বেহেশতের ‘বায়তুল মা’মুরের’ অনুকরণেই প্রথম ফেরেশতাগণ কর্তৃক এবং পরে হযরত ইব্রাহীম (আ) কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল।
পবিত্র কাবাগৃহ কয়েকটি বিষয়ের জ্বলন্ত স্বাক্ষর বহন করছে। আল্লাহর নবীগণ যে সত্য, তাঁর অনন্ত হিকমত ও অসীম কুদরত যে এ পবিত্র গৃহকে আবেস্টন করে আছে, তা দিবালোকের মতই সুস্পষ্ট।
এ পবিত্র আয়াতটি অবতীর্ণ হবার প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে (মতান্তরে চার হাজার বছর) পাহাড়-পর্বত ঘেরা জনমানবহীন এক বারিহীন প্রান্তরে ইক ব্যক্তি তাঁর প্রিয়তমা পত্নি ও একমাত্র দুগ্ধ পোষ্য শিশু সন্তানকে নির্বাসিত করে চলে যাচ্ছেন। কিছুকাল পর আবার সেই ব্যক্তিই উক্তস্থানে আল্লাহর এবাদতের জন্যে একটি গৃহ নির্মাণ করে উদাত্ত আহবান জানাচ্ছেন, “হে মানবজাতি তোমরা চলে এসো এ পবিত্র গৃহের দর্শন লাভ কর এবং হজ্ব সমাধা কর।”
তাঁর সে আহবানে এমন এক চুম্বক শক্তি ছিল এবং তা মানুষের হৃদয়-মন এমনভাবে জয় করে ফেলে যে, গৃহটি সমগ্র আরব দেশের কেন্দ্রীয় আকর্ষণীয় বস্তুতে পরিনত হয়। সেই মহান আহবানকারী আর কেউ নন-তিনিই মহিমান্বিত নবী হযরত ইব্রাহীম খলীলুল্লাহ (আ)। তাঁর আহবানে আরবের প্রতিটি নগর ও পল্লী প্রান্তর থেকে অগনিত মানুষ লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক, (আমরা হাযীর, আমরা হাযীর, হে আল্লাহ, আমরা হাযীর) ধ্বনিতে চারিদিক মুখরিত করে ছুটে এসেছে সে গৃহের দর্শনলাভের জন্যে। কারণ সেটা ছিল আল্লাহর ঘর।
গৃহটি নির্মাণের পর থেকে হাজার হাজার বছর পরে উপরোক্ত আয়াত অবতীর্ণ হওয়া পর্যন্ত তা শান্তি ও নিরাপত্তার লালনাগার রুপে বিরাজ করেছে এবং তা এখন করছে।
সেকালে আরবেরত চতুর্দিকে দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে, মানুষে মানুষে, রক্তের হোলিখেলা চলেছে। কিন্তু এ পবিত্র গৃহের নিকটবর্তী হয়ে দুর্দমনীয়, রক্তপিপাসুরও বজ্রমুষ্টি শিথিল হয়ে পড়েছে। এর চতুঃসীমার ভেতরে কারো হস্ত উত্তোলন করার দুঃসাহস হয়নি কখনো। এ ঘরের বদৌলতে আরববাসী এমন চারটি পবিত্র মাস লাভ করতে সক্ষম হয়েছে যে, এ মাসগুলোতে সর্বত্র বিরাজ করেছে শান্তি ও জানমাল ইজ্জতের পরিপূর্ণ নিরাপত্তা। এ সময়ে তারা ব্যবসার পন্যদ্রব্য নিয়ে নিয়ে নির্বিঘ্নে যথেচ্ছ গমনাগমন করেছে। ব্যবসাও তাদের জমে উঠেছে বাড়ন্ত শস্যের মতো।
এ পবিত্র গৃহের এমনই এক অত্যাশ্চার্য মহিমা ছিল যে, কোন প্রতাপশালী দিগবিজয়ীরও এর দিকে তাঁর লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে পারেনি। এ পবিত্র বাণী অবতীর্ণ হবার মাত্র পয়তাল্লিশ বছর পূর্বে এক অপরিণামদর্শী ক্ষমতা গর্বিত শাসক এ গৃহকে ধুলিস্মাত করার উদ্দেশ্যে অভিযান চালিয়েছিল। তাকে প্রতিহত করার কোন শক্তি তখন গোটা আরবে ছিল না। কিন্তু এ গৃহ স্পর্শ করা তো দুরের কথা, টার চতুঃসীমার বাইরে থাকতেই সে টার বিরাট বাহিনীসহ বিধ্বস্ত হয়েছে পরিপূর্ণরূপে। তাদের অস্থি-মাংস চূর্ণবিচূর্ণ হয়েছে এক অলৌকিক উপায়ে। এ ঘটনা যারা স্বচক্ষে দেখেছে, তাদের বহু লোক তখনো জীবিত ছিল যখন এ ঘটনার উল্লেখ করা হয়।
এসব কি একথারই প্রকৃত প্রমাণ নয় যে, আল্লাহর নবীগণ কোন কাল্পনিক কথা বলেন না? তাঁদের চক্ষু এমন কিছু দেখতে পায়, যা অপরের দৃষ্টিগোচর হয় না। তাঁদের কণ্ঠে এমন সত্য ও তথ্য উচ্চারিত হয় যা হৃদয়য়ংগম করার ক্ষমতা অন্যের হয় না। তারা এমন কিছু বলেন ও করেন যে, সমসাময়িক অনেকে তাঁদেরকে পাগল বলে অভিহিত করে। আবার শতাব্দী অতীত হওয়ার পর মানুষ তাঁদের বিচক্ষনতা ও দূরদৃষ্টির উচ্ছ্বসিত।প্রশংসা করে। এ ধরনের মহামানব যখন প্রত্যেক যুগে একই সত্যের পুনরাবৃত্তি করেছেন যে পরকাল অবশ্যই হবে, তখন তার প্রতি অবিশ্বাস হঠকারিতা ছাড়া আর কি বলা যায়?
অতপর আল্লাহ তায়ালা তাঁর অত্যাশ্চার্য সৃষ্টি নৈপুণ্যের নিদর্শন সুউচ্চ আকাশের উল্লেখ করে তাকে পরকালের সাক্ষ্যদাতা হিসেবে পেশ করেছেন। বিজ্ঞানের চরম উন্নতির যুগেও বিজ্ঞানীরা আকাশ সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হননি। আকাশের বিস্তৃতি কত বিরাট ও বিশাল এবং তার আরম্ব ও শেষ কোথায়, এখনো তা তাঁদের জ্ঞান বহির্ভূত। মাথার উপরে যে অনন্ত শূন্যমার্গ দেখা যায়, যার মধ্যে কোটি কোটি মাইল ব্যবধানে অবস্থিত চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্রাদি বিচরন করছে, সেই অনন্ত শূন্যমার্গই কি আকাশ, না তার শেষ সীমায় আকাশের শুরু তা সঠিকভাবে বলা শক্ত। যে আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল, সেই গতিতে বলা শুরু করে এখনো অনেক তারার আলো পৃথিবীর বুকে এসে পৌছায়নি। এ তারাগুলো যেখানে অবস্থিত পৃথিবী হতে তার দূরত্ব এখনো পরিমাপ করা সম্ভব হয়নি।
বিজ্ঞানীদের কাছে আকাশ এক মহা বিস্ময় সন্দেহ নেই। তাঁদের মতে সমগ্র আকাশের একাংশ যাকে galaxy (ছায়াপথ)বলে, তারই একাংশে আমাদের এ সৌরজগত।এই একটি galaxy-এর মধ্যেই চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্রাদি বিদ্যমান। বিজ্ঞানীদের সর্বশেষ পরীক্ষা নিরীক্ষায় অন্তত দশ লক্ষ galaxy-এর অস্তিত্ব ধরা পড়েছে। এসব অগনিত ছায়া পথের(galaxy) মধ্যে যেটি আমাদের অতি নিকটবর্তী, তার আলো পৃথিবীতে পৌছতে দশ লক্ষ বছর সময় লাগে। অথচ সে আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল।
সমগ্র ঊর্ধ্বজগতের যে সামান্যতম অংশের জ্ঞান এ জাবত বিজ্ঞান আমাদেরকে দিয়েছে, তারই আয়তন এত বিরাট ও বিশাল। এ সবের যিনি সৃষ্টিকর্তা, তাঁর কুদরত ও জ্ঞানশক্তি যে কত বিরাট, তা আমাদের কল্পনার অতীত। এ ব্যাপারে মানুষের জ্ঞান মহাসমুদ্রের তুলনায় জলবিন্দুর চেয়ে ক্ষুদ্রতর। এখন এই অত্যাশ্চার্য সৃষ্টি রাজ্যকে যে খোদা অস্তিত্বদান করেছেন, তাঁর সম্পর্কে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মানব যদি এমন মন্তব্য করে যে, মৃত্যুর পর পুনর্জীবন দান অথবা মহাপ্রলয় ও ধ্বংসের পর নতুন এক জগত সৃষ্টি তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়, তাহলে বলতে হবে যে, তার চিন্তা রাজ্যে অনশ্যই কোন বিশৃঙ্খলা ঘটেছে।
অতপর দেখুন, পৃথিবীর বুকে উচ্ছ্বসিত ও তরঙ্গায়িত সমুদ্ররাজির অবস্থান কি কম বিস্ময়কর? পৃথিবীর তিন ভাগ জল, একভাগ স্থল। একথা ভূগোল বলে। সমুদ্রের অনন্ত বারিরাশি ও স্থল্ভাগের গুরুভারসহ পৃথিবীটা শুন্যমার্গে লাটিমের মত নিয়ত ঘুরছে। চিন্তা করতে মানুষের মাথাটাও ঘুরে যায়।
যদি কেউ গভীর মনোযোগ সহকারে এবং স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভংগী নিয়ে সমুদ্র সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করে তাহলে তার মন সাক্ষ্য দেবে যে, পৃথিবীর উপরে অনন্ত বারিরাশির সমাবেশ এমন এক সৃষ্টি নৈপুণ্য যা কখনো হঠাৎ কোন দুর্ঘটনার ফল নয়। অতপর এত অসংখ্য হিকমত তার সাথে সংশ্লিষ্ট যে এত সুষ্ঠু সুন্দর বিজ্ঞতাপূর্ণ ও সুসামঞ্জস্য ব্যবস্থাপনা কোন সৃষ্টিকর্তা ও নিয়ন্তা ব্যতীত হঠাৎ আপনা আপনি হওয়া কিছুতেই সম্ভবপর নয়।
সমুদ্র গর্ভে অসংখ্য অগনিত প্রানী সৃষ্টি করা হয়েছে। তাদের আকৃতি ও গঠনপ্রণালী বিভিন্ন প্রকারের। যেরূপ গভীরতায় বাসস্থান নির্ণয় করা হয়েছে। তার ঠিক উপযোগী করেই তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। সমুদ্রের পানি করা হয়েছে লবনাক্ত। তার করানে প্রতিদিন তার গর্ভে অসংখ্য জীবের মৃত্যু ঘটলেও তাদের মৃতদেহ পঁচে –গলে সমুদ্রের পানি দুষিত হয় না। বারিরাশির বৃদ্ধি ও হ্রাস এমনভাবে সীমাবদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত করে রাখা হয়েছে যে, তা কখনো সমুদ্রের তলদেশে ভু-গর্ভে প্রবেশ করে নিঃশেষ হয়ে যায় না। অথবা প্রবল আকারে উচ্ছ্বসিত হয়ে সমগ্র স্থল্ভাগ প্লাবিত করে না। কোটি কোটি বছর যাবত নির্ধারিত সীমার মধ্যেই তার হ্রাস বৃদ্ধি সীমিত রয়েছে। এ হ্রাস বৃদ্ধিও সৃষ্টিকর্তারই নির্দেশে হয়ে থাকে।
সূর্যের উত্তাপে সমুদ্রের বারিরাশি থেকে বাস্প সৃষ্টি হয়ে ঊর্ধ্বে উত্থিত হয়। তা থেকে মেঘের সৃষ্টি হয়। মেঘমালা বায়ু চালিত হয়ে স্থল্ভাগে বিভিন্ন অঞ্চল বারিশিক্ত করে। বারিবর্ষণের ফলে শুধু মানুষ কেন, স্থলচর জীবের জীবন ধারনের জাবতীয় প্রয়োজনীয় উৎপন্ন হয়।
সমুদ্রগর্ভ থেকেও মানুষ তার প্রচুর খাদ্য-সামগ্রী আহরন করে। সংগ্রহ করে অমুল্য মণিমুক্তা, প্রবাল, হীরা জহরত। তার বুক চিরে দেশ থেকে দেশান্তরে জাহাজ চলাচল করে। অবাধ ব্যবসা-বানিজ্য চলে। স্থান থেকে স্থানান্তরে মানুষের গমানাগমন হয়। স্থল্ভাগ ও মানবজাতির সাথে এই যে গভীর নিবিড় মংগলকর সম্পর্ক এ এক সনিপুন হস্তের সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই একমাত্র সম্ভব। হঠাৎ ঘটনাচক্র দ্বারা পরিচালিত কোন ব্যবস্থাপনা এটা কিছুতেই নয়।
উপরোক্ত আলচনায় ফলে একি এক অনস্বীকার্য সত্য বলে গৃহীত হবে না যে, এক অদ্বিতীয় মহাশক্তিশালী খোদাই মানুষের প্রতিষ্ঠা ও জীবন ধারনের জন্যে অন্যান্য অগনিত প্রয়োজনীয় বস্তুসামগ্রীর সাথে সমুদ্রকেও এমন মহিমাময় করে সৃষ্টি করেছেন?
তাই যদি হয়। তাহলে একমাত্র জ্ঞানহীন ব্যক্তিই একথা বলতে পারে যে, তার জীবন ধারণের জন্যে খোদা তো সমুদ্র থেকে মেঘের সঞ্চার করে তার ভুমি সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা করে দেবেন। কিন্তু তিনি তাকে কখনো একথা জিজ্ঞেস করবেন না যে, একমাত্র তাঁরই অনুগ্রহে জীবন ধারণ করে সে তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছে, না নফরমানী করেছে। উত্তাল সমুদ্রকে সংযত ও অনুগত রেখে তার মধ্যে জলযান পরিচালনা করার শক্তি ও জ্ঞান-বুদ্ধি তো আল্লাহ তায়ালা তাকে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি তাকে কোনদিন একথা জিজ্ঞেস করবেন না যে, সে জলযান সে ন্যায় ও সত্য পথে পরিচালনা করেছিল, না অপরের ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করার জন্য। এ ধরনের চিন্তা ও উক্তি যারা করে তাদেরকে চিন্তার ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত বললে কি ভুল হবে?
যে শক্তিশালী খোদার অসীম কুদরতের যৎকিঞ্চিৎ নিদর্শন এই অনন্ত রহস্যময় সমুদ্রের সৃষ্টি, যিনি শূন্যমার্গে ঘূর্ণায়মান পৃথিবী পৃষ্ঠে অনন্ত বারিরাশির ভাণ্ডার করে রেখেছেন, যিনি অফুরন্ত লবন সম্পদ বিগলিত করে সমুদ্র গর্ভে মিশ্রিত করে রেখেছেন, যিনি তাঁর মধ্যে অসংখ্য জীব সৃষ্টি করে তাদের খাদ্য সংস্থান করে দিয়েছেন, যিনি প্রতি বছর লক্ষ কোটি গ্যালন পানি তা থেকে উত্তোলন করে লক্ষ কোটি একর শুস্ক ভুমি বারিশিক্ত করেন, তিনি মানবজাতিকে একবার পয়দা করার পর এমনই শক্তিহীন হয়ে পড়েন যে, পুনর্বার আর তাকে পয়দা করতে সক্ষম হবেন না। এ ধরনের প্রলাপোক্তি ও অবান্তর কথা বললে আপনি হয়তো বলবেন যে, তিনি নিশ্চয়ই তাঁর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন।
পবিত্র কুরআনে পরকালের অবশ্যম্ভাবিতা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা এমনি ভুরি ভুরি অকাট্য যুক্তি পেশ করেছেন। এসবের পর পরকাল সম্পর্কে তাঁর কোন সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না।
দুনিয়া মানুষের পরীক্ষা ক্ষেত্র
“(আরবী *********************************)
তিনিই মৃত্যু ও জীবন দিয়েছেন জেন তিনি তোমাদেরকে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন যে, তোমাদের মধ্যে আমলের(কৃতকর্মের) দিক দিয়ে কে সর্বোত্তম।”-(সূরা আল মুলকঃ২)
দুনিয়া যে মানুষের পরীক্ষা ক্ষেত্র তা কুরআনের অন্যত্রও কয়েক স্থানে বলা হয়েছে। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত পরিক্ষাই দিতে থাকে। মৃত্যুর সাথে সাথেই তার পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়। পরীক্ষা শেষ হলো বটে, কিন্তু তার ফলাফল কিছুতেই জানা গেল না। আর ফলাফল ঘোষণা ব্যতীত পরীক্ষা অর্থহীন। আর আমলের দিক দিয়ে সর্বোত্তম ব্যক্তি কে তা জানার জন্যেই তো পরীক্ষা। যে পরীক্ষা দিল সেতো মৃত্যুবরণ করলো। পরিক্ষায় সে কৃতকার্য হলো, না অকৃতকার্য তাতো জানা গেল না। এখন ফলাফল প্রকাশের পূর্বেই যখন মৃত্যু হলো, তখন ফলাফল জানার জন্যেই মৃত্যুর পর আর একটি জীবনের অবশ্যই প্রয়োজন। সেটাই আখেরাতের জীবন।
তাহলে কথা এই দাঁড়ালো যে, মানুষ তার জীবন ভর যে পরীক্ষা দিল তাঁর ফলাফল মৃত্যুর প্র প্রকাশ করা হবে। তাঁর জন্যে এক নতুন জগতে প্রতিটি মানুষকে পুনর্জীবন দান করে আল্লাহ তায়ালার দরবারে হাজীর করা হবে। যাকে বলা হয় হাশরের ময়দান। এ দরবার থেকেই মানুষের পরীক্ষার সাফল্য ও ব্যর্থতা ঘোষণা করা হবে। সাফল্যলাভের বেহেশতে এবং ব্যর্থকামীদের জাহান্নামে প্রবেশের আদেশ করা হবে।
ভালো-মন্দো, চূড়ান্ত ঘোষণা যদিও আখেরাতের আদালতে করা হবে, কিন্তু মৃত্যুর সময়ই প্রত্যেকে বুঝতে পারবে যে, তাঁর স্থান কোথায় হবে। মৃত্যুকালে ফেরেশতাদের আচরণেই তারা তা বুঝতে পারবে। যথাস্থানে এ আলোচনা করা হবে।
___________________
আলমে বরযখ
একটি প্রশ্ন মনের মধ্যে উদয় হয়। তাহলো এই যে, মৃত্যুর পর মানবাত্না তাৎক্ষনিকভাবে কোথায় যায় এবং কোথায় অবস্থান করে। কিয়ামতের দিন হিসাব-নিকাশের পর হয় বেহেশত না হয় জাহান্নাম এর কোন একটি তাঁর স্থায়ী বাসস্থান হবে। কিন্তু কিয়ামতের পূর্বে যে সুদীর্ঘ সময়কাল এ সময়ে আত্না থাকবে কোথায়?
এর জবাবও কুরআন পাকে পাওয়া যায়। মৃত্যুর অব্যবহিত পরের কালটাকে যদিও পরকালের মধ্যে গন্য করা হয়-তথাপি মৃত্যু ও বিচার দিবসের মধ্যবর্তী কালের একটা আলাদা নাম দেয়া হয়েছে যাকে ইসলামী পরিভাষায় বলা হয়- আলমে বরযখ।
‘বরযখ’ শব্দের অরথঃ যবনিকা পর্দা। আলমে বরযখ অর্থ পর্দায় ঢাকা এক অদৃশ্য জগত। অথবা এ বস্তুজগত ও পরকালের মধ্যে এক বিরাট জবনিকার কাজ করছে অদৃশ্য আলমে বরযখ।
আল্লাহ বলেনঃ
(আরবী *********************************)
“এবং তাদের পেছনে রয়েছে ‘বরযখ’ যার মুদ্দৎকাল হচ্ছে সেদিন পর্যন্ত যেদিন তাদেরকে পুনর্জীবিত ও পুনরুত্থিত করা হবে।”-(সূরা মু’মেনুনঃ ১০০)
ইসলামে চার প্রকার জগতের ধারণা দেয়া হয়েছে। প্রথম, আলমে আরওয়াহ- আত্নিক জগত। দ্বিতীয়, আল্মে আজসাম- স্থুলজগত বা বস্তুজগত (বর্তমান জগত)। তৃতীয়, আলমে বরযখ-মৃত্যুর পরবর্তী পর্দাবৃত অদৃশ্য জগত। চতুর্থ, আলমে আখেরাত-পরকাল বা পুনরুথানের পরে অনন্তকালের জগত।
আদি মানব হযরত আদম (আ)-এর সৃষ্টির পর কোন এক মুহূর্তে আল্লাহর আদেশ মাত্রই মানব জাতির সমুদয় আত্না অস্তিত্বলাভ করে। এ সবের সাময়িক অবস্থান সেই আলমে আরওয়াহ বা আত্নিকজগত।
এ আত্নাগুলোকে (অশরীরি অথবা সূক্ষ্ম শরীর বিশিষ্ট মানব সন্তানগুলো) একদা এক্ত্রে সম্বোধন করে আল্লাহ বলেনঃ
(আরবী ************************)
“আমি কি তোমাদের স্রষ্টা ও পালনকর্তা প্রভু নই?” সকল আত্নাই সমস্বরে জবাব দেয়-নিশ্চয়ই, আপনিই আমাদের একমাত্র স্রষ্টা ও প্রতিপালক।
এভাবে দুনিয়ার জন্যে সৃষ্ট সকল আত্না অর্থাৎ মানুষের কাছে আল্লাহ তাঁর দাসত্ব আনুগত্যের স্বীকৃতি গ্রহণ করেন। কারণ প্রভু বলে স্বীকার করলেই দাসত্ব আনুগত্যের স্বীকৃতি হয়ে যায়। দুনিয়ায় আগমনের পূর্বে এ আত্নাগুলো যে স্থানে অবস্থান করতো এবং এখনো করছে সেটাই হলো আলমে আরওয়াহ-আত্নাগুলোর অবস্থানের জগত।
অতপর এ দুনিয়ার মানুষের আগমনের পালা যখন শুরু হলো তখন সেই সূক্ষ্ম আত্নিক জগত থেকে এ স্থুল জগতে এক একটি করে আত্না স্থানান্তরিত (Transferred) হতে লাগলো। মাতৃগর্ভে সন্তানের পূর্ণ আকৃতি গঠিত হওয়ার পর আল্লাহ তায়ালার আদেশ মাত্র নির্দিষ্ট আত্না বা অশরীরি মানুষটি আত্নিক-জগত থেকে মাতৃগর্ভস্থ মনুষ্য আকৃতির মধ্যে প্রবেশ করে। অতপর নির্দিষ্ট সময়ে ভূমিষ্ঠ হয়ে দুনিয়ায় পদার্পণ করে।
মৃত্যুর পর আবার স্থুল জগত থেকে আত্না আলমে বরযখে স্থানান্তরিত হয়। আত্না দেহ ত্যাগ করে মাত্র। তাঁর মৃত্যু হয় না।
আলমে বরযখের বিশেষভাবে যে নির্দিষ্ট অংশে আত্না অবস্থান করে সে বিশেষ অংশের নাম ‘কবর’। কিন্তু সকলের কবর একই ধরনের হবে না। কারো কারো কবর হবে-আল্লাহ তায়ালার মেহমানখানার (guest House) মত। কারো কারো কবর হবে-অপরাধীদের জন্যে নির্দিষ্ট জেলখানার সংকীর্ণ কুঠরির মতো।
নির্দিষ্টকাল অর্থাৎ কিয়ামতের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত মৃত্যুবরণকারী মানুষের আত্নাগুলো এখানে অবস্থান করবে।
___________________________
কবরের বর্ণনা
মৃত্যুর পরবর্তী কালের বর্ণনা প্রসংগে পবিত্র কুরআন ও হাদীসে কররের বর্ণনা করা হয়েছে। প্রাক ইসলামী যুগে আরবের পৌত্তলিকগন এবং ইয়াহুদী নাসারা নির্বিশেষে সকলেরই মৃতদেহ কবরস্থ করত।
স্থুল ও বাহ্য দৃষ্টিতে কবর একটি মৃত্তিকাগর্ত মাত্র যার মধ্যে মৃতদেহ সমাহিত করা হয়। মাটি সে মৃতদেহ ভক্ষণ করে ফেলে। কিন্তু সত্যিকার কবর এক অদৃশ্য সূক্ষ্ম জগতের বস্তু। যা আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধি ও কল্পনার অতীত। উপরে বলা হয়েছে যে, কবর আলমে বরযখের অংশ বিশেষ।
প্রকৃত ব্যাপার এই যে, মৃত্যুর পর মানুষ কবরস্থ হোক অথবা চিতায় ভস্মিভুত হোক, বন্য জন্তুর উদরস্থ হোক অথবা জলমগ্ন হয়ে জলজন্তুর আহারে পরিনত হোক, তার দেহচ্যুত আত্নাকে যে স্থানটিতে রাখা হবে সেটাই তাঁর কবর। হযরত ইসরাফিলের (আ) তৃতীয় সাইরেন ধ্বনির সংগে সংগে নতুন জীবন লাভ করে প্রত্যেকে কবর থেকে উঠে বিচারের মাঠের দিকে দ্রুত ধাবিত হবে।
ফেরাউন তাঁর সেনাবাহিনীসহ লোহিত সাগরেরত অতল তলে নিমজ্জিত হয়েছে। বিরাট বাহিনী হয়তো জলজন্তুর আহারে পরিণত হয়েছে। অথবা তাদের অনেকের ভাসমান লাশ তটস্থ হওয়ার পর শৃগাল, কুকুর ও চিল-শকুনের আহারে পরিণত হয়েছে। ফেরাউনের মৃত দেহ হাজার হাজার বছর ধরে মিসরের যাদু ঘরে রক্ষিত আছে, যাকে কেউ ইচ্ছা করলে এখনো স্বচক্ষে দেখতে পারে। কিন্তু তাদের সকলের আত্না নিজ নিজ কররেই অবস্থান করছে। তাদের শাস্তি সেখানে অব্যাহত রয়েছে।
(আরবী ****************************************)
“আল্লাহ (ফেরাউন জাতির মধ্যে ঈমান আনয়নকারী মু’মেন ব্যক্তিকে) তাদের ষড়যন্ত্রের কুফল থেকে রক্ষা করলেন এবং ফেরাউন দলকে (তাদের মৃত্যুর পর) কঠিন আযাব এসে ঘিরে ফেললো। (সেটা হলো জাহান্নামের আগুনের আযাব)। তারপর কিয়ামত যখন সংঘটিত হবে, তক্ষণ আদেশ হবে, “ফেরাউন ও তার অনুসারী দলকে অধিকতর কঠিন আযাবে নিক্ষেপ কর।”-(সূরা আল মু’মেনঃ ৪৫-৪৬)
আলমে বরযখে পাপীদেরকে যে কঠিন আযাব ভোগ করতে হবে উপরের আয়াতটি তার একটি প্রকৃত প্রমাণ। “আজাবে কবর”-শীর্ষক অনেক হাদিসও বর্ণিত আছে। এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্টরূপে দু’পর্যায়ের আযাবের কথা উল্লেখ করেছেন। এক পর্যায়ের অপেক্ষাকৃত লঘু আযাব কিয়ামতের পূর্বে ফেরাউন ও তার দলের প্রতি দেয়া হচ্ছে। তা এই যে, তাদেরকে সকাল সন্ধ্যায় জাহান্নামের অগ্নির সামনে হাজির করা হচ্ছে যাতে করে তাকের মধ্যে এ সন্ত্রাস সৃষ্টি হয় যে, অবশেষে এ জাহান্নামের অগ্নিতে, তাদেরকে একদিন নিক্ষেপ করা হবে। অতপর কিয়ামত সংঘটিত হলে দ্বিতীয় পর্যায়ে তাদেরকে সে বিরাট শাস্তি দেয়া হবে যা তাদের জন্য নির্ধারিত আছে। অর্থাৎ সেই জাহান্নামে তাদেরকে নিক্ষেপ করা হবে, যার ভয়ংকর দৃশ্য তাদেরকে দেখানো হচ্ছে সমুদ্রে নিমজ্জিত হওয়ার পর থেকে।
এ শুধু মাত্র ফেরাউন ও তার অনুসারীদের জন্যেই নির্দিষ্ট নায়। বরঞ্চ প্রত্যেক পাপীকে তার মৃত্যুর পরক্ষণ থেকে আরম্ভ করে কিয়ামত পর্যন্ত সেই ভয়াবহ পরিণাম তার চোখের সামনে তুলে ধরা হবে যা তাকে অবশেষে ভোগ করতেই হবে। অপরদিকে আল্লাহ নেক বান্দাদেরকে সুন্দর বাসস্থানের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখানো হতে থাকবে যা আল্লাহ তাদের জন্য নির্ধারিত করে রেখেছেন। বোখারী মুসলিম এবং মসনদে আহমদে হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা) থেকে বর্ণিত আছেঃ
(আরবী **************************************)
“তোমাদের যে কেউ মৃত্যুবরণ করে, তাকে তার অন্তিম বাসস্থান সকাল সন্ধ্যায় দেখনো হয়। সে বেহেশতী হোক অথবা জাহান্নামী, তাকে বলা হয়, এটা সেই বাসস্থান যেখানে তুনি তখন প্রবেশ করবে যখন আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিনে দ্বিতীয়বার জীবনদান করে তাঁর কাছে তমাকে হাজির করবেন।”
মৃত্যুর পর পরই কররে বা আলমে বরযখে পাপীদের শাস্তি ও নেককার বান্দাহদের সুখ শান্তির কথা কুরআন হাকিম সুস্পষ্ট করে বলেছেনঃ
(আরবী *****************************************)
“যদি তোমরা সে অবস্থা দেখতে যখন ফেরেশতাগন কাফেরদের রূহ কবয করেছিল এবং তাদের মুখমণ্ডলে এবং পার্শ্বদেশে আঘাত করেছিল এবং বলেছিল “নাও, এখন আগুনে প্রজ্জলিত হওয়ার স্বাদ গ্রহণ কর।”
-(সূরা আনফালঃ ৫০)
(আরবী *******************************************)
“ঐসব খোদাভিরুদের রূহ পাক পবিত্র অবস্থায় যখন ফেরেশতাগন কবয করেন তখন তাঁদেরকে বলেন, “আসসালামু আলাইকুম। আপনারা যে নেক আমল করেছেন তার জন্যে বেহেশতে প্রবেশ করুন।”
-(সূরা আন নহলঃ ৩২)
উপরোক্ত দু’টি আয়াতে পাপী ও পুন্যবানদের মৃত্যুর পর পরই অর্থাৎ আলমে বরযখে বা কবরে তাদেরকে যথাক্রমে জাহান্নাম এবং বেহেশতে প্রবেশের কথা শুনানো হয়। কেয়ামতের দিনে বিচার শেষে জাহান্নাম অথবা বেহেশতে প্রবেশের পূর্বে আলমে বরযখে আযাবের মধ্যে কালযাপন করবে পাপীগন এবং পরম শান্তিতে বাস করবেন নেক বান্দাহগন। আয়াত দু’টি তাই কবরে পাপীদের জন্যে আযাব এবং পুণ্যবানদের জন্যে সুখ-শান্তির প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
হাদীসে আছে যে, কবর কারো জন্যে বেহেশতের বাগানের ন্যায় এবং কারো জন্যে জাহান্নামের গর্ত বিশেষের ন্যায়। যারা পাপাচারী তাদের শাস্তি শুরু হয় মৃত্যুর পর থেকেই। একটা সংকীর্ণ স্থানে আবদ্ধ রেখে তাদেরকে নানানভাবে শাস্তি দেয়া হয়। জাহান্নামের উত্তপ্ত বায়ু অগ্নিশিখা তাদেরকে স্পর্শ করে। বিভিন্ন বিষাক্ত সর্প, বিচ্ছু তাদেরকে দিবারাত দংশন করতে থাকে। কুরআন পাক বলেঃ
(আরবী ***************************************)
“যদি তোমরা সে অবস্থা দেখতে পেতে যখন ফেরেশতাগণ (যুদ্ধে নিহত) কাফেরদের জান কবয করছিল। তারা তাদের মুখমণ্ডলের ও দেহের নিম্নভাগের উপর আঘাতের উপর আঘাত করে বলছিল, ‘এখন আগুনে জ্বলে যাওয়ার মজা ভোগ কর।”-(সূরা আন নাহলঃ ২৮)
(আরবী ****************************************)
“যেসব (কাফের) তাদের নফসের উপর জুলুম করার পর (জান কবযের মাধ্যমে) ফেরেশতাদের দ্বারা গ্রেফতার হয়, তারা হঠকারী পরিহার করে আত্নসমর্পণ করে এবং বলে, ‘আমরা তো কোন অপরাধ করছিলাম না।’ ফেরেশতাগণ জবাবে বলে, ‘হ্যাঁ তাই বটে। তোমরা যা করছিলে তা আল্লাহ ভালভাবে জানেন। যাও এখন জাহান্নামের দরজায় ঢুকে পড়। সেখানেই তোমাদেরকে চিরকাল থাকতে হবে।’ অতএব, সত্য কথা এই যে, গর্ব-অহংকারীদের জন্যে অতি নিকৃষ্ট বাসস্থান রয়েছে।”-(সূরা আন নাহলঃ ২৮)
(আরবী ******************************************)
“তারপর সে সময়ে কি অবস্থা হবে-যখন ফেরেশতাগণ এদের রূহ কবয করবে এবং তাদের মুখে ও পিঠে মারতে থাকবে? এসব তো এ জন্যেই হবে যে তারা এমন পথ ও পন্থা অবলম্বন করেছিল-যা আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করেছিল এবং তাঁকে সন্তুষ্ট করার পথ অবলম্বন করা তারা পছন্দ করেনি। এজন্যে তিনি তাদের সকল আমল বিনষ্ট করে দিয়েছেন।”-(সূরা মুহাম্মদঃ ২৭-২৮)
মৃত্যুর পড় পাপীদের আত্নাগুলোকে আলমে বরযখের নির্দিষ্ট সংকীর্ণ স্থানগুলোতে রাখা হবে এবং সেখানে তাদেরকে নানানভাবে শাস্তি দেয়া হবে। আলমে বরযখে দেহ থাকবে না, থাকবে শুধু রূহ বা আত্না এবং তাঁর সুখ-দুঃখের পূর্ণ অনুভুতি থাকবে। পাপীদের অবস্থা হবে হাজতবাসী আসামীদের ন্যায়।
অপরদিকে যারা খোদাভীরু ও পুন্যবান-তাদের অবস্থা হবে সম্পূর্ণ বিপরীত। তাঁরা বলতে গেলে আল্লাহ তায়ালার মেহমান হবেন এবং তাঁদের বাসস্থান হবে বহুগুনে আরামদায়ক।
তার মধ্যে থাকবে সুখ-শান্তিদায়িনী বিভিন্ন দ্রব্য সামগ্রী। তাই বলা হয়েছে সেটা হবে বেহেশতের একটি বাগানের ন্যায়।
মুমেন ও মুত্তাকীকে মৃত্যুর সময় ও স্থানের সুসংবাদ দেয়া হবে।
(আরবী ***************************************)
“যারা বললো, আল্লাহ আমাদের রব এবং তারপর একথার উপর তারা অবিচল থাকলো, তাদের কাছে অবশ্যই ফেরেশতা নাযিল হয়ে বলে, ‘ভয় করো না, দুঃখ করো না, সেই বেহেশতের সুসংবাদ শুনে খুশী হও যার ওয়াদা তোমাদের সাথে করা হয়েছে।”-(সূরা হামীম আস সাব্জদাঃ ৩০)
(আরবী ***************************************)
“ঐসব কাফেরদের জন্য (দুর্ভাগ্য) যারা তাদের নিজেদের উপর জুলুম করে। যখন ফেরেশতারা তাদের জান কবয করে তাদের গ্রেফতার করে নেয়, তখন তারা সংগে সংগেই নতি স্বীকার করে বলে, আমরা তো কোন অপরাধ করিনি। ফেরেশতাগণ জবাবে বলবে, অপরাধ করনি কেমন? তোমাদের কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণ তো আল্লাহ তায়ালা ভালভাবে অবগত আছেন।”-(সূরা আন নহলঃ ২৮)
নবী (সঃ) বলনঃ
(আরবী *************************************)
নবী (সঃ) বলেন যে, আল্লাহ বলেনঃ “আমি আমার নেক বান্দাদের জন্যে কবরে এমন অনেক কিছুর ব্যবস্থা করে রেখেছি যা কোন চক্ষু কোন দিন দেখেনি। কোন কান তা শুনেনি এবং তা মানুষের কল্পনারও অতীত।”
পাপীদের কবরে শাস্তি সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছেঃ
(আরবী *****************************************)
“তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির আধিক্য ও প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে ক্ষমতা গর্বিত করে রাখে যার ফলে তোমরা খোদাকে ভুলে যাও। অতপর হঠাৎ এক সময় তোমরা মৃত্যুবরণ করে কবরে গিয়ে হাজির হও। তোমরা কি মনে করেছ যে, তারপর আর কিছুই নেই? তা কখনো মনে করো না। শীঘ্রই তোমরা প্রকৃত ব্যাপার জানতে পারবে। সে সময়ের অবস্থা যদি তোমাদের নিশ্চিতরূপে জানা থাকতো তাহলে তোমাদের এ ভুল ভেঙ্গে যেতো। কবরে যাবার পর তোমরা অবশ্য অবশ্যই জাহান্নাম দেখতে পাবে। যে জাহান্নাম তোমরা বিশ্বাস করতে চাওনি তার সম্পর্কে সে দিন তোমাদের চাক্ষুষ বিশ্বাস জন্মাবে। অতপর এ দুনিয়ার বুকে তোমরা যে আমার অফুরন্ত নিয়ামত ভোগ করেছ, সে বিষয়ে তোমাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।”-(সুরাঃ তাকাসুরঃ ১-৮)
কুরআন পাকের উপরোক্ত ঘোষণার সুস্পষ্ট ব্যাখা হাদীসে পাওয়া যায়। বুখারী এবং মুসলিমে হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমরের (রা) একটি বর্ণনা দেখতে পাওয়া যায়। বলা হয়েছেঃ
নবী বলেছেন, তোমাদের মধ্যে কেউ মৃত্যুর পর (কবরে গিয়ে পৌছলে) তাকে প্রতি সকাল সন্ধ্যায় তার ভবিষ্যৎ বাসস্থান দেখানো হয়। সে যদি বেহেশতবাসী হয় তো বেহেশতের স্থান এবং জাহান্নামবাসী হলে জাহান্নামের স্থান। অতপর তাকে বলা হয়, “এটাই তোমার আসল বাসস্থান।”
নবী বলেন, অতপর আল্লাহ তোমাকে সেখানে পাঠিয়ে দেবেন।
“যখন বান্দাকে কবরে রাখা হয় এবং যখন তার সংগী-সাথীগন তাকে দাফন করার পর প্রত্যাবর্তন করতে থাকে, যাদের চলার পদধ্বনী সে তখনো শুনতে পায় তখন তাঁর কাছে উপস্থিত হন দু’জন ফেরেশতা। তাঁরা মুর্দাকে বসাবেন। অতপর তাঁরা নবী মুস্তফার (স) প্রতি ইশারা করে বলবেন দুনিয়াতে এ ব্যক্তি সম্পর্কে তুমি কি ধারণা রাখতে?”
সে ব্যক্তি মুমেন হলে জবাব দেবে যে উনি আল্লাহর বান্দাহ এবং রাসুল। তখন তাকে বলা হবে, “এই দেখ জাহান্নামে তোমার জন্যে কিরূপ জঘন্য স্থান নির্দিষ্ট ছিল। কিন্তু আল্লাহ তোমার এ স্থানকে বেহেশতের স্থানের দ্বারা পরিবর্তন করে দিয়েছেন। তখন সে উভয় স্থান দেখবে।”
কিন্তু কাফেরকে উক্ত প্রশ্ন করলে তার জবাবে সে বলবে, “আমি তা বলতে পারি না। মানুষ যা বলতো, আমিও তাই বলতাম।”
তাকে বলা হবে, “তুমি তোমার জ্ঞান ও বুদ্ধি-বিবেক দ্বারা বুঝতে চেষ্টা করনি এবং আল্লাহর পবিত্র গ্রন্থ পড়েও জানতে চাওনি।”
অতপর তাকে লোহার হাতুড়ি দিয়ে কঠোরভাবে আঘাত করা হবে। সে অসহ্য যন্ত্রণায় বিকট চীৎকার করতে থাকবে। সে চীৎকার আর্তনাদ ভু-পৃষ্ঠে জিন ও মানুষ ব্যতীত আর সকল জীব শুনতে পাবে।
উক্ত ফেরেশতাদ্বয়ের নাম বলা হয়েছে মুনকির ও নাকির।
কবর আযাদের বিস্তারিত বিবরণ হাদীসের বিভিন্ন গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। কবর আযাব এক অনিবার্য সত্য। তাই সকল মুসলমানের উচিত কবর আযাব থেকে পরিত্রানের জন্যে সর্বদা আল্লাহ তায়ালার নিকটে কাতর প্রার্থনা করা এবং প্রকৃত মুসলমানের মতো জীবনযাপন করা।
হযরত যায়েদ বিন সাবেত বলেনঃ
“একদা রসুলুল্লাহ (স) বনি নাজ্জার গোত্রের প্রাচীর ঘেরা একটি বাগানে খচ্চরের পিঠে সওয়ার ছিলেন। আমরাও ছিলাম তাঁর সাথে। হঠাৎ খচ্চরটি লাফ মেরে উঠতেই হুজুর (স) মাটিতে পড়ার উপক্রম হয়েছিলেন। দেখা গেল সেখানে পাঁচ-ছয়টি কবর রয়েছে। নবী বললেন, “তোমরা কি কেউ এ কবরবাসীদের চেন?”
আমাদের মধ্যে একজন বললো, “আমি চিনি।”
নবী (স) বললেন, “এরা কবে মরেছে।”
সে বললো, “এরা মরেছে শির্কের যমানায়।”
নবী বললেন, “এ উম্মত তথা মনবজাতি কবরে পরীক্ষার সম্মুখীন হয় এবং শাস্তি ভোগ করে। যদি আমার এ ভয় না হতো যে তোমরা মানুষকে কবর দেয়া বন্ধ করে দেবে তাহলে আল্লাহর কাছে দোয়া করতাম তোমাদেরকে কবরের আযাব শুনতে যা আমি শুনতে পাচ্ছি।”
অতপর নবী (স) আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, “তোমরা সকলে জাহান্নামের আযাব থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা কর।”
সকলে সমস্বরে বললো, “আমরা জাহান্নমের আযাব থেকে আশ্রয় চাই।”
নবী (স) বললো, “তোমরা কবর আযাব থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাও।”
সকলে বললো, “আমরা কবর আযাব থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাই।”
নবী (স) বললেন, “তোমরা সকল গোপন ও প্রকাশ্য ফেৎনা থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাও।”
সকলে বললো, “আমরা সমস্ত গোপন ও প্রকাশ্য ফেৎনা থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাই।”
নবী (স) বললেন, “এবার তোমরা দাজ্জালের ফেৎনা থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাও।”
সকলে বললো, “আমরা দাজ্জালের ফেৎনা থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাই।”-(মুসলিম)
প্রকাশ থাকে যে, নামায শেষে সালাম ফেরার পূর্বে নবীর (সঃ) শিখানো পদ্ধতি অনুযায়ী উক্ত দোয়াটি করা হয়।
কোন ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার কবর যিয়ারত করা ইসলামে জায়েয আছে। কবরের পাশে গিয়ে কবরবাসীকে সালাম করে তার জন্য দোয়া করা-এ হচ্ছে ইসলাম সম্মত নীতি। অবশ্য মুসলিম সমাজে কবর পুজা এবং মৃত ব্যক্তির কাশে কোন কিছু চাওয়ার শি্র্ক চালু আছে। ঈমান বাঁচাবার জন্যে এর থেকে দূরে থাকতে হবে।
মৃত ব্যক্তির আত্না সম্পর্কেও কিছু কিছু ভ্রান্ত এবং মুশরেকী ধারণা মুসলমান সমাজে কারো কারো মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। তাদের ধারণা আত্না মৃত্যুর পরেও এ দুনিয়ার যাতায়াত ও ঘোরাফেরা করে। তাদের অনেক অসীম ক্ষমতাও থাকে বলে তাদের বিশ্বাস। আসলে এসব ধারণা করা যে শি্র্ক তাতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ এ ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে অনেকে এসব কল্পিত আত্নার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে, তাদের নামে নযর-নিয়ায পেশ করে। আলমে বরযখ থেকে এ স্থুল জগতে আত্নার ফিরে আসা কিছুতেই সম্ভব নয়।
তবে মৃত ব্যক্তিকে সালাম করলে সে সালাম আল্লাহ তার বিচিত্র কুদরতে আলমে বরযখে সে ব্যক্তিকে পৌছিয়ে দেন। অনেকে বলেন। সালামকারীকে মৃত ব্যক্তি দেখতেও পায় এবং চিনতে পারে। এ কেমন করে সম্ভব বেতার ও টেলিভিশনের যুগে সে প্রশ্ন অবান্তর।
______________________